ইতিকাফ সিরিজ (Nusus)
ইতিকাফ সিরিজ
.
প্রথম পর্ব: ইতিকাফের মৌলিক পরিচয়, উদ্দেশ্য
.
দ্বিতীয় পর্ব: ইতিকাফের গুরুত্ব, লাভ, উপকারিতা ও আমল
.
তৃতীয় পর্ব: নারীদের ইতিকাফের স্থান এবং নারীদের ইতিকাফের বিধান
.
চতুর্থ পর্ব: ইতিকাফের মাসয়ালা
.
পঞ্চম ও শেষ পর্ব: ইতিকাফকে সুন্দর ও সার্থক করতে কিছু পরামর্শ
.
---------------------
#ইতিকাফ (প্রথম পর্ব)
ইতিকাফ এমন এক ইবাদত, যেটিকে নবিজি শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও গুরুত্ব দিয়ে পালন করতেন। কোনো বছর মিস হলে পরের বছর কাজা করতেন। এই পোস্টে আমরা ইতিকাফের মৌলিক কিছু বিষয়ে আলোচনা করেছি।
.
❑ ইতিকাফের পরিচয়:
.
আরবি ইতিকাফ শব্দের অর্থ হলো: নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা, একাকী অবস্থান ইত্যাদি। পরিভাষায় ইতিকাফ মানে, দুনিয়াবি সকল কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা।
.
❑ ইতিকাফের বিধান:
.
উলামায়ে আহনাফ বলেন, রামাদানের শেষ দশ দিন মাসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নাতে কিফায়া। অর্থাৎ, এক মহল্লার মধ্যে কমপক্ষে একজন ইতিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। না হয় সবাই গুনাহগার হবে। এটি দশ দিনই করতে হয়। ২০ রামাদানের সূর্যাস্তের পূর্বেই মাসজিদে প্রবেশ করতে হয়। কারণ সূর্যাস্ত থেকে ২১ তম রামাদান শুরু হয়ে যায়। সহজে বললে, রামাদানের ২০ তারিখে মাগরিবের ওয়াক্ত (সূর্যাস্ত) শুরু হওয়ার আগেই ইতিকাফের উদ্দেশ্যে মাসজিদে প্রবেশ করতে হবে। আর সেটি চলবে ঈদের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত (১০ দিন)। এটা হলো সুন্নাত ইতিকাফের শর্ত।
.
আর, যারা নফল ইতিকাফ করতে চান, তাদের জন্য বিষয়টি খুব সহজ। তারা এক দিন, এক রাত, বা কয়েক দিন কিংবা কয়েক রাত অথবা কয়েক মুহূর্তের জন্যও ইতিকাফ করতে পারেন। কেউ চাইলে শুধু রামাদানের বেজোড় রাতগুলোতেও নফল ইতিকাফ করতে পারবেন। নফল ইতিকাফ রামাদানের বাইরেও করা যায়। যারা রামাদানে দশ দিনের সুন্নাত ইতিকাফ করতে পারবেন না, তারা অন্তত নফল ইতিকাফ করতে পারেন। নারী-পুরুষ সবার জন্য একই কথা।
.
❑ ইতিকাফের সূচনা:
.
ইতিকাফের সূচনা হয়েছিলো ইবরাহিম (আ.)-এর সময় থেকে। আল্লাহ্ বলেন, ‘‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম: তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদা আদায়কারীদের জন্য পরিচ্ছন্ন করো।’’ [সুরা বাকারাহ, আয়াত: ১২৫]
.
❑ ইতিকাফের উদ্দেশ্য:
.
ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো, সৃষ্টির সাথে যাবতীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে একান্ত নিভৃতে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন থাকা, যাতে মানবমনের যাবতীয় চিন্তা জুড়ে কেবল আল্লাহর যিকর, তাঁর ভালোবাসা এবং আকর্ষণই প্রাবল্য লাভ করে। [ইমাম ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ: ২/৮৭]
.
সেজন্য, উত্তম হলো: এমন মাসজিদে ইতিকাফ করা, যেখানে মানুষ চিনবে না। ফলে কেউ তার সাথে কথা বলতে আসবে না। সে নিরবে আল্লাহর সান্নিধ্যে থাকতে পারবে। তবে, এমনটি করা জরুরি নয়। সম্ভব না হলে পরিচিত মসজিদেই ইতিকাফ করবেন।
.
এছাড়া, ইতিকাফের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, লাইলাতুল কদর তালাশ করা। [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ১১৬৭]
.
তাছাড়া ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো: নিজের কামনা-বাসনার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, প্রবৃত্তিদমন এবং অহেতুক কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা।
.
❑ ইতিকাফ সুন্দর করতে করণীয়:
.
(১) মোবাইল ও অনলাইন থেকে দূরে থাকা উচিত। বিশেষ করে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ইতিকাফ অবস্থায় অনলাইনে আসা একদম অনুচিত। কারণ মাসজিদের পরিবেশ ইবাদতময় আর অনলাইনের পরিবেশ গুনাহময়।
(২) আড্ডায় লিপ্ত হওয়া যাবে না। অধিকাংশ ইতিকাফকারী এই কাজটা করেন। কেউ আড্ডা দিতে আসলে তাকে সরিয়ে দিতে হবে।
(৩) অত্যধিক পরিমাণে পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলে ইবাদতে উৎসাহ পাওয়া যাবে।
(৪) যথাসাধ্য কম ঘুমানো উচিত। ঘুমের জন্য সারা বছর পড়ে আছে। অন্তত এই দিনগুলো ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে।
(৫) প্রস্রাব-পায়খানা ব্যতীত মাসজিদের বাইরে বা ইতিকাফের স্থান থেকে সরে যাওয়া যাবে না। গেলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই খুব সাবধান!
(৬) ইতিকাফের মাসয়ালাগুলো আগেই ভালো করে জেনে নিতে হবে। না হয় কোনো ভুলের কারণে এই কষ্টের ইবাদত বিফলে যেতে পারে। (শীঘ্রই ইতিকাফের মাসয়ালা নিয়ে আলাদা পোস্ট দেওয়া হবে, ইনশাআল্লাহ)
.
-----------------------
#ইতিকাফ (দ্বিতীয় পর্ব)
কেন আমাদের ইতিকাফ করা উচিত? ইতিকাফে আমরা কীভাবে আমল করবো?
▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬
❑ ইতিকাফের গুরুত্ব ও উপকারিতা:
.
(১) আয়িশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ইন্তিকাল পর্যন্ত প্রতি বছর রামাদানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর (ইন্তিকালের) পর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করতেন।’ [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ২৬৭৪]
.
(২) রামাদানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ আদায় করলে লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য নসিব হয়। নবিজি এই উদ্দেশ্যেই ইতিকাফ করতেন।
.
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আমি (রামাদানের) প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করে এই (কদরের) রাতটি খুঁজলাম, এরপর দ্বিতীয় ১০ দিন ইতিকাফ করলাম। অতঃপর আমাকে বলা হলো, এ রাতটি শেষ ১০ দিনের (রাতের) মাঝে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই ইতিকাফ করতে চায়, সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে।’’ [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ২৬৬১]
.
(৩) ইতিকাফের (দশ দিন দশ রাত) পুরো সময়টাই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।
.
ইবনু আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘সে পাপ থেকে বেঁচে থাকে এবং তার নেকির প্রতিদানের মধ্যে সর্বপ্রকার নেকি সম্পাদনকারীর ন্যায় নেকি অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।’’ [ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ১৭৮১: হাদিসটির সনদে দুর্বলতা থাকলেও অর্থগত দিক থেকে হাদিসটি সঠিক]
.
(৪) ইতিকাফকারী বান্দাকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে হেফাজত করবেন।
.
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এক দিন ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন পরিখা পরিমাণ দূরত্ব তৈরি করে দেবেন। প্রত্যেক পরিখার দূরত্ব দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি।’’ [ইমাম বাইহাকি, শু‘আবুল ঈমান: ৩৯৬৫; ইমাম হাকিমের মতে, হাদিসটি সহিহ; ইমাম হাইসামির মতে, এর সনদ হাসান]
.
(৫) গুনাহ থেকে মুক্তি লাভের সুযোগ হয়।
.
আয়িশা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, প্রতিদান লাভের আশায় ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তার পূর্বের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন।’’ [শায়খ আলবানি, দ্বঈফুল জামি’: ৫৪৪২; হাদিসটির সনদ দুর্বল]
.
(৬) ইতিকাফের মাধ্যমে মাসজিদের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়।
.
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তির হৃদয় মাসজিদের সাথে আটকে থাকে, সে হাশরের দিন আরশের ছায়ায় স্থান পাবে।’’ [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৬৬০]
.
(৭) আল্লাহর প্রতিবেশী হওয়ার সুযোগ লাভ:
.
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন ‘‘কোথায় আমার প্রতিবেশীরা?’’ বলে ডাকতে থাকবেন। ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করবেন, ‘ইয়া রব! কারা আপনার প্রতিবেশী?’ আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ‘‘দুনিয়াতে যারা মাসজিদ আবাদ রেখেছিলো।’’ [শায়খ আলবানি, সিলসিলা সহিহাহ: ২৭২৮; হাদিসটি সহিহ]
.
(৮) আল্লাহর সান্নিধ্যে জীবনের পরিবর্তন:
.
ইমাম ইবনুল জাওযি (রাহ.) বলেন, ‘দেখলাম কিছু লোক খুব নামাজ পড়ে, তিলাওয়াত করে ও রোজা রাখে; কিন্তু তাদের হৃদয় যেন ছুটন্ত ঘোড়া। আবার, কিছু লোক নামাজ পড়ে সামান্য, রোজাও রাখে পরিমিত, কিন্তু তাদের অন্তর অত্যন্ত নিবিড়, একান্ত এবং শান্ত ও স্থির। আমি বুঝলাম, আল্লাহকে পেতে হলে বেশি ইবাদত নয়, বরং অধিক নির্জনতার প্রয়োজন।’ [ইমাম ইবনুল জাউযি, সইদুল খাতির, পৃষ্ঠা: ৩৫৫]
.
(৯) মাসজিদের পরিবেশে, একান্ত নিভৃতে ১০ দিনের এই সময়টা বান্দাকে ধৈর্যশীল, সহনশীল ও আল্লাহমুখী করে তোলে।
.
❑ ইতিকাফকারীর ইবাদত:
.
(১) ইতিকাফকারীর পুরো সময়টিই ইবাদত বলে গণ্য। তবুও সে বিভিন্ন ইবাদতে সময় ব্যয় করবে। মাঝে মধ্যে বিশ্রাম নিতে পারে, ঘুমাতে পারে আবার চুপ থাকতে পারে। তবে, সবসময় এগুলো করবে না। এটা ইতিকাফের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। বরং যথাসাধ্য ইবাদতে লেগে থাকবে।
.
(২) অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করবে।
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিদিন ৭০ বারের বেশি ইস্তিগফার পড়তেন। [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৬৩০৭]
.
(৩) অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করবে। হাদিসে এসেছে, “তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কারণ, কুরআন কিয়ামতের দিন তার সাথীর (তিলাওয়াতকারীর) জন্য সুপারিশ করবে।” [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ১৭৫৯]
.
ধর্মীয় বই পড়া যাবে। যেমন: কুরআনের অনুবাদ, তাফসির, হাদিস ইত্যাদি।
.
(৪) বেশি বেশি যিকর করবে। একদিন নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের সামনে বললেন, ‘‘মুফাররাদ বা একাকী মানুষেরা এগিয়ে গেলো।’’ সাহাবিগণ প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! মুফাররাদ বা একাকী মানুষ কারা?’ তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহর বেশি বেশি যিকরকারী নারী-পুরুষেরা।’’ [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৬৭০১]
.
(৫) দরুদ পাঠ করবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার উপর দশ বার রহমত বর্ষণ করবেন।” [ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ৪৮৫; হাদিসটি সহিহ]
.
(৬) সাধ্যানুসারে নফল নামাজ পড়বে। একজন সাহাবি জান্নাতে নবিজির সান্নিধ্য লাভের জন্য তীব্র বাসনা ব্যক্ত করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন, ‘‘তাহলে বেশি বেশি সিজদার মাধ্যমে (অর্থাৎ নামাজের মাধ্যমে) তুমি নিজের জন্যই আমাকে সাহায্য করো।’’ [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৯৮১]
.
ইতিকাফকারী গুরুত্বের সাথে তাহাজ্জুদ, চাশত (দোহা), যাওয়াল, তাহিয়্যাতুল অজু, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ ইত্যাদি নামাজ আদায় করবে। ইতিকাফের দিনগুলোতে এগুলোতে অভ্যস্ত হওয়া ব্যক্তির জন্য খুবই সহজ।
.
(৭) দু‘আ করবে। হাদিসে এসেছে, ‘‘যে আল্লাহর কাছে চায় না, আল্লাহ তার উপর রাগান্বিত হন।’’ [ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ৩৩৭৩; হাদিসটি হাসান]
.
অবশ্যই আন্তরিকভাবে তাওবাহ করবে। ইতিকাফের বরকতময় সময়ে নিজের গুনাহগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারলে, জীবনে আর কী চাই! আল্লাহ কবুল করুন।
.
--------------------------
#ইতিকাফ (তৃতীয় পর্ব)
নারীদের ইতিকাফের বিধান এবং নারীদের ইতিকাফের স্থান (মাসজিদ নাকি নিজ ঘর)
এবং এ বিষয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর:
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
❑ নারীদের ইতিকাফের স্থান:
.
(ক) নবিজির সময়ে তাঁর স্ত্রীগণ মাসজিদে ইতিকাফ করতেন। [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ২০৩৩; ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ২৬৭৪]
.
সে সময় নারী সাহাবিগণ মাসজিদের বাইরে, নিজ বাড়িতে ইতিকাফ করেছেন মর্মে কোনো সহিহ প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই, অধিকাংশ ইমামের মতে, নারী অথবা পুরুষ প্রত্যেকের জন্যই মাসজিদে ইতিকাফ করা আবশ্যক। ইমাম শাফিয়ি ও ইমাম আহমাদ এই মত দিয়েছেন।
.
(খ) ইমাম আবু হানিফার মতে, নারীরা বাড়িতে ইতিকাফ করবে। তিনি কিয়াস করেছেন, হাদিসে যেহেতু নারীদের বাড়িতে নামাজ পড়া উত্তম বলা হয়েছে, সেহেতু ইতিকাফও বাড়িতে আদায় করাই যথার্থ।
.
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নারীদের বাড়িতে নামাজ পড়া বাড়ির বাইরে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম।” [ইমাম তাবারানি, মু’জামুল আওসাত: ৯১০১; হাদিসের রাবিগণ নির্ভরযোগ্য]
.
এ ব্যাপারে একাধিক সহিহ হাদিস আছে। আমরা সেগুলো আলোচনা করছি না।
.
আয়িশা (রা.) বলেন, ‘নারীরা নতুনভাবে যা করেছে, তা যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখতেন, তবে তিনি তাদেরকে মাসজিদে যাওয়া নিষেধ করে দিতেন; যেভাবে বনি ইসরাইলের নারীদের জন্য মসজিদে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো।’ [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৮৬৯]
.
রাসুলের ইন্তিকালের পর আয়িশা (রা.)-এর সময়ে পরিবেশ যথেষ্ট ভালো ছিলো। তবুও তিনি এমন শক্ত কথা বলেছেন। বর্তমানে তার ধারেকাছেও নেই। আর, নবিজির সময়ের মতো ভালো পরিবেশ তো এখন কল্পনাও করা যায় না। এই যামানায় একজন নারী মাসজিদে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার সাথে থাকবেন, এমনটি নিশ্চিত করাও কঠিন। এসব কারণে ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) নারীদের বাড়িতে ইতিকাফের পক্ষে মত দিয়েছেন।
.
আমরা বলি: ইমাম আবু হানিফার মতামত অত্যন্ত যৌক্তিক এবং নিজ ঘরে নারীদের ইতিকাফ বৈধ। তবে, যদি কোনো মাসজিদে নারীদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, তাহলে সেই মাসজিদে ইতিকাফ করাই নারীদের জন্য উত্তম হিসেবে বিবেচিত হবে।
.
নারীরা তাদের ইতিকাফের জন্য সর্বোচ্চ একটি রুম বাছাই করতে পারবেন নিজ বাসায়। সেই রুমে তিনি স্বাধীন। অথবা এক রুমের মধ্যে পর্দা টানিয়ে আলাদা স্থানও করে নিতে পারেন। তো, সাধারণভাবে তিনি এই রুমটির বাইরে একদমই যেতে পারবেন না। শরিয়ত অনুমোদিত কোনো কারণ (যেমন: প্রস্রাব-পায়খানা) ছাড়া এই রুমটির বাইরে গেলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে।
.
❑ নারীদের ইতিকাফ-সংক্রান্ত বিধানসমূহ:
.
(১) উলামায়ে আহনাফের মতে, রামাদানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা পুরুষের জন্য সুন্নাতে কিফায়াহ। অর্থাৎ কোনো মহল্লার মসজিদে পুরুষদের মধ্যে একজনও যদি ইতিকাফ করে, তবে পুরো মহল্লার লোকজন দায়মুক্ত হয়ে যাবে। আর নারীদের জন্য ইতিকাফ করা মুস্তাহাব (উত্তম ও প্রশংসনীয়, তবে, জরুরি নয়)। রাসুলের স্ত্রীগণ ইতিকাফ করতেন। এমনকি তাঁর ইন্তিকালের পরও। [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ২৬৭৪]
.
নারী তার ইতিকাফের স্থানে ২০ রামাদান মাগরিবের আগেই চলে যাবে। এরপর ঈদের চাঁদ দেখা গেলে ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করবে। এটা হলো রামাদানের শেষ দশকের সুন্নাত ইতিকাফের বিধান।
.
(২) ইমাম আবু হানিফার মতে, নারীরা ঘরে তাদের নামাজ আদায়ের নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফ করবে। কিংবা একটি রুম ইতিকাফের জন্য নির্দিষ্ট করে নেবে। প্রস্রাব-পায়খানা ও অজু ব্যতীত অন্য প্রয়োজনে সেই স্থান থেকে আর বের হতে পারবে না। এটাচড বাথরুম/ওয়াশরুম থাকলে এটিতেই প্রয়োজন পূর্ণ করতে হবে। দূরে যাওয়া যাবে না। বাথরুম/ওয়াশরুম দূরে হলেও সেখানে প্রয়োজন হলে যাওয়া যাবে। এরপর আর সময় ব্যয় না করে দ্রুত ইতিকাফের স্থানে চলে আসতে হবে। [হিদায়াহ: ১/২৩০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১১]
.
(৩) বিবাহিত নারী ইতিকাফ করতে চাইলে স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া ইতিকাফ করা অনুচিত। আর স্বামীদের উচিত, যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া স্ত্রীদের ইতিকাফে বাধা না দিয়ে, তাদের ইতিকাফের সুযোগ করে দেওয়া। এতে উভয়েই সওয়াব পাবেন। স্বামী একবার অনুমতি দিলে পরে আর না করতে পারবে না। এই ‘না’ মানাও জরুরি নয়। [রাদ্দুল মুহতার: ২/৪৪১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১১]
.
(৪) যে নারীর স্বামী বৃদ্ধ বা অসুস্থ কিংবা তার ছোটো ছেলে-মেয়ে রয়েছে এবং তাদের সেবা করার কেউ নেই, সে নারীর জন্য ইতিকাফ করার চেয়ে তাদের সেবাযত্ন করা উত্তম। তবে, কেউ যদি দুটোর মাঝে সমন্বয় করতে চান, তাহলেও সমস্যা নেই। ইতিকাফরত নারী তার ইতিকাফের রুমের মধ্যে বাসার অতি জরুরি কোনো কাজ করতে পারবেন, যেটি না করলেই নয়। যেমন: কোনো বৃদ্ধ মানুষকে ঔষধ খাওয়ানো, বাচ্চাকে খাওয়ানো ইত্যাদি। তবে, এসব কাজ অন্যকে দিয়ে করানো গেলে নিজে করবে না।
.
(৫) ইতিকাফ অবস্থায় রাতেও সহবাস করা যাবে না। করলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক চুম্বন, আলিঙ্গন ও উত্তেজনার সাথে স্পর্শ করা বৈধ নয়। যদি এসবের কারণে বীর্যপাত ঘটে, তাহলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। [সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭; বাদায়িউস সানায়ে: ২/২৮৫; আদ্দুররুল মুখতার: ২/৪৫০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১৩]
.
(৬) জুমার দিনে গোসল করা সুন্নাহ। এ দিন ইতিকাফকারী নারী চাইলে কিছুটা সময় নিয়ে গোসল করতে পারবে। এটি কোনো কোনো আলিমের মত। আবার অনেক আলিম এটিরও বিরোধিতা করেছেন।
.
সপ্তাহের অন্যান্য দিনে এভাবে সময় নিয়ে গোসল করা যাবে না, ইতিকাফ ভেঙে যাবে। তবে, সর্বোচ্চ এটুকু সুযোগ রয়েছে যে, প্রস্রাব-পায়খানা করে ফিরে আসার সময় **অজু করতে যে সময়টুকু লাগে** এটুকু সময় পানি শরীরে দিয়ে দ্রুত ইতিকাফের স্থানে চলে আসবে। কাপড়-চোপড় ইতিকাফের স্থানে বদলাবে অথবা ওয়াশরুমে রেখে কাপড় পরে চলে আসবে। অন্য কেউ সেগুলো ওখানে ধৌত করবে। অথবা অন্য কোনো সময় প্রয়োজনে বাথরুমে গেলে দ্রুততার সাথে কাপড় ধুয়ে নিয়ে আসবে। গোসলে কোনো সাবান, শ্যাম্পু, ফেইসওয়াশ ইত্যাদি ব্যবহার করে আলাদা সময় ব্যয় করতে পারবে না। মোটকথা, গোসল একটি দুনিয়াবি কাজ। নামাজ বা ইতিকাফের জন্য গোসল শর্ত নয়, শুধু অজুই যথেষ্ট। সেজন্য গোসলে আলাদা সময় ব্যয়ের সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ অজু করতে যে সময়টুকু লাগে, এটুকু সময়ে দ্রুত শরীরে পানি ঢেলে চলে আসতে পারবে। তবে, এই কাজটিও করবে বাথরুম বা ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসার সময়। [রাদ্দুল মুহতার: ২/৪৪০; ২/৪৪৫; আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৫১৫]
.
(৭) রামাদানে অধিকাংশ নারী ব্যস্ত সময় কাটান। আবার অনেকের পিরিয়ড (হায়েজ) থাকে। তাই, অনেকের পক্ষে টানা দশ দিন ইতিকাফ করা কষ্টকর হয়ে যায়। এক্ষেত্রে তারা নফল ইতিকাফ করতে পারেন, যে কয়দিন সম্ভব হয়। লাইলাতুল কদর তালাশে শুধু রাতের বেলাতেও নফল ইতিকাফ করা যাবে।
.
(৮) হায়েজ অবস্থায় ইতিকাফ করা বৈধ নয়। কেননা এ অবস্থায় রোজা রাখা যায় না। আর, সুন্নাত ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। [সুনান বাইহাকি: ৪/৩১৭; বাদায়িউস সানায়ে’: ২/২৭৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১১]
.
হায়েজ ব্যতীত ইস্তিহাজার সমস্যা থাকলেও ইতিকাফ করা যাবে। ইস্তিহাজা হলো, নারীরা মাঝেমধ্যে হায়েজের মতো বিভিন্ন রক্ত বা এ জাতীয় জিনিস দেখতে পান। এগুলো আবার হায়েজের রক্তের মতো না। এমতাবস্থায় ইতিকাফ করতে সমস্যা নেই। কারণ এই অবস্থায় নামাজ বা রোজা দুটোই ফরজ। সহিহ বুখারিতে এসেছে, নবিজির একজন স্ত্রী ইস্তিহাজা অবস্থায় ইতিকাফ করেছিলেন। [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ২০৩৭]
.
ইতিকাফ শুরু করার পর হায়েজ শুরু হয়ে গেলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। পরে কমপক্ষে একদিনের ইতিকাফ রোজাসহ কাজা করতে হবে। এটিই উলামায়ে আহনাফের মত। সেটি রামাদানেই হতে হবে, এমনটি জরুরি নয়; তবে রামাদানে হলে সেটিই ভালো। এই এক দিন ইতিকাফ কাজা করার নিয়ম হলো, একদিন সূর্যাস্তের আগে ইতিকাফ শুরু করতে হবে। পরবর্তী দিন রোজা থাকতে হবে। সূর্যাস্তের পর ইতিকাফ শেষ হবে। এভাবে একদিন রোজাসহ ইতিকাফ করলেই কাজা আদায় হয়ে যাবে। পুরো দশ দিনের ইতিকাফ কাজা করতে হবে না। তবে, অবশিষ্ট দিনগুলো কাজা করা সম্ভব হলে, সেটিই উত্তম। [ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২০৭; আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৫০২]
.
ঔষধের মাধ্যমে হায়েজ বন্ধ রেখে রোজা বা ইতিকাফ পালন করা জায়েয। তবে, শারীরিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে এমনটি করা যাবে না। তাই, ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া উত্তম।
.
(৯) বিশেষ প্রয়োজনে ইতিকাফের স্থান ছেড়ে বাইরে গেলে কারো সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবে না, তবে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাবে। হাঁটতে হাঁটতে মানে নিজের প্রয়োজন পূরণে চলতে-ফিরতে, নিজ প্রয়োজন পূরণ করতে করতে। আয়িশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ অবস্থায় (প্রয়োজনে বাইরে গেলে) যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে অতিক্রম করতেন, তখন হাঁটা অবস্থাতেই ঐ ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিয়ে নিতেন। [ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ২৪৭২]
.
আর, ঘরে ইতিকাফ করলে, বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনই পড়বে না। তবে, প্রাকৃতিক প্রয়োজন এবং অজু করতে যাওয়ার সময়ে কারও সাথে কথা বললে, এই নিয়ম মেনে চলতে হবে। কোনোভাবেই ইতিকাফের নির্ধারিত স্থানের বাইরে আলাদা সময় ব্যয় করে অপ্রয়োজনীয় আড্ডা বা আলাপ-সালাপে মত্ত হওয়া যাবে না।
.
(১০) ইতিকাফের স্থানে অল্প-স্বল্প বৈধ কথা-বার্তা বলা জায়েয আছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রী সাফিয়্যাহ (রা.)-এর সাথে ইতিকাফ অবস্থায় কথা-বার্তা বলেছিলেন। [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ২০৩৫ ও ২০৩৮]
.
(১১) খাবার পাকানোর জন্য নারী পাকঘরে যেতে পারবেন না। তবে, প্রয়োজন হলে তিনি ইতিকাফের নির্ধারিত স্থানে খাবার রান্না করতে পারবেন। অন্যরা এক্ষেত্রে তাঁকে সাহায্য করবেন। তবে, খাবার পাকানোর কেউ থাকলে এই কাজ নিজে না করাই উত্তম। [ফাতাওয়া মাহমুদিয়্যাহ: ১০/২৫১]
.
এই ব্যাপারে অন্য অনেক আলিম বলেছেন, নারী দুনিয়াবি কাজ করলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। তাই, খাবার রান্না না করাই নিরাপদ।
.
ইতিকাফের গুরুত্ব, উপকারিতা, আমল ও অন্যান্য বিষয় জানতে এই লেখাটি পড়তে পারেন: #ইতিকাফ (দ্বিতীয় পর্ব) দেখুন- https://www.facebook.com/106265848436794/posts/164965312566847/
.
------------------------------
#ইতিকাফ (চতুর্থ পর্ব)
এই বছর যারা ইতিকাফে বসবেন, তাদের এই বিষয়গুলো জেনে রাখা দরকার।
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
ইতিকাফের বিভিন্ন বিধান:
.
(১) রামাদানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা পুরুষের জন্য সুন্নাতে কিফায়াহ। অর্থাৎ কোনো মহল্লার মসজিদে পুরুষদের মধ্যে একজনও যদি ইতিকাফ করে, তবে পুরো মহল্লার লোকজন দায়মুক্ত হয়ে যাবে। এটি উলামায়ে আহনাফের অভিমত।
.
ইতিকাফকারীকে ইতিকাফের স্থানে ২০ রামাদান সূর্যাস্তের আগেই চলে যেতে হবে। এরপর ঈদের চাঁদ দেখা গেলে ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করবে।
.
(২) মাসজিদে এটাচড বাথরুম থাকলে এবং অজুর ব্যবস্থা থাকলে এটিতেই প্রয়োজন পূর্ণ করতে হবে। প্রস্রাব-পায়খানা বা অজুর জন্য দূরে যাওয়া যাবে না। [হিদায়াহ: ১/২৩০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১১]
.
আর যদি এটাচড বাথরুম না থাকে, তবে বাইরে যাওয়া যাবে। তবে, চলার পথে থামা যাবে না। দ্রুত চলে আসতে হবে মাসজিদে। আসা-যাওয়ায় হাঁটার মধ্যে কারও সাথে জরুরি কথা বলা যাবে।
.
(৩) ইতিকাফ অবস্থায় রাতেও সহবাস করা যাবে না। করলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক চুম্বন, আলিঙ্গন ও উত্তেজনার সাথে স্পর্শ করা ইতিকাফ অবস্থায় বৈধ নয়। যদি এসবের কারণে বীর্যপাত ঘটে, তাহলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। [সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭; বাদায়িউস সানায়ে: ২/২৮৫; আদ্দুররুল মুখতার: ২/৪৫০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১৩]
.
(৪) জুমার দিনে গোসল করা সুন্নাহ। এ দিন ইতিকাফকারী চাইলে কিছুটা সময় নিয়ে গোসল করতে পারবে। এটি কোনো কোনো আলিমের মত। আবার অনেক আলিম এটিরও বিরোধিতা করেছেন।
.
সপ্তাহের অন্যান্য দিনে এভাবে সময় নিয়ে গোসল করা যাবে না, ইতিকাফ ভেঙে যাবে। তবে, সর্বোচ্চ এটুকু সুযোগ রয়েছে যে, প্রস্রাব-পায়খানা করে ফিরে আসার সময় **অজু করতে যে সময়টুকু লাগে** এটুকু সময় পানি শরীরে দিয়ে দ্রুত ইতিকাফের স্থানে চলে আসবে। কাপড়-চোপড় ইতিকাফের স্থানে বদলাবে অথবা ওয়াশরুমে রেখে কাপড় পরে চলে আসবে। অন্য কেউ সেগুলো ওখানে ধৌত করবে। অথবা অন্য কোনো সময় প্রয়োজনে বাথরুমে গেলে দ্রুততার সাথে কাপড় ধুয়ে নিয়ে আসবে। গোসলে কোনো সাবান, শ্যাম্পু, ফেইসওয়াশ ইত্যাদি ব্যবহার করে আলাদা সময় ব্যয় করতে পারবে না। মোটকথা, গোসল একটি দুনিয়াবি কাজ। নামাজ বা ইতিকাফের জন্য গোসল শর্ত নয়, শুধু অজুই যথেষ্ট। সেজন্য গোসলে আলাদা সময় ব্যয়ের সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ অজু করতে যে সময়টুকু লাগে, এটুকু সময়ে দ্রুত শরীরে পানি ঢেলে চলে আসতে পারবে। তবে, এই কাজটিও করবে বাথরুম বা ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসার সময়। [রাদ্দুল মুহতার: ২/৪৪০; ২/৪৪৫; আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৫১৫]
.
(৫) পূর্ণ দশ দিনের সুন্নাত ইতিকাফ পালন করা অনেকের জন্যই অসম্ভব। এক্ষেত্রে তাদের যে কয়দিন সম্ভব, নফল ইতিকাফ করতে পারেন। লাইলাতুল কদর তালাশে শুধু রাতের বেলাতেও নফল ইতিকাফ করা যাবে। কিংবা কয়েক ঘণ্টার জন্যও নফল ইতিকাফ করা যাবে।
.
(৬) সুন্নাত ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। রোজা না থাকলে ইতিকাফ হবে না। তবে, নফল ইতিকাফের জন্য এমন শর্ত নেই। [সুনান বাইহাকি: ৪/৩১৭; বাদায়িউস সানায়ে’: ২/২৭৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১১]
.
(৭) উলামায়ে আহনাফের মতে, কোনো কারণে ইতিকাফ ভেঙে গেলে, পরে কমপক্ষে একদিনের ইতিকাফ রোজাসহ কাজা করতে হবে। সেটি রামাদানেই হতে হবে, এমনটি জরুরি নয়; তবে রামাদানে হলে সেটিই ভালো। এই এক দিন কাজা করার নিয়ম হলো, একদিন সূর্যাস্তের আগে ইতিকাফ শুরু করতে হবে। পরবর্তী দিন রোজা থাকতে হবে। সূর্যাস্তের পর ইতিকাফ শেষ হবে। এভাবে একদিন রোজাসহ ইতিকাফ করলেই কাজা আদায় হয়ে যাবে। পুরো দশ দিনের ইতিকাফ কাজা করতে হবে না। তবে, অবশিষ্ট দিনগুলোও কাজা করতে পারলে, সেটিই উত্তম। [ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২০৭; আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৫০২]
.
(৮) ইতিকাফরত ব্যক্তি পেশাব-পায়খানা বা অজুর জন্য মসজিদের বাইরে গেলে আসা যাওয়ার পথে, চলতে-চলতে সালাম আদান-প্রদান করতে পারবে। এসময় পথ চলতে-চলতে কারো সাথে প্রয়োজনে অল্প-স্বল্প কথাও বলতে পারবে। এতে ইতিকাফের ক্ষতি হবে না। তবে, কারো সাথে কথা বলা বা কুশলাদি জিজ্ঞাসার জন্য মসজিদের বাইরে অল্প সময়ও দাঁড়ানো জায়েয হবে না। তেমনি, মাসজিদের বাইরে গিয়ে কোনো জানাজার নামাজেও শরিক হওয়া যাবে না। আয়িশা (রা.) বলেন, ইতিকাফকারীর সুন্নাত হলো: কোনো রোগী দেখতে যাবে না, জানাজায় অংশ নেবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না, তার সাথে মেলামেশা করবে না, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হবে না। [ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ২৪৭৩; বর্ণনাটি হাসান সহিহ]
.
ইতিকাফকারী ব্যক্তি অবশ্যই আগে জেনে নেবেন, মাসজিদের সীমানা কতটুকু। মসজিদের মালিকানায় থাকা জায়গা না, শুধু মাসজিদ কতটুকু, সেটি আগে জেনে নেবেন। কারণ প্রয়োজন ব্যতীত মাসজিদের সীমানার বাইরে গেলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে।
.
(৯) ইতিকাফের স্থানে অল্প-স্বল্প বৈধ কথা-বার্তা বলা জায়েয আছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রী সাফিয়্যাহ (রা.)-এর সাথে কথা-বার্তা বলেছিলেন। [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ২০৩৫ ও ২০৩৮]
.
(১০) মসজিদে খাবার পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ না থাকলে খাবার আনার জন্য বাসায় যাওয়া যাবে। এ কারণে ইতিকাফ ভাঙবে না। তবে খাবার আনার জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য কোনো কাজে বিলম্ব করা যাবে না। অন্য কাজে অল্প সময় ব্যয় করলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। অবশ্য কোনো কারণে খাবার প্রস্তুত হতে লেইট হলে, সেজন্য অপেক্ষা করতে পারবে। [আল বাহরুর রায়িক: ২/৩০৩; আল মুহিতুল বুরহানি: ৩/৩৮০]
.
---------------------------
#ইতিকাফ (পঞ্চম ও শেষ পর্ব)
শেষ সময়ের পরামর্শ: ইতিকাফকারীদের প্রতি
.
যারা ইতিকাফে বসবেন, তারা বিশেষ করে তাহিয়্যাতুল অজু, তাহাজ্জুদ, দোহা বা চাশতের নামাজ এবং যাওয়ালের নামাজে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। এগুলো একদম মিস করবেন না। এগুলো সবই নফল নামাজ। বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। সাধারণ নফলের মতো পড়বেন।
.
যখনই অজু করবেন, তাহিয়্যাতুল অজু দুই রাকাত পড়বেন। তাহাজ্জুদ যত ইচ্ছা দুই রাকাত করে পড়তে থাকবেন। চাশতের নামাজ চার রাকাত থেকে বারো রাকাত পর্যন্ত পড়তে পারেন। দুই রাকাতও পড়তে পারবেন। যাওয়ালের নামাজ চার রাকাত। নিয়ম হলো, ঠিক যোহরের চার রাকাত সুন্নাতের মতো একত্রে। অর্থাৎ, দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহহুদ পড়ে দাঁড়িয়ে যাবেন আর চতুর্থ রাকাতে সালাম ফেরাবেন।
.
কুরআন প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা পড়বেন। সম্ভব হলে অর্থসহ পড়বেন। না হয় শুধু তিলাওয়াত করবেন। তাফসিরসহ পড়তে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে।
.
যদি কখনও ইবাদতে ক্লান্তি আসে এবং কোনোকিছু ভালো না লাগে, তাহলে মোবাইলে তিলাওয়াত বা বয়ান শুনতে পারেন। মিউজিকহীন ইসলামি নাশিদও শুনতে পারেন। তবে, অনলাইনে ঢুকবেন না। পাশাপাশি ইসলামি অন্যান্য বইও পড়তে পারেন। কারও সাথে ইতিকাফের স্থানে বসে দ্বীনি কথাবার্তাও বলতে পারেন। খারাপ লাগলে ঘুমাতে পারেন।
.
দুটো বিষয় জোর দিয়ে মাথায় রাখবেন: কোনো অবস্থাতেই ইতিকাফের নির্ধারিত মাসজিদ (নারীরা নির্ধারিত রুম) ছেড়ে একটুও অন্যত্র যাওয়া যাবে না। তাহলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। একমাত্র প্রস্রাব-পায়খানার জন্য বাথরুম বা ওয়াশরুমে যেতে পারেন। শুধু গোসলের উদ্দেশ্যে বা ফ্রেশ হওয়ার জন্য যাওয়ারও সুযোগ নেই। অজু করতে যেতে পারবেন। গোসল যদি করতেই হয় তাহলে, কেবল প্রস্রাব-পায়খানা করে ফেরার সময় ‘‘অজু করতে যে সময়টুকু লাগে’’ এতটুকু সময়ে শরীরে পানি ঢেলে দ্রুত ইতিকাফের স্থানে চলে আসতে হবে। সাবান, শ্যাম্পু, ফেইসওয়াশ ইত্যাদি ব্যবহার করে সময় নষ্ট করা যাবে না। কোনো কোনো আলিমের মতে, কেবল জুমার দিনে গোসলের জন্য আলাদা সময় ব্যয় করে ভালোভাবে গোসল করার সুযোগ আছে। তবে, ইতিকাফের স্থানে তেল, লোশন, ক্রিম, চিরুনি ইত্যাদি ব্যবহারে সমস্যা নেই।
.
ইতিকাফকারীদের উচিত বেশি পরিমাণে দু‘আ করা। কারণ এমন মর্যাদাপূর্ণ আমলরত অবস্থায় দু‘আ কবুলের ব্যাপারে অধিক আশাবাদী হওয়া যায়। অবশ্যই ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউ-উন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি’ দু‘আটি অর্থের দিকে খেয়াল রেখে মনোযোগের সাথে আবেগ দিয়ে প্রতি রাতে বেশি করে পড়বেন। সঠিক উচ্চারণ শিখে নেবেন। বাংলা দেখে উচ্চারণ শিখলে ভুল হওয়া নিশ্চিত। লাইলাতুল কদরের সবচেয়ে স্পেশাল আমলই এটি। প্রতি রাতে বেশি বেশি পড়বেন।
.
সকাল-সন্ধ্যার মাসনুন আমলগুলো করবেন। সেজন্য হিসনুল মুসলিম অ্যাপটি ডাউনলোড করে নিতে পারেন। তাহলে যেসব দু‘আ মুখস্থ নেই, সেগুলো আপাতত দেখে পড়তে পারবেন। তবে, মুখস্থ পড়াই ভালো। শিখে নেবেন। আর প্রত্যেক ফরজ নামাজের পরের এবং ঘুমের আগে-পরের আমলগুলোও মনোযোগের সাথে করবেন। প্রতিদিন রাতে সুরা মুলক পড়বেন। জুমার দিন সুরা কাহাফ পড়বেন। তিন কুল, আয়াতুল কুরসি এবং সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের আমল মিস করবেন না।
.
প্রতিটি রাতে অধিক ফজিলতের আমলগুলো বেশি করে করবেন। কারণ জোড়-বেজোড় যেকোনো রাতেই কদর হতে পারে। এ বিষয়ে আমরা একটি পর্বে দলিলসহ আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ। তাই, প্রতি রাতেই বেশি বেশি সুরা ইখলাস পড়বেন। সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা হাউলা ওয়া লা কুওওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ কয়েকশো বার করে পড়বেন একেকটি। দরুদ এবং ইস্তিগফার পড়বেন প্রচুর পরিমাণে। নামাজে পড়ার দরুদটি এবং সায়্যিদুল ইস্তিগফারকে প্রাধান্য দেবেন। তবে, অন্যগুলোও করতে সমস্যা নেই।
.
একটি নোটখাতা বা ডায়েরি রাখতে পারেন। ইতিকাফ অবস্থায় মনে আসা ভালো ভালো চিন্তা ও অনুভূতিগুলো টুকে রাখবেন। সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকবে। তবে, বেশি সময় ব্যয় করবেন না বা সাহিত্যচর্চা করতে যাবেন না।
.
তাওবাহ ইস্তিগফারে সর্বোচ্চ মনোনিবেশ করবেন। যেন, এই ইতিকাফেই নিজের সকল গোনাহ ক্ষমা করে নিতে পারেন আল্লাহর কাছ থেকে। এই কাজটি করতে পারলে ইতিকাফ স্বার্থক বলা যাবে।
.
সকল মুমিন এবং মুসলিমের জন্য প্রাণখুলে দু‘আ করবেন। বিশেষ করে যারা নির্যাতিত-মাজলুম, অন্যায়ভাবে কারাবন্দী, ঋণগ্রস্ত, অসুস্থ, বেকার, যাদের বিবাহ হচ্ছে না বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হওয়া মুসলিম, নিজের বাবা-মা ও আত্মীয় স্বজন এবং মৃত সকল মুসলিমের জন্য।
.
-----------------------------
©Nusus
©Nusus
Page link- https://www.facebook.com/FromNusus
ইসলামিক বই, অডিও-ভিডিও লেকচার সিরিজ সহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের লিংকগুলো পাবেন এখানে
https://justpaste.it/48f6m