JustPaste.it

কুরআন কারীম নিয়ে আতীক উল্লাহ হুজুরের অসাধারন কিছু কথা ও উপদেশ

 

 

দিনলিপি-১৮০০

(১১-০৯-২০২১)

সুইটহার্ট কুরআন

-----------------
১. শিফা
কুরআন কারীম ‘শিফা’। আরোগ্য। কিসের আরোগ্য? আত্মিক রোগের আরোগ্য। কুরআন কারীম মানসিক রোগের আরোগ্য। কুরআন বুদ্ধিবৃত্তিক রোগের আরোগ্য। দৈনিক বিরদ-হিযব নিয়মিত আদায় করলে, এসব রোগের আরোগ্য এমনি এমনি হয়ে যায়। রোগ দেখা দিলে যেমন ডাক্তারের কাছে নিজের সমস্যার কথা খুলে বলতে হয়। মানসিক বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা দেখা দিলে, কুরআনের কাছে সমস্যার কথা খুলে বলতে হবে। কুরআন কি মানুষ, তার কাছে সমস্যার কথা বলব? আসল কথা হলো, নিয়মিত বিরদ-হিযব মনোযোগ দিয়ে আদায় করা মানেই, কুরআনের কাছে নিজের সমস্যার কথা খুলে বলা। প্রথম কয়েকদিন হয়তো দৃশ্যত কোনো ফল দেখা যাবে না। আসল কথা হলো, নিয়মিত বিরদ-হিযব আদায় করলে, কোনো সমস্যাই দেখা দেবে না। আমি ডাক্তারের কাছে যতটুকু প্রকাশ করব, ততটুকুই চিকিৎসা হবে। আমি কুরআনের কাছে যতটা ভিড়ব, আমার মনশ্চিকিৎসাও ততটুকু হবে। মানুষ জন্মগতভাবে ফিতরাহর অনুসারী। মানুষ জন্মগতভাবে তাওহীদের অনুসারী। শিরক-কুফর-ইরতিদাদ মানুষের স্বভাবজাত নয়। এগুলো আরোপিত। কুরআনের চিকিৎসা স্বভাবজাত। কুরআনি স্বভাবজাত চিকিৎসার সামনে দুনিয়ার কোনো আরোপিত রোগই টিকতে পারার কথা নয়।
.
২. কুরআনের পথে
এক যুবককে চিনি। বড় ঘরের সন্তান। ধন-সম্পদে ভরপুর। প্রাণ ও প্রাচুর্য যেন উপচে পড়ছে। পরিবারের সবাই জাগতিকভাবে উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু সে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম—কুরআনে হাফেয। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত। পরিবারের ভোগ-বিলাসী যিন্দেগীর কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বেশির ভাগ সময় কুরআন পড়ে। কুরআনের কথা বলে। কুরআনের দিকে দাওয়াত দেয়। যেহেতু আর্থিক চিন্তা নেই, পুরো সময়টা সে এ কাজেই ব্যয় করতে পারে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম,
‘তুমি কীভাবে এ পথে পা বাড়াতে পারলে? পরিবারের প্রথায় আরামের জীবন ছেড়ে?’
‘কীভাবে এসেছি ঠিক বলতে পারব না! তবে আমার কাছে কীভাবে যেন কুরআনকে ভালো লেগে গিয়েছিল। আব্বু আমার জন্যে বিদেশ থেকে সুন্দর একটা কুরআন শরীফ এনেছিলেন। ওটা ছিল কারুকার্যখচিত। আব্বু ধার্মিক নন। কিন্তু তার কী মনে হয়েছিল, আল্লাহই ভালো বলতে পারবেন। সবার জন্যে দামি খেলনা এনেছেন। ব্যতিক্রমভাবে শুধু আমার জন্যেই কেন কুরআনখানা আনলেন। কুরআন শরীফ যখন কিনতে গেলেন, পাশে আরেকজন ক্রেতা ছিলেন। আব্বু দোকান থেকে বের হওয়ার উপক্রম হতেই পাশের ভদ্রলোক আব্বুকে প্রশ্ন করলেন
‘কার জন্যে কিনলেন?’
‘আমার ছোট্ট ছেলের জন্যে। কিনতে এসেছিলাম খেলনা। কিন্তু এত সুন্দর কুরআন শরীফ দেখে রেখে যেতে মন চাইল না।’
‘বেশ করেছেন। আপনার ছেলেকে বলবেন,
‘তোমার অদেখা চাচ্চু বলেছেন, কুরআন কারীম বাইরে দেখতেই শুধু সুন্দর নয়, এর অর্থ আরও অনেক বেশি সুন্দর।”
ব্যস, আব্বু ফিরে এসে হুবহু সেই চাচ্চুর কথা আমাকে বলেছেন। আমি আব্বুর কথা শোনার সাথে সাথে বললাম, ‘আব্বু, আমি কুরআনের অর্থ শিখব।’ আব্বু ভীষণ অবাক হলেন। সাথে সাথে বললেন, ঠিক আছে। তোমার দাদুর সাথে কথা বলে নিই। এরপর আর কী, কুরআন কারীম নিয়েই আছি — শায়খ আবদুর রহমান আকল)।
.
৩. কুরআনি সাক্ষ্য
কুরআন আমার পক্ষের সাক্ষী হবে অথবা আমার বিপক্ষের সাক্ষী হবে। (মুসলিম)
القرآن حُجَّةٌ لَكَ أَوعَلَيْك
যাকে কুরআনের ইলম দান করা হয়েছে, কিন্তু সে এর দ্বারা উপকৃত হলো না, কুরআনের নিষেধসমূহ জানার পরও বিরত হলো না, কুরআন তার বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে। (কুরতুবী)
.
৪. কুরআনমুখিতা
অনেকে হৃদয়ের প্রশান্তির জন্যে, চিত্তশুদ্ধির জন্যে কসীদা শোনে, গান শোনে, সামা শোনে। এ ধরনের লোকদের কুরআনের প্রতি আগ্রহ দিনদিন কমে যায়। একসময় কুরআনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে যায়। মনের শান্তির জন্যে বেশি বেশি গযল শোনাও ক্ষতিকর। কুরআনের প্রতি উদাসীনতা চলে আসে।
.
৫. একমাত্র চাওয়া
ঈসা বিন ওয়ারদান রহ.-কে প্রশ্ন করা হলো, দুনিয়াতে আপনার একমাত্র চাওয়া কী? প্রশ্নটা শুনেই তিনি কেঁদে দিয়ে বললেন,
‘আমার চাওয়া হলো, আমার বক্ষটা উন্মুক্ত করে দেয়া হবে, যাতে আমি দেখতে পারি, সারা জীবন কুরআন তিলাওয়াতের কী প্রভাব সেখানে পড়েছে।’
আমাদের সালাফগণ কুরআন কারীম নিয়ে এমনই বুঁদ ছিলেন।
.
৬. গানের সুর
কুরআন কারীমকে গানের সুরে প্রচার করার জন্যে একদল লোক উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি ইহুদি-নাসারাদের পরিচালিত টিভি-রেডিওতেও এর বহুল প্রচার হচ্ছে। কারণ? তারা জানে, এই গীতালি কুরআন মৃতকে জীবিত করা তো দূরের কথা, যারা জীবিত আছে তাদেরকেও মৃত বানিয়ে ছাড়বে।
.
৭. কলবের প্রাণ
সবকিছুর যেমন প্রাণ আছে, কলবেরও প্রাণ আছে। কুরআন হলো সে প্রাণ। কুরআন কলবকে নূর-হেদায়াত-আদব-প্রাণশক্তি সরবরাহ করে। হকের ওপর অবিচলতা দান করে। অনেক আয়াতে এদিকে ইঙ্গিত আছে।
.
৮. সাফাইয়ে কলব
কুরআন কারীম পবিত্র। কুরআনকে রাখতে হয় পবিত্র জায়গায়। কুরআন থাকে মানুষের কলবে। গুনাহের কারণে কলব কলুষিত হয়ে গেলে, কুরআন কলব ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। মসিলিপ্ত কলবকে শুদ্ধ করতে ইস্তেগফারের বিকল্প নেই। ইস্তেগফার কলবকে ধুয়ে মুছে সাফসুতরো করে তোলে। পরিশুদ্ধ কলব পেয়ে কুরআন আবার ফিরে আসে। হিফয ভুলে গেলেও বেশি বেশি ইস্তেগফার করা জরুরি। কুরআনকে ফিরিয়ে আনার জন্য কলবকে পরিষ্কার করে রাখবে। হিফয ধরে রাখার জন্যও ইস্তেগফার উপকারী। কলবে কোনো ময়লা জমলে তা দূর করে দেবে।
.
৯. কুরআনের বরকত
কুরআনের বরকত কেমন? সবচেয়ে বড় কথা, কুরআন রাব্বে কারীমের পক্ষ হতে এসেছে। এর চেয়ে বড় বরকতময় আর কিছু হতে পারে না।
وَهَـٰذَا كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ مُبَارَكٌ
(এমনিভাবে) এটা এক বরকতপূর্ণ কিতাব, যা আমি নাযিল করেছি (আন‘আম, ১৫৫)।
বারাকাহ মানে, প্রভূত কল্যাণ সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্য। কুরআন কারীমকে (مُبَارَكٌ) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কুরআন কারীম আগাগোড়া মুবারক-বরকতময়। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে সবদিক থেকে কুরআনকে মুবারক করেছেন। পবিত্র পরিশুদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া-আখেরাতের সমস্ত বরকত জমা করেছেন। সর্বকালে সর্বযুগে কুরআনের সাথেই বরকত জড়িয়ে ছিল। নিহিত ছিল। কুরআন নাযিল হয়েছে মুবারক মাসে। মুবারক রাতে।
কুরআনের শব্দে শব্দে বরকত। কুরআনের অক্ষরে অক্ষরে বরকত। কুরআনের সাগরসম বিপুল অর্থ ও উপদেশ ভান্ডারে বরকত। কুরআনের প্রতিটি আয়াতে সূরায় বরকত। কুরআনে লুকিয়ে আছে বরকতের মণিমাণিক্য। উপচে পড়া কুরআনি বরকতে ডুবে থাকে—যে কুরআন শিক্ষা করে, শিক্ষা দেয়, কুরআনি ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকে, কুরআনি ইলমচর্চায় ডুবে থাকে, কুরআনি জীবনযাপনে সচেষ্ট থাকে।
কুরআনি বরকত জড়িয়ে থাকে—যে কুরআনকে আঁকড়ে ধরে, যে কুরআনি হেদায়াত লাভ করতে চায়, যে কুরআন থেকে শিফা-আরোগ্য হাসিল করতে চায়, যে কুরআন থেকে আখেরাত কামাতে চায়। যারা কুরআনি মজলিসে বসে, তাদের ওপর কুরআনের কারণে বরকত আসে। আল্লাহর পক্ষ থেকে সকীনা-প্রশান্তি নাযিল হয়। তাদের আল্লাহর রহমত ঢেকে রাখে। তাদের ফেরেশতারা আদরের বেষ্টনীতে ঘিরে রাখে,
كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ إِلَیۡكَ مُبَـٰرَكٌ لِّیَدَّبَّرُوۤا۟ ءَایَـٰتِهِ
(হে রাসূল!) এটি এক বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতের মধ্যে চিন্তা করে (সোয়াদ, ২৯)।
وَهَـٰذَا ذِكۡرٌمُّبَارَكٌ أَنزَلۡنَـٰهُۚ
এটা (অর্থাৎ এই কুরআন) বরকতময় উপদেশবাণী, যা আমি নাযিল করেছি (আম্বিয়া, ৫০)।
وَهَـٰذَا كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ مُبَارَكٌ مُّصَدِّقُ ٱلَّذِی بَیۡنَ یَدَیۡهِ
এবং এটা এক বরকতময় কিতাব, যা আমি নাযিল করেছি, যা পূর্ববর্তী আসমানি হেদায়াতসমূহের সমর্থক (আনআম, ৯২)।
.
১০. মনোজগতের বদল
কলবে যখন কুরআন কারীম বাস করতে শুরু করে, কলব এমনিতেই আল্লাহর প্রতি বিন¤্র হয়ে পড়ে। কুরআন কারীম আল্লাহর কালাম। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা নানাভাবে বান্দার সামনে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন। কখনো ভয় জাগানিয়া বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছেন। কখনো বড়ত্ব, সম্মান-সমীহ জাগানিয়া সিফাত বর্ণনা করেছেন। কুরআনের এসব আয়াত পড়ে, মুমিন বান্দার মনোজগতে বিচিত্র রূপবদল ঘটতে থাকে। হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার জন্ম হয়। আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা, ভয় ও ভালোবাসায় মাথা নুয়ে আসে। মন থেকে গর্ব-অহংকার দূর হয়ে ভেতরটা বিনয়ে বিগলিত হয়ে পড়ে। লবণ যেমন পানিতে গলে যায়, মনটাও আল্লাহর বড়ত্বের সামনে বিলীন হয়ে যায়।
.
১১. আমি ও কুরআন
কুরআন কারীমের সাথে আমার সম্পর্ক কেমন? নিজেকে প্রশ্ন করি।
আমি কি সাধ্যমতো সুর করে কুরআন তিলাওয়াত করি?
আমি কিছুটা সময় অর্থ বুঝে বুঝে তাদাব্বুরের সাথে তিলাওয়াত করি?
আমি কি কুরআনের সান্নিধ্যে নিজেকে নিরাপদ ভাবি?
আমি রোগবালাইয়ে কুরআনে শিফা-আরোগ্য খুঁজি?
আমি কি আচারে-বিচারে কুরআনের দ্বারস্থ হই?
আমি ন্যায়ে-অন্যায়ে কুরআনের কাছে বিচারপ্রার্থী হই?
আমি কি নিজের মধ্যে কুরআনের কিছু অংশ হলেও ধারণ করি?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যার মধ্যে কুরআন নেই, সে বিরান ঘরের মতো
إنَّ الذي ليس في جوفِه شيءٌ من القرآنِ كالبيتِ الْخَرِبِ
এই কুরআন আল্লাহর দিকে চলা পথিকের প্রধানতম পাথেয়।
আমি আল্লাহর দিকে পথচলা শুরু করেছি? আমি কি পাথেয় সাথে নিয়েছি?
আমি প্রতিদিন কুরআন নিয়ে বসি?
আমি সন্তান ও সমাজকে কুরআনের বার্তা পৌঁছাই?
এই কুরআন আলোকোজ্জ্বল পোশাক। আমি কীভাবে এই পোশাক পরি?
এই কুরআন ঈমানের এক সুরক্ষিত দুর্গ। আমি কি এই দুর্গে আশ্রয় নিই?
এই কুরআন এক বিস্ময়কর ঔষধি। আমি কীভাবে এই ওষুধ সেবন করি?
এই কুরআন দুনিয়ার সর্বোচ্চ আদালত। আমি কি এর হালাল-হারাম মেনে চলি?
মুমিনের কর্তব্য সর্বদা কুরআনের সাথে থাকা। কুরআন থেকে দূরে থাকা প্রকৃত মুমিনের পক্ষে অসম্ভব। কারণ কুরআন তার ও ¯্রষ্টার মাঝে যোগসূত্র।
ইউসুফ আ. যখন দেখলেন কারাগারই তার জন্য উত্তম। শান্তিমতো আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতে পারবেন। বাইরের লোভ-লালসার হাতছানিমাখা স্বাধীন জীবনের চেয়ে, স্বাধীনভাবে ইবাদত করতে পারা বন্দীজীবনই বেশি উত্তম নয় কি? এমন কিছু বিবেচনা করেই হয়তো তিন বলেছিলেন, “ইয়া রাব্ব, তারা আমাকে যেদিকে আহ্বান করছে, তার চেয়ে কারাগারই আমার কাছে বেশি প্রিয়” (ইউসুফ, ৩৩)।
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ
এই মহান কিতাবের ফলফলাদি যেমন বৈচিত্র্যময়, এই কিতাব নিয়ে আলাপ-আলোচনাও নানারঙা। এই কিতাবের বক্তব্য-উপদেশও বহুমুখী।
এই কিতাবের কিছু কথা সুখ-সৌভাগ্য, মানসিক প্রশান্তি আনয়ন করে।
এই কিতাবের কিছু কথা সাধ-সংকল্পকে সুদৃঢ় করে।
এই কিতাবের কিছু কথা মানুষকে অজ্ঞতার আঁধার থেকে জ্ঞানের আঙিনায় নিয়ে আসে।
এই কিতাবের কিছু কথা মানুষের অন্তরে প্রচ- শক্তিশালী নসীহার কাজ করে।
এই কিতাবের প্রতিটি কথা শরীয়ত ও সংবিধানের কাজ করে।
কুরআন কারীমের এতসব ভূমিকায় আমার অবস্থান কোথায়?
.
১২. সবার আগে কুরআন
কুরআন কারীমকে সবকিছু থেকে প্রাধান্য দেবো। জাগতিক প্রাপ্য থেকেও কুরআনকে প্রাধান্য দেবো। আল্লাহর মর্জি থাকলে, জাগতিক প্রাপ্য আমার কাছে পৌঁছে যাবে। কিন্তু নিজে থেকে কাছে না গেলে, কুরআন আমার কাছে আসবে না। কুরআনকে আমার সর্বোচ্চটুকু না দিলে, কুরআন আমাকে দেবে না। আমাকে বুঝেশুনে কুরআনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
.
১৩. কুরআনের মর্যাদা
কুরআনের হরফ, কুরআনের শব্দ, কুরআনের ইলম বড় আত্মমর্যাদাবোধম্পন্ন। আমি পুরো মনোযোগ আর গুরুত্ব না দিলে, কুরআন আমার কাছ থেকে ছুটে যাবে। আমি টেরটিও পাব না। আমার অগোচরেই কুরআন আর আমার মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবে। আমার কাছে মনে হতে পারে, কুরআনের হরফ সহজ। কুরআন মুখস্থ করা সহজ। আমার এটা জানা নেই—কুরআনের হরফগুলো ধরা যেমন সহজ, আমার সামান্য অবহেলার ফলে, কুরআনের হরফগুলোও সহজে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে।
.
১৪. কুরআনি আনন্দ
কুরআন নিয়ে আনন্দের কোনো শেষ নেই। কখনো একটা আয়াত শুদ্ধ করে পড়তে পারার আনন্দ। কখনো একটা আয়াত বুঝতে পারার আনন্দ। কখনো একটা সূরার তিলাওয়াত শেষ করার আনন্দ। কখনো একটি পারা শেষ করার আনন্দ। শুধু আনন্দ আর আনন্দ। একের পর এক। ধারাবাহিক। এতদিন আনন্দ না হলে, আজ থেকে এসবকে আনন্দের উপলক্ষ্য বানিয়ে নেব। ইন শা আল্লাহ।
.
১৫. শূন্য কলব
কলব একটি শূন্য পাত্রের মতো থাকে। কুরআন ছাড়া ভিন্ন কিছু দিয়ে ভর্তি করে রাখলে, কুরআন প্রবেশ করবে কী করে? আগে কলবকে খালি করতে হবে। কুরআনের জন্য কলবে রাজসিংহাসন বানিয়ে, কুরআনকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে।
.
১৬. জীবন্ত হৃদয়
জীবন্ত হৃদয় কোনটা? কুরআনপূর্ণ জীবন। কুরআনমুখী জীবন। কুরআনময় জীবন। এমন হৃদয়ের অধিকারী কীভাবে হওয়া যায়? কলবকে কুরআনবিরোধী বস্তু থেকে সুরক্ষিত রাখা। চোখকে বদনজর বা পাপদৃষ্টি থেকে হেফাযত করা। কানকে কুরআনবিরোধী শ্রবণ থেকে দূরে রাখা। অন্তরকে পাপ থেকে মুক্ত রাখা। এ সবকিছু করা কুরআনের জন্য। কুরআনের ভালোবাসায়। কুরআনের উপকার লাভের আশায়।
.
১৭. আহলে কুরআন
প্রকৃত আহলে কুরআন নিজের কলবে কুরআনকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত কত চেষ্টা-মুজাহাদা করতে থাকে, সেটা যদি অন্যরা জানতে পারত, তাহলে বুঝতে পারত, আহলে কুরআনের জগৎ আর তাদের জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আহলে কুরআন জানে, ছোট্ট একটি আয়াত রক্ষার জন্য, তারা জীবনের সমস্ত স্বাদমজা ত্যাগ করতে পারবে।
.
১৮. কুরআনের ভালবাসা
কুরআন কারীমের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এভাবেও হয়, আহলে কুরআন কোনো ভুল করে ফেললে, কোনো গুনাহ করে ফেললে, ভয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে, এই বুঝি তার কাছ থেকে কুরআন চলে গেল! এই বুঝি আমার আর কুরআনের মাঝে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো! আহলে কুরআন সব সময় চেষ্টা করে, তার জীবনাচার যেন কুরআনের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হয়। প্রকৃত ভালোবাসার দাবিই এটি।
.
১৯. হৃদয়ের হালচাল
কুরআনের সাথে হৃদয়ের সম্পর্কের হালচাল দিনকাল কেমন যাচ্ছে? রহমানের আয়াত পড়তে আগ্রহ জাগছে কি? কুরআন ছেড়ে অন্য ব্যস্ততায় ডুবে থাকছি না তো? কুরআনের সাথে লেগে থাকার কথা কিছুতেই ভোলা যাবে না। শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে কুরআনই যথেষ্ট। পাশাপাশি কুরআন বোঝার জন্য প্রয়োজন সুন্নাহ।
.
২০. গুনাহরোধী
কুরআন কারীমের মতো আর কোনো কিছুই মানুষকে গুনাহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে না। কুরআন মুমিনকে অত্যন্ত কোমলভাবে পাপ থেকে দূরে রাখে। কুরআন বান্দাকে গুনাহ ছাড়ার জন্য কঠোরতা বা জোরাজুরি করে না। কুরআনের কোনো আয়াত বা বিধান বান্দার কলবে বসে গেলে, আর কিছু লাগে না। কালামুল্লাহর প্রভাবে বান্দা আপছে-আপ গুনাহ থেকে হটে যায়। কলব যখন কুরআনি নূরে নূরানী হয়ে যায়, কলব থেকে এক ধরনের রশ্মি বিকিরিত হতে থাকে। কেমোথেরাপি যেমন ক্যান্সারের জীবাণু ধ্বংস করে, কুরআনি নূরও গুনাহের জীবাণু দূর করে। কুরআনি নূর কলবকে হালালে অভ্যস্ত আর হারামে অনভ্যস্ত করে তোলে। সহজেই।
.
২১. কুরআনি সালসাবীল
রাতের শেষ প্রহরে যারা তাহাজ্জুদে বা হিফযে তিলাওয়াতে কুরআন নিয়ে মশগুল থাকে, তারাই ভালো করে বুঝতে পারবে (إِنَّ نَاشِئَةَ ٱلَّیۡلِ هِیَ أَشَدُّ وَطْئًا) অবশ্যই রাত্রিকালের জাগরণ এমন যা কঠিনভাবে প্রবৃত্তি দলন করে (মুযযাম্মিল ৬)।
এই মহার্ঘ মুহূর্তে কুরআনের আয়াতগুলো ‘সালসাবীলের’ মতো সাবলীল গতিতে জিহ্বা থেকে অন্তর্দেশে গড়িয়ে যেতে থাকে। পাথর যেভাবে ধীরলয়ে গিয়ে পানির তলদেশে গিয়ে স্থির হয়ে বসে যায়—আয়াতগুলোও এমন। আস্তে গিয়ে কলবে বাসা বেঁধে বসে। এটাই শেষ-রাতের অপার রহস্য।
.
২২. কুরআনের বসন্ত
পৃথিবীতে বসন্ত আসে বছর ঘুরে একবার। কুরআনের বসন্ত আসে বারবার। কুরআন নিজেই একটি জীবন্ত বসন্ত। কুরআনের প্রতি সূরা-আয়াত-বাক্য এমনকি প্রতিটি হরকতেই বসন্ত আছে। বৃষ্টির পর পাতাময় গাছ ঝাড়া দিলে কেমন ঝুরঝুর করে পাতা থেকে অবশিষ্ট বৃষ্টির পানি ঝরে পড়ে। শীতের সকালে গাছ ঝাঁকালে কেমন টুপুরটাপুর শিশিরবিন্দু হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে। কুরআনের আয়াত নাড়া দিলেও এভাবে বসন্ত ঝরে। রহমত, হেদায়াত, ক্ষমা, সওয়াব ঝরে পড়ে। ভাই গাছে উঠে বড়ই পাড়লে, গাছ ঝাঁকি দিলে কীভাবে বড়ই ঝরে? পাকা বড়ই হাত দিয়ে ছিঁড়ে নিচে ফেললে ছোট্ট খুকি ফ্রকের আঁজলা দিয়ে বড়ইগুলো কুড়িয়ে নেয়। কুরআনও এমনি মুষলধারে করুণাধারা বর্ষণ করে। আঁজলা ভরে কুড়িয়ে নিলেই হলো। কুরআনি বসন্তের কোনো খরার মৌসুম নেই। কুরআন বারোমাস ফল দেয়।
.
২৩. হৃদয়ের গভীরে
আমি অবাক হয়ে ভাবি, কুরআন হৃদয়ের কত্ত গভীরে পৌঁছে যায়! দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির কারণে মাঠঘাট শুকিয়ে খটখটে। সব ঠনঠনা। কোত্থাও পানির চিহ্ন নেই। চিটিয়াল ধু-ধু চারদিক। সূর্যের প্রখর গনগনে উত্তাপ। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাগুলো মাটি কেমন গোগ্রাসে শুষে নেয়? পরের ফোঁটাগুলো শুকনো মাটির কত কত গভীরে পৌঁছে যায়? মাটির তলদেশের পানির স্তরে কত দ্রুত পৌঁছে যায়? পাপী-তাপী সকলের হৃদয়েও কুরআন কারীম এভাবে পৌঁছে যায়। দীর্ঘদিন ধরে মনের গভীরে ঘাপটি মেরে থাকা ‘অসুখ’ গোষ্ঠীসুদ্ধ ‘মনছাড়া’ করে ছাড়ে। মাটি কাটার জন্য পানি সেচে ফেলা শুকনো গরু-ভেড়া চরে বেড়ানো পুকুর যেমন বর্ষায় কানায় কানায় ভরে ওঠে, কুরআনের ছোঁয়ায় অসুখী মনগুলোও সুখে তৃপ্তিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে।
.
২৪. কুরআনে ফেরা
আমি এখন সুসময়ে আগ্রহ নিয়ে কুরআন নিয়ে বসছি না, এমন সময় আসতে পারে, আমাকে একান্ত বাধ্য হয়ে কুরআনের দ্বারস্থ হতে হবে। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় অশান্তি আমাকে ছেঁকে ধরবে। তখন একটুখানি স্বস্তির জন্য, সামান্য আশ্রয়ের জন্য কুরআনের কাছে ফিরে আসতে হবে। ভারসাম্যহীন জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য কুরআনের কাছে আসতে হবে। বর্তমানে স্বাভাবিক জীবন দেখে আমার মনে হতে পারে, আমি কুরআন ছাড়াই জীবন কাটিয়ে দিতে পারব। আমাকে মনে রাখতে হবে, কুরআন ছাড়া আমি ধ্বংসের দিকে ধাবিত হব। আমাকে কুরআনের কাছে ফিরে আসতেই হবে। বাধ্য হয়ে ফিরে আসার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগে আগে সাগ্রহে ফিরে আসাই উত্তম।
.
২৫. কুরআনি শিশির
কুরআন কারীম আল্লাহর কালাম। কুরআনের সংস্পর্শে এলে বান্দার মাঝে পরিবর্তন সাধিত হয়ই। কুরআনকে বোঝার চেষ্টা করলে, কুরআনের আয়াত নিয়ে তাদাব্বুর করলে, কুরআনকে আপন করে নিলে, কুরআনের কাছে নিজেকে সঁপে দিলে, কুরআন মানুষকে বদলে দেয়। এর মাঝেও কিছু আয়াত এমন আছে, গভীর অভিনিবেশের সাথে পড়তে গেলে, হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, এই আয়াত বুঝি এখন এই মুহূর্তে আমার ওপর নাযিল হয়েছে। সরাসরি আসমান থেকে আমার কলবে নেমে এসেছে। এতটাই তরতাজা আর টাটকা, মনে হতে থাকে শিশিরভেজা সর্ষেফুল মনের বাগানে আন্দোলিত হচ্ছে।
.
২৬. আত্মার সংযোগ
কুরআন কারীমের সাথে, আত্মার সংযোগে তৈরি হয় এক বিস্ময়কর রসায়ন। তাদাব্বুরের সাথে কুরআন তিলাওয়াতে কলবে একধরনের আলো তৈরি হয়। এই আলো প্রকাশ পায় কাজেকর্মে বরকতরূপে, চিন্তাচেতনায় উপদেশরূপে। ওই আলোর প্রভাবে সৃষ্টি হয় ইস্তেকামত। আল্লাহর আদেশ পালনের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি। তৈরি হয় অন্তর্দৃষ্টি। সহজ হয়ে যায় দীন ও দুনিয়ার পাথেয় অর্জন। কুরআনের তাদাব্বুর সুন্দর ও সঠিক পথ দেখায়,
إِنَّ هَـٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ یَهۡدِی لِلَّتِی هِیَ أَقۡوَمُ
বস্তুত এ কুরআন সেই পথ দেখায়, যা সর্বাপেক্ষা সরল (ইসরা ৯)।
.
২৭. দুঃখজনক অবহেলা
কুরআন কারীম বড় আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। নিতান্ত হেলাভরা কুরআনচর্চা আমাকে কুরআনের নিকটবর্তী করবে না। আন্তরিকতাহীন কুরআনচর্চা আমাকে কুরআনের রাজ্যে দাখিল করবে না। আমার সর্বোচ্চ মেধা ও চেষ্টা ব্যয় করলে, কুরআন আমার কাছে এলেও আসতে পারে। আমি কুরআনকে মাথায় করে রাখলে, কুরআন আমার মাথায় আসতে পারে। আমি কুরআনের যথাযথ মর্যাদা দিলে, কুরআনও আমাকে মর্যাদাসম্পন্ন করে তুলতে পারে। উদাসীন হৃদয়ে কুরআন আসে না। থাকে না। কুরআন কারীম সম্মানিত কিতাব। কুরআনের শিক্ষা ও হেদায়াতও সম্মানিত। এই সম্মানিত কিতাব অর্জন করতে হলে, আমাকেও সম্মানজনক ভঙ্গি আয়ত্ত করতে হবে। নিজের আচার-বিশ^াসকে সম্মানজনক করে তুলতে হবে।
.
২৮. কলবে সলীম
কুরআন দ্বারা উপকৃত হতে চাইলে, কলবকে সলীম করতে হবে। কলবকে যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত করতে হবে। একসাথে সম্ভব না হলে, সাফাইয়ে কলবের মেহনত ধীরে ধীরে চালিয়ে যেতে হবে। কুরআনি বসীরত বা অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে হলে, অন্তরের বাধাগুলো দূর করতে হবে। শরীর অসুস্থ হলে, পেট খারাপ হলে, পুষ্টিকর খাবারেও কোনো কাজ হয় না। মুখে রুচি থাকে না। খাবার পেটে থাকে না। সব বেরিয়ে যায়। ধরে রাখতে পারে না। কলব পেটের চেয়েও বেশি স্পর্শকাতর। কলব কালিমাযুক্ত হলে, পাপযুক্ত হলে, কলবেও কুরআনি শিক্ষা, কুরআনি হেদায়াত, কুরআনি বসীরত পিছলে যায়। কলবে স্থির হয়ে জমতে পারে না।
.
৩০. কুরআনের শত্রু
পাপ কুরআন কারীমের ঘোরতর শত্রু। পাপীর কাছে কুরআন আসে না। যার পাপ যত বেশি, কুরআন তার থেকে তত দূরে। একমাত্র (ٱلۡمُطَهَّرُونَ) পবিত্ররাই কুরআন কারীম স্পর্শ করতে পারে। কুরআন কারীম স্পর্শ করতে ওজু লাগে। পবিত্রতা লাগে। এই পবিত্রতা শুধু শারীরিক নয়, আত্মিকও বটে। হাত দিয়ে ধরতে যেমন পবিত্রতার প্রয়োজন, অন্তর দিয়ে কুরআনের হেদায়াত ছুঁতেও আত্মিক পরিশুদ্ধির প্রয়োজন। পাপমুক্ত কলব প্রয়োজন। আত্মিক পরিশুদ্ধি বলতে, শতভাগ পাপমুক্ত কলব হতে হবে এমন নয়, তবে পাপযুক্ত কলবকে পাপমুক্ত করার সদিচ্ছা থাকলেও, আপাত পাপযুক্ত কলবও কুরআনি হেদায়াতকে ছুঁতে পারবে। কারণ কলব তখন পাপী থেকে তাপীতে পরিণত হয়েছে। দাগি থেকে নিদাগ হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে।
.
৩১. সগীরা গুনাহ
সগীরা গুনাহ নামে সগীরা হলেও, কামে কবীরা। সগীরা গুনাহর কাজ স্লো পয়জনের মতো। ধীরে ধীরে কাজ করে। নীরবে। সগীরা গুনাহর সবচেয়ে ভয়ংকর ক্ষতি হলো, ইবাদত-বন্দেগীর ‘হিম্মত’ দুর্বল করে দিতে থাকে। ক্যান্সার যেভাবে ক্রমশ শরীরকে ক্ষইয়ে দিতে থাকে, সগীরা গুনাহও ইবাদতের ইচ্ছাশক্তিকে মেরে ফেলতে থাকে। সগীরা গুনাহ প্রথম প্রথম ইবাদতের সময়কে সংক্ষিপ্ত করে। তারপর ইবাদতের সময়কে পিছিয়ে দিতে শুরু করে। একসময় ইবাদত থেকেই দূরে সরিয়ে দেয়। নয়তো ইবাদতকে প্রাণহীন করে দেয়। সহীরা গুনাহ বেশি আঘাত হানে কুরআন আর মুনাজাতের ওপর। তিলাওয়াত ও মুনাজাতের স্বাদ নষ্ট করে দেয়। তিলাওয়াত ও মুনাজাতকে নামকাওয়াস্তের রূপ দেয়। মুমিন সচরাচর কবীরা গুনাহ করে না। সগীরা গুনাহই একসময় বান্দাকে কবীরা গুনাহের দিকে নিয়ে যায়। সগীরা গুনাহে লিপ্ত হতে হতে, গুনাহের সাথে একধরনের চিন-পরিচয় তৈরি হয়। একসময় কবীরা গুনাহকেও সগীরা মনে হতে থাকে। কবীরা গুনাহর প্রভাবে কলব শক্ত হয়ে যায়। তিলাওয়াত মুখে মুখেই থেকে যায়, কলব পর্যন্ত পৌঁছে না (لَّا یَمَسُّهُۤ إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ) কুরআনকে স্পশ করে কেবল তারাই, যারা অত্যন্ত পবিত্র (ওয়াকিয়া ৭৯)। কুরআন কারীম শুধু পবিত্র কলবেই বাসা বাঁধে। অপবিত্র কলবে কুরআনি নূর দানা বাঁধতে পারে না। জমাট হয়ে বসে না।
.
৩২. অন্তরায়
মানুষের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নেমে আসা কঠিনতম এক আযাব হলো ‘গাফলত’। উদাসীনতা। ইবাদতে উদাসীনতা। তিলাওয়াতে উদাসীনতা। তাদাব্বুরে উদাসীনতা। কুরআনের আয়াত শুনেও বোঝার চেষ্টায় উদাসীনতা। কুরআনের আয়াত শুনেও শিক্ষা গ্রহণের প্রতি উদাসীনতা। এই গাফলত বা উদাসীনতা আল্লাহর দেয়া আযাব। আমার গুনাহের কারণে এই আযাব নেমে এসেছে আমার ওপর। আমার গুনাহই আমার কলবকে মৃত বানিয়ে দিয়েছে। গুনাহের জং আমার কলবের ‘অন্তর্দৃষ্টি’ কেড়ে নিয়েছে। গুনাহের পর্দা কলব ও কুরআনের মাঝে পর্দা টেনে দিয়েছে।
.
৩৩. সত্যিকার ভালবাসা
কুরআন কারীমের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা জন্মালে, আপনা-আপনিই আমার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। বিশুদ্ধ ভালোবাসার সাথে সাথে ভয়ও আসে। প্রিয়জন বা প্রিয় বস্তুকে হারানোর ভয়। কুরআনের ভালোবাসাও আমার মধ্যে হারানোর ভয় সৃষ্টি করবে। গুনাহর মুখোমুখি হলে মনে ভয় জাগবে, গুনাহে লিপ্ত হলে আমার কাছ থেকে কুরআন চলে যাবে। নিজেকে মন্দ কাজে জড়াতে গেলে ভয় জাগবে, কুরআন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। কুরআনবিরোধী আখলাকে জড়াতে ভয় লাগবে, কুরআনবিরোধী মজলিসে বসতে ভয় লাগবে। কুরআনবিরোধী বইপত্র পড়তে ভয় লাগবে। কুরআনবিরোধী বন্ধু রাখতে ভয় লাগবে। কুরআনবিরোধী স্বামী/স্ত্রীর সাথে বসবাস করতে ভয় লাগবে। কুরআনবিরোধী প্রতিষ্ঠানে পড়তে/চাকরি করতে ভয় লাগবে। কুরআনবিরোধী সমাজে/রাষ্ট্রে বাস করতে ভয় লাগবে। কুরআনবিরোধী আড্ডায় জুড়তে ভয় লাগবে। কারণ, আল্লাহ আমাকে সব সময় দেখছেন। আমার ভেতরটা প্রতিনিয়ত অবলোকন করছেন।
.
৩৪. বিশদ কিতাব
ইয়া আল্লাহ, পৃথিবীর সমস্ত প্রশংসা আপনার। আপনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনি আমাদের কুরআনের মতো এক মহাগ্রন্থ দান করেছেন। আপনার সীমাহীন প্রশংসা, আপনি আমাদের একটি বিশদ (مُفَصَّلًاۚ) বর্ণনা-সংবলিত কিতাব দান করেছেন। যে কিতাবে আমাদের জন্য রেখেছেন হেদায়াত, রহমত, হেকমত ও শেফা। ইয়া আল্লাহ, আপনার অন্তহীন শোকর, আপনি আমাদের কুরআন কারীম বোঝার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও তাঁর সুন্নাহ দান করেছেন।
.
৩৫. মাওইযাহ
কুরআন আগাগোড়া এক ‘মাওইযাহ’। উপদেশ। কুরআনের উপদেশ পাত্থরদিলকে গলিয়ে মোমের মতো নরম করে দেয়। কুরআনের উপদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড়জ্ঞানীকেও সতত সতর্ক করে। কুরআনের উপদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষকেও প্রতিটি মুহূর্তে আখেরাতের ভয় দেখায়। অথচ আমি কত গাফেল, হাতের কাছে কুরআন পেয়েও তিলাওয়াত করি না। নিয়মিত কুরআন পড়েও উপদেশ গ্রহণ করি না। আমি কত দুর্ভাগা। আমি কি তাহলে কুরআনি হেদায়াতের উপযুক্ত নই? আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
فَذَكِّرۡ بِٱلۡقُرۡءَانِ مَن یَخَافُ وَعِیدِ
আমার সতর্কবাণীকে ভয় করে এমন প্রত্যেককে আপনি কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দিতে থাকুন (ক্বাফ, ৪৫)।
আমি যে কুরআনের উপদেশ গ্রহণ করছি না, তবে কি আমার মনে আল্লাহর সতর্কবাণীর ভয় নেই?
.
৩৬. কুরআনি ভ্রমণ
কুরআন খতম করা এক মুবারক সফরে বের হওয়ার মতো। এ-এক অপূর্ব জগতে ভ্রমণ। পথ চলতে চলতে কত কিছু যে চোখে পড়ে। কখনো হাসি, কখনো কান্না। কখনো বিপদ, কখনো ভয়, কখনো স্বস্তি। ভ্রমণে বের হলে অর্ধেক পথে থেমে যাওয়া উচিত নয়। মূল গন্তব্যপানে সফর অব্যাহত রাখা জরুরি। ভ্রমণপথে গুরুত্বপূর্ণ কোনো দ্রষ্টব্য স্থান ভালো করে না দেখে সামনে বাড়া উচিত নয়। আবার ভ্রমণকে অহেতুক ধীরগতির করাও ঠিক নয়। যথাসময়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গন্তব্যে পৌঁছার তাড়া থাকতে হবে। আবার চোখ বন্ধ করে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে সফর করাও চলবে না। সব দেখেশুনে, জেনেবুঝে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। আয়াতের সৌন্দর্য অবলোকন করতে হবে। আয়াতে আয়াতে আল্লাহকে চেনার চেষ্টা করতে হবে। জান্নাত-জাহান্নামের যথার্থ উপলব্ধি মাথায় হাজির করতে হবে। আমি দেখে দেখে কুরআন পড়তে পারি। এর অর্থ হলো, আমি কল্পনাতীত জগতে ভ্রমণের পাসপোর্ট পেয়ে গেলাম। এমন দুর্লভ পাসপোর্ট পেয়েও, ঘরে বসে থাকা, সুস্থ স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারে না। তাহলে বেরিয়ে পড়া যাক এক অনন্য বিশ^ভ্রমণে? রাব্বে কারীম তাওফীক দান করুন।
.
৩৭. আখেরাতের সঞ্চয়
আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যতটুকু কুরআন শেখার তাওফীক দিয়েছেন, একজন মুরুব্বীর সাথে পরামর্শ করে, সেটুকু অন্যকে শেখানোর চেষ্টা করা উচিত। কুরআন শেখা ও শেখানো উভয়টাই আখেরাতের সঞ্চয়। আমি যার কাছে শিখেছি, তার প্রতি সকৃতজ্ঞ আচরণ করা, আমি যা শিখেছি তা অন্যকে বিন¤্রচিত্তে শিখতে সহযোগিতা করা, এটা কুরআনি ইলমে বরকত আসার মূলকথা।
.
৩৮. কুরআনের উসীলায়
আমি কুরআনকে আমার সময়-শ্রম দিলে, কুরআন আমার জন্য বরকত নিয়ে আসবে। ইহজীবনে আমি কুরআনের জন্য আরাম হারাম করলে, পরকালে কুরআন আমার জন্য আরাম হালাল করে রাখবে। বিশিষ্ট মিসরীয় নাহুবিদ দাউদ বিন ইয়াজীদ রহ.। তার মৃত্যুর পর এক পরিচিতজন তাকে স্বপ্নে দেখলেন। জানতে চাইলেন, আল্লাহ আপনার সাথে কেমন আচরণ করেছেন? মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেয়ার উসীলায় তিনি আমার প্রতি রহম করেছেন।
.
৩৯. হামিলে কুরআন
কুরআনের বাহক—হামিলে কুরআন। আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না। আল্লাহর কালামের মর্যাদা রক্ষায় কারও নিন্দামন্দের তোয়াক্কা করে না। ফুযাইল বিন ইয়ায রহ. বলেছেন, হামিলে কুরআনের উচিত ইসলামের ঝান্ডাবাহী হওয়া। হামিলে কুরআনের উচিত নয়, অনর্থক গল্পগুজবকারীদের সাথে যোগ দেয়া, উদাসীনদের সাহচর্যে থাকা, কুরআনের সম্মানহানিকর কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে যাওয়া। হামিলে কুরআনকে হতে হবে সমাজে আদর্শস্থানীয়।
.
৪০. ত্যাগ-তিতিক্ষা
আরাম-আয়েশ করে সাধারণত কুরআন শেখা যায় না। কুরআনকে পেতে হলে ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করতে হয়। সাময়িকের জন্য হলেও নিজের সবচেয়ে মূল্যবান জানমাল কুরআনের জন্য ব্যয় করা জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা, জানমাল আল্লাহর দেয়া। আল্লাহর কুরআনের জন্য আমি আল্লাহর দেয়া বস্তু খরচ করতে পারব না কেন?
.
৫০. কুরআনি হালাকা
শায়খ শা‘রাবীর তাফসীরের দরস বিশ^বিখ্যাত। তার তাফসীর দরসের নিয়মিত ছাত্র ছিলেন শায়খ হুনাইদী। তিনি কিছুদিন তাফসীর দরসে অনুপস্থিত ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার কারণে অসুবিধায় পড়েছিলেন। সমস্যা কাটিয়ে ওঠার পর, আগের মতো নিয়মিত কুরআনি হালাকায় শামিল হতে শুরু করলেন। শায়খ শা‘রাভী রহ. অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলেন। শায়খ হুনাইদি পারিবারিক বিপর্যয়ের কথা জানালেন। দরসে শরীক হওয়ার বিনিময়ে ওস্তাদের সম্মানি আদায় করার মতো আর্থিক সংগতি ছিল না। শায়খ শা‘রাবী উত্তর দিলেন, আমরা কুরআনের শিক্ষকরা হলেম রাজার মতো। হাত খালি থাকলেও কারও কাছে কিছু চাই না। কাউকে খালিহাতে ফিরিয়ে দিই না। ইমাম শাতেবী রহ.-এর মতো বলেছেন,
‘আমরা আহলে কুরআনরা ‘কুরআন বেচে খাই না।’
.
৫১. নিয়ত
কুরআন শিখতে এসে, সব সময় নিয়তের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। সূরা ও পারার পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে নফস ও শয়তানের দৌরাত্ম্যও বাড়তে থাকে। বারবার যাচাই করতে হয়, মনে হিংসা-বিদ্বেষ, রিয়া-অহংকার বাসা বেঁধে আছে কি না। যতবেশি পারা বা সূরা ইয়াদ হবে, মনে মনে মানুষের প্রশংসা লাভের ইচ্ছাও প্রবল হতে থাকবে। সতর্ক থেকে নিয়মিত তাওবা-ইস্তেগফার করে যেতে হবে।
.
৫২. প্রশ্নোত্তর
কুরআন কারীম বুঝে বুঝে পড়তে গেলে অসংখ্য প্রশ্ন এসে ভিড় জমাতে শুরু করবে। আশেপাশে অভিজ্ঞ আলিম থাকলে তাঁর কাছ থেকে উত্তর জেনে নিতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহর কাছে উত্তর চেয়ে দোয়া করতে হবে। আশেপাশের কারও কাছে উত্তর না পেলেও সমস্যা নেই। থেমে না থেকে পড়া চালিয়ে যেতে হবে। প্রশ্নটির সন্তোষজনক উত্তর কোথাও না পেলে, ধরে নিতে হবে, কুরআনি হেদায়াত লাভের জন্য প্রশ্নটির উত্তর জানা আপাতত আমার প্রয়োজন নেই। প্রশ্নটির উত্তর জানা আমার মৌলিক হেদায়াত লাভের জন্য জরুরি হলে, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই গায়েবীভাবে উত্তরের ব্যবস্থা করে দিতেন। তবে উত্তর জানার চেষ্টা ও দোয়া অব্যাহত রাখা জরুরি। অনেক সময় কুরআন প্রশ্নগুলোর উত্তর আল্লাহ এমনি এমনি জানিয়ে দেন। কুরআন পড়তে পড়তেই একসময় চট করে উত্তরটা মাথায় জেগে ওঠে। তবে কুরআন বিষয়ক নিজস্ব যেকোনো চিন্তাই অভিজ্ঞ কারও সাথে আলোচনা করে নেয়া নিরাপদ।
.
৫৩. সুরের মায়া
নাশীদ-সংগীতের টান অনেক সময় কুরআনবিমুখ করে দেয়। সুরের মোহ পেয়ে বসলে, কুরআন কারীমও শোনে সুরের জন্য। আল্লাহর কালাম উপলব্ধির জন্য নয়। কুরআন কারীম সুর করে পড়া সুন্নাহ। কিন্তু সুরটা মুখ্য হয়ে গেলে, কুরআনের তাদাব্বুর আর হেদায়াতটা গৌণ হয়ে যায়। তিলাওয়াত যত সুন্দরই হোক, মনকে সুর থেকে অর্থের দিকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। তিলাওয়াতের সুরেই যেন আটকা না পড়ি, সুর ছাড়িয়ে যেন আরও গভীরে যেতে পারি, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। প্রথম প্রথম কিছুদিন সুরের স্তরে থাকলে সমস্যা নেই। পরে মনকে শুধু সুরেই তৃপ্ত থাকতে না দিয়ে আয়াতে কী বলছে সেদিকেও চিন্তা করতে অভ্যস্ত করে তুলতে পারি।
.
৫৩. অটুট ভালোবাসা
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আদম বিন ইয়াস রহ.। মৃত্যুশয্যায় শায়িত। কুরআন খতম হতে আরও কিছুটা বাকি আছে। শুয়ে শুয়ে তিলাওয়াত করে খতম করলেন। তারপর কুরআন কারীমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আজীবন তোমার প্রতি ভালোবাসা অটুট ছিল। তুমিও ভালোবেসে আমার সাথে এই পর্যন্ত থেকেছ। আমিও আজকের দিন পর্যন্ত তোমার পবিত্র সঙ্গ কামনা করে এসেছি। তোমার সাথে আমার ভালোবাসার বাসনা পূরণ হয়েছে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এরপর তিনি মারা গেলেন -মাজমূউর রাসায়েল, ৩/১১৯, ইবনে রজব রহ.।
.
৫৪. আল্লাহর মহব্বত
কুরআন তিলাওয়াত আল্লাহর মহব্বত বৃদ্ধির উপায়। কুরআন আল্লাহর কালাম। তার কালাম আমার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলে, আল্লাহর ভালো লাগে। আমি যত বেশি তিলাওয়াত করব, তত বেশি আমার হৃদয়ে আল্লাহর মহব্বত বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে আমার প্রতিও আল্লাহর মহব্বত রহমত বৃদ্ধি পাবে। কাউকে যখন তিলাওয়াত করতে দেখব, ধরে নেব তিনি আল্লাহর মহব্বতে মশগুল আছেন। আমি যতক্ষণ তিলাওয়াতে মশগুল থাকব, আল্লাহ মহব্বতের ছায়াতেই অবস্থান করব। কুরআনের সাথে সময় কাটানোর পরিমাণই বলে দেবে, আমি আল্লাহর কতটা মহব্বত চাই। আমি কতক্ষণ আল্লাহকে মহব্বত করতে চাই।
.
৫৫. যোগ্যতার ধোঁকা
কুরআনের পথিককে নিজের যোগ্যতা নিয়ে ধোঁকায় পড়া উচিত নয়। বর্তমানের কেউ যত বেশি কুরআনি ইলমই ধারণ করুক, তারা ইলম-আমলে, যোগ্যতা-সভ্যতায় প্রথম কয়েক শতাব্দীর কুরআনি আলিমদের মতো হতে পারবে না। তাদের তুলনায় বর্তমানের আল্লামা-ডক্টরেটরা কিছুই নয়। কুরআনি আলেমকে অন্যের প্রশংসায় একদম কর্ণপাত করা উচিত নয়। অন্যদের প্রশংসায় গলে যাওয়াও কুরআনি আলিমের জন্য শোভনীয় নয়।
.
৫৬. ব্যতিক্রমী সম্মান
কুরআনের একটি বিশেষণ ‘কারীম’। সম্মানিত। কুরআনের সম্মান ব্যতিক্রমী। সাধারণ কোনো বই একবারের বেশি পড়লে, বিরক্ত লাগে। রাজাদের দরবারে কোনো কথা একবারের বেশি বলা যায় না। কিন্তু কুরআন সম্পূর্ণ ভিন্ন। যতই তিলাওয়াত করা হোক, বিরক্তির উদ্রেক করে না। যত বেশি তিলাওয়াত করা হোক, কুরআন পুরোনো হয় না। কুরআন যত পড়া হয়, আরও বেশি তাজা হতে থাকে। কুরআন যত বেশি পড়া হয়, ততই কুরআনের সম্মান আরও সমুন্নত হতে থাকে। অন্য বই যত পুরোনো হয়, ততই তার কদর কমতে থাকে। পক্ষান্তরে যত দিন গড়াচ্ছে, কুরআনের সম্মান আরও বাড়ছে।
.
৫৭. সুপারিশকারী
কিতাবুল্লাহ বিশ^স্ততম সুপারিশকারী। কিতাবুল্লাহ মুক্তহস্তে দানকারী। কিতাবুল্লাহ অঢেল প্রাচুর্যের অধিকারী। কিতাবুল্লাহ শ্রেষ্ঠতম বন্ধু। কুরআনের সাথে কথা বলে কখনোই বিরক্তি আসে না। কুরআনের সাথে সময় কাটালে আত্মিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। মানবিক গুণাবলি উন্নত হয়। কুরআন কারীম সুন্দরতম কথা, যেমনটা রাব্বে কারীম বলেছেন, (ٱللَّهُ نَزَّلَ أَحۡسَنَ ٱلۡحَدِیثِ) আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী (যুমার, ২৩)।
.
৫৮. অগ্রাধিকার
কুরআন তিলাওয়াতই শ্রেষ্ঠতম যিকির (أفضل الذكر تلاوة القرآن)। মানুষের সত্যিকার উন্নয়নে নিয়োজিত প্রতিটি জ্ঞানশাস্ত্রই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন শাস্ত্র? অবশ্যই কুরআন। অন্যান্য শাস্ত্র প্রয়োজনবোধে চর্চা করতে হলেও, সর্বাবস্থায় কুরআনই অগ্রাধিকার পাবে। জীবনের চাহিদা মেটাতে জ্ঞানের অন্য শাখায় বাধ্যতামূলক বিচরণ করতে হলে, উক্ত শাস্ত্রে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জিত হওয়ার পর, কুরআনচর্চায় ফিরে আসা কাম্য।
.
৫৯. কুরআনি আবহ
সাহাবায়ে কেরামের দিনরাত কাটত কুরআন ও সুন্নাহর আবহে। তারা বাস করত কুরআনি সমাজে। তারা রাতে ঘুমুতে যেত, আগামীদিন নতুন কোনো আয়াত নাযিলের উন্মুখ প্রত্যাশা নিয়ে। তারা জানত, তাদের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর আল্লাহর কাছে পাবে। কখনো সরাসরি কুরআনের আয়াতে, কখনো রাসূলুল্লাহর সুন্নাহতে। তারা দৃঢ়বিশ^াস পোষণ করত, যেসব প্রশ্ন তারা উচ্চারণ করতে পারছে না, মনে মনে রেখে দিয়েছে, সেসবের উত্তরও আল্লাহ তা‘আলা কোনো-না-কোনোভাবে দিয়ে দেবেন।
কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি আত্মসমর্পণের এই মানসিকতা, সাহাবায়ে কেরাম থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মে। সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকেই উম্মাহ আসমানি ওহীর সাথে আত্মিক বন্ধনে জড়িয়ে আছে। তাদের অবচেতনেই গাঁথা আছে—যাবতীয় সমস্যার সমাধান আছে কুরআন ও সুন্নাহয়।
কালক্রমে উম্মাহর বৃহত্তর একটি অংশ, দুনিয়ার লোভলালসার প্রলোভনে প্রলুব্ধ হতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তারা অন্তরের শুদ্ধতা হারাতে শুরু করল। ওহীর প্রতি সমর্পণচিত্ততার যে আজন্ম শিক্ষা তাদের মর্মমূলে গেঁথে দেয়া ছিল, সেটার ওপর পার্থিব কলুষতার পলেস্তারা পড়তে শুরু করল। শয়তানের কুমন্ত্রণার প্রভাবে তারা সমস্যা সমাধানে কুরআন-সুন্নাহমুখী না হয়ে, পার্থিব নানা বাদ-মতবাদমুখী হতে শুরু করেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ভ্রান্তিতে ডুবে আছে। যে উম্মাহ একসময় চোখের পলকও আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করত, তাদের আজ এ কী বেহাল দশা! তাদের সূচনায় যে অকৃত্রিম ওহীশুদ্ধতা ছিল, তা থেকে তারা আজ কত দূরে! এই করুণ দশা থেকে মুক্তির একটাই উপায়, আবার কুরআন-সুন্নাহয় ফিরে আসা।
.
৬০. মনোব্যাধির আরোগ্য
কুরআন কারীম যাবতীয় মনোব্যাধির আরোগ্য। কুরআন শয়তানের যাবতীয় শয়তানি থেকে রক্ষা করে। দুষ্ট মানব ও জিন শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে। প্রবৃত্তির কুচাহিদা, নাফসের অসৎ বাসনা থেকেও কুরআন রক্ষা করে।
ওস্তাদ নির্ধারণের আগে দেখে নেয়া উচিত, আকীদা দুরস্ত আছে কি না, শরীয়তের পাবন্দি আছে কি না। ইলম অনুযায়ী আমল আছে কি না। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা কাম্য। তিনি কুরআনের শব্দের পাশাপাশি অর্থ মানে আমলও শিক্ষা দিতে পারেন কি না, এটা দেখা জরুরি। নিজে ইলম অনুযায়ী আমল না করলে ছাত্ররা কী শিখবে?
.
৬১. কুরআনি ফিতরাহ
কুরআন কারীম শিক্ষা লাভ করা মুসলিম শিশুর অন্যতম মৌলিক অধিকার। কুরআন একটি ‘ফিতরী’ বিষয়। স্বভাবজাত বিষয়। কুরআনি ইলম মানবশিশুর জন্মগত প্রকৃতির মতোই শুদ্ধ আর গ্রহণযোগ্য। একটি শিশু কুরআনের স্পর্শে এসে আরও বেশি শুদ্ধ হয়ে ওঠে। কুরআনের ছোঁয়ায় আরও বেশি বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। শিশুমন আর কুরআন দুটোই ‘ফিতরাহ’। উভয়টাই সাবলীল সহজাত। সব ধরনের কৃত্রিমতামুক্ত। কুরআন শিশুর হৃদয়ে ওহীর নূর ছড়িয়ে দেয়। পার্থিব কলুষতা কালিমা স্পর্শ করার আগেই, শিশুমনে কুরআনি নূর বসিয়ে দেয়া জরুরি। তাহলে মুসলিম উম্মাহ পাবে এক যোগ্যতর প্রজন্ম। বিশ^কে নেতৃত্ব দেয়ার মতো একদল সুশিক্ষিত নওজোয়ান।
.
৬২. বসিরাহ
দীর্ঘদিন কুরআন থেকে দূরে থাকলে, মনে একধরনের জং ধরে যায়। আবার নতুন করে শুরু করতে গেলে, অসুস্থ ব্যক্তির তিতা ওষুধ পান করার মতো অনুভূতি হয়। পড়া সামনে আগাতে চায় না। গিলতে কষ্ট হয়। একটু পড়েই হাঁপ ধরে যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে পড়া চালিয়ে যেতে হয়। অসুস্থ শরীরে ঠিক যেমন পুষ্টিকর মজাদার খাবার বিস্বাদ আর তিতকুটে লাগে। জোরদার তিলাওয়াতের কারণে, আস্তে আস্তে জং, কালিমা, বাতিল, ভ্রান্তি দূর হয়ে গেলে, তিলাওয়াতে মিষ্টতা আসতে শুরু করে। কুরআনি সময়গুলো মজাদার লাগতে শুরু করে। কুরআনের প্রভাবে কলব হয়ে ওঠে স্বচ্ছ নিটোল ঝরঝরে ফুরফুরে। কলব আলোকিত হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় অন্তর্দৃষ্টি-বাসীরাহ।
.
৬৩. কুরআনি জীবন
মনেপ্রাণে কুরআন গ্রহণ করলে, জীবনের অনেক হিসেবনিকেশ বদলে যায়। কুরআনমতো জীবন গড়ার সিদ্ধান্ত নিলে, ঘরে-বাইরে অনেক পরিবর্তন আসে। এতদিন যা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত, এমন অনেক কিছুই এখন গুরুত্বহীন হয়ে যায়। কুরআনপূর্ব জীবনে এতদিন যারা সেরা বন্ধু ছিল, তারাও কুরআনি জীবনে গৌণ আর গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। পুরোনো বন্ধুদের স্থানে আল্লাহ তা‘আলা নতুন কুরআনি বন্ধু জুটিয়ে দেন। কুরআন আমাকে নতুন করে গড়েপিটে নেয়। কুরআন আমার জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে নেয়। কুরআন আমার ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক রদবদল নিয়ে আসে। পরিবর্তন আনে। এই পরিবর্তন জীবনকে আরও সুন্দর করে তোলে। আরও অর্থবহ করে তোলে। আরও আখেরাতমুখী করে তোলে। কুরআনের জন্য আমি আগের প্রিয়তম যা কিছু ত্যাগ করেছি, তার বিনিময়ে আল্লাহ আরও উত্তম বদল দান করেন। কুরআন কখনোই তার অনুসারীকে হতাশ করে না। ক্ষতিগ্রস্ত করে না। পিছিয়ে দেয় না।
.
৬৪. কুরআনি নূর
আগুন পানি যেমন একসাথ হয় না, কুরআন আর গুনাহও একসাথ হয় না। দুটি বিষয়, কুরআনি তথ্যজ্ঞান আর কুরআনি নূর। গুনাহ থাকলেও কুরআনি তথ্যজ্ঞান আসতে পারে। তবে কুরআনি নূর আসে না। এ জন্য কাফেরও কুরআন শিখতে পারে। কুরআন-বিষয়ক গবেষণা করতে পারে। গুনাহ কুরআন বুঝতে উপলব্ধিতে আনতে বাধা দেয়। কুরআনে আছে,
وَجَعَلۡنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ أَكِنَّةً أَن یَفۡقَهُوهُ وَفِیۤ ءَاذَانِهِمۡ وَقۡرًا
আমি তাদের অন্তরে পর্দা ফেলে দিয়েছি। ফলে তারা তা বোঝে না; তাদের কানে বধিরতা সৃষ্টি করে দিয়েছি (আন‘আম, ২৫)।
.
৬৫. কুরআনি সঙ্গ
এখন কতকিছু আমার সাথে আছে। ভাই-বেরাদর। মা-বাবা। বিবিবাচ্চা। বন্ধু-বান্ধব। একটা সময় আসবে, আমার আশেপাশে কেউ থাকবে না। থাকবে শুধু আমার আমল। থাকবে শুধু কুরআন কারীম। কুরআন আমাকে কবরে সঙ্গ দেবে। কুরআন আখেরাতে আমার মর্যাদা বুলন্দ করবে। কুরআন আমাকে কেয়ামতের মহাবিপদের দিন আগলে রাখবে। কুরআন আমার মা-বাবাকে সম্মানিত করবে। কুরআন আমাকে মহাসম্মানে জান্নাতে পৌঁছে দেবে।
.
৬৬. কুরআনচর্চা
হাদীসে বর্ণিত আহলে কুরআন কারা? আহলে কুরআন কুরআন হিফয করে। যারা কুরআন কারীম বেশি বেশি তিলাওয়াত করে। সাহাবায়ে কেরামের মতো কুরআন কারীম চর্চা করে। যাদের পুরো সময়ই কুরআন নিয়ে কাটে। যারা রাতের শেষাংশে কুরআন নিয়ে সলাতে দাঁড়ায়।
৬৭. তিলাওয়াতের বাঁধ
গুনাহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন কোথাও পেশাগত কারণে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে নেয়া নিরাপদ। কলবে কুরআনের নূর ভর্তি করে নিয়ে গেলে, গুনাহ এড়িয়ে থাকা সহজ হবে ইন শা আল্লাহ।
.
৬৮. কুরআনি অনুগ্রহ
ইয়া আল্লাহ, না চাইতেই কুরআনের মতো নেয়ামত দান করেছেন। যোগ্যতা ছাড়াই যেহেতু কুরআনের মতো মহামূল্য অনুগ্রহ দান করেছেন, বাকিটুকুও নিজ অনুগ্রহে করে দিন। কুরআন কারীমকে হৃদয়ের বসন্ত বানিয়ে দিন। হৃদয়ের আলো বানিয়ে দিন। কুরআনের মাধ্যমে আমার ঈমান-ইয়াকীন বাড়িয়ে দিন। আমার মর্যাদা বুলন্দ করে দিন। আমাকে কুরআন, কুরআনের ইলম ও বুঝ দান করুন, যেমনটা আপনার নেককার বান্দাদের দান করেছেন। কুরআনের মাধ্যমে আমার মাকাম উঁচু করে দিন, আকাশকে খুঁটিবিহীনভাবে যেভাবে উঁচু করেছেন। কুরআনের মাধ্যমে আমাকে হকের ওপর অটল অবিচল রাখুন, ঠিক পর্বতমালাকে যেভাবে সমুন্নত-অবিচলিত রেখেছেন। আমীন।
.
৬৯. ওহীর বরকত
কুরআনের শব্দে বরকত, হরফে বরকত, প্রতিটি সূরায় বরকত, আয়াতে বরকত, সাগরসম মুক্তোসদৃশ অর্থে বরকত। ইবাদতের নিয়তে যে কুরআন শিখবে তার ওপর বরকত নেমে আসবে। যে হেদায়াত লাভের উদ্দেশ্যে বোঝার জন্য কুরআন নিয়ে মশগুল হবে, তার ওপর বরকত নেমে আসবে। যে নিজেকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে কুরআন নিয়ে বসবে, তার ওপর বরকত নেমে আসবে। যে ইলম ও হিকমত লাভের উদ্দেশ্যে কুরআনে ডুব দেবে, তার ওপর নেমে আসবে ইলম ও হিকমতের বরকত।
.
৭০. আল্লাহর রেজামন্দি
যে কুরআন আঁকড়ে ধরবে তার সাথে বরকত লেপ্টে থাকবে। যে হেদায়াত লাভের উদ্দেশ্যে কুরআনের সাথে জড়িয়ে থাকবে, হেদায়াতের বরকত তার সাথে লেগে থাকবে। যে শিফা লাভের উদ্দেশ্যে কুরআনের দ্বারস্থ হবে, আসমানি শিফার বরকত তাকে আরোগ্য দান করবে। যে সওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন নিয়ে থাকবে, আল্লাহর রেজামন্দির বরকত তাকে বেষ্টন করে থাকবে। কুরআন চর্চার উদ্দেশ্যে যারা মজলিসে বসে, তাদের ওপর নেমে আসে বরকতময় প্রশান্তি ও রহমত। তাদের বরকতময় বেষ্টনীতে জড়িয়ে নেয় রহমতের ফেরেশতারা।
.
৭১. আলোকিত কুরআন
গুনাহের প্রধান ক্ষতিকর দিক হলো, কলবকে কুরআনবিমুখ করে দেয়। গুনাহ কলবকে কুরআনি হেদায়াত ও শিফা থেকে বঞ্চিত করে রাখে। গুনাহ কলবকে কালো করে দেয়। কলব হয়ে যায় কৃষ্ণকালো ঘনঘোর কালো রাতের মতো। কুরআন আলোকিত। রাত আর দিন এক হয় না। আলোকিত কুরআনও অন্ধকার কলবে আসে না।
.
৭২. কুরআনের চারাগাছ
কলবে কুরআন আনতে হলে, আগে কলবকে সাফসুতরো করে নিতে হবে। গুনাহযুক্ত কলব সাফাইয়ের প্রধান উপায় ইস্তেগফার। বেশি বেশি কার্যকর অনুভূতিময় ইস্তেগফার কলবের কলুষতা দূর করে। গুনাহের কারণে কলব মরে যায়। মৃত কলবকে জীবিত করা সহজ কাজ নয়। ইস্তেগফারের পাশাপাশি তিলাওয়াতের পানি সিঞ্চন করে যেতে হবে অনবরত। শুরুতে স্পষ্ট কিছু বোঝা যাবে না। বীজ বপন করার পর, পানি দিয়ে যেতে হয়। চারা বের হতে সময় লাগে। কলব থেকে কুরআনের চারাগাছ বের হতেও সময় লাগবে। ইস্তেগফার তিলাওয়াতের পানি দিয়ে যেতে হবে। লেগে থাকলে একসময় কুরআনি নূরের চারা দেখা দেবে। চারা দেখা দিলেও পানি দেয়া বন্ধ করা যাবে না। চালিয়ে যেতে হবে। ফসল কাটা পর্যন্ত মেহনত খেদমত চালিয়ে যেতে হবে। মুমিন ফসল কাটবে মৃত্যুর পর থেকে।
.
৭৩. একনিষ্ঠ ভালোবাসা
কুরআনকে সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। নিজের ওপর, নিজের পরিবার-পরিজন, নিজের বিবিবাচ্চা সবকিছুর ওপর। দুনিয়ার সবকিছুর ওপর। দুনিয়াবি কাজকর্মের ওপর। দুনিয়ার পেছনে অন্ধের মতো না পড়লেও, আল্লাহ তা‘আলা আমার তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন, তা আমার কাছে পৌঁছবেই। কিন্তু আমি কুরআনের কাছে যেচে না গেলে, কুরআন আমার কাছে আসবে না। আমি আমার সবটা না দিলে, কুরআন আমাকে সামান্যও দেবে না। আমি সত্যি সত্যি কুরআনকে ভালোবাসলে, কুরআনের জন্য আমার সবকিছু উজাড় করে দিতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হওয়ার কথা নয়। কুরআনের প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসাই আমাকে কুরআনের দিকে ধাবিত করবে। কুরআনের প্রতি নিখাদ ভালোবাসাই আমাকে কুরআনের জন্য সময়-মেধা-শ্রম উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। কুরআন ছাড়া দুনিয়ার বাকি সব ইলম নশ^র। কুরআন ছাড়া বাকি সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র কুরআন আখেরাত পর্যন্ত আমার সাথে যাবে। তবে কুরআন চর্চাটা হতে হবে সুন্নাহর অনুসরণে। নবীজি ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ অনুসরণ করে।
.
৭৪. আহলুল্লাহ
আল্লাহর পরিবারভুক্ত কারা? আহলে কুরআন। যারা সুন্নাহ অনুযায়ী কুরআনচর্চা করে। আহলে কুরআনের পাঁচ রব্বানী স্তর। পাঁচটি পুরস্কার :
১. শাফা‘আত (فإنه يأتي يوم القيامة شفيعا لأصحابه)। কেয়ামতের দিন কুরআন তাদের জন্য সুপারিশ করবে (হাদীস শরীফ)।
২. রিফ‘আহ (فإن منزلتك عند آخر آية تقرؤها)। আহলে কুরআন উচ্চমর্যাদা লাভ করবে। আখেরাতে আহলে কুরআনকে বলা হবে, তুমি পড়তে থাকো, যত আয়াত পড়তে পারবে, তুমি তত উঁচু প্রাসাদ ও মর্যাদায় উন্নীত হবে (হাদীস শরীফ)।
৩. সুহবাহ (مع السفرة الكرام البررة)। আখেরাতে আহলে কুরআন সম্মানিত নেককারদের সুহবত-সাহচর্য লাভ করবে (হাদীস শরীফ)।
৪. খাইরিয়্যাহ (خيركم من تعلم القرآن وعلمه)। আহলে কুরআন সর্বোত্তম মানুষ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবে। যে কুরআন শিক্ষা করে ও শিক্ষা দেয়, তিনিই সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি (হাদীস শরীফ)।
৫. আহলিয়্যাহ (أهل القرآن هم أهل الله وخاصته)। আহলে কুরআন আল্লাহর পরিবারভুক্ত। তারা আল্লাহর খাস লোক। একান্ত কাছের লোক (হাদীস শরীফ)।
.
৭৫. থমকে দাঁড়ানো
মন নড়ে তন নড়ে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, কুরআনের অবিশ^াস্য বিস্ময়কর জগতের সামনে থমকে দাঁড়াও। (সাড়া দিয়ে জেগে ওঠে) হৃদয়কে নাড়া দাও। কুরআনকে শুকনো খেজুরের মতো ঠনঠন ঘড়ঘড়ে আওয়াজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ো না। কবিতার মতো দ্রুতগতির বিড়বিড়ে হুমহাম পাঠ কোরো না। থেমে থেমে অনুধাবন করে করে উপলব্ধিতে এনে এনে তিলাওয়াত করো। সূরা কখন শেষ হবে, এই যেন তোমাদের মূল অভিজ্ঞান হয়ে না ওঠে।
.
৭৬. সজীব প্রকৃতি
কুরআন নিয়ে জীবন কাটানো মানে, এক জীবনের মধ্যে আরেকটি জীবন যাপন করা। কুরআন আমার কলবকে জাগিয়ে তোলে। কলব আমার জীবনকে জাগিয়ে তোলে। আমি যখন একটি আয়াত তিলাওয়াত করি, আমার কলব আয়াতের ছোঁয়া পেয়ে লকলকিয়ে জেগে ওঠে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে ঘাসপাতা কীভাবে নড়ে ওঠে? সজীব হয়ে ওঠে? বৃষ্টির ছোঁয়ায় পুরো প্রকৃতি কীভাবে জেগে ওঠে, খেয়াল করেছি কখনো? কুরআনের একটি আয়াতের স্পর্শেও আমার কলব সেভাবে জেগে ওঠে। তবে আমি কেন কুরআন তিলাওয়াত করে কলবে কোনো সাড়া পাই না?
.
৭৭. প্রাণস্পন্দন
ধরা যাক এক গভীর কূপ। আমাকে কূপটি পানিভর্তি করার দায়িত্ব দেয়া হলো। পানি ঢালার কাজ শুরু হলো। প্রথম প্রথম কি আমি বুঝতে পারব, পানি ভর্তি হচ্ছে কি না? দীর্ঘদিন পানিহীন থাকার কারণে, প্রথম পানিগুলোর কিছু খাবে কূপের তলানি। কিছু শুষবে কূপের দেয়াল। তারপর আস্তে আস্তে পানি জমতে শুরু করবে। আমার কলবও দীর্ঘদিন কুরআনের আলোহীন থাকার কারণে, প্রথম দিকের তিলাওয়াতের তাৎক্ষণিক কোনো ফল দেখতে পাবো না। আমার অগোচরে ঠিকই কাজ হচ্ছে। গুনাহের অসংখ্য পরত জমতে জমতে এমন অবস্থা হয়েছে, গ-ারের মতো কাতুকুতু দিলেও একসপ্তাহ পরে হাসি আসে। তারপরও বিল-আখের হাসি আসে তো। আমার পাপাসক্ত কলবও এমন। কুরআন পড়ি কিন্তু কোনো ফল পাই না, এটা ভুল কথা। ফল ঠিকই হয়। আমি টের পাই না। আমাকে পানি ঢালা অব্যাহত রাখতে হবে। ধৈর্যহারা হওয়া চলবে না। কুরআন আমার কলবে প্রাণস্পন্দন জাগিয়ে তুলবেই। ইন শা আল্লাহ।
.
৭৮. কুরআনের মজা
নিয়মিত তিলাওয়াত করতে পারছি, হিফযও করতে পারছি, কিছু কিছু বুঝতেও পারছি, তাদাব্বুর করারও অভ্যেস গড়ে উঠছে, কুরআন তিলাওয়াতে মজাও লাগে, কুরআন শুনতেও আরাম লাগে। তাহাজ্জুদে গতানুগতিকতার বাইরে বেশি পরিমাণে তিলাওয়াত করতে পারি, এ তো রাব্বে কারীমের অকল্পনীয় নেয়ামত। যার মধ্যেই কমবেশ নেয়ামতগুলো আছে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়া দরকার।
.
৭৯. আল্লাহর নেয়ামত
অঢেল জ্ঞান-গরিমা। গভীর আর সূক্ষ্ম বুঝশক্তি। চট করে যেকোনো বিষয়ের গভীরে পৌঁছে যেতে পারেন। যা পড়েন, সবই মনে থাকে। কুরআন কারীমের যেকোনো আয়াতের তাফসীর বলে দিতে পারেন। সালাফ-খালাফের প্রামাণ্য সমস্ত তাফসীর থেকে তাৎক্ষণিক উদ্ধৃতি পেশ করতে পারেন। কথায় কথায় কুরআনের আয়াত বলতে পারেন। এক আয়াতের সূত্র ধরে আরও অসংখ্য আয়াত টেনে আনতে পারেন। এমন ঈর্ষণীয় যোগ্যতার কারণে, লোকজন তাকে সীমাহীন শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেন। মানুষের আদর-সমাদর দেখে, তার মনে ধীরে ধীরে অহংকার জন্ম নিল। আল্লাহ তা‘আলা বান্দার অহংকারকে ভীষণ অপছন্দ করেন। অহংকারী হৃদয়ে কুরআন থাকে না। মানুষটার কলব থেকে কুরআন চলে গেল। তার উচিত ছিল কুরআনের নেয়ামত পেয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। নিয়মিত শোকর আদায় করা। যেকোনো ইলমই আল্লাহর দান। আল্লাহর অনুগ্রহ। আল্লাহর নেয়ামত। নেয়ামতের শোকর আদায় না করলে, নেয়ামত তো চলে যাবেই।
.
৮০. বিশুদ্ধ আমি
কুরআন আমাকে বিশুদ্ধ ‘আমিকে’ ফিরিয়ে দেবে। সেই (أَلَسۡتُ بِرَبِّكُمۡ)-পর্বের শুদ্ধতম ‘আমিকে’। পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত আমিকে। জটিলতা কুটিলতামুক্ত ‘আমিকে’। আমিও ফিরে পাব আমার প্রকৃত ‘আমিকে’। শুদ্ধতম ‘আমিকে’। পাপাচারদুষ্ট হয়ে পড়ার পর, কুরআনি গোসলশুদ্ধ ‘আমিকে’। কুরআনি হিযব আমাকে চিনিয়ে দেবে প্রকৃত ‘আমিকে’।
.
৮১. অপার্থিব কুরআন
কুরআন কারীমকে আমার নিজের চেয়েও বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। বৈধ পার্থিব চাহিদার চেয়েও বেশি প্রাধান্য দিতে হবে কুরআনকে। আল্লাহর অনুমোদন থাকলে, দুনিয়ার প্রাপ্য অংশ আমার কাছে ধরা দেবেই। কিন্তু আমি অগ্রসর না হলে, কুরআন আমার কাছে যেচে আসবে না। আমি আমাকে না দিলে কুরআন নিজেকে দেবে না। কুরআনের প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা থাকলে, কুরআনের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে, সেটা অন্তর থেকেই জানা হয়ে যাবে। কারও কাছ থেকে জেনে নিতে হবে না। ভেতরে বাস করা সত্তাই আমাকে জানিয়ে দেবে, কীভাবে কুরআনের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। কীভাবে পার্থিব বিষয়ের ওপর অপার্থিব কুরআনকে প্রাধান্য দিতে হবে। কুরআনের প্রতি বিশুদ্ধ ভালোবাসাই আমাকে বলবে, কুরআন ছাড়া বাকি সব ভিত্তিহীন। অস্তিত্বহীন।
.
৮২. আখিরাতভীতি
কুরআন আমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে নেমে আসা রহমত। কুরআনকে সাথে নিয়ে যাপিত জীবনে আছে প্রশান্তি আর নিরাপত্তা। এই শান্তি কারও ছিনিয়ে নেয়ার অধিকার নেই। ক্ষমতাও নেই। কুরআন আমাকে যাবতীয় সমস্যার আগাম সমাধান দিয়ে রাখে। কুরআন আমার অন্তর থেকে দুনিয়াপ্রীতি দূর করে অন্তরে আখিরাতভীতি তৈরি করে। কুরআন আমার চিন্তাচেতনাকে শালীন সুশীল করে তোলে। কুরআন আমার মনে ওহীর নূর ছড়িয়ে দেয়। কুরআন আমার শিরা-উপশিরায় আল্লাহর রহমত মিশিয়ে দেয়। আল্লাহর রহমতে আমার জীবন হয়ে ওঠে শান্ত। আরামদায়ক।
.
৮৩. হুযুরে কলবী
কুরআন কারীম সবার ওপর প্রভাব ফেলে। কুরআন কারীম সবাইকে প্রভাবিত করে। তবে প্রভাবিত হওয়া ও প্রভাবিত করার মাত্রায় পার্থক্য আছে। সবাই কুরআন কারীম দ্বারা সমান প্রভাবিত হয় না। এর মূল কারণ ‘হুযুরে কলবী’। যে যত বেশি হুযুরে কলবী নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করবে, সে তত বেশি কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হবে। কোনোরকমে পারা শেষ করার উদ্দেশ্যে, দৈনিক হিযব আদায়ের লক্ষ্যে যেনতেন প্রকারে তিলাওয়াত করা আর পরিপূর্ণ আগ্রহ নিয়ে, ভক্তিশ্রদ্ধা, মনোযোগ দিয়ে তিলাওয়াতে অনেক পার্থক্য। আমি যখন নিজেকে প্রতিটি আয়াতের সম্বোধনের পাত্র কল্পনা করে, গভীর আগ্রহ নিয়ে সাধ্যমতো বুঝে বুঝে তিলাওয়াত করব, আমার ওপর কুরআনের প্রভাব হবে অপরিসীম। এমন তিলাওয়াত আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কুরআনের নূর পৌঁছে দেবে। আমার অস্তিত্বের গভীরে পৌঁছে দেবে কুরআনের আলো। যে তিলাওয়াতে ইয়াকীন ও হুযুরে কলব মিশে থাকে, সে তিলাওয়াত থেকে জন্ম নিতে পারে, যুগ বদলে দেয়া প্রজন্ম। আর সাদামাঠা তিলাওয়াতে বড়জোর হরফপ্রতি দশনেকী আর কিছু ফযীলত জুটবে। আমি কোন ধরনের তিলাওয়াত করি?
.
৮৪. আরামদায়ক ছোঁয়া
আমি যখনই রাতের তৃতীয় যামে তিলাওয়াতে মশগুল হয়েছি, আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে অপার্থিব এক আরামদায়ক ছোঁয়া অনুভব করেছি। দিনের আলোর তিলাওয়াতে এমন অনুভূতি পাইনি। দিনের তিলাওয়াত আর রাতের তিলাওয়াতে অনেক তফাত। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই এ-ব্যাপারে বলেছেন (إِنَّ نَاشِئَةَ ٱلَّیۡلِ هِیَ أَشَدُّ وَطۡـئًاوَأَقۡوَمُ قِیلًا)। যে কেউ একটু খেয়াল করলেই শেষ-রাতে ও দিনে তিলাওয়াত করে পার্থক্যটা ধরতে পারবে।
.
৮৫. পরাজিত নাফস
দুনিয়ার ভোগবিলাসে রসনাতৃপ্ত অন্তর কুরআনি নূরের নাগাল পায় না। প্রবৃত্তির চাহিদার কাছে পরাজিত ‘নাফস’ কুরআনি নূরের নাগাল পায় না। রাতদিন ঘুমিয়ে কাটানো অলসের পক্ষেও প্রকৃত কুরআনি হেদায়াতের দেখা পাওয়া সম্ভব নয়। দুর্বল ইচ্ছাশক্তি আর অনাগ্রহ অনাদরে নিতান্ত অবহেলা নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতে বসা ব্যক্তির পক্ষে সত্যিকারের কুরআনি নূরের দেখা পাওয়া কঠিন। কুরআন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন কিতাব। অদম্য বাসনা, দুর্মর প্রচেষ্টা, বিরামহীন লেগে থাকা ছাড়া, কুরআন কারও কাছে তার রহস্য উন্মোচন করে না। কুরআনের নিজস্ব জগতে প্রবেশ করতে চাইলে, নিজেকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। নিজেকে কুরআনি জগতে প্রবেশের উপযোগী বানাতে হবে। দেখে দেখে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারা আর কুরআনের একান্ত নিজস্ব ভুবনে প্রবেশ করতে পারা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
.
৮৬. ভার লাঘব
কুরআন কারীম আমাকে আগলে রাখে। কুরআন আমার সময়গুলোকে অপচয় থেকে বাঁচায়। কুরআন আমাকে ঢিলেমি শিথিলতা থেকে হেফাযত করে। কুরআন আমাকে নফসে আম্মারার অনিষ্ট থেকে বাঁচায়। কুরআন আমাকে নফসের অফুরন্ত বাসনা থেকে বাঁচায়। কুরআন আমাকে নফসের ক্লান্তিকর লোলুপতা থেকে বাঁচায়। কুরআন আমাকে ভুল পথ থেকে হেদায়াতের পথে নিয়ে আসে। পৃথিবীর যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে কুরআন আমার জন্য একাই এক শ হয়ে দাঁড়ায়। কুরআন আমাকে ভ্রান্তির সয়লাবে রক্ষা করে। কুরআন আমাকে এমন কিছু দেয়, যা অন্য কারও পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে কুরআন আমাকে আল্লাহর রহমতের বন্দরে পৌঁছে দেয়। কুরআন আমার কাঁধ থেকে জীবনযুদ্ধের দুর্বহ বোঝার ভার লাঘব করে দেয়।
.
৮৭. দোয়া
ইয়া আল্লাহ, আমাদের হাদীসে বর্ণিত আহলে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করুন। যারা আপনার পছন্দনীয় পদ্ধতিতে রাতে-দিনে কুরআন তিলাওয়াত-তাদাব্বুর করেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস মেনে কুরআন চর্চা করেন।
ইয়া আল্লাহ, আমাদের কুরআনের মাধ্যমে সম্মান দান করুন। আমাদের কুরআন দ্বারা উপকৃত করুন।
ইয়া আল্লাহ, কুরআনের মাধ্যমে আমাদের শরহে সদর (বক্ষকে উন্মুক্ত) করে দিন। কুরআনের মাধ্যমে আমাদের কলবকে হেদায়াত দান করুন। কুরআনের মাধ্যমে আমাদের কলবকে নূর দ্বারা ভরপুর করে দিন।
ইয়া আল্লাহ, কুরআনের মাধ্যমে আমাদের চেহারাকে উজ্জ্বল করে দিন। কুরআনের মাধ্যমে আমাদের মনমেজায ভালো করে দিন। আমাদের মন-মানসিকতা পরিশুদ্ধ কর দিন। কুরআনের মাধ্যমে আমাদের সুখী-সৌভাগ্যবান করে দিন। আল্লাহুম্মা আমীন।
.
৮৮. খোলস ছাড়া
যে কুরআনকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে, সে তার জীবনকে কুরআন অনুযায়ীই সাজিয়ে নেবে। তার সারাদিনের রুটিনও হবে কুরআনকে ঘিরে। যে বলে তার হাতে কুরআনের জন্য সময় নেই, সে আসলে আল্লাহর আযাবের মধ্যে আছে। তার ওপর শয়তান চেপে বসেছে। তাকে অলসতার দরিয়ায় ডুবিয়ে রেখেছে। তার কলবকে একটা বদ্ধ ঘেরাটোপে ঢুকিয়ে দিয়েছে শয়তান। নাহলে, কুরআনের উম্মাহর কী করে কুরআনের জন্য সময় হাতে থাকে না? তার হাতে খাবারের সময় থাকে, ঘুমের সময় থাকে, আড্ডার সময় থাকে, শুধু কুরআনের বেলাতেই হাত খালি? ¯্রফে শয়তানে পেয়েছে তাকে। শয়তানের চাপানো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে।
.
৮৯. কলবে নূর জারি
আল্লাহ আমাকে ভালোবাসলে, আমার যবানে নূর জারি করে দেবেন। কুরআন জারি করে দেবেন। এই নূর যবানকে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করবে। আল্লাহ আমাকে ভালোবাসলে আমার কলবে নূর জারি করে দেবেন। কুরআন জারি করে দেবেন। আমি বিভিন্ন বস্তুর হাকীকত বুঝতে পারব। আল্লাহ আমাকে ভালোবাসলে আমার কানে কুরআন জারি করে দেবেন। কুরআন আর আল্লাহর পছন্দনীয় কথা ছাড়া কান অন্যকিছু শুনতেই চাইবে না। শোনা পছন্দ করবে না। শুনে স্বস্তি পাবে না। এই নূর আল্লাহর ‘ইখতিয়ারী’। আল্লাহ ইচ্ছার অধীন (یَهۡدِی ٱللَّهُ لِنُورِهِۦ مَن یَشَاۤءُۚ) আল্লাহ যাকে চান তাকে নিজ নূরে উপনীত করেন (নূর, ৩৫)।
.
৯০. ভালোবাসার যাকাত
ভালোবাসারও যাকাত আছে। ফুলেরও কাঁটা আছে। ভালোবাসলে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। কুরআনের প্রতি আমার ভালোবাসার পরিমাণ অনুযায়ী আমার দিকে পরীক্ষা আসবে। আমাকে কুরআনবিমুখ করার জন্য, নানা বাধা আসতে শুরু করবে। প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে। দুনিয়াবি নানা প্রলোভন হাতছানি দেবে। আমার শানমানের উপযোগী নয় এমন অনেক মুবাহ হালাল বস্তু সহজলভ্য হয়ে আমার হাতে ধরা দিতে আসবে। আমার সততা পরীক্ষার মুখোমুখি হবে। আমাকে এসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। দৃঢ়তা অবিচলতার সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। আমার সবর-শোকর দেখে আল্লাহই আমাকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করবেন।
.
৯১. আচরণ
কুরআনের সাথে একেক জনের আচরণ একেক রকম। কারও সাথে কুরআনের সম্পর্ক খাবার-পানীয়ের মতো; বরং আরও দৃঢ়তর-শ^াস প্রশ^াসের মতো। সার্বক্ষণিক। কারও সাথে কুরআনের সম্পর্ক অবসরের ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’। কিছু করার নেই? আচ্ছা, একটু কুরআন পড়ে নেয়া যাক। কারও সাথে কুরআনের সম্পর্ক দুর্বহ বোঝার মতো। কুরআন পড়ার কথা মনে হলেই কাঁপুনি দিয়ে জ¦র আসে। আমি কোন দলে?
.
৯২. কুরআনের আগমন
কুরআন কি যার-তার কাছে আসে? কুরআন কি যার-তার ঘরে যায়? কুরআন কি যার-তার কাছে ধরা দেয়? কুরআন যে (وَإِنَّهُۥ لَكِتَـٰبٌ عَزِیز)। কুরআন এক মর্যাদাপূর্ণ কিতাব (ফুসসিলাত, ৪১)।
.
৯৩. হৃদয়ে কুরআন
যে হৃদয়ে কুরআন বাস করে, সে হৃদয়কে কি কোনো বালা-মুসীবত দুর্বল করতে পারে? মোটেও না। কুরআনের সাথে সুন্দরভাবে সময় কাটালে, জীবনও সুন্দর হয়ে ওঠে। আগে থেকেই নিজের জীবনপথকে কুরআনি নূরে আলোকিত করে রাখলে, ফিতনার সময় অন্ধকারে থাকতে হয় না।
.
৯৪. কুরআনময় সলাত
কুরআনের সাথে লেগে থাকলে, সলাত রক্ষা পায়। সলাতের সাথে লেগে থাকলে কুরআন রক্ষা পায়। তবে উভয়ের সাথে সালাফের মতো করে লেগে থাকতে হবে। সালাফের কুরআন ছিল সলাতময়। সালাফের সলাত ছিল কুরআনময়।
.
৯৫. স্বাধীনচেতা
কুরআনের আয়াত বড় স্বাধীনচেতা। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। অহংকারীর কাছে কুরআনের আয়াত আসে না। কুরআন আসে বিনয়ীর কাছে। যে নিজ থেকে কুরআনের কাছে যায়, কুরআন তার কাছে আসে। যে কুরআনের কাছে আসতে নাক-উঁচু ভাব দেখায়, কুরআনও তাকে এড়িয়ে চলে। কুরআনের জগতে বিনয়ের দাম আছে, অহংকারের কানাকড়ি মূল্যও নেই।
.
৯৬. আল্লাহর নৈকট্য
ইলম তলব আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। ইলম তলব অনেক বড় ইবাদত। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন জীবন্ত সার্বক্ষণিক তালিবে ইলম। নবীজি সাহাবায়ে কেরামকে ইলম তলবের উৎসাহ দিয়ে বলেছেন,
مَن سَلَكَ طَرِيقًا يلتَمسُ فيه عِلمًا سهَّلَ اللهُ له طريقًا إلى الجنةِ وأنَّ الملائكةَ لَتَضَعُ أجنِحَتَها لِطالِبِ العِلْمِ وأن العالِمَ ليَشْفَعُ له مَن في السمواتِ ومَن في الأرضِ حتى الحوتَ في الماءِ
ইলম তলবের পথে হাঁটলে, আল্লাহ জান্নাতের পথ সুগম করে দেবেন। ফেরেশতাগণ তালিবে ইলমের জন্য তাদের ডানা বিছিয়ে দেন। আলিমের জন্য আসমান-জমীনের সবাই সুপারিশ করতে থাকে। এমনকি পানির মাছও (সহীহ)।
তিলাওয়াতকারী তো আসলে ‘তালিবে ইলম’। ইলম তলবকারী। জ্ঞানান্বেষী। সত্যান্বেষী। হেদায়াত-প্রত্যাশী,
فضلُ العالمِ على العابدِ كفَضلِ القمرِ على سائرِ الكَواكبِ إنَّ العُلماءَ ورثةُ الأنبياءِ إنَّ الأنبياءَ لم يورِّثوا دينارًا ولا دِرهمًا إنَّما ورَّثوا العِلمَ فمن أخذَ بِهِ فقد أخذَ بحظٍّ وافرٍ
আলেম ও (জাহেল) আবেদের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। আলিমের মর্যাদা আবেদের ওপর এমন, ঠিক যেমন চাঁদের ওপর বাকি সব তারকার মর্যাদা। আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিস। নবীগণ দিরহাম-দীনারের ওয়ারিস করেন না। নবীগণ মূলত ইলমের মীরাস রেখে যান। যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করে, সে নবীর মীরাসের বিরাট অংশ লাভ করে।
.
৯৭. কারী
উমার রা.-এর পক্ষ থেকে নাফে বিন হারেস ছিলেন মক্কার গভর্নর। নাফের সাথে খলীফার দেখা হলো উসফান নামক স্থানে। খলীফা জানতে চাইলেন, মক্কায় কাকে তোমার স্থালাভিষিক্ত করে এসেছ? ইবনে আবজাকে। ইবনে আবজা কে? তিনি একজন আজাদকৃত দাস। তুমি একজন আজাদকৃত দাসকে মক্কাবাসীর শাসক নিয়োগ করে এসেছ? তিনি কিতাবুল্লাহর একজন ‘কারী’। রাসূলুল্লাহ বলেছেন,
إنَّ اللهَ لَيرفَعُ بهذا القُرآنِ أقوامًا ويضَعُ به آخَرينَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ এই কুরআনের মাধ্যমে এক জাতিকে সম্মানিত করেন, আরেক জাতিকে অসম্মানিত করেন (ইবনে মাজাহ)।
.
৯৮. সুখের নমুনা
জান্নাতে গিয়ে মুমিনগণ স্বস্তির নিশ^াস ফেলে বলবেন (ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ ٱلَّذِیۤ أَذۡهَبَ عَنَّا ٱلۡحَزَنَۖ) সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের থেকে সমস্ত দুঃখ দূর করেছেন (ফাতির, ৩৪)। জান্নাতে গেলে আমাদের কলবসমূহ সবধরনের হিংসাবিদ্বেষমুক্ত হয়ে যাবে। জান্নাতে আমাদের সমস্ত ভয়ভীতি, দুঃখকষ্ট দূর হয়ে যাবে। জান্নাতে আমাদের সব ধরনের ক্লান্তিশ্রান্তি দূর হয়ে যাবে। দুনিয়াতেও একটি জান্নাত আছে। এই জান্নাতে যথাযথভাবে প্রবেশ করলে পারলে, জান্নাতি সুখের কিঞ্চিৎ নমুনা উপভোগ করা সম্ভব। কুরআন কারীমই দুনিয়ার জান্নাত। আমি যদি শুদ্ধ দিলে শুদ্ধ নিয়তে উপযুক্ত সময়ে, যথাযথ পদ্ধতিতে কুরআনের গভীর প্রবেশ করতে পারি, আমি জান্নাতের সন্ধান পেতে পারি।
.
৯৯. অন্তরায়
কুরআন তাদাব্বুর ও কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হলো গুনাহ। গুনাহ অন্তরকে তালাবদ্ধ করে দেয় (أَفَلَا یَتَدَبَّرُونَٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَا) (মুহাম্মাদ, ২৪)।
.
১০০. ভুল কেরাত
ইমাম কিসাঈ রহ.। ইলমুল কেরাত, ইলমুন নাহুসহ আরও বহু শাস্ত্রের প-িত ব্যক্তি। তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, একদিন ইমামতি করছিলাম। পেছনে খলীফা হারূনুর রশীদ রহ.। সেদিন কী হয়েছিল বলতে পারব না, নামাজের কেরাতে এমন এক ভুল করলাম, একটি ছোট্ট শিশুও এমন ভুল করবে না। আমি (لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُونَ) এর স্থলে পড়লাম (لَعَلَّهُمْ يَرْجِعِيْنَ)। আল্লাহর কসম, আমীরুল মুমিনীন ওলামায়ে কেরামকে কত বেশি সম্মান করতেন, তাদের সাথে কতটা সম্মান বজায় রেখে কথা বলতেন, সেদিন সলাতের পর তার প্রশ্ন দেখে কিছুটা অনুমান করেছি। তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেন, আমি ভুল করেছি। কিন্তু তিনি আমি ভুল করেছি, সেটা সরাসরি না বলে, প্রশ্ন করলেন, এটা কোন ‘লুগাহ’? মানে এটা কোন কবীলার ভাষারীতি (কোন কেরাত)? আমি বিনয়ের সাথে উত্তর দিলাম,
‘আমীরাল মুমিনীন, অনেক সময় অতি দক্ষ ঘোড়াও দৌড়তে গিয়ে হোঁচট খায়।
তিনি বললেন, জি উত্তরটা বেশ হয়েছে।
.
১০১. কুরআন আঁকড়ে ধরা
কুরআন আমাদের। আমরা কুরআন আঁকড়ে না ধরলে, আল্লাহ তা‘আলা অন্যদের আমাদের স্থলাভিষিক্ত করে দেবেন।
وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لا يَكُونُوا أَمْثَالَكُمْ
তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে তোমাদের স্থানে অন্য কোনো সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করবেন অতঃপর তারা তোমাদের মতো হবে না (মুহাম্মাদ, ৩৮)।
.
১০২. জীবন ওয়াকফ
আবু বকর ইবনে আইয়াশ রহ. বর্ণনা করেছেন। আমি ইলমুল কেরাতের ইমাম আসেম রহ.-এর কাছে গেলাম। তিনি তখন মৃত্যুশয্যায়। সলাতে যেভাবে কেরাত পড়েন, সেভাবে বারবার পড়ছেন,
ثُمَّ رُدُّوۤا۟ إِلَى ٱللَّهِ مَوۡلَىٰهُمُ ٱلۡحَقِّ
অতঃপর তাদের সকলকে তাদের প্রকৃত মনিবের কাছে ফিরিয়ে নেওয়া হয় (আন‘আম, ৬২)।
সুবহানাল্লাহ! তারা সারাজীবন কুরআনের জন্য ওয়াফক করে দিয়েছে। তাই শেষ সময়েও কুরআন তাদের ছেড়ে যায়নি।
(গায়াতুন নিহায়াহ, ১/৩৪৬)
.
১০৩. ঈমানের শস্যক্ষেত্র
আমার কলব ঈমানের শস্যক্ষেত্র,
ক. কুরআন কারীম আমার কলবে কী রোপণ করছে? কুরআন হলো মুমিনের বসন্ত। বৃষ্টি যেমন যমীনের বসন্ত। আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। শুকনো বীজ থেকে, খটখটে শুকনো ডাঁটা থেকে, বৃষ্টির ছোঁয়ায় বীজ জন্ম নেয়। দুর্গন্ধময় মাটি, পচা কাদা, থকথকে পুঁতি ময়লা, কিছুই বীজের অঙ্কুরোদ্গম ঠেকাতে পারে না। সব বাধা দলে ঠনঠনে বীজ থেকে অঙ্কুর লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে। আমার কলব যতই ময়লাযুক্ত হোক, কুরআনী বীজ সেখানে সুন্দর কিছু ফলাবেই।
খ. কুরআন আমার কলবে কেমন বীজ রোপণ করছে? একেকটি সূরা অমিত সম্ভাবনাময় বীজ। একেকটি আয়াত অফুরন্ত ফল-ফসলের বীজ। এই বীজ আমার কলবে কিছু উৎপন্ন করছে তো? নাকি আমার কলবের বীজতলা এতটাই ঊষর, কুরআনের মতো বীজও সেখানে দাঁত বসাতে পারছে না?
গ. আল্লাহর পক্ষ থেকে মোহর লেগে না গেলে, পৃথিবীতে এমন কলব পাওয়া অসম্ভব, যাতে কুরআন কোনো প্রভাব ফেলে না। আমার মধ্যে যেটুকু কুরআন আছে, আমি কি সে অনুযায়ী আমল করছি?
.
১০৪. কুরআন নাযিল
আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি দাগ কাটা উপদেশটি ছিল আমার পিতার। তিনি বলেছিলেন,
-বেটা, এমনভাবে কুরআন কারীম তিলাওয়াত করবে, যেন কুরআন তোমার ওপরই এখন নাযিল হচ্ছে। আল্লাহ বলছেন আর তুমি গভীর মনোযোগে শুনে শুনে, বুঝে বুঝে পড়ার চেষ্টা করছ।-আল্লামা ইকবাল রহ.।
.
১০৫. প্রিয়তমের ভালোবাসা
প্রিয়তমকে যতটুকু ভালোবাসি, তার কথাও সে পরিমাণে প্রিয় হয়। আল্লাহকে যতটা ভালোবাসি তার কালামও সে পরিমাণে প্রিয় হবে আমার কাছে। কুরআন নিয়ে মেহনতের পরিমাণই বলে দেবে আমি আল্লাহকে কতটা ভালোবাসি!
.
১০৬. আল্লাহর সাথে ব্যবসা
কুরআন নিয়ে থাকা মানে আল্লাহর সাথে ব্যবসায় নামা। আল্লাহ তা‘আলা এ-ব্যবসায় কত হারে লাভ দেবেন, সেটা বান্দা কল্পনাও করতে পারবে না। এই ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স শুধু দুনিয়াতেই নয়, আখেরাতেও এর মেয়াদকাল ব্যাপ্ত থাকবে। লাভ আসতে থাকবে দুনিয়া ছাড়িয়ে আখেরাতেও।
.
১০৭. কুরআনের স্বাদ
কুরআন কারীমের স্বাদ পেতে হলে, জীবনটা গুনাহমুক্ত হতে হবে। গুনাহ হলো জংয়ের মতো। কলব আয়নার মতো। গুনাহর প্রভাবে কলবে কালিমা পড়ে যায়। কুরআন জং-ধরা কলবে প্রতিফলিত হয় না।
.
১০৮. পাথরহৃদয়
তিলাওয়াতের সময় কাঁদা মুস্তাহাব। কান্না না এলে কান্নার ভান করা। অতীতের দুঃখ-শোকের কথা চিন্তা করে কান্না আনার চেষ্টা করা। যদি শোক-দুঃখের কথা কল্পনা করার পরও মনে দুঃখবোধও না আসে, তাহলে এই না আসার জন্যেই আগে কাঁদা দরকার! কারণ, এটা আরও বড় বিপদ! পাথরহৃদয় মানুষের নিন্দা করা হয়েছে কুরআনে। হাদীসে।
.
১০৯. সন্দেহের নিরসন
নাগরিক জীবনে যত সমস্যা দেখা দেয়, এর অন্যতম কারণ হলো, কুরআন থেকে দূরে সরে যাওয়া। নিয়মিত কুরআনের সাথে লেগে থাকলে যাবতীয় সন্দেহ-দ্বিধা কাছেই ঘেঁষতে পারবে না। এমনিতেই সুখ নেমে আসবে।
.
১১০. নূর ও শিফা
একজন মুসলমানকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি বিশ্বাস করেন, কুরআন কারীম হলো বান্দার জন্যে হেদায়াত, নূর ও শিফা?’
‘অবশ্যই বিশ্বাস করি।’
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বেশির ভাগ মুসলমান শুধু রমযান এলেই কুরআনের কথা স্মরণ করে। অনেকেই তো তাও করে না। যেন বাকি এগারো মাস হেদায়াত নূর ও শিফার প্রয়োজন নেই।
.
১১১. বড় ওষুধ
পাপী হৃদয়ের জন্যে কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণের চেয়ে বড় ওষুধ আর কিছু হতে পারে না।
.
১১২. কুরআনি ফিকির
হৃদয়কে নাড়া দেয় এমন করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। সূরা বা পারা শেষ করা যেন কোনোভাবেই উদ্দেশ্য না হয়। এ জন্য কুরআনের রুটিনটা পারাভিত্তিক নয়, সময়ভিত্তিক হলে ভালো। আমি প্রতিদিন এতক্ষণ সময় কুরআন নিয়ে ফিকির করব।
.
১১৩. মুয়াল্লিমুল কুরআন
এক মুয়াল্লিমুল কুরআনকে প্রশ্ন করা হলো, কপর্দকশূন্য কোনো তালিবে ইলম আপনার কাছে কুরআন শিখতে হলে আপনি কি তাকে তাড়িয়ে দেবেন? ওস্তাদ উত্তর দিলেন, এমন করলে তো আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। আমি আযাবের উপযুক্ত হয়ে যাব। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেছেন,
وَلَا تَطۡرُدِ ٱلَّذِینَ یَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِیِّ یُرِیدُونَ وَجۡهَهُۥۖ مَا عَلَیۡكَ مِنۡ حِسَابِهِم مِّن شَیۡءٍ وَمَا مِنۡ حِسَابِكَ عَلَیۡهِم مِّن شَیۡءٍفَتَطۡرُدَهُمۡ فَتَكُونَ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ
যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সকাল ও সন্ধ্যায় তাকে ডাকে, তাদের আপনি তাড়িয়ে দেবেন না। তাদের হিসাব (-এর অন্তর্ভুক্ত কর্মসমূহ) থেকে কোনোটির দায় আপনার ওপর নয় এবং আপনার হিসাব (-এর অন্তর্ভুক্ত কর্মসমূহ) থেকে কোনোটিরও দায় তাদের ওপর নয়, যে কারণে আপনি তাদের বের করে দেবেন এবং জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন (আন‘আম, ৫২)।
.
১১৪. মুবারক কিতাব
কুরআন মুবারক কিতাব। বরকতময় গ্রন্থ। বরকত মানে পর্যাপ্ত কল্যাণ। সুখ-সমৃদ্ধি। প্রাচুর্য। কুরআন সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
وَهَـٰذَا كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ مُبَارَكٌ
(এমনিভাবে) এটা এক বরকতপূর্ণ কিতাব, যা আমি নাযিল করেছি (আন‘আম, ১৫৫)।
কুরআন কারীম নাযিল হয়েছে বরকতময় মাসে। বরকতময় রাতে। কুরআন কারীম ‘মুবারক’। পুরো কুরআনে প্রায় চারবার কুরআনকে ‘মুবারক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমকে বরকতময় করেছেন। পবিত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। সব ধরনের পার্থিব অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত রেখেছেন। অন্য ধর্মগ্রন্থের মতো বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছেন। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে কুরআনের মাঝে বরকত নিহিত রেখেছেন। সর্বকালে সর্বত্র আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের সাথেই বরকত জড়িয়ে রেখেছেন।
.
লেখাটি Maktabatul Azhar মাকতাবাতুল আযহার থেকে প্রকাশিত সুইটহার্ট কুরআন থেকে নেয়া হয়েছে।
প্রকাশক মহোদয় শায়খ Obyed Ullah হাফিযাহুল্লাহু-এর সদয় অনুমতি সাপেক্ষে লেখাটি পোস্ট করা হল। রাব্বে কারীম শায়খের দুনিয়া-আখেরাতে খাইর ও বরকত দান করুন। রুজি-রোজগার ও সন্তান-সন্ততিতে ভরপুর বরকত দান করুন। আমীন।
-শাইখ আতীক উল্লাহ
-----------------------------------

 

>> তাদাব্বুরে কুরআন!
(). তাদাব্বুর (تَدَبُّر) অর্থ গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা। অনুধ্যান করা। সাধারণত কুরআন কারীমের আয়াত নিয়ে চিন্তাভাবনাকে তাদাব্বুর বলে। 
.
(). দাল-বা-রা (دبر) এই তিন হরফ যোগে গঠিত শব্দ কুরআন কারীমে সাত ধরনের শব্দে সর্বমোট ৪৪ বার এসেছে।এই শব্দমূলের মূল অর্থ: পেছন দিক। পরে আসা। 
.
(). একটা কথা শুরুতেই বলে রাখি, কুরআন কারীম অর্থ না বুঝেও পড়াও একটা ইবাদত। প্রতি হরফে দশ নেকি। 
.
(). কুরআন কারীম নাযিল করা হয়েছে, হেদায়াতের জন্যে। না বুঝলে কিভাবে হেদায়াত আসবে? সবাইকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কুরআন বোঝার মেহনত শুরু করা জরুরী। 
.
(). কুরআন বোঝার মেহনত শুরু করার আগে কিছু ধাপ আছে। সেগুলো অতিক্রম না করে, কুরআন বুঝতে যাওয়া নিরাপদ নয়। ফলপ্রসূও নয়।
.
(). এই কুরআন ছোট্ট শিশু পড়ে, অবুঝ বালক পড়ে। কিছু না বুঝেই তারা পড়ে। তাবীল-তাদাব্বুর সম্পর্কে তাদের কোনও ধারনাই নেই। কিন্তু বড় হওয়ার পরও এভাবে না বুঝে পড়তে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয়। ধর্মসঙ্গতও নয়। একটু একটু করে হলেও বোঝার মেহনত শুরু করা উচিত।
.
(). কুরআনের তাদাব্বুর সমস্ত শরীয়তের যাবতীয় ইলমের চাবিকাঠি। তাদাব্বুরের মাধ্যমে কুরআন থেকে কল্যাণকর দিক-নির্দেশনা লাভ করা যায়। ঈমান বৃদ্ধি পায়। 
.
(). মানুষ ডাক্তারিবিদ্যার বই পড়ে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই পড়ে, অন্য আরো বিদ্যার বই পড়ে। বোঝার জন্যেই পড়ে। পঠিত বইয়ের তথ্যজ্ঞান নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্যে পড়ে। তাহলে কুরআনকে কেন না বুঝে পড়া হবে? কুরআন থেকেই তো সত্য ও মিথ্যার জ্ঞান আহরণ করা হয়। ভাল ও মন্দের জ্ঞান লাভ হয়! ধর্ম অধর্ম চেনার উপায় জানা হয়। 
= কথা আছে, অন্য বই অর্থ বোঝা ছাড়া পড়ে কোনও লাভ নেই কিন্তু কুরআন অর্থ বোঝা ছাড়া পড়লেও সওয়াব মেলে। তাই বলে শুধু পড়ার সওয়াব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা, কুরআনের হক আদায়ে যথেষ্ট নয়। 
.
(). একটা পাহাড়ের কথা কল্পনা করি! যদি কুরআন তার উপর নাযিল হতো, সেটা ভয়ে ভারে চুরমার হয়ে যেতো। পাহাড়ের তুলনায় মানুষের হৃদয় ছোট্ট একটা দানার মতো। কতো কতো কুরআন পাঠ শোনে, তবুও কেন বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ে না? কারন একটাই , তাদাব্বুর করে না। 
.
(১০). ধীরে ধীরে কুরআন পাঠই তাদাব্বুরের জন্যে সহায়ক। নবীজি সা. কিভাবে তিলাওয়াত করতে সেটা উম্মে সালামা রা. দেখিয়েছিলেন। সেটা ছিল ধীরে ধীরে তিলাওয়াত। প্রতিটি হরফকে আলাদা আলাদা করে স্পষ্ট তিলাওয়াত। 
-আনাস রা. বলেছেন: নবীজির তিলাওয়াত ছিল ধীরগতির। টেনে টেনে। থেমে থেমে। 
-ইবনে আবি মুলাইকা রহ. বলেছেন; আমি একবার ইবনে আব্বাস রা.-এর সাথে সফরে গিয়েছি। তিনি অর্ধেক রাত নামাজ পড়তেন। নামাযে কুরআন তিলাওয়াত করতেন, প্রতিটি হরফকে আলাদা করে উচ্চারণ করে। পড়তে পড়তে কাঁদতেন। দূর থেকেও তার ফোঁপানোর আওয়াজ ভেসে আসতো। 
.
(১১). তাদাব্বুর করে করে কুরআন পড়ো। তাহলে অর্থ বুঝতে পারবে। কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদাব্বুর করো। আমলের নিয়তে পড়ো। অমনোযোগী হয়ে পড়ো না। পরিপূর্ণ সচেতনতার সাথে পড়ো। কোনও আয়াতে সন্দেহ লাগলে আলিমের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নাও। 
-ইবনে বায রহ.। 
.
(১২). আজ কুরআনবিমুখ মানুষের ছড়াছড়ি। কুরআন মেনে চলা মানুষ আজ চারদিকে লাঞ্ছিত। কুরআনের দিকে আহবানকারী আজ উপেক্ষিত। এটা দেখে তুমি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেও না। প্রকৃত জ্ঞানী সাহসী ব্যক্তি সমালোচকদের ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় না। 
-শায়খ শানকীতি রহ.। 
.
(১৩). কুরআন পাঠকারীর মূল ভূষণ হবে বিনয়। ন¤্রতা। এর দ্বারা তার চিত্ত উন্মুক্ত হবে। হৃদয় আলোকিত হবে। সালাফ একটা আয়াত নিয়েই পুরো রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। তাদের কত রাত কেটে গেছে কুরআনের তাদাব্বুরে!
-ইমাম নববী রহ.। 
.
(১৪). একজন বুদ্ধিমান মুমিনের জন্যে কুরআন হবে আয়নার মতো। আয়নায় চেহারা দেখা যায়। সুন্দর অসুন্দর ফুটে ওঠে। কুরআন পাঠের সময়ও নিজের ভাল দিক মন্দ দিক স্পষ্ট হয়। কোনও আয়াতে ভাল একটা গুণের কথা আলোচিত হলে, আমার মধ্যে গুণটা আছে কি না, সেটা ধরা পড়ে। একজন মুমিন তিলাওয়াত করার সময়, ভয়ের আয়াত এলে ভয় পায়। আশার আয়াত এলে আশান্বিত হয়। 
কুরআনকে এভাবে পাঠ করলে, কুরআন হবে তার জন্যে সুপারিশকারী। সাক্ষী। বন্ধু। রক্ষাকবচ। আর সে নিজেও হয়ে উঠবে সবার জন্যে উপকারী বন্ধু। দুনিয়া ও আখেরাতে তার পিতামাতার উপর, তার সন্তানদের উপর নেমে আসবে কল্যাণ। 
- ইমাম আ-জুররী রহ.। 
.
(১৫). দ্বীন হলো কল্যাণকামিতা। কার জন্যে? আল্লাহর জন্যে। রাসূলের জন্যে। কুরআনের জন্যে। মুসলিম ভাইয়ের জন্যে। কুরআনের জন্যে কল্যাণকামিতা হলো: 
-কুরআনের প্রতি তীব্র ভালবাসা থাকা। কুরআনের প্রতি অত্যন্ত সশ্রদ্ধ থাকা। কুরআন বোঝার প্রতি তীব্র আগ্রহ থাকা। কুরআন তাদাব্বুরের প্রতি গভীর মনোযোগ থাকা। কেন? আল্লাহ কী বলেছেন সেটা জানার জন্যে। 
.
(১৬). একজন সাধারণ নসীহতকারীর কথা মানুষ বোঝে। তার পক্ষ থেকে কোনও চিঠি এলে তার মূলবার্তা উদ্ধার করতে পারে। বার্তা অনুযায়ী জীবন গড়ে। কুরআন কারীমের কল্যাণকামীও গুরুত্বের সাথে এর বাণী বোঝার চেষ্টা করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা বাণীকে আমরা না বুঝে থাকি! এটা কি বুদ্ধিমানের কাজ?
.
(১৭). এক আরব অধ্যাপক বললেন:
-আমার আব্বু ছিলেন হাসপাতালে। বয়সজনিত নানা রোগ উপসর্গ দেখা দিয়েছে। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা-অসুখবিসুখ। কথা বলতে পারেন না। ডাক্তার বেশি বেশি ঘুমুতে বলেছেন। কিন্তু আমি যখনই তাকে দেখতে যেতাম, তার হাতে কুরআন দেখতাম!
-ডাক্তার আপনাকে বেশি বেশি ঘুমুতে বলেছেন!
-বাছা, কুরআন পড়ার আনন্দে ঘুম আসে না! 
-কয়পারা পড়তে পারেন! সারা দিনে বেশি পড়া যায় না, সাত পারা পর্যন্ত হয়!
আমি জানি, আব্বু প্রতিটি আয়াতকে কয়েকবার করে পড়েন। নিজেকে প্রশ্ন করেন। অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবেন!
.
(১৮). প্রিয়তমকে যতটুকু ভালবাসি, তার কথাও সে পরিমাণে প্রিয় হয়। আল্লাহকে যতটা ভালবাসি তার কালামও সে পরিমাণে প্রিয় হবে আমার কাছে। কুরআন নিয়ে মেহনতের পরিমাণই বলে দিবে আমি আল্লাহকে কতোটা ভালবাসি! 
.
(১৯). কুরআন নিয়ে থাকা মানে আল্লাহর সাথে ব্যবসায় নামা। আল্লাহ তা‘আলা এ-ব্যাবসায় কতো হারে লাভ দেবেন, সেটা বান্দা কল্পনাও করতে পারবে না। এই ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স শুধু দুনিয়াতেই নয়, আখেরাতেও এর মেয়াদকাল ব্যাপ্ত থাকবে। লাভ আসতে থাকবে দুনিয়া ছাড়িয়ে আখেরাতেও। 
.
(২০). কুরআনের সুর কী চমৎকার! কী মোহনীয়! কী কমনীয়! পাথরহৃদয়কেও নরম করে দেয়। কোমল করে দেয়। ভিজিয়ে দেয়। কুরআনের সামনে কোনও অহংকারী দাম্ভিক টিকতে পারে না। কাফের মুনাফিক নাস্তিকও দাঁড়াতে পারে না। কুরআন হলো জীবন-নদী। প্রাণদায়িনী বারিধারা। উচ্ছল ঝরনা। আল্লাহর কাছ থেকে বয়ে এসে বান্দার হৃদয়সাগরে এসে মিলিত হয়। বান্দার হৃদয় হলো কুরআনের মিলন মোহনা। হৃদয়কে মুমিন বানায়। আল্লাহভীরু বানায়। হৃদয়কে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে। সব ধরনের কল্যাণ দিয়ে টইটম্বুর করে দেয়। এজন্য চাই কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর!
.
(২১). পথ চলতে চলতে দ্বিধা তৈরি হলে, জীবনে সংকট দেখা দিলে, সাথে সাথে কুরআনের কাছে ফিরব। আল্লাহ কী বলেছেন, বোঝার চেষ্টা করবো। দূর হয়ে যাবে হয়রানি। দুশ্চিন্তা। মানুষ কষ্টের সময় আপনজনের কাছেই ফিরে আসে। আমাদের আপনজন আল্লাহ। তার কালাম হবে মাধ্যম। 
.
(২২). কুরআন কারীমের স্বাদ পেতে হলে, জীবনটা গুনাহমুক্ত হতে হবে। গুনাহ হলো জংয়ের মতো। কলব আয়নার মতো। গুনাহর প্রভাবে কলবে কালিমা পড়ে যায়। কুরআন জংধরা কলবে প্রতিফলিত হয় না। 
.
(২৩). তিলাওয়াতের সময় কাঁদা মুস্তাহাব। কান্না না এলে কান্নার ভান করা। অতীতের দুঃখ-শোকের কথা চিন্তা করে কান্না আনার চেষ্টা করা। যদি শোক-দুঃখের কথা কল্পনা করার পরও মনে দুঃখবোধও না আসে, তাহলে এই না আসার জন্যেই আগে কাঁদা দরকার! কারণ এটা আরও বড় বিপদ! পাথরহৃদয় মানুষের নিন্দা করা হয়েছে কুরআনে। হাদীসে। 
.
(২৪). নফল ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা তার রবের বেশি নৈকট্য অর্জন করতে পারে। কুরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠতম নফল। কুরআন শোনা, তাদাব্বুর করাও এর অন্তর্ভুক্ত। খাব্বাব রা. একলোককে বলেছিলেন:
-যতটুকু সাধ্যে কুলোয় আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করো। আর আল্লাহর কালামই নৈকট্য লাভের কার্যকর মাধ্যম। 
.
(২৫). মুসলিম উম্মাহর যখনি দুর্দিন আসবে, তার উচিত কুরআনের সাথে তার সম্পর্কটা কেমন প্রথমে যাচাই করে নেয়া। সাধারণত উম্মাহর সমস্যা আসা শুরু হয় কুরআনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর কুরআনের তাদাব্বুর কমে গেলেই উম্মাহর উপর বিপদের ঘোর অমানিশা নেমে আসে। তখনো কিন্তু তিলাওয়াত ঠিকই চলতে থাকে। থাকে না শুধু ‘তাদাব্বুর’। 
.
(২৬) নাগরিক জীবনে যত সমস্যা দেখা দেয়, এর অন্যতম কারণ হলো, কুরআন থেকে দূরে সরে যাওয়া। নিয়মিত কুরআনের সাথে লেগে থাকলে, যাবতীয় সন্দেহ দ্বিধা কাছেই ঘেঁষতে পারবে না। এমনিতেই সুখ নেমে আসবে। 
.
(২৭). ইউসুফ বিন আসবাত রহ.-কে প্রশ্ন করা হল:
-কুরআন খতমের পর কী দু‘আ করেন?
-আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। কারণ, খতম করার পর, ভাবতে বসি পুরো কুরআনের কোনও কোনও হুকুম আমি মান্য করেছি, কোনও কোনও হুকুম মান্য করতে পারিনি! হিশেব করলে দেখা যায়, অনেক হুকুম আমি মান্য করছি না! এজন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া চাড়া আর কোনও উপায় দেখি না! কারণ না মানার পরিমাণই যে বেশি!
.
(২৮). হেদায়াত চাইলে তাদাব্বুর করতেই হবে। কারণ ইলম ও হিদায়াত হলো তাদাব্বুরেরর অধীনস্থ বিষয়। 
.
(২৯). পথহারা কেউ যদি পথ পাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরআন নিয়ে বসে। তাদাব্বুরের মাধ্যমে পথের সন্ধান করে, তাহলে তার সামনে পথ খুলে যায়। 
.
(৩০). বান্দার হেদায়াতের সাথে সম্পৃক্ত এমন প্রতিটি আয়াতের ব্যাখ্যাই কুরআনে দেয়া আছে। আমি বুঝতে না পারলে, ধরে নিতে হবে, আমার কোথাও অসম্পূর্ণতা আছে। 
.
(৩১). মুসলিম বিশ্বে এমনকি অমুসলিম দেশে হাজার-হাজার মাদরাসা আছে। যেখানে কুরআন হেফয করানো হয। কিন্তু শুধু কুরআনের তাদাব্বুর নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে কাজ করবে, এমন মাদরাসা বিরল। 
.
(৩২). একজন মুসলমানকে যদি প্রশ্ন করা হয়:
-আপনি কি বিশ্বাস করেন, কুরআন কারীম হলো বান্দার জন্যে হেদায়াত, নূর ও শিফা?
-অবশ্যই বিশ্বাস করি!
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বেশির ভাগ মুসলমান শুধু রমযান এলেই কুরআনের কথা স্মরণ করে। অনেকেই তো তাও করে না। যেন বাকী এগার মাস হেদায়াত নূর ও শিফার প্রয়োজন নেই। 
.
(৩৩). পাপী হুদয়ের জন্যে, কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণের চেয়ে বড় ওষুধ আর কিছু হতে পারে না। 
.
(৩৪). হৃদয়কে নাড়া দেয় এমন করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। সূরা বা পারা শেষ করা যেন কোনওভাবেই উদ্দেশ্য না হয়। এজন্য কুরআনের রুটিনটা পারাভিত্তিক নয়, সময় ভিত্তিক হলে ভাল। আমি প্রতিদিন এতক্ষণ সময় কুরআন নিয়ে ফিকির করবো। 
.
(৩৫). জাহেলের কথার চেয়ে আলেমের কথা শোনা ভাল। অন্যের কথা শোনার চেয়ে ¯েœহময় পিতার কথা শোনা ভাল। আল্লাহ হলেন সবচেয়ে বড় আলিম, সবেচেয়ে বেশি ¯েœহশীল। তার কথাও সবার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। তাদাব্বুরের সাথে, ভালবাসার সাথে। 
.
(৩৬). মনোযোগের সাথে আল্লাহর কালাম, নবীজির কালাম শুনলে এবং তাদাব্বুর করলে, না বুঝে পারার কথা নয়। প্রথম দিনেই সব হয়ে এমন ভাবলে তো চলবে না! নিয়তান্ত্রিকভাবে এগুতে হবে।
.
(৩৭). কুরআন তাদাব্বুরের বড় এক বাধা হলো ‘গান’। সংগীত কলবকে হেদায়াতবিমুখ করে দেয়। কুরআনবিমুখ করে দেয়। কুরআন ও গান এক পাত্রে জমা হতে পারে না। গান মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে ‘প্রবৃত্তির’ পূজার। কুরআন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে প্রবৃত্তির বিরোধিতার। কুরআন মানুষের মনে শুভবোধ তৈরী করে, গান তৈরী করে অশুভবোধ। কুরআন ডাকে হকের দিকে গান ডাকে বাতিলের দিকে। কুরআন ডাকে সত্যের দিকে গান ডাকে মিথ্যার দিকে। কুরআন ডাকে আল্লাহর দিকে, গান ডাকে তাগুতের দিকে। 
.
(৩৮). ১৮৫ জন বন্দীর মধ্যে একটা জরিপ চালানো হয়েছিল। তাদেরকে শর্ত দেয়া হয়েছিল, কুরআন হেফয করতে পারলে মুক্তি দেয়া হবে। সাধারণভাবে সাজা ভোগ করে যেসব অপরাধী মুক্তি পেয়েছিল, তাদের অনেকেই পুরনায় কারাগারে এসেছে। আবার কোনও অপরাধ করে। কিন্তু হিফযের শর্ত পূরণ করে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের পুনরায় অপরাধ করে জেলে আসার হার ছিল শতকরা ০%। 
.
(৩৯). কোনও আয়াত নিয়ে তদাব্বুর করতে বসলে, শুধু এই আয়াতেই দৃষ্টিটা সীমাবদ্ধ না রেখে, আগের পরের আয়াতের দিকেও গভীর মনোযোগের সাথে খেয়াল রাখা উচিত! তাতে কাঙ্খিত আয়াত বুঝতে সহজ হবে। 
.
(৪০). কুরআন কারীম শুধু মুখস্থ তিলাওয়াত করলে সওয়াব আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শুধু তিলাওয়াতের জন্যে কুরআন নাযিল হয়নি। 
.
(৪১). কুরআন পাঠের সময় তাজভীদের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরী। কিন্তু তাজভীদ নিয়ে অতি ব্যস্ততা পাঠকারীকে আয়াতের অর্থ বুঝতে বাধা দেয়। 
.
(৪২). আমি শায়খ শানকীতি রহ.-কে দেখেছি, তিনি প্রতি রাতে -শীত হোক গ্রীষ্ম হোক- নির্দিষ্ট পরিমাণে তিলাওয়াত করতেন। তাহাজ্জুদে। তিনি বলতেন: রাতের নামাযে পড়া ছাড়া, কুরআন বোঝা যায় না। বুঝলেও সে বুঝ স্থায়ী হয় না। 
শায়খ আতিয়া সালেম রহ.। 
.
(৪৩). যে শিশু বা কিশোর বয়ঃপ্রাপ্তির আগেই কুরআন কারীম হিফয করে ফেলে, তাকে বাল্যকালেই আল্লাহর পক্ষ থেকে হেকমত দিয়ে দেয়া হলো 
-ইবনে আব্বাস!
এই শিশুটার মধ্যে একজন নবীর গুণাবলী চলে আসে। ঈসা আ.-কেও শৈশবে হিকমত প্রদান করা হয়েছিল। একজন শিশু যদি কুরআন হিফযের কারণে এই মর্যাদা অর্জন করতে পারে, তাহলে যে কুরআনকে তাদাব্বুর করে বোঝার চেষ্টা করে ও কুরআনের বাতলানো পথে চলতে চেষ্টা করে, তার মর্যাদা কেমন হবে? তার মর্যাদা তো আরও বহুগুণে বেশি হওয়ার কথা!
.
(৪৪). একজন আরবের স্মৃতিচারণ:
-আমি ট্রেনে করে যাচ্ছিলাম। পাশেই বসেছিলেন একজন তুর্কি ভদ্রলোক। দীর্ঘ পথযাত্রা। তিনি ব্যাগ থেকে কুরআন বের করে পড়তে শুরু করলেন। একটু পর কাদতে শুরু করলেন। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম! 
-কেন কাঁদছেন? আপনি কুরআন কারীম বোঝেন?
-জ্বি না, বুঝি না, তবুও কুরআন না বুঝে পড়লেও, মনে হয় কী যেন বুঝছি! কী যেন বুঝে যাচ্ছি! আফসোস হয়, আহা! যদি আরবীটা বুঝতে পারতাম! আচ্ছা আপনারা তো আরব, আমার সাথে কয়েকজন আরব থাকেন, তাদেরকেও কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখি, কিন্তু তারা কুরআন বোঝেন, তবুও তারা কাঁদেন না কেন?
.
(৪৫). তোমরা আমাকে এসব ছাঁইপাশ বিদাতি কথাবার্তাপূর্ণ কিতাবপত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করেছ! আমি বলছি শোন, এসব বই বর্জন করো! তোমরা সালাফের কিতাবাদি পড়! কুরআন পড়ো! আল্লাহর কিতাবে যদি তোমাদের উপদেশের জন্যে যথেষ্ট না হয়, তাহলে, এসব কিতাবে তোমাদের জন্যে গোমরাহী ছাড়া আর কিছু নেই 
-আবু যুরআ রাযী রহ.। 
.
(৪৬). কুরআন কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বারবার তাকিদ দিয়েছেন, তার কালাম দিয়েই যেন মানুষকে দাওয়াত দেয়া হয়। 
 — — (وأَنْ أَتْلُوَا) এবং আমি যেন কুরআন তিলাওয়াত করি। নামল: ৯২। 
 — — নবীজিকে আদেশ করা হয়েছে, তিনি যেন মানুষকে তিলাওয়াত করে শোনান। দাওয়াত দেন।
 — — (حَتّى يَسْمَعَ كَلامَ اللهِ) সে (বন্দী কাফের) আল্লাহর বাণী শোনা পর্যন্ত (আশ্রয় দেবে)। তাওবা ৬। 
কাফির বন্দী হলে, তাকেও কুরআন কারীম শোনানোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। যাতে তার ঈমান আনার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। 
 — — (اتْلُ ما أُوْحِيَ إِلَيْك من الكِتابِ) (হে নবী!) ওহীর মাধ্যমে আপনার প্রতি যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে, তা তিলাওয়াত করুন (আনকাবূত: ৪৫)। 
= এসব আয়াত পড়লে বোঝা যায়, কুরআন কারীমের মাধ্যমে দাওয়াত দিলে বেশি ফলপ্রসূ হয়। এবং নিছক পাঠ নয়, বুঝে বুঝে পাঠের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। 
.
(৪৭). এক যুবককে চিনি। বড় ঘরের সন্তান। ধন-সম্পদে ভরপুর। প্রাণ ও প্রাচুর্য যেন উপচে পড়ছে। পরিবারের সবাই জাগতিকভাবে উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু সে উজ্জল ব্যতিক্রম। কুরআনে হাফেয। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত। পরিবারের ভোগ-বিলাসী যিন্দেগীর কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে নি! বেশির ভাগ সময় কুরআন পড়ে। কুরআনের কথা বলে। কুরআনের দিকে দাওয়াত দেয়। যেহেতু আর্থিক চিন্তা নেই, পুরো সময়টা সে এ-কাজেই ব্যয় করতে পারে। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম:
-তুমি কিভাবে এ-পথে পা বাড়াতে পারলে? পরিবারের প্রথায় আরামের জীবন ছেড়ে?
-কিভাবে এসেছি ঠিক বলতে পারবো না! তবে আমার কাছে কিভাবে যেন কুরআনকে ভাল লেগে গিয়েছিল। আব্বু আমার জন্যে বিদেশ থেকে সুন্দর একটা কুরআন শরীফ এনেছিলেন। ওটা ছিল কারুকার্যখচিত। আব্বু ধার্মিক নন। কিন্তু তার কী মনে হয়েছিল, আল্লাহই ভালো বলতে পারবেন! সবার জন্যে দামী খেলনা এনেছেন। ব্যতিক্রমভাবে শুধু আমার জন্যেই কেন কুরআনখানা আনলেন! কুরআন শরীফ যখন কিনতে গেলেন, পাশে আরেকজন ক্রেতা ছিলেন। আব্বু দোকান থেকে বের হওয়ার উপক্রম হতেই পাশের ভদ্রলোক আব্বুকে প্রশ্ন করলেন:
-কার জন্যেকিনলেন?
-আমার ছোট্ট ছেলের জন্যে! কিনতে এসেছিলাম খেলনা! কিন্তু এত সুন্দর কুরআন শরীফ দেখে রেখে যেতে মন চাইল না! 
-বেশ করেছেন! আপনার ছেলেকে বলবেন: 
-তোমার অদেখা চাচ্চু বলেছেন, কুরআন কারীম বাইরে দেখতেই শুধু সুন্দর নয়, এর অর্থ আরও অনেক বেশি সুন্দর!
.
ব্যস! আব্বু ফিরে এসে হুবহু সেই চাচ্চুর কথা আমাকে বলেছেন। আমি আব্বুর কথা শোনার সাথে সাথে বললাম:
-আব্বু! আমি কুরআনের অর্থ শিখব!
আব্বু ভীষণ অবাক হলেন।সাথে সাথে বললেন: ঠিক আছে। তোমার দাদুর সাথে কথা বলে নিই!
এরপর আর কী, কুরআন কারীম নিয়েই আছি। 
(শায়খ আবদুর রহমান আকল)। 
.
(৪৮). বান্দা যখন খালেস নিয়তে আল্লাহর কালাম শোনে, আল্লাহ তাকে কালাম বোঝার তাওফীক দিয়ে দেন। তার কলবকে নূর দ্বারা পূর্ণ করে দেন (ইমাম কুরতুবী)। 
.
(৪৯). কুরাআন আমার পক্ষের স্বাক্ষী হবে অথবা আমার বিপক্ষের স্বাক্ষী হবে (মুসলিম)। 
القرآن حُجَّةٌ لَكَ أَو عَلَيْك
যাকে কুরআনের ইলম দান করা হয়েছে, কিন্তু সে এর দ্বারা উপকৃত হলো না, যে কুরআনের নিষেধসমূহ জানার পরও বিরত হল না, কুরআন তার বিরুদ্ধে স্বাক্ষী হবে (কুরতুবী)। 
.
(৫০). অনেকে হৃদয়ের প্রশান্তির জন্যে, চিত্তশুদ্ধির জন্যে কসীদা শোনে, গান শোনে, সামা শোনে! এ-ধরনের লোকদের কুরআনের প্রতি আগ্রহ দিনদিন কমে যায়! এক সময় কুরআনের প্রতি ঘৃণাই জন্মে যায়। মনের শান্তির জন্যে বেশি বেশি গযল শোনাও ক্ষতিকর। কুরআনের প্রতি উদাসীনতা চলে আসে। 
.
(৫১). ঈসা বিন ওয়ারদান রহ.-কে প্রশ্ন করা হল:
-দুনিয়াতে আপনার একমাত্র চাওয়া কী?
প্রশ্নটা শুনেই তিনি কেঁদে দিয়ে বললেন:
-আমার চাওয়া হলো,, আমার বক্ষটা উন্মুক্ত করে দেয়া হবে, যাতে আমি দেখতে পারি, সারাজীবন কুরআন তিলাওয়াতের কী প্রভাব সেখানে পড়েছে!
আমাদের সালাফগণ কুরআন কারীম নিয়ে এমনই বুঁদ ছিলেন। 
.
(৫২). হাদীসে আছে, কুরআন শিক্ষাকারী ও শিক্ষাদানকারী ব্যক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ। এখানে শিক্ষা বলতে শুধু শব্দশিক্ষা নয়, বরং অর্থও উদ্দেশ্য। কারণ অর্থ শিক্ষার ফলেই ঈমানের বৃদ্ধি হয়। আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. বলেছেন:
-আমরা আগে ঈমান শিখতাম তারপর কুরআন শিখতাম। ফলে আমাদের ঈমানে বৃদ্ধি ঘটতো। কিন্তু তোমরা এখন উল্টোটা করো। আগে শেখো কুরআন তারপর শেখো ঈমান। 
এজন্যই তারা একেকটা সূরা শিখতে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় লাগিয়ে দিতেন। 
.
(৫৩). কুরআন কারীমের প্রতিটি সূরা একটার সাথে আরেকটার যোগসূত্র আছে। এক আয়াতের সাথে আরেক আয়াতের সংযোগ আছে। সূরার প্রথম আয়াতের সাথে শেষ আয়াতের সংযোগ আছে। একসূরার শেষ আয়াতের সাথে পরের সূরার প্রথম আয়াতের সংযোগ আছে। এগুলো একটু চিন্তা করে করে তিলাওয়াত করলে, তাদাব্বুরটা সহজ হয়। 
.
(৫৪). আল্লামা ইকবাল রহ. শেষ জীবনে তাদাব্বুরে কুরআনের প্রতি মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করে বলতেন:
-কুরআন কারীম নিছক একটা কিতাব নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। 
.
(৫৫). কুরআন কারীমের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখে এমন আলিম বর্তমানেও অনেক আছেন। একজন আলিম, বয়ান করতে গিয়ে, একটা বিষয় প্রমাণ করতে গিয়ে, বিভিন্ন আঙ্গিকে একশটা আয়াত উপস্থাপন করেছেন। শ্রোতাদের মনে হয়েছে, তাই তো, এ-বিষয়ে এতগুলো আয়াত আছে, আমাদের কল্পনাতেই ছিল না!
.
(৫৬). মানবজীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেছেন, জান্নাতের বিস্তৃতি আসমান-জমীনের সমান। কিন্তু অনেক মানুষ এই জান্নাতে একটা কদম রাখার স্থানও পাবে না। 
.
(৫৭). কুরআন কারীমকে গানের সুরে প্রচার করার জন্যে একদল লোক উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি ইহুদি নাসারাদের পরিচালিত টিভি-রেডিওতেও এর বহুল প্রচার হচ্ছে। কারণ? তারা জানে, এই গীতালি কুরআন মৃতকে জীবিত করা তো দূরের কথা, যারা জীবিত আছে তাদেরকেও মৃত বানিয়ে ছাড়বে!
.
(৫৮). এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়, কুরআন কারীমের ব্যাখ্যায় যত সুন্দর ভাষা, যত আকর্ষণীয় শব্দই ব্যবহার করা হোক, আল্লাহর কালামের সব ‘অর্থ’ প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। বান্দার এ প্রয়াস হবে সিন্ধু থেকে বিন্দু আহরণের মতো। তাই একটা আয়াতের বাহ্যিক কিছু দিক বুঝে, সন্তুষ্ট হয়ে ভাবা ঠিক হবে না: এই আয়াতের সব বুঝে ফেলেছি। এই আয়াতে আর বোঝার কিছু বাকী নেই। এটা ভুল চিন্তা। একটা আয়াতের পুরোপুরি অর্থ অনুধাবন করতে পারা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য বাহ্যিক অর্থ বোঝার পরও একটা আয়াত নিয়ে তাদাব্বুর চালিয়ে যেতে হবে।
.
(৫৯). কুরআন কারীমে ১৩০ বার ‘কলব’ শব্দটা উল্লেখ হয়েছে। কলবের সাথে ৩৬টারও বেশি ‘আমল’ ও গুণাবলীকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এতে করে কলবের গুরুত্ব বোঝা যায়। কলবই হলো শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রাজা। মানুষ এই কলবের প্রতিই সবচেয়ে বেশি উদাসীন থাকে। কলবে পরিশুদ্ধ করার কোনও উদ্যোগ সে গ্রহণ করে না। অথচ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। এই কলবকে ঠিক করার শ্রেষ্ঠ দাওয়াই হলো: কুরআন। তিলাওয়াত ও তাদাব্বুরের মাধ্যমে। 
.
(৬০). কুরআন কারীম নাযিল করার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো:
لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
যাতে মানুষ এর (আয়াতের) মধ্যে চিন্তা করে এবং যাতে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে (সোয়াদ ২৯)। 
.
(৬১). আমার ভীষণ অবাক লাগে, কুরআন তেলাওয়াত করে, অথচ তাদাব্বুর করে না, তাহলে যে কুরআন পাঠ করে কী মজা পায়? 
-ইবনে জারীর)। 
.
(৬২). আমাদেরকে কুরআন কারীম দান করার উদ্দেশ্য হলো, আমরা কুরআন কারীম বুঝবো, বুঝ অনুযায়ী আমল করবো। যার এমন হিম্মত নেই সে প্রকৃত দ্বীনদারই নয় (সালাফ)। 
.
(৬৩). কুরআন কারীমের আলোচনা করতে গেলে তিন শ্রেণীর মানুষ বের হয়:
ক. কুরআন পাঠকে পরিত্যাগ করেছে। এদের বিরুদ্ধে নবীজি আল্লাহর কাছে অভিযোগ করেছেন।
 খ. কুরআন কারীম তিলাওয়াত করেন। তবে তাফসীর জানে না। তাদের জীবনে কুরআন কারীমের কোনও প্রভাবও দেখা যায় না। 
গ. কুরআন কারীম বোঝে। তাফসীরও বোঝে। কিন্তু তাদাব্বুর করে না। 
.
(৬৪). যে তাদাব্বুর হৃদয়কে পরিবর্তন করে না, আমল পর্যন্ত নিয়ে যায় না, তা তাদাব্বুর হতে পারে না। 
হাসান বসরী রহ. বলেছেন ইলম দুই প্রকার:
ক. কলবে বাস করে এমন ইলম। এটা উপকারী। 
গ. যবানে বা জিহ্বায় থাকে এমন ইলম। এটার জন্যে বান্দা আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হবে। 
.
(৬৫). যারা আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে, নামায আদায় করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে গোপনে ও প্রকাশ্যে, তারা এমন ব্যবসায়ের আশাবাদী, যাতে কখনও লোকসান হয় না (ফাতির ২৯)। 
إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَّن تَبُورَ
আল্লাহর কিতাব পাঠ করা লাভজনক ব্যবসা। 
 .
(৬৬). সবকিছুর যেমন প্রাণ আছে, কলবেরও প্রাণ আছে। কুরআন হলো সে প্রাণ। কুরআন কলবকে নূর হেদায়াত আদব প্রাণশক্তি সরবরাহ করে। হকের উপর অবিচলতা দান করে। অনেক আয়াতে এদিকে ইঙ্গিত আছে।
.
(৬৭). আমি মানুষের কল্যাণার্থে এসব দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকি, কিন্তু তা বোঝে কেবল তারা, যারা জ্ঞানবান (আনকাবূত ৪৩)। 
وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ
তাদাব্বুরকারীদের প্রশংসা করা হয়েছে এই আয়াতে। তাদেকে জ্ঞানী বলেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কারণ আল্লাহর বর্ণনা করা মেসাল (দৃষ্টান্ত) যে তারাই শুধু বোঝেন!
.
(৬৮). কিছু সময় একান্তে নিজের সাথে কাটাব। প্রশ্ন করবো, আমি কি তাদাব্বুর করি? এ-ব্যাপারে আমার শিথিলতা আছে? থাকলে আজ থেকে শুরু করবো। নিজে নিজে নয়। ওস্তাদের অধীনে। সালাফের রেখে যাওয়া আদর্শের উপর থেকে। 
.
(৬৯). তাদাব্বুরের জন্যে ইখলাস ও নিয়তকে বিশুদ্ধ করা জরুরী। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
-তাদেরকে কেবল এই আদেশই করা হয়েছিল যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে, আনুগত্যকে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই জন্যে খালেস রেখে (বায়্যিনা: ৫)। 
وما أمروا إلا ليعبدوا الله مخلصين له الدين حنفاء
.
(৭০). তাদাব্বুরের আগে নিয়ত করে নিতে হবে। 
 — — আমাকে যেন সরল পথে পরিচালিত করা হয়। কারণ কুরআন হলো ঈমানদারদের জন্যে হোদায়ত ও রহমত (নামল ৭৭)। 
وَإِنَّهُ لَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ
কুরআন কারীম আঁকড়ে ধরে থাকলেই আমরা সরল পথের উপর থাকতে পারবো। এটা নবীজি সা.-ও বলে গেছেন। আমি তোমাদের মাঝে দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। সে দু’টি আঁকড়ে ধরলে কিছুতেই বিচ্যুত হবে না:
ক. আল্লাহর কিতাব। 
খ. আমার সুন্নাত
تركت فيكم شيئين لن تضلوا بعدهما : كتاب الله و سنتي
.
(৭১). তাদাব্বুরের সময় নিয়ত করবো, আমি যেন আল্লাহর পরিবারভুক্ত ও খাসলোক হতে পারি:
إن لله أهلين من الناس قالوا من هم يا رسول الله قال أهل القرآن هم أهل الله وخاصته
আল্লাহর পরিবারভুক্ত বিশেষ কিছু মানুষ আছে! তারা কারা? তারা আহলে কুরআন! (আহমাদ)। 
.
(৭২). আমি কুরআন কারীম নিয়ে লেগে থাকছি, কুরআন কারীম আমার জন্যে সুপারিশকারী হয়: 
 — — তোমরা কুরআন পড়ো। কারণ কুরআন কেয়ামতের দিন তার ধারকদের জন্যে সুপারিশকারী হবে (মুসলিম)। 
اقرؤوا القرآن فإنه يأتي يوم القيامة شفيعا لأصحاب
কুরআনের তাদাব্বুর যে করে, তার চেয়ে বেশি কুরআনের ধারক আর কে হতে পারে?
.
(৭৩). তাদাব্বুরের সময় ভাবব, আল্লাহর যিকির দ্বারা আমি যেন প্রশান্তচিত্ত হতে পারি!
الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
এরা সেই সব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর যিকিরে প্রশান্তি লাভ করে। স্মরণ রেখ, কেবল আল্লাহর যিকিরই সেই জিনিস, যা দ্বারা অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয় (রা‘দ: ২৮)। 
.
(৭৪). তাদাব্বুরের সময় নিয়ত করবো, আমি যেন যাবতীয় রোগ বালাই থেকে শিফা লাভ করি। কারণ কুরআন তো আমাদের জন্যে শি‘ফা।
.
(৭৫). তাদাব্বুরের সময় নিয়ত করবো, আমি যেন আনুগত্যের উপর অবিচল থাকতে পারি:
كَذَٰلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِ فُؤَادَكَ ۖ وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلًا
(হে নবী!) আমি এরূপ করেছি এর মাধ্যমে আপনার অন্তর মজবুত রাখার জন্যে আর আমি এটা পাঠ করিয়েছি থেমে থেমে (ফুরকান ৩২)। 
.
(৭৬). তাদাব্বুরের আরেকটি মাধ্যম হলো শব্দের অর্থ বোঝা! তাদাব্বুরের জন্যে কুরআন কারীমের অর্থ বুঝতে হবে!
وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ مِن كُلِّ مَثَلٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ قُرْآنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
-বস্তুত আমি এ কুরআনে মানুষের জন্যে সব রকমের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছি, যাতে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে। এটা আরবী কুরআন, এতে কোনও বক্রতা নেই, যাতে মানুষ তাকওয়া অবলম্বন করে (যুমার: ২৭-২৮)। 
 — — আরবী না বুঝলে কিভাবে তাদাব্বুর করবে? একজন অত্যন্ত বড় আলিম বলেছেন: তিলাওয়াতের সময় কোনও আয়াত না বুঝতে পারলে, ভীষণভাবে মুষড়ে পড়ি। একজন আলিমের যদিএমন অনুভূতি হয়, আমার মতো যারা সাধারণ, তাদের কী অবস্থা হওয়া উচিত!
.
(৭৭). সাহাবায়ে কেরাম কোনও আয়াতের অর্থ বুঝতে না পারলে, থেমে যেতেন। না বুঝে সামনে অগ্রসর হতেন না। ইবনে যোবায়ের রা. বলেছেন, একটা আয়াত বুঝতে পারছিলাম না। নির্ঘুম রাত কেটে গেল। সকালে ইবনে আব্বাস রা. বুঝিয়ে দিয়েছেন। আয়তটি ছিল:
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُم بِاللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشْرِكُونَ
তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই এমন যে, তারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখলেও তা এভাবে যে, তাঁর সঙ্গে শরীক করে (ইউসুফ ১০৬)। 
.
(৭৮). তাদাব্বুর করতে বসলে:
ক. তাদাব্বুরের সময় মূল কুরআনের পাশে তরজমা ও তাফসীর আছে এমন ‘মুসহাফ’ নিয়ে বসা।
 খ. সাথে কাগজ রাখা। কোনও প্রশ্ন জাগলে সেটা টুকে রাখা। পরে জেনে নেয়ার জন্যে। 
গ. এভাবে পড়তে গিয়ে যদি একপৃষ্ঠা শেষ করতে যদি দীর্ঘ সময়ও লেগে যায় বিরক্ত না হওয়া। 
.
(৭৯). তাদাব্বুরের জন্যে একটা আয়াতকে বারবার আওড়ানো। 
তামীম দারী রা. একটা আয়াত পড়তে পড়তে পুরো রাত কাটিয়ে দিয়েছেন;
أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَنْ نَجْعَلَهُمْ كَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
যারা অসৎ কার্যাবলীতে লিপ্ত হয়েছে, তারা কি ভেবেছে আমি তাদেরকে সেই সকল লোকের সম গণ্য করব, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, ফলে তাদের জীবন ও মরণ একই রকম হয়ে যাবে? তারা যা সিদ্ধান্ত করে রেখেছে তা কতই না মন্দ (জাসিয়া: ২১)। 
 — — সালাফের অভ্যেসই ছিল এমন। তারা একটি আয়াত নিয়ে রাত ভোর করে দিয়েছেন। 
.
(৮০). কুরআন পাঠের সময় কল্পনা করা, আমি এখন ররেব কালাম পড়তে যাচ্ছি। আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব মনে হাজির রাখা। যদি পড়ার সময় তাদাব্বুরের দিকে মন না যায়, বারবার পড়তে থাকা। সায়ীদ ইবনু জোবায়ের রহ. একটা আয়াতকে বিশবারেরও বেশি পড়েছেন:
وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ
এবং তোমরা সেই দিনকে ভয় কর, যখন তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে (বাকারা: ২৮১)। 
.
(৮১). তাদাব্বুরের জন্যে তারতীরে সাথে পড়া। আলকামাহ খুব তাড়াহুড়ো করে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। ইবনে মাসউদ দেখে বললেন:
رتل فإنه زين القرآن
তারতীলের সাথে ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করো। কারণ এভাবে পড়ার মাঝেই কুরআনের সৌন্দর্য নিহিত! (বায়হাকী)। 
.
(৮২). হাফসা রা. বলেছেন: আল্লাহর রাসূল থেমে থেমে তিলাওয়াত করতেন। তার তিলাওয়াত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকতো (মুসলিম)। 
.
(৮৩) আমি কুরআনকে আলাদা আলাদা অংশ করে দিয়েছি, যাতে আপনি মানুষের সামনে থেমে থেমে পড়তে পারেন আর আমি এটা নাযিল করেছি অল্প-অল্প করে (ইসরা: ১০৬)। 
وَقُرْآنًا فَرَقْنَاهُ لِتَقْرَأَهُ عَلَى النَّاسِ عَلَىٰ مُكْثٍ وَنَزَّلْنَاهُ تَنزِيلًا
নাযিলই করা হয়েছে ধীরে ধীরে। এবং তিলাওয়াতও করতে হবে ধীরে ধীরে! থেমে থেমে!
.
(৮৪)তাদাব্বুর করতে বসলে, নিজেকে শুনিয়ে তিলাওয়াত করবো। বেশি জোরে নয় আবার। আবার ফিসফিস করেও নয়। 
-আপনি নিজের নামাজ বেশি উঁচু স্বরে পড়বেন না এবং অতি নিচু স্বরেও নয়; বরং উভয়ের মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করবেন (ইসরা: ১১০)। 
وَلَا تَجْهَرْ بِصَلَاتِكَ وَلَا تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا
.
(৮৫). হাদীস শরীফেও সুন্দর কথা আছে:
مَا أَذِنَ اللَّهُ لِشَيْءٍ مَا أَذِنَ لِنَبِيٍّ حَسَنِ الصَّوْتِ يَتَغَنَّى بِالْقُرْآنِ ، يَجْهَرُ بِهِ
নবী সুর করে জোর আওয়াজে কুরআন-পাঠ আল্লাহ তা‘আলা খুবই আগ্রহ করে শোনেন। অন্য কিছু এতটা আগ্রহের সাথে শোনেন না (মুত্তাফাক)। 
.
(৮৬). একরাতে নবীজি বের হলেন। আবু বাকরকে দেখলেন নিন্মস্বরে নামাজে কুরআন তিলাওয়াত করছেন। উমারকে দেখলেন উচ্চ আওয়াজে নামাজে তিলাওয়াত করছেন। পরে আবু বকরকে বললেন
-তোমাকে দেখলাম মৃদুস্বরে তিলাওয়াত করছ!
-যার উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করছি, তিনি তো আস্তে বললেও শোনেন!
-আর উমার! তোমাকে দেখলাম বেশ জোরে তিলাওয়াত করছ?
-ঘুমন্তদের জাগিয়ে দেয়ার জন্যে, শয়তানকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে!
-আবু বাকর তুমি আরেকটু জোরে পড়বে! উমার তুমি আরেকটু নিচু আওয়াজে পড়বে! (তিরমিযি)
.
(৮৭). তাদাব্বুরের সময় সাধ্যানুযায়ী সুরেলা কণ্ঠে কুরআন পড়া। 
নবীজি সাহাবায়ে কেরামকে সুর করে কুরআন পাঠের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। যারা সুর করে কুরআন পাঠ করতেন, তাদের প্রশংসা করতেন। 
إن من أحسن الناس صوتا بالقرآن الذي إذا سمعتموه يقرأ حسبتموه يخشى الله
-যার কুরআন পাঠ শুনলে মনে, সে আল্লাহকে ভয় করে করে পড়ছে, সেই সবচেয়ে সুন্দর তিলাওয়াতকারী (ইবনে মাজাহ)। 
.
(৮৯). তোমরা কুরআন পড়ার সময় স্বরকে সুন্দর করো (আবু দাউদ)। 
زينوا القرآن بأصواتكم 
.
(৯০). যে ব্যক্তি কুরআনকে সুন্দর করে পড়ে না, সে আমাদের দলভুক্তই নয় (মুসলিম)
ليس منا من لم يتغن بالقرآن
.
(৯১). বারা বিন আযিব রা. বলেছেন:
নবীজি ঈশার নামাজে সূরা ত্বীন পড়েছেন। তার চেয়ে সুন্দর স্বর আর কারো শুনিনি (মুত্তাফাক)। 
.
(৯২). কুরআনকে সুন্দর করে পড়লে, ভাবটা হৃদয়ে ছাপ ফেলে। গলা সুন্দর না হলেও, সাধ্যমতো সুন্দর করার চেষ্টা করা।
.
(৯৩). আবু মুসা আশ‘আরী রা.-এর কুরআন পাঠ খুবই সুন্দর ছিল। নবীজি তার প্রশংসা করে বলেছেন:
-তোমাকে দাউদী বাঁশীর সুরের কিছুটা দেয়া হয়েছে!
-ইশ! ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যদি জানতাম আপনি আমার কুরআন-পাঠ শুনছেন তাহলে আরও সুন্দর করে পড়ার চেষ্টা করতাম!
.
(৯৪). কুরআন কারীমকে সুর করে পড়া দু’প্রকার:
ক. স্বাভাবিক সুর। কৃত্রিমতা নেই। এটা প্রশংসিত। 
খ. কৃত্রিম সুর। গানের মতো করে পড়া। এটা নিন্দনীয়। 
.
(৯৫). তাদাব্বুরের জন্যে কুরআন পড়তে বসার আগে গুনাহমুক্ত হয়ে নেয়া। অহংকার হিংসা ও অন্যান্য আত্মিক রোগ থেকে শুদ্ধ হয়ে নেয়া। কারণ এগুলো হলো মরিচা। কুরআনকে কলবে প্রবেশ করতে দেয় না। কুরআন কারীমে আছে:
سَأَصْرِفُ عَنْ آيَاتِيَ الَّذِينَ يَتَكَبَّرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ
পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে, তাদেরকে আমি আমার নিদর্শনাবলী হতে বিমুখ করে রাখব (আ‘রাফ: ১৪৬)। 
মনে অহংকার থাকলে কুরআনের আলো কলবে প্রবেশ করবে না। 
.
(৯৬). ইবনে কুদামা রহ. বলেছেন:
-কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক তিনটি:
ক. গুনাহে লেগে থাকা। 
খ. অহংকার থাকা। 
গ. প্রবৃত্তির পূজারী হওয়া। 
এগুলো কলবকে জং ধরিয়ে দেয়। 
.
(৯৭). তাদাব্বুরের জন্যে কুরআন কারীমকে মুখস্থ পড়া। তাদাব্বুরের জন্যে এটা অত্যন্ত উপকারী। 
একজন দেখে পড়ে তাদাব্বুর করছে, আরেকজন মুখস্থ পড়ে তাদাব্বুর করছে, দু’জনের মধ্যে তুলনাই চলে না। মুখস্থ পড়ার মানে হলো, সে এর আগেও আয়াতটা বহুবার পড়ছে। এই আয়াতের সাথে তার সম্পর্ক অনেক পুরনো। গভীর। 
.
(৯৮). আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ
প্রকৃতপক্ষে এ কুরআন এমন নিদর্শনাবলীর সমষ্টি, যা জ্ঞানপ্রাপ্তদের অন্তরে সুষ্পষ্ট (আনকাবূত ৪৯)। 
আল্লাহর আয়াত যাদের বক্ষে ধারণ করা আছে, তাদের চেয়ে সেরা আর কে হতে পারে! 
.
(৯৯). নবীজি বলেছেন:
لا حسد إلا في اثنتين : رجل آتاه الله القرآن فهو يقوم به آناء الليل و آناء النهار
হিংসা নিন্দনীয়, তবে দু’টি ব্যাপারে হিংসা (গিবতা) চলতে পারে, তার একটি হলো:
এক ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন দান করেছেন, সে রাতে ও দিনে কুরআন পড়েধ! (তাকে এ-কাজের জন্যে ঈর্ষা করা যেতে পারে) মুসলিম। 
.
(১০০). সাহল বিন আবদুল্লাহ এক ছাত্রকে প্রশ্ন করলেন:
-তুমি কুরআন হিফজ করেছ?
-জ্বি না!
-কুরআন হিফজ করে না এমন মুমিনের জন্যে আফসোস! কুরআন হিফজ না করলে সে দিয়ে সুর করবে, আনন্দ লাভ করবে?
.
(১০১). নিজের হিফজ থেকে মুখস্থ তাদাব্বুর করার বড় সুবিধা হলো, ইচ্ছেমতো যে কোনও সময় তাদাব্বুর করতে পারা। ইচ্ছেমতো কুরআন কারীম থেকে আয়াত বের করে আনতে পারা!
হাঁ, দেখে দেখে পড়লে সওয়াব বেশি। 
প্রথমত, পড়ার ইবাদত 
দ্বিতীয়ত, কুরআন কারীমের দিকে তাকানোর ইবাদত। 
তবে আমরা বলছি তাদাব্বুরের কথা। তিলাওয়াতের কথা নয়। তাদাব্বুর মুখস্থ করাই বেশি ফলদায়ক। তবে কথা হল, আমার যদি দেখে দেখে তাদাব্বুর করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয়, তাহলে দেখে দেখে তাদাব্বুর করাই আমার জন্যে উত্তম। মুখস্থ পড়ার বাড়তি উপকার হলো, মনটা বিক্ষিপ্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকে। 
.
(১০২). তাদাব্বুরের জন্যে সহায়ক হলো, তাহাজ্জুদে কুরআন পাঠ। 
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا
অবশ্যই রাত্রিকালের জাগরণ এমনই কর্ম যা দ্বারা কঠিনভাবে প্রবৃত্তির দলন হয় এবং কথাও বলা হয় উত্তমভাবে (মুযযাম্মিল ৬)। 
.
(১০৩). রাতের গভীরে তিলাওয়াত সত্যিই প্রভাবশালী। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন:
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ ۗ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ
তবে কি (এরূপ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে,) যে রাতের মুহূর্তগুলোর ইবাদত করে,কখনও সিজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে, যে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে? বল, যে ব্যক্তি জানে আর যে জানে না উভয়ে কি সমান? (যুমার: ৯)। 
.
(১০৪). নবীজি সা. বলেছেন:
الصيام و القرآن يشفعان للعبد يوم القيامة … يقول القرآن : رب منعته النوم بالليل فشفعني فيه فيشفعان
সিয়াম ও কুরআন কেয়ামতের দিন বান্দার জন্যে সুপারিশ করবে। কুরআন বলবে: রাব্বি, আমি তাকে রাতে ঘুমুতে বাধা দিয়েছি, আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন! (আহমাদ)। 
.
(১০৫). অন্তত দু‘রাকাত হলেও তাহাজ্জুদ পড়া দরকার। ছোট্ট একটা সূরা হলেও তাদাব্বুর করে করে তিলাওয়াত করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়!
.
(১০৬). তাদাব্বুরের স্তর আছে: 
চিন্তা-ভাবনা ও শিক্ষাগ্রহণ। কুরআন কারীমের বহু আয়াতে এদিকে ইশারা আছে:
হয়তো তোমরা চিন্তা করবে (لعلكم تتفكرون)।
চিন্তাশীল কওমের জন্যে রয়েছে নিদর্শনাবলী (لآيات لقوم يتفكرون)। 
.
(১০৭). সূরা আলে ইমরানের শেষদিকের আয়াতগুলো নাযিল হলে, নবীজি কেঁদে দিয়ে বললেন;
لقد نزلت عليَّ الليلة آية، ويل لمن قرأها ولم يتفكر فيها
আজ রাতে আমার উপর একটা আয়াত (১৯০) নাযিল হয়েছে। দুর্ভোগ! যে এই আয়াত পড়বে অথচ আয়াতটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে না!
.
(১০৮). ফিকর হলো কলবের আমল। কলবের নূর হলো চিন্তা-অনুধ্যান। 
তাদাব্বুর মানে একটা আয়াত নিয়ে চিন্তা করা। আয়াতের শব্দগুলো নিয়ে ভাবা। শব্দটা কী কী অর্থ হতে পারে!
.
(১০৯). আমি তাদাব্বুর করার সময় ভাববো, আমার অবস্থার সাথে সালাফের অবস্থা তুলনা করে দেখবো। একটা আয়াতে কোনও গুণাবলীর কথা বর্ণিত হলে, সেটা আমার মধ্যে আছে কি না, যাচাই করে দেখবো। নিজেকে প্রশ্ন করবো: আমি কি প্রকৃত মুমিন? সূরা আনফালের শুরুতে বলা মুনিনের গুণাবলী কি আমার মধ্যে আছে?
.
(১১০). তাদাব্বুরের আরেকটি স্তর হলো:
কুরআন কারীম দ্বারা প্রভাবিত হওয়া ও হৃদয় বিগলিত হওয়া। 
আয়াত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও তাদাব্বুরের পর আমার কলবে কোনও প্রভাব পড়ে? আমার চিত্তের কোনও ধরনের উত্তরণ ঘটেছে? চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়েছে? মনটা নরম হয়েছে? 
.
(১১১). নবীজি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। আবু বকরকে ইমামতি করার জন্যে খবর পাঠালেন। আয়েশা রা. বললেন:
-আবু বকর কোমল হৃদয়ের মানুষ! নামায পড়াতে গেলে কান্না রোধ করতে পারবে না! (কুরআন পাঠ করতে গেলে, কান্না চলে আসবে)। 
.
(১১২). হাসান বসরী রা. বলেছেন: মিষ্টতা খোঁজ তিন বস্তুতে! সালাতে, কুরআনে ও যিকিরে। যদি মিষ্টতা পাও, ভাল কথা। নইলে জেনে রাখ তোমার জন্যে আল্লাহর রহমতের দরজা বন্ধ! খোলার ব্যবস্থা করো!
.
(১১৩). তাদাব্বুরের আরেকটি স্তর হলো:
সাড়াদান ও আনুগত্য! আমি যা পড়ছি, তা মানছি তো? আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
اتبعوا ما أنزل إليكم من ربكم
(হে মানুষ!) তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে, তার অনুসরণ কর (আ‘রাফ: ৩)। 
.
(১১৪). সাহাবায়ে কেরাম দশটা আয়াত শিখতেন। সেগুলোর উপর আমল না করে সামনে বাড়তেন না। তারা প্রতিটি আয়াত নিয়ে গভীর চিন্তা ভাবনা করতেন। 
.
(১১৫). সুফিয়ান সাওরী রহ. বরেছেন: মায়েদার ৬৮তম আয়াতটাকে আমার অত্যন্ত ভারী মনে হতো:
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّى تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ
বলে দাও, হে কিতাবীগণ! তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত তাওরাত ও ইঞ্জিল এবং (এখনও) যে কিতাব তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের উপর নাযিল করা হয়েছে, তার যথাযথ অনুসরণ না করবে, ততক্ষণ তোমাদের কোনও ভিত্তি নেই!
এ-আয়াতে যথাযথ অনুসরণ মানে ‘বোঝা ও আমল করা! আমরা কি কুরআন কারীমকে যথাযথ বুঝছি? আমল করছি?
.
(১১৬). ইবনে মুফলিহ রহ. বলেছেন:
তোমার ঘরে কুরআন কারীম আছে, আর তুমি কুরআনে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞাগুলোতে দেদারসে লিপ্ত হচ্ছো, আমার ভয় হয়, তুমি এই আয়াতের হুমকির আওতায় চলে আসো কি না!
فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ
অতঃপর তারা এ প্রতিশ্রুতিকে তাদের পেছন দিকে ছুড়ে মারে (আলে ইমরান ১৮৭)। 
.
(১১৭). আমি কুরআন পড়ি কিন্তু মানি, তাহলে আমি বড় জালিম:
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّن ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ فَأَعْرَضَ عَنْهَا وَنَسِيَ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ إِنَّا جَعَلْنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَن يَفْقَهُوهُ وَفِي آذَانِهِمْ وَقْرًا وَإِن تَدْعُهُمْ إِلَى الْهُدَىٰ فَلَن يَهْتَدُوا إِذًا أَبَدًا 
সেই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় জালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতসমূহের মাধ্যমে উপদেশ দেওয়া হলে সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং নিজ কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়? বস্তুত আমি (তাদের কৃতকর্মের কারণে) তাদের অন্তরের উপর ঘেরাটোপ লাগিয়ে দিয়েছি, যদ্দরুণ তারা এ কুরআন বুঝতে পারে না এবং তাদের কানে ছিপি এঁটে দিয়েছি। সুতরাং তুমি তাদেরকে হিদায়াতের দিকে ডাকলেও তারা কখনও সৎপথে আসবে না (কাহফ: ৫৭)। 
.
(১১৮). তাদাব্বুর করলেই হবে না, কুরআনের হুকুমকে মাথা পেতে গ্রহণ করতে হবে:
خُذُوا مَا آتَيْنَاكُم بِقُوَّةٍ وَاسْمَعُوا
আমি তোমাদেরকে যা-কিছু দিয়েছি তা শক্ত করে ধর। এবং (যা-কিছু বলা হয়, তা) শোন (বাকারা ৯৩)। 
.
(১১৯). আমরা কিভাবে কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হতে পারি? কুরআনের প্রতি গভীর আস্থা ও অনুরাগ। বিশ্বাস করা, এই কুরআন আল্লাহর কালাম। 
.
(১২০). পূত-পবিত্র গুনাহমুক্ত জীবন যাপন করা। যার কলবটা জীবন্ত সেই কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হয়। 
إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُّبِينٌ لِّيُنذِرَ مَن كَانَ حَيًّا
এটা তো এক উপদেশবাণী এবং এমন কুরআন যা সত্যকে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে। যাতে প্রত্যেক জীবিতজনকে সতর্ক করে দেয় (ইয়াসীন ৬৯-৭০)। 
.
(১২১). মনোযোগ দিয়ে কুরআন কারীম শোনা। তাহলে কলবটা নরম হবে। প্রভাবিত হবে। তাদাব্বুরটা আন্তরিক হবে।
لِنَجْعَلَهَا لَكُمْ تَذْكِرَةً وَتَعِيَهَا أُذُنٌ وَاعِيَةٌ
এই ঘটনাকে তোমাদের জন্য শিক্ষণীয় বানানোর জন্যে এবং যাতে এটা (শুনে) স্মরণ রাখে সেই কান, যা স্মরণ রাখতে সক্ষম (হাক্কাহ: ১২)। 
.
(১২২). সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা রহ. বলেছেন: 
-ইলমের সূচনা হলো শোনার মাধ্যমে। তারপর বোঝা তারপর মুখস্থ তারপর আমল তারপর প্রচার। 
আমি কোন ধাপে আছি? কুরআন কারীমকে শুধুই শুনছি? শুধুই মুখস্থ করছি? আমল করছি? প্রচার করছি?
.
(১২৩). কুরআন কারীমকে ভাল করে বুঝতে হলে ভাল করে শুনতে হবে:
والذين اجتنبوا الطاغوت أن يعبدوها وأنابوا إلى الله لهم البشرى فبشر عباد الذين يستمعون القول فيتبعون أحسنه أولئك الذين هداهم الله وأولئك هم أولو الألباب
যারা তাগুতের পূজা পরিহার করেছে ও আল্লাহর অভিমুখী হয়েছে, সুসংবাদ তাদেরই জন্য। সুতরাং আামার সেই বান্দাদেরকে সুসংবাদ শোনাও। যারা কথা শোনে মনোযোগ দিয়ে, অতঃপর তার মধ্যে যা-কিছু উত্তম তার অনুসরণ করে, তারাই এমন লোক, যাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেছেন এবং তারাই বোধশক্তিসম্পন্ন (যুমার ১৭-১৮)। 
= এ-আয়াতে মনোযোগ দিয়ে শোনার কথা বলা হয়েছে। 
.
(১২৪). আল্লাহর প্রশংসিত বান্দা কারা?
وَالَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ لَمْ يَخِرُّوا عَلَيْهَا صُمًّا وَعُمْيَانًا
এবং যখন তাদের প্রতিপালকের আয়াত দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয়, তখন তারা বধির ও অন্ধরূপে তার উপর পতিত হয় না (ফুরকান: ৭৩)। 
.
(১২৫). মনোযোগ দিয়ে শোনা মুমিনের লক্ষণ পক্ষান্তরে কাফেরের লক্ষণ?
كِتَابٌ فُصِّلَتْ آيَاتُهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِّقَوْمٍ يَعْلَمُونَ بَشِيرًا وَنَذِيرًا فَأَعْرَضَ أَكْثَرُهُمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ
আরবী কুরআনরূপে এটি এমন কিতাব, জ্ঞান অর্জনকারীদের জন্যে যার আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে। এ কুরআন সুসংবাদদাতাও এবং সতর্ককারীও বটে। তা সত্ত্বেও তাদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ফলে তারা শুনতে পায় না (ফুসসিলাত ৩-৪)। 
.
(১২৬). কাফেররা সব সময়ই কুরআনবিমুখ:
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لا تَسْمَعُوا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ
এবং কাফেররা (একে অন্যকে) বলে, এই কুরআন শুনো না এবং এর (পাঠের) মাঝে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা জয়ী থাক (ফুসসিলাত: ২৬)। 
.
(১২৭). না শোনার মানসিকতার অধিকারীকে আল্লাহ হুমকি দিয়েছেন:
وَيْلٌ لِّكُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ يَسْمَعُ آيَاتِ اللَّهِ تُتْلَى عَلَيْهِ ثُمَّ يُصِرُّ مُسْتَكْبِرًا كَأَن لَّمْ يَسْمَعْهَا فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ 
দুর্গতি হোক প্রত্যেক এমন মিথ্যুক পাপিষ্ঠের- যে আল্লাহর আয়াতসমূহ শোনে, যখন তাকে পড়ে শোনানো হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে ঔদ্ধত্যের সাথে এমনভাবে (কুফরের উপর) অটল থাকে, যেন আয়াতসমূহ শোনেইনি। সুতরাং এমন ব্যক্তিকে যন্ত্রণাময় শাস্তির সুসংবাদ শোনাও (জাসিয়া: ৭-৮)। 
.
(১২৮). তারা আল্লাহর আয়াত না শোনার কারণে অচিরেই অনুতপ্ত হবে। কিন্তু সেটা তাদের কোনও কাজে আসবে না:
وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ فَاعْتَرَفُوا بِذَنبِهِمْ 
এবং তারা বলবে, আমরা যদি শুনতাম এবং বুদ্ধিকে কাজে লাগাতাম, তবে (আজ) আমরা জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম না। এভাবে তারা নিজেরা নিজেদের গোনাহ স্বীকার করবে (মুলক ১০-১১)। 
.
(২৯). কুরআন কারীমকে উপেক্ষা করার মতো বড় পাপ আর হতে পারে না:
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّن ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ ثُمَّ أَعْرَضَ عَنْهَا ۚ إِنَّا مِنَ الْمُجْرِمِينَ مُنتَقِمُونَ 
সেই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় জালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতসমূহ দ্বারা নসীহত করা হলে সে তা হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমি অবশ্যই এরূপ জালেমদের থেকে বদলা নিয়ে ছাড়ব (সাজদা ২২)। 
.
(১৩০). আল্লাহ আমার ডাকে কখন সাড়া দেবেন?
إِنَّمَا يَسْتَجِيبُ الَّذِينَ يَسْمَعُونَ
কথা তো কেবল তারাই মানতে পারে, যারা (সত্যের আকাঙ্খী হয়ে) শোনে (আনআম :৩৬)। 
 — — — সত্যের অন্বেষী হয়ে শুনলে, উপকৃত হবেই। 
.
(১৩১). আমি যদি মুমিন হই, তাহলে কুরআন আমার জন্যে। আমাকে মনে করতে হবে, কুরআন আমাকেই সম্বোধন করছে:
لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ ۗ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَىٰ وَلَٰكِن تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
নিশ্চয়ই তাদের ঘটনায় বোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যে শিক্ষা গ্রহণের উপাদান রয়েছে। এটা এমন কোনও বাণী নয়, যা মিছামিছি গড়ে নেয়া হয়েছে। বরং এটা এর পূর্ববর্তীদের কিতাবসমূহের সমর্থক, সবকিছুর বিশদ বিবরণ এবং যারা ঈমান আনে তাদের জন্যে হিদায়াত ও রহমতের উপকরণ (ইউসুফ: ১১১)। 
.
(১৩২). ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন:
কুরআন তিলাওয়াতকালে যখনই তুমি দেখবে
হে মুমিনগণ! (يا أيها الذين آمنوا)! 
তুমি পরিপূর্ণ সজাগ হয়ে যাবে। সামনে কী বিধান আসছে সেটার গ্রহণ করার জন্যে। আদেশ হলে মেনে নিবে। নিষেধ হলে বিরত থাকবে। 
.
(১৩৩). ইবনে কুদামাহ বলেছেন: 
-কুরআন পাঠকারীর জানা উচিত, কুরআনের সম্বোধনের উদ্দেশ্য কী? হুমকিগুলোর উদ্দেশ্য কী? কুরআনের গল্পগুলো নিছক সময় কাটানোর জন্যে বিবৃত হয় নি। শিক্ষাগ্রহণ করার জন্যে বর্ণিত হয়েছে। মনে করবে, আমি দাস, মনিবের পক্ষ থেকে চিঠি এসেছে। সেটা পড়ছি। 
.
(১৩৪). ইমাম গাযালী বলেছেন: 
-ভয়ের আয়াত পড়ার সময় এমন ভান করতে হবে, যেন ভয়ে মরে যাচ্ছি। আনন্দের আয়াত এলে এমন ভাব করতে হবে, যেন আনন্দে আকাশে উড়ছি! আল্লাহর গুণাবলীর আয়াত এলে মাথা নিচু করে দিতে হবে। আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ। কাফেরদের বৈশিষ্ট্য এলে, লজ্জার ভান করে আওয়াজ নিচু করে ফেলতে হবে। যেন তাদের এহেন কর্মকা-ে আমারও মাথা কাটা যাচ্ছে। 
.
(১৩৫). প্রতিটি আয়াতেই আমি থামব। ভাবব। মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হলে, চিন্তা করে দেখব, আমি কি গুণের অধিকারী? কাফির বা মন্দলোকদের বৈশিষ্ট্য হলে চিন্তা করবো, আমি নইতো! আল্লাহর বড়ত্বের বর্ণনা হলে, চিন্তা করব, আমি কি তা অনুভব করতে পারছি? আমার মনে কি গাইরুল্লাহর প্রতি ভালবাসা আছে?
.
(১৩৬). কুরআন তাদাব্বুরের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধক হলো, তাজভীদের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ! তাজভীদের সূক্ষèাতিসূক্ষè ভুল বের করার প্রয়াস চালানো। হরফের মাখরাজের দিকে অতিরিক্ত নজর দিলে হরফের অর্থ বের হবে না। এ-ধরনের পড়া শয়তানের হাসির খোরাক হবে। এটা ঠিক, তাজভীদ অত্যন্ত জরুরী বিষয়। তাজভীদ কুরআন পাঠের অলংকার। তাজভীদ ঠিক করে পড়তে না পারলে গুনাহগার হবে। কিন্তু এটাই কুরআনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। তাজভীদ হলো মাধ্যম। তাদাব্বুরের স্তরে পৌঁছার সেতু। কুরআন পাঠের সময় শয়তানের াএকটা শক্তিশালী অস্ত্র হলো, সে তিলাওয়াতকারীর মনে দ্বিধা ঢুকিয়ে দেয়: হরফটা বোধ হয় সঠিকভাবে আদায় করা হয়নি! আবার শুদ্ধ করে পড়ি! হরফ শুদ্ধ করার দিকে তার মনোযোগ ফিরিয়ে, অর্থের দিক থেকে তার মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়। 
.
(১৩৭). ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন: 
-এক জমানা আসবে, ফকীহ কম হবে ক্বারী বেশি হবে। কুরআন কারীমের হরফ মুখস্থ করা হবে, কিন্তু তার বিধি-বিধান অবহেলিত থাকবে!
.
(১৩৮). তাদাব্বুরের আরেকটি প্রতিবন্ধক হলো:
-কুরআন দ্বারা নিছক শিফা বা আরোগ্য লাভ করার নিয়ত করা। 
 কিছু মানুষ কুরআন কারীমকে হোমিও-এলোপ্যাথির দোকান বানিয়ে রাখে। তারা মনে করে রোগ-বালাই থেকে শেফা দেয়ার জন্যেই কুরআন নাযিল হয়েছে। এটা ঠিক, কুরআন শারীরিক-মানসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক সব ধরনের রোগ ভালো করার ক্ষমতা রাখে। তাই বলে আরোগ্য দান করাই কুরআনের প্রধান উদ্দেশ্য নয়। 
.
(১৩৯). তিলাওয়াত করতে গিয়ে আল্লাহর নামগুলো সামনে পড়লেই থমকে গিয়ে ভাবা, এখানে অন্য নাম না এনে ঠিক এই নামই কেন আনা হল?
.
(১৪০). কোত্থেকে তাদাব্বুর শুরু করবো? উমার রা. বলেছেন:
-তোমরা যদি কুরআন শিখতে চাও, ‘মুফাসসাল’ সুরা থেকে শুরু করো। কারন এগুলো ছোট ও সহজ। 
.
(১৪১). ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন:
-নবীজি সা. যখন ইন্তেকাল করেন, তখন আমি দশ বছরের বালক। আমি সবে মুহকাম ও মুফাসসাল সূরাগুলো পড়ে শেষ করেছি। 
মুফাসসাল সূরা হলো: সূরা ক্বফ থেকে নাস পর্যন্ত। এ-সূরাগুলো দিয়ে পাঠ শুরু করার বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে:
ক. কলবে ঈমান পোক্ত হয়। কারণ এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে উপদেশমূলক আয়াত আছে। 
খ. ছোট ছোট আয়াত হওয়াতে বোঝার ক্ষেত্রেও সহায়ক। এসব আয়াতে শরীয়তের বিধিবিধানও খুব একটা নেই। বেশির ভাগই জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা। নবী-রাসূলগণের ঘটনা। 
গ. আল্লাহর পরিচয়মূলক আয়াত আছে। আল্লাহর প্রতি ঈমানের কথা আছে। 
ঘ. রাসূলের ঈমানের কথা আছে। 
.
(১৪২). তারা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তা করে না, নাকি অন্তরে লেগে আছে সেই তালা, যা অন্তরে লেগে থাকে? (মুহাম্মাদ: ২৪)। 
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
ক. এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, কুরআন কারীম নিয়ে তাদাব্বুর করা ওয়াজিব (ইমাম শাওকানী)। 
খ. তাদাব্বুর ছেড়ে দেয়ার অর্থ কুরআনকে ছেড়ে দেয়া (ইবনে কাসীর)। 
গ. আমরা তাদাব্বুর কেন করবো তার উদ্দেশ্যও এই আয়াত থেকে বের করতে পারি। 
ঘ. তালাবদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী হৃদয়ের মানুষরা তাদাব্বুর থেকে বিমুখ থাকে। 
ঙ. পরোক্ষভাবে মুনাফিকদের নিন্দা করা হয়েছে। কারণ তারা কুরআনের তাদাব্বুরকে উপেক্ষা করে থাকে। 
.
(১৪৩). (হে রাসূল!) এটি এক বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর (আয়াতের) মধ্যে চিন্তা করে এবং যাতে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে (সোয়াদ: ২৯)। 
كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
অর্থাৎ: হে মুহাম্মাদ! আপনার কওমের মধ্য হতে যাদের প্রতি আমি এই কুরআন নাযিল করেছি, তারা যেন ‘তাদাব্বুর’ করে (তাবারী)। 
.
(১৪৪). যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা যখন তা সেভাবে তিলাওয়াত করে, যেভাবে তিলাওয়াত করা উচিত তখন তারাই তার প্রতি (প্রকৃত) ঈমান রাখে (বাকারা: ১২১)। 
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَٰئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ
যথার্থ তিলাওয়াত (حَقَّ تِلَاوَتِهِ) মানে? মুফাসসিরীনগণ বলেছেন, এর অর্থ ‘তাদাব্বুর’ করা ও সে অনুযায়ী আমল করা। 
.
(১৪৫). এবং ধীর-স্থিরভাবে স্পষ্টরূপে কুরআন তিলাওয়াত কর
وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلا
ক. এভাবে তিলাওয়াত করলে, কুরআন কারীম বুঝতে ও তাদাব্বুর করতে সহায়ক হবে (ইবনে কাসীর)। 
খ. ধীরে ধীরে তাদাব্বুরের সাথে পড়তে থাক (শাওকানী)। 
.
(১৪৬). আল্লাহ কারও উপর সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব অর্পণ করেন না (বাকারা: ২৮৬)। 
لا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلا وُسْعَهَا
কুরআনের বিধি-বিধান বোঝা যদি আমাদের সাধ্যের বাইরে হতো, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাদাব্বুরের হুকুম দিতেন না (ইবনে হাযম)। 
.
(১৪৭). আল্লাহ তা‘আলা যাকে কল্যাণ দান করতে চান, তাকে দ্বীনের ‘তাফাক্কুহ’ (গভীর বুঝ) দান করেন (মুত্তাফাক)। 
من يرد الله به خيراً يفقه في الدين
ওলামায়ে কেরাম বলেছেন: দ্বীনের ‘ফিকহ’-গভীর জ্ঞান হাসিলের সবচেয়ে বড় উপায় হলো, কুরআন কারীমের তাদাব্বুর। 
.
(১৪৮). সাহাবায়ে কেরামের কুরআনি তাদাব্বুর ছিল ভিন্নধর্মী। তারা কতোটা মনোযোগ দিয়ে কুরআনের তাদাব্বুর করতেন, উমার রা. এর ঘটনা তার স্বাক্ষী। তিনি বারো বছর সময় ব্যয় করে সূরা বাকারা শিখেছেন। শেষ হওয়ার পর, আনন্দে উট যবেহ করেছেন (বায়হাকী)। 
.
(১৪৯). আমরা তাফসীর বা তাদাব্বুরে বসলেও কত দ্রুত একেকটা সূরা শেষ হয়ে যায়। আমাদের তাদাব্বুর মানে ‘তরজমা’। বেশির চেয়ে বেশি সামান্য তাফসীর। ইবনে উমার রা. সূরা বাকারা নিয়ে আট বছর পড়ে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়টা তিনি সূরাটা শেখার পেছনে ব্যয় করেছেন (মুয়াত্তা)। 
.
(১৫০). উমার রা. নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করতেন। কোনও কোনও আয়াতের তাদাব্বুর তাকে ভীষণ বিহ্বল করে তুলতো। কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতো। কান্নার জন্যে দীর্ঘ সময় ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। লোকজন মনে করতো তিনি অসুস্থ। সবাই দেখতে আসতো!
.
(১৫১). আমি সূরা ফাতিহা থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত তিন তিনবার পড়ে শুনিয়েছি ইবনে আব্বাস রা.-কে। প্রতিটি আয়াত পড়া শেষ হলে থেমে আমি তাকে প্রশ্ন করেছি। আয়াতটা সম্পর্কে তার কাছ থেকে ইলম হাসিল করেছি
 — — মুজাহিদ রহ.)। 
.
(১৫২). হিজরী চতুর্থ হিজরীর বিখ্যাত বুযুর্গ, আবুল আব্বাস বিন আতা রহ.। বেশি বেশি কুরআন খতম করতেন। একটা খতম শুরু করেছিলেন তাদাব্বুর করে করে শেষ করবেন। দশ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। খতম শেষ করার আগেই মালাকুল মাউত এসে হাজির হয়ে গেছেন। 
.
(১৫৩). কুরআন তিলাওয়াত করার সময় মনোযোগটা ধরে রাখা। অর্থের দিকে খেয়াল করে করে তিলাওয়াত করা। কুরআন কারীম থেকে কিছু আহরণের চেষ্টা করা। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন:
-যে ব্যক্তি হেদায়াতের প্রত্যাশী হয়ে কুরআনের তাদাব্বুরে নিয়োজিত হবে, তার সামনে হকের রাস্তা খুলে যাবে। 
.
(১৫৪). তাদাব্বুর-তাফাক্কুর ছাড়া গড়গড় করে বেশি পরিমাণে তিলাওয়াত করা যায়। কিন্তু তাদাব্বুর ও গভীর চিন্তাভাবনা করে অল্প তিলাওয়াত করা আমার কাছে বেশি প্রিয়। 
-ইমাম আ-জুররি)। 
.
(১৫৫). তাদাব্বুর ও তাফাক্কুরের সাথে তিলাওয়াত করা সুন্নাত। এটাই কুরআন তিলাওয়াতের অন্যতম প্রদান ও গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাদাব্বুরমাখা তিলাওয়াতের মাধ্যমে বক্ষটা হেদায়াতের জন্যে প্রস্তুত হয়। হৃদয়টা রব্বানী নূরে নূরান্বিত হয় 
(আল্লামা সুয়ূতী)। 
.
(১৫৬). যার মধ্যে ইলম নেই, ফাহম নেই, তাকওয়া নেই, তাদাব্বুর নেই, সে কুরআনের কোনও স্বাদই পায় না
(ইমাম যারকাশী)। 
.
(১৫৭). কুরআনের ইলম হলো শ্রেষ্ঠ ইলম। সুতরাং কুরআনের বুঝ (ফাহম)-ই হলো শ্রেষ্ঠ বুঝ 
(ইবনুল জাওযী)। 
.
(১৫৮). কুরআনের তাদাব্বুর ছেড়ে দেয়া, কুরআনের অর্থ বোঝার চেষ্টা না করা, কুরআন সম্পর্কে জানাশোনা বাড়ানোর প্রতি আগ্রহী না হওয়াও একপ্রকার (هجر) বা কুরআন-ত্যাগ (ইবনুল কাইয়িম)। 
.
(১৫৯). কুরআন কারীমের তাদাব্বুর যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাবিকাঠি। এর মাধ্যমেই সমস্ত কল্যান লাভ হয়। এর মাধ্যমেই যাবতীয় ইলম আহরিত হয়। এর মাধ্যমেই ঈমান বৃদ্ধি পায়। ঈমানী বৃক্ষের শেকড় গভীরে প্রোথিত হয় 
(আল্লামা সা‘দী)। 
.
(১৬০). কুরআনের তাদাব্বুর করা তোমার জন্যে অপরিহার্য। কুরআন কারীমের অর্থ বোঝা পর্যন্ত তোমাকে এটা চালিয়ে যেতে হবে। কুরআন কারীম আগাগোড়া পড়তে থাকো তাদাব্বুরের সাথে। আগ্রহ নিয়ে। আমলের নিয়তে 
(শায়খ বায)। 
.
(১৬১). যে ব্যক্তি কুরআনের তাদাব্বুর করবে এবং বেশি বেশি তিলাওয়াত করবে, সে ব্যক্তি লাভবানদের গুণাবলী কী কী তা জানতে পারবে। ক্ষতিগ্রস্তদের গুণাবলী কী কী তাও সে বিস্তারিত জানতে পারবে 
(ইবনে বায)। 
.
(১৬২). তোমাদের প্রত্যেক এমন ব্যক্তিকে (সতর্ক করছে), যে অগ্রগামী হতে বা পিছিয়ে পড়তে চায় (মুদ্দাসসির: ৩৭)। 
لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَتَقَدَّمَ أَوْ يَتَأَخَّرَ 
এই আয়াতটা তাদাব্বুর করে দেখ। তোমার সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে, কোনও অবস্থাতেই থেমে পড়া যাবে না। সর্বাবস্থাতেই নিজের ঈমানের খোঁজ-খবর রাখতে হবে। আমলের প্রতি নজর রাখতে হবে। পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রতিটি মুহূর্তেই! 
(শায়খ নাসের উমর)। 
এটাই কুরআনী আয়াত তাদাব্বুরের ফায়েদা। আমাকে সচেতন করিয়ে দেবে। আমার ভুলগুলো ভাঙিয়ে দেবে। আমাকে জাগিয়ে রাখবে। 
.
(১৬৩). হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আল্লাহর সঙ্গে তাকওয়ার নীতি অবলম্বন কর, তবে তিনি তোমাদেরকে (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে) পার্থক্য করার শক্তি দেবেন (আনফাল: ২৯)। 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَتَّقُوا اللَّهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا
সত্য আর মিথ্যা পার্থক্য করা সহজ কাজ নয়। বর্তমানে মিথ্যা আসে নানামুখী রূপ নিয়ে। নিরূপণ করা কঠিন কোনটা হক আর কোনটা বাতিল! এই দুর্যোগে প্রকৃত ফুরকানই পারে আামাদের পথ দেখাতে। কুরআনই সেই ফুরকান। পথ দেখতে হলে তাদাব্বুর করতেই হবে। 
.
(১৬৪). তোমাদের প্রতি আল্লাহর ফযল ও রহমত না হলে তোমাদের মধ্যে কেউ কখনও পাক-পবিত্র হতে পারত না (নূর ২১)। 
وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ مَا زَكَىٰ مِنكُم مِّنْ أَحَدٍ أَبَدًا
বান্দার প্রতি আল্লাহর অন্যতম রহমত ও ফযল কী? আল্লাহর কালামের তিলাওয়াত ও তাদাব্বুর।
.
(১৬৫). তিনি তো রহমানই, যিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন (রহমান: ১-২)। 
الرحمن علم القرآن
তার মানে কুরআন শিক্ষা দেয়াটাও আল্লাহর বড় এক রহমত। কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর করা, কুরআন বোঝার জন্যে কিতাবাদি পড়া, কুরআনী রহস্য উদঘাটনের জন্যে সময় ব্যয় করা, রহমতেরই বহিঃপ্রকাশ। 
.
(১৬৬). আল্লাহর যদি জানা থাকত তাদের মধ্যে কোন কল্যাণ আছে, তবে তিনি তাদেরকে অবশ্যই শোনার তাওফীক দিতেন (আনফাল: ২৩)। 
ولو علم الله فيهم خيراً لأسمعهم
কুরআন কারীমের তাদাব্বুর না করার কারণ এই নয় তো, আল্লাহ আমাকে এই নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করেছেন! তাদাব্বুর না করা, কুরআন কারীমের অর্থ বোঝার জন্যে চেষ্টা না করার পরিণতি কি হতে পারে, এই আয়াতের দিকে খেয়াল করলে, কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে!
.
(১৬৭). যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত হয় (আ‘রাফ: ২০৪)। 
وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون
আল্লাহর রহমত, অন্তরে প্রশান্তি, সৌভাগ্য ও ঈমানের উপর অবিচলতা, রোগমুক্তি আসতে পারে, কুরআন কারীমের তিলাওয়াত মনোযোগ দিয়ে তাদাব্বুরের সাথে শোনার মাধ্যমে। 
.
(১৬৮). আল্লাহর কিতাবের তাদাব্বুরের মাধ্যমে বান্দার ঈমান বৃদ্ধি পায়। আল্লাহর দরবারে তার মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। কুরআনের সাথে একজন মুমিনের সম্পর্ক যত গভীর হয়, মজবুত হয়, ততই রবের প্রতি তার ইয়াকীন ও আস্থা বাড়তে থাকে। 
.
(১৬৯). কুরআন তাদাব্বুর করতে হলে, আগে কলবে কিছু বিষয়কে স্থান দিতে হবে: কুরআন কারীমের মহব্বত, তিলাওয়াতের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, আমলের প্রতি দৃঢ় বাসনা। তাহলে আল্লাহ তা‘আলা আমার সামনে তার কুরআনি নেয়ামতের ভা-ার খুলে দিবেন। কুরআনের রহস্যের দ্বার উন্মোচিত করতে থাকবেন। 
.
(১৭০). তাদাব্বুরের সাথে পড়লে আমরা দেখতে পাব, সূরা কাহফে ফিতনা থেকে বাঁচার চারটা উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। দ্বীনের ফিতনা। মালের ফিতনা। ইলমের ফিতনা। রাজত্বের ফিতনা। 
.
(১৭১). সূরা ক্বফ শুরু হয়েছে:
ق والقرآن المجيد
কাফ, কুরআন মাজীদের কসম!
আর সূরা ক্বফ শেষ হয়েছে:
فذكر بالقرآن من يخاف وعيد
আমার সতর্কবাণীকে ভয় করে এমন প্রত্যেককে আপনি কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দিতে থাকুন!
এই সূরারই এক জায়গায় আছে:
إن في ذلك لذكرى لمن كان له قلب أو ألقى السمع وهو شهيد
নিশ্চয়ই এর ভেতর এমন ব্যক্তির জন্যে উপদেশ রয়েছে, যার আছে অন্তর কিংবা যে মনোযোগ দিয়ে কর্ণপাত করে (৩৭)। 
= আমরা উপদেশ গ্রহণ করতে হলে, তাদাব্বুর করতে হবে। কুরআন কারীমের বাণীর অর্থ উদ্ধারে গভীর অনুধ্যান করতে হবে। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কুরআন কারীম থেকে উপকৃত হওয়ার জন্যে দু’টি শর্ত:
ক. জীবন্ত উন্মুখ হৃদয়!
খ. জাগ্রত মস্তিষ্ক!
আমাকে মনে রাখতে হবে, আমি যে তেলাওয়াত করছি, তা আল্লাহ তা‘আলা খোদ শুনছেন। ইবনে কুতাইবা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন:
-অর্থাৎ সে আল্লাহর কিতাব শ্রবণ করেছে সজাগ মনোযোগের সাথে, বোঝার সুতীব্র ইচ্ছা নিয়ে, অচেতন গাফেল হয়ে নয়। এ-আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, আল্লাহর কালামকে গুরুত্ব দিয়ে না শুনলে, না পড়লে এর প্রভাব অন্তরে পড়বে না।
.
(১৭২). কুখ্যাত কুরাইশ নেতা, ওলীদ বিন মুগীরাহ। ঈমান নসীব হয়নি, কিন্তু কুরআনের সমঝদার। কুরআনের বিরোধিতা করতে এসে, কুরআন সম্পর্কে এক অবিস্মরণীয় উক্তি করে গেছে এই লোক:
إن له حلاوة وإن عليه لطلاوة وإن أسفله لمورق وإن أعلاه لمثمر وإنه ليعلو ولا يعلا عليه
-কুরআনের মধ্যে রয়েছে অন্য রকমের মিষ্টতা। কুরআনের বাহ্যিক রূপে আছে মনোহারিত্ব-লাবণ্য। কুরআনের উপরিভাগ ফলভারানত নিম্œভাগ পত্রপল্লবশোভিত! কুরআন বিজয়ী হয়, তার উপর জয়ী হওয়া যায় না। 
= একজন কাফের হয়ে কুরআনকে এভাবে বুঝল! কুরআনের চমৎকারিত্বকে এভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারল, আমরা মুসলমান হয়ে কী করছি?
.
(১৭৩). ইসলাম গ্রহণের আগে, জুবাইর ইবনু মুতঈম রা. যখন নবীজি সা.-এর মুখ থেকে কুরআন কারীমের তিলাওয়াত শুনলেন, তখনকার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন:
-আমার হৃদয়টা উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল (كاد قلبي أن يطير)!
তিনি কী এমন পেয়েছিলেন কুরআনের মধ্যে, আশায় আনন্দে তার মনটা উড়–উড়– হয়ে গিয়েছিল! অথবা অপার্থিব এক অনুভূতি তার হৃদয়জুড়ে ছেয়ে গিয়েছিল! তিনি (তখনো) একজন কাফের! তা সত্ত্বেও এমন নিখাদ আলোর ঝলক কিভাবে টের পেলেন! আমরা জন্মসূত্রে মুসলমান হয়ে দীর্ঘদিন কুরআনের সাথে জীবনযাপন করার পরও কেন এর ছিঁটেফোঁটা ‘ঝলক’ টের পাই না!
.
(১৭৪). জ্বিনেরা কুরআন কারীমকে প্রথম বার শুনেই কিভাবে এর মাহাত্ম্য টের পেয়ে গেলো? স্বগতোক্তি করে উঠলো:
إنّا يسمعنا قرآناً عجبا
আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শুনে এসেছি (জ্বিন)!
আমাদের এমন বোধ জাগে না কেন? আমরা উঠতে বসতেই কুরআন দেখি, কুরআন শুনি তবুও?
.
(১৭৫). কুরআন তাদাব্বুর বলতে আমরা বুঝি:
ক. কুরআন কারীমের শব্দগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করা। এই চেষ্টার ফলে জীবনে আসে এক ইতিবাচক প্রভাব। আচরণে আসে অন্য রকম এক পরিবর্তনের ছোঁয়া। 
খ. আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এই আয়াতে কী বলতে চেয়েছেন, তা বোঝার চেষ্টা করা। আগের ও পরের আয়াতগুলোর সাথে সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করা। 
গ. আয়াতে সুসংবাদ থাকলে মনে খুশি খুশি ভাব ফুটিয়ে তোলা। দুঃসংবাদ থাকলে মনে ভীতাবস্থা সৃষ্টি করা। পূর্বেকার জাতিসমূহের ঘটনা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা। 
ঘ. কুরআনের সমস্ত কথাকে মনেপ্রাণে ইয়াকীন করা। সমস্ত আদেশকে মাথা পেতে নেয়া। যাবতীয় নিষেধাজ্ঞাকে মুখ বুজে মেনে নেয়া। 
.
(১৭৬). মুমিন তো তারাই, যাদের সামনে আল্লাহকে স্মরণ করা হলে, তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে (আনফাল: ২)। 
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا
যারা তাদাব্বুর করে, কুরআন কারীম দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাদের প্রশংসা করেছেন আল্লাহ তা‘আলা। 
.
(১৭৭). কুরআনের তাদাব্বুর ছেড়ে অহংকারের আলামত:
-এরূপ ব্যক্তির সামনে যখন আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে তা শুনতেই পায়নি, যেন তার কান দু’টিতে বধিরতা আছে (লুকমান: ৭)। 
وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِ آيَاتُنَا وَلَّىٰ مُسْتَكْبِرًا كَأَنْ لَمْ يَسْمَعْهَا كَأَنَّ فِي أُذُنَيْهِ وَقْرًا
শুধু তাদাব্বুরই তারা বর্জন করে না, তাদের কানেও সমস্যা। কুরআনের আয়াত তারা শোনে সত্য কিন্তু কোনও আবেদন সৃষ্টি করে না। এটাকেই আল্লাহ তা‘আলা বধিরতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। 
.
(১৭৮). তাদাব্বুর ছেড়ে দেয়ার ভীতিকর দিক হলো, মানুষ নগন্য জড় পদার্থের চেয়েও হীন হয়ে পড়া:
-আমি যদি এ কুরআনকে অবতীর্ণ করতাম কোনও পাহাড়ের উপর, তবে তুমি দেখতে তা আল্লাহর ভয়ে অবনত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে (হাশর ২১)। 
لَوْ أَنزَلْنَا هَٰذَا الْقُرْآنَ عَلَىٰ جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّهِ
বাক-বুদ্ধিহীন একটা পাহাড়ও কুরআনের ভয়ে বেসামাল হয়ে ওঠে! আর আমরা মানুষেরা!
.
(১৭৯). যাদের উপর তাওরাতের ভার অর্পণ করা হয়েছিল, অতঃপর তারা সে ভার বহন করতে পারেনি, তাদের দৃষ্টান্ত হল গাধা, যে বহু কিতাব বয়ে রেখেছে (জুমু‘আ: ৫)। 
مَثَلُ الَّذِينَ حُمِّلُوا التَّوْرَاةَ ثُمَّ لَمْ يَحْمِلُوهَا كَمَثَلِ الْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَاراً
এ-আয়াতে তাওরাতের কথা বলা হলেও, পরোক্ষভাবে কুরআন কারীমও প্রসঙ্গক্রমে আলোচিত হয়েছে। যারা কুরআন কারীম শুধু মুখস্থ পড়ে, আমল করে না, তারাও গাধার মতো। 
.
(১৮০). খারেজীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো:
يقرؤون القرآن لايجاوزر حناجرهم
তারা কুরআন পড়বে সত্য কিন্তু তার শিক্ষা তাদের গলা দিয়ে নামবে না (মুসলিম)। 
তারা কুরআনের যথাযথ তাদাব্বুর করে না। কুরআনের হেদায়াত গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। মনগড়া ব্যখ্যা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট। 
.
(১৮১). কুরআন কারীমকে পরিত্যাগ করার শাস্তি ভয়াবহ। স্বয়ং নবীজি এমন লোকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করেছেন:
يارب إن قومي اتخذوا هذا القرآن مهجورا
ইয়া রাব! আমার সম্প্রদায় এ কুরআনকে বিলকুল পরিত্যাগ করেছিল (ফুরকান: ৩০)। 
পরিত্যাগ করা বলতে, কুরআনের প্রতি ঈমান এনেছে , কুরআন পড়েছে কিন্তু তাদাব্বুর করেনি। নিদেনপক্ষে কুরআন অনুযায়ী আমল করেনি। কুরআনের হালাল-হারাম মেনে চলেনি। 
.
(১৮২). তাদাব্বুর মানে? ইলম অর্জনের জন্যে কুরআন পাঠ করা। ইলম মানে? আল্লাহকে চেনা। তার সম্পর্কে জানা। আল্লাহ সম্পর্কে প্রকৃত ইলম আমাকে ইস্তেগফার-অভিমুখী করে তুলবে। 
.
(১৮৩). আল্লাহর ভয়ই প্রকৃত ইলম। আল্লাহ সম্পর্কে ধোঁকাগ্রস্ত হওয়াই প্রকৃত অজ্ঞতা 
(ইবনে মাসউদ রা.)। 
.
(১৮৪). তোমরা ইলম হাসিল করতে চাইলে এই কুরআন ঘেঁটে দেখ, কারণ তাতেই আছে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের যাবতীয় ইলম 
(ইবনে মাসউদ)। 
.
(১৮৫). তোমাদের পূর্বে যারা বিগত হয়েছেন, তারা কুরআন কারীমকে মনে করতেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা চিঠি। তারা রাতের আঁধারে কুরআনের তাদাব্বুর করতেন। দিনের আলোতে কুরআনের বাস্তবায়নে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তার ইলম অন্বেষণে ব্যপৃত রাখতেন 
(হাসান বিন আলি রা.)। 
.
(১৮৬). তোমরা কুরআনকে আঁকড়ে ধর। কুরআন শেখো। তোমাদের সন্তানদেরকে কুরআন শিক্ষা দাও। কারণ তোমাদেরকে এ-ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে। এবং এজন্য তোমাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। জ্ঞানীদের জন্যে উপদেশদাতা হিশেবে কুরআনই যথেষ্ট 
(ইবনে উমার রা.)। 
.
(১৮৭). আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি আয়াত কেন নাযিল করেছেন, সেটা শিক্ষা দিতে ভালবাসেন। তিনি চান বান্দা প্রতিটি আয়াত পড়ে পড়ে তার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করুক 
(হাসান বসরী)। 
.
(১৮৮). তোমরা কুরআনকে আঁকড়ে ধরো। কুরআন হলো রহমানের সর্বশেষ কিতাব। তাতে আছে আকলের নির্যাস, প্রজ্ঞার আলো, যাবতীয় ইলমের উৎস 
(কা‘ব আহবার)। 
.
(১৮৯). আমি কুরআন পাঠ করি। গভীর দৃষ্টিতে আয়াতসমূহের দিকে নজর বুলাই। আমার কাছে অবাক লাগে, কিভাবে কুরআনের হাফেজগন শান্তিতে ঘুমায়? 
(একজন সালাফ)। 
.
(১৯০). কুরআনে হাফেজদেরকে দেখলে আমার অবাক লাগে, আল্লাহর কালাম পড়েও কিভাবে তারা দুনিয়াবী বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হতে পারে? তারা যা তিলাওয়াত করে, তার অর্থ যদি তারা বুঝতো তাহলে এর স্বাদ অনুভব করতে পারতো। মুনাজাতে মজা পেতো। তাকে যে নেয়ামত দেয়া হয়েছে, তার প্রাপ্তির আনন্দে তার ঘুম দূর হয়ে যেতো 
(একজন সালাফ)। 
.
(১৯১) কুরআন কারীম তিলাওয়াতের সময় যা মনে রাখা চাই:
কুরআন পাঠ করবে আমলের নিয়তে। 
তুমি কুরআনকে এমন করে পড়ো, কুরআন-পাঠ যেন তোমাকে মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। যদি তোমাকে মন্দ কাজ থেকে বিরত না রাখে তাহলে তুমি প্রকৃত কুরআন-পাঠক নও 
(হাসান বিন আলি রা.)। 
.
(১৯২). একটা আয়াত নিয়ে তাদাব্বুরের চুড়ান্ত রূপ হলো, সে আনুযায়ী আমল করা, কুরআনের হরফগুলোকে যথাযথভাবে উচ্চারন করলেই তাদাব্বুর হয়ে যায় না 
(হাসান বসরী)। 
.
(১৯৩). হে কুরআনের বাহক! কুরআন কারীম তোমার কলবে কী রোপন করেছে? কারণ কুরআন হলো মুমিনের বসন্ত ঠিক বৃষ্টি যেমন মাটির বসন্ত! (মালিক বিন দীনার)। 
.
(১৯৪). কুরআন কারীম আল্লাহর কাছে মুনাজাতের নিয়তে পড়া:
তিলাওয়াতকারী পড়ার সময় মনে করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দেখছেন। তার পড়া শুনছেন। নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতাদের কাছে তার প্রশংসা করছেন। তাকে নিয়ে গর্ব করেন। 
.
(১৯৫). তুমি যদি কুরআন কারীম দ্বারা পরিপূর্ণ উপকৃত হতে চাও, তাহলে তিলাওয়াত করা বা তিলাওয়াত শোনার সময় কলবকে পুরোপুরি সুস্থির করে নাও। তোমার তিলাওয়াত তুমি নিজেই মনোযোগ দিয়ে শোন! আল্লাহর সাথে কথা বলছো এমন তটস্থ ভাব ফুটিয়ে তুলবে 
(ইবনুল কাইয়িম)। 
.
(১৯৬). আল্লাহর যথার্থ মর্যাদাবোধ যদি তোমার কলবে স্থান পেয়ে যায়, তাহলে আল্লাহর কালাম শোনা ও পড়ার চেয়ে অধিক সুস্বাদু সুমিষ্ট সম্মানিত সমুন্নত কোনও কিছু আর হতে পারে না 
(সালাফ)। 
.
(১৯৭). কুরআন কারীম আল্লাহর কালাম। কুরআনের মধ্য দিয়েই আল্লাহ তা‘আলা ও তার পরিচয় আমাদের সামনে বিমূর্ত হয়ে ওঠে। এটা হতে পারে কয়েকভাবে:
বড়ত্ব ও ভীতি প্রকাশের মাধ্যমে। ফলে আমাদের হৃদয় বিন¤্র আর নতজানু হয়। 
সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা প্রকাশের মাধ্যমে। ফলে তার প্রতি মনটা পরম ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পড়ে 
(ইবনুল কাইয়িম)। 
.
(১৯৮). তাদাব্বুরে সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে: 
সওয়াবের নিয়তে পড়লে ও পড়ালে। নবীজি বলেছেন:
خيركم من تعلم القرآن وعلمه
যে ব্যক্তি কুরআন কারীম শিক্ষা করে ও শিক্ষা দেয়, সে-ই সর্বোত্তম। 
.
(১৯৯). শিফা বা আরোগ্য লাভের নিয়তে কুরআন কারীম পড়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
 
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ
হে মানুষ! তোমাদের কাছে এমন এক জিনিস এসেছে, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক উপদেশ, অন্তরের রোগ-ব্যাধির উপশম এবং মুমিনদের পক্ষে হিদায়াত ও রহমত (ইউনুস: ৫৭)। 
.
(২০০). কিভাবে তাদাব্বুর করব? জোরে স্পষ্ট আওয়াজে সুর করে তিলাওয়াত করার মাধ্যমে। 
ليس منّا من لم يتغن بالقرآن يجهر به
যে ব্যক্তি কুরআনকে সুর করে ও জোর আওয়াজে পড়বে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় (বুখারী)। 
.
(২০১). এক লোক সম্পর্কে ইবনে আব্বাসকে বলা হল:
-ওমুক খুব দ্রুত কুরআন তিলাওয়াত করে! 
ইবনে আব্বাস সে লোককে বললেন:
-তুমি যদি তিলাওয়াত করতেই চাও, তাহলে এমনভাবে তিলাওয়াত করো, যাতে তুমি তোমার নিজ কানে শুনতে পাও। তোমার হৃদয় দিয়ে যা পড়ছো অনুভব করতে পারো!
.
(২০২). তুমি যখন তিলাওয়াত করবে, তখন কান খাড়া করে রাখবে। তাহলে পড়াটা কলবে পৌঁছবে। আর কলব হলো কান ও জিহ্বার যোগসূত্র (ইবনে আবি লায়লা)। 
.
(২০৩). তাদাব্বুর হতে পারে: তারতীলের সাথে পড়ার মাধ্যমে। তারতীল মানে, ধীরে ধীরে থেমে থেমে তিলাওয়াত। 
আয়েশা রা. বলেছেন:
كان يقرأ السور فيرتلها حتى تكون أطول منها
তিনি (নবীজি) তারতীলের সাথে সূরাগুলো তিলাওয়াত করতেন। আগের সূরার চেয়ে পরের সূরার তারতীল হতো আরো দীর্ঘ সময় নিয়ে (মুসলিম)। 
.
(২০৪). হে বনী আদম! তোমার কলব কিভাবে কুরআন তিলাওয়াতের সময় নরম হবে, তোমার তো লক্ষ্য থাকে কখন সূরা শেষ করবে সেদিকে (হাসান বসরী)। 
.
(২০৫). তাদাব্বুর হতে পারে:
একটা আয়াতকে বারবার পড়ার মাধ্যমে। একবার পড়ার কিছুক্ষণ থেমে ভাবনা চিন্তা করে আবার আয়াতটা পড়ার মাধ্যমে। এভাবে বারবার অসংখ্যবার পড়ার মাধ্যমে। আবু যর রা. বলেছেন:
-আল্লাহর রাসূল নামাযে দাড়ালেন। সুবহে সাদেক পর্যন্ত একটা শুধু একটা আয়াতই বারবার পড়লেন! আয়াতটা ছিল:
إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন তবে তারা তো আপনারই বান্দা আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনার ক্ষমতাও পরিপূর্ণ এবং হিকমতে পরিপূর্ণ (মায়িদা: ১১৮)। 
.
(২০৬). হাসান বসরি রহ. একবার সারারাত ধরে একটা আয়াতই বারবার পড়েছেন:
وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ اللَّهَ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
তোমরা যদি আল্লাহর নেয়ামতসমূহ গুণতে শুরু কর, তবে তা গুণে শেষ করতে পারবে না। বস্তুত আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (নাহল: ১৮)। 
তার কাছে জানতে চাওয়া হল:
-এই আয়াত কেন?
-চোখ তুলে যেদিকেই তাকাই, শুধু নেয়ামত আর নেয়ামত! জানি না, দৃষ্টির আড়ালে আরও কত নেয়ামত লুকিয়ে আছে!
.
(২০৭). সারারাত দ্রুত পড়ে কুরআন খতমকরার চেয়ে, সূরা যিলযাল ও কারি‘আ বারবার তাদাব্বুর করে করে পড়া আমার কাছে অধিক প্রিয় (ইমাম কুরতুবী)। 
.
(২০৮). একটা আয়াত বারবার পড়ার মধ্যে অনেক উপকারিতা:
সালাফের অনুসরণ করা হবে। তারা এভাবে একটা আয়াতকে বারবার করে পড়তেন। 
বারবার পড়লে তাদাব্বুর করতে সুবিধা হয়। বুঝটা গভীর হয়। প্রথমবার না বুঝলে দ্বিতীয়বারে বোঝা যাবে। নইলে তৃতীয়বারে, নইলে চতুর্থবারে! প্রতিবারেই কিছু না কিছু বুঝ বাড়তেই থাকবে!
বারবার পড়লে, আত্মার শুদ্ধি হবে। ময়লা থাকলে দূর হয়ে যাবে। ঈমান বৃদ্ধি পাবে। কুরআনের স্বাদ অনুভব হবে। কারণ বারবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে ‘গাফলত’ দূর হয়। গাফেল কলবে কুরআন প্রবেশ করে না। 
একটা আয়াতকে যতবার পড়বো, ততই আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু না কিছু ‘হেদায়াতের’ নেয়ামত আমার উপর বর্ষিত হতে থাকবে। ঈমানের নবতর কলি প্রস্ফুটিত হতে থাকবে। 
.
(২০৯). তাদাব্বুর হতে পারে:
আয়াতটাকে কোনও ভাবে সীরাতের সাথে সম্পৃক্ত করা যায় কি না, দেখা। সীরাত পাঠের মাধ্যমে কুরআনের আয়াতগুলো অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কুরআন বোঝার জন্যে সীরাতপাঠ অপরিহার্য। 
.
(২১০). তাদাব্বুর হতে পারে:
তিলাওয়াতের সাথে সাথে সাড়া দেয়া। আয়াতে যা বলা হয়েছে তা তৎক্ষণাত করা। নবীজি সা. অত্যন্ত ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করতেন। আয়াদের দাবী পূরণ করে করে সামনে বাড়তেন। তাসবীহের আয়াত এলে, তাসবীহ পাঠ করে নিতেন। প্রার্থনার আয়াত এলে, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে নিতেন। পানাহ চাওয়ার আয়াত এলে, আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়ে নিতেন। 
.
(২১১). তাদাব্বুর হতে পারে:
কুরআন পাঠের সময় শোকের কথা মনে করে, কান্নার ভান করা। আয়াতের অর্থের সাথে সাথে গলার স্বরও ওঠানামা করানে া। আয়াতের আবেগ যেন গলায় ফুটে ওঠে। প্রতিটি আয়াত পড়ার সময় খেয়াল করা, আমি এখন কোন ধরনের আয়াত পড়ছি, হাসির? কান্নার? আনন্দের? বেদনার? চাওয়ার ? পাওয়ার? ভয়ের? আশার? চিন্তার? দুশ্চিন্তার? জান্নাতের? জাহান্নামের? আমলের? আদেশের? নিষেধের?
.
(২১২). কুরআন পাঠের সময় কান্না হলো বিনয় প্রকাশের মাধ্যম। এটা আল্লাহভিমুখী বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কান্না আনার একটা উপায় হলো: সামনে জাহান্নামের ভয়াবহ অবস্থার কথা কল্পনা করা। কবরের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা ভাবনায় আনা। সে তুলনায় আমার নগন্য আমল ও স্বল্প প্রস্তুতির কথা ভাবা। 
.
(২১৩). তাদাব্বুর হতে পারে:
পড়ার সময় খেয়াল করা, কুরআন কারীমের প্রতিটি আয়াতের লক্ষ্য আমি নিজেই। ইমাম কুরতুবি বলেছেন:
-যার কাছে কুরআন পৌঁছল, তার সাথে যেন আল্লাহ স্বয়ং কথা বললেন। 
.
(২১৪). উরওয়া বিন যোবায়ের বলেন:
-আমি দাদু (আসমা রা.)-এর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সাহাবীগন কুরআন তিলাওয়াত শুনলে কেমন হতো তাদের অবস্থা?
-ঠিক যেমনটা কুরআন কারীম বলেছে: (تدمع عيونهم وتقشعر جلودهم) তাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতো। তারা প্রকম্পিত হয়ে উঠত!
তিনি দু’টি আয়াতের দিকে ইশারা করেছিলেন:
প্রথম আয়াত: এবং রাসূলের প্রতি যে কালাম নাযিল হয়েছে তারা যখন তা শোনে, তখন তারা যেহেতু সত্য চিনে ফেলেছে, সেহেতু তাদের চোখসমূহকে দেখবে যে, তা থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে (মায়িদা: ৮৩)। 
وَإِذَا سَمِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَى الرَّسُولِ تَرَى أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا مِنَ الْحَقِّ
দ্বিতীয় আয়াত: আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী-এমন এক কিতাব যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসমঞ্জস, যার বক্তব্যসমূহ বারবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। যাদের অন্তরে তাদের প্রতিপালকের ভয় আছে, তারা এর দ্বারা প্রকম্পিত হয়। তারপর তাদের দেহ-মন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে (যুমার: ২৩)। 
.
(২১৫). আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ রহ. বলেন:
-আমি ফজরের নামাজের সময় ছিল শেষ কাতারে। সেখান থেকেই উমার রা.-এর ফোঁপানোর আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। তিনি সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত করছিলেন নামাজে। পড়তে পড়তে:
قَالَ إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ
ইয়াকুব বলল, আমি আমার দুঃখ ও বেদনার অভিযোগ (তোমাদের কাছে নয়) কেবল আল্লাহরই কাছে করছি (ইউসুফ: ৮৬)। 
পর্যন্ত পৌঁছলেন। আর কান্না ধরে রাখতে পারলেন না। 
.
(২১৬). আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. সূরা মুতাফফিফীন পড়তে পড়তে:
يوم يقوم الناس لرب العالمين
যে দিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে (৬)। 
পর্যন্ত পৌঁছলেন। আর সামনে বাড়তে পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। 
.
আমি কুরআন কারীম তিলাওয়াত করার সময় কী করি? কখনো কেঁদেছি? হেসেছি? মন খারাপ করেছি? আয়াতের প্রভাবে?
.
তাদাব্বুর নিয়ে যা বলার ছিল, তার চারভাগের একভাগ মাত্র বলতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ! বাকী কথার জন্যে আরো মেহনত লাগবে। ইনশাআল্লাহ!
-শাইখ আতীক উল্লাহ
---------------------------------------

 

দিনলিপি-১৭৯৮

(০৯-০৯-২০২১)

হিফজী মিনাল কুরআন

(সুইটহার্ট কুরআন’ বই থেকে নেয়া)

-
আই লাভ কুরআনে নামটা ছিল ‘হিযবী মিনাল কুরআন’। হিযব বলা হয় দৈনিক তিলাওয়াতের জন্য যেটুকু নির্ধারণ করা হয়। এটাকে ‘বিরদ’-ও বলা হয়। যেমন আমি ঠিক করেছি, প্রতিদিন একপারা করে তিলাওয়াত করব, তাহলে আমার হিযব হলো একপারা। আমার বিরদ একপারা। হিফজ মানে মুখস্থ করা। কুরআন কারীম মুখস্থ করাকেই সাধারণত ‘হিফজ’ বলা হয়। আমরা হিযব ও হিফজ উভয়টা নিয়েই কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছি। শিরোনামের অর্থ, আমার কুরআন হিফজ। রাব্বে কারীম আমাদের হাফেজে কুরআন বানিয়ে দিন। নিয়মিত তাদাব্বুরের সাথে হিযব আদায়ের তাওফীক দান করুন।
.
. কুরআন কারীম আল্লাহর দেয়া এক অপূর্ব নেয়ামত। জীবন চলার পথে নানা ঘাত-প্রতিঘাত আসে। পদে পদে উঠতি-চড়তি সামনে পড়ে। শারীরিক-মানসিক নানান সমস্যা-অসুবিধে। এসব বাধাবিঘ্ন মনমানসিকতা, চিন্তাচেতনায় গভীর ছাপ রেখে যায়। অনেক সময় আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্তও হয়ে পড়ি। জীবনের গতিপথ ব্যাহত হয়ে পড়ে। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচার সহজতর একটি উপায় হলো—দৈনিক হিযব/বিরদ নিয়মিত আদায় করা। দৈনিক হিযবুল কুরআন সব ধরনের মানসিক সমস্যা দূর করার মহৌষধ। মানসিক বিপর্যয় কোনো সুফল বয়ে আনে না। নিত্যদিনের বিরদুল কুরআন আদায় আমাকে অপার্থিব এক কুরআনি জগতে নিয়ে যাবে। এই কুরআনি জগৎ দৃশ্যমান জগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই জগতের সবকিছুই আখেরাতের চিরন্তন জগতের সাথে সম্পৃক্ত। কুরআনের সাথে জড়িয়ে থেকে, আমি একই সাথে ক্ষণস্থায়ী তুচ্ছ পার্থিব জীবন যাপনের পাশাপাশি চিরস্থায়ী জান্নাতী জীবনও যাপনের সুখ কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারব। কুরআন আমাকে পার্থিব জীবনের নানাবিধ কলুষতার প্রভাব থেকে মুক্ত করে, আখেরাতের পবিত্র জীবনের আস্বাদ দান করবে। নিয়মিত হিযব আদায় আমাকে জীবনের সূচনালগ্নের শুচিশুভ্র জীবন দান করবে। জীবনকে সার্থক করে তুলবে।
.
. হিফয শেষ হওয়ার পর, হেফযখানা থেকে বের হওয়ার পর, অনেক সময় ‘মুরাজায়া-তাকরার-দাওরে শিথিলতা এসে যায়। শয়তানই ধীরে ধীরে কৌশলে হিফয ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। প্রথম প্রথম মনে হয়, এত ইয়াদ, কখনো আমি কুরআন ভুলব না। এটা শয়তানের প্রথম সাফল্য। আস্তে আস্তে আসে ব্যস্ততার অজুহাত। আস্তে আস্তে কুরআন ছুটতে থাকে। একসময় সচেতনতা এলেও, আজ নয় কাল করতে করতে পেরিয়ে যায় আরও কিছুদিন। একদিন জোর করে বসলে দেখা যায়, আগের মতো ইয়াদ নেই বা পুরো ভুলে গেছে। পরিস্থিতি যা-ই হোক, আজ থেকেই মুরাজা‘আ শুরু করে দিতে হবে। অল্প করে হলেও। কুরআন কারীমকে আঁকড়ে ধরতে হবে সার্বক্ষণিক সঙ্গীর মতো।
.
. কুরআন কারীমকে দিতে হবে সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু। কুরআনকে দিতে হবে সবচেয়ে তীক্ষè মনোযোগটুকু। কুরআনকে দিতে হবে সবচেয়ে তীব্র আগ্রহটুকু। কুরআনকে দিতে হবে উদ্যম আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর সময়টুকু। কুরআন নিয়ে বসতে হবে, ফজরের পর দিনের শুরুতে। কুরআনকে সব সময়ই সাথে রাখতে হবে। তবে সব সময় দিনশেষে কর্মক্লান্ত দিবসের শেষে, পরিশ্রান্ত ঘুমন্ত ঢুলুঢুলু সময়টুকু কুরআনের জন্য বরাদ্দ করলে, কুরআন আমার দিকে কতটা অগ্রসর হবে, বলা মুশকিল।
.
. কুরআনে হাফেয বা নিত্য তিলাওয়াতকারী যখন ফজরের পর, মুসাল্লায় বসে কুরআন তিলাওয়াত করতে শুরু করে, তখন তার অনুভূতি কেমন হয়? তার মধ্যে অপূর্ব এক জান্নাতী সুখ খেলা করতে শুরু করে। মনেপ্রাণে এক চাঞ্চল্যকর আরামদায়ক সুবাতাস বইতে থাকে। যেন জান্নাত থেকে এক পশলা সুরভিত দখিনা হাওয়া নেমে এসেছে। যে হাওয়ায় মিশে আছে জান্নাতের ‘নায-নেয়ামত’। যে হাওয়া কানে কানে বলে যায় জান্নাতের সুখসম্ভারের কথা। যে হাওয়া তনুমনে বুলিয়ে দেয় সুখদ পরশ। কুরআন পাঠের সাথে সাথে বান্দা উড়তে থাকে অনন্য এক জগতের দিকে।
.
. বিশেষ কোনো অজুহাতে আজকের নির্ধারিত ‘বিরদ-হিযব’ আগামীর জন্য পেছানো, ভালো লক্ষণ নয়। যত ব্যস্ততাই থাক, বিরদ-হিযব থাকবে প্রধানতম কাজ। ব্যস্ততার অজুহাতে নিত্য বিরদ-হিযব পিছিয়ে দেয়ার মানে, কুরআনকে পিছিয়ে দেয়া। একবার পেছালে, পরে ‘টালবাহানা’ আরও পেয়ে বসবে। একসময় দেখা যাবে, সামান্য অজুহাতেই কুরআন তিলাওয়াত ছেড়ে দিতে হচ্ছে। শয়তানের এসব সূক্ষ্ম অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হবে অনঢ় অবস্থান নিয়ে। কোনো প্রকার ছাড় না দিয়ে। আমার এখনই ঠিক করতে হবে, আমি কি লড়াই চালিয়ে যাব নাকি ‘থকে’ যাব?
.
. কুরআন কারীম হিফয করতে ইচ্ছুকদের প্রতি অভিজ্ঞদের পক্ষ থেকে তিন নসীহত :
. নতুন হিফযের পরিমাণ কম রাখা।
. বেশি বেশি তাকরার পুনরাবৃত্তি বা আওড়ানো।
. উভয় কাজ নিয়মিত করতে থাকা।
. নিজের প্রিয়জন, বিশেষ করে পরিবারের কাউকে কুরআন কারীম হিফয করতে দেখা, দুনিয়াতে জান্নাতী নেয়ামত উপভোগের মতো। কুরআন তিলাওয়াত জান্নাতের ত্বরান্বিত ‘নাঈম’। কুরআন তো জান্নাতি ফলের মতো। ইয়া আল্লাহ, আমাদের আপনার কুরআনি অনুগ্রহ দান করুন।
.
. ফজরের পরপর বা রাতের তৃতীয় যাম, কুরআন তিলাওয়াত ও হিফযের সর্বোত্তম সময়। এ-সময় কুরআন তিলাওয়াতের স্বাদ, প্রভাব, কার্যকারিতাই আলাদা। কুরআনের সাথে হৃদয়ের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয় এ-সময়। রাতের তৃতীয় যামে, কলব যেন উন্মুখ হয়ে থাকে কুরআনের জন্য। তীর যেমন উড়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে এঁটে যায়, কুরআনও এই সময় হৃদয়পটে এঁটে যায়। কলবে গেঁথে যায়।
.
. হিফযের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় কয়েকটি বস্তু,
. আল্লাহর প্রতি ইখলাসে ঘাটতি থাকা। ইখলাস মানে শুধু আল্লাহর জন্যই কোনো কিছু করা।
. হিফযের সময় একমুখী হতে না পারা। মোবাইল বা অন্যকিছুর প্রতি এককান খাড়া থাকা।
. কোনো সময় নির্ধারণ না করে, পরিকল্পনাহীন সময় নিয়ে হিফয করতে বসা। সবচেয়ে ভালো হয়, আধাঘণ্টার বেশি একটানা নতুন ‘সবক’ হিফয না করা।
. ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে হিফয করতে বসা। হিফযের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাই বরাদ্দ রাখতে হবে।
.
১০. আমি আজ শয়তানকে প্রতিরোধ করতে পারছি না, সামান্য ছুতোয় কুরআনের ‘বিরদ’ ছেড়ে দিচ্ছি, নিয়মিত পঠিত ‘হিযব’ না পড়ে দিন পার করে দিচ্ছি, আগামীকাল শয়তান আরও বড় অজুহাত হাজির করবে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়? কোনো ক্রমেই ‘হিযব’ ত্যাগ করা যাবে না।
১১. নিয়মিত বিরদ আদায়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কয়েকটি বিষয়,
. একদিনেই সব তিলাওয়াত করে ফেলার চেষ্টা করা। আগ্রহ থাকতে থাকতে তিলাওয়াত সমাপ্ত করা। আগ্রহের শেষবিন্দু পর্যন্ত তিলাওয়াত না করা।
. মস্তিষ্ক অন্যকিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় বিরদ আদায় করতে বসা। সবচেয়ে ভালো হয় ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর তিলাওয়াত করতে বসা। এই সময় মনমেজায পরিচ্ছন্ন থাকে।
. কখন সূরাটা শেষ হবে, এই চিন্তাতাড়িত হয়ে তিলাওয়াত না করা। ধীরেসুস্থে তিলাওয়াত করতে থাকা।
.
১২. সারাদিনের এলোমেলো রুটিনকে ফেলেগেঁথে বিন্যস্ত করে তুলতে হবে। ছড়ানো-ছিটানো সময়গুলো একসুতোয় গাঁথতে হবে। সময়ের মালায় নানা কর্মপুঁতির ফাঁকে ফাঁকে কুরআনি মুক্তোও গেঁথে দিতে হবে। কুরআন পড়তে হবে সর্বোচ্চ আগ্রহে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। সর্বোচ্চ দামি সময়ে। দুনিয়া হামাগুড়ি দিয়ে নয়, দৌড়ে আসবে আমার দিকে।
.
১৩. অনেকেই নিত্যদিনের ‘হিযব’ তিলাওয়াতে বাধার সম্মুখীন হন। নিয়মিত ‘বিরদ’ আদায় করা হয়ে ওঠে না। সহজ পদ্ধতি হচ্ছে, প্রথমে অল্প করে নির্ধারণ করা। শুরুতে পাঁচ পৃষ্ঠা। দ্বিতীয় সপ্তাহে বা পক্ষে আধাপারা। এভাবে বাড়াতে থাকা। মনকে তিলাওয়াতে অভ্যস্ত করে তুললে পরে আর সমস্যা হয় না। মনকে তিলাওয়াতপোষ করে তুলতে হয় ক্রমান্বয় পদ্ধতি অবলম্বন করে। পরীক্ষা করে দেখতে পারি, ইন শা আল্লাহ সন্তোষজনক ফল আসবেই। কুরআন কাউকে খালি হাতে ফেরায় না।
.
১৪. একজন হাফেযের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো, আশেপাশে হিফয শোনানোর মতো একজন মানুষ থাকা। পরিবারের বা বাইরের। যে আগ্রহ করে তিলাওয়াত শুনবে। কখনোই বিরক্তি অনুভব করবে না। শুনতে বললে দ্বিরুক্তিও করবে না। তার মিলবে শোনা ও তিলাওয়াতের দুই প্রকার সওয়াব।
.
১৫. কখনো দেখা যায়, এক ঘণ্টায় তিন পারা তিলাওয়াত হয়ে গেছে। কখনো কুরআন তিলাওয়াত করতে বসলে, আধা ঘণ্টাও সহজে কাটতে চায় না। তিলাওয়াতও এগোয় না। এটা কেন হয়? কলবের ওপর চেপে বসা গুনাহের কারণে। অথবা খালেস নিয়তের অভাবে আমলটা বাতিল হয়ে যায়। আমল করা দুর্বহ হয়ে যায়।
.
১৬. যে চায়, কুরআন তার জন্য এমন নূর-হেদায়াত-ইলমের দরজা খুলে দিক, তাহলে তাকে দুটি কাজ করতে হবে।
. কুরআন কারীম পড়তে হবে হেদায়াত লাভের উদ্দেশ্যে। প্রতিটি শব্দ পড়ার সময় মনে হাজির-নাজির রাখতে হবে, এই শব্দে আমার জন্য হেদায়াত রেখে দেয়া আছে। আমি আপাতত না বুঝলেও, আল্লাহর কাছে আমি এই শব্দে নিহিত হেদায়াত প্রার্থনা করছি।
. দীর্ঘসময় ধরে কুরআনে তাকিয়ে থাকতে হবে। একটি আয়াত আওয়াজ করে করে পড়ার পর, চুপটি করে দীর্ঘসময় আয়াতখানার দিকে তাকিয়ে ভাবতে হবে, রাব্বে কারীম এই আয়াতে আমাকে কী বলতে চেয়েছেন। রবী বিন সুলাইমান রহ. বলেছেন, আমি ইমাম শাফেঈ রহ. এর দরবারে যতবার গিয়েছি, প্রায় সব সময় তার সামনে কুরআন কারীম খোলা দেখতে পেয়েছি। তাকে কুরআনে নিমগ্ন পেয়েছি।
.
১৭. প্রতিদিনের ‘বিরদ’ আদায়কে কষ্টকর রুটিন মনে না করা। অনিচ্ছা আর অনাগ্রহ নিয়ে, না পারতে মন শাসিয়ে কষিয়ে, মনের ওপর জোর খাটিয়ে বিরদ আদায় না করা। বিরদকে জাগতিক ও পারত্রিক উন্নতির মাধ্যম মনে করে পরম আগ্রহ নিয়ে বিরদ আদায় করা। বিরদকে নিজের প্রাণশক্তির আধার মনে করা। বরকত আর সৌভাগ্যের উৎস মনে করা। তাড়াহুড়ো করে কোনোরকমে আজকের বিরদ শেষ করার জন্য উঠেপড়ে না লেগে, ধীরেসুস্থে মহব্বতের সাথে তিলাওয়াত করতে থাকা।
.
১৮. পড়তে বা লিখতে বসলে, কোথাও আটকে গেলে, শব্দ বা বাক্যের অর্থ না বুঝলে, লেখার সময় উপযুক্ত শব্দ মাথায় না এলে, মুসহাফ খুলে তিলাওয়াত শুরু করে দেয়া। কিছুক্ষণ তিলাওয়াত করলে, আপনাআপনি মাথার জট খুলে যায়। লেখা বা পড়ায় নতুন গতি আসে।
.
১৯. আমি ভালো হাফেয হয়েছি। ভালো মুফাসসির হয়েছি। কুরআন বিষয়ে ভালো কথা বলতে পারি। লিখতে পারি। চারপাশ থেকে মানুষের প্রশংসা ভেসে আসতে শুরু করেছে। এসব দেখে আমার মধ্যে বাষ্প জমছে। নিজের মধ্যে হামবড়া ভাব সৃষ্টি হয়েছে। এটা আমার পতনের সূচনা। আমাকে আল্লাহ যে কুরআনি নূর দান করেছেন, সেটা ছিনিয়ে নেয়ার সময় হয়েছে। মানুষের সামান্য কথাতে অহংকারী হয়ে পড়ার মতো ন্যক্কারজনক স্বভাব আর হতে পারে না। বিশেষ করে অল্পবয়েসে হাফেয হয়ে গেলে, এই সমস্যা তৈরি হয়। এখন তো একটু ভালো ইয়াদ হলে, গলা একটু সুন্দর হলে, ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের ত্রিমুখী প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়ে যায়। অনেক হাফেযের শিক্ষাজীবন এভাবেই শেষ হয়ে যায়। পড়াশোনা আর আগায় না। মিডিয়ার চাকচিক্যময় প্রচারে ছোট্ট হাফেয সাহেব বেসামাল হয়ে পড়েন। আল্লাহর কালাম ধারণ করেও কুরআনের নূর থেকে বঞ্চিত হওয়া বড়ই কষ্টের।
.
২০. অভ্যেস না থাকলে, প্রথম প্রথম তিলাওয়াত অনেক ভারী মনে হয়। জিহ্বা দিয়ে উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়। এমনকি কলবও কুরআনকে গ্রহণ করতে চায় না। দুয়েক আয়াত পড়তে-না-পড়তেই ক্লান্তিবোধ হয়। জিহ্বা জড়িয়ে আসতে চায়। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। একটু পরেই হাঁপ ধরে যায়। যারা দৈনিক হিযব আদায় করার সংকল্প করেছে, প্রথম দিকের এমন ক্লান্তি-হাঁপ দেখে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে আসবে। শুরুতে তিলাওয়াতের পরিমাণ অল্প রাখতে হবে। ধীরে ধীরে জিহ্বা, কলব তৈরি হয়ে উঠবে। প্রথম দিকে সবর করে তিলাওয়াত অব্যাহত রাখতে হবে। একসময় সহজ হয়ে যাবে। একপারা, দুইপারা, তিনপারা বা আরও বেশি তিলাওয়াত অনায়াসে শেষ করা যাবে।
.
২১. কুরআনে আমার সমস্যার সমাধান আছে। এই সমাধানের ধরন কিছুটা ভিন্ন। কুরআন সরাসরি হুবহু নাম চিহ্নিত করে সমাধান বাতলায় না। কুরআন আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে। তবে অনেক সময় এমন হয়, কুরআন আমাকে আক্ষরিক অর্থে সুস্পষ্ট পথ দেখিয়ে দেয় না। কুরআনের ‘আচরণগুলো’ হয় সাধারণত গভীর।
ধরা যাক আমি একটি সমস্যার সম্মুখীন হলাম। আল্লাহর কাছে উদ্ধারের দু‘আ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি কুরআন তিলাওয়াত করছি। মুক্তির উপায় খুঁজছি কুরআনে। পড়তে পড়তে কোনো প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক কোনো আয়াত সামনে আসে, যার প্রভাবে দীর্ঘদিনের লালিত কোনো ভ্রান্ত ধারণা, অভ্যেস বা স্বভাবে পরিবর্তন আসে। আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে। কখনো জ্ঞাতসারে, কখনো অজ্ঞাতসারে। কখনো তিলাওয়াত করতে করতে মনে ভাবনার উদয় হয়, আমি যে পথে চলছি, সেটা সঠিক নয়। পাশাপাশি সঠিক পথ সম্পর্কেও একটা ধারণা জন্মায়।
কুরআন চট করে, দুম করে, তেলেসমাতি কা- আর ভোজবাজির মতো আকস্মিক কোনো পরিবর্তন ঘটায় না। কুরআন রূঢ়ভাবে কিছু করে না। কুরআন কাজ করে নরমকোমলভাবে। ধীরেসুস্থে অথচ কার্যকর, ফলপ্রসূ আর অব্যর্থভাবে।
.
২২. দৈনিক হিযব আদায়ের সময়, আমার প্রধান মনোযোগ পারা-সূরা-পৃষ্ঠাসংখ্যার দিকেই যেন কেন্দ্রীভূত না হয়ে পড়ে। একলাইন পড়তে-না-পড়তেই কদ্দূর পড়লাম আর কদ্দূর বাকি আছে, এই হিসেবে যেন ব্যতিব্যস্ত না হয়ে পড়ি। তিলাওয়াত করতে বসলে, হিযব শেষ করাই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য না হয়ে দাঁড়ায়। আমি গুনে গুনে তিলাওয়াত করলে, আল্লাহর পক্ষ থেকে বিনিময়ও তেমন হবে।
.
২৩. আমার তিলাওয়াত হতে হবে গভীর। কুরআনের মাঝে ডুবে যেতে হবে। এমনভাবে কুরআনে ডুব দিতে হবে, যেন আমি আর কুরআন ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কারও অস্তিত্ব নেই। একাকী নির্জনবাসের মতো। কুরআনকে সাথে নিয়ে জনতার মাঝে নির্জনতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। প্রতিটি আয়াত হয়ে উঠবে পরম সঙ্গী। চিন্তাচেতনায় থাকবে শুধুই কুরআন। এ জন্য কুরআন নিয়ে বসার সময়টাও এমন হবে, যখন লোকজনের আনাগোনা থাকে শূন্যের কোঠায়। সব ব্যস্ততা ফুরিয়ে যায়। এমন হলেই কুরআন হয়তো কিছু রহস্য আমার সামনে উন্মোচন করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি দয়া করলেও করতে পারেন।
.
২৪. কুরআন কারীম সাধ্যানুযায়ী সুর করে পড়াই সুন্নত। যথাসম্ভব বিশুদ্ধ তাজবীদে, আপন যোগ্যতার সর্বোচ্চ সীমায় সুন্দর করে তিলাওয়াত করলে, কুরআন তিলাওয়াতে বাড়তি মনোযোগ ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শয়তানের ওয়াসওয়াসা কাছে ঘেঁষতে পারে না। কুরআনের প্রতি বান্দার আগ্রহ দেখে আল্লাহ তা‘আলাই শয়তান ও তার সাঙ্গপাঙ্গকে তিলাওয়াতকারী থেকে দূরে হটিয়ে দেন,
ٱلَّذِی یُوَسۡوِسُ فِی صُدُورِ ٱلنَّاسِ مِنَ ٱلۡجِنَّةِ وَٱلنَّاسِ
যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়, সে জিনদের মধ্য হতে হোক বা মানুষের মধ্য হতে (আন-নাস)
.
২৫. সফরে-ঘরে সর্বাবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত অব্যাহত রাখা উচিত। কোনো অবস্থাতেই তিলাওয়াত ছাড়া উচিত নয়। এটাই উম্মাতে মুহাম্মদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অন্য কওমের কথা বলে আমাদেরও উদ্বুদ্ধ করছেন,
لَیۡسُوا۟ سَوَاۤءً مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَـٰبِ أُمَّةٌ قَاۤىِٕمَةٌ یَتۡلُونَ ءَایَـٰتِ ٱللَّهِ ءَانَاۤءَ ٱلَّیۡلِ وَهُمۡ یَسۡجُدُونَ
(তবে) কিতাবীদের সকলে এক রকম নয়। কিতাবীতের মধ্যেই এমন লোকও আছে, যারা (সঠিক পথে) প্রতিষ্ঠিত, যারা রাতের বেলা আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং তারা (আল্লাহর উদ্দেশ্যে) সিজদাবনত হয় (আলে ইমরান, ১১৩)।
.
২৬. যেকোনো কাজে সফল হতে গেলে সবর লাগে। দৈনিক হিযব আদায়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার জন্যও প্রথম কিছুদিন সবরের সাথে লেগে থাকতে হয়। হিফয করতে গেলে সবরের প্রয়োজন হয়। হিফয শেষ হওয়ার পর, ইয়াদ ধরে রাখতেও সবরের প্রয়োজন হয়। কুরআনের সাথে লেগে থাকার জন্য সবরের বিকল্প নেই।
.
২৭. আল্লাহ তা‘আলার কাছে কুরআনের অনেক সম্মান। যারা কুরআন নিয়ে থাকেন, তাদেরও আল্লাহ তা‘আলা অনেক সম্মান দান করেন। হাসাদ বা হিংসা কোনো অবস্থাতেই বৈধ নয়। হাসাদ না বলে, গিবতা বা ঈর্ষা বলা যেতে পারে। দুটি বিষয়ে ঈর্ষা বৈধ, একব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন দান করেছেন। সে ব্যক্তি দিনরাত সলাতে কুরআন তিলাওয়াত করে। আরেক ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পদ দান করেছেন। মানুষটা দিনরাত এক করে দান-খয়রাত করে। এই দুই ব্যক্তির আমল নিয়ে ঈর্ষা করা যেতে পারে। নিজেও এমন হওয়ার আশা পোষণ করা যেতে পারে (মুত্তাফাক)।
.
২৮. বয়েস হয়েছে, এতদিন পর ভালো ইয়াদ থাকার কথা নয়, তবুও পুরো কুরআন টাটকা ইয়াদ। অবাক লাগল। রহস্যাটা কী? সারাদিন খুবই ব্যস্ত থাকেন। আলাদা করে তিলাওয়াত করতে দেখি না। নামাযের আগে-পরে হয়তো কিছু তিলাওয়াত করেন। ইয়াদের রহস্য তিনিই ভাঙলেন। বসে তিলাওয়াত করতে না পারলেও, হাঁটাচলায় তিলাওয়াত করেন। বিশেষ করে মাদরাসায় আসা-যাওয়ার পথে প্রতিদিন অনেকটা তিলাওয়াত হয়ে যায়। অথচ দেখে মনেই হতো না, তিনি এই সময় তিলাওয়াত করেন বা করতে পারেন। আল্লাহর কালামকে আল্লাহর বান্দারা কতভাবে যে সংরক্ষণ করে!
.
২৯. আমি কুরআন হিফয না করলে, তবে আর করবে কে? কুরআন আমার, আমি কুরআনের। আমার মা-বাবার সম্মান সমাদর করার দায়িত্ব আমার। আমার হিফয আখেরাতে মা-বাবার জন্য সম্মান বয়ে আনবে। আল্লাহর দরবারে মা-বাবার মর্যাদা বুলন্দ করবে। মা-বাবার সুবিধার্থে আমি এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে না নিলে, কে নেবে? আমি আমার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে হলেও হিফযুল কুরআন শুরু করে দিতে পারি। সময়-মেধা-সুযোগ-বয়েসের কারণে যদি হিফয শেষ করে নাও উঠতে পারি, সন্তানরা আমাকে দেখে প্রেরণা লাভ করবে। সন্তানের হিফয আমার পরকালের পাথেয়। দুনিয়ার কত কিছুই তো আমার পছন্দের তালিকায় থাকে। আল্লাহর কালামের হিফয কেন এই তালিকায় স্থান পাবে না? আমার জীবনের প্রধানত লক্ষ্য কেন হিফযুল কুরআন নয়, এই প্রশ্ন কি নিজেকে কখনো করেছি?
.
৩০. কলব শক্ত হয়ে আছে? অন্তর নরম করার সবচেয়ে সহজ কার্যকর আর সুন্দর পদ্ধতি হচ্ছে নিজে তিলাওয়াত করা বা অন্যের তিলাওয়াত শোনা। তাদাব্বুরের সাথে। কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণে আছে অপূর্ব প্রশান্তি। অভিজ্ঞতা না থাকলে, বলে বোঝানো কঠিন।
.
৩১. বয়েস হয়ে গেলে, ব্যস্ততা বেড়ে গেলেও হিফয করার ফলপ্রসূ পদ্ধতি আছে। শেষদিক থেকে শুরু করতে হবে। মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত একটানা শুনে যেতে হবে। শোয়ার সময়। খাওয়ার সময়। পাশাপাশি কুরআন কারীম হাতে নিয়েও পড়তে হবে। প্রথমে ছোট ছোট সূরা, তারপর ধীরে ধীরে বড় বড় সূরা। মুখস্থ হলে প্রথমে নিজেকে শোনাতে হবে, তারপর অন্যকে। সুযোগ পেলেই সূরাটা পড়তে হবে। সলাতে পড়তে হবে। চলতে ফিরতে পড়তে হবে। শুয়ে শুয়ে, বসে বসে, হাঁটতে হাঁটতে পড়তে হবে। অর্থ বুঝে বুঝে পড়তে হবে। চিন্তা করে করে, তাদাব্বুরের সাথে পড়তে হবে। তাহলে একবার মুখস্থ করা সূরা, সহজে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
.
৩২. কুরআনের মৌলিক পাঠ একজন শিক্ষকের কাছে হওয়া বাঞ্ছনীয়। শুরুতেই শিক্ষক নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। মৌলিক দক্ষতার জন্য, জীবনের শুরুতে, একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের শিষ্যত্ব বরণ করে নেয়াই নিরাপদ। আর এই পর্বটা দীর্ঘমেয়াদে হওয়া উপকারী। তাহলে শুধু শব্দ নয়, অর্থও শেখা হয়ে যাবে।
.
৩৩. গুনাহ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে হিফযের। অনেক দক্ষ হাফেযও গুনাহের কারণে কুরআন ভুলে যায়। গুনাহের প্রভাবে কী হয়? কুরআনের প্রতি উদাসীনতা তৈরি হয়। কঠিন কঠিন পরিস্থিতি সামনে আসতে থাকে। ফলে কুরআন নিয়ে বসার সুযোগ হয় না। কুরআন থেকে দূরে সরার কারণে, একের পর এক সমস্যা আসতে থাকে। এক সমস্যার হাত ধরে আরও নানা সমস্যা হাজির হয়। এতসব ঘটনা ঘটতে থাকে অগোচরে। তার মনে হতে থাকে, সমস্যাগুলো এমনি এমনি ঘটছে। কুরআননিরোধী গুনাহগুলো সাধারণত গোপন হয়ে থাকে। প্রথম দিকে এগুলোকে গুনাহ বলেই মনে হয় না। আমার সতর্ক হওয়া উচিত, আমিও এমন কোনো গুনাহে লিপ্ত নই তো, যা আমাকে কুরআন কারীম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? আমাকে কুরআন থেকে বিমুখ করে রাখছে?
.
৩৪. আমি কুরআন অভিমুখী হতে পারছি না, নিয়মিত কুরআন নিয়ে বসতে পারছি না। কুরআনি ওযীফা আদায় করতে পারছি না। দৈনিক হিযব/বিরদ আদায় করতে পারছি না, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উপায় হচ্ছে না। এর একটাই কারণ, আমার গুনাহ আমাকে কুরআন কারীম থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। গুনাহ আমার আর কুরআনের মাঝে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। গুনাহ আমাকে কুরআনের কাছে যেতে বাধা দিচ্ছে। গুনাহ আমাকে কুরআন বুঝতে বাধা দিচ্ছে। গুনাহ আমাকে কুরআন অনুযায়ী আমল করতে, জীবন গড়তে বাধা দিচ্ছে।
.
৩৫. একজন হাফেযে কুরআন কখনোই অন্যের প্রশংসা বা নিন্দায় প্রভাবিত হয় না। আত্মমুগ্ধতা বা আত্মহংকারে ভোগাও কুরআনে হাফেযের জন্য শোভনীয় নয়। নিজের সুন্দর সুর নিয়ে, নিজের হিফযের যোগ্যতা নিয়ে অহংকারে ভুগবে না। কুরআন পড়তে পারা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ (لَّوۡ شَاۤءَ ٱللَّهُ مَا تَلَوۡتُهُۥ عَلَیۡكُمۡ وَلَاۤ أَدۡرَىٰكُم بِهِ) আল্লাহ চাইলে আমি এ কুরআন তোমাদের সামনে পড়তাম না এবং আল্লাহ তোমাদের এ সম্পর্কে অবগত করতেন না (ইউনুস, ১৬)। আল্লাহ চাইলে আমার কুরআনি যোগ্যতা যেকোনো মুহূর্তে ছিনিয়ে নিতে পারেন। আমার সতর্ক থাকা উচিত।
.
৩৬. আমি যত ভালো হাফেযই হই, যত ভালো মুফাসসিরে কুরআনই হই, আমার মধ্যে কখনোই যেন এই চিন্তা না আসে, আমি হিফযের চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে গেছি। আমি কুরআনের সমস্ত তাফসীর-তরজমা জেনে গেছি। আমি যাবতীয় সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে গেছি। কুরআনি যোগ্যতা যদি আমার মধ্যে বিনয় সৃষ্টি না করে, তাহলে বুঝতে হবে, আমি শয়তানের পাল্লায় পড়ে আছি।
.
৩৭. কুরআন তিলাওয়াতকারীর এটা জানা থাকা উচিত, কুরআন কারীমে যা-কিছু বলা হয়েছে, তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। কুরআনের প্রতিটি হুমকি-ধমকির উদ্দেশ্যও সে। কুরআনে গল্পগুলো এমনি এমনি বলা হয়নি। এগুলো শিক্ষা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।
(মিনহাজুল কাসিদীন, আল্লামা ইবনে কুদামাহ রহ.)।
.
৩৮. কুরআন কারীম আগাগোড়া রহমত। আল্লাহ তা‘আলা যদি আমাকে তার কুরআনি রহমত দ্বারা বেষ্টন করে না নেন, তাহলে আমি শেষ। কীভাবে বুঝব আমি তার কুরআনি রহমতের বেষ্টনীতে আছি কি না? যদি দেখি নিয়মিত দৈনিক হিযব আদায় করতে পারছি, ভেতর থেকে কুরআনের বিধিবিধান মেনে চলার পূর্ণ সায় পাচ্ছি, কুরআনের সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগছে, তাহলে ধরে নিতে পারি, আমি আল্লাহর কুরআনি রহমতের বেষ্টনীতে আছি। আলহামদুলিল্লাহ।
.
৩৯. প্রতিদিন তিলাওয়াত ও হিফযের আগে, নিয়ম করে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে দোয়া করে নেয়া জরুরি। একটু পরপর আল্লাহর তাওফীক চেয়ে দোয়া করা। আমার মেধা ভালো, আমার স্মরণশক্তি প্রখর, আমি মেধাবী—এটা মোটেও কাজ দেবে না, যদি আল্লাহর রহমত অনুগ্রহ না থাকে। তিলাওয়াত তাদাব্বুর ও হিফযের জন্য আমাকে আল্লাহর রহমত চেয়ে আনতে হবে। কারণ, রহমানই আমাকে কুরআন শিক্ষা দেবেন। কুরআন শেখার পেছনে আল্লাহর রহমত গুণই বেশি কার্যকর থাকে
ٱلرَّحۡمَـٰنُ عَلَّمَ ٱلۡقُرۡءَانَ
তিনি তো রহমানই। যিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন (সূরা আর রহমান)।
.
৪০. কুরআনি রুটিনের কখনো কিছুতেই ব্যতিক্রম করা ঠিক নয়। হিফযের সময় হিফয করতে বসে যাওয়া, হিফয শোনানোর সময়, কমবেশ যতটুকু হিফয হয়েছে শুনিয়ে ফেলা, হিযব আদায়ের সময় হলে সবকিছু স্থগিত রেখে তিলাওয়াতে মশগুল হয়ে পড়া। কোনো কারণে হিযব ছুটে গেলে, ঘুমের আগে হলেও কাযা আদায় করে নেয়া। কুরআনি রুটিন রক্ষায় নাছোড়বান্দা না হলে, কুরআন আসবে না। এলেও থাকবে না।
.
৪১. যার কাছে কুরআনের একটা হরফও শেখা হয়েছে, তাকে কিছুতেই ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ছেলেবেলা থেকে এই পর্যন্ত, কার কার কাছে আমি কুরআনি শিক্ষা লাভ করেছি? আমার কি মনে আছে? আমি কখনো কুরআনের ভালোবাসায়, কুরআনের শিক্ষকদের কথা স্মরণ করার চেষ্টা করেছি? তাদের জন্য আলাদা করে দোয়া করেছি? তাদের সাথে যোগাযোগ করার কথা ভেবেছি? তাদের খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করেছি? তাদের বিপদাপদে পাশে দাঁড়িয়েছি? কুরআনের প্রতি ভালোবাসার তাগিদেই আমাকে এটা করতে হবে। কোনো কুরআনি শিক্ষকের প্রতি মনে ক্ষোভ, অবজ্ঞা, অবহেলা বা অনীহা থাকলে, কুরআনের জন্যই তাকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত। তার ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত।
.
৪২. একা একা হিফয না করে, একজন শিক্ষকের অধীনে হিফয করা ভালো। আক্ষরিক অর্থে শিক্ষক না পেলে, একজন সহযোগী খুঁজে বের করা তো কঠিন কোনো কাজ নয়। তবে প্রথাগত শিক্ষক হলেই বেশি ভালো। তিনি চাপ দিয়ে পড়া আদায় করে নেবেন।
.
৪৩. আশেপাশের সবাই কুরআনের প্রতি উদাসীন, এই অজুহাতে নিজেও কুরআনের প্রতি অবহেলার মানসিকতা রাখা ঠিক নয়। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ, পরিচিত গ-ির প্রায় সবাই কুরআন হিফযের প্রতি আগ্রহী নয়, এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। আমাকেই আমার ব্যবস্থা নিতে হবে। কুরআনের হাফেয হতে হবে, দৈনিক হিযব আদায় করতে হবে, এটাই হবে আমার প্রধানতম প্রতিজ্ঞা। নিজের স্বার্থেই এটা করতে হবে। আমার আখেরাতকে সাজিয়ে তুলতেই আমাকে কুরআনের পথে পা-বাড়াতে হবে।
.
৪৪. কুরআনের পথে, হিফযের পথে, দৈনিক হিযব আদায়ের পথে, আমার চেয়ে যারা পিছিয়ে আছে, তাদের প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলার মনোভাব পোষণ করা সীমাহীন ক্ষতিকর। শুরুতে মাঝে এগিয়ে থেকেও কতজন শেষে গিয়ে পিছিয়ে পড়েছে। আমিও সেই দলে পড়ে যাব না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমাকে আল্লাহর কাছে বিনয়ের দোয়া করতে হবে।
.
৪৫. কুরআন হিফযের জন্য প্রচ- শক্তিশালী প্রতিজ্ঞা প্রয়োজন। হিফযুল কুরআন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম যোগ্যতা। শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান। শ্রেষ্ঠতম অর্জন। শ্রেষ্ঠতম স্বীকৃতি। যেনতেন চেষ্টায় এই বিশাল সম্মান অর্জন করা সম্ভব নয়। মরিয়া হয়ে না লাগলে, কুরআন সহজে ধরা দেবে না। আর এই দুর্লভ অর্জন এক-দুদিনেই সম্ভবপর হয়ে যাবে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর কাছে চেয়ে চেয়ে এই নেয়ামত লাভ করতে হবে।
.
৪৬. যা হিফয করছি, সেটার অর্থ ও তাফসীর বোঝা খুবই জরুরি। আল্লাহ তা‘আলা নিছক না বুঝে মুখস্থ করার জন্য কুরআন নাযিল করেননি। নাযিল করেছেন কুরআন বুঝে সে অনুযায়ী আমল করতে। আমি যা বুঝতে পারছি না, সেটা অন্ধের মতো হিফয করা, যুক্তিযুক্ত পদ্ধতি নয়। হিফযের জন্য আমি মরণপণ হলে, কুরআন বোঝার জন্য জীবনপণ হতে পারব না কেন?
.
৪৭. আমাদের দেশে কুরআন হিফযের সনদ নেয়ার প্রচলন নেই। হাদীস শরীফের যেমন সনদ আছে, ইলমুল কেরাতেরও সনদ আছে। হাদীসের সনদে যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, কেরাত বা হিফযের সনদেও থাকে। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে কুরআনে হাফেয হওয়ার তাওফীক দিলে, চেষ্টা করব একজন অভিজ্ঞ মুত্তাকী ওস্তাদের কাছ থেকে হিফযের সনদ নিতে। সমস্যা হলো, আমাদের দেশে হিফয সনদ গ্রহণের তেমন প্রচলন না থাকায় বড়ছোট বেশিরভাগ হাফেযের কাছেই হিফযের সনদ নেই। আমরা মাদরাসা বা বোর্ডের সনদের কথা বলছি না। সনদ মানে ‘ইজাযাহ’। আরবে এই সনদের ব্যাপক প্রচলন। অনলাইনেও ইজাযাহ লাভ করা যায়। সবচেয়ে ভালো হয়, হিফযের পাশাপাশি আল্লাহর কাছে ‘বায়তুল্লাহ’ যেয়ারতের তাওফীক চেয়ে দোয়া করা। মক্কা-মদীনা উভয় মসজিদেই সরকারি ব্যবস্থাপনায়, অনেক সনদধারী হাফেয/ক্বারী সাহেবান বসে থাকেন। আগ্রহীগণ তাদের কাছে পড়া শুনিয়ে সনদ গ্রহণ করতে পারেন।
আমিও মসজিদে নববীতে প্রতিদিন ফজরের পর, ২৬০ নম্বর জুতার বাক্সের কাছে, এক ওস্তাদের কাছে বসতাম। কিন্তু সনদ নেয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ইয়া আল্লাহ, আমাকে আপনার নবীর দেশে গিয়ে, হিফযের সনদ লাভের সৌভাগ্য দান করুন। এই লেখা যারা পড়বে, তাদেরও তাদের উপযুক্ত ওস্তাদের কাছ থেকে হিফযের সনদ লাভের অপূর্ব সৌভাগ্য দান করুন। আমীন।
হিফযের সনদ বা ইজাযাহ নেয়ার উদ্দেশ্য হলো, আমি কুরআনে হাফেয হয়েছি, এর স্বীকৃতি লাভ করা। আমি এখন অন্যকেও কুরআন শিক্ষা দিতে পারব, এই অনুমোদন লাভ করা। আমি যা শিখেছি, সেটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের শিক্ষা দিয়েছেন। সাহাবীগণ তাবেয়ীগণকে শিক্ষা দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমিও শিক্ষা লাভ করেছি। আমি সনদের সূত্র ধরে মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়ে সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকেই কুরআন শিক্ষা লাভ করেছি। সনদ হাসিলের পেছনে এমন একটা প্রতীকী রূপ থাকে।
আমাদের দেশে কি কোথাও এভাবে সনদ দেয়ার রেওয়াজ বিদ্যমান আছে? কুষ্টিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, ড. এবিএম হিযবুল্লাহ সাহেব, এ-বিষয়ে বেশ উচ্চকিত। তিনি পরিচিত সবাইকে এ-সনদের ব্যাপারে সচেতন করার চেষ্টা করেন। কারী হিসেবে হয়তো অতটা পরিচিত নন। অথচ যোগ্যতার বিচারে তিনি দেশের একজন প্রধানতম কারী। মদীনা ইউনিভার্সিটি থেকে ইলমুল কেরাতে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন। আমাদের জানামতে তিনিই দেশের একমাত্র ইলমুল কেরাতে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ব্যক্তি। রাব্বে কারীম তাকে দুনিয়া আখেরাতে খাইর ও বরকত দান করুন। তার পরিবার-পরিজনকে আমন ও আমানে রাখুন। আমীন।
.
৪৮. কুরআনি মাদরাসা, হিফযখানাগুলো ওস্তাদের প্রতি সম্মান দেখানোর কথা খুব বলা হয়। বলার দরকারও আছে। পাশাপাশি আরেকটা দিকও গুরুত্বের সাথে বলা দরকার, কুরআনি মাদরাসায় পড়তে আসা তালিবে ইলমরাও সম্মান পাওয়ার হকদার। তারা আল্লাহর মেহমান। তারা আল্লাহর কালাম শিখতে এসেছে। তাদের সম্মান করা মানে, আল্লাহকে সম্মান করা। তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করা মানে আল্লাহর সাথে দুর্ব্যবহার করা। তাদের দোষত্রুটি দুষ্টুমি উৎপাত সাধ্যমতো সবরের সাথে মেনে নেয়ার মাঝেই কল্যাণ নিহিত। অহেতুক শাসন করে, তাদের কুরআনবিমুখ করে দেয়া মহাপাপ।
.
৪৯. কুরআনের পথিককে সব সময় তার কলবের দিকে তীক্ষè নজর রাখতে হয়। কলবে রিয়া এসে গেল কি না, কলবে অহংকার এসে গেল কি না। আল্লাহর একান্ত বাছাই করা ব্যক্তিরাই কুরআনের পথিক হতে পারে। কুরআনের হাফেয হতে পারে। নিয়মিত দৈনিক হিযব আদায় করতে পারে। এ জন্য শয়তান সর্বশক্তি ব্যয় করে, তাদের পেছনে পড়ে থাকে। আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করাই আমাকে শয়তানের ফাঁদ থেকে বাঁচাতে পারে।
.
৫০. কুরআন শিক্ষার্থীকে সব সময় তার ওস্তাদের আদব বজায় রাখার প্রতি সতর্কদৃষ্টি রাখতে হয়। বর্তমানে একটা প্রবণতার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। অনেক সময় দীনি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, যোগ্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে। ইলম শেখার উদ্দেশ্যে নয়। যার কাছে নিয়মিত কুরআন শেখার সুযোগ হয়, নিয়মিত ইলম শেখার সৌভাগ্য হয়, তাকে পরীক্ষা করার জন্য প্রশ্ন করা চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ। নিজেকে কুরআনি ইলম থেকে বঞ্চিত করার পূর্বাভাস। ইলমের পথ পুরোটাই আদব-ইহতিরামের ওপর নির্ভরশীল। সাহাবায়ে কেরাম থেকে এই ধারা চলে আসছে। ইলম আসে আদবের পথে।
.
৫১. এখন টাকা দিয়ে সনদ কেনা যায়। দুনিয়াবি শিক্ষার মতো, কুরআনের বেলায়ও এমন পন্থা অবলম্বন করা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। যোগ্যতা ছাড়াই সনদ ইজাযাহ লাভ করা, নিজের প্রতি জুলুম করারই নামান্তর। দীনকেও টাকাপয়সা দিয়ে কেনাবেচার বিষয়ে পরিণত করা, কেয়ামতের লক্ষণ। ভুয়া লাইসেন্স বাগিয়ে হাতুড়ে ডাক্তারি করার চেয়েও, টাকায় কেনা সনদ দিয়ে, দীন বেচে খাওয়া আরও বেশি ভয়াবহ।
.
৫২. পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আনন্দ কী? কুরআনের হিফয সম্পন্ন করার আনন্দ। একজন তালিবে ইলম যখন হিফযের শেষ সবক ইয়াদ করতে বসে, শেষ সবক শোনানো শেষ করে, সেই সময় তার আবেগ উচ্ছ্বাস আর আনন্দের স্বরূপ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একজন হাফেয পুরো কুরআন হিফয করে, এক আয়াত এক আয়াত করে পড়ে, জান্নাতের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করারই আগাম ট্রায়াল দিলো।
.
৫৩. কুরআন কারীম হিফয করতে পারা, আল্লাহর অপার অনুগ্রহ। আল্লাহর এই বিরাট অনুগ্রহ লাভ করতে হলে, মরিয়া হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করার বিকল্প নেই। কুরআন হিফযের প্রধান সহায়ক শক্তি দোয়া, ছাত্রের মেধাশক্তি নয়। উঠতে-বসতে আল্লাহর কাছে তাওফীক চেয়ে দোয়া করা। কোনো সূরা সহজে মুখস্থ হতে না চাইলে দোয়ায় মশগুল হয়ে পড়া। কোনো পারা মুখস্থ করার পর ভুলে গেলে, কালবিলম্ব না করে, আল্লাহর দরবারে হাত পেতে বসে থাকা। আমার আত্মনিবেদন দেখে, আল্লাহ তা‘আলার রহমতের সাগরে ঢেউ উঠবে। তিনি আমাকে অনায়াসে হাফেয বানিয়ে দেবেন। ইন শা আল্লাহ।
.
৫৪. ইমাম দাহহাক রহ. বলেছেন, কেউ যখন কুরআন (হিফয করে বা পড়তে) শেখার পর ভুলে যাওয়ার একমাত্র কারণ ‘গুনাহ’। কুরআনে আছে,
وَمَاۤ أَصَـٰبَكُم مِّن مُّصِیبَةࣲ فَبِمَا كَسَبَتۡ أَیۡدِیكُمۡ
তোমাদের যে বিপদ দেখা দেয়, তা তোমাদের নিজ হাতের কৃতকর্মেরই কারণে দেখা দেয় (শুরা, ৩০)।
কুরআন ভুলে যাওয়ার চেয়ে বড় মুসীবত আর কী হতে পারে?
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা রহ.)।
.
৫৫. কুরআন তিলাওয়াত ও হিফযে দক্ষতা অর্জনের পথ তিনটি। বেশি বেশি অভিজ্ঞ কারী সাহেবানের কেরাত শোনা। নিজে বেশি বেশি পড়া। যা পড়া হয়েছে, হিফয হয়েছে, আরেকজনকে শোনানো।
.
৫৬. কুরআন হিফযের পথে সবচেয়ে বড় বাধা আশপাশ। বেশির ভাগ হাফেযে কুরআনই মা-বাবা বা আশেপাশের প্রভাবে কুরআন হিফয করেন। আবার চেষ্টা করেও হাফেয হতে না পারা অধিকাংশ ব্যক্তিও হিফয ছেড়ে দেন, আশেপাশের কথা বা আচরণে প্রভাবিত হয়ে। কুরআন হিফয করতে চাইলে, আশপাশ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কী হবে এত কষ্ট করে? হাফেয হওয়া ফরয ওয়াজিব কিছুই নয়, কেন এত কষ্ট করছ? তার চেয়ে বরং কুরআন বোঝার চেষ্টা করো, তাফসীর পড়ো, বেশি ফায়েদা হবে। এমন আরও নানা পরামর্শ আসতে থাকবে। এসবকে পেছনে ঠেলেই হিফযের দিকে পা বাড়াতে হবে।
.
৫৭. আমি কুরআন কারীম পড়তে শেখার সময়, হিফয করার সময়, যেসব ভুল করেছি, সেগুলো যতœ করে লিখে রাখা বা মনে রাখা। ওস্তাদজি আমার পড়া বা পড়ার পদ্ধতিতে যেসব ভুল ধরিয়ে দেন, সেগুলোও মাথায় রাখা। নিজে অন্যকে পড়ানোর সময় সেগুলো কাজে লাগবে।
.
৫৮. অভিজ্ঞ ওস্তাদের কাছে, একটা তাজবীদের কিতাব খুবই ভালো করে পড়ে নেয়া। মশক করে করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইলমে-আমলে অনেক বড় হলেও, কুরআন পড়া শুদ্ধ নয়, এমন মানুষও সমাজে দেখা যায়। পেছনে মুক্তাদি হলে, নামাজে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। অথচ দীর্ঘসময় লাগিয়ে মাদরাসায় পড়েছেন। অবশ্য এই চিত্র এখন কিছুটা বদলাচ্ছে।
.
৫৯. ছেলেকে ভর্তি করিয়ে, মাদরাসায় রেখে আসার সময়, আলিম বাবা পুত্রকে অশ্রুভেজা গলায় শেষ উপদেশ দিলেন, কোনো অবস্থাতেই কুরআন তিলাওয়াত ছাড়বে না। তুমি যত ইলম-কালামই শেখো, সবই কুরআনের জন্য। তুমি যতটুকু তিলাওয়াত করবে, অন্য ইলমে সে পরিমাণ বরকত তুমি আল্লাহর কাছ থেকে পাবে।
.
৬০. কিছু লোকের দৃষ্টিভঙ্গি কথাবার্তা শুনলে বেশ অবাক লাগে। তারা মুয়াল্লিমুল কুরআনকে সত্যিকারের মানুষ বলেই মনে করে না। তারা মনে করে, মুয়াল্লিমুল কুরআন সমাজের নিচুস্তরের লোক। সন্তানকে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি শিক্ষা দেয়ার জন্য টাকার মায়া করে না। টাকার যত মায়া মুয়াল্লিমুল কুরআনের বেলায়। দুনিয়ার পেছনে টাকা ঢালতে মন বাধে না, কুরআনের জন্য যাবতীয় অভাব-অনটনের ফিরিস্তি শুরু হয়ে যায়। সবারই জানা আছে, কুরআনের জন্য ব্যয় করা টাকার পুরোটাই আল্লাহর কাছে জমা থাকবে। তবুও দুনিয়া তাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখে।
.
৬১. কুরআন শিখতে গেলে, এমন শিক্ষকের কাছে যাওয়া, যার কাছে ইলমের আগে আমল শেখা যাবে। পেশাদার মুয়াল্লিমুল কুরআনের চেয়ে নেশাদার মুয়াল্লিমুল কুরআন বেছে নেয়া উত্তম। কুরআন কারীম যাদের নেশায় পরিণত হয়েছে, এমন শিক্ষক না পেলে অগত্যা পেশাদার মুয়াল্লিমুল কুরআনের দ্বারস্থ হতে হবে। নেশা ও পেশা একসাথে আছে, এমন শিক্ষক পেলে সোনায় সোহাগা।
.
৬২. আমি যত দক্ষ হাফেযই হই, আমার মধ্যে বিনয়ন¤্রতা না থাকলে, আমি ক্ষতির মধ্যে আছি। এমন হাফেযও দেখা যায়, তারা শুধুই কুরআনে হাফেয। অল্পবয়েসেই মিডিয়া-খ্যাতির পাল্লায় পড়ে, হিফযের পর আর পড়তে পারেননি। আল্লাহর ইচ্ছায় দেশে-বিদেশে ঘোরার কারণে টাকাপয়সা হয়েছে। এখন দেশের বড় আলিমকেও ছেড়ে কথা বলেন না। যথাযথ সম্মান বজায় রাখেন না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এমন বেয়াড়া আচরণ হাফেযে কুরআনের সাথে যায় না। গলা আর টাকার জোর স্থায়ী কোনো ‘অবলম্বন’ নয়। শুধু কুরআন মুখস্থ করলেই হবে না, কুরআনের শিক্ষা জীবনে ধারণ করা উচিত।
.
৬৩. দৈনিক হিযব নিয়মিত আদায় করার একটি উপায় হলো, হিযব আদায়কে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মতো আবশ্যকীয় অভ্যেসের মতো করে নেয়া। নামায ছুটে যাওয়ার কথা মনে হলে যেমন ভয় লাগে, হিযব ছুটে গেলেও যাতে সে-রকম ভয়ের অনুভূতি জেগে ওঠে। নামায আদায় না করলে যেমন অস্থির অস্থির লাগে, হিযব ছুটে গেলেও যেন সে রকম অস্থিরতা তৈরি হয়।
.
৬৪. হেফযখানার ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষকের সমালোচনা করার প্রবণতা কাজ করে। এই প্রবণতা সম্পূর্ণরূপে পরিহারযোগ্য। মা-বাবাকেও এ-ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। সন্তান যেন কিছুতেই ওস্তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ না করে। বেশির ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ওস্তাদ যৌক্তিক কারণে শাসন করলেও, দুষ্ট সঙ্গীদের পাল্লায় পড়ে, ভালো শিশুরাও ওস্তাদের সমালোচনায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। অভিভাবকদের এ-বিষয়টা খুবই গুরুত্বের সাথে খেয়াল রাখা জরুরি।
.
৬৫. হিফযের সবক শোনাতে গেলে, ভুল করলে ওস্তাদ অনেক সময় সবক না শুনে ফেরত পাঠিয়ে দেন। হেফযখানার পরিভাষায় বলা হয় ‘উঠিয়ে দেন’। একই সবকের জন্য বারবার উঠিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। ছাত্রকে এমন পরিস্থিতিতে মন খারাপ করতে নেই। ভেঙে পড়তে নেই। মা-বাবা আর ওস্তাদকেও ছাত্রের মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনায় রাখা জরুরি। ছাত্র যেন বিগড়ে না যায়। ছাত্রকে বলতে হবে, কুরআন শরীফ বারবার পড়তে পারা, আল্লাহর নেয়ামত। বাধ্য হয়ে পড়ার মানে এও হতে পারে, আল্লাহ তোমার পড়াটা বারবার শুনতে চাচ্ছেন। তাই সহজে সবকটা মুখস্থ হচ্ছে না। যতবার পড়ছ তোমার সওয়াব হচ্ছে। আল্লাহর দরবারে তোমার মর্যাদা বুলন্দ হচ্ছে।
.
৬৬. অতিব্যস্ত জীবনে দৈনিক হিযব আদায়ের জন্য একটানা লম্বা সময় পাওয়া না গেলেও সমস্যা নেই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প করে হিযব আদায় করে নেয়া যেতে পারে। একবারে এক পৃষ্ঠা আধা পৃষ্ঠা করে পড়া সহজ। কাজের ফাঁকে সামান্য তিলাওয়াত কাজেও নতুন শক্তি উৎসাহ মনোযোগ এনে দেবে। কাজের অবসাদ দূর করতেও কুরআনি টনিক ব্যবহার করা যায়। প্রচ- কাজের চাপে, ত্রিশ সেকেন্ড বিরতি দিয়ে কুরআন কারীম খুলে একটা লাইন পড়ে নিতে পারি। এটা হতে পারে, গুমোট পরিবেশে বিশুদ্ধ বাতাস।
.
৬৭. শরীরের মতো আমার মাথা ও মনেরও বিশ্রাম প্রয়োজন। কুরআন তিলাওয়াতই হতে পারে সেই বিশ্রাম। হাঁটাচলায় কুরআন পড়তে পারি। হাঁটার কষ্ট অনেকটাই দূর হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা তৈরি হলে, মুসহাফ খুলে একটু কুরআন পড়ে নিতে পারি। কুরআনকে বানাতে হবে সার্বক্ষণিক সঙ্গী। একবারের বসায় বেশি পড়ার দরকার নেই। একটা আয়াত পড়েই মুসহাফ রেখে দিতে পারি। তবুও কুরআনের সাথে সংযোগ অটুট থাকুক।
.
৬৮. কারও কুরআন তিলাওয়াত শোনার সময়, ঘুণাক্ষরেও ভুল ধরার মানসিকতা মনে স্থান দেয়া যাবে না। ভুল ধরা পড়লে, আমি ‘পারি’, অন্যে ‘পারে না’ এই মনোভাবকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। এক ছোট্ট হাফেয তার ওস্তাদকে বলল, হুজুর আমি ওমুক বিখ্যাত কারীর পুরো কুরআন শুনে, সর্বমোট পাঁচটি ভুল ধরেছি। হুজুর উত্তর দিলেন, সুবহানাল্লাহ পুরো ত্রিশ পারায় মাত্র ‘পাঁচটি’? তাহলে তো তিনি বহু ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন।
বুদ্ধিমান ওস্তাদ ছাত্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন। ছাত্রের ভুল প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেননি। কুরআনের সাথে কোনোভাবেই অহংকারকে মেশানো যাবে না। কুরআনের সাথে থাকতে হবে বিনয় নিয়ে।
.
৬৯. তৃতীয় হিজরীর বিখ্যাত বুযুর্গ, সাহল তুস্তরী রহ.। তাঁর এক ছাত্রের কাছে জানতে চাইলেন, কুরআন হিফয করেছ? জি না। সুবহা-নাল্লাহ! এ কেমন মুমিন, কুরআন হিফয করে না? তাহলে তুমি কী দিয়ে গুনগুন করবে? কী নিয়ে আনন্দ উদযাপন করবে? কী দিয়ে তোমার রবের সাথে কথা বলবে?
.
৭০. আল্লাহ তাওফীক দিলে কী না সম্ভব? ইমাম আল্লামা কাযি ইযযুদ্দীন বিন জামা‘আহ রহ.। ৮১৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। বেশি বয়েসে ইলম শেখা শুরু করেছিলেন। মাত্র এক মাসে পুরো কুরআন হেফয করে ফেলেছিলেন।
-বুগইয়াতুল উ‘আত, আল্লামা সুয়ূতী রহ.।
.
৭১. মুয়াল্লিমুল কুরআনের কী অপূর্ব সৌভাগ্য! প্রতিদিন তার কাছে কত ছাত্র কুরআন পড়তে আসে। ছাত্ররা হাজার হাজার হরফ তিলাওয়াত করে। সবগুলোর সওয়াব ওস্তাদের আমলনামায় লেখা হয়। মুয়াল্লিমুল কুরআনের এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?
.
৭২. তাজভীদ শেখার পর, প্রথম প্রথম কিছুদিন কুরআন তিলাওয়াত সাবলীল থাকে না। মুখে আটকায়। বারবার আটকাতে হয়। ইলমুল কেরাতে অভিজ্ঞ কোনো ওস্তাদের কাছে পড়তে গেলেও প্রথম প্রথম এত ভুল ধরা পড়ে, অনেক সময় মনে হয়, ইহজনমে বুঝি শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করতে পারব না। ধৈর্য ধরে কয়েক দিন মশক চালিয়ে গেলে, আর সমস্যা থাকে না। সহজ হয়ে ওঠে। মুখের আড় ভাঙতে থাকে। তিলাওয়াতও সাবলীল ফুরফুরে হয়ে ওঠে। ওস্তাদের কাছে অনুশীলনের পাশাপাশি বেশি বেশি অভিজ্ঞ কারী সাহেবানের তিলাওয়াত শুনতে হবে। বেশি বেশি নিজে তিলাওয়াত করতে হবে।
.
৭৩. মুতাশাবিহাত আয়াত নিয়ে হাফেযদের অনেক ভুগতে হয়। পাকাপোক্ত ইয়াদ আর বেশি বেশি চর্চা ছাড়া, মুতাশাবিহাতের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার ভিন্ন কোনো পথ নেই। বাজারে এ-বিষয়ে বহু কিতাব আছে। সেগুলোর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি, নিজেও মুতাশাবিহাতের খাতা বানিয়ে নিতে পারি। নিজে বানালে সুবিধা হলো, বিষয়টা বেশি চর্চা হয়। জেহেনে বসে। অন্য কিতাব সামনে রাখলে, চর্চা কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়।
.
৭৪. হাফেযে কুরআন বড় আলেম হয়ে গেলেও, ছোটবেলার হিফযের শিক্ষককে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। নূরানী-হিফয বিভাগের ওস্তাদকে সব সময় আদর-যতœ, আদব-ইহতিরাম করে যাওয়া জরুরি। তারা আমার ভিত গড়ে দিয়েছেন। প্রতিটি দোয়ায় তাদের কথা স্মরণ রাখা জরুরি। তারা আমার মাতা-পিতার মতোই। আমার পেছনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
.
৭৫. বড় ও বিখ্যাত ওস্তাদের কাছে যেতে অনেক সময় ভয় কাজ করে। তারা আমার মতো ছোট ছাত্রকে গ্রহণ করবেন কি না, এ-নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়। সংকোচের কারণে তাদের কাছ থেকে কিছু শেখা হয়ে ওঠে না। সংকোচ ঝেড়ে ফেলে, সরাসরি তাদের দরবারে হাজির হয়ে যাওয়া উচিত। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। কাক্সিক্ষত ব্যক্তিটি খুবই বিনয়ী। ছাত্রবৎসল। কুরআনি ইলমের জন্য মনে কোনো ভয় বা জড়তা রাখা উচিত নয়। কুরআনি ইলমের জন্য মরিয়া হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
.
৭৬. মুয়াল্লিমুল কুরআনের দায়িত্ব, জরুরি ভিত্তিতে একটি কাজ নিয়মিত করা। শিষ্যদের সামনে কুরআন-বিষয়ক আয়াতগুলো নিয়মিত তুলে ধরা। আয়াতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তাদের মনে গেঁথে দেয়া। বিশেষ করে এই আয়াত,
وَمَنۡ أَعۡرَضَ عَن ذِكۡرِی فَإِنَّ لَهُۥ مَعِیشَةً ضَنكًا وَنَحۡشُرُهُۥ یَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ أَعۡمَىٰ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِیۤ أَعۡمَىٰ وَقَدۡ كُنتُ بَصِیرًا قَالَ كَذَ ٰ⁠لِكَ أَتَتۡكَ ءَایَـٰتُنَا فَنَسِیتَهَاۖ وَكَذَ ٰ⁠لِكَ ٱلۡیَوۡمَ تُنسَىٰ
আর যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন হবে বড় সংকটময়। আর কিয়ামতের দিন দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাব। সে বলবে, হে রব্ব, তুমি আমাকে অন্ধ করে উঠালে কেন? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম! আল্লাহ বলবেন, এভাবেই তোমার কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আজ সেভাবেই তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে (ত্বহা, ১২৪-১২৬)।
.
৭৭. হিফযখানায় ওস্তাদজি কুরআনের আয়াত দিয়েই শিষ্যদের উপদেশ দেবেন। পঠিত আয়াত সাধ্যমতো নিজের ভাষায় বুঝিয়ে দেবেন, তাদের যেকোনো সমস্যার সমাধান কুরআন থেকে দেয়ার চেষ্টা করবেন। অন্তত সরাসরি প্রাসঙ্গিক না হলেও, ধারেকাছের অন্তত একটি আয়াত পাঠ করবেন।
.
৭৮. কুরআন কারীম হিফয অনেকেই করতে পারে। কিন্তু অল্পসংখ্যক মানুষ আছে, যারা আল্লাহর প্রতি নতজানু হয়ে, সমর্পিত চিত্তে, বিনয়ন¤্রতার মনোভাব নিয়ে হিফয করে। প্রতিটি সূরা শুরুর আগে, প্রতিদিন নতুন হিফয করতে বসার আগে, নিজের সবকিছু আল্লাহর কাছে সোপর্দ করা উচিত। নিছক নিজের মেধামেহনতের ওপর আত্মবিশ^াস রেখে আল্লাহর ভূমিকাকে গৌণ করে ফেলা মুমিনের কাজ নয়। হিফয করার সময়, প্রতিটি মুহূর্তে মনে রাখা দরকার, আমার কোনো শক্তি নেই, একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ আর তাওফীকের বদৌলতেই আমি হিফয করতে সমর্থ হব। একজন সুদক্ষ হাফেয হতে গেলে, সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার ওপর তাওয়াক্কুলের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহর মহা কুদরতের কাছে নিজের দুর্বলতা অসহায়ত্ব স্বীকার করা ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই।
.
৭৯. কুরআনে হাফেযের উচিত, নিজের নেক আমলের কথা মনে না রাখা। যথাসম্ভব নিজের নেককাজগুলো ভুলে থাকা নিরাপদ। নিজের নেক আমলকে যথেষ্ট বা পর্যাপ্ত মনে করার মানসিকতা থাকলে, পরিহার করা জরুরি। পাশাপাশি পুরো কুরআন হিফয হয়েছে বা এত এত পারা হিফয হয়েছে, এটা নিয়ে মনের মধ্যে গরম ভাব রাখাও বিপজ্জনক। এমন মানসিকতা থেকে অহংকার জন্মায়। আল্লাহ তা‘আলা অহংকারী থেকে নেয়ামত ছিনিয়ে নেন। আল্লাহ না করুন, কুরআনের হিফয ছিনিয়ে নিলে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর হতে পারে না।
.
৮০. কুরআনের প্রতি উদাসীন বা কুরআন হিফযের প্রতি আগ্রহী নয়, এমন কাউকে কুরআনের প্রতি আগ্রহী করে তোলার কার্যকর একটি উপায় হচ্ছে, নিজের হিফয করা অংশ থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে তাকে শোনানো। সে কুরআন খুলে পড়া ধরবে। ভুল হলে বলে দেবে। নিয়মিত কিছুদিন কাজটা চালিয়ে যেতে হবে। ইন শা আল্লাহ কুরআনের প্রতি তার আগ্রহ বাড়বেই।
.
৮১. ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কুরআন হিফযে কোনো টাকা খরচা নেই। কুরআন হিফয়ে সময়ের অপচয় হওয়ার ভয় নেই। পৃথিবীর যাবতীয় শাস্ত্র মুখস্থ করলে, তার সবটা কাজে না লাগারও সম্ভাবনা থাকে। একমাত্র কুরআন কারীম ব্যতিক্রম। যতটা মুখস্থ করব, তার পুরোটাই কাজে লাগবে। এখানে দুনিয়াতে, ওখানে আখেরাতেও। কুরআন হিফযের পেছনে সময় ব্যয় করলে, আমার অন্য কাজে ব্যাঘাত ঘটবে, এমনটা ভাবা উচিত নয়। আমি মুসলিম হলে, আমার জীবন-মরণ, সময়মেধাশ্রম সবই তো কুরআনের তরে হওয়া উচিত ছিল। কুরআনের সাথে সময় কাটানোকে জীবনের জন্য, রুজি-রোজগারের জন্য ক্ষতিকর ভাবছি কী করে? কুরআন কি নিজেই ‘মুবারক’ নয়? বরকতময় নয়? এ তো আল্লাহ তা‘আলারই স্বীকৃতি।
.
৮২. প্রতিজ্ঞা করার পরও দৈনিক হিযব আদায় করা হয়ে উঠছে না? বারবার চেষ্টা করার পরও ব্যর্থ হচ্ছি? আমাকে দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখতে হবে। ভালো করে পরীক্ষা করতে হবে, আমি কোনো গুনাহে লিপ্ত আছি কি না। আমি এমন কোনো কাজ করছি কি না, যা অজান্তেই আমাকে কুরআন থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। এমন কোনো বই পড়ছি কি না, যার বিষয়বস্তু মনে ‘অন্ধকার’ সৃষ্টি করে। মোবাইল/টিভি/ল্যাপটপে এমন কিছু দেখছি কি না, যা দুনিয়া-আখেরাতে কোনো কাজেই আসে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন কারও সাথে যুক্ত কি না, যার সাথে যোগাযোগ রাখা সম্পূর্ণ হারাম। এমন কোনো বন্ধু আছে কি না, যার সাথে ওঠাবসা করলে আখেরাতের চেয়ে দুনিয়ার দিকে মন বেশি ঝুঁকে পড়ে? এমন কোনো আড্ডায় বসি কি না, যেখানে শুধু দুনিয়া আর দুনিয়া নিয়েই কাজকারবার হয়? আমার পাতে যে খাবার উঠছে, সেখানে সুদঘুষজুলমের চিহ্ন নেই তো? নামাযের সময় এসে চলে যাচ্ছে দেখেও দুনিয়াবি কাজে মশগুল থাকছি না তো? এসব ঠিক থাকলে, দৈনিক হিযব এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
.
৮৩. কুরআন হিফয করলে দুনিয়ার বড় কোনো পদমদ লাভ হবে না। কুরআন হিফয আমাকে হয়তো দুনিয়াবি প্রাপ্তি জুটিয়ে দেবে না। তবে, কুরআন হিফয আমাকে আল্লাহর রহমত এনে দেবে। আমাকে আল্লাহর খাস আর বিশেষ বান্দায় পরিণত করবে। আমাকে বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করবে। আমাকে আত্মিক রোগব্যাধি থেকে পবিত্র রাখবে। আমাকে ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করবে। আমাকে সঠিক-সরল পথে পরিচালিত করবে। আমাকে শুধু হিফযের পাশাপাশি একটু একটু করে বোঝার চেষ্টাও করতে হবে।
.
৮৪. আমাকে আগে ঠিক করতে হবে, কুরআন কারীম আমার কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কি না। এটা নির্ধারিত হলে, অনেক প্রশ্নের উত্তর এমনি এমনি স্পষ্ট হয়ে যাবে। কুরআন কারীম আমার কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হলে, দৈনিক হিযব আদায়ে ব্যস্ততার অজুহাত থাকবে না। কারণ, তখন যত ব্যস্ততাই থাকুক, সব কুরআনের নিচে।
.
৮৫. দৈনিক হিযব আদায়ের অন্যতম উপকারিতা হলো, কলবকে প্রশান্ত করে তোলে। মনের অস্থিরতা দূর করে। মনের আঁধারকে আলোয় ভরিয়ে তোলে। ভেতরের পাপকে পুণ্যে রূপান্তরিত করে। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গপূর্ণ করে তোলে। সর্বোপরি জীবনকে বরকতময় করে তোলে।
যেমনটা কুরআনে আছে (كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ إِلَیۡكَ مُبَـٰرَكٌ)এটি এক বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি (সোয়াদ, ২৯)।
.
৮৬. তিলাওয়াতের আগে ও পরে, হিফযকারী ও দৈনিক হিযব আদায়কারীর কিছু অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
. তিলাওয়াত শুরুর আগে, নিয়ত দুরুস্ত করে নেয়া। ইখলাস বিশুদ্ধ করে নেয়া। ইখলাস মানে, শুধু আল্লাহর জন্যই কোনো আমল করা। আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা। আল্লাহর কাছে নিজের অক্ষমতা দুর্বলতা তুলে ধরা। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে সাহায্য প্রার্থনা করা।
. তিলাওয়াত শুরুর আগে বেশি বেশি ইস্তেগফার করা। মনকে আল্লাহমুখী করে তাওফীক চেয়ে দোয়া করা। এতে তিলাওয়াত সহজ হয়ে উঠবে। হিফয করলে দ্রুত মুখস্থ হবে। ইন শা আল্লাহ।
. যদ্দূর হিফয হয়েছে, সেটাকে সলাতে পড়ার চেষ্টা করা। আগে যা হিফয হয়েছে, যতটুকু সম্ভব সেটাও সলাতে তিলাওয়াতের চেষ্টা করা।
. গুনাহ থাকলে, হিফয থাকে না। তাই গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। নজরের হেফাজত করা। জবানের হেফাযত করা। অনর্থক কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা।
তিলাওয়াত-পরবর্তী কিছু করণীয়,
. নির্দিষ্ট পরিমাণ হিফয ও তিলাওয়াত শেষে আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করা। অন্তর থেকে আল্লাহর শোকর আদায় করা। তিনি তাওফীক দিয়েছেন, এ জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ গদগদ থাকা।
. তিলাওয়াতের সময় যেসব আয়াত ভাবিয়ে তুলেছিল, সেসব আয়াত আবার ভাবনায় আনা। সম্ভব হলে ভাবনাগুলো লিখে রাখা বা অন্য কারও সাথে কথা বলে নেয়া।
. আগ্রহের শেষসীমা পর্যন্ত তিলাওয়াত না করা। আগ্রহ একটু বাকি রেখেই তিলাওয়াত শেষ করা।
. যা তিলাওয়াত করেছি, যা হিফয করেছি, সেটা আমলে আছে কি না, যাচাই করে দেখা। আমল না থাকলে ইলমে বরকত থাকে না।
.
৮৭. দৈনিক হিযব আদায় করতে পারছি, প্রতিদিন কিছু কিছু হিফয করতে পারছি, এ জন্য আল্লাহর প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকা। উঠতে বসতে এ জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। ইলমের পূর্ণতা আমল ও শোকরে। ইলমে বরকত আসে আমল আর শোকরের দ্বারা,
لَىِٕن شَكَرۡتُمۡ لَأَزِیدَنَّكُمۡۖ
তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদের আরও বেশি দেবো (ইবরাহীম ৭)।
.
৮৮. আমি কি কুরআনে হাফেয? হাফেয না হলেও, আমার কি সাধারণের তুলনায় একটু বেশি কুরআন মুখস্থ আছে? আমি কি আমার মুখস্থ থাকা সূরা বা আয়াতগুলো নিয়মিত নামাজে তিলাওয়াত করি? কেন করি না? নামাজে পড়ার মতো মুখস্থ নেই বলে? নামাজেই যদি তিলাওয়াত না করলাম, তাহলে এই মুখস্থের কী দাম রইল?
.
৮৯. ছোট ছোট সূরা দিয়ে নামাজ পড়ার বাইরে গিয়ে, তিলাওয়াত করাকে কঠিন কাজ মনে হয়? এটা ভুল ধারণা। কাজটা মোটেও কঠিন নয়। প্রয়োজন সদিচ্ছার। আমাকে প্রথমে ঠিক করতে হবে, কোন কোন সূরা বেশি ইয়াদ আছে। প্রথমে সেগুলো দিয়ে শুরু করতে হবে। হিম্মত না হলে, নামাজে দাঁড়ানোর আগে কাক্সিক্ষত সূরাটা বারবার ইয়াদ করে নিতে হবে। পরিমাণ অল্প করে হলেও কাজটা শুরু হোক। কাজটা কঠিন মনে হলেও, মোটেও কঠিন নয়। আস্তে আস্তে পুরো কুরআনকে নামাজের তিলাওয়াতে নিয়ে আসতে হবে। তাহাজ্জুদে, আগে-পরের সুন্নত নফলে। ইন শা আল্লাহ।
.
৯০. কুরআন হিফযের সময় একটা ভুল প্রায় সবাই করে, প্রতিদিন নতুন আয়াত হিফযের প্রবল আগ্রহে পুরোনো হিফযের কথা ভুলে যায়। নতুনের মতোই পুরোনো হিফযকে গুরুত্ব দিয়ে পড়তে হবে।
.
৯১. আল্লাহর অশেষ রহমত, তিনি আমাদের এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। হায়াত আর কতটুকু বাকি আছে, সেটা আমরা কেউ জানি না। আমি চাইলে কুরআনের হাফেয হয়ে কেয়ামতের ময়দানে হাজির হতে পারি। এখনই প্রতিজ্ঞা করে হিফয শুরু করে দিতে পারি। শেষ করতে পারি আর না পারি, হিফয-প্রত্যাশীদের তালিকায় তো একবার নাম উঠিয়েছি। শেষবিচারের দিন এই তালিকায় নাম থাকাও নাজাতের উসীলা বনে যেতে পারে। আর দেরি কেন?
.
৯২. কুরআন কারীম হিফয করতে পারা আল্লাহর দেয়া এক বড় নেয়ামত। আমি কুরআনকে সীনায় সংরক্ষণ করলে, কুরআনও আমাকে নিচু অনৈতিক কাজ থেকে রক্ষা করবে। অনর্থক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা করবে। মিথ্যা-ভ্রান্ত চিন্তা থেকে রক্ষা করবে। অনৈতিক অশ্লীল আচরণ থেকে রক্ষা করবে। আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহ থেকে রক্ষা করবে। কুরআন হিফয আমাকে আকাশের উচ্চতায় উন্নীত করবে।
.
৯৩. ভালো হাফেয হতে পারলে, ভালো কারী হতে পারলে, অনেক সময় মনে অহংকার জন্মায়। তখন তিলাওয়াতে রিয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমি কীভাবে বুঝব আমার কুরআনি মেহনতে রিয়ার সংমিশ্রণ আছে কি না?
আমি অন্যকে তিলাওয়াত শোনানোর সময়, অন্যকে নিজের কুরআন-বিষয়ক যোগ্যতার কথা বলার সময়, যদি তাকে মুগ্ধ করা, নিজের কৃতিত্ব জাহির করা হয়, তাহলে এটা রিয়া। আর যদি সওয়াবের আশায় হয়, অন্যকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য হয়, এটা ইবাদত। আশা করা যায়, আল্লাহ কবুল করবেন।
.
৯৪. যখন আমি আত্মমুগ্ধ হয়ে তিলাওয়াত করি, অন্যদের চেয়ে নিজেকে সেরা শ্রেষ্ঠ মনে করে, অন্যদের মুগ্ধদৃষ্টি আর প্রশংসা লাভ করতে চাই—আমি রিয়াকারী। যখন আমি অন্যদের কুরআনের নূর বিতরণের উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করি, অন্যদের আনন্দ দেয়ার জন্য তিলাওয়াত করি, অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিলাওয়াত করি—আমি ইবাদতকারী। ইন শা আল্লাহ।
.
৯৫. বড় হয়ে হিফয শুরু করলে, প্রথম দিকে যাকে-তাকে বলে বেড়ানো ঠিক নয়। অনেক সময় মুখদোষ লাগে বা নেতিবাচক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়। যাদের কাছে দোয়া পাওয়া যাবে, উৎসাহ প্রেরণা পাওয়া যাবে, তাদের বলা যেতে পারে। তবে যতটা সম্ভব গোপন রাখাই নিরাপদ। হিফযের শুরুতে নিজের ‘ইখলাস’ ঠিক করে নেয়া। বারবার যাচাই করে নেয়া, আমি আল্লাহর জন্যই হিফয করছি তো? অনেক সময় হিফযের শুরুতেই ইখলাস দুর্বল হয়ে যায়। হিফয শুরু করার পর, অন্যদের বলার জন্য মন নিশপিশ করতে থাকে। কেউ গান শিখলে, সুযোগ পেলেই সেটা অন্যদের শুনিয়ে মুগ্ধদৃষ্টি দেখতে চায়। কুরআন যেন গানের মতো হয়ে না যায়।
.
৯৬. কুরআন কারীম হিফয করতে পারা, আল্লাহর অনেক বড় অনুগ্রহ। এই নেয়ামত পেয়ে আনন্দিত হওয়াও ইবাদত। কিন্তু আনন্দ যেন রিয়া আর তাকাব্বুর হয়ে না যায়, সেদিকে সতর্কদৃষ্টি রাখা জরুরি। শয়তান সব সময় ওত পেতে আছে। তবে জোর করে গোপন করাও ঠিক নয়, যার-তার কাছে প্রকাশ করাও ঠিক নয়। স্বাভাবিকভাবে আপন কাজ করে যাওয়াই ভালো। শুধু খেয়াল রাখা, ইখলাস ঠিক আছে কি না। নিয়মিত আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে দোয়া করে গেলে, আল্লাহর কাছে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় চাইতে থাকলে, লোকে জানলেও সমস্যা নেই। শয়তানও সুবিধা করতে পারবে না। আল্লাহই রক্ষা করবেন।
.
৯৭. দৈনিক হিযব আমার জন্য নেয়ামত। আমার ওপর বোঝা নয়। নিয়মিত আমার নিয়তের অবস্থা যাচাই করে নেব। আমি কেন হিযব আদায় করি? এই প্রশ্নের উত্তর সব সময় মনে হাজির রাখলে, হিযববিরোধী অনেক সমস্যা এমনি এমনি সমাধান হয়ে যাবে। অনীহা নিয়ে হিযব আদায়ে উপকার কম। কুরআন বড় আত্মমর্যাদাবোধ-সম্পন্ন কিতাব। উদাসীন কলবে কুরআন বসে না। ধীরস্থির তিলাওয়াত, বিনয়ন¤্র সুর কুরআনকে কাছে টানে।
.
৯৮. তিলাওয়াতের আগে, আমার মনে বসিয়ে নিতে হবে, আমি সাধারণ কোনো গ্রন্থ পাঠ করতে যাচ্ছি না। আমি মহান রাব্বুল আলামীনের কালাম তিলাওয়াত করতে যাচ্ছি। আল্লাহর কুদরত, আল্লাহর বড়ত্ব, আল্লাহর শক্তি উপলব্ধিতে জাগরূক রেখে তিলাওয়াত শুরু করতে হবে। একটু পরপর মনে হাজির করতে হবে, তিলাওয়াতকালে আমি প্রতিনিয়ত রহমত নূর হেদায়াত শিফা লাভ করছি।
.
৯৯. দৈনিক হিযব আদায়ের অন্যতম একটি উপকার হলো, আমি অনুভব করেছি, দীর্ঘদিন ধরে আমার মধ্যে থাকা কিছু বদভ্যেস, যেগুলো আমি শতচেষ্টা করেও দূর করতে পারছিলাম না, দৈনিক হিযব শুরু করার পর, আলহামদুলিল্লাহ সেগুলো সহজেই দূর হয়ে গেছে। দৈনিক হিযব আদায়ে নিজেকে সহজেই ভালোর দিকে পরিচালিত করা যায়। নিজেকে অনায়াসে নেক আমলের দিকে বাড়ানো যায়। নিজের মধ্যে থাকা নানাবিধ সমস্যা দূর হতে শুরু করে।
.
১০০. আমি অটল-অচল প্রতিজ্ঞা করে নিই, যেকোনো মূল্যে ফজরের পরপরই দৈনিক হিযব আদায় করে ফেলব। এই সময়ে বেশি বরকত পাওয়া যায়। এই সময়ের তিলাওয়াতের প্রভাবও মনের ওপর বেশি পড়ে। শেষ-রাতে আদায় করতে পারলে আরও উত্তম। একান্ত অপারগ হলে, এই দুই সময় ছাড়া অন্য সময় হিযব আদায় করা যেতে পারে।
.
১০১. কুরআন হিফযের দশ সূত্র :
. নিয়ত সহীহ করা। নিয়তে ইখলাস আনা। শুধুই আল্লাহর জন্য হিফয করছি। একমাত্র আল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্য হিফয করছি।
. আল্লাহর কাছে ইস্তে‘আনত-সাহায্য চাওয়া।
. কাকুতিমিনতি করে আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করে দোয়া করা।
. যেটুকু হিফয করব, একজন অভিজ্ঞ শায়খের কাছ থেকে শুনে নেয়া।
. সরাসরি কুরআন হাতে নিয়ে বারবার তাকরার আওড়ানো। দোহরানো। রিপিট করা। পুনরাবৃত্তি করা।
. কুরআন বন্ধ করে বারবার তাকরার করা।
. তাহাজ্জুদে-নফলে-সুন্নতে পড়া।
. নতুন পড়ার সাথে সাথে পেছনের পড়া নিয়মিত ইস্তেহযার—নতুন করে যাচাই করে দেখা।
. আয়াতের তরজমা-তফসীর দেখে নেয়া।
১০. আয়াতকে আমলে পরিণত করা।
.
১০২. আমি কুরআন কারীমের একটি আয়াত হেফয করতে পারলে, একটি আয়াতের তরজমা-তাফসীর বুঝতে পারলে, এর কৃতিত্ব কখনো কিছুতেই নিজের দিকে টেনে নেব না। আমার ছোট থেকে ছোট অর্জনও আল্লাহর অপার কৃপা ও অশেষ অনুগ্রহেই অর্জিত হয়েছে, এই মনোভাব সব সময় মনে হাযির-নাযির রাখা। ছোট অর্জনের জন্যও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়া।
.
১০৩. জাগ্রত হৃদয়ে দৈনিক ‘বিরদ’ আদায় করলে, আমার মধ্যে পরিবর্তন আসবেই। নিয়মিত ‘হিযব’ আদায় আমাকে হকের পথে অটল-অবিচল রাখবে। মাথার ওপর দুঃখ-দুশ্চিন্তার পাহাড় জমে থাকলেও, দৈনিক বিরদ সবকিছু দূর করে দেবে। অনেক চিন্তা ও বিশ্বাস এমন আছে, যেগুলো বাস্তবে ভ্রান্ত হলেও, সেগুলোর ভ্রান্তি আমার কাছে পরিষ্কার নয়, দৈনিক হিযব আদায়, আমার মাথা থেকে এসব ভ্রান্ত চিন্তাগুলো দূর করে দেবে। চিন্তাগুলোর ভ্রান্তি আমার কাছে পরিষ্কার করে দেবে। কিছু ভ্রান্তি থাকে, পরিবার-পরিবেশ থেকে আসে। জন্ম থেকেই এসব ভ্রান্ত আচার দেখে দেখে বড় হয়। এসব ভ্রান্ত চিন্তা-আচারকে সঠিক অভ্রান্ত মনে করেই বড় হয়। এমন শেকড় গেড়ে বসা ভ্রান্তিও নিয়মিত আন্তরিক হিযব আদায়ে দূর হয়ে যায়। ইন শা আল্লাহ।
.
১০৪. আমাকে দৃঢ়সংকল্প করে নিতে হবে, ফজরের আগে বা পরেই দৈনিক হিযব/বিরদ আদায় করে ফেলব। এই সময় তিলাওয়াতের অন্যরকম এক শক্তি থাকে। আগের হিফয ধরে রাখার জন্যও এই সময়ের তিলাওয়াত বেশি উপকারী। অভিজ্ঞজনের পরামর্শও এমন।
.
১০৫. দৈনিক হিযব আদায়ের অপূর্ব এক প্রভাব লক্ষ করেছি আমার জীবনে। কুরআনি হিযবের প্রভাবে আমার চারপাশের সবকিছু সহজ হয়ে যায়। প্রতিটি কাজে পদক্ষেপে আল্লাহর অনুগ্রহ আর করুণা অনুভব করি। নিয়মিত হিযবের প্রভাব অনেক বদ্ধ দুয়ারও সহজে খুলে যেতে দেখেছি। দৈনিক বিরদের বরকতী ছোঁয়ায় আমল-আখলাকেও উন্নতি দেখেছি। ফরয-নফল ইবাদতে উৎসাহ-উদ্দীপনা অনুভব করেছি। কুরআনের প্রভাবে কেমন যেন মনে হয়, আমার অদৃশ্য কিছু সহযোগী সেবক খাদেম আছে। তারা অগোচরে আমার কাজগুলো এগিয়ে রাখে। মানুষ যদি জানত, কুরআনের সাথে লেগে থাকার কী বরকত আর হাকীকত, তাহলে কুরআন ছেড়ে উঠতেই চাইত না। দৈনিক হিযব/বিরদের পরিমাণ দিন দিন বাড়িয়েই চলত। — নুসাইবা ঈমান (কায়রোয়ান)।
.
১০৬. দৈনিক হিযবের পরিমাণ একেকজনের একেকরকম। হাফেয আর অ-হাফেযের দৈনিক হিযবের পরিমাণে তারতম্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। সব হাফেয মুখস্থ তিলাওয়াত করতে পারেন না। দশ দিনে খতম করলে দৈনিক হিযব হবে তিন পারা। পনেরো দিনে খতম হলে, দৈনিক দুই পারা। তবে ২৯-দিনে মাস ধরাই নিরাপদ। তাহলে মাসটা কয়দিনের হবে, সেটা নিয়ে বাড়তি ভাবনা করতে হয় না।
.
১০৭. নিয়মিত হিযব আদায় শুরু করলে, প্রথম প্রথম বাহ্যিকভাবে এর প্রভাব চোখে পড়ে না। কিছুদিন যাওয়ার পর দৈনিক হিযবের প্রভাব পরিস্ফুট হতে শুরু করে। প্রথম কিছুদিন চলে যায়, মনকে পোষ মানাতে। কলবকে পরিষ্কার করতে। একটা আয়না দীর্ঘদিন মাটিতে পড়ে থাকলে, মাটি থেকে তুলেই চেহারা দেখা যায় না। ভালো করে মুছতে হয়, পালিশ করতে হয়। হিযবের প্রথম দিকটাও এমন। কিছুদিন কলবের মরিচা ঘষে সাফ করতে হয়। দীর্ঘদিন শুকনো পড়ে থাকা চৌবাচ্চা পানিভর্তি করতে গেলে, প্রথমে ঢালা পানিগুলো দেখা যায় না। শুকিয়ে থাকা মাটির দেয়াল, পানিগুলো শুষে নেয়। পরে আস্তে আস্তে পানি জমতে শুরু করে। দৈনিক হিযবও এমন। শুরুর দিকের তিলাওয়াত, কলবে লেগে থাকা গুনাহের কালিমা, নিফাক, প্রবৃত্তি, ভ্রান্ত চিন্তা সাফসুতরো করে তোলে। তারপর কলবকে কুরআনি নূরে সাজাতে শুরু করে। কলবের নূর আস্তে আস্তে বাইরে উপচে পড়তে শুরু করে। নিয়মিত হিযব আদায়কারীর আশেপাশের মানুষও তার কুরআনি বারাকাহ লাভ করে।
.
১০৮. আমরা যারা কুরআন কারীম বুঝি না, তারা শুরুতে না বুঝে দৈনিক হিযব আদায় করলেও, কিছুদিন যাওয়ার পর, কলব নিয়মিত হিযব আদায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে, কুরআন কারীম অল্প অল্প বোঝার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। নইলে হিযব আদায়ও একসময় দরবেশদের তাসবীহ টিপে যিকিরের মতো হয়ে যাবে। না বুঝে তিলাওয়াত করলেও উপকার আছে। তবে সামর্থ্য থাকলে, কেন বোঝার চেষ্টা করব না?
.
১০৯. নিয়মিত হিযব আদায়ে, অজান্তেই কলবের অনেক রোগ সেরে যায়। হিযব আদায়কারীও টের পায় না। অনেকের কলবে দীর্ঘদিনের দুরারোগ্য নানাবিধ মানসিক ব্যাধি বাসা বেঁধে থাকে। কুরআন আস্তে আস্তে এসব ব্যাধি থেকে কলবকে মুক্ত করতে শুরু করে। কলব পুরোপুরি সাফসুতরো হলে, পরের ধাপে কলবকে ওহীর নূর দ্বারা পূর্ণ করতে শুরু করে। ওহীর নূর যখন কলব ছাপিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, বান্দা পরিপূর্ণ আরোগ্য লাভ করে।
.
১১০. কুরআন হিফযের জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় বসে থাকা চরম ভুল চিন্তা। হিফয শুরু করার সময় এখনই। এই মুহূর্তেই। কখন সময় আসবে, কখন শরীর সুস্থ হবে, কখন ব্যস্ততা কমবে, এটার কোনো ঠিক আছে? এর আগে মরে গেলে? একলাইন হলে একলাইন করে হলেও, হিফয শুরুর সময় এখনই।
.
১১১. আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দৈনিক হিযব প্রতিদিন তিনপারা করে হওয়া দরকার। একপারা তো অবশ্যই। প্রথম প্রথম কষ্ট হবে। একনাগাড়ে চেষ্টা চালিয়ে গেলে, দৈনিক হিযব তিনপারায় উন্নীত করা সম্ভব। কুরআন আমাকে যা দিবে, পৃথিবীর অন্য কিছু আমাকে তা দিতে পারবে না। তাহলে কেন আমি কুরআনের সাথে সময় কাটাতে দ্বিধান্বিত থাকব?
.
১১২. ১৮৫ জন বন্দীর মধ্যে একটা জরিপ চালানো হয়েছিল। তাদের শর্ত দেয়া হয়েছিল, কুরআন হেফয করতে পারলে মুক্তি দেয়া হবে। সাধারণভাবে সাজা ভোগ করে যেসব অপরাধী মুক্তি পেয়েছিল, তাদের অনেকেই পুরনায় কারাগারে এসেছে। আবার কোনো অপরাধ করে। কিন্তু হিফযের শর্ত পূরণ করে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের পুনরায় অপরাধ করে জেলে আসার হার ছিল শতকরা ০%।
.
১১৩. যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, নামায আদায় করে এবং আমি তাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে গোপনে ও প্রকাশ্যে, তারা এমন ব্যবসায়ের আশাবাদী, যাতে কখনো লোকসান হয় না (ফাতির, ২৯)।
إِنَّ ٱلَّذِینَ یَتۡلُونَ كِتَـٰبَ ٱللَّهِ وَأَقَامُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُوا۟ مِمَّا رَزَقۡنَـٰهُمۡ سِرًّا وَعَلَانِیَةࣰ یَرۡجُونَ تِجَـٰرَةً لَّن تَبُورَ
আল্লাহর কিতাব পাঠ করা লাভজনক ব্যবসা।
.
১১৪. আমি হাফেয হব, কারণ :
. কুরআনের হাফেয হতে পারা অনেক বড় নেয়ামত। প্রতিটি মুসলমানের এই নেয়ামত লাভের জন্য লালায়িত হওয়া জরুরি। মাদরাসায় পড়িনি, বয়েস বেড়ে গেছে, ব্যস্ততার জন্য সময় নেই, এসব খুবই ঠুনকো অজুহাত। সব অজুহাত ছেড়ে হিফয শুরু করে দিতে পারি।
. আমার দায়িত্ব তাওয়াক্কুল করে শুরু করে দেয়া। দিনে এক আয়াত বা আধা আয়াত? নিদেনপক্ষে তিন দিনেও এক আয়াত? অসম্ভব কিছু? শুরু না করার যুক্তিসংগত কোনো অজুহাত আছে?
. ইমাম যুফার বিন হুযাইল রহ.। ইমাম আযম আবু হানীফা রহ.-এর অন্যতম শাগরিদ। তিনি একটু বেশি বয়েসেই ইমাম আযমের দরবারে এসেছিলেন। পড়াশোনাও দেরি করে শুরু করেছিলেন। প্রথম জীবনে হাফেয হতে পারেননি। জীবনের শেষ দুই বছরে, অন্য সব কাজে সময় কমিয়ে, হিফযুল কুরআনে মনোনিবেশ করেছিলেন।
. আল্লাহর অপূর্ব মহিমা। হিফয শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই মারা গেলেন। মৃত্যুর পর এক পরিচিতজন তাকে স্বপ্নে দেখলেন। অবস্থা জানতে চাইলেন। ইমাম যুফার রহ. বললেন,
-শেষের দুই বছরের জন্য রাব্বে কারীম মাফ করে দিয়েছেন। শেষ দুই বছরের হিফযুল কুরআনের আমল না থাকলে, যুফার ধ্বংসই হয়ে গিয়েছিল! (শরহু মুসনাদি আবি হানীফা, ১/৪৫)
. চাকরির ফাঁকে ফাঁকে, গার্হস্থ্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে, হিফযুল কুরআন চলতে পারে। এখন তো কত সহজ। কত কত অ্যাপ। একটি আয়াতকে বারবার পড়ে শোনায়। প্রতিটি শব্দকে ভেঙে ভেঙে পড়ে শোনায়।
. কুরআন পড়তে পারি না, কুরআন শুদ্ধ নেই, এসব অজুহাত ধোপে টিকবে? প্লে-স্টোরে হিফয সহায়ক কত কত অ্যাপ ছড়িয়ে আছে! কুরআন একদম পড়তে না জানলেও আজকাল হাফেয হওয়া খুবই সহজ। অন্ধরা শুনে শুনে হাফেয হচ্ছে না?
. রাব্বে কারীমের ওপর তাওয়াক্কুল করে শুরু করে দিতে পারি না? ইন শা আল্লাহ। রাব্বে কারীম তাওফীক দান করুন। আমীন।
.
এই লেখার পাশাপাশি ‘হিযবী মিনাল কুরআন’ লেখাটিও পড়তে পারি। নিচে দেয়া আছে।

 

-Atik Ullah

------------------------------------

 

>> হিযবী মিনাল কুরআন

(). এক প্রতিনিধি দল এল মদীনায়। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে। নবীজি তাদেরকে ঈশার পর সময় দিতেন। দীর্ঘ সময় তাদের সাথে কথা বলতেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। একদিন ঈশার পর আসতে দেরী করলেন। আসার পর জানতে চাওয়া হলো:
-আজ অন্যদিনের তুলনায় একটু পরে বের হয়েছেন যে?
-আমি আজকের ‘কুরআনের হিযব’ (حزبي من القرآن) পড়তে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটা আদায় না করে বাইরে আসতে মন চাইল না।
.
প্রতিদিন পড়ার বা তিলাওয়াতের জন্যে যা নির্ধারন করা হয় সেটাকে ‘হিযব’ (الحزب) বলা হয়। এই হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, নবীজি সা.-এরও নির্দিষ্ট ‘হিযব’ ছিল। এবং তিনি তা নিয়মিত আদায় করতেন। অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই আদায় করতেন।
.
(). কুরআন কারীম কী?
-আল্লাহর কালাম। কালামুল্লাহ।
এরচেয়ে বড় সংজ্ঞা আর কিছু হতে পারে না। দুনিয়ার সব বইতেই মানুষের কথা। কিন্তু কুরআন কারীম? তাতে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কথা আছে। আর কারও কথা এ-কিতাবে নেই।
.
(). কিছু মানুষ এত বেশি কুরআন কারীম তিলাওয়াত করেন, তাদের ‘হিযবী মিনাল কুরআন’ আর আমার ‘হিযবী মিনাল কুরআন’-এর মাঝে কতো পার্থক্য!
.
(). কুরআন কারীম তিলাওয়াতের সময়, কখনো কি ভেবে দেখেছি, আমি যা পড়ছি, তাতে আছে:
ক. সব সমস্যার সমাধান।
খ. সমস্ত রোগের উপশম।
গ. মুসীবতের মুস্কিলআসান।
ঘ. সব বিচ্যুতির সংশোধন।
ঙ. সব গোমরাহির হেদায়াত।
চ. সব অন্ধকারের আলো।
ছ. সব জটিলতার ব্যাখ্যা।
.
(). আমি প্রতিদিনের ‘হিযব’ আদায় করতে বসি। তার অর্থ, আমি এমন এক অনিবর্চনীয় অনুভূতির মুখোমুখি হতে চলেছি, যার বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা কোনও কবির পক্ষে সম্ভব নয়। কোনও বক্তার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনও লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা হলো, কলবের সাথে রবের একান্ত মিলনের মুহূর্ত।
.
(). কুরআন কারীমের সাথে থাকার অর্থ, আমি অপার্থিব এক ‘সাহচর্যে’ এসেছি। দুনিয়ার আর কোনও সঙ্গ-সুহবত এর সাথে তুল্য হতে পারে না। আমার হৃদয় আল্লাহর দাসত্বে ডুবে গেছে। আমি এখন হাঁটছি আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পথে। নবীজি সা.-এর পথে। সাহাবায়ে কেরামের পথে। তাবেয়ীগনের পথে। ইমামগনের পথে। সিদ্দীকীনের পথে। শুহাদা-সালেহীনের পথে।
.
(). যখন ঠিক করেছি, আমার হৃদয়ে কুরআন কারীমকে স্থান দেবো, আমার জেনে রাখা উচিত:
= আমাকে কলব থেকে বাকী সবকিছুকে তাড়াতে হবে। ঝেড়ে ফেলতে হবে গাইরুল্লাহকে। এমনকি আমাকে, আমার সত্ত্বাকেও আমার থেকে দুর করে দিতে হবে। সেখানে থাকবে শুধু কুরআন। আল্লাহ তা‘আলা।
.
(). কুরআন কারীম হলো (إِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ) অতি মর্যাদাপূর্ণ কিতাব (ফুসসিলাত: ৪১)। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন কিতাব। ইজ্জত (عِزَّة) তাকে বাধা দেয়, উপেক্ষাকারীদের অন্তরে অবস্থান করতে। আমি আমার সেরাটা না দিলে, কুরআনও আমাকে কিছুই দিবে না। তার অতলসমুদ্রের দ্বার উন্মোচিত করবে না।
.
(). প্রতিদিন কুরআন কারীমের জন্যে নির্দিষ্ট একটা ‘হিযব’ নির্ধারণ করার পর, আদায় না করলে, কুরআন কারীমে ইজ্জতে লাগার কথা। এমনকি আমি নিজেকে যদি কুরআন কারীমের উপর প্রাধান্য দেই, সেটাও কুরআন কারীমের জন্যে সম্মানজনক আচরণ হওয়ার কথা নয়।
.
(১০). প্রতিদিনের ‘হিযব’ আমার জন্যে নেয়ামতস্বরূপ। বোঝা নয়। বহু মানুষ এই নেয়ামত থেকে বঞ্চিত। কারণ তারা এটাকে বোঝা মনে করে। চাপ মনে করে। সময়ের অপচয় মনে করে। অপর দিকে অনেক সৌভাগ্যবান মানুষ নিয়মিত হিযব আদায় করে, সুখের সন্ধান পেয়ে যায়। আল্লাহর দরবারে মাকবুল হয়ে যায়।
.
(১১). কুরআন পাঠের সময়টা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অন্যতম উজ্জল সময়। প্রকৃত জ্ঞানীরা কোনও কিছুর সাথেই এর তুলনা করতে রাজী নন। তারা পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতে থাকেন ‘সুন্দর’ সময়টুকু উদযাপনের জন্যে। সচেতন-সজাগ হৃদয়ে তেলাওয়াত শুরু করেন। তীব্র পিপাসা থাকাবস্থাতেই তারা নিত্যকার ‘হিযব’ শেষ করেন।
.
(১২). টিকাপ্রাপ্ত তেলাওয়াতকারী আছেন। তারা রুটিন তিলাওয়াত করে। বাদ পড়ে না। কোনওরকমে প্রতিদিনের ‘হিযব’ শেষ করে। ফাঁকে ফাঁকে কথা বলে। চা খায়। মোবাইল ধরে। হাসে। এদিক-ওদিক তাকায়। উঁহু! কুরআন আমার পুরোটা দাবী করে। সমস্ত চিত্তের গভীর সমর্পণ দাবী করে। দুলে দুলে কোনও রকরে পারা শেষ করলেই হবে না।
.
(১৩). জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘আনন্দ’ কী?
-কুরআন কারীমের দিকে তাকিয়ে থাকা।
আমি যতই মুখস্থ পড়তে পারি, কিছু সময় কুরআন কারীম হাতে নিয়ে পড়বই। এটাও বিশেষ এক নেয়ামত। এর প্রভাব অনস্বীকার্য। উসমান রা. কুরআনের মাঝে ডুবে গিয়ে শত্রুভয়কেও উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন।
.
(১৪). কুরআন তিলাওয়াত, ক্লান্ত পথিকের শ্রান্তিবিনাশী আরক। দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত ব্যক্তির কোমল ছোঁয়া। ছাতিফাটা রোদ্দুরে মরুভূমিতে মরিচিকা দেখে দিশেহারা হয়ে পড়া উদ্ভ্রান্তের কম্পাস। শুষ্ক খরখরে হয়ে যাওয়া হৃদয়ের বসন্ত।
.
(১৫). কুরআন পড়তে গিয়ে, আমার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করে ফেলছি, ভারমুক্ত হচ্ছি। বেশ তৃপ্তিকর কাজ সেরে নিচ্ছি। এমন ভাব মোটেও অন্তরে ঠাঁই দেব না। জীবনে কতভাবে কুরআনের প্রতি অবহেলা দেখিয়েছি, কতভাবে কুরআনকে উপেক্ষা করেছি, কুরআন কারীমের সুশীতল ছায়া থেকে এতদিন কত দূরে ছিলাম, সেজন্য লজ্জিত অনুতপ্ত হৃদয় নিয়ে কুরআনের সামনে নতজানু হয়ে বসবো!
.
(১৬). যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে, সে হলো উতরুজ্জা (সুগন্ধিযুক্ত লেবুজাতয়ী) ফলের মতো। তার ঘ্রাণ উত্তম। স্বাদ উত্তম। যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে না, সে হলো ‘খেজুরের মতো, ঘ্রাণ নেই তবে স্বাদটা ভাল। যে মুনাফিক কুরআন তিলাওয়াত করে, সে হলো রায়হানা ফুলের মতো। ঘ্রাণটা উত্তম তবে স্বাদটা তিতা। যে মুনাফিক কুরআন তিলাওয়াত করে না, সে হানযালা (একপ্রকার টকজাতীয়) ফলের মতো। তার কোনও ঘ্রাণও নেই স্বাদটাও বিস্বাদ (বুখারী)।
.
(১৭). যে ব্যক্তির মধ্যে কুরআন নেই, সে হলো বিরান ঘরের মতো (তিরমিযী)।
.
(১৮) উসমান রা. বলে গেছেন:
-যদি আমাদের হৃদয়টা পবিত্র হতো, আমরা কখনোই কুরআন পাঠ করে তৃপ্ত থাকতে পারতাম না। শুধু পড়েই যেতাম। পড়েই যেতাম।
.
(১৯) কুরআন তিলাওয়াত নিছক ইবাদত নয়, এটা সব মুশকিলের আসান। ওলামায়ে কেরাম, ইলমি কোনও বিষয়ে সমস্যায় পড়লে, কুরআন নিয়ে বসে যেতেন। আমি যদি কুরআন কারীমকে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ি, তাহলে আমার কাছে দুনিয়ার কোনও বিষয়ই দুর্বোধ্য থাকবে না।
.
(২০). কুরআন তিলাওয়াত করা মানে, আমার হৃদয়কে ওহীর আলোয় আলোকিত করছি। আমার হৃদয়ের চারপাশটা আলোকিত হয়ে উঠছে। আমি পৃথিবীতে থেকেও আর এখানের নই, আসমানী মানুষে পরিণত হয়েছি।
.
(২১). কুরআন কারীম ঘুমন্ত আত্মায় প্রাণের সঞ্চার করে। ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলে। ছোট্র একটা বসতি থেকে টেনে নিয়ে যায় বিশ্বের দিক-দিগন্তে। সৃষ্টি করে নতুন ইতিহাসের। প্রতিষ্ঠা করে অনুপম সমাজের। ছড়িয়ে দেয় সৌভাগ্য।
.
(২২). এক বুযুর্গ বলেছেন:
-আমরা কুরআন নিয়ে মশগুল হয়েছি, দেখতে পেয়েছি, বরকত আমাদেরকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে নিয়েছে।
.
(২৩). কুরআনের সাথে লেগে থাকলে, সময়ের বরকত বেড়ে যায়। একজন শায়খ প্রতিদিন ৭ পারা কুরআন তিলাওয়াত করতেন। একজন সরকারী চাকুরে প্রতিদিন আসর থেকে ঈশা পর্যন্ত তিলাওয়াত করেন। তাদের সময়ের বরকতের অভাব ছিল না। সংসারের জন্যে পর্যাপ্ত মেহনত করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্যও ঠিক ছিল। চাকুরি ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করতে বেগ পেতে হয়নি।
.
(২৪). এক বুযুর্গের নসীহত:
-তুমি নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করবে। বের্শি বেশি তিলাওয়াত করবে। তিলাওয়াত ছাড়বে না। তুমি যত বেশি তিলাওয়াত করবে, ততবেশি মনোবাঞ্চা লাভ করবে।
.
(২৫). কুরআন কারীম কি?
-কুরআন কারীম জীবন। দুরারোগ্যের আরোগ্য। মুক্তি। সাফল্য।
.
(২৬). বিক্ষিপ্ত মন, অস্থির চিত্ত, বিস্রস্ত ভাবনা, উদাস দৃষ্টি তিলাওয়াতের মাঝে খুঁজে পাবে যাবতীয় সান্ত¦না। সৃষ্টি করবে সামাজিক ঐক্য। তৈরী করবে ‘একতাই বল’।
.
(২৭). কুরআন শক্তির উৎস। অদৃশ্য এক শক্তি সব সময় উৎসারিত হতে থাকে কুরআন থেকে। কুরআন পাঠে দুর্বল সবল হয়ে যায়। মৃতআত্মা জীবিত হয়ে যায়।
.
(২৮). আমি যতই চেষ্টা করি, আমার উপর কুরআন তিলাওয়ারে প্রভাব যথাযথ ভাষায় ব্যক্ত করতে পারি না (আয়েশা বারজাত)।
.
(২৯). কুরআন কারীমের প্রভাবমুক্ত আরবী-ইসলামী চিন্তগুলোকে আমার কাছে অনেকটা ‘রক্তহীন’ মানুষের মতো মনে হয় (জনৈক নবমুসলিম)।
.
(৩০). আমাদের সমস্যা হলো, আমরা কুরআন কারীমের জন্যে নির্ধারণ করি, আমাদের ‘অতিরিক্ত’ অপ্রয়োজনীয় সময়টা। ভাবি এতেই কুরআনের হক আদায় হয়ে যাবে। আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে।
.
(৩১). যারা কুরআনের তাদাব্বুর করে, তারা কেমন?
ক. সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান।
খ. কোমল হৃদয়ের অধিকারী।
গ. সুতীক্ষè যুক্তিবাদী।
ঘ. লক্ষ্যভেদী অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন।
ঙ. উঁচু হিম্মতের অধিকারী।
চ. গভীর ঈমানে মালিক।
.
(৩২). বিশেষ বিশেষ কিছু আয়াতের প্রতি অন্তরের ঝোঁক তৈরী করবো। সেগুলোর আলোকে জীবনকে রঙিন করবো। সালাফের জীবন থেকে আয়াতগুলো খুঁজে নিবো। তারা বলে গেছেন, কিছু আয়াত তাদের জীবনে কী গভীর রেখাপাত করেছে!
.
(৩৩). একটা আয়াতকে সামনে রাখতে পারি। যখনই প্রবৃত্তি আমাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করবে, আমি মনে করবো:
-আর যে ব্যক্তি নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় পোষণ করতো এবং নিজেকে মন্দ চাহিদা হতে বিরত রাখত (নাযি‘আত: ৪০)।
.
(৩৪). গুনাহ হয়ে গেলে, মনটা সংকুচিত হয়ে পড়লে আল্লাহর কাছে সাথে সাথে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। আল্লাহর কাছে আত্মনিবেদিত হওয়া। আয়াতটা স্মরণ রাখা:
-নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করেন (যুমার: ৫৩)।
.
(৩৫). কুরআন কারীমের প্রতিটি আয়াতের সাথেই জীবনের একটা ঘটনাকে সম্পৃক্ত করে নেয়া। ওই আয়াত পড়ার সময়, এই ঘটনা ঘটেছিল। ওমুক সূরা পড়ার সময় আমার এমনটা চিন্ত হয়েছিল। এভাবে পুরো কুরআনটা হয়ে উঠবে আমার একান্ত আপনার। ঘরোয়া। নিকটের। কাছের। আত্মার। প্রাণের। হৃদয়ের।
.
(৩৬). একটা সুন্দর দেখে কুরআন শরীফ কিনলাম। তারপর সেটাকে গিলাফবন্দী করে পরম যতেœ তাকে রেখে দিলাম, এজন্য কুরআনকে নাযিল করা হয়নি। কুরআন নাযিল হযেছে, তিলাওয়াতের জন্যে। তাদাব্বুরের জন্যে। জীবনের সংবিধান বানানোর জন্যে। কুরআন আমাকে দিবে নবজীবন।
.
(৩৭). প্রতিটি আয়াত পড়বো আর ভাববো, আল্লাহ তা‘আলা আমার জন্যে এই আয়াতে নাজাতের কী উপকরণ রেখেছেন।
.
(৩৮). কুরআন নিয়ে গবেষণা করেন। কুরআন নিয়ে থিসিস লিখছেন। কত কত বই, কতশত জার্নাল ঘাঁটাঘাঁটি হয়ে যাচ্ছে। আজ এ-লাইব্রেরী, কাল ও-লাইব্রেরি করে ঘুরপাক খাচ্ছে। সবই করছে কুরআন গবেষণার স্বার্থে। কিন্তু সরাসরি কুরআন থেকে দু’পৃষ্ঠা তিলাওয়াত করার ফুরসত মেলে না। এক পৃষ্ঠা পড়তে না পড়তেই হাঁপ ধরে যায়। আপনি বলুন তো:
-কোন কুরআনের গবেষণা করছেন?
.
(৩৮). একলোককে দেখেছি, সারাদিন তিলাওয়াত করে। দেখতে-শুনতে একেবারে নগন্য। সাধারণ মানুষ। অথচ মানুষটা এতবেশি তিলাওয়াত করে, দু’দিনে এক খতম হয়ে যায়। খতমের উদ্দেশ্যে নয়, এমনিতে তার কাছে তিলাওয়াত করতে ভাল লাগে তাই তিলাওয়াত করে। (শায়খ খালেদ)।
.
(৩৯). সারাদিন পেপার-পত্রিকা-ফেসবুক-টুইটার। বিকেলে-সন্ধায় পাঠ্যবই, রাতে আবার আনলাইন, তাকের উপর কুরআনখানা ধূলোমলিন। পরিত্যক্ত! কাঁদছে মাসকে মাস! কেউ ছুঁয়েও দেখছে না। কিভাবে বরকত আসবে? কী লাভ এই জ্ঞানসাধনায়?
.
(৪০). জীবনে বেশি বেশি তিলাওয়াত করেছেন, এমন কত বৃদ্ধকে দেখেছি, বয়স শ’য়ের কাছাকাছি হলেও, চোখের জ্যোতি একটুও কমেনি। মুখের ভাষা অস্পষ্ট হয়নি। চামড়ায় তেমন ভাঁজ পড়েনি। তাদের সাধারণ কথাও অসাধারণ প্রভাববিস্তারী। তাদের চেহারা থেকেও কুরআনের নূর চমকাতো। তাদের নিরবতা থেকেও শব্দ ঝরে পড়তো। তাদের হাঁটাচলা থেকেও হেদায়াত ঠিকরে পড়তো!
.
(৪১). প্রতিদিনের কুরআনি ‘হিযব’ নিছক আমলনামায় সওয়াব বৃদ্ধির ইবাদত নয়। এটা ঈমান বৃদ্ধির কারণ। আত্মার জ্বালানি। তিলাওয়াতকারী যখনই অনুভব করে, সে আল্লাহর কালাম পড়ছে, তার মধ্যে অন্য রকম এক ঢেউ বয়ে যায়।
.
(৪২). যখনই মনে কোনও সন্দেহ দেখা দেয়, বিশ্বাসে চিড় ধরতে চায়, চিন্তায় টালমাটাল অবস্থা তৈরী হয়, কুরআন নিয়ে বসে পড়া। কুরআনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার প্রয়াস চালানো। এই দুর্দিনে কুরআন আমার পাশে দাঁড়াবে। কুরআন আমাকে বাঁচতে শেখাবে।
.
(৪৩). আমি যখন কারো দ্বিধা-সন্দেহের জবাব দেই, আমি তার নির্দিষ্ট একটা সংশয়কে অপনোদন করার চেষ্টা চালাই। কখনও সফল হই, কখনো ব্যর্থ। কিন্তু একজন যুবককে যখন আমি সরাসরি কুরআনের সাথে জুড়ে দেই, মূলত তাকে আমি ‘খনিজ উৎসের’ সন্ধান দিয়ে দিই, তখন সেটা হয় ‘স্থায়ী’ সমাধান। মজ্জাগত নিরোধক। আমি তাকে একটা সুরক্ষিত দুর্গের বাসিন্দা বানিয়ে দিলাম।
.
(৪৪). নিয়মিত ‘হিযব’ আদায় করতে পারা, অনেক বড় সৌভাগ্যের প্রতীক। আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট স্বীকৃতি। আল্লাহ আমাকে তার কুরআনের জন্যে কবুল করে নিয়েছেন, তার বড় প্রমাণ। তখন আমি কিছু চাইলে, আল্লাহর কুরআনের উসিলায় কবুল করে নিবেন।
.
(৪৫). এক যুবককে চিনি, প্রতিদিন তিন পারা করে পড়বেই। মাসে তিনটা খতম তার নিয়মিত। সে বলে:
-খুব বেশি সময় লাগে না। সোয়া এক ঘণ্টা মাত্র।
কত স্বল্প শ্রমে কী বিরাট গনীমত! কল্পনা করা যায়?
.
(৪৬). আমি নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াতের পরিমাণ যত বৃদ্ধি করি, ততবেশি বরকত লাভ করি। তিলাওয়াতের পরিমাণ বাড়ালেও সময়ের টান পড়ে না। সময়েরও বরকত বাড়ে। পরিমাণ বাড়াতে বাড়াতে এখন প্রতিদিন দশ পারা করে পড়ি।
.
(৪৭). কুরআন তিলাওয়াত আমার সময়কে সংকুচিত করবে না, বরং সময়কে বরকতময় করে তুলবে। কুরআন কারীম যে (كِتابٌ مُبارَكٌ) বরকতময কিতাব! এই কিতাব পড়লে কিভাবে জীবন বরকতহীন হয়? সময়ে টান পড়ে? কুরআন আমার ইলমে বরকত দান করবে। রূহে বরকত দান করবে। সময়ে বরকত দান করবে।
.
(৪৮). কত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়! কত আপাত ভাল মানুষের মুখোশ খসে পড়ে! কত ভাল মানুষও খারাপ হয়ে যায়! আমরা যদি এদের সবাইকে কুরআনের সাথে পরিচিত করিয়ে দিতে পারতাম! ফলাফল ভিন্ন কিছু হতো!
.
(৪৯). আমরা একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াব। তার আগেই আমাদের কলবে আল্লাহকে মজবুত করে বসাতে হবে। এর উপায় হলো, নিয়মিত হিযব’ আদায় করা। এজন্য প্রয়োজন সামান্য ইচ্ছা।
.
(৫০). নবীজি সা. ইন্তেকাল করেছেন। উম্মে আইমান হাউমাউ করে কাঁদছেন। আবু বকর উমর রা. দু’জনেই তাকে দেখলেন। ধারনা করলেন, নবীজির বিচ্ছেদে কাঁদছেন। তবুও জানতে চাইলেন:
-কেন কাঁদছেন?
-কাঁদছি, ওহী চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল!
উম্মে আইমানের এমন অভিনব দৃষ্টিভঙ্গিতে দু’জন চমকে উঠলেন। তাই তো! তাই তো! এবার দু’জনেও নতুন করে কাঁদতে শুরু করলেন।
.
(৫১). বড় বঞ্চিত কে? যে মনে করে কুরআন তিলাওয়াত শুধু সওয়াবের জন্যে। কুরআন থেকে কোনও ইলম ও ফাহম সে অর্জন করে না।
.
(৫২). আমাদের যুগের অন্যতম ‘সালিহ’ কে?
-যে দূরের কোন সফরে বের হয়। নামাযের সময় হলে গাঁড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করায়। জায়নামায বিছিয়ে নামায আদায় করে নেয়। কুরআন কারীম খুলে আজকের হিযব তিলাওয়াত করে। তারপর গাড়ি স্টার্ট দেয়।
.
(৫৩). কিছু মানুষ আছেন। এই যমানাতেও। রাতের আঁধার গভীর হলে, তারা কুরআনের সাগরে ডুব দেয়। আয়াত আয়াত করে তিলাওয়াত করে। আল্লাহর সাথে গভীর আলাপচারিতায় মগ্ন হয়ে পড়ে। লাভ করতে থাকে হীরে-জহরত।
.
(৫৪). নতুন কোথাও গেলে, সব আওয়াজ চাপিয়ে যখন কুরআনের আওয়াজ ভেসে আসে, মনে হতে থাকে, বাকী সব আওয়াজ শুধুই হৈ চৈ! চিল-চিৎকার! একমাত্র কুরআনই সত্য।
.
(৫৬). কুরআনের নুরানী আবহে যদি কোনও প্রজন্মকে গড়ে তোলা যায়, তারা হবে কালের জন্যে এক জীবন্ত মু‘জিযা। তাদের জাগতিক আর কোনও শিক্ষার প্রয়োজন হতে পারে না।
.
(৫৭). কুরআনের আয়াত অত্যন্ত পবিত্র। তার নুরানী সংস্পর্শে কলবের যাবতীয় ময়লা দূরে হয়ে যায়। চোখ থেকে গুনাহের পর্দা সরে যায়। পুরো শরীর হয়ে ওঠে পূত-পবিত্র।
.
(৫৮). কুরআন এক আলোকিত কিতাব। তার আলো সর্বপ্লাবী। সে তুলনায় সূর্য একটা চেরাগ মাত্র। চাঁদ ছোট্ট এক মোমবাতি মাত্র।
.
(৫৯). কুরআনহীন পৃথিবী হলো ডানাহীন পাখির মতো। ভঙ্গুর। নৈরাজ্যপূর্ণ। বিশৃঙ্খল। রহমতবিচ্ছিন্ন।
.
(৬০). কুরআন মানুষকে একদিকে তার অক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় আরেকদিকে কুরআন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে হিম্মত! দুনিয়া ছাড়িয়ে আকাশের দিকে উত্তরণের অসীম আকাঙ্খা।
.
(৬১). কুরআন আমাদের জন্যে খুঁটিস্বরূপ। ঘূর্ণিঝড় এলে নড়বড়ে ঘর উড়িয়ে নিয়ে যায়। নিয়মিত ‘হিযব’ আদায় করলে, গোমরাহি ভ্রষ্টতার শত তুফান এলেও আমাদেরকে উড়িয়ে নিতে পারবে না। সে তুফান যত আচানকই আসুক, একচুলও নাড়াতে পারবে না।
.
(৬২). কুরআনের সমর্থন ছাড়া একটা নসীহত যত সুন্দরই হোক তা বাতিল বলে গণ্য। কুরআনের সমর্থন ছাড়া একটা ‘চিন্তা’ যতই আকর্ষণীয় হোক, তা সন্দেহজনক, অনিরাপদ। আল্লাহ তা‘আলার কথাই চূড়ান্ত:
-সুতরাং এরপর আর এমন কী কথা আছে, যার উপর তারা ঈমান আনবে? (মুরসালাত: ৫০)।
.
(৬৩). কুরআন কারীম যত কথাই বলি, যত আলোচনাই করি, সেটা তাদাব্বুর, ই‘জায, হেদায়াত, মর্যাদা যাই হোক, যদি নিয়মিত ‘হিযব’ আদায় না করি, আমাদেরকে খুব বেশিদূর নিয়ে যাবে না।
.
(৬৪). আমাদের কুরআন দরসে একবার শায়খ তিলাওয়াত করতে বললেন। এক ইন্দোনেশিয়ান সাথী তিলাওয়াত করল। সূরা মুমিনুন শুরু থেকে। আমাদের সৃষ্টির বিভিন্ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আয়াতগুলোতে। পুরো ক্লাশ একেবারে কেঁপে উঠেছিল তার তিলাওয়াত ও আয়াতের অর্থের মিশেলে তৈরী হওয়া ঘোরে। (সুলাইমান আব্বুদী)।
.
(৬৫). কুরআন নাযিল হয়েছে গারে হেরায়। রাসূলে আরাবীর উপর। আর এখন বাঙলার প্রত্যন্ত গাঁয়ের এক ছোট্ট শিশু তা তিলাওয়াত করছে। পরিপূর্ণ তাজভীদ মেনে! এ-এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
.
(৬৬). তিলাওয়াত করা সবার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু শোনা তো সম্ভব! ঘরে, বাইরে। গাড়িতে। অফিসে। মোবাইলে। আইফোনে। ট্যাবে। .
.
(৬৭). ইসলাম সম্পর্কে যাদের পূর্ব কোনও ধারণা নেই। তারা যখন ইমামগণের কিতাবাদি পড়েন আর দেখেন তাদের রচিত হাজার হাজার পৃষ্ঠার প্রতিটি কথা কুরআনের আয়াত দিয়ে প্রমাণিত! তাদের এ-ধারণা হওয়া অসম্ভব কিছু নয়:
= কুরআন কারীম নিশ্চয় অনেক খণ্ডে রচিত কোনও গ্রন্থ!
.
(৬৮). জীবন অনেকগুলো সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টার সমন্বয়! আমার প্রতিদিন যতবেশি সম্ভব সেকেন্ডগুলো কুরআন দিয়ে পূর্ণ করার চেষ্টায় কোতাহি করব না। অলসতা করবো না।
.
(৬৯) জীবন শুরু হোক কুরআন দিয়ে। শেষও হোক কুরআন দিয়ে। কুরআনে আছে ইলম। আলো। হেদায়াত।
.
(৭০). কুরআন কারীম হলো (مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ) শীতল পানির মতো। হৃদয়কে ধুয়েমুছে স্বচ্ছ ঝকঝকে করে দেয়। কুরআন কারীম এমন পানি, যা পান করলে মুমূর্ষ ব্যক্তিরও দেহে প্রাণসঞ্চার হয়।
.
(৭১). নবীজি সা. আল্লাহর কাছে অভিযোগ করেছিলেন। আমি যদি কুরআন কারীমকে অবহেলা করি, এড়িয়ে চলি, নবীজির সেই অভিযুক্তদের তালিকায় পড়ে যাবে না তো? তিনি বলেছিলেন:
-হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় এ কুরআনকে বিলকুল পরিত্যাগ করেছিল (ফুরকান: ৩০)।
.
(৭২). এক বুযুর্গ বলেছেন:
-কুরআন কারীম নির্ভরযোগ্য সুপারিশকারী। শ্রেষ্ঠ সঙ্গী। অনুপম উদার দাতা। কুরআন কারীমের সাথে কথা বলে বিরক্ত হতে হয় না। যতবেশি কুরআনের সাথে সময় কাটাবো,ততই আমার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
.
(৭৩). জিদ্দার এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের জরিপ চালানোর পর বের হয়েছিল: ৯৮% ভাগ ছাত্রই মসজিদে কুরআনী হালকাগুলোতে ভর্তি হয়েছে। হিফয করবে। কুরআন নূর। এই আলো শিশুদেরকে দিতেই হবে।
.
(৭৪). অনেক বুযুর্গ আছেন, প্রতি রাতে তাহাজ্জুদে একপারা করে তিলাওয়াত করেন।
.
(৭৫). প্রতি নামাযের পর চার পৃষ্ঠা করে তিলাওয়াত করলে, পাঁচ নামাযে একপারা। প্রতি নামাযের পর মাত্র চার মিনিট সময় বরাদ্দ করলেই হবে।
.
(৭৬). পরীক্ষা করে দেখতে পারি, দিনে কুরআন কারীমের সাথে একটা ঘণ্টা সময় কাটালে, পরিস্থিতি যতই সংকটাপন্ন হোক, সারাদিন সময়টা সহজে কেটে যাবে। পাশাপাশি বরকত লাভের জন্যে আল্লাহর কাছে হাত পাতলে, সেটা খালি ফিরবে না।
.
(৭৭). কুরআনের আয়াতগুলোর পানির মতো। প্রতিদিন যদি আয়াতের নদী দিয়ে কলবকে ধৌত করি, ময়লা কিছু থাকবে বলে মনে হয়?
.
(৭৮). আমি যতবারই প্রতিদিনের নির্দিষ্ট ‘হিযব’ বাদ দিয়েছি, তার খারাপ প্রভাব হাতেনাতে পেয়ে গেছি। দীর্ঘসময় পরে হলেও এর প্রভাব প্রকাশ পেয়ে যায়। শায়খ আবু মালেক।
.
(৭৯). যদি নিজেকে কুরআন কারীমের সাথে সম্পৃক্ত দেখি, তাহলে আল্লাহর শুকরিয়ায় সিজদায় লুটিয়ে পড়া উচিত। এর মতো নেয়ামত আর কী হতে পারে? এমন নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হলে, আল্লাহর কাছে নিয়মিত দু‘আয় লেগে থাকা জরুরী! তিনি যেন এই মহা নেয়ামত দ্বারা আমাকে ভরপুর করে দেন।
.
(৮০). কুরআন এসেছে জীবনের সংবিধান হওয়ার জন্যে। সর্বোতকরণে কুরআনের অভিমুখী না হলে, কুরআন তার ভান্ডার খুলে দেয় না। কুরআনের আয়াতে একটা প্রাণ আছে, এই প্রাণ তিলাওয়াতকারী নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে। এটা হলো আল্লাহর মারিফাতের প্রাণ। যা বান্দাকে কর্মমুখী করে তোলে।
.
(৮১). কুরআন প্রথম দিন থেকেই গোটা আরবকে জাদুগ্রস্ত করে ফেলেছে। যে কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাকেও মুগ্ধ করেছে। কলব-শ্রবণ ও দৃষ্টির উপর আবরণ থাকার কারণে যে ঈমান আনেনি তাকেও কুরআন মুগ্ধ করেছে।
.
(৮২). প্রথম দিকে যারা ঈমান এনেছে, তাদেরকে দেখলে বোঝা যায়, কুরআন কারীম তাদের ঈমান আনার পেছনে চূড়ান্ত কারণ হিশেবে ভূমিকা পালন করেছে। আবার চারদিকে দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে কুরআন নিজেই শক্তিশালি ‘দায়ী’ হিশেবে কাজ করেছে।
.
(৮৩). আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের মাধ্যমে বিশ্ব-ইতিহাসের সর্ববৃহত বিপ্লব সাধন করেছেন। কুরআনে প্রভাবে আরবরা নিরক্ষর জাতি থেকে সারা বিশ্বের শিক্ষকে পরিণত হয়েছে। নেতায় পরিণত হয়েছে।
.
(৮৪). গভীর রাতে, দূর থেকে ভেসে আসা কুরআনের সুরেলা আওয়াজ হৃদয়তন্ত্রীতে অন্যরকম ঢেউ তোলে। জন্ম দেয় অন্য রকম এক ভালোলাগার অনুভূতির।
.
(৮৫). কুরআন ছাড়া দ্বীন-দুনিয়ার হাকীকত জানা অসম্ভব। কুরআন ছাড়া হাকীকত জানার যত মাধ্যম আছে, সবগুলোই ভেজালপূর্ণ।
.
(৮৬). কুরআন কারীম কখনো পুরনো হবে না। কুরআন কারীম কখনো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কুরআন কারীমের মৃত্যু নেই। মৃত্যু হয় আমাদের অনুভূতির। কুরআন কারীম কখনো ক্ষয়প্রাপ্ত হবে না। ক্ষয়প্রাপ্ত হয় আমাদের ঈমান।
.
(৮৭). কুরআন কারীমের প্রাত্যহিক ‘হিযব’ আদায়ের সবচেয়ে নিরাপদ ও যুক্তিসঙ্গত সময় হলো মাগরিব থেকে ঈশা। এ-সময়টাকে কুরআন পাঠের জন্যে বরাদ্দ করলে, শিথিল হওয়ার অবকাশ কম। তবে কর্মব্যস্ততা থাকলে ঈশার পরও হতে পারে। মাগরিবের পরে হলেই বেশি ভাল। তাহলে ইশা পড়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া যাবে।
.
(৮৯). আমি অনেকবার প্রতিজ্ঞা করেছি: এবার থেকে আর ‘হিযব’ ছুটতে দেবো না। কিন্তু তারপরও ছুটে যায়। ছুটে যাক। ছুটে গেলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করতে হবে।
.
(৯০). নিঃসন্দেহে কুরআন কারীম আসমানী রহস্য। দুনিয়াতে নেমে আসা আল্লাহর নূর। এ নূর কেয়ামতের আগ পর্যন্ত থাকবে। কুরআন তার চিরন্তন অর্থ নিয়ে টিকে থাকবে।
.
(৯১). কুরআন প্রচণ্ড শক্তি সম্পন্ন এক কিতাব। কত মানুষ তার হৃদয়কে বদ্ধ করে রেখেছিল, তালাবদ্ধ করে রেখেছিল। কুরআন অনায়াসে সেই তালা ভেঙে তার হৃদয়ে ঢুকে পড়েছে। কত কুরআন বিরোধী বিবেক ছিল। সেগুলো কুরআনের বিরুদ্ধে তাদের বিবেককে শয়তানের কাছে বন্ধক দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কুরআন অবিশ্বাস্য শক্তিতে সেই বিবেকে হেদায়াতের আলো জ্বেলে দিয়েছে।
.
(৯২). আল্লাহর তা‘আলারও নিজস্ব একটা দল আছে। হিযবুল্লাহ (حزب الله)। আমি প্রতিদিন পড়ার জন্যে কুরআন কারীমের নির্দিষ্ট একটা অংশ ঠিক করে নিব। সেটাই হবে আমার ‘হিযব’।
.
(৯৩). নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াতকারী, হকের লাগাম ধরে থাকে। হেদায়াতের উৎসমুখে বসে থাকে। আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুদৃঢ় হাতল (العروة الوثقى) ধরে থাকে। বিনিময়ে তারতীলের মধু পান করতে থাকে। তানযীলের সুবাস পেতে তাকে। আল্লাহর প্রিয় বান্দার এই মৌচাকে মুখ লাগিয়ে তৃপ্ত হতে থাকে আর উর্দ্ধ জগতের (الملأ الأعلى) দিকে আরোহণ করতে থাকে।
.
(৯৪). কুরআনের ‘হিযব’ উত্তম জীবনের সঙ্গী। সফল জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। এই অনুভূতি জাগরূক থাকলে আমাদের নিত্যদিন কুরআন নিয়ে বসাকে সহজ করে তুলবে। তিলাওয়াতের পরিমাণে হ্রাসবৃদ্ধি করবে।
.
(৯৫). প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াতের সর্বনিম্ন একটা সীমা নির্ধারণ করে রাখা উচিত। পৃথিবী উল্টে গেলেও যা আদায়ে শিথিলতা করা হবে না। আর তিলাওয়াত কত বেশি হবে? তার কোনও সীমা নেই।
.
(৯৬). ফজরের পরকেও কুরআন তিলাওয়াতের জন্যে নির্ধারণ করা যায়। রাতের ঘুমটা তাড়াতাড়ি গেলে এ-সময় তিলাওয়াতটা আসানির সাথে করা যাবে। গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিলাওয়াতটা না ছাড়া। সময়টা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সুবিধামতো তিলাওয়াত করলেই হলো।
.
(৯৭). ভাল করে তিলাওয়াত করতে পারলে, বিশ মিনিটে একপারা তিলাওয়াত করা সম্ভব। বিশটা মিনিটও কি আল্লাহর জন্যে বের করা যাবে না?
.
(৯৮). আমাকে যদি বলা হয়, তোমাকে সারা বিশ্বের সমস্ত মানুষের উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করতে হবে। তাহলে আমি বেছে নেব, সূরা হূদের শেষ ২৪ আয়াতকে।
-শায়খ খালেদ।
.
(৯৯). কুরআন কারীমের বেশির ভাগ আয়াতই সর্বজনবোধ্য। একদম নিরক্ষর অশিক্ষিতও বুঝতে পারবে। শানে নুযুল জানা, ইলমুল কিরাত জানা, শব্দ ও তাফসীরের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ রহস্যে ডুব দেয়ার জন্যে কুরআন নাযিল হয়নি। এমন হলে কুরআন হতো শুধু শিক্ষিত মানুষের কিতাব।
.
(১০০). বেশি বেশি তিলাওয়াতের মাধ্যমে, বান্দার মধ্যে এক ধরনের অনুভূতি তৈরী হয়, স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূত হয়, কুরআনী অর্থের অব্যক্ত এক অনুভব তৈরি হয়, যা শত তাফসীরের কিতাব পড়লেও হয় না।
.
(১০১). বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত মানে?
= দুর্বল বান্দার স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপন মহা শক্তিশালী রবের সাথে।
= সৌভাগ্য, শ্রেষ্ঠত্ব, সুমতি লাভের কল্যাণকর মানহাজ (তরীকা)-এর সাথে স্থায়ী সম্পর্ক।
.
(১০২). আমি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, বান্দার মনে শয়তান অনুপ্রবেশের সবচেয়ে শক্তি ও বুদ্ধিদীপ্ত পথ হলো, তার মনে দ্বিধা তৈরী করে দেয়া:
= তিলাওয়াত করবো নাকি গভীর অনুধ্যান (তাদাব্বুর)-এ ডুবে গিয়ে কুরআনের অর্থের সাগবে ডুব দিব!
বান্দা যখন নিয়মিত তেলাওয়াত করে, শয়তান তখন তার মনে তাদাব্বুরের চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়। কিছুদিন পর তাদাব্বুর তো যায় যায়, তিলওয়াতও যায়
-(শায়খ আলি আলফীফি)।
.
(১০৩). বান্দা যখন তিলাওয়াতে প্রতি মনে উদ্যম খুঁজে পায়, শয়তান তখন তার সামনে একটা তালিকা হাজির করে, তাতে জ্বলজ্বল করে লেখা থাকে, কুরআন তাদাব্বুরের কী কী ফযীলত। আমি বলি কি, তাদাব্বুরও প্রয়োজন। তবে সেটা হতে পারে যখন তিলাওয়াতের আগ্রহ শেষ হবে তখন। এখন তিলাওয়াতের প্রতিই মনোযোগী হওয়া শ্রেয়
-(শায়খ আলি আলফীফি)।
.
(১০৪). কুরআন তাদাব্বুরের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। তিলাওয়াত করতে করতেই তাদাব্বুরের পথ খুলে যাবে। কোন ফাঁকে যে হয়ে যাবে, টেরটিও পাওয়া যাবে না
-(শায়খ আলি ফীফি)।
.
(১০৫). আমি কখন দৈনিক ‘হিযব’ আদায় করতে সক্ষম হবো?
= যখন আমি আমার জীবনকে আরো সুন্দর আরো পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মেহনত করতে পুরোপুরি প্রস্তুত হবো।
.
(১০৬). দৈনিক তিলাওয়াতের সময় হয়ে গেছে, কুরআন আমাকে ডাকছে, এসো! তিলাওয়তে বসে যাও! কিন্তু অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্খিত ব্যস্ততার কারণে আজ আর বসা হচ্ছে না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে! এই অশ্রুবিন্দুটা আল্লাহর কাছে কতোই না প্রিয়?
.
(১০৭). নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াতের কি কি উপকার, তা সব সময় মনে উপস্থিত রাখলে, কখনো তিলাওয়াত ছুটে গেলে, কাযা আদায় করে দিলে, নিয়মিত হিযব আদায় করাটা সহজ হয়ে ওঠে। তবে নিজের সামর্থের বাইরে ‘হিযব’ নির্ধারণ করা ঠিক নয়।
.
(১০৮). নবীজি সা. উপদেশ দিয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমারকে। তিনি যেন প্রতি মাসে একখতম কুরআন তিলাওয়াত করেন। ইবনে উমার বললেন: আমি এর চেয়েও বেশি তিলাওয়াত করার সামর্থ্য রাখি। নবীজি মেয়াদ আরেকটু কমিয়ে দিলেন। এভাবে কমাতে কমাতে শেষে এসে বললেন:
-তুমি তিনদিন খতম করো!
.
(১০৯). কুরআন তিলাওয়াত করবো বসে-বসে, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, হেঁটে-হেঁটে। সালাতে। আগে আগে মসজিদে গিয়ে। নামাজের আগে না পারলে, নামাজের পরে। তাহলে দুইটা ফযীলত: তিলাওয়াত ও মসজিদে সময় কাটানো।
.
(১১০). সালাফের অনেকে সপ্তাহে একখতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তাদের তরীকা ছিল:
সূরা ফাতেহা থেকে নিসা।
মায়েদা থেকে তাওবা।
ইউনুস থেকে নাহল।
ইসরা থেকে ফুরকান।
শু‘আরা থেকে ইয়াসীন।
সাফফাত থেকে হুজুরাত।
ক্বফ থেকে নাস।
.
(১১১). কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে মনটা অনেক সময় বিক্ষিপ্ত থাকে। আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে হতে মনটা কুরআনে ডুবতে শুরু করে। আল্লাহর রহমত হলে, আমার ব্যাপারে কল্যাণের ফয়সালা হলে, একসময় দেখা যায়, কুরআনের এই তিলাওয়াত আমার অন্তর থেকে সবকিছু বের করে দিয়েছে। আমার ‘দেলে’ একমাত্র আল্লাহ আছেন। আর কিছু নেই।
.
(১১২). এরচেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে, আমি দীর্ঘ সময় লাগিয়ে তিলাওয়াত করলাম, আমি কুরআনের অর্থ মোটামুটি বুঝিও, কিন্তু তিলাওয়াত শেষে দেখা গেল, আমি শুধু ঢুলেছি। আমার মধ্যে কুরআনের কোনও ‘রস’-ই প্রবেশ করে নি। তিলাওয়াত শেষে আমি বলতে পারছি না, এতক্ষণ আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এতক্ষণ কী আদেশ করেছেন, কী নিষেধ করেছেন! এটা কোন ধরনের তিলাওয়াত?
.
(১১৩). আমি কুরআন কারীম থেকে সবচেয়ে বড় যে উপকার লাভ করেছি তা হলো, আমার আব্বা আমাকে নসীহত করেছিলেন:
-বাবা! কুরআনকে এমনভাবে পড়ো, যেন তা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে। -আল্লামা ইকবাল।
.
(১১৪). কুরআন কারীমের নিজস্ব কিছু বর্ণনাভঙ্গি আছে। সেগুলো জানলে তাদাব্বুর করতে সুবিধা হবে। কুরআন কারীম থেকে জ্ঞান আহরণ করা সহজ হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে:
-কুরআন কারীম যেখানেই কোনও নবীর কোনও ‘ভিন্নধর্মী আচরণ (ذَنْب)-এর কথা বলা হয়েছে, সাথে সাথে উক্ত নবীর তাওবার কথাও আলোচিত হয়েছে।
এই তথ্যাটা জানা থাকলে, তিলাওয়াত-তাদাব্বুরের সময় খুঁজতে পারব, কোথায় আছে তাওবার কথা?
.
(১১৫). তাদাব্বুরের সহায়ক আরেকটা দিক বলা যায়: যেখানেই কোনও ত্যাগ দেখব, আমি ভেবে নেব, এই ত্যাগ বা কুরবানির পুরস্কারটা কি? এবং সেটা কোথায় বর্ণিত হয়েছে? এবং মিলিয়ে দেখব, একজনের কুরবানীর পুরস্কার আরেকজনের কুরবানীর পুরস্কারের সাথে মিলছে কি না।
আবার দেখব, একজন আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি পুরোপুরি ইয়াকীন প্রকাশ করেছে, তাহলে আরো যারা ইয়াকীন প্রকাশ করেছে, তাদের ফলাফলের মধ্যে কোনও সাদৃশ্য আছে কি না! যেমন: মুসার মায়ের সন্তান হারিয়ে ইয়াকীন, ইবরাহীমের সন্তান যবেহ করা ইয়াকীন, ইয়াকূবের সন্তান খোয়া যাওয়া ইয়াকীনের ফলটা কেমন? সবগুলোর মধ্যে কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায়? এভাবে আরকি!
.
(১১৬). আরো চিন্তা করতে পারি, কুরআন কারীমে ইয়াকীনের জন্যে যে পুরস্কার দেয়া হয়েছে, তার কারণ কী? আরো ভাবতে পারি, ইয়াকীন অর্জনের চাবিকাঠি কী? এসবের উত্তর আমাকে কুরআনী আয়াত ও ঘটনাগুলো থেকেই বের করতে হবে।
.
(১১৭). আরো চিন্তা করে দেখতে পারি. কুরআন কারীমে যাদের তাওবা কবুল করা হয়েছে, কী কারণে কবুল করা হয়েছে? তাদের তাওবা ও তাওবা কবুলের মাঝে যোগসূত্রটা কি?
.
(১১৮). বান্দাকে কখনো কখনো শাস্তি দেয়া হয়, গাফলতে ফেলে, কুফুরে নিমজ্জিত করে, কলবে মোহর মেরে, লাঞ্ছিত করে। অমাকে খুঁজে বের করতে হবে, এই শাস্তির কারণগুলো কী? কেন বান্দাকে গাফলতে পড়ে থাকার শাস্তি দেয়া হয়? কারণ খুঁজে বের করার পর, আমার প্রধান কাজ হলো, আমাকে যেন এই শাস্তি না পেতে হয়। সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা। এই শাস্তি ও আমার মাঝে শক্ত একটা দেয়াল তুলে নেয়া।
.
(১১৯). কুরআন পড়লে আমার কান্না আসে, এটা একটা চমৎকার বিষয়। কিন্তু এটাই যেন একমাত্র বিষয় না হয়ে যায়। আগের যুগের সালেহীন কুরআন পড়ে শুধু কাঁদতেনই না, প্রতিটি আয়াত থেকে হেদায়াতও সংগ্রহ করতেন।
.
(১২০). আমি কুরআন পড়বো। কেন? আমার আল্লাহ আমার কাছে কী চান, সেটা জানার জন্যে। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে কোনও ইসলাম মানতে বলেছেন সেটা জানার জন্যে। আমি কোন পরিণতির দিকে তিলে তিলে এগিয়ে যাচ্ছি সেটা জানার জন্যে।
.
(১২১). আল্লাহর দ্বীনের অনুসারীদের উপর যে বিপদই আসুক, আল্লাহর কিতাবে তার সমাধান দেয়া আছে। একটু কষ্ট করে খুঁজে নিতে হবে।
.
(১২২). রুগি ডাক্তারের কাছে গিয়ে দেখছে, ডাক্তারের হাতে কুরআন। তিনি তিলওয়াতে মগ্ন। আমি দোকানে গিয়ে দেখি, দোকানদার পণ্যদ্রব্যের স্তূপের আড়ালে বসে কুরআন তিলাওয়াত করছে। আমি যাওয়ার পর কুরআন বন্ধ করে এগিয়ে এসেছে। এমনটা হলে কেমন হতো!
.
(১২৩). নেটে বা চ্যাটে থাকলেও, সময় হলে বলে, আমার এখন তিলাওয়াতের সময়। আপাতত সাইন আউট করছি! আড্ডায় আছে, সময় হলে বলে যাচ্ছে, আমার এখন তেলাওয়াতের সময়, আর থাকা সম্ভব নয়। আমি উঠছি! এই মানসিকতার মানুষের বড় অভাব।
.
(১২৪). সাহাবায়ে কেরামের অন্যতম পরিচয় কি?
= তারা সূরা বাকারা, আলে ইমরান মুখস্থ করেছেন। শুনিয়েছেন নবিজী সা.-এর কাছে। তারা নবীজির কাছে কুরআনের অর্থ শিখেছেন।
.
(১২৫). সুফিয়ান সাওরী রহ. দীর্ঘ সময় কুরআন কারীমের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। যেদিন তাকাতে পারতেন না, কুরআন কারীমকে বুকের উপর রাখতেন। তিনি বলেছেন:
-আমি মনে চায়, আমি কুরআন নিয়েই থাকি, অন্য কিছুর কাছে ধারেও না ঘেঁষি!
.
(১২৬). একজন মুফাসসিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য কী? কুরআন কারীম নিয়ে সময় কাটাতে আনন্দ পাওয়া। আর কুরআন নিয়ে সত্যিকার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হয়, বেশি বেশি তিলাওয়াতের মাধ্যমে!
.
(১২৭). আমি এক অন্ধছাত্রকে দেখেছি। সব সময় তার ঠোঁট নড়ছে তো নড়ছেই। শায়খ সা‘দির দরসে বসতো। সাথীরা তার পাশে বসে গল্প করছে, কিন্তু মানুষটা সমানে তিলাওয়াত করেই যাচ্ছে। কেউ কিছু জানতে চাইলে উত্তর দিচ্ছে। আবার তিলাওয়াতে ডুবে যাচ্ছে।
-সালেহ আবূদী।
.
(১২৮). মানুষটাকে দেখতাম সবজি বাজারের এক কোনে বসে নিরবে সবজি বিক্রি করতো। বয়েস পঞ্চাশ হবে প্রায়। বেশিও হতে পারে। হঠাৎ মানুষটার মনে কী উদয় হলো, কুরআন শেখার প্রচণ্ড আগ্রহ তৈরি হলো। বেদুইন, লেখাপড়া জানে না। কুরআন শেখার জন্যে এ-বুড়ো বয়েসে চক-শ্লেট নিয়ে রীতিমতো নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা শুরু করলো। অল্পদিনেই কুরআন পড়তে শিখল। এরপর ক্বারী শায়খ মুহাম্মাদের দরসে বসতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে কেরাতে দক্ষতা অর্জন করলো। ওদিকে সবজির ব্যবসাও চলছে।
দেখা গেছে দোকান খুলে পসরা সাজিয়ে বসে আছে। কিন্তু হাতে খোলা কুরআন। দুলে দুলে পড়ছে। অন্য কোনও দিকে খেয়াল নেই। খদ্দের এসে দরদাম করছে, ভ্রুক্ষেপ নেই। খদ্দের বিরক্ত হয়ে ভর্ৎসনা করে বলছে:
-আরে বুড়ো! কুরআন পড়বে তো বাজারে কেন এসেছ! মসজিদে যাও! বাজারে বসেছ ব্যবসা করতে, মনদিল লাগিয়ে ব্যবসা করো! কুরআনকে মসজিদে রেখে এসো!
এভাবেই চলতে লাগল মেহনত। মানুষটা এই বয়েসেই, সবাইকে চমকে গিয়ে হাফেয হয়ে গেল। লোকজন ধরাধরি করে, বাজার মসজিদের ইমাম বানিয়ে দিল তাকে। মানুষটার কুরআন পাঠ আরো বেড়ে গেল এবার। আমি একবার তার অজান্তেই তিলাওয়াত প্রচার করেছি রেডিওতে। তার সাথে কথা বলতে গিয়ে সেটাকে ‘অন এয়ার’ করে দিয়েছি। শ্রোতারা ভীষণ মুগ্ধ! অনুপ্রাণিত! এসএমএসে কত মানুষ যে জানিয়েছে, তারা হিফয শুরু করেছে! মনে সান্ত্বনা, না বলে তার ভয়েস প্রচার করে অন্যায় করেছি, কিন্তু অনেক মানুষ তো হিফয শুরু করেছে! আরও অনেক নিরক্ষর বেদুইন তাকে দেখে কুরআন শিখতে আগ্রহী হয়েছে, এটা কম কিসের!
মানুষটার নাম ‘সু‘আইদি। তিনি একজন সাধারণ নিরক্ষর হয়েও কোথায় পৌঁছেছেন! সবজি বাজার থেকে একেবারে মিম্বরের চূড়ায়! তার অনঢ় অবিচল লেগে থাকা, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, আল্লাহর তাওফীক তাকে উচ্চ আসনে বসিয়ে দিয়েছে। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম
-হিফয তো শেষ হয়েছে। এখন দৈনিক কত পারা করে পড়েন?
-কমপক্ষে পাঁচ পারা।
-কখন তিলাওয়াত করেন?
-বাজারে মসজিদে যেখানেই থাকি, কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ করি না। করতে ইচ্ছে করে না। তিলাওয়াত আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো হয়ে গেছে। কারো সাথে কথাও বলতে ইচ্ছে করে না। শুধু তিলাওয়াত করতে মন চায়।
-ফাহদ সুনাইদি
.
(১২৯). কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে বাধা বা সমস্যা আসলে, সময়ের সংকীর্ণতা বা তিলাওয়াতের সামর্থ্য বা অবসর পাওয়া বা সুযোগ পাওয়া নয়, মূল বিষয় হলো ‘হিম্মত’। ইচ্ছাশক্তি। এটা থাকলে আর কিছু লাগে না। ইচ্ছা থাকলে, সময় ও সুযোগের অভাব হয় না।
.
(১৩০). এক আমেরিকানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল:
-কেন ইসলাম গ্রহণ করলে?
-সূরা বাকারার শুরুতেই আছে: এটি এমন কিতাব, যার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই! এটা পড়ে আমি ভীষণ চমকে গিয়েছি। পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস না থাকলে, কারো পক্ষে এভাবে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব নয়। আর এটা হতে পারে একমাত্র আল্লাহ পক্ষে।
.
(১৩১). কুরআনের সৌন্দর্য, তার বর্ণনাভঙ্গি এমন, কোনও কলম তা লিখে প্রকাশ করতে পারবে না।
-জনৈক নওমুসলিম।
.
(১৩২). আমি ফরাসি ভাষায় অনুদিত একটা কুরআনের অর্থের তর্জমা কিনেছি। আমি মনে করি, আমার সমস্ত সম্পদের মধ্যে ওটাই সবচেয়ে মূল্যবাণ।
-জনৈক খ্রিস্টান (উইলিয়াম সার্ভে)।
.
(১৩৩). আমি বাজার থেকে একটা কুরআন কিনে আনলাম। শুরু থেকেই পড়া শুরু করলাম। পড়তে পড়তে তৃতীয় সূরা শেষ করার আগেই অজান্তে আমি সিজদায় লুটিয়ে পড়লাম এই বিশ্বজগতের স্রষ্টার উদ্দেশ্যে। এটাই ছিল আমার আমার প্রথম ‘সালাত’।
-জনৈক নওমুসলিমা।
.
(১৩৪). আমি তখন মক্কায়। হারামে প্রায়ই এক বৃদ্ধকে দেখতাম। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে। কিন্তু কুরআন তিলাওয়াত করেই যাচ্ছে। আসরের পর শুরু করেছে। ঈশা পর্যন্ত তিলাওয়াত করেই গেছে। পিঠের ব্যথা, দৃষ্টির স্বল্পতা নিয়েই।
-মুহান্নাদ মু‘তাবি।
.
(১৩৫). রমযানে ওমরায় গিয়েছি। এক অন্ধকে দেখলাম, বসে বসে তিলাওয়াত করছে। প্রতিদিন আসর থেকে ঈশা পর্যন্ত একটানা।
-আবদুল্লাহ গুফাইলি।
.
(১৩৬). মাদরাসা (স্কুল) ছুটি হয়ে গেছে। ছেলেদের কেউ খেলছে। কেউ বাড়ির পথ ধরেছে। একটা ছেলেকে দেখলাম মাঠের একপাশে বসে বসে কুরআন খুলে তিলাওয়াত করছে। বিকেলে মসজিদে কুরআনী হালকার পড়া ইয়াদ করছে।
-মাজেদ গামেদী।
.
(১৩৭). কাজের চাপ বেশি? এজন্য কুরআন তিলাওয়াত করা যাচ্ছে না! মনে রাখতে হবে, এটা একটা ঠুনকো অজুহাত।
.
কুরআন নিয়ে লেখা কি শেষ করা যায়! এটাও অসমাপ্ত রেখে দিতে হলো। আস্তে আস্তে পুরো করবো। ইনশাআল্লাহ।
-শাইখ আতীক উল্লাহ

-------------------------------------

 

একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে: (২১)
খতমে কুরআন!
-
কুরআন কারীম মুমিনের জন্যে রক্ষাকবচ! ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করে:
নিশ্চয়ই এই কুরআন সর্বাধিক সরল পথের সন্ধান দেয় (ইসরা: ৯)।
কুরআনের বরকত লাভ করতে হলে, হিদায়াত লাভ করতে হলে, নিয়মিত তিলাওয়াত করতে হবে। বোঝার চেষ্টা করতে হবে। পাথরে পাথর ঘষলে যেমন আগুন ধরে, তদ্রূপ কলবের সাথে কুরআনের আয়াত ঘষলেও কলবে হেদায়াতের আগুন ধরবে। আল্লাহর মা‘রেফাতের নূর জ্বলবে।
আমরা গল্প পড়ি। উপন্যাস পড়ি। কবিতা পড়ি। কিন্তু কুরআন পড়ি না। সুযোগ পেলেই যদি গল্পের বই নিয়ে বসতে পারি। ফেসবুক নিয়ে বসতে পারি, কুরআন নিয়েও কিছু সময় বসতে পারবো না কেন?
এখন তো আরও সহজ! মোবাইলেই কুরআন কারীম থাকে। আয়োজন করে কুরআন নিয়ে বসতে হয় না। অনায়াসেই কুরআন পড়া যায়। শোনা যায়।
নবীজি সা. নিয়মিত কুরআন খতম করতেন। জিবরীল আ.-এর সাথে ধরাধরি করতেন। এক খতম শেষ হলে আরেক খতম ধরতেন। এটা সুন্নাত। তিনি বলেছেন:
-অন্তত একমাসে হলেও কুরআন খতম করো (বুখারী)।
হাদীসে বিশদিনে, দশ দিনে, সাতদিনে, তিনদিনে, চল্লিশ দিনে কথাও আছে। যে যারা সামর্থ্য অনুযায়ী খতম করবে। তবে সময় যাই লাগুক, চল্লিশ দিনের বেশি যেন না লাগে। কারণ হাদীসে সর্বোচ্চ চল্লিশ দিনের কথা আছে।
কুরআন তিলাওয়াতে (না বুঝে হলেও) প্রতি হরফে দশ নেকী। আর প্রতিটি নেকী দশগুণ হয়ে আসে (তিরমিযী)।
আমরা প্রতিদিন এক পারা পড়তেই পারি। নিজে না পারলে, অন্তত ত্রিশ মিনিট বরাদ্দ করে, একজন কারী সাহেবের মুখ থেকেও শুনে নিতে পারি। অবশ্য রেকর্ড শুনলে সওয়াব না হওয়ার ফতোয়া দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু কিছু না কিছু বরকতও লাভ হবেই।
একটানা সময় না হলে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুনে নিতে পারি। পড়ে নিতে পারি। প্রতি নামাযের আগে বা পরে চার পৃষ্ঠা করে শোনার বা পড়ার নিয়ম করে নিতে পারি।
কুরআন হলো হিদায়াতের আধার। গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়:
-কেউ নিয়মিত কুরআন খতম দিতে অভ্যস্ত হলে, ভ্রান্তি বা বিচ্যুতি তার আশেপাশে ঘেঁষতে পারবে না। চব্বিশ ঘণ্টায় ‘ত্রিশটা মিনিট’ খুব বেশি কিছু তো নয়! এটা নিজের জানমালের নিরাপত্তার জন্যে ব্যয় করছি বলেও ধরে নিতে পারি! আল্লাহও খুশী। নবীজিও খুশি! দুনিয়া-আখেরাত উভয়টাই নিরাপদ হয়ে গেলো!
প্রথম প্রথম কষ্ট হয়, যে কোনও আমলই একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে, পালতোলা নাওয়ের মতো তরতর এগুতে থাকে! আর থামাথামি হয় না! পালটা তুলতে যা দেরী! আল্লাহ তাওফীক দেয়ার জন্যে তৈরী হয়েই তো আছেন!
আমাদের শি‘আর (স্লোগান) হলো:
– ইন তুতীঊহু তাহতাদু (وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا): যদি তার (নবিজীর) অনুসরণ করো, হিদায়াত পেয়ে যাবে (নূর:৫৪)
-শাইখ আতীক উল্লাহ

------------------------

 

>> যে আয়াতের তাদাব্বুর গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখে :

জীবনকে সুন্দর ও আখিরাতমুখী করার কত প্রচেষ্টাই না আমরা করে থাকি! কিন্তু শয়তানের চক্রান্তে আমাদের প্রচেষ্টাগুলো বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আজ আমরা এমন একটি আয়াতের কথা বলব, যার প্রকৃত অর্থ করার সক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা শুধু এর শাব্দিক অনুবাদটাই করতে পারি; নতুবা আয়াতটির মর্ম ও গভীরতা বুঝতে হলে লাগবে পরিশুদ্ধ একটি অন্তর। আপাতত বাহ্যিক নজরে তাকালেও উপকার পাওয়া যাবে। একবার আমল করে দেখা যেতে পারে। আয়াতটি হলো :
وَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا
‘আর আপনি আপনার রবের হুকুমের অপেক্ষায় সবর করুন। নিশ্চয় আপনি আমার দৃষ্টির সামনে আছেন। (সুরা আত-তুর : ৪৮)
 
ওহ সবর! ইবাদতের সবর, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার সবর, বিপদে নিপতিত হওয়ার সবর; এত এত সবর কীভাবে সম্ভব!? অনেক কষ্টকর, তাই না?? শয়তান ও নফসের প্ররোচনা থেকে বেঁচে থাকা ‍কি এতই সহজ??? জি, খুবই সহজ। আয়াতের শেষাংশের দিকে একটু খেয়াল করুন, فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا [নিশ্চয়ই আপনি আমার দৃষ্টির সামনে আছেন।] আবার পড়ুন, আবারও পড়ুন; বারবার পড়ুন...। দেখুন তো, কেমন অনুভূতি হয়! অন্তরটা কেমন ভয়ে কেঁপে ওঠে!! আল্লাহর দৃষ্টির সামনে গুনাহ করার সকল অনুভূতি কেমন নিস্তেজ হয়ে যায়!!!
 
ওহ! এভাবে তো কখনো ভেবে দেখিনি! সবর করা তো এখন অনেক সহজ লাগছে। অনেক হালকা লাগছে সকল গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। আমার মহান রব আল্লাহ যে আমায় দেখছেন, চোখে চোখে রাখছেন। কেমন এক ভিন্নরকম অনুভূতি, যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। হে আল্লাহ, আজ থেকে সবর করব_সকল মুসিবতের নিদারুন হালতে, সকল গুনাহ থেকে বিরত থাকার যুদ্ধে এবং সকল ইবাদতের অবিরাম কষ্টে।
 
এ আয়াতটি নিয়ে যত চিন্তা করবেন, এর গভীর মর্মের দিকে যত নজর দিতে থাকবেন; আখিরাতের যাত্রপথে আপনার তত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। বর্ণিত আছে যে, এক বুজুর্গ এ আয়াতটি স্মরণ করে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য একটি কাগজে আয়াতটি লিখে সর্বদা পকেটে রেখে দিতেন এবং একটু পরপর কাগজটি বের করে পড়ে আবার রেখে দিতেন। এভাবে তিনি গুনাহমুক্ত সুন্দর একটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।
 
সুবহানাল্লাহ! আমাদের মতো দুর্বল মুমিনদের জন্য কী চমৎকার একটি পদ্ধতি! পরীক্ষার উদ্দেশ্যে হলেও একবার আমল করেই দেখুন না! দেখুন, আপনার জন্য কী সুন্দর ফলাফল অপেক্ষা করছে! পরিশুদ্ধ ও পবিত্র জিন্দেগির স্বাদ একবার পেয়ে গেলে আর কখনো নোংরা জীবনে আপনি ফিরতে চাইবেন না, সেটা গ্যারান্টি দিয়েই বলা যায়। আল্লাহ আমাদের সবরের সকল প্রকারের ওপর আমল করা সহজ করে দিন।

---------------------------------

 

>> বড় হবার পরও কিভাবে কোরআন মুখস্ত করবেন।

। প্রথম কাজ হলো তিলওয়াত শুদ্ধ করে নেয়া। এটা একা একা পারবেন না। কোনো আলেমের থেকে শিখে নিতে হবে। যদি ছোটকালে শিখে থাকেন এবং এখনো কনফিডেন্ট যে আপনার তিলওয়াত ঠিক আছে, তবে যে কোনো আলেমের কাছে ১০ মিনিট বসে বলবেন “দেখেন তো আমি কোরআন দেখে দেখে পড়ছি। আমার পড়া ঠিক আছে কিনা?”
যদি বলে ঠিক আছে, তবে হলো।
। অনেকে ধারনা করে মুখস্ত করার জন্য দ্রুত বার বার পড়তে হয়। এটা ভুল। খুব শুদ্ধভাবে পূর্ন মনোযোগ দিয়ে একটা একটা শব্দ পড়তে হবে। একটা শব্দকেই কয়েকবার যতক্ষন না সেটা শিখা হচ্ছে। এর পর পরের শব্দ। দ্রুত না। বরং শুদ্ধ করে ধীরে তেলওয়াতের মত।
। আপনার সময়ের ৯০% সময় যাবে আগের মুখস্ত রিভিউ করতে। ১০% সময় নতুন মুখস্ত করার পেছনে। এটাই স্বাভাবিক।
। মুখস্ত করার সবচেয়ে উত্তম সময় ফজরের আগে। কারো মতে মাগরিবের পরে। তবে মাগরিবের পরে ছাত্ররা ছাড়া বাকি সবাই ব্যস্ত থাকে।
কমপক্ষে ৩০ মিনিট পড়লেও আগাতে পারবেন। এটা নতুন মুখস্ত করার জন্য।
। রিভিউ যখনই অবসর পান করতে হবে। জ্যমে আটকিয়ে আছেন? অপেক্ষা করছেন? এই সব সময়ে।
। একটা ভালো প্রেকটিশ হলো প্রতি নামাজের ২০ মিনিট আগে মসজিদে চলে গিয়ে জামাতের পুর্ব পর্যন্ত রিভিউ করা।
। প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের সময় যতটুকু আপনার আগে মুখস্ত আছে সেখান থেকে ১ পারা করে পড়তে হবে। এটা একটা ভিত্তির মত যেটা করলে আপনি আর আগের মুখস্ত ভুলবেন না ইনশাল্লাহ। কোরআনের নূর নিজের মাঝে রিফ্লেক্ট হবে। এবং সমস্যায় পড়ে গেলে স্বরন হয়ে যাবে, ঐ আয়াতে এই কথা ছিলো, সেই আয়াতে আল্লাহ বলেছিলেন এই কথা। এরকম। পথ খুজে পাবেন।
। প্রথম ৫ পারা মূখস্ত করা একটু কষ্টকর হবে। কিন্তু এটা হয়ে গেলে বাকিটা এর পর সহজ হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।
। মুখস্ত করার সময় কেউ প্রথম সুরা বাকারা থেকে আরম্ভ করে। কেউ শেষ থেকে একটা একটা সুরা মুখস্ত করে প্রথম দিকে আসতে থাকে। অনেক মাদ্রাসায় শেষ ৫ পারা মুখস্ত করিয়ে এর পর প্রথম থেকে আরম্ভ করে। যেটা আপনার ভালো মনে হয়।
১০। আপনি কোরআন শরিফের যে কপি থেকে মুখস্ত করবেন সারা জীবন ঐ জায়গা পড়ার সময়ে ঐ বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো আপনার চোখে ভাসবে। তাই একটা ভালো কপি থেকে মুখস্ত করতে হবে।
হাফেজি কোরআন হয় ২০ পৃষ্ঠায় প্রতি পারা। এরকম একটা কোরআন শরিফের কপি জোগাড় করতে হবে। যত হাফেজ আছে কেউ আয়াতের নম্বর না বলতে পারলেও ঐ পৃষ্ঠা আরম্ভ হয়েছে এই আয়াত থেকে এটা বলতে পারবেন। এটা চোখে ভাসবে।
এর জন্য বাংলাদেশে প্রচলিত হলো নূরানী হাফেজী কোরআন। তবে আমার কাছে সৌদি উথমানী প্রিন্ট কোরআন আরো সহজ মনে হয়। দুটোই ২০ পৃষ্ঠায় পারা। কিন্তু কিছু পার্থক্য আছে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের পথ দেখান।
আমারা উনার কাছে ফিরছি।
cltd
----------------------------

 

>> কলেজ/ভার্সিটিতে পড়ুয়া ভাই বোনেরা কিভাবে কুর’আন হিফজ (মুখস্ত) করবেন?

হতাশ হবেন নাঃ
  • অনেকগুলো পৃষ্ঠা ভেবে ভয় পাবেন না। প্রতিদিন মাত্র পাঁচ লাইন মুখস্ত করুন,এটা খুবই অল্প আপনার জন্য। বাংলাদেশের “নুরানী হাফেজী কুর’আনগুলো”র প্রতি পৃষ্ঠায় থাকে পনেরো লাইন। তাঁর মানে এক পৃষ্ঠা খুব ভালো মতো শিখতে লাগবে মাত্র তিনদিন। বিশ পৃষ্ঠায় এক পারা/জুজ। যা মুখস্ত করতে লাগবে ৬০ দিন,মাত্র দুই মাস। প্রতি দুই মাসে এক পারা হলে,ত্রিশ পারা মাত্র ষাট মাস অর্থাৎ পাঁচ বছর মাত্র। ভাবা যায়! পাঁচ বছর পর আপনি কুর’আনের হাফিজ হিসেবে পরিচিত হবেন (আল্লাহর কাছে)। যেই কালাম আপনার পথ প্রদর্শক সেই কালাম আপনি মাত্র পাঁচ লাইন মুখস্ত করতে পারবেন না ??? চাইলেই পারবেন,খুবই সহজ। আর হ্যাঁ , শিওর থাকুন,ইন শা আল্লাহ্‌ আপনার পুরাটা মুখস্ত করতে পাঁচ বছর লাগবে না। তিন/চার বছরেই হয়ে যাবে। এবার আসুন পদ্ধতি নি্যে কথা বলি।
.
দেখে পড়তে শিখুন আগেঃ
  • প্রথমত ভালো একজন উস্তাদের কাছে সহিহ-শুদ্ধভাবে কুর’আন পড়তে শিখুন দেখে দেখে। উস্তাদের অনুমতি পেলে তাঁর অধীনে বা অন্য কারও অধীনে অথবা নিজে নিজেই মুখস্ত করা শুরু করুন। (এর পূর্বে অবশ্যই জেনে নিবেন যে, আপনি সহিহ ভাবে,বিনা ভুলে দেখে পড়তে পারেন কিনা!)
.
এবার মুখস্ত শূরু করুনঃ
  • প্রতিদিন আপনি একটি নির্দিষ্ট অংশ টার্গেট করুন, কতটুকু আপনি মুখস্ত/ইয়াদ করতে চান। প্রথম দিকে ন্যূন্তম সর্বনিম্ন পাঁচলাইন মুখস্ত/ইয়াদ করতে চেষ্টা করুন।
  • দুইটা নির্দিষ্ট সময় বের করুন,একটা দুপুর/বিকেলে। আরেকটা রাতে (আপনার দৈনিক কর্মব্যাস্ততা থাকলে ঘুমের পূর্বের এক/দেড় ঘন্টা সময় নির্ধারণ করুন,মুখস্ত শেষে ঘুমিয়ে যান)। যেই পাঁচ লাইন টার্গেট করবেন সেই পাঁচ লাইন বিকেলে মুতা’য়ালা করুন। (মুতা’য়ালা=প্রথমত আপনি দেখে পড়তে কিছুটা আটকে আটকে যাবেন,কয়েকবার পড়লে অনেক smoothly পড়তে পারবেন। এভাবে বেশ কিছু সময় চেষ্টা করলে প্রথমবারের চেয়ে অনেক সহজ লাগবে পড়াটা। এবার রেখে দিন।
  • রাতের নির্ধারিত সময়টুকু বিকেলের পড়াটুকুকে মুখস্ত করুন। ঝাড়া মুখস্ত যাকে বলে সেভাবে করুন। পরদিন সকালে ফজরের পর মুখস্ত করা অংশটুকুকে আবার পড়ুন। এরপর দৈনন্দিন কাজ শুরু করুন, দিনের অবসরে মুখস্ত অংশটুকু আউরে নিন মনে মনে/পড়ে।
  • কোনো ওস্তাদ বা ভালোমতো কুর’আন পড়তে পারে এমন কাউকে মুখস্ত করা পড়াটা শুনান , দেখেন ভুল পান কোথায় কোথায়,ভুল্গুলোর প্রতি খেয়াল রাখুন,কুর’আন এ মার্ক করে রাখুন, (আমরা লাল/হলুদ রঙ্গের কাগজ ব্যাবহার করতাম। ব্যানানার চুইঙ্গাম পাওয়া যেত,প্যাকেটটা ছিল হলুদ/বেগুনী/লাল,প্যাকেটে ৫/৬ টা থাকতো চুইংগাম।প্যাকেটের ভিতর প্রতিটা চুইংগাম পাতলা লাল/হলুদ/বেগুনী কাগজ দিয়ে মোরানো থাকতো, এইগুলা আমরা একেবারে ছোট করে ছিড়ে লালা দিয়ে লাগিয়ে রাখতাম ভুলের ঐখানে।) যেন প্রতিবার ঐ অনশটুকু পড়ার সময় ভুলটা চোখে পড়ে।
  • বিকেলে আবার আগের দিনের মতো নতুন একটা অংশকে টার্গেট করুন,মুতা’য়ালা করুন। (হোক সেটা পাঁচ লাইন,প্রথমদিকে পাঁচ লাইন করে করাই ভালো। আর তাছাড়া আপনার অন্য পড়াশোনা/কাজও আছে। )
  • রাতে আবার বিকেলের নতুন পড়াটাকে মুখস্ত করুন ভালোমতো। এরপর জেগে উঠুন তাহাজ্জুত এর জন্য, প্রথমদিন মুখস্ত করা পাঁচ লাইন দিয়ে তাহাজ্জুদ পড়ুন,প্রথম রাকাতে নতুন পাঁচ লাইন,দ্বিতীয় রাকাতে অন্য যেকোনো পুরনো মুখস্ত সুরা।
  • সকালে ফজরের পর গত রাতে নতুন মুখস্ত করা পাঁচ লাইন আবার মুখস্ত করুন,আরও ভালোমতো। এরপর এই নতুন পড়াটাও কাউকে শোনান দিনের যেকোনো সময়ে। আর হ্যাঁ যতক্ষণ না শিওর হচ্ছেন আপনার নতুন পড়াটায় কোনো ভুল নেই ততক্ষণ এটা নামাজে পরবেন না।আর সর্বমোট দশ লাইনকে আউড়ান নিজের মনে মনে/পড়ে।
  • বিকেলে আবার পুর্বের দিনগুলোর মতো করুন,রাতেও পূর্বানুরূপ করুন। রাতে তাহাজ্জুদে ওস্তাদের কাছে শোনানো নতুন পড়াটাকে সহ পুর্বেরদিনেরটা মিলিয়ে তাহাজ্জুদে সুন্দর লাহানে তিলাওয়াত করুন উচ্চস্বরে।
  • এভাবে করতে থাকুন। এক পারা পরিমাণ মুখস্ত হলে পুরো পারাটা ন্যুনতম একবার দেখে ও একবার না দেখে তিলাওয়াত করুন,রাতে পুরো এক পারা তাহাজ্জুদে পড়ুন। যখন পাচঁ লাইন মুখস্ত করা কোনো ব্যাপার ই হবে না তখন নতুন পড়ার পরিমাণ বাড়িয়ে সাত/দশ লাইন করুন মুখস্ত করার জন্য।এভাবে এক পৃষ্ঠা পর্যন্ত বাড়াতে পারবেন কিছুদিন পর,বেশি বেশি মুখস্ত করা জরুরি নাহ,অল্প করে ভালোমত পড়া জরুরি,যতো বেশিদিন সময় লাগবে ততো বেশিদিন আপনি আমলের উপর থাকতে পারবেন এই তাগীদে,কুর’আনের সাথে একনিষ্ঠভাবে লেগে থাকতে পারবেন।
  • একের অধিক পারা হলে সেটাকে দুই ভাগে রিভাইস দিন। একদিন এক পারা করে রিভাইস দিন (দিনে দুইবার) দেখে একবার, না দেখে একবার। পরেরদিন অন্য পারাটা পড়ুন দুইবার,একবার দেখে , আরেকবার না দেখে। তাহাজ্জুদেও একেকদিন একেক পারা পড়ুন,মনে রাখবেন যত বেশি তিলাওয়াত,ততো ভালোভাবে ইয়াদ হবে। আর হ্যাঁ প্রতিবার দেখে তিলাওয়াত করার সময় যেই ভুলগুলো মার্ক করে রেখেছেন সেগুলো ভালোভাবে খেয়াল রাখুন।
কখন পড়া ভালোমতো মুখস্ত হয়?
  • যখন আপনি মুখে পড়বেন,চোখে দেখবেন,কানে শুনবেন। অর্থাৎ এই তিনটা কাজ একসাথে করতে পারবেন তখন ভালভাবে মুখস্ত হবে,তাড়াহুড়া করবেন না মুখস্ত করার সময়। ধীরে-সুস্থে তারতীলের সাথে তিলাওয়াত করে মুখস্ত করুন,বারাকাহ পাবেন। উস্তাদ বলতেন, “যখন তোমার চোখ,কান,মুখ যখন একত্রিত হবে তখন তোমার হিফজ সহজ হবে।” অর্থাৎ মুখ দিয়ে যা পড়ছেন,কান দিয়ে শুনে চোখ দিয়ে তা পরখ করুন আপনার পড়ায় কোনো ভুল আছে কিনা!
  • ইন শা আল্লাহ্‌ আপনি সক্ষম হবেন।
  • প্রচুর তওবাহ করবেন রব্বে কারীমের দরবারে। প্রচুর দুয়া করুন সারাদিন,তাহাজ্জুদে। নফল ইবাদাত বাড়িয়ে দিন। ইলম ভিক্ষা চান রব্বে কারীমের দরবারে। হতাশ হবেন না,ধৈর্য্য হারা হবেন না।
যখন আপনি পাঁচোর্ধ পারা মুখস্ত করে ফেলবেনঃ
  • প্রতিদিন দুই/তিন পারা তিলাওয়াত করুন দেখে দেখে,সময় পেলে দেখে যেটা পড়লেন সেটাকেই মুখস্ত পড়ুন হাটতে ফিরতে।

এবার সামনে অগ্রসর হোন আমার ভাই ! আল্লাহ্‌ উত্তম সহায়ক আপনার জন্য। এই চেষ্টাটা আপনাকে নেক আমলের উপর অবিচল রাখতে সহায়ক হবে । মনে রাখুন,অনেক সময় স্বাভাবিকভাবে মাদ্রাসায় পড়াকালীনই ছাত্ররা পাঁচ থেকে ছয় বছরের চাইতেও বেশি সময় লাগিয়ে ফেলে,তাও তারা দাঁতে দাঁত চেপে লেগে থাকে । আপনার আমল ঠিক থাকলে,আল্লাহকে খুশি করার ইচ্ছা থাকলে বারাকাহ পাবেন ই পাবেন,আল্লাহ চাহেন তো ।

হিফজের জন্য মুসলিমদের উৎসাহিত করা বিরাট নেক আমল। দ্বীনি ভাইদের মনে কুর'আন হিফজের ভয়কে দূর করতে সহায়তা করুন। প্রায় সব দ্বীনি ভাইই চায় হিফজ করতে,সাহস করতে পারেন না।
cltd
-----------------------------

 

 

 

কুরআনের সাথে অ্যাটাচমেন্ট কীভাবে ইম্প্রুভ করা যায় ? অবভিয়াস উত্তর হচ্ছে বেশি বেশি শুদ্ধ তিলাওয়াত, হিফজ, অর্থ পড়া, তাফসীর পড়া - ইত্যাদি। অনেকের কাছে এই সিলেবাসটা একটু টাফ বা চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে - প্রধানত দুইটা কারণেঃ
১) শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করার দক্ষতা নেই
২) মুখস্ত হয় না
ওয়েল "মুখস্ত" অনেকেরই হয় না, সঠিক নিয়ম বা রুটিন ফলো না করার কারনে। তাজউইদ ঠিক নেই - এটাও কমন কেইস। তবে এই ব্যারিয়ার ভাঙ্গাতেই হবে, শুদ্ধ করতেই হবে, হিফজ অল্প অল্প হলেও করতেই হবে। ইন দি মিন টাইম, কুরআনের প্রতি আপনার ভালোবাসা সতেজ রাখতে এই কাজগুলা করতে পারেনঃ-
১) সবগুলা সুরার *নাম* মুখস্ত করতে ফেলতে পারেন। না দেখে ১১৪ টার মধ্যে অন্ততঃ ১০০টা মিনিট দুই-তিন এর মধ্যে যাতে বলতে পারেন।
২) কোন সুরার নাম্বার কত, সেগুলো মনে রাখতে পারেন। এতে করে হঠাৎ একটা সুরার নাম্বার মনে আসলে তার আশে পাশেরগুলার নাম্বার মনে আসবে। আর এভাবে কোন একটা সুরার নাম - যা খুব বেশি শোনা যায় না - সেগুলোও মনে থাকবে (যেমন যুখরুফ)।
৩) কোন সুরায় কতোগুলো আয়াত আছে, এগুলো রেগুলার ফলো আপ করতে পারেন। চট করে যাতে আপনি বলতে পারেন আল-কাহাফে ১১০ টি আয়াত আছে।
৪) বেশিরভাগ মসজিদে ইমাম সাহেব কিছু সংখ্যক সুরার আয়াত-ই রেগুলার তিলাওয়াত করেন, যেমন আয-যুমারের "ওয়াসিক্বল্লাযি" - আয়াত ৭১ এবং ৭৩ প্রায়-ই পড়ে। এসব কমন আয়াতগুলো খুঁজে বের করুন এবং সেগুলোর তাফসীর পড়ুন। https://www.islamicity.org/ps/default.asp এই সাইটে ফোনেটিক সার্চ করা যায়, যেকোন তিলাওয়াত নামাজে শুনলে ঘরে এসে ইংলিশ ট্রান্সলিটারেশনের মাধ্যমে সার্চ করে বের করুন।
৫) জানা সুরাগুলোর অর্থ মুখস্ত করে ফেলুন, তাফসীরও পড়তে পারেন বা ইউটিউবে লেকচার শুনতে পারেন।
৬) প্রত্যেকটা সুরার শুরুর আয়াত দেখুন, শুনেই যাতে বলে দিতে পারেন এইটা ঐ সুরা।
৭) একটা একটা করে সুরার শানে নুযুল দেখুন। Quran.com সুরাতে গিয়ে "Surah Info" লিংকে ক্লিক করলেই পেয়ে যাবেন সহজে।
মোট কথা - কুরাআনের ব্যাপারে আপনার কৌতুহলটাকে জিইয়ে রাখতে হবে যাতে কুরআনের আরো কাছে থাকতে পারেন, একটা আমল করলে আরেকটা করার ইচ্ছা জাগবে। এই কৌতুহলের বাড়ার সাথে সাথে অর্থ, তাফসীর, তাদাব্বুর - এগুলোও সহজ হবে ইনশা আল্লাহ।
চিন্তা করে দেখুন, যিনি সৃষ্টি করেছেন, তাঁর নিজের সরাসরি কথাগুলো বা আপনার আমার জন্য ইন্সট্রাকশন - শুধু এই কুরআন-ই। কুরআন এর কোথায় কী আছে - এই কৌতুহল একজন সাধারণ মুসলিমের না থেকে পারেই না। এই কুরআন বিচার দিবসে সাক্ষ্য দিবে, হয় আপনার পক্ষে অথবা বিপক্ষে, তবে দিবেই।
কৌতুহল + রিসার্চ জারি রাখুন, এত জিনিস আছে যে আপনার লাইফটাইমে নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করে শেষ করতে পারবেন না।
-M. Mahbubur Rahman
-----------------------------

 

কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনার ১০ পদ্ধতি

মহান রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে বহু নিয়ামত দান করেছেন। কিন্তু আল্লাহর দেওয়া এই বিপুল নিয়ামতরাজির মধ্যে এমন কোনো নিয়ামত নেই, যা কুরআনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। কুরআনের মতো মূল্যবান আর কোনো নিয়ামত নেই, হতেও পারে না। কেননা এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহর নিজের কথামালা, কুরআনের মাধ্যমে আপনি সরাসরি আপনার মালিকের সাথে কথা বলার বিশাল সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন! সুব’হানাল্লাহ!

এই কুরআন হচ্ছে আপনাকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবার পথ। এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উপায়। কুরআনই আপনাকে দেখিয়ে দেবে জান্নাতের অমরত্ব লাভের সুনিশ্চিত রাস্তা। কুরআনই হচ্ছে সুকূন আর এর মাধ্যমেই আসে সফলতা।

অতএব কুরআনকে বুঝার, একে অনুধাবন করার, এর মর্মকে নিজের মধ্যে ধারণ করার বিন্দুমাত্র বিকল্প নেই। একজন মুসলিম কুরআনকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। তার চলার পথে যত ধরনের দিকনির্দেশনা দরকার, তার প্রতিটির উৎসমূল হচ্ছে এই মহাগ্রন্থ। তাই কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা, কুরআন নিয়ে যথাযথ পদ্ধতিতে গবেষণা করা সব স্তরের মুসলিমের জন্যই অত্যন্ত জরুরি।

কুরআন অনুধাবন

কুরআন থাকা উচিত ছিল আমাদের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে। কুরআনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবার কথা ছিল আমাদের সকল চিন্তা, কথা, কাজকর্ম। কিন্তু আমাদের আলস্য আর অবহেলার কারণে আমরা আজ এটা থেকে অনেক দূরে। এ জন্যই আমাদের অন্তরের ইসলাহ হয় না, আমাদের কাজগুলোও সংশোধিত ও বরকতপূর্ণ হয় না। কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা তথা কুরআন নিয়ে তাদাব্বুরের মহাগুরুত্ব উপলব্ধি করতে চাইলে ইবনে হুবায়রা রাহিমাহুল্লাহর এই একটি কথাই যথেষ্ট –

“শয়তানের একটি বড় যন্ত্রণা হলো, কুরআন নিয়ে মানুষের তাদাব্বুর-চিন্তা ফিকির করা। কারণ, শয়তান জানে কুরআন নিয়ে চিন্তা-ফিকির করলেই হিদায়াত লাভ হয়।”

অতএব হিদায়াতের রাজপথে হেঁটে জান্নাতের সবুজে প্রবেশ করতে চাইলে কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই। এটা ছাড়া আপনার আমলের মধ্যে প্রাণ আসবে না, আপনার ঈমান জীবন্ত হয়ে উঠবে না। কুরআনের তাদাব্বুর ছাড়া কুরআনের ফুল দিয়ে আপনি আপনার জীবন সাজাতে পারবেন না। তাই কুরআন থাকতে হবে আমাদের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে। কুরআন তিলাওয়াতের সময় আমাদেরকে আয়াতের বক্তব্য নিয়ে ভাবতে হবে, ভাবতে হবে তার প্রকাশভঙ্গী নিয়ে, খেয়াল রাখতে হবে এর শব্দ ও অর্থের দিকে, জেনে নিতে হবে কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছিল এই আয়াত। এভাবেই কুরআন নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা পরিপূর্ণতা পাবে।

কুরআন তাদাব্বুরের ১০টি পদ্ধতি

কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা বা তাদাব্বুর করার অসংখ্য পদ্ধতি রয়েছে। এ বিষয়ে উলামায়ে কেরাম আলোচনাও করেছেন। এখানে আমরা তাঁদের আলোচনা থেকেই ১০টি পদ্ধতির কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

১। কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি: কুরআন নিয়ে চিন্তা করার, এর অন্তর্নিহিত রহস্য ও ভাব অনুধাবন করার এক নাম্বার পদ্ধতিই হচ্ছে কুরআনের সাথে সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলা। আমরা আমাদের একান্ত বিষয়-আশয় তাকেই বলে থাকি যে আমাদের খুব কাছের। আমাদের মনের কথাগুলো আমরা সেই বন্ধুকেই বলে থাকি যার সাথে আমাদের সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর। কুরআনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন। কুরআনের সাথে আপনার সম্পর্ক যতো গভীর হবে, আপনি ততো তার ভেতরের কথাগুলো জানতে পারবেন, বুঝতে পারবেন। কুরআন যতো বেশি আপনি তিলাওয়াত করবেন, যতো বেশি সময় আপনি কুরআনের সাথে কাটাবেন ততো বেশি আপনি কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করার, এর গভীরতা থেকে মণিমুক্তা তুলে আনার কাজে পারঙ্গম হয়ে উঠবেন। কুরআনের সাথে আপনার সম্পর্কের গভীরতা অনুযায়ী কুরআন তার রহস্য আপনার কাছে উন্মোচিত করবে। সম্পর্ক যত গভীর হবে, কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনাও ততোই গভীরে গিয়ে পৌঁছুবে।

২। ধীরেসুস্থে ও বুঝেশুনে কুরআন তিলাওয়াতের চেষ্টা করা: কুরআন তিলাওয়াতে তাড়াহুড়া এমনিতেই পরিত্যাজ্য। তার উপর যদি আপনি তাদাব্বুরের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনাকে দ্রুত তিলাওয়াতের চিন্তা পরিহার করতে হবে। একবার ভেবে দেখুন তো, কেউ যদি খুব দ্রুত কোনো কথা বলে যায় তবে কি আপনি তার কথার মর্ম ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারবেন? পারবেন না। সে খুব হৃদয়গ্রাহী কথা বলতে পারে, কিন্তু তার দ্রুততা কথার আবেদনকে আপনার পর্যন্ত পৌঁছুতে দেবে না। কুরআনের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটবে যদি আপনি স্রেফ দ্রুততার সাথে আয়াতগুলো আওড়ে যান। কিন্তু যদি আপনি কুরআন নিয়ে ভাবতে চান, কুরআনকে আপনার হৃদয় স্পর্শ করতে দিতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে ধীরেসুস্থে ও বুঝেশুনে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য চেষ্টা করতে হবে। শেষ করার প্রতি মনোযোগ না দিয়ে এর মর্ম অনুধাবনের চেষ্টায় রত থাকতে হবে।

৩। তিলাওয়াতের সময় অন্তরকে হাজির রাখা: একে আমরা বলতে পারি শুধু শরীরের কান দিয়ে না শুনে মনের কান দিয়ে শোনা। আপনাকে অবশ্যই অন্তর দিয়ে কুরআনকে শুনতে হবে, পড়তে হবে। আপনি যখন তিলাওয়াত করছেন তখন আপনার যবান তো কুরআনের আয়াত উচ্চারণ করে যাচ্ছে, কিন্তু আপনার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। এমন অবস্থায় কখনোই কুরআন নিয়ে চিন্তা করতে আপনি সক্ষম হবেন না। আপনাকে অবশ্য অবশ্যই আপনার অন্তরকেও কুরআন তিলাওয়াতকালে সমানভাবে হাজির রাখতে হবে। আপনাকে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে যাতে তিনি আপনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং তাঁর কালামকে আপনার অন্তরে বদ্ধমূল করে দেন।

৪। তিলাওয়াতের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রাখা: কুরআন তিলাওয়াতের সময় অবশ্যই আপনাকে মাথায় রাখতে হবে কেন আপনি এই কিতাব তিলাওয়াত করছেন। ড. খালিদ বিন আব্দিল কারীম মুহাম্মাদ হাফিযাহুল্লাহর মতে, কুরআন তিলাওয়াতের সময় ৫টি উদ্দেশ্য আপনার সামনে থাকা চাই। এগুলো হলো, ইলম অর্জন, কুরআন অনুযায়ী আমল, রবের সাথে কথোপকথন, সাওয়াব লাভ ও রোগ থেকে শিফা লাভ। এগুলো সামনে রেখে কুরআন তিলাওয়াত করলে নিশ্চয়ই তা আপনার জন্য কল্যাণকর চিন্তার দুয়ার খুলে দেবে, যা আপনাকে সাহায্য করবে কুরআনের গভীরে পৌঁছাতে এবং কুরআন থেকে উপকৃত হতে। তাছাড়া লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বিহীন কোনো কাজই সফলতা লাভ করতে পারে না। কুরআনের ক্ষেত্রে তো বিষয়টি আরো বেশি সত্য।

৫। নামাযে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া: নামাযের মধ্যে আমরা কুরআন তিলাওয়াত করেই থাকি। কিন্তু তবুও নামাযে আলাদাভাবে এর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত হবে। নামাযে বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা কুরআন নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনার দ্বারকে উন্মুক্ত করবে ইনশাআল্লাহ। বিশেষ করে তাহাজ্জুদের নামাযে এই বিষয়টির দিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। কারণ তখন সময়টা থাকে নির্ঝঞ্ঝাট, নীরব, সুনসান। কুরআন নিয়ে ভাবার, কুরআনের অতলে ডুব দেবার জন্য এই সময়টিই সবচেয়ে উপযুক্ত। আর এই সময়ে নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত তাদাব্বুরের জন্য সেরা একটি পদ্ধতি।

৬। একটি আয়াত বারবার পড়া: কুরআন তাদাব্বুরের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, একটি আয়াত একাধিকবার পড়া। বারবার পড়ে পড়ে আয়াতটি মনের মধ্যে গেঁথে ফেলা এবং এর মর্ম অনুধাবনের চেষ্টা করা। কুরআন নিয়ে চিন্তা করার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত জরুরি ও কার্যকর একটি পদ্ধতি।

৭। কুরআনের আয়াতকে জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখা: কুরআন নিয়ে চিন্তা করার জন্য এটি আরো একটি কার্যকর পদ্ধতি। কুরআনে প্রচুর উদাহরণের উল্লেখ দেখা যায়। সেই উদাহরণগুলো নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা। আল্লাহ যেখানে যেখানে উপমা দিয়েছেন সেগুলোকে সেভাবে চিন্তা করা। যেমন, আল্লাহ কুরআনে পার্থিব জীবনকে শস্যক্ষেতের সাথে তুলনা দিয়েছেন। এই বাস্তব উদাহরণগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা। এই উপমাগুলো আল্লাহ এজন্যই দিয়েছেন যাতে আমরা এগুলো নিয়ে ভাবি এবং এ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করি। কুরআনের আয়াতকে যতো বেশি আমরা জীবনের সাথে মিলিয়ে পড়বো, যতো বেশি নিজেদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলীর সাথে কুরআনের বক্তব্যের মিল খুঁজবো, কুরআন থেকে আমি ততো বেশি ফায়দা হাসিল করতে পারবো। কুরআন নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা ততো বেশি পোক্ত হবে, সমৃদ্ধ হবে ইনশাআল্লাহ।

৮। খুব গভীরভাবে কুরআনের আয়াত মুখস্থ করা: কুরআনের যে কয়টি আয়াতই আমরা মুখস্থ করি না কেন, সেগুলো এমনভাবে মুখস্থ করা যেন কোথাও শুনলেই সেগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এতে করে এই আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা করা আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।

৯। মুখস্থ অংশটুকু প্রতি সপ্তাহে আবার পড়া: কুরআন নিয়মিত যতোটুকুই সম্ভব মুখস্থ করতে চেষ্টা করতে হবে। আর যতোটুকুই মুখস্থ করুন না কেন, সেটা পরের সপ্তাহে আবার পড়ুন। একবার পড়েই পরবর্তী অংশে চলে যাবেন না। বরং পঠিত অংশ বারবার পড়ে সেটাকে নিজের মধ্যে গেঁথে নিন এবং তার অর্থ ও মর্ম নিয়ে চিন্তা অব্যাহত রাখুন।

১০। পঠিত আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা: কুরআনের প্রতিটি আয়াতেরই শানে নুযূল রয়েছে। সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আল্লাহ সুব’হানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনের আয়াতসমূহ একের পর এক নাযিল করেছেন। যদি আপনি আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট জেনে সেই আয়াতটি পড়েন তবে বাস্তবতার সাথে আয়াতকে যেমন আপনি আরো বেশি মেলাতে পারবেন ঠিক তেমনি আয়াতের মর্ম ও বাস্তবতা অনুধাবনেও পাবেন নতুন চিন্তার খোরাক।

এই আর্টিকেলে আমরা চেষ্টা করেছি আল্লাহর কালামকে বুঝার, জানার, অন্তরে ধারণ করার জন্য এর আয়াত নিয়ে তাদাব্বুর করার কিছু পদ্ধতি তুলে ধরার। এতে আপনারা উপকৃত হলে সেটা অবশ্যই আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর পক্ষ থেকে আর কোনো প্রকার ভুল হলে তা আমাদের তরফ থেকে। আল্লাহ আমাদের কুরআনের তাদাব্বুর করার তাওফীক দান করুন, তিনি আমাদের কুরআনের ফাহম দান করুন ও এর উপরই নিজেদের জীবন পরিচালনার তাওফীক দান করুন। আমীন।

কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনার পদ্ধতি জানতে এই বইগুলো উপকারি হতে পারে ইনশাআল্লাহ –

১। কুরআন অনুধাবন : পদ্ধতি ও সতর্কতা
২। তাদাব্বুরে কুরআন (কুরআন বোঝার রাজপথে আপনার প্রথম স্বপ্নযাত্রা)
৩। ৩০ মজলিসে কুরআনের সারনির্যাস
৪। ইলা রাওহিল কুরআন
৫। কুরআনের সাথে পথচলা
৬। কুরআনি ভাবনা
৭। খোলাসাতুল কুরআন
৮। কুরআন বোঝার মজা
৯। ম্যাসেজ অব কুরআন
১০। কুরআন জীবনের গাইডলাইন

.

-https://blog.wafilife.com/2023/01/30/quran-niye-chintavabnar-10-poddhoti/

 

----------------------------

 

>> কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক বইয়ের (৪০০+) pdf লিংক
https://justpaste.it/4ne9o

>> কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক Apps, YouTube Video, Quran Recitation, YouTube channel.
https://justpaste.it/islamicappvideo

>> রবের_কাছে_ফেরার_গল্পগুলো
https://justpaste.it/deen_a_ferar_golpo

>> "বিয়ে, রিজিক লাভ, ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি"
https://justpaste.it/5gol5

>> র‍্যান্ড, মডারেট ইসলাম, মডার্নিস্ট মুভমেন্ট
https://justpaste.it/76iwz

>> কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক Apps, YouTube Video, Quran Recitation, YouTube channel.
https://justpaste.it/islamicappvideo

>> ফেসবুক ও ইউটিউবের উপকারী সব পেইজ, গ্রুপ, আইডি এবং চ্যানেলের লিংক
https://justpaste.it/facebook_page_grp_link

>> তাকদির আগে থেকে নির্ধারিত হলে মানুষের বিচার হবে কেন? যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ পৌঁছেনি তাদের কী হবে?
https://justpaste.it/6q4c3

>> কুরআন এবং আপনি
https://justpaste.it/5dds8

>> কখনও ঝরে যেও না …
https://justpaste.it/3bt22

>> ফজরে আমি উঠতে পারি না
https://justpaste.it/6kjl6

>> এই ১০টি ফজিলতপূর্ণ আমল যা আপনার সারাবছরের_ই দৈনন্দিন রুটিনে থাকা উচিত
https://justpaste.it/9hhk1

>> ইস্তিগফার অপার সম্ভাবনার দ্বার
https://justpaste.it/6ddvr

>> দাম্পত্যজীবন, অজ্ঞতা ও পরিণাম
https://justpaste.it/7u5es

>> বিপদাপদে ধৈর্যধারণ : ফজিলত, অর্জনের উপায় ও করণীয়
https://justpaste.it/8dccj

>> মহান রবের আশ্রয়ে সিরিজের সকল পর্ব
https://justpaste.it/6ttuf

>> স্বার্থক মুনাজাত
https://justpaste.it/1xf0t

>> রাসূলের উপর দরুদ ও সালাম পাঠ-সংক্রান্ত ৭ পর্বের একটি সিরিজ
https://justpaste.it/4hhtd

>> তাহাজ্জুদ সিরিজ
https://justpaste.it/4ja0n

>> মহিমান্বিত কুরআন সিরিজের সকল পর্ব
https://justpaste.it/3dxi7

>> ধ্বংসাত্মক দৃষ্টি (বদ নজর সিরিজের সকল পর্ব)
https://justpaste.it/7056k

>> বিশুদ্ধ ঈমান সিরিজ
https://justpaste.it/7fh32

>> ইমান ভঙ্গের ১০ কারণ
https://justpaste.it/9icuq

>> দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির ১০ আমল
https://justpaste.it/8gmtk

>> পর্দায় প্রত্যাবতন: পর্দায় ফেরার গল্প
https://justpaste.it/3lqzf

>> নফসের জিহাদ -শায়খ আহমাদ মুসা জিবরীল (হাফিজাহুল্লাহ)
https://justpaste.it/8vnly

>> রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর সকাল-সন্ধ্যার দু'আ ও যিকর
https://justpaste.it/sokalsondharjikir

>> সালাফদের আত্মশুদ্ধিমূলক বাণী
https://justpaste.it/9e6qh

>> সন্তান লাভের ৭ টি গুরুত্বপূর্ণ আমল
https://justpaste.it/9hth5

>> Rain Drops, Baseera, Hunafa, Mubashshireen Media ও Ummah Network থেকে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সিরিজগুলোর (তাওহীদ সিরিজ, আকিদা সিরিজ, তাহাজ্জুদ, সালাত, আল্লাহর গুণবাচক নামসমূহ নিয়ে আলোচনা, ধূলিমলিন উপহার রামাদান, আলোর পথে যাত্রা, পরকালের পথে যাত্রা, শ্রেষ্ঠ মানুষেরা(নবীদের জীবনী), জীবন-মৃত্যু-জীবন, সীরাহ(রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনী), কুরআনের কথা, কোরআনের বিভিন্ন সূরার তাফসীর, আমি তাওবা করতে চাই কিন্তু, সাহাবীদের ঈমানদীপ্ত জীবনী, বোনদের প্রতি উপদেশ) অডিও ডাউনলোড লিংক
https://justpaste.it/4kes1

>> পাপ থেকে বাঁচার ১০ উপায়: যা সকল মুসলিমের জানা আবশ্যক
https://justpaste.it/3ob7j

>> রমজানের প্রস্তুতি : মুমিনের পথ ও পাথেয়
https://justpaste.it/5tziy

>> কাফির ও ইসলামের শত্রুদের মৃত্যু বা বিপদে আনন্দ প্রকাশ
https://justpaste.it/6ksvm

>> মহিমান্বিত রজনী (লাইলাতুল কদর) সিরিজ, লাইলাতুল কদরের জন্য ১২ টি সহজ আমল এবং ইতিকাফের গুরুত্ব, ফজিলত, উদ্দেশ্য, আমল।
https://justpaste.it/1q3bs

>> বিশেষ নফল নামাজ সিরিজ (ইশরাক, দোহা, চাশত, আওয়াবিন, যাওয়াল, সালাতুল হাজত, সালাতুত তাসবিহ)
https://justpaste.it/9n0kf

>> হাদিসের শিক্ষা সিরিজ
https://justpaste.it/4fywd

>> ইস্তিখারা সিরিজ
https://justpaste.it/2i736

>> আমাদের নবীজি (সাঃ) সিরিজ
https://justpaste.it/4c1tt

>> Words With Nusus সিরিজ
https://justpaste.it/6h968

>> বছরের শ্রেষ্ঠ দশ দিন (জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন)
https://justpaste.it/1s2vv

>> আশুরা দিবস : বাস্তবতা, পালনীয় ও বর্জনীয়
https://justpaste.it/3kn8w

>> বিবাহের কিছু আমল ও দু‘আ এবং সুখী দাম্পত্যজীবনের জন্য ১০টি করণীয়, স্ত্রীকে বশ করে রাখার টোটকা
https://justpaste.it/58k7y

>> দুআ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ লেখাসমূহ, দুআ কবুলের সময় শর্তাবলী ও আদবসমূহ, দুআ কবুলের গল্পগুলো
https://justpaste.it/7ttq6

>> কুরআন কারীম নিয়ে আতীক উল্লাহ হুজুরের অসাধারন কিছু কথা ও উপদেশ
https://justpaste.it/8abde

.

>> ইসলামিক বই, অডিও-ভিডিও লেকচার সিরিজ সহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের লিংকগুলো পাবেন এখানে। সবগুলো বিষয়ের লিংক এক জায়গায় রাখা হয়েছে। এই লিংকটা শেয়ার করতে পারেন। 
https://justpaste.it/48f6m