JustPaste.it

কখনও ঝরে যেও না …

 

>> ইসলামিক বই, অডিও-ভিডিও লেকচার সিরিজ সহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের লিংকগুলো পাবেন এখানে
https://justpaste.it/48f6m

.

 

কখনও ঝরে যেও না …

 

মু’মিন ব্যক্তি হচ্ছে বৃক্ষের মতো; দমকা হাওয়ার সাথে সর্বদা যুদ্ধে লিপ্ত। এই প্রবল বাতাসের ঝাপটার মাঝে বেঁচে থাকতে হলে সে বৃক্ষটির কিছু গুণ থাকা চাই। যেমন, সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে হলে গাছটির বীজ অবশ্যই উর্বর মাটিতে বপন করতে হবে। কুর’আনে ঠিক এ কথাটাই বলা আছে:

 

” মুহাম্মদ আল্লাহর রসূল এবং তাঁর সহচরগণ … তাওরাতে এবং ইঞ্জিলে তাদের বর্ণনা এরূপ যেমন একটি চারা গাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও মজবুত হয় এবং কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, চাষীকে আনন্দে অভিভূত করে, যেন আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন…” [সূরা আল-ফাতহঃ ২৯]

 

 

তাওরাতের নিম্নোক্ত বিবরণটির কথা এখানে বলা হয়েছে:

 

‘কৃষক তার বীজ বুনতে বের হলো। বপনের সময় কিছু বীজ পথের পাশে পড়ল। সেগুলোর কিছু পায়ের নিচে পিষ্ট হয় আর কিছু পাখিরা খেয়ে ফেলে। কিছু বীজ পড়ল পাথুরে মাটিতে। আর্দ্রতার অভাবে সেগুলো বড় হতে হতেই শুকিয়ে গেলো কিছু বীজ কাঁটার মাঝে পড়ল। ঐ বীজ থেকে জন্ম নেওয়া গাছের সাথেসাথে কাঁটাগুলোও বেড়ে উঠতে থাকে। একসময় কাঁটাগুলোই গাছগুলোকে মেরে ফেলে। বাকি বীজগুলো পড়ল উর্বর মাটিতে। সেগুলো বেড়ে উঠল মাথা উঁচু করে। আর বেড়ে উঠে শতগুণ বেশী শস্য উৎপাদন করল।

 

… এর তুলনা হল এই: বীজগুলো হল সৃষ্টিকর্তার বাণী। কিছু মানুষ সেই বাণী শুনার পর শয়তানের প্ররোচনায় সেগুলো অন্তর থেকে মুছে ফেলে। ফলে এরা ঈমান আনে না। তাই পরিশেষে এরা রক্ষা পাবে না। এদের তুলনা হচ্ছে পথের পাশের সেই অবহেলিত জমি।

 

কিছু লোক শুনার সময় আগ্রহের সাথে শুনে কিন্ত এদের আগ্রহে গভীরতা নেই। এরা কিছু সময়ের জন্য বিশ্বাস করে কিন্তু প্রলোভন দেখালেই বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এই শ্রেণীর লোকের উদাহরণ হল সেই পাথুরে মাটি যা আর্দ্রতার অভাবে গাছগুলোকে বেড়ে উঠতে দিতে পারে না। কাঁটাযুক্ত জমি হচ্ছে তাদের উপমা যারা সৃষ্টিকর্তার বাণী শুনেছে কিন্তু পথ চলতে চলতে একসময় ভয় আর দুনিয়ার মোহে আটকে গিয়ে পূর্ণতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়।

 

কিন্তু কিছু লোক সৎ এবং শুদ্ধ হৃদয় নিয়ে সৃষ্টিকর্তার বাণী শুনে তা আঁকড়ে ধরেছিল এবং ধৈর্য্যের সাথে পরিশেষে ফল লাভ করেছিল। এদের উদাহরণ হচ্ছে সেই উর্বর মাটি যা বীজকে বুকে নিয়ে মহীরুহের জন্ম দেয়।’ (লুক ৮: ৫-১৫)

 

অর্থাৎ, হৃদয়কে এমন উর্বর মাটির সাথে তুলনা করা হয়েছে যেখানে বীজ বপন করা হয়। ইমাম ইবন আল-ক্বাইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) আল-ফাওয়াইদ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৭০) এভাবেই বলেছেন, ‘সবার হৃদয়ের স্বাভাবিক অবস্থাই হচ্ছে উর্বর, এতে যা বপন করা হয় তাই সহজে বেড়ে উঠে। যদি ঈমান এবং আল্লাহভীরুতা বা তাক্বওয়ার চারা এতে রোপণ করা হয়, তবে তা এমন সুমিষ্ট ফল দান করবে যা হবে চিরন্তন। আর যদি অজ্ঞতা এবং কামনা-বাসনার চারা রোপণ করা হয় তাহলে তার ফল হবে তিক্ত এবং কটু।’

 

তাই তুমি যখন তোমার অন্তরকে ঈমানের বীজের জন্য উর্বর করে তুলবে, তখন সেই গাছটি সুন্দর ভাবে বেড়ে উঠবে এবং মিষ্টি ফল ধারণ করবে। হৃদয়কে উর্বর করার উপায়গুলো সামনে আলোচনা করা হবে।

 

যখন তোমার হৃদয়ে ঈমানের সুদৃঢ় বৃক্ষ গড়ে উঠবে, তখন একটা দমকা হাওয়া তোমার দিকে ধেয়ে আসবে। কারণ উপরে বর্ণিত আয়াত অনুযায়ী, আল্লাহ বলছেন শক্ত গাছটি ‘কাফেরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করে’। একজন দৃঢ় মুসলিম এর মতো আর কোনো কিছুই এই বাতাসকে এতটা ক্ষেপিয়ে তোলে না। আর এটাই চিরন্তন বাস্তবতা। যখন ফেরআউন মুসা (আলাইহিস সালাম) এবং তাঁর অনুসারীদের পিছনে মিশরের মরুভুমিতে ধাওয়া করছিল তখন সে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করে:

 

“নিশ্চয়ই এরা (বনী-ইসরাঈলরা) ক্ষুদ্র একটি দল। এবং তারা আমাদের ক্রোধের উদ্রেক করেছে। ” [সূরা শুআরাঃ ৫৪-৫৫]

 

এই দমকা হাওয়া তোমাকে সমূলে উচ্ছেদ করে ফেলে দিতে চাইবে। তুমি হয়ত চারিদিকে তাকিয়ে অন্য কিছু গাছকে সহজেই পড়ে যেতে দেখবে। কেউ হয়তো বাতাসের ধাক্কায় সমূলে উৎপাটিত হয়ে যাবে। এরা হল মুনাফিক্বেরা। এদের দুর্বল মূল সহজেই প্রকাশ হয়ে পড়ে:

 

“এবং নোংরা বাক্যের উদাহরণ হলো নোংরা বৃক্ষ। একে মাটির উপর থেকে উপড়ে নেয়া হয়েছে। এর কোনো স্থিতি নেই। ” [সূরা ইব্রাহিমঃ ২৬]

 

রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশেষভাবে মুনাফিক্বকে এমন গাছের সাথে তুলনা করেছেন যেটা বাতাসের সাথে সাথে নড়ে এবং কখনো বা পড়ে যায়। (দেখুন আল-লু’লু’ ওয়াল মারজান, হাদিস#১৭৯১)। সুতরাং তারা দলে দলে বাতাসের ধাক্কায় পড়ে যাক, তুমি তাদের মতো হয়ো না। বরং, তুমি তাদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন কর। আল্লাহকে ধন্যবাদ দাও যে তিনি তোমাকে তাদের পরিণতি থেকে রক্ষা করেছেন এবং তারপর এগিয়ে যাও। তাদের জন্য ইসলাম ছিল একটা শখ মাত্র, এ সপ্তাহের আকর্ষণ!

 

যখন বাতাস বুঝতে পারবে যে তোমাকে এভাবে মাটি থেকে সরাসরি তুলে ফেলা সম্ভব নয়, তখন সে আরো সূক্ষ্ণ পন্থা অবলম্বন করবে: সে চেষ্টা করবে তোমার পাতাগুলো কৌশলে ঝরিয়ে দিতে। কিন্তু সে তোমাকে সবগুলো পাতা একসাথে ঝরাতে বলবে না। কারণ সেটা তো তার দুরভিসন্ধি প্রকাশ করে দেবে। বরং তখন সেই বাতাস মৃদুভাবে বইবে যাতে করে তোমার একটা পাতা ঝরাতে পারে, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা – যতক্ষণ না তুমি পাতাহীন বৃক্ষে পরিণত হও। উস্তাদ সাইয়্যিদ কুতুব এটা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:

 

… কোনো আদর্শের পক্ষে অবস্থান নেওয়া গোষ্ঠীর প্রতি শাসকবর্গের আচরণ এমন হয় যে, তারা সবসময় কূটকৌশলের মাধ্যমে সেই আদর্শিক গোষ্ঠীকে তাদের দৃঢ় অবস্থান থেকে শুধু সামান্য বিচ্যুত করতে চায়। তারা এর মাধ্যমে একটা সমঝোতামূলক সমাধানে আসতে চায়। কিছু জাগতিক পুরস্কারের বিনিময়ে তারা তাদেরকে বোকা বানাতে চেষ্টা করে। এমন অনেকেই রয়েছে যারা ভাবে যে তারা তাদের আদর্শের জন্য লড়ছে কিন্তু বস্তুত তাদেরকে সমঝোতা আর আপসের ছদ্মবেশে তাদের আদর্শ থেকেই বিচ্যুত করে দেয়া হয়েছে। কারণ তারা আদর্শকে জলাঞ্জলি দেওয়া এই সমঝোতাগুলোকে বড় করে দেখে না। তাই বিরোধীপক্ষও তাদেরকে প্রকাশ্যভাবে আদর্শ ত্যাগ করতে বলে না। বরং এদিকে সেদিকে হালকা পরিবর্তন করতে অনুরোধ করে যাতে উভয়পক্ষ মাঝখানে মিলিত হতে পারে।

 

যে মানুষটি আদর্শের পক্ষে লড়ছে শয়তান তাঁকে ধোঁকা দিতে বলে, কর্তৃপক্ষের সাথে সামান্য সমঝোতার মাধ্যমে তো তুমি তোমার আদর্শকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু পথের শুরুতে যে বিচ্যুতি খুব সামান্য হয়, পথের শেষে তা-ই বিশাল হয়ে দেখা দেয়। আদর্শের পতাকাবাহীরা আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ে আপস করতে রাজি হওয়ার পর আসলে সেখানেই থেমে যেতে পারে না। কারণ এরপর যখনই এক পা পিছিয়ে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হবে তখনি সেটা ঠেকাতে তার সমঝোতায় আসার ইচ্ছা আরো বৃদ্ধি পাবে। তাই কর্তৃপক্ষ এই আদর্শবাদীদেরকে অতি সন্তর্পণে এবং ক্রমান্বয়ে তাদের আদর্শ থেকে টলাতে থাকে…’

 

তাই এই ফাঁদে পা দিবে না। বাতাসের মুখে একটা পাতাকেও ঝরতে দেবে না। যেভাবে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুনাফিক্বকে বাতাসের সাথে নুয়ে পড়া গাছের তুলনা দিয়েছেন তেমনি ভাবে মু’মিনকে খেজুর গাছের সাথে তুলনা করেছেন। কারণ খেজুর গাছের পাতা কখনো ঝরে না। (দেখুন আল-লু’লু’ ওয়াল মারজান, হাদিস#১৭৯২) বাতাস যতই তীব্র হোক না কেন তার সামনে মুসলিম শুধু দাঁড়িয়েই থাকে না, বরং সব পাতা মেলে মাথা উঁচু করে থাকে। বাতাস যত তীব্র হবে তোমার পাতাগুলোকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরবে। আর এ জন্যই তো তোমার বিরুদ্ধে বাতাসের এত ক্ষোভ !

 

 তারা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল শুধু এ কারণে যে, তারা প্রশংসিত, পরাক্রান্ত আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল” [সূরা বুরুজঃ ৮]

 

কিন্তু এই বাতাস তার ক্ষোভের পেছনে ভিন্ন কারণ দাঁড় করিয়ে এই বাস্তবতাকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। সে দাবী করবে এই রাগ আসলে তোমার বিরুদ্ধে নয়। এই রাগ তো কেবল উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ কিংবা অন্য কোনোকিছুর বিরুদ্ধে। কিন্তু সত্য কথাটা হচ্ছে যাদেরকে সে সমূলে তুলে ফেলতে পারে না, যাদেরকে তাদের আদর্শ থেকে এক বিন্দুও টলানো যায় না ঐসব মুসলিমদেরকে সে ভারি অপছন্দ করে। আর যখন গাছটা একটা পাতাও ত্যাগ করতে অস্বীকার করে তখন সেই বাতাস আরো রেগে যায়। আর যখন এই বাতাস রাগতে থাকবে, তখন আল্লাহ্‌ তোমাকে পুরস্কৃত করবেন:

 

“…এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফেরদের মনে ক্রোধের কারণ হয় আর শত্রুদের পক্ষ থেকে তারা যা কিছু প্রাপ্ত হয়- তার প্রত্যেকটির পরিবর্তে তাদের জন্য লিখিত হয় নেক আমল। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সৎকর্মশীল লোকদের হক নষ্ট করেন না।” [সূরা আত-তওবাহঃ১২০]

 

 

তাই যখন প্রবল আক্রোশে বাতাস বইবে তখন ভয় পেও না। বরং তার চোখে চোখ রাখো আর:

“…বল, তোমরা আক্রোশে মরতে থাক।” [সূরা আলে ইমরানঃ ১১৯]

 

ঐ পাতাগুলো হচ্ছে আল্লাহ্‌র তরফ থেকে তোমার প্রতি আমানত। আল্লাহ্‌ তোমাকে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে দিয়েছেন। যদি তুমি তার খিয়ানত কর তবে তোমাকে এমন মানুষ দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়া হবে যারা তাদের আমানত রক্ষা করবে।

 

‘হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় দীন থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ-তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন।…’ [সূরা আল-মা’ইদাহ: ৫৪]

 

এই আয়াতটি খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে গাছ এবং পাতাগুলোর বর্ণনা দেয়। এটাকে বীজ এবং পাতায় বিশ্লেষণ করা যাক।

 

সম্পূর্ণ গাছটি হচ্ছে দ্বীন।

 

তোমার অন্তরে আল্লাহর জন্য ভালোবাসার বীজ থেকে এই গাছটি অংকুরিত হবে। আত-তুহফাহ আল ইরাক্বিয়াহ নামে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহর (রাহিমাহুল্লাহ)একটি সুন্দর প্রবন্ধ রয়েছে। মাজমু আল ফাতওয়ার দশম খন্ডের শুরুতে এটি পাওয়া যাবে। সেখানে তিনি এই আয়াতে উল্লেখিত ভালবাসার কথা ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে,

 

‘আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রসূলের জন্য ভালোবাসা হচ্ছে ঈমানের সর্বোচ্চ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি এবং ঈমানের সর্বোচ্চ মূলনীতি। কার্যত এটিই দ্বীনের সকল আমলের মূল ভিত্তি… মুসা এবং ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) এর বর্ণিত ভাষ্য অনুযায়ী, আমাদের পূর্ববর্তী দুটি জাতি, ইহুদি এবং খৃস্টানদের প্রতি রেখে যাওয়া সর্বোত্তম উপদেশ হচ্ছে হৃদয়, মন এবং সদিচ্ছা দ্বারা সর্বান্তকরণে আল্লাহকে ভালোবাসা। এটাই ইব্রাহীমের (আলাইহিস সালাম) দ্বীনের আক্বীদার সারকথা যা তাওরাত, ইঞ্জীল এবং ক্বুরআনের আইনের নির্যাস।’

 

আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসাই হচ্ছে সেই বীজ যা থেকে প্রতিটি কাজ এবং বিশ্বাস – প্রতিটি পাতা এবং ফল- অঙ্কুরিত হয় আর এজন্যই এই ভালোবাসাটাই এ আয়াতে সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়েছে।

 

তারপর আমরা লাভ করব সেই বীজের প্রথম ফল, ওয়ালা’ এবং বারা‘ : ‘মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে’। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ এ বিষয়ে বর্ণনা করেন,

 

‘মানুষ যাকে ভালবাসে তার ভালবাসার মানুষকেও ভালবাসে, সে যা ঘৃণা করে তাও ঘৃণা করে, তার সহযোগীদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, তার শত্রুদের প্রতি শত্রুভাব পোষণ করে… তাই এই বিষয়ে তারা উভয়েই এক’

 

সহজ ভাষায় বললে, বাতাসের প্রথম কাজ হচ্ছে তোমার এই পাতাটি ঝরিয়ে দেওয়া যাতে করে তোমার মনে শত্রু আর বন্ধুর মাঝে বিভাজন রেখাটা অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। একবার যখন তুমি তোমার শত্রুকে বন্ধু ভাববে, তোমার শত্রুর কাজ তখনি সম্পন্ন হয়ে যাবে। তাই কখনো এই পাতাটি ঝরে যেতে দিবে না। কখনো না!

 

এর পরের পাতাটি হচ্ছে জিহাদ: ‘…তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে…’ স্পষ্টতই এই পাতাটিকে বাতাস অন্যগুলোর চেয়ে বেশী ঘৃণা করে। কেন তা বোঝার জন্য এইডস এর কথা ভাবো। এটা শরীরকে মেরে ফেলার জন্য কি করে? এইডস কিন্তু সরাসরি শরীরকে আক্রমণ করে না বরং এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অর্থাৎ শরীরের ‘প্রতিরক্ষা বাহিনী’কে আক্রমণ করে যাতে করে অন্যান্য রোগ জীবাণু কোনোরকম বাধা ছাড়াই আক্রমণ করতে পারে। এই শরীরটা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর মতো। জিহাদ হচ্ছে এর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে সে আক্রমণকারীদের থেকে নিজেকে রক্ষা করে। আর সেই বাতাস/সরকার হচ্ছে এইডসের মতো যা প্রতিরোধের এই স্পৃহাটাকে মেরে ফেলার জন্য কাজ করে যাতে করে মুসলিম উম্মাহকে আক্রমণ এবং দখল করে নেওয়া সহজ হয়ে যায়। এই কারণেই সাইয়্যিদ কুতুব, আব্দুল্লাহ আযযাম, আয-যারক্বাওয়ী, শাইখ ওসামা (রহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখদের মতো লোকদেরকে আজ দানব রূপে চিত্রিত করা হয়। কারণ এরা প্রতিরোধের সেই চেতনাকে ধারণ করেন। আর তাই তোমার এই পাতাটি ঝরিয়ে দিতেই বাতাস সবচে জোরে বইবে। এই ফাঁদে পা দিও না। মনে রেখো: এইডস!

 

পরিশেষে সুদৃঢ় বৃক্ষ সেটাই যা ‘কোনো নিন্দাকারীর নিন্দায় ভীত হবে না।’ বস্তুত বৃক্ষটি তিরস্কার বা নিন্দায় প্রভাবিত হবে। কিন্তু সেভাবে নয়, যেমনটি আশা করা হয়েছিল! সেটা কেমন হবে ? যখন বাতাস তোমার পাতাগুলো ঝরিয়ে দিতে চায়- যখন ‘ওয়ালা এবং বারা’ আর জিহাদের ধারণাকে আঁকড়ে ধরে রাখার কারণে সে তোমাকে আক্রমণ আর তিরস্কার করে তখন ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহর (রহিমাহুল্লাহ) ভাষায় তোমার প্রতিক্রিয়া হবে এমন: ‘যার হৃদয় আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সে অন্য কারো সমালোচনা বা তিরস্কারে দমে যায় না বরং এগুলো তাকে আরো শক্তভাবে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরতে প্রেরণা যোগায়…’

 

সবশেষে এই আয়াত আমাদেরকে সেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দেয় যে কুর’আনের এই শিক্ষাগুলোর প্রতি সৎ থাকতে পারা হলো, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ-তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন’। বাতাসের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারাটা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ্‌র একটা অনুগ্রহ। একটা গাছকে সোজা হয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে বা ধুলায় মিশিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী:

 

‘তোমরা যে বীজ বপন কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তাকে উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্নকারী ?আমি ইচ্ছা করলে তাকে খড়কুটা করে দিতে পারি, অতঃপর হয়ে যাবে তোমরা বিস্ময়াবিষ্ট।’ [সূরা ওয়াক্বিয়াহঃ ৬৩-৬৫]

 

শেষ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে শেষ জমানায় কারো বদলে যাওয়াটা খুব সহজ হয়ে পড়বে। মানুষ চাপে পড়ে এবং নিজেদের দুর্বলতার কারণে খুব দ্রুত সত্যকে ত্যাগ করবে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

 

‘পুনরুত্থান দিবসের আগে, রাতের অন্ধকারের মতো ফিতনা আসবে যার মাঝে একজন মানুষ মু’মিন হয়ে ঘুম থেকে উঠবে আর কাফির হয়ে ঘুমাতে যাবে, আবার মু’মিন হয়ে ঘুমাতে যাবে আর কাফির হিসাবে জেগে উঠবে।’

 

এই ধরনের ঘটনাগুলো হচ্ছে কিছু অজানা বা গায়েবী ঘটনার ফল যা আমরা মানুষেরা হয়তো ঠিক উপলব্ধি করতে পারব না। তবে, ক্বুরআন এবং সুন্নাহ তে এমন কিছু ব্যবহারিক উপায় বলে দেয়া আছে যার সাহায্যে আমরা মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঠিক পক্ষে থাকতে পারি। এখানে আমরা শুধু দুটি উপায় আলোচনা করব এবং দুটিই একটি মজবুত বৃক্ষের দৃঢ়তার সর্বপ্রথম শর্তটির উপর আলোকপাত করে: উর্বর জমি- একটি সুস্থ হৃদয়।

 

* রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় যখন কঠিনতম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর প্রতি নাযিলকৃত সূরাসমূহের মূল বিষয় ছিল পূর্ববর্তী নবীদের কাহিনী। ইসলামের জন্য কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন যে তিনিই প্রথম নন, বরং যুগে যুগে এমন আরো অনেকেই ছিলেন, এটা বোঝানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। একই সাথে আগের নবীরা কীভাবে এসব পরীক্ষার মোকাবিলা করেছিলেন সে শিক্ষাও তাঁকে এর মাধ্যমে দেয়া হচ্ছিল। মক্কার বিপদের ঘনঘটায় আচ্ছন্ন দিনগুলোতে এই ইতিহাসের গল্পগুলো রসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবীদের মনোবল দৃঢ় করতে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। এই কথাটিই নিমোক্ত আয়াতে প্রতিফলিত হয়,

 

‘আর আমি রসূলগণের সব বৃত্তান্তই তোমাকে বলছি, যদ্দারা তোমার অন্তরকে মজবুত করছি। আর এভাবে তোমার নিকট মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসীহত ও স্মরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে। ‘ [সূরা হুদঃ১২০]

 

একই ভাবে প্রথম দিককার মুসলিমদের সেইসব কঠোর পরীক্ষার দিনগুলোর পাশাপাশি ইতিহাস, বিশেষভাবে সেই সকল মুসলিমদের ইতিহাস অধ্যয়ন করাটা উপকারী হতে পারে যারা তাদের সময়ে কোনো না কোনো প্রকারের সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অনেক সময় কোনো একটা পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় বুঝে উঠতে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ফিক্বহের বই ঘাঁটি যেখানে শুধুমাত্র সৎকর্মশীলদের জীবনী পড়েই তাদের ব্যক্তিত্বকে আত্মস্থ করার মাধ্যমে আমাদের করণীয় সম্বন্ধে আরো ভাল দিকনির্দেশনা পেতে পারি। ‘সাফাহাত মিন সবর আল উলামা ‘(আলেমদের সবরের পাতা থেকে) নামক অসাধারণ বইটিতে লেখক বলেন:

 

‘নিজের মধ্যে সৎগুণের বিকাশ ঘটাতে এবং মহৎ উদ্দেশ্যে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা তৈরী করার একটি ভাল উপায় হচ্ছে সেই সকল আলেমদের জীবনী পড়া যারা তাঁদের অর্জিত ইলমের উপর আ’মল করেছেন। মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য অধ্যবসায়ের সাথে ত্যাগ স্বীকার করে যাওয়া আলেমদের পদাঙ্ক অনুসরণের ক্ষেত্রে তাদের জীবনী পড়াটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বলা হয়ে থাকে এই কাহিনীগুলো হচ্ছে আল্লাহ্‌র সেই সকল সৈন্য যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাঁর প্রিয়পাত্রদের অন্তরকে সুস্থির রাখেন। ইমাম আবু হানিফা(রহিমাহুল্লাহ) বলেন,”আলেমদের জীবনী এবং তাঁদের গুণাবলী অধ্যয়ন আমার কাছে ইলমের চেয়ে বেশী প্রিয় কারণ এগুলো তাঁদের চরিত্র বর্ণনা করে।” ‘

 

তাই সৎকর্মশীলদের জীবনী অধ্যয়ন, তাঁদের ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্রকে আপন করে নেয়া অন্তরকে শক্তিশালী এবং জীবন্ত করার একটি ভাল উপায়। এটি ঈমান এবং ইলমের বীজ বপনের জন্য অন্তরকে উর্বর করে তোলে। তাহলে কোথা থেকে শুরু করা উচিত ? শায়খ ইবনে আল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ), সাইদ আল খাতির গ্রন্থের ৬০ পৃষ্ঠায় বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর সাহাবীদের জীবনী থেকেই সবচেয়ে বেশি উপকারী জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।

 

* অন্তরকে দৃঢ় করার দ্বিতীয় উপায়টি আরো সহজ: শুধু তোমার রব্ব এর কাছে চাও! উম্মে সালামাহ (রাদি’আল্লাহু আনহা) কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন দুআটি সবচেয়ে বেশী করতেন। উত্তরে তিনি বলেন:

 

‘ওনার সবচেয়ে বেশী করা দুআটি ছিল: ও অন্তর সমূহের নিয়ন্ত্রণকারী, আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির করে দাও। (ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুব, সাব্বিত ক্বলবি ‘আলা দ্বীনিক)’

 

এই দুআটি সারাদিন সবসময় অভ্যাস করা উচিত। কাজে যাওয়ার সময় কিংবা স্কুলের বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময় যখনি সুযোগ পাওয়া যায় তখনি এই সহজ দুআটি পুনরাবৃত্তি করার অভ্যাস করা উচিত। গুপ্তধনের মতো এই দুআটিকে আঁকড়ে রাখা উচিত এবং সর্বদা এটিকে ঠোঁটের ডগায় রেখে অন্তরকে ইসলামের সাথে সংযুক্ত করে রাখা উচিত। এটা খুবই সহজ হওয়া সত্ত্বেও এটা যাদের খুব প্রয়োজন তাদের অনেকেই এটিকে অবহেলা করে।

 

তাই হৃদয়কে স্থির এবং সুস্থ রাখার মাধ্যমে, অন্তরের জমিকে উর্বর রাখার মাধ্যমে তোমার শিকড়কে সুদৃঢ় করো। আর মজবুত শিকড়বিশিষ্ট গাছগুলোর শাখা-প্রশাখাই একদিন আকাশ ছোঁয়:

 

“পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মতো। তার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত।” [সূরা ইব্রাহিমঃ ২৪]

 

আর যখন তোমার শাখা-প্রশাখা আকাশ ছোঁবে, তখন কেউ তোমার পাতা পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারবে না। তারা তোমাকে বন্দী করতে পারে, তোমাকে হত্যা করতে পারে কিন্তু তারা কখনো এ কথা বলতে পারবে না যে তারা তোমার পাতা ঝরাতে পেরেছিল…

 .

তারেক মেহান্না
বুধবার, ৪ সফর ১৪৩৩/ ২৮ ডিসেম্বর,২০১১
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট- সেল#১০৭

 

বাসনা ও বিপর্যয়

তিরমিযীতে আবু হুরায়রাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

“আল্লাহ যখন জান্নাত সৃষ্টি করলেন তখন তিনি জিবরীলকে সেখানে পাঠিয়ে বললেন, “দেখে এসো জান্নাত এবং জান্নাতের আরাম-আয়েশ যা আমি তাঁর অধিবাসীদের জন্য তৈরি করেছি”। জিবরীল গিয়ে তা দেখে এলেন এবং আল্লাহ কে বললেন, “আপনার বড়ত্বের শপথ, যে-ই শুনবে সে-ই এতে প্রবেশ করবে (অর্থাৎ এতে প্রবেশ করতে যা করা দরকার তাঁর সবই করবে) তারপর আল্লাহ জান্নাতকে আদেশ দিলেন দুঃখ-কষ্ট, বিপদআপদ ও অপছন্দনীয় জিনিস দিয়ে পরিবেষ্টিত হয়ে যেতে। তিনি জিবরীলকে বললেন, ফিরে যাও এবং দেখে সো সেই জান্নাত ও তার অধিবাসীদের জন্য আমি কী প্রস্তুত করে রেখেছি”। জিবরীল জান্নাতে ফিরে গিয়ে একে বিপদ আপদ ও অপছন্দনীয় জিনিস দিয়ে ঘেরা অবস্থায় পেলেন। তিনি ফিরে এসে আল্লাহকে বললেন, “আপনার বড়ত্বের শপথ, আমি ভয় করি যে কেউই এতে প্রবেশ করবেনা। (অর্থাৎ সে এটি এড়ানোর জন্য যা করা দরকার তা-ই করবে)”।

অতঃপর আল্লাহ জিবরীল কে বললেন, “জাহান্নামে যাও এবং দেখে এসো এর শাস্তিসমূহ যা আমি এর অধিবাসীদের জন্য তৈরি করেছি”। জিবরীল জাহান্নামের দিকে দেখলেন এবং তার কাছে তা অত্যন্ত ভয়ংকর লাগলো, তাই তিনি আল্লাহ কে বললেন, “আপনার বড়ত্বে শপথ, যে-ই এর কথা শুনবে সে-ই এটি থেকে বাঁচতে চাইবে”। তারপর আল্লাহ জাহান্নামকে আদেশ দিলেন কামনা ও বিলাসিতা দিয়ে পরিবেষ্টিত হয়ে যেতে এবং জিবরীলকে বললেন, “ওখানে ফিরে যাও”। জিবরীল সেখানে গেলেন ও বললেন, “আপনার বড়ত্বের শপথ, কেউই এ থেকে বাঁচতে পারবেনা”।

 

আপনার জীবন কী জান্নাত অভিমুখী নাকি জাহান্নাম – এই প্রশ্নের জবাব পেতে আপনার জীবনের দিকে লক্ষ করুন। যদি আপনি আল্লাহর ইবাদাত করেন আর আপনার জীবন কষ্ট আর অপছন্দনীয় জিনিস দ্বারা পূর্ণ থাকে, তবে সেটি আপনার জন্য ভালো লক্ষণ। মানুষ কি অপছন্দ করে? সে অপছন্দ করে ভয়, ক্ষুধা, দারিদ্র, তৃষ্ণা, নিরাপত্তার অভাব, আশ্রয়ের অভাব, বন্দীত্ব, বঞ্চনা, আপনজনের বিচ্ছেদ, একাকীত্ব, অনিশ্চয়তা এবং এরকম আরো অনেক কিছু, যা দিয়ে জান্নাত ঘেরা। জীবনে এসবের উপস্থিতি নির্দেশ করে যে একজন মু’মিন জান্নাতের পথে আছে কি না।

এবার ভাবুন কোন জিনিসগুলো একজন ব্যক্তি তার জীবনে পেতে চায় বা ভালোবাসে? সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, সুপ্রশস্ত বাড়ি, নিরাপত্তা, প্রচুর খাদ্য ও পানীয়, দামী কাপড়, প্রিয়জনের সান্নিধ্য – এরকম আরো অনেক কিছু। জাহান্নাম কিন্তু এসব দিয়েই ঘেরা। মু’মিনের জীবনের এসবের উপস্থিতি জানান দেয় সে ধ্বংসের পথে অভিমুখী কি না।

এজন্য অনেক ধনী সাহাবী সূরা আহক্বাফ এই আয়াত গুলো পড়ার সময় অঝোরে কাঁদতেন (৪৬:২০),

“এবং সেই দিন কাফিরদের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে, বলা হবে, ‘ তোমরা পার্থিব জীবনে আনন্দ ফুর্তি করেছো, এবং তা উপভোগ করেছো, অতএব এই দিনে তোমাদের চরম লাঞ্ছনাকর শাস্তিতে ভূষিত করা হবে কারণ তোমরা পৃথিবীর বুকে অনধিকারমূলকভাবে অহংকারী ছিলে এবং নিশ্চয় তোমরা অবাধ্য

উমার বিন আল খাত্তাব, আব্দুর রাহমান বিন আউফ এবং অন্যেরা (রাঃ) এই আয়াতটি প্রায়ই উল্লেখ করতেন, এমনকি খুব সামান্য খাওয়া দেখে আনন্দিত হলে তখনও।

কামনার অনুসরণ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। এজন্য সালাফরা বলতেন, “যদি আল্লাহর আনুগত্য করতে চাও তাহলে তোমার নাফসকে (প্রবৃত্তি, কামনা) অমান্য কর”। যেমনটা ইমাম আশ শাফি’র একটি কবিতায় আছে (আব্দুল্লাহ্ বিন মুবারক ও এটি উদ্ধৃত করেছেন বলে জানা যায়), “নাফসের জন্য সবচেয়ে উপকারী হচ্ছে তাকে অমান্য করা”।

অতএব, যদি আল্লাহকে মান্য করতে চান, তাহলে আপনার মনের সাথে কথা বলুন এবং আপনার প্রবৃত্তি যা করতে আদেশ দেয় তার উল্টো কাজটি করুন।

যদি আপনার প্রবৃত্তি আদেশ দেয়ে সালাত না পড়ে ঘুমাতে, উঠে পড়ে সালাত আদায় করুন। যদি আপনার প্রবৃত্তি কৃপণতার আদেশ দেয়, তাহলে আপনার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি খরচ করুন। আল্লাহ সূরা আলে-ইমরানে বলেন (৩:৯২), “তুমি কখনোই সত্যিকারের তাক্বওয়া অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষ না যা তুমি ভালবাসো তা থেকে খরচ করছো”। যদি আপনার প্রবৃত্তি ঘরে সালাত পড়তে আদেশ দেয়, তবে মাসজিদে চলে যান। যদি আপনার প্রবৃত্তি আদেশ দেয়ে অসুস্থ মুসলিম ভাইকে দেখতে না গিয়ে ঘরে বসে আরাম করতে তো উঠে চলে যান এবং তাকে দেখে আসুন, কারণ আল্লাহকে আপনি তার সাথে পাবেন।

অতএব, নিজের জীবনকে নিয়ে ভাবুন এবং নিজেই নিজের বিচারক হোন। আল্লাহ যদি আপনার উপর বিলাসিতার উপর বিলাসিতা, সম্পদের উপর সম্পদ, আরামের উপর আরাম ঢেলে দেন, তার মানে কোনো একটা সমস্যা আছে আর এমন হওয়া আপনার জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। উপরন্তু, এমন প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি যদি আপনি আল্লাহর প্রতি অবাধ্য ও তাঁর আদেশ সমূহের প্রতি উদাসীন থাকা অবস্থায় ঘটে, তবে এটি আপনার আসন্ন ধ্বংসের আলামত। বিলাসিতা ও আরাম-আয়েশ মানুষকে আল্লাহর ব্যাপারে বিস্মৃত করে এবং স্বীয় দায়িত্বের ব্যাপারে গাফেল করে।

অপরদিকে, আপনি সাধ্যমত আল্লাহর উপাসনা ও তাঁর আদেশ সমূহের প্রতি মনোযোগী হওয়া সত্ত্বেও যদি আপনার জীবন বিপদ-আপদ ও অপছন্দের জিনিসে ভরে যায়, তবে খুশী হোন। কারণ এটি একটি শুভ লক্ষণ যে আপনি জান্নাতের পথে আছেন। বিপদ-আপদ মু’মিনকে আল্লাহর কথা স্মরণ করায় এবং আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর দিকে মুখ ফেরাতে সাহায্য করে। একটি বহুল প্রচলিত কথা হলো: “কষ্ট জীবনের কাছে যতটা অপছন্দের, আত্মার জন্য ততটাই উপকারের আর আরাম জীবনের কাছে যতটা পছন্দের, আত্মার জন্য তা ততই ক্ষতির কারণ।

কাজেই, হে আল্লাহর পথের বন্দী, দুঃখ করবেন না যখন আপনাকে নিম্ন মানের খাদ্য ও ছেঁড়া কাপড় পরতে দেয়া হয়, পরিবার আর প্রিয়জন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়। দুঃখ করবেন না যদি দেখেন অন্যরা সম্পদ ও সন্তানে আপনাকে ছাড়িয়ে যায়, বরং খুশি হোন, কারণ, আপনি তো সেই জান্নাতের পথেই আছেন যা এতটা দুঃখ-কষ্ট দিয়ে আবৃত যে ফেরেশতা জিবরীল পর্যন্ত আশংকা করেছিলেন যে কেউই এতে প্রবেশ করতে সমর্থ হবে না।

১৩ শতকের বিখ্যাত ‘আলিম আল–‘ইযয্ বিন আব্দুস সালাম বলেন, “দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ভোগ মানুষকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর দিকে ধাবিত করে, যেখানে সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি তাকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, যেমনটা আল্লাহ আল-কুরআনে বলেন, “এবং যখন বিপদ মানুষকে স্পর্শ করে, সে আমাদের ডাকে, শায়িত বা উপবিষ্ট বা দন্ডায়মান অবস্থায়। কিন্তু যখন আমরা তার উপর হতে বিপদ সরিয়ে দেই, সে এমনভাবে চলাফেরা করে যেন সে কোনদিন বিপদে পড়ে আমাকে ডাকেনি”। (সূরা ইউনুস:১২)

হাসান আল বাসরি (র:) বলেন, “তোমার উপর বিপদ আপতিত হলে সেটি ঘৃণা কোরো না, কেননা তুমি যা অপছন্দ করছ, সেটি হয়তো তোমার নাজাতের কারণ এবং যা তুমি পছন্দ করছ তা হয়তো তোমার ধ্বংসের কারণ”।

সবশেষে বর্ণিত আছে যে, আলী বিন আবি তালিব (রাঃ) বলেছেন, “হে আদম সন্তান! ধনী হওয়ার ব্যাপারে খুশী হয়ো না এবং দারিদ্রের ব্যাপারে দুঃখী হয়ো না। দুর্দশার সময়ে দুঃখ করোনা এবং সমৃদ্ধির ব্যাপারে আনন্দ কোরো না। কারণ স্বর্ণ যেভাবে আগুনে পরীক্ষিত হয়, মুত্তাক্বীরা তেমনি পরীক্ষিত হন দুঃখ-কষ্ট দ্বারা। কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না যদি না তুমি পছন্দের জিনিসকে ত্যাগ করার ক্ষমতা রাখো। ধৈর্যের সাথে ঘৃণিত জিনিসকে সহ্য করার ক্ষমতা রাখো এবং যা তোমার উপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তা পালনের সর্বাত্মক চেষ্টা কর।”

-বাবর আহমাদ

কষ্ট ও পুরষ্কার

 

“আর (স্মরণ কর) আইয়ুবের (আ) কথা, যখন সে তাঁর প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিলেন: আমি দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, আপনি তো দয়ালুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু”। (সূরা আম্বিয়া ২১:৮৩)

কুরআনে বর্ণিত সকল নবীর মাঝে এমন একজন নবী আছেন যার দাওয়াতী কার্যক্রম ও অনুসারীদের ব্যাপারে কুরআনে কোনো উল্লেখ নেই। সেই নবী হলেন হযরত আইয়ুব (আ), ইংরেজিতে তিনি ‘জব (Job)’ নামে পরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, আল্লাহর বাণী প্রচার করাই যদি নবীদের কাজ হয় তাহলে একজন নবীর দাওয়াতী কাজের কথা উল্লেখ না করার পেছনে যুক্তি কী? এর জবাব হচ্ছে কুরআনে যেকোনো কিছুই বর্ণিত হওয়ার পিছনে একটি কারণ আছে, কোনো কিছুই অনাবশ্যক নয়। আইয়ুব (আ) এর বিশেষত্ব হল তার সাবর, ধৈর্য ও দৃঢ়তা, যার থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে। প্রশ্ন হচ্ছে কী সেই কাহিনী?

আল্লাহ আইয়ুব(আ) কে দু হাত ভরে স্বাস্থ্য, সম্পদ ও সন্তান দিয়েছিলেন, এবং এগুলো ফিরিয়ে নেবার মাধ্যমে তিনি তাঁকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাঁর সন্তানেরা প্রাণ হারালো, তাঁর গবাদিপশু মরে গেল, খামার ধ্বংস হয়ে গেল এবং তিনি সব রকম রোগে আক্রান্ত হলেন। এর মধ্যে একটি অসুখ ছিল এমন যে, পোকামাকড় তার শরীরের ক্ষতস্থান ভক্ষণ করতে লাগলো। বছরের পর বছর এভাবেই পেরিয়ে গেল। তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং সমাজের লোকেরা একে একে তাঁকে বর্জন করল। রোগ সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে তারা তাঁকে দেখতে যাওয়া বন্ধ করে দিল। স্বামীর ছোঁয়াচে রোগ স্ত্রীকেও আক্রান্ত করতে পারে এই আশঙ্কায় তাঁর স্ত্রীকেও (যিনি নিজের ও স্বামীর জন্য অর্থ উপার্জনে বাইরে যেতেন) এই ভয়ে সামাজিকভাবে বয়কট করা হল। এত কিছুর পরেও আইয়ুব (আ) ছিলেন ধৈর্যশীল এবং কৃতজ্ঞ।

একদিন তাঁর স্ত্রী এই দুঃখ-কষ্টের ভার সহ্য করতে না পেরে কেঁদে উঠে বললেন, “আর কতদিন এই দুর্দশা চলবে? কখন এই দুঃসময় শেষ হবে? কেন আপনি আপনার রবকে বলছেন না এই কষ্ট থেকে আমাদের মুক্তি দিতে?” আইয়ুব (আ)এটি শুনে রাগান্বিত হয়ে স্ত্রীকে বললেন, “এই কষ্টের আগে কত দিন যাবত আমরা আল্লাহর অনুগ্রহ উপভোগ করেছি?”

তাঁর স্ত্রী জবাবে বললেন, “৭০ বছর”।

আইয়ুব(আ)তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “আর কত বছর ধরে আল্লাহ আমাদের এভাবে পরীক্ষা করেছেন?”

তাঁর স্ত্রী উত্তর দিলেন, “৭ বছর।” (অন্য বর্ণনাতে আছে তিন বা আঠার বছর, যাই হোক না কেন মূল বিষয় হচ্ছে এর মেয়াদ ছিল ৭০ এর অনেক কম)

আইয়ুব (আ) প্রত্যুত্তরে বললেন, “৭০ বছর ধরে আল্লাহর নি’আমত ভোগ করেছি, আর মাত্র ৭ বছর হল তিনি আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন, এ ব্যাপারে আল্লাহকে নালিশ করতে আমার লজ্জা হচ্ছে। নিশ্চয়ই তোমার ঈমান দুর্বল হয়ে পড়েছে। যাও অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।”

অতঃপর বহুদিন পর আইয়ুব (আ) তাঁর সেই বিখ্যাত দু’আটি করেন, তবে সেটাও ছিল পরোক্ষভাবে এবং বিনয়ের সাথে, তাতে অনুযোগের কোন সুর ছিল না। যা কুরআনের ২১ নং সূরার ৮৩ নং আয়াতে আছে

“আর (স্মরণ কর) আইয়ুবের (আ )কথা, যখন সে তাঁর প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিলেনঃ আমি দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, আপনি তো দয়ালুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।”
আল্লাহ তাঁর দু’আর জবাব দেন এবং তাঁর স্বাস্থ্য, সম্পদ ও সন্তান ফিরিয়ে দেন। তদুপরি, তাঁর ধৈর্যের জন্য তাঁর জন্য নি’আমত আরও বাড়িয়ে দেন।

হে আল্লাহর পথের বন্দী, কতদিন ধরে আপনি কারাগারে? এক বছর? পাঁচ বছর? দশ বছর? বিশ বছর? আর আল্লাহর অনুগ্রহ ভোগ করেছেন আপনি কত বছর ধরে?

কত বছর আপনি স্বাধীনভাবে রাস্তায় হেঁটেছেন? কতগুলো বছর আপনি পরিবার-পরিজন আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গ উপভোগ করছেন? কত বছর ধরে সুস্বাদু সব খাবার খেয়েছেন, সবচেয়ে উত্তম পানীয় পান করেছেন, সুন্দর সব পোশাক পরেছেন? আপনি দেখবেন আপনি যতদিন কারাগারে আছেন তার থেকে বেশি সময় ধরে আপনি আল্লাহর নিয়ামতরাজি ভোগ করেছেন। এরপরেও কোন সাহসে আপনি অন্যদের কাছে আল্লাহর জন্য কারাভোগ নিয়ে অনুতাপ আর অভিযোগ করছেন? আপনি কি মানুষের কাছে নিজের অবস্থা সম্পর্কে মাতম করে লজ্জিত হন না? আপনি কি সেসব বছরের কথা ভুলে গেছেন যা আল্লাহর অনুগ্রহের মধ্যে কাটিয়েছেন?

“মানুষ অবশ্যই অতি মাত্রায় যালিম, অকৃতজ্ঞ।”(সূরা ইবরাহীম ১৪:৩৪)

মহা আরশের অধিপতির শপথ, আপনি যদি আল্লাহর রাহে ১০০০ বছরও একাকী কক্ষে বন্দীদশায় কাটিয়ে দেন, তা আপনার বুড়ো আঙ্গুলের কৃতজ্ঞতা আদায়ের জন্য যথেষ্ট হবে না, যা দিয়ে আপনি খান, পড়েন, লেখেন, কুড়ান, আঁকড়ে ধরেন, জিনিস পত্র সামলান। রাসুল(সাঃ) কি বলেননি, “যদি একজন মানুষের মুখকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মাটিতে ফেলে ছ্যাঁচড়ানো হয় তবুও পুনরুত্থান দিবসে সে আফসোস করবে এই ভেবে যে সে যথেষ্ট ভালো কাজ করে নি”।

আপনার ব্যাপারে আল্লাহর ফায়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকুন। যখন আপনি আপনার বন্দীত্বের প্রতিটি দিনকে অনুগ্রহ ও দয়া না ভেবে নির্যাতন ও শাস্তি হিসেবে মনে করবেন, তখন প্রতিটি মুহূর্ত আপনি ব্যথা অনুভব করবেন। আইয়ুব (আ) যদি তাঁর অবস্থার ব্যাপারে তাঁর রব্বের কাছে অনুযোগ করতে লজ্জিত বোধ করেন, তবে আপনার কী কারন থাকতে পারে মানুষের কাছে পরিবার পরিজনের ব্যাপারে অভিযোগ করতে? সেসব সুস্বাদু খাবারের কথা ভাবুন যা আপনি খেয়েছেন, সেসব অসাধারণ স্থানের কথা ভাবুন যেখানে আপনি ভ্রমন করেছেন। আল্লাহর অনুগ্রহের ব্যাপারে কৃতজ্ঞ হতে শিখুন, তিনি আপনাকে আরো দেবেন।

“যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেনঃ তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দিব, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর”। (সূরা ইবরাহীম ১৪:৭)
আপনি যদি সাম্যের ভিত্তিতে সবকিছু হিসেব করেন তবে অন্তত আপনার কারাগারের বাইরে যতদিন কেটেছে ঠিক ততদিন কারবাসের আগ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাওয়ার কথা না! তাই আপনি যদি কারাগারের বাইরে ৩০ বছর কাটান, তাহলে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করার আগে অন্তত ৩০ বছর কারাবাস করা উচিত! কিন্তু না, আল্লাহ তার চেয়ে দয়ালু। আপনার যদি সহ্য করতে না পারেন, তবে তাঁর কাছে, একমাত্র তাঁর কাছেই অভিযোগ করুন। তারপর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন, যতক্ষণ না তিনি সাড়া দেন। মনকে প্রবোধ দিন ইয়াকুব (আ) এর দুআর মাধ্যমে যা তিনি তার পুত্রের জন্য করেছিলেন,

“আমি আমার বেদনা ও আমার দুঃখ শুধু আল্লাহর নিকট নিবেদন করছি…” (সূরা ইউসুফ ১২:৮৬)

-বাবর আহমাদ

 

মন জুড়ানো মুহূর্ত

আল্লাহ আযযা ওয়াজাল কুরআনে বলেন:

“অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ। যারা বিনয়-নম্র নিজেদের নামাজে।” (২৩:১-২)

এবং

“তোমরা নামাযসমূহ ও মধ্যবর্তী নামাযের (আসর) ব্যাপারে যত্নবান হও এবং বিনীতভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে দন্ডায়মান হও।” (২:২৩৮)

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “সালাত ইসলামের খুঁটি”।

আল-মিরাজের দিনে রাসূলুল্লাহকে (সা) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের যে আদেশ দান করেছিলেন, তা ছিল তাঁর এবং সমগ্র উম্মাহর প্রতি আল্লাহর তরফ থেকে এক অসামান্য উপহার! সালাতকে কখনোই আমরা এভাবে দেখতে পারব না যে সালাতের দ্বারা আমরা আল্লাহকে ‘পুরস্কৃত’ করছি বা কোনরূপ প্রতিদান দিচ্ছি। কেননা আমাদের পক্ষে আল্লাহকে প্রতিদান দেওয়া সম্ভব নয়, না সালাতের সাহায্যে, না অন্য কোন কাজের মাধ্যমে। বরং সালাতের বিধান দেওয়া হয়েছে যেন আমরা এর মাধ্যমে উপকৃত হতে পারি। সালাত কেবল ইসলামের একটি খুঁটি কিংবা একটি ফরয দায়িত্ব থেকেও বেশি কিছু: এটি আপনার সাথে গোটা বিশ্বজগতের মালিক আল্লাহ তা’আলার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম।

সালাতকে একটি ‘হটলাইন’ এর সাথে তুলনা করা যায় যা দিয়ে আপনি যেকোন সময় আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এজন্য সালাফগণ বলতেন “যদি আপনি আল্লাহর সাথে কথা বলতে চান, তাহলে সালাত আদায় করুন আর যদি আপনি চান আল্লাহ আপনার সাথে কথা বলুক, তাহলে কুরআন পড়ুন”। সালাত হলো যাবতীয় সমস্যা থেকে মুক্তির পথ, অস্থিরতায় প্রশান্তি। এটি আপনাকে স্বস্তি দেবে, শান্ত করবে, আস্থা যোগাবে। সালাতের মাধ্যমে আপনি যেকোনো বিষয়ে আল্লাহর সাহায্য চাইতে পারবেন – হোক তা যুদ্ধের মত গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় অথবা রান্না বা কাপড়ের দাগ তোলার মত তুচ্ছ কোন কাজেও! সালাত যে কোন বিষয়ে আল্লাহর দিক নির্দেশনা ও পরামর্শ পাওয়ার উপায়। লোকে সঙ্গ পেতে বা বিনোদনের খোঁজে অনেক সময় এমনিতেই টেলিভিশন বা রেডিও ছেড়ে রেখে দেয়, হয়তো সে শুনছেও না বা দেখছেও না। নিঃসন্দেহে সালাহ এসব “সঙ্গের” চাইতে উত্তম সঙ্গ দান করে।

সালাত আপনাকে সুযোগ করে দেয় আল্লাহর সামনে অন্তরটা মেলে ধরবার, তাঁর কাছে নিরাপদ আশ্রয়স্থল খোঁজার। লম্বা সফরের পর, বা কোন বিপদে পড়লে, অথবা অসুস্থতায় কিংবা পথ হারিয়ে যাবার পর ফিরে আসতে পেরে সন্তান যেভাবে বাবার বুকে পরম নির্ভরতায় আশ্রয় নেয়, সালাতও তেমনি আল্লাহর কাছে আশ্রয় পাবার মাধ্যম। আল্লাহর দয়া ও ক্ষমতার মাঝে হৃদয়ের প্রশান্তি খুঁজে পাবার মাধ্যম। সালাতের উপকারিতার শেষ নেই, তবে তা পেতে হলে আপনাকে এর জন্য দাম দিতে হবে, এবং তাতে বিনিয়োগ করতে হবে।

আপনার সালাতকে মনে করুন একটি ঘোড়ার মত। যখন আপনার ঘোড়ার বয়স অল্প, তখন আপনি না এতে চড়তে পারেন, না পারেন অন্য কাজে ব্যবহার করতে। কিন্তু আপনি যদি একে ভালোভাবে দেখাশোনা করেন, প্রতিদিন পরিষ্কার করেন, প্রশিক্ষণ দেন, খাওয়া-দাওয়া ও যথাযথ পরিচর্যা করেন, এর ওপর খরচ করে একে বড় করতে থাকেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে কাজটি কষ্টসাধ্য হলেও এই ঘোড়াটিই একসময় পরিণত হয়ে আপনার জন্য এক শক্তিশালী, বিশ্বস্ত ও বাধ্য ঘোড়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। যখনই আপনার প্রয়োজন হবে, এটি আপনার খেদমতে হাজির থাকবে। সফরে, যুদ্ধে কী বিপদ থেকে পালাতে যখনই দরকার পড়বে আপনি এর পিঠে চড়তে পারবেন।

অনুরূপ আপনার সালাত। আপনার সালাত যখন দুর্বল, অল্পবয়সী ও অপরিণত, তখন সেটাকে বোঝার মত মনে হবে। প্রথম প্রথম সালাতের জন্য এ কাজগুলো করা খুব কঠিন মনে হবে: ওযূ করা, সময়মত আদায় করা, অর্থ-না-জানা সূরাগুলো মনযোগ দিয়ে পাঠ করা ও মুখস্থ আওড়ে যাওয়া, কিংবা ব্যস্ততা বা ক্লান্তির মাঝেও সালাত আদায় করা ইত্যাদি। তবে আপনি যদি লেগে থাকেন, অনেক চেষ্টা করেন, তাহলে চরম প্রয়োজনের মুহূর্তে আপনার সালাতই আপনাকে সাহায্য করবে। সালাত আপনাকে দেবে অন্তরের প্রশান্তি, স্থিরতা, দৃঢ়তা, শক্তি, সুখ, আশাবাদ ও সাহস। আর কেবল তখনই আপনার সালাত আপনার বোঝা হবার পরিবর্তে পরম উপভোগ্য বিষয়ে পরিণত হবে।

কিছু লোক অভিযোগ করে যে তারা বছরের পর বছর সালাত আদায় করছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সালাত তাদের কোন উপকারে আসে নি! বাস্তবতা হলো – সালাত তাদেরকে উপকার করতে ব্যর্থ হয় নি, বরং তারাই ব্যর্থ হয়েছে সঠিকভাবে সালাত আদায় করতে। সালাত আপনাকে কখনোই ব্যর্থ করবে না যদি না আপনি প্রথমে সালাতকে ব্যর্থ করে দেন। ভেবে দেখুন, আপনি কি এমন একজন যার কাছে সালাত উপভোগ্য নয়, বরং বোঝা স্বরূপ? যদি তা-ই হয়, সালাতের আগে পরে নিজের কাজের প্রতি লক্ষ্য করুন। আপনি কি তাড়াহুড়া করে সালাত আদায় করতে যান? কোনরকমে সালাত আদায় করেন যাতে করে যতো দ্রুত সম্ভব সালাত থেকে উঠে চলে আসতে পারেন? ভাবুন, সালাতের মাঝে কি আপনি তড়িঘড়ি করেন? সালাম ফেরানোর পরেই চট করে উঠে পড়েন? এই ব্যাপারগুলো যদি ঘটে থাকে, তাহলে বলা যায় যে আপনি সালাত থেকে উপকৃত হচ্ছেন না।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সূরা বাক্বারায় বলেন:

তোমরা নামাযসমূহ ও মধ্যবর্তী নামাযের (আসর) ব্যাপারে যত্নবান হও এবং বিনীতভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে দন্ডায়মান হও। (২:২৩৮)

সুতরাং ধীরেসুস্থে সালাতের দিকে যান, শান্তভাবে সালাত আদায় করুন। তাহলেই আপনি শান্তি পাবেন। আপনার মন যদি সারা দিনের কাজকর্ম ও চিন্তার জগতে ঘুরপাক খায়, তাহলে একটু সময় নিন একে শান্ত করতে। আপনার অস্থির মনকে ভাবুন এক কাপ চায়ের মত, যা চামচ দিয়ে নাড়া দেওয়া হয়েছে। চামচ সরিয়ে নেওয়ার সাথে সাথেই এটি থেমে যায় না, একটু সময় নেয়। একইভাবে, সালাত আদায় করার আগে যা করছিলেন, সে সব কাজ বন্ধ করে একটু শান্ত হয়ে বসুন। প্রয়োজন থাকলে প্রাকৃতিক কাজ সেরে নিন, তারপর সুন্দর করে ওযূ করুন। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে নিন ও কাপড় পরিচ্ছন্ন কিনা দেখে নিন। শত হোক, আপনি কিছুক্ষণের মাঝে নিজেকে বিশ্বজগতের মালিকের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন!

  • আযান দিন, যদি ইতিমধ্যে দেওয়া না হয়ে থাকে, তারপর সুন্নাহ সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ান।
  • সুন্নাহ আদায়ের পর সালাতের স্থানে বসেই কিছু যিকির করুন।
  • যখন আপনি নিশ্চিন্ত বোধ করবেন এবং ফরয সালাতের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হবেন, তখন দাঁড়িয়ে সালাত শুরু করুন। ধীরে ধীরে, সালাতের প্রতিটি কাজের মাঝে যথেষ্ট পরিমাণ সময় নিয়ে সালাত আদায় করুন। শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে প্রশান্ত অবস্থাতেই কেবল ফরয সালাত আদায় করুন।
  • সালাত শেষ হয়ে গেলেই উঠে দৌড় দিবেন না, একটু সময় নিয়ে সালাহ-পরবর্তী যিকির আদায় করুন।

যখন আপনি আপনার সালাতে প্রচুর সময় ও শ্রম দিতে শুরু করবেন, তখনই আপনার জন্য সালাত বোঝা হবার বদলে আনন্দের ক্ষণ হয়ে দাঁড়াবে। সালাতে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেও তখন আপনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করবেন না। আপনি এক ওয়াক্ত সালাতের পর পরবর্তী ওয়াক্তের জন্য অধীর হয়ে থাকবেন এবং ওয়াক্ত হওয়া মাত্র আদায় করে ফেলবেন। সালাতরত অবস্থায় আপনার মনে হবে যদি এ সালাত সারাজীবন ধরে চলতে থাকতো, আর কখনো শেষ না হতো! এ পর্যায়ে পৌঁছে সালাতের গুরুত্ব আপনার কাছে খাওয়া, পান করা ও যেকোনো বিনোদনের চেয়ে বেশি দামী মনে হবে, আপনি সালাত ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারবেন না। আর সে সময়েই আপনার কাছে সালাতকে মনে হবে সেই সবল সুঠাম ঘোড়ার মতো, যার পিঠে যখন ইচ্ছা তখনই চড়ে যাওয়া যায়।

-বাবর আহমাদ

 

ব্যথার কথা

সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ বলেন,

“তারা তাদের মুখ দিয়ে সেসব কথা বলে যা তাদের হৃদয়ে নেই।” (সূরা আলে ইমরান: ১৬৭)

আমাদের পুণ্যবান সালাফগণ বলতেন, “মুখের কথা কান পর্যন্তই পৌঁছে, কিন্তু অন্তরের কথা, অন্তরে গিয়ে কড়া নাড়ে।”

আজকাল অনলবর্ষী ভাষণ ও ভাষার অলংকারে অলংকৃত বক্তৃতার অভাব নেই, অথচ সেগুলো শ্রোতার মনে বিন্দুমাত্র দাগ কাটতে পারে না। কতই না বই ও প্রবন্ধ লেখা, যেগুলো কুরআনের আয়াত, উক্তি আর সাক্ষ্যপ্রমাণে ভরপুর, কিন্তু তবুও সেগুলো ব্যর্থ হয় পাঠকদের একটু নাড়া দিতে! কত কবিতার স্তবক লিখা হয় তবুও সেগুলো লোকেদের অন্তরে কোনো প্রভাব রাখতে ব্যর্থ হয়। যেন সেগুলো শক্ত বরফচাঁইয়ের উপর পতিত হয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়া ঠান্ডা পানির ফোঁটা। কত সালাহ আদায় করা হয় কুরআনের শ্রুতিমধুর সুললিত তিলাওয়াতে, তবু সেটা মানুষের জমে যাওয়া অন্তরকে ঈমানের দীপশিখায় এতটুকু গলাতে পারে না, পারে না চোখের কোণে এতটুকু অশ্রু এনে দিতে।

অথচ ‘উমার বিন খাত্তাব যখন সালাতে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন, তিনি ও তার মুসল্লীরা এত বেশি করে কাঁদতেন যে পেছনের কাতার থেকে ফোঁপানোর আওয়াজ শোনা যেত, কেন? তার কাছে যে কুরআন ছিল তা কি আমাদের কুরআন থেকে আলাদা কিছু?

নবী-তনয়া ফাতিমা আয-যাহরা (রাঃ) যতবার আল্লাহর কথা বলতেন ততবার কেন তার নারী শ্রোতাদের চোখে পানি চলে আসত? তিনি যে আল্লাহর কথা বলতেন, সেই আল্লাহর কথা তো আমরাও বলি, তবু আমাদের কেন এমন হয় না?

কেন ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাকের লেখা কবিতার আলোচিত সেই পঙক্তি – হে দুই হারামের প্রার্থনাকারীরা – শুনে ‘আলিম ফুদাইল বিন ইয়াদের হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে চোখ যেত ভিজে? অথচ এমন হাজারো পংক্তি আজ শুধু বইয়ের পাতায় নিষ্প্রাণ চেয়ে থাকে।

আর কেনই বা ইবন তাইমিয়া, ইবন আল ক্বাইয়িম, ইবন আন-নুহাস, সায়্যিদ ক্বুতুব, আব্দুল্লাহ আযযাম প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের বই বিশ্বের কোটি মানুষকে উজ্জীবিত ও প্রেরণা দান করতে থাকে, অথচ তাদের থেকেও জ্ঞানী লেখকদের লেখা এমন প্রচুর বই আছে যেগুলো বইয়ের দোকানের তাকেই পড়ে থাকে, কদাচিৎ মানুষ সেগুলো পড়ে?

এর কারণ হল, এই মানুষগুলো যখন কিছু বলেন, লেখেন বা আবৃত্তি করেন, তাদের হৃদয়ের বেদনা, ত্যাগ আর কষ্টের কথা সেই লেখনী, কথন আর আবৃত্তিতে ভেসে ওঠে। যে ব্যক্তি তার হৃদয়ে, তার শিরায়, তার রক্তে ব্যথা অনুভব করেন, তিনিই পারেন তার কথার দ্বারা তার আবেগকে শ্রোতার হৃদয়ে ঢেলে দিতে। যে লেখক, যে গল্পকার তার জীবনে কোনো পরীক্ষা বা কষ্টের সম্মুখীন হননি, তিনি কেবল কথার পর কথাই বলে যান। না থাকে সেই কথার কোনো মূল্য, না থাকে সেই কথায় কোনো প্রাণ। কেননা, তাদের এই কথার জন্ম তো হয়েছে আরাম-আয়েশের মাঝে বেড়ে ওঠা নিষ্প্রাণ এক হৃদয়ে। তাদের কথাগুলো তাদের মুখের কথা, কলমের কথা, জিহবার কথা। কিন্তু মনের কথা নয়, আবেগের কথা নয়। যদি তারা প্রাঞ্জলতম আর অলংকারপূর্ণ সব শব্দ দিয়েও তাদের কথা সাজায়, তবুও, বাস্তবতা হল তাদের শরীর ও মন সে কথাগুলোর উপর ‘আমল করেনি। তাদের কথাগুলো বরফের টুকরোর মতো। শীতল ও কঠিন এই শব্দগুলো কোমলতম হৃদয়েও বিন্দুমাত্র আলোড়ন সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়।

আর অন্যদিকে আছে একদল সত্যিকারের মু’মিন, যেমন সাহাবাগণ (রাঃ) এবং সেসব ব্যক্তি যারা ন্যায়ের পথে সাহাবীদের অনুসরণ করেছেন, করছেন এবং ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত যারা সাহাবীদের অনুসরণ করে যাবেন। তারা ও তাদের আপন লোকেরা অনুভব করেছেন ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও দারিদ্রের কষ্ট, তারা হয়েছেন প্রত্যাখাত, গৃহ ও দেশ থেকে হয়েছেন নির্বাসিত। তারা প্রিয়জন থেকে দূরে থাকার বিরহ ভোগ করেছেন, বঞ্চিত হয়েছেন পার্থিব সব ভোগ্যবস্তু থেকে, বরণ করে নিয়েছেন বন্দীত্ব, নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট এবং মৃত্যুর জ্বালা। এজন্যই তারা জান্নাতের পথে জ্বলন্ত মশাল।

“এরা হচ্ছেন তারা যাদের আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেছেন। অতএব, তাদের উদাহরণ হতে শিক্ষা নাও” (সূরা আন’আম:৯০)

এই চরম কষ্ট, অনুভূতি আর আবেগের তীব্রতা আমরা উপলব্ধি করতে পারি সাইদ কুতুবের (রহিমাহুল্লাহ) কথায়, যিনি তার কথার উপর ‘আমল করে জীবন দিয়েছেন। তার সেই বিখ্যাত উক্তি:

“নিশ্চয়ই আমাদের কথাগুলো থেকে যাবে প্রাণহীন, নিস্ফলা, আর ভাবাবেগহীন, যতদিন না আমরা সেই কথাগুলোর উপর ‘আমল করে মৃত্যুবরণ করি, আর তখনই আমাদের কথাগুলো জীবন্ত হবে, আর মৃত অন্তরে প্রাণের সঞ্চার করবে, তাদেরকে করে তুলবে সজীব ও প্রাণবন্ত…”

-বাবর আহমাদ

 

একটি নিয়ম

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

এখানে আসার পরপরই আমাকে ‘ইনমেইট হ্যান্ডবুক( Inmate Handbook)’ নামে একটা বই ধরিয়ে দেওয়া হয়। এটা মূলত এই জেলের নিয়মকানুন নিয়ে পঞ্চাশ পৃষ্ঠার একটা বই। বইটির মধ্যে একটি নিয়ম ছিল এমন:

‘ পরিষ্কার ও টানটান করে বিছানা গোছাতে হবে। বিছানার চাদর কুঁচকে থাকা চলবে না। মাথার দিক থেকে মোটামোটি ১৬ ইঞ্চি পর্যন্ত চাদর বিছিয়ে বাকিটুকু গুটিয়ে রাখতে হবে। সব বিছানা সকাল ৭.৩০ মিনিটের মধ্যে গুছিয়ে পর্যবেক্ষণের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। ‘

এটা পড়ামাত্রই সালাফদের দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিশেষ দিকের কথা আমার মনে পড়ে গেল। আলস্যকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে: ‘কাজ, সক্রিয়তা বা প্রচেষ্টার প্রতি অনীহা’। আর এই আলস্যকে সালাফগণ তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন।

* উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, ‘ দরকারি কিছু না করে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোকে আমি ঘৃণা করি।’

* ইবন মাস’উদ (রা) বলেন, ‘ এই দুনিয়া বা পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ না করে অলস বসে থাকে এমন ব্যক্তিকে আমি ঘৃণা করি।’

 

স্বয়ং আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) প্রতিদিন আল্লাহ্‌র কাছে এই দুআর মাধ্যমে দিন শুরু করতেন, ‘… আমি আলস্য থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই…’। আসলে অলসতা সুন্নাহর এতটাই বিপরীতধর্মী একটা বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) জীবনে একবারও হাই তোলেননি। ইবন হাজার উল্লেখ করেন: ‘ নবীজির (সা) অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি ছিল এই যে, তিনি (সা) কক্ষণো হাই তোলেননি। ইয়াজিদ বিন আল-আসামের মুরসাল থেকে ইবনু আবি শায়বাহ এবং আল-বুখারি তাঁর তারিখ গ্রন্থে এটি লিপিবদ্ধ করেছেন।’

 

তাই, জেলখানার নিয়ম হলেও এটা আসলে একটা ভালো নিয়ম। নানান রকম মানুষের সাথে বছরের পর বছর কাছাকাছি থাকার ফলে আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে যে, যত সকালসকাল ঘুম থেকে উঠে দিন শুরু করা যায় দিনভর আলস্য ততোই কম হয়। ‘উমার (রা) একবার শামে পৌঁছে দেখেন যে, মুয়াবিয়া (রা) কিছুটা শ্লথ এবং মন্থর হয়ে পড়েছেন। তাই মুয়াবিয়াকে দেখে ‘উমারের প্রথম প্রশ্নটিই ছিল: ‘কী ব্যাপার মুয়াবিয়া? তুমি কি দুহার (সকালের শেষভাগ) সময় ঘুমোও? ‘ সালাফদের দৃষ্টিভঙ্গী পর্যালোচনা করলে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তারা সকলেই বেশি ঘুমানোর অভ্যাসকে ঘৃণার চোখে দেখতেন – বিশেষ করে দিনের প্রথম ভাগে।

 

* সাখর আল-ঘামিদির সূত্রে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘ হে আল্লাহ্‌! আমার উম্মাহর ভোরের পাখিদের উপর তুমি রহম করো।’ কোনো অভিযান বা সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় তিনি (সা) সবসময় দিনের শুরুতেই তাদের প্রেরণ করতেন। সাখর নিজে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তিনি ভোরবেলাতেই তাঁর ব্যবসায়িক কাজকর্ম শুরু করতেন। ফলে, একসময় তিনি অস্বাভাবিক রকমের ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন।

 

* আলি ইবনে আবু তালিব বলেন, ‘ সকালবেলা ঘুমানো অজ্ঞতার লক্ষণ।’

 

* একবার একদল লোক ফজরের সালাতের পর ইবন মাস’উদের (রা) সাথে দেখা করতে আসে। ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার পরও তারা ইবন মাস’উদের (রা) ঘরে প্রবেশ করতে ইতস্তত করতে থাকে। ইবন মাস’উদ (রা) তাদের এই অস্বস্তির কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা উত্তরে বলে যে, তারা এই ভেবে অস্বস্তিবোধ করছে যে হয়তো ওনার স্ত্রী এই সময় ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। ইবন মাস’উদ প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘ আপনারা কী মনে করেন আমার স্ত্রী এতটাই অলস?’ (ইবন মুফলিহ আল-হাম্বালি এই ঘটনার উপর মন্তব্য করে বলেন: ‘ এই ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, সকালবেলার এই সময়টুকু অবহেলা করা উচিত না এবং এই সময়ে ঘুমোনোকে নিরুৎসাহিত করা হয়।’) বুখারি এবং মুসলিম উভয়েই এই ঘটনাটি তাঁদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।

 

* ইব্‌ন আব্বাস (রা) একদিন তাঁর এক ছেলেকে সকালে ঘুমুতে দেখে বলেন: “উঠো! তুমি কি এমন সময় ঘুমাচ্ছ যখন রিযক বণ্টন হচ্ছে?”

* একজন তাবি’ই বলেন, ‘ কোনো আলিমকে ফজরের পর ঘুমোতে দেখলে পৃথিবী দুঃখে কেঁদে ওঠে।’

* পূর্ববর্তী নবীগণও এমন মনোভাব পোষণ করতেন। নবী দাউদ (আ) সুলাইমানকে (আ) বলেছিলেন: ‘ অতিরিক্ত ঘুমানোর ব্যাপারে সতর্ক হও। অন্যরা যখন কাজ করে তখন এই অভ্যাস তোমাকে দরিদ্র করে দিবে।’

* ‘ঈসা ইবন মারইয়াম (আ) বলেছেন, ‘ দুটি স্বভাবকে আমি ঘৃণা করি:

১) রাতে জেগে না থাকা সত্ত্বেও দিনের বেলায় ঘুমানো,

২) কোনো কারণে আনন্দিত হওয়া ছাড়াই উচ্চস্বরে হাসা।

* একজন কবি বলেন: ‘ নিশ্চয়ই সকালবেলার ঘুম মানুষকে সন্দেহ-সংশয়ে ফেলে দেয়। আর বিকেলবেলায় ঘুমুনো তো পাগলামির নামান্তর।’

 

ইবন মুফলিহ উপরোক্ত বাণীগুলোর উপর মন্তব্য করে বলেন, ‘ সুতরাং দিনের বেলা ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কারণ এটা প্রাণোচ্ছলতা শুষে নেয় এবং শরীরের পেশিগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। তাই শারীরিক সক্রিয়তার মাধ্যমে পেশিগুলোকে সচল রাখা উচিত।’

 

কয়েক মাস আগে আমাকে CMU,Terre Haute থেকে এই জেলে( Marion CMU ) নিয়ে আসা হয়। এই ধরনের জেল বদল সাধারণত কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই করা হয়। এক ভোরে হঠাৎ ৫টার সময় একজন প্রহরী আমার সেলের তালা খুলে আমাকে অন্য এক জেলে স্থানান্তর করার খবর দিল। আরো বলল যে, আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আমার হাতে এক ঘন্টারও কম সময় আছে। আমি বুঝতে পারলাম, এই জেলের ভাইদের সাথে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। তাই সিএমইউর নিকষ কালো অন্ধকার করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে আমি অন্যান্য সেলে থাকা ভাইদের সালাম দিয়ে বিদায় জানিয়ে আসতে গেলাম। এই সময়ে বেশিরভাগ কয়েদিরাই ঘুমিয়ে থাকে।

 

কিন্তু বেশ কয়েকটা সেলে আমি আলো জ্বলতে দেখতে পাই। পা টিপে টিপে আলোকিত সেলগুলোর কাছে গিয়ে আমি কুরআন তিলাওয়াতের মৃদু গুনগুন শুনতে পাই। সেলের দরজা গলে চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলাম প্রতিটি সেলেই আমার ভাইয়েরা কিয়ামুল-লাইলে মগ্ন হয়ে আছে।

* আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) বলেন, ‘ জেনে রাখো, একজন মু’মিনের সম্মান হচ্ছে তাঁর কিয়ামুল লাইল।’

* তিনি (সা) আরো বলেন, ‘ রাতের শেষ ভাগে বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়, যদি তুমি সে সময়ে আল্লাহর যিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারো, তাহলে তাদের অন্তর্ভুক্ত হও। ‘

* তিনি (সা) বলেন, ‘ আমাদের রব প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন, যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে। অতঃপর তিনি বলেন: কে আমাকে আহ্বান করবে, আমি যার ডাকে সাড়া দেব? কে আমার নিকট প্রার্থনা করবে, আমি যাকে প্রদান করব? কে আমার নিকট ইস্তেগফার করবে, আমি যাকে ক্ষমা করব? ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত অনুরূপ বলতে থাকেন’

* রাসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেন, ‘তোমরা রাতের সালাত আঁকড়ে ধর, কারণ এটা তোমাদের পূর্বের নেককার লোকদের অভ্যাস এবং তোমাদের রবের নৈকট্য দানকারী, গুনাহের কাফ্ফারা ও পাপ মোচনকারী। এটা শরীর থেকে রোগ-বালাই দূর করে দেয়।'(ইবন রজব এই হাদিসের ব্যাপারে মন্তব্য করেন, ‘ এই হাদিসের একটি অন্যতম শিক্ষা হলো, কিয়ামুল লাইল এর ফলে সুস্বাস্থ্য লাভ করা যায়। এটি শরীরকে নীরোগ করে।’)

* তিনি (সা) বলেন, ‘ এমনভাবে ইবাদাত করো যেন তুমি আল্লাহকে দেখছো। সেটা না পারলে জেনে রাখো যে তিনি তোমাকে দেখছেন। আর এটাই হচ্ছে ইহসান। ‘

কিয়ামুল-লাইল এর মাধ্যমে মানুষের কাছে সুনাম কুড়ানোর কোনো উপায় নেই। রাতের গভীরে জেলখানার সেলে বন্দী অবস্থায় কাউকে দেখিয়ে দেখিয়ে ইবাদাত করার কোনো উপায় নেই। তাই এই ইবাদাতে কোনোরকম কোনো পার্থিব ফললাভের আশা নেই। আর কিয়ামুল-লাইল তো বাধ্যতামূলকও নয়। বরং হাসান আল-বসরী বলেছেন, এটি হচ্ছে ‘সবচেয়ে কঠিন এবং প্রগাঢ়’ ইবাদাত। তাহলে বলুন, কী মানুষকে স্বেচ্ছায় এবং খুশীমনে শীতকালের প্রবল শীতের রাতে বিছানা ছেড়ে নেমে এসে বরফশীতল পানি দিয়ে ওযু করে এমন এক সত্তার ইবাদাত করতে প্রেরণা যোগায় যাকে সে দেখতেও পায় না?

* আবু সুলাইমান আদ-দারানি বলেন, ‘ যারা বিনোদনে প্রমত্ত হয়ে রাত কাটায় তাদের চেয়ে যারা কিয়াম করে তারাই নিজেদের রাতগুলোকে বেশি উপভোগ করে। যদি রাত না থাকতো তাহলে আমি এই পৃথিবীতে থাকতে চাইতাম না। ‘

* আল-ফুদাইল বিন ‘ইয়াদ বলেন, ‘ রাতে কিয়াম আর দিনে সিয়াম পালন করতে না পারলে বুঝে নিও যে তোমার পাপকাজ তোমাকে বেঁধে রেখে বঞ্চিত করছে। ‘

* সালাফদের একজন বলেছেন, ‘ চল্লিশ বছর ধরে সূর্যোদয় ছাড়া অন্য কিছু আমাকে বিষণ্ণ করতে পারেনি। (কারণ সূর্যোদয়ের মাধ্যমেই কিয়াম এর সময় শেষ হয়ে যায়)’

তারা সকলেই কিয়ামুল-লাইলকে অত্যন্ত কঠিন কাজ বলে স্বীকার করেছেন কিন্তু তাদের ঈমান এই কঠিন কাজকেই তাদের বিশেষত্ব-তে পরিণত করেছে। কপটতা, স্বার্থপরতা আর বস্তুবাদিতায় ডুবে থাকা পশ্চিমা সমাজের কাছে এমন চিন্তাধারা সম্পূর্ণ অপরিচিত। যা-ই হোক, প্রবন্ধের মূল বিষয়বস্তুতে ফিরে আসি। এই হাদিসটি নিয়ে ভাবুন:

* ‘ ঘুমানোর সময় তোমাদের প্রত্যেকের মাথার শেষাংশে শয়তান তিনটি গিঁট দেয়। প্রত্যেক গিঁটের স্থানে সে মোহর এঁটে দিয়ে বলে: তোমার রাত এখনো অনেক বাকি, অতএব ঘুমাও। যদি সে জেগে উঠে আল্লাহর যিকর করে তখন একটি গিঁট খুলে যায়। যদি সে ওযু করে তো আরেকটি গিঁট খুলে যায়। যদি সে সালাত আদায় করে, তো তার সবকটি গিঁটই খুলে যায়, ফলে সে ভোরবেলায় প্রাণবন্ত ও প্রফুল্ল থাকে। অন্যথায় সে অবসাদ ও আলস্য অনুভব করে।’

 

এই হাদিসটির ব্যাপারে ইবন হাজার বলেন, ‘ এই হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মেজাজ ভালো রাখার গোপন চাবিকাঠি কিয়ামুল-লাইল এর মাঝে লুকিয়ে আছে।’ বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন ঘটনা থেকে এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে সব বর্ণনা বলে শেষ করা যাবে না, তবে নিচের ঘটনাগুলো নিয়ে একটু ভাবুন:

* ‘আইশাহ (রা) বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) কক্ষণো কিয়ামুল-লাইল ত্যাগ করতেন না। অসুস্থ বা ক্লান্ত হলেও তিনি বসে বসে তা আদায় করতেন। অথচ কিয়ামুল-লাইল এর কারণে তিনি কখনো ক্লান্ত হননি বরং এর প্রভাব এমন ছিল যে তিনি (সা) কখনো হাই পর্যন্ত তোলেননি। রাতভর কিয়ামুল-লাইলের পরেও দিনের প্রথম প্রহরেই যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে পড়তে তাঁর উদ্যমের অভাব হতো না।

 

* ইবরাহিম বিন শাম্মাস বলেন, ‘ আমি আহমাদ ইবন হাম্বালকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। সে কৈশোর থেকেই সারারাত কিয়ামুল-লাইল করতো। জীবনের এই সময়ের কথা বলতে গিয়েই ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, তিনি কত আগে আগে তাঁর দিন শুরু করতেন। তিনি বলেন, ‘ আমি হাদিস শুনার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে চাইতাম। তখন আমার মা আমার জামা টেনে ধরে বলতেন, ‘ অন্তত ফজরের আযান হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো। আগে মানুষজন ঘুম থেকে উঠুক!”

 

[দ্রষ্টব্য: যুহর এবং আসরের মধ্যবর্তী সময়ে একটু ঘুমিয়ে নেওয়াটা (কাইলুলা) সুন্নাহর অংশ। একারণেই ইমাম আহমাদ কিয়াম এর জন্য উঠতে পারতেন। তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেন, ‘ শীতগ্রীষ্ম সবসময়েই আমার বাবা দুপুরবেলায় একটু ঘুমিয়ে নিতেন। তিনি কখনো এটা ছাড়তেন না এবং আমাকেও এই অভ্যাস রপ্ত করতে উৎসাহিত করতেন। তিনি উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে বলতেন, ‘ কাইলুলা অর্থাৎ দুপুরবেলা একটু ঘুমিয়ে নাও কারণ, শয়তানরা তা করে না।’ আনাস, ইবন আব্বাস প্রমুখ সাহাবিরাও (রাদিয়াল্লাহু আনহুম ) এ ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। কিয়াম এর জন্য সহায়ক আরেকটি অভ্যাস রয়েছে। তা হলো ‘ইশার সালাতের আগে না ঘুমানো এবং ‘ইশার পর কথা না বলা এবং জেগে না থাকা। কারণ হাদিসে এসেছে যে, ‘ নবীজি (সা) ‘ইশার আগে ঘুমানো অপছন্দ করতেন এবং ‘ইশার পর জেগে থেকে কথা বলাও অপছন্দ করতেন।’

এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কিয়ামুল-লাইল এর মানে এই নয় যে সারারাত কিংবা রাতের একটা নির্দিষ্ট সময় জেগে থাকতে হবে। বরং, সুবহে সাদিকের আধাঘন্টা আগে জেগে উঠে দুই রাকাত সালাত আদায় করলে সেটাও কিয়ামুল-লাইল বলে গণ্য হবে। ]

 

আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাইদের সাথে থেকেছি। তাদের মাঝে যারা কিয়ামুল-লাইল এর ব্যাপারে নিয়মিত ছিল তাদেরকেই আমি সবচেয়ে মনোযোগী এবং সময়ের সদ্ব্যবহারকারী হিসাবে পেয়েছি। তারা কদাচিৎ হাই তুলতো, সতর্কতার সাথে তাঁদের শব্দ চয়ন করতো এবং জেলের জীবনযাত্রার মানদণ্ডেও তাঁদের পার্থিব সম্পদ ছিল সবচেয়ে কম। তাঁদের চিন্তা-চেতনা সর্বদা সুন্দরতম বিষয়গুলো ঘিরে আবর্তিত হতো।

এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোই অতীতের মুজাহিদদেরকে ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিতে সাহায্য করেছিল। “বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ” গ্রন্থে ইবনে কাসীর ইয়ারমুকের যুদ্ধের বিবরণে ইতি টানার সময় একটি বিশেষ মুহূর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। তখন লাঞ্ছিত অপদস্থ রোমান সৈন্যদের অবশিষ্টাংশ যুদ্ধের বিবৃতি দিতে অ্যান্টিয়কে তাদের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে ফিরে গিয়েছিল। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে খালিদ বিন ওয়ালিদের সেনাবাহিনীর হাতে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ হওয়ার কথা হিরাক্লিয়াসকে জানায়। তা শুনে হিরাক্লিয়াস বলে উঠলো: “লানত তোমাদের ওপর! যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তাদের সম্পর্কে আমাকে বলো। তারা কি তোমাদের মতোই মানুষ নয়?”

তারা জবাব দিলো: “হ্যাঁ।”

হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞেস করলো: “তোমাদের সংখ্যা বেশি, নাকি তাদের?”

তারা উত্তরে বললো: “বরং আমরা তো প্রতিটি যুদ্ধেই সংখ্যার দিক থেকে তাদেরকে বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছি।”

হিরাক্লিয়াস প্রশ্ন ছুঁড়লো: “তাহলে, কেন তারা তোমাদের পরাজিত করলো?”

তখন, তাদের এক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এগিয়ে এসে বললো: “কারণ তারা রাতে জেগে উঠে নামাজ পড়ে, দিনের বেলায় রোজা রাখে, ওয়াদা পূরণ করে, সৎ কাজে উৎসাহ দেয়, মন্দ কাজে বাধা দেয়, এবং তারা একে-অপরের সাথে উত্তম ব্যবহার করে। অন্যদিকে আমরা মদ খাই, ব্যভিচার করি, নিষিদ্ধ কাজে মত্ত হই, চুক্তি ভঙ্গ করি, অন্যায় ও অত্যাচার করি, আমাদের রবকে রাগান্বিত করে এমন কাজে উৎসাহ দিই, আর যা তাকে সন্তুষ্ট করে তাতে বাধা প্রদান করি এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় ছড়িয়ে বেড়াই।”

হিরাক্লিয়াস বললো: “তুমি সত্য বলেছো।”

 .

তারিক মেহান্না
শুক্রবার, ৩ রজব, ১৪৩৫ ( ২ মে, ২০১৪)
ম্যারিয়ন, সি এম ইউ

 

ফল হাতে প্রবেশ নিষেধ!

 

কিছুদিন আগে একটা চিঠি পেলাম। লেখক চিঠিতে নিজের জীবনে যেসব দুঃখ-দুর্দশার মুখোমুখি হচ্ছেন, এবং যেগুলো তার কাছে মনে হচ্ছে অন্তহীন, সেগুলো নিয়ে তার অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন। চিঠিতে একটা লাইন ছিলো:

 

“আমি ক্রুদ্ধ … কেন আল্লাহ্‌ আমার দু’আ শুনছেন না? কেন?”

 

তার চিঠিটা পড়ার পর, সিদ্ধান্ত নিলাম তার জবাব হিসেবে এই লেখাটা লেখার। দুঃখজনক হলেও সত্যি এধরনের প্রতিক্রিয়া আমাদের মধ্যে খুবই প্রচলিত। এবং এরকম হওয়ার কারণ হলো, দু’আ (আল্লাহ্‌র কাছে কোন কিছু চাওয়া) কীভাবে কাজ করে সেই সম্পর্কে আমাদের মারাত্মক ভুল ধারণা রয়েছে।

 

আমরা দু’আকে যেকোন বিপদের সময়, কঠিন মূহুর্তে প্যানিক বাটনের মতো ব্যবহার করার চেষ্টা করি। আপনি একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, আল্লাহ্‌ বারবার কুরআনে বলেছেন যে দরকারের সময় তাঁকে ডাকবে তিনি তাঁর ডাকে সাড়া দেবেন। সুতরাং, আপনি মনে করলেন যদি ঠিকঠাক মতো দু’আ করতে পারেন (রাতের শেষ তৃতীয়াংশে, মনোযোগের সাথে ইত্যাদি) তাহলে ঠিক পরদিন সকালেই আপনি আপনার দু’আর “জবাব” পেয়ে যাবেন। আর যদি না পান, তাহলেই আপনি ভিতরে ভিতরে আল্লাহ্‌র অঙ্গীকারকে সন্দেহ করা শুরু করবেন!

 

আল্লাহর রাসূল ﷺ একটি হাদীসে এই বিষয়ে বলেছেন। যদিও বুখারী ও মুসলিম – দু জায়গাতেই এই হাদীসটি আছে, তবে আমাদের আলোচনার জন্য মুসলিমের বর্ণনাটি অধিকতর উপযুক্ত:

 

“একজন ব্যক্তির দু’আর জবাব দেওয়া হতে থাকে – যদি সে অন্যায় অথবা হারাম কিছুর জন্য দু’আ না করে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন না করে – এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সে তাড়াহুড়া না করে এবং অধৈর্য না হয়”।

 

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলো -“কিসের দ্বারা ব্যক্তি অধৈর্য হয়ে যাবে?”

 

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জবাব দিলেন – “সে বলবে আমি দু’আ করছি এবং করতেই থাকছি কিন্তু আমি দেখছি আমার দু’আর কোনো জবাব দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে সে আশা হারিয়ে ফেলবে এবং আল্লাহ্‌-কে স্মরণ করা ছেড়ে দেবে।”

 

এই হাদীসটি বেশ কৌতূহল উদ্দীপক এবং আমরা যদি গভীরভাবে হাদীসটি বুঝার চেষ্টা করি, তাহলে কীভাবে দু’আ কাজ করে এবং কীভাবে কাজ করে না – সে বিষয়ে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারবো। একটু খেয়াল করুন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কি ধরনের শব্দ এখানে ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন: “… তাঁর দুআর জবাব দেওয়া হতে থাকবে। একবার অধৈর্য ব্যক্তির অভিযোগের সাথে তুলনা করুন তো “আমি দেখছি আমার দু’আর কোনো জবাব দেওয়া হচ্ছে না।” আপাত দৃষ্টিতে এই ব্যাপার দু’টো পরস্পর সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে। এটা কীভাবে সম্ভব যে একজন ব্যক্তির দু’আর জবাব দেওয়া হচ্ছে কিন্তু তাঁর কাছে মনে হচ্ছে সে কোনো ফল পাচ্ছে না? দু’আর উত্তর কোথায়?

 

ব্যাপারটা হলো, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দু’আর জবাব একসাথে না এসে, ধাপে ধাপে আমাদের কাছে আসে। যেমন এমন কিছু হয়তো ঘটবে যার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু আপনার কাছে মনে হচ্ছে আপনার দু’আর জবাব আসছে না।

 

মনে করুন আপনি একটা কক্ষে বন্দী। মুক্তির একমাত্র উপায় জানালা ভেঙে বের হওয়া। কিন্তু আপনার সম্বল শুধুমাত্র ছোট কিছু পাথরের টুকরো। আপনি জানালায় একটা ছোট পাথর ছুঁড়লেন। তাতে জানাল ভাঙলো না, কিন্তু খুব সূক্ষ্ণ একটা ফাটল ধরলো। আপনি আরেকটা পাথর ছুঁড়লেন। আরেকটি ছোট ফাটল। আপনি আবার একটা পাথর ছুঁড়ে দিলেন, তারপর আরেকটি। তারপর আরেকটি। যতক্ষণ না পর্যন্ত পুরো জানালা অসংখ্য সূক্ষ্ণ ফাটলে ভরে গেল।

 

শেষবারের মতো আপনি একটা পাথর ছুঁড়ে দিলেন এবং জানালার কাঁচ ভেঙে গেলো। ফলে আপনি বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেলেন। দু’আও এভাবেই কাজ করে। আপনি প্রতিটি দু’আর মাধ্যমে আংশিক জবাব পেতে থাকেন এবং আপনি ধৈর্য ও অবিচলতার সাথে একই দু’আ বারবার করার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে শেষ পর্যন্ত দু’আর পরিপূর্ণ জবাব পাবেন।

 

এজন্যই গুহায় আটকে পড়া তিনজন ব্যক্তিকে নিয়ে যে অতি পরিচিত হাদিসটি আছে, সেখানে আমরা দেখতে পাই যে, প্রথম ব্যক্তির দু’আর ফলে গুহামুখের পাথরটি সামান্যই সরেছিলো। দ্বিতীয় ব্যক্তির দু’আর পর পাথরটি আর একটু সরলো। এবং তৃতীয় ব্যক্তির দু’আর পরই তাঁরা তিনজন তাঁদের কাঙ্ক্ষিত ফল পেলেন – পাথরটি ওই পরিমাণে সরলো যার ফলে তাঁরা গুহা থেকে মুক্তি পেলেন।

 

মনে রাখবেন প্রথম পাথরটি শুধু একটি ফাটলই ধরাবে। কিন্তু যদি আপনি পাথর ছুঁড়তে থাকেন তাহলে এক সময় জানালা ভেঙে যাবে এবং আপনি মুক্ত হবেন। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। এই জন্যই হাদিসটিতে আমাদের বলা হচ্ছে – “…যতক্ষণ পর্যন্ত সে অধৈর্য না হচ্ছে 

 

আপনি যখন কোনো চারাগাছে পানি দেন, তখন নিশ্চয় আপনি একসাথে ত্রিশ গ্যালন পানি ঢেলে দিয়ে, কেন মাটি থেকে বিশাল বটবৃক্ষ বের হচ্ছে না, সেটা নিয়ে চিন্তা করতে বসেন না। বরং আপনি ধৈর্য সহকারে প্রতিদিন একটু একটু করে পানি দিতে থাকেন এটা জেনে যে, যত সময়ই লাগুক না কেন, শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ফুলটি পাবেন।

 

একইভাবে আপনি জানেন, আল্লাহ্‌ আপনার প্রতি তাঁর অঙ্গীকার পূর্ণ করবেন এবং আপনার দু’আর জবাব দেবেন – এটা সত্য। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে অলৌকিকভাবে দু’আর উত্তর পাওয়া নিয়মের ব্যতিক্রম, নিয়ম না। নিয়ম হলো আল্লাহর কাছে কোন কিছু চাওয়া এবং তাঁর কাছ থেকে এর উত্তর পাওয়ার প্রক্রিয়া সময় ও ধৈর্যের উপর নির্ভরশীল।

 

যেমনটি ইবনে আল জাওযী, সাইদ আল খাতির গ্রন্থে বলেছেন:

 

“কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা শেষ হবার একটি নির্ধারিত সময় আছে যা শুধু আল্লাহ্‌ জানেন। তাই যে ব্যক্তি দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাকে ধৈর্যশীল হতে হবে। আল্লাহ্‌র নির্ধারিত সময় আসার আগে ধৈর্য হারিয়ে ফেলা, কোনো কাজে লাগবে না। ধৈর্য আবশ্যক কিন্তু দু’আ ছাড়া ধৈর্য অর্থহীন। যেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দু’আ করে তাঁর কাছে সাহায্য চাইছে তাঁর উচিত অধৈর্য না হওয়া। বরং তাঁর উচিত, ধৈর্য, সালাহ এবং দু’আর মাধ্যমে সর্বজ্ঞানী আল্লাহর ইবাদাতে নিয়োজিত হওয়া।

 

অধৈর্য ব্যক্তি তাঁর ধৈর্য হারানোর মাধ্যমে আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা লঙ্ঘন করার চেষ্টা করছে এবং এটা আল্লাহ্‌র সামনে একজন গোলাম ও বান্দার উপযুক্ত আচরণ কিংবা অবস্থান নয়। আল্লাহর বান্দা হিসেবে আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ অবস্থান হলো, আল্লাহর কাছ থেকে আসা তাকদীরকে মেনে নেওয়া। এবং এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য। এবং এর সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো সালাহর মাধ্যমে ক্রমাগত আল্লাহ্‌-র কাছে ভিক্ষা চাওয়া।

 

আল্লাহর কাছ থেকে আসা তাকদীরের বিরোধিতা করা হারাম এবং এটা আল্লাহর পরিকল্পনা লঙ্ঘনের চেষ্টার মধ্যে পড়ে। তাই এই বিষয়গুলো অনুধাবন করো এবং তোমার জন্য তোমার দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা সহ্য করা অনেক সহজ হবে।”

 

কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, আল্লাহ্‌ যদি মুহূর্তের মাঝেই যেকোনো কিছু পরিবর্তন করতে পারেন, তাহলে আমাদের দু’আর জবাব দেওয়ার সময় কেন তিনি অপেক্ষা করেন?

 

এর কারণ হলো, একমাত্র প্রতিকূলতার সাথে দীর্ঘদিনের সংগ্রামের মাধ্যমেই আমরা আমাদের দুর্বলতাগুলো চিনতে পারি এবং সেগুলোকে উপড়ে ফেলে সেখানে আমাদের শক্তি সামর্থ প্রতিস্থাপিত করতে পারি। ব্যাপারটা তেতো ওষুধের মতো। একারণেই মক্কায় নিদারুণ অত্যাচারের শিকার সাহাবা (রাঃ) যখন কা’বার পাশে উপবিষ্ট রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে এসে আবেদন করেছিলেন –

 

“ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ), আপনি কি আমাদের বিজয়ের জন্য দু’আ করবেন না? আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন না?”

রাসূলুল্লাহ [সাঃ] জবাব দিয়েছিলেন – “...কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়ো করছো”।

 

ব্যাপারটা কিন্তু এমন ছিলো না যে আল্লাহ্‌ ঐ মুহূর্তেই পৃথিবী থেকে কুরাইশদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে সক্ষম ছিলেন না বরং ওই মুহূর্তে যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দু’আ করতেন এবং আল্লাহ্‌ সেটা কবুল করতেন তাহলে যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে সাহাবা (রাঃ) বঞ্চিত হতেন, সেটা সম্পর্কে প্রশ্নকর্তা ছিলেন অজ্ঞ।

 

শেষ পর্যন্ত মক্কায় তের বছর, অতঃপর মদীনায় দশ বছর – মোট তেইশ বছরের সংগ্রামের পরই আল্লাহ্‌ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় উম্মাহর প্রতি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেছিলেন এবং এই সুদীর্ঘ তেইশ বছরে সাহাবারাও (রাঃ) উপলব্ধি করলেন, যে অন্য কোনো উপায়ে এই বিজয় আসা বাঞ্ছনীয় ছিল না। মনে রাখবেন ফুল ফুটবেই, কিন্তু সেটা একরাতে না। দিনের পর দিন আপনাকে পানি দিয়েই যেতে হবে। অবশেষে এই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন যে, আপনার দু’আর উত্তর আল্লাহ্‌র তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের কাঠামোর ভেতর থেকেই আসবে। এই কাঠামোর ভেতর যা ঘটে আল্লাহ্‌ সেটা নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এই কাঠামোর মাধ্যমেই তিনি আপনার দু’আর উত্তর দেন। আবারো বলছি, অবশ্যই আলৌকিক ঘটনা, কারামাহ ঘটে, কিন্তু সেগুলো হলো নিয়মের ব্যতিক্রম।

 

একজন কুমারী নারী, যিনি সন্তানের জন্য দু’আ করছেন তিনি অলৌকিকভাবে মারিয়াম (আ) – এর মতো কুমারী অবস্থাতেই গর্ভবতী হয়ে পড়বেন, তার সম্ভাবনা খুবই কম! আবার একজন শতবর্ষী নারী, ইব্রাহীম [আঃ] – এর স্ত্রী সারাহ – এর মতো একশো বছর বয়সে গর্ভবতী হবেন সে সম্ভাবনাও কম। বরং দু’আ করার সময়ই আপনি জানেন, আপনি যখন সন্তান চেয়ে আল্লাহ-র কাছে দু’আ করছেন তখন সন্তান জন্মের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আপনার দু’আর উত্তর আসবে। বিয়ে – স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক – গর্ভধারণ এবং তারপরেই সন্তানপ্রসব। শেষ পর্যন্ত আপনার দু’আর উত্তর এসেছে, কিন্তু তা এসেছে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই। এমন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেটা শুধু আল্লাহ্‌ নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একমাত্র তিনিই আপনার দু’আর উত্তর দিয়েছেন এবং দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

 

ইউসুফ (আ) তাঁর শৈশবে একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে আল্লাহ্‌ অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি ইউসুফ (আ) কে মিশরের উপর ক্ষমতাসীন করবেন এবং আল্লাহ্‌ তাঁর অঙ্গীকার পূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট ঘটনাবলী ও ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমেই  বিন্দু থেকে  বিন্দু তে যাওয়া সম্ভব হয়েছিলো।

 

প্রথমে ইউসুফের (আ) ভাইয়েরা তাদের সাথে তাঁকে নিয়ে গেলো – তাঁকে কুয়ায় নিক্ষেপ করা হলো – তাকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হলো – তিনি অন্যান্য বন্দীদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলেন – বাদশা তাঁর ব্যাখ্যা শুনে চমৎকৃত হলেন – এবং অতঃপর ইউসুফ (আ) মিশরের অর্থমন্ত্রী পদে আসীন হলেন। শৈশবে তাঁর কাছে করা অঙ্গীকার পূর্ণ করা হলো, কিন্তু সেটা হলো আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। মিশরের আরেকটি গল্প দিয়ে শেষ করছি।

 

ষাটের দশকের শেষ দিকে যখন সাইদ কুতুব (রঃ) কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো, সেই একই সময় তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ও বোন হামিদা কুতুবও একই জেলে বন্দী ছিলেন। কিন্তু একই কারাগারে থাকা সত্ত্বেও তাঁদের একে অপরের সাথে দেখা করার কোনো উপায় ছিলো না। কারণ কারাকর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী এটা ছিল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

 

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শারাওয়ী জুমা আরেকটি আইন করেছিলেন যে, কোনো ইসলামপন্থী কয়েদীকে তাঁদের দর্শনার্থীর কাছ থেকে কোনো ফল বা খাবার নিতে দেওয়া হবে না। বেশ কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর মুহাম্মাদ কুতুব তাঁর বোনের সাথে দেখা করার সু্যোগ চেয়ে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানালেন।

 

শারাওয়ী জুমা উত্তর পাঠালো: “জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থাতেই তুমি তোমার বোনকে দেখতে পাবে না”।

 

এক বছরের মতো পার হবার পর নতুন এক সরকার ক্ষমতায় এলো এবং ক্ষমতাসীন হওয়া মাত্র তাঁরা পূর্ববর্তী সরকারের সব সদস্যকে জেলে ছুঁড়ে দিলো। হঠাৎ করেই মুহাম্মাদ এবং হামিদা কুতুব আবিষ্কার করলেন তারা এখন মুক্ত। আর শারাওয়ী জুমা নিজেকে আবিষ্কার করলো চার দেওয়ালের মাঝে বন্দী। সেই একই কারাগারে।

 

এরই মাঝে একদিন তাঁর স্ত্রী এক ঝুড়ি ফল নিয়ে তাকে দেখতে আসলো। কারারক্ষী নিয়ম মতো তাঁর তল্লাশী করলো এবং ঝুড়ি ভর্তি ফলও দেখতে পেলো। কারারক্ষী জিজ্ঞেস করলো এই ফল কার জন্য? জবাবে মহিলা বললেন: “ আমার স্বামী শারাওয়ী জুমার জন্য”। মুচকি হেসে প্রহরী জবাব দিলো: “দুঃখিত, আমি নিয়ম মানতে বাধ্য। ফল হাতে প্রবেশ নিষেধ!

 

এভাবে দুআ কাজ করে। দুআ কোন প্যানিক বাটন না যা মুহূর্তের মধ্যে অলৌকিক সমাধানের গ্যারান্টি দেবে। বরং এর জন্য প্রয়োজন সময় ও গভীরতা। এর জন্য দরকার অবিচলতা, অধ্যবসায়, ধৈর্য, পুনরাবৃত্তি এবং অন্তর্দৃষ্টি।

 

সর্বোপরি এটি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার কেন্দ্রে আছে এই সত্যটিই যে, প্রতি দিনের প্রতিটি মুহূর্তে এই দুনিয়া এবং এর মাঝে সবকিছু ও সবার উপর আল্লাহ্‌-র আছে একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ।

.

তারিক্ব মেহান্না
২৮শে ফেব্রুয়ারী ২০১২
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট-সেল #১০৭

 

হারিয়ে যাওয়া উট

 

 আল্লাহ কুরআনে বলেন, মুমিন লোকদের জন্য এখনও কি সময় আসেনি যে সে আল্লাহর স্মরণ এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর সম্মুখে অবনত হবে? এবং পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের মত যেন তারা না হয়, বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের হৃদয় কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাদের অধিকাংশই ফাসেক(সূরা হাদীদ ৫৭:১৬)

 

আরবের এক বেদুঈন ব্যক্তি মরুভুমিতে সফরের সিদ্ধান্ত নিল। যাত্রা শুরুর কিছুদিন আগে থেকে সে তার উটকে ভালো মত পানি ও খাবার দিয়ে উটটিকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করছিলো। এরপর সে নিজ হাতে উটের পিঠে মালামাল চাপিয়ে দিন একদিন যাত্রা আরম্ভ করল। উটটি সেই জন্ম থেকেই বেদুঈন লোকটিরই ছিল এবং কখনো কোন ঝামেলা করে নি।

 

যাত্রার কিছুদিন পর সেই বেদুঈন মরুভুমির মাঝে এক অদ্ভুত বালুর পাহাড় আবিষ্কার করলো। পাহাড়টা ছিল অর্ধ-চন্দ্রাকৃতির। পাহাড়ের পায়ের কাছে ছায়া। মরুভূমির বুকে এই দুর্লভ ছায়া খুঁজে পেয়েই সে সিদ্ধান্ত নিলো এখানে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া যাক। সে উট থেকে নেমে উটটিকে বসিয়ে এর পা গুলো বেঁধে দিলো, যেন এটি কোথাও চলে যেতে না পারে। এরপর শান্তির এক ঘুম দিলো। কিন্তু অল্পক্ষণ পর ঘুম থেকে উঠেই সে হতবাক। প্রচণ্ড বিস্ময় ও আতঙ্কের সাথে আবিষ্কার করলো, তার উটটি যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলো সে, এরপর পাগলের মত এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে উটটি খুঁজতে লাগলো। উটটা যে শুধু তার সফরের দরকারি জিনিসগুলো বয়ে বেড়াচ্ছিলো তা নয়; বরং লোকটির বেঁচে থাকার সব সম্বল তখন ঐ উটের পিঠে বাঁধা। উটের সাথে সাথে বেদুঈনের খাওয়া-দাওয়া আর পানীয় ও অজানায় হারিয়ে গেলো।  এভাবেই কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। বেদুঈন ব্যক্তিটি তখন আরো মরিয়া হয়ে খুঁজছে। সে টের পেল তার শরীর ক্ষুধায় ভেঙে পড়ছে, প্রতিটি রক্তবিন্দু তৃষ্ণায় কাতর! কিন্তু চারিদিকে ডেকে ডেকেও সে উটটির কোন সাড়াশব্দ পেলো না। সবখানে খুঁজে দেখলো, কিন্তু উটের কোন চিহ্ন নেই তো নেই। আরো কয়েক ঘণ্টা পর তার অবস্থা শোচনীয় আকার ধারণ করলো। হতাশায় মাথায় হাত দিয়ে সে সেখানেই বসে পরলো, বুঝলো বেঁচে থাকার আর কোন আশা নেই। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা এখন শুধু কিছু সময়ের ব্যাপার। সে টের পাচ্ছিল তার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। জীবনের সমস্ত আশা ছেড়েই দিলো সে, কিন্তু ভাবলো, মরতে যখন হবে, তখন ছায়ার নিচে মৃত্যু হলে খারাপ হয় না। বহু কষ্টে প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে সে সেই ছায়ায় নিচে পৌঁছুলো যেখানে সে প্রথমবার ঘুমিয়ে পড়েছিল, এবং সেখানে পোঁছেই জ্ঞান হারালো।

একটু পর তার হুঁশ ফিরলো। সে জেগে উঠে দেখলো, তার উটটি ঠিক তার সামনে দাঁড়ানো! আনন্দের আতিশয্যে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে সে চিৎকার করে বলে উঠলো, “হে আল্লাহ! আমি তোমার রব আর তুমি আমার বান্দা!”

 

সহীহ মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ(সা) বলেন, “আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবাতে ঐ লোকের চেয়ে বেশিও বেশি খুশি হন যে মরুভূমিতে উট হারিয়ে ফেলেছিল এবং তা খুঁজে পেয়ে আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করে বলে ওঠে, “হে আল্লাহ! আমি তোমার রব আর তুমি আমার বান্দা!”

 

হে কারাবন্দী! আপনি কেন কারাগারে? পরিচয় বিভ্রাট? ষড়যন্ত্র? শক্ত প্রমাণের অভাব? মিথ্যা অভিযোগ? ভুল সময় ভুল জায়গায় থাকা? অন্য কারো দোষে? হতে পারে আপনার বন্দীত্বের পেছনের কারণটি সাজানো, কিন্তু নিজেকে সৎভাবে জিজ্ঞেস করুন, “আমি কি আমার প্রতিপালকের বিরুদ্ধে গিয়ে পাপ ও অপরাধ করা থেকে নিষ্পাপ?” যখন আপনি অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, তখন কি সেটা অন্যের দোষ ছিল? যখন আপনি কোন অশ্লীল দৃশ্য উপভোগ করছিলেন, সেটা কি কোন পরিচয় বিভ্রাটের মামলা ছিল নাকি সেটা আসলে আপনিই ছিলেন? যখন আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে হারাম কিছু ভোগ করছিলেন বা পান করেছিলেন, তখন কি কেউ ষড়যন্ত্র করে আপনাকে ফাঁসিয়েছিল? তবে কেন আপনি মিথ্যা অপবাদের অভিযোগ করেন যখন আপনি হাজারটা অপরাধে দোষী, যেগুলোর কথা এসব অভিযোগকারীরা জানেও না? আপনি কি বুঝতে পারেন নি যে আল্লাহ তা’আলাই তাঁর অসীম দয়ায় আপনাকে বন্দীত্বের এই পরীক্ষায় এনে হাজির করেছেন যেন আপনি তাওবাহ করে হৃদয়কে ধুয়ে মুছে নিতে পারেন সেই সব অপরাধ থেকে যেগুলোতে আপনি নিঃসন্দেহে দোষী…।

 

হয়তো আপনি কোন অসতর্ক মুহূর্তে পাপ করেছেন, হয়তো আপনি লজ্জিত, হয়তো আপনার ইচ্ছা করছে মাটির সাথে মিশে যেতে, হয়তো আপনি সেই উট হারানো লোকটির মত হতাশ! কোন ব্যাপার নয়। আল্লাহর দিকে ফিরে আসুন, আল্লাহর কাছে তাওবাহ করুন, আপনার অন্তরটা খুলে ধরুন, চোখের পানিকে ছেড়ে দিন। আপনি তাকে আপনার সামনেই পাবেন, আর আপনি দেখবেন যে আল্লাহ তা’আলা আপনার তাওবায় সেই ব্যক্তির চেয়েও বেশি সন্তুষ্ট, যে মরুভূমিতে তার উট খুঁজে পেয়েছিলো।

-বাবর আহমাদ

 

ঈমানরত্ন

 

আল্লাহ কুরআনে বলেন:

হে আমার পুত্র, তোমার স্বপ্নের বৃত্তান্ত তোমার ভাইদের নিকট বর্ণনা কোরো না, করলে তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে, শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। (১২:৫)

যদি কেউ আপনাকে আপনার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের নাম লিখতে বলে, আপনি কি লিখবেন? আপনার শরীর? গাড়ি? পরিবার? গহনা? বাড়ি? চুল? আপনার চাকরি? অর্থবিত্ত? কিংবা আপনার কাপড়চোপড়? হয়তো এ ধরণের কিছুই। তবে রূঢ় বাস্তবতা হলো এর কোনটিই আপনার আখিরাতে কাজে আসবে না। আর চাইলেও আপনি এগুলো কবরে নিয়ে যেতে পারবেন না। তবে প্রত্যেক মানুষের কাছে এমন একটি বিশেষ সম্পদ আছে, যা পৃথিবীর জীবনে, কবরের অন্ধকারে আর পরকালে শুধু যে কাজে আসবে তা নয়, বরং ওজনের পাল্লায় এর ভার বাকি সব সম্পদকে ছাড়িয়ে যাবে। সে সম্পদটি হলো ঈমান।

ঈমান কী – এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হবে, মূসা (আ) এর দু’আতে যখন আল্লাহ তা’আলা সাগরকে দু’ভাগ করে দিয়ে তাঁর উম্মাতকে রক্ষা করেন, তখন মূসার অন্তরে যা ছিল তা হচ্ছে ঈমান। জালুতকে কতল করার সময়ে দাঊদের অন্তরে যা ছিল সেটি হলো ঈমান। ঈসা (আ) যখন আল্লাহর কাছে আকাশ থেকে খাঞ্চা ভর্তি খাবার পাঠানোর দু’আ করেছিলেন, যা থেকে হাজারো লোক দু’বেলা পেটপুরে আহার করবে, সেই মুহূর্তে উনার হৃদয়ে যা ছিল তা হচ্ছে ঈমান। আর ঈমান হলো যা রাসূলুল্লাহ (সা) আয়ত্ত্ব করেছিলেন, যার কারণে তিনি ও তাঁর সাহাবীরা হতে পেরেছিলেন পুরো বিশ্বের নেতা।

আপনি আপনার প্রিয় বস্তুটিকে চুরি-ডাকাতি বা ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে কিভাবে নিরাপদে রাখেন? যারা আপনার থেকে আপনার সম্পদ ছিনিয়ে নিতে চায়, তাদের থেকে একে কিভাবে রক্ষা করেন? নিশ্চিত বলা যায় যে আপনি আপনার মহামূল্যবান জিনিসটি বাঁচাতে দরকার হলে জান লাগিয়ে দেবেন। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ ঈমানকে রক্ষা করতে আপনার প্রচেষ্টা কতোখানি?

যদি আপনার ঈমান এক বিশাল হীরার খণ্ড হতো, যার মূল্য অসামান্য! আপনি কিভাবে একে চোর-ডাকাত আর শত্রুর নজর থেকে বাঁচাতেন? ভেবে দেখুন বড় বড় কোম্পানি কিংবা জাদুঘরগুলোই বা কিভাবে তাদের অমূল্য রত্নের দেখাশোনা করে। তারা হয়তো সেটি পেলে বাক্সের মাঝে তালা মেরে রেখে দিতো। এরপর সেই তালাবদ্ধ বাক্সকে কোন নিরাপদ ধাতব কম্পার্টমেন্টে রাখা হতো, যেখানে থাকবে অত্যাধুনিক সব ডিভাইস। এরপর কম্পার্টমেন্টটি রাখা হবে অগ্নি-নিরোধক কোন সিন্দুকে, সেখানেও থাকবে একাধিক নিত্যনতুন মেকানিজম। এর বাইরে থাকবে অদৃশ্য লেজার-বীম, সার্বক্ষণিক ক্যামেরার নজরদারি। কার সাধ্যি আছে এতোকিছু পাড়ি দিয়ে হীরার কাছে পৌঁছানোর!

এবারে আপনার ঈমানকে সেই একই স্থানে কল্পনা করুন তো! ধাতব বাক্সটি হলো আপনার সালাত, ওযূ হলো সে বাক্সের তালা। বাক্সটি ঘিরে আছে লোহার কম্পার্টমেন্ট, অগ্নি-নিরোধক সেইফ, লিভার মেকানিজম ইত্যাদি ইত্যাদি। চিন্তা করুন, এগুলো যেন একে একে আপনার ওপর আল্লাহর আদেশ-নিষেধ, আপনার ফরয ইবাদত, আপনার কষ্ট করে মেনে চলা রাসূলুল্লাহ (সা) এর এক একটি সুন্নাহ- আপনার করা যিকির, দিনভর দু’আ, আপনার নফল ইবাদত, তাহাজ্জুদ সালাহ, সাদাক্বাহ ইত্যাদি।  এর ওপর আছে অ্যালার্ম সিস্টেম, তা যেন আপনার কাজগুলো ধরে রাখার ব্যাপারে সতর্ক করছে। এমনি করে নিরাপত্তার যতোগুলো স্তর সেই বাক্সকে ঘিরে রেখেছে, সেগুলো দিয়ে আরও ভালো কিছু কাজ, আরো ভালো কোন ইবাদতের কথা বোঝানো হচ্ছে, মানে এবং পরিমাণে। এই নেক আমল আর ইবাদতগুলোই আপনার ঈমানকে রক্ষা করবে।

শয়তান আপনার সবচেয়ে বড়ো শত্রু। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে সে এই চেষ্টাই করে চলেছে যে কীভাবে আপনার ঈমানকে ধ্বংস করে দেবে। কীভাবে আপনার ঈমানকে উপড়ে ফেলবে। কিন্তু সে একটি জিনিস জানে – সে জানে একলাফে আপনার হীরার মতো দৃঢ় ঈমানের ধারে কাছে আসা সম্ভব নয়। তাকে অনেকগুলো শক্তিশালী স্তর ভেদ করে এই অমূল্য ঈমানরত্নের কাছে পৌঁছুতে হবে। তাই সে ওঁৎ পেতে থাকে কখন আপনি আপনার নিরাপত্তা বলয়ে একটুখানি ঢিল দেবেন। আপনার একটি নেক আমল ছুটে যাওয়ার অর্থ আপনার নিরাপত্তার বলয়টি একটু করে খসে পড়া। আপনার দ্বারা একটি হারাম কাজ ঘটার অর্থ ঈমান বিনষ্টের দিকে শয়তানের এক ধাপ এগিয়ে আসা। আপনার গুনাহর আকার ও মাত্রা নির্ধারণ করবে শয়তান কতো বেশি তার লক্ষ্যের দিকে এগোতে সফল।

আপনার ঈমানকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আপনি যতো বেশি সংখ্যক স্তর তৈরি করবেন এবং সেগুলো যতো বেশি মজবুত হবে, শয়তানের দ্বারা সেগুলো ভেঙে আপনার ঈমান-ভঙ্গের দিকে পৌঁছুনো হবে ততোটাই কঠিন। আপনি যদি আপনার সালাতে ক্ষতি হতে দেন, যদি এমন হয় যে আপনি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করছেন না, দেরী করে সালাহ আদায় করছেন কিংবা তাড়াহুড়ো করে পড়ছেন, তাহলে বুঝতে হবে এটি ভয়ানক বিপদের আভাস। ঈমান থেকে কুফরে পা দেওয়ার একেবারে শেষ বিন্দুতে হয়তো পৌঁছে গেছেন আপনি।  ঈমান আপনার সবচেয়ে দামি সম্পদ। কোন মানুষ, জ্বীন বা কোন শক্তির সাধ্য নেই যে সে আপনার সম্মতি ছাড়া আপনার সালাতকে ছিনিয়ে নেবে। এই পৃথিবীর ক্ষমতাধর লোকেরা হয়তো আপনার থেকে আপনার স্বাধীনতা, আপনার অর্থকড়ি, পরিবার, সম্পদ, ঘরবাড়ি বা আপনার শরীরের কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙকে কেড়ে নিতে পারবে, কিন্তু আপনার ঈমানকে কেড়ে নেওয়ার শক্তি কারো নেই।

ঈমানকে গড়ে তুলুন।

ঈমান গড়ে তুলুন, একে শক্তিশালী করুন, সমৃদ্ধ করুন, এবং একবার একে গড়ে তোলার পর সযত্নে এর রক্ষণাবেক্ষণ করুন। প্রতিটি নিরাপত্তা কার্যক্রমের রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। আপনি যদি কোন নিরাপত্তা বলয়কে সঠিক ভাবে দেখাশোনা করে রাখতে না পারেন, তাহলে শয়তানের সামনে একে খুলে দেওয়া হলো। আর তখন সে যদি আপনার ঈমানকে কেড়ে নিতে সফল হয়ে যায়, তাকে দোষ দেবেন না। দোষ দিন নিজেকে।

-বাবর আহমাদ

 

ফজরে আমি উঠতে পারি না

 

ভোরবেলা ঘুম থেকে জাগতে পারি না আমি। মাঝেমধ্যে জেগে উঠলেও আলসেমিতে পেয়ে বসে। আড়মোড়া ভেঙ্গে আরেকদিকে কাত হয়ে শুয়ে যাই। ফজরের জামা‘আতে শামিল হতে পারি না। সুবহে সাদিকের সুনির্মল হাওয়া আমার গায়ে ঝিরিঝিরি পরশ বুলানোর সুযোগ পায় না। পবিত্রতার সতেজতম আবহ আমাকে স্পর্শ করে না। বিশুদ্ধ বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার অনুভূতি থেকে আমি বঞ্চিত হই প্রতিদিন। আরেকটা চমৎকার জিনিস থেকে আমি বঞ্চিত হই। আসলে ‘বঞ্চিত হই’ বলাটা বাঞ্ছনীয় হবে না, আদতে আমি নিজেকে ‘বঞ্চিত করি’। কোন্ জিনিস থেকে বঞ্চিত হই, সেটা বলছি একটু পরে। তার আগে ছোট্ট একটা গল্পের কথা মনে পড়লো। সত্যি গল্প কিন্তু! আমি খুব ভালো ছাত্র। আমাদের কলেজটাও খুব নাম করা। এই কলেজের একজন কৃতী ছাত্র হলেন আমাদের প্রেসিডেন্ট। অনেক বছর পর তিনি তারুণ্যের স্মৃতিবিজড়িত এই কলেজটাতে এলেন। বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আমি তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে একটা মানপত্র পাঠ করেছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে প্রেসিডেন্ট যখন প্রিন্সিপ্যাল স্যারের রুমে, তখন না কি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এত চমৎকার বাচনভঙ্গী আর কাব্যিক উপস্থাপনা ছেলেটার! নাম কী ওর?’ প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন, ‘ও আমাদের একজন মেরিটরিয়াস স্টুডেন্ট- ফাইয়াজ আবদুল্লাহ।’ প্রেসিডেন্ট হেসে বললেন, ‘বাহ! ফাইয়াজ আব্দুল্লাহ- খুব সুন্দর নাম! পড়াশোনা করে কেমন?’ সব স্যার একবাক্যে বললেন, ‘ভেরি পাংচুয়াল অ্যান্ড অ্যাটেন্টিভ।’ ভাইস প্রিন্সিপ্যাল স্যার এই ঘটনা আমাকে পরদিন বললেন। আমি তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! প্রেসিডেন্ট আমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন, এ তো আমার এক জীবনের সবচে’ বড়ো পাওয়া! প্রেসিডেন্টের সামনে আমার প্রশংসা করা হবে, স্বপ্নেও কি কখনো ভেবেছিলাম? রোজনামচার খাতায় সেদিনের অনুভূতি লিখে রেখেছিলাম। কালো কালির কলম ছাড়া ইতোপূর্বে অন্য কোনো রঙের কলম দিয়ে আমি রোজনামচা লিখি নি। কিন্তু সেদিনের রোজনামচা-তে পাঁচটা রঙিন কলম ব্যবহার করেছি। বাঁধভাঙ্গা খুশির ঢেউ হৃদয়ের সৈকতে উপচে পড়লে যা হয় আর কি!
.
এটা আমার জীবনের গল্প। আরেকটা গল্প বলি, যে গল্পটা আবূ হুরায়রা বলেছেন। তিনি আবার বানিয়ে কোনো গল্প বলতেন না! প্রিয় নবীজি ( ﷺ ) যেভাবে যা বলতেন, তা-ই ঠিক ঠিক আমাদের জন্যে মুখস্থ করে নিতেন। একদিন নবীজি ( ﷺ ) বলছিলেন:
.
ﻳﺘﻌﺎﻗﺒﻮﻥ ﻓﻴﻜﻢ ﻣﻼﺋﻜﺔ ﺑﺎﻟﻠﻴﻞ ﻭﻣﻼﺋﻜﺔ ﺑﺎﻟﻨﻬﺎﺭ ﻭﻳﺠﺘﻤﻌﻮﻥ ﻓﻲ ﺻﻼﺓ ﺍﻟﻔﺠﺮ ﻭﺻﻼﺓ ﺍﻟﻌﺼﺮ ﺛﻢ ﻳﻌﺮﺝ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﺑﺎﺗﻮﺍ ﻓﻴﻜﻢ ﻓﻴﺴﺄﻟﻬﻢ ﺭﺑﻬﻢ ﻭﻫﻮ ﺃﻋﻠﻢ ﺑﻬﻢ ﻛﻴﻒ ﺗﺮﻛﺘﻢ ﻋﺒﺎﺩﻱ ﻓﻴﻘﻮﻟﻮﻥ ﺗﺮﻛﻨﺎﻫﻢ ﻭﻫﻢ ﻳﺼﻠﻮﻥ ﻭﺃﺗﻴﻨﺎﻫﻢ ﻭﻫﻢ ﻳﺼﻠﻮﻥ
.
“তোমাদের মধ্যে একদল ফেরেশতা রাতে এবং আরেকদল ফেরেশতা দিনে আসেন, একের পর এক। ফজর ও আসরের সালাতে তাঁরা মিলিত হন। এরপর যাঁরা তোমাদের মধ্যে ছিলেন, তাঁরা উঠে যান। এবার তাঁদের রব্ব তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করেন, যদিও তিনি তাদের অবস্থা সম্পর্কে সবচে’ বেশি জানেন, ‘আমার বান্দাহদেরকে কোন্ অবস্থায় রেখে এসেছো?’ তাঁরা বলেন: আমরা তাদের কাছ থেকে যখন চলে আসছিলাম, তখন তারা সালাতে মগ্ন ছিলো। আবার যখন তাদের কাছে এলাম, তখনও তারা সালাত আদায়রত অবস্থায় ছিলো।”
.
এই গল্পটা ইমাম বুখারী তাঁর হাদিসের গ্রন্থে এনেছেন। বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিমও। বোঝা-ই যায়, এই গল্পের বিশুদ্ধতা সন্দেহাতীত!
.
আমি ভাবছি ভিন্ন কথা। প্রেসিডেন্টের সামনে সেই যে এক বছর আগে আমার প্রশংসা করা হয়েছিলো, তাতে আমি কেমন উদ্বেল হয়েছিলাম! আচ্ছা, সাময়িক আত্মতৃপ্তি ছাড়া সেই আনন্দানুভূতির আর কোনো আবেদন কি এখন অবশিষ্ট আছে? নেই! কিংবা প্রেসিডেন্টের কি মনে আছে আমার কথা? নেই!
.
অন্যদিকে…
আল্লাহ কি ভুলে যান কোনোকিছু? না।
আল্লাহর কাছে পেশ করা কোনো রিপোর্ট কি বৃথা যায়? না।
.
সেই মানুষগুলো কত না ভাগ্যবান, যাঁদের নামে ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে প্রশংসা করেন! সেই আলোকিত মুখগুলো কত না সফল, মাসজিদের সাথে যাঁদের হৃদয় জড়িয়ে থাকে ভালোবাসার বন্ধনে! সেই বন্ধনের সুতো ফেরেশতারা টেনে নিয়ে যান আরশ পর্যন্ত! কেমন সৌভাগ্যবান তাঁরা!
.
আমারও তো সুযোগ ছিলো, এঁদের কাতারে নিজেকে শামিল করার। আসরের সালাত তো আমিও আদায় করেছিলাম! মাগরিব সালাতটাও মিস হয় নি, যদিও তাড়াহুড়ো করে গিয়েছি। দুই রাকাত মাসবূক না হয় হোল, ‘ইশা-ও তো আদায় করে এলাম। আলসেমি না করে ফজরটাও যদি আদায় করতাম, তাহলে আমিও আমার প্রিয়তম প্রভূর সামনে প্রশংসিত হতাম।
.
আমি আরো ভাবি… এই যে মুয়াজ্জিনের প্রাণস্পর্শী আহ্বান আমাকে প্রাণিত করছে না, ফজরটা হেলায় পার করে দিচ্ছি, এর কারণে শুধু আল্লাহর সামনে প্রশংসিত হওয়া থেকেই যে বঞ্চিত হচ্ছি, তা নয়, এই অবহেলার দরুণ আল্লাহর জিম্মা থেকেও আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছি। আমার দিনগুলো যে অস্থিরতায় কাটে, সময়গুলো বিবর্ণ-ধূসর হয়ে যায় হররোজ, এর কারণ কি তাহলে এটাই? আল্লাহর তত্ত্বাবধান যদি আমার ওপর না থাকে, জীবনটা নির্ভার হবে কিভাবে? প্রিয় নবীজি ( ﷺ ) তো বহু আগেই আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন:
.
ﻣﻦ ﺻﻠﻰ ﺻﻼﺓ ﺍﻟﺼﺒﺢ ﻓﻬﻮ ﻓﻲ ﺫﻣﺔ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﻼ ﻳﻄﻠﺒﻨﻜﻢ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﻦ ﺫﻣﺘﻪ ﺑﺸﻲﺀ ﻓﺈﻧﻪ ﻣﻦ ﻳﻄﻠﺒﻪ ﻣﻦ ﺫﻣﺘﻪ ﺑﺸﻲﺀ ﻳﺪﺭﻛﻪ ﺛﻢ ﻳﻜﺒﻪ ﻋﻠﻰ ﻭﺟﻬﻪ ﻓﻲ ﻧﺎﺭ ﺟﻬﻨﻢ
.
“যে ফজরের সালাত আদায় করলো, সে আল্লাহর তত্ত্বাবধানে চলে এলো। আল্লাহ যেন নিজ তত্ত্বাবধানের কোন কিছু সম্পর্কে তোমাদের বিরুদ্ধে বাদী না হন। কারণ, তিনি যার বিরুদ্ধে আপন তত্ত্বাবধানের কোনো কিছু সম্পর্কে বাদী হবেন, তাকে পাকড়াও করবেন, এরপর তাকে উপুড় করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।” [সাহীহ মুসলিম]
.
এই হাদিস আমার ভাবনার জগৎটাই এলোমেলো করে দিচ্ছে। কী মোহগ্রস্ততায় আমি নিজেকে নিজে ঠেলে দিচ্ছি অনিশ্চিত অন্ধকারে, জানি না। বিছানার মোলায়েম স্পর্শে সালাতকে ভুলে থেকে আগুনের নির্মম স্পর্শের জন্যে কেন নিজেকে প্রস্তুত করছি তিল তিল করে, জানি না। শুধু জানি, এই আত্মবিধ্বংসী অভ্যাস থেকে আমাকে মুক্ত হতে হবে। হতেই হবে।
.
এই হাদিস আমার ভেতর আরেকটা উপলব্ধির জন্ম দিয়েছে। আমার অস্থিরতাপূর্ণ আটপৌরে জীবন, বেলা করে ঘুম থেকে উঠার পর শুরু হওয়া উদয়াস্ত ব্যস্ততা, যেখানে আসমানী মদদের ছিঁটেফোঁটা নেই, সেই জীবনটাকে আল্লাহর কাছে সমর্পিত করতে পারলে আরেকটু কি গোছানো হতো? আরেকটু নির্ভার হতো? মনে হয় হতো। বিশ্বাসী অন্তর আমাকে কেন জানি প্রণোদনা দিচ্ছে এদিকে। এই সমর্পণের চমৎকার একটি সিঁড়ি হোল ফজরের সালাত। তাহলে কেন এই সুযোগ হাতছাড়া করবো আমি?
.
আমার মানসিক যন্ত্রণা আরো বহুগুণ বেড়ে গেলো, যখন জানতে পারলাম, আমাকে প্রচ-ভাবে নিন্দা করা হয়েছে কুরআনের পাতায়। আমি উৎসুক হয়ে আয়াতটা খুলে পড়তে লাগলাম:
ﻓَﺨَﻠَﻒَ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِﻫِﻢْ ﺧَﻠْﻒٌ ﺃَﺿَﺎﻋُﻮﺍ ﺍﻟﺼَّﻠَﺎﺓَ ﻭَﺍﺗَّﺒَﻌُﻮﺍ ﺍﻟﺸَّﻬَﻮَﺍﺕِ ﻓَﺴَﻮْﻑَ ﻳَﻠْﻘَﻮْﻥَ ﻏَﻴًّﺎ
“এদের পরে এমন সব মন্দলোকেরা স্থলাভিষিক্ত হোল, যারা সালাত নষ্ট করলো এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো। এরা শিগগির ‘গাই’ (জাহান্নামের একটি উপত্যকা) এর মুখোমুখি হবে।” [সূরা মারয়াম: ৫৯]
.
কারা সেই হতভাগ্য, যাদেরকে আল্লাহ নিজেই ‘মন্দ’ বলছেন! এরা তারাই, যারা আমার মতো সালাতে হেলা করে। বলতে দ্বিধা নেই, চিন্তাভাবনা করে দেখলাম, আমি সেই মন্দলোকদেরই একজন হয়ে যাচ্ছি।
.
আমি সালাতকে অযত্ন করছি।
নিজের খেয়াল-খুশি মতো ঘুমিয়ে থাকছি, আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর চেয়ে আয়েশী ঘুমের স্বাদ আস্বাদনে প্রবৃত্ত হচ্ছি।
জাহান্নামের উপত্যকাই কি তবে আমার শেষ ঠিকানা?
.
আমি কি এতটাই নীচ?
আমি কি এতটাই হীন?
.
হ্যাঁ, আমি এতটাই নীচ ও হীন যে, আমার কানে এমনকি নির্গত হয় শাইত্বানের স্রাব। খতীব সাহেবের মুখে অনেকবার এ কথাটা শুনেছি, কিন্তু কথাটা খুব হালকা বলে মনে হতো। বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ হতো। যখন আল্লাহর রাসূলের ( ﷺ ) কাছ থেকেই শুনলাম, তখন কি আর সংশয়ের সুযোগ থাকে?
.
আমাদেরকে গল্পটা শোনাচ্ছেন ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ (র)।
.
ﺫﻛﺮ ﻋﻨﺪ ﺍﻟﻨﺒِﻲّ ﺻﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠَّﻢ ﺭﺟﻞ، ﻓﻘﻴﻞ : ﻣﺎ ﺯﺍﻝ ﻧﺎﺋﻤﺎ ﺣﺘّﻰ ﺃﺻﺒﺢ، ﻣﺎ ﻗﺎﻡ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﺼَّﻼَﺓ، ﻓﻘﺎﻝ : ‏( ﺫﺍﻙ ﺭﺟﻞ ﺑﺎﻝ ﺍﻟﺸﻴﻄﺎﻥ ﻓﻲ ﺃﺫﻧِﻪ (
.
“রাসূলুল্লাহর ( ﷺ ) কাছে এক ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা হোল। বলা হোল: ভোর হওয়া পর্যন্ত সে ঘুমিয়ে ছিলো, সালাতে দাঁড়ায় নি। রাসূলুল্লাহ ( ﷺ ) বললেন: সে এমন লোক, শাইত্বান যার কানে প্রশ্রাব করেছে।”
[বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ ও ইবন হিব্বান]
.
এই যে শাইত্বানের প্রস্রাব করে দেয়া, এটার অর্থ হোল, শাইত্বান আমার উপর জয়ী হয়েছে। আমি যে তার অনুগত ও বশ্য, সেই সত্যের স্মারক হোল তার এই প্রশ্রাব করে দেওয়া। ছোটলোকের ছোটলোকি কারবার আর কি! কিন্তু আমার সাথে কেন এই ছোটলোকির সুযোগ সে পেলো? কারণ, আমিও তার কথা মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তার মতই নীচ হয়ে গেছি।
.
ছিঃ
এ কেমন আমি?
.
এখানেই শেষ নয়। দুনিয়ায় যতো ভর্ৎসনা-প্রকাশক শব্দ আছে, এর মধ্যে জঘন্যতম অভিব্যক্তির একটা তালিকা যদি করা হয়, তাহলে নিশ্চিত ‘মুনাফিক’ শব্দটা প্রথমদিকেই থাকবে। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করার চিন্তা করি, কেউ যদি আমাকে ‘মুনাফিক কোথাকার!’ বলে, আমার কেমন অনুভূতি হয়! অথবা আমি যদি কাউকে ‘মুনাফিক’ বলে সম্বোধন করি, তাহলে কী বিপুল তেজ ও ক্রোধ নিয়ে সে আমার দিকে তেড়ে আসবে? এর কারণ কী? কারণ হোল, মুনাফিকি একটি ঘৃণিত চরিত্র, গর্ব করার মতো কোনো বিষয় নয়।
.
কিন্তু… এই ‘মুনাফিক’ অভিধার তিলক যদি আমি নিজেই আমার কপালে পরে নেই, তাহলে কার কী করার আছে? আবারো আবূ হুরায়রার কাছে যাই। তিনি আমাদেরকে শোনাচ্ছেন আল্লাহর রাসূলের ( ﷺ ) একটা উক্তি:
ﻟﻴﺲ ﺻﻼﺓ ﺃﺛﻘﻞ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻤﻨﺎﻓﻖ ﻣﻦ ﺍﻟﻔﺠﺮ ﻭﺍﻟﻌﺸﺎﺀ
“ফজর ও ইশার চেয়ে মুনাফিকের জন্যে কঠিন কোনো সালাত নেই”
[বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবন মাজাহ]
.
আমি মুনাফিক নই ঠিক, কিন্তু মুনাফিকের মতো কাজই তো করলাম ফজর ত্যাগ করার মধ্য দিয়ে।
হায়, দিন দিন কত নিচে নেমে যাচ্ছি!
কত নীচ হয়ে যাচ্ছি!
.
আমি নিজেকে বলি,
উপুড় হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবার মতো পাপিষ্ঠ তাহলে আমি?
শাইত্বানের স্রাব প্রস্রবণের স্থান হবার মতো নীচ কি আমি?
মুনাফিকের মতো ঘৃণিত অভিধায় অভিহিত হবার মত কি অধম আমি?
আল্লাহর কাছ থেকে নিন্দিত হবার মতো হতভাগা হয়ে উঠার কথা কি আমার ছিলো?
ছিলো না।
.
আমি এই নীচতা থেকে পরিত্রাণ চাই।
আমি এই হীনতা থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে চাই।
শাইত্বানের অনুগামী হওয়ার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে চাই।
আমি আমার প্রিয়তম প্রভূর কাছে প্রশংসিত হতে চাই।
.
সিদ্ধান্ত নেই, ফজর সালাত ত্যাগ করবো না কখনোই। ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু আযানের পর আবারো তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। নবীজির ( ﷺ ) সাহাবী সামুরাহ ইবন জুনদুব (রা)-কে স্বপ্নে দেখি। তিনি আমার পাশে এসে বসলেন। মাথায় হাত রাখলেন। তারপর বললেন, ‘তোমাকে স্বপ্নের মধ্যেই একটা স্বপ্নের গল্প বলি’। আমি তো গল্প পছন্দ করি খুব। সোৎসাহে বললাম, ‘বলুন না প্লিজ!’ তিনি গল্প শুরু করার আগে বললেন, ‘এই যে স্বপ্নটা, এটা কিন্তু যেনতেন স্বপ্ন নয়। তোমাকে যে স্বপ্নের গল্প করছি, এটা নবীজি ( ﷺ ) দেখেছিলেন!’ আমি আরো উৎসুক হলাম। তিনি গল্পটা শোনাতে লাগলেন। যখনই বললেন:
ﺃﻣﺎ ﺍﻟﺬﻱ ﻳﺜﻠﻎ ﺭﺃﺳﻪ ﺑﺎﻟﺤﺠﺮ ﻓﺈﻧﻪ ﻳﺄﺧﺬ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻓﻴﺮﻓﻀﻪ ﻭﻳﻨﺎﻡ ﻋﻦ ﺍﻟﺼﻼﺓ ﺍﻟﻤﻜﺘﻮﺑﺔ
“যে ব্যক্তির মাথা পাথর দিয়ে চূর্ণ করে দেয়া হচ্ছিলো, সে হচ্ছে এমন ব্যক্তি, যে কুরআনকে নেয় ও প্রত্যাখ্যান করে এবং ফরয সালাত রেখে ঘুমিয়ে থাকে।” [সাহীহ বুখারী]
.
আমি প্রচণ্ডভাবে ঘেমে যাচ্ছিলাম। ধড়পড় করে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। ততক্ষণে ফজরের সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাড়াহুড়ো করে দুই রাকাত ফরয আদায় করে নিলাম। কিন্তু মনটা কেমন উদাস হয়ে থাকলো। কিছুতেই স্থির হতে পারছিলাম না। কিসের যেন শূন্যতাবোধ আমাকে গ্রাস করছিলো। একে তো জামা‘আতের সাথে পড়ি নি; আবার দুই রাকাত সুন্নাতও বাদ দিয়েছি। এই দুই রাকাত সুন্নাতের ব্যাপারে আমাদের নবীজি ( ﷺ ) বলেছিলেন:
ﺭﻛﻌﺘﺎ ﺍﻟﻔﺠﺮ ﺧﻴﺮ ﻣﻦ ﺍﻟﺪﻧﻴﺎ ﻭﻣﺎ ﻓﻴﻬﺎ
“পৃথিবী এবং পৃথিবীর মধ্যবর্তী যা কিছু আছে, তারচেয়ে বেশি উত্তম ফজরের দুই রাকাত (সুন্নাত) সালাত।” [মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, আহমাদ]
.
জায়নামাযে বসে বসে আরেকটা ভাবনার সৃষ্টি হোল। আচ্ছা, ফজরের দুই রাকাত সুন্নাতের মূল্য যদি এত বেশি হয়ে থাকে, তাহলে ফরজ দুই রাকাতের মূল্য ও মর্যাদা কত বেশি হতে পারে!
.
আধা ঘণ্টা বেশি ঘুমানোর জন্যে আমি প্রতিদিন এত বড়ো সম্মান ও মর্যাদাকর উপলক্ষকে হাতছাড়া করে চলছি! কী বোকা আমি! আমাকে কি আমি ধিক্কার দেবো? না, তা দিয়ে লাভ নেই। বরং আর দেরি না করে সৌভাগ্যবানদের কাতারে নিজেকে শামিল করে ফেলতে স্থিতধী হয়ে যাই।
.
এরপর থেকে আমি ফজরের সালাতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করি। বিছানার পেলবতা আমাকে আর পুরনো গর্তে ফেলতে পারে না। ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম’ আমার কানে অপার্থিব সুরের মূর্ছনা নিয়ে আসে। কী এক তন্ময়তার ঘোর আমাকে পেয়ে বসে! আমি ধীর পদক্ষেপে মাসজিদের দিকে পা বাড়াই। পৃথিবীর কোল থেকে রাত্রি তখনো পুরোপুরি নামে নি। আবছা অন্ধকারের বুক চিরে আমার কদম অগ্রসর হয়। কেমন একটা তৃপ্তির রেশ আমার ‘সুপ্তি-মগন’কে আলতো ছোঁয়ায় জাগাতে থাকে। এই তৃপ্তিবোধের উৎস কোথায়? উৎস তো অনেক! তোমাকে কোনটা বলি? একটা উৎস হতে পারে এই হাদিস:
ﻣﻦ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻌﺸﺎﺀ ﻓﻲ ﺟﻤﺎﻋﺔ ﻓﻜﺄﻧﻤﺎ ﻗﺎﻡ ﻧﺼﻒ ﺍﻟﻠﻴﻞ ﻭﻣﻦ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﺼﺒﺢ ﻓﻲ ﺟﻤﺎﻋﺔ ﻓﻜﺄﻧﻤﺎ ﻗﺎﻡ ﺍﻟﻠﻴﻞ ﻛﻠﻪ
“জামা‘আত সহকারে যে ‘ইশা আদায় করলো, সে যেনো অর্ধরাত্রি ধরে (নফল) সালাত আদায় করলো; এবং জামা‘আত সহকারে যে ফজর আদায় করলো, সে যেনো সারা রাত ধরে (নফল) সালাত আদায় করলো।” [সাহীহ মুসলিম, মুসনাদ আহমাদ]
.
গতরাতে জামা‘আতের সাথে ‘ইশার সালাত আদায় করেছিলাম, আলহামদুলিল্লাহ। ফজরটাও জামা‘আতের সাথে আদায় করতে যাচ্ছি। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার হিসেবের খাতায় সারা রাত নফল সালাত আদায়ের সাওয়াব যোগ হতে যাচ্ছে, আমি তৃপ্ত হবো না তো কে হবে? শাইত্বান এতদিন আমার সাওয়াবের নদীতে রুক্ষ বালুচরের উন্মেষ ঘটিয়েছে, আর আজকে আমি তার বালুচরে বিশ্বাসের ঢেউ নিয়ে আসতে পেরেছি, আমি উদ্বেল হবো না তো কে হবে?
.
এই তৃপ্তিবোধের ঘুড়ির নাটাই আরো কয়েক জায়গায় আছে। এই যেমন:
ﻣﻦ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﺒﺮﺩﻳﻦ ﺩﺧﻞ ﺍﻟﺠﻨﺔ
.
এই হাদিসটা খুব চমৎকার! এটাকে যদি আক্ষরিক অনুবাদ করা হয়, তাহলে অর্থ দাঁড়াই এই: “যে ব্যক্তি দুইটি শীতল সালাত আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [বুখারী, মুসলিম, ইবন হিব্বান, দারেমী, আহমাদ]
.
‘দুইটি শীতল সালাত’ বলতে এখানে কী বোঝানো হয়েছে, সে ব্যাপারে সকল স্কলার একমত: আসর সালাত ও ফজর সালাত। এই দুই ওয়াক্তে প্রকৃতি তুলনামূলক স্নিগ্ধ ও শীতল থাকে।
.
এই হাদিসের স্নিগ্ধতা যখন আমাকে স্পর্শ করে, হাদিসের মর্মবাণী যখন আমার মর্মমূলে শীতলতার অঙ্কুরোদগম ঘটিয়ে চলে, তখন আমার মতো প্রশান্ত, আমার মতো নির্ভার আর কেউ থাকে না।
.
এরকম আরেকটা ছোট্ট হাদিস আছে, আমার চোখেমুখে প্রশান্তির ঝিকিমিকি এনে দেয়:
ﻟﻦ ﻳﻠﺞ ﺍﻟﻨﺎﺭ ﻣﻦ ﺻﻠﻰ ﻗﺒﻞ ﻃﻠﻮﻉ ﺍﻟﺸﻤﺲ ﻭﻗﺒﻞ ﻏﺮﻭﺑﻬﺎ
“এমন কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবে না কখনো, যে সূর্য ওঠার আগে এবং সূর্য ডোবার আগে সালাত আদায় করে।”
[মুসলিম, নাসাঈ, তাবারানী, ইবন হিব্বান, ইবন খুযাইমাহ]
.
এতদিন নিজেকে নিয়ে যে হীনমন্যতার ডালপালা বেরোতে শুরু করেছিলো মনের বৃক্ষে, এই হাদিসগুলো যেন সেগুলো ছেঁটে দিয়ে আবারো দৃষ্টিনন্দন একটা বৃক্ষ দাঁড় করিয়েছে আমার ভেতর, যে বৃক্ষের ছায়ায় আমার ক্লান্ত বদন দখিনা হাওয়ার পরশ মাখে, যার শাখা-প্রশাখায় ফিরদাউসের পাখিরা এসে গান ধরে। আমি শুনি আর আন্দোলিত হই। আমি দেখি আর আলোড়িত হই।
.
তবে এতটুকু পথ মাড়িয়ে এসে প্রশান্তির জায়গাটা নিজের করে নিতে মোটেও যে বেগ পোহাতে হয় নি, তা কিন্তু নয়। আমাকে কতকিছু পিছুটান হয়ে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে! যখন শাইত্বান দেখলো, আমাকে কোনোভাবেই ফজর থেকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না, তখন রাতের বেলা আমার জন্যে হরেক পদের ব্যস্ততার ডালি নিয়ে এসে হাজির হোল। উদ্দেশ্য, আমি যেন অনেক রাত করে ঘুমাই, আর ফজরে কোনরকম যদি উঠিও, পূর্ণ মনোনিবেশের সাথে যেন ফজর আদায় না করতে পারি। আমি তার এই ফন্দি প্রথমে না বুঝে অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছি। ভাবলাম, অ্যালার্ম ক্লক আছে, আমিও আল্লাহর উপর ভরসা রাখি, মাসজিদও কাছে বিধায় আযান কাছ থেকে শোনা যায়, অতএব জাগ্রত হওয়া নিয়ে আমার তো কোনো দুশ্চিন্তা নেই। আসলেই জাগ্রত হওয়া নিয়ে আমার কোনো সমস্যা হয় নি। কিন্তু ক্ষতি যে জায়গায় হয়ে গেলো, সেটা হোল, আমি পূর্ণ হক আদায় করে ফজরে শামিল হতে পারছিলাম না। সালাতে দাঁড়ালে চোখের পাতা লেগে আসতে চায়, ইমামের কিরাআত মনোযোগ দিয়ে শোনার ধৈর্য ক্রমশ কমে আসে, কোনরকম সালাত শেষ করে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচি! কিন্তু শাইত্বান আর কতদিন পার পাবে? চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন। আমি ঠিকই হাতেনাতে ধরে ফেললাম তার ফন্দি। আমাকে কুরআন স্মরণ করিয়ে দিলো:
ﻭَﺇِﺫَﺍ ﻗَﺎﻣُﻮﺍ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﺼَّﻠَﺎﺓِ ﻗَﺎﻣُﻮﺍ ﻛُﺴَﺎﻟَﻰٰ
“আর তারা যখন সালাতে দাঁড়ায়, তখন আলসেমির সাথে দাঁড়ায়” [সূরা আন-নিসা: ১৪২]
.
সারে সব্বনাশ! এই রুকূর আয়াতগুলো তো মুনাফিকদের চরিত্র বর্ণনায় অবতীর্ণ হয়েছে! তবে কি আমিও তাদের একজন হয়ে যাচ্ছি? এদ্দিন তো তাদের কাতারে ছিলাম ফজর ত্যাগ করার মাধ্যমে। এখন দেখছি ফজর আদায় করেও তাদের একজন হয়ে যাচ্ছি! কারণটা কী? কারণটা আর কিছু নয়, আমি পূর্ণ মনোনিবেশ ও যথাযথ আন্তরিকতা নিয়ে সালাতে দাঁড়াচ্ছি না।
.
কিন্তু এই অভ্যাস ছাড়তেও দেরি হতে লাগলো। আজ নয় আগামীকাল, এই তো কালকে থেকেই ছাড়বো… এভাবে করতে করতে আমার আর রাত জাগা বন্ধ হচ্ছিলো না। এই চিন্তার আলস্যকে এক ঘা দিয়ে বিদায় না করতে পারলে সমূহ বিপদ! আল্লাহর রাসূলের সাহাবী কা’ব ইবন মালিক (র) এভাবেই তো পিছিয়ে পড়েছিলেন একবার! তাবুক যুদ্ধে সৈন্যবাহিনীর সাথে তিনি বের হন নি। দেরি করছিলেন। এখন নয়, একটু পরে। আজকে নয়, কালকে। সৈন্যবাহিনী তো ধীরগতিতেই আগাচ্ছে, আর আমি তাগড়া যুবক, সঙ্গে আছে তেজী ঘোড়া, কাজেই, যখনই বের হই, আমি তাদের সাথে মিলিত হবো। তারপর কী হোল? একদিন গেলো, দুইদিন, তিনদিন, চারদিন… সৈন্যবাহিনী অনেক দূরে চলে গেলো, তাঁরও আর যুদ্ধে যাওয়া হোল না। ফলাফল? আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ( ﷺ ) অসন্তুষ্টি। এই ঘটনা আমাকে তাড়না দিতে লাগলো, ‘যা করার আজ থেকেই শুরু কোর! কালকে করবো বলে দেরি করার অর্থই হচ্ছে অনিশ্চয়তার দিকে নিজেকে ঠেলে দেয়া।’
.
তারপর থেকে আমি ডিটারমাইন্ড। সেদিন থেকেই আর কখনো অধিক রাত পর্যন্ত জাগি না। ছোটবেলায় ইশকুলে পড়া ‘আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ / মেইক অ্যা মেন হেলদি অ্যান্ড ওয়াইজ’ ছড়া খুব মনে পড়তে থাকে। পরিমিত ঘুম যাতে হয়, এমন সময় হিসেব করে ঘুমিয়ে যাই। আয়াতুল কুরসী তো মায়ের কোল থেকেই পাঠ করে আসছি, এখনো বাদ যায় না। সূরা ফালাক্ব আর নাস পড়ে, হাত দিয়ে গায়ে পরশ বুলিয়ে ডান কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি আল্লাহর নামে। মুয়াজ্জিনের আযানের সাথে সাথে আবার জেগে উঠি। ধীরেসুস্থে অযু করি। সময় থাকলে দুই রাকাত সুন্নাত বাসা থেকেই আদায় করে মাসজিদের উদ্দেশে রওনা হই। খোলা বাতাসে আমার কণ্ঠ খলখল করে ওঠে। মায়ের কাছে শেখা সূরাগুলো বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকি। পবিত্রতার আবেশ জড়ানো অনুভূতি আর জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার আনন্দ মিলে আমার ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। নিজের অর্জিত পাপগুলোর কথা ভেবে চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে কখনো কখনো। তবুও ভরসা পাই, এমন জায়গায় নিজেকে সমর্পণ করতে যাচ্ছি, শত অপরাধ সত্ত্বেও যিনি বান্দাহকে কাছে টেনে নেন। ভোরের পাখিগুলো ঘুমের পাড়া জাগাতে শুরু করে। কখনো মনে হয়, আমার খলখল করা কণ্ঠের সাথে ওরাও একাত্ম হতে চাইছে। গলির মোড়ে ইলেক্ট্রিকের খাম্বায় দুইটা শালিক-সদৃশ পাখি হঠাৎ নজরে পড়ে। আমি ওদের দিকে তাকাই, আমার বন্ধু নজীবের ছড়াটা মনের ভেতর নতুন কোনো দ্যোতনার সৃষ্টি করে:
“বুকের খাতায় খুব যতনে / একটা স্বপন আঁকি
ফিরদাউসের ফুল বাগানে / আমি হবো পাখি।”
.
আমি পথ চলতে থাকি। মাসজিদের কাছে এসে পথ শেষ হয়। ভুল দেখছো, এই পথের শেষ এখানে নয়। এই পথ ফিরদাউসের স্বর্ণালী তোরণদ্বার পর্যন্ত প্রলম্বিত। আমি সেই পথেই হাঁটছি। তুমি যাবে আমার সাথে?

 

বৈচিত্র্য: তারিক মেহান্না

 

বসন্তের প্রথম দিনটিতেএই কামরার বাইরে পা রেখে দেখুন, দেখবেন বাহিরের দৃশ্যটা বড়ো অদ্ভুত: মাথার ওপর তাকিয়েআপনি লক্ষ কোটি মাইল দূর থেকে ছুটে আসা সূর্যের কিরণরশ্মি দেখতে পাবেন। কিন্তু যে পৃথিবীরবুকে আপনি দাঁড়িয়ে, সেই পৃথিবীটার চিত্রই আপনার নজরে পড়বে না, কারাগারের উঁচু প্রাচীরগুলোতাকে আপনার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে ফেলবে।

 

মানুষ কীভাবে দেখে? কয়েকশতহাজার বছর আগে, ইরাকের এক গণিতবিদ ইবন আল হাইসাম, এ প্রশ্নের জবাবে তাঁর কিতাব আল মানাযির(Book of Optics)-এ বলেছিলেন, আমরা দেখতে পাই কারণ আলোকরশ্মি বস্তুর ওপর থেকে প্রতিফলিতহয়ে আমাদের চোখে প্রবেশ করে। তবে যে যুগে তিনি এ কথা লিখেছেন, তখন পশ্চিমের বেশিরভাগচিন্তাবিদের ধারণা ছিল তার উল্টো: আমাদের চোখ থেকে আলোকছটা বের হয়েই নাকি বস্তুর ওপরপড়ে! কালের পরিক্রমায় ইবন হাইসামের কথাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান দেখিয়েদিয়েছে, আমরা যা দেখি তা চারপাশের বস্তু থেকে আসা প্রতিফলিত আলোর কারণেই দেখতে পাই।চক্ষুগোলকের ভেতরে ও চারপাশে রেটিনা নামের যে পাতলা আবরণী আছে, তাতে আছে লক্ষ লক্ষসংবেদনশীল কোষ; যেগুলো প্রতিফলিত আলোকে শোষণ করে নেয়, এরপর সেগুলোকে তড়িৎ প্রবাহেপরিণত করে মস্তিষ্কে পাঠায়। বাকি কাজ মস্তিষ্কের। এইসব তড়িৎ প্রবাহকে সাজিয়ে-গুছিয়ে“রঙিন চিত্র” হিসেবে আমাদের সামনে হাজির করে। এই হলো আমাদের দেখতেপাওয়ার প্রক্রিয়া। আল্লাহ তা’আলা “পৃথিবীতেযেসব রঙ-বেরঙের বস্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন…” [১৬:১৩]সেসব আমরা এভাবেই দেখতে পাই।
যদিও বসন্তের রঙিন সমাহারএখান থেকে নজরে আসে না, কিন্তু এই যে রঙের অস্তিত্ব, এই বিষয়টা দু’-একটি গুঢ় রহস্যউন্মোচন করে দেয় ঠিকই। কিছুক্ষণ আগেই একটি আয়াত উল্লেখ করেছি। ঐ একই সূরার আরও গভীরেআছে মৌমাছির উদরস্থ মধুর কথা। আল্লাহ বলেছেন, “তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয়নির্গত হয়…।” [১৬:৬৯] এই মধুও নানা রঙের হয়। সাদা থেকে শুরু করে গাঢ় বাদামী(amber) – এক এক গাছের রস থেকে তৈরি হয় এক এক জাতের মধু।

 

আবার এই গাছগাছালিরও কতোরঙ! আল্লাহ তা’আলা প্রশ্ন করেন,

“তুমি কি দেখোনি যে, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণকরেছেন, অতঃপর সে পানি যমীনের ঝর্ণাসমূহে প্রবাহিত করেছেন, এরপর তদ্বারা বিভিন্ন রঙেরফসল উৎপন্ন করেছেন?” [৩৯:২১]
কুরআনের অন্যখানে তিনিজানতে চাইলেন,

“তুমি কি দেখোনি আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টিবর্ষণ করেন, অতঃপর তদ্বারাআমি বিভিন্ন বর্ণের ফল-মূল উদগত করি? পর্বতসমূহের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বর্ণের গিরিপথ- সাদা, লাল ও নিকষ কালো কৃষ্ণ। অনুরূপ ভাবে বিভিন্ন বর্ণের মানুষ, জন্তু, চতুষ্পদপ্রাণী রয়েছে…” [৩৫:২৭-২৮]

মহাবিশ্বের মত প্রায় অসীমএক উদাহরণের পাশেই আল্লাহ রব্বুল আল আমীন রং আর ভাষার মত সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে চিহ্নবা নিদর্শন হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে হচ্ছেমহাকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি, আর তোমাদের ভাষা ও তোমাদের বর্ণের বৈচিত্র্য…”[৩০:২২]

ওপরের প্রত্যেকটি আয়াতেযেখানেই রঙের অস্তিত্বের কথা এসেছে, একে যুক্ত করা হয়েছে জ্ঞানের সাথে। আয়াতগুলোরশেষ হয়েছে এভাবেই – “সেগুলোতে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্যে যারা চিন্তা-ভাবনাকরে”, “নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন রয়েছে”,”নিশ্চয়ই এতে বুদ্ধিমানদের জন্যে উপদেশ রয়েছে”, “আল্লাহর বান্দাদেরমধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে”। দশজনের কাছে এগুলো কোন চিন্তার উদ্রেক করেনা; কিন্তু জ্ঞানী লোক মাত্রই বুঝবেন – প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে রঙের এমন বৈচিত্র্যথাকার অন্তর্নিহিত অর্থ কী। উম্মাহর এক ক্ষুদ্র বিভাগ – ত্বইফা আল মানসুরা, আর এই ক্ষুদ্রঅংশের মাঝেও বৈচিত্র্য রয়েছে – সাদা বর্ণের চেচনিয়ান থেকে শুরু করে কালো বর্ণের নাইজেরিয়ান,আর এ দুইয়ের মধ্যবর্তী সব রঙের মানুষ বিদ্যমান, অথচ তারা সবাই সেই এক আদি নারী ও একআদি পুরুষেরই বংশধর। উস্তাদ আশ-শাওকানি বলেছিলেন, “পুরো মানবজাতি কেবল এক নারীও এক পুরুষ থেকে আগত, এবং একটি সাধারণ জাতি (মানবতা) ও একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের (কথাবলার ক্ষমতা) দ্বারা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু মানুষ একে অপরের থেকে এতোটা স্বতন্ত্রহয়ে যায় যে, পৃথিবীর কোন দুটি মানুষ সম্পূর্ণরূপে একরকম হয় না, বরং প্রত্যেকের মাঝেইএমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা তাকে অন্যদের থেকে পৃথক করে। এই বিষয়টির মাঝে অনন্য একসৃজনশক্তির প্রকাশ ঘটেছে। আর এটা তারাই বুঝবে যারা চিন্তাশীল।”

 

যারা চিন্তা করে, প্রকৃতিররূপ-লাবণ্য আর মানবজাতির সৌন্দর্য্যের বিষয়টিও তাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। চিন্তাশীলদেরকেএই সৌন্দর্য্য কতোখানি নাড়া দেয়, তা নবীজি (সা) এর সহীহ হাদীস থেকেই বোঝা যায়। মি’রাজেরহাদীসে এসেছে, “(মিরাজের সময়) আমি সায়্যিদিনা ইউসুফের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম,আর তাকে দেখে বুঝতে পারলাম সমস্ত সৌন্দর্য্যের অর্ধেক তাকে দেওয়া হয়েছে।” সায়্যিদিনাইউসুফ এতো সুপুরুষ ছিলেন যে সাহাবী ইবন মাসউদ তাঁর চেহারাকে একটি ঝলমলে আলোর সাথে তুলনাকরেন। তিনি বলেন, “তাঁর চেহারা এতো অপূর্ব ছিল যে কোন নারী জরুরি দরকারে তাঁরকাছে হাজির হলে তিনি মুখ ঢেকে ফেলতেন, তিনি এই ভয় পেতেন যে নারীরা তাকে দেখে ফিতনায়পড়ে যাবে।” আর সত্যিই, যখন একদল নারী তাকে দেখলো, তারা বলে উঠলো,

“কখনোইনয়, এ ব্যক্তি মানব নয়। এ তো কোন মহান ফেরেশতা।” [১২:৩১]

আশ-শাওকানি এই আয়াতেরব্যাপারে বলেছেন, “সায়্যিদিনা ইউসুফের মানবীয় দিকটিকে উপেক্ষা করার একটি কারণছিল। কারণটি হলো এই যে, তিনি ছিলেন অসম্ভব মাত্রায় সুপুরুষ। এমন সৌন্দর্য্য মানুষএর আগে কখনও দেখে নি। মানুষের দৃষ্টি এ পর্যন্ত যাকেই দেখেছে, তারা কেউ তাঁর সৌন্দর্য্যেরধারেকাছেও আসতে পারবে না। আর এই অস্বাভাবিক সৌন্দর্য্যের দরুণ তারা তাকে মানবসমাজেরএকজন না বলে, ফেরেশতাদের একজন হিসেবে বর্ণনা করলো। যদিও তারা কোনোদিন ফেরেশতাকে দেখেনি,তবে তাদের বিচারবুদ্ধি জানান দিচ্ছিল যে ফেরেশতারা মানবজাতির চাইতে রূপে, গুণে ও অন্যান্যসকল দিকেই উন্নত।”

স্বয়ং নবীজিকে বর্ণনাকরার সময়ে আল-বারা’যি ‘আযীব বলেছিলেন, “আমি তাঁর চেয়ে বেশি সুন্দর আর কিছুইদেখিনি।”

তেমনি নবীজিও লক্ষ রাখতেনযেন তাঁর সাহাবিয়্যাতকে দেখতে সুন্দর লাগে। সহীহ হাদীসে এসেছে, তিনি নিজে আবদুর রহমানবিন আউফকে কালো পাগড়ি বেঁধে দিয়েছিলেন, পাগড়ি থেকে চার আঙ্গুল পরিমাণ শিষ ঝুলে ছিল,আর নবীজি বলেছিলেন, “এটাই উত্তম আর দেখতে বেশি সুন্দর।”

একবার নবীজি (সা) সূরাআর-রাহমানের তিলাওয়াত শুনে এক কাফের ব্যক্তি (কাইস বিন ‘আসিম আল-মিনক্বারী) ইসলামগ্রহণ করেন। তিনি এর তুলনা দিয়েছিলেন অঙ্কুরিত তরুর সাথে। তিনি বলেন, “আল্লাহরকসম, সৌন্দর্য্য একে (কুরআনকে) সবদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। এ কোন মানুষের কথা হতে পারেনা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য রব নেই, এবং আপনি আল্লাহর প্রেরিতরাসূল।”
আর তাই নবীজি আমাদের বলেছেন,”তোমরা তোমাদের কণ্ঠের মাধ্যমে কুরআনকে সৌন্দর্য্যমণ্ডিত করে তোল।” আর আরেকটিবর্ণনায় এসেছে, “কুরআনের মাধ্যমে তোমরা তোমাদের কণ্ঠকে সৌন্দর্য্যমণ্ডিত করেনাও।”
বৈচিত্র্য আর সৌন্দর্য্যেরঅভাব কারাগারকে কারাগার বানায়। কিন্তু বন্দী জীবনের এই ধূসর দিনগুলোকে রঙিন করে তুলতেখুব বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না – একটি কুরআনের কপি আর কামরায় মোটামুটি একজন ক্বারীথাকলেই চলে। মুসলিম কয়েদীরা একে অপরের কুরআন শুনে এই বদ্ধ ঘরেও যে অতিপ্রাকৃত সৌন্দর্য্যেরস্পর্শ অনুভব করে, তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না। আমাদের মনে পড়ে যায়- বাহিরের পৃথিবীটায়কুরআনের মাধ্যমে এমন আবেগী হতে পারাটা কতোই না দুঃসাধ্য ব্যাপার!
কুরআনের বার্তাবাহক পর্যন্তএই সৌন্দর্য্যে শরীক হয়েছেন। নবীজির সহীহ বর্ণনায় এসেছে, তিনি যখন জিবরাঈল (আ) কেতাঁর প্রকৃত অবয়বে দেখলেন, তখন তাঁর “ডানাগুলো থেকে বাহারি রঙের রত্ন ঝরে পড়ছিল,যাদের প্রকৃতি শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলাই জানেন।” আরেকটি বর্ণনায় বলা হয়েছে,”তাঁর পালকগুলো রঙবেরঙের মণিমুক্তোয় সজ্জিত ছিল।”
জিবরাঈলোকে তাঁর স্বরূপেদেখার ঘটনাটি ঘটেছিল সিদরাত আল-মুনতাহা নামক স্থানে, যার সৌন্দর্য্য বর্ণনা করতে গিয়েনবীজি বলেছেন, “এরপর তিনি (জিবরাঈল) আমাকে নিয়ে সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছালেন,আর তা এমন সব রঙে রঞ্জিত ছিল যেগুলো দেখে আমি চিনতে পারলাম না!” — এ ব্যাপারটিউল্লেখযোগ্য, কেননা মানুষের চোখ প্রায় এক কোটি রঙকে আলাদা-আলাদাভাবে চেনার ক্ষমতারাখে।
সিদরাতুল মুনতাহার অবস্থানসেই সুদূর ষষ্ঠ আসমানে; কিন্তু আসমানের সৌন্দর্য্য বাড়তে বাড়তে একদম নিচের এই প্রথমআসমানেও এসে পৌঁছেছে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন,

“আমি সর্বনিম্ন আকাশকে প্রদীপমালাদ্বারা সুসজ্জত করেছি; সেগুলোকে শয়তানদের জন্যে ক্ষেপণাস্ত্রবৎ করেছি এবং প্রস্তুতকরে রেখেছি তাদের জন্যে জলন্ত অগ্নির শাস্তি।” [৬৭:৫]

যদি কোন ঔৎসুক দর্শক প্রিজমেরমধ্য দিয়ে এই নক্ষত্ররাজি দেখে, তবে দেখতে পাবে কীভাবে সাদা আলোর বিচ্ছুরণ বিভক্তহয়ে রঙিন আলোর বর্ণালি সৃষ্টি করে। আর যখন নক্ষত্র জ্বলে, এর প্রতিটি পদার্থ পুড়েগিয়ে নিজস্ব রঙের একটি স্বাক্ষর এঁকে যায়। নক্ষত্র থেকে বেরিয়ে আসা এই বর্ণালি দেখেইবিজ্ঞানীরা টের পায় সেই নক্ষত্রের উপাদান ও বৈশিষ্ট্য। আর যেমনি করে আলোর মাধ্যমেরঙের উৎস ও অস্তিত্ব প্রকাশ পায়, তেমনি রঙের দ্বারাই উন্মোচিত হয় আলো ও এর উৎস। কুরআনহলো নূর। “অতএব তোমরা আল্লাহ তাঁর রসূল এবং অবতীর্ণ নূরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকর। তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত।” [৬৪:৮] এবং এর উৎস আল্লাহ। আরআল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বারবার উল্লেখ করেছেন রঙ সৃষ্টির কথা, যাতে করে এর মাধ্যমেআমরা তাঁর সম্পর্কে আরো বিশদভাবে জানতে পারি। নবীজি এ পুরো বিষয়টিকে এক কথায় প্রকাশকরেছেন, “আল্লাহ তা’আলা সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য্য ভালোবাসেন।”

আল্লাহ তা’আলা সৌন্দর্য্যএতো ভালোবাসেন যে এমন একটি ঋতু সৃষ্টি করেছেন, যাকে চিহ্নিত করার মাধ্যমই হলো প্রকৃতিরসৌন্দর্য্য! ইবন রজব বলেন, “বসন্ত বছরের সবচেয়ে সুন্দর সময়। বসন্তে জান্নাতেরমাধুর্যের কথা মনে পড়ে যায়, সেখানকার সুখী জীবনের কথা মনে আসে…। এক সালাফ ছিলেন,যিনি সুগন্ধি গাছপালা ও ফলমূল বেচাকেনার দিন বাজারে হাজির হতেন। তিনি সেগুলোর দিকেতাকিয়ে গভীর চিন্তায়/উপলব্ধিতে ডুবে যেতেন; এরপর আল্লাহর কাছে জান্নাতের দু’আ করতেন।”
বসন্তের শেষদিকে প্রচুরআঙ্গুর ফলে। নবীজি (সা) সালাতুল কুসুফের পর একবার একটা খুতবা দিয়েছিলেন, তখন বলেছিলেন,তিনি জান্নাতের আঙ্গুর ফল ঠিক তাঁর চোখের সামনে দেখতে পেলেন। তিনি সেগুলো ধরার চেষ্টাকরলেন কিন্তু হাত সে পর্যন্ত পৌঁছালো না। উপস্থিত সাহাবীদেরকে তিনি বললেন, “যদিআমি কেবল একমুঠো ভরা আঙ্গুর আনতে পারতাম, তাহলে পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই আঙ্গুরইতোমাদের জন্য যথেষ্ট হতো।” অথচ পৃথিবীর বুকে চাষ করা লক্ষ লক্ষ টন আঙ্গুরের গুরুভাগমদ তৈরির পেছনে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এমনি করে, একটি ফলের মাধ্যমে মানুষ ভিন্ন ভিন্নগন্তব্যে গিয়ে পৌঁছে: কেউ জান্নাতে, আর কেউ জাহান্নামে। আবার, একই উৎস থেকে আগত পানিওআঙুরের মধ্যে নানারকম বৈচিত্র্য এনে দেয়। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

“এবং যমিনে বিভিন্নশস্য ক্ষেত্র রয়েছে – একটি অপরটির সাথে সংলগ্ন এবং আঙ্গুরের বাগান আছে আর শস্য ও খেজুরেরগাছ রয়েছে – একটির মূল অপরটির সাথে মিলিত এবং কতক মিলিত নয়। এগুলো কে একই পানি দ্বারাসেচ করা হয়। আর আমি স্বাদে একটিকে অপরটির চাইতে উৎকৃষ্টতর করে দেই…” [১৩:৪]

অর্থাৎ একই ফল শুধু যেনানান বর্ণের হয় তাই-ই নয়, বরং স্বাদেও নানান রকম হয়ে থাকে।

আর মানুষের বেলায় এই একইসূত্র খাটে। শাইখ হাফিজ আল-হাকামি মা’আরিজ আল ক্বাবুলে লিখেছেন,

“মানুষ তার ঈমানেরস্তর অনুযায়ী দ্বীনের ক্ষেত্রে এক এক রকম পর্যায়ে পৌঁছে। এ কারণেই, কেউ কেউ বাকিদেরতুলনায় উত্তম হয়। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও উচ্চস্তরের মানুষ হলেন দৃঢ় ঈমানের অধিকারী আল্লাহরআম্বিয়াগণ। আর সবচেয়ে নিচু স্তরে রয়েছে তাওহিদে বিশ্বাসী সে সকল লোক, যারা ভালো-খারাপদু’ ধরণের কাজই করে। এই দুই পর্যায়ের লোকের মাঝে রয়েছে আরও বিভিন্ন স্তর ও মর্যাদারঈমানদার ব্যক্তি, যাদের কথা কেবলমাত্র আল্লাহ তা’আলাই জানেন। তিনিই তাদেরকে সৃষ্টিকরেছেন এবং তাদের জন্য রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন।”
শাইখ হাকামি আরো বলেন,”তাদের অন্তরে যেমন ঈমানের পরিমাণ সমান নয়, তেমনি বাহ্যিক ভাবে সেই ঈমানের প্রকাশেওতারতম্য ঘটে। সত্যি বলতে কী, আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলতে পারি যে- তারা সবাই মিলেযদি একই সময়ে একই স্থানে থেকে একটি বিশেষ কাজ করে, সেই কাজের মধ্যেও অনেক ফারাক থেকেযায়!
যেমন, জামাতের সালাত। বাইরেথেকে দেখে মনে হবে- সবাই একইভাবে দাঁড়াচ্ছে, রুকু-সিজদা করছে, উঠছে এবং বসছে। সবাইএকইভাবে তাকবির-তাহমিদ-তাহলীল বলছে, কুরআন পড়ছে। সবার একই সমান গতি, একই মসজিদের একইমামের পিছে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে সালাত আদায় করছে।

কিন্তু আদতে তাদের মাঝেবিস্তর ফারাক বিদ্যমান। কারো জন্য এই সালাত হলো আনন্দের উৎস! তার ইচ্ছে করে যেন এইনামাজ কখনও শেষ না হয়! আর কারো কাছে মনে হয় সে জেলখানার সবচেয়ে দমবন্ধ করা কামরায়আটকা পড়েছে; যতো জলদি নামাজ শেষ হবে, ততো জলদি সে রক্ষা পাবে! তার হয়তো নামাজ ছেড়েচলে যেতে ইচ্ছে হয়, এমনকি জামাতে কেন যে শরীক হতে এলো – এই ভেবেও আফসোস হয়! কেউ আল্লাহরইবাদত করার সময় তাঁর অস্তিত্ব ও ক্ষমতার কথা অনুভব করতে থাকে, এমনভাবে নামাজ পড়েযেন সে আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছে। আর কারো মন এতোটাই বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে যে সে কী বলছে,কী করছে, এমনকি কতো রাকাত নামাজ পড়ছে সেটাও স্মরণ থাকে না। একজন সাধারণ দর্শকের চোখেএসবের কিছুই ধরা পড়ে না। কিন্তু যদি চোখের পর্দা তুলে নেওয়া হতো, তবে সে দেখতে পেতোএকটি কাজের মধ্যেও কতো বৈচিত্র্য, কতো ব্যবধান! আর এ বৈচিত্র্য মহান আল্লাহ তা’আলাছাড়া আর কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়; তিনি প্রত্যেক ব্যক্তিকে দেখেন, পর্যবেক্ষণকরেন ও তার আমলের হিসাব রাখেন; তিনি সব দেখেন ও সব জানেন; কোনকিছুই তাঁর কাছে গোপনথাকে না।”
শাইখ আরো বলেন: “একইব্যাপার জিহাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কখনও দেখা যায়, একই আমীরের নেতৃত্বে একটি দলযুদ্ধ করছে এবং তারা সবাই একই ধর্মের অনুসারী। তারা  একই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে, সমান সমান প্রস্তুতিগ্রহণ করেছে এবং একই ধরণের শক্তির অধিকারী। কিন্তু তাদের মাঝে একজন যুদ্ধ করছে অন্ধআনুগত্যের কারণে; আরেকজন যুদ্ধ করছে লোক দেখানোর জন্যে, যাতে করে সবার কাছে সে সাহসীখেতাব পায়; আর আরেকজন যুদ্ধ করছে যুদ্ধলব্ধ গণিমতের মালামাল লাভের আশায়। তবে, এমনএক ব্যক্তিও আছে, যে লড়াই করছে কেবলি আল্লাহর কালামকে মর্যাদা দেয়ার জন্যে আর এইব্যক্তিই হলো প্রকৃত মুজাহিদ ফি সাবিলিল্লাহ, যে আল্লাহর পথ ব্যতীত অন্য আর কোন পথেযুদ্ধ করে না। এই ব্যক্তির জন্যেই তার প্রত্যেক চলাফেরা, দুশ্চিন্তা ও ক্ষুধা নেক কাজহিসেবে পরিগণিত হবে।

একইভাবে যাকাত, হজ্জ্ব,সৎ কাজে আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধ অর্থাৎ ঈমান থেকে উৎসরিত প্রতিটি কাজের জন্য একই ব্যাপারপ্রযোজ্য। মানুষ এগুলো কাজে তারতম্য করবে, আর কারো কারোটা বাকিদের চেয়ে উত্তম হবে।কার আমল কতো ভালো হবে – তা নির্ভর করবে তার জ্ঞানের মাত্রা এবং ঈমানের দৃঢ়তা দ্বারা।”
তাই বলা চলে এই পৃথিবীটাআসলে বিভিন্ন রকম বর্ণালি আর বৈচিত্র্যের সমাহার মাত্র – আর পরের জীবনটাও ঠিক তাই।শাইখ ইতি টেনেছেন এভাবে-

 

“(ঈমানের) এই স্তরই নির্ধারণ করবে তোমার মৃত্যু কীভাবে হবে।

এই স্তর বলে দেবে কোন অবস্থানে তোমাকে পুনরুত্থিত করা হবে।

এই স্তর বলে দেবে মাওক্বিফে দাঁড়িয়ে তুমি কতোটা ঘর্মাক্ত হবে।

এই স্তর বলে দেবে তোমার আমলসমূহ কেমন হবে আর মীযানে তাদের ওজন কতোখানি হবে।

এই স্তর নির্ধারণ করবে পুলসিরাতে তুমি কতোখানি আলো পাবে।

এই স্তর ঠিক করবে তুমি কতো শীঘ্রই তা পার হতে পারবে – তোমার কর্ম যদি তোমাকে পিছিয়ে দেয়, তখন তোমার বংশ তোমাকে এগিয়ে দিতে পারবে না।

এই স্তরই বলে দেবে, তুমি কতো দ্রুত বেগে জান্নাতের দিকে দৌড়ে যাবে!

এই স্তর ঠিক করবে সেখানে তোমার মর্যাদা কতোটা বৃদ্ধি করা হবে।

এই স্তর নির্ধারণ করবে যেদিন তুমি আল্লাহকে দেখবে, সেদিন তুমি তাঁর কতোটা নিকটে থাকতে পারবে।

এই স্তরই বলে দেবে, জান্নাতে তোমার রাজত্ব কতো বড়ো হবে এবং তুমি সেখানে কী কী উপভোগ করবে।

আর আল্লাহ তা’আলা তাঁর অসীম রহমত ও করুণায় যাকে ইচ্ছা তাকে মর্যাদা দান করেন …”

-তারিক মেহান্না

 

রিদ্দা বা দ্বীন ত্যাগ: কারণ এবং প্রতিকার (তারিক মেহান্নার কিছু উপদেশ)

দ্বীন ত্যাগের মাধ্যমে একজন মানুষ চিরকালের জন্য জাহান্নামের অভিশপ্ত স্থানে ঠাঁই করে নেয়, যদি না সে মৃত্যুর পূর্বে তাওবা করে। দ্বীন ত্যাগ করলে ক্ষতি আর কারো নয়, ক্ষতি তার নিজের। রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম)–এর সময় এমন মানুষও ছিলো যারা তাঁকে সা. সরাসরি দেখেছে,  তাঁর কথা শুনার সৌভাগ্যলাভ করেছে, তাঁর সাথে চলাফেলা করেছে, তাঁর পেছনে সালাত আদায় করেছে, এমনকি এদের মধ্যে কেউ কেউ কুরআন লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পর্যন্ত পালন করেছে–কিন্তু এরপরেও তাদের কেউ কেউ মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল।

 

সুতরাং এরকম সামান্য কোনো ব্যক্তি ইসলামে থাকলো কী থাকলো না–তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। এতে আমাদের লাভ বা ক্ষতি কিছুই হয় না।

 

ইসলাম ছেড়ে চলে যাবার কারণগুলো নিয়ে এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা করাটা বেশ কঠিন, কিছু কিছু ব্যাপার ব্যক্তিগতও বটে। কিন্তু আমি এতোটুকু বলবো যে–এক ধরনের শুষ্ক ইসলাম পালন করার ফলে এই পরিণতি ঘটে। এই বিশেষ ধাঁচের ইসলামচর্চায় ইবাদাত আর আত্মশুদ্ধির জন্য সময় থাকে না। মূল মনোযোগ থাকে খবর পড়ায় আর বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তর্ক করায়। ফলে, রিদ্দা বা দীনত্যাগ তারই অবশ্যম্ভাবী ফল।

 

এই ধারার মানুষদের লেখাগুলোতে আবার চোখ বুলিয়ে দেখুন, দেখবেন আমি ঠিকই বলছি।

 

 

আমরা অনেক সময় কোন ব্যাক্তির বিপ্লবী কথাবার্তা শুনে তাকে “ভালো দ্বীনি ভাই” ভাবা শুরু করি, তখন এমনটা হতে পারে যেআমরা তার বিদ্রোহী চেতনাকে দ্বীনের প্রতি আন্তরিক উৎসাহ ও নিষ্ঠা বলে ভুল করছি। প্রকৃতপক্ষে এমনটা হতে পারে যে ঐ ব্যক্তির জন্য ইসলাম হল শুধুমাত্র “এই মাসের স্পেশাল অফার”।

 

এরকম হওয়ার সবচেয়ে বড় লক্ষণ হলো–তার কথাবার্তা ও দ্বীনি পড়াশোনার মাঝে অন্তর কোমলকারী বিষয়সমূহের নগণ্য উপস্থিত। কখনোই নাফল ইবাদাত না করা এবং ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা হিসেবে অনুধাবন করার চেষ্টা না করাও এর অন্তর্ভূক্ত।

 

এই ধরনের মানুষগুলোকে শুধুমাত্র বিতর্কিত এবং আমোদজনক বিষয়গুলো নিয়ে তর্কে মেতে থাকতে দেখা যায়। কারণ শুধুমাত্র স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজেকে বাকি সবার চাইতে আলাদা প্রমাণ করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই মানুষগুলো ইসলামে প্রবেশ করে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে নয়।

 

তারা পুরোন কথা শুনতে আগ্রহ পায় না, সবসময় নতুন কিছুর জন্য অস্থির হয়ে থাকে। শতকরা ৯৯ ক্ষেত্রে এটাই তাদের ইসলামের ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে উঠার কারণ। এই ধরনের লক্ষণগুলো অন্য যাদেরমধ্যে দেখা যায় তাদেরকে নিয়েও আমার ভয় হয়। খুব বেশী দেরী হয়ে যাবার আগেই নিজে রক্ষা করুন। দ্বীনের মাঝে বিতর্ক আর বিনোদন খোঁজা বন্ধ করুন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার  সম্পর্কে জানতে, তাঁর সম্পর্কে সচেতন হতে চেষ্টা করুন । চেষ্টা করুন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সাথে নিজের সম্পর্ক গড়ে তুলতে।

 

 

কারো কারো কাছে হয়তো এটা একঘেয়ে, বিরক্তিকর মনে হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাই আপনাকে রক্ষা করবে। সবসময় বিতর্কিত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন না, এবং তার বদলে প্রতিদিন চোখ বোলানোর জন্য নিচের বইগুলোকে আপনার টেবিলে স্থান দিন:

 

 

– আল কুরআন

– রিয়াদুস সালেহীন, ইমাম নববী

– আল আদাব আলমুফরাদ, আল বুখারী

– আয যুহদ, ইমাম আহমাদ

 

 

এই বইগুলো শুধুশুধু লেখা হয়নি। এই সিলেবাসটি নিয়মিত ধরে রাখার চেষ্টা করুন। এগুলো নিয়মিত পড়লে আপনার হৃদয়ের চারপাশে একটি দুর্গ গড়ে উঠবে। যখন ফিতনার আঘাত আসবে তখন এই দুর্গই আপনাকে রক্ষা করবে। এবং নিশ্চিত থাকুন আজ হোক, কাল হোক, ফিতনার এই আঘাত এক সময় আসবেই।

 

রাসূলুল্লাহ সা. এর একটি হাদীস আছে যা এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী প্রযোজ্য-

 

 

ইয়াহইয়া ইবনু আইয়ুব, কুতায়বা ও ইবনু হুজর রহ. আবূ হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:

 

 

“অন্ধকার রাতের মত ফিতনা আসার আগেই তোমরা নেক আমলের প্রতি অগ্রসর হও। সে সময় সকালে একজন মুমিন হলে বিকালে কাফির হয়ে যাবে। বিকালে মুমিন হলে সকালে কাফির হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামগ্রীর বিনিময়ে সে তার দ্বীন বিক্রি করে বসবে।”

 

 

[ ইসলামিক ফাউন্ডেশন| সহীহ মুসলিম | অধ্যায়ঃ ১| কিতাবুল ঈমান | হাদিস নাম্বার: 214 ]

 

 

আমরা অত্যন্ত কঠিন এক সময়ে বসবাস করছি। এই সময়ে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরে রাখা জ্বলন্ত কয়লা আঁকড়ে ধরে রাখার মতো–এরকম আরো অনেক কিছুই আমি বলতে পারি, কিন্তু এগুলো আপনারা ইতিমধ্যেই জানেন।

 

আমাদের মূল সমস্যা হল, আমাদের ঈমান ও দ্বীনকে দৃঢ় করার যে ধীর, ক্লান্তিকর এবং কঠিন পথটি আছে, তা আমরা পাশ কাটিয়ে যেতে চাই। অথচ এই পথটিই আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করবে। আমাদের শক্তিশালী করবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের জন্য যে পরীক্ষা রেখেছেন তাঁর জন্য আমাদের প্রস্তুত করবে ।

 

 

ইসলাম প্রকৃত পুরুষদের দীন।এই দ্বীন সংগ্রামের দ্বীন।অধ্যবসায়েরদ্বীন ।ধৈর্যের দ্বীন।এবং পরীক্ষার দ্বীন।

 

 

আপনি অবশ্যই পরীক্ষিত হবেন–এবং একজন প্রকৃত পুরুষ মাত্রই ভালো মন্দ সকল অবস্থা নির্বিশেষে আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকতে পারে। আর যারা নামকা ওয়াস্তে আল্লাহর ইবাদাত করে, তারা বিপদের প্রথম আভাস পাওয়া মাত্র চাপের মুখে নতি স্বীকার করে।

 

এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, আমাদের কারো কারো মনে আমাদের অজান্তেই এক ধরনের গোপন অহংকার কাজ করে। দৃঢ়, স্থির সংকল্প হবার জন্য আমরা আমাদের নিজেদের ওপরই ভরসা করি এবং ভাবতে শুরু করি আমরা বর্তমানে ‘ইলম, আক্বীদাহ, ঈমানের যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছি সেটা সম্ভব হয়েছে আমাদের নিজেদের চেষ্টার মাধ্যমেই। আমি এরকম অসংখ্য ভাইকে দেখেছি, যে তাঁরা কখনো দ্বীন অথবা সুন্নাহ ছেড়ে দেবেন আমি তা কখনো কল্পনাও করিনি– কিন্তু তাই হয়েছে। এবং এরকম হবার মূলকারণ আমাদের এই ধরনের চিন্তাধারা।

 

প্রকৃত সত্য এই যে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাই আপনাকে এই দ্বীন, এই ঈমান দান করেছেন–এবং এটাই শেষ কথা। কিন্তু যখন আপনি নিজেরউপর ভরসা করা শুরু করবেন, এবং দ্বীন পালন করতে সক্ষম হবার জন্য গোপনে নিজেকে কৃতিত্ব দেওয়া শুরু করবেন–তখন আল্লাহ আপনাকে আপনার নিজের রাস্তাতেই ছেড়ে দেবেন। আর নিজের দৃঢ়তা, স্থিরসংকল্পতার জন্য যখন আপনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবেন–তখন শেষ পর্যন্ত তিনিও আপনার সাথে থাকবেন।

 

এই কারনেই রাসুলুল্লাহ সা. সব চেয়ে বেশী যে দুআটি করতেন তা হলো, “ইয়া মুক্বলিব্বাল ক্বুলুব, ছাব্বিত ক্বলবি ‘আলা দ্বীনিক”–আল্লাহ যেন তাঁর হৃদয়কে দ্বীনের ওপর দৃঢ় রাখেন। ঈমানের প্রশ্নে আমরা সকলেই আল্লাহর রহমতের উপর নির্ভরশীল। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, অনেকেই আন্তরিকভাবে নিয়মিত এই দুআ করেনি। তারা তাদের অন্তরের এই গোপন অহঙ্কার আর ঔদ্ধত্যের কারণেই এই অবস্থায় [রিদ্দা] উপনীত হয়েছে।

 

এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক মুরতাদের পরিবর্তে এক হাজার নও মুসলিম ইসলামে প্রবেশ করে। যেইদিন আমরা নিশ্চিত হলাম যে এক ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করেছে, সেই একইদিনে আমি মসজিদে বসে ৫৫ বছর বয়স্ক একজন হিস্পানিক ব্যক্তিকে শাহাদাহ গ্রহন করতে দেখেছি।

 

তাই মনে রাখবেন যখন কেউ মুরতাদ হয়ে যায়–তখন যা ক্ষতি হবার তার পুরোটাই তার–আমাদের না।

 

আমাদের কাজ হলো আমাদের হৃদয়গুলোকে দূর্গে পরিণত করা। কারণ যে বৈরী ও কষ্টকর সময়ে আমরা বসবাস করছি এবং সামনে যে ফিতনা আসছে–এটিই হল তার মোকাবেলা করার একমাত্র উপায়।

-তারিক মেহান্না

 

দা”ঈদের প্রতি নাসিহা

 

এই লেখাটি পড়ার আগে প্রথমে আংকেল টম বলতে কি বোঝানো হয় তা জেনে নেওয়া দরকার। আংকেল টম বলতে হীনমন্য প্রজাতির দাসভাবাপন্ন, বিনয়বিগলিত, সেবাপ্রদানে-তৎপর এক চরিত্রের দিকে নির্দেশ করা হয় যে কিনা শাসকশ্রেণীর প্রতি অতিমাত্রায় অনুগত। ঐতিহাসিকভাবে এটি একটি কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্র যে নিজেদের নীচু জাত এবং সাদাদের উঁচু জাত মনে করে এবং তাদের চাটুকারিতায় লিপ্ত থাকে।

——————————–

 

তারিক মেহান্নার কাছে প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম, আমার আগের প্রশ্নটির বিশদ উত্তর দেয়ার জন্য আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন। কিন্তু আমি আপনার কাছে আরো কিছু বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা আশা করছি। আপনি আগের প্রশ্নের জবাবে পশ্চিমা দেশের অনেক দা’ঈ কে আংকেল টম হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আপনার এ কথার সূত্র ধরে বলতে চাই, বর্তমান সময়ে এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে দা’ঈরা জেলে যাবার ভয়ে কথা বলতে চান না। হিকমাহর সাথে এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কীভাবে কথা বলা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন? … আর যারা এসব ব্যাপারে কথা বলতে ভয় করে তাদের আসলে করণীয় কী?

 

তারিক মেহান্নার উত্তর:

প্রথমত, আমি এই ব্যাপারে আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করি যে, কেবলমাত্র ভয় পায় বলে এই দা’ঈরা সত্য কথা বলা থেকে বিরত থাকে। কেউ যদি ইসলামের কথা বলতে ভয় পায়, তাহলে সে চুপ করে থাকবে, ব্যস! কিন্তু আমরা যখন দেখি আংকেল টম নীরবতা ভঙ্গ করে ‘অতি উদ্যোগী’ হয়ে ইসলামকে কাটছাঁট করে নখদন্তহীনভাবে মানুষের সামনে ইসলামকে উপস্থাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, এবং সেটা সে করছে ইসলামের শত্রুদের সাথে এক টেবিলে বসে, তখন আমরা বুঝতে পারি, নিছক ভয়ের কারণে সে এমনটি করছে না, বরং সমস্যার মূল আরো গভীরে। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, ইসলামের উপর আদর্শিক আক্রমণ নতুন কোনো ঘটনা নয়, বরং সেটা হয়ে আসছে বেশ কয়েক শতক জুড়েই, এবং প্রত্যেক আক্রমণের জবাবে আলিমদের কাছ থেকে তিনটি ভিন্ন ধরনের সাড়া মিলেছে।

 

  • প্রথম দল, এরা এই আক্রমণের মুখে কার্যত নতি স্বীকার করেছে। আক্রমণকারী কাফের সভ্যতার চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যে এরা বিমুগ্ধ হয়ে নিজেদের আত্মা ও মন পুরোপুরি বিকিয়ে দিয়ে মানসিক দাসে পরিণত হয়েছে। ফলে তারা কাফেরদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামকে বুঝাতে চেষ্টা করেছে এবং কাফেরদের ব্যবহৃত পরিভাষা ব্যবহার করে ইসলামকে ব্যাখ্যা করেছে।

 

  • দ্বিতীয় দল, তারা কিছু বিষয়ে আপস করে, কিছু বিষয়ে করে না (‘মানিয়ে চলো’ নীতি)।

 

  • তৃতীয় দলে আছেন এমন কিছু ‘আলিম, যাদের অবস্থান উপরের দুই দলের মতো নড়বড়ে নয়। তারা কোনোকিছুতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। সকল বাধা-বিপত্তি ও চাপের মুখেও তারা অবিচল থেকেছেন।

 

 

কাজেই, আংকেল টমের সমস্যাটি ভয়জনিত নয়, বরং মূল সমস্যা হচ্ছে তার পরাজিত মানসিকতা। সে ইসলামের শত্রুদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আদর্শিক আক্রমণের সামনে পরাভূত হয়েছে। তাই সে এখন মন থেকেই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে। সে এখন চায় সমাজে যেন তার গ্রহণযোগ্যতা টিকে থাকে এবং বিরোধিতার মুখে পড়তে না হয়। এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, আংকেল টম একাকী ঘরে বসে জালিমের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে না পারার যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট!! না, তার অবস্থা মোটেও এমন নয়! সে মানসিক দাসত্বের বেড়াজালে এতটাই বন্দী যে, সে জালিমকেও আর জালিম মনে করে না, উল্টো জুলুমের জন্য সে নিজেকেই দায়ী করে এবং জালিমের মন যুগিয়ে চলতে চায় (Stockholm syndrome)!

 

এসব লোকদের করণীয় কী জানতে চেয়ে আপনি যে প্রশ্নটি করেছেন সে প্রশ্নটি তাদের জন্য খাটেই না! আপনি ধরেই নিচ্ছেন তারা কিছু একটা করতে চায়! মনস্তত্ত্বের ভাষায়, বহু আগেই তারা হার মেনে নিয়েছে। যে বিষয়ে প্রশ্ন এবং বাস্তবিক আলোচনার অবকাশ আছে তা হলো, আমরা যারা হার-না-মানা দলের পথ অনুসরণ করতে চাই, যারা উম্মাহকে পুনর্জীবিত করতে চাই, তাদের এ মুহূর্তে কী করণীয়? বিশেষভাবে, আমরা যারা পশ্চিমা দেশে বসবাস করছি, তাদের কী করা উচিত যেখানে ভিনদেশি ও আজিব চেহারার এক ইসলাম পালিত হচ্ছে? যখন ইসলাম থেকে সম্মান আর গৌরবের চাদর খুলে ফেলে ইসলামকেই অপমানিত করা হচ্ছে এমন চরম মুহূর্তে আমাদের কী করণীয়?

 

কুরআনে কিছু আয়াত আছে যেগুলো আমাদেরকে গভীর চিন্তার খোরাক দেয়। নির্দিষ্ট করে বললে, মূসা (আ) এবং ফির’আউনের গল্পের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত। এই গল্পটি কুর’আনে সবচেয়ে বেশিবার বর্ণিত, সবচেয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত এবং আমরা যে সময়ে বাস করছি তার সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ। আজকে বিশ্বাসী মুসলিম জাতির অবস্থা তৎকালীন বনী ইসরাইলের মতো। ফির’আউনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আজ মুসলিমদের শোষণ করছে জুলুমবাজ আমেরিকান সরকার। সেদিনের মূসা (আ) এর মতো আজকে প্রয়োজন একজন মুসলিম নেতার যার দায়িত্ব হবে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করা ও তাদেরকে ইসলাম শিক্ষা দেওয়া, একই সাথে জালিমদের শিক্ষা দেওয়া ইসলাম কী। আসুন আমরা দেখি, আল্লাহর প্রেরিত একজন নবী, একজন সুদক্ষ এবং কুশলী দা’ঈ হিসেবে মূসা (আ) তার উম্মাহকে নিয়ে এই কঠিন পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিয়েছিলেন।

 

 

# প্রথমেই লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, মূসা (আ) এর কাছে ইসলামের “ওয়ালা” এবং “বারা” এ দুটো ধারণা ছিল স্ফটিকস্বচ্ছ। ফির’আউন এবং মূসা (আ) এর সম্পর্কের দিকে লক্ষ্য করুন, কোনো লুকোচুরি বা রাখঢাক নেই, কে কোন পক্ষে আছে – সেটা নিয়ে কোনোরকম অস্পষ্টতা নেই। দুটো দলকে মোটা দাগে পৃথক করা হয়েছে। মূসা (আ) ফির’আউন এবং ফির’আউনের দলভুক্ত সকলকে বনী ইসরাইলের স্পষ্ট ও প্রকাশ্য শত্রুরুপে চিহ্নিত করেছেন। বনী ইসরাইলকে আশ্বস্ত করে মূসা (আ) বলছেন,

 

”হতে পারে তোমাদের প্রভু তোমাদের শত্রুদের ধ্বংস করবেন, আর অচিরেই তোমাদেরকে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন” [সূরা আরাফ:১২৯]

 

ফির’আউনের বিরুদ্ধে করা আগ্রাসী দু’আ থেকে মূসা (আ) এর বৈরী মনোভাব আরও পরিষ্কার হয়।

 

‘আর মূসা বললেন — ”আমাদের প্রভু! নিশ্চয় তুমি ফিরআউন ও তার পরিষদবর্গকে এই দুনিয়ার জীবনে শোভা-সৌন্দর্য ও ধন- দৌলত প্রদান করেছ, যা দিয়ে, আমাদের প্রভু! তারা তোমার পথ থেকে পথভ্রষ্ট করে। আমাদের প্রভু! বিনষ্ট করে দাও তাদের ধনসম্পত্তি, আর কাঠিন্য এনে দাও তাদের হৃদয়ের উপরে, তারা তো বিশ্বাস করে না যে পর্যন্ত না তারা মর্মন্তুদ শাস্তি প্রত্যক্ষ করে  [সূরা ইউনুস:৮৮]

 

অথচ মূসা (আ) এর কাহিনী বর্ণনা করে আল্লাহ বলেছেন,

 

“অতঃপর ফির’আউন পরিবার মূসাকে কুড়িয়ে নিল, যাতে তিনি তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হয়ে যান। নিশ্চয় ফির’আউন, হামান, ও তাদের সৈন্যবাহিনী অপরাধী ছিল।” [সূরা ক্বাসাস:৮]

 

ফির’আউনের প্রতি মূসা (আ) যে ধরনের মনোভাব ও মানসিকতা পোষণ করতেন সেটা বোঝা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শত্রুর প্রকৃত পরিচয় নিয়ে যদি সুস্পষ্ট ধারণা না থাকে, তাহলে নিজেকে এবং নিজের উম্মাহকে শত্রুর ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সুপরিকল্পিত কোন কৌশল গ্রহণ করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। এ কারণেই কুর’আনে শয়তানের ব্যাপারে আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন,

 

“নিঃসন্দেহ শয়তান তোমাদের শত্রু, কাজেই তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ কর!” [সূরা ফাতির:৬]

 

আপনার শত্রু কখনোই আপনাকে তার পরিকল্পনা জানতে দেবে না। সে হবে খুব সূক্ষ্ণ, শঠতাপূর্ণ, কূটকৌশলী, স্মিতহাস্য, ধীরস্থির এবং ধূর্ত আপনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপনাকে সে আঘাত করে চুরমার করে দেবে। এমনটা যে কেবল বাস্তব জগতে ঘটবে তা নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেই আপনি মনোবল হারিয়ে পরাজয় স্বীকার করতে পারেন। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের একটা সুপ্রসিদ্ধ কৌশল হল আপনার শত্রু আপনাকে বোঝাবে যে, সে আপনার শত্রু নয় বরং বন্ধু। যেন আপনাকে ব্যবহার করে আপনার বন্ধু অর্থাৎ তার আসল শত্রুকে দমন করতে পারে। এই ফাঁদে পা দেয়ার অর্থই হলো নিজেদেরকে রক্ষা করার শেষ সুযোগটুকুও হারানো। অধিকন্তু, আপনার ভাই ও বোনদের দিকে বিশ্বস্ততার হাত না বাড়িয়ে সে হাত কাফিরদের সাথে মেলানো হলো মুনাফিক্বদের বৈশিষ্ট্য।

 

“এরা (মুনাফিক্বরা) দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলন্ত; এদিকেও নয় ওদিকেও নয়…” [সূরা নিসা:১৪৩]

 

কাজেই নিজে বাঁচতে এবং উম্মাহকে বাঁচাতে সর্বপ্রথম ধাপটি হচ্ছে ওয়ালা’ এবং বারা’ এর ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করা যেন আপনি শত্রুকে বন্ধু ভেবে গুলিয়ে না ফেলেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমান সময়ে বিশেষ চিন্তার দাবি রাখে।

 

 

# দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি আমাদের খেয়াল করতে হবে তা হলো, “মৌলবাদ”, “চরমপন্থা”, “সন্ত্রাসবাদ”, “উগ্রবাদ” – যত্রতত্র এসকল শব্দের অসতর্ক ব্যবহার। এই শব্দগুলো ধোকাঁবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। গণমানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখাই এসকল শব্দচয়নের উদ্দেশ্য। মূসা (আ) কে ফির’আউন রুখে দিতে চেয়েছিল “চরমপন্থা দমন” এর নামে!

 

“আর ফিরআউনের লোকদের প্রধানরা বললো -“আপনি কি মূসাকে ও তার লোকদের ছেড়ে দেবেন দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে এবং আপনাকে এবং আপনার দেবতাদের পরিত্যাগ করতে?”[সূরা আরাফ:১২৭]

 

ফির’আউন বলল; তোমরা আমাকে ছাড়, মূসাকে হত্যা করতে দাও, ডাকুক সে তার পালনকর্তাকে! আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে অথবা সে দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে” [সূরা গাফির: ২৬]

 

এবং ফির’আউন নিজেকে প্রগতিশীল, সুশীল এবং উদারপন্থী হিসেবে দাবি করতো !

 

“ফির’আউন বলল, আমি যা বুঝি, তোমাদেরকে তাই বোঝাই, আর আমি তোমাদেরকে মঙ্গলের পথই দেখাই” [সূরা গাফির:২৯]

 

কিন্তু মূসা (আ) যে দিকে মানুষকে আহবান করছিলেন সেটিকে বোঝাতেই মূলত ফির’আউন এই শব্দগুলোর (ফিতনাবাজ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারী) অবতারণা করেছিল। কারণ মূসা (আ) অবস্থান নিয়েছিলেন ফির’আউনের বিরুদ্ধে। যেসব মিশরীয় মূসা (আ) এর ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের কথা থেকে আমরা বুঝতে পারি ফির’আউন কি বুঝাতে চেয়েছিল। তারা বলেছিল:

 

“বস্তুতঃ আমাদের সাথে তোমার শত্রুতা তো এ কারণেই যে, আমরা ঈমান এনেছি আমাদের পরওয়ারদেগারের নিদর্শনসমূহের প্রতি যখন তা আমাদের নিকট পৌঁছেছে।” [সূরা আরাফ:১২৬]

 

ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটু থেমে এই আয়াতটি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত। ফির’আউন সকলের সামনে মূসার এমন একটি চরিত্র উপস্থাপন করতে চেয়েছিল যাতে মনে হবে মূসা একজন রক্তচোষা বিকারগ্রস্ত লোক, যে সমাজে ফিতনা-ফাসাদ করতে চায়! কিন্তু আমরা কুর’আনে দেখতে পাচ্ছি এমন কিছু মুসলিম ছিলেন যারা ফির’আউনের এই মিডিয়া ক্যাম্পেইনে প্রলুব্ধ হয়নি। তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন মূসা (আ) সত্য বলছেন, আর ফির’আউন মিথ্যা। তারা জানতেন ফির’আউন মৌলবাদ, ধর্মীয় চরমপন্থা কিংবা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না, বরং মূসা (আ) এর আহবান অর্থাৎ ইসলাম থেকে লোকজনকে দূরে সরিয়ে রাখতে এই ধরনের স্পর্শকাতর শব্দ ব্যবহার করছে। কেন? কারণ, মূসা (আ) যে বার্তাটি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন তা হলো, আমরা কেবল আল্লাহর কাছে মাথা নত করবো, ফির’আউনের মতো কোনো অত্যাচারী জালিমের কাছে নয়। যে মানুষগুলোকে ফির’আউন এতকাল মানসিক দাসত্বের বেড়াজালে বন্দী করে রেখেছিল তাদের মনে মূসার (আ) এই কথাগুলো গৌরব, মর্যাদা এবং আত্মসম্মানের একটি চেতনা সৃষ্টি করে।

 

আর আজকেও আমরা দেখছি ইসলামের যেসব ভাবনা মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করবে, ইসলামের যেসব চেতনা ও উপলব্ধি মানুষের সামনে মুক্তির দুয়ার উন্মোচিত করবে, সেইসব বিষয়গুলোর সাথে খুব অপ্রীতিকর লেবেল জুড়ে দিয়ে নেতিবাচকভাবে গণমানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়। তাই “ওয়ালা এবং বারা” হয়ে যায় ‘মৌলবাদ’, আত্মরক্ষার জন্য জিহাদের নাম হয় ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘জঙ্গিবাদ’, আর শরীয়াহকে অপবাদ দেওয়া হয় ‘চরমপন্থা’ বলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আপনি দেখবেন আমজনতাও কোনো চিন্তাভাবনা না করেই এসব সংজ্ঞা অবলীলায় গ্রহণ করছে। এমনকি অনেক আলিম এবং দা’ঈ পর্যন্ত তাদের কথায় এবং লেখায় কাফিরদের সাথে তাল মিলিয়ে এসব ‘পরিভাষা’ ব্যবহার করছেন।

 

লেখার শুরুতে আদর্শিক আক্রমণের জবাবে কার অবস্থান কেমন হয় সেটি আলোচনা করেছিলাম। উপরে যাদের কথা বলেছি তারাই হলো সেই প্রথম দল। এরা দাসসুলভ মানসিকতা বহন করে। এই শ্রেণির ‘আলিমরা আজকে তাগুত সরকার আয়োজিত “Counter-radicalism conference” এ গর্বের সাথে যোগ দিচ্ছে! আপনি কী কল্পনা করতে পারেন, মূসা (আ) ফির’আউনের কাছে গিয়ে আর্তি জানাচ্ছেন যেন বনী ইসরাইলকে সুশীল করে গড়ে তোলা হয়, যেন তাদের মধ্য থেকে মৌলবাদের বীজ নির্মূল করা হয়! কিংবা আমাদের রাসূল ﷺ স্পেশাল এজেন্ট আবু জেহেলকে দাওয়াত করে এনেছেন দারুল আরকামে সাহাবীদেরকে “চরমপন্থা দমনে কী করণীয়” তা নিয়ে লেকচার দেওয়ার জন্য? অবশ্যই না! কাজেই আপনাকে মূসা (আ) এর অনুসারীদের মতো সাবধান থাকতে হবে। এ ধরনের শব্দের উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারে প্রতারিত না হয়ে এই শব্দগুলোর ব্যবহার থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন।

 

আরো একটি ব্যাপার নিয়ে চিন্তার অবকাশ রয়েছে। তা হলো, হিকমাহ প্রয়োগ করা এবং নমনীয় হওয়া। আপনি আপনার প্রশ্নে হিকমাহ এর ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। আপনি হয়তো খেয়াল করবেন, এই হিকমাহ গ্রহণ করতে গিয়ে একদল বাড়াবাড়ি করছে, আবার আরেকদল হিকমাহ বর্জন করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। একদল লোক আছে শ্রোতার মেজাজ-মর্জির দিকে থোড়াই কেয়ার করে। শ্রোতার জ্ঞানের মাত্রার প্রতি খেয়াল না রেখে কোনো রাখ-ঢাক ছাড়াই কথা বলতে থাকে। আবার অনেকে হিকমাহ খাটাতে গিয়ে সত্যকেই গোপন করে বসে যার ফলে ইসলামের মর্মকথার নির্যাসটুকুই নষ্ট হয়ে যায় এবং বিকৃত হয়ে যায়। মূসা (আ) এর দিকে দেখুন। এ দুটোর কোনোটিই তিনি করেননি। আমাদের মতো তিনিও ছিলেন সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের মতো তাঁরও দুনিয়াবী শক্তির ক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল। আমাদের মত তাঁকেও এক কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছিল। আর আমাদের মতো, তাঁকে বিশেষভাবে আদেশ করা হয়েছিল যেন তিনি উম্মাহর ব্যাপারে নমনীয়তা অবলম্বন করে।

 

“তোমরা উভয়ে ফেরআউনের কাছে যাও সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে. অতঃপর তোমরা তাকে নম্র কথা বল, হয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে” [সূরা ত্ব-হা:৪৩,৪৪]

 

আবার আপনি যখন অন্য আয়াতগুলোর দিকে তাকাবেন, তখন আপনি মূসা (আ) এর দা’ওয়াহ এর মধ্যে প্রজ্ঞার ছাপ দেখবেন। দা’ওয়াহ এর ক্ষেত্রে নমনীয়তা অবলম্বনের রীতিকে ঢাল বা সেন্সরবোর্ড রূপে ব্যবহার করে মূসা (আ) কখনোই সত্যকে অস্পষ্ট রাখেননি।

 

“আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি সুদৃঢ়…” [সূরা আরাফ:১০৫]

 

শুধু তাই নয়, নমনীয়তা অবলম্বনের মানে এই নয় যে, জুলুম-নির্যাতনের মুখে ভীরু এবং নরম-সরম হয়ে থাকতে হবে।

 

“অতএব তোমরা তার কাছে যাও এবং বল: আমরা উভয়েই তোমার পালনকর্তার প্রেরিত রসূল, অতএব আমাদের সাথে বনী ইসরাইলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে নিপীড়ন করো না। আমরা তোমার পালনকর্তার কাছ থেকে নিদর্শন নিয়ে তোমার কাছে আগমন করেছি। এবং যে সৎপথ অনুসরণ করে, তার প্রতি শান্ত। আমরা ওহী লাভ করেছি যে, যে ব্যক্তি মিথ্যারোপ করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার উপর আযাব পড়বে”।[সূরা ত্ব-হা:৪৭,৪৮]

 

আসুন আমরা এক মিনিটের জন্য থামি এবং এই আয়াতগুলোর দিকে মনোযোগ দিই। এখানে আমরা দেখছি মূসা (আ) একজন নবী, যিনি কোনো ক্ষমতাশালী ব্যক্তি নন, বরং তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানুষদের একজন। তিনি ছিলেন সংখ্যালঘু। বিশ্বের তত্কালীন পরাশক্তির সাথে নম্রতা অবলম্বন করতে আদেশপ্রাপ্ত মূসা তাঁর সংকটাপন্ন উম্মাহকে উদ্ধার করতে তিনটি পদক্ষেপ নিলেন:

 

– তিনি ফিরাউনের অপকর্মের কথা খুব পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করলেন তার জাতির সামনে।

– তিনি খুব দৃঢ়তার সাথে দাবি করলেন যে, ফির’আউনকে অবশ্যই তার দুষ্কর্মের ইতি টানতে হবে।

– তিনি ফির’আউনকে তার দৌরাত্ম্যের জন্য তার অশুভ পরিণামের ব্যাপারে হুমকি দিলেন।

 

আপনি দেখবেন, মূসা (আ) আত্মপক্ষসমর্থন করার চেষ্টা করেননি, কোনো কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করেননি। তাঁর মধ্যে কোনো পরাজিত মানসিকতা ছিল না। তাঁর কথায় কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তাঁর মধ্যে ভীরুতা ছিল না। দুনিয়াবী শক্তির অভাব তাঁর নৈতিক মনোবলে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং তিনি তা-ই বলেছিলেন, যা বলা উচিত, যেভাবে বলা উচিত, এবং যখন বলা উচিত। ইমাম ইবনুল কায়্যিম(রাহিমাহুল্লাহ) হিকমাহকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবেই, “হিকমাহ হচ্ছে উচিত সময়ে, উচিত ভঙ্গিতে, উচিত কথাটি বলা” (মাদারিজ আস-সালিকিন, ২/৪৭৯)।

 

 

মূসা (আ) মিনমিন করে কথা বলেননি। তাঁর কথায় দৃঢ়তা ছিল। তাঁর মধ্যে আত্মমর্যাদার ছাপ ছিল সুস্পষ্ট এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী। ফির’আউনের প্রতিক্রিয়া দেখেই আমরা তা বুঝতে পারি। সে মূসাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘মৌলবাদ‘-বিরোধী কনফারেন্সে আমন্ত্রণ করেনি কিংবা মূসাকে তার সরকারের ‘সন্ত্রাসবাদ দমন বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে যোগ দিতে অনুরোধ করেনি। অথচ আজকে আমেরিকা কিছু স্বেচ্ছায় বিকিয়ে যাওয়া মুসলিম দা’ঈকে তার সাহায্যকারী হিসেবে পাচ্ছে! বরং ফির’আউন চেয়েছে মূসাকে হত্যা করতে, যেমন করে যুগে যুগে এই ফির’আউনদের অপকীর্তি প্রকাশ করে দেওয়ার কারণে মানবাধিকার এবং মুক্তিকামী নেতাদের যুগ যুগ ধরে গুপ্তহত্যা করা হয়েছে। এবং সেই একই ঘটনা ঘটে চলেছে আজ অবধি …

 

আমাদের অধিকাংশই ভীতু। আমরা যেকোনো মূল্যে দুশ্চিন্তা পরিহার করে চলতে চাই। লোকের বিরোধিতার মুখে পড়তে চাই না। আমরা চাই সবাই আমাদের পছন্দ করুক। যদিওবা আমরা কখনো বুঝতে পারি একটা সাহসী পদক্ষেপ নেয়া খুব জরুরী, আমরা সেটা নিতে চাই না, কারণ সেটার ফলাফল নিয়ে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত থাকি। লোকে আমাদেরকে কী ভাববে এবং মিডিয়া আঙ্গুল তাক করবে – এই দুশ্চিন্তায় আমরা কেটে পড়ি। হ্যাঁ, আমরা আমাদের ভীরুতাকে “হিকমাহ” কিংবা “বিচক্ষণতা” বলে চালিয়ে দিতে পারি, কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের মধ্যে যে ভয় আছে তা আমাদের নিজেদের হাতে গড়ে নেয়া অভ্যাস, এটা সহজাত নয়। নিজেকে দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচাবার জন্য আমরা এর আশ্রয় নিই। ভয়কে নিজের জীবন থেকে উপড়ে ফেলুন এবং সাহস দিয়ে একে প্রতিস্থাপিত করুন। ভীরুতার দরুণ আপনাকে যে মূল্য দিতে হবে তা সাহসের জন্য দেয়া মূল্য থেকে অনেক বেশি চড়া।

 

আপনার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে, সুফিয়ান আস-সাওরী, সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে গিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে ব্যর্থ হলে চরম হতাশার চোটে রক্ত প্রস্রাব করতেন। কাজেই, যখন আপনি কিছু বলার সুযোগ পাবেন তখন চুপ করে থাকবেন না। দ্ব্যর্থকতার আড়ালে নিজেকে নিরাপদ অবস্থানে লুকিয়ে রাখবেন না। এতে আপনার কোনোই উপকার হবে না। মূসা (আ) কে অনুসরণ করুন। ধরে ধরে সুনির্দিষ্ট করে নামগুলো উচ্চারণ করুন। আমেরিকান সরকারের নাম বলুন। তুলে ধরুন প্যালেস্টাইন, ইরাক আর আফগানিস্তানের কথা। বলুন বোন আফিয়া সিদ্দিকির কথা। এমন প্রতিটি বিষয় তুলে ধরুন যেন জালেমরা জানতে পারে তাদের কাজকর্ম নিয়ে আমরা কী ভাবছি। এটাকে চরমপন্থা কিংবা মৌলবাদ অথবা উগ্রবাদ বলে না, এটা হচ্ছে সত্যকে কোনো কাটছাঁট না করে যেমন-আছে-তেমন-ভাবে প্রকাশ করে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা

 

আর হিকমাহ মানে নিজেদের দ্বীনকে মানুষের কাছে লুকিয়ে রাখা নয়। আর এই কারণে তো নয়ই যে, দ্বীন ইসলামের কোনো একটি অংশ সমাজের চোখে অপছন্দনীয়, উচ্চারণের অযোগ্য কিংবা অযাচিত বলে ঠেকে। ইসলামিক দা’ওয়াহ এর মূল কথাই হল সত্যকে প্রকাশিত করা, তাকে গোপন করে রাখা নয়।

 

” আর স্মরণ করো! যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের থেকে আল্লাহ্ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন — ”তোমরা নিশ্চয় এর কথা লোকেদের কাছে প্রকাশ করবে, আর তা লুকিয়ে রাখবে না।” [সূরা আলে ইমরান:১৮৭]

 

“নিশ্চয় যারা গোপন করে, আমি যেসব বিস্তারিত তথ্য এবং হেদায়েতের কথা নাযিল করেছি মানুষের জন্য কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করার পরও; সে সমস্ত লোকের প্রতিই আল্লাহর অভিসম্পাত এবং অন্যান্য অভিসম্পাতকারীগণের ও” [সূরা বাক্বারা:১৫৯]

 

যারা কোনো প্রশ্নের উত্তর জানার পরেও নিশ্চুপ থাকাকে শ্রেয় মনে করে, আল্লাহর রাসূল ﷺ তাদের জন্য একটি কঠোর সতর্কবাণী রেখে গেছেন: “যে ব্যক্তি ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার পরে জানা সত্ত্বেও তা গোপন করেছে, ক্বিয়ামতের দিন তাকে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেয়া হবে হোক সে ব্যাপারটি আমাদের দ্বীনের ‘বিতর্কিত’ এবং সমাজের চোখে অযাচিত, অপছন্দনীয়, অনাহূত বিষয়গুলোর একটি। যেমন ধরা যাক জিহাদ। “আমার হাত-পা বাঁধা, আমার কিছু করার নেই” এরকম ভাব করে থাকবেন না। ইসলামে জিহাদের প্রকৃত ধারণাটি কেমন সেটা ব্যাখ্যা করে দিলেই তো পারেন, এমন তো নয় আপনাকে কেউ বলছে খাপখোলা তলোয়ার হাতে রাস্তায় নেমে পড়তে হবে!

 

যারা জানতে চায় তাদেরকে শুধু জানিয়ে দিন: ইসলামের মূলধারার, সর্বজনস্বীকৃত, প্রসিদ্ধ চারটি মাযহাব জিহাদের ব্যাপারে কী বলছে। আপনি যদি সেই তথাকথিত “বাকস্বাধীনতার দেশ” এ পড়ে থাকেন আর এ কথা বলতে ভয় করেন যে, ইসলাম আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার শিক্ষা দেয়, সেক্ষেত্রে আপনার উচিত সেই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও হিজরতের চিন্তা করা, যেখানে অন্তত এই মৌলিক মানবাধিকারের কথা বলার কারণে আপনাকে জেলে ছুঁড়ে ফেলা হবে না। আমাদের এই দ্বীনে এমন কিচ্ছু নেই, কুর’আন বা হাদীস একটা অক্ষরও খুঁজে পাওয়া যাবে না যার জন্য আমাকে বা আপনাকে বিব্রত হতে হবে, লজ্জিত হতে হবে, কিংবা মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করতে ভয় পেতে হবে। সবকিছু বাদই দিলাম, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকানরা যে বিপ্লব করেছিল, যুদ্ধ করেছিল সেটা জিহাদ নয়তো কি? নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে ফ্রেঞ্চরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সেটাকে জিহাদ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়? আর আজকে মুসলিমরা যখন আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়ছে সেটাকে জিহাদ বলতে এত বাধছে কেন?

 

# সবশেষে যে ব্যাপারটি আসে তা হল দা’ওয়াহ এর জন্য কষ্ট এবং যন্ত্রণা ভোগ। এই অজুহাতটি সকলে দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করে এবং যেকোনো কিছুকে জায়েজ করে ফেলে। হ্যাঁ, মূসা (আ) ও বনী ইসরাইলও একটি আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে অবস্থান করছিল এবং সে সময়টা ছিল আমাদের সময় থেকে আরো বেশি ভয়ঙ্কর। মূসা (আ) এবং হারূন (আ) আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন,

 

“তারা বলল: হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আশঙ্কা করি যে, সে আমাদের প্রতি জুলুম করবে কিংবা সীমালংঘন করবে” [সূরা ত্ব-হা:৪৫]

       

“কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের সন্তানসন্ততি ব্যতীত আর কেউ মূসার প্রতি বিশ্বাস করেনি ফিরআউন ও তাদের পরিষদবর্গের ভয়ে পাছে তারা তাদের নির্যাতন করে…” [সূরা ইউনুস:৮৩]

 

“অতঃপর মূসা মনে মনে কিছুটা ভীতি অনুভব করলেন” [সুরা ত্ব-হা:৬৭]

 

তারা কারাবন্দী হওয়ার ভয়ে ভীত হয়েছিলেন।

 

“ফির’আউন বলল, তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর তবে আমি অবশ্যই তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করব” [সূরা শু’আরা:২৯]

 

তারা অত্যাচারিত হবার আশঙ্কা করছিলেন,

 

“ফির’আউন বলল: … আমি অবশ্যই তোমাদের হস্তপদ বিপরীত দিক থেকে কর্তন করব এবং আমি তোমাদেরকে খেজুর বৃক্ষের কান্ডে শূলে চড়াব …” [সূরা ত্ব-হা:৭১]

 

তাদের মধ্যে মৃত্যুভয় ছিল, 

 

“নিঃসন্দেহে ফির’আউন তার দেশে উদ্ধত হয়েছিল এবং সে দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের একটি দলকে দূর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্র-সন্তানদেরকে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত রাখত …” [সূরা কাসাস:৪]

 

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। FBI কিংবা MI5 এর মত গোয়েন্দাসংস্থাগুলো আজ যা করে বেড়াচ্ছে সেগুলোর প্রত্যেকটি কাজের হুমকি আগেও ছিল, এখনো আছে, তবে সত্যি বলতে কি আমাদের সময়টা তুলনামূলক সহজ। চরম আতঙ্কের পরিস্থিতিতে, ফির’আউনের হাতে ভীষণভাবে অত্যাচারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা মূসা (আ) কে জালিমের গড়া ত্রাসের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। তাঁর সাথে আজকের আংকেল টমদের পার্থক্য এই যে, তিনি তাঁর ভয়কে জয় করার জন্য মনঃস্থির করেছিলেন, আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভর করেছিলেন এবং তাঁর সাধ্যে যা ছিল তা করেছিলেন। তাই আল্লাহও তাঁর জন্য সমুদ্রকে দু’ভাগ করে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন।

 

তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে ছিলেন দৃঢ়। তাঁর মতো যারা ছিলেন তাদের জন্যও অন্ধকার সমুদ্র সেদিন দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সিয়ার আ’লাম আল-নুবালা (১০/২৫৭) এ বর্ণিত আছে, নিজের দ্বীন বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানানোর ‘অপরাধে’ কারাবন্দী ইমাম আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন আল-মাওয়ারদি। আল-মাওয়ারদি ইমাম আহমদকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে অনুরোধ করেন। ইমাম আহমদ তাকে বললেন কারাগার থেকে বের হয়ে অমুক জায়গায় যাও এবং ফিরে এসে আমাকে জানাও তুমি কী দেখেছ। আল-মাওয়ারদি সেখানে গেলেন এবং দেখলেন, সেখানে যেন এক সাগর পরিমাণ মানুষ কাগজ-কলম হাতে বসে আছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কী করছো ? তারা উত্তর দিল, আমরা ইমাম আহমদ কী বলেন আমরা সেটা শুনার জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি যা বলবেন আমরা সেগুলো লিখে রাখবো। আল-মাওয়ারদি ফিরে এলেন এবং তিনি যা দেখে এসেছেন তা ইমাম আহমদকে জানালেন। ইমাম আহমদ কারাগারে তাঁর কক্ষ থেকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, তুমি কি চাও আমি এই লোকগুলোকে বিপথে পরিচালিত করি? তিন বছর কারাগারে থাকার পর ইমাম আহমদকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

 

যিনি সত্যিকারের একজন ‘আলিম, একজন মু’মিন, তিনি তার ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশের উপরে সত্যকে অগ্রাধিকার দেন। যখন রাসূল ﷺ আবু বকর (রাঃ) কে সাথে নিয়ে গুহাতে বন্দী ছিলেন, আপনাদের কি মনে আছে তিনি আবু বকরকে কী বলেছিলেন ? তিনি বলেননি, আবু বকর ভয় কোরো না। বরং তিনি বলেছিলেন, “আবু বকর, মন খারাপ কোরো না”, কারণ আবু বকর তার নিজ জীবনের ভয় করেননি। বরং তিনি দেখছিলেন যদি তারা মুশরিকদের হাতে মারা যান তবে ইসলামের এই আহবান, ইসলামের এই দা’ওয়াহ থেমে যেতে পারে। আবু বকর খুব ভালো করে জানতেন, ইসলামের দিকে আহবান করলে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ দুটো ব্যাপার অবিচ্ছেদ্য।

 

ইসলামী দা’ওয়াহর এটিই একমাত্র পথ। কেউ যদি কোনো প্রকার কাটা-ছেঁড়া ব্যতিরেকে নবীদের দা’ওয়াহকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে আগ্রহী হয় এবং একইসাথে সে একটা উপভোগ্য ও নির্বিঘ্ন জীবনের স্বপ্ন দেখে, তাহলে সে ভ্রান্তির জগতে বসবাস করছে। আপনাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। আরাম-আয়েশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে, যত যাই কিছুর মুখোমুখি হতে হোক না কেন। ইতস্তত বোধ করবেন না। ভয় যেন আপনাকে পেছনে টেনে না রাখে।

 

 

আশা করবো, উপরের আয়াতগুলো নিয়ে খুব মন দিয়ে আপনারা চিন্তা ভাবনা করবেন এবং আয়াতের শিক্ষাগুলোকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করবেন। আমাদের কথায় ও লেখায় যেন আমরা মাথা উঁচু করে নিজেদের প্রকাশ করতে পারি।

-তারিক মেহান্না

 

একটি চমৎকার দু’আ

 

আমাদের যখন খারাপ সময় যায় তখন আমরা অনেকেই খুব দ্রুত হতাশ হয়ে যাই। আল্লাহর সাথে “রাগ” করে বসি ! আল্লাহ কেন আমার এমন করলেন ? কেন তিনি আমাকে কষ্টে রেখেছেন ? আল্লাহর থেকে মুখ ফিরিয়ে তখন নিজেকে ভুলে থাকার জন্য হয়তো আমরা কেউ গান শুনি, কেউ ফোনে “ফাইট” দিই, কেউ মুভি দেখে মন ভাল করার চেষ্টা করি !

আমরা জানি, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে তায়েফ থেকে অপমানিত এবং প্রত্যাখাত হয়ে ফিরে আসেন। অত্যন্ত হৃদয় বিদারক সে ঘটনা, তিনি খুব নরম ভাষায় ইসলামের কথা বলছেন আর লোকজন তাকে খুব ঘৃণাভরে তাড়িয়ে দিচ্ছে, কমবয়সী ছেলেরা তার গায়ে পাথর ছুড়ে মারছে। চিন্তা করে দেখুন তো একবার নিজেকে সেখানে ! কত ভয়ংকর সেই সময়টি !

তিনি আয়েশা (রাঃ) কে বলেছিলেন, তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন দুটি দিনের একটি ছিল তায়েফের সেই দিন। একজন রাসূল হয়ে সে কঠিন সময়ে তিনি কিন্তু আমাদের মত হতাশ হয়ে যান নি, কিংবা আল্লাহর সাথে রাগ করেন নি। তিনি আল্লাহর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন নি, বরং আরও বেশি করে তার কাছে ফিরে যেতে চেয়েছেন। নিজের অক্ষমতার জন্য সাহায্য চেয়েছেন।

আমাদের এই কঠিন সময়গুলোতে আমরা কিভাবে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইব সেটা তিনি আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন এইভাবে,

“হে আল্লাহ তা’আলা ,আমি তোমার কাছে আমার দূর্বলতা, অসহায়ত্ব এবং মানুষের কাছে আমার মূল্যহীনতা সম্পর্কে অভিযোগ করছি। দয়ালু দাতা, তুমি দূর্বলদের প্রভু, তুমি আমারও প্রভু, তুমি আমাকে কার কাছে ন্যস্ত করছ ? আমাকে কি এমন কারও কাছে ন্যস্ত করছ, যে আমার সাথে রুক্ষ ব্যবহার করবে ? নাকি কোন শত্রুর হাতে ন্যস্ত করছ যে , যাকে তুমি আমার বিষয়ের মালিক করে দিয়েছ ? যদি তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট না হও তবে আমার কোন দুঃখ নেই, আফসোসও নেই। তোমার ক্ষমাশীলতা আমার জন্য প্রশস্ত ও প্রসারিত কর। আমি তোমার সে সত্ত্বার সে আলোর আশ্রয় চাই, যা দ্বারা অন্ধকার দূর হয়ে আলোয় চারিদিক ভরে যায়। দুনিয়া এবং আখিরাতের সকল বিষয় তোমার হাতে ন্যস্ত। তুমি আমার উপর অভিশাপ নাযিল করবে বা ধমকাবে, যে অবস্থায় তোমার সন্তুষ্টি কামনা করি।সকল ক্ষমতা এবং শক্তি শুধু তোমারই। তোমার শক্তি ছাড়া আর কোন শক্তি নেই।”

“O Allah ! To You alone I complain my weakness, my scarcity of resources, and the humiliation I have been subjected to by the people. O Most Merciful of those who have mercy! You are the Lord of the weak, and You are my Lord too. To whom have You entrusted me ?  To a distant person who receives me with hostility ? Or to an enemy to whom You have gained authority over my affair? But as long as You are not angry with me, I do not care except that Your Favour is a more expansive relief to me. I seek refuge in the light of Your Face by which all darkness is dispelled and every affair of this world and the next is set right, lest Your anger or Your displeasure descends upon me. Yours is the right to reproach until You are pleased. There is no power and no might except by You”

-আবু উমর

 

পতাকা তুলে নাও

 

জীবনে চলার পথে আমরা নানান ধরনের মানুষের সাথে পরিচিত হই।তবে আমরা আমাদের পছন্দসই শ্রেণীর সাথেই বন্ধুত্ব গড়ে তুলি। তাদেরকে নিয়ে,তাদেরকে ঘিরে আমাদের জীবন সাজাই। তাই কুরআন খুললে আপনি দেখতে পাবেন আল্লাহ্‌ আপনাকে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আমরা যেন এইসব শ্রেণীর কার্যক্রম এবং পরিণতি দেখে সঠিক শ্রেণীটির অংশ হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি সেজন্য কুরআনে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বিভিন্ন ধরনের,বিভিন্ন স্বভাবের মানুষের বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।এর উদাহরণ হিসাবে আমরা দেখতে পাই:

 

মু’মিনরা ‘অর্থহীন বিষয়ে লিপ্ত হয় না‘ (২৩:৩) আর ‘অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি তাদের সামনে উপস্থিত হলে তারা নিজেদের সম্মান সমুন্নত রেখে বিনয়ের সাথে সেসব বিষয় এড়িয়ে যায়‘ (২৫:৭২)। অন্যদিকে ‘এমন মানুষও আছে যারা অর্থহীন কথাবার্তায় নিমজ্জিত থাকে‘ (৩১:৬)। এই দুই শ্রেণীর সাথে পরিচিত হওয়ার পর আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনি কোন দলের অংশ হতে চান। তারপর সিদ্ধান্ত নিন।

 

সামনে এগোলে আল্লাহ্‌ আপনাকে অন্য এক শ্রেণীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন। এরা ‘অসহায়দের খাবার দিতে উৎসাহিত করে না‘(৮৯:১৮) এবং ‘নিজেদের ধন-সম্পদ গভীরভাবে ভালোবাসে‘(৮৯:২০)। একই সাথে তিনি এদের বিপরীত শ্রেণীর সাথেও পরিচয় করিয়ে দেন যারা ‘অন্যদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে ঈর্ষা পোষণ করে না এবং দারিদ্র্যের হুমকির সম্মুখীন হয়েও নিজেদের উপর অন্যের কল্যাণকে প্রাধান্য দেয়।‘ (৫৯:৯)

 

আপনি পরিচিত হবেন তাদের সাথে ‘যারা নিতান্ত অলসভাবে এবং লোক দেখানোর জন্য সলাতে দাঁড়ায় আর আল্লাহকে কদাচিৎ স্মরণ করে।‘ (৪:১৪২) এবং তাদের সাথেও ‘যারা নিজেদের সলাতে বিনয়ী এবং একাগ্রচিত্ত‘ (২৩:২)।
এমন মানুষও আপনার জীবনে আসবে যারা শুধুই ‘ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে আর চতুষ্পদ জন্তুর মতো খাওয়া-দাওয়া করে‘(৪৭:১২) আবার সেই সমস্ত চিন্তাশীল লোকেরা আপনাকে নাড়া দিয়ে যাবে যারা ‘আকাশ এবং পৃথিবীর সৃষ্টি নৈপুণ্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে‘ (৩:১৯১)।
নিজের প্রবৃত্তিকেই রবের আসনে বসিয়ে নিয়েছে‘ (৪৫:২৩) এমন মানুষের পাশাপাশি ‘অন্যান্য সব কিছুর চেয়ে আল্লাহকে বেশী ভালোবাসে‘ (২:১৬৫) এমন মানুষও আপনি দেখতে পাবেন।

 

এমনকি আপনি অবাক হয়ে আবিষ্কার করবেন যে ১৪০০ বছরের পুরোনো কুরআন কি অবিকলভাবে আজকের এই পৃথিবীর গল্প আপনাকে শোনাচ্ছে! কুরআন যেন আমাদের সময়ের নেতৃবর্গ আর সরকারসমূহের কথাই বলছে ‘যারা পৃথিবীর বুকে অত্যাচারের নেতৃত্ব দেয় এবং পৃথিবীর মানুষকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে অনুগত করে রাখে আর তাদের মাঝেই এক দলের সন্তানদের হত্যা করে তাদের উপর অত্যাচার চালায়‘ (২৮:৪) আর ‘যারা অনুগত হতে অস্বীকার করে তাদের জেলে বন্দী করে রাখার ভয় দেখায়।’( ২৬:২৯) এই শাসকেরা ‘মুসলিম নারী শিশুদের আগুনের মুখে ঠেলে দেয় ‘ (৮৫:৫) ‘শুধু এই কারণে যে তারা আল্লাহ্‌র উপর ঈমান এনেছে।‘ (৮৫:৮) অথচ এই অত্যাচারীরাই নিজেদেরকে অর্থবিত্ত ও প্রযুক্তিতে অগ্রগামী এবং সভ্য সমাজের মুখপাত্র দাবী করে। (২৮:৭৬) আর এতেই কেউ কেউ ধোঁকা খেয়ে তাদের কুফর এবং অন্যদের উপর তাদের অত্যাচারকে বেমালুম ভুলে গিয়ে বিস্ময়ভরা চোখে তাদের সমাজ- সংস্কৃতিতে মুগ্ধ হয়ে মনে মনে ভাবে, যদি তাদের মতো হতে পারতাম!(২৮:৭৯) কিছু সত্যনিষ্ঠ আলেম মানুষকে সচেতন করতে উঠে দাঁড়ায়(২৮:৮০)। এর ফলে কিছু মুসলিম জেগে ওঠে এবং শত্রুর ভূমিতে নিগৃহীত হওয়ার পর ইসলামের ভূমিতে হিজরত করে (১৬:১১০) এবং কেউ কেউ বিশ্বের বিভিন্ন অংশে নির্যাতিত নারী-পুরুষ এবং শিশুদের রক্ষার্থে আল্লাহ্‌র রাস্তায় লড়াই করে (৪:৭৫)। তবে অধিকাংশ মানুষই দিনের পর দিন অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে তোলা এসব শত্রুর ভূমিতে থাকাটাই পছন্দ করে(৪:৯৭)। শুধু তাই নয় বরং গৃহপালিত দাসের মতো ‘বসে থেকে নিজেদের ভাইদের সম্বন্ধে বলে, যদি তারা আমাদের কথা শুনত, তবে নিহত হত না‘(৩:১৬৮) এটুকুও যেন যথেষ্ট নয়। যেই অত্যাচারীরা –

 

  • পরিস্কারভাবে ‘একে অপরের সহযোগী‘( ৮:৭৩, ৪৫:১৯),
  • যারা চায় আমরা যেন ইসলামকে নির্বিষ তত্ত্বকথায় পরিণত করি,(৬৮:৯)
  • আমরা ইসলাম পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণরূপে তাদের অনুসরণ করলেই শুধু যারা আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবে, (২:১২০)

 

সেই অত্যাচারী কাফির গোষ্ঠীকে দুনিয়ার মোহে আবিষ্ট কিছু মুসলিম মিত্র হিসাবে গ্রহণ করে। তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে তাদের সেই মিত্রদের আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘ “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ” আমরা শেষ পর্যন্ত তোমাদের সাথে আছি।’(৫৯:১১) কিন্তু যেহেতু ‘এরা দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলন্ত; এদিকেও নয় ওদিকেও নয়‘ (৪:১৪৩), তাই তারা মু’মিনদেরকেও আশ্বস্ত করে বলে যে আমরা তো বিশ্বাসী (২:১৪) আর আমরাও তো ইয়ে…মানে… আসলে উম্মাহর বিজয়ই চাই। আর তাই ‘যারা পরীক্ষায় পড়লেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়‘ (২২:১১) এমন মানুষদের সাথে আপনাকে মানিয়ে নিতে হবে। তবে আপনি এমন মানুষের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্যও লাভ করবেন ‘যারা আল্লাহ্‌র সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে‘ এবং ‘ যাদের সংকল্প বিন্দুমাত্রও পরিবর্তিত হয়নি‘ (৩৩:২৩)
আর এভাবেই কুরআন পড়ার সময় মানবজাতির সর্বোত্তম থেকে শুরু করে সর্বনিকৃষ্ট পর্যন্ত নানান বৈচিত্র্যময় চরিত্রের মানুষ এবং তাদের বৈশিষ্ট্য আপনার সামনে উপস্থাপিত হয়। আল-হাসান আল-বাসরি (র) বলেন, ‘তোমাদের আগে যারা এসেছিল তারা কুরআনকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আগত বার্তার সংকলন হিসাবে দেখত। তারা রাতের বেলায় এগুলো নিয়ে চিন্তা করত আর দিনের বেলায় সেগুলোকে কাজে পরিণত করত।’

 

সুতরাং এবার নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘আমি এদের মধ্যে কোন দলটির অংশ হতে চাই? আমি কি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি?

 

কুরআন আপনার সামনে ঠিক এই চ্যালেঞ্জটাই ছুঁড়ে দেয়।

 

-তারিক মেহান্না

.

>>আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখার লিংক

 

>> "বিয়ে, রিজিক লাভ, ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি"

https://justpaste.it/5gol5

.

>> ফেসবুক ও ইউটিউবের উপকারী সব পেইজ, গ্রুপ, আইডি এবং চ্যানেলের লিংক

https://justpaste.it/facebook_page_grp_link

.

>> র‍্যান্ড, মডারেট ইসলাম, মডার্নিস্ট মুভমেন্ট

https://justpaste.it/76iwz

.

>> কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক বইয়ের pdf লিংক (৪০০+ বই)

https://justpaste.it/4ne9o

.

>> কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক Apps, YouTube Video, Quran Recitation, YouTube channel.

https://justpaste.it/islamicappvideo

.

>> তাকদির আগে থেকে নির্ধারিত হলে মানুষের বিচার হবে কেন? যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ পৌঁছেনি তাদের কী হবে?

https://justpaste.it/6q4c3

.

>> কুরআন এবং আপনি

https://justpaste.it/5dds8

.

>> কখনও ঝরে যেও না …

https://justpaste.it/3bt22

.

>> ফজরে আমি উঠতে পারি না

https://justpaste.it/6kjl6

.

>> এই ১০টি ফজিলতপূর্ণ আমল যা আপনার সারাবছরের_ই দৈনন্দিন রুটিনে থাকা উচিত
https://justpaste.it/9hhk1

.

>> ইস্তিগফার অপার সম্ভাবনার দ্বার
https://justpaste.it/6ddvr

.

>> দাম্পত্যজীবন, অজ্ঞতা ও পরিণাম

https://justpaste.it/7u5es

.

>> বিপদাপদে ধৈর্যধারণ : ফজিলত, অর্জনের উপায় ও করণীয়

https://justpaste.it/8dccj

.

>> মহান রবের আশ্রয়ে সিরিজের সকল পর্ব

https://justpaste.it/6ttuf

.

>> স্বার্থক মুনাজাত

https://justpaste.it/1xf0t

.

>> রাসূলের উপর দরুদ ও সালাম পাঠ-সংক্রান্ত ৭ পর্বের একটি সিরিজ

https://justpaste.it/4hhtd

.

>> তাহাজ্জুদ সিরিজ

https://justpaste.it/4ja0n

.

>> মহিমান্বিত কুরআন সিরিজের সকল পর্ব

https://justpaste.it/3dxi7

.

>> ধ্বংসাত্মক দৃষ্টি (বদ নজর সিরিজের সকল পর্ব)

https://justpaste.it/7056k

.

>> বিশুদ্ধ ঈমান সিরিজ

https://justpaste.it/7fh32

.

>> ইমান ভঙ্গের ১০ কারণ

https://justpaste.it/9icuq

.

>> দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির ১০ আমল

https://justpaste.it/8gmtk

.

>> পর্দায় প্রত্যাবতন: পর্দায় ফেরার গল্প
https://justpaste.it/3lqzf

.

>> দ্বীনে_ফেরার_গল্প_আমার_রবের_কাছে_ফেরার_গল্প

https://justpaste.it/deen_a_ferar_golpo

.

>> নফসের জিহাদ -শায়খ আহমাদ মুসা জিবরীল (হাফিজাহুল্লাহ)

https://justpaste.it/8vnly

.

>> রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর সকাল-সন্ধ্যার দু'আ ও যিকর
https://justpaste.it/sokalsondharjikir

.

>> সালাফদের আত্মশুদ্ধিমূলক বাণী
https://justpaste.it/9e6qh

.
>> সন্তান লাভের ৭ টি গুরুত্বপূর্ণ আমল
https://justpaste.it/9hth5

.
>> Rain Drops, Baseera, Hunafa, Mubashshireen Media ও Ummah Network থেকে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সিরিজগুলোর অডিও ডাউনলোড লিংক
https://justpaste.it/4kes1

.

>> পাপ থেকে বাঁচার ১০ উপায়: যা সকল মুসলিমের জানা আবশ্যক
https://justpaste.it/3ob7j

.

>> ইসলামিক বই, অডিও-ভিডিও লেকচার সিরিজ সহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের লিংকগুলো পাবেন এখানে। সবগুলো বিষয়ের লিংক এক জায়গায় রাখা হয়েছে। এই লিংকটা শেয়ার করতে পারেন। 
https://justpaste.it/48f6m