JustPaste.it

কুরআন এবং আপনি

 

 

>> ইসলামিক বই, অডিও-ভিডিও লেকচার সিরিজ সহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের লিংকগুলো পাবেন এখানে
https://justpaste.it/48f6m

 

 

পরিচয়

তারেক মেহান্না একজন ৩১ বছর বয়স্ক মুসলিম দা’ঈ, পেশায় ফার্মাসিস্ট। তিনি আমেরিকায় পড়াশোনা করেছেন এবং সেখানে মুসলিমদের মাঝে অত্যন্ত সম্মানিত এবং পছন্দনীয় একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি সেখানে দীর্ঘদিন জুমু’আর খুতবা দেওয়ার পাশাপাশি তরূণদের সাথে হালাক্বাহ ও দাওয়াতের কাজ করেছেন। আমেরিকার নিষ্ঠুর আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার, এবং মুসলিম বন্দীদের অধিকার রক্ষায় তিনি ছিলেন এক নিবেদিত কণ্ঠস্বর। তিনি শুধু দিয়েই গেছেন, কিছুই নেন নি। যারা তাকে চেনে তাদের ভাষায় তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, আন্তরিক, স্পষ্টভাষী এবং আপোসহীন এক ব্যক্তিত্ব।

একজন সচেতন রাজনৈতিক স্পষ্টবাদী ব্যক্তিত্ব হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে এফবিআই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল এবং তাকে নানাভাবে হয়রানি করে আসছিল। তাকে তারা গুপ্তচর হবার প্রস্তাব দিয়ে তারা ব্যর্থ হওয়ায় পরবর্তীতে তারা তার বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দাঁড়া করে এবং তাকে একাধিকবার গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে এক প্রহসনমূলক বিচারে ২০১২ সালের ১২ এপ্রিলে তার ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনইসের ম্যারিয়ন শহরে কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট ইউনিটে সাজা ভোগ করছেন।

 

তারেক মেহান্নার জবানবন্দিতে তার ‘সন্ত্রাসী’ হয়ে ওঠার গল্প

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

 

ঠিক চার বছর আগের এই দিনে আমি স্থানীয় হাসপাতালে আমার শিফটিং ডিউটি শেষ করে গাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখন দুই ফেডারেল এজেন্ট (FBI) আমার পথরোধ করে। তারা আমাকে দুটি প্রস্তাবের মাঝে একটি বেছে নিতে বলে।: একটি সহজ, অপরটি কঠিন। তাদের ভাষায় “সহজ” প্রস্তাবটি ছিল সরকারের চর অর্থাৎ এজেন্ট হিসেবে কাজ করার। সেটি করলে আমাকে কখনও আদালত বা কারাগারের ত্রিসীমানায়ও যেতে হবে না। আর কঠিন প্রস্তাবটির বাস্তব রূপ আজ আপনারা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। আমি কঠিন প্রস্তাবটিই বেছে নিয়েছি এবং তাই, গত চার বছরের অধিকাংশ সময় ধরে আমি আলমারির খোপের মত ছোট্ট একটা কক্ষে দিনের ২৩ ঘন্টাই নিঃসঙ্গ অবস্থায় বন্দী হয়ে কাটিয়েছি। আমাকে এতদিন আটকে রাখতে এবং বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে এফবিআই ও তাদের আইনজীবীরা কঠিন পরিশ্রম করেছে। সরকার সাধারণ মানুষের পকেটের ট্যাক্সের  লক্ষ লক্ষ ডলার ব্যয় করেছে। শেষমেশ আজ আমাকে আপনাদের সামনে হাজির করা হয়েছে যেন আমাকে আরো দীর্ঘদিন কারাভোগের সাজা দেওয়া যায়।

 

রায় ঘোষণার এই দিনটিকে সামনে রেখে অনেকেই আমাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছে। আপনাদের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কী বললে আমার উপকার হবে, আমার কী কথা বলা উচিত ইত্যাদি নিয়ে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছেন। অনেকেই বলেছেন আমার ক্ষমা চেয়ে আত্মসমর্পণ করা উচিত যাতে করে লঘু শাস্তি হয়। অনেকে বলেছেন ক্ষমা চাই বা না-চাই, আমার কপালে কঠিন শাস্তিই জুটবে। কিন্তু সেসব পরামর্শ উপেক্ষা করে আমি আজকে শুধু নিজেকে নিয়ে কয়েক মিনিট কথা বলতে চাই।

 

যখন আমি আমেরিকান সরকারের বেতনপুষ্ট গুপ্তচর হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম, তখন সরকার আমাকে আটক করল মুজাহিদীনদের সাহায্য করার “অপরাধে”। এই মুজাহিদীনরা মুসলিম বিশ্বের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়ছে। মিডিয়ার ভাষায় এরা হচ্ছে “সন্ত্রাসী” বা “টেররিস্ট”। আমি কোনো মুসলিম দেশে জন্মগ্রহণ করিনি। এই আমেরিকাতেই আমার জন্ম আর বেড়ে ওঠা। আর এ কারণেই অনেক মানুষ আমার উপর রীতিমত ক্ষেপে আছে! তাদের কথা হল, “কিভাবে এই লোকটা একজন আমেরিকান হয়ে “সন্ত্রাসী”দের পক্ষে অবস্থান নিতে পারলো! কিভাবে ওদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী হল!” মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী ও বিশ্বাস তার পারিপার্শ্বিকতার আদলে গড়ে ওঠে এবং আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আর তাই আমি বলছি, আমার আমেরিকা বিরোধীতার পেছনে স্বয়ং আমেরিকাই দায়ী।

 

ছয় বছর বয়স থেকে, আমি কমিক বইয়ের একটা বিশাল সংগ্রহ গড়ে তুলতে শুরু করি। ব্যাটম্যানের চরিত্রটি আমার মনে একটা ধারণা খুব স্পষ্টভাবে গেঁথে দেয়। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় বিশ্বের চিরন্তন বাস্তবতার সাথে আর তা হল: গল্পের চরিত্রগুলোর মত এই দুনিয়াতেও অত্যাচারী জালিম আছে, আছে নির্যাতিত ও মজলুম, এবং তাদের মাঝে আছে এমন কিছু মানুষ যারা নিপীড়িত শোষিত মানুষের পক্ষে অবস্থান নেয়। এই বাস্তবতা আমাকে এতটাই আন্দোলিত করেছিল যে আমার পুরো শৈশব জুড়ে আমি যেসব বইয়েই এ ধরনের বাস্তবতা খুঁজে পেতাম সেগুলো সাগ্রহে পড়ে ফেলতাম। আংকেল টম’স কেবিন, ম্যালকম এক্স এর আত্মজীবনী প্রভৃতি বইগুলো আমার মাঝে সেই ধারণাটিকেই সুদৃঢ় করে তোলে।. এমনকি ‘দ্য ক্যাচার ইন দ্য রে’(The Catcher in the Rye) বইটিতেও আমি আমি এই ধরনের নৈতিকতার ছাপ খুঁজে পাই।

 

হাইস্কুলে উঠার পরে আমি সত্যিকার ইতিহাস ক্লাস করা শুরু করি। আমি অবাক হয়ে দেখলাম সেই ব্যাটমানের কমিকের মতোই তো লাগছে সবকিছু! আমি আবিষ্কার করলাম শোষক-শোষিতের এই ঘটনাবলী উপন্যাসের সীমানা পেরিয়ে আসলে আরো অনেক বেশি বাস্তব। আমি নেটিভ আমেরিকানদের (আমেরিকার আদি অধিবাসী) ইতিহাস পড়লাম এবং জানতে পারলাম বহিরাগত ইউরোপিয়ানদের হাতে তাদের কী করুণ দশা হয়েছিল। আবার এই ইউরোপ থেকে আগত লোকদের বংশধরেরা কিভাবে রাজা জর্জ (৩য়) এর হাতে শোষিত হয়েছিল। আমি পল রিভিয়ার, টম পেইনদের সম্পর্কে জানলাম, জানলাম কিভাবে আমেরিকানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব করেছিল। আজকে সেটাকেই আমরা আমেরিকান রেভ্যুলেশন ওয়ার হিসেবে উদযাপন করি।

 

ছোটবেলায় শিক্ষাসফরে আমরা এই বিপ্লবের যুদ্ধক্ষেত্রগুলো দেখতে বের হতাম। এই আদালতের অদূরেই তেমন কিছু যুদ্ধক্ষেত্র রয়েছে। আমি হ্যারিয়েট টাবম্যান, ন্যাট টার্নার, জন ব্রাউনদের সম্পর্কে পড়াশোনা করলাম। তারা ছিলেন দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অগ্রপথিক। আমি ধীরে ধীরে পড়তে লাগলাম ইমা গোল্ডম্যান, ইউজিন ডেবস এবং লেবার ইউনিয়নের সংগ্রামের কথা। জানতে পারলাম সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ, গরীব লোকদের দুঃখের ইতিহাস। আমি আরও জানলাম অ্যানা ফ্রাংকের কাহিনী, নাতসিদের বর্বরতার কথা, কিভাবে তারা সংখ্যালঘু মানুষদের হত্যা করেছে এবং বিরোধী পক্ষকে কারারুদ্ধ করেছে। জানলাম রোজা পার্ক, ম্যালকম এক্স, মার্টিন লুথার কিং প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের মানবাধিকারের জন্য সংগ্রামের গল্প। হো চি মিন সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে জানলাম কিভাবে ভিয়েতনামবাসীকে নিজেদের স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখতে যুগ যুগ ধরে একের পর এক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। আরো জেনেছিলাম নেলসন ম্যান্ডেলা আর তৎকালীন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম সম্পর্কে।

 

এ সব ইতিহাসই যেন আমার ছয় বছর বয়সে শেখা কমিক বইয়ের কাহিনীর পুনরাবৃত্তি। জালিম এবং মজলুমের মধ্যকার এ দ্বন্দ্ব চিরন্তন দ্বন্দ্ব। যখনই এসব গল্প পড়তাম, সবসময়ই আমি নিজেকে শোষিত মানুষের পক্ষে অনুভব করেছি। মনের অজান্তে আমি শোষিতদের পক্ষে রুখে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে সম্মান ও সমর্থন করতে শুরু করেছি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। আমি আমার ক্লাস নোটগুলোকে কখনই অযত্নে ফেলে দিতাম না। আমার বেডরুমের আলমারিতে সেই ক্লাসনোটগুলো এখনও দিব্যি সাজানো আছে।

 

কিন্তু ইতিহাসের মহানায়কদের একজন যেন সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি ম্যালকম এক্স। তার অনেক কিছুই আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু আমি সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি তার পরিবর্তন দেখে। ম্যালকম এক্সকে নিয়ে নির্মিত স্পাইক লি এর “এক্স” চলচ্চিত্রটা আপনারা দেখেছেন কিনা জানি না। এটি প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার একটি চলচ্চিত্র, যেখানে দেখা যায় শুরুর দিকটাতে যে ম্যালকম এক্স ছিলেন একজন অশিক্ষিত অপরাধী, শেষের দিকটাতে সেই ম্যালকমই পরিণত হন একজন স্বামী, একজন পিতা, গণমানুষের রক্ষাকর্তা, একজন বাগ্মী নেতা এবং হজ্জ পালনকারী একজন নিয়মানুবর্তী মুসলিম ব্যক্তিতে। সবশেষে তিনি শহীদ হন।

 

ম্যালকমের জীবন আমাকে একটি মূল্যবান শিক্ষা দিয়েছে।

আর তা হল ইসলামটা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোনো বিষয় নয়। জন্মসূত্রে শুধুমাত্র মুসলিম পরিবারে জন্মালেই কেউ মুসলিম হতে পারে না। এটা কোনো সংস্কৃতি বা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ নয়। বরং এটি একটি জীবনব্যবস্থা, এটি একটি জীবনবোধ। আর এটা গ্রহণ করার জন্যে কে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছে বা কী পরিবেশে বেড়ে উঠেছে এগুলো কোনো ব্যাপার নয়। এ বিষয়টা আমাকে ইসলাম নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। আমি তখন কেবল কিশোর। কিন্তু ইসলাম আমাকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিল, যে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বড় বড় বিজ্ঞানীরা খেই হারিয়ে ফেলেছেন। যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পাবার ব্যর্থতা অনেক ধনী আর বিখ্যাত মানুষদের বিষাদ আর আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে, “কি আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য?”, “এই মহাবিশ্বে আমরা কেন, কিসের আশায় বেঁচে আছি?” – ইসলাম আমাকে কেবল জীবনের উদ্দেশ্য জানিয়ে ক্ষান্ত হল না, বরং দুনিয়ার বুকে কিভাবে বেঁচে থাকতে হবে তাও শিখিয়ে দিল।

 

ইসলামে খ্রিষ্টধর্মের মত যাজকতন্ত্রের জটিলতা নেই যে ধর্মীয় ব্যাপারে বিশেষ কিছু পুরোহিতের দারস্থ হতে হয়। তাই আমি নিজেই কুরআন এবং রাসূল ﷺ এর শিক্ষাগুলো ঘাঁটতে আরম্ভ করলাম। এই দুনিয়া, এই দুনিয়ায় আমার জীবনে, আমার চারপাশের মানুষের জীবনে আর সমগ্র বিশ্বকে ইসলামের কী দেওয়ার আছে – তা জানার আগ্রহ থেকে আমি শুরু করলাম জ্ঞানার্জনের যাত্রা। আমি যতই ইসলাম সম্পর্কে জানতে লাগলাম ততোই ইসলামকে বহুমূল্যবান সোনার টুকরোর মতো মূল্যবান মনে করতে লাগলাম। এগুলো উঠতি বয়সের কথা, কিন্তু আজকেও আমি শত চাপ আর ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে চাই, আমি একজন গর্বিত মুসলিম।

 

আমার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু একসময় নিবদ্ধ হল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিমদের জীবনে। আমি যেদিকেই তাকাতাম, সেদিকেই দেখতাম বড় বড় পরাশক্তিগুলো আমার ভালোবাসাকে ধ্বংস করতে তৎপর। আমি দেখেছি আফগানিস্তানের মুসলিমদের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন কী করেছে। আমি দেখেছি বসনিয়ার মুসলিমদের উপর সার্বিয়ানদের অত্যাচার, দেখেছি চেচনিয়ার মুসলিমদের উপর রাশিয়ার অনাচার। আমি দেখলাম লেবাননের মুসলিমদের সাথে ইসরাইল কী অন্যায় করেছে এবং যা সে আজও চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনে, আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন এবং সহযোগিতায়।

 

আমার এও অজানা ছিল না যে আমেরিকা নিজেই মুসলিমদের সাথে কী ভয়ানক অন্যায় করে আসছে। আমি উপসাগরীয় যুদ্ধ সম্পর্কে জানলাম, জানলাম কিভাবে ইউরেনিয়াম বোমা ব্যবহার করে ইরাক জুড়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সেই বোমার তেজস্ক্রিয়তায় মরণব্যাধি ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছিল বহুগুণে। আমেরিকার নেতৃত্বে জাতিসংঘ কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরাকে খাদ্য, পানি এবং ঔষধপত্র প্রবেশ করতে দেয়া হয় নি। যার ফলাফল ছিল ইরাকে অন্তত ৫ লক্ষ শিশুর মৃত্যু। আমার মনে আছে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখেছিলাম, “60 Minutes” প্রোগ্রামে, সেখানে সাক্ষাৎকারে ম্যাডেলিন অলব্রাইট বলেছিলেন, “এটাই তাদের যথার্থ পাওনা !” আমি দেখলাম কীভাবে কিছু মানুষ এই নির্মম শিশু হত্যার ঘটনায় শান্ত থাকতে না পেরে এরোপ্লেন হাইজ্যাক করে ১১ সেপ্টেম্বরে টুইনটাওয়ার উড়িয়ে এর প্রতিশোধ নেয়।

 

এর পরবর্তী সময়ে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া স্বরুপ আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে বসল। আবিষ্কার করলাম “Shock & Awe” (এক ধরণের আক্রমণাত্মক মিলিটারি tactic) এর পরিণতি। ইরাকের যন্ত্রণাক্লিষ্ট শিশুরা হাসপাতালের ওয়ার্ডে শুয়ে আছে, তাদের কপালে বিঁধে আছে মিসাইলের তীক্ষ্ণ শ্র্যাপনেল। না, CNN এ এসবের কিছুই দেখায়নি। মেরিন সেনারা হাদীসা শহরে ২৪ জন ঘুমন্ত মুসলিমকে গুলি করে হত্যা করে উড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল ৭৬ বছর বয়স্ক হুইলচেয়ারে বসা এক বৃদ্ধ, আরও ছিল বিছানাতে ঘুমন্ত নারী এবং শিশু।

 

আমি আরো জানলাম এক চৌদ্দ বছরের ইরাকি বালিকার কথা।

বোন আবীর-আল-জানাবি, তাকে পাঁচজন আমেরিকার সেনা গণধর্ষণ করে। তারপর তাকে ও তার পরিবারের সকলকে মাথায় গুলি করে হত্যা করে। পাষন্ডরা তাদের মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে দেয়। আমি আপনাদের একটা জিনিষ মনে করিয়ে দিতে চাই। একজন মুসলিম নারী কখনও তার একটি চুল পর্যন্ত পরপুরুষের সামনে উন্মুক্ত করে না। অথচ কল্পনা করে দেখুন একটিবার, রক্ষণশীল পরিবারের এই ছোট্ট মেয়েটির কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। পাশবিকভাবে তাকে যৌন নির্যাতন করছে, একজন-দুজন নয়, পাঁচ সৈনিক মিলে। এই আজও, আমি কারাগারে বসে পাকিস্তান, সোমালিয়া আর ইয়েমেনে আমেরিকার চলমান ড্রোন হামলার খবর শুনছি। এইতো গত মাসেই, শুনলাম ১৭ জন আফগান মুসলিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং এরপর তাদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এদের বেশিরভাগ ছিলেন মা এবং তাদের ছোট সন্তান।

 

এগুলো হয়তো আপনার কাছে নিছক পত্রিকার খবর বৈ কিছু নয়

কিন্তু এই আমি, এরই মাঝে শিখেছি, ইসলামের আনুগত্য আর ভ্রাতৃত্বের সংজ্ঞাটুকু। প্রতিটা মুসলিম নারী আমার বোন, আর প্রতিটা মুসলিম পুরুষ আমার ভাই, আর এই আমরা একসাথে একটা বিশাল পরিবার যারা একে অপরকে সাহায্য করে যাব। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমি আসলে আমার ভাইবোনদের উপর এমন নির্বিচার অত্যাচার দেখে চুপ বা “নিষ্ক্রিয়” থাকতে পারিনি। শোষিতের জন্য সহানুভূতি আমার সবসময়ই ছিল, কিন্তু আজ যেন ব্যাপারটা একদমই ব্যক্তিগত। যারা আমার ভাই-বোনদের হয়ে লড়ছে তাদের প্রতি আমার সম্মানও তাই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসরিত।

 

আমি পল রিভিয়ারের কথা উল্লেখ করেছি। একদিন ব্রিটিশ হানাদাররা স্যাম এডামস ও জন হ্যানকককে গ্রেফতার করতে এবং মিনিটম্যানদের অতর্কিত আক্রমণ করে তাদের অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করতে লেক্সিনটনে আসছিল। আগাম এই খবর পেয়ে সেদিন পল রিভিয়ার ঘোড়ায় চেপে মধ্যরাতে লোকদেরকে সতর্ক করতে বেরিয়ে যান। ফলে কনকর্ডে গিয়ে ব্রিটিশ সেনারা মুখোমুখি হয় ভিন্ন দৃশ্যের। মিনিটম্যানরা ব্রিটিশ অভিযানের আগাম বার্তা লাভ করে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে, অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে অপেক্ষা করছে যুদ্ধের জন্য। ব্রিটিশরা সে যুদ্ধে পরাজিত হয়, আর এ বিজয়ের হাত ধরে আসে আমেরিকান রেভ্যুলেশন। জেনে অবাক হবেন মিনিটম্যানরা সেদিন যা করেছিল আমি সেই ঘটনাকে একটি আরবী শব্দ দিয়ে অতি সহজে ব্যাখ্যা করে দেব। তা হল: জিহাদ। আর এটা নিয়েই আমার আজকের এই বিচার।

 

আমার বিরুদ্ধে হয়তো আপনারা জঙ্গিদের বক্তব্য এবং ভিডিও অনুবাদের অভিযোগ শুনেছেন। শুনেছেন শিশুতোষ এবং হাস্যকর অভিযোগ, “ওহ! সে তো ঐ অনুচ্ছেদের অনুবাদ করেছে!”, “ওহ! সে তো এই বাক্যটা এডিট করেছে” – এর সবই একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খেয়েছে, তা হল: ব্রিটিশরা আমেরিকার বিরুদ্ধে যা করেছিল ঠিক একই কাজ আমেরিকা মুসলিমদের বিরুদ্ধে করায় যেসব মুসলিমরা রুখে দাঁড়িয়েছে তাদের সমর্থন করা। আমার ব্যাপারে আনীত অভিযোগগুলোর ব্যাপারে এটা জলের মতো পরিষ্কার, আমি কখনই শপিং মলে আমেরিকান হত্যার পরিকল্পনা করিনি। এগুলো একেবারেই পাতানো অভিযোগ। সরকারদলীয় সাক্ষীদের সাক্ষ্যগুলোই এমন অভিযোগের বিপরীতে কথা বলে। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে অভিজ্ঞ আইনজ্ঞরা এই ব্যাপারে আমার লেখা ব্যবচ্ছেদ করে তাদের অভিযোগের পক্ষে কিছুই বের করতে পারেননি। পরে, আমি যখন মুক্ত হলাম, তখন সরকার আমার কাছে ছদ্মবেশী চর প্রেরণ করে একটি “সন্ত্রাস পরিকল্পনা”র সাথে যুক্ত হবার প্রস্তাব পাঠায়। সাজানো নাটক তৈরি করে সরকার আমাকে এর মধ্যে জড়ানোর ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু আমি তাতে সাড়া দেইনি। রহস্যজনকভাবে, বিচারকরা এই ঘটনাটি যেন শোনেইনি।

 

যাই হোক, আমার বিরুদ্ধে যে বিচার কার্যক্রম চলছে তা মুসলিম দ্বারা আমেরিকার নাগরিক হত্যা নিয়ে নয়, বরং তা আমেরিকান কর্তৃক মুসলিম হত্যার বিরোধিতা করার কারণে। আমি বিশ্বাস করি, মুসলিমদেরকে অবশ্যই হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে, হোক সে হানাদাররা সোভিয়েত বা আমেরিকা কিংবা মঙ্গলগ্রহ থেকে আগত। আমি এটাই বিশ্বাস করি, আমি সবসময় এমনটাই বিশ্বাস করতাম এবং সবসময় এমনটাই বিশ্বাস করে যাব (ইনশা আল্লাহ)। এটা সন্ত্রাসবাদ নয়, এটা চরমপন্থা নয়। এটা নিছক আত্মরক্ষা, নিজের মাটিকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা।

 

আমি আমার আইনজীবিদের সাথে এই মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করি যখন তারা বলে, “সবাই তোমার এই বিশ্বাসের সাথে একমত হবে এমনটা নয়”। আমি বলি, না, এটা যার-যার-তার-তার বিষয় নয়। যার সামান্য কান্ডজ্ঞান ও মানবতাবোধ আছে, আমার সাথে সে এই বিষয়ে একমত না হয়ে পারে না। কেউ যদি আপনার বাসায় ডাকাতি করতে আসে এবং আপনার পরিবার-পরিজনের ক্ষতি সাধন করে, কমনসেন্স বলে আপনার উচিত ডাকাতকে তাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু যখন সেই ভূমি হয় “মুসলিম ভূমি” আর আক্রমণকারী বাহিনী হয় “আমেরিকান সেনাবাহিনী”, তখন কেন যেন সব নীতিনৈতিকতার মাপকাঠি উল্টে যায়! নিজেদের রক্ষা করা তখন “সন্ত্রাসবাদ”; আর আকাশ আর সাগর পাড়ি দিয়ে আসা হানাদারদের বিরুদ্ধে নিজ দেশকে রক্ষা করতে যারা যুদ্ধ করে, তারা হয় “সন্ত্রাসী”, তারা হয় খুনী, “আমেরিকান হত্যাকারী”।

 

আজ থেকে আড়াইশ বছর আগে এই রাস্তায় আমেরিকানরা ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে যেভাবে নিগৃহীত হয়েছিল, ঠিক একই বাস্তবতার শিকার আজ মুসলিমরা, তবে এবার আমেরিকান সৈন্যদের হাতে। একেই বলে সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা। যখন সার্জেন্ট বেলস নিরীহ আফগানদেরকে হত্যা করেছিল তখন আমি দেখলাম সবাই কেবল তাকে নিয়ে ব্যস্ত, মিডিয়াতেও কেবল তার জীবনের উপর আলোকপাত করা হচ্ছে – তার পারিবারিক জীবন, তার মানসিক চাপ, তার বন্ধককৃত বাড়ি, তার PTSD নিয়ে বিস্তারিত খবর দেখানো হল। পুরো ব্যাপারটায় তার জন্য এমনভাবে একটা সহানূভূতি তৈরি করা হয়, যেন সে-ই ভুক্তভোগী! যাদেরকে সে নির্বিচারে হত্যা কছে, তাদের প্রতি কোনো সহানূভূতিই দেখানো হয়নি! যেন এটা কোনো ব্যাপারই নয়। যেন আফগানরা মানুষ নয়।

 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই মানসিকতা আমাদের সবাইকে গ্রাস করেছে। এমনকি আমার আইনজীবিদের তাদের বদ্ধ চেতনার খোলস থেকে বের করে এনে, “মুসলিমদেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে”- এই সামান্য ব্যাপারটা আলোচনা করে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে আমার পাক্কা দু’বছর সময় লেগেছে এবং শেষ পর্যন্ত তারা নিতান্ত অনিচ্ছার সাথে আমার সাথে একমত হয়েছে। দু’বছর! এই ঘাঘু আইনজীবিদের কাজ আমাকে রক্ষা করা। মুসলিমদের আত্মরক্ষাকে তাদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এই আইনজীবিদেরই সময় লেগেছে দুই বছর! আর সেখানে আমাকে যেকোনো একজন বিচারকের সামনে দাঁড় করিয়ে যখন বলা হয়, “এই বিচারক নিরপেক্ষ, তোমার সমমনা”, আমি তখন বলি, “রাখুন আপনার নিরপেক্ষতা”। আমেরিকাকে আজ যে মানসিকতা গ্রাস করে নিয়েছে তাতে আমার মতের পক্ষে কোনো উকিল বা বিচারক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা আমার সহজ কথাগুলো সহজভাবে বুঝবে। তাই সরকারও আমার উপর মামলা ঝুলিয়ে রেখেছে। এটা করা যে তাদের খুব প্রয়োজন ছিল তা নয়। কিন্তু আসলে তারা দেখাল যে তারা চাইলেই এমনটা করতে পারে।

 

ইতিহাসের ক্লাস থেকে আমি আরো একটা জিনিস শিখেছি: আমেরিকা হল সেই দেশ যারা ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে সবচেয়ে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করেছিল। তারা নিজেদের অন্যায়গুলোকে আইনগত বৈধতা দিত। আবার পরবর্তীতে তারাই অবাক হয়ে ভাবত, “আরে, আমরা এমন ছিলাম!” দাসত্ব, বৈষম্যমূলক জিম ক্রো আইন [৩], দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানীদের বন্দীশিবিরে অন্তরীণ রাখা- এই সবগুলো কাজকেই আমেরিকানরা স্বাভাবিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সুপ্রীম কোর্টও এই বৈষম্যমূলক আইনগুলোকে বছরের পর বছর লালন করেছে। কিন্তু সময়ের সাথে আমেরিকা তার চেহারা পরিবর্তন করেছে। তারা নিজেদের অতীতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়, “আরে, আমরা বুঝি এমন ছিলাম!” নেলসন ম্যান্ডেলার কথা ধরুন, তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার সন্ত্রাসী গণ্য করত। তাকে মৃত্যুদন্ডের শাস্তিতে দন্ডিত করা হয়েছিল। কিন্তু সময় গড়িয়েছে, বদলেছে বিশ্বের চেহারা, মানুষ জানতে পেরেছে আসলে সরকারই ছিল সন্ত্রাসী, ম্যান্ডেলা নয়। ম্যান্ডেলা মুক্তি পেলেন, পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হলেন। তাই আসলে সবকিছুই আপেক্ষিক। যে যেভাবে চায়, সেভাবেই “সন্ত্রাস” এবং “সন্ত্রাসী”দের সংজ্ঞায়িত করে। এই সংজ্ঞাগুলো নির্ভর করে স্থান-কাল-পাত্র আর সেই সময়ের ক্ষমতাধর পরাশক্তিগুলোর উপরে, কেননা তারাই নিজেদের মতো করে এসব সংজ্ঞা বানায়।

 

হ্যাঁ, আপনার চোখে আমি আজ একজন সন্ত্রাসী। আমি এখন জেলখানার কমলা রঙের একটা পোষাক পরে দাঁড়িয়ে আছি। এই পোষাকেই হয়তো আমি সারাটি জীবন কাটিয়ে দেব। এটাই আপনাদের কাছে যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। এমন একটা দিন আসবে, যেদিন এই আমেরিকা বদলে যাবে। বদলে যাবে এর মানুষগুলো। তারা বুঝবে আজকের এই দিনটিতে আসলে কী প্রহসন হয়েছিল। তারা আবিষ্কার করবে কিভাবে হাজার হাজার মুসলিম খুন হয়েছিল, পঙ্গু হয়েছিল আমেরিকান সেনাবাহিনীর হাতে। কিন্তু “হত্যা এবং ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে” কারাগারে যেতে হচ্ছে এই আমাকেই। কারণ আমি সেইসব মুজাহিদীনদের সমর্থন করেছিলাম, যারা প্রকৃতপক্ষে ‘হত্যা এবং ধ্বংসের ষড়যন্ত্র’ থেকে মুসলিমদের রক্ষা করতে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। একদিন আমেরিকানরা দেখবে, আমাকে “সন্ত্রাসী” বানাতে সরকার কিভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। যদি বোন আবীর আল জানাবিকে মৃত থেকে জীবিত করে ফিরিয়ে এনে আমেরিকানদের দ্বারা গণধর্ষণের সময় তাকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, “বল তো, সন্ত্রাসী কারা”, আমি নিশ্চিত, সে আমার দিকে আঙ্গুল তাক করত না।

 

সরকার বলছে সহিংসতায় আমার মন নাকি আচ্ছন্ন হয়ে আছে! আমেরিকানদের হত্যা করার জন্য আমি নাকি পাগল হয়ে আছি! একজন মুসলিম হিসাবে বর্তমান সময়ে এর চেয়ে হাস্যকর মিথ্যা আমি কল্পনা করতে পারছি না।

.

তারেক মেহান্না

১২ এপ্রিল, ২০১২

[৩] কালোদের প্রতি একধরণের বৈষম্যমূলক আইন যা ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল

.

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১)

সূরা বাকারার শুরুতে আপনি দেখতে পাবেন  আল্লাহ মুত্তাকীনদের সর্বপ্রথম যে বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তা হল তারা ‘আল গায়েব ‘ অর্থাৎ অদৃশ্য জগতে বিশ্বাস করে। সর্বজনবিদিত ধারণাগুলো ছাড়াও আপনার জীবনে এই  বিষয়টির আরও কিছু কার্যকরী তাৎপর্য রয়েছে।

প্রথমত, হে মুওয়াহহিদ [১] – আপনি যা বিশ্বাস করেন, তা এই জন্যে বিশ্বাস করেন না যে তা জনপ্রিয়, সহজলভ্য, আকর্ষণীয় এবং আরামদায়ক । আপনি আপনার আশেপাশের মানুষগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখে সত্য – মিথ্যা, ঠিক – ভুল, গ্রহণীয় – বর্জনীয় এসবের মানদণ্ড নির্ধারণ করেন না। বস্তুতঃ এইসব পারিপার্শ্বিক ব্যাপারগুলো আপনার কাছে অর্থহীন। যদি এই পৃথিবীর ছয়শ কোটি মানুষ কোনো কিছুতে বিশ্বাস করে, সেটা আপনার বিশ্বাসকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারে না। বরং মাস না যেতেই পালটে যাওয়ার প্রবণতায় নিমজ্জিত নিত্য পরিবর্তনশীল এই জগতে, আপনার বিশ্বাসের ভিত্তি হল এক অপরিবর্তনীয় জগতের প্রতিক্রিয়া, যার মানদণ্ড কখনও বদলায় না।  স্বর্গীয় সুখ আর শাস্তি, জান্নাত আর জাহান্নাম, ফেরেশতা আর শয়তানের অদেখা সেই জগতে  ভালো-খারাপ আর সত্য-মিথ্যার মানদন্ড সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অপরিবর্তিত আছে এবং শেষ সময় পর্যন্ত এমনই থাকবে। এই শ্বাশ্বত মানদন্ডের নথিপত্র, আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সেই-না-দেখা জগত থেকেই। আপনার আশপাশের মানুষ কী মনে করলো, আপনি তাদের কাছে নন্দিত হলেন নাকি নিন্দিত ,দুনিয়ার পরিবর্তনশীল ধারা কোন দিকে ধাবিত হল এই বিষয়গুলোকে সেই মানদন্ড মোটেই আমলে নেয় না।

আমার ভাই ও বোনেরা, এই জন্যই কুরআনে বর্ণিত  তাওহীদের মানদন্ডকে আঁকড়ে ধরতে পেরে আপনি নিজেকে সবচেয়ে লাভবান মনে করেন। এই যুগেও সেই আদর্শের আল ওয়ালা ওয়াল বারা[২] এর বাহক হতে পারাটাকে আপনি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কাজ হিসাবে গণ্য করেন। আর এই আদর্শই আপনাকে তাগুতের [৩] সাথে আপোষ অথবা এর সামনে মাথা নত করাকে এই পৃথিবীর হীনতম অপমান হিসেবে চিনতে শেখায়। আপনার হৃদয় আপনার জনপ্রিয়তা আর বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্যের পরোয়া না করেই এই আদর্শের উপর অটুট থাকে। কেন? কারণ আপনি যে আদর্শের উপর চলেন তা  এমন এক জগত  থেকে আগত যেখানে রীতিনীতি কখনো পরিবর্তিত হয় না। তাই এই অদৃশ্য জগতের উপর বিশ্বাস আপনাকে সেই অপরিবর্তনীয় মানদন্ডের মতোই দৃঢ়পদ রাখবে। রাতারাতি ধর্মত্যাগ করা যে সমাজে আধুনিকতায় পরিণত হয়েছে, আজকের সেই সমাজে সূরা বাকারার এই আয়াতগুলো যেন আরও অর্থবহ হয়ে ওঠে।

 

 

গায়েবের  উপর দৃঢ় বিশ্বাস আপনাকে সাহসী করে তোলে। সত্যকে সমুন্নত রাখতে আপনি জীবনে যেকোনো ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত। স্মরণ করুন বদর যুদ্ধের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই দুআ-

 

“হে আল্লাহ ! এই ক্ষুদ্র দল যদি আজ পরাজিত হয় তবে এই দুনিয়ায় আপনার ইবাদাত করার আর কেউ থাকবে না।”

 

চিন্তা করুন সেই দিন মুসলিমদের বিপক্ষে কতটুকু প্রতিকূলতা ছিল – ব্যর্থতা আর বিলুপ্তির ঝুঁকি এত বেশি ছিল যে ইসলাম চিরতরে মুছে যাবার মত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো। অথচ এসব কিছু শুধু তাদের সংকল্পকেই আরও দৃঢ় করে তুলেছিল এবং তারা নিঃশঙ্ক চিত্তে  অগ্রসর হয়েছিল। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, কী তাদেরকে এতটা ঝুকি নিতে উদ্বুদ্ধ করলো? কী তাদের মনে সাহস সঞ্চার করলো?কীসের দ্বারা তাদের অন্তরগুলো এতটা দৃঢ়তা লাভ করলো? আপনি অনুধাবন করবেন যে, এই পৃথিবীতে ক্রিয়াশীল শক্তিগুলো সম্পর্কে তাদের গভীর দূরদৃষ্টি  ছিল। তারা জানতেন যে অদেখা গায়েবের জগত থেকে এমন শক্তি উন্মোচিত হতে পারে এবং হবে যা মানুষের পক্ষে কখনও কল্পনাও করা সম্ভব না। সেই শক্তি কখন আসবে তা তারা নির্দিষ্টভাবে না জানলেও তারা এটা জানতেন যে তা প্রকাশ হবেই, আর তা প্রকাশ হয়েওছিল।৪ হেবা দাবাগ (Heba Dabbagh)তার ‘Just Five Minutes‘গ্রন্থে (পৃঃ ৪৮-৪৯) বর্ণনা করেন যে কারাবন্দী অবস্থায় তার মাকে ওনার  ছেলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিলো। তিনি এর উত্তরে বলেছিলেনঃ “আমি কেবল এতটুকু জানি যে, আমি তাকে বড় করেছি ঘর থেকে মসজিদ আর মসজিদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য”। পরবর্তীতে সেই কর্মকর্তা  জিজ্ঞাসাবাদকারীকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘”কে নির্যাতন করার ব্যবস্থা কর“। হেবার মা জবাবে বলেন যে, “কী আশ্চর্য ! আমি তোমার মা’র বয়েসী আর তুমি আমাকে মারতে চাও!”  এরপর তাকে  একাকী বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। তখন তিনি অকারণে তাকে আটকে রাখার ব্যাপারে কারাগারের ওয়ার্ডেনের কাছে অভিযোগ করেন। তিনি বলেনঃ “আমাকে কাগজ – কলম দিন। আমি এই পুরো ডিভিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করব”। অফিসার উত্তরে বলে যেঃ “এটার অনুমতি নেই। এটি কখনও কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছবে না।আর  এটা আইনের পরিপন্থী”। পরে হেবার মা বলেন,“তবে আমি একমাত্র আল্লাহ’র কাছে আমার অভিযোগ তুলে ধরবো। তিনিই সর্বোত্তম বিচারক। আল্লাহ চান তো একদিন তুমি আমার অবস্থানে থাকবে কিন্তু আমার মতো ধৈর্য তোমার থাকবে না।” বোন হেবা পরে উল্লেখ করেন যেঃ “একমাস বা দুইমাস পর আমরা সেই অফিসারের মৃত্যু সংবাদ পাই। সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় । গাড়ির স্টিয়ারিং তার পেটে ঢুকে গিয়েছিলো।”
সুতরাং,  অনুধাবন করুন কীভাবে অদৃশ্য জগত  আমাদের এই দৃশ্যমান পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এর বিপরীত কখনও হয় না – এই বিশ্বাস আপনাকে আরও দৃঢ়পদ করে তোলে। দুনিয়ার কোন শক্তিই আপনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কারণ আপনি এর থেকেও অনেক বেশী শক্তিশালী সত্ত্বার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। আর এই বাস্তবতায় আমাদেরকে শতভাগ বিশ্বাসী হতে হবে।
গায়েবে বিশ্বাসী হিসেবে আপনি  যেকোনো আপাতদৃষ্ট ক্ষতিকে গ্রহণ করতে সক্ষম। বরং ক্ষতিটাকে আপনি প্রাপ্তি বলে মনে করেন। আপনার লাভ ক্ষতির হিসাব আপনার আশেপাশের মানুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা লাভ ক্ষতির হিসাব করে টাকা আর সুস্থতার ভিত্তিতে। আর আপনি লাভ ক্ষতি পরিমাপ করেন দৃঢ়তা আর আল্লাহ’র সন্তুষ্টির ভিত্তিতে। আপনি যতক্ষণ আপনার নীতির সাথে সৎ থাকছেন আর আল্লাহ’র সন্তুষ্টির সবগুলি শর্ত যথাযথভাবে পালন করছেন, ততক্ষণ আসলে আপনার ক্ষতি বলতে কিছুই নেই। নীতির ক্ষেত্রে দুর্বলতা আর শরীয়াহ লঙ্ঘনই আপনার নিকট সবচেয়ে বড় ক্ষতি। বাহ্যতভাবে উহূদ যুদ্ধ মুসলিমদের পরাজয়  মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তা যে একটি বিজয় ছিল সে বিষয়ে ইমাম ইবন আল-কায়্যিম তার ‘যাদ-উল-মাআদ’ গ্রন্থে প্রায় আট পৃষ্ঠাব্যাপী বিশদ আলোচনা করেছেন। মুসলিমদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যারা পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে চান, তাদের উচিত তার এই লেখাটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করা। আমরা যদি গায়েবের আদর্শের মানদণ্ডে আমাদের লাভ – ক্ষতি নির্ধারণ করি তবে এই দুনিয়ার কোন ক্ষতিই আর আমাদের কাছে ক্ষতি মনে হবে না, তা সে যত বড়ই হক না কেন। আমাদের ধর্মকে আক্রমণ করা হবে, আমরা জেলে বন্দী হব, আমাদের ভূমি আক্রান্ত হবে, লুট করা হবে। কিন্তু এসব আমাদের পরাজিত করতে পারে না কারণ এসবই এই দুনিয়ার লেনদেন। কিন্তু সেই অদৃশ্য জগতে আমাদের পুরস্কারের খতিয়ান প্রস্তুতি, জান্নাতে আমাদের জন্য নির্মাণাধীন প্রাসাদসহ অন্যান্য কর্মচাঞ্চল্য  জয় – পরাজয়ের এক ভিন্ন চিত্র অংকন করে।
এই চিন্তাধারার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছেন আমাদের বোন আফিয়া সিদ্দিকীর মা। বোন আফিয়া সিদ্দিকী  বছরের পর বছর এমন মানুষদের কাছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যারা দিনরাত  বক্তৃতা দেয় নারীদের সাথে আমাদের কেমন আচরণ করা উচিত। তাকে প্রথমে অপহরণ করা হয়, পরে আমেরিকার গোপন কারাগারে আটকে রাখা হয়, সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা করা হয়, তার প্রতি কৃত অত্যাচারের প্রমাণগুলোকে তার সাথেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আশায় তাকে তলপেটে দুইবার গুলি করা হয়। আরও অনেক অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হয়েছেন আমাদের এই বোন। আর সবশেষে তার বিরুদ্ধে এমন এক অবাস্তব অভিযোগ আনা হয় যা তার শারীরিক অবস্থার আলোকে চরম হাস্যকর।এই নারীর প্রতি চালানো নির্যাতন আমাদের হৃদয়ের অনুভূতিগুলোকে বাকহীন করে দেয়।  এতদসত্ত্বেও তার সাহসী মায়ের চিন্তাধারা গায়েবের প্রতি অবিচল বিশ্বাসের এক নিখুঁত উদাহরণ।আর এই বিশ্বাসই তাকে আপাতদৃষ্টির এই দুরবস্থাকে বিজয় হিসাবে গ্রহণ করার শক্তি যুগিয়েছে। তিনি তার কন্যার প্রতি আনীত অভিযোগ শুনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এইভাবেঃ
‘এতদিন আমি খুবই অসুস্থ ছিলাম, আমি বিছানা থেকে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার মেয়ের বিচারের রায় শুনে আমি যেন নতুন জীবন পেয়েছি। যদি বিচারকরা মনে করে থাকে যে আফিয়ার পরিবারের জন্য আজকের দিনটি একটি কালো দিন, তার মা রায় শুনে অজ্ঞান হয়ে যাবে, তবে তারা জেনে রাখুক আজকের চেয়ে খুশির দিন আমার জীবনে আর আসেনি। আল্লাহ এক আফিয়ার পরিবর্তে আজ আমাকে হাজারটা পুত্র সন্তান  দিয়েছেন যারা প্রতিদিন আমাকে সাহায্য করার জন্য আমার দরজায় অপেক্ষা করে।’
সবশেষে তিনি বলেনঃ ‘একজন মু’মিনের লক্ষণ এটাই যে সে আল্লাহ ছাড়া আর কারও সামনে মাথা নত করে না। যেইদিন আমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন সৃষ্ট জীব অথবা বস্তুর করুণা ভিক্ষা করব,সেইদিন আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।’

এটাই লাভ-ক্ষতির প্রকৃত অর্থ যা  গায়েবের  মানদন্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত । এটি এই নশ্বর স্পৃশ্য জগতের উপর নির্ভর করে না ।

তাই গায়েবের উপর বিশ্বাস মুসলিম হিসেবে আমাদের জীবনে অত্যন্ত গভীর আর শক্তিশালী তাৎপর্য বহন করে।

শান্তি ও দয়া বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর।

.
তারিক মেহান্না
,

প্লিমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি, আইসোলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮

ফজরের আগে লিখিত,

শুক্রবার ২৭ শে সফর, ১৪৩১ / ১২ ই ফেব্রুয়ারী, ২০১০

.

[১] আল্লাহর তাওহীদে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপনকারী

[২] আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা শীর্ষক ইসলামের একটি মূলনীতি

[৩] আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদাত(এমন যে কোনো কাজ যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট) করা হয় এবং তারা এতে সন্তুষ্ট

[৪] বদর যুদ্ধে ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্যের কথা বলা হচ্ছে। দেখুন সূরাহ আনফাল [৮:৯-১০]

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ২)

সূরা বাকারা আয়াত ২১-২২ এ আল্লাহ বলেনঃ

 

হে মানুষ, তোমরা মহান আল্লাহ দাসত্ব স্বীকার করো, যিনি তোমাদের এবংতোমাদের আগে যারা ছিলো তাদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা ধর্মভীরু হও। যিনিতোমাদের জন্য যমীনকে শয্যা আর আসমানকে ছাদ স্বরূপ সৃষ্টি করেছেন…।

 

আপনি এই আয়াতগুলো থেকে যে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন তা হল, যদি আপনার ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে তবে দ্রুত তা শক্তিশালী করার উপায় হল দুটো জিনিসের দিকে মনোনিবেশ করাঃ আপনি এবং আপনার চারপাশ। বেশি নয়, প্রতিদিন কেবল ১৫ মিনিট মনোযোগ দিয়ে নিজের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দিকে তাকিয়ে একটু ভাবুন। আপনি দেখবেন আপনার দিনের বাকিটা আল্লাহর কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে করতে কেটে যাবে।

 

অতিক্ষুদ্র একটি শুক্রাণু আর একটি ডিম্বাণুর সম্মিলনে আমার আপনার এত বড় দেহ গঠিত হয়েছে। সেই ক্ষুদ্র বস্তু থেকে আমাদের হাড়, শিরা-উপশিরা, রক্ত-কণিকা, মাংস, ত্বক, ইত্যাদি অস্তিত্ব লাভ করেছে। দেহের ভিতরের অথবা বাইরের প্রত্যেকটি অঙ্গের স্ব-স্ব কাজ সম্পাদনের জন্যে প্রত্যেকের আলাদা আকৃতি, মাপ আর অবস্থান রয়েছে।

 

যেমন আপনার দেহের কংকালের কথাই ভাবুন। এটি শক্ত হাড় দিয়ে গঠিত যার উৎপত্তিস্থল ছিল সেই জমাট বাধা শুক্রাণু। আর দেখুন কীভাবে এটি এখন আপনার দেহের ভারবহন করে আছে। এর প্রত্যেকটি হাড়ের গঠন ও কাজ আলাদা। এদের কোনটি বড়, কোনটি ছোট, কোনটি লম্বা, কোনটি আবার ক্ষুদ্র, কোনটি গোল, কিছু আছে ফাঁপা, কিছু চওড়া, কতগুলি সরু, কোনটি ঘন আবার অনেকগুলো আছে হালকা। চিন্তা করুন যদি আপনার কংকাল কেবল একটি একক হাড়ের দ্বারা গঠিত হত তবে, আপনি নড়াচড়া করতে পারতে না। তার বদলে কয়েকশ হাড়ের সুসংগঠিত সমষ্টি দিয়ে আল্লাহ আপনার এই কংকাল বানিয়েছেন। এর প্রত্যেকটি হাড় একটি সূক্ষ্ণ জয়েন্টের মাধ্যমে একটি আরেকটির সাথে লেগে আছে। আর আপনার চলাফেরায় প্রতিটি হাড় নিজ নিজ ভূমিকা পালন করছে।

 

আপনি আপনার দেহের শত শত পেশীগুলোর কথাই একবার ভাবুন, যার প্রত্যেকটিতে আছে মাংস, শিরা-উপশিরা আর পেশীবন্ধ। এদের প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থিত, আর নির্দিষ্ট আছে এদের কাজ। দুই ডজন এরও বেশি পেশী কেবল চোখের পাতা খোলা আর বন্ধের কাজে নিয়োজিত আছে। যদি এর থেকে একটিও পেশী কম থাকত তবে আমরা আর কখনও আমাদের চোখের পাতা খুলতে পারতাম না। তেমনি দেহের প্রত্যেকটি পেশী কোন না কোনও অঙ্গের ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কোন একটি পেশীর অনুপস্থিতি হয়ত সেই অঙ্গটাকেই অকেজো করে ফেলত। চোখের পাতা নিজেই তো একটি বিস্ময়, কি নিঁখুতভাবে এটিকে বসানো হয়েছে আর তা আমাদের চোখকে ময়লা আর অতিরিক্ত আলো থেকে রক্ষা করছে।

 

চোখের কথাই ভেবে দেখুন – রেটিনা, ফোভিয়া-সেন্ট্রালিস, অপটিক নার্ভ, স্ক্লেরা, ভিট্রিয়াস হিউমার, লেন্স, আইরিস এবং কর্নিয়া নিয়ে আমদের একটি চোখ গঠিত। এসব কিছু একসাথে কাজ করছে বিধায় আপনি এই লেখাগুলো পড়তে পারছেন, আকাশ দেখছেন, তারা উপভোগ করছেন, মেঘ, রঙ, গাছপালা, প্রাণীজগৎ আরও কত কী সুন্দরভাবে দেখতে পারছেন। আর এই সবকিছুই হচ্ছে আমাদের চিন্তা আর চেষ্টার সীমার বাইরে।

 

আপনার কানের কথাও ভেবে দেখুন। কীভাবে এটিকে সুচারুভাবে নকশা করা হয়েছে যাতে যে কোন আওয়াজ এসে আপনার কানের ছিদ্রে প্রবেশ করে আপনার কানের পর্দা পর্যন্ত পৌঁছে যায় আর আপনি তা স্পষ্ট শুনতে পান।

 

জিহ্বার প্রতি খেয়াল করুন, একটি পেশী যা আপনার চিন্তা ও অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করতে সাহায্য করে। দেখুন কী সামঞ্জস্যপূর্নভাবে আপনার দাঁতগুলো একটি আরেকটির পাশে বসে আপনার মুখের সৌন্দর্যবর্ধন করছে। এই দাঁতগুলোর কোনটি কামড় দেয়, কোনটি চিবোয়, কোনটি আবার গুড়ো করে। প্রত্যেকটি দাঁতেরও ভিন্ন ভিন্ন কাজ এবং উদ্দেশ্য ভাগ করে দেয়া আছে। আপনার ঠোট আপনার মুখকে আটকে রাখে, একে রঙ দান করে আর আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী প্রত্যেকটি শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণে সহায়তা করে। আল্লাহ আপনার স্বরযন্ত্রকে এমন ভাবে বানিয়েছেন যে আপনার কন্ঠ নিঃসৃত প্রত্যেকটি শব্দ সেই ধ্বনি বহন করে যা দুনিয়াতে অনন্য, আর কারও সাথেই তা মিলে না। শ্রোতা শুনামাত্রই বুঝতে পারে সে কার কথা শুনছে। এসবের মাঝে আছে এক জটিল আর বিস্তারিত প্রক্রিয়া, পদ্ধতি আর বিস্ময় যা এখানে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না।

 

আপনার হাতের দিকে মনোনিবেশ করুন আর ভাবুন কীভাবে এটি কাজ করে। আপনার হাতের তালু, পাঁচটি আঙ্গুল যাদের চারটি একদিকে আর একটি অন্য দিকে। বৃদ্ধাঙ্গুলি অন্য দিকে হওয়াতে এটি অন্য সব আঙ্গুল স্পর্শ করতে পারে। অন্য আর কোন উপায় নেই যেভাবে হাত বানালে তা তার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারত। কল্পনা করুন যদি পাঁচটি আঙ্গুল একই পাশে পাশাপাশি থাকত ! তবে আপনার পক্ষে একটি বাক্যও লেখা সম্ভবপর হতো না।

 

তারপর আপনার নখের মত তুচ্ছ একটি জিনিসের দিকে নজর দিন। এটি আপনার আঙ্গুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে, আপনাকে অনেক কিছু ধরতে সহায়তা করছে যা আপনি অন্যভাবে ধরতে পারতেন না। এত সামান্য একটি জিনিস নখ যা হয়ত আপনার মনোযোগ আকৃষ্ট করে না, অথচ এটি না থাকলে হয়ত আপনি অসহায় হয়ে পড়তেন।

 

 

এসব অত্যাশ্চর্য বস্তুর সমন্বয়ে আপনার দেহ গঠিত হয়েছে, যার মূলে ছিল কেবল একবিন্দু আণুবীক্ষণিক জমাট বাধা তরল কণা। এসব মিলেই আপনি – শত কোটি ছায়াপথের মধ্যে কোন একটির মাঝে অবস্থিত নগণ্য এক তারকার চারপাশে পরিভ্রমণরত একটি গ্রহের অগণিত সৃষ্টিকুলের মাঝে কোটি কোটি সদস্যের মানব সম্প্রদায়ের একজন সদস্য মাত্র। আর বিস্ময়কর এই তারকাদের অলৌকিকত্বের সারাংশ তুলে ধরাও একটি বিশাল কঠিন কাজ। এসব কিছু উদ্দেশ্যবিহীন, দৈবক্রমে সংঘটিত কোন প্রাকৃতিক ঘটনা হতে পারে না।

 

এগুল সব কিছু সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ’র প্রয়াসহীন সৃষ্টি। সূরা বাকারার এই দুইটি আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে দুইটি ব্যাপারে চিন্তা করতে বলেছেনঃ

  •   নিজেদেরকে
  •   নিজেদের চারপাশকে, যাতে করে আল্লাহ’র ইবাদাতে আমাদের মন নিবিষ্ট হয় –  

হে মানুষ, তোমরা মহান আল্লাহ দাসত্ব স্বীকার করো, যিনি তোমাদের এবংতোমাদের আগে যারা ছিলো তাদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা ধর্মভীরু হও। যিনিতোমাদের জন্য যমীনকে শয্যা আর আসমানকে ছাদ স্বরূপ সৃষ্টি করেছেন…।

 

সুতরাং যখন নিজের মধ্যে ঈমান – আমলে দুর্বলতা অনুভূত হবে, ইবাদাতে শক্তি ও মিষ্টতা পাবেন না তখন নিজের দেহের কথা ভাবুন অথবা কোন এ্যানাটমি বই খুলে দেখুন অথবা গুগলে হাবল টেলিস্কোপে ধারণ করা  মহাকশের ছবি সার্চ করে দেখে ভাবুন আর তারপর চোখ বন্ধ করে আল্লাহ’র বড়ত্ব নিয়ে চিন্তা করুন।

 .

তারিক মেহান্না,

প্লিমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,

আইসলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮

তারিখঃ মঙ্গলবার ১৬ ই রবি-উল-আউয়াল ১৪৩১,

২রা মার্চ, ২০১০

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ৩)

 

সূরা বাকারা আয়াত ৬১, আল্লাহ্‌ বনী ইসরাইলদের উদ্দেশ্য করে বলেন,

 

(স্মরণ করো) যখন তোমরা বললে, হে মূসা! (প্রতিদিন) একই ধরনের খাবারের ওপর আমরা কিছুতেই (আর) ধৈর্যধারণ করতে পারি না, তুমি আমাদের পক্ষ থেকে তোমার রবের নিকট প্রার্থনা কর, তিনি যেন আমাদের জন্য এমন খাদ্যদ্রব্যের ব্যবস্থা করেন যা জমিন থেকে উৎপন্ন হয়, যেমন তরিতরকারি, পেয়াজ, রসুন,গম, ভুট্টা, ডাল। তিনি বললেন, তোমরা কি (আল্লাহ্‌র পাঠানো) এ উৎকৃষ্ট জিনিসের সাথে একটি তুচ্ছ (ধরনের) জিনিসকে বদলে নিতে চাও? (যদি তাই হয়) তাহলে তোমরা অন্য কোনো শহরে নেমে যাও, সেখানে তোমরা যা কামনা করছো তা পাবে, (আল্লাহ্‌ তা’আলার আদেশ অমান্য করার ফলে) শেষ পর্যন্ত অপমান ও দারিদ্র্যতা তাদের ওপর ছেয়ে গেল; …

 

কোন গোষ্ঠী বা জাতি দীর্ঘদিন যাবত অন্যায়-অবিচার এর শিকার হতে হতে একসময় সেই অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। আর এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে এই হীনম্মন্যতার গ্লানি তাদের অন্তরকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

ফির’আউনের অত্যাচার এবং অনাচার বনী ইসরাইলের মন-মননকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলো এবং তাদের চরিত্রে দাসত্বের বীজ বপন করেছিল। আল্লাহ্‌ মূসাকে (আলাইহিস সালাম) বনী ইসরাইলদের রক্ষা করে মিশর থেকে বের করে নিয়ে আসার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল বনী ইসরাইল সম্প্রদায়কে দাসত্বের লাঞ্ছনা থেকে পরিত্রাণ দেওয়া এবং সম্মানিত ও গৌরবময় এক জাতিতে পরিণত করা। কিন্তু মিশর ত্যাগ করে কিছু দূর যাওয়ার পরই তারা ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে। তখন তারা মূসাকে (আলাইহিস সালাম) দোষারোপ করতে লাগলো। এক্সোডাস ১৬:৩ এ আছে যে, তারা মূসা (আলাইহিস সালাম) এবং হারুন (আলাইহিস সালাম) কে বলেছিল,

 

“হায়! যদি আমরা কেবল মিশরে আমাদের প্রভুর হাতে নিহত হতে সম্মত হতাম, সেখানে আমরা মাংসের পাত্রের পাশে বসে থাকতাম আর ইচ্ছামতো রুটি খেতে পারতাম; কিন্তু তোমরা আমাদেরকে এই বিরান এলাকায় এনে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছ”

 

একটা বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পরও এরকম একটি অবস্থায় তারা আরও নানা রকম খাদ্য উপকরণ চেয়ে আল্লাহ্‌র কাছে অভিযোগ করছিলো! সেই কথাই সূরা বাকারার এই আয়াতটিতে বলা হয়েছে। মিশরে কঠিন দুর্দশা ভোগ করা সত্ত্বেও কেবল এইসব দুনিয়াবী ভোগের সামগ্রীর জন্য তারা সেই অতীত জীবনের কথা ভেবে আক্ষেপ করছিলো! এছাড়াও যখন মূসা (আলাইহিস সালাম) আল্লাহ্‌র সাথে কথা বলতে কয়েকদিনের জন্য তাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন, তখন তারা তাদের কাছে সঞ্চিত ফির’আউনের অলংকারগুলো দিয়ে স্বর্ণের বাছুর নির্মাণ করে তার ইবাদাত করা আরম্ভ করে দেয়! তাদের মনে তাদের মিথ্যে প্রভুদের ভক্তি এতটাই তীব্র ছিলো, যে তারা আক্ষরিক অর্থেই সেই প্রভুদের দাসে পরিণত হয়েছিল।

 

অর্থাৎ বাহ্যত মুক্ত হলেও বনী ইসরাইল জাতি হীনম্মন্যতা ও মানসিক দাসত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। আর এই দাসত্ব এমন মারাত্মক পর্যায়ের ছিল যে, যখন তাদেরকে প্রতিশ্রুত জেরুজালেমে প্রবেশ করতে বলা হল তখন তারা উত্তরে মূসা (আলাইহিস সালাম) কে বলে বসে, “তুমি আর তোমার প্রতিপালক গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানেই বসে থাকব।” তাদের আত্মসম্মানবোধ বলে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

 

যে ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা জাতি দীর্ঘদিন ধরে অবিচার, অন্যায় আর পরাজয়ের শিকার হয়ে আসছে তাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম পদক্ষেপ হল তাদের মধ্যে মুক্ত, স্বাধীন এবং মর্যাদাভিত্তিক গুণাবলী আর মানসিকতার উন্মেষ ঘটানো, যেটাকে আমরা বলে থাকি “হার-না-মানা-মানসিকতা”। দ্বিতীয় ধাপে আসবে জ্ঞান অর্জন, এ ধাপে সাহসী ব্যক্তিত্বের মাঝে শরীয়াহর জ্ঞানের উন্মেষ ঘটাতে হবে এবং তারপরের ধাপে আসবে সে জ্ঞানের প্রয়োগ। অজ্ঞতা এবং বিপথগামীতাই কেবল আমাদের একমাত্র সমস্যা নয়। আজ আমরা অনেক দা’য়ী আর ইমামদের দেখি যারা অনেক শিক্ষিত এবং সুন্নাহর উপর অনেক জ্ঞান রাখেন অথচ তাদের মাঝে কি যেন একটা নেই।

 

একজন মানুষ যে আদর্শ বা বিশ্বাসই গ্রহণ করুক বা সে অনুসারে জীবনযাপন করুক না কেন, তার পক্ষে বিস্ময়কর কিছু করে দেখানো সম্ভব হয় তখনই, যখন সে শারীরিক ও মানসিক উভয়বলয়ে মুক্ত আর স্বাধীন থাকে। আমাদের এই সত্যটি অনুধাবন করতে হবে। পৃথিবীতে এই পদ্ধতিতেই সফলতা আসে। সুতরাং বনী ইসরাইলের জন্য এবং অনুরূপভাবে আমাদের জন্যও প্রথম লক্ষ্য – জ্ঞানার্জন অথবা ইবাদাতে নিমগ্ন হওয়া নয়। বরং আমাদের প্রথম করণীয় হচ্ছে একজন সত্যিকার মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। নিজের মর্যাদা অনুধাবন করা। নিজেদেরকে মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করা। ইসলামের মাঝে জীবন খুঁজে পাওয়ার লক্ষণ মূলত এগুলোই- দুর্বলতা আর হীনম্মন্যতা হটিয়ে শৌর্যের সাথে উঠে দাঁড়িয়ে আত্মসম্মানবোধকে জাগ্রত করা। অন্যথায় আমরা শুধুই চলমান লাশ।

 

 

অতএব আমাদের প্রথম সমস্যা এবং তার প্রথম সমাধান হওয়া উচিত এই আভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মাধ্যমে। (প্রাতিষ্ঠানিক) অজ্ঞতা, গৌণ বিষয়ে বিচ্যুতি, ঐক্যের অভাব ইত্যাদি মুসলিম উম্মাহর বড় বড় সমস্যা ঠিকই কিন্তু মৌলিক সমস্যা নয়। আমাদেরকে অবশ্যই একেবারে প্রাথমিক, সার্বজনীন ও জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো থেকে আরম্ভ করতে হবে। নতুবা সত্যিকারের দা’ওয়াহ কার্যক্রম এবং মুসলিম হিসেবে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আমরা খুব বেশিদূর যেতে পারবো না। বনী ইসরাইলের মানুষেরা আল্লাহ্‌কে বিশ্বাস করত, ইবাদাত করত। কিন্তু মানসিকভাবে তারা তাদের পুরাতন প্রভুদের গোলামী থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাই স্বাধীন জীবনের সম্মানজনক ক্ষুৎপিপাসার চেয়ে অপমানজনক দাসত্বের সাথে আসা উচ্ছিষ্ট ভালো খাবারকেই তারা শ্রেয় মনে করা শুরু করে।

 .

তারিক মেহান্না,
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,
আইসোলেশন ইউনিট, সেল #১০৮

তারিখ: বুধবার, ১৭ ই রবি-উল-আওয়াল, ১৪৩১ হিজরি,
৩রা মার্চ, ২০১০

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ৪)

 

সূরা বাকারা আয়াত ৭৯ এ আল্লাহ্‌ বলেন,

অতএব তাদের জন্য আফসোস! যারা নিজ হাতে কিতাব লেখে এবং বলে এটি আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অবতীর্ণযাতে তারা এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্য।

 

পৃথিবীর অনেক ধর্মের ঐশী বাণীই মানুষ কাঁটাছেড়া করে বিকৃত করেছে। এটি একটি চিরাচরিত ঘটনা এবং ইতিহাসে অনেক আগে থেকেই ঘটে আসছে। আর এর ফলে ধর্মের ভাবমূর্তিতে ব্যাপক ধ্বস নেমেছে, রটেছে দুর্নাম। পশ্চিমে ধর্মীয় চিন্তাধারা আর বিজ্ঞানের মাঝে যে প্রকট দ্বন্দ্ব বিদ্যমান, এটি তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

 

প্রকৃতিপূজারি রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটে চতুর্থ শতাব্দীতে। খ্রিষ্টধর্মের প্রকৃত একত্ববাদের শিক্ষা দ্বারা পৌত্তলিক রোমানদের প্রভাবিত করার পরিবর্তে খ্রিষ্টধর্ম নিজেই পৌত্তলিকদের রীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন রোমান সম্রাট হিসেবে কন্সটানটাইন, খ্রিষ্টান আর রোমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে মিশ্রিত করে এক সংকর ভাবধারার প্রচলন করে। ফলাফল, আজকের বিকৃত খ্রিষ্টধর্ম। এই বিকৃত খ্রিষ্টধর্মই পুরো ইউরোপ জুড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। পুরো মধ্যযুগ ধরে “খ্রিষ্টধর্মের” এই রূপের আড়ালে ক্যাথলিক চার্চ ইউরোপে মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রা একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো। এর ফলে বাইবেলের ব্যাখ্যায় পোপের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হয় এবং সে হিসেবে পোপ হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক জীবনে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। খ্রিষ্টধর্মের কিতাবের বাণী নয়, বরং পোপের ব্যাখ্যাই ছিল সমস্ত ধর্মীয়, বৈষয়িক এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উৎস।

 

ফলে, ১৫শ’ শতকের দিকে, ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠে। এই “প্রোটেস্ট” বা প্রতিবাদের মূল আপত্তি ছিল ত্রিতত্ত্ববাদ(trinity), পাপ স্বীকার(confession) ইত্যাদি ধারণা। এগুলো প্রকৃত খ্রিষ্টধর্মের অংশ নয়। মার্টিন লুথার, কেলভিন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ যে সংস্কার নীতিমালা প্রস্তাব করেন তাতে তৎকালীন প্রচলিত খ্রিষ্টধর্মের অনেক রীতিনীতির বিরোধিতা করা হয়। ঐশ্বরিক বাণীর ব্যাখ্যায় পোপের একচেটিয়া আধিপত্যের উপর অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়। আরও কিছু বিষয় যেমন ত্রিতত্ত্ববাদ বা ট্রিনিটি(trinity) কেও বাতিল ঘোষণা করা হয়। এই ত্রিতত্ত্ববাদ রাসূল ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর আনীত শিক্ষার পরিপন্থী। এই পর্যায়েই রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে ভিন্ন মতাদর্শী নতুন আরেক ভাবধারার খ্রিষ্টান চার্চের আবির্ভাব হয়। যার নাম “প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ” (ইংরেজি ‘protest’ শব্দ থেকে উদ্ভূত)। এটি ছিল যীশুর ( ঈসা(আলাইহিস সালাম) ) প্রকৃত শিক্ষা বিকৃত করার প্রাথমিক পরিণাম।

 

এ ঘটনার দু’শ বছর পর আমরা দেখতে পাই যে, চার্চের পক্ষ থেকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া, বানোয়াট, ভ্রান্ত আর ভ্রমাত্মক বৈজ্ঞানিক শিক্ষার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দানা বেঁধেছে। ক্যাথলিক চার্চ তার শিক্ষার সাথে বিরোধপূর্ণ বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনকে সহিংসভাবে দমন করতে চেষ্টা করে। এইসব কিছুই করা হতো ধর্মের দোহাই দিয়ে। বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন বিষয়াদিতে চার্চের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সত্যিকারের অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী বিজ্ঞানী আর দার্শনিকদের চার্চের তোপের মুখে পড়তে হয়। বাড়তে থাকে চার্চ এবং বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক সংঘাত। এই নভেম্বরে (২০১০) লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ৩৫০ বছর পূর্ণ হল। প্রায় বারোজনের মতো বিভিন্ন বিষয়ের বিজ্ঞানীরা এক হয়ে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলো। বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতি প্রণয়নের কৃতিত্ব এদেরকে দেওয়া হয়। পশ্চিমা বিশ্বে এরাই বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা বের করা, পরস্পরের গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা(peer review) আর পরিকল্পিত বিশ্লেষণ করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। আজ পশ্চিমা বিশ্ব এটিকে আধুনিক বিজ্ঞানের সূতিকাগার হিসেবে কৃতিত্ব দিয়ে থাকে। খেয়াল করার ব্যাপার হল, এই উদ্যোগকে চার্চের প্রচলিত শিক্ষার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এটাকে ব্যাপক পরিসরে “ধর্মের” বিরুদ্ধেই চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হয়।

 

সপ্তদশ শতাব্দীতে দেখা গেল চার্চের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হতে চলেছে। এর মূল কারণ ছিল, বস্তুজগৎ সম্পর্কে চার্চের ভিত্তিহীন বিচার বিশ্লেষণ এবং সে বিচার-বিশ্লেষণ চাপানোর লক্ষ্যে তাদের অন্যায়ভাবে বল প্রয়োগ। ঈসা (আলাইহিস সালাম) আনীত বিশুদ্ধ তাওহীদবাদী শিক্ষাকে নষ্ট করে ফেলার কারণেই ঘটনা এতদূর গড়িয়েছিল। এতে করে ইউরোপের দার্শনিক সমাজে ধর্ম একটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়।

 

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে মানুষ ধর্মকে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা আরম্ভ করলো। অথচ পূর্বে যুক্তি ছিল ধর্মের অধীন আর চার্চের কর্তৃত্ব ছিল প্রশ্নাতীত। এ অবস্থায় জ্ঞানের উৎস আর পথনির্দেশিকা হিসেবে যুক্তি আর বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা সর্বাধিক গুরুত্ব পেতে শুরু করে। রাষ্ট্রনীতি, আইন, শিষ্টাচার এমনকি ধর্মীয় জ্ঞানের উৎস হিসেবেও মানুষ ধর্মের বদলে যুক্তিকে বেছে নেয়। এইসব “জ্ঞান” মূলত ছিল দার্শনিকদের চিন্তাধারার প্রতিফলন। এই যুগ ইতিহাসে আলোকপ্রাপ্তির যুগ, মানবতার যুগ, দেবত্বের যুগ নামে পরিচিত। হ্যাঁ, দেবত্বের যুগ এইজন্য যে দার্শনিকরা “বুদ্ধি” আর “যুক্তি” কে ঈশ্বরের সমকক্ষ বা তার চেয়েও বড় মনে করত। তাদের কাছে ঈশ্বর ছিলেন এক বহিরাগত সত্তা। এই দুনিয়ার কার্যকলাপের ব্যাপারে তার কোনো অধিকার বা যোগসূত্রও নেই। তারা মানুষকে শিক্ষা দিতো যে সকল আধিপত্য “মেধা”র এবং একমাত্র মেধাশক্তির। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মকে কর্তৃত্বের আসন থেকে হটানো। চার্চের দূষিত শিক্ষার ফলে ধর্ম, রাষ্ট্রনীতি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় জীবনের যে বেহাল দশা হয়েছিল, তা থেকে পরিত্রাণ পেতেই তারা এ লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়।

 

ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই ভাবধারার নতুন বিবর্তন ঘটে। এই পর্যায়ে এসে এক শ্রেনীর মানুষ মনে করলো যে ধর্মকে জীবনের নানা ক্ষেত্র থেকে নির্বাসিত করার চেষ্টায় “আলোকপ্রাপ্তির যুগ (Age of enlightenment)” যতটুকু অগ্রসর হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। খেয়াল করুন, এর আগ পর্যন্ত দার্শনিকেরা কখনো ধর্মকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেনি। তারা ধর্মকে যুক্তি দিয়ে বিচার করে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছিল। তারা চেয়েছিল যুক্তি এবং বাস্তবসম্মত জ্ঞানের আলোকে ধর্মসহ অন্য সকল জ্ঞান বিচার করা হবে। কিন্তু নব উদ্ভাবিত এই চিন্তাধারা অনুভব করা যায় না এমন সকল কিছুকে অস্বীকার করলো। যা দেখা যায় না, তার অস্তিত্ব মেনে নিতে তারা রাজী নয়। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে ধর্মকে কেবল নির্বাসিতই করা হল না বরং একে সমূলে উৎপাটনের চেষ্টা শুরু হল। মানুষের স্বভাবগত বুদ্ধিবৃত্তি, সহজাত যুক্তি এবং মূল্যবোধ লোপ পেতে থাকলো। সেখানে জায়গা করে নিলো প্রকৃতিগত আর জৈবিক প্রবৃত্তি। নব উদ্ভাবিত এই বস্তুবাদী দর্শন অনুযায়ী, যা বাহ্যত দেখা যায় না তার সবই ধোঁকা। কার্যত, এই সময়কালেই বিজ্ঞানকে প্রকাশ্যভাবে ধর্মের (মূলত, ক্যাথলিক চার্চ) বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আবরো মনে করিয়ে দেই, চার্চ কর্তৃক ধর্মের বিকৃতি সাধন, নতুন তত্ত্ব সংযোজন এবং এগুলোকে ইউরোপের মানুষের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার ফলেই, এমনটি হয়েছিল। ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয় যে, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ থাকার কারণে ডারউইন আল্লাহ্‌কে মানুষ সৃষ্টির কৃতিত্ব দিতে অস্বীকার করেছিল। আমার মনে পড়ে, কলেজে আমাদের “সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব” বিষয়টি পড়ানো হয়। সেই ক্লাসে আমি জেনে খুব অবাক হয়েছিলাম যে, বানর থেকে মানুষে রূপান্তর কখন কীভাবে হয়েছিল সে ব্যাপারে ডারউইন কোনোরকম তত্ত্ব দাঁড় করায়নি। বরং তার মূল উদ্দেশ্য ছিল চার্চের বিরোধিতা করা।

 

১৬৩৬ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে, খ্রিষ্টান মিশনারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি স্থাপন করা হয়েছিল। আর আজকে যদি কেউ গুরুত্বসহকারে ধর্মশিক্ষার ক্লাস করতে চায় তবে তাকে অনেক দূর হেঁটে নির্জন আর আলাদা একটা ধর্মীয় স্কুলে যেতে হয়। অথচ দু’শ বছরেরও বেশি সময় পর্যন্ত এর মূলমন্ত্র ছিল ‘Christ et Ecclesiae’ (যীশু এবং গীর্জার উদ্দেশ্যে)। ১৮৪৩ সালে এই মূলমন্ত্র পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘Veritas’ (সত্য)।

 

এভাবেই ধর্মের (বিশেষভাবে পশ্চিমা ধ্যানধারণায়) সাথে বিজ্ঞানের ব্যবধান আর সংঘাত বাড়তেই থাকে। এসবই ছিল চার্চ কর্তৃক কয়েক শতাব্দীব্যাপী ধর্ম বিকৃতির প্রত্যক্ষ ফল। অতএব, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্য। তিনি শেষ অবতীর্ণ আসমানী কিতাব কুরআনকে অপরিবর্তনীয় রেখেছেন। উপরন্তু, বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত বিষয়াবলী আর ইসলামের মধ্যে কোনো অসঙ্গতি নেই।

 .

তারিক মেহান্না,
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,
আইসোলেশন ইউনিট, সেল #১০৮

তারিখ: সোমবার, ২০শে রবিউস-সানি ১৪৩১ হিজরি
৫ই এপ্রিল, ২০১০

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ৫)

 

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে সূরা বাকারায় বলেন,

অতঃপর তোমরাই পরস্পর খুনাখুনি করছ এবং তোমাদেরই একদলকে তাদের দেশ থেকে বহিস্কার করছ। তাদের বিরুদ্ধে পাপ ও অন্যায়ের মাধ্যমে আক্রমণ করছ। আর যদি তারাই কারও বন্দী হয়ে তোমাদের কাছে আসে, তবে বিনিময় নিয়ে তাদের মুক্ত করছ। অথচ তাদের বহিস্কার করাও তোমাদের জন্য অবৈধ। তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দূগর্তি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।” [ :৮৫]

 

এই আয়াতে বনী ইসরাইলের একটি ঐতিহাসিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। তারা কখনই তাদের গোত্রের বা সমাজের মানুষকে ভুলে যায় না।

 

ইউশা ইবনে নুন (আলাইহিস সালাম) এর মৃত্যুর পরে বনী ইসরাইলের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। তাদের এক গোত্র অন্য গোত্রকে আক্রমণ করতে থাকে এবং নিজ ভূমি থেকে তাড়িয়ে বহিঃশত্রুর হাতে নিজেদের ভাইদের তুলে দিতে থাকে। এরপরও তাদের মধ্যে একটি গুণ তখনও বিদ্যমান ছিল। আর তা হল তাদের গোত্রের কেউ বন্দী হলে তারা তাকে উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে যেত। যদিওবা তারা নিজেরাই প্রাথমিকভাবে এসব শুরুর পেছনে দায়ী! আজকেও আপনারা তাদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবেন। যখনই কোনো ইসরাইলী সৈন্যকে বন্দী করা হয় তখনই তারা তাকে উদ্ধারে সচেষ্ট হয়ে পড়ে। ২০০৬ সালে গোটা ইসরাইলী বাহিনীর লেবানন আক্রমণের পেছনে অজুহাত ছিল গুটিকয়েক ইসরাইলী সৈন্যকে মুক্ত করা। এমনকি ইসরাইলীরা যখন হামাসের সাথে প্রায়ই বন্দী বিনিময় করে তখন বন্দী বিনিময়ের অনুপাতটি বেশ চমকপ্রদ। যেমন দশ হাজার প্যালেস্টাইনীর বিনিময়ে মাত্র তিন জন ইসরাইলী সৈন্য! এই ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যটি বনী ইসরাইল আজও ধরে রেখেছে। শত্রুর হাতে পতন আসন্ন হয়ে পড়লেও তারা যেকোনো মূল্যে তাদের বন্দী ভাইকে মুক্ত করার চেষ্টা করে।

 

প্রথম যুগের মুসলিমরা তাঁদের বন্দী মুসলিম ভাইদের উদ্ধারের ব্যাপারে ঠিক এমনই যত্নশীল ছিলেন। ‘উমার ইবন ‘আবদুল আজিজ (রা) মুক্তিপণের অঙ্কের ব্যাপারে পরোয়া না করেই মুসলিম বন্দীদের ছাড়িয়ে আনার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। আল ইমাম আল আওযা’ই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে চিঠি লিখে আবু জা’ফর আল মানসুরকে নিয়মিত স্মরণ করিয়ে দিতেন যেন রোমানদের হাত থেকে মুসলিম বন্দীদের যেভাবেই হোক উদ্ধার করা হয়। মুসলিম বন্দীদের উদ্ধারের ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ) ছিলেন নিবেদিত এক অক্লান্ত প্রাণ। চিঠি লিখে, সমঝোতা করে, যুদ্ধ করে হলেও তিনি মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। আল হাজ্জাজ ও আল মু’তাসিমের মত অত্যাচারী মুসলিম শাসকরাও কুফফারদের কারাগারে বন্দী এক-দুইজন মুসলিমকে উদ্ধার করতে সমগ্র শহরে আক্রমণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আল মানসুর বিন আবু ‘আমির ঘোড়ার পিঠে চড়ে কর্ডোভা থেকে উত্তর আন্দালুসিয়ায় গিয়েছিলেন! শুধুমাত্র এক মুসলিম বন্দীর মায়ের অনুরোধে খ্রিষ্টানদের হাতে আটক তার ছেলেকে উদ্ধারের জন্য।

 

এটাই আমাদের ইতিহাস। এটাই আমাদের ঐতিহ্য; যা বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা আর নিঃস্বার্থতার কাহিনীতে পূর্ণ। সেটা ছিল এমন একটা সময় যখন মানুষ নিজের আরাম আয়েশের উপরে অন্যের স্বস্তি আর নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিত। তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা নিন। বনী ইসরাইলের উদাহরণের উপরও দৃষ্টিপাত করুন। হৃদয় থেকে কাপুরুষতা ঝেড়ে ফেলুন। স্বার্থপর ধ্যানধারণা ভুলে গিয়ে উম্মাহ্‌র প্রতি আরো অনুগত, বিশ্বস্ত ও দায়িত্বশীল হোন। নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার এটাই সময়। কিভাবে একজন মানুষ নিজেকে মুসলিম সমাজের ‘‘সক্রিয় কর্মী’’ বলে দাবি করতে পারে যখন তাদের ভাইরা (শুধু ভাই নয়, এখন আমাদের বোনেরাও) কানাডা, আমেরিকা, গুয়ান্তানামো বে, ব্রিটেন, ভারত ইত্যাদি দেশের কারাগারে বন্দী রয়েছে? অথচ সে তাদের উদ্ধারের ব্যাপারে কোনো ভূমিকাই পালন করছে না! আর কতজন বন্দী হলে আপনি এগিয়ে আসবেন? পশ্চিমা ‘আলেম’’রা পরিষ্কারভাবেই এই ব্যাপারে নিজেদের অনাগ্রহ বুঝিয়ে দিয়েছেন। কাজেই তাদের আশা ছেড়ে দিন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, সামরিক প্রধান, স্বামী, পিতা, শিক্ষক এবং আল্লাহর রাসূল। এই শত ব্যস্ততাও তাঁকে অত্যাচারিত মুসলিমদের নাম মনে রাখতে ও তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো থেকে ভুলিয়ে রাখতে পারেনি। আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত যে, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর দু’আতে মু’মিনদের নামগুলো ধরে ধরে উচ্চারণ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন। তিনি বলতেন, “ও আল্লাহ্‌! আল ওয়ালিদ বিন আল ওয়ালিদ, সালামাহ বিন হিশাম এবং আইয়াশ বিন আবু রাবিয়াহ সহ সকল অত্যাচারিত মু’মিনদের তুমি উদ্ধার করো।” প্রকাশ্যে ও জনসম্মুখে তিনি মজলুমদের জন্য দু’আ করতেন।

 

নিজের সমাজের মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা ফিতরাতের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। এটাকেই বনী ইসরাইলীরা নিজেদের মাঝে ধরে রেখেছিল। কিন্তু এটা মুসলিমদের জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক যে এই ক্ষেত্রটিতে আমরা তাদের অনেক পেছনে পড়ে আছি। এটি লজ্জার বিষয় যে আমরা আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষায় লজ্জাজনক ভাবে ইহুদিদের কাছে পরাস্ত হচ্ছি।

 .

তারিক মেহান্না,
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,
আইসলেশন ইউনিট, সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ৬)

 

সূরা বাকারাহ এর ৯৩ নং আয়াতে আল্লাহ্ বনী ইসরাইলদের ব্যাপারে বলেছেন,

“আর যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলাম এবং তূর পর্বতকে তোমাদের উপর তুলে ধরলাম যে, শক্ত করে ধর আমি যা তোমাদের দিয়েছি আর শোন। তারা বলল, আমরা শুনেছি আর অমান্য করেছি। কুফরের কারনে তাদের অন্তরে বাছুরপ্রীতি পান করানো হয়েছিলো। বলে দিন, তোমরা বিশ্বাসী হলে তোমাদের সে বিশ্বাস মন্দ বিষয়াদি শিক্ষা দেয়।”

 

মুসা(আলাইহিস সালাম) যখন আল্লাহর সাথে কথা বলার জন্য সিনাই পর্বতে গেলেন, বনী ইসরাইল তখন চঞ্চল ও অস্থির হয়ে পড়ল। তারা আল্লাহর পাশাপাশি ইবাদাতের জন্য অন্য দেবতা খোঁজা শুরু করল। এরইমধ্যে তারা সোনার তৈরি একটি কৃত্রিম বাছুরের ইবাদাত শুরু করে দিল। এই বাছুরটিকে পূজা করার প্রতি তাদের প্রবল অনুরাগকে ব্যাখ্যা করতে আল্লাহ ‘উশরিবু  শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে কোনো কিছু পান করা, শুষে নেওয়া। অর্থাৎ তাদের এই ভ্রষ্টতা ও বিপথগামীতাকে আল্লাহ তরল কিছু পান করা বা শুষে নেওয়ার সাথে তুলনা করেছেন।

 

কুরআন এবং সুন্নাহর অন্যান্য জায়গাতে ইলম এবং হিদায়াহ গ্রহণ করার বিষয়টিকেও এই পান করা বা শুষে নেওয়ার উপমাটি দেওয়া হয়েছে। আল-বুখারি এবং মুসলিমে একটি হাদীস বর্ণিত আছে, যেখানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে যে হিদায়াহ ও ইলম দিয়ে পাঠিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত হল যমীনের উপর পতিত প্রবল বৃষ্টির ন্যায়… আল্লাহ্ তা’আলা তা দিয়ে মানুষের উপকার করেন। মানুষ তা থেকে পান করে তৃষ্ণা মেটায়” (সহিহ বুখারী :: খন্ড ১ :: অধ্যায় ৩ :: হাদিস ৭৬)।বুখারি ও মুসলিমের অন্য একটি হাদীসে এসেছে, ‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। (স্বপ্নে) আমাকে একটি দুধের পাত্র দেওয়া হল। আমি তা থেকে পান করতে লাগলাম। অবশেষে তা আমার নখের নিচ থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করলে অবশিষ্ট দুধসহ পাত্রটি ‘উমার ইবনুল খাত্তাবকে দিয়ে দিলাম।’ সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী? তিনি(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “এই দুধ হচ্ছে ইলম” (সহিহ মুসলিম :: বই ৩১ :: হাদিস ৫৮৮৮ এবং সহিহ বুখারী :: খন্ড ৫ :: অধ্যায় ৫৭ :: হাদিস ৩০)।

 

ইসরা’ এবং মি’রাজ এর হাদীসেও এমনটি আছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “এরপর আমার সম্মুখে দুটি পাত্র পেশ করা হয়, এর একটি দুধের ও অপরটি মদের। আমাকে বলা হলো, এর মধ্যে যেটা আপনার ইচ্ছা সেটা গ্রহণ করুন। আমি দুধ গ্রহণ করে তা পান করলাম। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমাকে বললেন: আপনাকে ফিতরাতেরই হিদায়াত করা হয়েছে। আপনি যদি মদ গ্রহণ করতেন, তবে আপনার উম্মাত গোমরাহ হয়ে যেত” (সহিহ মুসলিম :: খন্ড ১ :: হাদিস ৩২২)।

 

পানীয় দ্বারা যেমন দেহের তৃষ্ণা মেটে, তেমনি হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটে সঠিক জ্ঞান ও পথনির্দেশিকার দ্বারা। তৃষ্ণা পেলে মানুষ শুধু স্বাস্থ্যকর ও বিশুদ্ধ জিনিস পান করে। এক গ্লাস পানিতে মাত্র এক ফোঁটা কালি পড়লেও কেউ সেই দূষিত পানি পান করতে চাইবে না। তেমনি হৃদয় ও মনের তৃষ্ণা মেটাতে হলে প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পবিত্র উৎস থেকে উৎসরিত জ্ঞান এবং পথনির্দেশিকা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এভাবেই সাহাবাদের বিস্ময়কর প্রজন্মকে বিশুদ্ধ উৎস এবং ঐশ্বরিক পথনির্দেশিকার ছাঁচে গড়ে তোলেন। যার ফলে তাদের হৃদয় এবং মনন এমনভাবে গড়ে ওঠে, যা বিচক্ষণতা এবং জ্ঞানে অতুলনীয়। সাহাবাদেরকে শুধু কুরআন এবং সুন্নাহর আদর্শে গড়ে তোলার এই প্রক্রিয়া অন্য কোনো উৎসের অভাব থেকে জন্ম নেয় নি, কিংবা তা ওয়াহী ব্যতীত বিকল্প কোনো দিকনির্দেশনা থেকেও আসে নি। বরং এই প্রচেষ্টা সুচিন্তিত এবং ওয়াহী দ্বারা সুপরিকল্পিত। সায়্যিদ কুতুব (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

 

মহাগ্রন্থ আল কুরআন থেকেই সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) তাদের প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ গ্রহণ করতেন। তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণরুপে কুরআনের ছাঁচে গড়ে তুলেছিলেন। কথা হলো-কেন তারা কুরআনকে এভাবে গ্রহণ করতেন? অন্য কোনো সভ্যতা, সাহিত্য, শিক্ষাকেন্দ্র, বিদ্যাপীঠ ইত্যাদি না থাকার কারণে বাধ্য হয়েই কি তারা কুরআনকে এমন পরমভাবে গ্রহণ করেছিলেন? কিছুতেই নয়, কস্মিনকালেও এটা সত্য নয়।

 

প্রকৃত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাবো, তৎকালীন রোমান সভ্যতা ও রোমান আইনশাস্ত্রকে আজও ইউরোপে সভ্যতার আদি মডেল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সে যুগের গ্রীক যুক্তিবিদ্যা, গ্রীক দর্শন, শিল্পসহ সাহিত্যকে আজও পাশ্চাত্য উন্নত চিন্তাধারার অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পারস্য সভ্যতা, তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও সে যুগে ছিলো অত্যন্ত সুগঠিত ও ঐতিহ্যবাহী হিসেবে সুপরিচিত। আরবের কাছে ও দূরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক সভ্যতা তখন বিদ্যমান ছিলো; তাতে চীন ও ভারতের কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। আরবের উত্তরে ছিল রোমান সভ্যতার কেন্দ্রভূমি, আর দক্ষিণে ছিল পারস্য সভ্যতা। সুতরাং একজন সুস্থ চিন্তার মানুষ একথা বলতে পারে না যে, সাহিত্য, সভ্যতা ও সুগঠিত কোনো ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে সে যুগের মুসলমানরা কুরআনকে তাদের একমাত্র জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করেন। বরং একটি সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়ায় এই প্রজন্মটি সুনির্দিষ্টভাবে শুধুমাত্র কুরআন এবং সুন্নাহ্‌ থেকে নিজেদের জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটান যার ফলে ইতিহাসে তারা এক অনন্য স্থান লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে বিশুদ্ধ জ্ঞানের এই সরোবরের সাথে অন্য উৎসের মিশ্রণ ঘটিয়ে ফেলা হয়…’

 

সাহাবাদের জন্য কুরআন ছিল এক আলো যা দ্বারা তাঁরা বিশ্বকে চিনতে, জানতে এবং বুঝতে পারতেন। কুরআনকে তাঁরা বুঝতেন কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। অন্য কোনো মতবাদ, ওয়ার্ল্ডভিউ বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কুরআনকে বোঝা বা ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজনই হয়নি, বরং এ ধরনের প্রয়াসকে বাতিল বলে বিবেচনা করা হয়। রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেশ কঠোর ভাবে নিশ্চিত করেছিলেন যেন সাহাবারা কুরআনকে কুরআনের মত করেই বোঝেন, অন্য কোনো আদর্শ বা মতবাদের সংমিশ্রণ যেন তাঁদের হৃদয়-মনকে কলুষিত করতে না পারে। সাহাবাদের যুগে এই বিশুদ্ধতা সম্পূর্ণ বজায় রাখা হয়েছিল, তাই উম্মাহকে সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব হয়েছিল। তারা ছিল ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী। সাহাবাদের সময়ের শেষদিকে তাবিই’নদের যুগে এসে তাঁদের জ্ঞানের বিশুদ্ধ উৎসগুলো আর অনন্য থাকেনি। যার ফলে ঐ সময় কাদেরিয়াদের আবির্ভাব ঘটেছিল, বসরায় আবির্ভাব হয়েছিল মু’তাযিলাদের, খুরাসানে আবির্ভাব হয়েছিল জাহ্‌মিয়াহদের এবং এমন আরো অনেক সম্প্রদায়। মুসলিমদের মধ্যে এই ধরনের বিজাতীয় বিশ্বাস ও মনগড়া মতবাদের উদ্ভব ও বিস্তার লাভের কারণ হল ইসলামকে ভিনদেশী মতবাদ ও দর্শনের আলোকে বুঝতে চেষ্টা করা। আজ গ্রীক ও পার্সিয়ানদের সভ্যতা, সাহিত্য আর দর্শনের দিকে খেয়াল করলে আমাদের বোধগম্য হবে যে এদের কিছু বিশ্বাস ও চিন্তা চেতনার সাথে ইসলামের সংমিশ্রণে এই সকল ভ্রান্ত মতবাদ ও জামাতের উদ্ভব হওয়া শুরু হয়েছে তাবেঈনদের যুগ থেকে। কুরআনকে কুরআনের মতো করে বুঝতে হবে। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দৃষ্টিতে কুরআনকে বুঝতে হবে। পূর্ববর্তী সালাফগণ কুরআনের বিধি বিধান যেভাবে দেখেছেন ও মেনেছেন সেভাবে আমাদেরকেও বুঝতে হবে। অথচ কুরআনকে আজ বিচার করা হচ্ছে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে, তাদের তথাকথিত ‘’সভ্য’’ চোখে তারা ঠিক করে দিচ্ছে কুরআনের কতটুকু মানা যাবে আর কতটুকু ছেড়ে দিতে হবে। আজকের আরবরা পশ্চিমা সভ্যতা দেখে বিমুগ্ধ, অথচ সভ্যতার অর্থ এবং প্রকৃত জ্ঞানের মালিক ছিল তারাই যখন তারা কুরআন এবং সুন্নাহর অনুসরণ করত। বিশুদ্ধ ও পবিত্র সেই এক গ্লাস পানিকে এখন দূষিত ও অপবিত্র করা হচ্ছে যা হৃদয় ও মননের জন্য খুবই বিষাক্ত ও ক্ষতিকর। ইসলামের সাথে বিজাতীয় মতাদর্শ মিশে দূষিত হওয়ার যে ঝোঁক সৃষ্টি হয়েছিল ইমাম আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ) তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং ইসলামের বিশুদ্ধতাকে যথাযথভাবে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। আর শুধু একারণেই আল মু’তাসিমের হাতে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বালের (রহিমাহুল্লাহ) মতো বীরদের জেল-জুলুম ও নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। সে সময়ে ইসলামের বিশুদ্ধ উৎসের ভেতরে বিজাতীয় মতবাদ ঢুকে পড়ার কারণে ইসলামী আক্বীদাহ্‌র কিছু বিষয় দূষিত হয়েছিল, যেমন আল্লাহর অবস্থান এবং গুণাবলী সংক্রান্ত বিষয়াবলী।

 

কিন্তু বর্তমানে, এই দূষণ এমন সব বিষয়তেও ছড়িয়ে পড়েছে যা আগে দেখা যায়নি। উদাহরণস্বরূপ, আল মু’তাসিম মু’তাযিলাহ মতবাদের বিরোধিতার কারণে ইমাম আহমাদকে বেত্রাঘাত করেছিলেন ঠিকই কিন্তু পাশাপাশি তিনি কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। কেবল একজন অত্যাচারিত মুসলিমকে উদ্ধার করার জন্য তিনি অভিযান প্রেরণ করেন এমন ঘটনাও ঘটে। যদিও তার আক্বীদাহ্‌ তাত্ত্বিক দিক দিয়ে দূষিত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু বিশ্বের প্রতি তার যে সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি (worldview) তা ছিল অবিকল কুরআনের শিক্ষার অনুরূপ। মুসলিমদের সম্মান ও গৌরব ধরে রাখতে তিনি তখনও দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। তার মধ্যে তখনও নিঃস্বার্থতা এবং মুসলিমদের প্রতি বিশ্বস্ততা অটুট ছিল। তিনি ইসলাম এবং কুফরের দ্বন্দ্বকে অনুধাবন করতে তখনও ভুলে যাননি। মুসলিমদেরকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করার ব্যাপারে তার মধ্যে তখনও প্রবল ঈর্ষা কাজ করত। শত্রুর আচঁড় থেকে মুসলিমদের রক্ষা করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা। তিনি বিশ্বকে দেখতেন এবং বিচার করতেন প্রথম যুগের মুসলিম এবং সালাফগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল কুরআনের সূরা আলে-ইমরান, আন-নিসা, আল-আনফাল এবং আত-তাওবার স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন আয়াতগুলো সঠিকভাবে আত্মস্থ করার মাধ্যমে। কুরআনের বিষয়বস্তু আল মু’তাসিমের মত মু’তাযিলাহ শাসকও অত্যন্ত পরিষ্কার ভাবে বুঝেছিলেন, আর আজ কুরআনের অর্থ বিকৃত হচ্ছে শুধুমাত্র পশ্চিমা দৃষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ কুরআনকে বিবেচনা করার জন্য। বিজাতীয় পশ্চিমা ছাঁকুনি দ্বারা কুরআনের জ্ঞানের বারিধারাকে ছেঁকে ফেলার কারণে আজকে পশ্চিমা মুসলিমদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সেই উপলব্ধিগুলো যা মু’তাসিম মু’তাযিলাহ হয়েও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’ অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য ভালবাসা আর শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করা বিষয়টি সাহাবারা হৃদয়ঙ্গম করে অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন। আর আজ সাহাবাদের সেই আদর্শ পুঁজিবাদী মানসিকতার আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা চেতনা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। এই পুঁজিবাদী ধ্যান ধারণা এই সমাজকে এমন ভাবে দূষিত করেছে যে কিছু সংখ্যক “আলেম’’ যারা কিনা মু’তাসিমের চেয়েও দ্বীনের জ্ঞান বেশি রাখেন, তারাও কুরআনের পরিভাষা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত মুসলিমদের “মুজাহিদ” সম্বোধন না করে পশ্চিমা মিডিয়ার পরিভাষা “জঙ্গি” ব্যবহার করেন। তাই বলা যায় যে কুরআনের সঠিক জ্ঞান, পথ নির্দেশ, অভিমত আজ দূষিত হচ্ছে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক দৃষ্টিতে কুরআনকে বিবেচনা করার জন্য।

 

এখন আমাদের দায়িত্ব এই যে, আত্মার প্রশান্তির জন্য একটি বিশুদ্ধ উৎস খুঁজে বের করা। গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, কৃষি, প্রযুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে যেকোনো উৎস থেকে নিরাপদে জ্ঞান আহরণ করা যায়। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, জীবন ব্যবস্থা, সাংসারিক ও বৈষয়িক চিন্তা চেতনা–যা আল্লাহ্ আমাদের উপর কুরআনে ধার্য ও উল্লেখ করে দিয়েছেন–তা আমাদের গ্রহণ করতে হবে সেই বিশুদ্ধ উৎস থেকেই। আমাদেরকে তা গ্রহণ করতে হবে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী,পশ্চিমা অভিরুচি মোতাবেক নয়। আমাদের মনকে এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে।

 

যদি বনী ইসরাইলীরা মুসা (আলাইহিস সালাম) এর প্রকৃত শিক্ষাতেই অটল থাকত, তাহলে তারা অন্য মতের সাথে নিজেদের মতামতের সংমিশ্রণ করে মূর্তিপূজায় লিপ্ত হত না; সৃষ্টিকর্তার স্থলে স্বর্ণের তৈরি বাছুরের ইবাদাতও করতো না।

 .

তারিক মেহান্না,

প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,

আইসলেশন ইউনিট, সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ৭)

 

সূরা বাকারাহর ১৫২ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:

“অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব”।

 

এই আয়াতটি নিয়ে উল্লেখ করার মতো বেশ কিছু বিষয় আছে। প্রথমত, আয়াতটি পড়ে এই ভেবে আপনার সম্মানিত বোধ করা উচিত, “দারুণ, আল্লাহ আমাকে স্মরণ করবেন?” মানুষ সাধারণত তাঁর কাজের জন্যে পরিচিত হতে ভালোবাসে। এটা হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা, গরীবকে খাওয়ানো, মসজিদ পরিষ্কার করা। যে কাজই হোক না কেন, যখন একজন মানুষ আপনাকে আপনার কাজের জন্যে চিনবে এবং প্রশংসা করবে তখন আপনার ভালো লাগবে। এই কারণে অনেকেই তাদের কলেজের ডিগ্রী বা সার্টিফিকেট, পুরস্কার, স্মৃতিফলক এ ধরনের জিনিষগুলো দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখে। কারণ অন্যের দেওয়া এই স্বীকৃতিটাই আপনার ভালো কাজের সাক্ষ্য বহন করে। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হল, আপনি অন্যের মতামতকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ গুরুত্ব দেন এবং তাদের স্বীকৃতি আপনার অন্তরে গর্ববোধের জন্ম দেয়। এর মাধ্যমে আপনার কাজটির গুরুত্বও প্রতিফলিত হয়।

 

এখন ভেবে দেখুন, কোনো মানুষ নয় বরং মানবজাতি ও সমগ্র মহাবিশ্বের যিনি সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা, তিনি আপনাকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন! তিনি আপনার কথা আলাদা করে স্মরণ করছেন! এই ব্যাপারটি তো আপনার অন্তরকে কাঁপিয়ে তোলার কথা! এটি জানা মাত্রই আপনার ভাবতে বসে যাওয়ার কথা, আচ্ছা কোন সে কাজ যার জন্য আল্লাহ আমাকে স্মরণ করছেন? আপনি ভাববেন, “এই যে যিকর (আল্লাহকে স্মরণ), এর মধ্যে কি এমন আছে যাতে আত্মনিমগ্ন হওয়ার কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা হাজার-লক্ষ-কোটি সৃষ্টির মাঝে আমাকে স্মরণ করবেন? অথচ কাজটা কতই না সহজ! আপনি তো অন্য মানুষের স্বীকৃতি ও প্রশংসা পেয়েই সম্মানিত ও গর্ববোধ করেন, তাহলে এই আয়াতটি পড়ে যখন আপনি অনুভব করবেন সমগ্র বিশ্বের মালিক আপনাকে স্মরণ করছে, তখন কি আপনি এর চাইতেও বহুগুণ বেশি গর্ব আর সম্মান বোধ করবেন না? আর এই স্বীকৃতির তো কোনো মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। কারণ তা আল্লাহর পক্ষ থেকে।

 

দ্বিতীয়ত, আপনার জানা উচিত যে যিকর দুই ধরনের : একটি অভ্যাসগত আর অপরটি ঘটে থাকে সচেতনচিত্তে। এই দুয়ের মাঝে একটি মাত্র ধরনই কেবল আল্লাহর স্বীকৃতি এনে দিতে পারে। ইবন আল-যাওজী বলেন:

“একজন মানুষ হয়তো অভ্যাসের বশে অমনোযোগীভাবেই ‘সুবহানাল্লাহ’ বলে। অন্যদিকে একজন সচেতন ব্যক্তি সর্বদা সৃষ্টির রহস্য বা সৃষ্টিকর্তার অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা করতে থাকে এবং সেই চিন্তা থেকে ‘সুবহানাল্লাহ’ বলে ওঠে। তাই, এই তাসবীহ হচ্ছে চিন্তাশীল মনের গভীর ভাবনার ফসল। সচেতন মানুষেরা এভাবেই তাসবীহ পাঠ করে। আর তারা অতীতের গুনাহের পঙ্কিলতা চিন্তা করে গভীর অনুশোচনায় ডুবে যায়। গুনাহের পরিণাম চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। অনুতাপ করে। এই অনুতাপ থেকে তারা ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ (অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই) বলে। এটাই সত্যিকারের তাসবীহ এবং ইস্তিগফার। অথচ একজন গাফেল ব্যাক্তিও হয়তো তাসবীহ এবং ইস্তিগফার করে। কিন্তু অভ্যাসের বশে, উপলব্ধি থেকে নয়। চিন্তা করে দেখুন এই দুই ধরনের যিকরের মাঝে কী আকাশ-পাতাল ব্যবধান!……”

 

পরিশেষে, এই আয়াতে আমরা আল্লাহর উদারতার নিদর্শনও পাই। ভেবে দেখুন, তিনি আপনাকে স্মরণ করেন, স্বীকৃতি দেন এবং পুরস্কৃত করেন কারণ আপনি তাঁকে স্মরণ করেছেন। কিন্তু আপনি কেন তাঁকে স্মরণ করছেন? কারণ তিনি আপনার উপর রহম করেছেন বলেই তা উপলব্ধির পর আপনি তাঁর স্মরণের দিকে ধাবিত হয়েছেন, তার আগে নয়! আপনি তাঁকে স্মরণ করেছেন যখন আপনি তাঁরই দেয়া খাবার খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যে খাবার তাঁরই দেওয়া নি’আমত। আপনি তাঁর দেওয়া ঘরে প্রবেশ করছেন, যে ঘর তাঁর দেওয়া নি’আমত। আপনি তাঁরই দেওয়া নি’আমত, বিছানায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁরই দেয়া নি’আমত ঘুম থেকে উঠছেন আর তাঁর দেয়া দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করছেন। তাঁরই সৃষ্টি করা প্রকৃতির বিস্ময় দেখছেন। আপনি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আপনার ঘরে তাঁরই দেয়া নি’আমত শিশু সন্তানের জন্ম উপভোগ করছেন – আপনার পুরো জীবনটিই তাঁর দেয়া উপহার আর রহমতে ভরা – সমস্ত কিছুই তাঁর দেওয়া। তাই, এই আয়াত আপনাকে বলছে যে, আল্লাহ আপনাকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন শুধু তাঁকে স্মরণ করার জন্যই। অথচ সেই আল্লাহর দেওয়া নি’আমতের কারণেই কিন্তু আপনি তাঁকে স্মরণ করেছেন!

 .

তারিক মেহান্না,
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,
আইসলেশন ইউনিট, সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ৮)

 

সূরা বাক্বারার ১৫৩ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

“হে মুমিন গণ! তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর…”

জেলখানার এই ছোট্ট কামরায় এই আয়াতটির অর্থ আমার কাছে খুব পরিষ্কারভাবে ধরা দেয়। এ আয়াতে বর্ণিত সবর ও সালাতের একীভূত করার ব্যাপারটি আমি কারাগারে বসেই উপলব্ধি করতে পেরেছি। এই দুটো ইবাদাতকে একসাথে উল্লেখ করার তাৎপর্য সম্পর্কে আমি কিছু কথা বলতে চাই।

নীচের পাঁচটি পদ্ধতিতে সালাত আপনাকে ধৈর্য ধরার অর্থাৎ সবরের শিক্ষা দেয়:

 

সালাতের সময় আপনি মাটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়ান,রুকুতে মাথা নীচু করেন এবং সিজদায় অবনত হন। সালাতের পুরো সময়টা ধরে আপনি শারীরিকভাবে নিজেকে এটাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে আপনি একজন “নিয়ন্ত্রিত সত্তা” আর আপনি বিশ্বজগতের একমাত্র পালনকর্তা ও নিয়ন্ত্রকের ইবাদত করছেন। এভাবে চিন্তা করলে আপনার উপর বিপদাপদ যা কিছুই আপতিত হোক না কেন সবকিছুর মাঝে হাসিমুখে, সন্তুষ্টচিত্তে বেঁচে থাকা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়। কেননা এটা আপনাকে নিজের সঠিক অবস্থান উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। আপনি কেবলই আপনার মালিকের একজন অনুগত দাস। যে মালিকের জন্য আপনি নিজের পবিত্র মুখমণ্ডল মাটিতে স্পর্শ করেছেন, সেই মালিকই আপনাকে আজকের পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছেন। তিনিই আপনাকে রোগ-শোক দিয়েছেন, অথবা সম্পদ থেকে বঞ্চিত করছেন, কিংবা কোনো সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছেন। আপনি যখন সিজদায় মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আনুগত্যের সাথে বলতে থাকেন: “সুবহানা রাব্বি আল-আ’লা”, তখন আপনি সেই রবের সাথে আপনার সম্পর্কটিকে উপলব্ধি করেন। আপনি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, যেভাবে আমি আল্লাহর সামনে নিজের মুখমণ্ডল মাটিতে অর্পণ করছি, ঠিক একইভাবে আমার সমগ্র সত্তাকে আল্লাহর বেধে দেওয়া নিয়তির কাছে নতমস্তকে সমর্পণ করলাম। সালাত আপনাকে একটি পরম বাস্তবতা উপলব্ধি করতে শেখায়। আর তা হল, মহান আল্লাহ হচ্ছেন সৃষ্টিজগতের একমাত্র নিয়ন্ত্রক এবং আপনি তাঁর আজ্ঞাবহ দাস।

সালাত আপনার মধ্যে একধরনের শৃঙ্খলাবোধ গড়ে তুলবে। এই শৃঙ্খলাবোধ আপনাকে চরম অস্থিরতার মুহূর্তেও সুস্থির রাখবে। যেমন: যথাযথভাবে সালাত আদায় করার অর্থ হল আপনাকে অবশ্যই সময়-সচেতন হতে হবে এবং নির্দিষ্ট ওয়াক্তের মাঝে সালাত আদায় করে নিতে হবে। প্রত্যেক সালাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক রাক’আত আদায় করতে হবে। আপনাকে অবশ্যই শান্ত ও ধীর-স্থিরভাবে সালাত আদায় করতে হবে। কোনোক্রমেই কোনো সালাত বাদ দিতে পারবেন না। এমন আরো অনেক কিছু সালাতের ক্ষেত্রে আপনি মেনে চলতে বাধ্য। এভাবে সালাত আদায় মাধ্যমে আপনি নিজেকে নিয়মানুবর্তী করে গড়ে তুলতে পারবেন। আপনি জেলখানায় বন্দী বা আপনার চাকরি নেই- এই অজুহাতে আপনি সালাত ত্যাগ করতে পারবেন না। সালাত আপনাকে নিয়ন্ত্রিত করে। আপনার চরিত্র গঠন করে। যাচ্ছেতাই জীবনযাপনের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে আপনার জীবনকে সুশৃঙ্খল করে। জীবনে এমন কিছু কঠিন সময় আসে যখন মানুষ ভেঙে পড়ে। সালাত আপনাকে এমন সময়েও ধীরস্থির থাকতে সাহায্য করবে।

সময়ের সঠিক ব্যবহারে সালাত আপনাকে সহায়তা করে। সত্যি বলতে কি, আমি এই জেলে বসে আমার দিনগুলোকে সালাতের ওয়াক্তের ভিত্তিতেই ভাগ করি। যেমনঃ ফজর ও যোহরের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য কিছু কাজ নির্দিষ্ট করা থাকে। আবার যোহর থেকে আসর পর্যন্ত সময়টা আমি অন্য কিছু কাজের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখি। এমনি করে যখন জেলখানার বাকিরা দীর্ঘ, বিরক্তিকর, উদ্দেশ্যহীন সময় কাটিয়ে দিনাতিপাত করে তখন প্রতিদিনই আমার অনেকগুলো কাজ করা হয়ে যায়। অথচ জেলের বাকিদের দিনগুলো ক্যালেন্ডারের পাতার মতো। একটার সাথে আরেকটার পার্থক্য শুধু তারিখে। ধৈর্য্যশীল হবার জন্য ফলপ্রসূ সময় কাটানোটা খুবই জরুরি।

সালাতকে আত্মার জন্য এক ধরনের ব্যায়াম বলা চলে। রাগের সময় একজন মানুষ হাত-পা নাড়িয়ে চিৎকার করে যেভাবে তার মনের জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ করতে চায়, তেমনিভাবে সালাত, বিশেষ করে দু’আ, আপনার মনের কথাগুলো সর্বশ্রোতা ও জবাবদাতা আল-মুজিবের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। আপনার যত ফরিয়াদ, যত ইচ্ছা, দুশ্চিন্তা, যত আশা, ক্ষোভ, আবেগ, মনের যত চাপা কথা আছে – সবকিছু মন খুলে বলার এইতো সময়। মনের আগল খুলে দিন। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা প্রার্থনা আর দুঃখগুলোকে চোখের জল হয়ে আপনার গাল ছুঁয়ে নেমে আসতে দিন। নিশুতি রাতের শুনশান নীরবতায় কুনুতের জন্য হাত তুলে বিতর সালাতে আপনার রবের সাথে কথা বলুন। আপনার একান্ত, নিজস্ব রবের কাছে আপনার মনের কথাগুলো বলুন। আপনার রব একান্তে আপনার কথাগুলো শুনবেন এবং তিনি নিজে আপনার দু’আর জবাব দেবেন। আপনার মনের অনুভূতিগুলো তাঁকে বলে ফেলুন। জমিয়ে রাখা নালিশগুলো তাঁর কাছেই করুন। যেমনটি ইয়া’কুব (আলাইহিস সালাম) করেছিলেন- “…আমি তো আমার দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করছি…”[সূরা ইউসুফ]। সুতরাং, শরীরচর্চার মধ্য দিয়ে যেভাবে শরীরের উদ্বৃত্ত শক্তি নির্গমন হয়, সালাত তেমনি একটি আধ্যাত্মিক অনুশীলন যার মাধ্যমে আপনি মনের গহীনে জমে থাকা অনুভূতিগুলোকে সুন্দরতম উপায়ে নিঃসরণ করতে পারেন।

সবশেষে, সালাতে কুর’আন তিলাওয়াতের মধ্যে দিয়ে আপনাকে প্রতিনিয়ত আখিরাতের বড় চিত্রটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। জাহান্নামের চিরস্থায়ী বন্দীদশার বর্ণনা আপনার পার্থিব দুঃখকষ্টগুলোকে তুচ্ছ করে দেয়। জান্নাতের অবর্ণনীয় সুখের বর্ণনা আপনার চারপাশের রূঢ় বাস্তবতা থেকে আপনাকে ক্ষণিকের অবকাশ দেয়। নবী-রাসূলদের সংঘাতময় জীবন সংগ্রাম আপনার মনে সংহতির চেতনা সৃষ্টি করে। একইসাথে আপনাকে এও জানিয়ে দেয় যে, পৃথিবীর সেরা মানুষগুলোর পার্থিব জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। সালাতের মাঝে কুরআন পাঠ আপনাকে আপনার চারপাশকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে এবং সামনের বন্ধুর পথকে মসৃণ ও পরিচিত করে তোলে।

 .

তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেসন ইউনিট-সেল #১০৬

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ৯)

 

সূরা বাক্বারাহর ১৫৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:

“নিঃসন্দেহে ‘সাফা’ এবং ‘মারওয়া’ (পাহাড় দুটো) আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম, অতএব যদি তোমাদের মধ্যে কোনো লোক হজ্জ কিংবা ওমরা আদায় করার (এরাদা করে), তাঁর জন্যে এই উভয় (পাহাড়ের) মাঝে তাওয়াফ করাতে দোষের কিছু নেই… ”

 

প্রথমবার দেখেই এই আয়াতের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করা যায় না। কিন্তু এ আয়াত নাযিলের পরিস্থিতি বর্ণনা করে যে বিষয়টি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ।

 

আস-সাফা ও আল-মারওয়া হচ্ছে মক্কার দুটি পাহাড়। নবী ইবরাহীম(আলাইহিস সালাম) ফিলিস্তিন যাওয়ার আগে তাঁর স্ত্রী হাজেরা ও পুত্র ঈসমাইল(আলাইহিস সালাম) কে এই পাহাড় দুটির কাছে রেখে গিয়েছিলেন। বিবি হাজেরা তাঁর পিপাসার্ত পুত্রের জন্যে একটু পানি খুঁজতে গিয়ে এই দুই পাহাড়চূড়ার মাঝে সাতবার ওঠানামা করেন (এই ওঠানামার ঘটনাটি আস-সা’ঈ নামে পরিচিত)। পরবর্তীতে যখন ইবরাহীম(আলাইহিস সালাম) মানুষকে মক্কায় হজ্জ করার জন্যে আহবান করলেন তখন বিবি হাজেরার এই ঘটনা থেকেই হজ্জের সময় সা’ঈ করার প্রচলন ঘটে। পরবর্তীতে বহু-ঈশ্বরবাদ বা শিরক আরবে শিকড় গেড়ে বসে। তখন এই দুই পাহাড়চূড়ায় মূর্তি বসানো হয় আর মানুষ সা’ঈ করার সময় মূর্তিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা শুরু করে। কালক্রমে মুসলিমরা জয়ী হল এবং ইসলাম পৌত্তলিকতাকে পবিত্র মক্কাভূমি থেকে উৎখাত করল। বিশুদ্ধ তাওহীদের যুগে যে পদ্ধতিতে হাজ্জ পালিত হত সেই হাজ্জ আবার ফিরে এল। কিন্তু জাহিলিয়্যাতের যুগে পৌত্তলিকতার আদলে সাফা-মারওয়ার মাঝে সা’ঈ করার যে প্রথা প্রচলিত ছিল তা বহাল থাকবে কিনা তা নিয়ে মানুষের মনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হল। কারণ সাহাবাগণ জাহিলিয়্যাতের দাগে কলঙ্কিত প্রথাতে সামিল হতে আগ্রহী ছিলেন না। বুখারী এবং মুসলিম থেকে বর্ণিত, আনাস বিন মালিক(রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি কি সাফা-মারওয়ার মাঝে সা’ঈ করতে ঘৃণা করতেন?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, কারণ এটা জাহিলিয়্যার সময়কার প্রথা। কিন্তু এই ঘৃণা কুরআনের এই আয়াত নাযিল হওয়ার আগ পর্যন্তই ছিলো: “অবশ্যই ‘সাফা’ এবং ‘মারওয়া’ (পাহাড় দুটো) আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম, অতএব যদি তোমাদের মধ্যে কোনো লোক হজ্জ কিংবা ওমরা আদায় করার (এরাদা করে), তাঁর জন্যে এই উভয় (পাহাড়ের) মাঝে তাওয়াফ করাতে দোষের কিছু নেই…”। এই প্রথাটির অনুমোদন দেয়া হয়েছিল কারণ এটি ছিল প্রকৃতপক্ষে ইবরাহীম(আলাইহিস সালাম) এর হজ্জের সুন্নাহ। পরবর্তীতে মক্কার মুশরিকরা একে বিকৃত করেছিলো।

এই আয়াতটি দ্বীনের প্রতি সাহাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামের স্বতন্ত্র একটি বৈশিষ্ট্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারা যেকোনো আচার-প্রথা অথবা কাজকে ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ প্রমাণ হবার আগ পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না। দ্বীন ইসলাম সাহাবাদের হৃদয়, মন, আচরণ আর দৃষ্টিভঙ্গিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। তাদের জীবনে ইসলাম ছিল একটা বিদ্যুৎ প্রবাহের মত যা তাদের পুরো সত্তার ভিতরে প্রবাহিত হয়ে পুনর্বিন্যাস আর পরিমার্জনের মাধ্যমে নতুন এক সত্তার জন্ম দিত। বৈদ্যুতিক প্রবাহ যখন কিছু পরমাণুর গ্রুপের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন তা তাদের ইলেক্ট্রন বিন্যাসকেই সম্পূর্ণরুপে পুনর্বিন্যস্ত করে ফেলে। ইসলাম সাহাবাদের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) মাঝে ঠিক এই কাজটাই করেছিল। মুসলিম হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে সাহাবাগণ জীবনের প্রতিটা আঙ্গিক ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ করতেন আর দেখতেন কুর’আনের আলোতে তা কেমন দেখায়। যা কিছু ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা তাঁরা ধরে রাখতেন। আর যা কিছু ইসলামের একটুখানি হলেও বিপরীত, তার ধারে কাছেও সাহাবাগণ যেতেন না। কারণ সেগুলোকে তাঁরা জাহিলিয়্যাতের ধ্বংসাবশেষ হিসাবে বিবেচনা করতেন। সায়্যিদ কুতুব(রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন :

 

“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময় যখন একজন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করত, সে তৎক্ষণাৎ জাহিলিয়্যাতের সাথে নিজের সম্পর্ক ছেদ করে ফেলত। ইসলামের বৃত্তে প্রবেশ করা মাত্রই সে তার অতীত জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন এক জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করত। সে তার অজ্ঞতাপূর্ণ জীবনের কর্মকাণ্ডকে খুব সতর্কতার সাথে বিচার করত এবং তার মনে হত ইসলামে ঐ অপবিত্র কাজগুলোর কোনো ঠাঁই নেই। এই অনুভূতিকে সাথে করে সে নতুন এক পথে চলার আশায় ইসলামের ছায়ায় এসেছিল … এবং কুরআনের দিকে মনোনিবেশ করেছিল যেন এই কুরআনের ছাঁচে তার মন-মনন-আত্মা গড়ে ওঠে।

 

শিরকের স্থলে তাদের মনে বিশুদ্ধ তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে তারা জাহিলিয়্যাতের আবহ ও চেতনা, আচার ও প্রথা এবং ধারণা ও বিশ্বাসগুলো পরিত্যাগ করে। এই সামগ্রিক বর্জন ছিল ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা জাহেলী দৃষ্টিভঙ্গী প্রতিস্থাপনের ফলাফল। এ ছিল দুটি ভিন্ন পথের বিভাজন এবং নতুন পথে যাত্রার সূচনা এ যাত্রায় জাহিলিয়্যাতের মূল্যবোধ, চেতনা বা রীতিনীতির কোনো বালাই নেই।”

কোনো পদার্থের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে যেমন করে তার ইলেক্ট্রনগুলো সম্পূর্ণ পুনর্বিন্যস্ত হয়ে পড়ে, তেমনি ইসলামও তাদের জাহেল জীবনযাত্রা এবং মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন সাধন করেছিল। জাহিলিয়্যার মাঝে বসবাস না করলেও তারা তাদের ব্যক্তিত্বের ছোট-বড় সবগুলো দিক ইসলামের আলোকে যাচাই-বাছাই ও মূল্যায়ন করে দেখতেন এবং সে অনুযায়ী নিজেদের ঢেলে সাজাতেন, তা যত কঠিনই হোক না কেন। তাঁদের কাছে ইসলাম ছিল এতটাই গুরুত্বপূর্ণ। আজ আমাদের সামনে তাদের মতো করে ইসলাম পালনের সুযোগ এসেছে, কেননা আমরা আজকে জাহিলিয়্যাহ প্রত্যক্ষ করছি ও তার মাঝে বসবাস করছি।

 

উমর ইবন আল-খাত্তাব(রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছিলেন,

‘জাহিলিয়্যা কি তা না জেনেই যখন মানুষ মুসলিম হিসাবে বেড়ে উঠবে তখন ইসলামের বন্ধন আস্তে আস্তে এক এক করে ছুটে যেতে থাকবে।’

এই উক্তিটির উপর বক্তব্য দিতে গিয়ে ইমাম ইবন আল-কাইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :

জাহিলিয়্যাহর গতিপ্রকৃতির ব্যাপারে জ্ঞান ও ধারণা থাকার কারণে সাহাবাগণ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম ও এর প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়াদি, এর কর্মপদ্ধতি (methodology) এবং এর আওতাধীন বিষয়গুলো সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখতেন ইসলামের ব্যাপারে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন। তারাই ইসলামকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন তাঁরাই ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লড়াই করেছেন এবং ইসলামবিরোধী মতাদর্শের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সতর্ক ছিলেন আর এই সব কিছুই সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র ইসলামের বিপরীতধর্মী জিনিসগুলোর ব্যাপারে তাঁদের পরিষ্কার জ্ঞান থাকার কারণে। ইসলাম যখন তাঁদের কাছে এসেছিল তখন ইসলামের সবকিছুই তাঁদের জীবনযাত্রার সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। তাই, ইসলামের বিপরীতধর্মী জিনিসগুলোর নিকৃষ্টতার সাথে তাঁদের পূর্বপরিচিতির কারণে তাঁদের আবেগ আর লড়াই ছিল অন্য সবার চেয়ে তীব্র। আর এ জন্যই ইসলামের প্রতি তাদের জ্ঞান, ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগ ছিল সবচেয়ে বেশি। কেননা তারা ইসলামের বিপরীত বিষয়গুলোর ব্যাপারে সম্যক অবগত ছিলেন।

এটা অনেকটা এরকম যে, একজন দুঃখে জর্জরিত অসুস্থ, দরিদ্র, ভীত আর একাকী লোক হঠাৎ করেই এসব কিছু থেকে মুক্তি পেয়ে আরামদায়ক, নিরাপদ, ঐশ্বর্যময় এবং উন্নত জীবন লাভ করল। এরকম লোক তাঁদের পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকার কারণে অপেক্ষাকৃত বেশি সুখী হবে কারণ যেই ব্যক্তির অতীতে কষ্টের অভিজ্ঞতা নেই সে এই আরামের জীবন আর কষ্টের জীবনের মাঝে যে পার্থক্য সেটা উপলব্ধি করতে পারবে না।’

 

আমি সবসময় আশা করতাম যে পশ্চিমের কোনো দ্বীন শিক্ষার্থী ‘মাসা’য়িল আল-জাহিলিয়্যা’ – নামক অতুলনীয় গ্রন্থটির একটা আধুনিক সংস্করণ তৈরি করার দায়িত্ব নেবে যেটিতে বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়্যার একটা পরিষ্কার এবং উপলব্ধিযোগ্য বর্ণনা থাকবে। এটি থাকলে আধুনিক জাহিলিয়্যাহ এবং ইসলামের মধ্যকার পার্থক্য আমাদের চোখে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিত এবং ইসলামকে আমরা আরো গভীরভাবে বুঝতাম। এই সুন্নাহটি মেনে চললে আমাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে যেত। এরকম একটা সম্পাদনায় কিছু জিনিষ অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে যেমন আমাদের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গী (worldview), রাজনীতির একাল-সেকাল, সমাজের রীতিনীতি (যেমন: বাহ্যিক আচার-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে ইসলাম বনাম জাহিলিয়্যা), বিনোদন, পারিবারিক জীবন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সামাজিক কাঠামো, সমাজে ধর্মের প্রতি মনোভাব, বাজে ভাষার ব্যবহার, সম্পদের ভূমিকা, স্বাস্থ্যসেবা ও লিঙ্গ বিষয়ক বৈষম্য, বর্ণবাদ, সমাজে যৌনতা এবং আরো অনেক কিছু। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক একুশ শতকের জাহিলিয়্যার সকল বিষয় এমনভাবে সংকলন করতে হবে যেন সেটি পড়ে “কী করা যাবে আর কী করা যাবে না”, এমন একটা তালিকা পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে কোন কাজগুলো করা যাবে তা জানা হয়ে যাবে। ফলে ইসলামকে যুগোপযোগীভাবে দেখা সহজ হবে এবং সাহাবাদের মত করে ইসলাম বোঝা ও মানার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হবে।

 

ইমাম ইবন আল-কাইয়্যিম(রহিমাহুল্লাহ)তাঁর “মাদারিজ আস-সালিকিন” গ্রন্থে বলেছেন, ‘একজন মানুষের হৃদয় থেকে জাহিলিয়্যাতের শেষ অংশটুকুও বিদায় নেওয়ার আগপর্যন্ত সে কখনোই ঈমানের মিষ্টতা এবং সত্যতা ও ইয়াক্বীনের স্বাদ নিতে পারে না। ‘ সাফা-মারওয়ার মাঝে সা’ঈ করার ব্যাপারে সন্দিহান থাকার সময় এটাই ছিল সাহাবাদের মনের অবস্থা।

 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সাহাবাগণের(রাদিয়াল্লাহু আনহুম) উপর সন্তুষ্ট হোন এবং আমাদেরকে তাঁদের পথে চলার তাওফিক্ব দিন।

 .

তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেসন ইউনিট-সেল #১০৬

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১০)

 

সূরা বাকারার ১৭২ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন,

 

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর, যদি তোমরা একান্তভাবে শুধু তাঁরই বন্দেগী কর।

 

এই আয়াতে খাবার সংক্রান্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। এর প্রত্যেকটিই আমাদের তাওহীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

 

প্রথমটা হল, আল্লাহ আমাদের নির্দিষ্ট একটি খাবার খেতে বলেননি। তিনি বিশেষভাবে যে সকল খাবার ‘তাইয়্যিব‘ সেগুলো খেতে বলেছেন। অর্থাৎ শুধু স্বাদসর্বস্ব খাবার নয় যা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো, পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যকর এবং উপকারী সেগুলো খেতে বলেছেন। এর কারণ হল আমাদের দেহটা আসলে ‘আমাদের’ নয়, এটি আমাদের উপর অর্পিত একটি আমানাত। একটি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পাথেয় হিসাবে আমাদের এই আমানাতটি দেওয়া হয়েছে। আর সেই অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর ইবাদাত। এই কারণে, আল্লাহ কুরআনের কিছু অংশ জুড়ে শুধু খাবার হিসেবে আমাদের জন্য কী উত্তম সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে কথা বলেছেন। আর আল্লাহর নির্দেশনা মোতাবেক তাইয়্যিবাত গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর দেওয়া এই আমানতকে সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে পারব। মাটির তলা থেকে বের হয়ে আমাদের পেটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যে খাবারগুলোর চেহারা একই থাকে সেগুলোই হচ্ছে সর্বোত্তম খাবার। কারণ এগুলোতে কোনো আকর্ষণীয় মোড়ক আর বাহারী রঙ থাকে না। শাকসবজি ও ফলমূলে আছে ফাইটোক্যামিক্যালস আর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস যা আমাদের শরীরকে ক্রমাগত সচল ও কার্যকরী রাখার প্রক্রিয়াকে জিইয়ে রাখে। ওজন বেড়ে গেলে শরীরের এই প্রক্রিয়াগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর পরিণামে রক্তে চিনি ও চর্বির পরিমাণ এবং উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। ফলে ধমনীর ক্ষতি হয়। দিনে পাঁচ বেলা সবজি খেলেও হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা ততটা থাকে না, যতটা দুই বেলা অন্য খাওয়া খেলে থাকে। আর টমেটো, ফুলকপি ও অন্যান্য সবুজ শাক-সবজি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

 

 

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হল, এই আয়াত আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, আল্লাহই হলেন এইসব খাবারের যোগানদাতা। প্রতিবারই যখন আমরা আঙ্গুল বা চামচে করে একটুখানি খাবার মুখে তুলে নিই, ততবারই তা যেন দেখিয়ে দেয় এই পৃথিবীতে আমরা আল্লাহর কতটা মুখাপেক্ষী। আপনি যতই ধনী বা গরীব হোন, হোন বিখ্যাত বা অখ্যাত কেউ, অথবা সবল কিংবা দুর্বল; দুনিয়ার প্রতিটি মানুষই তার নিজের চাইতেও বড় বা শক্তিশালী কিছুর মুখাপেক্ষী। আমরা কে আর আমরা কে নই, খাবারই আমাদের সেটা জানিয়ে দেয়। কেউ অন্যের উপর যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, এই ক্ষমতা যে মিছে ভ্রম ছাড়া কিছুই নয় তা খাবারের ব্যাপার আসলেই বোঝা যায়। তখন সে আর আট-দশটি সৃষ্টিরই অনুরূপ, স্রষ্টার অনুগ্রহে বেঁচে থাকা এক সৃষ্টি। এই লেখাটি যারা পড়ছেন, তাদের বেশিরভাগেরই হয়তো কোনো বেলা অভুক্ত হয়ে থাকতে হয় না। কিন্তু খেয়াল করুন, খেতে বসে খাবারের স্বাদ-গন্ধ-বৈচিত্র্য, রন্ধন-কৌশলসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা মুখ্য আলোচনা থেকেই দূরে সরে যাই। পরিবার-পরিজন আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে খেতে বসে আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতার ব্যাপারে অসচেতন হয়ে পড়ছি। আর তা হল: মানুষ হিসেবে আল্লাহর উপর আমাদের নির্ভরতা। আল্লাহর দিকে আমাদের চেয়ে থাকা। আমরা ভুলে যাচ্ছি, আমরা আল্লাহর তুলনায় কতই না দুর্বল। আর আমাদের তুলনায় আল্লাহ কতই না শক্তিশালী! এই মহাসত্য আমরা উপলব্ধি করতে ভুলে যাই। খাবারের যোগান দেয়াটা আল্লাহর একটি অনন্য গুণ যা আল্লাহ সূরা আয-যারিয়াত এর ৫৭ নাম্বার আয়াতে বলেছেন, “….এবং (তাদের কাছে আমি) এটাও চাই না যে, তারা আমাকে আহার্য যোগাবে”, সৃষ্টি আর স্রষ্টার মাঝে খাবারের যোগান দেওয়ার বিষয়টিকে একটি পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য হিসেবে আল্লাহ চিহ্নিত করেছেন।

 

আর সত্যিই, এই জেলখানায় খাবার দিতে নির্ধারিত সময় থেকে মাত্র ৩০ মিনিট দেরি হলেই কয়েদিরা ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি আর দরজায় আঘাত করা শুরু করে দেয়। এটি যেন মানুষের সীমাবদ্ধতা আর পরমুখাপেক্ষীতার বাস্তব প্রদর্শনী। কাজেই, আজকের পর থেকে যখন আপনি কোনো খাবার অথবা নাশতা উপভোগ করতে বসবেন, অবশ্যই এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও বাস্তবতা অনুধাবন করে তা উপভোগ করবেন।

সবশেষে, উপরে বর্ণিত বাস্তবতার উপলব্ধি আপনাকে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার দিকে ধাবিত করবে। সহীহ মুসলিম-এ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সন্তুষ্ট হন তাঁর বান্দার ওপর, যখন সে কিছু খাবার খায় আর আল্লাহর প্রশংসা করে।’ এটা একই সাথে তাওহীদের বহিঃপ্রকাশ এবং এই রুঢ় বাস্তবতার স্বীকৃতি, যে এই ছোট্ট খাবারের টুকরোটা লক্ষ লক্ষ মুসলিম ভাই- যাদের আপনি হয়ত আপনার জীবনে কোনোদিন দেখেনও নি- তাদের চোখে এই টুকরোটি একটা কল্পনা মাত্র। যার কেবল স্বপ্নই দেখা চলে। সোমালিয়া বা হাইতির ভয়াবহ লাগামহীন দুর্ভিক্ষের দিকে তাকিয়ে দেখুন। খাবার কিছুক্ষণের মধ্যে আসবেই এই নিশ্চয়তা থাকার পরও আমার চারপাশের কয়েদীরা একটু দেরীতেই অস্থির হয়ে দরজায় আঘাত করা শুরু করে দেয়। অথচ এক মুহূর্ত ভাবুন তো, আপনার দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোথাও কোনো খাবার নেই। আপনার কোনো নিশ্চয়তা নেই যে আপনি সারাদিন বা সারা সপ্তাহ কিছু মুখে দিতে পারবেন কি না। কি করবেন আপনি? এহেন পরিস্থিতিতে বসবাসকারী একজন ব্যক্তি যে দুঃস্বপ্নের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করেন তা পশ্চিমা ধনী দেশের দরিদ্রতম লোকটিও কল্পনা করতে পারবে না। এমন দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে উন্মাদের মত ছোটাছুটি করা ছাড়া আর কীইবা করা আছে? ভাবুন তো, আপনার নিজের ক্ষুৎ-পিপাসার সাথে যদি স্ত্রী আর সন্তানদের অনাহারক্লিষ্ট মুখ যোগ হয় তাহলে আপনার কেমন লাগবে? খুশির কথা, এই কল্পনা শুধুই ক্ষণিকের জন্যে আপনার মাথার একটা ছোট্ট অংশ জুড়ে বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু এ দুনিয়ায় আপনার চোখের আড়ালের লাখো মানুষের জন্যে এটাই বাস্তবতা। এটাই জীবন, ভাবতে না চাইলেও ভাবতে হবেই। এই জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। যে ব্যক্তি মন-প্রাণ ভরে খাবার খায়, অথচ এ খাবারের সন্ধানদাতা (আল্লাহ) ও প্রকৃত অর্থে অমূল্য এই খাবারের সঠিক মূল্যায়ন করতে জানে না, সে আসলে এই খাবার খাওয়ারই যোগ্য নয়।

আল-ইমাম আল আওযা’ই (রহিমাহুল্লাহ) একবার দামাস্কাস থেকে শাম উপকূলে যাত্রা করছিলেন। পথিমধ্যে তার এক বন্ধুর শহরে তাকে থামতে হল। বন্ধুটি তাদের দুইজনের জন্যেই রাতের খাবার তৈরি করল। যখন তারা খেতে বসলেন, বন্ধুটি বললেন, “হে আবু ‘আমার! খাও। আর আমাকে ক্ষমা কর। কারণ, তুমি এমন একসময় এলে যখন আমি কিছুটা টানাপোড়েনে আছি।”ইমাম আওযা’ই তাঁর হাত সরিয়ে নিলেন এবং খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকলেন। বন্ধুটি বারবার তাঁকে খাওয়ার জন্যে অনুরোধ করতে লাগলেন কিন্তু তিনি প্রতিবারই অস্বীকৃতি জানালেন। শেষ পর্যন্ত বন্ধুটি খাবার গুছিয়ে ফেললেন। তারপর দুজনেই শুয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে উঠে বন্ধুটি ইমাম আওযা’ইকে প্রশ্ন করলেন, ‘কাল রাতে তুমি খেলে না কেন?” আল আওযা’ই জবাবে বললেন, “আমি সেই খাবার ছুঁয়ে দেখতে চাইনি যে খাবারের জন্যে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়নি বা যে খাবার সামনে নিয়ে আল্লাহর নি’আমত সেই খাবারকেই ছোট করে দেখা হয়েছে।

তাই খাওয়া-দাওয়ার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তাওহীদ।

 .

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১১)

 

কুরআনে সূরা বাক্বারার ২১৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন,

সম্মানিত মাস সম্পর্কে তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে যে, তাতে যুদ্ধ করা কেমন? বলে দাও এতে যুদ্ধ করা ভীষণ বড় পাপ। আর আল্লাহর পথে প্রতিবন্দ্বকতা সৃষ্টি করা এবং কুফরী করা, মসজিদে-হারামের পথে বাধা দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বহিস্কার করা, আল্লাহর নিকট তার চেয়েও বড় পাপ। আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহা পাপ …”

 

হিজরী ২য় বর্ষে এই আয়াত নাযিল হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)এর নেতৃত্বে ১২ জন সাহাবীকে কুরাইশদের একটি খাদ্যবাহী কাফেলাকে অবরোধ করতে নাখলাহ (মক্কা ও তায়েফের মাঝামাঝি) নামক স্থানে পাঠান। মুসলিমদের উপর বাড়াবাড়ি রকমের জুলুম-নির্যাতনকারী কিছু মুশরিক সেই কাফেলাতে ছিল। অত্যাচারের ক্ষেত্রে তারা সবরকমের সীমা অতিক্রম করেছিল। তারা মুসলিমদের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, মুসলিমদের ঘরছাড়া করেছিল, সাহাবীদের অত্যাচার করেছিল, এমনকি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ও তারা একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করেছিল। সেই কাফেলার কাছাকাছি গিয়ে ‘আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ এই ঘৃণ্য লোকগুলোকে দেখতে পান। সাহাবাদের মনে তখন এ কাফেলাটি আক্রমণ করে তাদের নিজেদের অর্থসম্পদের কিয়দাংশ ফেরত পাবার চিন্তা উদিত হয়। কিন্তু সে সময়টা ছিল রজব মাস। চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে অন্যতম রজব মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হওয়া ছিল হারাম। তবে অনেকক্ষণ ভেবে দেখার পর, মুসলিমদের সেই ছোট্ট দলটি তাই করার সিদ্ধান্ত নেয় যা ইতিহাস এবং পরিস্থিতির বিচারে সমর্থনযোগ্য। তারা সে কাফেলাটি আক্রমণ করেন এবং তাদের হারানো কিছু সম্পদ পুনরুদ্ধার করেন।

এই ঘটনা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে অস্বস্তিকর পরিস্থিতে ফেলে দেয়। এই ঘটনাকে পুঁজি করে এবার মুশরিকরা সমাজে হৈ চৈ বাঁধিয়ে মুসলিমদের বিপক্ষে জনসমর্থন আদায়ের সুযোগ পায়। তারা বলে বেড়াতে থাকে মুসলিমরা যুদ্ধের পবিত্র রীতি লঙ্ঘন করেছে। তারা উগ্র, তারা জঙ্গী, তারা রক্তপিপাসু যুদ্ধবাজ; তারা শান্তি ও স্বাধীনতা বিরোধী চক্র এবং এ ধরনের আরো নানান কথা তারা বলতে শুরু করে। এক পর্যায়ে গিয়ে ইবন জাহশ ও তার বাহিনীর কুরাইশদের কাফেলা আক্রমণের ঘটনায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত তা নিয়ে মুসলিমরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে, আল্লাহ এই আয়াতটি নাযিল করেন এবং নিশ্চিত করেন যে, হ্যাঁ, সম্মানিত মাসে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু মক্কার মুশরিকরা মুসলিমদের সাথে এতদিন ধরে যা কিছু অন্যায় করে আসছে সেগুলো নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করার চেয়েও নিকৃষ্ট। এই আয়াতের মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে কেন্দ্র করে কুরাইশরা যে মানবতার মেকি আর্তনাদ তোলে তা নিস্ফল হয়ে যায়।

বর্তমানকালেও এই ধরনের পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে সে ব্যাপারে এই আয়াত আমাদেরকে শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা হল, ইসলামের শত্রুরা কিছু ঘটনাকে পুঁজি করে ফায়দা লুটবার চেষ্টা করে। এই ঘটনাগুলো আমাদেরকে অনেক সময় রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দেয়। কিন্তু আমাদের রক্ষণাত্মক হয়ে পড়া মোটেই উচিত নয়। বরং কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা না করে বরং ইসলামের এইসব শত্রুদের তাদের অপরাধের জন্য কাঠগড়ায় তোলা উচিত। ইবনে জাহশের আপাতদৃষ্টিতে অনুচিত কাজটিকে তারা শঠতাপূর্ণ উপায়ে এমনভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবার সামনে তুলে ধরেছিল যে, তাদের নিজেদের সব অপকর্ম এর নীচে চাপা দিয়ে ফেলেছিল। অথচ তাদের অন্যায় ও অপকর্মই এই ঘটনার মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। তাদের এই উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার জবাবে আল্লাহ মুসলিমদেরকে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে রক্ষণাত্মক হতে বলেননি। মুশরিকদের সামনে কৈফিয়ত পেশ করতেও বলেননি। বরং আল্লাহ মুসলিমদেরকে আদেশ করেছেন এই মুশরিকদের সকল অপকর্ম সবার সামনে তুলে ধরতে। এখানে মুসলিমদের আচরণটা হবে এমন, “আরে? তুমি কাকে সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থী বলছ? তুমি নিজে কি করেছো আমাদের সাথে, সে ইতিহাসের দিকে আগে লক্ষ্য কর!”

এই যুগে এসেও মুসলিমদেরকে এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। যখনই আমাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ, উগ্রপন্থা এবং এই ধরনের আরো অতি পরিচিত কিছু অভিযোগ তাক করা হয়, তখন অধিকাংশ মুসলিম হয়তো ভালো নিয়ত নিয়েই রক্ষণাত্মক অবস্থানে গিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। “দেখুন অল্প কিছু মানুষের কাজের জন্য আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে দেওয়া যায় না”, “আমরা শান্তিকামী মুসলমান”, “ইসলাম নিরীহ মানুষ হত্যা কোনোক্রমেই সমর্থন করে না” ইত্যাদি কিছু গৎবাঁধা বুলি আওড়ে তারা যেন ইসলামকে কলঙ্কমুক্ত করার চেষ্টা করে। হতে পারে তারা এসবের সাথে মোটেও জড়িত ছিল না।অনেক ক্ষেত্রে তাদের এই বুলিগুলো সত্যও বটে। তবুও আগ-বাড়িয়ে এসব কথা বলে নিজেদের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করাটা পরাজিত মানসিকতার একটি লক্ষণ। এই লক্ষণটি পশ্চিমা মুসলিমদের একটি সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমারা এভাবেই আমাদের জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে। তারা চায় আমরা নমনীয় হই। কৈফিয়ত ও আত্মরক্ষাসুলভ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করি যাতে করে তারা নিজেদের হিংস্র ও রক্তাক্ত ইতিহাস আড়াল করতে পারে। এ কারণেই, এই আয়াতটি আমাদের শিক্ষা দেয়, কাফিরদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে নমঃনমঃ হয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার এই বেদনাদায়ক মানসিকতা যেন আমরা পরিত্যাগ করি। বরং হাঁটে হাড়ি ভেঙে তাদেরকে যেন তাদের অপকীর্তিগুলোকে দেখিয়ে দেই। আর তাদের অপকীর্তির উদাহারণ তো ভুরি ভুরি।

 

এই আয়াতে মুসলিমদেরকে কুরাইশদের অপকর্ম ও অন্যায়ের স্বরুপ উন্মোচন করে দিতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল তাদের তর্জন-গর্জনকে স্তিমিত করে দেওয়া। ঠিক একইভাবে আমাদের উচিত, আজকে যারা ইসলামের শত্রু, তাদের সীমালঙ্ঘন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া এবং সেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করা। যখনই তারা আমাদেরকে বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা উগ্রপন্থার অভিযোগ তুলে আঙুল তাক করার ধৃষ্টতা দেখাবে এবং নিজেদের পরম হিতৈষী শান্তিকামী হিসেবে দাবি করবে, তখন আমরা তাদের কুকীর্তির ইতিহাস উন্মোচন করব।

 

আমাদের নেটিভ আমেরিকানদের গণহত্যার ইতিহাস সম্বন্ধে জানা উচিত। কলম্বাস আসার আগে তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি। কিন্তু ইউরোপিয়ান হানাদাররা বর্তমান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এই আদি অধিবাসীদের কচুকাটা করে তাদের সংখ্যা নামিয়ে নিয়ে আসে ১০ লক্ষেরও নীচে।

আফ্রিকার দাসদের ইতিহাস নিয়ে আমাদের পড়াশোনা করা উচিত। দাস-বণিক ও উপনিবেশ স্থাপনকারীদের হাতে সেখানে ৫০ মিলিয়ন মানুষ তাদের জীবন দিয়েছে। এটি সুদূর ইতিহাসের ঘটনা নয়। এটি ঘটেছিল সেই যুগে, যে যুগকে আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার সূচনাকাল হিসাবে ধরা হয়। এই নিষ্ঠুরতার পেছনে কোন দেশ ছিল? পশ্চিমা ইউরোপ এবং আমেরিকা, যাদের কিনা সবচেয়ে “সভ্য” জাতি হিসেবে গণ্য করা হয়।

আমাদের মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধের ইতিহাস জানা উচিত, এবং “manifest destiny” এর অর্থ জানা উচিত। (manifest destiny হল এই নিয়তিতে বিশ্বাস করা যে, আমেরিকান সৈন্যরা বিশ্বের সকল প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে)।

১৯ শতকের শেষদিকে আমেরিকান দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিপিনোদের বিদ্রোহের কাহিনী সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।

আমাদের জ্ঞানের পরিধিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বিস্ফোরণের ঘটনা। প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ মুহুর্তের মাঝে ছাই হয়ে যায় এই বোমার কবলে পড়ে। এদের সবাই ছিল যে যার মত কাজ করা বেসামরিক লোক। ইতিহাসে এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির উপর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের এটিই একমাত্র ঘটনা। অথচ নির্মম বাস্তবতা এই যে, যারা সেইদিন নিজেরা পারমাণবিক বোমা ফাটিয়েছিল, তারাই আজকে হর্তা-কর্তাসেজে বিশ্বব্যাপী লেকচার দিয়ে বেড়ায় যেন যার-তার হাতে এই পারমাণবিক বোমা চলে না যায়! (জন হেরেসির(John Hersey) “হিরোশিমা” নামক বইটি পড়ুন)

 

ল্যাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে এল সালভাদর, চিলি, পানামা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, গ্রেনেডা এবং গুয়াতেমালায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান থাকা উচিত। হাওয়ার্ড যিন(Howard Zinn) এর বইগুলো সেক্ষেত্রে ভালো কাজ দিতে পারে।

 

আমাদের ১৯৯০ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের ইতিহাস এবং তৎপরবর্তী আমেরিকা-নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ কর্তৃক ইরাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার ইতিহাস জানতে হবে। এই অবরোধের মাধ্যমে ইরাকে খাদ্য-পানি-ঔষধপত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিশুদেরকে অনাহারে এবং ঔষধসেবা থেকে বিরত রাখা ছিল যুদ্ধের ‘আধুনিক’ একটি কৌশল। ১৯৯৬ সালে, “60 Minutes” নামের একটি অনুষ্ঠানে, ম্যাডেলিন অলব্রাইট (আমেরিকার প্রথম মহিলা সেক্রেটারি অফ স্টেট), আমেরিকার পক্ষ থেকে নিশ্চিত করেন যে তারা মনে করেন, ইরাকে ৫ লক্ষ শিশুর মৃত্যু তাদের যথার্থ প্রাপ্য ছিল।

১৯৯৩ সালে আমেরিকা কর্তৃক সোমালিয়া আক্রমণের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অধ্যয়ন করতে হবে। সেখানে তারা প্রায় ২০০০ সোমালিকে তারা হত্যা করেছিল।

আমেরিকা কর্তৃক ইসরাইলকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের খুঁটিনাটি জানতে হবে। ইসরাইলের প্রতিটি বুলেট, মিসাইল, বুলডোজার এবং যুদ্ধবিমানে আমেরিকানদের কালোহাত প্রকাশ পায়। এগুলো দিয়ে ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত আমাদের ভাই-বোনদের হত্যা করা হয়। (পড়ুন নরম্যান ফিনকেলস্টাইনের (Norman Finkelstein) বইগুলো)

আমাদের জানতে চাওয়া উচিত, কীভাবে তারা আমাদেরকে সন্ত্রাসী ডাকার আস্পর্ধা দেখায়? অথচ তারাই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে আমাদের দু-দুটো দেশে আগ্রাসন চালিয়ে জবরদখল করেছে এবং প্রতিনিয়ত বোমাবর্ষণ করছে।

মনোবিজ্ঞান শাস্ত্রে ‘সাইকোলজিক্যাল প্রজেকশান(Psychological projection)’ বলে একটি ধারণা আছে। এই ধারণামতে, কোনো অপকর্মের দায়ে দোষী ব্যক্তি নিজের বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পেতে নিজের উপর থেকে সকলের মনযোগ সরিয়ে নিতে চায় এবং অন্য কারো কাঁধে নিজের দোষ চাপিয়ে বাঁচতে চায়। আজকের দিনে আমাদের শত্রুদের সম্ভবত এই রোগেই ধরেছে। যা কিছুই হোক, আল্লাহ আমাদেরকে এই আয়াতে শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে আমরা তাদের অপপ্রচারে জবাব দেব (এবং কিভাবে দেব না)।

.

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮
জুন ১৮, সকাল ৯টা ২২ মিনিট।

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১২)

 

সূরা আলে ‘ইমরানের আয়াত ১১৯ এ আল্লাহ বলেছেন,

 “দেখ! তোমরাই তাদের ভালোবাসো, কিন্তু তারা তোমাদের প্রতি মোটেও সদভাব পোষণ করে না। আর তোমরা সমস্ত কিতাবেই বিশ্বাস কর। অথচ তারা যখন তোমাদের সাথে এসে মিশে, তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আর যখন তারা নিরিবিলি হয়, তখন তোমাদের উপর রোষবশতঃ আঙ্গুল কামড়াতে থাকে…”

অন্যদের সাথে কোনো বোঝাপড়া করার ক্ষেত্রে নিজেদের সহজাত অন্তর্জ্ঞান অর্থাৎ Intuition কে কাজে লাগানোর বিষয়ে এই আয়াতটি আমাদেরকে শিক্ষা দেয়। নেকড়েদের এই সমাজে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে দুই ধরনের প্রান্তিক আচরণ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। একদিকে যেমন অন্যদেরকে সাক্ষ্যপ্রমাণের স্বল্পতার কারণে সন্দেহ সত্ত্বেও ছাড় দিতে হবে ঠিক তেমনি এর বিপরীতে আবার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মুখের কথায় মুগ্ধ হয়ে সবকিছুকেই সরলমনে বিশ্বাস করে প্রতারিত হওয়া যাবে না। এ দুটোর মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। কেউ যেন আমাদের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে হীন স্বার্থোদ্ধার করার সুযোগ না পায়।

সহানুভূতিশীলতা এবং সতর্কতা-এ দুয়ের মাঝে হতে হবে আমাদের অবস্থান। সবকিছুকে অতি সরল মনে গ্রহণ করা বা মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করে ফেলা যেমন এক ধরনের চরমপন্থা, তেমনি সারাক্ষণ চরম নৈরাশ্যবাদে নিমজ্জিত থাকা, সবকিছুর মাঝে মন্দের আভাস খুঁজে পাওয়া আরেক ধরনের চরমপন্থা। উল্লেখিত দ্বিতীয় ধরনের চরমপন্থা একজন মানুষকে অন্যের প্রতি সদয় হতে নিরুৎসাহিত করে তোলে। তাই মুসলিমরা এ দুয়ের মাঝে এমন এক মধ্যপন্থা অবলম্বন করে যা বাস্তবধর্মী।

রাসূল (صلى الله عليه و سلم) এর সীরাহর দিকে একটু দৃষ্টিপাত করলেই আমরা দেখতে পাব যে, একজন নেতা হিসেবে রাসূলুল্লাহর(صلى الله عليه و سلم) সফল হবার কারণ হল তিনি মানুষের মনে কী চলছে তা ধারণা করতে পারতেন। তাঁর মানুষের সাথে বোঝাপড়া করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। এতে ছিল সহানুভূতি এবং বাস্তবধর্মী অন্তর্জ্ঞানের চমৎকার এক সমন্বয়। তিনি জানতেন কার সাথে চুক্তি করতে হবে এবং কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। তিনি জানতেন কাদের হাতে অঢেল সম্পদ ঢেলে দিতে হবে আর কাদেরকে কিছু কম দিলেও চলবে। তিনি যে কারো মুখের কথাকেই বিশ্বাস করে নিতেন না। কারণ তিনি মানবচরিত্রের দুর্বলতাগুলো জানতেন কারো কথায় মোহগ্রস্ত না হয়ে তিনি এই ব্যাপারগুলো খুব বাস্তবসম্মত পন্থায় সামলাতে পারতেন। তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী

যেমন, আবু ‘আযযা আল-জুমাইহ নামে এক মুশরিক ছিল যে বদর যুদ্ধে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরা পড়ে। সে ছিল হতদরিদ্র আর তাকে তার বড় সংসারের দেখাশোনা করতে হত, তাই রাসূল ﷺ সেবারের মত এই শর্তে তাকে মুক্তি দিলেন যে, সে ভবিষ্যতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার শত্রুতায় জড়াবে না। কিন্তু, ঠিক এক বছর পরেই সে উহুদ যুদ্ধে মুশরিকদের পক্ষে যুদ্ধ করতে এসে মুসলিমদের হাতে আবার বন্দী হয়। উহুদ যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবী শহীদ হন। আবু ‘আযযা আবার কাকুতি-মিনতি করে আবদার করল যেন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সে বদরের মতো এবারও অঙ্গীকার করল যে ভবিষ্যতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আর কখনও সে যুদ্ধে অংশ নেবে না। কিন্তু এবার, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন কঠোর। তিনি বললেন, ‘মু’মিনরা এক গর্তে দু’বার দংশিত হয় না‘। এ কথা বলার পর আয-যুবাইর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আবু ‘আযযাকে হত্যা করেন। কারণ, যতই অনুনয়-বিনয় সে এবার করুক না কেন, নিশ্চিতভাবেই তার অঙ্গীকার সে আবারো ভঙ্গ করত এবং সে আবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করত। কিন্তু খেয়াল করুন যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বদরের পর একটি সুযোগ দিয়েছিলেন এবং তার মধ্যে সদিচ্ছার উপস্থিতি বোধ করে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

কাজেই, এই আয়াতটি আমাদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়। অনেকেরই মুখের কথা আর অন্তরের কথা এক নয়। তাদের সাথে বোঝাপড়ায় এই জ্ঞান কাজে দেয়। এ আয়াত থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, এমন কারো মুখের কথা প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ করা উচিত নয় যা পরবর্তীতে আফসোসের কারণ হতে পারে। এই প্রসঙ্গে অধুনা বিশ্বের যে ঘটনাটি খুব করে আমাকে নাড়া দেয় তা হল ওবামার সস্তা স্লোগান ‘change we can believe in’। এই ডাকে সাড়া দিয়ে আমেরিকান মুসলিমদের তার সমর্থনে মেতে ওঠা বরাবরের মতোই আমেরিকান মুসলিমদের সবকিছু অতি সহজে হজম করার অভ্যাসের পরিচায়ক। এটা ছাড়াও কায়রোতে দেওয়া তার ভাষণ, তাতে কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করা এবং আরো অনেক কিছুই আমেরিকান মুসলিমদের মন অতিসহজে জয় করে ফেলেছে। এই ধরণের কূটচাল সম্পর্কে অবশ্য আল্লাহ আমাদেরকে অনেক আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘…তারা যখন তোমাদের সাথে এসে মিশে, তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি…’

পরবর্তীতে এল মুসলিমদের হা করে শুধু দেখবার পালা। যে ওবামা মুসলিম বিশ্বের সাথে যুদ্ধে না জড়াবার অঙ্গীকার করেছিল, সেই ওবামাই মুসলিমদের সাথে যেন বুশ থেকেও আরো মারাত্মক ও তীব্রতর যুদ্ধে নামল। উদাহারণস্বরুপ, রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরের ১৭ মাসে তার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে মুসলিম ভূমিতে প্রায় ১০০টি ড্রোন হামলা করা হয়েছে। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে এসব ড্রোন হামলায় হাজারেরও বেশি নিরীহ মুসলিম নিহত হয়েছে। বুশ তার সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে জুড়ে যত ড্রোন হামলার অনুমোদন দিয়েছে, ওবামা ১৭ মাসেই মুসলিম বিশ্বে তার দ্বিগুণ ড্রোন হামলা চালিয়েছে! অনেকের কাছে এটি অবাক করা বিষয় হতে পারে। তবে যারা এই আয়াতের মর্মার্থ বোঝে এবং মুসলিম ও কুফফারদের ইতিহাস সম্পর্কে জানে তারা এটা আগেই অনুমান করতে পেরেছিল।

সুবহানআল্লাহ! কি চমৎকার ভাবেই না ১৪০০ বছর আগে নাযিলকৃত একটি আয়াত আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে চিত্রিত করেছে!

 .

তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১৩)

 

সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১২০ এ, আল্লাহ বলেছেন,

তোমাদের কোনো কল্যাণ হলে সেটা তাদের দুঃখ দেয়, আর তোমাদের কোনো অকল্যাণ হলে তারা আনন্দিত হয়, আর তাতে যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো ও তাক্বওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না …”

 

এ আয়াতটি পড়ে আমি ইবন আল-যাওজির “সায়েদ আল-খাতির” বই (পৃষ্ঠা ১১৮) থেকে কিছু কথা যোগ না করে পারছি না। তিনি বলেন,

‘জেনে রেখো, সবগুলো দিন সমান নয় … কখনও তুমি নিঃস্ব, কখনও বা তুমি ধনী, কখনও তুমি অপমানিত, আর কখনও বা তুমি মানী। কখনো তুমি দেখছ তোমার বন্ধুদের সুখে উল্লাসরত, কখনও বা তুমি দেখবে তোমার শত্রুরা আনন্দে উদ্বেলিত।

কিন্তু সত্যিকারের সুখী ব্যক্তি হল সে, যে তার জীবনভর সকল পরিস্থিতিতে একটি আদর্শকে আকঁড়ে ধরে আছে। আর তা হল আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া অবলম্বন করা।

সে যদি ধনী হয়, তাক্বওয়া তাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে। সে যদি গরীব হয়, তাহলে তাক্বওয়া তার জন্য সবর করার দ্বার খুলে দেবে।

যদি সে স্বস্তি আর আয়েশের মাঝে জীবনযাপন করে, তবে এই তাক্বওয়া তার উপর বর্ষিত নি’আমত পূর্ণ করবে। আর যদি সে কষ্ট আর দুর্ভোগের মধ্যে দিনাতিপাত করে, তবে এই তাক্বওয়া তাকে অলংকৃত করবে। তাক্বওয়া তার সঙ্গী হলে তার দিনগুলো ভাল চলুক বা মন্দ-তাতে তার কিছুই আসে যায় না। তার পরনের জামাটা ছেঁড়া হোক বা নতুন; সে অভুক্ত থাকুক বা তুষ্ট থাকুক তাতে খুব বেশি কিছু আসে যায় না। কেননা, এসব কিছুই যেকোনো সময়ে হারিয়ে যেতে পারে বা বদলে যেতে পারে।

 

কাজেই, তাক্বওয়া হল নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী। সে নিদ্রা যায় না। বিপদের সময় তাক্বওয়া তোমার হাত ধরে রাখবে। সদাসর্বদা জেগে তোমাকে নিরাপদ রাখবে। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে তাক্বওয়া অবলম্বন করবে। তাহলে শত টানাপোড়েনের মাঝেও তখন তুমি স্বচ্ছন্দ থাকবে। কষ্টের মাঝেও তুমি স্বস্তি খুঁজে পাবে। ‘

 .

তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১৪)

 

আল্লাহ তা’আলা সূরা আলে-ইমরানের ১২১ নম্বর আয়াতে বলেছেনঃ

“আর স্মরণ করুন আপনি যখন ভোরবেলায় আপনার আপনজনদের কাছ থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুমিনগণকে যুদ্ধের ঘাঁটিসমূহে মোতায়েন করলেন…”

 

উহুদের যুদ্ধ নিয়ে অবতীর্ণ হওয়া প্রায় ৬০টি আয়াতের মধ্যে এ আয়াতটি-ই প্রথম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উহুদ পর্বতে মুজাহিদীনদের সংগঠিত করার জন্য ভোরবেলাকে বেছে নিয়েছিলেন। এ আয়াতে সেই কথাই বলা হচ্ছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো সময়ের উল্লেখ। আল্লাহ তা’আলা সুনির্দিষ্ট ভাবে “ভোরবেলা” কথাটি বলে দিয়েছেন।

ভোরবেলা বা দিনের প্রথম ভাগ হলো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সেরে ফেলার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট সময়। সাখর বিন ওয়াদা’আ আল-গামিদী বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ‘হে আল্লাহ! আমার উম্মাহর ভোরের-পাখিদের তুমি বরকত দাও!’ আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো সেনাবাহিনী পাঠালে বা অভিযান পরিচালনা করলে তা সর্বদা করতেন একেবারে দিনের প্রারম্ভে। সাখর বিন ওয়াদা’আ নিজেও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি সবসময় সকালবেলায় তার কাফেলা পাঠাতেন। যার ফলে তার ছিল অঢেল বিত্তবৈভব।

সত্যিকার অর্থেই কুর’আনের মধ্যে একটু ঘেঁটে দেখলে দেখা যাবে যে বহু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা দিনের প্রারম্ভে সংঘটিত হয়েছে। এই ভোরবেলাতেই আল্লাহ তা’আলা লুতের সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সূরা হুদের ৮১ নম্বর আয়াতে এই ঘটনার কথাই বর্ণিত হয়েছে:

“নিঃসন্দেহ তাদের নির্ধারিত সময় হচ্ছে ভোরবেলা। ভোরবেলা কি আসন্ন নয়?”

আর সূরা আল-হিজরের ৬৬ তম আয়াত:

“আমি লূতকে এই বিষয়ে জানিয়ে দিলাম যে, সকাল হলেই তাদেরকে সমূলে বিনাশ করে দেয়া হবে।”

এবং সূরা আল-ক্বমারের আয়াত ৩৮: “আর নিশ্চিতভাবে প্রত্যুষে তাদেরকে নির্ধারিত শাস্তি আঘাত হেনেছিল।”

এভাবে বার বার “ভোর” কথাটি কুরআনে এসেছে। সূরা আশ-শু’আরার ৬০-৬৬ আয়াতেও আমরা দেখি যে, ফির’আউন ও তার সৈন্যদলের ধাওয়া করার পর, এই সূর্যোদয়ের সময়েই মূসা (আলাইহিস সালাম) সমুদ্র বিদীর্ণ করেছিলেন।

এই ভোরবেলার ফজরের ফরয সালাতের পূর্বে আদায় করা দু’ রাকআত সুন্নাহ সালাতের কথা বলতে যেয়েই আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: এটা আমার কাছে দুনিয়া ও তাতে যা কিছু আছে তার চাইতেও বেশি প্রিয়”। সত্যিই! তাঁর কাছে তা এতোটাই প্রিয় ছিল যে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনোদিনও এ দু’রাকআত সালাহ বাদ দেননি। আর এই ফজর সালাত-ই যখন জামাতের সাথে আদায় করা হয়, তার বর্ণনা নিয়ে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “এ সালাত বান্দাকে আল্লাহর নিরাপত্তার ছায়াতলে নিয়ে আসে”

আপনি নিজের দিকেই লক্ষ করুন। দেখবেন, যে দিনগুলোতে আপনি ফজরের পর থেকেই কাজকর্ম শুরু করে দেন, সে দিনগুলি অন্যান্য দিনের চাইতে অনেক বেশি কার্যকর। আর যে দিনগুলিতে ফজরের পর আবার কয়েক ঘণ্টা ঘুমান, সে দিনগুলো কখনোই এত কর্মমুখর হয় না। সকালে উঠে একটু হাঁটতে বের হওয়া বা তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছানোর জন্য সকাল সকাল উঠে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। অথবা ক্লাসের পড়াটা তৈরি করে ফেলা এবং কুর’আন মুখস্থ করার জন্য কিংবা সফরে বের হওয়ার জন্য ভোরবেলার কোনো জুড়ি নেই। এমনকি দিনের প্রথম খাবার দেরি করে খাওয়ার বিপরীতে সকাল সকাল নাস্তা করার মতো ছোট্ট বিষয়টাও আপনার পুরো দিনটিকে সতেজ করে তোলে। ভোর থেকে শুরু হওয়া আপনার কর্মব্যস্ত দিনগুলোর সাথে সেই দিনগুলোর তুলনা করে দেখুন যখন পুরো সকালটা আপনি কিছু না করেই কাটিয়ে দেন। সেই অলস দিনগুলোতে হয়তো ঘুম থেকে উঠে কেবলমাত্র সকালের নাস্তা সারতে সারতেই বেলা বারোটা বেজে যায়। এই দুই ধরনের দিনে আপনার অর্জন কি কখনো সমান হয়? তফাৎটা তো দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার! আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর সাহাবাদের সুন্নাহ ছিল সকাল সকাল কাজ শুরু করে দেয়া। এমনকি কঠোর শারীরিক শ্রমজড়িত আমল, জিহাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি।

সুতরাং ফজর সালাতের পর অলসতা ঝেড়ে ফেলুন। জড়তা কাটিয়ে জেগে ওঠার চেষ্টা করুন। আর এসময়টিকে কাজে লাগান। আপনার দৈনন্দিন কাজগুলো আগে আগে সেরে নিন। সেই দলের সাথে যোগ দিন যাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আখ্যায়িত করেছেন “ভোরের-পাখি” হিসেবে। তাদের জন্য তিনি আল্লাহর কাছে বরকতের দু’আ চেয়েছেন! আর জেনে রাখুন সকালে করা সবচেয়ে উত্তম, সতেজ ও উপকারী কাজটি হলো আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন হওয়া। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন: “ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) এর উত্তরসূরীদের মধ্য হতে চারজন দাস মুক্ত করার চাইতে ভোর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর স্মরণে রত কোনো দলের সাথে বসে থাকা আমার নিকট অধিক প্রিয়”।

শেষ একটি ছোট্ট কথা বাকি রয়ে গেছে। আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন যারা দিনের প্রথম ভাগের নি’আমত সম্পর্কে ভালো ভাবেই অবগত। তারা সকাল থেকে শুরু করে সমগ্র দিন কাজে লাগাতে চান, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিদিন সকালে শরীরে যে আলস্য আর জড়তা জেঁকে বসে, তা কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারেন না। আমার মতো আরো অনেকেই মোটেও “ভোরের-পাখি” নন। তাহলে কীভাবে আমরা নিজেকে বদলাবো? কীভাবে আমাদের প্রতিটি দিনকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারব?

প্রথমত, আমাদের নিজেদেরকে শৃঙ্খলার মাঝে নিয়ে আসতে হবে। ইশার সালাতের পর কাজকর্ম সীমিত করে ফেলতে হবে। ইশার পর বেশি দেরি না করে শুয়ে পড়তে হবে। সহীহ হাদীস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে – ইশার সালাতের পরে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা এবং ইশার পূর্বে ঘুমানো – এ দু’টি কাজের ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত জোরালোভাবে আমাদেরকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কেননা এই দু’টো অভ্যাস ত্যাগ করলে আমরা দ্রুত ঘুমাতে পারবো। আর গাঢ় একটি ঘুমের পরে ঝরঝরে দেহ ও মন নিয়ে পরদিন সকালে জেগে উঠবো।

দ্বিতীয়ত, ভোরের কিছু আগে উঠে ইবাদতে নিয়োজিত হওয়ার বিষয়টি আমাদের মন ও মেজাজের উপর সরাসরি ছাপ ফেলে। বুখারী ও মুসলিম উভয়েই বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

“যখন তোমাদের কেউ ঘুমিয়ে পড়ে, শয়তান তোমাদের (মাথার) পশ্চাদাংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এ বলে চাপড়ায়, “তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব শুয়ে থাকো। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে তাহ’লে একটি গিঁট খুলে যায়। অত:পর যদি সে ওজু করে আরেকটি গিঁট খুলে যায়, তারপর যদি সে নামাজ পরে আরেকটি গিঁট খুলে যাবে। তখন তার প্রভাত হয় উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথা সে সকালে উঠে কলুষ কালিমা ও আলস্য সহকারে”। (বুখারী : ১১৪২, মুসলিম : ৭৭৬)

 

এসব কিছু চিন্তা করার পর যখন উপরের আয়াতটির দিকে আবার তাকাই তখন বুঝি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা কেন বিশেষ ভাবে সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এই একটি আয়াত-ই আমাদের দিনগুলোকে আরো বেশি কর্মতৎপর করে তুলতে পারে, ইনশা আল্লাহ..।

 .

তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১৫)

 

সূরা আলে ইমরানের ১৩৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

আর যারা কোনো পাপ কাজ করার পর বা নিজেদের উপর যুলুম করার পর আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ ব্যতীত আর কে আছে তাদের ক্ষমাকারী?

 

সাধারণভাবে, তাওবাহ (ক্ষমাপ্রার্থনা) ও ইস্তিগফারের (অনুশোচনা) সাথে বিষণ্ণতা ও অনুতাপের অনুভূতিগুলো জড়িত। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহর কাছে বান্দার তাওবাহ গৃহীত হওয়ার প্রথম শর্তই হল উক্ত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া ও অনুশোচনা করা। আপনি ইবন আল-জাওযীর বইগুলো পড়লে কিছু কথা ঘুরেফিরে বারবার দেখতে পাবেন। তা হল ‘অনুতাপের অশ্রু’ এবং ‘অনুশোচনার অশ্রু দ্বারা নিজের পাপমোচন’। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নিজেকে বা অন্য কাউকে আল্লাহর অবাধ্যতায় পতিত হতে দেখলে আমাদের তাতে দুঃখ পাওয়া উচিত।

কিন্তু আমি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের দিকে নির্দেশ করতে চাই। তা হল, আপনি কোনো পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার পর যখন অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে উদ্যত হন সেই মুহূর্তে আপনার দুঃখবোধ আনন্দের অনুভূতি দ্বারা পরিবর্তিত হওয়া উচিত। হ্যাঁ, মু’মিনের হৃদয় আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে অবশ্যই দুঃখে ভারাক্রান্ত হবে। কেননা পাপে লিপ্ত হওয়া হচ্ছে একটি খাঁচায় বন্দী হবার মত। আর সেই পাপকর্মের জন্য অনুতপ্ত বোধ করা এবং আল্লাহর কাছে সেজন্য ক্ষমা চাওয়া হল সেই খাঁচার দরজা খুলে মুক্ত হওয়ার চাবি। ভেবে দেখুন আপনি যখন কোনো খাঁচা থেকে মুক্তি লাভ করবেন তখন আপনার স্বাভাবিক অনুভূতিটি হবে আনন্দ এবং সুখমিশ্রিত। কোনো কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার সময় কেউ দুঃখ বোধ করে না। কাজেই, তাওবাহ এবং ইস্তিগফারের পর আপনার স্বাভাবিক অনুভূতি হওয়া উচিত মুক্তির আনন্দমিশ্রিত। পাপকর্মের দুঃখে অনুতপ্ত হবেন কিন্তু পাপ কাজের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা ও অনুশোচনা যেন আপনার মাঝে মুক্তির বোধ তৈরি করে।

প্রকৃতপক্ষে, পাপকাজের জন্য আপনার অনুশোচনা অন্য কারো জন্য নয় বরং স্বয়ং আল্লাহর জন্য আনন্দের এক উপলক্ষ। আনাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

 

 

মনে কর, তুমি মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাচ্ছ, এমতাবস্থায় তোমার খাদ্য-পানীয়সহ তোমার উটটি হারিয়ে গেল, তুমি সেটিকে ফিরে পাবার সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়ে একটি গাছের ছায়ায় বসে আছ। হঠাৎ তোমার উটটিকে তুমি তোমার সামনে দেখলে পেলে! এই অবস্থায় তুমি যতটা না খুশী হবে, তুমি কোনো পাপ করে আল্লাহর নিকট অনুতপ্ত হলে তিনি তার থেকে বেশী খুশী হন।’

সুতরাং, মহান ক্ষমাশীল আল্লাহ যেখানে আপনার অনুশোচনায় খুশী হন, সেখানে যাকে ক্ষমা করা হচ্ছে সেই আপনার তো তাওবাহ করার পর আনন্দিতই হওয়া উচিত।

তাই তাওবাহ এবং ইস্তিগফার আমাদের জীবনে আকাঙ্খিত বিষয় হওয়া উচিত। সেই সাথে সুযোগ পাওয়া মাত্রই তাওবাহ ও ইস্তিগফার করুন মুক্তির আনন্দে।

 .

তারিক মেহান্না
পলিমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেসন ইউনিট- সেল#১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১৬)

 

সূরা আলে ইমরানের ১৩৯ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

“আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও, তবে তোমরাই জয়ী হবে।”

 

উক্ত আয়াতটিই আমাদের সময়ের স্লোগান হওয়া উচিত।

কিছু পশ্চিমা দা’ঈ তাদের লেকচারে হুদায়বিয়ার সন্ধি, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মাক্কী জীবন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে এমনভাবে কথা বলেন যাতে মনে হয় মুসলিম উম্মাহর চলমান অধঃপতিত ও দুর্বল অবস্থাকেই যেন তারা নিজেদের নিয়তি হিসাবে মেনে নিয়েছেন। এমন একটা ভাব যেন এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আমাদের কিছুই করার নেই। এই চিন্তাধারাটি আমাকে ক্ষুব্ধ করে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ICNA এর এক কনভেশনে একজন দা’ঈ ইসলামের কিছু স্পর্শকাতর বিষয় উল্লেখ করে মন্তব্য করলেন, ‘এককালে আমরা এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারতাম!’ সাথে সাথে তিনি ও উপস্থিত অন্যান্যরা উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। আমি দর্শকসারিতে বসে আনমনে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ভাবছিলাম, ‘আশ্চর্য! আপনি আপনার লেকচারে ইসলামের কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারছেন না এতে হাসির কী আছে! এর থেকে দুঃখজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে যে, ইসলামের একজন দা’ঈ হয়েও আপনি আজকে একজন অনুগত ভৃত্যে পরিণত হয়েছেন?’ তখন এই আয়াতটি আমার কানে বাজছিল।

 

কিন্তু এই আয়াতটিই কেন? কারণ উহুদের যুদ্ধের এক ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত মুহূর্তে এই আয়াতটি নাযিল হয়। সাহাবীদের অনেকেই তখন মনোবল হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন। তাদের মনে লুকিয়ে থাকা ভয় এবং দুর্বলতা- এই দুটি সহজাত অনুভূতির দিকে নির্দেশ করে এই আয়াতটি বলছে, ভীত হয়ো না, ভেঙে পড়ো না। এই আয়াত শিক্ষা দিচ্ছে ঈমানের উপর দৃঢ় থাকাটাই প্রকৃত বিজয়। যুদ্ধক্ষেত্রের পরাজয় তো বাহ্যিক পরাজয়, এটি সাময়িক ব্যাপার। কাজেই মু’মিনদের হতাশ বা দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই বা নিজেদের দুর্বল ভাবার কোনো অবকাশ নেই।

 

আজকের দিনেও এই আয়াতটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আয়াতটি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, আমাদের বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং শক্তিহীনতা সত্ত্বেও আমাদের নিজেদেরকে দুর্বল ভাবার কোনো কারণ নেই। কেননা সত্যিকারের যুদ্ধ হল মনস্তাত্ত্বিক। মন এবং মগজই হচ্ছে যুদ্ধের আসল ক্ষেত্র। যতদিন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে বিশুদ্ধ ও ত্রুটিমুক্ত ঈমানধারী মুসলিম আছে ততদিন আমরা দুর্বল নই। বাহ্যিকভাবে আমাদের পরিস্থিতি যতই নড়বড়ে হোক না কেন।

যদি কোনো ব্যক্তি, সমাজ, জাতি অথবা উম্মাহ বৈষয়িক দিক থেকে নিরাপদ ও সমৃদ্ধশালী হয় অথচ তার নিজস্ব চেতনা বা ঈমান-আক্বীদার সাথে আপস করে ফেলে, তবে সে বাহ্যিক সফলতা নিরর্থক। আবার, বাহ্যিক সাফল্যের পরোয়া না করে যদি ঈমানের ব্যাপারে আপসহীন থাকা যায়, তখনও বাহ্যিক সাফল্য গৌণ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে বলা হয়ে থাকে, যখনই কোনো সাম্রাজ্য তার নিজস্ব চেতনা ও মূল্যবোধের সাথে প্রতারণা করে তখনই তার পতন ঘটে। আর তাই উহুদে সামরিকভাবে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমদেরকে আল্লাহ জয়ী বলেছেন, কেননা তারা নিজেদের চেতনা ও বিশ্বাসের উপর ছিলেন বলীয়ান। তাই, আজকে মুসলমানদের সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ যে যুদ্ধে লড়তে হচ্ছে তা হল মতাদর্শের যুদ্ধ, মনস্তাত্ত্বিক জগতের হৃদয় ও মননের যুদ্ধ (battle for hearts and minds)।

আজকে মুসলিম উম্মাহকে পরাজিত করার লক্ষে কুফফাররা আমাদের মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করছে। তারা দিনে রাতে কাজ করে চলেছে ইসলামের জীবনীশক্তি, আমাদের শক্তির আসল উৎস, “ঈমান” কে আমাদের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে। কারণ এই ঈমান পশ্চিমাদের দাসত্বের কলুষতা থেকে মুক্ত। তারা চায় আমরা যেন নিজেদের দুর্বলতাকে নিয়তি ভেবে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিই। এভাবে তারা আমাদের কেবল বাহ্যিকভাবে নয়, বরং অন্তরকেও সাম্রাজ্যবাদী দাসত্বের শেকলে আবদ্ধ করতে চায়। আমাদের উচিত আমাদের এই দুর্বল জায়গাগুলো সারিয়ে তোলা। আমাদের মনে রাখতে হবে, গোলামির কলুষতা থেকে মুক্ত ঈমান বুকে ধারণ করার কারণেই আল্লাহ সাহাবিদের সম্মানিত করেছেন, যদিও দুনিয়াবী শক্তির বিবেচনায় তারা ছিলেন দুর্বল। আজকেও আমরা একইভাবে সম্মানিত হব, যদি আমরা পশ্চিমাদের দাসত্বের মনস্তাত্ত্বিক বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে পারি।

 

এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের মনে এই বিষয়টি দৃঢ়ভাবে গেঁথে দিতে চান যে, বস্তুগতভাবে আমরা যতই দুর্বল হই না কেন, আমাদের হৃদয়ে জেঁকে বসা ঔপনিবেশিক দাসসুলভ মানসিকতার (mental colonialism) কারণসমূহ চিহ্নিত করতে পারলে এবং আমাদের হৃদয় ও মনকে এই হীনমন্যতা থেকে বিশুদ্ধ রাখতে পারলে আমরাও সম্মানিত হব। এই আদর্শিক যুদ্ধজয় তখন অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।

জেলখানাতে আমার কয়েক সেল পাশে ‘জো’ নামে এক মাদকব্যবসায়ী ছিল। কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতারের আগে সে কেমন করে তার মাদক ব্যবসা চালাতো, সেটা নিয়ে জো আমাকে অনেক গল্প বলেছিল।
গল্পের শেষে জো দুঃখের সাথে বলেছিল, ‘এখন সরকার আমাদের সাথে ইচ্ছামত যা খুশী করতে পারে।’
আমি তাকে বলেছিলাম, ‘জো, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি, “তুমি কি তোমার স্ত্রীকে ভালবাসো?”।’
সে উত্তর দিল, ‘অবশ্যই, আমি তাকে ভালবাসি।’
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মনে কর কর্তৃপক্ষ তোমার উপর অনেক শারীরিক নির্যাতন চালালো। তারা কি তোমার মুখ থেকে এ কথা বের করতে পারবে যে, “আমি আমার স্ত্রীকে ঘৃণা করি।”? ‘
সে বলল, ‘পারতেও পারে।’
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু কর্তৃপক্ষ যদি তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলোকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলে তারপরও কি তারা পারবে তোমার হৃদয়ের গভীর থেকে স্ত্রীর প্রতি তোমার ভালবাসাকে মুছে ফেলতে?’
জো উত্তর দিল, ‘কখনোই না।’
তখন আমি এই বলে কথোপকথন শেষ করলাম যে, ‘এজন্যই আসলে তারা যা খুশী তা করতে পারে না। কারণ তোমার হৃদয় তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।’
আল্লাহ বলেন,

“আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও, তবে তোমরাই জয়ী হবে।” (সুরা আলে ইমরান আয়াত ১৩৯)
সুতরাং, বাহ্যিক দুর্বলতা সত্ত্বেও সর্বদা অগ্রগামিতা ধরে রাখা সম্ভব। কাজেই দা’ঈদের আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে বারবার ‘মাক্কী জীবন’ আর ‘হুদাইবিয়াহ’র তুলনা দিয়ে দুর্বলতা আর হতাশাকে স্বাভাবিক হিসাবে মেনে নেওয়ার বোধ তৈরি করে দেওয়া মোটেই উচিত নয়। বরং তাদের উচিত ভিন্ন আঙ্গিকে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে উপস্থাপন করা। কুরআনের এই আয়াতে আল্লাহ মুসলিমদেরকে সেই শিক্ষাই দিচ্ছেন যে বাহ্যিক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও মুসলিমরাই হবে শ্রেষ্ঠ, যদি তারা হীনমন্য না হয়ে ঈমানের উপর দৃঢ় থাকার ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখে। তাই, উক্ত আয়াতটি আমাদের আজকের দিনের স্লোগান হওয়া উচিত। আমাদের মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার এই একটি আয়াতই যথেষ্ট।

 

 

এ বিষয়ে আরও পড়তে চাইলে:

  • সায়্যিদ ক্বুতুবের লেখা ‘Milestones’ বইয়ের ‘The Faith Triumphant’ অধ্যায়।
  • RAND কর্পোরেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘সিভিল ডেমোক্রেটিক ইসলাম ’ [Amazon.com: Civil Democratic Islam: Partners, Resources, and Strategies…]

.

তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেসন ইউনিট- সেল#১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১৭)

 

সূরা আলে ইমরানে, ১৪৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন,

আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ কিছু নন! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। অতএব তিনি যদি মারা যান অথবা নিহত হন, তবে কি তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? …

কুরআনে হাতেগোণা অল্প কিছু আয়াত আছে, যে আয়াতের শব্দগুলো কোনো সাহাবার মুখে প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল এবং পরে আল্লাহ কুরআনে ওহী হিসেবে সেগুলোকে নাযিল করেন। এই আয়াতটি তেমনই একটি আয়াত।

 

উহুদের ময়দান। মুশরিকরা চারিদিক থেকে মুস’আব বিন ‘উমাইরকে ঘিরে ফেলেছে। তিনি সামনে তাকিয়ে দেখলেন রাসূলুল্ললাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও বিপদের সম্মুখীন। মুশরিকরা রাসূলুল্লাহকেও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘিরে ফেলেছে। তখন মুস’আব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নিজেই নিজেকে বলে উঠেন,

 

আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ কিছু নন! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন

 

এর পরপরই মুস’আবকে মুশরিকরা হত্যা করে। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে মুস’আব নয়, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে মুশরিকরা হত্যা করেছে। এই বানোয়াট তথ্যটি যখন সাহাবাদের কাছে পৌঁছল তখন তারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে একটি দল এতটাই বিষাদগ্রস্ত এবং মনোবলহীন হয়ে পড়ল যে তারা পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেন। কেউ কেউ পালিয়ে মুনাফিক্বদের সাথে যোগ দিল। আর কেউ ছিল তাদের অবস্থানে অনড়। তারা বলল, ‘যদি আল্লাহর নবী মারা গিয়ে থাকেন, তবে যে উদ্দেশ্যে তিনি যুদ্ধ করে গেছেন, সে উদ্দেশ্য সাধনে আমরাও লড়াই করে যাব’। মৃত্যু সংবাদের গুজব শোনার আগে এবং পরে তারা একইরকম অবিচল ছিলেন। মুশরিকদের দ্বারা অবরুদ্ধ অবস্থায় মুস’আবের মুখ নিঃসৃত এ কথাগুলোকেই সম্পূর্ণ করে আল্লাহ কুরআনের আয়াত হিসাবে নাযিল করেন। এর মাধ্যমে তিনি মুস’আবের এ কথাটির প্রতি সমর্থন জানান। ইসলামের সঠিক দা’ওয়াহর অনুসারীদের জন্য এই আয়াতটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

 

কোনো কিছু বিশ্বাস করা বা অনুসরণ করার পেছনে একজন মানুষ বিভিন্ন কারণে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। যেমন:

 

–       কিছু মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে থাকতে পছন্দ করে। তারা স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে এবং আর দশজনের মত করে চলতে         চায়। তারা এমন একটা মানহাজ বা পদ্ধতির অনুসরণ করে যা তার বন্ধু এবং পরিচিতজনেরা মেনে চলছে।

–       কেউ কেউ নিজেদের আক্বীদা-বিশ্বাস এবং মানহাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকে। একটি ব্যর্থ হলে আরেকটি যাচাই         করে। যেন তারা ‘ এ-সপ্তাহের-সেরা-আকর্ষণ ‘ খুঁজতে ব্যস্ত !

–       কেউ কেউ আবার আবেগচালিত। হয়তো একটা অনলবর্ষী বক্তৃতা বা উপস্থাপনা তাদেরকে আবেগাপ্লুত করে একটি বিশ্বাস         বা মানহাযের দিকে ধাবিত করে। অনেকক্ষেত্রেই আবেগের সেই জোয়ারে ভাঁটা পড়লে তারা পুরনো পথে ফিরে যান।

–       অনেকে একটি নির্দিষ্ট মানহাজ বা পদ্ধতি অনুসরণ করে কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্বের প্রতি তাদের ভালো-লাগা থেকে।

 

এই কারণগুলোই ব্যাখ্যা করে কেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যুর নিছক গুজব শুনেই একদল সাহাবী আশাহত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই আয়াতটি আমাদের এই মানবীয় দুর্বলতাগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে এবং আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, যদি আমরা ইসলামের যে মূল নির্যাস বা আদর্শ রয়েছে তার প্রতি অনুরক্ত বা আকৃষ্ট না হয়ে উপরোক্ত কোনো একটি কারণে ইসলামের অনুসারী হই, তবে তুচ্ছাতিতুচ্ছ চাপের মুখেই আমরা ভেঙে পড়ব এবং পশ্চাদপসরণ করে বসব। আমরা আল্লাহর রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন নবী হিসেবে অবশ্যই ভালবাসি কেননা তিনি আমাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে ইসলামের বাণী ও পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও আমাদের মূল আনুগত্য এবং ভালোবাসা হতে হবে ইসলামের মূল বিষয়বস্তুর প্রতি।

ইসলামের প্রতি আমাদের ভালবাসা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া চলবে না। আর সে কারণেই, উহুদের দিনে বেশ কিছু সাহাবী ছিলেন যারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যুর গুজব শুনে পিছপা হননি বরং বলে উঠেছিলেন, ‘যদি তিনি মারা যান, তবে তিনি যে উদ্দেশ্যে লড়েছেন, আমরাও সে উদ্দেশ্যে লড়ে যাব।’ অর্থাৎ সহজ ভাষায় তাদের মনোভাব ছিল, ‘তিনি মারা গেছেন তো কি হয়েছে? তিনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন আমরা সেটা অনুসরণ করছি। ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে আমরা অনুসরণ করিনি, বরং অনুসরণ করছি একজন নবী হিসেবে। তিনি একজন নবী, এর বেশি কিছু তিনি নন।’ আর এ কারণেই, সাত বছর পরে যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যিই মারা যান, সেদিন আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মদের ইবাদাত করত, (জেনে রাখ) মুহাম্মদ মারা গেছে। আর তোমরা যারা আল্লাহর ইবাদাত কর, (জেনে রাখ), আল্লাহ চিরঞ্জীব এবং তাঁর কোনো মৃত্যু নেই।’ এরপর তিনি এই আয়াতটি আবৃত্তি করেন। তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন এই বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে যে, আমরা ইসলামের সত্য আদর্শের কারণে মুসলিম। কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্বের প্রতি অনুরাগ বা মোহ থেকে নয়।

 

পশ্চিমা সমাজে ব্যক্তিপূজা অত্যন্ত প্রবল। হোক তা গায়ক, নায়ক বা অন্য কোনো ধরনের খ্যাতিমান লোক। ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই অভ্যাসটি ইসলামী দা’ওয়াহ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ‘সুপারস্টার শাইখ বা স্কলার’ এর একটি সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। এটি জাহেলী সমাজের ‘তারকাব্যক্তি পূজা ‘র (Celebrity Culture) বিকল্পরূপে আবির্ভূত হয়ে ব্যক্তিপূজার ধারাটিকে ইসলামী ছদ্মবেশে বজায় রেখেছে। এই ধারাটির বিপদ দ্বিমাত্রিক,

#এক, এ ধরণের শাইখ বা ‘আলিমের উচ্চারিত যেকোনো কথাকে চূড়ান্ত এবং বিতর্কের উর্ধ্বে হিসেবে ধরা হয় যাকে কোনোভাবেই চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। যদিও ইসলামের সত্য উদঘাটন ও প্রচারের অধিকার কোনো বিশেষ দলভুক্ত আলিম বা কোর্স ইন্সট্রাক্টরদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়!

এবং #দুই, কোনো শাইখ বা নেতার প্রতি তাদের অনুসারীদের গভীর ভক্তি এবং অযাচিত আসক্তি থাকলে আরো যে সমস্যাটি হতে পারে তা হল, যদি সেই নেতা বা শাইখ তার অবস্থান থেকে সরে আসে, কিংবা গ্রেপ্তার হয় কিংবা তার মৃত্যু ঘটে, তখন তাদের অনুসারীরা পথের দিশা হারিয়ে ফেলে এবং পিছু হটতে আরম্ভ করে। কিছু সাহাবীদের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই হয়েছিল। তারা কেউ কেউ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যুর খবর শুনে উহুদের ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

 

এই সমস্যার সমাধান হল একটি মুক্ত, সমালোচক, বিশ্লেষণধর্মী এবং অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী হওয়া। এর ফলে আপনার আর সত্যের মাঝে কোনো বাধা থাকবে না। এবার সে সত্য যেখান থেকেই আসুক না কেন। এ ধরনের ইতিবাচক মানসিকতা আপনাকে সত্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে কেবল তা সত্য হওয়ার গুণেই। কে সেই সত্য বলছে তা আপনার কাছে আর মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে না। যেমন করে আল-ইমাম আহমাদ(রহিমাহুল্লাহ) বলেছিলেন, ‘একজন মানুষের জ্ঞানের ঘাটতি থাকে তখনই, যখন সে অন্য কাউকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করে।’ এবং সম্ভবত এ কারণেই, ইমাম আহমদ তাঁর ক্লাসগুলোকে ‘মুসনাদ থেকে হাদীস শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন এবং তাঁর নিজস্ব মতগুলোকে লিখে রাখার ব্যাপারে খুব জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত করতেন। তিনি চাইতেন তার ছাত্ররা যেন তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং মতামতের অনুসারী না হয়ে শুধুমাত্র কুরআন এবং সুন্নাহর অনুসারী হয়।

 

এটা খুবই দুঃখজনক যে, অনেক মুসলিম প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ উৎসাহী এবং উদ্যমী হওয়া সত্ত্বেও এই আয়াতের মূলভাব হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হওয়ায় পরবর্তীতে নানান মানহাজের মাঝে ছুটাছুটি করতে থাকে। আজকে তারা সালাফি, কালকে সুফী বা আশ’আরি, আরেকটা দিন হয়তো আসবে যেদিন তারা পুরো দ্বীনকেই পরিত্যাগ করে ফেলবে। এই সবকিছুর পেছনে ফিরে তাকালে যে সমস্যাটি আমরা আবিষ্কার করব তা আমি উপরে পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করেছি। মূলত, ইসলামের পথে তাদের প্রবেশের মুহূর্তটি ছিল অত্যন্ত ভাসাভাসা এবং ক্ষণিকের প্রণোদনায় উদ্বুদ্ধ। তাই প্রবল দ্রুততার সাথে তারা বারবার নিজেদের রঙ বদলায়। এর পেছনে মূল কারণ হল, তারা নানান কারণে একসময় সত্যের অনুসারী হলেও সঠিক কারণটি অনুধাবন করে অনুসারী হয়নি। আর সত্যকে অনুসরণ করার সঠিক কারণটি হচ্ছে সত্যের বাণীকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার মাধ্যমে তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা।

 

কাজেই, কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি অতিভক্তি এবং অপরিমিত শ্রদ্ধাবোধ থেকে সতর্ক হোন। মানুষ বদলায়, মৃত্যুবরণ করে। তাই, ইসলামী দা’ওয়াহর মূল বার্তাকে অধ্যয়ন করুন এবং ভালবাসুন। ইসলামের মূল বার্তা দ্বারা আন্তরিকভাবে উদ্বুদ্ধ হোন এবং অন্যকে উদ্বুদ্ধ করুন। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন নয় বরং এই দা’ওয়াহর মূল উৎসের প্রতি আন্তরিক হোন। কেননা, মানুষের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু এই আদর্শ মৃত্যুঞ্জয়ী। এই আদর্শ অপরিবর্তনীয়।

 .

তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১৮)

 

সূরা আলে ইমরানের ১৫৩ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,

…তাই আল্লাহ তোমাদের উপর দুঃখের পর দুঃখ দিলেন, যেন তোমাদের কাছ থেকে যা হারিয়ে গেছে এবং যা কিছু বিপদ তোমাদের উপর আপতিত হয়েছে, তার (কোনোটার) জন্য তোমরা অনুশোচনা না কর…

 

এই আয়াতটি উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে নাযিল হলেও এর নিহিতার্থ আমাদের বর্তমান জীবনে খুবই পরিস্কারভাবে প্রয়োগযোগ্য। মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে যত পায় ততই চায়। আর তার চাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তার দুশ্চিন্তা। কারণ আরও বেশি না পাওয়ার ব্যর্থতা তাকে বিমর্ষ করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন,

 

মানুষকে এক পাহাড় স্বর্ণ দেওয়া হলে সে অনুরুপ আরেকটি পাহাড় চাইবে। আর তাই কবরের মাটি ছাড়া কোনো কিছুই তাকে তুষ্ট করতে পারবে না।

 

তাই আল্লাহ বিভিন্ন সময়ে আমাদেরকে খাদ্য, অর্থ, স্বাধীনতা, পরিবার কিংবা সুস্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন নি’আমাত থেকে কিছু সময়ের জন্য বঞ্চিত করেন। এই পৃথিবী এবং তার আরাম-আয়েশের প্রতি আমাদের চির-অতৃপ্ত বাসনাকে নষ্ট করে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। আমরা কোনো কিছুকে যখন যেভাবে চাই সেভাবে পাওয়ার পরিবর্তে যখন কোনো বিপদ-আপদের সম্মুখীন হতে বাধ্য হই, তখন সেই অভিজ্ঞতাটি আমাদের ভবিষ্যতে যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে প্রস্তুত করে তোলে। এই আয়াতটিতে ঠিক একথাটিই বলা হয়েছে। আগেও এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে আমরা যা চাই সেটা না পাওয়ায় কিংবা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চাই না তার সম্মুখীন হতে বাধ্য হলে আমরা আর মুষড়ে পড়ব না। কারণ আরাম-আয়েশ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি আমাদের নির্ভরতার শেকড় কেটে দেওয়া হয়েছে।

 

এই আয়াতটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে বিষণ্ণতাকে নিরুৎসাহিত করা। অপ্রাপ্ত সাফল্য কিংবা আপতিত অকল্যাণ নিয়ে দুঃখ করে কোনো লাভ নেই। এতে কোনো উপকার হওয়া তো দূরের কথা, বাস্তবতার বিন্দুমাত্র পরিবর্তনও হয় না। বরং ইবন আল কায়্যিমের (রহিমাহুল্লাহ) ভাষায়, বিষণ্ণতা মানুষের সংকল্পকে দুর্বল করে দেয় ও হৃদয়কে ভঙ্গুর করে তোলে। যা তার উপকারে আসবে এমন কাজ করা থেকে বিরত রাখে এবং বাস্তবতাকে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। তাই যখন আপনি বিষণ্ণ অনুভব করবেন তৎক্ষণাৎ সেই অনুভূতিকে মন থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন। আল্লাহর প্রশংসা, ধৈর্য এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্টি, তাঁর প্রতি দৃঢ়তর ঈমান এবং ‘ক্বদ্দরাল্লাহ ওয়া মাশা-আ ফা’আল ‘ (আল্লাহ তাঁর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং তিনি তাঁর ইচ্ছানুযায়ীই সিদ্ধান্ত দেন) এই বাক্যাংশটি উচ্চারণের দ্বারা সেই অনুভূতিকে প্রতিস্থাপন করুন। এটাই হচ্ছে তাওহীদের চশমা দিয়ে যেকোনো বিপর্যয়কে দেখার ফলাফল।

 

তৃতীয়ত, এই পৃথিবী তো বিপদ-আপদমুক্ত হওয়ার কথা ছিল না। শুধু জান্নাতই হবে সবরকম সঙ্কটমুক্ত। উদাহরণস্বরুপ, রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এই পৃথিবীতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কী। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আ’ইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা)। অথচ পার্থিব জগতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সত্তাটির প্রতি তাঁর ভালোবাসাও কিন্তু ত্রুটিহীন ছিল না। কারণ আ’ইশার (রাদিয়াল্লাহু আনহা) উপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার ঘটনাটি কিছুটা হলেও আ’ইশাহর (রা) প্রতি রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভালোবাসাকে দ্বিধান্বিত করেছিল। এই ঘটনার মাঝেও একটি নিগুঢ় বার্তা রয়েছে। আর তা হল এই সকল সঙ্কটের উদ্দেশ্যই দুনিয়া থেকে আমাদের অন্তরকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এবং অন্তরকে আখিরাতের দিকে যাত্রার অভিমুখী করে তোলা।

.

طارقمهنا

তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১৯)

 

আল্লাহ তা’আলা কুরআনে সূরা আলে ইমরানের ১৫৬ নং আয়াতে বলছেন,

হে মু’মিনগণ! তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা কুফরি করে এবং তাদের ভাই-বন্ধুগণ যখন কোন অভিযানে বের হয় কিংবা কোথাও যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাদের সম্বন্ধে বলে, “তারা যদি আমাদের সাথে থাকতো, তাহলে মরতোও না আহতও হত না”।

 

এবং ১৬৮ নং আয়াতে বলছেন,

“…যারা (ঘরে) বসে থেকে নিজেদের ভাইয়ের সম্বন্ধে বলতে লাগলো, আমাদের কথা মত চললে তারা নিহত হত না…”

উপরের আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের ব্যাপারে বলা হয়েছে। এই মুনাফিকরা উহুদের ময়দানে মুসলিম বাহিনী থেকে বের হয়ে গিয়ে দর্শকের ভূমিকায় মুসলিমদের যুদ্ধ করতে দেখতে থাকে। তারা যুদ্ধরত মু’মিনদের দেখে মনে মনে ভাবতে থাকলো যে, দ্বীন কায়েমের সংগ্রাম থেকে দূরে থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকাটাই বিচক্ষণতা। আর মু’মিনদের যারা দ্বীনকে রক্ষা করা ও বিজয়ী করে তোলার জন্য নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে রাজি আছে, তারা যেন বোকার মতো নিজেদের জীবনটা নষ্ট করছে! এই আয়াত দুটিতে মুনাফিকদের মানসিকতার সারাংশ তুলে ধরা হয়েছে।

সত্যের দিকে মানুষকে ডাকতে গেলে কষ্ট ও বিপর্যয় নেমে আসবেই। এই কষ্ট সহ্য করতে পারাটাই একজন প্রকৃত সত্যান্বেষীর পরিচয়। ইবন আল-কায়্যিম দ্বীনের প্রচারে একজন দা’ঈর প্রচেষ্টার সর্বোচ্চ স্তরের দিকে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন: ‘(দা’ঈর পক্ষে সর্বোচ্চ ত্যাগ হল) আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত দিতে গিয়ে যাবতীয় বিপর্যয় ও মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বাধা-বিপত্তি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্য সহ্য করে যাওয়া।’ এছাড়াও আল্লাহ তাআলা কুরআনের সূরা আল-আসরে আমাদেরকে দ্বীনের প্রচার ও শিক্ষাদানের পথে সব বাধা-বিপত্তিতে ধৈর্যশীল হতে জোর দিয়ে বলেছেন:

“সময়ের শপথ! মানুষ ভ্রান্তির মধ্যে আছে; কেবল তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করে, সত্যের প্রচারক, আর ধৈর্যধারণে উৎসাহ দান করে”। [ সূরা আল-আসর ]

অতএব একজন মুসলিম যেচে পড়ে কষ্ট ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে না সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু যদি এমন হয় যে, সত্যপ্রচারের পথে বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন না হয়ে আর কোনো উপায় নেই, তবে একজন মু’মিন হাত গুটিয়ে বসে না থেকে স্বেচ্ছায় সে পথেই এগিয়ে যাবে। কেননা আলোচিত আয়াতগুলোর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন প্রচারের জন্য সকল কষ্ট মেনে নেয়ার এই ইচ্ছাই তার ঈমান ও নিফাকের মধ্যে পার্থক্যকারী।

আরাম-আয়েশের দিকে ঝুঁকে পড়া, নিরাপদ জীবন চাওয়া, এগুলো আমাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। স্বয়ং আ’ইশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যাপারে বলেছেন, ‘তাঁর সামনে যখন দুটো রাস্তা খোলা থাকত, তখন তিনি দুটোর মাঝে সহজটাই বেছে নিতেন, যদি না সেই সহজ পথে আল্লাহর অবাধ্যতা থাকে।’ কিন্তু যখন এমন হত, দ্বীন প্রচার করতে গিয়ে কুফফারদের কাছ থেকে কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হতেই হবে এবং নিজের আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দিতে হবে, তখন কি তিনি আরাম-আয়েশকে প্রাধান্য দিতেন? নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন।

তিনি বা অন্য কোনো নবী কি কখনো নিজেদের নিরাপত্তা ও আরাম-আয়েশের কথা ভেবে সত্য প্রচারে পিছু হটেছিলেন? আজকাল ইসলামের অনেক দা’ঈ সত্য গোপন করার পিছনে একটি খোঁড়া যুক্তি দাঁড়া করান যে, ‘এটা করলে আমাদেরকে অচিরেই শত্রুর হাতে ধ্বংস হতে হবে, বরং এ থেকে বিরত থাকলে সামনের দিনগুলোতে আমরা দ্বীনের উপকারে আসতে পারব ‘। নবীদের কেউ কি এসব খোঁড়া অজুহাত দিয়েছেন? কক্ষনো না।

 

বদরের সেই দিনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কথা স্মরণ করে দেখুন, যুদ্ধের আগে তিনি আল্লাহর কাছে কী ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! মু’মিনদের এই দল যদি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পরাজিত হয়, তোমার ইবাদাত করার জন্য আর কেউই অবশিষ্ট থাকবে না।’ অন্য ভাবে বলা যায়, তিনি জানতেন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ মানে মু’মিনদের জীবন নয়, খোদ ইসলামের অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া। আরাম-আয়েশ পরিত্যাগের বিষয়টি বাদই দিলাম। কিন্তু রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি বিপদের আশংকায় সাহাবীদেরকে নিজেদের মালামাল গুটিয়ে মদীনায় ফিরে যাওয়ার কথা একটিবারের জন্যেও মুখে এনেছিলেন? তিনি এমনটি করেননি। বরং নির্ভীকচিত্তে সামনে এগিয়ে গিয়ে মুশরিকদের মোকাবেলা করেছেন এবং আল্লাহ তাঁকে পরিপূর্ণ বিজয় দান করেছিলেন। এই ঘটনাটি সকল পরিস্থিতিতে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দেয় এবং আমাদের নিজেদের চিন্তার ধরন কেমন হওয়া উচিত সে ব্যাপারে আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দেয়।

সমগ্র পৃথিবী আজ পুঁজিবাদীদের ‘যার যার তার তার’ (every man for himself) চিন্তাধারা দ্বারা মগজধোলাইকৃত। এই চিন্তাধারা একজন মানুষকে শুধু তার স্বার্থোদ্ধারের জন্য কোনো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। আলোচ্য আয়াতগুলোতে আমরা মুনাফিকদের মুখেও ঠিক একই ধাঁচের কথা শুনতে পাই। তাদের ভাষ্যমতে, সত্যের পক্ষে দাঁড়ালে যদি ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে আমাদের সেই সত্যের দরকার নেই! তাই তারা ঘরে বসে নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর দীনের জন্য কাজ করে যাওয়া মুসলিমদের নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠে। ত্বাগুতের রোষানল থেকে নিরাপদে ঘরে বসে থাকার পরিবর্তে ‘অকারণে নিজেদের জীবন নষ্ট করা’ মুসলিমদের ধর্মান্ধ বলে তাচ্ছিল্য করে। দ্বীনের খাতিরে জান-মাল বিলিয়ে দেওয়া এদের চোখে নেহায়েত অপচয় বলে ঠেকে, আর তাই তারা ‘সহজ’, ‘হিকমাহপূর্ণ’ ও ‘বাস্তবসম্মত’ – এই শব্দগুচ্ছের আড়ালে এমন এক আরামের পথ বেছে নেয়, যে পথে কোনো বিতর্ক বা আদর্শিক দ্বন্দ্বের ঠোকাঠুকি নেই। এটাই অতীত ও বর্তমানের মুনাফিকদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তারা সর্বদা আত্মোৎসর্গের তুলনায় আত্মরক্ষা করতেই সদা তৎপর।

ইবনে আব্বাস একবার বলেছিলেন যে,“আল্লাহর রাসূল ছিলেন সবচেয়ে উদার ব্যক্তি”। তাঁর উদারতার উদাহরণ দেখাতে গিয়ে আমরা দরিদ্রদের প্রতি তাঁর দানশীলতার উদাহারণ টেনে আনি। অথচ আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে এর উদাহরণ দেয়া যায় যেটি নিয়ে আমরা সচরাচর ভাবি না। আর তা হলো সত্যের প্রচারে কোনো বাধা-বিপত্তির পরোয়া না করে তাঁর নিজের সুযোগ-সুবিধা, আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দেয়া। অর্থাৎ মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য যেখানে স্বার্থপরতা, আর নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য হবে নিঃস্বার্থতা। প্রতিটি মুসলিম সংগঠন, নেতা, দা’ঈ, এমনকি সাধারণ মুসলিম- প্রত্যেকের উচিত নিজেদের দিকে একবার ফিরে দেখা, নিজেদের কে প্রশ্ন করা। পুঁজিবাদী ধ্যানধারণার প্রভাববলয় থেকে কি তারা নিজেদের দ্বীনের কাজকর্মকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন? তাঁরা কি পেরেছেন দ্বীনের মূলনীতিগুলোকে সততার সাথে আঁকড়ে ধরে রাখতে? নাকি নিজের গা বাঁচানোটাই তাদের কাছে মুখ্য? যদি বলা হয় ‘আরাম-আয়েশ অথবা দ্বীনের কল্যাণে ঝুঁকি’ – এ দুয়ের মাঝে যেকোনো একটি বেছে নাও – তবে তারা কোনটিকে বেছে নিতে প্রস্তুত? তাঁরা কি নিজেদের ক্ষণস্থায়ী চাহিদাকে অধিক গুরুত্ব দেবেন, নাকি আল্লাহর দ্বীনের বিশুদ্ধতা রক্ষা ও সঠিকভাবে একে তুলে ধরার প্রয়াসে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে দ্বীনের দীর্ঘস্থায়ী উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত হবেন? তাঁরা কি মুনাফিকদের আলোচ্য বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিফলন নিজেদের মাঝে ঘটাবেন, নাকি আল্লাহর রাসূলের(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পথকে বেছে নিবেন? কোনটি বেছে নেবেন তারা? আদর্শ নাকি আত্মরক্ষা?

 

সুরা আল-বুরুজ এর “আসহাবুল উখদুদ” (গর্তের অধিবাসী) গল্পটির ব্যাপারে সাইয়্যিদ কুতুব বলেছিলেন:

এই ঈমানদার মানুষগুলো নিজেদের ঈমানকে বিক্রি করে দিয়ে দুনিয়ার জীবন লাভ করতে পারত সত্যি, কিন্তু তাতে তাদের আর পুরো মানবজাতির লাভ থেকে ক্ষতির পাল্লাটাই কি অনেক বেশি ভারি হত না? তারা বেঁচে থাকলেও তারা একসময় পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যেতেনই। অথচ ঈমান বিসর্জন দিলে তার সাথে তারা একটি মহাসত্যকেও গলা টিপে হত্যা করত। কিন্তু তারা তা হতে দেয়নি। ঈমানের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে তারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে তবেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।

 

ঈমান ছাড়া জীবন মূল্যহীন, আর স্বাধীনতা ছাড়া জীবন হয় মর্যাদাহীন। আর যালিমদের যদি শরীর ও আত্মার উপর আধিপত্য করতে দেওয়া হয়, তাহলে সে জীবন হয় লাঞ্ছনার।- এই মহাসত্যটিকে তারা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে সমুন্নত রেখে গেছেন।

 .

তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ২০)

 

সূরা আলে ইমরানের ১৮০ নং আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন –

“আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পণ্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে…”

কিছু কিছু দিক দিয়ে আমরা সবাই একইরকম। আমাদের সবাইকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার রহমত ও নি’আমত দান করেছেন, বেশি হোক আর কম হোক। আমাদের যতটুকু আছে তার চাইতে আরো বেশী পেতে আমরা সবাই ভালোবাসি। মুখে আমরা যাই বলি না কেন – যখন আমাদের নিজের কোনো জিনিস ত্যাগ করতে হয়, তখন আমরা সবাই সামান্য হলেও দ্বিধা বোধ করি। আমরা সবাই খুব ভালোমতো বুঝি আল্লাহর জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করার গুরুত্ব কী ও এর মূল্য কত বড়। সেটা হতে পারে দরিদ্রকে অর্থ-সম্পদের মাধ্যমে সাহায্য করা, কিংবা হতে পারে আল্লাহর পথে অন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করা। আমরা কৃপণতা করি বা না করি আমাদের এই উপলব্ধিগুলো কিন্তু সার্বজনীন।

 

এই কৃপণতাকে পাশ কাটিয়ে মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বগুলো ঝেড়ে ফেলে আরও উদার হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় কি?

সবচাইতে সহজ উপায় হল, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ধাপে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার যেই নি’আমতগুলো আপনি ভোগ করছেন সেগুলো এক এক করে গুণতে শুরু করুন। সেটা হতে পারে মনে মনে, মুখে মুখে, বা কাগজে লিখে; সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার যেই নিয়ামতগুলো আপনি ভোগ করছেন তার একটা লিস্ট বানানো শুরু করে দিন। সবচেয়ে ছোট এবং আপাত দৃষ্টিতে অকিঞ্চিৎকর নি’আমতটাও লিস্টে টুকে রাখুন…

আপনার জীবন, আপনার প্রতিটি নিঃশ্বাস, আপনার দৃষ্টিশক্তি এবং আপনার শরীর সম্পর্কিত সব কিছু, বাড়ি-গাড়ি, পোষাক-আশাক, খাবার এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কাজকর্ম, মসজিদ এবং আপনার সমাজ ও সামাজিকতা সবকিছুই তালিকাবদ্ধ করুন। আপনার স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবার ক্ষমতা, জীবনের আনন্দের মুহূর্তগুলো,আপনার প্রতি আপনার স্বামী বা স্ত্রীর ভালোবাসা, ইসলাম, বিশুদ্ধ বাতাস, ঠাণ্ডা পানি, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার অনুভূতি – যেই দয়া, উদারতা ও ভালোবাসা আপনি অন্য মানুষের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন সেসব কিছুকেও হিসাবে আনুন। আপনি খেয়াল করে দেখেবেন, প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে এরকম অসংখ্য নি’আমত আপনি ভোগ করছেন, যেগুলো লিখে শেষ করা যাবে না।

কিছুদিন আগে আমি ম্যাগাজিনে একটা প্রবন্ধ পড়ছিলাম, যেটাতে ইন্ডিয়া ও আফ্রিকার কিছু জায়গায় পানি স্বল্পতার জন্য কি কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এসব জায়গাতে প্রতিদিন সকালে, প্রত্যেক পরিবারের মায়েরা হেঁটে ছয় ঘণ্টার পথ পাড়ি দেওয়ার পর এক কলসী পানি যোগাড় করেন। তারপর তারা সেটা বয়ে আনেন।তারপর সেই এক কলসী পানি দিয়ে পুরো পরিবারের খাওয়া, গোসল ও রান্নার কাজ সারতে হয়, কেননা পানির আর কোনো উৎস তাদের হাতের নাগালে নেই!

অথচ এই কারাগারের সেলেও শুধু উঠে দাঁড়িয়ে দু’পা হেটে গিয়ে বেসিনের একটা বোতাম চাপলেই আমি সেকেন্ডের ব্যবধানে ইচ্ছামতো বিশুদ্ধ, ঠাণ্ডা পানি পেতে পারি। প্রথম দৃষ্টিতে আপনাদের কাছে হয়তো এটাকে একটা অভিশাপ মনে হবে, কারণ আমি কারাগারে। কিন্তু ইন্ডিয়া আর আফ্রিকার সেই মায়েদের সাথে তুলনা করুন একবার! তারা তো এত সহজে বিশুদ্ধ পানি পাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। তখনই বোঝা যায়, কারাগারে সেলে বসেও আমি প্রতিদিন যেসব নি’আমত ভোগ করছি তার মধ্যে এই পানি একটি। চিন্তা করে দেখুন,জেলে বসে আমি যদি এরকম নিয়ামত ভোগ করি, তাহলে বাইরের স্বাধীন, মুক্ত জীবনে আপনার নি’আমতের লিস্টটা কতো লম্বা হবে!

কাজেই এই নি’আমতগুলোর তালিকা তৈরি করে ফেলুন। লিস্ট যতো বড় হবে আপনি ততো গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন, আপনার চোখের সামনে থেকেও কত কী আপনার নজর এড়িয়ে গেছে। আপনার নাকের ডগায় থাকা সত্ত্বেও এতদিন এই অসাধারণ আশীর্বাদগুলো নিয়ে আপনি সামান্যতম চিন্তাও করেননি। তারপর আপনি উপলব্ধি করবেন, আপনি এই সবের কিছুই পাবার যোগ্য নন। এসব কিছুই আপনার প্রতি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার রহমত। তিনি তাঁর অসীম করুণার বশে আপনাকে এগুলো দান করেছেন। এর কোনোটার উপরই আপনার কোনো অধিকার নেই। আপনি যখন আপনার লিস্টের উপর বারবার চোখ বোলাবেন এবং দেখতে পাবেন, কিভাবে আপনার শত অযোগ্যতা সত্ত্বেও আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর অসীম ভালোবাসা, উদারতা ও করুণায় আপনাকে একটার পর একটা নি’আমত দান করেছেন – তখন আপনি আপনার হৃদয় ও মনে পরিবর্তন দেখতে পাবেন।

মানুষের স্বভাব হল, তার সাথে যেমন ব্যবহার করা হয়, অন্যের সাথে সে তেমনই ব্যবহার করে। সারাজীবন যদি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয় তাহলে আপনার স্বাভাবিক প্রবণতা হবে মানুষের সাথে রুক্ষ ব্যবহার করা। কারণ আপনি তেমনটাই শিখে এসেছেন। একইভাবে সারাজীবন যদি আপনি উদারতা, দয়া ও করুণা পেয়ে আসেন, তাহলে আপনি মানুষের সাথে সেভাবেই আচরণ করবেন; কারণ আপনি সেই শিক্ষাই পেয়েছেন। আমাদের সমস্যা হল, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রতিনিয়ত আমাদের দয়া, করুণা ও উদারতা দেখাচ্ছেন। প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি সেকেন্ডে তিনি আমাদের পরম মমতায় ঢেকে রেখেছেন। কিন্তু বেশীর ভাগ সময়ই আমরা এটা মনে রাখি না, কিংবা মনে রাখলেও এই করুণার পরিধি ও মাত্রা নিয়ে চিন্তা করি না।

তাই আমাদের উদার ও দানশীল হবার পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সূক্ষ বাধাটি হল, আমাদের প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দয়া ও করুণা সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতা। যতো বেশী আপনি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নি’আমতগুলোকে আবিষ্কার করবেন, গুণতে থাকবেন এবং আপনি যতো উপলব্ধি করবেন যে এই অসংখ্য নি’আমতের কোনোটারই আপনি যোগ্য নন ততোই আপনি আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত থেকে অপরকে সাহায্য করার আকাঙ্ক্ষা অনুভব করবেন। উদারতা ও দানশীলতাকে ভালবাসতে শেখার সবচেয়ে সহজ উপায় এটাই।

 .

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট- সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ২১)

 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সূরা আলে ইমরানের ১৮৫ নং আয়াতে বলেন,

…আর এই পার্থিব জীবন তো ছলনাময় ক্ষণিকের ভোগ-সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়”।

 

 

আয়াতের এই অংশটি আপনার জীবনে প্রয়োগ করতে চাইলে, দৈনন্দিন যেসব টুকরো সুখের মুহূর্তগুলো আপনি উপভোগ করেন সেগুলো উপভোগ করার আগে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ান। দগ্ধ দিনের শেষে শীতল পানির স্পর্শ, হিমশীতল পানীয় কিংবা সুস্বাদু খাবার, মোটা অঙ্কের চেক কিংবা চোখ ধাঁধানো গাড়ি অথবা আনকোরা নতুন পোশাক প্রভৃতির সুখস্পর্শ উপভোগ করার আগে একবার থামুন এবং ভাবুন। উপলব্ধি করুন যে আপনার সামনে যেই উপভোগ্য বস্তুটি আছে তা বিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। আপাতদৃষ্টিতে বস্তুটি সৃষ্ট, স্পৃশ্য এবং বাস্তব হলেও এর সাথে আরও সুগভীর এবং গুপ্ত এক বাস্তবতা সংযুক্ত রয়েছে। আর এই গোপন বাস্তবতাটির ব্যাপারে অসচেতন হলে আপনি ধোঁকায় পড়ে থাকবেন। যে ধোঁকার কথা এই আয়াতে বলা হয়েছে এই গোপন বাস্তবতাটি ঠিক তার বিপরীত। আর এই ধোঁকার পাশাপাশি এই বাস্তবতা সম্পর্কেও আমাদের সমান ভাবে সচেতন থাকা উচিত।

পার্থিব এই ধোঁকার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে যে এটি আমাদের মধ্যে নিজেদেরকে ক্ষমতাধর ভাবার এক মিথ্যে আত্মতুষ্টি তৈরী করে। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি বেশি ঘটে। ১৯১২ সালের কথা মনে করুন। সেবছর টাইটানিক নির্মাণ করা হয়েছিল। এর নির্মাতারা দাবি করেছিল যে ‘স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও এই জাহাজ ডুবাতে পারবেন না।’ ক্ষণিকের আরাম-আয়েশ আর স্বাচ্ছন্দ্যে ডুবে থাকলে, নিরাপত্তা আর অপরাজেয়তার এক মিথ্যা ধারণা খুব সহজে মানুষের অন্তরে জেঁকে বসে। তাই টাইটানিকের নির্মাতারা আপাতদৃষ্টিতে নিখুঁত এই জাহাজ তৈরী করতে পেরে এই একই ফাঁদে পা দিয়ে বসে। অবশেষে আর কেউ নয়, যখন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই এক টুকরো বরফ খন্ড দিয়ে টাইটানিক ডুবিয়ে দেন তখন তারা তাদের ধারণার অন্তঃসারশূন্যতা বুঝতে পারে। কি নির্মম পরিহাস! যে পানির উপর টাইটানিকের চলার কথা ছিল সেই পানি দ্বারা গঠিত এক খন্ড বরফই এটাকে ডুবিয়ে দিল!

আমেরিকান ব্যাংকগুলোর দায়িত্বজ্ঞানহীন অপচয় এবং লোভের ফলে আমেরিকায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার দিকে লক্ষ করুন। জাগতিক ধোঁকায় পড়ে থাকা হৃদয়ে ক্ষমতার যে মিছে আত্মতৃপ্তি জন্ম নেয় তার প্রকৃষ্ট ফলাফল হচ্ছে আজকের আমেরিকা। আর পার্থিব এই আনন্দের মাত্রা যত বেশী হয় পরবর্তীতে সৃষ্ট দুর্দশার মাত্রাও একই হারে বৃদ্ধি পায়। ধরুন দু’জন উদ্বাস্তু লোক একটি খাবার দোকানের সামনে বসে আছে। দুজনেরই দোকানের ভিতরে ঢুকে কিছু কিনে খেতে ১০ টাকা প্রয়োজন। দোকান থেকে বের হওয়ার পর একজন ক্রেতা তাদের দেখতে পেল। কিন্তু তাদের মধ্যে শুধু একজনকে তিনি ১০ টাকা দান করলেন। যাকে দান করা হল সে নিশ্চিতভাবে নিজেকে তার সঙ্গীর চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান এবং কর্তৃত্বময় মনে করবে। শুধু ১০ টাকার পার্থক্যেই একজন মানুষের মনে এসব ধারণা তৈরী হয়ে যেতে পারে। তাহলে ভাবুন আপনি আপনার জীবনে আরও কত-শত বিলাস উপভোগ করছেন, আপনার অন্তরে সেগুলোর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে! এই ধোঁকা দ্বারা প্রতারিত হওয়া থেকে বেঁচে থাকার উপায় হচ্ছে দুনিয়ার জীবনের প্রকৃত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা। উপলব্ধি করুন যে আপনি একজন ক্ষমতাহীন জীব এবং আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি বা ক্ষমতার উৎস নেই।

পার্থিব ধোঁকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে। আর তা হচ্ছে আপনি যা উপভোগ করছেন তা সবসময়ই আপনার কাছে থাকবে এমন ভেবে বসে থাকা। কোনো কিছু উপভোগ করার ঠিক আগ মূহুর্তে কি আপনার মনে কখনো এমন ধারণা উঁকি দেয় যে, যে বিলাসদ্রব্যটি আপনি উপভোগ করতে যাচ্ছেন তা চোখের পলকেই উধাও হয়ে যেতে পারে? আপনার হাতের হিমশীতল পানির গ্লাসটি উঁচু করে ধরে সূরা মুলকের শেষ আয়াতটির কথা ভাবুন,

 

‘…তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি তোমাদের পানি ভূগর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কে তোমাদেরকে সরবরাহ করবে পানির স্রোতধারা?

আপনার স্ত্রী, স্বামী, সন্তান কিংবা বন্ধুদের সঙ্গ উপভোগ করার সময় কি কখনো মনে হয় এরা আগামীকাল জীবিত নাও থাকতে পারে? পরবর্তীতে যখনই তাদের সাথে সময় কাটাবেন তখন নিজেকে সূরা আর-রহমানের ২৬ নং আয়াতটি মনে করিয়ে দেবেন- ভূপৃষ্টের সবকিছুই ধ্বংসশীল‘। যখন আপনার গাড়িটি গ্যারেজে রেখে আপনার বিশাল বাসার দিকে এগিয়ে যাবেন তখন এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে আপনার বাড়ির দিকে তাকিয়ে সূরা কাহফের ৩৩-৩৪ নং আয়াতে উল্লেখিত দুই বাগান মালিকের কাহিনী স্মরণ করুন। অনুধাবন করুন, আপনার এই সব সম্পত্তি মূহুর্তের ব্যবধানে নেই হয়ে যেতে পারে। ছোট-বড়, জীবিত বা জড় যা কিছুই আপনি উপভোগ করেন না কেন তার সবই উধাও হয়ে যেতে পারে। স্বস্তির যে প্রশান্তি আপনি অনুভব করছেন তা আপনার সামনে রাখা আল্লাহর সৃষ্ট দুনিয়ার ধোঁকা মাত্র।

পার্থিব ধোঁকার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আপনি সত্যিকারের আনন্দ কোনটি তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। আমাদের মন এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যে আমরা যদি দীর্ঘ সময় ধরে কোনো ছোটখাট কিছু বা কোনো বিলাসদ্রব্যের পেছনে ছুটি এবং অবশেষে তা অর্জন করি তখন এর চেয়ে ভালো কিছু পাওয়ার কথা আমরা আর ভাবতে পারি না। মনে করুন আপনি মরুভূমিতে হারিয়ে গেছেন। আপনি বেশ কয়েকদিন ধরে কিছুই খেতে বা পান করতে পারেননি। হঠাৎ করে আপনি এক টুকরো শুকনো রুটি, বহু দিনের পুরনো একটু পনির আর এক জগ কুসুম গরম পানি পেয়ে গেলেন। তীব্র ক্ষুধার জন্য এটুকুই তখন আপনার কাছে অমৃত বলে মনে হবে। আর এগুলো খেয়ে নিজের ক্ষুধা নিবারণ করতে করতে আপনার মনে হবে যে এর চেয়ে বেশি আপনার আর কিছুই চাওয়ার নেই। আপনি এই বাসি খাবার দিয়ে নিজের ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটিয়ে এতটাই সন্তুষ্ট যে গরম রুটি, তাজা পনির এবং পরিষ্কার ঠান্ডা পানির কথা চিন্তাও করবেন না।

 

 

এই পৃথিবী আর পরকালের বিলাসদ্রব্যের মাঝে তুলনাটাও ঠিক এইরকম। আর একারণেই আয়াতটির উল্লেখিত অংশের আগের বাক্যটি হচ্ছে – ‘…যাকে আগুন থেকে বহুদূরে রাখা হবে ও স্বর্গোদ্যানে প্রবিষ্ট করা হবে, নিঃসন্দেহ সে হ’ল সফলকাম । এই আয়াতটি আনন্দ এবং উপভোগের ধারণাটিকে যথাযথ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে। এই আয়াতটি আপনার সামনে বাস্তবতাকে উন্মোচন করে দিচ্ছে, আর তা হল এই যে, এই পৃথিবীতে আপনি সম্ভাব্য যা যা উপভোগ করতে পারেন তার কোনোটিই জান্নাতের সাথে তুলনীয় নয়। কিন্তু পার্থিব জীবন আমাদের জন্য বাস্তব ও চাক্ষুষ। আর জান্নাতের জীবন সম্পর্কে আমরা শুধু কুরআন এবং হাদীস থেকেই জানতে পারি। তাই এই পৃথিবীর প্রতিটি আনন্দ উপভোগের আগে নিজেকে মনে করিয়ে দিন যে পরকালে যা আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে- সেটা জান্নাতের আমোদ হোক বা জাহান্নামের আতঙ্কই হোক – তার তুলনায় এই পার্থিব পুলক একটি বিভ্রম মাত্র।

পার্থিব প্রতারণা বনাম বাস্তবতার এই তিনটি বৈশিষ্ট্য যদি আপনি আত্মস্থ করতে পারেন তবে তা আপনার ব্যক্তিত্বের উপর অত্যন্ত কার্যকর প্রভাব ফেলবে।

  • প্রথমটি আপনাকে বিনয় শেখাবে।
  • দ্বিতীয়টি আপনার যা আছে সেটাকে আরো মূল্যায়ন করতে শেখাবে।
  • তৃতীয়টি আপনার অন্তরকে পরকালের সাথে আরও দৃঢ় বন্ধনে যুক্ত করবে এবং এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের অসারতা থেকে আপনাকে মুক্ত করবে।

.

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ২২)

 

আল্লাহ তা’আলা কুরআনে সুরা আলে ইমরানের ১৮৬ নং আয়াতে বলছেন,

নিশ্চয়ই তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হবে তোমাদের সম্পদ ও জীবনের দ্বারা …”

 

 

কিছু লোকের জন্য এই পরীক্ষা হতে পারে দারিদ্র্য; কারো জন্য হতে পারে মারাত্মক কোনো শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা। আবার কিছু মানুষের জন্য তা হতে পারে ভালোবাসার মানুষকে হারানো। কারও জন্য বা বন্দীদশা। তবে আমাদের প্রত্যেকের জন্যই, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে এটা একটা প্রতিশ্রুতি যে, তিনি আমাদের সবাইকেই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে, কোনো একধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি অবশ্যই করবেন। আপনি নবীতুল্য এক সৎকর্মশীল ব্যক্তিত্ব হোন কিংবা একজন খুনীর মতন ঘৃণ্য কেউ হোন, আল্লাহ তা’আলা আপনার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ দুঃখ-কষ্ট এবং পরীক্ষা নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত নবীগণ যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন তা ভালো করে খেয়াল করলে আপনার কাছে মনে হবে যেন আল্লাহতা’আলা আগে থেকেই আপনার আমার জন্য এই জিনিসগুলোকে উদাহরণ হিসেবে রেখে দিয়েছেন। যেন আমরা আমাদের সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারি:

 

  • আদম (আলাইহিস সালাম) এর এক পুত্র আরেক পুত্রকে হত্যা করেছিল।

 

  • নূহ (আলাইহিস সালাম) এর এক পুত্র ছিল কাফির।পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়েছিল।

 

  • ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) এর বাবা ছিল এক অত্যাচারী মুশরিক।

 

  • ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) কে নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছিল।

 

  • আইয়্যুব (আলাইহিস সালাম) কে সম্মুখীন হতে হয়েছিল মারাত্নক ধরনের সব অসুখের।

 

  • ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম) দুইবার সাময়িকভাবে পুত্রহারা হয়েছিলেন (একবার ইউসুফ(আলাইহিস সালাম), আরেকবার বিন ইয়ামিন)।

 

  • রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দারিদ্র্যের সম্মুখীন হন। তাঁর জীবন একাধিক বার বিপন্ন হয়। তিনি তাঁর শিশু সন্তানদেরকে হারান, প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজাকে হারান, প্রাণপ্রিয় চাচা তাঁকে ছেড়ে চলে যান পরপারে। এমনকি তার নিজের জন্মভূমি থেকে তিনি হয়েছিলেন বিতাড়িত।

 

তাই বলা চলে এখনকার দিনে আমরা যে সমস্যা গুলোর মুখোমুখি হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে এমন একটি সমস্যাও নেই যেগুলো পূর্ববর্তী কোনো নবী-রাসূল মোকাবিলা করেননি। এর অনেকগুলো উপকারিতা আছে, যেমন:

  • আমাদের কাছে প্রত্যেকটি কষ্টকর পরীক্ষার নীলনকশা রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত দিক নির্দেশনা।

 

  • আল্লাহতা’আলার সবচাইতে প্রিয় বান্দাদেরকে এই ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতিগুলোর মুখোমুখি হবার ঘটনা থেকে আমরা সিদ্ধান্তে পৌছতে পারি যে এই সকল বিপদময় পরিস্থিতির মোকাবিলা মানুষকে পূর্ণতা দান করে।
  • আল্লাহ যেখানে প্রিয় বান্দা অর্থাৎ নবী-রাসূলদেরকেই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করেন, তাই আপনিও যদি তেমন কঠিন কোনো পরীক্ষায় পতিত হন তাহলে একথা বলার অবকাশ নেই, “আমি-ই কেন?” কারণ আপনার থেকেও অধিক প্রিয় বান্দাদেরকেও আল্লাহ এরচেয়ে কঠিনভাবে পরীক্ষা করেছেন।

 

  • নবীদের সাথে আমাদের অন্তত একটা দিকে সাদৃশ্য অর্জন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

 

  • যখন আমরা নিজেরা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হবো তখন নবীদের কষ্ট-ত্যাগ ইত্যাদি যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব। কারণ তারা আরো বৃহৎ পরিসরে এসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ফলে আল্লাহতা’আলার নবী -রাসূলদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা সৃষ্টি হবে।

 

  • আল্লাহতা’আলার উপর আপনার ভরসা আকাশচুম্বী হবে যখন আপনি জানতে পারবেন যে, নবীদের কঠিন বিপদের সময় আল্লাহ তা’আলা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সুতরাং তিনি আপনাকেও সাহায্য করবেন যদি আপনি তাক্বওয়া অবলম্বন করেন।

 

  • এমনকি নবীরাও আল্লাহতা’আলার পক্ষ থেকে পরীক্ষার উর্ধ্বে নন-এই সত্যটি সমগ্র সৃষ্টির উপর আল্লাহতা’আলার একচ্ছত্র আধিপত্যের বিষয়টিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলে।

 

কাজেই এই আয়াতে আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নেওয়ার যে ওয়াদা করেছেন তা আমাদের কাছে অপছন্দনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু এই অনিবার্য পরীক্ষা থেকে আমাদের অনেক কিছু অর্জন করার আছে। তবে সেজন্য আমাদের পরীক্ষাগুলোকে আল্লাহর নবীদের উপর আমাদের বিশ্বাসের সাথে সমন্বিত করতে হবে।

 .

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ২৩)

 

আল্লাহ তা’আলা সূরা আলে-ইমরানের ১৮৮ তম আয়াতে বলেছেন:

 

তুমি মনে করো না, যারা নিজেদের কৃতকর্মের উপর আনন্দিত হয় এবং নিজেরা যা করেনি, তার জন্যেও প্রশংসিত হতে ভালবাসে, তুমি কখনো ভেবো না এরা (বুঝি) আল্লাহর আযাব থেকে অব্যাহতি পেয়ে গেছে। বস্তুতঃ তাদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব”।

 

আবু সাঈদ খুদরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এই আয়াতের পটভূমি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন জিহাদের উদ্দেশ্যে রওনা হতেন, তখন এক দল মুনাফিক পেছনে বসে থাকতো আর জিহাদে শামিল হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে ভেবে খুব প্রফুল্ল বোধ করতো। যেই না রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লড়াই শেষে ফিরে আসতেন, এই মুনাফিকের দল যার যার কৈফিয়ত নিয়ে তাঁর সামনে হাজির হত। ইসলামের জন্য নিজের আন্তরিকতা প্রমাণে তখন তারা ব্যতিব্যস্ত। এদিকে মদীনাবাসীরা ভাবতো তারা হয়তো জিহাদে গেছে, তাই তারা এই লোকগুলোর প্রশংসা করতো। অথচ তারা জিহাদে না গেলেও অন্যের মুখে নিজেদের গুণগান শুনতে খুবই পছন্দ করত আর তা শোনার জন্যে মুখিয়ে থাকতো।

এই আয়াতটি একটি ইবাদতের ব্যাপারে (জিহাদ) নাযিল হলেও, আমাদের সামাজিক জীবনের জন্য খুব অসামান্য একটি শিক্ষা এ আয়াতের মাঝে লুকিয়ে আছে। আমরা চাইলে শিক্ষণীয় সেই নির্যাসটুকু বের করে নিজেদের চরিত্র গঠনের কাজে লাগাতে পারি। আমাদের সময়ে এই শিক্ষাটির গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা আজ আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে নিজেদের ‘ইমেজ’ বা ভাবমূর্তি নিয়ে সবাই প্রয়োজনের চাইতে বেশি সচেতন। ‘অমুক আমাকে নিয়ে কী ভাবলো, তমুক আমাকে নিয়ে কী চিন্তা করলো, সমাজ আমাকে নিয়ে কী মনে করলো!’- এই চিন্তায় সবাই অস্থির। কখনো কখনো সেই অস্থিরতা এতোটাই লাগামছাড়া হয় যে অন্যের প্রশংসা লাভের আশায়, আমরা নিজেরা যা নই তা প্রমাণ করার জন্য, নিজেকে জাহির করার জন্য আমরা অস্থির হয়ে পড়ি। প্রতিযোগিতায় পূর্ণ এ দুনিয়ায় মেকি চেহারা আর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে হলেও অন্যের সম্মান আর প্রশংসা কুড়োনোর প্রবণতাটা যেন বেড়েই চলেছে। এই আয়াত আমাদেরকে কৃত্রিমতার খোলস থেকে বের হয়ে আসার শিক্ষা দেয় এবং সেসব মুনাফিক্বদের মুখোশ উন্মোচন করে, যারা নিজেরা যতোটা না তারিফের যোগ্য, তারচেয়েও বেশি গুণকীর্তন খুঁজে বেড়াতো।

একজন মুসলিমের নিজের উপর ততটুকু আত্মবিশ্বাসী হওয়া প্রয়োজন যতটা হলে সে নিজেকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দেখানোর প্রয়োজন বোধ করবে না। ইমাম আহমাদকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে তিনি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জ্ঞানার্জন করেন কি না। উত্তরে তিনি যা বললেন সেখানে নিজেকে বড় দেখানো তো দূরে থাক, আল্লাহর জন্য বিশাল কিছু একটা করে ফেলছেন সেই ভাবটুকু পর্যন্ত ছিল না! তিনি কেবল বিনয়ভরে বলেছিলেন, “আসলে আমার কাছে হাদীসগুলো ভালো লেগেছিলো, তাই আমি সেগুলি সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলাম, এই আর কী!” আবু বকর আস-সিদ্দীক্ব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে কেউ প্রশংসা করলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে দু’আ করতেন: ‘হে আল্লাহ! তারা আমাকে যা মনে করে, আমাকে তারচেয়েও উত্তম হওয়ার তাওফিক্ব দান করুন এবং তারা আমার সম্পর্কে যা জানে না, সেগুলোর জন্যে আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ অথচ নবী-রাসূলদের পরে দুনিয়ার বুকে জন্ম নেয়া মানুষগুলোর মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ! সুতরাং এটিই প্রমাণিত হচ্ছে যে সালাফগণ মানুষের কাছে নিজেদেরকে খুব বড় মাপের কিছু প্রমাণে মোটেও ব্যস্ত ছিলেন না। সত্যি বলতে কী, তারা নিজেদের ভাবমূর্তি নিয়ে কোনো চিন্তাই করতেন না। তারা ছিলেন নিতান্তই অনাড়ম্বর সাদাসিধে বাসিন্দা। লোক দেখানোর ব্যাপারে অনাগ্রহী অকপট মাটির মানুষ। তাঁরা শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ব্যাপারে মনোযোগি ছিলেন।

আপনি যদি এই মানুষগুলোর মতো হতে চান তাহলে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না, শুধু আপনি যাদেরকে অভিভূত করার সংগ্রামে লিপ্ত, সেই মানুষগুলোকে তাদের সত্যিকার আসনে বসিয়ে দিলেই চলবে! হ্যাঁ, আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে তারাও ঠিক আপনার মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ, বীর্য ও ডিম্বাণু থেকে যাদের জন্ম। তারা আপনার মতোই দুর্বল, অসহায়, সীমাবদ্ধ, এবং ত্রুটিপূর্ণ। এ সুবিশাল বিশ্ব চরাচরে তারা কতই না তুচ্ছ! আর তাদের তুলনায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কতো বেশি শক্তিশালী, কতটা ক্ষমতাধর, সেটা নিয়ে কখনো ভেবে দেখেছেন? তবে কে আপনার সময়, শ্রম ও মনোযোগ পাওয়ার অধিকতর দাবীদার? একবার যদি আপনার অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয় ও শ্রদ্ধা স্থান পায়, তাহলে দেখবেন, আস্তে আস্তে অন্যরা কে কী ভাবলো সেটা নিয়ে আপনি কম মাথা ঘামাচ্ছেন। তখন একমাত্র আল্লাহ তা’আলার দিকে আপনি অধিক মনোযোগী হয়ে উঠবেন। সত্যি বলতে কী, আপনি যদি এমনটি করতে পারেন, কিছু-না-চাইতেই দেখবেন যে মানুষের চোখে আপনি মহৎ একজন হয়ে গেছেন। সবার অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন। মানুষ সাধারণত খাঁটি ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয় যারা লোকের প্রশংসা কুড়োতে মরিয়া নয়। তারা যেমন, তেমনই থাকে। আপনি লক্ষ করবেন, এ মানুষগুলো নিজের ব্যক্তিত্বের কারণেই লোকের সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হয়। লোকেরা তাকে এটা-সেটা ভাবুক এটা তার চাওয়া নয়।

এখানে প্রথম ব্যাপারটি জুড়ে ছিল এই নিজের ভাবমূর্তি নিয়ে অতিসচেতনতা অন্যদের উপর কী প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে আলোচনা। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এই নিন্দনীয় স্বভাবটি স্বয়ং আপনার উপর কী প্রভাব ফেলে তা বোঝার চেষ্টা করা। আপনি যখন দেখবেন মানুষ আপনাকে যা মনে করেছে আপনি আসলে তা নন, তখন নিজের ভেতর মারাত্মক অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা বোধ করবেন। অনেকটা নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করার মতো। বিশ্বের নামকরা সেলিব্রিটিদের মধ্যে হতাশা, মাদকাসক্তি এবং আত্মহত্যার আধিক্যের দিকে খেয়াল করুন! তারা যখন আবিষ্কার করে বাইরের জগতের সামনে তার যে মহান রুপ উপস্থাপন করা হয়, সেটার সাথে তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের বিস্তর ফারাক আছে, তখনই একরাশ বিষণ্ণতা তাদের উপর জেঁকে বসে। তারা যে মেকি জীবনযাপনের ভান করছে, সেটি কেবল-ই একটি মিথ্যে ছলনা, একটি অলীক অভিনয়।এই তেতো অনুভূতি তাদেরকে কুরে কুরে খায়। নিজেরা বাস্তবে যা নয়, তারচেয়েও বড় করে যারা নিজেকে মানুষের সামনে হাজির করতে চায় তাদের সবার জীবনেই এই ব্যাপারটি আরেকটু ছোট পরিসরে ঘটে থাকে।

আপনি হয়তো ভাবছেন যে মানুষকে বোকা বানাতে পেরে, নিজেদেরকে জাহির করে এ লোকগুলো খুব আনন্দবোধ করে। কিন্তু ২০১০ সালের জুন মাসে ‘সাইকোলজিকাল সায়েন্স’ (Psychological Science)নামক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি রিসার্চ অনুযায়ী তার উল্টোটাই প্রমাণিত হয়। এখানে একদল নারীর উপর একটি পরীক্ষা চালানো হয়। তাদের প্রত্যেককে দেয়া হয় একটি করে ৩০০ ডলার মূল্যের ব্র্যান্ডের সানগ্লাস (ক্লো ব্র্যান্ডের সানগ্লাস)। অংশগ্রহণকারী নারীদের কিছু অংশকে বলা হয় তারা যে সানগ্লাসটি পরেছে, তা আসল ব্র্যান্ডের চশমা। আর অন্যদেরকে বলা হয় যে এগুলো আসলে নকল। এরপর তাদের সবার একটি গণিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেখানে জিতলে তাদের ১০ ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই পরীক্ষায় তাদের নিজেদেরকেই নিজেদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে দেওয়া হয়। দেখা গেলো, যারা জানতো তারা আসল ব্র্যান্ডের চশমা পরেছে, তাদের মাঝে মাত্র ৩০ ভাগ নিজেদের নম্বর প্রদানে জালিয়াতি করেছে, আর যারা ভেবেছিল তারা নকল চশমা পরেছে, তাদের শতকরা ৭০ জনই মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে।

পরীক্ষার দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের কম্পিউটার স্ক্রিনের উপর কিছু বিন্দু গণনা করতে বলা হয়। বলা হয় যে, প্রত্যেকটি বিন্দুর অবস্থানের উপর পুরস্কারমূল্য নির্ভর করবে। এখানেও দেখা গেলো, যারা নকল সানগ্লাস পরে আছে বলে ভেবেছে, তারা গণণাকৃত বিন্দুর অবস্থান নিয়ে অনেক বেশি মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে, অথচ যারা ভেবেছে তাদের সানগ্লাস আসল তারা এতোটা করে নি। তৃতীয় অংশ ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব যেখানে তাদেরকে নৈতিকতা, সততা প্রভৃতি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়। এখানেও প্রকাশ পেলো যারা জানতো তারা নকল জিনিস পরে আছে, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। অন্যদেরকে অসৎ ও নীতিহীন মনে করে। চতুর্থ ভাগে তাদেরকে এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয় যার মাধ্যমে বোঝা যায় একজন কতটা একাকিত্ব বোধ করছে। এখানেও একই ব্যাপার! যারা জানতো যে তারা আসল চশমা পরে আছে, তাদের তুলনায় যারা ভেবেছে যে নকল চশমা পরে আছে, তারা নিজেদেরকে বেশি একা মনে করছিল।

চমকপ্রদ এই পরিসংখ্যানটিও এ উপসংহার টানে যে, নকল জিনিসপত্র পরে একজন মানুষ কাজেকর্মে এবং মানসিকভাবেও তিক্ততা অনুভব করে। অন্যদিকে যারা জানে তারা আসলটাই পরেছে, তারা হয় অধিক সৎ, নীতিবান ও পরিতৃপ্ত।

 .

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল নম্বর # ১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ২৪)

 

আল্লাহ তা’আলা কুরআনের সূরা আলে ইমরান এর ১৯৬-১৯৭ আয়াতে বলেন,

“ নগরীতে কাফেরদের চাল-চলন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয়। এটা হলো সামান্য (কয়েকদিনের) সামগ্রীমাত্র-এরপর তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর সেটি হলো অতি নিকৃষ্ট অবস্থান।”

 

পত্রিকায় আন্তর্জাতিক খবরের পাতা উল্টিয়ে শত্রুর হাতে আক্রান্ত মুসলিম দেশগুলোর খবর পড়ার সময় এই দুটো আয়াত আমার খুব মনে পড়ে। আমাদের বর্তমান বাস্তবতার নিরীখে এই দুটি আয়াত যেন আমাদের মনে প্রশান্তি ও ভরসা যোগাতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। আপনি খবরের কাগজ একবার উল্টিয়ে দেখুন। সপ্তাহের প্রতিটি দিনেই পাকিস্তানে সিআইএ এর ড্রোন হামলার খবর, ফিলিস্তিনে নতুন কোনো বসতি স্থাপনের খবর, আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিন দখলদারিত্ব সম্প্রসারণ এবং এধরনের আরো অনেক খবর খুঁজে পাবেন। আপনার মনে হয়তো সামান্য হলেও হতাশা জেঁকে বসে। আপনি হয়তো ভাবেন, ‘এসবের শেষ কবে? যালিমদের পাশার দান কখন উল্টে যাবে?” এই দুটি আয়াত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে, তা আমাদেরকে বর্তমান প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে। আপনার মনে হতেই পারে আল্লাহ বুঝি এই দুটি আয়াত বিশেষভাবে আমাদের জন্য নাযিল করেছেন!

 

প্রথমত, আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন, তিনি তার শত্রুদেরকে দুনিয়ার বুকে রাজত্ব দেবেন এবং তাতে মু’মিনরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর মানে হল যখন আপনার জীবনে দুঃসময় আসে, সেটি কোনো আকস্মিক “হ য ব র ল” অবস্থা নয়। বরং আল্লাহ এর দ্বারা আপনাকে শাণিত করে তুলতে চান। তিনি আপনাকে আরো বলিষ্ঠভাবে গড়ে তুলতে চান। এই কারণে তিনি আপনাকে ক্ষণিকের এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে চালনা করেন। তেমনি, মুসলিমদের উপর কাফিরদের আধিপত্য আমাদের সকলের অপছন্দ হলেও এটি মূলত মুসলিম উম্মাহকে প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী করে তোলার একটি পন্থা। এতে বিজয় লাভের আগে মুসলিমরা কঠিন সময় ও দুর্যোগ পাড়ি দিতে শেখে। ফলে অর্জিত বিজয়কে তারা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, আল্লাহ্ আমাদের আদেশ করছেন যাতে এই কুফফার সভ্যতার চাকচিক্য দেখে আমরা ধোঁকায় না পড়ি। আর এই ধোঁকা থেকে বাঁচতে যে বিষয়টি সবসময়ের জন্য মাথায় গেঁথে রাখতে হবে তা হল, কুফফারদের এই রাজত্ব সাময়িক, আর তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য জাহান্নাম, যা চিরস্থায়ী। রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ দুনিয়ার বুকের সবচেয়ে ধনী আর বিলাসী ব্যক্তিটিকে জাহান্নামে একবার ডুব দিয়ে তুলে এনে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘তুমি কি তোমার জীবনে কখনো কোনোকিছু উপভোগ করেছিলে?’ সেই ব্যক্তি উত্তর দেবে, ‘না’। কারণ জাহান্নামের সেই এক মুহূর্তের অভিজ্ঞতাই এতটা ভয়াবহ যে, নিমিষে সে তার দুনিয়ার জীবনের সমস্ত আরাম আয়েশের কথা ভুলে যাবে।

তেমনি কোনো জালেম ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতি যখন তাদের আধিপত্য আর প্রভাব-প্রতিপত্তির ঝলকানি দ্বারা বিশ্বের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় এবং একই সাথে কুফর ও জুলুম-নির্যাতনের ধারা অব্যাহত রাখে, তাদের পরিণতিও ঠিক একই রকম হবে। এই চিরন্তন পরিণতির সাক্ষী ইতিহাস। দুনিয়াবী কোনো উৎকর্ষই এই পতন ঠেকাতে পারবে না। তাদের দুনিয়াবী পতন ছাড়াও এই আয়াতের আরো একটি উপকারী দিক হল, জাহান্নামের গন্তব্যের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ এই সাময়িক দুনিয়াবি জীবনের তুলনায় আখিরাতের জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব এবং দীর্ঘস্থায়ীতা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন।

সবশেষে, আরো একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় আছে, যার কথা এই আয়াতে সরাসরি উল্লেখিত না হলেও আল-বুখারীর একটি হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত। সেই হাদিসটিতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘এটি আল্লাহর দায়িত্ব তিনি যদি কিছুকে উঁচুতে তুলে ধরেন তবে তিনি সেটিকে অবশ্যই নামিয়েও দেন’। অন্য কথায়, যার উত্থান আছে, তার পতনও আছে। আমরা এক্ষেত্রে কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটা চমৎকার বই পড়ে দেখতে পারি। বইটির নাম, ‘Why the West Rules – For Now: The Patterns of History and What They Reveal About the Future’। এই বইয়ে লেখক ইয়ান মরিস দুটো মৌলিক যুক্তির উপস্থাপনা করেছেন, প্রথমত, ইতিহাস জুড়ে যত সভ্যতা, তাদের উত্থান ও পতনের পেছনে যে কারণ সেগুলো কেউ কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, ২০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে আধিপত্য বিস্তারকারী পশ্চিমা সভ্যতার পতনও খুব দ্রুতই সংঘটিত হবে।

 

 

বইটিতে লেখক সেই ১২০০০ বছর আগের বরফ যুগের পর থেকে বর্ণনা শুরু করেছেন। তখন কৃষির ধারণা জন্ম লাভ করে আর বৃহৎ পরিসরে সুসংগঠিত সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি বর্ণনা করেন, কীভাবে প্রয়োজনীয় গাছপালা ও গৃহ্পালিত প্রাণীর প্রাচুর্যের কারণে দুটি আদি ভৌগলিক আবাস থেকে একের পর এক সভ্যতার জন্ম ও চতুর্মুখী সম্প্রসারণ হয়, এ দুটি এলাকা হল পশ্চিম ইউরেশিয়া এবং ইয়াংজি ও ইয়েলো নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল যা বর্তমানে চীন নামে পরিচিত। মরিস উল্লেখ করেন, শুরুতে পশ্চিমারা প্রযুক্তিগত উন্নয়নে প্রাচ্যের তুলনায় প্রায় ২০০০ বছর এগিয়ে থাকলেও খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ এ এসে এই অগ্রযাত্রা স্তিমিত হয় এবং তারা সমানে-সমান হয় ওঠে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রাচ্য নেতৃত্বের আসনে অবতীর্ণ হয়। কারণ, এই রোমান সাম্রাজ্যই তৎকালীন সময়ে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করত এবং তারাই ছিল সেই পশ্চিমা সভ্যতার সামাজিক উন্নয়নের চূড়া। এই অবস্থা ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বিরাজমান থাকে। এই সময়েই ইউরোপ অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে। অপরদিকে সুই রাজবংশের নেতৃত্বে চীন ঐক্যবদ্ধ হয় এবং পরবর্তী ১০০০ বছর পর্যন্ত তারা কর্তৃত্বের ছড়ি ধরে রাখে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রাচ্যের এই অগ্রগামিতা টিকে থাকে। কিন্তু সেই সময়ে এসে আবার পশ্চিমারা প্রাচ্যের সমকক্ষ রুপে আবির্ভূত হয়। এর কারণ হল ক্রমাগত যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিমারা তাদের সামরিক প্রযুক্তিক্ষেত্রে ব্যাপক পারদর্শীতা লাভ করে। ১৮ শতকের শেষে, শিল্প বিপ্লবের প্রারম্ভিক পর্যায়ে দুটি সভ্যতার শক্তিমত্তার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসে এবং তা পশ্চিমাদের দিকে হেলে যায়। ব্রিটিশ প্রকৌশলবিদগণ তাদের দেশে অবস্থিত বিপুল কয়লাখনির সুবাদে বাষ্পচালিত জাহাজ, ট্রেন এবং শিল্পকারখানায় প্রভূত উন্নতি সাধনে করে। এর মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জনে সক্ষম হয়। ব্রিটিশদের এই আধিপত্য পরবর্তী ১০০ বছর (বিংশ শতাব্দীর পূর্ব অবধি) টিকে থাকে। এই ব্রিটিশ আধিপত্যই আধুনিক যুগের আমেরিকান আধিপত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

মূল যে বিষয়টির উপর বইটি দৃষ্টিপাত করেছে তা হল, দশ হাজারেরও বেশি সময় ধরে, কী করে একের পর এক সভ্যতার জন্মই হয়েছে যেন ধ্বংস হবার জন্য! তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের কিছু কারণে তাদের পতন ছিল অনিবার্য। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের রাজত্বকালই ছিল মানবজাতির সামগ্রিক ইতিহাসের মাঝে একটি ছোট্ট পাতা মাত্র। সাময়িক ও সংক্ষিপ্ত।

লেখক এরপর উপসংহার টানতে বই এর নামের সাথে জুড়ে দেওয়া – ‘পশ্চিমারা এখন শাসন করছে, কিন্তু কতদিনের জন্যে?’ এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তার উত্তর ছিল এমন, যদি প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের উন্নতির ধারা এখন যেমনটা-আছে-তেমনটাই-থাকে, তবে আগামী শতাব্দীর শুরুতেই কবর রচিত হবে পশ্চিমা প্রতিপত্তির। আল্লাহু ‘আলাম।

 .

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশান ইউনিট – সেল নম্বর # ১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ২৫)

 

কুরআনে সূরা নিসার ১নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,

হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী…”

 

এই আয়াতে এক চিরন্তন বাস্তবতার কথা আছে। এই বাস্তবতাটি আপনাকে যেকোনো মহৎ কাজ করার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যোগাবে। ভেবে দেখুন, আল্লাহ তা’আলা সমগ্র মানবজাতিকে আহবান করে বলছেন, তিনি আমাদের সবাইকে কেবল একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে জন্ম দিয়েছেন। তাদের অন্তরঙ্গতা থেকে সন্তান জন্ম নিয়েছে, সেসব সন্তানদের আরো সন্তান-সন্ততি হয়েছে এবং এমনি করে ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর সময়ে পৃথিবীর লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু’শ মিলিয়ন! সতের শতকের মাঝেই বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ মিলিয়ন স্পর্শ করে আর উনিশ শতক নাগাদ এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে এক বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। বিশ শতকে তা আবারো বেড়ে দ্বিগুণ হয়, অর্থাৎ দুই বিলিয়ন। আর আজকে পুরো দুনিয়াতে প্রায় সাত বিলিয়ন লোকের বাস। অর্থাৎ জনসংখ্যা বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। ধারণা করা হয় আগামী শতক আসতে আসতেই পৃথিবীতে লোকসংখ্যা দশ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। শত ভাষাভাষী হাজার কোটি মানুষ বিভিন্ন দেশ আর মহাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের মাঝে রয়েছে বিভিন্ন জাতি, বর্ণ আর গোত্রের বৈচিত্র্য।এই বৈচিত্র্যময় বিশাল জনগোষ্ঠীর সূত্রপাত হয়েছে কেবল একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে। অথচ তারা দুনিয়ার বুকে এসেছিলেন আজ থেকে হাজার বছর আগে।

 

এ ব্যাপারটি একটি গভীর চিন্তার খোরাক যোগায়। আপনার একটিমাত্র কাজ আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও এর ফলাফল হতে পারে অসামান্য! কোনো এক অজানা দিনে করা আপনার একটি ছোট্ট কাজ, একের পর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে এক বিশাল পরিণতি সৃষ্টি করতে পারে। হয়তো কাজটি করার সময় সেদিন এমন পরিণতির কথা আপনি কল্পনাতেও ভাবেন নি। বৃষ্টির প্রথম ছোট্ট ফোঁটাটা যখন পানির বুকে আছড়ে পড়ে তখন সে জায়গাটাকে কেন্দ্র করে ছোট্ট একটা ঢেউ ওঠে। সেই ঢেউটা তার চারপাশে মৃদু আলোড়ন তুলতে তুলতে ছড়িয়ে যায়। তেমনি আপনার একটি ছোট্ট কাজ থেকেও জন্ম নিতে পারে অজস্র ঘটনা। ইংরেজিতে এর একটি নাম আছে, যাকে বলা হয় Domino Effect, তবে এর প্রকৃত নাম হওয়া উচিত জ্যামিতিক সংবৃদ্ধি (geometric progression)।

সমাজবিজ্ঞানীরা এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে মহামারীর উদাহারণের আশ্রয় নেন। ধরুন, ভারত থেকে এক পর্যটক বাংলাদেশে বেড়াতে আসার সময় তার শরীরে এমন এক সংক্রামক ভাইরাস বয়ে এনেছে, যার সংক্রমণের হার ১০%। অর্থাৎ তার সাথে দেখা হওয়া প্রতি দশ জন লোকের এক জন এ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হবে। বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে প্রতিদিন প্রায় ৫০ জন লোক তার সংস্পর্শে আসলো, অতএব তাদের মাঝে পাঁচ জনকে সে সংক্রমিত করলো। পরদিন, সেই পাঁচ ব্যক্তির প্রত্যেকে আরো নতুন পঞ্চাশ জনের সংস্পর্শে আসলো এবং তাদের ১০% লোককে আক্রান্ত করলো। তাহলে, এখন আক্রান্ত ব্যক্তির পরিমাণ দাঁড়ালো নতুন ২৫ জন+প্রথম ৫ জন+পর্যটক নিজে অর্থাৎ মোট ৩১ জন। তৃতীয় দিনে এই ৩১ জন লোকের প্রতেকে আরো ৫০ জনের সান্নিধ্যে আসলো এবং তাদের ১০% কে আক্রান্ত করলো। সুতরাং তিন নম্বর দিনে নতুন আরো ১৫৫ জন জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে আর আক্রান্ত লোকের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১৮৬! হিসেব করলে দেখা যাবে চার নম্বর দিনে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে!

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এক ভারতীয় পর্যটকের শরীর থেকে হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী লোক সেই সংক্রামক ভাইরাসের বাহকে পরিণত হয়েছে চার দিনের মাথায়! তাহলে ভেবে দেখুন, এক সপ্তাহ, এক মাস বা এক বছর পরে এই সংখ্যাটি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে পেতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে! ভারত থেকে যখন মাত্র একজন পর্যটক এ ভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিল, তখন এই কি বিশাল সংখ্যাটা আমরা কল্পনায়ও আনতে পেরেছিলাম?

 

দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার মসনদ আকঁড়ে রাখার পর আমেরিকান ডলারে পালিত মুবারক সরকারের শক্তিশালী বলয় আজ ভেঙে পড়েছে। তিউনিসিয়ার বেন আলীর শাসনের পতন ঘটেছে। লিবিয়াতে প্রকৃতপক্ষেই একটি সশস্ত্র বিপ্লবের সূচনা হয়েছে (যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে তারা বোকার মতো পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ ও সাহায্য কামনা করে বসেছে)। আজ আলজেরিয়া, বাহরাইন, জর্দান, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং সৌদি আরবের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে। এটা একসময় ছিল চিন্তারও অতীত। সমগ্র আরব জুড়ে এখন যালেম শাসকদের বিরুদ্ধে দাউদাউ করে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। এই শাসকরা যুগ যুগ ধরে জনগণের রক্ত চুষে খেয়েছে, তাদের উপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছে। এ ঘটনাগুলো ক্বিয়ামাতের পূর্বাভাস দেয়। এই ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত পৃথিবীর চেহারাকে পাল্টে দিতে থাকবে। কিন্তু এসবকিছুর শুরু হয়েছিল কোথায়?

 

এই আগুনের সূচনা হয়েছিল একটি মাত্র স্ফুলিঙ্গ থেকে। আপাতদৃষ্টিতে একক, অপ্রাসঙ্গিক ও তুচ্ছ একটি কাজ থেকে। এ সবের শুরু হয়েছিল ডিসেম্বরের এক গড়পড়তা দিনে। সেদিন হতাশায় জর্জরিত এক বেকার যুবক তিউনিসিয়ার রাস্তায় নিজের গায়ে গ্যাসোলিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। অবশ্যই ইসলামের দৃষ্টিতে এ কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তবে এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে তার এই একটি কাজের সুদূরপ্রসারী ফলাফল। তার ছোট্ট একটি কাজ ছোট ছোট প্রতিবাদের জন্ম দেয়। সেখান থেকে একটি বিশাল আন্দোলন বেগবান হয়। ফলস্বরূপ তিউনিসিয়া সরকারের পতন ঘটে, পতন ঘটে মিসর সরকারের। এই ঘটনা অন্যান্য বহু দেশের লক্ষাধিক লোককে যালিম-সরকার বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়তে উৎসাহ যোগায়। এমনকি এই আগুনের আঁচ আমেরিকাকেও স্পর্শ করে! (ম্যাডিসন, উইসকনসিনের ঘটনা এখানে উল্লেখ্য – যেখানে জনগণ রাজনৈতিক দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে)। মুহাম্মদ বুয়াজিজি যখন নিজের গায়ে গ্যাসোলিন ঢেলে দিচ্ছিল, সে মুহূর্তে কেউ ভাবতেও পারেনি এ ঘটনা শেষ পর্যন্ত পুরো মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রকে বদলে দেবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এ বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন।

আমেরিকায় কনকর্ড নামে এক এলাকা আছে। ম্যাসাচুসেটসে আমার বাসা থেকে গাড়ি করে কনকর্ড যেতে কয়েক মিনিট সময় লাগে। কনকর্ড হলো সেই শহর যেখানে ২০০ বছর আগে ব্রিটিশ দখলদারদের সাথে স্থানীয় আমেরিকানদের মোকাবিলা হয়। সেখান থেকে সূচিত হয় আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ। আর সেখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্র নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এ সবকিছুর শুরু কোথা থেকে? এর সূচনা ১৭৭৫ সালের এপ্রিল মাসের কোনো এক দিনে, যেদিন পল রেভার নামের এক আমেরিকান, ব্রিটিশ সেনাদের সশস্ত্র অভিযানের পরিকল্পনা আগেভাগে টের পেয়ে যান (তখন আমেরিকা ছিল ব্রিটিশদের ঔপনিবেশ)। তিনি জানতে পারেন, ব্রিটিশ বাহিনী লেক্সিংটন শহরে জন হ্যাংকক ও স্যামুয়েল অ্যাডামকে গ্রেপ্তার করে কনকর্ডে অতর্কিত আক্রমণ করে স্থানীয় সৈন্যবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র জব্দ করার পরিকল্পনা এঁটেছে। সে রাতে রেভার খুব সাধারণ একটি কাজ করেন। তিনি একটি ঘোড়া নিয়ে বের হয়ে শহরে শহরে গেলেন এবং স্থানীয় লোকদের কাছে আগাম সতর্কবার্তা পৌঁছে দিলেন যে, পরদিন সকালে ব্রিটিশ সৈন্যরা অভিযানের পরিকল্পনা করেছে। লেক্সিংটন যাবার পথে প্রত্যেক শহরে নেমে তিনি এই কাজটি করলেন। পরদিন সকালে ব্রিটিশরা সেখানে পৌঁছে আবিষ্কার করলো তাদের মোকাবিলার জন্য আগে থেকেই একদল মিলিশিয়া বাহিনী প্রস্তুত! লড়াই হল। ব্রিটিশরা কনকর্ডে পরাজিত হল এবং সূচনা হল আমেরিকান মুক্তিযুদ্ধের। এই মিলিশিয়া মুক্তিবাহিনীই পরবর্তীতে সারা দেশে ব্রিটিশ হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

 

 

উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে। দুনিয়ার চেহারা বদলে-দেওয়া, জাতির ভাগ্যের চাকা-ঘুরিয়ে দেওয়া এই বিশাল ঘটনাগুলোর শুরুটা হয়েছিল এক ব্যক্তির ছোট্ট একটি কাজ থেকে! অথচ সে ব্যাক্তির হয়তো ধারণাই ছিল না তার সামান্য কাজটির পরিণতি একসময় কোথায় গিয়ে ঠেকবে! এই উদাহরণ গুলোর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এখানে তেমন জরুরি নয়। বরং এখান থেকে শেখার বিষয় হল জ্যামিতিক সংবৃদ্ধির বিষয়টি। এটা আপনি প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ করতে পারেন। পল রেভারের ছোট্ট একটি কাজ আমেরিকান বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল। মুহাম্মদ বুয়াজিজির অভিমানি আত্মাহুতি আরব বসন্তের উত্থান ঘটিয়েছিল। শুধুমাত্র একজন পুরুষ ও নারীর সম্মিলন থেকে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের আগমন ঘটেছে। তেমনি করে দু’দিন আগে অচেনা সেই পথচারীর সাথে আপনার আলাপচারিতা বা আপনার কোনো বক্তৃতা, বন্ধুকে দেওয়া উপহারের বই, আপনার কোনো সাদাক্বাহ, অথবা আপনার কোনো কথা বা কাজের পরিণতি পরবর্তীতে অন্যদের জীবনে এমন সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে পারে যা আপনি সে সময় কল্পনাও করতে পারেননি। সূরা ইবরাহীমের ২৪ এবং ২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কী উপমা টেনেছেন তা লক্ষ্য করে দেখুন:

“…পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মত। তার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত। সে পালনকর্তার নির্দেশে অহরহ ফল দান করে…”

 

 

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সীরাহ থেকে একটি ঘটনার অবতারণা করে আমি আমার লেখা শেষ করছি। মদীনায় হিজরতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে ইসলামের বীজ বপন করার উদ্দেশ্যে মুস’আব ইবন উমাইরকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। মুস’আব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সেখানে পৌঁছলেন এবং আসাদ বিন যুরায়রাহ নামের স্থানীয় খাযরাজ গোত্রীয় এক ব্যক্তির আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন। তাদের দু’জনের প্রচেষ্টায় মদীনার বেশ কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করলো। একদিন এই দলটি জাফর গোত্রের কুয়ার পাশে বসে ছিল। তখন তারা মদীনার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হল। এই ব্যক্তি ছিলেন উসাইদ ইবন হুদাইর। মুস’আব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে তাঁদের মজলিসে বসে কথা শোনার আমন্ত্রণ জানান। আলোচনার এক পর্যায়ে উসাইদ ইসলাম গ্রহণ করলেন। উসাইদ এবার আরেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে সাথে করে হাজির হলেন। তাঁর নাম সাদ ইবন মুয়ায। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করলেন। বছরখানেক পর বনী কুরায়যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যেয়ে তিনি শহীদ হন। সাদ ইবন মু’আয(রাদিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন এমন একজন মুসলিম যার ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন যে সাদের মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। সাদ ইবন মুয়ায এরপরে নিয়ে আসলেন সাদ ইবন উবাদাহ কে। তিনিও তখনই ইসলাম গ্রহণ করেন।

ফলে মদীনার লোকেরা একে অপরকে বলতে থাকলো: ‘যদি উসাইদ ইবন হুদাইর, সাদ ইবন মুয়ায আর সাদ ইবন উবাদাহ উনারা সকলে মুসলিম হয়ে যান, তবে তো আমাদেরও তাই করা উচিত!’ আর-রাহীকুল মাখতুম বইটিতে এভাবেই বলা হয়েছে:

মুস’আব মদীনায় তাঁর দাওয়াহর কাজ অব্যাহত রাখলেন এবং সাফল্যের সাথে নিজের মিশন চালিয়ে যেতে থাকলেন। ফলে এক সময় এমন হলো যখন মদীনার আনসারদের প্রতিটি ঘরেই মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারীতে ভরে উঠল‘।’ মুস’আবের মিশন দ্বারা মদীনায় এভাবেই জন্ম হল প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের। হিজরতের ভূমি, ইসলামের ভিত্তি যে মদীনা শহর, যেখান থেকে পুরো বিশ্বের কাছে ইসলামকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা তৈরি হয়েছিল কেবল একজন লোকের প্রচেষ্টা থেকে – মুস’আব ইবন উমাইর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)।

এটা জানা সত্যিই দুঃসাধ্য যে, আপনার সামর্থ্য ও প্রচেষ্টাগুলো কখন ঢেলে দিলে বা কার সাথে করলে তা কাজে লেগে যাবে। আপনি কখনোই জানবেন না আপনার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কাজের পরিণতিও কতো বিশাল হয়ে যেতে পারে! সবসময় মনে রাখবেন এবং ইতিহাস থেকেও আমরা এই শিক্ষাটিই পাই যে শুধুমাত্র একজন মানুষের পক্ষেও পৃথিবীকে বদলে দেওয়া সম্ভব…

.
তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ২৬)

 

আল্লাহ তা’আলা সূরাহ আলে-ইমরানের ১৮৮ তম আয়াতে বলেছেনঃ

 

“তুমি মনে করো না, যারা নিজেদের কৃতকর্মের উপর আনন্দিত হয় এবং নিজেরা যা করেনি, তার জন্যেও প্রশংসিত হতে ভালবাসে, তুমি কখনো ভেবো না এরা (বুঝি) আল্লাহর আযাব থেকে অব্যাহতি পেয়ে গেছে। বস্তুতঃ তাদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।’

 

আবু সাঈদ খুদরী (রা) এই আয়াতের পটভূমি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন জিহাদের উদ্দেশ্যে রওনা হতেন, তখন এক দল মুনাফিক পেছনে পড়ে থাকতো আর জিহাদে শামিল হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে ভেবে খুব প্রফুল্ল বোধ করতো। যেই না রাসূলুল্লাহ ﷺ লড়াই শেষে ফিরে আসতেন, এই মুনাফিকের দল যার যার কৈফিয়ত নিয়ে তাঁর সামনে হাজির হত। ইসলামের জন্য নিজের আন্তরিকতা প্রমাণে তখন তারা ব্যতিব্যস্ত। এদিকে মদীনাবাসীরা ভাবতো তারা হয়তো জিহাদে গেছে, তাই তারা এই লোকগুলোর প্রশংসা করতো। মুনাফিকরা নিজেদের গুণগান শোনার জন্যে মুখিয়ে থাকতো, তারা আবার প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে কী না! অথচ যে কাজের জন্য তাদের তারিফ করা হচ্ছে, তারা সে কাজটি পর্যন্ত করে নি।

 

যদিও আয়াতটি একটি ইবাদতের ব্যাপারে (জিহাদ) নাযিল হয়, আমাদের সামাজিক জীবনের জন্য খুব অসামান্য একটি শিক্ষা এ আয়াতের মাঝে লুকিয়ে আছে। আমরা চাইলে শিক্ষণীয় সেই নির্যাসটুকু বের করে নিজেদের চরিত্র গঠনের কাজে লাগাতে পারি। আমাদের সময়ে এই শিক্ষাটির গুরুত্ব অনেক বেশি, কেননা আজ আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে নিজেদের “ইমেজ” বা ভাবমূর্তি নিয়ে সবাই প্রয়োজনের চাইতে বেশি সচেতন। “অমুক আমাকে নিয়ে কী ভাবলো, তমুক আমাকে নিয়ে কী চিন্তা করলো, সমাজ আমাকে নিয়ে কী মনে করলো!” – এই চিন্তায় সবাই অস্থির। কখনো কখনো সেই অস্থিরতা এতোটাই বেশি লাগামছাড়া হয় যে অন্যের প্রশংসা লাভের আশায়, আমরা নিজেরা যা নই তা প্রমাণ করার জন্য, নিজেকে জাহির করার জন্য আমরা তৎপর হয়ে পড়ি। প্রতিযোগিতায় পূর্ণ এ দুনিয়ায় মেকি চেহারা আর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে হলেও অন্যের সম্মান আর প্রশংসা কুড়োনোর প্রবণতাটা যেন বেড়েই চলেছে। এই আয়াত আমাদেরকে কৃত্রিমতার খোলস থেকে বের হয়ে আসার শিক্ষা দেয় এবং সেসব মুনাফিক্বদের মুখোশ উন্মোচন করে, যারা কিনা নিজেরা যতোটা না তারিফের যোগ্য, তারচেয়েও বেশি গুণকীর্তন খুঁজে বেড়াতো।

 

একজন মুসলিমের নিজের উপর ততটুকু আত্মবিশ্বাসী হওয়া প্রয়োজন যতটা হলে সে নিজেকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দেখানোর প্রয়োজন বোধ করবে না। ইমাম আহমাদকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে তিনি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জ্ঞানার্জন করেন কি না, উত্তরে তিনি যা বললেন সেখানে নিজেকে বড় দেখানো তো দূরে থাক, আল্লাহর জন্য বিশাল কিছু একটা করে ফেলছেন সেই ভাবটুকু পর্যন্ত ছিল না! তিনি কেবলই বিনয়ভরে বলেছিলেন, “আসলে আমার কাছে হাদীসগুলো ভালো লেগেছিলো, তাই আমি সেগুলি সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলাম, এই আর কী!” আবু বকর আস-সিদ্দীক্ব (রা) কে কেউ প্রশংসা করলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে দু’আ করতেনঃ “হে আল্লাহ! তারা আমাকে যা মনে করে, আমাকে তারচেয়েও উত্তম হওয়ার তাওফিক্ব দান করুন এবং তারা আমার সম্পর্কে যা জানে না, সে জন্যে আমাকে ক্ষমা করে দিন।” অথচ নবী-রাসূলদের পরে দুনিয়ার বুকে জন্ম নেয়া মানুষগুলোর মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ! সুতরাং প্রমাণিত হচ্ছে এটিই যে সালাফগণ মানুষের কাছে নিজেদেরকে খুব বড় মাপের কিছু প্রমাণে মোটেও ব্যস্ত ছিলেন না। সত্যি বলতে কী, তারা এই “ইমেজ” বা ভাবমূর্তি নিয়ে কোন চিন্তাই করতেন না। তারা ছিলেন বাস্তব জগতের নিতান্তই কিছু সাদাসিধে বাসিন্দা, মাটির মানুষ, মানুষকে দেখানোর ব্যাপারে অনাগ্রহী, শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে তটস্থ।

 

আপনি যদি এই মানুষগুলোর মতো হতে চান তাহলে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না, শুধু আপনি যাদেরকে অভিভূত করার সংগ্রামে লিপ্ত, সেই মানুষগুলোকে তাদের সত্যিকার আসনে বসিয়ে দিলেই চলবে! হ্যাঁ, আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে তারাও ঠিক আপনার মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ, বীর্য ও ডিম্বাণু থেকে যাদের জন্ম, দুর্বল, অসহায়, সীমাবদ্ধ, এবং ত্রুটিপূর্ণ। এ সুবিশাল বিশ্ব চরাচরে তারা কতই না তুচ্ছ! আর তাদের তুলনায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কতো বেশি শক্তিশালী, কতটা ক্ষমতাধর, সেটা নিয়ে কখনো ভেবে দেখেছেন? তবে কে আপনার সময়, শ্রম ও মনোযোগ পাওয়ার অধিকতর দাবীদার? একবার যদি আপনার অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয় ও শ্রদ্ধা স্থান পায়, তাহলে দেখবেন, আস্তে আস্তে অন্যরা কে কী ভাবলো সেটা নিয়ে আপনি কম মাথা ঘামাচ্ছেন। তখন একমাত্র আল্লাহ তা’আলার দিকে আপনি অধিক মনোযোগী হয়ে উঠবেন। সত্যি বলতে কী, আপনি যদি এমনটি করতে পারেন, কিছু-না-চাইতেই দেখবেন যে মানুষের চোখে আপনি মহৎ একজন হয়ে গেছেন, সবার অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন। মানুষ সাধারণত খাঁটি ব্যক্তিত্বদের প্রতি আকৃষ্ট হয়, যারা লোকের প্রশংসা কুড়োতে মরিয়া নয়, তারা যেমন, তেমনই থাকে। আপনি লক্ষ করবেনঃ এ মানুষগুলো নিজের ব্যক্তিত্বের কারণেই লোকের সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হয়। লোকেরা তাকে এই-সেটা ভাবুক এটা তার চাওয়া নয় এ কারণেই তাকে কোন আলগা ভাব নিতে হয় না।

 

এখানে প্রথম ব্যাপারটি জুড়ে ছিল এই “ইমেজ সচেতনতা” অন্যদের উপর কী প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে আলোচনা। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এই নিন্দনীয় স্বভাবটি স্বয়ং আপনার উপর কী প্রভাব ফেলে তা বোঝার চেষ্টা করা। আপনি যখন দেখবেন মানুষ আপনাকে যা মনে করেছে আপনি আসলে তা নন, তখন নিজের ভেতর মারাত্মক অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা বোধ করবেন, অনেকটা নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করার মতো। বিশ্বের নামকড়া সেলিব্রিটিদের মধ্যে হতাশা, মাদকাসক্তি এবং আত্মহত্যার আধিক্যের দিকে খেয়াল করুন! তারা যখন আবিষ্কার করে বাহিরের জগতের সামনে তার যে সেলিব্রেটি রুপ উপস্থাপন করা হয়, তার সাথে তাদের একান্ত ব্যাক্তিগত জীবনের বিস্তর ফারাক আছে, তখনই একরাশ বিষণ্ণতা তাদের উপর জেঁকে বসে। তারা যে মেকি জীবন যাপনের ভান করছে, সেটি কেবল-ই একটি মিথ্যে ছলনা, একটি অলীক অভিনয় – সেই তেঁতো অনুভূতি তাদেরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। এই ব্যাপারটি আরেকটু ছোট পরিসরে ঘটে তাদের সাথেও, যারা নিজেরা বাস্তবে যা নয়, তারচেয়েও বড় করে নিজেকে মানুষের সামনে হাজির করতে চায়।

 

আপনি হয়তো ভাবছেন যে মানুষকে বোকা বানাতে পেরে, নিজেদেরকে জাহির করে এ লোকগুলো খুব আনন্দবোধ করে। কিন্তু ২০১০ সালের জুন মাসে ‘সাইকোলজিকাল সায়েন্স” নামক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি রিসার্চ অনুযায়ী তার উল্টোটাই প্রমাণিত হয়। এখানে একদল নারীর উপর অনুসন্ধান করা হয়, তাদের প্রত্যেককে দেয়া হয় একটি করে ব্র্যান্ডের সানগ্লাস (ক্লো ব্র্যান্ডের সানগ্লাস), যার মূল্য ৩০০ ডলার। কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবীকে বলা হয় তারা যে সানগ্লাসটি পরেছে, তা আসল ব্র্যান্ডের চশমা, আর অন্যদেরকে বলা হয় এগুলো আসলে নকল। এরপর তাদের সবাইকে একটি গণিত কুইজ দেয়া হলো, সেখানে জিতলে ১০ ডলার পুরস্কার, আর তারা নিজেরা নিজেদের কুইজ মার্কিং করবে। দেখা গেলো, যারা জানতো তারা আসল ব্র্যান্ডের চশমা পরেছে, তাদের মাঝে মাত্র ৩০ ভাগ নিজেদের নম্বর প্রদানে জালিয়াতি করেছে, আর যারা ভেবেছিল তারা নকল চশমা পরেছে, তাদের শতকরা ৭০ জনই মিথ্যের আশ্রয় নেয়।

 

পরিসংখ্যানের দ্বিতীয় পর্যায়ে আরেকটি কাজ দেয়া হয়ঃ কম্পিউটার স্ক্রিনের ভেতর কিছু বিন্দু গণনা করা; কে কোন বিন্দু পর্যন্ত গুনেছে আছে তা নির্ধারণ করবে সে কতো ডলার পুরস্কার পাবে। এখানেও দেখা গেলো, যারা নকল সানগ্লাস পরে আছে বলে ভেবেছে, তারা গণণাকৃত বিন্দুর অবস্থান নিয়ে অনেক বেশি মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে, অথচ যারা ভেবেছে তাদের সানগ্লাস আসল তারা এতোটা করে নি। তৃতীয় অংশ ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব যেখানে তাদেরকে নৈতিকতা, সততা প্রভৃতি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়। এখানেও প্রকাশ পেলো যারা জানতো তারা নকল জিনিস পরিহিত, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যদের ব্যাপারেও একই রকম ধারণা পোষণ করে, অন্যদেরকে অসৎ ও নীতিহীন মনে করে। চতুর্থ ভাগে তাদেরকে এমন কিছু প্রশ্ন করা হয় যার মাধ্যমে বোঝা যায় একজন নিজের থেকে কতোখানি দূরত্ব বোধ করছে। এখানেও একই ব্যাপার! যারা জানতো তাদের মাঝে নকল কিছু নেই, তাদের তুলনায় যারা ভেবেছে নকল গ্লাস পরেছে, তারা নিজেদের থেকে বেশি দূরত্ব বোধ করছিল।

 

চমকপ্রদ এই পরিসংখ্যানটিও এ উপসংহার টানে যে, নকল জিনিসপত্র পরে একজন মানুষ কাজেকর্মে এবং মনের দিক থেকেও তিক্ততা অনুভব করে, অন্যদিকে যারা জানে তারা আসলটাই পরেছে, তারা হয় অধিক সৎ, নীতিবান ও পরিতৃপ্ত।

 .

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল নম্বর # ১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ২৭)

 

সূরা আলে ইমরানের ১৯০ এ আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন,

 

“..নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধ সম্পন্ন লোকদের জন্যে।”

 

আয়াতটি পড়ার পর প্রথম যে ভাবনাটি আমার মাথায় আসল তা হল, দুনিয়ার বুকে মানবজাতির আগমন হয়েছে বহু বছর আগে, সে তুলনায় মাত্র অল্প কিছুদিন হল আমরা মহাকাশীয় বস্তগুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে আরম্ভ করেছি। হাজার হাজার বছর হল পৃথিবীর বুকে আমাদের বসবাস, কিন্তু মাত্র কয়েকশ বছর আগে টেলিস্কোপের মাধ্যমে আমরা কাছ থেকে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলোর উপগ্রহ যেমন চাঁদের সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি; আরো পেয়েছি মিল্কি ওয়ের চারপাশের তারকারাজি এবং অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহের ছবি।

 

যে বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করে তা হল, আমাদের আবিষ্কারের লক্ষাধিক বছর পূর্ব থেকেই এই তারকারাজি, ছায়াপথ কিংবা এই সমগ্র মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল, এমনকি যখন এসবের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাও রাখতাম না তখনো এদের অস্তিত্ব ছিল; তখনো শনির সুন্দর বলয়, বৃহস্পতির রঙ বেরঙের স্তর ছিল, গাঢ় নীলের নেপচুন ছিল – সর্বোপরি সৌর মন্ডলের দেখা-অদেখা জগৎসমূহ বিরাজমান ছিল, আমাদের যখন তাদের সত্যিকারের সৌন্দর্য এবং চমকপ্রদ ছবি উপভোগ করার সৌভাগ্য হয় নি, তখনো সেগুলো ছিল। এরা নিজ কক্ষপথে ঘুরত, পরিভ্রমণ করত, জাজ্জ্বল্যমান ছিল এবং মহাকাশকে অলংকৃত করে রেখেছিল।

 

যে উপলদ্ধিটি আমাকে খুব করে নাড়া দেয় তা হল, আমাদের চারপাশের চেনাজানা জগত দেখে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলার কে যতটুকু ক্ষমতাবান মনে করি, প্রকৃতপক্ষে তিনি আরো অনেক বেশি শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান, কেননা আমাদের চারপাশের জগতেই সবকিছু শেষ নয়, বরং তা আরো সুবিশাল এবং আরো চমৎকার – যা কিনা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমাদের দেখা ও জানার পরিসর যতই বড় হোক না কেন, তার বাহিরেও একটা বিস্ময়কর জগতের অস্তিত্ব সবসময় অজানা থেকে যাবে।

 

এরপর আমার মনে প্রশ্ন উঁকি দিল – আচ্ছা, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অস্তিত্বমান এই নিদর্শনগুলো যদি আমাদের এই দীর্ঘসময় ধরে অজানাই থেকে যায়, তবে এই মহাকাশীয় বস্তুগুলো আজকে আমাদের নিকট আসলে কিসের বার্তা দেয়? আমি যে উপসংহারে উপনীত হলাম তা হল, এগুলো আমাদের নিকট সেই বার্তাই পৌছে দেয় যে, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলা এই নক্ষত্র, ছায়াপথসহ নানান মহাকাশীয় গ্রহাণুপুঞ্জ কিছু সৃষ্টি করেছেন কেননা তাঁর এগুলো সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে, তিনি তা পারেন, যেন বহু বছর পর টেলিস্কোপ কিংবা মহাকাশযান এর মাধ্যমে আমরা তাদের আবিস্কার করতে সক্ষম হই; যেন আমাদের উপর আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্বকে পুনরায় উপলদ্ধি করতে পারি।

 

এই সিরিজের পূর্বের একটি লেখাতেও আমাদের জীবনে আয়াতটির প্রয়োগের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি করার একটি উপায় উল্লেখ করেছিলাম, তা হল, হাবল টেলিস্কোপ এবং ভয়েজার মহাকাশযানের ধারণ করা ছবিগুলো থেকে এই লুক্কায়িত মহাকাশ এবং এই সুবিশাল মহাবিশ্বের বিশালতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা লাভ করা। এগুলো আমাদের জন্য নিদর্শনস্বরূপ এবং তা আমাদের বোধবুদ্ধিকে আরো মজবুত করতে সাহায্য করে।

 .

তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (পর্ব ২৮)

 

আল্লাহ তা’আলা কুরআনের সূরা আলে ইমরান এর ১৯৬-১৯৭ আয়াতে বলেন,

 

“ নগরীতে কাফেরদের চাল-চলন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয়। এটা হলো সামান্য ফায়দা-এরপর তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর সেটি হলো অতি নিকৃষ্ট অবস্থান।”

 

যখন আমি পত্রিকায় আন্তর্জাতিক খবরের পাতা উল্টিয়ে শত্রুর হাতে আক্রান্ত মুসলিম দেশগুলোর খবরগুলো পড়ি, তখন এই দুটো আয়াত আমার খুব মনে পড়ে। আমাদের বর্তমান বাস্তবতার নিরীখে এই দুটি আয়াত যেন আমাদের মনে প্রশান্তি ও ভরসা যোগাতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। আপনি খবরের কাগজ উল্টিয়ে দেখুন, সপ্তাহের প্রতিটি দিনেই খুঁজে পাবেন পাকিস্তানে সিআইএ এর ড্রোন হামলার খবর, ফিলিস্তিনে নতুন কোন বসতি স্থাপনের খবর, আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিন দখলদারিত্ব সম্প্রসারণ এবং এমন আরো অনেক কিছু। আপনার মনে হয়তো সামান্য হলেও হতাশা জেঁকে বসেঃ “এসবের শেষ কবে? জালিমরা হাত থেকে পাশার দান কখন উল্টে যাবে?” এই দুটি আয়াহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে, তা আমাদেরকে বর্তমান প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে, আপনার মনে হতেই পারে আল্লাহ বুঝি এই দুটি আয়াত বিশেষভাবে আমাদের জন্য নাযিল করেছেন!

 

প্রথমত, আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন, তিনি তার শত্রুদেরকে দুনিয়ার বুকে রাজত্ব দেবেন এবং তাতে মু’মিনরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর মানে হল যখন আপনার জীবনে দুঃসময় আসে, সেটি কোন অপরিকল্পিত “হ য ব র ল” অবস্থা নয়। বরং আল্লাহ চান এর দ্বারা আপনাকে শানিত করে তুলতে ও আপনাকে বলিষ্ঠভাবে গড়ে তুলতে, এই কারণে তিনি আপনাকে ক্ষণিকের এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে চালনা করেন। তেমনি, মুসলিমদের উপর কাফিরদের আধিপত্য আমাদের সকলের অপছন্দ হলেও এটি মূলত মুসলিম উম্মাহকে শক্তিশালী করে তোলার একটি পন্থা যেন বিজয় লাভের পূর্বেই মুসলিমদের এই অভিজ্ঞতা লাভ হয় কী করে কঠিন সময় ও দুর্যোগ পাড়ি দিতে হয়।

 

দ্বিতীয়ত, আল্লাহ্ আমাদের আদেশ করছেন যাতে এই কুফফার সভ্যতার চাকচিক্য দেখে আমরা ধোঁকায় না পড়ি। আর এই ধোঁকা থেকে বাঁচতে যে বিষয়টি সব্সময়ের জন্য মাথায় গেঁথে রাখতে হবে তা হল, কুফফারদের এই রাজত্ব সাময়িক, আর তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য জাহান্নাম, যা চিরস্থায়ী। রাসূলাল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ দুনিয়ার বুকের সবচেয়ে ধনী আর বিলাসী ব্যক্তিটিকে জাহান্নামে একবার ডুব দিয়ে তুলে এনে জিজ্ঞাসা করবেন, “তুমি কি তোমার জীবনে কখনো কোনকিছু উপভোগ করেছিলে?” সেই ব্যক্তি উত্তর দেবে, “না”। কারণ জাহান্নামের সেই এক মুহূর্তের চুবানি এতটাই ভয়াবহ যে, নিমিষে সে তার দুনিয়ার জীবনের সমস্ত আরাম আয়েশের কথা ভুলে যাবে।

 

তেমনি কোন জালেম ব্যাক্তি, গোষ্ঠী বা জাতি যখন তাদের আধিপত্য আর প্রভাব-প্রতিপত্তি ঝলকানি দ্বারা বিশ্বের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় এবং একই সাথে কুফর ও জুলুম-নির্যাতনের ধারা অব্যাহত রাখে, তাদের পরিণতিও ঠিক একই রকম হবে, এই চিরন্তন পরিণতির সাক্ষী ইতিহাস। দুনিয়াবী কোন উৎকর্ষই এই পতন ঠেকাতে পারবে না। তাদের দুনিয়াবী পতন ছাড়াও এই আয়াতের আরো একটি উপকারী দিক হল, জাহান্নামের গন্তব্যের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ আমাদের এই সাময়িক দুনিয়াবি জীবনের তুলনায় আখিরাতের জীবনের ওপর অধিক জোর দিয়েছেন।

 

সবশেষে, আরো একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় আছে, যার কথা এই আয়াতে সরাসরি উল্লেখিত না হলেও আল-বুখারীর একটি হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “এটি আল্লাহর দায়িত্ব তিনি যদি কিছুকে উঁচুতে তুলে ধরেন তবে তিনি সেটিকে অবশ্যই নামিয়েও দেন”। অন্য কথায়, যার উত্থান আছে, তার পতনও আছে। আমরা এক্ষেত্রে একটা চমৎকার বই পড়ে দেখতে পারি, যেটি কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে যার নাম হল, ‘Why the West Rules – For Now: The Patterns of History and What They Reveal About the Future’। এই বইয়ে লেখক ইয়ান মরিস দুটো মৌলিক যুক্তির উপস্থাপনা করেছেন, প্রথমত, ইতিহাস জুড়ে যত সভ্যতা, তাদের উত্থান ও পতনের পেছনে যে কারণ সেগুলো কেউ কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, এবং ২০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে আধিপত্য বিস্তারকারী পশ্চিমা সভ্যতার পতন ও খুব দ্রুতই সংঘটিত হবে।

 

তিনি সেই ১২০০০ বছর আগের বরফ যুগের পর থেকে বর্ণনা শুরু করেন, যখন কৃষির ধারণা জন্ম লাভ করে আর বৃহৎ পরিসরে সুসংগঠিত সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি বর্ণনা করেন, কীভাবে প্রয়োজনীয় গাছপালা ও গৃহ্পালিত প্রাণীর প্রাচুর্যের কারণে দুটি আদি ভৌগলিক আবাস থেকে একের পর এক সভ্যতার জন্ম ও চতুর্মুখী সম্প্রসারণ হয়, এ দুটি এলাকা হল পশ্চিম ইউরেশিয়া এবং ইয়াংজি ও ইয়েলো রিভারের মধ্যবর্তী অঞ্চল যা বর্তমানে চীন নামে পরিচিত। মরিস উল্লেখ করেন, শুরুতে পশ্চিমারা প্রযুক্তিগত উন্নয়নে প্রাচ্যের তুলনায় প্রায় ২০০০ বছর এগিয়ে থাকলেও খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ এ এসে এই অগ্রযাত্রা স্তিমিত হয় এবং তারা সমানে-সমান হয় ওঠে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রাচ্য নেতৃত্বের আসনে অবতীর্ণ হয়, কেননা এই রোমান সাম্রাজ্যই তৎকালীন সময়ে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করত এবং তারাই ছিল সেই সভ্যতার সামাজিক উন্নয়নের চূড়া। এই অবস্থা বিরাজমান থাকে ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত, যখন ইউরোপ অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে এবং সুই রাজবংশের নেতৃত্বে চীন ঐক্যবদ্ধ হয় এবং পরবর্তী ১০০০ বছর পর্যন্ত তারা কর্তৃত্বের ছড়ি ধরে রাখে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রাচ্যের এই অগ্রগামিতা টিকে থাকে, কেননা সেই সময়ে এসে আবার পশ্চিমারা প্রাচ্যের সমকক্ষ রুপে আবির্ভূত হয়, এর কারণ হল ক্রমাগত যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিমারা তাদের সামরিক প্রযুক্তিক্ষেত্রে ব্যাপক পারদর্শীতা লাভ করে। ১৮ শতকের শেষে, শিল্প বিপ্লবের প্রারম্ভিক পর্যায়ে দুটি সভ্যতার শক্তিমত্তার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসে এবং তা পশ্চিমাদের দিকে হেলে যায়। ব্রিটিশ প্রকৌশলবিদগণ তাদের দেশে অবস্থিত বিপুল কয়লাখনির সুবাদে বাষ্পচালিত জাহাজ, ট্রেন এবং শিল্পকারখানায় প্রভূত উন্নতি সাধনে করে। এর মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জনে সক্ষম হয় এবং ব্রিটিশদের এই আধিপত্য পরবর্তী ১০০ বছর (বিংশ শতাব্দীর পুর্ব অবধি) টিকে থাকে, এবং তা আধুনিক যুগের আমেরিকান আধিপত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

 

মূল যে বিষয়টির উপর বইটি দৃষ্টিপাত করেছে তা হল, দশ হাজারেরও বেশি সময় ধরে, কী করে একের পর এক সভ্যতার জন্মই হয়েছে যেন ধ্বংস হবার জন্য! বিশ্বের অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির কারণে তাদের পতন ছিল অনিবার্য, এবং তাদের প্রত্যেকের রাজত্বকাল ছিল মানবজাতির ইতিহাসের একটি ছোট্ট পাতা মাত্র, সাময়িক ও সংক্ষিপ্ত।

 

লেখক এরপর উপসংহার টানতে বই এর নামের সাথে জুড়ে দেওয়া – ‘পশ্চিমারা এখন শাসন করছে, কিন্তু কতদিনের জন্যে?’ এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তার উত্তর ছিল এমন, যদি প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের উন্নতির ধারা এখন যেমনটা-আছে-তেমনটাই-থাকে, তবে আগামী শতাব্দীর শুরুতেই কবর রচিত হবে পশ্চিমা প্রতিপত্তির। আল্লাহু ‘আলাম।

 .

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশান ইউনিট – সেল নাম্বার ১০৮

 

 

কুরআন এবং আপনি (শেষ পর্ব ২৯)

 

কুরআনে সূরা নিসার ১নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন:

 

“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি তা থেকে (তার) জুড়ি পয়দা করেছেন; (এরপর) তিনি তাদের এই আদি জুড়ি থেকে বহু সংখ্যক নরনারী (দুনিয়ার চারদিকে) ছড়িয়ে দিয়েছেন…”

 

এই আয়াতে এমন এক চিরন্তন বাস্তবতার কথা আছে যা আপনাকে যেকোন মহৎ কর্ম সম্পাদনে অনুপ্রেরণা যোগাবে। ভেবে দেখুনঃ আল্লাহ তা’আলা সমগ্র মানবজাতিকে আহবান করে বলছেন, তিনি আমাদের সবাইকে কেবল একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে জন্ম দিয়েছেন। তাদের অন্তরঙ্গতা থেকে সন্তান জন্ম নিয়েছে, সেসব সন্তানদের আরো সন্তান-সন্ততি হয়েছে এবং এমনি করে ঈসা (আঃ) এর সময়ে পৃথিবীতে লোকসংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দু’শ মিলিয়ন! সতের শতকের মাঝেই বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ মিলিয়ন স্পর্শ করে আর ঊনিশ শতক নাগাদ এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে এক বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। বিশ শতকে তা আবারো বেড়ে দ্বিগুণ হয়, অর্থাৎ দুই বিলিয়ন। আর আজকে পুরো দুনিয়াতে প্রায় সাত বিলিয়ন লোকের বাস, অর্থাৎ জনসংখ্যা বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। ধারণা করা হয় আগামী শতক আসতে আসতেই পৃথিবীতে লোকসংখ্যা দশ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। এই যে শত কোটি মানুষ, আর তাদের মুখের হাজারো ভাষা, যারা বিভিন্ন জাতি, বর্ণ আর গোত্রে বিভক্ত হয়ে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ আর মহাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে – এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সূত্রপাত হয়েছে কেবল একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে, যারা দুনিয়ার বুকে এসেছিলেন আজ থেকে হাজার বছর পূর্বে।

 

এ ব্যাপারটি একটি গভীর চিন্তার খোরাক যোগায়, তা হচ্ছেঃ আপনার একটিমাত্র কাজ আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও এর ফলাফল হতে পারে অসামান্য! কোন এক অজানা দিনে করা আপনার একটি ছোট্ট কাজ, একের পর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে এক বিশাল পরিণতি সৃষ্টি করতে পারে, যা হয়তো আপনি কাজটি করার সময় সেদিন কল্পনাতেও ভাবেন নি। পানির ঢেউ যেমন একটি বিন্দু থেকে শুরু হয়ে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি আপনার একটি কাজও জন্ম দেবে অজস্র ঘটনার। ইংরেজিতে এর একটি নাম আছে, যাকে বলা হয় Domino Effect, তবে এর প্রকৃত নাম হওয়া উচিত জ্যামিতিক সংবৃদ্ধি (geometric progression)।

 

সমাজবিজ্ঞানীরা এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে মহামারীর উদাহারণের আশ্রয় নেন। ধরুন, ভারত থেকে এক পর্যটক বাংলাদেশে বেড়াতে আসার সময় তার শরীরে এমন এক সংক্রামক ভাইরাস বয়ে এনেছে, যার সংক্রমণের হার ১০%, অর্থাৎ তার সাথে দেখা হওয়া প্রতি দশ জন লোকের এক জন এ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হবে। বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে প্রতিদিন প্রায় ৫০ জন লোক তার সংস্পর্শে আসলো, অতএব তাদের মাঝে পাঁচ জনকে সে সংক্রমিত করলো। পরদিন, সেই পাঁচ ব্যক্তির প্রত্যেকে আরো নতুন পঞ্চাশ জনের সংস্পর্শে আসলো, এবং তাদের ১০% লোককে আক্রান্ত করলো। তাহলে, এখন আক্রান্ত ব্যক্তির পরিমাণ দাঁড়ালো নতুন ২৫ জন+প্রথম ৫ জন+পর্যটক নিজে অর্থাৎ মোট ৩১ জন। তৃতীয় দিনে এই ৩১ জন লোকের প্রতেকে আরো ৫০ জনের সান্নিধ্যে আসলো এবং তাদের ১০% কে আক্রান্ত করলো। সুতরাং তিন নম্বর দিনে নতুন আরো ১৫৫ জন জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে আর আক্রান্ত লোকের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১৮৬! হিসেব করলে দেখা যাবে চার নম্বর দিনে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে!

 

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এক ভারতীয় পর্যটকের শরীর থেকে হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী লোক সেই সংক্রামক ভাইরাসের বাহকে পরিণত হয়েছে চার দিনের মাথায়! তাহলে ভেবে দেখুন, এক সপ্তাহ, এক মাস বা এক বছর পরে এই সংখ্যাটি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে পেতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে! ভারত থেকে যখন মাত্র একজন পর্যটক এ ভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিল, তখন এই বিশাল সংখ্যাটা আমরা কি কল্পনায়ও আনতে পেরেছিলাম?

 

দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার মসনদে আকঁড়ে রাখার পর আমেরিকান ডলারে পালিত মুবারক সরকারের শক্তিশালী বলয় আজকে ভেঙে পড়েছে। তিউনিসিয়ার বেন আলীর শাসনের পতন ঘটেছে। লিবিয়াতে প্রকৃতপক্ষেই একটি সশস্ত্র বিপ্লবের সূচনা হয়েছে (যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে তারা বোকার মত পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ ও সাহায্য কামনা করে বসেছে)। আজ আলজেরিয়া, বাহরাইন, জর্দান, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং সৌদি আরবের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে, যা একসময় ছিল চিন্তারও অতীত। সমগ্র আরব জুড়ে এখন জালেম শাসকের বিরুদ্ধে দাউদাউ করে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে, যে শাসকরা যুগ যুগ ধরে জনগণের রক্ত চুষে খেয়েছে, তাদের উপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছে। এ ঘটনাগুলো ক্বিয়ামাতের পূর্বাভাস দেয়, এগুলো ঘটতে থাকবে এবং পৃথিবীর চেহারাকে পাল্টে দিতে থাকবে প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু এসবকিছুর শুরু কোথা থেকে?

 

এই আগুনের সূচনা হয়েছিল একটি মাত্র স্ফুলিঙ্গ থেকে, আপাতদৃষ্টিতে একক, অপ্রাসঙ্গিক ও তুচ্ছ একটি কাজ থেকে। হ্যাঁ, এ সবের শুরু হয়েছে ডিসেম্বরের এক দিনে, যেদিন হতাশায় জর্জরিত এক বেকার যুবক তিউনিসিয়ার রাস্তায় নিজের গায়ে গ্যাসোলিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। অবশ্যই ইসলামের দৃষ্টিতে এ কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তবে এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে তার এই একটি কাজের সুদূরপ্রসারী ফলাফল। তার ছোট্ট একটি কাজ ছোট ছোট প্রতিবাদের জন্ম দেয়, সেখান থেকে একটি বিশাল আন্দোলন বেগবান হয়, ফলস্বরূপ তিউনিসিয়া সরকারের পতন ঘটে, পতন ঘটে মিসর সরকারের। এই ঘটনা অন্যান্য বহু দেশের লক্ষাধিক লোককে জালিম-সরকার বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়তে উৎসাহ যোগায়, এমনকি এই আগুনের আঁচ আমেরিকাকেও স্পর্শ করে! (ম্যাডিসন, উইসকনসিনের ঘটনা এখানে উল্লেখ্য – যেখানে জনগণ রাজনৈতিক দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে)। নিশ্চয়ই মুহাম্মদ বুয়াজিজি যখন নিজের গায়ে গ্যাসোলিন ঢেলে দিচ্ছিল, সে মুহূর্তে কেউ ভাবতেও পারেনি এ ঘটনা শেষ পর্যন্ত পুরো মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রকে বদলে দেবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এ বিষয়টা নিয়ে চিন্তার অবকাশ দরকার।

 

আমেরিকায় কনকর্ড নামে এক এলাকা আছে, ম্যাসাচুসেটসে আমার বাসা থেকে গাড়ি করে কনকর্ড যেতে কয়েক মিনিট সময় লাগে। কনকর্ড হলো সেই শহর যেখানে ২০০ বছর আগে ব্রিটিশ দখলদারদের সাথে স্থানীয় আমেরিকানদের মোকাবিলা হয়, সেখান থেকে সূচিত হয় আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, আর সেখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্র নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এ সবকিছুর শুরু কোথা থেকে? এর সূচনা ১৭৭৫ সালের এপ্রিল মাসের কোন এক দিনে, যেদিন পল রেভার নামের এক আমেরিকান ব্রিটিশ সেনাদের সশস্ত্র অভিযানের পরিকল্পনা আগেভাগে টের পেয়ে যান (তখন আমেরিকা ছিল ব্রিটিশদের ঔপনিবেশ)। তিনি জানতে পারেন, ব্রিটিশ বাহিনী লেক্সিংটন শহরে জন হ্যাংকক ও স্যামুয়েল অ্যাডামকে গ্রেপ্তার করে কনকর্ডে অতর্কিত আক্রমণ করে স্থানীয় সৈন্যবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র জব্দ করার পরিকল্পনা এঁটেছে। সে রাতে রেভার খুব সাধারণ একটি কাজ করলেনঃ তিনি একটি ঘোড়া নিয়ে বের হলেন, শহরে শহরে গেলেন এবং স্থানীয় লোকদের কাছে আগাম সতর্কবার্তা পৌঁছে দিলেন যে, পরদিন সকালে ব্রিটিশ সৈন্যরা অভিযানের পরিকল্পনা করেছে। লেক্সিংটন যাবার পথে প্রত্যেক শহরে নেমে তিনি এই কাজটি করলেন। পরদিন সকালে ব্রিটিশরা সেখানে পৌঁছে আবিষ্কার করলো তাদের মোকাবিলার জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়া একদল মিলিশিয়া বাহিনী! লড়াই হল, ব্রিটিশরা কনকর্ডে পরাজিত হল, এবং সূচনা হল আমেরিকান মুক্তিযুদ্ধের, এই মিলিশিয়া মুক্তিবাহিনী পরবর্তীতে সারা দেশে ব্রিটিশ হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

 

 

উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলোর মধ্যকার মিলটি হলো, দুনিয়ার চেহারা বদলে-দেওয়া, জাতির ভাগ্যের চাকা-ঘুরিয়ে দেওয়া এই বিশাল ঘটনাগুলোর শুরুটা হয়েছিল এক ব্যক্তির ছোট্ট একটি কাজ থেকে! অথচ সে ব্যাক্তির হয়তো ধারণাই ছিল না তার সামান্য কাজটির পরিণতি একসময় কোথায় গিয়ে ঠেকবে! এই উদাহরণ গুলোর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এখানে তেমন জরুরি নয়। বরং এখান থেকে শেখার যে বিষয় আছে তা হল জ্যামিতিক সংবৃদ্ধির বিষয়টি, যা আপনি প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ করতে পারেন। পল রেভারের ছোট্ট একটি কাজ যেমনি করে আমেরিকান বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল, মুহাম্মদ বুয়াজিজির একটি কাজ যেভাবে আরব বসন্তের উত্থান ঘটিয়েছিল, এবং একজন পুরুষ ও নারীর সম্মিলন থেকে যেভাবে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের আগমন ঘটেছিল, তেমনি করে দু’দিন আগে অচেনা সেই পথচারীর সাথে আপনার আলাপচারিতা, বা আপনার কোন লেকচার, বন্ধুকে দেওয়া উপহারের বই, আপনার কোন সাদাক্বাহ, অথবা আপনার কোন কথা বা কাজের পরিণতি পরবর্তীতে অন্যদের জীবনে এমন সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে পারে যা আপনি সে সময় কল্পনাও করতে পারেন নি। সূরা ইবরাহীমের ২৪ এবং ২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কী উপমা টেনেছেন তা লক্ষ্য করে দেখুন:

 

 “…পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মত। তার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত। সে পালনকর্তার নির্দেশে অহরহ ফল দান করে…”

 

রাসূলুল্লাহ (সা) এর সীরাহ থেকে একটি ঘটনার অবতারণা করে আমি আমার লেখা শেষ করছি। মদীনায় হিজরতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে ইসলামের বীজ বপন করার উদ্দেশ্যে মুস’আব ইবন উমাইরকে সেখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মুস’আব (রা) সেখানে পৌঁছুলেন এবং আসাদ বিন যুরায়রাহ নামের স্থানীয় খাযরাজ গোত্রীয় এক ব্যক্তির আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন। তাদের দু’জনের প্রচেষ্টায় মদীনার বেশ কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করলো। একদিন এই দলটি জাফর গোত্রের কুয়ার পাশে বসে ছিল এবং তারা মদীনার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হল। এই ব্যক্তি ছিলেন উসাইদ ইবন হুদাইর। মুস’আব (রাঃ) তাঁকে তাঁদের মজলিসে বসে কথা শোনার আমন্ত্রণ জানালেন, এবং আলোচনার এক পর্যায়ে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করলেন। উসাইদ এবার আরেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে সাথে করে হাজির হলেন, তাঁর নাম সাদ ইবন মুয়ায। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করলেন, যিনি বছরখানেক পর বনী কুরায়যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যেয়ে শহীদ হয়েছিলেন। নবীজি সাদ ইবন মু’আয ছিলেন এমন একজন মুসলিম যার ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) বলেন তাঁর মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। সাদ ইবন মুয়ায এরপরে নিয়ে আসলেন সাদ ইবন উবাদাহ কে, আর তিনিও মুসলিম হয়ে গেলেন!

 

ফলে মদীনার লোকেরা একে অপরকে বলতে থাকলোঃ “যদি উসাইদ ইবন হুদাইর, সাদ ইবন মুয়ায আর সাদ ইবন উবাদাহ উনারা সকলে মুসলিম হয়ে যান, তবে তো আমাদেরও তাই করা উচিত!” আর-রাহীকুল মাখতুম বইটিতে এভাবেই বলা হয়েছেঃ

 

মুস’আব মদীনায় তাঁর দাওয়াহর কাজ অব্যাহত রাখলেন এবং সাফল্যের সাথে নিজের মিশন চালিয়ে যেতে থাকলেন, ফলে এক সময় এমন হলো যখন মদীনার আনসারদের প্রতিটি ঘরেই মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারীতে ভরে উঠল”। আর মুস’আবের মিশন দ্বারা মদীনায় এভাবেই জন্ম হল প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের। হিজরতের ভূমি, ইসলামের ভিত্তি যে মদীনা শহর, যেখান থেকে পুরো বিশ্বের কাছে ইসলামকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা তৈরি হয়েছিল কেবল একজন লোকের প্রচেষ্টা থেকে – মুস’আব ইবন উমাইর।

 

এটা জানা সত্যিই দুঃসাধ্য যে, আপনার সামর্থ্য ও প্রচেষ্টাগুলো কখন ঢেলে দিলে বা কার সাথে করলে তা কাজে লেগে যাবে। আপনি কখনোই জানবেন না আপনার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কাজের পরিণতিও কতো বিশাল হয়ে যেতে পারে! সবসময় মনে রাখবেন, ইতিহাস থেকেও আমরা এই শিক্ষাটিই পাই, আর তা হলো কেবল একজন মানুষই পারে দুনিয়া বদলে দিতে…

 .

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮

 

 

কখনও ঝরে যেও না …

 

মু’মিন ব্যক্তি হচ্ছে বৃক্ষের মতো; দমকা হাওয়ার সাথে সর্বদা যুদ্ধে লিপ্ত। এই প্রবল বাতাসের ঝাপটার মাঝে বেঁচে থাকতে হলে সে বৃক্ষটির কিছু গুণ থাকা চাই। যেমন, সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে হলে গাছটির বীজ অবশ্যই উর্বর মাটিতে বপন করতে হবে। কুর’আনে ঠিক এ কথাটাই বলা আছে:

 

” মুহাম্মদ আল্লাহর রসূল এবং তাঁর সহচরগণ … তাওরাতে এবং ইঞ্জিলে তাদের বর্ণনা এরূপ যেমন একটি চারা গাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও মজবুত হয় এবং কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, চাষীকে আনন্দে অভিভূত করে, যেন আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন…” [সূরা আল-ফাতহঃ ২৯]

 

 

তাওরাতের নিম্নোক্ত বিবরণটির কথা এখানে বলা হয়েছে:

 

‘কৃষক তার বীজ বুনতে বের হলো। বপনের সময় কিছু বীজ পথের পাশে পড়ল। সেগুলোর কিছু পায়ের নিচে পিষ্ট হয় আর কিছু পাখিরা খেয়ে ফেলে। কিছু বীজ পড়ল পাথুরে মাটিতে। আর্দ্রতার অভাবে সেগুলো বড় হতে হতেই শুকিয়ে গেলো কিছু বীজ কাঁটার মাঝে পড়ল। ঐ বীজ থেকে জন্ম নেওয়া গাছের সাথেসাথে কাঁটাগুলোও বেড়ে উঠতে থাকে। একসময় কাঁটাগুলোই গাছগুলোকে মেরে ফেলে। বাকি বীজগুলো পড়ল উর্বর মাটিতে। সেগুলো বেড়ে উঠল মাথা উঁচু করে। আর বেড়ে উঠে শতগুণ বেশী শস্য উৎপাদন করল।

 

… এর তুলনা হল এই: বীজগুলো হল সৃষ্টিকর্তার বাণী। কিছু মানুষ সেই বাণী শুনার পর শয়তানের প্ররোচনায় সেগুলো অন্তর থেকে মুছে ফেলে। ফলে এরা ঈমান আনে না। তাই পরিশেষে এরা রক্ষা পাবে না। এদের তুলনা হচ্ছে পথের পাশের সেই অবহেলিত জমি।

 

কিছু লোক শুনার সময় আগ্রহের সাথে শুনে কিন্ত এদের আগ্রহে গভীরতা নেই। এরা কিছু সময়ের জন্য বিশ্বাস করে কিন্তু প্রলোভন দেখালেই বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এই শ্রেণীর লোকের উদাহরণ হল সেই পাথুরে মাটি যা আর্দ্রতার অভাবে গাছগুলোকে বেড়ে উঠতে দিতে পারে না। কাঁটাযুক্ত জমি হচ্ছে তাদের উপমা যারা সৃষ্টিকর্তার বাণী শুনেছে কিন্তু পথ চলতে চলতে একসময় ভয় আর দুনিয়ার মোহে আটকে গিয়ে পূর্ণতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়।

 

কিন্তু কিছু লোক সৎ এবং শুদ্ধ হৃদয় নিয়ে সৃষ্টিকর্তার বাণী শুনে তা আঁকড়ে ধরেছিল এবং ধৈর্য্যের সাথে পরিশেষে ফল লাভ করেছিল। এদের উদাহরণ হচ্ছে সেই উর্বর মাটি যা বীজকে বুকে নিয়ে মহীরুহের জন্ম দেয়।’ (লুক ৮: ৫-১৫)

 

অর্থাৎ, হৃদয়কে এমন উর্বর মাটির সাথে তুলনা করা হয়েছে যেখানে বীজ বপন করা হয়। ইমাম ইবন আল-ক্বাইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) আল-ফাওয়াইদ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৭০) এভাবেই বলেছেন, ‘সবার হৃদয়ের স্বাভাবিক অবস্থাই হচ্ছে উর্বর, এতে যা বপন করা হয় তাই সহজে বেড়ে উঠে। যদি ঈমান এবং আল্লাহভীরুতা বা তাক্বওয়ার চারা এতে রোপণ করা হয়, তবে তা এমন সুমিষ্ট ফল দান করবে যা হবে চিরন্তন। আর যদি অজ্ঞতা এবং কামনা-বাসনার চারা রোপণ করা হয় তাহলে তার ফল হবে তিক্ত এবং কটু।’

 

তাই তুমি যখন তোমার অন্তরকে ঈমানের বীজের জন্য উর্বর করে তুলবে, তখন সেই গাছটি সুন্দর ভাবে বেড়ে উঠবে এবং মিষ্টি ফল ধারণ করবে। হৃদয়কে উর্বর করার উপায়গুলো সামনে আলোচনা করা হবে।

 

যখন তোমার হৃদয়ে ঈমানের সুদৃঢ় বৃক্ষ গড়ে উঠবে, তখন একটা দমকা হাওয়া তোমার দিকে ধেয়ে আসবে। কারণ উপরে বর্ণিত আয়াত অনুযায়ী, আল্লাহ বলছেন শক্ত গাছটি ‘কাফেরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করে’। একজন দৃঢ় মুসলিম এর মতো আর কোনো কিছুই এই বাতাসকে এতটা ক্ষেপিয়ে তোলে না। আর এটাই চিরন্তন বাস্তবতা। যখন ফেরআউন মুসা (আলাইহিস সালাম) এবং তাঁর অনুসারীদের পিছনে মিশরের মরুভুমিতে ধাওয়া করছিল তখন সে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করে:

 

“নিশ্চয়ই এরা (বনী-ইসরাঈলরা) ক্ষুদ্র একটি দল। এবং তারা আমাদের ক্রোধের উদ্রেক করেছে। ” [সূরা শুআরাঃ ৫৪-৫৫]

 

এই দমকা হাওয়া তোমাকে সমূলে উচ্ছেদ করে ফেলে দিতে চাইবে। তুমি হয়ত চারিদিকে তাকিয়ে অন্য কিছু গাছকে সহজেই পড়ে যেতে দেখবে। কেউ হয়তো বাতাসের ধাক্কায় সমূলে উৎপাটিত হয়ে যাবে। এরা হল মুনাফিক্বেরা। এদের দুর্বল মূল সহজেই প্রকাশ হয়ে পড়ে:

 

“এবং নোংরা বাক্যের উদাহরণ হলো নোংরা বৃক্ষ। একে মাটির উপর থেকে উপড়ে নেয়া হয়েছে। এর কোনো স্থিতি নেই। ” [সূরা ইব্রাহিমঃ ২৬]

 

রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশেষভাবে মুনাফিক্বকে এমন গাছের সাথে তুলনা করেছেন যেটা বাতাসের সাথে সাথে নড়ে এবং কখনো বা পড়ে যায়। (দেখুন আল-লু’লু’ ওয়াল মারজান, হাদিস#১৭৯১)। সুতরাং তারা দলে দলে বাতাসের ধাক্কায় পড়ে যাক, তুমি তাদের মতো হয়ো না। বরং, তুমি তাদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন কর। আল্লাহকে ধন্যবাদ দাও যে তিনি তোমাকে তাদের পরিণতি থেকে রক্ষা করেছেন এবং তারপর এগিয়ে যাও। তাদের জন্য ইসলাম ছিল একটা শখ মাত্র, এ সপ্তাহের আকর্ষণ!

 

যখন বাতাস বুঝতে পারবে যে তোমাকে এভাবে মাটি থেকে সরাসরি তুলে ফেলা সম্ভব নয়, তখন সে আরো সূক্ষ্ণ পন্থা অবলম্বন করবে: সে চেষ্টা করবে তোমার পাতাগুলো কৌশলে ঝরিয়ে দিতে। কিন্তু সে তোমাকে সবগুলো পাতা একসাথে ঝরাতে বলবে না। কারণ সেটা তো তার দুরভিসন্ধি প্রকাশ করে দেবে। বরং তখন সেই বাতাস মৃদুভাবে বইবে যাতে করে তোমার একটা পাতা ঝরাতে পারে, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা – যতক্ষণ না তুমি পাতাহীন বৃক্ষে পরিণত হও। উস্তাদ সাইয়্যিদ কুতুব এটা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:

 

… কোনো আদর্শের পক্ষে অবস্থান নেওয়া গোষ্ঠীর প্রতি শাসকবর্গের আচরণ এমন হয় যে, তারা সবসময় কূটকৌশলের মাধ্যমে সেই আদর্শিক গোষ্ঠীকে তাদের দৃঢ় অবস্থান থেকে শুধু সামান্য বিচ্যুত করতে চায়। তারা এর মাধ্যমে একটা সমঝোতামূলক সমাধানে আসতে চায়। কিছু জাগতিক পুরস্কারের বিনিময়ে তারা তাদেরকে বোকা বানাতে চেষ্টা করে। এমন অনেকেই রয়েছে যারা ভাবে যে তারা তাদের আদর্শের জন্য লড়ছে কিন্তু বস্তুত তাদেরকে সমঝোতা আর আপসের ছদ্মবেশে তাদের আদর্শ থেকেই বিচ্যুত করে দেয়া হয়েছে। কারণ তারা আদর্শকে জলাঞ্জলি দেওয়া এই সমঝোতাগুলোকে বড় করে দেখে না। তাই বিরোধীপক্ষও তাদেরকে প্রকাশ্যভাবে আদর্শ ত্যাগ করতে বলে না। বরং এদিকে সেদিকে হালকা পরিবর্তন করতে অনুরোধ করে যাতে উভয়পক্ষ মাঝখানে মিলিত হতে পারে।

 

যে মানুষটি আদর্শের পক্ষে লড়ছে শয়তান তাঁকে ধোঁকা দিতে বলে, কর্তৃপক্ষের সাথে সামান্য সমঝোতার মাধ্যমে তো তুমি তোমার আদর্শকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু পথের শুরুতে যে বিচ্যুতি খুব সামান্য হয়, পথের শেষে তা-ই বিশাল হয়ে দেখা দেয়। আদর্শের পতাকাবাহীরা আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ে আপস করতে রাজি হওয়ার পর আসলে সেখানেই থেমে যেতে পারে না। কারণ এরপর যখনই এক পা পিছিয়ে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হবে তখনি সেটা ঠেকাতে তার সমঝোতায় আসার ইচ্ছা আরো বৃদ্ধি পাবে। তাই কর্তৃপক্ষ এই আদর্শবাদীদেরকে অতি সন্তর্পণে এবং ক্রমান্বয়ে তাদের আদর্শ থেকে টলাতে থাকে…’

 

তাই এই ফাঁদে পা দিবে না। বাতাসের মুখে একটা পাতাকেও ঝরতে দেবে না। যেভাবে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুনাফিক্বকে বাতাসের সাথে নুয়ে পড়া গাছের তুলনা দিয়েছেন তেমনি ভাবে মু’মিনকে খেজুর গাছের সাথে তুলনা করেছেন। কারণ খেজুর গাছের পাতা কখনো ঝরে না। (দেখুন আল-লু’লু’ ওয়াল মারজান, হাদিস#১৭৯২) বাতাস যতই তীব্র হোক না কেন তার সামনে মুসলিম শুধু দাঁড়িয়েই থাকে না, বরং সব পাতা মেলে মাথা উঁচু করে থাকে। বাতাস যত তীব্র হবে তোমার পাতাগুলোকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরবে। আর এ জন্যই তো তোমার বিরুদ্ধে বাতাসের এত ক্ষোভ !

 

 তারা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল শুধু এ কারণে যে, তারা প্রশংসিত, পরাক্রান্ত আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল” [সূরা বুরুজঃ ৮]

 

কিন্তু এই বাতাস তার ক্ষোভের পেছনে ভিন্ন কারণ দাঁড় করিয়ে এই বাস্তবতাকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। সে দাবী করবে এই রাগ আসলে তোমার বিরুদ্ধে নয়। এই রাগ তো কেবল উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ কিংবা অন্য কোনোকিছুর বিরুদ্ধে। কিন্তু সত্য কথাটা হচ্ছে যাদেরকে সে সমূলে তুলে ফেলতে পারে না, যাদেরকে তাদের আদর্শ থেকে এক বিন্দুও টলানো যায় না ঐসব মুসলিমদেরকে সে ভারি অপছন্দ করে। আর যখন গাছটা একটা পাতাও ত্যাগ করতে অস্বীকার করে তখন সেই বাতাস আরো রেগে যায়। আর যখন এই বাতাস রাগতে থাকবে, তখন আল্লাহ্‌ তোমাকে পুরস্কৃত করবেন:

 

“…এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফেরদের মনে ক্রোধের কারণ হয় আর শত্রুদের পক্ষ থেকে তারা যা কিছু প্রাপ্ত হয়- তার প্রত্যেকটির পরিবর্তে তাদের জন্য লিখিত হয় নেক আমল। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সৎকর্মশীল লোকদের হক নষ্ট করেন না।” [সূরা আত-তওবাহঃ১২০]

 

 

তাই যখন প্রবল আক্রোশে বাতাস বইবে তখন ভয় পেও না। বরং তার চোখে চোখ রাখো আর:

“…বল, তোমরা আক্রোশে মরতে থাক।” [সূরা আলে ইমরানঃ ১১৯]

 

ঐ পাতাগুলো হচ্ছে আল্লাহ্‌র তরফ থেকে তোমার প্রতি আমানত। আল্লাহ্‌ তোমাকে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে দিয়েছেন। যদি তুমি তার খিয়ানত কর তবে তোমাকে এমন মানুষ দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়া হবে যারা তাদের আমানত রক্ষা করবে।

 

‘হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় দীন থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ-তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন।…’ [সূরা আল-মা’ইদাহ: ৫৪]

 

এই আয়াতটি খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে গাছ এবং পাতাগুলোর বর্ণনা দেয়। এটাকে বীজ এবং পাতায় বিশ্লেষণ করা যাক।

 

সম্পূর্ণ গাছটি হচ্ছে দ্বীন।

 

তোমার অন্তরে আল্লাহর জন্য ভালোবাসার বীজ থেকে এই গাছটি অংকুরিত হবে। আত-তুহফাহ আল ইরাক্বিয়াহ নামে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহর (রাহিমাহুল্লাহ)একটি সুন্দর প্রবন্ধ রয়েছে। মাজমু আল ফাতওয়ার দশম খন্ডের শুরুতে এটি পাওয়া যাবে। সেখানে তিনি এই আয়াতে উল্লেখিত ভালবাসার কথা ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে,

 

‘আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রসূলের জন্য ভালোবাসা হচ্ছে ঈমানের সর্বোচ্চ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি এবং ঈমানের সর্বোচ্চ মূলনীতি। কার্যত এটিই দ্বীনের সকল আমলের মূল ভিত্তি… মুসা এবং ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) এর বর্ণিত ভাষ্য অনুযায়ী, আমাদের পূর্ববর্তী দুটি জাতি, ইহুদি এবং খৃস্টানদের প্রতি রেখে যাওয়া সর্বোত্তম উপদেশ হচ্ছে হৃদয়, মন এবং সদিচ্ছা দ্বারা সর্বান্তকরণে আল্লাহকে ভালোবাসা। এটাই ইব্রাহীমের (আলাইহিস সালাম) দ্বীনের আক্বীদার সারকথা যা তাওরাত, ইঞ্জীল এবং ক্বুরআনের আইনের নির্যাস।’

 

আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসাই হচ্ছে সেই বীজ যা থেকে প্রতিটি কাজ এবং বিশ্বাস – প্রতিটি পাতা এবং ফল- অঙ্কুরিত হয় আর এজন্যই এই ভালোবাসাটাই এ আয়াতে সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়েছে।

 

তারপর আমরা লাভ করব সেই বীজের প্রথম ফল, ওয়ালা’ এবং বারা‘ : ‘মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে’। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ এ বিষয়ে বর্ণনা করেন,

 

‘মানুষ যাকে ভালবাসে তার ভালবাসার মানুষকেও ভালবাসে, সে যা ঘৃণা করে তাও ঘৃণা করে, তার সহযোগীদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, তার শত্রুদের প্রতি শত্রুভাব পোষণ করে… তাই এই বিষয়ে তারা উভয়েই এক’

 

সহজ ভাষায় বললে, বাতাসের প্রথম কাজ হচ্ছে তোমার এই পাতাটি ঝরিয়ে দেওয়া যাতে করে তোমার মনে শত্রু আর বন্ধুর মাঝে বিভাজন রেখাটা অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। একবার যখন তুমি তোমার শত্রুকে বন্ধু ভাববে, তোমার শত্রুর কাজ তখনি সম্পন্ন হয়ে যাবে। তাই কখনো এই পাতাটি ঝরে যেতে দিবে না। কখনো না!

 

এর পরের পাতাটি হচ্ছে জিহাদ: ‘…তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে…’ স্পষ্টতই এই পাতাটিকে বাতাস অন্যগুলোর চেয়ে বেশী ঘৃণা করে। কেন তা বোঝার জন্য এইডস এর কথা ভাবো। এটা শরীরকে মেরে ফেলার জন্য কি করে? এইডস কিন্তু সরাসরি শরীরকে আক্রমণ করে না বরং এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অর্থাৎ শরীরের ‘প্রতিরক্ষা বাহিনী’কে আক্রমণ করে যাতে করে অন্যান্য রোগ জীবাণু কোনোরকম বাধা ছাড়াই আক্রমণ করতে পারে। এই শরীরটা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর মতো। জিহাদ হচ্ছে এর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে সে আক্রমণকারীদের থেকে নিজেকে রক্ষা করে। আর সেই বাতাস/সরকার হচ্ছে এইডসের মতো যা প্রতিরোধের এই স্পৃহাটাকে মেরে ফেলার জন্য কাজ করে যাতে করে মুসলিম উম্মাহকে আক্রমণ এবং দখল করে নেওয়া সহজ হয়ে যায়। এই কারণেই সাইয়্যিদ কুতুব, আব্দুল্লাহ আযযাম, আয-যারক্বাওয়ী, শাইখ ওসামা (রহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখদের মতো লোকদেরকে আজ দানব রূপে চিত্রিত করা হয়। কারণ এরা প্রতিরোধের সেই চেতনাকে ধারণ করেন। আর তাই তোমার এই পাতাটি ঝরিয়ে দিতেই বাতাস সবচে জোরে বইবে। এই ফাঁদে পা দিও না। মনে রেখো: এইডস!

 

পরিশেষে সুদৃঢ় বৃক্ষ সেটাই যা ‘কোনো নিন্দাকারীর নিন্দায় ভীত হবে না।’ বস্তুত বৃক্ষটি তিরস্কার বা নিন্দায় প্রভাবিত হবে। কিন্তু সেভাবে নয়, যেমনটি আশা করা হয়েছিল! সেটা কেমন হবে ? যখন বাতাস তোমার পাতাগুলো ঝরিয়ে দিতে চায়- যখন ‘ওয়ালা এবং বারা’ আর জিহাদের ধারণাকে আঁকড়ে ধরে রাখার কারণে সে তোমাকে আক্রমণ আর তিরস্কার করে তখন ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহর (রহিমাহুল্লাহ) ভাষায় তোমার প্রতিক্রিয়া হবে এমন: ‘যার হৃদয় আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সে অন্য কারো সমালোচনা বা তিরস্কারে দমে যায় না বরং এগুলো তাকে আরো শক্তভাবে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরতে প্রেরণা যোগায়…’

 

সবশেষে এই আয়াত আমাদেরকে সেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দেয় যে কুর’আনের এই শিক্ষাগুলোর প্রতি সৎ থাকতে পারা হলো, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ-তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন’। বাতাসের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারাটা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ্‌র একটা অনুগ্রহ। একটা গাছকে সোজা হয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে বা ধুলায় মিশিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী:

 

‘তোমরা যে বীজ বপন কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তাকে উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্নকারী ?আমি ইচ্ছা করলে তাকে খড়কুটা করে দিতে পারি, অতঃপর হয়ে যাবে তোমরা বিস্ময়াবিষ্ট।’ [সূরা ওয়াক্বিয়াহঃ ৬৩-৬৫]

 

শেষ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে শেষ জমানায় কারো বদলে যাওয়াটা খুব সহজ হয়ে পড়বে। মানুষ চাপে পড়ে এবং নিজেদের দুর্বলতার কারণে খুব দ্রুত সত্যকে ত্যাগ করবে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

 

‘পুনরুত্থান দিবসের আগে, রাতের অন্ধকারের মতো ফিতনা আসবে যার মাঝে একজন মানুষ মু’মিন হয়ে ঘুম থেকে উঠবে আর কাফির হয়ে ঘুমাতে যাবে, আবার মু’মিন হয়ে ঘুমাতে যাবে আর কাফির হিসাবে জেগে উঠবে।’

 

এই ধরনের ঘটনাগুলো হচ্ছে কিছু অজানা বা গায়েবী ঘটনার ফল যা আমরা মানুষেরা হয়তো ঠিক উপলব্ধি করতে পারব না। তবে, ক্বুরআন এবং সুন্নাহ তে এমন কিছু ব্যবহারিক উপায় বলে দেয়া আছে যার সাহায্যে আমরা মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঠিক পক্ষে থাকতে পারি। এখানে আমরা শুধু দুটি উপায় আলোচনা করব এবং দুটিই একটি মজবুত বৃক্ষের দৃঢ়তার সর্বপ্রথম শর্তটির উপর আলোকপাত করে: উর্বর জমি- একটি সুস্থ হৃদয়।

 

* রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় যখন কঠিনতম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর প্রতি নাযিলকৃত সূরাসমূহের মূল বিষয় ছিল পূর্ববর্তী নবীদের কাহিনী। ইসলামের জন্য কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন যে তিনিই প্রথম নন, বরং যুগে যুগে এমন আরো অনেকেই ছিলেন, এটা বোঝানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। একই সাথে আগের নবীরা কীভাবে এসব পরীক্ষার মোকাবিলা করেছিলেন সে শিক্ষাও তাঁকে এর মাধ্যমে দেয়া হচ্ছিল। মক্কার বিপদের ঘনঘটায় আচ্ছন্ন দিনগুলোতে এই ইতিহাসের গল্পগুলো রসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবীদের মনোবল দৃঢ় করতে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। এই কথাটিই নিমোক্ত আয়াতে প্রতিফলিত হয়,

 

‘আর আমি রসূলগণের সব বৃত্তান্তই তোমাকে বলছি, যদ্দারা তোমার অন্তরকে মজবুত করছি। আর এভাবে তোমার নিকট মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসীহত ও স্মরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে। ‘ [সূরা হুদঃ১২০]

 

একই ভাবে প্রথম দিককার মুসলিমদের সেইসব কঠোর পরীক্ষার দিনগুলোর পাশাপাশি ইতিহাস, বিশেষভাবে সেই সকল মুসলিমদের ইতিহাস অধ্যয়ন করাটা উপকারী হতে পারে যারা তাদের সময়ে কোনো না কোনো প্রকারের সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অনেক সময় কোনো একটা পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় বুঝে উঠতে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ফিক্বহের বই ঘাঁটি যেখানে শুধুমাত্র সৎকর্মশীলদের জীবনী পড়েই তাদের ব্যক্তিত্বকে আত্মস্থ করার মাধ্যমে আমাদের করণীয় সম্বন্ধে আরো ভাল দিকনির্দেশনা পেতে পারি। ‘সাফাহাত মিন সবর আল উলামা ‘(আলেমদের সবরের পাতা থেকে) নামক অসাধারণ বইটিতে লেখক বলেন:

 

‘নিজের মধ্যে সৎগুণের বিকাশ ঘটাতে এবং মহৎ উদ্দেশ্যে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা তৈরী করার একটি ভাল উপায় হচ্ছে সেই সকল আলেমদের জীবনী পড়া যারা তাঁদের অর্জিত ইলমের উপর আ’মল করেছেন। মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য অধ্যবসায়ের সাথে ত্যাগ স্বীকার করে যাওয়া আলেমদের পদাঙ্ক অনুসরণের ক্ষেত্রে তাদের জীবনী পড়াটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বলা হয়ে থাকে এই কাহিনীগুলো হচ্ছে আল্লাহ্‌র সেই সকল সৈন্য যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাঁর প্রিয়পাত্রদের অন্তরকে সুস্থির রাখেন। ইমাম আবু হানিফা(রহিমাহুল্লাহ) বলেন,”আলেমদের জীবনী এবং তাঁদের গুণাবলী অধ্যয়ন আমার কাছে ইলমের চেয়ে বেশী প্রিয় কারণ এগুলো তাঁদের চরিত্র বর্ণনা করে।” ‘

 

তাই সৎকর্মশীলদের জীবনী অধ্যয়ন, তাঁদের ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্রকে আপন করে নেয়া অন্তরকে শক্তিশালী এবং জীবন্ত করার একটি ভাল উপায়। এটি ঈমান এবং ইলমের বীজ বপনের জন্য অন্তরকে উর্বর করে তোলে। তাহলে কোথা থেকে শুরু করা উচিত ? শায়খ ইবনে আল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ), সাইদ আল খাতির গ্রন্থের ৬০ পৃষ্ঠায় বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর সাহাবীদের জীবনী থেকেই সবচেয়ে বেশি উপকারী জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।

 

* অন্তরকে দৃঢ় করার দ্বিতীয় উপায়টি আরো সহজ: শুধু তোমার রব্ব এর কাছে চাও! উম্মে সালামাহ (রাদি’আল্লাহু আনহা) কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন দুআটি সবচেয়ে বেশী করতেন। উত্তরে তিনি বলেন:

 

‘ওনার সবচেয়ে বেশী করা দুআটি ছিল: ও অন্তর সমূহের নিয়ন্ত্রণকারী, আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির করে দাও। (ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুব, সাব্বিত ক্বলবি ‘আলা দ্বীনিক)’

 

এই দুআটি সারাদিন সবসময় অভ্যাস করা উচিত। কাজে যাওয়ার সময় কিংবা স্কুলের বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময় যখনি সুযোগ পাওয়া যায় তখনি এই সহজ দুআটি পুনরাবৃত্তি করার অভ্যাস করা উচিত। গুপ্তধনের মতো এই দুআটিকে আঁকড়ে রাখা উচিত এবং সর্বদা এটিকে ঠোঁটের ডগায় রেখে অন্তরকে ইসলামের সাথে সংযুক্ত করে রাখা উচিত। এটা খুবই সহজ হওয়া সত্ত্বেও এটা যাদের খুব প্রয়োজন তাদের অনেকেই এটিকে অবহেলা করে।

 

তাই হৃদয়কে স্থির এবং সুস্থ রাখার মাধ্যমে, অন্তরের জমিকে উর্বর রাখার মাধ্যমে তোমার শিকড়কে সুদৃঢ় করো। আর মজবুত শিকড়বিশিষ্ট গাছগুলোর শাখা-প্রশাখাই একদিন আকাশ ছোঁয়:

 

“পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মতো। তার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত।” [সূরা ইব্রাহিমঃ ২৪]

 

আর যখন তোমার শাখা-প্রশাখা আকাশ ছোঁবে, তখন কেউ তোমার পাতা পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারবে না। তারা তোমাকে বন্দী করতে পারে, তোমাকে হত্যা করতে পারে কিন্তু তারা কখনো এ কথা বলতে পারবে না যে তারা তোমার পাতা ঝরাতে পেরেছিল…

 .

তারেক মেহান্না
বুধবার, ৪ সফর ১৪৩৩/ ২৮ ডিসেম্বর,২০১১
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট- সেল#১০৭

.

 

https://mubasshireen.wordpress.com

https://raindrops.media

------------------

 

কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনার ১০ পদ্ধতি

মহান রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে বহু নিয়ামত দান করেছেন। কিন্তু আল্লাহর দেওয়া এই বিপুল নিয়ামতরাজির মধ্যে এমন কোনো নিয়ামত নেই, যা কুরআনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। কুরআনের মতো মূল্যবান আর কোনো নিয়ামত নেই, হতেও পারে না। কেননা এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহর নিজের কথামালা, কুরআনের মাধ্যমে আপনি সরাসরি আপনার মালিকের সাথে কথা বলার বিশাল সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন! সুব’হানাল্লাহ!

এই কুরআন হচ্ছে আপনাকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবার পথ। এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উপায়। কুরআনই আপনাকে দেখিয়ে দেবে জান্নাতের অমরত্ব লাভের সুনিশ্চিত রাস্তা। কুরআনই হচ্ছে সুকূন আর এর মাধ্যমেই আসে সফলতা।

অতএব কুরআনকে বুঝার, একে অনুধাবন করার, এর মর্মকে নিজের মধ্যে ধারণ করার বিন্দুমাত্র বিকল্প নেই। একজন মুসলিম কুরআনকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। তার চলার পথে যত ধরনের দিকনির্দেশনা দরকার, তার প্রতিটির উৎসমূল হচ্ছে এই মহাগ্রন্থ। তাই কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা, কুরআন নিয়ে যথাযথ পদ্ধতিতে গবেষণা করা সব স্তরের মুসলিমের জন্যই অত্যন্ত জরুরি।

কুরআন অনুধাবন

কুরআন থাকা উচিত ছিল আমাদের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে। কুরআনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবার কথা ছিল আমাদের সকল চিন্তা, কথা, কাজকর্ম। কিন্তু আমাদের আলস্য আর অবহেলার কারণে আমরা আজ এটা থেকে অনেক দূরে। এ জন্যই আমাদের অন্তরের ইসলাহ হয় না, আমাদের কাজগুলোও সংশোধিত ও বরকতপূর্ণ হয় না। কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা তথা কুরআন নিয়ে তাদাব্বুরের মহাগুরুত্ব উপলব্ধি করতে চাইলে ইবনে হুবায়রা রাহিমাহুল্লাহর এই একটি কথাই যথেষ্ট –

“শয়তানের একটি বড় যন্ত্রণা হলো, কুরআন নিয়ে মানুষের তাদাব্বুর-চিন্তা ফিকির করা। কারণ, শয়তান জানে কুরআন নিয়ে চিন্তা-ফিকির করলেই হিদায়াত লাভ হয়।”

অতএব হিদায়াতের রাজপথে হেঁটে জান্নাতের সবুজে প্রবেশ করতে চাইলে কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই। এটা ছাড়া আপনার আমলের মধ্যে প্রাণ আসবে না, আপনার ঈমান জীবন্ত হয়ে উঠবে না। কুরআনের তাদাব্বুর ছাড়া কুরআনের ফুল দিয়ে আপনি আপনার জীবন সাজাতে পারবেন না। তাই কুরআন থাকতে হবে আমাদের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে। কুরআন তিলাওয়াতের সময় আমাদেরকে আয়াতের বক্তব্য নিয়ে ভাবতে হবে, ভাবতে হবে তার প্রকাশভঙ্গী নিয়ে, খেয়াল রাখতে হবে এর শব্দ ও অর্থের দিকে, জেনে নিতে হবে কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছিল এই আয়াত। এভাবেই কুরআন নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা পরিপূর্ণতা পাবে।

কুরআন তাদাব্বুরের ১০টি পদ্ধতি

কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা বা তাদাব্বুর করার অসংখ্য পদ্ধতি রয়েছে। এ বিষয়ে উলামায়ে কেরাম আলোচনাও করেছেন। এখানে আমরা তাঁদের আলোচনা থেকেই ১০টি পদ্ধতির কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

১। কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি: কুরআন নিয়ে চিন্তা করার, এর অন্তর্নিহিত রহস্য ও ভাব অনুধাবন করার এক নাম্বার পদ্ধতিই হচ্ছে কুরআনের সাথে সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলা। আমরা আমাদের একান্ত বিষয়-আশয় তাকেই বলে থাকি যে আমাদের খুব কাছের। আমাদের মনের কথাগুলো আমরা সেই বন্ধুকেই বলে থাকি যার সাথে আমাদের সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর। কুরআনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন। কুরআনের সাথে আপনার সম্পর্ক যতো গভীর হবে, আপনি ততো তার ভেতরের কথাগুলো জানতে পারবেন, বুঝতে পারবেন। কুরআন যতো বেশি আপনি তিলাওয়াত করবেন, যতো বেশি সময় আপনি কুরআনের সাথে কাটাবেন ততো বেশি আপনি কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করার, এর গভীরতা থেকে মণিমুক্তা তুলে আনার কাজে পারঙ্গম হয়ে উঠবেন। কুরআনের সাথে আপনার সম্পর্কের গভীরতা অনুযায়ী কুরআন তার রহস্য আপনার কাছে উন্মোচিত করবে। সম্পর্ক যত গভীর হবে, কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনাও ততোই গভীরে গিয়ে পৌঁছুবে।

২। ধীরেসুস্থে ও বুঝেশুনে কুরআন তিলাওয়াতের চেষ্টা করা: কুরআন তিলাওয়াতে তাড়াহুড়া এমনিতেই পরিত্যাজ্য। তার উপর যদি আপনি তাদাব্বুরের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনাকে দ্রুত তিলাওয়াতের চিন্তা পরিহার করতে হবে। একবার ভেবে দেখুন তো, কেউ যদি খুব দ্রুত কোনো কথা বলে যায় তবে কি আপনি তার কথার মর্ম ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারবেন? পারবেন না। সে খুব হৃদয়গ্রাহী কথা বলতে পারে, কিন্তু তার দ্রুততা কথার আবেদনকে আপনার পর্যন্ত পৌঁছুতে দেবে না। কুরআনের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটবে যদি আপনি স্রেফ দ্রুততার সাথে আয়াতগুলো আওড়ে যান। কিন্তু যদি আপনি কুরআন নিয়ে ভাবতে চান, কুরআনকে আপনার হৃদয় স্পর্শ করতে দিতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে ধীরেসুস্থে ও বুঝেশুনে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য চেষ্টা করতে হবে। শেষ করার প্রতি মনোযোগ না দিয়ে এর মর্ম অনুধাবনের চেষ্টায় রত থাকতে হবে।

৩। তিলাওয়াতের সময় অন্তরকে হাজির রাখা: একে আমরা বলতে পারি শুধু শরীরের কান দিয়ে না শুনে মনের কান দিয়ে শোনা। আপনাকে অবশ্যই অন্তর দিয়ে কুরআনকে শুনতে হবে, পড়তে হবে। আপনি যখন তিলাওয়াত করছেন তখন আপনার যবান তো কুরআনের আয়াত উচ্চারণ করে যাচ্ছে, কিন্তু আপনার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। এমন অবস্থায় কখনোই কুরআন নিয়ে চিন্তা করতে আপনি সক্ষম হবেন না। আপনাকে অবশ্য অবশ্যই আপনার অন্তরকেও কুরআন তিলাওয়াতকালে সমানভাবে হাজির রাখতে হবে। আপনাকে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে যাতে তিনি আপনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং তাঁর কালামকে আপনার অন্তরে বদ্ধমূল করে দেন।

৪। তিলাওয়াতের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রাখা: কুরআন তিলাওয়াতের সময় অবশ্যই আপনাকে মাথায় রাখতে হবে কেন আপনি এই কিতাব তিলাওয়াত করছেন। ড. খালিদ বিন আব্দিল কারীম মুহাম্মাদ হাফিযাহুল্লাহর মতে, কুরআন তিলাওয়াতের সময় ৫টি উদ্দেশ্য আপনার সামনে থাকা চাই। এগুলো হলো, ইলম অর্জন, কুরআন অনুযায়ী আমল, রবের সাথে কথোপকথন, সাওয়াব লাভ ও রোগ থেকে শিফা লাভ। এগুলো সামনে রেখে কুরআন তিলাওয়াত করলে নিশ্চয়ই তা আপনার জন্য কল্যাণকর চিন্তার দুয়ার খুলে দেবে, যা আপনাকে সাহায্য করবে কুরআনের গভীরে পৌঁছাতে এবং কুরআন থেকে উপকৃত হতে। তাছাড়া লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বিহীন কোনো কাজই সফলতা লাভ করতে পারে না। কুরআনের ক্ষেত্রে তো বিষয়টি আরো বেশি সত্য।

৫। নামাযে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া: নামাযের মধ্যে আমরা কুরআন তিলাওয়াত করেই থাকি। কিন্তু তবুও নামাযে আলাদাভাবে এর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত হবে। নামাযে বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা কুরআন নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনার দ্বারকে উন্মুক্ত করবে ইনশাআল্লাহ। বিশেষ করে তাহাজ্জুদের নামাযে এই বিষয়টির দিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। কারণ তখন সময়টা থাকে নির্ঝঞ্ঝাট, নীরব, সুনসান। কুরআন নিয়ে ভাবার, কুরআনের অতলে ডুব দেবার জন্য এই সময়টিই সবচেয়ে উপযুক্ত। আর এই সময়ে নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত তাদাব্বুরের জন্য সেরা একটি পদ্ধতি।

৬। একটি আয়াত বারবার পড়া: কুরআন তাদাব্বুরের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, একটি আয়াত একাধিকবার পড়া। বারবার পড়ে পড়ে আয়াতটি মনের মধ্যে গেঁথে ফেলা এবং এর মর্ম অনুধাবনের চেষ্টা করা। কুরআন নিয়ে চিন্তা করার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত জরুরি ও কার্যকর একটি পদ্ধতি।

৭। কুরআনের আয়াতকে জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখা: কুরআন নিয়ে চিন্তা করার জন্য এটি আরো একটি কার্যকর পদ্ধতি। কুরআনে প্রচুর উদাহরণের উল্লেখ দেখা যায়। সেই উদাহরণগুলো নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা। আল্লাহ যেখানে যেখানে উপমা দিয়েছেন সেগুলোকে সেভাবে চিন্তা করা। যেমন, আল্লাহ কুরআনে পার্থিব জীবনকে শস্যক্ষেতের সাথে তুলনা দিয়েছেন। এই বাস্তব উদাহরণগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা। এই উপমাগুলো আল্লাহ এজন্যই দিয়েছেন যাতে আমরা এগুলো নিয়ে ভাবি এবং এ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করি। কুরআনের আয়াতকে যতো বেশি আমরা জীবনের সাথে মিলিয়ে পড়বো, যতো বেশি নিজেদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলীর সাথে কুরআনের বক্তব্যের মিল খুঁজবো, কুরআন থেকে আমি ততো বেশি ফায়দা হাসিল করতে পারবো। কুরআন নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা ততো বেশি পোক্ত হবে, সমৃদ্ধ হবে ইনশাআল্লাহ।

৮। খুব গভীরভাবে কুরআনের আয়াত মুখস্থ করা: কুরআনের যে কয়টি আয়াতই আমরা মুখস্থ করি না কেন, সেগুলো এমনভাবে মুখস্থ করা যেন কোথাও শুনলেই সেগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এতে করে এই আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা করা আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।

৯। মুখস্থ অংশটুকু প্রতি সপ্তাহে আবার পড়া: কুরআন নিয়মিত যতোটুকুই সম্ভব মুখস্থ করতে চেষ্টা করতে হবে। আর যতোটুকুই মুখস্থ করুন না কেন, সেটা পরের সপ্তাহে আবার পড়ুন। একবার পড়েই পরবর্তী অংশে চলে যাবেন না। বরং পঠিত অংশ বারবার পড়ে সেটাকে নিজের মধ্যে গেঁথে নিন এবং তার অর্থ ও মর্ম নিয়ে চিন্তা অব্যাহত রাখুন।

১০। পঠিত আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা: কুরআনের প্রতিটি আয়াতেরই শানে নুযূল রয়েছে। সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আল্লাহ সুব’হানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনের আয়াতসমূহ একের পর এক নাযিল করেছেন। যদি আপনি আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট জেনে সেই আয়াতটি পড়েন তবে বাস্তবতার সাথে আয়াতকে যেমন আপনি আরো বেশি মেলাতে পারবেন ঠিক তেমনি আয়াতের মর্ম ও বাস্তবতা অনুধাবনেও পাবেন নতুন চিন্তার খোরাক।

এই আর্টিকেলে আমরা চেষ্টা করেছি আল্লাহর কালামকে বুঝার, জানার, অন্তরে ধারণ করার জন্য এর আয়াত নিয়ে তাদাব্বুর করার কিছু পদ্ধতি তুলে ধরার। এতে আপনারা উপকৃত হলে সেটা অবশ্যই আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর পক্ষ থেকে আর কোনো প্রকার ভুল হলে তা আমাদের তরফ থেকে। আল্লাহ আমাদের কুরআনের তাদাব্বুর করার তাওফীক দান করুন, তিনি আমাদের কুরআনের ফাহম দান করুন ও এর উপরই নিজেদের জীবন পরিচালনার তাওফীক দান করুন। আমীন।

কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনার পদ্ধতি জানতে এই বইগুলো উপকারি হতে পারে ইনশাআল্লাহ –

১। কুরআন অনুধাবন : পদ্ধতি ও সতর্কতা
২। তাদাব্বুরে কুরআন (কুরআন বোঝার রাজপথে আপনার প্রথম স্বপ্নযাত্রা)
৩। ৩০ মজলিসে কুরআনের সারনির্যাস
৪। ইলা রাওহিল কুরআন
৫। কুরআনের সাথে পথচলা
৬। কুরআনি ভাবনা
৭। খোলাসাতুল কুরআন
৮। কুরআন বোঝার মজা
৯। ম্যাসেজ অব কুরআন
১০। কুরআন জীবনের গাইডলাইন

.

-https://blog.wafilife.com/2023/01/30/quran-niye-chintavabnar-10-poddhoti/

 

 

#দ্বীনে_ফেরার_গল্প_আমার_রবের_কাছে_ফেরার_গল্প

https://justpaste.it/deen_a_ferar_golpo

.

>> "বিয়ে, রিজিক লাভ, ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি"

https://justpaste.it/5gol5

.

>> ফেসবুক ও ইউটিউবের উপকারী সব পেইজ, গ্রুপ, আইডি এবং চ্যানেলের লিংক

https://justpaste.it/facebook_page_grp_link

.

>> র‍্যান্ড, মডারেট ইসলাম, মডার্নিস্ট মুভমেন্ট

https://justpaste.it/76iwz

.

>> কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক বইয়ের pdf লিংক (৪০০+ বই)

https://justpaste.it/4ne9o

.

>> কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক Apps, YouTube Video, Quran Recitation, YouTube channel.

https://justpaste.it/islamicappvideo

.

>> তাকদির আগে থেকে নির্ধারিত হলে মানুষের বিচার হবে কেন? যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ পৌঁছেনি তাদের কী হবে?

https://justpaste.it/6q4c3

.

>> কুরআন এবং আপনি

https://justpaste.it/5dds8

.

>> কখনও ঝরে যেও না …

https://justpaste.it/3bt22

.

>> ফজরে আমি উঠতে পারি না

https://justpaste.it/6kjl6

.

>> এই ১০টি ফজিলতপূর্ণ আমল যা আপনার সারাবছরের_ই দৈনন্দিন রুটিনে থাকা উচিত
https://justpaste.it/9hhk1

.

>> ইস্তিগফার অপার সম্ভাবনার দ্বার
https://justpaste.it/6ddvr

.

>> দাম্পত্যজীবন, অজ্ঞতা ও পরিণাম

https://justpaste.it/7u5es

.

>> বিপদাপদে ধৈর্যধারণ : ফজিলত, অর্জনের উপায় ও করণীয়

https://justpaste.it/8dccj

.

>> মহান রবের আশ্রয়ে সিরিজের সকল পর্ব

https://justpaste.it/6ttuf

.

>> স্বার্থক মুনাজাত

https://justpaste.it/1xf0t

.

>> রাসূলের উপর দরুদ ও সালাম পাঠ-সংক্রান্ত ৭ পর্বের একটি সিরিজ

https://justpaste.it/4hhtd

.

>> তাহাজ্জুদ সিরিজ

https://justpaste.it/4ja0n

.

>> মহিমান্বিত কুরআন সিরিজের সকল পর্ব

https://justpaste.it/3dxi7

.

>> ধ্বংসাত্মক দৃষ্টি (বদ নজর সিরিজের সকল পর্ব)

https://justpaste.it/7056k

.

>> বিশুদ্ধ ঈমান সিরিজ

https://justpaste.it/7fh32

.

>> ইমান ভঙ্গের ১০ কারণ

https://justpaste.it/9icuq

.

>> দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির ১০ আমল

https://justpaste.it/8gmtk

.

>> পর্দায় প্রত্যাবতন: পর্দায় ফেরার গল্প
https://justpaste.it/3lqzf

.

>> নফসের জিহাদ -শায়খ আহমাদ মুসা জিবরীল (হাফিজাহুল্লাহ)

https://justpaste.it/8vnly

.

>> রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর সকাল-সন্ধ্যার দু'আ ও যিকর
https://justpaste.it/sokalsondharjikir

.

>> সালাফদের আত্মশুদ্ধিমূলক বাণী
https://justpaste.it/9e6qh

.
>> সন্তান লাভের ৭ টি গুরুত্বপূর্ণ আমল
https://justpaste.it/9hth5

.
>> Rain Drops, Baseera, Hunafa, Mubashshireen Media ও Ummah Network থেকে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সিরিজগুলোর অডিও ডাউনলোড লিংক
https://justpaste.it/4kes1

.

>> পাপ থেকে বাঁচার ১০ উপায়: যা সকল মুসলিমের জানা আবশ্যক
https://justpaste.it/3ob7j

.

>> ইসলামিক বই, অডিও-ভিডিও লেকচার সিরিজ সহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের লিংকগুলো পাবেন এখানে। সবগুলো বিষয়ের লিংক এক জায়গায় রাখা হয়েছে। এই লিংকটা শেয়ার করতে পারেন। 
https://justpaste.it/48f6m