JustPaste.it

The Greatest Nation

 

Notes

01

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আদম সন্তানের উপর শয়তানের আক্রমনের কৌশল

 

The Greatest Nation·Wednesday, July 13, 2016

 

আল্লাহ আমাদেরকে তার শত্রু ইবলিস শয়তানের ব্যাপারে জানিয়ে দিয়েছেন। যখন আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে কেন সে আদমকে সিজদাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তখন ইবলিশ এই যুক্তি দিয়ে তর্ক করলো যে সে আদমের থেকে উত্তম। আর সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো তাকে অবকাশ দেওয়ার জন্য, আল্লাহ তাকে অবকাশ দিলেন। এরপর আল্লাহর শত্রু ইবলিস বললো,

قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ ﴿١٦﴾

ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ ﴿١٧﴾

“যেহেতু আপনি আমাকে বিপথে চালিত করেছেন (নোটঃ ইবলিস নিজের অহংকারের কারনে পথভ্রষ্ট হওয়ার পরও নম্রতা অবলম্বন না করে সে উল্টো আল্লাহ’র উপর এভাবে দোষ চাপিয়ে দিলো), আমি তাদেরকে আক্রমনের জন্য আপনার প্রদর্শিত পথে (সিরাতুল মুস্তাকিম) নিজেকে নীরবভাবে গোপন রেখে প্রস্তুত থাকবো।

এরপর আমি তাদেরকে হঠাৎ আক্রমণ করবো তাদের সামনে থেকে, পিছন থেকে, ডান দিক থেকে, বাম দিক থেকে, এবং আপনি তাদের অধিকাংশকেই শোকরকারী হিসেবে পাবেন না।” (সূরা আল আ’রাফ, ৭ :১৬-১৭)

কুরআনের অধিকাংশ মুফাসসীরগণ এই তাফসীর করেছেন যে, শয়তানের জবাবটি ছিল একটি নির্দিষ্ট ব্যাপারে – আল্লাহ’র বিশ্বাসী বান্দাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার ব্যাপারে তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রদর্শনের জন্য।

ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, “সিরাতুল মুস্তাকিম হল আল্লাহর দ্বীন (ইসলাম)।” ইবন মাসউদ (রাঃ) বলেন, “এর অর্থ হল আল্লাহ’র কিতাব (আল-কুরআন)।” জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, “এটি হল ইসলাম।” আর মুজাহিদ (রহ.) বলেন, “এটি হল সত্য।”

এগুলো সবই একটি অর্থই প্রকাশ করে, সেটা হল -আল্লাহ’র প্রদর্শিত পথ।

সাবরাহ বিন আল-ফাকাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “শয়তান তার সকল ভ্রান্তিময় প্রতারণাপূর্ণ পদ্ধতি ব্যবহার করে আদম সন্তানকে আক্রমনের জন্য গোপনে প্রস্তুত থাকে।” (মুসনাদ আহমাদ, সুনান আন-নাসাঈ, ইবন হিব্বান)

ইবন আতিয়্যাহ থেকে বর্ণিত আছে যে ইবন আব্বাস (রাঃ) “এরপর আমি তাদেরকে অতর্কিত আক্রমণ করবো তাদের সামনে থেকে” -এর ব্যাপারে বলেন যে, শয়তান ‘পার্থিব ব্যাপারগুলোতে’ আদম সন্তানদের উপর তার কতৃত্বের চেষ্টা চালাবে। আলি বিন আবি তালহাহ থেকে বর্ণিত আছে যে এই আয়াতাংশ দিয়ে বুঝানো হয়েছে – “আমি তাদেরকে পরকালের ব্যাপারে সন্দেহ করিয়ে দিবো।” এই বর্ণনাটি আল-হাসান (রাঃ) এর সেই বর্ণনার সাথে মিলে যায় যেখানে বলা হয়েছে যে এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে শয়তানের সেই চেষ্টাকে, যা সে করে থাকে বিশ্বাসী বান্দাদের ক্ষেত্রে যেন তারা পুনরুত্থান, জান্নাত ও দোজখের ব্যাপারে অস্বীকার করে। মুজাহিদ (রহ.) এই আয়াতাংশের ব্যাপারে বলেন, “এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে, তারা যে স্থান থেকে তার শয়তানসুলভ কুকর্মের প্ররোচনা দেখতে সক্ষম হবে।”

“আর তাদের পিছন থেকে” - ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, “এর অর্থ হলঃ আমি দুনিয়াবী মায়াকে তাদের জন্য প্রবলভাবে আকাঙ্ক্ষিত করে দিবো।” আল-হাসান (রাঃ) বলেন, “আমি তাদের দুনিয়াবী ব্যাপারে তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করবো আর সেটাকে আমি তাদের জন্য আকর্ষণীয় করে প্রদর্শন করবো।” আবু সালিহ বলেন, “এর অর্থ হলঃ আমি তাদেরকে পরকাল অস্বীকার করাবো আর এর থেকে তাদেরকে দূরে রাখবো।” ইবন আব্বাস (রাঃ) এটাও বলেন যে এর অর্থ হলঃ “আমি তাদেরকে দ্বীন ইসলাম ও সৎ কর্মের গুরুত্বের ব্যাপারে সন্দেহ করিয়ে দিবো।” আল-হাসান (রাঃ) এর অর্থ হিসেবে এটাও বলেন, “আমি তাদেরকে সৎ কর্ম করা থেকে বিরত রাখবো।”

“আর তাদের বাম দিক থেকে” - আল-হাসান (রাঃ) বলেন, “এর অর্থ হলঃ আমি তাদেরকে মন্দ কাজ করতে আদেশ করবো, যেগুলোকে আমি তাদের চোখের সামনে খুবই আকর্ষণীয় করে তুলবো।”

ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে নির্ভরযোগ্যভাবে বর্ণিত হয়েছে, “শয়তান এটা বলেনি যে সে তাদের উপর থেকে আক্রমণ করবে কারন যে জানতো যে তাদের উপর আল্লাহ রয়েছেন।” আশ-শা’বি বলেন, “আল্লাহ তাদের উপর থেকে তাদের প্রতি তার রহমত প্রদান করেন।” কাতাদাহ বলেন, “হে আদম সন্তান, শয়তান তোমাদের কাছে উপর দিক ছাড়া সব দিক থেকে আসে। তাই আল্লাহ’র রহমত অর্জনের ক্ষেত্রে সে কখনোই তোমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।”

আল-ওয়াহিদি বলেন, “কিছু ব্যক্তি বলেনঃ ‘ডান দিক দ্বারা উদ্দেশ্য হল সৎ কর্ম, বাম দিক দ্বারা উদ্দেশ্য হল অসৎ কর্ম,’ যেহেতু আরবেরা বলেনঃ ‘আমাকে তোমার ডান দিকে রেখো, বামে রেখো না।’ যার অর্থ হলঃ ‘আমাকে তোমার নিকটস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে রেখো, দূরবর্তীদের মধ্যে নয়।’ ”

কয়েকজন আলিমের নাম উল্লেখ করে আল-আযহারি বর্ণনা করেন যে শয়তান আল্লাহ’র সম্মান-মর্যাদার কসম করে একটি শপথ করেছিলো -

قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ ﴿٨٢﴾ إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ ﴿٨٣﴾

“সে বললোঃ আপনার ‘ইজ্জাত (‘ইজ্জাহ এর অর্থ হলঃ গৌরব, ক্ষমতা, শক্তি, সম্মান, মর্যাদা, আত্মমর্যাদা, খ্যাতি, অহংকার, গর্ব) এর শপথ, আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে বিপথে পরিচালিত করবো তাদের মধ্য থেকে আপনার সে সকল গোলাম ছাড়া – যারা মুখলিস।” (সূরা সোয়াদ, ৩৮ :৮২-৮৩)

সে শপথ করেছিলো তাদের সবাইকে সে বিপথে পরিচালিত করবে, যেন তারা পূর্ববর্তী মানবসভ্যতার পরিণতি সম্পর্কে সকল বর্ণনা ও পুনরুত্থানের বিষয় অস্বীকার করে, আর লোকেরা যেন তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপে কিংকর্তব্যবিমুঢ়ও হয়ে পড়ে।

অন্যান্য আলিমগণ, যেমন – আবু ইস’হাক ও আয-যামাখশারি (এই কথাগুলো আবু ইস’হাকের) বলেন, “এই দিকগুলোর উল্লেখ করা হয়েছিলো তুলনামুলকভাবে বিশাল অর্থপূর্ণতার জন্য, অর্থাৎ এই অর্থ প্রকাশ করে – ‘আমি তাদেরকে সব দিক থেকে হঠাৎ আক্রমণ করবো।’ এটা এই অর্থও প্রকাশ করতে পারে – ‘আমি নিশ্চিত করবো যে তারা সব দিক থেকেই বিপথগামী।’; আর আল্লাহ’ই তো সবচেয়ে ভালো জানেন।”

আয-যামাখশারি বলেন, “আমি তাদেরকে চার দিক থেকেই আক্রমণ করবো, যে দিকগুলো দিয়ে শত্রুরা সাধারণত আক্রমণ করে থাকে।”

এটি হল শয়তানের ওয়াসওয়াসা এবং আদম সন্তানদের উপর তার প্রভাব বিস্তারের পরিসীমার একটি উদাহারন। আল্লাহ অপর এক আয়াতে শয়তানকে বলেন,

وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُم بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِم بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ وَعِدْهُمْ ۚ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا ﴿٦٤﴾

“আর তাদের মধ্যে যাকে সক্ষম হোস তাকে তোর আওয়াজ দিয়ে (পাপ কাজে) প্ররোচিত কর, এবং তোর অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে সমবেত হওয়ার আদেশ কর, আর তাদের সম্পদ ও সন্তানসন্ততিতে অংশীদার হ (অবৈধভাবে সম্পদ ও সন্তান পেতে প্ররোচনা করার মাধ্যমে) এবং তাদের কাছে ওয়াদা কর, আর শয়তান তো তাদের প্রতারণা ছাড়া কোন ওয়াদাই করে না।” (সূরা বানী ইস্রাঈল, ১৭ :৬৪)

শাকিক বলেন, “প্রতিটি সকালেই শয়তান আমাকে চতুর্দিক থেকে – আমার সামনে থেকে, পিছন থেকে, ডান দিক ও বাম দিক থেকে আক্রমনের জন্য ওঁৎ পেতে থাকে, আর বলেঃ ‘ভয় পেয়ো না, কারন আল্লাহ তো পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ তখন আমি তিলাওয়াত করি –

وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِّمَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدَىٰ ﴿٨٢﴾

‘কিন্তু নিশ্চয়ই আমি সেসব ব্যক্তির জন্য ক্ষমাশীল যারা অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসে এবং ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে, এরপর হিদায়াতের পথে চলতে থাকে।’ (সূরা তোয়া হা, ২০ :৮২)

শয়তান যখন আমার পিছন থেকে আসে, সে আমাকে আমি যে ব্যক্তিদেরকে মৃত্যুর পর ছেড়ে চলে যাবো তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করতে চায়, তখন আমি তিলাওয়াত করি –

وَمَا مِن دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّـهِ رِزْقُهَا

‘আর ভুপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযক আল্লাহ’র জিম্মায় নেই’ (সূরা হুদ, ১১ :৬)

যখন শয়তান আমার ডান দিক থেকে আসে, সে নারীদের প্রতি আমার প্রবৃত্তিকে উত্তেজিত করার জন্য আসে, তখন আমি তিলাওয়াত করি –

وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ﴿١٢٨﴾

‘আর মুত্তাকীদের জন্য শুভ পরিনাম।’ (সূরা আল আ’রাফ, ৭ :১২৮)

আর সে যখন আমার বাম দিক থেকে আসে, সে আমার সকল কামনা-বাসনা উত্তেজিত করতে আসে, তখন আমি তিলাওয়াত করি –

وَحِيلَ بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ مَا يَشْتَهُونَ

‘এবং তাদের ও তাদের বাসনার মধ্যে অন্তরায় স্থির করে দেওয়া হবে’ (সূরা সাবা, ৩৪ :৫৪)

আমি (ইবনুল কায়্যিম) বলিঃ মানুষ চারটি পথের একটি পথে চলে, অন্য কোন পথে নয়; সে তার ডান, বাম, সামনের বা পিছনের পথে চলে। সে প্রত্যেক পথেই শয়তানকে তার জন্য অতর্কিতে আক্রমণকারী হিসেবে পায়। কেউ আল্লাহ’র আদেশ মেনে চলতে গিয়ে যদি এই পথগুলোর কোন একটি পথে চলে, তবে সে দেখতে পাবে শয়তান তাকে আল্লাহ’র প্রতি অনুগত হওয়া থেকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু সেই ব্যক্তি যদি পাপকাজের জন্য এই পথগুলোর কোন একটি পথে চলে তবে শয়তান তাকে উৎসাহিত করবে আর তার যা প্রয়োজন হয় সবই সরবরাহ করে দিবে।

আমাদের মুত্তাকী আলিমদের এ মন্তব্যকে সমর্থন করে এ আয়াতটি –

وَقَيَّضْنَا لَهُمْ قُرَنَاءَ فَزَيَّنُوا لَهُم مَّا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ

“এবং আমরা তাদের জন্য নির্ধারিত করে দিলাম ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের আর তারা (সেই সহকর্মীরা) তাদের জন্য তাদের সামনে ও পিছনে যা ছিল তা সুসজ্জিত করে দিলো।” (সূরা ফুসসিলাত, ৪১ :২৫)

এ আয়াতের ব্যাপারে আল-কালবি বলেন, “আমরা শয়তানদের মধ্য থেকে কিছু সাথী দিয়ে তাদেরকে সীমাবদ্ধ করে দিবো।” মুকাতিল বলেন, “আমরা তাদের জন্য শয়তানদের মধ্য থেকে কিছু সাথী প্রস্তুত করে দিবো।”

ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, “তাদের সামনে রয়েছে পার্থিব ব্যাপারগুলো, আর তাদের পিছে রয়েছে পরকালের চিরস্থায়ী বিষয়গুলো।”

এর অর্থ হলঃ সেই সাথীরা এই দুনিয়াকে তাদের কাছে সুসজ্জিত করে দিয়েছে যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা এটা আখিরাতের জীবন থেকে পছন্দ করে এবং এমনকি তাদেরকে এটা পুরোপুরি অস্বীকার করতে আহবান করে।

আল-কালবি বলেন, “তারা (সেই সাথীরা) তাদের সম্মুখে যেটা সুসজ্জিত করে তা হল পরকালের বিষয়গুলো – জান্নাত, জাহান্নাম বা পুনরুত্থান বলে কিছু নেই। আর তাদের পিছন থেকে সুসজ্জিত করে এই দুনিয়ার বিষয়গুলো -এই দুনিয়ার জীবনে তাদের পথভ্রষ্টতা।”

ইবন যাইদ বলেন, “তারা (সেই সাথীরা) তাদের অতীতের পাপ আর ভবিষ্যতে করবে এমন পাপগুলোকে তাদের কাছে সুসজ্জিত করে তোলে।” (অর্থাৎ, তারা যা করছে শয়তান তাদের কাছে সেগুলোকে আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করে, যাতে করে তারা সেটার জন্য তাওবা না করে এবং তারা যেসব পাপ কাজ করার জন্য প্রস্তুত আছে সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য কখনোই নিয়্যত না করে।)

যখন আল্লাহ’র শত্রু শয়তান বলল, “এরপর আমি তাদেরকে হঠাৎ আক্রমণ করবো তাদের সামনে থেকে, পিছন থেকে”, সে এর দ্বারা এই দুনিয়া ও আখিরাতকে বুঝিয়েছে। আর যখন সে বলল, “ডান থেকে, বাম থেকে”, সে এর দ্বারা বুঝিয়েছে যে, আদম সন্তানের ডান দিকে থাকা সৎ কর্ম লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতা যিনি সেই আদম সন্তানকে শুধুমাত্র সৎ কর্ম করার তাড়না দেন, তাই আদম সন্তানকে সৎ কর্মে তাকে বাধা দেওয়ার জন্য সেদিক থেকে শয়তান তার কাছে পৌঁছতে চাবে। আর বাম দিকে থাকা অসৎ কর্ম লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতা অসৎ কর্ম করতে আদম সন্তানকে নিষেধ করেন, তাই শয়তান সেই দিক থেকে আদম সন্তানের কাছে পৌঁছে অসৎ কর্মগুলো করার জন্য তাকে উৎসাহিত করবে। এর সবকিছুই এ আয়াতগুলোতে সংক্ষেপে বলা হয়েছে –

قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ ﴿٨٢﴾

“সে বললোঃ আপনার ‘ইজ্জাত এর শপথ, আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে বিপথে পরিচালিত করবো …” (সূরা সোয়াদ, ৩৮ :৮২)

إِن يَدْعُونَ مِن دُونِهِ إِلَّا إِنَاثًا وَإِن يَدْعُونَ إِلَّا شَيْطَانًا مَّرِيدًا ﴿١١٧﴾ لَّعَنَهُ اللَّـهُ ۘ وَقَالَ لَأَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِيبًا مَّفْرُوضًا ﴿١١٨﴾

وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الْأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّـهِ ۚ وَمَن يَتَّخِذِ الشَّيْطَانَ وَلِيًّا مِّن دُونِ اللَّـهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِينًا ﴿١١٩﴾

يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيهِمْ ۖ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا ﴿١٢٠﴾

“তারা তাকে (আল্লাহ্‌কে) পরিত্যাগ করে তার পরিবর্তে নারীদের (সে সকল মূর্তিগুলোকে, যেগুলোকে তারা নারীবাচক নাম দিত, যেমনঃ আল-লাত, আল-‘উযযা ইত্যাদি, আর ফেরেশতাদের আল্লাহ’র মেয়ে বলে বিশ্বাস করে তাদের ছবির ইবাদাত করতো) আহবান করে, আর তারা তো বিদ্রোহী শয়তান ছাড়া আর কাউকেই আহবান করে না।

আল্লাহ তাকে অভিশাপ দিয়েছেন, আর সে বললঃ ‘আমি নিশ্চয়ই আপনার গোলামদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অংশকে গ্রহণ করবো।

এবং আমি নিশ্চয়ই তাদেরকে ভুল পথে চালিত করবো আর তাদের মধ্যে নিরর্থক আশা (যেমন – পুনরুত্থান, আল্লাহ’র কাছে জবাব দেওয়া, পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি বলে কিছুই নেই) জাগিয়ে দেবো আর তাদের আদেশ করবো যেন তারা গবাদি পশুর কান কেটে দেয়, আর আমি তাদের আদেশ করবো যেন তারা বাস্তবে আল্লাহ’র সৃষ্টির পরিবর্তন করে (আল্লাহ’র সৃষ্টির পরিবর্তন করার অর্থ হলঃ গাঠনিকভাবে পরিবর্তন, যেমন – মানুষের বা অন্যান্য প্রাণীর জননশক্তি নষ্ট করে দেওয়া; এবং, আল্লাহ’র মনোনীত দ্বীন ইসলামকে পরিবর্তন করে দেওয়া - বিদআত করার মাধ্যমে আর দ্বীন থেকে কিছু বর্জন করা ও কোন বিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে)। আর যে-ই আল্লাহ’র পরিবর্তে শয়তানকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহন করে, সে প্রকৃতপক্ষে এক সুস্পষ্ট ক্ষতিতে পতিত হয়।

সে তাদের কাছে ওয়াদা করে আর তাদের অনুপ্রাণিত করে নিরর্থক আশার মাধ্যমে; কিন্তু শয়তানের ওয়াদা তো প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।” (সূরা আন-নিসা, ৪ :১১৭-১২০)

এর অর্থ সম্পর্কে আদ-দাহহাক বলেন, “তার গৃহীত অংশটি হল আল্লাহ’র গোলামদের মধ্যে একটি অধিগত অংশ।” আয-যাজ্জাজ বলেন, “একটি অংশ যা শয়তান তার জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে।” আল-ফিরা’ বলেন, “যেসব লোকদের উপর শয়তান তার কতৃত্ব করতে পারবে, সেটাই হল তার অধিকৃত অংশের অনুরূপ।”

আমি (ইবনুল কায়্যিম) বলি, “শয়তানের একটি নির্দিষ্ট অংশ গ্রহণের বাস্তবতা হল এই যে, এটি হল তার একটি অনুমান, যার অর্থ হল, যে ব্যক্তিই তাকে অনুসরণ করবে ও তাকে মান্য করবে, সে-ই শয়তানের নিযুক্ত ব্যক্তিতে পরিণত হবে, যে কিনা তার অংশে পরিণত হবে। কারন মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত – শয়তানের অনুসারী এবং আল্লাহ’র হিদায়াতের অনুসারী।”

“এবং আমি নিশ্চয়ই তাদেরকে ভুল পথে চালিত করবো …” ; অর্থাৎ, শয়তান সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখার মাধ্যমে এটা করবে।

“আর তাদের মধ্যে নিরর্থক আশা জাগিয়ে দেবো …” - এ ব্যাপারে ইবন আব্বাস বলেন, “শয়তান তাওবা করার পথে বাধা দেওয়ার জন্য সংকল্প করে।” আল-কালবি বলেন, “শয়তান তাদের মধ্যে নিরর্থক আশা ও নিশ্চয়তা (জান্নাত, জাহান্নাম বা পরকাল বলে কিছুই নেই এ বিশ্বাস) জাগিয়ে দিবে।” আল-যাজ্জাজ বলেন, “শয়তান তাদের মধ্যে এই নিরর্থক আশা জাগিয়ে দেয় যে, পরকালে তাদের কোন ভাগ্য নেই, এটা করার মাধ্যমে সে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে একত্রিত করবে।”

এটা এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় – “আমি তাদের উত্তেজিত করবো পাপের ইচ্ছা ও দ্বীনের মধ্যে বিদআতের অনুসরনের জন্য তাড়না দিয়ে।” আর এটাকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা হয় – “আমি তাদেরকে উত্তেজিত করবো এই দুনিয়ার মনোরমতায় আটকে থাকার জন্য যতক্ষণ না তারা এটা পরকালের তুলনায় পছন্দ করবে।”

“আর তাদের আদেশ করবো যেন তারা গবাদি পশুর কান কেটে দেয় …” - অধিকাংশ মুফাসসীরদের মতে এটা দিয়ে আল-বাহিরাহ এর কান কাটাকে বুঝানো হয়েছে। আলিমরা বলেন যে এই আয়াতটি শিশুর কান ছিদ্র করার ব্যাপারে একটি রেফারেন্স, আর তাদের মধ্যে কিছু আলিম কেবল কন্যা শিশুদের অলংকারের জন্য এর অনুমতি দিয়েছেন, যার সমর্থন পাওয়া যায় আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত উম্ম যার’ এর হাদিসে, যেখানে উম্ম যার’ তার স্বামী আবু যার’ সম্পর্কে বলেন, “তিনি আমাকে অনেক গহনা দিলেন আর আমার কান সেগুলোর কারনে খুবই ভারী হয়ে গেলো।” রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আইশাহ (রাঃ) কে বললেন, “আবু যার’ উম্ম যার’ এর নিকট যেমন, আমিও তোমার নিকট তেমন।” (বুখারী) ইমাম আহমাদ বলেছেন যে এটা ছেলে শিশুর জন্য নয় বরং কন্যা শিশুর জন্য অনুমোদিত।

“আর আমি তাদের আদেশ করবো যেন তারা বাস্তবে আল্লাহ’র সৃষ্টির পরিবর্তন করে”- ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, “শয়তান এর দ্বারা আল্লাহ’র দ্বীন ইসলামকে বুঝিয়েছে।” আর এটি হল ইব্রাহীম, মুজাহিদ, আল-হাসান, আদ-দাহহাক, কাতাদাহ, আস-সুদদাঈ, সা’ইদ বিন আল-মুসাইইব ও সা’ইদ বিন জুবাইর এর মতামত। এর অর্থ হল, আল্লাহ তার গোলামদের একটি সুস্থ প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, আর এটা হল ইসলাম। আল্লাহ বলেন,

فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا ۚ فِطْرَتَ اللَّـهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا ۚ لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّـهِ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ﴿٣٠﴾

مُنِيبِينَ إِلَيْهِ وَاتَّقُوهُ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ﴿٣١﴾

مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا ۖ كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ ﴿٣٢﴾

“সুতরাং আপনি হানিফ (হানিফবলতে বুঝায় এমন কোন ব্যক্তিকে, যিনি মিথ্যা ধর্ম ত্যাগ করেন ও সত্য দ্বীন অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করেন, এভাবে তিনি একজন সত্যিকারের আন্তরিক ও খাঁটি তাওহীদপন্থী মুসলিম হোন) এর ন্যায় নিজেকে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন – যে ফিতরাহ (প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য) এর উপর তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ’র সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নেই। এটিই হল দ্বীনুল কায়্যিম (সঠিক, সরল, বহুমূল্যবান ও চমৎকার দ্বীন), কিন্তু অধিকাংশ লোকেরা এটা জানে না।

তাওবা করে তার দিকে ফিরে আসো আর তার ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করো ও সালাত কায়েম করো এবং কখনোই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না -

-যারা তাদের দ্বীনকে বিভক্ত করলো (দ্বীনের মত বাদ দিয়ে ভিন্ন মতের অনুসরণ ও দ্বীনের পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে) এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ে পরিণত হল, প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত।” (সূরা রুম, ৩০ :৩০-৩২)

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “প্রত্যেক শিশুই ফিতরাত (ইসলাম) এর উপর জন্মগ্রহন করে, আর এরপর তার পিতামাতা তাকে ইয়াহুদি, খ্রিস্টান বা জরোস্ট্রিয়ানে পরিণত করে। যখন একটি পশু একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু পশুর জন্ম দেয় তখন কি তোমরা এর শরীরের কোন অংশ কাটা দেখো ?” এরপর তিনি তিলাওয়াত করলেন – “যে ফিতরাহ (প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য) এর উপর তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন।” (বুখারি ও মুসলিম)

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) দুটি ইস্যু যুক্ত করলেন – ইয়াহুদি বা খ্রিস্টান ইত্যাদিতে পরিণত করার মাধ্যমে কারো ফিতরাহ পরিবর্তন করা, এবং কোন অঙ্গ কেটে দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ’র সৃষ্টির পরিবর্তন করা। এই দুটো ব্যাপার হল সেটাই, যেটার ব্যাপারে ইবলিস (শয়তান) বলেছিল যে সে তা করবে; সুতরাং সে আল্লাহ’র দেওয়া ফিতরাহ পরিবর্তন করলো শিরক করানোর মাধ্যমে ও আল্লাহ’র সৃষ্টির স্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট রূপ যা আল্লাহ কতৃক নির্দিষ্ট, তাকে পরিবর্তন করে দেওয়ার মাধ্যমে।

“সে তাদের কাছে ওয়াদা করে আর তাদের অনুপ্রাণিত করে নিরর্থক আশার মাধ্যমে” - তার ওয়াদা সেগুলোই, যেগুলো কিনা কোন ব্যক্তির অন্তরে পৌঁছে; যেমন – “তুমি আরও অনেক সময় ধরে বেঁচে থাকবে যেন তুমি এই জীবনে তোমার সব কামনা-বাসনা অর্জন করে নিতে পারো। তুমি তোমার নিজের লোকদের ও শত্রুদের ঊর্ধ্বে থেকে উঁচু অবস্থায় পৌছতে পারবে।” এক্ষেত্রে শয়তান একজনের আশা বাড়িয়ে দেয়, মিথ্যা ওয়াদা করে এবং ব্যক্তির মধ্যে মিথ্যা ও বিভিন্ন রকম কামনা-বাসনা জাগিয়ে তোলে। সে যা কিছু ওয়াদা করে তা হল প্রতারণাপূর্ণ মিথ্যা ওয়াদা, এবং আর যা কিছু জাগিয়ে তোলে তা হল সাধ্যাতীত আশা আকাংখা। নোংরা ও বিকৃত আত্মা সবসময় শয়তান থেকে আগত মিথ্যা আশা-আকাংখা দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে, আর এটি মিথ্যা আশাতেই বেঁচে থাকাটা উপভোগ করে।

الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُم بِالْفَحْشَاءِ ۖ وَاللَّـهُ يَعِدُكُم مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَفَضْلًا ۗ وَاللَّـهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ﴿٢٦٨﴾

“শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রতার ওয়াদা করে আর ফাহশা (মন্দ কাজ) এর আদেশ দেয়, আর আল্লাহ তোমাদের ওয়াদা করেন তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের, এবং আল্লাহ হলেন ওয়াসি’উন ‘আলিম (ওয়াসি’ এর সংক্ষিপ্ত অর্থ হল – অসীম, আল-‘আলিম অর্থ সর্বজ্ঞানী)।” (সূরা আল বাকারাহ, ২ :২৬৮)

বলা হয়েছেঃ “শয়তান তোমাদের ‘ফাহশা’ করার জন্য আদেশ দেয়,” (অর্থাৎ, নীচ ও কৃপণ হওয়ার জন্য আদেশ দেয়, যেমনটি এই আয়াতটিতে বলা হয়েছে)। মুকাতিল ও আল-কুলাবি বলেন, “কুরআনে ‘ফাহশা’ শব্দটি দিয়ে অবৈধ যৌনমিলনকে বুঝানো হয়েছে, তবে এই আয়াতে এটা দিয়ে কৃপণতা বুঝানো হয়েছে।”

সঠিক মত হল এই যে, ‘ফাহশা’ শব্দটি এখানে সাধারণ অর্থেই রয়েছে, এটি প্রত্যেক প্রকারের ‘ফাহিশা’ (মন্দ কাজ) কে নির্দেশ করে। এটি এমন এক কাজের ব্যাপারে নির্দেশ করে যার উল্লেখ করা হয় নি, তাই এই বৈশিষ্ট্যটি এই শব্দের সাধারণ ব্যাপক অর্থ বহন করে।

সুতরাং আমরা বলতে পারি যে শয়তান মানবজাতিকে মন্দ কাজ ও কৃপণতার আদেশ করে। আল্লাহ উল্লেখিত আয়াতে শয়তানের ওয়াদা ও তার আদেশের উল্লেখ করেছেন। সে মানুষকে মন্দ কাজের আদেশ করে আর মানুষকে মন্দ পরিনামের ভয় দেখায় (যদি তারা সৎ কর্ম করে)।

শয়তান মানুষ থেকে দুটো ব্যাপারে আকাংখা করে – সে তাদের সৎ কর্ম না করার জন্য সতর্ক করে, তাই তারা সে কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকে; এবং সে তাদের মন্দ কাজের আদেশ দেয় যেগুলোকে সে তাদের কাছে সুশোভিত করে তোলে, তাই তারা সহজেই সেগুলো চরিতার্থ করে।

এরপর আল্লাহ তার ওয়াদার উল্লেখ করেন, তাকেই আমাদের মেনে চলা উচিত, তিনি ওয়াদা করেন যে যারা আল্লাহ’র আদেশের অনুসরণ করবে আর তার নিষেধগুলো পরিহার করবে তাদের জন্য রয়েছে তার ক্ষমা ও অনুগ্রহ। তার ক্ষমা হল মন্দ থেকে রক্ষা পাওয়া আর তার অনুগ্রহ হল কল্যাণের উপহার।

আবদুল্লাহ বিন মাস’উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “আদম সন্তানের উপর শয়তান তার প্রভাবের প্রয়োগ করে যেমনটা করে থাকে ফেরেশতারা। শয়তানের প্রভাব হল, সে মন্দের ওয়াদা আর সত্যের বর্জন আঁকড়িয়ে ধরে রাখে; এবং ফেরেশতাদের প্রভাব হল, তারা কল্যাণের ওয়াদা ও সত্যের সমর্থন আঁকড়িয়ে ধরে রাখেন। যে ব্যক্তি কল্যাণের ওয়াদা উপলব্ধি করেন তার উচিত আল্লাহ’র প্রশংসা করা, আর যে ব্যক্তি এর বিপরীত উপলব্ধি করেন, তার উচিত হল অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহ’র নিকট আশ্রয় চাওয়া। এরপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন –‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রতার ওয়াদা করে আর ফাহশা (মন্দ কাজ) এর আদেশ দেয়’ ” (তিরমিযি)

ফেরেশতা ও শয়তান কোন ব্যক্তির অন্তরের পরিবর্তন করে যেমন করে রাত ও দিনের পরিবর্তন ঘটে থাকে।

 

সূত্রঃ শারহে যাম আল-মুওাসওিসিন ওয়াত-তাহযির মিনাল ওয়াসওয়াসাহ (ইমাম ইবন কায়্যিম)

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-Q

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

কুরআন তাফসির (ইমাম ইবনে কায়্যিম) : সূরা আনকাবুত (১-১১)

 

 

The Greatest Nation·Wednesday, July 13, 2016

 

 

 

الم ﴿١﴾

(১) আলিফ লাম মিম।

أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ ﴿٢﴾

(২) মানুষ কি এটা মনে করেছে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এ কথা বলার কারনে তাদের স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের কোন পরীক্ষা করা হবে না ?

وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّـهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ ﴿٣﴾

(৩) প্রকৃতপক্ষে তোমাদের পূর্বের লোকদেরও পরীক্ষা করা হয়েছিলো। এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ (এটি) জানিয়ে দিবেন যে কারা সত্যবাদী এবং এটা জানিয়ে দিবেন যে কারা মিথ্যাবাদী।

أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ أَن يَسْبِقُونَا ۚ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ ﴿٤﴾

(৪) অথবা যারা পাপ কাজ করে তারা কি মনে করে যে তারা আমার শাস্তি থেকে পালিয়ে যেতে পারবে ? আমার সম্পর্কে তারা খারাপ ধারণা করলো।

مَن كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ اللَّـهِ فَإِنَّ أَجَلَ اللَّـهِ لَآتٍ ۚ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ﴿٥﴾

(৫) যারা আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাত আশা করে (তারা জেনে রাখুক) আল্লাহ’র দেওয়া নির্দিষ্ট সময়টি অবশ্যই আসবে। এবং তিনি সব শুনেন ও জানেন।

وَمَن جَاهَدَ فَإِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِهِ ۚ إِنَّ اللَّـهَ لَغَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ ﴿٦﴾

(৬) এবং যে ব্যক্তি (আল্লাহ্র জন্য) জিহাদ করে, সে (আসলে) তা নিজের (কল্যাণের) জন্যই করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ বিশ্বজগৎ থেকে অমুখাপেক্ষী।

وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿٧﴾

(৭) এবং যারা ঈমান আনে ও সৎ আমল করে, আমি নিশ্চয়ই তাদের পাপগুলো দূর করে দিব এবং তারা যেসব সৎ আমল করে আমি তাদের সেসব আমলের উত্তম প্রতিদান দিবো।

وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا ۖ وَإِن جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۚ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿٨﴾

(৮) এবং আমি মানুষকে তাদের পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার আদেশ দিয়েছি, কিন্তু কখনো যদি তারা তোমাকে আমার সাথে কোন কিছু শরিক করার ব্যাপারে জোর করে যে ব্যাপারে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না। আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে অতপর আমি তোমাদের জানিয়ে দিবো তোমরা (দুনিয়ার জীবনে) কি করতে।

وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُدْخِلَنَّهُمْ فِي الصَّالِحِينَ ﴿٩﴾

(৯) এবং যারা ঈমান আনে এবং সৎ আমল করে, নিশ্চয়ই আমি তাদের ন্যায়নিষ্ঠ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিবো।

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّـهِ فَإِذَا أُوذِيَ فِي اللَّـهِ جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللَّـهِ وَلَئِن جَاءَ نَصْرٌ مِّن رَّبِّكَ لَيَقُولُنَّ إِنَّا كُنَّا مَعَكُمْ ۚ أَوَلَيْسَ اللَّـهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِي صُدُورِ الْعَالَمِينَ ﴿١٠﴾

(১০) এবং মানুষদের মধ্যে এমনও আছে যারা মুখে বলে ‘আমরা আল্লাহ্র উপর ঈমান এনেছি’ কিন্তু তারা যদি আল্লাহ্র (পথে চলার) কারনে কোন ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তখন তারা সেই পরীক্ষাকে আল্লাহ্র শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করে, এবং যদি তোমার রবের পক্ষ থেকে সাহায্য আসে তখন তারা (মুনাফিকরা) বলে, ‘আসলে আমরা তোমার সাথেই ছিলাম’। আল্লাহ কি তার সমস্ত সৃষ্টির অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে সবচেয়ে ভালোভাবে সচেতন নন ?

وَلَيَعْلَمَنَّ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْمُنَافِقِينَ ﴿١١﴾

(১১) এবং আল্লাহ সুনিশ্চিতভাবে জানেন কারা ঈমান এনেছে আর সুনিশ্চিতভাবে জানেন কারা মুনাফিক।”

(সূরা আনকাবুত, ২৯ :১-১১)

 

তাফসির

মহান আল্লাহ বলেন,

أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلِكُم ۖ مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّىٰ يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَىٰ نَصْرُ اللَّـهِ ۗ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّـهِ قَرِيبٌ ﴿٢١٤﴾

“তোমরা কি মনে করেছ যে তোমরা কোন পরীক্ষা দেওয়া ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে যেমনটি তোমাদের পূর্বের লোকদের পরীক্ষা করা হয়েছিলো ? তার কঠোর দারিদ্রতা ও মুশকিল দ্বারা ব্যথিত হয়েছিলো এবং এমনভাবে প্রকম্পিত হয়েছিলো যে এমনকি রসুল ও তার সাথে থাকা ইমানদারগণ বলে উঠেছিল, ‘আল্লাহ’র সাহায্য কখন আসবে?’ হ্যাঁ ! নিঃসন্দেহে আল্লাহ’র সাহায্য নিকটেই।” (সূরা বাকারা, ২ :২১৪)

আল্লাহ তার বাণীতে উল্লেখ করেছেন যে কে দ্বীন ত্যাগ করেছে এবং কে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছে,

مَن كَفَرَ بِاللَّـهِ مِن بَعْدِ إِيمَانِهِ

“যে ব্যক্তি আল্লাহ’র উপর বিশ্বাস আনার পর কুফরি করে…” (সুরা নাহল, ১৬ : ১০৬)

এরপর আল্লাহ বলেছেন,

ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ هَاجَرُوا مِن بَعْدِ مَا فُتِنُوا ثُمَّ جَاهَدُوا وَصَبَرُوا إِنَّ رَبَّكَ مِن بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ ﴿١١٠﴾

“অতপর যারা (ঈমানের পথে) নির্যাতিত হওয়ার পর হিজরত করে, অতপর (আল্লাহ’র পথে) জিহাদ করে এবং সবর অবলম্বন করে, নিঃসন্দেহে এ (পরীক্ষা)’র পর তোমার রব তাদের প্রতি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু (হবেন)।” (সুরা নাহল, ১৬ :১১০)

লোকেরা আল্লাহ’র পাঠানো রসূলদের এই দুইটির মধ্যে কোন একটি উপায়ে গ্রহণ করেঃ

হয় তারা বলে ‘আমরা ঈমান আনলাম’; অথবা তারা এটা বলতে প্রত্যাখ্যান করে এবং পাপ কাজ চালু রাখে।

তাদের মধ্যে যারা বলে ‘আমি ঈমান আনলাম’, আল্লাহ তাকে পরীক্ষা করেন এবং তাকে তার পথ নির্বাচনে ঠেলে দেন যাতে করে এটা প্রকাশ হয়ে পড়ে যে সে সত্যবাদীদের (ঈমানের ব্যাপারে) মধ্যে অবস্থান করা মিথ্যাবাদী (মুনাফিক) কিনা।

যারা এটা বলা (অর্থাৎ - আমরা ঈমান আনলাম) প্রত্যাখ্যান করে, তাদের এটা মনে করা উচিত নয় যে তারা আল্লাহ্কে পরাজিত করতে পারবে, কারন এমন কেউই নেই যে সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ্কে পরাজিত করতে পারে।

এটাই তার পথ – তিনি তার সৃষ্টির কাছে তার রসূলদের পাঠান এবং এরপর লোকেরা তার রসূলদের মিথ্যুক বলে অভিযুক্ত করে আর তাদের ক্ষতি করে। আল্লাহ বলেন,

وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ

“এবং এভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্য শত্রু নিযুক্ত করে দিয়েছি, (তারা হল) মানুষ ও জীনদের মধ্যে থেকে শয়তান …” (সূরা আনআম, ৬ :১১২)

كَذَٰلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ ﴿٥٢﴾

“অনুরূপভাবে তাদের আগে এমন কোন রসুল আসেন নি যাদের বলা হয়েছিলো তারা (রসূলরা) জাদুকর অথবা পাগল …” (সূরা আয যারিয়াত, ৫১ :৫২)

مَّا يُقَالُ لَكَ إِلَّا مَا قَدْ قِيلَ لِلرُّسُلِ مِن قَبْلِكَ ۚ

“তোমার সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে তা তোমার আগের রসূলদের সম্পর্কেও বলা হয়েছিলো ....” (সূরা ফুসসিলাত, ৪১ : ৪৩)

এই ধরনের পাপিষ্ঠ লোকেরা তাদেরও ক্ষতি করেছিলো এবং শত্রুতা প্রকাশ করেছিলো, যারা তাদের রসূলদের বিশ্বাস ও আনুগত্য করতো। তারা সেসব ইমানদারদের কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে নিপীড়িত করতো এবং ইমানদাররা তাদের কথা বিশ্বাস না করলে তাদের শাস্তি দেওয়া হতো, যার ফলে তাদের জীবন আরও কষ্টকর হয়ে যেত।

কোন সন্দেহ নেই যে, প্রতিটি মানুষকেই কষ্টে ভুগতে হবে – হোক সে মুমিন অথবা কাফির। কিন্তু মুমিনরা এই দুনিয়ার ছোট্ট জীবনটাতে কষ্টভোগ করে থাকে এবং অতপর পরকালের জীবনে পুরস্কৃত হয়ে থাকে। আর কাফির লোকেরা এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া উপভোগে মশগুল থাকে কিন্তু এরপরই যখন পরকালের অসীম যাত্রা শুরু হয়, তখন তার অসহনীয় কষ্টকর জীবন শুরু হয়।

দুর্দশা ও কতৃত্ব প্রদানের ব্যাপারে ইমাম শাফিঈ’র মত

এক ব্যক্তি ইমাম শাফিই কে জিজ্ঞেস করলো, “হে আবু আবদুল্লাহ, একজন মানুষের জন্য কোনটা উত্তম –দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া নাকি কতৃত্ব ?” ইমাম শাফিঈ বললেন, “দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যক্তিকে কতৃত্ব প্রদান করা হয় না, আল্লাহ দুর্দশাগ্রস্ত করেছিলেন নুহ (আঃ), ইবরাহীম (আঃ), মুসা (আঃ), ঈসা (আঃ) এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে - তারা সবাই ছিলেন সবরের উপর অবিচল এবং আল্লাহ তাদেরকে কতৃত্ব প্রদান করলেন। কারো একথা মনে করা উচিত নয় যে সে চিরদিনের জন্য কস্ট এড়িয়ে যেতে সক্ষম হবে।”

যারা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এবং এর ফলে লোকজন অসন্তুস্ট হয়

কতৃত্বের একটি বিশাল উৎস যা একজন বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই জানেন সেটা হল – মানুষের একটি প্রকৃতি হল সে সভ্য হতে চায়, সে মানুষের সাথে বাস করতে চায়; আর মানুষের রয়েছে কিছু ইচ্ছা ও কিছু চিন্তা এবং তাদের সাথে সব ব্যাপারেই সম্মত থাকার দাবী । সে যদি সম্মত না হয় তবে তারা তার ক্ষতি করবে, তাকে নির্যাতন করবে এবং সে যদি তাদের সাথে সম্মত থাকে তবে সে তাদের পক্ষ থেকে ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে ক্ষতি ও নির্যাতনের সম্মুখীন হবে।

যে-ই তার এবং অন্য লোকদের অবস্থার ব্যাপারে চিন্তা করবে, সে এই ধরনের আরও অনেক অবস্থা দেখতে পাবে। প্রত্যেক জাতি যারা ব্যাভিচার করতে চায়, অন্যায় করতে চায় এবং দ্বীন বাতিল করতে চায়, তারা সেসব নিষিদ্ধ কাজের কারনে অপরাধী, যেগুলো আল্লাহ কুরআনের এই আয়াতে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেনঃ

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّـهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّـهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ﴿٣٣﴾

“বলঃ ‘আমার রব যা কিছু হারাম করেছেন তা হল আল ফাওাহিশ (বড় ধরনের গুনাহ, বিশেষ করে প্রত্যেক প্রকারের অনৈতিক যৌন আচরণ ইত্যাদি) তা গোপনে বা প্রকাশ্যেই করা হোক, পাপ (সব ধরনের), অন্যায়ভাবে অত্যাচার করা, আল্লাহ্র সাথে অন্য কিছু শরীক হিসেবে যোগ করা যার ব্যাপারে তাদের কোন অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং আল্লাহ্র সম্পর্কে এমন কিছু বলা যার ব্যাপারে তোমার কোন জ্ঞান নেই।’ ” (সূরা আল আরাফ, ৭ : ৩৩)

যদি এই ধরনের মানুষগুলো এক স্থানে একত্রিত হয়, যেমনঃ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্রামাগার, স্কুল, গ্রাম অথবা শহরে যেখানে তাদের সাথে আরও অনেকে আছে, তারা কি করতে পারে ? তারা অন্যদের সমর্থন দেওয়া অথবা অন্যদের ক্ষেত্রে নীরব ভুমিকা পালন করা ছাড়া এবং প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা ছাড়া আর কি করতে চাবে ? যদি অন্যরা শান্তিপূর্ণ ভুমিকায় থাকে তবে তবে তারা হয়তো বা তাদের পাপের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না কিন্তু তারা হয়তো তাদেরকে অপমান করতে পারে এবং তাদের দমিয়ে রাখার জন্য শাস্তি দিতে পারে তাদেরই এলাকাতে। তাকে হয়তো মিথ্যা শপথ বা শপথ ভঙ্গ করতে বলা হতে পারে বা দ্বীন সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলতে বলা হতে পারে অথবা অথবা ব্যাভিচার ও অন্যায় কাজ করতে বলা হতে পারে। সে যদি প্রত্যাখ্যান করে তবে তারা তার ক্ষতি করবে এবং তার প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করবে ; আর যদি সে তাদের জবাব দেয় তবে তারা নিজেরাই শাসন করবে, ক্ষতি করবে এবং অপমান করবে তাকে ভয় প্রদর্শনের জন্য (পূর্বের মতো) অথবা তাকে নির্যাতন করা হবে।

হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে (যা তিনি মুওাওিয়া’র কাছে বর্ণনা করেছেন) যা উল্লেখ আছে সেটাই করতে হবে। এই বর্ণনাটি মাওকুফ ও মারফু’ হিসেবে বর্ণনা করা আছেঃ

“যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করার মাধ্যমে আল্লাহকে খুশী করে, আল্লাহ তাকে রক্ষা করবেন তার ব্যাপারে মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করা থেকে।” (তিরমিযি, হাদিস নং ২৪১৪)

এবং অন্য বর্ণনায় বলা আছে, “আল্লাহ তার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হবেন এবং মানুষকে তার ব্যাপারে সন্তুষ্ট করাবেন এবং যে ব্যক্তি মানুষকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে আল্লাহ্কে অসন্তুস্ট করে, তারা তাকে কখনোই আল্লাহ থেকে (তার আযাব থেকে) রক্ষা করতে পারবে না।”

এটি তাদের ব্যাপারে প্রযোজ্য যারা খারাপ উদ্দেশ্যে শাসক ও নেতাদের সমর্থন করে, যারা বিদআতি লোকদের তাদের বিদআতের ব্যাপারে সমর্থন করে, যাদের কিনা জ্ঞানী ব্যক্তি ও ধার্মিক ব্যক্তি বলে মনে করা হয়।

যাকে আল্লাহ হিদায়াত দান করেন এবং সরল পথ দেখান, সে কখনোই হারাম কাজ করবে না এবং সেগুলোর ক্ষতি স্বীকার করবে আর সেগুলোর প্রতি বিরোধিতা পোষণ করবে, ফলে সে পরকালে আল্লাহ্র ইচ্ছায় তার প্রচেষ্টার প্রতিদান পাবে। কারন এটি ঘটেছিল আল্লাহ্র রসূলদের ও তাদের অনুসারীদের ক্ষেত্রে যাদের ক্ষতি করা হয়েছিলো এবং তাদের প্রতি শত্রুতা প্রকাশ করা হয়েছিলো; এই উম্মাহর মুহাজির, বিজ্ঞানী, ইবাদতকারী, ব্যাবসায়ী ও দ্বীনের সাহায্যকারীদের মতো যারা দুর্দশাগ্রস্থ হয়েছিলেন।

 

দুর্দশাগ্রস্থ হওয়া অবধারিত ব্যাপার

কিছু নির্দিষ্ট ঘটনার ক্ষেত্রে, সমর্থন প্রদর্শন করা আর অস্বীকৃতি গোপন করা বৈধ, সেই ব্যক্তির ঘটনার মতো যাকে অস্বীকৃতি (কুফরি) মূলক শব্দ উচ্চারনে বাধ্য করা হয়েছে। এখানে যা বুঝানো হয়েছে তা হল এটি অবধারিত যে প্রত্যেকেই দুর্দশা ও ক্ষতির মুখোমুখি হবে। দুর্দশামুক্ত হওয়ার কোন উপায় নেই।

তাই মহান আল্লাহ এই পয়েন্টটি বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন এটি বলার মাধ্যমে যে মানুষকে দুর্দশার মুখোমুখি হতে হবে এবং এই দুর্দশা সুখ অথবা দুঃখের মধ্য দিয়ে হতে পারে।। মানুষকে যেটা সন্তুষ্ট করে আর ক্ষতি করে তা দিয়েই তাকে দুর্দশার সম্মুখীন হতে হবে, তাই তাকে সবর অবলম্বন করতে হবে এবং আল্লাহ্র প্রশংশা করতে হবে। আল্লাহ বলেন,

إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ﴿٧﴾

“যা কিছু এ জমিনের বুকে আছে আমি তাকে তার জন্য শোভা বর্ধনকারী করে পয়দা করেছি, যাতে করে তাদের (মানবজাতিকে) আমি পরীক্ষা করতে পারি যে তাদের মধ্যে আমলে কে শ্রেষ্ঠ।” (সূরা আল কাহফ, ১৮ :৭)

وَبَلَوْنَاهُم بِالْحَسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ﴿١٦٨﴾

“আমি তাদের পরীক্ষা করছিলাম ভাল অবস্থা ও বিপর্যয়ের মাধ্যমে যাতে করে তারা ফিরে আসে (আল্লাহ্র আনুগত্যের দিকে)।” (সূরা আল আ’রাফ, ৭ : ১৬৮)

فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَىٰ ﴿١٢٣﴾

وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ ﴿١٢٤﴾

“… অতঃপর (তোমাদের জীবন পরিচালনার জন্য) আমার কাছ থেকে হিদায়াহ (পথনির্দেশ) আসবে, এরপর যে আমার হিদায়াহ অনুসরন করবে না সে না কখনো (দুনিয়ায়) বিপথগামী হবে, না (আখিরাতে) বিষণ্ণ হবে।

কিন্তু যে-ই আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে (অর্থাৎ, না কুরআনে বিশ্বাস করবে অথবা না এর আদেশ নিষেধ মেনে চলবে, ইত্যাদি), নিঃসন্দেহে তার জন্য রয়েছে কষ্টপূর্ণ জীবন, এবং আমি তাকে পুনরুত্থান দিবসে অন্ধ করে উঠাবো।” (সূরা তোয়া হা, ২০ :১২৩-১২৪)

أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّـهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ ﴿١٤٢﴾

“তুমি কি মনে করো যে তুমি জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ আল্লাহ এখনও জানিয়ে দেন নি যে তোমাদের মধ্যে কারা আল্লাহ্র পথে জিহাদ করে আর জানিয়ে দেন যে কারা সবরকারী (ধৈর্যশীল)।” (সূরা আল ইমরান, ৩ :১৪২)

সূরা আল ইমরানের এই আয়াতটি আল্লাহ এর পূর্বের সূরাতে (সূরা আল বাকারাতে) বলেছেন,

أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلِكُم ۖ مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّىٰ يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَىٰ نَصْرُ اللَّـهِ ۗ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّـهِ قَرِيبٌ ﴿٢١٤﴾

“তোমরা কি মনে করেছ যে তোমরা কোন পরীক্ষা দেওয়া ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে যেমনটি তোমাদের পূর্বের লোকদের পরীক্ষা করা হয়েছিলো ? তার কঠোর দারিদ্রতা ও মুশকিল দ্বারা ব্যথিত হয়েছিলো এবং এমনভাবে প্রকম্পিত হয়েছিলো যে এমনকি রসুল ও তার সাথে থাকা ইমানদারগণ বলে উঠেছিল, ‘আল্লাহ্র সাহায্য কখন আসবে?’ হ্যাঁ ! নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র সাহায্য নিকটেই।” (সূরা বাকারা, ২ :২১৪)

দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাওয়া ছাড়া আত্মা কখনোই পরিশুদ্ধ ও আল্লাহভীরু হবে না। এর উদাহারন ঠিক এ ব্যাপারটির মতো যে, স্বর্ণ কখনোই বিশুদ্ধ হয় না যতক্ষণ না এর নিকৃষ্ট ধাতুগুলো অপসারিত হয়। আত্মা হল অজ্ঞ ও ন্যায়বিরুদ্ধ এবং এটিই অমঙ্গলের উৎস যা বান্দার সম্মুখীন হয়। আল্লাহ বলেন,

مَّا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّـهِ ۖ وَمَا أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍ فَمِن نَّفْسِكَ ۚ

“তোমাদের কাছে যে কল্যাণ পৌঁছায় তা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে এবং যে অমঙ্গল তোমাদের উপর আপতিত হয় তা তোমাদের কাছ থেকে।” (সূরা আন নিসা, ৪ :৭৯)

أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُم مُّصِيبَةٌ قَدْ أَصَبْتُم مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّىٰ هَـٰذَا ۖ قُلْ هُوَ مِنْ عِندِ أَنفُسِكُمْ ۗ إِنَّ اللَّـهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴿١٦٥﴾

“অথবা যখন তোমাদের উপর মুসিবত এলো তখন তোমরা বললে ‘এ বিপদ কোথা থেকে আসলো ?’ অথচ তোমরা তো দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। বল, ‘এটি তোমাদের কাছ থেকে এসেছে (তোমাদের মন্দ কর্মের কারনে)’ ” (সূরা আল ইমরান, ৩ :১৬৫)

وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ ﴿٣٠﴾

“যে বিপদই তোমাদের উপর আপতিত হোক না কেন তা তোমাদের হাতের কামাই এর ফল। এবং তিনি প্রচণ্ড ক্ষমাশীল।” (সূরা আশ সূরা, ৪২ :৩০)

ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّـهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ ۙ وَأَنَّ اللَّـهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴿٥٣﴾

“এটা এ কারনে যে, আল্লাহ যখন কোন জাতিকে কোন নিয়ামত দান করেন তিনি ততক্ষন পর্যন্ত তার সে নিয়ামত (তাদের জন্য) বদলে দেন না যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে।” (সূরা আনফাল, ৮ : ৫৩)

وَإِذَا أَرَادَ اللَّـهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ ۚ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِ مِن وَالٍ ﴿١١﴾

“আল্লাহ যখন কাউকে শাস্তি দিতে চান তখন তা প্রতিহত করার কেউ থাকে না, না তিনি ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক থাকতে পারে !” (সূরা আর-রদ, ১৩ :১১)

আল্লাহ আদম (আঃ) থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জাতির উপর তার আযাবের ঘটনা জানিয়ে দিয়েছেন। আর তা উল্লেখ করার সময় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে তারা কিভাবে নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিলো, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের প্রতি অন্যায়কারী ছিলেন না। যুলুমের প্রথম স্বীকারোক্তি করেছিলেন আমাদের পিতামাতা, আল্লাহ বলেছেন যে তারা বলেছিলেন,

قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ ﴿٢٣﴾

“(নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে) তারা দুজনই বলে উঠলো, ‘হে আমাদের রব, আমরা আমাদের নিজেদের উপর যুলুম করেছি, আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন তাহলে আমরা অবশ্যই চরম ক্ষতিগ্রস্তদের দলে শামিল হয়ে যাবো। ’ ” (সূরা আ’রাফ, ৭ :২৩)

আল্লাহ শয়তানকে বলেছিলেন,

لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنكَ وَمِمَّن تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِينَ ﴿٨٥﴾

“তোকে আর তোর অনুসারীদের সবাইকে দিয়ে আমি জাহান্নাম পূর্ণ করবই।” (সূরা সাদ, ৩৮ :৮৫)

আর শয়তান বলল,

قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ ﴿٣٩﴾ إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ ﴿٤٠﴾

“সে বলল, ‘হে আমার রব, আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন (নোটঃ শয়তান এভাবে সরাসরি আল্লাহ্কে দোষ দিলো নিজের পথভ্রষ্টতার জন্য) তাই আমি নিশ্চয়ই দুনিয়াতে তাদের জন্য (মানবজাতি) ভুল পথকে সুশোভিত করে দিবো এবং আমি সবাইকে পথভ্রষ্ট করে দিবো (তবে) তাদেরকে ছাড়া, যারা ইখলাসের (একনিষ্ঠতার) সাথে আপনার ইবাদাত করবে। ’ ” (সূরা আল হিজর, ১৫ :৩৯-৪০)

আল্লাহ বললেন,

إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ ﴿٤٢﴾

“এ পথভ্রষ্ট মানুষদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরন করবে তারা ছাড়া আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন কতৃত্ব চলবে না।” (সূরা আল হিজর, ১৫ :৪২)

আমাদের পূর্ববর্তী সম্মানিত ধার্মিক ব্যক্তিগণ (সালাফগণ) স্বীকার করেছেন যে এর প্রকৃত অবস্থা হল আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ) আর ইবন মাসউদ (রাঃ) যা বলেছেন – “আমি এই বিষয়ে আমার যে মতামত দিচ্ছি, তা যদি সঠিক হয় তবে সেটা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মঞ্জুর করা, আর যদি তা ভুল হয়ে থাকে তবে সেটা আমার পক্ষ থেকে ।”

আবু যর (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে আল্লাহ বলেছেন, “……. হে আমার বান্দারা ! এ তো তোমাদের আমলেরই ফলাফল। আমি তোমাদের জন্য তা হিসেব করে রেখেছি। অতঃপর আমি তোমাদেরকে পুরোপুরিভাবে তোমাদের আমলের প্রতিফল দান করবো। অতএব, যে ভাল ফল পাবে সে যেন আল্লাহ্র প্রশংসা করে এবং যে খারাপ প্রতিফল লাভ করে সে যেন এ জন্য নিজেকেই দায়ী ও অভিযুক্ত করে।” (মুসলিম; অধ্যায় – সদ্ব্যবহার, পারস্পরিক সম্পর্ক ও শিষ্টাচার)

 

ইমাম ইবনে কায়্যিমের কিতাব আল ফাওাইদ এর ইংলিশ ট্রান্সলেশন থেকে অনূদিত

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-J

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বিদআত সিরিজ (পর্ব ১) বিদআতের স্বরূপ

 

 

The Greatest Nation·Thursday, July 14, 2016

 

 

বিদআত বলতে কি বুঝায় ?

ভাষাগত অর্থঃ

ভাষাগতভাবে বিদআত বলতে বুঝায় কোন মডেল বা নমুনা ছাড়াই নতুনভাবে উদ্ভাবিত বিষয়বস্তুকে।

শারিয়াহ’র সংজ্ঞাঃ

রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “প্রত্যেক নতুনভাবে উদ্ভাবিত বিষয়বস্তু (দ্বীন এর ক্ষেত্রে) হল বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআত পথভ্রস্টতা এবং প্রত্যেক পথভ্রস্টতার পরিণতি জাহান্নাম।” (তিরমিযি -২৬৭৬)

“প্রত্যেক নতুনভাবে উদ্ভাবিত বিষয়বস্তু (দ্বীন এর ক্ষেত্রে) হল বিপথগামী এবং পথভ্রষ্টতা।” (আবু দাউদ-৪৬০৭)

“আমি তোমাদেরকে নতুনভাবে উদ্ভাবিত বিষয়বস্তু (দ্বীন এর ক্ষেত্রে) এর ব্যাপারে সতর্ক করছি, এবং প্রত্যেক নতুনভাবে উদ্ভাবিত বিষয়বস্তু (দ্বীন এর ক্ষেত্রে) বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআত (দ্বীন এর ক্ষেত্রে) পথভ্রস্টতা এবং প্রত্যেক পথভ্রস্টতার পরিণতি জাহান্নাম।” (সুনান নাসাঈ-১/২২৪)

প্রথম দুটি হাদিস ইবন হাযার (রহ.)সাহিহ বলেছেন (তাখরিয হাদিস ইবনুল হাজিব,১/১৩৭) এবং তৃতীয় হাদিসটি ইবন তাইমিয়্যাহ (রহ.)সাহিহ বলেছেন। (মাযমু’উল ফাতওয়া,৩/৫৮)

 

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.)বলেন, “ভাষাগতভাবে বিদআত বলতে বুঝায় প্রথমবার সম্পন্ন হয়েছে এমন কিছু, যার অনুরুপ উদাহারন অতীতে দেখা যায় না। শারিয়াহগতভাবে বিদআত বলতে বুঝায় সেগুলোকে, যেগুলোর ব্যাপারে শারিয়াহ থেকে কোন প্রমান পাওয়া যায় না।”

ইমাম শাফি’ (রহ.)বলেছেন, “বিদআত হল সেটাই, যেটা কিনা কুরআন, সুন্নাহ বা সাহাবাদের উক্তির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত নয়।”

ইবন আল জাওজি (রহ.)বলেছেন, “বিদআত হল ইবাদাতের এমন একটি রূপ, যেটা রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবিদের সময় বিদ্যমান ছিল না, পরবর্তীতে ইবাদাত হিসেবে তা চালু হয়েছে।”

ইবন রজব (রহ.)বলেছেন, “রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসের অংশ - ‘প্রত্যেক বিদআত পথভ্রস্টতা’-এর অর্থটি ব্যাপক অর্থ বহন করে , যা বিদআতের ব্যাপারে সবই অন্তর্ভুক্ত করে এবং এটি দ্বীনের একটি বড় ধরনের মৌলিক ভিত্তি; যেমনটি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিস এ রয়েছে – “যে ব্যক্তি দ্বীন এর মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করবে যেটার প্রমান দ্বীন থেকে পাওয়া যায় না, সেটা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারি ৩/১৬৭/২৬৯৭)। তাই কোন ব্যক্তি যদি কোন নতুন প্রথা চালু করে দ্বীন এর সাথে সেটাকে সম্পৃক্ত করে আর সেটার যদি দ্বীন এর উপর কোন ভিত্তি না থাকে, তাহলে সেটা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে; আর দ্বীন তো এটা থেকে সম্পূর্ণই মুক্ত - হোক এটা আকিদার কোন ইস্যু অথবা হোক সেটা ই’বাদাহ’র ক্ষেত্রে বাহ্যিক/ অভ্যন্তরীণ কাজ অথবা উক্তি।” (শারহ আল আরবা’ঈন)

এছাড়াও ইবন রজব (রহ.)তার সুপ্রসিদ্ধ কিতাব জামি’ আল উলুম ওয়াল হিকামে বলেছেন, “সুন্নাহ হল অনুসৃত পথ; এটি অন্তর্ভুক্ত করে যা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং খুলাফায়ে রাশিদিন মেনে চলতেন –আকিদাগত বিশ্বাস, ইবাদাতের নিয়মনীতি এবং আল্লাহ্‌ও তার রসুলের (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বাণী …… এটিই হল পরিপূর্ণ সুন্নাহ।”

আশ-শাতিবী (রহ.)তার সুপ্রসিদ্ধ কিতাব আল-ই’তিসাম এ বলেন, “বিদআত হল দ্বীনের মধ্যে চালু হওয়া নতুন পথ (বিশ্বাস অথবা ইবাদাত) যার মাধ্যমে আল্লাহ’র নৈকট্য অন্বেষণ করা হয়, কিন্তু শারিয়াহ অনুসারে কোন নির্ভরযোগ্য দলীল দিয়ে সমর্থিত হয় না – না সমর্থিত হয় এর ভিত্তি অথবা এর পদ্ধতি ।”

 

বিদআতের মধ্যে কি সত্যিই কোন শ্রেণিবিভাগ আছে ?

ইসলামের শত্রু এবং বিদআতীরা বিদআত সৃষ্টি করার মাধ্যমে ইসলামকে বিভক্ত করতে চায় এবং তারা বিদআতকে ভাল বিদআত বা বিদআতে হাসানাহ হিসেবে বৈধ প্রমান করার জন্য কিছু হাদিস ব্যবহার করে। তাদের অসার দাবীকে এই সিরিজের তৃতীয় আর্টিকেলে খন্ডন করা হয়েছে। সে আর্টিকেল পড়ার আগে চলুন আমরা বিদআতের শ্রেণীবিভাগের বাস্তবতা সম্পর্কে জেনে নেই যে তা আদৌ থাকার কথা কিনা।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসের অংশ -“.... প্রত্যেক বিদআত”– এটি পরিপূর্ণ,ব্যাপক এবং সর্বজনীন অর্থ প্রকাশ করে। আরবিতে “কুল্লু”(প্রত্যেক) শব্দটি দৃঢ় গ্র্যামারটিক্যাল পার্টিক্যাল দ্বারা বেষ্টিত হওয়ার মাধ্যমে একটি নামপদকে সর্বজনীন ও সর্ব –পরিবেষ্টনকারী অর্থের রূপ দেয়।

আল্লাহ তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে অল্প কথায় ব্যাপক অর্থ প্রকাশের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন সৃষ্টি জগতের জন্য এক বিশাল রহমত। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তো তা-ই প্রকাশ করতেন যা তিনি বলতে চাইতেন। যখন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন “প্রত্যেক বিদআত পথভ্রষ্টটা....” – তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতেন যে তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কি বলছেন,এ ব্যাপারে তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) মোটেও অসচেতন ছিলেন না বরং আল্লাহ্‌র বান্দাদের মধ্যে তো তিনিই (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সবচেয়ে বেশী একনিষ্ঠ আর উম্মতের জন্য সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এভাবে বলার মাধ্যমে উম্মতের জন্য বিদআতের ধারনাটা আরও পরিষ্কার করে দিলেন আর সেই সাথে উম্মতকে বিদআতের আসল চেহারা ও তার পরিনতির ব্যাপারে সাবধান করে দিলেন, আর আমরা সাহাবীদের মধ্যেই এই সাবধানতার অনুশীলন সবচেয়ে বেশী দেখতে পাই।

এরপরেও কিভাবে বিদআতকে ভালো বা কল্যাণকর হিসেবে চিহ্নিত করা যায় যেখানে তিনি ব্যাপক অর্থবিশিষ্ট শব্দ দিয়ে ব্যাপারটিকে পরিস্কার করে দিয়েছেন ?

 

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদআত সম্পর্কে বলেছিলেনঃ “যদি কেউ এমন একটি কাজ করল যা (দ্বীন এর ক্ষেত্রে) আমাদের (রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবীদের) অনুসরনে না, তবে সে কাজটি প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারি ও মুসলিম)

“অতঃপর নিশ্চয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ বানী হল আল্লাহ্‌র বানী এবং সর্বোত্তম পন্থা হল মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) পন্থা। সর্বনিকৃষ্ট বিষয় হল যা দ্বীন সম্পর্কে (মনগড়াভাবে) নতুন সৃষ্টি হয়েছে এবং (এমন) প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই (বিদআত) গোমরাহী।” (মুসলিম)

 

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) বলেন, “সুন্নত অনুসরন কর এবং বিদআত কর না। যা আমাদের দেওয়া হয়েছে তা-ই যথেষ্ট এবং প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী।” [ আবু খাইসামাহ থেকে বর্ণিত, কিতাবুল ই’লম (৫৪০); দারিমী ও এটি বর্ণনা করেছেন ]

আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) বলেন, “প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী যদিও লোকেরা এটিকে উত্তম মনে করে থাকে।” (দারিমী)

ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন, “কোন মুসলিমের জন্য এটি হালাল নয় যে সে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিস ‘প্রত্যেক বিদআত পথভ্রষ্টতা’ - এই ব্যাপক অর্থবিশিষ্ট বক্তব্যটিকে সাধারনভাবে বর্জন করে এর বিরোধীতা করবে আর দাবি করবে প্রত্যেক বিদআতই যে পথভ্রষ্ট – সে কথা ভুল; প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হাদিসের অপব্যাখ্যা করে তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরুদ্ধে চলে যাওয়া হয়।” (ইকতিদা সিরাত আল-মুস্তাকিম)

ইমাম শাফি’ বলেন, “যে ব্যক্তি কোন বিদআতকে ভাল বিদআত হিসেবে মনে করে, সে যেন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সংশোধন করতে চাইলো।” (বুলুগুল মা’রাম, ১৯০ পৃষ্ঠা, ফুটনোট ২)

উল্লেখ্য, কিছু ব্যক্তি ইমাম শাফি’র একটা উক্তি ব্যবহার করে থাকেন যে তার মতে বিদআত ২ প্রকার। ইমাম আয-যাহাবী এবং আরো অনেক হাদিস বিশেষজ্ঞ’র মতে তার এই উক্তি দুর্বল অথবা ভিত্তিহীন।

 

প্রসঙ্গঃ পার্থিব বিষয়ে নতুন কিছুর উদ্ভাবন

পার্থিব বিষয়ে নতুন কিছুর উদ্ভাবন, যার সাথে দ্বীন এর কোন সম্পর্কই নেই তা শারিয়াহগতভাবে বিদআত নয়। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এ ধরণের নব উদ্ভাবিত বিষয়ের ক্ষেত্রে আমাদের নিষেধ করেন নি। নিষিদ্ধতার প্রমান না পেলে সব কিছুই বৈধ। তবে সেগুলো শারিয়াহগত ভাবে বিদআত হিসেবে বিবেচিত হবে না কারন সেগুলো প্রকৃতপক্ষে ইবাদাহ সম্পর্কিত আমল নয়।

রাফি ইবন খাদিজ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)যখন মদিনায় আসলেন, তখন মদিনার লোকেরা খেজুর গাছে তা’বীর করছিলো। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা এমনটি কেন করছ ?” তারা উত্তর দিল, “আমরা সবসময়ই এমনটি করে আসছি।” রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বললেন, “মনে হয় তোমরা এমন না করলেই ভাল হয়।” সুতরাং তারা এটা করা ছেড়ে দিল। কিন্তু এতে ফলন কম হল। লোকেরা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কাছে আসলো। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “আমি (তোমাদের মত) একজন মানুষ। আমি যখন তোমাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে কোন বিষয়ে নির্দেশ দেই, তখন তোমরা তা গ্রহন করবে; আর যখন আমি দুনিয়া সম্পর্কে আমার নিজের মত অনুসারে তোমাদেরকে কোন বিষয়ে নির্দেশ দেই, তখন (মনে করবে যে) আমিও একজন মানুষ। (এক্ষেত্রে আমার ভুল হতে পারে)।” (মুসলিম)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বিদআত সিরিজ (পর্ব ২) বিদআত সম্পর্কে কুরআনের আয়াত, তাফসীর, হাদিস এবং সালাফদের উক্তি

 

 

The Greatest Nation·Thursday, July 14, 2016

 

 

 

প্রথম আয়াত

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ

“……আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের উপর আমার (প্রতিশ্রুত) নিয়ামত আমি পূর্ণ করে দিলাম, আমি তোমাদের জন্য ইসলামকেই দ্বীন (জীবনবিধান) হিসেবে মনোনীত করলাম……” (সূরা আল মায়িদাহ , ৫ :৩)

এ আয়াত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলো যে, দ্বীন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে এবং দ্বীন ইসলামে আর না কোন কিছু না যোগ হবে অথবা না তা থেকে কিছু বাদ পড়বে। বিদআতের বিরোধীতার জন্য এবং আল্লাহ্‌র দেখানো পথকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য এই আয়াত বুঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা সাহাবীরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন।

এই আয়াতটি আ’রাফার দিনে নাজিল হয় এবং এটি নাজিল হওয়ার পর থেকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তিকাল পর্যন্ত (ইবন জারির আত তাবারীর মতে ৮১ দিন ) হালাল-হারাম এর ব্যাপারে আর কোন আয়াত নাজিল হয় নি।

হযরত আনতারা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ যখন এই আয়াতটি নাযিল হয় তখন উমর (রাঃ) কাঁদতে শুরু করলেন। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কাঁদার কারন জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “আমরা এই দ্বীন সম্পর্কে আরও বেশী আশা করছিলাম। কিন্তু তা যখন পূর্ণতা লাভ করেছে, তখন তো এর চেয়ে বেশী আশা করা যায় না বরং ক্রমান্বয়ে এর অবনতিই আশংকা করা যায়।” রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন, “তুমি সত্য বলেছো।” (তাফসীর ইবন কাসির, তাফসীর তাবারী)

সুবহান আল্লাহ্‌! উমর (রাঃ) বুঝতে পেরেছিলেন যে, দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণতা লাভের মাধ্যমে হালাল-হারাম আর আদেশ-নিষেধ সংক্রান্ত ওহী স্থগিত থাকার অর্থ হল রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) শীঘ্রই এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন। আর তিনি কি চমৎকারভাবেই না দ্বীন এর এই “কমে যাওয়া”র ব্যাপারটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, যা কিনা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আরেকটি হাদিস দিয়ে সমর্থিত হয়, যেখানে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “নিঃসন্দেহে, ইসলাম শুরু হয়েছিল অপরিচিত অবস্থায় আর তা পুনরায় ফিরে যাবে অপরিচিত অবস্থায় -সে অপরিচিতদের জন্য সুসংবাদ।” (মুসলিম, তিরমিযি)

একটি অবাক করা ব্যাপার হল, অধিকাংশ মুসলিমরা (হোক আলিম অথবা অন্যান্যরা) এই আয়াতের ব্যাপারে মোটেও সৎ না অথচ ইয়াহুদিরা এই আয়াত এর তাৎপর্য ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলো আর উমর (রাঃ) এর কাছে এই আয়াত সম্পর্কে তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলো -

“আপনি এমন একটি আয়াত তিলাওয়াত করেছেন যা আমাদের উপর নাযিল হলে আমরা দিনটিকে ঈদ হিসেবে পালন করতাম।” তখন উমর (রাঃ) বললেন, “আমি জানি এই আয়াত কখন আর কোথায় নাযিল হয়েছিল, এবং যখন এই আয়াত নাযিল হয়েছিল তখন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কোথায় অবস্থান করেছিলেন – (এটা নাযিল হয়েছিলো) আ’রাফার দিনে, আর আল্লাহ’র শপথ! আমি আ’রাফায় ছিলাম।” (বুখারি)

মুসনাদে আহমাদ থেকে বর্ণিত একই বর্ণনায় পাওয়া যায় উমর (রাঃ) আরও বলেন যে, এটি আরাফায় বিকালে নাযিল হয়েছিল আর দিনটি ছিল পবিত্র জুমু’আহ।

ইবন মারদাওিহ থেকে বর্ণিত আছে যে আলি (রাঃ) বলেন, “যখন এই আয়াত নাযিল হয়, তখন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আ’রাফায় দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলেন আর এটা ছিল বিকেল (আসর ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়)।”

সাহাবীরা এই আয়াত নাযিল হওয়ার বরাবর সময় ও স্থান সম্পর্কে জানতেন,আর এই আয়াত তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে ইসলামের ব্যাপারে আল্লাহ্‌র অনুমোদন ও নিশ্চয়তা প্রদান করে, যা প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে দেওয়া বিরাট এক অনুগ্রহ।

মহান আল্লাহ মানবজাতির জন্য এই দ্বীন অর্থাৎ জীবনব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে মনোনীত করে দিয়েছেন, আর এই দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ হিসেবে মনোনীত করার পর এতে কোন কিছু যুক্ত করা বা বর্জন করে দেওয়ার ব্যাপারে এই দ্বীন সম্পূর্ণ মুক্ত।

এই ব্যাপারটি তো এমনকি ইহুদীরা পর্যন্ত ভালভাবে বুঝতে পেরে উমার (রাঃ) কে বলেছিল যে তাদের উপর এই আয়াত নাযিল হলে তারা দিনটিকে ঈদ হিসেবে পালন করতো। কিন্তু সাহাবীরা – যারা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সত্যিকার অর্থেই নিজেদের আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন, তারা এই আয়াতের তাৎপর্য বুঝতে পেরেও যে দিন এই আয়াত নাযিল হয়েছিলো তার স্মরণে প্রতি বছর ওই একই দিন এ ঈদ পালন করার মত বিদআত চালু করার কোন ইচ্ছা পোষণ করতেন না, যদিও এই আয়াত উম্মাহকে এক চরম মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। কারন সুন্নাহ ও বিদআত সম্পর্কে তারা খুব ভালমতোই জানতেন আর এটাই হল রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা দ্বীনের ক্ষেত্রে নিজেদের মর্জি মোতাবেক চলতেন না, তারাই ছিলেন সুন্নতের সর্বোত্তম অনুসারী আর এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ অংশ।

 

ইবন কাসির (রহ.) বলেন, “আল্লাহ’র দেওয়া শ্রেষ্ঠ রহমতগুলোর একটি হল এই যে, তিনি দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন,তাই মুসলিমদের অন্য কোন জীবনব্যবস্থা আর তাদের নিজেদের নবী (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া অন্য নবীর প্রয়োজন নেই। এ কারনেই আল্লাহ্‌ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে খাতামুন-নাবিয়্যিন হিসেবে ভূষিত করেছেন এবং জিন ও মানবজাতির কাছে তার বার্তাবাহক হিসেবে পাঠিয়েছেন। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)যেগুলো হালাল বলেছেন কেবল সেগুলোই হালাল আর যেগুলো হারাম বলেছেন কেবল সেগুলোই হারাম। কেবলমাত্র সেগুলোই দ্বীনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে যেগুলো রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যেগুলো আমাদের জানিয়ে যাননি সেগুলো কখনও দ্বীনের অংশ হতে পারে না। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সবই ছিল সত্য ও শুদ্ধ, এমনকি তাতে কোন ধরনের সূক্ষ্ম ভুল বা অসততা ছিলোনা।”

 

ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, “যে ব্যক্তি ইসলামে বিদআত শুরু করে আর মনে করে সেটা কল্যাণকর, সে যেন দাবী করলো রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে প্রতারণা করেছে। আল্লাহ কি বলেছেন তা পড়ুন - ‘...... আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের উপর আমার (প্রতিশ্রুত) নিয়ামত আমি পূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের জন্য দ্বীন (জীবনবিধান) হিসেবে আমি ইসলামকেই মনোনিত করলাম……’ (সূরা আল মায়িদাহ, ৫:৩)। তাই দ্বীনের ক্ষেত্রে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও সাহাবিদের সময় যেটা দ্বীনের অংশ ছিল না, সেটাকে এর পরবর্তী সময়েও দ্বীনের অংশ হিসেবে মনে করা ও পালন করা যাবে না। আর এই উম্মতের শেষ অংশ ততক্ষন পর্যন্ত কখনোই পরিশুদ্ধ হবে না, যতক্ষন পর্যন্ত না তারা এই উম্মতের প্রথম অংশ (সাহাবা) যেটা দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়েছিলেন তারাও সেটা দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়।” (ইমাম শাতিবী’র আল ই’তিসাম)

 

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, “এমন কিছুই নেই যেটার ব্যাপারে আল্লাহ্‌ আদেশ দিয়েছেন অথচ আমি আদেশ দেই নি। আর না এমন কিছু আছে যা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে আল্লাহ্‌নিষেধ করেছেন অথচ আমি নিষেধ করিনি।” (বায়হাকি, ৭/৭৬)

বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে জানা যায়, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আমি তোমাদের যা কিছু করতে আদেশ করেছি সেগুলো ছাড়া এমন কিছু তোমাদের না বলে যাইনি যা তোমাদেরকে আল্লাহ’র নিকটবর্তী হতে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে; এবং আমি তোমাদের যা কিছু থেকে নিষেধ করেছি সেগুলো ছাড়া এমন কিছু তোমাদের না বলে যাইনি যা তোমাদের জাহান্নাম এর নিকটবর্তী ও আল্লাহ্‌থেকে দুরবর্তী করে দিবে।”

আবু যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ওফাতের পূর্বেই দুই ডানায় ভর করে উড়ে যাওয়া পাখি থেকেও আমাদেরকে শিক্ষা দান করেছেন।” (মুসনাদে আহমাদ)

এক মুশরিক সালমান আল-ফারসী (রাঃ) কে বলল, “তোমাদের নবী তো তোমাদের সবই শিখিয়েছেন, (এত বেশী শিখিয়েছেন যে) এমনকি টয়লেটের ব্যাপারেও।” সালমান আল ফারসী (রাঃ) জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)আমাদেরকে এটাও নিষিদ্ধ করেছেন যে আমরা যেন কিবলামুখী হয়ে টয়লেট না করি আর তিনটির কম পাথর দিয়ে পবিত্রতা অর্জন না করি, আর ডান হাত পবিত্রতা অর্জনের জন্য ব্যবহার না করি এবং গবর বা হাড়কে পবিত্রতার কাজে ব্যবহার না করি।” (মুসলিম)

 

আয়েশা (রাঃ)থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, “যদি কোন ব্যক্তি এমন কাজ করলো যা (দ্বীনের ক্ষেত্রে) আমাদের (রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীদের) অনুসরনে না, তবে সে কাজটি প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারি ও মুসলিম)

আশ-শাওকানি (রহ.) নাইলুল আওতার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইমাম নববী (রহ.) এই হাদিসটির প্রতি ভালোভাবে মনোযোগ দেওয়ার জন্য এবং এই হাদিসটি (উপরের হাদিসটি) মন্দের (মুনকার) বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে ও মুনকারকে বাতিল করতে উপদেশ দিয়েছেন।

 

“যে আমাদের দ্বীনে নতুন কোন প্রথা চালু করলো যা এই দ্বীনের কোন অংশ নয়, তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যাত।” (মুসনাদে আহমাদ)

ইবন রজব (রহ.) এই হাদিস সম্পর্কে বলেন, “এই হাদিসটি একটি পরিস্কার দলিল যে, যেসব কাজ (দ্বীনের ক্ষেত্রে) শারিয়াহ দ্বারা অনুমদিত নয় সেগুলো অবশ্যই ইসলাম কতৃক প্রত্যাখ্যাত।” (জামি’ আল উসুল, ১/১২০)

 

আল-মারওয়াজি (রহ.) তার আস-সুন্নাহ গ্রন্থে বলেন, উমর ইবন আবদুল আযীয (রহ.) বলেন, “সুন্নত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরও এ ব্যাপারে কারো কোন ওজর থাকার মানে হয় না যে, কেউ এমন একটি ভুলের উপর পথভ্রষ্ট অবস্থায় আছে যাকে সে হিদায়াত মনে করছে।”

 

দ্বিতীয় আয়াত

وَأَنَّ هَـٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿١٥٣﴾

“এটিই আমার দেখানো পথ, এটিই অনুসরন কর এবং অন্য কোন পথ অনুসরন কর না, অন্যান্য পথগুলো তার পথ থেকে তোমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিবে। আল্লাহ্‌তোমাদের এটি আদেশ করছেন যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার। ” (সূরা আল আনআ’ম :১৫৩)

ইবন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)মাটিতে একটি দাগ কাটলেন আর বললেন, ‘এটিই আল্লাহ’র দেখানো সরলপথ’। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ডানে-বামে কিছু দাগ কেটে বললেন, ‘এই সরলপথের আশেপাশে বেশ কিছু পথ আছে, তার প্রত্যেক পথের মাথায় শয়তান আছে, যে ওই পথের দিকে ডাকে।’ এরপর রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন।” (মুসনাদে আহমাদ, সুনান নাসাঈ, মুসতাদরাক হাকিম, দারিমী)

মুজাহিদ (রহ.) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, “এই আয়াতে অন্যান্য পথ বলতে বুঝানো হয়েছে প্রবৃত্তির অনুসরন ও বিদআতকে।”

আশ-শাতিবী (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, “সরলপথ হচ্ছে আল্লাহর দেখানো সেই পথ, যে পথে তিনি আহবান করেন এবং এই পথটি হল সুন্নত। আর অন্যান্য পথ হল তাদের পথ, যারা এই পথ থেকে মতানৈক্য করে ও আল্লাহ্‌র পথ থেকে সরিয়ে রাখে; এরা হল বিদআতি। এই পথগুলোকে গুনাহের পথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নি, কারন গুনাহের কাজকে কেউ সর্বদা অনুসরনের পথ হিসেবে নেয় না, কারন তা শারিয়াহ’র বিপরিত; বরং এই ব্যাখ্যাটি নব উদ্ভাবিত প্রথা বা বিদআত এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যাকে ভাল মনে করে করা হয় অথচ তা শারিয়াহ’র সাথে সাঙ্ঘর্ষিক।”

 

ইবন মাসউদ (রাঃ) কে একবার সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরলপথ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেনঃ “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এই পথের শুরুতে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে গিয়েছেন, যার সমাপ্তি জান্নাতে। এর ডানে ও বামে দ্রুতগামি মানববাহী ঘোড়া (এটি দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে তারা যে গতিতে মানুষকে দোযখে পরিচালিত করবে তাকে) এই সরলপথের উপর চলতে থাকা মানুষদের তাদের সাথে আসার জন্য জন্য তাদের ডাকতে থাকে; তাই যারা তার ডাকে সারা দিবে তা তাদেরকে দ্রুত জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করবে এবং যারা ওই সরল পথের উপর অবিচল থাকবে, সেই অবিচলতা তাদেরকে জান্নাতের দিকে পরিচালিত করবে।”

 

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন,“আমার উদাহারন সে ব্যক্তির মতো, যিনি আগুন জ্বালালেন, এবং যখন আগুন তার চারদিক আলোকিত করলো, পতঙ্গ ও সে সকল কীট যারা আগুনে ঝাপিয়ে পড়ে, তারা দলে দলে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো আর সে ব্যক্তি তাদের বাধা দিতে লাগলেন। কিন্তু তারা সে ব্যক্তিকে পরাস্ত করে ঝাপিয়ে পড়তে লাগলো। ঠিক তেমনি আমিও তোমাদের কোমর ধরে তোমাদেরকে আগুন থেকে পিছনে টানছি এটা বলে যে – ‘আগুনের কাছ থেকে তোমরা ফিরে আস’, কিন্তু তোমরা আমাকে পরাস্ত করে তাতে ঝাপিয়ে পড়ছো।” (বুখারি, মুসলিম; মুসলিম শরিফে সামান্য কিছু শাব্দিক পরিবর্তনের সাথে এ হাদিসটি বর্ণিত আছে,শেষের দিকে তার বর্ণনায় কিছু অতিরিক্ত সংযোজন আছে।)

 

আল ইরবাদ ইবন সারিয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, “...... আমি তোমাদের কে এক সুস্পস্ট হিদায়াতের উপর রেখে যাচ্ছি, যার রাত হচ্ছে দিনের মতো। ক্ষতিগ্রস্ত ছাড়া কেউই এই পথ থেকে পথভ্রষ্ট হবে না।“ (মুসনাদ আহমাদ, ইবন মাজাহ, মুসতাদরাক হাকিম)

“আমি তোমাদের কাছে দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি, এই দুটো জিনিস আঁকড়িয়ে ধরলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। এগুলো হল আল্লাহ্‌’র কিতাব ও আমার সুন্নত।” (মুসতাদরাক হাকিম)

“...... যে (ব্যক্তি) আমার সুন্নত অনুসরণ করলো সে হিদায়াতপ্রাপ্ত হল, আর যে (ব্যক্তি) বিদআত অনুসরন করলো সে ধ্বংস হল।” (মুসনাদ আহমাদ)

 

আবু নাজিহ আল ইরবাদ বিন সারিয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ একবার রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি অভিব্যক্তিপূর্ণ উপদেশ দিলেন,যা আমাদেরকে ভীষণভাবে প্রকম্পিত করলো আর আমাদের অন্তরে ভয়ের ঢেউ আঘাত করলো আর আমাদের চোখের অশ্রু বর্ষণ করলো। …… তোমাদের মধ্যে যারা ভবিষ্যতে বেঁচে থাকবে তারা অনেক ব্যাপারে মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের জন্য আবশ্যক হবে আমার সুন্নতের অনুসরণ করা আর আমার খুলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নতের অনুসরণ করা এবং তাদের সুন্নতের সাথে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকবে, এবং দ্বীনের মধ্যে সকল বিদআত সম্পর্কে সতর্ক থাকবে কারন প্রত্যেক বিদআত ভুল পথের দিকে পরিচালিত করে।” (দাউদ – হাদিস ৪৬০৭; তিরমিযি – কিতাবুল ইলম, হাদিস ২৬৭৬; ইবন মাজাহ’র আল মুকাদ্দিমাহ – হাদিস ৪২; মুসনাদ আহমাদ – ৪/১২৬/১২৭; আবু দাউদ ও তিরমিযি এই হাদিসকে নির্ভরযোগ্য হাদিস হিসেবে বলেছেন।)

এবং, খুলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নত অনুসরণের ব্যাপারে উমর ইবন আবদুল আযীয (রহ.) বলেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)সুন্নত প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন এবং খুলাফায়ে রাশিদিন সেই সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। সুতরাং সেই সুন্নতের চর্চা প্রমান করে কোন ব্যক্তির আল্লাহ্‌র কিতাবের উপর বিশ্বাস,আল্লাহ্‌কে মান্য করার পরিপূর্ণ ইচ্ছা আর আল্লাহ’র দেওয়া দ্বীনের উপর অবিচলতার ক্ষেত্রে তার সত্যবাদিতা। কেউ এই সুন্নতের বিকৃতি সাধন করতে পারবে না, আর না পারবে কোন কিছু মান্য করতে যা এর বিরোধীতা করে। যে এই সুন্নাহ মেনে চলবে সে সঠিক পথেই চলবে, আর যে এর মাধ্যমে আল্লাহ’র সাহায্য খুঁজবে সে বিজয়ী হবে; এবং যে এর বিরোধিতা করবে ও একে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে আর অন্য কোন পথ অনুসরন করবে, আল্লাহ্‌তাকে সেই পথেই ছেড়ে দিবেন যে পথ সে অনুসরন করতে চায়, ফলে সে জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে, কতই না নিকৃষ্ট সে বাসস্থান।” (ইগাতুল লাহফান, ১/১৫৯)।

হুযায়ফা ইবন আল-ইয়েমেন (রাঃ) বলেন, “ ইবাদাতের ক্ষেত্রে সাহাবীরা যা করেন নি, তা কখনও করবে না।” (আবু দাউদ)

 

“আমি তোমাদেরকে দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার ব্যাপার থেকে সাবধান করছি। তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার কারনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।” (সুনান নাসাঈ ৫/২৬৮, ইবন মাজাহ ৩০২৯, মুসনাদে আহমাদ ১/২১৫,৩৪৭)

হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ একদিন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ইবাদাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য তিন ব্যক্তি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর স্ত্রীদের নিকট আসলো। যখন তাদেরকে (সে ব্যাপারে) জানানো হল, তখন তারা বলল, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে আমাদের তুলনা কোথায়, যার আগে-পরের সব গুনাহ আল্লাহ্‌মাফ করে দিয়েছেন ?”

এরপর তাদের একজন বলল, “আমি সর্বদা সারা রাত সালাত আদায় করি।” অপরজন বলল, “আমি সর্বদা রোযা রাখি, কখনও রোযা ছাড়ি না।” তৃতীয় ব্যক্তি বলল, “আমি সর্বদা মেয়েদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকি, কখনও বিয়ে করব না।”

এমন সময় রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)তাদের কাছে আসলেন আর বললেন, “তোমরাই কি সেসব লোক যারা এসব কথা বলেছ ? আল্লাহর শপথ, আমি আল্লাহ্‌কে তোমাদের থেকে বেশী ভয় করি আর তার নিষিদ্ধ কাজ থেকে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশী পরহেয করি। এরপরেও আমি কোন দিন রোযা রাখি আর কোন দিন ছেড়ে দেই। আমি নামাজও পড়ি, ঘুমিয়েও থাকি, আমি বিয়েও করি। সুতরাং যে আমার সুন্নত থেকে বিমুখ হবে সে আমার কেউ নয়।” (বুখারি, মুসলিম)

এই হাদিস থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, তিন ব্যক্তি বিশুদ্ধ নিয়্যতে কিছু ইবাদাত করতে চাচ্ছে যার মাধ্যমে তারা আল্লাহ’র নৈকট্য অর্জন করতে চায় আর তাদের গুনাহগুলো ঝরিয়ে ফেলতে চায়। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের জলজ্যান্ত উদাহারন দেখিয়ে সুন্নতের সীমারেখা দেখিয়ে দেন আর জানিয়ে দেন, যে কেউই এই সীমারেখা থেকে বিমুখ হবে আর অন্য কোন পথ অন্বেষণ করবে (এমনকি নিয়্যত বিশুদ্ধ হলেও), তার সাথে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কোন সম্পর্ক থাকবে না। নিঃসন্দেহে সেভাবেই আল্লাহ্‌কে ভয় করা (তাকওয়া অবলম্বন করা) উচিত, যেভাবে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্‌কে ভয় করতেন।

সাহাবাদের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হল, তারা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নতের প্রতি বিশুদ্ধভাবে আনুগত্য করতেন আর বিদআতকে ঘৃণা করতেন (যেহেতু তা সুন্নতের বিপরীত) ও এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন চলতেন। নিঃসন্দেহে, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নতের ব্যাপারে তারাই হলেন তাদের পরবর্তী যে কারো থেকে অধিক জ্ঞানী।

কিছু সাহাবা থেকে নিচের এই বর্ণনাটি পাওয়া যায়ঃ

ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, “আমরা আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) এর বাসার সামনে অপেক্ষা করছিলাম একসাথে ফজর সালাত আদায় করতে মাসজিদে যাওয়ার জন্য। আবু মুসা আল-আশআরী (রাঃ) আমাদের কাছে আসলেন আর বললেন, ‘আব্দুর রহমান (আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ) কি বেরিয়ে গিয়েছে ?’ আমরা বললাম, ‘না।’। অতঃপর তিনিও আমাদের সাথে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) ঘর থেকে বের হলে মসজিদে রওনা দেওয়ার জন্য আমরা উঠে গেলাম।

আবু মুসা (রাঃ) তাকে বললেন, “আব্দুর রহমান, আমি কিছুক্ষন আগে মসজিদে এমন একটা ব্যাপার দেখলাম, যা আমার কাছে ভাল বলে মনে হয় নি।” আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “সেটা কি ছিল ?”

আবু মুসা (রাঃ) বললেন, “আপনি যদি বেঁচে থাকেন তবে আপনিও তা দেখবেন। মসজিদে আমি একদল লোক দেখলাম যারা ছোট ছোট দলে বৃত্তাকার হয়ে বসে সালাতের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক বৃত্তাকার দল একজন দলপতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আর প্রত্যেক ব্যক্তির হাতে ছোট পাথর আছে। যখন দলের আমির বলে, ‘একশবার আল্লাহু আকবর বলো’, তখন তারা একশবার আল্লাহু আকবর বলো। এরপর বলা হয় ‘একশবার লা ইলাহা ইল্লালাহ বল’, তখন তারা একশবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো। এরপর বলা হয়, ‘একশবার সুবহান-আল্লাহ বলো’, তারা একশবার সুবহান আল্লাহ বলে।”

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, “তাদেরকে তুমি কি বলেছ ?”

আবু মুসা (রাঃ) বললেন, “আমি আপনার মতামতের জন্য অপেক্ষা করতে চাচ্ছিলাম, তাই তাদের কিছু বলিনি।”

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, “তুমি কি তাদেরকে এর বদলে তাদেরকে নিজেদের গুনাহ গুনে নেওয়ার মাধ্যমে তাদের সওয়াব পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে আসতে পারলে না ?”

এরপর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) মাসজিদের দিকে গেলেন আর আমরাও তার সাথে গেলাম।

তিনি মাসজিদে গিয়ে একটি দলের কাছে গেলেন (যারা একসাথে সেই কাজ করছিলো) আর বললেন, “তোমরা এগুলো কি করছ ?”

তারা বলল, “আব্দুর রহমান, এই ছোট পাথরগুলো দিয়ে আমরা আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও সুবহান আল্লাহ কতবার বলছি তা গুনে রাখছি।”

তিনি বললেন, “তোমরা তোমাদের গুনাহগুলোই গুনে রাখো, আমি তোমাদের নিশ্চিতভাবে বলছি, তোমাদের কোন সওয়াবই হচ্ছে না। দুর্ভাগ্য তোমাদের হে লোকেরা, কত দ্রুতই না তোমরা ধ্বংস হবে। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবীরা যেখানে জীবিত এবং না তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) পোশাক এখনও জরাজীর্ণ হয়েছে আর না তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) পাত্রদানি ভেঙ্গেছে। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, তোমরা অনুসরন করছো এমন একটা দ্বীনের, যেটা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর দ্বীনের থেকে উত্তম (তোমাদের দাবী অনুসারে)অথবা তোমরা বিপথগামীতার দরজা খুলছো।”

তারা বলল, “আল্লাহ’র শপথ করে বলছি হে আব্দুর রহমান, আমাদের ভাল নিয়্যতের কারনে আমরা এটা করছি, অন্য কোন নিয়্যত এতে নেই।”

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, “তাতে কি ? কত মানুষই না ভাল নিয়্যতে ভাল কাজ করতে চায় কিন্তু সেগুলো (সত্যিকার অর্থে) করতে পারে না ? রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের সেসব মানুষ সম্পর্কে জানিয়েছেন যারা কুরআন তিলাওয়াত করবে অথচ তাদের উপর এর কোন প্রভাব থাকবে না বরং কুরআন তাদের কণ্ঠনালীই অতিক্রম করবে। আল্লাহ’র শপথ করে বলছি,আমি প্রায়ই নিশ্চিত যে তোমাদের মধ্যে বেশিরভাগই সে ধরণের লোক।”

এরপর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) তাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

আমর ইবন সালামাহ (রাঃ) বললেন, “সেই দলের সাথে থাকা অনেক ব্যক্তিকেই আন-নাহরাওয়ান এর যুদ্ধে খারিজিদের পক্ষ হয়ে আমাদের (সাহাবাদের) বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমরা দেখেছিলাম।”

[ সুনান দারিমী (১/৭৯) এবং আবু নাঈম এটি নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়েত এ বর্ণনা করেছেন। ]

 

আবদুল্লাহ ইবন আবি সালামাহ থেকে বর্ণিত আছে যে সাহাবী সা’দ ইবন মালিক (রাঃ) দুজন মানুষকে হজ্জ পালন করার সময় বলতে শুনলেন, “লাব্বাইক সাল-মা’আরিজ (আমরা শুনলাম এবং আসলাম, হে ঊর্ধ্বগমনের পথের মালিক)”, সা’দ ইবন মালিক (রাঃ) বললেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সময়ে আমরা (সাহাবীরা) এটি কখনও বলিনি।”

 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, “সালাফদের বাণী ও পথের সাথে লেগে থাকো, দ্বীনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নতুন উদ্ভাবিত ব্যাপার থেকে সতর্ক থাকো, কারন দ্বীনের ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবিত প্রত্যেক কিছুই বিদআত।” (আস-সুয়্যুতির’র সাউনুল মানতাক গ্রন্থে বর্ণিত)

ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, “সুন্নতের মৌলিক নীতিগুলো হল………… বিদআত থেকে দূরে থাকা, আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহি।” (উসুল আস সুন্নাহ)

ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, “উম্মতের প্রথম ভাগ যা দ্বারা উপকৃত হয়েছিল, তা ছাড়া অন্য কিছু উম্মতকে উপকৃত করবে না।” (ইবন তাইমিয়্যাহ’র কিতাব - কাইদাহ জালিলাহ ওয়া তাওাসসুল ওয়াল ওয়াসিলাহ)

ইমাম আল-আওযায়ি’র বলেছেনঃ “সবরের সাথে নিজেকে সুন্নতের গণ্ডির ভিতর সীমাবদ্ধ করে নাও আর এ ব্যাপারে সাহাবীদের অবস্থান কখনও অতিক্রম করবে না; তাদের মত করে সুন্নত আঁকড়ে ধরার চেষ্টা কর আর তারা যা পরিহার করতেন তা পরিহার করে চল। সালাফ আস-সালিহিনদের (সাহাবী এবং তাদের অনুসারীদের) পথকে গ্রহন করে নাও, নিশ্চয়ই যেটা তাদের জন্য পর্যাপ্ত ছিল তা তোমাদের জন্যও পর্যাপ্ত।” (ইবন আল-জাওজী (রহ.) তার কিতাব তালবিস ইবলিস)

ইমাম জুহরী (রহ.) ইমাম মালিক (রহ.) এর এই উক্তিটি গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেনঃ “সুন্নাহ’র সাথে নিজেকে আটকিয়ে রাখাটা ঠিক যেন নুহ (আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নৌকার উদাহারনের ন্যায়। যে এতে চড়ল সে বেঁচে গেল এবং যে তা করলো না সে ধ্বংস হয়ে গেলো।” (দারিমী)

সুফিয়ান আস-সাওরী (রহ.) বলেন, “কাজ ছাড়া কোন কথাই গ্রহণীয় নয়; আর কাজ ও কথা সঠিক নিয়্যত ছাড়া পরিশুদ্ধ নয়; এবং কথা, কাজ ও বিশুদ্ধ নিয়্যত সঠিক হয় না যতক্ষন না পর্যন্ত তা সুন্নত অনুযায়ী করা হয়।”

 

সুফিয়ান আস-সাওরী (রহ.) আরও বলেন, “অন্যান্য যেকোনো পাপের তুলনায় বিদআত শয়তানের নিকট অধিক প্রিয়, কেননা পাপ থেকে তওবা করা হয় (এটাকে পাপ হিসেবে সহজে চিহ্নিত করা যায় বলে) কিন্তু বিদআত থেকে তওবা করা যায় না (কারন মানুষ বিদাআতকে ইবাদাতের নতুন একটা ভাল রূপ হিসেবে বিশ্বাস করে, যা তাকে সেটাকে পাপ হিসেবে চিন্তা করতে দেয় না, এভাবে তার জন্য তওবা করা হয়ে উঠে না।)” (শারহ উসুল ই’তিকাদ)

তিনি আরও বলেন, “… অতএব তোমরা মূল বিষয়ের [রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার সাহাবীদের জামাআত] সাথে নিজেদের দৃঢ়ভাবে আটকিয়ে রাখো।” (আল হিলইয়া, ৬/৩৭৬)

 

শাইখ আল-বারবাহারি (রহ.) বলেন, “জেনে রেখো, যে দ্বীন আল্লাহ’র পক্ষ থেকে এসেছে, সেটি সুউচ্চ ও পবিত্র। এটি এমন কোন দ্বীন নয় যা কিনা মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও মনগড়া মতামতের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই দ্বীনের পবিত্র জ্ঞান আল্লাহ্‌ও তাঁর রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে আমরা পাই, সুতরাং সেটা বাদ দিয়ে তুমি তোমার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না আর এর মাধ্যমে নিজেকে দ্বীন থেকে পথভ্রস্ট করো না এবং দ্বীনের গন্ডি ছেড়ে দিয়ো না। সুন্নত থেকে পথভ্রষ্ট হওয়ার কোন কারণই গ্রহণীয় নয় কারন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)সুন্নতকে পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সাহাবীদের কাছে সুন্নতকে পরিস্কারভাবে তুলে ধরেছেন। মনে রাখবে, তারাই হলেন জামাআত, তারাই উম্মতের প্রকৃত অংশ, আর তাদের সত্যিকার অনুসারীরাই সেই জামাআতের অন্তর্ভুক্ত।”

 

তৃতীয় আয়াত

وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا ﴿١١٥﴾

“যে ব্যক্তি তার কাছে প্রকৃত সত্য স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে আর ঈমানদারদের পথ ছেড়ে অন্য নিয়মনীতির অনুসরণ করবে, তাকে আমি সেদিকেই ধাবিত করব যেদিকে সে ধাবিত হয়েছে, তাকে আমি জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে দিব, কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থল সেটি।” (সূরা আন-নিসা, ৪ :১১৫)

ইমাম ইবন কাসীর (রহ.) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, “এ আয়াতে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ গ্রহন করে। এর ফলে তাদের অবস্থান শারিয়াহ’র অবস্থানের অন্যদিকে হয়, যদিও সত্য তাদের কাছে স্পষ্ট আর তারা সেটা জানেও।”

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, “আমার উম্মতের সকলেই জান্নাতে যাবে (তবে) সে ছাড়া, যে সেখানে প্রবেশ করাকে প্রত্যাখ্যান করবে।” তখন জানতে চাওয়া হল, “কে প্রত্যাখ্যান করবে ?” রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “যে আমাকে মেনে চলবে যে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমাকে অমান্য করে সে যেন জান্নাতে প্রবেশ করাটা প্রত্যাখ্যান করলো।” (বুখারী)

 

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেন, “আমি হাউজের (হাউজে কাউসারের) পাড়ে তোমাদের আগে উপস্থিত থাকবো। যে সেখানে উপস্থিত হবে, সেখান থেকে সে পান করার সুযোগ পাবে। আর যে একবার সে হাউজ থেকে পান করবে সে কখনোই তৃষ্ণার্ত হবে না। অবশ্যই এমন কিছু দল আমার কাছে উপস্থিত হবে যাদেরকে আমি (আমার উম্মত বলে) চিনতে পারবো এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে। কিন্তু এর পরই তাদের ও আমার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেওয়া হবে।”

আবু সাঈদ খুদরি বর্ণিত একই হাদিসে এরপর বলা হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বলবেন, “এরা তো আমারই অনুসারী।” তখন বলা হবে, “আপনি নিশ্চয়ই জানেন না যে, আপনার পড়ে এরা দ্বীনের মধ্যে কই পরিবর্তন করেছে।” এটা শুনে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলবেন, “যারা আমার পড়ে (দ্বীনের মধ্যে) পরিবর্তন করেছে, তারা দূর হোক, দূর হোক।” (বুখারী, মুসলিম – ভিন্ন বর্ণনায় হাদিসটি উল্লেখ করা আছে)

 

“যে ব্যক্তি বিদআত করে অথবা বিদআতিকে সমর্থন করে, তার উপর আল্লাহ্‌, তার ফেরেশতা এবং পুরো মানবজাতির অভিশাপ বর্ষিত হয়।” (বুখারী, মুসলিম)

 

চতুর্থ আয়াত

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴿٦٣﴾

“… সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের এ ব্যাপারে ভয় করা উচিত যে তাদের উপর (এ বিরুদ্ধাচরনের জন্য এ দুনিয়ায়) কোন ফিতনা এসে পড়বে কিংবা (পরকালে) কোন কঠিন আযাব এসে তাদের গ্রাস করে নিবে।” (সূরা নূর, ২৪ :৬৩)

 

ইমাম ইবন কাসীর (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “যে ব্যক্তি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আদেশের এবং তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নতের, হুকুমের, নীতির আর শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। মানুষের কথা ও কাজকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নত ও হাদিসের সাথে মিলিয়ে দেখা উচিত। যদি সেটা তার সুন্নতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে সেটা ঠিক আছে, আর যদি সুন্নাতের সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তবে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে।”

 

এক ব্যক্তি ইমাম মালিক (রহ.) কে জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক কোথা থেকে আমাকে ইহরাম করতে হবে ?” তিনি বললেন, “যেখান থেকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) করতেন – যুল হুলায়ফাহ।” লোকটি বলল, “আমি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কবর এর পাশ থেকে তা করতে চাই।” তিনি বললেন, “সাবধান! সেটা কর না। আমি ভয় করছি যে তোমার উপর ফিতনা আপতিত হবে।” লোকটি বলল, “তা কেন হতে যাবে ? আমি যেখান থেকে করতে চাচ্ছি সেটা তো যুল হুলায়ফাহ থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে।” তিনি বললেন, “তুমি এমন কোন ভাল কাজ করতে যাচ্ছ যার ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের কোন নির্দেশ দেন নি ?” এরপর ইমাম মালিক (রহ.) লোকটিকে সূরা নূর এর এ আয়াতটি (৬৩) তিলাওয়াত করে শুনালেন।

 

পঞ্চম আয়াত

يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ ۚ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ ﴿١٠٦﴾

“সেদিন (বিচার দিবসে) কিছু সংখ্যক চেহারা শুভ্র হয়ে যাবে (আমলনামা ভাল হওয়ার কারনে) আর কিছু সংখ্যক চেহারা কাল হয়ে যাবে (আমলনামা খারাপ দেখার কারনে) ,যাদের মুখ কালো হয়ে যাবে তাদের জিজ্ঞেস করা হবে, ‘তোমরা কি ইমান এর পরও কুফরি করেছো ? এখন তোমরা যা প্রত্যাখ্যান করেছো তার কারনে আযাব ভোগ করতে থাকো।’ ” (সূরা আল-ইমরান, ৩ : ১০৬)

ইবন আব্বাস (রাঃ) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, “সুন্নতের অনুসারিদের মুখমণ্ডল শুভ্র (উজ্জ্বল) হবে আর বিদআতী লোকদের চেহারা কালো (হতাশায় বিষাদময়) বর্ণ ধারণ করবে।”

কুরতুবি (রহ.) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ’র দ্বীনের কোন কিছু পরিবর্তন করবে সে ওই কাল বর্ণের চেহারার লোকদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে, এদেরকেই রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাউজে কাউসার এর নিকট যেতে বাধা দেওয়া হবে আর সেখান থেকে পান করাতে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে নিষেধ করা হবে।”

 

আনাস ইবন মালিক (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : “বিদআতী ব্যক্তি যতক্ষন পর্যন্ত তার বিদআত ছেড়ে দিবে না, ততক্ষন পর্যন্ত তার তওবা কবুল করা হবে না।” (তাবারানি, বায়হাকি)

 

ষষ্ঠ আয়াত

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّـهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّـهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّـهَ كَثِيرًا ﴿٢١﴾

“তোমাদের জন্য অবশ্যই আল্লাহ’র রসূলের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে এমন সব ব্যক্তির জন্য,যারা আল্লাহ’র সাক্ষাত পেতে আগ্রহী আর যারা পরকালের মুক্তিলাভের আশা করে।” (সূরা আহযাব, ৩৩ : ২১)

 

ইবন আব্বাস (রহ.) ও মুওাওিয়া ইবন আবু সুফিয়ান (রহ.) একবার কাবা তাওয়াফ করছিলেন, এটি ছিল মুওাওিয়া’র খিলাফাহ’র সময়কার ঘটনা। মুওাওিয়া (রহ.) তাওয়াফ করার সময় পবিত্র কাবা’র চারটি কর্নার স্পর্শ করছিলেন। এটি দেখে ইবন আব্বাস (রহ.) বললেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)শুধু দুটি কর্নার স্পর্শ করতেন (হাজরে আসওয়াদ ও ইয়েমেনি কর্নার)।” মুওাওিয়া (রহ.) বললেন, “আল্লাহ’র ঘরের কোন কিছুকেই উপেক্ষা করা উচিত না।” তখন ইবন আব্বাস (রহ.) সূরা আহযাব এর এই আয়াতটি (২১) তাকে তিলাওয়াত করে শুনালেন। এটা শুনার পর মুওাওিয়া (রহ.) যেটাকে ভাল মনে করে সেটার উপর আমল করছিলেন, তা থেকে সাথে সাথে নিজেকে সরিয়ে নিলেন।

 

সপ্তম আয়াত

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ۚ

“এবং রসুল তোমাদের যা কিছু (অনুমতি) দেন তা গ্রহণ করো, আর যা কিছু নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকো।” (সূরা হাশর, ৫৯ : ৭)

 

রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আমি তোমাদের কিছু করতে আদেশ দিলে তা তোমরা তোমাদের সাধ্য অনুযায়ী করতে থাকো,আর কোন কিছু নিষেধ করলে তা থেকে বিরত থাকো।”(বুখারি,মুসলিম)

 

আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, “একবার রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)সফরে রোযা ভাঙলেন এবং তা করার জন্য অন্যদেরও অনুমতি দিলেন (একে বলে রোখসত – শারিয়াহ’র নির্ধারিত কারনে কোন ফরয শিথিল হলে তাকে রোখসত বলে, যেমন ফরজ রোযা শারিয়াহ’র কিছু নির্ধারিত কারনে ওই বিশেষ অবস্থা কেটে গেলে তারপর কাযা আদায় করা যায়)। এরপরও কিছু মানুষ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর আদেশ থেকে বিরত থাকলো। এ কথা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কাছে পৌঁছালে তিনি খুতবা দিলেন এবং প্রথমে আল্লাহ’র প্রসংশা করলেন আর এরপর বললেন, ‘সেসব লোকের কি হলো, যারা আমি যা করি তা থেকে বিরত থাকে ? আল্লাহ’র শপথ! তাদের থেকে আমিই আল্লাহ্‌কে বেশী জানি এবং তাদের থেকে আমিই আল্লাহ্‌কে বেশী ভয় করি।’ ” (বুখারি, মুসলিম)

 

এক ব্যক্তি উমর (রাঃ) এর উপস্থিতিতে হাঁচি দিয়ে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ এবং রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” উমর (রাঃ) লোকটিকে আঘাত করলেন আর বললেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)আমাদেরকে হাঁচি দেয়ার পর শুধুমাত্র ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলাই শিখিয়েছেন।” (তিরমিযি)

 

আলকামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ “এক মহিলা ইবন মাসউদ (রাঃ) এর নিকট এসে জানতে চাইলেন, ‘আমি শুনলাম আপনি নাকি উল্কি লাগানো আর পরচুলা ব্যবহার করা হারাম বলেছেন ? এটি কি আপনি আল্লাহ’র কিতাব বা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নত থেকে পান ?’ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, ‘আমি এটা আল্লাহ’র কিতাব এবং রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নত থেকেই বলছি।’ মহিলাটি বললেন, ‘আল্লাহ’র শপথ। আমি কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারটি খুঁজে দেখেছি, কিন্তু হারাম হওয়ার বিষয়টি পাইনি।’ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, ‘আপনি কি এই আয়াতটি পাননি - এবং রসুল তোমাদের যা কিছু (অনুমতি) দেন তা গ্রহণ করো, আর যা কিছু নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকো।’ মহিলাটি বললেন, ‘জী, তা পেয়েছি।’ ইবন মাসউদ বললেন, ‘নিঃসন্দেহে আমি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বলতে শুনেছি যে, ভ্রু তুলে ফেলা, পরচুলা ও উল্কি হারাম।’ মহিলাটি বললেন, ‘এমন কি হতে পারে না যে, আপনার পরিবারের কোন সদস্যদের মধ্যে এগুলো আছে ?’ ইবন মাসউদ (রাঃ) বললেন, ‘তাহলে ঘরে ঢুকে দেখুন।’ এরপর মহিলাটি ইবন মাসউদের ঘরে ঢুকে যা দেখতে চেয়েছিলেন তা দেখলেন এবং বের হয়ে এলেন আর বললেন, ‘আমি এই ব্যাপারে কিছুই দেখলাম না।’ ইবন মাসউদ (রাঃ) তাকে বললেন, ‘আপনার কি আল্লাহ’র ন্যায়নিষ্ঠ দাসের এই সাক্ষটি জানা নেই –আমি তোমাদের করতে নিষেধ করি অথচ তা আমি নিজেই পালন করি না, আমি এ ব্যাপারটা করার ইচ্ছা পোষণ করি না। ’ ” (তাফসির ইবন কাসির)

 

ইবন তাইমিয়্যাহ (রহ.) তার একটি কিতাবে বিদআত সম্পর্কে বলেন, “প্রকৃতপক্ষে ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের কুফরির কারন হলো বিদআত। তারা তাদের দ্বীনে নতুন বিষয় উদ্ভাবন করেছিলো আর সেগুলো তাদেরকে মুসা (আ'’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ঈসা (আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নির্দেশিত পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো। ”

 

অষ্টম আয়াত

الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا ﴿١٠٤﴾

“এরা হল সেসব লোক - যাদের সব প্রচেষ্টা এই দুনিয়ায়ই বিনস্ট হয়ে যাচ্ছে, অথচ তারা মনে করছে তারা ভাল কাজই করে যাচ্ছে।” (সূরা কাহফ, ১৮ :১০৪)

ইমাম তাবারি (রহ.) এই আয়াতের তাফসিরে বলেন, “এটি তাদের দিকে নির্দেশ করছে, যারা কোন একটি কাজকে ভাল ও আল্লাহ্‌সন্তুস্ট হবে এরকম মনে করে কাজটি করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি হলো আল্লাহ্‌কে অমান্য করা ও ইমানদারদের পথ থেকে দূরে সরে যাওয়া।”

 

ইমাম ইবন রজব (রহ.) বিদআত নিয়ে লিখিত তার কিতাবে বলেন, “… আল্লাহ্‌কে খুশি করার নিয়্যতে কোন হারাম কাজকে ভাল মনে করে করা একটি বিদআত, যেমন - আল্লাহ্‌কে নিয়ে কোন গান করা।”

 

নবম আয়াত

وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ ۚ وَأُولَـٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ﴿١٠٥﴾

“তোমরা কখনো তাদের মত হয়োনা - যাদের কাছে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে সুস্পস্ট নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আর (নিজেদের মধ্যে) নানা ধরণের মতানৈক্য সৃষ্টি করছে; এরাই হল সেসব মানুষ - যাদের জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে।” (সূরা আল ইমরান, ৩ :১০৫)

 

কুরতুবি (রহ.) বলেন, “বেশিরভাগ আলিমদের মতে, এই আয়াত ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের ব্যাপারে বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য আলিমদের মতে এটি মুসলিম উম্মাহ’র বিদআতিদের নির্দেশ করছে।”

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বিদআত সিরিজ (পর্ব - ৩) বিদআতীদের দাবীকৃত যুক্তি খন্ডন

 

 

The Greatest Nation·Wednesday, July 13, 2016

 

 

 

দাবীকৃত যুক্তি -১

উমর (রাঃ) যখন খলীফা ছিলেন, তিনি উবাই বিন কা’ব (রাঃ) আর তামীম আস-দারি (রাঃ) কে তারাবীহ সালাত জামাআতে আদায় করানোর নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি মসজিদে গেলে দেখলেন, মুসলিমরা এক ইমামের পিছনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সালাত আদায় করছে। তখন তিনি বললেন, “কতই না উত্তম বিদআত এটি! তারা তারাবীহ সালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে থাকতো, তার চেয়ে বরং তারা এখন যা করছে তা তো অধিকতর উত্তম।” (বুখারী)

খন্ডনঃ

(ক) প্রথমত, প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল তার প্রেক্ষাপট বুঝাটা খুবই জরুরি। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদিনায় হিজরত করেন,তখন মুসলিমরা একা একা তারাবীহ সালাত আদায় করতো,এ কারনে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)তিন রাত জামাত সহকারে তাদের নিয়ে তারাবীহ সালাত আদায় করান। কিন্তু এরপর থেকে তিনি সেটা করা থকে নিজেকে বিরত রাখেন, কারন তিনি বলেন,“আমি ভয় করছি যে, এটা তোমাদের উপর ফরজ হয়ে যায় কিনা।”

এ ঘটনার পর থেকে মুসলিমরা একা একা বা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফতের সময়ে তারাবীহ সালাত আদায় করতো। উমর (রাঃ) এর খিলাফত শুরু হলে মসজিদে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আলাদা আলাদা ইমামের পিছনে সালাত আদায় করা মুসলিমদের তিনি এক ইমামের পিছে সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করলেন আর সেটা সম্পন্ন হতে দেখে বললেন, “কতই না উত্তম বিদআত এটি !” (বুখারী)

সুতরাং, কিভাবে একথা চিন্তা করা যায় যে উমর সেটা করেছিলেন যেটা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) করেন নি?

 

দ্বিতীয়ত, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তারাবীহ সালাত জামাআতে আদায় করা থেকে বিরত থাকার কারন আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন; আর ওই সময় ওহী নাযিল চালু ছিল, তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের জন্য ভয় করলেন যে, তারাবীহ সালাত জামাআতে আদায় করা ফরয হয়ে যেতে পারে আর উম্মতের জন্য এটা কস্টদায়ক হবে।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ইন্তিকালের পর ওহী নাযিল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তাই তারাবীহ সালাত ফরজ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আর কোন ভয় থাকে না। ফলে উমর (রাঃ) তার খিলাফত চলাকালীন সময়ে তারাবীহ সালাত জামাআতে পড়ার সুন্নতকে পুনরজ্জীবিত করলেন। তিনি ভাল করেই জানতেন এটি কোন বিদআত নয় বরং রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নত, আর এর ফরয হওয়ার ব্যাপারেও কোন ভয় নেই।

তৃতীয়ত, সব সাহাবীই উমর (রাঃ) এর এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন, এভাবেই এ বিষয়টির ব্যাপারে একটি ইজমা তৈরি হয়, আর উসুলি আলিমরা এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, ইজমা কখনও ভুলের উপর ভিত্তি করে হয় না; তবে যদি শারিয়াহ’র পরিস্কার দলীল দিয়ে তা ভুল প্রমানিত হয়, তবে সেটা আলাদা কথা।

তাই উমর (রাঃ) এর ‘উত্তম বিদআত’ কথাটির সঠিক বুঝ হল এই যে, এটাকে আরবি ভাষাগত দিক দিয়ে উত্তম বিদআত বলা হয়েছে (কারন এটাকে ‘পুনর্জীবিত’ করা হয়েছে), শারিয়াহ’র পরিভাষার দিক থেকে বলা হয় নি (কারন তার উদ্ভব হয়েছিল স্বয়ং রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে)। তারাবীহ’র সালাত জামাআতে আদায় করার ব্যাপারটা আবু বকর (রাঃ) এর সময় বলতে গেলে স্থগিত ছিল যা উমর (রাঃ) এর মাধ্যমে ‘পুনর্জীবিত’ হয়। উমর (রাঃ) এর ওই উক্তিকে শারিয়াহ’র পরিভাষা হিসেবে বুঝে নেওয়া যাবে না, কারন এটি বিদআত হওয়ার ব্যাপারে যে শর্ত আছে তার অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং এটা ছিল সুন্নতকে পুনর্জীবিত করা।

 

(খ) আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, “ আমি ইমাম আবু হানিফাকে তারাবীহ আর এ ব্যাপারে উমর (রাঃ) যা করেছিলেন সেটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। আবু হানিফা (রহ.) জবাবে বললেন, ‘তারাবীহ একটি অতিরিক্ত সুন্নত। আর উমর (রাঃ) যা করেছিলেন তা তিনি মনগড়াভাবে করেন নি, আর না তিনি কোন বিদআত করেছেন; বরং তিনি যা করেছেন তার একটি শারিয়াহগত ভিত্তি ছিল এবং সেটা স্বয়ং রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)কতৃক অনুমোদিত ছিল। ’ ” (শারহে মুখতার)

 

(গ) ইমাম ইবন রজব (রহ.) বলেন, “যদি পূর্ববর্তী ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের (সালাফদের) কেউ কোন কিছুকে ‘উত্তম বিদআত’ (বিদআতে হাসানাহ) হিসেবে সম্বোধন করে, তবে সেটাকে আরবী ভাষাগত দিক থেকে গ্রহণ করতে হবে, শারিয়াহ’র পরিভাষা’র দিক থেকে নয়; যেমনটি উমর (রাঃ) তারাবীহ সালাত জামাআতে আদায় করার সুন্নতকে পুনর্জীবিত করার সময় সেটাকে ‘উত্তম বিদআত’ (বিদআতে হাসানাহ) হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। ”

 

(ঘ) ইবন তাইমিয়্যাহহ (রহ.) বলেন “যদি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)কোন কাজকে মুস্তাহাব বা ফরয হিসেবে দেখিয়ে দেন, কিন্তু তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ওফাতের আগ পর্যন্ত সেই কাজের উপর আমল করা না হয়, তবে সেই কাজগুলো আরবী ভাষার দিক থেকে বিদআত কারন সেটা একটা নতুন কাজ (যার অনুমোদন আগে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু করা হয় নি)।”

 

দাবীকৃত যুক্তি - ২

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেন, “যে ব্যক্তি উত্তম সুন্নত শুরু করবে, সে এটার উপর আমলের জন্য পুরস্কৃত হবে, আর যারা সেটার উপর আমল করবে তাদের সওয়াবও সে বিচার দিবসের আগ পর্যন্ত পেতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি দ্বীনে কোন মন্দ কাজ চালু করবে সেটার উপর আমলের জন্য তার তো শাস্তি হবেই, আর যারা বিচার দিবসের আগ পর্যন্ত যারা সেটার উপর আমল করবে সেটার কারনেও তাকে শাস্তি পেতে হবে।” (মুসলিম)

খন্ডনঃ

প্রথমত, ইমাম শাতিবী (রহ.) যারা এই হাদিস কে ব্যাবহার করে বিদআতে হাসানাহকে বৈধ প্রমান করতে চায় তাদের জবাব দিয়েছেনঃ

“এই হাদিস দিয়ে বিদআত বৈধ প্রমাণ করার ব্যাপারটা পরোক্ষভাবে এই অর্থই প্রকাশ করে যে, বিভিন্ন দলীলগুলো (হাদিস) একে অপরের বিপরীত (কারন, অন্যান্য হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বিদআতের ব্যাপারে পরিস্কারভাবেই সতর্ক করে দিয়েছেন)।

যখন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)হাদিসটি বর্ণনা করেন,সে সময় সদকা দেওয়া হচ্ছিলো, আর তখন সদকা করা শারিয়াহ’র অনুমোদিত ছিল। এর প্রমান পাওয়া যায় প্রায় একই হাদিসে –

মুনযির ইবনে জারীর থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেছেনঃ আমরা ভোরের দিকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এ সময় তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে পাদুকাবিহীন, বস্ত্রহীন, গলায় চামড়ার আবা পরিহিত আর নিজেদের তরবারি ঝুলন্ত অবস্থায় একদল লোক আসলো। তাদের অধিকাংশ বা সকলেই মুদার গোত্রের ব্যক্তি ছিলেন। অভাব অনটনে তাদের এই করুন অবস্থা দেখে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মুখমণ্ডল পরিবর্তিত ও বিষণ্ণ হয়ে গেলো। তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন, এরপর বেরিয়ে আসলেন। তিনি বিলাল (রাঃ) কে আযান দিতে নির্দেশ দিলেন। বিলাল (রাঃ) আযান ও ইকামত দিলেন।

নামায শেষ করে তিনি উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন আর এ আয়াত পাঠ করলেন – “হে মানবজাতি, তোমরা নিজেদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একটি মাত্র ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। ... নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী।” এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সূরা হাশরের শেষের দিকের এ আয়াত পাঠ করলেন – “হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় করো। প্রত্যেক ব্যক্তি যেন ভবিষ্যতের জন্য কি সঞ্চয় করেছে সেদিকে লক্ষ্য করে।”

এরপর উপস্থিত লোকদের কেউ দীনার, কেউ দিরহাম, কেউ কাপড়, কেউ এক সা’ আটা ও কেউ এক সা’ খেজুর দান করলেন। অবশেষে তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “অন্তত এক টুকরো খেজুর হলেও নিয়ে আসো।”

বর্ণনাকারী বলেন – আনসারদের এক ব্যক্তি একটি বিরাট থলি নিয়ে আসলেন। এর ভারে তার হাত অবসাদগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছিলো কিংবা অবশ হয়ে গেলো। এরপর লোকেরা সারিবদ্ধভাবে একের পর এক দান করতে থাকলেন। ফলে খাদ্য ও কাপড়ের দুটো স্তুপ হয়ে গেলো। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চেহারা মুবারক খাঁটি সোনার মতো উজ্জ্বল হয়ে হাসতে লাগলো।

এরপর রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “যে ব্যক্তি ইসলামে সুন্নাতে হাসানাহ (উত্তম সুন্নত, অর্থাৎ ইসলাম অনুমোদিত কোন কাজ বা প্রথা) প্রচলন করে, সে তার এ কাজের সওয়াব পাবে, আর তার পরে যারা তার এ কাজ দেখে তা করবে সে এর বিনিময়েও সওয়াব পাবে; তবে এতে তাদের সওয়াব কোন অংশে কমানো হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে সুন্নাতে সাইয়্যিআহ (মন্দ সুন্নত, অর্থাৎ ইসলাম বিরোধী কোন কাজ বা প্রথা) প্রচলন করবে, তাকে এ কাজের বোঝা (গুনাহ ও শাস্তি) বহন করতে হবে, তারপর যারা তাকে অনুসরণ করে এ কাজ করবে তাদের সমপরিমাণ বোঝাও তাকে বইতে হবে; তবে এতে তাদের অপরাধ ও শাস্তি কোন অংশেই কমবে না।” (মুসলিম)

এটি সুস্পস্ট যে, এ হাদিসে যে কাজটিকে (সদকা) ‘উত্তম সুন্নত’ বলা হয়েছে সেটা দ্বীন কতৃক অনুমোদিত ছিল। এটিকে ‘উত্তম সুন্নত’ বলার কারন হল, লোকেরা সদকা প্রদানের ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিল, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে উৎসাহিত করার পর এক লোক সদকা দিলেন আর তার দেখাদেখি অন্যরাও সদকা দিতে লাগলো। এভাবেই রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)সদকা দেওয়ার সুন্নতটি পুনর্জীবিত করলেন। আর এটিই হল উত্তম সুন্নতের অর্থ।

 

দ্বিতীয়ত, হাদিসে আমরা যে ‘সুন্নত’ শব্দটি দেখতে পাই, তাকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নত হিসেবে বুঝা যাবে না,এটিকে আরবি ভাষাগত দিক থেকে সুন্নত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে,শারিয়াহ’র পরিভাষার দিক থেকে নয়। কারন শারিয়াহ’র পরিভাষার দিক থেকে সুন্নত মনে করলে যে অর্থ দাড়ায় সেটা হল এমন যে, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নতে কোন ভুল আছে; নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মাধ্যমে পরিপূর্ণ দ্বীন আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, এবং দ্বীন পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পর এতে না হবে কিছু যোগ আর না কিছু বাদ পড়বে।

 

তৃতীয়ত, হাদিসে দুটো শর্ত ব্যবহার করা হয়েছে – উত্তম এবং মন্দ। শারিয়াহ তো ভাল ও মন্দ পরিপূর্ণভাবেই সংজ্ঞায়িত করে দিয়েছে যে, কোনটা খারাপ (মুনকার) আর কোনটা ভাল (মা’রুফ)।

ইমাম শাফি (রহ.) ইহতিসান (কোন কিছুকে ভাল হিসেবে ঘোষণা করা) এর ব্যাপারে বলেন, “যে ব্যক্তি কোন কিছুকে ভাল হিসেবে ঘোষণা করলো, সে সেটাকে শারিয়াহ’র একটা অংশ হিসেবে ঘোষণা করলো।” (আর-রিসালা)

 

দাবীকৃত যুক্তি - ৩

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ইন্তিকালের পর কুরআনকে একটি লিখিত কিতাব হিসেবে রূপ দেওয়া আর এ প্রসঙ্গে আবু বকর (রাঃ) এর বক্তব্য , “আমরা সেটা কিভাবে করতে পারি যা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) করেন নি ?”

বিদআতিদের যুক্তি অনুসারে, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ওফাতের পর কুরআনকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে সাহাবীরা যা করেছিলেন সেটা হল বিদআতে হাসানাহ।

খন্ডনঃ

কুরআন সঙ্কলন শারিয়াহ’র ভিত্তিতেই করা হয়েছিলো। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)কুরআনকে লিখে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাই বিচ্ছিন্ন রূপে কুরআন লিপিবদ্ধ অবস্থায় ছিল। আর সাহাবীরা সেই বিচ্ছিন্ন রূপে লিখিত কুরআনকে সংকলন করেছিলেন।

উমর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ) কে ব্যাপারটি বুঝিয়ে বললে তিনি এ ব্যাপারে সম্মত হলেন।

তাই কুরআন সংকলন কোন বিদআতে হাসানাহ তো ছিলই না, বরং এটি ছিল সাহাবীদের এক ইজমা, যার ভিত্তি শারিয়াহ’র উপর।

 

দাবীকৃত যুক্তি – ৪

হাদিস লিখে রাখা।

খন্ডনঃ

হাদিস লিখে রাখার ব্যাপারটা শারিয়াহ কতৃক অনুমোদিত।

কোন কোন সাহাবা হাদিস লিখে রাখার ব্যাপারে অনুরোধ করলে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)তাদেরকে হাদিস লিখে রাখার ব্যাপারে অনুমতি দেন।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সময়ে সাধারনভাবে হাদিস লিখে রাখা এ কারনে নিষেধ ছিল যে, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)হাদিস আর কুরআন এক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আশঙ্কা করতেন। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ওফাতের পর কুরআন সংকলন করা হল,ফলে যে কারনে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম)হাদিস লিখে রাখতে নিষেধ করতেন সেটা নিয়ে আর কোন আশঙ্কা থাকলো না। তাই সাহাবী ও পরবর্তী মুসলিমরা সুন্নতকে লিখে রাখার মাধ্যমে সংরক্ষন করা শুরু করলেন।

 

দাবীকৃত যুক্তি - ৫

ইবন মাসউদ (রাঃ) বলেন, “মুসলিমরা যেটা ভাল মনে করে সেটাই আল্লাহর দৃষ্টিতে ভাল, তারা যেটা খারাপ মনে করে সেটাই আল্লাহর দৃষ্টিতে খারাপ।” (মুসনাদ আহমাদ)

খন্ডনঃ

আস-সিন্দি (রহ.) বলেন, “এটি সুস্পষ্ট যে তিনি এখানে মুসলিম বলতে সাহাবীদের বুঝিয়েছিলেন। আর তিনি কেবল সেসব জিনিসের ব্যাপারে কথা বলেছিলেন, যেগুলোর ব্যাপারে তাদের সর্বসম্মত ইজমা (সাহাবীদের ঐকমত) ছিল; তার বক্তব্য অন্যান্য মুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।”

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বিদআত সিরিজ (পর্ব -৪) বিদআতীদের সাথে সাহাবীদের আচরন এবং উম্মাহর মধ্যে মতভেদ ও বিভক্তির বিষয়

 

 

The Greatest Nation·Wednesday, July 13, 2016

 

 

 

বিদআতের অনুসারীদেরকে দ্বীন থেকে বহিষ্কৃত করা যাবে না

সাহাবীরা যে খারেজীদের কাফির বলে ঘোষণা দেন নি এর প্রমাণ হল সাহাবীরা তাদের পিছে সালাত আদায় করতেন। উদাহারন হিসেবে বলা যায়, আবদুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) এবং আরও অনেক সাহাবী নাজদাহ আল হারুরি ১ এর পিছে সালাত আদায় করেছিলেন। সাহাবীরা খারেজীদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন, দ্বীনের বিষয়ে খারেজীদেরকে সাহাবীরা তাদের মতামত ব্যাখ্যা করে তুলে ধরতেন, আর এক মুসলিম অপর মুসলিমকে যেভাবে সম্বোধন করে থাকে, সাহাবারাও খারেজীদের সেভাবে সম্বোধন করতেন।

উদাহারন হিসেবে বলা যায়, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) এর কাছে নাজদাহ আল হারুরি যে প্রশ্ন করেছিলো তিনি সেগুলোর জবাব দিয়েছিলেন। ইমাম বুখারি নাজদাহ থেকে বর্ণিত হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন। একইভাবে, নাফি’ ইবন আল আযরাক ২ তার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন আর বিভিন্ন বিষয়ে কুরআন থেকে আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে তিনি তার সাথে আলোচনাও করেছিলেন, যেমনটি তিনি অন্য কোন মুসলিমের ক্ষেত্রেও করতেন। এটিই ছিল পুরো যুগ জুড়ে তখনকার মুসলিমদের অনুশীলন, তারা বিদাতীদেরকে সেই লোকগুলোর মতো মুরতাদ মনে করতেন না যাদের বিরুদ্ধে আবু বকর (রাঃ) জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন।

যদিও রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ধরনের লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দিয়েছিলেন (যা নির্ভরযোগ্য হাদিসে বর্ণিত), তবুও সাহাবীরা তাদের সাথে এ আচরন করে যেতেন। সেই হাদিসে বলা হয়েছিলো যে, তারা হল আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক, যাদের হত্যা করতে হবে; আর তাদের যারা হত্যা করবে তারা হল সর্বোত্তম লোক, এটি আবু উমামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যা তিরমিযি লিপিবদ্ধ করেছেন। (তিরমিযি - তাফসিরঃ ৩ :৮; ইবন মাজাহ, মুকাদ্দামাহঃ ১২; মুসনাদ আহমাদ - ২৫০, ২৫৩, ২৫৬, ২৬৯)

এ হাদিস দ্বারা কেবল এটাই বুঝায় যে, তারা মুসলিমদের জন্য অন্যদের থেকে অধিকতর ক্ষতিকর। আর এটাও সত্য, তারা মুসলিমদের অধিকতর পরিমাণ ক্ষতি করেছে, যা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের দ্বারা মুসলিমদের ক্ষতির পরিমাণ থেকেও বেশী। তারা সে সকল মুসলিমদের হত্যা করার ক্ষেত্রে খুবই আগ্রহী ছিল, যারা তাদের সাথে ঐকমত পোষণ করতেন না। কারন তারা মনে করতো, যেহেতু সে মুসলিমরা কাফির (তাদের দৃষ্টিতে), তাই সে মুসলিমদের হত্যা করা, তাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া বা তাদের সন্তানদের হত্যা করা তাদের জন্য পুরোপুরি বৈধ। তারা এই ব্যাপারটাকে দ্বীনের প্রতি নিষ্ঠামূলক আমল হিসেবে বিবেচনা করতো, কারন তারা অজ্ঞতা ও দ্বীন ইসলামের মতবাদের সাথে সাংঘর্ষিক বিশ্বাসে ডুবে ছিল।

কিন্তু এর পরেও সাহাবীরা বা তাদের উত্তরসূরিরা (সালাফ আস সালিহিন) তাদেরকে কাফির বা মুরতাদ বলে ঘোষণা করেন নি, আর না তারা আমল বা কথাবার্তায় তাদের প্রতি কোন অন্যায় করেছিলেন। তাদের ব্যাপারে তারা আল্লাহ্‌কে ভয় করে চলতেন আর তাদের প্রতি কখনো অন্যায্য ছিলেন না। এটিই ছিল সকল বিদআতিদের (শিয়া, মুতাযিলা এবং অন্যান্যদের) সাথে তাদের নীতি।

সুতরাং, কেউ যদি বাহাত্তর ফিরকার কোন একটিকেও কাফির বলে ঘোষণা দেয়, তবে সে এটা বলার মাধ্যমে কুরআন,সুন্নত,খুলাফায়ে রাশিদিন ও সাহাবীদের ইজমার বিরুদ্ধে চলে যায়।

এটা লক্ষ্য করা দরকার যে, বাহাত্তর ফিরকার ব্যাপারে যে হাদিসটি বর্ণিত আছে তা সিহাহ সিত্তাহ (বিশুদ্ধ ছয়টি হাদিস সংকলন কিতাব) এর মধ্যে নেই। ইবন হাযম এবং আরও অনেকে এই হাদিসকে দুর্বল হাদিস বলেছেন, অন্য আলিমরা বলেছেন এটি হাসান হাদিস। আবার অনেকে, যেমন আল হাকিম তার মুসতাদরাক হাকিমে একে সাহিহ বলেছেন, যদিও সুনান সংকলনের সংকলনকারীরা একের অধিক সনদ উল্লেখ করেছেন যার মাধ্যমে এই হাদিসটি বর্ণিত হয়ে এসেছে।

এছাড়াও, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসে যা বলা হয়েছে – “তাদের মধ্যে বাহাত্তরটি দল জাহান্নামে যাবে এবং কেবলমাত্র একটি নাজাতপ্রাপ্ত হবে” – আল্লাহ্‌র সেই সকল আয়াত থেকে অধিকতর দৃঢ় নয়, যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ

إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَىٰ ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا ۖ وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا ﴿١٠﴾

“যারা অন্যায়ভাবে এতীমদের ধনসম্পদ ভক্ষন করে, তারা যেন আগুন দিয়েই নিজেদের পেট ভর্তি করে, অচিরেই এ লোকগুলো জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে থাকবে।” (সূরা আন নিসা, ৪ :১০)

وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ عُدْوَانًا وَظُلْمًا فَسَوْفَ نُصْلِيهِ نَارًا ۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّـهِ يَسِيرًا ﴿٣٠﴾

“যে কেউই বাড়াবাড়ি ও যুলুম করতে গিয়ে এই (হত্যার) কাজ করে, অচিরেই আমি তাকে আগুনে পুড়িয়ে দিবো, (আর) আল্লাহ্‌র পক্ষে এ কাজ একেবারেই সহজ (মোটেই কঠিন কিছু নয়)।” (সূরা আন নিসা, ৪ :৩০)

এ ধরনের আরও অনেক কুরআনের আয়াত আছে যেখানে তাদেরকে দোযখের আগুন দিয়ে ভয় প্রদর্শন করা হয়েছে যারা মন্দ কর্ম করে, কিন্তু এ আয়াতগুলো কোন বিশেষ ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়নি; কারন এমনটা হতে পারে, ব্যক্তি হয়তোবা তওবা করতে পারে বা তার পাপ কাজ থেকে তার সৎ কাজ অধিক হতে পারে বা আল্লাহ তাকে দুর্দশাগ্রস্ত করার মাধ্যমে তার পাপ মুছে দিতে পারেন।

(মিনহাজ আস সুন্নাহ – ইবনে তাইমিয়্যাহ)

 

যখন কাউকে পাওয়া যাবে না তখন বিদআত প্রবক্তার পিছে সালাত আদায় করা যাবে

আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের একটি নীতি হল, যেকোন মুসলিমের পিছনেই সালাত আদায় করা যাবে – হোক সে ধার্মিক বা পাপী। যদি কাউকে পাওয়া না যায় তবে জুমুয়ার সালাত আর ঈদের সালাতও এমন মুসলিমের এর পিছে আদায় করা যাবে, যার মধ্যে ইসলাম প্রদত্ত মতবাদের সাংঘর্ষিক মতবাদ রয়েছে। কোন মুসলিমকেই তার পাপের কারনে বা উম্মতের কোন বিতর্কিত বিষয়ের ব্যাপারে কোন ভুলের কারনে কাফির বলে অভিযুক্ত করা যাবে না।

আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের একটি নীতি হল, তারা জুমুয়ার সালাত, ঈদের সালাত ও দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে এবং এগুলো কখনো স্থগিত রাখে না; যেমনটি করে বিদআতের প্রবক্তারা, যেমন রাফেযি ও অন্যান্যরা।

ইমামের আচার ব্যবহার যদি জানা না থাকে অথবা তার বিদআত বা পাপাচার প্রকাশ্য না হয়, তবে জুমুয়ার সালাত আর দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত তার পিছে জামাআতের সাথে আদায় করা যাবে। মুসলিম উম্মাহর চার ইমাম আর অন্যান্যরা এই ব্যাপারে একমত। তাদের মধ্যে কেউই কখনো একথা বলেন নি যে, সালাত ততক্ষন পর্যন্ত বৈধ হবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত যে ইমামের পিছে সালাত আদায় করা হবে তার ব্যক্তগত জীবন সম্পর্কে লোকেরা জানে। প্রকৃতপক্ষে, মুসলিমরা এমন ব্যক্তির পিছেই সালাত আদায় করে যাচ্ছে যার জীবন সম্পর্কে তাদের জানা নেই।

কিন্তু যদি এমন হয় যে, এমন এক ব্যক্তির পিছে সালাত আদায় করা হবে যে বিদআতের দোষে দোষী হিসেবে বা প্রকাশ্য পাপের (ফাজির) কারনে পরিচিত, আর সে সময় বিকল্প ইমামও থাকে; এক্ষেত্রে অনেক আলিম বলেছেন, যারা সে সময় তার পিছে সালাত আদায় করবে তখনও তা বৈধ হবে। এটি হল ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফি’ই, ইমাম মালিক ও ইমাম ইমাম আহমাদের মত।

কিন্তু যখন কোন বিকল্প ইমাম থাকবে না আর বিদআতী বা পাপী ব্যক্তির পিছে সালাত আদায় করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়; উদাহারন হিসেবে বলা যায় – আপনি জুমুয়ার সালাতে ইমাম হিসেবে সালাত আদায় করানোর জন্য বিদআতী বা পাপী ছাড়া অন্য কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না, আর এমন অন্য কোন স্থান নেই যেখানে আপনি এটি আদায় করবেন, তবে আপনাকে অবশ্যই এই বিদআতী বা পাপী ব্যক্তির পিছে সালাত আদায় করতে হবে। এটি হল সাধারণভাবে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মত। ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.) এবং আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অন্যান্য ইমামরা এই ব্যাপারে একমত।

সাহাবীরা এমন ব্যক্তির পিছে সালাত আদায় করেছিলেন যাদের পাপ সম্পর্কে তাদের জানা ছিল। উদাহারন হিসেব বলা যায়, আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবীরা আল ওয়ালিদ ইবন ইকবাহ ইবন আবি মু’ইত ৩ এর পিছে সালাত আদায় করেছিলেন, যে কিনা মদ্যপান করতো। এই ব্যক্তি একবার ফজর সালাতে ইমামতি করার সময় বলেছিল এটি চার রাকআত, এর কারনে উসমান ইবন আফফান (রাঃ) এই ব্যক্তিকে আঘাত করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবন উমার (রাঃ) এবং আরও অনেক সাহাবীরা হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ ৪ এর পিছে সালাত আদায় করেছিলেন। একইভাবে, অনেক সাহাবী আর তাদের উত্তরসুরিরা ইবন আবি উবাইদ ৫ এর পিছে সালাত আদায় করেছিলেন,যে ব্যক্তি কিনা ইসলাম প্রদত্ত মতবাদের সাথে সাংঘর্ষিক অভিমত আর সেগুলো প্রচারের ব্যাপারে অভিযুক্ত ছিল।

কোন পাপ বা বিতর্কিত কোন ইস্যুতে করা কোন ভুলের উপর ভিত্তি করে কোন মুসলিমকে দ্বীন থেকে বহিষ্কৃত করা যাবে না। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,

آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِن رَّبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ ۚ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّـهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ ۚ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا ۖ غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ ﴿٢٨٥﴾

“রাসুল সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে যা তার উপর তার রবের পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে, আর যারা (সে রাসুলের উপর) বিশ্বাস স্থাপন করেছে তারাও (সে একই বিষয়ের উপর) ঈমান এনেছে; এরা সবাই ঈমান এনেছে আল্লাহ্‌র উপর, তার ফেরেশতাদের উপর,পর, তার কিতাবসমুহের উপর, তার রাসুলদের উপর, (তারা বলে,) আমরা তার (পাঠানো) রসূলদের কারো মাঝে কোন রকম পার্থক্য করি না; তার আরও বলে, আমরা তো (আল্লাহ্‌র নির্দেশ) শুনেছি এবং (তা) মেনেও নিয়েছি, হে আমাদের মালিক, (আমরা) আপনার ক্ষমা চাই এবং (আমরা জানি,) আমাদের (একদিন) আপনার কাছেই ফিরে যেতে হবে।” (সূরা আল বাকারা, ২ :২৮৫)

সাহিহ সংকলনের এক হাদিসে বলা আছে, এই প্রার্থনার জবাবে আল্লাহ তার বিশ্বাসী বান্দাদের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দেন।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) খারেজীদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছিলেন এ কারনে যে, তারা ছিল মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী। খুলাফায়ে রাশেদিনের অন্যতম খলীফা আমীরুল মু’মিনিন আলী (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন এবং সাহাবীরা,তাদের উত্তরসুরীরা আর তাদের অনুসারীদের মধ্যকার দ্বীনের সকল আ’ইম্মাহ কেরামেরা এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে একমত। এমনকি আলী ইবন আবি তালিব (রাঃ) বা সা’দ ইবন আবি ওয়াককাস (রাঃ) ৬ বা অন্য কোন সাহাবীই এদেরকে কাফির বলে ঘোষণা দেন নি। উনারা এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন, কিন্তু তাদের সাথে মুসলিমের মতোই আচরণ করেছিলেন।

আলী (রাঃ) এদের বিরুদ্ধে ততক্ষন পর্যন্ত জিহাদ শুরু করেন নি যতক্ষণ না পর্যন্ত এরা মুসলিমদের রক্ত ঝরানো এবং তাদের সম্পদ লুট করা শুরু করে। আলী (রাঃ) এদের বিরুদ্ধে এ কারণে জিহাদ করেন নি যে তারা কাফির ছিল, বরং তিনি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন যাতে তিনি এদের পাশবিকতা থেকে মুসলিমদের রক্ষা করতে পারেন। এ কারনেই আলী (রাঃ) খারেজীদের যুদ্ধবন্দী নারীদেরকে গ্রহন করেন নি বা তাদের সম্পদকে গনিমত হিসেবেও গ্রহণ করেন নি।

খারেজীরাই হল সে সকল লোক, আল্লাহ্‌র ওহী আর সাহাবাদের ইজমা যাদেরকে ভুল ও ভ্রান্ত বলে ঘোষণা করেছিলো, এবং আল্লাহ ও তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দিয়েছিলেন অথচ তাদেরকে কাফির বলা হয় নি। সুতরাং এদেরকে কিভাবে কাফির বলা যাবে যারা কিনা সেসব বিষয়ে সত্য দেখতে না পেয়ে পথভ্রস্ট হয়, যে বিষয়ে তাদের থেকেও অধিকতর জ্ঞানী ব্যক্তি রয়েছে!

এই দলগুলোর মধ্যে কোন ব্যক্তি কিভাবে অন্যদের কাফির ডাকার ব্যাপারে বা তাদের হত্যা করার ব্যাপারে বা তাদের সম্পদ দখলের ব্যাপারে সমর্থনযোগ্য হবে, এমনকি যদিও তারা সত্যিই বিদআতের কারনে দোষী হয়! এটি কিভাবে হতে পারে যে, যেসব লোক অন্যদের কাফির বলে তারা নিজেরাও বিদআত করে, যেটা এমনকি অন্যদের বিদআত থেকেও নিকৃষ্ট! প্রকৃত ঘটনা হল তো এটাই যে, তারা সকলেই যে বিষয়ে তর্ক করে সেই বিষয়ের সত্যতার ব্যাপারে সমানভাবে অজ্ঞ।

মৌলিক নীতি হল, একজন মুসলিমের জীবন, সম্পদ ও সম্মান লঙ্ঘন করা যাবে না, এবং আল্লাহ ও তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ত্যাগ করে দেওয়া ছাড়া কোন কারনে তা ধরা যাবে না।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজের সময় বলেছিলেন, “তোমাদের রক্ত, ধনসম্পদ, সম্মান, সবকিছুই তেমন পবিত্র, যেমনটি তোমাদের আজকের দিনটি, তোমাদের এই শহরটি আর তোমাদের এই মাসটি পবিত্র।” (বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি, নাসাঈ, ইবন মাজাহ, দারিমী, মুসনাদ আহমাদ)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছিলেন, “একজন মুসলিমের রক্ত, তার সম্পদ আর তার সম্মান – এসব কিছু অপর মুসলিম লঙ্ঘন করতে পারবে না।” (তিরমিযি, ইবন মাজাহ, মুসনাদ আহমাদ)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছিলেন, “যে কেউ আমাদের মতো সালাত আদায় করে, আমাদের কিবলার দিকে মুখ করে আর আমরা যে পশু হত্যা করি তা খায়, সে একজন মুসলিম, আর সে আল্লাহ ও তার রাসুলের নিরাপত্তার মধ্যে থাকবে।” (বুখারি, তিরমিযি, মুসনাদ আহমাদ)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, “যখন দুইজন মুসলিম তরবারি নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয়, তখন তারা দুজনই হত্যাকারী, আর যাকে হত্যা করা হবে সে দোযখে যাবে।” লোকেরা জানতে চাইলো, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম), হত্যাকারীর ব্যাপারে এটা সত্য, কিন্তু এটা তার ব্যাপারে কেন যাকে হত্যা করে হবে ?” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “কারন সে তার সাথীকে হত্যা করতে চাচ্ছিলো।” (বুখারি, মুসলিম, দাউদ, নাসাঈ, ইবন মাজাহ, মুসনাদ আহমাদ)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এই সতর্কতা জারী করেছিলেন, “আমার পরে তোমরা একে অপরকে হত্যা করার মাধ্যমে কাফির হয়ো না।” (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ, ইবন মাজাহ, দারিমী, মুসনাদ আহমাদ)

এবং, “যখন একজন মুসলিম তার মুসলিম ভাইকে কাফির বলে, তখন তাদের দুইজনের একজন কাফির।” (বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি, মুওাত্তা মালিক, মুসনাদ আহমাদ)

এসকল হাদিসই হাদিসের সংকলনগুলোতে বর্ণিত হয়েছে।

কিন্তু যখন একটি দলীলের ব্যাখ্যার আলোকে কোন একজন মুসলিম অপর কোন মুসলিমের সাথে লড়াই করে বা তাকে কাফির ডাকে, তখন সে কাফির হবে না।

উমার ইবন আল খাত্তাব (রাঃ) যখন হাতিব ইবন আল বালতা’আহ (রাঃ) সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) কে বলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম), এই মুনাফিককে হত্যা করার জন্য আমাকে অনুমতি দিন।” তখন রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বললেন, “সে বদরের জিহাদে অংশগ্রহন করেছিলো। তুমি কি জান না যে আল্লাহ তা’আলা বদরের জিহাদে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা যা খুশী কর, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম।’ ” (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবন মাজাহ)

সেখানে এ হাদিসটিও বর্ণিত আছে যে, উবাইদ ইবন খুদাইর (রাঃ) ৭ একবার সা’দ ইবন উবাদাহ (রাঃ) ৮ কে বললেন, “তুমি মুনাফিকদের রক্ষা করছো,তুমি একজন মুনাফিক।” এরপর তাদের মধ্যে ঝগড়া হল এবং রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) কে তাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধটি মিটিয়ে দিতে হল।

উনাদের প্রত্যেকেই বদর এর জিহাদে অংশগ্রহন করেছিলেন, কিন্তু একে অপরকে মুনাফিক বলে ডাকলেন। এরপরও রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) তাদের কাউকেই কাফির বলে ডাকলেন না। বরং রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) তাদের দুজনকেই জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। [এই বাক্য বিনিময়গুলো সেই অপবাদের ঘটনায় ঘটেছিল যখন কিছু মুনাফিক রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটেছিল। আর এই ব্যাপারে আল্লাহ আয়াত নাযিল করে সত্য ঘটনা সবার সামনে উন্মোচিত করে দেন এবং মুনাফিদের নিফাকি প্রকাশ হয়ে পড়ে,দেখুন ইবন কাসিরের তাফসীর,খণ্ড ৩ পৃষ্ঠা ২৬৮,সুরা নুরঃ ১১ এর তাফসীর।]

সিহাহ সিত্তাহ’র মধ্যে আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, উসামাহ ইবন যাইদ (রাঃ) ৯ ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই’ এটা স্বীকার করার পরও এক ব্যক্তিকে হত্যা করলেন। যখন রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) এই ব্যাপারটি জানার পর উসামাহকে জিজ্ঞেস করলেন, “উসামাহ, তুমি কি তাকে একথা বলার পর হত্যা করলে যে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই ?’ ” এবং রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) উসামাহ (রাঃ) কে এ কথা বারবার বলতেই থাকলেন আর উসামাহ আকাংখা করতে লাগলেন যে যদি তিনি সে দিনের পূর্বে ইসলাম গ্রহন না করতেন। (বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি, মুসনাদ আহমাদ)

কিন্তু এসত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) তার ব্যাপারে কোন প্রতিশোধ গ্রহনের নির্দেশ দেন নি, অথবা এর কোন বিনিময়মূল্য বা প্রায়শ্চিত্তের নির্দেশ দেন নি, কারন উসামাহ (রাঃ) শুধুমাত্র তার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভুল করেছিলেন। তিনি সেই ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন এ কারনে যে, তিনি মনে করেছিলেন যে সেই ব্যক্তিটি শুধুমাত্র তরবারি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যই কালেমা স্বীকার করেছিলো।

উটের যুদ্ধ, জাঙ্গে সিফফিন এবং আরও অনেক ঘটনায় অগ্রজ সাহাবীরা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তারা সবাই ছিলেম মুসলিম ও মুমিন। আল্লাহ বলেছেন,

وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّـهِ ۚ فَإِن فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا ۖ إِنَّ اللَّـهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ ﴿٩﴾

“মুমিনদের দুটি দল যদি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে বসে, তখন তোমরা উভয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে, অতঃপর তাদের এক দল যদি আরেক দলের উপর যুলুম করে, তাহলে যে দলটি যুলুম করেছে তার বিরুদ্ধেই তোমরা লড়াই করো – যতক্ষণ না পর্যন্ত সে দলটি (সম্পূর্ণ) আল্লাহ্‌র হুকুমের দিকে ফিরে না আসে, যদি সে দলটি (আল্লাহ্‌র হুকুমের দিকে) ফিরে আসে তখন তোমরা দুটি দলের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে মীমাংসা করে দিবে এবং ন্যায়বিচার করবে; অবশ্যই আল্লাহ ন্যাবিচারকদের ভালবাসেন।” (সূরা আল হুজুরাত, ৪৯ :৯)

এভাবেই আল্লাহ তা’আলা এটা খুব পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তারা একে অপরের সাথে লড়াই করা এবং যুলুম করা সত্তেও তারা ছিলেন একে অপরের মুসলিম ভাই। এই আয়াতে আল্লাহ আরও বলেছেন তাদের মধ্যে শান্তি ও বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনার জন্য এবং ন্যায়পরায়নতার সাথে একসাথে বাস করার জন্য। একারনেই অগ্রজরা তাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং একে অপরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যদিও এর পূর্বে তাদের নিজদের মধ্যে লড়াই ঘটে গিয়েছিলো। তারা একে ওপরের সাথে শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করতেন না যেমনটা তারা করতেন কাফিরদের সাথে। তারা একে অপরের সাক্ষ্য গ্রহন করতেন, একে অপরের থেকে ইলম অর্জন করতেন, তাদের মধ্যেই নিকাহ (বিয়ে) হতো, একে অপরের উত্তরাধিকারী হতেন এবং একে অপরের সাথে মুসলিমের মতো আচরণ করতেন, যদিও তারা এর পূর্বে একে অপরের সাথে লড়াই করেছিলেন এবং একে অপরের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন।

সাহিহ সংকলনের একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ’র কাছে দুয়া করেছিলেন যে আল্লাহ যেন তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উম্মতকে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দিয়ে ধ্বংস না করেন, আল্লাহ এ দুয়া কবুল করেছিলেন; এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্‌র কাছে দুয়া করলেন আল্লাহ যেন বিজাতীয় শত্রুদেরকে তার উম্মতের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে না দেন, আল্লাহ এটাও মঞ্জুর করলেন; কিন্তু যখন তিনি আল্লাহ্‌র কাছে এটা বলে দুয়া করলেন যে, আল্লাহ যেন তাদের নিজেদের লোকদের হাত দ্বারা আল্লাহ তাদের শাস্তি না দেন (অন্তরকলহ ঘটার মাধ্যমে), তখন আল্লাহ এই দুয়া কবুল করলেন না। (হাদিসটি বর্ণিত আছে মুসলিম, ইবন মাজাহ, মুওাত্তা মালিক, মুসনাদ আহমাদে)

এভাবেই রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে আমরা জানতে পারি, আল্লাহ এই উম্মতের উপর অন্য জাতিকে শত্রু হিসেবে নিযুক্ত করে দিবেন না উম্মতকে দমনের জন্য, কিন্তু উম্মতের মধ্যেই একে অপরকে হত্যা করা ও দমন করার ঘটনা ঘটবে।

সাহিহ সংকলনে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে রয়েছে যে, এই আয়াতগুলো নাযিলের প্রেক্ষিতে –

قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَىٰ أَن يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِّن فَوْقِكُمْ

“বলঃ আল্লাহ তোমাদের উপর থেকে তোমাদের উপর আযাব পাঠাতে সক্ষম” (সূরা আল আন’আম, ৬ :৬৫)

এবং,

أَوْ مِن تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ

“ … তোমাদের পায়ের নিচ থেকে” (সূরা আল আন’আম, ৬ :৬৫)

তখন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্‌র কাছে আশ্রয় চাইলেন। কিন্তু আয়াতের শেষ অংশে বলা হলঃ

أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُم بَأْسَ بَعْضٍ ۗ

“অথবা তিনি তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম” (সূরা আল আন’আম, ৬ :৬৫)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “এই দুটি শাস্তি হল হালকা শাস্তি।” (বুখারি, তিরমিযি, মুসনাদ আহমাদ)

মহান আল্লাহ ঐক্য ও সংহতি’র আদেশ এবং বিদআত ও দল-উপদলে বিভক্ত হওয়ার বিষয়টি প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও এটাই সত্য। আল্লাহ বলেছেনঃ

إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ ۚ

“যারা তাদের দ্বীনকে বিভক্ত করে আর নিজেরাই নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে, তাদের কোন দায়িত্বই তোমার উপর নেই” (সূরা আল আন’আম, ৬ : ১৫৯)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বলেছেন, “তোমরা অবশ্যই জামাআত আঁকড়ে ধরে রাখবে, কারন জামাআতের উপর আল্লাহ্‌র হাত রয়েছে।” (তিরমিযি, নাসাঈ)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বলেছেন, “শয়তান এক ব্যক্তির নিকটে থাকে, কিন্তু দুই ব্যক্তির থেকে দূরে থাকে।” (তিরমিযি, মুসনাদ আহমাদ)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বলেছেন, “শয়তান এক ব্যক্তির নিকটে থাকে যেমনটি নেকড়ে থাকে মেষশাবকের নিকট, আর তুমি দেখবে, নেকড়ে নির্জনে থাকা মেষশাবককে সহজেই ছোঁ মেরে তার পাল থেকে নিয়ে যায়।” (দাউদ, নাসাঈ, মুসনাদ আহমাদ)

তাই কোন মুসলিম যখন মুসলিমদের একটি শহরের মধ্য দিয়ে যায়, তখন তার উচিত তাদের সাথে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তের ফরয সালাত আদায় করা আর জুমুয়ার সালাত করা এবং তাদের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ করা। সে যদি তাদের কারো মধ্যে কোন ভুল পায় তবুও তার উচিত হবে না তাদের সাথে শত্রুর মতো আচরণ করা। যদি সম্ভব হয়, তবে তার উচিত হবে তাদের সঠিক পথটি দেখানো এবং সত্যের দিকে আহবান করা। যদি তারা তার কোথায় কান না দেয় তবে সে তাদের ব্যাপারে দায়িত্ব বহন করবে না, কারন আল্লাহ তো কেবল এ কারনেই জবাবদিহিতা করবেন যে তার সামর্থ্যের মধ্যে সে কি করেছে। যদি সে পারে, তবে সে যেন তাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিকে সালাতে ইমাম হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করে এবং তাদের মধ্যে বিদআতের বিস্তার ও লজ্জাজনক চর্চার ব্যাপারে সতর্ক করে। কিন্তু এটা যদি সম্ভব না হয়, তবে সে যেন সেই ব্যক্তির পিছে সালাত আদায় করে, যে কিনা কুরআন ও সুন্নতের ব্যাপারে অধিকতর জ্ঞানী এবং আল্লাহ ও তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি অধিকতর অনুগত।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বলেছেন, “লোকদের মধ্যে সেই ব্যক্তির উচিত সালাতে ইমাম হওয়া, যে ব্যক্তি তাদের মধ্যে কুরআনে সবচেয়ে বেশী জ্ঞানী; যদি তারা এক্ষেত্রে সমান হয় তবে সুন্নতের ব্যাপারে তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী জ্ঞানী; যদি তারা এক্ষেত্রেও সমান হয় তবে তাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম হিজরত করেছে; আর এটাতেও যদি তারা সমান হয় তবে তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি একে অপরের থেকে বয়সে বড়, তাকে ইমাম করা উচিত।” (বুখারি, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ, ইবন মাযাহ, মুসনাদ আহমাদ)

কিন্তু কেউ যদি এটা মনে করে যে, সে বিদআত ও মন্দ কাজ সম্পাদনকারীকে পরিহার করে চললে উত্তমরূপে কাজ করতে পারবে, তবে তার সেটাই করা উচিত। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) সেই তিন ব্যক্তি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন যারা তাবুক অভিযানে পিছনে ছিল, যতক্ষণ না পর্যন্ত আল্লাহ তাদের প্রতি অনুগ্রহ করলেন।

কোন ব্যক্তিকে যদি এমন কারো ইমাম করা হয় যাদের মধ্যে কোন একজন তাকে ইমাম হিসেবে সমর্থন করে না এবং একজন ব্যক্তি যদি জামাআতের সাথে জুমার সালাত বা দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা থেকে দূরে থাকার মধ্যে কোন অধিকতর কল্যাণ আশা না করে, তবে সে যেন এটা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে হঠকারী ও বোকামি পূর্ণ কাজ করলো, আর সে যেন এক বিদআত দিয়ে অপর বিদআতকে প্রতিহত করলো।

(মাজমু’আত আর রাসাইল ওয়াল মাসাইল - ইবনে তাইমিয়্যাহ)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

The Greatest Nation

 

Notes

02

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাদিস তাফসীর – “… বল, আমি আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনলাম, এবং এরপর এর উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকো

 

 

The Greatest Nation·Thursday, July 14, 2016

 

 

সুফিয়ান বিন আবদুল্লাহ আস-সাকাফি (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ “আমি একবার রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট গিয়ে বললাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম), আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন একটি চূড়ান্ত কথা বলুন যে সম্পর্কে আমার আপনার পরে (অন্য বর্ণনায় রয়েছে –‘আপনি ছাড়া’) আর কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হবে না।’ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘বল, আমি আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনলাম, এবং এরপর এর উপর ইস্তিকামা অবলম্বন করো (দৃঢ় ও অবিচল থাকো)।’ ”

(মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৬২/৩৮; মুসনাদে আহমাদ – হাদিস ২/৪১৩)

 

হাদিসটির ব্যাখ্যা

সুফিয়ান বিন আবদুল্লাহ আস-সাকাফি (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে যা জানতে চেয়েছিলেন –“ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম), আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন একটি চূড়ান্ত কথা বলুন যে সম্পর্কে আমার আপনার পরে (অন্য বর্ণনায় রয়েছে –‘আপনি ছাড়া’) আর কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হবে না।” এর অর্থ হল, তিনি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে থেকে এমন একটি ব্যাপক উপদেশ জানতে চেয়েছিলেন, যাতে করে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পরে তার আর কারো কাছে জানার প্রয়োজন না হয়।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন, “বল – আমি আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনলাম, এবং এরপর এর উপর ইস্তিকামা অবলম্বন করো (দৃঢ় ও অবিচল থাকো)।”

এ হাদিসটি পাওয়া যায় আল্লাহ্‌র এ পবিত্র বাণী থেকে,

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّـهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنتُمْ تُوعَدُونَ ﴿٣٠﴾

“নিঃসন্দেহে, যারা বলে ‘আমাদের রব (একমাত্র) আল্লাহ’, অতঃপর তারা ইস্তিকামা (আল্লাহ যেসব কাজ হারাম করেছেন তা থেকে বিরত এবং যেসব কাজ আদেশ করেছেন সেগুলো মেনে চলার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র একত্ববাদের উপর দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকা) অবলম্বন করে, তাদের কাছে (তাদের মৃত্যুর সময়) ফেরেশতারা নাযিল হয়ে বলবে, ‘ভয় পেয়ো না, দুঃখও করো না ! সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো যার ব্যাপারে তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো।’ ” (সূরা ফুসসিলাত, ৪১ :৩০)

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّـهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿١٣﴾ أُولَـٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿١٤﴾

“নিঃসন্দেহে, যারা বলে ‘আমাদের রব (একমাত্র) আল্লাহ’, অতঃপর তারা ইস্তিকামা (আল্লাহ যেসব কাজ হারাম করেছেন তা থেকে বিরত এবং যেসব কাজ আদেশ করেছেন সেগুলো মেনে চলার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র একত্ববাদের উপর দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকা) অবলম্বন করে, না তারা ভয় পাবে অথবা দুঃখ পাবে (পরকালে)। তারাই হবে জান্নাতের অধিকারী, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে, এ হচ্ছে তাদের সেই কাজের পুরস্কার যা তারা (দুনিয়ায়) করে এসেছে।” (সূরা আল আহকাফ, ৪৬ : ১৩-১৪)

فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَن تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا ۚ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ﴿١١٢﴾

“অতএব (হে নবী), তোমাকে যেমনি করে (সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার) আদেশ দেওয়া হয়েছে তুমি ইস্তিকামা অবলম্বন করো, তোমার সাথে যারা (তাওবা করে) ফিরে এসেছে তারাও, তোমরা কখনো সীমালঙ্ঘন করো না, তোমরা যা কিছু করছ আল্লাহ অবশ্যই তার সবকিছু দেখছেন।” (সূরা হুদ, ১১ :১১২)

আল্লাহ তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে এবং সাহাবীদেরকে ইস্তিকামা অবলম্বন করার (দ্বীনের উপর দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকার) এবং সীমালঙ্ঘন না করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। আর তিনি তাদের সব কাজের খবর জানেন। আল্লাহ আরও বলেছেন,

فَلِذَٰلِكَ فَادْعُ ۖ وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ ۖ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ ۖ

“অতএব (হে নবী), তুমি (মানুষদের) এ (দ্বীনের) দিকে ডাকতে থাকো, তোমাকে যেভাবে আদেশ দেওয়া হয়েছে সেভাবেই এর উপর ইস্তিকামা অবলম্বন করো, ওদের খেয়াল খুশীর অনুসরন করো না …” (সূরা আশ শুরা, ৪২ :১৫)

কাতাদাহ বলেন, “রাসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে তাওহিদের উপর ইস্তিকামা অবলম্বনের আদেশ দেওয়া হয়েছিলো।” আল্লাহ আরও বলেছেন,

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَىٰ إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَـٰهُكُمْ إِلَـٰهٌ وَاحِدٌ فَاسْتَقِيمُوا إِلَيْهِ وَاسْتَغْفِرُوهُ ۗ وَوَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِينَ ﴿٦﴾

“(হে নবী,) তুমি বলো, আমি তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ, কিন্তু আমার উপর (এ মর্মে) ওহী নাযিল হয় যে, তোমাদের মাবূদ হচ্ছে একজন, অতএব তোমরা ইস্তিকামা অবলম্বন করো এবং তার কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করো।” (সূরা ফুসসিলাত, ৪১ :৬)

 

ইস্তিকামা’র (দৃঢ় অবিচল থাকা) সংজ্ঞা

ইস্তিকামা বলতে বুঝায় সঠিক পথ থেকে ন্যূনতম বিচ্যুতি না ঘটিয়েই এই পথ আঁকড়িয়ে ধরে থাকা। সৎ কর্ম করা (গোপনে বা প্রকাশ্যে) এবং হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা ইস্তিকামার অন্তর্ভুক্ত। এভাবে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সেই দৃঢ় থাকার উপদেশের মধ্যে দ্বীনের সকল ভাল বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত হল।

আল্লাহর বানীঃ “অতএব তোমরা ইস্তিকামা অবলম্বন করো এবং তার কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করো” – এই আয়াত ইঙ্গিত করে যে, একজন ব্যক্তির ইস্তিকামার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকতে পারে। এ কারনে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য যাতে করে ব্যক্তির ইস্তিকামা পরিপূর্ণ হতে পারে। এখানে বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) মু’আয (রাঃ) কে যা বলেছিলেন তার মতো – “যেখানেই থাকো না কেন আল্লাহ্‌কে ভয় করো এবং পাপ কাজ হয়ে গেলে সৎ কর্ম করো, যা তোমার সেই পাপ কাজকে মুছে দিবে।” (তিরমিযি – কিতাব আল বির ওয়াস সিলাহ, হাদিস ১৯৮৭; তিনি বলেছেন যে হাদিসটি নির্ভরযোগ্য হাদিস)

 

পূর্ণাঙ্গ ইস্তিকামা ও নিকটবর্তী (কাছাকাছি) ইস্তিকামা

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “দৃঢ় অবিচল থাকো এবং নির্ভুল হওয়ার চেষ্টা করো।” (বুখারি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৩৯; মুসলিম – কিতাব সিফাত আল মুনাফিকিন, হাদিস ২৮১৬)

ইস্তিকামা বলতে বুঝায় কথা, কর্ম ও নিয়্যত উত্তমরূপে করা।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আলী (রাঃ) কে আদেশ করেছিলেন আল্লাহ্‌র কাছে হিদায়াত ও ইস্তিকামার ব্যাপারে দুয়া করার জন্য। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বলেছিলেন, “মনে রাখবে, ইস্তিকামা হল নিখুঁতভাবে তীর নিক্ষেপের মতো, আর হিদায়াত হল সঠিক পথটি গ্রহণ করার মতো।” (মুসলিম – কিতাবুয যিকর ওয়াদ দুয়া, হাদিস ৭৮/২৭২৫)

নিকটবর্তী ইস্তিকামা হল পূর্ণাঙ্গ ইস্তিকামার জন্য প্রচেষ্টা করা, কিন্তু ব্যক্তি সেটা করতে পারে না। ব্যক্তির উচিত ইস্তিকামা অবলম্বনের ব্যাপারে নিয়্যত রাখা। ব্যক্তি কখনো পূর্ণাঙ্গ ইস্তিকামা অবলম্বন করতে সক্ষম নয়, এর প্রমাণ হল রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসঃ

“হে লোকসকল, তোমরা আমার সব আদেশই সম্পাদন বা বহন করতে পারবে না। তবুও তোমরা ইস্তিকামা অবলম্বন করতে থাকো এবং নিখুত হওয়ার চেষ্টা করো।” (আবু দাউদ – কিতাব আস সালাহ, হাদিস ১০৯৬; মুসনাদে আহমাদ – হাদিস ৪/২১২; ইবন খুযাইমাহ তার সাহিহ (১৪৫২) তেও বর্ণনা করেছেন)

এর অর্থ হল, ব্যক্তির উচিত নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করা, কারন কেউই পরিপূর্ণভাবে ইস্তিকামা অবলম্বন করতে পারবে না।

 

ইস্তিকামার সারমর্ম

ইস্তিকামার সারমর্ম হল, আল্লাহ্‌র একত্ববাদের উপর অন্তরকে ইস্তিকামা অবলম্বন করতে হবে; যেমনটি আবু বকর আস সিদ্দিক (রাঃ) এবং অন্যান্যরা আল্লাহ্‌র এই আয়াতের ব্যাপারে ব্যাখ্যা করেছেন –

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّـهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿١٣﴾

“নিঃসন্দেহে, যারা বলে ‘আমাদের রব (একমাত্র) আল্লাহ’, অতঃপর তারা ইস্তিকামা (আল্লাহ যেসব কাজ হারাম করেছেন তা থেকে বিরত এবং যেসব কাজ আদেশ করেছেন সেগুলো মেনে চলার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র একত্ববাদের উপর দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকা) অবলম্বন করে …” (সূরা আল আহকাফ, ৪৬ :১৩)

তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন দিকে মনোযোগ দিবে না। একবার যদি অন্তর আল্লাহ সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান লাভ করে, তাকে ভয় করে, ভালবাসে, সম্মান করে, তাকে ডাকে, তার সম্পর্কে আশা করে এবং তার প্রতি ভরসা রাখে; তবে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহ ছাড়া কারো আনুগত্য করবে না। অন্তর হল সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রাজা যেখানে প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার সৈনিক। রাজা যদি একবার দৃঢ় অবিচল হয়ে যায়, তবে তার সৈন্যরা ও অধিনস্তরা তার অনুসরন করবে এবং ঠিক তার মতো হয়ে পড়বে।

ইস্তিকামার ব্যাপারে অন্তরের পর একজন ব্যক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল তার জিহবা, কারন অন্তর যা লুকিয়ে রাখে এটি তা প্রকাশ করে। এ কারনে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সাহাবীদের ইস্তিকামার ব্যাপারে উপদেশ দেওয়ার পর তিনি তাদেরকে জিহবার ব্যাপারে ইস্তিকামার আদেশ দিয়েছিলেন।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাসী ব্যক্তির ঈমান অবিচল হবে না যদি না তার অন্তর দৃঢ় অবিচল হয়। তার অন্তর দৃঢ় অবিচল হবে না যদি না তার জিহবা দৃঢ় অবিচল হয়।” (মুসনাদে আহমাদ – হাদিস ৩/১৯৮)

আবু সাই’দ আল খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “সকালে প্রত্যেক মানুষের অঙ্গগুলো জিহবাকে উপদেশ দেয় এবং বলে, ‘আল্লাহ্‌কে ভয় করো। তুমি যদি অবিচল থাকো তবে আমরাও অবিচল থাকবো। যদি তুমি পথভ্রষ্ট হও তবে আমরাও পথভ্রষ্ট হবো।’ ” (তিরমিযি – কিতাবুয যুহদ, হাদিস ২৪০৭)

 

হাদিসের তাফসীরটি ইমাম ইবন রজব আল-হানবালি’র কিতাব জামি'আল 'উলুম ওয়াল হিকাম এর ইংলিশ ভার্শন থেকে ট্রান্সলেশন করা হয়েছে।

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাদিস তাফসীর – “ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের উপর …”

 

The Greatest Nation·Thursday, July 14, 2016

 

 

 

‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছিলাম, “ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের উপর স্থাপিত – এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর রাসুল, সালাত কায়েম করা, যাকাত দান করা, হজ করা এবং রামাদান মাসে সিয়াম পালন করা।”

(বুখারি –কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৮; মুসলিম – কিতাবুল ইমান, হাদিস ১৬/২১)

 

হাদিসটির অর্থ

হাদিসটি যে অর্থ প্রকাশ করে তা হল - দ্বীন ইসলামের ভিত্তি হল প্রদত্ত পাঁচটি আমলের উপর, যেগুলো দ্বীন ইসলামের পুরো কাঠামোটির ভারবহনের জন্য স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। ইসলাম ও বস্তুগত কাঠামোর মধ্যে যে সুস্পষ্ট তুলনা এখানে প্রকাশ করা হয়েছে তা এটা ইঙ্গিত করে যে, কোন গঠনই একটি দুর্গ হতে পারবে না যদি এটি কোন স্তম্ভ দ্বারা সমর্থন লাভ না করে। অনুরূপভাবে, প্রদত্ত পাঁচটি আমল ছাড়া ইসলাম কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না, যখন কিনা অন্যান্য ইসলামিক আমলগুলো পুরো কাঠামোর শক্তিকে আরও পরিপূর্ণ করে। এর অর্থ হল, যদি প্রদত্ত পাঁচটি আমল ছাড়া যদি অন্য কোন ইসলামিক আমলের অভাব হয়, তবে কাঠামোটির শক্তি যথেষ্ট নয় বলে বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে, প্রদত্ত পাঁচটি আমলের অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে দ্বীন ইসলামের পুরো কাঠামোটিই বিনষ্ট করে দিবে। এর ফলে, দুই সাক্ষ্য‘র অনুপস্থিতি (আল্লাহ্‌ও তার রসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনার সাক্ষ্য) ইসলামের অস্তিত্বকে বিনষ্ট করে দিবে।

ইমাম বুখারি কতৃক বর্ণিত অপর বর্ণনায় এই দুই সাক্ষ্য‘র অর্থ পাওয়া যায় এই বর্ণনার মাধ্যমে – “দ্বীন ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের উপরঃ আল্লাহ্‌র ও তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করা .....।” (বুখারি – কিতাবুত তাফসীর, হাদিস ৪৫১৪)

ইমাম মুসলিম থেকে আরেকটি বর্ণনা পাওয়া যায় এই বর্ণনার মাধ্যমে – “দ্বীন ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি – আল্লাহ্‌র একত্ববাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়া .....।”

ইমাম মুসলিম থেকে পাওয়া আরেকটি বর্ণনা হল – “দ্বীন ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি – আল্লাহ্‌র ইবাদাহ করা এবং অন্য সকল কিছুকে প্রত্যাখ্যান করা।” (মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ১৬/১৯-২০)

এটি ইঙ্গিত করে যে, আল্লাহ ও তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর ঈমান আনার বিষয়টি ইসলামের মুল বিষয় হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে, যেভাবে উপরোক্ত হাদিসগুলোতে এই সিদ্ধান্তে আসা গিয়েছে।

 

ইসলামে সালাতের অবস্থান

এ ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনেক হাদিস আছে যে, যে ব্যক্তি ফরয সালাত আদায় করা ছেড়ে দেয় সে একজন মুসলিম হিসেবে বিবেচিত হবে না।

জাবির (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “সালাত বর্জন করা হল একজন মুসলিম এবং শির্ক ও কুফরীর মধ্যে অন্তরায়।” (মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৮২/১৩৪)

মুয়ায (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ইসলাম হল সমস্ত কিছুর চুড়া এবং সালাত হল এর স্তম্ভ।” (তিরমিযি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ২৬১৬, এটি একটি ভালো নির্ভরযোগ্য হাদিস; মুসনাদ আহমাদ – খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৩১,২৩৭)

হাদিসটি হল একটি উপমা যা ইসলামে সালাতের অবস্থানের তুলনা করা হয়েছে (এভাবে) যে, একটি তাঁবুর স্থান ধ্বসে পড়লে সে তাঁবুটি সুস্পষ্টভাবেই বিনষ্ট হয়ে যাবে।

উমার বিন আল খাত্তাব (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি সালাত বর্জন করে ইসলামের জন্য তার করার কিছুই নেই।” (মুওাত্তা মালিক – কিতাবুত তাহারাহ, হাদিস ৫৩)

রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবীরা এবং আলী ইবন আবি তালিব (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি সালাত বর্জন করলো সে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করলো।” (ইবন আবি শাইবাহ -১১/৪৭, ৪৯)

‘আবদুল্লাহ বিন শাকিক বলেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবীরা সালাত বর্জন ছাড়া কোন কোন কাজকেই এমন মনে করতেন না যা একজন ব্যক্তিকে কুফরীর দিকে নিয়ে যায়।” (ইবন আবি শাইবাহ -১১/৪৭, ৪৯)

আইয়ুব আশ শিখতায়ানি বলেন, “সালাত বর্জন নিঃসন্দেহে দ্বীন বিরোধী।” এই যথার্থ মতটি প্রথম যুগের একদল আলিম এবং পরবর্তী আলিমগণ কতৃক গৃহীত হয়েছিলো, তাদের মধ্যে রয়েছে ইবন আল মুবারাক, ইমাম আহমাদ এবং ইসহাক। ইসহাক বলেছেন যে এই মতের উপর সকল আলিমগণ একমত আছেন।

মুহাম্মাদ বিন নাসর আল মারওয়াযি বলেন, “হাদিসের বেশীরভাগ আলিম যে মতটি গ্রহণ করেছেন এটি সেই একই মত।

আলিমদের এক দল এই মতটি গ্রহণ করেছেন যে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের কোন একটি বর্জন করে সে নিজেকে একজন কাফির ব্যক্তিতে পরিণত করে। এই মতটি পাওয়া যায় সা’ইদ বিন জুবাইর, নাফি’ এবং আল হাকাম থেকে। এছাড়াও তা পাওয়া যায় ইমাম আহমাদ থেকে যা তার কিছু অনুসারী গ্রহণ করেছেন। মালিকি মাযহাবের আলিম ইবন হাবিব একই মতটি গ্রহণ করেছেন।

সালাত বর্জন যে দ্বীন বিরোধী কাজ তার দলীল হিসেবে ইমাম আহমাদ এবং ইসহাক উল্লেখ করেছেন শয়তান কতৃক আল্লাহ্‌র আদেশের সেই বিরোধীতা যা সে করেছিলো আদমকে সিজদাহ করতে অস্বীকার করার মাধ্যমে। ইমাম আহমাদ এবং ইসহাক এ ব্যাপারে বলেছেন, “তবে কোন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ্‌কে সিজদাহ’র ব্যাপারটি কিরূপ হবে, যিনি কিনা আদম থেকেও শ্রেষ্ঠ ?”

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যদি কেউ সিজদাহ’র আয়াত তিলাওয়াত করে এবং এরপর আল্লাহ্‌কে সিজদাহ করে, তখন শয়তান কাঁদে আর বলে, ‘আমার উপর দুঃখ আপতিত হোক ! আদমের সন্তানকে আদেশ করা হল (আল্লাহকে) সিজদাহ করার জন্য আর সে তা মান্য করলো, যেটার জন্য তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। কিন্তু আমাকে সিজদাহ করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছিলো আর আমি তা অমান্য করলাম, যার কারনে আমাকে দোযখে প্রবেশ করানো হবে।’ ” (মুসলিম –কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৮১/১৩৩)

ইবন উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আরেকটি নিকটবর্তী হাদিস এটা প্রমাণ করে যে, যদি কোন মূল বিষয়ের অধীনে বিভিন্ন অপরিহার্য অংশ থাকে, তবে উক্ত মূল বিষয়টি এর কিছু অপরিহার্য অংশের অনুপস্থিতির কারনে অবধারিতভাবে বিনষ্ট হয়ে যায় না। এই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার জন্য আলিমরা ঈমান এবং বিভিন্ন শাখা বিশিষ্ট একটি গাছের মধ্যে তুলনা করেছেন। যদি এই গাছের কিছু শাখা দেখতে পাওয়া না যায় বা পড়ে যায়, তবে মূল গাছটি এরপরও সেই গাছের নামটি বহন করবে, যদিও সে গাছের কিছু শাখা অনুপস্থিত।

মহান আল্লাহ প্রায় একই উপমা উল্লেখ করেছেন কুরআনেঃ

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللَّـهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ ﴿٢٤﴾

تُؤْتِي أُكُلَهَا كُلَّ حِينٍ بِإِذْنِ رَبِّهَا ۗ وَيَضْرِبُ اللَّـهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ ﴿٢٥﴾

“তুমি কি দেখছ না, আল্লাহ কিভাবে একটি রূপক ব্যাখ্যা করছেন ? এটি একটি চমৎকার বানী - সেটা যেন একটি উৎকৃষ্ট (জাতের) গাছ, যার মূল (জমিনে) সুদৃঢ়, যার শাখা প্রশাখা আসমানে (বিস্তৃত), সেটি প্রতি মৌসুমে তার মালিকের আদেশে ফল দান করে।” (সূরা ইবরাহীম, ১৪ :২৪-২৫)

এই রুপকে যে ‘বানী’ ’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটা হল আল্লাহ্‌র একত্ববাদের ব্যাপারে সংশোধিত হওয়া, আর ‘মূল’ বলতে বুঝানো হয়েছে মুমিন বান্দার অন্তরের গভীরে গেথে যাওয়া ঈমানকে, আর ‘ফল’ বলতে বুঝানো হয়েছে মুমিনদের সৎ আমলকে।

রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ইমানদার মুসলিমদেরকে খেজুর গাছের সাথে তুলনা করতে গিয়ে (দেখুন –বুখারি – কিতাবুল ইলম, হাদিস ৬১,৬৩; মুসলিম – মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য, হাদিস ২৮১১) একইরকম রূপক ব্যাখ্যা করেছেন, যার কিছু শাখা পতিত হওয়ার পরও এটি একটি ‘খেজুর গাছ’ নামটিই বহন করবে।

জিহাদ এবং ইসলামের স্তম্ভ

যদিও জিহাদ হল ইসলামের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আমল, কিন্তু এটা ইবন উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত এ হাদিসে উল্লেখ করা হয়নি।

মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ইসলাম হল সবকিছুর চুড়া, আর জিহাদ হল ইসলামের কাঠামোর সবচেয়ে উঁচু প্রান্ত।” (তিরমিযি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ২৬১৬; মুসনাদ আহমাদ – খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৩১,২৩৭)

এর অর্থ হল, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে জিহাদ নেই, এর কারন হলঃ

প্রথমতঃ অধিকাংশ আলিমরা এ ব্যাপারে একমত যে জিহাদ একটি সমষ্টিগত দায়িত্ব (ফারযে কিফায়াহ) এবং এটা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের ন্যায় একটি ব্যক্তিগত দায়িত্ব (ফারযে ‘আইন) নয়।

দ্বিতীয়তঃ কিয়ামতের আগ পর্যন্ত জিহাদের ফারযিয়্যাহ সমাপ্ত হবে না, যেমনটি জিহাদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে ঈসা (আঃ) এর আবির্ভাবের পর আর দুনিয়ার বুকে একমাত্র ইসলামই দ্বীন হিসেবে বিদ্যমান থাকবে, যখন কিনা সকল যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে। এটি ইসলামের সেই পাঁচটি স্তম্ভের মতো সকল ইমানদারদের জন্য ব্যক্তিগত ফরয আমল নয়, যাদেরকে সেগুলো মেনে চলতে হবে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত বা কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত।

 

হাদিসের তাফসীরটি ইমাম ইবন রজব আল-হানবালি’র কিতাব জামি'আল 'উলুম ওয়াল হিকাম এর ইংলিশ ভার্শন থেকে ট্রান্সলেশন করা হয়েছে।

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাদিস তাফসীর – “দ্বীন হল নাসিহাহ

 

 

The Greatest Nation·Friday, July 15, 2016

 

 

আবু রুকাইয়্যাহ তামিম বিন আউস আদ-দারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বলেছেন, “দ্বীন হল নাসিহাহ।” লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, “কার জন্য (নাসিহাহ) ?” রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বললেন, “আল্লাহ’র জন্য, তার কিতাবের জন্য, তার রসূলের জন্য, মুসলিমদের নেতাদের জন্য আর মুসলিম জনসাধারণের জন্য (নাসিহাহ)।”

(মুসলিম – কিতাবুল ঈমান)

 

হাদিসটির গুরুত্ব

যে হাদিসগুলোর উপর ফিকহশাস্ত্র বিশেষভাবে নজর দেয়, এ হাদিসটি সে হাদিসগুলোর একটি।

আল-হাফিজ আবু নু’আইম বলেছেন, “এ হাদিসটির এক মহান অবস্থান রয়েছে।”

 

নাসিহাহ করা – সুন্নাহতে এর অবস্থা

মুসলিমদের জন্য নাসিহাহ করার বিষয়টি অনেক হাদিসেই পাওয়া যায়, এদের মধ্যে কিছু হাদিসে মুসলিমদের নেতাদের জন্য আর কিছু হাদিসে মুসলিম নেতাদের তাদের অধীনস্তদের জন্য নাসিহাহ করার বিষয়টি এসেছে।

 

(১) মুসলিমদের জন্য সাধারণভাবে নাসিহাহ করা

জারির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেছেন, “আমি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) এর কাছে সালাত কায়েম আর যাকাত আদায়ের জন্য বাইয়াত করেছি।” (বুখারি – কিতাবুল মাওাকিত আস-সালাহ, মুসলিম – কিতাবুল ঈমান)

এ হাদিসটিতে নাসিহাহটি সকল মুসলিমদের জন্যই।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বলেছেন, “এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের ছয়টি হক রয়েছে …”, আর এই ছয়টি হকের মধ্যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বলেছেন – “যদি সে তোমার কাছে নাসিহাহ চায় তবে তুমি তাকে নাসিহাহ করবে।” (মুসলিম – কিতাবুস সালাম)

 

(২) কতৃত্বশীল লোকদের নাসিহাহ করা

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বলেছেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ তিনটি বিষয়ে তোমাদের উপর খুশী হোন আর তিনটি বিষয়ে তোমাদের উপর অসন্তুষ্ট হোন। (যে বিষয়গুলোর জন্য) তিনি তোমাদের উপর খুশী হোন (সেগুলো হল) – তার ইবাদাত করা আর তার সাথে কিছুকে অংশীদার না করা, আল্লাহ’র রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে রাখা আর বিভক্ত না হওয়া, এবং যাদেরকে আল্লাহ তোমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে দায়িত্বশীল করেছেন তাদের সাথে পরস্পর আন্তরিক থাকা …” (আল-আদাবুল মুফরাদ, সাহিহ ইবনে হিব্বান)

 

(৩) কতৃত্বশীল ব্যক্তিদের অধীনস্তদের জন্য নাসিহাহ করা

মাকিল বিন ইয়াসার থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) বলেছেন, “কোন বান্দাকে আল্লাহ যদি জনগনের নেতৃত্ব দান করেন আর সে কল্যাণকামিতার সাথে তাদের তত্ত্বাবধান না করে, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।” (বুখারি – কিতাবুল আহকাম, মুসলিম – কিতাবুল ঈমান)

আল্লাহ তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, নবীরা তাদের জনসাধারণকে নাসিহাহ করতেন, যেমনটি বর্ণিত হয়েছে নূহ এবং সালিহ (আ’লাইহিস সালাম) এর ব্যাপারে।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উক্তি – “দ্বীন হল নাসিহাহ” – এই উক্তি দিয়ে জানা যায়, নাসিহাহ অন্তর্ভুক্ত করে ইসলাম, ঈমান ও ইহসানের শাখাগুলোকে; হাদিসে জিব্রাইলে ইসলাম, ঈমান ও ইহসানকে একত্রে “দ্বীন” আখ্যায়িত করা হয়েছিলো।

সঠিক নাসিহাহ করাটা অপরিহার্য করে আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা সম্ভাব্য সবচেয়ে সম্পূর্ণ উপায়ে সম্পাদন করাকে, যেটা হল ইহসান। আর এভাবেই এটা (ইহসান) ছাড়া নাসিহাহ পরিপূর্ণ হয় না, যেটা আল্লাহ’র আদেশ করা পূর্ণ ভালোবাসা আর উপলব্ধি ছাড়া ঘটে না। এর জন্য প্রয়োজন নফল ইবাদাত করার মাধ্যমে এবং হারাম ও মাকরুহ (অপছন্দনীয়) ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ’র নিকটবর্তী হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা করা।

আল-খাত্তাবি বলেছেন, “ ‘নাসিহাহ’ হল এমন একটি শব্দ যেটা একটি বাক্যকে প্রকাশ করে – উপদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তির কল্যাণ কামনা করাই হল নাসিহাহ।” তিনি আরো বলেন, “ ‘নাসিহাহ’ শব্দের ভাষাগত মূলের অর্থ হল ‘বিশুদ্ধতা’।”

এটি সেই একই অর্থের, যেমনটি বলা হয় – “মক্ষিমল থেকে মধুকে বিশুদ্ধ করা হলো।”

সুতরাং, আল্লাহ’র জন্য নাসিহাহ করার অর্থ হল – আল্লাহ’র তাওহীদের প্রতি বিশ্বাসে বিশুদ্ধতা আর তার ইবাদাতে নিয়্যতের আন্তরিকতা।

আল্লাহ’র কিতাবের জন্য নাসিহাহ করার অর্থ হল তার কিতাবের উপর ঈমান রাখা আর কিতাবের অনুসরণে আমল করা।

আল্লাহ’র রসূল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য নাসিহাহ করার অর্থ হল রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নবুউওয়াতের প্রতি ঈমান আনা আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যা কিছু আদেশ ও নিষেধ করেছেন সেগুলো মেনে চলা।

মুসলিম জনসাধারণের জন্য নাসিহাহ করার অর্থ হল যেটা তাদের জন্য উপকারী, সেটার প্রতি তাদেরকে পথ দেখানো।

 

“নাসিহাহ” – এর ব্যাখ্যা

আদেশকৃত কাজের জন্য যে কোন ব্যক্তি নির্বিশেষে অন্তরের মনোনিবেশ করাই হল নাসিহাহ। এটি দুই প্রকারের – ফরজ ও নফল।

আল্লাহ’র দৃষ্টিতে ফরজ নাসিহাহ হল ফরয কাজ করার ও হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে ব্যক্তির প্রগাঢ় মনোনিবেশ করা।

নফল নাসিহাহ হল কাউকে ভালোবাসার উপর আল্লাহ’র প্রতি ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেওয়া। এ কারনে ব্যক্তি যদি এমন অবস্থার মুখোমুখি হয় – তার সামনে দুটো কাজ, একটি আল্লাহ’র আর অপরটি নিজের, তবে তার উচিত হবে নিজের কাজটি স্থগিত রেখে যে কাজটি আল্লাহ’র জন্য সেটাই করা।

 

আল্লাহ’র কিতাবের জন্য নাসিহাহ করা হল তার কিতাবের অবস্থানের জন্য এর প্রতি তীব্র ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা রাখা আর এটি বুঝার জন্য তীব্র ইচ্ছা রাখা, যেহেতু এটি সৃষ্টিকর্তার বাণী।

আল্লাহ’র কিতাবের জন্য নাসিহাহ করার আরো অর্থ হল, এই কিতাবের উপর গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার ব্যাপারে প্রচণ্ড যত্নবান হওয়া, আর এটা তিলাওয়াত করার সময় থেমে থেমে এর অর্থ খোঁজ করা যে, তার রব স্বয়ং নিজের সম্পর্কে অনুধাবনের ব্যাপারে তার গোলামদের জন্য কি ভালোবাসেন (অর্থাৎ, যেভাবে তিনি নিজেকে বর্ণনা করেছেন, কুরআনের আয়াতগুলোর উপর চিন্তা করার মাধ্যমে তাকে সেভাবেই চিনে নেওয়া), আর অনুধাবন করতে পারার পর সেটার উপর আমল করা।

 

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য নাসিহাহ করা ছিল তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আনুগত্যে, তাকে (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহায্য ও সমর্থন করা, তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পদ ব্যয়ের কামনা করলে সম্পদ ব্যয় করা এবং তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ভালবাসায় অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টায় উদ্যমী হওয়া।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তিকালের পর তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য নাসিহাহ করার অর্থ হল তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাতের অনুসরণের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া, তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) নীতি আর আচার-আচরণ পুনর্জীবিত করা, তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশগুলোকে সম্মান করা আর সেগুলোর উপর আমল করা, দ্বীন থেকে সুন্নাতকে বিচ্ছিন্নকারী ব্যক্তির প্রতি অত্যন্ত রাগান্বিত হওয়া ও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, আর তার প্রতিও রাগান্বিত হওয়া যে কিনা পার্থিব লাভের জন্য রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাতের অনসরন করে – যদিও সে ব্যক্তি এমনটা করার মাধ্যমে ধার্মিক হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকে।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য নাসিহাহ করার আরো অর্থ হল – যে ব্যক্তিই রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর (সাথে দ্বীনী সম্পর্কের) ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেমন – তার আত্মীয়রা, বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়রা, হিজরতের সমর্থনকারীরা, অথবা যিনি ইসলামের জন্য দিন বা রাতের এক ঘণ্টা সময়ও তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে ছিলেন আর তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আচার আচরণ ও পোশাকের ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করেছিলেন – তাদের প্রতি ভালোবাসা রাখা।

 

মুসলিমদের নেতাদের (রাজনৈতিক ও আলিম) জন্য নাসিহাহ করার অর্থ হল – তাদের সৎ কর্মপরায়ণতা, হিদায়াত, ন্যায়বিচারের জন্য অন্তরে ভালোবাসা রাখা; আর মুসলিম নেতাদের অধীনে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আকাংখা রাখা, আর মুসলিমেরা তাদের কারনে বিভক্ত হলে সেটা ঘৃণা করাও।

এ নাসিহাহ করার আরো অর্থ হল – আল্লাহ’র আনুগত্যে তাদের মেনে চলার মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ হওয়া; আর সে ব্যক্তিদের ঘৃণা করা যারা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অথবা আল্লাহ’র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের বদলে সে নেতাদের প্রশংসা করে।

 

মুসলিমদের জন্য নাসিহাহ করার অর্থ হল – আপনি নিজের জন্য যা ভালবাসবেন তাদের জন্যও সেটা ভালোবাসা, নিজের জন্য যেটা ঘৃণা করবেন তাদের জন্যও সেটা ঘৃণা করা, আর তাদের প্রতি সহানুভূতি ও ক্ষমাশীলতা অনুভব করা।

একজন মুসলিমের উচিত তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করা, তাদের দুঃখে দুঃখিত হওয়া আর তাদের সুখে আনন্দিত হওয়া, যদিও সেটার ফলে তার জীবিকার ক্ষতি হয়ে থাকে; এটা হতে পারে পণ্যদ্রব্যের দাম কমানোর মাধ্যমে, যদিও এর ফলে তার ব্যবসায় লাভ না করার ক্ষতিটি হয়ে থাকে। একইভাবে, মুসলিমদের ক্ষতি করতে পারে এমন অনুভূতিগুলোয় একজন মুসলিমের সাধারণভাবে অংশীদার হওয়া উচিত, আর যা তাদের কল্যাণ করে সেটাতে তার আনন্দিত হওয়া উচিত, তাদের অবিরাম সাফল্যেও আনন্দিত হওয়া উচিত, এবং তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য সমর্থন করা উচিত, আর তাদের কাছ থেকে সব আঘাত বা ক্ষতিকর কিছু দূরে সরিয়ে রাখা উচিত।

তাদের জন্য নাসিহাহ করার কিছু উপায় হল – তাদের কাছ থেকে আঘাত বা ক্ষতিকর কিছু দূরে সরিয়ে রাখা, তাদের মধ্যকার দরিদ্রদের অগ্রাধিকার দেওয়া, অজ্ঞদের শিক্ষা প্রদান করা, কথা বা কাজে যে ব্যক্তিই পথভ্রষ্ট হয়েছে তার কাছে ভদ্রতার সাথে ফিরে যাওয়া, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধে তাদের সাথে ভদ্র আচরণ করা, তাদের যে কোন দুর্নীতি দূর হওয়াটাকে ভালোবাসা – যদিও এর ফলে ব্যক্তির নিজের জীবনে কোন ক্ষতি হয়ে থাকে। যেমনটা কিছু সালাফ বলেছিলেন, “আমি চাই এ সৃষ্টি যেন আল্লাহ’র আনুগত্য করুক, যদিও এর জন্য আমার শরীর থেকে মাংস বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজন হয়।”

 

নাসিহাহ করার ধরণসমূহ

আল্লাহ, তার কিতাব ও তার রসূল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য নাসিহাহ করার ধরণগুলোর মধ্যে একটি ধরণ আলিমদের জন্য নির্দিষ্ট, যেমন – কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে এমন কামনা বাসনার পিছু নেওয়া যেটা একজন ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করতে পারে আর এমন কামনা বাসনার বিরুদ্ধে প্রমাণ স্পষ্ট করা। একইভাবে, এটি অন্তর্ভুক্ত করে আলিমদের ভুলগুলো থেকে দুর্বল বক্তব্যগুলো প্রত্যাখ্যান করা আর সেগুলোর জবাবে কুরআন ও সুন্নাহ’র দলিলগুলো স্পষ্ট করা; আর রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসগুলো থেকে যেটা সঠিক সেটা স্পষ্ট করা, আর হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে কারা গ্রহণযোগ্য আর কারা গ্রহণযোগ্য নয় সেটা স্পষ্ট করার মাধ্যমে অনির্ভরযোগ্য হাদিস স্পষ্ট করা; এবং সেই সাথে বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনাকারীদের বর্ণনাগুলোর ভুলগুলো স্পষ্ট করাটাও।

শ্রেষ্ঠ নাসিহাহ গুলোর মধ্যে একটি হল, যদি কোন ব্যক্তি তার ব্যাপারে নাসিহাহ চায় তবে তাকে নাসিহাহ করা, যেমনটা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কাউকে যদি তার (মুসলিম) ভাই তাকে নাসিহাহ করার জন্য বলে, তবে তাকে নাসিহাহ করবে।” (তিরমিযি – কিতাবুল আদাব)

কিছু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, মুসলিমদের একে অপরের উপর হকগুলোর মধ্যে একটি হল মুসলিমের অনুপস্থিতে তার জন্য নাসিহাহ করা। (দেখুনঃ তিরমিযি – কিতাবুল জানাইয, মুসনাদে আহমাদ)। এর অর্থ হল, যদি কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে লোকেরা তার সম্পর্কে খারাপ কথা বলে, তবে একজন মুসলিমের উচিত সে (অনুপস্থিত) মুসলিমকে সমর্থন করা আর তার জন্য জবাব দেওয়া। যদি সে (সমর্থনকারী মুসলিম) পরে সেই অনুপস্থিত মুসলিমকে দেখতে পায়, তবে তার উচিত হবে না সেই ব্যাপারটি উল্লেখ করা। কারন কারো অনুপস্থিতিতে নাসিহাহ করাটা নাসিহাহকারীর নিয়্যতের আন্তরিকতার দিকেই ইঙ্গিত করে, বরং এই নাসিহাহ তার উপস্থিতিতে করা হলে তার তোষামোদ করা হবে, অথচ তার অনুপস্থিতিতে তার সাথে প্রতারণা করা হবে।

 

নাসিহা করার পদ্ধতি

সালাফরা কাউকে নাসিহাহ করার ক্ষেত্রে এমনই গোপনীয়তা অবলম্বন করতেন যে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার (মুসলিম) ভাইকে নিজেদের দুজনের মধ্যেই উপদেশ দিলো, সেটা নাসিহাহ। কিন্তু কেউ যদি তাকে লোকদের সামনেই উপদেশ দেয়, তবে সেটা তো একটি কঠোর ভর্ত্সনা।”

 

হাদিস তাফসীরটি ইমাম ইবনে রজব আল-হানবালি (রাহিমাহুল্লাহ)’র কিতাব জামি’ আল উলুম ওয়াল হিকামের ইংলিশ ভার্সন থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-14

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাদিস তাফসির – “…প্রত্যেক আমল তার নিয়্যতের উপর নির্ভর করে…”

 

 

The Greatest Nation·Thursday, July 14, 2016

 

 

 

আবদুল্লাহ বিন আল জুবাইর আল হুমাইদি (র.) থেকে …… আলকামাহ বিন ওয়াক্কাস আল লাইসি (র.) থেকে বর্ণিত, উমর ইবনে আল খাত্তাব (রা.) কে মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ

“আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছিঃ প্রত্যেক আমল শুধুমাত্র নিয়্যতের উপর নির্ভর করে আর প্রত্যেক মানুষ কেবল সেটাই পাবে যেটার জন্য সে নিয়্যত করে। তাই যে হিজরত করবে দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে – তার হিজরত সেটার জন্যই হবে, যেটার জন্য সে হিজরত করবে।”

 

আল হুমাইদি (র.) থেকে বর্ণিত

আল হুমাইদি (র.) হলেন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর একজন আত্মীয় এবং সেই সাথে তিনি খাদিজা (রা.) এর বংশের লোকও। ইমাম বুখারি কুরাইশ ব্যক্তির বর্ণনাকে সামনে রেখে তার কিতাবটি রচনা করতে চাচ্ছিলেন, সম্ভবত এ কারনে তিনি এই কুরাইশের বর্ণনা দিয়ে তার কিতাব শুরু করেছিলেন।

কিতাবের প্রথম অধ্যায় “ওহীর শুরু” তে আল হুমাইদি (র.) এর বর্ণনা দিয়ে শুরু করার আরেকটি কারন হতে পারে আল হুমাইদি (র.) মক্কার নাগরিক ছিলেন, ঠিক যেমনটি ছিলেন তার শিক্ষক (এই হাদিস তিনি যার থেকে বর্ণনা করেন) সুফিয়ান বিন ‘উয়াইনাহ (র.), কারন ওহী প্রথম নাযিল হয় মক্কাতেই এবং এরপর ইমাম বুখারি এই অধ্যায়ে পরবর্তী বর্ণনা দেন মালিক থেকে যিনি একজন মাদানী, কারন পরবর্তীতে মদিনাতে ওহী নাযিল স্থানান্তরিত হয়েছিলো।

 

“ওহীর সূচনা” অধ্যায়ের নামের সাথে হাদিসটির সম্পর্ক

ইবনে নাজ্জার বলেন, “এই অধ্যায়ের নামকরনের সাথে সূরা আন নিসার ১৬৩ নাম্বার আয়াত এবং এই হাদিস – উভয়েরই সম্পর্ক আছে, কারন আল্লাহ তার বার্তাবাহকদের প্রতি এবং সবশেষে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লম) এর প্রতি ওহী নাযিল করে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে মানুষের কর্মকাণ্ড তার নিয়্যতের উপর নির্ভর করে, যেমনটি কুরআনে বলা হয়েছেঃ

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّـهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ ﴿٥﴾

‘এবং তারা এটা ছাড়া আর অন্য কিছুর জন্য আদিস্ট হয় নি যে তারা ইখলাসের সাথে সকল বাতিল ধর্ম ও দ্বীন বর্জনকারী এবং একমাত্র সত্য দ্বীন ইসলামকে অনুসরণকারীদের মতো ইবাদাহ করবে ..... ’ (সূরা আল বাইয়্যিনাহ, ৯৮ : ৫)

আবুল আলিয়াহ বলেন, “মহান আল্লাহ্‌র বাণী –

شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا

‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সেই দ্বীন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি নুহকে...’ (সূরা আশ শুরা, ৪২ : ১৩),

এবং তিনি তাদেরকে ইখলাসের সাথে (একনিষ্ঠভাবে) তাঁর ইবাদাত করার আদেশ দিয়েছিলেন।”

অনেক আলিম বলেছেন যে এই হাদিসটির সাথে প্রথম অধ্যায়টির নামের সাথে সম্পর্ক আছে, কারন মহান আল্লাহ্‌র নিয়্যতের ফলে ওহী নাযিলের সূচনা হয়েছে। আল্লাহ তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রকৃতি এমনভাবে তৈরি করেছেন যেন তা তাওহিদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং তিনি সকল মিথ্যা উপাস্যকে ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান করেন।

আবার কিছু আলিম হাদিসটির সাথে এ অধ্যায়ের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) রিসালাতপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই হিরা গুহায় নির্জনতা অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র দিকে হিজরত করেছিলেন।

 

হাদিসটির গুরুত্ব

আব্দুর রহমান আল মাহদি, ইমাম শাফিই, আহমাদ বিন হানবাল, আলী বিন আল মাদিনি, আবু দাউদ, আত তিরমিযি, আল দারাকুতনি এবং আল কিনানি – এ সকল ইমামগণ এই ব্যাপারে একমত পোষণ করেছিলেন যে, এই হাদিসটি ইসলামের এক-তৃতীয়াংশ, অথবা কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ।

এই ব্যাপারে বায়হাকি ব্যাখ্যা করেন যে, মানুষের আমল (কাজ) সংঘটিত হয় তার অন্তর, জিহ্বা আর অঙ্গের মাধ্যমে, তাই নিয়্যত এর এক-তৃতীয়াংশ এবং আমলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ইমাম শাফিই বলেছেন যে এই হাদিস জ্ঞানের অনেক শাখা ধারন করে।

 

আরও যারা এই হাদিসটি বর্ণনা করেন

ইমাম মালিক (তার কিতাব মুওাত্তা আল মালিকে) ছাড়া সব বিখ্যাত আলেমরা এই হাদিসটি তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য বুখারি, মুসলিম এবং নাসাঈ ইমাম মালিক থেকে পাওয়া এই বর্ণনাটিই তাদের কিতাবে বর্ণিত করেছেন।

উমর থেকে শুরু হয়ে ইয়াহইয়া বিন সাইদ পর্যন্ত হাদিস বর্ণনাকারীদের শুধুমাত্র একটি সনদ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ইয়াহইয়ার বর্ণনা থেকে অনেক ব্যক্তি হাদিসটি বর্ণনা করার কারনে ইয়াহইয়া থেকে অনেক সনদে এই হাদিসটির বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়াও এই হাদিসের আরও কিছু সনদ পাওয়া যায় যেগুলো নির্ভরযোগ্য নয়।

তাই হাদিসের পরিভাষা অনুযায়ী এটি একটি ফারদ (একক) ধাঁচের বর্ণনা। যেহেতু অনেক হাদিসেই এই বর্ণিত হাদিসের অর্থ পাওয়া যায়, তাই এটি মুতাওাতির মা’নাওি (অবিচ্ছিন্ন, অর্থাৎ অনেক বর্ণনা দেখা যায় যেখানে শব্দগুলো একইরকম নয় কিন্তু হাদিসগুলো একই অর্থ প্রকাশ করে) পর্যায়ের হাদিস।

 

হাদিসটির ব্যাখ্যা

“ মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে ”

এই মিম্বর হল মদিনাতে অবস্থিত মাসজিদ আন-নববী’র মিম্বর।

 

“ প্রত্যেক আমল শুধুমাত্র নিয়তের উপর নির্ভর করে ”

এখানে আমল ও নিয়্যত বহুবচন, অর্থাৎ প্রত্যেক আমল তার নিজস্ব নিয়্যতের উপর নির্ভর করে।

আল খুবি বলেন, “বর্ণনায় মনে হচ্ছে তিনি ইঙ্গিত করতে চাচ্ছেন, নিয়্যত বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে যেমনিভাবে আমলও বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। উদাহারনস্বরূপঃ একজন ব্যক্তি কোন একটি কাজ করতে পারে এই নিয়্যতের উপর ভিত্তি করে যে, সে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পুরস্কৃত হওয়ার জন্য তা করছে অথবা ঐ কাজের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত কিছু পাওয়ার জন্য কাজ করছে অথবা তাঁর শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য কাজটি করছে।”

অন্যান্য বর্ণনায় দেখা যায়,আমল এর ক্ষেত্রে বহুবচন অথচ নিয়্যতের ক্ষেত্রে একবচন ব্যাবহার করা হয়েছে; যেমনটি দেখা যায় সাহিহ বুখারির কিতাবুল ঈমান অধ্যায়ে ইমাম মালিক থেকে বর্ণিত হাদিসে – “আমল (বহুবচন) নির্ভর করে নিয়্যতের (একবচন) উপর”; কারন বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে আমল সংঘটিত হয় তাই আমলের ক্ষেত্রে বহুবচন ব্যাবহার করা হয়েছে, কিন্তু নিয়্যত শুধুমাত্র ইখলাস (একনিষ্ঠতা) এর উপর নির্ভর করে তাই এটির ক্ষেত্রে একবচন ব্যাবহার করা হয়েছে।

বুখারিতে আরেকটি বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে আমল ও নিয়্যত উভয়ের ক্ষেত্রেই একবচন ব্যবহার করা হয়েছে – “আমল (একবচন) নির্ভর করে নিয়্যতের (একবচন) উপর।” এখানে আমল বলতে বুঝানো হয়েছে ইবাদাতকে।

“ নিয়্যতের উপর নির্ভর করে ”

“উপর” শব্দটি দিয়ে হয় এটা বুঝানো হচ্ছে যে, নিয়্যত তার আমলের অখন্ড অংশ অথবা এটিই আমল করার পিছনে কারন।

বলা হয়ে থাকে যে এর অর্থ হল - “আমলগুলোকে বিচার করা হয় তাদের নিয়্যতের ভিত্তিতে” অথবা “আমল সম্পূর্ণভাবে নিয়্যতের উপর নির্ভর করে” অথবা “নিয়্যতের উপর নির্ভর করে আমলের বৈধতা” অথবা “নিয়্যত ছাড়া কোন আমলই সম্পূর্ণ বা বৈধ নয়” অথবা “নিয়্যতের অনুসরনে আমল হয়ে থাকে”।

আমল বলতে সেসব কাজ বুঝানো হয় যা বিভিন্ন অঙ্গ দ্বারা সঙ্ঘটিত হয়, এর মধ্যে রয়েছে মুখ নিঃসৃত শব্দ আর অন্তরের আমল।

 

“ প্রত্যেক মানুষ কেবল সেটাই পাবে যেটার জন্য সে নিয়্যত করে ”

ইমাম কুরতুবি বলেন, “এখান থেকে এ ব্যাপারে দলীল পাওয়া যায় যে, নিয়্যত ও ইখলাস হল আমলের পূর্বশর্ত”, আর তিনি নিয়্যাত করাকে মুওাক্কাদাহ হিসেবে বিবেচনা করতে চেয়েছেন।

অন্যান্য আলেমরা বলেছেন যে এই দুটি বাক্য – “আমল তার নিয়্যতের উপর নির্ভর করে” এবং “প্রত্যেক মানুষ তাই পায় যেটার জন্য সে নিয়্যত করে” – উভয়ই পৃথক পৃথক অর্থ প্রকাশ করে।

প্রথম বাক্যটি থেকে জানা যায় যে আমল ও নিয়্যত একে অপরের সাথে যুক্ত, এবং আমল তার নিয়্যতের অনুগামী হয় (অর্থাৎ নিয়্যতের অনুসরনে আমল হয়), তাই এর উপর ভিত্তি করেই বিচার করা হবে।

পরবর্তী বাক্য থেকে জানা যায়, আমলকারী সেটা ছাড়া কিছুই পাবে না যেটা করার ব্যাপারে সে নিয়্যত করে।

ইবন দাকিক আল ঈদ বলেন, “দ্বিতীয় বাক্যটি এই অর্থ প্রকাশ করে যে, কোন ব্যক্তি যেটার জন্য নিয়্যত করে সে সেটাই পাবে; উদাহারনস্বরূপ – কেউ একটা আমল করলো ঐ আমলের পূর্বশর্তের কারনে অথবা এমনকি সে ঐ আমল করা থেকে বিরত থাকল কোন বৈধ গ্রহণযোগ্য অজুহাতে। সে যেটার জন্য নিয়্যত করে নি, সে সেটা পাবে না।”

হাদিসের এই বাক্যটি – “সে যেটার জন্য নিয়্যত করে নি” – এটা বলার মাধ্যমে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন নির্দিষ্টভাবে অথবা সাধারনভাবে কোন নিয়্যত না করা। সে যদি কোন নির্দিষ্ট নিয়্যত না করে, কিন্তু তার একটি ব্যাপকভাবে নিয়্যত থাকে, যা কিনা অন্তর্ভুক্ত করে সেটিকে - যেটির ব্যাপারে সে নির্দিষ্টভাবে নিয়্যত করে নি; - এক্ষেত্রে আলেমরা ইখতিলাফ করেছেন এবং এ থেকে অনেক ঘটনা উদ্ভুত হতে দেখা যায়।

কখনো এমন হয় যে একজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট কাজ করে আর সে এমন কিছু লাভ করে যার ব্যাপারে সে নির্দিষ্টভাবে নিয়্যত করে নি; যেমনঃ একজন ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে বসার আগেই ফরয অথবা রতিবাহ সালাত (আল সুনান আল রাওাতিব – ফরজ সালাতের সাথে সম্পর্কিত ১২ রাকআত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ সালাত) আদায় করলো, এতে প্রকৃতপক্ষে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ সালাত (মসজিদে প্রবেশ করার পর বসার পূর্বে ২ রাকআত সুন্নাহ সালাত) আদায় করা হয়ে গেল – সে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ সালাতের জন্য নির্দিষ্টভাবে নিয়্যত করুক বা না-ই করুক, কারন তাহিয়্যাতুল মাসজিদ সালাত আদায়ের কারন ইতিমধ্যেই সম্পাদিত হয়ে গেছে আর এ ‘কারন’ টা হল দুই রাকআত সালাত আদায়ের পূর্বে না বসা।

এই ব্যক্তির উদাহরণটি সে ব্যক্তির উদাহারন থেকে ভিন্ন, যে জুমুআর দিনে জানাবাহ এর গোসল (অপবিত্রতার গোসল) করে। শক্তিশালী অভিমত হল এটা, এই ব্যক্তি জুমুআর দিনের সুন্নাহ গোসল করেছে বলে বিবেচিত হবে না কারন জুমুআর গোসল একটি ইবাদাহ, যা শুধুমাত্র শরীর পরিষ্কার করা নয়; তাই এই ব্যাপারে নির্দিষ্ট নিয়্যত থাকতে হবে আর এটা তাহিয়্যাতুল মাসাজিদ থেকে ভিন্ন, যেখানে ব্যাপক নিয়্যতই যথেষ্ট। আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

ইমাম নববী বলেন, “দ্বিতীয় বাক্যটি (‘প্রত্যেক মানুষ কেবল সেটাই পাবে যেটার জন্য সে নিয়্যত করে’) থেকে জানা যায়, নির্দিষ্ট নিয়্যত করার ক্ষেত্রে এটি একটি পূর্বশর্ত; যেমন – যে ব্যক্তিকে কাযা সালাত আদায় করতে হবে তার জন্য কেবলমাত্র এটাই যথেষ্ট নয় যে সে কাযা সালাত আদায় করতে যাচ্ছে, বরং তাকে এটাও নির্দিষ্টভাবে নিয়্যত করতে হবে সেটি কোন ওয়াক্তের সালাত।” এটা স্পস্ট যে (এটা তখনই প্রযোজ্য) যখন তাকে একাধিক কাযা সালাত আদায় করতে হবে।

ইবন সূম‘আনি বলেন, “এই দ্বিতীয় বাক্য দ্বারা বুঝানো হয়েছে যেসব কাজ ইবাদাত এর অন্তর্ভুক্ত নয় সেগুলো করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবেন না, যদি না সে এই কাজের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের নিয়্যত না করে; যেমন আল্লাহ্‌র ইবাদাত করার শক্তি অর্জনের নিয়্যতে খাবার গ্রহণ করা।”

অন্যান্য আলেমরা বলেছেন, “এর অর্থ হল নিয়্যত করাকে থামিয়ে রাখা যাবে না (অর্থাৎ নিয়্যত করা চালিয়ে যেতে হবে)। এটি হল মূল নীতি। কিছু উদাহারন এই মূলনীতির ব্যতিক্রম, যেমন - ওয়ালি (অভিভাবক) তার সন্তানকে হজ ও উমরাহ করানোর জন্য নিয়্যত করেছে।”

ইবন আবদিল সালাম বলেন, “প্রথম বাক্য (প্রত্যেক কাজ শুধুমাত্র নিয়্যতের উপর নির্ভর করে) দিয়ে নির্দিষ্টভাবে বুঝানো হয়েছে কোন আমল গ্রহণযোগ্য আমল হিসেবে গণনা করা হবে এবং দ্বিতীয় বাক্য (প্রত্যেক মানুষ কেবল তাই পাবে যেটার জন্য সে নিয়্যত করে) দিয়ে বুঝানো হয়েছে ঐ আমলের ফলাফল কি হবে। এটি এ অর্থও প্রকাশ করে যে, নিয়্যত কেবল সেই ইবাদাতগুলোর ক্ষেত্রেই পূর্বশর্ত যেগুলো অন্যান্য কাজ থেকে (যে কাজগুলো ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত নয়) স্বতন্ত্র। তাই সে ইবাদাতের আমল, যেগুলো পরিস্কারভাবে স্বতন্ত্র; যেমন আল্লাহ্‌র স্মরণ (যিকর), দুয়া করা, কুরআন তিলাওয়াত করা ইত্যাদি হল ঐসব পদ্ধতি থেকে নির্ধারণযোগ্য, যে পদ্ধতিতে এগুলো সম্পন্ন করা হয়।”

এটি সুস্পষ্ট যে, এটি ইবাদাতের মূল পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইবাদাত যদি অভ্যাসবশত কারনে ঘটে, যেমন – আশ্চর্য হলে অথবা আল্লাহ্‌র প্রশংসায় ‘সুবহান আল্লাহ’ বলা, তাহলে উপরোক্ত কথা প্রযোজ্য হবে না। এছাড়া আল্লাহ্‌র নিকটবর্তী হওয়ার নিয়্যত সহকারে যিকর করা হলে এতে সওয়াব রয়েছে।

তাই সংক্ষেপে বলা যায়, প্রত্যেক আমলের (ইবাদাতের ক্ষেত্রে) নিয়্যত করা দরকার। এর মধ্যে সেই আমলও অন্তর্ভুক্ত যা করার ব্যাপারে ব্যক্তি ইচ্ছুক নয়। এই যেমন, ব্যক্তি যদি আল্লাহ্‌র শাস্তির ভয়ে কোন নির্দিষ্ট আমল করা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়, তাহলে সে এর কারনে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পুরস্কৃত হবে। তার এই ব্যাপারটি সে ব্যক্তির থেকে আলাদা, যে কিনা কোন গুরুত্তই দেয় না সেই অন্যায়ের ক্ষেত্রে যা আল্লাহ্‌র অবাধ্যতার কারনে হয়ে থাকে, আর সেই অন্যায় কাজ কোন নিয়্যত ছাড়াই ছেড়ে দেয়।

 

“ তাই যে হিজরত করবে দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে ”

[ ইমাম বুখারি এ হাদিসে হাদিসটির একটি অংশ বাদ (খারম) দিয়ে বর্ণনা করেছেন – “যে আল্লাহ ও তার রসূল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত হবে আল্লাহ ও তার রসূল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্যই।” ]

ইমাম বুখারি তার কিতাবের এ অধ্যায়ে হাদিসটি বর্ণনা করার সময় উপরোক্ত অংশটুকু বাদ দিয়েই হাদিসটি বর্ণনা করেন। হাদিসের পুরো বর্ণনা বুখারির হিজরতের অধ্যায়ে পাওয়া যায়ঃ

“প্রত্যেক কাজ শুধুমাত্র নিয়্যতের উপর নির্ভর করে এবং প্রত্যেক মানুষ কেবল তাই পাবে যেটার জন্য সে নিয়্যত করে। তাই যে হিজরত করবে দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে – তার হিজরত সেটার জন্যই হবে, যেটার জন্য সে হিজরত করবে। আর যে আল্লাহ ও তার রসূল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য হিজরত করবে তার হিজরত হবে আল্লাহ ও তার রসূল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্যই।”

এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে।

প্রথমত, কিছু আলেম বলেছেন যে এই হাদিসটি ইমাম বুখারি তার কিতাবের প্রথম হাদিস হিসেবে বর্ণনার মাধ্যমে একে কিতাবের ভুমিকা হিসেবে রেখেছেন সেসব কিতাব লেখকদের মতো,যারা তাদের কিতাবে ভুমিকা লিখেন তাদের কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা করার জন্য। তাই ইমাম বুখারি তার কিতাবের সূচনা করেছেন তার নিয়্যতকে নির্দিষ্ট করার মাধ্যমে, যা নির্দেশ করে তার কিতাব রচনার জন্য নিয়্যতের একনিষ্ঠতা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যই আর আল্লাহ তাকে তার নিয়্যত অনুসারে বিচার করবেন। তাই তিনি জেনেশুনেই হাদিসের একটি অংশ ছেড়ে দিয়েছিলেন এই অধ্যায়ে (পূর্বেই বলা হয়েছে এই অংশের ব্যাপারে), যাতে তিনি আত্ম প্রশংসা ও আত্মশোধন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন, কারন এখানে লেখক (ইমাম বুখারি) আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে তার নিয়্যত ছিল এই কিতাবটি লেখা।

এছাড়াও ইমাম বুখারির মতে কোন হাদিসের অংশবিশেষ বর্ণনা করা আর আসল শব্দের অর্থ বর্ণনা করা অনুমোদনযোগ্য, তিনি এই হাদিসের ক্ষেত্রে উভয়ই ব্যবহার করেছেন। এটি ইমাম বুখারির একটি কর্মপদ্ধতি যে তিনি মাঝে মাঝে কিছু শব্দ বাদ দিয়ে (এমনকি সেটা বর্ণনার মধ্যে থেকে হলেও) হাদিস বর্ণনা করেন। এটাও তার একটা কর্মপদ্ধতি যে তার যদি একাধিক সনদ বিশিস্ট একই বর্ণনা থাকে তাহলে তাহলে তিনি বর্ণনাটি এক স্থানে (অর্থাৎ অধ্যায়ে) এক সনদের উল্লেখ করে এবং অপর স্থানে আরেক সনদের উল্লেখ করে বর্ণনা করেন। তিনি এটা তখনই করেন যদি সেটার নির্ভরযোগ্যতা সেই পর্যায়ে পৌছায় যে পর্যায়ে পৌঁছালে তার শর্ত অনুযায়ী একটা হাদিস নির্ভরযোগ্য হয়। কিন্তু যদি সেই পর্যায়ে না পৌছায় (তার শর্ত অনুযায়ী নির্ভরযোগ্য হাদিস হওয়ার ক্ষেত্রে), তবে তিনি বর্ণনাটি সনদ ছাড়া অথবা সনদের কোন অংশ (মু’আল্লাক) ছাড়া বর্ণনা করেন। এটা তিনি করেন হয় নির্দিষ্টতার সাথে, যেমন এইভাবে বর্ণনা করেন – “তিনি বলেছেন এটা এবং এটা” – যদি হাদিসটি নির্ভরযোগ্যভাবে বর্ণিত হয়ে থাকে কিন্তু তার শর্ত অনুসারে নির্ভরযোগ্যতা পায় না; অথবা তামরিয সহকারে বর্ণনা করেন যেমন - “বর্ণিত আছে যে তিনি বলেছেন এটা এবং এটা” - এভাবে, যদি হাদিসে কিছু দুর্বলতা থাকে।

আর যদি তার কাছে এক সনদ বিশিষ্ট বর্ণনা থাকে (আরও পরিস্কারভাবে বলতে গেলে, তিনি এ ব্যাপারে যে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন সে পর্যন্ত), সে ক্ষেত্রে তিনি সেই বর্ণনা স্বাধীনভাবে বর্ণনা করেছেন – এর কোন অংশ এক স্থানে এবং অন্য অংশ আরেক স্থানে (তার নামকরন করা অধ্যায়ের প্রয়োজন অনুসারে)।

এটি খুবই বিরল যে তিনি তার কিতাবের একাধিক স্থানে কোন বর্ণনার একই পাঠ ও একই সনদ পরিপূর্ণভাবে উল্লেখ করেছেন। আমি (ফাতহুল বারির তাফসিরকারক – ইবন হাজার) এক আলিমের সাথে সাক্ষাত করেছিলাম যিনি আমাকে বলেছেন যে তিনি যত্নশীলভাবে বুখারি পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে ইমাম বুখারি একাধিক স্থানে একই সনদ সহকারে সম্পূর্ণ বর্ণনা উল্লেখ করেছেন এমন বর্ণনা তিনি বুখারি শরীফে প্রায় ২০ টি স্থানে খুজে পেতে সক্ষম হয়েছেন কেবল!

 

“ যে হিজরত করবে ”

হিজরতের আক্ষরিক অর্থ হল কোন কিছু ত্যাগ করা, আর “কোন কিছুর দিকে হিজরত করা” বলতে বুঝায় অন্য কিছু থেকে আরেকটা কিছুতে স্থানান্তরিত হওয়া।

ইসলামিক পরিভাষায় হিজরত বলতে বুঝায় -“এমন কিছু ত্যাগ করা যার ব্যাপারে আল্লাহ নিষিদ্ধতা জারী করেছেন।”

ইসলামিক পরিভাষায় হিজরত দুই ধরনের হয়ে থাকেঃ

প্রথমত, ভয়ভীতিপূর্ণ কোন স্থান ত্যাগ করে শান্তিপূর্ণ স্থানে হিজরত করা, যেমন ঘটেছিল আবিসিনিয়া হিজরতের ক্ষেত্রে আর প্রথম দিকে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ক্ষেত্রে;

দ্বিতীয়ত, কুফফারদের ভুমি থেকে ইসলামের ভুমির দিকে হিজরত করা,যেমন মদিনায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতিষ্ঠা লাভের পর সেখানে হিজরত করা।

মক্কা বিজয়ের পর দ্বিতীয় প্রকারের হিজরত শুধু মদিনায় সীমাবদ্ধ থাকে নি, তবে ইসলামের সকল ভূমিতে হিজরত করাটা ব্যাপক হিসেবে পরিনতি লাভ করে।

 

“ অথবা কোন নারীকে ”

যদিও ‘দুনিয়া’ শব্দটির প্রাধান্যতার কারনে নারীকে বিবেচনা করা হয় (যেমন –দুনিয়াবি লাভ), কিন্তু নারীকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কারন নারীজনিত ফিতনা অনেক মারাত্মক, এ কারনে এই ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্তের সাথে এর ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।

আবার অনেক আলিম বলে থাকেন যে এই হাদিসটি বর্ণনার পিছনে একটি বিশেষ ঘটনা রয়েছে যা তাবারানির বর্ণনায় ইবন মাসউদ (রাঃ) থেকে জানা যায়, সেটি হল এমন - এক ব্যক্তি মদিনাতে হিজরত করলো কায়লাহ উম কায়েস নামক এক নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে, এ কারনে ঐ ব্যক্তিকে বলা হতো ‘উম কায়েসের মুহাজির’ (যেহেতু উম কায়েসকে বিয়ে করার নিয়্যতে হিজরত করেছিলো)। তবে এটি স্পষ্ট নয় যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এই হাদিসের নির্দিষ্ট কারন কি এই ঘটনা কিনা।

 

“ তার হিজরত সেটার জন্যই হবে যেটার জন্য সে হিজরত করবে ”

এর দ্বারা এটা বুঝানো হয়নি যে কোন ব্যক্তি বিয়ে অথবা দুনিয়াবি লাভের জন্য হিজরত করলে সকল ক্ষেত্রেই তার সে হিজরত পরিপূর্ণভাবে বাতিল বা নিন্দনীয় বলে গণ্য হবে। উদাহারন হিসেবে বলা যায়, এক ব্যক্তি কুফফারদের ভুমি থেকে হিজরত করলো (মুসলিম শাসিত ভুমির দিকে) যার একই সাথে বিয়ে করার নিয়্যতও রয়েছে, এক্ষেত্রে তার সওয়াব সেই ব্যক্তির তুলনায় কম হবে যিনি শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যই হিজরত করেছেন। নিন্দিত বলে গণ্য হবে সেই ব্যক্তি যে শুধুমাত্র সম্পূর্ণরূপে নারীকে পাওয়ার জন্য হিজরত করবে।

ঠিক একইভাবে, কোন ব্যক্তি যদি বিয়ের কারনে হিজরত করে যার দ্বারা সে নিজেকে পবিত্র রাখার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি হাসিল করতে চায়, তবে এটি সওয়াবের কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই ব্যাপারে একটি উদাহারন হল, আনাস (রাঃ) এর মা উম সুলাইম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আবু তালহার পূর্বেই। যখন আবু তালহা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, উম সুলাইম তাকে বলেন যে তিনি আবু তালহাকে বিয়ে করতে রাজি যদি আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করেন। এতে আবু তালহা রাজি হোন এবং তাদের উভয়ের এই বিয়ের মোহর ছিল আবু তালহার ইসলাম গ্রহণ। (ইমাম নাসাঈ এটি বর্ণনা করেছেন)। ব্যাপারটি এমন যে আবু তালহা তার নিজের ইচ্ছাতেই ইসলাম গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন আর এই নিয়্যতের সাথে তিনি বিয়ে করার নিয়্যতও যুক্ত করেন, ঠিক তেমনি যে কিনা সিয়াম পালন করে এক সাথে ইবাদাহ ও ফিটনেস উভয়ের নিয়্যতে।

 

এই হাদিস থেকে প্রাপ্ত ফিকহ

এই হাদিসকে নিন্মোক্ত ফিকহগুলোর দলীল হিসেবে ব্যবহার করা যায়ঃ

(১) কোন কাজের নিয়মকানুন না জেনে এর উপর আমল অনুমোদনযোগ্য না, কারন কোন কাজের নিয়মকানুন জানা ছাড়া সেই কাজের জন্য নিয়্যত করাটা সঠিক না।

(২) যে ব্যক্তি জ্ঞান রাখে না তাকে হিসাব দিতে বাধ্য করা যাবে না; কারন নিয়্যত তো তখনই হয় যদি যেটা করার ব্যাপারে নিয়্যত করা হবে তা জানা থাকে, তাই এই ব্যক্তি যে কাজ করেছে সেটার ব্যাপারে নিয়্যত করতে পারে না, কারন তার তো সেই ব্যাপারে জ্ঞানই নেই।

(৩) কোন ব্যক্তি যদি দিনের কোন অংশে নফল সিয়াম পালনের নিয়্যত করে (এর পূর্বে সাহরির শেষ সময়ের পর কোন খাদ্য গ্রহণ না করা অবস্থায়), তবে তিনি নিয়্যত করার সেই সময় থেকে সওয়াব পাবেন, এই হাদিস সেই অর্থই প্রকাশ করে।

আবার এটাও বলা হয় যে তিনি পূর্ণ সওয়াব পাবেন যার দলীল পাওয়া যায় আরেক হাদিস থেকে – “যে ব্যক্তি এক রাকআত সালাত (জামাআতে) পেলো সে যেন পুরো সালাতই জামাআত অবস্থায় পেলো” (এর দ্বারা একাকী সালাত আদায়ের তুলনায় জামাআতে সালাত আদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয়)। নিঃসন্দেহে এটি আল্লাহ্‌র তরফ থেকে তার বান্দাদের প্রতি বিরাট এক নিয়ামত।

(৪) যদি কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তি কিছু লোকজনের সমাবেশে উপস্থিত থাকে আর সেই সমাবেশ থেকে শোনা কিছু অন্যান্যদের কাছে বর্ণনা করে, তবে তার সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার কারনে তার বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হবে, এমনকি যারা শুনেছে তাদের কোন একজনও যদি সেই সমাবেশে উপস্থিত নাও থাকে। এই হাদিসে দেখা যায় যে আলকামা-ই একমাত্র ব্যক্তি যিনি উমার (রাঃ) মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে যা বলেছেন তা নির্ভরযোগ্যভাবে বর্ণনা দিয়েছেন।

(৫) যেটাকে আমল বলে গণ্য করা হয় না তার ব্যাপারে নিয়্যত পূর্বশর্ত নয়। উদাহারনস্বরূপ, দুই সালাত একত্রে মিলিয়ে পড়া আমল নয় বরং আমল হল সালাত। এ ব্যাপারে প্রমাণ হল এটি - রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাবুক যুদ্ধে তার সালাতগুলো একত্রে আদায় করেছিলেন আর তাঁর পিছে যারা সালাত আদায় করেছিলেন তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে এই একত্রে সালাত কায়েমের ব্যাপারে জানান নি।

(৬) যদি কোন এক শ্রেণীর কর্মের ফলে বিভিন্ন কর্মের উৎপত্তি হয়, তবে কেবল সেই শ্রেণীর কর্মের জন্যই নিয়্যত করলে হবে। উদাহারনস্বরূপঃ এক ব্যক্তি কাফফারা (এটি এক শ্রেণীর কর্ম) আদায়ের জন্য তার দাসকে মুক্ত করে দিতে চায় কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোন নিয়্যত না করলেও চলবে যে কোন পাপের (এই শ্রেণীর কর্মের জন্য কারন থাকা দরকার) কারনে তিনি এই কাফফারা আদায় করছেন; কারন হাদিসে বুঝানো হয়েছে “প্রত্যেক আমল তার নিয়্যতের উপর নির্ভর করে।” এখানে উদ্দিস্ট কর্ম হল ফরজ কাফফারা থেকে নিজেকে মুক্ত করা আর যে কারনে কাফফারা ফরজ হয়েছে সেই কারনটির উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন নেই। অতএব যদি সে ব্যক্তি এটা জানে যে তাকে কাফফারা আদায় করতে হবে কিন্তু তিনি এটা স্মরণ করতে না পারেন যে কি কারনে তাকে এটা আদায় করতে হচ্ছে, তবে এটাই যথেষ্ট যে তিনি কাফফারা ফরজ হওয়ার কারণটি নির্দিষ্টভাবে নিয়্যত না করেই কাফফারা আদায় করতে পারবেন।

(৭) এই হাদিসের কারন যদি ‘মুহাজির উম কায়েস’ এর ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে হাদিসটি এ অর্থ প্রকাশ করে যে, দুনিয়াবি লাভ উল্লেখ করার ব্যাপারটি ছিল অতিরিক্ত কিছু যা সতর্কতাকে ব্যাপক করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবেই মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট বিধিনিষেধে নির্দিষ্ট কারন ফল হিসেবে পাওয়া যায়, তবে এই বিধিনিষেধ ব্যাপক হতে পারে। তাই এই হাদিসের ব্যাপক অর্থ ব্যাবহার করা যাবে যদিও প্রকৃত কারন নির্দিষ্ট।

বুখারির অন্যান্য স্থানে এই হাদিসের উদাহারন

কিতাবুল ঈমানে এই হাদিসের ব্যাপারে আরও আলোচনা আসবে (লেখক ইবনে হাজার তার কিতাব ফাতহুল বারীর দিকে নির্দেশ করে বলেছেন) যেখানে ইমাম বুখারি এটি আবারও বর্ণনা দিয়েছেন।

(এই হাদিসটি দারুস সালাম পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত সহিহ বুখারির ১,৫৪,২৫২৯,৩৮৯৮,৫০৭০,৬৬৮৯ এবং ৬৯৫৩ নং হাদিসে পাওয়া যাবে)

 

Bukhariexplanation.com সাইটে ফাতহুল বারি’র ইংলিশ ট্রান্সলেশনের প্রজেক্ট শুরু হয়েছিলো বাট এখন সাইটটি মে বি টেম্পোরারিলি ক্লোজ,সেই ইংলিশ ট্রান্সলেশন থেকে এর অনুবাদ করা হল।

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-x

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাদিস তাফসীর – “তোমরা সবাই যদি আল্লাহর প্রতি যথাযথভাবে তাওয়াককুল করো …”

 

 

The Greatest Nation·Friday, July 15, 2016

 

 

 

উমর বিন আল-খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ আমি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি –

“তোমরা সবাই যদি আল্লাহ’র প্রতি যথাযথভাবে তাওয়াককুল (ভরসা) করো, তবে নিশ্চয়ই তিনি তোমাদেরকে সেভাবে রিযক দিবেন, যেভাবে তিনি পাখিদের রিযক দিয়ে থাকেন - তারা ক্ষুধার্ত হয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠে আর সন্ধ্যায় ভরা পেট নিয়ে ফিরে আসে।”

(জামি’ আত-তিরমিযি – কিতাবুয যুহদ, হাদিস ২৩৪৪; সুনানে নাসাঈ; সুনানে ইবনে মাজাহ – হাদিস ৪১৬৪; মুসনাদে আহমাদ – ১/৩০; সাহিহ ইবনে হিব্বান – হাদিস ৭৩০; মুসতাদরাকে হাকিম – ৪/৩১৮; ইমাম তিরমিযি হাদিসটিকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন।)

 

হাদিসটির ব্যাখ্যা

এই হাদিসটি দ্বীন ইসলামের মৌলিক পাঠগুলোর মধ্যে অন্যতম, এটি আল্লাহ’র উপর তাওয়াককুল (ভরসা) করার বিষয়টির ব্যাখ্যায় ভূমিকা রাখে, আর তাওয়াককুল করার বিষয়টি হল আল্লাহ’র রিযক অর্জনের শ্রেষ্ঠ একটি কারন, যেমনটি আল্লাহ বলেন -

“যে কেউ আল্লাহ’র প্রতি তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য পথ করে দিবেন আর তাকে রিযক দান করবেন তার ধারণাতীত উৎস থেকে; যে ব্যক্তি আল্লাহ’র উপর তাওয়াককুল অবলম্বন করে, তার জন্য তো আল্লাহই যথেষ্ট …” (সূরাহ আত-তালাক, ৬৫ :২-৩)

লোকেরা যদি মুত্তাকী (আল্লাহ’র প্রতি তাকওয়া অবলম্বনকারী) হয় আর আল্লাহ’র প্রতিই ভরসা করে, তবে তিনি তাদের প্রতি যথেষ্ট হবেন – যে পর্যন্ত তাদের পার্থিব কল্যাণ আর আখিরাতের বিষয়গুলো সম্পর্কিত থাকবে। এ বিষয়টি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত – “আল্লাহ্‌কে হেফাজত করো, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন” – এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।

একজন আলিম বলেছিলেন, “একজন ব্যক্তিকে উদ্বেগ করে এমন যে কোন কিছুতেই আল্লাহ’র উপর ভরসা করা তার জন্য যথেষ্ট।”

আল্লাহ’র উপর ভরসা করার অর্থ হল, ব্যক্তি তার স্বার্থ অর্জন আর নিজেকে মন্দ কিছু থেকে হেফাজতের জন্য তার অন্তরকে একান্তভাবেই আল্লাহ’র প্রতি নিয়োজিত করবে – যে পর্যন্ত এই দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয়গুলো সম্পর্কিত থাকবে। ব্যক্তির এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে হবে যে, একমাত্র আল্লাহই কোন কিছু দান করেন, তিনিই দান করা থেকে বিরত থাকেন আর একমাত্র তার কারনেই উপকার ও ক্ষতি হয়।

সাইদ বিন জুবাইর বলেছেন, “আল্লাহ’র প্রতি ভরসা করা হল ঈমানের সারমর্ম।”

ওয়াহব বিন মুনাব্বিহ বলেছেন, “ঈমানের চূড়ান্ত সমাপ্তি হল আল্লাহ’র উপর ভরসা করা।”

আল-হাসান বলেছেন, “আল্লাহ’র প্রতি ভরসা করা অর্থ তো এটাই যে, আল্লাহ ছাড়া বান্দা আর কারো উপর ভরসা করবে না।”

 

আল্লাহ’র প্রতি ভরসা করার বিষয়টি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিপরীত নয়

কোন কাজে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার ব্যাপারে তো আল্লাহই আদেশ করেছেন আর এটা তো যেকোন ঘটনারই স্বাভাবিক কার্যধারা, তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা তাওয়াককুলের বিপরীত নয়, আল্লাহ বলেছেন –

“হে ঈমানদারগণ, (শত্রুর মুকাবিলায়) তোমরা (সবসময়) সতর্কতা গ্রহণ করো (অস্ত্রে সজ্জিত থাকার মাধ্যমে, সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে, শক্তি দৃঢ় করার মাধ্যমে ইত্যাদি উপায়ে) …” (সূরাহ আন-নিসা, ৪ :৭১)

“তোমরা কাফিরদের মুকাবিলা করার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, যা দিয়ে আল্লাহ’র শত্রু আর তোমাদের শত্রুদের ভীত-সন্ত্রস্ত করবে, এ ছাড়া অন্যান্যদেরকেও – যাদেরকে তোমরা জানো না কিন্তু আল্লাহ জানেন …” (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ :৬০)

“এরপর যখন (জুমুয়ার) নামায শেষ হবে, তখন তোমরা (কাজকর্মে) পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহ’র অনুগ্রহ তালাশ করো, আর (বেচাকেনার অবস্থাতেও) আল্লাহ্‌কে বেশী বেশী স্মরণ করো …” (সূরাহ আল- জুমু’আহ, ৬২ :১০)

সাহল আত-তুস্তুরি বলেছেন, “যদি একজন ব্যক্তি কোন কাজের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা বর্জন করে, তবে সে তো সুন্নাহ বর্জন করলো। আর সে যদি আল্লাহ’র প্রতি তাওয়াককুল করা বর্জন করে, তবে ঈমানকেই প্রত্যাখ্যান করলো। আল্লাহ’র প্রতি তাওয়াককুল করাটা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাজের ধরণ, আর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাও রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অভ্যাস। যে ব্যক্তি তার কাজের ধরনের প্রতি অনুগত, তার তো উচিত নয় রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাহ বর্জন করা।”

 

আল্লাহ’র গোলাম কতৃক সম্পাদিত কাজ

আল্লাহ’র গোলাম কতৃক সম্পাদিত কাজ তিন ধরণের –

প্রথম প্রকারঃ আল্লাহ’র আদেশকৃত সৎ কাজ – যা ব্যক্তিকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করে আর দোযখ থেকে হেফাজত করে। এ কাজগুলো অবশ্যই আল্লাহ’র উপর ভরসা রেখে আর তার সাহায্য প্রার্থনা করে সম্পাদন করতে হবে। ব্যক্তি যদি প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পাদন না করে তবে সে এই দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তির যোগ্য হবে।

দ্বিতীয় প্রকারঃ আল্লাহ কতৃক আদেশকৃত চিরাচরিত অভ্যাস, যেমন – ক্ষুধা পেলে (হালাল) খাবার খাওয়া, তৃষ্ণা পেলে (হালাল) কিছু পান করা আর শীত অনুভূত হলে নিজেকে (হালাল কোন উপায়ে) উষ্ণ করা। কোন ব্যক্তি যদি এমনভাবে এ ধরণের অভ্যাসগুলো বর্জন করে যা তার ক্ষতির কারন হবে, তবে সে শাস্তির যোগ্য হবে।

এ সত্ত্বেও, আল্লাহ তার কিছু গোলামকে কিছু পরিস্থিতি সহ্য করার ক্ষমতা দান করেন, যে পরিস্থিতি অন্যান্যদের জন্য সহনীয় নয়। উদাহারনস্বরূপ, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সাওমে বেসাল (পরপর দুদিন ধরে রোজা রাখা) করতেন, কিন্তু তিনি সাহাবীদেরকে তা করতে নিষেধ করেছিলেন, তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, “আমি তোমাদের মতো নই, আমাকে পানাহার করানো হয়।” (বুখারি – কিতাবুস সাওম, হাদিস ১৯৬২; মুসলিম – কিতাবুস সিয়াম, হাদিস ১১০২)

আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে যে তিনি বলেছেন, “আমার প্রতিপালক আমাকে পানাহার করান।” (বুখারি – কিতাবুস সাওম, হাদিস ১৯৬৪; মুসলিম – কিতাবুস সিয়াম, হাদিস ৬১/১১০৫)

তৃতীয় আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে যে তিনি বলেছেন, “আমার জন্য একজন খাদ্য পরিবেশনকারী থাকেন, যিনি আমাকে আহার করান আর একজন পানীয় পরিবেশনকারী আমাকে পান করান।” (বুখারি – কিতাবুস সাওম, হাদিস ১৯৬৩)

এর অর্থ হল, আল্লাহ তাকে ভোজন করান আর শক্তিদান করেন ঐশ্বরিক জ্ঞান ও পুরস্কার দ্বারা – যা তাকে খাবার ও পানীয় ছাড়াই বাঁচিয়ে রাখে। যদি কোন ব্যক্তি এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আর এটির অনুসরণ যদি তাকে আল্লাহ’র আনুগত্য থেকে ফিরিয়ে না দেয়, তবে সে নিন্দিত হবে না। এ সত্ত্বেও, এটি তার জন্য নির্ধারিত কিছু কাজ করা থেকে তাকে বিরত রাখে, (তাই) এটি একটি প্রত্যাখ্যানযোগ্য কাজ।

তৃতীয় প্রকারঃ সাধারণ কাজ – যেগুলোর উপর এই পার্থিব জীবন নির্ভর করে। এ ধরণের কাজগুলো কিছু লোকদের জন্য লঙ্ঘিত হতে পারে, যেভাবে আল্লাহ চান। উদাহারনস্বরূপ, ঔষধ ছাড়াই রোগমুক্ত হওয়া। আলিমদের মধ্যে এ নিয়ে ইখতিলাফ আছে যে, ব্যক্তির কি ঔষধ গ্রহণ করা উচিত নাকি আল্লাহ’র উপর তাওয়াককুল করা উচিত।

ইমাম আহমাদের মত হল, এক্ষেত্রে আল্লাহ’র উপর তাওয়াককুল করাটাই অধিকতর ভালো, যদি এটির প্রভাবের উপর ব্যক্তির সমর্থ হওয়ার ক্ষমতা থাকে; যেমনটা আমাদের জানিয়েছেন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) – “তোমাদের মধ্যে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে আর বিনা শাস্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” তিনি তাদের ব্যাপারে জানিয়েছেন, “তারা কোন দাগ লাগাতো না, ঝাড়ফুঁকের শরণাপন্ন হতো না আর কুযাত্রা মানতো না। তারা কেবল তাদের রবের উপরই তাওয়াককুল করতো।” (বুখারি – কিতাবুর রিকাক, হাদিস ৬৪৭২)

যেসব আলীমগণ ঔষধ গ্রহণের পক্ষে মত দিয়েছেন তাদের দলীল এই যে, ঔষধ গ্রহণ তো রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর রীতিই ছিল, আর তিনি তো সবচেয়ে সেরা কাজটিই চর্চা করতেন। তারা (বরং) এ হাদিসটিকে ঝাড়ফুঁক হারাম হওয়ার দলীল হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

এ ধরণের নীতি হয়তো কিছু লোকের জন্য লঙ্ঘিত হবে; এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা থেকে আল্লাহ যাদের জন্য উপায় করে দিয়েছেন, তাদের জন্য এ নীতির লঙ্ঘন দেখা যেতে পারে। একজন ব্যক্তিকে যদি আল্লাহ’র তরফ থেকে অতি মাত্রায় তাওয়াককুল প্রদান করা হয় আর সে জানে যে, তার নিজের কোন প্রচেষ্টা করা ছাড়াই আল্লাহ তাকে রিযক প্রদান করবেন, তবে তার জন্য রিযক সন্ধান বর্জন করা অনুমোদিত। হাদিসটি এ ধারনাই বিশদভাবে তুলে ধরেছে। এটি ইঙ্গিত করে যে, এই দুনিয়াতে লোকেরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে, কারন তারা তাওয়াককুলের সত্যিকারের অর্থ বুঝতে পারে না। তারা যদি আল্লাহ’র প্রতি তাওয়াককুলের ব্যাপারে আন্তরিক হয়, তবে তাদের সামান্য চেষ্টাতেই আল্লাহ তাদেরকে রিযক প্রদান করবেন, যেমনটি তিনি পাখিদের প্রদান করেন – তারা ক্ষুধার্ত পেতে সকালে ঘুম থেকে উঠে আর সন্ধ্যাতে ভরা পেট নিয়েই ফিরে আসে।

 

পাপের কারনে একজন ব্যক্তি রিযক থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে, যেমনটি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “একজন বান্দা তার পাপের কারনে রিযক থেকে বঞ্চিত হয়।” (মুসনাদে আহমাদ – ৫/২৭৭, ২৮০; ইবনে মাজাহ – হাদিস ৯০; সাহিহ ইবনে হিব্বান – হাদিস ৮৭২)

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “একজন ব্যক্তি তার সমস্ত রিযক পাওয়ার আগ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। তাই আল্লাহ্‌কে ভয় করো আর হালাল উপায়ে রিযক খুঁজো। হালাল অর্থ গ্রহণ করো আর অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ বর্জন করো।” (ইবনে মাজাহ – হাদিস ২১৪৪; সাহিহ ইবনে হিব্বান – হাদিস ৩২৩৯-৩২৪১)

উমার বিন আল-খাত্তাব (রাঃ) বলেছিলেন, “বান্দা তো তার তাকদিরে নির্ধারিত রিযক পাবেই। যদি সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে, আল্লাহ তাকে অনুরূপ রিযক প্রদান করবেন। যদি সে তা অর্জন করতে গিয়ে পাপ করে, সেগুলোর চেয়ে তার আর বেশী কিছু থাকবে না।”

 

যদি একজন ব্যক্তি রিযক খোঁজার জন্য কোন চেস্টাই না করে, তবে সে একজন অক্ষম ও পাপী ব্যক্তি।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “মযবুত ঈমানদার আল্লাহ’র কাছে দুর্বল ঈমানদার থেকে প্রিয়, অবশ্য প্রত্যেকের মধ্যেই ভালো বৈশিষ্ট্য আছে। তোমার পক্ষে যা উপকারী ও কল্যাণপ্রদ, সে বিষয়ে আগ্রহ করো, আল্লাহ’র কাছে সাহায্য কামনা করো। হিম্মতহারা হয়ো না, কোন বিপদে পড়লে এমন বলো না – ‘যদি এটা করতাম তাহলে এমন এমন হতো (বা হতো না)।’ বরং বলো – আল্লাহ’র (দেওয়া) তাকদিরে তো এটাই ছিল, তিনি যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। কারন ‘যদি’ শব্দটি শয়তানের কাজ উন্মুক্ত করে দেয়।” (মুসলিম – কিতাবুল কদর, ৩৪/২৬৬৪)

একজন ব্যক্তির উচিত কাজ করার পূর্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, এরপর সে কাজের পূর্বশর্ত সম্পাদনের জন্য উদ্যমী হয়ে চেষ্টা করা, আর এরপরই আল্লাহ’র প্রতি তাওয়াককুল করা। আল্লাহ’র প্রতি তাওয়াককুল করাটা কোন কাজের পূর্বশর্ত সম্পাদনের জন্য চেষ্টা করার বিপরীত নয়।

মুওাওিয়া বিন কুররাহ থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ উমার বিন আল-খাত্তাবের সাথে কিছু ইয়েমেনি লোকের সাক্ষাৎ ঘটলো, তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কারা ?” তারা বলল, “আমরা আল্লাহ’র উপর তাওয়াককুলকারী।” তিনি বললেন, “না, যে ব্যক্তি আল্লাহ’র উপর তাওয়াককুল করে, সে তো প্রথমে চেষ্টা করার জন্য উদ্যমী হয়, এরপরই সে আল্লাহ’র উপর তাওয়াককুল করে।”

 

আন্তরিকতার সাথে আল্লাহ’র প্রতি তাওয়াককুল করার অর্থ হল এই যে, ব্যক্তি খুব ভালোভাবেই জানে যে আল্লাহ তার রিযকের নিশ্চয়তা দেন আর সেই রিযক ঈমানদার ও কাফির উভয়ের জন্যই তাকদিরে নির্ধারিত রয়েছে, যেমনটি আল্লাহ বলেন –

“আর ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই, যার রিযক আল্লাহ’র যিম্মায় নেই …” (সূরাহ হুদ, ১১ :৬)

আল্লাহ সমস্ত জীবিত সৃষ্টিকেই রিযক দিয়ে সাহায্য করেন, যদিও সেগুলোর অনেকেই দুর্বল আর রিযক অর্জনে অক্ষম। আল্লাহ আরো বলেন –

“এমন কতো জীবজন্তু আছে যারা নিজেদের খাদ্য মওজুদ রাখে না, আল্লাহই তাদেরকে ও তোমাদেরকে রিযক দান করেন …” (সূরাহ আল-আনকাবুত, ২৯ :৬০)

বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে থাকবে, ততক্ষন পর্যন্ত তার রিযক আল্লাহ কতৃক নিশ্চিত। তারা নিজেরা রিযক অর্জনের চেষ্টা না করলেও হয়তো আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন।

 

ইমাম আহমাদের একজন অনুসারী আল-মুসান্না আল-আনবারি বলেছিলেন, “রিযক নিয়ে উদ্বেগ করো না আর আল্লাহ’র দেওয়া রিযকের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ো না।”

আল্লাহ’র প্রতি তাওয়াককুলের ফল হল আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদির নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। যে ব্যক্তির তার সমস্ত বিষয়ই আল্লাহ’র প্রতি সমর্পণ করে আর তার তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, সে তো ইতিমধ্যেই আল্লাহ’র প্রতি তাওয়াককুল অবলম্বন করছে। আল-হাসান আর আল-ফুদাইল এভাবেই তাওয়াককুলকে ব্যাখ্যা করেছেন।

ইবনে আবিদ্দুনিয়া বলেছেন, “এক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছিলেন – ‘আল্লাহ’র প্রতি তাওয়াককুলের তিনটি মাত্রা আছে – প্রথমটি হল (তাকদিরের ব্যাপারে) অভিযোগ করা ত্যাগ করা, এটি যুহদের মাত্রা; দ্বিতীয়টি হল (তাকদিরে) সন্তুষ্ট থাকা, এটি আন্তরিক ও সৎকর্মপরায়ণ লোকদের মাত্রা; তৃতীয়টি হল (তাকদিরকে) ভালোবাসা, এটি রসূলদের তাওয়াককুলের মাত্রা।’ ”

একজন ব্যক্তি যখন আল্লাহ’র উপর ভরসা রাখে আর আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদিরের উপর সবর করে, সে তখনই একজন সবরকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়। যদি সে আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তবেই সে একজন সন্তুষ্ট ব্যক্তি। আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদির ছাড়া যদি সে কোন কিছুই পছন্দ না করে, তবে সে আল্লাহকে মুহাব্বাতকারী।

উমার বিন আবদুল আযিয বলেছেন, “আমার সুখের মূল উৎস হল আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা।”

 

হাদিস তাফসীরটি ইমাম ইবনে রজব আল-হানবালি (রাহিমাহুল্লাহ)’র কিতাব জামি’ আল উলুম ওয়াল হিকামের ইংলিশ ভার্সন থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-22

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাদিস তাফসীর – “এ দুনিয়াতে তুমি (এমনভাবে) থাকো, যেন তুমি একজন অপরিচিত বা একজন মুসাফির

 

 

The Greatest Nation·Friday, July 15, 2016

 

 

 

‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কাঁধ ধরে বললেন, “এ দুনিয়াতে তুমি (এমনভাবে) থাকো, যেন তুমি একজন অপরিচিত বা একজন মুসাফির।”

ইবনে ‘উমার (রাঃ) বলতেন, “যদি তুমি সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকো, তবে সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার আশা করো না। যদি তুমি সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকো, তবে সন্ধ্যার প্রত্যাশা করো না। সুস্থ থাকা অবস্থায় তুমি অসুস্থতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো, আর বেঁচে থাকা অবস্থায় নিজেকে প্রস্তুত করো মৃত্যুর জন্য।”

(সাহিহ বুখারি – কিতাবুর রিকাক, হাদিস ৬৪১৬)

 

হাদিসটির ব্যাখ্যা

দীর্ঘ জীবনের আশা ছোট করা

এই হাদিসটি দীর্ঘ জীবনের আশা ছোট করার সাথে সম্পর্কিত। একজন মুমিনের এটা মনে করা উচিত নয় যে, সে এই দুনিয়াতে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে, বরং তার তো কেবল একজন মুসাফিরের মতোই হওয়া উচিত। সকল নবীগণ আর তাদের অনুসারীগণ এ ব্যাপারে একমত। মহান আল্লাহ বলেন,

يَا قَوْمِ إِنَّمَا هَـٰذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ ﴿٣٩﴾

“হে আমার জাতি, দুনিয়ার এ জীবন তো কেবল উপভোগের বস্তু, নিঃসন্দেহে পরকালই হল স্থায়ী বসবাসের আবাস।” (সূরাহ গাফির, ৪০ :৩৯)

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “দুনিয়ার সাথে আমার কি ? দুনিয়া আর আমার সম্পর্ক হল (এমন যে), আমি তো কেবল একজন আরোহীর মতোই, যে কিনা একটি গাছের ছায়ার নিচে বসে, এরপর সে তা ছেড়ে চলে যায়।” (তিরমিযি – হাদিস ২৩৭৭, ইবনে মাজাহ – হাদিস ৪১০৯, মুসনাদে আহমাদ – হাদিস ১/৩৯১)

এক ব্যক্তি আবু যার (রাঃ) এর বাসায় গিয়ে তার বাসা দেখতে লাগলেন। এরপর তিনি বললেন, “হে আবু যার, আপনার আসবাবপত্র কই ?” আবু যার (রাঃ) বললেন, “আমাদেরকে তো আরেকটি বাড়িতে যেতে হবে।” লোকটি বললেন, “যেহেতু আপনি এখানে আছেন, তাই আসবাবপত্র তো অবশ্যই থাকতে হবে।” আবু যার (রাঃ) বললেন, “বাড়ির মালিক আমাদেরকে এখানে থাকতে দিবেন না।

কিছু লোক এক ধার্মিক ব্যক্তির বাড়িতে প্রবেশ করে বাড়িটি দেখে বললেন, “আপনার বাড়ি তো একজন মুসাফিরের বাড়ির মতোই।” তিনি বললেন, “আমি তো সফর করবো না, আমি বিদায় নিবো।”

আলি বিন আবু তালিব (রাঃ) বলেছেন, “দুনিয়া অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে আর পরকাল চলে আসছে। এদের প্রত্যেকেরই পুত্র আছে। পরকালের পুত্র হও, কখনো এই দুনিয়ার পুত্র হয়ো না। আজ তো তুমি আমল করছো, এর জন্য তোমাকে জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না; কিন্তু কাল তোমাকে জবাবদিহিতা করতে হবে, তখন তুমি আর আমল করতে পারবে না।”

 

এই দুনিয়াতে মুমিনের অবস্থা

যদি একজন মুমিন জেনে থাকে যে, এই দুনিয়াতে সে অনন্তকাল জীবনযাপন করবে না, তবে তার উচিত হবে বিদেশে থাকা সেই অপরিচিত ব্যক্তির মতো এই দুনিয়াতে অবস্থান করা, যে ব্যক্তি তার ঘরে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে তার ভ্রমণকালীন জিনিষপত্র প্রস্তুত করছে; অথবা একজন সফরকারী ব্যক্তির মত অবস্থান করা, যে ব্যক্তি তার গন্তব্যে পৌঁছার জন্য দিন-রাত হেঁটে যাচ্ছে।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবন ‘উমার (রাঃ) কে এই দুটোর কোন একটি হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন।

প্রথম উদাহারনটির ব্যাপারে বলা যায়, একজন মুমিন তো বিদেশে অবস্থান করা ঠিক একজন অপরিচিত ব্যাক্তির মতোই, মাতৃভূমির সাথে যার অন্তর লেগে থাকা উচিত। সে তার বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য তার ভ্রমণকালীন জিনিসপত্র প্রস্তুত করার কাজে ব্যস্ত।

ফুদাইল বিন ‘ইয়াদ বলেছেন, “এই দুনিয়াতে একজন মুমিন বিষণ্ণ ও চিন্তিত থাকে। নিজেকে পরকালের জন্য প্রস্তুত করা ছাড়া তার আর কোন লক্ষ্যই থাকে না।”

এ ক্ষেত্রে মুমিন ব্যক্তি সেই ভিনদেশের বাসিন্দাদের সাথে প্রতিযোগীতা করবে না, আর না সে তাদের কাছে নিজেকে হীন করবে।

আল-হাসান বলেছেন, “একজন মুমিন তো ঠিক একজন অপরিচিত ব্যক্তির মতোই। সে নিজেকে অপর লোকদের কাছে হীন করে না, আর না সে পার্থিব লাভের জন্য তাদের সাথে প্রতিযোগীতা করে। তার জন্য আছে তার নিজস্ব করণীয় কাজ, আর লোকদের জন্যও আছে তাদের নিজস্ব করণীয় কাজ।”

দ্বিতীয় উদাহারনটির ব্যাপারে বলা যায়, মুমিন ব্যক্তিটি নিজেকে একজন মুসাফির হিসেবে বিবেচনা করবেন, যার শেষ গন্তব্য হল পরকাল। অন্তরে এই গন্তব্য ঠিক করার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তিটি সফরের জন্য কেবল প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলোই অর্জন করবেন। তিনি পার্থিব আনন্দের ব্যাপারে মোটেই পরোয়া করবেন না। এ কারনে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বেশ কিছু সাহাবীদেরকে একজন মুসাফিরের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ছাড়া দুনিয়ার আর কোন কিছুর অধিকারী না হওয়ার ব্যাপারে উপদেশ দিয়েছিলেন। (যেমনটি উপদেশ দিয়েছিলেন ইবন ‘উমার (রাঃ) কে, যা হাদিসটিতে উল্লেখ করা হয়েছে)।

মুহাম্মাদ বিন ওয়াসি’কে জিজ্ঞেস করা হলো, “আজ আপনি কেমন আছেন ?” তিনি জবাব দিলেন, “সেই ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কি মনে করো, যে কিনা প্রতিটা দিনই পরকালের দিকে সফর করছে ?”

আল-হাসান বলেছেন, “তুমি তো দিনগুলোর চেয়ে বেশী কিছু না। যখন একটি দিন অতিক্রম করে, তোমাদের মধ্যে কিছু লোক সেই দিনগুলোর সাথেই অতিক্রান্ত হয়ে যায় (দুনিয়ার জীবন অতিক্রম করে পরকালে যাত্রার মাধ্যমে)।”

তিনি আরো বলেছেন, “হে আদম সন্তান, দুটো প্রাণীর উপর তোমরা সওয়ার হয়ে আছো, এগুলো হল দিন আর রাত। রাত তোমাদেরকে দিনের কাছে হস্তান্তর করে আর দিন তোমাদেরকে রাতের কাছে হস্তান্তর করে, এমনটি চলতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত তোমরা পরকালের কাছে হস্তান্তর হয়ে যাও। হে আদম সন্তান, তোমাদের কাছে কে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ?”

তিনি আরো বলেছেন, “মৃত্যু তোমার গন্তব্য, আর এই দুনিয়ার তো সমাপ্তির ঘটবে।”

ফুদাইল বিন ‘ইয়াদ এক ব্যক্তিকে বললেন, “আপনার বয়স কতো ?” ব্যক্তিটি জবাব দিলেন, “ষাট বছর।” ফুদাইল বললেন, “ষাট বছর ধরে আপনি আপনার রবের দিকে সফর করছেন, আপনার তো গন্তব্যে পৌঁছার সময় নিকটবর্তী।” লোকটি বললেন, “আল্লাহ’র কাছেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।” ফুদাইল বললেন, “আপনি কি এর ব্যাখ্যা জানেন ? যখন কোন ব্যক্তি এটা জানে যে, সে একজন গোলাম আর সে আল্লাহ’র কাছে ফিরে যাবে, সে এটাও জানে যে তাকে তার আমলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর যদি সে জানে যে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, তবে তার উচিত হবে প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া।” লোকটি বললেন, “আমার কি করা উচিত ?” ফুদাইল বললেন, “এটা তো একটি সহজ বিষয় ?” লোকটি বললেন, “ সেটি কি ?” ফুদাইল বললেন, “আপনার জীবনের বাকিটা সময় আপনাকে সিরাতুল মুস্তাকিমের সাথে লেগে থাকতে হবে, এতে করে আল্লাহ আপনার অতীতের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিবেন। আপনি যদি বাকি জীবন গুনাহ করে যেতে থাকেন, তবে সারাজীবন আপনি যেসব গুনাহ করেছেন সেগুলোর ব্যাপারে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”

এই কথার আলোকে এক কবি বলেছেন, “কোন ব্যক্তি যদি ষাট বছর ধরে কোন গন্তব্যের দিকে হাঁটতে থাকে, তবে গন্তব্য তো খুবই নিকটবর্তী হয়ে যায়।”

একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছিলেন, “কোন ব্যক্তির সওয়ার হওয়ার প্রাণী যদি হয় দিন আর রাত, তবে সে না হাঁটলেও তারা ঠিকই তাকে সাথে নিয়ে হেঁটে যাবে।”

আরেকজন কবি বলেছিলেন,

“দিনগুলো তো মৃত্যুতেই শেষ হওয়া ধাপ ছাড়া আর বেশী কিছু নয়,

গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখতে পাবে এক বিস্ময়কর ব্যাপার – মুসাফির বসে আছে !”

 

ইবনে ‘উমার (রাঃ) এর উপদেশ

ইবনে ‘উমার (রাঃ) এর উপদেশটি বর্ণিত হাদিস থেকে পাওয়া যায়। এটিও দীর্ঘ জীবনের প্রতি আশা ছোট করার সাথে সম্পর্কযুক্ত; আর এটার সাথেও সম্পর্কযুক্ত যে – যদি কোন ব্যক্তি সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকে, তবে সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার আশা করা উচিত নয়, যদি সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকে তবে সন্ধ্যার প্রত্যাশা করা উচিত নয়। তার উচিত এই বিশ্বাস রাখা যে, সেই সময়ের আগেই সে মারা যেতে পারে। অনেক আলিম এই উপদেশের আলোকে যুহদকে ব্যাখ্যা করেছেন।

আল–মারওয়াজি বলেছেন, “ইমাম আহমাদকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘দুনিয়াতে যুহদ বলতে কি বুঝায় ?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘দীর্ঘ জীবনের আশা ছোট করা; এবং যদি কেউ সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকে তবে তার সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার আশা করা না করা, আর সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকলে সন্ধ্যার প্রত্যাশা না করা। এটা সুফিয়ানেরও মত।’ ”

ইমাম আহমাদকে আরো জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “একজন ব্যক্তি কিভাবে দীর্ঘ জীবনের প্রতি আশা ছোট করতে পারে ?” তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “সেটা আমি জানি না। এটি তো আল্লাহ’র পক্ষ থেকে হিদায়াত।”

আল-হাসান বলেছিলেন, “একবার তিনজন আলিমের সাক্ষাৎ হল। তাদের একজন আরেকজনকে বললেন, ‘আপনি কি পরিমাণ সময় বেঁচে থাকার আশা করেন ?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘মাসের শুরুতে আমি চিন্তা করি, আমি সে মাসেই মারা যাবো।’ অপর দুজন আলিম বললেন, ‘আসলে এটিই তো জীবনে ছোট্ট আশা।’ এরপর তারা তাদের মধ্যকার অপরজনকে বললেন, ‘আপনি কি পরিমাণ সময় বেঁচে থাকার আশা করেন ?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘সপ্তাহের শুরুতে আমি চিন্তা করি, আমি সে সপ্তাহেই মারা যাবো।’ অপর দুজন আলিম বললেন, ‘এটিই আসলে জীবনে ছোট্ট আশা।’ এরপর তারা তাদের মধ্যকার আরেকজনকে বললেন, ‘আপনি কি পরিমাণ সময় বেঁচে থাকার আশা করেন ?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘যে ব্যক্তির আত্মার মালিকানা অন্য কারো কাছে রয়েছে, তার আবার এ ব্যাপারে আশা কি থাকতে পারে ?’ ”

দাউদ আত-তাঈ বলেছেন, “আমি আতওয়ান বিন আমর আত-তাইমিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জীবনে ছোট আশা কোনটি ?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘সেটা তো দুটো নিঃশ্বাসের মাঝে রয়েছে।’ এরপর আমি ফুদাইল বিন ইয়াদকে তার এ কথাটা জানালে তিনি কাঁদলেন আর বললেন, ‘তিনি একবার নিঃশ্বাস নিয়ে ভয় করলেন যে তিনি দ্বিতীয়বার নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারবেন না; আতওয়ান বিন আমর তো মৃত্যুর জন্য সত্যিই খুব প্রস্তুত।’ ”

একজন আলিম বলেছিলেন, “আমি ঘুম থেকে উঠতে পারবো না - এটা চিন্তা করা ছাড়া আমি কখনোই ঘুমোই নি।”

 

ইবনে উমার (রাঃ) বলেছেন, “সুস্থতার সময় তুমি অসুস্থতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো, আর বেঁচে থাকার সময়টাতে নিজেকে প্রস্তুত করো মৃত্যুর জন্য।”

এর অর্থ হল, একজন ব্যক্তির উচিত মৃত্যুর পূর্বে সুস্থতার সময়টাতে সৎ কাজ করা। এই উপদেশটি আরেকটি হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “এমন দুটো নিয়ামত আছে, যে দুটোতে অনেক মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত, সেগুলো হলো – সুস্থতা আর অবসর (সময়)।” (বুখারি – কিতাবুর রিকাক, হাদিস ৬৪১২)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে এক ব্যক্তিকে নসিহত দিতে শুনেছিলেন, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বলছিলেন, “পাঁচটি ঘটনার আগেই পাঁচটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করো – তোমার বৃদ্ধ বয়সের আগে যৌবনকালকে, অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে, দারিদ্রতার পূর্বে ঐশ্বর্যকে, ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে এবং মৃত্যুর পূর্বে তোমার জীবনকে।” (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস ৪/৩০৬; আয-যাহাবি এর বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেছেন)

গুনাইম বিন কায়েস বলেছেন, “ইসলামের শুরুতে আমরা একে অপরকে এটা বলে দ্বীনের দিকে আহবান করতাম – ‘হে আদম সন্তান, সৎ কাজ করো - ব্যস্ততার পূর্বেই অবসর সময়ে, বৃদ্ধ হওয়ার পূর্বে তোমার যৌবনকালে, অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতার সময়, মৃত্যুর পূর্বে এই জীবনে আর পরকালের পূর্বে এই দুনিয়াতে।”

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ছয়টি বিষয় ঘটবার পূর্বেই সৎ কাজের ব্যাপারে দ্রুত অগ্রসর হও – পশ্চিম থেকে সূর্যোদয়, ধোঁয়া, দাজ্জাল, অদ্ভুত প্রাণী, মৃত্যু, মহাপ্রলয়।”

এটা এই অর্থ প্রকাশ করে যে, অনুরূপ বিষয়গুলো একজন ব্যক্তিকে সৎ কাজে বাধা দেয়; হতে পারে সে বিষয়গুলো একজন ব্যক্তির নিজস্ব কোন বিষয়, যেমন – দারিদ্রতা, অসুস্থতা, বৃদ্ধ বয়স বা মৃত্যু, অথবা হতে পারে সেটি ব্যাপক কোন বিষয়, যেমন – পুনরুত্থান, দাজ্জাল ও ফিতনা।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, “রাতের অন্ধকারতম অংশের মতো অন্ধকার ফিতনার পূর্বেই সৎ কাজ করার ব্যাপারে দ্রুত অগ্রসর হও।” (মুসলিম – কিতাবুল ফিতান, হাদিস ১২৮/২৯৪৭)

কিছু ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কোন সৎ কাজই উপকারে আসবে না, যেমনটি আল্লাহ বলেছেন –

يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِن قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا ۗ

“যেদিন তোমার রবের কিছু নিদর্শন প্রকাশ হবে, সেদিনের পূর্বে যারা ঈমান আনেনি, তাদের তখন ঈমান আনাতে কোন উপকার হবে না, অথবা যারা নিজেদের ঈমান দিয়ে কোন সৎ কাজ করেনি (তখন সৎ কাজ দিয়ে কোন ফলোদয় হবে না) … ” (সূরাহ আল-আন’আম, ৬ :১৫৮)

 

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “পশ্চিম থেকে সূর্য উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কিয়ামাত হবে না। এরপর যখন পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্য উদিত হবে, তখন সব মানুষই আল্লাহ’র উপর ঈমান আনবে। কিন্তু এর পূর্বে যে ব্যক্তি ঈমান আনেনি বা ঈমানের সাথে সৎ কাজ করেনি, সে ঈমান তার কোন উপকারে আসবে না।” (বুখারি – কিতাবুর রিকাক, হাদিস ৬৫০৬; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ১৫৭)

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, “যখন তিনটি নিদর্শন প্রকাশ পাবে তখন কোনো ব্যক্তির ঈমান তার উপকারে আসবে না, যদি সে এর পূর্বে ঈমান না এনে থাকে অথবা ঈমানের সাথে কোন নেক আমল সঞ্চয় না করে থাকে, (নিদর্শন তিনটি হল) – পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্য উদিত হওয়া, দাজ্জালের আবির্ভাব আর দাব্বাতুল আরদ্‌বা জমিন থেকে একটি জন্তুর আবির্ভাব।” (মুসলিম – কিতাবিল ঈমান, হাদিস ১৫৮)

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, “যদি একজন ব্যক্তি পশ্চিম থেকে সূর্য উঠার পূর্বেই তাওবা করে, তবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন।” (মুসলিম – কিতাবুয যিকর ওয়াদ-দুয়া, হাদিস ৪৩/২৭০৩)

আবু মুসা আশয়ারি (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “মহান আল্লাহ রাতে নিজ হাতকে প্রসারিত করেন, যাতে করে দিনের পাপকারী বান্দা তাওবা করে; আর দিনে নিজ হাত প্রসারিত করেন যাতে রাতে পাপকারী বান্দা তাওবা করে – (এমনটি হতে থাকবে) যে পর্যন্ত না পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হয়।” (মুসলিম – কিতাবুত তাওবা, হাদিস ৩১/২৭৫৯)

 

অসুস্থতা, মৃত্যু বা এই নিদর্শনগুলোর কোন একটি নিদর্শন সৎ কাজ করা থেকে বিরত করার পূর্বেই একজন মুমিনের উচিত সৎ কাজ করার ব্যাপারে দ্রুত অগ্রসর হওয়া।

আবু হাযিম বলেন, “সব লোকই পরকালের মাল বিক্রি করে দেয় না; যারা পরকালের মাল খরচ করে ফেলে, তারা কেউই পরকালের কোন মাল কিনতে সক্ষম হয় না।”

একজন ব্যক্তি যদি সৎ কাজ না করে তবে তার তো উচিত অনুতপ্ত হওয়া, আর যে অবস্থায় সে সৎ কাজ করতে পারবে সে অবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য আকাংখা করা। আল্লাহ বলেছেন,

وَأَنِيبُوا إِلَىٰ رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ ﴿٥٤﴾ وَاتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ ﴿٥٥﴾ أَن تَقُولَ نَفْسٌ يَا حَسْرَتَىٰ عَلَىٰ مَا فَرَّطتُ فِي جَنبِ اللَّـهِ وَإِن كُنتُ لَمِنَ السَّاخِرِينَ ﴿٥٦﴾

أَوْ تَقُولَ لَوْ أَنَّ اللَّـهَ هَدَانِي لَكُنتُ مِنَ الْمُتَّقِينَ ﴿٥٧﴾ أَوْ تَقُولَ حِينَ تَرَى الْعَذَابَ لَوْ أَنَّ لِي كَرَّةً فَأَكُونَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ ﴿٥٨﴾

“সুতরাং তোমরা তোমাদের রবের দিকে ফিরে আসো আর তার কাছেই (পূর্ণ) আত্মসমর্পণ করো তোমাদের উপর আল্লাহ’র আযাব আসার পূর্বেই, (কেননা একবার আযাব এসে গেলে) এরপর তোমাদের আর কোনো রকম সাহায্য করা হবে না। তোমাদের অজান্তে তোমাদের উপর অতর্কিতভাবে কোন রকম আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বেই তোমাদের কাছে তোমাদের রব যে উৎকৃষ্ট (কিতাব) নাযিল করেছেন তোমরা তার অনুসরণ করো;

(এরপর এমন যেন না হয়,) কেউ (একদিন) বলবে, হায় আফসোস! আল্লাহ’র প্রতি আমার কর্তব্য পালনে আমি দারুন শৈথিল্য প্রদর্শন করেছি, আমি তো (মূলত) ছিলাম ঠাট্টা বিদ্রুপকারীদেরই একজন। কিংবা (কেউ) যেন একথা না বলে, যদি আল্লাহ আমাকে হিদায়াত দান করতেন, তবে আমি অবশ্যই মুত্তাকীদের দলে শামিল হয়ে যেতাম।

অথবা আযাব সামনে দেখে কেউ বলবে, আহা, যদি আমার (আবার) দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া (নসীবে) থাকতো, তাহলে আমি সৎ কর্মশীল বান্দাদের দলে শামিল হয়ে যেতাম।” (সূরাহ আয-যুমার, ৩৯ :৫৪-৫৮)

حَتَّىٰ إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ ﴿٩٩﴾ لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ ۚ كَلَّا ۚ إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا ۖ وَمِن وَرَائِهِم بَرْزَخٌ إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ ﴿١٠٠﴾

“এমনকি (এ অবস্থায় যখন) এদের কারো মৃত্যু এসে হাজির হবে, তখন সে বলবে, হে আমার রব, আপনি আমাকে (আরেকবার দুনিয়াতে) ফেরত পাঠান, যাতে করে (সেখানে গিয়ে) এমন কিছু সৎ কাজ করে আসতে পারি, যা আমি (পূর্বে) ছেড়ে এসেছি; (তখন বলা হবে,) না, তা আর কখনোই হওয়ার নয়; (মূলত) সেটা হল এক (অসম্ভব) কথা, যা সে শুধু বলার জন্যই বলবে, এ (মৃত) ব্যক্তিদের সামনে একটি যবনিকা (তাদের আড়াল করে রাখবে) সে দিন পর্যন্ত, যেদিন তারা (কবর থেকে) পুনরুত্থিত হবে।” (সূরাহ আল-মু’মিনুন, ২৩ :৯৯-১০০)

وَأَنفِقُوا مِن مَّا رَزَقْنَاكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَىٰ أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُن مِّنَ الصَّالِحِينَ ﴿١٠﴾ وَلَن يُؤَخِّرَ اللَّـهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا ۚ وَاللَّـهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ ﴿١١﴾

“আমি তোমাদেরকে যা কিছু অর্থ সম্পদ দিয়েছি তা থেকে তোমরা (আল্লাহ’র পথে) ব্যয় করো তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বেই, (কেননা সামনে মৃত্যু এসে দাঁড়ালে সে বলবে,) হে আমার রব, আপনি যদি আমাকে আরও কিছু কালের অবকাশ দিতেন তাহলে আমি আপনার পথে দান করতাম এবং (এভাবেই) আমি আপনার সৎ কর্মশীল বান্দাদের দলে শামিল হয়ে যেতাম। কিন্তু যখন কারো আল্লাহ নির্ধারিত সময় এসে যাবে, তখন আল্লাহ আর তাকে (এক মুহূর্তও) অবকাশ দিবেন না; তোমরা (দুনিয়ার জীবনে) যা কিছু করছো, আল্লাহ সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত আছেন।” (সূরাহ আল-মুনাফিকুন, ৬৩ :১০-১১)

 

সুতরাং একজন মুমিনের উচিত সৎ কাজ করার মাধ্যমে বাকি জীবনটা ব্যয় করা।

সাই’দ বিন যুবাইর বলেছিলেন, “একজন মুমিনের জীবনে প্রতিটা দিনই হল একটি সম্পদ।”

বাকর আল-মুযানি বলেন, “আল্লাহ’র সৃষ্টি করা প্রতিটি দিন বলে, ‘হে আদম সন্তান, আমাকে ব্যবহার করো, হয়তোবা তুমি আরেকটি দিন বেঁচে থাতে পারবে না।’ আল্লাহ’র সৃষ্টি করা প্রতিটা রাত বলে, ‘হে আদম সন্তান, আমাকে ব্যবহার করো, হয়তোবা তুমি আরেকটি রাত বেঁচে থাকতে পারবে না।’ ”

 

হাদিসের তাফসীরটি ইমাম ইবন রজব এর কিতাব জামি'আল 'উলুম ওয়াল হিকাম এর ইংলিশ ভার্শন থেকে ট্রান্সলেশন করা হয়েছে।

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-Y

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মহিমান্বিত আল্লাহর সৌন্দর্য

 

 

The Greatest Nation·Friday, July 15, 2016

 

 

 

সবচেয়ে মূল্যবান জ্ঞান হল মহিমান্বিত আল্লাহ’র সৌন্দর্য জানার মাধ্যমে আল্লাহ্‌কে জানা। আর এ জ্ঞান তো তার সৃষ্টির সত্যিকারের ধার্মিক সৃষ্টিকেই দেওয়া হয়, যখন কিনা অন্যান্য সৃষ্টিগুলো তার কোন একটি গুণের মাধ্যমে তাকে জানতে পারে। যারা তাকে সবচেয়ে ভালোভাবে জানে, তারা তো তার পরিপূর্ণতা, তার গৌরব আর তার সৌন্দর্য জানার মাধ্যমেই তাকে জানতে পারে।

তার গুনে গুণান্বিত আর কিছুই নেই। আমরা যদি সকল সৃষ্টিকেই সুন্দর হিসেবে ধরে নেই আর মনে করি যে সবচেয়ে সেরা সুন্দর সৃষ্টিকে আমরা জানি, এবং তাদের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সৌন্দর্যকে মহিমান্বিত আল্লাহ’র সৌন্দর্যের সাথে তুলনা করি, তবে তো ব্যাপারটি সূর্যের আলোর সাথে বাতির আলোর তুলনা করার মতো হবে।

নিশ্চয়ই তিনি যদি তার চেহারা থেকে পর্দা উঠিয়ে দেন, তবে তার চেহারার জ্যোতি তার সৃষ্টিকে গ্রাস করে ফেলবে। এই পার্থিব জীবন আর পরকালের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উপাদানগুলোতে থাকা সৌন্দর্য তো তার সৃষ্টির প্রভাব থেকেই আসে; তাহলে চিন্তা করে দেখুন, এ সৃষ্টিগুলোর স্রস্টার সৌন্দর্য কেমন হতে পারে ?

তারই তো রয়েছে সকল গৌরব, ক্ষমতা, দানশীলতা, বদান্যতা, জ্ঞান ও অনুগ্রহ। তার চেহারার জ্যোতিতে সকল অন্ধকার হয়ে যায় অদৃশ্য, যেমনটি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাইফে দুয়া করার সময় বলেছিলেন – “আপনার চেহারার জ্যোতির মাধ্যমে আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা অন্ধকারকে আলোকিত করে দেয় এবং যার উপর দুনিয়া ও আখিরাতের উপযুক্ততা নির্ভরশীল।”

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ’র কাছে দিন বা রাত নেই, (বরং) আসমান ও জমিনের আলো তো তার চেহারার জ্যোতি থেকেই আসে।”

মহিমান্বিত আল্লাহ আসমান ও জমিনের জ্যোতি, আর পুনরুত্থান দিবসে মানবজাতির বিচার করার সময় দুনিয়া তো তার জ্যোতি থেকেই ঔজ্জ্বল্য লাভ করবে।

আল্লাহ নামগুলোর মধ্যে একটি নাম হল “আল-জামিল” (সবচেয়ে সুন্দর); রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর (জামিল) আর তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন।” (মুসলিম – কিতাবুল ঈমান)

আল্লাহ’র সৌন্দর্যের চারটি উচ্চতা রয়েছে – তার নিজের সৌন্দর্য, তার গুণাবলীর সৌন্দর্য, তার কাজের সৌন্দর্য আর তার নামগুলোর সৌন্দর্য। তার সব নামই সুন্দর, তার সব গুণই উৎকৃষ্ট গুণ, তার সব কাজই প্রজ্ঞাপূর্ণ, ন্যায্য ও দয়াপূর্ণ, এবং তিনি তো মানুষের কল্যাণই বিবেচনা করেন।

কেবল আল্লাহই তার নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানেন, আর জানেন তার সে সৌন্দর্য কিসের মতো; তার সৃষ্টির কাছে তো কেবলই কিছু সংজ্ঞা আছে যা কিনা তিনি তার সম্মানিত কিছু গোলামদের প্রদান করেছেন। সে সৌন্দর্য অন্যান্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখে তা পর্দা ও পোশাক দিয়ে আবৃত করা হয়েছে; যেমনটি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে আল্লাহ বলেছেন, “অহংকার আমার চাদর আর শ্রেষ্ঠত্ব আমার পোশাক।” আল্লাহ তো মহান, আর তার অবস্থান সবচেয়ে উপরে, তাই তার অহংকারও মহান ও ব্যাপক হওয়ার কারনে চাদরই হল প্রাপ্য (যা তার অহংকার ঢেকে রাখার জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন)।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ নিজেকে আবৃত করেছেন তার গুণাবলী দিয়ে আর তার গুণাবলীকে আবৃত করেছেন তার কাজ দিয়ে। সে সৌন্দর্য সম্পর্কে তুমি কি মনে করো, যা কিনা উৎকৃষ্ট গুণাবলী, গৌরব আর মহিমা দিয়ে আবৃত ?”

এটা থেকে সৌন্দর্যের অন্যান্য অর্থগুলো অনুধাবন করা যায়। গোলাম প্রথমে আল্লাহ’র কাজ, এরপর তার গুণাবলী এবং এরপরে স্বয়ং আল্লাহ্‌কে জানার মাধ্যমে উন্নতি লাভ করে। যদি সে কাজগুলোর সৌন্দর্যের মধ্যে কিছু দেখতে পায়, তবে সে গুণাবলীর সৌন্দর্যে পৌঁছে যাবে, এরপর সে পৌঁছে যাবে আল্লাহ’র সৌন্দর্য জানার পর্যায়ে।

সুতরাং সকল প্রশংসা ও শুকরিয়া তো মহিমান্বিত আল্লাহ’র জন্যই, তার সৃষ্টির কোন কিছুই তার প্রাপ্য অনুযায়ী তার প্রশংসা করতে সক্ষম নয়, একমাত্র তিনিই তার পরিপূর্ণ প্রশংসা করতে পারেন, আর তিনিই তো একমাত্র ইবাদাতের যোগ্য, ভালোবাসা ও প্রশংসিত হওয়ার যোগ্য। তিনি তার গুণাবলী ও কাজকে ভালোবাসেন যেমনটা ভালোবাসেন নিজেকে। তার সকল কাজই তো সুন্দর ও মূল্যবান এবং তার কাজে এমন কিছুই নেই যেটার প্রতি ঘৃণা আসে।

মহিমান্বিত আল্লাহ ছাড়া মহাবিশ্বে আর কিছুই নেই যাকে ভালোবাসা হয় আর যার প্রশংসা করা হয়। যদি তাকে ছাড়া অন্য কিছুকে তার জন্যই ভালোবাসা হয়, তবে সে ভালোবাসা বৈধ, নতুবা তা অবৈধ; আর এটিই হল রবুবিয়্যাতের বাস্তবতা। সত্যিকারের রব তো তিনিই- যাকে ভালোবাসা হয় আর যার প্রশংসা করা হয়। আর এতে যদি আমরা তার দানশীলতা, অনুগ্রহ, দয়াশীলতা, ক্ষমাশীলতা আর গভীর শ্রদ্ধা যোগ করি, তবে কেমন হবে ব্যাপারটি ?

গোলামের তো জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তার উচিত আল্লাহ’র সত্তা ও তার পরিপূর্ণতার জন্য আল্লাহ্‌কে ভালোবাসা ও তার প্রশংসা করা। তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই যে কিনা গোপনে ও প্রকাশ্যে দয়া-অনুগ্রহ প্রদান করে, তাই গোলামের উচিত তার দয়ার কারনে তাকে ভালোবাসা।

যেহেতু আল্লাহ মতো আর কিছুই নেই, তাই আল্লাহ্‌কে ভালোবাসাটাও অন্য কিছুকে ভালোবাসার মতো নয়। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ভালোবাসা হল এমনই এক ইবাদাত, যেটার জন্য আল্লাহ সব কিছুকে সৃষ্টি করেছেন। এটিই হল চূড়ান্ত নম্রতার সাথে চূড়ান্ত ভালোবাসা, আর এ ভালোবাসা আল্লাহ ছাড়া কারো প্রতিই দেখানো যাবে না। আল্লাহ ছাড়া এ ভালোবাসা অন্য কারো কাছে দেখানো হল শিরক, যা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না যদি সে শিরককারী ব্যক্তি শিরক থাকা অবস্থাতেই মৃত্যু বরণ করে।

আল্লাহ’র প্রশংসা করা দুটো বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে – তার প্রশংসনীয় কাজের ব্যাপারে জানা আর তার উৎকৃষ্ট গুণাবলীর ব্যাপারে জানা, আর এগুলোর কারনে তাকে ভালোবাসা। কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা না রেখেই তার প্রশংসনীয় কাজের কথা বলে, তবে সে তার প্রশংসা করছে না। আর যদি সে তার প্রশংসনীয় কাজগুলোর ব্যাপারে কাউকে না জানিয়ে তাকে ভালোবাসে, তবে সেও তার প্রশংসা করছে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সে দুটো বিষয় একত্রিত করছে।

আল্লাহ তো নিজেই নিজের প্রশংসা করেছেন, আর তার ফেরেশতা, নবী রসূলগণ ও ইমানদারদের মধ্যে যারা তার প্রশংসা করেছেন, তিনি তাদের জবান দিয়ে তার প্রশংসা করিয়েছেন। তারা তো তাদের রবের ইচ্ছা ও অনুমতি অনুসারেই তার প্রশংসা করেছেন। তিনিই তো সে মহান সত্তা, যিনি তাদেরকে তার প্রশংসার ক্ষমতা দিয়েছেন, আর সব কিছুই তো তার অনুমতির কারনে ঘটে।

সব কল্যাণই তাকে দিয়ে শুরু হয় আর শেষ হয় তাকে দিয়ে, সেগুলো শুরু হয় তার প্রশংসা করার মাধ্যমে আর শেষ হয় তার প্রশংসার মধ্য দিয়ে।

তিনি তার গোলামদের অনুপ্রাণিত করেন তাওবা করার জন্য, আর সে তাওবার ফলে তিনি খুশী হন; এটি তো তার অনুগ্রহ ও মহত্ত্ব।

তিনি তার গোলামদের অনুপ্রাণিত করেন তার আনুগত্য করার জন্য, তাদের সাহায্য করেন আনুগত্য করার জন্য, আর সেটার জন্য তিনি পুরস্কৃতও করেন !

তার তো কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই, কিন্তু সব কিছুরই সব সময়ই তার জন্য গভীর প্রয়োজন রয়েছে। গোলামের তো প্রয়োজন তার রবকে, যেন তিনি তাকে তার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করেন।

তিনি যেটার অনুমতি দেন নি তা তো কখনোই হওয়ার নয়, আর তার জন্য যা করা হয় না সেটার কোন মূল্যই নেই।

 

ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ)’র কিতাব আল-ফাওাইদ থেকে (ইংলিশ-বাংলা) অনূদিত।

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-1T

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাদিস তাফসীর - “…কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে আর কাগজ শুকিয়ে গিয়েছে

 

 

The Greatest Nation·Friday, July 15, 2016

 

 

 

 

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ একদিন আমি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পিছনে ছিলাম, তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন,

“হে বালক, আমি তোমাকে কিছু কথা শেখাবো - আল্লাহকে হেফাজত করো, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন; আল্লাহকে হেফাজত করো আর তুমি তাকে তোমার সাথেই পাবে। কিছু চাইলে আল্লাহ’র কাছেই চাবে। তুমি সাহায্য চাইলে আল্লাহ’র কাছেই চাবে।

এটা মেনে নাও যে,জাতি যদি তোমার উপকার করার জন্য একত্রিত হয়, তবে আল্লাহ তাকদিরে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন সেটা ছাড়া তারা কখনোই তোমার উপকার করতে পারবে না; তারা যদি তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়, তবে আল্লাহ তাকদিরে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন সেটা ছাড়া তারা কখনোই তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।

কলম তুলে নেওয়া হয়েছে আর কাগজ শুকিয়ে গিয়েছে।”

(তিরমিযি – কিতাবুস সিফাত আল-কিয়ামাহ, হাদিস ২৫১৬; মুসনাদে আহমাদ – প্রথম খন্ড)

 

তিরমিযির বর্ণনা ছাড়া অপর আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে –

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহকে হেফাজত করো আর তুমি তাকে তোমার সাথেই পাবে। (জীবনে) সমৃদ্ধির সময়টাতে তার কাছেই থাকো আর তিনি তোমার দুর্দশার সময়ে তোমার সাথেই থাকবেন। এটা স্বীকার করবে যে - তুমি যা হারিয়েছো তা কখনোই পাওয়ার ছিল না, আর যা তুমি পেয়েছো তা কখনোই হারানোর ছিল না। স্বীকার করো – সাহায্য তো সবরের সাথেই আসে, দুর্দশার পরই আসে সুখ এবং কস্টের পরই রয়েছে স্বস্তি।”

(মুসনাদে আহমাদ – প্রথম খণ্ড; তাবারানি – আল কবির, হাদিস ১১২৪৩। ইমাম হাকিম একে নির্ভরযোগ্য বলেছেন, দেখুন মুসতাদরাকে হাকিম ৩/৫৪২; ইমাম আয-যাহাবি বলেছেন এটি নির্ভরযোগ্য নয়।)

 

এই হাদিসটির গুরুত্ব

এ হাদিসটিতে রয়েছে মহান উপদেশ আর এটি দ্বীন ইসলামের সকল ব্যাপক স্তম্ভগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

একজন আলিম বলেছিলেন, “এ হাদিসটির উপর আমি গভীরভাবে চিন্তা করেছিলাম, হাদিসটি যেন আমায় চিন্তার গভীরে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো, আমি তো নিজের মনটা প্রায় হারিয়ে যেতেই বসেছিলাম। সে লোকগুলো কি বিশাল ক্ষতির মধ্যেই না রয়েছে, যারা না জানে এ হাদিসটি আর না বুঝে এর অর্থ।”

 

হাদিসটির ব্যাখ্যা

“আল্লাহকে হেফাজত করো” – এর অর্থ হল, একজন ব্যক্তির উচিত আল্লাহ’র সাথে কৃত অঙ্গীকার হেফাজত করা এবং আল্লাহ’র হক, আদেশ ও নিষেধের প্রতি মনোযোগ দেওয়া। তার উচিত আল্লাহ’র আদেশ মেনে চলা, হারাম কাজগুলো বর্জন করা আর তার নির্ধারিত দায়িত্বগুলো কখনোই লঙ্ঘন না করা এবং তিনি যা হারাম করেছেন তা করা থেকে বিরত থাকা। যে ব্যক্তিই এগুলো মেনে চলবে সে-ই আল্লাহ’র সাথে কৃত অঙ্গীকারের হেফাজতকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ প্রশংসা করে বলেছেন –

“এরই প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেওয়া হয়েছিলো – প্রত্যেক আল্লাহ অভিমুখী, হেফাজতকারীর জন্য। যারা না দেখে আর-রহমানকে ভয়কে করে আর বিনীত চিত্তে উপস্থিত হয় …” (সূরাহ কাফ, ৫০ : ৩২-৩৩)

এর তাফসীরে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ’র সাথে করা অঙ্গীকারের হিফাজত করে, আর তারা হল সেসব ব্যক্তি – যারা তার আদেশ মেনে চলে আর তাদের পাপগুলোকে স্মরণ করে তাওবা করে।

 

আল্লাহ’র নির্ধারিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আদেশটি হল সালাতের হেফাজত করা। আল্লাহ আমাদেরকে সালাত কায়েমের আদেশ দিয়েছেন –

“(পাঁচ ওয়াক্ত ফরয) সালাতগুলো, (বিশেষ করে) মধ্যবর্তী সালাতের হেফাজত করো, আর আল্লাহ’র সামনে একান্ত আদবের সাথে দাঁড়াও।” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ :২৩৮)

 

যারা এটা মেনে চলে আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেছেন –

“এবং যারা নিজেদের সালাতে যত্নবান …” (সূরাহ আল-মা’আরিয, ৭০ : ৩৪)

 

আর শপথ করার পর তা হেফাজত করার আদেশ দেওয়া হয়েছে –

“এবং তোমাদের শপথগুলোর হেফাজত করো …” (সূরাহ আল-মা’ইদাহ, ৫ : ৮৯)

অনেক লোকই তো শপথ করে, কিন্তু তারা সে শপথের উপর অটল থাকে না।

 

একজন ব্যক্তির উচিত তার অন্তর ও চিন্তাভাবনার প্রতিও মনোযোগ দেওয়া আর হারাম খাবার বর্জন করা। আল্লাহ বলেন –

“নিশ্চয়ই কান, চোখ ও অন্তর – এদের প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করা হবে।” ( সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ : ৩৬)

 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হারাম কাজ - যা জিহ্বা ও যৌনাঙ্গ দিয়ে করা হয়, সেটাও বর্জন করা উচিত। আল্লাহ বলেন –

“… যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী নারী, আল্লাহ্‌কে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী – এদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহান প্রতিদান।” (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ :৩৫ )

 

“আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন” – এর অর্থ হল, কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহ’র আদেশ মেনে চলে, তবে আল্লাহ তার হেফাজত করবেন। পুরস্কার হল কাজের সমানুপাতিক, যেমনটি আল্লাহ বলেছেন –

“… আমার অঙ্গীকার পূর্ণ করো, আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করবো …” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ :৪০)

 

আল্লাহ কতৃক বান্দার হেফাজত দুই প্রকারের –

প্রথম প্রকার হল এই যে, আল্লাহ তার বান্দাকে তার পার্থিব বিষয়ে (যেমন – তার শরীর, সন্তান, পরিবার ও ধনসম্পদ) হেফাজত করবেন। যে ব্যক্তিই যৌবনে আর শক্তি-সামর্থ্য থাকা অবস্থায় আল্লাহ’র আনুগত্য করবে, আল্লাহ তাকে বৃদ্ধ বয়সে আর দুর্বল অবস্থায় হেফাজত করবেন এবং তাকে তার শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শারীরিক ও মানসিক শক্তি ভোগ করতে দিবেন।

হয়তো ভালো আবেদ হওয়ার কারণে আল্লাহ কোন ব্যক্তির বংশের হেফাজত করতে পারেন, যেমন কুরআনে আল্লাহ বলেছেন –

“… আর তাদের পিতা ছিলো সৎকর্মপরায়ণ।” (সূরাহ আল-কাহফ, ১৮ :৮২)

বলা হয়ে থাকে যে, তাদের পিতা সৎকর্মপরায়ণ হওয়ার কারণে তার সন্তানদের হেফাজত করা হয়েছিলো।

সা’ইদ বিন আল-মুসায়্যিব তার পুত্রকে বলেছিলেন, “তোমার জন্য আমি ইবাদাতকে এ আশায় বাড়িয়ে দিবো যে, আল্লাহ আমার কারনে তোমাকে হেফাজত করবেন।” এরপর তিনি এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন –

“… আর তাদের পিতা ছিলো সৎকর্মপরায়ণ।” (সূরাহ আল-কাহফ, ১৮ : ৮২)

 

দ্বিতীয় প্রকারের হেফাজত তো অধিকতর সম্মানিত, কারন এটি হল আল্লাহ কতৃক তার গোলামের ঈমান ও দ্বীনের হেফাজত। সে সত্যিকারের ঈমানদার ব্যক্তি হলে আল্লাহ (এ দুনিয়াতে) তাকে হেফাজত করবেন বিভ্রান্তকর ও সন্দেহজনক চিন্তা-ধারণা ও হারামকৃত লালসায় পতিত হওয়া থেকে, আর তার মৃত্যুর সময় আল্লাহ তার দ্বীনের হেফাজত করবেন (মৃত্যুর ফিতনা থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে)।

 

“আল্লাহকে হেফাজত করো আর তুমি তাকে তোমার সাথেই পাবে” – এর অর্থ হল, একজন ব্যক্তি যখন আল্লাহ’র আদেশ মেনে চলবে, তখন আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন আর হিদায়াত দিবেন, এমনকি তাকে বিজয়ও দান করবেন। আল্লাহ বলেছেন –

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাথেই আছেন, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে আর যারা মুহসিন।” (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ১২৮)

কাতাদাহ বলেছেন, “যদি একজন ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে, তবে আল্লাহ তার সাথেই থাকবেন। আর আল্লাহ যদি তার সাথেই থাকেন, তাহলে সে ব্যক্তি কখনোই পরাজিত হবে না – ব্যাপারটা যেন এমন যে, তার কাছে রয়েছে এক অতন্দ্র প্রহরী আর স্থিরভাবে অবস্থান করা এক পথপ্রদর্শক (যিনি তাকে ছেড়ে চলে যান না)।”

আল্লাহ এমন ব্যক্তিদের সাথেই থাকেন, যেমনটি ঘটেছিলো মুসা (আঃ) ও হারুন (আঃ) এর ক্ষেত্রে, আল্লাহ বলেন –

“তিনি (আল্লাহ) বলেছিলেনঃ ভয় পেয়ো না, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের উভয়ের সাথে আছি, (আমি সবই) শুনছি আর দেখছি।” (সূরা তোয়া-হা, ২০ :৪৬)

মুসা (আঃ) বলেছিলেন,

“না, আমার রব তো আমার সাথেই রয়েছেন, তিনি অবশ্যই আমাকে (এ সঙ্কট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটি) পথ দেখিয়ে দিবেন।” (সূরাহ আশ-শুয়ারা, ২৬ : ৬২)

এই বিশেষভাবে সাথে থাকার অর্থ হল ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ’র সাহায্য থাকা, তাকে হেফাজত করা, সাহায্য করা আর বিজয় দান করা।

সাধারণভাবে ব্যক্তির সাথে থাকার ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন -

“তোমাদের তিনজনের সলাপরামর্শে চতুর্থ থাকেন তিনি (আল্লাহ), পাঁচজনের সলাপরামর্শে তিনি থাকেন ষষ্ঠতম, এবং এর চেয়ে কম ও বেশীতেও। তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তিনি তাদের সাথেই থাকেন।” (সূরাহ আল-মুজাদিলাহ, ৫৮ : ৭)

এই সাথে থাকার অর্থ হল, আল্লাহ তার গোলামদের প্রত্যেকের সম্পর্কে প্রতিটি বিষয় সম্পর্কেই জানেন আর তিনি তাদের কাজগুলোর প্রতি নজর রাখেন। তাই এটা চিন্তা করে গোলামদের উচিত আল্লাহ’র ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করা।

 

এরপর রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন – “(জীবনে) সমৃদ্ধির সময়টাতে তার কাছেই থাকো আর তিনি তোমার দুর্দশার সময়টাতে তোমার সাথেই থাকবেন।”

গোলাম যদি আল্লাহ’র ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করে, তার আদেশ মেনে চলে আর তার জন্যই জীবনের সমৃদ্ধির সময়টাতে তার হকগুলো আদায় করে ও সৎ কাজ করে, তবে সে আল্লাহ’র নিকটবর্তী হবে এবং তার ও তার রবের মাঝে একটি বিশেষ সম্পর্ক হবে। তার দুর্দশার সময়ে আল্লাহ তার সাথেই থাকবেন আর যেকোন বিপদ থেকে তাকে হেফাজত করবেন। এই বিশেষ সম্পর্কের কারনে আল্লাহ তার নিকটে থাকবেন, তাকে ভালবাসবেন আর তার দুয়ার জবাব দিবেন।

 

গোলামের তার রব সম্পর্কিত জ্ঞান দুই ধরণের –

(১) সাধারণ জ্ঞান – এটা হল আল্লাহ’র প্রতি দৃঢ় ঈমান ও আস্থা রাখা।

(২) বিশেষ জ্ঞান – এটা হল আল্লাহ’র প্রতি নিজের অন্তরকে সম্পূর্ণভাবে অনুগত করে রাখা, তাকে স্মরণ করার সময় শান্ত অবস্থা ও প্রশান্তি প্রাপ্ত হওয়া, তার ব্যাপারে ভীত থাকা এবং তার সম্মুখে লজ্জাশীল থাকা। এই বিশেষ জ্ঞানটি সৎকর্মপরায়ণ ও ধার্মিক ব্যক্তিদের দ্বারাই গৃহীত হয়।

 

গোলামের সম্পর্কে আল্লাহ’র জ্ঞানও দুই ধরণের –

(১) সাধারণ জ্ঞান – আল্লাহ তার সব গোলাম সম্পর্কে সব কিছুই জানেন, তারা বলুক আর না-ই বলুক, যেমনটি আল্লাহ বলেছেন –

“নিঃসন্দেহে আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি, তার মনের কোণে যে খারাপ চিন্তা উদয় হয় আমি সে সম্পর্কেও জানি …” (সূরাহ কাফ, ৫০ :১৬)

(২) বিশেষ জ্ঞান – এটা হল গোলামের প্রতি আল্লাহ’র ভালোবাসা, তার দুয়ার জবাব দেওয়া এবং তাকে বিপদ ও দুর্দশা থেকে হেফাজত করা।

এ ধরণের জ্ঞানের ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসে উল্লেখ রয়েছে –

“আল্লাহ বলেছেন – ‘যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সাথে শত্রুতা রাখবে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার গোলাম আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ - যে কাজগুলো আমি ফরয করেছি, তা পালন করার করার মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হয়, আমার গোলাম আমার আরো নিকটবর্তী হতে থাকে নফল ইবাদাত করার মাধ্যমে। আমি যখন তাকে ভালোবাসি, (তখন) আমি তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শোনে, তার চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে, তার পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে হাঁটে; আর সে যদি কিছু চায় তবে আমি তাকে তা দেই, সে আমার কাছে আশ্রয় চাইলে আমি তাকে আশ্রয় দেই। মুমিনের রূহ কবজে আমি যত না সংকোচ করি, অন্য কিছুতে আমি ততটা সংকোচ করি না, কারন সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার কষ্টকে অপছন্দ করি।’ ” (বুখারি – কিতাবুর রিকাক, হাদিস ৬৫০২)

সব মিলিয়ে বলা যায়, গোলাম যখন আল্লাহ’র ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করে আর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে তারই আনুগত্য করে, আল্লাহ তার দুর্দশার সময়ে তার সাথেই থাকবেন আর তাকে সাহায্য করবেন।

 

সবচেয়ে বড় দুর্দশা

সবচেয়ে বড় যে দুর্দশাটি গোলামকে নিপীড়িত করে সেটি হল মৃত্যু। যদি তার পরকালীন আবাস হয় মন্দ, তবে মৃত্যুর পর তো তার অবস্থা পূর্বের তুলনায় অধিকতর মন্দই হবে। যুবক ও শক্তি সামর্থ্যবান থাকা অবস্থায় একজন মুসলিমের উচিত ধার্মিকতা আর সৎ কর্ম করার মাধ্যমে নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা, যেমনটি আল্লাহ বলেছেন –

“হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ্‌কে ভয় করো, প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক যে, আগামীকালের জন্য সে কি অগ্রীম পাঠিয়েছে। আর আল্লাহ্‌কে ভয় করো, তোমরা যা করো আল্লাহ তা সম্পর্কে জানেন। আর তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহ্‌কে ভুলে গিয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদের (নিজ নিজ অবস্থা) ভুলিয়ে দিয়েছেন। তারাই তো ফাসিক।” (সূরাহ আল-হাশর, ৫৯ :১৮-১৯)

 

গোলাম তার যৌবনে ও সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করলে আর মৃত্যুর পর তার সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলে আল্লাহ তাকে তার দুর্দশার সময়টিতে সাহায্য করবেন, তার হেফাজত করবেন, তাওহীদকে আঁকড়ে ধরে মারা যাওয়ার ব্যাপারে তার অন্তরকে খচিত করে দিবেন আর আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট থাকা অবস্থাতেই তার রূহ গ্রহণ করবেন।

গোলাম তার যৌবন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে আল্লাহ্‌কে ভুলে গেলে আর নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত না করলে, আল্লাহ তাকে তার দুর্দশার সময়ে পরিত্যাগ করবেন আর তাকে একাকী ছেড়ে দিবেন।

আবু বকর বিন আবি আইয়াশ মৃত্যুর সময় তা পুত্রকে বলেছিলেন, “তুমি কি মনে করো যে আমি ধারাবাহিকভাবে চল্লিশ বছর ধরে প্রতি রাতে যে সম্পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করতাম, আল্লাহ আমার কাছ থেকে সেটা কবুল করবেন না ?”

 

কিছু চাওয়া আর সাহায্য প্রার্থনা করা

“কিছু চাইলে, আল্লাহ’র কাছেই চাইবে। তুমি সাহায্য চাইলে আল্লাহ’র কাছেই চাবে” – রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এই উক্তিটি আল্লাহ’র এ বাণী থেকে পাওয়া যায় –

“আমরা (কেবল) আপনারই ইবাদাত করি আর (কেবল) আপনার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।” (সূরাহ আল-ফাতিহাহ, ১ :৫)

 

আল্লাহ’র কাছে সাহায্য চাওয়া মানে হল তাকে আহবান করা (তার কাছে দুয়া করা), আর দুয়া হল ইবাদাতের সারমর্ম।

নুমান বিন বাশির থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “দুয়া হল ইবাদাত (-এর সারমর্ম)।” এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তিলাওয়াত করলেন -

“এবং তোমাদের রব বলেনঃ তোমরা আমাকে আহবান করো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো।” (সূরা গাফির, ৪০ :৬০)

(আবু দাউদ – কিতাবুস সালাহ, হাদিস ১৪৭৯; ইবনে মাজাহ – হাদিস ৩৮২৮; মুসনাদে আহমাদ – হাদিস ৪/২৬৭)

আল্লাহ আমাদেরকে তার কাছে চাওয়ার আদেশ করেছেন –

“তোমরা আল্লাহ’র কাছে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা করো …” (সূরাহ আন-নিসা, ৪ :৩২)

 

অনেকে নির্ভরযোগ্য হাদিসেই কোন ব্যক্তি থেকে কিছু চাওয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আওফ ইবনে মালিক আশজাঈ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ আমাদের সাত বা আট বা নয় জন লোকের উপস্থিতিতে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “কেন তোমরা আল্লাহ’র রসূলের কাছে বাইয়াত করছো না ?” অথচ আমরা এর পূর্বে বাইয়াত গ্রহণের সময় তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতেই বাইয়াত করেছি। আমরা বললাম, “ইয়া রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম), আমরা তো আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছি।” তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার বললেন, “কেন তোমরা আল্লাহ’র রসূলের কাছে বাইয়াত হচ্ছো না ?” আমরা বললাম, “ইয়া রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম), আমরা তো এর পূর্বে বাইয়াত হয়েছি।” তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার বললেন, “কেন তোমরা আল্লাহ’র রসূলের কাছে বাইয়াত হচ্ছো না ?” বর্ণনাকারী বলেন, “এরপর আমরা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ইয়া রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম), আমরা তো এর পূর্বেই আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছি, এখন কিসের বাইয়াত করবো ?”

তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তোমরা আল্লাহ’র ইবাদাত করো আর তার সাথে কাউকে শরীক করো না, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করো আর আল্লাহ’র আনুগত্য করো।”

তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো একটা কথা চুপে চুপে বললেন – “মানুষের কাছে কিছুর জন্য হাত পাতবে না।”

বর্ণনাকারী বলেন, “এরপর আমি দেখেছি, সেই বাইয়াত গ্রহণকারী দলের কারো কারো উটের পিঠে থাকা অবস্থায় হাত থেকে চাবুক পড়ে গেলেও তিনি কাউকে তা তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ না করে নিজেই নিচে নেমে তুলে নিয়েছেন।”

(মুসলিম – কিতাবুয যাকাত, হাদিস ২২৭২)

 

কেবল আল্লাহ’র কাছেই চাওয়া আবশ্যিক আর তার গোলামদের কাছে চাওয়া বর্জন করাটাও আবশ্যিক। কোন কিছু চাওয়ার অর্থ তো এই যে, সে ব্যক্তি অপদস্থ আর তার একজন মানুষ দরকার যার কাছে সে চাবে। এর অর্থ হল, সে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিটি জানে, যে লোকটির কাছে চাওয়া হবে তার সামর্থ্য আছে অমুক ক্ষতি অপসারণের, দরকারি লক্ষ্য অর্জনের আর স্বার্থ অর্জনের। নিজের অবনমিত অবস্থা আর প্রয়োজন তো কেবল আল্লাহ’র সামনেই উপস্থাপন করা উচিত, কারন এটিই হল ইবাদাতের সারমর্ম।

আল্লাহ তার গোলাম কতৃক সাগ্রহে ও আন্তরিকভাবে কোন কিছু চাওয়ার আহবান শুনতে ভালোবাসেন। গোলাম আল্লাহ’র কাছে কিছু না চাইলে আল্লাহ রেগে যান, যে গোলাম কিনা আল্লাহ্‌কে বাদ দিয়ে তার নিজের মতো অন্যান্য সৃষ্টির কাছে চায়। আল্লাহ তো সর্বশক্তিমান, তিনি তার সব গোলামের প্রয়োজনে সাড়া দিতে পারেন আর এতে তার রাজত্বে কোন প্রভাবই পড়ে না। অপর দিকে, সৃষ্টি তো এটা ঘৃণা করে যে তার কাছে কিছু চাওয়া হবে, কারন এটার সাথে তাদের দারিদ্রতা, অক্ষমতা ও অভাবের সম্পর্ক রয়েছে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “মহামহিম আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন – ‘এমন কে আছে, যে আমাকে ডাকবে ? আমি তার ডাকে সাড়া দিবো। এমন কে আছে, যে আমার কাছে চাবে ? আমি তাকে তা দিবো। এমন কে আছে, যে আমার কাছে ক্ষমা চাবে ? আমি তাকে ক্ষমা করবো।’ ” (বুখারি – কিতাবুত তাহাজ্জুদ, হাদিস ১১৪৫; মুসলিম – কিতাবুস সালাত আল-মুসাফিরিন, হাদিস ১৬৮/৭৫৮)

 

কেবল আল্লাহ’র কাছেই সাহায্য চাওয়াটা আবশ্যিক, কারন একজন গোলাম নিজের স্বার্থ অর্জন আর মন্দ ও পাপ থেকে রক্ষা পেতে অক্ষম এবং আল্লাহ ছাড়া তো আর কেউই নেই যে তাকে পার্থিব ও দ্বীনের স্বার্থ অর্জনে সাহায্য করবে। আল্লাহ যদি কোন গোলামকে সাহায্য করেন তবে সে গোলাম তো রক্ষা পেলো, কিন্তু আল্লাহ যদি তাকে পরিত্যাগ করেন তবে সে তো ধ্বংস হয়ে গেলো।

আর এটিই হল “লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া কোন শক্তি বা আশ্রয়দাতা নেই) এর যথার্থ অর্থ। এই মহান বাক্যটি জান্নাতের অন্যতম সম্পদ। এর অর্থ –আল্লাহ’র সাহায্য ছাড়া গোলাম কিছুই করতে পারে না।

আল্লাহ’র আদেশকৃত কাজগুলো করা, পাপ বর্জন করা আর এই পার্থিব ফিতনা ও মৃত্যুর ফিতনাতে সবরের সাথে লেগে থাকার ব্যাপারে এবং কবর ও বিচার দিবসের ফিতনার ব্যাপারে গোলামের তো আল্লাহ’র সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। এ সকল বিষয়গুলোতে একমাত্র আল্লাহই পারেন তার গোলামকে সাহায্য করতে। গোলাম আল্লাহ’র কাছে সাহায্য চাইলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের উপকারী বিষয়ে যত্নশীল থাকো, আল্লাহ’র সাহায্য চাও আর অক্ষমতা পরিত্যাগ করো।” (মুসলিম – কিতাবুল কদর, হাদিস ৩৪/২৬৬৪)

গোলাম যদি আল্লাহ’র সাহায্য চাওয়া ছেড়ে দেয় আর অন্য সৃষ্টির কাছে সাহায্য চায়, তবে আল্লাহ’র তাকে সেই সৃষ্টির কাছেই ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় ছেড়ে দিবেন।

আল্লাহ আমাদের তাকদিরে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন সেটা ছাড়া অন্য কিছু ঘটবে না।

 

“এটা মেনে নাও যে,জাতি যদি তোমার উপকার করার জন্য একত্রিত হয়, তবে আল্লাহ তাকদিরে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন সেটা ছাড়া তারা কখনোই তোমার উপকার করতে পারবে না; যদি তার তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়, তবে আল্লাহ তাকদিরে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন সেটা ছাড়া তারা কখনোই তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।”

এর অর্থ হল – এ দুনিয়াতে গোলামের যে ক্ষতি বা উপকারই হয়ে থাকুক না কেন, তা আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত। তাকদিরে লেখা না থাকলে সে কিছুই বুঝবে না, এমনকি যদি সকল সৃষ্টির অন্য কোন মত থাকেও।

এ বিষয়টি পবিত্র কুরআনে আল্লাহ’র বানীতেই ঘোষিত আছে –

“বলুন - আল্লাহ আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা ছাড়া অন্য কোন বিপদ আমাদের কাছে আসতে পারে না …” (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ :৫১)

“পৃথিবীতে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয় আসে, আমি তা সংঘটিত করার আগেই তা লিপিবদ্ধ থাকে …” (সূরাহ আল-হাদীদ, ৫৭ :২২)

হাদিসের এ অংশটি সকল গুণের মূল আর অন্য অংশগুলো হল এর গুণ।

একজন গোলাম যখন এটা জানে যে, সে আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদির ছাড়া অন্য কিছুর মোকাবিলা করবে না – হোক সেটা ভালো বা মন্দ, আর এটাও জানে যে, আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদির পরিবর্তনের জন্য সব মানুষের প্রচেস্টাও কোন উপকারে আসবে না; তবে সে তো এটাও জানবে যে, একমাত্র আল্লাহ’র কারনেই উপকার ও ক্ষতি ঘটে থাকে আর তিনিই তো সে সত্তা, যিনি দান করেন আর দান করা থেকে বিরতও থাকেন। আর এভাবেই, গোলাম তার সকল ইবাদাত একমাত্র আল্লাহ’র প্রতি পরিচালিত করবে আর তার আদেশ মেনে চলবে।

একজন গোলাম তো আল্লাহ’র ইবাদাত করে যেন সে তার স্বার্থ অর্জন করতে পারে আর নিজেকে মন্দ কিছু থেকে হেফাজত করতে পারে। এ কারনে আল্লাহ মূর্তি পূজারীদের নিন্দা করেছেন, যে মূর্তিগুলো কিনা তাদের পূজকদের কোন উপকার বা ক্ষতির ক্ষমতাই রাখে না।

 

দুর্দশার ক্ষেত্রে আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদিরের প্রতি ঈমানের দুটো মাত্রা রয়েছে।

প্রথমটি হল, আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদিরে সন্তুষ্ট থাকা, এটা খুবই উঁচু মর্যাদার, যেমনটি আল্লাহ বলেন –

“আল্লাহ’র অনুমতি ছাড়া কোন বিপদই আপতিত হয় না, আর যে (ব্যক্তি) আল্লাহ্‌কে বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন।” (সূরাহ আত-তাগাবুন, ৬৪ :১১)

আলকামা (রাঃ) বলেন, “এ আয়াত দিয়ে সেই ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে ব্যক্তি প্রত্যেক বিপদের সময় এ বিশ্বাস রাখে যে – সে বিপদ আল্লাহ’র পক্ষ থেকে এসেছে, এরপর সে সন্তুষ্ট চিত্তে সেটা সহ্য করে।”

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহ কাউকে ভালবাসলে তিনি তাদেরকে দুর্দশাগ্রস্ত করেন –সন্তুষ্টদের উপর তিনি খুশী হোন আর অসন্তুষ্টদের উপর রেগে যান।” (তিরমিযি – কিতাবুয যুহদ, হাদিস ২৩৯৬; ইবনে মাযাহ – কিতাবুল ফিতান, হাদিস ৪০৩১)

কোন ব্যক্তি এমন অবস্থায় পৌঁছলে তার জীবন হবে সুখী, যেমনটি আল্লাহ বলেছেন -

“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎ কাজ করবে, নিশ্চয়ই তাকে আমি (এ দুনিয়াতে সম্মান, সন্তোষ আর হালাল রিযক দেওয়ার মাধ্যমে) পবিত্র জীবন দান করবো …” (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ :৯৭)

একজন আলিম বলেছিলেন, “পবিত্র জীবন হলো সন্তুষ্ট (থাকা)।”

 

দ্বিতীয়টি হল, ব্যক্তির উপর বিপদ আপতিত হলে সবরের সাথে লেগে থাকা।

এই মাত্রাটি সে ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত, যে কিনা আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদিরে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না।

সন্তুষ্ট থাকা হল মুস্তাহাব (আকাঙ্ক্ষণীয়), কিন্তু সবরের সাথে লেগে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয। সবরের ফলে একজন মুসলিমের মধ্যে অতিরিক্ত গুণের উপস্থিতি ঘটে, আল্লাহ তাকে এটি অবলম্বনের আদেশ করেছেন, এমনকি তিনি এর জন্য মহা পুরস্কারের ওয়াদাও করেছেন, তিনি বলেছেন –

“সবরকারীদেরকে অগণিত পুরস্কার দেওয়া হবে।” (সূরাহ আয-যুমার, ৩৯ :১০)

 

সবর ও সন্তুষ্টির পার্থক্য

সবর ও সন্তুষ্টির মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, সবর হল কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সেটার ব্যাপারে অভিযোগ করা থেকে নিজেকে দমিয়ে রাখা আর একই সাথে সেটা অপসারিত হওয়ার আশাও রাখা। কষ্টের জবাব দেওয়া থেকে শরীরকে দমিয়ে রাখাও সবরের অন্তর্ভুক্ত।

সন্তুষ্টি হল আল্লাহ’র নির্ধারিত তাকদিরের সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা আর কষ্ট দূর হওয়ার আশা বর্জন করা। যদি কোন কষ্ট থাকে, তবে সন্তুষ্টির অনুভূতি সেটাকে সহনীয় করে তুলে, কারন সে অন্তর তো ঈমান ও আল্লাহ’র প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবিষ্ট হয়ে যায়। সন্তুষ্টির অনুভূতি বৃদ্ধি পেলে কষ্টের অনুভূতি পুরোপুরিই দূর হয়ে যেতে পারে।

 

বিজয় আসে সবরের সাথে

“সাহায্য তো সবরের সাথেই আসে” – এটি উভয় প্রকার জিহাদের বিজয়কেই ইঙ্গিত করে, এগুলো হল কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ আর নিজের খোশখেয়াল ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ, আর এটিই প্রথম প্রকার জিহাদ থেকে অধিকতর মহান।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “মুজাহিদ তো সে – যে কিনা আল্লাহ’র জন্যই নিজের উপর জিহাদ চর্চা করে (অর্থাৎ, নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে)।” (তিরমিযি – কিতাব ফাযাইল আল-জিহাদ, হাদিস – ১৬২১, ইমাম তিরমিযি বলেছেন এটি একটি নির্ভরযোগ্য হাদিস; মুসনাদে আহমাদ – হাদিস ৬/২০,২১,২২; সাহিহ ইবনে হিব্বান – হাদিস ৪৮৬২)

কোন ব্যক্তি সবর অবলম্বন করলে সে তার শত্রুদের উপর বিজয়ী হবে। কিন্তু সে সবর অবলম্বন না করলে হবে পরাজিত, তাকে কারাবন্দী করা হবে অথবা হত্যা করা হবে।

 

দুর্দশার পরই আসে সুখ

“দুর্দশার পরই আসে সুখ” – রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এ কথাটি পাওয়া যায় আল্লাহ’র এ বাণী থেকে –

“অবশেষে যখন রসূলগণ নিরাশ হলো আর লোকে ভাবলো যে, রসূলদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য আসলো ...” (সূরাহ ইউসুফ, ১২ :১১০)

আল্লাহ তার নবীদের অনেক কাহিনী বর্ণনা করেছেন যারা বিপদ ও দুর্দশায় ভুগেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে হেফাজত করেছিলেন। তিনি নূহ (আঃ) আর তার উপর ঈমান আনা মুমিনদের জাহাজে চড়িয়ে হেফাজত করেছিলেন, ইব্রাহীম (আঃ) কে রক্ষা করেছিলেন আগুন থেকে আর তার পুত্রকে কুরবানির আদেশ দেওয়ার পর সে পুত্রকে (এ পরীক্ষা বাস্তবায়িত হওয়া থেকে) মুক্তি দিয়েছিলেন (দুম্বা জবেহের দ্বারা), সমুদ্র থেকে মুসা (আঃ) ও তার অনুসারীদের হেফাজত করেছিলেন আর তাদের শত্রুদের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন, আইয়ুব (আঃ) ও ইউনুস (আঃ) কে হেফাজত করেছিলেন দুর্দশা থেকে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে গুহার ঘটনায়, বদর যুদ্ধে, ওহুদ যুদ্ধে, আহযাবের যুদ্ধে, হুনাইনের যুদ্ধে - বিভিন্ন সময়ে শত্রুদের থেকে হেফাজত করেছিলেন।

 

একটি কষ্ট দুটো স্বস্তির উপর জয়যুক্ত হতে পারে না

“কস্টের পরই রয়েছে স্বস্তি” - রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এ কথাটি পাওয়া যায় আল্লাহ’র এ বাণী থেকে –

“আল্লাহ কষ্টের পরই স্বস্তি দিবেন।” (সূরাহ আত-তালাক, ৬৫ :৭)

“কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। অবশ্যই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে।” (সূরাহ আশ-শারহ, ৯৪ :৫-৬)

একজন মুসলিমকে যখন চরমভাবে কোন কষ্ট পীড়িত করে আর সে একারনে হতাশ হয় যে দুনিয়ার কোন সৃষ্টিই তাকে সাহায্য করতে পারবে না, তখন সে আল্লাহ’র দিকেই ফিরে যায়। এটিই হল তাওাক্কুলের (আল্লাহ’র উপর ভরসা করার) যথার্থ সারমর্ম। আল্লাহ’র প্রতি ভরসা করাটাই তো ব্যক্তির প্রয়োজন মেটায়, যেমনটি আল্লাহ বলেছেন –

“যে ব্যক্তি আল্লাহ’র উপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট …” (সূরাহ আত-তালাক, ৬৫ :৩)

একজন মুসলিম যখন অনুভব করে যে তার কষ্ট থেকে সে পরিত্রাণ পাচ্ছে না আর এমনকি অনেক দুয়া করার পরও সেগুলোর জবাব না পাওয়ার কারনে সে হতাশ হয়ে পড়ে, তখন তার তো উচিত নিজেকে বলা যে – “আমার পাপের কারনেই আমি এ কষ্টে আছি। আমি যদি ভালো ব্যক্তি হয়ে থাকি, তবে আমার দুয়ার জবাব দেওয়া হবে।” নিজেকে এ ধরণের উপহাস করাটা আল্লাহ’র কাছে অনেক ইবাদাতের থেকেও অধিকতর প্রিয়, কারন এটা ইঙ্গিত করে যে গোলাম স্বীকার করছে তার নিজের পাপের কারনেই কষ্ট তাকে নিপীড়িত করেছে আর সে তার দুয়ার জবাব পাওয়ার যোগ্য না।

তার মাঝে এমন অনুভূতি আসলে তার দুয়ার জবাব দেওয়া হবে আর তার কষ্ট দূর করা হবে। এ প্রসঙ্গে অতীত কালের কিছু কবি বলেছেন, “যা তুমি দেখছো তা শেষ হবে না, আর তুমি এ সময়ের সর্বনাশ থেকে মুক্তি দেখতে পাবে। আল্লাহই পারেন এমন কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে, কারন আল্লাহই তো তার সৃষ্টির বিষয়গুলো নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যদি কোন কষ্ট দেখো, তবে স্বস্তির আশা করো। আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন যে প্রতিটি কষ্টের পরই স্বস্তি রয়েছে।”

 

হাদিস তাফসীরটি ইমাম ইবনে রজব আল-হানবালি (রাহিমাহুল্লাহ)’র কিতাব জামি’ আল উলুম ওয়াল হিকামের ইংলিশ ভার্সন থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-1L

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

The Greatest Nation

 

Notes

03

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

কুরআনের বাণীবাহকদের বৈপ্লবিক চরিত্র

 

 

The Greatest Nation·Friday, July 15, 2016  

 

 

 

ইসলামের বিপ্লবী জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যে কালেই হোক, যে ভূখণ্ডেই হোক – তা শুরু করতে হলে এ পথের মুজাহিদদেরকে অবশ্যই এর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এ জ্ঞানের একমাত্র উৎস হল মহাগ্রন্থ আল কুরআন। এ অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কুরআনই এক সময় এমন এক মানবগোষ্ঠী তৈরি করেছিলো যাদের তুলনা শুধু ইসলামের ইতিহাসে কেন, গোটা মানবজাতির ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই।

ইসলামী ইতিহাসের সেই সোনালি অধ্যায়ের পর আর কখনোই তাদের মতো যোগ্যতা ও গুনের সমাহার কোন মানবগোষ্ঠীর মাঝেই দেখা যায় নি। অবশ্য বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও কোথাও দু একজন মানুষের জন্ম হয়েছে, তবে তাদের মতো উচুমানের নৈতিক গুণসম্পন্ন কোন সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খলিত মানবগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেনি।

এটা এমনই এক প্রমাণিত ও বাস্তব ইতিহাস, যা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তাই বিষয়টির তাৎপর্য ও কারন সম্পর্কে আমাদের ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে এর রহস্য খুঁজে বের করতে হবে।

 

তাদের মতো সোনার মানুষ এখন আর নেই কেন ?

যে কুরআন সে যুগের জাহিলিয়্যাতের পঙ্কে নিমজ্জিত মানুষদেরকে আকাশের তারার মতো উদ্ভাসিত এক-একজন আলোকিত মানুষে পরিণত করেছিলো, সেই কুরআন তো আজও আমাদের সামনে অবিকৃত ও অবিকলভাবেই উপস্থিত রয়েছে, সে কুরআনের বাহক আল্লাহ’র নবী (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবনাদর্শ ও কর্ম পদ্ধতির বিস্তারিত ইতিহাসও আমাদের জানা।

এরপরেও বর্তমান পৃথিবীতে মুসলিম জাতির বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই কেন ? আমরা কি এ কথা বলতে পারি যে, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সশরীরে আমাদের মাঝে উপস্থিত নেই বলে আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না ? ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যদি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সশরীর উপস্থিতি এমন অপরিহার্যই হতো, তাহলে তো আল্লাহ ইসলামকে কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা বলে ঘোষণা দিতেন না।

মূলত এখন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সশরীর উপস্থিতির কোন প্রয়োজনও নেই, বরং কুরআনের বিদ্যমানতাই দ্বীন প্রতিষ্ঠার সকল উপায়-উপকরণ ও দিকনির্দেশনা সরবরাহের জন্য যথেষ্ট। তাই আল্লাহ তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জীবিত না রেখে পবিত্র কুরআন অবিকৃত ও বিকল রেখে হিফাজতের দায়িত্ব নিজ হাতেই তুলে নিয়েছেন।

আল্লাহ পবিত্র কুরআন এমনভাবে রচনা করেছেন যে, কিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভূত যে কোন ধরণের সমস্যার বাস্তব সমাধান এর মাধ্যমে সম্ভব। এজন্যই আল্লাহ তার হাবিব রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মাধ্যমে মানবজাতির কাছে এ কুরআন পৌঁছে দিয়ে তাকে (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের কাছে তুলে নিয়ে এ ঘোষণা দেন যে, এ কুরআন তথা ইসলাম মানবজাতির জন্য কিয়ামত পর্যন্ত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকর থাকবে। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শারীরিক অনুপস্থিতি এ দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে কোন অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারবে না।

 

প্রথম কারন

সাহাবীদের মতো মানুষ এখন না হওয়ার কারন খুঁজতে গেলে প্রথমে দেখা যাবে, তারা কুরআনের যে স্বচ্ছ, নির্মল, নির্ভেজাল ঝর্ণাধারা থেকে তাদের জ্ঞান পিপাসা মিটিয়েছেন, কালের আবর্তনে সেই ঝর্ণাধারার সাথে অনেক ভেজাল মিশে গেছে। পুঁথিগতভাবে এসবের কিছুই মূল কুরআনের সাথে যুক্ত হয়নি, কিন্তু মানুষের চিন্তা চেতনায় ওইসব ভেজালের প্রভাব আমরা এখন অস্বীকার করতে পারি না।

যে ঝর্ণাধারা থেকে সে যুগের সোনার মানুষেরা তাদের জ্ঞান পিপাসা মেটাতেন, সঞ্জীবনীশক্তি গ্রহণ করতেন, পাথেয় সংগ্রহ করতেন তা হল পবিত্র কুরআন। কারন হাদিস বলতে আমরা যা বুঝি, তা মূলত কোন উৎস বা ঝর্ণাধারা নয়, বরং তা তো ওই কুরআনী ঝর্ণারই স্রোতধারা। তাই আমরা দেখতে পাই, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চরিত্র কেমন ছিল ?” – এ প্রশ্নের জবাবে উম্মুল মু’মিনিন আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, “কুরআনই তো তার চরিত্র।”

মহাগ্রন্থ আল কুরআন থেকেই সাহাবীরা তাদের প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ গ্রহণ করতেন। তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে কুরআনের ছাঁচে গড়ে তুলেছিলেন।

কথা হলো – কেন তারা কুরআনকে এভাবে গ্রহণ করতেন ? অন্য কোন সভ্যতা, সাহিত্য, শিক্ষাকেন্দ্র, বিদ্যাপীঠ ইত্যাদি না থাকার কারনে বাধ্য হয়েই কি তারা কুরআনকে এমন পরম ভাবে গ্রহণ করেছিলেন ? না, কিছুতেই নয়, এটা কখনোই সত্য নয়।

প্রকৃত ইতিহাস খুঁজলে আমরা দেখতে পাবো, সে সময়ের রোমান সভ্যতা ও রোমান আইনশাস্ত্রকে আজও ইউরোপে সভ্যতার আদি মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে যুগের গ্রীক যুক্তিবিদ্যা গ্রীক দর্শন, আর্টসহ সাহিত্যকে আজও পাশ্চাত্যে উন্নত চিন্তাধারার অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পারস্য সভ্যতা, তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও সে যুগে অত্যন্ত সুগঠিত ও ঐতিহ্যবাহী হিসেবে সুপরিচিত ছিলো। আরবের নিকটে ও দূরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আরো অনেক সভ্যতা তখন বিদ্যমান ছিলো – তাতে চীন ও ভারতের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরবের উত্তরে ছিল রোমান সভ্যতার কেন্দ্রভূমি, আর দক্ষিনে ছিল পারস্য সভ্যতা।

তাই একজন সুস্থ চিন্তার মানুষ এ কথা বলতে পারে না যে - সাহিত্য, সভ্যতা ও সুগঠিত কোন ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারনে সে যুগের মুসলমানেরা (সাহাবীরা) কুরআনকে তাদের একমাত্র জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তারা অনেক ভেবেচিন্তে, বুঝেশুনে বিদ্যমান সব ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে কুরআনকেই তাদের জীবনবিধান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তাওরাতের অংশবিশেষ নিয়ে উমার (রাঃ) এর রসুলুল্লাহ (সালাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে আসার ঘটনাটি আমাদেরকে আরো সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়। তাওরাতের কপি আনতে দেখে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) অসন্তুষ্ট হয়ে উমার (রাঃ) কে বলেছিলেন, “আল্লাহ’র কসম, আজ যদি স্বয়ং মুসাও জীবিত থাকতেন, তাহলে আমার আনুগত্য তার উপরেও ফরয করে দেওয়া হতো।”

এ ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায়, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন দেওয়ার জন্য একমাত্র কুরআনিক নির্দেশনাই কাজে লাগিয়েছেন। কুরআনের বিশুদ্ধ ঝর্ণাধারা থেকেই জ্ঞান পিপাসা মেটানোর আদেশ দিয়েছেন। সুস্পষ্টভাবে তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এ কুরআনের জন্যই জীবন উৎসর্গ করতে হবে আর এ কুরআনের শিক্ষা অনুসারেই জীবন গড়ে তুলতে হবে।

এ কারনে দেখা যায়, ঐশী কিতাব হওয়া সত্ত্বেও তাওরাতের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কারণে উমার (রাঃ) এর প্রতি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) অসন্তুস্টি প্রকাশ করেছিলেন। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর একমাত্র চাওয়া পাওয়াই ছিল এমন একটি সুসংগঠিত, সুসঙ্ঘবদ্ধ মানবগোষ্ঠী গড়ে তোলা – যারা হবে সব ধরণের হীনমন্যতা, কলুষতা ও পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত; যারা হবে সম্পূর্ণই আল্লাহ’র রঙে রঞ্জিত একটি বিপ্লবী মানবগোষ্ঠী। আর আল্লাহ’র রঙে রঞ্জিত হতে হলে বিশুদ্ধ কুরআনি প্রশিক্ষন ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। কারন এ কুরআন তো সেই মহাগ্রন্থ, যার মাধ্যমে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন সরাসরি তার বান্দাদেরকে প্রশিক্ষন দান করেন।

আমাদের সবারই জানা আছে, সে মহাভাগ্যবান সোনার মানুষেরা স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের জীবন-মরন সবকিছু এ কুরআনী প্রশিক্ষনের লক্ষ্যে বিলীন করে দিয়ে নিজেদেরকে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ আসনে সমাসীন করেন। পরবর্তী যুগের মানুষেরা এদিক থেকে প্রায় বঞ্চিত আর বিমুখ।

সেই সোনালি যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এ পথের পরিচ্ছন্ন স্রোতধারার সাথে কিছু ভেজাল মিশে যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – গ্রীক দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা, প্রাচীন উপকথা, ইহুদীদের মুখরোচক রুপকথা (ইস্রায়েলি বর্ণনা), খ্রিস্টানদের কাছে রক্ষিত আসমানী কিতাবের বিক্ষিপ্ত ও বিকৃত কিছু অংশ ইত্যাদি। পরবর্তীকালের মুফাসসিরিনগণ এসব বিষয়গুলোকে তাদের স্থূল পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার অংশে পরিণত করেন। ফলে অবাঞ্ছিত এ বিষয়গুলো কুরআনী স্রোত ধারার সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। এ কারনেই পরবর্তী বংশধর বঞ্চিত হয় কুরআনের নির্ভেজাল জ্ঞান থেকে।

এর স্বাভাবিক পরিণত হল – পরবর্তী বংশধরের মাঝে সাহাবীদের মতো চরিত্র ও গুণসম্পন্ন কোন মানুষ বা মানবগোষ্ঠী গড়ে উঠেনি। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সোনালি যুগের সোনালি মানুষদের সাথে চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও গুণগত মানের দিক থেকে পরবর্তীকালের মানুষের যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে, এটিই হল এর প্রধান কারন। এ কারনেই বিক্ষিপ্তভাবে দুই-একজন মানুষ বিভিন্ন যুগে জন্ম নিলেও সমষ্টিগতভাবে সাহাবীদের মতো কোন মানবগোষ্ঠী পরবর্তীকালে গড়ে উঠেনি। উপরন্তু বিভিন্ন ধরণের অবাঞ্ছিত ও বাতিল সংমিশ্রণের ফলে যেসব মনগড়া ইলম তৈরি হয় তাতে ইসলামের আসল রূপ চেনা কঠিন হয়ে পড়ে।

 

দ্বিতীয় কারন

এ ব্যাপারে আরো একটি কারণ আমরা কোনভাবে অবহেলা করতে পারি না। কারণটি বের করতে হলে আমাদের দেখতে হবে প্রথম যুগের মানুষদের (সাহাবীদের) জীবনে কুরআনের সাথে তাদের সম্পর্কের ধরণ কি ছিল ? কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি কি ছিল ?

এক্ষেত্রে পরবর্তীকালের মানুষদের সাথে প্রথম যুগের মানুষদেরর সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল - সাহাবীরা কখনোই হাফেয, মাওলানা, ক্বারী, ইমাম, খতীব, মোল্লা, মৌলভী ইত্যাদি হওয়ার জন্য কুরআন পড়েননি; কিংবা নিছক পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান অর্জন, বৈজ্ঞানিক তথ্যের মূলসূত্র অনুসন্ধান, আইনশাস্ত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ – এক কথায় নিছক বুদ্ধিবৃত্তির কোন প্রয়োজন বা চাহিদা মেটানোর জন্য কুরআন পড়েননি; বরং বাস্তব জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহ রব্বুল আলামীন কোন বিষয়ে কি বিধান নাযিল করেছেন, তা জেনে সেভাবে জীবন পরিচালনার জন্যই তারা কুরআন পড়তেন।

যুদ্ধের ময়দানে একজন সৈনিক যেভাবে কম্যান্ডারের প্রতিটি হুকুম জীবনবাজি রেখে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, ঠিক তেমনিভাবে সাহাবীরাও কুরআনের প্রতিটি নির্দেশ পালন করতেন। এমন ঘটনাও রয়েছে, কেউ কেউ দশটি আয়াতের বেশী একসাথে পড়তেন না। কারন তারা জানতেন, একসাথে অনেকগুলো বিধি-নিষেধের বোঝা বহন করা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর একটি বর্ণনার মাধ্যমে এ তথ্যটি আমরা জানতে পারি।

কুরআনের বিধান এসেছে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা জন্য – এ চেতনাই তাদের নৈতিক উন্নতি ও বাস্তবমুখী জ্ঞানের পথ সুগম করে দিয়েছিলো। তারা যদি নিছকই পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান অর্জন, তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ, কিংবা হাফেয, মাওলানা, ক্বারী, খতীব ইত্যাদি নাম ধারণের জন্য কুরআন অধ্যয়ন করতেন, তবে এ নৈতিক উন্নতির পথে তারা অগ্রসর হতে পারতেন না।

তাছাড়া, কুরআন এসেছে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য – এ উপলব্ধিই তাদেরকে কুরআনের বিধি-বিধান জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ করে দিতো। ফলে তারা চালচলন, আচার-আচরণ, লেনদেন তথা সার্বিক জীবনে কুরআনকে এমনভাবে বাস্তবায়ন করতেন, যে কারণে তারা কুরআনের এক একটি বাস্তব দৃষ্টান্তে পরিণত হতেন।

তাদের কাছে ঈমান কোন পাণ্ডিত্যের জটিল বাক্য বা কুটিল সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত বিষয় ছিল না, সেটা না ছিল বই পুস্তকে লেখা নিছক জ্ঞানগর্ভ আলোচনার বিষয়, আর তা ছিল না শুধু অন্তরে ধারণকৃত নিছক উপলব্ধির ব্যাপার; বরং ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক তথা সার্বিক জীবনের আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত একটি বৈপ্লবিক আন্দোলনের নাম ছিল ঈমান।

কুরআনের হুকুম-আহকাম যারা নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অধ্যয়ন করে না, কুরআন কখনোই তাদের জন্য লুক্কায়িত জ্ঞানভাণ্ডার খুলে দেয় না। কুরআনকে যারা নিছক পুঁথিগত তাত্ত্বিক আলোচনা, একই শব্দের বিভিন্ন অর্থবোধক এক অসাধারণ গ্রন্থ, সাহিত্য চর্চা, পৃথিবীর আদি ইতিহাস জানার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র কিংবা কেবলই সুর করে পড়ার একটি কিতাব হিসেবে গ্রহণ করে, তারা কুরআনের সাথে যথার্থ আচরণ করেন না। কুরআন এমন কোন কিতাব নয়।

কুরআন একটি জীবন্ত ও সার্বজনীন জীবনবিধান। কুরআনী আইন জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে মানুষ আল্লাহ’র দরবারে সর্বাত্মক আত্মসমর্পণ করবে – কুরআন তো এজন্যই এসেছে। এ কারনেই আল্লাহ সমগ্র কুরআন এক সাথেই নাযিল করেননি, বরং প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে অল্প অল্প করে ধাপে ধাপে নাযিল করেছেন।

“আমি কুরআনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছি, যাতে তুমি ক্রমে ক্রমে তা মানুষের সামনে পড়তে পারো, আর (এ কারনেই) আমি তা পর পর নাযিল করেছি।” (সূরাহ বনী ইসরাইল, ১০৬)

ক্রমবিকাশমান ইসলামী সমাজের নতুন নতুন সমস্যার প্রেক্ষিতে, মানুষের চিন্তাচেতনার পরিবর্তনের ধারার সাথে সঙ্গতি রেখে, সমাজজীবনের পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পর্যায়ক্রমে কুরআন নাযিল হয়েছে। কোন কোন বিশেষ ঘটনা, বিশেষ প্রশ্নের জবাব কিংবা বিশেষ পরিস্থিতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জরুরী দিক নির্দেশনা সহ এক বা একাধিক আয়াত নিয়ে বিভিন্ন সময় আল্লাহ’র দূত জিবরাঈল (আঃ) এসেছেন। বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে মানুষের মনে উদিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও ছিল কুরআনের একটি বিশেষ দিক। মানুষের জীবনে যেসব দোষ-ত্রুটি, ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে, সেগুলোকে হাতে কলমে ধরিয়ে দিয়ে তা সংশোধনের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহ’র ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণের কথা বলতে কুরআন এসেছে।

এ কারনেই সে সময়ের মুসলমানরা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাদের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি চিন্তা সৃষ্টিকুলের মালিক আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সার্বক্ষণিক তদারকিতেই সংঘটিত হচ্ছে আর তাদের প্রতিটি মুহূর্তই আল্লাহ’র রহমতের ছায়ায় অতিবাহিত হচ্ছে। দয়াময় আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাথে গভীর ও সার্বক্ষণিক সম্পর্কের অনুভুতিই তাদেরকে আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার অদম্য সাহস ও আগ্রহ যুগিয়েছিলো।

এভাবেই সোনালি যুগের সোনার মানুষেরা নিজেদের জীবন কুরআনিক ছাঁচে গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু খুবই দুঃখজনক হলেও সত্য, পরবর্তী কালের মুসলমানরা কুরআনকে নিছক জ্ঞানগর্ভ তাত্ত্বিক আলোচনা, বিজ্ঞানের তথ্যসূত্র, তর্ক বিতর্ক, ফিকহি জটিলতার দুর্ভেদ্য জাল, সেমিনার, সিম্পেজিয়াম ও কেবলই ওয়াজ-মাহফিলের বিষয়ে পরিণত করে ফেলে।

এ কারনেই কুরআন অবিকৃত অবস্থায় উপস্থিত থাকা এবং কুরআনের যথেষ্ট পাঠ হওয়ার পরও সে ধরণের আদর্শ সমাজে গড়ে উঠেনি।

 

তৃতীয় কারন

তৃতীয় যে কারণটি আমরা খুঁজে পাই সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ - রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময়ে যে ব্যক্তি কুরআনের ছায়াতলে আসতেন, তিনি আগের জাহেলি জীবন ও জাহেলি সমাজব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্ক ছিন্ন করেই আসতেন; কুরআনের ছায়াতলে এসে তিনি সম্পূর্ণ নতুন জীবন শুরু করতেন।

জাহেলি সমাজের সদস্য থাকায় তিনি যে পাপ-পঙ্কিল পথে চলেছেন সেজন্য হৃদয়ের গভীর থেকে প্রচন্ড অনুতাপ-অনুশোচনা বোধ করতেন। কোন অবস্থাতেই যে আর জাহেলি সমাজ ও তার নেতৃত্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা যাবে না – তা পূর্ণ মাত্রায় বিশ্বাস করতেন। মানবীয় দুর্বলতার কারণে, জীবনের কোন ঘূর্ণিপাকে বা কোন প্ররোচনায় পড়ে যদি ভুল করে কোনরকম জাহেলি আচরণ করে ফেলতেন, তবে সাথে সাথেই অনুতাপ অনুশোচনায় উৎকণ্ঠিত ও অনুতপ্ত হয়ে উঠতেন এবং একটুও দেরী না করে কুরআনের ছায়ায় আশ্রয় নিতেন।

এভাবেই ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে একজন মানুষের জীবনযাত্রার গতি জাহেলিয়্যাত থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করে কুরআনমুখী হয়ে যেতো। জাহেলিয়্যাত থেকে সম্পর্কচ্ছেদ ও কুরআনী বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ এ কারনেই তাদের পক্ষে সম্ভব হতো যে, তারা ভেবে চিন্তে, বুঝেশুনে, মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পথে নিজেকে কুরবানি করে দেওয়ার মানসিকতা নিয়েই ইসলামে প্রবেশ করতেন।

অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, তারা মুশরিকদের সাথে লেনদেন, বেচাকেনা, দেখা-সাক্ষাৎ সবকিছু বন্ধ করে জঙ্গলে চলে যেতেন। কেননা, বৈষয়িক সম্পর্ক ও আদর্শিক ঐক্যবদ্ধতা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো বিষয়। জাহেলি সমাজ ও তাদের চিন্তাচেতনার সাথে সম্পর্কচ্ছেদের মূল অর্থ হলো শিরকবাদী সমাজ ও আদর্শের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে তাওহীদ ভিত্তিক জীবনাদর্শ গ্রহণ ও নতুন ইসলামী সমাজের আনুগত্য মেনে নেওয়া। ইসলাম গ্রহণের অর্থই ছিল এক নতুন জীবনবিধানের সাথে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং সকল প্রকার অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে উঠে এসে এক আলোকিত জীবনে পদার্পণ করা।

ইচ্ছে করলেই যে কেউ এ আলোকিত জীবনের পথে পা বাড়াতে পারতো, জাহেলিয়্যাত থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারতো – এমনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। ইসলামের পথে পা বাড়াবার অর্থই ছিল জাহেলি সমাজের নিষ্ঠুর ও নির্মম যুলুম-নির্যাতনের শিকার হওয়া। কেউ এ পথে অগ্রসর হলেই তার উপর নেমে আসতো চরম অত্যাচার। এতদিনের ঘনিষ্ঠ পরিচিত আপনজনরাও হঠাৎ হয়ে উঠতো অন্য চেহারার মানুষ। বহুদিনের পরিচিত সমাজ, হাট-ঘাট সবকিছু তাদের উপর সংকুচিত হয়ে আসতো। চতুর্মুখী বিভীষিকাময় নির্যাতন ও আগ্রাসনের মুখে পড়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই এ পথে তারা অগ্রসর হতেন। এমনকি মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে এ সোনার মানুষেরা সত্যকে গ্রহণ করেছেন। কোন কিছুই তাদের সংকল্পে সামান্য ফাটলটুকু পর্যন্ত ধরাতে পারেনি।

 

আমাদের অবস্থান ও করণীয়

মুষ্টিমেয় যে সব ব্যক্তিকে আল্লাহ হিফাযত করেছেন, তারা ছাড়া বর্তমান বিশ্বের সামগ্রিক সমাজব্যবস্থা আজ জাহেলিয়্যাতের পঙ্কে নিমজ্জিত।

আরো ভয়ংকর ব্যাপার তো এই যে - তৎকালীন জাহেলিয়্যাতের রূপ ছিল খোলামেলা ও প্রকাশ্য, যা চিহ্নিত করা তেমন কঠিন বিষয় ছিল না। কিন্তু বর্তমান জাহেলিয়্যাত খুবই জটিল ও কুটিল, যা সাধারণ মানুষ তো দুরের কথা, আলিমগণও এর স্বরূপ উদঘাটন করতে সক্ষম হচ্ছেন না, বরং অনেকক্ষেত্রে তারাও এর আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন।

আমাদের চিন্তা-চেতনা, রীতিনীতি, চালচলন, তথা সমাজনীতি, রাজনীতি ও সামগ্রিক সমাজব্যবস্থা জাহেলিয়্যাতের ঘোর আধারে নিমজ্জমান। এমনকি সমাজের অধিকাংশ মানুষ যেসব কার্যাবলীকে ইসলামী সংস্কৃতি, সভ্যতা ও আকিদা-বিশ্বাস বলে পালন করে – তার অধিকাংশই জাহেলিয়্যাত দিয়ে পরিপুষ্ট। এ জাহেলিয়্যাত মিশ্রিত ইসলাম লালনপালনের কারনেই আমাদের মন মগজে ইসলামের সঠিক সঠিক চেতনা জাগছে না এবং সমাজে সঠিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটছে না।

সুতরাং, আমরা যদি দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করতে চাই, তাহলে সমাজের সব রকম জাহেলিয়্যাত থেকে মুক্ত হতে হবে, জাহেলিয়্যাত থেকে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে এবং ষড়যন্ত্রমূলক জ্ঞান গবেষণা বর্জন করতে হবে। বিশুদ্ধ জ্ঞানের উৎস আল কুরআন ও রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সালাম) এর সুন্নাতের নির্দেশনা ও প্রেরণা নিতে হবে। এ উৎস থেকেই সৃষ্টিলোকের প্রকৃতি এবং একচ্ছত্র সার্বভৌম স্রস্টার সাথে মানবজাতি ও অন্যান্য সৃষ্টির সম্পর্ক কি, তা নির্ণয় করতে হবে আর এ উৎস থেকেই জানতে হবে আমাদের সমাজ, সরকার ও দেশ পরচালনার নিয়মকানুন।

ভ্রান্তিপূর্ণ তাত্ত্বিক আলোচনা, বাহাস-মোবাহাসা, তর্কবিতর্ক কিংবা বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে নয়, বরং ‘আল্লাহ’র নাযিল করা বিধান জেনে আমরা সেই অনুযায়ী জীবনযাপন করবো’ – এ উদ্দেশ্যেই কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে। কুরআন আমাদেরকে যেমন ছাঁচে গড়তে চায়, আমরা নিজেদেরকে তেমন ছাঁচেই গড়ে তুলবো।

এ দিকগুলো যদি আমরা যথাযথ বজায় রাখতে পারি তবেই আমরা কুরআনের ভাষাশৈলী, সাহিত্য সৌন্দর্য, উপস্থাপনরীতি, সম্মোহনীশক্তি, বৈজ্ঞানিক তথ্য ইত্যাদি সম্পর্কে গবেষণা চালানোর নীতিগত অধিকার অর্জন করি। মনে রাখতে হবে, আমরা এগুলোর মাধ্যমে জীবন চলার পথে অনেক সহযোগিতা ও কল্যাণ পেতে পারি, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ঠিক না রেখে শুধু এ ধরণের গবেষণা করাটা কুরআনের মূল উদ্দেশ্য হতে পারে না।

কুরআন থেকে আমাদের জানতে হবে আল্লাহ আমাদের জন্য কোন ধরণের জীবনবিধান দিয়েছেন, সৃষ্টিজগতের সাথে আমাদেরকে কেমন সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন, কোন ধরণের নীতি-নৈতিকতা, চালচলন, আচার-ব্যবহার শিক্ষা দিয়েছেন আর সামগ্রিকভাবে বিশ্বমানবতার জন্য কোন ধরণের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছেন।

এ বাস্তব অনুশীলনের সাথে সাথে বর্তমান সমাজের সব ধরণের জাহেলি চিন্তাধারা ও সামাজিক রীতিনীতি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে হবে। বিদ্যমান জাহেলি সমাজের প্রতিষ্ঠিত জাহেলি নেতৃত্বের সাথেও সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। কেননা, যে ব্যক্তি ইসলামের পবিত্র সুশীতল ছায়াতলে জীবনযাপন করতে চায়, সে কখনোই জাহেলি সমাজ ও তার পৃষ্ঠপোষক নেতৃত্বের সাথে আপোষমূলক সহাবস্থান করতে পারে না। জাহেলিয়্যাত্রে সাথে আপোষ করে তাকে খুশী রেখে তার অধীনে জীবনযাপন করা কোন কিছুতেই তার পক্ষে সম্ভব নয়।

এ সমাজ ও বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নিজের জীবনের আমুল পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেহেতু বিক্ষিপ্ত আর সামান্য কোন পরিবর্তন নয় বরং সমাজ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন, তাই আমাদেরকে গোঁড়া থেকেই এ পরিবর্তন সাধনের প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। কারন, যে ভ্রান্ত মতবাদের উপর ভিত্তি করে এ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানে জাহেলিয়্যাত নির্ভর মতবাদ থাকার কারণে সমাজের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে এ জাহেলিয়্যাতের প্রভাব পড়ছে এবং বিভিন্ন ধরণের অপব্যাখ্যা, ধোঁকা, প্রতারণা, মিথ্যাচার ও ক্ষেত্রবিশেষে পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমেও সমাজের মানুষের উপর এ ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত জাহেলি নেতৃত্বের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই জনসাধারণকে আল্লাহ’র দেওয়া জীবনবিধানের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।

এ সমাজ পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমরা নিজেদেরকে জাহেলি সমাজ ও এর চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধ থেকে মুক্ত করবো।

আর মনে রাখতে হবে, আমরা কোন অবস্থাতেই জাহেলি সমাজের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের সাথে আপোষ করার জন্য আমাদের আদর্শে ও মূল্যবোধে কোনরকম নমনীয়তা প্রদর্শন করতে পারবো না।

ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের গন্তব্য আর জাহেলি সমাজের গন্তব্য সম্পূর্ণই বিপরীতমুখী। আমরা যদি কোন অজুহাত দেখিয়ে তাদের সাথে তাল মিলিয়ে একই পথে চলতে শুরু করি, তবে আমরা কখনোই আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে পোঁছাতে পারবো না।

যথেষ্ট ভেবেচিন্তে, বুঝেশুনে এ রক্তপিচ্ছিল পথে আমাদের পা বাড়াতে হবে। কেননা, এটি তো ইতিহাদের এক মহাসত্য যে, এ পথে যখনই কেউ পা বাড়িয়েছে, তখন হাজারো বাধাবিপত্তি, দুঃখকষ্ট, জুলুম-নির্যাতন তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

সর্বোচ্চমানের আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত যারা দেখাতে পেরেছেন, সেই জানবাজ মাযলুমদের মাধ্যমে আল্লাহ জাহেলিয়্যাতের মূলোৎপাটন করে তার দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেছেন। মনে রাখতে হবে, তাদের সে সংগ্রাম আর আমাদের সংগ্রাম এক ও অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। সুতরাং, বাধাবিপত্তি আর জুলুম নির্যাতনের মুখে পিছিয়ে গেলে কখনোই এ সংগ্রাম সফলতার মুখ দেখবে না। যে রক্তপিচ্ছিল পথ আমরা বেছে নিয়েছি, সে সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে।

কোন পথে আমরা যাত্রা শুরু করলাম, কোথায় আমাদের গন্তব্য, জাহেলিয়্যাতের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে ইসলামের আলোকিত রাজপথে পৌঁছুতে কোন কোন অন্ধগলি আমাদের অতিক্রম করতে হবে, এ আলোকিত রাজপথের মিছিলে এর পূর্বে যারা চলেছেন তার কিভাবে সফলতা অর্জন করেছিলেন – এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নিয়েই আমাদেরকে এ মিছিলে শামিল হতে হবে।

 

সূত্রঃ মা’লিম ফিত-তারিক (সাইয়েদ কুতুব)

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-1E

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাদিস তাফসীর হাদিসে জিব্রাইল

 

 

The Greatest Nation·Friday, July 15, 2016

 

 

 

 

উমর বিন আল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ একদিন আমরা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে বসে ছিলাম, তখন আমাদের সামনে এক ব্যক্তি উপস্থিত হলেন যিনি অত্যন্ত সাদা কাপড় পরিহিত ছিলেন, তার চুল ছিল প্রচণ্ড কালো। তার মধ্যে সফরের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছিলো না আর আমাদের কেউই তাকে চিনতাম না।

তিনি অগ্রসর হয়ে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সামনে এসে নিজের দুই হাঁটু রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দুই হাঁটুর সাথে মিলিয়ে দিলেন এবং তার দুই হাতের তালু তার [(সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বা নিজের ]দুই উরুর উপর রাখলেন আর বললেন, “হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম), আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন।” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “ইসলাম (অর্থাৎ এর স্তম্ভ) হল এই যে – (১) আপনি সাক্ষ্য দিবেন আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তার রসুল, (২) সালাত কায়েম করবেন, (৩) যাকাত আদায় করবেন, (৪) রামাদান মাসের সিয়াম পালন করবেন এবং (৫) আল্লাহ্‌র ঘরে হজ করার সামর্থ্য থাকলে হজ পালন করবেন।” প্রশ্নকারী বললেন, “আপনি সত্য বলেছেন।”

উমর বিন আল খাত্তাব (রাঃ) বলেন, “এই নবাগত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করতে ও উত্তরকে সত্য ও সঠিক বলে ঘোষণা করতে দেখে আমরা খুবই অবাক হলাম।”

সেই ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন।” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেন, “ঈমান হল এই যে, আপনি আল্লাহ্‌কে, তার ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবসমুহকে, নবী রসুলদেরকে ও বিচার দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করবেন এবং তাকদীরকে বিশ্বাস করবেন – তা ভালো বা মন্দ হোক।” সে ব্যক্তি বললেন, “আপনি সত্য বলেছেন।”

এরপর সেই ব্যক্তি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন।” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “ইহসান হল এটি যে, আপনি এমনভাবে আল্লাহ্‌র ইবাদাহ করবেন যেন আপনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন, যদিও আপনি তাকে (দুনিয়াতে) দেখতে পাবেন না তবে (জেনে রাখুন) তিনি আপনাকে দেখছেন।”

সেই ব্যক্তি এবার জানতে চাইলেন, “কিয়ামত কবে হবে আমাকে সে সম্পর্কে বলুন।” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারী অপেক্ষা বেশী জানে না।”

সেই ব্যক্তি এরপর বললেন, “আমাকে আপনি এর কিছু নিদর্শন বলুন।” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “দাসী তার নিজের কর্ত্রী (অথবা কর্তা) কে জন্ম দিবে, আর আপনি দেখবেন যে নগ্নপদ বিশিষ্ট নিঃস্ব ছাগলের রাখালেরা একে অপরের সাথে বিশাল বিশাল ভবন তৈরিতে প্রতিযোগিতা করবে।”

বর্ণনাকারী (উমর বিন আল খাত্তাব) বলেন, “এরপর সে (জিজ্ঞাসাকারী ব্যক্তি) তার পথে চলে গেল কিন্তু আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে অনেকক্ষণ ধরে অবস্থান করলাম।”

পরে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন, “উমার, তুমি কি জান জিজ্ঞাসাকারী ব্যক্তিটি কে ছিলেন ?” আমি জবাব দিলাম, “আল্লাহ এবং তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ই সবচেয়ে ভাল জানেন।”

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তিনি ছিলেন জিব্রাইল। তিনি তোমাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমাদের কাছে এসেছিলেন।” (মুসলিম - কিতাবুল ঈমান, হাদিস ১/৮)

 

উপরোক্ত হাদিসটি শুধুমাত্র মুসলিমেই বর্ণিত আছে। তবে আবু হুরায়রা (রাঃ) এর বর্ণনাটি বুখারি ও মুসলিম উভয় কিতাবেই বর্ণিত আছে যা নিন্মরুপঃ

 

একদিন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবারা বসে ছিলেন এমন সময় এক ব্যক্তি তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “ঈমান কি ?” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “ঈমান হল এটা যে আপনি বিশ্বাস স্থাপন করবেন আল্লাহ, তার ফেরেশতাগণ, তার কিতাবসমূহ, তার সাথে সাক্ষাত, তার নবী-রসুলগণ এবং পরকালে পুনরুত্থানের উপর।”

সে ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, “ইসলাম কি ?” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “ইসলাম হল এটাই যে আপনি আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করবেন না, সালাত কায়েম করবেন, যাকাত আদায় করবেন এবং রামাদান মাসে সিয়াম পালন করবেন।”

সে ব্যক্তি এরপর জিজ্ঞেস করলেন, “ইহসান কি ?” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “ইহসান হল এটি যে, আপনি এমনভাবে আল্লাহ্‌র ইবাদাত করবেন যেন আপনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন, যদিও আপনি তাকে (দুনিয়াতে) দেখতে পাবেন না তবে (জেনে রাখুন) তিনি আপনাকে দেখছেন।”

সেই ব্যক্তি এবার জানতে চাইলেন, “কিয়ামত কবে হবে আমাকে সে সম্পর্কে বলুন।” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারী অপেক্ষা বেশী জানে না। তবে আমি আপনাকে এর লক্ষণগুলো বলতে পারি। এর একটি নিদর্শন হল, দাসী তার নিজের কর্ত্রী (অথবা কর্তা) কে জন্ম দিবে। এর আরেকটি নিদর্শন হল, যখন আপনি দেখবেন নগ্নপদ বিশিষ্ট লোকেরা জনগনের নেতা হবে, আর যখন কালো উটের রাখালেরা গর্ব-অহংকার আর একে অপরের সাথে সুদীর্ঘ ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতা শুরু করবে, এটি কিয়ামতের অন্যতম লক্ষন; এবং কেয়ামতের সময়ের ব্যাপারে জ্ঞান হল সেই পাঁচটি বিষয়ের একটি যার ব্যাপারে কেবল আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না।”

এরপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তিলাওয়াত করলেনঃ

 

إِنَّ اللَّـهَ عِندَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًا ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ ۚ إِنَّ اللَّـهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ﴿٣٤﴾

“নিঃসন্দেহে কেবল আল্লাহ্‌রই কেয়ামত সম্পর্কে জ্ঞান রয়েছে, তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি তা জানেন যা জরায়ুতে আছে, কেউই বলতে পারে না আগামীকাল সে কি অর্জন করবে, না কেউ জানে যে কোন স্থানে সে মৃত্যুবরণ করবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবই জানেন, তিনি সব বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে অবগত।” (সূরা লুকমান, ৩১ : ৩৪)

 

এরপর সেই জিজ্ঞাসাকারী ব্যক্তি চলে গেলেন এবং রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন (সাহাবীদেরকে), “সেই ব্যক্তিকে আমার কাছে নিয়ে এসো।”

কিন্তু যখন তারা সেই ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য গেলেন, তখন তারা সেই ব্যক্তির কোন চিহ্ন পেলেন না।

এরপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তিনি ছিলেন জিব্রাইল। তিনি লোকদেরকে তাদের দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছিলেন।”

(বুখারি - কিতাবুল ঈমান, হাদিস নং ৫০; মুসলিম - কিতাবুল ঈমান, হাদিস নং ৫/৯)

 

এই হাদিসের গুরুত্ব

এই হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারন এই হাদিসটি দ্বীনের প্রত্যেক বিশেষ অংশের একটি ব্যাপক ব্যাখ্যা। ইসলাম, ঈমান ও ইহসানের তিনটি স্তর ব্যাখ্যার পর তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের সবগুলোকে একত্রে একটি একক দ্বীন হিসেবে হাদিসের শেষে এই বলে উল্লেখ করেছেন - “ইনি ছিলেন জিব্রাইল, যিনি তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিখাতে এসেছিলেন।”

এভাবে এই হাদিসটিতে ইসলামিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সমস্ত শাখা অন্তর্ভুক্ত হল, যেমনি করে এটি ফিকহ,আকিদাহ, যুহদ, আত্মা কোমলকারী বিষয়, সৎ আমল এবং ইসলামিক জ্ঞান – এসবের মৌলিক বিষয়ও ঘিরে রেখেছে।

 

ইসলামের অর্থ

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামকে ব্যাখ্যা করেছেন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ দ্বারা সম্পাদিত বাহ্যিক কাজকে, অর্থাৎ কথা ও আমলকে। এসব কাজের প্রথমটি হল মৌখিক – আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্‌র রাসুল - এটা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা। এই ঘোষণার দেওয়ার পর একজন মুসলিমের উপর যা করা ফরয তা হল সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রামাদানে সিয়াম পালন করা এবং সামর্থ্য থাকলে হজ করা।

 

ইসলামকে প্রদত্ত শ্রেণীগুলোতে ভাগ করা হয়েছেঃ

(১) শরীরের আমল (সালাত ও সিয়াম),

(২) আর্থিক আমল (যাকাত আদায় করা),

(৩) উপরোক্ত দুটি মাধ্যমের সম্মিলিত আমল (হজ পালন করা)।

 

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিস – “একজন মুসলিম তো সে, যে অন্য মুসলিমদের জিহ্বা (মুখের কথা) বা হাত দিয়ে ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকে” (বুখারি - কিতাবুল ইমান, হাদিস নং ১০; মুসলিম - কিতাবুল ইমান, হাদিস নং ৪০/৬৪) – এটা ইঙ্গিত করে যে সব বাহ্যিক আমলই ইসলামের শ্রেণীর অধীনে অন্তর্ভুক্ত।

আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলো, “ইসলামে কোন ধরনের (অথবা কোন গুণসম্পন্ন) আমল উত্তম ?” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “দরিদ্র লোকদের খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত ব্যক্তিদের সালাম দেওয়া।” (বুখারি - কিতাবুল ইমান, হাদিস নং ১২; মুসলিম - কিতাবুল ইমান, হাদিস নং ৩৯/৬৩)

একইভাবে, নিষিদ্ধ কাজগুলো ছেড়ে দেওয়াও ইসলামের শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, যেমন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ব্যক্তি পর্যায়ে ইসলামের সর্বোত্তম বৈশিস্টগুলোর একটি হল যা তার সম্পর্কিত নয়,তা পরিত্যাগ করা।” (তিরমিযি - কিতাবুল যুহদ, হাদিস ২৩১৭; ইবন মাজাহ - কিতাবুল ফিকহ, হাদিস ৩৯৭৬)

নাওাস বিন সাম’আন (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহ সরল পথের যে উপমা দেখিয়েছেন তা হল এই যে - এটি দুই পাশের দেয়াল দ্বারা ঘেরা রয়েছে। দেয়ালগুলোর সামনে রয়েছে উন্মুক্ত দরজা যেখানে পর্দা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রবেশপথে রয়েছে এক আহবানকারী যে বলে, ‘হে লোকসকল, তোমরা সবাই এই পথে প্রবেশ করো এবং বিপথে যেয়ো না।’ সেই পথের ভিতরে রয়েছে আরেকজন আহ্বানকারী যে সবাইকে (যারা অন্য কোন দরজা খুলতে চায়) আহবান করে, ‘তোমাদের উপর দুঃখ আপতিত হোক, এই দরজা খুলবে না!’ এটি হল ইসলামের পথ, আর দেয়ালগুলো হল আল্লাহ্‌র বেঁধে দেওয়া সীমারেখা। উন্মুক্ত দরজাগুলো হল সেগুলো যেগুলোকে আল্লাহ হারাম করেছে এবং পথের মাথায় আহ্বানকারী হল আল্লাহ্‌র কিতাব আর ভিতরের পথের আহ্বানকারী হল আল্লাহ্‌র দেওয়া উপদেশ যা প্রত্যেক মুসলিমের অন্তরে থাকে।” (মুসনাদে আহমাদ – ৪/১৮২,১৮৩; তিরমিযি – কিতাবুল আমসাল, ২৮৫৯; নাসাঈ’র আল কুবরা কিতাব – কিতাবুত তাফসীর, ১১২৩৩)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামের সরল পথের এই উপমাবিশিস্ট পথ প্রদর্শন করে গেছেন যার ব্যাপারে আল্লাহ আমাদের আদেশ দিয়েছেন দৃঢ় থাকার জন্য এবং নিষেধ করেছেন যেন এর সীমার বাইরে না যাওয়া হয়, যে ব্যক্তি কোন নিষিদ্ধ কাজ করলো সে আল্লাহ্‌র বেঁধে দেওয়া সীমা অতিক্রম করলো।

 

ঈমানের অর্থ

এই হাদিসে এটি বলার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈমানকে সংজ্ঞায়িত করেছেন আন্তরিক বিশ্বাস হিসেবে – “ঈমান হল আল্লাহ্‌কে, তার ফেরেশতাদেরকে, কিতাবসমুহকে, নবী রাসুলদেরকে, মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে এবং প্রত্যেক ভাল মন্দ সম্পর্কে তাকদীরকে সত্য বলে বিশ্বাস করা।”

এই পাঁচটি বিষয়ের উপর ঈমান আনার ব্যাপারে আল্লাহ কুরআনের বিভিন্ন অংশে উল্লেখ করেছেন, যেমনঃ

آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِن رَّبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ ۚ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّـهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ ۚ

“রাসুল সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে যা তার উপর তার রবের পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে, আর মুমিনরাও (ঈমান এনেছে); তারা সবাই ঈমান এনেছে আল্লাহ্‌র উপর, তার ফেরেশতাদের উপর, তার কিতাবসমুহের উপর, তার রাসুলদের উপর…” (সূরা আল বাকারাহ, ২ :২৮৫)

وَلَـٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّـهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ

“… বরং সৎ কাজ হল এই যে, মানুষ ঈমান আনবে আল্লাহ্‌র উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর, আল্লাহ্‌র কিতাবের উপর, নবীদের উপর …” (সূরা আল বাকারাহ, ২ :১৭৭)

الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ ﴿٣﴾

“… যারা *গায়ব এর প্রতি ঈমান আনে এবং সালাত কায়েম করে এবং তাদের রিযক থেকে (তাদের যা দান করা হয়েছে) (তা আমার নির্দেশিত পথে) ব্যয় করে।” (সূরা আল বাকারাহ, ২ :৩)

[* আল গায়বঃ এর আক্ষরিক অর্থ হল যা দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থ বহন করে – আল্লাহ্‌কে, ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবসমুহকে, তার নবী রাসুলদেরকে, পুনরুত্থান দিবসকে এবং আল কদর (ভাগ্য) কে বিশ্বাস করা। এর অর্থ গুলোর মধ্যে এটিও অন্তর্ভুক্ত – যা আল্লাহ ও তার রাসুল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্ঞান সম্পর্কে মানুষদের জানিয়েছেন; যেমন, আসমান ও দুনিয়ার সৃষ্টি সম্পর্কে, উদ্ভিদ ও প্রানীদের জীবন সম্পর্কে, পূর্ববর্তী জাতিদের ঘটনা এবং বেহেশত ও দোযখ সম্পর্কে। ]

 

নবী রাসুলদের উপর ঈমান আনার ফলে অপরিহার্য হয়ে পড়ে সেসব কিছুর উপর ঈমান আনা যা তারা প্রচার করতে আদিস্ট হয়েছিলেন। এটি অন্তর্ভুক্ত করে ফেরেশতাদের উপর, নবী রাসুলদের উপর, কিতাবের উপর (আল কুরআন), পুনরুত্থানের উপর, তাকদিরের উপর, আল্লাহ্‌র গুণাবলীর উপর, বিচার দিবসের উপর, *আস সিরাত এর উপর, আমল পরিমাপের মাপকের উপর এবং বেহেশত ও দোযখের উপর ঈমান আনা।

[* আস সিরাতঃ এটি হল একটি সেতু যেটা প্রত্যেক ব্যক্তিকে জান্নাতে যাওয়ার পূর্বে পাড়ি দিতে হবে। চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম এই সেতুর নিচে দোযখের আগুন জ্বলতে থাকবে। ]

 

প্রত্যেক ভাল মন্দ সম্পর্কে তাকদীরকে সত্য বলে বিশ্বাস করাটাও ঈমানের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। এটি ইবন উমার (রাঃ) এই হাদিসটির উপর ভিত্তি করে জানা যায়, যেখানে তিনি তাকদিরের বিষয়টি প্রত্যাখ্যানকারীদের ব্যাপারে বলেছেন। হাদিসটি হলঃ

ইয়াহইয়া বিন ইয়া’মুর থেকে বর্ণিতঃ “যে ব্যক্তি আল-কদরের ব্যাপারে প্রথম কথা বলেছিল সে ছিল বসরার লোক মা’বাদ আল জুহানি। আমি (ইয়াহইয়া) আর হুমাইদ বিন আব্দুর রহমান আল হিমাইরি হজ বা উমরা করার জন্য বের হয়ে পড়েছিলাম আর বললাম, ‘যদি এমনটি ঘটে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কোন এক সাহাবীর সাথে আমাদের সাক্ষাত লাভ হয়, তবে আমরা তাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করবো যে তারা (সাহাবীরা) তাকদিরের ব্যাপারে কি বলেন।’ অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের সাথে আবদুল্লাহ বিন উমার বিন আল খাত্তাব (রাঃ) এর সাথে দেখা হয়ে গেল তিনি মাসজিদে প্রবেশ করার সময়। আমার সাথী আর আমি তার কাছে গেলাম। আমাদের মধ্যে একজন তার ডানে এবং অপরজন তার বামে দাঁড়ালো। আমি আশা করেছিলাম যে আমার সাথী আমাকে কথা বলার অনুমতি দিবে। তাই আমি বললাম, ‘হে আবু আবদুর রহমান (আবদুল্লাহ বিন উমার), আমাদের দেশে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব হয়েছে যারা পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করে এবং জ্ঞান অন্বেষণ করে।’ এরপর তাদের সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার পর আমি বললাম, ‘তারা দাবী করে যে আল-কদর বলতে কিছুই নেই এবং কোন কিছুই পূর্বে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয় নি।’ তিনি (আবদুল্লাহ বিন উমার) বললেন, ‘তোমার সাথে যদি সেই লোকগুলোর দেখা হয় তবে তুমি তাদের বলবে যে আমার তাদের ব্যাপারে করার কিছু নেই এবং তাদেরও আমার ব্যাপারে করার কিছু নেই।’ আবদুল্লাহ ইবন উমার (রাঃ) আল্লাহ্‌র নামে শপথ করে বললেন, ‘যদি তাদের (যারা আল-কদরে ঈমান আনে না) কেউ তার কাছে থাকা উহুদ পাহাড়ের সমান স্বর্ণও (আল্লাহ্‌র পথে) ব্যয় করে, আল্লাহ সেটা গ্রহণ করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আল-কদরের উপর ঈমান আনবে।’ ” (মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ১/৮)

 

ঈমানের শ্রেণীবিভাগের মধ্যে আমলও অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ কুরআনে বলেছেনঃ

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّـهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ﴿٢﴾ الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ ﴿٣﴾ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا ۚ لَّهُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ ﴿٤﴾

“মুমিন তো হল সেসব লোক, (যাদের) আল্লাহ তা’আলাকে স্মরণ করানো হলে তাদের হৃদয় কম্পিত হয়ে উঠে এবং যখন তাদের সামনে তার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা (সব সময়) তাদের মালিকের উপর নির্ভর করে। যারা সালাত কায়েম করে আর আমি তাদের যা কিছু (অর্থ সম্পদ) দান করেছি তা থেকে তারা (আমার পথে) খরচ করে। (মুলত) এ (গুণসম্পন্ন) লোকগুলোই হল সত্যিকারের মু্মিন, তাদের রবের কাছ তাদের জন্য রয়েছে (বিপুল) মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা (-র ব্যবস্থা)।” (সূরা আল আনফাল, ৮ :২-৪)

 

ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আবদুল কায়েস গোত্র থেকে আসা এক প্রতিনিধিকে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে চারটি কাজ করতে আদেশ দিচ্ছিঃ এক আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনবে । তুমি কি জান এক আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনা বলতে কি বুঝায় ? এটি বুঝায় এই ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করা যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এমন কারো অধিকার নেই যে তার ইবাদাহ করা যাবে এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্‌র রাসুল, এবং সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রামাদানের সিয়াম পালন করা এবং আল খুমুস (গনিমতের পাঁচ ভাগের এক অংশ যা তোমার অংশে পড়ে) এর অর্থ প্রদান করা।” (বুখারি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৫৩; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস – ১৭/২৩)

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ঈমানের রয়েছে ষাট অথবা সত্তরটির কিছু বেশী সংখ্যক শাখা, এদের মধ্যে সর্বোত্তম হল এটা ঘোষণা দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই; এবং এদের মধ্যে সবার নিচে যেটা রয়েছে সেটা হল পথ থেকে ক্ষতিকর কিছু সরিয়ে ফেলা; আর লজ্জাশীলতা হল ঈমানের একটি শাখা।” (বুখারি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৯; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, ৩৫/৫৮)

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ব্যভিচারী যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না। কোন ব্যক্তি মুমিন থাকা অবস্থায় চুরিতে লিপ্ত হতে পারে না। কোন ব্যক্তি মুমিন থাকা অবস্থায় মদ পানে লিপ্ত হতে পারে না।” (বুখারি – কিতাবুল মাযালিম, হাদিস ২৪৭৫; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৫৭/১০০)

এভাবে, এই বড় গুনাহগুলো ছেড়ে দেওয়া যদি ঈমানের কোন অংশ না হতো, যে ব্যক্তি এই পাপগুলোর কোন একটি করে, সে ব্যক্তির ব্যাপারে ‘ইমানদার’ পরিভাষাটি অস্বীকার করা হতো না। কারন ‘ইমানদার’ পরিভাষাটি অস্বীকার করা হবে না যদি না এই পরিভাষার স্তম্ভ অথবা ফরয অস্বীকার করা হয়।

 

ঈমান ও ইসলামের পার্থক্য

ঈমান ও ইসলামের পার্থক্য হল - ঈমান হল বিশ্বাস, স্বীকারোক্তি ও অন্তর সম্পর্কিত জ্ঞান, এটি হল আল্লাহ্‌র কাছে তার দাসের নিজেকে উপস্থাপন করা, তার প্রতি নম্রতা প্রদর্শন করা আর তার কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করা। এভাবে ইসলাম হল আমল বা কাজ (অপরপক্ষে, বিশ্বাস ও জ্ঞান)।

এটি হল সেই আমল যাকে আল্লাহ কুরআনে “আদ দ্বীন” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অপরদিকে হাদিসে জিব্রাইলে দেখা যায়, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বীন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ইসলাম, ঈমান ও ইহসান কে।

এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, যদি এই দুই পরিভাষার কোন একটি পরিভাষা ব্যাবহার করা হয়, তবে অপর পরিভাষার অর্থও গৃহীত পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কিন্তু যখন একটির সাথে অপরটির তুলনা করা হয়, যেক্ষেত্রে ঈমানের সংজ্ঞা অন্তরের বিশ্বাসের একটি শ্রেণীভুক্ত এবং ইসলাম হল আমলের শ্রেণীভুক্ত; সেক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত ব্যক্তির জানাযার সালাতে দুয়া করতেন, “হে আল্লাহ, আপনি আমাদের যাকে জীবিত রাখেন, তাকে ইসলামের উপর জীবিত রাখুন এবং আমাদের যাকে মৃত্যু দেন, তাকে ঈমানের সাথে মৃত্যু দিন।” (মুসনাদে আহমাদ – খণ্ড ২, হাদিস ৩৬৮; আবু দাউদ – কিতাবুল জানাইয, হাদিস ৩২০১; তিরমিযি – কিতাবুল জানাইয, হাদিস ১০২৩; ইবন মাজাহ – কিতাবুল জানাইয, হাদিস ১৪৯৮; সবকটি হাদিসই আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে)

কারন মানুষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল করতে পারে কেবল এই দুনিয়ার জীবনেই; পক্ষান্তরে, মৃত্যুর সময় অন্তরের ঈমান ছাড়া আর কিছুই থাকে না।

এই পয়েন্ট থেকে নির্ভরযোগ্য আলিমরা বলেছেন, “সকল মুমিনই মুসলিম। যারা ঈমান এনেছে এবং তা অন্তরে দৃঢ়ভাবে বসিয়ে নিয়েছে, সেটা তাদেরকে দ্বীন ইসলামের আমলগুলো করতে উদ্বুদ্ধ করে।”

এটা তো সেটাই, যেমনটি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “সাবধান! শরীরে এমন এক টুকরো মাংস রয়েছে তা যদি ভালভাবে সংশোধন করা হয় তবে পুরো শরীর ভাল হয়ে যাবে, কিন্তু যদি এটি বিনস্ট হয় তবে পুরো শরীরই বিনস্ট হয়ে যাবে; আর এটি হল কলব।”

এভাবে, যদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইসলামের আমল অনুসরন না করে তবে অন্তর ঈমান অর্জন করবে না। তবে প্রত্যেক মুসলিমই মুমিন নয়। কারন তার ঈমান দুর্বল অথবা পূর্ণ ঈমান অর্জন করতে পারে নি তার শরীরের অঙ্গের দ্বারা ইসলামের আমলগুলো সম্পাদন করা সত্তেও। এক্ষেত্রে সে একজন মুসলিম তবে পূর্ণ ঈমান বিশিস্ট মুমিন নয়। এটি ঠিক তেমন, যেমনটি আল্লাহ বলেছেন,

قَالَتِ الْأَعْرَابُ آمَنَّا ۖ قُل لَّمْ تُؤْمِنُوا وَلَـٰكِن قُولُوا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الْإِيمَانُ فِي قُلُوبِكُمْ ۖ

“বেদুইনরা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’। তুমি বল, ‘না, তোমরা (সঠিক অর্থে এখনও) ঈমান আনোনি, তোমরা (বরং) বল – আমরা (ইসলামে) আত্মসমর্পণ করলাম’, কারন তোমাদের অন্তরে এখনও (যথার্থ) ঈমান প্রবেশ করেনি …” (সূরা আল হুজুরাত, ৪৯ :১৪)

এভাবেই, কুরআনের বেশীরভাগ সঠিক তাফসিরকারকদের মতে বেদুইনেরা পুরোপুরিভাবে মুনাফিক নয়, বরং তাদের ঈমান দুর্বল। এটি ইবন আব্বাস (রাঃ) ও অন্যান্যদের মতামত। আর এই বিষয়টি আল্লাহ্‌র এই আয়াত দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছেঃ

وَإِن تُطِيعُوا اللَّـهَ وَرَسُولَهُ لَا يَلِتْكُم مِّنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا ۚ إِنَّ اللَّـهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ ﴿١٤﴾

“এবং তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করো, তবে আল্লাহ তোমাদের কর্মফলের সামান্য পরিমাণও কমিয়ে দেবেন না, নিঃসন্দেহে আল্লাহ বারবার ক্ষমাকারী ও পরম করুণাময়।” (সূরা আল হুজুরাত, ৪৯ :১৪)

 

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসঃ “তার পুরষ্কারের কিছুই কমানো হবে না”

এটা স্পষ্ট হল, সেই বেদুইনদের কিছু পরিমাণ ঈমান ছিল যার কারনে তাদের আমল গ্রহণযোগ্য ছিল।

একইভাবে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সেই হাদিস – যখন সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম), অমুক ব্যক্তিকে আপনি দান করলেন না কেন ? সে তো একজন মুমিন।” রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “নাকি মুসলিম ?” … (বুখারি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ২৭; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ১৫০)

এই হাদিসটি ইঙ্গিত করে, সে ব্যক্তি ঈমানের লেভেলে পৌঁছায় নি। বাহ্যিকভাবে যেটা অনুসারে বিচার করা হয়েছিলো তা হল এই যে, সে ইসলামের লেভেলে ছিল।

কোনও সন্দেহ নেই যে, যখন অভ্যন্তরীণভাবে ঈমান দুর্বল হয়ে যায়, এর ফলে শরীরের অঙ্গ দ্বারা সংঘটিত বাহ্যিক আমলগুলো দুর্বল হতে থাকে। ফরয আমল উপেক্ষা করার মাধ্যমে কোন ব্যক্তির ঈমান বাতিল হয়ে যায়। যেমনটি এই হাদিসে বলা আছে – “ব্যভিচারী যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না।” (বুখারি – কিতাবুল মাযালিম, হাদিস ২৪৭৫; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস – ৫৭/১০০)

 

ইহসানের অর্থ

কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ইহসানের উল্লেখ করা আছে – কখনো ঈমানের সাথে ইহসান এক সাথে উল্লেখ করা আছে, আবার কোথাও ইসলাম, তাকওয়া অথবা সৎ আমলের সাথে এর উল্লেখ আছে।

ইহসান ও ঈমান একসাথে কুরআনে উল্লেখ আছে, যেমনঃ

لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا إِذَا مَا اتَّقَوا وَّآمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوا وَّآمَنُوا ثُمَّ اتَّقَوا وَّأَحْسَنُوا ۗ وَاللَّـهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ﴿٩٣﴾

“যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কর্ম করেছে, (এ নিষেধাজ্ঞা জারির আগে) তারা যা কিছু খেয়েছে তার জন্য তাদের উপর কোন গুনাহ নেই, যদি তারা আল্লাহ্‌কে ভয় করে (তার নিষিদ্ধ ঘোষিত আমল থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে) আর ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে, অতপর তাকওয়া অবলম্বন করে করে আর ঈমান আনে, অতঃপর তাকওয়া অবলম্বন করে এবং সৎ কর্ম করতে থাকে, এবং আল্লাহ মুহসিন (সৎকর্মশীল) লোকদের ভালবাসেন।” (সূরা আল মাইদাহ, ৫ :৯৩)

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ مَنْ أَحْسَنَ عَمَلًا ﴿٣٠﴾

“নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ্‌র উপর ঈমান এনেছে এবং সৎ কর্ম করেছে (তাদের কোন আশংকা নেই), যারা সৎ কর্ম করে আমি কখনো তাদের বিনিময় নস্ট করি না।” (সূরা আল কাহফ, ১৮ :৩০)

 

ইহসানের সাথে ইসলামের উল্লেখ রয়েছে এমন কিছু আয়াতঃ

بَلَىٰ مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّـهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِندَ رَبِّهِ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿١١٢﴾

“যে ব্যক্তিই (আল্লাহ্‌র সামনে) নিজের সত্তাকে সমর্পণ করে দিবে এবং সে হবে অবশ্যই একজন মুহসিন ব্যক্তি, তার জন্য তার রবের কাছে (এর) বিনিময় আছে, তাদের কোন ভয় নেই আর না তারা (সেদিন) চিন্তিতও হবে।” (সূরা আল বাকারাহ, ২ :১১২)

وَمَن يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّـهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ ۗ وَإِلَى اللَّـهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ ﴿٢٢﴾

“যদি কোন মুহসিন ব্যক্তি আল্লাহ্‌র কাছে নিজেকে (সম্পূর্ণ) সমর্পণ করে দেয়, সে (এর দ্বারা) একটি মযবুত হাতল ধরলো, আর যাবতীয় কাজকর্মের চূড়ান্ত পরিণাম আল্লাহ্‌র কাছে।” (সূরা লুকমান, ৩১ :২২)

 

ইহসানের সাথে তাকওয়ার উল্লেখ রয়েছেঃ

إِنَّ اللَّـهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوا وَّالَّذِينَ هُم مُّحْسِنُونَ ﴿١٢٨﴾

“নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের সাথে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা মুহসিন।” (সূরা নাহল, ১৬ :১২৮)

 

ইহসানকে এককভাবেও কুরআনে উল্লেখ করা আছেঃ

لِّلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَىٰ وَزِيَادَةٌ ۖ

“যারা সৎ কর্ম করেছে তাদের জন্য থাকবে উত্তম পুরস্কার (জান্নাত) এবং এর থেকেও বেশী (অর্থাৎ, আল্লাহ্‌র পবিত্র চেহারা দেখার এক বিরাট সম্মান)।” (সূরা ইউনুস, ১০ :২৬)

 

সহিহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) উপরোক্ত আয়াতের “এর থেকেও বেশী” - এর তাফসীর করেছেন যে, এটা দ্বারা বুঝানো হচ্ছে জান্নাতে আল্লাহ্‌র পবিত্র চেহারা দেখতে পাওয়া। (এই হাদিসটি রয়েছে এখানে - মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, ১৮১/২৯৮; মুসনাদে আহমাদ – ৪/৩৩২,৩৩৩)

আল্লাহ্‌র পবিত্র চেহারা দেখার এই মর্যাদা পাবে মুহসিন ব্যক্তিরা। এই বিরাট সম্মানজনক পুরষ্কারের কারন হল, ইহসান হল মুমিন বান্দার তার রবের প্রতি এমন এক ইবাদাত যেন তার রব তার সামনেই উপস্থিত আছেন। সে তার রবকে ভয় করে এমনভাবে যেন সে রবকে তার অন্তর দিয়ে দেখছে এবং ইবাদাত করার সময় সে তাকে দেখছে। তাই পরকালে তার পুরস্কার হবে তার নিজ চোখে সত্যিকার অর্থেই আল্লাহ্‌কে দেখতে পাওয়া। এটি বুঝা যায় কুরআনের সেই আয়াত থেকে, যেখানে আল্লাহ পরকালে অবিশ্বাসীদের জন্য তার প্রতিদানের কথা উল্লেখ করেছেন,

كَلَّا إِنَّهُمْ عَن رَّبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوبُونَ ﴿١٥﴾

“নিঃসন্দেহে পাপী ব্যক্তিদেরকে তাদের রবকে দেখা থেকে আড়াল করে রাখা হবে।” (সূরা আল মুতাফফিফিন, ৮৩ : ১৫)

 

আল্লাহ পাপী ব্যক্তিদের এই বিনিময় দিবেন দুনিয়াতে তাদের অবস্থার কারনে (তাদের অন্তরে জমিয়ে রাখা পাপ ও অসৎ কাজ, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহ্‌কে জানা ও ভয় করা থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখে)। তাই পরকালে আল্লাহ্‌র কাছে এর প্রতিদান হল পরকালেও তাদের পর্দা টেনে দেওয়া, যাতে তারা তখনও আল্লাহ্‌কে দেখতে না পারে।

ইহসানের ব্যাখ্যার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিস – “ইহসান হল এটি যে, তুমি এমনভাবে আল্লাহ্‌র ইবাদাহ করবে যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ ……” – এটি ইঙ্গিত করে, বান্দা আল্লাহ্‌র ইবাদাত করবে, তার নৈকট্য খুঁজবে এবং মনে করবে যে সে আল্লাহ্‌র হাতের মধ্যে রয়েছে যেন সে আল্লাহ্‌কে দেখতে পাচ্ছে। এর ফলে সৃষ্টি হয় তাকওয়া, তার প্রতি সশ্রদ্ধ ভয় এবং এতে তার নিকট পদমর্যাদার উন্নতি ঘটে; এছাড়াও ইবাদাতে শুদ্ধতা আর কর্ম প্রচেষ্টার উদ্যমের উন্নতি ঘটে এবং আরও নির্ভুল হয়।

“যদি তুমি মনে করো যে তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ না, তবে জেনে রাখো তিনি তোমাকে দেখছেন”

বলা হয় যে হাদিসের এ অংশটুকু এর প্রথম অংশের (“তুমি এমনভাবে আল্লাহ্‌র ইবাদাহ করবে যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ”) কারন।

যখন আদেশ দেওয়া হল, তখন আল্লাহ্‌র বান্দা তার ইবাদাত করার ক্ষেত্রে তাকে ভয় পাওয়ার ব্যাপারে এবং যতক্ষন পর্যন্ত না তাকে দেখতে পাচ্ছে ততক্ষন তার নিকটে অবস্থানের অনুভূতি – এসব ক্ষেত্রে কাঠিন্যতার মুখোমুখি হতে পারে।

তাই সে এভাবে তার ঈমান অবলম্বন করবে যে, আল্লাহ তাকে দেখছেন এবং তিনি তার গোপন বিষয় ও নিয়্যত সম্পর্কে জানেন, তিনি জানেন তার গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় এবং তার কোন কিছুই আল্লাহ্‌র কাছ থেকে গোপন নয়। সে যদি এই ধাপ অর্জন করতে পারে, তবে তার জন্য দ্বিতীয় ধাপে চলে যাওয়া সহজ হবে, যেটা হল আল্লাহ্‌র সাহায্য ও তার নৈকট্যের ব্যাপারে সবসময়ই দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত থাকা, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে যেন আল্লাহ্‌কে দেখতে পেলো।

অন্যান্য আলিমরা বলেছেন, “বরং এটি আল্লাহ’র ইবাদাতে কাঠিন্যতা পাওয়া ব্যক্তির প্রতি নির্দেশনা – আল্লাহ তাকে দেখছেন এটা জেনে এমনভাবে ইবাদাত করা যেন সে আল্লাহ্‌কে দেখছে।”

এই জ্ঞানের কারনে আল্লাহ্‌র দৃষ্টির সামনে তার লজ্জাশীলতা অনুভূত হবে, যেমনটি বলেছেন কিছু আলিম, “আল্লাহ্‌কে ভয় করুন, যাতে তিনি যেন তাদের মধ্যে ন্যূনতম একজন না হয়ে যান, যিনি আপনাকে দেখছেন (যারা আপনাকে দেখছে তাদের কাছ থেকে আপনার লজ্জাশীলতার ব্যাপারটি বিবেচনা করো)।”

আবার কিছু আলেম বলেছেন, “আপনাদের উপর আল্লাহ্‌র ক্ষমতার পরিমানের ব্যাপারে ভয় করুন এবং আপনাদের সাথে আল্লাহ্‌র নৈকট্যের পরিমানের ব্যাপারে তার সামনে লজ্জাশীল থাকুন।”

আমাদের পূর্ববর্তী ধার্মিক ব্যক্তিগনের (সালাফদের) মধ্য থেকে কিছু জ্ঞানী ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন, “যে ব্যক্তি কাজ করার সময় আল্লাহ্‌কে (অন্তর দিয়ে) দেখে, সে তাদের মধ্যে একজন যে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত আছে; আর আল্লাহ দেখছে এটা জেনে যে ব্যক্তি কাজ করে, সে মুখলিস (একনিষ্ঠ) ব্যক্তিদের একজন।”

শেষের এই বিবৃতিতে দুই পদমর্যাদার উল্লেখ আছে যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছিলঃ

(১) ইখলাসের অবস্থা :ইখলাস হল আল্লাহ্‌র পর্যবেক্ষণ করার ব্যাপারটি অন্তরের ভিতর ও বাইরে উপস্থিত রেখে আল্লাহ্‌কে দেখার ইচ্ছা আর তার নিকটস্থ হওয়ার লক্ষ্যে বান্দা কতৃক আমল। বান্দা যখন তার আমলের ব্যাপারে আল্লাহ্‌র পর্যবেক্ষণ কামনা করে আর এর শেষ পর্যন্ত কাজ করে যেতে থাকে, তখন সে সত্যিই মুখলেস বান্দা হয়ে যায়, যে কেবলমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য আমল করে থাকে। কারন সে তার আমলের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি খুঁজে, যা আল্লাহকে ছাড়া অন্য কিছুকে সন্তুষ্টি করা থেকে তাকে ফিরিয়ে রাখে।

(২) আল্লাহ্‌কে দেখার ব্যাপারে অবস্থা :এটা হল বান্দা কতৃক সংগ্রাম করা, যা ভিত্তি করে সেটার উপর, যেটার কারনে অন্তর আল্লাহ্‌কে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে ও আল্লাহ্‌র দিকে মুখ করে এবং যেটা অন্তরকে ঈমানের আলোয় আলোকিত করে। অন্তর্দৃষ্টি জ্ঞানের ভিতর প্রবেশ করে যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি চোখের ন্যায় হয়ে পড়ে। এটি হল ইহসানের অবস্থার বাস্তবতা,যা হাদিসে জিব্রাইলে উল্লেখ করা আছে। আর এই অবস্থার ব্যক্তিরা তাদের অন্তর্দৃষ্টির প্রবলতা অনুযায়ী জাগরিত হয়।

কুরআনের বিভিন্ন অংশে এই অর্থগুলো নির্দেশ করা হয়েছেঃ

وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ ۚ وَاللَّـهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ﴿٤﴾

“…… এবং তিনি তোমাদের সাথেই আছেন (তার জ্ঞানের মাধ্যমে), তোমরা যা কিছু করছ আল্লাহ তার সব কিছুই দেখছেন।” (সূরা আল হাদিদ, ৫৭ :৪)

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّـهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۖ مَا يَكُونُ مِن نَّجْوَىٰ ثَلَاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَمْسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا أَدْنَىٰ مِن ذَٰلِكَ وَلَا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا ۖ ثُمَّ يُنَبِّئُهُم بِمَا عَمِلُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ إِنَّ اللَّـهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ﴿٧﴾

“কখনো এমন হয় না যে, তিন ব্যক্তির মধ্যে কোন গোপন সলাপরামর্শ হয় এবং (সেখানে) ‘চতুর্থ’ হিসেবে আল্লাহ উপস্থিত থাকেন না এবং পাঁচ জনের মধ্যে ‘ষষ্ঠ’ হিসেবে সেখানে থাকেন না, (এ সলাপরামর্শকারীদের সংখ্যা) তার চেয়ে কম হোক কিংবা বেশী, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, আল্লাহ সবসময়ই তাদের সাথে আছেন, অতঃপর কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সবাইকে বলে দিবেন তারা কি কাজ করে এসেছে; আল্লাহ সকল বিষয়ে সম্যক অবগত আছেন।” (সূরা আল মুজাদিলাহ, ৫৮ :৭)

وَمَا تَكُونُ فِي شَأْنٍ وَمَا تَتْلُو مِنْهُ مِن قُرْآنٍ وَلَا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفِيضُونَ فِيهِ ۚ وَمَا يَعْزُبُ عَن رَّبِّكَ مِن مِّثْقَالِ ذَرَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَلَا أَصْغَرَ مِن ذَٰلِكَ وَلَا أَكْبَرَ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ ﴿٦١﴾

“(হে নবী,) তুমি যে কাজেই থাকো না কেন এবং সে (কাজ) সম্পর্কে কুরআন থেকে যা কিছু তিলাওয়াত করো না কেন (তা আমি জানি, হে মানুষেরা), তোমরা যে কোন কাজ করো, কোনও কাজে তোমরা যখন প্রবৃত্ত হও, আমি তার ব্যাপারে তোমাদের উপর সাক্ষী হয়ে থাকি, তোমাদের মালিকের (দৃষ্টি) থেকে একটি অনু পরিমাণ জিনিষও গোপন থাকে না, আসমান ও জমিনে এর চাইতে ছোট কিংবা এর চাইতে বড় কোন কিছুই নেই যা এ সুস্পস্ট গ্রন্থে লিপিবদ্ধ নেই।” (সূরা ইউনুস, ১০ :৬১)

وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ ﴿١٦﴾

“…… আমি তার ঘাড়ের রগ থেকেও তার অনেক কাছে থাকি (আমার জ্ঞানের মাধ্যমে)।” (সূরা কাফ, ৫০ :১৬)

يَسْتَخْفُونَ مِنَ النَّاسِ وَلَا يَسْتَخْفُونَ مِنَ اللَّـهِ وَهُوَ مَعَهُمْ إِذْ يُبَيِّتُونَ مَا لَا يَرْضَىٰ مِنَ الْقَوْلِ ۚ وَكَانَ اللَّـهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطًا ﴿١٠٨﴾

“… কিন্তু তারা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে (নিজেদের অপরাধ) লুকোতে পারবে না …… তিনি তাদের সাথে আছেন (তার জ্ঞানের মাধ্যমে)।” (সূরা আন নিসা, ৪ :১০৮)

 

নির্ভরযোগ্য হাদিসে মুসলিমদেরকে ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নৈকট্য চাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, যেমন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসঃ

“তোমাদের মধ্যে যে কেউই সালাতে দাঁড়ায়, সে তার রবের সাথে গোপনে কথা বলে অথবা তার রব থাকে তার আর কিবলা উভয়ের মাঝে।” (বুখারি – কিতাবুস সালাহ, হাদিস – ৪০৫; মুসলিম – কিতাবুল মাসাজিদ, ৫৪/৫৫১)

এছাড়াও এটি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অপর হাদিসেও পাওয়া যায়ঃ

“তোমাদের মধ্যে কেউ যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন আল্লাহ তার সামনে থাকেন।” (বুখারি – কিতাবুস সালাহ, হাদিস – ৪০৬; মুসলিম – কিতাবুল মাসাজিদ, ৫০/৫৪৭)

যারা উচ্চস্বরে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করে তাদের ব্যাপারে একই অর্থ প্রকাশ করে এমন আরেক হাদিসঃ

“তোমরা এমন কারো ইবাদাত করছো না যিনি বধির বা অনুপস্থিত। নিঃসন্দেহে তোমরা যাকে ডাকছো তিনি সবই শুনেন এবং তোমাদের কাছেই আছেন আর তোমাদের সাথেই আছেন।” (বুখারি – কিতাবুল কদর, হাদিস ৬৬১০; মুসলিম – কিতাবুজ জিকর ওয়াদ দু’য়া, ৪৪/২৪০৭)

আরেক বর্ণনায় আছেঃ

“তোমার ঘাড় থেকে মাথা যতখানি নিকটবর্তী, তিনি তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তির প্রতি তার চেয়েও অধিক নিকটবর্তী।”

এবং আরেকটি বর্ণনা হলঃ

“তিনি তোমাদের ঘাড়ের শিরার থেকেও অধিক নিকটবর্তী।” (মুসলিম – কিতাবুয যিকর ওয়াদ দু’আ, ৪৬/২৭০৪)

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে আল্লাহ বলেছেন, “আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে থাকে আমি বান্দার সে ধারনার নিকটেই আছি। অর্থাৎ সে ধারণা অনুযায়ী ফল দিয়ে থাকি। এবং বান্দা যখন আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তার সাথেই থাকি। বান্দা যদি আমাকে তার অন্তরে স্মরণ করে তবে আমিও তাকে আমার অন্তরে স্মরণ করি আর সে যদি কোন জনসমষ্টি নিয়ে স্মরণ করে তবে আমিও বিশেষ দল নিয়ে স্মরণ করি যা তাদের জনসমষ্টি থেকে উত্তম। বান্দা যখন আমার নিকট এক বিঘত নিকটবর্তী হয় তখন আমি তার নিকট একহাত নিকটবর্তী হই। আর সে একহাত অগ্রসর হলে আমি দুই হাত অগ্রসর হই। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে তবে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।” (বুখারি – কিতাবুত তাওহীদ, হাদিস ৭৪০৫; মুসলিম – কিতাবুজ জিকর ওয়াদ দু’আ, ২১/২৬৭৫)

যে ব্যক্তি বুঝে নিবে যে এই হাদিসটি নাস্তিকতা, অবতারত্ব অথবা আল্লাহ ও তার সৃষ্টিকে একত্রীকরণ করাকে নির্দেশ করে, এটা তার অজ্ঞতা এবং আল্লাহ্‌ও তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বুঝার ত্রুটি থেকে তার এই অনুমান উদ্ভুত হবে।

নিঃসন্দেহে আল্লাহ ও তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব আনুমানিক ব্যাপার থেকে মুক্ত, আর মহান আল্লাহ্‌তার সৃষ্টির কোন কিছুর মতো নয় (অদ্বিতীয়), তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।

 

কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে ?

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিব্রাইল জিজ্ঞেস করেছিলেন কিয়ামতের সময় সম্পর্কে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে জবাব দিয়েছিলেন, “জিজ্ঞাসাকৃত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারীর অপেক্ষা বেশী জানেন না।”

এর অর্থ হল কেয়ামতের দিনকাল সম্পর্কে সকল সৃষ্টির জ্ঞানই সমান (অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কেউই এ ব্যাপারে জানে না)।

এটি একটি নিদর্শন যে একমাত্র আল্লাহই এই জ্ঞানের অধিকারী, যেমনটি আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “এমন পাঁচটি বিষয় আছে যা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানেন না,” এরপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেনঃ

إِنَّ اللَّـهَ عِندَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ

“নিঃসন্দেহে একমাত্র আল্লাহ্‌রই রয়েছে কিয়ামত সম্পর্কে জ্ঞান” (সূরা লুকমান, ৩১ : ৩৪)

আল্লাহ বলেছেন,

يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا ۖ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِندَ رَبِّي ۖ لَا يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلَّا هُوَ ۚ ثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ لَا تَأْتِيكُمْ إِلَّا بَغْتَةً ۗ

“তারা তোমার কাছে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, এ দিনটি কখন সংঘটিত হবে; তুমি (তাদের) বল, এ জ্ঞান তো (রয়েছে কেবল) আমার রবের কাছে, এর সময় আসার আগে তিনি তা প্রকাশ করবেন না, (তবে) আকাশমণ্ডল ও জমিনের জন্য সেদিন তা হবে একটি ভয়াবহ ঘটনা; এটি তোমাদের কাছে আকস্মিকভাবে আসবে …” (সূরা আল আ’রাফ, ৭ : ১৮৭)

ইবন উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “গায়বের চাবি পাঁচটি যা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না”, এরপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন – “নিঃসন্দেহে একমাত্র আল্লাহ্‌রই রয়েছে কিয়ামত সম্পর্কে জ্ঞান, তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন ……” {সূরা লুকমান, ৩১ : ৩৪}

(বুখারি – কিতাবুত তাফসীর, হাদিস ৪৭৭৮)

 

কিয়ামতের নিদর্শনসমূহ

হাদিসটিতে জিব্রাইল যা জিজ্ঞেস করেছিলেন – “আমাকে কিয়ামতের কিছু নিদর্শন সম্পর্কে বলুন” – দ্বারা বুঝানো হচ্ছে কিয়ামত আবির্ভাবের নিদর্শন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) দুটি নিদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেনঃ

 

প্রথম নিদর্শনঃ দাসী তার কত্রী (অথবা কর্তা) কে জন্ম দিবে

“তার কত্রী” বলতে বুঝানো হচ্ছে দাসীর মালিককে। আবু হুরাইরা (রাঃ) এর হাদিসে বলা আছে “তার কর্তা”।

এটি একটি নিদর্শন যা ইঙ্গিত দেয় অনেক দেশ উদ্ভুত হওয়ার আর প্রচুর পরিমাণ দাস পাওয়ার, যতক্ষণ না পর্যন্ত বন্দীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের সন্তানও একইভাবে বৃদ্ধি পায়, যাতে করে বন্দী নারীরা তাদের মালিকের দাসে পরিনত হয় এবং তার সন্তানেরা তার মালিকের অবস্থানে, কারন মালিকের সন্তানের অবস্থান আর মালিকের অবস্থান একই, দাসীদের সন্তান তার মালিকের অবস্থানে পৌঁছে যায়।

বলা হয় যে, দাসী পাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে যতক্ষণ না পর্যন্ত একজন মেয়েকে দাস বানানো হবে এবং অতঃপর মুক্ত করে দেওয়া হবে, এরপর মাকে দাস বানানো হবে এবং মেয়েটি তাকে কিনে নিবে এবং তাকে ব্যবহার করবে এটা না জেনে যে সে-ই তার মা। এটি ইসলামের বিভিন্ন যুগে ঘটেছিল।

এটাও বলা হয় যে দাসিরা তাদের রাজাদেরকে জন্ম দিবে।

 

দ্বিতীয় নিদর্শনঃ আপনি দেখবেন যে নগ্নপদবিশিস্ট , নিঃস্ব ……….

নিঃস্ব (আল ‘আলাহ) অর্থ হল নিঃস্ব ও দরিদ্র, যেমনটি আল্লাহ কুরআনে বলেছেনঃ

وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَىٰ ﴿٨﴾

“তিনি তোমাকে নিঃস্ব অবস্থায় পেয়েছেন অতঃপর সমৃদ্ধ করে দিয়েছেন” (সূরা আদ দুহা, ৯৩ :৮)

 

“ছাগলের রাখালেরা একে অপরের সাথে বিশাল বিশাল ভবন তৈরিতে প্রতিযোগিতা করবে।” – এর অর্থ পাওয়া যায় উমার (রাঃ) বর্ণিত হাদিসে। এর অর্থ হল সমাজের নিচু শ্রেণীর লোকেরা তাদের নেতা ও শাসকে পরিণত হবে এবং তাদের সম্পদ বাড়তে থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা ভবনের উচ্চতা, ডিজাইন ও পরিপূর্ণতা/উৎকর্ষতা নিয়ে নিজেদের ব্যাপারে অহংকার করবে।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনটি নিদর্শনের উল্লেখ আছে, তার মধ্যে একটি হল, “যখন আপনি দেখবেন নগ্নপদ বিশিষ্ট লোকেরা জনগনের নেতা হবে এবং যখন কালো উটের রাখালেরা গর্ব/অহংকার আর একে অপরের সাথে সুদীর্ঘ ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতা শুরু করবে।”

এভাবে, কিয়ামতের নিদর্শনসমুহের মধ্যে একটি নিদর্শন পাওয়া গেল যে, উপযুক্ত ব্যক্তিদের ছাড়া অন্যদের (অযোগ্য) হাতে সমাজের দায়িত্ব অর্পিত হবে; যেমনটি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই ব্যক্তিকে বলেছিলেন, যে ব্যক্তি কিয়ামত সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল -“যোগ্য ব্যক্তি ছাড়া যদি অন্য কারো হাতে দায়িত্ব চলে যায়, তবে কিয়ামতের জন্য অপেক্ষা করো।” (বুখারি – কিতাবুল ইলম, হাদিস ৫৯)

এভাবে, যদি নগ্নপদ বিশিস্ট রাখালেরা (যারা অজ্ঞ আর কর্কশ হিসেবে পরিচিত) সমাজের নেতা হয়ে যায় এবং ধন-সম্পদের অধিকারী হয়ে যায়, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের সুদীর্ঘ ভবন তৈরি সম্পন্ন হয়, এর ফলে দ্বীন ইসলামের নিয়মশৃঙ্খলা ও জীবন হয়ে পড়বে বিকৃত। কারন, যদি সমাজের লোকদের নেতা নিঃস্ব ও দরিদ্র লোকদের মধ্য থেকে হয় এবং এরপর লোকজনের নেতা হয়, হোক তার কতৃত্ব ব্যাপক অথবা সর্বনিন্মস্থ, তবে এটি বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব যে সেই ব্যক্তি মানুষজনের অধিকার আদায় করবে, বরং সে নিজের জন্য সম্পদ বেদখল করবে এবং জনগনের সম্পদ দখল করে নিবে।

পূর্বের কিছু ধার্মিক ব্যক্তিগন (সালাফ) বলেছেন, “ড্রাগনের মুখের দিকে তোমার হাত প্রসারিত করা এর থেকেও উত্তম যে তুমি সম্পদশালী ব্যক্তির হাতের দিকে তোমার হাত প্রসারিত করবে, কারন ড্রাগন তোমার হাত খাবলিয়ে ছিড়ে নিবে কিন্তু সেই সম্পদশালী ব্যক্তি তোমাকে গরীব করে ছাড়বে।”

এছাড়াও, যদি সে অজ্ঞ আর রুক্ষ হয়ে থাকে, তাহলে এভাবে দ্বীন ইসলাম বিকৃত হয়ে যাবে কারন তার কাছে দ্বীনের উন্নতির বা শিক্ষার কোন গুরুত্তই নেই। বরং সে অগ্রাধিকার দেয় সম্পদ সংগ্রহ ও একত্র করাকে। সে এই ব্যাপারে কোন তোয়াক্কাই করে না যে দ্বীনের বিষয়সমূহের কি কি বিকৃত হচ্ছে,আর না সে তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখে যাদের এই সিস্টেমের কারনে সর্বনাশ হচ্ছে।

যখন সমাজের নেতা ও প্রধানরা এই অবস্থায় পৌঁছায়, তখন পুরো সমাজটাই উল্টে যায়। মিথ্যুকদের বিশ্বাস করা হয় আর সত্যবাদীদের মিথ্যুক বলে অভিহিত করা হয়, বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাস করা হয় আর বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, অজ্ঞরা কথা বলে অথচ আলেমরা চুপ থাকে অথবা সেখানে একদম কেউই থাকে না। যেমনটি জানা যায় একটি নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “নিঃসন্দেহে কিয়ামতের নিদর্শন সমুহের একটি হল যে জ্ঞানকে তুলে নেওয়া হবে এবং অজ্ঞতা প্রকাশ পাবে।” (বুখারি – কিতাবুল ইলম, হাদিস ৮০,৮১; মুসলিম – কিতাবুল ইলম, হাদিস ২৬৭১)

এবং রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে জ্ঞান তুলে নেন না। তিনি জ্ঞানীদের তুলে নেওয়ার মাধ্যমে জ্ঞান তুলে নেন, যাতে করে যখন তিনি সকল অজ্ঞ ব্যক্তিদের ছেড়ে দেন,মানুষ তখন সেই অজ্ঞ লোকদের কাছে যায় যারা তাদের নেতা; এরপর লোকেরা দ্বীনের কোন ফয়সালা জানতে চায় এবং সেই অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে কোন জ্ঞান ছাড়াই উত্তর প্রদান করে, এতে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হয় এবং অন্য লোকদেরও পথভ্রষ্ট করে।” (বুখারি – কিতাবুল ইলম, হাদিস ১০০; মুসলিম – কিতাবুল ইলম, হাদিস ২৬৭৩)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসের অংশ – “সুদীর্ঘ ভবন নির্মাণে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করবে” – হল তাদের গর্ব ও অহংকারের প্রমাণ, বিশেষ করে ভবন এর উচ্চতা সম্পর্কে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তার সাহাবীদের সময়ে সুদীর্ঘ ভবন পরিচিত ছিল না। বরং তাদের ঘর ছিল তাদের চাহিদা অনুযায়ী নিচু।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “ততক্ষন পর্যন্ত কিয়ামত হবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত লোকেরা সুদীর্ঘ ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতা করবে।”

আল হাসান থেকে হারিস বিন আস সা’ইব বর্ণনা করেন, “আমি উসমান (রাঃ) এর খিলাফাহ চলাকালীন সময়টাতে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের ঘরে প্রবেশ করেছিলাম, এবং আমি আমার হাত দিয়ে ঘরের ছাদ স্পর্শ করতে পারছিলাম।”

উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে তিনি লিখেছিলেন, “তোমাদের ভবনগুলো উঁচু করবে না কারন নিশ্চয়ই এটি মন্দ কাজ।”

এবং আম্মার বিন আবু আম্মার থেকে বর্ণিত, “কোন ব্যক্তি যদি তার ঘরের উচ্চতা সাত হাতের উপর নিয়ে যায়, এটা তাকে সাথে সাথে বলে, ‘হে পাপীদের মধ্যে পাপিষ্ঠ ব্যক্তি, কোথায় তুমি তোমার ঘর নির্মাণ করছ ?’ ”

 

ইমাম ইবন রজব আল হানবালি’র প্রসিদ্ধ হাদিস তাফসীর কিতাব জামি’ আল ‘উলুম ওয়াল হিকাম এর ইংলিশ ভার্শন থেকে অনুবাদকৃত।

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-U

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাদিস তাফসীর – “তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমান আনলো না যতক্ষণ না পর্যন্ত …”

 

 

The Greatest Nation·Friday, July 15, 2016

 

 

 

আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আল আস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমান আনলো না যতক্ষণ না পর্যন্ত তোমাদের চঞ্চল খামখেয়ালী প্রবৃত্তি আমি যেটা সহকারে এসেছি তার প্রতি অধীন হয়।”

(এই নির্ভরযোগ্য হাদিসটি নির্ভরযোগ্য ইসনাদ সহকারে হুজ্জাহ এর উপর লিখিত কিতাবে লিপিবদ্ধ করা আছে। দেখুনঃ ইবন আবি আসিমের আস সুন্নাহ, নং ১৫; আবু আল কাসিম আল আসবাহানি’র কিতাবুল হুজ্জাহ, নং ১০৩; আল বাগাওি’র শারহ আস সুন্নাহ, নং ১০৪; আল খাতিব এর তারিখ বাগদাদ, নং ৪/৪৬৯)

হুজ্জাহ এর উপর রচিত কিতাবের লেখক হলেন শাইখ আবু আল ফাতহ নাসর বিন ইবরাহীম আল মাকদিসি আশ শাফি’ই, তিনি দামাস্কাসে বসবাস করতেন। তার কিতাবটি হল আল হুজ্জাহ আলা তারিকি সুলুক তারিক আল মাহাজ্জাহ (যারা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের আচার-ব্যবহার পরিত্যাগ করে তাদের ভ্রান্তির খণ্ডন) – এই কিতাবটিতে সুন্নাহ আলিম কতৃক স্থির করা দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

 

হাদিসের তাফসীর

একজন ব্যক্তি কখনোই পূর্ণ বিশ্বাসী হতে পারবে না যদি তার কামনা-বাসনা আর প্রবৃত্তি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শিক্ষা দেওয়া আদেশ ও নিষেধ সম্পর্কিত কাজের প্রতি অনুগত না হয়। একজন ব্যক্তির উচিত সেটাই ভালবাসা যেটা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশ করেছেন এবং সেটাকে ঘৃণা করা যেটার ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) নিষেধ করেছেন।

কুরআনের একাধিক আয়াতে এ অর্থটির উল্লেখ আছে, আল্লাহ বলেনঃ

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ﴿٦٥﴾

“না, তোমার রবের শপথ, এরা কিছুতেই ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের যাবতীয় মতবিরোধের ফয়সালায় তোমাকে (শর্তহীনভাবে) বিচারক মেনে নিবে, এরপর তুমি যা ফয়সালা করবে সে ব্যাপারে তাদের মনে আর কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না, বরং তোমার সিদ্ধান্ত তারা সর্বান্তকরণে মেনে নিবে।” (সূরা আন নিসা, ৪ :৬৫)

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّـهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ اللَّـهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِينًا ﴿٣٦﴾

“আল্লাহ ও তার রসুল যখন কোন ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তখন কোন মুমিন পুরুষ ও কোন মুমিন নারীর তাদের সে ব্যাপারে নিজেদের কোন রকম এখতিয়ার থাকবে না (- যে তারা তাতে কোন রদবদল করবে)।” (সূরা আল আহযাব, ৩৩ :৩৬)

 

আল্লাহ নিন্দা করেছেন সেসব লোকদের, যারা আল্লাহ যা ভালবাসেন তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে আর আল্লাহ যা ঘৃণা করেন তার প্রতি ভালবাসা পোষণ করে, আল্লাহ বলেনঃ

ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا مَا أَنزَلَ اللَّـهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ ﴿٩﴾

“এর কারন হল, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন (কুরআন, ইসলামিক বিধান ইত্যাদি) সেগুলোকে তারা ঘৃণা করে, তাই আল্লাহ তাদের কর্মসমূহকে নিস্ফল করে দিয়েছেন।” (সূরা মুহাম্মাদ, ৪৭ :৯)

ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّـهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ ﴿٢٨﴾

“এর কারন হল, তারা সেটাই অনুসরন করেছে যা আল্লাহ্‌কে ক্রুদ্ধ করে, আর সেটা ঘৃণা করেছে যা তাকে সন্তুষ্ট করে। তাই তিনি তাদের কর্মসমূহকে নিস্ফল করে দিয়েছেন।” (সূরা মুহাম্মাদ, ৪৭ :২৮)

 

একজন মুসলিমের উচিত আল্লাহ যেটা ভালবাসেন সেটাকেই ভালবাসা, যাতে করে সে এ কারনে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে দেওয়া বাধ্যবাধকতামূলক কাজগুলো সম্পাদন করতে পারে। যদি এমন ভালবাসা বৃদ্ধি পায়, তবে সে নফল আমলগুলো সম্পাদন করবে। তার উচিত আল্লাহ যেটা ঘৃণা করেন তারও সেটা ঘৃণা করা, যাতে করে সে আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন তা বর্জন করতে পারে। যদি এমন ঘৃণার বৃদ্ধি ঘটে, সে এমনকি মাকরুহ আমলগুলোও বর্জন করবে।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমান আনল না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি আমি তোমাদের নিজেদের থেকে, তোমাদের পুত্রদের থেকে, তোমাদের পরিবার ও সকল লোকজন থেকে অধিকতর প্রিয় হই।” (বুখারি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস নং ১৫; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৪৪/৬৯,৭০)

একজন আল্লাহতে বিশ্বাসী বান্দা পূর্ণভাবে বিশ্বাসী গোলাম হতে পারবে না যদি সে সকল লোকদের থেকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ভালবাসার প্রতি অগ্রাধিকার না দেয়। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ভালবাসা হল তাকে (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যিনি পাঠিয়েছেন তার ভালবাসার প্রতি অনুগত হওয়া। সত্যিকারের ভালবাসার দাবী হল যেকোন কিছু ভালবাসা বা ঘৃণা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রিয় কারো অনুসরন করা। আল্লাহ বলেনঃ

قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّـهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّـهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّـهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ﴿٢٤﴾

“বলঃ যদি তোমাদের পিতাদের, তোমাদের পুত্রদের, তোমাদের স্ত্রীদের, তোমাদের স্বজাতি, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের বাণিজ্য যা ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার ব্যাপারে তোমরা ভয় করো, আর তোমাদের বাস করার স্থান যা তোমাদের আনন্দিত করে – যদি এগুলো তোমাদের কাছে আল্লাহ ও তার রসূলের থেকে অধিকতর প্রিয় হয়ে থাকে এবং তার পথে জিহাদ করার থেকে অধিকতর প্রিয় হয়ে থাকে, তবে তোমরা আল্লাহ্‌র (পক্ষ থেকে তার আযাবের) ঘোষণা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো।” (সূরা আত তাওবাহ, ৯ :২৪)

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّـهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّـهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّـهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ ﴿٣١﴾

“বলঃ যদি তোমরা সত্যিই আল্লাহকে ভালোবাসো তবে আমাকে অনুসরন করো (অর্থাৎ, ইসলামিক একত্ববাদ গ্রহণ করো, কুরআন ও সুন্নাহ’র অনুসরন করো), আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন আর তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন।” (সূরা আল ইমরান, ৩ :৩১)

 

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যার মধ্যে তিনটি গুন থাকে সে ঈমানের স্বাদ পায় – (১) আল্লাহ ও তার রসুল অন্য সব কিছুর থেকে বেশী প্রিয় হওয়া, (২) কাউকে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যই ভালবাসা, এবং (৩) কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো অপছন্দ করা।” (বুখারি – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ১৫; মুসলিম – কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৪৩/৬৭,৬৮)

যখন একজন ব্যক্তি অকপটভাবে আল্লাহ ও তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ভালবাসে, তখন সে আল্লাহ ও তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যা ভালবাসেন সেটাই ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যা ঘৃণা করেন সেও তা-ই ঘৃণা করে; আল্লাহ ও তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যে কাজে সন্তুষ্ট থাকে সেও সে কাজে সন্তুষ্ট থাকে এবং আল্লাহ ও তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যে কাজে ক্রোধান্বিত হোন সেও সে কাজে ক্রোধান্বিত হয়। তার উচিত এই ভালবাসা ও ঘৃণা অনুসারে কাজ সম্পাদন করা। সে যদি এমন কোন কাজ করে যা কিনা আল্লাহ ও তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যা ভালবাসেন তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, অথবা এমন কোন কাজ করে যা আল্লাহ ও তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ক্রোধের কারন হয়, তবে এটা এই ইঙ্গিত করে যে তার এই ভালবাসা পূর্ণ নয় এবং তার উচিত আল্লাহ্‌র কাছে তওবা করা আর আল্লাহ্‌র দিকে প্রত্যাবর্তন করা যাতে করে তার এই ভালবাসা পূর্ণতা লাভ করে।

আবু ইয়াকুব আন নাহরাজাওরি বলেন, “যদি কেউ দাবী করে যে সে আল্লাহ্‌কে ভালবাসে কিন্তু তার দেওয়া শিক্ষার প্রতি আনুগত থাকে না, তবে তার দাবী মিথ্যা। এমন প্রত্যেক ব্যক্তি - যারা আল্লাহ্‌কে ভালবাসে কিন্তু তাকে ভয় করে না, তারা মুখলিস ব্যক্তি নয়।”

ইয়াহইয়া বিন মুয়ায বলেন, “যদি কোন ব্যক্তি দাবী করে যে সে আল্লাহ্‌কে ভালবাসে অথচ সে আল্লাহ্‌র দেওয়া শিক্ষার প্রতি অনুগত থাকে না, এর মানে সে এই ভালবাসার দাবীতে সত্য নয়।”

পূর্বেকার দিনের একজন কবি বলেন,

“তুমি আল্লাহ্‌কে অমান্য কর যখন কিনা তুমি দাবী করো যে তুমি তাকে ভালোবাসো

এটা তো এক জঘন্য কাজ,

তোমার ভালবাসা যদি সত্যি হতো, তবে তুমি তাকে মান্য করতে

প্রেমিক তো সবসময়ই প্রিয়কে মান্য করে।”

 

আত্মার খামখেয়ালী

সকল পাপের উৎস হল আত্মার খামখেয়ালীকে আল্লাহ ও তার রসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ভালবাসার উপর অগ্রাধিকার দেওয়া। আল্লাহ মুশরিকদের চিহ্নিত করেছেন তাদের খামখেয়ালী ও প্রবৃত্তির অনুগত হিসেবে, তিনি বলেছেনঃ

فَإِن لَّمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ ۚ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللَّـهِ ۚ إِنَّ اللَّـهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ﴿٥٠﴾

“তবে যদি তারা তোমার এ কথার কোন জবাব না দেয় (অর্থাৎ, ইসলামিক একত্ববাদের মতবাদে বিশ্বাস না করে অথবা তোমাকে অনুসরন না করে),তবে জেনে রাখো যে তারা কেবল তাদের নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। তার চেয়েও অধিক পথভ্রষ্ট আর কে আছে, যে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত (পাওয়া) ছাড়াই কেবল নিজের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করে ? (সূরা আল কাসাস, ২৮ :৫০)

 

একই বিষয় দ্বীনের মধ্যে বিদআত ও পাপসমূহের সম্পর্কে প্রযোজ্য, যেগুলোর উদ্ভব ঘটে প্রবৃত্তি ও খেয়ালখুশী থেকে ইসলামিক বিধান উপেক্ষা করার মাধ্যমে। লোকজনের ভালবাসাকে দ্বীনের শিক্ষার প্রতি অধীন করতে হবে। আল্লাহতে বিশ্বাসী ব্যক্তির উচিত আল্লাহ্‌কে ভালবাসা, এবং সৃষ্টি তার স্রস্টা আল্লাহ রব্বুল আ’লামিনের ভালবাসা পেয়ে থাকে যেমন ফেরেশতাগণ, নবী ও রসুলগণ, শহীদগণ আর সৎ কর্ম সম্পাদনকারীগণ।

ঈমানের মধুরতা অনুভবের একটি নিদর্শন হল আল্লাহ্‌র জন্যই লোকদের ভালবাসা এবং মুশরিকদেরকে আল্লাহ্‌র জন্যই ঘৃণা করা। এভাবে একজন ব্যক্তি দ্বীনের সকল স্তম্ভে একজন মুখলিস ব্যক্তি হিসেবে পরিণত হয়। যদি একজন ব্যক্তি আল্লাহ্‌র জন্যই ভালবাসে, ঘৃণা করে, কিছু প্রদান করে বা কিছু প্রদান করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে, তবে তার ঈমান সম্পূর্ণ। এই অনুভূতিগুলো যদি তার প্রবৃত্তি ও খেয়ালখুশী থেকে উদ্ভুত হয়, তবে তার ঈমান অসম্পূর্ণ এবং তার অবশ্যই আল্লাহ্‌র দিকে ফিরে যাওয়া উচিত।

প্রবৃত্তি ও খেয়ালখুশী নিজের কামনা-বাসনা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যেগুলো কিনা সত্য অনুসরনের বিপরীত, যেমনটি আল্লাহ বলেছেনঃ

وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَىٰ فَيُضِلَّكَ عَن سَبِيلِ اللَّـهِ ۚ

“এবং তোমার কামনা-বাসনার অনুসরণ করবে না, কারন এটা তোমাকে আল্লাহ্‌র পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে।” (সূরা সোয়াদ, ৩৮ :২৬)

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىٰ ﴿٤٠﴾ فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَىٰ ﴿٤١﴾

“যে ব্যক্তি তার রবের সামনে দাঁড়ানোকে (তার সামনে দাঁড়ানোর দিনকে) ভয় করেছে এবং (এ ভয়ে) নিজের নফসকে কামনা-বাসনা থেকে বিরত রেখেছে, নিঃসন্দেহে জান্নাতই হবে তার ঠিকানা।” (সূরা আন নাযিয়াত, ৭৯ :৪০-৪১)

 

প্রবৃত্তি ও খেয়ালখুশী দ্বারা শক্তিশালী ভালবাসাকেও নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে, এগুলো সত্য অথবা পথভ্রষ্টতা’র পথের দিকের প্রবৃত্তিকে ইঙ্গিত করে।

تُرْجِي مَن تَشَاءُ مِنْهُنَّ وَتُؤْوِي إِلَيْكَ مَن تَشَاءُ ۖ

“তুমি ইচ্ছা করলে তাদের (তোমার স্ত্রীদের) মধ্য থেকে কাউকে (নিজের কাছ থেকে) দূরে রাখতে পারো, আবার যাকে ইচ্ছা তাকে নিজের কাছেও রাখতে পারো;” (সূরা আল আহযাব, ৩৩ :৫১)

 

আয়েশা (রাঃ) বলেছেন যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এই আয়াত সম্পর্কে বলেছেন, “আমি দেখেছি যে আল্লাহ তোমার প্রবৃত্তিগুলো পূর্ণ করে দিয়েছেন।” (বুখারি – কিতাবুত তাফসীর, হাদিস ৪৭৮৮; মুসলিম – কিতাবুর রিদা, হাদিস ১৪৬৪)

বদরের বন্দী সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদের মধ্যকার পরামর্শের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে উমার বিন আল খাত্তাব (রাঃ) বলেন, “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার পরিবর্তে আবু বকরের মতামতের প্রতি ইচ্ছুক হলেন।” (মুসলিম – কিতাবুল জিহাদ, হাদিস ৫৮/১৭৬৩)

এমন সংজ্ঞা দিয়ে এই শব্দটি সালাফগণ কতৃক বারবার ব্যবহৃত হয় যা আসলে নির্দেশ করে আল্লাহ্‌র দিকে অন্তরের অনুরক্তিকে, যেমনটি তাদের একজন বলেছিলেন, “আমার অন্তরে থাকা আপনার প্রতি অনুরক্তি আমাকে করেছে আপনার শ্রবণকারী আর আপনার মান্যকারী। আপনার কাছে আছে আমার অন্তর আর আমি ঘুম থেকে হয়েছিলাম বঞ্চিত। আমার অন্তরকে অবকাশ দিন আর আমাকে ঘুমোতে দিন। তা সত্তেও তিনি বললেনঃ আমি দুটোই গ্রহণ করবো।”

 

হাদিসের তাফসীরটি ইমাম ইবন রজব আল-হানবালি’র কিতাব জামি'আল 'উলুম ওয়াল হিকাম এর ইংলিশ ভার্শন থেকে ট্রান্সলেশন করা হয়েছে।

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-v

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ইসলামিক জ্ঞানের কপিরাইট - ইসলাম কি বলে ?

 

 

The Greatest Nation·Saturday, January 7, 2017

 

 

 

প্রশ্নঃ আসসালামু আ’লাইকুম, কপিরাইট ইস্যুতে আমি আপনার জবাবটি শুনেছিলাম। তো এখন আমি জানতে চাই, যে ইসলামিক লেকচারগুলো (কষ্ট করে) তৈরি করা হয় আর কপিরাইট বহন করে, আমাদের কি সেই কপিরাইট মেনে চলা উচিত না ? আসুন ব্যাপারটাকে এভাবে দেখি –

এই লেকচার রেকর্ডের পিছে ব্যয় করা সমস্ত সময় আর প্রচেষ্টা, এরপর তা এডিট করতে সমস্ত সময় ও প্রচেষ্টা এবং ডিভিডির কভার ও কপি তৈরিতে আর সেগুলোকে কেইসে রাখার পিছে সমস্ত সময় ও প্রচেষ্টা করা –আমরা যদি এ সকল বিষয়ের দিকে তাকাই, তবে দেখতে পাবো যে, এগুলোর সাথে (প্রচুর) টাকার ব্যাপারটি যুক্ত হয়, এছাড়া কালি, সিডি ইত্যাদির ব্যাপার তো আছেই।

আর ধরুন কোন ইসলামিক সংস্থা’র কথা, যারা ইসলামিক লেকচার বিক্রি করে আর ওগুলো তৈরি করে। আমাদের কি তাদেরকে সাহায্য-সমর্থন করা উচিত না তাদের প্রোডাক্টগুলো কিনার মাধ্যমে, যাতে করে তারা ভবিষ্যতে আরো ইসলামিক লেকচার তৈরি করতে পারেন ? তাছাড়া অনেক সময় লোকেরা তো জীবিকা নির্বাহের জন্যই এই কাজ করেন ।

সুতরাং, এ সমস্ত বিষয় থাকার পরও কি কপিরাইট করার ব্যাপারটি হারাম হবে ? আপনি কি এ ব্যাপারগুলো আমাকে পরিস্কার করে বুঝাতে পারবেন ?

ভাই শাইখ ফায়েজ, আল্লাহ আপনাকে সর্বোত্তম পুরস্কার জান্নাত দেওয়ার মাধ্যমে পুরস্কৃত করুন, আমীন।

ওয়া আ’লাইকুম আস-সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ

 

জবাবঃ

আসসালামু আ’লাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু,

প্রিয় ভাই আহমাদ, আল্লাহ’র কাছে আমি দুয়া করি যেন তিনি আপনার ইলম বৃদ্ধি করে দেন, এমন ইলম যা আমল করা হয়, এরপর তা অপরকে শিখানো হয়, এরপর সবর করা হয় দুর্দশার সময়টাতে – এভাবেই সেই ইলম নিজের মধ্যে প্রতিপালন করা হয়।

এই ইস্যুতে আপনার বুঝটির তারীফ করি আর আমি আপনার মতের প্রতি সম্মানও করি।

কিন্তু এই ইস্যুতে কোন সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করা দরকার বলে আমি বিশ্বাস করি, কারন নিশ্চয়ই এটি এমন একটি ইস্যু, যেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে।

প্রথমত – ইসলাম কারো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। কুরআন ও সুন্নাহ তো হল মানুষের প্রতি নাযিলকৃত ওহী, যাতে করে তারা এর অনুসরণ করতে পারে।

দ্বিতীয়ত – ইসলামিক ইলম কি ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধীনে করা যাবে কিনা বা বেচা-কেনা করা যাবে কিনা – এ নিয়ে আল্লাহ’র কালামে বা সুন্নাহতে কোন নজির নেই, অথবা পূর্ববর্তী ফুকাহায়ে কেরামগণের কোন মতও নেই।

তৃতীয়ত – ইসলামিক ইলম কপিরাইট করাকে আমি এই চমৎকার দ্বীন ইসলাম প্রসারের একটি বড় বাধা হিসেবেই দেখি, যেহেতু অনেক লোকই - আমার মতে অধিকাংশ লোকই কেবল তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণেই সামর্থ্য রাখে, তাই কপিরাইটের ব্যাপারটি এই লোকগুলোকে তাদের দ্বীন শিখাতে বাধা দেয়।

চতুর্থত – অনেক লোকই অনলাইনে ইসলামিক ম্যাটরিয়ালগুলো কিনেন, এক্ষেত্রে তাদেরকে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মতো হারাম কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়।

পঞ্চমত – অধিকাংশ লোকের কাছেই বর্তমানে কপিরাইট করার বিষয়টি ব্যবসা হয়ে গেছে, যখন কিনা অনেক লোকই দাওয়াহ করার সত্যিকারের ফোকাসটিই হারিয়ে ফেলেছে - যেটা কিনা কেবল আল্লাহ’র জন্যই হওয়া উচিত।

এসব কিছু থেকে এবং আরো অনেক কিছু থেকে আমি যা দেখতে পাই হে আমার প্রিয় ভাই আহমাদ, এই চমৎকার দ্বীনের প্রসারের একটি বড় বাধা হল এই কপিরাইটের ব্যাপারটি।

মহান আল্লাহ বলেছেন,

“এবং আপনার পালনকর্তার নেয়ামতের কথা প্রকাশ করুন।” (সূরাহ আদ-দুহা, আয়াত ১১)

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ প্রচার করো – এমনকি এক আয়াত হলেও।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেনঃ যে-ই লোকদেরকে সঠিক পথের দিকে আহবান করবে, সে তাদের মতোই পুরস্কৃত হবে –যারা সে হিদায়াতের অনুসরণ করবে, আর সেটা তাদের সওয়াবের কোন কমতি না করেই।

সুতরাং একজন ব্যক্তি কিভাবে মহামূল্যবান সম্পদ এই দ্বীন ইসলামের দাওয়াত বহন করবেন, যখন কিনা তিনি কপিরাইটের কারনে সেটা করতে বাধা পান ?

আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের ত্রুটির জন্য ক্ষমা করুন আর তিনি যা ভালোবাসেন ও যেটার প্রতি সন্তুষ্ট, সেটার প্রতিই আমাদেরকে হিদায়াত দিন, আমীন।

এটিই আমার মত। আর আল্লাহই তো সবচেয়ে ভালো জানেন।

ওয়া আ’লাইকুম আসসালাম ওয়া রহমাতুলাহি ওয়া বারাকাতুহু।

 

শায়খ সুলাইমান ইবনে নাসির আল-আলওয়ানকে কপিরাইট ইস্যু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি যে জবাব দিয়েছিলেন সেটাতে এই কথাগুলো রয়েছে -

প্রথমত, এটি একটি ইখতিলাফপূর্ণ ইস্যু, যেটাতে আলিমগণ মতভেদ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ সীমাবদ্ধতা ছাড়াই কপিরাইটের এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন, কেউ কেউ সীমাবদ্ধতা ছাড়াই এই ধারণাটি গ্রহণ করেছেন, আর কেউ কেউ এর বর্ণনা অনুসারে একে ব্যাখ্যা করেছেন।

তৃতীয়ত, এ ব্যাপারে শায়খের উপসংহার হল এই যে, যেটা আপনার নিজের করা কাজ না, সেটা কপিরাইট করা যাবে না, যেমন – আমাদের পূর্ববর্তী আলিমদের কোন কাজ; উদাহারন হিসেবে বলা যায় – একজন ব্যক্তি তাদের একটি কাজ (যেমন - কোন কিতাব) গ্রহণ করলো, আর সেই কাজটির অধিকার দাবী করলো এ কারনে যে, তিনি সেই কাজটি পাবলিশ করেছেন।

চতুর্থত, কিন্তু ব্যক্তি যদি নিজেই কাজ করেন (অর্থাৎ, নিজেই কিতাব রচনা করেন বা অন্য কিছু করেন), তবে তার অধিকার আছে বেচা-কেনার শর্তে এর কপিরাইট করা। এক্ষেত্রে কারো জন্যই এই কপিরাইটেড প্রোডাক্টটি কপি করা ও এ থেকে আয় করা উচিত হবে না এর মালিকের অনুমতি ছাড়া।

পঞ্চমত, কিন্তু কেউ যদি শেখার বা শেখানোর জন্য, দাওয়াহ’র প্রসারের জন্য ইত্যাদি কারনে এটি কপি করতে চায়, তবে তার অধিকার আছে সেটা করার যদিও এটা কপিরাইটেড; তবে সে এটাকে আয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত করতে পারবে না। আর যদি সে এর মালিককে সম্মানি দিতে পারে, তবে তার তো সেটাই করা উচিত, যেহেতু এর মালিকের সেই কাজটির জন্য শুরু থেকেই সেটার পিছে সময় ও টাকা খরচ হয়েছে।

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

 

ইংলিশ থেকে ভাবানুবাদ করা হয়েছে এই লিঙ্ক থেকে

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সূরাহ আলি ইমরানের ১২০ নাম্বার আয়াতের তাফসীর

 

 

The Greatest Nation·Friday, July 29, 2016

 

 

 

وَإِن تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا ۗ إِنَّ اللَّـهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ

“এবং যদি তোমরা সবর করো আর তাকওয়া অবলম্বন করো, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা কিছু করছে তা সবই আল্লাহ’র (জ্ঞান ও শক্তির) আওতাভুক্ত।” (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ :১২০)

 

ইমাম ইবনে কাসির তাফসীর করেছেন -

আল্লাহ মুমিনদের সম্বোধন করে বলছেনঃ হে মুমিনগণ, যদি তোমরা তাদের দুষ্টামি থেকে মুক্তি পেতে চাও, তবে ধৈর্যধারণ করো, সংযমী হও আর আমার উপর নির্ভর করো, আমি তোমাদের শত্রুদেরকে ঘিরে নেবো। কোন মঙ্গল লাভ করা আর কোন অমঙ্গল থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহ যা চান তা-ই হয়, যা চান না তা হতে পারে না। তোমরা যদি আল্লাহ’র উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করো, তবে তিনিই তোমাদের জন্য যথেষ্ট।

এ সম্পর্কেই এখন উহুদ যুদ্ধের বর্ণনা শুরু হচ্ছে – যার মধ্যে মুসলমানদের ধৈর্য ও সহনশীলতার বর্ণনা রয়েছে, আর যার মধ্যে রয়েছে আল্লাহ’র পরীক্ষার পূর্ণচিত্র, যা দ্বারা মুমিন ও মুনাফিকদের মধ্যে পার্থক্য প্রকাশ পেয়েছে। (এরপর উহুদ যুদ্ধ সংক্রান্ত আয়াত শুরু)

(তাফসীর ইবনে কাসির)

 

ইমাম আত-তাবারি তার তাফসীরে বলেছেন –

ইবনে জুরাইজ এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন, “এর অর্থ হল, আল্লাহ মুমিনদেরকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেছেন, যদি তোমরা আল্লাহ’র অনুগত হও আর তাদের আদেশ পালন ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে সবর করো, যেসব ইয়াহুদির সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য আল্লাহ নিষেধ করেছেন তাদেরকে তোমরা বর্জন করো, অনুরূপভাবে আল্লাহ’র সব নিষেধাজ্ঞা মেনে চল, তাকওয়া অবলম্বন করো, মহান আল্লাহ’র হক ও রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হক সম্পর্কে সতর্ক হও - তাহলে যেসব ইয়াহুদির বর্ণনা আল্লাহ মুসলমানদের অবহিত করেছেন, মুসলমানদের সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য যারা সব সময় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের কোন ষড়যন্ত্রই তোমাদের কোন ক্ষতিই করতে পারবে না।”

(তাফসীর তাবারি)

 

সাইয়েদ কুতুব এ আয়াত প্রসঙ্গে তাফসীর করেছেন –

“অর্থাৎ, তাদের ক্ষতি ও চক্রান্ত থেকে বাঁচার উপায় হল, তারা শক্তিশালী হলেও তাদের শক্তির সামনে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্যধারণ করা, আর তারা যদি যুদ্ধ কিংবা ষড়যন্ত্রের পথ ধরে, তবে তাকেও দৃঢ়তার সাথে রুখে দাঁড়ানো। তাদের মৈত্রী ও বন্ধুত্ব লাভের আশায় আদর্শের ব্যাপারে আপোষ করার বদলে দৃঢ়তা ও সবর অবলম্বনই মুসলমানদের বাঁচার একমাত্র পথ। সেই সাথে একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করা আর আল্লাহ’র সাথে সব কিছুকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আল্লাহভীরু মানুষ আদর্শের প্রশ্নে কারো সাথে আপোষ করে না আর আল্লাহ’র রজ্জু ছাড়া আর কোন রজ্জু ধারণ করে না। হৃদয় যখন আল্লাহ’র সাথে মিলিত হবে, তখন তা আল্লাহ’র শক্তি ছাড়া আর সকল শক্তিকে তুচ্ছ মনে করবে, আর এ সম্পর্ককেই সে নিজের অত্যাবশ্যকীয় বস্তু মনে করবে। এর ফলে আত্মরক্ষার্থে বা সম্মান লাভের উদ্দেশ্যে কোন দুশমনকে তোয়ায করবে না।

বস্তুত সবর, তাকওয়া, দৃঢ়তা ও আল্লাহ’র রজ্জু ধারণ – এ কয়টি জিনিষই হল মুসলমানদের বাঁচার উপায়। যতদিন মুসলমানেরা একমাত্র আল্লাহ’র রজ্জকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছে আর নিজেদের সমগ্র জীবনে আল্লাহ’র বিধানকে বাস্তবায়িত করেছে, ততদিন তারা শ্রদ্ধাভাজন থেকেছে, বিজয়ী হয়েছে। আল্লাহও তাদেরকে তাদের শত্রুদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেছেন আর তাদের আদর্শই সর্বোচ্চ আসনে আসীন হয়েছে। মুসলমানেরা তাদের ইতিহাসের কোন পর্যায়ে যখনই তাদের আজন্ম দুশমন (ইয়াহুদি, খ্রিস্টান বা পৌত্তলিকদের) ধ্বজাধারী ও পদলেহি হয়েছে, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেছে আর তাদেরকে উপদেষ্টা, বিশেষজ্ঞ ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করেছে, তখনই আল্লাহ তাদের ভাগ্যে জুটিয়েছেন পরাজয় ও লাঞ্ছনা। মুসলমানদের এই আজন্ম শত্রুরা প্রকাশ্যে হোক আর গোপনেই হোক – ইসলামী আকিদা, আদর্শ ও জীবন পদ্ধতির বিরুদ্ধে সবসময়ই যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, আল্লাহ’র বাণীই চিরস্থায়ী আর আল্লাহ’র নীতিই কার্যকর। আল্লাহ’র এই নীতির প্রতি যারা ভ্রূক্ষেপ করে না, তাদের ভাগ্যে অপমান ও লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছুই জুটে না।”

(তাফসীর ফি জিলালিল কুরআন)

 

মাওলানা মুফতি শফি তাফসীর করেছেন –

যাবতীয় বিপদাপদ ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য সবর ও তাকওয়াকে কুরআন শুধু এ আয়াতেই নয়, বরং অন্যান্য আয়াতেও একটি কার্যকরী প্রতিষেধক হিসেবে বর্ণিত করেছে।

(মা’রিফুল কুরআন)

 

আয-যামাখশারী তাফসীর করেছেন –

এটি আল্লাহ’র পক্ষ থেকে শিক্ষা ও নির্দেশনা যে, শত্রুদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবর ও তাকওয়ার মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা হোক।

(আল-কাসশাফ)

 

আব্দুর রহমান ইবনে নাসির আস-সাদি তাফসীর করেছেন –

মহান আল্লাহ তাদের কঠিন শত্রুতা বর্ণনা ও তাদের কুস্বভাবগুলো স্পষ্ট করার পর মুমিন বান্দাদেরকে সবর ও তাকওয়ার সাথে জড়িত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। (আর বলেছেন যে,) যখন তারা এমন করবে, তখন শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কারন মহান আল্লাহ তাদেরকে আর তাদের কাজগুলো ও ষড়যন্ত্রগুলোকে বেস্টন করে রেখেছেন এবং তিনি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছেন যে, তোমাদের তাকওয়া অবলম্বন করার স্থিতিতে তারা তোমাদের কোন ক্ষতিই করতে পারবে না।

(তাফসীরে সাদি)

 

মাহমুদ আল-আলুসি তাফসীর করেছেন –

সবর ও তাকওয়ার বরকতের কারনে তার তোমাদের ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না – না বেশী, না কম। কারন এ দুটো হল উত্তম আনুগত্য আর উৎকৃষ্ট চরিত্রের শামিল। এ দুটি বৈশিষ্ট্যতে নিজেকে সুসজ্জিতকারী ব্যক্তি শত্রুর ষড়যন্ত্রের মুকাবিলায় মহান আল্লাহ’র সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে চলে আসে।

(রুহুল মা’আনি, তাফসীরে কুরতুবি)

 

মুফতি মুহাম্মাদ আশিক ইলাহি তাফসীর করেছেন –

“সবর অবলম্বন করা, সৎ কাজ করা আর পাপ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে মুসলিমেরা তাদের শত্রুদের আক্রমণকে পরাস্ত করতে পারে, এগুলোই হল তাদের আক্রমণ নিবৃত্ত করার সত্যিকারের অস্ত্র।”

(তাফসীর আনওয়ারুল বায়ান)

 

ইমাম ফখরুদ্দিন আর-রাযি তাফসীর করেছেন,

এ আয়াতের অর্থ হল, যে ব্যক্তি আল্লাহ’র আদেশ পালনে সবর করে আর তার নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকে, সে আল্লাহ’র নিরাপত্তায় চলে আসে আর তাকে কাফিরদের ষড়যন্ত্র তথা ফন্দিবাজদের ফন্দি ক্ষতি পৌঁছাতে পারে না।

মুল বাস্তব কথা হল তো এটাই, মহান আল্লাহ সৃষ্টিকে নিজের ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তাই এ সম্পর্কে বন্দেগীর চুক্তি পূর্ণ না করা মহান আল্লাহ’র মাহাত্ম্যের পরিপন্থি। এ বাস্তবতার দিকেই মহান আল্লাহ’র নিন্মোক্ত বাণীতে ইঙ্গিত করা হয়েছে –

“আর যে কেউ আল্লাহ’র (প্রতি) তাকওয়া অবলম্বন করবে, আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ বের করে দিবেন আর তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রুযী দান করবেন।” (সূরাহ আত-তালাক, ৬৫ :২-৩)

(তাফসীরে কাবির)

 

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করুন এখান থেকে

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-2h

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

পর্দাহীনতাঃ যেভাবে শুরু

 

 

The Greatest Nation·Saturday, July 30, 2016

 

 

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগ থেকে হিজরি চৌদ্দ শতাব্দীর মাঝ পর্যন্ত মুসলিম নারীরা পূর্ণ পর্দা করতো,চেহারাও ঢেকে রাখতো, শারীরিক কোন সৌন্দর্য প্রদর্শন করে পথে-ঘাটে বের হতো না। হিজরি চৌদ্দ শতাব্দীর শেষভাগে ইসলামী শাসনব্যবস্থা তথা খিলাফতের ধারা সমাপ্তির পরপরই মুসলিম সমাজে ইসলামী রীতি-নীতিতে বিকৃতি সাধনে পশ্চিমা উপনিবেশই প্রথমত প্রধান ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে মিশরের নারীরাই সবার আগে চেহারা থেকে পর্দা খুলে ফেলে।

মিশরের বাদশাহ মুহাম্মাদ আলি পাশা উচ্চ শিক্ষার জন্য মুসলিম শিক্ষার্থীদের কে ফ্রান্সে পাঠাতে থাকে। সেসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক শিক্ষার্থীর নাম ছিল রেফায়া তাহতাবী। সে শিক্ষাগ্রহন শেষে মিসরে ফিরে আসার পর নারীদের চেহারা থেকে পর্দা খুলে ফেলার জন্য আন্দোলন শুরু করলো। রেফায়া তাহতাবীর পর মারকাস ফাহমী নামক এক খ্রিস্টান লেখক এ আন্দোলন অব্যাহত রাখলো। সে “আল-মারআতু ফিশ-শারকী” নামে একটি বই লিখলো, যে বইতে সে নারীদেরকে পর্দা থেকে বেরিয়ে আসার এবং পুরুষ-নারীর অবাধ বিচরনের প্রতি ব্যাপক উৎসাহ যোগালো।

মিসরের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আহমাদ লুতফী সাইয়্যেদই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যে মিসরীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় সহশিক্ষার আবির্ভাব ঘটায়। আহমাদ লুতফী সাইয়্যেদের পর ত্বহা হুসাইন আর কাসিম আমীন নামের দুই ব্যক্তি এ আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করে। কাসিম আমীন তো এ ব্যাপারে “তাহরিরুল মারআহ” (নারীর মুক্তি) আর “আল-মারআতুল জাদিদাহ” (আধুনিক নারী) নামের দুটো বইও লিখে ফেলে। কাসিম আমিনের বই দুটো পড়ে সাদ যাগলুল আর আহদম যাগলুল খুবই প্রভাবিত হল। তারা দুজনও পর্দাহীনতার এ আন্দোলনকে সফল করতে উঠেপড়ে লাগলো।

পরে কায়রোতে শারাবীর নেতৃত্বে নারী স্বাধীনতা আন্দোলন নতুন রূপে আবির্ভূত হয়, যে আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মুসলিম নারীদের চেহারা থেকে পর্দা হটানো। নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সমাবেশ ১৯২০ সালে মিসরের মুরকাসায় অনুষ্ঠিত হয়। হুদা শারাবীই ছিল মিসরের সর্বপ্রথম নারী, যে কিনা পর্দাশীলা মুসলিম নারীদের শরীর থেকে পর্দা ছিনিয়ে নেওয়ার দুঃসাহস করেছিলো।

অবশেষে সাদ যাগলুল ব্রিটেন থেকে ফিরে আসার দিন ঘনিয়ে এলো। তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বিমান বন্দরে দুটো বড় তাঁবু স্থাপন করা হল। একটিতে ছিল পুরুষ, অপরটিতে নারী। সাদ যাগলুল বিমান থেকে নেমে সোজা নারীদের তাবুর দিকে চললো, যে তাঁবু পর্দাশীনা বহু নারীর উপস্থিতে ভরপুর ছিল। সে তাঁবুতে প্রবেশ করা মাত্রই হুদা শারাবী তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় বরণ করে নিলো। হুদা নিজেও তখন আপাদমস্তক পর্দাবৃত ছিল। সাদ যাগলুল এক ঝটকায় হুদার চেহারা থেকে পর্দা খুলে ফেললো। পুরো তাঁবু তখন করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। সাথে সাথে তাঁবুতে উপস্থিত বাকি সব নারীরাও চেহারা থেকে পর্দা সরিয়ে ফেললো। আর এভাবেই পর্দাহীনতার আনুষ্ঠানিক সূচনার পূর্ব পরিকল্পিত নাটক মঞ্চায়িত হল।

পরে কায়রোতে নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের আরেকটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সে সমাবেশে সাদ যাগলুলের স্ত্রী সফিয়া ফাহমীও উপস্থিত ছিল। সে প্রকাশ্য দিবালোকে হাজারো মানুষের সামনে নিজের পরিধেয় বোরকাটি খুলে পায়ের নিচে মাড়িয়ে ফেললো। সমাবেশে উপস্থিত বাকি নারীরাও তার অনুসরণ করলো। তারপর মাটিতে পড়ে থাকা সেই বোরকাগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হল।

১৯৯০ সালে “আস-সাফুর” (পর্দা হীনতা) নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হল। যেটির উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তুতে ছিল নামের যথার্থতার বিচ্ছুরণ। ম্যাগাজিনের প্রতিটি পাতা ছিল নারী-পুরুষের সমান অধিকারের দাবিতে সোচ্চার। আর সে অধিকার আদায়ে ম্যাগাজিনের লেখক সম্প্রদায় মুসলিম নারীর পর্দাকে “অনাবশ্যক আবরণ” ব্যাখ্যা দিয়ে শরীর থেকে তা ছুড়ে ফেলে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার প্রতি উৎসাহ যোগাচ্ছিলো। ম্যাগাজিনটির বিশেষ কিছু পাতা অভিনেতা-অভিনেত্রী ও মুক্তমনা নারীদের জন্য বরাদ্দ ছিল।

ধীরে ধীরে পথে ঘাটে পর্দাহীনা মুসলিম নারীর নির্লজ্জ চলাফেরা মামুলি বিষয় হয়ে গেলো। যে মিসরের হাজার বছরের ইতিহাসে পথে-প্রান্তরে মুসলিম নারীর বেপর্দা চলাফেরার নজির মেলাটাই দুস্কর ছিল, সেখানে নারী স্বাধীনতার নামে পর্দাহীনতার কুপ্রথা ব্যাপকতা লাভ করলো।

এরপর নারী স্বাধীনতা আন্দোলন নামের সংগঠনটি তাদের পরবর্তী এজেন্দা বাস্তবায়নে তৎপর হল। তারা নারীদেরকে ঘর থেকে বের করে পুরুষের মাঝে দাঁড় করিয়ে দিলো। এখন তো নারী এয়ার হোস্টেস হয়েছে, বিমানে যাত্রীদের সেবিকার কাজ করছে। মদের দোকানে কাস্টমারের গ্লাস ভরে দিচ্ছে। হোটেল রিসিপশনে রূপের পসরা সাজিয়ে গ্রাহকের কামনার খোরাক যোগাচ্ছে। আর এভাবেই মুসলিম নারী তার স্বকীয়তা হারিয়ে পুরুষের মনোরঞ্জনের পণ্যে পরিণত হয়েছে।

অবশেষে কালের আবর্তে মুসলিম দেশগুলোতেও ব্যাভিচার ও বেহায়াপনা ঘাঁটি গেঁড়ে বসলো। নারী-পুরুষের পারস্পরিক সন্তুষ্টির শর্তে ব্যভিচারের শাস্তি তুলে নেওয়া হল। তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, আলবেনিয়া, সোমালিয়া, আলজেরিয়াসহ আরো বহু মুসলিম দেশে যথারীতি আইনপাশ করে পর্দা পালনে কঠোরতা আরোপ করা হল আর পর্দাশীনা নারীদেরকে শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করানোর ঘোষণা দেওয়া হল।

 

সূত্রঃ ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে (শাইখ মুহাম্মাদ আল-আরিফি)

আর্টিকেলটি পিডিএফ হিসেবে ডাউনলোড করুন এখান থেকে

ব্লগ লিঙ্কঃ http://wp.me/p43zxV-2m

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শত্রুর দৃষ্টি থেকে গোপন থাকার আমল

 

 

The Greatest Nation·Monday, April 3, 2017

 

 

 

হজরত কা’ব বলেনঃ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মুশ্রিকদের দৃষ্টি থেকে আত্মগোপন করতে চাইতেন, তখন কুরআনের তিনটি আয়াত তিলাওয়াত করতেন; এর প্রভাবে শত্রুরা তাকে (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখতে পেতো না। আয়াত তিনটি হলঃ সূরা কাহাফের (৫৭ নাম্বার) আয়াত,

.

إِنَّا جَعَلْنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَن يَفْقَهُوهُ وَفِي آذَانِهِمْ وَقْرًا

.

সূরা নাহলের (১০৮ নাম্বার) আয়াত,

.

أُولَـٰئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللَّـهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ ۖ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ

.

সূরা জাশিয়া’র (২৩ নাম্বার) আয়াত,

.

أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَـٰهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّـهُ عَلَىٰ عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَىٰ بَصَرِهِ غِشَاوَةً

.

হজরত কা’ব বলেনঃ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এই ব্যাপারটি আমি সিরিয়ার এক ব্যক্তির কাছে বর্ণনা করি। তিনি কোন প্রয়োজনে রোমে গমন করেন। বেশ কিছুদিন সেখানে অবস্থান করার পর তিনি রোমীয় কাফিরদের নির্যাতনের শিকার হয়ে পড়লে প্রাণের ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। শত্রুরা তার পিছু নেয়, এমন সংকটময় মুহূর্তে হঠাৎ হাদিসটি তার মনে পড়ে। তিনি দেরী না করে আয়াত তিনটি তিলাওয়াত করতেই শত্রুদের দৃষ্টির সামনে পর্দা পড়ে যায়। তিনি যে রাস্তায় চলছিলেন, শত্রুরাও সেই রাস্তাতেই চলাফেরা করছিলো, কিন্তু তারা তাকে দেখতে পাচ্ছিলো না।

.

ইমাম সা’লাবি বলেনঃ হযরত কা’ব থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতটি আমি ‘রাই’ অঞ্চলের এক ব্যক্তির কাছে বর্ণনা করেছিলাম। ঘটনাক্রমে সায়লামের কাফিররা তাকে গ্রেপ্তার করে। তিনি কিছুদিন কয়েদে থাকার পর সুযোগ পেয়ে পালিয়ে যান। শত্রুরা তাকে পেছনে ধাওয়া করে। তিনি আয়াত তিনটি তিলাওয়াত করলে আল্লাহ তাদের চোখের উপর পর্দা ফেলে দেন। ফলে তাদের দৃষ্টি থেকে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান, অথচ তারা পাশাপাশি চলছিল আর তাদের কাপড় তার কাপড় স্পর্শ করছিলো।

.

ইমাম কুরতুবি বলেনঃ এই আয়াত তিনটির সাথে সূরা ইয়াসিনের সেই আয়াতগুলোও মিলানো উচিত, যেগুলো রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের সময় তিলাওয়াত করেছিলেন। তখন মক্কার মুশ্রিকেরা তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বাসা ঘেরাও করে রেখেছিলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়াতগুলো তিলাওয়াত করে তাদের মাঝখান দিয়ে চলে যান, বরং তাদের মাথায় ধুলো নিক্ষেপ করতে করতে যান, কিন্তু তাদের কেউ টেরও পায়নি। সূরা ইয়াসিনের আয়াতগুলো হলঃ

.

يس ﴿١﴾ وَالْقُرْآنِ الْحَكِيمِ ﴿٢﴾ إِنَّكَ لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ ﴿٣﴾ عَلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ ﴿٤﴾ تَنزِيلَ الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ ﴿٥﴾ لِتُنذِرَ قَوْمًا مَّا أُنذِرَ آبَاؤُهُمْ فَهُمْ غَافِلُونَ ﴿٦﴾ لَقَدْ حَقَّ الْقَوْلُ عَلَىٰ أَكْثَرِهِمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ ﴿٧﴾ إِنَّا جَعَلْنَا فِي أَعْنَاقِهِمْ أَغْلَالًا فَهِيَ إِلَى الْأَذْقَانِ فَهُم مُّقْمَحُونَ ﴿٨﴾ وَجَعَلْنَا مِن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لَا يُبْصِرُونَ

.

ইমাম কুরতুবি বলেনঃ আমি স্বদেশ আন্দালুসে করডোভার নিকটবর্তী মনসুর দুর্গে নিজেই এ ধরণের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম। অবশেষে নিরুপায় অবস্থায় আমি শত্রুদের সামনে দিয়ে দৌড়ে এক জায়গায় বসে গেলাম। শত্রুরা দুই জন অশ্বারোহীকে আমার পিছে ধাওয়া করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে। আমি সম্পূর্ণ খোলা মাঠেই ছিলাম, নিজেকে আড়াল করার মত কোন বস্তুই ছিল না। আমি তখন বসে বসে সূরা ইয়াসিনের আয়াতগুলো তিলাওয়াত করছিলাম। অশ্বারোহী ব্যক্তি দুই জন আমার সম্মুখ দিয়ে ‘লোকটি কোন শয়তান হবে’ বলতে বলতে যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই ফিরে গেলো। তারা আমাকে অবশ্যই দেখেনি, আল্লাহ তাদেরকে আমার দিক থেকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন।

.

উৎসঃ তাফসীরে মা’রিফুল কুরআনে সূরা বানী ইসরাইলের তাফসীরের অংশে তাফসীরে কুরতুবির রেফারেন্সে এর উল্লেখ আছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সম্মানিত মুসলিম বোনদের ব্যাপারে শয়তানী চক্রান্ত

 

 

The Greatest Nation·Thursday, February 2, 2017

 

 

 

কানয দ্বীপ ও পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশের সামাজিক জীবনব্যবস্থার মাঝে খুব একটা তফাৎ ছিল না। পথে বের হলেই চারদিকে উঁচু মিনারের সুদৃশ্য মসজিদ আর নূরানি চেহারার মুসলমান চোখে পড়তো। যা পথের শোভা বহুগুণে বাড়িয়ে দিতো। পুরুষদের মন আত্মমর্যাদা ও পৌরুষত্বের মহিমায় ভরপুর ছিল। রাস্তায় কিংবা বাসে কোন নারীর সাথে অশালীন আচরণ করার মতো দুঃসাহস ছিল না কারোই। নারীরাও নিজেদেরকে লজ্জার আবরণে সবসময় আবৃত রাখতেন।

অধিকাংশ নারী শরঈ পর্দা পালনে ব্রতী ছিলেন। আর এভাবেই তারা নিজেদেরকে পুরুষের কামুক দৃষ্টি ও উপহাসমূলক বাক্যবাণ থেকে নিরাপদ রাখতেন।

দ্বীপটিতে একজন আলিম ছিলেন। ছোট বড় সবাই তাকে সশ্রদ্ধ মুহাব্বত করতো। বাদশাহ, আমীর-উমারা, মন্ত্রি-আমলা, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ সবার পছন্দনীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। জনসাধারণের কাছে তার বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ছিল ঈর্ষনীয়। তিনি যা বলতেন, নির্দ্বিধায় সবাই তা মেনে নিতো। বাস্তবে তিনি ছিলেন অতি মর্যাদাবান আল্লাহভীরু একজন আলিম। মহান প্রভুর সান্নিধ্য অর্জনের নিমগ্নতায় কেটে যেতো তার রাত-দিন।

কানয দ্বীপের টেলিভিশনগুলোতেও উন্মত্ত নৃত্য-গীতির পসরা ছিল না, আর না ছিল কোন নারীর উপস্থিতি। বড় সুন্দর ও শান্তিময় ছিল কানয দ্বীপের জীবন। মানুষেরা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ঝগড়া বিবাদে জড়াতো না। আলেম সাহেব কোন বিষয়ে ফতোয়া দিলে লোকেরা তা অকপটে মেনে নিতো। জুমার দিন খতীব সাহেব প্রদত্ত খুৎবা ও আল্লাহ’র পথে আহ্বানকারীর সুমিষ্ট বাণী তারা মনোযোগের সাথে শুনতো আর আমলে পরিণত করতো। দ্বীপের লোকদের উপর বিজাতীয় সংস্কৃতি তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

তবে মাঝে মাঝে বিজাতীয় কৃষ্টির পক্ষে কিছু ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যেতো। যাদের মুখ থেকে এ আওয়াজ বের হতো, তারা বিজাতীয়দের জীবনধারায় আসক্ত ও শত্রুপক্ষের চক্রান্তের শিকার ছিল। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের কিছু কর্মচারীও নির্লজ্জতার প্রসার আর অশ্লীল চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে পাপের বীজ বপনে তৎপর ছিল। এরপরেও তাদের প্রচেষ্টা সমাজে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নি।

এরপর বহুবছর কেটে গেছে। প্রচার মাধ্যমও পৌঁছেছে উন্নতির শিখরে। কানয দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছে গেছে ডিশ, অর্থাৎ স্যাটেলাইট কানেকশন। আর স্যাটেলাইট কানেকশনের হাতে ধরে এখানে বেদ্বীন-কাফেরদের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটতে লাগলো। দ্বীপের অধিবাসীরা এখন টিভির পর্দায় এমন মানুষদের দেখতে লাগলো, যাদের জীবনধারা ছিল পশুসুলভ; বরং আরো নিন্মতর। খানা-পিনা, ভোগবিলাস ও আনন্দ-ফুর্তি ছাড়া যাদের কাছে জীবনের অন্য কোন অর্থ ছিল না। আর ছিল না নামায-রোজা কিংবা আত্মিক পবিত্রতা বা দৈহিক পরিচ্ছনতার কোন বালাই।

কানয দ্বীপের মুসলিম নারীগণ টেলিভিশনের পর্দায় উলঙ্গ-বেহায়া নারীদের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখতে লাগলো। দ্বীপের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম মহোদয় চিৎকার করে বলতে লাগলেন – “আল্লাহ্‌কে ভয় করো, বিজাতিদের অনুসরণ থেকে বাঁচো। নিজ দ্বীনের উপর অবিচল থাকো।”

তিনি নারীদের প্রতি বিশেষভাবে আহ্বান জানালেন – “তোমরা হিজাব খুলো না, পর্দা ছেড়ো না। তোমরা হলে মূল্যবান রত্ন, যে কারো তোমাদের দেখার বৈধতা নেই। তোমরা সতীসাধ্বী। তোমরা আমাদের মা, আমাদের বোন, আমাদেরই মেয়ে। আমাদের ইজ্জত তোমরা।”

তিনি তাদের হাতে পায়ে ধরে ধ্বংসের গহ্বর থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে চাইলেন। দ্বীপের অন্যান্য আলেমগণও রেডিও, টিভিসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সহায়তায়, জুময়ার খুৎবার আলোচনায়, লেখালেখির সক্রিয়তায় নানাভাবে এর কুফল তুলে ধরেছিলেন। তারা ভয় পাচ্ছিলেন যে, নদীর উত্তাল তরঙ্গে ভাসমান নৌকাতে ফুটো হয়ে গেলে সেটার নিমজ্জন সুনিশ্চিত। লোকেরা আলেমদের ভালোবাসতো বলে তাদের কথা মানতে লাগলো।

কয়েক বছর পরের কথা। সর্বজন শ্রদ্ধেয় সেই আলিম ব্যক্তিটি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার সমকালীন বাকি আলেমগণও একে একে সবাই প্রভুর সান্নিধ্য গ্রহণ করেছেন। জীবিতরা পূর্বসূরিদের মহান দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। তারা সেই নৌকাটিকে নিমজ্জনের হাত থেকে বাঁচাতে সচেষ্ট রইলেন।

এদিকে শত্রুপক্ষও বসে নেই। তারা লোকদেরকে ডেকে ডেকে বলছে – “হে দ্বীপবাসী, তাকাও আমাদের দিকে। দেখো, কতো আনন্দময় আমাদের জীবন। যুবকের বাহুতে যুবতী নারী, যখন যেখানে খুশী দুজন দুজনার সান্নিধ্য গ্রহনে কোন বাধা নেই। দেখো, মেয়েরা সমুদ্র তটের মুক্ত বাতাসে বিকিনি পড়ে জীবনের স্বাদ নিচ্ছে। নারী স্বাধীনতার স্বাদ নিতে আকাশের বিশালতায় ছুটে চলা উড়োজাহাজে যাত্রীদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকছে। হোটেল রিসিপশনে নিজেদের চপলা-চঞ্চলা অঙ্গভঙ্গিতে গ্রাহকদেরকে বিমুগ্ধতায় ডুবিয়ে রাখছে।”

কিন্তু কানয দ্বীপের নারীগণ মনোলোভা এ আহবানে সাড়া দিলেন না। কারন “কাঁধের গোস্ত কোথা থেকে কেটে খেতে হয়” (অর্থাৎ, এ কাজ কিভাবে আঞ্জাম দিতে হয়), নির্বুদ্ধিতাবশত শত্রুপক্ষের সেটা জানা ছিল না।

সেসব পুণ্যাত্মা নারীগণ, যারা আশৈশব শরঈ পর্দার পূর্ণ পাবন্দি করে আসছে, তারা হঠাৎ অনাবৃত মুখে পরপুরুষের সামনে যাওয়া বা এক ঝটকায় নিজেদের হিজাব খুলে ফেলাকে কিভাবে মেনে নিবে ? ফলে শত্রুপক্ষের কুবাসনা পুরণে এসব পুণ্যাত্মা নারীগণ কিছুতেই প্রস্তুত ছিলেন না।

শত্রুপক্ষ নারীদেরকে হিজাবমুক্ত করার লক্ষ্যে তাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিকে ব্যর্থ হতে দেখে বুঝতে পারলো যে, তারা তীব্র স্রোতের বিপরীত মুখে চলছে। তাই তারা স্রোতের তীব্রতাকে দ্বিখণ্ডিত করে তাকে দুর্বল করা পন্থা অবলম্বন করলো। নারীদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে ভেঙে ফেলা মুশকিল। কিন্তু কোনভাবে তাদের ঐক্যের বাধন যদি খুলে দেওয়া যায়, তাহলে ভেঙে ফেলা সহজ হবে।

শত্রুপক্ষ ধূর্ত দৃষ্টিতে দেখলো যে, নারীগণ নিজেদেরকে আবৃত রাখতে যেসব হিজাব বা বোরকা পড়ে থাকে, সেগুলো যথেষ্ট ঢিলেঢালা ও গোটা শরীরের আদ্যোপান্ত আবৃতকারী। নারীরা বোরকা পড়ে পথে বের হলে তাদের শরীরের কোন অঙ্গই আর দৃষ্টিগোচর হয় না।

তাই এবার তারা নতুন ফন্দি আঁটল। তারা বলতে লাগলো, “আমরা তো এ কথা বলছি না যে, তোমরা বোরকা পুরোপুরি খুলে ফেলো, কারন ওটা হারাম। কিন্তু দেখো, যে বোরকাগুলো তোমরা গায়ে জড়াচ্ছো, সেগুলোর স্টাইল খুব সেকেলে, আধুনিকতার নামগন্ধও নেই তাতে। বর্তমান যুগের সাথে সেগুলো একেবারেই বেমানান। তোমাদেরকে আধুনিক বোরকা পড়তে হবে।”

এরপর আধুনিক পোশাক ডিজাইনাররা কোমর বেঁধে নেমে পড়লো। তারা নানা রকম নতুন নতুন ডিজাইনের বোরকা তৈরি করলো, যেগুলোর ব্যাপ্তি সাধারণ বোরকার চেয়ে অনেক কম ছিল। তাতে কি ? নামসর্বস্ব হলেও সেগুলোতো বোরকাই ছিল। তাই (এটা চিন্তা করে) নারীদের অনেকেই সেসব বোরকা পড়তে শুরু করলো। দেখতে দেখতে বোরকা ‘গাউন’ এর রূপ পরিগ্রহ করলো। সৌন্দর্যকে আড়াল করার জন্য যে বোরকা পরিধান করা হতো, এখন তা নিজেই সৌন্দর্য প্রকাশক হয়ে গেলো।

শত্রুপক্ষ এখন খুশীর জোয়ারে ভাসছে। তারা অনুভব করলো, স্রোতের তীব্রতা ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসছে।

তারপর নিত্যনতুন ফ্যাশনের হাত ধরে এমন বোরকার প্রচলন শুরু হলো, যা বেল্ট দিয়ে কোমরে বেঁধে রাখতে হতো। ক্রমশ এমন বোরকার উদ্ভব ঘটলো, যা আঁটসাঁট হয়ে শরীরে লেগে থাকতো, এতে করে দেহের প্রলুব্ধকর অঙ্গের ভাজ প্রস্ফুটিত হয়ে পড়তো। এখন মানুষের লোলুপ দৃষ্টি বোরকা পড়া নারীদের পিছু ছুটলো। আর এভাবেই একটি শান্ত সমাজব্যবস্থায় অস্থিরতা শিকড় গেঁড়ে বসলো।

নৌকাটির নিমজ্জন ত্বরান্বিত হতে লাগলো। এ দেখে সমাজ সংস্কারক আলেমগণ চুপ করে বসে রইলেন না। তারা সেসব বোরকার ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে লাগলেন। বক্তাদের অগ্নিঝরা জ্বালাময়ী বক্তৃতায় কেঁপে উঠলো মিম্বর। ইসলামের দাঈরা ওয়াজ-নাসিহাতের মাধ্যমে এর জঘন্যতা বর্ণনা করতে লাগলেন। তারা সৌন্দর্য প্রকাশক এসব ফ্যাশনেবল বোরকা পরিধানকারী নারীদেরকে এর মন্দ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করলেন আর বললেন, তোমাদের এসব বোরকা দিয়ে সেসব অঙ্গ দৃশ্যমান হয়, যেগুলোকে আল্লাহ্‌ ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

সংকুচিত ও চিকন বোরকা হারাম হওয়ার ব্যাপারে প্রতিটি সচেতন মানুষেরই জ্ঞান ছিল। তাই এর প্রচলন কমে আসলো। নারীগণ পুনরায় সেসব বোরকা গায়ে জড়াতে লাগলেন, যা গোটা শরীরকে ঢেকে রাখে।

শত্রুপক্ষ তাদের সব পরিশ্রম পন্ডু হতে দেখে প্রচণ্ড হতাশ হলো। পর্দা অপসারন করে নারী-পুরুষদের অবাধ বিচরণকে আরো সহজতর করার লক্ষ্যে তাদের শত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। তারা দেখলো, দিন-রাত এক করে, প্রতারনার হাজারো ফাঁদ পেতে তারা যখন নারীদেরকে তাদের জালে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে, ঠিক তখনই কোন আলেম এসে তাদের সামনে পবিত্র কোরআনের আয়াত ও হাদিসের বাণী পাঠ করে শোনালে মুহূর্তেই তারা তওবা করে নিজেদের শুধরে নিচ্ছে।

বস্তুত, ফিতনাবাজদের এ কথা জানা ছিল না যে, প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে ইসলামের শিকড় প্রোথিত রয়েছে অত্যন্ত দৃঢ় ও সুগভীরভাবে। মুসলিম নারীরা মাঝে মাঝে ভুল যেমন করে, তেমনি দ্রুত তওবাও করে নেয় আর ফিরে আসে ইসলামের দিকে। মুসলিম নারীদের চরিত্র খাঁটি সোনার মতো। পরিচ্ছন্নতার হালকা প্রলেপ পেলেই ধুলাবালি দূর হয়ে আগের মতো চমকাতে থাকে।

পরিশেষে অনেক চিন্তা ফিকিরের পর শত্রুপক্ষ প্রতারনার নতুন পন্থা উদ্ভাবন করলো।

ফিতনাবাজরা গভীর মনোযোগে ইতিহাসের পাতা উল্টাতে লাগলো এটি দেখার জন্য যে, অতীতে মুসলিম দেশগুলো থেকে পর্দা প্রথা কিভাবে বিলুপ্ত হয়েছিলো। তারা দেখলো, পর্দা প্রথা বিলুপ্তির শুরু লগ্নে নারীদেরকে প্রথমে চেহারা খোলা রাখতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিলো। এরপর চেহারা খোলা রাখাটা যখন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হলো, তখন চেহারাকে সৌন্দর্য বর্ধনের বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সুসজ্জিত করার প্রবণতা দেখা গেলো। এরপর এলো বোরকার রঙে ভিন্নতা। সাদামাটা কাপড়ের পরিবর্তে উজ্জ্বল-মসৃণ, কারুকার্য খচিত কাপড় ব্যবহার হতে লাগলো। নারীদের রূপ-মাধুরীও যেন বেড়ে গেলো। তারা মুখায়বের কমনীয়তা প্রদর্শনে আরো একধাপ এগিয়ে গেলো। এতদিন কপালকে হিজাবের আওতাভুক্ত করে রেখেছিলো, কিন্তু এখন সেটাও উন্মুক্ত করে দিলো। ধীরে ধীরে মাথার চুলও দৃশ্যমান হতে লাগলো। আর এভাবেই অতীতের নারীরা পর্দা থেকে বেরিয়ে এসেছিলো।

শত্রুপক্ষ কানয দ্বীপের নারীদের মাঝে এই ফর্মুলাটি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিলো। কারন কানয দ্বীপের নারীরা বোরকা পরিধানকালে পূর্ণ চেহারা ঢেকে রাখতো। স্যাটেলাইট চ্যানেল আর বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রথমে তাদের সামনে তুলে ধরা হলো যে, পর্দার ক্ষেত্রে চেহারা ঢেকে রাখার কোন আবশ্যিকতা শরীয়তে নেই। নারীদের জন্য চেহারা খোলা রাখা জায়েজ আছে। অনেক ওলামা চেহারা উন্মুক্ত রাখার পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, চেহারার পর্দার বিষয়টিকে মতবিরোধপূর্ণ হিসেবে প্রমাণিত করা। এরপর স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে কিছু মুফতি সরাসরি ফতোয়া দিতে লাগলো যে, ঘরের বাইরে বের হওয়ার সময় নারীরা চাইলে তাদের মুখাবয়ব খোলা রাখতে পারে, এটা তাদের জন্য জায়েয আছে, আল্লাহ্‌ নারীদের যেসব সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন চেহারা সেসবের আওতাভুক্ত নয়।

এটি শাইখ আবদুর রহমান আরিফি রচিত পর্দা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের অনুবাদ "ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিন" থেকে নেওয়া হয়েছে। এ বইতে পর্দার বিধান সম্পর্কে দলীল সহকারে আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামে পর্দার বিধান জানার জন্য পুরুষ বা নারী - যে কারোর জন্যই এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ। বইটির পিডিএফ ডাউনলোড করতে বা অনলাইনে অর্ডার করতে ভিজিট করুন এখানে

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বলআম বাউরার ঘটনা

 

 

The Greatest Nation·Monday, November 5, 2018

 

 

 

 

 

আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহিমাহুল্লাহ এই ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন (শামসুল হক ফরিদপুরী গ্রন্থাবলী ১ম খণ্ড) -

 

সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মুসা আলাইহিস সালামের জমানার ঘটনাটি এই -

 

বলআম বাউরা নামে অতি বড় একজন আলিম ছিলেন। তিনি এতো বড় আলিম ও এতো বড় পীর ছিলেন যে, তিনি যা কিছুই দুয়া করতেন, তা-ই আল্লাহ'র দরবারে কবুল হয়ে যেতো।

 

একবার এক ঘটনা ঘটলো। হযরত মুসার শরীয়তের হুকুমের সাথে আর তৎকালীন বাদশাহর সাথে মুকাবেলা হলো। বাদশাহর পক্ষের লোকেরা বহু টাকা তার স্ত্রীকে দিয়ে বলআম বাউরাকে রাজার পক্ষ হয়ে হযরত মুসার শরীয়তের বিরুদ্ধে যেতে তাকে প্রস্তুত করলো।

 

প্রথমত, তার গৌরব ছিল যে, সে যা দুয়া করবে, তা-ই কবুল হবে। তাই সে প্রস্তুত হয়ে গেলো পাহাড়ে নির্জনে গিয়ে হযরত মুসা যাতে পরাস্ত ও পর্যুদস্ত হোন, রাজা যাতে জয়ী হয় - তেমন দুয়া করার জন্য। কিন্তু দুয়া করার সময় তার জবাব উল্টে গেলো। হযরত মুসার জয়ের আর রাজার পরাজয়ের দুয়া তার মুখ দিয়ে বের হলো।

 

তারপর, যেহেতু এক পাপ আরেক পাপকে টেনে আনে, তাই সে রাজাকে কুমন্ত্রণা দিলো যে, এখন মুসাকে পর্যুদস্ত করার এক উপায় আছে। সে উপায় এই যে, তোমরা ষোড়শী সুন্দরী যুবতী নারীদের মুসার লস্করের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ফেরী-দোকানদারী করার জন্য পাঠিয়ে দাও। মুসার লস্করের মধ্যে সব যুবকদের দল। স্ত্রী ছাড়া তারা অনেক দিন আছে। যৌন ক্ষুধা তাদের প্রবল হয়ে আছে। পুরো লস্করের মধ্যে যদি একটি লোকও একটি সুন্দরী নারীর সাথে যিনা করে অর্থাৎ তার সতীত্বে মুগ্ধ হয়ে তার সতীত্ব নষ্ট করে, তবে মুসার লস্কর থেকে আল্লাহ'র মদদ হটে যাবে, হয়তো আল্লাহ'র গযবও নাযিল হতে পারে, ফলে তোমরা জয়ী হয়ে যাবে।

 

এই কুমন্ত্রণা অনুসারে কাজ করা হলো। হযরত মুসার লস্করের মধ্য থেকে একজন লোক যখন যিনা করলো, তখন আল্লাহ'র গযব নাযিল হয়ে ৭০ হাজার সৈন্য প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হলো।

 

এরপর হযরত মুসার সেনাপতি খবর পেয়ে ঐ যিনাকারী আর যিনাকারিণী উভয়কেই বল্লম দিয়ে বিদ্ধ করে আসমানের দিকে উঠিয়ে ধরে আল্লাহ'র কাছে এই ফরিয়াদ করলো যে - আমরা ব্যাভিচারীকে এভাবেই শাস্তি দিবো।

 

প্রার্থনার পর প্লেগ রোগ কমে যায়।

 

ওদিকে, বলআম বাউরার জিহবা কুকুরের মতো ঝুলে যায় আর লোকেরা তাকে কুকুরের মতো দূর ! দূর ! ছেই ! ছেই ! করতে থাকে।

 

সরকার ঘেঁষা, অর্থলোভী, স্বার্থপর আলিম ও পীরের এটাই আসল শাস্তি। দুনিয়া আল্লাহ'র শেষ বিচারের স্থান নয়, সে জন্য এক জায়গায় তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, বাকি সবাইকে চিন্তা করে ওরকম মহাপাপ থেকে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। যারা বিরত থাকবে, তারা আল্লাহ'র দরবারের মহাপুরস্কার পাবে। আর যারা ঐ মহাপাপে পাপগ্রস্ত হবে, দুনিয়াতে তাদের কোন শাস্তি না হলেও আখিরাতে তাদের মহাশাস্তি এবং ভয়াবহ ও ভীষণ আযাব ভোগ করতে হবে।

 

"আর আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন সে লোকের অবস্থা, যাকে আমি নিজের নিদর্শনসমূহ দান করেছিলাম, অথচ সে তা পরিহার করে বেরিয়ে গেছে। আর তার পেছনে লেগেছে শয়তান, ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়েছে।

অবশ্য আমি ইচ্ছা করলে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিতাম সে সকল নিদর্শনসমূহের দৌলতে; কিন্তু সে যে অধঃপতিত এবং নিজের রিপুর অনুগামী হয়ে রইলো; সুতরাং তার অবস্থা হল কুকুরের মতো; যদি তাকে তাড়া করো তবুও হাঁপাবে, আর যদি ছেড়ে দাও তবুও হাঁপাবে; এ হল সেসব লোকের উদাহরণ - যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে আমার নিদর্শনসমূহকে; অতএব, আপনি বিবৃত করুন এসব কাহিনী, যাতে তারা চিন্তা করে।"

(সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ১৭৫-১৭৬)

 

"আল্লাহ লিখে দিয়েছেনঃ

 

নিশ্চয়ই আমি বিজয়ী হবো, আমি আর আমার রসূলগণ।

 

নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।"

 

(সূরাহ আল-মুজাদিলাহ, ৫৮ : ২১)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মায়ের গর্ভে থাকা দুটো শিশুর মধ্যে কথোপকথন

 

 

The Greatest Nation·Wednesday, December 5, 2018

 

 

 

মায়ের গর্ভে থাকা দুটো শিশুর মধ্যে কথোপকথন হচ্ছেঃ

প্রথমজনঃ তুমি কি ডেলিভারির পরের জীবন বিশ্বাস করো?

দ্বিতীয়জনঃ কেন নয়? অবশ্যই করি। ডেলিভারির পর কিছু একটা তো অবশ্যই হবে। হয়তোবা আমরা পরবর্তী সময়ের জন্য এখানেই প্রস্তুত হচ্ছি।

প্রথমজনঃ পুরোই বাজে কথা। শোন, ডেলিভারির পর কোন জীবনই নেই। সে জীবন আবার কি হতে পারে?

দ্বিতীয়জনঃ তা আমার জানা নেই,তবে সেখানে নিশ্চয়ই এ জায়গা (গর্ভ) থেকে বেশী আলো থাকবে। হয়তো আমরা আমাদের পা দিয়ে হাঁটবো আর মুখ দিয়ে খাবো।”

প্রথমজনঃ কি সব অযৌক্তিক কথাবার্তা বলছো তুমি ? হাটা তো পুরোই অসম্ভব। আর আমরা আমাদের এই মুখ দিয়ে খাবো? কি হাস্যকর ব্যাপার! আমাদের Umbilical cord খাবার সরবরাহ করে, ডেলিভারির পড়ে তো তা কেটেই ফেলা হবে।

দ্বিতীয়জনঃ আমার মনে হয় এটা থেকে ভিন্ন কিছু একটা থাকবে।

প্রথমজনঃ ডেলিভারির পর কেউই এখানে (গর্ভে) ফিরে আসেনি। ডেলিভারি হওয়ার মাধ্যমেই আমাদের এই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে।

দ্বিতীয়জনঃ আমি সেটা জানি না, তবে নিশ্চয়ই আমরা আমাদের মা কে দেখতে পাবো আর তিনি আমাদের দেখাশোনা করবেন।

প্রথমজনঃ কি বললে ??? মা !!! আরে তুমি মাকে বিশ্বাস করো ??!! তাহলে আমাকে বল যে সে এখন কোথায়।

দ্বিতীয়জনঃ তিনি আমাদের সবদিকেই আছেন, আমরা তো তার ভিতরেই বাস করছি। তিনি না থাকলে আমরা আমাদের এই জগতে অস্তিত্ব লাভ করতে পারতাম না।

প্রথমজনঃ কই,আমি তো তাকে দেখছি না। তাই এটা যৌক্তিক যে তার কোন অস্তিত্বই নেই।

দ্বিতীয়জনঃ তুমি যখন নীরব থাকো,তখন তাকে শুনতে পাবে,উপলব্ধি করতে পারবে। আমি বিশ্বাস করি যে, ডেলিভারি হওয়ার পর অবশ্যই একটা বাস্তবতা আছে আর আমরা এই বাস্তবতার জন্যই এখানে প্রস্তুত হচ্ছি।

(ফেইসবুক থেকে পাওয়া একটি পোস্টের অনূদিত রূপ)

এই অনূদিত পোস্টের ব্লগ লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-b

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা পবিত্র কুরআনের ঘোষণার পরিপন্থী নয়

 

 

The Greatest Nation·Thursday, November 29, 2018

 

 

 

 

وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَاءُوا بِغَضَبٍ مِّنَ اللَّـهِ ۗ

"...... আর তাদের উপর ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে লাঞ্ছনা ও দারিদ্রের, আর তারা আল্লাহ'র গযবের উপযুক্ত হয়েছে ....."

(সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ৬১)

 

وضربت

এর অর্থ, তাদের উপর লাঞ্ছনা নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে আর তারাও একে নিজেদের উপর অবশ্যম্ভাবী করেছে। (তাফসীর তাবারী)

 

عليهم

এই সর্বনামটির উদ্দেশ্য ভালোভাবে বুঝতে হবে। এরা কারা, যাদের উপর লাঞ্ছনা ও অভাব-অনটন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ?

এরা ইহুদী জাতি নয়, ইসরাইলি সম্প্রদায়। অর্থাৎ, এই শাস্তির পাত্র অমুক অমুক আকিদা বিশ্বাসের ধারক-বাহকরা নয়, বরং বনী ইসরাইল নামের এক সুনির্দিষ্ট কাওম ও সম্প্রদায়।

সুবহান-আল্লাহ ! একটিমাত্র শব্দ কি সুগভীর তত্ত্ব ধারণ করে আছে এবং অত্যন্ত দ্ব্যার্থহীনভাবে এ সত্য তুলে ধরেছে যে, আজ প্রায় চৌদ্দশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যে লাঞ্ছনা-অপমান ও অভাব-দারিদ্র্য অব্যাহতভাবে চেপে বসে আছে, তার ক্ষেত্র বিশেষ বংশ-সম্প্রদায় মাত্র, বিশেষ কোন ধর্ম ও আকিদা-বিশ্বাসের অনুসারীরা নয়।

খোদ Anti-Semitism শব্দটিই প্রমাণ করে যে, ইহুদীদের প্রতি বিশেষভাবে নাজী জার্মানির এবং সাধারণভাবে ইটালি, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া ও অন্যান্য ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের যে জাত শত্রুতা, তার ভিত্তি কোন বিশ্বাস বা আদর্শ নয়, বরং বর্ণ, বংশ ও জাতীয়তাবাদই হচ্ছে তার ভিত্তি।

তবে রাজনৈতিক পরাধীনতা ও দাসত্বের কথা বাদ দিলেও, অভাব ও দারিদ্র্যের প্রসঙ্গে পাঠকমনে এ বিস্ময়াবিষ্ট প্রশ্ন খুব সঙ্গতভাবেই দেখা দিতে পারে যে, ইহুদীদের সম্পদ-প্রাচুর্য তো প্রবাদতুল্য, তা সত্ত্বেও তাদেরকে অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র জাতি কিভাবে বলা যেতে পারে ?

কিন্তু বাস্তবে এটা বহুল প্রচারিত একটা বাহ্য বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই না। কেননা সকল সম্পদ-প্রাচুর্য ইহুদী সম্প্রদায়ের অতি উচ্চ স্তরেই শুধু সীমাবদ্ধ। পক্ষান্তরে ইহুদী জনসাধারণ পৃথিবীর চরমতম দরিদ্র জনগোষ্ঠীরূপেই বিবেচিত হয়ে আসছে। খোদ ইহুদী গবেষকরাও এ সত্য স্বীকার করেছেন। ইহুদী ধর্মের বিশ্বকোষ বলছেঃ ইহুদীদের সম্পদ-প্রাচুর্য প্রবাদতুল্য খ্যাতি লাভ করছে সত্য কিন্তু বিদগ্ধ গবেষকরা এ বিষয়ে পূর্ণ একমত যে, ইউরোপে যে সকল ইহুদী জনবসতি আছে, সেখানে গোটা জনবসতির তুলনায় দরিদ্র জনসংখ্যার গড় তাদের মাঝেই বেশী। (খণ্ড ১০) ইহুদী জনসাধারণ অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর তুলনায় শোচনীয় দারিদ্র্যাবস্থার শিকার। আসল কথা এই যে, মাত্র মুস্টিমেয় ইহুদী অভাবিত সম্পদের অধিকারী। (খণ্ড ১) (তাফসীরে মাজেদি)

 

জিল্লত (লাঞ্ছনা) আর মিসকিনি অবস্থা অর্থাৎ দারিদ্র্যতা নির্ধারিত হওয়া সম্পর্কে তাফসীরের ভাষ্য -

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে যাহহাক ইবন মুযাহিম রাহিমাহুল্লাহ তাদের লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্যের এই মর্ম বর্ণনা করেন - ইহুদীরা সর্বদা অপরের দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকবে এবং তাদেরকে জিযিয়া, ট্যাক্স ইত্যাদি প্রদান করে যাবে, তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জিত হবে না। (তাফসীরে মারেফুল কুরআন - মুহাম্মাদ ইদ্রিস কান্দলবী)

এ সম্পর্কে আরো আলোচনা একটু পরই আসছে।

আল্লামা আশেকে ইলাহী বুলন্দশহরী'র তাফসীরে এ সম্পর্কে উল্লেখ হয়েছেঃ ইহুদীদের উপর অপমান ও দারিদ্রতা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা সর্বদা লাঞ্ছিত থাকবে। কোন জাতির অধীনস্থ হয়ে বা কর দিয়ে থাকা, অনেক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এরই অন্বেষণে লেগে থাকা এবং মনেপ্রাণে এই চেষ্টা করা - এ সবই অপমানের মধ্যে গণ্য। মাআলিমুত তানযিলের গ্রন্থকার লিখেছেন, ইহুদীদের উপর যেহেতু অপমান, নিঃস্বতা ও দারিদ্র্যতা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই তাদের তনু-মন-প্রাণ সবই সম্পদের সাথে জড়িত। এজন্য তোমরা তাদেরকে সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও গরীব দেখতে পাবে।

কেউ বলেছেন, অপমান বলে অন্তরের দারিদ্র্যতা বুঝানো হয়েছে। এজন্য জাতিসমূহের মধ্যে ইহুদীদের মতো লাঞ্ছিত কোন জাতি নেই। তাদের মতো এতো সম্পদের লোভী কেউ নেই। মাআলিমুত তানযিলের গ্রন্থকার সত্যই বলেছেন, সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও তারা লোভী এবং একটা পয়সার জন্যই তারা প্রাণ দিয়ে দেয়। সামান্য ক্ষতি হলে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাদের অন্তর কাঁপে। অনেক সময় দুঃখে হঠাৎ করেই তারা মরে যায়। এসব বিষয় অন্তরের অভাববোধকেই প্রকাশ করে। এ সবের নমুনা যদি দেখতে হয়, তা হলে হিন্দুস্থানের বেনিয়া সাহেবদের মধ্যে দেখা যেতে পারে। (তাফসীরে আনওয়ারুল বয়ান)

 

"আর তারা আল্লাহ'র গযবের উপযুক্ত হয়েছে"

ইতিহাসের অধ্যায়ে অধ্যায়ে মানুষেরই হাতে ইসরাইলি সম্প্রদায়ের উপর আসমানী গযবের লাগাতার প্রকাশ ঘটে আসছে। ফ্যাসিস্ট হিটলারের হাতে ইহুদী নিধনের নির্মম ঘটনা ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিমাত্রেরই জানা। মুরশিদ থানবী বলেন, চক্ষুষ্মানদের জন্য এ ঘটনা বড়ই শিক্ষণীয়। এ সম্প্রদায়ের ইতিহাস থেকে উপদেশ গ্রহণ করা উচিত, যারা বিপদে যেমন ধৈর্য ধরেনি, তেমনি নিয়ামত লাভেও কৃতজ্ঞচিত্ত হয়নি। আল্লাহ'র ফয়সালার সামনে হয়নি সমর্পিত। তাই অবাধ্যতাজনিত লাঞ্ছনা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো। পার্থিব লোভ-লালসা তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল করে দেওয়া হলো এবং মর্যাদার উচ্চ শিখর থেকে তাদের অধঃপতন ঘটানো হলো। (তাফসীরে মাজেদি)

কিয়ামতের পূর্বে ইহুদীদের দুরাবস্থার মধ্যে একটি দুরাবস্থা জানা যায় এই হাদিস থেকে -

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মুসলমানরা ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। মুসলমানরা ইহুদীদের হত্যা করবে। এমনকি ইহুদীরা পাথর ও গাছের আড়ালে লুকাবে। তখন পাথর ও গাছ বলবে - আল্লাহ'র হে বান্দা, এই যে আমার পেছনে এক ইহুদি লুকিয়ে আছে, তুমি এসে ওকে হত্যা করো। তবে ‘গারকাদ’ বলবে না। কেননা, সেটি ইহুদীদের গাছ।” (মুসলিম)

 

আরো একটি আয়াত

আল্লাহ এটিও বলেছেন,

"তারা যেখানেই যাক না কেন, তাদের উপর সংহত করে দেওয়া হয়েছে লাঞ্ছনা, তবে আল্লাহ'র পক্ষ থেকে কোন উপায় হলে বা মানুষের পক্ষ থেকে কোন উপায় হলে ভিন্ন কথা ......" (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১১২)

আল্লাহ'র পক্ষ থেকে উপায়ের অর্থ হলো, যাদেরকে আল্লাহ স্বীয় বিধানে নিরাপত্তা দিয়েছেন, যেমন - নারী ও শিশু এবং যে বৃদ্ধ ও ইবাদাতকারী মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় না, তারা নিরাপদে থাকবে।

মানুষের পক্ষ থেকে উপায়ের অর্থ হলো সন্ধিচুক্তি, যেমন - মুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তি করে বা অমুসলিম সংখ্যালঘু হিসেবে জিযিয়া কর প্রদান করে মুসলিম দেশে বসবাসের সুযোগ লাভ করবে।

তবে আয়াতে "মানুষের পক্ষ থেকে" বলা হয়েছে, "মুসলিমদের পক্ষ থেকে" বলা হয়নি, তাই অমুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তি করে তাদের আশ্রিত হয়ে নিরাপত্তা লাভ করবে, এ অর্থের সম্ভাবনাও রয়েছে। অবশ্য এ অর্থ তখনই হয়, যদি "কাশশাফ" গ্রন্থপ্রণেতা যামাখশারী'র অভিমত অনুসারে "ইসতিসনা" (الا) কে "মুত্তাসিল" ধরা হয়। সেক্ষেত্রে আয়াতের অর্থ হবেঃ

ইহুদীরা সর্বদা ও সর্বত্র লাঞ্ছিত হবে দুই অবস্থা ছাড়া। একটি হলো, আল্লাহ'র বিধানের কারণে তাদের নারী ও শিশুরা লাঞ্ছনা থেকে বাইরে থাকবে। দ্বিতীয়টি হলো, সন্ধিচুক্তি করে নিজেরা নিজেদেরকে লাঞ্ছনা থেকে বাঁচিয়ে নিবে। সন্ধিচুক্তি মুসলিমদের সাথেও হতে পারে, অমুসলিমদের সাথেও হতে পারে।

অনেক মুফাসসির "ইসতিসনা" কে "মুনকাতি" বলেছেন। সেক্ষেত্রে অর্থ হবে, ইহুদীরা নিজস্ব ও জাতিগত বিচারে সর্বদা লাঞ্ছিত হবে, তবে আল্লাহ'র বিধানের আওতায় এসে তাদের কেউ কেউ তা থেকে নিরাপদ থাকবে কিংবা অন্য কোন গোষ্ঠীর উপর ভর করে লাঞ্ছনার জীবনের উপর পর্দা টেনে দিতে সক্ষম হবে।

এভাবে সূরাহ আলি ইমরানের উক্ত আয়াত দিয়ে সূরাহ আল-বাকারাহ'র আয়াতটির বিশদ ব্যাখ্যা হয়। (মাআরিফুল কুরআন - আল্লামা ইদ্রিস কান্ধলবী)

 

প্রাসঙ্গিক আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসীর শেষে শেয়ার করছি ইসরাইল প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত একটি আর্টিকেলঃ

কারো কারো মাঝে এ সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, পবিত্র কুরআনে ইহুদীদের অবমাননার যে ঘোষণা রয়েছে, তা সত্ত্বেও তো ইহুদীরা ইসরাইল নামক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

বস্তুতঃ এমন সন্দেহের কোন ন্যায্য কারণ নেই। কেননা, বর্তমান দুনিয়ায় দুই ধরনের রাষ্ট্র বিদ্যমান রয়েছে -

এক প্রকার রাষ্ট্র হলো, যে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল, কারো মুখাপেক্ষী নয়, পরনির্ভরশীল নয়, আপন গুণে-জ্ঞানে, জাতীয় স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তায় এবং ক্ষমতায় ধন্য, অন্য কারো তোয়াক্কা রাখার তার প্রয়োজন নেই, বরং অন্যদের প্রয়োজন তার কাছে থাকে।

আর দ্বিতীয় প্রকারের রাষ্ট্র হলো, যে রাষ্ট্র অন্যদের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অন্যদের ইশারা-ইঙ্গিতেই সে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, অন্যদের ক্ষমতাই তার উপর চলে।

বলাবাহুল্য, ইসরাইল এমনই একটি রাষ্ট্র যা ব্রিটেন আর আমেরিকা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আর তাও ইহুদীদের জন্য নয় আর ইহুদীদের উদ্দেশ্যেও নয়; বরং ব্রিটেন আর আমেরিকা তাদের নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে ইসরাইল নামক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে। এ কথার অনেক প্রমাণ রয়েছে যে, ইসরাইল নামক ইহুদী রাষ্ট্রটি খৃষ্টানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ফলে ইহুদীরা কোন প্রকার সম্মানের অধিকারী হয়নি, বিশ্ববাসীর অন্তরে ইসরাইল রাষ্ট্রের কারণে ইহুদীদের জন্য আদৌ কোন সম্মানবোধ সৃষ্টি হয়নি। এটিই পবিত্র কুরআনের ঘোষণার বাস্তব প্রমাণ।

এটা ছাড়াও, পবিত্র কুরআন এ কথা ঘোষণা করেনি যে, কোন দিন ইহুদীদের কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। বরং পবিত্র কুরআন বলেছে যে, তারা চির অপমানিত, চির লাঞ্ছিত থাকবে। তাই আজকের বিশ্বে ইসরাইল রাষ্ট্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ইহুদীদের কোন সম্মান নেই, কেননা, সকলেই জানে যদি আজ আমেরিকা ইসরাইলের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তবে পরদিন সকালে ইসরাইলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে।

এটা ছাড়াও, এখানে আরো একটি কথাও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, খৃষ্টান জাতি তথা ব্রিটেন ও আমেরিকা যদিও ইসরাইল রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে এবং আরব দেশসমূহের বিরুদ্ধে ইসরাইলকে লেলিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্তরেও এই ইহুদীদের জন্য কোন সম্মান নেই, কেননা তারা নিজেদের দেশে তথা ইউরোপ-আমেরিকার কোথাও ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ মনে করেনি, বরং এই হীন ও ঘৃণ্য জাতিকে হাজার হাজার মাইল দূরে মধ্যপ্রাচ্যে আবাদ করেছে এবং তারা এর দ্বারা এক গুলিতে দুই শিকার করেছে -

প্রথমত, ইহুদীদের মতো ঘৃণ্য ও অপমানিত জাতিকে নিজেদের থেকে দূরে রাখা হলো;

দ্বিতীয়ত, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে কোন সময় এ আন্তর্জাতিক দস্যুদের ব্যবহার করার ব্যবস্থাও করেছে।

লন্ডন টাইমসের সংবাদদাতার প্রতিবেদন এ পর্যায়ে প্রণিধানযোগ্য। হিটলারের প্রচার মন্ত্রী ডক্টর গুয়েবলস নাজী কংগ্রেসের বার্ষিক সভায় বক্তৃতা করার সময় এ রহস্য উদঘাটন করেছেনঃ

ইহুদী একটি অত্যন্ত জঘন্য রক্তচোষা জাতি। যারা অন্যের রক্ত চুষে নিজের উদর পূর্ণ করে। যে সত্যটি জার্মান জাতি আজ উপলব্ধি করেছে, হয়তো ইংরেজ জাতি বহু পূর্বেই তা বুঝেছিল। পার্থক্য শুধু এতোটুকু যে, জার্মান জাতি এ জঘন্য মানবরূপী জোঁকদের থেকে স্বদেশকে রক্ষার্থে তাদেরকে এক এক করে খুঁজে খুঁজে দেশ থেকে বিতারিত করে দিয়েছে। আর ইংরেজরা এদের জঘন্য চরিত্রের দ্বারা অন্যায় ফায়দা লুটবার জন্য তাদের প্রতিপালন শুরু করেছে এবং তাদের মুরব্বী সেজেছে, যাতে তারা যে কোন দেশকে দখল করার অসৎ উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে এ জোঁকদের ব্যবহার করতে পারে। সর্বপ্রথম সেখানে এ জোঁকদের একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয়, এ রক্ত চোষা সম্প্রদায় সে দেশের মানুষের রক্ত চুষে তাদেরকে শুধু যে অকেজো করে দেয়, তাই নয়; বরং মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এরপর ইংরেজরা কোন প্রকার প্রতিবন্ধিকতা ছাড়া সে দেশে প্রবেশ করে এবং তাদেরকে অতি সহজে গোলাম বানিয়ে দেয়। যেমন এ জোঁকদের যোগ্যতা প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছে ফিলিস্তিনে, এ পরীক্ষায় তারা সফল হয়েছে, লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনবাসীকে তারা শুধু গৃহচ্যুতই করেনি, বরং তাদের রক্ত চুষে, তাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।

যদিও আমেরিকা ইসরাইলকে সর্বাধিক সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে, বরং আরো সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে আমেরিকাই ইসরাইলের শক্তির মূল উৎস, কিন্তু তবু আমেরিকাও ইহুদীদেরকে অপমানিত লাঞ্ছিত এবং মানব জাতির কলঙ্ক বলে মনে করে। দিল্লী থেকে প্রকাশিত দৈনিক দাওয়াত পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে এ সত্যের প্রমাণ স্বরূপ যে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তার কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছিঃ

বিখ্যাত আমেরিকান লেখক মিস্টার রবার্ট গোস্তার এমন ৬৫ টি আমেরিকান প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করেছেন, যারা ইহুদীদের দুশমন। এ লেখক এমন বহু কারখানা ও অফিসের নাম উল্লেখ করেছেন, যেখানে ইহুদীদেরকে সর্বশেষ চাকরী দেওয়া হয় এবং সর্বপ্রথম তাদেরকে বহিস্কার করা হয়। সামরিক গুরুত্বের অধিকারী কলকারখানায় তাদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত চাকরি দেওয়া হয় না, যতক্ষণ তাদের কেউ বিজ্ঞানী হিসেবে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী না হয়। অনুরূপ অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও বিদ্যমান। অনেক ক্লাবে এবং স্বাস্থ্যকর স্থানে এমনই সাইনবোর্ড লাগানো আছে - "এখানে ইহুদীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ"।

তিনশ বছর ধরে ইহুদীরা আমেরিকায় বসবাস করছে, আর তাদের মধ্যে অধিকাংশই সাদা। কিন্তু তাদের ঘৃণ্য চরিত্রের কারণে তারা এখনো আমেরিকান সমাজের অংশ হিসেবে পরিগণিত হতে পারেনি, এমনকি শহরে পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর এলাকায় ইহুদীরা বাড়ী পর্যন্ত পায় না।

এতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, আমেরিকা ইহুদীদের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন সমাজে ইহুদীরা অপমানিত ও ঘৃণিত। অতএব, ইহুদীরা ইসরাইল রাষ্ট্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কুরআনের ঘোষণার সত্যতাই প্রমাণিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকাতে তাদের অপমানের বোঝা এতোটুকু লাঘব হয়নি, আর এর দ্বারা পবিত্র কুরআনের ঘোষণার সত্যতাই প্রমাণিত হচ্ছে।

যদিও ইসরাইলকে প্রকাশ্য দৃষ্টিতে ইহুদীদের রাষ্ট্র মনে হয়, কিন্তু এর প্রকৃত ক্ষমতা তাদের হাতে - যারা এ রাষ্ট্র তৈরি করেছে, আর তারা নিশ্চয়ই ইহুদী নয়, বরং তারা ব্রিটেন ও আমেরিকা, অতএব পরের ক্ষমতায় ক্ষমতাবান সম্মান পাওয়ার বদলে অপমানের গ্লানিই তাদেরকে ভোগ করতে হয়। এজন্য পবিত্র কুরআনের ঘোষণা তথা ইহুদীদের চিরন্তন অবমাননা চিরসত্যই থেকে যায়। ব্রিটেন আর আমেরিকার তল্পিবাহক রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল তার তাঁবেদারি চরিত্রের প্রমাণ বহুবার হাযির করেছে। (তাফসীরে নুরুল কুরআন)

 

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-3M

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সাহাবীগণের জীবনাদর্শ সিরিজ (১) - উত্তম হাদিয়া

 

 

The Greatest Nation·Monday, November 26, 2018

 

 

 

আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পক্ষ থেকে একবার কোন এক কারণে আশআস বিন কায়েস রাদিয়াল্লাহু আনহু আর জারীর ইবন আবদুল্লাহ আল-বাজালী রাদিয়াল্লাহু আনহু মাদায়েন শহরে সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বস্তিতে আসলেন।

তারা সালাম করে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনিই কি সালমান ফারসী ?"

সালমান ফারসী বললেন, "হ্যা, আমিই সালমান ফারসী।"

তারা জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি কি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী ?"

সালমান ফারসী বললেন, "এ বিষয়টি আমি জানি না।"

এ উত্তর শুনে তারা সংশয়ে পড়ে গেলেন আর পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলেন যে, হয়তো তিনি অন্য কেউ হবেন।

সালমান ফারসী এরই মধ্যে বলে উঠলেন, "আপনাদের উদ্দিষ্ট ব্যক্তি আমিই। আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছি। তবে বাস্তবিক পক্ষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথী / সাহাবী তো সেই ব্যক্তিই, যে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে জান্নাতে যাবে। সুতরাং আপনারা উভয়ে নিজ নিজ প্রয়োজন বলতে পারেন।"

তারা বললেন, "আমরা শাম দেশ থেকে আপনার ভাই আবু দারদা'র পক্ষ থেকে এসেছি।"

সালমান ফারসী বললেন, "তিনি হাদিয়াস্বরূপ কিছুই পাঠাননি ? আপনারা আল্লাহ'কে ভয় করুন আর আমানত আদায় করুন। আজ পর্যন্ত তিনি আমার কাছে কাউকে হাদিয়া ছাড়া পাঠাননি।"

তারা বললেন, "আপনি আমাদের প্রতি আস্থা বহাল রাখুন, অবশ্যই তিনি আপনার নামে অনেক মাল হাদিয়া পাঠিয়েছেন, সবগুলোই আপনাকে দিয়ে দেওয়া হবে।"

সালমান ফারসী বললেন, "আমার উদ্দেশ্য মাল নয়, আমার মালের কোন প্রয়োজনও নেই, বরং আমি শুধু তার পাঠানো হাদিয়া চাই।"

তারা বললেন, "আল্লাহ'র কসম, এগুলো ছাড়া অন্য কিছুই তিনি আপনাকে হাদিয়া দেননি। অবশ্য একটি কথা তিনি এরকম বলেছিলেন যে - আপনাদের মাঝে সালমান এমন একজন অনন্য ব্যক্তি যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে একাকীত্ব পছন্দ করতেন না। তাই তোমরা যখন এই মহান ব্যক্তিত্বটির কাছে পৌঁছবে, তখন আমার পক্ষ থেকে অবশ্যই সালাম পৌঁছাবে।"

সালমান ফারসী বললেন, "আমি কি হাদিয়া চাই বুঝতে পারেননি ? আমি তো এই 'সালাম' হাদিয়াই চাচ্ছিলাম। সালামের হাদিয়া থেকে আর বড় কি হাদিয়া আছে ? সালামের হাদিয়া সম্পর্কে তো আল্লাহ নিজেই বলেছেন -

'... এরপর তোমরা যখন ঘরে প্রবেশ করো, তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে; এটা আল্লাহ'র কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া; এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্যে আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ননা করেন, যাতে তোমরা বুঝে নাও।' (সূরাহ আন-নূর, ২৪ : ৬১) "

(হিলইয়াতুল আউলিয়া)

ব্লগ লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-3K

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বিনতে আবু বাকর রাদিয়াল্লাহু আনহু

 

 

 

The Greatest Nation·Monday, January 14, 2019

 

 

 

 

 

নাম ও বংশপরম্পরা

তার নাম "আসমা", উপাধি "যাতুন নাতাকীন"। তিনি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কন্যা। তার মাতার নাম কুতালা বিনতে আবদুল উযযা। তিনি হিজরতের ২৭ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন।

 

বিয়ে

যুবায়ের বিন আওয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সাথে তার বিয়ে হয়।

 

ইসলাম গ্রহণ

স্বামীর মতো তিনিও ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী ছিলেন। ইবনে ইসহাকের ভাষ্য অনুযায়ী আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা ১৮ তম ইসলাম গ্রহণকারী।

 

সাধারণ অবস্থা

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরতের (পরিকল্পনা করার) সময় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বন্ধুর সহচার্যে ছিলেন। নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুপুরে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বাড়িতে আসেন এবং হিজরতের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।

আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা দুই-তিন দিনের সফরের নাস্তা তৈরি করে পুটলিতে রাখেন। "নাতাক" শব্দের অর্থ কোমরবন্দ, মেয়েদের কোমরে বাঁধার জন্য এক ধরণের বিশেষ দড়ি। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজের নাতাক চিড়ে পুটলির মুখ বেঁধে দেন। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র জন্য এটি ছিলো সেই মর্যাদাপূর্ণ কাজ, যার জন্য আজ পর্যন্ত "যাতুন নাতাকীন" উপাধির মাধ্যমে তাকে স্মরণ করা হয়। (১)

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু হিজরতের সময় সমুদয় অর্থকড়ি সাথে নিয়ে যান। আবু কুহাফা হলেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পিতা। তিনি জানতে পেয়ে বললেন, "সে জান ও মাল উভয় দিক থেকে কষ্টে ছিলো।" আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, "তিনি তো বিপুল পরিমাণ ধন-দৌলত রেখে গেছেন।" এই বলে আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা উঠে দাঁড়ালেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যেখানে সম্পদ রাখতেন, আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা সেখানে অনেকগুলো পাথর এনে রাখলেন আর এগুলোর উপর কাপড় ছড়িয়ে দিলেন। এরপর আবু কুহাফাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে বললেন, "স্পর্শ করে দেখুন, তিনি এগুলো রেখে গেছেন।" আবু কুহাফা ছিলেন অন্ধ। ফলে তিনি বিশ্বাস করে বললেন, "খাওয়ার জন্য অনেক কিছুই রয়েছে।" আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, "আমি শুধুমাত্র আবু কুহাফার সান্ত্বনার জন্য এমনটি করেছি। পক্ষান্তরে শেখা একটি দানাও ছিলো না।" (২)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় পৌঁছে সকল মেয়েদের ডেকে পাঠান। তখন আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা'ও আসেন। (৩)

তিনি কুবায় বসবাস করতেন। এখানে আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'র জন্ম হয়। তিনি তাকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হোন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে কোলে নিয়ে আদর করেন আর তার জন্য দুয়া করেন। (৪)

আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু বড় হলে আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার কাছে এসে থাকতেন। কারণ যুবায়ের বিন আওয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে তালাক দিয়েছিলেন। (৫)

আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু আদরের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লালা মুবারাক পান করেছিলেন। ফলে বুদ্ধির বয়স থেকেই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্মল ও বিশুদ্ধ। ওদিকে বনু উমাইয়ার ইয়াযিদ চৌকুস পাপাচারী। আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু তার বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মক্কায় অবস্থান নেন, আর এখানেই তার খিলাফতের আওয়াজ বুলন্দ করেন। আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মর্যাদা ও মহত্ত্ব সম্পর্কে সকলেই জ্ঞাত ছিলো। এজন্য গোটা ইসলামী জগত তার আওয়াজে সাড়া দেয় আর সাম্রাজ্যের বিশাল অংশ তার পতাকা তলে এসে যায়।

আবদুল মালিক বিন মারওয়ান মসনদে সমাসীন হয়ে নিজ দূরদর্শিতার মাধ্যমে কিছু করদরাজ্য দখল করে নেন আর আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেন। সিরিয়ার সৈন্যরা কাবা শরীফ অবরোধ করলে আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র কাছে আসেন। তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন। আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়ল্লাহু আনহু তার মাকে জিজ্ঞেস করলেন, "এখন কি অবস্থা ?" আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, "আমি অসুস্থ।" আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "মৃত্যুর পর মানুষ শান্তি পায়।" আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, "মনে হয় তুমি আমার মৃত্যু কামনা করছো। কিন্তু আমি এখন মৃত্যুবরণ করাকে পছন্দ করি না। আমার অভিলাষ এই যে, তুমি লড়াই করে নিহত হবে আর আমি ধৈর্য ধারণ করবো, অথবা তুমি বিজয়ী হয়ে আমার নয়ন জুড়াবে।" আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু হাসিমুখে চলে যান।

শাহাদাত লাভের প্রাক্কালে তিনি আবার মায়ের খেদমতে উপস্থিত হোন। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা মসজিদে বসেছিলেন। সন্ধির ব্যাপারে আলোচনা হয়। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, "বাবা, মৃত্যুর ভয়ে লজ্জাজনক সন্ধি করা কোন উত্তম কাজ নয়। কারণ মর্যাদার জন্য তলোয়ার নিয়ে লড়াই করা অপমানের সাথে কোড়া মারার চেয়ে উত্তম।" আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু মায়ের কথা মান্য করেন আর বীরত্বের সাথে লড়াই করতে করতে শাহাদাত লাভ করেন।

হাজ্জাজ তার লাশ শূলীতে ঝুলিয়ে রাখে। তিনদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা কানিজকে সাথে নিয়ে নিজের ছেলের লাশের কাছে আসেন। লাশটি উল্টোভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা দিলে পাথর চাপা দিয়ে এ দৃশ্য দেখেন আর অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে বলেন, "এই আরোহীর ঘোড়া থেকে অবতরণের সময় এখনো কি হয়নি ?" (৬)

হাজ্জাজ ছিলো ক্রোধের জ্বলন্ত অগ্নি মশাল। সে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠালো। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা গেলেন না। সে আবার এই বলে লোক পাঠালো যে, এখনো ভালোভাবে চলে আসুন, অন্যথায় এর পরে যে আসবে সে চুলের মুটি ধরে টেনে নিয়ে যাবে। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা কেবল আল্লাহ'র শানের স্বীকারোক্তিকারী হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। তিনি জবাব দিলেন, "আমি যাবো না।" বাধ্য হয়ে হাজ্জাজ জুতো পড়ে নিজেই এলো। হাজ্জাজ বললো, "বলুন, আমি আল্লাহ'র দুশমনের (তার উদ্দেশ্য - আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু) সাথে কেমন ব্যবহার করেছি ?" আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, "তুমি তার দুনিয়া নিয়ে বিবাদ করেছো, আর সে তোমার শেষ পরিণাম অকল্যাণে ভরে দিয়েছে। আমি শুনেছি, তুমি তাকে যাতুন নাতেকীনের (কোমরবন্দের) ছেলে বলেছো। আল্লাহ'র কসম, আমিই যাতুন নাতেকীন। আমি নিজ কোমরবন্দের দড়ি দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র খাবার বেঁধেছিলাম, আর কোমরবন্দের অবশিষ্ট দড়িটি কোমরে পেঁচিয়েছিলাম। এটুকু মনে পড়ে যে, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে শুনেছি, সাকীফ গোত্রে এক মিথ্যাবাদী ও এক অত্যাচারীর জন্ম হবে। মিথ্যাবাদীকে দেখেছি, আর অত্যাচারী তো তুমি নিজেই।" এ হাদিস শুনে হাজ্জাজ নিরবে প্রস্থান করে। (৭)

কয়েক দিন পর আবদুল মালিকের ফরমান পেয়ে হাজ্জাজ আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'র লাশ নামিয়ে ইহুদীদের কবরস্থানে ছুড়ে মারে। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা লাশ উঠিয়ে অন্যের সাহায্যে বাড়িতে আনেন, গোসল দেন আর জানাযা পড়ান। আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'র শরীরের জোড়াগুলো খুলে গিয়েছিলো। গোসল দেওয়ার সময় শরীরের অংশগুলো হাতের সাথে উঠে আসতো। কিন্তু আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা সন্তানের এ অবস্থা দেখেও ধৈর্যধারণ করেন যে, আল্লাহ'র রহমত তার ছিন্ন ভিন্ন প্রতিটি টুকরোর উপর নাযিল হয়।

 

ইন্তেকাল

আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা দুয়া করতেন, আব্দুল্লাহ'র লাশ না দেখা পর্যন্ত আমার যেন মৃত্যু না আসে। (৮) আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'র লাশ সমাহিত করার পর এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত না হতেই তিনি ইন্তেকাল করেন। এটি ৭৩ হিজরির ঘটনা। সে সময় তার বয়স হয়েছিলো একশো বছর।

 

আওলাদ

তার সন্তানগণ হলেন - আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু, মুনযির, উরওয়া, মুহাজির, খাদিজাতুল কুবরা, উম্মুল হাসান আর আয়শা। (৯)

 

দৈহিক গঠন

আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র বয়স একশো বছর হয়েছিলো। কিন্তু তার একটি দাঁতও পড়েনি, আর তার বিবেক-বুদ্ধি ছিলো সম্পূর্ণ সুস্থ। (১০) তিনি ছিলেন লম্বা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী। শেষ বয়সে এসে তার দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। (১১)

 

মহত্ত্ব ও বৈশিষ্ট্য

তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ৫৬ টি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা সহিহাইন ও সুনান গ্রন্থসমূহে বিধৃত হয়েছে। তার হাদিসের রাবীগণ হলেন - উবাদা ইবনে আব্দুল্লাহ'র দুই ছেলে আবদুল্লাহ আর উরওয়া, আবদুল্লাহ বিন উরওয়া, ফাতেমা বিনতে মুনযির, ইবনে যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু, আয়াদা বিন হামযা বিন আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবদুল্লাহ বিন কায়সান, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু, সুফিয়া বিনতে শায়বা, ইবনে আবু মালিকা, ওহাব বিন কায়সান, ইবনে যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'র দুই ছেলে আবু বকর ও আমের, মুত্তালিব বিন খুত্তাব, মুহাম্মাদ বিন মানকিদর, মুসলিম মুআরা, আবু নওফেল বিন আবু আকরাব।

 

চরিত্র

আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা সর্বদা পুণ্যময় কাজে জড়িত থাকতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার কুসুফ (সূর্য গ্রহণের) নামায পড়ছিলেন। নামায অনেক দীর্ঘ হওয়ায় আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা এদিক-ওদিক দেখতে শুরু করেন। তার কাছে দুই নারী দাঁড়িয়েছিলো - ফারবা আর লাগার। তা দেখে তিনি নিজের অন্তরকে সান্ত্বনা দিলেন যে, তাদের থেকে বেশী দাঁড়িয়ে থাকা উচিত। (১২) কয়েক ঘণ্টা ব্যাপী নামায চললো। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা চৈতন্য হারিয়ে ফেললেন আর তার মাথায় পানি ছিটানো হয়। (১৩)

ইবনে আবু মালিকা বর্ণনা করেন, তার মাথা ব্যাথা করলে তিনি মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, "এটা আমার পাপ, আল্লাহ যে পাপ ক্ষমা করেছেন, এটি তার চেয়ে বেশী।"

সত্য কথা বলাটা ছিলো তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এর কয়েকটি উপমা উপরে বিধৃত হয়েছে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো জালিমের সামনে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলেছেন। এ কাজে তার দৃষ্টান্ত তিনি নিজেই। একবার হাজ্জাজ মিম্বরে উপবিষ্ট ছিলো। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজের কানিজকে সাথে নিয়ে এসে বললেন, আমীর কোথায় ? এরপর হাজ্জাজের কাছে গেলেন। হাজ্জাজ তাকে দেখেই বললো, "আপনার ছেলে আল্লাহ'র ঘরে খোদাদ্রোহীতা ছড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য আল্লাহ তাকে ভয়ংকর শাস্তি দিয়েছেন।" আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন, "তুমি মিথ্যাবাদী। সে বিপথগামী ছিলো না, বরং সে তো ছিলো রোজাদার, পুণ্যবান ও রাত জেগে ইবাদাতকারী।" (১৪)

আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীলা নারী। আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'র শাহাদাত ছিলো কিয়ামতের বিভীষিকা। আর আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র জন্য তা বড় কিয়ামত হয়ে এসেছিলো। তবে সে সময় তিনি যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন, ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত বিরল।

তিনি ছিলেন দারুন আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো শাসকের অহংকার ও গর্ব তার আত্মমর্যাদার প্রান্তরে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।

আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। তিনি কঠোর পরিশ্রম করতে সামান্যতমও লজ্জাবোধ করতেন না। বিয়ের সময় যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছে একটি উট আর একটি ঘোড়া ছাড়া কিছুই ছিলো না। তিনি ঘোড়াকে আহার্য দিতেন আর পানি ভরে তা বয়ে আনতেন। তিনি রুটি বানাতে জানতেন না। এজন্য আটা খামির করে রাখতেন আর জনৈক আনসারী নারী এসে তা বানিয়ে দিয়ে যেতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে যে ভূভাগ দিয়েছিলেন, তিনি সেখানে গিয়ে শুস্ক খেজুরের বিচি কুড়াতেন আর বোঝা বেঁধে মাথায় করে নিয়ে আসতেন। একদিন এভাবে আসছিলেন। পথিমধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের উটটি বসিয়ে দিলেন, আরোহন করার জন্য বললেন। কিন্তু তিনি লজ্জা পেয়ে যান এবং উটে আরোহণ করলেন না। তিনি বাড়িতে এসে যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছে বিস্তারিত ঘটনা বলে শোনালেন। যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "সুবহানাল্লাহ ! মাথায় বোঝা বহন করতে লজ্জা পায় না তোমার ?" এর কিছুদিন পর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে একটি গোলাম দেন, যে ঘোড়াকে লালনপালন করতো। তখন তার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলতেন, "আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আমাকে স্বাধীন করে দিয়েছেন।" (১৫)

দুস্থতার কারণে তিনি হিসাব করে খরচ করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা করতে নিষেধ করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, অতঃপর আল্লাহ'ও মেপে মেপে দিবেন। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা তখন থেকে এ অভ্যাস পরিত্যাগ করেন। এর ফলে আয় বৃদ্ধি পায় এবং দারিদ্রতা আর কখনোই হানা দেয়নি। (১৬)

তিনি উদার, দয়ালু ও দানশীল ছিলেন। আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, "আমি তার চেয়ে দয়ালু কাউকে দেখিনি।" আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র ভাগে একটি বনভূমি ছিলো। মৃত্যুর সময় তিনি তা রেখে যান। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা এক লক্ষ দিরহামে বনভূমিটি কিনে প্রিয়জনদের মাঝে ভাগ করে দেন। (১৭)

তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজের সকল গোলাম আযাদ করে দিতেন। (১৮)

যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু তেজস্বী স্বভাবের মানুষ ছিলেন। এজন্য তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে জিজ্ঞেস করেন, "আমি অনুমতি ছাড়া তার সম্পদ দরিদ্রদের দান করতে পারবো ?" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি দিলেন। (১৯)

একবার তার মা মদিনায় এসে তার কাছে অর্থ-কড়ির আবেদন করেন। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে জিজ্ঞেস করলেন, "তিনি তো মুশরিক, এ অবস্থায় আমি তাকে সাহায্য করতে পারি ?" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যা। (অর্থাৎ, নিজের মায়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখো) (২০)

আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা কয়েকবার হজ্জ করেছেন। প্রথমবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আদায় করেন। (২১) এ হজ্জের সফরে তিনি যা দেখেন, সবই তার মনে ছিলো। (২২) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা হজ্জ করতে এসে মুযদালিফায় অবস্থানকালে রাতে নামায পড়ে গোলামকে জিজ্ঞেস করলেন, "চাঁদ কি অস্ত গেছে ?" সে বললো, "না"। চাঁদ ডুবে যাওয়ার পর আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, "রমী (পাথর নিক্ষেপ) করার জন্য চলো।" রমী করার পর পুনরায় ফিরে আসেন এবং ফজর নামায আদায় করেন। এরপর তাড়াহুড়া করতে লাগলেন। তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্দানশীন নারীদের (আগেই রওয়ানা হওয়ার) অনুমতি দেন। (২৩)

তিনি মানুষের ভির অতিক্রম করার সময় বলতেন, "আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এখানে অবস্থান করেছিলাম। সে সময় আমার কাছে অনেক অল্প সামান ছিলো। আমি, আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) আর যুবায়ের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) উমরা করেছি আর তাওয়াফ করে হালাল হয়েছি।" (২৪)

আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা একজন বীরাঙ্গনা নারী। উপরে এর কয়েকটি উদাহরণ বিধৃত হয়েছে। সাঈদ বিন আসের যুগে রাষ্ট্রে ইসলামের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও চুরি-ডাকাতি আরম্ভ হলে তিনি নিজের সাথে একটি খঞ্জর রাখতেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করতো, এতে লাভ কি ? তিনি বলতেন, কোন দস্যু-তস্কর এলে এ খঞ্জর তার বুকে বসিয়ে দিবো। (২৫)

আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র পবিত্রতা সাধারণ জন্যশ্রুতিতে পরিণত হতো। কোন মেয়ে জ্বরে আক্রান্ত হলে দুয়ার জন্য তার কাছে আসতেন। তিনি তাদের বুকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে বলতেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জ্বরকে পানির মাধ্যমে ঠাণ্ডা করো। (২৬)

ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু আর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, জ্বর জাহান্নামের আগুন থেকে সৃষ্ট, একে পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করো। (২৭)

পরিবারে কারো অসুখ হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জুব্বা (যা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ইন্তেকালের সময় তাকে দিয়েছিলেন) ধুয়ে তার পানি পান করাতেন। এতে অসুস্থ ব্যক্তি আরোগ্য লাভ করতেন। (২৮)

 

ফুটনোটঃ

(১) ইসাবা - ৪/২৩০, বুখারী - كتاب المنافب ، باب ذكر هجزة النبي و اصحا به الي المدينة

(২) সিয়ারে আলামিন নুবালা - ২/২৯০, মুসনাদে আহমাদ - ৬/৩৫০, নাসাউ হাওলুর রাসুল - পৃষ্ঠা ১৮২।

(৩) তবকাত - ১/১৬১।

(৪) বুখারী - كتاب المغازي

(৫) উসদুল গাবা - ৫/৩৯২।

(৬) উসদুল গাবা - ৪/২৩০।

(৭) ইসাবা - ৪/২৩০, মুসনাদে আহমাদ - ৬/৩৫২।

(৮) তারিখুল খামিস - ২/৩০৫।

(৯) তাবারী - ৩/২৪৬১, রিয়াযুন নযর - পৃষ্ঠা ২৭৯-২৮৮।

(১০) ইসাবা - ৪/২৩০।

(১১) মুসনাদে আহমাদ - ৬/৩৪৯।

(১২) মুসনাদে আহমাদ - ৬/৩৪৯।

(১৩) বুখারী - كتاب صلاة الكسوف

(১৪) মুসনাদে আহমাদ - ৬/৩৫১।

(১৫) মুসনাদে আহমাদ - ৬/৩৫২।

(১৬) মুসনাদে আহমাদ - ৬/৩৫৩।

(১৭) বুখারী - باب هبة الواحد الجماعت

(১৮) খুলাসাতুত তাহযিব - পৃষ্ঠা ৪৮৮।

(১৯) মুসনাদে আহমাদ - ৬/৩৫৩।

(২০) বুখারী - كتاب الادب

(২১) মুসলিম - كتاب الحج

(২২) বুখারী - كتاب الحج

(২৩) বুখারী - كتاب الحج

(২৪) বুখারী - كتاب العمرة

(২৫) তাবারী - ১৩/২৪৬।

(২৬) বুখারী - كتاب المرضي

(২৭) বুখারী - كتاب الطب

(২৮) মুসনাদে আহমাদ - ৬/৩৪৮।

 

উৎসঃ সীরাতুস সাহাবীয়াত - সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (মদিনা পাবলিকেশান্স)

ব্লগ লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-3V

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

উম্মুল মুমিনীন খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহা

 

 

 

The Greatest Nation·Wednesday, January 9, 2019

 

 

 

তিনি হলেন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উযযা ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে কাআব ইবনে লুওয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।

ইয়ামানের রাজা তুব্বা হাজরে আসওয়াদ জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়ার পায়তারা করলে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র পিতা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে রাজাকে প্রতিহত করার গৌরব অর্জন করেছিলেন।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র মা হচ্ছেন ফাতেমা বিনতে যা'দা ইবনে আসিম (যার নাম জুন্দুব) ইবনে রাওয়াহা ইবনে হাজার ইবনে আবদে মুগীস ইবনে আমের ইবনে লুওয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা চারিত্রিক নির্মলতা, বুদ্ধিদীপ্ততা আর দানশীলতায় প্রসিদ্ধ ছিলেন। জাহেলী যুগেও মানুষ তাকে "তাহেরা" (পূত-পবিত্র) উপাধিতে ভূষিত করেছিলো। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা পিতা পক্ষে কুসাই আর মাতা পক্ষে লুওয়াইর পুরুষে গিয়ে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশে মিলিত হোন। তিনি পিতা ও মাতা দু'দিক দিয়েই কুরাইশী বংশের মহীয়সী নারী। ১

তিনি ছিলেন উচ্চ ও ভদ্র পরিবারের কন্যা, দূরদর্শীতা ও উদার স্বভাবের মহিলা, নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং নেক কর্মপরায়ণতায় সকলেই তার প্রশংসা করতো। অতি সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ পরিবারের পরিবেশে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা লালিত-পালিত হোন। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিয়ের পূর্বে তার আর দুইবার বিয়ে হয়েছিলো। ২

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র প্রথম বিয়ে হয় আতীক ইবনে আবিদ ইবনে আবদুল্লাহ মাখযুমীর সাথে। কুরাইশী এই স্বামীর ঘরে তার একটি মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। আর দ্বিতীয় বিয়ে হয় আবু হালা হিন্দ ইবনে যুরারা ইবনে নাববাশ তামীমীর সাথে। এই স্বামীর ঘরে তার হিন্দ নামক ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে।

দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা একাকী জীবন যাপন করেন। মক্কা এবং কুরাইশের শ্রেষ্ঠ ও বুদ্ধিমতী মহিলা হিসেবে তার বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিলো বিধায় গোত্র প্রধান ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা একের পর এক তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু তিনি প্রস্তাব গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকেন। প্রস্তাবকারীদের সম্মান ও মর্যাদা বহাল রেখে অতি নম্রতা, ভদ্রতা আর শ্রদ্ধার সাথে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতেন অথবা ওজর পেশ করতেন। তবে বিয়েতে তার সম্মতি না থাকা এবং শেষ পর্যন্ত প্রস্তাব অনুযায়ী বিয়ে না হওয়ার বিষয়টি প্রস্তাবকারীগণ সহজেই বুঝতে সক্ষম হতো।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের স্বার্থে স্বামী গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থেকে তার বিরাট সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের তত্ত্বাবধানে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণকরণের মানসে যোগাযোগ সীমিতকরণের প্রচেষ্টা চালান আর মক্কার যথেষ্ট ব্যবসায়ী ও নিজ কর্মচারীদের সাথে সম্পর্ক কম করে ফেলেন।

রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন তখন যুবক বয়সী মহাপুরুষ। আবদুল মুত্তালিবের বংশের আমীন ও শরীফ এই মহাপুরুষের নাম-ধাম, মক্কার আশেপাশে অলিতে-গলিতে, হাটে-বাজারে, ঘরে বাইরে আর ছোট-বড় বৈঠকে ও সমাবেশে আতরের সুগন্ধির মতো ছড়িয়ে পড়ে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবীহুল্লাহ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের ছেলে। অত্যন্ত কোমল ও নম্র চরিত্রের অধিকারী, কর্মপরায়ণ, মানুষের সাথে চলাফেরা করে আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত হয়ে অযথা সময় নষ্ট করেন না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রভাবশালী। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখমন্ডলীতে প্রশান্তি ও প্রভাব প্রস্ফুটিত। অত্যন্ত বিনয়ী, আর্থিক দৈন্যতা সত্ত্বেও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেহারায় গাম্ভীর্য প্রস্ফুটিত। আমানতদার আর দানবীর, মুখমণ্ডলী যেন পূর্ণিমার চাঁদ, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লাজুক। মানুষকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব ভালোবাসেন, মানুষও তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত মায়া করে আর ভালোবাসে। মানুষ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি সহনশীল, তিনিও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের প্রতি সহনশীল। হাসিমুখে মানুষের সাথে মিলিত হোন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন মিষ্টভাষী, কথাবার্তা বড়ই মধুর। শৈশবকাল থেকে খেলাধুলা ও অনর্থক কাজে শরীক হয় এরূপ লোকদের সংশ্রবে উঠাবসা করেন না। ৩

কেউ ভৎসনা করলে বা ক্ষিপ্ত হলে নীরবতা অবলম্বন করেন, যুক্তিসঙ্গত উক্তি করেন। তার (সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাষা অতি প্রাঞ্জল ও সুস্পষ্ট। অনর্থক ও বাজে কথা বলেন না। তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষ সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখে। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তিতে মানুষের অন্তর পরিপূর্ণ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মতো সন্তান কামনা করে সমস্ত জননীরা। মক্কার প্রতিটি সতী মহিলা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বামী হিসেবে পেতে চায়। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুঝে-শুনেই মূর্তি পূজা আর পৌত্তলিকতা থেকে বিরত থাকেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রখর প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির নিরিখে মূর্তি পূজা আর লক্ষণ বাজীর প্রচলন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সততা, সরলতা, ন্যায়নিষ্ঠা ও সুবিচারের দক্ষতার কারণে সমাজের সর্বশ্রেণীর লোকেরা কোন বিষয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হলে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট বিচার প্রার্থী হয়। বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিদ্ধান্তকে এক বাক্যে সকলেই মেনে নেয়।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র ব্যবসায়ী কাফেলা বসরার উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। এই কাফেলার তত্ত্বাবধানের জন্য লোকেরা সুবিজ্ঞ ও প্রসিদ্ধ মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ হাশেমীর (অর্থাৎ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র সম্মুখে প্রস্তাব করলে তিনি অনুমোদনের সুরে তা স্বাগত জানালেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশংসা করলেন, আর দ্বিগুণ প্রতিদানের ওয়াদা দিয়ে ব্যবসায়ী কাফেলার মহা-ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করলেন, আর সাহায্যকারী ও সহকারী হিসেবে নিজ গোলাম মাইসারাকে সাথী করে দিলেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা গোলাম মাইসারাকে চুপেচুপে বলে দিলেন, "তুমি গোপনে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি তীক্ষ্ণ ও সজাগ দৃষ্টি রাখবে, যাতে ফেরার পর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে আমাকে অবহিত করতে পারো।" এরপর দুজন কাফেলাসহ বসরার পথে রওয়ানা হয়ে যান।

রওয়ানা হওয়ার পর থেকে মাইসারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সততা, সরলতা, আমানতদারী ও কর্মতৎপরতা দেখে অবাক হতে থাকেন। ৪

পানাহারের সময় তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতের বরকত পরিদর্শন করে মাইসারা অত্যন্ত বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। ব্যবসা-বাণিজ্যে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তীক্ষ্ণবুদ্ধি নজীরবিহীন। মাইসারা আরো দেখলেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন অগ্রসর হোন, তখন মেঘরাশি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর স্থির হয়ে ছায়া প্রদান করে, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেমে গেলে মেঘরাশিও থেমে যায়। আশেপাশের বৃক্ষগুলো ডালপালা নিচু করে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বাগত জানায় আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঝুঁকে ছায়া প্রদান করে। মাইসারার মতো একজন পাদ্রীও এই বিস্ময়কর ঘটনা পরিদর্শন করে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে জানার জন্য কৌতূহলী হয়ে পড়ে এবং এই মহান লোকটি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে তা মাইসারার নিকট থেকে জেনে নেয়, আর বলে - এই বৃক্ষের নীচে নবী-রাসুলগণ ছাড়া আর কেউ অবতরণ করেননি।

মক্কাবাসীরা যাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহা সত্যবাদী আর আমীন বলে স্মরণ করে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সান্নিধ্যে মাইসারার ভ্রমণকালীন সময়টুকু অত্যন্ত আনন্দে আর প্রফুল্লতার সাথেই কাটতে লাগলো। দীর্ঘ সময় তার কাছে দীর্ঘ মনে হয় না, দীর্ঘ পথ সফরে তার ক্লান্তিবোধ হয় না। এই মহান যুবকের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহচর্যে তার রাত্রিগুলো নির্ভয়ে-নিরাপদেই কেটে যাচ্ছে। তবে মাইসারা এই ভ্রমণকালে তাকে দেখে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘটনাবলী পরিদর্শন করে বিস্মিত হলেন, শ্রদ্ধা ভক্তিতে তার অন্তর আপ্লুত হয়ে উঠলো। মাইসারা ভালোভাবেই অবগত হলেন যে, আমার সাথী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যান্যদের মতো লাত-উযযার শপথ গ্রহণ করেননি। অথচ মাইসারা ইতিপূর্বে অসংখ্য ব্যবসায়ীকে অবলোকন করেছেন, তারা ব্যবসার স্বার্থে মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য অযাচিত কথাবার্তা বলে, অপ্রয়োজনেই শপথ করে থাকে। এরূপ আচরণই মাইসারা ইতিপূর্বে দেখেছে। কিন্তু এবারের সফরসাথী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তেমন নয়। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেচা-কেনা ও তাগাদার সময় অত্যন্ত কোমল আর নম্র ও উদারমনা। তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখলে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে মিলিত হলে অন্তরে প্রশান্তি বোধ হয়। যারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বেচা-কেনা করে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে মেলামেশা করে আর উঠা-বসা করে, তারা সকলেই তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মায়া করে, মুহাব্বাত করে। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সংশ্রবে মানুষ আত্মমর্যাদাবোধ এবং ক্ষমা ও উদারতার শিক্ষা লাভ করে। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথাগুলো মুক্তার দানার মতো সুশৃঙ্খলিত, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথাবার্তা অসারতা, অতিরঞ্জন ও অশ্লীলতামুক্ত।

যেদিন ব্যবসায়ী কাফেলা মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলো, মাইসারা প্রথমেই মুনিবের নিকট সুসংবাদ দিতে ছুটে গেলেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা খবর শুনে সঙ্গিনীদেরকে নিয়ে দোতলা থেকেই পথের দিকে তাকালেন। দৃষ্টি কেবল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামক যুবকের উপর নিবদ্ধ, অন্য কোন দিকে নয়। তিনি দেখতে পেলেন যে, মহাব্যবস্থাপক উটের আরোহী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঠিক দুপুরে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছনে ব্যবসায়ীদের বিরাট কাফেলা।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার কাফেলাকে ফিরতে দেখে অত্যন্ত খুশী হলেন। খুশীর একটি কারণ ছিলো যে, সুবিজ্ঞ হাশেমী যুবক নিরাপদে সমস্ত মালামালসহ ফিরে আসছে, পথিমধ্যে কোন অঘটন ঘটেনি। দ্বিতীয় কারণ, এই সুবিজ্ঞ যুবক ব্যবসায়ী ব্যবসায় দ্বিগুণ লাভ অর্জন করেছে।

গোলাম মাইসারা তার ভ্রমণকালের সাথীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত ঘটনাবলী খোলাখুলি বলতে শুরু করেন। মাইসারা স্বচক্ষে যা দেখলেন, পাদ্রীর নিকট নিজ কানে যা শুনলেন, কিভাবে মালে এতো লাভ হলো - মোটকথা ভ্রমণ কালের সমস্ত কিছু মাইসারা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'কে বিস্তৃতিভাবে শুনালেন। কিন্তু খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র অন্তর্দৃষ্টি মুহূর্তের জন্যও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা অধীরচিত্তে অপেক্ষায় আছেন। দেখতে দেখতে অল্পক্ষণের মধ্যেই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র বাসভবনের সামনে অবতরণ করলেন অভিজ্ঞ যুবক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। অত্যন্ত লজ্জাভরে, দৃষ্টি নত করে যুবক মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। এমন সময় খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা অতি আনন্দের সাথে প্রফুল্ল মনে বরকতময় ঐতিহাসিক ভ্রমণ থেকে নিরাপদে লাভবান হয়ে ফিরে আসার কারণে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আন্তরিক ধন্যবাদ ও মুবারাকবাদ দেন, সালাম পেশ করেন। এ সময়ে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে সফর থেকে প্রত্যাবর্তন ও ব্যবসা সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট পেশ করে ব্যবসার পুঁজি ও ও লভ্যাংশসহ সমস্ত মালামাল খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'কে বুঝিয়ে দিলেন আর বিদায় গ্রহণ করলেন, সামান্য সময়ও অবস্থান করলেন না।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা আর তার বান্ধবীগণ সকলেই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যাবর্তন ও প্রতিটি কদম, কদমের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আশ্চর্য হচ্ছিলেন। এই অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী যুবক যদি আর একটু সময় তাদের সম্মুখে অবস্থান করতেন ! তাহলে সেই মুহূর্তটি তাদের জন্য হতো অত্যন্ত আনন্দের। যদি লজ্জা বাধার কারণ না হতো, তাহলে আর একটু সময় অবস্থানের জন্য তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট আবেদন করা যেতো।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র বংশ ছিল মক্কার অতি উচ্চবংশ। এই বংশের পুরুষদের মধ্যে এমন লোকও ছিলেন, তাওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে যাদের যথেষ্ট জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিলো, আর তারা মিল্লাতে ইব্রাহীমীর উপরও বিদ্যমান ছিলেন। তাদের জানা ছিলো যে, সর্বশেষ নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমনের সময় অতি নিকটে, তারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমনের গভীর অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ ছিলেন। সূর্যের আলো সদৃশ সেই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশে জন্মগ্রহণ করবেন, এটাই ছিল তাদের আকিদা আর অভিজ্ঞতা।

ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, হাজরে আসওয়াদ জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়ার জন্য ইয়ামানের তুব্বার অভিযানকে প্রতিহত করে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র পিতা বিশেষ গৌরবের অধিকারী হয়েছিলেন। সমাজের লোকেরা তার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভক্তি পোষণ করতো। আর তার কন্যা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন অত্যন্ত লাজুক ও সংযমশীলা মহিলা। সমগ্র আরব বিশ্বে আর বিশেষত কুরাইশ বংশে প্রচলিত পৌত্তলিকতা ও মূর্তি পূজা থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। এই শিক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফিলের কাছ থেকে। তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন যে, লাত ও উজ্জাসহ অন্যান্য মূর্তি মানুষের না ক্ষতি করতে পারে, না উপকার করতে পারে। পৌত্তলিকতা যেমন মিল্লাতে ইব্রাহীমী আদর্শের পরিপন্থী, তেমনি তাওরাত ও ইঞ্জিল কর্তৃক প্রবর্তিত তাওহীদী আকিদার পরিপন্থী - এ বিশ্বাস খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র অন্তরে দৃঢ় ও বদ্ধমূল হয়েছিলো। তাই তিনি তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকার মতো অধীর চিত্তে শেষ যুগের নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমনের অপেক্ষায় ছিলেন, যে নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমন সংবাদ তাওরাত ও ইঞ্জিল বারবার প্রদান করে আসছে।

অপেক্ষার এই মুহূর্তে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে দেখতে পাচ্ছেন। তিনি দেখতে পাচ্ছেন মহান এই যুবকের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্মল চরিত্র, উদার স্বভাব এবং সততা সরলতার প্রচার সমগ্র মক্কায় ছড়িয়ে পড়েছে। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র ব্যবসার মহাব্যবস্থাপক হিসেবে যা ঘটেছে আর গোলাম মাইসারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে যেসব বিষয়বস্তুর বর্ণনা প্রদান করেছে, এসব কিছুও সমগ্র মক্কা নগরী আর আশেপাশের এলাকায় এ আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শও তাৎপর্যপূর্ণ। কোনদিন মূর্তির সম্মুখে যান না, আর নতশীরও হোন না, আরবদের সাথে তাদের পূজাপাটেও অংশগ্রহণ করেন না, মদ্যপান করেন না, অনর্থক কর্মকাণ্ডে, ব্যভিচার ও অন্যান্য অশ্লীল পাপাচারে অংশগ্রহণ করেন না। তাই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র মনে প্রশ্ন উদিত হয়, তবে কি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামের এই যুবকটিই শেষ যুগের সেই প্রতীক্ষিত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ? যারা দ্বীনদার-আল্লাহভীরু, তারা সকলেই শেষ নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমনের নিদর্শনাবলীর প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য রাখছেন। তাদের ধারণা মতে শেষ নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমনের সময় অতীব সন্নিকটে। তবে কি তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই প্রতীক্ষিত শেষ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ?

সময় অতি ধীর গতিতে অতিবাহিত হচ্ছে। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র অন্তরে বিভিন্ন প্রশ্নের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আশার আলো বুঝি নিকটতম সময়েই প্রজ্বলিত হবে। তাকদীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিটিকেই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনে হয় খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র জন্য নির্বাচিত করে রেখেছে। অনেক সময় একাকী জীবনযাপনের পর একজন উপযুক্ত সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা তিনি বিশেষভাবেই উপলব্ধি করছিলেন। তিনি একজন আদর্শ স্বামীর প্রতীক্ষায় ছিলেন, যার পরশে শেষ সময়টুকু কাটাবেন, সাহায্য-সহানুভূতি আর ভালোবাসার সুযোগ পাবেন। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামের যুবকটিই এমন স্বামী হতে পারেন। কিন্তু মহান এই যুবককে স্বামী হিসেবে লাভ করার উপায় কি ? কি করা যায় ? কাকে বলা যায় ? মনের গোপন এই ভেদ কার কাছে প্রকাশ করা যায় ? খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা এসব প্রশ্নে মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

কিন্তু খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র দূরদর্শীতা ও বুদ্ধিমত্তা বান্ধবী নাফিসা বিনতে সানিয়্যার কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। তিনি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র উদাসীনতা, চেহারার মলিনতা ও অস্থিরতা অবলোকন করে তার অন্তরের গোপন ভেদ আর গুঞ্জন অনুধাবন করতে সক্ষম হোন এবং তাকে তার মনের কথা প্রকাশে বাধ্য করেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রথম প্রথম গোপন ভেদকে প্রকাশ করতে কুণ্ঠা বোধ করেন। কিন্তু নাফিসা সুকৌশলে অতি আপনজন হয়ে বারবার জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামের যুবকের আলোচনা শুরু করেন। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামের যুবকটি অবিবাহিত, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেন বিয়ে করেন না ? কেন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাকী জীবনযাপন করছেন ? মক্কার উচ্চ খান্দানের বহু লোকেই খাদিজাকে বিয়ে করতে প্রস্তাব করছে, করেই চলেছে, কিন্তু তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেন প্রস্তাব করেন না ? নাফিসা বললেন, "মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসুক তুমি কি তা চাও ?"

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা সম্পূর্ণ নীরব। তার মুখে কোন উত্তর ফোটে না। তবে তার নীরবতার আড়ালে উত্তর সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। লজ্জার আবরণে তার মৃদু মুচকি হাসি মনের গুপ্ত বাসনার জানান দিয়ে দেয়। নাফিসা বললেন, "হে আমার বোন, তোমার মনের বাসনা অচিরেই পূরণ হবে।" ৫

নাফিসা বের হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তালাশে। তালাশ করে করে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আম্মার ইবনে ইয়াসিরের সাথে আলোচনায় রত অবস্থায় পেলেন। নাফিসা জিজ্ঞাসা করলেন, বনী হাশিমের মতো উচ্চ বংশ এবং মক্কার শেষ স্বনামধন্য যুবক হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে না করার কারণ কি ? যুবক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন, বিয়ে করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। নাফিসা বললেন, যদি আমি সামর্থ্যের ব্যবস্থা করি, আর অর্থশালী রূপসী ও সুন্দরী মহিলার প্রস্তাব করি ? যুবক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তিনি কোন মহিলা ? নাফিসা বললেন, কুরাইশ বংশের শ্রেষ্ঠ মহিলা খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)।

যুবক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ভালো করেই জানেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে জড়িত ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা। মক্কার গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে ব্যর্থ হয়েছে, আর সেই তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব করছেন ! তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবাক হলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রস্তাবের বিষয়টি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুরব্বী চাচাদের সম্মুখে পেশ করলেন। উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তড়িৎ ব্যবস্থা নিলেন।

হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহু, আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আবু তালিবের পরামর্শক্রমে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র বাসভবনে উপস্থিত হলেন। প্রস্তাবের ভাষণে আবু তালিব বললেন, "মহান আল্লাহ পাকের প্রশংসা, যিনি আমাদেরকে ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর খান্দান, ইসমাইল (আলাইহিস সালাম) এর বংশধর এবং মাআদ ও মুজারের নসলে সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাদেরকে তার পবিত্র ঘরের হেফাজত ও সংরক্ষণের প্রহরী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, যিনি আমাদের জন্য হারাম শরীফকে সুসংরক্ষিত নিরাপদের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, আর যিনি আমাদের সমস্ত মানুষের উপর তত্ত্বাবধায়ক ও হাকিম নির্ধারণ করেছেন। এরপর, আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ সকলের কাছে সুপরিচিত। যুবকদের মধ্যে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমকক্ষ কেউ নেই, এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। হ্যা, সে অর্থ সম্বলহীন, কিন্তু অর্থ সম্পদের কোন স্থায়িত্ব নেই, বরং ছায়ার মতো পরিবর্তনশীল ও ক্ষণস্থায়ী। আর আমার ভাতিজার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উন্নত চরিত্র ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে আপনারা সকলেই অবগত আছেন। সে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদিজাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করছে। এ বিয়েতে নগদ ও বাকি সমস্ত মোহরানা আমার সম্পদ থেকে প্রদান করা হবে। আপনারা শুনে রাখুন, অচিরেই সমাজের সম্মুখে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব সূর্যের মতো ফুটে উঠবে।" ৬

বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনপথে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র বিশেষ অবদান ও সৃষ্টিশীল ভূমিকা রয়েছে। তিনি ছিলেন রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অত্যন্ত উদারমনা। তিনি রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে নিজের কাজে ব্যস্ত রাখেননি, নিজের অধিকার আদায়ে কোন সময়ে চাপ দেননি। তার কাছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অল্প সময় অবস্থানের কারণে কোন সময় আত্মকুণ্ঠিত হোননি। ঘরের যাবতীয় দায়িত্ব খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজেই পরিচালনা করতেন। জীবনোপকরণ সংগ্রহ ও আয়-উপার্জনের ঝামেলা থেকে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুক্ত করে নির্জনে আল্লাহ পাকের ইবাদাত রিয়াযতের সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছিলেন। যখনই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র কাছে উপস্থিত হতেন, খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহস যোগাতেন। একজন বিশ্বস্ত সরলপ্রাণ ওয়াফাদারের মতো তার সমস্ত প্রয়োজন মিটাতেন। আন্তরিকতা, নম্রতা আর ভালোবাসা নিয়ে তিনি রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে দাঁড়াতেন। ওহী অবতীর্ণ হওয়ার কারণে সৃষ্ট ভীতির মুহূর্তে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা অবিস্মরণীয়। তিনি বলেছিলেন, "অসম্ভব ! আল্লাহ পাক আপনাকে কখনো অপমান করবেন না। কারণ আপনি আত্মীয়দের প্রতি সংবেদনশীল, অসহায় মানুষের বোঝা বহন করে থাকেন, নিঃস্বদের জন্য উপার্জন ব্যবস্থা করে থাকেন, মেহমানদারী করেন আর হকের পক্ষে সাহায্য করে থাকেন।" সত্যিই সান্ত্বনার এই বানী অত্যন্ত মহান এবং এক মহান বুদ্ধিমতী ও দূরদর্শী মহিলার সাহসী ভুমিকাই বটে।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থা শুনে এবং সমর্থন ও সান্ত্বনার বাণী ব্যক্ত করেই নীরব থাকেননি, বরং তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে চাচাতো ভাই ওয়ারাকার কাছে গমন করেন আর গারে হেরায় জিবরাঈল ফেরেশতার হঠাৎ আগমন, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরাঈল আলাইহিস সালাম'কে কেমন দেখলেন, তার কাছে কি শ্রবণ করলেন ইত্যাদি সব ঘটনাবলী ওয়ারাকাকে শুনালেন।

ওয়ারাকা অত্যন্ত ধীর মস্তিস্কে সবিস্তারে সবকিছু শুনে বললেন, "হে আমার ভাতিজা, সুসংবাদ ! সুসংবাদ ! এ তো সেই ফেরেশতা জিবরাঈল, যিনি মুসা আলাইহিস সালামের কাছে ওহী নিয়ে অবতরণ করতেন। আফসোস ! আমি যদি সেই মুহূর্তে জীবিত থাকতাম, যখন তোমাকে তোমার সম্প্রদায় মক্কা থেকে বহিস্কার করে দিবে !"

রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়ারাকার বক্তব্য শুনে অত্যন্ত অবাক হলেন। বিস্ময়ের সুরে বললেন, "তবে কি তারা আমাকে অবশ্যই বহিস্কার করে দিবে ?" ওয়ারাকা উত্তরে বললেন, "হ্যা, অবশ্যই তোমাকে বহিস্কার করবে। কেননা, তোমার পূর্বে যে সমস্ত নবী-রাসুল তাশরীফ এনেছেন, তাদের সাথেও এরূপ ব্যবহারই করা হয়েছে। আমি সেই মুহূর্তে বেঁচে থাকলে তোমাকে আমার সাধ্যমত সাহায্য-সহযোগিতা করবো।" ৭

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ডক্টর বিনতুশ শাতী লিখেছেন, "খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা হেরা গুহার ঐতিহাসিক দাওয়াতে নিঃসন্দেহ চিত্তে, প্রশস্ত মনে, উন্মুক্ত হৃদয়ে ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে স্বাগত জানিয়েছিলেন আর এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবশ্যই আল্লাহ'র নবী, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ মোটেই অপমান করতে পারেন না।"

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আর কোন স্ত্রীর ভাগ্যে এরূপ স্বাগত জানানোর সুযোগ জুটেছে কি ? হকের জন্য ঈমানের রাস্তায় খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র মতো ভোগ-বিলাস সামগ্রী ও নিয়ামতের অধিকারিণী মহিলা ব্যতীত অন্য কোন মহিলার সাহস হতো কি যে, সে সমস্ত আরাম ও শান্তি দ্বিধাহীনচিত্তে পরিহার করে চতুর্মুখী যাতনা, বেদনা, নির্যাতন, নিপীড়ন সন্তুষ্টচিত্তে বরণ করে নিবে ? না, মোটেই না। হ্যা, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে শান্তি ও সাহস যোগানোর জন্য ইয়াতিমের মা হওয়ার জন্য, বীর পুরুষের মনে শক্তি সঞ্চারের জন্য, মুজাহিদের দুর্গ ও আশ্রয়স্থল হওয়ার জন্য আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শান্তি নিরাপত্তা ও ভরসাস্থল হওয়ার জন্য যাকে আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন, কেবল সেই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র জন্যই সম্ভব, অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক বলেন, শত্রু ও বিদ্রোহীদের মিথ্যা অপবাদ আর ঘাত-প্রতিঘাত ও দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হয়ে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদিজার নিকট ফিরে আসলে তার ব্যবহারে, তার সান্ত্বনাবাণী শুনে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত কষ্ট-দুঃখ ও মানসিক অবসাদ দূরীভূত হয়ে যেতো, শত্রুদের ষড়যন্ত্রের দুশ্চিন্তা লাঘব হয়ে যেতো আর নতুন করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে শক্তি ও সাহস সঞ্চার হতো। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার মৃত্যু পর্যন্ত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য এই ভূমিকা পালন করতে থাকেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন এমন বুদ্ধিমতী ও সুক্ষ্মদর্শী মহিলা, আল্লাহ পাক তার অন্তরকে দয়া-মায়া আর সহানুভূতিশীল করে গড়ে তুলেছিলেন। আল্লাহ প্রদত্ত এই গুণাবলীর সাহায্যে তিনি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনকে সর্বপ্রকার দুশ্চিন্তামুক্ত ও প্রশান্তিযুক্ত করে রাখতে সক্ষম হতেন।

তাছাড়া খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'ও কাফির-মুশরিকদের নির্যাতন-নিপীড়ন হতে মুক্ত থাকতে পারেননি। তিনিও কাফির-মুশরিকদের যুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মুসলমানদের সাথে তাকেও শিয়াবে আবু তালিবের বন্দীখানায় অসহনীয় দুঃখ-কষ্টে জীবনযাপন করতে হয়েছে। কাফিররা তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে বয়কট করে রেখেছিলো। তাদের সাথে সামাজিক বয়কটের যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলো। তাদের ঘোষণাপত্র ছিল নিন্মরুপঃ

"কুরাইশগণ বনী হাশিমের সাথে সম্পূর্ণ বয়কট করবে। বেচা-কেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিয়ে-শাদী সম্পূর্ণ বর্জন করবে। তাদেরকে কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ। পানাহার সামগ্রী সরবরাহ করা বন্ধ থাকবে, যাতে বনু হাশেম মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে হত্যা করার জন্য আমাদের কাছে অর্পণ করতে বাধ্য হয়, কিংবা তারা সকলেই বন্দীখানায় অত্যাচারিত আর ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।" ৮

মক্কার জ্ঞানী-গুণী নেতৃবৃন্দ সকলেই এই সিদ্ধান্তে সম্মতি প্রকাশ করে আর সন্ধিপত্রে স্বীকৃতিস্বরূপ সাক্ষর প্রদান করে। এই সন্ধিপত্রের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে এই সন্ধিপত্রকে কাবা শরীফে লটকিয়ে রাখা হয়। এভাবে বনী হাশিমের লোকজনকে সম্পূর্ণভাবে বয়কট করে শিয়াবে আবু তালিবে বেষ্টিত করে তাদেরকে অনাহারে অর্ধাহারে আর জীবন-মরণ সমস্যার সম্মুখীন করে তোলে, প্রাণ বাঁচার তাগিদে এক ফোঁটা পানি সরবরাহের পর্যন্ত অনুমতি দেয়নি। এই বিপদের মুহূর্তেও খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে দাঁড়ান এবং শিয়াবে আবি তালিবের বন্দীখানায় রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নিষ্ঠুর পাপিষ্ঠদের যাতনা কষ্ট বরণ করে নেন। তিনি সমস্ত মুসলমানদের সাথে নির্যাতন ও নিপীড়নের জীবনযাপন গ্রহণ করেন, অধৈর্য ও অধীরচিত্ত হোননি। অথচ খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন অত্যন্ত উচ্চ পরিবারের মহিলা, সুখ-শান্তির পরিবেশে লালিতা-পালিতা। অনাহার-অর্ধাহার, বালা-মুসিবত, দুঃখ-কষ্ট, গ্লানি সহ্য করায় তিনি মোটেই অভ্যস্ত ছিলেন না। অপর দিকে তখন তার মধ্যে এতো দুঃখ কষ্ট সহ্য করার মতো শারীরিক শক্তিও ছিলো না। কেননা, প্রায় ৬০ বছরের বার্ধক্য জীবনে উপনীত ছিলেন। এতদসত্বেও তিনি নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্যে ত্রুটি করেননি। তার রাসুল স্বামীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য তিনি তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন আর আগত বংশধরের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষার আদর্শ স্থাপন করেন। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত শিয়াবে আবি তালিবের বন্দীখানায় জীবনযাপন করেন। এতো কঠিন মুহূর্তেও তার ঈমানি শক্তি হ্রাস-পায়নি। তিনি ইয়াকিনে কামেল ও দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারিণী হয়ে থাকলেন, সর্বাবস্থায়ই তিনি আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি কামনা করলেন। বালা-মুসীবতে ধৈর্যধারণ ও ত্যাগ-তিতিক্ষার এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তিনি।

নিঃসন্দেহে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন আল্লাহ পাকের তরফ থেকে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য এক অপূর্ব নিয়ামত। আরববাসী তথা সমগ্র মানবজাতিকে আল্লাহ পাকের পথে আহবানকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা আর নবুওয়াতের বিরাট দায়িত্বভার বহনকরণে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য করুণাময় আল্লাহ পাক খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'কে তৈরি করে রেখেছিলেন। তাই তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিপদের মুহূর্তে সাহায্য করেছেন, সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন আর সহানুভূতি জানিয়েছেন, নৈরাশ্যের স্থলে সাহস সঞ্চার করেছেন আর কার্যক্রম ও কর্মসূচী বাস্তবায়নে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ফলে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি আল্লাহ পাক কর্তৃক রিসালাতের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে প্রতিপালনে সমর্থ হয়েছেন।

একবার কারণবশত ওহী অবতরণে বিলম্ব হয়, এতে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাবলেন, হয়তো আমার উপর আর ওহী অবতীর্ণ হবে না। আল্লাহ পাক এই ধারণা নিরসনের জন্য বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তার অগণিত ইহসানের কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেনঃ

"পূর্বাহ্ণের শপথ, গভীর রাতের শপথ। আপনার পালনকর্তা আপনাকে ত্যাগ করেননি আর আপনার প্রতি বিরূপও হোননি। আপনার জন্য পরকাল তো ইহকাল অপেক্ষা উত্তম। আপনার পালনকর্তা অতিসত্বর আপনাকে এমন কিছু দিবেন যাতে আপনি সন্তুষ্ট হোন। তিনি কি আপনাকে এতীমরূপে পাননি ? এরপর তিনি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি আপনাকে পথ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ পেয়েছেন, এরপর আপনাকে তিনি পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি আপনাকে নিঃস্ব অবস্থায় পেয়েছেন, এরপর তিনি আপনাকে অভাব মুক্ত করেছেন।" (সূরাহ আদ-দুহা, ৯৩ : ১-৮)

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। তার মৃত্যুর পর অনেক সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যান্য স্ত্রীদের সাথে তার ভালোবাসা আর ইহসানের কথা এমনভাবে আলোচনা করতেন যে, এই আলোচনা ও প্রশংসা অন্যান্য স্ত্রীদের জন্য ঈর্ষার কারণ হতো। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র অধিক আলোচনা ও প্রশংসা এজন্য করতেন যে, খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্যাসঙ্কুল অবস্থায়, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভয়াবহ ও কঠোরতম সময়ে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে শরীক থেকে জান-মালে আল্লাহ ও তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহায্য সহযোগিতা করেন। সর্বাবস্থায় তিনি সীমাহীন ধৈর্য ধারণ করেন। কোন প্রতিকূল অবস্থাতেই হীনবল হোননি, দুর্বল হোননি, ক্লান্তবোধ ও নৈরাশ্যবোধ করেননি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে আশা-ভরসা সঞ্চার করতে থাকতেন। শিয়াবে আবি তালিবে বন্দী থাকা অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে অধিক কষ্ট ও যন্ত্রণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আবু লাহাব যখন দুই ছেলেকে রুকিয়া ও রুকিয়ার বোন কূলসুম বিনতে খাদিজাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তালাক দেওয়ায় বাধ্য করেছিলো, তখন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা যেরূপ ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা কখনো বিস্মৃত হওয়ার মতো নয়।

দ্বীনের জন্য খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র ইখলাস, ধৈর্য ও মেহনতের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ পাক দুনিয়ায় থাকা অবস্থায় তাকে সর্বশান্তির নিকেতন জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেন, তার কাছে জিবরাঈলের মাধ্যমে সালাম প্রেরণ করেন।

বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে জিবরাঈল হাজির হয়ে বললেন, "হে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), খাদিজা চামড়ার বাসনে পানাহার সামগ্রী ভর্তি করে আপনার জন্য নিয়ে আসছেন। তিনি আপনার দরবারে হাজির হলে আল্লাহ ও আমার পক্ষ থেকে তাকে সালাম জানাবেন, আর নিরাপদ ও মনিমুক্তা খচিত জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করবেন।" খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে জিবরাঈলের বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত করেন। এর উত্তরে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, "আল্লাহ পাক সালাম তথা শান্তিময়, তার পক্ষ থেকে সালাম, আর জিবরাঈলের প্রতি সালাম।" ৯

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র অসাধারণ মর্যাদা ও সম্মানের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। যদি তিনি দীর্ঘকাল হায়াত পেতেন, তাহলে তার চরিত্র ও গুণাবলী সম্পর্কে মানুষ যা জানে আর ইতিহাসে যা সংরক্ষিত আছে, তার চেয়ে অনেক বেশী প্রকাশ পেতো। আমি যদি বলি, তিনি ইসলামের জন্য শহীদ হয়েছেন, আর জিহাদের ময়দানেই শহীদ হয়েছেন, তাহলে মোটেই অতিরঞ্জিত হবে না। কারণ, তিনি শিয়াবে আবি তালিবে আবদ্ধ সময়ের অসহনীয় যাতনা ক্লেশের কারণে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হোন আর শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েন। অঙ্গসমূহ ঢলে খসে পড়ে। শিয়াবে আবি তালিব থেকে মুক্তির পর আর সুস্থতা নসীব হয়নি, বরং নানা কারণে রোগ বৃদ্ধির পর অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ'র সাথে মিলিত হোন যে, আল্লাহ পাক তার প্রতি আর তিনি আল্লাহ পাকের প্রতি সন্তুষ্ট। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির দশম বছর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র পবিত্র আত্মা তার সৃষ্টিকর্তার নিকট ফিরে যায়। আল্লাহ পাক তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন আর নিজ রহমতের দ্বারা তাকে পরিবেষ্টিত করে রাখুন, আমীন।

যখন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা শেষ সময়ে পরিবার-পরিজন আর কন্যাদের কাছ থেকে শেষ বিদায় গ্রহণ করছিলেন, তখন তার কন্যা রুকিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা স্বামী উসমান গনী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সাথে হাবশায় (ইথিওপিয়া) হিজরতে অবস্থান করছিলেন। আর রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাশে দাঁড়িয়ে অতি শ্রদ্ধাভাজন জীবনসঙ্গিনীকে অশ্রুসিক্ত নয়নে ভরাক্রান্ত হৃদয়ে অবলোকন করছিলেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রাণপ্রিয়া খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র প্রতি বেদনাভরা দৃষ্টি এমনভাবে নিবদ্ধ করেন যেন তিনি তার জীবনের সবকিছুই তার জন্য বিলিয়ে দিলেন আর আল্লাহ পাকের আমানতকে যথাস্থলে পৌঁছিয়ে দিয়ে শ্রান্ত হয়ে পড়লেন। তার শিরা উপশিরাগুলো অবশ হয়ে এলো। তিনি কেঁদে কেঁদে ঢলে পড়লেন। মক্কার উঁচু এলাকা হাজুন-এর জান্নাতুল মুআল্লা হলো খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র শেষ নিদ্রাস্থল। যেখানে কবর খনন করে নিজে কবরে অবতরণ করে নিজ হাতে সমাহিত করে ঘরে ফিরে পরিবার-পরিজন আর কন্যাদের সাথে বিচ্ছেদ বেদনায় শরীক হোন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা - যাকে গভীর দুঃখ ভরে তার শেষ নিদ্রাগারে আমানত রাখা হয়েছে, স্বামী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিদ্রোহীদের উপহাস-বিদ্রুপ ও ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবিলায় তিনি ছিলেন মজবুত খুঁটি ও সহায়ক। কাফিরদের রুক্ষ আচরণে দুঃখ ও বেদনাহত মনে যখনই বাড়ি ফিরতেন, মহান সুকৌশলী এই স্ত্রী হাসিমুখে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বাগত জানাতেন। তার ভালোবাসা ও মধুর আচরণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মন আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠত। পিছনের দুঃখ কষ্ট সবকিছুই মন থেকে মুছে যেতো। তাকে দেখে, তার সান্নিধ্যে এসে পুনরায় শক্তি সাহস ফিরে পেতেন, নতুন করে আশা ভরসার সঞ্চার হতো আর পরিশ্রম-মেহনত, মুজাহাদা ও আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনুপ্রাণিত ও ব্রতী হতেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র মিষ্টি কথা, তার মধুবাক্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণে শক্তি, সাহস ও প্রেরণা যোগাতো। তার আশ্বস্ত বাণী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে ধৈর্যশীল ও দৃঢ়-প্রত্যয়ী করে তুলতো। হকের উপর সুদৃঢ় হওয়ার জন্য হতো সহায়ক। এমন স্ত্রীকে শেষ বিদায় দেওয়ার সময় বিচ্ছেদ বেদনায় কাতর হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর যা স্বাভাবিক, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বেলায় তা-ই ঘটেছে।

রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিন এতো কেঁদেছিলেন যে, কোন স্বামী তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ বেদনায় এতো অধিক কাঁদে না। ১০

এজন্যই কেঁদেছিলেন যে, খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য যেমন ছিলেন প্রেমাস্পদ-বন্ধু, তেমনি ছিলেন অতি শ্রদ্ধাভাজন মুরব্বী ও সংবেদনশীল স্ত্রী। এজন্যই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ বছরের নামকরণ করেছেন "আমুল হুযুন" অর্থাৎ দুঃখের বছর। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য পাহাড়তুল্য সুদৃঢ় প্রাচীর, সংরক্ষিত দুর্গ। যখন দুনিয়ার মানুষ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিথ্যুক বলে ভৎসনা করেছে, তখন তিনি তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবীয়ে বরহক বলে স্বীকৃত দিয়েছেন। মানুষ যখন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে যুদ্ধ করেছে, তখন তিনি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমর্থন ও সাহায্য করেছেন। যখন মানুষ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বঞ্চিত করেছে, তখন তিনি তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপন মনে সাহায্য করেছেন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত প্রয়োজন মিটানোর যথাযথ ব্যবস্থা করেছেন, প্রচুর অর্থসম্ভারে শক্তিশালী করে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিয়েছেন। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তর তার ভালোবাসায় আচ্ছন্ন ছিলো। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র প্রতি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এতো অধিক ভালোবাসা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য অনেক স্ত্রীর জন্য ঈর্ষারও কারণ হয়ে উঠত। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, স্বয়ং আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, "রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আমার বিয়ে খাদিজার মৃত্যুর পর সম্পাদিত হয়েছে। আমি তাকে কোনদিন দেখিওনি। কিন্তু খাদিজার মতো আর কারো প্রতি আমার ঈর্ষা সৃষ্টি হয়নি।"

এই ঈর্ষার কারণ বর্ণনা করে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, "রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা তার প্রশংসা করতেন। কোন সময় কোন পশু জবাই হলে খাদিজার বান্ধবীদের অনুসন্ধান করে তাদের বাড়ীতে খাদিজার স্মরণে গোশতের হাদিয়া পাঠাতেন। আমি অনেক সময় বলে থাকতাম, 'মনে হয় আপনার দৃষ্টিতে সারা পৃথিবীতে খাদিজা ছাড়া আর কোন মহিলাই নেই।' রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বলতেন, 'খাদিজা তো খাদিজা-ই, তার কোন নজীর নেই, আমার সমস্ত সন্তান তারই গর্ভের।' "

মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, "বকরী যবাই হলে তার বান্ধবীদের কাছে গোশত হাদিয়া করতে আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন। একদিন আমি অত্যন্ত রাগান্বিত স্বরে বললাম, 'খাদিজা আবার কে ?' রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, 'আমার অন্তরে তার গভীর ভালোবাসা বিদ্যমান।' " ১১

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, "রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদিজার কথা স্মরণ করে অত্যন্ত প্রশংসা ও তার জন্য মাগফিরাতের দুয়া করতেই থাকতেন, দমতেন না। একদিন ঈর্ষাতুর হয়ে আমি বললাম, 'আল্লাহ পাক আপনাকে এই বুড়ীর বদলে আমাকে দান করেছেন।' এতে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন আর আমার উপর ভীষণ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। আমি এ অবস্থা দেখে মুনাজাত করলাম, 'হে আল্লাহ, আমার উপর আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসন্তুষ্টি দূরীভূত করুন, আমি আমার জীবনে আর কোনদিন খাদিজার ব্যাপারে কটূক্তি করবো না।' আমার দুরাবস্থা ও অনুতাপ দেখে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, 'তুমি কি করে এমন কথা খাদিজার সম্পর্কে বলতে পারলে ? অথচ সে আমার উপর ঈমান স্থাপন করেছে, যখন সমস্ত মানুষ আমাকে মিথ্যুক বলে উপহাস করেছে। মানুষ যখন আমাকে বয়কট করেছে, তখন সে আমাকে বরণ করেছে, আশ্রয় দিয়েছে। তার গর্ভে আমার সন্তান জন্ম নিয়েছে, তোমাদের গর্ভে সন্তান জন্ম নেয়নি।' " ১২

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, "এরপর এক মাস রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাছে আসতেন আর ফিরে যেতেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শিথিল করে রাখেন। একদিন খাদিজার বোন 'হালা' আসছিলেন, তার কথাবার্তা ও গলার স্বর খাদিজার মতো ছিলো, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। আমি ঈর্ষা ভরে বললাম, 'কুরাইশদের এক লাল গালওয়ালী বুড়ির কথা আর কতো বলবেন, এক যুগ পূর্বে যার মৃত্যু হয়ে গেছে। আল্লাহ পাক তো আপনাকে তার তুলনায় উত্তম একজনকে দান করেছেন।' এতে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভীষণ অসন্তুষ্ট হোন। একেই বলে ভালোবাসা, একেই বলে ওয়াফাদারী। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা যুবতী ছিলেন, সুন্দরী মহিলা ছিলেন, বংশ গৌরবও তার ছিল যথেষ্ট, আর রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অত্যধিক ভালোও বাসতেন বটে, কিন্তু খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র ব্যাপারে তির্যক রসিকতাকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহ্য করেননি এবং অত্যন্ত অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে মহীয়সী এই নারীর প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, 'না, আল্লাহ'র কসম, অবশ্যই না। আল্লাহ তার বদলে তার তুলনায় আমাকে উত্তম কোন কিছুই দেননি। যখন সমস্ত মানুষ আমার দাওয়াতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে, তখন সে আমার প্রতি ঈমান স্থাপন করেছে। যখন দুনিয়ার মানুষ আমাকে মিথ্যুক বলে আখ্যায়িত করেছে, তখন সে আমাকে সমর্থন করেছে। যখন মানুষ আমাকে বয়কট করেছে, তখন সে আমার প্রতি করুণা করেছে। আল্লাহ তার গর্ভে আমাকে সন্তান দিয়েছেন, অন্যদের গর্ভে কোন সন্তান দেননি।' " ১৩

আল্লাহ পাক মুসলমানদের প্রথম জননী খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন, তার প্রতি অফুরন্ত রহমত নাযিল করুন, আর তাকে সন্তুষ্ট করে সর্বশেষ জান্নাত - জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চস্তরে সমাসীন করুন, আমীন। তাকে আর আমাদের সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যান্য নবী-রাসুলগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও নেককার মুত্তাকীদের সাথে হাশরের ময়দানে জমায়েত করুন, আমীন। কেননা, তারাই হচ্ছেন উত্তম সহচর। আল্লাহ তাদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় আমাদের অন্তরকে উদ্ভাসিত করুন, আর তাদের পদাংকানুসরণে আমাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দানকারী শ্রেষ্ঠ ও আদর্শ উম্মত হিসেবে কবুল করুন, আমীন। অভিভাবক হিসেবে আল্লাহ পাকই যথেষ্ট।

 

পাদটীকাঃ

(১) ইবনে সাআদ - ৫২/৮, সিয়ারু আলামিন নুবালা - ১০৯/২, সাফওয়া - ৭/২, ইস্তিআব - ২৭৯/৪, ইসাবা - ২৮/৪, উসদুল গাবা - ৪৩৪/৫, মাআরিফ - ৫৯, তাহযীবুল আসমা - ৩৪১/২, শাজারাতুয যাহাব - ১৪/১, তারিখুল ইসলাম - ৪১/১, জামিউল উসুল - ১২০/৯, মুস্তাদরাক - ১৮২/৩, কানযুল উম্মাল - ৬৯০/১৩, মাজমাউয যাওয়ায়েদ - ২১৮/৯, ইবনে ইসহাক - ৮২।

(২) দালাইল - ২৮৩/৭, মারিফা - ২৬৭/৩, তাবারী - ১৬০/৩, ইবনে ইসহাক - ২৪৫, মাজমা - ২৫৩/৯।

(৩) ফাতহুল বারী - ৪৭৪/১, আবু নুয়াইম - ১৪৩, দালাইল - ৩০/২, সুনানুল কুবরাঃ বাইহাকী - ৩৬৬/৬, খাসাইস - ৭৯/১, সুবুলুল হুদা - ১৯৯/২, ইবনে হিশাম ১৮৩, নিহায়া - ২৮৭/২।

(৪) দালাইল - ৬৬/২, মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক - ৩২০/৫, আবু নুয়াইম - ৫৪/১, ইবনে হিশাম - ১৮৮/১, রাওযুল উনুফ - ২৩৬/২, তাবারী - ২৮০/২, ইবনে সাআদ - ৮২/১, উয়ুনুল আসার - ৬১/১, নিহায়াতুল আরব - ৮৫/১৬।

(৫) ইবনে সাআদ - ৩১০/১, মুস্তাদরাক - ১৮২/৩, আহমাদ - ৩১২/১, মুজামে তাবারানী - ১৮৬/১২, মুসান্নাফা - ৩২০/৫, ইবনে ইসহাক - ৮১, আরাকী - ২৬৭/৩, মাজমা - ২২০/৯, ইবনে হিশাম - ১৮৯, মাওয়াহিব - ২০২/১, দালাইল - ৯০/১, মুনতাখাব - ১৯৯।

(৬) ইবনে সাআদ - ৮৪/১, সিমতুসসামীন - ৩২/১৬, মুসান্নাফা - ৩২০/৫, দালাইল - ৪২৪/১, মাজমা - ২২১/৯, উয়ুনুল আসার - ৬২/১, মুনতাখাব - ২৫, ইবনে হিশাম - ১৮৯/১, সিরাতে ইবনে কাসির - ২৬৭/১।

(৭) বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, শারহুস সুন্নাহ - ২৬৯/৭, বাইহাকী - ৫১/৭, আহমাদ - ২৩২/৬, ইবনে হিব্বান - ১১৫/১।

(৮) বুখারী, মুসলিম, ফাতহুল বারী - ৪৫২/৩, ইবনে হিশাম - ৩৫২/১, রাওযুল উনুফ - ২৮৩/৩।

(৯) বুখারী, ফাতহুল বারী - ১৩৩/৭, মুসলিম, তিরমিযি, নাসাঈ, সিমতুসসামীন - ২৪, আহমাদ - ২০৫/১, ২০৩/২, তাবারী - ১১/১৩, মাজমা - ২২৩/৯, মুস্তাদরাক - ১৮৫/৩, কানযুল উম্মাল - ১৩০/১২।

(১০) দালাইল - ৩৫২/২, হাকিম - ১৮২/৩, ইবনে ইসহাক - ২৪৩, তাবারী - ৩৪৩/২।

(১১) বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, ফাতহুল বারী - ১৩৩/৭।

(১২) তাবরানী - ১৩/২৩, আহমাদ - ১১৭/৩, হাইসামী - ২২৪/৯।

(১৩) মাজমা - ২২৪/৯, বুখারী, মুসলিম, ফাতহুল বারী - ১৩৪/৭।

 

উৎসঃ নবী পরিবারের প্রতি ভালোবাসা - মাওলানা মাহমুদুল হাসান (প্রকাশনী - মাকতাবাতুল আবরার)

ব্লগ লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-3S

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু

 

 

The Greatest Nation·Thursday, January 24, 2019

 

 

 

 

মদিনার বিখ্যাত গোত্র আউসের শাখা আবদুল আশহারের সন্তান সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু। তার পিতা মুয়ায। তার ডাকনাম আবু আমর, উপাধি সাইয়েদুল আউস। তার মাতা কাবশা বিনতে রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহা, প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র চাচাতো বোন।

জাহেলি যুগেই পিতা মুয়াযের ইন্তিকাল হয়। তবে মাতা হিজরতের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন আর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মৃত্যুর পর বহুদিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

বংশধারা হলো - সাদ ইবনে মুয়ায ইবনে নোমান ইবনে ইমরাউল কায়েস ইবনে যায়েদ ইবনে আবদুল আশহাল।

আউস গোত্রের মধ্যে বনু আবদুল আশহাল শাখা ছিলো সর্বাধিক অভিজাত ও সম্মানিত। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন তার সময়ের একজন বড় মাপের নেতা। (১)

 

ইসলামের পতাকাতলে

যদিও প্রথম আকাবার বায়আতের মধ্য দিয়ে মদিনায় ইসলামের আলোকচ্ছটা এসে পড়েছে, বাস্তবে মদিনা ইসলামের আলোয় আলোকিত হওয়ার পিছনে মুসআব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র ব্যক্তিত্ব জড়িত ছিলো। মুসআব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের দাঈ হয়ে মদিনায় আসেন এবং নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে মদিনার প্রতিটি লোকের কানে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন কুফরের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলেন। তিনি মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সফলতার উপর দারুন আশ্চর্য হোন আর নিজ সম্প্রদায়ের ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা দেখে ভীষণ ব্যথিত ও মর্মাহত হোন। (২)

অবশেষে একদিন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'ও মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু'র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। আসআদ ইবনে যুরারার ঘরে তখন মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু অবস্থান করছিলেন। মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে একবার আসআদ ইবনে যুরারা বললেন, "যদি সাদ ইবনে মুয়ায মুসলমান হয়, তাহলে তার গোত্রের দুজন লোকও বিধর্মী থাকবে না। এজন্য সাদকে মুসলমান বানানোর চেষ্টা চালানো উচিত।"

সাদ ইবনে মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছে আসেন। মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বললেন, "আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। কথাগুলো বসে আপনি প্রথমে শুনুন। গ্রহণ করা না করা আপনার ইচ্ছা।" সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার এই আবেদন মনযুর করেন। মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সামনে ইসলামের বাস্তবতা তুলে ধরেন, কুরআনের কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত করে শুনান। তখন সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু কালেমা পরে মুসলমান হয়ে যান।

 

পুরো গোত্রের ইসলাম গ্রহণ

আবদুল আশহাল গোত্রে এই সংবাদ মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘরে যান। গোত্রের লোকেরা এসে তাকে বললো, "এখন আপনার সেই পূর্বের চেহারা নেই।" সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "আমি আপনাদের মধ্যে কোন পর্যায়ের লোক ?" সকলে সমস্বরে বলে উঠলো, "আপনি আমাদের সর্দার, আর আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।" সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "আপনারা যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনাদের সাথে কোন ধরণের কথাবার্তা বলবো না।"

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সম্প্রদায়ের মধ্যে যে মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, তার প্রভাবে সন্ধ্যা হতে না হতেই পুরো গোত্র মুসলমান হয়ে যায়। মদিনার আকাশ-বাতাস তখন তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে। তবে বনু উমাইয়া ইবনে যায়েদ, বনু খুতমা, বনু ওয়াইল ও ওয়াকেফের লোকেরা এর ব্যতিক্রম। তারা মুসলমান হয়নি। (৩)

ইসলামের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে এটি সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মহা অবদান। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে কেউ এই গৌরবে তার তুল্য নেই। এ কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন যে, আনসারদের মধ্যে সর্বোত্তম গোত্র হলো বনু নাজ্জার। তারপর বনু আবদুল আশহালের স্থান।

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তার গোত্রের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা প্রথম ও দ্বিতীয় আকাবার মাঝামাঝিতে সংঘটিত হয়েছিলো। মুসলমান হওয়ার পর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসআব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে আসআদ ইবনে জুরারার ঘর থেকে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন।

 

মক্কায় আবু জাহেলের সাথে বিতর্ক

কিছুদিন পর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় রওয়ানা হোন। উমাইয়া ইবনে খালফ মক্কার প্রসিদ্ধ নেতা আর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু মক্কায় পৌঁছে তার বাড়িতে অবস্থান করেন। উমাইয়া ইবনে খালফ মদিনায় এলে বন্ধুত্বের সুবাদে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বাড়িতে উঠতো। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উমাইয়া ইবনে খালফকে বললেন, "হারাম শরীফে যখন লোকজন না থাকে, তখন আমাকে অবহিত করবে।"

দুপুরবেলা সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উমাইয়ার সাথে তাওয়াফ করার জন্য বের হোন। পথে হলো আবু জাহেলের সাথে সাক্ষাৎ। আবু জাহেল জিজ্ঞেস করলো, "এই লোক কে ?" উমাইয়া জবাবে বললো, "সাদ ইবনে মুয়ায।"

আব্দু জাহেল বললো, "আশ্চর্য! তুমি একজন বিধর্মী অর্থাৎ মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসারীকে আশ্রয় দিয়েছো আর তার সাহায্যকারী হয়ে নিশ্চিন্তে মক্কায় ঘুরে ফিরছো ! তুমি তার সাথে না থাকলে তার ঘরে ফেরা কঠিন হতো।"

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন, "তুমি আমাকে বাধা দাও, দেখবে কি হয়। আমি তোমার মদিনার রাস্তা বন্ধ করে দিবো।"

উমাইয়া বললো, "সাদ, আবুল হাকাম (আবু জাহেল) মক্কার একজন বিশিষ্ট নেতা। তার সামনে নিচু স্বরে কথা বলো।" সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "যাও, সরো। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বলতে শুনেছি, মুসলমানরা তোমাদেরকে হত্যা করবে।" উমাইয়া বললো, "তারা আমাদের মক্কায় এসে হত্যা করবে ?" সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "তা আমি জানি না।" (৪)

হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ মতান্তরে সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাসের সাথে তার দ্বীনী ভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। (৫)

 

মদিনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিনিধি

দ্বিতীয় হিজরি সনের রবিউল আউয়াল মাসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশ নেতা উমাইয়া ইবনে খালফের নেতৃত্বাধীন একশো লোকের একটি কাফেলার খোঁজে বের হোন। ইতিহাসে এটি বাওয়াত অভিযান নামে খ্যাত। এক বর্ণনামতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রতিনিধি হিসেবে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে তখন মদিনায় রেখে যান। (৬)

 

জ্বালাময়ী ভাষণ

বাওয়াত অভিযানের পর ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধের সময় চলে আসে। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সেই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়ন হওয়ার সময় ছিলো এই যুদ্ধ। কুরাইশ পৌত্তলিকরা মদিনা আক্রমণের জন্য পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সংবাদ জানতে পেরে বদরের দিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরাইশ বাহিনীর সর্বশেষ গতিবিধি অবগত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মুহাজির ও আনসারদের নিয়ে পরামর্শে বসেন। মুহাজিরদের মধ্যে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ সাহাবী নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করেন। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের লক্ষ্য করে বললেন, "লোকসকল, আমাকে পরামর্শ দিন।"

সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি। আপনাকে সত্যবাদী বলে জেনেছি। আমরা স্বীকার করেছি যে, আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন সবই সত্য ও সঠিক। আপনার কথা শুনার আর আপনার আনুগত্য করার অঙ্গীকার আমরা করেছি। সুতরাং আপনার যা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। আমরা আপনার সঙ্গেই আছি।

সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজন লোকও পিছনে থাকবে না। আমরা যুদ্ধকে ভয় করি না। রণাঙ্গনেও সত্যবাদী হিসেবে প্রমাণিত হবো, ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে এমন আচরণ প্রত্যক্ষ করাবেন, যা আপনার চোখ শীতল করে দিবে। (৭)

আল্লাহ'র উপর ভরসা করে আমাদের নিয়ে আপনি অগ্রসর হোন।"

তিনি আরো বললেন, "আমরা তাদের মতো হবো না, যারা মুসাকে বলেছিলো - আপনি আর আপনার প্রতিপালক যান আর শত্রুর সাথে যুদ্ধ করুন, আর আমরা এখানে বসে থাকি।

বরং আমরা বলবো - আপনি আর আপনার প্রতিপালক যান, আর আমরাও আপনাদের অনুসরণ করবো।

হতে পারে আপনি এক উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন কিন্তু আল্লাহ অন্য একটি করালেন। দেখুন, আল্লাহ আপনার দ্বারা কি করান।"

ঐতিহাসিকদের বর্ণনা হলো, সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র এই কথার সমর্থনে আল্লাহ সূরাহ আনফালের ৬ নং আয়াত অবতীর্ণ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র এই বক্তব্যে দারুণ খুশী হোন। সেনাবিন্যাস করার সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আউস গোত্রের ঝাণ্ডা সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র হাতে সোপর্দ করেন। তবে অন্য এক বর্ণনা মতে, এই যুদ্ধে গোটা আনসার সম্প্রদায়ের পতাকা ছিলো সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র হাতে। (৮)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য তাঁবু স্থাপনের পরামর্শ

বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, বদরযুদ্ধ শুরুর পূর্বে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বললেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমরা আপনার জন্য একটি আরিশ বা তাঁবু স্থাপন করে একটি বাহিনী মোতায়েন রাখছি না কেন ? কারণ আমরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবো। তাতে যদি আল্লাহ আমাদের সম্মান দান করেন, আমরা বিজয়ী হই, তাহলে তো আমাদের আশা পূর্ণ হলো। আর যদি এর বিপরীত কিছু ঘটে যায়, তাহলে আপনি এই বাহিনীসহ আমাদের পেছনে ছেড়ে আসা লোকদের সাথে মিলিত হবেন।

ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমাদের পিছনে মদিনায় যেসব লোক রয়ে গেছে, আপনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা তাদের থেকে একটুও বেশী নয়। যদি তারা বুঝতে পারতো আপনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন, তাহলে তারা এভাবে পিছনে পড়ে থাকতো না। আল্লাহ তাদের দ্বারা আপনার হেফাযত করবেন। তারা আপনাকে সৎ উপদেশ দান করবে। আপনার সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করবে।"

এই বক্তব্যের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রশংসা করে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র জন্য দোয়া করেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য রনাঙ্গনের অদূরে একটি তাঁবু নির্মাণ করা হয়, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। (৯)

 

পৌত্তলিকদের হত্যা করা আমার বেশী পছন্দ

কুরাইশ বাহিনী পরাজিত হয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। তখন মুসলিম সৈন্যরা তাদের ধাওয়া করে ধরে ধরে বন্দী করতে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর হঠাৎ আক্রমণ হতে পারে ভেবে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু আরো কিছু আনসারী সাহাবীকে নিয়ে অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে তাঁবুর দরজায় পাহারায় নিয়োজিত হোন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ লক্ষ্য করে বললেন, "সাদ, মনে হচ্ছে লোকজনের কাজ তোমার পছন্দ হচ্ছে না।"

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "হ্যা, পৌত্তলিকদের সাথে এটা আমাদের প্রথম সংঘাত। তাদের পুরুষদের জীবিত রাখার চেয়ে হত্যা করাই আমার কাছে বেশী পছন্দ।" (১০)

সাহাবায়ে কিরামের অনুশোচনা

উহুদের যুদ্ধে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থানস্থলের পাহারাদার ছিলেন। শুরুতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মত ছিলো মদিনার ভিতর থেকে পৌত্তলিকদের মোকাবিলা করা। মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলেরও এই মত ছিলো। কিন্তু কিছু নওজোয়ান সাহাবী, যারা ছিলেন শাহাদাতের বেশী আকাঙ্ক্ষী, তারা মদিনার বাইরে গিয়ে লড়াই করার জন্য জেদ ধরে বসেন। তারা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মত মেনে নেন আর রণসাজে সজ্জিত হওয়ার জন্য অন্দরমহলে প্রবেশ করেন।

সাদ ইবনে মুয়ায ও উসাইদ ইবনে হুদাইর তখন বললেন, "তোমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে মদিনার বাইরে যেতে বাধ্য করেছো, অথচ তার উপর আসমান থেকে ওহী নাযিল হয়। এজন্য তোমাদের উচিত, তোমাদের মত প্রত্যাহার করা আর বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তরবারি, ঢাল, বর্ম ইত্যাদি নিয়ে রণসাজে সজ্জিত হয়ে ঘর থেকে বের হোন। সকল সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে অনুতপ্ত হোন। আরয করেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনার বিরোধিতা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আপনি যা-ই নির্দেশ দেন, আমরা তা পালন করতে প্রস্তুত আছি।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "এখন আমার করার কিছুই নেই। যখন নবীগণ অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বের হোন, তখন যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েই বের হোন। এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ থাকে না।" (১১)

 

উহুদের যুদ্ধে বীরত্ব

উহুদের পাদদেশে যুদ্ধ শুরু হয়। মুসলিম বাহিনী প্রথম দিকে বিজয় অর্জন করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পিছু হটে যায়। পৌত্তলিকরা মুসলমানদের উপর সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত হানতে থাকে। সেসময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবচেয়ে বেশী অবিচল ছিলেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কিছু সাহাবীও দৃঢ়পদে লড়াই করে যান। তাদের মধ্যে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু অন্যতম। এই যুদ্ধেই তার ভাই আমর ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু শাহাদাত লাভ করেন। (১২)

খন্দকের যুদ্ধে হাতে তীরের আঘাত

খন্দকের যুদ্ধের সময় সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ম পরিধান করে হাতে বর্শা নিয়ে রনাঙ্গনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হোন। পথে বনু হারেসার কেল্লায় তার মা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র কাছে বসে ছিলেন। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছন্দ আবৃত্তি করতে করতে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার মা তাকে দেখে চিৎকার করে বললেন, "বৎস, তুমি পিছনে থেকে গেছো, দ্রুত যাও।"

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র যে হাতে বর্শা ছিলো, সে হাত বর্মের বাইরে বেরিয়ে ছিলো। মুলত তিনি ছোট বর্ম পরিধান করেছিলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, "সাদের মা, দেখুন, তার বর্মটি কতো ছোট।" (১৩)

যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছার পর তাকে লক্ষ্য করে হিব্বান ইবনে কায়েস একটি তীর ছুঁড়ে মারে। কোনো কোনো বর্ণনায়, হিব্বানের পরিবর্তে আবু উসামা বা খাফাজা ইবনে আসিমের নাম রয়েছে। তীরটি তার হাতে লেগে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করে। এতে হিব্বান খুশী হয়ে বলে উঠে, "আমি আরিকার পুত্র।" এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মতান্তরে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু বলে উঠলেন, "আল্লাহ তাআলা দোযখে তোমার চেহারা ঘামে নিমজ্জিত করুন।" (১৪) আরাকা অর্থ ঘাম।

 

মসজিদে নববীর চিকিৎসা শিবিরে

যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র হাতে তীর বিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে অবহিত হোন, তখন তাকে মসজিদে নববীতে স্থাপিত রুফায়দার চিকিৎসা-শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেন। মসজিদে নববীতে যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার জন্য একটি শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। এলাম গোত্রের রুফায়দা নামের এই মহিলা সেই শিবিরের একজন সেবিকা। তিনি আহতদের সেবা ও চিকিৎসা করতেন। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এই তাঁবুতেই থাকতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন এসে তার খোঁজখবর নিতেন। (১৫)

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র দোয়া

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন এই শিবিরে এসে অসুস্থ সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র দেখাশোনা করতেন। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন নিজের জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েন তখন বলেন,

"আল্লাহ, যদি কুরাইশদের সাথে এখনো যুদ্ধ বাকি থাকে তাহলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। আমি তাদের থেকে বেশী আর কারো সাথে যুদ্ধ করতে আগ্রহী নই। কারণ তারা আপনার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে কষ্ট দিয়েছে, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, মাতৃভূমি মক্কা ছাড়তে বাধ্য করেছে। যদি আমাদের ও তাদের মধ্যকার সংঘাত শেষ করে দেন, তাহলে এই ক্ষত দ্বারাই আমার জন্য শাহাদাত দান করুন। যতক্ষণ বনু কুরাইযার ধ্বংস দেখে আমার চোখ শীতল না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে মৃত্যু দিবেন না।" (১৬)

 

বনু কুরাইযার বিচারক

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দক যুদ্ধে কুরাইশ ও তাদের মিত্রবাহিনীর পরাস্ত হওয়ার পর ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযাকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কারণ তারা বিশ্বাসঘাতকতা ও চুক্তি ভঙ্গ করেছিলো। প্রাচীনকাল থেকে বনু কুরাইযার সাথে আউস গোত্রে মৈত্রীচুক্তি ছিলো।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন আউস গোত্রের লোকেরা বললো, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমাদের প্রতিপক্ষ খাযরাজ গোত্রের বিরুদ্ধে তারা ছিলো আমাদের মিত্র। এর আগে আপনিই আমাদের ভাই খাযরাজিদের মিত্র গোত্র বনু কায়নুকার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তা আপনার জানা আছে।" মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এই একই কথা বললো। মূলত তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে বনু কুরাইযার ব্যাপারে কোন কঠিন শাস্তির আশংকা করছিলো।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "হে আউস সম্প্রদায়, তোমাদের গোত্রের কেউ তাদের সিদ্ধান্ত দিলে তোমরা কি তাতে খুশী হবে ?" উত্তরে তারা বললো, "হ্যা, খুশী হবো।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "তাদের ব্যাপারে সাদ ইবনে মুয়ায সিদ্ধান্ত দিবেন।"বনু কুরাইযার ফয়সালার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে বিচারক নিয়োগ করেন।

তখন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। আউস গোত্রের লোকেরা উটের পিঠে গদি বিছিয়ে তার উপর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে উঠিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যায়।

পথে তারা সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে বললো, "আবু আমর, আপনার মিত্রদের সাথে একটু ভালো আচরণ করবেন। সম্ভবত একারনেই আপনাকে বিচারক বানানো হয়েছে।"

তারা বেশী বাড়াবাড়ি শুরু করলে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "আল্লাহ'র নির্দেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন নিন্দুকের নিন্দার বিন্দুমাত্র পরোয়া সাদের নেই।"

সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছেন তখন তার আশেপাশে বসা সাহাবীদের বললেন, "তোমাদের নেতার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাও।"

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র গোত্রের লোকেরা বিচারের ক্ষেত্রে একটু নমনীয় হওয়ার জন্য আবার পীড়াপীড়ি শুরু করে। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন বললেন, "তোমাদের এ ব্যাপারে আল্লাহ'র সাথে অঙ্গীকার ও চুক্তি অনুসরণ করা উচিত।"

তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে বললেন, "বনু কুরাইযার লোক তোমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে।"

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "আমি সিদ্ধান্ত দিচ্ছি যে, তাদের মধ্যে যে সব লোক যুদ্ধ করার উপযুক্ত তাদেরকে হত্যা করা হবে, নারী ও শিশুদেরকে দাস-দাসীতে পরিণত করা হবে আর তাদের সব সম্পদ বণ্টন করে দেওয়া হবে।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র এ ফয়সালা শুনে বললেন, "সাদ, তুমি তাদের ব্যাপারে আল্লাহ ও তার রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাহিদা অনুযায়ী ফয়সালা করেছো।" (১৭)

তখন সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু'র রায় অনুযায়ী বনু কুরাইযার চারশো লোককে হত্যা করা হয়।

 

পরম প্রভুর সান্নিধ্যে

রায় বাস্তবায়ন হওয়ার পর অল্প কিছুদিন তিনি জীবিত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার নিজ হাতে তার ক্ষত সেঁকে দেন। তাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার হাত ফুলে উঠে। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু যে দুয়া করেছিলেন তা আল্লাহ'র দরবারে কবুল হয়ে গিয়েছিলো।

একদিন তার ক্ষত ফেটে প্রবলবেগে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। মসজিদে নববী অতিক্রম করে গিফার গোত্রের তাঁবু পর্যন্ত রক্তের স্রোত বয়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়ে। জিজ্ঞেস করে - কি হয়েছে ? উত্তর আসে - সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র ক্ষত ফেটে গিয়েছে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবহিত হয়ে অস্থির হয়ে পড়েন। কাপড় টানতে টানতে দৌড়ে মসজিদে নববীতে আসেন আর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মাথা কোলে উঠান। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন আর এ পৃথিবীতে নেই, তবে রক্ত আগের মতোই ঝরতে থাকে। লোকজন জড়ো হয়ে যায়।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আসেন, আর লাশ দেখে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠেন, "হায়, তার কোমর ভেঙ্গে গেছে।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "এমন কথা বলো না।"

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কাঁদতে কাঁদতে "ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন" পাঠ করেন। গোটা তাঁবুতে কান্নার রোল পড়ে যায়।

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র দুখিনী মা কাঁদতে কাঁদতে একটি ছন্দ আবৃত্তি করতে থাকেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে কবিতা পড়তে নিষেধ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "থাক, তাকে পড়তে দাও। অন্য বিলাপকারিণীরা মিথ্যা বলে থাকে, কিন্তু সাদের মা সত্য বলছেন।" (১৮)

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে দাফনের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে খুব বিমর্ষ দেখা যায়। চোখ দিয়ে ক্রমাগতভাবে অশ্রু ঝরতে থাকে। খন্দক যুদ্ধের এক মাস আর বনু কুরাইযার ঘটনার কয়েক রাত পর হিজরি পঞ্চম সনে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মৃত্যু হয়। (১৯)

 

ফেরেশতাদের গোসল দেওয়ার ভয়ে

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র ইন্তিকালের পর তার বাড়িতে যাচ্ছিলেন। সাহাবীরাও সঙ্গে ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতো দ্রুত চলছিলেন যে, সাহাবায়ে কিরাম তার অনুসরণ করতে পারছিলেন না।

তাদের একজন বলে বসেন, "আপনি এতো দ্রুত হাঁটছেন কেন ? আমরা তো ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "আমার ভয় হচ্ছে, আমাদের আগেই ফেরেশতারা তাকে গোসল না দিয়ে ফেলে, যেমন দিয়েছিলো হানযালাকে।" (২০)

 

জানাযায় সত্তর হাজার ফেরেশতার অংশগ্রহণ

সাহাবায়ে কিরাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র জানাযা নিয়ে কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'ও সাথে যান। মুনাফিকরাও যায়।

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র লাশ হালকা মনে হচ্ছিলো। এজন্য মুনাফিকরা বলাবলি শুরু করে - এমন হালকা লাশ আমরা কখনোই দেখিনি, সম্ভবত বনু কুরাইযার ব্যাপারে সে যে ফয়সালা করেছিলো, তারই কুফল এটি।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের এ কথা শুনে বললেন, "যার হাতে আমার জীবন, তার নামের শপথ, ফেরেশতাগণ তার খাট বহন করছেন।"

ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, "নিশ্চয়ই সাদ খুব নেককার মানুষ। তার জন্য আল্লাহ'র আরশ দুলে উঠেছে, আসমানের দরজাসমূহ খুলে গেছে। তার জানাযায় এমন সত্তর হাজার ফেরেশতা অংশগ্রহণ করেছেন, যারা এর আগে কখনোই পৃথিবীতে আসেননি।" (২১)

পাগড়ি বেঁধে জিবরীল আলাইহিস সালামের আগমন

বিশিষ্ট সিরাতবিদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু ইন্তিকাল করার পর রাতের বেলা একটি রেশমি কাপড়ের পাগড়ি বেঁধে জিবরীল আমিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), কে এই মৃত ব্যক্তি, যার জন্য আকাশের সব দরজা খুলে গেছে আর আল্লাহ'র আরশ কেঁপে উঠেছে ?"

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দ্রুত কাপড় টানতে টানতে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছে গিয়ে দেখেন যে, তিনি ইন্তিকাল করেছেন। (২২)

 

একজন বিশিষ্ট সাহাবীর বিদায়

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মৃত্যু ইসলামী ইতিহাসের এক অসাধারণ ঘটনা। তিনি ইসলামের মধ্যে যে অবদান রাখেন, আর যে দ্বীনী অনুপ্রেরণা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিলো, তার জন্য তাকে আনসারদের "আবু বকর" মনে করা হতো।

আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র প্রতি মিথ্যা অপবাদের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষোভ নিয়ে বললেন, "আল্লাহ'র এই দুশমন (মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই) আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। তোমাদের কেউ কি এর প্রতিবিধান করতে পারবে ?"

সাথে সাথে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, "আউস গোত্রের কেউ হলে আমাকে বলুন, আমরা তার গর্দান উরয়ে দিবো। আমাদের ভাই খাযরাজিদের কেউ যদি হয় তাহলে আমাদের নির্দেশ দিন, আমরা আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবো।"

তার দ্বীন প্রচারের একটি সুফল হলো, তার পুরো গোত্র একসাথে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এটি আনসারদের প্রথম গোত্র, যার সকল সদস্য একসাথে মুসলমান হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে "সাইয়েদুল আনসার" উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের সবচেয়ে মর্যাদাবান ও সম্মানিত ব্যক্তি। তার মৃত্যুর ঘটনাটি যে কতো গুরুত্বপূর্ণ তা অনুমিত হয় তার জানাযায় ফেরেশতাদের অংশগ্রহণ আর আল্লাহ'র আরশ কেঁপে উঠার মাধ্যমে। তাই একজন আনসারি কবি গর্ব করে বলেন -

وما اهتزله عرش الله عن موت هالك - سمعنا به الا لسعد ابي عمرو

একমাত্র সাদ আবু আমরের মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন মরণশীল ব্যক্তির মৃত্যুতে আল্লাহ'র আরশ কেঁপে উঠেছে, এমন কথা আমরা কখনো শুনিনি।

এ ছাড়া হাসসান ইবনে সাবিতও তার বহু কবিতায় সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক জ্ঞাপন করেছেন। (২৩)

নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একজন উঁচু স্তরের লোক। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, "রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে আবদুল আশহাল গোত্রের তিন ব্যক্তি থেকে উত্তম কেউ নেই। তারা হলেন - সাদ ইবনে মুয়ায, উসাইদ ইবনে হুদাইর ও আব্বাদ ইবনে বিশর।" (২৪)

 

তিনটি বিষয়ে আমার স্তরে কেউ নেই

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, "এমনিতে আমি একজন সাধারণ মানুষ। তবে তিন জিনিসে যে পর্যন্ত পৌঁছা উচিত, আমি সেখানে পৌঁছেছি -

(১) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে যে বাণী শুনি, তা আল্লাহ'র পক্ষ থেকে হওয়ার বিশ্বাস আমার হয়ে যায়,

(২) নামাযের মধ্যে কোন দিকে আমার মন যায় না,

(৩) কোনো জানাযার সাথে থাকলে আমার মধ্যে মুনকার-নাকিরের প্রশ্নের চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু থাকে না।" (২৫)

সায়িদ ইবনে মুসাইয়াব বলেন, "এই বৈশিষ্ট্যগুলো পয়গাম্বরদের মধ্যে থাকে।"

 

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র আমলের প্রতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আস্থা

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র আমলের উপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দারুণ আস্থা ছিলো। এক হাদিস থেকে তা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়।

আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "কবরে একটি চাপ অবশ্যই আছে। যদি এই চাপ থেকে কেউ মুক্তি পেয়ে থাকে, তাহলে সে সাদ ইবনে মুয়ায।" (২৬)

 

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র জান্নাতি রুমালের কোমলতা

একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কেউ একটি রেশমি জুব্বা পাঠায়। সাহাবায়ে কিরাম জুব্বাটির কোমলতা দেখে অভিভূত হয়ে যান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, "তোমরা এর কোমলতা দেখে আশ্চর্য হচ্ছো ? জান্নাতে সাদ ইবনে মুয়াযের রুমাল এর চেয়েও বেশী কোমল ও মোলায়েম হবে।" (২৭)

 

কবরের মাটি মেশকে রুপান্তর

আবু সায়িদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, "যারা বাকী কবরস্থানে (অর্থাৎ, জান্নাতুল বাকী'তে) সাদের কবর খুঁড়েছিল, আমি তাদের একজন। আমরা কবরের মাটি খোঁড়ার সময় মেশকের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম।"

শুরাহবিল ইবনে হাসানা বলেন, "এক ব্যক্তি সাদের কবরের মাটি থেকে এক মুঠ মাটি নিয়ে ঘরে রেখে দেয়। কিছুদিন পর সে দেখে, সেই মাটি মেশকে রূপান্তরিত হয়েছে।" (২৮)

 

ফুটনোটঃ

(১) সিরাতে ইবনে হিশাম - ২/২৫২, তাবাকাত - ৩/৪২০

(২) খুলাসাতুল অফা বি-আখবারি দারিল মুসতফা - ৯২

(৩) তারিখে তাবারী - ১/১৯৯

(৪) বুখারী - ২/৫৬৩

(৫) তাবাকাত - ৩/৪২১

(৬) আনসাবুল আশরাফ - ১/২৮৭

(৭) যারকানি - ১/৪৭৯

(৮) সিরাতে ইবনে হিশাম - ১/৬১৩, হায়াতুস সাহাবা - ১/৪১৫

(৯) সিরাতে ইবনে হিশাম - ১/৬২০

(১০) সিরাতে ইবনে হিশাম - ১/৬২৮

(১১) তাবাকাত - ২/২৬

(১২) তাবাকাত - ২/৩০

(১৩) তাবারী - ১/২৮৭

(১৪) সিরাতে ইবনে হিশাম - ২/২২৬, উসদুল গাবাহ - ২/২৯৬

(১৫) উসদুল গাবাহ - ২/২৯৭

(১৬) তারিখে তাবারী - ১/২৮৬

(১৭) তারিখে তাবারী - ১/২৯৮, আল ইসাবাহ - ২/৩৮

(১৮) তাবাকাত - ৩/২২৮, সিরাতে ইবনে হিশাম - ২/২৫২

(১৯) আল ইসাবাহ - ২/২৮

(২০) হায়াতুস সাহাবা - ৩/৫৪৫

(২১) তাবাকাত - ৩/৪৩০, উসদুল গাবাহ - ২/২৯৭

(২২) তাবাকাত - ৩/৪৩২

(২৩) সিরাতে ইবনে হিশাম - ২/২৫২

(২৪) আল ইসাবাহ - ২/৯৭

(২৫) তাহযিবুত তাহযিব - ৩/৪৮২

(২৬) সিরাতে ইবনে হিশাম - ২/২৫২

(২৭) বুখারী - ১/৫৩৬

(২৮) হায়াতুস সাহাবা - ৩/৫৯৫

 

উৎসঃ আসহাবে বদরের জীবনকথা - মুহাম্মাদ সুলাইমান সালমান মনসুরপুরী (মাকতাবাতুল ইসলাম)

ব্লগ লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-3Z

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু

 

 

The Greatest Nation·Tuesday, January 22, 2019

 

 

 

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী সুফফাহ'র ছাত্রদের (আসহাবে সুফফার) মধ্যে গণনা করেছেন। (১)

সমস্ত মুয়াযযিনদের সর্দার আর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র আযাদকৃত গোলাম ও অন্তরঙ্গ বন্ধু বেলাল হাবশী রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের সূচনাতেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নববী দরবারে উপস্থিত হোন, আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু পর্যন্ত স্বস্থানে ও ভ্রমণে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদেম, মুয়াযযিন ও ঘরোয়া মালামালের চাবিরক্ষক বা দারোয়ান ছিলেন। বদর, উহুদসহ সমস্ত যুদ্ধে তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে শরীক ছিলেন। (২) এমনকি বদর যুদ্ধে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'ই কাফিরদের দলপতি অহংকারী ও গর্বকারী উমাইয়া বিন খালফকে হত্যা করেন। (৩)

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এটি ছিলো যে, তিনিই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাবারের ব্যবস্থাপনা করতেন।

আবদুল্লাহ হাওযানী বলেন, হালব নামক স্থানে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "হে বিলাল, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিকার খরচ কোত্থেকে জোগাড় করেন ?" বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু উত্তর দিলেন, "নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছুই ছিলো না। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত আমিই তার আহারের বন্দোবস্ত করতাম।" (৪)

 

বংশ পরিচিতি

তার নাম - বিলাল। তার উপনাম - আবু আবদুল্লাহ, অথবা আবু আমর, অথবা আবদুল কারীম। পিতার নামে - রবাহ, মাতার নাম - হামামাহ। (৫)

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু জন্মগতভাবেই কুচকুচে কালো কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন। (৬) তবে পরবর্তীতে গেরুয়া বর্ণের হয়ে গিয়েছিলেন, যেমনটি তবাকাতে ইবনে সাআদের এক বর্ণনাতে আল মুস্তাদরাকের সূত্রে উল্লেখ আছে। (৭)

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু আর তার মা হামামাহ উভয়েই ইসলাম গ্রহণে ধন্য হয়েছেন। (৮)

 

ইসলাম গ্রহণ ও পাহাড়সম বিপদ

আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পর গোলামদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবী হলেন বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু। ইসলামের সূচনা যুগে আমর বিন আবাসা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন এটিও ছিলো যে, "আপনার এই দ্বীন অনুসরণ করা ক্ষেত্রে আপনার সাথে আর কে কে আছে ?" তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, "গোলাম ও আযাদ সব ধরণের লোকজন আছে।" সেই দিনগুলোতেই আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর ঈমান এনেছিলেন। (৯)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বর্ণনাঃ সর্বপ্রথম নিজের ইসলাম গ্রহণের স্পষ্ট ঘোষণাদানকারী হলেন সাতজন - (১) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, (২) আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, (৩) আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু, (৪) তার মা সুমাইয়্যা রাদিয়াল্লাহু আনহা, (৫) বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু, (৬) সুহাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু, (৭) মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু।

এ সকল সাহাবায়ে কিরাম মক্কার কাফিরদের পশুসুলভ আর ধ্বংসাত্মক আচরণ সহ্য করেছেন। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে আল্লাহ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে হেফাযতে রেখেছেন। এ রকমই আবু বকরকে তার বংশ আর কুরাইশদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে সেই অত্যাচারীদের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু মুশরিকদের বিষাক্ত ছোবলের ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে অবশিষ্ট পাঁচজন বাঁচতে পারেননি, তাদেরকে মক্কার কাফিররা লৌহ বর্ম পরিধান করিয়ে মক্কার দগ্ধকারী ও কাঠ ফাটা রোদে ক্ষুধার্তাবস্থায় দাঁড় করিয়ে উত্ত্যক্ত করতো আর যুলুম-নিপীড়নের লক্ষ্যস্থল বানিয়ে রাখতো।

বিশেষ করে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে এই দ্বীন ইসলামের জন্য অত্যন্ত কষ্ট দেওয়া হয়েছে। মক্কার কাফিররা তাকে দুষ্ট ছেলেদের হাতে ন্যস্ত করে দিতো। তারা তাকে মক্কার অলিতে-গলিতে টেনে হিঁচড়ে বেড়াতো। কিন্তু সেই অবস্থাতেও বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু "আহাদ, আহাদ" (এক আল্লাহ, এক আল্লাহ) বলে যেতে থাকতেন। (১০)

কখনো আবু জাহিল, কখনো দুষ্ট প্রকৃতির বাচ্চারা তাকে সচেতনতা হরণকারী সাজা দেওয়ার জন্য তাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দিতো। এই রক্তক্ষয়ী অবস্থার কারণে তার প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দয়া-মায়া উপচে পড়তে শুরু করলো। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সাথে দেখা করলেন আর বললেন - হায় ! যদি আমার কাছে এ পরিমাণ সম্পদ থাকতো, তাহলে আমি বিলালকে কিনে নিতাম। এ কথা শুনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু'র (যিনি সে সময় পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি) মাধ্যমে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে পাঁচ উকিয়া - দুইশত দিরহাম দিয়ে কিনে আযাদ করে দিলেন। (১১)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু আর আবু উবাইদাহ ইবনে জাররাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মাঝে ভাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠা করে দেন। (১২)

 

বিলালী আযান ও এর প্রভাব

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর সাহাবায়ে কিরাম হিজরত করে মদিনা মুনাওওয়ারায় এসে পড়লেন। এখানে আল্লাহ'র ইবাদাত করার ক্ষেত্রে কোন ধরণের বাঁধা ছিলো না, প্রকাশ্যভাবে এক উপাস্যের ইবাদাত করা যেতো। যার কারণে সক সাহাবী এক সাথে জামাআতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তবে এমন কোন পদ্ধতি সামনে আসছিলো না, যার মাধ্যমে সকল সাহাবীদেরকে এক সাথে এক সময়ে একত্রিত করা যেতে পারে। প্রত্যেকেরই বিভিন্ন মতামত ছিলো। আবদুল্লাহ বিন যায়েদ বিন আব্দে রাব্বিহী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র এ বিষয়ে খুব ফিকির ছিলো। তিনি ঘরে আসলেন আর রাতে ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে এক অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি আযানের শব্দগুলো শিখে নেন। ভোর বেলা নববী দরবারে উপস্থিত হয়ে রাতে স্বপ্নে দেখা পুরো বিষয়টি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে শুনালেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই স্বপ্নের সত্যতার স্বীকৃতি দিয়ে বললেন - তুমি বিলালকে আযানের শব্দগুলো শিখাও আর তাকে আযান দিতে বলো। কেননা, বিলালের আওয়াজ তোমাদের আওয়াজের চেয়ে বড়। এ কারণেই বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলামে সর্বপ্রথম আযান দেওয়ার গৌরব অর্জন করতে পেরেছিলেন। (১৩)

বনু নাজ্জারের এক মহিলা সাহাবীর বর্ণনাঃ আমার আবাসস্থল মসজিদের কাছেই ছিলো, আর সেই আবাসস্থলের ভবনটি উঁচু ছিলো। রাতের শেষভাগে বিলাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ভবনের ছাদটিতে বসে পূব আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। যখন সুবহে সাদিকের আভা পূব আকাশ ছেদ করে বের হতো, তখন বিলাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আড়মোড়া দিয়ে এ দুয়াটি পাঠ করতেন -

اللهم اني احمدك استعينك على قريش ان يقيموا دينك

এরপর আযান দেওয়া শুরু করে দিতেন। (১৪)

কিছুকাল পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার কিছু পূর্বে রাতের শেষ ভাগে আযান দেওয়ার জন্য নিযুক্ত করে লোকদেরকে সম্বোধন করে বললেন - তোমাদের কাউকে যেন বিলালের আযান সাহরী খাওয়া থেকে বিরত না রাখে। বরং তোমরা খাওয়া চালিয়ে যেতে থাকবে আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক ফজরের আযান দেওয়া পর্যন্ত। কেননা, বিলাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর আযান ঘুমন্ত ব্যক্তিদেরকে উদাসীনতার নিদ্রা থেকে জাগ্রত আর ইবাদাতে মগ্ন লোকদেরকে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য দেওয়া হতো। যাতে তারা তাড়াতাড়ি সাহরী থেকে অবসর হয়ে যেতে পারে। (১৫)

সাধারণ নামাযে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'র এটিই আমল ছিলো যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য তিনি অপেক্ষমাণ থাকতেন। যখন তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদের দিকে আসতে দেখতেন, তখন তৎক্ষণাৎ তাকবীর ও ইকামাত দিতে শুরু করে দিতেন। (১৬)

সফরেও বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'ই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুয়াযযিন হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। আবু যার গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমরা এক সফরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলাম। তখন বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু যোহরের আযান দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। সে সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "এখন থামো, আবহাওয়া সামান্য ঠাণ্ডা হলে তারপর আযান দিবে।" (১৭)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাইবার যুদ্ধ থেকে ফেরতকালে রাতের এক অংশে সফর করছিলেন, তখন সাহাবায়ে কিরামের শরীরে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব এসে পড়লো। সে সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক জায়গায় তাবু গেঁড়ে অবস্থান করতে বললেন, আর বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে বললেন, তুমি আজ আমাদের দেখাশুনা করবে আর ফজরের নামাযের জন্য জাগিয়ে দিবে। ঘটনা এমন ঘটলো যে, বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজ বাহনজন্তুর সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন, আর এরই মাঝে তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তখন সূর্য উদিত হলো আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা মুবারাকের উপর সূর্যের আলো এসে পড়তে লাগলো, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচলিত অবস্থায় জাগ্রত হলেন আর বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে তালাশ করতে লাগলেন। বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু নববী দরবারে হাজির হলেন আর ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনার উপর আমার মা-বাবা উৎসর্গ হোক, যে মহান সত্তা আপনাকে নিদ্রাকোলে ঠেলে দিয়েছেন, সেই মহান সত্তা আমাকেও কুদরতি হাত বুলিয়ে শুইয়ে দিয়েছেন।" নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বিষয়টিকে ক্ষমা করে ইসলামী সৈন্যদলকে এ জায়গা থেকে চলে যাওয়ার আদেশ দিলেন। তারপর কিছুদূর গিয়ে অবস্থান করলেন আর বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে আযান ও ইকামাতের আদেশ দিলেন। (১৮)

মক্কা বিজয়ের দিন বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'ই কাবা শরীফের ছাদে উঠে তাওহীদ ও রিসালাতের আওয়াজ উঁচু করে ঘোষণা করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। (১৯)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার পর থেকে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু কখনোই কারো নির্দেশে আযান প্রদান করেননি। (২০)

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু শাম দেশে থাকা অবস্থায় খলীফাতুল মুসলিমীন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু জাবিয়া নামক এলাকায় তাশরীফ আনেন। সেখানে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সাথে সাক্ষাৎ হয়ে গেলো। তখন সেখানকার মুসলমানগণ আমীরুল মুমিনীন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছে আবদার রাখলেন যে, আমাদের দীর্ঘদিনের কামনা ও আশা যে, আমরা বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটু আযান শুনবো। তার কাছে আপনি একটু নিবেদন করুন, যাতে তিনি আমাদেরকে একটু আযান শুনান। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু'র অনুরোধে একদিন তিনি আযান প্রদান করলেন, যার প্রভাব এতোটা হলো যে, সমস্ত লোকজন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকতপূর্ণ যুগ ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্মৃতিচারণ করে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিলো। আর এতো পরিমাণ কাঁদলো যে, ইতোপূর্বে শামবাসী এতো কাঁদা কখনোই কাঁদেনি। (২১)

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার স্বপ্নযোগে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাক্ষাৎ লাভ করলেন। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটি কি রকম যুলুম ও রুক্ষতা যে, তুমি আমার কাছে আসছো না ? চোখ খোলা মাত্রই তিনি সফরের পাথেয় নিয়ে মদিনা মুনাওওয়ারাতে রওয়ানা হলেন আর সোজা রওজা মুবারাকে উপস্থিত হয়ে গেলেন আর কাঁদতে শুরু করলেন। হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে দেখামাত্রই সিনায় জড়িয়ে ধরলেন আর চুমো খেলেন। তখন হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু উভয়ে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে আযান দেওয়ার অনুরোধ জানালেন। আর এ অনুরোধ ছিলো এমন যে, তা প্রত্যাখ্যান করার কোন সুযোগই ছিলো না। ফলে তিনি উঁচু একটি স্থানে আরোহণ করে আযান দিতে শুরু করলেন। এদিকে মদিনা মুনাওওয়ারাতে নববী যুগের আযান কানে পড়া মাত্রই এক বিশাল হৈ চৈ পড়ে গেলো। ফলে পর্দানশীন নারীরাও কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বের হয়ে পড়লো। আর সকল লোকজন এ কথা বলতে লাগলো যে, মনে হয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে দ্বিতীয়বার এই দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর মদিনাবাসীকে এ দিন থেকে বেশী কাঁদতে কেউ কখনোই দেখেনি। (২২)

 

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিতে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযের পর বললেন, "হে বিলাল, তুমি আমাকে সেই আমলটি বলো, যেটি তুমি ইসলাম গ্রহণের পর করেছো। যার ফলস্বরূপ তোমার প্রতিদান পাওয়ার অধিক আশা রয়েছে। কেননা, আমি আজ রাতে জান্নাতে প্রবেশকালীন সময়ে তোমার জুতার আওয়াজ শুনেছি।" বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "আমি ইসলামে প্রবেশের পর থেকে আজ পর্যন্ত এ আমলটির চেয়ে অধিক কোন আমল করিনি, আর তা হলো - রাত বা দিন যখনই আমি ওযু করতাম তখনই ঐ ওযু দিয়ে আমি আল্লাহ'র তাওফিকে নামায আদায় করতাম।" (২৩)

এক বর্ণনায় এরকম আছে যেঃ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে ফজরের সময় বলেছিলেন, "হে বিলাল, কোন আমলের বদৌলতে তুমি আমার চেয়েও আগে জান্নাতে প্রবেশ করেছিলে ? কেননা, গত রাতে আমি যখন জান্নাতে প্রবেশ করলাম, তখন প্রথমেই তোমার জুতার আওয়াজ শুনতে পেলাম।" সে সময় বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সেই প্রিয় আমলটির কথা বললেন। (২৪)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, "ইসলাম গ্রহণ করে সবচেয়ে অগ্রগামীতা লাভকারী ব্যক্তি হলেন চারজন -

(১) আমি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - যিনি আরবদের মাঝে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী,

(২) সালমান - যিনি পারস্যবাসীদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী,

(৩) বিলাল - যিনি আবিসিনিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী,

(৪) সুহাইব - যিনি রোমদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী।" (২৫)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, "বিলাল কতোই না ভালো। সে কিয়ামতের দিন সমস্ত মুয়াযযিনদের সর্দার হবে।" (২৬)

অপর একটি হাদিসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, "সুদানবাসীদের সর্দার লোকমান, নাজাশী, বিলাল ও মিহজা।" (২৭)

 

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র দৃষ্টিতে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু যেভাবে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র আযাদকৃত গোলাম ছিলেন, তেমনিভাবে তার অন্তরঙ্গ আর গভীর বন্ধুও ছিলেন। (২৮)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই দুনিয়া থেকে পরকালে যাওয়ার পর বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু জিহাদ করার জন্য শাম দেশে যাওয়ার ইচ্ছা করলেন। এদিকে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সান্নিধ্য ছাড়তে পছন্দ করতেন না। ফলে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে জিহাদে যেতে বারণ করেন (আর্টিকেল বহির্ভূত নোটঃ তখন জিহাদ ফরজে কিফায়া থাকার কারণে)। তখন বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বলতে শুনেছি যে, মুমিনের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল হলো আল্লাহ'র রাস্তায় জিহাদ করা।" এ কথা শুনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "হে বিলাল, আপনি কি চান ?" বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু উত্তরে বললেন, "আমি আল্লাহ'র পথে জিহাদ করতে করতে শহীদ হয়ে যেতে চাই, আর এতোটুকুই আমার আশা।" আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "হে বিলাল, আমি আপনাকে আল্লাহ'র দোহাই দিচ্ছি, আমার ইযযতের কসম, আমার হকের কসম, আমি বৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে গিয়েছি, আর আমার মৃত্যুর সময়ও অতি নিকটবর্তী। দয়া করে পানি আমার কাছেই থেকে যান।" এ কথা শুনে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছেই থেকে গেলেন। (২৯)

কিন্তু হিলয়াতুল আউলিয়া ও ইবনে হিব্বানের বর্ণনাতে আছে যে, বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে এই উত্তর দিয়েছিলেন - "যদি আপনি আমাকে কাফিরদের থেকে কিনে আমাকে আযাদ করে দিয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে ছেড়ে দিন। আমার তো নিজ বিষয়ে অধিকার আছে। আর যদি আমাকে কাফিরদের থেকে কিনে নিজ কর্মচারী বানানোর ইচ্ছা থেকে থাকে তাহলে আমাকে আটকে রাখুন। এ ক্ষেত্রে তো আমার নিজের ব্যাপারে নিজের কোনই অধিকার নেই।" এ কথা শুনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়লেন আর বললেন, "ঠিক আছে, আপনি যান, আপনার অধিকার আছে। আমি আপনাকে আল্লাহ'র সন্তুষ্টির জন্য আযাদ করেছিলাম।" এ কথা শোনামাত্রই বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু শামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান, আর সেখানেই তার মৃত্যু হয়ে যায়। (৩০)

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে নিজের নেতা মনে করে বলতেন, আমাদের এই সর্দার বিলাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তো আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) 'র নেকীসমূহের অন্যতম একটি নেকী। একবার বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু জানতে পারলেন যে, লোকেরা তাকে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিচ্ছে। তখন তিনি বলতে লাগলেন, এ সকল লোকেরা আবু বকরের উপর আমাকে কিভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দিচ্ছে ? অথচ আমি তার নেকীসমূহের একটি নেকী মাত্র। (৩১) তা এভাবে যে, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে কাফিরদের কাছ থেকে কিনে আযাদ করেছিলেন।

 

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বর্ণিত হাদিস ও তার শিষ্যবৃন্দ

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই তার বাড়িতে ও বাইরের সফরে লেগে থাকতেন। আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহান বাণীসমূহ দিয়ে উপকৃত হতে থাকতেন। তা সত্ত্বেও হাদিস বর্ণনা করার ক্ষেত্রে এ পরিমাণ সাবধানতা অবলম্বন করেছেন যে, যার সীমা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে পর্যন্ত অতিক্রম করেছে। কেননা, তার সহমর্মী বন্ধুর সাবধানতার কারণে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ছিলো মাত্র একশত বিয়াল্লিশটি। আর বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বর্ণনাকৃত হাদিসের সংখ্যা সর্বমোট চুয়াল্লিশটি। বুখারী ও মুসলিমে আছে শুধু চারটি। শুধু বুখারীতে দুটি আর শুধু মুসলিমে একটি হাদিস আছে। অবশিষ্ট হাদিসগুলো হাদিসের অন্যান্য কিতাবে আছে। (৩২)

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে শিক্ষা-দীক্ষা প্রাপ্তদের সংখ্যা হলো পনেরো জন, যাদের মধ্যে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উসামা বিন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু আর বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মতো বড় বড় সাহাবায়ে কিরামগণও রয়েছেন। (৩৩)

 

মৃত্যুবরণ

বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজ মৃত্যুর একদিন পূর্বে বলেছিলেন, “আমি আগামীকাল নিজের পরম প্রিয় বন্ধু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবায়ে কিরামের সাক্ষাতে যাবো।” এ কথা শুনে তার সহধর্মিণী বলে উঠলেন, “হায়রে আমার আফসোস আর আক্ষেপ আর ধ্বংস!” তখন বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "বাহ, কি আনন্দ ! এটি কতোই না খুশীর খবর যে, কাল আমার প্রিয়ের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে আমার সাক্ষাৎ হবে।"

অধিকাংশ মুহাদ্দিসীনের মতামত এটিই যে, বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মৃত্যু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র শাসনামলে বিশ হিজরিতে দামেশকে হয়েছে। আর সে সময় তার বয়স ষাট বছর অতিক্রম করেছিলো। তার কবরস্থানের ব্যাপারে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। হয়তো বাবুস সাগীর বা বাবে কাসান বা দামেশকে বা হলবে তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। ইবনে মানদার বর্ণনা, হলবেই তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। অথচ ওয়াকেদীর বর্ণনাতে আছে যে, তাকে বাবুস সাগীরে কবরস্থ করা হয়েছে। (৩৪)

 

দৈহিক গঠন

শাম দেশের ইমামুল মুহাদ্দিসীন মাকহুল শামী বলেন, যে ব্যক্তি বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সাথে সাক্ষাৎ করেছিলো, তিনি আমাকে তার দৈহিক গঠনের বৃত্তান্ত এভাবে দিয়েছেন যে, বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত বেশী গৌর বর্ণের ছিলেন। হালকা গড়ন, লম্বা দেহবিশিষ্ট ছিলেন। আর সামান্য একটু সামনে ঝুঁকা ছিলেন। তার চুল অনেক ছিলো। ছিলো হালকা দাঁড়ি, আর তা ছিলো কালো, তবে সাদার দিকে ধাবমান। (৩৫)

 

ফুটনোটঃ

(১) আল হিলয়াহ - ১/৩৪৯

(২) আল ইস্তিআব - ১/১৪৫, হিলয়াতুল আউলিয়া - ১/১৪৭

(৩) বুখারী - ২/৫৬৬

(৪) আবু দাউদ - ২/৪৩৩

(৫) কিতাবুস সিকাত : ১৪৪

(৬) আল মুস্তাদরাক - ৩/২৮৩

(৭) তবাকাত - ৭/৩৮৬, আল মুস্তাদরাক - ৩/২৮৩

(৮) আল মুস্তাদরাক - ৩/২৮৩

(৯) মুসলিম - ১/২৭৬

(১০) হিলয়াতুল আউলিয়া - ১/১৪৮, আল ইসাবাহ - ১৬৯

(১১) তবাকাতে ইবনে সাআদ - ৩/৩৮৫, আল ইস্তিআব - ১/১৪৮

(১২) আল ইসাবাহ - ১/১৬৯

(১৩) আবু দাউদ - ১/৭২, তবাকাতে ইবনে সাআদ - ২/১২২

(১৪) আবু দাউদ - ১/৭৭

(১৫) বুখারী - ১/৮৭

(১৬) আবু দাউদ - ১/৭৯

(১৭) তিরমিযি - ১/৪১, বুখারী - ১/৭৭

(১৮) আবু দাউদ - ১/৬২-৬৩

(১৯) সিয়ারু আলামিন নুবালা - ১/৩৫৬

(২০) তবাকাতে ইবনে সাআদ - ৩/১৬৯

(২১) সিয়ারু আলামিন নুবালা - ১/৩৫৭

(২২) সিয়ারু আলামিন নুবালা - ১/৩৫৮

(২৩) বুখারী - ১/১৫৪, মুসলিম - ২/২৯২

(২৪) তিরমিযি - ২/৯০২, মুসনাদে আহমাদ - ৫/৩৫৪

(২৫) আল মুস্তাদরাক - ৩/২৮৫, আল হিলয়াহ - ১/১৮৫

(২৬) আল মুস্তাদরাক - ৩/২৮৫, আল হিলয়াহ - ১/১৪৭

(২৭) আল মুস্তাদরাক - ৩/২৮৪, সিয়ারু আলামিন নুবালা - ১/২৫৫

(২৮) তবাকাতে ইবনে সাআদ - ৭/৩৮৬

(২৯) তবাকাতে ইবনে সাআদ - ৭/৩৮৬, সিয়ারু আলামিন নুবালা - ১/৩৫০

(৩০) আল ইসাবাহ - ১/১৫০-১৫১, কিতাবুস সিকাত ১৪৪ পৃষ্ঠা

(৩১) সিয়ারু আলামিন নুবালা - ১/৩৫৯

(৩২) সিয়ারু আলামিন নুবালা - ১/৩৬০

(৩৩) আল ইস্তিআব - ১/১৪৭

(৩৪) তবাকাতে ইবনে সাআদ - ৭/৩৮৬, আল ইসাবাহ - ১/২৬৯, সিয়ারু আলামিন নুবালা - ১/৩৫৯

(৩৫) তবাকাতে ইবনে সাআদ - ৭/৩৮৬, আল ইস্তিআব - ১/২৪৭, সিয়ারু আলামিন নুবালা - ৩/২৮৩

 

উৎসঃ আসহাবুস সুফফাদের জীবন ও খেদমত – মাওলানা আশরাফ আলী আশেকে ইলাহী কাসেমী (আল হিকমাহ পাবলিকেশন্স)

ব্লগ লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-3X

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

The Greatest Nation

 

Notes

04

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রসঙ্গঃ খতমে নবুওয়াত, নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার ও কিছু ভ্রান্তির নিরসন - প্রথম পর্ব

 

 

 

The Greatest Nation·Saturday, February 9, 2019

 

 

 

 

মহান আল্লাহ তাআলা হেদায়াত ও সঠিক পথনির্দেশনা প্রদানের উদ্দেশ্যে যুগে যুগে পৃথিবীতে অসংখ্য নবী ও রাসুল পাঠিয়েছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভাবের পর নবুওয়াত ও রিসালাতের এই ধারাপরম্পরার সফল সমাপ্তি ঘটে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের স্পষ্ট ঘোষণা অনুযায়ী কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী বা রাসুলের আগমনের প্রয়োজন নেই আর অবকাশও নেই। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের মাধ্যমে ইসলাম সার্বজনীন ধর্ম ও কালজয়ী জীবনাদর্শ হিসেবে অনন্তকালের জন্য পূর্ণতা ও স্বীকৃতি লাভ করে। আল্লাহ'র দ্বীন পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ হওয়ার ঘোষণার প্রেক্ষাপটে নবুওয়াত ও রিসালাতের ক্রমধারার অবসান ঘটে।

খতমে নবুওয়াতের স্বীকৃতি ও আস্থা মুসলমানদের মৌলিক আকিদা বিশ্বাসের অঙ্গ। নবুওয়াতের সিলসিলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বারা খতম হয়ে গিয়েছে - এই কথা যে বিশ্বাস করে না, অথবা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে যে ব্যক্তি নবী অথবা রাসুল হওয়ার দাবী করবে, যে হবে দাজ্জাল (প্রতারক), কাযযাব (মিথ্যুক) আর মুরতাদ (স্বধর্মত্যাগী), আর যে ব্যক্তি তার উপর ঈমান আনবে, তারও একই পরিণতি হবে।

আদম আলাইহিস সালাম থেকে নবুওয়াত ও রিসালাতের যে সিলসিলা শুরু হয়েছিলো, তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে। কুরআন, হাদিস, ইজমা (মুসলিম উম্মাহ'র ঐকমত্য), কিয়াস - তথা শরীয়তের এ চারটি দলীল দিয়ে আকিদা প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত। এমনকি পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহেও এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। ইবন সাদ ও শাবীর উদ্ধৃতি দিয়ে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়্যুতি বর্ণনা করেন যে, ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের প্রতি অবতীর্ণ সহীফায় উল্লেখ রয়েছেঃ

"আপনার সন্তানদের মধ্যে বংশপরম্পরায় নবুওয়াতের ধারা চলতে থাকবে। অবশেষে উম্মী নবী (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসবেন। তিনি হবেন সর্বশেষ নবী।"

ইবন সাদ ও মুহাম্মাদ ইবন কাব থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে এই মর্মে ওহী পাঠালেনঃ আমি আপনার সন্তানদের মধ্যে বাদশাহ ও নবী সৃষ্টি করবো। শেষ পর্যন্ত হারামবাসী নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভূত হবেন, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতগণ বায়তুল মাকদিসের প্রাসাদরাজি পুনর্নির্মাণ করবে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হবেন সর্বশেষ নবী, আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম হবে আহমাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। (জালালুদ্দীন সুয়্যুতি, খাসায়েসুল কুবরা, ১ম খণ্ড)

"বার্নাবাসের বাইবেল" নামক গ্রন্থে উদ্ধৃত ঈসা আলাইহিস সালাম এক সমাবেশে জনৈক যাজকের প্রশ্নের উত্তরে যে মন্তব্য করেন, তা এই ক্ষেত্রে সবিশেষ প্রণিধানযোগ্যঃ

আরেকজন নবীর আবির্ভাবই আমার সান্ত্বনা, যিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার প্রতি আরোপিত ভুল মতামতসমূহ বিনাশ করবেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধর্ম প্রচারিত হবে আর গোটা বিশ্বের কর্তৃত্ব লাভ করবে, যে ব্যাপারে আমাদের পিতা ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম'কে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটি আমাকে আরো সান্ত্বনা দিয়েছে যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধর্ম নিঃশেষিত হবে না, আর আল্লাহ একে অপবিত্রতার ছোঁয়াচ থেকে রক্ষা করবেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আর কোন সত্যিকারের নবীর আগমন ঘটবে না, কিন্তু বহু সংখ্যক ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটবে, যার কারণে আমি দুঃখবোধ করি। এই ত্রাণকর্তার নাম বিস্ময়করভাবে প্রশংসার যোগ্য। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলো তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিমান্বিত নাম। আল্লাহ তাআলা নিজেই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রুহ সৃষ্টির পূর্বে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামকরণ করেছেন আর স্বর্গীয় উৎকর্ষে এটিকে স্থাপন করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন - মুহাম্মাদ, অপেক্ষা করুন, একমাত্র আপনার জন্য আমাকে জান্নাত তৈরি করতে হবে, পৃথিবী বানাতে হবে আর বিপুল সংখ্যক মাখলুকাত সৃষ্টি করতে হবে। উপস্থিত জনতা সমস্বরে বলে উঠলো - হে আল্লাহ, আপনার সেই নবীকে প্রেরণ করুন। হে মুহাম্মাদ, বিশ্বের মুক্তির জন্য তাড়াতাড়ি আসুন। (The Gospel of Barnabas, edited and translated by Lonsdale and Laura Ragg, pp. 122-3)

ইমাম আবু হানিফার যুগে এক ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করে বললো, "আমাকে সুযোগ দাও, আমি নবুওয়াতের আলামত পেশ করবো।" এই কথা শুনে ইমাম আবু হানিফা বললেন, "যে ব্যক্তি তার কাছ থেকে আলামত তলব করবে, সেও কাফির হয়ে যাবে। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'আমার পরে আর কোন নবী নেই।' " (ইবন আহমাদ আল-মাক্কী, মানাকিব আল-ইমাম আল-আজম আবী হানিফা, ১ম খণ্ড)

খতমে নবুওয়াত মুসলিম উম্মাহ'র জন্য আল্লাহ'র এক বিরাট রহমতস্বরূপ। এর বদৌলতে সমগ্র মুসলিম জাতি একটি চিরন্তন বিশ্বভ্রাতৃত্বে শামিল হতে পেরেছে। এই বাস্তবতা মুসলমানদেরকে সব মৌলিক মতবিরোধ থেকে রক্ষা করেছে, যা তাদের মধ্যে চিরন্তন বিভেদের বীজ বপন করতো। কাজেই, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে হেদায়াত দানকারী ও পথপ্রদর্শনকারী বলে স্বীকার করে, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া অন্য কোন হেদায়াতের উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায় না, সে এই ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা সমাপ্ত না হলে মুসলিম জাতি কখনো এই ঐক্যের সন্ধান পেতো না। কেননা, প্রত্যেক নবী আগমনের পর এই ঐক্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো। (তাফহীমুল কুরআন, ৪র্থ খণ্ড)

পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে -

".... বরং তিনি আল্লাহ'র রাসুল ও শেষ নবী।" (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৪০)

যেহেতু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ'র সর্বশেষ রাসুল, তাই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাধ্যমে প্রয়োজনীয় বিধানসমূহকে পরিপূর্ণতা লাভ করতে হবে, যাতে মানবকুলের জন্য আল্লাহ'র পরিপূর্ণ বিধান অনুসারে জীবন পরিচালনা করা সহজ হয়। সর্বশেষ আসমানী রিসালাতের বিধান মোতাবেক যমীনের অধিবাসীদের জীবনপ্রবাহ সুষ্ঠু ও কল্যাণময় ধারায় প্রবাহিত হবে। সর্বশেষ নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিষ্ঠিত আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের পরিবর্ধন, পরিবর্তন ও লঙ্ঘন করা যাবে না।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে "খাতামুন নাবিয়্যিন" বিশেষণে ভূষিত করার মাধ্যমে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবীকুলের মধ্যে অনন্য বৈশিষ্ট্যে, বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম ব্যক্তি। "খাতাম" শব্দের দুই প্রকার কিরাআত রয়েছে। ইমাম হাসান ও ইমাম আসিমের মতে, এই কিরাআতে "খাতাম" এর "তা" এর উপর যবর রয়েছে। অন্যান্য ইমামগণের কিরাআত অনুযায়ী উক্ত "তা" যেরবিশিষ্ট, কিন্তু উভয়ের সারমর্ম এক ও অভিন্ন, অর্থাৎ, নবীগণের আগমন ধারার সমাপ্তি সাধনকারী। কেননা, যেরবিশিষ্ট "খাতিম" এবং যবরবিশিষ্ট "খাতাম" উভয়ের অর্থ একই - "শেষ"। আবার উভয় অর্থ সীলমোহরের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দ্বিতীয় অর্থের বেলায়ও সারকথা "শেষ", কেননা, কোন বস্তু বন্ধ করে দেওয়ার জন্য মোহর সর্বশেষে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। "খাতাম" শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কোন বস্তুকে এমনভাবে বন্ধ করা, যাতে ভিতরের বস্তু বাইরে আসতে না পারে আর বাইরের বস্তু ভিতরে যেতে না পারে। (ইমাম কুরতুবি, আল-জামি লি আহকামিল কুরআন, ১৪ খণ্ড; সায়্যিদ মাহমুদ আলুসী বাগদাদী, রুহুল মাআনী, ২২ খণ্ড; শিবলী নুমানী, সিরাতুন্নবী, ৩য় খণ্ড)

"খাতামুন নাবিয়্যিন" এমন এক মর্যাদাপূর্ণ পরিভাষা, যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উচ্চতর মাকামের সাক্ষ্য বহন করে। কারণ প্রত্যেক বস্তুই ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে ধাবিত হয় এবং সর্বোচ্চ শিখরে পৌছলে পূর্ণতা সাধিত হয়। এই সর্বশেষ পূর্ণতার কথাই ১০ম হিজরির ৯ যুলহিজ্জা বিদায় হজ্জের দিন পবিত্র কুরআনে ধ্বনিত হয়েছে -

"......আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম ......." (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ৩)

পূর্ববর্তী নবীগণের দ্বীনও নিজ নিজ যুগ অনুসারে পরিপূর্ণই ছিল, কোনটাই অসম্পূর্ণ ছিল না। কিন্তু সার্বিক পরিপূর্ণতার কথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যা পূর্ববর্তী সবার জন্য দলীলস্বরূপ, আর এই দ্বীনে মুহাম্মাদী কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত ও কার্যকর থাকবে। এর পিছনে একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে আর কোন ওহী বা নবীর আগমন ঘটবে না বলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভুত যাবতীয় সমস্যার সমাধান ও যাবতীয় প্রয়োজনাদি মিটানোর পথনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছেন। পক্ষান্তরে পূর্ববর্তী নবীগণের এ কথা ভাবতে হতো না। কেননা, তারা ভালোভাবে জানতেন যে, উম্মতের মাঝে গোমরাহী ও বিভ্রান্তি প্রসার লাভ করলে তাদের পর অন্যান্য নবীগণ আবির্ভূত হয়ে এসবের সংশোধন ও সংস্কার সাধন করবেন। কিন্তু "খাতামুন নাবিয়্যিন" (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে এই কথা ভাবতে হতো যে, কিয়ামত পর্যন্ত উম্মত যে বিভিন্নমুখী সমস্যা ও বিভ্রান্তির সম্মুখীন হবে, সেগুলো সম্পর্কে উম্মতকে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ তাকেই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিতে হবে। ভবিষ্যতে অসত্য ও অন্যায়ের যতো ধ্বজাধারীর প্রাদুর্ভাব ঘটবে, তাদের যাবতীয় লক্ষণ, অবস্থা ও তথ্যাদি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়েছেন, যেন একজন সাধারণ চিন্তাশীল ব্যক্তিরও এই সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ না থাকে। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন - আমি তোমাদের জন্য এমন উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় পথ রেখে গেলাম, যেখানে দিন-রাত দুটোই সমান, কখনো পথভ্রষ্ট হওয়ার আশংকা নেই। (মুফতি মুহাম্মাদ শফী, মাআরিফুল কুরআন, ৭ম খণ্ড)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "অন্যান্য নবীগণের উপর ছয়টি বিষয়ে আমাকে অধিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে - আমাকে স্বল্প বাক্যে ব্যাপকার্থক কথা বলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, শত্রুর মনে ভীতি সৃষ্টি করে আমাকে সাহায্য করা হয়েছে, আমার জন্য গনীমতের সম্পদ হালাল করা হয়েছে, সমগ্র পৃথিবীকে আমার জন্য মসজিদ ও তাহারাতের উপায় (তায়াম্মুম) হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, সমগ্র সৃষ্টির প্রতি আমি প্রেরিত হয়েছি আর আমার মাধ্যমে নবীগণের আগমনধারা শেষ করা হয়েছে।" (জামে তিরমিযি, ৪র্থ খণ্ড)

 

খতমে নবুওয়াত সম্পর্কে তাফসীরকারদের অভিমত

প্রখ্যাত মুফাসসির মুফতি মুহাম্মাদ শফী "খতমে নবুওয়াত" নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সর্বশেষ নবী ও রাসুল, এ বিষয়টি পবিত্র কুরআনের শতাধিক আয়াত দ্বারা সুপ্রমানিত। এক কথায়, গোটা কুরআনই "খতমে নবুওয়াত" এর প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। "খতমে নবুওয়াত" এর আকিদায় বিশ্বাস না করলে পবিত্র কুরআনের চিরন্তনতা ব্যাহত হয়। কারণ কুরআন চিরন্তন, বিকৃতিমুক্ত ও সংরক্ষিত এক মহিমান্বিত আসমানী গ্রন্থ। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে কোন নবীর আগমনকে স্বীকার করার অর্থ কুরআনের আয়াতকে সরাসরি অস্বীকার করা। পবিত্র কুরআনের উপর সারা জীবন গবেষণা করে যে সব তাফসীরকার বিশ্বজোড়া খ্যাতি, স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন, তারা এ বিষয়ে একমত যে, "খাতামুন নাবিয়্যিন" আয়াতের শাব্দিক, পারিভাষিক, যৌক্তিক ও আল্লাহ প্রদত্ত ব্যাখ্যা হলোঃ

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমন করে নবুওয়াতকে পূর্ণতা দান করেছেন আর এর ধারাবাহিকতাকে সমাপ্ত করেছেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে নবী ও রাসুলের আগমনের ধারা সমাপ্ত হয়েছে।

আল্লামা ইবন কাসির তার বিখ্যাত তাফসীরে "খাতামুন নাবিয়্যিন" আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ আলোচ্য আয়াত থেকে এই কথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আর কোন নবী নেই, তখন অন্য কোন রাসুলের আগমনের প্রশ্নই উঠে না। কেননা, রিসালাতের মাকাম নবুওয়াতের মাকাম অপেক্ষা খাস। প্রত্যেক রাসুল নবী হোন, কিন্তু প্রত্যেক নবী রাসুল হোন না। এটি এমন একটি আকিদা, যার ব্যাপারে অসংখ্য ধারাবাহিক হাদিসের বর্ণনা সাক্ষীরূপে রয়েছে আর সাহাবীদের এক বিরাট জামাআতের বর্ণনা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। (ইবনে কাসির, তাফসীরুল কুরআনুল কারীম, ৩য় খণ্ড)

ইবন জারীর তাবারী উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ যিনি নবুওয়াতকে খতম করে দিয়েছেন আর তার উপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন, কিয়ামত পর্যন্ত এটার দরজা আর কারো জন্য খোলা হবে না। (তাফসীর ইবন জারীর তাবারী, ২২তম খণ্ড)

আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়্যুতি "আদ-দুররুল মানসুর" তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেনঃ হাসান (র) 'খাতামুন নাবিয়্যিন' এর ব্যাখ্যায় এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা নবীগণের সিলসিলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী ও রাসুল। (৫ম খণ্ড)

তাফসীরে খাযিনে এই প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছেঃ খাতামুন নাবিয়্যিন" অর্থ হলো, আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে নবুওয়াতের ধারা খতম করে দিয়েছেন। সুতরাং, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর নবুওয়াতের সিলসিলা জারী থাকতে পারে না, আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবদ্দশায়ও অন্য কেউ নবী হতে পারে না। (আলাউদ্দীন বাগদাদী, তাফসিরুল খাযিন, ৬ খণ্ড)

হিজরি ষষ্ঠ শতকের বিশিষ্ট মুফাসসির শায়খ মহিউস সুন্নাহ বাগাভী তার খ্যাতনামা তাফসীর "মাআলিমুত তানযীল" এ লিখেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা নবুওয়াতের সিলসিলা খতম করেছেন। কাজেই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে ফয়সালা করে দিয়েছেন যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী নেই। (৩য় খণ্ড)

 

খতমে নবুওয়াত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণা

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সর্বশেষ নবী ও রাসুল, এই সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত আছে। মুফতি মুহাম্মাদ শাফী খতমে নবুওয়াত গ্রন্থে এতদসংক্রান্ত ২১০ টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য কিছু হাদিস উল্লেখ করা হলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন -

"আমি আর আমার পূর্ববর্তী নবীগণের দৃষ্টান্ত এরূপঃ এক ব্যক্তি একটি অট্টালিকা নির্মাণ করলেন, এটিকে সুশোভিত ও সুসজ্জিত করলেন, কিন্তু এক কোণায় একটি ইটের জায়গা খালি রয়ে গেলো। লোকজন এর চারপাশে ঘুরে বিস্ময়ের সাথে বলতে লাগলো - ঐ শুন্য স্থানের ইটটি লাগানো হলো না কেন ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন - আমিই সেই ইট আর আমিই সর্বশেষ নবী।" (সহীহ বুখারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড; সহীহ মুসলিম, ৭ম খণ্ড)

"নিশ্চয়ই রিসালাত ও নবুওয়াত বিচ্ছিন্ন (শেষ) হয়েছে। অতএব আমার পর আর কোন রাসুলও নেই, নবীও নেই।" (মুসনাদে আহমাদ, ৫ম খণ্ড)

"আমি নবীগণের সর্বশেষ এবং তোমরা সর্বশেষ উম্মত।" (ইবনে মাজা, কিতাবুল ফিতান)

"আল্লাহ'র নিকট আমি তখনো 'খাতামুন নাবিয়্যিন' রূপে লিপিবদ্ধ ছিলাম, যখন আদম ছিলেন মাটির খমিরায়।" (মিশকাতুল মাসাবিহ, ১০ম খণ্ড)

"হে জনসমাজ, আমার পরে কোন নবী নেই, আর তোমাদের পরে কোন উম্মত নেই।" (নুরুদ্দীন হাইসামী, কাশফুল আসতার, ২য় খণ্ড; ইবনে কাসির, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, ৪র্থ খণ্ড)

"আমি রাসুলগণের নেতা, এটা অহংকারের কথা নয়। আমি সর্বশেষ নবী, এতে কোন অহংকার নেই।" (মিশকাত, ১০ম খণ্ড)

"আমার পরে কারো নবী হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে খাত্তাবের পুত্র উমারই হতো সেই নবী।" (হাকেম নিশাপুরী, আল-মুসতাদরাক, ৩য় খণ্ড)

"বনী ইস্রাইলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতেন নবীগণ। একজন নবী মৃত্যুবরণ করলে আরেকজন নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। কিন্তু আমার পর কোন নবী নেই, আর খলীফাগণ (উম্মতের) নেতৃত্ব গ্রহণ করবে, তাদের সংখ্যা হবে প্রচুর।" (বুখারী, কিতাব আহাদীসিল আম্বিয়া)

"আমি সমগ্র সৃষ্টিকুলের জন্য প্রেরিত হয়েছি আর আমার দ্বারা নবীগণের আগমনধারা সমাপ্ত হয়েছে।" (মুসলিম - মাসাজিদ; তিরমিযি - সিয়ার)

"আমি মুহাম্মাদ, আমি আহমাদ, আমি নির্মূলকারী, আমার দ্বারা কুফরকে নির্মূল করা হবে। আমি সমবেতকারী, আমার পরে লোকজন হাশরের ময়দানে একত্র হবে। আর আমি চূড়ান্ত পরিণতি, যার পরে কেউ নবী হবে না।" (বুখারী - মানাকিব; মুসলিম - কিতাবুল ফাদাইল; মুওয়াত্তা ইমাম মালিক - আসমাইন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

"অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন ডাহা মিথ্যাবাদী আবির্ভূত হবে। এদের প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী করবে। অথচ আমিই নবীগণের শেষ, আমার পরে কোন নবী নেই।" (আবু দাউদ - কিতাবুল ফিতান)

"প্রায় ত্রিশজন ডাহা মিথ্যাবাদী দাজ্জাল আবির্ভূত হবে, এদের প্রত্যেকে নিজেকে আল্লাহ'র রাসুল বলে দাবী করবে।" (আবু দাউদ - ফিতান; মুসনাদে আহমাদ, ২য় খণ্ড)

আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায়ীর বেশে আমাদের কাছে বের হয়ে আসলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার বললেন - "আমি মুহাম্মাদ উম্মী নবী, আর আমার পরে কেউ নবী হবে না।" (মুসনাদে আহমাদ, ২য় খণ্ড)

 

খতমে নবুওয়াত সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আলিমগণের চূড়ান্ত রায়

ইমাম আবু জাফর তাহাভী তার "শারহু আকীদাতিত তাহাবিয়া" গ্রন্থে প্রথম শ্রেষ্ঠ সৎকর্মশীলগণের, বিশেষ করে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের নবুওয়াত সম্পর্কিত আকিদা আলোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন আল্লাহ'র প্রিয়তম বান্দা, নির্বাচিত নবী, পছন্দনীয় রাসুল, শেষ নবী, মুত্তাকীদের ইমাম, রাসুলগণের নেতা আর রব্বুল আলামীনের বন্ধু। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর নবুওয়াতের প্রতিটি দাবী ভ্রস্টতা, গোমরাহী এবং কুপ্রবৃত্তি ও লালসার গোলামী ছাড়া আর কিছুই না।

হিজরি ষষ্ঠ শতকের বিখ্যাত আলিম কাযী ইয়ায তার "আশ-শিফা" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনঃ যে ব্যক্তি নিজে নবুওয়াত দাবী করে অথবা ঐ দাবীকে বৈধ মনে করে, অথবা যে ব্যক্তি নিজের প্রচেষ্টায় নবুওয়াত হাসিল করতে পারে বলে বিশ্বাস করে অথবা আত্মপরিশুদ্ধির মাধ্যমে নবীর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে মনে বলে করে, অথবা যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করে না কিন্তু এই কথার দাবী করে যে, তার উপর ওহী নাযিল হয় - এ ধরণের সব লোক কাফির, আর তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। কেননা, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শেষ নবী, তার পরে আর কোন নবী আসবে না আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ'র পক্ষ থেকে এই খবর পেয়েছেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের ধারা পরম্পরাকে খতম করে দিয়েছেন আর সমগ্র মানব জাতির জন্য তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রেরণ করা হয়েছে। গোটা মুসলিম উম্মাহ এই ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছে যে, এখানে কথাটির বাহ্যিক অর্থটি গ্রহণীয় এবং এর দ্বিতীয় কোন অর্থ গ্রহনের সুযোগ নেই। কাজেই কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও ইজমার দৃষ্টিতে উল্লিখিত দলগুলি কাফির - এই কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। (আশ শিফা, ২য় খণ্ড)

হিজরি দশম শতকের খ্যাতনামা ফকিহ আল্লামা ইবন নুজায়ম "আল-আশবাহ ওয়ান নাযাইর" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনঃ কেউ যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সর্বশেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস না করে, তবে সে কিছুতেই মুসলিম উম্মাহ'র সদস্য বলে গণ্য হবে না, বরং সে কাফিরদের দলভুক্ত হয়ে যাবে। কেননা, খতমে নবুওয়াতের আকিদা ইসলামের মৌলিক আকিদার অন্তর্ভুক্ত। (আল আশবাহ ওয়ান নাযাইর; বাহরুর রাইক, ৫ম খণ্ড)

ফাতাওয়া আলমগীরীর ৩য় খণ্ডে উল্লিখিত রয়েছেঃ কোন ব্যক্তি যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সর্বশেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস না করে, তবে সে মুসলমান নয়। যদি কেউ বলে - 'আমি আল্লাহ'র রাসুল', অথবা ফার্সী ভাষায় বলে, আমি হলাম পয়গম্বর যার অর্থ হলো আমি পয়গাম পৌঁছিয়ে থাকি, তাহলে ঐ ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে।

 

খতমে নবুওয়াত সম্পর্কে উম্মতের ইজমা

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কেউ নবী হবে না, এই সত্যের ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম ও পরবর্তী প্রতিটি যুগের আলিম সমাজের ঐকমত্য (ইজমা) রয়েছে। "মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী" - এ বিষয়টি যেমন কুরআন হাদিস দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, অনুরূপভাবে উম্মতের বিদগ্ধ আলিমগণের ইজমা দিয়েও সুপ্রতিষ্ঠিত। এ ক্ষেত্রে ইমাম গাযালীর নিন্মোক্ত বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্যঃ

যদি এই দরজাটি (অর্থাৎ, ইজমাকে প্রমাণ হিসেবে মানতে অস্বীকার করার দরজা) খুলে দেওয়া হয়, তাহলে বড়ই ন্যাক্কারজনক ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। যদি কেউ বলে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে অন্য কোন নবীর আগমন অসম্ভব নয়, তাহলে তাকে কাফির বলার ব্যাপারে ইতস্তত করা যাবে না। কিন্তু বিতর্কের সময় যে ব্যক্তি তাকে কাফির আখ্যায়িত করতে ইতস্তত করাকে অবৈধ প্রমাণ করতে চাবে তাকে অবশ্যই ইজমার সাহায্য নিতে হবে। কারণ নিরেট যুক্তি দিয়ে তার অবৈধ হওয়ার ফয়সালা করা যায় না। আর কুরআন ও হাদিসের বাণীর ব্যাপারে বলা যায়, এই মতে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি "আমার পরে আর কোন নবী নেই" এবং "নবীদের মোহর" এই উক্তি দুটোর নানা রকম চুলচেরা ব্যাখ্যা করতে অক্ষম হবে না, সে বলবে - "খাতামুন নাবিয়্যিন" অর্থ হচ্ছে অতীত মর্যাদাবান নবীদের আগমন শেষ হয়ে যাওয়া। আর যদি বলা হয় - "নবীগণ" শব্দ দিয়ে সাধারণভাবে সকল নবীকে বুঝানো হয়েছে, তাহলে এই সাধারণ থেকে "অসাধারণ ও ব্যতিক্রম" বের করা তার জন্য মোটেই কঠিন হবে না। "আমার পর আর নবী নেই" এই ব্যাপারে সে বলে দিবে, "আমার পর আর রাসুল নেই" - এই কথা তো বলা হয়নি। রাসুল ও নবীদের পার্থক্য রয়েছে। নবীর মর্যাদা রাসুলের চেয়ে বেশী।

মোটকথা, এ ধরণের উদ্ভট কথা অনেক বলা যেতে পারে। আর নিছক শাব্দিক দিক দিয়ে এই ধরণের চুলচেরা ব্যাখ্যাকে আমরা অসম্ভবও বলি না, বরং বাহ্যিক উপমার ব্যাখার ক্ষেত্রে আমরা এর চেয়েও দূরবর্তী সম্ভাবনার অবকাশ স্বীকার করি। আর এই ধরনের ব্যাখ্যাকারীদের সম্পর্কে আমরা এ কথাও বলতে পারি না যে, কুরআন হাদিসের সুস্পষ্ট বক্তব্য সে অস্বীকার করেছে, কিন্তু এই অভিমতের প্রবক্তার বক্তব্য খণ্ডন করে আমি বলবো, মুসলিম উম্মাহ ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই শব্দ (অর্থাৎ - "আমার পর আর কোন নবী নেই") থেকে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘটনাবলীর প্রমাণাদি থেকে এই কথা বুঝেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্য ছিল এ কথা বুঝানো যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আর কখনো কোন নবী আসবে না আর রাসুলও আসবে না। এটা ছাড়াও মুসলিম উম্মাহ এই ব্যাপারেও একমত যে, এর মধ্যে কোন তাবীল, ব্যাখ্যা ও বিশেষিত করার কোন অবকাশ নেই। কাজেই এহেন ব্যক্তিকে ইজমা অস্বীকারকারী ছাড়া আর কিছুই বলা যেতে পারে না। (আল ইকতিসাদ ফিল ইতিকাদ)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রসঙ্গঃ খতমে নবুওয়াত, নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার ও কিছু ভ্রান্তির নিরসন - দ্বিতীয় পর্ব

 

 

The Greatest Nation·Saturday, February 9, 2019

 

 

 

 

নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার

অতীতে যুগে যুগে, দেশে দেশে ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটেছে আর এখনো ঘটছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যৎবাণী করেছেন যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে ত্রিশজন ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটবে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে নবুওয়াতের যে দুইজন মিথ্যা দাবীদারের আবির্ভাব হয়, তাদের মধ্যে ছিল ইয়ামামার অধিবাসী মুসায়লামাতুল কাযযাব ও ইয়ামানের আসওয়াদ আনাসী।

মুসায়লামার উপনাম ছিল আবু সুমামা, আর রহমাতুল ইয়ামামা (ইয়ামামার আশীর্বাদ) নামেও তাকে ডাকা হতো। ভণ্ডামীর কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কাযযাব (ডাহা মিথ্যাবাদী) অভিধায় অভিহিত করেন। তখন কাযযাব শব্দটি তার নামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে বিবেচিত হয়ে আসছে।

মুসায়লামাতুল কাযযাব হিজরি নবম সালে তার গোত্র বনু হানীফার সতরজনের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে মদিনায় আগমন করে। মদিনা নগরীতে প্রবেশ করার সময় সে নিজেকে বস্ত্রাবৃত করে রাখে। মাসলামা বিনতুল হারিসের বাড়িতে তাদের থাকার ও যথারীতি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। মুসায়লামা ছাড়া প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ মসজিদে নববীতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম কবুল করে। তারা মুসায়লামাকে তাদের অবস্থানক্ষেত্রে বাহনের প্রহরায় রেখে এসেছিলো। বিদায় নেওয়ার সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসায়লামার দলের প্রত্যেককে পাঁচ উকিয়া (দুইশত দিরহাম) করে রৌপ্য মুদ্রা উপঢৌকন দিলেন আর তার বাহন পাহারায় রত মুসায়লামার কথা উল্লেখ করলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকেও সমপরিমাণ প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বললেন - "শোন, সে তোমাদের তুলনায় নিকৃষ্ট নয়।" সদস্যবৃন্দ মুসায়লামার কাছে প্রত্যাবর্তন করে তার সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে মন্তব্য তাকে অবগত করালে সে বললো, "তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ কথা এ কারণে বলেছেন, যেহেতু তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানেন যে, নবুওয়াতের বিষয়টি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আমার জন্য সাব্যস্ত রয়েছে।"

সে মদিনার জনগণকে বলতে লাগলো, "মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যদি পরবর্তীতে আমাকে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করেন, তাহলে আমি আনুগত্য করবো।" এই সংবাদ পেয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাবিত ইবন কায়েস ইবন শাম্মাস রাদিয়াল্লাহু আনহু সমভিব্যাহারে মুসায়লামার কাছে উপস্থিত হোন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে লক্ষ্য করে মুসায়লামা বললো, "আপনি চাইলে আমি বর্তমানে আপনার জন্য কর্তৃত্ব ছেড়ে দিবো, ইসলাম গ্রহণ করবো, আপনার হাতে বায়আত গ্রহণ করবো আর আপনার খিদমতে হাজির হয়ে আপনার সাহায্য করবো, তবে শর্ত থাকবে যে - আপনার পরে মুসলমানদের কর্তৃত্ব আমার হাতে থাকবে।"

সে সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে ছিল একটি খেজুরের শাখা। মুসায়লামাকে উদ্দেশ্য করে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, "না, চোখের মতো মূল্যবান নিয়ামতের শপথ, এটা কখনো হতে পারে না। যদি তুমি আমার কাছে এই তুচ্ছ খেজুরের শাখাটিও চাও, তবে আমি তোমাকে এটাও দিবো না। তোমার ব্যাপারে আল্লাহ'র ফায়সালা লঙ্ঘিত হতে পারে না। যদি তুমি আমার আনুগত্য থেকে পিঠ প্রদর্শন করো, তবে আল্লাহ অবশ্যই তোমাকে ধ্বংস করবেন। আমি তোমাকে ঠিক তেমনই দেখতে পাচ্ছি, যেমনটি আমাকে স্বপ্নযোগে দেখানো হয়েছে। এই সাবিত আমার পক্ষ থেকে তোমার কথার জবাব দিবে।"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা বলে তার কাছ থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন।

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি - "আমি তোমাকে ঠিক তেমনই দেখতে পাচ্ছি যেমনটি আমাকে স্বপ্নযোগে দেখানো হয়েছে" - সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাকে জানান যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "একদিন আমি নিদ্রামগ্ন ছিলাম। এমন অবস্থায় স্বপ্নে পৃথিবীর সমুদয় সম্পদ আমার কাছে উপস্থিত করা হয় আর আমার হাতে দুটো স্বর্ণের কাঁকন রাখা হয়, যার কারণে আমার হৃদয় ভরাক্রান্ত হয়ে উঠে। তখন ঘুমের মধ্যে আমার প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়, আমি যেন উক্ত স্বর্ণ কাঁকন দুটোকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেই। আমি আদিষ্ট হয়ে উক্ত কাঁকন দুটো ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিলাম। এরপর তা উড়ে গেলো। আমি এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা এভাবে বুঝে নিয়েছি যে, আমার পরে দুইজন ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটবে, যাদের একজন আসওয়াদ আনাসী আর অপরজন মুসায়লামাতুল কাযযাব।" (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫ম খণ্ড; ফুতুহুল বুলদান; ইনআমুল বারী ফি শারহে বুখারী; সিরাতুল হালাবীয়া, শিবলী নুমানী, সিরাতুন্নবী, ৩য় খণ্ড; ইবন হিশাম, সিরাতুন নবী, ২য় খণ্ড)

মদিনা থেকে ইয়ামান প্রত্যাবর্তন করে মুসায়লামাতুল কাযযাব নিজেকে নবী দাবী করে আর প্রচার করতে থাকে যে, সে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের শরীকদার। সে কুরআনের আয়াতের মুকাবিলায় ছন্দোবদ্ধ স্তবক রচনা করতো আর এগুলোকে ওহী বলে জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালাতো। যেমনঃ

"আল্লাহ গর্ভবতীকে নিয়ামত দিয়েছেন, তার অভ্যন্তর থেকে স্পন্দনশীল প্রাণ উদগত করেছেন অন্তঃতক (গর্ভফুল) ও অন্ত্রের মধ্য দিয়ে। আর তাদের জন্য মদ ও ব্যাভিচার বৈধ করেছেন, তাদের সালাত রহিত করে দিয়েছেন।" (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫ম খণ্ড; সিরাতুল হালাবীয়া, ৬ষ্ঠ খণ্ড)

"গম পিষে আটা প্রস্তুতকারিণীদের শপথ। আটা মেখে খমীর প্রস্তুতকারিণীদের শপথ। খমীর দিয়ে রুটি প্রস্তুতকারিণীদের শপথ। রুটির টুকরা দিয়ে সারিদ প্রস্তুতকারিণীদের শপথ। গ্রাসে গ্রাসে উদরপূর্তিকারিণীদের শপথ।" (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫ম খণ্ড)

"কসম সেসব মহিলার, যারা ফসলের বীজ বপন করে, যারা ফসল কেটে ঘরে উঠায়, যারা দ্রুত গম বের করে, যারা পেষণ করে, যারা রুটি তৈরি করে, যারা সারিদ বানায়, লুকমা বানিয়ে খাওয়ায়। এরা মোটা ও চর্বিধারী হয়। পল্লীবাসীদের উপর তোমাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। নগরবাসীও তোমাদের ছাড়িয়ে যেতে পারে নাই। যারা তোমাদের সফরসঙ্গী তাদেরকে বিরত রাখো। যারা বিপদগ্রস্ত তাদেরকে আশ্রয় দাও এবং মৃত্যুর সংবাদ বহনকারীকে সমবেদনা জ্ঞাপন করো।" (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৬ষ্ঠ খণ্ড; সিরাতুল হালাবীয়া, ৬ষ্ঠ খণ্ড)

"হস্তি, তুমি কি জানো, হস্তি কি জিনিস ? তার একটি লম্বা শুঁড় আছে।"

"অন্ধকার রাতের কসম। গর্জনকারী নেকড়ের কসম। ভালো-মন্দ কাকেও সিংহ মারে নাই।" (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৬ষ্ঠ খণ্ড)

মহান আল্লাহ'র অপার অনুগ্রহে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, ইতিহাসে যা মুজিযাতুর রাসুল নামে খ্যাত। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা দুয়া করতেন বা বলতেন, আল্লাহ তা পূর্ণ করে দিতেন প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বীকৃতি স্বরূপ। ইতিহাসে এমন হাজারো বাস্তব দৃষ্টান্ত রয়েছে। কিন্তু নবুওয়াতের কোন মিথ্যা দাবীদারের দুয়া কবুল হওয়ার বা সত্য হওয়ার কথা নয় সঙ্গত কারণে। হ্যা, যাদু, ভোজবাজি বা তেলেসমাতির কথা ভিন্ন।

ইতিহাসবিদদের বিবরণ অনুযায়ী, মুসায়লামাতুল কাযযাব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযার অনুরূপ কাজ করার চেষ্টা করতো। সে জানতে পারলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক কূপে থুথু নিক্ষেপ করায় কূপের মধ্যে পানির প্লাবন ফুটে উঠেছে। সেও এক কূপে থুথু নিক্ষেপ করে, কিন্তু পানির ধারা ফুটে উঠা তো দূরের কথা, প্রবাহমান পানির ধারাটুকু পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। সে আরেক কুপে থুথু নিক্ষেপ করলে সেই কূপের পানি তিক্ত ও লবণাক্ত হয়ে যায়। একবার সে উযু করে অবশিষ্ট পানি খেজুর গাছের গোড়ায় দিলে গাছটি শুকিয়ে মারা যায়।

দুটি বালককে একবার তার কাছে আনা হয় দুয়া নেওয়ার উদ্দেশ্যে। সে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কিন্তু এতে একজনের মাথার চুল সব পড়ে যায় আর অপরজন তোতলা হয়ে যায়।

এক ব্যক্তি মুসায়লামার কাছে হাজির হয়ে তার দুই শিশু পুত্রের জন্য বরকতের দুয়া চাইলো, মুসায়লামা দুয়া করে দিলো। ঘরে ফিরে লোকটি জানতে পারলো যে, এক শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে আর অপর শিশুটির দেহ হিংস্র জন্তুর নখর থাবায় ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। কোন এক লোকের চোখে ব্যাথা হলে মুসায়লামা তার দুই চোখ মর্দন করে দেয়, কিন্তু এতে তার দুই চোখই অন্ধ হয়ে যায়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৬ষ্ঠ খণ্ড; সিরাতুল হালাবীয়া, ৬ষ্ঠ খণ্ড)

মুসায়লামাতুল কাযযাব ম্যাজিক ও ভোজবাজিতে ছিল সিদ্ধহস্ত। সরু কাঁচের পাত্রে সে অনায়াসে ডিম প্রবিষ্ট করাতে পারতো, পাখির বিচ্ছিন্ন পালককে জোড়া লাগাতে পারতো, এমনকি বনের হরিণীকে ডেকে তার দুধ দোহন করতে পারতো। সে সালাত নিষিদ্ধ করে দেয় এবং মদ পান ও যিনাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে। মুসায়লামাতুল কাযযাব নিজে নবী হওয়ার দাবী করা সত্ত্বেও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে নবী বলে স্বীকার করতো। সম্ভবত এই স্বীকারোক্তি দ্বারা ইয়ামামা অঞ্চলের মুসলমানদের শান্ত রাখাই ছিল তার উদ্দেশ্য। (ইবন সায়্যিদিন্নাস, উয়ুনুল আসার, ২য় খণ্ড; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫ম খণ্ড)

দশম হিজরিতে মুসায়লামা কাযযাব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিন্মোক্ত চিঠি লিখে পাঠায় -

"আল্লাহ'র রাসুল মুসায়লামার পক্ষ থেকে আল্লাহ'র রাসুল মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি। প্রকাশ থাকে যে, পৃথিবীর অর্ধাংশ আমাদের, আর অর্ধাংশ কুরায়শদের, কিন্তু কুরায়শগণ ন্যায়বিচার করে না।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে চিঠি দেন -

"রাহমানুর রাহীম আল্লাহ'র নামে। আল্লাহ'র রাসুল মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পক্ষ থেকে মিথ্যাবাদী মুসায়লামার প্রতি। প্রকাশ থাকে যে, পৃথিবী আল্লাহ'র। তিনি নিজ বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে তার উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। পরিণামে পরহেযগার লোকদের জন্যই মঙ্গল। যে হিদায়াতের অনুসরণ করে তার প্রতি সালাম।" (যাদুল মাআদ, ৩য় খণ্ড; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫ম খণ্ড; আসাহুস সিয়ার)

হাবীব ইবন যায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি নিয়ে মিথ্যাবাদী মুসায়লামার কাছে গিয়েছিলেন। পাপিষ্ঠ মুসায়লামা তার হাত-পা চারটিই কেটে তাকে পঙ্গু করে দিয়েছিলো। মুসায়লামার চিঠি নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ইবনুন নাওয়াহা আর ইবন উসাল এসেছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বললেন, "তোমরা বলো - লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।" তারা বললো - "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুসায়লামাতু রাসুলিল্লাহ।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "মুসায়লামা যা বলে, তোমরা কি তাই বলো ?" তারা বললো, "হ্যা।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "আল্লাহ'র কসম, যদি (আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী) দূত হত্যা নিষিদ্ধ না হতো, তবে নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে হত্যা করতাম।" (ফুতুহুল বুলদান; আবু দাউদ তায়ালিসী, ১ম খণ্ড; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫ম খণ্ড)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর ভণ্ড নবী মুসায়লামার অপতৎপরতা বন্ধ করার লক্ষ্যে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু হিজরি একাদশ সালের যুলহিজ্জা মাসে খালিদ ইবন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র নেতৃত্বে ১৩ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী ইয়ামামা শহরে প্রেরণ করেন। মুসায়লামাতুল কাযযাবের পক্ষে বনু হানীফার ৮০ হাজার সৈন্য রাজাল ইবন আনফুহ ও মাহকাম ইবন তুফায়লের সেনাপতিত্বে মুসলিম বাহিনীর মোকাবিলায় এগিয়ে আসে। এই রাজাল হলো মুসায়লামা বিশ্বস্ত সেকেন্ড ইন কমান্ড। সে সাক্ষ্য দিয়েছিলো - আমি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বলতে শুনেছি যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসায়লামাকে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের কাজে শরীক করেছেন। এই অভিশপ্ত লোকটি ইয়ামামাবাসীদের বিপথগামী করার জন্য সর্বাধিক দায়ী। তার প্রচেষ্টায় ইয়ামামার জনগণ মুসায়লামার মিথ্যা নবুওয়াতের অনুসারী হয়ে যায়।

এর আগে এই রাজাল একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আসে আর পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারা শিক্ষা করে। রিদ্দার যুগে সে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র খিদমতে হাজির হলে তিনি তাকে ইয়ামামাবাসীদেরকে আল্লাহ'র পথে দাওয়াত দেওয়ার এবং ইসলামের উপর তাদের প্রতিষ্ঠিত রাখার দায়িত্ব দিয়ে ইয়ামান পাঠান। কিন্তু সে দেশে এসে ভণ্ড নবী মুসায়লামার সাথে মিলিত হয়ে নিজেও ভণ্ড ও অভিশপ্ত হয়ে যায়। মুসায়লামার মিথ্যা নবুওয়াতের পক্ষে সে জনমত সৃষ্টি করতে থাকে। ইতিহাসবিদ ইবন কাসির বলেন, মুসায়লামার ফিতনা থেকে রাজালের ফিতনা ছিল আরো ভয়াবহ। খালিদ ইবন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু অমিত বিক্রমে ১৩ হাজার মুসলিম সেনাসদস্যসহ মুসায়লামাতুল কাযযাবের ৪০ হাজার মুরতাদ সৈন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।

এই অভিযান ছিল ভয়ংকর ও প্রলয়ংকারী। মুসলিম সেনাসদস্যদের আক্রমণের তীব্রতা ও রণকৌশলের ক্ষিপ্রতায় মুসায়লামা বাহিনী হতচকিত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। অবশেষে তারা পার্শ্ববর্তী একটি উদ্যানে আশ্রয় নিলো পুনরায় সংগঠিত হওয়ার উদ্দেশ্যে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা লক্ষ্য করে মুসায়লামা নিজ সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে তেজদ্দীপ্ত ভাষায় বললো, "আজ আত্মমর্যাদা রক্ষার দিন। আজ যদি তোমরা হারিয়ে যাও, তাহলে তোমাদের মহিলারা বন্দী হবে, অপাত্রে তাদের বিয়ে হবে। তাই তোমরা বংশমর্যাদা রক্ষার্থে জীবনপণ যুদ্ধ করো আর তোমাদের স্ত্রীদেরকে রক্ষা করো।"

মুসায়লামা বাহিনী উদ্যান অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মূল ফটকসহ সব দরজা বন্ধ করে দেয়। মুসলিম যোদ্ধাগণ মূল ফটক ও প্রাচীর ভেঙ্গে উদ্যানের ভিতর প্রবেশ করার সাথে সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুসায়লামা অস্ত্র হাতে ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে তার অনুসারীদের লড়াই করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে লাগলো। কিন্তু চারদিকে মুসলিম যোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধ ব্যূহ লক্ষ্য করে সে উদ্যম হারিয়ে ফেলে। অবশেষে ঘোড়া থেকে নেমে চুপিসারে উদ্যানের বাইরে যাওয়ার প্রয়াস চালায়, কিন্তু বিধি বাম। উদ্যান ফটকের অদূরেই ওয়াহশী ইবন হারব (হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র হন্তা) দণ্ডায়মান ছিল। তার নিক্ষিপ্ত বর্শা মুসায়লামার বুক বিদীর্ণ করে পিছনে বের হয়ে গেলো। আবু দুজানা সিমাক ইবন খারাশা দ্রুত গিয়ে তরবারির আঘাত হানেন, এতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নিহত হওয়ার সময় তার বয়স হয়েছিলো একশত পঞ্চাশ বছর। এমন অবস্থায় শত্রুপক্ষ যে যেদিকে পারলো পালিয়ে বাঁচলো।

এ যুদ্ধে অভিশপ্ত রাজালসহ মুসায়লামার বাহিনীর ২১ হাজার লোক মুসলমানদের হাতে প্রাণ হারায় এবং এক হাজার মুসলমান যোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। আহতদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল বেশী। শাহাদাত বরণকারীদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক ছিলেন হাফিজে কুরআন। ৩০০ জন আনসার ও ৩০০ জন তাবিঈন এ যুদ্ধে শহীদ হোন। আনসার কমান্ডার সাবিত ইবন কায়েস রাদিয়াল্লাহু আনহু ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাত লাভ করেন। তিনি কাফনের কাপড় পড়ে আর তাতে কর্পূরের সুগন্ধি মেখে রণাঙ্গনে এসেছিলেন।

ওয়াহশী আনন্দ প্রকাশ করে বলতেন, কাফির থাকাকালে আমি সেরা মুসলমান আমীর হামযাকে হত্যা করেছিলাম, আর মুসলমান হওয়ার পর সেই ত্রুটির ক্ষতিপূরণের জন্য সেরা কাফির মিথ্যাবাদী মুসায়লামাকে হতা করলাম। (ফুতহুল বুলদান; আকবার শাহ নজীবাবাদী, তারিখে ইসলাম, ১ম খণ্ড; মোল্লা মাজদুদ্দীন, সিরাতে মুস্তাফা; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৬ষ্ঠ খণ্ড; আর-রাহিকুল মাখতুম)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন সায়াহ্নে আসওয়াদ আনাসী ইয়ামানের রাজধানী সানআতে নবুওয়াতের দাবী করে এবং সানআর মুসলিম শাসক মুহাজির ইবন আবি উমায়র রাদিয়াল্লাহু আনহু'র উপর বিজয় লাভ করে। আসওয়াদ আনাসীর আসল নাম হলো আবহালাহ ইবন কাব ইবন গাওস। কৃষ্ণকায় ছিল বলে তাকে আসওয়াদ নামে ডাকা হতো, কিন্তু সে "রাহমানুল ইয়ামান" অর্থাৎ "ইয়ামানের আশীর্বাদ" উপাধিতে নিজেকে ভূষিত করেছিলো। স্বভাবগতভাবে সে ছিল অত্যন্ত অহংকারী, উদ্ধত ও গর্বিত। যাদুবিদ্যা ও ভোজবাজির উপর দক্ষতা থাকায় সে সহজে মূর্খদের মোহাবিষ্ট করে তোলে।

আসওয়াদ আনাসীর সাথে সুহায়ক ও সুকায়ক নামের দুটো শয়তান থাকতো। তার একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাধাও ছিল। সে যখন তাকে বলতো, তোমার প্রভুকে সিজদা করো, তখন সে তাকে সিজদা করতো। আর যখন বলতো, হাঁটু গেঁড়ে বসো, তখন সে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়তো। এই কারণে তাকে "যুল-হিমার" বা "গাধাওয়ালা" বলা হতো। অনেক সময় তাকে "যুল-খিমার" বা "ঘোমটাওয়ালা" বলেও ডাকা হতো। কারণ সে সবসময় ঘোমটা পড়ে ও পাগড়ি বেঁধে থাকতো। সে নাজরান থেকে সানআয় এসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মালিক হয়। সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিযুক্ত শাসনকর্তাকে নিন্মোক্ত ভাষায় চিঠি লিখে ধৃষ্টতার পরাকাষ্ঠা দেখায়ঃ

"হে অত্যাচারী দল, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির যে অংশ তোমরা দখল করেছো তা আমাদেরকে ফেরত দাও। আমাদের যা কিছু ক্ষতি করেছো তা পূরণ করে দাও। কারণ এসবের আমরা মালিক। তোমাদের যা আছে তা নিয়েই তোমরা থাকো।"

সানআ শহরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে শাসক শাহর ইবন বাজাম আসওয়াদ আনাসীর সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। এই সুযোগে আসওয়াদ আনাসী নিজ গোত্রের সাতজন যোদ্ধা নিয়ে রাজধানী সানআ অধিকার করে আর শাসক বাজামের স্ত্রী আযাজ মারযুবানকেও বিয়ে করে নিয়ে যায়। ফিরোজ দায়লামীর চাচাতো বোন এই আযাজ মারযুবান ছিলেন আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান পোষণকারী এক খাঁটি মুসলিম ও পুণ্যবতী নারী।

শাসনকর্তা মুয়ায ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সাময়িকভাবে ইয়ামান অঞ্চল ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সমগ্র ইয়ামানে আসওয়াদ আনাসীর ক্ষমতা সুসংহত হয়। গোটা রাজ্যে তার দৌরাত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার রাজত্বকাল ছিল মাত্র চার মাস। মুয়ায ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মাধ্যমে প্রাপ্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে মুসলিম সেনাপতি ফিরোজ দায়লামী সেনাবাহিনীর এক চৌকস বিগ্রেড নিয়ে আসওয়াদ আনাসীর রাজপ্রাসাদে অভিযান পরিচালনা করেন। যেহেতু রাজপ্রাসাদের প্রবেশ মুখে এক হাজার সশস্ত্র রক্ষী প্রহরারত ছিল, সেজন্য মুসলিম বাহিনীকে রাতে প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে রাজপ্রাসাদে ঢুকতে হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজামের স্ত্রী মারযুবান আসওয়াদ আনাসীকে মদ পান করিয়ে নেশাগ্রস্ত করিয়ে রাখে। এই সময় ফিরোজ দায়লামী সামনে অগ্রসর হয়ে তরবারির মাধ্যমে আসওয়াদ আনাসীর দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। সেনাপতি ফিরোজ দায়লামী ও বাজামের স্ত্রী মারযুবান প্রয়োজনীয় ধনসম্পদ নিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসেন।

এই ঘটনাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের প্রাগুক্তকালে সংঘটিত হয়েছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকালের এক দিন এক রাত আগে সেনাপতি ফিরোজের বিজয় অভিযানের সংবাদ ওহীর মাধ্যমে অবহিত হোন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের সুসংবাদ দিয়ে বললেন, "ফিরোজ কৃতকার্য হয়েছে।" এরপর ইয়ামান থেকে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছে যথারীতি খবর এসে পৌঁছায়। (শায়খ আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব, মুখতাসার সিরাতির রাসুল; ফুতুহুল বুলদান; ইনআমুল বারী ফি শারহে বুখারি, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৬ষ্ঠ খণ্ড)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় তাগলীব গোত্রের শাজাহ বিনতুল হারস ইবনে সুওয়ায়দ নামের এক নারী নবুওয়াতের দাবী করে। সে চার হাজার মানুষ তার দলে ভিড়িয়ে মদিনা আক্রমণ করতে চেয়েছিলো। শাজাহ তার অনুসারীদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায অপরিহার্য রাখলেও শুকরের গোশত খাওয়া, মদপান করা ও যিনা-ব্যাভিচার বৈধ ঘোষণা করলো। বহু খৃষ্টানও নিজ ধর্ম ত্যাগ করে শাজাহের দলভুক্ত হয়েছিলো। শাজাহ ও মুসায়লামার মিশন এক অভিন্ন হওয়ায় তারা একে অপরকে বিয়ে করে। তবে তাদের দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র তিন দিন। শাজাহের বিয়ের মোহরানার বিনিময়ে মুসায়লামা তাগলীব গোত্রের ইশা ও ফজরের নামায মাফ করে দেয়। ইত্যবসরে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বাহিনী ভণ্ড নবীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসছে এই সংবাদ পেয়ে শাজাহের সঙ্গীরা পালিয়ে গেলো। আর শাজাহ অতিকষ্টে আপন তাগলীব গোত্রের জাযীরা নামক স্থানে পৌঁছে অজ্ঞাত জীবন যাপন করতে লাগলো। উমাইয়া খলীফা আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু'র শাসনকালে সে ইসলাম কবুল করে। (আকবার শাহ নজিবাবাদী, তারিখে ইসলাম, ১ম খণ্ড; মাওলানা মুহাম্মাদ গুফরান কিরানভী, যখীরা-ই মালুমাত; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৬ষ্ঠ খণ্ড)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের শেষপ্রান্তে আরব দেশে তুলায়হা আসাদী নামক অপর এক ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটে। সে ছিল গনক ও যাদুকর। প্রাথমিক অবস্থায় সে ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেই নবী হওয়ার দাবীদার সাজে। গাতাফান, হাওয়াযিন, আমের, সুলায়ম ও তাঈ গোত্রের বেশ কিছু লোক এবং বনী ইস্রাঈলের কোন কোন গোত্র তার দলে যোগ দেয়। নাজদের বিখ্যাত কূপের কাছে তুলায়হা তার দলবল নিয়ে আস্তানা গড়ে তুলে। তার অপতৎপরতা দমন করার জন্য দিরার ইবনুল আদওয়ার রাদিয়াল্লাহু আনহু অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু তার অভিযান শেষ হওয়ার আগেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দিরার রাদিয়াল্লাহু আনহু অভিযান অসম্পূর্ণ রেখে সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

এই অবসরে তুলায়হার হাতে তার শক্তি সুসংহত ও জনবল বৃদ্ধি করার সুবর্ণ সুযোগ আসে। পরবর্তীতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র খিলাফতকালে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তুলায়হার বিরুদ্ধে বড় ধরণের অভিযান চালিয়ে বাযাখার ময়দানে তাকে পরাজিত করেন। তুলায়হা সস্ত্রীক ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেলো আর অতিকষ্টে সিরিয়া পৌঁছে কুদাআ গোত্রে আশ্রয় গ্রহণ করলো। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে তার গোত্রসহ বিভিন্ন গোত্রের জনগণ যখন মুসলমান হয়ে গেলো, তখন তুলায়হা ইসলাম কবুল করে। উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু'র খিলাফতকালে তুলায়হা মদিনায় এসে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে। (তারিখ তাবারী, ২য় খণ্ড; আকবার শাহ নজীবাবাদী, তারিখে ইসলাম, ১ম খণ্ড)

 

স্থান ও সালসহ ভণ্ড নবীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা নিচে পেশ করা হলোঃ

::: নাম ::: ----------------------------------------::: স্থান ::: ------------------------ ::: সাল :::

(১) মুসায়লামাতুল কাযযাব ------------------------- ইয়ামামা --------------------------- ৯ হিজরি

(২) আসওয়াদ আনাসী ------------------------------ ইয়ামান --------------------------- ১০ হিজরি

(৩) শাজাহ তাগলিবী --------------------------------ইয়ামামা ---------------------------- ৯ হিজরি

(৪) তুলায়হা আসাদী --------------------------------বনু আসাদ --------------------------১১ হিজরি

(৫) হারিস -----------------------------------------দামেস্ক ------------------------------- ?

(৬) আবু মানসুর ইজা -------------------------------কুফা ----------------------------- ১২০ হিজরি

(৭) মুগীরা ইবনে সয়িদে উজানি ---------------------- কুফা ----------------------------- ১২৯ হিজরি

(৮) সালেহ ইবন তরীফ ----------------------------- স্পেন ---------------------------- ১৩০ হিজরি

(৯) মুহাম্মাদ ইবন ফুজলাসুল খাত্তাব ------------------ কুফা ----------------------------- ১৩৪ হিজরি

(১০) ইসহাক আখরাস ------------------------------ মরক্কো --------------------------- ১৩৫ হিজরি

(১১) হাকিম মুকান্নে ------------------------------ বাগদাদ -------------------------- ১৪৮ হিজরি

(১২) ইসতাদে সিস ------------------------------- ইরান ---------------------------- ১৫৪ হিজরি

(১৩) আবদুল্লাহ ইবন মায়মুন ---------------------- ইরাক ---------------------------- ১৭৫ হিজরি

(১৪) আবু ঈসা ইবনে ইয়াকুব ---------------------- ইস্পাহান -------------------------- ২১৮ হিজরি

(১৫) বাহবূদ ----------------------------------- ইরাক ----------------------------- ২৫৬ হিজরি

(১৬) ইয়াহূদ ইবন আবান ----------------------- বাহরায়ন --------------------------- ২৬০ হিজরি

(১৭) আকরাওয়াহ কারমাতী -------------------- ইরাক ------------------------------ ২৮৯ হিজরি

(১৮) আবুল আব্বাস ----------------------------- কায়রো --------------------------- ২৯৮ হিজরি

(১৯) আবদুল্লাহ ইবন আহমাদ যাকরিয়া --------------- মিসর ----------------------------- ৩০১ হিজরি

(২০) আবু মুহাম্মাদ হাশিম -------------------------- আফ্রিকা -------------------------- ৩১৩ হিজরি

(২১) মাওয়াতি ----------------------------------- সুদান ----------------------------- ৩১৬ হিজরি

(২২) আহমাদ ইবন কায্যাল ------------------------ আফগানিস্তান ----------------------- ৩১৬ হিজরি

(২৩) তানজিত (মহিলা) ---------------------------- আফ্রিকা -------------------------- ৩১৮ হিজরি

(২৪) জয় (মহিলা) --------------------------------- আফ্রিকা -------------------------- ৩২২ হিজরি

(২৫) হামিজা জুখানি -------------------------------- মিসর ---------------------------- ৪১১ হিজরি

(২৬) বাহাফরিদ ইবন মাহেজনীন ---------------------- নিশাপুর ------------------------ ৪৪২ হিজরি

(২৭) হুসায়ন ইবন ইমরান -------------------------- ইরাক -------------------------- ৪৮৩ হিজরি

(২৮) আহমাদ ইবন হিলাল -------------------------- দামেস্ক --------------------------- ৬৫৫ হিজরি

(২৯) মাহমুদ ওয়াহিদ জিলানী ---------------------- ইরাক ----------------------------- ৬৮০ হিজরি

(৩০) কুতবুদ্দীন আহমাদ ------------------------- আফ্রিকা --------------------------- ৬৮০ হিজরি

(৩১) চেরাগুদ্দীন -------------------------------- জম্মু, কাশ্মীর ------------------------- ১৯০৩ খৃ.

(৩২) আবদুল্লাহ তিমারপুরী ------------------------ হায়দরাবাদ -------------------------- ১৯০৪ খৃ.

(৩৩) আহমাদ নূর সুরমা ফরুশ -------------------- কাদিয়ান ----------------------------- ১৯১৮ খৃ.

(৩৪) খাজা ইসমাঈল ---------------------------- লন্ডন -------------------------------- ১৯৩০ খৃ.

(৩৫) মুহাম্মাদ মুর্দা ------------------------------ নাইজেরিয়া --------------------------- ১৯৮১ খৃ.

(৩৬) ইয়াহইয়া আইনুল্লাহ ------------------------- বিহার -------------------------------- ১৯২০ খৃ.

(৩৭) টুমতি ওরফে চারডিওআলী -------------------- আমেরিকা ---------------------------- ১৯৮২ খৃ.

(৩৮) মুহাম্মাদ আলী ---------------------------- গাজিপুর, শেখোপুরা -------------------- ১৯৮৩ খৃ.

(৩৯) গোলাম ফরীদ -------------------------- কসকা, হাজারা ----------------------- ১৯৮৩ খৃ.

(৪০) মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ---------- কাদিয়ান, পাঞ্জাব ----------------------- ১৮৯১ খৃ.

(মাওলানা মুহাম্মাদ জুনায়েদ, খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী সমস্যা; মাওলানা মুহাম্মাদ গোফরান কিরানভী, যখীরা-ই মালুমাত)

 

ভণ্ড নবীদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান

যারা "খাতামুন নাবিয়্যিন" শব্দের অপব্যাখ্যা বা ভিন্নতর বিশ্লেষণ করে, আর যারা নবুওয়াতের মিথ্যা দাবী করে মুসলিম উম্মতের সর্বসম্মত অভিমত (ইজমা) অনুযায়ী তারা ধর্মদ্রোহী, কাফির ও হত্যাযোগ্য। এই বিষয়ে ফকিহ, মুহাদ্দিস ও ইসলামী বিদ্বানগণের মধ্যে মতপার্থক্য নেই। অষ্টম হিজরি শতকের খ্যাতনামা হাদিস বিশেষজ্ঞ ইমাম শাতিবী তার "আল-ইতিসাম" গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, যে সব ব্যক্তি নবুওয়াত বা ওহী প্রাপ্তির দাবী করবে, তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে। এ ব্যাপারে উম্মতের বিশেষজ্ঞ আলিমগণের ইজমা রয়েছে।

ইমাম শাতিবী ফাযাযী নামের এক ব্যক্তির ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, সে নানা ভোজবাজির আশ্রয় নিয়ে নবুওয়াতের দাবী করে বসে। কিছু দিনের মধ্যে অনেক মানুষ তার দলভুক্ত হয়ে যায়। ফাযাযী আর তার অনুসারীরা "খাতামুন নাবিয়্যিন" এর অপব্যাখ্যা করে দাবী করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর নতুন নবী আগমনের অবকাশ আছে। এই নতুন ফিতনার প্রেক্ষিতে সেই যুগের উলামায়ে কিরাম সর্বসম্মতভাবে তাদের এই দাবীকে কুফরী বলে ঘোষণা করেন। সুতরাং সেই যুগের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইমাম শায়খুল মাশাইখ আবু জাফর ইবন যুবায়েরের ফতোয়ার ভিত্তিতে তাকে হত্যা করা হয়। (ইমাম শাতিবী, কিতাবুল ইতিসাম, ২য় খণ্ড)

সায়্যিদ মাহমুদ আলুসী বাগদাদী বলেন, "মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী হওয়ার ব্যাপারটি কুরআনে আলোচিত হয়েছে এবং হাদিসে সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা রয়েছে। উম্মতে মুহাম্মাদি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। তাই এর বিপরীত মতাবলম্বী কাফির বলে গণ্য হবে। যদি সে তওবা না করে, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করাই শরীয়তের নির্দেশ।" (রুহুল মাআনী, ২২তম খণ্ড)

আল্লামা যুরকানী বলেছেন, "যে ব্যক্তি এ কথা বিশ্বাস করে যে, নবুওয়াত পরিশ্রম করে অর্জন করা যায় ও নবুওয়াতের সিলসিলা রহিত হয় নাই কিংবা এই বিশ্বাস করে যে, ওয়ালী নবী থেকে উত্তম, তাহলে এই ব্যক্তি যিন্দীক, তাকে হত্যা করা ওয়াজিব।" (যুরকানী, ৬ষ্ঠ খণ্ড; মুফতি মুহাম্মাদ শফী, খতমে নবুওয়াত)

কাযী ইয়ায "আশ-শিফা" গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, "খলীফা আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান নবুওয়াতের দাবীদার হারিস নামের এক ব্যক্তিকে শূলীতে চড়িয়ে হত্যা করেন। অনেক খলীফা ও বাদশাহ নবুওয়াতের দাবীদারদের সাথে এই ধরণের আচরণ করেছেন। সেই যুগের আলিমগণ এই বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে ঘোষণা দিয়েছেন যে, খলীফা ও বাদশাহদের উপরিউক্ত ফায়সালা সঠিক ছিল এবং যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবীদারকে কাফির বলতে দ্বিধা করবে সেও কাফির।" (মুফতি মুহাম্মাদ শফী, খতমে নবুওয়াত)

আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশীদের আমলে এক ব্যক্তি নিজেকে নবী বলে দাবী করে বলে, "আমি হলাম হযরত নূহ (আঃ)। কেননা, নূহ (আঃ) এর বয়স এক হাজার বছর পূর্ণ হতে পঞ্চাশ বছর বাকি ছিল। এই অপূর্ণতা পূরণের উদ্দেশ্যে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কুরআন এর প্রমাণ বহন করে - أَلْفَ سَنَةٍ إِلَّا خَمْسِينَ عَامًا

(২৯ : ১৪), অর্থাৎ, নূহ আলাইহিস সালাম পঞ্চাশ বছর কম এক হাজার বছর জীবিত ছিলেন।"

খলীফা হারুনুর রশীদ সমসাময়িক আলীমদের ফাতওয়া নিয়ে ধর্মত্যাগী (মুরতাদ) হওয়ার অভিযোগে তাকে হত্যা করেন আর ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে লাশ শূলী কাষ্ঠে ঝুলিয়ে রাখেন। (মুফতি মুহাম্মাদ শফী, খতমে নবুওয়াত)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রসঙ্গঃ খতমে নবুওয়াত, নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার ও কিছু ভ্রান্তির নিরসন - তৃতীয় পর্ব

 

 

 

The Greatest Nation·Saturday, February 9, 2019

 

 

 

 

ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন খতমে নবুওয়াত আকিদার পরিপন্থী নয়

পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত ও হাদিসের ধারাবাহিক বর্ণনায় এই কথা প্রমাণিত যে, শেষ যমানায় ঈসা ইবন মারইয়াম পুনরায় এই পৃথিবীতে আগমন করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। এই কথা মনে রাখা দরকার যে, বনী ইস্রাইলের নবী ঈসা ইবনে মারইয়াম আবার পৃথিবীতে আগমনের ফলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের "খাতামুন নাবিয়্যিন" হওয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধা নয়। সহীহ হাদিস দিয়ে এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত যে, ঈসা ইবন মারইয়াম দ্বিতীয়বার নতুন নবী হিসেবে অবতরণ করবেন না, আর তার উপর কোন ওহীও নাযিল হবে না। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তাকে পূর্ব প্রদত্ত নবুওয়াতের মর্যাদা আল্লাহ ছিনিয়ে নিবেন। আল্লাহ'র পক্ষ থেকে তিনি কোন নতুন বাণী বা বিধান আনবেন না। শরীয়তে মুহাম্মাদির মধ্যে তিনি হ্রাস-বৃদ্ধিও করবেন না। দ্বীন ইসলামের পুনরজ্জীবনের জন্যও তাকে পৃথিবীতে পাঠানো হবে না। তিনি এসে জনগণকে নিজের উপর ঈমান আনার আহবান জানাবেন না এবং তার প্রতি যারা ঈমান আনবে তাদেরকে নিয়ে পৃথক উম্মতও গড়ে তুলবেন না। বরং তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ও আদর্শের অধীনে উম্মতের সংশোধন, সংস্কার ও তাবলীগের খিদমত আঞ্জাব দিয়ে যাবেন। (হাশিয়াতুল আল্লামা আস-সাভী, ৩য় খণ্ড; তাফসীর মাযহারী, ৯ম খণ্ড; তাফহীমুল কুরআন, ৪র্থ খণ্ড; মাআরিফুল কুরআন, ৭ম খণ্ড; তাফসীরে খাযিন, ৬ষ্ঠ খণ্ড)

শায়খ মাহমুদ আলুসী বাগদাদী এ প্রসঙ্গে বলেন, "অর্থাৎ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ নবী হওয়ার অর্থ হচ্ছে নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে শেষ হয়ে গিয়েছে। এরপর আর কেউই এই বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার অধিকারী হবে না। এর ফলে ঈসা ইবন মারইয়ামের শেষ যমানায় আগমনের বিষয়ে কোন সমস্যার সৃষ্টি করবে না। কারণ এই বিষয়ে উম্মতের ঐকমত্য রয়েছে, পবিত্র কুরআনের ঘোষণা রয়েছে আর বিপুল সংখ্যক হাদিসের ধারাবাহিক সাক্ষ্য রয়েছে। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বেই তিনি এই পৃথিবীতে নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়েছেন।" (রুহুল মাআনী, ২২তম খণ্ড)

আল্লামা তাফতাযানী বলেছেন, "মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী, এ কথা প্রমাণিত সত্য। যদি বলা হয়, হাদিসে ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনের কথা বর্ণিত হয়েছে, তাহলে আমি বলবো - হ্যা, ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনের কথা বলা হয়েছে সত্য, তবে তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারী হবেন, কারণ তার শরীয়ত রহিত হয়ে গেছে, কাজেই তার উপর ওহী নাযিল হবে না এবং তিনি নতুন বিধানও নির্ধারণ করবেন না, বরং তিনি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন।" (শারহু আকাঈদীন নাসাফী)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে নবী হিসেবে প্রেরণ করাই হলো বান্দার প্রতি আল্লাহ'র রহমত। এরপর আল্লাহ'র পক্ষ থেকে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি অধিক সম্মান প্রদর্শনের জন্য তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বারা সমস্ত নবী ও রাসুলের ক্রমধারা সমাপ্ত করেছেন এবং দ্বীন ইসলামকে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বারা পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তার কিতাব কুরাআনুল কারীমে আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে মুতাওয়াতিরে ঘোষণা করেছেন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আর কোন নবী আবির্ভূত হবে না। তাই এই জনগণ যেন এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে যে, মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করবে, সে ভয়ানক মিথ্যাবাদী, মিথ্যা অপবাদকারী, দাজ্জাল, পথভ্রষ্ট, বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী, প্রতারক ও ধোঁকাবাজ। কেননা, এগুলো জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবিদের কাছে বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।

যেমন, আল্লাহ তাআলা ইয়ামানে নবুওয়াতের দাবীদার আসওয়াদ আনাসী আর ইয়ামামায় নবুওয়াতের দাবীদার মুসায়লামা কাযযাবের বিশৃঙ্খল অবস্থা ও অযৌক্তিক কথাবার্তা প্রকাশ করেন, যা দেখে সমস্ত জ্ঞানীগণ এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, উভয়ই মিথ্যাবাদী ও পথভ্রষ্ট। আল্লাহ তাআলা এই দুইজনের উপর এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা নবুওয়াতের দাবী করবে তাদের উপর লানত বর্ষণ করবেন। এমনকি প্রতিশ্রুত মসীহ দাজ্জালের উপরও এই লানত বর্ষিত হবে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যাদের উপর এই ধরণের অবস্থা প্রকাশ পাবে, উলামায়ে কিরাম এবং মুসলিম সমাজ তাদের দাবী মিথ্যা হওয়া সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন। (ইবন কাসির, তাফসীরুল কুরাআনিল কারীম, ৩য় খণ্ড)

আল্লামা যামাখশারী তার সুবিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ "আল-কাসশাফ" এ লিখেছেনঃ যদি তোমরা বলো - রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ নবী কিভাবে হলেন, অথচ ঈসা আলাইহিস সালাম শেষ যুগে অবতীর্ণ হবেন, তাহলে আমি বলবো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ নবী হওয়ার অর্থ এই যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আর কাকেও নবী পদে প্রতিষ্ঠিত করা হবে না। ঈসা আলাইহিস সালাম'কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে নবী বানানো হয়েছে। শেষ যুগে তিনি অবতীর্ণ হওয়ার পর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারী হবেন এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিবলার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করবেন, অর্থাৎ, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হবেন। (আল-কাশশাফ, ৩য় খণ্ড)

পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা, ইজমার সিদ্ধান্ত আর নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের পর্যালোচনার মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের সূচনা কাল থেকে অদ্যাবধি সারা দুনিয়ার মুসলমান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে আসছে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম "খাতামুন নাবিয়্যিন" অর্থাৎ সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর আর কোন নবী বা রাসুলের আগমন ঘটবে না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ দ্বীন ইসলামের পূর্ণতা সাধন করেছেন। ইসলাম ধর্মে নতুন করে সংযোজন বা বিয়োজনের সুযোগও নেই, প্রয়োজনও নেই। এটি দলমত নির্বিশেষে সব দেশের সব মুসলমানের সর্বসম্মত আকিদা ও বিশ্বাস। খতমে নবুওয়াতের আকিদা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত এবং দ্বীনকে যে অস্বীকার করবে সে কাফির।

সুতরাং কেউ যদি কোন কালে পয়গাম্বরী বা নবুওয়াত দাবী করে, তাহলে সে তখনই কাফির হয়ে যাবে, আর যারা তাকে নবী বলে বিশ্বাস করবে তারাও কাফির বলে বিবেচিত হবে। নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার ও তাদের অনুসারীরা মুসলমানদের কাছে মিথ্যাবাদী, দাজ্জাল ও পথভ্রষ্ট। এই ব্যাপারে মুসলিম উম্মতের কারো দ্বিমত নেই।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খতমে নবুওয়াতের আকিদা ও বিশ্বাস মুসলিম মিল্লাতের শক্তির উৎস আর জাতীয় সংহতির চাবিকাঠি। এর মাধ্যমে সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে অধিকতর সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে। এই মৌলিক বিশ্বাসের প্রতি সামান্যতম শৈথিল্য মুসলিম মিল্লাতের ঐক্য ও সংহতির প্রতি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মাদ ইকবালের সাহসী মন্তব্য প্রণিধানযোগ্যঃ

ইসলাম অপরিহার্যরূপে একটি ধর্মীয় বিধান - যার রয়েছে সুস্পষ্ট সীমারেখা, এটি হচ্ছে আল্লাহ'র একত্ব ও সর্বশক্তিতে বিশ্বাস, পূর্ববর্তী নবীদের উপর বিশ্বাস, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের পরিসমাপ্তির উপর বিশ্বাস। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সর্বশেষ পয়গাম্বর, মূলত এ বিশ্বাসই হলো পার্থক্যসূচক উপাদান, যা ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের মধ্যে স্থায়ী সীমারেখা চিহ্নিত করে এবং কোন ব্যক্তি বা গ্রুপ মুসলিম মিল্লাতের অংশ কিনা তাও মীমাংসা করে দিয়েছে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ, ভারতে ব্রহ্ম সমাজের সেবকগণ আল্লাহ'র অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে আল্লাহ'র নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাই বলে তাদেরকে মুসলমান বলা যায় না। কারণ কাদিয়ানীদের মতো তারাও নবীর সিলসিলা জারী আছে বলে বিশ্বাস করে আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সর্বশেষ পয়গাম্বর মানে না। আমার জানামতে ইসলামের এমন কোন সম্প্রদায় নেই, যারা এই সীমারেখা অতিক্রম করবার দুঃসাহস দেখায়। ইরানের বাহাই গোষ্ঠী অপরিহার্য এই আকিদাকে অস্বীকার করে, কিন্তু এই কথাও তারা স্বীকার করেছে যে, তারা ভিন্ন সম্প্রদায় এবং তারা মুসলমান জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়। আমরা বিশ্বাস করি যে, ইসলাম আল্লাহ'র পক্ষ থেকে নাযিলকৃত একটি ধর্ম, কিন্তু সামাজিক বিধান হিসেবে এর অস্তিত্ব রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহিমান্বিত ব্যক্তিত্বের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

আমার দৃষ্টিতে কাদিয়ানীদের জন্য এখন দুটো পথ খোলা আছে - হয় তারা বাহায়ীদের অনুসরণ করবে, অথবা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের আকিদাকে পরিপূর্ণ তাৎপর্য সহকারে মেনে চলবে এবং সাথে সাথে তাদেরকে ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা ভাষ্য পরিত্যাগ করতে হবে, কারণ এগুলো অভিসন্ধি সহকারে প্রণীত হয়েছিলো মুসলমানদের দলে থেকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। (ড. মুহাম্মাদ ইকবাল, হারফে ইকবাল; Sayyid Abul Hasan Ali Nadwi, Qadianism - A Critical Study)

 

ঈসা আলাইহিস সালামের পুনরাগমন

আল্লাহ তার বিশেষ কুদরতি ব্যবস্থায় ঈসা আলাইহিস সালাম'কে জীবন্ত অবস্থায় সশরীরে ঊর্ধ্বজগতে উঠিয়ে নিয়েছেন। ইয়াহুদীরা তাকে হত্যা করেছে বলে যে দাবী করে এবং খৃষ্টানরা তাকে শূলীবিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে যে বিশ্বাস করে, তার কোন ভিত্তি নেই। কুরআন মাজিদ উপরোক্ত দাবী ও ধারণা-কল্পনাকে অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছে।

"এবং তাদের (ইয়াহুদীদের) এই উক্তির জন্য যেঃ নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহ'র রাসুল ও মারইয়াম-পুত্র ঈসাকে হত্যা করেছি। অথচ তারা তাকে হত্যাও করতে পারে নাই আর ক্রুশবিদ্ধও করতে পারে নাই, বরং এটা তাদের জন্য সন্দেহজনক করে দেওয়া হয়েছে। আর যারা এই বিষয়ে মতভেদ করেছিলো, তারাও সংশয়ের মধ্যে রয়েছে, শুধু অনুমানের অনুসরণ ছাড়া এই বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই। এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করতে পারে নাই, বরং আল্লাহ তাকে তার কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ মহাশক্তিমান, অতিশয় প্রজ্ঞাবান।" (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ১৫৬-১৫৭)

ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ'র কুদরতে সশরীরে পৃথিবীতে কিয়ামতের আলামত হিসেবে পুনরাগমন করবেন। তিনি কিয়ামতের অপর আলামত দাজ্জালকে হত্যা করে পৃথিবীময় শান্তি স্থাপন করবেন আর সমগ্র পৃথিবীবাসীর মধ্যে দ্বীন ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন। আল্লাহ বলেনঃ

"নিশ্চয়ই সে কিয়ামতের একটি নিদর্শন।" (সূরাহ আয-যুখরুফ, ৪৩ : ৬১)

"আহলে কিতাবের মধ্যে এমন কেউ থাকবে না যে তার মৃত্যুর পূর্বে তার (ঈসা) উপর ঈমান আনবে না এবং কিয়ামতের দিন সে (ঈসা) তাদের (খৃষ্টানদের) সম্পর্কে সাক্ষী হবে।" (সুরাহ আন-নিসা, ৪ : ১৫৯)

পূর্বোক্ত ১৫৬-১৫৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, ইয়াহুদীরা ঈসা আলাইহিস সালাম'কে হত্যাও করতে পারেনি আর শূলীবিদ্ধও করতে পারেনি, বরং আল্লাহ নিজ ব্যবস্থাপনায় তাকে তার কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আর ৪ : ১৫৯ আয়াতে বলা হয়েছে যে, আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের লোকজন মৃত্যুর পূর্বে ঈসা আলাইহিস সালামের উপর ঈমান আনবে। অর্থাৎ, ৪৩ : ৬১ এবং ৪ : ১৫৯ আয়াত থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ঈসা আলাইহিস সালাম পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, ঈসা আলাইহিস সালাম ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে পৃথিবীতে পদার্পণ করবেন।

"সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ। অচিরেই তোমাদের মধ্যে মারইয়াম-পুত্র ঈসা আবির্ভূত হবেন ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে। তিনি ক্রুশ ধ্বংস করবেন, শুকর হত্যা করবেন, যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটাবেন এবং সম্পদের প্রাচুর্য হবে, এমনকি তা কেউই গ্রহণ করবে না।" (বুখারী - কিতাবুল আম্বিয়া, মুসলিম - কিতাবুল ঈমান, তিরমিযি - আবওয়াবুল ফিতান; ইবন মাজা - ফিতান, মুসনাদ আহমাদ - ২য় খণ্ড)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "কেমন হবে তোমাদের অবস্থা, যখন মারইয়াম-পুত্র তোমাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করবেন, আর তোমাদের মধ্যকার লোকই হবে তোমাদের শাসক।" (বুখারী - আম্বিয়া; মুসলিম - ঈমান)

আবদুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "মারইয়াম-পুত্র ঈসা পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন, এরপর বিয়ে করবেন এবং তার সন্তানও জন্মগ্রহণ করবে। তিনি পঁয়তাল্লিশ বছর জীবিত থাকবেন, এরপর মৃত্যুবরণ করবেন, এরপর আমার পাশে আমার কবরস্থানে সমাহিত হবেন।" (মিশকাতুল মাসাবিহ, বাব নুযুলি ঈসা, আল ফাসলুস সালিস)

আল কুরআনের উল্লিখিত আয়াত এবং উল্লিখিত হাদিসসমূহ থেকে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছয়শত বছর পূর্বে আগমনকারী নবী ঈসা আলাইহিস সালাম পুনরায় পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে দাজ্জালকে হত্যা করবেন আর সমগ্র ভুমণ্ডলে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন।

 

ঈসা আলাইহিস সালামের পুনরাগমন খতমে নবুওয়াতের প্রতিবন্ধক নয়

ঈসা আলাইহিস সালামের পুনরাগমন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ নবী হওয়ার প্রতিবন্ধক নয়। কারণ তিনি নবুওয়াতের নতুন দাবীদার হিসেবে আবির্ভূত হবেন না, বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিনিধি ও প্রধানত দাজ্জালকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আগমন করবেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন -

"নিশ্চয়ই তিনি (ঈসা) হবেন আমার পরে আমার উম্মতের মধ্যে আমার খলীফা।" (তাবারানীর বরাতে আদ-দুররুল মানসুর ফিত-তাফসীরিল মাসুর, ২য় খণ্ড)

অতএব, ঈসা আলাইহিস সালাম সমগ্র পৃথিবীতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খলীফা হিসেবে পুনরাগমন করবেন, নতুন নবী হিসেবে নয়। কারণ নবুওয়াতের পদ তো আগেই তাকে দান করা হয়েছে, তা বাতিল করা হয় নাই আর করা হবেও না। তার নবুওয়াতে ঈমান আনা আগেও যেমন ফরয (অপরিহার্য) ছিল, বর্তমানেও ফরয আর ভবিষ্যতেও ফরয থাকবে। কেউ তার নবুওয়াত অস্বীকার করলে মুসলিম উম্মতের গণ্ডিবহির্ভূত হয়ে যাবে। কারণ, কুরআন মাজিদের বাণী অনুসারে সকল নবী-রাসুলের উপর ঈমান আনা ফরয (অপরিহার্য)। (উদাহরণস্বরূপ দ্র. ২ : ২৮৬)

"ঈসা ইবনে মারইয়াম ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে অবতীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না।" (বুখারী - কিতাবুল মাজালিম; ইবন মাজা - কিতাবুল ফিতান)

"ইত্যবসরে, আল্লাহ তাআলা মারইয়াম-পুত্র মসীহকে প্রেরণ করবেন। তিনি দামিশকের পূর্ব অংশে সফেদ মিনারের সন্নিকটে একজোড়া পীতবর্ণের বস্ত্র পরিহিত অবস্থায় দুজন ফেরেশতার ডানায় তার হাত দুটো রেখে অবতরণ করবেন ...... এরপর তিনি দাজ্জালের পশ্চাদ্ধাবন করবেন এবং লুদ্দ এর দ্বারপ্রান্তে তার নাগাল পেয়ে তাকে হত্যা করবেন।" (মুসলিম - ফিতান; আবু দাউদ - মালাহিম; তিরমিযি - ফিতান; ইবন মাজা - ফিতান)

এখানে উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি হাদিস উপস্থাপন করা হলো। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশিষ্ট সাহাবীগণ কর্তৃক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ প্রসঙ্গে আরো অনেক সহিহ হাদিস বিদ্যমান রয়েছে। এসব হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রায় ছয়শত বছর আগে আবির্ভূত এবং মারইয়াম (আঃ) এর গর্ভে জন্মগ্রহণকারী হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম কিয়ামতের আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করে বিশ্বব্যাপী একটি কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম করবেন।

 

কুরআন মাজিদের আয়াতের ভ্রান্ত প্রয়োগ

বর্তমান যুগে পথভ্রষ্ট একটি সম্প্রদায় কুরআন মাজীদের কিছু আয়াতের অপব্যাখ্যা করে প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছে যে, কুরআন মাজীদে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরও নবী-রাসুল আগমনের ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী নন। যেমন, তারা নিন্মোক্ত আয়াত পেশ করে থাকেঃ

"হে আদম সন্তান, যদি তোমাদের মধ্য থেকে রাসুলগণ তোমাদের কাছে এসে আমার আয়াতসমূহ বিবৃত করে, তখন যারা সাবধান হবে আর নিজেদের সংশোধন করবে, তা হলে তাদের কোন ভয় থাকবে না আর তারা দুঃখিতও হবে না।" (সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ৩৫)

পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়টি বলে যে, উপরোক্ত আয়াতে সমগ্র মানজাতিকে সম্বোধন করে তাদের মধ্যে রাসুলগণের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে এবং তাদেরকে গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উপরোক্ত বক্তব্য বিভ্রান্তিকর প্রতারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। আলোচ্য আয়াতকে তার পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে উপরোক্ত মনগড়া মত রচনা করা হয়েছে। আসলে যে বক্তব্য পরম্পরায় উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়েছে, তা সূরা আল-আরাফের দ্বিতীয় রুকু থেকে চতুর্থ রুকুর মাঝামাঝি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বিবৃত হয়েছে। সর্বপ্রথম, দ্বিতীয় রুকুতে আদাম ও হাওয়ার ঘটনা বিবৃত হয়েছে এবং তৃতীয় ও চতুর্থ রুকুতে তার ফলাফলের উপর মন্তব্য করা হয়েছে। এই পূর্বাপর আলোচনা সামনে রেখে ৩৫ নং আয়াতটি পাঠ করলে পরিষ্কার জানা যায় যে, এখানে যে কথা বলা হয়েছে, তা আলমে আরওয়াহে সৃষ্টির সূচনাপর্বের সাথে সম্পর্কিত, কুরআন নাযিল কালের সাথে নয়। সৃষ্টির সূচনাপর্বেই আদম সন্তানদেরকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিলো যে, আল্লাহ'র পক্ষ থেকে যুগে যুগে তোমাদের জন্য যে হেদায়াতবাণী প্রেরণ করা হবে, তার অনুসরণ করার উপর তোমাদের আখিরাতের মুক্তিলাভ নির্ভরশীল। (বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুনঃ তাফসীরে তাবারী, ৮ম খণ্ড; রুহুল মাআনী, ৮ম খণ্ড; তাফসীর আল-খাযিন, ২য় খণ্ড)

"হে রাসুলগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎ কাজ করো, তোমরা যা করো সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।" (সূরাহ আল-মুমিনুন, ২৩ : ৫১)

একইভাবে, উপরোক্ত আয়াতকেও তার পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন না করা পর্যন্ত বিভ্রান্তিকর অর্থ গ্রহণ সম্ভব নয়। যে বক্তব্য প্রসঙ্গে আয়াতটি নাযিল হয়েছে, তা আলোচ্য সূরার দ্বিতীয় রুকু থেকে শুরু হয়ে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। উক্ত আয়াতসমূহে নূহ আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সমস নবী ও তাদের উম্মতের বিষয়ে আলোচনা করে বলা হয়েছে - প্রতিটি দেশে ও প্রতিটি যুগে নবী-রাসুলগণ মানবজাতিকে একটি শিক্ষাই দিতে থেকেছেন, তাদের পদ্ধতিও ছিল এক ও অভিন্ন এবং আল্লাহ তাদের উপর একই ধরণের অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। বিপরীতপক্ষে, পথভ্রষ্ট সম্প্রদায় হামেশা আল্লাহ'র পথ ত্যাগ করে পাপাচারে ও দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়েছে।

উপরোক্ত বর্ণনা প্রসঙ্গে আলোচ্য আয়াতটি কোনক্রমেই এই অর্থে নাযিল হয়নি - "হে রাসুলগণ, তোমরা যারা মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আসবে, তোমরা পাক-পবিত্র খাবার আহার করবে আর উত্তম কাজ করবে।" বরং আয়াতটির অর্থ হচ্ছে - নূহ আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত যতো নবী-রাসুল এসেছেন, তাদের সকলকে আল্লাহ একই নির্দেশ দিয়েছেন যে, "তোমরা পাক-পবিত্র খাবার গ্রহণ করো আর উত্তম কাজ করো।" কুরআনের ভাষ্যকার মুফাসসিরগণ কোন যুগে এবং কখনো উপরোক্ত আয়াতের এই তাৎপর্য গ্রহণ করেননি যে, নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরও কেউ নবুওয়াতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হবে। (দ্র. প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থাবলীতে উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যাধীন)

"আর কেউ আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করলে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, তাদের সঙ্গী হবে আর তারা কতই না উত্তম সঙ্গী।" (সুরাহ আন-নিসা, ৪ : ৬৯)

বিপথগামী সম্প্রদায় বলে যে, আল্লাহ ও রাসুলের অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ ও আনুগত্য করে যেমন সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ হওয়া সম্ভব, তেমনই তাদের নবী হওয়াও সম্ভব, উপরোক্ত আয়াত থেকে এটাই প্রমাণিত হয়। উপরন্তু, আয়াতে মাআ (مع) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার দ্বারা বুঝা যায়, তারা শুধু সঙ্গীই হবে না, নবী ইত্যাদিও হবে।

চৌদ্দশত বছরের দীর্ঘকালে কোন তাফসীরকারকই উপরোক্ত আয়াতের এই ধরণের উদ্ভট ব্যাখ্যা করেননি। আর মাআ (مع) শব্দটি কুরআনের যে স্থানে যে অর্থেই ব্যবহৃত হোক, কিন্তু এই আয়াতের শেষে রফিক (رفيقا) শব্দটি বলে দিচ্ছে যে, এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কিয়ামত পর্যন্ত জন্মগ্রহণকারী লোকেরা আয়াতোক্ত ব্যক্তিগণের সঙ্গী হবে, নবী বা রাসুল হবে না। (বিস্তারিত দেখুনঃ তাফসীর বাহরুল মুহীত, ৩য় খণ্ড; এবং অন্যান্য তাফসীর) উপরন্তু, সমগ্র মুসলিম উম্মাহ একমত যে, কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী ব্যক্তিগত সাধনার মাধ্যমে কখনো নবুওয়াত লাভ করা যায় না। এটা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ'র পক্ষ থেকে বিশেষভাবে দানকৃত (وهبي) মর্যাদা।

"আল্লাহ ফেরেশতাগণের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে রাসুলগণকে মনোনীত করেন।" (সূরাহ আল-হাজ্জ, ২২ : ৭৫)

আরো দ্র. ৭২ : ২৭

ইবনুল আরাবী বলেন,

"যে ব্যক্তি বলে, নবুওয়াত চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে অর্জন করা যায়, সে ভুল বলে। কারণ নবুওয়াত অকাট্য ও চূড়ান্তভাবেই আল্লাহ'র খাস জিনিস।" (আল-ইয়াওয়াকীত ওয়াল জাওয়াহির, ২য় খণ্ড)

হাদিসের বাণী থেকেও উল্লিখিত আয়াতের এই ব্যাখ্যাই পাওয়া যায়। যেমন, মুয়ায ইবনে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

"যে ব্যক্তি বরকতময় আল্লাহ'র রাস্তায় এক হাজার আয়াত তিলাওয়াত করবে, কিয়ামতের দিন তাকে নবীগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মপরায়ণ লোকদের দলভুক্ত করা হবে। আল্লাহ'র মর্জি তারা কতোই না উত্তম সঙ্গী।" (মুসনাদ আহমাদ, ৩য় খণ্ড)

আমর ইবন মুররা আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমি সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহ'র রাসুল। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ি, আমার মালের যাকাত দেই এবং রমযান মাসের রোযা রাখি।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "যে ব্যক্তি এই অবস্থায় মারা যাবে, সে কিয়ামতের দিন নবীগণের, পরম সত্যবাদীগণের ও শহীদগণের সঙ্গী হবে।" (আদ- দুররুল মানসুর ফিত-তাফসীরিল মাসুর, ২য় খণ্ড)

অতএব, উল্লিখিত আয়াতসমূহ থেকে মোটেই প্রমাণিত হয় না যে, মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন ব্যক্তি নবুওয়াত লাভ করবে। বিপরীতক্রমে, এর দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'ই হলেন কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির নবী ও রাসুল।

 

কিছু হাদিসের ভ্রান্ত প্রয়োগ

বর্তমান কালের পথভ্রষ্ট কিছু লোক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু হাদিসের অপপ্রয়োগ করে প্রমাণ করতে চায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী নন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরেও নবী আগমনের সুযোগ আছে। উদাহরণস্বরূপ এখানে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "নিশ্চয়ই আমি নবীগণের মধ্যে সর্বশেষ (নবী) এবং আমার মসজিদ হলো সর্বশেষ মসজিদ।" (মুসলিম - কিতাবুল হাজ্জ; নাসাঈ - কিতাবুল মাসাজিদ; কানযুল উম্মাল, ১২তম খণ্ড)

পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়টি বলে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদকে সর্বশেষ মসজিদ ঘোষণা করেছেন, অথচ এটাই সর্বশেষ মসজিদ নয়, এর পরও অসংখ্য মসজিদ নির্মিত হয়েছে আর হচ্ছে। একইভাবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেকে সর্বশেষ নবী বলে অভিহিত করেছেন। কাজেই অনিবার্যভাবে এটারও এই অর্থ হবে যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরেও নবী আসবে, যদিও মর্যাদায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদ সর্বশেষ মসজিদ।

উপরোক্ত বক্তব্যের উত্তরে বলা যায়, সহিহ মুসলিম, সুনান আন-নাসাঈ ও কানযুল উম্মাল গ্রন্থ তিনটির যে অধ্যায়ে ও অনুচ্ছেদে উক্ত হাদিস উধৃত হয়েছে, তার সবগুলো হাদিস একত্রে পাঠ করলে জানা যায় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদকে কোন অর্থে সর্বশেষ মসজিদ বলেছেন। এখানে উধৃত হাদিসগুলোর অর্থ এই যে, পৃথিবীতে তিনটি মসজিদই অন্যান্য সকল মসজিদের তুলনায় অধিক ফযিলত ও মর্যাদাপূর্ণ। সেগুলোতে সালাত আদায় করলে অন্যান্য মসজিদের তুলনায় বহু গুণ বেশী সওয়াব পাওয়া যায়। অন্যান্য সকল মসজিদে সালাত আদায়ের সওয়াব একসমান।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরোক্ত হাদিসের তাৎপর্য এই যে, মসজিদে নববী হলো একজন নবী কর্তৃক নির্মিত সর্বশেষ মসজিদ। কারণ তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আর কাকেও নবুওয়াতের পদে অভিষিক্ত করা হবে না। অতএব, এই মসজিদের পরে আর এমন কোন মসজিদ নির্মিত হবে না যার মর্তবা ও মর্যাদা তিনটি মসজিদের সমান হতে পারে। সুনান নাসাঈর ভাষ্যকার আল্লামা আবুল হাসান সিন্দী উপরোক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, "আখিরুল মাসাজিদ" অর্থাৎ সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ তিনটি মসজিদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নির্মিত মসজিদই সর্বশেষ মসজিদ অথবা নবীগণ কর্তৃক নির্মিত সর্বশেষ মসজিদ। (নাসাঈর পার্শ্বটিকা, ভারতীয় মুদ্রণ, ১ম খণ্ড)

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কর্তৃক বর্ণিত হাদিস থেকেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আমি নবীগণের মধ্যে সর্বশেষ এবং আমার মসজিদ নবীগণের মসজিদসমূহের মধ্যে সর্বশেষ মসজিদ।" (দায়লামী ও ইবনুন-নাজ্জারের বরাতে কানযুল উম্মাল, ভারতীয় মুদ্রণ, ৬ষ্ঠ খণ্ড; আলেপ্পো নং ১২তম খণ্ড)

 

খাতামুল আম্বিয়া বলো, শেষ নবী বলিও না

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, "তোমরা বলো, তিনিই খাতামুল আম্বিয়া, কিন্তু বলিও না যে, তার পরে আর কোন নবী নেই।" (তাফসীর আদ-দুররুল মানসুর, ৫ম খণ্ড; ইবন কুতায়বা, কিতাব তাবীল মুখতালিফিল আহাদিস; মাজমা বিহারিল আনওয়ার)

পথভ্রষ্ট সম্প্রদায় বলে যে, উপরোক্ত হাদিস থেকে প্রতিভাত হয় যে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা "খাতামুন নাবিয়্যিন" শব্দের যে অর্থ গ্রহণ করেছেন, তাতে প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরেও নবী আগমনের সুযোগ আছে।

মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র হাদিস বলে কথিত উপরোক্ত বক্তব্যের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনটি গ্রন্থের বরাতে উপরোক্ত বক্তব্য উধৃত হয়েছে, তাদের কোনটিতেই এর সনদ সূত্র উল্লেখ নেই এবং তা হাদিসের গ্রন্থও নয়। এটা সনদসূত্রবিহীন একটি মওযূ (বানোয়াট, মনগড়া) কথা, যা হাদিস জালকারীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র বক্তব্য হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। মনে হয় যুগে যুগে যারা নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার হয়েছে, এটা তাদেরই উদ্ভট রচনা।

কোন বক্তব্য যথার্থই হাদিস হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান শর্ত হলো - তার পূর্ণ সনদসূত্র বিদ্যমান থাকতে হবে এবং সনদের অন্তর্ভুক্ত রাবীগণকে বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী হতে হবে। এর ভিত্তিতে বলা যায়, উপরোক্ত বক্তব্যের কোন সনদসূত্রই নেই, রাবীগণের বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতার প্রশ্ন তো পরে। উপরন্তু আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বিশ্বস্ত সূত্রে বা সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আর কোন নবী নেই।

 

ইব্রাহীম জীবিত থাকলে নবী হতো

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুত্র ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর বললেন, "সে (ইব্রাহীম) জীবিত থাকলে পরম সত্যবাদী (সিদ্দীক) ও নবী হতো।" (সুনান ইবনে মাজা, কিতাবুল জানাইয)

বর্তমান যুগের নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদারগণ বলে থাকে যে, উপরোক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুত্র ইব্রাহীম বেঁচে থাকলে অবশ্যই নবী হতো। কেবল তার মৃত্যুই তার নবুওয়াত লাভের প্রতিবন্ধক হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরও নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। অন্যথায়, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, ইব্রাহীম জীবিত থাকলেও নবী হতো না।

উপরোক্ত যুক্তি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রথমত, এটি একটি যঈফ হাদিস, খতমে নবুওয়াতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এটি মোটেও দলীলযোগ্য নয়।

দ্বিতীয়ত, উপরোক্ত হাদিসের ঠিক পূর্বেকার হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুত্র ইব্রাহীম শিশুকালেই ইন্তেকাল করেন। তাকদির লিপিতে যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন ব্যক্তির নবী হওয়ার সিদ্ধান্ত থাকতো, তাহলে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুত্র জীবিত থাকতেন। কিন্তু আসল কথা হলো, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর আর কোন নবী আসবে না। (সুনান ইবনে মাজা, পূর্বোক্ত বরাত)

শুধু তাই নয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কেও বলেছিলেন, "আমার পর যদি কেউ নবী হতো, তাহলে খাত্তাবের পুত্র উমারই হতো সেই নবী।" (জামে আত তিরমিযি, আবওয়াবুল মানাকিব)

অতএব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুত্র ইব্রাহীম জীবিত না থাকায় নবী হতে পারেন নাই, যদি এই যুক্তি মেনে নেওয়া হয়, তবে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পরও বারো বছর জীবিত ছিলেন। তার নবুওয়াত লাভে কি অন্তরায় ছিল ?

নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদারগণ উপরোক্ত হাদিসের বিপরীতে আরো একটি জাল হাদিস পেশ করে - আমি যদি প্রেরিত না হতাম, তাহলে অবশ্যই হে উমার, তুমি প্রেরিত হতে। (মিরকাত শারহু মিশকাত, ৫ম খণ্ড)

অপর পাঠে আছে - আমি যদি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত না হতাম, তাহলে অবশ্যই উমার তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হতো। (ইবনে আদীর আল-কামিল, ২য় খণ্ড; হাফেজ মুনাবীর কুনূযুল হাকাইক ফি হাদিসি খায়রিল খালাইক এর বরাতে মিরকাত, ৫ম খণ্ড)

ফিরদাওস দায়লামীর গ্রন্থে এভাবে আছে - আমি প্রেরিত না হলে অবশ্যই আমার পরে উমার প্রেরিত হতো। (মিরকাত, ৫ম খণ্ড)

নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদারগণ বলে যে, উপরোক্ত হাদিস থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী হিসেবে প্রেরিত না হলে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী হিসেবে প্রেরিত হতেন। কিন্তু যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন, তাই উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু'র নবী হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না।

এর উত্তরে বলা যায়, যে কারণে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পক্ষে নবুওয়াত লাভ সম্ভব হয়নি, ঠিক একই কারণে ভবিষ্যতেও কারো নবুওয়াত প্রাপ্তি সম্ভব না। অতএব, এই হাদিস থেকেও খতমে নবুওয়াতের পক্ষেই সমর্থন পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, একাধিক কারণে হাদিসটি গ্রহণযোগ্য নয়। হাদিস বিশারদগণের মতে বিভিন্ন সূত্রে শাব্দিক পার্থক্যসহ বর্ণিত উপরোক্ত হাদিস বাতিল, মিথ্যা ও জাল (মাওদু)। আল্লামা ইবনুল জাওযী তার আল-মাওদুয়াত গ্রন্থে দুটি সনদসূত্রে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন এবং উভয় সনদে জাল হাদিস রচনাকারী রাবী থাকায় তিনি সেটাকে জাল হাদিসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেন, রাবী যাকারিয়া ইবন ইয়াহইয়া কাযযাব (চরম মিথ্যাবাদী) এবং জাল হাদিস রচনাকারী। আর রাবী আবদুল্লাহ ইবন ওয়াকিদ হাদিস বিশারদগণের মতে পরিত্যাক্ত (মাতরুক)।

আল্লামা যাহাবী তার মিযানুল ইতিদাল গ্রন্থে ইবন আদীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এভাবেঃ প্রথম সনদের রাবী যাকারিয়্যা জাল হাদিস রচনা করে। আর সালেহ বলেন, সে ডাহা মিথ্যুকদের অন্যতম।

ইবনুল জাওযী ও জুযজানীর মতে রাবী আবদুল্লাহ ইবন ওয়াকিদ আল-হাররানী পরিত্যাক্ত (মুনকার)। মীযানুল ইতিদাল গ্রন্থে ইয়াকুব ইবন ইসমাঈল তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছেন।

ফিরদাওস দায়লামী কর্তৃক বর্ণিত সনদসূত্রও জাল। ইমাম যাহাবী বলেন, ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল বলেছেন, রাবী ইসহাক ইবন নাজীহ আল-মালাতী চরম মিথ্যাবাদী (কাযযাব)। ইয়াহইয়া বলেন, সে মিথ্যাচারে ও জাল হাদিস রচনায় কুখ্যাত, অপর রাবী আতা ইবন মায়সারা আল-খুরাসানীর অবস্থাও তদ্রূপ। তাহযীবুত তাহযীব গ্রন্থে উল্লেখ আছে, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব তাকে মিথ্যাবাদী আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম বুখারী তার আত-তারীখুস সাগীর গ্রন্থে এই কথা উল্লেখ করেছেন আর বলেছেন, তার সমস্ত বর্ণনাই বিশৃঙ্খল ও উল্টাপাল্টা। অতএব, হাদিস নামে কথিত উপরোক্ত বক্তব্য বাতিল ও মিথ্যা।

 

আমার পরে আবু বকর সর্বোত্তম

নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদারগণ তাদের মনগড়া মতের সমর্থনে আরো একটি হাদিস পেশ করে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "এই উম্মতের মধ্যে আবু বকরই সর্বোত্তম ব্যক্তি, কিন্তু নবী ব্যতীত।" (আল্লামা মুনাবীর কুনূযুল হাকাইক ফি হাদিসি খাইরিল খালাইক)

"আমার পরে মানুষের মধ্যে আবু বকরই সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু নবী ব্যতীত।" (কানযুল উম্মাল, ৯ম খণ্ড; আল্লামা সুয়্যুতির আল জামিউস সগীর গ্রন্থের বরাতে তাবারানী ও আল-কামিল)

নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারেরা الا ان يكون نبي এর অর্থ করেঃ কিন্তু ভবিষ্যতে কেউ নবী (এই উম্মতের মধ্যে) হলে তার তুলনায় উত্তম নয়। এ বাক্য দিয়ে (তাদের মতে) প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরেও নবী আসবে।

হাদিসের উপরোক্ত ধরণের ভ্রান্ত অনুবাদ পাঠ করলে কুরআন হাদিসের জ্ঞান বর্জিত যে কোন মুসলমান বিভ্রান্ত হতে পারে। "ভবিষ্যতে কোন নবী আসবে" এরূপ কথা হাদিসে বলা হয়নি। আর বর্তমান-ভবিষ্যৎ জ্ঞাপক ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হলেই সেটার ভবিষ্যৎ জ্ঞাপক অর্থ গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়।

হাদিসের মূল বক্তব্য হলো, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সমগ্র মানবজাতির মধ্যে মর্যাদায় সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু নবী-রাসুলগণ ব্যতীত। অর্থাৎ, নবী-রাসুলগণের মর্যাদা সকল মানুষের ঊর্ধ্বে। উপরোক্ত হাদিসে "এই উম্মতের মধ্যে" এবং "আমার পরে" বাক্যাংশ কখনো এটা নির্দেশ করে না যে, কেবল এই উম্মতের মধ্যেই আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সর্বশ্রেষ্ঠ এবং পূর্ববর্তী উম্মতগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নন, বরং নবী-রাসুলগণ ব্যতীত গোটা মানবজাতির মধ্যে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ।

আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "নবীগণ ও রসূলগণের পর আবু বকর ও উমারের তুলনায় শ্রেষ্ঠ এমন কোন ব্যক্তির উপর দিয়ে কখনো সূর্য উদিত হয়নি আর অস্তও যায়নি।" (কানযুল উম্মাল, ১৩ খণ্ড)

কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তিলাওয়াত করতেন -

"যখন আমি নবীগণের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম আর তোমার কাছ থেকেও আর নূহের কাছ থেকেও" (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৭)

- তখন বলতেন, "আমাকেই সর্বপ্রথম নবুওয়াত দান করা হয়েছিলো, কিন্তু প্রেরণের দিক থেকে আমি সকলের শেষে এসেছি।" (মুসান্নাফ ইবন আবি শায়বা, ১৩ তম খণ্ড; তাফসীর তাবারী, ২১ তম খণ্ড; আদ-দুররুল মানসুর, ৫ম খণ্ড)

উপরোক্ত হাদিস থেকে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে অনাদি কালে সর্বপ্রথম নবুওয়াত দান করা হয় এবং সর্বশেষে নবী হিসেবে মানবজাতির মধ্যে পাঠানো হয়। অর্থাৎ, তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানবজাতির জন্য সর্বশেষ নবী ও রাসুল এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আর কোন নবী বা রাসুল নেই।

আলী ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বলতে শুনেছি, "এই উম্মতের মধ্যে এই উম্মতের নবীর পরে সর্বোত্তম মানুষ আবু বকর ও উমার।" (কানযুল উম্মাল, ১৩ তম খণ্ড, দায়লামীর বরাতে; আরো দ্রষ্টব্য হিলয়াতুল আউলিয়ার বরাতে)

উপরোক্ত হাদিসে বলা হয়েছে, "এই উম্মতের নবীর পরে"। প্রশ্ন হলো, এই উম্মতের নবী কে ? নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উম্মতের নবী। উপরন্তু একবচনের শব্দ (নবী) ব্যবহৃত হয়েছে, বহুবচনের (আম্বিয়া) শব্দ নয়। অতএব, الا ان يكون نبي -এ "ইয়াকুনু" ক্রিয়াপদটি ভবিষ্যৎকাল জ্ঞাপক নয়, সাধারণ অর্থে জ্ঞাপক। অর্থাৎ, যে কোন নবী বা রাসুলের মর্যাদা সর্বাবস্থায় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মর্যাদার ঊর্ধ্বে।

পরিশেষে বলা যায়, হাদিস বিশারদগণ আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সংক্রান্ত উপরোক্ত হাদিস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন - "এটা সেসব হাদিসের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।" মুনকার হাদিস কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।

 

নতুন নবী আগমনের প্রেক্ষাপট

বিশেষ প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তাআলা কোন বিশেষ ব্যক্তিকে নবুওয়াত দান করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। সেই প্রেক্ষাপট যখন উপস্থিত হয়, কেবল তখনই আল্লাহ তাকে প্রেরণ করেন এবং যখন প্রয়োজন হয় না বা থাকে না, তখন তিনি অকারণে নবী- রাসুল প্রেরণ করেন না। কোন প্রেক্ষাপটে মহামহিম আল্লাহ নবী-রাসুল প্রেরণ করে থাকেন তা যদি আমরা কুরআন মাজিদের আলোকে জানতে চাই, তবে সেখানে এই ধরণের নিন্মোক্ত পাঁচটি অবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়ঃ

(১) কোন বিশেষ জাতির মধ্যে কখনো নবী-রাসুল আগমন করেনি এবং অপর জাতির মধ্যে প্রেরিত নবীর বাণীও তাদের কাছে পৌঁছেনি।

(২) সংশ্লিষ্ট জাতি ইতিপূর্বে তাদের মধ্যে প্রেরিত নবীগণের শিক্ষা বিস্মৃত হলে অথবা তা চরমভাবে বিকৃত হলে, যার ফলে ঐ শিক্ষা থেকে হেদায়াত লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

(৩) ইতিপূর্বে প্রেরিত নবীগণের মাধ্যমে সার্বিক জীবনব্যবস্থার শিক্ষা মানবজাতির জন্য পূর্ণতা ও পূর্ণাঙ্গতা লাভ করতে পারেনি।

(৪) কোন নবীর সাথে তার সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আরো নবী-রাসুল প্রেরণের প্রয়োজন হলে।

(৫) নবীর শিক্ষা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তা মানব জাতির কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো উপযুক্ত মানবগোষ্ঠী বিদ্যমান না থাকলে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে কোন নতুন নবী প্রেরণের প্রেক্ষাপট বিদ্যমান নেই -

(১) কুরআন মাজীদ স্পষ্ট ভাষায় বলে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সমগ্র মানবজাতির জন্য নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে (দেখুন- ৩৪ : ২৮, ৩৩ : ৪৫, ৯ : ৩৩, ৪৮ : ২৮, ৬১ : ৯ ইত্যাদি)। এখন আর কোন জাতির মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে নবী প্রেরণের প্রয়োজন নেই।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আমাকে সমগ্র সৃষ্টিকুলের রাসুল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে এবং আমার দ্বারা নবীগণের পরিসমাপ্তি করা হয়েছে।" (তিরমিযি - আবওয়াবুস সিয়ার; মুসলিম - কিতাবুল মাসাজিদ; মুসনাদে আহমাদ - ২য় খণ্ড)

(২) কুরআন মাজীদ এ কথা বলে এবং একই সাথে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস ও সিরাতের যাবতীয় বিবরণও এই কথার সাক্ষ্য প্রদান করে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা সর্বাঙ্গীণভাবে নির্ভুল ও নির্ভেজাল আকারে সংরক্ষিত আছে। এর কোনরূপ বিকৃতি বা রদবদল ঘটেনি। যে কুরআন মাজিদ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর নাযিল হয়েছিলো, তার মধ্যে আজ পর্যন্ত একটি শব্দেরও হ্রাস-বৃদ্ধি হয়নি। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তত্ত্বাবধানে লিপিবদ্ধ কপির হুবহু যে নকল বা সংকলন চতুর্থ খলীফা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র শাসনামলে তারই নির্দেশে তৈরি করা হয়েছিলো, তার সাতটি কপি এই একবিংশ শতকেও পৃথিবীর বিভিন্ন যাদুঘরে অত্যন্ত সযত্নে সংরক্ষিত আছে। কি আশ্চর্য ! সাতটি কপির মধ্যে বিন্দু পরিমাণও বৈপরীত্য নেই এবং বর্তমান কালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত মুদ্রিত ও হাতে লিখিত কুরআনের সাথেও এর কোন বিরোধ নেই। অনন্তর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথা ও কাজের মাধ্যমে যেসব নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাও এমন অবয়বে বিদ্যমান আছে, যেন আমরা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুগেই বাস করছি। অতএব, দ্বিতীয় প্রয়োজনও অবশিষ্ট নেই।

(৩) কুরআন মাজিদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে মানবজাতির বিশ্বজনীন ধর্ম ইসলামকে পূর্ণতা দান করা হয়েছে (দেখুন - ৫ : ৩)। তাই দ্বীনের পূর্ণতার জন্যও এখন আর নবী প্রেরণের প্রয়োজন নেই।

(৪) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য যদি নবী প্রেরণের প্রয়োজন থাকতো, তবে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুগেই এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথেই তাকে প্রেরণ করা হতো।

(৫) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন এবং বিদায় হজ্জে কুরবানির দিন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাষণে বলেন - "শোন, উপস্থিতরা যেন অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়।" (বুখারী - কিতাবুল ইলম; মুসলিম - হাজ্জ; তিরমিযি - হাজ্জ; নাসাঈ - হাজ্জ; ইবন মাজা - মুকাদ্দিমা; সুনান আদ-দারিমী - মানাসিক)

অতএব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা সমগ্র মানবজাতির কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য সকল যুগে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মত সদা তৎপর ছিলেন এবং বর্তমান কালে এই তৎপরতা অত্যন্ত জোরালোভাবে বিশ্বজনীনতা লাভ করেছে। দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে। তাই নবী আগমনের পঞ্চম প্রেক্ষিতও বিদ্যমান নেই।

তাই, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আর কোন নবী নেই।

হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মুসলিম উম্মাহ শতধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সুদূরপরাহত, তারা দ্বীন ইসলামের আদর্শ থেকে আশংকাজনকভাবে বিচ্যুত হয়েছে আর তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। তাই তাদের সংস্কারের জন্য একজন নবীর আবির্ভাব অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

এ কথা সত্য যে, মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন দল-উপদলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রভাবে তাদের মধ্যে ভ্রস্টতা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সাথে সাথে এ কথাও সত্য যে, তারা শতধা বিচ্ছিন্ন হলেও ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসসমূহে , যা দ্বীন ইসলামের মূল ভিত্তি, অপরিহার্য মৌলিক ইবাদাতে এবং স্পষ্ট হালাল-হারামের ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনকভাবে তারা ঐক্যবদ্ধ এবং এই ক্ষেত্রে ভ্রষ্টতা তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে নাই। যেহেতু মূল বিষয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ, তাই তাদের মধ্যে অচিরেই এক উম্মাহ ভিত্তিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে এবং তার আভাষও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিটি জাতির ইতিহাসেই উত্থান-পতন রয়েছে। আজ হয়তো মুসলিম উম্মতের পতন যুগ, কিন্তু তার উত্থান যুগেরও সূচনা হয়েছে।

তাই মুসলিম উম্মতের বিশ্বাসের ঐক্য এবং ঐক্যের ভিত্তি আল-কুরআনের হুবহু বিদ্যমানতায় নতুন কোন নবীর আগমনের প্রয়োজন নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'ই কিয়ামত কাল পর্যন্ত মানবজাতির সর্বশেষ নবী ও রাসুল।

 

সূত্রঃ সিরাত বিশ্বকোষ ১৪তম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-44

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী মতবাদ – ১

 

 

 

The Greatest Nation·Monday, February 11, 2019

 

 

 

খতমে নবুওয়াত নিয়ে আলোচনা ও পুস্তক রচনার কারণ যেহেতু মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর দাবী ও তার নানাবিধ উক্তি - তার দাবী ও উক্তিগুলো এতোই পরস্পর বিরোধী যে, তার অনুসারীরাও তার দাবী সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারণা করতে সক্ষম হচ্ছে না। কোন কোন সময় মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য মীর্জা কাদিয়ানীর এ সমস্ত উক্তি উপস্থাপন করা হয়, যাতে খতমে নবুওয়াতের স্বীকৃতি রয়েছে এবং তার ব্যাখ্যাও ঠিক তাই বর্ণনা করা হয়, যা মুসলিম উম্মাহ'র আকিদাহ। এ সমস্ত উপস্থাপন করে অজ্ঞ মুসলমানদেরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করা অথবা প্রয়োজনানুযায়ী স্বীয় জামাআতকে ইসলামী মিল্লাতের সাথে সংযুক্ত করা ছাড়া এর আর কোন উদ্দেশ্যই থাকতে পারে না। অথচ সে ব্যাখ্যা নিশ্চিতভাবেই বাস্তব অবস্থার বিরোধী। এজন্য খতমে নবুওয়াত সম্পর্কে দলীল-প্রমাণ আর "খাতামুন নাবিয়্যিন" এর উপর বিস্তারিত আলোচনা পেশ করার পূর্বে মীর্জা কাদিয়ানী ও তার প্রতিনিধিদলের আসল বর্ণনার দ্বারা খতমে নবুওয়াত সম্পর্কে প্রকৃত চিন্তা ও বিশ্বাস কি, তা প্রকাশ করা আবশ্যক। এরপর উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রতি তাদের ব্যবহার ও আচরণ পর্যায়ে তাদের কোটি কোটি বাক্য ও উক্তি উদ্ধৃত করে প্রাসঙ্গিক আলোচনা শেষ করা যাবে।

খতমে নবুওয়াত সংক্রান্ত বিশ্বাস ও অবিশ্বাস , খতমে নবুওয়াতের অর্থ আর নবুওয়াত ও ওহীর দাবী সম্পর্কে মীর্জা সাহেবের উক্তিগুলোর মধ্যে যদি কোন যৌক্তিকতা ও সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়, তবে তা শুধু এভাবেই হতে পারে যে, তাকে বিভিন্ন জীবনকাল ও বিভিন্ন যুগের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে স্বীকার করে নিতে হবে। এতে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যাবে যে, এ বিষয়ে মীর্জা সাহেবের উপর দিয়ে তিনটি অধ্যায় অতিবাহিত হয়েছে -

প্রথম অধ্যায়ঃ তার জীবনের প্রথম অধ্যায় হলো, যখন মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী সমস্ত মুসলমানের মতোই একজন মুসলমান ছিলেন, আর উম্মতে মুহাম্মাদীর সম্মিলিত বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির কোন নতুন ব্যাখ্যা বা এতে কোন পরিবর্তন ও বিকৃতি ছাড়াই মেনে নিতেন, ইসলামের একজন প্রচারক হিসেবে কিছু কিছু লিখতেনও।

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি কিছু দাবী পেশ করা শুরু করেন, আর এতে তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হোন। প্রথমে মুজাদ্দিদ ও পরে মাহদি হওয়ার দাবী করেন, এমনকি পূর্ব ঘোষিত মাসীহ হওয়ারও দাবী করেন। এখানে পৌঁছে চিন্তা করতে বাধ্য হলেন যে, পূর্ব ঘোষিত মাসীহ আল্লাহ তাআলার প্রিয় ও সম্মানিত রাসুল, নবী এবং ওহীপ্রাপ্ত ছিলেন। খতমে নবুওয়াতে বিশ্বাস থাকা অবস্থায় কোন নতুন ব্যক্তির পক্ষে পূর্ব ঘোষিত মসীহ হওয়ার দাবি খতমে নবুওয়াতের পরিপন্থি। ঐ সময় তিনি খতমে নবুওয়াতের অর্থ পরিবর্তন করা শুরু করেন। নবুওয়াতের কৃত্রিম প্রকার, শরীআতী, শরীআতবিহীন, যিল্লী, বরোজী, আক্ষরিক আর নকল প্রভৃতি বর্ণনা করে খতমে নবুওয়াতের সঠিক ও প্রকৃত প্রয়োগে সন্দেহ প্রবেশ করানোর চেষ্টা করেন আর স্বীয় চিন্তাপ্রসূত নবুওয়াতের বিভিন্ন প্রকারের মধ্য থেকে কোন কোন প্রকার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর চালু থাকবে বলে ঘোষণা করেন আর নিজেকে ঐ সমস্ত নবী বলে দাবি করেন।

তৃতীয় অধ্যায়ঃ তৃতীয় অধ্যায় হলো, যখন খতমে নবুওয়াতের ব্যাখ্যা ও পরিবর্তন থেকে মুক্ত হয়ে নবুওয়াতের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে কোন পার্থক্য না করে শরীআতবিহীন ক্রমধারা ঘোষণা করেন আর নিজেকে শরীআতযুক্ত নবী বলে দাবি করেন।

এখানে উপরিউল্লিখিত বর্ণনার সত্যতা মীর্জা সাহেবের স্বীয় রচনা ও তার দ্বিতীয় খলীফার কিছু প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রমাণ করা হলো।

 

প্রথম অধ্যায়

 

নবী ও রাসুলের সংজ্ঞা (১৮৯১ খৃ.)

(১) ইসলামী পরিভাষায় নবী ও রাসুলের অর্থ হলো, তিনি পূর্ণাঙ্গ শরীআত নিয়ে প্রেরিত হয়ে থাকেন, অথবা পূর্ববর্তী শরীআতের কোন অংশ বিলুপ্ত করে থাকেন। পূর্ববর্তী নবীর উম্মত হিসেবে পরিচিত হবেন না, আর কোন নবীর কাছে থেকে কোনরূপ ফায়দা লাভ করা ছাড়াই সরাসরিভাবে আল্লাহ'র সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। (পত্র মসীহ মাওঊদ, ১৭ই আগস্ট, ১৮৯১ খৃ. বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৪৫)

(২) যেরূপ এই উম্মতের মধ্যে ঈসা আলাইহিস সালামের নবী হিসেবে অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে প্রদত্ত দলীল-প্রমাণ স্বরূপ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

ক. নবী ও উম্মত হওয়া পরস্পর বিরোধী (বিতর্ক, পর্যালোচনাঃ পৃ. ৮, রাওয়ালপিন্ডি)

খ. একই সাথে রাসুল ও উম্মত হওয়া পরস্পর বিরোধী। (ইজালা ওহাম, পৃ. ৫৭৫, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৪৬)

(৩) "মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহ'র রাসুল ও নবীগণের ক্রমধারা সমাপ্তকারী।" (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৪০)

তোমরা কি জানো না, অনুগ্রহকারী রব্ব আমাদের নবীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবীগণের ক্রমধারা সমাপ্তকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) "আমার পরে কোন নবী নেই" বলে উক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। (হামামাতুল বাশরী, পৃ. ২০, রচয়িতা মীর্জা গোলাম আহমাদ, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৪৭)

(৪) কুরআনে খতমে নবুওয়াত কথাটি বিস্তারিত ও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। অতএব, পুরনো বা নতুন নবী বলে কোনরূপ পার্থক্য করা মারাত্মক অপরাধ। হাদিস "আমার পরে নবী নেই" - এর মধ্যে "لا" শব্দটি নাবাচক। (আইয়ামিস সুলহি, পৃ. ১৪৬, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৪৭)

(৫) তুমি কি জানো না, পরম করুণাময় রব্বুল আলামীন কোনরূপ বাদ-ব্যতিক্রম ছাড়াই আমাদের নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) "খাতামুন নাবিয়্যীন" নামকরণ করেছেন আর আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যাখ্যা অভিলাষীদের জন্য "আমার পরে কোন নবী নেই" বলে উক্ত কথার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দান করেছেন। এক্ষণে আমরা যদি আমাদের নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর অন্য কোন নবীর আবির্ভাব বৈধ বলে মেনে নেই, তাহলে ওহী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় তার দুয়ার খোলা বৈধ বলে মেনে নেওয়া হবে। কিন্তু এটি সঠিক নয়, যেমন মুসলিম সমাজে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ঈমান ও আকিদার সাথে জড়িত। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর ওহী বন্ধ হয়ে গিয়েছে আর আল্লাহ তাআলা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর নবীদের ক্রমধারা সীলমোহর করে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় আমাদের নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর আবার কি করে নবী আসতে পারে ? (হামামাতুল বাশরী, পৃ. ৩৪, মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী)

(৬) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আমার পরে কোন নবী আসবে না", এবং হাদিস "لا نبي بعدي" এরূপ প্রসিদ্ধ যে, এর শুদ্ধতার ব্যাপারে কোনরূপ মতদ্বৈধতার অবকাশ নেই। কুরআন মাজীদের প্রতিটি শব্দ অকাট্য, আর কুরআনের আয়াত - "وَلَـٰكِن رَّسُولَ اللَّـهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ" - এই বিষয়টির সত্যতা প্রমাণিত করেছে যে, প্রকৃতপক্ষে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বারা নবুওয়াতের ক্রমধারা পরিসমাপ্ত করা হয়েছে। (কিতাবুল বারীয়া, পৃ. ১৮৪, হাশিয়া, মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী)

(৭) সকল জ্ঞানী ব্যক্তি এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন যে, যদি আল্লাহ তাআলা তার অঙ্গীকারে সত্যবাদী হোন, তাহলে যে আয়াতে খাতিমুন নাবিয়্যীন সম্পর্কে অঙ্গীকার করা হয়েছে আর যে সমস্ত হাদিসে বিস্তারিতভাবে এ কথা বর্ণনা করা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর সব সময়ের জন্য জিবরীল আলাইহিস সালামের ওহী নিয়ে অবতীর্ণ হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এ সমস্ত কথা যদি সত্য ও সঠিক হয়, তাহলে এরপর কোন ব্যক্তিই আমাদের নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর রাসুল হিসেবে কখনো আসতে পারে না। (ইজালায়ে ওহাম, পৃ. ৫৭৭, মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী)

(৮) কুরআনে কারীম খাতিমুন নাবিয়্যীনের পর কোন রাসুলের আগমন জায়েয রাখেনি - সে নবী নতুন হোক কি পুরনো। কেননা, রাসুলের ইলমে দ্বীন জিবরীল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে মিলে থাকে। এখন রিসালাতের ওহী নিয়ে জিবরীল আলাইহিস সালামের নাযিল হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এরপর রাসুল আসবেন কিন্তু রিসালাতের ওহী আসবে না - তা অসম্ভব। (ইজালায়ে ওহাম, পৃ. ৭৬১, গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী)

(৯) রাসুলের বাস্তবতা ও প্রকৃতির মধ্যে এটিও অন্তর্ভুক্ত যে, নবীগণ ইলমে দ্বীন জিবরীল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে লাভ করবেন। এখন এটা প্রমাণিত হয়েছ যে, এখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত ওহী আসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। (ইজালায়ে ওহাম, পৃ. ৬১৪, গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী)

(১০) এ কথা স্পষ্ট যে, খাতিমুন নাবিয়্যীনের পর রিসালাতের ওহী নিয়ে পৃথিবীতে জিবরীলের আগমন পুনরায় শুরু হবে এবং পবিত্র কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক কথাবার্তা নিয়ে একটি নতুন কিতাব গড়ে উঠবে - তা অসম্ভব। আর যার দরুন কোন অসম্ভবকে মেনে নিতে হয়, তা চিরকালের জন্য অসম্ভব। (ইজালায়ে ওহাম, ২খ, পৃ. ৫৮৩)

(১১) খাতিমুন নাবিয়্যীনের পরে কোন নবী প্রেরণ করা এবং দ্বিতীয়বার নবুওয়াতের ক্রমধারা নতুন করে শুরু করা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মাহাত্মের পরিপন্থি। কেননা, এর পূর্বেই নবুওয়াতের ক্রমধারাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। (আয়নায়ে কামালাতে ইনসান, পৃ. ২৭৭, মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী)

(১২) এ সমস্ত বিষয়ে (খতমে নবুওয়াত ও খাতিমুল আম্বিয়া) অন্যান্য আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতো আমার মাযহাবও একই। এখন উপরিউল্লিখিত বিষয়ের উপর আমি আল্লাহ'র এই ঘরে (জামে মসজিদ, দিল্লী) মুসলমানদের সামনে স্পষ্ট স্বীকার করছি যে, খাতিমুল আম্বিয়া (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বারা নবুওয়াত খতম হয়ে যাওয়ার প্রতি আমি বিশ্বাসী এবং যে ব্যক্তি খতমে নবুওয়াতকে অস্বীকার করে, তাকে বেদ্বীন ও ইসলামের গণ্ডি থেকে বাইরে মনে করি। (১৮৯১ সালের ২৩শে অক্টোবর দিল্লীর জামে মসজিদের এক সভায় মীর্জা গোলাম আহমাদের লিখিত ভাষণ, তাবলীগে রিসালাত, ২খ. পৃ. ২৪)

(১৩) আমরাও "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" তে বিশ্বাসী, এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খতমে নবুওয়াতের প্রতিও বিশ্বাসী। আমরা নবুওয়াতের দাবিকারীদের প্রতি লানত বর্ষণ করি। (ইশতেহার, মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী, ২০ শাবান, তাবলীগে রিসালাত, পৃ. ২)

(১৪) আমি নবুওয়াতের দাবি করে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবো আর কাফিরদের জামাআতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো - তা আমার জন্য শোভন নয়। (হামামাতুল বাশরী, পৃ. ৯৬)

 

দ্বিতীয় অধ্যায় (১৮৯৯ খৃষ্টাব্দের পরে)

 

নবীর সংজ্ঞার পরিবর্তন

(১৫) এখন থেকে মুহাম্মাদী নবুওয়াত ছাড়া সমস্ত নবুওয়াত বন্ধ। শরিআত নিয়ে কোন নবী আসবেন না। তবে শরিআত ছাড়া নবী আসতে পারেন, কিন্তু তাকে পূর্ববর্তী নবীর উম্মত হতে হবে। তাই এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি উম্মতও, আর নবীও। (তাজাল্লীয়াতে ইলাহীয়া, পৃ. ২৫, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩০)

 

খতমে নবুওয়াতের অর্থে পরিবর্তন আর অনুচ্চ ধ্বনিতে নবুওয়াত

(১৬) বর্তমান যুগে নবী শব্দটির অর্থ শুধু এই যে, কোন ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সাথে কথোপকথন ও আলাপচারিতার মর্যাদা লাভা করবে এবং দ্বীন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নির্দেশিত হবে। কোন নতুন শরীআত নিয়ে আসবে, তা নয়। কেননা, শরীআত নাযিল হওয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে শেষ হয়ে গিয়েছে। (তাজাল্লীয়াতে ইলাহীয়া, পৃ. ৯, হাশিয়া বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১২০)

(১৭) নবী ও রাসুল ছাড়া তোমরা কিভাবে সেসব নিয়ামত পেতে পারো ? সুতরাং তোমাদেরকে ইয়াকীন ও মুহাব্বাতের উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছবার জন্য আল্লাহ'র নবী সময় সময় আসা প্রয়োজন, যাদের মাধ্যমে তোমরা ঐসব নিয়ামত লাভ করবে। এখন তোমরা কি আল্লাহ'র বিরোধিতা করবে আর তার প্রাচীন নিয়মকে ভঙ্গ করবে ? (বক্তৃতা, শিয়ালকোট, পৃ. ৩২, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ৩)

(১৮) ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে গায়বের সাথে সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী সমাজে প্রচারকারীকে নবী বলা হয়। (ভাষণ, হুজ্জাতুল্লাহ, পৃ. ২, আল-হিকাম, ২মে, ১৯০৮, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১২১)

(১৯) দুর্ভাগ্যবশত নবীর প্রকৃত অর্থ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। নবী অর্থ হলো, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে বাণী পাওয়া এবং কথোপকথন ও সম্বোধনের মর্যাদা লাভ করা। শরীআত নিয়ে আসা তার প্রয়োজন নেই এবং শরীআতওয়ালা রাসুলের অনুসরণ করবে, তা-ও অপ্রয়োজনীয়। (দামিমা বারাহীন পঞ্চম, পৃ. ১৩৮, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩১)

(২০) আমার মতে নবী তাকেই বলা হয়, যার প্রতি আল্লাহ তাআলার বাণী অকাট্য ও স্পষ্টভাবে অবতীর্ণ হয়, যা গায়বের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য আল্লাহ তাআলা আমার নাম নবী রেখেছেন, যদিও শরীআতবিহীন। (তাজাল্লীয়াতে ইলাহীয়া, পৃ. ২৬, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩২)

(২১) আমি কোন নতুন নবী নই, আমার পূর্বে শত শত নবী এসেছেন। (আল-মুহকাম, ১০ই এপ্ল্রিল, ১৯০৮, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩৩)

(২২) এ উম্মতের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুসরণ ও অনুকরণের বরকতে হাজার হাজার আউলিয়া এসেছেন। এর মধ্যে একজন এমন, যে উম্মতও, আর নবীও। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ২৮, হাশিয়া, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি)

(২৩) আল্লাহ'র মোহর এ কাজ করেছে যে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুসরণকারী এ মর্যাদা পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয়েছে যে, একদিন থেকে তিনি উম্মত আর অন্যদিক দিয়ে তিনি নবী। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৯৬, হাশিয়া, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি)

(২৪) নিজে হাদিসসমূহ পড়ে থাকি। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উম্মতের মধ্যে বনী ইসরাইলের নবীদের মতো লোক হবে। এর মধ্যে একজন এরূপ হবে যে একদিকে নবী হবে আর একদিকে উম্মত। তাকেই মসীহ মাওঊদ বা প্রতিশ্রুত মসীহ বলা হবে। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ১০১, হাশিয়া, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ৩৪)

(২৫) আমার পূর্বে যে সমস্ত আউলিয়া, আবদাল ও আকতাব এই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে চলে গিয়েছেন, তাদেরকে এই নিয়ামতের অনেক কিছু দেওয়া হয়নি। সুতরাং নবীর নাম পাওয়ার জন্য আমাকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে আর অন্যান্য লোক এই নামের অধিকারী নয়। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৩৯১, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি)

(২৬) ঐ সম্পর্ককে সামনে রেখে এবং তার নাম মুহাম্মাদ ও আহমাদের পদবী নিয়ে আমি রাসুলও এবং নবীও। (এক গলতি কা ইজালাহ, পৃ. ৪, বিতর্ক, রাওয়ালপিণ্ডি)

(২৭) আমাদের দাবি হলো এই যে, আমরা নবী। প্রকৃতপক্ষে এটা শাব্দিক বিতর্ক। আল্লাহ তাআলা যার সাথে এরূপ কথোপকথন ও সম্বোধন করেন, যা পরিমাণ, অবস্থা ও বর্ণনার দিক দিয়ে অতি উচ্চে এবং এতে ভবিষ্যদ্বাণীও যথেষ্ট রয়েছে, তাকেই নবী বলা হয়। এ সংজ্ঞা আমার উপরও প্রযোজ্য হয়। সুতরাং আমি নবীও। (বালদ, ৫ মার্চ, ১৯০৮, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩৭)

(২৮) আমি প্রতিশ্রুত মসীহ আর ঐ ব্যক্তি যার নাম সায়্যিদুল আম্বিয়া (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ'র নবী রেখেছেন। (নুযুলে মসীহ, পৃ. ৪৮, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি)

(২৯) আমি রাসুল ও নবী, অর্থাৎ পূর্ণ প্রতিবিম্ব হিসেবে আমি এরূপ আয়না, যাতে মুহাম্মাদী সাদৃশ্য বা আকৃতি নবুওয়াতের পূর্ণ প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়েছে। (নুযুলে মসীহ, পৃ. ৩, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩)

(৩০) এভাবে আমাকে আল্লাহ'র কিতাবে ঈসা ইবনে মারিয়াম বলা হয়েছে। কেননা, মারিয়াম এক পর্যায়ে উম্মত, আর ঈসা একজন নবী। সুতরাং আমার নাম মারিয়াম ও ঈসা রাখায় এটিই প্রতীয়মান হয় যে, আমি উম্মত ও নবী উভয়ই। (দামিমা বারাহিনে পঞ্চম, পৃ. ১৮৩, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি)

(৩১) এই যৌগিক নাম (উম্মতী নবী) রাখার মধ্যে হিকমত এটাই বোঝা যায় যে, যেন খৃষ্টান সম্প্রদায়ের উপর ভৎসনা বা অভিযোগ পেশ করে বলা যায় যে, তোমরা ঈসা বিন মারিয়ামকে খোদা বলে স্বীকার করো, কিন্তু আমাদের নবী এরূপ সম্মানের নবী যে, তার উম্মতের এক ব্যক্তি নবী হতে পারে আর ঈসা নামে অভিহিত হতে পারে। অথচ তিনি উম্মত। (দামিমা বারাহিনে পঞ্চম, পৃ. ১৮৪, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩৮)

(৩২) তারপর ঐ ব্যক্তির (প্রতিশ্রুত মসীহ, নাকেল) নবুওয়াতের দাবি সত্ত্বেও যার নাম প্রতিচ্ছায়া হিসেবে মুহাম্মাদ ও আহমাদ রাখা হয়েছে। এরপরও সায়্যিদিনা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাতামুন নাবিয়্যীন হয়েছেন। (এক গলতি কা ইজালাহ, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩৮)

(৩৩) আল্লাহ জাল্লাহ শানুহু রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে (নবুওয়াতের) মোহর ধারক বানিয়েছেন, অর্থাৎ কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মোহর দেওয়া হয়েছে, যা অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। এ কারণেই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম খাতামুন নাবিয়্যীন রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণ নবুওয়াতের পূর্ণতা দান করে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দৃষ্টি আত্মিক নবী সৃষ্টি করে। এ পবিত্র ও ঐশ্বরিক শক্তি অন্য কাউকে প্রদান করা হয়নি। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৯৭, বিতর্ক, রাওয়ালপিণ্ডি, পৃ. ১৪১)

(৩৪) যে সমস্ত জায়গায় আমি নবুওয়াত বা রিসালাত সম্পর্কে অস্বীকার করেছি তা শুধু এ অর্থে যে, আমি পৃথকভাবে কোন শরীআত নিয়ে আসিনি এবং পৃথক কোন নবীও নই। তবে এই অর্থে আমি রাসুল ও নবী যে, আমি স্বীয় পথ প্রদর্শক রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে অদৃশ্য বা আধ্যাত্মিক ফয়েয ও শক্তিলাভ করে এবং নিজের জন্য সেই নাম গ্রহণ করে তারই মধ্যস্থতায় আল্লাহ'র পক্ষ থেকে ইলমে গায়েব পেয়েছি। কিন্তু কোন নতুন শরীআত ছাড়া এরূপ নবী বলাতে আমি কখনো অস্বীকার করিনি, বরং এসব অর্থে আল্লাহ তাআলা আমাকে নবী ও রাসুল বলে আহবান করেছেন। সুতরাং এখনো আমি এ অর্থে নবী ও রাসুল হওয়ার কথা অস্বীকার করি না। (ইশতিহার, এক গলতি কা ইজালাহ, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৪২)

(৩৫) আমরা বিশ্বাস করি, তিনি (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাতিমুল আম্বিয়া। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর আর কোন নবী নেই। তবে আল্লাহ তাআলার ফয়েয ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যদি কাউকে নবুওয়াত দান করা হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। (বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৪৩)

 

তৃতীয় অধ্যায়

 

প্রকাশ্যে নবুওয়াত, রিসালাত ও ওহীর দাবি

(৩৬) আমি ঐ আল্লাহ'র কসম খেয়ে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ, তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন আর তিনিই আমার নাম নবী রেখেছেন। (তাতিম্মা, হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৬৮; বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩৫)

(৩৭) "আমরা (কোন জাতিকে) শাস্তি দেই না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মাঝে রাসুল না পাঠাই।" (সূরাহ বনী ইসরাইল, ১৭ : ১৫)

সুতরাং এর দ্বারা শেষ জমানায় এক রাসুল আবির্ভূত হওয়া প্রতীয়মান হয়, আর তিনি প্রতিশ্রুত মসীহ। (তাতিম্মা, হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৬৫; বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩৫)

(৩৮) "আর (পাঠিয়েছি) তাদের অন্যান্যদের নিকটও যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি।" (সূরাহ আল-জুমুয়াহ, ৬২ : ৩)

এই আয়াতে শেষ যুগে একজন নবী আবির্ভূত হওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। (তাতিম্মা, হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৬৭; বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩৫)

(৩৯) স্পষ্টভাবে আমাকে নবীর উপাধি দেওয়া হয়েছে। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ১৫০, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩৫)

(৪০) আল্লাহ তাআলা এ যুগে ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, যতো সৎ ও পবিত্র নবী চলে গিয়েছেন, তাদের সাদৃশ্য একই ব্যক্তির অস্তিত্বের মাধ্যমে প্রকাশ করবেন। সুতরাং আমিই সেই ব্যক্তি। তেমনি এ যুগে সমস্ত বদলোকের নিদর্শন আর (অত্যাচারী ও সীমাতিক্রমকারীদের) সাদৃশ্যও প্রকাশ হয়েছে, ফিরআউন হোক বা ঐ সমস্ত ইয়াহুদী যারা হযরত মসীহকে শূলে চড়িয়েছিল বা আবু জাহল। সবার উদাহরণ এ সময় বিদ্যমান রয়েছে। (বারাহিনে পঞ্চম, পৃ. ৯০; বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩৫)

(৪১) আমি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে - এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি এমন চিহ্ন বা আলামত দেখিয়েছেন যে, তা হাজার নবীর উপর বণ্টন করা হলেও এর দ্বারা নবুওয়াত প্রমাণিত হবে। কিন্তু এরপরও মানুষের মধ্যে যারা শয়তান তারা তা মানে না। (চশমায়ে মারিফাত, পৃ. ২১৭)

(৪২) আল্লাহ তাআলা আমাকে হাজার হাজার প্রমাণ দ্বারা সাহায্য করেছেন। স্বল্প সংখ্যক নবী এরূপ ছিলেন যাদের এরূপ সাহায্য করা হয়েছে। এরপরও যাদের অন্তঃকরণে মোহর করে দেওয়া হয়েছে, তারা আল্লাহ'র নিশানা বা কুদরত দ্বারা কোন উপকার লাভ করে না। (তাতিম্মা, হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ১৪৮)

(৪৩) আমি ঐ আল্লাহ'র শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ, তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, তিনিই আমার নাম নবী রেখেছেন, তিনি আমাকে প্রতিশ্রুত মসীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনিই আমার সত্যতা প্রমাণের জন্য বিরাট বিরাট প্রমাণ পেশ করেছেন, যা তিন লাখ পর্যন্ত পৌঁছেছে। (তাতিম্মা, হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৬৮)

(৪৪) সত্য খোদা তিনিই যিনি কাদিয়ানে স্বীয় রাসুল পাঠিয়েছেন। (দাফেউল বালা, পৃ. ১০০) বাস্তব সত্য হলো এই যে, আল্লাহ'র ঐ পবিত্র ওহী যা আমার উপর অবতীর্ণ হয়েছে, এতে রাসুল, মুরসাল ও নবী একবার নয়, হাজারবার উল্লেখ করা হয়েছে। (বারাহীনে আহমাদীয়া, পৃ. ৪৯৮; এ বিষয়টি আরবাঈন পৃ. ৪,৬ আর নুযুলে মসীহ, পৃ. ৯৯; হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ১০২, ১০৭; আনজামে আতহাম, পৃ. ৬২ এবং হাকীকাতুন নবুওয়াত, মীর্জা মাহমুদ, পৃ. ২০৯, ২১৪ ইত্যাদি কিতাবে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে)

(৪৫) আমি আল্লাহ'র প্রেরিত ক্রমাগত তেইশ বছরের ওহীকে কিভাবে অস্বীকার করবো। আমি তার ঐ পবিত্র ওহীর উপর এমনই ঈমান এনেছি, যেমনই আমার পূর্ববর্তী ওহীর উপর ঈমান এনেছি। (হাকিকাতুল ওহী, পৃ. ১৫০, ২১১; আনজামে আতহাম, পৃ. ৬২)

(৪৬) আমাকে বলা হয়েছে যে, তোমার সংবাদ কুরআন ও হাদিসে বিদ্যমান রয়েছে আর তুমিই এই আয়াতের মূল লক্ষ্য -

"তিনি ঐ পবিত্র সত্তা যিনি তার রাসুলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, যেন তাকে তিনি বাতিল সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করে দেন।" (সূরাহ আল ফাতহ, ৪৮ : ২৮)

(ইযাজে আহমাদী, পৃ. ৭)

(৪৭) আল্লাহ'র ওহী থেকে আমি যা শ্রবণ করি, তা সকল ভুল থেকে মুক্ত ও পবিত্র বলে জানি। তা কুরআনের মতোই সব ভুল থেকে মুক্ত, এটাই আমার ঈমান। (রিসালায়ে নুযুলে মসীহ, পৃ. ৯৯)

(৪৮) ঐ কিতাবের ৯৯ পৃষ্ঠায় আরো বলেছেন - "নবী যদিও অসংখ্য রয়েছে, কিন্তু আল্লাহ'র পরিচিতি লাভের দিক দিয়ে আমি কারোর চাইতে নিকৃষ্ট নই। দৃঢ় বিশ্বাসের দিক দিয়ে তা থেকে কিছু কম যে বলবে, সে মিথ্যাবাদী ও অভিশপ্ত।"

(৪৯) প্রত্যেক নবীকেই পানপাত্র দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমাকে তা পূর্ণপাত্র করে দেওয়া হয়েছে। (রিসালায়ে নুযুলে মসীহ, পৃ. ৯৯)

(৫০) সুতরাং আল্লাহ'র তাআলার ঐ কথোপকথন, যা বারাহিনে আহমাদীয়ায় প্রকাশিত হয়েছে, এর মধ্যে এটিও আল্লাহ'র একটি ওহী -

"তিনি ঐ পবিত্র সত্তা যিনি তার রাসুলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, যেন তাকে তিনি বাতিল সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করে দেন।" (সূরাহ আল ফাতহ, ৪৮ : ২৮)

(বারাহিনে আহমাদীয়া, পৃ. ৪৯৮)

এতে স্পষ্টভাবে এ অধমকে রাসুল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর ঐ কিতাবের ঐ বাক্যের সাথেই আল্লাহ'র অন্য ওহী হলো -

"মুহাম্মদ আল্লাহর রসূল এবং তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল।" (সূরাহ আল ফাতহ, ৪৮ : ২৯)

এ আয়াতে আর অন্যান্য কয়েক জায়গায় "রাসুল" শব্দ দ্বারা এই অধমকে স্মরণ করা হয়েছে। (তাবলীগে রিসালাত, পৃ. ১০৪, ১০ খ., কাদিয়ানী মাযহাব, পৃ. ৩৩৪)

(৫১) যদি বলো শরীআতওয়ালা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ধ্বংস হয়ে থাকে, সকল অপবাদকারী নয়, তাহলে প্রথম এ দাবি প্রমাণহীন। কেননা, আল্লাহ ইফতিরার (মিথ্যা অপবাদের) সাথে শরীআতের কোন বাধ্যবাধকতা রাখেননি। তাছাড়া এটাও বোঝা প্রয়োজন যে, শরীআত কি বস্তু ? যিনি ওহীর মাধ্যমে কিছু বিধি-নিষেধ বর্ণনা করেন, স্বীয় উম্মতের জন্য নীতিমালা নির্ধারণ করেন, তিনিই হবেন শরীআতের অধিকারী। সুতরাং এ সংজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের বিরোধীরা অভিযুক্ত। কেননা, আমার ওহীর মাঝে বিধি-নিষেধ রয়েছে, যেমন -

"মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে।" (সূরাহ আন নূর, ২৪ : ৩০)

এটা বারাহিনে আহমাদীয়ায় বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বিধি-নিষেধ রয়েছে আর এর উপর অনেক বছর অতিবাহিত হয়েছে। অনুরূপ এখনো আমার ওহীর মাঝে পূর্ণমাত্রায় আমর ও নাহী অর্থাৎ বিধি-নিষেধ রয়েছে। যদি বলো, শরীআতের দ্বারা ঐ শরীআত বুঝায়, যাতে নতুন কোন বিধান থাকে, তাহলে এটিও বাতিল বা অগ্রাহ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন -

"নিশ্চয়ই এটা লিখিত রয়েছে পূর্ববতী কিতাবসমূহে; ইব্রাহীম ও মূসার কিতাবসমূহে।" (সূরাহ আল-আ’লা, ৮৭ : ১৮-১৯)

কুরআনের শিক্ষায়ও এটা বিদ্যমান রয়েছে।

আর যদি বলো যে, শরীআত এটাকে বলে যেখানে পুরোপুরিভাবে আদেশ ও নিষেধের উল্লেখ থাকবে, তবে সেটাও বাতিল বা অগ্রাহ্য। কেননা, যদি তাওরাত ও কুরআনে পূর্ণমাত্রায় আহকামে শরীআতের উল্লেখ করা হতো, তাহলে ইজতিহাদের সুযোগ থাকতো না। মোটকথা, এ সমস্ত হলো অনর্থক ও সংকীর্ণ চিন্তাধারা।

ঐ কিতাবের ৭ নং টীকায় লিখেছেন, যেহেতু আমার শিক্ষায় আদেশ ও নিষেধ রয়েছে, আর শরীআতের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থা রয়েছে, এজন্য আল্লাহ তাআলা আমার শিক্ষা আর আমার উপর যে ওহী নাযিল হয় তা "ফুলক" অর্থাৎ "নৌকা" নাম রেখেছেন। যেমন, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক ইলহামের বাক্য হলো -

"আমাদের ওহী অনুযায়ী আমাদের চোখের সামনে এই শিক্ষা ও পুনরুজ্জীবনের নৌকা তৈরি করো, যে ব্যক্তি তোমার হাতে বায়আত করবে সে যেন আল্লাহ'র সাথে বায়আত করলো। এটা আল্লাহ'র হাত, যা তাদের হাতের উপর রয়েছে।"

এখন দেখো, আল্লাহ তাআলা আমার ওহী, আমার শিক্ষা ও বায়আতকে নূহের নৌকা হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং সমস্ত মানুষের জন্য তা পরিত্রাণের উপায় হিসেবে স্থির করেছেন। যাদের চক্ষু আছে তারা যেন দেখে আর যাদের কান আছে তারা যেন শুনে। (হাশিয়া আরবাঈন, পৃ. ৭)

 

সমস্ত নবীর সমকক্ষতা বরং তাদের চেয়ে উত্তম হওয়ার দাবি

(৫২) আমি আদম, শীস, নূহ, ইব্রাহীম, ইসহাক, ইসমাঈল, ইয়াকুব, ইউসুফ, মুসা, দাউদ, ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ নামের উত্তম প্রকাশ। প্রতিচ্ছায়া স্বরূপ আমি মুহাম্মাদ ও আহমাদ। (হাশিয়া, হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৭২; নুযুলুল মসীহ, পৃ. ৪; খতমে নবুওয়াত, পৃ. ৮)

(৫৩) ইবনে মারিয়ামের স্মরণ ও চিন্তাধারা ছেড়ে দাও। তার চেয়ে উত্তম বান্দা আহমাদ। (দাফেউল বালা, পৃ. ২, খতমে নবুওয়াত, পৃ. ৮)

(৫৪) আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের মাঝে মসীহ পাঠিয়েছেন যিনি এর পূর্ববর্তী মসীহ থেকে সমস্ত শান-শওকতের দিক দিয়ে অনেক উচ্চে। সেই আল্লাহ তাআলার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, যদি মসীহ ইবনে মারিয়াম আমার যুগে হতো, তাহলে আমি যা কাজ করছি, তিনি তা কখনো করতে সক্ষম হতেন না, আর যে সব নিদর্শন আমার দ্বারা প্রকাশিত হচ্ছে তা তিনি কখনো দেখাতে সক্ষম হতেন না। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ১৩৫, ১৪৮)

(৫৫) তার বংশ অত্যন্ত পাক ও পবিত্র, তার তিনজন দাদী ও নানী ব্যাভিচারিণী ছিলো, যাদের রক্ত থেকে তার অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে। (হাশিয়া, আনজাম আতহাম, পৃ. ৭)

এটাও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, তার কিছু মিথ্যা বলারও অভ্যাস ছিলো। (হাশিয়া, দামিমা আনজাম আতহাম, পৃ. ৫, ইজালা কালাম, পৃ. ৩, ইযাজ আহমাদী, পৃ. ১৩, ১৪, ইজালা ওহাম, পৃ. ১৩২ এবং কিস্তিহ, পৃ. ১৬, খতমে নবুওয়াত)

 

খাতামুল আম্বিয়া (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে উত্তম হওয়ার দাবি

(৫৬) আমাদের নবী আকরামের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুজিযার সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার লেখা হয়েছে। (তোহফায়ে গাওহারদিয়া, পৃ. ৪০ এবং বারহিনে আহমাদীয়ার ৫ম খণ্ডের ৫৬ পৃষ্ঠায় তার নিজের মুজিযার সংখ্যা ১০ লাখ বর্ণনা করা হয়েছে)

"রাসুলুল্লাহ'র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম) জন্য চাঁদের গ্রহণের নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছে, আর আমার জন্য চাঁদ-সুরুজ উভয়ের গ্রহণ হয়েছে। এখনো কি তোমরা অস্বীকার করবে ?" (ইযাজে আহমাদী, পৃ. ৭১)

(৫৭) "এক গলতি কা ইজালা" (প্রচারপত্র) এর মধ্যে মসীহ মাওঊদ বলেছেন,

"মুহাম্মদ আল্লাহর রসূল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল।" (সূরাহ আল ফাতহ, ৪৮ : ২৯)

এই আয়াতের ইলহামের মধ্যে "মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" অর্থ আমি, "মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" আল্লাহ আমাকে বলেছেন। (আখবারুল ফযল কাদিয়ান, ১০খ, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯১৫)

(৫৮) এরপর প্রতিচ্ছায়া নবী প্রতিশ্রুত মসীহ'র পা পিছে হটাতে পারেনি, বরং সামনে বাড়িয়েছে, আর এমন সামনে বাড়িয়েছে যে , নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জানুর নিকট দাঁড় করিয়েছে। (কালিমাতুল ফযল, লেখকঃ সাহেবযাদা বশির আহমাদ কাদিয়ানী, রিসালা বিউআক রিলজিনজ, পৃ. ১১২, ৪খ.)

(৫৯) "মুহাম্মাদ পুনরায় আমাদের মাঝে অবতীর্ণ হয়েছেন পূর্বের চেয়ে বেশী মান-মর্যাদা নিয়ে। যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে পূর্ণাঙ্গভাবে দেখতে চায়, সে যেন গোলাম আহমাদকে কাদিয়ানে দেখে নেয়।" (কাযী জহিরুদ্দীন, আকমলে কাদিয়ানী, "আখবার পয়গামে সোলেহ", লাহোর, ১৪ই মার্চ, ১৯১৬)

(৬০) মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আমার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। কেননা, সর্বদা আমার আল্লাহ'র সাহায্য ও সহযোগিতা মিলে থাকে। (নুযূলুল মসীহ, মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী, পৃ. ৯৬)

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের অবমাননা

(৬১) আমি আল্লাহ'র শপথ নিয়ে ঐ প্রশ্নের উত্তরে বলছি যে, আমার এ দাবির ভিত্তি হাদিস নয়, বরং কুরআন আর ওহী - যা আমার উপর অবতীর্ণ হয়েছে। তবে সাহায্যের জন্য (প্রমাণস্বরূপ) ঐ সমস্ত হাদিসও গ্রহণ করে থাকি যা কুরআন শরীফ অনুযায়ী হয় আর আমার ওহীর বিরুদ্ধে না হয়। অন্যান্য হাদিসকে আমরা অকেজো বলে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকি। (ইযাজে আহমাদী, পৃ. ৩০.৩১,২৯; গোলহারদীয়া, পৃ. ১০)

 

তাকে অস্বীকারকারী মুসলমানদেরকে কঠোর গালি ও কাফির বলা

(৬২) যে ব্যক্তি তোমার অনুসরণ করবে না, তোমার বায়আত গ্রহণ করবে না আর তোমার বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে আল্লাহ ও রাসুলের বিরুদ্ধাচরণকারী দোযখী। (ইলহামে মীর্জা গোলাম আহমাদ, তাবলীগে রিসালাত, ৯খ. পৃ. ৬৭)

(৬৩) সমস্ত মুসলমান আমাকে গ্রহণ করেছে আর আমার দাওয়াতের সত্যতা স্বীকার করেছে, কিন্তু নীচ ও ব্যাভিচারীদের সন্তানেরা আমাকে মানে না। (আয়নায়ে কামালাত, পৃ. ৫৪)

(৬৪) যে ব্যক্তি আমার বিরোধী সে ঈসায়ী, ইয়াহুদী, মুশরিক ও জাহান্নামী। (নুযূলুল মসীহ, পৃ. ৪; তাযকিরাহ, পৃ. ২২৭; তোহফা, গোলাহবদীয়া, পৃ. ৩১; তাবলীগে রিসালাত, ৯খ. পৃ. ২৭)

(৬৫) নিঃসন্দেহে আমাদের শত্রুরা অরণ্যের বানরে পরিণত হয়েছে আর তাদের স্ত্রীরা কুকুরীর চেয়েও বেশী সীমাতিক্রম করেছে। (নাজমুল হুদা, পৃ. ১০; দুররে শামীন, পৃ. ২৯৪)

(৬৬) যে ব্যক্তি আমার বিজয়কে স্বীকার না করবে, এতে পরিষ্কার বোঝা যাবে যে, তার জারজ সন্তান হওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। (আনওয়ারুল ইসলাম, পৃ. ২০)

(৬৭) যে কোন ব্যক্তির কাছে আমার দাওয়াত পৌঁছেছে, অথচ সে আমাকে কবুল করেনি, সে মুসলমান নয়। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ১৬৩; আজ খাতেমা বহেস, পৃ. ২৬)

(৬৮) কুফর দুই প্রকার।

প্রথম কুফর হলো এই যে, কোন ব্যক্তি ইসলামকে অস্বীকার করে আর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আল্লাহ'র রাসুল বলে মানে না।

দ্বিতীয় কুফর হলো এই যে, প্রতিশ্রুত মসীহকে মান্য করে না, আর প্রামাণ্য দলীলপত্র থাকা সত্ত্বেও তাকে মিথ্যা জানে, যাকে মান্য করা আর সত্য জানার জন্য আল্লাহ ও রাসুল নির্দেশ দিয়েছেন। পূর্ববর্তী নবীদের কিতাবেও এ সম্পর্কে তাকীদ পাওয়া যায়। সুতরাং এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশের অস্বীকারকারী। যদি গভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, এই উভয় প্রকার কুফর একই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ১৭৯; খাতেমা বহেস, পৃ. ২৬)

(৬৯) পৃথিবীতে প্রত্যাদিষ্টদের অস্বীকার করা যেমন কোন বর্বরতা বা অন্যায় নয়, তেমনি ঐ সমস্ত মাকবুল বা গৃহীতাদেরকে মেনে নেওয়াও কোন সৌভাগ্য নয় এবং এটা নিরাপদ ও নিরাপত্তার দুর্গের চাবি এবং প্রবেশকারীদের আশ্রয়স্থল। এরপর তার অবস্থা কি হবে যে এর চাবি খুলে দিয়েছে আর দুর্গে প্রবেশ করেনি আর যাদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে, তাদের সাথে বসে রয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে দুই ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী দুর্ভাগা। প্রথমত, ঐ ব্যক্তি যে সর্বশেষ নবীকে না মানে; দ্বিতীয়ত, ঐ ব্যক্তি যে সর্বশেষ খলীফার উপর বিশ্বাস না রাখে। (আল-হুদা, পৃ. ৪ : গোলাম আহমাদ, খাতেমা বহেস, পৃ. ২৬)

(৭০) বস্তুত কাফির উক্তিকারী অবিশ্বাসী হবে এবং যে ব্যক্তি অবিশ্বাসী, সে অবশ্যই কাফির হয়েছে। (বারাহিনে আহমাদীয়া, ৫খ. ২সং, পৃ. ৬৭; খাতেমা বহেস, পৃ. ৩৬)

(৭১) আশ্চর্য কথা হলো এই যে, তিনি কাফির উক্তিকারী আর অমান্যকারী দুই প্রকার গণ্য করেন। অথচ আল্লাহ'র কাছে একই প্রকার। কেননা যে ব্যক্তি আমাকে মানে না, সে এজন্যই মানে না যে, সে আমাকে প্রতারক মনে করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ তাআলার উপর প্রতারণাকারী সমস্ত কাফির হতে বড় কাফির। সুতরাং আমি যখন কোন মিথ্যাবাদীর কাছে আল্লাহ'র উপর প্রতারণা করি, এ অবস্থায় আমি শুধু কাফিরই নই, বরং চূড়ান্ত পর্যায়ের কাফির। এছাড়া যে আমাকে মান্য করে না, সে আল্লাহ ও রাসুলকেও মানে না। কেননা আমার সম্পর্কে আল্লাহ ও আল্লাহ'র রাসুলের ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ১৬৩; গোলাম আহমাদ, খাতেমা বহেস, পৃ. ৬)

(৭২) ব্যারিস্টার ফযল হোসেন ছয়বার এই প্রার্থনা করে যে, আমরা কাফির বলি না অথবা যারা কাফির বলে না, তাদের সাথে মিলে নামায পড়ার অনুমতি দেওয়া যায়। তখন মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী অনুমতির পরিবর্তে বলেনঃ না, আমরা এরূপ করতে পারি না। যে কাফির না বলে, তাকেও আমরা কাফির বর্ণনাকারীদের সাথে গণ্য করে থাকি। (ফয়সালা, হুকুম নং ৩৩, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ২৬৫; খাতেমা বহেস, পৃ. ২৭)

(৭৩) যে ব্যক্তি প্রকাশ করে যে, আমি এদিকে নই, ওদিকে নই। প্রকৃতপক্ষে সে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপকারী। যে ব্যক্তি আমাদেরকে বিশ্বাস করে না আর বলে যে, আমি তাকে ভালো জানি, সেও বিরোধীদের মধ্যে গণ্য। এরূপ ব্যক্তি বাস্তবিকপক্ষে স্বভাবগত মুনাফিক। (বদর, ২৪শে এপ্রিল, ১৯০৩, বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ২৭৩; খাতেমা বহেস, পৃ. ২৭)

(৭৪) মোটকথা, কারো কুফরী আর এর পূর্ণাঙ্গ প্রমাণ সম্পর্কে পৃথক পৃথক অবস্থা জিজ্ঞাসা করা বা জানা আমাদের কাজ নয়। এটা আলিমুল গায়ব এর কাজ। হ্যা, তবে শরীআতের ভিত্তি যেহেতু বাহ্যিক বিষয়ের উপর, এজন্য আমরা অস্বীকারকারীকে মুমিন বলতে পারি না যে, সে শাস্তি বা জবাবদিহি থেকে মুক্ত হয়েছে আর কাফিরকে মুনকের বা অস্বীকারকারী বলে থাকে। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ১৭৯; খাতেমা বহেস, পৃ. ৫২৭)

(৭৫) সুতরাং ঐ ব্যক্তিকে নয়, যে তাকে কাফির বলে না। কিন্তু তার দাবি মান্য করে না তাকে কাফির গণ্য করা হয়। বরং ঐ ব্যক্তি, যে তাকে অন্তরে সত্য বলে স্বীকার করে আর মৌখিকভাবেও তাকে অস্বীকার করে না, কিন্তু বায়আত গ্রহণে কিছুটা বিলম্ব করেছে, তাকে কাফির ঘোষণা করা হয়েছে। তাই চিন্তার অবকাশ রয়েছে যে, হযরত সাহেব এ ব্যাপারে কতো কঠোরতার সাথে কাজ করেছেন আর বিবেকও এটাই চায়। কেননা, যদি একটি হিন্দু রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সত্য বলে মান্য করে আর অন্তরে স্বীকার করে আর প্রকাশ্যভাবে অস্বীকারও না করে। হ্যা, কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে এখন প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত থাকে, তখন আমরা তাকে কখনো মুসলমান হিসেবে ভাবি না, বরং তাকে কাফিরই ভেবে থাকি আর ইসলামী শরীআত তার সাথে আত্মীয়তা করা জায়েয রাখেনি। অর্থাৎ, তার সাথে কোন মুসলমান মহিলার বিয়ে দেওয়ার অনুমতি দেয়নি। সুতরাং আহমাদী ছাড়া অন্যদের অবস্থা হলো এই, তারা আমাদের হযরত সাহেবকে অন্তরে সত্যবাদী হিসেবে বিশ্বাস করে কিন্তু বাইয়াত গ্রহণের উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। সুতরাং যারা তার দাবি মান্য করার জন্য উৎকণ্ঠায় রয়েছে, তাদের সম্পর্কে তিনি কুফরের ফতওয়া দিয়েছেন। যেমন আমি পূর্বে তার উক্তি (বাণী) বর্ণনা করেছি। (তাশজীহুল আজহান, পৃ. ৪১, ১৪২; এপ্রিল ১৯১১ খৃ.; মীর্জা বশিরুদ্দীন মাহমুদ কাদিয়ানী, খাতেমা বহেস, পৃ. ৩৭, ৩৮)

(৭৬) আমাদের কর্তব্য হলো, আহমাদীয়া ছাড়া অন্যদেরকে আমরা মুসলমান মনে করবো না আর তাদের পিছনে নামায পড়বো না। কেননা আমাদের মতে তারা আল্লাহ তাআলার একজন নবীকে অস্বীকার করে। এটা দ্বীনের ব্যাপার। এতে কারো নিজস্ব ক্ষমতা বা পসন্দ নেই যে, কিছু করতে পারে। (আনওয়ারে খিলাফত, মীর্জা বশিরুদ্দীন মাহমুদ কাদিয়ানী, পৃ. ৯০; খাতেমা বহেস, পৃ. ৩৮)

(৭৭) সমস্ত মুসলমান যারা প্রতিশ্রুত মসীহ'র বায়আতে শামিল হয়নি, এমনকি যদিও তারা মসীহ মাওঊদের নাম না শুনে থাকে, তবুও তারা কাফির আর ইসলাম বহির্ভূত। আমি স্বীকার করি যে, এটা আমার আকাইদ বা বিশ্বাস। (আয়নায় সাদাকাত, পৃ. ৩৫; খাতেমা বাহেস, পৃ. ৩৮)

 

খতমে নবুওয়াতের অর্থের পরিবর্তন, ব্যাখ্যায় বৈপরীত্য আর অসংলগ্ন আলোচনা

(১) হাকীকাতুল ওহী পৃ. ৯৭ এর হাশিয়ায় লিখেছেনঃ আল্লাহ হযরত (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সাহেবে খাতিম বানিয়েছেন, অর্থাৎ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কামালিয়াত বৃদ্ধির জন্য মোহর দেওয়া হয়েছে, যা অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। এ কারণে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম খাতিমুন নাবিয়্যীন হয়েছে, অর্থাৎ, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণ নবুওয়াতের পূর্ণতা দান করে, আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দৃষ্টি আত্মিক নবী তৈরি করে। এই পবিত্র শক্তি অন্য কাউকে দেওয়া হয়নি।

বস্তুত খাতিমুন নাবিয়্যীন অর্থ আখেরী নবী নয়, বরং নবীদের মোহর যাকে নবী তৈরির ক্ষমতা ও ইখতিয়ার দেওয়া হয়েছে, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের মোহর দেওয়া হয়েছে। তিনি যতো ইচ্ছা নবী তৈরি করতে পারবেন।

(২) তার কিতাব নুযূলে মসীহ'র ৩ নং পৃষ্ঠার টীকায় লিখেছেনঃ আমি রাসুল আর নবী অর্থাৎ প্রতিচ্ছায়া হিসেবে আমি ঐ আয়না যাতে মুহাম্মাদী আকৃতি আর মুহাম্মাদী নবুওয়াতের পূর্ণাঙ্গ ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। এরপর ঐ ব্যক্তির (মীর্জা সাহেব) নবুওয়াতের দাবী সত্ত্বেও যার নাম প্রতিচ্ছায়া হিসেবে মুহাম্মাদ ও আহমাদ রাখা হয়েছে, এরপরও সায়্যিদিনা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাতিমুন নাবিয়্যীন রয়েছেন। (এক গলতি কা ইজালা)

উপরিউল্লিখিত কথা দ্বারা এটিই প্রতীয়মান হয় যে, খাতিমুন নাবিয়্যীনের অর্থ এটাই যা সমস্ত মুসলমান বুঝে থাকে। কিন্তু মীর্জা সাহেবের নবী হওয়া এর বিরোধী নয়। কেননা (মা'আযাল্লাহ) মুহাম্মাদই আহমাদ।

(৩) তাজাল্লিয়াতে ইলাহিয়ার ৯ নং পৃষ্ঠার টীকায় লিখিত আছেঃ নবীর শব্দ দ্বারা এই যুগে শুধু এটাই বুঝায় যে, কোন ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ'র সাথে কথোপকথনের মর্যাদা লাভ করে এবং দ্বীনকে পুনরজ্জীবন দান করার জন্য আদিষ্ট হয়। এটা নয় যে, দ্বিতীয় কোন শরীআত নিয়ে আসবে। কেননা শরীআত রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর খতম হয়েছে। (বিতর্ক, রাওয়ালপিন্ডি, পৃ. ১৩০)

এতে খতমে নবুওয়াতের অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, শরীআত খতম হয়েছে কিন্তু নবুওয়াত খতম হয়নি। মোটকথা, যখন থেকে মীর্জা সাহেব দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেন আর নবী হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার মনে জাগরিত হয়, তখন খাতিমুন নাবিয়্যীন ও খতমে নবুওয়াত সংক্রান্ত বিষয়কে স্বীয় পথে বাঁধা মনে করে এর পরিবর্তন ও সম্পূর্ণ ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন। কিন্তু এতেও অভ্যাসানুযায়ী কোন একটি পরিবর্তনের উপর স্থির থাকেননি। কখনো খাতিমুন নাবিয়্যীনের অর্থ পরিবর্তন করে মহরে নবুওয়াত স্থির করেছেন, কখনো খতমে নবুওয়াতের সঠিক ও প্রচলিত অর্থ ঠিক রেখে নবুওয়াতের প্রতিচ্ছায়া ও বরোজী এ দুই প্রকার আবিস্কার করেছেন আর প্রতিচ্ছায়া নবীকে প্রকৃত মুহাম্মাদ ও আহমাদ বলে খতমে নবুওয়াতের আশংকা থেকে বাইরে আসার চেষ্টা করেছেন। কোথাও খতমে নবুওয়াতের মধ্যে একটি কয়েদ বাড়িয়ে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন এই বলে যে, খতম হওয়া নবুওয়াত তাই, যার সাথে শরীআত আছে, সম্পূর্ণভাবে নবুওয়াত খতম হওয়া বুঝায় না।

মীর্জা সাহেবের নবুওয়াত এবং কাদিয়ানী শিক্ষা ও বিশ্বাস থেকে তাওবা করার জন্য আমার (মুফতি মুহাম্মাদ শফী'র) দৃষ্টিতে কুরআন ও হাদিসের প্রমাণ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। স্বয়ং মীর্জা সাহেবের পরস্পর বিরোধী ও অসংলগ্ন কথাবার্তা পড়াই একজন ন্যায়বান ও বুদ্ধিমান মানুষের জন্য যথেষ্ট। সমস্ত বক্তব্য পড়ার প্রয়োজন নেই। এ ভূমিকায় যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে, প্রত্যেকটি বুদ্ধিমান মানুষের ভিতর এর দ্বারা নিঃসন্দেহে একই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কিন্তু সাধারণ মুসলমানের বুঝার জন্য আর প্রকৃত বিষয়টি অনুধাবন করানোর জন্য সামগ্রিকভাবে এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে যে, কুরআন এ হাদিস, পূর্ববর্তী বুজুর্গ, সাহাবা ও তাবিঈর কার্যাবলী ও বর্ণনার দ্বারা এ বিষয়টির বিভিন্ন দিক বিকশিত হয়েছে। এ উদ্দেশ্যেই "খতমে নবুওয়াত" নামের কিতাবটি রচিত হয়েছে। (والله الموفق والمعين)

 

বক্তব্য চার ভাগে বিভক্ত

যেহেতু আমরা এ আলোচনা এমন একটি দল সম্পর্কে করবো, যারা ইসলামের দাবি করে এবং কুরআন-হাদিস ও ইজতেমায়ে উম্মতের অনুসরণেরও দাবি রাখে, তাই নিন্মলিখিত বিষয়টি ইসলামী উসুল ও আহকামে শরীআহ'র তিনটি অকাট্য প্রমাণ (অর্থাৎ, কুরআন, হাদিস ও ইজমা) দ্বারা পৃথক পৃথক তিনটি ভাগে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করবো।

 

প্রথমত, খতমে নবুওয়াত ফিল কুরআন

অর্থাৎ, কুরআনের আয়াত দ্বারা এ বিষয়ের অকাট্য ও স্পষ্ট প্রমাণ পেশ করা হবে। তাছাড়া এ সম্পর্কে যা বিপরীত শোবা-সন্দেহ রয়েছে, তার উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য উত্তর দেওয়া হবে।

দ্বিতীয়ত, খতমে নবুওয়াত ফিল হাদিস

অর্থাৎ, হাদিসে খতমে নবুওয়াত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস দ্বারা এ বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হবে আর বিপরীত মতের লোকদের সন্দেহেরও উত্তর দেওয়া হবে।

তৃতীয়ত, খতমে নবুওয়াত ফিল আসার

অর্থাৎ, ইজমায়ে উম্মত ও পূর্ববর্তী সাহাবা, তাবিঈন, আয়িম্মায়ে দ্বীন ও প্রত্যেক যুগের বিজ্ঞ আলিম অর্থাৎ আকাইদ ও কালামশাস্ত্রের মনীষীবৃন্দ, মুফাসসিরীন, মুহাদ্দিসীন, ফুকাহা, সূফিয়া আর অন্যদের অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এ বিষয়ের সম্পর্কে পেশ করা হবে। এর শেষদিকে পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদি দ্বারা বিষয়টির প্রতিটি দিক উন্মুক্ত করা হবে এবং আকলী দালায়েল (যুক্তি-প্রমাণ) দ্বারা খতমে নবুওয়াতকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে।

চতুর্থত, কাদিয়ানী দল নিজেদের মতবাদ অর্থাৎ নবুওয়াতের স্থায়িত্বের কথা বলে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে থাকে, এ সবের উত্তর বিশ্লেষণ ও নিরপেক্ষ বিচার সহকারে দেওয়া হবে।

পঞ্চমত, মীর্জার ব্যক্তিগত অবস্থা, বাণী, চরিত্র আর কার্যাবলী একত্র করে তুলে ধরা হবে। যার দ্বারা প্রমাণিত হবে যে, যদি ধরে নেওয়া যায় যে, নবুওয়াত এখনো খতম হয়নি আর দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান নবী হতে পারবে, তবুও মীর্জা গোলাম আহমাদের পক্ষে নবুওয়াত লাভ করা কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়।

 

প্রথম তিনটি অধ্যায় এ কিতাবে সন্নিবেশিত। চতুর্থ ও পঞ্চম অংশ এখানে সংযুক্ত করা হয়নি। কারণ এ বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত অনেক বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে।

(ইন শা আল্লাহ, চলবে .......)

 

মূলঃ খতমে নবুওয়াত (মুফতি মুহাম্মাদ শফী রাহিমাহুল্লাহ)

ব্লগ লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-4a

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী মতবাদ – ২

 

 

 

The Greatest Nation·Wednesday, February 13, 2019

 

 

 

 

প্রথম অংশ - পবিত্র কুরআনে খতমে নবুওয়াত - ১

 

কুরআন মাজীদ এক মহাসম্মানিত কিতাব। এর একটি বিষয়ে চিন্তা ও গবেষণা করে জ্ঞানীগণ জান ও মাল উৎসর্গ করেন, আর এর প্রত্যেকটি ইঙ্গিতের উপর মুসলমানদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে। আলোচ্য বিষয়ে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু সর্বজ্ঞানী আল্লাহ খুব ভালোভাবেই জানেন, ভবিষ্যতে কোন মাসআলাটি সর্বাধিক প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিবে। তাই তিনি স্বীয় আদি কালামে এ বিষয়টির প্রতিটি দিক অত্যন্ত স্পষ্ট করে প্রকাশ করেছেন।

যদি কোন মুসলমানের সামান্যতম বোধশক্তি, অন্তরে সামান্যতম আল্লাহ-ভীতি এবং তার কিতাবের প্রতি সামান্য পরিমাণ মর্যাদাবোধ থাকে, তবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কুরআনের ঘোষণা পাঠ করার পর তার মনে কোন সন্দেহ বা অধিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের কোন অবকাশ থাকতে পারে না। কেননা কুরআনে শুধু একবার বা এক জায়গায় নয়, বরং বহুবার, বহু জায়গায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে এ বিষয়টিকে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে। আমি এই গ্রন্থে তাই বিস্তারিতভাবে হাদিয়া হিসেবে পাঠকদের কাছে তা পেশ করার ইচ্ছা রাখি।

 

তাফসীরে কুরআনের নির্ভুল মানদণ্ড

প্রতিটি ভাষায় কোন বাক্যের অর্থ বুঝবার জন্য যেমন সেই ভাষার একক শব্দ ও যৌগিক শব্দ গঠন পদ্ধতি জানা আবশ্যক, অনুরূপভাবে প্রত্যেকটি কথার তাৎপর্য বুঝার জন্য সেই কথার কথক বা উচ্চারণকারীকেও সামনে রাখতে হবে।

কেননা সাধারণত প্রত্যেকটি ভাষার দিক বিবেচনা করে প্রতিটি কথা বা বাক্যের বিভিন্ন অর্থ আর বিভিন্ন তাৎপর্য হতে পারে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত বক্তা ও শ্রোতাকে সালিসরূপে মেনে না নেওয়া হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার কথার অর্থ ও তাৎপর্য নির্ধারণ করা যেতে পারে না। বাক্যের অর্থ বলতে চেষ্টা করা হলে প্রায়শই ভুলের স্বীকার হওয়ার এবং অনেক ভুল অর্থ গ্রহণের আশংকা কিছুতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

মা'আনী ও বালাগাতে (আরবী ভাষাতত্ত্ব) এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে শুধু একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করা হবে।

যদি কোন ব্যক্তি বলে যে, "বৃষ্টি জমিতে ঘাস ও বৃক্ষ উৎপাদন করেছে", তাহলে এই কথার যথার্থ তাৎপর্য নির্ধারণের জন্য উক্তিকারী ব্যক্তির আকিদাহ জানা একান্ত দরকার হবে। বক্তা যদি তাওহীদবাদী মুসলমান হয়, তাহলে প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ বাক্যের অর্থ এটা বুঝবে যে, বৃষ্টি ঘাস উৎপন্নের বাহ্যিক কারণ। আর যদি বক্তা নাস্তিক্যবাদী হয়, তাহলে এটা কুফরী বাক্য বলে বুঝা যাবে। এর অর্থ এটাই ধরে নেওয়া হবে যে, সে বৃষ্টিকে ঘাস, বৃক্ষ প্রভৃতি সৃষ্টি করার একমাত্র নিয়ামক বলে মনে করে, যা সম্পূর্ণরূপে কুফরী। বক্তার বোধ-বিশ্বাস ও আস্থা বিভিন্ন হওয়ার ফলে একটি বাক্যের অর্থে বিরাট পার্থক্য দেখা দেয়। একটি বাক্য যখন মুসলামান বলে, তখন তার অর্থ সঠিক হয়, তাতে কুফরীর কোন লেশমাত্র থাকে না, অথচ কোন নাস্তিক ঐ বাক্য বললে তা কুফরী বাক্য হয়ে যায়। (মুখতাসারুল মাআনী ও মুতায়্যেল দ্রষ্টব্য)

এভাবে কোন কোন সময় সম্বোধিত ব্যক্তির পরিবর্তনে বাক্যের অর্থ পরিবর্তিত ও ভিন্নতর হয়ে যায়। একজন আলিম-ফাযিলকে যখন "আল্লামা" সম্বোধন করা হয়, তখন এর দ্বারা তাকে উচ্চ পর্যায়ের সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং একই শব্দ যখন মূর্খ সম্পর্কে বলা হয়, তখন এর দ্বারা তাকে ঠাট্টা করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।

এভাবে, আপন স্ত্রীকে "হুররা" (حره) সম্বোধন করে তালাক অর্থ নেয়া যেতে পারে, যা নিকৃষ্ট বৈধ ও অত্যন্ত অপসন্দনীয় কাজ, কিন্তু অন্যান্য মহিলার বেলায় একই শব্দ প্রয়োগ করা তাদের প্রতি উচ্চ সম্মান প্রদর্শন ও প্রশংসার মধ্যে গণ্য হয়।

এভাবে স্থান-কাল এবং বক্তা ও শ্রোতার বিশেষ পার্থক্যের কারণে বাক্যের অর্থের মধ্যেও বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি হয়। সামান্য চিন্তা করলেই প্রতিটি ভাষায় প্রতিটি মানুষ এ ধরণের হাজার হাজার উদাহরণ পেশ করতে পারে, যার বিস্তারিত বর্ণনা করা এখানে সমীচীন নয়।

মোটকথা, প্রত্যেক ভাষায় যেভাবে বাক্যের অর্থ বোঝার জন্য ঐ ভাষার অভিধান ও ব্যাকরণ জানা প্রয়োজন, তেমনি বক্তা ও শ্রোতার বিশেষত্বের দিকেও লক্ষ্য রেখে অর্থ নির্ধারণ করা আবশ্যক। এছাড়া যে বাক্যের অর্থ বর্ণনা করা হবে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হবে। কেননা অধিকাংশ বাক্যে প্রকৃত অভিধানের দৃষ্টিতে কয়েকটি অর্থ ও তাৎপর্য হতে পারে। এর মধ্যে বাস্তব অর্থ নির্ধারণ করা শুধু উপরিউল্লিখিত বিশেষত্বের উপর নির্ভর করে।

ইবনে সাআদ হযরত ইকরামা থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু খারেজীদের সাথে বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে নির্দিষ্ট করেন এবং নির্দেশ দেন যে, "কুরআনের আয়াতকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রহণ করো না, বরং হাদিস পেশ করো।" ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু আরয করলেন, "হে আমীরুল মুমিনীন, কুরআন মাজীদের দ্বারা বিতর্ক সৃষ্টি করায় কি ভয় বা অসুবিধা আছে ? আমরা আল্লাহ তাআলার অপার কৃপায় কুরআন মাজীদ তাদের চেয়ে বেশী বুঝি। আমাদের ঘরেই পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে।"

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "আপনি এটি সত্য বলেছেন। কিন্তু কুরআন মাজীদ এক সংক্ষিপ্ত ও মুজিযাপূর্ণ কালাম, তাতে বিভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। যদি এর জ্ঞান লাভ ও তাফসীরের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ও তদীয় হাদিসকে মানদণ্ডরূপে গ্রহণ না করা হয়, তাহলে এক আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরাও কিছু বলবো আর তারাও কিছু বলতে থাকবে। মীমাংসার জন্য কোনটাই গ্রহণযোগ্য হবে না।" সুতরাং ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এটি গ্রহণ করে এভাবেই কাজ করেন।" (ইতকান, পৃ. ১৪৩, ১ খ.)

এই বর্ণনায় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র নির্দেশে স্পষ্ট হয়েছে যে, কুরআন মাজীদে দুই অর্থবোধক বাক্যে ভাষার কারণে বিভিন্ন অর্থের অবকাশ রয়েছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এর অর্থ নির্ধারণ করার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ও উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি রাখা না হয়, ততক্ষণ তার প্রকৃত ও সঠিক অর্থ অনুধাবন করা অত্যন্ত দুষ্কর। অন্যদিকে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু যে বলেছেন, "কুরআন আমাদের ঘরে নাযিল হয়েছে, তাই আমরা কুরআন মাজীদ তাদের চেয়ে বেশী বুঝি", এর দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বক্তা ও শ্রোতার বিশেষত্ব বাক্য বুঝার ব্যাপারে বিশেষ অধিকার রয়েছে।

সারকথা এই যে, কুরআন মাজীদের অধিকাংশ বাক্যে আরবদের বিশেষ ভাষারীতি ও আরবি ব্যাকরণের হিসেবে বিভিন্ন অর্থের অবকাশ রয়েছে। এই কারণে কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল তা জানার জন্য কোন মাপকাঠি থাকা প্রয়োজন। নতুবা প্রত্যেকেই যে অর্থ ইচ্ছা গ্রহণ করবে আর মীমাংসার কোন পথই থাকবে না।

এর পূর্বে আমরা খতমে নবুওয়াতের প্রমাণের জন্য কুরআন মাজীদের আয়াত পেশ করে এই বিষয়ের মীমাংসা করা প্রয়োজন মনে করি যে, কুরআনের তাফসীরের প্রকৃত মাপকাঠি কি, যার দ্বারা কোন তাফসীর নির্ভুল ও সঠিক এবং কোন তাফসীর ভুল, তা আমরা বুঝতে পারি।

 

তাফসীরে কুরআনের মাপকাঠি ও এর সঠিক পদ্ধতি

যে সমস্ত বুজুর্গ ইলমে কুরআনের উসুল পর্যায়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন, তারা এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আমরা এখানে জালালুদ্দীন সুয়্যুতি রাহিমাহুল্লাহ'র কিতাব "আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন" এর ইবারতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাঠকদের সামনে পেশ করছি। তার এই ব্যাখ্যা অধিকাংশ কুরআন পারদর্শীর কাছ থেকে গৃহীত।

কুরআন মাজীদের তাফসীর নিন্মে বর্ণিত পদ্ধতির ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য হবে এবং যে তাফসীর এ পদ্ধতিসমূহের মধ্যে কোন একটি পদ্ধতির ভিত্তিতে করা হয়নি, তা অগ্রহণযোগ্য ও তা কুরআনের তাফসীরের বিকৃতি মনে করতে হবে।

(১) সর্বাগ্রে আর সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কুরআনেরই এক আয়াত দ্বারা অপর আয়াতের তাফসীর। কেননা এই পবিত্র কালামে একটি বিষয়কে এক আয়াতে অস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্য জায়গায় তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আল্লামা ইবনে জাওযী রাহিমাহুল্লাহ কুরআন দ্বারা কুরআনের তাফসীর পর্যায়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাতে কুরআনের এক অস্পষ্ট আয়াতের অন্য আয়াত দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন এবং হাফিয ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহও স্বীয় তাফসীরে এর ব্যবহার করেছেন। এক আয়াতের তাফসীর যদি অন্য আয়াতের দ্বারা সম্ভব হয়, তাহলে সর্বপ্রথম সেই আয়াতটিকে তিনি উদ্ধৃত করেছেন।

(২) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে যা আয়াতের তাফসীর নিজ কথা বা কার্যের দ্বারা করেছেন, সে আয়াতের সেই তাফসীরই সর্বাধিক সহীহ ও গ্রহণীয়। কেননা এ স্পষ্টভাষী কিতাব তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরই নাযিল হয়েছে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে রাসুলরূপে প্রেরণের এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই কিতাবের ব্যাখ্যা ও শিক্ষাদান করবেন আর এতে যে অস্পষ্ট বিষয় আছে, তা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্পষ্ট করে বর্ণনা করবেন। কুরআন মাজীদে পুনঃ পুনঃ এর উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে এজন্য প্রেরণ করা হয়েছে যে -

"..... তিনি কুরআন মাজীদ শিক্ষা দিবেন আর যৌক্তিকতা বুঝিয়ে দিবেন ......" (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১৬৪)

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে -

".... যেন তিনি লোকদের মাঝে সেসব আয়াত ব্যাখ্যা করে বর্ণনা করেন, যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে ...." (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ৪৪)

এ সমস্ত আয়াত দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন মাজীদ সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ও নির্দেশিকার একান্ত প্রয়োজন। যদি কুরআন উপলব্ধি করার জন্য শুধু আরবি ভাষা জানা ও আল্লাহ'র কিতাব (কুরআন) পাঠ যথেষ্ট হতো, তাহলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে প্রেরণ ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দায়িত্বের মধ্যে কুরআনের শিক্ষা ও নির্দেশ অন্তর্ভুক্ত করার কোন প্রয়োজন ছিলো না।

যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন মাজীদ শিক্ষা দিবেন আর তার সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করবেন - নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে রাসুল হিসেবে প্রেরণের মূলে এটি যখন উদ্দেশ্যরূপে গণ্য, তখন এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত ফরমান বা নির্দেশ আল্লাহ প্রেরিত ওহীই হবে। এজন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের করা তাফসীরই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হবে, এটিই স্বাভাবিক।

(৩) তৃতীয় পর্যায়ে নির্ভরযোগ্য সাহাবায়ে কিরামের তাফসীর। কেননা তারা কুরআন অবতরণ প্রত্যক্ষ করেছেন। তাদের সামনে আর অধিকাংশ তাদের মধ্যকার ঘটনাকে উপলক্ষ করেই কুরআন মাজীদ নাযিল হয়েছে। এছাড়া কুরআন মাজীদ তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন।

এ কথা স্পষ্ট যে, কোন ব্যক্তি যখন কোন বৈষয়িক বা দ্বীন সম্পর্কিত কোন কিতাব কোন ব্যক্তির কাছ থেকে পাঠ শিক্ষা করে, তখন এই পাঠের উদ্দেশ্য শুধু বাক্য পাঠ করাই হয় না, বরং এর উপলব্ধি করাই হয় তার মুখ্য উদ্দেশ্য। যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান বা নাহু ও সরফ (আরবি ব্যাকরণ) এর কোন কিতাব কোন শিক্ষার্থীর না বুঝে পাঠ করা বোকামি ও জীবন অপচয় মনে করা হয়, তাহলে শিক্ষক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে শিক্ষার্থী সাহাবায়ে কিরাম শুধু বাক্যগুলো পড়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন, তা কি করে সম্ভব হতে পারে ? অথচ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কুরআন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই প্রেরিত হয়েছেন, আর সাহাবাগণ গোটা মুসলিম উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক পরিশুদ্ধ, আর তাদের ও গোটা উম্মতের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ এই কিতাবের সুষ্ঠু ও যথার্থ পাঠের উপর নির্ভর করে।

সাহাবায়ে কিরাম নিজেরাই বলেছেন, "যখন আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কুরআন পাঠ শিক্ষা করি, তখন এর ব্যাখ্যা ও অর্থ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেই শিখেছি।"

আল্লামা সুয়্যুতি রাহিমাহুল্লাহ আবু আবদুর রহমান সালমা সূত্রে উসমান গনী রাদিয়াল্লাহু আনহু আর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেনঃ সাহাবায়ে কিরাম যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ১০ টি আয়াত শিক্ষা করতেন, তখন পূর্বেরগুলোর জ্ঞান ও আমলের (ব্যবহারিক) ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন না করে তারা সম্মুখে অগ্রসর হতেন না। সাহাবা বলেন, আমরা কুরআন মাজীদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শিক্ষা লাভ করেছি আর এর ইলম বা জ্ঞান ও আমল ইত্যাদি সবকিছু তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছ থেকে অর্জন করেছি। (আল-ইতকান, ১খ. পৃ. ১৭৬)

এ কারণে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মতো সম্মানিত সাহাবীর সূরাহ বাকারাহ পাঠ করতে আট বছর সময় অতিবাহিত হয় (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)। তিনি আট বছরে কি কি জ্ঞান ও দর্শন এই সূরা থেকে অর্জন করেছেন, তা আল্লাহ-ই ভালো জানেন। নতুবা শুধু মুখস্থ করার ব্যাপার হলে সেজন্য মাত্র কয়েকদিনই যথেষ্ট ছিলো। যেহেতু সাহাবায়ে কিরাম কুরআনী ইলম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অর্জন করেছেন, তাই ইমামুল হাদিস হাকিম বলেছেন, তাফসীরে সাহাবা দ্বারা এখানে শুধু ঐ তাফসীর বুঝায়, যা শানে নুযূল ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। সাধারণভাবে সাহাবাদের বর্ণনা এর উদ্দেশ্য নয়। স্বয়ং হাকিম স্বীয় কিতাব "উলুমুল হাদিস" এ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

(৪) চতুর্থ পর্যায়ে তাবিঈগণের বর্ণিত তাফসীর নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। কেননা অনেক তাবিঈ পূর্ণ কুরআন মাজীদ সাহাবায়ে কিরামের কাছে শিক্ষা লাভ করেছেন আর তাদের থেকে সেই ইলম ও দর্শন শিক্ষা লাভ করেন, যা তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন।

(৫) পঞ্চম পর্যায়ে সেসব তাফসীর গ্রহণযোগ্য, যা ইলমে তাফসীরের ইমামগণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তাদের জীবন এ কাজেই অতিবাহিত হয়েছে আর তার তাফসীরের ব্যাপারে পূর্ববর্তী নীতি সম্মুখে রেখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস এবং সাহাবা ও তাবিঈনের বর্ণনাকে নিজেদের আদর্শ ও নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে যা কিছু বলেছেন, তা সাহাবা ও তাবিঈনের বর্ণনার অনুবাদমাত্র।

এজন্য যদি বলা হয় যে, পঞ্চম পর্যায় স্বতন্ত্র বা ভিন্নতর কোন পর্যায় নয়, তাহলে অত্যুক্তি হবে না। তা মূলত তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের মধ্যে গণ্য। কেননা সাহাবা ও তাবিঈনের "আসার" বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এ সমস্ত তাফসীর থেকেই জানা যায়।

এ ধরণের তাফসীরের মধ্যে আল্লামা সুয়্যুতি যে সকল মুফাসসিরগণের কিতাবগুলোর নাম উল্লেখ করেছেন তারা হলেন - ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতিম, ইবনে মাজাহ, হাকিম, ইবনে মারদুবিয়া, আবুশ শায়খ, ইবনে হিব্বান, ইবনুল মুনযির ইত্যাদি। আর পরবর্তী কিতাবের মধ্যে ইবনে কাসির, দুররে মানসুর ইত্যাদি এই ধরণের তাফসীরের মধ্যে গণ্য।

কিন্তু এগুলোর মধ্যে আল্লামা সুয়্যুতি রাহিমাহুল্লাহ ইবনে জারীরকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন, "নির্ভরযোগ্য আলিমগণ এ কথায় ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, ইবনে জারীর তাবারী লিখিত তাফসীরের কোন দৃষ্টান্ত নেই।"

 

এ পাঁচটি নীতি, যা মহিমান্বিত কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা ও তাফসীরের মাপকাঠি, যে সমস্ত তাফসীর এই নীতির মধ্যে পড়ে, তা নির্ভরযোগ্য, এবং যা এই মাপকাঠির মধ্যে পড়ে না, তা কুরআন মাজীদের বিকৃতি ও অগ্রহণযোগ্য তাফসীররূপে গণ্য। সেসব তাফসীর ইচ্ছামত করা তাফসীর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর হাদিসে এই মনগড়া তাফসীর সম্পর্কে বলা হয়েছে,

"যে ব্যক্তি নিজের ইচ্ছানুযায়ী ও স্বীয় চিন্তা-ভাবনার ভিত্তিতে কুরআনের তাফসীর করে, সে তাফসীর সঠিক হলেও এরূপ করে অন্যায় ও গুনাহ করলো।" (নাসাঈ, আবু দাউদ ও তিরমিযি - ইতকান, পৃ. ১৭৯)

অন্য এক হাদিসে আছে -

"যে ব্যক্তি ইলম ছাড়া পবিত্র কুরআনের তাফসীর করবে, সে যেন তার ঠিকানা দোযখে বানিয়ে নেয়।" (আবু দাউদ)

কারণ স্পষ্ট যে, সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন ও পূর্ববর্তী বুজুর্গদের তাফসীরসমূহের পর এগুলোর বিরোধী কোন বর্ণনা এবং আয়াতের উদ্দেশ্য বা মর্মার্থ ঘোষণা করা প্রকারান্তে এ কথাই বুঝায় যে, (নাউযুবিল্লাহ) তেরশো বছর পর্যন্ত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত পবিত্র কুরআনের মর্মার্থ ভুল বুঝেছে এবং সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন, তাবে-তাবিঈন আর পূর্ববর্তী আয়িম্মা ও বুজুর্গদের মধ্যে কেউই হিদায়াতপ্রাপ্ত ছিলেন না !

কুরআন মাজীদকে আল্লাহ তাআলার কিতাব হিসেবে জানেন এমন কোন মুসলমানই এরূপ কথা বলতে পারেন না। কেননা এই কথা অত্যন্ত মারাত্মক, তা ইসলামের মূল ও ভিত্তিকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, কোন নিষ্ঠাবান কাফিরও এই অযৌক্তিক ও অর্থহীন কথা মেনে নিতে পারে না।

উম্মতের পূর্ববর্তী লোকেরা কোন আয়াতের মর্মার্থ বুঝেন নি কিংবা ভুল বুঝেছেন, এরূপ ধারণা নিন্মোদ্ধৃত কারণসমূহের আলোকে সম্পূর্ণ বাতিল ও অগ্রহণযোগ্যঃ

প্রথম কারণঃ যদি তাই সত্য হয়, তাহলে কুরআন মাজীদ আল্লাহ'র কালাম হওয়া তো দূরের কথা, কোন বুদ্ধিমান লোকের কালামরূপেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা কুরআনের দাবি হচ্ছে, তা সমস্ত জগদ্বাসীর হিদায়াতের জন্য নাযিল হওয়া কিতাব। কিন্তু কি আশ্চর্য ! সম্ভাব্য সকল প্রকারের চেষ্টা করা সত্ত্বেও বিগত তের-চৌদ্দশ বছরেও তার উদ্দেশ্য সফল হলো না ! আর তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে কুরআন আদপেই হিদায়াতের কিতাব হতে পারলো না। হলো গুমরাহীর উপর গুমরাহী সৃষ্টিকারী গোলক ধাঁধার গ্রন্থ (নাউযুবিল্লাহ)। বাস্তবে অনুসরণযোগ্য কোন কিতাব হতে পারলো না (নাউযুবিল্লাহ)।

দ্বিতীয় কারণঃ এই অবস্থায় কুরআন মাজীদ কোন গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য কিতাব হিসেবে অবশিষ্ট থাকতে পারে না। এই কিতাবের উপর নির্ভরশীলতাও নিঃশেষ হয়ে যায়। কেননা যখন এটাই সম্ভব হলো যে, তেরশো বছর পর্যন্ত উম্মতের অবিশ্রান্ত শ্রম ও সাধনার পরও জীবন দিয়ে এর সঠিক অর্থে পৌঁছাও সম্ভব হলো না, সকলের ঐকান্তিক চেষ্টাও এর রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হলো না, সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবা ও তাবিঈনও এর রহস্য উন্মোচনে অক্ষম হয়ে থাকলেন (নাউযুবিল্লাহ), আর শুধু ভ্রান্তপথেই চলতে থাকলেন, তাই যারা আজ এর নতুন অর্থ ও ব্যাখ্যাকে সঠিক বলছেন, তাদের দেওয়া অর্থ প্রথম অর্থের মতোই ভবিষ্যতে ভুল প্রমাণিত হবে না, তার নিশ্চয়তাই নেই। পরবর্তী তেরো-চৌদ্দ বছর পর সেই ভুল প্রকাশিত হবে না, তার দাবি করারও অধিকার কারো থাকতে পারে না। অন্যথায় তারা যে অর্থ বুঝছেন তা কখনো ভুল হবে না, এমন গ্যারান্টি কি তারা দিতে পারেন ?

যে মহান সত্তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি কুরআন নাযিল হলো, তার নির্ভুল শিক্ষাদান যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দায়িত্ব, আর যে সাহাবায়ে কিরামকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শিক্ষাদান করলেন, তাদের কাছেও এর সঠিক অর্থ প্রকাশ হয়নি, অথচ তারা এরই নির্ভুল শিক্ষালাভের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে জীবন অতিবাহিত করেছেন, তারাও এক-একটি সূরাহ অধ্যয়নে আট কি বারোটি বছর ব্যয় করলেন, আর এরপর পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্য থেকে প্রতি যুগে এর গুঢ় অর্থ প্রকাশের জন্য ঐ সমস্ত বুজুর্গ জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, যাদের বুদ্ধিমত্তা, তীক্ষ্ণবোধ ও আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান সম্পর্কে কাফিররা অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু এতদসত্ত্বেও তারা সবাই এর সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে অসমর্থ থাকলেন ! তাহলে এরপরেও কি এই কিতাবের প্রতি ঈমান আনার জন্য কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে আহবান জানানোর এবং কেউ তা গ্রহণে প্রস্তুত হবে তা আশা করার কোন যৌক্তিকতা থাকে ?

মোটকথা এই যে, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈন কোন মধ্যস্থতা ছাড়াই বা একজন মধ্যস্থের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাগরিদ ছিলেন, আর যে পবিত্র কুরআনের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে প্রেরণ করা হয়েছিলো, এদিক দিয়ে সাহাবী ও তাবিঈনই সর্বাধিক যোগ্য লোক ছিলেন। এই সমস্ত লোকই যদি কুরআনকে সঠিকভাবে না বুঝে থাকেন, তাহলে বুঝতে হয় যে, কুরআন মাজীদ একটি নিরাপত্তাহীন কালাম (নাউযুবিল্লাহ), উম্মতের পূর্ববর্তী লোকজন এ পর্যন্ত যে অর্থ উপলব্ধি করেছেন, তা আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এরপর আজ যে অর্থ গ্রহণ বা স্বীকার করা হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে ভুল প্রমাণিত হবে না, এমন আস্থা এর প্রতি রাখা চলে না। এরূপ অবস্থায় কাফিরদেরকে এই পবিত্র কিতাবের উপর ঈমান আনার ও তার অনুসরণের জন্য আহবান জানাবার মুসলমানদের কি অধিকার থাকতে পারে ?

তৃতীয় কারণঃ হাদিসসমূহের বর্ণনা অনুযায়ী সাহাবায়ে কিরাম ইলম ও আমলের সবদিক দিয়ে এই উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম। সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, "সকল মানুষের মধ্যে সাহাবায়ে কিরাম সবচেয়ে বেশী পবিত্র অন্তর ও সবচেয়ে বেশী জ্ঞানের অধিকারী।"

এ হাদিসে মারফু থেকেও তাই প্রমাণিত হয় - "আমার যুগের মুসলিমগণ অন্য সকল কালের মুসলমানের তুলনায় অনেক উত্তম, তাদের পরে তাদের নিকটবর্তী লোকেরা, তাদের পরে তাদের সঙ্গের লোকেরা।"

এ প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও তারা কুরআনেরই সমভাষী আর তার আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার দিন-রাতের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণকারীও। তদুপরি এক একটি সূরার পাঠ গ্রহণে বারো-বারোটি বছরও অতিবাহিত করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, তারা কুরআনের মর্মার্থ সেই মহান পবিত্র সত্তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছ থেকে শিখেছেন, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর কুরআন নাযিল হয়েছে, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র বক্ষ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত ইলমের দ্বারা সমৃদ্ধিশালী করা হয়েছে এবং তাকেই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ মহাসম্মানিত কিতাবের প্রশিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।

স্বয়ং সাহাবায়ে কিরাম বলেছেন, "আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে শুধু কুরআন মাজিদের শব্দই শিখিনি, তার অর্থ ও ব্যাখ্যা এবং ইলম ও আমল সবকিছু তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছ থেকে অর্জন করেছি।"

এরপরও কুরআনের মাজীদের সঠিক অর্থ এ সকল বুজুর্গদের কাছে অপ্রকাশিত ছিলো, তা কিভাবে সম্ভব হতে পারে ? এমনিভাবে তাবিঈনও পবিত্র কুরআন সাহাবায়ে কিরামের কাছ থেকেই শিক্ষালাভ করেছেন। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে যে, তাদের সবাই এর সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে পারেন নি ? যদি এ সমস্ত বুজুর্গ এতোসব গুণ ও অবস্থা থাকা সত্ত্বেও এর সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে সক্ষম না হয়ে থাকেন, তাহলে দুনিয়ার কোন মানুষই এর সঠিক অর্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না বলেই ধরে নিতে হয়।

চতুর্থ কারণঃ কুরআন মাজীদ স্বয়ং ঘোষণা করেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে কুরআন মাজীদের শিক্ষা ও প্রচারের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে, পূর্বোদ্ধৃত কতিপয় আয়াত থেকে তা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়। সুতরাং যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে থাকেন আর কুরআন ঐ সমস্ত সন্দেহের গোপন অন্ধকারেই পড়ে থেকে থাকে, তাহলে মনে করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলার বাসনা পূর্ণ হয়নি (নাউযুবিল্লাহ) এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পূর্ণ করেননি। কিন্তু তা সম্পূর্ণ অসম্ভব কথা।

তাই ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি এখন কোন নতুন কথা আবিস্কার করবে, সে প্রকারান্তে এটাই বলতে চায় যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় রিসালাতের দায়িত্বের খিয়ানত করেছেন আর পূর্ণাঙ্গ দ্বীন উম্মতের মাঝে প্রচার করেননি। এটাও এক অসম্ভব কথা।

সারকথা, আজ যদি কোন ব্যক্তি কোন আয়াতের তাফসীর বুঝতে চান, তার জন্য অত্যন্ত সহজ ও নিরাপদ উপায় হলো, তিনি যেন পূর্ববর্তী বুজুর্গ সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈনের তাফসীরকে স্বীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন, তাদের বর্ণিত তাফসীরকে কুরআনের নির্ভুল মর্মার্থ ও সঠিক ব্যাখ্যা মনে করেন এবং যে সমস্ত অর্থ অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন ও পূর্ববর্তী উম্মতদের বিপরীত মনে হয়, তা স্বীয় ভ্রান্ত উপলব্ধি ও ইলমের স্বল্পতার কারন মনে করতে হবে। যদিও এর ধারণা অনুযায়ী তার গৃহীত অর্থই কুরআনের যথার্থ তাৎপর্য।

মোটকথা, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈন এই কিতাবের জ্ঞান অর্জনে সরাসরি বা একজন মধ্যস্থতার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাগরিদ ছিলেন। তাদের বর্ণনা থেকে সীমাতিক্রম করা এবং তাদের সবার বর্ণনা ছাড়া কোন নতুন অর্থ আবিস্কার করা পবিত্র কুরআনকে অগ্রহণযোগ্য ও আমলের অনুপযুক্ত মনে করা ছাড়া আর কিছুই না।

এ সম্পর্কে ইমামুল হাদিস ও তাফসীর ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ'র একটি বাক্য আল্লামা সুয়্যুতি রাহিমাহুল্লাহ নির্ভরযোগ্য হিসেবে তার "ইতকান" গ্রন্থে বর্ণনা করেছেনঃ যদি সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন আর আয়িম্মায়ে তাফসীরগণের কোন কোন আয়াতের কোন তাফসীর বর্ণিত থাকে, তারপর কোন জনগোষ্ঠী এসে স্বীয় বিশ্বাসে মাযহাবের অনুকূলে নতুনভাবে আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে নতুন কোন কথা বর্ণনা করে, যা সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনের মাযহাব নয়, তাহলে এই ব্যক্তি মুতাজিলা ও অন্যান্য বিদআতি দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সর্বশেষ কথা হলো, যে ব্যক্তি সাহাবা ও তাবিঈনের মাযহাব ও তাদের তাফসীর গ্রহণ না করে কোন বিপরীত বর্ণনা গ্রহণ করে, তবে সে তাফসীরে অন্যায়কারী বরং বিদাআতকারী হবে। কেননা সাহাবা ও তাবিঈন কুরআন মাজীদের অর্থ ও তাফসীর সম্পর্কে বেশী বিজ্ঞ ছিলেন। আল্লাহ যে মহাসত্যসহ রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে প্রেরণ করেছিলেন, সে সম্পর্কেও ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞানী। (ইতকান, ২খ. পৃ. ১৮)

 

সারকথা, বর্তমানে বর্তমানে কুরআন মাজীদের তাফসীর ও অর্থ নির্ধারণের সবচেয়ে সহজ ও গ্রহণযোগ্য উপায় হলোঃ

প্রথমতঃ পূর্ববর্তী বুজুর্গগণ, সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন, তাবে-তাবেঈন আর মুফাসসিরীনে কিরামের বর্ণনা ও তাফসীরসমূহের উপর দৃষ্টিপাত করতে হবে। কোন আয়াতের তাফসীর ঐ সমস্ত বুজুর্গের তাফসীরের সাথে মিলে গেলে তা-ই কুরআনের মর্মার্থ মনে করে শান্ত হতে হবে। তবে আরো বেশী আত্মপ্রশান্তি ও বক্ষ প্রসারিত (অধিক জ্ঞান) করার জন্য যদি হাদিসসমূহ ও কুরআন মাজীদের অন্যান্য আয়াতের দ্বারা এই তাফসীরের উৎস খোঁজ করে বুঝতে পারে যে, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈন এই আয়াতের তাফসীর কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন, তাহলে এটাও একটি উত্তম ও ফলপ্রসূ জ্ঞান যা আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিয়ামত। কিন্তু এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, শুধু স্বীয় বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করে সাহাবা ও তাবিঈনের বিপরীত কোন বিষয়কে কুরআনের মর্মার্থ হিসেবে গ্রহণ করা জায়েয নয়।

দ্বিতীয়তঃ যদি কোন আয়াতের তাফসীর সাহাবা, তাবিঈন ও মুফাসসিরীনে কিরামের বর্ণনার সাথে না মিলে, তাহলে একমাত্র হাদিসসমূহের উপর গবেষণা করবে, যদি সেখানে কিছু ব্যাখ্যা বা ইঙ্গিতের দ্বারা আয়াতের মর্মার্থ নির্ধারণ করা যায়, তাহলে এটাকেই মর্মার্থ মনে করতে হবে।

তৃতীয়তঃ এরপর ঐ আয়াতের পূর্ব ও পরের বিষয় এবং অন্যান্য আয়াতের পর্যালোচনা করে যা কিছু মর্মার্থ বুঝে আসবে, তার উপর নির্ভর করবে।

চতুর্থতঃ যদি এর মধ্যেও কোন অবস্থাতেই আয়াতের তাফসীর প্রকাশ না পায় (যদিও তা অসম্ভব), তাহলে এরপর লুগাতে আরব ও নাহু-সরফ এবং মাআনী ও বালাগাতের দৃষ্টিতে এবং পূর্বাপর পর্যালোচনা করে যে মর্মার্থ উপলব্ধি হয়, সেটিকেই আয়াতের তাফসীর হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। কেননা সাহাবায়ে কিরাম এ ধরণের আয়াতের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, "কাব্য ও কবিতা আরবের দপ্তর। তাই যখন কুরআনের কোন শব্দ আমাদের উপর প্রচ্ছন্ন বা অপ্রকাশিত হয়ে পড়ে, তখন আমরা ঐ দীওয়ান বা দপ্তরের দিকে ফিরে আসবো।" (ইতকান, ১খ. পৃ. ১২১)

কিন্তু আহলে ইলম বা উলামা সম্প্রদায়ের কাছে এটা গোপন নয় যে, সর্বশেষ তিনটি পদ্ধতি, বিশেষ করে চতুর্থ পদ্ধতি খুবই দুর্লভ ও বিরল। বরং যদি বলা হয় যে, একেবারেই অস্তিত্ব নেই, তাহলেও অত্যুক্তি হবে না। কেননা প্রায় সমগ্র কুরআন মাজীদের তাফসীর সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন ও পূর্ববর্তী ইমামগণ থেকে বর্ণিত এবং কিতাবের মধ্যে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। শুধু আনুমানিকভাবে সর্বশেষ তিনটি পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।

মোটকথা, বর্তমানে আমাদের জন্য তাফসীরে কুরআনের ব্যাপারে সহজ সরল ও সবচেয়ে প্রশান্তিমূলক উপায়, যাতে ভ্রান্তির অবকাশ থাকবে না, তা শুধু এই যে, আমরা সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন ও পূর্ববর্তী ইমামগণের তাফসীরের উপর নির্ভর করবো। যদি এর বিপরীত কোন অর্থ অনুভূত হয়, তাহলে তা স্বীয় জ্ঞান ও অনুভূতির স্বল্পতা মনে করতে হবে। কেননা আমরা উপরে বর্ণনা করে এসেছি যে, সমস্ত দুনিয়া একত্রিত হলেও এ সম্পর্কে সাহাবায়ে কিরামের সমকক্ষ হতে পারবে না। তাছাড়া প্রকাশ্য বর্ণনায় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও প্রচলিত নীতির দাবি হচ্ছে, বাক্যের মর্মার্থ যতটুকু এর সম্বোধিত ব্যক্তি বা তার শাগরিদগণ উপলব্ধি করতে পারেন, পাঠক লিখিত কিতাব পাঠ করে ততটুকু উপলব্ধি করতে পারে না।

 

একটি সন্দেহ ও তার অপনোদন

সম্ভবত এটা কারো ধারণা হতে পারে যে, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনদের বর্ণনা তাফসীরের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। তাহলে এ অবস্থায় তা কিভাবে সমাধানযোগ্য হতে পারে ?

তাই প্রথমত এই মতভেদ পর্যবেক্ষণকারী লৌকিকতা ছাড়াই এই সিদ্ধান্তে পৌছতে পারে যে, ঐ সমস্ত মতবিরোধ বাস্তবে মতবিরোধ নয়। মূলত তা শুধু ব্যাখ্যা, উপমা এবং শব্দ ও শিরোনামের পার্থক্য, যদিও সাধারণভাবে দর্শনকারী এটিকে মতবিরোধ মনে করে।

যেমন, "صراط المستقيم" এর তাফসীরে কোন কোন সাহাবায়ে কিরাম বলেছেন যে, এর দ্বারা কুরআন অনুসরণ করা বুঝায়। কেউ কেউ "ইসলামের" দ্বারা এর তাফসীর করেছেন, কেউ কেউ সুন্নাত ও জামাআত দ্বারা, কোন কোন সাহাবা ইবাদাতের প্রক্রিয়া দ্বারা, কেউ কেউ আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য দ্বারা এর তাফসীর করেছেন।

এ সমস্ত বর্ণনা বাহ্যত ভিন্ন দৃষ্টিগোচর হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলোর মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। কেননা কুরআন অনুসরণই প্রকৃতপক্ষে ইসলাম এবং এর নামই সুন্নাত ও জামাআত। এটিই আল্লাহ'র ইবাদাত করার পদ্ধতি আর এটিই আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য ও অনুসরণ (ইবাদাতের প্রক্রিয়া)।

অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরামের মতপার্থক্য এ ধরণের ব্যাখ্যার উপর প্রভাব পড়ে , এমন মতবিরোধ খুব কমই আছে। শায়খ জালালুদ্দীন সুয়্যুতি বলেন, "এ কারণেই বলা যায়, সাহাবায়ে কিরাম কুরআনের জ্ঞান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মধ্যস্থতা দ্বারাই অর্জন করেছেন বলে কুরআনের তাফসীর পর্যায়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য খুব কমই ছিলো।"

এরপর যে সমস্ত আয়াতের তাফসীরের ব্যাপারে সাহাবাদের বর্ণনায় প্রকৃত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, এগুলোর মধ্যে তাবিঈন ও আয়িম্মায়ে মুজাহিদীন বর্ণনার সনদ, সংরক্ষণ, সতর্কতা ও বর্ণনাকারীদের সিকাহ বা বিশ্বাসযোগ্যতার দিক দিয়ে অগ্রাধিকার দানের পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ কারণে আল্লাহ'র অনুগ্রহে এ ব্যাপারেও কোন অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। ফলে তাফসীর লেখকগণের এ পথে চলার ক্ষেত্রে কোনরূপ পদস্খলনের আশংকা নেই।

এই মানদণ্ড বর্তমান থাকার কারণে কোনটি ভুল, কোনটি শুদ্ধ আর কোনটি হক, কোনটি বাতিল তার ফয়সালা সহজেই হয়ে যেতে পারে। তেরশো বছর পর্যন্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকগণ এই নিয়মকেই অনুসরণ করেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ পথেই চলতে থাকবেন।

এ প্রেক্ষিতে মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী কুরআন মাজীদের তাফসীরের জন্য কি মাপকাঠি স্থির করেছেন আর এটা কতোটা নির্ভরযোগ্য ও সমাধানযোগ্য মাপকাঠি হতে পারে, এখানে আমরা তার বিশ্লেষণ পেশ করবো।

 

কুরআনের তাফসীরে মীর্জা নির্ধারিত মাপকাঠি

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনের পদ্ধতিতে মীর্জার পক্ষে কুরআনের আয়াতের অর্থে বিকৃতি সাধন ও পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সন্দেহ সৃষ্টির কোন উপায় ছিলো না। তাই কুরআনের তাফসীর করার জন্য তিনি উক্ত মাপকাঠি ও পদ্ধতিটাই বদলে দেওয়া জরুরী মনে করেছেন।

তাই স্বীয় পুস্তিকা "بركات الدعاء" এর ১৩ পৃষ্ঠায় এবং "لغاء" নামক পুস্তিকার ১৫ পৃষ্ঠায় এ বিষয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে তাফসীরের জন্য সাতটি মাপকাঠি স্থির করেছেন। এতে তার পুরনো অভ্যাস অনুযায়ী জনসাধারণকে প্রলুব্ধ করার জন্য কয়েকটি সর্বসম্মত মাপকাঠিরও উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু আসলে তাদের কাছে সপ্তম মাপকাঠি আমলের যোগ্য। সুতরাং তাদের বর্ণনা হলো এই যে, এই মাপকাঠিতেই অন্য সকল মাপকাঠি শামিল ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এই সাতটি মাপকাঠির মধ্যে চারটি উপরে আমাদের উদ্ধৃতির মধ্যে রয়েছে। আর তা হচ্ছে স্বয়ং - (১) কুরআনের অন্যান্য আয়াত, (২) হাদিসসমূহ, (৩) সাহাবাদের বর্ণনা ও (৪) তাবিঈদের বর্ণনা। আর তিনটি মাপকাঠি নিজের পক্ষ থেকে এরূপ উদ্ভাবন করেছেন, যাতে মীর্জা সাহেব যে কোন প্রয়োজন কুরআন মাজীদ থেকে পূরণ করতে পারেন আর তার বিকৃত তাৎপর্যাবলীকে কুরআনের তাফসীরে বলে চালিয়ে দিতে পারেন। তিনি বলেনঃ

পঞ্চম মাপকাঠি হলো, স্বীয় পবিত্র আত্মা নিয়ে কুরআনে গবেষণা করা।

ষষ্ঠ মাপকাঠি হলো, আধ্যাত্মিক ক্রমধারা উপলব্ধি করার জন্য দৈহিক কর্মধারা অতি প্রয়োজন, কেননা আল্লাহ তাআলার উভয় ক্রমধারার মধ্যে পূর্ণ সাযুজ্য ও সামস্য রয়েছে।

সপ্তম মাপকাঠি হলো, হাদিসবিদদের উচ্চ মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস। আর এই মাপকাঠিটিই সম্ভবত সমস্ত মাপকাঠির পরিবেষ্টনকারী।

আমরা এ বিষয়টি নিষ্ঠাবান পাঠকদের কাছে ছেড়ে দিচ্ছি। যে তিনটি মাপকাঠি মীর্জা কাদিয়ানী তৈরি করেছেন, তা কুরআনের অর্থ নির্ধারণ করার জন্য মাপকাঠি হতে পারে কিনা এবং এর দ্বারা আমরা তাফসীর অধ্যায়ে ভুলত্রুটি পার্থক্য করতে সক্ষম হতে পারি কিনা, তা তারাই বিবেচনা করবেন।

যে ব্যক্তি সামান্যতম জ্ঞান ও বুদ্ধি রাখেন তিনি কোন চিন্তা ছাড়াই এটা উপলব্ধি করতে পারেন যে, এই মাপকাঠি কোনমতেই চূড়ান্ত ফয়সালাকারী হতে পারে না।

কেননা, এগুলোর মধ্যে প্রথম (পঞ্চম হিসেবে উল্লিখিত) মাপকাঠির দৃষ্টিতে কুরআনের অর্থ অনুধাবন করার জন্য প্রত্যেকেই বিশেষজ্ঞ হয়ে যেতে পারে। প্রতিটি নির্বোধ ব্যক্তি বলতে পারে যে, আমার পবিত্র আত্মা এ আয়াতের এই অর্থ স্থির করেছে, আর কুরআনি ঘোষণা - "প্রত্যেক গোষ্ঠীই নিজের মত নিয়ে আনন্দে বিভোর।" (সূরাহ মুমিনুন, ২৩ : ৫৩) এর দাবি অনুযায়ী প্রত্যেকেই স্বীয় ধারণা অনুযায়ী স্থির করা অর্থকে হক ও সঠিক বলে গণ্য করবে। এর ফলে কুরআনুল কারীমে তাফসীর যতো মুখ ততো সংখ্যক হয়ে যাবে।

এছাড়া যে মাপকাঠি দ্বারা ভুলত্রুটি পার্থক্য হতো, হক-না হক সমাধান হতো, উক্ত মাপকাঠি দ্বারা তা সম্ভব হবে না। এই পৃথক ও অদ্ভুত মাপকাঠির ফলে সবচেয়ে অসত্য ও অর্থহীন চিন্তাধারাকে অর্থহীন ও অসত্য বলা কারো পক্ষে সম্ভব হবে না।

এমনিভাবে, দ্বিতীয় (ষষ্ঠ হিসেবে উল্লিখিত) মাপকাঠিও এক আশ্চর্য হেঁয়ালি ও প্রহসন, যার দ্বারা কোন সমস্যার সমাধান হয় না। কেননা সম্ভবত এর দ্বারা মীর্জা সাহেবের উদ্দেশ্য হলো, কুরআনের আয়াতের তাফসীর এমন পদ্ধতিতে করা উচিত, যা দৈহিকভাবে অনুভূত, পর্যবেক্ষণ ও প্রচলিত রীতির সাথে সঙ্গতিসম্পন্ন হবে, কোন আয়াতের তাফসীর স্বভাব নিয়ম লঙ্ঘনমূলক ও সাধারণ পর্যবেক্ষণ পরিপন্থি ধারায় করা উচিত না।

কিন্তু পাঠকমণ্ডলী উপলব্ধি করেছেন যে, এর দ্বারা মীর্জার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মুজিযাকে অস্বীকার করা। অথচ তা ইসলামের মৌলিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত এবং সে বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের মুতাওয়াতির বর্ণনা ও অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। তাই এই মাপকাঠি তাফসীরের ক্ষেত্রে কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়, বরং তা ইসলামের মৌলিক বিষয়ের পরিপন্থি।

তৃতীয় (সপ্তম হিসেবে উল্লিখিত) মাপকাঠিকে মীর্জা গোলাম আহমাদ সমস্ত মাপকাঠির উপর শ্রেষ্ঠ বলে স্থির করেছেন। কিন্তু সেটি প্রকৃতপক্ষে কুরআনে আযীযের সুস্পষ্ট অকাট্য আয়াতসমূহের পরিবর্তন ও রুপান্তর করার একটা সহজতর ধোঁকা ও সূক্ষ্ম কৌশল। কেননা আউলিয়ায়ে কিরাম ও মুহাদ্দিসগণের অন্তর্দৃষ্টি শয়তানের ধোঁকা থেকে সুরক্ষিত নয়। পক্ষান্তরে রাসুলগণের ওহী আর কুরআন মাজীদ এর থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র ও নিরাপদ। ওহীর সাথে আল্লাহ তাআলার পুলিশ (ফেরেশতা) সামনে ও পিছনে নিরাপত্তার জন্য এসে থাকেন। তাই ইরশাদ হয়েছে -

"... তিনি তার সামনে ও পিছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।" (সূরাহ আল-জীন্ন, ৭২ : ২৭)

সুতরাং একটি নিষ্কলুষ ও নির্ভরযোগ্য কালাম অন্য একটি সন্দেহযুক্ত অন্তর্দৃষ্টির উপর নিবদ্ধ হতে পারে না। কিন্তু জ্ঞানী বুদ্ধিজীবীগণ সামান্য চিন্তা করলে লৌকিকতা ছাড়াই এই সিদ্ধান্তে পৌছতে পারেন যে, এই মাপকাঠির দ্বারা কুরআন মাজীদের উপর নিজের ইচ্ছামূলক অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই মীর্জা কাদিয়ানীর একমাত্র উদ্দেশ্য। কেননা, অন্যদিকে তার মুহাদ্দিস, মুজাদ্দিদ এমনকি নবী হওয়ারও দাবি রয়েছে।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস সম্পর্কে "শাহাদাতুল কুরআন" নামক স্বীয় গ্রন্থে তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, "যে সমস্ত হাদিস আমার ওহীর বিরোধী, তা অকেজো বলে গ্রহণযোগ্য।"

তাফসীরের এই মাপকাঠির স্পষ্ট উদ্দেশ্য এটাই যে, যে সমস্ত তাফসীর মীর্জার অন্তর্দৃষ্টি ও মনগড়া ওহীর সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়, তাকে তিনি বাজে ও অগ্রহণযোগ্য বলে প্রত্যাখ্যান করবেন।

এই সপ্তম মাপকাঠিকে অন্য সব কয়টি মাপকাঠির সাররূপে স্থির করা হয়েছে এবং এর সারমর্ম হলো, মীর্জা সাহেব কুরআনের যে তাফসীর করেছেন, একমাত্র তাই নির্ভরযোগ্য।

এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, এই প্রবঞ্চনার দ্বারা হাদিস ও কুরআন স্বীয় করতলগত করাই মীর্জার একমাত্র লক্ষ্য।

কিন্তু এটা স্মরণ রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলার কালাম ও তার সত্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীতে এ উদ্দেশ্যে এসেছেন যে, পৃথিবী (তথা সমগ্র সৃষ্টি) তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণ করবে। এ উদ্দেশ্যে নয় যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে কোন কামনালোলুপ মানুষের আবেগের অনুসরণকারী হয়ে যাবেন। যদি তাই হয়, তাহলে দুনিয়াবাসী সংকটে পতিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

"যদি তিনি (রাসুল) অধিকাংশ বিষয়ে তোমাদের অনুসরণ করেন, তাহলে তোমরা সংকটে পতিত হবে।" (সূরাহ আল-হুজুরাত, ৪৯ : ৭)

আমার মত হলো, যদি কুরআনের তাফসীরের জন্য মীর্জা সাহেবের পেশকৃত তিনটি বিষয় মাপকাঠি হিসেবে স্থির করা হয়, তাহলে কুরআন প্রত্যেক ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিকের তাহরীফ বা বিকৃতকরণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়ে যাবে। বরং এ অবস্থায় কুরআন মাজীদ প্রত্যেক ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিকের খেলনায় পরিণত হবে আর তারা ইচ্ছা এর অর্থ ও তাৎপর্য পরিবর্তন করবে। কেননা এ তিনটির মাপকাঠির সারমর্ম হলো, কুরআনের তাফসীর শুধু এক ব্যক্তির জ্ঞান ও চিন্তাধারা আর অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভরশীল (এবং এ কথা খুবই স্পষ্ট যে, দুনিয়ার কোন লোকই নিজেকে জ্ঞান-বুদ্ধিহীন মনে করে না)।

প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের চিন্তাধারাকে কুরআনের তাফসীর বানাবে। এভাবে বিলায়েত ও মুকাশিফাতের (আল্লাহ'র নৈকট্য ও অন্তর্দৃষ্টি লাভের) দাবিও কারো জন্য কঠিন হবে না। প্রত্যেকেই যা ইচ্ছা তাই বলবে। কিন্তু এর ফলে কুরআনের তাফসীর ভিত্তিহীন ও প্রলাপে পরিণত হয়ে যাবে। তাই উম্মতে মুহাম্মাদীর উলামায়ে কিরাম এই বিষয়টি প্রথমেই মীমাংসা করার জন্য আকাইদের পর্যায়ে তা উল্লেখ করেছেন।

আল্লামা নসফী রাহিমাহুলাহ স্বীয় আকাইদের গ্রন্থে, আল্লামা তাফতাজানী রাহিমাহুল্লাহ'র শরাহ'র মধ্যে আর আল্লামা সুয়্যুতি "ইতকান" গ্রন্থে এটাকে জমহুর আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের (অধিকাংশ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআত) সর্বসম্মত নীতি বলে স্বীকার করেছেন।

"আয়াতের অর্থ এটাই সঠিক হবে, যা এর বাহ্যিক দৃষ্টিতে উপলব্ধি করা যায় আর এটা ছেড়ে বাতেনী ফিরকার দাবি অনুযায়ী আয়াতের তাৎপর্য গ্রহণ চরম নাস্তিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।" (আকাইদে নসফী)

মীর্জা গোলাম আহমাদ এখন জীবিত নেই। তার অনুসরণকারীদের উচিত আল্লাহ তাআলার কাছে লজ্জাবোধ করা আর স্বীয় আবেগ ও বাসনা পূরণ করার উদ্দেশ্যে কুরআন মাজীদকে শিশুদের খেলনা ও ঠাট্টা-বিদ্রুপের শিকারে পরিণত না করা।

পাঠকমণ্ডলী নিজেরাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হয়েছেন যে, কুরআন মাজীদের মর্মার্থ নির্ধারণ করার জন্য আল্লামা সুয়্যুতির মাধ্যমে বর্ণিত জমহুর উলামার পদ্ধতি ও নীতিই সবদিক দিয়ে নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য। যার অন্তরে আল্লাহ-ভীতি আর তার কালামের প্রতি সামান্যতম মর্যাদাবোধ রয়েছে, তিনি তাই বিবেচনা করবেন আর গ্রহণ করবেন।

এই আলোচনা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছুটা দীর্ঘ হয়ে গেলো। তবু এর মূলে আমাদের এই উদ্দেশ্য রয়েছে যে, এর ফলে চিন্তা ও বিবেচনার পথ স্পষ্ট হয়ে যাবে আর ভবিষ্যতে মীর্জা দলের যেসব উদ্ধৃতি উপস্থাপন করবো, তার কোনটা গ্রহণযোগ্য আর কোনটা বর্জনীয় তা পাঠকবৃন্দ নিজেরাই ঠিক করতে পারবেন।

এরপর আমরা আসল উদ্দেশ্যের দিকে ফিরে আসছি আর কুরআন মাজীদের আয়াতের ভিত্তিতে খতমে নবুওয়াতের প্রমাণ উপস্থাপনা করছি।

 

(ইন শা আল্লাহ, চলবে .......)

 

মূলঃ খতমে নবুওয়াত (মুফতি মুহাম্মাদ শফী রাহিমাহুল্লাহ)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-4f

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী মতবাদ - ৩ (প্রথম অংশ)

 

 

The Greatest Nation·Friday, March 8, 2019

 

 

 

প্রথম অংশ - পবিত্র কুরআনে খতমে নবুওয়াত

 

প্রথম আয়াত

مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَـٰكِن رَّسُولَ اللَّـهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ۗ وَكَانَ اللَّـهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا

"মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন, কিন্তু তিনি আল্লাহ'র রাসুল ও নবুওয়াতের ক্রমধারা সমাপ্তকারী বা শেষ নবী; আল্লাহ প্রত্যেক বস্তু সম্পর্কে বিজ্ঞ।"

(সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৪০)

 

শানে নুযূল বা অবতীর্ণ হওয়ার উপলক্ষ

উপরোক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার উপলক্ষ হলো, নবুওয়াতের আলোকরশ্মি উদয় হওয়ার পূর্বে সমগ্র আরব সমাজ ধ্বংসকারী ও হাস্যাস্পদ এবং লজ্জাজনক রীতিনীতির মধ্যে নিপতিত ছিলো, পালিত পুত্রকে ঠিক ঔরসজাত মনে করা ছিলো তন্মধ্যে একটি। তাকে তার পুত্র হিসেবে ডাকা হতো আর মৃত্যুর পর সে তার মীরাসের অংশীদার হতো, তার সাথে রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে হালাল-হারামের সমস্ত আহকাম স্বীকার করা হতো। যেভাবে ঔরসজাত ছেলের মৃত্যুর পর অথবা তালাক দেওয়ার পর পিতার জন্য পুত্রের (বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা) স্ত্রীকে বিয়ে করা হারাম, তেমনি তার পোষ্যপুত্রের মৃত্যু বা তালাক দেওয়ার পর স্ত্রীকে বিয়ে করাও পালক পিতার জন্য হারাম মনে করা হতো।

এ প্রথা ও রীতির ফলে নানাবিধ ঝগড়া ও ফাসাদের সৃষ্টি হতো। তন্মধ্যে এগুলো উল্লেখযোগ্য - (১) বংশের মিশ্রণ, (২) শরীআত অনুযায়ী যে অংশীদার নয় এমন ব্যক্তিকে অংশীদার হিসেবে গণ্য করা, (৩) শরীআত অনুযায়ী হালালকে নিজের পক্ষ থেকে হারাম জানা ইত্যাদি।

যে ইসলাম কুফর ও গুমরাহীর কুপ্রথাগুলো থেকে দুনিয়াকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে এসেছিলো এবং সেসব প্রথার মূলোৎপাটনই যার লক্ষ্য হওয়া উচিত, সেই ইসলাম এতো বড় একটা কুপ্রথাকে কিছুতেই বৈধ মনে করতে পারে না। সুতরাং ইসলাম এর জন্য দুটি পন্থা অবলম্বন করেছে - (এক) বর্ণনামূলক, (দুই) বাস্তবে পালন। একদিকে এই ঘোষণা করেছে -

"আল্লাহ তোমাদের পোষ্যপুত্রকে তোমাদের ঔরসজাত পুত্র হিসেবে স্থির করেননি। এটা তোমাদের মুখের কথা, আল্লাহ সঠিক কথা বলেন আর তিনিই সঠিক পথ প্রদর্শন করেন। পোষ্যপুত্রদেরকে তাদের পিতার নামে আহবান করো, এটিই আল্লাহ'র কাছে অধিক ন্যায়সঙ্গত কাজ।" (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৪-৫)

বংশ ও সম্পত্তির অংশীদারিত্বে এবং হারাম ও হালাল ইত্যাদিতে মুখ ডাকা পুত্রকে ঔরসজাত পুত্রবৎ মনে না করা এবং তাকে তার জন্মদাতা পিতার সন্তান হিসেবে ডাকা ও পরিচয় দান করাই আল্লাহ'র কাছে ইনসাফপূর্ণ বিধান। এই পর্যায়ে পূর্ববর্ণিত প্রথাটি রহিত করাই এ আয়াতটির উদ্দেশ্য।

ওহী নাযিল হওয়ার পূর্বে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়দ ইবনে হারিসা রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে (যিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোলাম ছিলেন) আযাদ করে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সমস্ত লোক এমনকি সাহাবায়ে কিরাম পর্যন্ত আরবের পুরনো রীতি অনুযায়ী তাকে যায়দ ইবনে মুহাম্মাদ বলে ডাকতো।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়, ঐ সময় আমরা ঐ রীতি ছেড়ে তাকে যায়দ ১ ইবনে হারিসা বলে ডাকা শুরু করি। সাহাবায়ে কিরাম এ আয়াত নাযিল হওয়ার সাথে সাথে পুরনো রীতি ত্যাগ করেন, কিন্তু প্রচলিত কোন রীতির বিরোধিতা ও পরিত্যাগ করা হলে আত্মীয়-স্বজন ও স্বীয় গোত্রের হাজারো ঠাট্টা-বিদ্রুপের শিকার হতে হয়, যা সহ্য করা প্রত্যেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এই কুপ্রথাটিকে স্বীয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বারা বাস্তবভাবে রহিত করাই আল্লাহ'র ইচ্ছা ছিলো। সুতরাং যখন যায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় স্ত্রী যয়নাব রাদিয়াল্লাহু আনহা'কে পারস্পরিক তিক্ততার কারণে তালাক দেন, তখন আল্লাহ স্বীয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে নির্দেশ দেন তাকে বিয়ে করার, যেন এই রীতিটি চিরতরে ও সম্পূর্ণরূপে মূলোৎপাটিত হয়ে যায়। সুতরাং ইরশাদ হয়েছে -

"..... এরপর যায়দ যখন তার থেকে প্রয়োজন শেষ করলো (অর্থাৎ, তালাক দিলো), তখন আমি তার সাথে তোমাকে বিয়ে দিলাম, যেন মুমিনদের জন্য কোন অসুবিধা না থাকে তাদের পালকপুত্রদের স্ত্রীদের (বিয়ে করার) ক্ষেত্রে...." (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৩৭)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ'র নির্দেশে বিয়ে করেন। এদিকে পূর্বের ধারণা অনুযায়ী সমস্ত আরবের কাফিরদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি হলো যে, "এই নবীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখো, নিজের পুত্রবধূকে বিয়ে করেছেন।"

এ সমস্ত লোকের নিন্দা ও প্রতিবাদের উত্তরে ঐ আয়াত নাযিল হয়, যা আমরা এখানে দলীল হিসেবে উল্লেখ করছি -

"মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন, কিন্তু তিনি আল্লাহ'র রাসুল ও নবুওয়াতের ক্রমধারা সমাপ্তকারী বা শেষ নবী ..." (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৪০)

আয়াতটির বক্তব্য হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন পুরুষের বংশগত পিতা নন। যায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু'রও বংশগত পিতা নন। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য তার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করা জায়েয ও উত্তম হয়েছে। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে নিন্দা করা সম্পূর্ণ বোকামি ও মূর্খতা।

তাদের দাবি রহিত করার জন্য এতটুকু বলে দেওয়াই যথেষ্ট ছিলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পিতা নন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার নিন্দাকারীদেরকে অতি কঠোরভাবে প্রতিহত ও তাদের কথাকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করার জন্য এই বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন। কথা শুধু এতটুকুই নয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পিতা নন, বরং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন পুরুষেরই পিতা নন। অর্থাৎ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন পুত্র সন্তানই নেই। অতএব, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের পুত্রবধুকে বিয়ে করেছেন, এরূপ অপবাদ দেওয়া অতি বড় যুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়।

যদি বলা হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারজন পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন - (১) কাসিম, (২) তাইয়্যেব, (৩) তাহের - খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র গর্ভজাত এবং (৪) ইব্রাহীম- মারিয়া কিবতীয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা'র গর্ভজাত, তাহলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কারো পিতা নন বলা কেমন করে যথার্থ হতে পারে ?

এর উত্তর স্বয়ং কুরআনে কারীমের শব্দে বিদ্যমান রয়েছে। কেননা এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন পুরুষের পিতা নন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারজন পুত্রই শিশুকালে ইন্তিকাল করেছেন। তাদেরকে পুরুষ বলার সময় ও সুযোগ হয়নি। আয়াতে رجالكم শব্দ এ কারণেই সংযোজন করা হয়েছে।

অধিকন্তু এটাও বলা যায় যে, আয়াত নাযিল হওয়ার সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন পুত্র সন্তান জীবিত ছিলেন না। কাসিম, তাইয়্যেব ও তাহের ইন্তিকাল করেছিলেন এবং ইব্রাহীম তখনো জন্মগ্রহণ করেননি। তাই ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে সাধারণভাবে এটা বলা বৈধ যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন পুরুষ বা ছেলের পিতা নন।

মোট কথা, এই আয়াতটির নাযিল হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের উপর কাফির ও মুনাফিকদের আরোপিত কলঙ্ক অপনোদন করা আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্রতা ও উঁচু মর্যাদা বর্ণনা করা, আর এটিই আয়াতের শানে নুযূল।

 

এরপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে -

"..... কিন্তু তিনি আল্লাহ'র রাসুল ও নবুওয়াতের ক্রমধারা সমাপ্তকারী বা শেষ নবী ..." (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৪০)

এই বাক্যাংশের সাথে আমাদের বক্তব্য অধিক সম্পর্কিত। সুতরাং পরবর্তীতে আমাদের আলোচনা, বর্ণনা ও তাফসীর শুধু এই বাক্য সম্পর্কেই হবে। কিন্তু এর পূর্বে আয়াতের তাফসীর পূর্বে উল্লিখিত নীতি (আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি) অনুযায়ী কুরআন ও হাদিস ইত্যাদির সাহায্যে পেশ করবো। এই বাক্যাংশে প্রথম বাক্যের সাথে কি সম্পর্ক রাখে তাও বলা আবশ্যক। আয়াতের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার জন্য তা খুবই সহায়ক হবে।

 

উপরিউক্ত আয়াতে উভয় বাক্যের মধ্যে পার্থক্য

আয়াতের প্রথম বাক্যে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন পুরুষের পিতা নন। সাধারণ পর্যবেক্ষণে এর উপর কিছু সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে। এটা দূরীভূত করার জন্য দ্বিতীয় বাক্যটি "ولكن" শব্দ দ্বারা বর্ণনা করেছেন। কেননা আরবি ভাষাতত্ত্ব অনুযায়ী প্রথম বাক্যে যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়, দ্বিতীয় বাক্যে তা দূর করার উদ্দেশ্যেই এই শব্দটির ব্যবহার হয়ে থাকে। ঐ সন্দেহগুলো হলো -

প্রথমত, পিতৃত্বের জন্য যে পিতৃস্নেহের প্রয়োজন তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বর্তমান ছিলো না। অথচ একজন নবী ও রাসুলের জন্য উম্মতের উপর অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ হওয়া খুবই প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, একথা সর্বজনবিদিত যে, প্রত্যেক নবী স্বীয় জাতি ও উম্মতের পিতৃতুল্য হয়ে থাকেন।

ইমাম রাগিব ইস্পাহানী বলেন, "যদি কোন জিনিসের সৃষ্টি, সংশোধন, সংস্কার কিংবা প্রকাশমান হওয়ার নিমিত্ত হয়, তাকেই সে জিনিসের পিতা বলা হয়। এ কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে মুমিনদের পিতা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন -

'নবী মুমিনদের ব্যাপারে তাদের নিজেদের তুলনায়ও অধিক দায়িত্বশীল, তার স্ত্রীগণ তাদের মা, .....' (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৬)

কোন কোন পাঠে 'اولي' (নিকটবর্তী দায়িত্বশীল) এর পরিবর্তে তাকে (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিতা 'اب' বলা হয়েছে।"

সারকথা হলো, নবী হওয়ার জন্য পিতা হওয়া আবশ্যক। তাই যখন উপরিউক্ত আয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতৃত্বকে (পিতা হওয়া) অস্বীকার করা হয়েছে, তখন সাধারণ পাঠকের মনে এই সন্দেহ জাগতে পারে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কারোর পিতা নন, তখন হয়তো তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতও নেই।

তৃতীয়ত, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতৃত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে, তখন এত বাহ্যিক দৃষ্টিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুণাবলীর মধ্যে অনিবার্যভাবে এক প্রকারের ঘাটতি দেখা দেয়। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন জীবিত পুত্র নেই। অধিকন্তু এর দরুন কাফিরদের হাসি-ঠাট্টারও একটা সুযোগ হয়ে যায়, যা তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে আবতার (ابتر) বা সন্তানহীন হওয়া ত্রুটি হিসেবে প্রচার করতো।

মোটকথা এই যে, আয়াতের প্রথম বাক্যে এ ধরণের কিছু সন্দেহ পরিলক্ষিত হওয়া স্বাভাবিক। এগুলো দূরীভূত করার জন্য ইরশাদ হয়েছে -

وَلَـٰكِن رَّسُولَ اللَّـهِ

"... কিন্তু তিনি আল্লাহ'র রাসুল ...."

এখানে, "لكن" শব্দ দ্বারা উপরিউক্ত সন্দেহ দূর করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যদিও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন ঔরসজাত পুত্র ছিলো না, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই দৃষ্টিতে কোন পুরুষের পিতা নন, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ'র রাসুল ছিলেন এবং রাসুল স্বীয় উম্মতের পিতা হয়ে থাকেন। যেমন আমরা উপরে ইমাম রাগিবের বর্ণনা উদ্ধৃত করে এসেছি যে, কোন কোন পাঠে পবিত্র কুরআন স্বয়ং স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে মুসলমানদের পিতা বলে ঘোষণা করেছে। এ কারণেই লুত আলাইহিস সালাম স্বীয় উম্মতের মেয়েদের সম্পর্কে বলেছেন -

هَـٰؤُلَاءِ بَنَاتِ

".... এগুলো আমার কন্যা ...." (সূরাহ হুদ, ১১ : ৭৮)

(এ কথা নবী হিসেবেই বলেছিলেন, যদিও তারা তার ঔরসজাত নয়)

এই দৃষ্টিকোণ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লাখো সন্তান রয়েছে, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লাখো পুরুষের পিতা। এর সারকথা হলো, পিতৃত্ব দুই প্রকার -

প্রথম প্রকার হচ্ছে, দৈহিক পিতৃত্ব (বংশগত ও দুগ্ধজাত), যার উপর হালাল-হারামের আহকাম আরোপিত হয় আর যার ফলে পুত্রবধু হারাম হয়ে যায় ইত্যাদি।

দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে, আত্মিক পিতৃত্ব, যার উপর হালাল-হারামের আহকাম আরোপিত হয় না। তবে সন্তানের পক্ষ থেকে সম্মান আর পিতার পক্ষ থেকে স্নেহ-মমতা ঔরসজাত ও বংশগত পিতার মতো, বরং তার চেয়ে অধিক হওয়া প্রয়োজন। যেমন উস্তাদের পিতৃ সম্পর্ক ছাত্রের জন্য আর পীরের সম্পর্ক মুরিদের জন্য অথবা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্নেহ মুহাব্বাত ও সম্পর্ক সমগ্র উম্মতের জন্য। সুতরাং - "মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন" - এ আয়াতাংশের মধ্যে প্রাথমিক অর্থে পিতৃত্বের অস্বীকৃতি, আর - "কিন্তু তিনি আল্লাহ'র রাসুল" এ আয়াতাংশের মধ্যে পিতৃত্বের স্বীকৃতি রয়েছে।

এই একটি বাক্য তিনটি সন্দেহ দূরীভূত করেছে, কেননা -

১. এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বীয় উম্মতের আত্মিক বা রূহানী পিতা এবং রূহানী পিতা অর্থাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্নেহ-মমতা ও অনুগ্রহ স্বীয় সন্তানের উপর বংশগত পিতার তুলনায় বেশী হয়ে থাকে। এজন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশগত পিতা না হওয়ায় তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্নেহ-মমতা ও অনুগ্রহ কম হওয়া জরুরী নয়।

২. এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, নবীর জন্য যে ধরণের পিতা হওয়া প্রয়োজন তা আয়াতে অস্বীকার করা হয়নি, বরং বংশগত ও দুগ্ধজাত পিতা হওয়াকে অস্বীকার করা হয়েছে। তাই দ্বিতীয় সন্দেহকেও দূরীভূত হয়েছে।

৩. এটিও অতি সুন্দরভাবে প্রতীয়মান হলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্তানহীন ও বংশহীন নন। কাফিররা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বলে তা ভিত্তিহীন। বরং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এতো অধিক সন্তান রয়েছে, যা আজ পর্যন্ত কারো জন্য হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের মধ্যে অসংখ্য পুরুষের পিতা। এর দ্বারা তৃতীয় সন্দেহটিও দূরীভূত হয়েছে।

এই তিনটি সন্দেহই উপরিউক্ত বর্ণনার দ্বারা অপনোদিত হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে স্বীয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্রতা প্রকাশ করতে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গুণাবলী ও কামালাত এবং সবচেয়ে মমতা ও স্নেহ প্রবণ হওয়ার গুণ সম্পর্কে জ্ঞাত করতে ইচ্ছুক, যেন গাফিল সজাগ হয়ে যায় আর আল্লাহ তাআলার শেষ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পদাংক অনুসরণ করে। সুতরাং ইরশাদ হয়েছে -

وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ

অর্থাৎ, তিনি নবী-রাসুলগণের ক্রমধারা খতমকারী, তিনি শেষ নবী।

সর্বজ্ঞানী ও হিফাযতকারী আল্লাহ তাআলা স্বীয় পবিত্র কালামের এক-একটি শব্দে কি কি রহস্য ও সূক্ষ্ম ব্যাপার রেখে দিয়েছেন আর এতে কি কি কল্যাণের তাৎপর্য নিহিত রয়েছে তা তিনিই সর্বাধিক জানেন। আমরা আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি, তা বর্ণনা করছি। এই আয়াতটিতে কতগুলো কল্যাণকর তাৎপর্য লক্ষ্য করা যেতে পারে, যেমন -

১. যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবতার বা নির্বংশ হওয়ার কুৎসা রটনা করে, তাদেরকে যেন বলে দেওয়া হলো যে, "হে ভ্রান্তের দল, তোমরা যে পবিত্র মহামানবের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর আবতার (নিঃসন্তান) হওয়ার কালিমা লেওপন করছো, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কেননা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতো অসংখ্য সৃষ্টিকুলের পিতা, যা কারো ধারণা ও কল্পনায়ও আসতে পারে না।"

প্রথমত, অধিকাংশ রাসুল স্বীয় উম্মতের পিতা হওয়ার কারণে এতো অসংখ্য বংশধারা ও সন্তান রাখেন, যা কোন মানুষ ধারণা করতে পারে না এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তিকালের পর যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য কোন রাসুল প্রেরিত না হোন, ততদিন পর্যন্ত তার উম্মতের মর্ত্যে জন্মগ্রহণকারী সমস্ত মানুষই তার সন্তানরূপে গণ্য। এভাবেই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিতৃত্বের ক্রমধারা অব্যাহত ধারায় চলতে থাকে। এরপর বিশেষত এ সম্মানিত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শেষ নবী, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর কোন নবী আসবেন না। তাই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিতৃত্বের ক্রমধারা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যে অসংখ্য মুসলমান জন্মগ্রহণ করবে, সকলেই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সন্তানরূপে গণ্য হবে। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত নবী ও রাসুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সন্তানের পিতা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি এটা বলা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশী সন্তানের ধারক, তাহলে তা কিছুমাত্র অত্যুক্তি হবে না। এটাই উদ্দেশ্য ছিলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিন্মুলিখিত ফরমান ২ ও নির্দেশের -

"নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে অন্যান্য উম্মতের উপর গৌরব করবো।"

মোটকথা, আয়াতে "رسول الله" শব্দ দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিঃসন্তান ছিলেন না, বরং রাসুল হওয়ার কারণে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসংখ্য সন্তান রয়েছে।

এরপর "خاتم النبيين" বলে কাফিরদেরকে পূর্ণভাবে লাঞ্ছিত অপমানিত করা আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ণতাকে অত্যন্ত ঔজ্জ্বল্যের সাথে প্রকাশ করার জন্য সম্ভবত এ দাবি করা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক সন্তানের ধারক ছিলেন, শুধু তাই নয়, এই নীল আকাশের ও যমিনের মাঝে সৃষ্ট কোন ব্যক্তিই সংখ্যাধিক্যের দিক দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমকক্ষ হতে পারবে না। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতৃত্বের ক্রমধারা কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আর কোন নবী আসবে না। সে সাথে এই অঙ্গীকারও রয়েছে যে, এই দৃঢ় ও মজবুত দ্বীন কখনোই পরিবর্তন হবে না , মানুষ ক্রমাগতভাবে এই দ্বীনকেই গ্রহণ করতে থাকবে। তাই এর সংখ্যা হবে কল্পনাতীত। হাদিসে উদ্ধৃত রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন ফেরেশতাগণ বলবেন, মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে যতো মানুষ এসেছে, এতো মানুষ আর কোন নবীর সাথে আসেনি।

দ্বিতীয়ত, এখানে "خاتم النبيين" শব্দ যোগ করে হয়তো সমগ্র বিশ্বের মানব জাতিকে এ বিষয়ের উপর সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, হে উচ্চাকাঙ্ক্ষাকারী ও উচ্চাভিলাষী লোকসকল, ইনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের শেষ নবী। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের শেষ পয়গাম ও নির্দেশাবলী নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছেন। এখনো সতর্ক হয়ে যাও আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণ করে ইহকাল ও পরকাল এবং পরকালের জীবন ও জীবিকাকে নিশ্চিত করে নাও। এরপর কোন নতুন আসমানি পয়গাম পৃথিবীর বুকে প্রেরণ করা হবে না এবং নতুন কোন পয়গম্বরও আবির্ভূত হবেন না। তাই এখন ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ এবং আল্লাহ'র নৈকট্য লাভ শুধু তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণের মধ্যে নিহিত। তার নির্দেশকে আল্লাহ'র অনুগ্রহ মনে করো আর ঠাট্টা-বিদ্রুপ থেকে বিরত থাকো।

এ কথাটি ঠিক এই ধরণের, যেমন দুনিয়ার প্রত্যেক ভাষায় বলা হয়ে থাকে যে - দেখো, এটা আমার শেষ কথা বা শেষ উপদেশ, এটা মূল্যবান মনে করো ও গ্রহণ করো।

তৃতীয়ত, যখন - ""মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন" - বাক্যে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতৃত্বের অস্বীকারে কারোর মনে সন্দেহ জাগতে পারে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃতিতে পিতৃস্নেহ বিদ্যমান নেই। তাই এটাকে রহিত করার জন্য "কিন্তু তিনি আল্লাহ'র রাসুল" বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, যদিও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারো বংশগত পিতা নন, কিন্তু তিনি আল্লাহ'র রাসুল হওয়ার কারণে বংশগত পিতা হওয়ার তুলনায় অনেক বেশী স্নেহশীল।

এরপর এই স্নেহ-মমতার পূর্ণতা বর্ণনা করার জন্য ইরশাদ হয়েছে -

وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ

অর্থাৎ, প্রথমত প্রত্যেক রাসুল স্বীয় উম্মতের পিতা এবং স্নেহ-মমতায় (বংশগত) পিতা অপেক্ষা বেশী স্নেহশীল। বিশেষত তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন শেষ নবী, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর কোন নবীর আগমন হবে না। এ অবস্থায় এটা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবী (আলাইহিমুস সালাম) থেকে বেশী স্নেহশীল হবেন এবং উম্মতের হিদায়াত, নসীহত ও মঙ্গলের জন্য কোন সূক্ষ্ম বস্তুও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাকি রাখবেন না। কেননা যে রাসুলের পরে অন্য রাসুল ও নবী আগমনের প্রত্যাশা থাকে, আর তখন যদি কোন বস্তু বা বিষয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তাহলে পরবর্তী আগমনকারী নবীগণ তা পূর্ণ করতে পারেন। কিন্তু যিনি সমস্ত নবী-রাসুলের সর্বশেষ হবেন, তার এটা চিন্তা হবে যে, মানবজাতির জন্য তিনি জীবন চলার পথকে এমনই সুগম করে যাবেন, যাতে তাদের ভবিষ্যতে পথভ্রষ্ট হওয়ার আশংকা না থাকে, এটাই তো তো স্বাভাবিক। মোটকথা, তিনি স্বীয় উম্মতের জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের স্নেহ-মমতার কাজ করবেন।

যেমন একজন বংশগত পিতা তার অবর্তমানে রেখে যাওয়া স্বীয় সন্তানাদি সম্বন্ধে অধিক চিন্তিত হবেন। বিশেষ করে যখন তার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে তার সন্তানদের পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করার কেউ না থাকে, তখন পিতার স্নেহ-মমতায় যে কতটুকু তীব্রতা প্রকাশিত হবে তা সহজেই অনুমেয়। এ অবস্থায় পিতা স্বীয় জীবনকালে এরূপ আসবাব বা ধন-সম্পদ জমা করার চিন্তা করবেন, যেন ভবিষ্যতে তার সন্তানগণ কারো মুখাপেক্ষী না হয়।

সুতরাং আমাদের আকায়ে নামদার সরওয়ারে কায়েনাত (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের জন্য শরীআতের সঠিক পথ এমনই স্পষ্ট করে গিয়েছেন যে, তা রাত ও দিনের মতোই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর পূর্ববর্তী শরীআতের কোন প্রয়োজন থাকেনি। পবিত্র কুরআন এই শরীআতের অনন্তকালের জন্য পরিপূর্ণতার কথা নিন্মলিখিত আয়াতে ঘোষণা করেছে -

".... আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম ...." (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ৩)

এর দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ববর্তী শরীআত অনন্তকালের জন্য পূর্ণতা এবং বাস্তব অর্থে পূর্ণতাপ্রাপ্ত ছিলো না। যদিও সে সময়ের ক্ষেত্রে ঐ সমস্ত পরিপূর্ণ ছিলো এবং এটাই আয়াতের মর্মার্থ। ইমাম রাযী রাহিমাহুল্লাহ তার "তাফসীরে কাবীর"-এ আয়াতের এরূপ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন।

মোটকথা, কুরআনের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে এ শরীআতকে অনন্তকালের জন্য পরিপূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে। তাই স্বীয় নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর কোন নবীরও প্রয়োজন নেই এবং কোন নতুন শরীআত উপস্থাপনকারীরও প্রয়োজন নেই। আল্লামা ইবনে কায়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, "উম্মাতে মুহাম্মাদীর বাস্তব অবস্থা এর বিপরীত। কেননা আল্লাহ তাআলা তাদেরকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কারণে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। তারা কোন নবীর মুখাপেক্ষী নয়, না কোন নতুন শরীআতদার, বরং ঐ সমস্ত গুণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃতিতে একত্র করা হয়েছে, যা অন্যান্য নবীর মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে ছিলো।" (রিসালাতিল ফুরকান, পৃষ্ঠা ৫৬)

মোটকথা, এই "خاتم النبيين" শব্দ দ্বারা এটা বলা উদ্দেশ্য ছিলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুলনামূলকভাবে অন্যান্য আম্বিয়া-কিরামের তুলনায় অনেক বেশী স্নেহশীল ছিলেন।

এরপর আমরা আয়াতের বিস্তারিত তাফসীর পাঠকের সামনে পেশ করবো। এতে তাফসীরের মানদণ্ড হিসেবে উলামায়ে উম্মত কর্তৃক নির্ধারিত মৌলনীতি অনুসরণ করা হবে। কিন্তু প্রত্যেকের প্রথম দৃষ্টি বাক্য ও ব্যবহৃত শব্দসমূহের আভিধানিক অর্থের উপর পড়ে এবং তা ঐ ভাষার কাওয়ায়েদ বা ব্যাকরণের সাহায্যে এর মর্মার্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা করে বিধায় বর্ণনার ক্রমধারায় আমরা প্রথমে লুগাতে আরব এর প্রতি লক্ষ্য রেখেছি এবং এরপর অবশিষ্ট পদ্ধতিগুলো ক্রম অনুসারে পেশ করা হবে।

 

আরবি অভিধানের আলোকে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর আভিধানিক আলোচনা

আলোচ্য আয়াতে কয়েকটি শব্দ রয়েছে -

وَلَـٰكِن رَّسُولَ اللَّـهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ

যার মধ্যে "واؤ" হলো عطف বা সম্পর্কের জন্য, "لكن" ইসতিদরাক বা সন্দেহ দূরীকরণের জন্য। শব্দের ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।

অবশিষ্ট "النبيين" ، "رسول" ، "خاتم" এই তিনটি শব্দের ব্যাখ্যা প্রয়োজন, শেষোক্ত শব্দ দুটো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা "মারযিয়া" নামক গুমরাহ ফিরকার লোকেরা এই আয়াতের অর্থে ও তাৎপর্যে বিকৃতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে এ দুটো শব্দের ভিত্তিতে। তাই এ শব্দগুলো সম্পর্কে কিছু বিশ্লেষণ পাঠকদের সামনে পেশ করা প্রয়োজন রয়েছে।

 

রাসুল (رسول)

যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা স্বীয় ওহীর মাধ্যমে সম্মানিত করে মানব জাতির প্রতি তাবলীগ ও হিদায়াতের কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন, তাকে "رسول" ও "نبي" বলা হয়। এরপর এ দুটো শব্দের ব্যাখ্যায় উলামায়ে কিরাম ও আরবি ব্যাকরণের দৃষ্টিতে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে।

 

রাসুল ও নবীর অর্থে পার্থক্য

কোন কোন বিশেষজ্ঞের মত হলো, শরীআতের প্রচলিত অর্থে এ দুটো শব্দ একই অর্থবোধক। অর্থাৎ এগুলোর অর্থে পারস্পরিক কোন পার্থক্য নেই। যেসব আয়াত, হাদিস ও আরবি বাক্যে একই ব্যক্তি সম্পর্কে কখনো "رسول" আবার কখনো "نبي" শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সেসব উদ্ধৃত করে তারা তাদের বক্তব্য প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন। অধিকাংশ মুতাযিলারও এই মত। এদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, "রাসুল" তুলনামূলকভাবে "নবী" থেকে "আ'ম" (عام) বা সাধারণ ব্যাপক অর্থবোধক। কেননা নবী হওয়ার জন্য মানুষ হওয়া প্রয়োজন। ফেরেশতাকে নবী বলা যায় না। রাসুল যেভাবে মানুষ হতে পারেন, তেমনি ফেরেশতাও হতে পারেন। কুরআনের অনেক আয়াতে ফেরেশতাদেরকে রাসুল উপাধি দেওয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেছেন -

"আর আমাদের রাসুল (ফেরেশতা) ইব্রাহীমের কাছে সুসংবাদ নিয়ে এসেছে ..." (সূরাহ হুদ, ১১ : ৬৯)

সমস্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত আর পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরামের মত হলো, "নবী" হলো আ'ম বা সাধারণ ব্যাপক অর্থবোধক, আর "রাসুল" হলো নির্দিষ্ট, কেননা শরীআতের প্রচলিত অর্থে রাসুল শুধু ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যাকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কোন কিতাব দেওয়া হয়েছে বা যে নবী পৃথক শরীআত নিয়ে এসেছেন। নবী হওয়ার জন্য দুটোর মধ্যে কোন শর্ত নেই। যিনি কোন কিতাব বা শরীআতপ্রাপ্ত, তিনি হলেন নবী। (পূর্ববর্তী শরীআত বা সমকালীন শরীআত ও কিতাব প্রচারকারী হবেন) তার কাছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী আসবে আর তিনি শরীআতের হুকুম-আহকাম প্রচার করবেন। কিন্তু তার জন্য কোন নতুন কিতাব ও শরীআতের প্রয়োজন নেই। কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন আয়াতে এই বিশ্লেষণের উপর প্রমাণ রয়েছে -

"আমি আপনার পূর্বে যে সকল রাসুল ও নবী প্রেরণ করেছি ..." (সূরাহ আল-হাজ্জ, ২২ : ৫২)

এমনিভাবে এখানে "রাসুল" শব্দের পর "নবী" শব্দটি নির্দিষ্ট করার পর সাধারণ অর্থ ও ভাব বুঝানোর জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। তেমনিভাবে হাদিসে বর্ণনা রয়েছে -

আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আম্বিয়া এক লাখ চব্বিশ হাজার আগমন করেছেন। তার মধ্যে রাসুল ছিলেন তিনশো পনেরো জন, যাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলেন আদাম (আলাইহিস সালাম), আর সর্বশেষ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।" (এ হাদিসটি ইসহাক ইবনে রাহওয়াহ, ইবনে আবি শায়বা ও আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেন এবং ইবনে হিব্বান ও ইবনে আবু শায়বা এটিকে সহীহ বলেছেন, মুসামিরাহ, পৃ. ১৯৩)

এ হাদিস সম্পূর্ণ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, রাসুল ও নবীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে এবং নবী রাসুলের তুলনায় অধিক সংখ্যক আগমন করেছেন। অধিকন্তু এই হাদিসে লম্বা চিহ্নওয়ালা বাক্যও উপলব্ধির বিষয়।

তাই জমহুর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এই বিশ্লেষণকে গ্রহণ করেছেন। হাফিয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ সহীহ বুখারির শরাহ "ফাতহুল বারী" গ্রন্থের দ্বাদশ খণ্ডের ৩৩১ পৃষ্ঠার কিতাবুত তাবীরে এর ব্যাখ্যা করেছেন। আল্লামা যারকানী শরহে মুয়াত্তায়, ইবনে হুমাম মুসামিরায়, কাযী ইয়ায আশ-শিফায় এর সত্যতা বর্ণনা করেছেন। শরহে আকাঈদে নসফীর হাশিয়াতে এরূপ বর্ণনা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এ কথা বলে দেওয়া প্রয়োজন যে, জমহুর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এটা অস্বীকার করে না যে, কোন কোন জায়গায় "রাসুল" শব্দ "নবী"র জায়গায়, আর "নবী" শব্দ "রাসুল" এর জায়গায় রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়।

এরপর আমরা অবশিষ্ট দুটো শব্দের ব্যাখ্যা পৃথকভাবে নির্ভরযোগ্য অভিধান থেকে পেশ করছি। এরপর পূর্ণ বাক্যের অর্থ আরবি ব্যাকরণের ভিত্তিতে উল্লেখ করা হবে।

"خاتم" শব্দের জন্য আলোচ্য আয়াতে দুটি ভিন্ন ভিন্ন পাঠ রয়েছে। যে সমস্ত বুজুর্গ এই শব্দ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ "خاتم" এর "ت" যবর-এর সাথে পড়েছেন।

এরপর ইমামুল মুফাসসিরীন ওয়াল মুহাদ্দিসীন ইবনে জারীর তাবারী রাহিমাহুল্লাহ ও জমহুর মুফাসসিরীন নিজ নিজ তাফসীরে বলেছেন যে, দ্বিতীয় পাঠ "خاتم" এ "ت" এর উপর যবর দিয়ে দুজন কারী হাসান ও আসেম পড়েছেন। এদের ছাড়া অন্যান্য পাঠ-বিশেষজ্ঞের মতে প্রথম কিরাআত অর্থাৎ "خاتم" এর "ت" যের দিয়ে পড়া উত্তম। (ইবনে জারীর, ২২খ. পৃ. ১১)

যখন আয়াতে যের ও যবর উভয় কিরাআত বর্তমান রয়েছে, তাই এখন প্রয়োজন হলো যের ও যবর দিয়ে গঠিত উভয় শব্দের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পাঠকদের সামনে পেশ করা।

এ উভয় শব্দ আরবি ভাষায় কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। সেগুলো নিন্মে উল্লেখ করা হলোঃ

 

উপরের বর্ণনা দ্বারা এটিই প্রতীয়মান হয় যে, এ দুটো শব্দ সাতটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। সেগুলোর মধ্যে প্রথম পাঁচটি যের যবর দ্বারা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। ষষ্ঠ শুধু যের দ্বারার সাথে নির্ধারিত, আর সপ্তম শুধু যবর দ্বারার সাথে নির্ধারিত।

পূর্বোক্ত আয়াতে যের দ্বারা ছয় অর্থের মধ্যে কোন অর্থ হতে পারে এবং যবর দ্বারা ছয় অর্থের মধ্যে কোনটি হতে পারে, তাও দেখা আবশ্যক। সুতরাং এটিও স্পষ্ট যে, প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থ (আংটির পাথর ও আংটি) কোনভাবেই পবিত্র কুরআনে আয়াতের বাস্তবতার নিরিখে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং সমস্ত অভিধান বিশেষজ্ঞ ও দুনিয়ার সকল জ্ঞানীর সর্বসমর্থিত মতে যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত অর্থ যথার্থ বিবেচিত হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত রূপক অর্থ অগ্রহণযোগ্য। সুতরাং প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থ কখনোই হতে পারে না।

চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থ এই আয়াতে কোন মানুষের কল্পনাও হতে পারে না। কেননা তা এই আয়াতে প্রকৃত অর্থেও সঠিক নয়, রূপক অর্থেও নয়।

এভাবে সপ্তম অর্থ মোহরের চিত্র ও প্রকৃত অর্থের দৃষ্টিতে আয়াতের অর্থ হতে পারে না এবং রূপক অর্থ গ্রহণ করার কোন কারণই নেই।

সুতরাং এখন দুটো অর্থ বিবেচনাযোগ্য। তৃতীয় অর্থ সর্বশেষ জাতি ও ষষ্ঠ অর্থ খতমকারী বা সমাপ্তকারী। এ দুটো অর্থ কোন লৌকিকতা ছাড়াই প্রকৃত অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক। শুধু এতটুকু পার্থক্য যে, এগুলোর মধ্যে প্রথম অর্থ উভয় পাঠে সঠিক এবং দ্বিতীয় অর্থ শুধু "خاتم" এর সাথে নির্ধারিত।

মোটকথা, "خاتم" শব্দের উভয় পাঠ এবং এগুলোর আভিধানিক অর্থের বিস্তারিত আলোচনার ফলে পাঠকবৃন্দ এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, যদি কুরআন ও হাদিসের বিশ্লেষণ এবং সাহাবা ও তাবিঈনের তাফসীর ও পূর্ববর্তী নবীদের সাক্ষ্য থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া হয়, আর মীমাংসা শুধু আরবি অভিধানের ভিত্তিতেই করা হয়, তাহলেও তা থেকে এই সিদ্ধান্ত লাভ করা যাবে যে, উপরোক্ত আয়াতে প্রথম পাঠের দুটি অর্থ হতে পারে। সর্বশেষ নবী ও নবীদের সমাপ্তকারী, দ্বিতীয় পাঠের একটি অর্থ হতে পারে অর্থাৎ সর্বশেষ নবী।

কিন্তু যদি প্রকৃত অর্থের উপর চিন্তা করা হয়, তাহলে উভয়ের সারমর্ম একই বের হয় এবং অর্থের দিকে লক্ষ্য করে এটা বলা যায় যে, উভয় পাঠে আয়াতের অর্থ অভিধানের ভিত্তিতে এই হবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল নবীর মধ্যে সর্বশেষ, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে আর কোন নবীর আগমন হবে না। যেমন তাফসীরে রুহুল মাআনীতে ব্যাখ্যা রয়েছে -

"এবং খাতাম একটি যন্ত্রের নাম, যার দ্বারা মোহর লাগানো হয়। তাই 'خاتم النبيين' এর অর্থ হবে ঐ ব্যক্তি দ্বারা নবীগণের ক্রমধারা সমাপ্ত করা হয়েছে আর এই অর্থের মূল কথা হলো সর্বশেষ নবী।" (রুহুল মাআনী, ৭খ. পৃ. ৫৯)

আল্লামা আহমাদ ওরফে মোল্লা জিউন স্বীয় তাফসীরে আহমাদীর মধ্যে এ শব্দের তাফসীর করে বলেছেন, "উপরিউক্ত দুটি পদ্ধতি শুধু শেষ অর্থটি বুঝায়, তাই তাফসীরে মুদারিকে মুফাসসির আসেমের পাঠ যবর-এর তাফসীর সর্বশেষ করেছেন আর বায়যাবী উভয় পাঠের একই তাফসীর করেছেন।"

তাফসীরে রুহুল মাআনী ও তাফসীরে আহমাদীর এ ব্যাখ্যার দ্বারা এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, আয়াতে "خاتم" শব্দের দুটো অর্থ হতে পারে, কিন্তু এর সারমর্ম একটি। তা হলো "اخر النبيين" সর্বশেষ নবী বা নবীগণের সর্বশেষ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লামা বায়যাবী উভয় পাঠের তরজমায় কোন পার্থক্য করেননি, বরং উভয় পদ্ধতিতে "اخر النبيين" (নবীগণের সর্বশেষ) করেছেন।

আল্লাহ তাআলা অভিধান পারদর্শীদের উত্তম সওয়াব দান করুন। তারা "خاتم" শব্দের অর্থ একত্র করেই ক্ষান্ত হোননি, বরং আলোচ্য আয়াত সম্পর্কেও স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, সমস্ত অর্থের মাধ্যমে যে শব্দ "خاتم" এর মধ্যে আভিধানিকভাবে সম্ভাব্য আলোচ্য আয়াতেও শুধু ঐ অর্থই হতে পারে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ই সমস্ত নবীর সমাপ্তকারী সর্বশেষ নবী।

আরবি অভিধানরূপে ছোট বড় এবং নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য কতোই লিখিত হয়েছে এবং তা কোথায় কোথায় কোন অবস্থায় বর্তমান আছে তা আল্লাহ তাআলা'ই ভালো জানেন। তার সবগুলো একত্র করার প্রয়োজন নেই। কোন মানুষের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। ঐ কিতাবসমূহ আরব ও অনারবের কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রমাণের উপযুক্ত মনে করা হয়। নমুনা স্বরূপ পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করে এটাই প্রমাণ করা হবে যে, "খাতাম" আর "খাতিম" এ দুটো শব্দের অর্থের মধ্যে অভিধান পারদর্শীগণ আলোচ্য আয়াতের কোন অর্থ স্থির করেছেন।

 

মুফরিদাতুল কুরআন

এই কিতাবখানি ইমাম রাগিন ইস্পাহানী রাহিমাহুল্লাহ'র এরূপ আশ্চর্য রচনা যে, এর উদাহরণ মিলে না। এতে তিনি কুরআনের শব্দসমূহের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে বর্ণনা করেছেন। শায়খ জালালুদ্দীন সুয়্যুতি রাহিমাহুল্লাহ স্বীয় আল-ইতকান গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, কুরআনের অভিধান হিসেবে এর চেয়ে উত্তম কিতাব অদ্যাবধি রচিত হয়নি। আলোচ্য আয়াত সম্পর্কে এর ব্যাখ্যা হলো -

"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে এজন্য খাতামুন্নাবিয়্যীন বলা হয় যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের ক্রমধারাকে সমাপ্ত করে দিয়েছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসে নবুওয়াতকে পূর্ণত্ব দান করেছেন, এর ধারাবাহিকতাকে সমাপ্ত করেছেন।" (মুফরিদাতে রাগিব, পৃ. ১৪২)

 

আল-মুহকাম লি ইবনিস সাইয়েদা

আরবি শব্দের অভিধান হিসেবে এটিও একটি নির্ভরযোগ্য কিতাব। আল্লামা সুয়্যুতির মতে কুরআনের ব্যাপারে এর উপর পূর্ণমাত্রায় নির্ভর করা যেতে পারে। এতে বলা হয়েছে -

"এবং খাতিম ও খাতিমা প্রত্যেক বস্তুর শেষ ও সমাপ্তিকে বলা হয়।" (লিসানুল আরব)

 

তাহযীব লিল-আযহারী

এই কিতাবকেও আল্লামা সুয়্যুতি নির্ভরযোগ্য অভিধানের মধ্যে গণ্য করেছেন। এতে বলা হয়েছে -

"এবং 'خاتم' (যেরযুক্ত) ও 'خاتم' (যবরযুক্ত) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নন, কিন্তু তিনি আল্লাহ'র রাসুল ও সমস্ত নবীর মধ্যে সর্বশেষ।" (লিসানুল আরব)

এতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, "خاتم" (যেরযুক্ত ও যবরযুক্ত উভয়ই) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের অংশ এবং কুরআন মাজীদে "خاتم النبيين" বলে সর্বশেষ নবী বুঝিয়েছেন।

অভিধান বিশেষজ্ঞদের এতো ব্যাখ্যার পরও কোন ন্যায়বান লোক এ অর্থ ছাড়া অন্য কোন অর্থ স্থির করতে পারেন বলে মনে করা যায় কি ?

 

লিনাসুল আরব

এটি আরবি ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ অভিধান গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণযোগ্য। আরব ও অনারবদের কাছে তা নির্ভরযোগ্য ও সঠিক গ্রন্থরূপে গণ্য। এই অভিধানে আলোচ্য "খাতাম" বা "খাতিম" শব্দের ব্যাখ্যায় লিখিত হয়েছে -

" 'খাতাম' ও 'খাতিম' উভয় শব্দের অর্থ সর্বশেষ জাতি। এই অর্থেই 'লিহইয়ানী' হতে বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন 'خاتم الانبياء' বা সর্বশেষ নবী।"

এখানেও বিশদভাবে বলা হয়েছে যে, আলোচ্য আয়াতে "খাতিম" বা "খাতাম" যা-ই পড়া হোক "خاتم النبيين" আর "خاتم الانبياء" এর অর্থ "اخر النبيين" আর "اخر الانبياء" বা সর্বশেষ নবী।

লিসানুল আরবের এ বাক্যের দ্বারা একটি নীতি জানা যায়। তা হলো, "খাতাম" ও "খাতিম" পাঠেই মূল অভিধানের দৃষ্টিতে শব্দটির বহু অর্থ হতে পারে, কিন্তু যখন জনগোষ্ঠী এর লক্ষ্য হয়, তখন এর অর্থ আখির বা শেষ ও সমাপ্তকারী হয়ে থাকে। সম্ভবত ঐ নীতির প্রতি ইঙ্গিত করেই "خاتم" শব্দটি এককভাবে উল্লেখ করা হয়নি, বরং কাওম ও জামাআতের সর্বনামের দিকে লক্ষ্য করে বর্ণনা করা হয়েছে।

আরবি অভিধানসমূহ পর্যালোচনা দ্বারাও এটিই প্রমাণিত হয় যে, "খাতিম" বা "খাতাম" কোন কওম বা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ব্যবহৃত হলে এর অর্থ "আখির" বা শেষ-ই হয়ে থাকে। আলোচ্য আয়াতে "খাতিম" বা "খাতাম" এর সম্পর্ক নবীগণের সমষ্টির সাথে। তাই এর অর্থ "اخر النبيين" বা সর্বশেষ নবী ও নবীগণের সমাপ্তকারী ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। এই নীতির সমর্থন "তাজুল আরুস শরহে কামূস" থেকেও পাওয়া যায়।

 

তাজুল আরুস

আল্লামা যুবায়দী শরহে কামুসে লিহইয়ানী থেকে বর্ণনা করেছেন,

"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র নামসমূহের মধ্যে 'খাতিম' বা 'খাতাম' শব্দ অন্যতম। খাতিম ঐ ব্যক্তি, যার আগমনে নবুওয়াত সমাপ্ত করে দিয়েছেন।"

 

মাজমাউল বিহার

এতে হাদিসের শব্দসমূহের অর্থ নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে একত্র করা হয়েছে। এর বাক্য নিন্মে বর্ণনা করা হলোঃ

" 'খাতিম' ও 'খাতাম' রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র নামসমূহের অন্তর্ভুক্ত। 'খাতাম' এর অর্থ হলো 'সর্বশেষ', আর 'খাতিম' অর্থ হলো সমাপ্তকারী।"

এর প্রথম খণ্ডের ৩২৯ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করা হয়েছে -

" 'খাতিম' অর্থ সমাপ্তকারী এবং 'খাতাম' অর্থ মোহর। এর দ্বারা বুঝায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী নেই।"

 

কামূস

এতে বর্ণনা করা হয়েছে -

" 'খাতিম' কওমের সর্বশেষকে বলা হয়, আর এই অর্থেই আল্লাহ ইরশাদ করেছেন - 'وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ', অর্থাৎ 'সর্বশেষ নবী' "।

এখানে "কাওম" শব্দটি বৃদ্ধি করে উপরিউক্ত নীতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং আলোচ্য বিষয়টিও অত্যন্ত স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে।

 

কুল্লিয়াতে আবিল বাকা

আরবি অভিধানের একটি প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কিতাব। এতে আলোচ্য বিষয়টি সবচেয়ে বেশী স্পষ্ট করে বলা হয়েছে -

"আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম খাতিমুল আম্বিয়া এজন্য রাখা হয়েছে যে, খাতিম জনগণের সর্বশেষ ব্যক্তিকে বলা হয়। এ অর্থে আল্লাহ তাআলা বলেছেন - "মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন, বরং আল্লাহ'র রাসুল ও সর্বশেষ নবী" "।(পৃ. ৩১৯)

এখানেও অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম খাতাম বা খাতিমুন-নাবিয়্যীন রাখার কারণ হলো, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী।

এর উদ্দেশ্য হলো, নবী শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। শরীআতপ্রাপ্ত হোক বা না হোক ৪ এবং রাসুল বিশেষ করে শরীআতপ্রাপ্তকে বলা হয়। আয়াতে যখন তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যাপক অর্থে সমাপ্তকারী বলা হয়েছে, তখন বিশেষ অর্থে রাসুলগণেরও সমাপ্তকারী বুঝায় অবশ্যম্ভাবীরূপে। তাই এই আয়াতে শরীআতপ্রাপ্ত ও শরীআতবিহীন যে কোন প্রকার নবীর সমাপ্তি এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর নবী সৃষ্টি হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রমাণিত হয়। যারা আয়াতে শরীআতপ্রাপ্ত ও শরীআতবিহীন (تشريعي و غير تشريعي) এর বিভাগ করে থাকেন, আল্লামা আবুল বাকা প্রথমেই তাদের দাবি খণ্ডন করেছেন।

 

সিহাহীল আরাবিয়া লিল জাওহারী

এ অভিধানটির প্রসিদ্ধি ও নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। এর বক্তব্য হলো -

"খাতিম ও খিতাম এবং খাতাম - এ সব কয়টি শব্দের একই অর্থ। এর বহুবচন হলো 'খাওয়াতীম'। আর কোন জিনিসের সমাপ্তি বলতে তার শেষ বুঝায়। এই দৃষ্টিতেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সমস্ত নবীর সর্বশেষ।"

এখানেও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, খাতাম ও খাতিম উভয় শব্দের একই অর্থ।

 

মুনতাহিউল আদম

এতে "خاتم" শব্দ সম্পর্কে বলা হয়েছে -

"খাতিম অর্থ মোহর ও আংটি ধারণকারী এবং প্রত্যেক বস্তুর সমাপ্তকারী ও জনগোষ্ঠীর সর্বশেষ। আর খাতাম এর অর্থও একই। এই অর্থে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাতিমুল আম্বিয়া।"

 

সূরা

এতে রয়েছে -

"কোন জিনিসের খতমকারী অর্থ তার সমাপ্তকারী। তাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাতিমুল আম্বিয়া বা সর্বশেষ নবী।"

 

আরবি অভিধানের বহু সংখ্যক গ্রন্থ থেকে এ কয়টি ভাষ্য নমুনা হিসেবে পেশ করা হলো। এসব পড়ে পাঠকদের মনে নিশ্চয়ই বিশ্বাস জন্মেছে যে, আরবি অভিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচ্য আয়াতে "خاتم النبيين" এর অর্থ "اخر النبيين" বা সর্বশেষ নবী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

আল্লাহ'র শোকর যে, এ পর্যন্ত আলোচনার বিষয়টি সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, আলোচ্য আয়াতে "খাতাম" বা "খাতিম" এর প্রকৃত অর্থ দুটি হতে পারে। যদি পরোক্ষ অর্থ ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও। যদিও প্রকৃত অর্থ সঠিক হওয়া সত্ত্বেও তার কোন প্রয়োজন নেই "خاتم" এর অর্থ মোহর (مهر) হবে। যেমন স্বয়ং মীর্জা কাদিয়ানী "হাকীকাতুল ওহী" নামক গ্রন্থের ৯৭ পৃষ্ঠায় ব্যাখ্যা করেছেন। তাহলেও আয়াতের অর্থ হবে - রাসুলুল্লাহ হলেন আম্বিয়ায়ে কিরামের উপর মোহর প্রদানকারী। যার সারমর্মও পূর্বের অর্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা সাধারণ কথোপকথনে বলা হয়ে থাকে যে, অমুক ব্যক্তি অমুক বস্তুর উপরে মোহর করে দিয়েছে - যখন এতে কোন বস্তু প্রবেশ করাতে পারবে না এবং ভিতর থেকেও কিছু বাইরে আসতে পারবে না। কুরআনে বলা হয়েছে -

خَتَمَ اللَّـهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ

অর্থঃ "আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর করে দিয়েছেন ..." (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ৭)

তাই এখন তাদের অন্তরে হিদায়াত প্রবেশ করবে না।

জনৈক কবি বলেছেন -

اروح و قد ختمت على فؤادي * بحبك ان يحل به سواكا

"আমি তোমার কাছ থেকে এমনিভাবে বিদায় নিচ্ছি যে, তুমি আমার অন্তরে তোমার ভালোবাসার মোহর লাগিয়ে দিয়েছো, যেন এতে তুমি ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে না পারে।"

 

এ পর্যন্ত যা কিছু আলোচনা হয়েছে তা "خاتم" শব্দের আভিধানিক অর্থের প্রতিপাদ্য ছিলো। এরপর দ্বিতীয় শব্দ, অর্থাৎ "النبيين" এর আভিধানিক অর্থ ও এর প্রতিপাদ্য পেশ করা হচ্ছে।

 

النبيين শব্দের আভিধানিক প্রতিপাদ্য

এ শব্দটি প্রকৃতপক্ষে দুটো শব্দের দ্বারা গঠিত এক আলিফ ও লাম (الف و لام) এবং দ্বিতীয় "نبيين" উভয়ের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পেশ করা হলোঃ

দ্বিতীয় শব্দ نبي، نبيين শব্দের বহুবচন, এর ব্যবহার আম্বিয়া কিরামের জামাআতের জন্য করা হয়।

অবশ্য প্রথম শব্দ অর্থাৎ الف و لام এর সম্পর্কে এখানে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। পাঠকদের সামনে তা উপহারস্বরূপ পেশ করা হচ্ছে। তবে যেহেতু এটা একটা বিশেষ ইলমী মাসআলা, তাই সম্ভবত সহজ হওয়ার পরও যদি সাধারণ পাঠকদের কাছে পূর্ণাঙ্গভাবে স্পষ্ট না হয়, তাহলে আমাকে যেন অক্ষম মনে করা হয়।

এটা প্রসিদ্ধ নিয়ম যে, ৫ الف و لام আভিধানিকভাবে চারটি অর্থের জন্য ব্যবহৃত হয় -

(১) جنس, (২) استغراق, (৩) عهد خارجي এবং (৪) عهد ذهني

কিন্তু যখন الف و لام বহুবচনের উপর আসে, তখন আরবি ভাষাভাষী ও মৌলনীতি বিশারদদের সর্বসম্মতিক্রমে এতে দুটি দিকের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম عهد خارجي বা عهد ذهني দ্বিতীয় استغراق ; (আল্লামা নাসাফীর كشف الاسرار দেখা যেতে পারে) সেখানে বলা হয়েছে -

"যদি الف و لام বহুবচনের উপর আসে, তাহলে عهد যদি হতে পারে তবে তাই হবে, নতুবা عموم و استغراق এর অর্থ গ্রহণ করা হবে।" (কাশফুল ইসরার, ১খ. পৃ. ৩২)

আল্লামা আবুল বাকা স্বীয় কুল্লিয়াতে বলেন -

"সাধারণভাবে আরবি ভাষা ও মৌলনীতি বিশারদগণ বলেছেন, لام تعريف একবচনের উপর বা বহুবচনের উপরই আসুক না কেন, তা ستغراق এর অর্থ হবে যদি معهود হয় তাহলে তা عهد এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়।" (কুল্লিয়াতে আবিল বাকা, পৃ. ৫৬৩)

পুরনো সংস্করণের ৪৯ পৃষ্ঠায় এ বিষয়টি আর বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে যে, এ ব্যাপারে একবচন ও বহুবচনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, الف لام প্রকৃতপক্ষে এ দুটি অর্থের জন্যই ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য অর্থে শুধু স্থানবিশেষে প্রয়োজনানুযায়ী এসে থাকে।

আল্লামা রাযীও শরহে কাফিয়ায় এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করে এটিই গ্রহণ করেছেন তার সারমর্ম হলো এই যে, بعضيت اور جزءيت (কিছু অংশ) এর চিহ্ন হলো تنوين (অর্থাৎ, দুই যবর, দুই যের, দুই পেশ) যখন কোন اسم (বিশেষ্য) এর উপর الف لام এসে تنوين বাধ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন এর বা কর্ম শুধু مدلول বা কর্ম শুধু استغراق كل সমষ্টিকে বুঝাবে। হ্যা, যদি কোন প্রমানপত্র প্রমাণ করে যে, এই শব্দের দ্বারা সমষ্টি উদ্দেশ্য নয়, বরং কোন নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট একক ব্যক্তি বা বস্তু বুঝায়, তাহলে এ সময় এর একককেই বুঝাবে। যাকে প্রচলিতভাবে عهد ذهني ও عهد خارجي বলা হয়। যেমন বলা হয় গোশত ক্রয় করো (اشتر اللحم) এখানে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, গোশত দ্বারা এর সমষ্টিকে বুঝায় না এবং এটা কোন ব্যক্তির জন্য শোভনও নয়। তাই ক্রয়-বিক্রয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে اللحم এর মধ্যে لحم দ্বারা শুধু অনির্দিষ্ট পরিমাণ গোশত বুঝাবে এবং এটিকেই عهد ذهني বলা হয়। যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে -

أَوْ أَجِدُ عَلَى النَّارِ هُدًى

".... অথবা আমি আগুনের সন্ধান পাবো।" (সূরাহ তো-হা, ২০: ১০)

তাই النار দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আগুনের সমস্ত অংশ বা সমষ্টি এখানে উদ্দেশ্য হতে পারে না, বরং ঐ নির্দিষ্ট আগুন বুঝাবে, যার উল্লেখ প্রথম বাক্যে রয়েছে, এবং নামগুলো عهد خارجي যখন এই প্রকারের কোন নির্দিষ্ট দলীল এই শব্দটিকে নিজ কর্ম (مدلول صريح) অর্থাৎ استغراق হতে বাঁধা না দেয়, তাহলে استغراق ছাড়া অন্য কোন তাৎপর্য গ্রহণ করা প্রচলিত ও আভিধানিক নীতি অনুযায়ী বৈধ নয়। যদিও في نفسه جنس ماهيت (বাস্তব সমষ্টিগত বস্তু) বুঝবার সম্ভাবনাও থাকে। কিন্তু প্রচলিত অর্থেও প্রথাগত পদ্ধতির কোন মূল্যায়ন হয় না, বরং প্রচলিত অর্থে বাহ্যিক পর্যবেক্ষণের দ্বারা আলোচনা হয়ে থাকে, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা নয়। সুতরাং جنس এর সম্ভাবনা প্রথম থেকেই অগ্রহণযোগ্য। (শরহে কাফিয়া)

সারমর্ম হলো এই যে, مفرد، الف و لام বা একবচনের উপর আসে কিংবা বহুবচনের উপর - এতে দুটিই সম্ভাবনা থাকে استغراق বা عهد এই দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লামা রাযী এরপর বলেন -

"এরপর যখন بعضيت (অংশবিশেষ) এর দলীল বা চিহ্ন না হওয়ার কারণে এটা প্রমাণ না হয়, তখন এটাই সামগ্রিকভাবে সকলের উপর ওয়াজিব হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী الماء طاهر (পানি পবিত্রতাকারী) তারই প্রমাণ বহন করে অর্থাৎ পানির সমস্ত অংশ (মৌলিকভাবে) পবিত্র; النوم حدث অর্থাৎ ঘুমের সমস্ত অংশই উযু ভঙ্গকারী। যেহেতু الف و لام আসার কারণে مفرد (একক বস্তু)-ও সামগ্রিকভাবে সকলের উপর আপতিত হয়। তাই (একক বস্তুর) এর চিহ্নে বহুবচন গ্রহণ করা হয়। তবে এরূপ বাকপদ্ধতি খুব কমই ব্যবহৃত হয়। যেমন আখফাশ বর্ণনা করেছেন الدرهم البيض و الدينار الصفر এখানে درهم একবচন ও মাওসুফ (موصوف) এবং بيض বহুবচন ও সিফাত (صفت)।"

এ পর্যন্ত একবচন ও বহুবচনের নির্দেশাবলী ও আহকামে একই ধরণের। অবশ্য আল্লামা রাযী এরপর একবচন ও বহুবচনের মাঝে এ পার্থক্য করেছেন যে, যখন مفرد، الف و لام এর উপর আসে, তখন ঐ শব্দ সকল ব্যক্তি বা বস্তুকে বুঝায়। যখন تشنيه বা দ্বিবচনের উপর আসে, তখন جمع বা বহুবচনের বিপরীত প্রতিটি দ্বিবচনকে যুক্ত করে। কেননা এ অবস্থায় তা প্রতিটি একক, দ্বৈত ও সমষ্টিকে সংযুক্ত করে। তাই আল্লামা রাযী বলেন,

"কেননা আলিফ-লামযুক্ত বহুবচনের বাক্যের মাঝে এরূপ একটি বা অনির্দিষ্ট বিষয়ের হুকুমে সমস্ত مفرد ইত্যাদির উপযোগ হয়ে থাকে। তাই لقيت العلماء الا زيدا এর অর্থ এই হয়ে থাকে যে, 'আমি যায়দ ছাড়া প্রত্যেক আলিম, প্রত্যেক দুজন আলিম ও সমস্ত আলিম সমষ্টির সাথে সাক্ষাৎ করেছি।' " (রাযী, ২খ. পৃ. ১০৪)

এর দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বহুবচনের আওতা অধিক সংযোজনশীল।

এ বর্ণনার পর আমরা উপরিউক্ত আলোচিত বাক্যের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই আশা করবো যে, خاتم النبيين এর মধ্যে الف و لام কোন অর্থের জন্য হতে পারে, তা তারা নিজেরাই বুঝে নিবেন। এখানে শুধু দুটি সম্ভাবনা আছে। তা হলো - (১) استغراق, (২) عهد

কিন্তু যার সামান্যতম জ্ঞান ও বোধশক্তি রয়েছে, তিনি কখনো এটা কল্পনা করতে পারেন না যে, এখানে عهد خارجي الف و لام বা عهد ذهني এর জন্য। কেননা النبيين কে بعض نبيين থেকে নির্দিষ্ট করবে এমন কোন প্রমাণ নেই, বরং এর বিপরীতে শক্তিশালী ও সুস্পষ্ট প্রমাণ বর্তমান রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে একটি, স্বতঃই প্রমাণিত (بديهي الشبوت) কথা হলো, যদি النبيين এর الف و لام কে عهد خارجي বা عهد ذهني এর জন্য স্বীকার করে বাক্যের এই অর্থ করা হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন কোন নবীর জন্য খাতিম বা সমাপ্তকারী, তাহলে সম্পূর্ণ অস্পষ্ট ও অর্থহীন হয়ে পড়বে আর خاتم النبيين শব্দে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য কোন বিশেষ গুণ ও মর্যাদা থাকবে না। কেননা আদম আলাইহিস সালাম ছাড়া প্রত্যেক নবী তার পূর্বের নবীগণের সমাপ্তকারী ও সর্বশেষ। তাই প্রত্যেক নবীর উপর এ অর্থে খাতামুন-নাবিয়্যীন (خاتم النبيين) সংযোগ হতে পারে। এজন্য এখানে এ ধারণা করা যাবে না যে, خاتم النبيين এর মধ্যে عهد خارجي الف و لام বা عهد ذهني এর জন্য। তাহলে এখন স্বেচ্ছায় استغراق সমস্ত নবীই শামিল এই অর্থ নির্দিষ্ট হয়ে যায় এবং তার অর্থ এই হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীর সমাপ্তকারী ও সর্বশেষ। যে সম্মানিত ব্যক্তিদেরকে শরীআতের প্রচলিত অর্থে নবী বলা হয়, তিনি নতুন শরীআতপ্রাপ্ত হোন বা না হোন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এদের সবার সমাপ্তকারী ও সর্বশেষ (خاتم او اخر)।

আল্লাহ'র রহমতে উপরিউক্ত বর্ণনার দ্বারা পাঠকবৃন্দ এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে, আয়াতে الف و لام (استغراق) সমগ্র নবীকে শামিল করা ছাড়া অন্য কোন অর্থের জন্য হতে পারে না। কিন্তু এখানে استغراق কোন প্রকারের ? এই প্রশ্ন আলোচনা সাপেক্ষ রয়েছে। কেননা, استغراق দুই প্রকারের - (১) প্রকৃত ও (২) প্রচলিত।

প্রকৃত استغراق সামগ্রিকতা সমস্ত ব্যক্তিকে বুঝায়। যেমন عالم الغيب و الشهادة আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক অদৃশ্য ও দৃশ্য সব কিছুই জানেন। এর দ্বারা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বুঝায় না।

استغراق عرفي বা প্রচলিত ধরণের সামগ্রিকতা বাস্তবে সমস্ত ব্যক্তিকে বুঝায় না। তাতে শামিল হয় সেসব ব্যক্তি যারা প্রচলিত অর্থে বুঝাবে। যেমন - বলা হয়ে থাকে, جميع الامير الصا غة (বাদশাহ সমস্ত স্বর্ণকার একত্র করেছেন)। প্রকাশ থাকে যে, এখানে সমস্ত দুনিয়ার সমস্ত স্বর্ণকার একত্র করা অর্থ নয়। এজন্য বাস্তবে এ অর্থ বুঝায় যে, নিজ শহর বা বেশীর পক্ষে স্বীয় রাজ্যের স্বর্ণকারদের একত্র করেছেন। এটা বাস্তবিকপখে সমস্ত ব্যক্তিকে শামিল করে না। যদিও রূপক ও প্রচলিত অর্থে এটাকেও استغراق বলা হয়।

কেননা, প্রথমত استغراق عرفي একটি রূপক (مجازي) অর্থ, যেমন مفتي اللبيب নামক কিতাবের হাশিয়ায় এর বিপরীত বর্ণনা রয়েছে এবং সর্বজন স্বীকৃত নিয়ম হলো এই যে, রূপক (مجازي) অর্থ ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণীয় হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত অর্থ হওয়া সম্ভব। আলোচ্য আয়াতে কোন লৌকিকতা ছাড়াই প্রকৃত সামগ্রিকতা বৈধ ও সঠিক। নবীগণের সমাপ্তকারী। সুতরাং প্রচলিত অর্থে সামগ্রিকতা গ্রহণের কোন কারণ নেই।

দ্বিতীয়ত, যদি প্রচলিত অর্থে সামগ্রিকতা গ্রহণীয় হয়, তাহলে যেভাবে عهد خارجي বা عهد ذهني এর অবস্থায় আয়াত অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং خاتم النبيين অবস্থার মধ্যে ঐ সমস্যা সামনে এসে যায়। কেননা এ অবস্থায়ও আয়তের অর্থ এটাই হবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন বিশেষ নবীর জন্য সমাপ্তকারী ও সর্বশেষ (خاتم و اخر) নবী।

উপরিউক্ত অর্থ আদম আলাইহিস সালাম ছাড়া সমস্ত আম্বিয়া কিরামের উপর পতিত হয়। পক্ষান্তরে সহীহ মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ ও ফরমান রয়েছে, আল্লাহ তাআলা ছয়টি বিষয়ে আমাকে সমস্ত আম্বিয়া কিরামের উপর ফযীলত ও মর্যাদা দান করেছেন। এর মধ্যে খাতামুন-নাবী হওয়াও উল্লেখ করেছেন। (দেখুনঃ মুসলিম শরীফ, ফাযাইল অধ্যায়)

উপরিউল্লিখিত বর্ণনার সারমর্ম হলো এই যে, خاتم النبيين এর মধ্যে الف و لام শুধু প্রকৃত সামগ্রিকতা ছাড়া অন্য কোন অর্থে গ্রহণীয় হতে পারে না, বরং এই শব্দের দ্বারা সামগ্রিকভাবে সমস্ত নবীর সমাপ্তি বুঝায়। এটাই আমাদের দাবি।

এ পর্যন্ত কুরআনের আয়াত - "وَلَـٰكِن رَّسُولَ اللَّـهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ" - এর একক ও পৃথক বাক্য সম্পর্কে বর্ণনা ছিলো। এরপর পূর্ণ বাক্য ও সমস্ত আয়াতের তাফসীর আরবি অভিধান ও এর ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টিতে উপলব্ধি করা দুর্বোধ্য থাকেনি এবং আয়াতের বক্তব্য স্পষ্ট হয়েছেঃ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ'র রাসুল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত নবীর পরে সর্বশেষে আগমনকারী আর নবীগণের সমাপ্তকারী। এতে কোন প্রকার ফাঁক নেই, নেই কোন ব্যক্তিক্রম আর নেই কোন প্রকার ব্যাখ্যারও অবকাশ। শরীআতপ্রাপ্ত বা শরীআতবিহীন - এর কোন বাধ্যবাধকতাও নেই।

 

ফুটনোটঃ

(১) যায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র একটা দুঃখ ছিলো - তার নাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্বন্ধ থেকে পৃথক করা হয়েছে। সম্ভবত এ দুঃখকে দমন করার জন্য কুরআনে কারীম স্পষ্টভাবে তার নাম ঘোষণা করে বলেছে -

"..... এরপর যায়দ যখন তার থেকে প্রয়োজন শেষ করলো (অর্থাৎ, তালাক দিলো) ...." (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৩৭)

অথচ উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবায়ে কিরাম ও খুলাফায়ে রাশেদীনের কারো নাম কুরআনে কারীমে উল্লেখ নেই। এর উল্লেখ ও বিশেষত্বের মধ্যে এটাই রহস্য।

(২) (كذا في حديث ابي مالك الاشعري عند الطبراني از كنز العمال - (ج ٦ - ص ٢٣٢

(৩) এ বিশ্লেষণের ব্যাপারে অভিধান বিশেষজ্ঞদের আরো কিছু বর্ণনা রয়েছে, তবে সাধারণত অভিধান গ্রন্থ থেকেই এ বিশেষণ পাওয়া যায়।

(৪) স্মরণ রাখা উচিত যে, এই গ্রন্থের যেখানে আমরা শরীআতপ্রাপ্ত ও শরীআতবিহীন (تشريعي و غير تشريعي) শব্দ লিখেছি, এর দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য হলো, নতুন শরীআত নিয়ে আসা অথবা পূর্বের শরীয়াতের অনুসারী হওয়া। নতুবা সমস্ত আম্বিয়া-কিরাম শরীয়াতপ্রাপ্ত ছিলেন এবং শরীআত নবুওয়াতের জন্য অপরিহার্য। মীর্জা সাহেব যার নাম "غير تشريعي" রেখেছেন, তা নবুওয়াতের কোন প্রকার নয়।

(৫) الف و لام تعريف যখন কোন শব্দের উপর আসে তখন এর কয়েকটি অবস্থা হয়ে থাকে। হয়তো এর সমষ্টির মধ্যে কিছুই বুঝাবে না, বরং ভুল বস্তুকেই বুঝাবে, তখন এই الف و لام কে جنس বলা হবে, যদি افراد বুঝায় তাহলে হয়তো সকল افراد বুঝাবে অথবা কিয়দংশ, যদি সমস্ত افراد বুঝায় তাহলে استغراق, আর যদি بعض বুঝায় তাহলে এটা নির্দিষ্ট হবে অথবা অনির্দিষ্ট। যদি নির্দিষ্ট (معين) হয় তাহলে এটা হবে عهد خارجي নতুবা عهد ذهني বলা হবে।

 

পরবর্তী অংশঃ https://bit.ly/2EVooP8

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী মতবাদ - ৩ (দ্বিতীয় অংশ)

 

 

The Greatest Nation·Friday, March 8, 2019

 

 

 

 

পবিত্র কুরআনের সাহায্যে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর

কুরআন মাজীদের সত্যতা ও সঠিকতার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে এর এক অংশ অন্য অংশের তাফসীর করে। স্বয়ং কুরআন মাজীদ এ আয়াতের কি ব্যাখ্যা পেশ করে তা এই দৃষ্টিতে বিবেচ্য। খতমে নবুওয়াতের বিষয়টি যেমনই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কুরআন এর গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে একশোরও বেশী আয়াত এ বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছে। ইন শা আল্লাহ, আমরা তা পাঠকদের সামনে পৃথকভাবে পেশ করবো।

এখানে এমন কতগুলো আয়াত পেশ করা হবে, যা আয়াত خاتم النبيين এর তাফসীর ও ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট। এর মধ্যে ঐ আয়াতের জন্য একটি পাঠও পেশ করবো, যার দ্বারা আয়াতের অর্থ সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে যায়।

ইবনে জারীর তাবারী রাহিমাহুল্লাহ, ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহ, আল্লামা সুয়্যুতী রাহিমাহুল্লাহ প্রমুখ বিশিষ্ট তাফসীর লেখক নিজ নিজ তাফসীর গ্রন্থে এ আয়াত সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পাঠ অনুযায়ী বর্ণনা করেছেন -

ولكن نبينا ختم النبييون

"কিন্তু তিনি এরূপ একজন নবী, যিনি সমস্ত নবীর সমাপ্তকারী।"

এ আয়াত মীর্জায়ী দল خاتم শব্দকে ভিত্তি করে যেসব বিকৃতির সৃষ্টি করেছে, তার মূলোৎপাটন করেছে। কেননা, এখন আয়াতের অর্থে এটাই স্পষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ নবী, যিনি সমস্ত নবীর সমাপ্তকারী।

এ আয়াতও একই অর্থ প্রকাশ করে -

".... আমরা তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিয়েছি আর স্বীয় নিয়ামত তোমাদের উপর পূর্ণ করে দিয়েছি ...." (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ৩)

উপরিউক্ত আয়াত দিয়ে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, দ্বীন ইসলাম নিয়ামতে নবুওয়াত এবং ওহী ইত্যাদি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর সমাপ্ত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আগমনের প্রয়োজন বা অবকাশ নেই। এ আয়াতের তাফসীর ও ব্যাখ্যা কিছু পরেই বর্ণনা করা হবে।

অধিকন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার ইরশাদ রয়েছে -

"বলুনঃ হে লোকসকল, আমি তোমাদের সবার জন্য ঐ আল্লাহ'র রাসুল (হিসেবে প্রেরিত হয়েছি) যিনি আসমান ও যমিনের মালিক ...." (সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ১৫৮)

"আমি আপনাকে সমস্ত মানুষের কাছে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছি ...." (সূরাহ সাবা, ৩৪: ২৮)

এ উভয় আয়াতে এবং এ দুটোর ন্যায় অন্যান্য আয়াতে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত মানুষের ৬ রাসুল।

এখন ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, আয়াতে মানুষের দ্বারা ঐ সমস্ত মানুষকেই বুঝানো হয়েছে যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে বিদ্যমান ছিলেন, নাকি ভবিষ্যতে আগমনকারী জনগোষ্ঠী এতে শামিল রয়েছে ?

প্রথম অবস্থায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিঃসন্দেহে শুধু সাহাবায়ে কিরামেরই রাসুল, তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত ও নবুওয়াত শুধু সাহাবা পর্যন্ত সমাপ্ত হয়েছে - এটা এমন অগ্রহণযোগ্য কথা, যা কোন মুসলমানই সমর্থন করতে পারে না।

দ্বিতীয় অবস্থায় সমস্ত মানুষ বলতে সাহাবায়ে কিরামের পর ভবিষ্যতে আগমনকারী সমস্ত মানুষকেই বুঝায় এবং আয়াতে جميعا ও كافة এর অর্থঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র দুনিয়ার বর্তমান জনগোষ্ঠী ও ভবিষ্যতে আগমনকারী সমস্ত মানব জাতির রাসুল (এ অর্থই সবচেয়ে সঠিক ও নির্ভুল)। এতে সুষ্ঠুভাবে আমাদের দাবি প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবীর সৃষ্টি হবে না। কেননা যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য সাধারণ, তাহলে কি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত ও রিসালাতে কোন অসম্পূর্ণতা ছিলো ? উম্মতের হিদায়াতের জন্য তা পরিপূর্ণ ছিলো না এই কারণে অন্য কোন নবীর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ আয়াতের তাফসীরও অচিরেই বর্ণনা করা হবে।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে -

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

"আমরা আপনাকে জগতসমূহের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।" (সূরাহ আল-আম্বিয়া, ২১ : ১০৭)

(নোটঃ "আলামীন" এর বাংলা অনুবাদে বইতে "দুনিয়া" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, অথচ এর অর্থ "জগতসমূহ", তাই "জগতসমূহ" শব্দটিই এখানে রিপ্লেস করা হলো)

যেভাবে জগতসমূহের অভিন্নতা অনুযায়ী "الْحَمْدُ لِلَّـهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ" - এর মধ্যে العلمين এর দ্বারা সমস্ত জগত বুঝায়, তেমনি এখানেও কোন ব্যতিক্রমের অবকাশ নেই।

সুতরাং আয়াতের সারমর্ম হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত, আর এটা তখনই হতে পারে, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত ও রিসালাত সর্বসাধারণের জন্য হবে এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর কোন নবী আগমনের প্রয়োজন থাকবে না। কেননা যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আবির্ভূত হোন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কঠোরভাবে ঈমান আনয়নকারী ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাতের অনুসরণকারী কোন ব্যক্তি যদি পরবর্তী নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপন না করেন, তাহলে তার সমস্ত চেষ্টা বিফল ও সমস্ত আমল বাতিল হয়ে যাবে। এটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের رحمة للعلمين হওয়ার পরিপন্থি। বরং এ অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র সত্তা ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণ শুধু ঐ ব্যক্তিদের জন্য রহমত হবে, যারা অন্য নবী আবির্ভূত হওয়ার পূর্বেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে, সমস্ত দুনিয়ার জন্য রহমত হওয়া প্রমাণিত হবে না।

এগুলো ছাড়া কুরআন মাজীদের আরো বহু আয়াতের ব্যাখ্যা ও ইঙ্গিতের দ্বারা এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।

কুরআন মাজীদের এ সমস্ত আয়াতের দ্বারা পাঠকবর্গ এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, পূর্বোক্ত আলোচনা খাতামুন-নাবিয়্যীন (خاتم النبيين) এর বিবৃত অর্থেরই সমর্থন করে এবং উপরের সমস্ত বর্ণনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, আলোচ্য আয়াতে خاتم النبيين ঐ একই তাফসীর যা আরবি অভিধানের ভিত্তিতে বর্ণনা করা হয়েছে। স্বয়ং কুরআন মাজীদের অন্যান্য আয়াতও সেই তাফসীরই বর্ণনা করে। যেহেতু এ বিষয়টি একটু পরেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, তাই এখানে দুই-তিন আয়াতের মাধ্যমেই আপাতত ইতি টানা হয়েছে আর এগুলো সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

 

হাদিসের দ্বারা আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা

কুরআন মাজীদের তাফসীরের যে ক্রমধারা আমরা উপরে বর্ণনা করেছি, এর দ্বিতীয় পর্যায় হলো হাদিস। এ সম্পর্কে বক্তব্য হলো এই যে, আলোচ্য আয়াতের যে তাফসীর আমরা আরবি অভিধান ও স্বয়ং পবিত্র কুরআনের আয়াতের আলোকে বর্ণনা করেছি, সে তাফসীরের সমর্থনে হাদিসেরও একটি বিরাট অধ্যায় রয়েছে। তা অধ্যয়ন করার পর একজন মুসলমানের এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না এবং এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, উপরিউক্ত তাফসীর ছাড়া خاتم النبيين এর অন্য কোন তাফসীর হতে পারে না।

যেহেতু আমরা এ সমস্ত হাদিস একটি পৃথক অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে পাঠকদের সামনে পেশ করবো, তাই এখানে তাফসীরের সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিসের উপর বক্তব্য সমাপ্ত করা হচ্ছে। যে কোন জ্ঞানী মুসলমানের জন্য তা যথেষ্ট।

সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

لاتقوم الساعة حتي يبعث دجالون كذابون كلهم يزعم انه نبي وانا خاتم النبيين لا نبي بعدي

"কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত অসংখ্য মিথ্যাবাদী দাজ্জাল আবির্ভূত না হবে, যাদের মধ্যে অনেকেই এ দাবি করবে যে, সে নবী। অথচ আমি সর্বশেষ নবী, আআম্র পর কোন নবী আসবে না।" (আবু দাউদ, তিরমিযী)

এ হাদিসের দ্বারা সর্বশেষ নবী ও কুরআন উপস্থাপক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই উপরিউক্ত বিতর্কের স্থায়ী সমাধান দিয়ে বলেছেন যে, خاتم النبيين এর অর্থ হচ্ছে তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবীগণের শেষ এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে কোন নবী আসবে না।

এখানে خاتم অর্থ মোহর বা আংটি নয়। কেননা لا نبي بعدي এর মধ্যে لايء نفي حنس দ্বারা এ বিষয়টিকে সম্পূর্ণ স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ইন শা আল্লাহ, সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে এর বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে।

হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, "আমিই সর্বশেষ নবী, আমার পর কোন নবী আসবে না।" (আহমাদ, তিরমিযী)

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমার ও আমার পূর্ববর্তী নবীদের উদাহরণ এরূপ, যেমন কোন ব্যক্তি একটি ঘর তৈরি করলো আর এটা খুব সৌন্দর্যমন্ডিত করলো। কিন্তু একটি ইটের জায়গা অসম্পূর্ণ রেখে দিলো। জনগণ এর চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করে এবং এর নির্মাণ কৌশল দেখে খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলতে থাকে, কেন এ ইটটি স্থাপন করা হয়নি (তাহলে নির্মাণ পূর্ণ হয়ে যেতো)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমিই এ সর্বশেষ ইট আর আমিই সর্বশেষ নবী। (বুখারী, মুসলিম)

হে মুসলমান দাবিকারী ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপনকারী ব্যক্তিগণ, উপরিউল্লিখিত স্পষ্ট বর্ণনার পরও আপনাদের কি এতে সন্দেহ রয়েছে যে, উপরিউক্ত আয়াতে খাতামুন-নাবিয়্যীন এর অর্থ তাই যা আমরা উপরে বর্ণনা করেছি ? আপনারা কি কুরআন-হাদিস ও এর ব্যাখ্যায় কোথাও শরীআতবিহীন নবীর কোন অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছেন ?

যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সেই নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট উদাহরণ দিয়ে বলে দিয়েছেন যে, خاتم النبيين এর অর্থ اخر النبيين অর্থাৎ সমস্ত নবীর পর আগমনকারী এবং যার আগমনের পর নবুওয়াতের মজবুত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত মহল নির্মাণ পূর্ণাঙ্গ হয়ে যায়। ফলে আর কোন নবী আগমনের প্রয়োজন বা অবকাশ থাকে না। নবুওয়াতের ইটের এতে কোন প্রয়োজন থাকে না, তেমনি শরীআতবিহীন নবীরও প্রয়োজন থাকে না। فباي حديث بعده يؤمنون

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "সমস্ত নবীর উপর আমাকে ৬টি বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে - (১) আমাকে ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ সংক্ষিপ্ত কথা বলার যোগ্যতা দান করা হয়েছে, (২) প্রভাব ও ভয়ের দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে, (৩) আমার জন্য গনিমতের মাল হালাল করা হয়েছে, (৪) আমার জন্য সমস্ত মাটি নামাযের স্থান ও তায়াম্মুমের জন্য বৈধ করে দিয়েছেন, (৫) আমাকে সমস্ত সৃষ্টির প্রতি নবী পাঠানো হয়েছে, (৬) আমার দ্বারা নবীদের ক্রমধারা সমাপ্ত করা হয়েছে।" (মুসলিম, ফাযাইল অধ্যায়)

এ হাদিসের দ্বারা خاتم শব্দের অর্থে যে বিকৃত করা হয়, এর মূলোৎপাটন করা হয়েছে। خاتم শব্দের পরিবর্তে ختم بي النبيون "আমার দ্বারা নবী প্রেরণের ধারা সমাপ্ত করা হয়েছে" - এতে কি কোথাও শরীআতবিহীন বা অন্য কোন ধরণের নবীর প্রয়োজনীয়তা অবশিষ্ট থাকে ?

আবু উমামা বাহিলী রাদিয়াল্লাহু আনহু একটি দীর্ঘ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, "আমি নবীগণের সর্বশেষ, আর তোমরা সমস্ত উম্মতের মধ্যে সর্বশেষ।" (ইবনে মাজাহ, ফিতনাতুদ-দাজ্জাল অধ্যায়)

খাতামুন-নাবিয়্যীন এর পূর্বোদ্ধৃত ব্যাখ্যাই এসব হাদিস থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু এতটুকু বলেই শেষ করা হয়নি, বরং সাথে সাথে এটাও বলা হয়েছে যে, "তোমরা সর্বশেষ উম্মত"। এর দ্বারা এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে এ উম্মতের জন্য নবী হিসেবে প্রেরণ করা হবে না, নতুন কোন উম্মতেরও উদ্ভব হবে না।

ইরবায ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ'র দরবারে ঐ সময় خاتم النبيين হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছি, যখন আদম মাটির সাথে মিশ্রিত ছিলেন।" (আদম আলাইহিস সালাম'কে যখন সৃষ্টি করা হয়নি) (মিশকাত, শরহে সুন্নাহ, মুসনাদে আহমাদ)

জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আমি রাসুলগণের নেতা, এটা অহংকারের কথা নয়। আমি নবীগণের শেষ, এতেও কোন অহংকার নেই। আমি প্রথম শাফাআতকারী হবো এবং আমার শাফাআত গ্রহণযোগ্য হবে, এতেও আমার কোন অহংকার নেই।" (মিশকাত, দারিমী থেকে সংকলিত)

যে সমস্ত লোক خاتم النبيين আয়াতাংশের অর্থে এ বিকৃতির ষড়যন্ত্র করছে এবং النبيين এর الف و لام এর বিতর্ক সৃষ্টি করে বলেছে যে, نبيين দ্বারা সমস্ত নবী উদ্দেশ্য নয়, তারা কাদিয়ানীদের নবী আগমনের অবকাশ সৃষ্টি করতে চেয়েছে। তারা যেন ভেবে দেখে যে, রাসুলগণের নেতা বলে সমস্ত রাসুলই বুঝানো হয়েছে কিনা। অন্যথায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত রাসুলের নেতা হওয়ার কথা সত্য হয় না, বরং তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু রাসুলের নেতা করতে হয়। কিন্তু তা কুরআনের ব্যাখ্যা ও হাদিসের সমস্ত ঘোষণার সম্পূর্ণ বিরোধী। মীর্জার দলের লোকদের পক্ষেও তা গ্রহণীয় হতে পারে না। কেননা তারাও ন্যূনতম পক্ষে মৌলিকভাবে স্বীকার করে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীর সর্দার ও নেতা। কিন্তু "আল-মুরসালিন" এর দ্বারা যদি সমস্ত রাসুলকে গণ্য করা হয়ে থাকে, তাহলে "আন-নাবিয়্যীন" এর দ্বারা সমস্ত নবীকে বুঝানো হয়েছে - এ কথা মনে করা যাবে না কেন ? কেন এর ব্যাখ্যা নিয়ে এতো কলা-কৌশল গ্রহণ করে তাতে বিকৃতি আনতে চেষ্টা করা হবে ?

ইবনে আবিদ দুনিয়া ও আবু ইয়ালা হযরত তামীমে দারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক দীর্ঘ হাদিসের অংশে বর্ণনা করেন, যখন কবরে ফেরেশতা (মুনকির ও নাকীর) মৃত ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞাসা করবেন যে, তোমার প্রভু কে এবং তোমার ধর্ম কি ? তখন মৃত ব্যক্তি বলবে, আমার প্রভু আল্লাহ, ইসলাম আমার দ্বীন আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার নবী ও সর্বশেষ নবী। এ উত্তর শুনে ফেরেশতা বলবেন, তুমি সত্য বলেছো। (তাফসীরে দুররে মানসুর, পৃ. ১৬৫)

যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সর্বশেষ নবী আর সমস্ত নবীর ক্রমধারা সমাপ্তকারী মনে করে, মুনকির ও নাকীর ফেরেশতাদ্বয় তাকে সত্যবাদী বলে সাক্ষ্য দান করেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ নবী হওয়ার সত্যতার এ একটা বড় প্রমাণ।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে জনসমাবেশে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে এখানে প্রয়োজনানুযায়ী মাত্র কয়েকটি হাদিস পেশ করা হলো। যেগুলো পাঠ করে কোন আল্লাহভীরু লোক এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী কোন মুসলমানই তা বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করতে পারে না।

উপরিউক্ত আলোচনার সারবস্তু হলো خاتم النبيين আয়াতাংশের যে অর্থ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন তা হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীর মধ্যে সর্বশেষ এবং নবীগণের ক্রমধারা সমাপ্তকারী। না এখানে কোন শরীআতপ্রাপ্ত নবীর অবকাশ রয়েছে আর না কোন শরীআতবিহীন নবীর।

আরবি অভিধান এ অর্থের দিকে ইঙ্গিত করছে, কুরআন নিজেই বলছে এ আয়াতাংশের অর্থ এই, কুরআন যে পবিত্র সত্তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর অবতীর্ণ হয়েছে, তিনিও(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন যে, আলোচ্য আয়াতের অর্থ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীর মধ্যে সর্বশেষ। হাদিসসমূহের বিরাট সংগ্রহের কোথাও শরীআত ধারক ও অধারকের কথা বলা হয়নি। এরপরেও কি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ নবী ও রাসুল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতে পারে ? فباي حديث بعده يؤمنون

 

সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনের মাধ্যমে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর

কুরআন মাজীদের তাফসীর সম্পর্কে যে ক্রমধারা প্রথমে বর্ণনা করা হয়েছে, এর তৃতীয় ও চতুর্থ স্তর হলো সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনের তাফসীর ও তাদের বর্ণনা।

সাহাবা ও তাবিঈনের সংখ্যা নিরূপণ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনের কিছু বর্ণনা প্রয়োজনানুযায়ী পাঠকদের সামনে পেশ করা হচ্ছে। উম্মতের পূর্ববর্তী বুজুর্গগণ এ আয়াতের কি অর্থ উপলব্ধি করেছেন, তা এ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তারা তো কোন মাধ্যম ছাড়াই স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে দ্বীন ইসলামের শিক্ষা লাভ করেছেন।

ইমাম আবু জাফর ইবনে জারীর তাবারী রাহিমাহুল্লাহ তার তাফসীরে কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাফসীর বর্ণনা করেনঃ

কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ'র রাসুল আর খাতামুন-নাবিয়্যীন অর্থাৎ সর্বশেষ নবী। (ইবনে জারীর, ২২খ. পৃ. ১১)

কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বর্ণনা শায়খ জালালুদ্দীন সুয়্যুতী তাফসীরে দুররে মনসুরে আবদুর রাযযাক, আবদ ইবন হুমায়দ, ইবন মুনযির ও ইবনে আবি হাতিম থেকেও বর্ণনা করেছেন (দুররে মনসুর, পৃ. ২০৪, ৫খ.) এসব বর্ণনা থেকেও আরবি অভিধান এবং কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে আমাদের প্রতিপাদ্য কথাই প্রমাণিত হয়েছে। তা হলো خاتم النبييبن এর অর্থ সর্বশেষ নবী। এতে শরীআত ধারক বা শরীআতবিহীন নবীর কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। অধিকন্তু আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পাঠেও সেই অর্থই প্রকট হয়ে উঠছে, আর তা হলো ولكن نبيا ختم النبيين "বরং তিনি এমন নবী, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বারা নবীগণের ধারা সমাপ্ত করা হয়েছে।"

আল্লামা সুয়্যুতী দুররে মানসুর গ্রন্থে আবদ ইবনে হুমায়দের মধ্যস্থতায় হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেনঃ

হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আয়াতে خاتم النبيين এর তাফসীর বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা নবীগণের ক্রমধারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বারা সমাপ্ত করেছেন, এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ'র প্রেরিত রাসুলগণের মধ্যে সর্বশেষ। (দুররে মানসুর, ৫খ. পৃ. ২০৪)

এরূপ বিস্তারিত বর্ণনার পরও কি এতে কোন সন্দেহ বা ব্যাখ্যার অবকাশ আছে ? দুররে মানসুর গ্রন্থে আল্লামা সুয়্যুতী মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা থেকে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র এ কথাটি উদ্ধৃত হয়েছে -

"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে خاتم النبيين বলো, কিন্তু এটা না বলো যে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর কোন নবী আসবেন না।" আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র এ বর্ণনা ইবনে কুতায়বা تاويل الحديث এ বর্ণনা করেছেন।

দুররে মনসুরে মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বার উদ্ধৃতি দিয়ে মুগীরা ইবনে শুবা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র এ ধরণের একটি বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছেঃ

সম্মানিত তাবিঈ শাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এক ব্যক্তি মুগীরা ইবনে শুবা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সামনে বলেন, "আল্লাহ পাক দরূদ পাঠ করেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর, যিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী, আর যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর আর কোন নবী নেই।" মুগীরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, "যখন তোমরা এ বিষয়ে কিছু বলো, তখন তোমাদের জন্য خاتم النبيين (নবীগণের ধারা সমাপ্তকারী) বলাই যথেষ্ট, لانبي بعده বলার প্রয়োজন নেই। কেননা আমাদের কাছে হাদিস বর্ণনা করা হয় যে, ঈসা আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হবেন। তাই তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বেও নবী ছিলেন এবং পরে আসবেন।" (দুররে মানসুর, ৫ম খ., পৃ. ২০৪)

উভয় হাদিসের উদ্দেশ্য স্পষ্ট, তা হলো, لانبي بعده এর দ্বারা যেহেতু স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নতুন বা পুরনো নবী আসবেন না। এর দ্বারা ঈসা আলাইহিস সালামের দ্বিতীয়বার আবির্ভূত হওয়া সম্পর্কে ইসলামের সামগ্রিক আকিদা ও সাহাবায়ে কিরামের সম্মিলিত বিশ্বাসের উপর সাধারণ দৃষ্টিতে বিপত্তি সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ রয়েছে।

তাই আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা আর মুগীরা রাদিয়াল্লাহু আনহু ইরশাদ করেন, এ ধরণের শব্দ গ্রহণ বা উল্লেখ করবে না, যার দ্বারা সম্মিলিত আকিদার বিরোধী ধারণা বা সন্দেহ হতে পারে। বরং যে উদ্দেশ্যে তোমরা খতমে নবুওয়াত বর্ণনা করতে চাও, তা শুধু خاتم النبيين (নবীগণের সর্বশেষ) বাক্যের দ্বারা পূর্ণভাবে প্রকাশ পেতে পারে এবং এতটুকুই যথেষ্ট। لانبي بعده যদিও মূলত স্বীয় অর্থের দিক থেকে সম্পূর্ণ সঠিক ৭ কিন্তু তবুও তাতে যখন ঈসা আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে সন্দেহ প্রকাশ পায়, তাই প্রকৃত কথাটি বুঝার জন্য আর সন্দেহ থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য শুধু خاتم النبيين (নবীগণের সমাপ্তকারী)বলাই উত্তম।

যেহেতু خاتم النبيين এর অর্থ اخر النبيين বা সর্বশেষ নবী এবং ঈসা আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়ার কিছুমাত্র বিরোধিতা হয় না। আলোচ্য আয়াতের অর্থ এ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না যে, বিশ্ব জগতে ৮ নবুওয়াতের এ সম্মানিত দায়িত্ব সমস্ত নবীর পরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর অর্পিত হয়েছে অর্থাৎ অর্থাৎ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবুওয়াত লাভ করেছিলেন।

মনে রাখা আবশ্যক যে, শেষ যুগে যখন ঈসা আলাইহিস সালাম আবির্ভূত হবেন, তখন তাকে নবুওয়াতের দায়িত্ব দেওয়া হবে না, বরং তার নবুওয়াতের যে পদ ও সম্মান যে সময় থেকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাকে প্রদান করেছেন তখন থেকে সর্বকালের জন্য বাকি রয়েছে এবং থাকবে।

সুতরাং خاتم النبيين এবং اخر النبيين কোনভাবেই ঈসা আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়ার বিরোধী নয়। উপরিউক্ত বাক্যের এ অর্থ আমাদের আবিস্কার নয়, বরং মারফূ হাদিস হিসেবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাফসীরে ইবনে কাসিরের ৮ম খণ্ডে ৪৮ পৃষ্ঠায় ইবনে আবি হাতিম সংগৃহীত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক মারফূ হাদিস বর্ণনা করেনঃ

انا اول النبيين في الخلق و اخر هم في البعث

"আমি সৃষ্টির দিক থেকে সমস্ত নবী হতে প্রথম এবং আবির্ভূত হওয়ার দিক থেকে সর্বশেষ।" (ইবনে কাসির, হাশিয়া, ফাতহুল বয়ান)

উপরিউক্ত হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, خاتم النبيين ও اخر النبيين এর অর্থ হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের মর্যাদা আবির্ভূত হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত নবীর পর এবং এ সূত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবীর পুনরাগমন হলে তা আয়াতের কখনোই বিরোধী নয়।

এ বিষয়টি তাফসীরে রুহুল মাআনীর ৭ম খণ্ডের ৬০ পৃষ্ঠায় এবং তাফসীরে কাশশাফের ২য় খণ্ডের ২১৫ পৃষ্ঠায় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া যদি আরবি অভিধান ও বাক-পদ্ধতি লক্ষ্য করে সামান্য চিন্তা করা হয়, তবে এটা প্রমাণিত হবে যে,

اخر العلماء اول النبيين اخر النبيين اخر الاولاد اخر القادمين اخر الشاهدين اخر المؤمنين اخر القاءمين اخر الطلباء

ইত্যাদি বাক-পদ্ধতি (محاورت) শুধু وصف مضاف اليه এর দৃষ্টিকোণ থেকে اوليت ও اخرين (সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ) এর অর্থ বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত এর থেকে বিরত রাখার জন্য কোন বাধ্য-বাধকতা না পাওয়া যায়, যেমন اول المؤمنين هجرة مثلا হিজরতের দিক থেকে প্রথম। তাই আরবি ভাষায় আল্লামা যামাখশারী রাহিমাহুল্লাহ خاتم النبيين এর অর্থ বর্ণনা করেছেন لانبيا احدا بعده "রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হবে না।" (তাফসীরে কাশশাফ, ২খ. পৃ. ২১৫)

خاتم النبيين এর অর্থ আরবের বাক-পদ্ধতি, (মরফূ) হাদিস এবং গভীর পারদর্শী তাফসীর লেখকগণের দৃষ্টি দিয়ে সামান্য জ্ঞানী ব্যক্তির ও ঈসা আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়া সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে "আমার পরে কোন নবী নেই" - এ কথার বাহ্যিক শব্দ দ্বারা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যক্তির এতে সন্দেহ হতে পারে। কিন্তু সামান্য চিন্তা করার পর এ সন্দেহও সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়ে যায়।

এই বাহ্যিক ও ক্ষুদ্রতম সন্দেহ দূর করার জন্য আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা ও মুগীরা রাদিয়াল্লাহু আনহু ইরশাদ করেন, কথা বলার সময় এমন শব্দ ব্যবহার করবে না, যাতে সাধারণ লোকদের মনে বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোন সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে।

এরপর لانبي بعدي "আমার পরে কোন নবী নেই" - এ হাদিসটি সহীহ এবং মরফূ বর্ণনার রীতিতে বর্ণিত। তাই এ বাক্যটি কোনভাবেই বাদ দেওয়া যায় না। সুতরাং আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ও মুগীরা রাদিয়াল্লাহু আনহু এই বাক্যটিকে ভুল বা অশুদ্ধ কিংবা তা বর্ণনা করা জায়েয নয় - এ কথা বলতে চাননি; বরং তাদের উদ্দেশ্য হলো শুধু সাধারণ লোকদের বিশ্বাস সংশোধন এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের সন্দেহ দূর করা। এ উদ্দেশ্যে অনেক মারফূ হাদিস জনসাধারণের কাছে বর্ণনা না করা উত্তম মনে করা হয়।

ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ এ বিষয়ের উপর স্বীয় সহীহ বুখারী গ্রন্থে একটি পৃথক অধ্যায় সংযোজন করেছেন। এ অধ্যায়টির শিরোনাম হচ্ছে -

"কোন অনুমোদিত কাজ গ্রহণ করার ফলে যদি সাধারণ লোক কোনরূপ অন্যায়ের মাঝে পতিত বা লিপ্ত হয়ে যাবে বলে সংশয়ের সৃষ্টি হয়, তাহলে অনুমোদিত কাজ ছেড়ে দিয়ে তার বিপরীতটাকেই কায়েম রাখাই আলীমগণের কর্তব্য।"

এরপর এ হাদিস বর্ণনা করা হয়েছেঃ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, "হে আয়েশা, যদি তোমার কওম নও-মুসলিম ও সদ্য কুফর ত্যাগকারী না হতো, তাহলে আমি কাবা শরীফকে ভেঙ্গে দুটো দরজা তৈরি করতাম। একটি প্রবেশের এবং দ্বিতীয়টি বের হওয়ার। (যেরূপ ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের নির্মাণ ছিলো)।" আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় খিলাফতকালে এভাবে নির্মাণ করেছিলেন। (বুখারী - কিতাবুল ইলম)

এ কথার সারমর্ম হলো, কুরাইশ যেহেতু সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী লোক, তাই এখনই কাবা শরীফ ভেঙ্গে নতুনভাবে নির্মাণ করা হলে তাদের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে এবং এর উদ্দেশ্য যে প্রকৃতপক্ষে কাবা শরীফকে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের নির্মাণ-কাঠামোর উপর স্থায়ী করা, তারা তা বুঝবে না। এ আশংকার কারণেই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সে কাজটি করেননি।

এ হাদিস পাঠ করে এটা অনুমান করা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা শরীফের সঠিক নির্মাণের বাসনা নিয়ে পরলোকগমন করেছেন এবং এর সংস্কার এজন্য করেননি, যাতে স্বল্প জ্ঞানী লোক উল্টো না বুঝে এবং উপকারের পরিবর্তে অপকার না হয়। সুতরাং এ ঘটনার বর্ণনাকারী আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা এ বিষয়ের প্রতি অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করেন এবং একটি নিরেট সত্য বিষয়কে এই দৃষ্টিকোণ দিয়ে সাধারণভাবে প্রচারের জন্য এ কারণে নিষেধ করে থাকেন যে, এর দরুন হয়তো লোকেরা ভুল বুঝতে পারে, তাহলে তা শরীআত বিরোধী হবে না।

এমনিভাবে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, "লোকদের কাছে ঐ সমস্ত কথা বর্ণনা করো, যা তারা বুঝতে পারে। আল্লাহ ও তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে মিথ্যা আরোপ করা হোক, তা কি তোমরা পছন্দ করো ?" (বুখারী)

মোটকথা, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা আর মুগীরা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বর্ণনায় لا نبي بعدي কথাটি বলতে নিষেধাজ্ঞা দ্বারা জনসাধারণের উপকার আর তাদেরকে ভুল বোঝা থেকে রক্ষা করাই উদ্দেশ্য। বাস্তব হাদিসের এই শব্দগুলোর বিরোধিতা উদ্দেশ্য নয়। নতুবা সম্মানিত ব্যক্তিদ্বয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি মুতাওয়াতির হাদিসের বিরোধী কিছু করেছেন - তা কোন জ্ঞানী ব্যক্তিই মেনে নিতে পারেন না। এরপরেও যদি এরূপ ধরে নেওয়া হয়, তবে এক্ষেত্রে স্পষ্ট বিধান হলো, ঐ সময় স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মুতাওয়াতির বর্ণনা উম্মতের জন্য গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। দুই সাহাবীর বর্ণনা, যাদের সনদেরই প্রমাণ নেই - তা গ্রহণযোগ্য নয়।

আলোচ্য আয়াতের যে তাফসীর উপরে উদ্ধৃত হয়েছে, এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু, হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু, আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা ও মুগীরা ইবনে শুবা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র নাম পাঠকবৃন্দ জানতে পেরেছেন। এছাড়া আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু, আক্কাস ইবনে মুসলিম রাদিয়ালাহু আনহু, আবু মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু, যুবায়র ইবনে মুতয়িম রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু, হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু, সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু, উবাদা ইবনে সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু, আতা ইবনে ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু, ইরবায ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু, উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু, উম্মে কুরয রাদিয়াল্লাহু আনহা, ফারুকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহু, উম্মে আয়মান রাদিয়াল্লাহু আনহা ও অন্য ৬৪ জন সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের দ্বারা খতমে নবুওয়াতের একই অর্থ বিভিন্ন বাক্যের দ্বারা বর্ণিত এবং প্রমাণিত আছে (বর্ণনাগুলোর উল্লেখ পরবর্তীতে আসবে), যা একাধিকবার পেশ করা হয়েছে।

অর্থাৎ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ নবী এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আবির্ভূত হবেন না। যদি অন্তরে কোন অনুভূতি ও মস্তিস্কে উপলব্ধির কোন অংশ থেকে থাকে, তাহলে কোন মুসলমান এমনকি কোন ন্যায়বান কাফিরও ৬৪ জন সম্মানিত সাহাবীর সাক্ষ্য ও বর্ণনার পর আমাদের দাবীর প্রতি কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করতে পারে না।

 

আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে মুফাসসিরীনে কিরামের বিভিন্ন উক্তি ও বর্ণনা

এ যাবত পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উলামায়ে কিরামের মধ্যে খ্যাত ও অখ্যাত কতজন কত সংখ্যক তাফসীরের কিতাব লিখেছেন, তা আল্লাহ রব্বুল আলামীন'ই ভালো জানেন। তবে এটা অনেকেই ধারণা করতে পারে যে, এর সংখ্যা এতো অধিক যা কোন মানুষের দ্বারা গণনা করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সবগুলো গণনা করার কোন প্রয়োজনও নেই এবং এটা আমার দ্বারা সম্ভবও নয়। বরং কিছু বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরের উল্লেখ এবং মুফাসসিরীনের বর্ণনা পাঠকদের সামনে পেশ করা হবে যাতে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হোন যে, যে সমস্ত বুজুর্গ সমস্ত জীবনকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর গবেষণায় শেষ করেছেন, তারা এ আয়াতের মর্ম কি বুঝেছেন আর কি তাফসীর করেছেন।

ইমামুল মুফাসসিরীন আবু জাফর ইবনে জারীর আত-তাবারী রাহিমাহুল্লাহ তার তাফসীরে উল্লেখ করেছেন, "কিন্তু তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ'র রাসুল ও খাতামুন নাবিয়্যীন, অর্থাৎ তিনি (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন ব্যক্তি, যিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের ক্রমধারা সমাপ্ত করে দিয়েছেন আর এর উপর মোহর অংকন করা হয়েছে। সুতরাং এটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কিয়ামত পর্যন্ত কারো জন্য খোলা হবে না। আয়িম্মায়ে তাফসীর, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈগণ এরূপ বর্ণনা করেছেন।" (ইবনে জারীর, ২২খ. পৃষ্ঠা ১১)

ইমামুল মুফাসসিরীন ইবনে জারীরের উপরিউক্ত ব্যাখ্যার পর কেউ কি এ কথা বলতে পারেন যে, خاتم النبيين এর দ্বারা সাধারণভাবে খতমে নবুওয়াত প্রমাণ হয় না, শুধুমাত্র শরীআতপ্রাপ্ত নবীদের সমাপ্তি বুঝায় ? অথচ তিনি অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে এটাও সুষ্ঠুভাবে ঘোষণা করেছেন যে - কিয়ামত পর্যন্ত নবুওয়াতের মহান বন্ধ দুয়ার আর কারো জন্যই উন্মুক্ত করা হবে না।

এটা শুধু তার ব্যক্তিগত মত ও গবেষণার ফসলই নয়, এরূপ তাফসীর সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈদের থেকেও বর্ণিত আছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি বিভিন্ন বুজুর্গ থেকে বিভিন্ন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন।

ইবনে জারীর রাহিমাহুল্লাহ হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেনঃ খাতামুন নাবিয়্যীন (خاتم النبيين) - এর অর্থ হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীর ক্রমধারা সমাপ্ত করেছেন। হাসান উক্ত শব্দটিকে "খাতাম" পাঠ করেছেন। এর অর্থ হলো, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী। (ইবনে জারীর, ২খ., পৃ. ২২)

হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এ সমাধানও দিয়েছেন যে, "খাতিম" পাঠ করা হোক কি "খাতাম" - উভয়ের অর্থ, শব্দ ও সংগ্রহের পার্থক্য ছাড়া সারমর্ম অভিন্ন হবে।

শীর্ষস্থানীয় মুফাসসির হাফিয ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহ তার নির্ভরযোগ্য ও সুবিখ্যাত তাফসীরে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর আমাদের দাবীকে অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন, "সুতরাং এ আয়াতের দ্বারা অকাট্যভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আবির্ভূত হবেন না। তাহলে রাসুল তো মোটেই আসবেন না, যেহেতু রিসালাতের দৃষ্টিতে নবুওয়াতের মর্যাদা নির্ধারিত। প্রত্যেক রাসুলের নবী হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু প্রত্যেক নবীর রাসুল হওয়া আবশ্যক নয়।"

ইবনে কাসির সাতশো হিজরির "হুজ্জাতুল ইসলাম" বা ইসলামের অকাট্য দলীল বিশ্লেষণে বিশিষ্ট সম্মানিত আলীমগণের মধ্যে গণ্য। তাফসীরের কিতাবের মধ্যে তার কিতাব সর্বকালেই সর্বজন গ্রহণযোগ্য।

এ সম্মানিত মুফাসসিরের ব্যাখ্যা পাঠ করে অনুমান করা যায় যে, আমরা আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে যা কিছু পেশ করেছি তা কুরআন-হাদিস, সাহাবীগণের অভিমত এবং ইমামগণের বর্ণনার সঠিক অনুবাদ। এতে আমাদের নিজস্ব কোন কৃতিত্ব নেই।

ইবনে কাসির এটাও স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবুওয়াত ও রিসালাত কেউই পাবে না। কেননা রাসুল তো শরীআতপ্রাপ্ত নবীকে বলা হয়। আর নবী হলেন সাধারণ ওহীপ্রাপ্ত ব্যক্তি, শরীআতপ্রাপ্ত হোক বা না হোক। তাই আয়াতে "خاتم المرسلين" (রাসুলগণের শেষ) এর পরিবর্তে বলা হয়েছে "خاتم النبيين" (নবীগণের শেষ)। সুতরাং সর্বপ্রকার নবুওয়াতের সমাপ্তি ঘোষণা করাই শ্রেয়। শরীআতপ্রাপ্ত হোক বা মীর্জাদের দাবি অনুযায়ী শরীআতবিহীন।

উপরিউক্ত বর্ণনার দ্বারা এটাও প্রতীয়মান হয় যে, খতমে নবুওয়াতের হাদিসসমূহ মুতাওয়াতির এবং সাহাবায়ে কিরামের এক বিরাট জামাআত হলেন এর বর্ণনাকারী।

এরপর ইবনে কাসির খতমে নবুওয়াতের উপর বিপুল সংখ্যক হাদিস উদ্ধৃত করেছেন। এগুলো ইন শা আল্লাহ, হাদিস অধ্যায়ে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হবে।

অবশেষে এ সম্মানিত মুফাসসির খতমে নবুওয়াতের বিষয়ে চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে একটি বিশেষ প্রতিবেদন লিখেছেন, যা বিশেষভাবে পাঠ করা প্রয়োজন। এর পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আল্লামা ইবনে কাসির আজ থেকে সাতশো বছর পূর্বেই মীর্জা কাদিয়ানীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিতে জেনে তা প্রতিহত করেছেন। সে ব্যাখ্যাটি হলোঃ

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে নবী হিসেবে প্রেরণ করাই হলো বান্দার প্রতি আল্লাহ'র রহমত। এরপর আল্লাহ তাআলা তার পক্ষ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বারা সমস্ত নবী ও রাসুলের ক্রমধারা সমাপ্ত করেছেন এবং দ্বীন ইসলাম তার উপর পূর্ণাঙ্গ করে নিয়েছেন। আল্লাহ তার কিতাব কুরআন মাজীদে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে মুতাওয়াতিরে এ ঘোষণা করেছেন যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে কোন নবী আবির্ভূত হবে না। তাই এ উম্মতের লোকেরা যেন এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর যে কোন ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবি করবে, সে ভয়ানক মিথ্যাবাদী, মিথ্যা অপবাদকারী, দাজ্জাল, পথভ্রষ্ট ও পথভ্রষ্টকারী। সে প্রতারণা করে এবং বিভিন্ন প্রকার ধোঁকাবাজি করে। কেননা এগুলো জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের নিকট বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত। যেমন, আল্লাহ তাআলা ইয়ামানে নবুওয়াতের দাবীদার আসওয়াদে আনসী আর ইয়ামামায় নবুওয়াতের দাবীদার মুসায়লামা কাযযাবের দ্বারা বিশৃঙ্খল অবস্থা ও অযৌক্তিক কথাবার্তা প্রকাশ করেন, যা দেখে সমস্ত জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, উভয়েই মিথ্যাবাদী ও পথভ্রষ্টকারী। আল্লাহ তাআলা এদের উপর এবং এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত যে কেউ নবুওয়াতের দাবি করবে, তাদের উপর লানত বর্ষণ করবেন, এমনকি মসীহ দাজ্জাল পর্যন্ত এই লানত বর্ষিত হবে। যাদের দ্বারা এ ধরণের অবস্থা প্রকাশ পাবে, উলামায়ে কিরাম ও মুসলিম সমাজ তাদের দাবি মিথ্যা হওয়া সম্পর্কে সাক্ষী দিবেন। (ইবনে কাসির, ৮খ. পৃ. ৯৯)

বাক্যগুলো মনোযোগ সহকারে পড়ুন। ইবনে কাসিরের মতো সুবিখ্যাত ইমামের এরূপ উচ্চাঙ্গ ও তেজোদ্দীপ্ত বক্তব্যও কি আপনাদেরকে সচেতন করেনি ? এ ধরণের সুস্পষ্ট বর্ণনার পরও কি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর পৃথিবীতে কোন নতুন নবী আবির্ভূত হবে বলে বিশ্বাস করবেন ?

শায়খ জালালুদ্দিন সুয়্যুতি রাহিমাহুল্লাহ তার সুবিস্তৃত তাফসীর দুররে মনসূরের ৫ম খণ্ডের ২০৪ পৃষ্ঠায় সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন ও আয়িম্মায়ে মুফাসসিরীণের বর্ণনার উপর নির্ভর করে উপরিউক্ত আয়াতের এই তাফসীরই লিপিবদ্ধ করেছেন, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া তিনি সংক্ষিপ্ত তাফসীর জালালাইন শরীফেও এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। আল্লামা যামাখশারী রাহিমাহুল্লাহ তার সুবিখ্যাত ও সর্বজনগ্রহণযোগ্য তাফসীর কাশশাফে এ আয়াতের তাফসীর বর্ণনা করে বলেনঃ

"খাতাম" শব্দের অর্থ হলো মোহর বা সীল দেওয়ার যন্ত্র, আর "খাতিম" শব্দের অর্থ সীল বা সমাপ্তকারী। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পাঠ ولكن نبياً ختم النبيين বরং তিনি এমন নবী, যার দ্বারা নবীগণের ধারা সমাপ্ত করা হয়েছে - এ অর্থকেই জোরদার করে। যদি আপনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে সর্বশেষ নবী হবেন অথচ ঈসা আলাইহিস সালাম শেষ যুগে অবতীর্ণ হবেন ? তাহলে আমরা বলবো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ নবী হওয়ার অর্থ হলো, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর কাউকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হবে না। সুতরাং ঈসা আলাইহিস সালামের অবতীর্ণ হওয়ার সাথে কোন বিরোধ রইলো না। কেননা ঈসা আলাইহিস সালাম'কে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বেই নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার তাকে নবুওয়াত দান করা হবে না। (কাশশাফ, মিসরী, ২খ. পৃ.২১৫)

আল্লামা যামাখশারী তাফসীর ছাড়া আরবি অভিধান ও আরবি ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর অদ্বিতীয় ইমাম হিসেবে স্বীকৃত। তিনিও خاتم النبيين এর এই অর্থ করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আর কোন নবী আবির্ভূত হবেন না। তাই তিনি ঈসা আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়া সম্পর্কে উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন যে, خاتم النبيين এর সারমর্ম হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হবে না। সুতরাং ঈসা আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়া এর বিরোধী নয়। কেননা তিনি ঐ সময় নবী হিসেবে আসবেন না, বরং পূর্বের নবুওয়াতের উপরই তিনি অবস্থান করবেন। পূর্বে আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

ইমাম রাযী রাহিমাহুল্লাহ তার তাফসীরে কবীরের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৬১৭ পৃষ্ঠায় (মিসর থেকে মুদ্রিত) এই তাফসীরই সমর্থন করেছেন এবং সাইয়্যেদ মাহমুদ আলূসী বাগদাদী রাহিমাহুল্লাহ তার নির্ভরযোগ্য তাফসীর রুহুল মাআনী গ্রন্থেও অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ

নবী বলতে এখানে এখানে রাসুল হতে সাধারণ মর্যাদা বুঝিয়েছেন। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাতামুন নাবিয়্যীন হওয়াতে খাতামুল মুরসালীন হওয়া অনিবার্য হয়েছে। (তাফসীরে রুহুল মাআনী, ৭খ. পৃ.৬০)

উপরে ইবনে কাসির থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সাইয়্যেদ মাহমুদ আলূসীও এটিই বলেছেন। এর থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, خاتم النبيين এর দ্বারা সাধারণভাবে নবীগণের ক্রমধারা সমাপ্তি বুঝানো মূল উদ্দেশ্য।

কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিতে এতে ঈসা আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে যে প্রশ্নের উদয় হয়, তার জবাবে বলা হয়েছেঃ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের "খাতামুন নাবিয়্যীন" হওয়ার অর্থ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে নবুওয়াত নিয়ে আবির্ভূত হওয়ার পর নবুওয়াতের পদ নতুন করে সৃষ্টি হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। জীন্ন ও মানবজাতির কারো জন্যই ঐ পদ আর সৃষ্টি করা হবে না। খতমে নবুওয়াতের ব্যাপারটি ঈসা আলাইহিস সালামের অবতীর্ণ হওয়া সংক্রান্ত আকিদা বিরোধী নয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত এই আকিদার উপরই ঐক্যবদ্ধ। এমনকি হাদিসের দ্বারা বিষয়টি এরূপ প্রচার হয়েছে যা মুতাওয়াতিরের স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছে। পবিত্র কুরআন এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছে যার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। শেষ যুগে ঈসা আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়াকে যারা অবিশ্বাসকারী, তারা কাফির দার্শনিকরূপে গণ্য। তিনি তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেই নবুওয়াত লাভ করেছিলেন। (রুহুল মাআনী, ৭খ. পৃ. ৯০)

খতমে নবুওয়াত ও এর মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে এ পর্যন্ত যেরূপ সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, এতে আমার মনে হয় এরপর এ বিষয়ে কোন মুসলমানের মনে একবিন্দু সন্দেহ থাকতে পারে না।

আলোচ্য আয়াতের যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে তা বিশেষভাবে পাঠ করা প্রয়োজন।

"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ নবী হওয়ার ব্যাপারটি কুরআনে আলোচিত হয়েছে, আর হাদিসসমূহে রয়েছে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা। সমস্ত উম্মতে মুহাম্মাদি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। তাই এর বিপরীত মতাবলম্বী অবশ্যই কাফির বলে গণ্য হবে। যদি তাওবা না করে, তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করাই শরীআতের অকাট্য বিধান।" (রুহুল মাআনী, ৭খ. পৃ. ৬৫)

তাফসীরের বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য কিতাব "খাযেন" এ বর্ণিত হয়েছেঃ

خاتم النبيي এর অর্থ আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নবুওয়াত সমাপ্ত করে দিয়েছেন। সুতরাং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর না কোন নবুওয়াত থাকতে পারে, না তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে একসময়ে। (খাযেন, ৩খ. পৃ. ৩৭০)

আল্লামা নসফী তার নির্ভরযোগ্য তাফসীর মাদারিকে লিখেছেনঃ

আল্লামা আসিমের পাঠ অনুযায়ী خاتم النبيين এর অর্থ মোহর, যার দ্বারা সর্বশেষ বুঝায়। অর্থাৎ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হবে না এবং ঈসা আলাইহিস সালাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্বে নবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাই শেষ যুগে তার আবির্ভূত হওয়ায় কোন বিরোধের উৎপত্তি হবে না। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পাঠও এরই সমর্থন করে। (মাদারিক, হাশিয়া খাযেন, ৩খ. পৃষ্ঠা ৩৭)

আল্লামা যারকানী শরহে মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া গ্রন্থের ৫ম খণ্ডের ২৬৭ পৃষ্ঠায় আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা করে লিখেছেনঃ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষত্বের মধ্যে এটাও রয়েছে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত নবী ও রাসুলের সমাপ্তকারী। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন, "কিন্তু তিনি আল্লাহ'র রাসুল ও সর্বশেষ নবী", যিনি(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবীগণের ক্রমধারা সমাপ্ত করেছেন বা যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বারা নবুওয়াত খতম হয়েছে। ইমাম আসিমের পাঠ অনুযায়ী এ অর্থ হয়ে থাকে। ইমাম আহমাদ, তিরমিযী ও হাকিম সঠিক সনদের সাথে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করে বলেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রিসালাত ও নবুওয়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আমার পর কোন রাসুল বা নবী নেই। বলা হয়ে থাকে, যে নবীর পর কোন নবী নেই, তিনি নিজ উম্মতের জন্য বেশী স্নেহপরায়ণ ও দয়ালু হবেন। এর উদাহরণ ঐ পিতার মতো, যার সন্তানদের লালনপালনের জন্য তার পর আর কেউ থাকে না। ঈসা আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়া আর খতমে নবুওয়াতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কেননা ঈসা আলাইহিস সালাম আগমন করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধর্মাবলম্বী হবেন। তাছাড়া খতমে নবুওয়াতের অর্থ হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সর্বশেষ নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে এবং ঈসা আলাইহিস সালাম পূর্বেই নবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। (যারকানী, শরহে মাওয়াহিব, ৫খ. পৃ. ২৬৭)

আবুল সাইয়ান তার তাফসীর বাহরে মুহীতের ৭ম খণ্ডের ২৩৬ পৃষ্ঠায় অনুরূপ বক্তব্য পেশ করেছেন।

আল্লামা আহমাদ আনুস সাউদ তার তাফসীরে একই মত সমর্থন করেছেন। (তাফসীরে কবীরের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৭৮৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)

বিশ্ববিশ্রুত আলিম আল্লামা আহমাদ সাহেব ওরফে মোল্লা জিউন তার তাফসীরে আহমাদিতে একই বিষয়ে অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।

কাযী ইয়ায "শিফা" গ্রন্থে আমাদের দাবীর স্বপক্ষে আলোচ্য আয়াতের যে ব্যাখ্যা করেছেন তা বিশেষভাবে পাঠ করা প্রয়োজনঃ

যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবি করবে, অথবা দার্শনিকদের মতো আত্মার উন্নতির দ্বারা নবুওয়াতের স্তর পর্যন্ত পৌঁছা এবং তা অর্জন করা বৈধ ও জায়েয মনে করে এবং শরীআতের সীমালঙ্ঘনকারী তাসাউফের দাবিদার এবং যে ব্যক্তি দাবি করে যে, সে নবুওয়াতের দাবি না করলেও তার কাছে ওহী আসে, অথবা আসমানে চড়ে, বেহেশতে প্রবেশ করে, সেখানে ফলমূল ভক্ষণ করে আর হুরদের সাথে কোলাকুলি করে - তারা সকলেই কাফির এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মিথ্যা দোষারোপকারী। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাতিমুন-নাবিয়্যীন এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর কোন নবী আবির্ভূত হবেন না। আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পৃথিবীর সমস্ত মানুষের প্রতি রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। সমস্ত উম্মত একমত হয়েছেন (اجماع) যে, আলোচ্য আয়াতকে বাহ্যিক অবস্থার উপর রাখতে হবে এবং কোন বিশ্লেষণ ও ভিন্নমত প্রকাশ করা চলবে না। অতঃপর উপরিউক্ত দলগুলোর কুফরীতে কোন সন্দেহ নেই। বরং ঐকমত্য ও বর্ণনার দ্বারা তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। (শিফা, বেরেলী মুদ্রিত, পৃ. ৩৬২)

উপরিউক্ত বাক্যসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে প্রতীয়মান হয় যে, সে কথাগুলো দ্বারা কাদিয়ানীদের ধোঁকা উদঘাটন করা হয়েছে। বাক্যের যে অর্থ প্রকাশ্য অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীর সমাপ্তকারী, সে অর্থই চূড়ান্তভাবে স্বীকৃত। এতে না যিল্লি বা বুরুজী নবীর কোন স্থান রয়েছে, না শরীআতবিহীন নবীর কোন অবকাশ রয়েছে।

তাফসীরে "মুরাহে লাবীদ লি কাশফ মাআনীউল কুরআনুল মাজীদ" এর ২য় খণ্ডে আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছেঃ

আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সর্বশেষ নবী এজন্য বলা হয় যে, "খাতিম" এর অর্থ সর্বশেষ ব্যক্তি, আর আল্লাহ তাআলা বলেছেন - "বরং আল্লাহ'র রাসুল ও নবীগণের শেষ"। (নিয়মানুযায়ী) সাধারণ নিয়মের নিষেধাজ্ঞা বিশেষ বিষয়ের উপরও আরোপিত হয়। অর্থাৎ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর অপর কোন নবী না হওয়ার কথা বলে তার পর রাসুল হওয়াকেও অস্বীকার করা হয়েছে অনিবার্যভাবে। (কুল্লিয়াতে আবিল বাকা, পৃ. ৩১৯)

শরহে তায়ারুফের ১ম খণ্ডের ১৪ ও ১৫ পৃষ্ঠায় আবু ইব্রাহীম বুখারী আলোচ্য আয়তের একই তাফসীর বর্ণনা করে বলেছেন যে, এরপর কোন নবী আবির্ভূত হবেন না।

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী রাহিমাহুল্লাহ'কে ইলমে যাহের ও বাতেনের সর্বজনস্বীকৃত ইমাম হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে এমন বিষয় উল্লেখ করেছেন, যাতে কাদিয়ানীদের ফিতনার দ্বার চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাদের দাবি খণ্ডন করার জন্য লিখেছেনঃ

এটা স্মরণ রাখা উচিত যে, সমস্ত উম্মতে মুহাম্মাদি خاتم النبيين এর দ্বারা এটাই বুঝেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী বা রাসুল আসবেন না, এই বিষয়ে ইজমা ও ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, আলোচ্য আয়াতের ভিন্নতর কোন ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের অবকাশ নেই। যে ব্যক্তি এ আয়াতে কোন প্রকার বিশেষত্বের সাথে ভিন্নতর কোন বিশ্লেষণ করে, তার সমস্ত কথা নিরর্থক। এর ফলে তার উপর কুফরীর ফাতওয়া থেকে তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। কেননা সে প্রকাশ্য আয়াতে মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়েছে। অথচ এ বিষয়ে উম্মতে মুহাম্মাদি ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, এতে ভিন্নতর ব্যাখ্যা দেওয়ার কোন অবকাশ নেই। (কিতাবুল ইকতিসাদ)

 

আলোচ্য আয়াতের ভিন্নতর ব্যাখ্যাদানকারীকে হত্যা করা হয়েছে

হাদিসের ইমাম আল্লামা শাতিবী রাহিমাহুল্লাহ ৮ম হিজরি শতকের একজন প্রসিদ্ধ ও খ্যাতনামা ইমাম ছিলেন। তিনি তার "ইতিসাম" নামক কিতাবে ঐ সমস্ত লোকের একটি তালিকা প্রণয়ন করেছেন, যারা নবুওয়াত বা ওহী অথবা নিস্পাপ হওয়ার দাবি করেছে, ফলে সমস্ত উম্মতের ঐকমত্য ও ইজমা অনুযায়ী তাদেরকে কাফির, মুরতাদ হিসেবে হত্যার উপযুক্ত গণ্য করেছে। (ইতিসাম, ২খ. পৃ. ১৬৩)

এ পর্যায়ে ইমাম শাতিবী ফাযাযী নামক এক ব্যক্তির ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, সে নবুওয়াতের দাবি করে আর এমন অনেক ঘটনা প্রদর্শন করে, যা কারামত ও অলৌকিক বলে মনে করা হয়। সর্বযুগেই জনসাধারণ আশ্চর্য ও অলৌকিক বস্তুর পূজা করে থাকে। এ সময় একদল লোক তার দলভুক্ত হয়ে যায়। এরাও কাদিয়ানীদের মতো কুরআন অনুসরণের দাবি করে। তাই তারা আয়াতে خاتم النبيين এর মাঝে এরূপ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ শুরু করে, যার ফলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আগমনের অবকাশ থাকে। কিন্তু সে যুগের উলামায়ে কিরাম সর্বসম্মতভাবে এ দাবি এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সবকিছুই কুফরী ও নাস্তিকতা বলে ঘোষণা করেন। তাই সে যুগের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইমাম শায়খুল মাশায়িখ আবু যার ইবনে যুবায়র রাহিমাহুল্লাহ'র ফতোয়ার ভিত্তিতে তাকে হত্যা করা হয়। (কিতাবুল ইতিসাম, ২খ. পৃ. ২৬৩)

উপরোক্ত ঘটনাটি বিষয়টির চূড়ান্ত মীমাংসা করে দিয়েছে। এ থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ উম্মতের উলামায়ে কিরাম আলোচ্য আয়াতে কোন প্রকার ভিন্নতর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদর্শন করাকে কুফর ও নাস্তিকতা বলে ঘোষণা করেছেন এবং এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র মতপার্থক্য নেই।

 

ফুটনোটঃ

(৬) হাদিসে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আমি ঐ সমস্ত লোকের রাসুল যারা এখন জীবিত, আর তাদেরও - যারা আমার পরে জন্মগ্রহণ করবে।"

(৭) ইন শা আল্লাহ, হাদিস لانبي بعدي এর আলোচনায় বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করা হবে।

(৮) এর দ্বারা ঐ দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রূহের জগতের সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের মর্যাদা লাভ করেছিলেন, যার ফলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) خاتم النبيين ও اول النبيين অর্থাৎ প্রথম ও শেষ নবী। কিন্তু এখানে দুনিয়ার জীবন নিয়ে আলোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীর শেষে নবুওয়াত লাভ করেছিলেন।

 

(পরবর্তী পার্টে এ আয়াত সম্পর্কিত উত্থাপিত কিছু সন্দেহের উত্তর উপস্থাপন করার মাধ্যমে এ আয়াত সম্পর্কিত দীর্ঘ আলোচনা শেষ হবে, এরপর খতমে নবুওয়াত সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াতগুলোর আলোচনা শুরু হবে .........)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী মতবাদ - ৩ (তৃতীয় অংশ)

 

 

 

The Greatest Nation·Thursday, March 14, 2019

 

 

 

 

 

কিছু সন্দেহ ও তার অপনোদন

আলোচ্য আয়াতের উপর উল্লিখিত সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত তাফসীর পাঠ করার পর কোন মুসলমান, কোন ন্যায়বান মানুষেরই মধ্যে ভিন্নতর কোন প্রকার সন্দেহের প্রশ্ন উঠে না। কিন্তু দুনিয়ায় প্রায় এরূপ লোকও থাকে, যাদের সম্মুখে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি কার্যকর হয় না। হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতার প্রাচীর তাদের চোখ ও কানের সামনে আবরণ হয়ে যায়। এর চেয়েও বেশী আশ্চর্য হলো নিজ চোখের ত্রুটিকে অস্বীকার করে সূর্যের ত্রুটিকে প্রাধান্য দেয় এবং নিজ জ্ঞানের সংকীর্ণতাকে দলীল-প্রমাণাদির ত্রুটি বলতে শুরু করে।

নবুওয়াত ও অত্র خاتم النبيين আয়াতাংশের ক্ষেত্রেও তারা এমনটি করেছে। তারা এসব অবস্থায় আয়াতের বিকৃত অর্থ প্রদানের অপচেষ্টা করে এবং কুরআন ও হাদিস, সাহাবা ও তাবিঈদের বর্ণনা এবং অভিধানের নিয়ম-নীতির বিরোধী সন্দেহের আবিস্কার করে।

মীর্জা দলের মৃদুবাক্য ও ধোঁকাবাজির আচরণ জনগণের সম্মুখে এই সমস্ত সন্দেহকে এক সুন্দর (?) আকৃতিতে পেশ করেছে, যার ফলে অজ্ঞ লোকদের সন্দেহের মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই সম্ভাব্য সকল সন্দেহের অপনোদন আবশ্যক।

 

প্রথম সন্দেহ

যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী হয়ে থাকেন, আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর কোন নবী আগমন না করেন, তাহলে সর্বজনস্বীকৃত নবী ঈসা আলাইহিস সালাম কিভাবে সর্বশেষে আগমন করবেন ? অথচ তার শেষ যুগে আগমন মুসলমানদের সম্মিলিত আকিদা-বিশ্বাস। কুরআন ও হাদিসেও তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

মোটকথা, হয়তো খতমে নবুওয়াতকে অস্বীকার করতে হয় নতুবা ঈসা মসীহ আলাইহিস সালামের আগমনকে অবিশ্বাস করতে হয়।

এ সন্দেহটি মীর্জায়ী দলের গৌরবের বস্তু ও একটি মোক্ষম হাতিয়ার মনে করা হয়। স্বয়ং মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী আর তার অনুসারী দল অজ্ঞ জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য এটিকে সুন্দর একটি কৌশল মনে করে বিভিন্ন স্থানে পেশ করে থাকে।

সন্দেহের উত্তর

(১) আরবি অভিধান ও আরবি কথন-রীতি অনুযায়ী خاتم النبيين ও اخر النبيين এর অর্থ হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুনিয়ায় সর্বশেষ নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছেন, যার সারমর্ম হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে নবুওয়াত প্রদান করা হবে না এবং ভবিষ্যতে নবুওয়াতের উপাধিতে কেউ ভূষিত হবে না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে সমস্ত নবী সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ হয়ে গেছেন।

আরবি ভাষায় এর শত শত প্রমাণ রয়েছে। যেমন বলা হয়ে থাকে- اخر الاولاد يا خاتم الاولاد

আরবি ভাষাভাষীদের ঐকমত্য ও দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞানীর ইজমা অনুযায়ী উপরিউক্ত বাক্যের অর্থ হলো, এ শিশু সর্বশেষে জন্মগ্রহণ করেছে। এর পর কোন শিশুর জন্ম হয়নি। এটা নয় যে, এর পূর্বে সমস্ত সন্তান ও শিশু মৃত্যুবরণ করেছে।

সুতরাং মীর্জা মনের অজান্তে আমাদের বক্তব্যকেই মেনে নিয়েছে।

এভাবে বলা হয়ে থাকে - خاتم المهاجرين (মুহাজিরদের সর্বশেষ)। কোন জ্ঞানী এর অর্থ এটা মনে করেন না যে, প্রথম মুহাজির সবাই ইন্তেকাল করেছেন, বরং যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক বালকও এর অর্থ এটাই বুঝবে যে, এ ব্যক্তি সর্বশেষে হিজরত করেছেন। হিজরতের গুণাবলী বা পুণ্য তিনি সর্বশেষে প্রাপ্ত হয়েছেন। এখন পূর্ববর্তী কোন মুহাজিরের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বা পুনরায় গমন করা এর কিছুমাত্র বিরোধী হতে পারে না। এ ব্যক্তি সর্বশেষ রয়েছেন কিন্তু এটা নয় যে, প্রথমে যারা এসেছেন তারা সবাই মৃত্যুবরণ করেছেন। এমনিভাবে اخر الراحلين এর অর্থ হলো এ ব্যক্তি সর্বশেষ ভ্রমণ করেছে। কিন্তু এটা নয় যে, প্রথম ভ্রমণকারী সবাই মৃত্যুবরণ করেছে এবং বর্তমানে তাদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বা নিজ দেশে আগমন অসম্ভব।

এরপরও বোধগম্য নয় যে, خاتم النبيين ও اخر النبيين এর দ্বারা কিভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ববর্তী সমস্ত নবী ইন্তেকাল করে গেছেন এবং ঈসা আলাইহিস সালামের পৃথিবীতে আগমন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের خاتم النبيين হওয়ার পরিপন্থী।

উপরিউক্ত দৃষ্টান্তসমূহের আলোকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীর পর নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে এ নবুওয়াতের পদ প্রদান করা হবে না - এই অর্থ কেন গ্রহণ করা যাবে না ? প্রকাশ থাকে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর নবুওয়াতপ্রাপ্ত হোননি, বরং পূর্বেই তিনি নবুওয়াত লাভ করেছেন। তিনি সে সময় থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত এ পদে ভূষিত ছিলেন, এরপরও নবুওয়াত খতমকারী ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনের আকিদার মাঝে কোন বৈপরীত্য থাকে কি ?

(২) সাহল ইবনে সাদ সায়িদী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হিজরতের অনুমতি প্রার্থনা করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

يا عم اقم مكانك انت به فان الله قد ختم بك الهجرة كما ختم بي النبيون

"হে পিতৃব্য, নিজ জায়গায় অবস্থান করুন। কেননা আল্লাহ আপনার দ্বারা হিজরত সমাপ্ত করে দিয়েছেন, যেমনি আমার উপর নবুওয়াতের ক্রমধারা সমাপ্ত করা হয়েছে।" (তাবারানী, আবু নুয়াইম, আবু ইয়ালা, ইবনে আসাকির ও ইবনে নাজ্জার থেকে বর্ণিত)

এখানে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খতমে নবুওয়াতকে খতমে হিজরতের দৃষ্টান্তরূপে তুলে ধরেছেন।

আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু'র খাতিমুল মুহাজিরীন হওয়া তার পূর্ববর্তী মুহাজিরদের পৃথিবীতে জীবিত থাকার বিরোধী নয়। অথবা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু'র উপর খতমে হিজরতের কথাটি দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, তার পূর্ববর্তী সকল মুহাজির মৃত্যুবরণ করেছেন।

এরপরও নবুওয়াত ও খাতিমুন-নাবিয়্যীন -এর বিপরীত ধরণের কোন অর্থ এবং এটাকে ঈসা আলাইহিস সালামের জীবিত থাকার বিরোধী বলে প্রচার করার যুক্তিসংগত কারণই থাকতে পারে না। খাতামুন নাবিয়্যীন -এর প্রকৃত অর্থ দ্বারা মীর্জা সাহেবের আবিষ্কৃত নবুওয়াত প্রতিষ্ঠায় বাঁধার সৃষ্টি হয় বলেই বিপরীত ধরণের অর্থ গ্রহণ করতে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর কোন ভিত্তি নেই।

(৩) আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ

"আর যখন আমি নবীদের কাছ থেকে তাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম, এবং তোমার কাছ থেকে আর নূহ (থেকে) ...." (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩: ৭)

এ আয়াতের তাফসীরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

كنت اول النبيين في الخلق و اخرهم في البعث

"সমস্ত নবীর পূর্বে আমার সৃষ্টি এবং সর্বশেষে আমার আগমন হয়েছে।" (তাফসীরে ইবনে কাসির, ৮খ. পৃ. ৮৯; ইবনে আবু হাতিম, ইবনে মারদুবিয়া, আবু নুআইম, আদ-দায়লামী, ইবনে আসাকির, ইবনে আবি শায়বা, ইবনে জারীর ও ইবনে সাদ থেকে বর্ণিত)

উপরোক্ত হাদিস দ্বারাও খাতামুন-নাবিয়্যীনের অর্থ স্পষ্ট করা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন দুনিয়ায় সর্বশেষে হয়েছে যদিও নবী হিসেবে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সৃষ্টি করা হয়েছে সকলের পূর্বে। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্বের সমস্ত নবীর মৃত্যু সংঘটিত হয়নি। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের خاتم النبيين হওয়া কোনভাবেই ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনের বিরোধী নয়।

(৪) ইতোপূর্বে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আমার উদাহরণ হলো এরূপ, যেমন একটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু একটি ইট সংযোজন বাকি রয়েছে। ঐ একটি ইট সংযোজন করা হলে নবুওয়াতের প্রাসাদ কিংবা তার ক্রমধারা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। আমার দ্বারা সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করা হয়েছে এবং আমাকে সর্বশেষে প্রেরণ করা হয়েছে।" (বুখারী, মুসলিম)

এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাতামুন-নাবিয়্যীন হওয়ার অর্থ এই যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব সমস্ত নবীর শেষে হয়েছে। এটা নয় যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্বে সমস্ত নবী ইন্তেকাল করেছেন। যেমন সর্বশেষ ইটের জন্য অন্যান্য ইটের বিলুপ্তির কোন প্রয়োজন নেই, বরং এটা কল্পনাও করা যায় না। তেমনি خاتم النبيين এর জন্য পূর্ববর্তী সমস্ত নবীর মৃত্যুবরণ করারও কোন প্রয়োজন নেই।

(৫) আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

"নিশ্চয়ই রিসালাত ও নবুওয়াতের ক্রমধারা নিঃশেষিত হয়েছে। তাই আমার পরে কোন রাসুল বা নবী আগমন করবে না।" (তিরমিযী)

এ হাদিসে নবী ও রাসুল ছাড়া নবুওয়াতের নিঃশেষিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে বিষয়টি পূর্ণাঙ্গভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, খতমে নবুওয়াতের অর্থ ভবিষ্যতে নবুওয়াতের পদে ভূষিত হওয়ার সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। পূর্ববর্তী নবীদের জীবিত থাকা বা পৃথিবীতে পুনরায় আগমন করা খতমে নবুওয়াতের বিরোধী নয়।

(৬) উম্মে কুরয রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

"নবুওয়াতের ক্রমধারা শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সুসংবাদ সম্বলিত স্বপ্ন এখনো অবশিষ্ট রয়েছে।" (ইবনে মাজাহ)

এখানেও নবুওয়াতের পদের বিলুপ্তির উল্লেখ করে খতমে নবুওয়াতের ঐ অর্থই স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, নবুওয়াতে পদ ভবিষ্যতের জন্য বিলুপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রথম নবীদের জীবিত থাকা বা তাদের পুনরাগমনের বিরোধী নয়।

(৭) হাদিসে আছে, আদম আলাইহিস সালাম জিবরীল আলাইহিস সালামের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, "মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে?" তিনি উত্তরে বলেন, "اخر ولدك من الانبياء" অর্থাৎ, "তিনি(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন নবীগণের মধ্যে আপনার সর্বশেষ সন্তান।" (ইবনে আসাকির থেকে বর্ণিত)

উপরিউক্ত হাদিসের দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, خاتم النبيين এর অর্থ হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবীদের মধ্যে সর্বশেষ সন্তান। সর্বশেষ সন্তান হওয়ার ফলে পূর্ববর্তী সন্তানদের মৃত্যুবরণ করা প্রয়োজনীয় নয় এবং এর মধ্যে কারো জীবিত থাকারও বিরোধী নয়। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের اخر الانبياء এবং خاتم الانبياء হওয়া ও ঈসা আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়ার মধ্যে বৈপরীত্য নেই।

(৮) হাদিসে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

انا خاتم الانبياء و مسجدي خاتم المساجد

"আমি সর্বশেষ নবী এবং আমার নির্মিত মসজিদ সর্বশেষ মসজিদ।" (মুসলিম)

এর অর্থ হলো, আমার মসজিদ সমস্ত নবী নির্মিত মসজিদের সর্বশেষ মসজিদ। দায়লামী, ইবনে নাযর ও বাযযারের বর্ণনায় এর ব্যাখ্যা রয়েছে।

আলোচ্য বিষয়ের উপর উপরিউক্ত হাদিস একটি যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য সমাধান। কেননা خاتم المساجد الانبيا রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভূত হওয়ার পর পূর্ববর্তী নবীদের কোন মসজিদ অবশিষ্ট থাকবে না, তা নয়। পূর্ববর্তী নবীগণের নির্মিত বহু মসজিদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে বর্তমান ছিলো এবং এখনো বর্তমান আছে। এরপর خاتم المساجد এর অর্থ যদি এই হয় যে, পূর্ববর্তী নবীদের সমস্ত মসজিদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বর্ণনা কিভাবে সঠিক হতে পারে ? সুতরাং যখন خاتم المساجد "মসজিদসমূহের শেষ" কথাটি পূর্ববর্তী মসজিদের স্থায়িত্বের বিরোধী নয়, তাহলে خاتم الانبياء "নবীগণের শেষ" কথাটি পূর্ববর্তী নবীদের জীবিত থাকা বা আবির্ভূত হওয়ার বিরোধী হবে কেন? বরং যেভাবে خاتم المساجد এর অর্থ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নতুন আগমনকারী নবীর মসজিদ তৈরি হবে না, তেমনি خاتم الانبياء এর অর্থ হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর পৃথিবীতে আর কাউকেই নবুওয়াতের পদ ও মর্যাদা প্রদান করা হবে না।

(৯) আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে কয়েকজন খ্যাতনামা তাফসীরকারের আলোচনা উদ্ধৃত হয়েছে। এতে ঈসা মাসীহ আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়া সম্পর্কে যে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে, তারই জবাব উপরে উদ্ধৃত হয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষ করে নিন্মে বর্ণিত কয়েকজনের তাফসীর পুনরায় দেখা যেতে পারে। তা হলো -

সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আলূসী লিখিত "রহুল মাআনী", আল্লামা যামাখশারী রচিত "কাশশাফ" এবং আল্লামা নসফী লিখিত "মুদারিক"।

(১০) গ্রহণীয় সমাধানঃ কুরআন, হাদিস, সাহাবীদের অভিমত, তাবিঈন ও পূর্ববর্তী মনীষীদের বর্ণনায় যাদের মনের সান্ত্বনা হয় না, বরং মীর্জা কাদিয়ানীর রচিত গ্রন্থ দেখতে না পেলে যারা সান্ত্বনা পায় না, তাদেরকে মীর্জা গোলাম আহমাদ লিখিত "তারইয়াকুল কুলূব" গ্রন্থখানির ১৫৬ পৃষ্ঠা পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি। তাতে লিখিত রয়েছেঃ

"এটা অবশ্যই প্রয়োজন যে, যার উপর মানবতার পূর্ণত্ব সমাপ্ত করা হয়েছে তিনি হবেন সর্বশেষ সন্তান। অর্থাৎ তার মৃত্যুর পর কোন পরিপূর্ণ মানুষ কোন মহিলার গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করবে না।"

মীর্জা সাহেবের মতে خاتم الاولاد এর অর্থ যখন এই যে, কোন মহিলার গর্ভ থেকে কোন পরিপূর্ণ মানুষ তার পর আর জন্মগ্রহণ করবেন না, তখন خاتم النبيين এর অর্থ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী কোন মহিলার গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করবে না, এ অর্থ হবে না কেন ?

মীর্জা কাদিয়ানীর উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হলো।

প্রথমত, খতমে নবুওয়াত ও ঈসা আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়ার মধ্যে কোন বিরোধ নেই। خاتم النبيين বলতে বুঝায়, অতঃপর কোন মহিলার গর্ভ থেকে কোন নবী জন্ম নিবেন না এবং মসীহ আলাইহিস সালাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বেই জন্ম লাভ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, মীর্জা কাদিয়ানী যদি কোন মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তাহলে তার কথানুযায়ী তার নবুওয়াত خاتم النبيين এর পরিপন্থী।

তৃতীয়ত, হাদিসে যে মাসীহ আলাইহিস সালামের আবির্ভূত হওয়ার খবর দেওয়া হয়েছে, তিনি ঐ সময় মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করবেন না। তাই তা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের خاتم النبيين হওয়ার বিরোধী হবে না। আর এ জন্যই মীর্জা কাদিয়ানীর নবুওয়াতের দাবি ভিত্তিহীন।

 

দ্বিতীয় সন্দেহ

মীর্জা সাহেব স্বীয় রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে এবং তার অনুসারীরা তাদের রচনায় এ বক্তৃতায় অত্যন্ত জোর দাবীর সাথে পেশ করে থাকে যে, خاتم النبيين এর মধ্যে خاتم এর অর্থ মোহর এবং خاتم النبيين এর অর্থ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মোহর বা সত্যায়ন দ্বারা নবী হবেন।

সন্দেহের অপনোদন

এখন আযাদীর যুগ। প্রত্যেক বদ দীনের হাতে কলম আর সামনে অভিভাবকহীন কুরআন রয়েছে। যার যেভাবে মন চায় এর অর্থ বর্ণনায় ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। যদি স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এর হিফাযতের দায়িত্ত্ব গ্রহণ না করতেন তাহলে যে কোন নির্ভীক বাহাদুর এর শাব্দিক ও অর্থগত পরিবর্তনের চেষ্টার বিন্দুমাত্র ত্রুটি করতো না।

এই কারণে দেখতে পাই এক-এক ব্যক্তির কুরআনের আয়াতের অর্থ আভিধানিক নিয়মের বিপরীত। স্বয়ং কুরআনের ব্যাখ্যার বিরোধী, দেড়শোর বেশী হাদিসের পরিপন্থী এবং লক্ষ লক্ষ সাহাবা, তাবিঈ ও তাফসীর বিশারদের মতের বিরুদ্ধে খোলাখুলি বর্ণনা করে থাকে; এরূপ উদ্ভট ব্যাখ্যার প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই।

মুসলমানরা হাসিখুশিতে এই ব্যাখ্যা শুনে থাকে। কেননা এটা কুরআনের তাফসীর হোক বা না হোক, তাতে তাদের যেন কিছুই এসে যায় না। মনে রাখা আবশ্যক যে, তা বেশীদিন চলতে পারে না।

কিন্তু মানুষ আল্লাহ পাকের মযবুত ও দৃঢ় কালামের পরিবর্তনকে প্রতিবাদ ছাড়া শুধু নীরবে শুনে থাকলে এবং পবিত্র কুরআনকে অভিভাবকহীন মনে করে ছেড়ে দিলেও মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা এমনি ছেড়ে দিবেন না। তিনি পবিত্র কালামের হেফাযতের অঙ্গীকার করেছেন। যে ব্যক্তি এর হেফাযতের বিরুদ্ধে হাত প্রসারিত করবে, তাকে আল্লাহ তাআলা'র কঠোর শাস্তি থেকে মুক্তি লাভের জন্য যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ বলেন -

".... একমাত্র আল্লাহ'র রহমত ছাড়া আজ কেউ রক্ষা পাবে না....." (সূরাহ হুদ, ১১ : ৪৩)

যদি মীর্জা কাদিয়ানী আর তার অনুসারীদের দাবি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আরবি অভিধান ও আরবি ভাষার নীতিমালার ভিত্তিতে এ কথা প্রমাণ করুন যে, خاتم النبيين এর অর্থ হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মোহরের দ্বারা নবী হয়ে থাকে। এরূপ অর্থ করার যৌক্তিকতা আরবি অভিধান থেকে তার একটি উদাহরণ পেশ করুন কিংবা আরবি ভাষাভাষীদের কোন একটি কথা দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরুন।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মীর্জার সমস্ত দলবল, তাদের নবী ও তার সন্তানদের নিয়েও আরবি ভাষা ও সাহিত্যের কোন বর্ণনায় এর উদাহরণ দেখাতে পারবে না।

মীর্জা কাদিয়ানী তার নিজস্ব "বারাকাতুদ্দোয়া" গ্রন্থের ১৪ ও ১৫ পৃষ্ঠায় সর্বপ্রথম কুরআন মাজীদের দ্বারা, দ্বিতীয়ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের দ্বারা, তৃতীয়ত সাহাবায়ে কিরামের অভিমত দ্বারা তাফসীরে কুরআনের মাপকাঠি পেশ করেছে। যদি এটা হাতির দাঁত দেখানোর মতো না হয়, তাহলে আল্লাহ'র দিকে চেয়ে কুরআনের কোন আয়াতের দ্বারা خاتم النبيين এর এ তাফসীর পেশ করুন। তা সম্ভব না হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস সম্ভার থেকে কোন হাদিসে এরূপ তাফসীর রয়েছে তা পেশ করুন। তারপর বুখারী ও মুসলিম বা ছয়খানা সহীহ হাদিস, এমনকি কোন দুর্বল হাদিস থেকে পেশ করুন যে, خاتم النبيين এর অর্থ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মোহরের দ্বারা নবী হয়ে থাকেন বলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন।

যদি এটাও সম্ভব না হয় (কখনো সম্ভব হবে না), তাহলে কমপক্ষে কোন সাহাবী অথবা কোন তাবিঈর বর্ণনা পেশ করুন, যাতে خاتم النبيين এর এ অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে।

 

চ্যালেঞ্জ

হে মীর্জায়ী দল ও তার অনুসারীরা, যদি তোমাদের দাবীতে সত্যের কোন নিদর্শন থাকে এবং অন্তরে কোন মর্যাদাবোধ থাকে, তাহলে তোমাদের আবিষ্কৃত তাফসীরের কোন প্রমাণ পেশ করো। যদি সমস্ত জামাআত মিলে এটা পেশ করতে সক্ষম হও যে, কুরআনের ত্রিশ পারার কোন আয়াতে, অসংখ্য হাদিসের মধ্যে কোন একটি হাদিসে [তা যতোই দুর্বল (ضعيف) হোক না কেন] অথবা সাহাবা ও তাবিঈদের অসংখ্য উক্তি ও অভিমতের মধ্য থেকে কোন একটি বর্ণনায় এটি বলা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মোহর দ্বারা নবী হতে পারে, তাহলে পুরস্কার হিসেবে আমাদের থেকে পাঁচশো টাকা (তখনকার পাঁচশো টাকা) গ্রহণ করতে পারো।

যদি বাস্তবে তাদের বর্ণিত তাফসীর কুরআনের তাহরীফ বা অর্থসহ বিকৃতি না হয় এবং উপরিউল্লিখিত তাফসীর নীতির ভিত্তিতে তাদের কোন দাবি থাকে, তাহলে তারা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সাহসী হবে।

কিন্তু আমি আল্লাহ'র উপর ভরসা করে প্রকাশ্যভাবে এ কথা ঘোষণা করতে চাই যে, যদি মীর্জা সাহেব আর তার অনুসারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রচেষ্টা করে, তবুও একটি দলীল পেশ করতে সক্ষম হবে না।

অধিকন্তু পবিত্র কুরআনের আয়াত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের ব্যাখ্যা, সাহাবা ও তাবিঈদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, পূর্ববর্তী বুজুর্গ ও মুফাসসিরগণের বর্ণনা এবং আরবি অভিধান ও আরবি ভাষার ব্যাকরণের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা তাদের বিকৃত ব্যাখ্যার বিরোধিতা করেছে এবং ঘোষণা করেছে যে, মীর্জায়ী দল خاتم النبيين আয়াতের যে অর্থ আবিস্কার করেছে, তা নিন্মিলিখিত কয়েকটি কারণে বাতিল ও অগ্রহণযোগ্যঃ

(১) এ অর্থ আরবের বাক-পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিরোধী। নতুবা এটা আবশ্যক হয়ে যাবে যে, خاتم القوم আর اخر القوم এর অর্থও এটাই হবে যে, তার মোহরে কওম সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং خاتم المهاجرين এর অর্থও তার মোহরের দ্বারা মুহাজির সৃষ্টি হয়ে থাকে। তেমনি خاتم الاولاد এর অর্থও তার মোহরে সন্তান সৃষ্টি হয়ে থাকে।

কিন্তু এটা খুবই সুস্পষ্ট যে, কোন বুদ্ধিমান লোক, এমনকি স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন বালকও উপরিউক্ত বাক্যের এ অর্থ গ্রহণ করতে পারে না। এরপরও خاتم النبيين এর এ অর্থ কিভাবে এবং কোথা থেকে আবিস্কার হলো ? অথচ মীর্জা কাদিয়ানী خاتم الاولاد এর যে অর্থ মনে করে, তাও এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

(২) কুরআন মাজীদের প্রায় একশো আয়াত এ তাফসীরকে ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ বলে ঘোষণা দিয়েছে (আয়াতসমূহ পরে উদ্ধৃত করা হবে)। তাছাড়া ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আলোচ্য আয়াতের অন্য যে পাঠ বর্ণিত হয়েছে, তা মীর্জা কাদিয়ানীর বিকৃত অর্থের ভিত্তিহীনতা প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কেননা তার কিরায়াতে خاتم النبيين এর পরিবর্তে خاتم النبيين যা অতীতকাল বুঝায়, ব্যবহার করা হয়েছে। তাতেও মীর্জার বিকৃত অর্থ প্রমাণিত হয় না।

(৩) এ বিকৃতি ঐ সমস্ত মুতাওয়াতির বা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদিসের বিরোধী, যা সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে ঘোষণা করেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবীর জন্ম হবে না।

(৪) এ তাফসীর সাহাবায়ে কিরামের বর্ণনারও বিরোধী।

(৫) তাবিঈন, মনীষী ও আয়িম্মায়ে মুফাসসিরীনের যেসব অভিমত ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে, তাও এই বিকৃতির পরিপন্থী।

যে তাফসীর কাওয়াইদে লুগাত, কুরআনের আয়াত ও হাদিস এবং সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনের মতের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তা যদি কুরআনের বিকৃতি (تحريف) এবং আল্লাহ'র প্রতি মিথ্যা অপবাদরূপে চিহ্নিত না হয়, তাহলে তদপেক্ষাও অধিক নিকৃষ্ট বিকৃতি (تحريف) বলে গণ্য হবে না, বরং যে কোন পাগলের প্রলাপকেও কুরআনের তাফসীর হিসেবে মানতে হবে।

 

সন্দেহ

মীর্জায়ীদের চিন্তাধারা আর দুষ্কর্ম এক অদ্ভুত খেলনার মতো। তারা বলে থাকে -

"আল্লাহ কুরআনের দ্বারা অনেক লোককে গোমরাহ করেন আর অনেককে হিদায়াত প্রদর্শন করেন।" (সূরাহ আল-বাকারাহ'র ২৬ নং আয়াতের আয়াতাংশের ভাবানুবাদ)

তাদের কল্পনা ও চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একদিকে কুরআনের আয়াতের বিকৃতি তাদের জন্য খুবই সহজ, কিন্তু অন্যদিকে তাদের নিজেদের রচনা বা বক্তৃতায় যে বৈপরীত্য প্রকাশ পায়, তাও তারা উপলব্ধি করতে পারে না।

এ সমস্ত বিভিন্নমুখী বর্ণনার মধ্যে একটা হলো ৯ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শরীআতপ্রাপ্ত নবীদের ক্রমধারা সমাপ্তকারী, সমস্ত নবীদের জন্য নয়। কিন্তু এ কথা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

যদি النبيين এর মধ্যে الف و لام শুধু عهد خارجي এর জন্যই হয়ে থাকে, তাহলে পূর্ববর্তী আয়াতে উল্লেখ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু পরবর্তী আয়াতে কোথাও শরীআতপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট কোন নবীর উল্লেখ নেই। যদি থাকে, তবে কোথায় এবং কোন কুরআনে রয়েছে ? কাদিয়ানীর কাছে কোন নতুন কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে কি ? যার আয়াতে মীর্জাকে নবী বানিয়ে পাঠানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ?

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে যে পবিত্র কুরআন প্রদান করা হয়েছে, তার মধ্যে তো কোথাও এর চিহ্নমাত্র নেই, বরং এতে সমস্ত নবীর কথাই বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার পয়গাম পৌঁছানোর জন্য নবী হওয়ার প্রয়োজন এবং সমস্ত নবীই আল্লাহ তাআলার পয়গম্বর। শুধু শরীআতপ্রাপ্ত নবীগণই নন। সূরাহ আল-আহযাবের ৩৯ নং আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে।

 

একটি সন্দেহ ও এর অপনোদন

মীর্জায়ী দল خاتم النبيين এর অর্থ বর্ণনায় এ কথাও বলতে চেষ্টা করেছে যে, এ বাক্যটি শুধু রূপক অর্থে ব্যবহৃত। যেমন এর দ্বিতীয় উদাহরণ خاتم المحدثين ، خاتم المفسرين ইত্যাদিতে সর্বসম্মতিক্রমে এই রূপক অর্থই করা হয়েছে। কেননা এর প্রচলিত অর্থ যে ব্যক্তিকে خاتم المحدثين লিখা হয়, কারো মতেই এর দ্বারা এটা বুঝায় না যে, এরপর আর কোন মুহাদ্দিস জন্মগ্রহণ করবেন না। এই ধরণের উদ্ভট দলীল উপস্থাপন কেবল মীর্জায়ীদের পক্ষেই সম্ভব। ১০ কেননা خاتم المفسرين ، خاتم المحدثين ইত্যাদি মানুষের রচিত বাক্য - যাদের আগামী দিনে কি ঘটবে সে বিষয়ে কোন জ্ঞানই নেই। যদি কোথাও তাদের এ ধরণের বাক্য দেখা যায়, তাহলে এটা রূপক বা অতিশয়োক্তি ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করা হবে, নতুবা এ বাক্য নিরর্থক বরং মিথ্যা হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্ত বিশ্বের সৃষ্টিকর্তার কালাম ও বাক্যে কি এরূপ মনে করা যায় ? তার জ্ঞানের আওতার বাইরে কোন বস্তুই নেই এবং তিনি স্বীয় জ্ঞান ও ইচ্ছানুযায়ী নবীদেরকে প্রেরণ করেন।

সুতরাং সর্বজ্ঞানী আল্লাহ'র কালামে যখন কোন ব্যক্তি সম্পর্কে خاتم النبيين শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে, তখন কোনরূপ লৌকিকতা ছাড়াই তার প্রচলিত অর্থই গ্রহণ করতে হবে।

বস্তুত মানুষের উচ্চারিত বাক্যে এর প্রকাশ্য অর্থ ছেড়ে অতিশয়োক্তি বা রূপক অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু আল্লাহ'র কালামে এর কোন প্রয়োজন নেই এবং বিনা প্রয়োজনে প্রকৃত অর্থ ছেড়ে রূপক অর্থ গ্রহণ করা সর্বজনস্বীকৃত নীতি বিরুদ্ধ।

তাছাড়া যখন কুরআন মাজিদের একশো আয়াত خاتم النبيين এর অর্থ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছে যাতে কোন প্রকার রূপক বা অতিশয়োক্তির সুযোগ দেওয়া হয়নি এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুশো হাদিসে এর অর্থ এমন বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, যাতে কোন অস্পষ্টতা নেই, এরপর ইজমায়ে সাহাবা ও পূর্ববর্তী বুজুর্গগণ এর প্রকাশ্য ও প্রকৃত অর্থ গ্রহণের উপর মোহর করে দিয়েছেন। এরপর এর বিপরীত অর্থ গ্রহণ করার কারোই কোন অধিকার থাকতে পারে না, আল্লাহ রব্বুল আলামীন নিজেই যখন তার কালামের প্রকৃত অর্থ বর্ণনা করেন এবং এরপর যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কালাম অবতীর্ণ হয়েছে, তিনিও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ অর্থ সুস্পষ্টভাবে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সাহাবায়ে কিরাম এবং পূর্ববর্তী সমস্ত বুজুর্গ ঐ অর্থই বলেন, তখন এটাই আয়াতের প্রকাশ্য ও প্রকৃত অর্থ হবে, তাতে সন্দেহ থাকতে পারে না। এ গ্রন্থে ইমাম গাযালী রাহিমাহুল্লাহ'র রচিত "ইকতিসাদ" এবং কাযী ইয়ায রাহিমাহুল্লাহ'র "শিফা" এর উদ্ধৃতি দিয়ে আমরা এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। এ সম্পর্কে ইমাম গাযালীর বক্তব্য হলোঃ

আয়াতে خاتم النبيين এর মাঝে ভিন্নরূপ কোন ব্যাখ্যা দানের অবকাশ নেই। যে ব্যক্তি এতে ভিন্নতর ব্যাখ্যার কোন অপচেষ্টা করে, তার কথা অগ্রহণযোগ্য ও ধোঁকা বলে গণ্য হবে এবং এ ব্যাখ্যার ফলে তাকে কাফির গণ্য করা হবে। কেননা সে ঐ আয়াতের মিথ্যা ব্যাখ্যা করেছে। যে সম্পর্কে উম্মতের ইজমা রয়েছে যে, এ আয়াতের ভিন্নতর কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে না।(কিতাবুল ইকতিসাদ)

কিন্তু মীর্জায়ীগণ মোরগের পিছনের পায়ের দিকে দৌড়াতে অভ্যস্ত।

মোটকথা, কুরআন, হাদিস, ইজমায়ে সাহাবা ও পূর্ববর্তী বুজুর্গগণ خاتم النبيين এর যে প্রকৃত ও প্রকাশ্য অর্থের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, সেটাই অকাট্য ও সর্বশেষ কথা।

 

সন্দেহ

خاتم النبيين এর মধ্যে خاتم এর অর্থ আংটির মণি হিসেবে গ্রহণ করে সৌন্দর্য বা শোভা উদ্দেশ্য নেওয়া হয়ে থাকে এবং আয়াতের অর্থ এই যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীর সৌন্দর্য বা শোভা। এ অবস্থায় খতমে নবুওয়াতের সাথে আয়াতের কোন সম্পর্কই থাকে না।

উত্তর

তাফসীরের মূলনীতির দৃষ্টিতে বিচার করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তাদের এ ব্যাখ্যা কুরআন বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আলোচ্য আয়াতের এ অর্থ কখনোই হতে পারে না। কারণ -

(১) خاتم এর অর্থ زينت বা সৌন্দর্য ও শোভা তার রূপক অর্থ, আসল অর্থ নয়। কোনরূপ লৌকিকতা ছাড়াই এর প্রকৃত অর্থ হতে পারে বলে তার রূপক অর্থ গ্রহণের কোন যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না। এটা গ্রহণ করা হলে তা আরবি অভিধান ও অলংকারশাস্ত্রের পরিপন্থী হবে।

(২) আমরা আলোচ্য আয়াতের যে তাফসীর কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত এবং স্বয়ং ঐ আয়াতের অন্যান্য পাঠরীতির আলোকে উপরে বর্ণনা করেছি, তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

(৩) আলোচ্য আয়াতের যে তাফসীর মুতাওয়াতির হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাও এর সম্পূর্ণ বিরোধী।

(৪) মীর্জায়ীদের এ তাফসীর ইজমা ও পূর্ববর্তী বুজুর্গদের বর্ণনার বিরোধী, যা আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি।

(৫) তাফসীরশাস্ত্রের ইমামগণের মতেরও সম্পূর্ণ বিরোধী এ তাফসীর। এরপরও কি কোন মুসলমান পবিত্র কুরআনের এ অর্থ গ্রহণ করতে পারেন ?

যদি এমনিভাবে যে কোন সাধারণ লোকের চিন্তাধারা এবং মূল বা রূপক অর্থ পবিত্র কুরআনের তাফসীর হয়, তাহলে কেউ বলতে পারে যে, সমস্ত কুরআন মাজীদের যেখানে اقيموا الصلوة ইত্যাদি আয়াতের দ্বারা নামাযের ফরয হওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, যেখানে صلوة শব্দের আভিধানিক অর্থ শুধু দরূদ প্রেরণ ও দুয়া করাও হতে পারে।

এমনিভাবে আয়াতে কারীমা "فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ" ইত্যাদি যাতে রোযা ফরয করা হয়েছে, এর আভিধানিক ও শাব্দিক অর্থ হলো, যখন রমযান মাস আগমন করে, তখন তোমরা বিরত থাকো। কেননা আরবি অভিধানে صوم এর মূল অর্থ হলো বিরত থাকা।

এমনিভাবে صوم ও زكوة প্রভৃতি শব্দের অর্থ যদি হাদিস ও পূর্ববর্তী বিশেষজ্ঞগণের বর্ণনার প্রতি লক্ষ্য না রেখে শুধু অভিধানের দৃষ্টিতে করা হয়, তাহলে মীর্জা সাহেব ও তার অনুসারীদের বদৌলতে সমস্ত ফরয থেকে মুক্ত হওয়া যাবে, এমনকি ইসলামের বিধি-নিষেধ থেকেও মুক্তি লাভ করা যাবে।

কিন্তু আলোচ্য আয়াতে صلوة ، صوم ، حج প্রভৃতি শব্দের আভিধানিক অর্থ এজন্য পরিত্যাগ করা হয় যে, পবিত্র কুরআন অন্যান্য আয়াত, মুতাওয়াতির হাদিস ও পূর্ববর্তী আলিমগণের দ্বারা যে ব্যাখ্যা প্রমাণিত রয়েছে, তা এর সম্পূর্ণ বিরোধী। যদি এখন ঐ সমস্ত আয়াতের আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করা হয়, তাহলে লোকদেরকে এ ফরযসমূহ আদায় করার দায়িত্ব থেকে মুক্ত করা হবে।

মোটকথা, কোন নির্বোধ ব্যক্তিও এ ধরণের বিকৃতি মেনে নিতে পারে না। কিন্তু এমনিভাবে যদি خاتم শব্দের রূপক অর্থে সৌন্দর্য বা শোভা গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা কুরআনের আয়াত, হাদিস এবং পূর্ববর্তী আলিমগণের তাফসীরের বিরোধী হবে, তাই এটা বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। যেমনিভাবে صلوة ، صوم ، حج ، زكوة প্রভৃতি ধর্মীয় প্রসিদ্ধ শব্দের আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করা সর্বসম্মতভাবে অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল।

 

সন্দেহ

আয়াতে خاتم النبيين এর মধ্যে ১১ الف و لام সর্বব্যাপকতা বোঝাবার জন্য নয়, বরং প্রচলিত ব্যাপকতার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তাই এর অর্থ হবে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাধারণভাবে সমস্ত নবীর জন্য নয়, বরং কেবল শরীআতপ্রাপ্ত নবীগণের জন্য তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) خاتم বা সমাপ্তকারী। যেমন, "وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ" (নবীগণকে তারা হত্যা করে) আয়াতে এই প্রচলিত ব্যাপকতাই বুঝানো হয়েছে, সর্বাত্মক ব্যাপকতা নয়। উক্ত আয়াতে নাবিয়্যীন বলতে বনী ইস্রাইলীরা যেসব নবীকে হত্যা করেছিলো, কেবল তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে, সকল নবীকে বুঝানো হয়নি।

সন্দেহের জবাব

আমাদের উপরোক্ত আলোচনা যারাই মনোযোগ সহকারে পাঠ করবেন, তারা কোন লৌকিকতা ছাড়াই বুঝতে পারবেন যে, এটাও একটা বিকৃতি, শরীআতে এর কোন ভিত্তি নেই।

(১) প্রথমত এ কারণে যে, আরবি ভাষা নীতিবিদদের মতে প্রকৃত সর্ব ব্যাপকতার তাৎপর্য গ্রহণ সম্ভব হলে প্রচলিত সামগ্রিকতার তাৎপর্য গ্রহণ করা যায় না। এ কারণে খাতামুন নাবিয়্যীন-এ সমস্ত নবীই শামিল, তাদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক নন। অতএব আয়াত অনুযায়ী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীরই শেষ এবং নবুওয়াতের ক্রমধারা সমাপ্তকারী।

পক্ষান্তরে "وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ" (নবীগণকে তারা হত্যা করে) বলে সমগ্র নবীকে হত্যা করে বুঝাবে না, বরং নবীগণের কিছু সংখ্যককে হত্যা করে বুঝাবে নতুবা আয়াতের অর্থ হবে এই যে, বনী ইসরাইল সমস্ত নবীকে হত্যা করেছে, কিন্তু এটা কোনমতেই সঠিক নয়, বরং এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা হবে। কেননা প্রথমত বনী ইসরাইলের যুগে সমস্ত নবী বর্তমান ছিলেন না। বহু নবী তাদের পূর্বে ইন্তিকাল করেছেন এবং কোন কোন নবী তখনো আবির্ভূত হোননি। এরপরও তাদের দ্বারা সমস্ত নবীকে হত্যা করার কথা বলা হলে তার কোন অর্থ হয় না।

(২) দ্বিতীয়ত, বনী ইসরাইল তাদের যুগের সমস্ত নবীকে কোন ব্যতিক্রম ছাড়া নিরঙ্কুশভাবে হত্যা করেছে তা আদৌ প্রমাণিত নয়, বরং পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছেঃ

"..... কিছু সংখ্যককে তোমরা অমান্য করেছো আর অপর কিছু সংখ্যককে তোমরা হত্যা করেছো।" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ৮৭)

বনী ইসরাইল তখনকার যুগের সমস্ত নবীকে হত্যা করেনি। এ ঘোষণার পরও যদি "وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ" এর استغراق حقيقي الف و لام এর জন্য ব্যবহৃত হয়, তাহলে যেভাবে ঘটনাবলী ও পর্যবেক্ষণ এটা মিথ্যা বলে প্রমাণিত করবে, তেমনি স্বয়ং কুরআনে কারীমও এটাকে ভুল প্রমাণিত করবে।

আয়াতে কারীমা"وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ" এতে الف و لام যদি প্রকৃত সামগ্রিকতার অর্থে ব্যবহৃত মনে হয়, তাহলে আয়াতের মূল বক্তব্যই সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভুল হয়ে যাবে।

সুতরাং উপরিউক্ত আয়াতে যখন বিষয়টি সূর্যের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, তাতে সর্বাত্মক সামগ্রিকতা হতে পারে না, তাই এতে চলতি সামগ্রিকতা মনে করতে হবে।

অপরপক্ষে, خاتم النبيين আয়াতাংশে কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই পূর্ণাঙ্গ সামগ্রিকতা রয়েছে। তাই সমস্ত নবীর সমাপ্তকারী বুঝাবে। আয়াতে কারীমা -

وَلَـٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّـهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ

".... কিন্তু তিনি নেককার ব্যক্তি যার ঈমান রয়েছে আল্লাহ'র প্রতি, পরকাল, ফেরেশতা, কিতাব ও নবীগণের প্রতি ......" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১৭৭)

এখানে আলিফ ও লাম দ্বারা নিরঙ্কুশ সামগ্রিকতা বুঝায়, তাই সকল নবীর প্রতিই ঈমান আনা জরুরী শর্ত। নিন্মোদ্ধৃত আয়াতটিতেও তাই -

فَبَعَثَ اللَّـهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ

".... আল্লাহ সমস্ত নবীকে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন...." (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ২১৩)

এখানে কতিপয় নবীকে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শক করে পাঠিয়েছেন মনে করা সম্পূর্ণ ভুল, বরং তিনি সকল নবীকেই একই গুণে ভূষিত করে ও অভিন্ন দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন বুঝতে হবে। এমনিভাবে -

وَلَا يَأْمُرَكُمْ أَن تَتَّخِذُوا الْمَلَائِكَةَ وَالنَّبِيِّينَ أَرْبَابًا

"আল্লাহ তোমাদেরকে এই নির্দেশ দেননি যে, ফেরেশতা আর নবীদেরকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করো ..." (সূরাহ আলি ইমরান, ৩: ৮০)

এ আয়াতেও সকল নবীই শামিল, শুধু কতিপয় নবী নয়।

এখানেও কি আমাদের বন্ধুগণ استغراق عرفي এর সাথে আয়াতের এ অর্থ বর্ণনা করবেন যে, আল্লাহ কোন কোন নবীকে প্রভু হিসেবে গ্রহণে নিষেধ করেছেন এবং কোন কোন নবী সম্পর্কে এর নির্দেশ দিয়েছেন ? এছাড়া আয়াতে কারীমা -

مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّـهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ (৪ : ৬৯)

এর মধ্যেও কোন কোন নবীকে বুঝায় না, এবং আয়াতে কারীমা -

وَوُضِعَ الْكِتَابُ وَجِيءَ بِالنَّبِيِّينَ وَالشُّهَدَاءِ (৩৯ : ৬৯)

এখানে কোন কোন নবীকে না বুঝিয়ে সকল নবীকেই বুঝানো হয়েছে।

وَإِذْ أَخَذَ اللَّـهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ (৩ : ৮১)

এর মধ্যেও সকল নবীকেই শামিল করা হয়েছে, কিছু সংখ্যক নবীকে নয়।

(৩) সবচেয়ে বেশী চিন্তার বিষয় হলো, যদি এ সমস্তের প্রতি দৃষ্টিপাত না করা হয় এবং আরবি ভাষার ব্যাকরণ ও নীতিমালার গুরুত্ব স্বীকার করা হয়, আর খাতামুন-নাবিয়্যীন -এ সমস্ত নবীকে শামিল করা না হয়, তাহলে خاتم النبيين এর অর্থ হবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীর সমাপ্তকারী নন।

কিন্তু আল্লাহ যাকে সাধারণ জ্ঞান দান করেছেন, তিনি কোন চিন্তা ছাড়াই এটা উপলব্ধি করতে পারেন যে, এ অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের خاتم النبيين হওয়ায় কোন বিশেষ মর্যাদা থাকে না। বরং আদম আলাইহিস সালামের পর প্রত্যেক নবী তার পূর্ববর্তী নবীর خاتم বা সমাপ্তকারী। মুসা আলাইহিস সালাম তার পূর্ববর্তী নবীর এবং ঈসা আলাইহিস সালাম তার পূর্ববর্তী নবীর জন্য خاتم বা সমাপ্তকারী (এমনিভাবে ক্রমশ)।

কিন্তু আলোচ্য আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক ও বিশ্লেষণের দ্বারা এটা প্রতীয়মান হয় যে, خاتم النبيين হওয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান। তাছাড়া স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খতমে নবুওয়াতকে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশেষ মর্যাদার মধ্যে গণ্য করেছেন। এই মর্যাদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে অন্য কোন নবীকে প্রদান করা হয়নি। এ সম্পর্কে মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিস পেশ করা হয়েছে। এতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছয়টি বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করে বলেছেন,

"এবং আমার বিশেষ মর্যাদাগুলোর মধ্যে একটি হলো এই যে, আমি সমস্ত সৃষ্টির প্রতি প্রেরিত হয়েছি এবং আমার দ্বারা নবীদের ক্রমধারা সমাপ্ত করা হয়েছে।" (মুসলিম)

(৪) এসব কথাকে যদি গুরুত্ব দেওয়া না হয়, নিজেদের ইচ্ছামত চলতি ব্যাপকতার অর্থে কোন কোন নবী অর্থাৎ শরীআতপ্রাপ্ত নবী বোঝাতে হয়, তাহলে আয়াতের অর্থ সঠিক হবে না। তা সত্ত্বেও এটা যদি স্বীকৃত হয় তাহলেও মীর্জা সাহেব এবং তার অনুসারীদের উদ্দেশ্য "দিল্লী বহুদুর" এর পর্যায়ে পড়বে। কেননা আমরা বলে এসেছি যে, শুধু সাধারণ ধারণা ও শাব্দিক অর্থের দ্বারা কুরআন মাজীদের তাফসীর করা যায় না।

কিন্তু মীর্জা সাহেব ও তার সমস্ত অনুসারী মিলেও কুরআন মাজীদের কোন একটি আয়াতে এটা দেখা সক্ষম হবে না যে, আয়াতে خاتم النبيين এর মধ্যে নতুন শরীআতপ্রাপ্ত নবীকে বুঝানো হয়েছে।

অথবা তিনি আর তার সমস্ত অনুসারী ও বংশধর মিলে হাদিসের এতো বিরাট সম্ভার থেকে কোন একটি সহীহ, বরং একটি দ্বইফ বা অনির্ভরযোগ্য হাদিসে ও আয়াতে خاتم النبيين এর এ তাফসীর প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে না যে, এর দ্বারা শরীআতপ্রাপ্ত নবীদের সমাপ্তকারী বুঝায়। আমরা আল্লাহ'র রহমতে দাবি করে বলতে পারি যে, তারা কিয়ামত পর্যন্ত এক হাদিসেও এ তাফসীর প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে না।

অথবা মীর্জা সাহেব আর তার সমস্ত অনুসারী মিলে সাহাবা ও তাবিঈদের বর্ণনার (اسار) মধ্যে কোন একটি বর্ণনাও এ তাফসীরের স্বপক্ষে পেশ করতে সক্ষম হবেন ?

যদি এর কোনটাই সম্ভব না হয়, তাহলে কমপক্ষে মুফাসসির মনীষীদের কোন নির্ভরযোগ্য তাফসীর পেশ করুন, যাতে خاتم النبيين শরীআতপ্রাপ্ত নবীদের সমাপ্তকারী বলে তাফসীর করা হয়েছে।

মীর্জা সাহেব আর তার সমস্ত অনুসারী মিলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও কিয়ামত পর্যন্ত উপরে উল্লিখিত তাদের নিজস্ব তৈরি তাফসীর ও বিকৃতির স্বপক্ষে কোন অকাট্য প্রমাণ পেশ করতে পারবে না।

যখন এটা সম্ভব নয়, তখন যুগ পরিবর্তন সত্ত্বেও এখনো মুসলমানের উপর এমন একটি অভিযোগ করা ঠিক নয় যে, তারা এরূপ একটি অর্থহীন আওয়াজকে কুরআন মাজীদের তাফসীর মনে করে, তার কোন অস্তিত্ব বা মূল কুরআন, হাদিস বা সাহাবাদের বর্ণনায় পাওয়া যাবে না। এ পর্যন্ত যতো তাফসীর লেখা হয়েছে, কোন একটিতেও তার একবিন্দু সমর্থন পাওয়া যাবে না।

(৫) তাফসীরের মৌলনীতি ছাড়াও আমরা যখন আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তখন দেখি যে, خاتم النبيين আয়াতের نبيين শব্দটি সমস্ত নবীকেই বুঝিয়েছে, তারা নতুন শরীআতপ্রাপ্ত হোন বা পূর্ববর্তী শরীআত ও পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারী হোন।

আমরা نبي শব্দের আভিধানিক ও প্রচলিত বিশ্লেষণ নিন্মে উল্লেখ করছি।

আরবি ভাষাভাষী সব আলিম ও বিভিন্ন মাযহাবের মনীষীগণের মতে نبي শব্দটি সাধারণ এবং رسول শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ, রাসুল শুধু ঐ নবীকেই বলা হয়, যার উপর পৃথক শরীআত অবতীর্ণ হয়েছে। যেখানে نبي (নবী) শব্দ ব্যবহার হয়েছে সেখানে مجاز বা রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে প্রকাশ থাকে যে, আলোচ্য আয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে خاتم النبيين বলা হয়েছে, خاتم الرسل বা خاتم المرسلين বলা হয়নি। কেননা এর পূর্বে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পর্কে "وَلَـٰكِن رَّسُولَ اللَّـهِ " এর মধ্যে রাসুল বলা হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, خاتم المرسلين তুলনামূলকভাবে خاتم النبيين থেকে বেশী অর্থবহ ও প্রয়োগযোগ্য। এটা কিন্তু আল্লাহ আল-আলীম আল-খাবীর (সর্বজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞাতা) - এর কালাম। তিনি এটা জানতেন যে, উম্মতের মধ্যে এ ধরণের লোক জন্মগ্রহণ করবে যারা আয়াতের বিকৃতি ঘটাবে। তাই তিনি এ বিকৃতির পথ ও সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। সুতরাং ইমামুল মুফাসসিরীন আল্লামা ইবনে কাসির এর উপর সতর্ক করে ঘোষণা করেছেনঃ

আল্লাহ বলেছেন যে, বরং তিনি আল্লাহ'র রাসুল ও নবীদের ক্রমধারা সমাপ্তকারী, আর আল্লাহ তো সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত। সুতরাং আলোচ্য আয়াতের দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে কোন নবী আবির্ভূত হবে না। যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে কোন নবী আগমন করবে না, তখন রাসুল আগমন তো আর বেশী করে অসম্ভব। কেননা রাসুলের মর্যাদা ও স্থান নবুওয়াতের তুলনায় বিশেষভাবে নির্দিষ্ট। যেহেতু প্রত্যেক রাসুলের জন্য নবী হওয়া শর্ত, আর প্রত্যেক নবীর জন্য রাসুল হওয়া শর্ত নয়। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক হাদিস বর্ণিত আছে, যা অনেক সাহাবায়ে কিরাম বর্ণনা করেছেন।(তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৮খ. পৃ.৮৯)

এমনিভাবে সাইয়্যেদ মাহমুদ আলূসী "তাফসীরে রুহুল মাআনী" গ্রন্থে লিখেছেনঃ

"নবী" সাধারণ অর্থবোধক, আর"রাসুল" বিশেষ অর্থবোধক। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের خاتم النبيين হওয়ার ফলে خاتم المرسلين (অর্থাৎ, শরীআতপ্রাপ্ত নবীদের সমাপ্তকারী) হওয়া একান্তই অনিবার্য। (তাফসীরে রুহুল মাআনী, ৮খ. পৃ.৬০)

 

আরো একটি নীতি পরিবর্তন

মীর্জা সাহেব নবী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় "হাকীকাতুল ওহী"র ২৭ ও ৯৭ পৃষ্ঠায় টীকায় خاتم النبيين আয়াতের অর্থে বিকৃতি করে আয়াতের অর্থ এরূপ বলেছেন,

"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণে নবুওয়াতের পূর্ণতা লাভ হয় এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে নবী সৃষ্টি হয়", অন্য একটি হলো - "যার মোহরে এরূপ নবুওয়াত লাভ হতে পারে।"

خاتم النبيين এর লুগাত ও আরবি ভাষার দৃষ্টিতে হতে পারে কিনা, সে আলোচনা আমরা এখানে করবো না। কেননা এ নতুন আবিষ্কৃত তাফসীরের ফল হলো, কাউকে নবী তৈরি করার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষমতা রয়েছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাকে ইচ্ছা নবুওয়াতের মোহর লাগিয়ে দিবেন ! অথচ রাসুল প্রেরণ শুধু একমাত্র আল্লাহ'র কাজ। কে আল্লাহ'র রাসুল বা নবী হবেন তা আল্লাহ নিজেই ঠিক করেন।

মীর্জা সাহেবের এ ভুলের কারণে নবুওয়াত একটি উপার্জনের বস্তু হয়ে যায়। যে কেউ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করবেন, তিনিই নবী হয়ে যাবেন। অথচ কুরআন মাজীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রতীয়মান হয় যে, নবুওয়াত লাভ করা কারো ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না, বরং এটা একমাত্র আল্লাহ'র দানের বস্তু। তিনি যাকে উপযুক্ত মনে করেন তাকেই নবী বা রাসুল হিসেবে মনোনীত করেন। কোন মানুষের ইচ্ছা তো দূরের কথা, বরং মানুষের এ সম্পর্কে কোন জ্ঞানও থাকতে পারে না। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বাণী খুবই সুস্পষ্ট।

اللَّـهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ

".... আল্লাহ'ই ভালো জানেন স্বীয় রিসালাত কাকে অর্পণ করবেন ...." (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১২৪)

হ্যাঁ, আমরা এখানে এ নতুন আবিষ্কৃত তাফসীরের ফলাফলের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যদি এটাকে সঠিক বলে মেনে নেওয়া হয় তাহলে এর অর্থ হবে এই যে, এ উম্মতের মধ্যে যতো বেশী নবী ও রাসুল আগমন করবেন, ততোই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা প্রকাশ পাবে।

কিন্তু মীর্জা সাহেব নিজেও এ বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে সম্মত নন। কেননা এতে অন্য কারো এ পদ অলংকৃত করার সম্ভাবনা থাকে আর তেরশো বছর পর্যন্ত একই ব্যক্তির নবী হওয়ার ব্যাপারে তিনি সম্মত নন। তাহলে এটা কতো আশ্চর্য ব্যাপার যে, আল্লাহ যাকে এ মর্যাদা প্রদান করেছেন তার আধ্যাত্মিক দৃষ্টির কারণে মীর্জা সাহেবের বর্ণনা অনুযায়ী نبي تراش বা নবী নিয়োগ হয়ে থাকে। তার আধ্যাত্মিক দৃষ্টি এক লাখেরও বেশী জীবন উৎসর্গকারী সাহাবাদের কাউকে নবী করতে সক্ষম হয়নি। এরপর যাদেরকে তিনি উত্তম যুগের বলে অভিহিত করেছেন, তাদের মধ্যেও কেউ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করে তার আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে নবী হতে পেরেছেন - এর কোন দৃষ্টান্ত নেই।

তেরশো বছর পর্যন্তও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ ফলপ্রসূ হলো না। এরপর চৌদ্দশো হিজরীতে মীর্জা সাহেব জন্মগ্রহণ করেন আর ঐ আধ্যাত্মিক দৃষ্টির ফল শুধু এই এক ব্যক্তির মাধ্যমে প্রকাশ পেলো ! কুরআন মাজীদের বিকৃতির সাথে এটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কতো বড় জঘন্য অপবাদ, তা বলে শেষ করা যায় না।

 

একটি নতুন পট পরিবর্তন

মীর্জা সাহেবের কুরআনের জ্ঞান এবং তাফসীরের অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতা "হাকীকাতুল ওহী" নামক গ্রন্থে যা বর্ণিত হয়েছে, এতে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ পায়নি এবং তার এক প্রচারপত্র"এক গলতি কা ইজালাহ" এর মধ্যে আলোচ্য আয়াতের বিকৃতির আর এক পট পরিবর্তন হয়েছে।

মীর্জা সাহেবের এ আশ্চর্য বিশ্লেষণের বিচার পরে করা হবে। এর পূর্বে এটার উপর দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন যে, "হাকীকাতুল ওহী"র তাফসীর অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর শত-সহস্র নবী আগমন করতে পারে যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে তৈরি হয়। তার নবুওয়াতের দাবীর ফলে মোহর বিদীর্ণ হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। আর প্রচারপত্র "এক গলতি কা ইজালাহ" এর নতুন বিশ্লেষণের উপর ব্যক্তির নবুওয়াতের দাবি خاتم النبيين এর মোহর বিদীর্ণ হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।

আর প্রচারপত্র "এক গলতি কা ইজালাহ" এর নতুন বিশ্লেষণের উপর ব্যক্তির নবুওয়াতের দাবি خاتم النبيين এর মোহর বিদীর্ণ হওয়ার সমার্থবোধক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ, خاتم النبيين এর এ অর্থই নেওয়া হয়েছে, যা সমস্ত উম্মত গ্রহণ করেছে। কিন্তু নবী হওয়ার উদ্দীপনাকে পুনর্জন্ম ও আকৃতি গ্রহণের হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসের আশ্রয় নিয়ে পূর্ণ করা হচ্ছে যে, যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছায়া হয়ে যায়, সে-ই স্বয়ং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! তার আগমনে خاتم النبيين এর মোহর বিদীর্ণ হয়নি। কেননা তার আগমন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাতীত অন্য কোন নবীর আগমন নয়, স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের'ই আগমন !

এখন মীর্জা সাহেব ও তার অনুসারীদেরকে জিজ্ঞাসা করুন যে, তাদের এ দুটো দাবীর মধ্যে কোনটি সঠিক ও কোনটি ভুল ? "হাকীকাতুল ওহী"র বর্ণনামতে خاتم النبيين এর অর্থ হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মোহর দ্বারা আম্বিয়া তৈরি বা নিয়োগ অথবা "গলতি কা ইজালাহ" এর ভাষ্য অনুযায়ী এর অর্থ হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নবুওয়াত সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু এ কথা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আগমনের বিরোধী নয়।

 

ছায়ারুপ ও অবয়বরূপ নবুওয়াতের কাহিনী

অতঃপর গলতি কা ইজালাহ-এর গলতি বা ভুল দেখুনঃ

(১) এর সারমর্ম হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের দ্বারা কোন ব্যক্তি ছায়ারূপ বা অবয়বরূপ স্বয়ং মুহাম্মাদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হয়ে যেতে পারেন।

যদি এটা সঠিক হয়, তবে আমরা জিজ্ঞাসা করি, ইসলামের শুরু থেকে মীর্জা সাহেবের জন্ম পর্যন্ত কি কারো পক্ষে নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্ণ অনুসরণ সম্ভব হয়নি ? সিদ্দীকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু, ফারুকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহু, উসমান গনী রাদিয়াল্লাহু আনহু, আলী মুর্তাজা রাদিয়াল্লাহু আনহু - যারা নবীগণের পর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে উত্তম বলে বিবেচিত এবং হাদিসে "যদি আমার পর কেউ নবী হতেন, তাহলে হতেন উমর" ইত্যাদি বর্ণিত রয়েছে। এ সমস্ত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবী কি তাদের জীবন উৎসর্গকারী ও আমৃত্যু অনুসরণের পরও ছায়ারূপ মুহাম্মাদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হয়ে গিয়েছিলেন ?

এছাড়া ঐ সাহাবায়ে কিরাম, যারা নিজের দেহকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ঢাল বানিয়ে শত্রুদের পক্ষ থেকে আগত তীরের দ্বারা চালুনী বানিয়েছেন, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামান্যতম ইঙ্গিতে দুনিয়ার সবকিছু ত্যাগ করেছেন, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বাত ও অনুসরণ করে নিজের মাতাপিতা, ভাই ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে যুদ্ধ করেছেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক একটি সুন্নাত প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন- তাদের মধ্যে কেউ এ যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হলেন না যে, তাদের ভিতর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা প্রতিবিম্বিত হয় ? যদি এ সমস্ত বুজুর্গের কারো এ মর্যাদা লাভ হয়েও থাকে, তাহলে কি মীর্জা সাহেব তাদের মধ্যে কারো ইতিহাসে নবুওয়াতের দাবীর সামান্যতম ইঙ্গিত দেখাতে সক্ষম হবেন ?

(২) মীর্জা সাহেব হয়তো এ ছায়ারূপ ও অবয়ব-এর কাহিনী হিন্দুদের পুনর্জন্মবাদ থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু লজ্জার কথা হলো এই যে, তিনি এটাও না বুঝেই গ্রহণ করেছেন।

ছায়ারূপ ও অবয়ব-এর সমর্থকগণ কখনো এটা বলে না যে, পুনর্জন্মের মাধ্যমে অন্যের আকৃতি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে হুবহু প্রথম ব্যক্তি হয়ে যায় এবং প্রথম ব্যক্তির মতোই তারও অধিকার ও মর্যাদা হয়ে যায়। যেমন ধরা যাক, যায়দ মৃত্যুবরণ করেছে। এরপর সে অন্যের আকৃতি নিয়ে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছে আর মাতাপিতা তার নাম রেখেছে উমর। এখন কোন মাযহাব ও আকিদা অনুযায়ী উমরের আকৃতিতে আগমনকারী যায়দের পুরাতন দাবি উত্থাপন করার কোন অধিকার থাকতে পারে না। নিজের প্রাক্তন স্ত্রীকে স্ত্রী, মাতাপিতাকে মাতাপিতা হিসেবে আহবান করা, অংশীদারদের মধ্যে বণ্টনকৃত সম্পদ ও আসবাবপত্রকে স্বীয় সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা তার পক্ষে বৈধ নয়। কাদিয়ানীদের দর্শন ও চিন্তা অদ্ভুত। যে ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছায়া ও অবয়ব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তাকে রাসুল ও নবী বলে দাবি করার অধিকারও দিয়েছেন এবং দুনিয়ার সবাইকে স্বীয় নবুওয়াত মেনে নেওয়ার জন্য বাধ্য করার কথাও বলেছেন ! এসব প্রলাপোক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।

(৩) অতঃপর কেউ যদি মীর্জা সাহেবের কাছে জিজ্ঞাসা করে যে, নবুওয়াত ও রিসালাতের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছায়ারূপ ও অবয়বের চিন্তা ও দর্শনের উপর কুরআন এ হাদিসের কি কোন প্রমাণ রয়েছে? কুরআন কারীমের কোথাও কি ছায়ারূপ ও অবয়ব নবীর উল্লেখ রয়েছে অথবা কোন হাদিসে এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে ?

যদি এরূপ না থাকে তবে এরপর ইসলামের দাবি করে রিসালাত সম্পর্কে ইসলামের মূল আকিদায় এ হিন্দু মতবাদের আকিদাকে গ্রহণ করা কোন ধরণের ধর্মীয় প্রচার বা এটা কোন শরীআত হতে পারে ?

(৪) শুধু তাই নয়, এর দ্বারা অবয়ব ও অবয়ব নবীর জন্ম হওয়া সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায়।

সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় জীবনের শেষ মুহূর্তে উপদেশ হিসেবে যেসব কথা বলেছেন, তা এখানে বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

"হে লোকসকল, নবুওয়াতের সুসংবাদের মধ্যে সুস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।" (ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মুসলিম, নাসাঈ ও অন্যরা এ হাদিস বর্ণনা করেছেন)

এ পর্যায়ে বুখারী ও মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে, তা হলো -

"শুভ সংবাদপূর্ণ স্বপ্ন ছাড়া নবুওয়াতের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।" (বুখারী, মুসলিম)

একই বিষয়ে তাবারানী হুযায়ফা ইবনে উসাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম আহমাদ আবু সাঈদ এবং ইবনে মারদুবিয়া ঐ একই বিষয়ে আবুত-তুফায়ল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। এছাড়া ইমাম আহমাদ ও খাতীব একই বিষয়ে আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসগুলোর মধ্যে একটি হলো -

"নবুওয়াত নিঃশেষ হয়ে গেছে। কেবলমাত্র শুভ সংবাদসম্পন্ন স্বপ্নের অবকাশ রয়েছে।"

মোটকথা এ সমস্ত হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনার সারমর্ম হলো, সর্বপ্রকার নবুওয়াতের সমাপ্তি ও বিলুপ্তি ঘটেছে। কেবলমাত্র শুভ স্বপ্নই অবশিষ্ট রয়েছে, যা নবুওয়াতের ছেচল্লিশ অংশের একাংশ। (যেমন বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত)

কিন্তু এটা সুস্পষ্ট যে, কোন বস্তুর একাংশ বর্তমান থাকলে সেই গোটা বস্তুর বর্তমান থাকা বুঝায় না এবং অংশের নাম কখনো সম্পূর্ণ বস্তুর নাম হতে পারে না। নতুবা নখকে মানুষ বলা হবে, কেননা এটা মানুষের অংশ। এমনিভাবে একবার"আল্লাহ" বলাকে নামায বলা হবে, কেননা এটা নামাযের অংশ। অথবা কুলি করাকে গোসল বলা হবে, কেননা এটা গোসলের অংশ এবং পানিকে রুটি বলা হবে, যেহেতু এটা রুটির অংশ।

বস্তুত কোন জ্ঞানী ব্যক্তি অংশ ও সমুদয় বস্তুর নামের পার্থক্য দূর করতে পারে না। সুতরাং লবণকে পোলাও, পানিকে রুটি, নখ বা একটি পশমকে যদি মানুষ বলা না যায়, তাহলে নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের একাংশকেও নবুওয়াত বলা যাবে না।

মোটকথা, হাদিসে নবুওয়াতের সম্পূর্ণ বিপুপ্তির খবর দিয়ে এতে নবুওয়াতের কোন বিশেষ প্রকার অথবা এর কোন অংশের অবশিষ্ট থাকার কথা বলা হয়েছে বলে দাবি করা যায় না, বরং ছেচল্লিশ ভাগ বা সমুদয় বিষয়েরই করা হয়েছে, যেটাকে কোন লোকই নবুওয়াত বলতে পারে না।

এখন জ্ঞানী পাঠকদের ভেবে দেখা উচিত যে, যদি নবুওয়াতের কোন প্রকার বা কোন অংশ স্থায়ী বা অস্থায়ী, শরীআতবিহীন, ছায়ারূপ বা অবয়ব হিসেবে পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকে, তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগের বর্তমান থাকার কথা না বলে শুধু এ নবুওয়াতেরই কোন প্রকারের বর্তমান থাকার কথা বলাই বেশী প্রয়োজন ছিলো।

সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগের ব্যাতিক্রমকে নির্দিষ্ট করেছেন, তাহলে মীর্জা কাদিয়ানীর আবিষ্কৃত অবয়বী নবুওয়াতের কোন অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না।

(৫) আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাইলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতেন নবীগণ। যখন কোন নবী মৃত্যুবরণ করতেন, তখন দ্বিতীয় নবী তাদের প্রতিনিধি হতেন, কিন্তু আমার পর কোন নবী হবে না। অবশ্য খলীফা হবে, হবে বহু সংখ্যক। সাহাবীগণ আরয করলেন, খলিফাদের ব্যাপারে আপনার কি নির্দেশ ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, প্রথম খলীফা, তারপরে পর্যায়ক্রমে খলীফার হাতে বায়আত করবে। তোমরা তাদের হক আদায় করবে।(বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, ইবন মাজাহ, ইবনে জারীর ও ইবনে আবি শায়বা)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরিউক্ত ইরশাদের প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করুন। প্রথমত, নবুওয়াতের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ও সমাপ্তির ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিনিধি হিসেবে যা অবশিষ্ট থাকবে, তা বর্ণনা করেছেন। এ পর্যায়ে শুধু খলিফাদের কথা বলা হয়েছে। যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন ধরণের নবী আসতেন এবং নবুওয়াতের কোন প্রকার অবয়ব বা ছায়ারূপী, স্থায়ী বা অস্থায়ী শরীআতপ্রাপ্ত বা শরীআতবিহীন দুনিয়ায় অবশিষ্ট থাকতো, তাহলে তার উল্লেখ এখানে অবশ্যই করা হতো। যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের পর শুধু খিলাফতকেই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছেন, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন অবয়ব বা অন্য কোন নবী আগমন করবেন না - এটিই চূড়ান্ত ঘোষণা হয়ে দাঁড়ালো।

(৬) আবু মালিক আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

"আল্লাহ এ কাজের সূচনা করেছেন নবুওয়াত ও রহমত দিয়ে। পরবর্তীকালে হবে খিলাফত ও রহমত।" (তাবারানী কবীরে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন)

উপরিউক্ত হাদিসেও নবুওয়াতের সমাপ্তি ও এর পূর্ণ বিলুপ্তির সাথে সাথে এটাও বর্ণনা করা হয়েছে যে, নবুওয়াতি রহমত সমাপ্ত হয়ে খিলাফত ও রহমতরূপে অবশিষ্ট থাকবে। এর দ্বারা স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে যে, নবুওয়াতের কোন প্রকারই অবয়ব বা ছায়ারূপে বাকি থাকবে না। নতুবা খিলাফতের পরিবর্তে প্রথমে নবুওয়াতের উল্লেখ করা হতো।

(৭) অবশেষে আমরা এমন একটি বিষয়ের দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যাতে সামান্য একটু চিন্তা করলে প্রত্যেকেরই নির্দ্বিধায় বিশ্বাস হবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর অবয়ব বা ছায়ারূপ কোন নবীই আগমন করবেন না।

এর সারমর্ম হলো, কোন একজন সাধারণ মুসলমান এতে সন্দেহ করতে পারে না যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় উম্মতের জন্য সবচেয়ে বেশী দয়ালু ও মেহেরবান নন। অথচ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে দুনিয়ার সমস্ত বস্তুর মধ্যে একজন লোকের হিদায়াতপ্রাপ্তি সর্বাধিক পছন্দনীয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিদায়াত গ্রহণ না করা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য সর্বাধিক দুঃখের বিষয়। আল্লাহ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দয়া ও রহমতের উল্লেখ করে বলেছেন,

"তোমাদের উপর কোন মুসীবত তো রাসুলের জন্য খুব কষ্টকর। তিনি তোমাদের হিদায়াতের জন্য খুবই উদগ্রীব আর তিনি মুসলমানদের উপর খুবই দয়াশীল ও মেহেরবান।" (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯: ১২৮)

অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রচারের চেষ্টাকে মূল্যবান বক্তব্যের দ্বারা পেশ করেছেন -

"যদি তারা এই বিষয়বস্তুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে, তবে তাদের পশ্চাতে সম্ভবতঃ আপনি পরিতাপ করতে করতে নিজের প্রাণ নিপাত করবেন।" (সূরাহ আল-কাহফ, ১৮ : ৬)

দ্বীন প্রচারে প্রাণপণ চেষ্টা, মানব জাতিকে হিদায়াত করার জন্য কষ্ট স্বীকার, কাফিরদের নির্যাতন ভোগ এবং তাদের প্রস্তরাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েও -

"হে আল্লাহ, আপনি আমার কওমকে হিদায়াত দান করুন, কেননা তারা প্রকৃত সত্য জানে না।"

- বলে দুয়া করা প্রভৃতি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চরিত্রের বাস্তব প্রমাণ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসলমানদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু, তাতে কারোই কোন সন্দেহ থাকতে পারে কি ?

তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে এমনই সরল ও সহজ এবং উজ্জ্বল রাজপথের উপর ছেড়ে দিয়ে গিয়েছেন, কিয়ামত পর্যন্ত এ পথে চলে সর্ব প্রকারের বিপদ থেকে তারা সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে পারবে। কেননা এ পথে দিনের ও রাতের পার্থক্য এ পথের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কিয়ামত পর্যন্ত যতো প্রকার ফিতনা সৃষ্টি হতে পারে, একদিকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেগুলোর একটি একটি করে খবর দিয়ে তা থেকে নিরাপদ থাকার উপায় উম্মতের জন্য বর্ণনা করেছেন, তেমনি অন্যদিকে এ উম্মতের মধ্যে যতো যোগ্যতর অনুসরণকারী ও বিশ্বাসী মানুষ সৃষ্টি হতে পারে, তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে উম্মতকে খবর জানিয়ে তাদের অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। মোট কথা, কোন উত্তম বিষয় নেই, যা অর্জন করার জন্য তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতকে অনুপ্রেরণা দেননি এবং এমন কোন অন্যায় বা পাপ নেই, যে সম্পর্কে উম্মতকে ভীতি প্রদর্শন করে তা থেকে মুক্তির জন্য গুরুত্ব আরোপ করেননি।

সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিরোধানের পর স্বীয় উম্মতকে আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র নেতৃত্ব গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, "আমার পরে আবু বকর ও উমরকে অনুসরণ করে চলবে।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, "আমার আর খুলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ গ্রহণ করা তোমাদের উপর অবশ্য কর্তব্য।"

এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর বলেছেন, "আমি তোমাদের জন্য এমন দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি, এর বিধানগুলো গ্রহণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, প্রথমে আল্লাহ'র কিতাব কুরআন, আর আমার বংশধর ও আহলে বায়ত।" (নাসাঈ, তিরমিযি)

এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ কথাও ঘোষণা করেছেন যে, প্রত্যেক শতাব্দীর পর একজন মুজাদ্দিদ (সংস্কারক) আবির্ভূত হবেন, যিনি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের অন্যায় কার্যকলাপের সংশোধন করে তাদেরকে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সঠিক পথে ও আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপস্থাপিত মৃতপ্রায় সুন্নাত ও আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। (আবু দাউদ, হাকিম, বায়হাকী)

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন যে, শেষ যমানায় ঈসা ইবনে মারিয়াম আকাশ থেকে অবতরণ করবেন এবং এ উম্মতের ইমাম হয়ে তাদের অন্যায় কার্যকলাপের সংশোধন করবেন। এমনকি তিনি তার পর আগমনকারী খলিফাদের অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এ সম্পর্কে তিনি(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো অধিক গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, "আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহ'কে ভয় করার জন্য উপদেশ দিচ্ছি এবং খলিফাদের অনুসরণ করার ও অনুগত হওয়ার জন্য ওসীয়ত করছি, যদিও তোমাদের উপর একজন হাবশী ক্রীতদাস, খোঁড়া ও খঞ্জকে নেতা নির্বাচন করা হয়।" (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, হাকিম)

গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যদি এ উম্মতের মধ্যে কোন প্রকার ছায়ারূপ বা অবয়বরূপ নবী আবির্ভূত হতো, তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী উল্লেখ করতেন এবং তার অনুসরণের জন্য গুরুত্বারোপ করতেন, যেন এ উম্মত তাকে অস্বীকার ও অসত্য মনে করে কাফির না হয়। নতুবা এটি অতি আশ্চর্যের বিষয় হবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় উম্মতকে একজন খোঁড়া হাবশী গোলামের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার নাফরমানী না করতে বলেছেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম) অবয়বরূপে আগমন করবেন আল্লাহ'র এমন কোন নবী সম্পর্কে কোন আগাম সংবাদই দিয়ে যাননি। অথচ এটা সুস্পষ্ট বিষয় যে, খলীফার আনুগত্য না করা হলে বেশীর পক্ষে ফিসক বা নাফরমানী হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে নবীকে অমান্য করা সম্পূর্ণ কুফরী। যদি কোন ব্যক্তি সমস্ত কুরআনের উপর আমল করে এবং সমস্ত নবীর প্রতি ঈমান গ্রহণ করে, কিন্তু মাত্র একজন নবীকে অস্বীকার ও অমান্য করে, তাহলে সে কুরআন ও ইজমার দৃষ্টিতে কাফির হয়ে যাবে।

আল্লাহ যে নবীকে"রাউফুর রহীম" এবং "রহমাতুললিল আলামীন" উপাধিতে ভূষিত করেছেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সৃষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় সম্পর্কে খবর দিয়েছেন এবং খলীফা ও আমীরবৃন্দ বরং একজন হাবশী ক্রীতদাসের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু ভবিষ্যতে আগমনকারী নবীর উল্লেখ করেননি এবং "চৌদ্দশো হিজরিতে আমি নিজের অবয়ব নিয়ে দুনিয়াতে আবির্ভূত হবো" - এ কথার প্রতি ইঙ্গিতও করেননি। অন্য কথায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতকে গুনাহ থেকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করে গেছেন, কিন্তু কুফর থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করে যাননি, তা কি কল্পনা করা যায় ?

মোটকথা, হাদিসে এর স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন অবয়ব বা ছায়ারূপ, শরীআতপ্রাপ্ত বা শরীআতবিহীন কোন নবীই আগমন করবেন না।

এ পর্যন্ত যা আলোচনা হলো, তা শুধু خاتم النبيين আয়াত সম্পর্কে। এর দ্বারা এবং আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আলোচ্য বিষয়ের উপর বহু কুরআনের আয়াত পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু আলোচ্য আয়াতকে যেভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে বর্ণনা করা হয়েছে, যদি প্রত্যেক আয়াতের এমনই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়, তাহলে এ গ্রন্থের কলেবর বিরাট আকার ধারণ করবে। সুতরাং অন্যান্য আয়াতসমূহের তাফসীর অতি সংক্ষিপ্তভাবে পেশ করা শ্রেয় বলে মনে হয়।

 

ফুটনোটঃ

(৯) এবং তা আল্লাহ'র কাছে বড় গুনাহ, যা অনেক মীর্জা দলের প্রচারকদের বক্তৃতা ও কথাবার্তা থেকে জানা গিয়েছে।

(১০) অর্থাৎ মীর্জা সাহেবের ওহী হতো এরূপ যে, আমরা কাদিয়ানীদের নিকট কুরআন অবতীর্ণ করেছি।

(১১) الف و لام استغراق حقيقي প্রচলিত অর্থে এটাকেই বলা হয় যে, তা যে শব্দের উপর ব্যবহৃত হবে, এর সমস্ত افراد গুলোকে বুঝাবে। যেমন, عالم الغيب এর মধ্যে غيب শব্দের উপর যে الف و لام ব্যবহৃত হয়েছে, এর দ্বারা সমস্ত গায়বকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, পৃথিবীর সমস্ত অদৃশ্য বিষয়কে বুঝানো হয়েছে, কিন্তু استغراق عرفي এর মধ্যে সমস্ত একককে বুঝায় না। যেমন, جمع الامير الصاغة অর্থাৎ বাদশাহ স্বর্ণকারদের একত্র করেছেন। এখানে صاغة এর উপর الف - لام ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু এতে সমস্ত একককে বুঝায় না, বরং নিজ শহর বা শহরতলীর স্বর্ণকারদের একত্র করেছেন। এ সম্পর্কে পূর্বে আরো আলোচনা করা হয়েছে।

 

(ইন শা আল্লাহ, চলবে .......)

 

মূলঃ খতমে নবুওয়াত(মুফতি মুহাম্মাদ শফী রাহিমাহুল্লাহ)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-58

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী মতবাদ - ৪

 

 

The Greatest Nation·Sunday, March 17, 2019

 

 

 

 

দ্বিতীয় আয়াত

"..... আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করে দিলাম, এছাড়া তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম ......"

(সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ৩)

 

শানে নুযূল

উপরিউক্ত আয়াত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিদায় হজ্জে জুমুআর দিন আরাফাতের ময়দানে নাযিল হয়। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র ৮১ দিন জীবিত ছিলেন। (ইবনে কাসীর, দুররে মনসুর)

অধিকাংশ হাদিস ও সাহাবীর উক্তি দ্বারা এটিই প্রতীয়মান হয় যে, এ সময় হালাল, হারাম বা শরীআতের বিধান পর্যায়ের কোন আয়াত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর অবতীর্ণ হয়নি। (ইবনে কাসীর ও ইবনে জারীর)

মাত্র দু-তিনটি আয়াত রয়েছে, যেগুলো আলোচ্য আয়াতের পর অবতীর্ণ হয়েছে বলে বর্ণনা করা হয় এবং কোন কোন জ্ঞানী ব্যক্তি ঐ আয়াতকে সর্বশেষ আয়াত বলে ঘোষণা করেছেন। (আল্লামা সুয়্যুতী লিখিত ইতকান দ্রষ্টব্য)

মোটকথা, আয়াতটি এ উম্মতের জন্য এক বিশেষ ফযীলত ও সম্মানের ঘোষণা করছে। তাই একদিন জনৈক ইয়াহুদী ফারুকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছে বলে, "হে আমিরুল মুমিনীন, আপনাদের কুরআনে এমন একটি আয়াত রয়েছে যা আপনারা পড়ে থাকেন, যদি তা আমাদের প্রসঙ্গে নাযিল হতো, তাহলে আমরা নাযিল হওয়ার দিনকে ঈদ হিসেবে পালন করতাম।" উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞাসা করেন, "সেটি কোন আয়াত ?" জবাবে ইয়াহুদী উক্ত আয়াতটি পাঠ করে। ফারুকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বললেন, "আমরা ঐ দিন আর ঐ স্থানকে ভালোভাবেই জানি। সেদিন এ আয়াতটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর জুমুআর দিন ঐ সময় নাযিল হয়, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফাতের মাঠে দণ্ডায়মান ছিলেন।" (বুখারী, মুসলিম)

অর্থাৎ, ঐদিন আমাদের জন্য দুটি ঈদ ছিলো, আরাফাতের দিন এবং জুমুআর দিন। তাই দুররে মনসুরের মধ্যে মুসনাদে ইসহাক ইবনে রাওয়ায়হর এবং মুসনাদে আবদ ইবনে হুমায়দের উল্লেখ করে উপরিউক্ত ঘটনার সাথে নিন্মোক্ত বাক্যটিও লিখে দিয়েছেন -

"আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া, যিনি আমাদের জন্য এই দিনটিকে ঈদ বানিয়েছেন।"

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ এদিন পাঁচটি ঈদ একত্রিত হয়েছিলো - (১) জুমুআ, (২) আরাফা, (৩) ইয়াহুদীদের ঈদ, (৪) নাসারাদের ঈদ, (৫) মজূসীদের ঈদ। পৃথিবীর ইতিহাসে পৃথিবীর সমস্ত জাতির ঈদ এ পর্যন্ত কখনো একত্রিত হয়নি। (তাফসীরে খাযেন, ১খ. পৃ. ৪৩৫)

মোটকথা, আলোচ্য আয়াত এ উম্মতের বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদার কথা বর্ণনা করেছে। আহলে কিতাবদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এর পূর্বে অন্য কাউকে এরূপ ফযীলত প্রদান করা হয়নি। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা স্বীয় গ্রহণযোগ্য দ্বীনকে এ উম্মতের জন্য এমনই পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন, যেন কিয়ামত পর্যন্ত এতে কোন প্রকার সংশোধন ও সংযোজনের প্রয়োজন না হয়। আকাইদ, আমল, আখলাক, হুকুমাত বা রাষ্ট্র, রাজনৈতিক, ব্যক্তি-চরিত্র, হারাম-হালাল, মাকরূহ ও মুস্তাহাবসমূহের নিয়মাবলী এবং কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত প্রয়োজনীয় জীবিকার্জনের উপায় ও পরকালের নীতি তাদের জন্য এমনই সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কিয়ামত পর্যন্ত কোন নতুন দ্বীন বা কোন নবীর আগমনের একবিন্দু প্রয়োজন নেই। এ সম্মানিত উম্মত ও উত্তম জাতির নেতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া থেকে প্রস্থান করেছেন, যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় উম্মতের জন্য একটি সহজ-সরল ও সুস্পষ্ট পথ তৈরি করেছেন। এই পথের উপর দিয়ে গমনকারীকে দিবারাত্র কোন বাধার সম্মুখীন হতে হবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এ কথা বলে গিয়েছেন।

 

আলোচ্য আয়াতে পরিপূর্ণ দ্বীন (كمال دين) এর অর্থ হলো ফরয ও সুন্নাত, হুদুদ ও আহকাম এবং হালাল-হারামকে পূর্ণাঙ্গভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর কোন হালাল ও হারামের বিধান অবতীর্ণ হয়নি, কিয়ামত পর্যন্ত এর কোন প্রয়োজনও হবে না।

কোন কোন মুফাসসির ১ বলেছেন, দ্বীন পূর্ণ হওয়ার অর্থ হলো এ দ্বীন কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকবে, কখনো বিলুপ্ত ও নিশ্চিহ্ন হবে না। কোন কোন তাফসীরকারক ২ এ উম্মতের জন্য দ্বীন পূর্ণ হওয়ার অর্থ বলেছেন, এ উম্মত প্রত্যেক নবী ও প্রত্যেক আসমানী কিতাবের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। কেননা সমস্ত নবী ও সমস্ত কিতাব এ উম্মতের পূর্বেই পৃথিবীর বুকে এসেছে। পক্ষান্তরে পূর্বের কোন উম্মতের এ ফযীলত ও সম্মান ভাগ্যে হয়নি। কেননা এদের পূর্বে সমস্ত নবী ও সমস্ত আসমানী কিতাব পৃথিবীতে আসেনি।

বস্তুত এ আয়াতটি আমাদের আলোচিত বিষয় "খতমে নবুওয়াত" এর পর্যায়ে একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। কেননা তিনটি তাফসীরের সারমর্ম এই যে, এ দ্বীনের পর কোন দ্বীন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কিয়ামত পর্যন্ত কোন নবী আবির্ভূত হবেন না।

নিন্মলিখিত হাদিস, সাহাবায়ে কিরামের উক্তি ও মুফাসসিরগণের বর্ণনা উপরিউল্লিখিত তাফসীরসমূহের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হলোঃ

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ আলোচ্য আয়াত নাযিল হওয়ার পর না কোন হালাল ও হারামের নির্দেশ নাযিল হয়েছে, না কোন ফরয, সুন্নাত, হুদুদ এবং অন্যান্য আহকাম। এক কথায় এরপর কোন আয়াত অবতীর্ণ হয়নি। (তাফসীরে মাযহারী)

ইমামুল মুফাসসিরিন ইবনে জারীর আল্লামা সুদ্দী থেকে বর্ণনা করেনঃ এ আয়াতটি আরাফার দিনে নাযিল হয়েছে। এরপর নতুন করে কোন হালাল-হারামের বিধান নাযিল হয়নি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখান থেকে প্রত্যাগমন করার পর ইন্তিকাল করেন। (দুররে মনসুর, ২খ. পৃ. ২৫৯)

এ আয়াত আহকাম সম্পর্কিত আয়াতের মধ্যে সর্বশেষ আয়াত এবং ভবিষ্যতের জন্য ওহী ও নবুওয়াত চূড়ান্তভাবে রহিত ও বিলুপ্ত হওয়ার সংবাদ এতে রয়েছে।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কাঁদতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, কেন কাঁদছ ? উমর রাদিয়াল্লাহু আনু বললেন, নিশ্চয়ই আমরা আমাদের দ্বীনের কাজে চরম উন্নতি করছিলাম, কিন্তু এটা পূর্ণাঙ্গ হুয়ে গেলো এবং (এখন আল্লাহ'র নিয়ম এমনিভাবেই চলছে) যখন কোন বস্তু পূর্ণাঙ্গ হয়ে যায়, এটা পুনরায় অঙ্গহীন বা পূর্ণতা হ্রাস পেতে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি সত্য বলেছো।

এ আয়াতেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চির বিদায়ের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাত্র ৮১ দিন দুনিয়ায় জীবিত ছিলেন। (ইবনে আবি শায়বা, ইবনে জারীর ও আল্লামা বাগাবী এবং হারুন ইবনে আশারা, দুররে মনসুর ও তাফসীরে মাযহারী থেকে বর্ণনা করেছেন।)

ফারুকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহু'র এ ঘটনা পূর্বে উল্লিখিত তাফসীরের যথার্থতার জ্বলন্ত প্রমাণ। কেননা যদি দ্বীন পূর্ণ হওয়া ও নিয়ামত দান সম্পূর্ণ ও শেষ হওয়ার কথা দ্বারা দ্বীনের বিধান নাযিল হওয়ার পরিসমাপ্তি, ওহী ও নবুওয়াতের বিলুপ্তি এবং খাতিমুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের কথা বুঝানো না হতো, তাহলে ফারুকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কান্না নিতান্তই অর্থহীন হয়ে যেতো।

ইমামুল মুফাসসিরীন আল্লামা ইবনে কাসীর আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ এ উম্মতের জন্য এটি আল্লাহ'র সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। তিনি এদের জন্য দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। সুতরাং মুহাম্মাদী উম্মতের জন্য অন্য কোন দ্বীন বা নবীর প্রয়োজন নেই। তাই আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে খাতিমুল আম্বিয়া হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত মানব জাতির প্রতি প্রেরণ করেছেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৩খ. পৃ. ২৭৯)

ইবনে কাসীরের এ তাফসীরের দ্বারা যেমন দ্বীনের পূর্ণতার অর্থ প্রতীয়মান হয়েছে, তেমনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন শরীআতপ্রাপ্ত নবী বা শরীআতবিহিন সাধারণ নবীরও কোন প্রয়োজন নেই বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী তার তাফসীরে কাবীরে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেনঃ আল্লাহ'র প্রেরিত দ্বীন কখনো অসম্পূর্ণ ছিলো না, বরং আল্লাহ'র প্রেরিত শরীআত সময় ও যুগের দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ণাঙ্গ ও যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু আল্লাহ জানতেন যে শরীআত আজ পূর্ণাঙ্গ আগামী দিন তা পূর্ণাঙ্গ থাকবে না। তাই নির্দিষ্ট সময়ের পর এটা বিলুপ্ত ও রহিত করে দেওয়া হতো। কিন্তু শেষ যুগের নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে আল্লাহ এরূপ পূর্ণাঙ্গ শরীআত প্রেরণ করেন, যা সর্বযুগ ও সর্বকালের জন্য পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে অনুমোদিত এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

সারমর্ম হলো এই যে, পূর্ববর্তী শরীআত পূর্ণাঙ্গ ছিলো, তবে তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, কিন্তু এ শরীআত কিয়ামত পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ও যথেষ্ট থাকবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আল্লাহ উপরিউক্ত ঘোষণাটি দিয়েছেন।

ইমাম রাযীর উপরিউক্ত বর্ণনার দ্বারা এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, দ্বীনের পূর্ণত্বের অর্থ তা-ই, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে এবং এ উম্মতের জন্য দ্বীনের পূর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্য হলো, এ উম্মত সর্বশেষ উম্মত এবং এ যুগও সর্বশেষ নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুগ। তাই এরপর কোন নবী আবির্ভূত হবে না।

অধিকন্তু ইমাম রাযীর উপরিউক্ত বর্ণনার দ্বারা বিরোধীদের এ সন্দেহের অপনোদন করা হয়েছে যে, আলোচ্য আয়াতের দ্বারা পূর্ববর্তী দ্বীন-ই-ইলাহী ও শরীআত অসম্পূর্ণ হওয়া জরুরী হয়ে পড়ে এবং এতে কতগুলো ক্ষতিকর দিক রয়েছে।

প্রথমত, এতে আল্লাহ'র প্রতি কৃপণতার অপবাদ এসে যায় যে, পূর্ববর্তী উম্মতের জন্য পূর্ণাঙ্গ দ্বীন প্রেরণ করেননি।

দ্বিতীয়ত, যখন তাদের জন্য অসম্পূর্ণ দ্বীন প্রেরণ করা হলো, তাহলে তাদেরকে কেন বিচার করা হবে ?

তৃতীয়ত, এতে ঐ সমস্ত নবীকে অসম্পূর্ণ করা হয়েছে, যাদেরকে অপূর্ণাঙ্গ দ্বীন প্রদান করে প্রেরণ করা হয়েছে।

ইমাম রাযীর উক্ত বর্ণনার দ্বারা এই সমস্ত সন্দেহ ও ভ্রান্ত ধারণার মূলোৎপাটন হয়ে গেছে। এতে বলা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী সমস্ত শরীআত ও আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন অপূর্ণাঙ্গ ছিলো, শুধ এই দ্বীন পূর্ণাঙ্গভাবে নাযিল হয়েছে - প্রত্যেকটি দ্বীন ও শরীআত সংশ্লিষ্ট সময় ও যুগের দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ণাঙ্গ ছিলো এবং সে যুগের লোকদের হিদায়াতের জন্য পরিপূর্ণভাবে যথেষ্ট ছিলো। অবশ্য আল্লাহ জানতেন যে, ভবিষ্যতে অবস্থার পরিবর্তনে এ শরীআত ও নীতিমালা আগামী বংশধরদের জন্য যথেষ্ট বা পূর্ণাঙ্গ হবে না এবং এটা বিলুপ্ত করে অন্য দ্বীন ও শরীআত প্রেরণ করার প্রয়োজন দেখা দিবে। কিন্তু খাতিমুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দ্বীন নিয়ে আগমন করেছেন, তা কিয়ামত পর্যন্ত হিদায়াত ও সঠিক পথে পরিচালনার জন্য অটল ও স্থায়ী হয়ে থাকবে। এর পূর্ণত্ব সর্বকালের জন্য থাকবে।

মোটকথা, আল্লাহ প্রদত্ত কোন দ্বীন অপূর্ণাঙ্গ ছিলো না। শুধু এতটুকু পার্থক্য ছিলো যে, যেমনিভাবে পূর্ববর্তী নবীগণ বিশেষ বিশেষ সময় এবং বিশেষ বিশেষ লোকদের জন্য আবির্ভূত হতেন, তাদের আবির্ভাব যুগের দৃষ্টিতে সাধারণত (عام) এবং মানুষের স্তরভেদে সাধারণ ও সর্বব্যাপী ছিলো না। তেমনি তাদের শরীআতও সর্বকালের জন্য ছিলো না। কিন্তু এতে সেই নবীগণের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়নি এবং এতে পূর্ববর্তী দ্বীন ও শরীআতের অপূর্ণাঙ্গ হওয়াও জরুরী হয় না। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন সমস্ত মানুষ ও জীন জাতির জন্য আবির্ভূত হয়েছেন, তেমনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীনও কিয়ামত পর্যন্ত যথেষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ থাকবে। এটি খাতিমুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ মর্যাদা এবং সর্বশেষ উম্মতের জন্য বিশেষ ফযীলত ও সম্মান, আর এ মর্যাদা আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকেই দান করেন।

তাফসীরে খাযেনের ৪৩৫ পৃষ্ঠায় আলোচ্য আয়াতের একই তাফসীর বর্ণিত হয়েছে। এতে লিখিত আছেঃ "তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম" - এ আয়াতের তাফসীর হলো, ফরয ও সুন্নাত, হুদুদ ও আহকাম, হালাল ও হারামের বর্ণনার দ্বারা তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এরপর হালাল ও হারাম অথবা ফরয সম্পর্কে কোন নতুন বিধান নাযিল হওয়ার দরকার নেই। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এ কথাই বলেছেন।

ইমাম রাগিব ইস্ফাহানী "মুফরাদাতুল কুরআন" গ্রন্থে এ লিখেছেনঃ আল্লাহ আমাদের নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের সাথে নবুওয়াতের ক্রমধারা সমাপ্ত করে দিয়েছেন এবং পূর্ববর্তী শরীআতকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীআত দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ও প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। আলোচ্য আয়াতের বক্তব্য তাই।

তাফসীরে মাদারিকের ১ম খণ্ডের ৪৬৩ পৃষ্ঠায় একই তাফসীর বর্ণিত আছে। কিতাবুল ইতিসামের ১ম খণ্ডের ৪৭ পৃষ্ঠায় এবং তাফসীরে দুররে মনসুরের ২য় খণ্ডের ২৫৯ পৃষ্ঠায় দ্বীনের পূর্ণতা পর্যায়ে একই তাফসীর বর্ণনা করা হয়েছে।

সকল নির্ভরযোগ্য ও বিশুদ্ধ তাফসীর এবং সমস্ত সাহাবা এ আয়াতকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর দিকে ইঙ্গিত মনে করা উপরে উদ্ধৃত তাফসীরের সত্যতার উজ্জ্বল প্রমাণ। তাফসীরশাস্ত্রের সকল ইমাম এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত।

 

একটি সন্দেহ ও তার অপনোদন

আমরা আলোচ্য আয়াতের তাফসীরকে হাদিস, সাহাবীদের অভিমত এবং প্রখ্যাত তাফসীর লেখকদের নির্ভুল ব্যাখ্যার দ্বারা যা প্রমাণ করেছি, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকার কথা নয়। তবুও যদি কোন অবিশ্বাসী এখনো মনে করে যে, দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করার এই অর্থ হতে পারে যে, আল্লাহ এ দ্বীনকে দুনিয়ার সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয় ও প্রাধান্য দিয়েছেন এবং এ উম্মতকে সমস্ত শত্রু থেকে রক্ষা করেছেন।

অধিকন্তু এটাও সম্ভব যে, দ্বীন পূর্ণ হওয়ার অর্থ এই হতে পারে যে, ঐ বছরই মক্কা বিজয়ের ফলে হজ্জের সময় মক্কা নগর সমস্ত মুশরিকের জবর দখল থেকে মুক্ত ও পবিত্র হয়েছিলো। এই নিরাপত্তার সাথে হজ্জ করাকে দ্বীনের পূর্ণত্ব বলে অভিহিত করা হয়েছে।

এ পর্যায়ে আমরা শুধু ফারুকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাঁদার ঘটনা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সে ধারণাকে সত্য বলে সম্মতি দেওয়া ইত্যাদির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াকে যথেষ্ট বলে মনে করি। কেননা সমস্ত দ্বীনের উপর এর বিজয়ী হওয়া বা কাফিরদের থেকে মুক্ত হওয়া কোন বুদ্ধিমান মানুষের কাঁদার কারণ হতে পারে না। দ্বীনের পূর্ণত্বের যদি এই অর্থ হয়, তাহলে পূর্ববর্তী আলীমদের "এবং এটাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর ইঙ্গিত বলে মনে করা হয়েছে" এই উক্তির কি তাৎপর্য হতে পারে ?

এছাড়া ঐ সময় পর্যন্ত ইসলাম অন্য সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয় লাভও করেনি। কেননা সমস্ত অনারব ঐ সময় পর্যন্ত কুফর ও শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো। ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ও সাহাবায়ে কিরামের উক্তি থেকে তা-ই প্রমাণিত হয়।

অধিকন্তু সাহাবায়ে কিরামের যেসব উক্তি এবং তাফসীরকারকদের যেসব ব্যাখ্যা দ্বীনের পূর্ণত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তা এ তাফসীরের বিরোধী। তাই এ বিশেষ ধরণের কথাকে কুরআনের তাফসীর আখ্যা দেওয়া এবং এ সমস্ত বিষয় বিবেচনা করা শুধু একটি সংশয়পূর্ণ চিন্তা।

 

ফুটনোটঃ

(১) তাফসীরে লুবাবুত তাবীল, ১খ. পৃ. ৪৩৫

(২) তাফসীরে কাযেন, ১খ. পৃ. ৪৩৫

 

(ইন শা আল্লাহ, চলবে .......)

 

মূলঃ খতমে নবুওয়াত (মুফতি মুহাম্মাদ শফী রাহিমাহুল্লাহ)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী মতবাদ – ৫

 

 

 

The Greatest Nation·Tuesday, April 2, 2019

 

 

 

 

 

আয়াত নং ৩

"আর আল্লাহ যখন নবীদের ডেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যে, যখন আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত প্রদান করেছি এবং এরপর তোমাদের কাছে এরূপ রাসুল এসেছেন, যিনি তোমাদের আসমানী কিতাবের সত্যতা ঘোষণা করেন, তোমরা সবাই তার প্রতি অবশ্যই বিশ্বাস স্থাপন করবে আর তার সাহায্য করবে ...." (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ৮১)

এ আয়াতে আল্লাহ ঐ চুক্তি ও অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করেছেন, যা তিনি সমস্ত নবীর কাছ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আদিকালে গ্রহণ করেছিলেন। আয়াতের তাফসীর আর প্রসঙ্গত ঘটনা বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন। আল্লামা সুবকী রাহিমাহুল্লাহ শুধু এ আয়াতের তাফসীরের জন্য একটি পৃথক পুস্তিকা লিখেছেন। এর নাম - التعظيم و المنة في لتؤمنن به ولتنصرنه এ পুস্তিকা মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া'র ষষ্ঠ অধ্যায়ে সংযোজন করেছেন।

যে তাফসীরের সারকথা হলো, যখন আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টির রূহ বা আত্মা সৃষ্টি করে তাদের থেকে স্বীয় প্রভুত্বের স্বীকৃতি গ্রহণ করলেন, তখন নবীদের থেকে আলোচ্য সাধারণ অঙ্গীকার ছাড়াও একটি বিশেষ চুক্তি গ্রহণ করা হয়েছিলো, যা একটি বিশেষ শর্তের সাথে যুক্ত ছিলো। তা হলো, যদি তোমাদের মধ্যে কারো জীবদ্দশায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবির্ভূত হোন, তাহলে তোমরা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহায্য করবে।

এই পর্যায়ে তাফসীর ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর এবং তারীখে ইবনে আসাকির ও ফাতহুল বারীর কিতাবুল আম্বিয়ায় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এ উক্তিটি বর্ণিত আছে -

"আল্লাহ সমস্ত নবীর কাছ থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন যে, যদি তাদের জীবদ্দশায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবির্ভূত হোন, তাহলে যেন তারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন আর তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহায্য করেন।" (শরহে মাওয়াহিব, যারকানী, ২খ. পৃ. ১৬৩)

এ বিশেষ অঙ্গীকার একটি শর্তের সাথে জড়িত। নিয়মানুযায়ী তা সংঘটিত হওয়া জরুরী নয়। হিকমত ও ফায়দার দিক দিয়ে শুধু এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, এর দ্বারা সমস্ত নবীর উপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বিশেষ মর্যাদাকে শর্তের স্তরেই রাখেননি, বরং বিভিন্ন প্রকারে বিভিন্ন স্থানে এই বিশেষ মর্যাদার কথা প্রকাশও করেছেন। প্রথম মিরাজের রাতে যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সমস্ত নবীকে বায়তুল মুকাদ্দাসে একত্র করে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামাযে সকলের ইমাম নিযুক্ত করেছিলেন। এরপর আখিরাতে সমস্ত নবীকে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পতাকার নীচে একত্র করা হবে।

অনুভবনীয় ও পর্যবেক্ষণীয় জগতে যদিও তার রাস্তা এভাবে করা হয়েছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম'কে এখনো জীবিত রাখা হয়েছে এবং কিয়ামতের পূর্বে তাকে আকাশ থেকে অবতরণ করানো হবে, ফলে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুশমন দাজ্জালকে হত্যা করবেন ইত্যাদি।

এ সমস্ত বিষয় যারকানী লিখিত শরহে মাওয়াহিবের ষষ্ঠ খণ্ডের ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। যদিও এ আয়াতের তাফসীরে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে, কিন্তু সাধারণভাবে মুফাসসিরদের কাছে এ তাফসীরই প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য।

"ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقٌ"

- এই আয়াতাংশই এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয়। এতে সমস্ত নবীর পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের কথা ثم (অতঃপর) শব্দের সাথে বর্ণনা করা হয়েছে, আরবি ভাষা রীতিতে এই শব্দটি পরবর্তীকাল বুঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রচলিত কথা جاءني القوم ثم عمر (আমার কাছে লোকেরা এসেছে, পরে এসেছে উমর) - এই কথায় উমরের আগমন সর্বশেষে হয়েছে বলে স্পষ্ট বুঝা যায়।

উক্ত আয়াতে "النبيين" এর পর "ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقٌ" এর অর্থ হবে সমস্ত নবীর আগমনের পর সর্বশেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগমন করবেন এবং অঙ্গীকার গ্রহণে যেহেতু কোন নবী ও রাসুল বাদ যাননি, তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত নবীর মধ্যে সর্বশেষ নবী হওয়া নিশ্চিত ও অকাট্য হয়ে গেছে। এটিও স্পষ্ট হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন প্রকার নবী আবির্ভূত হবে না। শরীআতপ্রাপ্ত হোক বা শরীআতবিহীন, ছায়ারূপ ও অবয়ব-এর মতো কৃত্রিম কোন প্রকারের নবীর আগমনের অবকাশ নেই।

 

আয়াত নং ৪

"..... এবং এই কুরআন আমার প্রতি ওহী করা হয়েছে যাতে আমি তোমাদেরকে আর যার নিকট এটা পৌঁছবে তাকে এর মাধ্যমে সতর্ক করতে পারি ....." (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১৯)

এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, পবিত্র কুরআনের শরীআত শুধু বর্তমান মানব গোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত নয়, বরং কিয়ামত পর্যন্ত যাদের কাছে এ কুরআনের বাণী পৌঁছবে, তাদের সবার জন্যই তা-ই একমাত্র জীবন-বিধান। ভবিষ্যতে কোন কিতাব ও শরীআত বা নবুওয়াতের প্রয়োজন নেই। ইবনে কাসীর তার তাফসীরে বিস্তারিতভাবে এ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।

 

আয়াত নং ৫

"হে মানুষ, রাসুল তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে সত্য নিয়ে এসেছেন, সুতরাং তোমরা ঈমান আনো, তোমাদের জন্য কল্যাণকর হবে ....." (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ১৭০)

এ আয়াতেও الناس এর দ্বারা সমস্ত মানুষকে বুঝানো হয়েছে। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভাবে সাধারণত ব্যাপকতা বুঝায়, এ কথা দ্বারাই খতমে নবুওয়াত প্রমাণিত হয়। এ সম্পর্কে পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

 

আয়াত নং ৬

"আর আমি আপনাকে জগতসমূহের জন্য কেবল দয়াস্বরূপ প্রেরণ করেছি।" (সূরাহ আল-আম্বিয়া, ২১ : ১০৭)

এ আয়াত দুটো কারণে খতমে নবুওয়াতের নির্ভরযোগ্য দলীল।

প্রথমত, পূর্ববর্তী আয়াতের মতো এ আয়াতও সাধারণ আবির্ভাবের প্রমাণ করে এবং আবির্ভাবের সাধারনত্বের জন্য নবওয়াতের সমাপ্তি আবশ্যক।

দ্বিতীয়ত, আয়াত ঘোষণা দিচ্ছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা মুক্তি ও নাজাতের জন্য যথেষ্ট। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর যদি অন্য কোন নবী দুনিয়ায় আগমন করেন, তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের জন্য তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তার অনুসরণ করা নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা না হবে এবং তার নির্দেশিত পথে চলবার অঙ্গীকার না করবে। কেননা কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে,

"বলোঃ আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ'র প্রতি এবং যা অবতীর্ণ করা হয়েছে আমাদের উপর তার প্রতি এবং যা অবতীর্ণ করা হয়েছিলো ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার সন্তান-সন্ততির উপর তার প্রতি এবং যা মুসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিলো তার প্রতি; আমরা তাদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না এবং আমরা তারই নিকট আত্মসমর্পণকারী।" (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ৮৪)

অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,

"যারা আল্লাহ ও তার রাসুলগণকে অমান্য করে এবং আল্লাহ ও তার রাসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় আর বলে, আমরা কাউকে মানি আবার কাউকে মানি না, কুফর ও ঈমানের মাঝে একটি ভিন্নতর পথ করার ইচ্ছা করে; তারা নিশ্চিতভাবেই কাফির ......" (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ১৫০-১৫১)

এ আয়াতের স্পষ্ট উদ্দেশ্য হলো, কোন ব্যক্তি ঐ সময় পর্যন্ত (পূর্ণাঙ্গ) মুসলমান হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ'র প্রেরিত সমস্ত নবীর উপর কোন পার্থক্য ছাড়াই বিশ্বাস স্থাপন না করবে, এ কারণে সমস্ত মুহাম্মাদী উম্মতের ইজমা হলো, যদি কোন ব্যক্তি সমস্ত নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং স্বীয় নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্ণ অনুসরণ করে, কিন্তু কোন একজন নবীর (যে কোন সময়ের হোন না কেন) উপর বিশ্বাস স্থাপন না করে, তাহলে তার সমস্ত নেকী বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে। সে অনন্তকালের জন্য জাহান্নামী হবে। তাই পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কিরাম স্বীয় উম্মতদেরকে তার পরবর্তী নবীদের অনুসরণ করার উপদেশ দিয়েছেন।

সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর যদি কোন নবী আগমন করেন, তিনি শরীআতপ্রাপ্ত হোন না শরীআতবিহীন অথবা মীর্জা সাহেবের বর্ণনানুযায়ী ছায়ারূপী বা অবয়বরূপী নবী হোন - বস্তুত যখন তিনি নবী হতে আগমন করবেন, তখন সমস্ত উম্মতে মুহাম্মাদীর মুক্তি তার উপর বিশ্বাস স্থাপন ও তার অনুসরণের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল হবে। ঐ ব্যক্তি যতো খালিস অন্তর দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং তার যতো অনুসরণই করুক, সে তখন পর্যন্ত বেহেশতের দর্শন লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ এ নতুন নবীর অনুসরণ না করবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন উম্মত যদি ইচ্ছা প্রকাশ করে যে, কুরআন মাজীদের ত্রিশ পারার উপর অক্ষরে অক্ষরে আমল করবে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত হাদিসের ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুসরণ করে নিজেকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করবে, তাহলে নতুন নবীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করা পর্যন্ত তা তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এ কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, এ নবীর আগমনের পর বিশ্ববাসীর হিদায়াত ও তাদের উন্নতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্নেহ-মমতা ও সহানুভূতির উপর নির্ভরশীল থাকলো না, তাদের পরকালের মুক্তি কেবলমাত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ অনুসরণে পাওয়া যাবে না এবং পাপী ও গুমরাহদের শাফাআতের জন্য রহমাতুললিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রয়োজন নিঃশেষ হয়ে যাবে।

এ অবস্থায়ও কি রহমাতুললিল আলামীনকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রহমাতুললিল আলামীন বলা যায়, যখন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শরীআতের অনুসরণ কোন মানুষের মুক্তির সহায়ক বা যিম্মাদার হতে পারে না ?

সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর পৃথিবীতে অন্য কোন নবীর আগমনকে স্বীকার করে, যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবজ্ঞা এবং কুরআন মাজীদের প্রকাশ্য আয়াতকে অস্বীকার ও মিথ্যা প্রমাণ করে, সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে রহমাতুললিল আলামীন বলে মান্য করে না।

জরুরী কথা

মীর্জায়ীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, বড় দাজ্জাল হত্যার জন্য যখন একজন নবীর প্রয়োজন, তখন এটাই সবচেয়ে উচিত ছিলো যে, আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের মধ্যে কোন নবী প্রেরণ করে দিতেন - এটাই স্বাভাবিক। এ কাজের জন্য একজন ঈসরাইলী নবীকে আকাশের উপর তুলে রাখবেন এবং প্রয়োজনের সময় তাকে দ্বিতীয়বার অবতরণ করাবেন, তার কি প্রয়োজন ছিলো ?

যদি কোন ব্যক্তি আমাদের উপরিউক্ত আলোচনাকে ন্যায়নীতির দৃষ্টিতে বিবেচনা করে তাহলে সে অবশ্যই বলবে যে, মুসলিম উম্মতের মধ্য থেকে কাউকে নতুন করে নবী বানিয়ে পাঠানোর পরিবর্তে এমন একজন নবীকে পাঠানোই যুক্তিযুক্ত, যিনি আগেই নবী হয়ে এসেছিলেন এবং যার প্রতি উম্মতে মুহাম্মাদীর লোকেরা পূর্বেই ঈমান এনেছে। এতেই মুহাম্মাদী উম্মতের শৃঙ্খলা সংরক্ষিত থাকে। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নতুন নবী দুনিয়ায় আবির্ভূত হলে এরপর শুধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ ও তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনই উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য যথেষ্ট থাকে না, বরং ঐ নতুন আগত নবীর অনুসরণের উপর সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তা সাইয়্যেদুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদার সম্পূর্ণ বিরোধী। পক্ষান্তরে ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতগণ পূর্বেই বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তার (ঈসা আলাইহিস সালাম) অবতরণের পর উম্মতে মুহাম্মাদী'র মুক্তির জন্য কোন নতুন শর্ত সংযোগ করার প্রয়োজন নেই।

 

আয়াত নং ৭

"আর যে ব্যক্তি তার নিকট সঠিকপথ স্পষ্ট হওয়ার পর রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তাকে আমি যেদিকেই সে ফিরে যায় সেদিকেই ফিরিয়ে দিবো এবং তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো, আর তা কতোই না মন্দ গন্তব্যস্থল।" (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ১১৫)

ন্যায়বান পাঠকগণ গভীরভাবে লক্ষ্য করুন যে, যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আগমন করেন, তাহলে উল্লিখিত আয়াতের দাবি অনুযায়ী তিনি মুমিনদের পথের অনুসরণ করবেন অথবা নবুওয়াতের দাবি অনুযায়ী লোকদেরকে স্বীয় আনুগত্যের জন্য আহবান করবেন - এ দুটির যে কোন একটি করা তার কর্তব্য হয়ে পড়বে।

প্রথম অবস্থায় মূল ব্যাপারে বিপরীত কাজ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে এবং এতে ঘটনা বিপরীত হয়ে যায়। কেননা আল্লাহ'র প্রেরিত নবী লোকদেরকে স্বীয় আদেশ অনুসরণের জন্য আহবান করে থাকেন। লোকদের অনুসরণ করার জন্য তাকে প্রেরণ করা হয় না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

"আর আমি কোন রাসুল কেবল এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছি যেন আল্লাহ'র নির্দেশে তার আনুগত্য করা হয় ...." (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৬৪)

আরো ইরশাদ হয়েছে,

".... তিনি যদি অনেক বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করতেন তাহলে অবশ্যই তোমরা কষ্ট পেতে ...." (সূরাহ আল-হুজুরাত, ৪৯: ৭)

এছাড়া আল্লাহ'র পয়গম্বরও যদি দুনিয়ায় আগমন করে মুমিনদের পথ অনুসরণ করেন তাহলে এর দুটি অবস্থা হতে পারে। হয়তো মুমিনদের এ পথ গুমরাহী ও নাফরমানী হবে, নয়তো আল্লাহ তাআলার গ্রহণযোগ্য ও তার প্রদর্শিত পথ হবে।

প্রথম অবস্থা তো সম্পূর্ণ মিথ্যা, কোন মুসলমানই তা মেনে নিতে পারে না। কেননা তাহলে কুরআনুল কারীম লোকদেরকে (মুমিনদেরকে) গুমরাহীর পথে পরিচালিত করে বলে ধরে নিতে হয়। আর দ্বিতীয় অবস্থা অত্যন্ত হাস্যকর। আল্লাহ'র প্রেরিত নবী হিদায়াতের জন্য প্রেরণ করা হবে এবং তিনি দুনিয়ায় আগমন করে নিজেই গুমরাহীর পথে চলতে থাকবেন, এটা যুক্তিসঙ্গত কথা বলে কখনোই মনে করা যেতে পারে না।

দ্বিতীয় অবস্থায় নবীর অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে যায়। তার আবির্ভাব অকার্যকর থেকে যায়। কেননা যখন আল্লাহ'র বান্দাগণ সঠিক পথ পরিত্যাগ করে, তখনই তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত ও হিদায়াত করার জন্যই নবীর আগমন প্রয়োজন হয়।

আর যখন মুমিনদের পথ এমন হয় যে, আল্লাহ সমস্ত বিশ্ববাসীকে কিয়ামত পর্যন্ত সেই পথে চলার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এ পথ পরিত্যাগকারীর জন্য কঠোর আযাব ও শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন, তাহলে এরপরও কি কোন নতুন নবীর আগমন এবং মীর্জা সাহেবের ধারণা অনুযায়ী নতুন প্রকারের নবী তৈরির কি কোন প্রয়োজন থাকতে পারে ?

অবশিষ্ট থাকে শেষ যুগে ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনের ব্যাপারটি। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা-পর্যালোচনার খুব একটা প্রয়োজন নেই। কেননা তিনি একজন মর্যাদাসম্পন্ন নবী ছিলেন, কিন্তু তার দ্বিতীয়বার নাযিল হওয়ার পর তিনি পূর্বের ন্যায় আল্লাহ'র নবী হিসেবে নয়, বরং উম্মত হিসেবে আগমন করবেন। তার প্রথম আবির্ভাব যেহেতু সমস্ত বিশ্ববাসীর জন্য ছিলো না, ছিলো তার সময়কার বনী ঈসরাঈলদের জন্য। যেমন কুরআনের আয়াতের (৩ : ৪৯) দ্বারা প্রতীয়মান হয়, তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য নবী হিসেবে আগমন করবেন না, ইমাম ১ হিসেবে আগমন করবেন। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিভিন্ন হাদিস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই এ উম্মতের জন্য ইমাম হিসেবে যখন তিনি আগমন করবেন, তখন রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ নবী হওয়ার ব্যাপারে তা কোন অসুবিধারই সৃষ্টি করবে না।

 

আয়াত নং ৮

"বহু সংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে। আর অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য থেকে।" (সূরাহ আল-ওয়াক্বিআহ, ৫৬ : ১৩-১৪)

এ আয়াতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে اخرين শব্দের দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এ উম্মতই হলো সর্বশেষ উম্মত। ভবিষ্যতে কোন নবীও আগমন করবে না এবং নতুন উম্মতও হবে না।

ইমামুল মুফাসসিরীন ইবনে জারীর তাবারী আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে বলেছেন,

"আল্লাহ তাআলা বলেন, পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্য থেকে হবে এক জামাআত এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের মধ্য থেকে হবে খুবই সামান্য। উম্মতে মুহাম্মাদীকে اخرين এজন্য বলা হয়েছে যে, তারা হলেন সর্বশেষ উম্মত।" (ইবনে জারীর, ২৭ খ. পৃষ্ঠা ৭৯)

এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, اخرين এর দ্বারা উম্মতে মুহাম্মাদীকে বুঝানো হয়েছে।

 

আয়াত নং ৯

"বহু সংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে। আর বহু সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য থেকে।" (সূরাহ আল-ওয়াক্বিআহ, ৫৬ : ৩৯-৪০)

এ আয়াতে اخرين এর দ্বারা উম্মতে মুহাম্মাদীকে বুঝানো হয়েছে, যা স্পষ্ট খতমে নবুওয়াতের ঘোষণা।

এর প্রমাণে এ আয়াতের শানে নুযূল বর্ণিত হাদিসটি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। হাদিসটির বক্তব্য হলোঃ আয়াতের প্রথমাংশে বর্ণনা করা হলো যে, পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্য থেকে এক বিরাট জামাআত বেহেশতী হবে এবং শেষাংশে মুসলিম উম্মতের মধ্য থেকে খুবই কম হবে বলে জানানো হলো। তখন সাহাবায়ে কিরামের কাছে এটা খুবই দুঃসহ মনে হলো। সুতরাং সান্ত্বনার জন্য দ্বিতীয় আয়াত নাযিল হলো এবং এতে ইরশাদ হলো যে, পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্য থেকে এক জামাআত এবং এ উম্মতের মধ্য থেকে এক জামাআত বেহেশতী হবে। এতে পূর্ববর্তী উম্মত ও এ উম্মতের মধ্য সমতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। (ইবনে কাসীর)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু আলোচ্য আয়াতের তাফসীর করে এক দীর্ঘ হাদিসের উল্লেখ করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, আমার আশা হলো, তোমরা বেহেশতবাসীদের মধ্যে অর্ধেক হবে (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত)। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা এটাকে অত্যন্ত বেশী মনে করলাম। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াত পাঠ করেনঃ

وَثُلَّةٌ مِّنَ الْآخِرِينَ - ثُلَّةٌ مِّنَ الْأَوَّلِينَ

এ ধরণের একটি বর্ণনা কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও বর্ণিত আছে।

হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, "পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে এক বিরাট জামাআত অর্থাৎ পূর্ববর্তী সমস্ত উম্মতের মধ্য থেকে আর পরবর্তীদের মধ্য থেকে এক বিরাট জামাআত অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের মধ্য থেকে এক জামাআত।" (ইবনে জারীর, ২৭ খ. পৃ. ৯৮)

ইমামুল মুফাসসিরীন ইবনে জারীর তাবারী আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে বলেছেনঃ পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে এক জামাআত বলতে ঐ সমস্ত লোকদের বুঝানো হয়েছে, যারা উম্মতে মুহাম্মাদীর পূর্বে অতীত হয়ে গেছে এবং পরবর্তীদের মধ্য থেকে এক জামাআত অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত থেকে এক বিরাট জামাআত। সাহাবা ও তাবিঈনের মধ্যে তাফসীরবিদগণ এরূপ ব্যাখ্যাই পেশ করেছেন। (তাফসীরে ইবনে জারীর, ২৭ খ. পৃ. ১৮)

মোটকথা, আলোচ্য দুটো আয়াতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে اخرين এর উপাধি উল্লেখ করে এ কথাই ঘোষণা করা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতই হলো সর্বশেষ উম্মত।

 

আয়াত নং ১০

"হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ'র আনুগত্য করো, আর আনুগত্য করো রাসুলের, আর সেসব লোকদের যারা তোমাদের মাঝে দায়িত্বপ্রাপ্ত ...." (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৫৯)

কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, اولي الامر এর দ্বারা মুসলিম শাসক আর ইসলামী রাষ্ট্রের নেতাদের বুঝানো হয়েছে। অনেক মুফাসসির মুজতাহিদ ইমাম ও উম্মতের উলামায়ে কিরামকেও اولي الامر এর মধ্যে গণ্য করেছেন।

বস্তুত আলোচ্য আয়াত ঘোষণা প্রদান করেছে যে, মুসলমান আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করবে। এরপর ইসলামের খলীফা, ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ আর আলীমদের আনুগত্য করবে। এর থেকে দুটি কারণে খতমে নবুওয়াতের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।

প্রথম কারণ, আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের মুক্তির জন্য নবীগণের মাঝে একমাত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যকে যথেষ্ট ২ বলে ঘোষণা করেছেন এবং এর উপর জান্নাত ও মাগফিরাতের অঙ্গীকার করা হয়েছে। অথচ এ উম্মতের মধ্যে যদি কোন নবী আগমন করতেন, তাহলে তার প্রতি ঈমান আনা ও তার আনুগত্য করার উপর জান্নাত লাভ নির্ভরশীল হয়ে যেতো। কেননা কোন ব্যক্তির নাজাত ঐ সময় পর্যন্ত হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে আল্লাহ তাআলার নবীদের মধ্যে নিন্মতম সম্মানের নবীকেও অস্বীকার করবে অথবা তার আনুগত্য থেকে দূরে থাকবে।

মোট কথা, নবীগণের মধ্যে শুধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যকে মুক্তির উপায় ঘোষণা এবং মাগফিরাতের জন্য যথেষ্ট বলার মাধ্যমে স্পষ্ট ঘোষণা হয়ে গেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর অন্য কোন নবী আগমন করবেন না। নতুবা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কোন নবী দুনিয়ায় প্রেরণ করা হবে এবং তার আনুগত্যের জন্য লোকদেরকে দায়ী করা হবে না - তা হতে পারে না। অথচ স্বয়ং কুরআনে কারীমে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে -

"আর আমি কোন রাসুল কেবল এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছি যেন আল্লাহ'র নির্দেশে তার আনুগত্য করা হয় ....." (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৬৪)

উম্মতের আনুগত্যকে কেবল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর সীমাবদ্ধ ও পরিসমাপ্ত করে দেওয়া হয়েছে বিধায় নবুওয়াতও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সমাপ্ত ও শেষ হয়ে গেছে বলে বুঝতে হবে।

দ্বিতীয় কারণ এই যে, আলোচ্য আয়াতে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতগণ اولي الامر অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা ও ইমামগণের আনুগত্য করবে।

আল্লাহ তাআলা যাদেরকে সামান্যতম জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক দান করেছেন, তারা একটু চিন্তা করুন। যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন শরীআতপ্রাপ্ত নবী বা মীর্জা সাহেবের বর্ণনা অনুযায়ী শরীআতবিহীন নবী, ছায়ারূপ বা অবয়বী নবীর আগমন হতো, তাহলে কি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর اولي الامر এর আনুগত্যের পরিবর্তে এ নবীর আনুগত্যের নির্দেশ ও উপদেশ দেওয়া প্রয়োজন ছিল না ? কেননা সকলেই এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত যে, اولي الامر এর আনুগত্য না করা কুফরী নয়, কিন্তু নবীর আনুগত্য না করা কুফরী এবং অনন্তকালের জন্য জাহান্নামী হওয়ার কারণ। সেই নবী নিন্মতম ৩ মর্যাদাসম্পন্ন এবং মীর্জা সাহেবের বর্ণনা অনুযায়ী ছায়ারূপ বা অবয়ব নবী হলেও। যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আগমন করতেন তাহলে উম্মতের লোকদেরকে اولي الامر এর আনুগত্যের জন্য কুরআন আহবান জানাবে, অথচ নবীর আনুগত্য করতে বলবে না, তা চিন্তাই করা যায় না। যারা এ ধরণের সুস্পষ্ট ঘোষণার পরও এ উম্মতের মধ্যে কোন নবীর আবির্ভূত হওয়া জায়েয মনে করে, যদিও তারা এটিকে ছায়ারূপ বা অবয়বরূপী নবী বলে থাকে, তারাই কুরআনে কারীমের বিকৃতি করে থাকে এবং তারাই মুসলমানদের প্রকাশ্য দুশমন।

যদি দুনিয়ার অমুসলিম জাতি পবিত্র কুরআন নিয়ে উপহাস করে বলে যে, যে কিতাব সমস্ত বিশ্বের হিদায়াতের দাবীদার ও মুক্তির যিম্মাদার হওয়া সত্ত্বেও তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছেড়ে মানুষের কল্পনাপ্রসূত চিন্তাধারাকে সাধারণ বিষয়ের সাথে সংযুক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাস্তি থেকে রক্ষা করে কিন্তু কুফর ও পথভ্রষ্টতা এবং অনন্তকালের দোযখ থেকে মুক্তির পথ-নির্দেশ দেয় না, তাদের সম্মুখে রক্ষিত দোযখের সংবাদ পর্যন্ত দেয় না, বরং সাধারণ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ করে তাদের পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে, তাহলে কি দুনিয়ার মুসলিমগণ বরদাশত করতে প্রস্তুত আছে ?

পূর্ব বর্ণিত আয়াত শরীআতপ্রাপ্ত নবুওয়াতের বিরুদ্ধে যেমন অকাট্য প্রমাণ, তেমনি এ বিষয়েরও সুস্পষ্ট ঘোষণা যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন ছায়া বা অবয়বরুপী অথবা অন্য কোন প্রকার নবী সৃষ্টি হবে না।

 

আয়াত নং ১১

"... যে আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করবে তাকে তিনি প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যেগুলোর নীচে নহরসমূহ প্রবাহিত, আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে তিনি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিবেন।" (সূরাহ আল-ফাতহ, ৪৮: ১৭)

কুরআন মাজীদে সন্ধান করা হলে এ বিষয় সম্পর্কে আরো শত শত আয়াত পাওয়া যাবে। এর সারমর্ম হলো, এ উম্মতের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী বংশধরদের পরকালের মুক্তি ও বেহেশতে প্রবেশের জন্য শুধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশের আনুগত্য করাই যথেষ্ট। পূর্ববর্তী যে সমস্ত নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপনের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুরুত্ব সহকারে নির্দেশ দিয়েছেন, তাদের ছাড়া অন্য কোন নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপন করার প্রয়োজন নেই। এটা খতমে নবুওয়াতের সুস্পষ্ট ঘোষণা ও উচ্চ পর্যায়ের অকাট্য প্রমাণ।

উপরিউক্ত সারসংক্ষেপের ব্যাখ্যা হলো এই যে, উক্ত আয়াত এবং এ ধরণের অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা অঙ্গীকার করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণকারীদেরকে কোন শর্ত ছাড়াই বেহেশত প্রদান করা হবে।

পবিত্র কুরআন যদি কখনো বিলুপ্ত না হয় এবং পবিত্র কুরআনের বিধান যদি কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী ও কার্যকর থাকে, তাহলে সাড়া বিশ্বে কিয়ামত পর্যন্ত জন্মগ্রহণকারী বংশধর (আগমনকারী জাতি) অনিবার্যভাবে উপরিউক্ত অঙ্গীকারের অন্তর্ভুক্ত।

যদি এখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আগমন করেন এবং যদি ধরে নেওয়া যায় যে, মীর্জা সাহেবের মতে অবয়বরূপী নবী আগমন করেন, তাহলে হয়তো কুরআন কারীম স্বীয় অঙ্গীকার পূর্ণ করবে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদেরকে কোন নতুন শর্ত ছাড়াই বেহেশতে প্রবেশ করাবে এবং মুক্তির দায়িত্ব পালন করবে অথবা যারা এটা সিন্দুকের পরিবর্তে স্বীয় বুকে ধারণ করেছে এবং যারা এর এক-একটি অক্ষরের উপর স্বীয় জীবন উৎসর্গ করেছে, তারা এখন এটা বলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে যে, আমরা এখন নিজেদের অঙ্গীকার পূর্ণ করতে অক্ষম, আজ তোমাদের মুক্তি আমার হাতে নেই, যাও ঐ নতুন নবীর পা জড়িয়ে ধরো। তার কাছেই তোমাদের মুক্তি নিহিত।

কিন্তু প্রত্যেক মুসলমান অবগত আছেন যে, প্রথম অবস্থা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। কেননা নতুন নবী সৃষ্টির পর যদি কুরআন কারীম স্বীয় ওয়াদা পূরণ করার জন্য এই নতুন নবীর অনুসরণ উম্মতে মুহাম্মাদীর যিম্মায় অর্পণ না করে, তাহলে প্রশ্ন হবে এই নবীকে পৃথিবীতে প্রেরণের উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন কি ছিলো, যখন মানুষ এই নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপন ও অনুসরণের জন্য বাধ্য হয় ? বরং এটা সেটা নবীর জন্য কঠোরতম শাস্তি এবং সবচেয়ে মারাত্মক ধরণের অবমাননা। নবীকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা এজন্য যে, তিনি লোকদেরকে স্বীয় আনুগত্য গ্রহণে আহবান করবেন। অথচ লোকদেরকে বলা হয়েছে যে, তোমাদের জন্য সেই নবীর আনুগত্য করার প্রয়োজন নেই। এটা ছাড়াই তোমরা বেহেশতবাসী হতে পারবে। এ এক আশ্চর্য ধরণের কথা।

এসব কার্যকলাপ স্বয়ং কুরআন মজীদের আয়াত ও ইজমায়ে উম্মতের সম্পূর্ণ বিরোধী। যেসব লোক সকল নবীর প্রতি ঈমান আনা সত্ত্বেও কোন এক নবীর প্রতি ঈমান রাখে না, তাদের সম্পর্কে কুরআন ঘোষণা করেছে,

"তারাই প্রকৃত কাফির ....." (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ১৫১)

বস্তুত পৃথিবীতে কোন নবী প্রেরণ করা হবে আর তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ও তার আনুগত্য প্রকাশ করা মানব জাতির উপর দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং মুক্তির উপায় হিসেবে ঘোষণা করা হবে না, তা কুরআনী শরীআত হতে পারে না।

প্রথম অবস্থা যখন বাতিল হয়ে গেলো, তখন অনিবার্যভাবেই দ্বিতীয় অবস্থা নির্দিষ্ট ও গ্রহণীয় হয়ে গেলো। অর্থাৎ, যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আবির্ভূত হোন (মীর্জা সাহেবের বর্ণনা অনুযায়ী) অবয়বরূপীও আবির্ভূত হোন, তাহলে কুরআন মাজীদের আবির্ভূত হওয়ার পর স্বীয় দাবি কখনো পূর্ণ করতে পারবে না এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য বা অনুসরণকারীদেরকে সাধারণভাবে কোন শর্ত ছাড়া বেহেশতে প্রবেশ করানো হবে না। বরং ঐ নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তার আনুগত্য-অনুসরণকে একমাত্র মুক্তির শর্ত গণ্য করা জরুরী হবে। অন্য কথায় কুরআনের ঐ সমস্ত আয়াতকে বিলুপ্ত বলতে হবে, যা উম্মতে মুহাম্মাদী'র সর্বসম্মত আকিদার বিরোধী ছাড়াও জ্ঞানী মনীষীদের কাছে এক অত্যাশ্চর্য বিষয় হবে। কেননা আলীমগণের সর্বসম্মতিক্রমে প্রদত্ত ওয়াদার কোন পরিবর্তন হয় না। নতুবা এরপর ওয়াদা ভঙ্গ এবং ওয়াদা পরিবর্তনের মধ্যে কি পার্থক্য হবে। যে সমস্ত আসমানী কিতাব আজ বিলুপ্ত বা রহিত, তার মধ্যে কোন ওয়াদা কখনো বিলুপ্তি হয়নি, তার কারণ এটাই।

 

আয়াত নং ১২

"যে (ব্যক্তি) রাসুলের আনুগত্য করলো সে আল্লাহ'রই আনুগত্য করলো, আর যে মুখ ফিরিয়ে নিলো আমি আপনাকে তাদের উপর সংরক্ষক হিসেবে প্রেরণ করিনি।" (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৮০)

এ আয়াতেও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের জন্য শুধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যকে আল্লাহ'র আনুগত্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আগমন করতেন, তবে তার আগমনের পর ঐ সময় কোন ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার আনুগত্যকারী বলার উপযুক্ত হতো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে ঐ নবীর আনুগত্য না করতো, যেমন উপরে বর্ণনা করা হয়েছে।

 

আয়াত নং ১৩

"এবং যারা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করবে, তারা নবী, সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গী হবে, যাদের উপর আল্লাহ নিয়ামত দান করেছেন, আর তারা কতোই না উত্তম সঙ্গী।" (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৬৯)

এ আয়াতেও বেহেশতবাসী ও আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের অঙ্গীকার শুধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যের উপর নির্ভরশীল করা হয়েছে। তা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আসবে না। নতুবা আল্লাহ'র নৈকট্য লাভের জন্য তার আনুগত্যও অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচিত হতো।

এক অদ্ভুত যুক্তি

আলোচ্য যে আয়াতটি স্পষ্টভাবে খতমে নবুওয়াতের ঘোষণা করছে, অতি আশ্চর্যের বিষয়, মীর্জা কাদিয়ানী ঐ আয়াতটি নিজ দাবী প্রমাণের জন্য পেশ করেছে। মুসলমান পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে আল্লাহ'র কাছে এই প্রার্থনা করেন -

"আমাদেরকে সরল-সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। তাদের পথ, যাদের উপর আপনি নিয়ামত দান করেছেন।" (সূরা আল-ফাতিহাহ, ১: ৫-৬)

উপরিউক্ত আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এ সমস্ত লোকের দ্বারা নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং উভয় আয়াত সংযুক্ত করা হলে দুয়ার সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে - (ইয়া আল্লাহ,) আমাদেরকে নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণের চলার পথে পরিচালিত করুন।

আল্লাহ মুসলমানদের এ প্রার্থনা কবুল করে থাকেন। ফলে মুসলমানদেরকে নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণের চলার পথে পরিচালিত করে থাকেন এবং এর ফলে এটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে যে, মুসলমানগণ নবী, সিদ্দীক ও শহীদ হয়ে যাবেন। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন ব্যক্তির পক্ষে নবী হওয়া নিষেধ বা বাধা নেই।

মীর্জা কাদিয়ানী স্বীয় মিথ্যা নবুওয়াতকে কুরআন ভিত্তিক সত্য প্রমাণ করার মতলবে হাস্যকর দলীল পেশ করেছে। কি কৌতূহলপূর্ণ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চাওয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তি যার পথে চলে, সে তাই হয়ে যায়। নবীদের পথে বিচরণকারী নবী, সিদ্দীকের রাস্তায় বিচরণকারী সিদ্দীক ও শহীদদের রাস্তায় বিচরণকারী শহীদ হয়ে যায়।

তাহলে এটা তো উন্নতির একটা উত্তম পন্থা। কালেক্টরের পথে চলে মানুষ কালেক্টর, ভাইসরয়ের পথে চলে ভাইসরয় এবং বাদশাহের পথে চলে বাদশাহ হয়ে যাবে। এমনকি উন্নতির এই সোপান বেয়ে সম্ভবত আল্লাহ'র মর্যাদা লাভ করাও সম্ভব হতে পারে ! (নাউযুলিল্লাহ) কেননা আল্লাহ বলেছেন, "আল্লাহ'র পথ হলো এই ...." সুতরাং মীর্জা কাদিয়ানীর ধারণা ধারণা ও যুক্তি অনুযায়ী যে ব্যক্তি আল্লাহ'র পথে চলবে, সে আল্লাহ হয়ে যাবে ! (নাউযুবিল্লাহ)

 

আয়াত নং ১৪

"তিনিই উম্মীদের (নিরক্ষরদের) মাঝে তাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদেরকে তার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা ইতঃপূর্বে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলো।

আর (পাঠিয়েছি) তাদের অন্যান্যদের নিকটও যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি; আর তিনিই মহাপ্রতাপশালী ও মহাপ্রজ্ঞাবান।" (সূরাহ আল-জুমুআহ, ৬২ : ২-৩)

আলোচ্য আয়াতের অনুবাদকৃত বাক্যের প্রতি লক্ষ্য করুন। এতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু ঐ যুগের জন্যই নবী ও রাসুল ছিলেন না, বরং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত ঐ সমস্ত মানুষের জন্যও, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে জন্মলাভ করেনি, বরং কিয়ামত পর্যন্ত জন্মলাভ করতে থাকবে।

ইমামুত তাফসীর ইবনে কাসীর এ আয়াতের তাফসীরে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত সহীহ বুখারীর একটি হাদিস উদ্ধৃত করার পর বলেনঃ

এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ সূরাহ মাদানী এবং এটিও প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত ও আবির্ভাব সমস্ত মানুষের জন্য। কেননা আলোচ্য আয়াতে "وَآخَرِينَ مِنْهُمْ" বলতে পারস্যের লোকদের কথা বুঝানো হয়েছে। এর ফলেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পারস্য ও রোম এবং অন্যান্য জাতির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে দাওয়াতনামা প্রেরণ করেছিলেন এবং তাদেরকে এক আল্লাহ'র প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছিলেন। তাই ইমামুত তাফসীর মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ এবং অন্য অনেক মুফাসসির "وَآخَرِينَ مِنْهُمْ" সম্পর্কে বলেন, এর দ্বারা আজমী (অনারব) লোকদেরকে মনে করা হয়েছে। অর্থাৎ আরবের বাইরের যে সমস্ত লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান এনেছে। (ইবনে কাসীর)

ইবনে কাসীর ইবনে হাতীমের উদ্ধৃতি দিয়ে সাহল ইবনে সাদুস সায়েদী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

নিশ্চয়ই আমার উম্মতের নরনারীদের মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবে এরূপ লোক আগমন করবে, যারা বিনা হিসেবে বেহেশতে প্রবেশ করবে।

এরপর এর প্রমাণস্বরূপ এ আয়াত পাঠ করেন - وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ

"آخَرِينَ"

- এর দ্বারা ঐ সমস্ত লোককে বুঝানো হয়েছে যারা উম্মতে মুহাম্মাদী হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত আগমন করবে। (ইবনে কাসীর, ৯ম খ.)

আলোচ্য আয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত ও রিসালাত কিয়ামত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এবং সেই সময় পর্যন্ত জন্ম নেওয়া সমস্ত মানুষ এর অন্তর্ভুক্ত।

আর ভবিষ্যতে আগমনকারী সমস্ত মানুষ যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত বেস্টিত, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর অন্য কোন নবীর আগমনের কোন প্রয়োজন নেই, তার অবকাশও নেই।

 

আয়াত নং ১৫

"বলুনঃ এটিই আমার পথ, আমি আর আমার অনুসারীরা নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ'র প্রতি মানুষকে আহবান করি ....." (সূরাহ ইউসুফ, ১২ : ১০৮)

এ আয়াতে "أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِ" বাক্যটি লক্ষণীয়। এতে বলা হয়েছে যে, عَلَىٰ بَصِيرَةٍ সত্য পথের আহবানকারী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ঐ সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম, উলামায়ে উম্মত, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তম আদর্শের অনুসারী।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু مَنِ اتَّبَعَنِي এর তাফসীরে বলেনঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবায়ে কিরাম উত্তম ও সঠিক পথে ও হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। (মুআলিমুত তানযিল)

যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর অন্য কোন নবী দুনিয়ায় আগমন করতেন, তাহলে তিনিও অনিবার্যভাবে দলীল-প্রমাণের সাথে সত্যের দিকে আহবানকারীদের মধ্যে গণ্য হতেন। বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর প্রথম ঐ সমস্ত নবীর উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিলো, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সত্যের দিকে আহবান করার জন্য আগমন করবেন। এরপর মানের ক্রমানুসারে সাহাবায়ে কিরাম ও আলীমদের উল্লেখ হতো। কিন্তু পরাক্রমশালী আল্লাহ যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর নবীদের নামের পরিবর্তে সাহাবায়ে কিরাম ও উলামায়ে কিরামের উল্লেখ করেছেন, এতে এটিই প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর অন্য কোন নবী আগমন করবেন না।

 

আয়াত নং ১৬

"আর অবশ্যই আপনার প্রতি ও আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি ওহী করা হয়েছে যে, যদি আপনি শরীক করেন তাহলে অবশ্যই অবশ্যই আপনার কাজ বিফল হবে এবং অবশ্যই অবশ্যই আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।" (সূরাহ আয-যুমার. ৩৯ : ৬৫)

এখানেও চিন্তার বিষয় রয়েছে যে, শিরক যদি নেক আমলও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ হয়, তাহলে এটা শুধু পূর্ববর্তী নবীদের বেলায়ই নয়, বরং পরবর্তীতে যদি কোন নবী আগমন করতেন তাহলে তিনিও এ নির্দেশ থেকে বাদ পড়তেন না।

এতদসত্ত্বেও "مِن قَبْلِكَ" বলে কি এদিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করা হয়নি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আগমন করবেন না এবং এ সমস্ত নির্দেশ তার উপর প্রয়োগ করা হবে না ? নতুবা এটা তো স্পষ্ট যে, আল্লাহ তাআলার বিধান পরবর্তীতে আগমনকারী কোন নবীর জন্য শিরক বৈধ করতে পারে না।

 

আয়াত নং ১৭

"যেদিন তাদের চেহারাগুলো আগুনে উল্টে দেওয়া হবে সেদিন তারা বলবে, 'হায় ! আমরা যদি আনুগত্য করতাম আল্লাহ'র এবং আনুগত্য করতাম রাসুলের !' " (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৬৬)

আলোচ্য আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্কের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, "الرسول" শব্দ দ্বারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বুঝানো হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, مايدريك ইত্যাদি শব্দ দেখা যেতে পারে।

সুতরাং আয়াতের সারমর্ম হলো, এই উম্মতের কাফিরদের দোযখে শাস্তি হবে। কেননা তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করেনি এবং এজন্য তাদের অনুতাপ হবে।

যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর নবী আগমন করতেন এবং তাদের আনুগত্য উম্মতের জন্য অপরিহার্য হতো, তাহলে তাদের এ আনুগত্য থেকে বিরত থাকার শাস্তি হওয়ারও প্রয়োজন ছিলো এবং অনুতাপ প্রকাশের সময় কাফিরদের এ কথা বলা আবশ্যক ছিলো যে, اطعنا الرسول অর্থাৎ, হায় ! যদি ঐ সমস্ত রাসুলের আনুগত্য করতাম যাদেরকে (পরবর্তীকালে) আমাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিলো।

এমনিভাবে এ আয়াতটিও ঐ অর্থের সাক্ষ্য বহন করে -

 

আয়াত নং ১৮

"এবং যেদিন জালিম ব্যক্তি তার দু'হাত কামড়াতে থাকবে, (আর) বলবে, হায় ! আমি যদি রাসুলের সাথে পথ গ্রহণ করতাম।" (সূরাহ আল-ফুরকান, ২৫: ২৭)

 

পরিশিষ্ট

একটি সন্দেহ ও তার অপনোদন

মীর্জায়ী দল خاتم النبيين এর অর্থ বর্ণনায় যে সুস্পষ্ট গুমরাহীর সৃষ্টি করেছে, তার মধ্যে এটাও বলা হয়েছে যে, এই শব্দ শুধু রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন এর দ্বিতীয় উদাহরণ خاتم المفسرين - خاتم المحدثين ইত্যাদির মধ্যে সর্বসম্মতিক্রমে রূপক অর্থেই এগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা, সাধারণভাবে যে ব্যক্তি সম্পর্কে خاتم المحدثين লেখা হয়, তা থেকে কারো মতেই এটা বুঝা যায় না যে, এরপর কোন মুহাদ্দিস জন্মগ্রহণ করবেন না।

মীর্জায়ী দলের এই শঠতাপূর্ণ বক্তব্য নিতান্তই অন্তঃসারশূন্য। কেননা خاتم المحدثين - خاتم المحققين ইত্যাদি মানুষের মুখ নিঃসৃত বাক্য। মানুষ জানে না যে, আগামীকাল কি ঘটবে, কতজন লোক জন্মগ্রহণ করবে, কতজন জ্ঞানী হবে, কতজন মূর্খ হবে, কতজন মুহাদ্দিস ও মুফাসসির হবে এবং কতজন ভবঘুরে হবে। তাই কোন ব্যক্তি সম্পর্কে خاتم المحدثين বা خاتم المفسرين ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করার তাদের কোন অধিকার নেই। যদিও কোথাও তাদের কথায় বা ভাষায় এ ধরণের শব্দ পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই মনে করতে হবে যে, তা রূপক বা অতিশয়োক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা এই বাক্য বা কথা সম্পূর্ণ অসম্ভব, অর্থহীন বরং মিথ্যা বলে গণ্য হবে।

কিন্তু এই বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তার কথাকে অনুরূপ অনুমান করা যেতে পারে না। তার জ্ঞানের পরিধির বাইরে কোন কিছুই থাকতে পারে না এবং তিনি স্বীয় জ্ঞান ও ইচ্ছানুযায়ী নবীদেরকে প্রেরণ করেছেন। সুতরাং যখন সর্বজ্ঞানী, সর্ব খবরবিদ এবং পবিত্র ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালামে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে خاتم النبيين এর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এরপর এই শব্দের প্রকাশ্য ও প্রকৃত অর্থ যা নিঃসন্দেহে হতে পারে, তা ছেড়ে দিয়ে তাকে রূপক বা অতিশয়োক্তি মনে করা যেতে পারে না।

মোটকথা, মানুষের কথা ও আল্লাহ'র কথার মধ্যে যে আসমান-যমিন পার্থক্য রয়েছে, তা কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয়। আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীনের বাক্যকে রূপক বা অতিশয়োক্তি মনে করার কোন অবকাশ নেই। বিনা প্রয়োজনে তা করা শরীআতের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ না-জায়েয।

এছাড়া পবিত্র কুরআনের আটানব্বইটি আয়াতে যেখানে خاتم النبيين এর অর্থ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, এতে কোন প্রকার রূপক বা অতিশয়োক্তির অবকাশ নেই। এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু'শ দশটি হাদিসে এর এমনই ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যাতে কোন প্রকার সন্দেহ বা গোপনীয়তা থাকেনি। এরপর ইজমায়ে সাহাবা ও পরবর্তী বুজুর্গদের বাণী প্রকাশ্য ও প্রকৃত অর্থ গ্রহণ করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করে দিয়েছে। এরপর কারো কি অধিকার থাকতে পারে যে, এর বিপরীতে কোন রূপক অর্থ গ্রহণ করবে ?

আশ্চর্যের বিষয় হলো, স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীন স্বীয় পবিত্র কালাম কুরআনে প্রকৃত অর্থবোধক একটি বাক্য ব্যবহার করেছেন। এরপর তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর এই কালাম অবতীর্ণ হয়েছে, তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অর্থ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। এরপর সাহাবায়ে কিরাম ও পূর্ববর্তী সমস্ত উলামায়ে কিরাম এর ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, এই কালাম তার প্রকাশ্য ও প্রকৃত অর্থের উপর প্রতিষ্ঠিত। এতে কোন রূপক বা অতিশয়োক্তির স্থান নেই। যেমন আমরা এ গ্রন্থে اقتصاد امام غزالي এবং شفا قاضي عياض এর উল্লেখ করে তা বর্ণনা করেছি।

কিন্তু মীর্জা সাহেব আর তার অন্ধ অনুসারীরা এ শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে সম্পূর্ণ নতুনভাবে দাবী করেছেন, সে দাবীর সমর্থন কোথাও নেই।

 

("খতমে নবুওয়াত" বইতে খতমে নবুওয়াত সম্পর্কিত আরো অনেক আয়াতের উল্লেখ ও আলোচনা রয়েছে। এখানে কেবল সিলেক্টেড কিছু আয়াত ও সেই আয়াত সংক্রান্ত আলোচনাই উল্লেখ করা হলো।

ইন শা আল্লাহ, পরবর্তী পার্টে আসছে - হাদিসে খতমে নবুওয়াত।)

 

ফুটনোটঃ

(১) কিন্তু এটাও ভালোভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, ইমামত - এর অর্থ এই নয় যে, তিনি (ঈসা আলাইহিস সালাম) নবুওয়াত থেকে পদচ্যুত হয়ে যাবেন, বরং ঐ সময় এ উম্মতের মধ্যে তার আগমন সম্পূর্ণ এরূপ হবে, যেমন পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর কোন বিশেষ প্রয়োজনে বিহার প্রদেশে গমন করেন। ঐ সময় তিনি গভর্নর হিসেবে বিবেচিত হোন না। কিন্তু এটাও বলা যাবে না যে, তিনি গভর্নরের পদ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন।

(২) এটা স্মরণ রাখা উচিত যে, পূর্ববর্তী নবীদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করাও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যের মধ্যে গণ্য। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উপর বিশ্বাস স্থাপনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং ভবিষ্যতে কোন নবীর আগমনের খবরও প্রদান করেননি। সুতরাং তার আনুগত্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যের মধ্যে গণ্য হবে না।

(৩) স্মরণ রাখা উচিত, যে আল্লাহ তাআলার মনোনীত কোন নবী ব্যক্তিগতভাবে সামান্য মর্যাদাপ্রাপ্ত নন, বরং সবাই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। কিন্তু নবীগণের পারস্পরিক মর্যাদা কম-বেশী এবং উঁচু-নিচু হওয়া পবিত্র কুরআন উল্লেখ রয়েছে (দেখুন, ২ : ২৫৩)। এখানে ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে ادني বা নিন্ম মর্যাদার কথা বলা হয়েছে।

মূলঃ খতমে নবুওয়াত (মুফতি মুহাম্মাদ শফী রাহিমাহুল্লাহ)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-5k

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী মতবাদ - ৬

 

 

The Greatest Nation·Monday, April 8, 2019

 

 

 

হাদিসে খতমে নবুওয়াত

 

খতমে নবুওয়াত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসসমূহের যে বিরাট দফতর মজুদ রয়েছে, এর পরিমাপ করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এর মধ্যে যতটুকু সম্ভব এবং হাদিসের ভাণ্ডারের মধ্যে যা পেয়েছি, তা এখানে লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছি। তবে হাদিসসমূহের জমাকৃত ভাণ্ডার দেখে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, খতমে নবুওয়াত বিষয়ের হাদিসসমূহ (মুতাওয়াতির) -এর বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে আমরা সংক্ষিপ্তভাবে মুতাওয়াতির হাদিসের অর্থ আর এর আইনগত মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়োজনবোধ করছি।

মুতাওয়াতির হাদিস বলা হয় সেই হাদিসকে, যার বর্ণনাকারী এতো বেশী যে, এদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও পদমর্যাদা পর্যবেক্ষণ করে এরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিথ্যা বলেছেন, সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি তা মেনে নিতে পারে না। যেমন, বাগদাদ শহরকে আমরা কখন দেখিনি। কিন্তু এ শহরটি যে অতীব সুন্দর, সে সম্পর্কে আমরা দৃঢ় বিশ্বাস করি। কেননা, এর অস্তিত্ব সম্পর্কে বর্ণনাকারী সংবাদদাতা এতো অধিক যে, তাদের সবাইকে মিথ্যাবাদী বলা বা মিথ্যা বলার জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াকে বিবেক কখনোই মেনে নিতে পারে না।

শরীআতের দৃষ্টিতে মুতাওয়াতির হাদিস দ্বারা যে জ্ঞানলাভ হয়, তা অকাট্য ও বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রত্যক্ষ দর্শনলব্ধ জ্ঞানের মতোই সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। যেমন, দিল্লী নগরী দেখে এর বিরাট নগর হওয়া সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস জন্মে, ঠিক এমনিভাবে বাগদাদ শহর সুন্দর হওয়ার বিশ্বাস মুতাওয়াতির সংবাদের মতোই অকাট্য। অথবা, যেভাবে নিজের পিতামাতাকে দেখে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস জন্মে, তেমনিভাবে (বাদশাহ) সিকান্দার ও দারার অস্তিত্ব সম্পর্কেও বিশ্বাস জন্মে। অথচ আমরা তাদের যুগ পাইনি এবং তাদেরকে নিজেদের চোখে দেখিনি। শুধু মুতাওয়াতির সংবাদের মাধ্যমেই এ জ্ঞান ও বিশ্বাস জন্মে থাকে।

এভাবে মুতাওয়াতির হাদিসকে বুঝতে হবে যে, যে হাদিসের বর্ণনাকারী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এতো অধিক সংখ্যক যে, তারা একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোন মিথ্যা ঘটনাকে সত্য বলে চালিয়ে দিয়েছেন এ কথা চিন্তা করাও অসম্ভব। এটিকেই "হাদিসে মুতাওয়াতির" বলে। দ্বিপ্রহরের সূর্যের অস্তিত্বের মতো এটিও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ সত্য।

তাই সমস্ত উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো এই যে, এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা কুরআনের মতোই ফরয এবং একে যে অগ্রাহ্য করবে, সে নিঃসন্দেহে কাফির। কেননা, বাস্তবে এটি হাদিসের অস্বীকৃতিই শুধু নয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের অস্বীকৃতিও ১ এবং এটা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সততা ও সত্যবাদিতার উপর আক্রমণ ছাড়া আর কি হতে পারে ?

এরপর এটা উপলব্ধি করা মোটেই কষ্টকর নয় যে, খতমে নবুওয়াত সম্পর্কিত হাদিসসমূহ অধিক সংখ্যক লোকের দ্বারা বর্ণিত। মুতাওয়াতির হাদিসের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে মুহাদ্দিসগণ এ হাদিসটি উল্লেখ করেছেন (যার অনুবাদ) -

"যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যা আরোপ করবে, তা ঠিকানা হবে দোযখে।"

হাফিয আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী এই হাদিসটিকে মুতাওয়াতির সাব্যস্ত করে তা প্রমাণ করার জন্য বলেছেন যে, এই হাদিস একশো বর্ণনাকারীর মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাদের মাঝে ত্রিশটি সনদ বা ত্রিশজন বর্ণনাকারী মুহাদ্দিসের নীতি অনুযায়ী এই হাদিস নির্ভুল ও সঠিক।

এ হলো মুতাওয়াতির হাদিসের উত্তম নিদর্শন। এক্ষণে আমরা বলতে পারি যে, খতমে নবুওয়াতের হাদিসসমূহ মুতাওয়াতির হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কেননা খতমে নবুওয়াত প্রসঙ্গে একশোরও বেশী স্পষ্ট ও সহীহ হাদিস রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে প্রায় চল্লিশটি হাদিস মুহাদ্দিসগণের স্থিরীকৃত নীতি অনুযায়ী সহীহ। শুধু এতটুকু পার্থক্য যে, "যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যা আরোপ করবে ...." - এই হাদিসটির বাক্য মুতাওয়াতির এবং খতমে নবুওয়াতের হাদিসসমূহ متواتر المعني অর্থের দিক দিয়ে, অন্য কথায় মূল বক্তব্যের দিক দিয়ে মুতাওয়াতির। বিভিন্ন বাক্যের একশোরও বেশী হাদিসে খতমে নবুওয়াতের বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। এমনকি ভালো করে খোঁজ নিলে لانبي بعدي (আমার পরে কোন নবী হবে না) - এ বাক্যটিও হাদিসে মুতাওয়াতিরের স্তরে পৌঁছবে। কেননা এই বাক্য সমন্বিত ত্রিশটি হাদিস আপনারা এই গ্রন্থেই পাঠ করবেন।

পুবেই আমরা উল্লেখ করেছি যে, আমাদের কাছে হাদিসগ্রন্থের যে ভাণ্ডার রয়েছে, তা খুবই সংক্ষিপ্ত। তদুপরি বিভিন্ন ব্যস্ততার সময় অশান্ত পরিবেশে এ গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। হাদিসের ইমাম হাফিয ইবনে হাযম আন্দালুসীর বর্ণনা আমাদের এ ধারণার সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

"যারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত, মুজিযা ও কুরআন বর্ণনা করেছেন, তাদের মধ্য থেকে বহু সংখ্যক লোক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ঘোষণাটিও বর্ণনা করেছেন-'আমার পরে কোন নবী নেই (হবে না)'। " (মিলাল ও নিহাল, ইবনে হাজার, ১খ. পৃ.৭৭)

উদ্ধৃত উক্তির দ্বারা শুধু এটিই প্রমাণিত হয় না যে, "আমার পরে কোন নবী নেই" হাদিসটি মুতাওয়াতির, বরং এটিও প্রতীয়মান হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত, মুজিযা ও কুরআন মাজীদ যে স্তরের মুতাওয়াতির বলে গণ্য হয়ে থাকে, এই হাদিসটিও ঠিক সেই পর্যায়েরই।

তাফসীর ও হাদিসের ইমাম হাফিয ইমামুদ্দীন ইবনে কাসীর خاتم النبيين আয়াতের তাফসীর করে বলেনঃ এই পর্যায়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাহাবীদের একটি জামাআত বহু মুতাওয়াতির হাদিস বর্ণনা করেছেন।

সাইয়েদ মাহমুদ আলূসী তাফসীরে রুহুল মাআনীতে লিখেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাতামুন-নাবিয়্যীন হওয়া সম্পর্কে কুরআন মাজীদ যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে এবং মুহাম্মাদী উম্মত এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ঐকমত্য গ্রহণ করেছে। অতএব এর বিরোধীরা অবশ্যই কাফির হবে। আর যদি সে এই বিরোধিতায় পৌনপুনিকতা করে, তাহলে তাকে হত্যা করতে হবে। (রুহুল মাআনী, ৭খ. পৃ,৩৫)

এরপর খতমে নবুওয়াত পর্যায়ের হাদিসসমূহ অনুবাদ সহকারে পাঠকবর্গের সামনে পেশ করা হবে। লেখার সময় বুখারী ও মুসলিমের হাদিস প্রথমে এবং অন্যান্য হাদিস পরে উদ্ধৃত হবে।

 

হাদিস নং ১

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

আমার পূর্ববর্তী নবীদের তুলনায় আমার দৃষ্টান্ত এরূপ, যেমন কোন ব্যক্তি একটি ঘর তৈরি করেছে আর সে ঘরটি সৌন্দর্যমণ্ডিত ও চাকচিক্যময় করেছে। কিন্তু একটি কোণে নির্মাণের সময় একটি ইটের জায়গা শূন্য রেখেছে। এরপর লোকজন আনন্দ ও উৎসাহে তা দেখতে আসে এবং সন্তুষ্ট ও বিস্মিত হয়ে বলতে থাকে যে, এই একটি ইট কেন সংযোজন করা হয়নি (তাহলে ঘরের নির্মাণ কাজ পূর্ণাঙ্গ হতো) ? সুতরাং আমি সেই শূন্যস্থান পূর্ণকারী, আমিই নবুওয়াত খতমকারী (আমার দ্বারাই নবুওয়াতের ইমারত পূর্ণ হয়েছে)।

(বুখারী - কিতাবুল আম্বিয়া, মুসলিম- ফাযাইল, মুসনাদে আহমাদ - ২ খ. ৩৯৮ পৃ., নাসাঈ, তিরমিযী)

কোন কোন হাদিসে এ বাক্যটিও রয়েছে - "এরপর আমিই নির্মাণের ঐ শূন্যস্থান পূর্ণ করেছি, আমার দ্বারা ঐ নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে এবং আমার দ্বারা রাসুল আগমনের ক্রমধারা সমাপ্ত করা হয়েছে।" (আবি আসাকির কর্তৃক "কানয" নামক গ্রন্থে এরূপ বর্ণিত আছে)

 

যে সমস্ত লোক প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণভাবেই নবুওয়াত খতম হওয়ার কথা থেকে নবুওয়াতের নব আবিস্কার অবয়ববিহীন বা অবয়বরূপীকে গোপন রেখে খতমে নবুওয়াতের বিষয়টিকে শুধু শরীআত প্রদত্ত নবুওয়াতের সাথে একত্র করতে চায়, আলোচ্য হাদিসটি নিয়ে তাদের চিন্তা করা উচিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতো উত্তম উদাহরণের দ্বারা তাদের সন্দেহের অপনোদন করেছেন। কেননা, এই উদাহরণের সারমর্ম হলো, নবুওয়াত একটি উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন ইমারতের মতো, যার খুঁটি হলেন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ পৃথিবীতে আগমনের পূর্বে এ ইমারত সম্পূর্ণ তৈরি হয়েছে। একটিমাত্র ইট ছাড়া ঐ ইমারতের নির্মাণ কাজে অন্য কিছুর অপূর্ণতা ছিলো না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই অপূর্ণতাকেই পূর্ণ করে দিয়ে নবুওয়াতের ইমারতকে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। এখন এতে শরীআতপ্রাপ্ত নবুওয়াতের ইটের অপূর্ণতা নেই এবং শরীআতবিহীন ইত্যাদি নবীর অপূর্ণতা নেই।

এছাড়া হাদিসের مثل الانبياء من قبلي এ বাক্যে বিবেচনার বিষয় হলো এতে সাধারণভাবে সমস্ত নবীর কথাই বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে যে সমস্ত নবী ছিলেন তেমনি পূর্ববর্তী শরীআতের অনুসরণকারী নবীও ছিলেন। এ সকলের সমন্বয়ে নবুওয়াতের ইমারত পূর্ণাঙ্গ হওয়ার মধ্যে শুধু একটি ইটের শুন্যতা ছিলো, সেটাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমাপ্ত করেছেন। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আর কোন প্রকার নবী আগমনের অবকাশ নেই।

 

একটি সন্দেহ ও এর অপনোদন

মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর অনুসারীরা এ হাদিস বিকৃত (تحريف) করে বলেন, যখন নবুওয়াতের ক্রমধারায় কোন নবীর আগমনের অবকাশ নেই, তাহলে শেষ যুগে ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন কিভাবে সম্ভব হবে ? অধিকন্তু তার স্বীয় স্থান ত্যাগ করে স্থানান্তর হওয়া নবুওয়াতের ইমারতে বা ক্রমধারায় একটি অসঙ্গতির কারণ হবে।

কিন্তু যে ব্যক্তি সামান্যতম জ্ঞান ও নীতির অধিকারী, তিনি সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে, বাড়ির নির্মাণ কাজে কোন একটি ইটের সর্বশেষ হওয়াতে পূর্ববর্তী সমস্ত ইটের ধ্বংস হয়ে যাওয়া জরুরী হয় না। ঠিক এমনিভাবে কোন নবীর সর্বশেষ হওয়ার জন্য তার পূর্ববর্তী সমস্ত নবীর ইন্তিকাল হওয়াও জরুরী নয়। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টান্তটির মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের ইমারত বা নবুওয়াতের ক্রমধারায় সর্বশেষ হওয়া সত্ত্বেও তা কোনভাবেই ঈসা আলাইহিস সালামের জীবিত থাকার বিরোধী নয়।

ঈসা আলাইহিস সালামের শেষ যুগে আগমনের কারণে নবুওয়াতের ইমারতে বা ক্রমধারায় কোন প্রকার পরিবর্তন ও অসঙ্গতি আবশ্যক হয়ে পড়বে এরূপ বলারও কোন যুক্তি নেই। কেননা, এর অর্থ হলো, কেউ যদি বলে যে, অমুক ব্যক্তি বাঘের মতো, তাহলে এর অর্থ কি এই যে, সেই ব্যক্তি চতুস্পদ জন্তু, জঙ্গলে বাস করে, তার লেজ আছে আর বিরাট বিরাট নখ ও লোম আছে ?

অথবা যদি কোন ব্যক্তি বলে যে, অমুক ব্যক্তি চাঁদের মতো, তাহলে কি সেই ব্যক্তিকে একটি গোলাকার বলের মতো হতে হবে ? তার হাত, পা, চোখ, নাক কিছুই থাকবে না ? তাকে আকাশের সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে ? নতুন গবেষণার নীতি অনুযায়ী এটা পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘুরছে, সেই ব্যক্তিকেও কি তাই করতে হবে ?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে যদিও নবী আলাইহিমুস সালামগণকে একটি বাড়ির বা দালানের ইটের সাথে তুলনা করা হয়েছে, এর দ্বারা তথাকথিত জ্ঞানীগণ নবীদেরকে একমাত্র গর্তের ইটকে বুঝে নিয়েছেন। এগুলোকে স্তর স্তর মনে করে একটি কল্পনাপ্রসূত বাড়ি তৈরি করেছেন এবং ঈসা আলাইহিস সালামের শেষ যুগে দ্বিতীয়বার এ পৃথিবীতে আগমনের কারণে এ বাড়িতে অসঙ্গতি সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করে নিয়েছেন। এটা ঐ সমস্ত জ্ঞানপাপীর মনের সংকীর্ণতা আর সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিরোধী।

 

হাদিস নং ২

আবু হাযিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি পাঁচ বছর আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছে অবস্থান করেছি। আমি তাকে স্বয়ং এ হাদিস বর্ণনা করতে শুনেছি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বনী ইস্রাইলীদের নেতৃত্ব করতেন তাদের নবীগণ। যখন কোন নবী ইন্তিকাল করতেন, তখন আল্লাহ অন্য কোন নবীকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করে দিতেন। কিন্তু আমার পরে কোন নবী আগমন করবেন না। তবে খলীফা হবে এবং তাদের সংখ্যাও হবে অনেক। (এটা শুনে) সাহাবায়ে কিরাম নিবেদন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), ঐ সমস্ত খলীফার ক্ষেত্রে আমাদের কি নির্দেশ দিচ্ছেন ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, একজনের পর দ্বিতীয়জনের বায়আত পূর্ণ করো এবং যথার্থভাবে তাদের আনুগত্য করো। কেননা আল্লাহ তাদেরকে তাদের অধীনস্থদের সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। ২

(বুখারী - ১ খ., মুসলিম- কিতাবুল ইমারা, মুসনাদে আহমাদ - ২খ., ইবনে মাজাহ, ইবনে জারীর ও ইবনে আবি শায়বা প্রভৃতি গ্রন্থে এ হাদিসটি বর্ণিত আছে)

 

আলোচ্য হাদিসে শরীআতপ্রাপ্ত নবুওয়াত রহিত হওয়ার জন্য যেভাবে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে, তেমনিভাবে প্রত্যেক প্রকারের নবুওয়াত সমাপ্তির ঘোষণাও রয়েছে। এরদ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মীর্জা সাহেবের আবিষ্কৃত শরীআতবিহীন নবুওয়াতের কোন অবকাশ নেই, ছায়াবিহীন বা ছায়াস্বরূপ নবী প্রমাণিত হওয়ার তো কোন প্রশ্নই আসে না।

 

আলোচ্য হাদিস দ্বারা শরীআতবিহীন বা অবয়বরূপী অথবা অবয়ববিহীন বা আক্ষরিক নবুওয়াতের রহিত হওয়া সম্পর্কে প্রমাণ

প্রথমত, এজন্য যে, উল্লিখিত হাদিসের বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী আগমন করবেন না। এর দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যেক প্রকারের নবুওয়াতের নিষিদ্ধ হওয়া প্রমাণিত হয়। সুতরাং মীর্জা সাহেবের মতানুযায়ী যদি শরীআতবিহীন এবং অবয়বরূপে বা অবয়ববিহীন নবীও হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে لانبي এর نفي বা না-বাচকের অধীন হবে। বরং যদি (লাহোরী মীর্জায়ীদের ধারণানুযায়ী) কোন আক্ষরিক নবীও হয়, তাহলে তা لانبي এর نفي (না-বাচক) থেকে মুক্তি পাবে না, কেননা لانبي بعدي এর অর্থ হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর এমন কোন ব্যক্তিই জন্মগ্রহণ করবে না, যার উপর নবী শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্রের একটি প্রসিদ্ধ নিয়ম হলো যখন نكره (অনির্দিষ্ট বিষয়) نفي এর পরে আসে, তখন তা استغراق وعموم বা সমগ্রকে বুঝায়। এ হাদিসেও نبي শব্দটি نكره এবং لانفي এর পরে এসেছে। তাই নিয়মানুযায়ী নবী বলতে সকল নবীকেই বুঝাবে। অর্থাৎ নতুন শরীআতপ্রাপ্ত ব্যক্তি হোক বা পূর্ববর্তী আক্ষরিক নবী হোক, প্রত্যেক নবীকেই বুঝাবে এবং কোন নবীই আসবেন না এই ঘোষণা চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

বস্তুত আলোচ্য হাদিসে এ বিষয়ের স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর এমন কোন ব্যক্তির আগমন হবে না, যার উপর"নবী" শব্দ ব্যবহার করা যাবে।

তৃতীয়ত, হাদিসে বনী ইস্রাইলিদের নবীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, আমার পর কোন নবী হবে না, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এই উম্মতে এরূপ নবীও আগমন করবে না, যেরূপ বনী ইস্রাইলিদের সমাজে আগমন করতো। এখন দেখা প্রয়োজন তারা কি ধরণের নবী ছিলেন এবং বনী ইস্রাইলিদের রাজনীতি বলতে কি বুঝায়।

হাফিয আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী বুখারি শরীফের শরাহ (ব্যাখ্যা) - এর মধ্যে বলেছেন, "বনী ইস্রাইলদের মধ্যে যখন ঝগড়া-বিবাদ শুরু হতো, তখন আল্লাহ তাদের জন্য কোন নবী প্রেরণ করতেন, যিনি তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতেন এবং ঐ সমস্ত পরিবর্তনকে দূর করতেন, যা তারা তাওরাত করেছে।" (ফাতহুল বারী, ৬খ., পৃ. ৩৬)

এর দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বনী ইসরাইলের এ সমস্ত নবী পৃথক কোন শরীআত নিয়ে আগমন করেননি, বরং তারা মুসা আলাইহিস সালামের শরীয়াতের অনুসারী হয়ে তা প্রচারের কাজ করতেন আর লোকদেরকে তাওরাতের সঠিক আহকামের অনুসারী বানিয়ে দিতেন। এ ধরণের নবীদের মীর্জা সাহেব শরীআতবিহীন নবী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাই উল্লিখিত হাদিসে সারমর্ম দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, এই উম্মতের মধ্যে শরীআতবিহীন নবীও (পূর্ববর্তী শরীয়াতের অনুসারী) আগমন করবেন না।

চতুর্থত, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও সুস্পষ্ট বিষয় হলো এই যে, এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু নবুওয়াত রহিত হওয়া সম্পর্কে বর্ণনা করেই শেষ করেননি, বরং এর সাথে এ বিষয়টিও বর্ণনা করেছেন যা নবুওয়াতের প্রতিনিধি হয়ে বিশ্ববাসীর ইসলাহ বা সংশোধনের জন্য অবশিষ্ট থাকবে অর্থাৎ খিলাফতে নবুওয়াত। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, "আমার পর কোন নবী হবে না কিন্তু অনেক খলীফা হবে।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বর্ণনার দ্বারা কি প্রতিটি মানুষের জন্য এটি উপদেশ নয় যে, কোন প্রকার নবুওয়াতের ক্রমধারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর অব্যাহত থাকবে না ? নতুবা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খলিফাদের পরিবর্তে আগমনকারী নবীদের উল্লেখ করা কি অধিক প্রয়োজন ছিলো না ? আর হাদিস বর্ণনার পদ্ধতিতে যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর শুধু খলীফাদেরকে রাখা হয়েছে, তখন তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের পর কোন শরীআতপ্রাপ্ত নবী আগমন করবেন না। এছাড়া মীর্জা সাহেবের মতানুযায়ী শরীআতবিহীন বা অবয়বরূপী আর অবয়ববিহীন নবীও নয়। তেমনি এর দ্বারা এটিও প্রতীয়মান হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে আক্ষরিকভাবে নবীও বলা যাবে না।

 

একটি সন্দেহ ও তার উত্তর

বলা হয়ে থাকে যে, আলোচ্য হাদিসটি সঠিক নয়, কারণ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, "তোমরা খাতামুন-নাবিয়্যীন বলো, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে কোন নবী নেই, এই কথা বলো না।"

মুগীরা ইবনে শুবা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সামনে এক ব্যকি বললেন, আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর রহমত বর্ষণ করুন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন خاتم النبيين অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী নেই।

মুগীরা রাদিয়াল্লাহু আনহু এটা শুনে বললেন, "তোমাদের জন্য শুধু খাতিমুল আম্বিয়া বলাই যথেষ্ট, কেননা আমাদের কাছে এ হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে যে, , ঈসা আলাইহিস সালাম আবির্ভূত হবেন। এরপর যখন তিনি আবির্ভূত হবেন, তখন তো তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বেও নবী ছিলেন এবং পরেও নবী।" (দুররে মনসুর, ৪খ. পৃ. ২০৪)

আমরা মীর্জায়ীদের উল্লিখিত অদ্ভুত নীতি উপলব্ধি করতে অক্ষম। কেননা, যদি কোন বিষয় তাদের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হয়, তাহলে হাদিসে মুতাওয়াতির ও মশহুর এবং সহীহ বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনাও তারা গ্রহণ না করে দূরে নিক্ষেপ করতে তৈরি হয়। আর যদি তাদের মনমতো হয়, তবে সর্বশেষে দুর্বল (ضعيف) হাদিস, বরং এমন বর্ণনা যার সম্পর্ক কোন সাহাবীর দিকে করা হয়েছে, যদিও এর বর্ণনাকারীদের কোন খোঁজ মিলে না, এটাকেই এমনভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, এর বিপরীতে বুখারি শরীফের মরফূ হাদিসকে রহিত করা তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়।

কি ধরণের অদ্ভুত ব্যাপার যে, একদিকে সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমের মরফূ হাদিস, এর বিপরীতে এমন দুটি বর্ণনা রয়েছে যার সম্পর্ক আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ও মুগীরা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রতি করা হয়েছে, যাদের বর্ণনাকারীর অবস্থাও জানা নেই। উসূলে হাদিস ও বিবেকের বিচার অনুযায়ী সহিহ ও মরফূ হাদিসকে অজ্ঞাত বর্ণনাকারীর হাদিসের উপর প্রাধান্য দিয়ে সহিহ হাদিসের বিপরীতে এগুলোকে অগ্রহণযোগ্য বলে স্বীকার করে নেওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু মীর্জায়ী দুনিয়ায় আশ্চর্য নীতিমালা হলো এই যে, এক অজ্ঞাত বর্ণনাকারীর বর্ণনা অনুযায়ী বুখারি ও মুসলিম শরীফের নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর মরফূ হাদিসকে অগ্রহণযোগ্য বলে রায় দিয়েছে।

উপরিউক্ত সন্দেহ এবং এর বিস্তারিত উত্তর আয়াত خاتم النبيين এর ব্যাখ্যায় বর্ণনা করা হয়েছে।(দেখুনঃ https://bit.ly/2Uu0HpD) সেখানে সাহাবায়ে কিরামের হাদিসের বর্ণনা ও অর্থের দিকটা পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে।

 

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা খতমে নবুওয়াতের বর্ণনাকারী ছিলেন

যখন আমরা খতমে নবুওয়াতের হাদিসসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করি এবং এগুলোর বর্ণনাকারীদের তালিকা পর্যবেক্ষণ করি, তখন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র নাম উজ্জ্বল অক্ষরে আমাদের সামনে উদিত হয়। হাদিসের ভাণ্ডার থেকে এ সকল হাদিসসমূহ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র বর্ণনার মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছেছে -

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমার পর নবুওয়াতের কোন অংশ বাকি থাকবে না, একমাত্র মুবাশশিরাত বা শুভ স্বপ্ন বাকি থাকবে। সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), মুবাশশিরাত কি ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ভালো স্বপ্ন যা কোন মুসলমান দেখে বা তার জন্য কেউ দেখে। (কানযুল উম্মাল, আহমাদ ও খাতিব থেকে বর্ণিত)

এছাড়া আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মরফূ হাদিস বর্ণনা করেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আমিই সর্বশেষ নবী, আমার মসজিদ নবীদের সর্বশেষ মসজিদ। (কানযুল উম্মাল এই হাদিস দায়লামী, ইবনে নাজ্জার ও বাযযার থেকে বর্ণনা করেছেন)

এরপরও কি কোন মুসলমান - এমনকি কোন ন্যায়বান মানুষের পক্ষে আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র উপর মিথ্যা অপবাদ রটনা করা বৈধ হবে ? এটা কি বলা যাবে যে, তিনি খতমে নবুওয়াতে অস্বীকার করেছিলেন?

এটা কি যুলম নয় যে, মনঃপূত হলে কি কোন অজ্ঞাত বর্ণনাকারীর উপর ভিত্তি করে কোন চিন্তা বা গবেষণা ব্যতীত বিশ্বাস স্থাপন করবে, আর মনঃপূত না হলে সবচেয়ে সহীহ ও শক্তিশালী হাদিসকে বর্জন করবে ?

 

একটি সন্দেহ

বলা হয়ে থাকে যে, হাদিস لانبي بعدي ঈসা আলাইহিস সালামের জীবিত থাকারও বিরোধী। যেমন কিছুক্ষণ পূর্বে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা আর মুগীরা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয়। কেননা যদি لانبي শব্দটির نفي বা না-বাচক শব্দ সাধারণভাবে সব নবীই বুঝায়, তাহলে ঈসা আলাইহিস সালামের বেঁচে থাকাও এর আওতায় পড়ে। যদি عام বা সাধারণ না হয়, তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর নবী হওয়ার অবকাশ থাকে এবং খতমে নবুওয়াতের বিষয়টি হাতছাড়া হয়ে যায়।

এই সন্দেহটি মীর্জায়ী উম্মতরা খুব শক্ত মনে বিরাট দাবী হিসেবে পেশ করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এটাই তাদের শেষ মজবুত প্রমাণ আর তাদের জ্ঞানের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি। কেননা আরবি ভাষায় যে কোন জ্ঞানী ব্যক্তিই এরূপ সন্দেহ করতে পারে। আরবি ভাষায় যখন এ ধরণের বাক্য বলা হয়, তখন এর অর্থ হলো যে, ভবিষ্যতে কোন ব্যক্তির মাঝে এ গুণ হতে পারবে না বা কেউ এ গুণের অধিকারী হতে পারবে না। কিন্তু পূর্ব থেকে এ গুণ যাদের মধ্যে রয়েছে, তা বিলোপ হয়ে যাওয়া জরুরী হয় না।

দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে কতিপয় বাক্য উদ্ধৃত করা যাচ্ছে। হাদিসে আছেঃ لاهجرة بعد الفتح (মক্কা বিজয়ের পর হিজরত করা যায় না)। প্রত্যেকটি জ্ঞানী লোক এ বাক্য থেকে এটিই বুঝে থাকেন যে, মক্কা বিজয়ের পর কোন ব্যক্তি মুহাজির হতে পারবে না। কিন্তু এটা নয় যে, মক্কা বিজয়ের পূর্বে যে ব্যক্তি মুহাজির হয়েছে, মক্কা বিজয়ের পর তার জীবিত থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে অথবা তার হিজরত বাতিল হয়ে যাবে।

সুতরাং لاهجرة بعد الفتح এর গঠন প্রণালী যখন একইরূপ, তখন لانبي بعدي এর অর্থ সমস্ত শরীআতের নির্দেশাবলীর বিপরীত এভাবে গ্রহণ করার কারণ নেই যে, পূর্ববর্তীদের কেউ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর পৃথিবীতে আসতে পারবে না অথবা জীবিত থাকতে পারবে না।

অথবা কোন ব্যক্তি যদি বলে, لاعمل بعد الموت তাহলে নিঃসন্দেহে তার অর্থ হবে এই যে, মৃত্যুর পর কোন আমল বা কর্ম থাকবে না। কিন্তু এর অর্থ হলো, আমলের ক্রমধারা রহিত হয়ে যাবে এবং ভবিষ্যতে কোন নতুন আমল হতে পারবে না। কোন ব্যক্তি এ বাক্যের অর্থ এটা মনে করতে পারবে না যে, মৃত্যুর পর তার পূর্ববর্তী কর্ম বা আমল বাতিল হয়ে যাবে। এ বিষয়ে যে ধরণের বাকপদ্ধতি আরবে প্রচলিত রয়েছে, তা সব একই ধরণের।

আরবের বাকপদ্ধতি ছেড়ে যদি হাদিসের বর্ণনা পদ্ধতি এবং হাদিসের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়, তাহলে স্বয়ং হাদিসের বাক্য বর্ণনা দ্বারা আমাদের বর্ণিত অর্থের প্রমাণ পাওয়া যাবে।

তাবূক যুদ্ধে সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত মুসলিম শরীফে দুটো হাদিস রয়েছে। যাতে لانبي بعدي এর পরিবর্তে لانبوات بعدي এই বাক্য রয়েছে। যার অর্থ, আমার পর কোন নবুওয়াত থাকবে না। এর দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, لانبي بعدي এর অর্থ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে নবুওয়াত প্রদান করা হবে না।

অতঃপর আমরা বলবো, لانبي بعدي এর মধ্যে نفي (لا) সম্পূর্ণ সাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ। এর দ্বারা কোন নবুওয়াতকে বাদ দেওয়া হয়নি। কিন্তু আরবের বাকপদ্ধতি এবং হাদিস অনুযায়ী এর অর্থ হলো এই যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে নবুওয়াতের পদ প্রদান করা হবে না। মুসা আলাইহিস সালাম ও ঈসা আলাইহিস সালাম'কেও প্রদান করা হবে না এবং ভবিষ্যতে আগমনকারী মীর্জাকেও তা প্রদান করা হবে না।

হ্যাঁ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে যাদেরকে এ নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছে, তা ছিনিয়ে নেওয়া এবং তাদেরকে নবুওয়াতের পদ থেকে বরখাস্ত বা পদচ্যুত করা এজন্য আবশ্যক নয়। সুতরাং যদিও এ পৃথিবীতে ঈসা আলাইহিস সালাম'কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে নবুওয়াতের পদ প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু তবুও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর তার আগমন কখনো لانبي بعدي এর বিরোধী নয়। হ্যাঁ, যে মসীহ(কাদিয়ানী) বর্তমানে নিজের জন্য নবুওয়াতের পদ দাবী ও প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, তার জন্য নিশ্চিতভাবে এই হাদিস নৈরাশ্যের বাণী বয়ে আনছে। তাই এর উপর আহাজারী করাই তাদের জন্য শ্রেয়।

বস্তুত আরবের বাকপদ্ধতির অনুকরণে এই নির্দেশ করে যে, لانبي بعدي এর অর্থ হলো - রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কাউকে নবুওয়াতের পদ প্রদান করা হবে না এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে যাদের এ পৃথিবীতে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছে, তাদের সবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া অথবা নবুওয়াতের পদ থেকে তাদের পদচ্যুতি হওয়া কিংবা রাসুলুলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে আগমন না করা কোনমতেই এ হাদিসের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং এটা মীর্জায়ীদের ব্যক্তিগত রুচির অভিপ্রায়। সম্ভবত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ও মুগীরা ইবনে শুবা রাদিয়াল্লাহু আনহু অন্তর্দৃষ্টিতে এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার সমাধান ও তাদের অশুভ চিন্তাধারাকে পদানত করার জন্য لانبي بعدي এ বাক্যের প্রয়োগ প্রথম থেকেই সাধারণের জন্য থামিয়ে দিয়েছেন। নতুবা আরবি ভাষা সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকদের এ ধরণের সন্দেহের উদ্রেক হতো না।

 

একটি সন্দেহ ও তার অপনোদন

কাদিয়ানী নবুওয়াতের অনুসারী লোকেরা لانبي بعدي হাদিসটির অর্থে বিকৃতি সাধন করার জন্য যে সমস্ত কৌশল অবলম্বন করেছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হলো, لانبي এর (না-বাচক)-কে نفي كمال বলা হয়েছে। অর্থাৎ আমার পর কোন পূর্ণাঙ্গ নবী হবে না। এতে অপূর্ণাঙ্গ ও শরীআতবিহীন নবী হওয়ার নিষেধ হয় না। যেমন হাদিসে আছেঃ لا ايمان لمن لا امانة له (হে ব্যক্তির আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই) অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ ঈমান নেই।

হাদিসে আরো আছেঃ لا صلواة لجار المسجد الا في المسجد (মসজিদ সংলগ্ন এলাকাবাসীর নামায মসজিদ ছাড়া অন্যত্র হবে না) অর্থাৎ নামায পূর্ণাঙ্গ হবে না। সুতরাং এ সমস্ত হাদিসে যেমনিভাবে সর্বসম্মতিক্রমে نفي كمال বুঝায়, তেমনিভাবে যদি لانبي بعدي এর মাঝে نفي كمال স্বীকার করা হয়, তাহলে অসুবিধা কোথায় ?

উত্তর

যদি এটাই তাদের ইজতিহাদ ও কিয়াস হয়, তাহলে যদি কোন মূর্তিপূজারী হিন্দু বলে যে, لا اله الا الله এর মধ্যে نفي كمال রয়েছে অর্থাৎ কামিল বা পূর্ণাঙ্গ মাবূদ আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই বলে বিশ্বাস করে, তবে অপূর্ণাঙ্গ ও শরীআতবিহীন মাবূদ হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এটা সমস্ত পূজারীর বিশ্বাস। এ অবস্থায় আপনারা তাদেরকে কি উত্তর দিবেন ? অথবা কেউ যদি বলে যে, পবিত্র কুরআনের আয়াত - "لا ريب فيه" - এর মধ্যেও نفي كمال অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ কোন সন্দেহ কুরআনে নেই, তবে কোন প্রকার অপূর্ণাঙ্গ সন্দেহ থাকতে পারে। তাহলে মীর্জায়ী উম্মত কি এটা গ্রহণ করবেন ?

নবুওয়াতের দাবীদারদের কাছে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে যে, হাদিস لا ايمان لمن لا امانة له এবং অন্যান্য হাদিসে যদি نفي كمال স্বীকার করে নেওয়া হয়, তাহলে لانبي بعدي এর মধ্যেও نفي كمال হতে হবে কেন ? কোন একটি হাদিসে রূপক হিসেবে نفي كمال উদ্দেশ্য হওয়াতে কি তার কাছে এটা আবশ্যক হয়ে যায় যে, সর্বত্র একই অর্থ চালিয়ে দিতে হবে ? আর যদি এরূপ হয় তাহলে لا اله الا الله এবং لا ريب فيه ও অন্যান্য হাদিসে نفي كمال না হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।

যদি আপনাদের কাছে এমন কোন প্রমাণ বর্তমান থাকে, কার দ্বারা لا اله الا الله এর মধ্যে نفي كمال এর অর্থ নেওয়া নিষেধ করা যেতে পারে, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকেও لانبي بعدي এর মধ্যে نفي كمال এর অর্থ না হওয়া সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করুন।

 

একটি সন্দেহ ও তার উত্তর

মীর্জায়ী অনুসারীগণ নতুন নবুওয়াত লাভের বাসনায় হাদিস لانبي بعدي এর অর্থ পরিবর্তনের জন্য কোন কৌশল বা চেষ্টার ত্রুটি করেনি। এজন্য যে কোন দুর্বলতম ও ক্ষুদ্র যুক্তিরও অবতারণা করেছে। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, لانبي بعدي এরূপ মনে করা উচিত যেমন হাদিসে আছেঃ

"পারস্য সম্রাট কিসরা ধ্বংস হয়ে গেলে তারপর কোন কিসরা হবে না, আর রোম সম্রাট কায়সার ধ্বংস হয়ে গেলে তারপর কোন কায়সার হবে না।"

যেহেতু কিসরা ও কায়সার কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম নয়, বরং কিসরা পারস্য সাম্রাজ্যের সকল সম্রাটের উপাধি। এটিও প্রকাশ থাকে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ থেকে অদ্যবধি পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যে বাদশাহ উপাধি চলে আসছে। অন্যভাবে এটা বলা যায় যে, কিসরা ও কায়সার সর্বদা বিদ্যমান আছে। তাই এটা বলা যায় যে, এ হাদিসে এর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা হয়নি, বরং হাদিসের অর্থ হলো, যদিও কায়সার ও কিসরার ক্রমধারা অব্যাহত থাকবে, কিন্তু তা ইসলামের অধীন হয়ে থাকবে। তাদের স্বাধীন সাম্রাজ্য বাকি থাকবে না। এভাবে لا نبي بعدي হাদিসটিকে বুঝতে হবে। অর্থাৎ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর স্বাধীন বা পৃথক ও শরীআতপ্রাপ্ত নবী হবে না, বরং যিনি নবী হবেন তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারী এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীআতের অধীন হবেন।

কিন্তু একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে যদি বিষয়টি বিবেচনা করা হয়, তাহলে মীর্জায়ীদের যুক্তির প্রকৃত রূপ এবং এর অসৎ উদ্দেশ্যের স্বরূপ উদঘাটিত হয়ে পড়বে। নিজেরাই তারা আপন মনে ধরে নিয়েছে যে, কিসরা ও কায়সার এখনো বর্তমান আছে এবং নিজেরাই কিসরার একটি হাদিসের বিকৃত অর্থ তৈরি করেছে। এরপর ইসলামের অনুসারীদেরকে আহবান করতে শুরু করেছে যে, তারা এই বিকৃতি (تحريف) কে অন্য সমস্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় গ্রহণ করে নিয়েছে এবং সবগুলোকে একত্র করে একই রূপদান করেছে।

এটা শুধু ধোঁকা এবং সম্পূর্ণ ভুল তথ্য হিসেবে পরিবেশন করা হয়েছে। কিসরা ও কায়সার এখন আর বিদ্যমান নেই। ইমাম নববী মুসলিম শরীফের শরাহ গ্রন্থে এ হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ ইমাম শাফেঈ আর অন্য সমস্ত উলামায়ে কিরাম বলেছেন, হাদিসের অর্থ হলো, ইরাকে কিসরা ও সিরিয়ায় কায়সার বাকি থাকবে না। যার সারমর্ম ছিলো এই যে, ঐ দুটি দেশে তাদের সাম্রাজ্য অবশিষ্ট থাকবে না। বাস্তবে তাই ঘটেছে। কিসরা আর তাদের আদর্শ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন ও ধ্বংস হয়ে গেছে। কায়সার সিরিয়া রাজ্য ত্যাগ করে গেছে। মোটকথা, ঐ দুটি কিসরা ও কায়সার অবশিষ্ট রইলো না।

তাই এটা বলা ভুল হবে যে, কিসরা সংক্রান্ত হাদিসটি (لاكسري) তার বাহ্যিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। এরপর لانبي بعدي হাদিসটির অনুরূপ অর্থ করা নিতান্তই উদ্দেশ্যমূলক।

হ্যাঁ, এখানে মীর্জায়ী ইজতিহাদের আর একটি অদ্ভুত লক্ষণীয় বিষয় হলো, যদি কিছু সময়ের জন্য এটা ধরে নেওয়া হয় যে, কোন কারণে হাদিস لاكسري এর বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। হাদিস لانبي بعدي কে টেনে নিয়ে উক্ত হাদিসের মতো করতে হবে। কোন কারণে কোন এক হাদিস কোন রূপক অর্থে ব্যবহৃত হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীআতের অপর কোন হাদিসে তার প্রকৃত (حقيقي) অর্থ গ্রহণ করতে কি বাঁধা থাকতে পারে ?

 

একটি কৌতুক

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এই উম্মতের মধ্যে মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীদার আগমন করবে এবং হাদিস لانبي بعدي যেহেতু তাদের উদ্দেশ্য সফলের পথে বিরাট বাধা, তাই এর অর্থে বিকৃতি সাধন করে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য পূরণ করতে চেস্টিত হয়েছে।

এক ব্যক্তি নিজের নাম "লা" (لا) রেখে নবুওয়াতের দাবীদার হয়ে এই হাদিসকে স্বীয় নবুওয়াতের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে আর বলে যে, হাদিসের প্রকৃত বাক্য ছিলো لانبي بعدي এখানে لا হলো مبتدا (উদ্দেশ্য) এবং نبي হলো خبر (বিধেয়)। এ নিয়মানুযায়ী হাদিসের অর্থ হলো, আমার পর لا নামক ব্যক্তি হবে। (ফাতহুল বারী)

পাশ্চাত্যের এক মহিলার এমনই মতিভ্রম হলো যে, সে নবুওয়াতের দাবী করে বসলো। লোকেরা তার নবুওয়াতের দাবীর বিপরীত হাদিস لانبي بعدي পেশ করলো। এর উত্তরে ঐ মহিলা বললো, হাদিসে لا نبي بعدي রয়েছে, কিন্তু لا نبية بعدي নেই। অর্থাৎ মহিলাদের নবী হওয়া সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা নেই। (ফাতহুল বারী)

কিন্তু ঐ যুগেও পবিত্রতা ও সংস্কৃতিবোধ বিদ্যমান ছিলো। অন্তরে ঈমানের কিছু অংশ লোকদের মাঝে বিদ্যমান ছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ঈমানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এ অবস্থায় সেখানে ঐ ধরণের لا অর্থাৎ হাদিসের অর্থগত পরিবর্তন গৃহীত হয়নি। মুসলিম উম্মতগণ তাদেরকে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) বলে মনে করতো। ইসলামী দুনিয়ায় তাদের অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয়েছিলো আর তাদের অর্থগত বিকৃতি সাধনের মলিনতা থেকে মুসলিম সমাজকে পবিত্র রেখেছিলো।

 

হাদিস নং ৩

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে মুহাদ্দিস ছিলেন। যদি আমার উম্মতের মধ্যে কোন মুহাদ্দিস থাকেন, তাহলে তিনি উমর।

এ হাদিসের অন্য এক বর্ণনায় রয়েছেঃ তোমাদের পূর্বে বনী ইসরাইলদের মধ্যে নবী হওয়া ছাড়া কিছু লোক مكلم বা প্রচারক ও আহবায়ক হয়েছেন। সুতরাং যদি তাদের মতো আমাদের উম্মতের মধ্যে কেউ হয়, তাহলে তিনি হবেন উমর।

 

মুহাদ্দিস বা মুকাল্লিম কে ?

হাফিয ইবনে হাজার ফাতহুল বারীর ৪র্থ খণ্ডে মুহাদ্দিসের ব্যাখ্যা করে বলেন যে, مكلم আর محدث এর তাফসীরে কয়েকটি বর্ণনা আছে। কোন কোন লোক এর অর্থ ملهم (ইলহামপ্রাপ্ত) করেছেন। অর্থাৎ, যার কাছে আল্লাহ'র পক্ষ থেকে ইলহাম হয়ে থাকে। সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে হাদিসে محدثون এর পরিবর্তে ملهمون শব্দ বর্ণনা করা হয়েছে।

এভাবে মুসনাদে হুমাইদি গ্রন্থে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে একই বিষয়ের একটি হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে। হাদিসটির শেষে الملهم بالصواب (নির্ভুল ইলহামপ্রাপ্ত) উল্লেখ রয়েছে। ইমাম তিরমিযী ইবনে উয়ায়নার কোন কোন ছাত্রের কাছ থেকে محدثون এর ব্যাখ্যায় مفهون শব্দের বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ, যাদেরকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সঠিক পথ ও মতের জ্ঞানদান করা হয়।

বিষয়টি হাদিসের দ্বারাই প্রমাণিত হয়েছে। মুহাদ্দিস বা মুকাল্লিম বলে সেই লোকদের বুঝানো হয়েছে, যারা নবী নন, কিন্তু তাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ বর্ষণ করা হয় আর আল্লাহ'র পক্ষ থেকে তাদের সঠিক পথ ও মত সম্পর্কে বাণী বা নির্দেশনা প্রেরণ করা হয় অথবা সঠিক পথের জ্ঞানদান করা হয়। কিন্তু মুহাদ্দিস কখনোই নবী হতে পারে না।

মূল হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উম্মতের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত করেছেন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে। আর এ উম্মতে কেউ মুহাদ্দিস হলে তিনি হতেন উমর বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তার জন্যও নবুওয়াতের পদ ও মর্যাদা বিবেচনা করেননি। এতে বরং স্পষ্টভাবে নিষেধ রয়েছে। উম্মতের ইজমা অনুযায়ী নবীদের পরেই সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম। খুলাফায়ে রাশেদিন ও তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য যাদের সুন্নাতের অনুসরণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের মতোই উম্মতের জন্য প্রয়োজন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তারাই যখন নবুওয়াতের পদমর্যাদা লাভ করতে পারেননি, তাহলে এদের পর আর কোন ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে এই মর্যাদা লাভ করতে পারবে না।

 

হাদিস নং ৪

সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে সম্বোধন করে বলেছেনঃ তোমার সাথে আমার এরূপ সম্পর্ক, যেমন হারুন ও মুসার সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু আমার পর কোন নবী হতে পারবে না (অর্থাৎ, তুমি হারুনের মতো নবী নও)। (তাবূক যুদ্ধ অধ্যায়ে বুখারী ও মুসলিম এ হাদিস উদ্ধৃত করেছেন)

মুসলিম শরীফের বর্ণনায় অতিরিক্ত আরো কিছু কথা রয়েছেঃ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক জিহাদে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে সাথে না নিয়ে মদিনায় রেখে গিয়েছেন। তাই আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু অভিযোগের সুরে বিনীতভাবে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনি আমাকে মহিলা ও শিশুদের সাথে রেখে গেলেন ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন (সান্ত্বনার সুরে) আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে বললেন, আমার সাথে তোমার যদি সেরূপ সম্পর্ক হয়, যেরূপ হারুন ও মুসার মধ্যে ছিলো, তাহলে কি তুমি সন্তুষ্ট হবে না ? তবে আমার পর কাউকে নবুওয়াত প্রদান করা হবে না।

মুসলিম শরীফের অন্য এক বর্ণনায় রয়েছেঃ তবে তুমি নবী নও।

 

যে সমস্ত লোক لا نبي بعدي এই বাক্যটিকে অর্থগত বিকৃতির লীলাক্ষেত্র বানিয়ে নিয়েছে, তারা উপরিউক্ত আলোচনার উপর দৃষ্টিপাত করলে তাদের সকল মনস্কামনা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

 

হাদিস নং ৫

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে লোকসকল, শুভ স্বপ্ন ছাড়া নবুওয়াতের কোন অংশ অবশিষ্ট নেই। (বুখারী, কিতাবুত তাবীর; মুসলিম)

 

এ হাদিসের সারমর্ম হলো, নবুওয়াত সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং ওহীর ক্রমধারা রহিত করা হয়েছে। তবে নবুওয়াতের অংশের মধ্যে একটি অংশ সুসংবাদপূর্ণ স্বপ্ন অবশিষ্ট রয়েছে।(অর্থাৎ, মুসলমানগণ যে সত্য স্বপ্ন দেখে, এটাও নবুওয়াতের অংশগুলোর মধ্যে গণ্য)।

 

হাদিস নং ৬

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসের এক অংশে বর্ণনা করা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন যখন সমস্ত লোক ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে গমন করে শাফাআতের জন্য অনুরোধ করবে, তখন তিনি বলবেন, তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে মুহাম্মাদের(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে যাও। লোকেরা আমার কাছে আসবে এবং বলবে - হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনি আল্লাহ'র রাসুল ও সর্বশেষ নবী। (বুখারী, মুসলিম)

 

ফুটনোটঃ

(১) কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ কারো কাছে এটি হতে পারে না যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আকৃতি ও দৈহিক অবস্থার উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে, বরং একজন নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ তার বর্ণিত বাণী কোন সন্দেহ ছাড়া মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।

(২) এর অর্থ হলো এই যে, যদি তারা যুলম করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে শাস্তি দিবেন, কিন্তু তোমরা স্বীয় আনুগত্য প্রকাশে কম করবে না।

 

মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহিমাহুল্লাহ তার "খতমে নবুওয়াত" কিতাবে খতমে নবুওয়াতের প্রমাণে যে ২১০ টি হাদিস উল্লেখ করেছেন, এখানে তার কয়েকটিমাত্র হাদিস উল্লেখ করা হলো। বিস্তারিত জানার জন্য বইটি পড়তে পারেন।

 

ইন শা আল্লাহ, পরবর্তী পার্টে আসছেঃ ইজমার দৃষ্টিতে খতমে নবুওয়াত

 

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-5w

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী মতবাদ – ৭

 

 

The Greatest Nation·Tuesday, April 9, 2019

 

 

 

 

ইজমার দৃষ্টিতে খতমে নবুওয়াত

 

ইজমার মূলতত্ত্ব ও এর মর্যাদা

আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বদৌলতে আমাদের উপর আল্লাহ তাআলা যে অসংখ্য নিয়ামত ও মর্যাদা দান করেছেন, ইজমায়ে উম্মত তার মধ্যে একটি বিশেষ দিক। তার মূলতত্ত্ব হলো, যদি এই উম্মতের মুজতাহিদগণ কোন দ্বীনী বিষয়ে একই নির্দেশের উপর ঐকমত্য পোষণ করেন, তাহলে এই নির্দেশটিও কুরআন-হাদিসের স্পষ্ট নির্দেশাবলীর মতোই পালন ও অনুসরণ ওয়াজিব হয়ে যায়। এর যথার্থতা অন্য কথায় এভাবে বলা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত যখন নবুওয়াত সমাপ্ত করা হয়েছে, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর এমন কোন নিষ্কলঙ্ক বা নিস্পাপ ব্যক্তি নেই, যার নির্দেশকে নির্ভুল এবং আল্লাহ তাআলার সঠিক নির্দেশের ব্যাখ্যাকারী বলা যাবে। আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহামাদীর ঐক্যবদ্ধ হওয়াকে একজন নিস্পাপ নবীর মর্যাদা প্রদান করেছেন। সুতরাং উম্মতে মুহাম্মাদী যখন কোন বস্তু বা বিষয়ের ভালো অথবা মন্দের ব্যাপারে একমত হবেন, তখন নিঃসন্দেহে মনে করতে হবে যে, এ কাজটি আল্লাহ তাআলার কাছেও ঠিক তাই, যে বিষয়ে তারা ঐকমত্য পোষণ করেছেন।

এ বিষয়টি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বাক্যের দ্বারা ঘোষণা করেছেন (যার অনুবাদ) -

"আমার উম্মতগণ কখনো ভ্রান্ত মতবাদের উপর ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না।"

তাই উসূলের কিতাবে এর দলীল ও প্রমাণ এবং এর শর্তসমূহও বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়ে থাকে। শরীয়াতের বিধানসমূহের দলীল হিসেবে কুরআন ও হাদিসের পর তৃতীয় পর্যায়ে ইজমাকে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে শরীআতের দলীল হিসেবে ইজমার সংযোজন এবং এই উম্মতের জন্য তা নির্দিষ্ট হওয়া খতমে নবুওয়াতের আলোচনায় আমাদের সুস্পষ্ট দলীল। "তাওজীহ" নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছেঃ

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের মুজতাহিদগণ যদি কোন যুগে কোন বিষয়ে একমত হয়ে যান, তাহলে তা পালন করা ওয়াজিব। এই ওয়াজিব হওয়াটা এই উম্মতের বৈশিষ্ট্যরূপে গণ্য। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সর্বশেষ নবী এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কারো প্রতি ওহী নাযিল হবে না। এদিকে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন, "আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছি", তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, স্পষ্ট ওহীর মাধ্যমে যেসব হুকুম আহকাম প্রমাণিত হয়েছে, তা দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। এ পর্যায়ের সমস্ত ঘটনার বিধান যখন স্পষ্ট ওহীর মাধ্যমে জানা সম্ভব নয় এবং শরীআতে এ সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে কোন আহকাম না থাকে, তাহলে দ্বীন পূর্ণাঙ্গ থাকে না। তাই এ উম্মতের লোকদের ইজতিহাদের মাধ্যমে ওহীভিত্তিক যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিধান জানার অধিকার রয়েছে। (তাওহীদ, মিসরী, ১খ. পৃ.৪৯)

মোটকথা, কুরআন ও হাদিস থেকে যেভাবে শরীআতের আহকাম জানতে পারা যায়, তেমনিভাবে কুরআন ও হাদিসের বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞদের ঐকমত্যের (ইজমার) সাহায্যে শরীআতের আহকাম অবশ্যই জানা যেতে পারে।

অবশ্য এতে কয়েকটি স্তর রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বেশী নিশ্চিত হলো সাহাবায়ে কিরামের ইজমা। এ সম্পর্কে উলামায়ে উসূলের ঐক্যবদ্ধ মত হলো, যদি কোন বিষয়ে সমস্ত সাহাবা ঐকমত্য পোষণ করেন, তাহলে তা কুরআন মাজীদের আয়াতের মতোই অকাট্য বলে গণ্য হবে।

ব্যক্তিগতভাবে কোন সাহাবী কোন বিষয়ে কোন মত পোষণ ও প্রকাশ করলে অন্যান্য সাহাবী তা খণ্ডন না করে চুপ থাকলে তাও ইজমায়ে সাহাবার অন্তর্ভুক্ত। এভাবে যে হুকুম কার্যকর হয়, তা অকাট্য, মুতাওয়াতির হাদিস দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের মতোই অবশ্য পালনীয়।

গভীরভাবে বিবেচনা করা হলে প্রতীয়মান হয় যে, শরীআতের অন্য সমস্ত দলীলের তুলনায় ইজমা অধিকতর ফলপ্রসূ। কোন কোন দিক দিয়ে শরীআতের সমস্ত দলীল হতেও নগণ্য। কেননা কুরআন ও হাদিসের উদ্দেশ্য ও অর্থ নির্ধারণে বিভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু ইজমা তো ঐকমত্যের ফলশ্রুতি। এতে মতপার্থক্যের অবকাশ নেই। তাই হাফিয আল্লামা ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ

"ইজমায়ে সাহাবা অকাট্য দলীল হিসেবে গণ্য। তা অনুসরণ করা ফরয, বরং তা শরীআতের জন্য সমস্ত দলীল থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রগণ্য। এ গুরুত্ব শুধু উপরিউক্ত বিষয় আলোচনার জন্যই নয়, উসূলের কিতাবসমূহে এ বিষয়টি আলিমগণের মতৈক্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত ও কার্যকর। এতে ফিকহবিদগণ ও প্রকৃত মুসলমানদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই।" (ইকামাতুদ দলীল, ৩খ., পৃ. ১৩০)

এরপর আমরা আমাদের আসল উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এ পর্যায়ে অত্যন্ত শক্তিশালী ও সঠিক বর্ণনা উপস্থাপন করতে চেষ্টা করবো।

সাহাবায়ে কিরামের সর্বপ্রথম এ বিষয়ের উপর ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো যে, নবুওয়াত খতম এবং তা অস্বীকারকারী মুরতাদ। এ মুরতাদের শাস্তি প্রাণদণ্ড।

 

মুসায়লামা কাযযাবের নবুওয়াতের দাবী এবং তার বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কিরামের জিহাদ

ইসলামের ইতিহাসে এ বিষয়টি মুতাওয়াতির হাদিস পর্যায়ে গণ্য। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় মিথ্যাবাদী মুসায়লামা নবুওয়াতের দাবী করে। বিরাট সংখ্যক লোক তার অনুসারী হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় খিলাফতকালে সর্বপ্রথম এই লোকদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ করেছিলেন। অধিকাংশ সাহাবা, মুহাজির ও আনসার নবুওয়াতের দাবীর কারণে তাকে এবং তাকে বিশ্বাস করার কারণে তার দলকে কাফির মনে করতেন। সাহাবা ও তাবিঈগণের ইজমা অনুযায়ী তাদের সাথে কাফির তুল্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইসলামে এটাই সর্বপ্রথম ইজমা। অথচ মুসায়লামা কাযযাব মীর্জা কাদিয়ানীর মতো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত ও কুরআন অস্বীকারকারী ছিলো না, বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের সাথে সাথে স্বীয় নবুওয়াতের দাবীদারও ছিলো। এমনকি তার আযানে সর্বদা "আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ" বলা হতো এবং সে নিজেও আযানের সময় এই সাক্ষ্য প্রদান করতো। তারিখে তাবারীতে বর্ণিত আছেঃ

"(তারা) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য আযান প্রদান করতো এবং আযানে এ সাক্ষী প্রদান করতো যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন আল্লাহ'র রাসুল। এর মুওয়াযযিন ছিল আবদুল্লাহ ইবনে নাওয়াহা এবং ইকামাত বলতো হুজায়র ইবনে উমায়র। হুজায়র যখন আযানে শাহাদাত বাক্য পর্যন্ত পৌঁছত, তখন মুসায়লামা উচ্চৈঃস্বরে বলতো হুজায়র স্পষ্ট কথা বলেছে এবং নিজেও এর সত্যতা ঘোষণা করতো।" (তারিখে তাবারী, ৩খ. পৃ. ২৪৪)

মোটকথা, নবুওয়াত ও কুরআনের প্রতি বিশ্বাস এবং নামায-রোযা সবকিছুই ছিলো কিন্তু খতমে নবুওয়াতের মতো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তটি অস্বীকার করতো। নবুওয়াতের দাবীদার হওয়ার কারণে সাহাবাদের ইজমা অনুযায়ী তাকে কাফির বলে গণ্য করা হয়েছে। তাই আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু সাহাবায়ে কিরাম, মুহাজির ও আনসার এবং তাবিঈগণের এক বিরাট বাহিনী খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র নেতৃত্বে মুসায়লামার বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য ইয়ামামার দিকে প্রেরণ করেন।

সাহাবাদের মধ্যে কেউ এর বিপরীত মত পোষণ করেননি। তাকে কেউই আহলে কিবলা, কালেমা উচ্চারণকারী, কুরআন পাঠকারী ও নামায-রোযা-হাজ্জ ও যাকাত না আদায়কারী বলে চিহ্নিত করেননি। এতদসত্ত্বেও তাকে কাফির বলা যায় কিরূপে ? প্রথমত, ফারুকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহু বিপরীত মত প্রকাশ করেন। পরে প্রকৃত ব্যাখ্যা বুঝতে পেরে সিদ্দীকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সাথে একমত হোন। এ বিষয়ে যে বর্ণনা বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে উল্লিখিত রয়েছে, তা এ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তা যাকাত প্রদান অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ সম্পর্কিত ছিলো।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন লোক যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করলে সিদ্দীকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার সংকল্প করেন। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু দুঃসময় এবং মুসলমানদের স্বল্পতা ও দুর্বলতার কারণ উল্লেখ করে তার মতের বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সাথে কিছু কথাবার্তা বলার পরই সম্পূর্ণ ঐকমত্য পোষণ করেন।

এই আসমানী নবুওয়াতের নির্ভীক তারকারাজি এবং আল্লাহ'র দলের এক বিরাট বাহিনী ইয়ামামার দিকে অগ্রসর হয়। তাদের মোট সংখ্যা কতো, তা জানা যায়নি। তবে তারিখে তাবারীতে খালিদ ১ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র নামে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র একটি নির্দেশ উল্লিখিত রয়েছে। যে সমস্ত সাহাবা ও তাবিঈ উক্ত জিহাদে শাহাদাত বরণ করেছেন, তাদের সংখ্যা ছিলো এক হাজার দুশো। এ গ্রন্থেই এটাও উল্লেখ রয়েছে যে, ঐ সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মুসায়লামার দলে চল্লিশ হাজার অস্ত্রধারী বীর যোদ্ধা ছিলো। এদের মধ্যে প্রায় আট হাজার নিহত হয় এবং মুসায়লামা নিজেও নিহতদের তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। অবশিষ্ট লোকজন অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রচুর গনিমতের মাল লাভ করেন এবং অনেককে গ্রেফতার করেন। অবশেষে সন্ধি হয়ে যায়।

এই বিবরণ থেকে জিহাদে শরীক সাহাবীদের সংখ্যা অনুমান করা যায়। খতমে নবুওয়াতের একটি বিষয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অমান্য করার কারণে কেউ দুঃসময়ের চিন্তা না করেও , মুসলমানদের অস্ত্রের স্বল্পতার কথা না ভেবেই তারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। খতমে নবুওয়াত অমান্যকারীদের আযান, নামায ও তিলাওয়াত এবং সমস্ত ইসলামী আইন-বিধান পালনের কোন গুরুত্বই স্বীকৃত হয়নি এবং এই বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ করার উদ্দেশ্যে সর্বসম্মতি ও ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে একবিন্দু দ্বিধাবোধ করা হয়নি।

 

ফলাফল

(১) এই ঘটনায় মুসায়লামা কাযযাবের দাবীর পক্ষে দলীল ও তার অবস্থার পর্যবেক্ষণ ছাড়াই সমস্ত সাহাবী তাকে মিথ্যাবাদী মনে করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য তৈরি হয়েছেন। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, সাহাবায়ে কিরামের কাছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের পর কোন ব্যক্তির নবুওয়াতের দাবী করার সমর্থনে কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা কোন পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তার একমাত্র কারণ এই ছিলো যে, সমস্ত সাহাবাই সর্বসম্মতভাবে তাকে কাফিররূপে চিহ্নিত করেছেন। ইজমার ফলেই তা সম্ভব হয়েছিলো।

(২) এর দ্বারা খুব সহজেই এটা প্রতীয়মান হয় যে, মীর্জা কাদিয়ানী ও তার অনুসারী স্বীয় নবুওয়াতের দাবীতে শরীআতবিহীন, অস্থায়ী, ছায়ানবী বা ছায়াবিহীন, শাব্দিক বা আংশিক প্রভৃতি অর্থহীন বাক্যের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সেইসাথে খতমে নবুওয়াতের বিষয়টিকে পরিবর্তন করে অর্থহীন এক শব্দ বানিয়ে ফেলেছে। এসবের মাধ্যমে মুসলমানদের চোখ, বুদ্ধি ও জ্ঞানের উপর আবরণ চাপিয়ে দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। তাদের এই চাতুর্য ও মূল বিষয়টির রদবদল তাদেরকে কুফরী থেকে রক্ষা করতে পারেনি। যেমন সাহাবাগণের ইজমা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে মুসায়লামা ও তার দলের ব্যাখ্যা কোন গুরুত্ব পায়নি, বরং নবুওয়াতের সাধারণ দাবীকে কুফর মনে করা হয়েছে।

(৩) এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি ইসলামের সমস্ত ফরয ও আহকাম বিশ্বাসের সাথে গ্রহণ করে এবং খাঁটিভাবে এগুলোর উপর আমল করে, কিন্তু শরীআতের আহকামের মধ্যে একটি হুকুম (যদি এর শরীআতের হকুম হওয়া অকাট্য হয়) অস্বীকার করে, তাহলে তা সুস্পষ্ট কুফরীরূপেই চিহ্নিত হবে এবং তা গোটা শরীআতকেই অস্বীকার করার মতো গণ্য হবে। যেমন করে মুসায়লামা ও তার দলের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, তাদের নামায-রোযা ইত্যাদি আদায় করা সত্ত্বেও তাদেরকে কাফিরই মনে করা হয়েছে।

মীর্জায়ী দল তাদের কার্যকলাপ নিয়ে গৌরব করে। তারা নাকি ইসলাম প্রচার করছে। কিন্তু মুসায়লামার ঘটনার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাদের তাবলীগ যদি প্রকৃত ও সঠিক ইসলামের তাবলীগও হতো, তবুও ঈমানের ক্ষেত্রে এই কুফরী তাদের ধ্বংসকে কিছুমাত্র ঠেকাতে পারতো না।

(৪) এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির অনুগত ও অনুসারীদের সংখ্যাধিক্য তার সত্যতার প্রমাণ হতে পারে না। মুসায়লামা কাযযাবের অনুসারীর সংখ্যাধিক্য, জাঁকজমক ও শক্তিই প্রথমত তাদের সত্যতার দলীল হতো। কেননা তার সমর্থক চল্লিশ হাজার বীর যোদ্ধার অবস্থিতি যে তাদের পিছনে আরো অসংখ্য নরনারী ও আবাল-বৃদ্ধের অবস্থিতির জ্বলন্ত প্রমাণ কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা মুসলমানদের হাতে মৃত্যুদণ্ড এড়াতে পারেনি।

আশ্চর্যের বিষয়, আজ মীর্জা কাদিয়ানী তার একটি সাধারণ জনগোষ্ঠীর উপর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বকে শুধু গৌরবের বিষয়ই নয়, বরং তার সত্যতার এক বিরাট দলীল বলে ঘোষণা করে। অথচ মীর্জায়ী দলের সংখ্যা অদ্যাবধি মুসায়লামার অনুসারীদের সংখ্যার সাথে তুল্য হওয়ার কাছাকাছিও পৌছতে পারেনি।

(৫) সাহাবায়ে কিরামের উল্লিখিত ইজমার দরুন প্রমাণিত হয়েছে যে, উম্মতে মুহাম্মাদী থেকে যে দল অন্য কোন নবুওয়াতের দাবীদারের আনুগত্য প্রকাশ করবে, তারা ইসলাম ও মুসলমানদের থেকে বহিষ্কৃত বলে গণ্য হবে। ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু, ইয়াহুদী, নাসারা ও মুশরিকদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় তাদেরকে মুসলমানদের মধ্যে গণ্য করা হবে না। এমনকি মুসলমান যতো দুর্বলই হোক, বাহ্যিক সাজ-সরঞ্জামহীন হোক, সে লোকদেরকে মুসলমানরূপে কখনোই গণ্য করা হবে না এবং তাদের সাহায্য-সহযোগিতাও গ্রহণ করা হবে না।

মুসায়লামার বিরুদ্ধে যখন জিহাদ করা হয়, তখন মুসলিম সম্প্রদায় ছিলো অত্যন্ত অসহায় ও আসবাবপত্রবিহীন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকাল করেছেন, এদিকে বাইরের শত্রু ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও মুশরিক, যারা সর্বদা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো এবং মুসলমানদের ধ্বংস করার স্বপ্ন দেখছিলো। এদিকে মুসলমানদের অনেক গোত্র ও দল মদিনার বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মত্যাগী হয়ে তাদের সাথে একত্রিত হয়ে গিয়েছিলো। একদিকে মুসায়লামার ফিতনা প্রচণ্ড ঝড়ের রূপ ধারণ করছে এবং চতুর্দিকে পারস্পারিক মতভেদের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। ইসলামের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ কঠিন দুশ্চিন্তায় নিপতিত হলেন। এ সময় যদি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন অবিশ্বাসী ও বিপথগামী রাজনীতিবিদদের পরামর্শ গ্রহণ করা হতো, তাহলে তারা এটা ফরয বলে পরামর্শ দিতো যে, মুসায়লামা কাযযাব ও তার দল একদিক দিয়ে মুসলমানদের অতি কাছে এবং অধিকাংশ ইসলামী আহকাম ও আকাইদ গ্রহণ করেছে বলে তাদেরকে নিজেদের সঙ্গী হিসেবে গ্রহণের ও অন্য বিরোধীদের প্রতিহত করা হোক। কিন্তু সেখানে তখন আল্লাহ'র রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিলো। তাই সিদ্দীকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু আর অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরাম তাদের কারো কথার গুরুত্ব দেননি, বরং সর্বপ্রথম সেই মুরতাদের (ধর্মত্যাগী) বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন। কেননা তারা এই রহস্যকে ভালোভাবে জানতেন যে, মুসলমানদের সম্মান এবং জয় ও পরাজয় তাদের লোকসংখ্যার আধিক্যের উপর নির্ভরশীল নয়। তিনি বদর যুদ্ধে একটি অস্ত্রহীন ক্ষুদ্র ও দুর্বল দলকে সহস্র যুবকের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত দলের উপর বিজয় প্রদান করেছেন এবং হুনায়নের যুদ্ধে সংখ্যাধিক্য ও সর্বপ্রকার শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরাজিত করে দেন। তিনি (আল্লাহ) ভালোভাবে জানেন যে, মুসলমান যদি সত্যিকার মুসলমান হয়, তাহলে স্বল্প সংখ্যকই অধিক সংখ্যকের কাজ করতে সমর্থ হতে পারে।

মোটকথা এই ঘটনার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, কোন রাজনৈতিক পরিণামদর্শিতার কারণে মুসলমানদের উপলব্ধিকে খর্ব করা যায় না। কোন দুর্বল মুহূর্তেও কাফির লোকেরা তাদের দলে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ পেতে পারে না।

 

নবুওয়াতের অন্যান্য দাবীদারদের সাথে পূর্ববর্তী আচরণ সম্পর্কে জানতে পড়ুনঃ https://bit.ly/2MVyj9C

মোটকথা, মুসায়লামা কাযযাব ও তার মতো অন্যান্যের এই ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করে এবং নবুওয়াতের দাবীর তাৎপর্য অনুভব করে সাহাবায়ে কিরামের কোন মুজিযা খোঁজ করা ব্যাতীত তাদেরকে মিথ্যাবাদী (কাযযাব) ও দাজ্জাল এবং মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) ঘোষণা করা ও হত্যা করা এবং এক-একজন সাহাবী বা তাবিঈর পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ না হওয়া অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন প্রকার নবী আগমন না করা সম্পর্কে ইজমা সংঘটিত হয়েছে। এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্যেরই উল্লেখ করা যেতে পারে না। যে ব্যক্তি এরূপ দাবী করবে, সে আর তার সকল অনুগামী মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী।

 

কাযী ইয়াজ স্বীয় "শিফা" নামক গ্রন্থে উক্ত ইজমার ব্যাখ্যা করে বলেনঃ কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন সর্বশেষ নবী এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী হবে না। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেও সংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন নবীদের সমাপ্তকারী এবং এর উপর উম্মতের ইজমা রয়েছে। এই বাক্যটি সম্পূর্ণ স্বীয় বাহ্যিক অর্থের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকাশ্য বাক্যের দ্বারা এর যে অর্থ বুঝা যায়, কোন ব্যাখ্যা ছাড়া এটাই তার প্রকৃত অর্থ। সুতরাং যারা তা অস্বীকার করবে, তাদের কাফির হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এটা অকাট্য ও ইজমায়ী আকিদা।

সাইয়্যেদ মাহমুদ আলূসী তার তাফসীরে উক্ত ইজমার ব্যাখ্যা করে লিখেছেনঃ এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ নবী হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ'র কিতাব স্পষ্টভাষী। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত তা উদঘাটিত ও প্রতিভাত করেছে এবং গোটা মুসলিম উম্মাহ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। অতঃপর নবুওয়াতের দাবী এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতরাং নবুওয়াতের দাবিকারী কাফির। যদি সে তাওবা না করে, তাহলে তাকে হত্যা করতে হবে। (রুহুল মাআনী, ৭খ.)

ইবনে হাজার মাক্কী স্বীয় "ফাতাওয়া" নামক গ্রন্থে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন ব্যক্তি কোন ওহীর উপর বিশ্বাসী হলে সে সমস্ত মুসলমানের ইজমা অনুযায়ী কাফির।

মোল্লা আলী কারী "শরহে ফিকহে আকবর" নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ এবং আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর নবুওয়াতের দাবী করা সর্বসম্মতভাবে কুফরী।

 

ফুটনোটঃ

(১) খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন মুসায়লামা কাযযাবকে হত্যা করে ইয়ামামার বাসিন্দাদের উপর বিজয় লাভ করলেন, তখন মুসায়লামার সঙ্গীদের এক ব্যক্তি মাজামাহ নামক এক মেয়েকে বিয়ে করে। আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন এ খবর জানতে পারলেন তখন তার নামে নিন্মলিখিত নিন্দাসূচক পত্র প্রেরণ করেনঃ

فانك فار غ تنكه النساء بفناء بيتك دم الف ومانتي رجال من المسلمين لم يجفف بعد -

(تاريخ طبري - ص ٢٥٤_٢٢)

 

(কিছুটা সংক্ষেপিত)

 

খতমে নবুওয়াত নিয়ে সিরিজ আর্টিকেল এখানেই শেষ করা হলো। পুরো সিরিজটি মূলত মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহিমাহুল্লাহ রচিত "খতমে নবুওয়াত" এর অনুবাদগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে, যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ অনুবাদ করেছে। খতমে নবুওয়াত সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে এ বইটি পড়তে পারেন।

 

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-5y

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

The Greatest Nation

 

Notes

05

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাদিসের ব্যাখ্যা সিরিজ – ১

 

 

 

The Greatest Nation·Saturday, February 2, 2019

 

 

 

হাদিসের অনুবাদঃ

উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বলতে শুনেছি -

"মানুষের সকল কর্মকাণ্ড নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল। মানুষ তার নিয়্যত অনুসারেই ফলাফল লাভ করে।

তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিকে হিজরত করে (আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তুষ্টি বিধান ছাড়া এর পিছনে অন্য কোন কার্যকারণ থাকে না), তার হিজরত যথার্থই আল্লাহ ও তার রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিকেই হয়। (নিঃসন্দেহে সে আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি হিজরতকারী হিসেবে পরিগণিত হয় এবং এ হিজরতের নির্ধারিত পুণ্য ও বিনিময় সে লাভ করবে)।

অপর দিকে যে ব্যক্তি পার্থিব কোন স্বার্থসিদ্ধি অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার জন্য হিজরত করে, (তার হিজরত আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্যে পরিগণিত হবে না, বরং) সে বাস্তবে যে উদ্দেশ্যে হিজরত করলো, আল্লাহ'র নিকট তার এ হিজরত সে উদ্দেশ্যেই ধরা হবে।" (বুখারী, মুসলিম)

 

হাদিসটির বিশেষ গুরুত্ব

ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাঁচ লক্ষ হাদিস লিখেছি, তার মধ্য থেকে চার হাজার আটশো হাদিস নির্বাচন করে আমার সুনানে আবু দাউদে উল্লেখ করেছি, এ চার হাজার থেকে শুধু এরূপ চারটি হাদিস নির্বাচিত করেছি, যার মানুষের দ্বীনদার হওয়ার জন্য যথেষ্ট -

(১) নিয়্যত অনুযায়ী আমলের প্রতিদান দেওয়া হবে

(২) অনর্থক কাজ ও কথা পরিত্যাগ করাই ইসলামের সৌন্দর্য

(৩) কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের ভাইয়ের জন্য তাই ভালবাসবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে।

(৪) হালাল স্পষ্ট বা পরিষ্কার এবং হারামও স্পষ্ট, এর মাঝে রয়েছে সন্দেহজনক বস্তু। তাই যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বস্তু থেকে বেঁচে থাকলো সে নিজের দ্বীন ও সম্মানকে মুক্ত ও নির্ভেজাল রাখলো।

শাহ আবদুল আযীয রাহিমাহুল্লাহ এর ব্যাখ্যা করেছেনঃ প্রথম হাদিস ইবাদাত সহীহ করার জন্য যথেষ্ট, দ্বিতীয় হাদিস মূল্যবান সময় নষ্ট করা থেকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট, তৃতীয় হাদিস বান্দার হক আদায়ের জন্য যথেষ্ট, আর চতুর্থ হাদিস সংশয়যুক্ত বস্তু থেকে বেঁচে থাকা ও নিরাপদ থাকার জন্য যথেষ্ট।

শায়খ যাকারিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ তার "আওজাযুল মাসালিক" এর ষষ্ঠ খণ্ডে লিখেছেন যে, ইমাম আবু দাউদ রহিমাহুল্লাহ'র নির্বাচিত হাদিসগুলো এর পূর্বে ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ নির্বাচন করেছিলেন, তবে তিনি এ চারটি ছাড়া আর একটি হাদিস নির্বাচন করেছেন, সে মতে সর্বমোট পাঁচটি হাদিস। পঞ্চম হাদিসটি হলো -

"মুসলমান সে ব্যক্তি, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।"

শায়িখুল হাদিস যাকারিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলতেন যে, এ পঞ্চম হাদিসকে ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ সম্ভবত এজন্য নেননি যে, এর বিষয়বস্তু তৃতীয় হাদিসের বিষয়বস্তু ও অর্থ থেকে ফুটে উঠে। (কাশফুল বারী শারহু সহীহিল বুখারী, ১ম খণ্ড)

 

মনযুর নোমানী রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেনঃ এ হাদিসটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অত্যন্ত তত্ত্বপূর্ণ অথচ সংক্ষিপ্ত বাণীসমূহের অন্তর্ভুক্ত। দ্বীনের একটি বিরাট অংশ এই হাদিস নিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। তাই এটিকে "ক্ষুদ্র ঝিনুকের ভিতরে মহাসমুদ্র" বলা যায়। এ জন্যই কোন কোন ইমাম বলেছেন, ইসলামের ইসলামের এক-তৃতীয়াংশ এ হাদিসে এসে গিয়েছে। আর বাস্তবতার নিরিখে বলতে গেলে মহান ইমামদের এই কথায় কোন অতিরঞ্জন নেই, বরং তাদের কথাই যথার্থ। কেননা, মৌলিক দিক থেকে ইসলামের বিভাগ তিনটি - (১) ঈমান তথা আকিদা সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী, (২) আমল এবং (৩) ইখলাস।

যেহেতু এই হাদিস ইখলাসের সম্পূর্ণ বিভাগকে তার অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে, তাই বলা যায় যে, ইসলামের এক-তৃতীয়াংশই এখানে এসে গিয়েছে।

ইখলাস এমন বস্তু যে, প্রত্যেক কাজে আর প্রতিটি পদক্ষেপে এর প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ করে আল্লাহ'র কোন বান্দা যখন কোন শুভ কাজের সূচনা করে, সে কাজটি আমল সংক্রান্তই হোক অথবা গবেষণাধর্মীই হোক, সেখানে সে প্রয়োজন অনুভব করে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণীটি চোখের সামনে থাকুক। এ জন্যই অনেক মনীষীকেই দেখা যায় যে, তারা নিজেদের গ্রন্থসমূহ এই হাদিস দ্বারা শুরু করা খুবই পছন্দ করেছেন। ...... (মাআরিফুল হাদিস, ১ম খণ্ড)

 

হাদিসটির ব্যাখ্যা

নূর মুহাম্মাদ আযমী রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেনঃ "নিয়্যত" শব্দের সাধারণ অর্থ সংকল্প, দৃঢ় সংকল্প। শরীয়তে এর বিশেষ অর্থ -

(১) কোন কাজকে কোন কাজ থেকে পৃথক করা, নির্দিষ্ট করে নেওয়া। এ অর্থেই বলা হয়, "যোহরের নিয়্যত করা" অর্থাৎ যোহরকেই নির্দিষ্ট করে নেওয়া, অপর নামাযকে নয়। "ফরযের নিয়্যত করা", অর্থাৎ ফরযকেই নির্দিষ্ট করা, সুন্নাত বা নফলকে নয়।

(২) কার্য সম্পাদনের সংকল্প করা, যথা - হজ্জের নিয়্যত করা, অর্থাৎ হজ্জ সম্পাদনের সংকল্প করা।

(৩) কোন কার্য সম্পাদনে আল্লাহ'র সন্তুষ্টি বিধানের সংকল্প করা, এবং

(৪) কাজের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য।

এখানে এই শেষোক্ত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

"কাজ নির্ভর করে" - অর্থাৎ, কাজের পুরস্কার (সওয়াব) নির্ভর করে।

"হিজর" - এটির অর্থ ত্যাগ করা, ছিন্ন করা। শরীয়তে এর দুটো অর্থ রয়েছে -

(১) আল্লাহ'র সন্তোষলাভ বা ধর্মের নিরাপত্তার জন্য বাসভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র গমন করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু সাহাবী এ উদ্দেশ্যেই জন্মস্থান মক্কা ত্যাগ করে মদিনা গমন করেছিলেন, তাই তা হিজরত নামে প্রসিদ্ধ।

(২) শরীয়তের নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, মুহাজির সে-ই, যে আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা ত্যাগ করেছে।

"নারীকে বিবাহ করার নিয়্যতে" - এতে একটি বিশেষ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবেরা অনারব ও দাসদেরকে হেয় মনে করতো আর তাদের প্রতি কন্যাদানে বিরত থাকতো। ইসলাম সকলকে সমান করিয়ে দেওয়ায় আরবেরা এটা ত্যাগ করে আর দাস ও অনারবদের প্রতি কন্যাদান আরম্ভ করেন। এটি দেখে কোন কোন অনারব ও দাস আরব মহিলা বিয়ে করার উদ্দেশ্যে মদিনায় হিজরত করে। হাদিসে এর প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটিও কথিত আছে যে, উম্মে কায়েস নামের এক সুন্দরী মহিলাকে বিয়ে করার জন্য এক ব্যক্তি মদিনায় হিজরতও করেছিলো। কিন্তু এর সূত্র বিশ্বস্ত নয়।

 

হাদিসের উদ্দেশ্যঃ

মুসলমানদেরকে নিয়্যতের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়াই হাদিসটির উদ্দেশ্য। শরীয়তে নিয়্যতের গুরুত্ব অত্যধিক। নেক নিয়্যতে কাজ করে বিফল হলেও তার জন্য পুরস্কার রয়েছে। আর বদ নিয়্যতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও সেটার জন্য শাস্তি রয়েছে। নিরপরাধীকে হত্যার চেষ্টা করে অকৃতকার্য হলেও তার জন্য শাস্তি অবধারিত। শুধু নেক নিয়্যত বা নেক সংকল্পেরও একটি পুরস্কার রয়েছে। তাবুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণে অক্ষম কিছু সাহাবীর প্রতি ইঙ্গিত করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের বলেছিলেন - তারা মদিনায় থেকেও সওয়াবে তোমাদের অংশীদার।

আল্লাহ'র কাছে কোন কাজের পুরস্কার পেতে হলে তা একমাত্র আল্লাহ'র উদ্দেশ্যেই করতে হবে, অন্য কারো উদ্দেশ্যে বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে করা কোন কাজের পুরস্কার আল্লাহ'র কাছে পাওয়া যাবে না। এক হাদিসে এটিও রয়েছে যে, এরূপ কাজের পুরস্কার আল্লাহ'র কাছে চাওয়া হলে তিনি বলবেন - যার উদ্দেশ্যে তুমি এই কাজ করেছিলে তারই কাছে এর পুরস্কার তালাশ করো।

পাঠকগণ যেন নিয়্যতের এই গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং বিদ্যার্জন ও অপর সকল কাজই যেন একমাত্র আল্লাহ'র উদ্দেশ্যেই করেন - এ কথার প্রতি সতর্ক করার জন্যই মুহাদ্দিসগণ তাদের কিতাবের শুরুতেই এ হাদিসটি বর্ণনা করে থাকেন।

সকল কাজ আল্লাহ'র উদ্দেশ্যে করার জন্য কুরআন পাকেও তাকীদ রয়েছে। ইহুদী ও খৃষ্টানদের সম্পর্কে বলা হয়েছে -

"তারা শুধু এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছিলো যে, তারা আল্লাহ'র ইবাদাত করবে, দ্বীনকে নিছক আল্লাহ'র উদ্দেশ্যে অকৃত্রিম করে, একনিষ্ঠভাবে আর নামাযের পাবন্দী করে আর যাকার প্রদান করে, আর এটিই সেই (বর্ণিত) সঠিক বিষয়সমূহের পন্থা।" (সূরাহ আল-বায়্যিনাহ, ৯৮ : ৫)

অপর আয়াতে বলা হয়েছে -

"মুনাফিকরা দোযখের সর্বনিন্মস্তরে হবে আর তাদের জন্য আপনি কোন সাহায্যকারী পাবেন না। কিন্তু যারা অনুতাপ করে (আল্লাহ'র দিকে) ফিরে এসেছে আর (নিজেদের জীবনকে) সংশোধন করেছে, আর আল্লাহ'কে আঁকড়িয়ে ধরেছে আর তাদের দ্বীনকে নিছক আল্লাহ'র উদ্দেশ্যে অকৃত্রিম করেছে তারা থাকবে মুমিনদের সাথে ...." (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ১৪৫-১৪৬)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেছেন -

"আপনি বলুনঃ আমার নামায ও আমার কুরবানী, বরং আমার জীবন ও মরণ সমস্তই আল্লাহ রব্বুল আলামীনের উদ্দেশ্যে। তার কোন শরীক নেই, আর আমি এরই জন্য আদিস্ট হয়েছি, আর আমি আল্লাহ'র কাছে আত্মসমর্পণকারীদের প্রথম।" (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১৬২-১৬৩)

এতে বুঝা গেলো যে, মানুষের সমস্ত ধর্ম-কর্ম, বরং গোটা জীবন ও মরণই একমাত্র আল্লাহ'র উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত। নিয়্যতের হাদিস আর এ জাতীয় অন্যান্য হাদিস প্রকৃতপক্ষে এই শ্রেণীর আয়াতসমূহেরই ব্যাখ্যা। (মিশকাত শরীফ, এমদাদিয়া পুস্তকালয়, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেনঃ হাদিসটির যে অনুবাদ করা হয়েছে, এতেই এর মর্ম উদ্ধার হয়ে যায় এবং ভাবার্থ প্রকাশের জন্য এর চাইতে অধিক কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু হাদিসটির বিশেষ গুরুত্বের দাবী এই যে, এর অর্থ ও তাৎপর্যের উপর আরো কিছু লেখা হোক।

হাদিসটির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, উম্মতের উপর এই বাস্তব ও সত্য কথাটি তুলে ধরা যে, মানুষের সকল কর্মকাণ্ডের শুদ্ধাশুদ্ধ এবং এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও অগ্রহণযোগ্যতা নিয়্যতের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ, পুণ্য কাজ বলে কেবল সেটিকেই ধরা হবে এবং আল্লাহ তাআলার কাছে সে কাজেরই মূল্যায়ন হবে, যা ভালো নিয়্যতে করা হবে। আর যে পুণ্য কাজ কোন হীন উদ্দেশ্য ও খারাপ নিয়্যতে করা হবে, সেটা পুণ্য কাজ বলে গণ্য হবে না এবং আল্লাহ'র দরবারে গ্রহণযোগ্যও হবে না; বরং নিয়্যত অনুসারে সেটা অশুদ্ধ ও প্রত্যাখ্যাত হবে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও সেটা পুণ্য কাজই মনে হয়।

সারকথা এই যে, আল্লাহ তাআলা কাজের সাথে নিয়্যতও দেখেন, আর বাহ্যিক অবস্থার সাথে অন্তরের অবস্থারও খবর রাখেন। তাই তার দরবারে প্রত্যেক কাজের মূল্যায়ন আমলকারীর নিয়্যত অনুসারে করা হয়।

 

একটি ভ্রান্তির নিরসনঃ

এখানে কেউ যেন এই ভুল ধারণা না করে যে, কাজের ফলাফল যেহেতু নিয়্যত অনুসারেই হয়ে থাকে, তাহলে কোন মন্দ কাজও ভালো নিয়্যতে করলে সেটা পুণ্য কাজ বলে গণ্য হয়ে যাবে আর এর জন্য সওয়াব পাওয়া যাবে। যেমন, কেউ যদি এই নিয়্যতে চুরি বা ডাকাতি করে যে, এর দ্বারা অর্জিত সম্পদ গরীব-মিসকিনের সাহায্যে ব্যয় করবে, তাহলে সে সওয়াবের অধিকারী হতে পারবে।

আসল কথা এই যে, যে কাজটি আদতেই মন্দ, আর যে কাজ করতে আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন, এমন কাজে ভালো নিয়্যতের প্রশ্নই আসতে পারে না। এগুলো সর্বাবস্থায়ই মন্দ এবং আল্লাহ'র ক্রোধ ডেকে আনে, বরং এমন খারাপ কাজে ভালো নিয়্যতে করা আর সওয়াবের আশা করা অধিক শাস্তির কারণ হতে পারে। কেননা, এটা আল্লাহ'র দ্বীন ও আহকামের সাথে এক ধরণের উপহাসের শামিল।

এখানে হাদিসটির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে নেক আমল সম্পর্কে এ কথাটি বলে দেওয়া যে, নেক কাজও যদি কোন অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়, তাহলে সেটা আর নেক আমল থাকবে না, বরং অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে তার ফল মন্দই হবে।

যেমন, যে ব্যক্তি নামায খুব একাগ্রতা ও বিনয়ের সাথে আদায় করে, যাকে আমরা অত্যন্ত উচ্চ স্তরের নেক আমল মনে করি, সেখানে লোকটি যদি একাগ্রতা ও বিনয়ভাব এজন্য অবলম্বন করে যে, মানুষ এর দ্বারা তার দ্বীনদারী ও খোদাভীতি সম্পর্কে ভালো মনোভাব পোষণ করবে ও তার সম্মান করবে, তাহলে এ হাদিসের দৃষ্টিতে তার এ বিনয়ভরা ও একাগ্রতার নামাযেরও আল্লাহ তাআলার কাছে কোন মূল্য নেই।

অথবা, এক ব্যক্তি কুফরের দেশ থেকে ইসলামী রাষ্ট্রে হিজরত করে যায় এবং হিজরতের সকল কষ্ট-মুসিবত বরণ করে নেয়, কিন্তু এই হিজরতের দ্বারা তার উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলার সন্তোষ অর্জন নয়, বরং এর মধ্যে পার্থিব কোন স্বার্থ ও উদ্দেশ্য লুক্কায়িত থাকে। যেমন, হিজরতের দেশে বসবাসকারী কোন মহিলাকে বিয়ে করার খাহেশ তাকে হিজরতে উদ্বুদ্ধ করলো। এমতাবস্থায় এই হিজরত ইসলামের জন্য হিজরত হবে না, এবং আল্লাহ'র দরবারে সে কোন প্রতিদানও পাবে না, বরং উল্টো সে গুনাহের ভাগী হবে। এটিই হচ্ছে এ হাদিসের মর্ম।

 

বিরাট নেক আমলও ইখলাসশূন্য হলে সেটা জাহান্নামেই নিয়ে যাবেঃ

এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তিকে আল্লাহ'র আদালত থেকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার ফয়সালা দেওয়া হবে।

সবার আগে ঐ ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যে জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছিলো। সে যখন আদালতে হাজির হবে, তখন আল্লাহ তাআলা প্রথমে তাকে নিজের নিয়ামতরাশির কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। সেও এগুলো স্মরণ করে স্বীকার করে নিবে। তারপর তাকে বলা হবে - বলো তো, তুমি এগুলোর কি হক আদায় করেছো আর কি কাজ করে এসেছো ? সে বলবে - হে আল্লাহ, আমি আপনার পথে জিহাদ করেছি আর আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমার জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছি। আল্লাহ তাআলা বলবেন - তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি তো কেবল এই উদ্দেশ্যেই জিহাদ করেছিলে যে, বীর বাহাদুর হিসেবে প্রসিদ্ধ হবে, আর দুনিয়াতে তো তোমার বীরত্বের আলোচনা হয়েই গিয়েছে। এরপর তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

অনুরূপভাবে একজন দ্বীনের আলিম ও কুরআনের আলিমকে আদালতে হাজির করা হবে। তাকেও আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেনঃ তুমি কি আমল করে এসেছো ? সে বলবেঃ আমি আপনার দ্বীন ও আপনার কুরআনের জ্ঞান লাভ করেছিলাম আর তা অন্যকেও শিক্ষা দিয়েছিলাম, এবং এসব আপনার সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই করেছিলাম। আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যাবাদী, তুমি তো নিজেকে আলিম ও ক্বারী হিসেবে প্রকাশ করার জন্য ওসব করেছিলে। এরপর আল্লাহ'র নিদেশে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

তারপর আরেক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যাকে আল্লাহ তাআলা প্রচুর ধন-সম্পদ দান করেছিলেন। তাকেও জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তুমি কি করে এসেছো ? সে বলবেঃ হে আল্লাহ, আমি পুণ্য অর্জনের কোন ক্ষেত্রই অবশিষ্ট রাখিনি, বরং সকল খাতে আপনার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য আমি অর্থ ব্যয় করেছি। আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যাবাদী, তুমি তো কেবল এই উদ্দেশ্যে তোমার সম্পদ ব্যয় করেছিলে যে, দুনিয়ার মানুষ তোমাকে বড় দানশীল বলবে, আর দুনিয়াতে তো তোমার দানশীলতার খুব সুনাম হয়েই গিয়েছে। তারপর তাকেও উপুড় করে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। (মুসলিম)

মোটকথা, আল্লাহ'র কাছে কেবল ঐ আমলই কাজে আসবে, যা বিশুদ্ধ নিয়্যতে অর্থাৎ কেবল আল্লাহ'র সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই করা হয়। দ্বীনের বিশেষ পরিভাষায় একেই ইখলাস বলা হয়।

 

কুরআন মাজিদে মুখলিস ও অমুখলিসের আমলের একটি দৃষ্টান্তঃ

পবিত্র কুরআনের নিন্মের দুটো আয়াতে দান-খয়রাতকারী দুই শ্রেণীর মানুষের আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণীতে রয়েছে ঐসব লোক, যারা লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে নিজেদের সম্পদ কল্যাণখাতে ব্যয় করে থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে রয়েছে ঐ সকল মানুষ, যারা কেবল আল্লাহ'র সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজেদের ধন-সম্পদ দ্বারা গরীব, মিসকিন ও অভাবীদের সাহায্য করে। এ দুই শ্রেণীর মানুষের বাহ্যিক কর্মকান্ডকে দেখতে সম্পূর্ণ একই মনে হয়। মানুষের চোখ এর মধ্যে কোন পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। কিন্তু পবিত্র কুরআন বলে যে, যেহেতু তাদের নিয়্যত ও উদ্দেশ্য ভিন্ন, তাই তাদের আমলের ফলাফলও ভিন্ন হবে। এক শ্রেণীর মানুষের আমল বরকত ও কল্যাণে পরিপূর্ণ, আর অপর শ্রেণীর মানুষের আমল সম্পূর্ণ নিস্ফল ও বিনষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন -

"..... তোমরা ঐ ব্যক্তির মতো নিজেদের দান-খয়রাতকে বিনষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে থাকে, অথচ সে আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে না; তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন যে - একটি মসৃণ পাথরে কিছু মাটি জমে গেলো (এবং এর উপর কিছু সবুজ ঘাস উৎপন্ন হয়ে গেলো), তারপর এর উপর প্রবল বৃষ্টিপাত হলো আর একে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিলো; তাই এ ধরণের রিয়াকার লোকেরা নিজেদের উপার্জিত সম্পদের কোন বিনিময় লাভ করতে পারবে না; আর আল্লাহ এই অকৃতজ্ঞদেরকে হিদায়াত ও এর সুমিষ্ট ফল থেকে বঞ্চিতই রাখবেন।" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ২৬৪)

অপরদিকে মুখলিসদের সম্পর্কে বলা হয়েছে -

"যারা কেবল আল্লাহ'র সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে আর নিজেদের মনকে সুদৃঢ় ও ত্যাগ-তিতীক্ষায় অভ্যস্ত করার জন্য নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহ'র রাহে খরচ করে - তাদের উদাহরণ হচ্ছে টিলায় অবস্থিত সজীব বাগানের মতো, যাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং এর ফলে দ্বিগুণ ফল দান করে ......" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ২৬৫)

এখানে যদিও উভয় ব্যক্তি বাহ্যত একইভাবে নিজেদের ধন-সম্পদ গরীব, মিসকিন ও অভাবীদের জন্য ব্যয় করেছে, কিন্তু একজনের নিয়্যত যেহেতু কেবল লোকদেখানোই ছিলো, তাই মানুষের সামনে তার এই প্রদর্শনী সাময়িক বাহবা কুড়ানো ছাড়া আর কিছুই লাভ হলো না। কেননা, তার এই অর্থব্যয়ের পিছনে এ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্যই ছিলো না। পক্ষান্তরে, দ্বিতীয় ব্যক্তি যেহেতু এ অর্থ ব্যয় ও ত্যাগ দ্বারা কেবল আল্লাহ'র সন্তোষ ও তার অনুগ্রহ কামনা করেছিলো, তাই আল্লাহ তাআলা তাকে তার নিয়্যত অনুযায়ী ফল দান করেছেন।

সারকথা, এটিই হচ্ছে আল্লাহ'র নীতি ও তার বিধান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদিসে এ কথাটিরই ঘোষণা দিয়েছেন।

 

দুনিয়াতে বাহ্যিক অবস্থার উপর সকল ফায়সালা হয়ে থাকে, আখিরাতে নিয়্যতের উপর ফায়সালা হবেঃ

এই জগতে যেখানে আমরা বর্তমানে রয়েছি আর যেখানে আমাদেরকে কাজ করার সুযোগ দিয়ে রাখা হয়েছে, এটাকে "আলমে যাহের" তথা দৃশ্য ও প্রকাশ্য জগত বলা হয়। এখানে আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং সকল বোধ-বুদ্ধির সীমানা ও বাহ্যিক অবস্থা ও বিষয়াবলী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এখানে আমরা কোন ব্যক্তির কোন বাহ্যিক আচার-আচরণ দেখেই তার ব্যাপারে ভালো অথবা মন্দ কোন মন্তব্য করতে পারি এবং এরই ভিত্তিতে তার সাথে আমরা নিজেরাও আচরণ করে থাকি। বাহ্যিক কর্মকাণ্ড ও আচার-আচরণের বাইরে তাদের নিয়্যত, অন্তরের রহস্য ও মনের গোপন অবস্থা উপলব্ধি করতে আমরা অক্ষম। এ জন্যই ফারুকে আযম উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, "আমাদের কাজ হচ্ছে বাহ্যিক অবস্থা দেখে বিচার করা, আর গোপন অবস্থা আল্লাহ'র হাতে ছেড়ে দেওয়া।"

কিন্তু আখিরাতের জগতে বিচারক হবেন আল্লাহ তাআলা, যিনি সকল গোপন বিষয় সম্যক অবগত। তাই সেখানে মানুষের নিয়্যত ও মনের ইচ্ছা বিবেচনায় সকল বিচার ও সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। তাই মনে রাখতে হবে যে, এই জগতে বিধান প্রয়োগের বেলায় যেমন বাহ্যিক আমল ও কর্মই মূল বিষয় এবং কারো নিয়্যতের উপর এখানে বিচার করা যায় না, অনুরূপভাবে আখিরাতে বিষয়টি হবে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা সেখানে বিচার ও ফায়সালা করবেন নিয়্যত দেখে। সেখানে বাহ্যিক আমল ও কর্মকে কেবল নিয়্যতের অনুগামী হিসেবে গণ্য করা হবে। (মাআরিফুল হাদিস, ১ম খণ্ড)

 

আজিজুল হক রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেনঃ মানুষের যাবতীয় কার্যাবলী তিন ভাগে বিভক্ত -

(১) মাসিয়াত, অর্থাৎ মন্দ কাজগুলো,

(২) হাসানাত, অর্থাৎ ভালো ও সৎ কাজসমূহ,

(৩) মুবাহাত, অর্থাৎ মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের কাজসমূহ, যাতে ধরা বাঁধা সওয়াব বা গুনাহ নেই।

যে সব কাজ কুরআন হাদিসে স্পষ্ট ভাষায় গুনাহ বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাকে মাসিয়াত বলা হয়। যথা - ঘুষ নেওয়া, চুরি করা, যিনা করা, জুয়া খেলা, সুদ খাওয়া, শরাব পান করা, আমানতের খিয়ানত করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, নামায না পড়া, যাকাত না দেওয়া, রোযা না রাখা, আল্লাহ'র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বা কুরআন-হাদিসের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা ইত্যাদি সবই পাপ ও মন্দ কাজ।

নিয়্যতের দ্বারা এই শ্রেণীর কাজগুলোকে কিছুতেই ভালো বা সওয়াবের কাজে পরিণত করা সম্ভব না। অধিকন্তু যদি কেউ পাপ কাজ সওয়াবের নিয়্যতে করে তবে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সে আল্লাহ'র নিষিদ্ধ কাজ করে অথচ মুখে বলে যে, আমি এই কাজ করছি আল্লাহ'কে সন্তুষ্ট করার জন্য ! যেমন কেউ নিমের ফল খাচ্ছে আর বলছে - আমি মিষ্টির স্বাদ পাওয়ার জন্য নিমের ফল খাচ্ছি ! এমন ব্যক্তিকে শুধু বোকা না, পাগল বলতে হবে। এ জন্যই শরীয়তের ভাষায় এরূপ ব্যক্তিকে শুধু ফাসেকই নয়, বরং কাফির বলা হবে। কারণ সে প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহ'র সাথে ঠাট্টা করছে।

যে সমস্ত কাজকে শরীয়তে ভালো বা জরুরী বলে ঘোষণা করা হয়েছে, তাকে হাসানাহ বলা হয়। যেমন - নামায পড়া, রোযা রাখা, যাকাত দেওয়া, হজ্জ করা, সত্য কথা বলা, ন্যায় বিচার করা, মেহমানের খিদমত করা, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের উপকার করা, গরিবের সাহায্য করা, মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করা, দায়িত্ব পালন করা, অঙ্গীকার রক্ষা করা, সতীত্ব রক্ষা করা, মুরব্বীকে মান্য করা, ছোটদেরকে স্নেহ করা ইত্যাদি।

হাসানাত বা সৎকার্যাবলী অবশ্য করণীয়, না করলে শাস্তি হবে - এমন অপরিহার্য পর্যায়ের হলে তাকে ফরয বা ওয়াজিব বলে। করার জন্য তাকীদ থাকলে তাকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলা হয় এবং ভালো কাজ বলে প্রশংসা করা হলে বা করার জন্য আদেশ না করে শুধু উৎসাহ প্রদান করা হলে তাকে মুস্তাহাব বা নফল বলা হয়।

হাসানাত পর্যায়ের কাজগুলো সুষ্ঠু নিয়্যত ছাড়া অস্তিত্বহীন ও নিস্ফল হয়ে যায়, অর্থাৎ, আল্লাহ'র কাছে সওয়াব পাওয়ার যোগ্য থাকে না। বরং অপনিয়্যতের দরুন হাসানাত পরিণত হয়ে যায় অপকর্ম ও মাসিয়াতে।

যেমন - সবচেয়ে বড় হাসানাহ (নেক কাজ) হচ্ছে ইসলাম গ্রহণ করা, অর্থাৎ, আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য, আখিরাতের হিসাব-নিকাশ ও বেহেশত-দোযখের অস্তিত্ব এবং আল্লাহ'র বাণী কুরআনের ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হাদিসের সত্যতা স্বীকার করা। এটিও যদি কেউ শুধু মুখে মুখ স্বীকার করে কিন্তু অন্তরে আল্লাহ ছাড়া হীনস্বার্থ ইত্যাদি অন্য কোনরূপ উদ্দেশ্য রাখে, তবে তাকে বলে মুনাফিক। মুনাফিকের জন্য দোযখের সর্বনিন্ম স্তর আর সবচেয়ে বেশী শাস্তি নির্ধারিত আছে।

নামায ইসলামের প্রধান রুকন। এটি যদি কেউ বিনা নিয়্যত তথা অন্ততঃ মনের মধ্যে নামায পড়ার ইরাদা ও ইচ্ছা ছাড়া পড়ে, তবে আদৌ কোন মূল্য নেই, নামায হবে না। আর যদি কেউ অপনিয়্যতে, অর্থাৎ রিয়াকারী - লোক দেখানো বা সুখ্যাতি অর্জন ইত্যাদি হীনস্বার্থের নিয়্যতে পড়ে, তবে তাতে সওয়াবের পরিবর্তে ভীষণ আযাব - ওয়াইল নামক দোযখের শাস্তি হবে। কুরআনে উল্লেখ আছে -

"অতএব ওয়াইল দোযখ ঐ শ্রেণীর নামাযীদের জন্য; যারা নামাদের ব্যাপারে গাফিল - সময় সময় পড়লেও উদাসীনরূপে পড়ে; যারা লোক দেখানো উদ্দেশ্যে নামায পড়ে।" (সূরাহ আল-মাউন, ১০৭ : ৪-৬)

প্রত্যেক নেক কাজেই নিয়্যত খালিস করার একান্ত প্রয়োজন আছে। নিয়্যত খালিস না হলে আযাবের কারণ হবে, যেমন মুসলিম শরীফের এটি হাদিসে উদ্ধৃত হয়েছে।

যে সব কাজে মানুষকে আল্লাহ তাআলা স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের অধিকার দিয়েছেন, তাকে বলে মুবাহাত। যেমন - খাওয়া, পরা, শোওয়া, কথা বলা, দেখা শোনা, হাঁটাচলা, জীবিকা উপার্জন করা, কৃষি শিল্প ও ব্যবসায় উন্নতি করা, মস্তিষ্ক চালনা করে বিজ্ঞানে উন্নতি করা, বিভিন্ন দেশ পর্যটন করা, বিভিন্ন ভাষা শেখা ইত্যাদি।

নিয়্যতের তারতম্য বিশেষভাবে মুবাহ পর্যায়ের কাজগুলোতেই প্রয়োগ হয়ে থাকে। মুবাহ পর্যায়ের যে কোন একটি কাজ আল্লাহ'র সন্তুষ্টি ও আল্লাহ'র দাসত্বের ধ্যান করে নিয়্যত ঠিক করে করলে তখন আর ঐ কাজটি শুধু মুবাহ থাকে না, তা একটি উচ্চ পর্যায়ের সওয়াবের ও ইবাদাতের কাজে পরিণত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে, ঐ কাজটিকেই কোন অপনিয়্যতে করলে তা মাসিয়াত বা গুনাহের কাজে পরিণত হয়ে যায়। (বুখারী শরীফ বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা, হামিদিয়া লাইব্রেরী, ১ম খণ্ড, সংক্ষিপ্তে উল্লেখ করা হলো)

 

মাসায়েল

(১) নিয়্যত অন্তরের সংকল্পেরই নাম। সুতরাং কোন বিষয় নিয়্যত করার কালে অন্তরে সংকল্প না করে শুধু মুখে উচ্চারণ করলে চলবে না, বরং অন্তরে সংকল্প করে মুখে উচ্চারণ না করলেও চলবে।

(২) নামাযের নিয়্যত মুখে উচ্চারণ করা শর্ত নয়। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ করেছেন বলে প্রমাণ নেই। সুতরাং মুখে উচ্চারণ না করার মধ্যেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইত্তিবা (অনুসরণ) রয়েছে। অবশ্য স্মরণের উদ্দেশ্যে মুখে উচ্চারণ করাকে কোন কোন ফকীহ উত্তম বলেছেন।

(৩) কোন কোন কাজ একাধিক নিয়্যত বা উদ্দেশ্যেও করা যেতে পারে। যথা - দরিদ্র আত্মীয়কে দান করা। এতে তাদের দারিদ্র্য মোচন এবং আত্মীয়তা বন্ধন রক্ষা করা - উভয় উদ্দেশ্যই থাকতে পারে। এরূপ কাজের জন্য আল্লাহ'র কাছে একাধিক পুরস্কারও পাওয়া যেতে পারে, যদি কাজ সম্পাদনকালে একাধিক উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয় আর এ সবের মূলে আল্লাহ'র সন্তোষ লাভের সংকল্প থাকে।

(৪) মুবাহ কাজের জন্যও আল্লাহ'র কাছে সওয়াব পাওয়া যেতে পারে, যদি তা নেক নিয়্যতে করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ, শ্রম ইত্যাদিও যদি পরিবারের বেরোজগার লোকদের পালন, তাদের সৎশিক্ষার ব্যয়বহন, কোন অভাবী লোকের অভাব দূরীকরণ অথবা অন্য কোন নেক কাজ করার নিয়্যতে - এক কথায় আল্লাহ'র হুকুম পালন ও তার সন্তোষলাভের উদ্দেশ্যে করা হয়, তাহলে এসকল কাজের জন্যও আল্লাহ'র কাছে সওয়াব রয়েছে।

(৫) মক্কা বিজয়ের পর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের আবশ্যকতা না থাকলেও দ্বীন ও ঈমানের অশান্তির স্থান থেকে দ্বীন-ঈমানের শান্তির স্থানে হিজরত করার আবশ্যকতা এখনো বাকি আছে আর কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। (মিশকাত শরীফ, এমদাদিয়া পুস্তকালয়, ১ম খণ্ড)

 

ব্লগ পোস্ট লিংকঃ https://wp.me/p43zxV-41

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আখেরি যুগে ঈসা আঃ এর আগমনের দ্বারা আল্লাহ কর্তৃক রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ

 

 

 

 

The Greatest Nation·Sunday, February 10, 2019

 

 

 

 

জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বলতে শুনেছেনঃ

"আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সবসময় হকের পক্ষে লড়াই (কিতাল) করতে থাকবে এবং তারা কিয়ামত পর্যন্ত দুশমনদের উপর জয়ী থাকবে।"

এরপর তিনি বললেনঃ

"অবশেষে ঈসা ইবন মারইয়াম অবতরণ করবেন। (নামাযের সময় হবে) মুসলমানগণের নেতা তাকে আরয করবেন - 'আসুন, নামায পড়িয়ে দিন।' তিনি বলবেন - 'এমনটি হয় না, আল্লাহ'র পক্ষ থেকে এ উম্মতকে এ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে যে, আপনারা নিজেরাই পরস্পরের ইমাম ও আমীর হবেন।' "

(মুসলিম, মুসনাদ আহমাদ)

 

আল্লামা বদরে আলম মিরাঠী রাহিমাহুল্লাহ তার কিতাব "তরজমানুস সুন্নাহ" তে এ হাদিস প্রসঙ্গে লিখেনঃ

এ উম্মতের মর্যাদা এর থেকে বেশী আর কি হতে পারে যে, তাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর এতো দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও বিদ্যমান থাকেন যে, ইসরাইলী ধারাবাহিকতার একজন পবিত্র রাসুল এসেও তাদের ইমামকে বহাল রাখেন, আর তার পিছনে এসে নামায আদায় করেন, আর এ ঘোষণাও দেন যে, তোমরা পূর্বে যে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলে, এতটা দীর্ঘ সময় পরে আজও সেই মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী থাকবে।

ভাবুন আর একটু ইনসাফ করুন যে, ঈসা আলাইহিস সালাম যদি আগমন করে এভাবে এ উম্মতের পিছনে ইকতিদা না করতেন, তা হলে কি এটা প্রমাণিত হতে পারতো যে, যেই উম্মতকে গতকাল পর্যন্ত উত্তম উম্মত বলা হতো, আজও তারা একই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত আছে।

এমনিতে তো পূর্ববর্তী নবীগণের সময়েও উম্মতের কেউ কেউ যোগ্য থেকে যোগ্যতর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিছু কিছু সময় পরে তার পরিণতি শূন্যতায় পর্যবসিত হয়েছে। যারা ছিল নবী হওয়ার উপযুক্ত, তারা অভিশপ্তের কাতারে এসে পড়েছে কিনা।

কিন্তু কেবল এই একটি উম্মত, যার মর্যাদায় এতটা দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর কোনই পার্থক্য সূচিত হয়নি।

এ তাৎপর্য আর বেশী প্রকাশ পায়, যখন আমরা এদিকেও দৃষ্টি দেই যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তিম সফরের সময়েও এক নামাযের চিত্র এমন ছিল যে, মৃত্যুকালীন অসুস্থতাতেও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইমামতির দায়িত্ব সবচেয়ে সম্মানিত সিদ্দিকে আকবর (আবু বকর) রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে সোপর্দ করেছিলেন, আর এর মধ্যে এমন একটি সময় আসে, যখন তার ইমামতিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পিছনে নামায আদায় করেন। আর প্রকৃতপক্ষে এটা এরই ঘোষণা ছিল যে, এ উম্মত এখন এমন পূর্ণতায় পৌঁছেছে যে, একজন রাসুলের নামায তার (এ উম্মতের) পিছনে আদায় হতে পারে।

কাজেই এবারে বোঝা উচিত যে, রাসুল আগমনের যে মহান উদ্দেশ্য থাকে, তা পূর্ণ হয়েছে। এজন্যে রাসুলগণের প্রথা অনুসারে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওফাতের সময়ও এসে পড়ে, তাহলে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

একদিকে ইমাম ও ইকতিদার এ চিত্র আপনাদের চোখের সামনে রাখুন, আর এর হাজার বছরেরও বেশী সময় পর ইমামত ও ইকতিদার এ দ্বিতীয় চিত্রও সামনে রাখুন, যা এখানে হাদিসে আপনার সামনে বিদ্যমান। তাহলে এটা আপনার কাছে পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হবে যে, যে সময়ে পূর্ববর্তী উম্মত ধ্বংস হয়ে হয়ে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তাদের চেয়ে বেশী সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এই উম্মত তাদের সেই সম্মান ও মর্যাদার উপর অবশিষ্ট আছে, যা তাদের পূর্ণতার যুগে অর্জিত হয়েছিলো।

এর দ্বারা যেখানে একদিকে এ উম্মতের মর্যাদার প্রমাণ পাওয়া যায়, তারও বেশী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশাল ব্যক্তিত্ব ও পূর্ণতার প্রমাণ পাওয়া যায়, আর বিশ্বাস করতে হয় যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রকৃত অর্থেই শেষ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর আর কেউ নবী হতে পারে না।

কেননা, কিয়ামত পর্যন্ত যখন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের মধ্যে এমন গুণসম্পন্ন ব্যক্তি বিদ্যমান রয়েছে যে, যদি কোন পূর্বতন রাসুলও আগমন করেন, তাহলে তিনি অবলীলায় তার পিছনে নামায আদায় করতে পারেন, তাহলে এতে পরিষ্কার এ ফলাফল প্রকাশ পায় যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শেষনবী এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর আর কোন নবীর প্রয়োজন নেই।

ভালোভাবে স্মরণ রাখা উচিত যে, প্রকৃত রাসুলের পদ হচ্ছে আল্লাহ'র দ্বীনের ভিত্তি আর প্রসার ঘটানো। কোন বিশেষ ব্যক্তিকে হত্যা করা রাসুলের কর্মের অন্তর্ভুক্ত নয়। আল্লাহ'র অনেক রাসুল এমনও ছিলেন, যারা হত্যা করার পরিবর্তে নিজেই দুশমনের হাতে নিহত হয়েছিলেন। এতে এটা বলা যায় না যে, তারা নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে সামান্যতমও ত্রুটি করেছিলেন। কাজেই ঈসা আলাইহিস সালাম কর্তৃক দাজ্জালকে হত্যা করার দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, তিনি নতুন শরীয়তের প্রেক্ষিতে আগমন করবেন, বরং এ খিদমত কোন কৌশলের দরুন তাকে সোপর্দ করা হয়েছে। যেমন অনেক কর্মই খিযির আলাইহিস সালামের প্রতি সোপর্দ করা হয়েছিলো, কিন্তু তার অলৌকিক কাজকর্ম দ্বারা তার রাসুল হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুতরাং আজ অবধি উম্মতের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে যে, তিনি (খিযির আলাইহিস সালাম) রাসুল ছিলেন কিনা।

ঈসা আলাইহিস সালামের বনী ইস্রাইলের জন্য শরীয়তদাতা রাসুল হওয়া কুরআনুল কারীম দ্বারা প্রমাণিত, আর এর উপর প্রত্যেক উম্মতের ঈমান আনয়ন তার রিসালাতের দাবী, যা পূর্বেও ছিল, আজও আছে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর যেহেতু শরীয়ত বলতে কেবল তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শরীয়ত থাকবে, এজন্যে ঈসা আলাইহিস সালাম এসেও এই শরীয়তেরই অনুসরণ করবেন। বরং যদি তাওরাতের অধিকারী মুসা আলাইহিস সালামও এসে পড়েন, তবে এ শরীয়তই তারও শরীয়ত হবে।

যদি কোন পূর্ণ থেকে পূর্ণতর রাসুল কোন বড় শরীয়তের অনুসরণ করেন, তা হলে এতে তার নবুওয়াত ও রিসালাতে কোনই পার্থক্য সূচিত হয় না। উপরন্তু এমন অনেক নবী অতিক্রান্ত হয়েছেন, যাদের কোন শরীয়তই ছিল না, অথচ তাদের আল্লাহ'র নবীই বলা হতো। আবার যে শরীয়ত সমস্ত শরীয়তের সমষ্টি, যদি কোন রাসুল এসে তার অনুসরণ করেন, তবে এটা তার রিসালাতের বিরোধী কিরূপে হবে ?

কাজেই এ প্রশ্ন কতোই না অযৌক্তিক যে, ঈসা আলাইহিস সালাম তো আসবেন, তখন কি তার রিসালাত ক্ষুণ্ণ হবে ?

না, তিনি রাসুলই থাকবেন, আর আমরা এখন যেভাবে তার প্রতি ঈমান এনেছি, একইভাবে তখনো ঈমান রাখবো। প্রসঙ্গটি কেবল শরীয়তের অনুসরণের। তা যখন প্রত্যেক রাসুলের শরীয়তে রহিতকরণ এবং রহিতকারী হওয়ায় এতে কোন পার্থক্য সূচিত হয় না, অনুরূপ যদি এক শরীয়ত রহিত হয়ে অপর শরীয়ত এসে যায়, তবে তাতেও কোন পার্থক্য হয় না। তার পূর্ণতা তিনিই, তার প্রতি ঈমান আনা সেভাবেই আবশ্যিক এবং যে শরীয়তের তিনি দাওয়াত দেন, তার অনুসরণ সর্বদাই জরুরী। কাজেই পূর্বকালে তার শরীয়ত ছিল ইনজিল এবং অবতরণের পর তার শরীয়ত হবে কুরআনুল কারীম। পূর্বে যখন তিনি ইনজিলের শরীয়তের আহবানকারী ছিলেন, তখন তার অনুসরণ করা আবশ্যিক ছিল। আর যখন তিনি পুনরাগমন করবেন, তখন তার থেকে প্রথমে ইনজিল রহিত হয়ে যাবে আর তার সামনে কুরআনি শরীয়ত থাকবে। কাজেই তিনি নিজেও এর অনুসরণ করবেন।

কোন শরীয়তের বিশেষ বিশেষ আহকাম অথবা শরীয়ত রহিত হওয়ার দ্বারা রিসালাত ছিন্ন হওয়া না হওয়ার প্রশ্নের উদ্রেকই হয় না। অন্যথায় সে হাদিসের সৃষ্টি হতো, যা মুসা আলাইহিস সালামের প্রসঙ্গে আপনি পাঠ করেছেন। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, তিনি এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীয়তের অনুসরণ করেন, তাহলে কি তিনি আপন রিসালাত থেকে বঞ্চিত হবেন ? নাউযুবিল্লাহ।

 

সূত্রঃ তরজমানুস সুন্নাহ -৩য় খণ্ড

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-47

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

উসমান যিন্নুরাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মর্যাদা

 

 

 

The Greatest Nation·Tuesday, February 26, 2019

 

 

 

 

 

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

(আমার পিতা) আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কোন প্রয়োজনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসার অনুমতি চাইলেন। এ সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার বিছানায় আমার একটি চাদর গায়ে দিয়ে শোয়া ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে ভিতরে আসার অনুমতি দিলেন এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেভাবে শোয়া ছিলেন সেভাবেই শুয়ে থাকলেন। আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ভিতরে আসলেন এবং প্রয়োজনীয় কথা বলে চলে গেলেন।

এরপর উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) (কোন প্রয়োজনে) ভিতরে আসার অনুমতি প্রার্থনা করলেন এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকেও অনুমতি দিলেন। উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ভিতরে আসলেন এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে অবস্থায় ছিলেন সে অবস্থায়ই থাকলেন। তারপর তিনিও নিজের প্রয়োজনীয় কথা বলে ফিরে গেলেন।

এরপর উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ভিতরে আসার অনুমতি চাইলেন। এবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গোছালো অবস্থায় বসে গেলেন আর নিজের কাপড়গুলো ঠিক করে নিলেন, আর আমাকে বললেন, "তুমি নিজের কাপড় (চাদর ইত্যাদি) ভালোভাবে গায়ে দিয়ে নাও।" তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে ভিতরে আসার অনুমতি দিলেন। তিনিও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে আসলেন এবং যেসব প্রয়োজনীয় কথা বলার ছিলো সেগুলো বলে চলে গেলেন।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ (উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু চলে যাওয়ার পর) আমি বললাম, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), উসমানের জন্য আপনি যেরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন, আবু বকর ও উমরের জন্য তো এরূপ করতে দেখলাম না।"

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তর দিলেন, "উসমান খুবই লাজুক মানুষ। তাই আমি আশংকা করেছিলাম যে, তাকে যদি এ অবস্থায় অনুমতি দিয়ে দেই, তাহলে সে (চরম লাজুকতার কারণে দ্রুত চলে যাবে) এবং সেই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলতে পারবে না, যার জন্য সে এসেছিলো। (এজন্যই আমি তার সাথে একটু ভিন্ন আচরণ করেছি।)" --- মুসলিম

 

আবদুর রহমান ইবনে খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ

আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত ছিলাম, যখন তিনি [(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (মিম্বরের উপর তাশরীফ রেখে] তাবূক যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য লোকদেরকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন।

এমন সময় উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) দাঁড়িয়ে বললেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমার যিম্মায় একশো উট-গদি ও পালানসহ (অর্থাৎ, আমি এ জিহাদে একশো উট পেশ করবো সম্পূর্ণ সামানসহ)।"

তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার উৎসাহ দিলেন।

এবারও উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) দাঁড়িয়ে গেলেন আর বললেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমি (অতিরিক্ত আরো) দু'শ উট দান করবো গদি ও পালানসহ।"

তারপর আবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য উৎসাহ প্রদান করলেন।

এবারও উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) দাঁড়িয়ে গেলেন আর বললেন, "আমি (অতিরিক্ত আরো) তিনশো উট দান করবো গদি ও পালানসহ।"

বর্ণনাকারী বলেনঃ আমি দেখলাম যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বর থেকে নেমে আসছেন আর বলছেন -

ما علي عثمان ما عمل بعد هذه

অর্থাৎ, উসমান তার এ আমল ও আর্থিক কুরবানির পর যা-ই করুক, তার কোন ক্ষতি হবে না।

কথাটি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুইবার বললেন। --- তিরমিযী

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রাহিমাহুল্লাহ মাআরিফুল হাদিসে লিখেছেনঃ

মক্কা বিজয়ের আগের বছর ৯ম হিজরিতে কিছু সংবাদের ভিত্তিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বিরাট বাহিনীসহ সিরিয়ার দিকে অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেন। এ সফর তাবূক পর্যন্ত হলো, যা ঐ সময় সিরিয়ার সিমান্তের ভিতরে ছিলো। সেখানে তাদের অবস্থান প্রায় বিশ দিন থাকলো। যে উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্তের এ সফর করা হয়েছিলো, সেটা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ ও সাহায্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই কেবল তাবূক পর্যন্ত গমন ও সেখানে বিশ দিন অবস্থানের দ্বারাই পূর্ণ হয়ে গেলো। তাই সেখান থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এ কারণে এ অভিযান তাবূক অভিযান নামে পরিচিত হয়ে গেলো।

হাদিসে এ অভিযানকে جيش العسرة (কষ্টের অভিযান) বলা হয়েছে। عسرة শব্দের অর্থ হচ্ছে কষ্ট ও ক্লেশ। এ সফরটি এমন সময় করা হয়েছিলো যে, মদীনা মুনাওয়ারা ও এর আশেপাশে তখন দুর্ভিক্ষ ও ফসল কম উৎপন্ন হওয়ার কারণে খুব অভাব চলছিলো, মৌসুমও ছিলো প্রচণ্ড গরমের, সৈন্যদের সংখ্যাও ঐ সময়ের হিসাবে খুবই নগণ্য ছিলো। (বিভিন্ন বর্ণনায় ত্রিশ হাজার বলা হয়েছে)। বাহন, অর্থাৎ উট ও ঘোড়া খুবই কম ছিলো। পাথেয়, অর্থাৎ পানাহার সামগ্রীও সৈন্য সংখ্যা হিসেবে অত্যন্ত কম ছিলো। এসব কারণে এ যুদ্ধাভিযানকে جيش العسرة (কষ্টকর অভিযান) বলা হয়েছে।

এই অসাধারণ পরিস্থিতির কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ যুদ্ধের জন্য লোকদেরকে জান-মালের কুরবানী দেওয়ার জন্য এভাবে উৎসাহ দিলেন, যা অন্যান্য যুদ্ধের ব্যাপারে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাধারণ রীতি ছিলো না।

উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু এ অভিযানের সৈন্যদের সাহায্য-সহযোগিতায় সবচেয়ে বেশী অংশ নিয়েছেন। আবদুর রহমান ইবনে খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু'র এ বর্ণনা থেকে জানা গিয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উৎসাহদানে তিনি ছয়শো উট সামানপত্রসহ পেশ করেন।

হাদিস ব্যাখ্যাতাগণ অন্য কিছু রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে লিখেছেন যে, এই ছয়শো উট ছাড়া তিনি আরো সাড়ে তিনশো উটও দিয়েছিলেন। এ হিসেবে তার পেশকৃত উটের সংখ্যা সাড়ে নয়শো হয়ে যায়। তাছাড়া তিনি পঞ্চাশটি ঘোড়াও পেশ করেছিলেন।

পরবর্তী হাদিস থেকে জানা যাবে যে, উট ও ঘোড়া ছাড়া উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রাও নিয়ে এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র এসব দান গ্রহণ করে আ'ম মজলিসে এ সুসংবাদ শোনালেন আর বারবার বললেন -

ما علي عثمان ما عمل بعد هذه

(ভাবার্থ এই যে, জান্নাত ও আল্লাহ'র সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য উসমানের এ আর্থিক কুরবানী যথেষ্ট।)

যখন ঐ সকল অবস্থার কল্পনা করা হয়, যেগুলোর কারণে এ অভিযানকে جيش العسرة বলা হয়েছে, তখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র এ আর্থিক কুরবানীর মূল্য অনেক বেড়ে যায়।

 

আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাবূক যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ সরঞ্জাম প্রস্তুত করছিলেন, তখন উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নিজের জামার আস্তিনে করে এক হাজার দীনার নিয়ে আসলেন এবং এগুলো তার কোলে ঢেলেছিলেন।

আমি দেখলাম যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের কোলে এগুলো উলট-পালট করছেন আর বলছেন, "উসমান আজ যে কাজ করছে, এরপর সে যাই করুক, তার কোন ক্ষতি হবে না।"

এ কথাটি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুইবার বললেন। --- মুসনাদে আহমাদ

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রাহিমাহুল্লাহ মাআরিফুল হাদিসে লিখেছেনঃ

উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পেশকৃত স্বর্ণমুদ্রাগুলো উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য লোকের সামনে নিজের কোলে নিয়ে উলট-পালট করাটা স্পষ্টত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আন্তরিক খুশী প্রকাশের জন্য ছিলো। .....

 

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন (হুদায়বিয়ার) বাইয়াতে রিদওয়ানের নির্দেশ দিলেন, সে সময় উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূত হিসেবে মক্কায় ছিলেন। লোকেরা (যারা উপস্থিত ছিলো) বায়আত গ্রহণ করে নিলো।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন - আল্লাহ ও তার রাসুলের কাজে উসমান মক্কায় রয়েছে। (সে যদি উপস্থিত থাকতো, তাহলে তোমাদের সাথে সেও বায়আতে শরীক থাকতো। তাই আমি তার পক্ষ থেকে বায়আত গ্রহণ করছি।)

এরপর তিনি [(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উসমানের পক্ষ থেকে] নিজেরই এক হাত অপর হাতের উপর রাখলেন।

(হাদিসের বর্ণনাকারী আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত, যা দ্বারা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উসমানের পক্ষ থেকে বায়আত গ্রহণ করছিলেন, এটা উসমানের জন্য অন্যান্য লোকের হাত থেকে উত্তম হয়ে গেলো, যারা নিজ হাতে বায়আত গ্রহণ করেছিলো। --- তিরমিযী

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেনঃ

বায়আতে রিদওয়ানের ঘটনা সুবিদিত ও প্রসিদ্ধ। কুরআন মাজীদেও এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে কেবল এতটুকু আলোচনা করা হচ্ছে, হাদিসের মর্মার্থ বুঝার জন্য যতটুকু জরুরী।

হিজরি ষষ্ঠ বর্ষে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি স্বপ্নের ভিত্তিতে অনেক সাহাবায়ে কিরামের পীড়াপীড়িতে উমরা আদায়ের জন্য মক্কা শরীফ যাওয়ার ইচ্ছা করলেন। যারা বিষয়টি জানতে পারলেন, তারা এ মুবারক সফরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথী হওয়া ও উমরার সৌভাগ্য লাভের জন্য সঙ্গী হয়ে গেলেন। এ সফরসঙ্গীদের সংখ্যা চৌদ্দশ'র কাছাকাছি হয়ে গেলো।

যেহেতু সফর উমরার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিলো এবং যিলকদ মাসে হয়েছিলো - যা হারাম ও সম্মানিত মাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত, আর মক্কার মুশরিকরাও যার সম্মান করতো ও যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকতো, এজন্য এর কোন প্রয়োজন মনে করা হয়নি যে, আগেই কাউকে পাঠিয়ে মক্কাবাসীদের সম্মতি নেওয়া হোক।

মক্কার মুশরিকরা তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনীত দ্বীনের চরম শত্রু ছিলো। যখন তারা জানতে পারলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বিরাট দল নিয়ে মক্কায় আসছেন, তখন তারা পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত নিলো যে, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথীদেরকে আমরা আমাদের নগরী মক্কায় প্রবেশ করতে দিবো না। যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফেলা মক্কার নিকটবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছে গেলেন, (যেখান থেকে মক্কার দূরত্ব বিশ মাইলের কিছু বেশী) তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কাবাসীদের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলেন।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফেলাসহ হুদায়বিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করলেন এবং উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে কুরাইশ সর্দারদের সাথে কথাবার্তা বলার জন্য নিজের বিশেষ দূত বানিয়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ জন্য নির্বাচন করলেন যে, বিরোধী নেতাদের মধ্যে তার কিছু নিকটাত্মীয় ছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন যে, তিনি যেন কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে বিশেষভাবে এ কথাটি বুঝিয়ে দেন যে, আমরা কেবল উমরার জন্য এসেছি। এর বাইরে আমাদের কোন উদ্দেশ্য নেই, আমরা উমরা আদায় করেই মদিনায় ফিরে যাবো।

উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু মক্কায় চলে গেলেন, কিন্তু সময়ের হিসাবে যে সময় ফিরে আসার কথা সে সময় ফিরে আসেননি। এদিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাফেলায় কোনভাবে এ সংবাদ প্রচারিত হয়ে গেলো যে, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে শত্রুরা শহীদ করে ফেলেছে। এতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত মর্মাহত হলেন আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, যদি এমনটাই হয়ে থাকে, তাহলে যুদ্ধ হবে। সকল সাথীদের মধ্যেও এ সংবাদে চরম উত্তেজনা দেখা দিলো। এ পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরাম থেকে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ ও এতে শাহাদাত বরণ পর্যন্ত দৃঢ়পদ থাকার বিশেষ বায়আত ও অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। এ বায়আত ও প্রতিশ্রুতি একটি বৃক্ষের নীচে নেওয়া হয়েছিলো। কুরআন মাজীদে এ ক্ষেত্রে বায়আত গ্রহণকারীদের জন্য আল্লাহ তাআলার সবিশেষ সন্তুষ্টির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এজন্যই এর নাম "বায়আতে রিদওয়ান" (সন্তুষ্টির বায়আত) নামে প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।

আগেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ বায়আত যখন অনুষ্ঠিত হয়, তখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু উপস্থিত ছিলেন না, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূত হিসেবে মক্কায় গিয়েছিলেন। হুদায়বিয়ায় উপস্থিত সকল সাহাবায়ে কিরাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র হাতে হাত রেখে বায়আত গ্রহণ করলেন। আর উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র অবর্তমানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের একটি হাত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র হাত সাব্যস্ত করে অপর হাতের উপর রেখে বায়আত করলেন। নিঃসন্দেহে এটি উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র একটি বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদা। পরে জানা গেলো যে, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র শাহাদাতের সংবাদটি সঠিক ছিলো না ......

 

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ

মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি সস্ত্রীক হাবশার দিকে হিজরত করে যান, তিনি হলেন উসমান ইবনে আফফান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। তিনি তার স্ত্রীকে (রুকাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা'কে) নিয়ে হাবশার দিকে রওয়ানা হোন। (এরপর দীর্ঘ দিন পর্যন্ত) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কোন সংবাদ পাননি। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সংবাদ জানার জন্য বাইরে যেতেন আর অপেক্ষায় থাকতেন।

এরই মধ্যে এক কুরায়শী মহিলা হাবশা থেকে মক্কায় আসলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কাছে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। সে বললো, "হে আবুল কাসেম, আমি তাদের দুজনকে দেখেছি।"

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞাসা করলেন, "কি অবস্থায় দেখেছেন ?"

মহিলা বললেন, "আমি উসমানকে দেখলাম যে, তিনি (আপনার কন্যা) রুকাইয়াকে একটি ধীরগতির হিমারের উপর সওয়ার করিয়ে দিয়ে নিজে পিছন থেকে পায়ে হেঁটে যাচ্ছে।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "আল্লাহ তাদের উভয়ের সাথে থাকুন (আর তাদের হেফাযত করুন)।" এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, "লুত (আলাইহিস সালাম) এর পর উসমান-ই প্রথম ব্যক্তি, যিনি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে আল্লাহ'র দিকে হিজরত করেছেন।" --- তাবরানী, বায়হাকী, ইবনে আসাকির

 

সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিতঃ

(একদিন) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। আর তখন উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) অত্যন্ত শোকাহত অবস্থায় ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (তার এ অবস্থা দেখে) বললেন, "তোমার এ কি অবস্থা হে উসমান !"

উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) উত্তরে বললেন, "আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান হোন। কারো উপর কি এমন বিপদ এসেছে, যা আমার উপর এসেছে। আপনার কন্যা যিনি আমার সাথে ছিলেন (অর্থাৎ, রুকাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা) ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ তার উপর রহম করুন। (এ আঘাতে) আমার কোমর ভেঙ্গে গিয়েছে এবং আপনার জামাতা হওয়ার যে সৌভাগ্য আমার অর্জিত ছিলো, সেটা চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছে।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, "হে উসমান, তুমি এ কথাই বলছো ?"

উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমি কসম খেয়ে ঐ কথাই বলছি, যা আগে নিবেদন করেছি।"

যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর সাথে কথা বলছিলেন, তখন বললেন, "হে উসমান, ইনি জিবরীল। তিনি আল্লাহ'র নির্দেশে আমাকে হুকুম করেছেন যে, আমি যেন রুকাইয়্যার বোন উম্মে কুলসুমকে তোমার কাছে বিয়ে দিয়ে দেই ঐ মোহরের উপর আর ঐ সামাজিক আচরনের উপর, যা রুকাইয়্যার জন্য নির্ধারিত ছিলো।"

এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহা'কে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছে বিয়ে দিয়ে দিলেন। --- ইবনে আসাকির

এর বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনে মুসআব রাহিমাহুল্লাহ ঐ সকল বিশিষ্ট তাবেঈগণের অন্তর্ভুক্ত, যাদের এ জাতীয় মুরসাল রেওয়ায়াত নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া অন্যান্য একাধিক রেওয়ায়াত দ্বারা এ হাদিসের বিষয়বস্তুর সমর্থন পাওয়া যায়। (মাআরিফুল হাদিস থেকে সংক্ষেপিত মন্তব্য)

 

উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বিতীয় কন্যার (উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহা) মৃত্যুর পর আমাকে বলেছিলেন, "হে উসমান, আমার যদি দশটি কন্যা সন্তান থাকতো, তাহলে আমি একের পর আরেকজনকে তোমার কাছে বিয়ে দিয়ে দিতাম। কেননা, আমি তোমার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট।" --- তাবরানী, দারাকুতনী, ইবনে আসাকির

 

আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মদিনার এক বাগানে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি আসলো আর দরজা খুলে দিতে অনুরোধ করলো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তার জন্য দরজা খুলে দাও আর তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করো। আমি তার জন্য দরজা খুলে দিলাম আর দেখলাম যে, ইনি হলেন আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। আমি তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিলাম। তিনি আল্লাহ'র প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করলেন।

এরপর আরেক ব্যক্তি আসলেন আর দরজা খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তার জন্যও দরজা খুলে দাও আর তাকেও জান্নাতের সুসংবাদ দান করো। আমি দরজা খুলে দিলাম আর দেখলাম যে, ইনি হলেন উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। আমি তাকে ঐ কথা শুনিয়ে দিলাম, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন। তিনিও আল্লাহ'র প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করলেন।

এরপর আরেক ব্যক্তি এসে দরজা খুলার অনুরোধ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, তার জন্যও দরযা খুলে দাও আর তাকেও জান্নাতের সুসংবাদ দাও একটি বড় বিপদের সাথে, যা তার উপর আসবে। আমি (দরজা খুলে দিয়ে) দেখলাম যে, ইনি উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। আমি তাকে ঐ কথা বলে দিলাম, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বেলায় বলেছিলেন। তিনিও আল্লাহ'র প্রশংসা ও তার শুকরিয়া আদায় করলেন, এরপর বললেন - الله المستعان (অর্থাৎ, আগত বিপদে আল্লাহ'ই আমার সহায়) --- বুখারী, মুসলিম

 

মুররাহ ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ

আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে (এক ভাষণে বলতে) শুনেছি। এ ভাষণে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন ফিতনার কথা আলোচনা করছিলেন এবং এগুলো যে নিকটবর্তী সময়েই প্রকাশিত হবে, এ কথাও উল্লেখ করছিলেন।

এমন সময় কাপড়ে মাথা ঢেকে এক ব্যক্তি যাচ্ছিলো।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার দিকে ইশারা করে বললেন, "এ লোকটি ঐ ফিতনার সময় সঠিক পথে থাকবে।"

(বর্ণনাকারী বলেন, আমি এ কথা শুনে) তার নিকট গেলাম, (যাতে লোকটা কে তা চিনতে পারি।) লক্ষ্য করে দেখলাম যে, তিনি উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)।

আমি তার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করলাম, ইনিই কি তিনি ? (যার ব্যাপারে আপনি বলেছেন যে, ফিতনার সময় হিদায়াত ও সঠিক পথে থাকবে ?)

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তরে বললেন, "হ্যাঁ।" --- তিরমিযি, ইবনে মাজাহ

হাদিসটির ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেনঃ

...... রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ জাতীয় বাণীসমূহের আলোকেই আহলে সুন্নাতের আকিদা এই যে, ফিতনার যুগে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু সত্য ও হিদায়াতের উপর ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধবাদীরা যারা ফিতনা খাড়া করেছিলো তারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট ছিলো।

সুমামা ইবনে হাযম কুশায়রী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ

আমি উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর ঘরে ঐ সময় উপস্থিত ছিলাম, যখন তিনি (তার গৃহ অবরোধকারী বিদ্রোহী ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে) বলেছিলেন -

আমি তোমাদেরকে আল্লাহ ও ইসলামের দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা কি জানো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হিজরত করে মদিনায় আসলেন, তখন সেখানে রূমা কূপ ছাড়া অন্য কোথাও মিঠা পানির ব্যবস্থা ছিলো না ? (আর এটা ছিলো এক ইয়াহুদীর মালিকানাধীন। সে এর পানি ইচ্ছামত চড়ামূল্যে বিক্রি করতো) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন বললেন, "এমন কে আছে যে, রূমা কূপটি খরিদ করে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দিবে ? আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে এর চেয়ে উত্তম দান করবেন।" আমি তখন আমার ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে এটি ক্রয় করে (ওয়াকফ করে) দিলাম। আর আজ তোমরা আমাকে সেখান থেকে পানি পান করতে নিষেধ করছো, যে কারণে আমি সমুদ্রের পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছি।

এর উত্তরে তারা বললো - اللهم نعم (অর্থাৎ, হে আল্লাহ, আমরা জানি যে, উসমানের এ কথা ঠিক)

এরপর উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহ ও ইসলামের দোহাই দিয়ে বলছি, তোমাদের কি একথা জানা আছে যে, মসজিদে নববী নামাযীদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (একদিন) বললেন, "এমন কেউ আছে কি, যে অমুক পরিবারের ভূখণ্ডটি (যা মসজিদের বরাবর ছিলো) ক্রয় করে আমাদের মসজিদে শামিল করে দিবে ? আল্লাহ এর বিনিময়ে জান্নাতে উত্তম স্থান দান করবেন।" তখন আমি এটা ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে ক্রয় করে মসজিদে শামিল করে দিলাম, অথচ আজ তোমরা আমাকে সেখানে দু রাকআত নামায পড়তে বাঁধা দিচ্ছো !

লোকেরা উত্তরে বললো - اللهم نعم

এরপর তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহ ও ইসলামের দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা কি জানো যে, আমি তাবূক অভিযানে সৈন্যদের জন্য আমার অর্থ দিয়ে যুদ্ধ উপকরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম ?

লোকেরা বললো - اللهم نعم

এরপর উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি আল্লাহ ও ইসলামের দোহাই দিয়ে তোমাদের জিজ্ঞাসা করছি যে, তোমাদের কি একথা জানা আছে যে, (একদিন) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার "সাবীর" পাহাড়ের উপর ছিলেন আর তার সাথে আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ও উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)ও ছিলেন ? আমিও তাদের সাথে ছিলাম। এ সময় পাহাড়টি নড়াচড়া করতে লাগলো আর এর পাথর নীচে পড়তে শুরু করলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন নিজের কদম মুবারক পাহাড়ের উপর সজোরে মারলেন আর বললেন - স্থির হয়ে যাও হে সাবীর। কেননা, এ সময়ে তোমার উপর রয়েছেন একজন নবী, একজন সিদ্দীক ও দুজন শহীদ।

লোকেরা উত্তর দিলো - اللهم نعم

এরপর উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন - আল্লাহু আকবার, এ লোকেরাও সাক্ষ্য দিয়েছে। (এরই সাথে তিনি বললেন) কাবার মালিকের কসম, আমি শহীদ হবো। কথাটি তিনি তিনবার বললেন। --- তিরমিযী, নাসায়ী ও দারাকুতনী

 

এ হাদিসটির ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী লিখেছেনঃ

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু'র শাহাদাতের পর খলীফা নির্বাচনের জন্য তারই গঠিত মজলিসে শুরা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে খলীফা নির্বাচন করেছিলো। সকল মুহাজির ও আনসার সাহাবী তাকে এভাবেই খলীফা মেনে নিলেন - যেভাবে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে আর তার পূর্বে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে খলীফা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।

প্রায় বারো বছর পর্যন্ত তিনি খলীফা রইলেন। তার খিলাফতের শেষ বছরগুলোতে তার বিরুদ্ধে ঐ ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, যার ভবিষ্যদ্বাণী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময়ে করেছিলেন। এ অবরোধ - যার উল্লেখ এ হাদিসে করা হয়েছে, এটা ছিলো এ ফিতনার শেষ পর্যায়।

অবরোধকারীরা মিসর ও ইরাকের কোন কোন শহরের বিদ্রোহী ও দাঙ্গাবাজ গোষ্ঠী ছিলো - যাদেরকে ফিতনা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অভিজ্ঞ এক মুনাফিক ইয়াহুদী আবদুল্লাহ ইবনে সাবা গোপন ষড়যন্ত্র ও আন্দোলনের মাধ্যমে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ করেছিলো। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সিরাত ও ইতিহাসের কিতাব)

হাদিস থেকে যেমন জানা গেলো যে, বিদ্রোহী ও দাঙ্গাবাজদের এ অবরোধ এমন কঠিন হয়ে গিয়েছিলো যে, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে গিয়ে নামাযও পড়তে পারতেন না এবং তিনি আর তার পরিবারের লোকজন পান করার মতো পানিও পেতেন না। ঐ ফিতনাবাজদের দাবি ছিলো যে, আপনি খিলাফত থেকে সরে যান, অর্থাৎ নিজেই এ দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করুন।

উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক কঠোর নির্দেশের ভিত্তিতে (একটু পরই হাদিসটি উপস্থাপন করা হবে) ঐসব লোকের চাপ ও দাবীর মুখে খিলাফত থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা জায়েয মনে করতেন না। এর বিপরীত এসব বিদ্রোহী ও দাঙ্গাবাজদের হাতে মজলুম অবস্থায় জীবন দিয়ে দেওয়া ও শহীদ হয়ে যাওয়াকে উত্তম মনে করতেন।

এ কথা জানা যে, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু সে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী এক রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন। যদি ঐ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তিনি শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতেন অথবা এর অনুমতিপ্রার্থীদেরকে অন্তত অনুমতিটুকুই দিতেন, তাহলে এ বিদ্রোহ সম্পূর্ণ নির্মূল করে দেওয়া যেতো। কিন্তু তার প্রকৃতি ও স্বভাবে লাজ নম্রতার ন্যায় ধৈর্য ও সহনশীলতারও প্রাবল্য ছিলো। তাছাড়া তিনি এর জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না যে, তার জীবন রক্ষার জন্য কোন কালেমা পাঠকারী মানুষের এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ুক।

এজন্য তিনি শেষ সীমা পর্যন্ত বুঝানোর চেষ্টা করেন এবং প্রমাণ প্রতিষ্ঠার জন্য ঐ ভাষণ দেন - যা এ হাদিসের রাবী সুমামা ইবনে হাযম কুশায়রী বর্ণনা করেছেন, যিনি এ ভাষণ নিজ কানে শুনেছিলেন আর অবরোধের ঐ দৃশ্যটি নিজ চোখে দেখেছিলেন।

শেষে হাদিসের এ শব্দমালা - ورب الكعبة اني شهيد ثلاثا - (কাবার মালিকের কসম, আমি শাহাদাত লাভ করবো) - দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, তিনি আল্লাহ প্রদত্ত ঈমানী দূরদর্শিতা ও কিছু গায়েবী ইশারা দিয়ে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, এ ফিতনা তার শাহাদাতের খোদায়ী ব্যবস্থা হবে - যার ভবিষ্যদ্বাণী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে করেছিলেন। এজন্য তিনি মাজলুম অবস্থায় শহীদ হয়ে আল্লাহ'র দরবারে হাজির হওয়ার ফয়সালা করলেন এবং নির্মম শাহাদাত ও আত্মত্যাগের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন। ......

 

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (একদিন) উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, "হে উসমান, আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাআলা তোমাকে একটি বিশেষ জামা পরিধান করাবেন। তাই লোকেরা যদি এ জামা খুলে নিতে চায়, তাহলে তাদের কথায় এটা তুমি খুলে ফেলো না।" --- তিরমিযী, ইবনে মাজাহ

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী লিখেছেনঃ

হাদিস ব্যাখ্যাতাগণ এ ব্যাপারে একমত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার উদ্দেশ্য এটিই ছিলো যে, হে উসমান, আল্লাহ তাআলা তোমাকে খিলাফতের পোশাক পরিধান করাবেন। তাই লোকেরা যদি এ পোশাক খুলে নিতে চায়, অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত খিলাফতের পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার দাবি করে, তাহলে তুমি তাদের দাবী মানবে না।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ নির্দেশ ও অসিয়্যত তিরমিযী শরীফে স্বয়ং উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও বর্ণিত হয়েছে। রেওয়ায়েতটি উল্লেখ করা হলোঃ

আবু সাহলা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু গৃহবন্দী অবস্থায় আমাকে বিশেষভাবে একটি অসিয়্যত করেছিলেন। আমি ধৈর্যের সাথে ঐ অসিয়্যতের উপর আমল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এর ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী লিখেছেনঃ

আবু সাহলা ছিলেন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র আযাদকৃত গোলাম। তিনি অবরোধের সময় উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কাছে ছিলেন এবং অন্যান্য সহানুভূতিশীল ও বিশ্বস্ত বন্ধুদের সাথে তিনিও চাইতেন যে, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা হোক। সম্ভবত এ কথাটিই তিনি উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র খেদমতে নিবেদন করেছিলেন। যার উত্তরে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ ও অসিয়্যতের বরাত দিলেন, যা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ করে আসা হয়েছে।

এটিই ছিলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই বিশেষ নির্দেশ ও ওসিয়্যত, যা পালন করতে গিয়ে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বিদ্রোহী ও হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের দাবীর মুখে খিলাফত থেকে অব্যাহতি নিতে রাজি হলেন না, বরং এর বিপরীতে মজলুম অবস্থায় শহীদ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, যার ভবিষ্যদ্বাণী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার করেছিলেন।

 

উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র আযাদকৃত গোলাম মুসলিম ইবনে সাঈদ থেকে বর্ণিতঃ

(যেদিন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে শহীদ করা হয়, সেদিন) তিনি বিশটি গোলাম আযাদ করলেন আর পায়জামা আনতে বললেন (আর এটা পরিধান করলেন)। এটাকে শক্ত করে বাধলেন। অথচ তিনি ইসলামপূর্ব জাহিলিয়্যাত যুগে এবং ইসলাম গ্রহণের পরও কখনো এটা পরিধান করেননি।

তিই বললেন, "আমি গত রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বকর ও উমরকে স্বপ্নে দেখেছি। তারা আমাকে বলছেন - তুমি ধৈর্যধারণ করো, আগামীকাল তুমি আমাদের সাথে ইফতার করবে।"

এরপর তিনি কুরআন শরীফ আনতে বললেন এবং সামনে নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করলেন। পরে এ অবস্থায়ই তাকে হত্যা করা হলো যে, কুরআন শরীফ তার সামনেই ছিলো। --- মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদে আবু ইয়ালা

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী লিখেছেনঃ

....... যে রাতে তিনি এ স্বপ্ন দেখেছিলেন, এটা ছিলো বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত। পরের দিন শুক্রবারে তিনি রোযা রাখলেন, বিভিন্ন ধরণের নেক আমল অতি যত্ন সহকারে আঞ্জাম দিলেন, বিশজন গোলাম আযাদ করলেন আর তিনি পায়জামা আনতে বললেন, যা তিনি কখনো পরিধান করেননি। আরবদের মধ্যে সাধারণত লুঙ্গি পড়ার প্রচলন ছিলো, তিনিও সবসময় লুঙ্গিই পড়তেন। কিন্তু যেহেতু তার মধ্যে লজ্জা প্রবল ছিলো, এজন্য এদিন তিনি লুঙ্গির বদলে পায়জামা আনিয়ে পরিধান করলেন আর এটা খুব শক্ত করে বেঁধে নিলেন। এমনটি তিনি এজন্য করেছিলেন, যেন মৃত্যু ও শাহাদাতের পরও তার দেহের কোন অংশ উন্মুক্ত হয়ে না যায়।

এরপর তিনি কুরআন শরীফ আনতে বললেন আর এর তিলাওয়াত করা শুরু করে দিলেন। এ অবস্থায়ই হতভাগা জালিমরা তাকে শহীদ করে দিলো।

কোন কোন রেওয়ায়াত দ্বারা জানা যায় যে, শাহাদাতের মুহূর্তে তিনি সূরাহ আল-বাকারাহ'র এ আয়াতটি (১৩৭ নং আয়াত) তিলাওয়াত করছিলেন -

فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّـهُ ۚ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

অনুবাদঃ "..... সুতরাং তাদের বিপরীতে তোমার জন্য আল্লাহ'ই যথেষ্ট, এবং তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।"

এটা যেন আল্লাহ'র পক্ষ থেকে এর ঘোষণা যে, এসব হতভাগা জালিমদের থেকে আল্লাহ তাআলা পূর্ণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। (মাআরিফুল হাদিস)

 

ইমাম জালালুদ্দিন সুয়্যুতি রাহিমাহুল্লাহ "তারিখুল খুলাফা" তে উল্লেখ করেছেনঃ

হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,“সর্বপ্রথম ফিতনা হলো উসমানের শাহাদাত, আর সর্বশেষ ফিতনা দাজ্জালের আবির্ভাব। যে তার শাহাদাতে সামান্যতম খুশি হবে, সে দাজ্জালের যুগ পেলে অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে,আর না পেলে তার কবর দাজ্জালের আনুগত্য করবে।” (ইবনে আসাকির)

হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,“তিনি শহীদ হওয়ার সময় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু মদীনায় ছিলেন না। সংবাদ পেয়ে তিনি বললেন – ‘হে আল্লাহ, আমি এ ঘটনায় সন্তুষ্ট নই, আর কোনোভাবেই এর সাথে সম্পৃক্ত না।’ ” (ইবনে আসাকির)

কায়েস বিন উবাদ বলেছেনঃ জঙ্গে জামালের দিন আমি আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে বলতে শুনেছি – “হে আল্লাহ, আপনি খুব ভালো করেই জানেন যে,আমি উসমানের রক্তের সাথে কোনোভাবেই জড়িত না। তার শাহাদাতের সংবাদ পেয়ে আমার জ্ঞান হারিয়ে যায়। লোকেরা আমার কাছে বাইআত করতে এলে আমি তাদের ভাল মনে করিনি, আমি তাদের বলেছি - আল্লাহ'র কসম, উসমানকে যারা হত্যা করেছে তাদের সম্প্রদায়ের নিকট থেকে বাইআত নিতে আমি লজ্জাবোধ করছি। তবুও এরচেয়েও আমি বেশী লজ্জিত আল্লাহ তাআলার কাছে, এরপর আমি তাদের ফিরিয়ে দিলাম। তারা আবার আসে আর বাইআত করে। আমি উসমানের জন্য দুয়া করছি, হে আল্লাহ, উসমানের প্রতি সন্তুষ্ট হোন।” (হাকিম)

ইয়াযিদ বিন হাবীব থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন,“আমি জেনেছি, যারা উসমানের উপর আক্রমণ করেছে তাদের অধিকাংশই পাগল হয়ে গেছে।”

আব্দুর রহমান বিন মাহদী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন,"উসমানের এমনও বৈশিষ্ট্য ছিল, যা আবু বকর আর উমরের মধ্যে ছিল নাঃ

এক – শহীদ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ,

এবং দুই – কিরাতের মাধ্যমে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধকরণ।"

 

ইয়া হাইয়ুল কাইয়ুম, আপনি উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'র পরকালিন নিয়ামত বৃদ্ধি করে দিন, আমীন।

ইয়া হাইয়ুল কাইয়ুম, আপনি জান্নাতে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে বেশী বেশী করে আপনাকে দেখার তাওফিক দিন, আমীন।

 

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-4h

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আল কুরআনে মহান স্রস্টার পরিচিতি

 

 

 

The Greatest Nation·Saturday, March 2, 2019

 

 

 

 

 

 

স্রস্টা বলতে কেউ আছেন কি ?

প্রাচীন ধর্ম বিশেষ করে ইয়াহুদি ও খৃষ্টান ধর্ম এ প্রশ্নের জবাবে ইতিবাচক কথা বলেছে। বলতে গেলে আল্লাহ'র অস্তিত্বে বিশ্বাসই এ ধর্ম দুটির প্রধান ভিত্তি। যদিও এ ধর্ম দুটি স্রস্টা সম্পর্কে খুব একটা স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ ধারণা উপস্থাপিত করতে পারে নি।

প্রথম পর্যায়ে নির্ভুল ধারণা উপস্থাপিত করে থাকলেও পরবর্তীতে তা চরম মাত্রায় বিভ্রান্তির বেড়াজালে সে ধারণা আচ্ছন্ন ও প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। আর জনগণ সে ধারণার দরুন দিশেহারা হয়ে গেছে। ফলে এই ধর্ম দুটির প্রতি বিশ্বাসীদের অনেকেই দর্শন ও বিজ্ঞান চিন্তার ক্ষেত্রে স্রস্টার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে অগ্রসর হতে পারে নি। কিংবা বলা যায়, দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চায় তারা স্রস্টা বিশ্বাসের প্রতি প্রথমে উপেক্ষা ও পরে অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। এ কারণে তারা যে দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রাসাদ রচনা করেছে, তা বাস্তবে সম্পূর্ণ স্রস্টা বিশ্বাসহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা স্রস্টার পরিবর্তে "জড়" বা "বস্তু" (Matter) কেই সৃষ্টির মৌল উৎস ধরে নিয়েছে এবং বর্তমান বিশ্বলোককে এই বস্তুর ক্রমবিকাশ বা বিবর্তনের ফলশ্রুতি বলে মনে করেছে।

এভাবে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দর্শন ও বিজ্ঞানের যে চর্চা ও বিকাশ হয়েছে তা সম্পূর্ণ স্রস্টা বিশ্বাসহীন দর্শন ও বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এই দর্শন ও বিজ্ঞানে স্রষ্টাকে স্বীকার করা হয়নি, শুধু তা-ই নয়, স্রস্টা বিশ্বাসকে দর্শন ও বিজ্ঞান পরিপন্থী সাব্যস্ত করতেও দ্বিধাবোধ করেনি।

আর ধর্ম যেহেতু স্রস্টা বিশ্বাসের উপর ভিত্তিশীল, তাই ধর্মকেও তারা তারা আধুনিক দর্শন ও বিজ্ঞানের চূড়ান্তভাবে অ-গ্রহণযোগ্য বা কুসংস্কার মনে করে তার প্রতি ধিক্কার দিতেও উদ্যত হয়েছে। তারা বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে, দর্শন-বিজ্ঞান ও ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে মৌলিক বিরোধ। ধর্ম মানলে দর্শন ও বিজ্ঞানকে অস্বীকার করতে হয়। আর যারা দার্শনিক ও বিজ্ঞানী তারা কোনক্রমেই ধর্মকে মেনে নিতে পারে না। বরং ধর্মকে অস্বীকার, অগ্রাহ্য করাই দার্শনিকতা, বৈজ্ঞানিকতা। এ পর্যায়ে বিশ্বলোকে সৃষ্টির যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা একান্তই গোঁজামিল ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

স্রস্টা ছাড়াই কি সৃষ্টি সম্ভব ? কর্তা ব্যতিরেকে কর্ম সম্পাদিত হতে পারে ? বীজ ছাড়াই বৃক্ষ ? এই বিশ্বলোক কি স্বতঃস্ফূর্ত জড়-এর স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ বা অভিব্যক্তি ?

তারপক্ষে যতো সূক্ষ্ম ও জটিল ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক, যুক্তিবাদী মন তাতে কিছুমাত্র স্বস্তি ও সান্ত্বনা পেতে পারে না। আদিতে ছিল জড়। দূর অতীতে কোন এক মুহূর্তে তাতে আপনা আপনি হঠাৎ করে গতির সৃষ্টি হয়, এক মহা বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়, আর তারই ফলশ্রুতিতে ক্রম অভিব্যক্তির ধারায় এই বিশ্বলোক অস্তিত্ব লাভ করে, সৃষ্টিলোকের এই ব্যাখ্যাই বরং নিতান্তই হাস্যকর ও বাল্যসুলভ প্রতিভাত হচ্ছে। এ কথাটিকে কোন দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ববিদ অনুমোদিত বিধি বা সমস্যা সমাধানের সাধারণ সংকেত (Formula) মনে করে নেওয়া কোন সুস্থবিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। এ কথাটিকে নেহাত আজগুবী ও অপরিপক্ক মগজের উদ্ভট চিন্তা ছাড়া আর কিছুই মনে করা যায় না। এটি একটি ধারণা মাত্র, এর পশ্চাতে কোন নির্ভুল জ্ঞানের ভিত্তি নেই। কেননা এই তত্ত্বের উপর এই কঠিন প্রশ্ন তীব্র হয়ে দেখা দেয় যে, আদিতে যে জড় ছিল, তার পূর্বে কি ছিল ? জড় কোত্থেকে কেমন করে এলো ? ..... এর জবাবে একমাত্র যে কথাটি বলা যায়, তা হলো এই আদিম জড় এর পূর্বে ছিলেন একমাত্র আল্লাহ। তখন আর কিছুই ছিল না।

কিন্তু আল্লাহ কে - তার জবাব কুরআন থেকে পেশ করা হচ্ছে।

 

মহান আল্লাহ আছেন

দুনিয়ার সেরা বিজ্ঞানীগণ নিজেদের স্বাধীন বিমুক্ত ও অনাসিক্ত অপ্রভাবিত বৈজ্ঞানিক চিন্তার ফলে বিশ্বলোকের একজন মহাপরাক্রমশালী মহাবিজ্ঞানী স্রস্টার অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেছেন, কুরআন মাজিদ সেই প্রয়োজনবোধের অকাট্য যৌক্তিকতা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে স্বীকার করেছে এবং উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছে যে, হ্যা, সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আছেন। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এই বিশ্বলোক কখনোই অস্তিত্ব লাভ করতে পারতো না, পারেনি এবং তিনি বহু নন, তিনি এক ও একক। তিনি নিজ কুদরতে মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ নতুনভাবে পূর্বের কোন নমুনা না দেখে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন আসমান ও যমিনের সবকিছু।

আল্লাহ মহাবিশ্বকে নিজ শক্তিবলে সৃষ্টি করে নিজেকে আড়ালে রেখে তাকে কঠিন ও শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছেন। সৃষ্টির কোন কিছুর মধ্যে তিনি নেই, সৃষ্টির কোন একটি বিন্দুও তার প্রত্যক্ষ ও কঠিন নিয়ন্ত্রণ পরিচালনা থেকে সামান্য পরিমাণেও মুক্ত নয়।

তার সর্বশেষ নাযিল করা কালামে তিনি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন। ফলে তার দেওয়া পরিচিতির মাধ্যমেই আর তার ঘোষিত স্বীয় গুণবাচক নামসমূহের মাধ্যমেই তাকে জানা সম্ভব। অন্য কোনভাবে বা উপায়ে তাকে জানা ও চেনা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আল্লাহ'র নিজের সেই কালাম থেকেই তার পরিচিতি কতিপয় দিক এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, আল্লাহ'র এই পরিচিতি সামগ্রিক নয়, সম্পূর্ণও নয়।

"আল্লাহ আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর কোনরূপ নমুনা না দেখেই নিজ শক্তিবলে সৃষ্টিকর্তা ...... তিনিই সমস্ত ও প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন আর তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় অবহিত।" (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১০১)

অর্থাৎ, এই আসমান যমীনের অস্তিত্ব পূর্বে ছিল না। আল্লাহ'ই নিজ শক্তিবলে ও নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করে এসব থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি। এর প্রত্যেকটি সম্পর্কেই তিনি পুরোমাত্রায় অবহিত রয়েছেন। তার জানার আওতার বাইরে কোন জিনিস নেই। মানুষকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন -

"আমরাই তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তাহলে তোমরা এই কথার সত্যতা স্বীকার করে নিচ্ছো না কেন ?" (সূরাহ আল-ওয়াকিয়াহ, ৫৬ : ৫৭)

"..... আল্লাহ'ই আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অন্ধকার ও আলো তিনিই বানিয়েছেন ..."(সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১)

সৃষ্টি অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে বের করে অস্তিত্বমান বানিয়ে দেওয়ার এই কাজ একমাত্র আল্লাহ'র। তিনি ছাড়া এই কাজ করার সাধ্য আর কারোই নেই। কাজেই তিনি যা সৃষ্টি করেন, তা তার সমান বা তার সাথে তুল্য কোনক্রমেই হতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেছেন -

"যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কি তার মতো বা তার তুল্য হতে পারেন যে সৃষ্টিকর্ম করে না ? তোমরা কি এ বিষয়ে গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করো না ?" (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ১৭)

সৃষ্টিকর্ম মৌলিকভাবে এক তুলনাহীন কাজ। এই কাজ যিনি করেন, তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে, সবচেয়ে বড় ও মহান, বিবেকমান কোন মানুষই তা অস্বীকার করতে পারে না। তাই আল্লাহ'কে সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বশক্তির অধিকারী অবশ্যই মানতে হবে।

"...... মহান পবিত্র সর্ব দুর্বলতা মুক্ত তিনি, তিনিই আল্লাহ - এক ও একক, মহাপরাক্রমশালী। তিনিই সৃষ্টি করেছেন আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী পরম সত্যতা সহকারে, তিনিই রাতকে দিনের উপর আবর্তিত করেন, দিনকে করেন রাতের উপর; সূর্য ও চাঁদকে তিনিই সুদৃঢ়ভাবে কর্মে নিরত-নিয়ন্ত্রিত রেখেছেন, সবই একটি সুনির্দিষ্ট সময়কালের জন্য সদা প্রবাহমান ...." (সূরাহ আয-যুমার, ৩৯ : ৪-৫)

"আল্লাহ'ই হচ্ছেন প্রত্যেকটি জিনিসের স্রস্টা, প্রত্যেকটি জিনিসের উপর সংরক্ষক-পর্যবেক্ষক-কর্তৃত্বশীল। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর রহস্য উদঘাটনের সমস্ত কুঞ্জিকা তারই কর্তৃত্বাধীন ...." (সূরাহ আয-যুমার, ৩৯ : ৬২-৬৩)

"আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং এ দুটোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থানকারী সকল জীব-প্রাণীর সৃষ্টিতে আল্লাহ'র অস্তিত্বের নিদর্শন রয়েছে ..." (সূরাহ আশ-শুরা, ৪২ : ২৯)

 

অর্থাৎ, আমরা যে পৃথিবীর বুকে বসবাস করি, এ পৃথিবীর উপর চাঁদোয়া সদৃশ যে নীল আসমান, তাতে জ্বলজ্বল করা তারকারাজি, উজ্জ্বল চাঁদ, দেদীপ্যমান সূর্য এবং পৃথিবীর দিকে দিকে যে লক্ষ-কোটি জীবজন্তু বিচরণশীল - এ সবই এক মহাশক্তিমান স্রস্টার অস্তিত্বকে অপরিহার্য করে এবং তিনি চিরন্তন ও শাশ্বত সত্তা হিসেবে রয়েছেন, এ সবই তার অকাট্য প্রমাণ।

"তিনি খুঁটি ব্যতীত আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করেছেন - তোমরা তা দেখছো, আর পৃথিবীতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত উঁচু পর্বতমালা করেছেন সংস্থাপিত যাতে পৃথিবী তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে, আর আমি ঊর্ধ্বলোক থেকে পানি বর্ষণ করেছি, পরে পৃথিবীতে সর্ব প্রকারের উত্তম জোড়া সৃষ্টি করেছি। এ সবই তো আল্লাহ'র সৃষ্টি, এরপর আল্লাহ ছাড়া আর কে কি সৃষ্টি করেছে তা এনে আমাকে দেখাও ....." (সূরাহ লুকমান, ৩১ : ১০-১১)

অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্ম এককভাবে একমাত্র আল্লাহ'র। সৃষ্টিকর্তা তিনি ছাড়া আর কেউই নেই। তিনিই আকাশমণ্ডলকে মহাশূন্যে ভাসমান করে রেখেছেন, তাকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখার জন্য কোন দৃশ্যমান খুঁটি ব্যবহার করা হয়নি। আর পৃথিবীও মহাশূন্যে ভাসমান একটি গ্রহ। শূন্যে ভাসমান থাকার কারণে তা হেলতে দুলতে পারে। আর তাহলে ভূপৃষ্ঠে কারো পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। এ কারণে পৃথিবীর বুকে আল্লাহ দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ভারী ভারী পর্বতমালা দাঁড় করে দিয়েছেন।

তিনিই পৃথিবীতে বৃষ্টি বর্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। কেননা বৃষ্টি বর্ষিত না হলে ভূপৃষ্ঠে ফল-ফসলের সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়ে যেতো। ভূপৃষ্ঠে যে শস্য-শ্যামল সবুজ মন-ভোলানো শোভা বিরাজ করছে, তার প্রধান কারণ এই বৃষ্টি। এর ফলে সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভবপর হচ্ছে। সৃষ্টি করা আর সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় খোরাক-পোশাক ইত্যাদি জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ'র পক্ষেই সম্ভব।

"(হে নবী), তুমি ওদের জিজ্ঞেস করো - আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী থেকে তোমাদেরকে কে রিযক-জীবনোপকরণ দিচ্ছে ? কিংবা শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তিরই বা মালিক কে ? কে জীবন্তকে মৃত থেকে ও মৃতকে জীবন্ত থেকে বের করে আনে ? আর কে-ই বা এসব ব্যাপারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সুসম্পন্ন করে ? ....." (সূরাহ ইউনুস, ১০: ৩১)

এ প্রশ্ন কয়টির জবাব যে একটিমাত্র শব্দ - আল্লাহ, তা কে অস্বীকার করতে পারে ?

"সেই মহান সত্তাই তো সূর্যকে আলোকমণ্ডিত ও চন্দ্রকে উজ্জ্বল-উদ্ভাসিত বানিয়েছেন এবং তার জন্য মনযিলসমূহ সুনির্ধারিত পরিমিত করেছেন, যেন তোমরা বছরের সংখ্যা ও হিসাব জানতে পারো, আল্লাহ এসব পরম সত্যতা সহকারে সৃষ্টি করেছেন ....." (সূরাহ ইউনুস, ১০ : ৫)

"আল্লাহ তো তিনিই, যিনি আকাশমন্ডলীয় অবয়বসমূহকে কোন দৃশ্যমান খুঁটি বা স্তম্ভ ছাড়াই ঊর্ধ্বে তুলে রেখেছেন, এরপর তিনি আরশের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছেন ....." (সূরাহ আর-রদ, ১৩ : ২)

আল্লাহ এই বিশ্বলোককে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সাথে সমগ্র বিশ্বলোকের উপর এক প্রতিটি অণু-পরমাণুর উপর নিজস্ব নিরংকুশ কর্তৃত্ব সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই বিশ্বলোকের উপর অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃত্ব সার্বভৌমত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। তিনি এক একক ও লা-শরীক।

"তারা কি কখনো তাদের উপরে অবস্থিত আকাশমণ্ডলের দিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখেছে যে, কিভাবে আমরা তা নির্মাণ করেছি, সুসজ্জিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত বানিয়েছি এবং তাতে কোনরূপ ফাঁক ও ফাটল নেই ? আর যমীনকে আমরা সুবিস্তীর্ণ করেছি, তাতে পর্বতমালার ভার স্থাপন করেছি এবং তাতে তরতাজা চাকচিক্যময় জোড়াসমূহ উৎপাদন করেছি।" (সূরাহ ক্বাফ, ৫০ : ৬-৭)

 

সুসজ্জিত সুবিন্যস্ত আকাশমণ্ডল মানুষের কাছে চিরদিনের জন্য এক মহাবিস্ময়ের ব্যাপার। তার নির্মাণ কৌশল ও চাকচিক্যময়তা মানুষকে সবসময়ই আকৃষ্ট করেছে। সেই সাথে প্রশস্ত বিস্তৃত পৃথিবী, তাতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পর্বতমালা মানুষকে চিরকাল মুগ্ধ ও বিমোহিত করেছে। আর এসবের সহযোগিতায় মাটিতে উত্তম উৎকৃষ্ট ফল ও ফসলের উৎপাদন মানুষকে এখানে বেঁচে থাকার উপকরণ জুগিয়েছে। যে নিয়ম আকাশমণ্ডলেও কার্যকর, ঠিক সেই নিয়ম-শৃঙ্খলা যমীনের বুকে চালু। যমীনের বুকে যেমন উঁচু উঁচু শক্ত দুর্ভেদ্য প্রস্তরময় পর্বতমালা রয়েছে, তেমনি রয়েছে নরম মসৃণ উর্বরাশক্তি সম্পন্ন ভূমি, যেখানে ফল ও ফসলের নরম লতাপাতা ও শক্ত কান্ড ও শাখা-প্রশাখা পত্র-পল্লব সুসজ্জিত গাছপালাও রয়েছে।

স্পষ্ট মনে হচ্ছে, শত-কোটি আলোকবর্ষের দূরত্বে অবস্থিত আকাশমণ্ডল ও পায়ের তলায় পড়ে থাকা মাটি, মাটির প্রতিটি কণা যেন একই সূত্রে গাঁথা, এক অখণ্ড বস্তুপিন্ড। একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন নয়, বরং প্রত্যেকটি অংশের সাথে আর অংশে নিবিড় সম্পর্ক, এ কারণে অন্যটি, একটি অপরটির সহযোগী, পরিপূরক। এর কোন একটি না হলে যেন অন্য কোন একটিও হতে পারতো না। এর কোন একটি অংশকে বাদ দিলে অপর অংশগুলো যেন নিতান্তই অর্থহীন, সম্পূর্ণ নিস্ফল। পরস্পর পরিপূরক এই অসংখ্য কোটি সৃষ্টিকুল , দূর-ঊর্ধ্বের নীলাকাশ আর নিচের এই বিস্তীর্ণ ধরণীতল সবই মানুষের প্রয়োজন পূরণে ও ব্যাপক কল্যাণ সাধনে সদা ব্যতিব্যস্ত ও কঠিনভাবে কর্মরত।

ভিন্নভিন্নভাবে এর প্রত্যেকটি আর সমষ্টিগতভাবে এই গোটা সৃষ্টিলোক নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে মহাশক্তিমান দয়া ও অনুকম্পার একমাত্র আধার মহান আল্লাহ'র অস্তিত্ব তার একত্ব ও এককত্ব। তিনি না হলে এসব এবং এসবের কোন কিছুই হতে পারতো না। তিনি নিজ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত আছেন বলেই এসবের অস্তিত্ব সম্ভবপর হয়েছে। যেদিক যেখানে যা কিছু আছে, সবই আর প্রত্যেকটি কেবলমাত্র তারই অবদান, তারই তুলনাহীন দয়া অনুকম্পার ফলশ্রুতি। তাই বলা হয়েছে -

"বলোঃ তিনি আল্লাহ - এক ও একক। আল্লাহ সবকিছু থেকে নিরপেক্ষ অনির্ভরশীল - সবই তার প্রতি মুখাপেক্ষী। তার কোন সন্তান নেই, আর তিনিও জাত নন। আর তার সমতুল্য সমকক্ষ কেউ কোথায়ও নেই।" (সূরাহ আল-ইখলাস, ১১২ : ১-৪)

কুরআনে আরো বলে হয়েছেঃ

"আল্লাহ আকাশমণ্ডল ও যমীনের নূর, (বিশ্বলোক) তার নূর হওয়ার দৃষ্টান্ত এরূপ যেমন একটি তাকের উপর প্রদীপ রক্ষিত, প্রদীপটি একটি ঝাড়ের মধ্যে, ঝাড়টির অবস্থা এরূপ - যেমন মোতির মতো ঝকমক করা তারকা, সেই প্রদীপ যায়তুনের বরকতওয়ালা বৃক্ষের তেল দিয়ে উজ্জ্বল করা হয়, যা না পূর্বের না পশ্চিমের, যার তেল স্বতঃই প্রজ্বলিত, আগুন স্পর্শ করুক আর না-ই করুক, (এভাবে) আলোর উপর আলো (বৃদ্ধি পাওয়ার সব উপাদান একত্রিত), আল্লাহ তার নূরের দিকে যাকে ইচ্ছে পথ দেখান ....." (সূরাহ আন-নূর, ২৪ : ৩৫)

আল্লাহ'র আরো ব্যাপক পরিচিতি স্বরূপ বলা হয়েছেঃ

"আল্লাহ তো সেই চিরঞ্জীব শাশ্বত সত্তা, যিনি সমগ্র বিশ্বজগৎকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছেন, তিনি ছাড়া আর কেউই প্রভু-সার্বভৌম নয়, তন্দ্রা বা নিদ্রা কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না, আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সব তো তারই কর্তৃত্ব মালিকানাধীন, তার কাছে তার অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করতে পারে এমন কে আছে ? যা কিছু লোকদের সামনে আর যা তাদের অগোচরে, সবই তো তার জানা। মানুষ তার জ্ঞানের একবিন্দু জিনিসও কখনোই আয়ত্তাধীন করতে পারে না, তিনি নিজেই যা জানাতে চান তা ছাড়া। তার নিরংকুশ কর্তৃত্ব সার্বভৌমত্ব সমগ্র আসমান-যমীনকে আয়ত্ত করে নিয়েছে। এই আসমান ও যমীনের সংরক্ষণ তাকে বিন্দুমাত্রও ক্লান্ত করতে পারে না, তিনিই একমাত্র মহান সু-উচ্চ শ্রেষ্ঠতম।" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ২৫৫)

"মহান বরকত সম্পন্ন সেই সত্তা, যার মুষ্টিতে সমগ্র কর্তৃত্ব মালিকত্ব সার্বভৌমত্ব নিবদ্ধ, আর তিনি তো সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। সেই সত্তাই মৃত্যু ও জীবন উদ্ভাবন করেছেন তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম আমলকারী কে, যেন তিনি তার পরীক্ষা করতে পারেন, আর তিনিই তো দুর্জয় ও মহাক্ষমাশীল।" (সূরাহ আল-মূলক, ৬৭ : ১-২)

"আল্লাহ'ই সৃষ্টি করেছেন আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী পরম সত্যতা সহকারে এবং তিনিই তোমাদেরকে আকার-আকৃতি দিয়েছেন, অতীব উত্তম বানিয়েছেন তোমাদের আকার-আকৃতি। আর শেষ পরিণতি তো তারই কাছে। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার সবকিছুই আল্লাহ জানেন, যা তোমরা গোপন রাখো আর যা প্রকাশ করো, তাও তার জানা। আসলে আল্লাহ (মানুষের) অন্তরে নিহিত প্রচ্ছন্ন বিষয়েও অবহিত।" (সূরাহ আত-তাগাবুন, ৬৪ : ৩-৪)

আসমান-যমীন নির্মাণ ও মানুষের বাহ্যিক আকার-আকৃতি দান ও সর্বোত্তম আকৃতি ভূষিতকরণ একদিকে, অপরদিকে আসমান-যমীনের যা কিছু আছে, যা মানুষ গোপন রাখে, যা প্রকাশ করে, এমনকি যেসব মানুষের অন্তরে গভীরভাবে প্রচ্ছন্ন - সে বিষয়ে অবহিত হওয়া এ সবই সেই আল্লাহ'রই করায়ত্ত। একদিকে বাস্তব কাজ অপরদিকে সর্ববিষয়ে জ্ঞান - এ দুটিরই একচ্ছত্র অধিপতি একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ বলেই তার এই ক্ষমতা। এই ক্ষমতা তার আছে বলেই তিনি আল্লাহ। আর এই আল্লাহ'র পক্ষেই সম্ভব বিশ্বলোক সৃষ্টি, বিশ্বলোক পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ।

"আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারের বাস্তব ব্যবস্থাপনা তিনিই করেন ...." (সূরাহ আস-সাজদাহ, ৩২ :৫)

"তিনিই আল্লাহ - যিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত। তিনিই পরম দয়াবান ও করুণা নিধান। তিনিই আল্লাহ - তিনি ছাড়া কেউ মাবুদ নেই। তিনিই মালিক, বাদশাহ, অতীব মহান পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থাপক, সংরক্ষক, সর্বজয়ী, নিজ নির্দেশ-বিধান নিজ শক্তিবলেই কার্যকরকারী আর স্বয়ং বড়ত্ব অবলম্বনকারী। মহান পবিত্র আল্লাহ - লোকদের কৃত শিরক থেকে তিনি সম্পূর্ণই মুক্ত ও পবিত্র। তিনি আল্লাহ - তিনি স্রস্টা, সৃষ্টি পরিকল্পনা রচনাকারী ও তার বাস্তবায়নকারী এবং তদনুযায়ী রূপ ও আকার-আকৃতি দানকারী। তারই জন্য অতীব উত্তম নামসমূহ। আসমান-যমীনের সবকিছু তারই পবিত্রতা বর্ণনা করে। আর তিনিই তো মহাপরাক্রমশালী, দুর্জয়, মহাবিজ্ঞানী।" (সূরাহ আল-হাশর, ৫৯ : ২২-২৪)

স্রস্টা আল্লাহ'ই। সৃষ্টিকর্ম কেবলমাত্র তারই কৃত। সৃষ্টি করার ক্ষমতা শক্তি ও যোগ্যতা পূর্ণমাত্রায় কেবল তারই রয়েছে। তিনি নিরংকুশ, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছিলেন, সে ইচ্ছাকে তিনি সৃষ্টিকর্মের প্রতি নিবদ্ধ করেছিলেন। ফলে এই বিশ্বলোকের পক্ষে অস্তিত্ব লাভ করা সম্ভবপর হয়েছিলো। তাই যেমন তিনি চেয়েছেন, সৃষ্টিটা সেভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। মাঝখানে কোন মাধ্যম বা সহায়কের প্রয়োজন দেখা দেয় নি। মাধ্যম বা সহায়ক হওয়ার সাধ্যও ছিলো না, নেই কারুরই।

আল্লাহ'র সে ইচ্ছার নিগূঢ় তত্ত্ব কি, তা কারোই জানা নেই, কারো পক্ষে তা জানা সম্ভবও নয়। সে ইচ্ছা বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করলো কিভাবে, তা অনুভব করা মানবীয় ক্ষমতার বাইরে। এ তত্ত্ব গভীর নিগূঢ় তমসাচ্ছন্ন রহস্য। সে রহস্য জানার শক্তি মানুষের নেই। নেই এ কারণে যে, মানুষকে যে দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করা ও দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছে, সে দায়িত্ব পালনের জন্য এই শক্তির কোন প্রয়োজনই নেই। মানুষকে দেওয়া হয়েছে দুনিয়ার খিলাফতের দায়িত্ব, পৃথিবীকে মানুষের বাসোপযোগী করে বিনির্মাণের ও সুষ্ঠ পরিচালনার দায়িত্ব। প্রাকৃতিক নিয়ম-বিধানের সূক্ষ্মতত্ত্ব মানুষকে ততটুকুই জানতে দেওয়া জানার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার বেশী নয়। মানুষকে তার ব্যবহার ও প্রয়োগ করার ও এবং তা থেকে কল্যাণ লাভ করার ক্ষমতা যোগ্যতা দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু তার নিগূঢ় তত্ত্ব কি, তা জানার কোন উপায়ই মানুষের করায়ত্ত নয়। কেননা, খিলাফতের দায়িত্ব পালনের সাথে এই নিগূঢ় তত্ত্ব-জ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই।

তবু দুনিয়ার দার্শনিকরা সে তত্ত্ব রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন, সে বিষয়ে কোন না কোন ধারণা গ্রহণ করতেও হয়তো সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু তা নিছক ধারণা (Speculation) মাত্র। তা সত্য হতেও পারে, নাও হতে পারে। তার উপর দৃঢ় আস্থা ও প্রত্যয় স্থাপন করা আর বলা যে, তা-ই একমাত্র সত্য, তার বিপরীত কথা সত্য নয়, কিছুতেই সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ধারণা ও অনুমান হাস্যোদ্দীপকও হয়ে পড়ে। তখন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, দার্শনিক হয়ে এমন হাস্যকর কথা কি করে বললেন ? কেননা এ দার্শনিকেরা মানুষের প্রকৃতিকে বদলে দিতে চেষ্টা করেছেন, তার শক্তি ও ক্ষমতার সীমা বেস্টনী অতিক্রম করে যেতে চেষ্টা করেছেন। ফলে মানুষের মনের স্বস্তিদায়ক কোন তত্ত্ব প্রকাশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে গ্রীক দর্শন যে সব তত্ত্ব প্রকাশ করেছে, তা সত্য নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়।

উপরে উল্লিখিত কুরআন মাজীদের আয়াতসমূহ থেকে যে দার্শনিক মতটি গড়ে উঠে, তা হচ্ছে - সৃষ্টি স্রস্টা থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র সত্তাবান। স্রস্টা তুলনাহীন, সাদৃশ্যহীন। তার সৃষ্টি তার থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

ইসলামে অদ্বৈতবাদ (Pantheism) এর কোন স্থান নেই। এই মতে মনে করা হয় যে, সৃষ্টি ও স্রস্টা অভিন্ন, একাকার। যা স্রস্টা তা-ই সৃষ্টি ! অথবা স্রস্টা নিজেই নিজেকে সৃষ্টির মধ্যে প্রতিফলিত করেছেন। সৃষ্টির মধ্যেই স্রস্টা স্থান গ্রহণ করেছেন ! স্রষ্টাকে সৃষ্টির মধ্যেই সন্ধান করো প্রভৃতি।

কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে, স্রস্টা সৃষ্টির অস্তিত্ব দানকারী, সৃষ্টির বাইরে অবস্থিত। সৃষ্টির একমাত্র কাজ হছে স্রস্টার দাসত্ব করা, আনুগত্য হুকুমবরদারী করা। স্রস্টা ছিলেন, সৃষ্টি ছিল না। স্রস্টা সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করলেন, তার এই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে সৃষ্টির অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে। তাই কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে -

"...... আর যখন সৃষ্টিকর্তা কোন ব্যাপারের (সৃষ্টি কর্মের) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন তার কাজ হয় শুধু এই কথা বলা যে - 'হও', অমনি তা হয়ে যায়।" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১১৭)

"যখন" বলতে বিশেষ কোন সময়কে বুঝায় না। কেননা, একে তো আল্লাহ সকল সময় কালের ঊর্ধ্বে, দ্বিতীয়ত, এ সেই সময়ের কথা যখন সময় কাল বলতে কিছুই ছিল না। অপর এক আয়াতে এই কথাটি বলা হয়েছে এই ভাষায়ঃ

"কোন জিনিসকে অস্তিত্ব দানের ইচ্ছা করলে সেই জিনিসের প্রতি আমার শুধু এতোটুকু কথা বলাই যথেষ্ট যে - 'হও', তখন তা হয়ে যায়।" (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ৪০)

অর্থাৎ, তার কোন ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য কোন সাজ সরঞ্জাম বা দ্রব্য-সামগ্রী, কোন কারণ, কোন নিমিত্ত আর অবস্থার কোন অনুকূলের মুখাপেক্ষী হোন না। তার প্রত্যেকটি ইচ্ছা শুধুমাত্র তার হুকুমেই বাস্তবায়িত হয়ে যায়। তার নির্দেশেই প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী সংগ্রহীত হয়ে যায়। কারণ ও নিমিত্ত গড়ে উঠে। তার নির্দেশেই তার ইচ্ছার অনুকুল অবস্থার সৃষ্টি করে। বর্তমানের এই বিশ্বভুবন কেবলমাত্র তার হুকুমেই অস্তিত্বমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, তার ইচ্ছা পূরণে ও নির্দেশ বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক কিছুই কোথাও নেই। "হও" - এরপর হয়ে যায়, বাহ্যত কথা দুটো হলেও আর একটি অপরটির উপর ভিত্তিশীল হলেও, মূলত তা একটিমাত্র জিনিস।

এ পর্যায়ে এ বিতর্ক নিতান্তই অবান্তর যে, "হও" কথাটি বলা যায় বর্তমান থাকা কোন কিছুকে, কিন্তু এখানে বর্তমানে তো কিছুই নেই। আছেন কেবলমাত্র আল্লাহ, তিনিই এই আদেশের দাতা। আর যাকে এ আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা তো অস্তিত্বহীন (Non Existent)। কেননা, যা অস্তিত্বমান নেই বাহ্যিক দৃষ্টিতে, আল্লাহ'র ইচ্ছায় তা অস্তিত্বশীল। তাই তাকে প্রকাশমান বানিয়ে দেওয়ার জন্য "হও" বলা বিন্দুমাত্র অসঙ্গত ব্যাপার না।

তবে এই বিশ্বলোক শাশ্বত ও চিরন্তন কিনা, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এই বিশ্বলোকের চিরন্তন ও শাশ্বত (Eternal) হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। কেননা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হচ্ছে, তাপ উত্তপ্ত বস্তু থেকে উত্তাপহীন বস্তুতে সংক্রমিত হয়। এর বিপরীতটা সম্ভব নয়। প্রদত্ত শক্তি (Energy) ও অপ্রদত্ত শক্তির মধ্যে আনুপাতিক সম্পর্ক পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বলোক পৌঁছে যাবে যখন সমগ্র অস্তিত্বের জগতে তাপমাত্রা সমান হয়ে যাবে। আর তা যখন হবে, তখন জীবনেও গতিশীলতার পক্ষে কল্যাণকর শক্তি অবশিষ্টই থাকবে না। তারই পরিনতিতে রাসায়নিক ও প্রাকৃতিক কার্যক্রম নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর তার অনিবার্য পরিণতিতে জীবনের সব চিহ্নই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিঃশেষ ও বিলীন হয়ে যাবে।

এক্ষণে জীবন বর্তমান, সক্রিয়। আর সে কারণেই তাপযুক্ত সত্তাও বর্তমান। এর দরুন রাসায়নিক ও পদার্থগত কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে বিশ্বলৌকিক বস্তু সৃষ্টির। এ থেকে এ কথা প্রকট হয়ে উঠে যে, এই বিশ্বলোক শাশ্বত নয়। আর যা শাশ্বত নয় তার শক্তি খুব বেশী বিলম্বে হলেও নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তার পরিণতিতে জীবনের স্পন্দন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাবে। আমেরিকান দার্শনিক এডওয়ার্ড লুথার ক্যাসেল বলেছেন, "বৈজ্ঞানিক তত্ত্বালোচনা প্রমাণ করেছে, এই বিশ্বলোকের একটা সূচনা আছে। তাতে স্রস্টার অস্তিত্বও প্রমাণিত হয়। কেননা, সূচনা সম্পর্ক কোন জিনিস নিজস্বভাবে সূচিত হতে পারে না, সে জন্য অনিবার্যভাবে একজন সূচনাকারী স্রস্টার প্রয়োজন।" স্যার জেমস জীনসও তাই বলেছেন তার বই "The Mysterious Universe" নামের বইতে।

"তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ, তিনিই প্রকাশমান সর্ববিজয়ী, তিনিই অভ্যন্তরস্থ আর তিনিই সর্ববিষয়ে মহাজ্ঞানী।" (সূরাহ আল-হাদীদ, ৫৭ : ৩)

তিনিই প্রথম - অর্থাৎ, তিনি সব কিছুরই পূর্বে ছিলেন, সব কিছু নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পরও থাকবেন। এই বিশ্বালোক বা সৃষ্টিলোক বলতে যেখানে যা আছে, তা কিছুই যখন ছিল না, তখনো তিনি ছিলেন। আর এক সময় যখন এর কিছুই থাকবে না, সব কিছুই ধ্বংস ও নিঃশেষ হয়ে যাবে, তখনো তিনি থাকবেন। কেননা, তিনিই একমাত্র শাশ্বত সত্তা। তিনি সময় কালের হিসাবের ঊর্ধ্বে। যখন এই সময় কাল সূচিত হয়নি, সময় কালের হিসাব বা গণনারও কিছু ছিল না, তখনো তিনি স্ব-সত্তায় মহিয়ান হয়ে ছিলেন।

আবার যখন সময়কালের গতিপ্রবাহ স্তব্ধ হয়ে যাবে, বিশ্বলোক ও সৃষ্টিলোকের সব কিছুই চূর্ণ-বিচূর্ণ, ধ্বংস এবং নিঃশেষ ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখনো তিনি স্বীয় মহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবেন। তার নিজের শেষ বা সূচনা নেই, নেই কোন পরিসমাপ্তি।

মর্যাদায় তিনি যেমন সর্বোচ্চে, সক্রিয়তায়ও তিনি সর্বাগ্রে। তার সত্তা কোন কাল বা সময়ের আওতার মধ্যে নয়, সময় কালের হিসাবের মধ্যে পড়ে না তার সত্তা ও সক্রিয়তা। কেননা তিনি অন্যান্য সবকিছুর মতো সময় ও কালেরও স্রস্টা। সময় ও কাল তারই সৃষ্টি। তাই সৃষ্টির উপর স্রস্টার অগ্রবর্তীতা ও পূর্ববর্তিতা কিছুমাত্র দুর্বোধ্য বা অমানুমেয় নয়। পরন্ত সবকিছুই যখন নিঃশেষ হয়ে যাবে, তখন সময় কালের গতি ও হিসাবও স্তব্ধ হয়ে পড়বে। কিন্তু তার সক্রিয়তা থেমে যাবে না।

তিনিই প্রকাশমান - অর্থাৎ, বিশ্ব চরাচরের যেদিকেই তাকানো যায়, সে দিকেই স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায় তার অসীম ক্ষমতা ও সক্রিয়তার বাস্তব লক্ষণ। কেননা যা কিছুই গোচরীভূত হয়, তা আছে বলেই গোচরীভূত হয়। আর আছে এজন্য যে, তিনিই সেই জিনিসকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। তা সবই সৃষ্ট ও নশ্বর, তাই স্রস্টা অবিনশ্বর, তার উপর বিজয়ী, কর্তৃত্বশালী ও নিয়ন্ত্রণকারী। সৃষ্টিই স্রস্টার অস্তিত্বের অকাট্য ও অনস্বীকার্য প্রমাণ। সে সাথে সৃষ্টির নশ্বরতা স্রস্টার অবিনশ্বরতার অনিবার্য ফল। সৃষ্টির একটা সময় ছিল, যখন তা সৃষ্ট হয়নি, অর্থাৎ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু স্রস্টা চির বর্তমান, চির অম্লান, চির ভাস্বর আর এ কারণেই তিনি এক, অনন্য। কেননা, এরূপ সত্তা একাধিক হওয়া সম্ভব নয়। অতএব, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যে এক ও অনন্য, তা এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত।

কিন্তু সে সাথে এ কথাও সত্য যে, মহান আল্লাহ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন, তার মহান সত্তা না স্পর্শ করা যেতে পারে, না দেখা যেতে পারে এই দুনিয়ায় মানুষের এই চোখ দিয়ে।

".... তিনি ছাড়া সত্যই কোন ইলাহ নেই, সবকিছুই ধ্বংসশীল - কেবল তার মহান সত্তা ব্যতীত, সার্বভৌমত্ব ও শাসন কর্তৃত্ব কেবলমাত্র তারই এবং তোমরা সকলে তারই কাছে ফিরে যেতে বাধ্য।" (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮ : ৮৮)

"প্রত্যেকটি জিনিসই যা এই জগতে রয়েছে অবশ্যই ধ্বংসশীল ও বিলিয়মান। কেবলমাত্র তোমার মহীয়ান গরিয়ান রব - এর পবিত্র সত্তাই চিরন্তন হয়ে থাকবে।" (সূরাহ আর-রহমান, ৫৫ : ২৬-২৭)

"...... প্রত্যেকটি সময়ই তিনি নবতর ভিন্নতর অবস্থায় অবস্থান করেন।" (সূরাহ আর-রহমান, ৫৫ : ২৯)

অর্থাৎ, আল্লাহ'র মহান সত্তা চিরন্তন, শাশ্বত। তিনি চিরদিন ছিলেন, চিরদিন আছেন, চিরদিনই থাকবেন। ধ্বংস বা বিলুপ্তি থেকে তিনি চির মুক্ত ও চির ঊর্ধ্বে। তিনি ছাড়া এই বিশাল জগত যেহেতু সৃষ্ট, নতুন করে অস্তিত্বপ্রাপ্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া একান্তই অবধারিত অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী।

এই বিশ্ব কর্মক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তার সীমাহীন কর্মক্ষমতাকে সদা কার্যকর করে রেখেছেন। তার এই কর্মতৎপরতার একটি শেষহীন সীমাহীন ধারাবাহিকতা অব্যাহত ধারায় চলছে। তিনি কাউকে জীবন দিচ্ছেন, কারো জীবন শেষ করে দিচ্ছেন। কাউকে ঊর্ধ্বে তুলছেন, কাউকে নিচে ঠেলে দিচ্ছেন। কাউকে রোগাক্রান্ত করছেন, কাউকে নিরাময়তা দান করছেন। কোন নিমজ্জিতমানকে উপরে ভাসিয়ে তুলছেন, কোন ভাসমানকে ডুবিয়ে মারছেন। সীমা সংখ্যাহীন সৃষ্টিকুলকে তিনি রিযক দিচ্ছেন, সীমাসংখ্যা পরিমাণহীন দ্রব্য সম্ভাব তিনি নিত্য নতুনরূপে ও গুণে, আকারে ও আকৃতিতে তৈরি করছেন। অন্যদিকে এসব কিছুকে তিনি আবার ধ্বংসও করছেন। তার সৃষ্ট এই বিশাল জগত একই অবস্থায় স্থিতিশীল হয়ে থাকছে না। বিশ্ব প্রকৃতিতে যেমন চলছে নিত্য নতুন নির্মাণ প্রক্রিয়া, তেমনি চলছে ধ্বংস বিলয়, ভাঙন ও বিপর্যয়। কোথাও ভুমিকম্পে স্থলভাগে চলছে ভূমিধ্বস, কোথাও মহাসমুদ্রের অতল গহবর থেকে জেগে উঠছে নতুন নতুন দেশ, মহাদেশ। এই জগতের অবস্থা প্রতিটি মুহূর্তই পরিবর্তনশীল। মহান স্রস্টা প্রতি মুহূর্ত তাকে এক নতুন রূপে ও সজ্জায় সাজিয়ে তুলছেন। তা যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি ক্রমঃবিকাশমান।

বিশ্ব জাহানের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও মহান আল্লাহ স্ব-শক্তি, স্ব-কুদরাতে ও স্বীয় গুণপরিচিতিতে চিরকালই অক্ষয় অব্যয় অম্লান হয়ে থাকবেন। সৃষ্টিকুলের ধ্বংসের কোন প্রতিক্রিয়াই তার সত্তাকে ক্ষুণ্ণ করবে না বিন্দুমাত্রও। তাই অপর আয়াতে বলা হয়েছেঃ

"তোমাদের কাছে যা আছে তা সব ফুরিয়ে যাবে, আর আল্লাহ'র কাছে যা আছে তা সবই যথাযথ স্থায়ী হয়ে থাকবে ...." (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ৯৬)

(এখানে কয়েক লাইনের ছোট্ট একটি প্যারা বাদ দিয়েছি এ কারণে যে, আকিদাগতভাবে সংশ্লিষ্ট এ বক্তব্যের দলীল আমার জানা নেই, তাই আমি এটা উপস্থাপন করছি না। আল্লাহ'ই সবচেয়ে ভালো জানেন।)

হাদিসে আল্লাহ'কে লক্ষ্য করে এ বাণীটি উদ্ধৃত হয়েছেঃ

"হে আল্লাহ, আপনিই সবকিছুর উপর প্রকাশমান, বিজয়ী ও সর্বোচ্চ, অতএব আপনার উপরে কিছু নেই, কেউ নেই।"

আল্লাহ বাতিন - অন্তর্নিহিত প্রচ্ছন্ন সবকিছুই তার কাছে উদঘাটিত, প্রকাশিত। তার নিকট থেকে গোপন কিছু নেই, থাকতে পারে না। সমস্ত জিনিস ও ব্যাপারের অন্তর্নিহিত নিগূঢ় রহস্য তার আয়ত্তাধীন। তার এই সীমা পরিসীমা ও কূল কিনারাহীন জ্ঞানকে কেউই আয়ত্ত করতে পারে না। তার নিগূঢ় তত্ত্ব সমূহও কেউ জানতে পারে না। যেমন অপর এক আয়াতে আল্লাহ'কে লক্ষ্য করে বলা হয়েছেঃ

"..... আপনি অনেক বেশী জানেন আমার মনের কথা, কিন্তু আমি তো জানি না আপনার মনের কথা ....." (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১৬)

বলা হয়েছেঃ

"..... আর তিনিই অন্তর্নিহিত সববিষয়ে সর্বাধিক অবহিত।" (সূরাহ আল-হাদীদ, ৫৭ : ৬)

দিল বা মন মানুষের। তাতে নানান সময় নানান কথার উদয় হয়। নানান চিন্তা বিশ্বাস বা মূল্যবোধের সঞ্চার হয়। মানুষ অনেক সময় নিজেও ঠিক বুঝতে পারে না তার মনের অবস্থা। কিন্তু আল্লাহ সেই সব বিষয়ে পূর্ণমাত্রায় অবহিত থাকেন।

"আমরা প্রত্যেকটি জিনিস একটি পরিমাণ সহকারে সৃষ্টি করেছি। আর আমাদের সিদ্ধান্ত একটি একক ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই হয়ে থাকে ...." (সূরাহ আল-কামার, ৫৪ : ৪৯-৫০)

অর্থাৎ, আল্লাহ'র এই সৃষ্টিলোকের কোন জিনিসই বিশৃঙ্খল ও অপরিমিতভাবে সৃষ্টি হয়নি। প্রত্যেকটি জিনিসেরই একটি তাকদির - একটি সামগ্রিক পরিমাণ নির্ধারণ রয়েছে। তদনুযায়ীই একটি বিশেষ সময় তা অস্তিত্ব লাভ করে, একটি বিশেষ রূপ ও আকার-আকৃতি গ্রহণ করে, একটি বিশেষ পরিমাণ পর্যন্ত তা প্রবৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করে, একটি বিশেষ মেয়াদ পর্যন্ত তা অবশিষ্ট থাকে আর একটি বিশেষ সময়ে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। এই বিশ্ব ব্যাপক ও সর্বাত্মক (Universal) নিয়ম-পদ্ধতি অনুযায়ী আল্লাহ'র এই মহাসৃষ্টিকর্ম অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে, তা অব্যাহতভাবে চলবে, চলতে থাকবে, যদ্দিন তিনি তা চালাতে চাইবেন। আর যখন তিনিই তা শেষ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তখন তা নিঃশেষ ও স্তব্ধ হয়ে যাবে। এই বিশ্বলোক অনাদিও নয়, আর অবিনশ্বরও নয়। তা চিরকাল ছিল না যেমন, তেমনি চিরকাল থাকবেও না। এই হচ্ছে সমগ্র বিশ্বলোকের তাকদীর।

গ্রন্থপঞ্জিঃ

১. আল কুরআনুল কারীম

২. তাফহীমুল কুরআন

৩. তাফসীরে কাবীর

৪. তাফসীর আল-মারাগী

৫. তাফসীর মাহাসীনুত-তাবীল

৬. الظو اهرالجغرا فية بين العلم والقران

৭. The Mysterious Universe

৮. তাফসীর আল-মীযান

 

সূত্রঃ স্রস্টা ও সৃষ্টিতত্ত্ব (মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম রাহিমাহুল্লাহ)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-4p

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রয়োজনীয়তা

 

 

 

The Greatest Nation·Thursday, February 28, 2019

 

 

 

 

 

ইমাম রাযী তাফসীরে কাবীরে লিখেছেনঃ আল্লাহ'র বিচারক ও শাসনকর্তারূপ গুণের চাহিদা এই যে, যেভাবে পৃথিবীর বাদশাহগণ নিজেদের প্রজা সাধারনের কাছে রাষ্ট্রীয় আইনকানুন স্বয়ং নিয়ে আসেন না, বরং এ কাজের জন্য নিজের প্রতিনিধি বা দূত নিয়োগ করেন এবং তাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় বিধান জারি করেন, অনুরূপভাবে তিনিও আপন বান্দাদের কাছে রাসুল প্রেরণ করেন এবং তার মাধ্যমে আপন বিধানাবলি প্রচার করেন।

এরপর তার প্রজ্ঞাগুণ এটাই কামনা করে যে, যেন এর উপর আমলকারীদেরকে পুরস্কৃত আর এর বিরুদ্ধচারীদেরকে শাস্তিও দেওয়া হয়। যদিও সৃষ্টিকর্তা ও প্রভু হওয়ার কারণে এ সব ছাড়াও পুরস্কার এবং শাস্তি দেওয়ার নিঃশর্ত তার ছিল, কিন্তু তার প্রজ্ঞাগুণের চাহিদা হলো যাকে শাস্তি দিবেন, তার পাপ সম্বন্ধে তাকে জানিয়েই তা দিবেন, যাতে শেষ বিচারের দিন অজ্ঞতার অজুহাত পেশ করার সুযোগ না পায়। ইরশাদ হয়েছে -

"হে কিতাবীরা, রাসুল প্রেরণের বিরতির পর আমার রাসুল তোমাদের কাছে এসেছেন, তিনি তোমাদের কাছে স্পষ্ট ব্যাখ্যা করছেন, যাতে তোমরা বলতে না পারো - কোন সুসংবাদবাহী ও সাবধানকারী তো আমাদের কাছে আসেনি, এখন তো তোমাদের কাছে একজন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এসেছেন ....." (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১৯)

"যদি আমি ওদেরকে ইতিপূর্বে শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করতাম, তবে ওরা বলতো - হে আমাদের রব, আপনি আমাদের কাছে একজন রাসুল প্রেরণ করলেন না কেন ? করলে আমরা তো লাঞ্ছিত ও অপমানিত হওয়ার আগেই আপনার নিদর্শন মেনে চলতাম।" (সূরাহ তো-হা, ২০ : ১৩৪)

"..... আর আমি রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকেই শাস্তি দেই না।" (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ : ১৫)

ইমাম রাযী আরো লিখেছেনঃ আল্লাহ'কে জানা জ্ঞানত প্রতিটি সৃষ্টির জন্য আবশ্যিক, নবীগণ ছাড়া এ জ্ঞান অর্জন করা কোনক্রমেই সম্ভব না। কাজেই নবুওয়াত ও রিসালাতকে অস্বীকার করা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ'র মহান সত্তাকেই অস্বীকার করা। ইরশাদ হয়েছে -

"তারা আল্লাহ'র যথার্থ মর্যাদা উপলব্ধি করেনি যখন তারা বলে - আল্লাহ মানুষের জন্য কিছুই নাযিল করেননি ....." (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ৯১)

অর্থাৎ, যখন এসব লোক রাসুলগণের প্রতি শরীয়াত অবতরণের বিষয়টি অস্বীকার করে, তারা যেন আল্লাহ'র পক্ষ থেকে রাসুল আগমনকেই অস্বীকার করে। আর রিসালাতকে অস্বীকার এ বিষয়ের প্রমাণ যে, আল্লাহ প্রদত্ত গুনাবলী এবং উচ্চতর মর্যাদা সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই অর্জিত হয়নি।

আজকের দুনিয়ার জাতিসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিন, আপনার কাছে সুপ্রমাণিত হয়ে যাবে যে, যেসব সম্প্রদায় নবুওয়াত ও রিসালাতকে অস্বীকার করেছে, আল্লাহ সম্বন্ধেও তাদের ধারণায় কোন অংশ নেই, বরং রাসুলকে জানার ব্যাপারে যে যতোটা পিছনে থেকেছে, সে আল্লাহ'কে জানার ব্যাপারেও ততোটাই পিছনে রয়ে গেছে।

খৃষ্টান জগতে আজ যাদের যুগশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বলা হয়, তারা তাদের রাসুলের সঠিক পরিচয় জানতে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই দেখুন, আল্লাহ'র পরিচয় লাভের কতোটা অংশ তারা লাভ করেছে। এমনকি ত্রিত্বের আনুগত্যের মতো মৌলিক বিষয়ও তাদের কাছে তাকদিরের মতোই ধর্মীয় রহস্যে পরিণত হয়ে আছে।

এর বিপরীত হলো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত, যখন তারা নিজেদের রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সঠিকভাবে চেনার ব্যাপারে অগ্রগামী হয়েছে, তখন তাদের রব সম্বন্ধে সম্যক পরিচিতিও তারা পূর্ণরূপে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ জন্যই এ উম্মতকে সমস্ত উম্মতের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে। যেমন -

"তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ করো আর আল্লাহ'তে বিশ্বাস করো ......" (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১১০)

উপরোক্ত আয়াতের আলোকে এবার সহজেই এ ফয়সাল করা যায় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতকে যে অস্বীকার করে, অথচ তাওহীদের প্রবক্তা, প্রকৃত অর্থে তাওহীদ ও আল্লাহ'র প্রতি ঈমান কি তাদের ভাগ্যে জুটেছে ?

এ জন্যই ইমাম রাযী বলেছেন, "যে ব্যক্তি নবুওয়াত ও রিসালাতকে অস্বীকার করলো, প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহ'র মহান সত্তাকেই স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বঞ্চিত রইলো।" (তাফসীরে কাবীর, ৪খ.)

কাজেই নবুওয়াত ও রবুবিয়াতের পারস্পরিক সম্পর্ক এতোটাই সুস্পষ্ট যে, এতে পার্থক্য করার কোনই সুযোগ নেই। এ প্রেক্ষিতে কুরআনুল কারীম বলছে -

".....তারা আল্লাহ ও তার রাসুলের মধ্যে ঈমানের ব্যাপারে তারতম্য করতে চায়...." (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ১৫০)

"কেউ রাসুলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহ'রই আনুগত্য করলো ....." (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৮০)

এক্ষণে চিন্তা করুন, যে মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানা বা না জানা আল্লাহ'কে জানা বা না জানার অনুরূপ; পৃথিবীতে বন্ধু ও শত্রুর মাঝে পার্থক্য এবং আখিরাতে জাহান্নাম ও জান্নাতের তাদের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল, যেন দুনিয়া ও আখিরাতের তাদের কারখানার সাথে সম্পর্কিত - তিনি কতোই না বড় ব্যক্তিত্ব।

প্রকৃতপক্ষে স্রস্টার অনুগ্রহ ও দয়ার সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী হলো এ মহান ব্যক্তিবর্গ, তাদের আগমনের ফলেই ধারণা করা সম্ভব হয়েছে যে, মহান দয়াময়ের স্বীয় সৃষ্টির প্রতি কতোই না মেহেরবান যে, যখন অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ সীমা অতিক্রম করে, তারা বন্ধুদের কাতার থেকে শত্রুদের কাতারে শামিল হয় এবং হিদায়াতের আলোকমালা ছেড়ে পথভ্রষ্টতার অন্ধকারকে বরণ করে নেয় আর জান্নাতের অফুরান নিয়ামত থেকে বঞ্ছিত হয়ে ধ্বংসের অতল গহবরে পতিত হয়, তখন তাকে ধ্বংস করে দেওয়ার পরিবর্তে তার এর স্থায়িত্বের উপকরণ সৃষ্টি করে দেন। দুশমনদের কাতার থেকে বের করে এনে বন্ধুদের কাতারে শামিল করে দেন। অন্ধকারের ঘোর অমানিশায় নিপতিত হওয়ার পর হিদায়াতের বিচ্ছুরিত আলোকের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেন এবং ধ্বংসের গহবর থেকে উদ্ধার করে জান্নাতুল ফিরদাওসের অধিকারী বানিয়ে দেন। অথচ এ সমস্ত নিয়ামত ও সৌভাগ্য কেবল ঐ পবিত্র আত্মাগণের বদৌলতে অর্জিত হয়।

সুবহানাল্লাহ ! রাসুলগণের মহান ব্যক্তিত্ব কতোই না উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আর কতোই না রহস্যময় হয়ে থাকে। যারা তাদের সাথে সম্পর্ক গড়তে পারেন, তার সম্পর্ক মহান স্রস্টার সাথে গড়ে উঠে। আর যে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তার সম্পর্ক স্বয়ং স্রস্টা থেকেই ছিন্ন হয়ে যায়।

".... তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন ...." (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১০৩)

 

হাফিয ইবন কায়্যিম চমৎকার বলেছেন যে - নবীগণের কথা, কাজ ও চরিত্র সেই সঠিক মানদণ্ড, যে এ মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে, সে পুরোপুরি উৎরে গেছে। আর যে এতে পিছলে পড়েছে, সে সমুদয় কাজেই ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি বলেছেন - শরীরের জন্য আত্মার যতোটা প্রয়োজন আর চোখের জন্য আলোর যতোটা প্রয়োজন, তা থেকে বেশী প্রয়োজন বিশ্ববাসীর জন্য নবীগণের। কেননা, শরীরের জন্য আত্মার আর চোখের জন্য আলোর প্রয়োজন কেবল জীবিতাবস্থায় পার্থিব জীবনের সাথে সীমাবদ্ধ আর পার্থিব জীবনও স্বয়ং সীমাবদ্ধ। কিন্তু এ পবিত্র আত্মাগণের সম্পর্ক উভয় জাহানের সাথে সম্পর্কিত। মানুষ আপন আকস্মিক ও স্থায়ী উভয় জীবনেই সরাসরি তাদেরই মুখাপেক্ষী।

উক্ত ইমাম সাহেব এরই সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে নবীগণের পরিচিতি সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে - যেভাবে আল্লাহ'র বাদশাহী গুণের চাহিদা ছিলো আপন সৃষ্টির প্রতি স্বীয় রাসুলগণকে প্রেরণ করা, অনুরূপভাবে তার শক্তিগুণের চাহিদা ছিল, রাসুলগণের মাধ্যমে এমন কর্মের প্রকাশ ঘটানো যা সাধারণ মানুষের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে, যাতে করে এটি তার নিদর্শনে পরিণত হয় যে, প্রকৃতপক্ষে তারা এমন সত্তার পক্ষ থেকে এসেছেন, যার শক্তির সামনে সবাই অক্ষম। আর এতে রাসুলগণের ব্যক্তিত্বের সম্যক পরিচিতি হয়ে যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি মুজিযা অস্বীকার করে, বাস্তবে সে আল্লাহ'র শক্তিগুণেরই অস্বীকারকারী।

উক্ত ইমাম সাহেবের উদ্দেশ্য হলো, মুজিযা নবীগণের নিজস্ব কর্ম নয়, কাজেই তাদের অপরাপর কর্মের মতো এটা তাদের ক্ষমতা আর ইচ্ছার মাধ্যমে ঘটে না যে, যখন ইচ্ছা করবেন, অপরাপর কাজের মতো মুজিযাও দেখিয়ে দিবেন। কাজেই এখানে মুজিযাকে অপরাপর মানবীয় কর্মকাণ্ডের সাথে তুলনা করাই ভুল। যদি তুলনা করতে হয়, তবে স্রস্টার সরাসরি কর্মের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আসমান ও যমিনে মহান স্রস্টার সৃষ্ট আশ্চর্য ও দুর্লভ বস্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কোন নবীর কোন মুজিযাই তার থেকে অভাবনীয় নয়।

কুরআনুল কারীমে বর্ণিত মুজিযাসমূহ আর হাদিসসমূহে বর্ণিত সমস্ত মুজিযা আল্লাহ'র সরাসরি সৃষ্টির বিপরীতে রাখুন, তাহলে আপনার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাবে যে, স্রস্টার সরাসরি কর্ম যদি যুক্তিসম্মত হয়, তবে সেই শক্তির সামনে মুজিযাসমূহও অযৌক্তিক হতে পারে না। কিন্তু যে ব্যক্তি নবীগণের মাধ্যমে স্রস্টার অলৌকিক কর্মকে অস্বীকার করে, তার জন্য স্রস্টার অপরাপর সরাসরি কর্মকে মেনে নেওয়ার কোন যুক্তিসম্মত কারণ নেই।

উক্ত ইমামের এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় রিসালাত ও নবুওয়াতের প্রয়োজনীয়তা, তাদের পরিচিতি - এ উভয় প্রসঙ্গের জ্ঞানগত ও উদ্ধৃতিগত, উভয় পদ্ধতিতেই প্রমাণিত হয়ে গেলো। আল্লাহ যাকে কোন নূর দেননি, তার জন্য কোন নূর নেই।

 

হাফিয ইবন তাইমিয়া লিখেছেনঃ সৃষ্টির দিন এবং দুনিয়ার জন্য যে বস্তুর প্রয়োজন যতোটা তীব্র ছিলো, বিশ্ব স্রস্টা ততোটাই বেশী দয়ার্দ্র ও উদারতার সাথে সেসব সৃষ্টি করেছেন। দেখুন, শ্বাস গ্রহণের জন্য প্রত্যেকেরই বাতাসের প্রয়োজন এবং সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। কাজেই এর সৃষ্টিও এ পরিমাণে করা হয়েছে যে, আপন প্রয়োজন পূরণে কারো কোথাও কোন কষ্টই হয় না। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে হয় পানির প্রয়োজন। এরপর পানাহারের। এ জন্য পানিও পর্যাপ্ত পরিমাণে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু অতটা প্রচুর নয়, যতোটা প্রাচুর্য রয়েছে বাতাসের।

একইভাবে এবারে দ্বীনী বিষয়ের দিকে দৃষ্টি ফিরান, তা এখানে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন স্রষ্টাকে জানা, এ জন্য তিনি নিজ রবুবিয়াতের প্রমাণাদি মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে এমনভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে ছড়িয়ে দিয়েছেন যে, প্রতিটি অণুই তার রবুবিয়াতের সাক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।

আর প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে রয়েছে তারই নিদর্শন

যা প্রমাণ করে - নিশ্চয়ই তিনি এক।

এরপর দ্বিতীয় নাম্বারে প্রয়োজন নবুওয়াতের। এটা কে জানে না যে, একজন মানুষ তারই মতো অপর একজন মানুষের খুশী-অখুশীর কারণ এবং উপকরণ কেউ বলে দেওয়া ছাড়া জানতে পারে না, তাহলে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির কারণাদি তিনি বলে দেওয়া ছাড়া কে জানতে পারে ? এ জন্যই তিনি নবীগণকে প্রেরণ করেছেন, যাতে করে তাদের মাধ্যমে তার সমুদয় বিষয় বিস্তারিত বর্ণনা করতে পারেন।

আর তাদেরকে সনাক্ত করার প্রমাণাদিও এতো ব্যাপকভাবে প্রকাশ করে দিয়েছেন যে, একজন অজ্ঞ থেকে অজ্ঞতম ব্যক্তির পক্ষেও তাকে সনাক্ত করা মোটেও কষ্টকর থাকেনি। জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণের ক্ষেত্র পরিত্যাগ করে আপনি নিজেই যদি তার জীবনেতিহাস পর্যালোচনা করেন, তাহলে আপনি জানতে সক্ষম হবেন যে, মহান সৃষ্টিকর্তা তাকে চেনার উপকরণাদি প্রতিটি যমানায় এতো বেশী পরিমাণে সন্নিবেশিত করে রেখেছেন যে, অশিক্ষিত মূর্খ ব্যক্তির জন্যও নবীগণকে সনাক্ত করতে মোটেই কষ্টসাধ্য ছিল না। এমনকি তার শত্রুদের পক্ষেও তাকে অস্বীকার করা চিন্তাভাবনার বিষয়ে পরিণত হয়েছিলো।

পবিত্র কুরআনে মুসা আলাইহিস সালামের সাথে ফিরআউনের মতো স্রস্টার দাবিকারীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সেখানে দেখুন, জাদুকরেররা কিভাবে মুসা আলাইহিস সালামের সামনে এসে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নবুওয়াতের সমর্থন করতে বাধ্য হলো, আর তাও কতোটা প্রত্যয়ের সাথে যে, এর পর ফিরআউন হাজারো হুমকি ধমকি দিলো, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা কি বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেছিলো ? বরং পরিষ্কারভাবে তারা ঘোষণা করলো -

".... সুতরাং তুমি করো, যা তুমি করতে চাও, তুমি তো কেবল এ পার্থিব জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে পারো। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছি, যাতে তিনি আমাদের পাপ এবং তুমি আমাদেরকে যে যাদু করতে বাধ্য করেছ, তা ক্ষমা করেন ...." (সূরাহ তো-হা, ২০ : ৭২-৭৩)

আবার, শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারপাশে প্রমাণের যে বারিধারা বর্ষিত হয়, যার বাস্তবতা আজও পৃথিবীর জীবন্ত ইতিহাস হিসেবে সুপ্রকাশিত, কতোটা নিঃসঙ্গ অবস্থায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমন করেছেন এবং কতোটা গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয়ভাবে বিশ্বকে কয়েক বছরের মধ্যেই জয় করে ফেললেন - যার মধ্যে বাদশাহও ছিল, ফকীরও ছিল, গণক ও জাদুকরও ছিল, ছান্দিক চারণ কবিও ছিল। আর যেসব জেদি ও একগুঁয়ে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানেনি, তাদের এ অস্বীকৃতির দরূন কতো চক্রান্ত, কতো অত্যাচার, আর কতো যুদ্ধ বিগ্রহের সম্মুখীন হতে হয়েছে, আর এতেও কোন দল তাদের সঙ্গী হয়নি। অবশেষে পরাজয়ের কলঙ্ক কপালে লাগিয়ে নিয়ে বঞ্চিত ও ব্যর্থ হয়ে পৃথিবী থেকে চলে গেছে।

"সুতরাং ওরা কুরআনের পরিবর্তে আর কোন কথায় বিশ্বাস স্থাপন করবে ?" (সূরাহ আল-মুরসালাত, ৭৭ : ৫০)

(আল- জাওয়াবুস সহীহ, ৪খ.)

 

ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেসানী স্বীয় "মাকতুবাত শরীফ" এ বিভিন্ন স্থানে নবুওয়াতের প্রয়োজনের উপর দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। যার সারমর্ম এই যেঃ পরম দয়ালু আল্লাহ তার সাধারণ দানসমূহের মধ্যে, - যা কোন রাষ্ট্র, কোন ভূখণ্ড এবং কোন বিশেষ দলের সাথে নির্দিষ্ট ছিল না, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দান ছিল এটিই যে, তিনি তার আর তার বান্দাদের মধ্যে কথোপকথনের পথ সৃষ্টি করেছেন।

"... এমন কোন সম্প্রদায় নেই যাতে সতর্ককারী আসেনি।" (সূরাহ ফাতির, ৩৫ : ২৪)

যিনি এসে যে সম্পদের প্রাচুর্য লাভ করে যে কেউ ঈর্ষনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে পারে, তা সুলভ করে দিয়েছেন।

অস্তিত্বের নিয়ামত, মেঘ ও বারিধারার নিয়ামত, সূর্য ও চাঁদের নিয়ামত এবং সর্বোপরি মানুষের সভ্যতার নিয়ামত, এ সবই যেন ঐ সাধারণ নিয়ামতের অন্তর্ভুক্ত - যা বন্ধু ও শত্রু, বাদশাহ ও ফকির সবার জন্যই সুলভ রাখা হয়েছে।

কিন্তু এসব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান নিয়ামত হলো নবুওয়াতের নিয়ামত। যদি এ নিয়ামত না হতো, তাহলে সমস্ত নিয়ামতই মূল্যহীন হয়ে পড়তো। এ নিয়ামতের মাধ্যমে বিশ্বপ্রভু আল্লাহ আপন সত্তা ও গুনাবলীর মর্যাদাপূর্ণ জ্ঞান দান করেছেন, হাশর এবং পুনরুত্থান, জান্নাত ও জাহান্নাম এবং মানুষের স্থায়ী ও অফুরান জীবন সম্পর্কে অবহিত করেছেন। এবং অদৃশ্য জগতের মহামূল্যবান বাস্তবতার পর্দা করেছেন উন্মোচন। এহেন পবিত্রাত্মাগণের মাধ্যমেই নিজ সন্তুষ্টির মাধ্যম দেখিয়েছেন।

মানবীয় জ্ঞান তা যতোই দূরদর্শী হোক না কেন, কিন্তু তার দৌড় কেবল সম্ভাবনার জগত পর্যন্ত, তাও আবার বেশীরভাগ আপন পারিপার্শ্বিক অনুভবযোগ্য এবং চাক্ষুস দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ। আল্লাহ'র পবিত্র সত্তা পর্যন্ত যদি কোন জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তির পৌঁছা সম্ভব হয়েও থাকে, তবে তাও ছিল অসমাপ্ত এবং অসম্পূর্ণ থেকে অসম্পূর্ণতর।

এক্ষেত্রে যুক্তি প্রমাণের কোন তীর যদি চালানোও হয়ে থাকে, তবে তা বেশীর থেকে বেশী এতোটুকু যে, অবহিত করা হয়ে থাকবে, এ বিশ্বের জন্য কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ স্রস্টা থাকা তো আবশ্যক, যার সৃষ্টির সাক্ষ্য পরতে পরতে দৃশ্যমান, কিন্তু তার একত্ববাদ আর সে একত্ববাদের মাধুর্য, তার গুণাবলী আর সে গুণাবলীর তাৎপর্য, এখানে এসে বেচারা জ্ঞান হয়রান পেরেশান হয়ে পড়েছে। এ উপত্যকায় পূর্বতন আলিমগণ যখন পা রেখেছেন আর আপন জ্ঞানের দৌড়কে সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন, তখন তার ফলাফল এই বেড়িয়েছে যে, আল্লাহ'কে কর্তা আর কারণ হিসেবে তো মেনে নিয়েছেন, কিন্তু তা অপ্রস্তাবিত অর্থাৎ অক্ষম হিসেবে। তার পবিত্র সত্তা ও সৃষ্টির মাঝে অনেকগুলো মাধ্যম সৃষ্টি করেছেন আর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির অস্তিত্ব যার প্রতি ন্যস্ত করেছেন, তার নাম রেখেছেন "আকলে আশা"।

"... তাদের মুখনিঃসৃত বাক্য কি সাংঘাতিক, ওরা তো কেবল মিথ্যাই বলে।" (সূরাহ আল-কাহফ, ১৮ : ৫)

ঐ নক্ষত্র, যার অস্তিত্বের প্রমাণও আজকাল পাওয়া যায় না, তাকেই আদি হিসেবে ধরা হয়েছে, বরং একে নিজ ইচ্ছায় চলমান বলা হয়েছে। এতেই শেষ নয়, বরং এর ভেঙ্গে যাওয়া অর্থাৎ ছিঁড়ে ফেড়ে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াকে অসম্ভব মনে করা হয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত এতটা অবুঝের প্রমাণ দিয়েছে যে, আল্লাহ'র সত্তা থেকে সরাসরি বিশ্বের প্রকাশ পাওয়াকে অসম্ভব সাব্যস্ত করা হয়েছে। বাকী রইলো আল্লাহ'র গুণ। তা এর দ্বারাও তাদের ভাগ্যে কোন সুফল দেখা দেয়নি, আল্লাহ'র ফেরেশতা আর অপরাপর অদৃশ্য সৃষ্টির উল্লেখ তো দূরের কথা, আপনি তো দেখেছেন, মানুষ যখন কেবল অনুভবযোগ্য ও দর্শনযোগ্য মূলের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন তার পরিণতি কি দাঁড়ায়।

এরপর যখন আমাদের পণ্ডিতবর্গের যমানা এলো, তখন এ উচ্চাভিলাষীদের দৃষ্টি এতোই পশ্চাৎপদ ছিল যে, তারা সরাসরি সৃষ্টিকর্তাকেই অস্বীকার করে বসলো এবং বিশ্বের অস্তিত্বকে খোদ বিশ্বের (প্রকৃতির) হাতে ছেড়ে দিয়ে আপন জ্ঞানের পূর্ণ শক্তি বস্তুবাদ অনুসন্ধানের পিছনে ব্যয় করে ফেললো। এরপর এরই প্রেক্ষাপটে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি তাদের সামনে এলো, তা এমন প্রশ্ন ছিল, মানবীয় আভিজাত্য যাকে সবসময় কুনজরে দেখে থাকে, অর্থাৎ সম্পদের বণ্টন ও পেটের প্রসঙ্গ।

এ পণ্ডিতেরা যদি এতোটুকু ভেবে দেখতো যে, সৃষ্টিকর্তা যেভাবে তাদের বিভিন্ন মাধ্যমের জ্ঞান দান করেছেন, সেভাবে তাদের উপলব্ধির ক্ষেত্রও বিভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন।

পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতি লক্ষ্য করুন, প্রতিটি ইন্দ্রিয় অপর ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি থেকে কতোটা অজ্ঞ।

উদাহরণত, শ্রবণশক্তি দৃষ্টিশক্তি থেকে এতটাই অনবহিত, যেমনটি দৃষ্টিশক্তি শ্রবণ জগত থেকে, একজন তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিধারী ব্যক্তি যদি হাজারো চোখ মেলে ধরে কোন শব্দকে নিজের চোখ দিয়ে শুনতে চায়, তাহলে তা শুনতেও সক্ষম হবে না, দেখতেও সক্ষম হবে না। একইভাবে শ্রবণশক্তিকে যদি দর্শনীয় বস্তুর নিকট থেকে নিকটে আনা হয়, তবুও তার দ্বারা বস্তুটির আকৃতি কিংবা বর্ণ সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণাও জন্মাতে পারে না।

এখানে যদি কোন একটি ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের দ্বারা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা হলে ফলাফল অনুভূতির একটা বড় অংশকে অস্বীকার করা ছাড়া আর কি-ই বা হবে। অথচ প্রতিটি মানুষ এ ক্ষেত্রে তা অস্বীকার করার পরিবর্তে তা ইন্দ্রিয় শক্তির অপরাধ হিসেবেই সাব্যস্ত করে।

যদি সৃষ্টিকর্তা কখনো তা অনুভবের জন্য অপর কোন ইন্দ্রিয় সৃষ্টি না করতেন, তাহলে অজ্ঞ মানুষকে তা পরিষ্কার অস্বীকার করতে দেখা যেতো।

আবার মানুষকে এ পঞ্চ ইন্দ্রিয় থেকে উন্নততর এক অনুভবশক্তি দানে ধন্য করা হয়েছে, যার নাম জ্ঞান। জ্ঞানের সামনে এ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বৈশিষ্ট্য ঠিক তেমনি যে, যেমনটি একটি ইন্দ্রিয়ের তুলনায় অপরটির বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ এখানে পঞ্চ ইন্দ্রিয় সম্মিলিতভাবেও জ্ঞানের রাজত্বের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র একটি অংশ অনুভব করতেও অক্ষম প্রতিপন্ন হয়। যদি মহান অনুগ্রহকারী তাদের জ্ঞান উপলব্ধির জন্য অপর কোন অনুভূতি শক্তি দান না করতেন, তবে এ নিঃস্বগণকে নিজেদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ভরসা করে জ্ঞানের সমুদয় উপলব্ধিকে অস্বীকার করতে দেখা যেতো।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, জ্ঞানের মর্যাদাই শীর্ষস্থানে, আর সম্ভবত কোন কিছুই উপলব্ধি করতে সে অক্ষম নয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত যদি কোন একটি ইন্দ্রিয়ের অনুগত রাখা হয়, তাহলে সব অনুভূতি এর সংকুচিত পরিবেশের গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়বে। কিন্তু যখন অপরাপর ইন্দ্রিয়শক্তির প্রতিও লক্ষ্য রাখা হয়, তাহলে এ প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পাবে যে, এর সমস্ত বিস্তৃতি তার আপন অনুভূতির গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল। জ্ঞানের অবস্থাও এমনটিই বুঝতে হবে।

অদৃশ্য জগত যেমন অনুভূতি ও দৃষ্টিসীমার বাইরে, তেমনিভাবে জ্ঞানের পরিধিরও বাইরে। তা উপলব্ধি করতে জ্ঞানও ঠিক তেমনি অক্ষম, যেমনটি পঞ্চ ইন্দ্রিয় অক্ষম জ্ঞানের উপলব্ধিকে অনুভব করতে। কাজেই সেখানে যেমন সঠিক পন্থা হলো পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অক্ষমতাকে মেনে নেওয়া আর জ্ঞানের উপলব্ধিকে অস্বীকার না করা, একইভাবে এখানেও খাঁটি কথা হলো নবীগণ আর তাদের প্রতি আগত ওহীকে স্বীকার করে নেওয়া এবং নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞানের সংকীর্ণতার কারণে তাকে অস্বীকার না করা। এতে পার্থক্য যদি কিছু থাকে, তবে তা কেবল এই যে, ওখানে উপলব্ধির মাধ্যম অর্থাৎ জ্ঞান সবাই পেয়েছে, আর এখানে পেয়েছে কেবল কিছু নির্দিষ্ট ও বাছাইকৃত ব্যক্তি।

আবার জ্ঞানের ব্যাপারে যেমন প্রত্যেকে অপরের জ্ঞানের উপর বিশ্বাস রাখে, অনুরূপভাবে এখানেও নবীগণের প্রজ্ঞা ও অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তিগণ কর্তৃক তার সত্যায়নের প্রতি আস্থা রাখা উচিত ছিল এবং তাদের অদৃশ্য জ্ঞানের প্রতি কোনরূপ তত্ত্ব তালাশ না করেই মেনে নেওয়া উচিত ছিল। অথচ এ ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষই দাবী করে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সরাসরি সে নিজেই ঐ জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে সক্ষম না হচ্ছে, ততক্ষন পর্যন্ত কেবল নবীগণের বিশ্বাসের প্রতি তারা সমর্থন জানাতে পারে না।

"মানুষ ধ্বংস হোক, সে কতো অকৃতজ্ঞ।" (সূরাহ আবাসা, ৮০ : ১৭)

(মাকতুবাতে ইমাম রাব্বানী, ৩খ.)

 

মহাসম্মানিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনীর একটি ঝলকঃ সত্যপ্রিয় মানুষের চিন্তাভাবনার জন্য

এ বিস্তারিত দীর্ঘ আলোচনার পর আপনাদের সামনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা উপযুক্ত মনে করছি, যাতে উপরোক্ত আলোচনার বিষয়বস্তুর আলোকে আপনি অনুধাবন করতে সক্ষম হোন।

পবিত্র কুরআন দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, নবুওয়াত ও রিসালাতের ধারা অবশেষে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের বংশধরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং পরবর্তীতে যে নবীই এসেছেন, তারই বংশধরদের মধ্য থেকেই এসেছেন। তার দুই পুত্র ছিলেন - ইসহাক আলাইহিস সালাম ও ইসমাইল আলাইহিস সালাম। উভয়ের উল্লেখ তাওরাতে বিদ্যমান।

তাওরাতের বর্ণনানুসারে ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশে কেবল একজন নবীরই সুসংবাদ ছিল। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম যখন বায়তুল্লাহ'র নির্মাণ কাজ শেষ করলেন, তখন তিনি ইসমাইল আলাইহিস সালাম'কে - যিনি বায়তুল্লাহ নির্মাণে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তার বংশধরগণের মধ্যে একজন রাসুল প্রেরণের জন্য দুয়া করেছিলেন, যিনি ঐ পবিত্র শহরেই জন্মলাভ করবেন, যেখানে তিনি আল্লাহ'র ঘর নির্মাণ করেছিলেন। সুতরাং ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের দুয়া অনুসারে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমন করেন।

বংশধারায় সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত, খান্দানে সব থেকে অভিজাত, আপন শৈশবকাল থেকেই সর্বদা উত্তম চরিত্র, উত্তম চেহারা, অভ্যাস ও আচরণে গোত্রের সব থেকে পৃথক, উপাসনা আর সংস্কৃতিতে তাদের থেকে আলাদা, খেল তামাশা থেকে বিরূপ, শিরক ও কুফরিকে অপছন্দকারী, সত্যবাদিতা ও পরিচ্ছন্নতা আর অনুগ্রহ ও সুসম্পর্কে সুশোভিত, অত্যাচার, শত্রুতা ও অশ্লীলতা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থানকারী, যুদ্ধ বিগ্রহকে ঘৃণাকারী, ধন সম্পদের মোহ থেকে ঊর্ধ্বে, ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের শাহজাদা - মোট কথা, সৎ চরিত্রের সার্বিক গুণে গুণান্বিত আর অসৎ চরিত্রের সব প্রকার দোষ থেকে মুক্ত, যৌবনকালে নিস্পাপ নিষ্কলুষ ফেরেশতাসুলভ, বার্ধক্যে গাম্ভীর্য ও মর্যাদার প্রতিবিম্ব, প্রতিটি লোম থেকে সৌন্দর্য ঝরে পড়তো, প্রতিটি বাক্যে পুস্প ঝরতো, প্রতি অঙ্গে বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা চমকাত, ক্রোধ ও ভালোবাসা, আনন্দে ও বেদনায় একইরূপ সত্যবাদী, ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শনকারী, আল্লাহ'র সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বড় সহানুভূতিশীল, চুক্তি ও শপথ রক্ষায় প্রত্যয়ী, সবচেয়ে বেশী সত্যভাষী, সব থেকে বেশী আমানতদার।

মজার বিষয় হলো, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও ছিলেন নিরক্ষর এবং সম্প্রদায়ের লোকজনও নিরক্ষর, তাওরাত ইনজিল সম্পর্কে না তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতেন আর না জানতো তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্প্রদায়, না কারো কাছে এক হরফও পড়েছেন আর না উঠাবসা করেছেন শিক্ষিত ব্যক্তির কাছে।

দরবেশ ও সন্ন্যাসীরা সবাই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের দাবীর সাথে ছিল একমত আর আরববাসী তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গুণাবলী সম্বন্ধে ছিল ওয়াকিবহাল। এ অবস্থায়ই চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়, কোন দিন নবুওয়াতের দাবীর একটি বাক্য তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখ থেকে বের হয়নি।

যখন পবিত্র বয়স চল্লিশে পৌঁছল, তখন এমন সব আশ্চর্য দাবী করলেন, যার সাথে না দেশ পরিচিত ছিল আর না বাপ-দাদারা পরিচিত ছিল। আর এমন একটি বাক্য মানুষের সামনে পেশ করলেন, যা না আজ পর্যন্ত কেউ শুনেছে আর না ভবিষ্যতে এর উদাহরণ সম্ভব। আসমানি সহিফাসমূহ সবই এর সামনে অবনত, না প্রভুত্ব ও কর্মে কেউ সমমানের, আর না রাজনীতি ও উপার্জনে কেউ তার সহযাত্রী, গোপন রহস্যের ভাণ্ডার, জ্ঞানের সমুদ্র, কাহিনী ও উপমা, নসীহত ও শিক্ষার মহাসাগর, পবিত্রতাকে বৈধকারী আর অপবিত্রতাকে নিষিদ্ধকারী, কল্যাণের আদেশদাতা ও মন্দকাজে বাধাদানকারী, কোন ভালো জিনিস এমন ছিল না যা স্বাভাবিক জ্ঞান উত্তম মনে করেছে অথচ তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশ দেওয়া হয়নি, আর কোন মন্দও এমন ছিল না যাকে স্বাভাবিক জ্ঞান মন্দ মনে করে কিন্তু তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা নিষেধ করেননি।

এমনটি কখনো হয়নি যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশ করেছেন অথচ স্বাভাবিক প্রকৃতির চাহিদা হলো, যদি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হুকুম না দিতেন; আর না কখনো এমন কাজ নিষেধ করেছেন যার ব্যাপারে বাস্তব জ্ঞানের কামনা হলো, যদি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিষেধ না করতেন !

অধিকন্তু মোড়লী ও নেতৃত্বে অনীহা, শত্রু ও বিরোধিতাকারীদের সম্পর্কে নির্বিকার, বন্ধু ও সাহায্যকারীর মুখাপেক্ষীহীন; না ছিল তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতে কোন ধন-দৌলত, না ছিল পিছনে কোন শক্তি, না ছিল তার হাতে কোন সাম্রাজ্য। নারী ও কাঞ্চনসহ এমন কোন সম্পদ নেই যা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পদপ্রান্তে নিবেদন করা না হয়েছে, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাতে ভ্রুক্ষেপও করেননি; অবরোধ ও বন্দী, দেশ থেকে উচ্ছেদ, এমনকি হত্যার প্রচেষ্টা - হেন কোন কর্ম নেই যা প্রয়োগ করা না হয়েছে। অথচ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুশমনদের সমাবেশে একইভাবে নির্ভীক চিত্তে আল্লাহ'র দ্বীনের আহবান জানিয়েছেন।

জনপদসমূহে, বাজারসমূহে কিংবা হজ্জের মৌসুমে কোন স্থান এমন পরিত্যাগ করেননি, যেখানে পৌঁছে সত্যের আহবান না জানিয়েছেন - নিঃসঙ্গ অবস্থায় ও সভা-সমাবেশেও, সাধারণ্যে আর বিশিষ্টদের মাঝেও। তবে কখনো এমনটি ঘটেনি যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বীন গ্রহণের জন্য কাউকে হত্যা করেছেন, ধমক দিয়েছেন কিংবা কোন ধরনের লোভ-লালসায় প্রলুব্ধ করেছেন।

তেরটি বছর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এভাবেই কাটিয়ে দেন। না ছিল কোন সাজ-সরঞ্জাম, আর না ছিল কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী। অথচ এতে না ছিল তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তরে কোন ভয়-ভীতি, আর না ছিল চেহারায় কোন হতাশা।

যখন ক্ষমতা এসেছে, তখন দুশমনদের প্রতি উদারতা আর কষ্টদানকারীদের প্রতি ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন, কারো প্রতি সামান্যতম যুলুম-নিপীড়ন তো প্রশ্নাতীত, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারাটি জীবন ছিল নিক্তিতে মাপা। নিরাপদ অবস্থায় কিংবা ভীতিকর অবস্থায়, স্বাচ্ছন্দ্যে কিংবা সংকীর্ণতায়, পরাজিত অবস্থায় কিংবা বিজয়ী হয়ে, আপন অনুসারীর স্বল্পতা কিংবা আধিক্য - সর্বাবস্থায়ই দৃঢ় অবস্থান থেকে এক ইঞ্চি এদিক সেদিক সরে যাওয়া ছিল অসম্ভব।

মোট কথা এই যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন পৃথিবীতে আগমন করেন, তখন বিশ্ব ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিশ্ববাসী না ছিল দুনিয়া সম্বন্ধে অবহিত, আর না ছিল হিদায়াতের কোন পরিচিতি। মূর্তিপূজার দ্বারা আল্লাহ'র যমিন হয়ে পড়েছিলো অপবিত্র; রক্তপাত, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে ছিল বিলাপরত, না ছিল আদির কোন সংবাদ আর না ছিল পরিনামের কোন জ্ঞান। আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন আগমন করলেন, তখন তারাই পরিণত হলো সবচেয়ে বিজ্ঞে, সব থেকে সংস্কৃতমনা, সবার থেকে উত্তম দ্বীনদার, সুবিচার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠাকারী এবং পৃথিবীর দৃষ্টিতে এতোই উন্নত শির যে, যদি তাদের প্রতি বাদশাহদের দৃষ্টি পড়তো, তবে তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো, যদি কোন আহলে কিতাব তাদের দেখত, তখন অজ্ঞাতসারে এ কথা বলতে বাধ্য হতো যে, ঈসা আলাইহিস সালামের সাহায্যকারীগণ এদের চেয়ে কতোটাই বা উত্তম হবেন।

এহেন কর্তৃত্ব ও গ্রহণযোগ্যতার পর্যায়ে যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ইহধাম ত্যাগ করেন, তখন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিত্যক্ত সম্পদের মধ্যে না ছিল দিরহাম ও দিনার, না ছিল বাদশাহী বা ধন-ভাণ্ডার, ছিল একটি খচ্চর ও পবিত্র বর্ম, তাও ছিল ত্রিশ সা' যবের বিনিময়ে এক ইয়াহুদীর কাছে বন্ধক।

যখন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খলীফাগণের প্রতি লক্ষ্য করবেন, তবে তাদের মধ্যে প্রথম খলীফা - যিনি সবার মধ্যে বিখ্যাত জ্ঞানী, চরিত্রে উন্নত, সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রিয়, গোত্রে সম্মানিত; যেদিন তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গী হলেন, সেদিন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে কোন ভয়ংকর বিপদজনক স্থানেও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহচর্য ত্যাগ করেননি। প্রতিটি স্থানেই আপন প্রাণ করেছেন উৎসর্গ, নিজের সমস্ত সম্পদ তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহায্যার্থে বিলিয়ে দিয়েছেন। আর যখন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর খলীফা হোন, তখন প্রথমদিকে ফেরি করে নিজের আর পরিবারের আহারের ব্যবস্থা করতেন। পরে বাধ্য হয়ে যখন ভাতা গ্রহণ করলেন, তাও ছিল এতোই কম যে, এর দ্বারা কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করা যেতো। আর যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন, তখন বায়তুলমালের এ সীমিত ব্যয়কৃত অর্থও পরিশোধ করে দিয়ে যান। (দ্র. ফাতহুল বারী, ৪খ.)

উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কথা তো বলাই বাহুল্য। রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য জয় করেন। অথচ বায়তুলমাল থেকে কর্য করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন। শেষে যখন পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণের সময় ঘনিয়ে এলো, বায়তুলমালের অর্থ পাই পাই হিসেব করে পরিশোধ করেন। আর এ জন্য তার মালিকানাধীন যে একটিমাত্র ঘর ছিল, সেটি বিক্রি করার ওসীয়ত করে যান।

উসমান গনী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি তো গনী, অর্থাৎ সম্পদশালী ছিলেন, আর সে সম্পদ সর্বদা মুসলমানদের কল্যাণে বেহিসাব বিলিয়ে দিতে থাকেন। খিলাফতকালীন মুসলমানদের একফোঁটা রক্তপাত করাও অপছন্দ করেন। অবশেষে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে দেন।

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু আর পবিত্র দুই শাহজাদা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের কথা কি বলা যায়, দ্বীনের খাতিরে কীরূপ নির্যাতনের মুখে তারা প্রাণ উৎসর্গ করেন। আর কেবল সত্যের খাতিরে প্রকৃত কুরবানির যে উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেন, ইতিহাসে তা সবসময়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এ উম্মতের প্রতি লক্ষ্য করুন। এরা তো সেই উম্মত, যাদের বিশ্বস্ততা, নিষ্কলঙ্ক ও নির্লোভ চরিত্র দীর্ঘদিন উদাহরণে পরিণত হয়েছিলো। আপন দ্বীনের এতো বড় তত্ত্বাবধায়ক আর নিজেদের আসমানি কিতাব, বরং নিজেদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর প্রতিটি হরফ এমনি সংরক্ষক, যা দেখে বিশ্ব স্তম্ভিত। না এর পূর্বে এ ধরনের কোন উদাহরণ পাওয়া সম্ভব, আর না পরবর্তীতে এমনটি হওয়া সম্ভব। শাসনকাজে ছিলেন এতোই উদার যে, পরিচিত অপরিচিত নির্বিশেষে সকল প্রজাই তাদের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। আর নিজেদের পতনকালেও তার এতোটাই দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন যে, সারা বিশ্ব তাদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত, অপরাপর জাতিসমূহ যতোই তাদের নাম নিশানা মিটিয়ে দিতে তৎপর হয়, তারা ততোই উত্থিত হয়ে উঠে। মোট কথা, এহেন চরম পতনকালেও তাদের খ্যাতি এতোটাই যে, কুফরি বিশ্ব যদি কাউকে ভয় করে, তা কেবল এদেরকেই করে।

যদিও সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতার এমন কোন পদ্ধতি নেই যে, যখন কোন জাতির পর্যালোচনা করা হয়, তখন কেবল তাদের বিপর্যয়ের ইতিহাসের প্রতিই লক্ষ্য করা হয়। তবে দেখা উচিত যে, তাদের উত্থানকালের ইতিহাস অপরাপর জাতি-গোষ্ঠীর বিপরীতে কীরূপ ছিল।

এক্ষণে আপনি এই মহাসম্মানিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামস্টিক গুণাবলি এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমনের ফলে সংগঠিত এ মহাবিপ্লবকে সামনে রেখে নিজেই সিদ্ধান্ত নিন যে, নবুওয়াত কি এবং এ নবীগণ কেমন হয়ে থাকেন। আর তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ও সর্বশেষ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা কতো ঊর্ধ্বে!

বাস্তবতা এই যে, আমাদের চোখ নিন্মমুখী আর কলম লাজনম্র, ফলে বিতর্ক ও আলোচনার যে পদ্ধতি কোন সময় আহলে কিতাব ও অস্বীকারকারীদের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছিলো, শত আফসোস, আজ ঐ পদ্ধতি খোদ মুসলমানদেরকে তাদের আকাইদ বুঝানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হচ্ছে।

 

সূত্রঃ তরজমানুস সুন্নাহ (বদরে আলম মিরাঠী) - ৩য় খণ্ড

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-4m

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের কৃতিত্ব

 

 

 

The Greatest Nation·Tuesday, March 12, 2019

 

 

 

 

 

মানুষের মর্যাদা

আবহমানকাল ধরে দুনিয়ার ভাগ্য মানুষেরই ভাগ্যের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এ দুনিয়ার উন্নতি ও অবনতি, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের সম্পর্ক মানুষেরই অস্তিত্বের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তাই তো যদি দুনিয়ায় সঠিক মানব যিন্দা থাকে, আর দুনিয়ার যাবতীয় মূল্যবান জিনিস, ধন-দৌলত ও বিলাস-সামগ্রী শেষ হয়ে যায়, তবুও তেমন উল্লেখযোগ্য কোন বিপর্যয় দেখা দিবে না এবং দুনিয়াটি যে একেবারেই মহাসংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়বে তাও না। বরং মানুষের মতো মানুষের উপস্থিতিই অন্যসব বস্তুর ঘাটতির যথাযথ পরিপূরক। সমস্ত বঞ্চনার প্রতিকার এবং হরেক শ্রান্তির এটিই উত্তম বিনিময় সাব্যস্ত হবে। মানুষ তার কর্ম-তৃপ্তি, উদ্দীপনা এবং শ্রম ও নিপুণতা দিয়ে সেসব লুপ্ত দ্রব্য পুনঃস্থাপন করে দিতে সক্ষম হবে।

এটুকুই নয় শুধু, বরং হারানো সেসব জিনিস অপেক্ষা অত্যধিক কল্যাণকর জিনিস সঞ্চিত করে দেখিয়ে দিতেও প্রয়াসী হবে। যদি দুনিয়ার কোন ক্ষমতাসীনকে এ অধিকার দেওয়া হয় যে, তিনি হয়তো নির্বাচন করবেন দুনিয়া ছেড়ে মানুষকে, নয়তো নির্বাচন করবেন মানুষ ছেড়ে দুনিয়াটিকে (আর তিনি এ নির্বাচনে সুবুদ্ধি ও আল্লাহ প্রদত্ত বিবেকশক্তিকে যথাযথ খাটাবেন) তাহলে এটা অনিবার্য যে, তিনি মানুষকেই গ্রহণ ও নির্বাচন করে নিবেন। এতে তিনি কোন প্রকার দ্বিধা-সংশয়ের পক্ষপাতী হবেন না। কারণ দুনিয়া সৃষ্টি করা হয়েছে একমাত্র মানুষেরই নিমিত্ত। এ দুনিয়ার মান-মর্যাদা মানুষকে দিয়েই।

এ পৃথিবীতে দুর্ভাগ্য ও অবক্ষয়ের জন্য অস্ত্রশস্ত্র, বৈষয়িক উপকরণাদি এবং অন্যান্য দ্রব্য-সামগ্রীর অবর্তমানতা দায়ী নয়। বরং ওসব বৈষয়িক উপকরণাদি ও অস্ত্রশস্ত্রের যথোচিত ও যথাস্থানে ব্যবহার না করারই এই পরিণতি। এ পৃথিবীর সুদীর্ঘ ও ঘটনাপ্রবাহে ভরা ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, এতে যতসব বিপর্যয় আমদানি হয়েছে, সবগুলোরই উৎস মানুষের পথভ্রষ্টতা এবং সুপথ ও মৌল স্বভাব থেকে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়া বৈ কিছু নয়। উপকরণ ও মেশিনাদি তো মানুষের হাতে থাকে বাকহীন ও নিষ্কলঙ্ক সম্বল হিসেবে। ওগুলো মানুষের কথায় চলে এবং মানুষেরই কামনা পূরণ করে থাকে। এ মেশিনাদির যদি কোন ত্রুটি থেকে থাকে, তাহলে বিপদের সময় চলার পথে বোঝা ও কষ্ট বাড়িয়ে তোলে।

 

মানব প্রকৃতিতে গুপ্ত তথ্য ও রহস্যাবলী

এ বিশাল ভূমণ্ডল তথ্য ও রহস্য এবং নানাবিধ বিস্ময়কর জিনিস এবং অদ্ভুত লীলায় এতোই পরিপূর্ণ, যার রং ও রূপ বিবেককে বিব্রত করে তোলে এবং বিবেক ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।

কিন্তু মানব প্রকৃতির গুপ্ত রহস্যসমূহ, বিস্ময়কর বিষয়াদি এবং এর সম্ভাব্য ফসল এবং লুপ্ত সব প্রতিভা হৃদয়ের প্রসারতা ও গভীরতার সামনে অন্যসবের তো তুলনাই চলে না। মানুষের চিন্তা-শক্তির ঊর্ধ্বারোহণ, মানুষের দিগন্তের সুবিশালতা, মানবাত্মার রোমান্টিকতা, এর মধ্যে পুঞ্জীভূত আশা-আকাঙ্ক্ষা, এর সাহসিকতা ও উচ্চাভিলাষ (যা অসীম ও যা শত জয়, শত আনন্দ, বিশাল রাজ্য ও রাজত্ব এবং প্রাচুর্য ও প্রশান্তির পরও তৃপ্ত হয় না) - এর বিভিন্নমুখী ও বিপরীতধর্মী যে অগণিত ও অসংখ্য প্রক্রিয়া রয়েছে, তা যদি দুনিয়ার অবশিষ্ট তথ্য ও রহস্যসমূহের সাথে পরখ করা হয়, তখন এ সুবিশাল ভূমন্ডল ও সৃষ্টিকুলের তুলনায় সাগরের পাশে এক ফোঁটা পানি কিংবা মুরুভূমির পাশে একটি বালুর কণার মতো বিবেচিত হবে। সারা বিশ্ব যদিও দেখতে এতো প্রকাণ্ড, কিন্তু মানব মনের প্রসারতা ও গভীরতায় তা নিক্ষেপ করলে এমনিভাবে নিমজ্জিত হয়ে যাবে, যেমনি সাগরের অতলতলে একটি ছোট্ট পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করলে নিমজ্জিত হয়ে যায়।

মানব মনের ঈমানী সুদৃঢ়তা ও অবিচলতার কাছে পাহাড়ের অস্তিত্ব তুচ্ছ। এর জ্বলন্ত প্রেমের আকর্ষণের প্রখর স্ফুলিঙ্গের কাছে আগুনকে মনে হবে শীতল কিংবা ঈষৎ উষ্ণ। আল্লাহ'র ভয়ে কিংবা আর্তের সমবেদনায় অথবা পাপের অনুশোচনায় প্রবাহিত এক ফোঁটা অশ্রু এক সাগরের পানির উপর ছেড়ে দিলে তখন তা নিজ ধারণ ক্ষমতার অপারকতার জন্য মাতম তুলবে। এমনকি নিজ সংকীর্ণতার জন্য শোকাতুর হতে বাধ্য হবে। মানব চরিত্রে বিরাজমান মাধুর্য, চারিত্রিক উৎকর্ষ এবং প্রেম-প্রকৃতির মায়ামুখর সৌন্দর্যের যদি প্রস্ফুটন ঘটতো, তাহলে এ বসুন্ধরায় রং-বেরঙের বৈচিত্র্য ও মায়াজালের লীলাখেলা ঠাণ্ডা হয়ে যেতো আর সৃষ্টিকূলের রূপ শোভাকে হারিয়ে দিতো। মানুষের অস্তিত্বই নিখিল ধারার লক্ষ্যমণি এবং মহাকাব্য ছন্দের পরম উৎস। বিশ্বস্রস্টার কুদরত লীলার সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কুদরতের বাস্তব নকশা মানব জাতি, যে জাতিকে তিনি সুশোভিত করেছেন সর্বোত্তম সৌন্দর্যাকৃতি ও সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র এবং কাঠামো দিয়ে।

 

মানুষের তুল্য অন্য কিছুর মূল্য হতে পারে না

পৃথিবীর যাবতীয় খনিজ দ্রব্য, গুপ্ত ধনভাণ্ডার এবং মাল ও দৌলত রাজকীয় মর্যাদা মানবিক সে দৃঢ় প্রত্যয় ও আকিদার তুল্য হতে পারে না, যা দ্বিধা-সংশয়ের বহু ঊর্ধ্বে। তুল্য হতে পারে না সে প্রগাঢ় ভালোবাসার, যা বৈষয়িক লাভ ও উন্নতির দোহাই মানে না। সে আকর্ষণের সমতুল্যও হবে না, যা কারো বিধি-নিষেধকে পরোয়া করে না একটুও। এসব বস্তু মানুষের সেই একনিষ্ঠতার বরাবর হতে পারে না মোটেও, যা স্বার্থপরায়ণতার ছোঁয়াচ থেকে মুক্ত। মানুষের মহান চরিত্রের সেই মহানুভবতার তুল্য আর কিছু হতে পারে না, যা বিনিময় ও সুযোগ সন্ধানের কালিমা থেকে পবিত্র। হতে পারে না সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সে নিঃস্বার্থ সেবার সমতুল্য, যা কারো প্রতিদান কিংবা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের তোয়াক্কা করে না।

মানুষ যদি নিজেকে ঠিক ঠিকভাবে জেনেশুনে তার যথোচিত বিনিময়ের সন্ধানী হয়, তাহলে সমস্ত দুনিয়াবাসী তার সেই বিনিময় পেশ করতে অপারক হয়ে বসবে। যদি তার অস্তিত্ব একটু বিস্তৃতি খুঁজে নেয় এবং নিজ দৃঢ়তা ও নৈপুণ্যের বলগা স্বাধীন করে দেয়, আর এর সাথে সাথে তার স্বভাব-প্রকৃতিকে আপন গতিকে ছুড়ে দেওয়া হয়, তখন এ পৃথিবীটি তার কাছে নেহায়েতই ক্ষুদ্রায়িত হয়ে আসবে এবং সংকীর্ণ হয়ে দীপ্তিহীন বায়ুর পিঞ্জিরায় পরিণত হতে বাধ্য হবে।

পতিত হলে মাত্র এক মুষ্টি মাটি - এ মানব জাতি,

উত্থিত হলে আবার ধরবে না উভয় জাহানেও এ মানব জাতি।

মানব প্রকৃতির গভীরতাকে জরিপ দেওয়া যেমনি দুষ্কর, তেমনি তার শেষ প্রান্তকে অতিক্রম করাও অসম্ভব। তার গুপ্ত রহস্যাবলী আয়ত্তে আনাও যাচ্ছে না, আবার এর তত্ত্বও এবং মূল হাকিকতের সন্ধানটুকুও মিলছে না। এ মানব জাতির বিস্ময়কর এবং বৈচিত্র্যময় যোগ্যতা, জ্ঞান ও সহনশীলতা, ভদ্রতা ও বিনয়ী ভাব, দয়া ও ভালোবাসা, অনুগ্রহ ও দান এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও অনুভূতির তীক্ষ্ণতায় হতবাক হতে হয়। যতো বড় ধী-শক্তিধরই হোক না কেন, হতবুদ্ধিতার পরিচয় দিতে হয়। অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, যখন চিন্তা করা হয় মানুষের মাঝে দুনিয়ার মোহের প্রতি বিরাগ ও মানুষের ত্যাগ সামর্থ্য, মানুষের আত্মমর্যাদা ও নম্রতা, মাওলার পরিচিতি লাভের উপযোগিতা এবং তার জন্য আত্মত্যাগের বাসনা নিয়ে চিন্তা করলে তো বিব্রত না হয়ে পারা যায় না। এই গোষ্ঠীটির মাঝে পুঞ্জিত জনসেবার প্রেরণা এবং জটিল ও কঠিন নতুন নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুরাগ সম্পর্কে যখন ভাবা হয়, তখনও বিস্মিত হতে হয়।

 

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের কৃতিত্ব

মানুষের অস্তিত্বই মূলত যাবতীয় মঙ্গল ও কল্যাণকামিতা এবং সৌভাগ্য ও অগ্রগতির চাবিকাঠি। সমস্ত বৈষম্য ও সংকটের প্রকৃত সমাধানকারী এই মানুষই। এই মানুষের গঠনে যখন বক্রতা চলে আসে আর বিনষ্ট হয়ে উঠে তার কৃষ্টি-কালচার, তখন মানুষের মতো মানুষ মেলা বিরল ও দুর্লভ হয়ে পড়ে। মানুষ তৈরি করার নীতি ও পদ্ধতি তখন আর টিকে থাকে না। মানুষ তৈরি করাই সর্বযুগে নুবওয়াতের প্রধান লক্ষ্যমূল হয়ে আসছে। নবীগণ সবাই নিজ যুগে এ সমস্যাটি নিয়ে জনসমাজে আবির্ভূত হয়েছেন।

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের কৃতিত্ব এটুকু যে, এই নবুওয়াতের মাধ্যমে এমন কিছু অতুলনীয় গুণ ও অবর্ণনীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষ গড়ে উঠেছে, যাদের নজীর ইতিহাসের চোখে কোনদিন ধরা পড়েনি এবং আসেনি এমন অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত সৌর দৃষ্টির সামনে। তারা গ্রথিত মুক্তার মালা, সীসা ঢালা প্রাচীর এবং জামাআত ও সম্প্রদায়ে সুসংগঠিত হলেন, যার ফলশ্রুতিতে তারা একটি ঐক্যবদ্ধ উদ্দেশ্য ও বিশ্বাসের লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার অটুট সূত্র স্থাপন করে ফেললেন। নবুওয়াতে মুহাম্মাদির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুপম কৃতিত্ব আর মহা অলৌকিকতা তো এটিই।

মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সুদূর প্রান্ত থেকে মানুষ তৈরি ও মনুষ্যত্বের পুনঃ জাগরণের কাজে হাত দেন, যেখান থেকে আর কোন নবী কিংবা সংস্কারও করতে হয়নি। তারা কেউ এই দায়িত্বে আদিষ্টও হোননি। কেননা, অন্যান্য নবীর সামাজিক পরিবেশ আরবের বর্বরতার যুগ থেকে বহু উচ্চমানের ছিল। তদুপরি, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান কাজকে নিয়ে এতখানি উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে সফলকাম হলেন, যতখানি অন্য কোন নবীর কর্মধারা পৌঁছেনি।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাশবিকতার চরম সীমা থেকে কর্মনীতি পরিচালনা করলেন। অথচ মানবতার প্রশিক্ষণের সেটিই ছিল প্রাথমিক বিন্দু। তারপর পৌঁছে দিলেন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষকে মনুষ্যত্বের ঊর্ধ্ব শিখরে, যার ঊর্ধ্বে নবুওয়াতের একটি সোপান ছাড়া কোন সোপান আর অবশিষ্ট রয়নি। এই কৃতিত্বের চিরন্তন শিরোপা অর্জন করেন যে মহামানব, তিনিই নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

 

আসল বাস্তবটি ধারণাতীত চিত্তাকর্ষক

উম্মতে মুহাম্মাদির প্রতিটি সদস্যই নবুওয়াতের অলৌকিকতার একটি স্বতন্ত্র নিদর্শন এবং নবুওয়াতের শাশ্বত কামিয়াবী এবং মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানত্বের উজ্জ্বল প্রমাণ। কোন শিল্পী তার তুলির রেখায় কিংবা কল্পনার আকাশে এর চেয়ে সুন্দর কিছু আঁকতে পারে না। পারে না তাদেরকে সেভাবে তুলে ধরতে, যে মনোহর আলোকে তারা বাস্তব ক্ষেত্রে ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল রয়েছেন।

কোন কবির তার প্রাণবন্ত খেয়াল, আনন্দঘন মন ও কবিত্ব শক্তিকে পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেও মানব সত্তায় বিরাজমান কোমল গুণাবলী, নিখুঁত চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিকগুলোর কাল্পনিক নকশা তৈরি করা সম্ভব না। এমনকি সমস্ত সাহিত্যিক সমবেত হলেও মানবতার কোন একটি দিক মাত্রের প্রসারতার বাহ্যিক নমুনা পেশ করার চেষ্টা করা ব্যর্থতার নামান্তর বৈ কিছু নয়।

যারা ছিলেন নবুওয়াতের কোলে লালিত, যারা মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষায়তনে প্রশিক্ষণ লাভ করে বের হয়েছিলেন, তাদের মজবুত ঈমান, গভীর ইলম আর ন্যায়পরায়ণ মনের কোন তুলনাই হয় না। তাদের জীবন ছিল ভাওতাবাজি, লোক-দেখানো মনোবৃত্তি, মুনাফিকী এবং দাম্ভিকতা থেকে বিলকুল মুক্ত। তাদের আল্লাহ-ভীতি, সাধুতা, পবিত্রতা, আতিথেয়তা এবং অনুগ্রহের ধরণের উদাহরণ অন্যসব উম্মতের মধ্যে বিরল। এদিকে আবার তারা ছিলেন বীরত্ব ও নিপুণতা, ইবাদাতের অনুপ্রেরণা এবং শাহাদাতের ব্রতে সদাব্রতী। দিন তাদের কাটতো বীরের বেশে এবং রাত কাটিয়ে দিতেন তারা আল্লাহ'র ইবাদাতে। পার্থিব আরাম-আয়েশ ও ভোগ বিলাসের প্রতি বৈরাগ্যের ফলে তারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ। ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, জনদরদ, রাতে প্রজাদের কুশলাদির খবর নেওয়া এবং নিজের আরামকে হারাম করে জনগণকে শান্তি পৌঁছানোর অভিব্যক্তিতে তাদের তুলনা বিরল।

 

জীবনের বিভিন্ন ধাপে ও বিভিন্ন ময়দানে নিষ্ঠাবান মনীষা

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাওয়াত ও রিসালাতের মাধ্যমে তৈরি করলেন এমন এমন মনীষা, যারা আল্লাহ'র উপর অগাধ বিশ্বাস স্থাপনকারী, তার গ্রেফতার সম্পর্কে নিতান্তই ভীত, দ্বীনদার, আমানতদার, দুনিয়ার উপর আখিরাতকে প্রাধান্যদাতা এবং জড়বস্তুর রঙ্গমঞ্চের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন ছিলেন। জড় বস্তুকে তারা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়ে কাবু করে নিতেন।

তাদের প্রাণভরা আস্থা এটি ছিল যে, দুনিয়াকে তাদেরই জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে আর তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে আখিরাতের জন্য। এজন্যই ব্যবসা ক্ষেত্রে তারা পরিচিত হতেন নিষ্ঠাবান ও আমানতদার ব্যবসায়ী হিসেবে। অভাব-অনটনের সম্মুখীন হলে তারা পরিচিত হতেন ভদ্র ও মেহনতী মানুষ হিসেবে। শুভাকাঙ্ক্ষী শাসনকর্তা ও কঠোর পরিশ্রমীরূপে তারা চিহ্নিত হতেন যখন কোন অঞ্চলের শাসনের দায়িত্ব নিতেন। তাদের হাতে যখন অর্থ ভাণ্ডার আসতো, তখন অতুলনীয় করুনা ও সমবেদনার সাথে এর সদ্ব্যবহার করে থাকতেন। ন্যায়পরায়ণতায় অনুরাগী ও বাস্তবানুরাগী হিসেবে তারা প্রমাণিত হতেন, যখন তারা বিচার ও আদালতের এজলাসে সমাসীন হতেন। তারা কোথাও গভর্নর হিসেবে নিয়োজিত হলে একনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত হিসেবে আখ্যায়িত হতেন। নেতৃত্বের অঙ্গনে তারা বিনয়ী, অন্তরঙ্গ এবং সমবেদনা প্রদর্শনকারী নেতারূপে প্রতীয়মান হতেন। জনসাধারণের অর্থ-তহবিলের দায়িত্ব পেলে তারা ভক্ষক না হয়ে বুদ্ধিমান রক্ষক হিসেবে খ্যাত হতেন।

 

যেসব বুনিয়াদি জিনিস দিয়ে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করলো

উল্লিখিত আদর্শসমূহের ইট দ্বারা ইসলামী সমাজের প্রাচীরটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো। সেসব জিনিসকে নির্ভর করেই ইসলামী হুকুমাত একদিন দাঁড়িয়েছিলো। সে সমাজ ও রাষ্ট্র প্রকারান্তে সে সকল মনীষীরই চারিত্রিক ও মানসিক অবস্থার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তাদেরই ন্যায় তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমাজটি ছিল আমানতের পথিকৃৎ। ইহকালের উপর পরকালকে প্রাধান্য প্রদানকারী ছিল সেই সমাজটি। বস্তু কর্তৃক প্রভাবান্বিত না হয়ে বস্তুর প্রশাসক হতেন তারা।

এ সমাজের নেতৃত্বে এক ব্যবসায়ীর সততা ও আমানত, এক নিঃস্বের সারল্য ও দৈন্য, এক শাসনকর্তার পরিশ্রম ও শুভ কামনা, একজন ধনবানের বদান্যতা ও হিত কামনা এবং বিচারকর্তার ন্যায়পরায়ণতা ও বিচক্ষণতার যৌথ মিশ্রণ বিদ্যমান ছিল। এ সমাজ প্রতিষ্ঠায় একজন গভর্নরের একনিষ্ঠতা ও বিশ্বস্ততা, একজন নেতার বিনয়ী ভাব ও দয়া, একজন কৃতজ্ঞ সেচ্ছাসেবকের সার্বিক প্রয়াস এবং একজন আমানতদার প্রহরীর অতন্দ্রপ্রহরা ও সতর্ক দৃষ্টির সমাবেশ ঘটেছিলো। রাষ্ট্রটি ছিল দাওয়াত ও হিদায়াতের পতাকাবাহী। এ রাষ্ট্র আকিদার জগতকে বাহ্যিক লাভ-লোকসানের উপর প্রাধান্য দিতো। এ রাষ্ট্র অর্থ সংগ্রহ ও ট্যাক্স তহশীলের উপর জনগণকে হিদায়াত দান ও সুপথ প্রদর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে সে সমাজের প্রভাব ও প্রচলন এবং তার রাষ্ট্রীয় প্রভাবে জনজীবনে ঈমান, সুকর্ম, সততা, একনিষ্ঠতা, জিহাদ ও ইজতেহাদ, লেনদেন, ন্যায় ও সাম্য এবং পারস্পরিক ইনসাফ কায়েমের দৃশ্যই একমাত্র গোচরীভূত হতো।

 

পরীক্ষা এবং অভিজ্ঞতার যাচাইয়ে নিষ্ঠাবানদের সফলকামিতা

সেসব নিষ্ঠাবানই এমন এমন কঠিন পরীক্ষা ও যাচাইয়ের সম্মুখীন হয়েছেন, যেসব পরীক্ষায় মানবিক দুর্বল দিকগুলো আর গুপ্ত ব্যাধিসমূহের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে পারে না। অথচ তারা সে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার জ্বলন্ত চুল্লী থেকে অকৃত্রিম ও নির্ভেজাল হীরকের মতো বের হয়ে এসেছেন। তার মধ্যে কিঞ্চিৎ ভেজাল কিংবা অন্য কিছুর মিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়নি। সমস্ত নাযুক পরিস্থিতিতে তারা ঈমানী শক্তি, অভিপ্রেত ক্ষমতা আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশিক্ষণের আদর্শকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। নিজ সততা, দায়িত্ববোধ, আমানত, আত্মনির্ভরশীলতা আর আত্মবিসর্জনের বুলন্দ নমুনা তারা পেশ করতেন। পরবর্তী যুগের মনোবিজ্ঞানী, চরিত্র বিশেষজ্ঞ এবং ঐতিহাসিক ও প্রকৃতিবিদগণের ধারণাতীত নজীর স্থাপন করে গেছেন তারা।

সেসব নাযুক পরিস্থিতিগুলো হতে বেশী নাযুক পরিস্থিতি হচ্ছে আমীর ও শাসকের পদটি। তিনি পৃথিবীর কারো কাছে জবাবদিহি করার নন, নেই তার পিছনে কোন প্রকার গুপ্তচর নিয়োজিত, তাকে কোন কমিটি কিংবা আদালতের সম্মুখীন হওয়ারও নেই - অথচ তিনি নিজের জন্য অনেক অনেক বৈধ জিনিসের ব্যাপারেও সংযমী থাকতেন। নিজের ব্যক্তিগত সম্পদের দিক থেকেও উদাসীনতা প্রদর্শন করতেন। এমনকি সামান্য সম্পদেরও ধার ধারতেন না তিনি। অথচ সেগুলোর ব্যবহার শরীয়তের পক্ষ থেকে একান্তই বৈধ। সাধারণ সমাজেও তা ব্যবহার্য আর সর্বযুগেই তা তুচ্ছ ও নগণ্যের ফিরিস্তিতে শামিল রয়েছে।

 

শাসকদের দুনিয়া সম্পর্কে অনীহা ভাব ও তাদের সারল্য

এ প্রেক্ষিতে সবচেয়ে উত্তম দৃষ্টান্ত হচ্ছে, খলিফাতুল মুসলিমীন আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মহীয়সী পত্নীর একদিন মিষ্টান্ন খাওয়ার অভিপ্রায়ের ঘটনাটি। এজন্য তিনি তার দৈনন্দিন খরচ থেকে কিছু কিছু বাঁচিয়ে রেখে সঞ্চয় করেছিলেন। সিদ্দীকে আকবর ব্যাপারটি সম্পর্কে অবহিত হলে তিনি সে সঞ্চিত টাকাগুলো বায়তুলমালে জমা তো দিয়ে দিলেনই, সাথে সাথে দৈনন্দিনের নির্ধারিত ভাতা থেকে সে পরিমাণ কেটে কমিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, এ কথা বোঝার আর বাকি নেই যে, এ পরিমাণ ভাতা এ যাবত অতিরিক্ত আসছিলো। আর বললেন, নির্ধারিত ভাতার চেয়ে কমেও তো আবু বকরের জীবন যাপন সম্ভব। মুসলমানদের বায়তুল মাল তো এজন্য নয় যে, এর দ্বারা প্রশাসকের পরিবার-পরিজন বিলাসবহুল জীবন যাপনের সুযোগ গ্রহণ করবে। আর আহারে-বিহারে তারা অত্যধিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময়ী হয়ে পড়বে।

এ প্রসঙ্গে খিলাফতে রাশিদার শাসনামলের একটি সত্য ছবি আমি তুলে ধরছি। আর এটি হছে তদানীন্তন বৃহত্তর সাম্রাজ্যের শৌর্যশালী একজন প্রশাসকের সরকারী সফরকে কেন্দ্র করে। তা ছিল এমন একজন প্রতাপশালী প্রশাসকের সফর, যার নাম শোনামাত্র জনমনে কম্পন সৃষ্টি হতো তারা বর্ণনাকারী সফরসঙ্গী ছিলেন বিধায়। তার প্রত্যক্ষ বর্ণনাটিই তার সাহিত্যের অলংকারে অলংকৃত করে যেভাবে বর্ণনা দিতে প্রয়াসী হয়েছিলেন, আমি ঠিক সেভাবে পেশ করার চেষ্টা করবো। ইবনে কাসির বর্ণনা করেন -

"উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে একটি মেটে রঙের উটের উপর সওয়ার হয়ে রওয়ানা দিলেন। খুব রৌদ্র তাপ। তার মাথায় নেই লৌহ-শিরস্ত্রাণ, নেই পাগড়ি। উটের পিঠের হাওদার উপর বসে বসে তিনি পা দুটো দুদিকে ঝুলিয়ে রাখছেন। পা দুটো রাখার জন্য দুটো রেকাবও ছিল না। উটের উপর ছিল একটি মোটা পশমী কাপড়। মাঝেমধ্যে উট থেকে নেমে তিনি সেটি বিছাতেন। তৃণলতায় ভরা তার চামড়ার অথবা পশমের একটি পুটলি ছিল। যখন উটের উপর থাকতেন তখন সেটিতে হেলান দিতেন, নেমে সেটি দিয়ে বালিশের কাজ করতেন। পরনের জামাটি ছিল খুবই মোটা। সুতি বস্ত্র। তাও কাঁধের তলদেশ দিয়ে ছেঁড়া ছিল।

খলিফার আদেশক্রমে লোকজন তথাকার সর্দারকে ডাকতে গেলো। জুলুমুসকে ডাকতে গেলো। তারপর খলীফা তার পরনের জামাটি ধুয়ে ছেঁড়া জায়গায় একটি তালি লাগিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন এবং ধার হিসেবে ক্ষণিকের জন্য একটি কাপড় কিংবা জামার ব্যবস্থা করতে বললেন। একটি রেশমী জামা উপস্থাপিত করা হলো। তিনি দেখামাত্র বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন - এটা কি ? লোকজন বললেন- রেশম। তিনি জানতে চাইলেন যে, রেশম কি জিনিস ? লোকজন তা বুঝিয়ে দিলে তিনি পরনের জামাটি খুলে গোসল করে নিলেন। ইত্যবসরে তার তালি দেওয়া জামাটি হাযির করা হলে তিনি রেশমী জামাটি খুলে সেটিই পরিধান করে নিলেন।

উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু'র খেদমতে জুলুমুস পরামর্শ হিসেবে আবেদন জানালো যে, আপনি আরবের বাদশাহ। এখানকার লোকজনের মধ্যে উটের কোন গুরুত্ব নেই। এই হেতু আপনি মর্যাদাপূর্ণ পোশাক পড়ে ঘোড়ায় আরোহণ করে নিলে রোমানদের মনে প্রভাব সৃষ্টি করবে। এ আবেদনের প্রেক্ষাপটে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন - আমরা সেই জাতি, আল্লাহ পাক যাদের সম্মান বৃদ্ধির মাধ্যম নির্ধারণ করেছেন একমাত্র ইসলামকেই, তাই আল্লাহ পাকের নির্ধারিত সম্মান মাধ্যমকে উপেক্ষা করে অন্য কিছুকে মাধ্যম হিসেবে আমরা গ্রহণ করতে পারি না মোটেই।

একটি ঘোড়া আনা হলো। তিনি তার চাদরটি রেখে দিলেন ঘোড়াটির উপর। লাগাম লাগালেন না আর রেকাবও সংযোগ করলেন না, বরং এমনিতেই সওয়ার হয়ে গেলেন ঘোড়াটির উপর। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই তিনি বলে উঠলেন - থামো, থামো, আমি এর আগে কাউকে আর শয়তানের উপর সওয়ার হতে দেখিনি। এরপর তার উটটি আনা হলে তিনি সেটাতেই সওয়ার হয়ে গেলেন।" (১)

ইতিহাসবেত্তা তাবারীও অনুরূপ একটি ঘটনা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু'র একটি ভ্রমণ বিবরণীতে বর্ণনা করেছেন -

"একসময় উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু ভ্রমণে বের হলেন। স্থলাভিষিক্ত করে রেখে গেলেন তিনি মদীনায় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে। কয়েকজন সাহাবায়ে কিরামও তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। তিনি লোহিত সাগরের তীরে ইবিল্লার দিকে যাচ্ছিলেন। ইবিল্লার সন্নিকটে এসে পাশ কেটে তিনি সামনে বেড়ে গেলেন এবং গোলামকে তার পিছনে রেখে দিলেন। এরপর তিনি ইস্তিঞ্জা করে নিলেন। ইস্তিঞ্জা হাতে প্রত্যাবর্তন করে তিনি গোলামের সওয়ারীটির উপর সওয়ার হয়ে গেলেন। নিজের সওয়ারীটি দিয়ে দিলেন তার গোলামকে। এরপর সেখানকার জনগণের প্রথম দলটি এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো - আমিরুল মুমিনীন কোথায়? উত্তরের তিনি বললেন - তিনি তোমাদের সামনেই। অতএব, জনগণ সামনে বেড়ে গেলেন। ইবিল্লা পৌঁছে খলীফা বললেন - আমিরুল মুমিনীন ইবিল্লা পৌঁছল, যদ্দরুন জনগণ তাকে চিনে নিতে আর ভুল করলো না এবং সবাই তার দিকে ঝুঁকে পড়লো।" (২)

 

মানবতার আদর্শ নমুনা

খুলাফায়ে রাশিদা ও সাহাবায়ে কিরামগণের জীবনচরিতে দুনিয়ার প্রতি বিরাগ ভাব, নম্রতা, কুরবানী, সমবেদনা, ন্যায়পরায়ণতা ও নিপুণতা, প্রজ্ঞা ও সততার উজ্জ্বল আদর্শ এতো অধিক পাওয়া যায়, যেগুলোকে কোন ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, মনোবিজ্ঞানী বা চরিত্র বিশেষজ্ঞ যদি একত্র করে গুছিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনচিত্র অংকনের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে অবশ্যই মানব মণ্ডলে তা একটি অনুপম আদর্শ ও নিখুঁত ব্যক্তিত্বরূপে প্রতিভাত হবে। পরিণত হবে তা দিয়ে মানবতার মহাজাগরণের অ্যালবাম। মানবতার বিশ্বজনীন প্রদর্শনীতে তা আদৃত হবে এক অপূর্ব শোভার নিদর্শন হিসেবে।

কিন্তু পরিতাপের সাথে বলতে হয়, আমরা সে মনোনীত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জামাআতটির পূর্ণাঙ্গ এবং যথাযথ গুণাবলী ও চিত্র কোন গ্রন্থে খুঁজে পাচ্ছি না। তা অবশ্য তাদের জীবনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুকোমল সংস্পর্শে ও সুস্নিগ্ধ দীক্ষার ফলশ্রুতি হিসেবেই বিদ্যমান ছিল। তা থেকে মাত্র গুটিকয়েক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা আলো, কিছু সাহিত্য সুষমামণ্ডিত রচনা এবং চরিত্র চিত্রণ গ্রন্থাবলীতে সংরক্ষিত হয়ে গেছে। কেননা, আরববাসীগণ আবহমান কাল ধরে স্বীয় পাণ্ডিত্য, বাগ্মিতা, শিল্প নিপুণতা এবং যথোচিত ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে শিরোপা অর্জন করে আসছে। তাদের সে সাহিত্য-প্রজ্ঞা ও শিল্প-নিপুণতার বদৌলতেই আমরা নববী সংস্পর্শের প্রভাব ও ফলাফল এবং সফলতা ও অনুপমতা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আঁচ করতে সক্ষম হচ্ছি এবং সে সুপ্রতিষ্ঠিত মহতী সমাজটির নমুনা অবলোকন করার সুযোগ পাচ্ছি।

তাদের সে আদর্শমাখা সমাজটিকে দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযা হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য নিয়ে দৃষ্টিলোকে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। তার মধ্যে একটি দৃশ্য আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে নিয়ে, যা ভাব ও সাহিত্যিকতার নিরিখে অতীব রসালো। সে চিত্রটি তার প্রভাব ও তাৎপর্য বিচারে বস্তুবাদী ও আধ্যাত্মিক সাহিত্য জগতের এক অনুপম উপজীব্য হওয়ার দাবী রাখে।

একদিন আমীরে মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র একজন ঘনিষ্ঠ সহচর যিরার ইবন যামরাকে আবেদন জানালেন, তিনি যেন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন। যিরার ইবন যামরার খুবই কাছে থেকে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সোহবত নেওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। আমীরের আবেদন অনুযায়ী যিরার বলতে লাগলেন -

"আল্লাহ'র শপথ, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন উচ্চ সাহসিকতাসম্পন্ন, সুঠাম দেহের অধিকারী একজন বীর কেশরী। তার ফয়সালা যে কোন বিষয়ে চূড়ান্ত বলে গণ্য হতো। ন্যায়পরতার উপর প্রতিষ্ঠিত হতো তার ফয়সালা। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রতিটি কাজ থেকে জ্ঞানের প্রস্রবণ উৎসরিত হতো। দুনিয়া ও দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি ছিল তার নিঃস্পৃহতা। রাতে একাকী অন্ধকারে তিনি বেশী বেশী সময় কাটাতেন।

আমি আল্লাহ'র শপথ করে বলছি, অত্যধিক আহাজারী ও কান্নাকাটি, অবর্ণনীয় চিন্তা-সাধনাই ছিল তার সার্বক্ষণিক ও অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি তার হাতের তালু নিজের দিকে ফিরিয়ে সম্বোধন করতেন নিজেই নিজেকে। অতীত কর্মের হিসাবও নিতেন নিজেই। মোটা কাপড় ও সাধারণ পানাহার পছন্দ করতেন। আমাদের মধ্যে থাকতেন তিনি আমাদেরই মতো হয়ে। আবার যখন কোন কথা জানতে চাইতাম, তা প্রশান্তচিত্তে বুঝিয়ে দিতেন তিনি। আমরা তার কাছে আসলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতেন। তাকে আমরা দাওয়াত করলে চলে আসতেন অকুণ্ঠ চিত্তে। কিন্তু তার নজিরবিহীন অন্তরঙ্গতা ও বিনয়ী ভাব এবং সারল্য সত্ত্বেও আমরা তার প্রতি সৃষ্টি ভীতিমাখা শ্রদ্ধার ফলে বেশী কিছু বলার হিম্মত হারিয়ে ফেলতাম। এমনকি আমাদের পক্ষ থেকে কোন কিছু বলার সূচনা করার সাহসটুকুও হতো না। মৃদু হাসিটুকু যখন দিতেন তিনি, মুক্তামালার মতো দাঁতগুলো চকচক করতো। দ্বীনদারদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং সহায়-সম্বলহারাদের সমবেদনা প্রদর্শনই ছিল তার জীবনের মৌল আদর্শ। যতটুকু প্রতাপশালী ব্যক্তিই হোক না কেন, তাকে দিয়ে কোন প্রকার অন্যায়ের পক্ষপাতিত্বের আশাটুকু করতো না। কোন আর্ত ও দুর্বল মানুষ তার ন্যায়পরায়ণতা থেকে বঞ্চিত ও বিমুখ হতো না।

আমি আবারো আল্লাহ'র শপথ করে বলছি, আমি অনেক সময় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে এমন অবস্থায় দেখেছি যে, রাত শেষ হতে চলেছে, তারকারাজি অস্তপ্রায়, তিনি তখন তার দাড়িগুলো ধরে মসজিদের মিহরাবে সর্পে দংশিত মানুষের মতো অস্থির ও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছেন কিংবা নিতান্তই বিষাদগ্রস্ত হয়ে কাঁদছেন।

আমি তাকে এ কথা বলতে শুনতাম - হে দুনিয়া, তুই কি আমাকে যাবতীয় বিপর্যয়ের লক্ষ্যস্থল নির্ণীত করতে চাস ? আমাকে আকৃষ্ট করার জন্যই কি তোর এসব অভিমান ও ছলনা ? দূর হো, তুই দূর হো। তোর প্রতারণা আমার এখানে না, অন্যখানে। আমি তোকে এমনভাবে তালাক দিয়েছি যে, তোর দিকে প্রত্যাবর্তন করা আর সম্ভব না। তোকে নিয়ে জীবনকাল নেহায়েতই সাময়িক। তোকে দিয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অকিঞ্চিৎ। অথচ পরিণাম তার কতোই না ধ্বংসাত্মক। আহ ! চলার পথের পাথেয় এতো সামান্য, অথচ ভ্রমণ কতো দীর্ঘ, পরন্তু পথ কতোই কণ্টকাকীর্ণ।"

 

প্রথম ইসলামী সমাজ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত সে সমাজটি মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ হিসেবে নন্দিত ও স্বীকৃত। এটি একমাত্র তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুপম তারবিয়াতের ফসল। সে সমাজটি যেমনি ছিল হৃদয়গ্রাহী তেমনি মানবিক সমস্ত গুণের সঞ্চিত ভান্ডার। সে সমাজটির সঠিক রূপরেখাটি ফুটে উঠেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক বিশ্বস্ত সহচর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র একটি বর্ণিত হাদিস দিয়ে, যা নিতান্তই সাহিত্য রসালো, সংক্ষিপ্ত, তাৎপর্য, বিশালত্ব, গাম্ভীর্য এবং ভাববোধক শব্দে উচ্চারিত হয়েছে। তিনি বলেন, "সাহাবায়ে কিরাম অপরাপরের মাঝে ছিলেন পূত হৃদয়ের অধিকারী, গভীর প্রজ্ঞাময়। তাদের জীবনে লৌকিকতা বা কৃত্রিমতা খুবই কম পরিলক্ষিত হতো। তারা ছিলেন সেসব মনীষী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকতময় সান্নিধ্য লাভের এবং দ্বীনের ঝাণ্ডা বুলন্দ ও মদদের নিমত্ত স্বয়ং আল্লাহ পাক যাদেরকে নির্বাচন করেছিলেন।" (৩)

যখন সেই মহতী সমাজটিকে অন্য কোন সমাজের সাথে তুলনা করা হবে, তো সমষ্টিগতভাবে সেটির পাল্লা বহু ভারী প্রতীয়মান হবে। আর তাদের দুর্বলতার দিক (যা থেকে সৃষ্টিমাত্রই মুক্ত নয়) এদের গুণাবলী ও আদর্শাবলীর তুলনায় একেবারেই নগণ্য ও অধর্তব্য সাব্যস্ত হবে। তাদের চরিত্র মাধুরীর দৃষ্টান্ত তো মানব ইতিহাসে বিরল। এই প্রেক্ষিতে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ'র সাহিত্য অলংকারমন্ডিত সুদৃঢ় বাণীটি প্রণিধানযোগ্য মনে করি -

"সাহাবায়ে কিরামগণই ছিলেন এই উম্মতের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কেননা, হিদায়াত ও দ্বীনের পথে উম্মতের মধ্যে তাদের চেয়ে অগ্রগামী অন্য কেউ হয়ে উঠেনি। মতভেদ ও মতানৈক্য থেকে তারাই তুলনামূলক বেশী মুক্ত ছিলেন। আর যদি কোথাও তাদের সাথে কোন ত্রুটির সংযুক্তি ঘটেছে, তা অন্যদের তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। অনুরূপ এ উম্মতের ত্রুটিগুলো অন্য সমাজগুলোর নিরিখে হিসাব করলে তা তুচ্ছ ও উপেক্ষণীয় বলে বিবেচিত হবে। তা দেখে যারা সাহাবায়ে কিরামগণ সম্পর্কে ভিত্তিহীন অপপ্রচারে মত্ত হয়েছে, তাদের উদাহরণ হচ্ছে, যেন তারা ফটিকের মতো শুভ্র কাপড়ের একটি তিলককে প্রকট করে দেখানোর অপচেষ্টা করছে। তারা অন্যান্য সমাজের কালো কাপড়গুলো দেখছে না, যার ভিতরে শুভ্রতার বিন্দুমাত্র দেখা যায় না। এ ধরেনর সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত জুলুম ও অজ্ঞতার পরিণতি বৈ কিছু নয়।" (৪)

পরবর্তী বংশধরগণের উপর মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রিসালাতের প্রভাব

নববী দাওয়াত, তালীম ও সুমহান আদর্শ, যা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামের জীবন-চরিতের রূপ-রঙে উপস্থাপন করেছিলেন, তা শুধু সে যমানার জন্যই সীমিত ছিল তা নয়, বরং পরবর্তী উত্তরসূরিদেরকেও শিক্ষাদানের দিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুপ্রাণিত করেছেন। কেননা, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সনাতন আদর্শ সকল দেশ এবং সকল পরিবেশের জন্য শাশ্বত আদর্শ। তাই তা চলার পথের দীপ্ত প্রদীপ এবং চিরন্তন পথিকৃৎ। আর এজন্যই এমন জিনিস তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রেরিত সমাজটিতে শুধু সীমাবদ্ধ থাকার নয়। বরং তা সেই জ্যোতিষ্মান সূর্যের মতো যার আলো ও তাপে প্রতিটি যুগে প্রতিটি স্থানে ফসল ও ফল-ফলাদি পরিপক্বতা লাভ করছে। এটি এমন শাশ্বত সূর্য, যেটি আপন সৌরমণ্ডলে অবস্থান করছে বটে, কিন্তু তার মৃদু সোনালি মাখা সঞ্জীবনী কিরণ এ বসুন্ধরাকে প্রতিনিয়ত প্রেরণ করছে। কাছে হোক কিংবা দূরে থাকুক, প্রতিটি প্রাণী তা থেকে লাভ করছে সজীবতা।

আল্লাহ তাআলা আর আখিরাতের উপর ঈমান আনার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত , আল্লাহ'র মেহেরবানীর প্রতি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐকান্তিকতা, তার অসন্তুষ্টি ও গ্রেফতারীর ভয়, প্রতিদান ও সওয়াবের প্রত্যাশা, জাহান্নামের ভীতি, জান্নাতের প্রেরণা, পার্থিব জিনিসের প্রতি নিঃস্পৃহতা, আখিরাতের পাথেয়র অনুসন্ধান, অত্যধিক সারল্য, নিজ ও নিজ সন্তান-সন্ততি অপেক্ষা অন্যদেরকে প্রাধান্য দেওয়া, অনাত্মীয়ের জন্য ত্যাগ, তাদেরকে আত্মীয়দের চেয়েও নিকটতম ভাবার মানসিকতা ইত্যাদি এক বিশ্বজয়ী সার্বজনীন শিক্ষণীয় পাঠ্যসূচী হিসেবে গণ্য। শুধু তাই নয়, বরং জিহাদ, উৎসর্গীকরণ ও আত্মবিসর্জনের মতো জীবন-পরীক্ষায় একান্ত আপনজনদেরকে সামনে বাড়িয়ে দেওয়া বিভিন্ন চরিত্র মাধুরী ও সূক্ষ্ম অনুভূতি চালিত উজ্জীবন বিশ্বজনীন প্রশিক্ষণই বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচ্য।

মোটকথা, তা দিয়ে পরবর্তীকালে বংশ পরম্পরায় মানব সন্তানগণ আদর্শবান হচ্ছিলো। উলামা, নেতৃবর্গ, রাজা-বাদশা, শাসক-প্রশাসক, আবিদ-জাহিদ সকলেই এ ফোয়ারা থেকে স্বচ্ছ ও পবিত্র হয়ে আসছে। চরিত্র ও মানবতার প্রথম সবক নিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছে এ শিক্ষা পাদপীঠ থেকে, যার ফলে স্বীয় চরিত্র মাধুরীর উৎকর্ষ, তীক্ষ্ণ অনুভূতি, সূক্ষ্ম দৃষ্টি, আমানতদারী, বিলাস-সামগ্রী, ধনাগারের চাবি, প্রশাসন ভাব এবং সমাজের ভবিষ্যৎ নিজের হাতে নিয়ন্ত্রিত থাকা সত্ত্বেও তারা দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত ছিলেন। তারা আল্লাহ'র ইবাদাতে যুগের পথিকৃৎ ছিলেন।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শে দীক্ষিত মনীষীগণ স্থান ও কালের দুস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও নবুওয়াতের ফসল, ইসলামী দাওয়াতের ফল এবং মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রিসালাতেরই কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের নিদর্শন হয়ে রয়েছেন। এদের চরিত্রে যে আকর্ষণ পরিদৃষ্ট হচ্ছে, এসব তো নবুওয়াতে মুহাম্মাদিরই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিচ্ছবি। এই আকিদা-বিশ্বাস ও চরিত্র বিকাশে তাদের পিতা-মাতা, পরিবেশ এবং নিজস্ব মেধার তেমন কোন ভুমিকা নেই। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে দাওয়াত ও তালীম না হলে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও অনুশীলনের প্রেরণা জাগ্রত হয়ে ইসলামের অবদানে তারা ধন্য না হলে, হয়তো তারা আকিদাগত দিক দিয়ে হতো মূর্তিপূজারী, হতো হিংস্র পশুর তুল্য। তাওহীদ যদি না হতো, আল্লাহ-ভীতি আসতো না। দুনিয়ার প্রতি অনীহা ও ত্যাগ না হলে ক্ষমা ও উদারতার মহানুভবতা তারা পেতো না। কোন মহৎ অনুপ্রেরণাও আসতো না, ফলে তাদের চরিত্র মাধুর্যও দেখা যেতো না।

 

বিশ্বজনীন ও শাশ্বত মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদর্শ নিকেতনের কিছু খ্যাতিমান শিষ্য এবং তাদের সুমধুর চরিত্র ও জীবনের কিছু দৃষ্টান্ত

সেই আদর্শ শিক্ষা নিকেতন থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত এমন একজনকেই সামনে রাখুন, যিনি ইসলামের মূল দোলনা তথা আরব উপদ্বীপ থেকে সুদূরবর্তী এক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রিসালাতের সময়কাল পেরিয়ে যাওয়ার বহু পরে এ মনীষীর আবির্ভাব ঘটে। জন্ম ও বংশগত দিক দিয়ে যার রক্তমাংস ছিল অনারবীয়। সে মনীষী সুলতান সালাহুদ্দীন কুর্দি আজমী। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সালাহুদ্দীন আইয়ুবী নামে বিখ্যাত। ষষ্ঠ হিজরিতে তার আবির্ভাব। তার সম্পর্কে তারই একজন বিশ্বস্ত সহচর (সেক্রেটারি) ইবন শাদ্দাদের বক্তব্য নিন্মরূপঃ

"পক্ষান্তরে তার শাসনামলে দেশ কি উন্নতি লাভ করেনি ? তদুপরি মৃত্যুকালে রেখে যান তিনি সর্বমোট মাত্র সাতচল্লিশটি নার্সেরী রৌপ্য মুদ্রা আর একটি স্বর্ণ মুদ্রা। ওজনের দিক দিয়ে তা কতটুকু ছিল তা আমার জানা নেই। আমি তাকে একবার বায়তুল মুকাদ্দাসে বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের মাঝখানে দেখেছিলাম। তিনি তখন দিমাশক যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেসব প্রতিনিধি দলকে দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না তার কোষাগারে। আমি তখন এ বিষয়ে তার সাথে আলোচনা করছিলাম। পরিশেষে তিনি বায়তুল মালের কিছু সামগ্রী বিক্রি করে সব প্রতিনিধি দলের মাঝে বণ্টন করে দিলেন। একটি রৌপ্য মুদ্রাও অবশিষ্ট রইলো না।

প্রাচুর্যের সময় যেভাবে তিনি প্রাণ খুলে দান করতেন, দৈন্যের সময়ও ঠিক অনুরূপ উদারচিত্তে তা অব্যাহত রাখতেন। যদ্দরুন তার কোষাধ্যাক্ষগণ অনেক সময় তার অজান্তে কিছু মাল লুকিয়ে রাখতেন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য। কারণ সুলতান যখনই কোন দ্রব্য সম্পর্কে জ্ঞাত হতেন, তখনই তা চেয়ে নিতেন। কথা প্রসঙ্গে একদিন তিনি বলেছিলেন - এমনও কিছু মানুষ আছে, যারা ধন-সম্পদকে মাটির মতো ভেবে থাকে। উক্তিটি দিয়ে যেন তিনি নিজেকেই উদ্দেশ্য করছিলেন। সর্বদাই তিনি সাহায্য প্রার্থীর আশারও ঊর্ধ্বে দান করে থাকতেন।" (৫)

এমন একজন মহান সম্রাট, যার সাম্রাজ্য সিরিয়ার উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিনে নওবা মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, ইহধাম ছেড়ে চলেছেন, অথচ তার নিজের কোষাগারে দাফন-কাফনের পয়সাটুকুও ছিল না।

ইবন শাদ্দাদ বলেন -

"এরপর তাকে গোসল দেওয়া ও কাফনের প্রস্তুতি চলছিল যখন, তখন আমাদের তার ব্যবস্থা এভাবে গ্রহণ করতে হয়েছিলো যে, সাধারণ ও তুচ্ছ জিনিস পর্যন্ত ধার করে আনতে হয়েছিলো। এমনকি কবরে রাখার জন্য ঘাসের আঁটি পর্যন্ত যোগাড় করতে হয়েছিলো ধার করে। যোহরের নামাযের পর একটি সাধারণ খাটে আবৃত করে তার জানাযা আনা হলো। কাফনের কাপড় সবটুকুও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কাযী ফাযিল।" (৬)

সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি সম্পর্কে ইউরোপীয় জীবনীকার লেনপুন (Stanely Lanepool) তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ "সালাহুদ্দিন" (পৃষ্ঠা ২০৫) এ লিপিবদ্ধ করেন, "সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবির ভদ্রতা ও সুপরিসর মানসিকতার অবগতি সম্পর্কে একটি ঘটনার অবতারণই যথেষ্ট, যা ঘটেছিল বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের সময়। এ বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় ও পুনরুদ্ধারের সময় তিনি খৃষ্টান শত্রুদের যে অতুলনীয় সদাচরণ দেখিয়েছিলেন, তা ছাড়া যদি আর কোন কিছুই তার সম্পর্কে না জানা যায়, তবুও এটুকুই এটা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট হবে যে, তা ব্যক্তিত্ব, চারিত্রিক মহত্ত্ব, শৌর্যবীর্য ও পৌরষের শ্রেষ্ঠত্বে তার সমকক্ষ সেখানে আর কেউ ছিল না। বরং এসব ক্ষেত্রে যেন তিনি সর্বকালের মানুষের শীর্ষে অবস্থান করেছেন।"

এ মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের প্রভাব নিজ শক্তি, প্রেরণা ও সম্ভাবনাময় পরিপূর্ণতা নিয়ে প্রতিটি যুগে সক্রিয় রয়েছে। এমনকি এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে সেসব ইসলামী রাষ্ট্র থেকে সুদূরে এক প্রান্তে অবস্থিত রাষ্ট্রসমূহেও। প্রকাশ পেয়েছে সেসব নতুন নতুন সমাজ ও ব্যক্তিবর্গের মাঝেও, যারা ইসলামের প্রথম সারির মনীষীদের সাথে ভাষা, বংশ ও শিল্পগত দিক দিয়ে আদৌ সম্পৃক্ত ছিল না। তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এমন হয়েছিলো যে, তারা প্রথম ইসলামী দাওয়াতদাতা কিংবা আধ্যাত্মিক পীরের হাতে মুসলমান হতেন। পরে তাদেরই বংশে কোন বাদশাহ কিংবা শাহী মর্যাদার এমন আল্লাহ-ভীরু কামিল ওয়ালীর আবির্ভাব ঘটতো, যার মধ্যে আল্লাহ-প্রীতি, তাকওয়া, ইনসাফ, সাম্য, সমবেদনা ও সহানুভূতি, দয়া-দাক্ষিণ্য, আল্লাহ'র তুষ্টি ও একনিষ্ঠতা, সততা ও সরলতার এমন প্রতীক সাব্যস্ত হতো, যা অন্য সমাজের হিবর, রাহিব, পোপ এবং পাদরীদের মধ্যেও হতো না। তাদের রাজা ও মহারাজাদের তো প্রশ্নই উঠে না।

আমি উপমহাদেশের দীর্ঘ ইসলামী ইতিহাসে এ জাতীয় সমৃদ্ধ বহু ঘটনার এমন একটি উদাহরণ পেশ করছি, যেটির অভূতপূর্ব আকর্ষণ, অকৃত্রিমতা যতদিনই অতিবাহিত হোক না কেন, যতবারই তা শোনা যাক না কেন, হ্রাস পায়নি কিঞ্চিৎও।

গুজরাটের বাদশাহ মুজাফফর হালীম (মৃত্যু ৯৩২ হিজরি) আর তার সমসাময়িক মান্ডোর শাসনকর্তা সুলতান মাহমুদ খিলজীর মাঝখানে বহুদিন যাবত রাজনৈতিক মতপার্থক্য চলছিলো। সুলতান খিলজী তার রণচাতুর্যের দরুন উপর্যুপরি আক্রমণ অব্যাহত রাখতেন। ফলে সুলতান মুজাফফর হালীমকেও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হতো। ভাগ্যের পরিহাস, কালের পট পরিবর্তন হলো, পতন আসতে লাগলো মাহমুদের শৌর্য-বীর্যে। পরিশেষে পরাক্রমশালী সুলতান মাহমুদকে একজন আশ্রয় প্রার্থী হিসেবে তার পুরনো ঘোর শত্রুর দ্বারে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হলো। কেননা তার ওয়াযীর মুন্ডলী রায় তার রাজ্যে জবর দখল করে বসেছে।

সুলতান মাহমুদ সাহায্য প্রার্থনার জন্য সুলতান মুজাফফর হালীমের সহানুভূতি ও সাহায্য কামনা ছাড়া ইসলামী মর্যাদাবোধের দৃষ্টিতে অন্য কোথাও তার আশ্রয়ের স্থল খুঁজে পেলো না। তাই তিনি পরিশেষে সুলতান মুজাফফরকেই স্বীয় সাহায্য-সহানুভূতি, মদদ ও সহযোগিতার যোগ্য পাত্র মনে করলেন। জাহিলী সংকীর্ণতায় আক্রান্ত কোন ব্যক্তির পক্ষে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিছুতেই সম্ভব হতো না, পারতো না কোন জড়বাদী দর্শনের অনুসারী এভাবে শত্রুকেই যথার্থ আশ্রয়স্থল বলে ভাবতে। আবার এদিকে সুলতান মুজাফফর হালীম সে সুযোগটুকুর সদ্ব্যবহারের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না। একটু কটাক্ষও তিনি করলেন না প্রাণের শত্রুকে। বরং একমাত্র আল্লাহ'র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আর নাফস ও শয়তানের ভেলকী নস্যাৎ করার এটিকে একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে করে নিলেন।

দেরী না করে সুলতান মুজাফফর এক বিরাট সেনাবাহিনী সাথে নিয়ে মান্ডোর দিকে যাত্রা করলেন। তিনি যে তার শত্রু রাষ্ট্রের (রাজনৈতিক) সমস্যাকে নিজের রাষ্ট্রের সমস্যার তুল্য ভেবেছিলেন তাই নয়, বরং তার চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং একটি ইসলামী রাষ্ট্রের আযাদীর সংরক্ষণ ও ইসলামের শান-শওকতের পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে নিজের রাষ্ট্রের আযাদী ও নিরাপত্তাকে জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠাবোধ করলেন না। ওদিকে কাফির সেনা ও শিরক শক্তিগুলো তাদের মিত্র রাষ্ট্র মান্ডোর সাহায্যের উদ্দেশ্যে রণক্ষেত্রে একত্রিত হতে শুরু করলো। ফলে সংঘটিত হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সে যুদ্ধে শত শত মৃতদেহের বিরাট স্তুপ হলো। রাজপথগুলোয় প্রবাহিত হলো রক্তধারা। পরিশেষে সুলতান মুজাফফরেরই বিজয় হলো, শত্রুপক্ষ পরাজয় বরণ করলো। রাজপুত রাজাদের চিরাচরিত প্রথানুযায়ী রাজপুত ও সম্রাজ্ঞীগণ জহরব্রত পালনের প্রাচীন রীতি সমাপন করলো। অবশেষে এ রাষ্ট্র ইসলামী শাসনের আওতাভুক্ত হলো।

এখানে মানবিক ভদ্রতা ও ইসলামী আদর্শের আরো একটি উত্তম নমুনা প্রতিভাত হচ্ছে। তা হচ্ছে এই - সুলতান মুজাফফর হালীমের কিছু সামরিক উপদেষ্টা তাকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, এ মনোরম উর্বর ভূমিটি বাদশাহ যেন হাতছাড়া না করেন। কেননা, সুন্দর সুন্দর স্থাপত্য, দুর্ভেদ্য দুর্গে আর পরিপূর্ণ কোষাগারে এই দেশটির তুলনা উপমহাদেশে আর একটি নেই। যা দুর্বল ও পথভ্রষ্ট বাদশার অদূরদর্শিতার কারণে জীর্ণ হয়ে আসছিলো। তাদের যৌক্তিকতা ছিল এই যে, বাদশাহ যেহেতু এই মান্ডোকে নব অভিযানের মাধ্যমে জয় করলেন, সুতরাং তিনি-ই এই বিজিত রাষ্ট্রের অধিকারী। বলাবাহুল্য, রাষ্ট্র তো শক্তি ও বিজয়েরই ফসল। আর বিজিত দেশকে সাধারনত বিজেতারই হক ও অধিকার ভাবা হয়।

সুলতান মুজাফফর হালীম সেনানায়কদের এ অভিপ্রায় সম্পর্কে অবহিত হলে সাথে সাথে তিনি সুলতান মাহমুদকে নির্দেশ দিলেন যে, তার সৈনিকদের কাউকে যেন নগরীতে প্রবেশ করতে না দেওয়া হয়। সুলতান মাহমুদ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বাদশাহ মুজাফফরকে মাত্র কিছুক্ষণ সময় দুর্গে অবস্থান করে বিশ্রাম নেওয়া আর গোসল ইত্যাদি করার জন্য আহবান জানালে সুলতান মুজাফফর শুকরিয়ার সাথে তাও প্রত্যাখ্যান করলেন। তার সৈনিকদেরকে আহমদাবাদ আর নিজ নিজ ঠিকানায় প্রত্যাবর্তনের জন্য হুকুম দিলেন। আর সুলতান মাহমুদকে বললেন, আমি এই দেশে এসেছি একমাত্র আল্লাহ'র সন্তুষ্টি অর্জনের নিমত্ত, তার সওয়াবের আশায় আর তার হুকুম পালন করার উদ্দেশ্যে।

"..... তারা যদি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সহায়তা কামনা করে, তবে তোমাদের জন্য অপরিহার্য হবে তাদের সাহায্য করা ....." (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ৭২)

"একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের ভাই। এক ভাই অপর ভাইকে শত্রুর কাছে সোপর্দ করতে পারে না আর অপমানিত করতেও পারে না।" (হাদিস)

উপরোক্ত উক্তি দুটো পেশ করে সুলতান মুজাফফর বললেন, এখন আমার নিয়ত পুরা হয়েছে। আল্লাহ পাক আমাকে, আপনাকে আর ইসলামকে সফল করেছেন। আমি আমার সঙ্গী-সাথীদের থেকে এমন কিছু উক্তি ও যুক্তি পেয়েছি, যেগুলোয় আমি কান দিলে আমার সব আমল বিনষ্ট হতো, জিহাদ বরবাদ হতো। মূলত এ ব্যাপারে আমার কোন অবদান নেই। অবদান তো সবটুকু আপনার। আমাকে এ শুভ কাজের সুবর্ণ সুযোগ প্রদান করেছেন তো আপনি। আপনি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। এখন আমি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে ইচ্ছা করেছি। আমি আমার আমলকে মূল্যহীন করতে চাইনি। ভালোর সাথে মন্দের ভেজাল দিতে আমি রাযী নই।

বাদশার এ ভাবগম্ভীর বক্তব্য শুনে তার বিজয়ী সেনাদল আনন্দ হিল্লোলে মেতে উঠলো। আহমদাবাদের দিকে ইচ্ছার বলগাকে ফিরিয়ে দিলেন নিপুণ অশ্বারোহীগণ। একটি স্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলে গেলেন তারা নিজ দেশে।

সুলতান মুজাফফর মান্ডো বিজয়ের সময় যখন বিজয়ীর বেশে সসম্ভ্রমে নগরীর দিকে প্রবেশ করছিলেন, তখন সুলতান মাহমুদ তার মনোরঞ্জনের জন্য তাকে ধনাগার ও প্রাচুর্যগুলো পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে সঙ্গে নিয়ে নিলেন। মান্ডোর প্রতিটি জিনিস ছিল নেহায়েত চিত্তাকর্ষক ও বৈচিত্র্যময়। নগরীটি এক দীর্ঘকাল ব্যাপী সৌন্দর্য, সজীবতা, সম্পদ ও স্থপতি, রূপসী দাসী ও মহিলাদের মীনা বাজারের খ্যাতি লাভ করে আসছিলো। অথচ সুলতান মুজাফফর মাথা নিচু করে সেসব থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে পথ অতিক্রম করে আসছিলেন। বিজয়ী নেতার অভিনন্দন জ্ঞাপনার্থে হাসিমুখে প্রতীক্ষারত দাস-দাসী ও সেচ্ছাসেবী ছাউনি অতিক্রমকালে সুলতান মাহমুদ তার লাজুক ও সংকুচিত সহযাত্রী সুলতান মুজাফফরকে নিবেদন জানালেন - জনাবে আলী, ব্যাপার কি ? আপনি যে মাথা উঠাচ্ছেন না আর এমন নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলো একটু লক্ষ্যও করছেন না ? সুলতান মুজাফফর বললেন - আমার জন্য তা জায়েয না। আল্লাহ পাক বলেছেন -

"মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে ......."(সূরাহ আন-নূর, ২৪ : ৩০)

সুলতান মাহমুদ বললেন - এরা তো আমারই দাসী, এদিকে আমি আপনার এমন একজন গোলাম, যাকে আপনার অফুরন্ত করুনা আজীবনের জন্য কিনে নিয়েছে। তাই এরা নীতিগতভাবেই আপনার দাস-দাসী।

কিন্তু সুলতান মুজাফফরকে এ যুক্তি স্বস্তি যোগাতে ব্যর্থ হয়। তার নিশ্চিত প্রত্যয় এই ছিল যে, আল্লাহ পাক যা হারাম করেছেন, তা অন্য কেউ হালাল করার নেই। (৭)

এভাবে আল্লাহ-প্রেমিক মুত্তাকী বাদশাহ তার ভদ্রতা, অন্তরের পবিত্রতা, ইসলামের প্রতি মজবুত আকর্ষণ আর ইসলামী চরিত্রের বুলন্দ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এগুলো কৃত্রিম ছিল না। বরং এগুলোতেই তার প্রকৃতি গড়ে উঠেছিলো। নিক্তিতেই গড়া ছিল তার দৈনন্দিন জীবন প্রণালী। অথচ একজন আদর্শের দিশারী বাদশার বংশধারা দুই তিন পুরুষ পূর্বে গিয়ে অমুসলিম হিন্দু বংশের পেশাধারী নর্তকীদের সাথে মিশে যায়। এমন একটি বংশের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি যখন ইসলামের সম্মানে বিভূষিত হলেন, এক বিরাট সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে সফল হয়ে গেলেন। ইতিহাসবেত্তাগণ তার পিতামহের উপরে গিয়ে ইসলামী নাম আর খুঁজে পাচ্ছেন না। ফিরোজশাহ তুগলকের শাসনকালে তারা অষ্টম হিজরীতে ইসলাম কবুল করেছিলেন। তাই এর পূর্বে গিয়ে ইসলামী নাম না এসে ভারতীয় নাম আসতে থাকে। তাই তাদের ইসলামী বংশের ধারাবাহিক পরিচিতি শত তল্লাশী চালিয়েও মিলেনি।

এ অতুলনীয় ভদ্রতা ও আল্লাহ-ভীতি তিনি পেলেন একমাত্র মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদর্শের শিক্ষানিকেতন থেকেই। তিনি সে শিক্ষানিকেতনের একজন একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন মাত্র। তিনি ইসলামের নিয়ামত এবং মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইহসান ও অবদানকে পুঙ্খানুপুঙ্খ সদ্ব্যবহার করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। দ্বীনের সাথে তার সম্পৃক্তি নিতান্তই আন্তরিক ও শ্রদ্ধাপূর্ণ ছিল।

 

যে শাশ্বত ও মুবারক শিক্ষা নিকেতনের কৃতিত্ব সার্বজনীন ও সর্বকালীন

এ সুষমামণ্ডিত ও নয়নাভিরাম শিক্ষা পাদপীঠ থেকে যে কতো কৃতী সন্তান সারা বিশ্বে কারণে আওয়াল সাহাবা যুগ, তাবেয়ীনদের যুগ আর পরবর্তী যুগসমূহে বের হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেসব খ্যাতিমান সন্তানদের কতোই না কৃতিত্ব, বিজয় সম্মান ও শ্রদ্ধাঞ্জলী বসুন্ধরার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে।

এ পাদপীঠের প্রশিক্ষণ ও এর প্রতিষ্ঠার প্রভাব কখনো প্রতিফলিত হয়েছে মহাবীর তারেকের দুঃসাহসিকতায়, মুহাম্মাদ ইবন কাসিমের অসীম বীরত্বে এবং মুসা ইবন নাসীরের আজেয় মনোবলে। আবার কখনো তা প্রতিফলিত হয়েছে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফেঈ'র মেধা ও তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিতে। কখনো তা ধরা দিয়েছে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল, ইমাম মালিকের দৃঢ়তা ও অটলতার আকৃতিতে। আবার কখনো এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নুরুদ্দীন যঙ্গী'র দয়া-দাক্ষিণ্যের ধরণ নিয়ে। আবার কখনো সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি'র অধ্যবসায় ও সাধনার রঙে রঞ্জিত হয়ে তা প্রদর্শিত হয়েছে। ইমাম গাযযালির দর্শনের বেশে সামনে এসেছে কখনো, আবদুল কাদির জিলানির সংস্কার ও আধ্যাত্মিকতার রক্তে রঞ্জিত হয়ে এসেছে কখনো।

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষা নিকেতনের সে প্রভাব ইবন জাওযীর মাধ্যমে কখনো বিকশিত হয়েছে, আবার কখনো তা মুহাম্মাদ ফাতিহের তরবারী সেজেছে। সুলতান মাহমুদ গযনভীর রণস্পৃহা নিয়ে কখনো চমকিত হয়েছে, কখনো নিজামুদ্দীন আউলিয়ার করুনা ও বিনয়রূপে তা প্রমাণিত হয়েছে। একবার রূপ ধারণ করেছে ফিরোয শাহ খিলজীর উচ্চ মানসিকতায় ভূষিত হয়ে আবার তা ইমাম তাইমিয়ার সুগভীর ইলমী প্রজ্ঞার ধাঁচে ধরা দিয়েছে। সামনে এসেছে তা কখনো শেরশাহ সূরীর দূরদৃষ্টির বেশে, কখনো সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের লৌহ মনোবলের বেশে।

এ মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাগারেও তার প্রতিষ্ঠাতার প্রেরণা প্রতিফলিত হয়েছে কোন কোন সময় শরফুদ্দীন ইয়াহয়া মুনীরার মারিফাত ও দর্শনে, কখনো মুজাদ্দিদে আলফেসানীর তীর্যক লেখনী ও অভিযানে। আবার তা কোন কোন সময় প্রস্ফুটিত হয়েছে আবদুল ওয়াহহাব নাজদীর দাওয়াতের কলিতে। কখনো শাহ ওয়ালী উল্লাহর দর্শনরূপে প্রকাশিত হয়েছে, আবার কখনো উত্তরসূরি দাওয়াতদাতা উলামায়ে রাব্বানীয়ীনদের অনুপম খিদমতের চমক নিয়ে বিকশিত হয়েছে।

এসব খ্যাতিমান মনীষীর ইলমী ও আমলী খিদমতের সূত্রধারা সেই মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাগারের প্রশিক্ষণের সাথে জুড়ে রয়েছে, যা ছিল এ ধারার প্রাথমিক স্বর্ণযুগ। আর এটিই ছিল সে যুগ, যে যুগে মানবতার সর্বোৎকৃষ্ট সম্ভাবনাগুলো উৎসরিত হচ্ছিলো। আর তা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের মাধ্যমেই সূচিত হয়। সে যুগেই ওসব যোগ্যতার সদ্ব্যবহার করার মতো যোগ্য পাত্র পরিদৃষ্ট হচ্ছিলো।

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ শিক্ষানিকেতন কালের শত অবজ্ঞা এবং জনগণের জানাবিধ অনীহা সত্ত্বেও ইতিহাসে কতো নজীরবিহীন ব্যক্তিবর্গকে সৃষ্টি করে আসছে আল্লাহ'র মহিমায় নিজ ফসল ও _ দ্বারা তারা মানবতার শুন্য কোটাটিকে পরিপূর্ণ করে আসছে। এ অনুপম শিক্ষাগারটি সেসকল একনিষ্ঠ নেতৃবর্গ আর রাব্বানী আলিমকুলের বদৌলতে অব্যাহত রেখেছে মানবতা ও ন্যায়পরায়ণতা অনুসন্ধানের পথটুকু। যারা কুরআনের ভাষায় বিঘোষিত হয়েছে -

"...... ঈমানদারদের সামনে তারা নিতান্তই বিনয়ী, কাফিরদের বেলায় বজ্রকঠোর; আল্লাহ'র পথে জিহাদ করে, অথচ তারা বিদ্রুপকারীদের কিঞ্চিৎও পরোয়া করে না ......" (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ৫৪)

এদিকে এ গায়েবী আওয়াজে প্রতিনিয়ত শ্রুত হচ্ছে -

"...... আর যদি এ কুরআনের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে, তাহলে আমি এর জন্য এমন এক সমাজকে নির্ধারণ করবো, যারা তা অস্বীকার করবে না।" (সূরাহ আল আনআম, ৬ : ৮৯)

 

টীকাঃ

(১) আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খণ্ড।

(২) তাবারী, ৪র্থ খণ্ড।

(৩) মুসনাদে দারেমী।

(৪) মিনহাজুস সুন্নাহ, ৩য় খণ্ড।

(৫) আন নাওয়াদির আস সুলতানিয়া ওয়াল মাহাসিনুল ইউসুফিয়া, ইবন শাদ্দাদ, পৃষ্ঠা ১৩-১৪।

(৬) আন নাওয়াদির আস সুলতানিয়া ওয়াল মাহাসিনুল ইউসুফিয়া, ইবন শাদ্দাদ, পৃষ্ঠা ৩৫১।

(৭) বিস্তারিত জানার জন্য আল্লাম আসেজীর আরবী ইতিহাস "জাফরে ইলওয়া" দ্রষ্টব্য।

 

সূত্রঃ নবুওয়াত ও আম্বিয়ায়ে কিরাম (সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহিমাহুল্লাহ)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-52

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রিসালাতের মাহাত্ম্য

 

 

 

The Greatest Nation·Monday, March 11, 2019

 

 

 

বর্বরতার যুগের ট্র্যাজেডি

যে বর্বরতার যুগের চরম অধঃপতন সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের কিঞ্চিৎ দ্বিমত নেই, এর ট্র্যাজেডি কিন্তু কুফর, অনাবৃষ্টি, বদ আমল, গুনাহ, জুলুম, ঔদ্ধত্য, প্রকৃত মানবতার অনুপস্থিতি, মানবাধিকারের বিলুপ্তি, স্বেচ্ছাচারী এবং স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর শাসন বিস্তার ইত্যাদি নয়। অনুরুপ ট্র্যাজেডি এটিও নয় যে, আল্লাহ'র ইবাদাতকারী সালিহ বান্দাদের সংখ্যাস্বল্পতা কিংবা তাদের সমূলহারা হওয়া। এসব জিনিস পরিতাপের বিষয় বটে। তবে এসবের অবতারণা মানবতার আবহমান কালের সুদীর্ঘ ইতিহাসে অসংখ্যবার ঘটেছে এবং সেগুলোর প্রতিরোধে দাওয়াত ও ইসলাহর প্রক্রিয়া হাতে নিয়ে সচেতন হৃদয়সম্পন্ন, দৃঢ় ও অনঢ় ব্যক্তিবর্গ নিজ নিজ যুগে আপন কার্যক্ষেত্রে অব্যাহত রেখেছেন।

প্রকারান্তে জাহিলিয়াতের সে ট্র্যাজেডি, যার বিভীষিকাময় পরিণতি থেকে পরিত্রাণ দেওয়া এবং মানুষের সামাজিক অধিকার বলবৎ করার জন্য মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রিসালাতের অভ্যুদয় হলো - তা হচ্ছে সঠিক ইলম, সদিচ্ছা, ন্যায় প্রতিষ্ঠার বুক টান করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এমন গুণের অধিকারী জামাআতের তদনীন্তন বিশাল বসুন্ধরায় অবর্তমান থাকা। অর্থাৎ, সে ট্র্যাজেডির মূল কারণ ছিল, এমন একটি হক্কানি জামাআতের অনুপস্থিতি, যারা অশুভ শক্তিগুলোর মাঝবেলায় কল্যাণকামিতার ভিতের উপকরাণাদি একটা নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার প্রয়াস পাবেন।

 

সঠিক ইলমের অভাব

যে ইলমের বদৌলতে মানুষ তার রবকে যথাযথভাবে চিনতে পারে, তার কাছে পৌঁছা যায়, যা দিয়ে মানুষ সহিহ, খালিস, পছন্দনীয় ইবাদাত করতে পারে - এমন ইলম বর্বরতার যুগে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। আর তখনকার সে জাহিলী যুগে যদিও পাওয়া যেতো নিখুঁত ইলম, সুঠাম মনোবৃত্তি আর হকের সন্ধানী দু-একজনকে, তবে অনাচারে বেস্টিত পারিপার্শ্বিকতার দরুন বেশী কিছু তার থেকে আশা করা সম্ভব হয়ে উঠত না। সে তিমিরাচ্ছন্ন পরিবেশে যে ইলমই আসুক না কেন - মূর্খতা এবং কুসংস্কারে মিশ্রিত থাকা এবং অন্তঃসারশুন্য হওয়া একান্তই স্বাভাবিক। এ জাতীয় ইলমে বিশুদ্ধতা নগণ্য, ভ্রান্তির আধিক্য, লাভ কদাচিৎ, ক্ষতি সুনিশ্চিত হওয়ার আশংকাই বেশী ছিল।

 

সুঠাম ও সঠিক মনোবৃত্তির অভাবে

আর যদিও সে দুর্লভ সঠিক ইলম কোন আলিমের অন্তর কিংবা কোন দার্শনিকের কিশতি অথবা প্রাচীন যুগে অবতারিত কোন সঠিক ইলমের অবশিষ্টাংশ হিসেবে কোথাও পাওয়া যায়, তাও পরিবেশজনিত অসুবিধার কারণে সেই নিখুঁত মনোবৃত্তি পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ে, যা সেই সঠিক ইলমকে যথোচিত মর্যাদা সাথে আহরণ করবে, জীবন চলার আলোকবর্তিকা করে দিবে, এর বাহক এর দ্বারা তার কুপ্রবৃত্তির মোহ এবং অজানা জীবন পদ্ধতির মুকাবিলা করবে।

তাই তো সেই বর্বরতার যুগে আল্লাহ-তালাশী ও ন্যায়ের সন্ধানের প্রেরনা লোপ পেয়ে গিয়েছিলো। এই পথের সন্ধান পরিক্রমায় শক্তি ও মনোবল অচল হয়ে পড়েছিলো। তা ব্যয়িত হতো একমাত্র জীবিকার অন্বেষা, কুপ্রবৃত্তি পূজা, কামনা-বাসনার চাহিদা মোচন, রাজগণের অন্ধ-অনুসরণ আর তাদের জন্য আত্মবিসর্জনে। মমত্ববোধের স্ফুলিঙ্গ তখন নিবু নিবু প্রায়। অন্তরের উত্তাপ ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো। সেগুলোয় তখন পার্থিব মোহের বরফ জমে উঠেছিলো। দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কেন্দ্রগুলোতে পরিদৃষ্ট হতো শুধু কুসংস্কারক্লিস্ট পৌত্তলিকতা এবং বাহ্যিক প্রথা-প্রচলনের ক্রিয়াকলাপ।

 

ন্যায়ের সহযোগী ও সংরক্ষক দলের অনুপস্থিতি

ঘটনাক্রমে যদিও এ জাতীয় বর্বর পরিবেশে কোথাও সহিহ ইলম এবং সৎ মনোবৃত্তির অস্তিত্ব পাওয়া যেতো, তাও আবার পাওয়া যেতো না তখন এমন কোন আশ্রয়দাতা কিংবা শক্তি, যার ছত্রছায়ায় সেটি বিকশিত হয়ে উঠবে আর দুর্বল মুহূর্তে সুসংহত শক্তি থেকে একটু শক্তি হাসিল করতে পারবে। কারণ ন্যায়ের সহায়তা ও সংরক্ষণের ব্যাপারটি ব্যক্তিগত সংস্কার ও সংযম শুদ্ধিতেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। আর কিছুসংখ্যক যারা একাকী দিন কাটাচ্ছিলো গির্জা, মন্দির, পর্বতগুহা কিংবা পর্বতশৃঙ্গে - তাদেরকে উপমা দেওয়া যেতে পারে এমন একটি প্রদীপের সাথে, যেটির সলিতা জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছে, অবশিষ্ট নেই তাতে একটু তেলও। ফলে এর আলো একেবারেই ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছিল শীত ঋতুর ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন নিশির দীর্ঘক্ষণ প্রবল বারিপাতের পর মিট মিট করে জ্বলতে থাকা জোনাকি পোকার মতো। এদিক-ওদিক সেগুলো ডানা খুলে উড়ে আর একটু একটু করে আলো বিতরণ করে। অথচ এতে কোন পথহারা মুসাফিরের পথের দিশা তো পাওয়া যায়-ই না, পায় না এর দ্বারা শীতে থরথর করে কম্পমান একজন ভ্রাম্যমাণ পথিক কিঞ্চিৎ তাপ।

 

একটি দীপ্ত সূর্যের প্রতীক্ষায়

যে সঠিক ইলম মানুষকে সৃষ্টির স্রস্টা ও মালিকের সত্তা ও তার গুণাবলী এবং নির্বাচিত নামসমূহের যথাযথ পরিচিতি দান করে, তাদেরকে তাদের স্রস্টার সাথে এক সুদৃঢ় অথচ অভিনব শৃঙ্খলে জুড়ে দেয়, যে ইলম বুদ্ধি ও দেমাগকে নতুন ঈমান ও নিশ্চিত প্রত্যয়ে পরিপূর্ণ করে দেয়, অন্তরাত্মাকে মুহাব্বাতে আপ্লুত করে তোলে, সীমালঙ্ঘনকারীদের দ্বীনের বিকৃতি সাধন এবং বাতিল পছন্দের ভ্রান্ত মিশ্রণ ও ভিত্তিহীন সংযুক্তিকে বিদূরিত করে মানুষদেরকে ঘোর তমসা থেকে আলোর দিকে ধাবিত করে যে ইলম, যে ইলম সংশয় থেকে মুক্ত করে দৃঢ়তার দিকে নিয়ে যায়, সে ইলম বিশ্ববাসী হাসিল করার প্রয়াস পেলো একমাত্র নবুওয়াতে মুহাম্মাদির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রূপরেখায়। এ ইলমই যাবতীয় দ্বিধা, সংশয় আর সর্বপ্রকার ভ্রান্তির মূলে কুঠারাঘাত হানার উপযোগী ছিল। যেগুলোতে আক্রান্ত ছিল পৌত্তলিক ও নাস্তিক জাতিগুলো এক দীর্ঘকাল ব্যাপী। নবুওয়াতে মুহাম্মাদির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বদৌলতে অর্জিত এ ইলম ইয়াহুদি, খৃষ্টান, অর্থাৎ আহলে কিতাবের মাঝখানে বিরাজমান মতান্তরের সঠিক সমাধান দিতে সক্ষম হয়েছিলো। বস্তুত, যদি তাদের মধ্যে আল্লাহ-ভীতির সামান্যতম লেশও থাকতো, তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতো যে, তারকারাজি জ্যোতিহীন হয়ে পড়েছে, ভূগর্ভ থেকে উদয় হয়েছে এক জ্যোতিষ্মান সূর্য। প্রভাতী কিরণের দীপ্তির প্রদীপের প্রয়োজনীয়তা ঘুচিয়ে দিয়েছে।

"কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিলো, তারা আর মুশরিকেরা স্বীয় মতে অবিচলিত ছিল তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ না আসা পর্যন্ত। আল্লাহ'র নিকট থেকে এক রাসুল এলেন, যিনি তিলাওয়াত করেন পবিত্র গ্রন্থ, যেখানে রয়েছে সঠিক বিধান।" (সূরাহ আল-বায়্যিনাহ, ৯৮ : ১-৩)

 

ঈমানকে দুর্বল ও মানুষকে পথভ্রষ্ট করার ফালসাফা ও শিরকের কারসাজি

সদিচ্ছা সবসময়ই সঠিক ইলম এবং প্রবল ঈমানের অনুগামী হয়। মানুষ যখন দুই-একটি হাকিকতের উপর আস্থা স্থাপন করতে যায়, ভালো-মন্দ বুঝতে পায় আর এতদ্বারা আশা-ভীতি, সংশয় ও লোভের প্রেরণা জাগ্রত হয়, তখন তার ইচ্ছাশক্তি তাকে সহায়তা করে। তার অঙ্গরাজিও তাকে সাহায্য করে। কিন্তু বর্বরতার যুগে সুদৃঢ় ঈমান অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। যার কারনে মানুষ মহান আল্লাহ'র সত্তা, জান্নাত ও দোযখ, আখিরাত এবং স্বীয় আমলের জবাবদিহির মূল্যবান আকিদা থেকে মাহরুম হতে চলেছিল। তখনকার সে পরিস্থিতিতে ঈমান এবং স্রস্টা ও সৃষ্টির পারস্পরিক বাঁধনকে টুটে দেওয়ার পিছনে ফালসাফা ও শিরকেরও এক বিরাট হিসসা ছিল। এই ফালসাফা মহান আল্লাহ পাকের জন্য তার বিশেষ গুণাবলীকে জোরালোভাবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে আসছে। এদিকে আল্লাহ পাকের সেসব বিশেষ গুণের ক্ষেত্রে শিরক এসে আল্লাহ'র সাথে সৃষ্টিকেও অংশীদারীর শামিল করে দিয়েছে। এমনি করে ফালসাফা এবং শিরক - উভয়টিই আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যকার সম্পর্কে ক্ষতি পৌঁছিয়েছে। তাই তো যার সম্পৃক্তি গড়ে উঠেছে ফালসাফার সাথে, তার আকিদা খোদাকে কুদরত, হিকমত, রহমত এবং মুহাব্বাতশুন্য ভাবা, তাই তাকে ভয় করা কিংবা তার থেকে কিছু একটা আশা করার আদৌ প্রয়োজন নেই। এদিকে যারা শিরকের আকিদা পোষণ করে থাকে, তারা তো ব্যস্ত রয়েছে সৃষ্টিকুলের আশ্রয় গ্রহণ এবং তার সামনে শিরাবনত করায়! তারা তো দৃষ্টির আড়ালে বিরাজমান খোদার কাছে সাহায্য প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তাই বোধ করে না। তাদের আর এতটুকু অবসরই বা কোথায় ?

এমনি করে তখনকার বিশ্ব দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি শিবির তো তাদের নিজেদের মধ্যে পরকালের নিমিত্ত কোন প্রকার চেষ্টা সাধনার যৌক্তিকতাই খুঁজে পাচ্ছিলো না। দ্বিতীয় শিবিরটি অবকাশ পাচ্ছিল না ঈশ্বরদের মহা ঈশ্বরের কাছে একটু আরাধনার। বর্বরতার যুগের এই দৃষ্টিভঙ্গি দুটি নিখিল বিশ্বের সম্পৃক্তিকে এক দীর্ঘকাল ব্যাপী মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন থেকে ছিন্ন করে রেখে দিয়েছিলো। ফলে মানবাত্মায় মমত্ববোধ এবং আল্লাহ প্রেমের দীপ্ত মশাল নিস্প্রভ হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে মানব প্রকৃতিতে গচ্ছিত গুণাবলী ও যোগ্যতা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। শিকার হয়ে যায় মানুষ শিরক, কুসংস্কার, কুপ্রবৃত্তি ও রাজা বাদশাহদের দাসত্ব, তাগুত ও শয়তানের প্রতারণায় বেড়াজালের। পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সমস্ত মানববিশ্ব সকল দেব-দেবী ও উপাস্যদের উপাসনায় নিমগ্ন হয়ে যায়, যেগুলোর জন্ম দিয়েছে তারা নিজেরাই। এগুলো হয় তারা পূর্বপুরুষদের থেকে পেয়েছে অথবা স্বীয় উদ্দেশ্য সাধন, কর্মপদ্ধতি বাস্তবায়িতকরণ এবং জীবন প্রণালীর অধীনে তারা নিজেরাই গড়ে নিয়েছে। তারপর নিজের জন্য তা অপরিহার্য করে নিয়েছে। এ বিভিন্নমুখী উপাস্যদের প্রসঙ্গে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের উক্তিটি উপস্থাপনযোগ্য -

"তোমরা নিজেরা যাদেরকে খোদাই করে নির্মাণ করো, তোমরা কি তাদেরই পূজা করো ?" (সূরাহ আস-সাফফাত, ৩৭ : ৯৫)

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনীত বিশ্বজনীন ঈমানি দাওয়াতের মাধ্যমেই জাহিলী পরিবেশে পরিবর্তন আনা সম্ভব

মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ'র শক্তিতে ক্ষমতাবান মহামানব ব্যতিরেকে শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে বিলুপ্ত ঈমানকে পুনরায় উজ্জীবিত করা, নতুন চেতনা এবং ভালোবাসা অন্তরে সৃষ্টি করা অসম্ভব ছিল। অসম্ভব ছিল এটুকুও যে, তাদের সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তিকে ছলনাময়ী আনন্দদায়ক জীবন যাত্রার মোহ এবং নাফসের আরাম এবং বিলাসের চাহিদা পূরণের কঠিন চাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখা। সম্ভব হিল না তখন মানুষের মনোবৃত্তিকে প্রভাবশালী বাদশাহদের তোষামোদী থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে নিরাকার আল্লাহ'র দিকে ধাবিত করা কিংবা আল্লাহ'র মর্জি মুতাবিক তাদেরকে গড়ে তোলা। অসম্ভব ছিল আল্লাহ'র পথে তাদের জানমাল এবং সমস্ত প্রিয় বস্তুকে একমাত্র পরকালের সওয়াবের প্রত্যাশায় জলাঞ্জলি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করে তোলা।

এ গুরুত্ববহ কাজ এমনকি এ কৃতিত্বের জন্যই এমন লৌহ মানবের প্রয়োজন যাকে গগনচুম্বী পাহাড়েও লক্ষ্যচ্যুত করা দুরূহ। জীন ও ইনসানের ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতার দরুন যিনি কিঞ্চিৎ দুর্বল হওয়ার নন। এ বাক্যাংশটি যথাযথ পরিত্যক্ত হয়েছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বাণীতেঃ

"যদি কুরায়শগণ আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চন্দ্রও তুলে দেয়, আমি এ দাওয়াতের কাজ ছাড়বো না। যতক্ষণ আল্লাহ পাক এটিকে না সফলকাম করে দেন কিংবা আমি এই পথে নিঃশেষ হয়ে যাই।" (১)

এই মহতী কাজের জন্য প্রয়োজন সেই দৃঢ় ঈমানের, যা সমস্ত বিশ্ব এবং বিশ্ববাসীকে বণ্টন করে দিলে যথেষ্ট হবে আর সমস্তের দ্বিধাকে ইয়াকিন এবং দুর্বলতাকে সবলতায় পরিণত করে দিবে। এই-ই হবে সেই ঈমান, যা ঈমানদারের রসনা বা জিহবা থেকে এমন জটিল মুহূর্তেও উচ্চারিত হয়, যখন এ রসনা বাকহীন হয়ে পড়ে এবং দৃষ্টিশক্তি হয়ে পড়ে ক্ষীণ। তাই তো জগতবাসী অবলোকন করেছে - গুহার সন্নিকটে প্রাণের শত্রু দণ্ডায়মান, অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গুহাসঙ্গীকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন -

".... বিচলিত হয়ো না, আল্লাহ রয়েছেন আমাদের সাথে...." (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ : ৪০)

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূরদৃষ্টি স্থান-কাল এবং বিভিন্ন আচরণের প্রতিবন্ধকতা ছেদ করে আরবের একজন আর্ত বেদুইন সুরাকাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু'র হাতে ইরানের সম্রাট স্বর্ণ-নির্মিত বলয় অবলোকন করেছিলেন। অসহনীয় চরম ক্ষুধা ও শত্রু বেস্টনীর ভেতর দিয়েও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক পাথরের স্ফুলিঙ্গে দেখতে পেয়েছিলেন রোম সম্রাটের শ্বেত মহল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের সময় সুরাকাহ ইবন জুসুম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে ধাওয়া করতে এসে গুহাদ্বারে পৌঁছলে তার ঘোড়ার পা মাটিতে বসে যায়। এরপর সুরাকাহ তার গোস্তাখীর জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমীপে অনুকম্পা প্রার্থী হোন। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, "সুরাকাহ, সে সময়টি কেমন মনে হবে, যখন পারস্য-সম্রাটের স্বর্ণ নির্মিত বলয় তোমার হাতে এসে পৌঁছবে ?" পারস্য রাজধানী মাদাইন বিজয়ের পর সম্রাটের স্বর্ণ-বিগলিত বলয় যখন গনীমতের মালের সাথে পেশ করা হলো, তখন আমিরুল মুমিনীন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু সুরাকাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে সেই বলয় পরিধান করিয়ে দিলেন। অকল্পনীয় সেই ভবিষ্যৎবাণী পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়িত হলো। অনুরুপ, খন্দকের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি পাথরের উপর কোদাল নিক্ষেপ করলে পাথর থেকে চমকিত হলো অগ্নিশিখা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "এই আলোয় আমি রোম সম্রাটের শ্বেত-মহল অবলোকন করেছি।" নবুওয়াতের এই দূরদৃষ্টি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হল। মুসলমানদের করায়ত্তে এলো কায়সারের সেই শ্বেত মহল। (২)

বিশ্বব্যাপী জাহিলিয়াতের সমাপ্তি এবং এর স্থলে নব-জীবন, ইয়াকিন এবং দ্বীনি মূল্যবোধের উজ্জীবন যদি কারো দ্বারা সম্ভব হওয়ার থাকে, তো এমনই শক্তিশালী ও পয়গম্বরী ঈমানের দ্বারাই সম্ভব হতে পারে। আল্লাহ'র রহমতের আশ্রয় ধরে তা মানুষের দ্বারা মানুষেতেই বিকশিত হয়।

"তিনিই উম্মীদের মধ্যে তাদের একজনকে পাঠিয়েছেন রাসুলরূপে, যিনি তাদের কাছে আবৃত্তি করছেন তার আয়াত, তাদেরকে পবিত্র করেন আর শিক্ষা দেন তাদেরকে কিতাব ও হিকমত; ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।" (সূরাহ আল-জুমুয়াহ, ৬২ : ২)

"তিনিই তার রাসুলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ, সকল দ্বীনের উপর এটিকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়ার জন্য; যদিও মুশরিকেরা তা অপছন্দ করে।" (সূরাহ আস-সাফ, ৬১ : ৯)

 

স্থায়ী সংস্কারক ও অধ্যবসায়ী জামাআতের প্রয়োজনীয়তা

বর্বরতার এ সংক্রামক ব্যাধি গুটিকয়েক সংস্কারক কিংবা সংঘবদ্ধ একটি দল অথবা বড় একটি শিক্ষা পাদপিঠ দ্বারা যথেষ্ট হওয়ার ছিল না। কেননা প্রায় অপ্রতিরোধ্য এ সংক্রামক ব্যাধি চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিলো। এর জন্য প্রয়োজন ছিল একদল স্থায়ী উম্মতের - যারা এর প্রতিবিধানে ঐক্যবদ্ধ ও একটানাভাবে চেষ্টা-সাধনাকে অব্যাহত রাখবে। আল্লাহ'র যমিনে বাতিল যেখানেই থাকুক না কেন, তা প্রতিহত করার জন্য তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে আর অনাচারের শিকড় যতো গভীরেই পৌঁছুক, তা সমূলে উৎপাটনে সচেষ্ট থাকবে। তারা আল্লাহ'র যমিনকে ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতায় পরিপূর্ণ করে দিবে, যেমনিভাবে একবার এই যমিন জুলুম ও নির্যাতনে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো। আর তখন যমিন অপেক্ষমাণ ছিল একজন নিপুণতা-সম্পন্ন এমন নবীর জন্য, যার অনুসারী হবেন একদল অজেয় উম্মত। পরিশেষে হলোও তাই।

"তোমরাই উত্তম উম্মত, মানব জাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহ'র প্রতি ঈমান আনবে ......" (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১১০)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ঠিক এমন সময়ে ঘটলো, মানবতা যখন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমনী বার্তার প্রতীক্ষায় অস্থির ও উতলা হয়ে উঠেছিলো; যেমনি প্রখর রোদে বিদগ্ধ পরিবেশ এবং উত্তপ্ত ভূমি মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিপাতের প্রতীক্ষায় থাকে।

"..... তুমি ভূমিকে দেখো শুষ্ক, এরপর তাতে আমি পানি বর্ষণ করলে তা শস্য-শ্যামলা হয়ে আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদগত করে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ। এটি এ জন্য যে, আল্লাহ সত্য এবং তিনিই মৃতকে জীবন দান করেন এবং তিনিই সর্ববিষয়ে শক্তিমান।" (সূরাহ হাজ্জ, ২২ : ৫-৬)

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের বৈপ্লবিক প্রভাব

হঠাৎ সে মৃত মানবদেহ, তথা মানব বংশধরের মৃতদেহে জীবনের সঞ্চালন হলো। দুর্গন্ধময় মৃতদেহটি আবার হাত-পা নাড়তে শুরু করলো। এই তথ্যটিকেই ঐতিহাসিকগণ তাদের নিজস্ব ভাষায় পারস্য সম্রাটের প্রাসাদ কম্পন এবং পারস্যের আগুন নিস্প্রভ হয়ে যাওয়ার অর্থে ধরে নিয়েছে। আপনারা হয়তো অবলোকন করেছেন - পাকা ও মজবুত বিল্ডিংগুলো এবং গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলো পর্যন্ত একটুখানি ভূমিকম্পের কারণে হেমন্তকালীন পল্লবরাজীর মতো মাটিতে খসে পড়ে যায়। তাহলে কায়সার ও কিসরার এবং অপরাপর ফিরাউনের অপকীর্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথা বসুন্ধরার সৌভাগ্য ভাস্বরের উদয়নে কি বিদূরিত হতে পারে না ?

 

এক নতুন দুনিয়ার আত্মপ্রকাশ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম ও আবির্ভাব শুধু একজন নবী কিংবা এক উম্মত অথবা একটি যুগেরই জন্ম নয়, বরং একটি নতুন দুনিয়ার আত্মপ্রকাশ ছিল। আর তা একমাত্র তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাধ্যমে ঘটেছে। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই দুনিয়া কিয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যুদয়ের শুভ প্রভাব পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিরাজমান। পৃথিবীর অণু-পরমাণুতে গাঁথা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমনী প্রভাব। বিশ্বাসী স্বীয় আকিদা, ভাবধারা, কৃষ্টি-কালচার, চরিত্র ও সমাজ এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে তা যে কার্যকর করে নিয়েছে শুধু তা-ই নয়, বরং এমন সুদৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে ধরেছে যে, কোনক্রমেই তা এখন আর পৃথক করা সম্ভব নয়। আর যদি পৃথক করানো হয় কোনভাবে, তাহলে অবশ্যই পৃথিবীবাসী তার মহামূল্যবান মূলধন এবং আসল উপকরণ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে, দুনিয়া তার জীবনীশক্তি পাওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে চিরঋণী। কেননা, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভাবই এটিকে বেঁচে থাকার উপযোগিতা দান করলো, এর আয়ুসীমা বর্ধিত করা হলো। কল্যাণকে অনাচারের উপর প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো আল্লাহ'র গযবের তান্ডবলীলা এবং আল্লাহ'র অত্যাসন্ন লানত (অভিশাপ) এবং দুর্ভোগের করাল গ্রাস থেকে পরিত্রাণ দিলেন দুনিয়াকে। অথচ তার (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমনের পূর্বক্ষণেও দুনিয়া এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে, এর শয়নকক্ষ যেন উল্টে পাল্টে যাচ্ছিলো। ভীত যেন উৎপাটিত হতে চলেছিলো।

"মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে এবং স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদেরকে তাদের কোন কোন কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান যাতে তারা ফিরে আসে।" (সূরাহ আর-রুম, ৩০ : ৪১)

এই প্রেক্ষিতে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছেঃ

"আল্লাহ পাক দৃষ্টি দিলেন যমিনবাসীদের দিকে, আরব অনারব সবাইকেই অপছন্দ করলেন অবশিষ্ট গুটিকয়েক আহলে কিতাব ব্যতীত।"

 

বর্বরতার যুগের খতিয়ান

মহান প্রজ্ঞাময়ী আল্লাহ তাআলা ভুপৃষ্ঠে কি দেখলেন ? কাউকে দেখলেন পুতুলের সামনে মাথানত অবস্থায় পড়ে আছে, কাউকে দেখলেন উদর পূজায় লিপ্ত। কেউ রয়েছে রাজা-বাদশাদের কিংবা শয়তানের গোলামিতে ব্যতিব্যস্ত। খালিস দ্বীন, সত্যের অন্বেষা, সঠিক জ্ঞান, উত্তম আমল, আল্লাহ'র দিকে রুজু এবং আখিরাতের সাধনা ইত্যাদি যেখানে অনুসন্ধানযোগ্য, সেখানে এগুলোর অস্তিত্ব পরশমণির মতো দুর্লভ হয়ে পড়েছিলো। হাকিমুল ইসলাম শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী তার সুপ্রসিদ্ধ "হুজ্জাতুললিল বালিগাহ" গ্রন্থে সেই বর্বরতার যুগের যে করুণ চিত্রটি পরিবেশন করেছেন, আমি এর চেয়ে সফলকাম উপস্থাপনা এ প্রসঙ্গে অন্য কোন লেখকের লেখনীতে আর দেখিনি। শাহ সাহেব লিখেছেন -

"শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপী স্বেচ্ছাচারী রাজত্ব করার ফলশ্রুতিতে ও দুনিয়ার আরাম-আয়েশে লিপ্ত থাকার কারণে আর আখিরাতকে ভুলে যাওয়ার কারণে শয়তানের দোসর হয়ে পড়েছিলো বিধায় পারস্য ও রোমীয়রা জীবনযাত্রার উপকরণে প্রাচুর্য সৃষ্টি ও নানাবিধ বিলাস সামগ্রীতে ডুবে নিতান্তই বিলাসপ্রিয় ও চঞ্চলমনা হয়ে উঠেছিলো। তারা এই পথে সার্বিক অগ্রগতি আর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিযোগিতা আর দাম্ভিকতার সাধনায় নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলো। সারা পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খ্যাতিবান সুধী সমাজ এবং গুণগ্রাহীদের গমনাগমনের কেন্দ্রস্থল ছিল উপরোক্ত রাষ্ট্র দুটি। বিলাস দ্রব্যের অভিনব ধরণ আবিস্কার ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সাথে সাথে আবার তা কাজে বাস্তবায়িত করা হতো। আধুনিকতার দিকে খুবই লক্ষ্য রাখা হতো। এতে তারা গর্ববোধও করতো। জীবনযাত্রার মান এতো ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলো যে, সাধারণ একজন আমীরও তখন ন্যূনতম এক লাখ রৌপ্য মুদ্রার কম মূল্যের কোমর বেল্ট কিংবা মুকুট ব্যাবহার করাটা নিজের জন্য মর্যাদা হানিকর ভাবতো। কারো যদি তখন শানদার বাসভবন, প্রস্রবণ, স্নানাগার, বাগবাগিচা, উন্নত আহার্য, মওজুদ জীবজন্তু, সুশ্রী যুবক আর গোলাম না-ই থাকতো, যদি আহারে-বিহারে কিংবা বসনে-ভূষণে জাকজমকই না হতো, তবে তো বন্ধুমহলে তার কোন গুরুত্বই থাকতো না। সে যুগের বিশ্লেষণ দীর্ঘায়িত হওয়ার ব্যাপার। নিজ যুগের ক্ষমতাসীন বাদশাদের অবস্থা যা দেখছো কিংবা জানছো, তা দিয়েই আঁচ করে নিও। (৩)

এসব কৃত্রিমতা যেন তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। এসব বিষয় তাদের অন্তরাত্মায় এভাবে শিকড় গেঁড়ে বসেছিলো যে, তা ছিন্ন করার মতো ছিল না। যদ্দরুন এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি হয়েছিলো, যা তাদের সমগ্র সমাজ জীবন এবং কৃষ্টি-কালচারকে বিনষ্ট করার পথ ধরেছিলো। এটি তাদের জন্য এমন একটি সর্বনাশা সমস্যা ছিল, যার অভিশাপ থেকে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র কেউই মুক্ত ছিল না। শহরের প্রতিটি লোকের বাহ্যিক চাকচিক্য আর উচ্চমানের জীবনযাত্রা এমনভাবে আসন পেতে বসেছিলো যে, তাদের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা সৃষ্টি হয়ে গেলো। এজন্য দুশ্চিন্তা ও মানসিক যাতনার একটা পাহাড় সর্বক্ষণ তাদেরকে চেপে থাকতো। কেননা, সেসব কৃত্রিমতার আঞ্জাম দেওয়া এক মোটা অংকের টাকা ছাড়া সম্ভব হতো না কিছুতেই। এসব কৃত্রিমতা ও প্রাচুর্যের আয়োজন হতো একমাত্র কৃষক, ব্যবসাজীবী এবং অন্যান্য পেশাজীবীর উপর শুল্ক ও ট্যাক্সের হার বর্ধিতকরণ কিংবা তাদের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। আর সেসব গোষ্ঠী তাদের দাবী রক্ষা করতে কিঞ্চিৎ অপারগতা কিংবা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেই যুদ্ধ কিংবা চরম শাস্তির সম্মুখীন হতে হতো এদেরকে। আনুগত্য প্রদর্শন করলে এদেরকে ব্যবহার করা হতো চতুস্পদ গাধা ও ষাঁড়ের মতো। অর্থাৎ, তারা প্রতিপালিত হতো শুধু মালিকের ক্ষেতে-খামারে পানি সেচ, চাষাবাদ ও কাজ নেওয়ার উদ্দেশ্যে। শ্রান্তি ও ক্লান্তি থেকে খানিক নিস্তার নেওয়ার জন্য তাদের সামান্য সময়ও ছুটি মেলে না। এ শ্রেণীর লোকদের দিন-রাত কষ্ট-যাতনা আর পাশবিক জীবন ধারণের পরিণতি গিয়ে ঠেকেছিলো এই পর্যায়ে যে, তার যে কোন মুহূর্তে একটু মাথা তুলে দাঁড়াবে কিংবা পারলৌকিক সৌভাগ্য নিয়ে একটু চিন্তা করবে এর অবকাশটুকু ছিল না। অনেক সময় গোটা দেশটিতে এমন একজন নাগরিকও পাওয়া যেতো না, যার মধ্যে দ্বীনের চিন্তা ও গুরুত্ব প্রাধান্য পেতো।" (৪)

বিশ্বে অভিনব আকর্ষণ

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব বর্বরতার সে পরিবেশকে পরিবর্তন করে দেয়। সভ্য বিশ্বে ঈমান ও খোদা-তালাশী, জিহাদ ও আখিরাতের সাধনা, মানবতা বিরোধীদের হাত থেকে মানবতাকে ছিনিয়ে আনা, অধঃপতিত সমাজের অগ্রগতি, মানুষের গোলামী থেকে মানুষকে মুক্ত করে আল্লাহ'র গোলামীতে আনার শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সোচ্চার হয়ে উঠলো পৃথিবীর কোণঠাসা পরিবেশ থেকে সুপরিসর আখিরাতের দিকে আর বিভিন্ন বাতিল ধর্মের নির্যাতন থেকে ইসলামের দিকে অনুপ্রাণিত করার চালিকা শক্তিগুলো। এই বিশ্বটিকে আদর্শমণ্ডিত আর আল্লাহ'র দিকে ধাবিত করার জন্য নিয়োজিত হলো বরেণ্য বীরদের মনোবল, যোগ্যদের যাবতীয় যোগ্যতা, ধীশক্তিধরদের ধীশক্তি, সাহিত্যিকদের গুণ-জ্ঞান, কবিগণের অভিব্যক্তি ও কাব্যপ্রতিভা, রণ-কৌশলীদের তরবারি, পণ্ডিতদের পাণ্ডিত্য, বিত্তশীলদের প্রাচুর্য। এই দুনিয়ায় তখন পরিদৃষ্ট হতো একই ধরণের, একই ধাঁচের মানবতা। যা আটকে পড়েছিলো কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব, কাম, মোহ আর লোভ-লালসার বন্দীশালায়। অথচ নবুওয়াতের আবির্ভাবের প্রতিটি যুগে প্রতিটি স্থানে আল্লাহ'র একনিষ্ঠ বান্দা, রাব্বানী ও হাক্কানী আলিম সমাজ, ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক, ধর্মভীরু বাদশাহ এবং এমন এমন মুজাহিদীনের পরিচয় পাওয়া যায়, যাদের সংখ্যা সম্ভবত বালুকারাশির অণু এবং মরুভূমির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরখণ্ডের চেয়েও বেড়ে গিয়েছে। তারা ছিলেন আল্লাহ পাকের গৌরব, ইতিহাস তাদের সম্মান প্রদর্শন করতে বাধ্য, পরম দুশমনের মাথাও তাদের আদর্শের সামনে আনত। এরপর ক্রমে ক্রমে নির্ভুল এ মহা উপকারী ইলম এবং পূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ আমল এবং শুভ কামনা সর্বত্র উজ্জীবিত হতে থাকে। ছড়িয়ে পড়ে আল্লাহ'র পথের বীর সেনানীগণ দিকে দিকে - যাদের মূলমন্ত্রই ছিল ভালো কাজের আদেশ প্রদান ও মন্দ কাজ থেকে বিরতিকরণ। আল্লাহ'র উপর তারা ঈমান রাখতেন আর জিহাদ করে বেড়াতেন। এ পথে কারো কুটুক্তির প্রতি একটু ভ্রুক্ষেপও করতেন না তারা। এভাবেই রচিত হলো জিহাদ ও ইসলাহ, দাওয়াত ও হিদায়াতের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস, যে ইতিহাসে কোন প্রকার বিরতি এ যাবত সূচিত হয়নি।

"আমার উম্মতের একটি শ্রেণী সব সময়ই হক নিয়ে বিজয়ী থাকবে। তাদের ক্ষতিসাধন করতে পারবে না তাদের বিরোধীরা কিয়ামত পর্যন্ত।" (সহিহ মুসলিম)

 

উম্মতে মুহাম্মাদিই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠতম মুজিযা

শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ রহিমাহুল্লাহ তার মহামূল্যবান গ্রন্থ "আল-জাওয়াবুস সহিহ" এর মধ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক আনীত বৈপ্লবিক প্রভাব , গুরুত্ব এবং ফলাফল সম্পর্কে নেহায়েতই প্রশংসনীয় বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন -

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহান সিরাত ও চরিত্র, বাণী ও কর্ম এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শরীয়ত আল্লাহ'র অসীম কুদরতরাজির একটি। অনুরুপ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মত, উম্মতের ইলম ও দ্বীন এবং এই উম্মতের সালিহীনদের কারামত ও আল্লাহ'র পক্ষ থেকে কুদরতের এক মহিমা।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ'র হুকুমের উপর সবসময়ই অটল রয়েছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ পথে অক্ষুণ্ণ রাখেন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, কৃতজ্ঞতা। কখনো মিথ্যা, জুলুম এবং অপ্রীতিকর কোন আচরণ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে পরিলক্ষিত হয়নি। বরং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সর্বাপেক্ষা সত্যবাদী, সংযমী ও হৃদ্যতার পুরাধা। যদিও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনতরী সাঁতার কাটছিলো যুদ্ধ ও সন্ধি, আপদ ও নিরাপদ, দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য, স্বল্পতা ও আধিক্য এবং জয়-পরাজয়ের বৈচিত্র্যময় পরিস্থিতির মাঝখান দিয়ে, তদুপরি সেসব ভাঙ্গা-গড়ার অবস্থাতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সে কল্যাণবাহী সে অনুপম আদর্শ ছেড়ে কখনো একটু পিছপা হোননি। যদ্দরুন ইসলামের সে আদর্শমন্ডিত দাওয়াত সারা আরব ভূখণ্ডে বিস্তৃত হয়ে গেলো। অথচ কিছুদিন পূর্বেও সে অঞ্চলটি পৌত্তলিকতা, নক্ষত্রের উপাসনা, নাস্তিকতা, শিরক, হত্যা, রাহাজানি, আত্মীয়তার সম্পর্কচ্যুতিতে কলঙ্কমনা ও কলুষিত হয়ে পড়েছিলো। আখিরাত ও পুনরুত্থান যে কি, তা তো জানতোই না তারা। নিখিল বসুন্ধরায় তখন তারাই মহাজ্ঞানী ধর্ম-বিশ্বাসী এবং নিষ্ঠা ও মহত্ত্বের কান্ডারী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করলেন। এমনকি একজন সিরীয় পাদ্রী তাদেরকে দেখে এ মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলো যে - যীশুর হাওয়ারী বা সহচরবৃন্দ এসব মনীষীর থেকে উত্তম ছিলেন না কিছুতেই। ধরাপৃষ্ঠে আজও মুসলমান ও অমুসলমানদের ইলম ও আমলের অনুসারীরা পাশাপাশি সবদিকে ছড়িয়ে আছে। ফলে শিক্ষিত চিন্তাবিদগণ উভয়টির মাঝখানে স্পষ্ট পার্থক্য অনুধাবন করছেন। তদ্রূপ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতও অন্য উম্মতদের তুলনায় সব ব্যাপারেই মর্যাদাশীল ও উত্তম। যদি এদের ইলমকে খতিয়ে দেখা হয় অন্যদের ইলমের সাথে এবং এদের দ্বীন, তাবেদারী ও ইবাদাতের পরিমাপ করা হয় অন্যদের দ্বীন, তাবেদারী ও ইবাদাতের সাথে, তো অবশ্যই এদেরকে অন্যদের অপেক্ষা বহু অগ্রগামী দেখা যাবে। আর যদি এদের বীরত্ব, আলাহ'র পথে জিহাদ এবং আল্লাহ'র সন্তুষ্টি লাভের ব্যাপারে ত্যাগ-তিতিক্ষার একটি পরিসংখ্যান নেওয়া হয়, তাহলে এদেরকেই তুলনামূলক বেশী অগ্রণী পাওয়া যাবে। যদি এদের দানশীলতা, বদান্যতা, অপরের জন্য ত্যাগ ও কুরবানি স্বীকার এবং চরিত্র মাধুরীর বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা হয়, তাহলে তারাই এসব গুনে বেশী গুণী। এসব মহানভবতা এ উম্মাতে মুহাম্মাদি অর্জন করেছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকেই। একমাত্র তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসবের তালীম ও দীক্ষাদাতা।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতদের অবস্থা এমন নয় যে, তারা অন্য একটি আসমানী কিতাবের অনুসারী ছিল। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ন্যায় আসমানী তাওরাতের পরিপূরক হিসেবে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভাব ঘটেনি। যদ্দরুন ঈসায়ীদের চরিত্র, সৌন্দর্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের কিয়দংশ চয়ন করা হয় তাওরাত থেকে, কিয়দংশ যবূর থেকে, কিছু অন্যান্য নবীর তালিম থেকে, কিছু মসিহ আলাইহিস সালাম থেকে আর কিছু তার সহচরবর্গ থেকে। এতদ্ভিন্ন তারা সহায়তা নিয়েছে দর্শনগ্রন্থ থেকেও। খৃষ্টধর্ম পরিবর্তন সাধিত হয় যখন, তখন এতে এমন কিছু বিষয় সংযোজিত হয়ে যায়, যা পক্ষান্তরে ঈসায়ী মতাদর্শের বিপরীতধর্মী এবং নাস্তিকতার সাথে সরাসরি সম্পৃক্তি রাখে।

অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভাবের পূর্বে আসমানী কিতাব সম্পর্কে কোন অবগতিই রাখতো না। বরং তাদের বেশীরভাগ লোক হযরত মুসা আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম, দাউদ আলাইহিস সালামের উপর যে ঈমান এনেছিলেন, তাও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরই ইঙ্গিতে অনুরূপ তাওরাত, যবূর, ইঞ্জিলের উপর ঈমান আনার বিষয়টিও। সমস্ত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের উপর ঈমান আনার হুকুম তো তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) করলেন। আর মুখে মুখেও তা ইকরার করার জন্য তাকীদ করলেন। কোন নবীকে মর্যাদাগত হেয় কিংবা আপেক্ষিক কটাক্ষ থেকে বিরত থাকার জন্য উম্মতদেরকে নির্দেশ দিলেন তো তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।

 

টীকাঃ

(১) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বাণীর একাংশ। বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য ইবনে কাসিরের আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৪৩/৩ দ্রষ্টব্য।

(২) ব্যাখ্যার জন্য হাদিস ও সিরাত গ্রন্থাবলী দ্রষ্টব্য।

(৩) দিল্লীর বাদশাহ ও মোগল সম্রাটদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

(৪) হুজ্জাতুললিল বালিগা - "ইকামাতুল ইরতিফাকাত ওয়া ইসলাহুর রাযূম" অধ্যায়।

 

সূত্রঃ নবুওয়াত ও আম্বিয়ায়ে কিরাম (সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহিমাহুল্লাহ)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-4X

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৈহিক বর্ণনা পাঠকারীদের প্রতি একটি জরুরী আহবান

 

 

The Greatest Nation·Wednesday, March 13, 2019

 

 

 

প্রকাশ থাকে যে, আজকাল সাধারণ প্রথা হলো, পুস্তকের প্রারম্ভে এর লেখকের ছবিও লাগানো হয়। যার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো, মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এ আন্দাজ করা যে, এ গ্রন্থের লেখক কেমন সৎ উদ্দেশ্য, কতোটা সাহস, কতোটা জ্ঞান ও দূরদর্শিতা এবং কেমন চরিত্রের অধিকারী, যাতে তার বক্তব্য পর্যালোচনার পূর্বে ভাগ্যবান উপস্থাপনকারীর পর্যালোচনা করা হয়, যা পুস্তকের ভূমিকায় কাজ দেয়।

(বইয়ের) পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে আপনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র ও আকৃতি, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্রতা, উন্নত শিক্ষা ও দূরদর্শিতার প্রশিক্ষণের কিছু চিত্র পর্যালোচনা করেছেন। এবার তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সংক্ষিপ্ত দৈহিক বর্ণনাও পর্যালোচনা করুন, যাতে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জ্ঞানের পূর্ণতা দেখে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র দৈহিক আকৃতির একটা চিত্র আপনার সামনে ফুটে উঠে এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র আকৃতি সম্বন্ধে পাঠ করে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জ্ঞানের পূর্ণতা সম্পর্কেও অনুমান করা যায়।

প্রকৃতপক্ষে অসীম সৌন্দর্যের বর্ণনা সীমাবদ্ধ বাক্য ও শব্দের দ্বারা কিভাবে বোঝা সম্ভব ? তবুও এ ব্যাপারে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র সাহাবীগণ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র আকৃতি সম্বন্ধে যা কিছু বলা সম্ভবপর, তা বর্ণনায় এনেছেন। এটা তাদের অত্যন্ত বড় অনুগ্রহ যে, তারা এ পরবর্তী উম্মতের জন্য, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দর্শন থেকে বঞ্চিত রয়েছে, কমপক্ষে এই সান্ত্বনার উপকরণ রেখে গেছেন।

কাজেই আপনি একেই পূর্ণ আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে, দৃঢ় ঈমান ও প্রত্যয়ের সাথে পাঠ করুন এবং বারবার পাঠ করুন। সম্ভবত এ পথেই আপনার অন্তরে নবুওয়াতের সৌন্দর্যের ভালোবাসা প্রবিষ্ট হবে এবং এভাবে মহাপ্রভুর সুন্দর তাৎপর্যের কোন ঝলক নসীবে জুটে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে।

এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এ কথা স্মরণ রাখা উচিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আকার-আকৃতি বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কিরাম সামান্যতমও অতিরঞ্জিত করেননি। এ কারণেই হাদিসে আপনি সবকিছু সংক্ষিপ্ত আকারেই পাবেন। অন্যথায় আরবি অভিধানের বিস্তৃতি, আবার ভালোবাসার ক্ষেত্র, কেবল ভালোবাসারই নয় বরং ঈমানেরও, না জানি এক এক সাহাবী এক্ষেত্রে কতোটা দফতর খুলে বসতেন।

কিন্তু নবুওয়াতের এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তগণ যখন নিজেদের সাধারণ কথাবার্তায়ও অতিশয়োক্তি আর কাব্যিক আচরণ পরিত্যাগ করেছিলেন, তখন নবীর সৌন্দর্য বর্ণনার ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আশ্রয় কেন নিবেন ?

কাজেই আপনি এ হাদিসসমূহকে এমন দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে পাঠ করবেন যে, বর্ণনাকারী যা-ই বলেছেন, তা কোন অতিরঞ্জন ব্যতিরেকে অক্ষরে অক্ষরে তা-ই বলেছেন, যা তারা নিজ চোখে দেখেছেন।

আক্ষেপের বিষয় হলো, এ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পাঠকারীরা সাধারণভাবে কেবল সাহিত্যের কিতাবের মতো বাক্য বিশ্লেষণ করে অগ্রসর হয় এবং চিন্তা-ভাবনা করে না যে, কেবল শামাইলের (দৈহিক বর্ণনা) দর্পণেই নবুওয়াতের সৌন্দর্যের ধারণা লাভ করা সম্ভব।

 

সূত্রঃ তরজমানুস সুন্নাহ ৩য় খণ্ড (বদরে আলম মিরাঠী)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-55

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজ (প্রথম পার্ট)

 

 

The Greatest Nation·Thursday, March 21, 2019

 

 

 

 

মুজিযা কি ও কেন ?

 

শব্দ পরিচিতি

মুজিযা (معجزة) মূলঃ ع-ج-ز = عجز (আজয) , ضرب - يضرب - ضرباً - এর ওজনে।

যথা عجز - يعجز - عجزاً এর যেমন ব্যবহার রয়েছে, তেমনি বাব-ই ইফআলের ওজনে তার ব্যবহার হয়ে থাকে।

মুজিযা শব্দটি উক্ত মূল থেকে উদ্ভূত একটি কর্তৃপদ (إسم فاعل) জাতীয় শব্দ। আসল রূপ معجزة (মুজিযা) তার ة বর্ণটি মুবালাগা (مبالغة) আধিক্য জ্ঞাপক অর্থের জন্য সংযুক্ত হয়েছে। সেটা স্ত্রীবাচক (تاء تانيث) তা (ة) নয়। তবে কারো কারো মতে, معجزة শব্দটি উহ্য বিশেষ্য (موصوف) শব্দের বিশেষণ (صفت)। আসল রূপ - اية معجزة (আয়াতুন মুজিযাতুন), অলৌকিক নিদর্শন। (দ্র. ফাতহুল বারী, ৬ খণ্ড; আর-রাগিব ইসফাহানী, আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন, শিরো.)

সাধারণত কোন কাজ সম্পাদনে অক্ষম ও অসমর্থ হওয়ার অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি القدرة (শক্তি) এর বিপরীত। এই অর্থে শব্দটির ব্যবহার পবিত্র কুরআনে একাধিক স্থানে পাওয়া যায়, যথা -

".... সে বললো - হায় ! আমি কি এই কাকের মতোও হতে অক্ষম হলাম, যাতে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ গোপন করতে পারি? এরপর সে অনুতপ্ত হলো।" (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫: ৩১)

এই অর্থে শব্দটির আরো ব্যবহার দেখুন আল-কুরআনের এ আয়াতসমূহে - ৬ : ১৩৪ ; ৮ : ৫৯ ; ৯ : ২-৩ ; ১০ : ৫৩ ; ১১ : ২০, ৩৩ ; ১২ : ৩১ ; ১৬ : ৪৬ ; ২২ : ৫১ ; ২৪ : ৫৭ ; ২৯ : ২২ ; ৩৪ : ৩৮ ; ৩৫ : ৪৪ ; ৩৯ : ৫১ ; ৪৬ : ৩২ ; ৭২ : ১২।

এই অর্থের সূত্র ধরেই শব্দটি পবিত্র কুরআনে বার্ধক্য বুঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন -

"তখন তার স্ত্রী চিৎকার করতে করতে সামনে আসলো আর তার মুখ চাপড়িয়ে বললো- আমি তো বৃদ্ধা, বন্ধ্যা।" (সূরাহ আয-যারিয়াত, ৫১ : ২৯)

আরো দেখুন - সূরাহ হুদ, ১১ : ৭২

মোটকথা, মুজিযা শব্দের আভিধানিক অর্থ - "কোন কাজ সম্পাদনে অথবা কোন বিষয় প্রদর্শনে অক্ষম করা, অভিভূত করা।" (সুত্রঃ প্রাগুক্ত)

 

মুজিযার পারিভাষিক শব্দ

মুজিযার পারিভাষিক সংজ্ঞা বর্ণনায় বিশেষজ্ঞ আলিমগণের ভাষ্যসমূহে কিছু মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। তবে এই মতপার্থক্য একান্তই শব্দগত, সবগুলোর ভাবার্থ প্রায় এক ও অভিন্ন। মুজিযার কয়েকটি পারিভাষিক সংজ্ঞা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ

আল্লামা ইবনে হাযার আসকালানী লিখেছেনঃ রাসুলগণ কর্তৃক সম্পাদিত সে সকল অলৌকিক বা অসাধারণ কার্যাবলীই মুজিযা, যার প্রতিযোগিতা করতে সমসাময়িক যুগের মানুষ ব্যর্থ হয়েছে। (ফাতহুল বারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড)

শায়খ আবু হাফস উমার আন-নাসাফী লিখেছেনঃ মুজিযা হলো প্রচলিত সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমী কাজ, যা একজন নবুওয়াতের দাবীদার কর্তৃক প্রকাশ পায়। নবুওয়াত অস্বীকারকারীদের চ্যালেঞ্জে তিনি তা সম্পাদন করেন এবং কাজটির প্রকৃতি এমন যে, অস্বীকারকারীদের পক্ষে সেরূপ কাজ সম্পাদন করা অসম্ভব। (শারহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যা)

বিখ্যাত অভিধান গ্রন্থ "আল-মুজামুল ওয়াসীত" এ মুজিযার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছেঃ মুজিযা এমন অসাধারণ কাজ, যা আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত নবী-রসূলগণের দ্বারা সংঘটিত করে থাকেন। উদ্দেশ্য নবীর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করা।

উপরে উল্লিখিত মুজিযার সংজ্ঞা তিনটির মর্ম প্রায় একই। তার সারসংক্ষেপ এই যে, মুজিযা বলা হয় -

(১) যা অসাধারণ, অস্বাভাবিক ও অলৌকিক,

(২) যা নবী-রাসুলগণের দ্বারা প্রকাশ পায়,

(৩) তবে তার সংঘটক স্বয়ং আল্লাহ তাআলা,

(৪) তা নবী-রাসুলগণের নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর সত্যতার প্রমাণস্বরূপ,

(৫) তার মধ্যে নবী-রাসুলগণের পক্ষ থেকে বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি মুকাবিলার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়, তবে তারা তার মুকাবিলা করতে সক্ষম হয় না।

মুজিযার উল্লিখিত সংজ্ঞার আলোকে আল-ঈযী আল-মাওয়াকিফ গ্রন্থে লিখেছেন, যিনি আল্লাহ'র নবী তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা প্রমাণ করাই মুজিযার উদ্দেশ্য। তবে যে কোন অসাধারণ ঘটনাই মুজিযা নয়, বরং তা মুজিযারূপে স্বীকৃত হওয়ার জন্য নিন্মোক্ত শর্তাবলীর উপস্থিতি অপরিহার্যঃ

(১) তা আল্লাহ'র কাজ হতে হবে,

(২) প্রচলিত সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম হতে হবে,

(৩) অনুরূপ কাজ সম্পাদন অন্যের পক্ষে অসম্ভব হতে হবে,

(৪) মুজিযা এমন ব্যক্তির মাধ্যমে সংঘটিত হবে, যিনি নিজেকে নবী বলে দাবী করেন যা তার সত্যতার প্রমাণস্বরূপ প্রকাশ পায়,

(৫) তার মাধ্যমে প্রকাশিত মুজিযাটি তার ঘোষণার সমর্থন জ্ঞাপক হতে হবে,

(৬) মুজিযা তার দাবীর পরিপন্থী হবে না,

(৭) মুজিযা দাবীর পরে সংঘটিত হতে হবে, পূর্বে নয়।

আল-ঈযীর মতে, মুজিযা এভাবে সংঘটিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যার (নবী-রাসুল) সত্যতা প্রমাণ করতে চান তার মাধ্যমে তা ঘটিয়ে থাকেন। ফলে মুজিযা দর্শকদের মধ্যে নবী-রাসুলের সত্যতায় দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় সৃষ্টি করে। (আল-মাওয়াকিফ, মুজিযা অধ্যায়)

ইবন ইউসুফ সালিহী বলেন, মুজিযাকে মুজিযা বলে স্বীকার করার ক্ষেত্রে চারটি শর্তের আওতায় তাকে বিশ্লেষণ করতে হবে -

(১) যা স্বাভাবিক নিয়মনীতি ভঙ্গ করে সংঘটিত হবে, যেমন - চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া, অঙ্গুলীসমূহ থেকে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হওয়া, লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, প্রস্তরের মধ্য থেকে উস্ট্রী বের হওয়া ইত্যাদি।

(২) যা চ্যালেঞ্জের সাথে জড়িত। আবার অনেকে বলেছেন, যা চ্যালেঞ্জের সাথে জড়িত নয়। কারণ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে স্বাভাবিক নীতিবিরুদ্ধ যে সকল ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার অধিকাংশই চ্যালেঞ্জবিহীন। তাই যারা চ্যালেঞ্জের শর্ত আরোপ করেছেন, তাদের অভিমত সঠিক নয়। সমস্যাটির সমাধান এভাবে করা যেতে পারে যে, যখনই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের দাবী করেছেন, তখনই স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ করেই তা সংঘটিত হয়েছে। যখনই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাবী করছেন- "আমি সৃষ্টি জগতের প্রতি আল্লাহ'র একজন রাসুল", তখনই বুঝতে হবে স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ করেই এই দাবীটি করা হচ্ছে। মুখ্যত চ্যালেঞ্জ এখানে পরোক্ষভাবেই জড়িত। (শায়খ কামালুদ্দীন ইবনুল হুমাম, মাসীরাত)

(৩) যা নবুওয়াত ও রিসালাত প্রাপ্তির পূর্বে সংঘটিত হয়েছে। তাতে চ্যালেঞ্জ বা মুকাবিলার কোন উৎস থাকে না। এটি মুজিযা বলে অভিহিত নয় বরং কারামাত বলা যেতে পারে। যেমন - মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শৈশব অবস্থায় তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বক্ষ বিদারণ, কৈশোরাবস্থায় তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেঘের ছায়াদান। শিশুকালে ঈসা আলাইহিস সালামের দোলনা থেকে কথা বলা। এটা নবী-রাসুলগণের নবুওয়াত ও রিসালাতের ভিত্তি।

(৪) যা দাবীদারের দাবীর স্বপক্ষে সংঘটিত হবে তা-ই মুজিযা, বিপক্ষে হলে মুজিযা নয়। যেমন - নবুওয়াতের দাবীদার দাবী করবেন যে, আমার নবুওয়াতের নিদর্শন হলো, আমার দাবীর স্বপক্ষে আমার হাত বা এই প্রাণী যার কথা বলবে। তার হাত বা প্রাণীটি যদি তার বিপক্ষে বলে এই লোকটি মিথ্যুক, সে নবী না। তা হলে তার হাত ও প্রাণীটি কথা বলা সত্ত্বেও তার বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছে বলে তা মুজিযা নয়। যেমন - মুসায়লামা কাযযাব একটি কূপে পানি বৃদ্ধির জন্য থুথু নিক্ষেপ করেছিলো, ফলে কূপটি ধ্বসে গিয়ে তার পানি উধাও হয়ে গিয়েছিলো।

এই চারটি শর্ত বহির্ভূত বিষয়গুলো মুজিযা নয়। তবে দাজ্জাল তার দুই হাতে স্বাভাবিক নীতি বিরুদ্ধ নিদর্শনসহ আগমন করবে, তাকে মুজিযা বলা যাবে না। কারণ সে নবুওয়াতের দাবীদার হবে না, বরং সে দাবীদার হবে প্রভুত্বের। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৯খ.)

আল্লামা ইবন হাযার আসকালানীর মতেও নবী-রাসুলগণের দ্বারা সংঘটিত যে কোন অসাধারণ কর্মকাণ্ডই মুজিযা নয়, বরং তিনি এ ক্ষেত্রে দুটো পরিভাষা স্থির করেছেন - মুজিযা, আর আলামাতুন নুবুওয়াত(নবুওয়াতের নিদর্শন বা চিহ্ন)। যে সকল অসাধারণ কাজের মাধ্যমে নবী-রাসুলগণ বিরুদ্ধবাদীদেরকে চ্যালেঞ্জ করে থাকেন, কেবল তা-ই মুজিযা। যেমন তিনি বললেন, "যদি আমি এই কাজ করতে পারি, তবে আমি নবী, অন্যথা আমি মিথ্যাবাদী।" পক্ষান্তরে নবুওয়াতের আলামত ও নিদর্শনের মধ্যে কোন চ্যালেঞ্জ থাকে না, মুকাবিলার আহবান থাকে না।(ফাতহুল বারী, ৬ খণ্ড)

পবিত্র কুরআনে মুজিযা শব্দটি আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, পারিভাষিক অর্থে নয়। মুজিযা অর্থ প্রকাশের জন্য পবিত্র কুরআনে "আয়াত" (اية) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, বহুবচনে "আয়াত" (ايات) এবং "আই" (اي)। এর অর্থ কোন বস্তু চিনার উপায় বা নিদর্শন। এই চিহ্ন বা নিদর্শন বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যথা, আল্লাহ'র অস্তিত্ব ও তার একত্ব প্রমাণের জন্য সমগ্র সৃষ্টি একটি প্রমাণ বা নিদর্শন। এই অর্থে "আয়াত" এর ব্যবহার এরুপঃ

وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيْ

"আর আমি রাত ও দিনকে করেছি দুটো নিদর্শন ...." (সূরাহ বানি ঈসরাঈল, ১৭ : ১২)

আরো দেখুনঃ ৩০: ২২-২৫, ৪৬ ; ১০ : ৬ ; ২ : ৭৩, ১৮৭ ; ৩ : ১৯০।

অনুরূপ, নবীগণের নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে শব্দটি অসাধারণ কাজ ও অলৌকিক বিষয় বুঝানোর অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে।

وَلَئِنْ أَتَيْتَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ بِكُلِّ آيَةٍ مَّا تَبِعُوا قِبْلَتَكَ

"যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে আপনি যদি তাদের কাছে সমস্ত দলীল পেশ করেন, তবুও তারা আপনার কিবলা মেনে নিবে না ........" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১৪৫)

আরো দেখুনঃ ২: ২১১, ২৪৮, ২৫৯; ৩ : ৪৯, ৫০ ; ৫ : ১১৪ ; ৬ : ২৫, ১২৪ ; ৭ : ৭৩, ১০৬, ১৩২, ১৪৬।

 

অবশ্য আয়াত শব্দটির ব্যবহার পবিত্র কুরআনে উক্ত দুটো অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং শব্দটি এটি ছাড়া অন্যান্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, উপদেশ ও শিক্ষণীয় অর্থে, যথা, আল-কুরআনে আছেঃ

إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ

".... তার রাজত্বের নিদর্শন এই যে ..... " (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২: ২৪৮)

আরো দেখুনঃ ৩: ১৩; ১০ : ৯২; ১১ : ১০৩,

 

এবং কুরআনের আয়াত অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যেমন - আল কুরআনে আছেঃ

وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا

".... তোমরা আমার আয়াতের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করিও না ....." (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২: ৪১)

আরো দেখুনঃ ২: ৯৯, ১০৬, ২২১, ২৫২ ; ৬ : ৪, ১২৪ ; ১৬ : ১০১ ; ৩৬ : ৪৬ ; ৪৫ : ৩১ ; ৬২ : ২ ; ৮৩ : ১৩।

"আয়াতুন" শব্দটি "মুজিযা" শব্দ অপেক্ষা অধিক ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে। সুতরাং বলা যায়, পবিত্র কুরআনে "মুজিযা" শব্দ ব্যবহৃত না হয়ে বরং "আয়াতুন" শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় নবী-রাসুলগণের মুজিযা ও তাদের আলামতে নবুওয়াত উভয়বিধ বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত। "মুজিযা"'র অর্থ বুঝাতে পবিত্র কুরআনে আরো একটি শব্দের ব্যবহার পরিদৃষ্ট হয়, তা হলো "বুরহান" (برهان) শব্দ। এর অর্থ অকাট্য এবং সুস্পষ্ট দলীল ও প্রমাণ। আল-মুজামুল ওয়াসীতে এর অর্থ বলা আছে, "সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী প্রমাণ।" যথাঃ পবিত্র কুরআনে মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা প্রসঙ্গে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন -

"যখন মুসা আগুনের কাছে পৌঁছালো, তখন উপত্যকার দক্ষিণ পার্শ্বে পবিত্র ভূমিস্থিত এক বৃক্ষের দিক থেকে তাকে আহবান করে বলা হলো - হে মুসা, আমিই আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালক। আরো বলা হলো- তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ করো। এরপর সে যখন সেটাকে সাপের মতো ছুটাছুটি করতে দেখলো, তখন পিছনের দিকে ছুটতে লাগলো এবং ফিরে তাকালো না। তাকে বলা হলো - হে মুসা, সামনে আসো, ভয় করো না, তুমি তো নিরাপদ; আর তোমার হাত বগলে রাখো, এটি বের হয়ে আসবে শুভ্র সমুজ্জল নির্দোষ হয়ে। ভয় দূর করার জন্য তোমার হাত দুটো নিজের দিকে চেপে ধরো। এ দুটো তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত প্রমাণ, ফিরাউন ও তার পরিষদবর্গের জন্য, তারা তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়।" (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮: ৩০-৩২)

সারকথা এই যে, নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনকারীগণের হাতে কখনো কখনো মানবিক শক্তির অতীত কর্মকাণ্ড সাধিত হয়, যা পূর্ণাঙ্গভাবে অনুধাবনে মানবিক প্রজ্ঞা ও মনীষা অপারগ হয়ে যায়। যেমন - ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের উপর আগুন শীতল হয়ে যাওয়া, মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, ঈসা আলাইহিস সালামের হাতে মৃত জীবিত হওয়া, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক রাতে পবিত্র কাবাঘর থেকে আল-বায়তুল মুকাদ্দাস, এরপর সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা, এরপর আল্লাহ'র অদৃশ্য জগত পরিদর্শন করা ইত্যাদি। এ সমস্ত ঘটনার মর্মোদঘাটন আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মানবিক জ্ঞান-বুদ্ধি একান্তই অপারগ। আল-কুরআনের ভাষায় এই সমস্ত ঘটনার নাম বুরহান (برهان), বায়্যিনাত (بينات)। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি আয়াত (ايات) অথবা আয়াতুম বায়্যিনাত (ايات بينات) রূপেও ব্যবহৃত হয়েছে। মুহাদ্দিসগণ এ সমস্ত হাদিসকে "দালাইলুন নুবুওয়াত" বলে অভিহিত করে থাকেন। আর আকাইদ বিশেষজ্ঞ (মুতাকাল্লিমুন) ও দার্শনিকদের পরিভাষায় একে মুজিযাত বলা হয়।

 

মুজিযার তাৎপর্য

নবুওয়াতের দাবীদার নিজ গোত্রের সন্তানদেরকে যে আমন্ত্রণ জানান আর এই জগতের বুকে যে পয়গাম ছড়িয়ে দেন, তার সত্যতার সমুজ্জ্বল প্রমাণ বা নিদর্শন যদিও স্বয়ং পয়গাম বা পয়গামবাহকের অস্তিত্ব, তথাপি সংশয়ী চিত্তের স্বস্তির প্রয়োজনে প্রমাণে পূর্ণতা সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সত্যের আহবায়কের দ্বারা এমন কিছু কার্যাবলী প্রকাশ পায়, যা সাধারণ মানুষের ক্ষমতা বা ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বে।

ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে আগুন শীতল হয়, মুসা আলাইহিস সালামের হাতের লাঠি পরিণত হলো অজগর সাপে, পিতাবিহীন সন্তানের অস্তিত্ব হলেন ঈসা আলাইহিস সালাম, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা এরপর সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পরিভ্রমণ করে আসেন স্বল্প সময়ে। মানববুদ্ধি যেহেতু এগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করতে অক্ষম, তাই এতে এক অদৃশ্য শক্তির ক্রিয়া ধরা পড়ে। যে ব্যক্তির উদ্দেশ্যে এটি প্রকাশ পায়, অদৃশ্যের জ্ঞানসহ অন্যান্য নিদর্শনাদি যার সহায়ক হয়, তাকে অদৃশ্য সাহায্যপ্রাপ্ত বলে ধরা হয়। কুরআন মাজিদ এ সকল ঘটনা নাম দিয়েছে "বায়্যিনাত", "বারাহীন" এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে "আয়াত"। মুহাদ্দিসগণ সেগুলোকে "দালাইলুন নুবুওয়াত" আখ্যা দিয়েছেন। দার্শনিকগণের পরিভাষায় সেগুলোর নাম হলো "মুজিযা" বা অস্বাভাবিক কার্যাবলী। (সায়্যিদ সুলায়মান নদবী, সিরাতুন-নবী, ৩খ.)

 

মুজিযার স্বরূপ

আল্লাহ তাআলা কোন নিয়ম, উপকরণ, কার্যকরণ নীতি ছাড়াই যে কোন বস্তুকে অস্তিত্বে আনতে সক্ষম। মুজিযা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও তেমনই কোন নিয়মনীতির প্রয়োজন নেই। যখনই তিনি ইচ্ছে করেন, তখনই তিনি মুজিযা প্রদর্শন করেন। তবে এটি মানবিক শক্তির ঊর্ধ্বে। এটি শিক্ষা করার উদ্দেশ্যে কোন শিক্ষাগার, পাঠাগার, পরীক্ষাগার বা পাঠ্যসুচি তৈরি করাও সম্ভব না। মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি দিয়ে লক্ষবার মাটিতে আঘাত করলেও আর ঝর্ণা প্রবাহিত হবে না, লক্ষবার মাটিতে নিক্ষেপ করলেও তা সাপে পরিণত হবে না, শুধু আল্লাহ'র ইচ্ছে হলেই তা সম্ভব হবে। আবার যে নবীর মাধ্যমে মুজিযা প্রদর্শিত হবে, তিনি নিজেও অনবহিত যে, কখন ও কিভাবে মুজিযা প্রদর্শিত হবে। কারণ মুজিযা প্রদর্শনের জন্য কোন সুনির্ধারিত নিয়মকানুন বা সময় নেই। দেখা গেছে, ফিরআউন ও তার নিজ জাতির সামনে মুসা আলাইহিস সালাম তার হাতের লাঠিটি মাটিতে ফেলে দিলেন। সাথে সাথে লাঠিটি বিরাট একটি অজগর সাপে পরিণত হলো আর ফোঁস ফাঁস, লম্ফঝম্ফ করতে লাগলো। মুসা আলাইহিস সালাম নিজেও ভীত-সন্ত্রস্ত হলেন। আল্লাহ নির্দেশ দিলেন -

"তিনি বললেন - তুমি একে ধরো, ভয় করো না, আমি একে এর পূর্বরূপে ফিরিয়ে দিবো।" (সূরাহ তা-হা, ২০ : ২১)

মুসা আলাইহিস সালাম যদি পূর্ব থেকেই জানতেন যে, লাঠি ছেড়ে দিলে সাপে পরিণত হবে, তাহলে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হতেন না।

মুজিযার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এই জগতে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার খেলা চলছে। দেখা যায় যে, কেউ যদি কোন কিছু আবিস্কার-উদ্ভাবন করে, তখন অপর একজন তার প্রতিযোগিতায় তার চেয়ে উন্নততর আবিস্কারে মেটে উঠেছে। কিন্তু মুজিযার ক্ষেত্রে তেমনটি চিন্তা-ভাবনারও ঊর্ধ্বে। মহাপ্রলয়কাল পর্যন্ত সংগ্রাম করেও কেউ মুজিযার অনুরূপ কিছু প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে না। উড়োজাহাজ আকাশে উড়ে চলে মেশিনের সাহায্যে, আরো উন্নততর মেশিনের সাহায্যে রকেট চলে। পক্ষান্তরে সুলায়মান আলাইহিস সালামের তখত- সিংহাসন আকাশে উড্ডীয়মান হয় মেশিন ছাড়াই, আল্লাহ'র ইচ্ছার দ্বারা। অনুরূপ মেশিন ছাড়া উড়া কি আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়েছে ? মানবিক শক্তি ও জগতের যাবতীয় শক্তি মুজিযার ক্ষেত্রে অচল, অকার্যকর। বস্তুত মুজিযা উপাত্ত-উপকরণ বহির্ভূত আল্লাহ'র গোপন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।

 

মুজিযা কখন ও কিভাবে সংগঠিত হয় ?

মুজিযা দুইভাবে সংগঠিত হয়ে থাকে -

(১) তলবী (طلبي) : মানুষের মুজিযা প্রদর্শনের দাবীর প্রেক্ষিতে। এর প্রকাশ এভাবে হয় যে, বিরুদ্ধবাদীরা নবী-রাসুলকে মিথ্যাবাদী মনে করে। তাই তার নিকট অতি প্রাকৃত কিছু ঘটানোর দাবী জানায়। তারা মনে করে যে, পয়গাম্বর তা কখনো প্রদর্শন করতে সক্ষম হবেন না। ফলে তাকে মানুষের সামনে লজ্জিত ও অপমানিত হতে হবে। তখন আল্লাহ তা উপযোগী মনে করলে তা পয়গাম্বরের হাতে অতি প্রাকৃত ঘটনার প্রকাশ ঘটান। আর তখন তার ফলে দাঁড়ায় বিপরীতমুখী। পয়গাম্বরের লজ্জিত ও অপমানিত হওয়ার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় তার সত্যতা ও যথার্থতা। যেমন - ফেরাউন যাদুকরদের সমবেত করে মুসা আলাইহিস সালাম'কে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করতে এবং তাকে জনসম্মুখে লজ্জিত ও অপমানিত করতে চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ'র কুদরতে মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি সাপে পরিণত হওয়ার মুজিযা সংগঠিত হলো। ফলে ঘটনাটি পরিণামে মুসা আলাইহিস সালামের লজ্জা ও অপমানের পরিবর্তে তার সফলতা ও তার মিশন বিজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা জনসম্মুখে সূর্যের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। পরিণামে উপস্থিত যাদুকরগণ তার নবুওয়াতে বিশ্বাসী হয়ে ঈমানদার হয়ে গেলো। (দেখুনঃ সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ১০৩-১২৬)

আরিফ রুমী তার মসনবীতে চমৎকার বলেছেনঃ অবিশ্বাসীরা মুজিযা তলবের মাধ্যমে সত্যকে নিস্প্রভ করে দিতে চায়, অথচ তাদের এই অপচেষ্টার ভিতর দিয়েই সত্যের বিজয় ও যথার্থতা পরিস্ফুটিত হয়ে উঠে। তাদের ইচ্ছে ছিল মুজিযা তলব করে পয়গাম্বরকে লজ্জিত ও অপমানিত করা। কিন্তু তাদের এই পায়তারাই পয়গাম্বরের মর্যাদাকে উদ্ভাসিত করে তোলে। (মসনবীর বরাতে সিরাতুন্নবী, ৪র্থ খণ্ড)

(২) গায়রে তলবী (غير طلبي) - অর্থাৎ মানুষের পক্ষ থেকে মুজিযার দাবী করা ছাড়াই আল্লাহ নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যার (নবী-রাসুল) সত্যতা প্রমাণ করতে চান, তারই দ্বারা কোন অসাধারণ কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন, যাতে সেটি তার নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রমাণ হিসেবে দর্শকদের মধ্যে প্রভাব ও প্রত্যয় সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। যেমন - খাবারের মধ্যে বরকতের মুজিযা। এটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে প্রদত্ত ঐতিহাসিক মুজিযা। খন্দকের যুদ্ধের সময় মুসলমানগণ চরম আর্থিক সংকট এবং অনাহারের মধ্যে জীবন যাপন করছিলেন। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুধায় কাতর হয়ে কটিদেশ সোজা করতে পারছিলেন না, তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেটে পাথর বেঁধে খন্দক খননের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য সাহাবীদের অবস্থাও ছিল অনুরূপ। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই অবস্থা দেখে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু তার ঘরে গিয়ে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন - ঘরে খাবার আছে কি? স্ত্রী বললেন - এক সা অর্থাৎ প্রায় সোয়া তিন কিলো গম আছে। এরপর জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু তার ঘরে পালিত একটি ছাগল জবাই করে স্ত্রীকে রুটি ও গোশত পাকানোর নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমতে হাজির হয়ে অতি সন্তর্পণে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো দুই তিনজন সাহাবীসহ তার ঘরে রুটি ও গোশতের দাওয়াত গ্রহণের জন্য সবিনয় অনুরোধ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দাওয়াত কবুল করলেন আর উচ্চস্বরে ডেকে বললেন - হে পরিখা খননকারী, জাবির তোমাদেরকে দাওয়াত করছে, তোমরা সকলে তার ঘরে চলে আসো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই আহবান শুনে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমাদ গুনতে লাগলেন। মাত্র এক সা গমের রুটি আর একটি ছাগলের গোশত দিয়ে সহস্রাধিক মেহমানকে কিভাবে পরিতুষ্ট করবেন, তিনি তা-ই ভাবছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু'র রন্ধনশালায় প্রবেশ করে উনুনের উপর চড়ানো গোশতের হাড়িতে এবং খমীর করা আটায় পবিত্র মুখের লালা মিশ্রণ করে বললেন - সমস্ত মেহমানের আহার গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চুলার উপর থেকে হাঁড়ি নামিও না। আর এই খামীর থেকে অল্প অল্প করে আটা নিয়ে রুটি তৈরি করতে থাকো। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা হলো। ফলে সহস্রাধিক মেহমানকে আহার করানোর পরও দেখা গেলো, যে পরিমাণ আটা খামীর করা হয়েছিলো, এখনো সেই পরিমাণই অবশিষ্ট রয়েছে এবং হাঁড়ি পূর্ববৎ গোশতে পরিপূর্ণই আছে। (বুখারী, ২য় খণ্ড)

 

মুজিযার প্রকারভেদ

নবী-রাসুলগণকে আল্লাহ তাদের নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর স্বপক্ষে যে প্রমাণ তথা মুজিযা প্রদান করেছেন, তা প্রথমত দুই প্রকারের - জাহেরী বা বস্তুভিত্তিক এবং বাতেনী বা আত্মিক। জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযা, যেমন মৃতকে জীবিত করা, লাঠিকে সাপে পরিণত করা, আঙ্গুল থেকে পানির প্রবাহ জারী হওয়া, রুগ্নকে সুস্থ করা, চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করা, সমুদ্র বক্ষে চলার পথ তৈরি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। আর বাতেনী ও আত্মিক(রূহানী) মুজিযা হচ্ছে - নবুওয়াতের দাবীদারের সত্যতা, নবীগণের নিস্পাপ ও পবিত্র হওয়া, তাদের প্রভাব শক্তি, সফলতা ও গায়বী সাহায্য ইত্যাদি। এর মধ্যে পবিত্র কুরআন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম বাতেনী মুজিযা। বস্তুত নবুওয়াত ও রিসালাতের আসল ও মৌলিক প্রমাণ হচ্ছে এই সমস্ত আত্মিক ও রূহানী নিদর্শন। আর জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযাসমূহ শুধুই আবরণ এবং বাইরের প্রতি দৃষ্টি দানকারীদের জন্য। এ কারণে দেখা যায়, যারা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গূঢ় মর্মজ্ঞানী, তার কখনো জাহেরি মুজিযা তলব করেন নাই। অনুরূপ নবী-রাসুলগণের যুগে যারা শিক্ষিত সমাজ হিসেবে পরিচিত ছিল, তারাও নবী-রাসুলগণের কাছে কোন জাহেরী মুজিযা দাবী করেন নাই। উদাহারনস্বরূপ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের আহলে কিতাবগণ। তারা সন্দেহপ্রবণ মনে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে বারবার উপস্থিত হয়েছে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যতার প্রমাণ নিয়েছে। কিন্তু তাদের পরীক্ষার বিষয়বস্তু কি ছিলো ? তা ছিলো এই যে, তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র চরিত্র ও আখলাক পরীক্ষা করেছিলো। তারা অতীতের বনী ইস্রাইলী নবী-রাসুলের অবস্থাসমূহ ও ঘটনাবলী জিজ্ঞাসা করেছিলো এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষা ও উলুমের ভাণ্ডার পর্যালোচনা করেছিলো। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে কেউই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জাহেরী মুজিযা তলব করেনি। কারণ তারা জানতো যে, নবুওয়াতের দাবীর সত্যতার আসল ও মৌলিক প্রমাণ হচ্ছে দাবীদারের আধ্যাত্মিক ও অভ্যন্তরীণ দিক এবং তার আখলাক ও চারিত্রিক অবস্থা। ঠিক একই কারণে আমরা দেখতে পাই যে, তৎকালীন খৃষ্ট ধর্মবলম্বী রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবারে যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূত দিহইয়া কালবী রাদিয়াল্লাহু আনহু উপস্থিত হলেন আর সম্রাটের কাছে ইসলামের দাওয়াত পত্র পেশ করলেন, তখন হিরাক্লিয়াস রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা যাচাই করার জন্য কুরাইশ সর্দার আবু সুফিয়ানকে রাজ দরবারে ডাকিয়ে এনে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। তার এই প্রশ্নগুলোর সমস্তটাই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র ও প্রভাব সম্পর্কে। সবশেষে হিরাক্লিয়াস বলেছিলেন - তুমি (আবু সুফিয়ান) যা বলেছো তা যদি সত্য হয়, তবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবশ্যই আল্লাহ'র প্রেরিত নবী ও রাসুল। (বুখারী, ১০ম খণ্ড)

অনুরূপ নাজরানের খৃষ্টান বিদ্বানগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হয়ে কুরআনের আয়াতসমূহ শুনলো আর মুসলমানদের আত্মিক বিকাশের অবস্থা লক্ষ্য করলো। এরপর তারা ঈসা আলাইহিস সালাম সম্বন্ধে ইসলামের সিদ্ধান্ত কি তা জানতে চাইলো। সবশেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল-কুরআনের হুকুম মুতাবিক তাদের সাথে মুবাহালা করতে চ্যালেঞ্জ প্রদান করলেন। কিন্তু তারা এতে সম্মত হলো না। তারা পরস্পর বলতে লাগলো - প্রকৃতই যদি মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হোন, তাহলে আমরা সবংশে ধ্বংস হয়ে যাবো। পরিশেষে তারা বাৎসরিক খারাজ আরায় করার শর্তে সন্ধি স্থাপন করলো। লক্ষ্য করুন, তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সার্বিক শিক্ষা ও তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আখলাক-চরিত্র ও আচার-অনুষ্ঠান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, কিন্তু দাবী প্রমাণের জন্য বাহ্যিক বস্তুভিত্তিক কোন মুজিযা তলব করে নাই। (যাদুল মাআদ, ৩য় খণ্ড)

স্বয়ং আরবের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের কথা পর্যালোচনা করে দেখুন। তাদের হাজারো ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা স্বীকার করেছেন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঈমান এনেছেন। অথচ তারা কেবল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাতেনী ও আত্মিক মুজিযা অনুধাবন করেছেন, তাদের একজনও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযা দাবী করেন নাই। যথা - খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা, আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু, ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু, বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ সাহাবা-ই কিরাম। আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির কথা জানতে পারলেন, তখন নিজের ভাইকে বললেন - ঐ ব্যক্তির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে যাও, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাবী করেছেন যে, তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে আসমান থেকে ওহী এসেছে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থা পর্যবেক্ষণ করো। তার ভাই মক্কায় আসলেন আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে বললেন - আমি তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সচ্চরিত্রের নির্দেশ দেন এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন কালাম পেশ করেন যা কবিতা নয়। (মুসলিম, ২য় খণ্ড)

জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহু আবিসিনিয়ায় নাজাশীর দরবারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের পরিচয় সম্বন্ধে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন - হে সম্রাট, আমরা ছিলাম অজ্ঞ ও জাহিল সমাজ। আমরা মূর্তিপূজা করতাম, মৃত জীব ভক্ষণ করতাম, দুষ্কর্মে লিপ্ত ছিলাম, প্রতিবেশীদের উপর অবিচার করতাম, পরস্পর হানাহানি ও মারামারি করতাম, দুর্বল লোককে সবল লোক নিশ্চিহ্ন করে দিতো। এমন অমানিশা ও দুর্যোগের সময় আমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভূত হলেন, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভদ্র ও শিষ্ট আচরণ, সততা, ন্যায়ানুবর্তিতা সম্পর্কে আমরা পূর্বেই জ্ঞাত ছিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ইসলামের পথে আহবান করলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে এই শিক্ষা দিলেন যে, আমরা যেন মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করি, সত্য কথা বলি, রক্তপাত থেকে বিরত থাকি, ইয়াতিমের অধিকার হরণ না করি, প্রতিবেশীদের কষ্ট না দেই, সতী রমণীদের প্রতি যিনার মিথ্যা অপবাদ আরোপ না করি, নামায আদায় করি, যাকাত প্রদান করি, সিয়াম পালন করি। আমরা এ সমস্ত কথার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি, শিরক বর্জন করেছি, সকল প্রকার অপকর্ম পরিত্যাগ করেছি। (ইবন হিশাম, ১ম খণ্ড; মুসনাদ আহমাদ ইবন হাম্বল, ১ম খণ্ড)

আলোচনার সারাংশ এই যে, নবুওয়াত ও রিসালাতের আসল ও মৌলিক দলীল হচ্ছে, নবী-রাসুলগণের বাতেনী ও আধ্যাত্মিক মুজিযা ও নিদর্শনাবলী। তবে তাদের জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযাও ছিলো। তাই পবিত্র কুরআনে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহ অতীত নবী-রাসুলগণের জীবনেতিহাস বর্ণনার প্রেক্ষাপটে তাদের জাহেরী মুজিযার বিস্তৃত বর্ণনা পেশ করেছেন। তথা - মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, তার হাত শুভ্র আলোকোজ্জ্বল হওয়া, সালিহ আলাইহিস সালামের সময়ে পাথরের মধ্য থেকে উস্ট্রী বের হয়ে আসা, ঈসা আলাইহিস সালামের হাতে মৃত ব্যক্তির জীবিত হয়ে যাওয়া, অসুস্থ ব্যক্তির সুস্থ হওয়া ইত্যাদি। নবীগণের জাহেরী ও বাতেনী মুজিযার আরো একটি পর্যালোচনা এই যে, জাহেরী বস্তুভিত্তিক মুজিযা শুধু ঐ সমস্ত লোক তলব করে যাদের অন্তরচক্ষু অন্ধ আর যারা বিরুদ্ধতাবাদীতা, পক্ষপাতিত্ব ও কূপমণ্ডূকতাসুলভ মনোভাবের কারণে সত্যকে মেনে নিতে রাজি হয় না। বস্তুত গোঁড়া কাফিররাই জাহেরী মুজিযা তলব করে থাকে। এ কারণে দেখা যায়, পবিত্র কুরআনে মুজিযা তলব সংক্রান্ত দাবীগুলোকে সর্বদা কাফিরদের প্রতিই আরোপ করা হয়েছে, যেমন -

"এবং যারা কিছু জানে না তারা বলে, আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কেন, কিংবা কোন নিদর্শন আমাদের কাছে নিয়ে আসে না কেন ? এভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও তাদের অনুরূপ কথা বলতো; তাদের অন্তর একই রকম; আমি দৃঢ় প্রত্যয়শীলদের জন্য নিদর্শনাবলী স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি।" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১১৮)

"তারা বলে, তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তার কাছে কোন নিদর্শন নাযিল করা হয় না কেন ? বলো, নিদর্শন নাযিল করতে আল্লাহ অবশ্যই সক্ষম, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।" (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ৩৭)

"যারা কুফরি করেছে তারা বলে, তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তার কাছে কোন নিদর্শন নাযিল করা হয় না কেন ? তুমি তো কেবল সতর্ককারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আছে পথপ্রদর্শক।" (সূরাহ আর-রদ, ১৩: ৭)

"তারা বলে, সে তার প্রতিপালকের কাছ থেকে আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আনে না কেন ? তাদের কাছে কি আসেনি সুস্পষ্ট প্রমাণ, যা আছে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে ?" (সূরাহ তো-হা, ২০ : ১৩৩)

উল্লিখিত আয়াতসমূহে লক্ষণীয় যে, প্রত্যেক আয়াতেই মুজিযা তলব করার বিষয়টি কাফিরদের প্রতি আরোপ করা হয়েছে। পুণ্যবানগণ কখনো মুজিযা তলব করেননি। এটা থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, মুসা আলাইহিস সালাম'কে প্রদত্ত মুজিযা বনী ইস্রাইলের দাবীর প্রেক্ষিতে দেওয়া হয়নি, বরং ফিরাউন ও তার অনুসারীদের দাবীর প্রেক্ষিতে দেওয়া হয়েছিলো। তাই যখন হাওয়ারীগণ ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে খাদ্যভর্তি আসমানী খাঞ্চার জন্য বললো -

"...... হে মরিয়ম-পুত্র ঈসা, আপনার পালনকর্তা কি এরূপ করতে পারেন যে, আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করে দিবেন ? ......" (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১২)

তখন ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন -

".... যদি তোমরা ঈমানদার হও তবে আল্লাহ'কে ভয় করো।" (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১২)

এতে বুঝা যায়, ঈমানদার বান্দার পক্ষে এ ধরনের ফরমাইশ করে আল্লাহ'কে পরীক্ষা করা কিংবা তার কাছে অলৌকিক বিষয় দাবী করা একান্তই অনুচিত।

এমনিভাবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মুজিযাসমূহ আবু বকর, উমর ও উসমান (রাঃ) তলব করেননি, বরং আবু জাহল, আবু লাহাব, উতবা, শায়বা প্রমুখ কাফিররাই তলব করেছিলো। অন্যান্য নবী-রাসুলগণের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।

আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কাফিররা জাহেরি মুজিযা তলব করতো তাদের শত্রুতা, হিংসা, দ্বেষ এবং অন্তরের হঠকারিতা ও গোঁয়ার্তুমির বশবর্তী হয়ে - সত্যানুসন্ধানী হয়ে নয়। এ কারণে তারা একের পর এক জাহেরী মুজিযা তলব করেই যাচ্ছিলো। পক্ষান্তরে যখনই তাদের দাবী অনুসারে কোন মুজিযা বাস্তবায়িত হতো তখন তারাই তাকে যাদু বলে আখ্যায়িত করে বসতো। বস্তুত এরূপ গোঁয়ার্তুমি ও কূপমণ্ডূকতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা কখনো জাহেরী মুজিযা দেখে উপকৃত হতে পারে না বরং তারা নিজেদের অন্তরের কপটতার দরুন জাহেরী মুজিযাকে যাদু ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে এবং নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। মুসা আলাইহিস সালাম ফিরাউন ও তার অনুসারীদেরকে অনেক মুজিযা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিটি মুজিযার ক্ষেত্রেই মুসা আলাইহিস সালাম'কে ফিরাউনের মুখে একই জবাব শুনতে হয়েছিলো - "তুমি মহাযাদুকর", অথবা - "এটা তো প্রকাশ্য যাদু", অথবা - "এই মুসা ও তার ভাই উভয়ে জাদুকর।" দেখুনঃ ৫ : ১১০; ৬ : ৭ ; ১০ : ৭৬ ; ১১ : ৭ ; ২৭ : ১৩ ; ৩৪ : ৪৩ ; ৩৭ : ১৫ ; ২০ : ৬৩ ; ৭ : ১১২।

আরো আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই যে, মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা দেখে মিসরের সমস্ত যাদুকর সিজদায় পড়ে গিয়েছিলো আর তাদের প্রত্যেকে ঈমান এনে চির সৌভাগ্যমণ্ডিত হয়েছিলো। কিন্তু ফিরআউনের মুখে ছিল পূর্বের সেই একই কথা, অভিন্ন বুলি -

" ...... সে তো তোমাদের (যাদুকর) প্রধান, সে তোমাদেরকে যাদু শিক্ষা দিয়েছে ....." (সূরাহ তো-হা, ২০ : ৭১)

শেষনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে ঠিক একই অবস্থা ঘটেছিলো। কাফির কুরাইশ সম্প্রদায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মুজিযা তলব করেছিলো আর মুজিযার বিকাশ দেখার পরই তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদুকর বা কাহিনীকার বলে আখ্যায়িত করেছিলো। দেখুনঃ ৭৪: ২৪ ; ৫২ : ২৯, ৩০ ; ৫৪ : ১-২ ; ৬৯ : ৪০, ৪৮।

উপরে উল্লিখিত আলোচনার দ্বারা একটি সংশয়ের অবসানও হয়ে গেলো যে, পবিত্র কুরআন ও হাদিসে লক্ষ্য করা যায় যে, মক্কায় কাফিররা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বরাবর মুজিযা তলব করেছে, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সেই দাবী অনুসারে মুজিযা দেখাননি কেন?

বস্তুত তাদেরকে অনেক জাহেরী মুজিযা দেখানো হয়েছিলো, কিন্তু জাহেরী মুজিযা দিয়ে কাফিরদের মন কখনো শান্ত হয় না এবং এতে তারা কখনো হিদায়াত লাভ করতে পারে না। কারণ এই সমস্ত মুজিযা তলবের পিছনে তাদের অন্তরের কপটতা, হিংসা, দ্বেষ ও গোঁয়ার্তুমি কার্যকর থাকে। এই অবস্থায় তাদের প্রার্থিত মুজিযা সংঘটনে তাদের বিশেষ কোন ফায়দা হতো না, বরং এটা তাদের অন্তরের শঠতাকে আরো বৃদ্ধি করতো। আল্লাহ তাআলা বলেন -

"আর যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটি তাদের কলুষের সাথে আরো কলুষ যুক্ত করে ....." (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ : ১২৫)

আরো দেখুনঃ ২: ১০ ; ৭১ : ২৪, ২৮ ; ১৭ : ৮২ ; ৫ : ৬৪, ৬৮।

তাই পবিত্র কুরআনে জাহেরী মুজিযা তলবের কারণে কাফিরদেরকে ভৎসনা করা হয়েছে আর বাতেনী মুজিযার প্রতি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ

"তারা বলে, সে তার প্রতিপালকের কাছ থেকে আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আনে না কেন ? তাদের কাছে কি আসেনি সুস্পষ্ট প্রমাণ, যা আছে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে ?" (সূরাহ তো-হা, ২০ : ১৩৩)

"তারা বলে, তার প্রতিপালকের কাছ থেকে তার কাছে নিদর্শন প্রেরিত হয় না কেন ? বলুন, নিদর্শন আল্লাহ'র এখতিয়ারে, আমি তো একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী মাত্র। এটি কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি আপনার কাছে কুরআন নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয় ? এতে অবশ্যই বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে।" (সূরাহ আল-আনকাবুত, ২৯ : ৫০-৫১)

এ কারণেই পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে কাফিরদের জাহেরী মুজিযা তলবের প্রতিউত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে কেবল এতোটুকু বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে - আমি তো কেবল একজন মানুষ ও পয়গাম্বর। ইরশাদ হয়েছেঃ

"এবং তারা বলে, আমরা কখনো আপনার প্রতি ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না আপনি আমাদের জন্য ভূমি থেকে এক প্রস্রবণ উৎসারিত করবেন; অথবা আপনার খেজুরের বা আঙ্গুরের এক বাগান হবে, যার ফাঁকে-ফাঁকে আপনি অজস্র ধারায় প্রবাহিত করবেন নদী-নালা; অথবা আপনি যেমন বলে থাকেন, সে অনুযায়ী আকাশকে খণ্ড-বিখন্ড করে আমাদের উপর ফেলবেন, অথবা আল্লাহ ও ফেরেশতাগণকে আমাদের সামনে উপস্থিত করবেন ; অথবা আপনার একটি স্বর্ণ নির্মিত ঘর হবে অথবা আপনি আকাশে আরোহণ করবেন, কিন্তু আপনার আকাশ আরোহণে আমরা কখনো ঈমান আনবো না, যতক্ষণ আপনি আমাদের প্রতি কিতাব নাযিল না করবেন, যা আমরা পাঠ করবো, বলুন - পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক, আমি তো হচ্ছি কেবল একজন মানুষ, একজন রাসুল।" (সূরাহ বানি ঈসরাঈল, ১৭ : ৯০-৯৩)

 

মুজিযা সম্পর্কে বিতর্ক

নবী-রাসুলগণকে আল্লাহ জাহেরী ও বাতেনী উভয় প্রকার মুজিযা প্রদান করেছেন। এটা প্রত্যেক নবীর বেলায়ই ঘটেছে। কিন্তু এই জাহেরী ও বাতেনী মুজিযার পার্থক্য এবং উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহের গুঢ়ার্থ অনুধাবনের ব্যর্থতার কারণে কোন কোন লোক মনে করে বসেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফিরদেরকে কোন জাহেরী মুজিযা দেখাননি। যদি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাহেরী মুজিযা দেখাতেন, তাহলে বারবার কেন তারা মুজিযা তলব করেছিলো ? এমনকি কোন কোন অবিবেচক ইসলামী পণ্ডিত এ কথাও বলেছেন - "রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুরআন ছাড়া অন্য কোন মুজিযা ছিল না!" এ কারণে বর্তমানে কালে নতুন বিতর্কের সূচনা হয়েছে যে, আসলে কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা ছিল কিনা ?

মিসরের কয়েকজন মুসলিম পণ্ডিত, যথা উস্তাদ মুহাম্মাদ ফারীদ ওয়াজদী, শায়খ মুহাম্মাদ আবদুহু, সায়্যিদ আবদুল আযীয জাবীশ, আল-মানার সাময়িকীর সম্পাদক সায়্যিদ রাশীদ রিদা এবং মিসরের আল-আযহার রেক্টর মুহাম্মাদ মুস্তাফা আল-মারাগী এবং প্রখ্যাত লেখক শায়খ মুহাম্মাদ হুসায়ন হায়কাল প্রমুখ আধুনিক মুসলিম পণ্ডিতদের অভিমত এই যে, "পবিত্র কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা ছিল না।" [দৃষ্টব্যঃ (১) মুহাম্মাদ ফারীদ ওয়াজদী, আল-মাদীনা ওয়াল ইসলাম, মিসর, হিজরি ১৩৫৩ / খৃ. ১৯৩৩, পৃষ্ঠা ৭১-৭২; (২) মুহাম্মাদ রাশীদ রিদা, তাফসিরুল মানার, মিসর, হিজরি ১৩৭৩ / খৃ. ১৯৫৪; ১১খ. ; (৩) ঐ লেখক, আল- ওয়াহয়ুউল মুহাম্মাদী, মিসর, হিজরি ১৩৫৪ ; (৪) শায়খ মুহাম্মাদ আবদুহু, রিসালাতুত তাওহীদ, মিসর, হিজরি ১৩৬৫ ; (৫) মুস্তাফা আল-মারাগী, মুকাদ্দাম হায়াতে মুহাম্মাদ লিল-হায়কাল, মিসর, খৃ.১৯৭৪ ; (৬) সায়্যিদ আবদুল আযীয জাবিশ, দ্বীনুল ফিতরাতি ওয়াল-হুরারিয়্যাহ ; (৭) মুহাম্মাদ হুসায়ন হায়কাল, হায়াতে মুহাম্মাদ, মিসর, দারুল আআরিফ, খৃ. ১৯৭৪, ১২শ সংস্করণ, ভুমিকা]

ড. মুহাম্মাদ হুসায়ন হায়কাল তার কিতাব "হায়াতে মুহাম্মাদ" গ্রন্থের ভুমিকায় তাদের উক্ত অভিমতের সমর্থনে পবিত্র কুরআনের পূর্বোক্ত চারটি আয়াত (১৭ :৯০-৯৩) আর তার সাথে নিন্মোক্ত আয়াত প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেনঃ

"তারা আল্লাহ'র নামে কঠিন শপথ করে বলে যে, তাদের কাছে যদি কোন নিদর্শন আসতো, তবে অবশ্যই তারা এতে ঈমান আনতো; বলুন, নিদর্শন তো আল্লাহ'র এখতিয়ারভুক্ত, তাদের কাছে নিদর্শন আসলেও তারা যে ঈমান আনবে না এটা কিভাবে তোমাদের বোধগম্য করানো যাবে ?" (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১০৯)

ড. হায়কাল আয়াত দুটো উপস্থাপনের পর লিখেছেনঃ বস্তুত পবিত্র কুরআন ও তার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হাদিসসমূহ কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যান্য মুজিযার ব্যাপারে অনেকটা নীরব বলা চলে। এ ক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, এমতাবস্থায় পূর্ববর্তীদের থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের মুসলমানগণ পর্যন্ত সকলেই পবিত্র কুরআন ছাড়া অন্যান্য মুজিযার ব্যাপারে এতোটা সোচ্চার কেন ? এ প্রশ্নের একটাই উত্তর হতে পারে। তা এই যে, মুসলমানগণ পবিত্র কুরআনে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের বিভিন্ন মুজিযার ঘটনা ও কাহিনী দেখতে পেয়েছে। এতে তারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। তারা মনে করেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে জন্যও মুজিযা হওয়া অত্যাবশ্যক। তাদের ধারণায় জড়ো অলৌকিক ঘটনা ছাড়া বিশ্বাস-ই পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তারা অলৌকিক ঘটনাবলীর ব্যাপারে বর্ণনাগুলোকে নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য মনে করে বসেছে, অথচ এ সকল বর্ণনা যে পবিত্র কুরআন সমর্থিত না, এ দিকটির প্রতি তারা কোন প্রকার গুরুত্বারোপই করেননি। তারা ধারণা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযার প্রাচুর্য তার রিসালাতের প্রতি মানুষের ঈমান ও বিশ্বাসকেই শক্তিশালী ও বৃদ্ধির কারণ হবে। অথচ পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাদৃশ্য ভিন্নধর্মী বিষয়কে একত্রিকরণ বৈ আর কিছু না। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভুমিকা)

"পবিত্র কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা ছিলো না" - এই দাবীর সমর্থনে ড. হায়কাল কুরআনের যে দুটো আয়াত উদ্ধৃত করেছেন, তা দিয়ে তার দাবী কোনভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ, সকল নির্ভরযোগ্য তাফসীর ও হাদিসে উক্ত আয়াত দুটোর যে শানে নুযূল, প্রেক্ষাপট ও ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে, তাতে তার দাবীর সমর্থন নেই, বরং আয়াত দুটোর মর্ম এই যে, এতে মক্কার মুশরিকদের কূট-উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়েছে। "পবিত্র কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আর কোন মুজিযা নেই" - এতে এমন উক্তি করা হয়নি। আল্লামা ইবনে কাসির তার "তাফসিরুল কুরআনিল আযীম" গ্রন্থে প্রথমোক্ত আয়াতটির পটভূমি বর্ণনা প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সূত্রে সহিহ হাদিস রিওয়ায়াত করেছেন যে, একদিন মক্কার মুশরিক সর্দারেরা বসে খোশগল্প করছিলো। তারা এক লোক দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে ডেকে পাঠালো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে হাজির হলে তারা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপরের আয়াতে উল্লিখিত প্রশ্নগুলো করলো। এ সমস্ত প্রশ্নের পিছনে তাদের কোন সদুদ্দেশ্য ছিল না। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের দাবীগুলো বাস্তবায়িত করে দেখালেও তারা ঈমান আনতো না, বরং আরো হাজারো মুজিযা দাবী করে বসতো। আর তাদের দেখাদেখি অন্যরাও এই ধরণের দাবী করতে আরম্ভ করতো। ফলে আল্লাহ'র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে ইসলাম প্রচারের মহান ব্রতকে বাদ দিয়ে তাদের এই সমস্ত গোঁয়ার্তুমিমূলক প্রশ্নের উত্তরেও দাবী-দাওয়া পূরণের কাজ করেই বেড়াতে হতো। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুশরিকদের এ সমস্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্নের কোন গুরুত্ব দেননি।(তাফসীর ইবনে কাসির, ৩খ.)

পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতটির পটভূমিও এমন একটি ঘটনা। মক্কার মুশরিকরা শপথ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বললো, আপনি আমাদের প্রত্যাশিত মুজিযার অংশবিশেষ বাস্তবায়িত করে দেখালে আমরা ঈমান আনবো। বস্তুত তাদের এই শপথ ছিল মিথ্যা, অসার। আল্লাহ তাদের এই মিথ্যা শপথের পর্দা উন্মোচনের লক্ষ্যে উক্ত আয়াতটি নাযিল করেন আর বলেন, একটি মুজিযা প্রকাশের পর আরেকটি, এরপর আরো একটি, এভাবে মুজিযার পর মুজিযা প্রকাশের মাধ্যমে কোন শুভ ফল হতে পারে না; বরং সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার মতো একটি মুজিযাই যথেষ্ট। বারবার অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শনের দাবী নিরর্থক বৈ কিছু না।(তাফসীর ইবন কাসির, ২খ.)

মোটকথা, উক্ত ভাষ্য দুটোতে এ কথা বুঝানো হয়নি যে, কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন মুজিযা নেই, বরং তাতে এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, সত্য প্রমানের জন্য বারবার জাহেরী মুজিযা তলব ও তা প্রদর্শনের মধ্যে কোন ফায়দা নেই। হঠকারী ও গোঁয়ার্তুমিমুক্ত অন্তর নিয়ে একটি মুজিযা দেখাই সত্য প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

পূর্বোল্লিখিত বক্তব্যের বিপরীতে ড. হায়কাল যুক্তি পেশ করেছেন যে, "কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযা আছে" মেনে নিলে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের সাথে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাদৃশ্য ভিন্নধর্মী বিষয়কে একত্রকরণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তার এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য না। কারণ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল নবী-রাসুলগণের নেতা এবং সর্বশেষ নবী ও রাসুল ছিলেন। কিন্তু তাই বলে অন্য নবী-রাসুলগণের সাথে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন সাদৃশ্য ও মিল থাকবে না, এমন না। যেমন আল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলেছেনঃ

"মুহাম্মাদ একজন রাসুল মাত্র, তার পূর্বে বহু রাসুল গত হয়েছেন; সুতরাং তিনি যদি মারা যান বা নিহত হোন, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে ? ......" (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১৪৪)

অনুরূপ অসংখ্য আয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের নানাবিধ অবস্থাকে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের অবস্থার সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং তা থেকে উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। (দ্রষ্টব্যঃ ৬ : ১০, ৩৩, ৩৪, ৪২)। উপরন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

"আমার আর অন্যান্য রাসুলগণের উদাহারন এরূপ, যেমন একটি সুরম্য অট্টালিকা নির্মিত হলো। বহু লোক সমবেত হয়ে এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে লাগলো, তারা সকলেই বাহবা বলে প্রশংসা করতে লাগলো। কিন্তু এই সুরম্য অট্টালিকার এক কোণে একটি ইস্টকের স্থান শূন্য দেখে তারা বলতে লাগলেন - আহ, এই শূন্য স্থানটি যদি পূর্ণ হতো তবে কতোই না সুন্দর হতো।" এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "অনন্তর আমিই সেই(শূন্যস্থান পূর্ণকারী) ইষ্টক, আর আমিই সর্বশেষ নবী।" (বুখারী, ১খ. ; মুসলিম, ২খ.)

সুতরাং অন্যান্য নবী-রাসুলগণের জাহেরী ও জড়ো মুজিযা ছিল বলে অনুরূপ মুজিযা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থাকতে পারবে না, এটা কোন যুক্তিগ্রাহ্য কথা নয়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনায় অতীতে কিছু কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটেছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। তবে এ কথাও স্বতঃসিদ্ধ যে, অতীতের বিভিন্ন যুগের মুহাদ্দিসীন ও হাদিস বিশেষজ্ঞগণ নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন-চরিত বিষয়ক বর্ণনারাজিকে সে সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত করার নিরলস চেষ্টা চালিয়েছেন আর এ ক্ষেত্রে তারা অভাবিত সাফল্য অর্জন করেছেন। তারা রিওয়ায়াতসমূহের শুদ্ধ-অশুদ্ধ পার্থক্যকরণে সক্ষম হয়েছেন। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের অলৌকিক ঘটনাবলী সম্পর্কিত বিশুদ্ধ হাদিস ও রিওয়ায়াতসমূহ গ্রহণ করতে এখন আর আপত্তি করার সঙ্গত কোন কারণ নেই।

কিন্তু ড. হায়কাল তার কিতাব "হায়াতে মুহাম্মাদ" এর ভুমিকায় এ সমস্ত হাদিস ও রিওয়ায়াতসমূহকে শুদ্ধ-অশুদ্ধ নির্বিশেষে এক দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন - "পবিত্র কুরআনই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একক মুজিযা।" এরপর তিনি লিখেছেন - "যদি রিসালাত প্রমাণের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা থাকতো, তবে তা পবিত্র কুরআন উল্লেখ করা হলো না কেন ?" এ পর্যন্ত বলেই তিনি ক্ষান্ত হোননি, আরেকটু অগ্রসর হয়ে তিনি মুজিযাকে যুক্তি-বুদ্ধির নিরিখে বিচার করতে চেয়েছেন। তিনি বলেন - "আজও যদি কোন অমুসলিম সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করে এবং মুজিযার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ছাড়া অন্য কোন কিছু স্বীকার না করে, তাহলে এজন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা যাবে না। এতে তাদের ধর্মবিশ্বাস অসম্পূর্ণ হবে না। কেননা, সে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঈমান এনেছে। তার এই অধিকার রয়েছে যে, সে পবিত্র কুরআনের আলোকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যান্য মুজিযা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিন্তা-গবেষণা করতে পারবে। এরপর যদি অকাট্য প্রমাণ দিয়ে কোন কিছু সাব্যস্ত হয়, তা বিনা দ্বিধায় মেনে নিবে।"

ড. হায়কালের এই অভিমতও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যা অস্বাভাবিক ও যা যুক্তি-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে, তা-ই তো মুজিযা। সুতরাং যুক্তি বুদ্ধির নিরিখে কিরূপে কোন নবী ও রাসুলের অলৌকিক কর্মকীর্তির বিশুদ্ধতা মূল্যায়ন করা যাবে ?

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, কুরআন ছাড়া অন্য কোন মুজিযা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের থাকলে তা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হলো না কেন ? অথচ কুরআনের সাধারণ পাঠক মাত্রই জানেন, কুরআনে মাত্র একটি দুটি না, বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক মুজিযার উল্লেখ রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে কয়েকটির উল্লেখ করছি -

(১) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিরাজে গমন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের একটি ঐতিহাসিক সুবিখ্যাত মুজিযা। পবিত্র কুরআনে মিরাজ সম্পর্কে পরিষ্কার আলোচনা হয়েছে। এমনকি কুরআনের একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে "ইসরা" তথা মিরাজ নামে। এই সূরাতুল ইসরা'র সূচনাই হয়েছে এভাবে -

"পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত - যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই; নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।" (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ : ১)

(২) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতও ছিল তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের একটি অলৌকিক ও অস্বাভাবিক ঘটনা। হিজরত মাত্র একটি মুজিযাই নয়, বরং এটি ছিল একাধিক মুজিযার ধারক ও সংঘটন স্থল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পার্থিব সহায়-সম্বলহীন। অপরদিকে কুরাইশ কাফিররা ছিল অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত ধনে-জনে বলীয়ান। তারা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হত্যার পরিকল্পনা করেছিলো। প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে দুর্ধর্ষ বীর খোলা তরবারি নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে হত্যা করার দৃঢ় উদ্দেশ্যে বের হয়ে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে চারদিকে অবস্থান করছিলো। আল্লাহ কাফিরদের কবল থেকে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অলৌকিকভাবে রক্ষা করলেন। পবিত্র কুরআনে সেই ভয়াল ষড়যন্ত্রের দৃশ্য এভাবে চিত্রিত হয়েছে শব্দের গাঁথুনিতে (যার অনুবাদ) -

"আর স্মরণ করুন, কাফিররা আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আপনাকে বন্দী করার জন্য, হত্যা করার জন্য অথবা নির্বাসিত করার জন্য, এবং তারা ষড়যন্ত্র করে আর আল্লাহ'ও কৌশল করেন; আর আল্লাহ'ই তো কৌশলীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।" (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ৩০)

কুরআনের অপর একটি সূরায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের অলৌকিক ঘটনাবলী এভাবে বিবৃত হয়েছেঃ

"যদি তোমরা তাকে সাহায্য না করো তবে স্মরণ করো, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফিররা তাকে বহিস্কার করেছিলো এবং সে ছিল দুইজনের একজন, যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল, সে তখন তার সঙ্গীকে বলেছিলো - বিষণ্ণ হয়ো না, আল্লাহ আছেন আমাদের সাথে; এরপর আল্লাহ তার উপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং তাকে শক্তিশালী করেন এমন এক সৈন্যবাহিনী দিয়ে, যা তোমরা দেখোনি; তিনি কাফিরদের বাক্য হেয় করেন আর আল্লাহ'র বাক্যই সর্বোপরি, আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।" (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯: ৪০)

(৩) অনুরূপ বদর যুদ্ধে আল্লাহ মুসলমানগণকে অলৌকিকভাবে বিজয় দান করেছিলেন, বদরে তিনি তার ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এটা ছাড়া আরো অলৌকিক ঘটনা বদরে সংঘটিত হয়েছে, যার প্রতিটির বর্ণনা কুরআনে রয়েছে। ফেরেশতা বাহিনীর মাধ্যমে যুদ্ধের ফলাফল মুসলমানদের অনুকূলে আনয়নের মুজিযা এভাবে উপস্থাপিত হয়েছেঃ

"স্মরণ করো, যখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে, তিনি তা কবুল করেছিলেন আর বলেছিলেন, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো এক হাজার ফেরেশতা দিয়ে যারা একের পর এক আসবে। আল্লাহ এটা করেন কেবল শুভ সংবাদ দেওয়ার জন্য এবং এই উদ্দেশ্যে যাতে তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করে, আর সাহায্য তো শুধু আল্লাহ'র কাছ থেকেই আসে; আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ৯-১০)

(৪) এমনিভাবে বদর প্রান্তরে মুসলমানদের কল্যাণে অসময়ে বৃষ্টি বর্ষণের মুজিযা কুরআনে বিবৃত হয়েছেঃ

"... এবং আকাশ থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন তা দিয়ে তোমাদের পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা অপসারণের জন্য, তোমাদের হৃদয় দৃঢ় করার জন্য আর তোমাদের স্থির রাখার জন্য।" (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ১১)

(৫) অনুরূপ বদর প্রান্তরে কাফিরদের চোখে মুসলমানদের সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে যাতে তারা অধিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অপর দিকে মুসলমানদের চোখে কাফিরদের কম দেখানো হয়েছে যাতে মুসলমানগণ ঘাবড়িয়ে না যায়। এটি ছিল একটি মুজিযা ও অসাধারণ ব্যাপার। কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছেঃ

"দুটি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে- একদল আল্লাহ'র পথে লড়াই করছিলো, অন্যদল কাফির ছিলো; তারা তাদেরকে চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিলো; আল্লাহ যাকে ইচ্ছে নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন; নিশ্চয়ই এতে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের জন্য শিক্ষা রয়েছে।" (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১৩)

বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন মাওলানা তফাজ্জল হুসাইন রচিত হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) : মুজিযার স্বরূপ ও মুজিযা। দৃষ্টান্তস্বরূপ মাত্র কয়েকটি মুজিযা এখানে উল্লেখ করা হলো। এগুলো ছাড়াও আরো বহু মুজিযার ঘটনা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং ড. হায়কালের এই দাবী যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযা বলতে শুধু পবিত্র কুরআনকে বুঝায় এবং এটি ছাড়া তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন মুজিযা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি - এই দাবী সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভিত্তিহীন।

ড. হায়কালের মতে, হাদিস ও সিরাত গ্রন্থসমূহে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে সংঘটিত যে সমস্ত অসাধারণ ও অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা হয় মনগড়া, বানোয়াট কিংবা সমালোচনার ঊর্ধ্বে না। সুতরাং তার নানারূপ ব্যাখ্যার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এরপর তিনি কুরআন ছাড়া অন্যান্য মুজিযাসমূহের অসারতা ও অবাস্তবতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে দুটো কাহিনী উপস্থাপন করেছেন এবং তার অসারতা প্রমাণের জন্য যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন। কাহিনী দুটো নিন্মরূপঃ

(১) ড. হায়কাল লিখেছেন, সিরাত বিষয়ক সকল গ্রন্থেই অভিন্ন মত প্রকাশ করা হয়েছে যে, মিরাজের পূর্বে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে শুনতে পেলেন যে, একই রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় ভ্রমণ করানো হয়েছে এবং সেখানের পবিত্র স্থানগুলো পরিদর্শন করানো হয়েছে। এ কথা শুনার সাথে সাথে একদল মুসলমান তা অবিশ্বাস করে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলো। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা)

(২) ড. হায়কাল লিখেছেন, সুরাকা ইবন মালিক ইবন জুশুমের ঘটনাও এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। হিজরতের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবিত কিংবা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মক্কাবাসী কাফিররা পুরস্কার ঘোষণা করে। সুরাকা পুরস্কারের লোভে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে ধরার জন্য তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছু ধাওয়া করে। সে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয়। এমনকি কোন কোন জীবন-চরিতকার লিখেছেন, সে তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে পৌছলে অলৌকিকভাবে তার ঘোড়ার ক্ষুর মাটিতে দেবে যায়।(হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা)

ড. হায়কালের এই দুটো ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্য এই যে, নবী- রাসুলগণের মুজিযা তাদের দাবীর সত্যতা প্রতিষ্ঠা ও তাদের প্রতি ঈমান আরো সুদৃঢ়করণের জন্য সহায়কস্বরূপ। সে হিসেবে কোন নবী-রাসুল থেকে কোন মুজিযা প্রকাশ পাওয়া তার প্রতি অবিশ্বাসীদের ঈমান আনয়নের সহায়ক হবে, আর বিশ্বাসীদের ঈমানকে আরো সুদৃঢ় করবে। এটিই যুক্তির চাহিদা। অথচ মিরাজের ঘটনায় কোন কাফিরের ঈমান আনা তো দূরের কথা, স্বয়ং ইতিপূর্বে যারা ঈমানদার ছিলো তাদের একটি দল পর্যন্ত এই ঘটনা শুনে মুরতাদ হয়ে গেলো। এটি তো এ কথাই প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে আল-কুরআন ভিন্ন অন্য কোন মুজিযা ছিল না।

অনুরূপ, সুরাকার ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, এই মুজিযা দেখেও সুরাকা ঈমান আনলো না কেন ? ফিরআউনের যাদুকররা তো মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা দেখে ঈমান এনেছিলো।

মুজিযার সত্যতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ড. হায়কালের গৃহীত মূলনীতি দেখে বড়ই আশ্চর্যবোধ হয়। তিনি কোথা থেকে এই মূলনীতি আবিস্কার করলেন যে, কোন নবীর মুজিযা দেখে তার উম্মত ঈমান না আনলে উক্ত মুজিযা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে ? স্বয়ং ড. হায়কালের দাবী মতে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একমাত্র মুজিযা পবিত্র কুরআন শুনে তার সকল শ্রোতাই কি ঈমান এনেছিলো ? উত্তর"না" হলে পবিত্র কুরআন কি অসত্য হয়ে যাবে ? বস্তুত তিনি তার ভিত্তিহীন মনগড়া একটি যুক্তি দিয়ে দুটো সুপ্রতিষ্ঠিত মুজিযা অস্বীকার করার প্রয়াস পেয়েছেন, যার একটি(মিরাজ) স্বয়ং কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং অপরটি(সুরাকার ঘটনা) বুখারী ও মুসলিমসহ হাদিস ও সিরাতের সকল বিশুদ্ধ গ্রন্থে সহিহ সনদে সংরক্ষিত আছে।(দ্রষ্টব্যঃ বুখারী, ১ম খণ্ড ; মুসলিম, ২য় খণ্ড)

ড. হায়কাল আরো একটি যুক্তি পেশ করেছেন যে, অন্যান্য নবী-রাসুলগণের মুজিযা দেখে বিরুদ্ধবাদীদের ঈমান আনার ঘটনা পবিত্র কুরআন ও ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন মুজিযা দেখে কোন মুশরিক ঈমান এনেছে এমন বর্ণনা ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়নি। এটা প্রমাণ করে যে, কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন মুজিযা ছিল না। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা)

ড. হায়কালের এই যুক্তি তথ্যনির্ভর না। কারণ হাদিস ও সিরাতের গ্রন্থসমূহে এ জাতীয় একাধিক ঘটনা সহিহ সনদ দ্বারা সংরক্ষিত হয়ে আসছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা তার কয়েকটি ঘটনা এখানে উদ্ধৃত করছিঃ

(১) এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাজির হয়ে বললো, আমি ঐ পর্যন্ত আপনাকে সত্য নবী বলে স্বীকার করবো না, যতক্ষণ না এই খেজুর বৃক্ষের কাঁদিসমূহ আপনার কাছে এসে আপনার রিসালাতের সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহ'র কৃপায় তা-ই ঘটলো। যখন সে এই ঘটনা নিজ চোখে দেখলো, তখন ইসলাম গ্রহণ করলো। (তিরমিযি)

(২) একবার এক সফরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এক বেদুঈনের সাক্ষাৎ হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকটিকে ইসলামের প্রতি আহবান জানালেন। লোকটি বললো, আপনার সত্যতার সাক্ষ্য কে দিচ্ছে ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সামনের এই বৃক্ষটি। এই কথা বলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃক্ষটিকে কাছে ডাকলেন। তৎক্ষণাৎ বৃক্ষটি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে হাজির হলো আর তার মধ্য থেকে তিনবার কালেমা তায়্যিবার ধ্বনি উচ্চারিত হলো। এই দৃশ্য দেখে লোকটি তৎক্ষণাৎ ইসলামে দাখিল হয়ে গেলো। (সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

(৩) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতকালে উম্মে মাবাদ ও আবু মাবাদ নামক দুইজন মরুবাসীর ইসলাম গ্রহণের কথা সুবিখ্যাত। তারা ছিলেন খুজাআ গোত্রের লোক। মদিনার পথে একটি ঝুপড়ীতে তারা বাস করতো আর পথিক-মুসাফিরদের সেবা ও মেহমানদারী করতো। মেষ পালনই ছিল তাদের একমাত্র জীবিকা নির্বাহের উপায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু উম্মে মাবাদের ঝুপড়ীর পার্শ্ব অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন। তারা কিছু পাথেয় খরীদ করার জন্য উম্মে মাবাদের ঝুপড়ীতে আসলেন। কিন্তু খরীদ করার মতো কিছুই তার কাছে পাওয়া গেলো না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন, উম্মে মাবাদের ঝুপড়ীর এক কোণে একটি ছাগী দাঁড়িয়ে আছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, এই ছাগীটি দুধ দেয় কি ? উম্মে মাবাদ বললেন, সে তো হাঁটতেই পারে না, এতো দুর্বল ছাগী আবার দুধ দেয় ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনি অনুমতি দিলে আমি দোহন করে দেখতে পারি। উম্মে মাবাদ বললেন, আচ্ছা, আপনি দোহন করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিসমিল্লাহ বলে তার দুধ দোহন করতে লাগলেন। দেখা গেলো, দুধ বের হয়ে আসছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথীগণ, উম্মে মাবাদ ও তার ঝুপড়ীর লোকজন সকলেই তৃপ্তি সহকারে পেট ভরে দুধ পান করলেন। তারপর আরো কিছু দুধ উম্মে মাবাদের কাছে অবশিষ্ট রয়ে গেলো।

দুধ পান করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথীসহ মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই আবু মাবাদ মরুভূমিতে মেষ চারণ করে ঝুপড়ীতে ফিরে আসলেন। আবু মাবাদ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনে বললেন, আল্লাহ শপথ, ইনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনে হয় কুরাইশ গোত্রের সেই লোকটি, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথা অনেক শুনেছি, আমাদের সুযোগ হলে আমরা তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দরবারে উপস্থিত হবো। ইবন কাসির রিওয়ায়াত করেছেন যে, এ ঘটনার পর উম্মে মাবাদ ও আবু মাবাদ উভয়ই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। (ইবন হিশাম, ১খ. ; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ৩খ.)

কিছু আধুনিক সিরাতকার উম্মে মাবাদের হাদিসটিকে সনদের দিক থেকে দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু মুহাক্কিক আলিমগণ হাদিসটির সনদ সম্বন্ধে তথ্য তালাশের পর হাদিসটিকে সহিহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাদের অনুসন্ধান মতে এ হাদিসটি একাধিক সাহাবী থেকে একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে, যথা -

(১) উম্মে মাবাদের সনদে ইবনুস সাকান, আল ইসাবায়। (দ্রষ্টব্যঃ ইসাবা, বাবুল আসমা ওয়াল কুনা)

(২) আবু মাবাদের সনদে ইমাম বুখারী তার তারিখ গ্রন্থে। (দ্রষ্টব্যঃ তাবাআত ইবন সাদ, ১খ.)

(৩) হুবায়শ ইবন খালিদের সনদে আল্লাম বাগাবী, ইবন শাহীন, ইবনুস সাকান ও ইমাম তাবারানী প্রমুখ মুহাদ্দিস নিজ নিজ গ্রন্থে। (দ্রষ্টব্যঃ তাহযিবুল কামাল, ১খ.)

(৪) আবু সালিত বদরীর সনদে হাদিসটি উয়ুনুল আসার গ্রন্থে বর্ণিত আছে। (দ্রষ্টব্যঃ সিরাতে মুস্তফা, ১খ.)

(৫) হিশামের সনদে মুসতাদরাকে হাকেম গ্রন্থে। হাকেম হাদিসটি রিওয়ায়াত করার পর মন্তব্য করেছেন- "এই হাদিসটি সনদ সহিহ"।(মুসতাদরাক, ৩খ.)

উপরন্তু এ ঘটনাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের সাথী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। (দ্রষ্টব্যঃ দালায়েল লিল বায়হাকী, মুসতাদরাক লিল হাকেম ও আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া লি ইবন কাসির, ৩খ.) ইবন কাসির বলেন, "তার সনদ হাসান-নির্ভরযোগ্য।"

অতএব উম্মে মাবাদের বর্ণিত এই মুজিযার ঘটনাটি সম্বন্ধে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় পোষণ করার কোনই যুক্তিসংগত কারণ নেই।

ড. হায়কালের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণের জন্য সূরাহ আল-কামারের প্রথম দুই আয়াতই যথেষ্ট। ইরশাদ হয়েছেঃ

"কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে, আর চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। এরা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলে- এটা তো চিরাচরিত যাদু।" (সূরাহ আল-কামার, ৫৪: ১-২)

ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিলো, এক খণ্ড পাহাড়ের উপরের দিকে আর অপর এক খণ্ড পাহাড়ের নিচের দিকে ছিলো। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন - তোমরা সাক্ষী থাকো। (বুখারী, কিতাবুত তাফসীর)

আধুনিক মুসলিম পণ্ডিতদের এরূপ অভিমতের কারণ

জড়বাদী, বস্তু পূজারী ইউরোপীয় লেখকদের মধ্যে একটি প্রবণতা বিশেষভাবে দেখা যায় যে, তারা নবী-রাসুলগণের জীবদ্দশায় সংঘটিত যথার্থ তথ্য-প্রমাণে সুপ্রতিষ্ঠিত অলৌকিক (মুজিযা) ঘটনাবলী অস্বীকার করে থাকেন অথবা তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ মানবীয় বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তি দ্বারা তা বিকৃত করার অপচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। তাদের এই সংকীর্ণ মানসিকতা সম্বন্ধে এটাই যথার্থ বক্তব্য হবে যে, যারা আধ্যাত্মিক জগতের খোঁজ জানে না, যাদের জ্ঞানের দৌড় বস্তুতান্ত্রিক জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যাদের অন্তর ও মস্তিষ্ক জড় জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ - তাদের চোখে এ সমস্ত অলৌকিক (মুজিযা) ঘটনাবলী এভাবে প্রতিভাত হওয়াই স্বাভাবিক।

যারা নিজেদের রাসুল ঈসা আলাইহি সালামের অলৌকিক জন্মের কথা অস্বীকার করতে পেরেছে, তারা যে অন্যান্য নবী-রাসুলের, বিশেষ করে শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে সংঘটিত অলৌকিক (মুজিযা) ঘটনাবলী অস্বীকার করবে, এতে বিস্মিত হওয়ার কি আছে ? তবে বিস্ময় লাগে আমাদের কিছু মুসলিম পণ্ডিতের জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তি-বিবেচনার উপর। কারণ তারা আল্লাহ'র জড়-ঊর্ধ্ব মহান কুদরত ও অসাধারণ ক্ষমতায় বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও সহিহ সনদ দিয়ে প্রমাণিত মুজিযাসমূহকে নিজেদের প্রসার যুক্তি ও সংকীর্ণ মেধা বুদ্ধি দিয়ে অস্বীকার করতে কিংবা তার অপব্যাখ্যা সন্ধানে উদ্যত হয়েছেন। তারা যে নিরপেক্ষ, সুস্থ যুক্তি ও বিবেক দিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি, বরং ইউরোপীয় জড়বাদী লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন - তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে তাদেরই অন্যতম লেখক বন্ধু মিসরের ড. হুসাইন হায়কালের এই বক্তব্য থেকে।

তিনি তার গ্রন্থ "হায়াতে মুহাম্মাদ" এর ভুমিকায় মুজিযা প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, খুব সম্ভব সে কালের ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখকগণ যুগের প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সংশ্লিষ্ট পবিত্র কুরআন বহির্ভূত অলৌকিক ঘটনাবলী তাদের গ্রন্থরাজিতে সংকলন করেছিলেন। বলা চলে, যুগের প্রয়োজনে এই ব্যাপারে তারা নিরুপায় ছিলেন। পরবর্তী যুগের লেখক ও চিন্তাবিদগণও এ ব্যাপারে তাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন। তারা মনে করেছেন যে, এ সমস্ত অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমান সুদৃঢ় হবে। এমনকি এ সমস্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি করাও তাদের ধারণায় উপকার বৈ ক্ষতি ছিল না। তারা যদি এ ধরনের সুধারণা পোষণ না করতেন, তাহলে অবশ্যই তারা এ সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন। তারা বর্তমানে জীবিত থাকলে দেখতে পেতেন, ইসলামের শত্রুরা এ সমস্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসলাম সম্পর্কে জঘন্য সমালোচনা করেছে। এ পরিণতি দেখতে পেলে পবিত্র কুরআন বহির্ভূত অলৌকিক ঘটনাবলী কখনো তারা নিজেদের গ্রন্থগুলোতে সংকলন করতেন না। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা, মুজিযা প্রসঙ্গে)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজ (দ্বিতীয় পার্ট)

 

 

 

The Greatest Nation·Thursday, March 21, 2019

 

 

 

মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ না নিদর্শন ?

"মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ না নিদর্শন" - বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌছতে প্রাচীন মুসলিম মনীষীদের মধ্যে যেমন মতবিরোধ হয়েছে, বর্তমানকালেও তাতে প্রচণ্ড মতভেদ বহাল রয়েছে। অতীত ও প্রাচীন মুসলিম মনীষীদের মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আশাইরা আকিদা বিশেষজ্ঞ আলীমদের অভিমত এই যে, মুজিযা নবুওয়াত ও রিসালাতের হুজ্জত বা প্রমাণস্বরূপ। পক্ষান্তরে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বহির্ভূত মুতাজিলা সম্প্রদায়ভুক্ত চিন্তাবিদগণের অভিমত এই যে, মুজিযা নবুওয়াতের হুজ্জত বা প্রমাণ নয়, তবে তা নবুওয়াতের আলামত যে নিদর্শন মাত্র।(সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

বর্তমান কালে মিসরীয় ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখকগণও এই অভিমত পোষণ করে থাকেন, এর বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলিম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ইসলামী বিশেষজ্ঞ মনীষীদের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, মুজিযা নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর সত্যতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ, তা নিছক আলামত বা নিদর্শনের পর্যায়ের নয়। (দ্র. মানহাজুল মাদরাসাতিল আকলিয়া আল হাদিসাহ ফিত তাফসীর, ড. ফাহদ বিন আবদুর রহমান, বৈরুত, মুআসসাসতুর রিসালাহ, ১৪১৪ হিজরি, ২খ.)

 

যুক্তি ভিত্তিক প্রমাণ

মুতাযিলাদের দাবীর পক্ষে যুক্তি এই যে, তর্কশাস্ত্রের বিধানানুসারে দাবী ও দলীলের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র থাকা অপরিহার্য। কিন্তু মুজিযা ও নবুওয়াতের মধ্যে কোন প্রকার যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায় না। যেমন, কোন ব্যক্তি যখন নবুওয়াতের দাবী করেন তখন তার উদ্দেশ্য হয়, তিনি আল্লাহ'র পক্ষ থেকে মানব জাতির আকিদা ও বিশ্বাস, আমল ও কার্যক্রম এবং আখলাক ও চরিত্র সংশোধনের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। কিন্তু যখন তার কাছে এই দাবীর সত্যতা নিরূপণের জন্য দলীল প্রমাণ তলব করা হয়, তখন তিনি বিশুদ্ধ কুয়াকে পানি দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেন কিংবা চাঁদকে দুই টুকরো করে দেখান অথবা তার লাঠি সাপে পরিণত হয়ে যায়। এ সমস্ত ঘটনা যদিও নেহায়েত আশ্চর্যজনক ও অভাবিতপূর্ব, কিন্তু এই সমস্ত দলীল-প্রমাণের সাথে দাবীর কোন কোন যোগসূত্র আছে কি ?

আশাইরা মনীষীগণ মুতাযিলাদের এই তর্ক-যুক্তির উত্তরে বলেন, নবুওয়াত হচ্ছে ইলম ও আমলের সমন্বিত রূপ। যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করেন ও তার সম্পর্কে এ কথা স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, তিনি এই ইলম ও আমল সম্বন্ধে পরিপূর্ণ দক্ষতার অধিকারী এবং তার এই পরিপূর্ণতার বিকাশকল্পে তার কাছে মুজিযা তলব করা হয়। নবীগণের মুজিযা যদিও বিভিন্ন শ্রেণীর হয়ে থাকে, তবুও এগুলোকে শুধু দুই শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়। যেমন, অদৃশ্য জগতের সংবাদ প্রদান করা এবং সৃষ্টি জগতের বস্তুনিচয়ের উপর স্বীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখা। এই দুই শ্রেণীর কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন অংশের সাথে এবং নবুওয়াতের বিভিন্ন অংশের সাথে রয়েছে এক নিবিড় বন্ধন ও একাত্মতা। অদৃশ্য জগতের সংবাদ প্রদানের মাধ্যমে নবী-রাসুলগণের জ্ঞান ও মনীষার পরিপূর্ণতা বিকশিত হয়ে উঠে। অপরদিকে সৃষ্টি জগতের বস্তুনিচয়ের উপর কর্তৃত্ব নিষ্পন্ন করার দ্বারা তার ব্যবহারিক শক্তির বিকাশ সাধিত হয়।

অপর একটি যোগসূত্র হচ্ছে, মুজিযা হলো সহজাত স্বভাবের অতীত কোন স্বভাবের নাম। তবে এ ক্ষেত্রে এটি নিয়ে কোন মতবিরোধ নেই যে, বস্তুনিচয় তার গুণাবলী আর তার কারণসমূহ কেবল আল্লাহ'র নির্দেশ ও হুকুম দ্বারা আত্মপ্রকাশ করে। এখন যদি কোন শক্তি এসব বৈশিষ্ট্য ও কারণসমূহকে স্বীয় মুজিযার দ্বারা নিশ্চিহ্ন কিংবা ভেঙ্গে-চুরে একাকার করে দিতে সক্ষম হোন, তাহলে তিনি বস্তুত এ কথার যথার্থতাই তুলে ধরলেন যে, যে মহানুভব ও সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তির অধিকারী সত্তা এ সমস্ত কারণ ও উপাদান সৃষ্টি করেছেন, কেবল তিনিই সেগুলোকে ধ্বংস কিংবা অকেজো করে দিতে পারেন। এই ভাঙ্গা-গড়ার অবিকল ধারা যেহেতু তার (নবীর) মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, সেহেতু এটা প্রমাণ করে যে, ইনিই সেই সত্তার প্রতিনিধি।

এর দৃষ্টান্ত এরূপ যে, একজন বাদশাহ স্বীয় প্রজাদের কাছে প্রয়োজনের তাকিদে দূত প্রেরণ করেন। প্রজাগণ জিজ্ঞাসা করলো, এ কথার প্রমাণ কি যে, আপনি মহান বাদশাহর একজন বার্তাবাহক প্রতিনিধি ? তখন সে তার প্রতিউত্তরে বাদশাহর সীলমোহর আর অঙ্গুরী পেশ করতে বাধ্য হয়; যদিও প্রকাশ্যভাবে দূতের পয়গাম্বরীসুলভ দাবীর সাথে সীলমোহর আর অঙ্গুরীয়ের সরাসরি কোন যোগসূত্র নেই, কিন্তু তবুও এর মধ্যে সম্পর্ক এভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, সীলমোহর আর অঙ্গুরীয় বাদশারই নিদর্শন বটে, যা একজন সাধারণ মানুষের হাতে কখনো আসতে পারে না। সুতরাং এতে সুস্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, এই দূতকে বাদশাহ সরাসরি তার একান্ত ব্যক্তিগত নিদর্শন প্রদান করেই প্রেরণ করেছেন।

 

মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ হওয়ার অনুকূলে কুরআন-হাদিসের দলীল

(১) আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের মুশরিক ও পৌত্তলিকদের নিন্দা, তিরস্কার ও ভৎসনা করেছেন এবং এই মর্মে তাদের বর্ণনা দিয়েছেন যে, মুশরিকরা আল্লাহ'র আয়াত ও মুজিযায় বিশ্বাসী না। যদি মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণই না হতো, তাহলে মুজিযা দেখার পর তাতে ঈমান না আনলে তারা ভৎসনা ও নিন্দার যোগ্য হবে কেন? অথচ দেখুন, নিচের আয়াতসমূহে মুজিযা অস্বীকার করার কারণে মুশরিকদেরকে কীরূপ ভৎসনা করা হয়েছে -

"তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলীর এমন কোন নিদর্শন তাদের কাছে উপস্থিত হয় না, যা থেকে তারা মুখ না ফিরায়। সত্য যখন তাদের কাছে এসেছে, তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে; যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো, তার যথার্থ বিবরণ অচিরেই তাদের কাছে পৌঁছবে।" (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ৪-৫)

"তাদের মধ্যে কিছুলোক তোমার দিকে কান পেতে রাখে, কিন্তু আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা তা উপলব্ধি করতে না পারে, আমি তাদেরকে বধির করেছি এবং তারা সমস্ত নিদর্শন দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না, এমনকি তারা যখন তোমার কাছে উপস্থিত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তখন কাফিররা বলে, এটা তো সেকালের উপকথা ছাড়া কিছুই না। তারা অন্যকেও তা শুনতে বিরত রাখে আর নিজেরাও তা থেকে দূরে থাকে, আর তারা নিজেরাই তো শুধু নিজেদেরকে ধ্বংস করে, অথচ তারা উপলব্ধি করে না। তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তাদেরকে আগুনের পার্শ্বে দাঁড় করানো হবে আর তারা বলবে, হায়! যদি আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটতো তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।" (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ২৫-২৭)

মুজিযা যদি হুজ্জত বা প্রমাণই না হয়, তাহলে কিসের ভিত্তিতে উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহে মুজিযা অস্বীকারকারীদেরকে এরূপ তিরস্কার করা হলো ?

(২) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ

"পূর্ববর্তীগণ কর্তৃক নিদর্শন অস্বীকার করাই আমাকে নিদর্শন প্রেরণ করা থেকে বিরত রাখে, আমি শিক্ষাপ্রদ নিদর্শনস্বরূপ সামুদ জাতিকে উস্ট্র দিয়েছিলাম, এরপর তারা তার প্রতি জুলুম করেছিলো, আমি ভীতি প্রদর্শনের জন্যই নিদর্শন প্রেরণ করি।" (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ : ৫৯)

এ আয়াতের সারমর্ম এই যে, আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে মানুষের প্রতি মুজিযা প্রেরণ করেন না। কেননা, মুজিযা প্রকাশের পর মানুষ যদি তা অস্বীকার করে তাহলে তারা আযাবের যোগ্য হয়ে পড়বে। যেমন, অতীতের উম্মতসমূহের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। সুতরাং এটাই এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, মুজিযা নবুওয়াতের হুজ্জত বা প্রমাণ, যার প্রকাশের পর আর কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। এর পরেও কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করলে সে শাস্তিযোগ্য হয়ে যাবে। সুতরাং মুজিযা হুজ্জত না হলে তা অস্বীকার করার প্রেক্ষিতে আযাব অবধারিত হয় কিভাবে ?

(৩) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ

"স্মরণ করো, হাওয়ারীগণ বলেছিলো, হে মরিয়ম-পুত্র ঈসা, আপনার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য পরিপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করতে সক্ষম ? সে বলেছিলো, তোমরা আল্লাহ'কে ভয় করো, যদি তোমরা মুমিন হও। তারা বলেছিলো, আমরা চাই যে, তা থেকে আমরা কিছু খাবো আর আমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করবে, আর আমরা জানতে চাই যে, আপনি আমাদেরকে সত্য বলেছেন আর আমরা তার সাক্ষী থাকতে চাই। মরিয়ম-পুত্র ঈসা বললো, হে আল্লাহ, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য পরিপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন, এটা আমাদের আর পরবর্তী সকলের জন্য হবে আনন্দোৎসবস্বরূপ এবং আপনার নিকট থেকে নিদর্শন, আর আমাদেরকে জীবিকা দান করুন আর আপনিই তো শ্রেষ্ঠ জীবিকাদাতা। আল্লাহ বললেন, আমিই তোমাদের কাছে তা প্রেরণ করবো, কিন্তু এর পর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরি করলে তাকে এমন শাস্তি দিবো, যে শাস্তি বিশ্বজগতের অপর কাউকেও দিবো না।" (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১২-১১৫)

উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, হ্যা, আমি তোমাদের কাঙ্ক্ষিত মুজিযা প্রদান করবো, কিন্তু তা প্রদানের পর কেউ তা অস্বীকার করলে তাকে নজীরবিহীন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। "মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ" - এই অভিমতের সমর্থনে কুরআনের এই আয়াতগুলো অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ।

(৪) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ

"মুসা বললো, আমি তোমার কাছে স্পষ্ট কোন প্রমাণ আনয়ন করলেও? ফিরআউন বললো, তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে তা(প্রমাণ) পেশ করো। এরপর মুসা তার লাঠি নিক্ষেপ করলে তৎক্ষণাৎ তা এক সাক্ষাৎ অজগর হলো। এবং মুসা হাত বের করলো আর তৎক্ষণাৎ তা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র উজ্জ্বল প্রতিভাত হলো। ফিরআউন তার পরিষদবর্গকে বললো, এ তো সুদক্ষ যাদুকর।" (সূরাহ আশ-শুয়ারা, ২৬ : ৩০-৩৪)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালাম'কে প্রদত্ত মুজিযাকে "স্পষ্ট ব্যাপার" (بشيء مبين) তথা প্রমাণ বলে উল্লেখ করেছেন এবং ফিরআউনও সেটিকে তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করার জন্য আহবান করেছে। এরপর মুসা আলাইহিস সালাম তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে তাকে প্রদত্ত মুজিযা পেশ করেছেন।

(৫) নবী ও রাসুলগণকে প্রদত্ত মুজিযা তাদের নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর সত্যতার প্রমাণস্বরূপ - এ কথা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালাম'কে প্রদত্ত দুটো মুজিযা সম্বন্ধে স্পষ্টত বলেছেন। যেমন -

"আরো বলা হলো, তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ করো; এরপর সে যখন সেটাকে সাপের মতো ছুটাছুটি করতে দেখলো তখন পিছনের দিকে ছুটতে লাগলো এবং ফিরিয়ে তাকালো না; তাকে বলা হলো, হে মুসা, সামনে এসো, ভয় করো না, তুমি তো নিরাপদ। তোমার হাত তোমার বগলে রাখো, এটি বের হয়ে আসবে শুভ্র সমুজ্জ্বল নির্দোষ হয়ে; ভয় দূর করার জন্য তোমার হাত দুটো নিজের দিকে চাপিয়ে ধরো; এ দুটো তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত প্রমাণ, ফিরআউন ও তার পরিষদবর্গের জন্য; তারা তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়।" (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮ : ৩১-৩২)

অতএব, কুরআনের এ জাতীয় সুস্পষ্ট প্রমাণ বর্তমান থাকার পর "মুজিযা প্রমাণ না নিদর্শন" - এ বিষয়ে কোনরূপ মতবিরোধ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই।

 

মুজিযার সত্যতা প্রতিষ্ঠা

হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর সূচনাক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী আকাইদ ও মুজিযা সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক কোন বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন গ্রীক দর্শন সম্বলিত গ্রন্থাবলীর আরবী তরজমা মুসলমানদের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করে, তখন এটা ইসলামের ইলমে কালাম তথা আকাইদ তর্কশাস্ত্রের একটি প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে রচিত হয় এবং এ সমস্ত যুক্তি-তর্কের গুরুত্ব এতোই বৃদ্ধি পায় যে, তখন এই গ্রীক দর্শনের কষ্টিপাথরে যাচাই ছাড়া কোন বিষয়ই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতো না।

গ্রীসের অধিবাসীরা আল্লাহ প্রদত্ত শরীআত সম্বন্ধে পরিচিত ছিল না। তারা ছিল পৌত্তলিক। এজন্য তারা নবুওয়াত, নবুওয়াতের বৈশিষ্ট্য, ওহী, ইলহাম ও মুজিযা সম্পর্কেও ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও অপরিচিত। এ কারণে গ্রীক দর্শনে এ সমস্ত বিষয়ের কোন আলোচনাই স্থান পায়নি। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবন রুশদ তার "তাহাফাতুত তাহাফুত" নামক গ্রন্থে বিস্তৃত বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। আল্লামা ইবন তাইমিয়াও নিজ রচনাবলীতে এ প্রসঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন মুসলিম দার্শনিক শায়খ ইয়াকুব আল-কিন্দী। তার পর দার্শনিক ফারাবীও এ সম্পর্কে যথেষ্ট লেখালেখি করেছেন। তিনি মুজিযা সম্পর্কে লিখেছেনঃ নবুওয়াতের অধিকারী সত্তার রূহের মধ্যে এক ধরণের পবিত্র শক্তির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন তোমাদের দেহের মধ্যে তোমাদের প্রানশক্তি রয়েছে এবং তোমাদের দেহ তোমাদের রূহের অনুগত হয়ে থাকে, অনুরূপ সেই পবিত্র শক্তিসম্পন্ন রূহ সার্বিকভাবে বিশ্বের অবয়বধারী বস্তুনিচয়ের মধ্যে ক্রিয়াশীল আছে এবং সমগ্র বিশ্বজগৎ তার প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং এ কারণেই পবিত্র রূহানী শক্তিসম্পন্ন সত্তা থেকে সহজাত স্বভাবের অতীত কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়ে থাকে। এটাই মুজিযা। (দ্রষ্টব্যঃ সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

"যে কোন বস্তুর সহজাত স্বভাবের অতীত কর্মকাণ্ডের নাম মুজিযা" - কথাটির ব্যাখ্যা এই যে, প্রত্যেক বস্তুর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও নিয়মতান্ত্রিকতা আছে, যা তা থেকে কখনো পৃথক হয় না। যেমন, আগুনের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো ভস্মীভূত করা, সমুদ্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো প্রবাহিত থাকা, বৃক্ষের সহজাত স্বভাব হলো স্থির থাকা, পাথরের বৈশিষ্ট্য হলো চলতে না পারা, মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো মৃত্যুর পর পুনরায় দুনিয়াতে জীবিত না হওয়া ইত্যাদি। এখন যদি এমন হয় যে - আগুন ভস্মীভূত করেনি, সমুদ্র স্থির হয়ে রয়েছে ও প্রবাহ নেই, পাথর চলতে শুরু করেছে আর কথা বলতে আরম্ভ করেছে, মৃত জীবিত হয়ে গিয়েছে - তাহলে বলতে হবে যে, এটি পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এটা সেই বস্তুর সহজাত কার্যকরণ সম্পর্কের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, প্রাকৃতিক নিয়মাবলীকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, পৃথিবীর বস্তুনিচয়ের এই সহজাত নিয়মাবলী কি পরিবর্তনযোগ্য? দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের একটি দলের অভিমত এই যে, বস্তুনিচয়ের সহজাত নিয়মতান্ত্রিকতার কোনরূপ পরিবর্তন সম্ভব না। এই ভিত্তিতে তারা মুজিযার অসম্ভাব্যতা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পান। মুসলিম দার্শনিকদের একটি শ্রেণীও এই অভিমত সমর্থন করেছেন। যেমন ফারাবী, ইবন সিনা, ইবন মিসকাওয়ায়হ প্রমুখ। (দ্রষ্টব্যঃ সিরাতুন্নবী ৪খ.)

ইবন তাইমিয়্যা তার"রাদ্দুল মানতিক" নামক গ্রন্থে এবং ইবন হাযম জাহিরী তার "আল ফিসাল ফিল মিলালি ওয়ান নিহাল" নামক গ্রন্থে ফারাবী, ইবন সীনা প্রমুখ দার্শনিকের অভিমতকে পরিত্যাজ্য বলে সাব্যস্ত করেছেন। কারণ "প্রকৃতির সহজাত নিয়মাবলীর পরিবর্তন সম্ভব নয়" কথাটি বাস্তবসম্মত না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কোন প্রাণীর জন্মের প্রাকৃতিক নিয়ম হলো, এক ফোঁটা বীর্য থেকে রক্ত উৎপন্ন হয়, রক্ত থেকে গোশত উৎপন্ন হয়, এরপর পর্যায়ক্রমে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত তা মাতৃ উদরে প্রতিপালিত হয়, ফলে তা পরিণত হয় একটি পূর্ণাঙ্গ দেহাবয়বে। এরপর তা নবজাত শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হয় এবং পর্যায়ক্রমে শিশুরূপ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং পরবর্তীতে সুস্থ, সুডৌল দৈহিক কান্তির অধিকারী একজন শৌর্য-বীর্য সমৃদ্ধ যুবকে রূপান্তরিত হয় এবং তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়।

এই হলো একজন মানুষের জন্মের সহজাত প্রাকৃতিক নিয়ম। এখন এই নিয়ম ভঙ্গ করে অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়সমূহ অতিক্রম করা ছাড়া কারো পক্ষে সুদেহী প্রাণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করাও সম্ভব, মোটেও অসম্ভব না। এ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্য এই যে, এক ফোঁটা বীর্য রক্তে রূপান্তরিত হতে, এরপর গোশতে, এরপর অস্থি-মজ্জায় ও সুডৌল-সুঠাম থেকে অন্তর্বর্তীকালীন যে পর্যায়গুলো অতিক্রম করার আবশ্যকতা রয়েছে, তা যদি কোনভাবে পূরণ করে দেওয়া যায়, তাহলে উক্ত অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়গুলো অতিক্রম করা ছাড়াই এক ফোঁটা বীর্য একটি সুঠাম-সুডৌল দেহে রূপান্তরিত হতে পারে। আধুনিক কালে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে নানান ফসলাদির উৎপাদন বিজ্ঞান প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গের প্রকৃষ্ট উদাহারন নয় কি ?

কিছু দার্শনিক মনে করেন, পৃথিবীর ঘটনাবলী কোন না কোন প্রাকৃতিক কার্যকরণ দ্বারাই সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু সহজাত প্রকৃতির অতীত কর্মকাণ্ডে এই কার্যকারণ অনুপস্থিত। এই ভিত্তিতেও তারা মুজিযা অস্বীকার করার প্রয়াস পান। এর সমাধান এই যে, হ্যা, যাবতীয় ঘটনার পিছনে কোন না কোন কার্যকারণ ক্রিয়াশীল রয়েছে। কিন্তু এটা তো জরুরী নয় যে, সকল ধরণের প্রাকৃতিক কারণসমূহ আমরা আমাদের জ্ঞান ও মনীষা দ্বারা সার্বিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবো ? কিছু কিছু কার্যকারণ এমনও রয়েছে, যা অতিশয় প্রচ্ছন্ন ও সূক্ষ্ম হওয়ার দরুন স্বভাবত মানুষের জ্ঞান ও মনীষা তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। এ পৃথিবীতে অসংখ্য অগণিত সৃষ্টি রয়েছে যার সূক্ষ্ম রহস্যটির যৎসামান্যই মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছে। আবার বহু সংখ্যক এমনও আছে যে, তার কার্যকারণের গুঢ় রহস্য আজও অজানার পর্দার অন্তরালেই রয়ে গেছে। যেমন, নবী-রাসুলগণ চল্লিশ দিন পর্যন্ত একটানা সিয়াম সাধনা করেছেন। এ সময়ের মধ্যে তারা সামান্যতম আহার্য-পানীয় গ্রহণ করেননি। কিন্তু এতেও তাদের শারীরিক শক্তির মধ্যে কোনই পরিবর্তন দেহা দেয় নি। এটা স্পষ্টত আশ্চর্যজনক বিষয়। কিন্তু এ ঘটনাও কার্যকারণ থেকে পৃথক নয়। কেননা, আমরা যদি অনুসন্ধান করি, মানুষের ক্ষুধার তাড়না দেখা দেয় কেন, তাহলে দেখা যাবে যে, মানুষের উদরস্থ হজমশক্তি ভক্ষিত খাদ্যকণাকে পরিপূর্ণরপে হজম করার পর তা থেকে উদ্ভূত রক্ত কনিকাগুলোকে দেহের বিভিন্ন অংশে পৌঁছিয়ে দেয়। তার উদরস্থ হজম শক্তির আর কোন কাজ অবশিষ্ট থাকে না, যার ফলে তার মধ্যে তালাশ করার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠে। এরই ফলে মানুষ ক্ষুধার তাড়না অনুভব করে থাকে।

কিন্তু আমরা চলমান জীবনে এমন অভিজ্ঞতারও সম্মুখীন হই যে, কোন রোগের কারণে অথবা ভয়ভীতির কারণে অথবা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকার কারণে আমাদের দেহে এমন এক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, যার প্রভাবে দীর্ঘ কয়েক দিন পর্যন্ত আমাদের পাকস্থলীর হজমশক্তি লোপ পেয়ে যায়। এর ফলে আমরা ক্ষুধার তাড়না অনুভব করি না। ঠিক একই নীতির ভিত্তিতে যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে আধ্যাত্মিকতার সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং দৈহিক অবস্থার সাথে তার সম্পর্ক শিথিল হয়, এমতাবস্থায়ও তার শারীরিক শক্তির মধ্যে স্থবিরতা বা শক্তিহীনতা দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রেও সে কয়েক দিন পর্যন্ত উপবাস থাকতে পারে।

মোটকথা, আধ্যাত্মিক শক্তির সাথে যখন গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তখন দৈহিক স্বাভাবিক গতিবিধি ও কার্যক্রমের মধ্যে নিস্পৃহ ভাব দেখা দেয়। এই নাজুক লগ্নেও মানুষ দীর্ঘদিন পর্যন্ত উপবাস করে বেঁচে থাকতে পারে। সুতরাং এই সহজাত প্রকৃতির বরখেলাপ কার্যপ্রবাহকে যদি স্বীকার করে নিতে কষ্ট না হয়, তাহলে অতি প্রকৃত আধ্যাত্মিক শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ মুজিযাসমূহকে অস্বীকার করার কোনই কারণ থাকতে পারে না। (সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

বস্তুত কার্যকারণ সম্পর্কের উপর সর্বাঙ্গীণ অভিজ্ঞতা মানুষের নেই। মানুষ যা কিছু জানার সুযোগ লাভ করেছে, তার তুলনা বিশাল সমুদ্রের এক ফোঁটা পানি অথবা তা থেকেও স্বল্প ও ক্ষীণ। উপরন্তু মানুষ যা কিছু জানার ও অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছে, তাও পৃথিবীর কিছু বস্তুর চলমান গতি-প্রকৃতির সামান্য নিরীক্ষা মাত্র। তার হাকিকতও প্রকৃত জ্ঞান নয়। মানুষ জ্ঞানের এই সীমানায় পৌঁছতে অক্ষম যে, বস্তুটি কেন চলছে আর যদি বস্তুটি বিপরীত দিকে চলতো তাহলে কি কি অসামঞ্জস্য প্রকাশ পেতো ? এ কারণেই পৃথিবীর স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিকগণ একবাক্যে এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তারা কেমন প্রশ্নটির উত্তর দিতে সক্ষম, কিন্তু কেন প্রশ্নটির যথার্থ উত্তর দেওয়া তাদের আলোচ্য বিষয়ের বাইরে। উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, পানি কেমন ? এর উত্তর বৈজ্ঞানিকগণ তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পানি কেমন ? এই প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারেননি, এমনকি এই প্রশ্নের আলোচনাও তারা করেননি।

প্রকৃত সত্য এই যে, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণ কার্যকারণ সম্বন্ধে যে মতাদর্শ দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরেছেন, বস্তুত এটির পরিণতি অজ্ঞতা ও বুদ্ধিহীনতা বৈ কিছু নয়। কারণ তাদের বিশ্বাস যে, এই বস্তুটি এই কার্যকারণ ও উপাদানে সৃষ্টি হয়েছে। এটি ছাড়া এই বস্তুটি অস্তিত্বে আসতেই পারে না। যেমন বীর্য থেকে প্রাণের উৎপত্তি, ডিম থেকে পাখির উৎপত্তি, উদ্ভিদের উৎস বীজ, তাদের বিশ্বাসের এই সমস্ত উপাদান ছাড়া এসব বস্তু অস্তিত্বে আসার কথা কল্পনাও করা যায় না। এখানে আমাদের প্রশ্ন যে, দুনিয়ার প্রথম প্রাণী, প্রথম পাখি এবং প্রথম উদ্ভিদ কি বীর্য, ডিম ও বীজ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে ? এর উত্তরে যদি তারা "হ্যা" বলেন, তাহলে তো তারা নিজেদের দাবী ও মতাদর্শের বিপরীত সাক্ষ্য প্রদান করবেন। আর যদি এটা অস্বীকার করেন, তাহলে এ কথাও তাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে, প্রথম বীর্য, প্রথম ডিম ও প্রথম বীজ, প্রাণী, পাখী, উদ্ভিদ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে।

মোটকথা, এই লক্ষ্যমাত্রাকে কখনো বিজ্ঞান তার বুদ্ধির শাণিত অস্ত্র দ্বারা নির্মূল করতে পারবে না। এমতাবস্থায় কার্যকারণ সম্পর্কিত কিছু দর্শন ও মতাদর্শ তাদেরকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। পাশাপাশি তাদেরকে এ কথারও স্বীকৃতি দিতে হবে যে, এক মহাশক্তিমান ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব অবশ্যই বর্তমান রয়েছে, যার ইচ্ছা ও নির্দেশে বিশ্বজগতের এই কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। উপরন্তু তাকে এ কথাও মেনে নিতে হবে যে, কার্যকারণ সম্পর্কে সেই মহান শক্তিমান সত্তার ইচ্ছা এবং নির্দেশ বিকাশের বাহ্যিক দৃষ্টান্ত ছাড়া অতিরিক্ত আর কিছু না। বস্তুত কার্যকারণও তার সার্বভৌম ইচ্ছার অধীন। পবিত্র কুরআনে এ কথাই বিবৃত হয়েছেঃ

"....... জেনে রাখো, সৃজন ও আদেশ তারই; মহিমাময় বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ।" (সূরাহ আল-আরাফ, ৭: ৫৪)

সুতরাং বিশ্বজগতের সবকিছুর পিছনে আল্লাহ'র কুদরত এবং তার ইচ্ছাই হলো মূল কারণ।

আল্লামা রুমী বলেছেন, বাহ্যিক কারণসমূহের উপর হাকীকী ও মৌলিক কারণসমূহের নিয়ন্ত্রাণাধিকার থাকে। সুতরাং হে দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ, তোমরা বাহ্যিক কারণসমূহ দেখে অভিভূত হয়ো না, বরং হাকীকী ও মৌলিক কারণসমূহ সম্পর্কেও গভীর চিন্তা-গবেষণা করো। কেননা, নবীগণ বাহ্যিক কারণ ও উপাদান সম্পর্ককে পরিহার করে নিজেদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান এবং আল্লাহ প্রদত্ত মুজিযা ও অলৌকিক শক্তির ঝাণ্ডা সর্বত্র সমুন্নত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তাই দেখা যায়, কোন কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়াই তারা গহীন সমুদ্রকে দ্বিধাবিভক্ত করে নিজেদের চলার পথ রচনা করেন এবং কৃষিক্ষেত-খামার ছাড়াই গম ও যবের ফসল লাভ করেন। এমনকি পবিত্র কুরআনে যে দিকনির্দেশনা মূর্ত হয়ে উঠেছে, তাও এই যে, কার্যকারণ সম্পর্ক শক্তিহীন ও নিষ্ক্রিয়। এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে বিজয়ী হয়েছেন এবং তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পার্শ্বে আবু জাহল হয়েছে ধ্বংস। এভাবে ক্ষুদ্র আবাবিল পাখীর প্রস্তর খণ্ডে আবিসিনিয়ার হস্তিবাহিনী হয়েছে পর্যুদস্ত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তর কণা আবাবীলের চঞ্চু থেকে নিক্ষিপ্ত হতো হস্তিবাহিনীর উপর, ফলে দীর্ণ-বিদীর্ণ এবং ঝাঁজরা করে দিতো চর্বিত তৃণলতার মতো।

মোটের উপর পবিত্র কুরআনে আগাগোড়া এ কথাই তুলে ধরা হয়েছে যে, কার্যকারণ সম্পর্কিত চলমান দুনিয়ার বাহ্যিক কারণের মধ্যে কোনই মৌলিক ক্ষমতা ও শক্তি নেই। মূল কার্যকারণের নিয়ন্ত্রণকারী মহান আল্লাহ নিজ ইচ্ছানুসারে বাহ্যিক কার্যকারণের মধ্যে কখনো কখনো কার্যকরী শক্তি ও ক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়ে থাকেন। তথাপি এই বিকাশ কারণসম্ভুত নয়, বরং আল্লাহ প্রদত্ত গুণাবলীর বাহ্যিক প্রতিফলন মাত্র। (মসনবী)

এ পর্যন্ত আমরা যা কিছু আলোচনা করেছি তার সারমর্ম এই যে, সহজাত স্বভাবকে এবং কার্যকারণ সম্পর্কের নিয়মতান্ত্রিকতাকে সর্বতোভাবে পরাজিত করা নাম হচ্ছে মুজিযা, যা মহান আল্লাহ নিজ মনোনীত পয়গাম্বরের সত্যতার প্রমাণস্বরূপ মানুষের সম্মুখে প্রকাশ করে থাকেন। দ্বিতীয় কথা এই যে, সহজাত স্বভাবের বিপরীত কোন কিছু সংঘটিত হওয়া এবং কার্যকারণ সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, কোন বিষয়ের জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাব্যতা তার কার্যত সংঘটিত হওয়ার দলীল বহন করে না, বরং কোন বিষয়ের কার্যত সংঘটিত হওয়াকে কবুল করার জন্য নিন্মোক্ত শর্তাবলীর উপস্থিতি অপরিহার্য -

(১) বর্ণনাকারীর সন্দেহাতীত প্রত্যক্ষ করা এবং গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া;

(২) বর্ণনাকারীর সত্যবাদী হওয়া এবং তার স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ম হওয়া, তার মধ্যে প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার প্রবণতা না থাকা;

(৩) বর্ণনাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমগুণ সম্পন্ন বর্ণনাকারীদের দ্বারা বিবৃত হওয়া;

(৪) উপরন্তু এই প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ অবিচ্ছিন্ন ধারায় সকল যুগের নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সূত্র-পরম্পরায় সংরক্ষিত হয়ে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছা।

এখন উল্লিখিত নীতি ও মানদণ্ডের আলোকে আমাদের দেখতে হবে যে, হাদিস, ইতিহাস ধর্মীয় কিতাবাদিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সমস্ত মুজিযার বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে, তাতে উপরোক্ত শর্তানুসারে দলীল-প্রমাণ ও সাক্ষ্য পাওয়া যায় কিনা ?

আমাদের উসুলে হাদিসে প্রত্যেকটি রিওয়ায়াত গ্রহণ করার জন্য উপরে উল্লিখিত নীতিসমূহকে পূর্বশর্তরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযাত সম্পর্কে যে সকল সাহাবী প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য প্রদান করেছেন, তাদের সত্যবাদিতা, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা, স্মরণশক্তি ও সুষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণী প্রতিভার প্রমাণ সর্বজন স্বীকৃত। তাদের কাছ থেকে পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত মুহাদ্দিসীনে কেরাম উক্ত বর্ণনাসমূহ নকল করেছেন তাদের সত্যবাদিতা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ ধীশক্তির কথা আসমাউর রিজাল এর কিতাবসমূহে বিস্তারিতভাবে সুসংরক্ষিত রয়েছে। উপরন্তু তাদের সামনে সর্বদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই সতর্ক হুঁশিয়ারি বারবার ঝংকৃত হতো -

"যে ব্যক্তি আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তার ঠিকানা হবে দোযখ।" (মুসলিম, ১খ.)

এ কারণে তারা যখনই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পর্কিত কোন বক্তব্য রিওয়ায়াত করতেন, তখন পরিপূর্ণ মানবিক সচেতনতা এবং বিশেষ বিবেচনার সাথে তা বর্ণনা করতেন। তবে যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে সকলের সচেতনতা ও স্মৃতিশক্তি সমান নয়, সেহেতু সার্বিক সতর্কতা আর মনোনিবেশের পরও সকলের বর্ণনা একই মূল্যমানের হওয়া সম্ভব ছিল না। এ কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পর্কিত মুজিযার বর্ণনাসমূহ নির্ভরযোগ্যতার মাত্রা বা স্তর বিবেচনায় কম-বেশী হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো, কিন্তু আমাদের সচেতন মুহাদ্দিসীনে কেরাম অক্লান্ত পরিশ্রম ও পরিপূর্ণ আমানতদারির সাথে নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুর্বল বর্ণনাসমূহকে সহিহ বর্ণনাসমূহ থেকে পৃথক করতে সক্ষম হয়েছেন এবং এই মানদন্ডের দ্বারা সত্যতা ও যথার্থতা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

সারকথা এই যে, মুজিযার সত্যতা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ বিদ্যমান থাকা একান্ত জরুরী। সহিহ মুজিযাতই পরবর্তী সাক্ষ্য-প্রমাণ সম্বলিত রিওয়ায়াতসমূহ এতোই মজবুত ও সুদৃঢ় যে, দুনিয়ার কোন বর্ণনা তার মুকাবিলা করতে সক্ষম না। এর ফলে মুজিযার অকাট্যতা আর সহজাত প্রকৃতির বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বাস্তবতাকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না।

 

মুজিযা ও কারামাতের মধ্যে পার্থক্য

মুজিযা নিয়ে আলোচনা পূর্বেই হয়ে গেছে। এখন কারামাত বলতে কি বুঝায় এবং মুজিযা ও কারামাতের পার্থক্য তুলে ধরা হবে।

كرامة (কারামাত) শব্দটি كرم ধাতুমূল থেকে গঠিত হয়েছে। এর অর্থ - উদার, দয়ালু, সম্মানিত হওয়া। আল্লাহ পাকের অসংখ্য গুণবাচক নামের মধ্যে "কারীম" একটি গুণবাচক নাম। আল-কুরআনে এটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ পাক সেখানে আল-কারীম (الكريم) অর্থাৎ উদার বা দয়ালু নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। তবে কারামাত বলতে যা বুঝায়, আল-কুরআনে উল্লিখিত আল-কারীম শব্দ তা বুঝায় না।

কারামাত (كرامة) শব্দটির বহুবচন কারামাত (كرامات)। ধর্মীয় পরিভাষায় এর অর্থ - আল্লাহ'র দেওয়া দান, যা সম্পূর্ণ মুক্ত, অবারিত অনুগ্রহ (ইহসান বা ইনআম)। তবে যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে এভাবে যে, আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহপূর্বক তার প্রিয়জনদেরকে অলৌকিক ঘটনা সম্পাদন করার যোগ্যতা প্রদান করে থাকেন। আর তারাও আল্লাহ পাকের অনুকম্পাসিক্ত হয়ে অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ করেন। এটিই কারামাত নামে অভিহিত। এ সমস্ত ঘটনা সাধারণত বস্তুজগতে সংঘটিত বিস্ময়কর ঘটনার সমন্বয়ে ঘটিত নতুবা ভবিষ্যতের কোন পূর্ব সংকেতস্বরূপ অথবা আধ্যাত্মিক বিষয়ের কোন ব্যাখ্যাস্বরূপ। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ৭ম খ.)

মুজিযা ও কারামাতের সংজ্ঞা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, মুজিযা ও কারামাতের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তবে আউলিয়ায়ে কিরামগণের দ্বারা কারামাত প্রকাশ পাওয়া আদৌ সঠিক কিনা, সে ব্যাপারে আলিমগণ মতভেদ করেছেন।

মুতাযিলি মতবাদঃ অধিকাংশ মুতাযিলি সম্প্রদায় কারামাতের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। তাদের প্রসিদ্ধ যুক্তি, যা আল-কুরআনের সুপ্রসিদ্ধ ভাষ্যকার জারুল্লাহ যামাখশারী কর্তৃক ৭২ : ২৬-২৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন-

"তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনি তার অদৃশ্যের জ্ঞান কারো কাছে প্রকাশ করেন না; - তার মনোনীত রাসুল ব্যতীত, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ রাসুলের অগ্রে ও পশ্চাতে প্রহরী নিয়োজিত করেন।" (সূরাহ আল-জিন্ন, ৭২ : ২৬-২৭)

আল-কুরআনের এ আয়াত থেকে যামাখশারী বুঝাতে চান যে, আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত নবীগণের মিশনের সত্যতা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের দ্বারা প্রকাশ্যভাবে বিভিন্ন রকমের অলৌকিক ব্যাপার প্রকাশ করেন, কিন্তু অন্য সকল অতি-প্রাকৃত ঘটনা তিনি সৃষ্টির অগোচরে সম্পন্ন করেন। আল জুব্বাঈ বলেন, ওয়ালীগণ যদি এই ক্ষমতার অধিকারী হোন তাহলে কিভাবে তাদেরকে নবীগণ থেকে পৃথক করা যাবে ?

এভাবে মুতাযিলি সম্প্রদায় কারামাতের যথার্থতা অস্বীকারের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন।

দার্শনিকগণের অভিমতঃ দার্শনিক ইবনে সীনার দৃষ্টান্ত থেকে কারামাতের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তার সৃষ্টিতত্ত্ব "অপরিহার্য ও আত্মসচেতন ইচ্ছাসম্পন্ন" উদ্ভবের অস্তিত্বমূলক অদৃষ্টবাদের মধ্যে মুজিযাত ও কারামাতকে তিনি স্থান দিয়েছেন। নবীগণ তাদের মানবীয় প্রকৃতির পরিপূর্ণতা ও বাহ্যিক বস্তুনিচয়ের উপর প্রকৃতিগত আত্মিক প্রভাবেই মুজিযা দ্বারা তাদের আগমনকে সুনিশ্চিত করে থাকেন। উল্লেখ্য যে, ইবন রুশদ তার "তাহাফুতুত তাহাফুত" গ্রন্থে (সম্পা. Bouyes, 515) একটি পার্থক্য উল্লেখ করেছেন। তা হলো, যার মধ্যে গুনগত পার্থক্য নিহিত শুধু সেগুলোই অলৌকিক ঘটনা। কারণ সাধারণ মানুষের পক্ষে তা অসম্ভব হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সম্ভব। তার রিসালা ফি আকসামিল উলুম গ্রন্থে (তিসউর রাসাইলের অন্তর্ভুক্ত, কায়রো সংস্করণ, ১৩২৬/১৯০৪) ইবনে সিনা বলেন, কারামাত প্রকৃতিগতভাবে মুজিযার সমার্থক। তার ইশারাত গ্রন্থে (সম্পা. Foger Leiden, ১৮২০ খৃ.) তিনি এ কথা সমর্থন করেন যে, আধ্যাত্মিক গভীরতার কল্যাণে যার আত্মা জাগতিক বস্তুর উপর প্রভাবশীল এবং যিনি এই প্রভাব কল্যাণকর ও নীতিসিদ্ধ পন্থায় ব্যবহার করেন, যদি তিনি নবী হোন তাহলে আল্লাহ'র দান হিসেবে তিনি তা লাভ করেন, সেটিই মুজিযা। আর যদি তিনি ওলী হোন, তাহলে তিনি কারামাতের সৌভাগ্য অর্জন করেন। নবীগণ নবুওয়াতপ্রাপ্ত হোন আল্লাহ'র প্রতি তাদের প্রকৃতিগত সহজাত প্রবৃত্তি, প্রজ্ঞার ত্রিবিধ পরিপূর্ণতা, চিন্তাশক্তি ও কঠোর সত্যনিষ্ঠার মাধ্যমে, যদিও সেই সাধনা বা মুজিযা নিন্ম মানের হয়। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ৭ম খ.)

আশআরী সম্প্রদায়ের জবাবঃ ধারণা করা হয়, কিছু সংখ্যক আশআরী, যেমন - আল ইসফারাইনী, আল হালিমী প্রমুখ কারামাত প্রসঙ্গে মুতাযিলি সম্প্রদায়ের জোরালো মতামত বা বিচার-বিবেচনাকে সমর্থন করে। তবে আশআরী সম্প্রদায়ের সাধারণ মতবাদের যথার্থতা নিন্মে বর্ণিত যুক্তির ভিত্তিতে স্বীকৃত -

(ক) বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাব্যতাঃ কোন নবীর নৈতিক পরিপূর্ণতার নিদর্শন কোন অলৌকিক ঘটনা বা মুজিযা অহেতুক না, বরং তা আল্লাহ পাকের সদিচ্ছা বা কার্যকর ইচ্ছা। তিনি তার সেই ইচ্ছাকে একজন নবীর মাধ্যমে সম্পাদন করে থাকেন। সেই অলৌকিক কাজটি সম্পাদিত হয় কোন ঘোষণা বা চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায়। সুতরাং আল্লাহ পাকের পক্ষে কোন বিজ্ঞপ্তি বা চ্যালেঞ্জ ছাড়াই কোন সাধকের মাধ্যমে অতি প্রাকৃত কোন ঘটনা ঘটানো বৈধ বা জায়েজ।

(খ) আল-কুরআনের সমর্থনঃ এমন কতগুলো ঘটনার অস্তিত্ব দিবালোকের মতো দেদীপ্যমান ও যথার্থ বলে প্রমাণিত, কুরআন মাজিদে যা উল্লেখ হয়েছে, যার ধারকগণ কোন নবুওয়াতের দাবীদার ছিলেন না, যেমন -

"..... যখনই যাকারিয়া কক্ষে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতো, তখনই তার কাছে খাদ্য-সামগ্রী দেখতে পেতো; সে বলতো, এসব তুমি কোথায় পেলে ? সে বলতো, তা আল্লাহ'র কাছ থেকে, নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন।" (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ৩৭)

সন্দেহাতীতরূপে ঘটনাটি ছিল বিস্ময়কর, অলৌকিক। ঈসা আলাইহিস সালামের মা মারিয়াম নিজে কোন নবী ছিলেন না, নবুওয়াতের দাবীদারও ছিলেন না, অথচ তার কাছে পাওয়া যেতো অসম মৌসুমে মৌসুমী ফল। আরো উল্লেখ হয়েছে-

"তুমি কি মনে করো যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ?" (সূরাহ আল-কাহফ, ১৮ : ৯)

যারা একটি পার্বত্য গুহাতে একাধারে তিনশত বছর ঘুমন্ত ছিলেন, তারা নবী-রাসুল নন, অথচ এ সকল ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘটনা আল্লাহ'র পক্ষ থেকে অলৌকিক নিদর্শন। আরো উল্লেখ পাওয়া যায় -

"কিতাবের জ্ঞান যার ছিলো, সে বললো, আপনি চোখের পলক ফেলার আগেই আমি তা আপনাকে এনে দিবো; সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত অবস্থায় দেখলেন তখন বললেন, এটি আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ ...." (সূরাহ আন-নামল, ২৭ : ৪০)

ঘটনাটি ঘটেছিলো সুলায়মান আলাইহিস সালামের আদেশে হয় একজন জিন্ন বা কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির মাধ্যমে (নোটঃ তাফসীরে ইবনে কাসিরে এই ব্যক্তির মানুষ হওয়ার পক্ষেই মত দেখা যায়, বিস্তারিত দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসিরে এই আয়াতের তাফসীরে), যারা কোন নবী ছিলেন না যিনি চোখের পলকে রানী বিলকিসের বিরাট সিংহাসন এনেছিলেন অনেক দূর থেকে।

সুতরাং কারামাত সম্ভব, তাবে তাকে মুজিযার সাথে সংযুক্ত করা কোনক্রমেই সঙ্গত হবে না। আল্লাহ মুজিযা প্রকাশ করেন নবীগণের মিশনের প্রমাণস্বরূপ, আর কারামাতকে প্রকাশ করেন ওলীগণকে সম্মানিত ও তাদের ধর্মনিষ্ঠা ও তাকওয়া সংরক্ষণ মানসে। মুজিযাত সকল মানুসের সামনে প্রকাশ করা উচিৎ, তবে কারামাত গোপন করাই বিধেয়। সর্বদা দুটোর মধ্যে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পার্থক্য বজায় রাখা কর্তব্য। জেনে রাখতে হবে, যাবতীয় ঐন্দ্রজালিক বিদ্যা এটা থেকে ভিন্নতর। উল্লেখ্য যে, আশআরী মতবাদ আরো বিধৃত হয়েছে - ইবন খালদুন, মুকাদ্দিমা, অনু ৬খ. ; DE Slane, ১খ. , ৪৩খ. ; অনু. Rosenthal, ১খ. , ৯১খ. গ্রন্থসমূহে।

(গ) সূফী মনস্তত্ত্ব কর্তৃক স্বীকৃতঃ ওলীগণের কারামাত সূফী দার্শনিকগণ কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। সুন্নী সূফী বিদ্যায় পারদর্শীগণ কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা সাধারণভাবে আশআরী মতবাদের খুবই নিকটবর্তী। এই মতবাদে কারামাত ও মুজিযার পার্থক্যের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কোন ওলী-দরবেশ বিস্ময়কর কার্যাবলী সম্পাদন করলে তিনি সে কারণে নবী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন না। তিনি তদানীন্তন রাসুল কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মীয় আইনের অনুশাসন মানতে বাধ্য থাকেন।

কারামাত কখনো মুজিযার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না, বরং মুজিযার পৃষ্ঠপোষকতা করে। মনে রাখতে হবে যে, ওলীগণের কারামাত সেই নবীর মুজিযার প্রমাণ, যে নবীর তিনি উম্মত। সে কারণে মুজিযা নবীর সত্যতার প্রতীক। আমরা দেখতে পাই, খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে অবিশ্বাসীরা যখন মক্কাতে শূলীতে দেয়, তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক দূরে মদিনার মসজিদে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহচরবৃন্দ পরিবেষ্টিত অবস্থায় উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তর্দৃষ্টিতে দেখলেন খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু'র উপর জুলুম-অত্যাচারের করুণ অবস্থা। সহচরবৃন্দকে তা সবিস্তারে অবহিত করেন। অপরদিকে আল্লাহ পাক খুবাইবের অন্তরায় দূরীভূত করেন। তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দর্শন লাভ করেন, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাম পেশ করেন, তিনিও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালামের জবাব দেন, খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু সালামের জবাব শুনতে পান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য দুয়া করেন। মক্কা-মদিনার মধ্যে দূরত্ব ছিল বিস্তর। তবুও তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ, সালাম আদান-প্রদান সুনিশ্চিতরূপে অস্বাভাবিক ব্যাপার। এটি খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু'র জন্য ছিল কারামাত আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ছিল মুজিযা। (দাতা গনজে বখশ, কাশফুল মাহজুব)

 

ইসতিদরাজ

ইসতিদরাজ শব্দটি সাধিত হয়েছে "দারজ" ধাতুমূল থেকে। ইসতিদরাজ অর্থ ধোঁকা দেওয়া, প্রতারণা করা। আবার ইসতিদরাজ অর্থ শনৈঃ শনৈঃ নিকটবর্তী হওয়া। বলা হয়, ইসতাদরাজাল্লাহুল আবদা, অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা ধীর গতিতে বান্দার নিকটবর্তী হলেন। এর অর্থ, বান্দা যখন নিত্য-নতুন পাপ কর্মে লিপ্ত হয়, আল্লাহ'ও তখন নতুন নতুন নিয়ামতরাশি দিয়ে তাকে পরিতুষ্ট করেন, তাকে ভুলিয়ে দেন ক্ষমা প্রার্থনা করতে। যেমন, আল্লাহ বলেছেন -

"আর যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা অভিহিত করেছে, আমি অচিরেই তাদেরকে আস্তে আস্তে এমনভাবে পাকড়াও করবো যে, তারা বুঝতেই পারবে না।" (সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ১৮২)

এ কারণেই উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু'র সামনে যখন বাদশাহ কিসরার ধনভাণ্ডার আনা হলো, তখন তিনি আল্লাহ'র কাছে দুয়া করেছিলেন - ইয়া আল্লাহ, ইসতিদরাজকারী হওয়া থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি; যেহেতু আমি আপনার ঘোষণা শুনেছি যে আপনি বলেছেন, "আমি অচিরেই তাদেরকে আস্তে আস্তে এমনভাবে পাকড়াও করবো যে, তারা বুঝতেই পারবে না"।(আল-যাবীদী, তাজুল আরুস, ৫খ.)

ধোঁকা ও প্রবঞ্চনার দ্বারা মানুষকে ধীরে ধীরে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার প্রক্রিয়াকে আরবী পরিভাষায় ইসতিদরাজ বলে। সিহর, যাদু, ইন্দ্রজাল, সম্মোহন, ভেল্কীবাজি, নজরবন্দী ইত্যাদি পরিভাষাগত ইসতিদরাজ। যাদুকররা সম্মোহন বা ইন্দ্রজালের দ্বারা মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে। আস্তে আস্তে মানুষ তাদের খপ্পরে পড়ে।

অস্বাভাবিক কার্যকলাপ দিয়ে মানুষকে প্রতারণা করে। ফলে এটিও অলৌকিক মুজিযা বা কারামাতের পর্যায়ে বিবেচিত হয়, তবে এটি শরীআত সমর্থিত না।

মুফতি মুহাম্মাদ ইউসুফ বলেন, যে অস্বাভাবিক ক্রিয়া-কর্ম কোন ফাসিক পাপী বিধর্মী কাফির থেকে প্রকাশ পায়, তাকে প্রতারণা বা ইসতিদরাজ বলে। একজন ফাসিক ফাজির থেকে এ রকম অলৌকিক কাজ প্রকাশ পাওয়া একটি ফিতনা আর মানুষের জন্য মহাপরীক্ষা। (মুফতি মুহাম্মাদ ইউসুফ, যাওয়াহিরুল ফারাইদ)

মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজের মধ্যে পার্থক্য - কারামাত শব্দের ভাবার্থ মুজিযা থেকে ভিন্নতর। তবে বিষয় দুটোই বস্তুর স্বাভাবিক নিয়মকানুন ভঙ্গের সাথে জড়িত। তা একটি বিস্ময়কর ঘটনা যা আল্লাহ'র নিয়ম-কানুনের (সুন্নাতুল্লাহ) স্বাভাবিক ধারাকে লঙ্ঘন করে। তা যদি নবী-রাসুলের মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাহলে মুজিযা, আর যদি কোন ওলীর মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাহলে কারামাত বলে অভিহিত হয়।

আল্লামা জুরজানী বলেন, "নবী নন - এমন কোন মুসলিম ব্যক্তি থেকে যদি অস্বাভাবিক কিছু প্রকাশ পায় তাহলে তা কারামাত। আর প্রকাশিত বিষয় যদি ঈমান ও পুণ্য কর্মের সহায়ক না হয়, তবে তা ইন্দ্রজাল। আর যদি অনুরূপ ঘটনা প্রকৃতই নবুওয়াতের দাবীদার থেকে প্রকাশ পায় তাহলে তা মুজিযা বলে অভিহিত।" (কিতাবুত তারীফাত)

আল্লামা শাব্বির আহমাদ বলেন, মুজিযা এবং কারামাত দুটোই সুসম্পন্ন হয় আল্লাহ'র পক্ষ থেকে। মুজিযা একজন নবী থেকে আর কারামাত একজন ওলী থেকে প্রকাশ পায়। এ দুটোই শিক্ষন-প্রশিক্ষণের ঊর্ধ্বে। দুটোরই কারণ একমাত্র আল্লাহ।

আল্লাহ'র অন্যান্য ক্রিয়াকর্মের মতো মুজিযাও একটি কর্ম যা সাধারণ নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে। তিনি তার ইচ্ছার অধীন মুজিযাকে কার্যকর করে থাকেন। পক্ষান্তরে যাদু বা ইন্দ্রজাল এমনই একটি বিষয়, যার জন্য যথারীতি শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। যে কেউ এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে তার দ্বারাই বিস্ময়কর ও আশ্চর্যজনক কার্যাদি প্রকাশিত হবে। অথচ মুজিযা শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে কোন শিক্ষাসার বা পাঠ্যসূচি, কোন নীতিমালা রচিত হয়নি। পক্ষান্তরে ইন্দ্রজাল বা সম্মোহন বিদ্যা শিক্ষার জন্য বই-পুস্তক রচিত হয়েছে, যার অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকদের দিয়ে রচিত। আজ যদি প্রতিদিন কেউ ঈসা আলাইহিস সালামের কথা"আল্লাহ'র হুকুমে উঠে দাঁড়াও" হাজারবারও মুখে আওড়ায়, তবুও কোন মৃত উঠে দাঁড়াবে না। মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি দিয়ে মাটিতে লক্ষবার আঘাত করলে বা মাটিতে নিক্ষেপ করলেও কোনরূপ মুজিযাই প্রকাশ পাবে না - না সাপে পরিণত হবে, না পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হবে। কারণ শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের দ্বারা মুজিযাকে আয়ত্ত করা যায় না।

মুজিযা প্রদর্শনকারী নবী মুজিযা প্রকাশ হওয়ার পূর্বে তার রূপ-প্রকৃতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেন না। পক্ষান্তরে, যাদুকর তার যাদুর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত থাকে। মুজিযার জন্য কোন সময়ও নির্ধারিত থাকে না। পক্ষান্তরে যাদু নির্দিষ্ট স্থান ও কালের মুখাপেক্ষী। মুসা আলাইহিস সালামের প্রতিদ্বন্দ্বী ফিরআউনের যাদুকররা রশির উপর মন্ত্র পাঠ করার আগেই জানতো যে, রশিতে মন্ত্র পড়ে ছেড়ে দিলে তা সাপে পরিণত হবে। এ কারণেই যাদুর প্রতিক্রিয়াতে সাপ দেখার পরও তাদের মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, বরং তাদের যাদুর প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনে দর্শকদের কাছ থেকে তারা বাহবা লুটছিল, আনন্দে বিভোর ছিল।

অপরদিকে, লাঠি নিক্ষেপের জন্য মুসা আলাইহিস সালামের উপর আদেশ হলে তিনি লাঠি নিক্ষেপ করলেন, সাথে সাথে তা পরিণত হলো একটি বিরাট অজগর সাপে, যা দেখে মুসা আলাইহিস সালাম ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। এরপর প্রত্যাদেশ হলো - হে মুসা, তা ধারণ করো, ভীত হয়ো না, আমি তাকে পূর্বাকৃতিতে পরিবর্তিত করবো। তার ভীত সন্ত্রস্ত হওয়ার কারণ একটিই ছিল যে, তিনি আগে থেকে জানতেন না যে, লাঠি ছেড়ে দিলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে। সুতরাং মুজিযার রূপ-প্রকৃতি সম্পর্কে আল্লাহ পাকই সর্বজ্ঞ।

যাদুবিদ্যায় শয়তান অংশগ্রহণ করে। এ কারণেই একজন অভিজ্ঞ যাদুকর অশ্লীলতার শিরোমনী সর্বশ্রেষ্ঠ দাজ্জাল। আর মুজিযার শিরোমনী খতমে নবুওয়াত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সুতরাং এই দুটো কল্যাণ ও অকল্যাণ, আলো ও আঁধারকে এই নশ্বর জগতে জড়াজড়ি করে রাখা একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা।

 

মুজিযা ও ইসতিদরাজের মধ্যে পার্থক্য

পূর্ববর্তী আলোচনায় মুজিযার সংজ্ঞা, স্বরূপ ও তাৎপর্য এবং ইসতিদরাজের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতেই মুজিযা ও ইসতিদরাজ এবং নবী ও যাদুকরের মধ্যে তারতম্য সুস্পষ্ট রূপে বিশ্লেষিত হয়েছে। যাদু, সম্মোহন বা ভেল্কিবাজি শুধু হাসি-কৌতুকের সাময়িক প্রহসন মাত্র। পক্ষান্তরে মুজিযা বা নিদর্শন হলো বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সংস্কার ও ধ্বংস, নির্মাণ ও বিনষ্ট, উন্নতি ও অবনতির উপায় উপাদান। যাদুকরের উদ্দেশ্য থাকে, যাদুর প্রহসন দ্বারা কোন অসাধারণ ঘটনাকে শুধু বিস্ময়কর পদ্ধতিতে প্রতিহত করা, যাতে সে কিছুক্ষণের জন্য দর্শকমণ্ডলীকে বিস্ময়াভিভূত করে দিতে পারে। পক্ষান্তরে একজন নবীর উদ্দেশ্য থাকে সেই বিস্ময়কর নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে বিশ্বজোড়া সংস্কার সাধন, জাতিকে চিরসত্যের পথে আহবান, গোত্রসমূহকে কৃষ্টি ও ঐতিহ্য ঐশ্বর্যশালী হওয়ার শিক্ষাদান ও আল্লাহ'র দ্বীনকে সুদৃঢ় করা। নবী-রাসুলগণ হলেন সুসংবাদদাতা, ভীতি প্রদর্শনকারী, পূত-পবিত্রকারী, উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা ও বিশ্ববাসীর সাক্ষ্যদাতা। আর যাদুকর এ সকল গুণের দিক থেকে সম্পূর্ণ রূপে বঞ্চিত।

পবিত্র কুরআনে যাদুমন্ত্র সম্পর্কে যা আলোচিত হয়েছে তাতে স্পষ্ট বুঝা যায় আল-কুরআন যাদু-মন্ত্রের অস্তিত্ব বা প্রতিক্রিয়াকে স্বীকার করে, কিন্তু তা অনুমোদন বা সমর্থন করে না। একটি ধাঁধা বা সম্মোহন ব্যতীত তার কোন গুরুত্বই দেয় না। লক্ষ্য করা যায়, হারুত-মারুত ঘটনায় যাদুর শক্তি ও ক্ষমতার সীমা সম্পর্কে বলা হয়েছে -

"..... তারা উভয়ের (হারুত-মারুত) কাছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে তা শিক্ষা করতো, অথচ আল্লাহ'র নির্দেশ ছাড়া তারা কারো কোন ক্ষতিসাধন করতে পারতো না, তারা যা শিক্ষা করতো তা তাদের ক্ষতিসাধন করতো, কোন উপকারে আসতো না ...... " (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১০২)

"..... তাদের যাদুর প্রভাবে অকস্মাৎ তার (মুসার) মনে হলো তাদের দড়ি ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে।" (সূরাহ তো-হা, ২০: ৬৬)

মুসা আলাইহিস সালামের সামনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী যাদুকররা প্রথমে তাদের যাদু দেখালে এরকম ঘটনা ঘটেছিলো। এরপর আল্লাহ'র পক্ষ থেকে মুসা আলাইহিস সালামের প্রতি প্রত্যাদেশ হলো -

"আমি বললাম, ভয় করো না, তুমিই প্রবল। তোমার ডান হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ করো, তারা যা করে তা গ্রাস করে ফেলবে, তারা যা করেছে তা তো কেবল যাদুকরের কলাকৌশল, যাদুকর যেখানেই আসুক সফল হবে না।" (সূরাহ তো-হা, ২০ : ৬৮-৬৯)

আল্লাহ যাদুকর ও নবীর মধ্যে যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন তা হলো - নবী কৃতকার্য হোন আর যাদুকর হয় অকৃতকার্য। নবীর কার্যকলাপ চেষ্টা-সাধনা ও মুজিযার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে সফলকাম ও কল্যাণধর্মী হওয়া। অপরপক্ষে যাদুকরের উদ্দেশ্য হলো ধোঁকাবাজি, প্রবঞ্চনা ও অনিষ্ট সাধন করা। অপর একটি আয়াতে এ ব্যাখ্যারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। মিসরীয় যাদুকরদেরকে লক্ষ্য করে মুসা আলাইহিস সালাম বললেন -

"..... তোমরা যা এনেছো তা যাদু, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে অসার করে দিবেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ অশান্তি সৃষ্টিকারীদের কর্ম সার্থক করেন না।" (সূরাহ ইউনুস, ১০ : ৮১)

যাদু ও তন্ত্রমন্ত্র একটি সাময়িক ক্রীড়া-কৌতুক। আর মুজিযার প্রভাব, ক্রিয়াশীলতা সার্বজনীন ও সর্বকালীন। এ জগতে তার ফলাফল অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা দেখে ফিরআউন যখন বললো, এটা তো সব যাদুমন্ত্রের লীলাখেলা। জবাবে মুসা আলাইহিস সালাম বললেন -

".... এটি কি যাদু ? যাদুকররা তো সফলকাম হয় না।" (সূরাহ ইউনুস, ১০ : ৭৭)

পৌত্তলিক অবিশ্বাসীরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলাবলি করতো, এই লোকটি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শয়তানী শক্তির সাহায্যে এসব বাণী পেশ করছে, তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাণীর উৎস হলো শয়তানী শিক্ষা। তার জবাবে আল্লাহ পাক তাদেরকে জানিয়ে দিলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর উৎসমূল ভালো না মন্দ, শয়তানী শক্তির বহিঃপ্রকাশ না ফেরেশতা শক্তির ফল - এই তত্ত্ব ও তথ্যটি অনুধাবন করা খুবই সহজ। স্বয়ং আহবানকারীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চরিত্র ও কার্যকলাপ সেটার উজ্জ্বল সাক্ষী। ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষায় বৃক্ষের পরিচয় ফল দ্বারাই। সুতরাং শয়তানী ও আসমানি উচয় শক্তির মধ্যে তারতম্য নিরূপণ করা মোটেই কষ্টসাধ্য নয়। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন শয়তান কার কাছে যায় -

"তারা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর উপর। তারা কান পেতে থাকে আর তাদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী।" (সূরাহ আশ-শুয়ারা, ২৬ : ২২২-২২৩)

আসল ও নকল নবীর মধ্যে তারতম্য নিরূপণের নিমিত্ত তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারিত্রিক জীবনই যথেষ্ট। এতদ্ব্যতীত মিথ্যাবাদী ও অপবাদ রটনাকারী ও অসৎ চলাফেরা কম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, দীর্ঘস্থায়ী কিংবা চিরন্তন হয় না। যেমন আল-কুরআন ঘোষণা দেয়-

".... নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে তারা সফলকাম হবে না। তাদের সুখ-সম্ভোগ সামান্যই আর তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।" (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ১১৬-১১৭)

(আল্লামা শিবলী নুমানী, সিরাতুন্নবী, ৩খ.)

 

সূত্রঃ সিরাত বিশ্বকোষ - একাদশ খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-5c

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামসমূহ ও তাৎপর্য (১)

 

 

 

The Greatest Nation·Monday, April 1, 2019

 

 

নামের আধিক্য নিঃসন্দেহে ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব, সুউচ্চ সম্মান ও সুমহান মর্যাদার প্রমাণ বহন করে। এজন্য আরব সমাজে ব্যক্তির একাধিক নামকরণ এবং তার সংরক্ষণের বিশেষ প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে এই নীতি-প্রথার পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেছিলো। আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেটির পূর্ণ উপযুক্তও ছিলেন। কারণ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন ব্যক্তিত্বে সর্বশ্রেষ্ঠ, সম্মান ও মর্যাদায় সর্বশীর্ষে, চরিত্র ও গুণমাধুর্যে সর্বউচ্চ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন এমন এক গৌরবান্বিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী সত্তা, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধ্যে একই সময় পুঞ্জীভূত হয়েছিলো মানবীয় সকল প্রশংসনীয় গুণ।

বিশ্বাস ও চেতনার বিশুদ্ধতা, আমল ও কর্মের পুণ্যময়তা এবং গুণাবলী ও সৌন্দর্যের পূর্ণাঙ্গতায় তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তুলনা ছিলেন কেবল তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। এমন একজন ইনসানে কামিল ও পরিপূর্ণ মানুষের অসংখ্য অগণিত নাম হবে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিচয় প্রকাশে নিবেদিত হবে অজস্র বিশেষণ, এটিই তো স্বাভাবিক। তাই মহান আল্লাহ আল-কুরআনে তার প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বিভিন্ন গুণবাচক নামে অভিহিত করেছেন। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন হাদিসে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন বিভিন্ন বিশেষ্য ও বিশেষণে। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবা ও তৎপরবর্তীগণও প্রিয় হাবীবের অনুপম গুণাবলী ও আদর্শের ভিত্তিতে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসংখ্য উপাধিতে অলংকৃত করেছেন, অভিহিত করেছেন প্রশংসাবাচক বিভিন্ন নামে-উপনামে।

যুগে যুগে ইসলামী দুনিয়ার উলামা-মাশায়েখ ও ঐতিহাসিকগণ প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ সকল নাম, উপনাম ও উপাধি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন, সংকলন করেছেন বৃহদাকারের কিতাব। আল্লামা বাগাবী তার "আল-কাওলুল বাদী" গ্রন্থে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ৬০ টির অধিক নাম ও উপাধি সংকলন করেছেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইউসুফ আস-সালিহী আশ-শামী তার "সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ" গ্রন্থে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ৭৫৯ টি গুণবাচক নাম আরবি বর্ণমালার ক্রমানুসারে লিপিবদ্ধ করেছেন। আল্লামা ইবনুল জাওযী তার সিরাত গ্রন্থের "আসমাউ নাবীয়্যিনা মুহাম্মাদ" (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শীর্ষক অধ্যায়ে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ২৩ টি নাম উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনুল আরাবী রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের সংখ্যা গণনা করেছেন ৬৪ টি, কয়েকজন বিশেষজ্ঞ আলিম রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের সংখ্যা এক হাজার পর্যন্ত গণনা করেছেন। (ফাতহুল বারী, ৬খ.) এটা ছাড়া সাধারণভাবে মুহাদ্দিসীনে কিরাম তাদের নিজ নিজ হাদিস গ্রন্থে "বাবূ আসমাইন-নাবীয়্যি" (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শীর্ষক শিরোনামে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম সম্বলিত রিওয়ায়াতসমূহ সংকলিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে ইমাম বায়হাকি, ইবন কাসির ও ইবন আসাকিরের সংকলিত হাদিস গ্রন্থাদি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। আল্লামা হিফযুর রহমান সিওহারবী তার "কাসাসুল কুরআন" গ্রন্থে লিখেছেন যে, আল্লামা ইবন দিহয়া হলেন প্রথম মনীষী, যিনি এ সম্পর্কে স্বতন্ত্র পুস্তক রচনা করেন।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম, গুণবাচক নাম ও উপাধির সংখ্যা কয়টি - এ সম্পর্কে অতীতের মনীষী-বুযুর্গগণের লেখনীর বিভিন্নতা এবং কোন কোন গ্রন্থে এর সংখ্যার আধিক্য প্রসঙ্গে শায়খ হিফজুর রহমান সিওহারবী অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও যুক্তিসংগত দুটো মন্তব্য করেছেন। সেগুলো হলো -

(১) রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম, উপনাম ও উপাধি বর্ণনায় এমন কিছু যোগসূত্রও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা কোন বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে তার সাথে সংযুক্ত হয়েছে, নাম, গুণ বা উপাধি হিসেবে নয়। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম, গুণ ও উপাধির সংখ্যাধিক্যের প্রতি যে সকল মনীষীর উৎসাহ অধিক ছিল, তারা ঐ সূত্রগুলোকেও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম, গুণ বা উপাধির মধ্যে গণনা করেছেন। তার দৃষ্টান্ত "আল-লিবনাহ" (اللبنة) শব্দটি, যার অর্থ ইট। অন্য সকল নবী-রাসুল এবং রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতী বৈশিষ্ট্যের সম্পর্ক ব্যক্ত করার জন্য এবং খতমে নবুওয়াতকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেকে নবওয়াতরূপ প্রাসাদের সর্বশেষ "লিবনাহ" (ইট) বলেছেন। এটি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম, গুণ বা উপাধি না। কিন্তু বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির মনীষীবৃন্দ এটিকেও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

(২) এ সত্যও বিস্মৃত হওয়া যাবে না যে, রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম, গুণ ও উপাধিসমূহ কেবল প্রথাসিদ্ধ নয় যে, পিতা-মাতা বা আপন বন্ধু ও অনুরক্তগণ যা চাইলেন তা-ই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম, গুণ বা উপাধি রেখেছিলেন। বরং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিটি নাম, গুণ ও উপাধির সাথে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবন, কর্ম ও আখলাক-চরিত্রের সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। (কাসাসুল কুরআন, ৪খ., ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)

 

নাম পরিচয়ের প্রকারভেদ

মানুষের ব্যক্তিত্ব, গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের পরিচয়দানের জন্যই নামের প্রণয়ন ও প্রয়োগ। তাই "নাম" মানুষের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিচয়ের বাহক ও প্রতিনিধিত্বকারী। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের পরিচয় দানের জন্য নামের প্রণয়ন ও প্রয়োগের তিনটি রীতি অনুসৃত হয়ে আসছে, যথা -

(১) ইসম (اسم) মূলনাম। একে আলাম (علم) ও বলা হয়,

(২) কুনয়া (كنية) উপনাম / ডাকনাম,

(৩) লাকাব (لقب) উপাধি।

সাধারণভাবে ব্যক্তির গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের পরিচয়বাহী নামসমূহ লকব বা উপাধিরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু - তার নাম (اسم) উমার, উপনাম বা ডাকনাম (كنية) আবু হাফস, উপাধি (لقب) ফারুক (সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারী)।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রেও নামের প্রণয়ন ও প্রয়োগের উক্ত রীতির পূর্ণ অনুসরণ লক্ষ্য করা যায়। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসংখ্য নাম-পরিচয়ের কিছু মূল নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন- মুহাম্মাদ (محمد) ও আহমাদ (احمد), আর কিছু রয়েছে উপনাম ও ডাকনামরূপে, যেমন - আবুল কাসিম (ابو القاسم), আবু ইব্রাহীম (ابو ابرهيم) এবং রাসুলুল্লাহ (رسول الله) ও নাবীয়্যুল্লাহ (نبي الله)। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবশিষ্ট নামসমূহের প্রয়োগ হয়েছে উপাধিরূপে, যেমন - বাশীর (بشير), নাযীর (نذير) ইত্যাদি।

 

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামসমূহ দুই প্রকার

কুরআন, সুন্নাহ আর সাহাবায়ে কিরামগণ থেকে প্রাপ্ত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুণবাচক নামসমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় -

(১) বিশেষ (خاص) অর্থাৎ এমন সকল নাম, যা কেবল তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্যই এককভাবে প্রযোজ্য, অন্য কোন নবী-রাসুলের ক্ষেত্রে এই নাম প্রযোজ্য নয়। যেমন - মুহাম্মাদ (محمد), আহমাদ (احمد), মাহী (ماحي), হাশির (حاشر), আকিব (عاقب), খাতামুন নাবিয়্যিন (خاتم النبيين), সায়্যিদু উলদি আদাম (سيد ولد ادم) এবং রহমাতুললিল আলামীন (رحمة للعا لمين)।

(২) সাধারণ (عام), অর্থাৎ এমন সকল নাম, যার অর্থ ও মর্মের ব্যাপকতা অন্যান্য নবী- রাসুলকেও শামিল করে। যেমন - শাহিদ (شاهد), বাশীর (بشير), নাযীর (نذير), দাঈ ইলাল্লাহ (داعي الى الله) ইত্যাদি।(নাদরাতুন নাঈম)

 

আল-কুরআনে উদ্ধৃত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামসমূহ

আল-কুরআনে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বেশ কিছু নাম, উপনাম ও উপাধিসমূহ উল্লেখ হয়েছে, যাদের মধ্যে কিছু নাম, উপনাম ও উপাধি একাধিক আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামসমূহের তাৎপর্য বর্ণনার সময়ে বেশ কিছু আয়াত উল্লেখ করা হবে, তবে এখানে আল-কুরাআনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উল্লিখিত নাম, উপনাম ও উপাধিসমূহ এবং তা যে আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি করে আয়াত উল্লেখ করা হলো সংক্ষিপ্ততার জন্যঃ

(১) মুহাম্মাদ (محمد) - প্রশংসিত। দেখুনঃ ৩ : ১৪৪।

এছাড়াও, আল-কুরআনে "মুহাম্মাদ" একটি সূরার নাম, সূরাটি ২৬তম পারায়, এই সূরার আয়াত সংখ্যা ৩৮।

(২) আহমাদ (احمد) - সর্বাধিক প্রশংসাকারী। দেখুনঃ ৬১ : ৬।

(৩) বাশীর (بشير) - সুসংবাদদাতা। এটি গুণবাচক নাম। দেখুনঃ ২ : ১১৯।

(৪) মুবাশশির (مبشر) - সুসংবাদদাতা। এটি গুণবাচক নাম। দেখুনঃ ১৭ : ১০৫।

(৫) নাযীর (نذير) - সতর্ককারী। এটি গুণবাচক নাম। দেখুনঃ ২ : ১১৯।

(৬) শাহিদ (شاهد) - সাক্ষ্যদাতা। এটি গুণবাচক নাম। দেখুনঃ ৩৩ : ৪৫।

(৭) শাহীদ (شهيد) - সাক্ষ্যদাতা। দেখুনঃ ২ : ১৪৩।

(৮) হারীস (حريص) - মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ; (৯) রাউফ (رءوف) - দয়ার্দ্র, সহানুভূতিশীল ; (১০) রহীম(رحيم) - পরম দয়ালু, করুণাময়।

এই তিনটি গুণবাচক নাম ৯ নং সূরাহ - "সূরাহ আত-তাওবাহ" এর ১২৮ নং আয়াতে উল্লেখ করা আছে।

(১১) দাঈ ইলাল্লাহ (داعي الى الله) - আল্লাহ'র দিকে আহবানকারী। এটি একটি ব্যাপক গুণবাচক নাম। দেখুনঃ ৩৩ : ৪৬।

(১২) সিরাজুম মুনীর (سراج منير) - উজ্জ্বল প্রদীপ। এটি গুণবাচক নাম, নামটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিচয় প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। দেখুনঃ ৩৩ : ৪৬।

(১৩) নূর (نور) - হিদায়াতের জ্যোতি। দেখুনঃ ৫ : ১৫।

(১৪) হাদি (هاد) - পথপ্রদর্শক। দেখুনঃ ২৭ : ৮১।

(১৫) নি'মাহ (نعمة) - নিয়ামত। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে নিয়ামত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। দেখুনঃ ২ : ২৩১।

(১৬) রহমত (رحمة) - করুণা। বিশ্বজগতের জন্য রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রহমত ঘোষণা করা হয়েছে। দেখুনঃ ২১ : ১০৭।

(১৭) মুনযির (منذر) - সতর্ককারী। দেখুনঃ ২৭ : ৯২।

(১৮) আল-মুদদাসসির (المدثر) - বস্ত্রাচ্ছাদিত। দেখুনঃ ৭৪ : ১।

(১৯) আল-মুযযামমিল (المزمل) - বস্ত্রাবৃত। দেখুনঃ ৭৩ : ১।

(২০) মুযাক্কির (مذكر) - উপদেশদাতা। দেখুনঃ ৮৮ : ২১।

(২১) খাতামুন নাবিয়্যিন (خاتم النبيين) - শেষনবী। দেখুনঃ ৩৩ : ৪০।

(২২) বুরহান (برهان) - সুস্পষ্ট প্রমাণ। দেখুনঃ ৪ : ১৭৪।

(২৩) মুবীন (مبين) - স্পষ্ট বর্ণনাকারী / ভাষ্যকার। দেখুনঃ ১৫ : ৮৯।

(২৪) আবদুল্লাহ (عبدالله) - আল্লাহ'র বান্দা; কোথাও সর্বনাম (ه) এর সাথে আবদুহু (عبده) রূপে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উল্লেখ করা হয়েছে। দেখুনঃ ৫৭ : ৯।

(২৫) রাসুলুল্লাহ (رسول الله) - আল্লাহ'র রাসুল; কোথাও সর্বনাম (ه) যোগে "রাসুলুহু" (رسوله), কোথাও (نا) সর্বনাম যোগে "রাসুলুনা" (رسولنا) শব্দে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে উল্লেখ করা হয়েছে, আবার কোথাও সর্বনাম ও ইযাফতবিহীন শুধু "রাসুল" (رسول) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। দেখুনঃ ২ : ১০১।

(২৬) নবী (نبي) - সংবাদবাহক, পয়গাম্বর। দেখুনঃ ৩ : ৬৮।

(২৭) উম্মী (الامي) - অক্ষরজ্ঞানমুক্ত, নিরক্ষর। দেখুনঃ ৭ : ১৫৭-১৫৮।

উপরে উল্লিখিত আল-কুরআনে বর্ণিত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম ও গুণবাচক নামসমূহের মধ্যে কিছু নাম কেবল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যই খাস ও বিসেশভাবে নির্ধারিত। যথাঃ মুহাম্মাদ, আহমাদ, সিরাজুম মুনীর, নিয়ামাত, নূর, রহমাতুললিল আলামীন, মুযযামমিল, মুদদাসসির, খাতামুন নাবিয়্যিন। অবশিষ্ট নামসমূহ অন্যান্য নবী-রাসুলগণের শানেও ব্যবহৃত হয়েছে।

 

একটি প্রশ্ন ও তার সমাধান

উপরে প্রদত্ত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের তালিকা পাঠে একটি বিষয় দেখা যায় যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু নাম আল্লাহ'র গুণবাচক নামের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেমন- রাউফ (رءوف), রহীম (رحيم) ইত্যাদি। এতে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে আল্লাহ'র গুণবাচক নামে আখ্যায়িত করা হলো কেন, বা এর তাৎপর্য কি ?

এ প্রশ্নের জবাব এই যে, এ জাতীয় গুণবাচক নামগুলো আল্লাহ'র শানে ও ক্ষেত্রে যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে ও ক্ষেত্রে সে অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। এই রহস্যের কারণেই কেবল রাসুল নন, বরং সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও আল্লাহ'র কোন কোন গুণবাচক শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় পবিত্র কুরআনে। যেমন -

"আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুক্রবিন্দু থেকে তাকে পরীক্ষা করার জন্য, এজন্য তাকে শ্রবণশক্তিসম্পন্ন (سميع) ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন (بصير) বানিয়েছি।" (সূরাহ আল-ইনসান, ৭৬: ২)

লক্ষ্য করুন, এখানে প্রত্যেক মানুষকে سميع এবং بصير বলা হয়েছে। অথচ এগুলো আল্লাহ'র মৌলিক ৭ টি গুণের অন্তর্ভুক্ত।

মোটকথা, এ জাতীয় শব্দ যখন আল্লাহ'র ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে, তখন এর অর্থ হবে যে, এটা তার সত্তাগত গুণ। অপরপক্ষে যখন কোন সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে, তখন এর অর্থ হবে যে, এটি তার সত্তাগত গুণ নয়, বরং আল্লাহ'র সৃষ্টি হিসেবে তিনি তার মধ্যে যে দয়া-মায়া ইত্যাদি গুণ বা বৈশিষ্ট্য রেখেছেন তা প্রকাশের জন্য তাকে ঐ গুণে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

হাদিসে বর্ণিত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামসমূহ

প্রসিদ্ধ-অপ্রসিদ্ধ সকল হাদিস গ্রন্থেই রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম, উপাধি ও গুণবাচক পরিচিতি সম্পর্কিত রিওয়ায়াত সংকলিত হয়েছে। ইমাম বুখারি তার "আল জামি আস সহিহ" গ্রন্থে "বাবূ মা জাআ ফী আসমাই রাসুলিল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)" এর "বাবূ কুনিয়াতি রাসুলিল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)" শিরোনামে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম, উপনাম ও গুণবাচক নাম সম্বলিত রিওয়ায়াতসমূহ সংকলন করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম মুসলিম তার সহিহ গ্রন্থেও নামের হাদিসসমূহ সংকলিত করেছেন। সহিহুল বুখারি'র রিওয়ায়াতে মোট ৮ টি নাম ও উপাধি স্থান পেয়েছে, যথাঃ

(১) মুহাম্মাদ, (২) আহমাদ, (৩) মাহী, (৪) হাশির, (৫) আকিব, (৬) খাতামুন নাবীয়্যিন, (৭) আবুল কাসিম, (৮) রাসুলুল্লাহ।

উল্লিখিত এ নামগুলো ছাড়া সহিহ মুসলিমে উল্লিখিত অতিরিক্ত নামগুলো হলো -

(৯) রাউফ, (১০) রাহীম, (১১) আল-মুকাফফা (المقفى), (১২) নবীউত-তাওবাহ, (১৩) নবীউর-রহমাহ।

ইমাম তিরমিযি তার "আল জামি আস সুনান" গ্রন্থে আরো কিছু নাম / উপাধি উল্লেখ করেছেন, যথাঃ

(১৪) খায়রুল খালক (خير الخلق) - সৃষ্টির সেরা,

(১৫) সাহিবু লিওয়াইল হামদ (صاحب لواء الحمد) - স্তুতির পতাকা উত্তোলনকারী,

(১৬) ইমামুন নাবীয়্যিন (امام النبين) - নবীদের নেতা,

(১৭) সায়্যিদু উলদি আদাম (سيد ولد ادم) - সর্বশ্রেষ্ঠ আদম সন্তান,

(১৮) হাবিবুল্লাহ (حبيب الله) - আল্লাহ'র প্রিয় বন্ধু,

(১৯) শাফি (شافع) - সুপারিশকারী,

(২০) মুশাফফা (مشفع) - যার সুপারিশ গ্রহণ করা হয়,

(২১) আকরামুল আওয়ালীন ওয়াল-আখিরীন(اكرم الاولين والاخرين) - পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মানবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ,

(২২) সায়্যিদুল আলামীন (سيد العلمين) - সকল বিশ্বের নেতা,

(২৩) রাসুলু রব্বিল আলামীন (رسول رب العلمين) - বিশ্বপ্রভুর পয়গাম্বর,

(২৪) মুস্তাফা (مصطفي) - নির্বাচিত, চয়নকৃত।

শায়খ ওয়ালিয়্যুদ্দীন আত-তিবরীযী তার "মিশকাতুল মাসাবীহ" গ্রন্থে হাদিসের বিভিন্ন কিতাবের সূত্রে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরো কিছু নাম ও উপাধি বর্ণনা করেছেন, যথাঃ

(২৫) শাফী (شفيع) - পৃষ্ঠপোষক,

(২৬) আল-মুতাওয়াক্কিল (المتوكل) - আল্লাহ'র উপর নির্ভরশীল,

(২৭) কাইদুল মুরসালীন (قائد المر سلين) - নবী-রাসুলগণের অগ্রজ,

(২৮) খাতীবুল মুরসালীন (خطيب المر سلين) - নবী-রাসুলগণের পক্ষে বক্তব্য প্রদানকারী,

(২৯) সাহিবুল কারামাহ (صاحب الكرمة) - সর্বোচ্চ মর্যাদা অধিকারী,

(৩০) সাহিব মাফাতীহিল খায়র (صاحب مفاتيح الخير) - সর্বকল্যাণের চাবির অধিকারী,

(৩১) আল-মুখতার (المختار) - মনোনীত,

(৩২) আজওয়াদুন নাস (اجود الناس) - শ্রেষ্ঠতম দাতা,

(৩৩) আসদাকুন নাস (اصدق الناس) - পরম সত্যবাদী,

(৩৪) রহমাত (رحمة) - দয়া ও করুণাময়,

(৩৫) মুহদা (مهداة) - হিদায়াতপ্রাপ্ত, সঠিক পথে পরিচালিত,

(৩৬) আহসানুন নাস (احسن الناس) - সুন্দরতম মানুষ,

(৩৭) আশজাউন-নাস (اشجع الناس) - বীরশ্রেষ্ঠ,

(৩৮) আবদ (عبد) - বান্দা, আল্লাহ'র গোলাম।

(মিশকাতুল মাসাবীহ, বাবূ ফাদাইলি সায়্যিদিল মুরসালীন এবং বাবূ আসমাইন নাবিয়্যী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

(৩৯) মুআল্লিম (معلم) - শিক্ষক,

(৪০) মুয়াসসির (ميسر) - সহজতা আনয়নকারী।

(মিশকাতুল মাসাবীহ)

(৪১) কাসিম (قاسم) - বণ্টনকারী (মিশকাতুল মাসাবীহ)

(৪২) আস-সাদিক (الصادق) - সত্যবাদী,

(৪৩) আল-মাসদূক (المصدوق) - সত্যায়িত, সত্যবাদীরূপে স্বীকৃত।

(ফাতহুল বারী, ৭খ.)

(৪৪) আফসাহুল আরাব (افصح العرب) - শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ও সাহিত্যিক। (আল মুযহির লিস সুয়ূতী)

(৪৫) ইবনুয যাবীহায়ন (ابن الذبيحين) - আল্লাহ'র জন্য কুরবানীর উদ্দেশ্যে পেশকৃত দুই ব্যক্তির পুত্র। (আল-খাসাইসুল কুবরা, ১খ.)

 

উপরে উল্লিখিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম, উপনাম ও উপাধিসমূহ কুরআন ও হাদিসে উদ্ধৃতিসহ আমরা আলোচনা করলাম। এটা ছাড়াও মুসলিম সমাজে ইসলাম বিশেষজ্ঞ উলামা বুযুর্গগণের গ্রন্থাদিতে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরো কিছু গুণবাচক নাম ও উপাধির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে সেগুলোর কুরআন ও হাদিস নির্ভর নামাকারে ব্যবহারের কোন সূত্র আমরা ব্যাপক অনুসন্ধানের পরও পাইনি। সম্ভবত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় তার প্রচলন পরবর্তীতে ঘটেছে। তবে এটি সন্দেহাতীত সত্য যে, এ সকল নাম ও উপাধিসমূহ অর্থ, মর্ম ও বাস্তবতার দিক থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে যথার্থ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ প্রকার গুণবাচক নামের একটি তালিকা -

(১) সাহিবুল কুরআন (صاحب القران) - কুরআনের অধিকারী, কুরআনের বাহক,

(২) হামিদ (حامد) - প্রশংশাকারী,

(৩) মাহমুদ (محمود) - প্রশংসিত,

(৪) রাশীদ (رشيد) - সৎপথপ্রাপ্ত,

(৫) কালীম (كليم) - আল্লাহ'র সাথে বাক্যালাপের সৌভাগ্যপ্রাপ্ত,

(৬) নাসির (ناصر) - সাহায্যকারী,

(৭) মানসূর (منصور) - সাহায্যপ্রাপ্ত,

(৮) হাফিয (حافظ) - হিফাযতকারী, সংরক্ষক,

(৯) আদিল (عادل) - ইনসাফকারী,

(১০) হাকীম (حكيم) - প্রজ্ঞাবান,

(১১) মুতী (مطيع) - অনুগত,

(১২) ওয়ায়েয (واعظ) - নসীহতকারী,

(১৩) নাতিক (طق نا) - সত্যের প্রবক্তা,

(১৪) ফাত্তাহ (فتاح) - মহাবিজয়ী,

(১৫) আলিম (عالم) - জ্ঞানী,

(১৬) তাহির (طاهر) - পবিত্র,

(১৭) মুতাহহার (مطهر) - যাকে পবিত্র করা হয়েছে,

(১৮) সাবিক (سابق) - অগ্রবর্তী,

(১৯) ফারাত (فرط) - অগ্রবর্তী,

(২০) হক (حق) - সত্য, সত্য স্বীকৃত,

(২১) আমীর (امر) - সত্যাদেশকারী,

(২২) নাহী (ناه) - নিষেধকারী,

(২৩) শাকুর (شاكور) - অতিকৃতজ্ঞ,

(২৪) মুনীব (منيب) - আল্লাহভিমুখী,

(২৫) মুবাল্লিগ (مبلغ) - সত্যপ্রচারক,

(২৬) হাদী (هادي) - পথপ্রদর্শক,

(২৭) বার (بار) - নেককার,

(২৮) তায়্যিব (طيب) - পূত-পবিত্র,

(২৯) সায়্যিদুল কাওনায়ন (سيد الكونين) - দুইজাহানের নেতা,

(৩০) ওয়াসীম (وسيم) - উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন,

(৩১) আল-ওয়ারি (الورع) - পরহেযগার,

(৩২) মুকাদ্দাস (المقدس) - পূত-পবিত্র,

(৩৩) আমান (الامان) - শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক,

(৩৪) মু'লীন (المعلن) - স্পষ্ট ঘোষক,

(৩৫) আল-বারি (البارع) - শীর্ষস্থান অধিকারী,

(৩৬) রাহহাব (الرهاب) - আল্লাহভীরু,

(৩৭) আওয়াহ (الاواه) - ক্রন্দনশীল, কোমল হৃদয়ের অধিকারী,

(৩৮) হালীম (الحليم) - ধৈর্য ও সহনশীল,

(৩৯) ওয়াদি (الواضع) - বিনয়ী,

(৪০) মুঈন (المعين) - সাহায্যকারী,

(৪১) মুযীল (المزيل) - অনিষ্ট মোচনকারী,

(৪২) আল-বাদর (البدر) - পূর্ণিমার চাঁদের মতো সুন্দর, অনুপম,

(৪৩) হানীফ (الحنيف) - দ্বীনে ইব্রাহীমের অনুসারী,

(৪৪) যাফূর (الظفور) - সদা সাফল্যের অধিকারী,

(৪৫) তাকী (التقي) - পরহেযগার,

(৪৬) আজীর (الاجير) - পূর্ণ প্রতিদানপ্রাপ্ত,

(৪৭) আযীয (العزيز) - সর্বজনপ্রিয়,

(৪৮) নাসীব (النسيب) - সুমহান ও আভিজাত্যের অধিকারী,

(৪৯) আল-খাশি (الخاشع) - আল্লাহ'র একান্ত ভয়কারী,

(৫০) যাঈম (الزعيم) - সৃষ্টিকুলের নেতৃত্বদানকারী,

(৫১) হাজুদ (الهجود) - আল্লাহ'র সাথে প্রেমালাপে নিমগ্ন,

(৫২) সাঈদ (السعيد) - চিরসৌভাগ্যের অধিকারী,

(৫৩) রাগিব (الراغب) - আগ্রহী,

(৫৪) জালীল (الجليل) - সুমহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী,

(৫৫) সাফী (الصفي) - স্বচ্ছ জীবনাধিকারী,

(৫৬) সাদীদ (السديد) - চিরসত্য,

(৫৭) ওয়াফী (الوفي) - পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পালনকারী,

(৫৮) আসদাক (الاصدق) - সর্বাধিক সত্য,

(৫৯) মুকরী (المقري) - পাঠদানকারী,

(৬০) ওয়াইদ (الواعد) - নির্ভুল প্রতিশ্রুতি দানকারী,

(৬১) মুকতাসিদ (المقتصد) - ভারসাম্যের নবী,

(৬২) মুকাদ্দাম (المقدم) - অগ্রবর্তী,

(৬৩) আজমাল (الاجمل) - সৌন্দর্যের আধার,

(৬৪) বাশার (البشر) - মানুষ,

(৬৫) রাজী (الراجي) - আশাবাদী,

(৬৬) তালী (التالي) - কুরআন তিলাওয়াতকারী,

(৬৭) যাহির (الزاهر) - সৌরভের অধিকারী,

(৬৮) আমীন (الامن) - নিরাপত্তার প্রতীক,

(৬৯) বাহর (البحر) - সমুদ্রসম উদার ও বদান্যতার অধিকারী,

(৭০) মুবতাহিল (المبتهل) - (দরবারে ইলাহীতে) প্রচুর আহাজারীতে অভ্যস্ত,

(৭১) মাতলূ (المتلو) - সর্বত্র আলোচিত,

(৭২) আতূফ (عطوف) - দয়াবান,

(৭৩) নাবীউল হুমাম (نبي الهمام) - হিদায়াতের প্রতীক,

(৭৪) নবীউল হুদা (نبي الهدي) - হিদায়াতের প্রতীক,

(৭৫) খাদি (الخاضع) - আল্লাহ সমীপে মস্তকাবনত,

(৭৬) মুসলিহ (المصلح) - মহাসংস্কারক,

(৭৭) শারি (شارع) - শরিআতের প্রবর্তক,

(৭৮) তিহামী (تهامي) - তিহামা অধিকারী,

(৭৯) হাশিমী (هاشمي) - বনু হাশিম গোত্রীয়,

(৮০) আবতাহী (ابطهي) - আবতাহ অঞ্চলীয়,

(৮১) তো-হা (طه) - তো-হা

(৮২) ইয়াসীন (يس)

(৮৩) মাতীন (متين) - দৃঢ়তার অধিকারী,

(৮৪) কুরায়শী (قريشي) - কুরায়শী,

(৮৫) নাজিউল্লাহ (نجي الله) - আল্লাহ'র সাথে একান্ত আলাপকারী,

(৮৬) রাসুলুর-রাহমাহ (رسول الرحمة) - রহমতের রাসুল,

(৮৭) নাবীয়্যুন কারীম (نبي كريم) - সুমহান দয়ালু নবী,

(৮৮) রাসুলুল মালাহীম (رسول الملاحم) - ন্যায় যুদ্ধ পরিচালনার রাসুল,

(৮৯) মুনজী (المنجي) - মুক্তির পথ প্রদর্শক।

(শায়খ মুহাম্মাদ ইউসুফ মাতালাহ, দরূদ ও সালাম, আল-মারকাজুল ইসলামী, বাংলাদেশ)

 

দ্বিতীয় পার্ট পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন - https://bit.ly/2Uf4zvy

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামসমূহ ও তাৎপর্য (২)

 

 

 

The Greatest Nation·Monday, April 1, 2019

 

 

 

 

 

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুনয়াসমূহের তাৎপর্য

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুনয়া (উপনাম বা ডাকনাম) ছিল তিনটি - আবুল কাসিম (ابو القاسم), আবু ইব্রাহীম (ابو ابر هيم) এবং রাসুলুল্লাহ (رسول الله) বা নাবীয়্যুল্লাহ (نبي الله)। সাহাবায়ে কিরামগণ এ তিনটি ডাকনামে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে ডাকতেন ও সম্বোধন করতেন, তবে সর্বশেষ বর্ণিত "রাসুলুল্লাহ" বা "নাবীয়্যুল্লাহ" নামেই তারা সাধারণত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সম্বোধন করতেন। এই তিনটি ডাকনামের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হলোঃ

 

(১) আবুল কাসিম (ابو القاسم) - কাসিমের পিতা।

এই নামের তাৎপর্য এই যে, উম্মুল মুমিনীন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা'র গর্ভে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তার নাম রাখা হয়েছিলো "কাসিম"। আরব সমাজে সন্তানের নাম যুক্ত করে পিতার উপনাম ব্যবহারের প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। এ সূত্রেই রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম "আবুল কাসিম" উপনামে সম্বোধিত হোন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে "আবুল কাসিম" উপনাম উল্লেখ করতে দেখা যায়। (বুখারি, ১খ.)

 

(২) আবু ইব্রাহীম (ابو ابراهيم) - ইব্রাহীমের পিতা।

এ নামের তাৎপর্য এই যে, রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী মারিয়া কিবতিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা'র গর্ভে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার নাম রাখেন ইব্রাহীম। এর পর একদিন জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে "আবু ইব্রাহীম" নামে সম্বোধন করেন। (আল-ওয়াফা বিআহওয়ালিল মুস্তাফা)

তবে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে এই উপনামে সম্বোধন করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ কারণে সাহাবীগণ কখনো তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) "আবু ইব্রাহীম" উপনামে ডাকতেন না। (প্রাগুক্ত)

 

(৩) রাসুলুল্লাহ (رسول الله) বা নাবিয়্যুল্লাহ (نبي الله) - আল্লাহ'র রাসুল, বা, আল্লাহ'র নবী।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) "মুহাম্মাদ" নামের স্থানে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই পরিচয় ও উপনামে অধিকতর সম্বোধিত হয়েছেন। (বুখারি, ১খ.)

আল-কুরআনেও রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম উল্লেখ করার পরিবর্তে সাধারণত তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গুণবাচক নামে ও পদবীতে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অধিকতর ব্যবহৃত হয়েছে তার উপনাম "রাসুলুল্লাহ"।

আরো একটি বিশেষ লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, মহান আল্লাহ আল-কুরআনুল কারীমে তার রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে কোথাও "ইয়া মুহাম্মাদ" - এভাবে সম্বোধন করেননি, বরং সর্বত্রই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন গুণবাচক নাম বা পদবীর মাধ্যমে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করেছেন। যেমন -"হে রাসুল", "হে নবী", "হে বস্ত্রাচ্ছাদিত", "হে বস্ত্রাবৃত" - এ বিশেষণে।

এর বিপরীতে অন্য সকল নবী-রাসুলকে আল্লাহ তাদের নামেই সম্বোধন করেছেন, যেমন - "হে লুত" (১১: ৮১), "হে দাউদ" (৩৮ : ২৬), "হে ইব্রাহীম" (১১ : ৭৬), "হে ঈসা" (৩ : ৫৫), "হে মুসা" (৫ : ২২) ইত্যাদি। মহান আল্লাহ'র এই নীতির দ্বারা শেষ নবী ও শেষ রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের বিশেষ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পেয়েছে। এই একই কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণকেও অন্য সাধারণের মতো তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম ধরে সম্বোধন করতে নিষেধ করা হয়েছে। (দেখুন, ৪৯: ১-৫)

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামসমূহের তাৎপর্য

 

(১) মুহাম্মাদ (محمد), (২) আহমাদ (احمد)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুবারাক নাম "মুহাম্মাদ" ও "আহমাদ" উৎপত্তি হয়েছে "হামদ" (حمد) ধাতুমূল থেকে। এর বুৎপত্তিগত অর্থ হলো - কারো আখলাকে হাসানা, প্রশংসনীয় গুণাবলী, পূর্ণাঙ্গ সৌন্দর্যাবলী, শ্রেষ্ঠ মর্যাদাবলী এবং পুণ্যময় কর্মকে গভীর ভালোবাসা, নিখুঁত বিশ্বাস ও মাহাত্ম্যের সাথে বর্ণনা করা। (দাইরা মাআরিফ ইসলামিয়্যা, ১৯খ.)

"মুহাম্মাদ" (محمد) শব্দের উৎপত্তি ও এর অর্থ প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে, "মুহাম্মাদ" শব্দটি "তাহমিদ" (تحميد) শব্দমূল থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই বাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে - অর্থের আধিক্য প্রকাশ করা এবং পুনপুন ব্যবহার। محمد শব্দটি ইসম মাফউল বা কর্মবাচক বিশেষ্য। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম) "প্রশংসিত" এমন এক মর্যাদাবান সত্তা, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্ণাঙ্গতা, সত্তাগত বৈশিষ্ট্য আর মৌলিক প্রশংসাবলীকে বিশুদ্ধ আকিদা ও ভালোবাসার সাথে বেশী বেশী এবং বারবার বর্ণনা করা। "মুহাম্মাদ" নামের অন্য একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এরকম যে, তিনি(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন এক গৌরবান্বিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী সত্তা, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধ্যে প্রশংসনীয় সকল অভ্যাস আর অনুপম গুণাবলী ও আদর্শসমূহ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকে। (দাইরা মাআরিফ ইসলামিয়্যা, ১৯খ.)

নাদরাতুন নাঈম গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, যদি বাবে তাফঈলের মাসদার থেকে اسم فاعل বা কর্তৃবাচ্ক বিশেষ্য পদ গঠিত হয়, তখন তার অর্থ হবে, এমন ব্যক্তি যিনি কাজটি বারবার করেন। যেমন - معلم শিক্ষক, مبين বর্ণনাকারী ইত্যাদি। পক্ষান্তরে, যদি এই মাসদার থেকে اسم مفعول বা কর্মবাচ্ক বিশেষ্য পদ গঠিত হয়, তখন অর্থ হবে, যে ব্যক্তির দ্বারা বারবার কাজটি কৃত হয়। সুতরাং "মুহাম্মাদ" (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শব্দের অর্থ দাঁড়ায় এমন সত্তা, প্রশংসাকারীরা বারবার যার প্রশংসা করেন অথবা যিনি বারবার প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তিসত্তায় এই দুটো অর্থই যথার্থভাবে বিদ্যমান। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বারবার প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য এবং প্রশংসাকারীরাও বারবার তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশংসা করে। (নাদরাতুন নাঈম, ১খ.)

আহমাদ (احمد) শব্দটি ইসমে তাফযীল বা গুণের আধিক্য প্রকাশক বিশেষ্য পদ। অধিকাংশ অভিধানবিদের মতে এটি ইসমে ফাঈল বা কৃর্তবাচক বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে কোন কোন অভিধানবিদের মতে এটি ইসমে মাফউল বা কর্মবাচক বিশেষ্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যদি এটি ইসমে ফাঈল বা কৃর্তবাচক বিশেষ্য পদ এর শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়, তখন অর্থ হবে - তিনি সৃষ্টিজগতের সমগ্র সৃষ্টজীবের মধ্যে মহান আল্লাহ'র সর্বাধিক প্রশংসাকারী। এর এটি যদি কর্মবাচক বিশেষ্য পদরূপে ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ হবে যার সর্বাধিক প্রশংসা করা হয়েছে। (দা.মা.ই. , ১৯খ.)

ইবনুল জাওযী তার সিরাত গ্রন্থে "মুহাম্মাদ" নামকরণের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নবীকুল শিরোমণি হবেন, এর প্রাক-বৈশিষ্ট্যাবলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্বে কারো নাম "মুহাম্মাদ" রাখা হয়নি। নিঃসন্দেহে এটি মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পছন্দনীয় ও সুসংরক্ষিত একটি নাম। ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়্যা আলাইহিস সালামের নামটি যেমনভাবে তিনি সংরক্ষিত করে রেখেছিলেন, তেমনি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামটিও বিশেষভাবে সংরক্ষিত করেছিলেন। (ইবনুল জাওযী, আল ওয়াফা বি আহওয়ালিল মুস্তাফা, ১খ.)

সমগ্র মানবের চেয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশী প্রশংসিত বলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাহমুদ, মুহাম্মাদ ও আহমাদ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসংখ্য গুণের অধিকারী বিধায় তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামটি একই মূলধাতু থেকে একাধিকরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ৩খ.)

মুহাম্মাদ ও আহমাদ - এই উভয় নামের এক বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইবন সায়্যিদিন নাস কাযী আবুল ফযল ইয়াদের উদ্ধৃতি উলেখ করেন - রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রসিদ্ধ দুটো নাম "মুহাম্মাদ" ও"আহমাদ" এর এক বিশেষ তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মহান আল্লাহ এই পবিত্র নাম দুটোকে যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করে আসছিলেন। যেমন, "আহমাদ" - এ পবিত্র নামটি মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে আলোচনা করেছেন এবং সকল নবীকে এই নামে আগত একজন নবীর সুসংবাদ জানিয়েছিলেন। এটি ছাড়া মহান আল্লাহ সুকৌশলে উভয় নামে নামকরণ করা থেকে বিরত রেখেছিলেন। এমনকি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্বে এ নামে কাউকেও ডাকা হতো না। অনুরূপভাবে, সমগ্র আরব জাহানে "মুহাম্মাদ" নামেও কারো নামকরণ করা হতো না। (ইবন সায়্যিদিন নাস, উয়ুনুল আসার, ১খ.)

"আহমাদ" ও "মুহাম্মাদ" নামের মধ্যে রয়েছে এক অনুপম সাদৃশ্য, চমৎকার মিল। এ প্রসঙ্গে ইবন কায়্যিম আল-জাওযিয়্যা "যাদুল মাআদ" গ্রন্থের ২য় খণ্ডে উল্লেখ করেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের "আহমাদ" ও "মুহাম্মাদ" নামের মধ্যে রয়েছে এক চমৎকার মিল ও অনুপম সাদৃশ্য। "মুহাম্মাদ" নামে সকল প্রশংসিত গুণাবলীর আধিক্যের ব্যাপক সমাবেশ ঘটেছে। আর "আহমাদ" নামের মধ্যে নিহিত আছে অন্যান্য সকল গুণাবলীর উপরে একক মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের একচ্ছত্র প্রভাব। ফলে উল্লিখিত নাম দুটো একটি অন্যটির সাথে একাকার হয়ে গিয়েছে, যেমনটি ঘটে থাকে দেহের সাথে প্রাণের।

কুরআনে উল্লেখ আছে -

"মুহাম্মাদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নন - বরং তিনি আল্লাহ'র রাসুল ও শেষ নবী; আর আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।" (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৪০)

এ আয়াতে আল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম "মুহাম্মাদ" ব্যবহার করে তার রিসালাত ও খাতামে নবুওয়াতের বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এই আয়াতের বিশদ ব্যাখ্যা পড়তে পারেন এখান থেকে। প্রখ্যাত মুফাসসির মুফতি মুহাম্মাদ শফী "খতমে নবুওয়াত" নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সর্বশেষ নবী ও রাসুল, এ বিষয়টি পবিত্র কুরআনের শতাধিক আয়াত দ্বারা সুপ্রমানিত।

এছাড়া কুরআনে আরো উল্লেখ আছে -

"আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে এবং মুহাম্মাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে ঈমান এনেছে - আর এটাই তাদের রবের পক্ষ থেকে (প্রেরিত) সত্য - তিনি তাদের পাপগুলো মোচন করবেন আর তাদের অবস্থা সংশোধন করবেন।" (সূরাহ মুহাম্মাদ, ৪৭ : ২)

"মুহাম্মাদ আল্লাহ'র রাসুল; তার সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল, আল্লাহ'র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে, তাদের মুখমণ্ডলে সিজদাহ'র চিহ্ন থাকবে - তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপই এবং ইঞ্জিলেও ...." (সূরাহ আল-ফাতহ, ৪৮ : ২৯)

"আর মুহাম্মাদ একজন রাসুল ছাড়া কিছু নন, তার পূর্বেও রাসুলগণ গত হয়েছেন; সুতরাং তিনি যদি মারা যান বা নিহত হোন, তাহলে কি তোমরা তোমাদের পিছনের দিকে (পূর্বাবস্থায়) ফিরে যাবে ? আর যে তার পিছনের দিকে ফিরে যাবে, সে কখনো আল্লাহ'র কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না; আর শীঘ্রই আল্লাহ কৃতজ্ঞদেরকে প্রতিদান দিবেন।" (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১৪৪)

কুরআনে আরো উল্লেখ আছে -

"স্মরণ করো, যখন মরিয়ম-পুত্র ঈসা বললেন - হে বনী ইসরাইল, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহ'র প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী, আর আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তাঁর নাম আহমাদ; অতঃপর যখন তিনি স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করলেন, তখন তারা বললো - এ তো এক প্রকাশ্য যাদু।" . (সূরাহ আস-সফ, ৬১ : ৬)

এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনে কাসির উল্লেখ করেনঃ ঈসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাইলের শেষ নবী, আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আম্বিয়াকুলের শেষ নবী; সুতরাং বনী ইসরাইলের নবুওয়াতের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি খাতামুল আম্বিয়া আহমাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুসংবাদ দিলেন, তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর নবুওয়াত ও রিসালাতের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।

সর্বকালের সবচেয়ে বেশী প্রশংসিত ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন -

"আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।" (সূরাহ আল-ক্বালাম, ৬৮: ৪)

মানবজাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম ও সবচেয়ে বেশী প্রশংসিত ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে এই পৃথিবীতে সশ্রদ্ধ ও সসম্মানের সাথে কোন সময়ে স্মরণ করা হয় না ? শুধু আযানের উদাহারনই যদি দেখানো হয়, তাহলে দেখা যাবে - "আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" - এই ঘোষণা প্রতি দিন কোন না কোন সময় পৃথিবীর কোন না কোন স্থানে উচ্চারিত হয়েই যাচ্ছে অবিরতভাবে, এই পৃথিবীতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের ঘোষণা ও তার আলোচনা থেমে নেই কোন সময়েই, যেখানেই আল্লাহ'র আলোচনা, সেখানে আহমাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের'ও আলোচনা। আল্লাহ বলেছেন -

"এবং আমি আপনার জন্য আপনার উল্লেখকে করেছি সমুন্নত।" (সূরাহ আলাম নাশরাহ, ৯৪ : ৪)

তাহলে পুরো পৃথিবীতে অসংখ্য মুসলিম কর্তৃক সালাতে ও সালাতের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করা, অসংখ্য মাদরাসায় হাদিস পাঠে "রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন" এর মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম প্রেরণ করা, শত শত ভাষায় রচিত অসংখ্য কিতাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম লেখা ও পাঠকদের তা পড়া, আলিমগণের ওয়াজে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আলোচনা করা ...... সে এক অসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর বিষয়। এমন কোন মানুষ আগে ছিল না, পড়েও আসবে না, যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসার অতি সামান্য প্রশংসাও লাভ করতে পারবে।

আর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো শুধু এই পৃথিবীতেই সম্মানের অধিকারী নয়, বরং আল্লাহ তাকে সুসংবাদ দিয়েছেন -

".... শীঘ্রই আপনার রব আপনাকে অধিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে (মাকামে মাহমুদে)।" (সূরাহ বানী ইসরাইল, ১৭ : ৭৯)

ইবনে জারীর বলেন যে, অধিকাংশ তাফসীরকারের মত হলো - মাকামে মাহমুদ হলো সেই স্থান, যেখানে কিয়ামতের দিন দাঁড়িয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের জন্য সুপারিশ করবেন, যেন তারা কিয়ামতের ভীষণ বিপদ থেকে রক্ষা পায়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা সম্পর্কিত আলোচনা অনেক দীর্ঘ। পাঠকদের কথা মাথায় রেখে এতোটুকুতেই "মুহাম্মাদ" ও "আহমাদ" নাম সংক্রান্ত আলোচনা শেষ করলাম।

 

(৩) বাশীর (بشير) - সুসংবাদদাতা,

(৪) মুবাশশির (مبشر) - সুসংবাদদাতা,

(৫) নাযীর (نذير) - সতর্ককারী,

(৬) মুনযির (منذر) - সতর্ককারী,

এই চারটি গুণবাচক নামের তাৎপর্য এই যে, রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন, মুসলিম ও আল্লাহ'র একনিষ্ঠ বান্দাদের জন্য বাশীর ও মুবাশশির - সুসংবাদবাহক, এবং কাফির, মুশরিক ও আল্লাহ'র অবাধ্যদের জন্য নাযীর ও মুনযির - ভয় প্রদর্শনকারী, সতর্ককারী। নবী-রাসুলগণকে প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যও এটিই। আল-কুরানে বলা হয়েছে -

"আমি তো আপনার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি তা দিয়ে মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পারেন আর বিতণ্ডাপ্রবণ সম্প্রদায়কে তা দিয়ে সতর্ক করতে পারেন।" (সূরাহ মারইয়াম, ১৯ : ৯৭)

শেষনবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন বিশ্বনবী। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত ও রিসালাত বিশ্বব্যাপী। পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কিরামগণের মতো কোন সুনির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা সুনির্দিষ্ট এলাকার লোকদেরকে হিদায়াতের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রেরণ করেননি, বরং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো সমগ্র বিশ্ব জাহানের সকল বংশের, সকল গোত্রের, সকল বর্ণের কাছে প্রেরিত রাসুল। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাওয়াত সর্বকালীন ও সার্বজনীন। সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাঠানো হয়েছে। আল্লাহ বলেন -

"নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে; এবং এমন কোন উম্মত (সম্প্রদায়) নেই যার মধ্যে কোন সতর্ককারী অতিক্রান্ত হয়নি।" (সূরাহ ফাতির, ৩৫ : ২৪)

"আর আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।" (সূরাহ সাবা, ৩৪ : ২৮)

আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আমার এবং আমাকে আল্লাহ যা কিছু দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার উপমা হলো এমন যে -

এক ব্যক্তি কোন এক সম্প্রদায়ের কাছে এসে বললেন - 'হে কাওম, আমি নিজের চোখে শত্রুবাহিনীকে দেখে এসেছি, আমি সুস্পষ্ট সতর্ককারী, সুতরাং তোমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করো।' কাওমের কিছু লোক তার কথা মেনে নিলেন, সুতরাং রাতের প্রথম ভাগে তারা সে স্থান ছেড়ে রওনা হলেন এবং একটি নিরাপদ স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন, ফলে তারা রক্ষা পেলেন। তাদের একদল তার কথা অবিশ্বাস করলো, ফলে তারা নিজেদের আবাসস্থলেই রয়ে গেলো। প্রভাতে শত্রুবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ করলো, তাদেরকে ধ্বংস করে দিলো আর তাদেরকে নির্মূল করে দিলো।

এটাই হলো তাদের উপমা - যারা আমার আনুগত্য করে আর আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসরণ করে, এবং যারা আমার নাফরমানী করে আর আমি যে সত্য নিয়ে এসেছি তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। (বুখারী, মুসলিম)

 

(৭) শাহিদ (شاهد) - সাক্ষ্যদাতা।

(৮) শাহীদ (شهيد) - সাক্ষ্যদাতা।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের দিন মুমিন মুসলিম সৎকর্মশীলদের পক্ষে এবং কাফির মুশরিক ও অসৎকর্মশীলদের বিপক্ষে শাহিদ ও শাহীদ - সাক্ষী হবেন।

"এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্যে এবং যাতে রসূল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য ......" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২: ১৪৩)

"আর তখন কি অবস্থা হবে - যখন আমি ডেকে আনবো প্রতিটি উম্মতের মধ্য থেকে সাক্ষ্যদাতা এবং আপনাকে ডাকবো তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে।" (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৪১)

"নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে প্রেরণ করেছি এখন রাসুল, তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ, যেমন প্রেরণ করেছিলাম ফিরআউনের কাছে একজন রাসুল।" (সূরাহ আল-মুযযাম্মিল, ৭৩ : ১৫)

"হে নবী, আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।" (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৪৫)

সুলায়মান সালমান মনসুরপুরী তার কিতাব "রহমাতুল লিল আলামীন" এ শাহিদ (شاهد) নামের আলোচনায় লিখেছেনঃ উত্তম শাহিদ ও উত্তম সাক্ষী তাকেই বলা হয়, যার সাক্ষ্যের দ্বারা কোন গোপন বিষয় উদঘাটিত হয়, যার সাক্ষ্য দ্বারা অজ্ঞাত লোক জ্ঞাত হয়, অজানা লোক জেনে যায় এবং গোপন বিষয় সামনে প্রকাশ হয়ে যায়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাহিদ ছিলেন এবং اشهد ان لا اله الا الله এর সাক্ষ্য সারা বিশ্বের সামনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'ই দিয়েছিলেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাক্ষ্যে রাব্বুল আলামীনের জন্য ইবাদাতের অধিকার উলুহিয়াতের অধিকার প্রমাণ করেছে। গায়রুল্লাহ'র কাছে সাহায্য প্রার্থনা, তাকে ইবাদাত করার বিষয়ে অজস্র ধর্মমতের লোক তৎপর ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাহাদাতের ফলে তাদের সেই ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম اشهد ان محمدا رسول الله এর শাহাদাত আদায় করেছেন। রিসালাত ও নবুওয়াতের বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য, ওহীর হাকিকত, আমলের সাথে রূহের সম্পর্ক, পুরস্কার ও শাস্তির কাজের বর্ণনা, শরীয়তের প্রয়োজনীয়তা - এসবই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাহাদাতের মাধ্যমে প্রবর্তিত হয়েছে।

আল্লাহু আকবার ! শাহিদ কেমন জবরদস্ত শাহাদাত ও একনিষ্ঠ সত্যবাদিতার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন যে, বিশ্বের বুকে একলাই এসেছিলেন এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই আল্লাহ'র হাজার হাজার বান্দাকে সেই শাহাদাতের উপর প্রতিষ্ঠিত, এমনকি ভবিষ্যতে আগমনকারী সম্প্রদায়ের লোকজনের জন্যও শাহিদ বলে বিবেচিত হবেন। তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই সনদপত্র দেওয়া হয়েছে - تَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ

 

(৮) হারীস (حريص) - মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী,

(৯) রাউফ (رءوف) - দয়ার্দ্র, সহানুভূতিশীল,

(১০) রহীম (رحيم) - পরম দয়ালু, করুণাময়।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন সর্বাত্মক কল্যাণ ও মঙ্গলকামী - হারীস, মানবজাতির প্রতিটি দিক ও বিভাগের প্রতি রাউফ - সহানুভূতিশীল এবং রাহীম - করুণাসিক্ত। এই তিনটি গুণবাচক নাম এই আয়াতে এসেছে -

"অবশ্যই তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে এক রাসুল এসেছেন, তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে, তা তার জন্য কষ্টদায়ক, তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।" (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ : ১২৮)

কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ লোকজনের বিভ্রান্তির বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কল্যাণকামী ছিলেন, যেন আল্লাহ তাদের হিদায়াত দান করেন। যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি, তাদের প্রতিও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কল্যাণকামী ছিলেন, যেন তারা ইসলাম গ্রহণ করে। (তাবারী, ৫খ.)

আল্লামা আলূসী বলেন, উম্মতের কষ্টে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কষ্ট পান। কোন ব্যক্তির অঙ্গে আঘাত লাগলে যেরূপ কষ্ট অনুভূত হয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের কষ্টে সেরূপ কষ্ট অনুভব করেন। সাহল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ থেকে সামান্য সময় গাফিল থাকা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য কষ্টকর। মাহবুব থেকে গাফিল থাকা অপেক্ষা অধিক কষ্ট অন্য কিছুতে নেই। সুতরাং তোমাদের অবস্থার সংশোধন, তোমাদের উপস্থিতি এবং প্রভু থেকে গাফিল না হওয়ার প্রতি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগ্রহী। (রুহুল মাআনি, ৬খ.)

আহমাদ রহঃ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ যতো বিষয়কে হারাম করেছেন, এর প্রতিটি বিষয় সম্বন্ধেই একে হারাম করার পূর্বে জানতেন যে, তার কোন না কোন বান্দা তা করতে চেষ্টা করবে; আর আমি তোমাদের কোমর ধরে পিছনে টেনেছি, যাতে তোমরা কীট-পতঙ্গের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো দোযখে ঝাঁপিয়ে না পড়ো।

মানবজাতিকে দোযখের পথ থেকে ফিরে এসে জান্নাতের পথের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য আহবান করতে গিয়ে মানুষকে সেই আহবান না শুনে দোযখের পথে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখাটা মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য কষ্টকর ছিল। আল্লাহ বলেছেন -

"আপনি যাকে পছন্দ করেন, তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ'ই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন; কে সৎপথে আসবে সে সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন।" (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮: ৫৬)

আর আল্লাহ তার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সান্ত্বনা দিয়েছেন -

"তারা মুমিন হচ্ছে না বলে আপনি হয়তো মনোকষ্টে আত্মবিনাশী হয়ে পড়বেন।" (সূরাহ আশ-শুয়ারা, ২৬ : ৩)

"তারা এই বাণী বিশ্বাস না করলে সম্ভবত তাদের পিছনে ঘুরে আপনি দুঃখে আত্মবিনাশী হয়ে পড়বেন।" (সূরাহ আল-কাহফ, ১৮ : ৬)

"হে রাসুল, তাদের জন্যে দুঃখ করবেন না যারা দৌড়ে গিয়ে কুফরে পতিত হয় ....." (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ৪১)

"তারা যদি আপনাকে মিথ্যাবাদী বলে, তবে আপনার পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণকেও তো মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল; আল্লাহর প্রতিই যাবতীয় বিষয় প্রত্যাবর্তিত হয়।" (সূরাহ ফাতির, ৩৫ : ৪)

"বিদ্রুপকারীদের জন্যে আমি আপনার পক্ষ থেকে যথেষ্ট।" (সূরাহ আল-হিজর, ১৫ : ৯৫)

 

(১২) দাঈ ইলাল্লাহ (داعي الى الله) - আল্লাহ'র দিকে আহবানকারী।

"আর (আপনাকে প্রেরণ করেছি) আল্লাহ'র দিকে আহবানকারীরূপে তারই (আল্লাহ'র) অনুমতিক্রমে ...." (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৪৬)

সুলায়মান সালমান মনসুরপুরী বলেনঃ আল্লাহ তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম "দাঈ ইলাল্লাহ" নির্ধারণ করেছেন, আর তার পবিত্র কালামে এর সাথে সাথে "باذنه" শব্দটিও সংযোজন করা হয়েছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সার্বিক অনুমতি দেওয়া হয়েছে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকলকে আল্লাহ'র ঘরের মেহমান নির্ধারণ করবেন আর নৈকট্য ও সন্তুষ্টির দাওয়াত দিবেন। (রাহমাতুললিল আলামীন, ৩খ.)

"হে আমার সম্প্রদায়, আল্লাহ'র(প্রেরিত) আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি ঈমান আনো, তিনি (আল্লাহ) তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন এবং নির্মম শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহ'র আহবানকারীর প্রতি সাড়া দিবে না, সে পৃথিবীতে আল্লাহ'র অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পারবে না এবং আল্লাহ'র সম্মুখে তাদের কোন সাহায্যকারী নেই, তারা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।" (সূরাহ আল-আহক্বাফ, ৪৬: ৩১-৩২)

 

(১৩) হাদী (هادي) - পথপ্রদর্শক।

সুলায়মান সালমান মনসুরপুরী বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন হাদী। হিদায়াত শব্দের অর্থ ও ভাব দুই প্রকারের -

(ক) কারো অন্তরে ঈমান ঢেলে দেওয়া বা পৌঁছে দেওয়া। প্রদত্ত আয়াতটিতে এই অর্থ গৃহীত হয়েছে -

"নিশ্চয়ই যাকে আপনি ভালোবাসেন, তাকে আপনি হিদায়াত দিতে পারেন না ....." (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮ : ৫৬)

(খ) কাউকে ঈমান ও ইয়াকিনের দিকে আহবান করা এবং নিজের দাওয়াতের গুরুত্ব ও সত্যতার স্বপক্ষে আত্মিক ও জ্ঞান-বিবেক গ্রাহ্য দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করা এবং নিজের প্রশংসিত ক্রিয়া-কর্ম ও যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তা দ্বারা মজবুত করা। উদ্দেশ্য থাকবে তার মধ্যে কোন প্রকার লোভ-লালসা থাকবে না বা ব্যক্তিগত কোন বিশেষ উদ্দেশ্য থাকবে না; বরং উদ্দেশ্য থাকবে সৎ এবং কর্তব্য পালন করা। এই উদ্দেশ্যের পূর্ণতা শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যেই পাওয়া যায়। নিচের আয়াতে এই উদ্দেশ্যেরই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় -

"..... আর নিশ্চয়ই আপনি সরল পথ প্রদর্শন করেন" (সূরাহ আশ-শুরা, ৪২ : ৫২)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিদায়াত ও সত্য পথের দিকে দাওয়াতের সকল উৎকৃষ্ট পন্থা একত্রিত করেছিলেন। দূরদৃষ্টি, নম্র স্বভাব, উৎকৃষ্ট চরিত্র এমন সকল গুণাবলী - যাতে শত্রুরাও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে দেখে তাদের শত্রুতার কথা ভুলে যেতো। মিষ্টভাষী, স্পষ্ট বর্ণনা এমন ছিল যে, মুখ থেকে বের হলেই শ্রবণকারীর হৃদয়ে গেঁথে যেতো।

কোন দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করার সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তর্কশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্রের কূটকৌশলে তা জটিল করে তুলতেন না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দলীল ছিল প্রকৃতিগত ও ঐশ্বরিক। মানুষের সামনে তার নিজস্ব স্বভাব-প্রকৃতি তুলে ধরা অথবা মানুসের আশেপাশের পরিবেশকে মানুষের জন্য দলীলস্বরূপ উপস্থাপন করা ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নীতি।

আল্লাহ তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য এমন সব প্রকৃতিগত নিয়মকানুন খুলে দিয়েছিলেন, যার উপর মানুষ জন্মলাভ করেছে। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দলীলও হতো সরাসরি মানুষের সৃষ্টিগতভাবে আকর্ষণকারী ও সম্বোধন উপযোগী।

এছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানব সম্প্রদায়ের জন্য এমন পরিপূর্ণ নমুনা ছিলেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাবতীয় কাজকর্ম হতো তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথা বা বক্তব্য অনুযায়ী। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা হতো তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাজের অনুরূপ। এই জাহের ও বাতেনের সমন্বয় এবং কথা ও কাজের সমন্বয় অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে মানব সম্প্রদায়ের সত্য "হাদী" বানিয়ে দিয়েছিলো। (রহমাতুললিল আলামীন, ৩খ.)

 

(১৪) মুযাক্কির (مذكر) - উপদেশদাতা।

"সুতরাং আপনি উপদেশ দিন, আপনি তো একজন উপদেশদাতা।" (সূরাহ আল-গাশিয়াহ, ৮৮ : ২১)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন এক অনন্য অসাধারণ উপদেশদাতা, অন্য কোন ব্যক্তিত্বের সাথে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তুলনাই হয় না।

কাযী ইয়ায লিখেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে "জাওয়ামিউল কালাম" বা "এক বাক্যে বহু বাক্যের সমাবেশ" এর বৈশিষ্ট্য আল্লাহ দিয়েছেন। (আশ শিফা, ১খ.)

উম্মে মাবাদ রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, "তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কণ্ঠস্বর ছিল সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেশী কথা বলতেন না, আর প্রয়োজনের চেয়ে কমও বলতেন না। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাক্যগুলো মুক্তার মতো পৃথক পৃথক গণনা করা সম্ভব হতো। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আওয়াজ ছিল উচ্চ ও মাধুর্যপূর্ণ। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।" (মুসতাদরাক হাকেম, দালায়েলুন নবুওয়াত)

আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, "রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কথা কথা বলতেন, তখন (মমত্ববোধের কারণে) কথা বলার মুহূর্তে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওষ্ঠাধারে স্মিত হাসির রেখা ফুটে থাকতো।" (আখলাকুন নবী)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাবার্তার বৈশিষ্ট্যের আরো বিস্তারিত বিবরণ পড়লে এবং মানুষের সাথে তার অসাধারণ ব্যবহারের প্রকৃতি সম্পর্কে জানলে এটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মানব ইতিহাসে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মতো অনন্য উপদেশদাতা আর হতে পারেই না।

 

(১৫) সিরাজুম মুনীর (سراج منير) - উজ্জ্বল প্রদীপ,

(১৬) নূর (نور) - হিদায়াতের জ্যোতি।

নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যের জমাট আঁধারে আবদ্ধ মৃতপ্রায় ধরণীতে সভ্যতার আলো প্রজ্বলিত করতে এবং মুক্তির প্রাণপ্রদীপ জ্বালাতে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে পাঠানো হয়েছে "সিরাজুম মুনীর" প্রদীপ্ত আলোকবর্তিকারূপে। আসমানি হিদায়াতের উজ্জ্বল সূর্য রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিচ্ছুরিত জ্যোতি ও আলোকশিখায় নিহিত মানুষের সর্বপ্রকার কল্যাণ। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জ্যোতি থেকেই মানবতার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জগত লাভ করে রূহানী শক্তি, ঐশী আলো - নূরে হিদায়াত। আলোকে অস্বীকার করলে যেমন অন্ধকারে পতন অনিবার্য, তেমনি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাকে অস্বীকার করলে ভ্রষ্টতা আর ধ্বংস অনিবার্য।

"..... আল্লাহ'র কাছ থেকে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে। যারা আল্লাহ'র সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, এর দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন।" (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১৫-১৬)

এখানে "জ্যোতি" অর্থ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

 

(১৭) নি'মাহ (نعمة) - কল্যাণ ও সৌভাগ্যের নবী,

(১৮) রহমত (رحمة) - করুণা ও দয়ার নবী,

(১৯) নবীয়ীর-রহমাহ (نبي الرحمة) - করুণার নবী।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অস্তিত্ব বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান ব্যক্তিত্ব বিশ্বব্যবস্থার জন্য নিয়ামতস্বরূপ। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বরকতে বিশ্ববাসী লাভ করেছে হিদায়াতের আলো, জীবনপথের দিশা, সর্বশেষ পয়গাম - আল কুরআন, এবং মূর্খতা ও শিরকের অন্ধকার থেকে মুক্তি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমগ্র বিশ্বের করুণা - রহমাতুললিল আলামিন (رحمة للعلمين)। মহান আল্লাহ যেমন সমগ্র বিশ্বের খালিক - স্রস্টা, তার বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেমনি গোটা বিশ্বের করুণা।

সুলায়মান সালমান মনসুরপুরী "রহমত" নামের আলোচনায় লিখেছেনঃ কুরআন মাজিদে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে "রহমাতুললিল আলামিন" বলা হয়েছে।

আল্লাহ নিজেকে "রব্বুল আলামিন" বলেছেন, কুরআন হাকীমকে "যিকরুললিল আলামিন", কাবা শরীফকে "মুবারাকাও-ওয়া হুদাললিল আলামিন", নূহের কিশতীকে এবং মারিয়াম ও ঈসাকে "আয়াতুললিল আলামিন" বলা হয়েছে। কিন্তু "রহমাতুললিল আলামিন" শুধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কেই বলা হয়েছে। ........

............ এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রহমতের ফয়েজ পশু-পাখি ও পতঙ্গকুলের কাছেও পৌঁছেছে। তাদের শিকার ও জবাই করার নিয়মকানুন এবং লালনপালনের পালনের ব্যাপারে বিধান জারি করেছেন। ....... মোটকথা, এই রহমত থেকে কেউ বঞ্চিত হয়নি। (রহমাতুললিল আলামিন, ৩খ.)

ইবনুল কায়্যিম "নবীয়ীর রহমাহ" নামের আলোচনায় লিখেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সারা বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল দুনিয়াবাসীর জন্য এ কারণে সাধারণ যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসলমান হোক বা কাফির - সকলের উপরই রহম করেন। ইসলামের অনুসারীরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রহমত থেকে অত্যন্ত উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু কাফির এবং তাদের মধ্যে আহলে কিতাব বিশেষভাবে সর্বদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগ্রহের আশ্রয়ে শান্তিপূর্ণভাবে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে। তবে হ্যা, যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যুদ্ধ শুরু করেছিলো, তারা নিজেরাই জাহান্নামকে স্বাগত জানিয়েছে .... (যাদুল মাআদ, ১খ.)

 

(২০) খাতামুন নাবিয়্যিন (خاتم النبيين) - নবীদের সর্বশেষ, শেষ নবী,

(২১) আকিব (عاقب) - শেষে আগমনকারী শেষ নবী।

".... বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী ...." (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ : ৪০)

আবু উমামা বাহিলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আমি নবীগণের সর্বশেষ, আর তোমরা সমস্ত উম্মতের মধ্যে সর্বশেষ।" (ইবন মাজা)

সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "... আমিই সর্বশেষ নবী ...." (মুসলিম)

"...... আর আমি হলাম আকিব, যার পরে কোন নবী নেই।" (বুখারী)

 

(২২) শাফি (شافع) - সুপারিশকারী,

(২৩) শাফী (شفيع) - সুপারিশকারী, পৃষ্ঠপোষক,

(২৪) মুশাফফা (مشفع) - যার সুপারিশ গৃহীত।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত পরবর্তী বিচার দিবসে মুসলিমদের জন্য মহান আল্লাহ'র আদালতে শাফী - সুপারিশকারী হবেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হবেন অপরাধীদের পক্ষে প্রার্থনাকারী। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শাফাআত ও মুক্তি প্রার্থনা অপরাধীদের পক্ষে গৃহীত হবে। (মিশকাতুল মাসাবিহ, বাবুল হাওজ ওয়াশ শাফাআহ)

 

(২৫) মুস্তাফা (مصطفي) - নির্বাচিত, মনোনীত;

(২৬) আল-মুখতার (المختار) - বাছাইকৃত, চয়নকৃত।

গোটা বিশ্বের জন্য হিদায়াত ও পয়গামে ইলাহী বহনের জন্য রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মহান আল্লাহ'র মনোনীত বাছাইকৃত ও নির্বাচিত ব্যক্তি - মুস্তাফা ও মুখতার। মহান আল্লাহ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাছাই করেছেন নবী হিসেবে যুগ-যুগান্তর, বংশ পরম্পরায়। এ প্রসঙ্গে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

"মহান আল্লাহ ইসমাইলের বংশ থেকে কিনানাকে মনোনীত করেছেন, কিনানা বংশ থেকে কুরাইশকে মনোনীত করেছেন, এরপর কুরাইশ বংশ থেকে বনু হাশিমকে মনোনীত করেছেন এবং বনু হাশিম থেকে আমাকে মনোনীত করেছেন।" (মুসলিম)

 

(২৭) মুতাওয়াক্কিল (المتوكل) - আল্লাহ'র উপর আস্থাশীল ও নির্ভরকারী।

তাওয়াককুল অর্থাৎ আল্লাহ'র উপর ভরসা করার ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোটা জীবনে তাওয়াককুলের ঘটনাসমূহের মধ্যে হিজরতের সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায় উদাহারনবশত। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের এক চরম পরিস্থিতিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে বললেন -

"..... তুমি বিষণ্ণ হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথেই রয়েছেন ...." (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ : ৪০)

 

(২৮) আবদুল্লাহ (عبدالله) - আল্লাহ'র বান্দা।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে বড় গুণবাচক নাম হলো "আবদ" বা বান্দা। কুরআনুল কারীমের বহু স্থানে, বিশেষ করে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশেষ বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রকাশের ক্ষেত্রগুলোতে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) "আবদ" নামে স্মরণ করা হয়েছে। যেমন, মিরাজের ঘটনা বর্ণনায় রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সরাসরি নাম উল্লেখ না করে "আবদ" গুণবাচক নামে আলোচনা করা হয়েছে। দেখুনঃ ১৭ : ১, ১৮ : ১, ৫৭ : ৯, ৭২ : ১৯।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এটি যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন মানুষের দাস নন, নফস তথা মনস্কামনারও দাস নন, বরং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বয়ং আল্লাহ'র আবদ - বান্দা, কেবল তারই বান্দা ও তারই অনুগত। এ কারণে পৃথিবীর বুকে তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবচেয়ে স্বাধীন মানুষ। নিজেকে আল্লাহ'র আবদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা মানব জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তাই নবী-রাসুলগণ নিজেদেরকে এই গুণে প্রতিষ্ঠিত করতে সদা সচেস্ট ছিলেন।

সুলায়মান সালমান মনসুরপুরী "আবদুল্লাহ" নামের আলোচনায় লিখেছেনঃ

দাসত্বই হচ্ছে পরিপূর্ণ মানবতা এবং দাসত্বের (উবুদিয়াতের) পূর্ণতা আসে নবুওয়াতের মর্যাদার দ্বারা। আল্লাহ যেখানে কোন নবীকে ভালোবাসা ও মুহাব্বাত এবং কবুল করার ভাষায় উচ্চারণ করেছেন, সেখানে "আবদ" শব্দটি সংযোজন করেছেন -

"..... আর আমার শক্তিশালী বান্দা দাউদকে স্মরণ করুন ......." (সূরাহ সাদ, ৩৮ : ১৭)

"আর স্মরণ করুণ, আমার বান্দা আইয়ুবের কথা ....." (সূরাহ সাদ, ৩৮ : ৪১)

"এটি আপনার রবের অনুগ্রহের বিবরণ তাঁর বান্দা যাকারিয়ার প্রতি।" (সূরাহ মারইয়াম, ১৯ : ২)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উবুদিয়াতের পবিত্র শাজরা এমন, যার ফল অত্যন্ত সুমিষ্ট -

(ক) কুরআন অবতরণের কারণ উবুদিয়াতে কামেলা বলা হয়েছে -

"পরম কল্যাণময় তিনি - যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফয়সালার গ্রন্থ অবর্তীণ করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হয়।" (সূরাহ আল-ফুরকান, ২৫ : ১)

(খ) আল্লাহ'র প্রাচুর্যের কারণ হচ্ছে উবুদিয়াত -

"আল্লাহ কি তার বান্দার পক্ষে যথেষ্ট নন ? ...." (সূরাহ আয-যুমার, ৩৯ : ৩৬)

(গ) মিরাজ উবুদিয়াতের ফল -

"পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন ..." (সূরাহ বনী ইসরাইল, ১৭ : ১)

(ঘ) উচ্চ মর্যাদার পুরস্কার উবুদিয়াতের উপর প্রদত্ত -

"তখন আল্লাহ তার বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করবার, তা প্রত্যাদেশ করলেন।" (সূরাহ আন-নাজম, ৫৩ : ১০)

এ কথা সত্য যে, মসীহ আলাইহিস সালামও সিদ্দীকা মারিয়ামের কোলে বলেছিলেন -

"... নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ'র বান্দা ......" (সূরাহ মারইয়াম, ১৯ : ৩০)

এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কেও "আবদুল্লাহ" (আল্লাহ'র বান্দা) বলা হয়েছে -

"আর যখন আল্লাহ বান্দা তাকে ডাকার জন্যে দন্ডায়মান হলো, তখন অনেক জিন তার কাছে ভিড় জমালো।" (সূরাহ আল-জীন্ন, ৭২: ১৯)

কিন্তু দুটি স্থানের মর্যাদার পার্থক্য অত্যন্ত পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে। "নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ'র বান্দা" - এটা মসীহের নিজের কথা, কর্ম তার সাথে নেই। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে স্বয়ং আল্লাহ'ই "আবদুল্লাহ" বলেছেন, সাথে সাথে ইবাদাতের উপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং দাওয়াতের কাজে লেগে থাকার কথাও প্রমাণিত আছে।

হ্যা, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবদুল্লাহ, এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উবুদিয়াতের সাক্ষ্য স্বয়ং মাবুদ মাসজুদ নিজেই।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবদুল্লাহ, এবং উবুদিয়াতের দাওয়াতের কাজে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকলের চেয়ে বেশী উত্তীর্ণ।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবদুল্লাহ, এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কালেমা তাওহীদে নিজের প্রশংসিত নামের সাথে "আবদুহু ওয়া রাসুলুহু" শব্দ অবিভাজিতভাবে স্থাপন করেছেন। এটা তো অসম্ভব যে, কোন ব্যক্তি কালেমা শাহাদাত পড়বে আর তিনি আল্লাহ'র নামের সাথে "ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু" এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের সাথে "আবদুহু ওয়া রাসুলুহু" পড়বে না।

 

(২৯) মুআল্লিম (معلم) - শিক্ষক।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হয়েছিলেন মানবজাতির জন্য আদর্শ শিক্ষক হিসেবে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানবজাতিকে অজ্ঞতা ও মূর্খতার সকল পংকিলতা থেকে পরিচ্ছন্ন করে জ্ঞানের পরশে শিক্ষিত করে গড়ে তোলেন।

ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ও ইসমাইল আলাইহিস সালাম উভয়ে তাদের বংশধর থেকে মানবজাতির জন্য শিক্ষক হিসেবে একজন রাসুল প্রেরণের জন্য মহান আল্লাহ'র কাছে মোনাজাত করেছিলেন -

"হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে থেকেই তাদের কাছে একজন রাসুল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন, আর তাদের পবিত্র করবেন; নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১২৯)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন তাদের সেই দুয়ার ফল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহ'র কিতাব আল কুরআন, হিকমত এবং আরো এমন সব ঐশী জ্ঞান-বিজ্ঞান, যা মানুষ জানতো না।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ পরিচয় সম্পর্কে বলেছেন, "আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।" (মিশকাতুল মাসাবিহ)

 

(৩০) উম্মী (الامي) - অক্ষরজ্ঞানমুক্ত, নিরক্ষর।

উম্মী বা নিরক্ষর হওয়া সাধারণ মানুষের জন্য সুখকর ও প্রশংসনীয় কোন গুণ নয়, বরং তা একজন মানুষের ত্রুটি হিসেবেই গণ্য। কিন্তু রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, মহাজ্ঞানী, মহান শিক্ষক ও অতুলনীয় বাগ্মিতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) "উম্মী" উপাধিতে পরিচিত করা হয়েছে। কেননা, এটি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য ত্রুটি বা অগৌরব নয়, বরং এটি তো তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিপূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের দলীল; তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রচারিত শিক্ষার সন্দেহাতীত সত্য ও অকাট্য প্রমাণ - সর্বোপরি উম্মীত্ব হচ্ছে মহান আল্লাহ'র পক্ষ থেকে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেওয়া এক বিশেষ নিয়ামত ও অনন্য মুজিযা। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অস্তিত্ব তথা জাগতিক ধ্যানধারণা প্রসূত শিক্ষাগ্রহণ এবং লেখাপড়া প্রসূত জ্ঞান থেকে মুক্ত থাকা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেন -

"আপনি তো এর পূর্বে কোন কিতাব পাঠ করেননি এবং নিজ হাতে কোন কিতাব লিখেননি যে, মিথ্যাচারীরা সন্দেহ পোষণ করবে।" (সূরাহ আল-আনকাবুত, ২৯: ৪৮)

মূলত এ কারণেই উম্মী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে যখন কাফিররা আল-কুরআনের প্রজ্ঞাপূর্ণ বলিষ্ঠ ও উচ্চ সাহিত্যিক মানসম্পন্ন কালাম শুনতে পেলো, তখন তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো এবং শেষতক তাদের গোঁয়ার্তুমীমুক্ত ব্যক্তিরা এ কথা বলতে বাধ্য হলো যে, এটি কোন মানুষের রচিত কালাম নয়, এটি আল্লাহ প্রদত্ত।

মূল কথা, রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মীত্ব তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত ও আসমানী ওহী প্রাপ্তির এক অকাট্য প্রমাণ। মহান আল্লাহ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত স্বপ্রমাণ করার জন্য যে সকল সুস্পষ্ট মুজিযা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্ণ অক্ষরজ্ঞানমুক্ত রাখাও অন্যতম।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাগতিক ধ্যান-ধারণা প্রসূত শিক্ষায় শিক্ষা লাভ করেননি, কোন মানুষও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষক ছিলেন না; অথচ তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন মানব সমাজের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, সকল শিক্ষকের শিক্ষক। এর তাৎপর্য এই যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষক ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ।

"...... আর তিনি আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন এমন সব বিষয়, যা আপনি জানতেন না; আর আপনার প্রতি আল্লাহর করুণা অসীম।" (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ১১৩)

 

(৩১) কাসিম (قاسم) - বণ্টনকারী।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহ'র পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হয়েছিলেন অফুরন্ত মঙ্গল, কল্যাণ ও ইহ-পরকালীন সুখ-শান্তির পথনির্দেশক ঐশী জ্ঞান - ইলমে ওহী। এরপর আল্লাহ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশ করেছেন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাধ্যানুসারে আল্লাহ'র এই নিয়ামতকে মানবজাতির মধ্যে বণ্টন করে দিতে।

"এবং আপনার রবের নিয়ামতের কথা প্রকাশ করুন।" (সূরাহ আদ-দুহা, ৯৩: ১১)

মহান দাতা আল্লাহ'র নিয়ামতের বণ্টনকারী হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -

"আমি তো কেবল বণ্টনকারী, আল্লাহ'ই আমার দাতা।" (মিশকাতুল মাসাবীহ)

 

(৩২) মুয়াসসির (ميسر) - সহজকারী।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবজাতির জন্য যে দ্বীন ও শরিয়াত নিয়ে এসেছেন, তা অত্যন্ত সহজ-সরল ও কঠিনতামুক্ত। সর্বস্থানে সকল পরিবেশে, সকল সময়ে, সকল ক্ষেত্রে, সর্বস্তরের মানুষের পক্ষে অনুসরণযোগ্য দ্বীন হলো দ্বীনে মুহাম্মাদী। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে আসা দ্বীন সহজ-সরল, জবরদস্তি ও বাড়াবাড়িমুক্ত এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর নাযিলকৃত কিতাব "আল-কুরআন"ও সহজপাঠ্য, সহজবোধ্য এবং সহজে আয়ত্তযোগ্য।

"কুরআনকে আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি ?" (সূরাহ আল-কামার, ৫৪ : ১৭)

 

(৩৩) আস-সাদিক (الصادق) - সত্যবাদী,

(৩৪) আল-মাসদুক (المصدوق) - যাকে সত্যবাদী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে,

(৩৫) আল-আমীণ (الامين) - বিশ্বস্ত, বিশ্বাসী।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত লাভের পূর্বে বাল্যকাল থেকেই সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার কারণে সকলের কাছে অতি প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন। সত্যবাদী ও আমানতদার হিসেবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরব সমাজে সর্বোচ্চ শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই গুণের খ্যাতির কারণে আরবেরা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) "আল আমীন" ও "আস-সাদিক" উপাধি দিয়েছিলো। (ইবনে হিশাম - আস সিরাতুন নাবাবিয়্যা, ১খ.)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ প্রদত্ত ওহী যথাযথভাবে ও বিশ্বস্ততার সাথে দুনিয়াবাসীর কাছে পৌঁছিয়েছেন। ইলাহী পয়গাম পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই সততা ও বিশ্বস্ততার কারণে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) "আল-মাসদুক" উপাধিতে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শানেই নাযিল হয় কুরআনের এই আয়াত -

"তোমাদের সংগী পথভ্রষ্ট হননি এবং বিপথগামীও হননি। এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথাও বলেন না। এটি তো ওহী - যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।" (সূরাহ আন-নাজম, ৫৩ : ২-৪)

 

(৩৬) আফসাহুল আরাব (افصح العرب) - শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও শ্রেষ্ঠ বাগ্মী।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষা ও কথাবার্তা হতো অতি উঁচু সাহিত্যমান সমৃদ্ধ, বলিষ্ঠ ও বাগ্মিতায় পরিপূর্ণ। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিটি বাণী শাব্দিক বিশুদ্ধতা ও ভাষালংকারের দিক দিয়ে ছিল অতুলনীয়।

একদিন উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু বিস্ময়ের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে প্রশ্ন করলেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনি তো কখনো ভাষা শিখার জন্য আমাদের লোকালয় থেকে বাইরে যাননি, তাহলে কি রহস্য ? আমরা যে আপনাকে আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যিক ও বাগ্মীরূপে দেখতে পাচ্ছি ?"

উত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "জিবরীল আমাকে ইসমাইলি ভাষা (আরবি) শিক্ষা দিয়েছেন।" (আল-মুযহির লিস-সুয়ুতী, ১খ.)

মোটকথা, রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উঁচু সাহিত্যগুণ ও বাগ্মিতা ছিল তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যতম মুজিযা।

 

(৩৭) ইবনুয-যাবীহায়ন (ابن الذبيحين) - আল্লাহ'র নামে কুরবানীকৃত দুই ব্যক্তির পুত্র।

এই যাবীহ দুই ব্যক্তি হলেন - ইসমাইল ইবন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতা আবদুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিব।

ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তার আদরের সন্তান ইসমাইল আলাইহিস সালামকে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতামহ আবদুল মুত্তালিব তার আদরের সন্তান আবদুল্লাহ'কে মহান আল্লাহ'র জন্য কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এরপর মহান আল্লাহ'র অনুগ্রহে একটি দুম্বা ও একশত উটের বিনিময়ে যথাক্রমে তাদের কুরবানী সম্পাদিত হয়। এই প্রেক্ষিতে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেকে "আমি দুই যাবীহুল্লাহ'র সন্তান" বলতেন। (তাবাকাত ইবন সাদ, ১খ.)

 

(৩৮) নবীয়ীল মালহামাহ (نبي الملحمة) - যুদ্ধের নবী।

রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আমি মুহাম্মাদ, আর আহমাদ, আর মুকাফফা, আর হাশের, আর নবীয়্যুর রহমাহ, আর নাবিয়্যুত তাওবাহ, আর নাবিয়্যুল মালহামাহ।" (মুসনাদ আহমাদ)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা - যার যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে, দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টিকারী শয়তানী শক্তিকে উৎখাত করে আল্লাহ'র দ্বীন কায়েম করার মাধ্যমে দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই জিহাদ ও কিতাল করতে গিয়ে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন একটি মানুষের সাথেও বে-ইনসাফি করেন নি, করার নির্দেশও দেন নি। বরং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গোটা জীবনই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনসাফপূর্ণ যুদ্ধের জীবন্ত প্রমাণ। এই জিহাদ ও কিতালকে কেবল অপরাধীরাই ভয় করে। জিহাদ অশান্তির কারণ নয়, বরং জিহাদের অভাবেই অশান্তি সৃষ্টি হয়, যেহেতু অপরাধীরা ঢিল পেয়ে যায়।

ইবনুল কায়্যিম এই নামের আলোচনায় লিখেছেনঃ উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে আল্লাহ শত্রুদের সাথে জিহাদ করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। এটিই কারণ যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মত পূর্বের সকল উম্মত থেকে অধিক মাত্রায় জিহাদ করেছিলেন। সুতরাং এই উম্মত ও কাফিরদের মধ্যে যে পরিমাণ তুমুল যুদ্ধ হয়েছিলো ইতিপূর্বে কোন উম্মতকে এমন ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। কেননা, এ এমন এক উম্মত, যারা প্রত্যেক যুগে দুনিয়ার আনাচে-কানাচে আল্লাহ'র দ্বীনের শত্রুদের সাথে জিহাদ করতে মুখোমুখি হয়েছে। (যাদুল মাআদ, ১খ.)

আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বাধিক সুপুরুষ, সর্বাধিক সাহসী ও সবচেয়ে বেশী দয়া-দাক্ষিণ্যের অধিকারী। (আখলাকুন নবী)

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ বদরের যুদ্ধের দিন আমি নিজ চোখে দেখেছি যে, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আশেপাশে আশ্রয় খুঁজছিলাম, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের সকলের তুলনায় শত্রুদের বেশী কাছাকাছি পৌঁছে মুকাবিলা করে যাচ্ছেন। বদরের সেদিন তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বীরত্ব ও সাহসিকতা ছিল সর্বাধিক। (আখলাকুন নবী)

 

(৩৯) সাহিব (صاحب) - সাথে থাকা।

মসীহ আলাইহিস সালাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিহ্ন বর্ণনায় বলেছেন - তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদের সাথে থাকবেন। এর দ্বারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত স্থায়ী হওয়া প্রমাণিত হলো। এ কথা প্রমাণিত সত্য যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানব সম্প্রদায়ের সাথে সেই সময় পর্যন্ত থাকবেন, যতদিন তারা স্বয়ং অবশিষ্ট থাকবে। মক্কার কাফিররাও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে "সাহিবে কুরাইশ" স্মরণ করতো। তারা যে উদ্দেশ্যেই এই শব্দটি ব্যবহার করুক না কেন, আল্লাহ পবিত্র অর্থেই শব্দটি ব্যবহার করেছেন আর বলেছেন -

"এবং তোমাদের সাথী পাগল নন।" (সূরাহ আত-তাকওয়ীর, ৮১ : ২২)

আম্বিয়াগণের মধ্যে এমন বুজুর্গও ছিলেন, যারা পাপী উম্মতের খারাপ কাজ ও ঘৃণিত কাজসমূহ দেখে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন এবং তাদেরকে ত্যাগ করে পৃথক হয়ে গেছেন। আল্লাহ তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধৈর্য ও সবরের প্রশংসা করে বলেছেন যে, এই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে যে, তিনি(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাফরমানদের সংশোধনের ব্যাপারে নিরাশ হতেন না, তাদেরকে দরবার থেকে দূর করে দিতেন না, তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়াকে পছন্দ করতেন না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো ছিলেন সবরকারী এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবর ছিল আল্লাহ'র সাহায্য ও সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। যাকে তারা "সাহিব" বললো, তাদের মধ্যকার লোকেরাই পরবর্তীতে তার সাহাবী হওয়াকে সম্মানের কাজ বলে গণ্য করলো। (রহমাতুললিল আলামীন, ৩খ.)

 

(৪০) সাদি (صادع) - বর্ণনা করা।

আল্লাহ'র হুকুমকে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা, দুনিয়ার বিরুদ্ধাচরণ ও শত্রুতাকে পরওয়া না করা, হুমকি-ধমকির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা, শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও আক্রমণের ভয়ে ভীত না হওয়া - রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন এসব গুণের অধিকারী।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরবের মতো দুর্ধর্ষ খুনি, জংলী, মূর্তি পূজারীদেরকে সাফ সাফ শুনিয়ে দিয়েছিলেন -

"নিশ্চয়ই তোমরা, আর আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদাত করো - সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা তাতে প্রবেশ করবে।" (সূরাহ আল-আম্বিয়া, ২১ : ৯৮)

ইয়াহুদী সম্প্রদায় ব্যবসা-বাণিজ্যের একচ্ছত্র মালিক হওয়ার কারণে সমগ্র আরব বিশ্বের উপর আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলো এবং যাদের সুদ ও ঋণের জালে প্রত্যেক ধনী ও গরীব আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি খৃস্টানেরা - যাদের রাজত্ব সিরিয়া, মিসর, ইয়ামান এবং এশিয়া মাইনর ও ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তাদেরও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিষ্কার ভাষায় শুনিয়ে দিয়েছিলেন -

"বলুনঃ হে আহলে কিতাব, তোমরা কোন কিছুর উপরই (প্রতিষ্ঠিত) নও, যতক্ষণ না তোমরা তাওরাত, ইনজিল ও তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা (কুরআন) কায়েম করো ....." (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫: ৬৮)

আর "সাদি" তো তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), যিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের কালেমা পাঠকারীদেরও বলে থাকেন -

"বলুনঃ আমি তোমাদের ক্ষতি সাধন করার ও সুপথে আনয়ন করার মালিক নই।

বলুনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ থেকে কেউ আমাকে কখনো রক্ষা করতে পারবে না, আর তিনি ছাড়া আমি কোন আশ্রয় পাবো না।" (সূরাহ আল জীন্ন, ৭২ : ২১-২২)

(রহমাতুললিল আলামিন, ৩খ.)

 

(৪১) তাহির (طاهر) - পবিত্র,

(৪২) তাইয়েব (طيب) - পবিত্র।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন"তাহির"। তিনি হসব-নসব বা বংশাবলীর দিক দিয়ে সর্বোচ্চে। পূর্ব পুরুষগণ যারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নূর বহন করতেন, সকল প্রকার খুন-খারাবী ও খারাপ কাজ থেকে পবিত্র ছিলেন এবং বংশাবলীর মধ্যে সকল শ্রদ্ধেয় বুজুর্গগণ অপরের গোলামী থেকে মুক্ত ছিলেন।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন"মুতাহহার"ও - শিক্ষা দিয়েছেন তাহারাতের, এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসারী ও অনুগামীদের সকল পরকার জাহেরী ও বাতেনী পবিত্রতা দান করেছেন।

আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন তাইয়েব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বংশধর, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিবারবর্গ, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সন্তান-সন্ততি, তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যক্তিসত্ত্বা সকল প্রকার রিপুর তাড়না ও কু-অভ্যাস থেকে পবিত্র ছিল। (রহমাতুললিল আলামিন, ৩খ.)

 

(৪৩) আফু (عفو) - ক্ষমাকারী।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষমাশীলতার দৃষ্টান্তের চেয়ে উত্তম কোন ক্ষমাশীলতার দৃষ্টান্ত মানবজাতিতে নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষমাশীলতার কিছু উদাহরণঃ

(ক) তানয়ীম পর্বতের আশি জন দ্বীনের শত্রু যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে মুসলমানদের জামাআতের সাথে সালাত (নামায) কায়েমরত অবস্থায় দেখে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেছিলো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

(খ) জয়নাব বিনতে হারেস বিন সালাম খায়রী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বিষ মিশ্রিত গোশত হাদিয়া দিয়েছিলো, সে অপরাধ স্বীকার করার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

(গ) কুরাইশ সর্দারেরা দীর্ঘ ১৩ বছর পর্যন্ত ইসলাম প্রচার বন্ধ করে রেখেছিলো এবং ইসলাম গ্রহণকারীদেরকে চরম নির্যাতনে রেখেছিলো, তারা পরাজিত হওয়ার পরও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

(ঘ) মুনাফেক সর্দার ইবন সলুল ও তার দল মদিনাবাসীদেরকে বার বার ক্ষমা করে দিয়েছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

(ঙ) হুনাইন যুদ্ধে ছয় হাজার বন্দীকে শুধু তাদের মৌখিক আবেদনে মুক্ত করে দিয়েছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। (রহমাতুললিল আলামীন, ৩খ.)

 

(৪৪) মুত্বা (مطاع) - অনুসরণযোগ্য।

আল্লাহ তাআলার জাতে সুবহানী যার অনুসরণ করাই আসল উদ্দেশ্য। আল্লাহ তার অনুসরণ বা এতায়াতকারীদের শনাক্ত করার জন্য একটি মাপকাঠি নির্ধারণ করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ'র নবীগণকে অনুসরণ করলেই আল্লাহ'র অনুসরণ করা বোঝা যাবে এবং নবীগণের অনুসরণ থেকে পশ্চাদপসারণকারীদেরকেই আল্লাহ'র অনুসরণ থেকে পশ্চাদপসারণকারী হিসেবে গণ্য করা হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে নিয়মকানুন বলে দিয়েছেন -

"আর আমি কোন রাসুল কেবল এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছি যেন আল্লাহ'র নির্দেশে তার আনুগত্য করা হয় ..." (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৬৪)

সংবিধানগত নির্দেশের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে বিশেষ করে ইরশাদ করেছেন -

"যে ব্যক্তি রাসুলকে অনুসরণ করলো, সে আল্লাহ'রই অনুসরণ করলো।" (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৮০)

আর বলা হয়েছে -

"..... আর যদি তোমরা তার অনুসরণ করো, তবে তোমরা হিদায়াত পাবে ....." (সূরাহ আন-নূর, ২৪ : ৫৪)

কুরআন মাজিদে জিবরীলের প্রশংসায় বলা হয়েছে -

"সেখানে (ঊর্ধ্ব জগতে) মান্যবর ও বিশ্বাসভাজন।" (সূরাহ আত-তাকওয়ীর, ৮১ : ২১)

আর সূরাহ তাহরীমে বলা হয়েছে -

"... আর জিবরীল ও সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণও, উপরন্তু অন্যান্য ফেরেশতাগণও তার সাহায্যকারী।" (সূরাহ আত-তাহরীম, ৬৬ : ৪)

অর্থ দাঁড়ালো যে, তিনি আসমানি মুত্বা (অনুসরণযোগ্য) এবং আল্লাহ পাকের ওহীর আমীন ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্যার্থে এমনভাবে প্রবিষ্ট যেমন অন্যান্য ফেরেশতা ও মুমিনগণ তৎপর। দুটো আয়াতই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সর্বশ্রেষ্ঠ মুত্বা (অনুসরণযোগ্য) হওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।

অতএব, এখন কোন নবী বা রাসুল, কোন ফেরেশতা বা ওহী বাহক, কোন পীর ও মুরশিদ, কোন ইমাম, কোন শহীদ - অর্থাৎ আল্লাহ'র সৃষ্টি রাজ্যের এমন কেউ অবশিষ্ট থাকে না যিনি সাইয়্যেদিনা ও মাওলানা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে "মুত্বা" বলে দাবী করার সাহস দেখাতে পারে অথবা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ ছেড়ে দিয়ে তাকে অনুসরণ করে হিদায়াতপ্রাপ্ত হওয়া ও আল্লাহ'র নৈকট্য লাভ করা যাবে মনে করতে পারে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "যদি মুসা তোমাদের মধ্যে জীবিত থাকতেন, তাহলে আমার অনুসরণ ছাড়া তার জন্য অন্য কিছু বৈধ হতো না।" (মুসনাদে আহমাদ)

কালেমা পড়া প্রত্যেক মুসলমানের দ্বীন ও ঈমান এটাই যে, আল্লাহ'র নৈকট্য, আল্লাহ'র সন্তুষ্টি, মাগফিরাত, নাজাতের উপায় তো সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মধ্যে শুধু একটিই, আর সেটা হলো - মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ। আমরা বিশ্বাস করি যে, আজ যদি কোন ব্যক্তি সাইয়্যেদিনা মুসা আলাইহিস সালামের অনুসারী দাবী করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ ত্যাগ করে, তাহলে সে ব্যক্তি মাগফিরাত ও নাজাত থেকে বঞ্চিত হবে এবং নৈকট্য ও সন্তুষ্টির মর্যাদা থেকে পরিত্যক্ত হবে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন "মুত্বা" এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতায়াত (অনুসরণ) আল্লাহ'রই এতায়াত। সাহাব্যে কিরামগণ আর আইম্মায়ে দ্বীনের পদমর্যাদা ও স্থান এ কারণে অন্যান্য সৃষ্টি থেকে উচ্চতর ও মর্যাদাসম্পন্ন যে, এই বুজুর্গ ব্যক্তিগণ হুজুরের অনুসরণে অত্যন্ত দৃঢ় ও প্রত্যয়ী ছিলেন।

 

(৪৫) মাহী (ماحي) - নিশ্চিহ্নকারী।

"তিনিই তার রাসুলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন একে সকল দ্বীনের উপর জয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।" (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ : ৩৩)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আমার পাঁচটি নাম ..... আমি মাহী, যার দ্বারা আল্লাহ কুফরী নিশ্চিহ্ন করবেন ......" (বুখারী, মুসলিম)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন "মাহী", যেহেতু তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুফর ও পথভ্রষ্টতাকে দূরীভূত করেছেন, শিরক ও অন্যান্যদের উপাসনাকারীদের নির্মূল করেছেন, মনগড়া সমাজ প্রথাকে তুলে দিয়েছেন, অবিশ্বাসী ও প্রবঞ্চকদের ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করেছেন, ভাঁওতাবাজ ও মুনাফিকদের সুউচ্চ প্রাচীর ধ্বংস করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরবের তিনশত ষাটটি মূর্তিকে -

"... সত্য এসেছে আর মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে; নিশ্চয়ই মিথ্যা তো বিলুপ্ত হওয়ারই ছিলো।" (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ : ৮১)

- সংবাদ শুনিয়ে উপুড় করে ফেলে দিয়েছিলেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে খৃস্টানেরা সাইয়্যেদা মারিয়াম'কে "আল্লাহ'র মা" বলা থেকে সাবধান হয়েছিলো। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষার দ্বারা মনি মাশরুকের নাপাক শিক্ষা থেকে ইরানবাসী নিষ্কৃতি পেয়েছিলো। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পথ নির্দেশনার কারণে দাস মার্গ, চিতর রঙ্গদ যেমন অশ্লীল কাজে লিপ্ত সম্প্রদায়কে উদ্ধার করেছিলেন। তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাসুম শিশুদেরকে অকালে (জীবন্ত) কবর দেওয়ার হাত থেকে বাচিয়েছিলেন এবং নিস্পাপ দুলহানদের জীবিত আগুনে নিক্ষেপ থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন। তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদ ও জুয়াকে অপবিত্র ও নাপাক ঘোষণা করেছিলেন। তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নেশাকর জিনিসকে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও শত্রু বলে প্রকাশ করেছিলেন।

পরিশেষে বলতে হয়, সকল প্রকার অনিষ্টকারী বিষয়কে নির্মূল করাই ছিলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র ও নিষ্কলুষ শিক্ষার বিশেষত্ব। (রহমাতুললিল আলামীন, ৩খ.)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুরো জীবনই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম ও গুণসমূহের বিস্তারিত বিবরণ। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এ সম্পর্কে আলোচনা সম্ভব নয়। তবুও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান ব্যক্তিত্বের সামান্য এক অংশের সামান্য এক ঝলক উপস্থাপনের চেষ্টা করা হলো মাত্র। এরপরেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাদবাকি নাম ও বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে আলোচনা করতে না পারার একটা অতৃপ্তি নিয়েই এ সম্পর্কিত আলোচনা এখানেই শেষ করতে হচ্ছে।

 

গ্রন্থপঞ্জীঃ

সিরাত বিশ্বকোষ - চতুর্থ ও ত্রয়োদশ খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)

আল কুরআনুল কারীম সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ (ঐ)

যাদুল মাআদ (ইবনুল কায়্যিম)

রহমাতুললিল আলামীন (সুলায়মান সালমান মনসুরপুরী)

হাফেয আবু শায়খ ইসফাহানি (আখলাকুন নবী)

 

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-5h

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

উম্মী নামের তাৎপর্য

 

 

 

The Greatest Nation·Wednesday, April 3, 2019

 

 

 

মহান আল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সমগ্র বিশ্বের শিক্ষকরূপে প্রেরণ করেছিলেন, যদিও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন অক্ষরজ্ঞানহীন - উম্মী। উম্মী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা বিশ্বে সভ্যতা ও মানবতার এক প্রতিচ্ছবি হিসেবে শত্রু-মিত্র সকলের কাছে স্বীকৃত ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন মানবজাতির মুআল্লিম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, "আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।" (দারিমী, মিশকাতুল মাসাবীহ)

"আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি, উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন।" (শারহুস সুন্নাহ, বরাত মিশকাতুল মাসাবীহ)

আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া না জানা এক ব্যক্তির মুআল্লিম হওয়া, মানব সভ্যতার শিক্ষকরূপে নিজেকে ঘোষণা করার পিছনে নিশ্চয়ই আল্লাহ কর্তৃক তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাদানের কোন ব্যবস্থা কার্যকর ছিলো। কিন্তু উম্মী বলতে কেবল লেখাপড়া না জানা ব্যক্তিকে বুঝায় না, এতে অন্য কিছুর সম্ভাবনাও রয়েছে।

 

"উম্মী" শব্দের তাত্ত্বিক পর্যালোচনা

امي = ي + ام

"উম্ম" শব্দ দিয়ে জননীকে বুঝানো হয়। জনকের বিপরীতে জননী। সরাসরি জন্মদাত্রী যেমন জননী, তেমন তার মাধ্যমে আসা ঊর্ধ্বতন মহিলাগণকেও জননী বলা হয়। এই অর্থে যদি আদি মানবী হাওয়া (আঃ) কে আমাদের আদি মাতা বলে অভিহিত করা হয়, যদিও তার ও আমাদের মাঝে বহু মহিলার দূরত্ব রয়েছে।

এভাবে অস্তিত্বের দিক দিয়ে, লালন-পালন, সংশোধন কিংবা সূচনার দিক দিয়ে প্রত্যেক মূল জিনিসকে "উম্ম" বলা হয়। আরবি ব্যাকরণবিদ আল-খালীলের মতে, সকল প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলী, যেগুলোকে কোন একটি জিনিসের সাথে সম্পর্কিত করা হয়, তাকে আরবিতে "উম্ম" বলা হয়। এ কারণে আল-লাওহুল মাহফুয (সংরক্ষিত ফলক) কে উম্মুল কিতাব বলা হয়েছে। কারণ সকল ইলম, জ্ঞান-বিজ্ঞান তার সাথে সম্পর্কিত, সেখান থেকে অস্তিত্ব লাভ করে। মকা নগরীকে "উম্মুল কুরা" বলা হয়। এ কারণে যে, তার নিন্মদেশ থেকে সমস্ত পৃথিবী বিস্তার লাভ করেছে।

"এইভাবে আমি তোমাদের কাছে কুরআন নাযিল করেছি আরবি ভাষায়, যাতে আপনি সতর্ক করতে পারেন মক্কা ও তার চারদিকের জনগণকে ..." (সূরাহ আশ-শুরা, ৪২: ৭)

সূরাহ আল-ফাতিহা'কে "উম্মুল কিতাব" বলা হয়, কারণ তা আল-কুরআনের একেবারে সূচনাতে রয়েছে।

শেষ ঠিকানা অর্থেও উম্মু শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে -

"তার ঠিকানা হবে হাবিয়া।" (সূরাহ আল-কারিআহ, ১০১ : ৯)

 

উম্মাহ (امة) - "উম্ম" শব্দমূল থেকে উদগত হয়েছে "উম্মাহ" শব্দটি। উম্মাহ বলা হয় যে কোন একটি বিষয়ের ভিত্তিতে একটি দল বা কোন বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে, তা একটি দ্বীনের ভিত্তিতে হোক কিংবা একটি কালের ভিত্তিতে বা স্থানের ভিত্তিতে। এই ঐক্য হোক ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। এর বহুবচন হলো "উমাম"।

"এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যমপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসুল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হয় ....." (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১৪৩)

"সকল মানুষ ছিল একই উম্মতভুক্ত, এরপর আল্লাহ নবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করলেন ...." (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২: ২১৩)

"..... আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে এক উম্মত করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান ....." (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫: ৪৮)

"আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।" (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১০৪)

"উম্মাহ" শব্দটিকে আল-কুরআনে বহুবার ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই একই চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী দল হিসেবে "উম্মাহ" শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। (ইসলামী বিশ্বকোষ)

 

"উম্মী" বলতে কি বুঝায় ?

উম্মী শব্দের সাধারণ অর্থ হলোঃ যে ব্যক্তি লিখতে জানে না এবং কোন গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে পারে না।

এ অর্থেই আল-কুরআনে বলা হয়েছে -

"তিনিই উম্মীদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত, ইতিপূর্বে তারা ছিলো ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।" (সূরাহ আল-জুমুয়াহ, ৬২ : ২)

আরবি ভাষাবিদ কুতরুব বলেনঃ উম্মীহ (امية) শব্দের অর্থ হলো অসচেতন (الغفلة) ও অজ্ঞ (الجهالة)। আর এটি থেকে উম্মী শব্দটি উদগত হয়েছে, যার অর্থ হলো "স্বল্প জানাশোনা লোক"। এ অর্থে আল-কুরআনে বলা হয়েছে -

"তাদের মধ্যে এমন কিছু স্বল্প জানা লোক আছে, যাদের মিথ্যা আশা ছাড়া কিতাব সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই, তারা তো শুধু অমূলক ধারণা পোষণ করে।" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ :৭৮)

আয়াতটির অনুবাদ এমন হয় যে, তাদের কাছে পাঠ করার পূর্বে তাদের কিতাবটি সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিল না। কারণ امنية শব্দের অর্থ কিরাআত পাঠ করা অর্থেও প্রয়োগ হয়।

ব্যাকরণবিদ আল-ফাররা বলেনঃ উম্মী হলো সেই আরবজাতি, যাদের কাছে কোন আসমানি গ্রন্থ ছিল না। কেউ কেউ বলেন, উম্মী শব্দটি امة শব্দের সাথে সম্বন্ধযুক্ত নাম। এই অর্থে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য উম্মী শব্দের প্রয়োগের সার্থকতা হবে, যেহেতু তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন উম্মাহ বা জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন যারা লেখাপড়া জানতো না। কেউ কেউ মনে করেন, উম্মুল কুরা (ام القري) শব্দের সাথে সম্পর্ক করে উম্মী বলা হতো। উম্মুল কুরা বলতে মক্কা নগরীকে বুঝায়। সেখানকার অধিবাসী সাধারণ জনগণ সকলকেই উম্মী বলে আখ্যায়িত করা হতো, যে কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কেও উম্মী বলা হতো।

কেউ কেউ ইমাম (امام) শব্দ থেকে উম্মী শব্দের উৎপত্তি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের যুক্তি হলো, মানুষ বা গ্রন্থ যারই অনুসরণ করা হয় তাকে ইমাম বলা হয়, তা কথায় বা কাজে বা অন্য যে কোন পন্থায় হোক না কেন। এই অনুকরণ যে শুধু সত্য পন্থায় হতে হবে তা নয়, বরং বাতিল পন্থায় কারো অনুসরণ করা হলে সে ক্ষেত্রেও ইমাম শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। (লিসানুল আরাব, ১খ.)

"সেদিন আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতাসহ ডাকবো ...." (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭: ৭১)

" ..... নিশ্চয়ই আমি তোমাকে মানবজাতির জন্য একজন নেতা বানাবো ....." (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২: ১২৪)

সাধারণভাবে উম্মী বলা হয় অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তিকে, যার দ্বারা লেখাপড়া কোনটিই সম্ভব নয়। আরবি ভাষায় একে নিন্মোক্ত বাক্য দ্বারা ব্যক্ত করা হয় -

هو الذي لم يكن يكتب ولا يقرا من كتاب

"যে ব্যক্তি কোন ধরনের গ্রন্থ লিখতে ও পড়তে সক্ষম নয়।"

এই লিখতে ও পড়তে না পারার কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে উম্মী বলা হতো। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই লেখাপড়ায় অক্ষম হওয়া তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য ত্রুটিযুক্ত ছিল না, বরং তা ছিল তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফযিলত ও শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক। লিখতে ও পড়তে অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে মহান আল্লাহ'র বাণী বহন করতেন আর মানবজাতির কাছে তা পৌঁছিয়ে দিতেন, তা প্রমাণ করে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সরাসরি আল্লাহ'র সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে জ্ঞানার্জন করেন। এ ব্যাপারে আল-কুরআনে বলা হয়েছে -

"আমি আপনাকে পাঠ করাতে থাকব, ফলে আপনি বিস্মৃত হবেন না। - আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া ..." (সূরাহ আল-আলা, ৮৭ : ৬-৭)

(আল মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন)

কোন কোন প্রাচ্যবিদের মতে, উম্মী বলা হয় সেই লোককে, যার লিখিত কোন গ্রন্থ নেই। উম্মী শব্দের এই সংজ্ঞা দুরভিসন্ধিমূলক, কারণ এই সংজ্ঞার মাধ্যমে এই কথা প্রমাণ করার প্রয়াস চালানো হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রয়োজনীয় লেখাপড়া জানতেন, তবে তা গ্রন্থ রচনার পর্যায়ের ছিলো না। এই বক্তব্য আদৌ যথার্থ নয়।

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মী হওয়া

উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মী হওয়ার বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে অনুমিত হয় যে, বহু ক্ষেত্রে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মী হিসেবে আখ্যায়িত করার অবকাশ আছে। তবে লেখাপড়া না জানা অর্থেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মী ছিলেন বলে বহু বিশেষজ্ঞ আলিম মনে করেন। তবে এই ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গোটা জীবনই নিরক্ষর ছিলেন কিনা ? একদল আলিম মনে করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমদিকে নিরক্ষর ছিলেন। এরপর আল্লাহ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লেখাপড়া শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এ ধারণার সৃষ্টি হয় নবুওয়াতি জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার বর্ণনার ধরণ থেকে। সারাজীবন উম্মী বা নিরক্ষর থাকেন বা না থাকেন - ওহী নাযিল হওয়া পর্যন্ত তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে লেখাপড়া জানতেন না, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

 

উম্মী হওয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি মুজিযা

মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেকগুলো মুজিযা দান করেছিলেন। সেগুলো মধ্যে অন্যতম মুজিযা হলো, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্ব থেকেই নিরক্ষর রাখা। জন্মলগ্ন থেকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চল্লিশ বছর পর্যন্ত কারো কাছে লেখাপড়া শিক্ষা করেননি। ফলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) না কোন কিছু পাঠ করতে পারতেন আর না কোন কিছু লিখতে পারতেন। এমতাবস্থায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কাবাসীদের কাছে চল্লিশ বছর অতিবাহিত করেন। এখানে বাস করে কোন শিক্ষিত লোকের কিংবা পূর্ববর্তী কোন কিতাবধারীর সংসর্গ লাভ করা সম্ভব নয়। মক্কায় তখন শিক্ষা-দীক্ষার তেমন চর্চা ছিলো না, বিখ্যাত কোন বিদ্যানিকেতনও ছিল না। এ কারণে তাদেরকে উম্মী জাতি বলে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন।

এখানকার অধিবাসীরাও মুশরিক ছিলো, যদিও তারা নিজেদেরকে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম অনুসৃত দ্বীনে হানীফের অনুসারী বলে দাবী করতো। পূর্ববর্তী ধর্মানুসারী ইয়াহুদী ও নাসারাদের অস্তিত্বও মক্কায় ছিলো না যে, তাদের কাছ থেকে কিছু ধর্মীয় আচার-আচরণের কথা শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু একটা রচনা করে ফেলবেন।

চল্লিশ বছর পূর্তির পর হঠাৎ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র মুখ থেকে এমন বাণী উচ্চারিত হলো, যার কোন তুলনা তাবৎ বিশ্বের কোন লেখক-কবি-সাহিত্যিক কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। সাহিত্যের মান, বিষয়বস্তু ও অর্থের দিক দিয়ে সেটির মুকাবিলা করতে গোটা সৃষ্টিকুল অক্ষম হয়ে পড়ে। শব্দ চয়ন ও ভাষালংকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে এমন অনুপম বাণী দেখে তদানীন্তন আরবের শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ে যে, সেটি তো কোন মানব রচিত গ্রন্থ নয়। গতানুগতিক শিক্ষা-দীক্ষাহীন নিরক্ষর এমন এক লোকের মুখ থেকে এ ধরনের কালাম নিঃসৃত হওয়া অবশ্যই সকল সমাজে অবাক হওয়ার মতো বিষয়।

এটিই প্রমাণ করে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে বাণী শুনিয়েছিলেন, সেটি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রচিত ছিল না, বরং সেটি ছিল আল্লাহ'র কালাম, আল্লাহ'র কাছ থেকে প্রাপ্ত - যেটির মুকাবিলা করা গোটা জগতের পক্ষে ছিল অসম্ভব, সেটিই তো তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি শ্রেষ্ঠ মুজিযা।

"আমি আমার বান্দার প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ কোন সূরা নিয়ে আসো, আর তোমরা যদি সত্যবাদী হও, আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহবান করো। যদি তোমরা তা না পারো, আর কখনো করতে পারবে না, তবে ভয় করো সেই আগুনকে - মানুষ ও পাথর হবে যার ইন্ধন, যা কাফিরদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ২৩-২৪)

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে উম্মী বলার কারণ সম্পর্কে নানাবিধ উক্তি রয়েছে। উম্মী শব্দটির বহুমুখী অর্থের কারণেই বিভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে লেখাপড়া জানতেন না, এ সম্পর্কে কোন দ্বিমত নেই। কেবল ইয়াহুদী-নাসারা এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

"আপনি তো এর পূর্বে কোন কিতাব পাঠ করেননি এবং নিজ হাতে কোন কিতাব লিখেননি যে, মিথ্যাচারীরা সন্দেহ পোষণ করবে।" (সূরাহ আল-আনকাবুত, ২৯ : ৪৮)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবী ও রাসুল হওয়ার গুণের সাথে তৃতীয় একটি গুণের কথা উল্লেখ রয়েছে, তা হলো তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মী হওয়া। সাধারণ আরবদেরকে এ কারণে উম্মী বলা হতো যে, তাদের মধ্যে লেখাপড়ার প্রচলন ছিল না। তবে অন্যান্য সকল মানুষের জন্য লেখাপড়া না জানা ছিল দূষণীয়, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ছিল তা প্রশংসার বিষয়।

নবুওয়াত প্রাপ্তির লগ্নে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে নিরক্ষর ছিলেন এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি সাক্ষরদানে সমর্থ হয়েছিলেন - এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ আলীমগণের মতবিরোধ রয়েছে। এ বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু উক্তি থেকে, যেমন - ওহী নাযিলের নাযিলের সূচনালগ্নে যখন জিবরীল আলাইহিস সালাম তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাঠ করতে বললেন, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তর দিলেন - "আমি পড়তে জানি না"। প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার পাঠ করার কথা বললে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই উত্তর দিলেন এবং জিবরীল আলাইহিস সালাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধ্যে পাঠ করার শক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলিঙ্গন করলেন। আইশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। ওহী নাযিলের সূচনাকালীন বিভিন্ন সময়ের বিবরণমূলক দীর্ঘ হাদিসের নিন্মোক্ত অংশ এ স্থলে প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করা যায় -

"তার কাছে ফেরেশতা এসে বললেন - পড়ুন। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেরাগুহায় অবস্থানরত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন - আমি পড়তে পারি না। তিনি বলেন - তারপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে, আমার খুবই কষ্ট হলো। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন - পড়ুন। আমি বললাম - আমি তো পড়তে পারি না। তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে, আমার ভীষণ কষ্ট হলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন - তৃতীয়বার তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন -

'পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক (ঝুলন্ত রক্তপিণ্ড) থেকে। পড়ুন আপনার রব মহিমান্বিত।' (সূরাহ আল-আলাক, ৯৬ : ১-৩) " (বুখারী, ১খ.)

এই আলিঙ্গনের ফলে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তরাত্মা খুলে গেলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়া শুরু করলেন। জিবরীল আমীনের উত্তরে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লেখাপড়া না জানার কথা বলায় নবুওয়াত প্রাপ্তিকাল পর্যন্ত তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে উম্মী ছিলেন, তা তো দিবালোকের মতো প্রতিভাত হচ্ছে। আর নবুওয়াত লাভের সূচনালগ্নের এ ঘটনাটি হাদিসের সকল গ্রন্থে এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তাতে সন্দেহ পোষণের সুযোগ নেই।

জিবরীল আলাইহিস সালামের আলিঙ্গনের পর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তরাত্মা কি এ পরিমাণ খুলে গিয়েছিলো যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়ার সাথে লিখাও শুরু করে দিয়েছিলেন ? হাদিস দিয়ে তো তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পঠনশক্তির কথা প্রমাণিত হয়। আর এই পঠনশক্তি অন্যের কোন লেখা দেখে পড়তে সক্ষম হওয়াকে বুঝায় না। জিবরীল আলাইহিস সালাম যা শুনাতেন, যা মুখস্ত করাতেন - তা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তরে অংকিত হয়ে যেতো। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা অন্যদের কাছে ব্যক্ত করতে পারতেন। প্রথমদিকে দিকে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে ওহী আসতো, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিবরীল আলাইহিস সালামের সাথে মুখস্ত করার লক্ষ্যে পড়া শুরু করে দিতেন। কিন্তু আল্লাহ'র পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আসে যে, এমন করার প্রয়োজন নেই, জিবরীল পাঠ করার সময় যেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরবতা অবলম্বন করেন, কেবল ধ্যানের সাথে তা শুনেন, বাকি দায়িত্ব আল্লাহ'র। কুরআনে বলা হয়েছে -

"তাড়াতাড়ি ওহী আয়ত্ত করার জন্য আপনি আপনার জিহবা তার সাথে সঞ্চালন করবেন না। এটি সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করি আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন। এরপর এর বিশদ ব্যাখার দায়িত্ব আমারই।" (সূরাহ আল-কিয়ামাহ, ৭৫ : ১৬-১৯)

এই আয়াতে আল্লাহ তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে শিক্ষা দেন যে, আয়াতসমূহকে আপনার অন্তরে সংরক্ষণ করা আর হুবহু আপনার দ্বারা পাঠ করিয়ে দেওয়া আল্লাহ'র দায়িত্ব। আপনার কাজ হলো - নীরব থেকে শুনা। আর আপনাকে আবৃত্তি করা আর অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার শক্তি প্রদান করা হলো আল্লাহ'র দায়িত্বে।

এই আয়াতও স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্ব থেকে লেখাপড়া জানা ব্যক্তি ছিলেন না। কারণ লেখাপড়া জানা ব্যক্তি পূর্ব থেকেই অবহিত থাকে অন্যের লেখা বা শিখানো কোন কিছুকে কিভাবে আত্মস্থ করতে হয়। পাঠশালার কোন শিক্ষানবীশকে যখন কিছু শিখতে বলা হয় তখন তার মাঝে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, ঠিক সেই অবস্থা ওহী প্রাপ্তির সূচনালগ্নে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে ফুটে উঠেছিলো বলে প্রদত্ত আয়াতটি ঘোষণা করছে। নবীনদের মতো তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখস্ত করার জন্য আওড়াতে শুরু করে দিয়েছিলেন জিবরীল আমীনের আবৃত্তি করার সাথে সাথে। এরপর আল্লাহ তাকে শিখিয়ে দিলেন কিভাবে তা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আত্মস্থ করবেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লিখতে-পড়তে জানতেন না, তবুও তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি করে জিবরীল আলাইহিস সালাম পড়ার নির্দেশ দিলেন ? সেটি কি সাধ্যের বহির্ভূত বিষয়ে কোন ব্যক্তিকে বাধ্য করার পর্যায়ভুক্ত নয় ? সেটি আল-কুরআনের এই আয়াতের বিপরীত নয় কি ? -

"আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোন কাজের জন্য বাধ্য করেন না ...." (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২: ২৮৬)

এ প্রসঙ্গে হাদিসবিদ ও সিরাতবিদগণের অভিমত হলো, তা প্রকৃতপক্ষে পড়ার নির্দেশ ছিলো না, বরং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনোযোগ আকর্ষণের একটি কৌশল ছিল মাত্র। তাতে ইঙ্গিত ছিল এ ধরনের কাজের জন্য ভবিষ্যত প্রস্তুতি গ্রহণের। এ কথায় আবারো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, যদি তাতে পড়ার প্রকৃত নির্দেশ না থেকে থাকে, তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক "আমি পড়তে জানি না" বলে উত্তর দেওয়ার কারণ কি ? এর উত্তর হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রশ্ন মুতাবেক উত্তর দিয়েছিলেন। যেহেতু তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়তে বলা হয়েছিলো, তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে পড়তে জানেন না, সেটাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যক্ত করলেন। (সিরাতুল হালাবী, ১খ)

 

জিবরীল আলাইহিস সালাম কি কিছু দেখিয়ে পড়তে বলেছিলেন ?

জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে কি কোন কিছু দেখে পাঠ করতে বলেছিলেন ? গরিষ্ঠ সংখ্যক বিশেষজ্ঞ আলীমগণের মতে জিবরীল আমীনের হাতে কোন কিছু ছিল না। কিন্তু একদলের মতে, জিবরীল আলাইহিস সালামের হাতে একটি গিলাফের অভ্যন্তরে আল-কুরআনুল কারীমের একটি কপি ছিলো। ইবন হিশাম এই অভিমত গ্রহণ করেছেন। (আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, ১খ.)

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি লিখতেও শিখেছিলেন ?

আগেই বলা হয়েছে যে, একদল আলিম মনে করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পড়ার সাথে লেখাও শিখেছিলেন। তারা এই ব্যাপারে এমন কিছু দলীল উত্থাপন করেন, যেগুলোতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন রাজা-বাদশাহগণের কাছে পত্র লিখেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। যেমন কোন কোন রিওয়ায়াতে বর্ণিত আছে -

"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।"

এ ধরনের কথা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রেরিত প্রায় পত্রের ব্যাপারে ব্যক্ত করা হয়েছে। এমনকি এ ব্যাপারে হাদিসের রিওয়ায়েতও পাওয়া যায়। সহীহ মুসলিমের একটি অনুচ্ছেদের শিরোনাম হলো -

অনুচ্ছেদঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফির রাজা-বাদশাহগণের কাছে পত্র লিখেছিলেন তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দানের নিমিত্ত। (সহীহ মুসলিম, ২খ.)

আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ'র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিসরা, কায়সার, নাজ্জাশী ও এইরূপ সকল প্রতাপশালী ব্যক্তিবর্গের কাছে পত্র লিখেছিলেন তাদেরকে আল্লাহ'র দিকে দাওয়াত দেওয়ার নিমিত্ত। উল্লেখ্য যে, এই স্থলে নাজাশী বলতে সেই নাজ্জাশী উদ্দেশ্য নয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার গায়েবানা জানাযার সালাত আদায় করেছিলেন। (মুসলিম, ২খ.)

এটি ছাড়া হুদায়বিয়ার সন্ধির ব্যাপারে যখন কাফিরদের পক্ষ থেকে চুক্তিনামা থেকে "মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শব্দটি মুছে ফেলার জন্য তীব্র আপত্তি উত্থাপিত হয়, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে তা মুছে ফেলার নির্দেশ দিলেন, কিন্তু আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ঈমানে এতো বলীয়ান ছিলেন যে, তিনি বললেন - যে কথাটি মহাসত্য, সে কথাটি আমি আমার হাত দিয়ে কিভাবে মুছে ফেলতে পারি ? কাফিরদের এই আপত্তি আপনি বিনম্রতাস্বরূপ মেনে নিতে পারেন, কিন্তু আমার দ্বারা তা মুছে ফেলা সম্ভব না। ফলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে সন্ধির স্বার্থে তা মুছে দিলেন। এখানে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি লেখাপড়া না জানতেন, তাহলে কি করে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাতে এই লিখাটি মুছে ফেললেন ? এ সম্পর্কিত রিওয়ায়াতটি হলো -

আল বারাআ ইবন আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ আলী ইবন আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু হুদায়বিয়ার চুক্তি দিবসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুশরিকদের মধ্যে অনুষ্ঠিত চুক্তিটি লিখার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি তাতে লিখেছিলেন - এই চুক্তিনামাটি আল্লাহ'র রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে সাক্ষরিত হচ্ছে। মুশরিকরা আপত্তি উত্থাপন করলো যে, "রাসুলুল্লাহ" (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শব্দটি লিখিও না। যদি আমরা আপনাকে আল্লাহ'র রাসুল হিসেবে বিশ্বাস করতাম, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতাম না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে বললেন - এ কথাটি কেটে দাও। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন - আমি এমন না যে, তা মুছতে হিম্মত রাখি। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে তা মুছে ফেললেন। (মুসলিম, ২খ.)

এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে নির্দেশ দিলেন "রাসুলুল্লাহ" শব্দটি কেটে দিতে, কিন্তু আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তা অমান্য করলেন কিসের ভিত্তিতে ? অথচ এ কথা সুপ্রসিদ্ধ যে, "নির্দেশ পালন শিষ্টাচারের ঊর্ধ্বে।"

এই নির্দেশ তো সাধারণ কারো নয়, বরং সরাসরি আল্লাহ'র রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ পালন করা সকলের জন্য অপরিহার্য। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে ইবন হাযার আল-আসকালানী বলেনঃ আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এ কথাটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই নির্দেশটি অবশ্য পালনীয় পর্যায়ভুক্ত ছিলো না। ফলে তিনি তা পালন করা থেকে বিরত থাকেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ'র রাসুল, কিন্তু সন্ধির স্বার্থে কাফিরগণের আপত্তি রক্ষার্থে তা কেটে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই কেটে ফেলাকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হয়তো সামগ্রিক স্বার্থে মেনে নিতে পারেন, কিন্তু আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তা বরদাশত করতে পারলেন না।

তা ছাড়া সুনান নাসাঈ'র রিওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছেঃ সুহায়ল (যে কাফিরদের পক্ষে চুক্তি সাক্ষরের দায়িত্বশীল ছিল) প্রথমে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে শব্দটি কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলো। উত্তরে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন - তিনি অবশ্যই আল্লাহ'র রাসুল, রাগে-ক্ষোভে তোমার নাক ধুলিধুসরিত হয়ে গেলেও তা সত্য। কসম আল্লাহ'র, আমি তা কাটতে পারবো না। তাতে বুঝা গেলো, কাটার নির্দেশ ছিলো প্রথমে সুহায়লের পক্ষ থেকে। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপাতত বিতর্ক এড়াতে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুহায়লের উত্তরে মূলত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু অসম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাধ্য হয়ে সুহায়লের কথা মানার জন্য তাকে বললেন, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, আসলে কথাটি সুহায়লেরই, ফলে তিনি অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। (ফাতহুল বারী, ৭খ.)

উপরোক্ত হাদিসে শুধু বলা হয়েছে - "মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাতে মুছে দিলেন"। কিন্তু সহীহ মুসলিমেরই অপর একটি রিওয়ায়াতের শব্দগুলোর প্রতি লক্ষ্য করুন -

"আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু মুছতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সেই স্থানটি দেখিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা দেখালে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা মুছে দিলেন এবং 'ইবন আবদিল্লাহ' শব্দটি লিখে দিলেন।"

সহীহুল বুখারীর মাগাযী অধ্যায়ে ইসরাইল সূত্রে যে হাদিসটি এ হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে তা এরূপ -

"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লিখতে লেগে গেলেন, অথচ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভালোভাবে লিখতে জানতেন না, এরপর লিখলেন ...." (বরাতঃ তাকমিলাতু ফাতহিল মূলহিম, প্রাগুক্ত, ৩খ.)

এই রিওয়ায়াতগুলো প্রমাণ করে যে, উত্তমরূপে লিখা না জানলেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লিখতে জানতেন। আবুল ওয়ালীদ আল-বাজী এ ধরনের রিওয়ায়াতের বাহ্যিক বক্তের প্রতি লক্ষ্য করে বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতেই লিখতেন, তবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্দর বর্ণে লিখতে সক্ষম ছিলেন না।

তার এই অভিমতের কথা সমসাময়িকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে সকলেই তার তীব্র বিরোধিতা করেন, এমনকি তাকে যিন্দিক বলেও অভিহিত করেন। তদানীন্তন স্পেনের (আন্দালুস) এই সকল উলামায়ে কিরামগণের বক্তব্য ছিল যে, এই লোকটি আল-কুরআনের বিরুদ্ধাচরণ করে তার বিপরীত মনোভাব পোষণ করেছেন। বিতর্কের এই ঝড় যখন গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তখন তথাকার শাসক উলামায়ে কিরামকে একত্রিত করে তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ করে দেন। আল-বাজী তার ইলমী যুক্তি-তর্ক দিয়ে সমসাময়িকগণের উপর বিজয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার বক্তব্য ছিলো, তার এই অভিমত আল-কুরআনের বিপরীত নয়, বরং তা আল-কুরআনের আলোকেই গ্রহণ করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ বলেছেন -

"আপনি তো এর পূর্বে কোন কিতাব পাঠ করেননি এবং নিজ হাতে কোন কিতাব লিখেননি যে, মিথ্যাচারীরা সন্দেহ পোষণ করবে।" (সূরাহ আল-আনকাবুত, ২৯ : ৪৮)

এই আয়াতের বিষয়বস্তু আল-কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বেকার অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মী হওয়ার বিষয়টি যখন সাব্যস্ত হয়ে যায়, আর এর দ্বারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুজিযা প্রমাণিত হয়, এর ফলে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যাপারে সন্দেহ পোষণের সকল পন্থা দূরীভূত হয়ে যায়। তখন শিক্ষাদান ব্যতীত লেখাপড়া জানতে কোন বাঁধা নেই। বরং কারো কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করেও যে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লিখতে পড়তে জানতেন, সেটা হবে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য আরো একটি মুজিযা।

ইবন দিহয়া বলেনঃ এর ফলে উলামায়ে কিরামের বিরাট একটি দল আল-বাজীর অনুসারী হয়ে গেলেন। তাদের মধ্যে শায়খ আবু যার আল-হারাবী ও আবুল ফাতহ আন-নিশাপুরী উল্লেখযোগ্য। আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলের বহু উলামায়ে কিরাম আল-বাজীর অনুকূলে অভিমত গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ এই অভিমতের পক্ষে ইবন আবী শায়বা ও উমার ইবন শাব্বাহ কর্তৃক মুজাহিদ সূত্রে আওন ইবন আবদিল্লাহ থেকে নিন্মোক্ত উক্তিটি বর্ণনা করেছেন -

"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লেখা ও পড়া শিখার পূর্বে ইন্তেকাল করেননি।" (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম, প্রাগুক্ত, ৩খ.)

এই উক্তিটির বর্ণনাকারী মুজাহিদ (রহঃ) বলেনঃ আমি এই বিষয়টি আশ-শাবীর কাছে উল্লেখ করলে তিনি বললেন - উক্তিটি যথার্থ। আমিও তা শুনেছি যিনি তা বর্ণনা করেছেন। কাযী ইয়াজ বলেনঃ এমন কিছু হাদিস বর্ণিত পাওয়া যায়, যেগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবি বর্ণমালা চিনতেন এবং লিখনের সুন্দর পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। যেমন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যক্তিগত সচিবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন - "কলমটি তোমার কানে রেখে দাও, কারণ সেটা তোমার স্মৃতিকে অধিক প্রখরকারী হবে।"

আরো বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু'কে লক্ষ্য করে বলেছেন, "দোয়াতটি ফেলে দাও, কলমটি পরিবর্তন করো 'বা' বর্ণকে সোজা করে লিখো, 'সীন'কে পৃথক রাখিও এবং 'মীম'কে বাঁকা করে লিখিও না।"

আরো বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, " 'বিসমিল্লাহ' শব্দকে টেনে লিখিও না।"

এ সকল বিবরণ যদিও স্পষ্টভাবে এ কথা বুঝায় না যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে লিখেছিলেন, কিন্তু এ বিষয়টি প্রমাণিত হওয়া অসম্ভব না যে, আল্লাহ'র পক্ষ থেকে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লিখার কলাকৌশল শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। বর্ণিত আছে যে, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল জিনিসের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছে - "আমাকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলেরই ইলম দেওয়া হয়েছে।"

কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ আলিম উপরিউক্ত রিওয়ায়াতসমূহকে দুর্বল বলে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের যুক্তি হলো, আল-কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদিসের বিপরীতে এ সকল কথা গ্রহণযোগ্য নয়। হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রাককালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে মুছে তদস্থলে "মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহ" লিখেছিলেন বলে যে রিওয়ায়াত উল্লেখ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে জমহুর উলামার অভিমত হলো, হুদায়বিয়ার এই ঘটনা অবিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে লেখক হিসেবে মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। আল-মিসওয়ার রাদিয়াল্লাহু আনহু'র রিওয়ায়াতে এবং অন্যান্য বহু রিওয়ায়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, চুক্তিপত্রটি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু হাদিসে পাওয়া যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মুছে স্বয়ং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লিখেছিলেন। এর ব্যাখ্যা হলো, প্রকৃতপক্ষে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'ই তা লিখেছিলেন, কিন্তু বিষয়টির শীর্ষকর্তা ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এজন্য রুপক অর্থে তার সাথে কথাটি সংযুক্ত করা হয়েছিলো। আরবী পরিভাষায় তাকে বলা হয় نسبة مجا زية (রুপক অর্থে সম্পর্কিত করা)।

সকল ভাষাতেই এ ধরনের রুপক অর্থের প্রচুর প্রমাণ রয়েছে। যেমন - কাজ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ, আর বলা হয় - রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এই কাজটি করেছেন।

"রাষ্ট্রপতি এই শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছেন" - এ ধরনের উদাহারন এরূপ ক্ষেত্রে দেওয়া হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তার সাথে কাজটি সম্পর্কিত করার কারণ হলো, তার নির্দেশে আর তারই প্রধান ভূমিকায় কাজটি সম্পাদিত হয়ে থাকে। এভাবে কোন কোন রাবী কর্তৃক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পর্কিত করে এরূপ বলা - كتب الى قيصر وغيره রুপক অর্থে তার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। কারণ সরাসরি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো তা লিখেননি আর পৌঁছিয়ে দেননি, কিন্তু তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশে পত্র দেওয়া হয়েছিলো, এ কারণে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। যেমন আমাদের সময়ের রাষ্ট্রপ্রধানরা একে অপরের কাছে চিঠি লিখেছেন বলা হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা লিখে তাদের সচিব। যেহেতু তার নির্দেশে আর অনুমোদনে কাজটি সম্পন্ন হয়েছে, আর সেটার সকল দায়-দায়িত্ব তার উপরই আরোপিত হবে, এজন্য তিনি লিখেছেন বলা হয়। আল-কুরআনের আলোকে এই ব্যাখ্যাই হলো সর্বোত্তম। কারণ তাতে তার উপাধি দেওয়া হয়েছে উম্মী বলে, এমনকি তার উক্তিও এমন রয়েছে -

"আমরা উম্মী জাতি, আমরা লিখতে ও হিসাব করতে জানি না।" (তাকী উসমানী, তাকমিলাতু ফাতহিল মূলহিম, ৩খ.)

 

শেষকথা

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মী ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু উম্মী হওয়া সত্ত্বেও তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় নিজ হাতে "মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শব্দটি মুছে তদস্থলে "মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহ" সংযোজন করেছিলেন। হাদিসে এ বিষয়টি প্রতিভাত হয়েছে। তা ছিল নবী হিসেবে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যতম বৈশিষ্ট্য, একটি মুজিযা। মুজিযা তো সেটিই, যা সাধারনের কাছে অসম্ভব বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু আল্লাহ তার নবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য অস্বাভাবিক পন্থায় সেটি তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বারা বাস্তবায়ন করিয়েছেন। ইবন হাযার আল-আসকালানীর মত হলো, এ সম্পর্কিত হাদিসকে তাবীল না করে তার যাহিরী অর্থে প্রয়োগ করা উত্তম। (ফাতহুল বারী, ৭খ.)

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মী হওয়া সম্পর্কে আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের সংশয়

আহলে কিতাব তথা ইয়াহুদী-নাসারাগণ মনে করে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মী ছিলেন না। তাদের দাবী হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লেখাপড়া জানা শিক্ষিত লোক ছিলেন। তাদের এই অযৌক্তিক দাবীর পিছনে কোন প্রমাণ নেই। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উড়ে এসে জুড়ে বসা কোন লোক ছিলেন না যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে জানার কোন উপায় ছিলো না। যদি তাদেরকে প্রশ্ন করা হয়, আপনারা তাহলে ইতিহাসের ভিত্তিতে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষক বা প্রশিক্ষকের নামটি বলুন, যিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে সে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। অবশ্যই তা পারবেন না, কারণ সেটার পিছনে কোন বাস্তবতা নেই। অথচ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো এমন মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন, জন্মের পরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবার আগে যে মহিলার বুকের দুধ পান করেছিলেন, আজো সে ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে।

যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে শিক্ষিত বলে দাবী করেন, তাদের কাছে নিন্মোক্ত আরো কিছু প্রশ্ন রাখা হলো।

গোটা বিশ্বে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইলম ও হিকমতের বিজয়বার্তা পৌঁছে যাবে, কিন্তু যার কাছ থেকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই ইলম শিক্ষা করলেন, তার নামও কেউই জানবে না, এটি কি সম্ভব কথা ? যোগ্য ছাত্রের দ্বারা শিক্ষাগুরুর প্রসার তো বেশী হয়ে থাকে। সুতরাং সে হিসেবে কিছু না কিছু তার সম্পর্কে জানার কথা। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার যে, ইসলামের দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে কতো লোক তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রাণের দুশমন পর্যন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রচারিত বাণী সম্পর্কে কতো ধরনের আপত্তিকর কথাবার্তা তারা বলাবলি করলো, কিন্তু একটি দিনের জন্য হলেও তারা এই প্রশ্নটি উত্থাপন করলো না যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অমুক শিক্ষক থেকে শিক্ষা করে এই সকল কথাবার্তা বলছেন।

শিক্ষার জন্য আবশ্যক হলো যে, শিক্ষার্থী বারবার শিক্ষকের কাছে গমনাগমন করবে, তার দিকনির্দেশনা মতো চলবে, তার সেবায়েত হিসেবে দরবারে আসা-যাওয়া করবে এবং দীর্ঘ একটি জীবন সেটার পিছনে ব্যয় করবে। আক্ষেপের বিষয়, আরবরা গোটা জীবনে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষা গ্রহণের বিষয় সম্পর্কে কোন তথ্যই পেলো না। অথচ ইয়াহুদী-নাসারারা তেরশত বছর পর অনুমাননির্ভর কথা দূর থেকে কিভাবে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর চালিয়ে দিলো যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষিত ছিলেন তা বোধগম্য না। যে সমাজে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বড় হয়েছিলেন, চল্লিশ বছর পর্যন্ত সেখানে জীবনযাপন করেছেন, কোথায় কখন গিয়েছেন - তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল বিষয় স্পষ্ট ও জ্ঞাত ছিলো। এ সমাজেরই অংশ ছিলো আবু জাহল, আবু লাহাব, উতবা, শায়বা, উমায়্যা ইবন খালাফ প্রমুখ। তারা ছিলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণের শত্রু। তারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে কতো আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছে, কিন্তু এমন কথা তো কখনো বলেনি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লেখাপড়া শিখা লোক ছিলেন আর এই লেখাপড়ার জোরে তিনি এই আজিব গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

হেরা গুহায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধ্যানে যেতেন, সেখানে কিভাবে খাবার গ্রহণ করতেন, কতদিন পরপর বাড়ীতে ফিরতেন ইত্যাদি কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। কিন্তু মক্কার কোন গলির কোন বিদ্যানিকেতনে গিয়ে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাগ্রহণ করেছেন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাগুরু কোন ব্যক্তি ছিলো তার কোন তথ্য কি ইয়াহুদী-নাসারারা দিতে সক্ষম হবে ? তাদের তদানীন্তন মিত্র মক্কার কুরাইশদের কাছে কি সেটার কোন প্রমাণ আছে ? সে মহান শিক্ষাগুরু থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষা গ্রহণ করে গোটা বিশ্বকে একটি মতবাদের দিকে দাওয়াত দিলেন, বিশ্বে সেটির বিপ্লব ঘটালেন, তখনকার শিক্ষিত সমাজের কাছে তো তা গোপন থাকার কথা ছিলো না। তারা তো তাওহীদের নতুন দাওয়াত শুনে যে স্থল থেকে তা আবিষ্কৃত হচ্ছিলো সেখানে হানা দিয়ে সেই গুরুকে তা থেকে নিবৃত্ত করতে পারতো। তখনকার শিক্ষিত রোম সাম্রাজ্যেও তো অতি দ্রুত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিলো। তারা যদি মনে করতো, সেটা কলেজ ভার্সিটিতে পড়ুয়া কোন শিক্ষিত লোকের কাজ, তাহলে তার বিরুদ্ধে তারা একটি বিবৃতিও দিলো না। বরং তদানীন্তন পোপ হিরাক্লিয়াস ইসলামের দাওয়াত পেয়ে সেটার অনুকূলে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা তো ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের কাছে অজানা থাকার কথা না। সম্রাট হিরাক্লিয়াস তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের পক্ষে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে তো বহু শিক্ষিত লোকের সমাবেশ ছিলো, কেউই তো তা শিক্ষিত লোকের আবিস্কার বলে অভিযোগ করেনি।

যে শিক্ষক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল কিছুর ইলম দান করলেন, তাওরাত ও ইনজিলের বিষয়বস্তু সম্পর্কেও জ্ঞান দিলেন, পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসুলগণের শরীয়াতের শিক্ষা দিলেন, নিঃসন্দেহে তার কাছে একটি বিশাল গ্রন্থাগার থাকার কথা, কিন্তু আজো মক্কার সেই গোপনীয় গ্রন্থাগারটির তথ্য উদঘাটিত হলো না।

যদি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন শিক্ষক থেকে থাকে, তাহলে বিশ্ববিখ্যাত একজন ছাত্র পেয়েও তিনি কি কারণে নীরব ছিলেন ? ব্যক্তিত্বশীল তো স্বাভাবিকভাবে কোন প্রসিদ্ধ ছাত্র পেলে তাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। মনের আনন্দে তা অন্যের কাছে প্রকাশ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষাগুরু সেই কথা একবারও কারো কাছে বলে যান নাই যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার ছাত্র ছিল।

যদি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কারো কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে থাকেন, তাহলে তার তো অবশ্যই সহপাঠী থাকার কথা। একান্ত না হলে অন্তত দুই-একজন দর্শক থাকবে, যারা দেখেছে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদালয়ে গিয়ে বা অমুকের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করেছেন। যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষকে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের কথা বললেন, তখন চরম বিরোধিতার মুখেও কেউ এ তথ্য দিলো না যে - আমরা দেখেছি যে, এই লোকটি অমুক স্থানে গিয়ে অমুকের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করেছেন।

তদানীন্তন পরিবেশ অনুযায়ী মানুষ তিন ধর্মের যে কোন এক শ্রেণীর অনুসারী হওয়া আবশ্যক ছিলো - মুশরিক বা ইয়াহুদী বা খৃষ্টান। যদি শিক্ষক মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তিনি কি করে তাওহীদের শিক্ষা ও তার দলীল, শিরকের অপকারিতা আর তার অসারতা সম্পর্কে ছাত্রকে শিক্ষা দিলেন ? গোটা কুরআন তো মুশরিকদের মূর্খতা আর তাদের গোমরাহীর বর্ণনায় পরিপূর্ণ রয়েছে, তিনি মুশরিক হলে অবশ্যই তা এমন হতে দিতেন না।

আর যদি তিনি ইয়াহুদী হতেন, তাহলে তিনি কি করে আল-কুরআনে ঈসা আলাইহিস সালামের সুন্দর জীবন ও তার ফযীলত আর তার পূত-পবিত্র মা মারিয়াম (আঃ) এর সতীত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন ! আর ইয়াহুদীরা যে তাদের তাওরাতকে বিকৃত করেছে তার বিশদ বিবরণ কি আল-কুরআন জুড়ে এভাবে বিবৃত হতো ? এদিকে ইয়াহুদী লাঞ্ছনা-বঞ্চনার যে ইতিহাস আল-কুরআনে বিবৃত হয়েছে তা কি থাকতো ? অপরদিকে, যদি তিনি খৃষ্টান হতেন, তাহলে ত্রিত্ববাদ আর ঈসা আলাইহিস সালামের ইলাহ হওয়ার দাবীটি যে বাতিল, তা কি করে আল-কুরআনে বিবৃত হতো ? আর ঈসা আলাইহিস সালাম'কে হত্যা করার আর শূলীকাষ্ঠে ঝুলানোর ঘটনাটি মিথ্যা বলে কিভাবে ব্যক্ত হতো ? এ সকল অলীক কাহিনী প্রকাশ করে ঈসা আলাহিস সালাম'কে আকাশে উঠানোর বিষয়টি কিভাবে সুন্দর করে আল-কুরআনে উপস্থাপিত হতো ? (ইদ্রিস কান্ধালাবী - মাআরিফুল কুরআন, ৬খ.)

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কাব্যচর্চার অভিযোগ

আল-কুরআনুল কারীম নাযিল হওয়ার প্রারম্ভিককালে মক্কার অবিশ্বাসীরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে কবি হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তাদের বিশ্বাস ছিলো, অপূর্ব বাচনভঙ্গিতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা আবৃত্তি করছেন, তা কাব্য ছাড়া কিছুই না, আর তার রচয়িতাও একজন কবি হয়ে থাকবেন। আল্লাহ তাদের এই অভিযোগকে স্পষ্টভাবে অবাস্তব বলে ঘোষণা করেন -

"আমি তাকে কাব্য রচনা করতে শিখাইনি আর সেটা তার পক্ষে শোভনীয়ও না; এটি তো কেবল এক উপদেশ ও সুস্পষ্ট কুরআন।" (সূরাহ ইয়া-সীন, ৩৬ : ৬৯)

"আর এটি কোন কবির রচনা নয়, তোমরা অল্পই বিশ্বাস করো।" (সূরাহ আল-হাক্কাহ, ৬৯ : ৪১)

এ স্থলে উল্লেখ্য যে, "وَمَا يَنبَغِي لَهُ" (তার পক্ষে শোভনীয়ও নয়) - এর ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন -

"তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পক্ষে কাব্য রচনা সহজসাধ্য নয়, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাতে সক্ষম হবেন না। তাকে আমি এমনভাবে রূপায়িত করেছি যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইচ্ছা করতে চাইলেও তাতে সক্ষম হবেন না এ সম্পর্কে প্রকৃতিগত ও অভিজ্ঞতালব্ধ যোগ্যতা না থাকায়।"

এ সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছেঃ আইশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন ধরনের কবিতা দিয়ে উপমা দিতেন কিনা। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে - তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত বিষয় ছিল কবিতা। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার এই পংক্তিটি ছাড়া তিনি অন্য কোন কবিতা দিয়ে উপমা দেন নাই -

ستبدي لك الا يام ما كنت جاهلا - ويأ تيك بالا خبار من لم تزور

"তুমি যে বিষয়ে মূর্খতায় ছিলে তার যুগ অচিরেই প্রকাশ করে দিবে, আর তুমি যে সম্বল সংগ্রহ করোনি তার সংবাদও নিয়ে উপস্থিত হবে।"

এ পংক্তিটি আবৃত করার সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) "ويأ تيك" এর স্থলে "وما يأتيك بالا خبار" বলতে শুরু করলেন। তখন আবু বকর তা শুনে বললেন, আপনি যেভাবে তা আবৃত্তি করছেন, তা যথাযথ হয়নি ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, "আমি তো কবি নই আর তাতে সক্ষমও নই।" (পাদটীকা তাফসীরুল জালালায়ন, ইন্ডিয়ান সংস্করণ, উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছন্দবদ্ধ কথা

ক্ষেত্রবিশেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে ছন্দবদ্ধ কথা বের হয়ে আসতো যা কবিতার মতো মনে হয়। সেটি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবি হওয়ার প্রমাণ বহন করে না। যেমন, হুনায়ন যুদ্ধের সময় কাফিরদের তুমুল আক্রমণের মুখে অন্যরা পিছপা হতে লাগলো, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ স্থানে অবিচল থেকে ছন্দাকারে বলতে লাগলেন -

انا النبي لا كذب - وانا ابن عبد المطلب

"আমি সত্য সত্যই নবী, আমি আবদুল মুত্তালিবের বংশধর।"

কোন এক যুদ্ধে অংশগ্রহণের সময় হোঁচট খেয়ে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি আঙ্গুল আহত হলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে লাগলেন -

هل انت الا اصبع رميت - وفي سبيل الله ما قد لقيت

"তুমি তো একটি আঙ্গুল মাত্র রক্তাক্ত হয়েছো, তুমি যে কষ্ট ভোগ করলে তা তো আল্লাহ'র পথে।"

এ সম্পর্কে বিশিষ্ট তাফসীরবিদ কুরতুবী বলেনঃ ক্ষেত্রবিশেষে কবিতা আবৃত্তি করতে সক্ষম হওয়ায় এ কথা প্রমাণিত হয় না যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবি ছিলেন। অন্য কথায়, তা তো কবিতাই ছিলো না। একান্তই যদি মেনে নেওয়া হয় যে, তা কবিতা ছিলো, তা হলেও বলা যায়, কবিতা আবৃত্তি করতে পারা এ কথা বুঝায় না যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কবিতা বিশেষজ্ঞ ছিলেন আর তিনি একজন কবিও বটে।

কেউ কেউ বলেন, মহান আল্লাহ তো ইরশাদ করেছেন যে, তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে কবি হিসেবে তৈরি করেন নাই। তার অর্থ এই না যে, আল্লাহ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছ থেকে অনিচ্ছাবশত কিছু কবিতা সৃষ্টির ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ এরূপও বলেছেন - কোন ব্যক্তি ছন্দবদ্ধ এমন কোন বাক্য প্রয়োগ করলো অথচ তা দিয়ে তার কবিতা বলা উদ্দেশ্য নয়, তাহলে তাকে কবি বলা যাবে না। বড়জোর এ কথা বলা যায় যে, তার উক্তিটি কবিতার সাথে মিলে গিয়েছে।

আর-রাগিব আল-ইসফাহানী বলেনঃ আল-কুরআনুল কারীম যখন ছন্দময় বাক্য ও অনুপম শব্দের মিল সহকারে নাযিল হলো, তখন কিছু সংখ্যক অবিশ্বাসী অভিযোগ করে বসলো যে, তার বাহক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন একজন কবি। অথচ এর পূর্বে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবি সত্তার কোন অভিযোগ ছিল না। কেউ কেউ বলেন, অনেক অবিশ্বাসী পৌত্তলিক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে কবি বলে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিথ্যাবাদী বলে বুঝাতো। কারণ কবিগণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অবাস্তব ও মিথ্যা কথা কাব্যে প্রয়োগ করে থাকে। (হাশিয়া জালালায়ন, প্রাগুক্ত)

শরীফ আল-জুরজানী বলেনঃ মহান আল্লাহ'র বাণী - "আমি তাকে কবিতা শিক্ষা দেইনি" - এ বাক্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো, আমি আল-কুরআন শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে কবিতা শিখাইনি। অন্য কথায়, আল-কুরআন কোন কাব্যগ্রন্থ নয়। কারণ কবিতা হলো সৃজনশীল কৌশলী বাক্য, শব্দভাণ্ডারকে সুবিন্যস্তভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে তা সৃষ্টি করা হয়। অলীক কল্পনা ও বাস্তবতা বর্জিত ধ্যান-ধারণার সংমিশ্রণে তা তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ'র কাছ থেকে নাযিলকৃত আল-কুরআনুল কারীম এ সকল কাল্পনিক বিষয় থেকে বহু দূরত্বে অবস্থিত। এ সকল কাব্যের সাথে সেটির তুলনাই তো ভাবনার ঊর্ধ্বে। (হাশিয়া জালালায়ন, প্রাগুক্ত)

 

সূত্রঃ সিরাত বিশ্বকোষ - ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (ত্রয়োদশ খণ্ড)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-5n

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আয়াতুল কুরসীর তাফসীর (১ম পার্ট)

 

 

 

The Greatest Nation·Thursday, April 4, 2019

 

 

 

আয়াতের অনুবাদঃ

আল্লাহ - তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, স্বপ্রতিষ্ঠ সংরক্ষণকারী। তাকে ধরে না তন্দ্রা, আর না নিদ্রা। আকাশসমূহে যা রয়েছে আর পৃথিবীতে যা রয়েছে - সব তারই সত্বাধীন। এমন কে আছে, যে তার অনুমতি ছাড়া তার কাছে সুপারিশ করবে ? তাদের সামনে যা রয়েছে আর তাদের পিছনে যা রয়েছে তিনি তা অবগত আছেন। আর যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ছাড়া তার ইলমের কিছুই তারা (সৃষ্টিকুল) আয়ত্ব করতে পারে না। তার কুরসী আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী পরিব্যাপ্ত। আর এ দুটোর রক্ষণাবেক্ষণ তাকে ক্লান্ত করে না। আর তিনিই সর্বোচ্চ মর্যাদাবান, সর্বোচ্চ মাহাত্ম্যের অধিকারী।

(সূরাহ আল- বাকারাহ, ২ : ২৫৫)

 

---------------------- তাফসীর পূর্ব আলোচনা ----------------------

 

এ আয়াতের শ্রেষ্ঠত্ব

ইবনে কাসির তার তাফসীরে লিখেছেনঃ কুরআন শরীফের মধ্যে সবচেয়ে ফযীলতের আয়াত সম্পর্কে সহীহ হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এই আয়াতের মর্যাদা সব আয়াতের চেয়ে উচ্চে।

আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ধারাবাহিকভাবে উবাইদ ইবন খাশখাশ ...... আহমাদ বর্ণনা করেছেন যে, আবু যর জুনদুব ইবন জানাদাহ বলেছেনঃ একদিন আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে বসা দেখতে পাই আর আমিও গিয়ে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে বসি ........ এরপর আমি বললাম, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনার প্রতি সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন কোন আয়াতটি নাযিল হয়েছে ?" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "আয়াতুল কুরসী।" ( "...." এর পর পূর্ণ হাদিসটির শেষ অংশ উল্লেখ করা হয়েছে)

উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ ইবন রিবাহ ..... আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ একদিন উবাই ইবন কাব'কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করেন - কুরআনের মধ্যে কোন আয়াতটি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ? তিনি বলেন - আল্লাহ ও তার রাসুল'ই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা বেশী জানেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন - আয়াতুল কুরসী।

এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন - হে আবুল মানযার, তোমাকে এই উত্তম জ্ঞানের জন্য ধন্যবাদ। সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার আত্মা, এটির একটি জিহবা ও দুটো ঠোঁট রয়েছে যা দিয়ে সে আরশের অধিকারীর পবিত্রতা বর্ণনা করে।

আবু সালীল রহিমাহুল্লাহ থেকে ধারাবাহিকভাবে উসমান ইবন ইতাব ...... আহমাদ বর্ণনা করেছেন যে, আবু সালীল বলেছেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন এক সাহাবীর সাথে লোকজন কথা বলছিলো। কথা বলতে বলতে তিনি ঘরের ছাদের উপর উঠেন। তখন তিনি বলেন - রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার জিজ্ঞাসা করেন যে, বলতে পারো, কুরআন শরীফের কোন আয়াতটি সবচেয়ে বড় ? তখন জনৈক সাহাবী বললেন - اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ (এই আয়াতটি সবচেয়ে বড়)

এরপর সেই লোকটি বলেন - আমি এই উত্তর দেওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাঁধের উপর হাত রাখেন আর আমি সেটির শীতলতা বুক পর্যন্ত অনুভব করছিলাম। অথবা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুকে হাত রেখেছিলেন আর আমি সেটির শীতলতা কাঁধ পর্যন্ত অনুভব করছিলাম।

এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন - হে আবু মানযার, তোমাকে এই উত্তম জ্ঞানের জন্য ধন্যবাদ।

উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ধারাবাহিকভাবে ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু ...... ইবন মারদুবিয়া বর্ণনা করেছেনঃ উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার শহরতলীর কতগুলো লোককে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে দেখলেন আর তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন - তোমাদের মধ্যে কেউ বলতে পারো, কুরআন শরীফের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত আয়াত কোনটি ? তখন ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন - এটি আমার ভালো জানা আছে। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বলতে শুনেছি যে, "اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ" হলো কুরআনের সবচেয়ে সম্মানিত আয়াত। (তাফসীরে ইবন কাসির, ২য় খণ্ড)

 

এ আয়াতের ফযীলত

আসমা বিনতে ইয়াযীদ ইবনে সাকান থেকে ধারাবাহিকভাবে শাহর ইবন হাওশাব ...... আহমাদ বর্ণনা করেছেন যে, আসমা বিনতে ইয়াযীদ ইবন সাকান বলেছেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে বলতে শুনেছি - "اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ" এবং "الم ﴿١﴾ اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ" এই দুই আয়াতে ইসমে আযম রয়েছে।

আবু ইমামা থেকে ধারাবাহিকভাবে কাসিম ইবনে আবদুর রহমান ..... ইবন মারদুবিয়া বর্ণনা করেছেন যে, আনু ইমামা বলেছেন, "আল্লাহ'র ইসমে আযম দিয়ে দুয়া করলে তা আল্লাহ কবুল করেন। আর সেটি সূরা বাকারা, সূরা আলি ইমরান ও সূরা তো-হা'র মধ্যে রয়েছে।"

দামেস্কের খতীব ইবন হিশাম ইবন আম্মার বলেছেনঃ সূরা বাকারার মধ্যে ইসমে আযমের আয়াত হলো "اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ", সূরা আলি ইমরানের মধ্যে আয়াতটি হলো "الم ﴿١﴾ اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ" এবং সূরা তো-হা'র মধ্যে আয়াতটি হলো "وَعَنَتِ الْوُجُوهُ لِلْحَيِّ الْقَيُّومِ"।

উবাই ইবন কাবের পিতা থেকে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন কাব রহিমাহুল্লাহ ....... আবু ইয়ালা আল মোসেলী রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেনঃ উবাই ইবন কাবের পিতা তাকে বলেন - আমার খেজুর ভর্তি একটি বস্তা ছিল আর প্রত্যেকদিন আমি সেটি পরিদর্শন করতাম। কিন্তু একদিন কিছুটা খালি দেখে রাত জেগে পাহারা দিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম যে, যুবক ধরণের কে একজন আসলো। আমি তাকে সালাম দিলাম, সে সালামের উত্তর দিলো। এরপর জিজ্ঞাসা করলাম, "তুমি কি জীন না ইনসান ?" সে বললো - "আমি জীন।" আমি বললাম - "তোমার হাতটা বাড়াও তো"। সে বাড়ালে আমি তার হাতে হাত বুলাই। হাতটা কুকুরের হাতের গঠনের মতো এবং কুকুরের লোমও রয়েছে। আমি বললাম - "সকল জীন কি এই ধরণের ?" সে বললো - "সমগ্র জীনের মধ্যে আমিই সর্বাপেক্ষা বেশী শক্তিশালী।" এরপর আমি তাকে বললাম, "যে উদ্দেশ্যে তুমি এসেছো, সেটা তুমি কিভাবে সাহস পেলে ?" সে উত্তরে বললো, "আমি জানি যে, আপনি দানপ্রিয়। তাই ভাবলাম, সবাই যখন আপনার নিয়ামতের দ্বারা উপকৃত হচ্ছে, তাহলে আমি কেন বঞ্চিত হবো ?" অবশেষে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, "তোমাদের অনিষ্ট থেকে কোন জিনিস রক্ষা করতে পারে ?" সে বললো, "তা হলো - আয়াতুল কুরসী।"

সকালে উঠে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে রাতের ঘটনাটি বললে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দুষ্ট তো ঠিক বলেছে।

সালমা ইবন ওয়াদান থেকে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ ইবন হারিস ও আহমাদ বর্ণনা করেছেন যে, সালমা ইবন ওয়াদান বলেছেন যে, তাকে আনাস ইবনে মালিক বলেছেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক সাহাবীকে জিজ্ঞাসা করলেন ....... এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার কাছে কি আয়াতুল কুরসী নেই ?" সাহাবী বললেন, "জ্বী, আছে।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "এটিও কুরআনের এক-চতুর্থাংশ।" ( "...." এর পর পূর্ণ হাদিসটির শেষ অংশ উল্লেখ করা হয়েছে)

সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ধারাবাহিকভাবে মুহাম্মাদ ইবন সীরীন ...... উসমান ইবন হাইসাম আবু আমর বর্ণনা করেছেন যে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে রমযানের যাকাতের মালামাল সংরক্ষণের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। কিন্তু এক ব্যক্তি এসে তা থেকে খাদ্য তুলে নিতে থাকলে আমি তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলি। এরপর তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে সে অনুনয় করে বললো, "আমি অত্যন্ত অভাবী, পরিবার-পরিজন অনাহারে রয়েছে। তাই খাবারের আমার এতো প্রয়োজন যে তা অবর্ণনীয়।" এরপর আমি তাকে ছেড়ে দেই। কিন্তু সকালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, "হে আবু হুরায়রা, রাতের বন্দীকে কি করলে ?" আমি বললাম, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), সে আমার কাছে পরিবারের ভীষণ অভাবের অভিযোগ করলে দয়া-পরবশ হয়ে তাকে মুক্তি দেই।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটি শুনে বললেন, "সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে। দেখবে, সে আবার আসবে।"

তাই আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বলেছেন যে, সে আসবে, তখন আসবেই। আমিও টহল দিতে থাকলাম। সত্যিই সে এসে খাদ্য নিতে থাকলে আমি তাকে পাকড়াও করলাম। এরপর বললাম, "তোমাকে এবার অবশ্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যাবো।" সে কাকুতি মিনতি করে বললো, "আমার সংসার বড় অভাবের সংসার, আমি অত্যন্ত গরীব। আর আসবো না, আপনি আমাকে মুক্তি দিন।" তাই আমি করুণাবশত তাকে মুক্তি দান করি। সকালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ডেকে বললেন, "হে আবু হুরায়রা, বন্দীকে কি করলে ?" আমি বললাম, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমাকে তার অবর্ণনীয় অভাবের কথা বললে আমি দয়ার্দ্র হয়ে তাকে মুক্তি দান করি।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে। দেখবে, সে আবার আসবে।"

এরপর তৃতীয়বার এসেও সে খাদ্য নিতে প্রবৃত্ত হলে এবারও তাকে বন্দী করে বললাম, "তোমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যাবো। কেননা, তিনবার তোমাকে পাকড়াও করেছি, আর প্রত্যেকবার তুমি বলেছো - আর আসবো না। অথচ তুমি ওয়াদা ভেঙ্গে প্রত্যেকবারই এসেছো (তাই তোমাকে এবার আর ছাড়বো না)।" তখন সে বললো, "আমাকে ছেড়ে দিন। আপনাকে এমন কতগুলো বাক্য শিখাবো, যার দ্বারা আল্লাহ আপনার কল্যাণ করবেন।" আমি বললাম, "সেটা কি ?" সে বললো, "আপনি যখন শুতে যাবেন, তখন বিছানায় আয়াতুল কুরসী পড়বেন, অর্থাৎ - اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ - এই আয়াতের শেষ পর্যন্ত। তাহলে আল্লাহ আপনার রক্ষক হবেন এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান আপনার নিকটবর্তী হতে পারবে না।" এরপর আমি তাকে মুক্তি দেই।

এরপর সকালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ডেকে বললেন, "গত রাতের বন্দীকে কি করলে ?" আমি বললাম, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), সে আমাকে উপকারী কতগুলো বাক্য শিখিয়ে দিলে আমি তাকে মুক্তি দেই।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "কি শিখিয়েছে ?" আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "সে আমাকে বলেছে যে - যখন আপনি শুতে যাবেন, তখন আয়াতুল কুরসীর তখন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়বেন, তাহলে আপনি সে রাতে এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহ'র হিফাযতের বহির্ভূত হবেন না, আর সকাল পর্যন্ত শয়তানও আপনার নিকটবর্তী হতে পারবে না, উপরন্তু সে রাতে যা কিছু হবে সবই কল্যাণকর হবে।" পরিশেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "সে মিথ্যাবাদী হলেও এটা সে সত্যই বলেছে। তবে হে আবু হুরায়রা, জানো কি, তুমি এই তিন রাত কার সাথে কথা বলেছিলে ?" আমি বললাম, "না।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "সে হলো শয়তান।"

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ধারাবাহিকভাবে আবু সালিহ ....... হাকাম বর্ণনা করেছেন যে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "সূরা বাকারার মধ্যে এমন একটি আয়াত রয়েছে, যে আয়াতটি সমগ্র কুরআনের নেতা স্বরূপ। তা পড়ে ঘরে প্রবেশ করলে শয়তান বের হয়ে যায়। সেটি হলো আয়াতুল কুরসী।"

আবু ইমামা থেকে ধারাবাহিকভাবে মুহাম্মাদ ইবন যিয়াদ ...... আবু বকর ইবন মারদুবিয়া বর্ণনা করেছেন যে, আবু ইমামা বলেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয নামাযের পর আয়াতুল কুরসী পড়বে, তাকে মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু বেহেশতে যেতে বাঁধা দেয় না।"

হাসান ইবন বাশারের সূত্রে নাসাঈ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, দিনে ও রাতে দুইবার পড়লে। (তাফসীরে ইবন কাসীর, ২য় খণ্ড)

 

পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে সম্পর্ক

তাফসীরকারকগণ বলেছেন, একটি বাগানে ভ্রমণ করার সময় হঠাৎ অন্য বাগানে পৌঁছে তার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখলে যেমন দর্শক মাত্রেরই আনন্দের সীমা থাকে না, ঠিক তেমনি পবিত্র কুরআন একটি বিষয়ের বর্ণনা করতে করতে হঠাৎ অন্য একটি প্রসঙ্গ উপস্থাপন করে। এতে পাঠক মাত্রই আরো অধিক জানার আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করে। এটি পবিত্র কুরআনের বর্ণনা শৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। (তাফসীরে নুরুল কুরআন) কুরআনের বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা পড়ুন এখানে।

এ আয়াতের পূর্বের তিনটি আয়াত হচ্ছেঃ

"এগুলো আল্লাহ'র আয়াত। আমি তোমাকে যথাযথভাবে শুনাই, আর নিশ্চয়ই তুমি আমার রাসুলগণের অন্তর্ভুক্ত।

এই রাসুলগণ। আমি তাদের মধ্যে কাউকে কারো উপর মর্যাদা দিয়েছি। তাদের মধ্যে কেউ তো এমন, যার সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন, আবার কাউকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। আর আমি মারইয়াম-পুত্র ঈসাকে স্পষ্ট মুজিযা দিয়েছি আর তাকে রুহুল কুদস (অর্থাৎ, জিবরীল) দ্বারা শক্তিশালী করেছি। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে তাদের পরবর্তীরা তাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণাদি আসার পর পরস্পর যুদ্ধ করতো না, কিন্তু তাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলো, ফলে তাদের মধ্যে কেউ ঈমান আনলো, আর কেউ কাফির হলো। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা পরস্পরে যুদ্ধ করতো না, কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।

হে ঈমানদারগণ, আমি তোমাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করো সেদিন আসার পূর্বে - যেদিন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না। আর যারা কাফির তারাই যালিম।" (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ২৫২-২৫৪)

শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান লিখেছেনঃ আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে মিশ্রিত আকারে তিন প্রকার বিষয়বস্তু উল্লেখ করেছেন - (১) তার সত্তা ও গুণাবলীর একত্ব বিষয়ক জ্ঞান, (২) বিধি-বিধান এবং (৩) ইতিবৃত্ত ও ঘটনাবলী। শেষোক্তটি দ্বারাও হয় মহান আল্লাহ'র একত্ব ও গুণাবলীকেই পরিস্ফুট করা উদ্দেশ্যে, নয়তো বিধি-বিধানের সমর্থন ও তার প্রতি গুরুত্ব আরোপের লক্ষ্য থাকে।

আবার, তাওহীদ ও গুণাবলী সংক্রান্ত জ্ঞান এবং বিধি-বিধান সম্পর্কিত আলোচনা এমনভাবে পরস্পর সন্নিবদ্ধ যে, একটি অপরটির কারণ ও নিদর্শন স্বরূপ। আল্লাহ'র গুণাবলী হলো শরঈ বিধি-বিধানের উৎস ও মূল, এবং বিধি-বিধান হলো তার গুণাবলীর শাখা-প্রশাখা ও ফল স্বরূপ। কাজেই বলা বাহুল্য, ইতিবৃত্ত ও ঘটনাবলী এবং বিধি-বিধান সম্পর্কিত জ্ঞান দ্বারা অবশ্যম্ভাবীরূপে তাওহীদ ও গুণাবলী সংক্রান্ত জ্ঞানের সমর্থন হবে এবং তা আরো বলিষ্ঠ হয়ে উঠবে। আবার ইতিবৃত্ত ও ঘটনাবলী তাওহীদও গুণাবলী এবং বিষয়ক জ্ঞান দ্বারা অবশ্যই বিধি-বিধানের সমর্থন হবে ও তার প্রয়োজন পরিস্ফুট হবে, বরং তার প্রকৃত রহস্য ও তাৎপর্য এবং তার মৌলিকত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

এই যে তিন পদ্ধতির এক সমন্বিত পদ্ধতি - এটি কল্পনাতীত সুন্দর, সহজ ও হৃদয়গ্রাহী। কেননা, প্রথমত বিশেষ একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে যাওয়া বিতৃষ্ণার কারণ হয়ে থাকে। একটি জ্ঞান দ্বারা অন্যটিতে স্থানান্তর যেমন উদ্যান থেকে উদ্যানান্তরে গমনের মতোই উপভোগ্য। দ্বিতীয়ত, তিনটি পদ্ধতি দ্বারা স্বরূপ, উৎস ও ফল সবই জানা হয়ে যায়। ফলে বিধি-বিধান অত্যন্ত আগ্রহ ও উদ্দীপনা এবং পরিশ্রম ও ব্যুৎপত্তির সাথে পালন করা সম্ভব হয়, এ কারণেই তা একটি চমৎকার ও ফলপ্রসূ পদ্ধতি এবং কুরআন মাজীদে বহুল ব্যবহৃত। এ স্থলেই দেখুন, প্রথমে কতগুলো বিধান কি বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে। তারপর প্রয়োজন মাফিক ঘটনাবলী উদ্ধৃত করে বিধৃত বিধানসমূহের উপকারিতা ও ফলাফল যেন আমাদেরকে চাক্ষুস দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সবের পর তাওহীদ ও সিফাত সম্পর্কিত শ্রেষ্ঠ আয়াত আয়াতুল কুরসীকে উল্লেখ করে সমস্ত বিধি-বিধানের শিকড় অন্তরে এমন দৃঢ়ভাবে করে দেওয়া হয়েছে যে, উৎপাটনের চেষ্টা করলেও তা উৎপাটিত হওয়ার নয়। (তাফসীরে উসমানী, ১ম খণ্ড)

মাওলানা মুহাম্মাদ ইদরীস কান্দলভী লিখেছেনঃ পূর্বের রুকুর আয়াতে (অর্থাৎ, ২৫২ নং আয়াত) রিসালাতের কথা আছে - "... আর নিশ্চয়ই তুমি আমার রাসুলগণের অন্তর্ভুক্ত"। আলোচ্য আয়াতে (আয়াতুল কুরসীতে) তাওহীদের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে।

তা ছাড়া ".... আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা পরস্পরে যুদ্ধ করতো না, কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।" - এই আয়াতে আল্লাহ'র কুদরত ও ইচ্ছার কথা আছে। "... যেদিন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না ..." - এই আয়াতে কিয়ামতের দিন বন্ধুত্ব ও সুপারিশ কাজে আসবে না এ কথাও আছে। এ থেকে আল্লাহ'র বড়ত্ব ও প্রতাপের কথা জানা যায় যে, তার সামনে মুখ খোলার সাধ্য কারো থাকবে না। এ প্রসঙ্গে আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলার সত্তার একত্ব ও গুণাবলীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়।

এ ছাড়া পূর্বের আয়াতে কাফিরদের যালিম বলা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে তাদের যুলুমের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে যে, কাফির ও মুশরিকরা যালিম, কারণ তারা আল্লাহ'র সাথে শরীক সাব্যস্ত করে। আর তাওহীদের বিশুদ্ধ আকিদা বর্ণনা করা হয়েছে যে, হে মুসলিমগণ, তোমরা কাফিরদের মতো শিরক করে যালিম হয়ো না, বরং তাওহীদের বিশ্বাসকে প্রাণাধিক প্রিয় বানিয়ে নাও। (মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ আলী আস-সাবূনী লিখেছেনঃ যখন আল্লাহ নবীগণের কারো উপর কাউকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের আলোচনা করেছেন এবং এ কথা বর্ণনা করেছেন যে, নবীগণের পরে তাদের উম্মতগণ ধর্মের বিষয়ে মতবিরোধ করেছে এবং পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হয়েছে, তখন আল্লাহ তাআলা এ কথা স্পষ্টভাবে শুনিয়ে দিয়েছেন যে, নবীদের মাঝে এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান তাদের অনুসারীদের মাঝে কলহ-বিবাদ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত দাবী করেনা। কেননা, যদিও মর্যাদার বিবেচনায় রাসুলগণের পরস্পরের মাঝে পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু তারা সকলেই অভিন্ন দাওয়াতের বাহক। আর তা হলো - আল্লাহ'র একত্ববাদের দাওয়াত। সুতরাং তাদের সকলের পয়গাম অভিন্ন এবং তাদের ধর্মও অভিন্ন। (সাফওয়াতুত তাফাসীর, ১ম খণ্ড)

মাওলানা মুহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম লিখেছেনঃ পূর্ববর্তী কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ পাকের রাসুলগণের সম্পর্কে বিশেষ বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। রাসুলগণের প্রধানতম কর্তব্য হলো আল্লাহ'র তাওহীদ বা একত্ববাদের বিবরণ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা। তা এ আয়াতে আল্লাহ তার তাওহীদের বিবরণ এভাবে পেশ করেছেন ... ।" (তাফসীরে নুরুল কুরআন, ৩য় খণ্ড)

মাওলানা আশরাফ আলী থানভী লিখেছেনঃ পূর্বের আয়াতে অনুমতি ছাড়া সুপারিশ নিষিদ্ধ হওয়া দ্বারা যেমন কিয়ামত দিবসে সৎকর্মের অক্ষমতা প্রমাণিত হয়, তদ্রূপ এটি দ্বারা আল্লাহ'র প্রতাপশালী হওয়াও বুঝা যায়, অর্থাৎ, সেদিন তার সামনে মুখ খোলার সাধ্যও কারো হবে না; আর এই মর্মের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই পরবর্তী আয়াতে, যা"আয়াতুল কুরসী" নামে আখ্যায়িত - আল্লাহ'র সত্তার একত্ব ও তার গুণাবলীর পূর্ণতা উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে খুব স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য বিকশিত হয়। (তাফসীরে আশরাফী, ১ম খণ্ড)

আমীন আহসান ইসলাহী লিখেছেনঃ ইতিপূর্বে জিহাদ ও আল্লাহ'র পথে ব্যয় (ইনফাক) সম্পর্কে আলোচনা চলে আসছিলো। মাঝে প্রসঙ্গত মনোযোগ আকর্ষণ মূলক দুটো আয়াত এসেছে সতর্কীকরণ ও উপদেশ প্রদান হিসেবে। একে "জুমলা মুতারাযা" বা পূর্বাপর সম্পর্কহীন বাক্য বলা হয়। তারপর নতুন করে পুনরায় ইনফাক সম্পর্কে আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচ্য বিষয়টিকে বুঝাবার জন্য যে প্রমাণ-পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তাতে এ কথাই প্রকাশ পায় যে, আল্লাহ'র নিকট যে মূল বস্তুটি কাজে আসবে তা হচ্ছে আল্লাহ'র পথে জান ও মালের কুরবানী। কিন্তু শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করা লোকেরা তো এটি করার জন্য প্রস্তুত নয়। বরঞ্চ তারা আল্লাহ'র সাথে নিজেদের মনগড়া অনেক শরীক ও সুপারিশকারী বানিয়ে রেখেছে এবং তাদের সুপারিশ ও সাহায্যের উপর ভরসা করে বসে আছে। অথচ এ মিথ্যা ভরসা ও সাহায্য কোনই কাজে আসবে না, যারা এ ধরণের বোকামির মধ্যে ডুবে আছে তারা নিজেদের উপর বিরাট যুলুম করছে।

এরপর অতি সংক্ষেপে অথচ ব্যাপক অর্থবহ ভাষায় তাওহীদের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে এবং শিরকের প্রতিবাদ করা হয়েছে। যাতে করে একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত আশ্বাসের উপর নির্ভর করে যে লোকগুলো বেঁচে আছে তারা যেন সতর্ক হয়ে যায় এবং খোদা-পুরস্তির সঠিক পথ অবলম্বন করে। (তাদাব্বুরে কুরআন, ১ম খণ্ড)

 

------------------------------ তাফসীর ------------------------------

 

এই পবিত্র আয়াতে দশটি বাক্য রয়েছে। দশটি বাক্য আলাদা আলাদা তাফসীর উপস্থাপন করা হচ্ছে।

 

১ম বাক্যঃ

اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ

অনুবাদঃ আল্লাহ - তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই।

 

"আল্লাহ" নাম সম্পর্কিত ব্যাখ্যাঃ

আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু'র বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহ হলেন এমন সত্তা - সমগ্র সৃষ্টি যার ইবাদাত করে। অর্থাৎ, সারা বিশ্বের মাবুদ হলেন আল্লাহ। (তাফসীরে তাবারী, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ শাফী লিখেছেনঃ "আল্লাহ" শব্দটি সৃষ্টিকর্তার নামসমূহের মধ্যে সবচেয়ে মহত্তর ও তার যাবতীয় গুণের সম্মিলিত রূপ। কোন কোন আলিম একে ইসমে আযম বলেও অভিহিত করেছেন। এ নামটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য প্রযোজ্য নয়, এজন্যই এ শব্দটির দ্বিবচন বা বহুবচন হয় না। কেননা, আল্লাহ এক, তার কোন শরীক নেই।

মোটকথা, আল্লাহ এমন এক সত্তার নাম, যে সত্তা পালনকর্তার সমস্ত গুণের এক অসাধারণ প্রকাশবাচক। তিনি অদ্বিতীয় ও নজিরবিহীন। (মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানীপথী লিখেছেনঃ "আল্লাহ" শব্দটি সেই অপরিহার্য সত্তার নাম, যিনি পূর্ণতার সমষ্টি এবং হীনতা থেকে পবিত্র। (তাফসীরে মাযহারী, ১ম খণ্ড)

শামসুল হক ফরিদপুরী লিখেছেনঃ "আল্লাহ" শব্দটি এতই খাস যে, এর চেয়ে খাস শব্দ জগতে আর নেই। আল্লাহ নিজেই তার ব্যক্তিবাচক নাম রেখেছেন "আল্লাহ"। তার অন্যান্য যতো নাম আছে, সেগুলো গুণবাচক নাম। ...... কুরআন শরীফে ও হাদিস শরীফে আল্লাহ'র যে নাম নেই, সে নাম ধরে আল্লাহ'কে ডাকা ঠিক নয়। ..... "আল্লাহ" নামের বৈশিষ্ট্য এই যে, এ শব্দটি অন্য কোন ভাষায় অনুবাদ হতে পারে না। এ শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গ নেই, বহুবচন নেই। আর ইংরেজিতে বলা হয় গড, কিন্তু তার স্ত্রীলিঙ্গও আছে, বহুবচনও আছে। বাংলায় ঈশ্বর শব্দেরও স্ত্রীলিঙ্গ আছে। ফারসীতে খোদা শব্দের খাস আল্লাহ অর্থেও ব্যবহার আছে, আবার অধিকারী, মালিক অর্থেও ব্যবহার আছে। অনুবাদ যখন হতে পারে না, তখন ব্যাখ্যার প্রয়োজন। ব্যাখ্যা এই - নিরাকার নিরঞ্জন, অগতির গতি, অনাথের নাথ, নিরুপায়ের উপায়, নিরাশ্রয়ের আশ্রয়, সকলের সকল অভাব মোচনকারী, সর্বশক্তিমান, দয়াময়, অনাদি-অনন্ত, চিরঞ্জীব, সর্বগুণাকর, সর্ব গুণের আধার, আত্মা-দেহ আর ইহকাল-পরকালের সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, পালনকর্তা যিনি - তার মহামহিম পবিত্র নাম ব্যক্তিগত ও ব্যক্তিবাচক নাম "আল্লাহ"। (হাক্কানী তাফসীর, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ আলী আস-সাবূনী লিখেছেনঃ "আল্লাহ" সবচেয়ে মহান পবিত্র সত্তার নাম। এ নামটি আল্লাহ ছাড়া আর কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তার নামসমূহের মধ্যে সবচেয়ে মহান ও অদ্বিতীয় নাম। সত্যের অস্তিত্বের এক সত্তার নাম, প্রভুত্বের যাবতীয় গুণাবলীর সম্মিলিত রূপ। প্রতিপালনের যাবতীয় গুণাবলীতে গুণান্বিত, বাস্তব অস্তিত্বের একমাত্র সত্তা, তিনিই সেই পবিত্র সত্তা যিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। (সাফওয়াতুত তাফাসীর, ১ম খণ্ড)

ইবনে কাসির লিখেছেনঃ "আল্লাহ" শব্দটি মহাবিশ্বের একমাত্র মহান প্রতিপালক মহাপ্রভুর নাম। কেউ কেউ বলেন, সেটিই ইসমে আজম। কারণ, "আল্লাহ" শব্দের মধ্যে সকল গুণের সমাবেশ ঘটেছে। যেমন আল্লাহ বলেনঃ

"তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই; তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা; তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু।

তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, তিনিই নিরাপত্তা-বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত; তারা যাকে শরীক স্থির করে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র, মহান।

তিনিই আল্লাহ - সৃজনকর্তা, উদ্ভাবন কর্তা, রুপদাতা, সকল উত্তম নাম তারই। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্তই তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" (সূরাহ আল-হাশর, ৫৯ : ২২-২৪)

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা উল্লিখিত অন্যান্য সকল গুণকে "আল্লাহ" এর সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেখিয়েছেন। অনুরূপভাবে অন্যত্র বলেছেনঃ

"আর আল্লাহ'র সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে, তোমরা সেসব নামে তাকে ডাকো ...." (সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ১৮০)

তিনি আরো বলেনঃ

"বলোঃ আল্লাহ বলে আহবান করো কিংবা রহমান বলে, যে নামেই আহবান করো না কেন, সব সুন্দর নাম তো তারই ....." (সূরাহ বানি ঈসরাঈল, ১৭: ১১০)

......... "আল্লাহ" একটি অনন্য নাম। মহাবিশ্বে একক মহান প্রতিপালক প্রভু ভিন্ন অন্য কেউ উক্ত নামে অভিহিত নয়। এ কারণেই আরবী ভাষায় সেটির সম-ধাতুজ কোন সমাপিকা ক্রিয়া পরিদৃষ্ট হয় না। ....." (তাফসীরে ইবন কাসির, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ ইদ্রিস কান্দলভী লিখেছেনঃ "আল্লাহ" সেই ওয়াজিবুল অজুদ বা অবশ্যম্ভাবী অস্তিমান সত্তার নাম, যিনি উত্তম গুণাবলীর আধার এবং সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটির আভাস ও ধারণা থেকে পুত-পবিত্র। এ কারণেই "আল্লাহ" শব্দটি সর্বদা বিশেষিত পদ বা মাওসুফ (الموصوف) রূপে ব্যবহৃত হয় এবং আসমাউল হুসনা বা আল্লাহ'র গুণবাচক নামগুলোকে বিশেষণ পদ বা সিফাত রূপে "আল্লাহ" নামের পরে উল্লেখ করা হয়। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ

"তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই; তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা; তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু।

তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, তিনিই নিরাপত্তা-বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত; তারা যাকে শরীক স্থির করে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র, মহান।

তিনিই আল্লাহ - সৃজনকর্তা, উদ্ভাবন কর্তা, রুপদাতা, সকল উত্তম নাম তারই। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্তই তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" (সূরাহ আল-হাশর, ৫৯ : ২২-২৪)

"আল্লাহ" নামটি মহাপ্রভু ও স্রস্টার জন্যই নির্দিষ্ট। এটি সর্বদা সেই একক, লা-শারীক, পুত-পবিত্র সত্তার জন্য ব্যবহৃত হয়। যেভাবে তার সত্তা ও গুণে কোন শরীক নেই, তেমনিভাবে এ মহান নামেও তার কোন শরীক নেই। এ কারণেই সকল আউলিয়ায়ে কেরামের অভিমত হলো, "আল্লাহ" নামই ইসমে আজম। ...." (মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ আবদুর রহীম লিখেছেনঃ "আল্লাহ" শব্দটি মূলতঃ "ইলাহ" শব্দ থেকে নির্গত হয়েছে। এটির প্রথমের "আলিফ" (হামজা) উহ্য করে দিয়ে সেখানে "আলিফ" ও "লাম" বসানো হয়েছে এবং একই স্থানের দুই "লাম" পরস্পর মিলিত হয়েছে। এভাবে "আল্লাহ" শব্দটি গঠিত হয়েছে।

আভিধানিক অর্থে "ইলাহ" বলা হয় এমন প্রত্যেক মাবুদকে, যার কোন না কোন প্রকারের ইবাদাত-বন্দেগী ও আনুগত্য আরাধনা করা হয়। কিন্তু এর উপর "আলিফ" ও "লাম" অক্ষর দুটো বসার ফলে "আল্লাহ" শব্দটি গঠিত হয়েছে বিধায় এর অর্থ সম্পূর্ণ নতুনভাবে গ্রহণ করেছে।

আল্লাহ হচ্ছেন একমাত্র সেই মহান সত্তা, যিনি নিজ ক্ষমতা ও প্রতিভার দ্বারা বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করেছেন, লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করছেন, এটির যাবতীয় প্রয়োজন যথাযথভাবে পূরণ করে সেটিকে ক্রমশঃ বিকাশ দান করছেন, সামনের দিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং এই সব কারণে নির্দিষ্টভাবে একমাত্র তিনিই সকল প্রকার পূজা-উপাসনা ও আনুগত্য-ইবাদাত পাওয়ার উপযুক্ত ও নিরঙ্কুশভাবে এই সব কিছুরই অধিকারী।

"আল্লাহ" খোদা তাআলার নিজ মূল সত্তার নাম। এ নাম তিনি ছাড়া আর কারো জন্য ব্যবহৃত হতে পারে না। কুরআনে স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে - "যিনি আল্লাহ, তিনি ছাড়া কেউই ইলাহ নয়, আর কোন ইলাহ নেই।"

বস্তুতঃ ইলাহ হওয়ার যে সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ ভাবধারা, তা-ই এই শব্দটির মৌলিক অর্থ। এটি ছাড়া আল্লাহ'র আরো যতো নাম আছে, তা সবই এর অধীন, এবং তা সবই আল্লাহ'র গুণবাচক নাম। (সূরা ফাতিহার তাফসীর)

ফখরুদ্দীন আর-রাযী "আল্লাহ" নাম সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনায় লিখেছেনঃ "আল্লাহ" শব্দটি নামবাচক বিশেষ্য ...... খলীল বলেন, এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, "আল্লাহ" শব্দটি আল্লাহ তাআলার জন্যই নির্দিষ্ট। এমনিভাবে "الاله" শব্দটিও। যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্যও "الاله" এর ব্যবহার করতো, তারা এটিকে কোন কিছুর সাথে সম্বন্ধযুক্ত করেই ব্যবহার করতো। অথবা, এটিকে নাকিরা বা অনির্দিষ্টতাবাচক হিসেবে "ال" ছাড়া ব্যবহার করতো। যেমন, আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের উক্তি বর্ণনা করেন যে, তারা তাকে বলেছিলো -

اجْعَل لَّنَا إِلَـٰهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ ۚ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ

অর্থঃ".... আপনি আমাদের জন্য একটি ইলাহ বানিয়ে দিন, যেমন তাদের ইলাহ আছে; তিনি বললেনঃ তোমরা এক অজ্ঞ সম্প্রদায়।" (সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ১৩৮)

এরপর আর-রাযী লিখেছেনঃ উল্লেখ্য, "الله" শব্দটির এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা আল্লাহ তাআলার অন্য কোন নামের মধ্যে পাওয়া যায় না। আমরা নীচে সেদিকে ইশারা করছি।

একঃ আপনি যদি "الله" এর"আলিফ" লোপ করেন, তবে অবশিষ্ট থাকবে "لله", আর তা-ও কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যই প্রযোজ্য, যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ

وَلِلَّـهِ جُنُودُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ

অর্থঃ"..... আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সেনাদল তো আল্লাহ'র-ই....." (সূরাহ আল-ফাতহ, ৪৮ : ৪)

আরো ইরশাদ হয়েছেঃ

وَلِلَّـهِ خَزَائِنُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ

অর্থঃ".... আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর ধনভাণ্ডারসমূহ আল্লাহ'র-ই....." (সূরাহ আল-মুনাফিকুন, ৬৩ : ৭)

"الله" থেকে প্রথম "ل" লোপ করলে বাকি থাকে "له" (তার জন্য)। এর দ্বারাও আল্লাহ তাআলাকেই বুঝায়। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ

لَّهُ مَقَالِيدُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ

অর্থঃ"আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কুঞ্জিসমূহ তো তারই ...." (সূরাহ আয-যুমার, ৩৯: ৬৩)

আরো ইরশাদ হয়েছেঃ

لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ

অর্থঃ"..... সার্বভৌমত্ব তারই আর প্রশংসা তারই ....." (সূরাহ আত-তাগাবুন, ৬৪ : ১)

দ্বিতীয় "ل" লোপ করলে অবশিষ্ট থাকে "هو", এটিও আল্লাহ তাআলাকে নির্দেশ করে, যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ

قُلْ هُوَ اللَّـهُ أَحَدٌ

অর্থঃ"বলোঃ তিনিই আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়।" (সূরাহ আল-ইখলাস, ১১২ : ১)

আরো ইরশাদ হয়েছেঃ

هُوَ الْحَيُّ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ

অর্থঃ"তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই ...." (সূরাহ আল-মুমিন, ৪০ : ৬৫)

"هو" এর "و" হরফটি অতিরিক্ত। প্রমাণ এই যে, দ্বিবচন ও বহুবচনে এটি লোপ পেয়ে যায়। বস্তুত দ্বিবচনে বলা হয় "هما" আর বহুবচনে বলা হয় "هم"। দেখা যাচ্ছে উভয় ক্ষেত্রেই "و" হরফটি অনুপস্থিত। আর "الله" শব্দটির মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলার অন্য কোন নামে এই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় না।

আবার এ বৈশিষ্ট্য যেমন শাব্দিকভাবে পাওয়া যায়, তেমনি অর্থগতভাবেও পাওয়া যায়। কেননা, আপনি যখন আল্লাহ তাআলাকে "আর-রহমান" বলে ডাকেন, তখন তাকে কেবল "রহমত" গুণেই বিশেষিত করে থাকেন, কাহর বা প্রচণ্ডতা গুণে নয়। যখন "আল-আলিম" (العليم) নামে ডাকেন, তখন তাকে ইলম বা জ্ঞানের গুণে বিশেষিত করে থাকেন, কুদরত বা শক্তি গুণে নয়।

পক্ষান্তরে যখন "আল্লাহ" বলে ডাকেন, তখন তাকে তার সমস্ত গুণের সাথেই ডেকে থাকেন। কেননা, ইলাহ যতক্ষণ না সংশ্লিষ্ট সমস্ত গুণে গুণমণ্ডিত হোন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি ইলাহ হতে পারেন না।

কাজেই প্রমাণিত হয় যে, উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যটি কেবল "আল্লাহ" শব্দের মধ্যেই বিদ্যমান আছে, অন্য কোন নামে নয়।

দুইঃ কালেমায়ে শাহাদাত অর্থাৎ যে বাক্য দ্বারা কাফির তার কুফর থেকে ইসলামে চলে আসে, তাতে কেবল এই নামটিই ব্যবহৃত হয়। কোন কাফির যদি "اشهد ان لا اله الا الرحمن" বলে, অথবা "الا الرحيم" বা"الا الملك" কিংবা "الا القدوس" বলে, তবে সে কুফর থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামে প্রবেশ করতে পারে না। পক্ষান্তরে সে যদি বলে "اشهد ان لا اله الا الله", তবে এর দ্বারা সে কুফর থেকে বের হয়ে ইসলামে চলে আসে। এটিও "আল্লাহ" শব্দটির এক মহান বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলাই সরল সঠিক পথের দিশারী। (তাফসীরে কাবীর, ১ম খণ্ড)

আমীন আহসান ইসলাহী লিখেছেনঃ "اله" শব্দের প্রথমে আলিফ-লাম যুক্ত করে "الله" শব্দ গঠিত হয়েছে। সৃষ্টির শুরু থেকে এ নাম কেবলমাত্র আসমান যমীনসহ সর্ব জগতের সৃষ্টিকর্তা মহান সত্তার জন্যই নির্দিষ্ট। তিনি ছাড়া অন্য কোন বস্তু কিংবা ব্যক্তির নামকরণ এ শব্দ দ্বারা করা হয়নি। কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বে জাহেলী আরবদের মধ্যেও এ অর্থই প্রচলিত ছিলো। মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের উপাস্য দেব-দেবীর কাউকে তারা আল্লাহ'র সমকক্ষরূপে বিশ্বাস কিংবা তার মর্যাদায় স্থান দিতো না। তারা স্বীকার করতো নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডলসহ সমগ্র সৃষ্টিজগতের মালিক ও খালিক একমাত্র আল্লাহ। চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করে এদেরকে তিনিই সেবায় নিয়োজিত করেছেন। মেঘের কোল থেকে বৃষ্টি বর্ষণ এবং সৃষ্টিকুলের রুজি-রোজগার, পানাহারসহ প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ তারই দায়িত্বে এবং তিনি এ সবের একক যিম্মাদার। অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা ও আরাধনা-উপাসনা ছিলো নিছক তাদের মিথ্যা আকিদার ফলশ্রুতি। তারা মনে করতো, এরা মহান আল্লাহ'র নৈকট্যশীল। আল্লাহ'র দরবারে এরাই তাদের পক্ষে সুপারিশের আরযী দিবে। পবিত্র কুরআনে তাদের এহেন মিথ্যা আকিদার বিবরণ বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। নীচে সংখিপ্তাকারে মাত্র ২/৩ টি আয়াতের উদ্ধৃতি দেওয়া হলো -

".... আমরা তো এদের উপাসনা শুধু এজন্যই করে থাকি যে, ওরা আমাদেরকে আল্লাহ'র ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে পৌঁছে দিবে ....." (সূরাহ আয-যুমার. ৩৯: ৩)

"আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন - নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল কে সৃষ্টি করেছে, চন্দ্র ও সূর্যকে সেবায় নিয়োজিত কে করেছে ? তখন তারা অবশ্যই বলবে - 'আল্লাহ'। তাহলে তারা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ? আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা রিযিক বাড়িয়ে দেন আর যার জন্য ইচ্ছা কমিয়ে দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে সম্যক অবগত। আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন - কে আকাশ থেকে বারিবর্ষণ করে, এরপর সে পানি দ্বারা মৃত হওয়ার পর যমীনকে সঞ্জিবীত করে ? তাহলে অবশ্যই তারা বলবে - 'আল্লাহ'।" (সূরাহ আল-আনকাবুত, ২৯ : ৬১-৬৩)

একইভাবে সকল শক্তির যোগ্যতা, জীবন-মরণ, বিশ্ব পরিচালনা-ব্যবস্থাপনা, হ্রাস-বৃদ্ধি ইত্যাদির মূলকেন্দ্র এবং আসল উৎসরূপে আল্লাহ'কে স্বীকার করে নিতেও তাদের কোন আপত্তি ছিল না। যেমন আল-কুরআনের ভাষায়ঃ

"আপনি জিজ্ঞাসা করুন, তোমাদেরকে আসমান-যমীন থেকে কে রুযী দান করেন, অথবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক ? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভিতর থেকে, অনুরূপ কে-ই বা মৃতকে জীবিতের ভিতর থেকে বের করেন ? আর কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাই বা কার হাতে ? তখন তারা বলে উঠবে, 'আল্লাহ'। তাহলে আপনি বলুন - এরপরও কি তোমরা তাকে ভয় করো না ?" (সূরাহ ইউনুস, ১০: ৩১) (তাদাব্বুরে কুরআন, ১ম খণ্ড)

 

"ইলাহ" শব্দের ব্যাখ্যাঃ

"আল্লাহ" নাম সম্পর্কিত আলোচনায় "ইলাহ" সম্পর্কিত কিছু আলোচনা চলে এসেছে, এতে "ইলাহ" এর সহজ ব্যাখ্যাও সাথে সাথে চলে এসেছে। একটু পর পূর্ণ প্রথম অংশের ব্যাখ্যায় আরো পরিষ্কারভাবে বুঝা যাবে। আর পূর্বে "ইলাহ" সম্পর্কিত ছোট্ট একটি আলোচনা -

আরবদের কাছে "ইলাহ" কোন একক সত্তার নাম ছিলো না, বরং তারা যে সমস্ত দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা করতো, এদের প্রত্যেকের জন্য এই শব্দ প্রয়োগ করতো। আল-কুরআনের কোথাও "আল-ইলাহ" শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। শুধু "ইলাহ" আর "আল্লাহ" শব্দের ব্যবহার হয়েছে। বিভিন্ন আয়াতে "ইলাহ" শব্দ দিয়ে ঐ সমস্ত উপাস্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, মানুষ যাদের পূজা-অর্চনা, উপাসনা ও আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে। বহু আয়াতে আল-কুরআন দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছে যে, "ইলাহ" আখ্যায়িত হওয়ার একমাত্র অধিকার আল্লাহ'র-ই জন্য সংরক্ষিত। তিনি এক, অদ্বিতীয় ও সমস্ত ইবাদাতের হকদার, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। আল-কুরআনের এই ঘোষণাটি শুধু আরব অঞ্চলের অবিশ্বাসীদের জন্য সীমিত নয়, এটি সমগ্র দুনিয়াবাসীর প্রতি, যেখানে প্রতিমা পূজার বিশ্বাস ব্যাপকতা লাভ করেছিলো আর যেখানে আল্লাহ'র প্রকৃত সত্তা, তার গুণাবলী ও অবস্থান সম্পর্কে মানব অন্তর বহুবিধ পথভ্রষ্টতার মধ্যে নিমজ্জিত ছিলো। (আল- কুরআনুল কারীমের সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ, ১ম খণ্ড; "ইলাহ" সম্পর্কিত আলোচনার একটি অংশ সংক্ষেপিতভাবে এখানে তুলে ধরা হলো)

"আল্লাহ - তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই" - এর ব্যাখ্যাঃ

ইবনে কাসির লিখেছেনঃ অর্থাৎ তিনি সৃষ্ট জীবসমূহের একক ইলাহ বা উপাস্য। (তাফসীরে ইবনে কাসির, ২য় খণ্ড)

"তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই" - এর ব্যাখ্যায় ইবনে জারীর আত-তাবারী লিখেছেনঃ এ কালেমায় আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদাত করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা, আল্লাহ তো চিরঞ্জীবী, চিরস্থায়ী। তাছাড়া, তিনি অন্যান্য গুণেরও অধিকারী, যা এ আয়াতে তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ এমন এক সত্তা, শুধু যার জন্যই সৃষ্টির ইবাদাত নির্ধারিত। তিনি চিরঞ্জীবী ও চিরস্থায়ী। আল্লাহ ছাড়া তোমরা কারো ইবাদাত করো না। কেননা, তিনি এমন চিরঞ্জীবী চিরস্থায়ী, যাকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করে না। এ আয়াতে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যারা আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেওয়া আহকাম ও নিদর্শনাদির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে আর তারা রাসুলগণের আবির্ভাবের পর আল্লাহ'র নিদর্শনাদির মধ্যে মতভেদ করেছে। তাদেরকে আল্লাহ অবহিত করেছেন যে, তিনি রাসুলগণের মধ্যে কাউকে আবার কারো থেকে অধিক মর্যাদা দিয়েছেন। বান্দাগণ মতভেদ করার পর একে অন্যের সাথে বিবাদ করেছে, যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছে, তাদের মধ্যে কেউ ঈমান নিয়েছে, কেউ আবার কুফরী করেছে। কাজেই আল্লাহ'র জন্যই সমস্ত প্রশংসা, যিনি তার প্রতি বিশ্বাস করার জন্য আমাদের শক্তি দান করেছেন এবং তাকে স্বীকার করার জন্য তাওফিক দিয়েছেন। (তাফসীরে তাবারী, ৫ম খণ্ড)

আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদি লিখেছেনঃ জাহিলী ধর্মগুলোও তো আল্লাহ'র নিছক অস্তিত্ব স্বীকার করে। অবশ্য তারা এই বড় ইলাহ ছাড়াও অনেক অধীনস্থ ইলাহ আর দেবতায়ও বিশ্বাস করে। এটা কেবল ইসলামেরই শিক্ষা যে, এক ইলাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ'র অস্তিত্ব নেই। ইসলাম এটা স্বীকার করে না যে, আল্লাহ বড় ইলাহ, এছাড়া আরো অনেক ইলাহ, অনেক ছোট ছোট ইলাহ'রও অস্তিত্ব আছে। ..... (তাফসীরে মাজেদি, ১ম খণ্ড)

 

২য় বাক্যঃ

الْحَيُّ الْقَيُّومُ

অনুবাদঃ (তিনি) চিরঞ্জীব, স্বপ্রতিষ্ঠ সংরক্ষণকারী

 

"الحي" নামের ব্যাখ্যাঃ

রাগীব ইস্পাহানী এ নাম প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ যার উপর মৃত্যু নেই, এটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর প্রযোজ্য নয়। (আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন)

আবু জাফর আত-তাবারী লিখেছেনঃ এখানে "الحي" কথাটির অর্থ - যিনি চিরঞ্জীবী, যার অস্তিত্বের শুরুও নেই, শেষও নেই। তিনি ছাড়া অন্য সবকিছু লয়প্রাপ্ত হয়ে যাবে। সৃষ্টি মাত্রেরই জীবন আছে, কিন্তু তাদের জীবনের শুরু ও শেষ নির্ধারিত। সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর তারা বিলীন হয়ে যাবে। প্রতিটি সৃষ্টির উদ্দেশ্য সফল হলে তার পরিসমাপ্তি ঘটবে। (তাফসীরে তাবারী, ৫ম খণ্ড, সংক্ষেপিত)

মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানীপথী লিখেছেনঃ তিনি এমন সত্তা, যার জন্য জানা-শোনা, দেখা, সক্ষম হওয়া, ইচ্ছা করা ইত্যাদির সম্বন্ধ যথার্থ রূপে সাব্যস্ত এবং যা কিছু তার জন্য যথার্থ রূপে সাব্যস্ত, তা তার জন্য ওয়াজিব অর্থাৎ অনাদি-অনন্ত রূপে সাব্যস্ত, যাতে কখনো বিচ্যুতি আসেনি, আসবে না। অর্থাৎ, তিনি যেমন অনাদি-অনন্ত, তার গুণেরও শুরু ও শেষ নেই। যেহেতু قوة ও فعل অর্থাৎ কোন কিছু করার যোগ্যতা আর কোন কিছু তাৎক্ষণিক সম্পাদনা তার অনিত্য সত্তার গুণ। মোট কথা, "হায়াত" আল্লাহ'র এমন গুণ, যা সব পূর্ণাঙ্গতা গুণের সূত্র। (তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড)

আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদী লিখেছেনঃ তিনি স্থায়ীভাবে জীবিত আর অনাদি-অনন্ত। জীবনের গুণ বিশেষণটি তার সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মৃত্যু বা জীবনের অবসান তার উপর অতীতেও আপতিত হয় নি, ভবিষ্যতেও হবে না।

তবে কি এমন জাতিও আছে, যে নিজেদের মাবুদের এই স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন গুণটির ব্যাপারেও সন্দেহ-সংশয় পোষণ করেছে ? এক নয়, অনেক জাতিই এ সন্দেহ পোষণ করেছে। অর্থগতভাবে এ গুণটি অস্বীকারও করেছে। রোম সাগর তীরে এমন অনেক জাতি ছিলো, যারা বিশ্বাস করতো যে, তাদের খোদা প্রতি বছর অমুক তারিখে মৃত্যুবরণ করে, আবার পরদিন নতুন করে অস্তিত্ব লাভ করে। তদনুযায়ী প্রতিবছর ঐ তারিখে খোদা বা بعل এর পুতুলী বানিয়ে দাহ করা হতো আর পরদিন ভোরে তার জন্মের খুশীতে আনন্দ উৎসব করা হতো। হিন্দু ধর্মে অবতারের মৃত্যু আর আবার জন্ম নেওয়া এ বিশ্বাসেরই দৃষ্টান্ত। আর স্বয়ং খৃষ্টানদের আকিদা এছাড়া আর কি ছিলো যে, খোদা আগে মানুষের রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে আগমন করেন আর এরপর ক্রুশে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা যেহেতু শুরু থেকেই এক অনাদি অনন্ত শাশ্বত অবিনশ্বর খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত ও পরিচিত থাকে, বড় হয়ে তাদের ধারণা কল্পনায়ও একথা আসে না যে, তাদের খোদা কখনো কোন অবস্থায় কোন অর্থে আর কোন বিচার বিবেচনায়ই লয়-ক্ষয় ও লীন হতে পারেন। কিন্তু অবশেষে আজো কি কোটি কোটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আল্লাহ'র এ বিলীন হওয়াকেই স্বীকার করে নিচ্ছে না ? (তাফসীরে মাজেদি, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ ইদরীস কান্দলভী লিখেছেনঃ আল্লাহ'র সিফাতসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম হলো "হায়াত" বা জীবন। অভিধানে "الحي" বলা ঐ সেই জীবিত বস্তুকে - যা বোধসম্পন্ন, যে শ্রবণ করে, দেখে, আর যে শক্তিমান। তাই "হায়াত" সিফাতটি সকল উত্তম সিফাতের উৎস। (মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

 

"القيوم" নামের ব্যাখ্যাঃ

ইবনে জারীর আত-তাবারী লিখেছেনঃ সৃষ্টির তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে সত্তা অনাদি ও অনন্তকাল ব্যাপী বিরাজমান, আপন সত্তার জন্য যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন অথচ যিনি সর্বসত্তার ধারক, তাকেই القيوم বলা হয়। (তাফসীরে তাবারী, ৫ম খণ্ড)

ইবনে কাসির লিখেছেনঃ "সমগ্র সৃষ্টি জীব তার মুখাপেক্ষী, আর তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। আর তার হুকুম ছাড়া সব কিছুই অস্তিত্বহীন।" (তাফসীরে ইবনে কাসির, ২য় খণ্ড)

মাহমুদ আল-আলূসী এ শব্দের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করে এরপর রাগিব আল-ইস্পাহানী'র উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেনঃ আল-কাইয়্যুম তিনি, যিনি স্বীয় শক্তিতেই বিদ্যমান। তিনি সব কিছুর রক্ষাকারী, সব কিছুর অস্তিত্ব প্রদানকারী। (তাফসীরে রুহুল মাআনী, ৩য় খণ্ড)

মুহাম্মাদ শফী লিখেছেনঃ "القيوم" শব্দটি "কিয়াম" শব্দ থেকে উৎপন্ন, এটি বুৎপত্তিগত আধিক্যের অর্থে ব্যবহৃত। এর অর্থ হচ্ছ এই যে, তিনি নিজে বিদ্যমান থেকে অন্যকে বিদ্যমান রাখেন ও নিয়ন্ত্রণ করেন। "কাইয়্যুম" আল্লাহ'র এমন এক বিশেষ গুণ, যাতে কোন সৃষ্টি অংশীদার হতে পারে না। তার সত্তা স্থায়িত্তের জন্য কারো মুখাপেক্ষী নয়। কেননা, যে নিজের স্থায়িত্ব ও অস্তিত্বের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী, সে অন্যের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ কি করে করবে ? সে জন্যই কোন মানুষকে "কাইয়্যুম" বলা জায়েজ নয়। যারা "আবদুল কাইয়্যুম" নাম বিকৃত করে শুধু "কাইয়্যুম" বলে, তারা গুনাহগার হবে। (মাআরেফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আশেকে ইলাহি বুলন্দশহরি লিখেছেনঃ "قائم" নিজে প্রতিষ্ঠিত, আর "قيوم" যে অন্যকে প্রতিষ্ঠিত রাখে। সমগ্র বস্তুজগত আল্লাহ'র সৃষ্টি। আল্লাহ এ সব কিছুর অস্তিত্ব দান করেছেন। তারই ইচ্ছা ও ইঙ্গিতে এ সব কিছু বিদ্যমান রয়েছে। তার ইচ্ছায় ও শক্তিতে বিশ্বজগতের সকল অবস্থা পরিবর্তিত হয়। তিনি যাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে রাখেন।

বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে যে, রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে যখন তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য জাগ্রত হতেন, তখন আল্লাহ'র দরবারে যে সব আরজি পেশ করতেন, তার মধ্যে এও অন্তর্ভুক্ত থাকতো -

"হে আল্লাহ, আপনার জন্যই সমস্ত প্রশংসা। আপনি আসমান, জমিন ও তার মাঝে যা কিছু আছে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক (কাইয়্যুম)।" (তাফসীরে আনওয়ারুল বয়ান, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানিপথী লিখেছেনঃ সুতরাং আল্লাহ'র এ সিফাতী নামের দাবী হলো - তিনি ছাড়া সবকিছু তাদের অস্তিত্বের জন্য যেরূপ তার মুখাপেক্ষী, তদ্রূপ তাদের স্থিতির জন্যও তারা তারই মুখাপেক্ষী, যেমন মূল বস্তুর সাথে তার ছায়ার সম্পর্ক। বরং সবই এর চাইতে আল্লাহ'র অধিক মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তো মহোত্তম প্রকৃতির অধিকারী। (তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড)

আমীন আহসান ইসলাহী লিখেছেনঃ "قيوم" শব্দের অর্থ হচ্ছে সেই সত্তা, যিনি স্বয়ং নিজ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত এবং অন্যদের প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্বের মাধ্যম ও উসিলা। (তাদাব্বুরে কুরআন, ১ম খণ্ড)

আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদী লিখেছেনঃ খৃষ্টানরা যেমন আল্লাহ'র জীবন গুণের ক্ষেত্রে মারাত্মক হোঁচট খেয়েছে, তেমনি তার قيوميت গুণের ক্ষেত্রেও নানা বিস্ময়কর গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছে। তাদের বিশ্বাস এই যে, পুত্র যেমন পিতার অংশগ্রহণ ছাড়া খোদা হতে পারে না, তেমনি পুত্রের অংশগ্রহণ ছাড়াও পিতাকে পিতা বলা যায় না। যেন যেভাবে মাসীহ আল্লাহ'র মুখাপেক্ষী, তেমনি খোদাও তার খোদায়ীত্ব প্রমাণ করার জন্য মাসীহ এর মুখাপেক্ষী। قيوميت এর গুণ প্রমাণ করে, কুরআন খৃষ্টানদের এ আকিদার উপর আঘাত হেনেছে। قيوم তিনি, যিনি যে কেবল নিজেই স্থির আছেন তা নয়, বরং তিনি অন্যদের স্থির থাকার কার্যকারণও, আর তিনি সকলকে ধারণ করে রেখেছেন। সকলেই তার মুখাপেক্ষী, তিনি কারোরই মুখাপেক্ষী নন। (তাফসীরে মাজেদি, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ ইদরীস কান্দলভী লিখেছেনঃ "الحي" দ্বারা আল্লাহ যে "ওয়াজিবুল অজুদ" বা অবশ্যম্ভাবী সত্তা, তা বর্ণনা করা হয়েছে। আর "القيوم" শব্দ দ্বারা তিনি যে "ওয়াহিবুল অজুদ" বা অস্তিত্বদাতা, তা বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ, তিনি নিজে ওয়াজিবুল অজুদ - যার অস্তিত্ব অপরিহার্য এবং অন্যদেরকে অস্তিত্ব ও হায়াত দানকারী। সৃষ্টিজীবের মাঝে যা কিছু অস্তিত্বশীল, তা সেই ওয়াজিবুল অজুদের দান ও হেবা। "হায়াত" সিফাতের উল্লেখ দ্বারা "অজুদ" বা নিজ অস্তিত্বের কথা এবং "কাইয়ুমিয়্যাত" সিফাতের উল্লেখ দ্বারা "ইজাদ" বা অন্যদেরকে অস্তিত্ব দানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। (মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

 

 

 

 

 

 

আয়াতুল কুরসীর তাফসীর (২য় পার্ট)

 

 

The Greatest Nation·Thursday, April 4, 2019

 

 

 

 

৩য় বাক্যঃ

لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ

অনুবাদঃ তাকে ধরে না তন্দ্রা, আর না নিদ্রা।

ইবনে কাসির লিখেছেনঃ অর্থাৎ, কোন অনিষ্টই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি স্বীয় সৃষ্ট জীব থেকে কখনো উদাসীন নন, প্রত্যেকের প্রতি তার সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। সুতরাং, তিনি মুহূর্তের জন্যও অসতর্ক নন। যে যেই অবস্থায় আছে, সবই তার দৃষ্টির গোচরে, তাই কোন কিছুই তার দৃষ্টির আড়ালে নেই। তার দৃষ্টি থেকে কারো গোপন থাকার শক্তি নেই। কেননা, তাকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না, আর নিদ্রাও না।

"لَا تَأْخُذُه"

- এর শাব্দিক অর্থ হলো, তাকে কাবু করতে পারে না। অর্থাৎ তিনি ক্লান্তিহীন ও সর্বদা সজাগ।

"سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ"

- এজন্য বলা হয়েছে যে, তিনি তন্দ্রা ও নিদ্রার চাইতে অধিক শক্তিশালী।

আবু মুসা থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে চারটি কথা বললেন, তা এই -

নিশ্চয়ই আল্লাহ নিদ্রা যান না, আর তার জন্য নিদ্রা শোভনীয়ও না। কেননা, তিনি দাঁড়িপাল্লা সমুন্নত করে রাখেন। আর তার কাছে রাতের আমল দিনের পূর্বে আর দিনের আমল রাতের পূর্বে পেশ করা হয়। তার ও সৃষ্টি জগতের মাখখানে নূর বা আগুনের পর্দা রয়েছে। যদি তা অপসারিত হয়, তা হলে তার দৃষ্টি গোচরের সবকিছুই পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে। (তাফসীরে ইবনে কাসির, ২য় খণ্ড, সংক্ষেপিত)

আবু জাফর আত-তাবারী লিখেছেনঃ আল্লাহ তাআলাকে কোন প্রকার বাধা-বিপত্তি ও আপদ-বিপদ স্পর্শ করে না। পক্ষান্তরে, তন্দ্রা ও নিদ্রা হচ্ছে শরীরের দুটো অবস্থার নাম, যা ধীশক্তিসম্পন্ন লোকের ধীশক্তি ঢেকে ফেলে, অবচেতন করে দেয়, আর এ দুটো অবস্থা যাকে স্পর্শ করে তার মধ্যে পূর্বাবস্থা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ও পরিবর্তিত অবস্থার জন্ম দেয়। এখন আমাদের ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটির অর্থ হচ্ছে -

"আল্লাহ" এমন এক সত্তার নাম, যিনি ছাড়া অন্য কেউ উপাস্য নেই। যিনি জীবিত, তার কোন মৃত্যু নেই, তিনি ছাড়া অন্য সকলের যিনি রক্ষণাবেক্ষণ করেন, রিযিক দান করেন আর এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন হওয়া ও যাবতীয় কাজ-কারবার সম্পাদন করার সকলকে তাওফিক দান করেন।

তাকে তন্দ্রা বা নিদ্রা স্পর্শ করে না। কোন বস্তু অন্যের মধ্যে যেরূপ পরিবর্তন সাধন করে, তার মধ্যে এরূপ পরিবর্তন সাধন করে না। রাত-দিন, যুগ-যুগান্তর ও বিভিন্ন পরিবর্তনশীল অবস্থাদির পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য বস্তুতে যেরূপ অহরহ পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে, তার মধ্যে এরূপ পরিবর্তন সাধিত হয় না। বরং তিনি পরিবর্তনহীন একই অবস্থায় সর্বকালে বিরাজমান এবং তিনি সমগ্র মাখলুকের রক্ষণাবেক্ষণে সদা-সর্বদা সচেতন ও সুযত্নবান। কাজেই, যদি তাকে নিদ্রা স্পর্শ করতো, তাহলে তিনি প্রভাবিত হয়ে পড়তেন, কেননা নিদ্রা নিদ্রায় মগ্ন ব্যক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যদি তিনি তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়তেন, তাহলে আসমান-যমিন ও উভয়ের মধ্যে যা কিছু বিদ্যমান, তা ধ্বংস হয়ে যেতো। কেননা, এসবের রক্ষণাবেক্ষণ তারই তদবীর ও কুদরতের মাধ্যমে সুসম্পন্ন হয়ে থাকে। অথচ নিদ্রা রক্ষণাবেক্ষণকারীকে তার রক্ষণাবেক্ষণ কর্ম পরিচালনা থেকে বিরত রাখে। অনুরূপভাবে তন্দ্রাও তন্দ্রাচ্ছন্ন ব্যক্তিকে তার কর্তব্য কাজ যথাযথ আঞ্জাম দিতে দেয় না। (তাফসীরে তাবারী, ৫ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ শফী লিখেছেনঃ "সীন" এর যের দ্বারা উচ্চারণ করলে এর অর্থ হয় তন্দ্রা বা নিদ্রার প্রাথমিক প্রভাব। "نَوْمٌ" পূর্ণ নিদ্রাকে বলা হয়। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাআলা তন্দ্রা ও নিদ্রা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। পূর্ববর্তী বাক্যে "কাইয়্যুম" শব্দে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আসমান ও যমিনের যাবতীয় বস্তুর নিয়ন্ত্রণকারী হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা। সমস্ত সৃষ্টি তার আশ্রয়েই বিদ্যমান। এতে করে হয়তো ধারণা হতে পারে যে, যে সত্তা এতো বড় কার্য পরিচালনা করছেন, তার কোন সময় ক্লান্তি আসতে পারে আর কিছু সময় বিশ্রাম ও নিদ্রার জন্য থাকা দরকার। দ্বিতীয় বাক্য দ্বারা সীমিত জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে জানানো হয়েছে যে, আল্লাহ'কে নিজের বা অন্য কোন সৃষ্টির সাথে তুলনা করবে না, নিজের মতো মনে করবে না। তিনি সমকক্ষতা ও সকল তুলনার ঊর্ধ্বে। তার পরিপূর্ণ ক্ষমতার পক্ষে এসব কাজ করা কঠিন নয়। আবার তার ক্লান্তিরও কোন কারণ নেই। আর তার সত্তা যাবতীয় ক্লান্তি, তন্দ্রা ও নিদ্রার প্রভাব থেকে মুক্ত ও পবিত্র। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আমিন আহসান ইসলাহী লিখেছেনঃ "سنة" শব্দের অর্থ হচ্ছে তন্দ্রা, আর"نوم" শব্দের অর্থ নিদ্রা। এর কোনটিই আল্লাহ'র স্পর্শ করে না বলায় বুঝা গেলো নিদ্রার প্রথম ও শেষ উভয় অবস্থা থেকে তিনি মুক্ত। যার অর্থ হচ্ছে, শৈথিল্য ও উদাসীনতা বা অবসাদগ্রস্ততার যাবতীয় প্রভাব থেকে তিনি সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। (তাদাব্বুরে কুরআন, ১ম খণ্ড)

আশেকে ইলাহি বুলন্দশহরি লিখেছেনঃ "سنة" বলা হয় হালকা ঘুমকে, যার তরজমা করা হয়েছে তন্দ্রা। "نوم" বলে এমন পূর্ণ নিদ্রাকে, যার ফলে হুঁশ থাকে না। আল্লাহ তাআলা তন্দ্রা ও নিদ্রা উভয়টি থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। ক্লান্তি দূরীকরণার্থে ও বিশ্রামের জন্য সৃষ্টিজীবের নিদ্রার প্রয়োজন হয়। আল্লাহ জাল্লা শানুহু'র কোনো ধরণের ক্লান্তি আসি না এবং আসতেও পারে না। অধিকন্তু নিদ্রা ও তন্দ্রার মধ্যে প্রভাব গ্রহণ ও অবস্থার পরিবর্তন হয়। আল্লাহ জাল্লা শানুহু প্রভাব গ্রহণ ও অবস্থার পরিবর্তন থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। কাজেই তার নিদ্রা আসে না এবং তা সম্ভবও না। মাখলুকের অবস্থা এই যে, কাজ করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, নিদ্রা তার উপর প্রভাব বিস্তার করে। শয়ন করতে না চাইলেও সে শয়ন করতে বাধ্য হয়। আল্লাহ তাআলা শয়ন করেন না, নিদ্রাও তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

"لَا تَأْخُذُه"

- শব্দের মধ্যে বলা হয়েছে, নিদ্রা আল্লাহ'র উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। যখন হালকা নিদ্রা বা তন্দ্রা তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে না, তখন গভীর নিদ্রা তো প্রভাব ফেলার প্রশ্নই আসে না। নিদ্রা মাখলুকের একটি বিশেষ গুণ, যা খালিকে কায়েনাতের শানে আয়েব ও ত্রুটি। এজন্যই হাদিস শরীফে (মুসলিম শরীফে) বর্ণিত হয়েছে, "আল্লাহ নিদ্রা যান না, আর নিদ্রা তার জন্য শোভনীয়ও না।" (তাফসীরে আনওয়ারুল বয়ান, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানিপথী লিখেছেনঃ "السنة" হলো নিদ্রা পূর্ববর্তী অবসাদ। অতিশয়তার ধারায় নিদ্রার পরে তন্দ্রার কথা বলার নিয়ম হলেও বাস্তব অস্তিত্বের ধারায় তন্দ্রা আগে হওয়ার প্রতি লক্ষ্য রেখে ধারা পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

"النوم"

- নিদ্রা হলো প্রাণীর একটি অবস্থা, যা ঊর্ধ্বগামী বাস্পের আর্দ্রতার কারণে, মস্তিস্কের শিরা-উপশিরাসমূহ শিথিল হয়ে যাওয়ার ফলে প্রাণীর উপর আপতিত হয় এবং বাহ্য অনুভূতি কেন্দ্রগুলোকে (পঞ্চ-ইন্দ্রিয়কে) সম্পূর্ণরূপে অনুভূতিশূন্য করে দেয়। এ বাক্যটি নেতিবাচক বিশেষণরূপে উল্লিখিত হয়েছে তুলনা ও উপমার ধারণা বিদূরিত করার লক্ষ্যে। সুতরাং এটি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী - এর দৃঢ়তাজ্ঞাপক। কেননা, নিদ্রা বা তন্দ্রা যাকে কাবু করতে পারে, তার জীবনীশক্তি রহিত হয়ে যায়। কারণ নিদ্রা হলো মৃত্যুর ভাই। আর সে অন্য কিছুর সংরক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান, স্থিতিবিধান করতে অপারগ হয়। এটি পূর্ববর্তী বাক্যের তাকীদ হওয়ার কারণে এ বাক্যের শুরুতে সংযোজক "ওয়াও" (و) ব্যবহৃত হয়নি। (তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড)

মুহাম্মাদ ইদরীস কান্দলভী লিখেছেনঃ তাকে তন্দ্রাও স্পর্শ করে না আর নিদ্রাও না। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যে পরিবর্তন, ক্ষণস্থায়িত্ব ও সৃষ্টিজীবের গুণ-বৈশিষ্ট্য থেকে পবিত্র ও মুক্ত তা বর্ণনা করা হয়েছে। এ বাক্যটি পূর্বোক্ত "الْحَيُّ الْقَيُّومُ" এর তাকীদ। কারণ তন্দ্রা ও নিদ্রার কারণে হায়াত বা জীবন ত্রুটিপূর্ণ হয়। কেননা, নিদ্রা মৃত্যুর সমগোত্রীয়। আর আল্লাহ তাআলা মৃত্যুর নাম-গন্ধ থেকেও পবিত্র ও মুক্ত। তাছাড়া যার হায়াত বা জীবন ত্রুটিপূর্ণ হবে তার "কাইয়ুমিয়্যাত" তথা হেফাযত ও রক্ষণাবেক্ষণও ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল হবে। কাজেই "لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ" এর মর্ম হলো, তিনি এমন ধারণকর্তা ও ব্যবস্থাপক যে, এক মুহূর্তও ব্যবস্থাপনা থেকে গাফিল হোন না। তিনি নিজ ব্যবস্থাপনা ও ধারণ কাজে ভুল, বিস্মৃতি, গাফলত ও আলস্য থেকে পবিত্র ও মুক্ত। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদী লিখেছেনঃ (যেমন মুশরিক জাতি ধারণা করে নিয়েছে) জাহিলী ধর্মমতের দেবতারা নিদ্রায় কাতর হয়, নেশায় ঘুমায় আর এ অবচেতন অবস্থায় তাদের দ্বারা নানা ভুল-ভ্রান্তিও হয়ে যায়। খৃষ্টান আর ইহুদীদেরও আকিদা এই যে, আল্লাহ তাআলা ছয় দিনে আসমান-যমিন পয়দা করে সপ্তম দিন তার বিশ্রাম গ্রহণের প্রয়োজন হয়। ইসলামের খোদা চিরন্তন, সদা সতর্ক, সবকিছু সম্পর্কে খবর রাখেন, অবচেতনতা, অলসতা আর অবসাদের অনেক ঊর্ধ্বে তিনি। এসব কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না, পারে না আচ্ছন্ন করতেও। (তাফসীরে মাজেদী, ১ম খণ্ড)

 

৪র্থ বাক্যঃ

لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ

অনুবাদঃ আকাশসমূহে যা রয়েছে আর পৃথিবীতে যা রয়েছে - সব তারই সত্বাধীন।

ইবনে কাসির লিখেছেনঃ অর্থাৎ এর মর্যাদা হলো যে, সমগ্র সৃষ্টি তার দাসত্বে নিয়োজিত, সবই তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত, সবই তার আয়ত্তাধীন এবং সব কিছুর উপর তার একচ্ছত্র রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত। যথা আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন -

"আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে, সে দয়াময়ের নিকট বান্দা হিসেবে উপস্থিত হবে না। অবশ্যই তিনি তাদের সংখ্যা নির্ণয় করেছেন আর তাদেরকে পূর্ণরূপে গণনা করেছেন। আর তাদের প্রত্যেকেই কিয়ামতের দিন তার কাছে একা আসবে।" (সূরাহ মারইয়াম, ১৯: ৯৩-৯৫)

আবু জাফর আত-তাবারী লিখেছেনঃ এ আয়াতাংশে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে, সমস্ত কিছুর মালিকই তিনি, তার কোন শরীক বা অংশীদার নেই। তিনিই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। অন্য সকল ভ্রান্ত মাবুদ ও উপাস্য সৃষ্টিকর্তা নয়।

"لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ"

- কালেমা দ্বারা এ অর্থ নেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করা উচিত বা সঙ্গত নয়। কেননা, মালিকানা সম্পত্তি মালিকের হাতেরই পুতুল বিশেষ। মালিকের অনুমতি ছাড়া মামলুক ব্যক্তি বিশেষ অন্যের সেবা করতে পারে না।

এজন্যই আল্লাহ ইরশাদ করেন যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে তার সমস্তই আমার মালিকানা সম্পদ ও আমার সৃষ্টি। সুতরাং আমার মাখলুকের কারোরই অন্যের উপাসনা করার অধিকার নেই। আমিই তার মালিক। কেননা, কোন গোলামের জন্য সঙ্গত নয় যে, সে তার মালিক ছাড়া অন্যের ইবাদাত বা সেবা করবে। সুতরাং সে তার মালিক ও প্রভু ছাড়া অন্যের আনুগত্য স্বীকার করে না। (তাফসীরে তাবারী, ৫ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ শফী লিখেছেনঃ এ বাক্যের প্রারম্ভে ব্যবহৃত "লাম" অক্ষর মালিকানা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, আকাশ ও যমিনে যা কিছু রয়েছে, সেসবই আল্লাহ'র মালিকানাধীন। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইচ্ছাশক্তির মালিক। যেভাবে ইচ্ছা তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদী লিখেছেনঃ "له" অগ্রে উল্লেখ করায় অর্থের জোর সৃষ্টি হয়েছে আর এতে সীমাবদ্ধতার তাৎপর্য পরিস্ফুট হয়েছে। অর্থাৎ, গোটা বিশ্ব চরাচরের মালিকানা কেবলমাত্র তারই। এক্ষেত্রে কেউ তার শরীক নেই। তার মালিকানা ক্ষেত্রে মাখলুক তথা সৃষ্টিলোকের কোন অংশ কোন বিভাগই মুক্ত নয়। মুশরিক জাতিগুলো নিজেদের দেবতাকে সৃষ্টিলোকের মালিক স্বীকার করলেও তা তো নিছক ল্যাংড়া-লুলা অপূর্ণ ধরণের। ইসলাম এসে এ বিষয়ে জোর দিয়ে বলেছে, স্রস্টার সাথে সৃষ্টির সত্যিকার ও সঠিক সম্পর্ক হচ্ছে পূর্ণ মালিকানার সম্পর্ক। "له" এর "লাম" অব্যয়টি সর্বসম্মতভাবে মালিকানা অর্থে (بحر - نهر) (তাফসীরে মাজেদী, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানিপথী লিখেছেনঃ এটি তার চিরস্থায়ী হওয়ার জন্য দৃঢ়তা জ্ঞাপক এবং ইলাহ হওয়ার ব্যাপারে তার একত্বের প্রমাণ। "আসমান-যমিনে যা কিছু আছে" দ্বারা উদ্দেশ্য যা কিছু এই দুইয়ের মধ্যে বিদ্যমান, চাই তা তাদের সত্তার অন্তর্ভুক্ত হোক, বা বাইরে হোক, কিন্তু তা তাদের মাঝে অবস্থিত। (তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড)

মুহাম্মাদ ইদরীস কান্দলভী লিখেছেনঃ এ বাক্য দ্বারা "মালিকানা" সিফাত সাব্যস্ত করা হয়েছে। তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মালিক। কারণ প্রকৃত মালিক সে-ই, যে অস্তিত্ব দান করে। অতএব, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে অস্তিত্ব দান করেছেন এবং যিনি উভয়ের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছেন ও উভয়ের রক্ষণাবেক্ষণ করছেন, তিনিই এ দুয়ের প্রকৃত মালিক। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আশেকে ইলাহি বুলন্দশহরী লিখেছেনঃ সমস্ত মাখলুক তার বান্দা ও তার মালিকানার অধীন। সবকিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনিই স্বাধীন স্রস্টা। তিনি যেভাবে চান নিজ মাখলুক পরিচালনা করতে পারেন। (তাফসীরে আনওয়ারুল বয়ান, ১ম খণ্ড)

৫ম বাক্যঃ

مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ

অনুবাদঃ এমন কে আছে, যে তার অনুমতি ছাড়া তার কাছে সুপারিশ করবে ?


ইবনে কাসির লিখেছেনঃ এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন -

مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ

অর্থাৎ, এমন কে আছে, যে তার অনুমতি ছাড়া তার সামনে কারো সুপারিশ করতে পারে ?

যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন -

"আকাশসমূহে বহু ফেরেশতা রয়েছে, কিন্তু তাদের সুপারিশ কোন কাজে আসবে না; তবে আল্লাহ যদি ইচ্ছা করে সন্তুষ্ট হয়ে কাকেও অনুমতি দান করেন, তবে তা অন্য কথা।" (সূরাহ আন নাজম, ৫৩ : ২৬)

অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন -

"..... তারা কারো জন্য সুপারিশ করে না, কিন্তু একমাত্র তার জন্য সুপারিশ করে যার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট রয়েছেন ....." (সূরাহ আল-আম্বিয়া, ২১: ২৮)

এর দ্বারা তার শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ত্ব ও উচ্চতম মর্যাদার কথা প্রকাশিত হয়েছে। আয়াতে বলা হয়েছে, তার অনুমতি ছাড়া কারো জন্য সুপারিশ করার সাহস কার আছে ?

যেমন শাফাআতের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন - আমি আরশের নীচে গিয়ে সিজদায় পড়ে থাকবো। আল্লাহ তার ইচ্ছা মোতাবেক আমাকে ডাকবেন আর বলবেন, মাথা তোলো আর যা বলতে হয় তা বলো, তোমার আবেদন শোনা হবে, তুমি সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সুপারিশের জন্য আমাকে সংখ্যা নির্ধারিত করে দেওয়া হবে, অবশেষে তাদেরকে আমি বেহেশতে নিয়ে যাবো। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ২য় খণ্ড)

আবু জাফর আত-তাবারী লিখেছেনঃ এর মাধ্যমে (আল্লাহ) প্রশ্ন রাখছেন যে, কে তার মালিকের কাছে অন্য সকলের জন্য সুপারিশ করতে পারে যদি মালিক তাদেরকে শাস্তি দিতে চায়। হ্যা, যদি সে তাদেরকে দায়মুক্ত করেন আর তাকে তাদের জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দেন, তাহলে সে তা পারে। আল্লাহ'র এ ঘোষণা দেওয়ার কারণ হলো যে, মুশরিকরা বলেছিলো, আমরা এসব মূর্তির অর্চনা শুধুমাত্র এজন্য সম্পাদন করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহ'র পাকের নৈকট্য লাভে সক্রিয় সাহায্য-সহায়তা করবে। প্রতিউত্তরে আল্লাহ তাদেরকে বলেন, আকাশ ও পৃথিবীতে এবং উভয়ের মধ্যে যা কিছু বর্তমান রয়েছে সব কিছুর মালিকানা স্বত্ব আমারই। কাজেই আমার ব্যতীত অন্যের ইবাদাত করা সঙ্গত নয়। সুতরাং তোমরা মূর্তিপূজা করো না, যাদেরকে তোমরা ধারণা করছো যে, তারা তোমাদেরকে আমার নৈকট্য লাভে সাহায্য-সহায়তা করবে। তারা আমার কাছে তোমাদের কোন উপকারে আসবে না এবং তারা তোমাদের কোন অভাবও মিটাতে পারবে না। তবে যদি কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে সে সুপারিশ করতে পারবে। তারা হচ্ছেন আমার পয়গাম্বর, ওলী ও বাধ্যগত বান্দাগণ। (তাফসীরে তাবারী, ৫ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ শফী লিখেছেনঃ এর অর্থ হচ্ছে - এমন কে আছে, যে তার সামনে কারো সুপারিশ করতে পারে তার অনুমতি ব্যতীত ?

এতে কয়েকটি মাসআলা বর্ণনা করা হয়েছে।

প্রথম হচ্ছে এই যে, যখন আল্লাহ তাআলা যাবতীয় সৃষ্টবস্তুর মালিক এবং কোন বস্তু তার চাইতে বড় নয়, তাই কেউ তার কোন কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকারী নয়। তিনি যা কিছু করেন, তাতে কারো আপত্তি করার অধিকার নেই।

তবে এমন হতে পারতো যে, কেউ কারো জন্য সুপারিশ করে। তাই এ বিষয়টিও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, এ ক্ষমতাও কারো নেই। তবে আল্লাহ'র কিছু খাস বান্দা আছেন, যারা তার অনুমতি সাপেক্ষে তা করতে পারবেন, অন্যথায় নয়।

হাদিসে ইরশাদ হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম আমি সমস্ত উম্মতের জন্য সুপারিশ করবো।

একে "মাকামে মাহমুদ" বলা হয়, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য খাস, অন্যের জন্য নয়। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদী লিখেছেনঃ "مَن ذَا الَّذِي" - এমন কে আছে ? (এটি) অস্বীকৃতি জ্ঞাপক জিজ্ঞাসা, অর্থাৎ, এমন কেউই নেই।

"يَشْفَعُ عِندَهُ"

- শাফাআত বা সুপারিশ সম্পর্কে টীকা এইমাত্র উল্লিখিত হয়েছে। মাসীহ - এর মহান শাফায়াত মাসীহীদের এক বিশেষ আকিদা। খৃষ্টানদের মতে মাসীহের কেবল স্বতন্ত্র শাফাআতই প্রমাণিত নয়, বরং তার এ সন্তানের মাধ্যমে তিনি এ বিশ্বলোকই সৃষ্টি করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। খৃষ্টানদের সম্বোধনকালে কুরআন মাজীদ তাদের কাফফারা, শাফায়াত ইত্যাদি বিশেষ ও কেন্দ্রীয় আকিদার উপর আঘাত হেনে থাকে।

"بِإِذْنِهِ"

- তার অনুমতিক্রমে। এটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করাও অতীব প্রয়োজন ছিলো। খৃষ্টানদের মতে পরিত্রাণ নির্ভর করে শাফাআতের উপর, ঠিক এর বিপরীতে কোন মুশরিক জাতি খোদাকে কর্মফল বিধানের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে নিয়েছে যে, তার জন্য ক্ষমা ও সুপারিশের কোন অবকাশই অবশিষ্ট রাখেনি। ইসলাম মধ্যমপন্থার রাজপথ অবলম্বন করে বলেছে যে, মুক্তি কখনো কারো সুপারিশের উপর নির্ভর করে না। অবশ্য আল্লাহ সুপারিশের অবকাশ রেখেছেন এবং তার অনুমতিক্রমে মকবুল বান্দাগণকে অপরের জন্য সুপারিশ করার সুযোগ দিবেন (মূলতঃ যা এক ধরণের দোয়া'ই) আর তাদের দোয়া কবুল করবেন। আর আল্লাহ'র মাকবুল বান্দাগণের সবচেয়ে বড় সর্দার হচ্ছেন আমাদের রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। (তাফসীরে মাজেদী, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানিপথী লিখেছেনঃ এটি তার উঁচু মর্যাদা বর্ণনা। অর্থাৎ, এমন কেউ নেই, যে তার সমকক্ষ হতে পারে বা তার ধারেকাছে যেতে পারে। কার এমন শক্তি যে, তিনি যা ইচ্ছা করেন, সুপারিশের জোরে তা খন্ডাতে পারে ? সরাসরি তার মোকাবিলা করা তো দূরের কথা। (তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড)

মুহাম্মাদ ইদরীস কান্দলভী লিখেছেনঃ এ বাক্য দ্বারা তার সর্বময় কর্তৃত্ব, প্রতাপ ও বড়ত্ব বর্ণনা করা উদ্দেশ্য যে, কার সাধ্য তার সমীপে তার অনুমতি ছাড়া মুখ খুলে ? (মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আশেকে ইলাহী বুলন্দশহরী লিখেছেনঃ এখানে বলা হয়েছে যে, কারো এতোটুকু ক্ষমতা ও যোগ্যতা নেই, যার ফলে আল্লাহ'র দরবারে সে সুপারিশ করতে সক্ষম হবে। তবে তিনি তার অপার অনুগ্রহে যাকে সুপারিশ করার আর যার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন, একমাত্র তিনিই সুপারিশ করতে পারবেন।

কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য অত্যন্ত কঠিন ও ভয়াবহ হবে। সেদিন সব মানুষ সুপারিশের জন্য বিভিন্ন নবীগণের কাছে উপস্থিত হবে। যখন সমস্ত নবী অপারগতা প্রকাশ করবেন, তখন সবাই ফখরুল আউওয়ালিন ওয়াল আখিরিন সায়্যিদিনা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমতে উপস্থিত হয়ে আবেদন করবে - আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, "তখন আমি রওয়ানা হয়ে যাবো। আরশের নীচে এসে আমার প্রভুর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়বো। তখন আল্লাহ তাআলা তার ঐসব প্রশংসা ও স্তুতিবাক্য আমার সামনে উদ্ভাসিত করে দিবেন, যেগুলো আমার পূর্বে কারো জন্য উদ্ভাসিত করে দেওয়া হয়নি। তারপর আমার রবের হুকুম হবে - হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), মাথা উঠাও, আমার কাছে প্রার্থনা করো, তোমার প্রার্থনা পুরা করা হবে; সুপারিশ করো, তোমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।" (এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুপারিশ করবেন, যার বিস্তারিত বিবরণ বুখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখ আছে)

আল্লাহ ইরশাদ করেন -

"সেদিন সুপারিশ উপকার দিবে না, কিন্তু ঐ ব্যক্তির জন্য ছাড়া - যাকে আল্লাহ তাআলা সুপারিশের অনুমতি প্রদান করবেন আর যার কথা পছন্দ করবেন।" (সূরাহ তো-হা, ২০ : ১০৯)

ফেরেশতাদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে -

"আল্লাহ তাদের আগেপিছের সমস্ত অবস্থা জানেন, তারা কেবল ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারবে, যার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট, তারা সবাই আল্লাহ'র ভয়ে প্রকম্পিত থাকবে।" (সূরাহ আল-আম্বিয়া, ২১ : ২৮)

"আকাশসমূহে বহু ফেরেশতা রয়েছে, কিন্তু তাদের সুপারিশ কোন কাজে আসবে না; তবে আল্লাহ যদি ইচ্ছা করে সন্তুষ্ট হয়ে কাকেও অনুমতি দান করেন, তবে তা অন্য কথা।" (সূরাহ আন নাজম, ৫৩ : ২৬) (তাফসীরে আনওয়ারুল বয়ান, ১ম খণ্ড)

৬ষ্ঠ বাক্যঃ

يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ

অনুবাদঃ তাদের সামনে যা রয়েছে আর তাদের পিছনে যা রয়েছে তিনি তা অবগত আছেন।

ইবনে কাসির লিখেছেনঃ অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্যকভাবে পরিজ্ঞাত। যেমন কুরআনে উল্লেখ হয়েছে -

"(জিবরীল বললোঃ) আমি আপনার পালনকর্তার আদেশ ব্যতীত অবতরণ করি না, যা আমাদের সামনে আছে, যা আমাদের পশ্চাতে আছে এবং যা এ দুই-এর মধ্যস্থলে আছে, সবই তার, এবং আপনার পালনকর্তা বিস্মৃত হওয়ার নন।" (সূরাহ মারইয়াম, ১৯: ৬৪) (তাফসীরে ইবনে কাসির, ২য় খণ্ড)

আবু জাফর আত-তাবারী লিখেছেনঃ এ আয়াতাংশের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, যা কিছু সংঘটিত হয়েছে, হচ্ছে বা হবে - সবকিছুর সম্বন্ধেই তিনি অবগত, তার কাছে কোন কিছুই গোপন নেই।

আত-তাবারী আরো লিখেছেন - আমার এ বক্তব্য তাফসীরকারগণ সমর্থন করেছেন। (তাফসীরে তাবারী, ৫ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ শফী লিখেছেনঃ অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা অগ্র-পশ্চাৎ যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনা সম্পর্কে অবগত। অগ্র-পশ্চাৎ বলতে এ অর্থও হতে পারে যে, তাদের জন্মের পূর্বে ও জন্মের পরের যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনা আল্লাহ'র জানা রয়েছে। আর এ অর্থও হতে পারে যে, অগ্র বলতে সে অবস্থা বুঝানো হয়েছে, যা মানুষের জন্য প্রকাশ্য, আর পশ্চাৎ বলতে বুঝানো হয়েছে যা অদৃশ্য। তাতে অর্থ হবে এই যে, কোন কোন বিষয় মানুষের জ্ঞানের আওতায় রয়েছে, কিন্তু কোন কোন বিষয়ে তাদের জ্ঞান নেই। কিছু তাদের সামনে প্রকাশ্য আর কিছু গোপন। কিন্তু আল্লাহ'র ক্ষেত্রে সবই প্রকাশ্য। তার জ্ঞান সে সমস্ত বিষয়ের উপরই পরিব্যাপ্ত। সুতরাং এ দুটোতে কোন বিরোধ নেই। আয়াতের ব্যাপকতায় উভয় দিকই বুঝানো হয়। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আমিন আহসান ইসলাহী লিখেছেনঃ এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ'র জ্ঞান লোকদের সামনের ও পিছনের, তাদের অতীত ও ভবিষ্যৎ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে। (তাদাব্বুরে কুরআন, ১ম খণ্ড)

আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদী লিখেছেনঃ অর্থাৎ উপস্থিত অনুপস্থিত, অনুভূত ও বুদ্ধিগত, জানা অজানা সবকিছুর পুরোপুরি জ্ঞান তার রয়েছে। এখানে কেবল দুটি দিকের উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু উদ্দেশ্য সকল দিক। এ ধরণের রূপক ব্যবহার আরবী ভাষায় ব্যাপক।

خَلْفَهُمْ - أَيْدِيهِمْ

- এ هُمْ সর্বনাম দ্বারা "مَن ذَا" এর উদ্দিষ্টই উদ্দেশ্য। আম্বিয়া ও ফেরেশতারা যার অন্তর্ভুক্ত, অথবা এর দ্বারা "فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ" ই উদ্দেশ্য। পুরুষ বাচক সর্বনাম এজন্য ব্যবহার করা হয়েছে যে, এতে আসমান-যমিনের জ্ঞানবানরাই লক্ষ্য।

উপরে (তাফসীরে মাজেদীর এই আয়াতাংশ সংক্রান্ত তাফসীরের পূর্বে) আল্লাহ'র গুনাবলী প্রসঙ্গে "قيوميت" ও"مالكيت" গুণের উল্লেখ করা হয়েছে। এখন এখানে আর একটি তত্ত্ব প্রমাণ করা হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলার জ্ঞান বিশেষণটিও পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ। চেষ্টা-সাধনা আর সুপারিশ-তদবীরের একটা ধারা তো দুনিয়ায় এমনও হয়ে থাকে যে, যে বিচারক-মালিকের সামনে মামলা পেশ করা হয়, তার জ্ঞান সর্বব্যাপী ও পূর্ণাঙ্গ নয়। এ কারণে বাইরের উপরকরণ দ্বারা তার জ্ঞানে সংযোজন করা প্রয়োজন, প্রয়োজন তার জ্ঞানকে সর্বব্যাপক ও পরিপূর্ণ করা। আল্লাহ'র জ্ঞান প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব কিছুতেই ব্যাপ্ত হয়ে আছে। এখানে একথা উল্লেখ করে যেন বলে দেওয়া হয়েছে যে, তার জ্ঞানে কারো সংযোজন করার, তার সামনে কারো গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার দ্বারা তাকে কোন অজ্ঞাত বিষয়ে অবহিত করা অর্থহীন। আর এমনিভাবে খৃষ্টানদের সুপারিশ সংক্রান্ত বিশ্বাসের উপর আর একটি আঘাত হানা হয়েছে। (তাফসীরে মাজেদী, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানিপথী লিখেছেনঃ অর্থাৎ যা তাদের পূর্বে ছিলো আর যা তাদের পরে আসবে, অথবা যা তারা বুঝতে পারে আর যা বুঝতে পারে না, অথবা যা তারা গ্রহণ করে আর যা বর্জন করে। কেননা, তারা যা বর্জন করলো তা যেন তারা পিঠের পিছন দিকে ফেলে দিলো। هُمْ সর্বনাম দ্বারা "আসমান-যমিনে যা কিছু" আছে উদ্দেশ্য। এতে বিবেকবানদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বিবেকহীনদের উপর। কিংবা সর্বনাম দ্বারা পূর্বোক্ত "ذا" (ইসমুল ইশারা) দ্বারা যাদের বুঝানো হয়েছে - অর্থাৎ নবীগণ ও ফেরেশতাগণ। (তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড)

মুহাম্মাদ ইদরীস কান্দলভী লিখেছেনঃ এ বাক্যে তার সর্বব্যাপী জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে যে, তার জ্ঞান সৃষ্টিজীবের সকল অবস্থাকে বেষ্টন করে আছে। (মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আশেকে ইলাহী বুলন্দশহরী লিখেছেনঃ অর্থাৎ, তাদের পার্থিব ও পারলৌকিক সকল বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিফহাল। কোনো কোনো মুফাসসির এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন, আমলকারীদের ভালো-মন্দ সমস্ত আমল আল্লাহ'র সামনে। তিনি এগুলো সম্পর্কেও জানেন, তারা যা পূর্বে করেছে সেগুলো সম্পর্কেও জানেন। মোটকথা, তার জ্ঞান সমগ্র মাখলুক এবং মাখলুকের সার্বিক অবস্থা, আমল ও কার্যসমূহকে পরিপূর্ণভাবে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। (তাফসীরে আনওয়ারুল বয়ান, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম লিখেছেনঃ এ আয়াতের মর্ম হলো এ কথা প্রকাশ করা যে, মানুষের জন্মের পূর্বে ও পরে দুনিয়া ও আখিরাতে যা কিছু ঘটেছে আর যা কিছু ঘটবে এবং মানুষের কাছে যা প্রকাশিত বা গোপন - এই সমস্ত বিষয়ে আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন সম্পূর্ণ অবগত। ভূত বা ভবিষ্যৎ কোন কিছুই আল্লাহ পাকের কাছে গোপন নেই।

কারো মনে এ প্রশ্ন উত্থিত হতে পারে যে, পৃথিবীর অগণিত মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে সঠিক বিবরণ সংরক্ষণ করা, প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের যাবতীয় কার্যাবলীর হিসাব রক্ষা করা, প্রত্যেকের কার্যক্রমের ভালো-মন্দ নির্ণয় করা, তাদের পুরস্কার ও তিরস্কার নির্দিষ্ট করা আদৌ সহজ নয়, বরং কঠিনতর এমনকি অসম্ভব। আলোচ্য আয়াত দ্বারা মানব মনের এমনি সন্দেহের নিরসন করা হয়েছে যে, আল্লাহ পাকের জ্ঞানের কোন সীমা নেই। তার জ্ঞান, তার ক্ষমতা ও আধিপত্য সমগ্র সৃষ্টিজগতকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে, মানুষের কাছে যা অসম্ভব মনে হয়, আল্লাহ পাকের দরবারে তা কোন সমস্যাই নয়, কেননা তার জ্ঞান, তার কুদরত হেকমত অনন্ত অসীম, সবই তার কর্তৃত্বাধীন। (তাফসীরে নুরুল কুরআন, ৩য় খণ্ড)

৭ম বাক্যঃ

وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ

অনুবাদঃ আর যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ছাড়া তার ইলমের কিছুই তারা (সৃষ্টিকুল) আয়ত্ব করতে পারে না।

ইবনে কাসির লিখেছেনঃ অর্থাৎ, কেউই তার জ্ঞানের একটি অংশবিশেষকেও পরিবেস্টিত করতে পারে না। তবে আল্লাহ যাকে জানাবার ইচ্ছে করেন, সে-ই কেবল কিছু জানতে পারে।

এর অর্থ এটিও হতে পারে যে, আল্লাহ তার জাতিসত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে কাকেও জ্ঞান দান করেন না, তবে যাকে জানাবার ইচ্ছা করেন তাকে জানান। যেমন তিনি অন্যত্র বলেছেন -

"..... আর তারা তাকে নিজ জ্ঞানের পরিধিতে বেষ্টন করতে পারে না।" (সূরাহ তো-হা, ২০ : ১১০) (তাফসীরে ইবনে কাসির, ২য় খণ্ড)

আবু জাফর আত-তাবারী লিখেছেনঃ তিনি এমন জ্ঞানী যার কাছে কোন কিছুই গোপন নেই এবং প্রত্যেক জিনিসকেই স্বীয় জ্ঞান দ্বারা আয়ত্তাধীন রেখেছেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ এরূপ গুণের অধিকারী নন এবং তিনি ছাড়া অন্য কেউ তিনি যা ইচ্ছা করেন তার চেয়ে অধিক কোন কিছুর জ্ঞান রাখেন না। অন্য কথায়, তিনি যে জ্ঞান সম্বন্ধে কাউকে অবগত করাবার ইচ্ছা করেন, সে তা-ই জানে, এর চেয়ে অধিক জানে না। এটি এজন্য যে, যদি কোন ব্যক্তি যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে অবগত না হয়, তাহলে তার সত্তার ইবাদাত করা সঙ্গত হতে পারে না। আর যারা কিছুই বুঝে না, যেমন মূর্তি ও দেবদেবী, তাদের ইবাদাত কিভাবে সঙ্গত হতে পারে ? এজন্য আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দেন যে, তোমরা এমন সত্তার জন্য ইবাদাত নির্ধারণ করো, যিনি যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন, তার কাছে ছোট-বড় কোন কিছুই গোপন থাকে না। (তাফসীরে তাবারী, ৫ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ শফী লিখেছেনঃ অর্থাৎ, মানুষ ও সমগ্র সৃষ্টির জ্ঞান আল্লাহ'র জ্ঞানের কোন একটি অংশবিশেষকেও পরিবেস্টিত করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ যাকে যে পরিমাণ জ্ঞান দান করেন, শুধু ততটুকুই সে পেতে পারে। এতে বলা হয়েছে যে, সমগ্র সৃষ্টির অণু-পরমাণুর ব্যাপক জ্ঞান আল্লাহ'র জ্ঞানের আওতাভুক্ত - এটি তার বৈশিষ্ট্য। মানুষ অথবা অন্য কোন সৃষ্টি এতে অংশীদার নয়। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদী লিখেছেনঃ কে পরিবেষ্টন করতে পারে না ? সেই সৃষ্টিকূল পীর-পয়গম্বর ফেরেশতা সকলেই যার অন্তর্ভুক্ত। "من علمه" তে"علم" অর্থ "আল্লাহ'র জ্ঞান"। আল্লাহ'র জ্ঞানের কোন একটি বিষয়ের তত্ত্ব-রহস্য উদঘাটন করা সবচেয়ে বড় আলিম ও আরিফের পক্ষেও সম্ভব নয়। সসীম আর অসীমের জ্ঞানের কি তুলনা চলে !

"إِلَّا بِمَا شَاءَ"

- (স্বীয় প্রজ্ঞা ও উপযোগিতা অনুযায়ী)। এখানে এ তত্ত্ব বিবৃত হয়েছে যে, বান্দা যতো বড় আলিম আরিফ'ই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তার জ্ঞান তো সীমাবদ্ধই এবং আল্লাহ'র জ্ঞান ও ইচ্ছা-অভিপ্রায়ের অধীন। (তাফসীরে মাজেদি, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানিপথী লিখেছেনঃ "তারা তার জ্ঞানের কোন কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না" - অর্থাৎ, তার জ্ঞাত বিষয়সমূহ। সবকিছুই আল্লাহ'র জ্ঞাত হওয়া সত্ত্বেও "তার জ্ঞান" বলে তাদের আয়ত্ত না করতে পারাকে সীমিতরূপে উল্লেখ করার কারণ এ কথা বুঝানো যে, এখানে আয়ত্ত করা দ্বারা জ্ঞানমূলক আয়ত্ত উদ্দেশ্য। আয়ত্ত করতে পারে না বলা হয়েছে, "তারা কোন কিছু জানে না" বলা হয়নি। এর দ্বারা এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, বস্তুর মূলতত্ত্ব সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ পরিব্যাপ্ত জ্ঞান আল্লাহ'র জন্যই খাস, অন্য কারো মাঝে কদাচিৎ কোন কিছুর তত্ত্ব জ্ঞান পাওয়া যায় না। অথবা তার জ্ঞান দ্বারা তার জন্য বিশিষ্ট জ্ঞান অর্থাৎ "ইলমুল গাইব" - অদৃশ্য বস্তুর জ্ঞান বুঝানো হয়েছে। কেননা, তারা অদৃশ্য জ্ঞানের কোন কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না।

"যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ছাড়া" - অর্থাৎ, যতটুকু তিনি বেষ্টন করার ইচ্ছা করেন এবং তা অতি নগণ্য পরিমাণ। আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন -

"...... তোমাদের অতি অল্প পরিমাণ জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।" (সূরাহ বানি ঈসরাঈল, ১৭ : ৮৫)

"وَلَا يُحِيطُونَ"

- এর"و" টি "يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ" এর কর্তার (আল্লাহ'র) অবস্থা জ্ঞাপক বিশেষণ। কিংবা এটি সংযোজক বর্ণ। সংযোজন করার কারণ এই যে, বাক্যদ্বয়ের সমষ্টি দ্বারা বুঝা যায় যে, সৃষ্টিকুলের অবস্থাদি বেস্টনকারী তার পূর্ণাঙ্গ সত্তাগত জ্ঞান এবং এক্ষেত্রে তিনি একক ও অদ্বিতীয়। (তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড)

মুহাম্মাদ ইদরীস কান্দলভী লিখেছেনঃ এ বাক্যে বলা হয়েছে, যেভাবে সৃষ্টিজীবের অস্তিত্ব আল্লাহ'র দান, তেমনিভাবে সৃষ্টিজীবের জ্ঞানও তার দান। বান্দা কেবল ততটুকুই জানতে পারে যতটুকু তিনি চান। বান্দার জ্ঞান তার ইচ্ছার অধীন। বান্দার জ্ঞান অতি সামান্য ও সীমিত এবং অজ্ঞতা সীমাহীন ও অসীম। (মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আশেকে ইলাহী বুলন্দশহরী লিখেছেনঃ মাখলুক যতটুকু ইলমের অধিকারী হয়েছে, তা আল্লাহ'র পক্ষ থেকেই প্রাপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে কারো নিজস্ব ইলম নেই। কারো ইলম আল্লাহ'র সমগ্র জ্ঞানের পরিধি পরিবেষ্টন করতে সক্ষম নয়। (তাফসীরে আনওয়ারুল বয়ান, ১ম খণ্ড)

৮ম বাক্যঃ

وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ

অনুবাদঃ তার কুরসী আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী পরিব্যাপ্ত।

ইবনে জারীর আত-তাবারী লিখেছেনঃ এ আয়াতাংশের মাধ্যমে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, আল্লাহ'র "কুরসী" আকাশ ও পৃথিবীময় সুবিস্তৃত। তবে বিশ্লেষণকারীরা এ আয়াতে উল্লিখিত "কুরসী" এর অর্থ নিয়ে মতবিরোধ করেছেন। (তাফসীরে তাবারী, ৫ম খণ্ড)

ইবনে কাসির লিখেছেনঃ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, "এর(কুরসীর) পরিমাপ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জানা নেই।" (তাফসীরে ইবনে কাসির, ১ম খণ্ড)

মুহাম্মাদ শফী লিখেছেনঃ অর্থাৎ, তার কুরসী এতো বড়, যার মধ্যে সাত আকাশ ও যমিন পরিবেস্টিত রয়েছে।

আল্লাহ উঠা-বসা আর স্থান-কাল থেকে মুক্ত। এ ধরণের আয়াতকে মানুষের কার্যকলাপ ও আচার-আচরনের সাথে তুলনা করা উচিত নয়। এর অবস্থা পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করা মানবজ্ঞানের ঊর্ধ্বে। তবে হাদিসের বর্ণনা দ্বারা এতোটুকু বোঝা যায় যে, আরশ ও কুরসী এতো বড় যে, তা সমগ্র আকাশ ও যমিনকে পরিবেস্টিত করে রেখেছে।

ইবনে কাসির আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র উদ্ধৃতিতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, কুরসী কি এবং কেমন ?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "যার ইখতিয়ারে আমার প্রাণ, তার কসম - কুরসীর সাথে সাত আকাশ ও সাত যমিনের তুলনা একটি বিরাট ময়দানে ফেলে দেওয়া একটি আংটির মতো।"

অন্য এক বর্ণনাতে আছে যে, আরশের তুলনায় কুরসীও অনুরূপ। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আমীন আহসান ইসলাহী লিখেছেনঃ তার ব্যাপক-বিস্তৃত রাজত্বের দূরবর্তী কোন প্রান্তও এমন নয়, যেখানে তিনি তার কর্তৃত্ব পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে সফল হচ্ছেন না এবং তিনি সেখানে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য উপাস্যদেরকে নিজের ক্ষমতার অংশীদার বানাতে বাধ্য। (তাদাব্বুরে কুরআন, ১ম খণ্ড)

৯ম আয়াতঃ

وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا

অনুবাদঃ আর এ দুটোর রক্ষণাবেক্ষণ তাকে ক্লান্ত করে না।

ইবনে কাসির লিখেছেনঃ অর্থাৎ, আসমান ও যমিন এবং এর অভ্যন্তরের প্রতিটি সৃষ্টিকে রক্ষণাবেক্ষণ করা তার জন্য কোন কষ্টকর ব্যাপার নয়, বরং এটি তার জন্য খুবই সহজ। আর সমগ্র সৃষ্টি তার কাছে অতি নগণ্য ও তুচ্ছ এবং সকলেই তার নিকট মুখাপেক্ষী ও দরিদ্র। তিনি ঐশ্বর্যশালী ও অতি প্রশংসিত। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন। তাকে হুকুম দেওয়ার কেউ নেই। নেই তার কাজের কোন হিসাব গ্রহণকারী। তিনিই সকল বস্তুর উপর একচ্ছত্র ক্ষমতাবান ও সকলের হিসাব আদায়কারী, সকল জিনিসের একমাত্র মালিকানা তার। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, নেই কোন প্রতিপালক। (তাফসীরে ইবনে কাসির, ২য় খণ্ড)

আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদী লিখেছেনঃ মুশরিক জাতিগুলো ধারণা করে নিয়েছে যে, এতো বিশাল-বিস্তীর্ণ ও বিজন প্রান্তর, যার কোন সীমা-পরিসীমা নেই, তার দেখাশুনা আল্লাহ একা কি করে করবেন ? এ কারণে (নাউযুবিল্লাহ) তিনি কখনো ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে যেতে পারেন, আর এসব সামাল দেওয়ার জন্য তার অংশীদার ও সহায়কেরও প্রয়োজন হতে পারে। আল্লাহ'র অবসন্ন হওয়া ও বিশ্রাম নেওয়া সম্পর্কে স্বয়ং ইহুদী-খৃষ্টানদের বিশ্বাস এ দিকেই ইঙ্গিত করে। (তাফসীরে মাজেদী, ১ম খণ্ড)

আমীন আহসান ইসলাহী লিখেছেনঃ আল্লাহ তাআলা এ দুনিয়ার বাদশাহদের মতো নন, যারা নিজেদের রাজত্ব সামাল দেওয়ার জন্য বহুসংখ্যক সহকারী ও সাহায্যকারীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। তাদের ছাড়া রাজ্যের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। বরং তিনি অসীম জ্ঞান, অশেষ ক্ষমতা ও সীমাহীন শক্তি প্রয়োগের অধিকারী। সুতরাং যেভাবে আমরা আমাদের বাড়ির প্রাঙ্গনকে দেখাশোনা করি, তার চেয়েও লাখো গুণ সহজতরভাবে তিনি তার আসমান ও যমিনব্যাপী রাজত্বের শৃঙ্খলা রক্ষা করেন এবং এটা তার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃসাধ্য ব্যাপার নয় যে, কারো পক্ষ থেকে সহযোগিতার প্রয়োজন পড়তে পারে। (তাদাব্বুরে কুরআন, ১ম খণ্ড)

১০ম বাক্যঃ

وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ

অনুবাদঃ আর তিনিই সর্বোচ্চ মর্যাদাবান, সর্বোচ্চ মাহাত্ম্যের অধিকারী।

ইবনে কাসির লিখেছেনঃ (এর অর্থ,) তিনি সমুন্নত মহীয়ান। (তাফসীরে ইবনে কাসির, ২য় খণ্ড)

মুহাম্মাদ শফী লিখেছেনঃ তিনি অতি উচ্চ ও অতি মহান। পূর্ববর্তী নয়টি বাক্যে আল্লাহ'র সত্তা ও গুণের পূর্ণতা বর্ণনা করা হয়েছে। তা দেখার ও বুঝার পর প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তি বলতে বাধ্য হবে যে, সকল শান-শওকত বড়ত্ব ও মহত্ত্ব এবং শক্তির একমাত্র মালিক আল্লাহ তাআলা। এ দশটি বাক্যে আল্লাহ'র যাত ও সিফাতের পূর্ণ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

আমীন আহসান ইসলাহী লিখেছেনঃ অর্থাৎ, তার সত্তা বিশালতম ও শ্রেষ্ঠতম। তার জ্ঞান, তার ক্ষমতা ও তার ব্যাপকতাকে নিজেদের সীমিত পাল্লায় পরিমাপ করো না, এখান থেকেই তো তার সম্পর্কে বিভ্রান্তি বা পথচ্যুতির সৃষ্টি হয় আর শিরকের বিভিন্ন পথ উন্মুক্ত হয়। তার গুণাবলী সম্পর্কে তিনি স্বয়ং যা কিছু বলেন তার উপর ঈমান আনো। ধারণা ও অনুমান এবং সাদৃশ্য ও উপমার খেয়ালীপনা থেকে দূরে থাকো। (তাদাব্বুরে কুরআন, ১ম খণ্ড)

 

ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহ এ আয়াতের তাফসীর শেষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেনঃ

উল্লেখ্য, আলোচ্য আয়াতটি এবং এ ধরণের যতো আয়াত ও হাদিস রয়েছে, এ সম্বন্ধে পূর্ববর্তী বিজ্ঞ আলিমগণের অভিমত হলো, এ বিষয়গুলোর প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা না করে ও প্রলম্বিত আলোচনায় প্রবৃত্ত না হয়ে তা যেভাবে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, সেভাবে তার প্রতি ঈমান রাখা এবং কোন বস্তুর সাথে তার পরিমাপ ও তুলনা না করাই ঈমানদারের কাজ। তাহলে কোন সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকে না। (তাফসীরে ইবনে কাসির, ২য় খণ্ড)

 

আহকাম শিক্ষাঃ

(১) তাওহীদের বিষয় বর্ণিত হয়েছে।

(২) আল্লাহ তাআলার একাধিক গুণাবলীর কথা বর্ণিত হয়েছে।

(৩) আল্লাহ তাআলা সবকিছুর মালিক।

(৪) আল্লাহ তাআলার অনুমতি ছাড়া কেউ তার কাছে কোন সুপারিশ করতে পারবে না।

(৫) আল্লাহ তাআলা ভূত-ভবিষ্যৎ ও প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছু সম্বন্ধে জ্ঞান রাখেন।

(৬) কুরসী ও তার ব্যাপকতার কথা বর্ণিত হয়েছে।

(৭) আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রক্ষণাবেক্ষণ তাকে ক্লান্ত করে না - এর দ্বারা তার মহা শক্তিমত্তার কথা বর্ণিত হয়েছে। (বুরহানুল কুরআন, ১ম খণ্ড)

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-5r

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বাংলাদেশে খৃষ্টান মিশনারির অপতৎপরতা ও আমাদের করণীয় (১)

 

 

 

The Greatest Nation·Sunday, April 7, 2019

 

 

 

 

২০২৫ সাল পর্যন্ত খৃষ্টানদের বিভিন্ন টার্গেট ও পরিকল্পনা

১৯৭৮ সালে উত্তর আমেরিকার লুওয়াজিন নামক স্থানে সমকালীন খৃষ্টবাদ প্রচারের ধারাবাহিকতায় এক ঐতিহাসিক কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। তাতে সারা দুনিয়ার প্রায় দেড়শ প্রথম সারির খৃষ্টান ধর্মগুরু ও ধর্মনেতাগণ যোগদান করেন। তাদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন দেশের বড় বড় গির্জা, মিশনারি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি ছিলেন। উক্ত কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারী সবাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা, জ্ঞান-গবেষণা এবং বোধ ও বুদ্ধিমত্তার আলোকে বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে মুসলমানদের মাঝে খৃষ্টবাদ প্রচারের স্বার্থে এ ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেন যে, দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার সময় যদি তাৎক্ষণিকভাবে মুসলমানদেরকে খৃষ্টবাদের বিষাক্ত ট্যাবলেট গলধকরণ করানো নাও যায় তাহলে সমস্যা নেই; কিন্তু কমপক্ষে অতি অবশ্যই মুসলমানদের মাঝে নৈতিক ও চারিত্রিক স্খলন ঘটানো এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাদেরকে পঙ্গু করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতে হবে। কনফারেন্সে যোগদানকারী ধর্মনেতাগণ এ প্রস্তাবকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে একটি রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবী জানান। যা পরবর্তীতে একজন প্রসিদ্ধ উগ্র ও চরমপন্থী খৃষ্টান ধর্মপ্রচারক স্যমুয়েল জেইমারের নামে পরিচিতি লাভ করে।

মোটকথা, গির্জাপতি আর ধর্মনেতাগণ খৃষ্টধর্ম প্রচার-প্রসারের পথকে সহজ ও সুগম করতে কোন কল্পনা-পরিকল্পনা বাকি রাখেননি। একজন মুসলমানের অমূল্য সম্পদ ঈমানকে ছিনতাই করা, মুসলিম যুবসমাজের চরিত্রকে নষ্ট করা এবং ইসলামবৃক্ষের গোড়াকর্তন করার - সার্বিক অর্থেই যতো পথ ও পন্থা হতে পারে তারা সব আবিস্কার করেছে এবং মুসলমানদেরকে সে অনুযায়ী পরিচালিত করছে। কিন্তু পরিতাপের কথা হলো, মুসলমানরা নিজেদের সঠিক পথ ছেড়ে ইয়াহুদি-খৃষ্টানদের বাতলানো পথে চলতে লজ্জা ও অনুশোচনাবোধ তো দূরের কথা, বরং সেটাকেই গর্ব ও আভিজাত্যের বিষয় মনে করছে। যারা এ ব্যাপারে সামান্য "নাক গলায়", তাদেরকে সেকেলে, চরমপন্থী, প্রগতির পথে বাধা ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করছে।

আপনাদের সামনে একটি রিপোর্ট পেশ করছি, আশা করছি এর দ্বারা আপনি খৃষ্টানদের বিভিন্ন পরিকল্পনা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা লাভ করতে পারবেন।

আন্তর্জাতিক খৃষ্টান মিশনারি প্রতিষ্ঠান তার তেরতম বাৎসরিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে রয়েছে খৃষ্টান মিশনারিদের অতীত সফলতাসহ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটি সংক্ষিপ্ত খসড়া। চলতি শতাব্দীর প্রথম ২৫ বছরে তাদের কি কি অভিসন্ধি রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে কোন পথে এগুতে হবে, কি পরিমাণ অর্থসম্পদ তাতে ব্যয় হবে, কতজন ধর্মপ্রচারক ও মিশনারি এই মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তার সম্ভাব্য ফলাফল কি দাঁড়াতে পারে ইত্যাদি বিষয়ের সামান্য চিত্র তাতে তুলে ধরা হয়েছে। আমেরিকার অরজিনা ভার্সিটির খৃষ্টান প্রফেসর ডক্টর ডিওড বেরিয়েট এ প্রতিবেদনের উপর বিস্তর গবেষণা-পর্যালোচনা করার পর মন্তব্য করেছেন-

"নিশ্চয়ই এই প্রতিবেদন দুনিয়াজুড়ে খৃষ্টানদের একচ্ছত্র আধিপত্যের ইঙ্গিত বহন করছে। এ আধিপত্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও হতে পারে, আবার হতে পারে চিন্তানৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক অঙ্গনে। খৃষ্টানদের কর্মতৎপরতা ও সফলতার একটি চিত্র দেখুন - শুধুমাত্র ১৯৯৬ সালের এক বছর সময়েই খৃষ্টানরা সারা দুনিয়ায় বাইবেলের ২৮ বিলিয়ন কপি(আঠারশত কোটি কপি) বিতরণ করেছে। আর এ কথা শুনলে তো রীতিমত অবাক হতে হয় যে, গেলো বছর পর্যন্ত পৃথিবীর নামী-দামী বড় বড় লাইব্রেরীগুলোতে যীশু খৃষ্টের নামে লেখা বই-পত্রের সংখ্যা ৬৫৭৫১ এ দাঁড়িয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৫৩০৯৪ টি বইয়ের প্রচ্ছদে উজ্জ্বল ও স্পষ্ট অক্ষরে যীশু খৃষ্টের নাম লেখা আছে।"

ডক্টর বেরিয়েট আরো বলেন, উক্ত প্রতিবেদনে সে সকল অঞ্চলের আলোচনাও এসেছে যেগুলোতে এখনো পর্যন্ত খৃষ্টধর্মের দাওয়াত পৌঁছেনি। উক্ত প্রতিবেদনে অ-খৃষ্টান রাজ্যসমূহকে 'আলিফ' ও 'বা' - এই দুটো শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে।

"আলিফ' দ্বারা উদ্দেশ্য সে সকল রাজ্য, যেগুলোতে খৃষ্টধর্মের আওয়াজ বিলকুল পৌঁছেনি। আর'বা' দ্বারা সে সকল রাজ্য উদ্দেশ্য, যেগুলো খৃষ্টান রাজ্যের পার্শ্ববর্তী ও ভৌগলিক দিক থেকে তার সাথে মিলিত। উক্ত প্রতিবেদনে দাবী করা হয় যে, অ-খৃষ্টান রাজ্যসমূহে অনতিবিলম্বে খৃষ্টধর্মের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য ভৌগলিক তথ্য, ভাষা ও আঞ্চলিক সব রীতি অভ্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ইতিমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে।

উক্ত প্রতিবেদনের একটি পরিসংখ্যান ছিল এই যে, বর্তমানে অ-খৃষ্টান রাজ্যে বসবাসকারী জনগণের সংখ্যা হলো তের বিলিয়ন। আর এই জনপদগুলোতে বছরে প্রায় ৪৭ মিলিয়ন লোক বাড়ছে। এ হিসেবে দৈনিক ১২৯০০০ নবজাতক শিশু জন্মগ্রহণ করছে। উনিশ শতকে জনসংখ্যার বাৎসরিক প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র এক মিলিয়ন। এ হিসেবে আশা করা যায়, বিশ শতকে অ-খৃষ্টানদের রাজ্যের জনসংখ্যা ১৪ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫ বিলিয়নে পৌঁছে যাবে। (এডিটেডঃ হিসাবে কোন একটা প্রবলেম হয়েছে, তবে এটা শিউর যে, “বিলিয়ন” হবে না। হতে পারে মিলিয়নের পরিবর্তে ভুল করে বিলিয়ন লেখা হয়েছে, কিন্তু শিউর না হয়ে কারেক্ট করতে পারছি না।)

পৃথিবীর শতকরা ৮১ ভাগ লোক কোন না কোন ধর্ম পালন করে। এ হিসেবে পৃথিবীতে বর্তমানে নাস্তিক বা স্রস্টায় অবিশ্বাসী লোকের সংখ্যা হলো ১১১০ মিলিয়ন। সারা পৃথিবীতে ১৫ হাজারেরও বেশী ধর্মের প্রচলন রয়েছে। আর দিন দিন তো নতুন ধর্মের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এই বৃদ্ধি খৃষ্টানদের ধর্ম প্রচারে বড় বাঁধা। এখন আমরা বাংলাদেশে খৃষ্টান মিশনারীদের কর্মফলাফল, গির্জার সফলতা ও অন্যান্য সংস্থার কারগুজারী ধারাবাহিক উল্লেখ করবো ইন শা আল্লাহ। যা দ্বারা অনুমান করা সহজ হবে যে, বাংলাদেশে তাদের অপতৎপরতা কি পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

বাংলাদেশে মিশনারির আগমন

মিশনারি হলো খৃষ্টানদের দাওয়াতি সংস্থা। সারা দুনিয়াতে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে লক্ষ্ লক্ষ প্রচারকের মাধ্যমে খৃষ্টানরা খৃষ্টধর্মের দাওয়াত দিয়ে আসছে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে, আজ থেকে পাঁচশ বা ছয়শ বছর আগে খৃষ্টান মিশনারিরা এই বাংলায় আসে। পর্তুগিজরা যখন বাংলায় বা ভারতে আসে তখন সাথে করে খৃষ্টান মিশনারিদেরও নিয়ে আসে। জেসুইস ও অগস্টেইনিয়া নামক ক্যাথলিক খৃষ্টানদের দুটো দল পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের ছত্রছায়ায় ২০০ বছর যাবত বাংলায় খৃষ্টধর্ম প্রচার করে আসছে। মোগল সম্রাট আকবর ভারতের বাঙাল প্রদেশের প্রসিদ্ধ স্থান হুগলিতে পর্তুগিজদের বসতি স্থাপনের অনুমতি দিলে তাদের ছত্রছায়ায় মিশনারিরা এসে এলাকায় গির্জা প্রতিষ্ঠা করলো, স্কুল বানালো, হাসপাতাল চালু করলো। হুগলিকে কেন্দ্র করে খৃষ্টধর্ম প্রচার করতে তারা ঢাকাতেও নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করলো।

এভাবে ১৬২১ খৃষ্টাব্দে এতদাঞ্চলে খৃষ্টান মিশনারি তৎপরতা পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয়। ১৬৩৩ খৃষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান ৭৭৭ বিঘা জমি বিনা খাজনায় (লা-খেরাজ) খৃষ্টান মিশনারিদের দান করলেন। ফলে তারা আরো বেশী উৎসাহিত হয়। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোঘল আমলে খৃষ্টান মিশনারিরা অগস্টেইনিয়া গির্জা গড়ে তোলে। (আমাদের মধ্যে যেমন বিভিন্ন দল-উপদল আছে, তেমন খৃষ্টানদের মধ্যে বিভিন্ন দল আছে, যেমন - জেসুইল, অগস্টেইনিয়া, ক্যাথলিক, ব্যাপটিস্ট, প্রটেস্ট্যান্ট ইত্যাদি) মোগল আমলে মোগল বাদশাহদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে বাংলায় ১৬৩৩ খৃষ্টাব্দের পরে ১৩ টি অগস্টেইনিয়া গির্জা গড়ে উঠে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রোমান ক্যাথলিকদের সংখ্যা বেশী। ব্যাপটিস্টদের সংখ্যাও কম নয়।

১৯০৮ সালে ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় ব্যাপটিস্টরা এসে একটি সোসাইটি হাসপাতাল গড়ে তোলে। লেবৃসি হসপিটাল কুষ্ঠনিরাময় কেন্দ্র খোলে। বাংলাদেশে মোট খৃষ্টান সংখ্যা ৫ লাখ, এর মধ্যে ব্যাপটিস্ট খৃষ্টানদের সংখ্যা বর্তমানে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ছলে বলে কৌশলে পুরো ভারতের ক্ষমতা হাতে নিলো, তখন মূলত আনুষ্ঠানিকভাবে খৃষ্টান মিশনারিদের তৎপরতা চালু হয়। পর্যায়ক্রমে পাকিস্তান আমলে এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে খৃষ্টান মিশনারিদের তৎপরতা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখি, খৃষ্টানরা যেখানেই গেছে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে আর সমাজের বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ করেছে। হাসপাতাল স্থাপন, ঋণসুবিধা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং দরিদ্রতা বিমোচনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। নারীদের ক্ষমতায়ন তাদের অন্যতম শ্লোগান আজ। তবে খৃষ্টধর্ম প্রচারই তাদের মূল লক্ষ্য। যা সেবার ছলনায় শুরু থেকেই তারা বাস্তবায়ন করে আসছে।

১৮৫৭ সালে আযাদী আন্দোলনের পর এই উপমহাদেশে ৯০ টি প্রটেস্ট্যান্ট খৃষ্টান মিশনারি কর্মরত ছিল। তারা এদেশে জটিল রোগের চিকিৎসার জন্যে বড় বড় ডাক্তার, সার্জনদের ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসে এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের মালুমা ঘাট, ময়মনসিংহ, রংপুর, রাজশাহীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাসপাতাল তৈরি করে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দেয়। এর আড়ালে সমতল ভূমি ও পার্বত্য এলাকায় খৃষ্টধর্ম প্রচার পুরোপুরি অব্যাহত রাখে।

৭১ এ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ৩০,০০০ এনজিও কাজ করে যাচ্ছে। এই এনজিওরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে। প্রশ্ন জাগে, এই টাকা দেয় কারা ? তাদের তো টাকশাল নেই, তারা টাকা বানায় না। বিশ্বের বড় বড় ধনকুবেররা ইয়াহুদি ও খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। আর কোন ধনকুবের বরং সাধারণ সম্পদশালীও তার অর্থ বেকার খরচ করে না। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, মুসলমানদের খৃষ্টান বানানোর জন্য তারা কোটি কোটি টাকা খৃষ্টান মিশনারিতে দেয়।

 

Board of Directors এর প্রস্তাব

আযাদী আন্দোলনের পর ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে খৃষ্টানদের Board of Directors গৃহীত প্রস্তাবে যে বক্তব্য রাখা হয়েছে তাতে খোলাখুলি বলা হয়েছে যে, "প্রকৃতি ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি এই জন্যে ব্রিটেনের কাছে সোপর্দ করে, যাতে এতদঅঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত মিশনারিদের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়। তাই এতদঞ্চলকে খৃষ্টান রাষ্ট্রে পরিণত করার আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিৎ।" (সূত্রঃ তারিখে পাকিস্তান)

বর্তমানে এটাই বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চলছে।

 

যে সমস্ত এনজিও সেবার নামে সরাসরি ধর্ম প্রচার করছে

অসহায়, নিরক্ষর মানুষকে সেবা দেওয়ার নামে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত করতে যে সংস্থাগুলো উল্লেখযোগ্য তৎপরতা চালাচ্ছে তার মধ্যে কিছু হলো-

(১) কারিতাস, (২) এন.সি.সি. (ননলাইট সেন্ট্রাল কমিটি), (৩) লুথারান মিশন, (৪) দ্বীপশিখা, (৫) সালভেশন আর্মি, (৬) ওয়ার্ল্ড ভিশন, (৭) সি.ডি.এস. (সেন্ট্রাল ফর ডেভেলপম্যান্ট সার্ভিস), (৮) আর.ডি.আর.এস. (রংপুর দিনাজপুর রোড এন্ড সার্কেল), (৯) সি.সি.ডি.ভি. (খৃষ্টান কমিশন অফ ডেভেলপম্যান্ট), (১০) হিড বাংলাদেশ, (১১) সেভেন ডে এডভেঞ্চারিস্ট, (১২) চার্চ অফ বাংলাদেশ, (১৩) পের ইন্টারন্যাশনাল, (১৪) সুইডিশ ফ্রেমিশন, (১৫) কনসার্ন, (১৬) এডরা, (১৭) অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপটিস্ট সোসাইটি, (১৮) এমসিনি, (১৯) ওয়াই.ডব্লিউ.সি. (২০) ফেমিলিজ ফর চিলড্রেন, (২১) আল-হানিফ কল্যাণ ট্রাস্ট ইত্যাদি।

এসব সংস্থা বাজেটের ৯০ ভাগ খৃষ্টানদের অথবা খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনায়ময় ব্যক্তিদের পিছনে ব্যয় করে থাকে।

 

এনজিওদের কার্যক্রম

চার্চ অফ বাংলাদেশ

ডঃ জিগা বি. আলসেনের পরিচালনায় "চার্চ অফ বাংলাদেশ" নামে একটি খৃষ্টান মিশনারি এনজিও"মৌলবাদী এনজিও", ১৯৬৫ সালে কক্সবাজারের মালুমঘাটে "মেমোরিয়াল হসপিটাল" নামে একটি খৃষ্টান হাসপাতাল তৈরি করে। এলাকার লোকজন ছিল অভাবগ্রস্ত ও নিরক্ষর। এই সুযোগে ড. ভিগা বি আলসেন তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে সেবাদানের মাধ্যমে ৩৮ বছর এই মালুমঘাটের চকরিয়ায় খৃষ্টধর্ম প্রচার করতে থাকেন। ১৯৬৪ সালে মালুমঘাটে যেখানে একজনও খৃষ্টান ছিল না, তার প্রচেষ্টায় ২০০৩ সালে সেখানে খৃষ্টানদের সংখ্যা ৪০ হাজারে উন্নীত হয়েছে। তারা আশেপাশের জমি ক্রয় করে নয়া খৃষ্টানদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের দৌলতপুরে মরিয়াম আশ্রমের পাশে তারা বিশাল খৃষ্টান এলাকা গড়ে তুলেছে। সেখানে দুর্গম এলাকায় পাহাড়ের ভিতরে তারা গির্জা নির্মাণ করেছে।

সেভেন ডে এডভেঞ্চারিস্ট

এই "সেভেন ডে এডভেঞ্চারিস্ট" খৃষ্টান মিশনারি তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে ৮৫ টি প্রাইমারী স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল পরিচালনা করে। এসব স্কুলে কোন মুসলমানের সন্তান ভর্তি নেওয়া হয় না। ১৯৯০-৯১ সনে এই "সেভেন ডে চার্চ" ২৩০ মিলিয়ন টাকা খরচ করে বহু মানুষকে খৃষ্টান বানিয়েছে।

হিড বাংলাদেশ

"হিড বাংলাদেশ" নামে এ এনজিও মৌলভী বাজারে, কমলগঞ্জে, সুন্দরবনে সেবার আড়ালে খৃষ্টধর্ম প্রচার করে যাচ্ছে। সূচনাতেই তারা ৬ লক্ষ মার্কিন ডলার নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে।

সি. সি. ডি. ভি.

"সি. সি. ডি. ভি." নামক সংস্থা রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে কাজ করছে। আর "ডি.আর. আর. এস." এর সমস্ত সংগঠন টাকা নেয় সুইডেন, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড থেকে। টাকা আনে মিস্টার টরবেন পিটারসের নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালে ২১৮ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বৃহত্তর দিনাজপুর, রংপুর অঞ্চলে সাঁওতাল উপজাতিদেরকে দাওয়াত দিয়ে ৩৫ হাজার সাঁওতালকে তারা খৃষ্টান বানিয়েছে।

 

পাহাড়িদের বিভিন্ন উপজাতি

এগুর্ণা, চাকমা, মারমা, তনচৈঙ্গা, চাক, ক্ষুমি, ভৌম, ত্রিপুরা, খাশিয়া, মনিপুরী, খিয়াং, মাংখু, লুশাই, মগ, গারো, মুরু, সাঁওতাল, রাখাইন, হাজং, রাজবংশী, মুরং, কুকি, হুদি, পাংখো, উড়াও, বোনজোগী, দালই, লুসাই, খুশী, তংচংগা, বংশাই, বোম, মুনী চাক, চোক, হরিজন, মুন্ডা ইত্যাদি- এগুলো আলাদা আলাদা জাতিগোষ্ঠী। এক গোত্র আরেক গোত্রের সাথে বিয়ে-বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। বৈবাহিক ক্ষেত্রে তারা বংশীয় সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ। এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে শুধু"পাঙন" সম্প্রদায় ছাড়া অন্য উপজাতির অধিকাংশ লোক ধর্মান্তরিত হয়ে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে। আবার ১০.৫ % হিন্দু জনসংখ্যার বিপুল পরিমাণ লোক ধর্মান্তরিত হয়ে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে।

 

মুসলমানের সন্তান নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে চিনে না, মেরী ও যীশুকে চিনে!

বারিধারা নতুন বাজারের পিছনে একটি বড় বস্তি আছে। একদিন বিকালে বন্ধুবর মাওলানা মুজিব সাহেবসহ ঐ এলাকায় ঘুরছিলাম। চোখের সামনে পড়লো একটি স্কুল, সাথে গির্জা। স্কুলটি দেখে আমাদের কৌতূহল হলো।

স্কুলের সামনে ১০ / ১২ বছর বয়সের কয়েকটি ছেলে খেলাধুলা করছে। একজনকে তার নাম জিজ্ঞেস করলে"রাকিবুল ইসলাম" বলে উত্তর দিলো এবং এও জানতে পারলাম যে, সে এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশুনা করে। তাকে কালেমা জিজ্ঞাসা করলে"পারি না" বলে উত্তর দেয়। এবার আমাদের নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে বললো"জানি না"। এবার জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি মেরী বা যীশুকে চেনো ? সে উত্তর দিলো- হ্যা, চিনি। আবার জিজ্ঞাসা করলাম - কিভাবে চেনো। সে বললো, আমাদের স্যার আমাদের শিখিয়েছেন।

দেখুন, আমাদের উদাসীনতার সুযোগে আমাদের সন্তানদেরকে তারা খৃষ্টান বানাচ্ছে। এটাই হলো তাদের সেবার আসল রূপ।

 

মিশনারির স্বরূপ সন্ধানে

পৃথিবী জুড়ে খৃষ্টধর্ম প্রচার কাজে তাদের সেবার ছদ্মাবরণে বহুরূপী কর্মকাণ্ড দেখে সচেতন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে- "খৃষ্টধর্ম কি আসলেই কোন ঐশী ধর্ম ?"

তা যদি ঐশীই হয়, তাহলে মিশনারিদের খৃষ্টধর্ম প্রচার কাজে কেন এতো ব্যাপক কৃত্রিমতা, জালিয়াতি, অপপ্রচার ও প্রলোভন ? বর্তমানে খৃষ্টধর্মের ধ্বজাধারীগণ বিশ্বব্যাপী শান্তি তথা পাপ মুক্তির জন্য ত্রাণকর্তার ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ তারাই আড়াই শতাব্দী আগে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা করে। যার ফলে বর্তমান খৃষ্টধর্মের কেন্দ্রভূমি পাশ্চাত্যেই ব্যক্তি স্বার্থ, বর্ণবাদের উন্মত্ততা, নৈতিক অধঃপতন তথা অনৈতিক কর্মকাণ্ড বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। খৃষ্টবাদের প্রচারকগণ এদেশেও তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থে নানা সূক্ষ্ম কুটচালের মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছে।

আজ তাই প্রতিটি সচেতন ধার্মিক ব্যক্তির তাদের এই অশুভ ও মানবতাবিরোধী কর্মতৎপরতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক। আসুন তাদের রূপ উদঘাটন করি।

 

মিশনারি শ্রেণীবিভাগ

বিশ্বে খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে ১৫৬ টি প্রধান এবং ২৮,০০০ টি উপদল রয়েছে। মূল দলগুলোর মধ্যে দুটো দলই প্রধান- ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট। এদের মধ্যে শুধু ধর্ম-বিশ্বাসের পার্থক্যই নয় বরং মূল ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের মধ্যেও রয়েছে পার্থক্য। তাছাড়া তাদের বাইবেল সংস্করণগুলোর একটির সাথে অন্যটির বহুলাংশেই মিল নেই।

 

বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক

যদিও প্রচলিত খৃষ্টধর্ম ছিল সেমেটিক অর্থাৎ প্রাচ্যের, কিন্তু বর্তমানে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীরাই এর ধারক-বাহক হয়ে বসেছে। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সরকার ও সংস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য সহযোগিতায় খৃষ্টান মিশনারীরা বিশ্ব জুড়ে গড়ে তুলছে খৃষ্টধর্ম প্রচার ও প্রচারের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক।

 

প্রতিষ্ঠান ও প্রচার মাধ্যম

বর্তমানে ৭০ হাজারের বেশী মিশনারি ক্রুসেডার (ধর্ম যোদ্ধার) শিকার মুসলিম বিশ্ব। এ প্রেক্ষিতে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় গড়ে তুলেছে চার্চ ও বিভিন্ন ছদ্মবেশী সেবা, শিক্ষা ও আর্থিক দাতা প্রতিষ্ঠান"এনজিও" সমূহ।

সরাসরি মিশনারির মধ্যে "হ্যাগাই ইন্সটিটিউট" এমন একটি সংস্থা, যার কাজ হলো ধর্মের অসারতা প্রমাণ ও ইসলামের নবজাগরণকে প্রতিহত করা এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। এ ব্যাপারে জার্মান, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত থেকে প্রচুর নিষিদ্ধ ও ইসলাম বিরোধী বই এদেশে বহু কথিত বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, নাট্যকর্মী, কণ্ঠশিল্পী এবং প্রগতিবাদীদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে।"হ্যাগাই ইন্সটিটিউট" ২০০০ অ্যালুমনই (সদস্য) নিয়ে ৫ টি মহাদেশের ৭০ টি প্রদেশে ১,০০,০০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ২০০০ সালের মধ্যে ১০ লক্ষ মানুষকে দক্ষ প্রচারকরূপে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বে খৃষ্টধর্ম প্রচারের জন্য পাঠাবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক খৃষ্টান মিশনারি গবেষণা বুলেটিন থেকে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জানা যায় যে, ১৯৯১ সালে বিশ্বব্যাপী খৃষ্টধর্ম প্রচার ও ইসলামী জাগরণকে প্রতিহত করতে ১,২০,৮৮০ টি প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে প্রটেস্ট্যান্ট গোত্রের ইয়াং খৃষ্টান ওয়ার্কস এবং এভরী হোম কান্ট্রাস্ট, খৃষ্টান কমিশন ফর ডেভেলপম্যান্ট ইন বাংলাদেশ(সি. সি. ডি. বি.) ইয়াং ম্যানস খৃষ্টান এসোসিয়েশন(ওয়াই. এম. সি.) উল্লেখযোগ্য। তারা বাংলাদেশের নানা স্থানে বিভিন্ন নামে অসংখ্য সংস্থা স্থাপন করেছে। যেমন -

* নুর-ই-ইলাহী, পোস্টবক্স নং ৩৫০৭, ঢাকা,

* খোদার পথ, পোস্টবক্স নং ৫৮, ঢাকা - ১০০০,

* মাসীহী জামাত, পোস্টবক্স নং ৩৫০৭, ঢাকা,

* আল হানিফ কল্যাণ ট্রাস্ট,

* ডাকযোগে বাইবেল শিক্ষার জন্য পোস্টবক্স ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

১৯৯৭ সালের তথ্য ও পরিসংখ্যানের সংরক্ষণ ও প্রচারে ব্যবহৃত হয় ৩১ কোটি ৫০ লক্ষ কম্পিউটার সেট। তাছাড়া ৩৪০০ রেডিও ও টেলিফোন সেন্টার খৃষ্টধর্ম প্রচারে নিয়োজিত ছিল। দেশে বর্তমানে "ঈমানের পথ" নামে ইসলামী আঙ্গিকে রেডিও অনুষ্ঠান চালু করেছে।

 

প্রকাশনা

বই প্রচার ও পত্রাদি বিলি

উল্লিখিত আন্তর্জাতিক খৃষ্টান মিশনারি গবেষণা বুলেটিন থেকে জানা যায়, খৃষ্টধর্ম বিষয়ক ১ লাখ ৯ হাজার ৯ শত ধরনের বই ও একত্রিশ হাজার তিনশত রকম ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়। মুসলিম বিশ্বে বিনামূল্যে বিলিকৃত বাইবেলের সংখ্যা প্রায় ৬৩ কোটি ৯ লক্ষ ৪০ হাজার এবং মুসলমানদের জন্য ইসলামী পরিভাষায় রচিত বাইবেল অর্থাৎ"কিতাবুল মুকাদ্দাস" আঠারো কোটি তিরাশি লক্ষ তিরিশ হাজার। সর্বোপরি খৃষ্টবাদ, ইউরোপীয় ধর্মদর্শ ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লক্ষ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণ্যতম মিথ্যাচারে সমৃদ্ধ অগণিত পুস্তক-পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ করে চলেছে। ১৬ ই এপ্রিল ১৯৯৮ ইং সনে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এডওয়ার্ডের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৮৯০ সাল থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে অর্থাৎ ২৫ বছরে ইসলামের বিরুদ্ধে ষাট হাজার রকম বই প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও ভিডিও, অডিও ক্যাসেট প্রকাশ করা এবং "স্বর্গমত ম্যাগাজিন" উল্লেখযোগ্য।

 

প্রকাশনায় অপকৌশল

ধর্মগ্রন্থ ও সংস্থার নাম পরিবর্তন

মিশনারিরা মানুষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করে থাকে। যেমন খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ সারা বিশ্বে বাইবেল নামেই বহুল পরিচিত। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্রভেদে নাম পরিবর্তন করার কৌশলে খৃষ্টান মিশনারিদের জুড়ি নেই। সর্ব প্রথম বাংলা ভাষায় খৃষ্টানরা বাইবেলকে "ধর্ম পুস্তক" নামে ১৯৬৩ সালে"পাকিস্তান বাইবেল সোসাইটি" থেকে প্রকাশ করে। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে একই সংস্থা"বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি" (বি. বি. এস.) তাদের গ্রন্থের নাম পরিবর্তন করে"পবিত্র বাইবেল" নামে প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, উভয় নামের বাইবেলে (তথাঃ ধর্ম পুস্তক- ১. "বাংলাদেশ বাইবেল", ২. "পবিত্র বাইবেল"; মৌলিকভাবে দুটো অংশ রয়েছে- ১. "নতুন নিয়ম", ২. "পুরাতন নিয়ম") পরবর্তীতে সংস্থার নাম পাল্টিয়ে"মসীহী জামাত" নামকরণ করে তাদের পবিত্র বাইবেলকে"কিতাবুল মুকাদ্দাস" নামে প্রকাশ করে। এই কিতাবুল মুকাদ্দাসে "পুরাতন নিয়ম" অংশের নামকরণ করেছে "তৌরাত, জবুর ও নবীদের কিতাব" এবং "নতুন নিয়ম" অংশের নামকরণ করেছে"ইঞ্জিল শরীফ"। প্রমাণ্য ঐতিহাসিক সত্য হলো, ওসব নামের তৌরাত, জবুর ও ইঞ্জিল শরীফ আল্লাহ'র পক্ষ থেকে অবতীর্ণ অবিকৃত কিতাব নয়।

মুসলিম ঐতিহ্যবাহী নকশা নকল

খৃষ্টান মিশনারিরা তাদের "কিতাবুল মুকাদ্দাস" ও "ইঞ্জিল শরীফ" এর মলাট সম্পূর্ণ ইসলামী ঐতিহ্যের ধারক প্রচ্ছদে অলংকৃত করে প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন রঙের সুদৃশ্য কভারের উপর সোনালী রঙের ইসলামী ধাঁচের প্রচ্ছদ দেখে এটাকে পবিত্র কুরআনের তাফসীর বা পবিত্র হাদিসগ্রন্থ বলে ভুল করা অস্বাভাবিক নয়।

তারা এখন তাদের যাবতীয় ধর্মীয় বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, পত্রাদির প্রচ্ছদ, মসজিদ, কালেমা, আরবি বর্ণের শৈল্পিক নকশা দ্বারা অলংকৃত করার অপকৌশল অবলম্বন করছে। এমনকি ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি যেমন পর্দা, নামায, নারী শিক্ষা, ওযু ইত্তাদিকে বিকৃত উপস্থাপনে ও বক্তব্যে সমৃদ্ধ করে বই প্রকাশ করে চলেছে।

ইসলামী পরিভাষা ও নামাবলী ব্যবহার

খৃষ্টান মিশনারিরা এতটুকুতেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা তাদের ধর্ম গ্রন্থের নাম পরিবর্তনের সাথে সাথে ইসলামী পরিভাষা, শব্দ ও নামাবলী চুরি করে তাদের ধর্মগ্রন্থ ও বইগুলো প্রকাশ করে চলেছে। তাদের পবিত্র বাইবেলের কিছু শব্দ উল্লেখ করা হলো, যে শব্দগুলোকে তারা তাদের গ্রন্থ কিতাবুল মুকাদ্দাসে ইসলামী পরিভাষা ও নামের রূপ দিয়েছে(কিতাবুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তিত রূপ ব্র্যাকেটে উল্লেখ করা হলো) -

আদিপুস্তক (আল-তৌরাত), প্রথম সিপারা(পয়দায়েশ), পরমগীত (নবীদের কিতাব সোলায়মান), গীতসংহিতা (আল জবুরঃ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম সিপারা), ঈশ্বর (আল্লাহ), ঈশ্বর পুত্র(ইবনুল্লাহ), পরিত্রাণ (নাজাত), ভাববাদী (নবী), ভজনা (এবাদত), বিশ্বাস (ঈমান), ব্যবস্থা (শরীয়ত), আব্রাহাম (ইব্রাহীম), মোশি(মুসা), দায়ুদ(দাউদ), যীশুখৃষ্ট(ঈসা মসীহ), দূত (ফেরেশতা), শির্ষ (সাহাবী), প্রায়শ্চিত্ত (কাফফারা), উবড় (সিজদা), যাচঞা(মুনাজাত), অলৌকিক কার্য (মোযেজা) ইত্যাদি।

বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জালিয়াতি

সর্বোপরি তাদের নির্লজ্জ ও জঘন্যতম জালিয়াতির দৃষ্টান্ত হলো দীর্ঘ ১৬ বছর সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার পর কুরআনের বিভিন্ন আয়াত চুরি করে প্রতিটি অধ্যায়ে আরবিতে "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" দিয়ে শুরু করে তাদের কথিত ইঞ্জিল শরীফ প্রকাশ করেছে। অথচ তাদের কোন কিছু শুরু করা হয় "পিতা-পুত্র ও পবিত্র আত্মা" এর নামে। বিশ্বের ইতিহাসে ধর্মের নামে এতো বড় জালিয়াতির নজির আর নেই।

পবিত্র কুরআনের অপব্যাখ্যা

ইদানিং তাদের ঘৃণ্য প্রতারণা ও ধোঁকাবাজী চরমে পৌঁছেছে। তারা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের আংশিক প্রয়োগ এবং নিজেদের মনগড়া বানোয়াট অনুবাদ ও বাইবেলের স্বপক্ষে অপব্যাখ্যা দিয়ে নানা রকম পুস্তিকাদি প্রকাশ ও প্রচার করছে। যেমন ত্রিত্ববাদের মাঝে আল্লাহ এক, ইঞ্জিল ও কুরআনে ঈসা কালিমাতুল্লাহ'র ব্যক্তিসত্তা রক্তমাংসের দেহে আবৃত, আমরা কিভাবে সালাত কায়েম করি ?

তারা এখন তাদের বইয়ে সরাসরি কুরআনের আরবি আয়াত সংযোজন করছে। মুসলমানরা কুরআনের আয়াতকে সম্মান করে বলে তাদের ঘরে মিশনারিদের রচিত বই-পুস্তক স্থান পায়। কালার সমৃদ্ধ তাদের এ বইগুলো পড়ে সরল মনের সাধারণ মুসলমানরা বিভ্রান্ত হয় এবং ঈমান আমল হারিয়ে চিরস্থায়ী জাহান্নামের পথ ধরে। এভাবে মিশনারিগুলো তাদের (ঈমান ধংসের) লক্ষ্যে পৌছতে সক্ষম হয়।

তাদের প্রত্যেক বইয়ের শেষে প্রশ্নপর্ব থাকে। সেগুলোর উত্তর প্রদানে আরো বই ও উপহারের আশ্বাস দেওয়া হয়। বইয়ের বিকৃত বিষয়ের কোন প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। তবুও কেউ প্রশ্ন করলে তারা নীরবতার কৌশল অবলম্বন করে। এভাবে যে কোন মূল্যে পাঠক থেকে মিথ্যার সাক্ষ্য নিয়ে কুফরীর পক্ষে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়।

এলাকা ও জনগণ নির্ধারণ

তারা সমগ্র বাংলাদেশকে প্রচারের আওতাভুক্ত করার জন্য ১৯৬৮ সালে ১লা সেপ্টেম্বর তৎকালীন ঢাকা মহাপ্রদেশের অধীনে পুরো পূর্ব পাকিস্তানকে চারটি ধর্ম প্রদেশে বিভক্ত করে, এগুলো হলো -

চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশঃ এ ধর্মপ্রদেশের আওতাভুক্ত এলাকা প্রদেশের সমস্ত দক্ষিণাঞ্চল।

দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশঃ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে এ ধর্মপ্রদেশ। এ ধর্মপ্রদেশের পরিধি যমুনা নদীর পশ্চিমাঞ্চল তীর থেকে দক্ষিণে পদ্মা এবং পশ্চিমে ভারতীয় সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত।

খুলনা ধর্মপ্রদেশ।

ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশ।

এ সকল এলাকায় তারা সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করছে। আর হবেই না কেন? তাদের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য রয়েছে বিশাল অর্থের যোগান। ১৯৯৭ সালে খ্রিস্টবাদের প্রচার সংস্থাগুলোর মধ্যে শুধু ওয়ার্ল্ড ভিশনের অর্থ পরিকল্পনা ছিল ২১২৯ মিলিয়ন ইউ.এস. ডলার।

 

প্রচার ও প্রচারণার অপকৌশল

নকল ইমাম তৈরি

তারা গোপনে খৃষ্টান দেশগুলোতে ছদ্মবেশী ইমাম তৈরি করে মুসলিম দেশে পাঠিয়ে দেয়। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসকে নষ্ট করে তাদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করাই হলো এর মূল উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাদ্রীদের সম্মেলনে "জবাজ" নামক এক পাদ্রী বিশেষ সভায় সভাপতিত্বের ভাষণে বলেনঃ মুসলমানদের সাথে বিতর্কে আমরা বিজয়ী হতে পারবো না। তাই আমরা তাদের পরস্পরে ঝগড়া বিবাদ লাগিয়ে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করছি। এটা আমাদের সফলতার একমাত্র পথ। সুতরাং আমাদের সবাইকে দেশে বিদেশে এ ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।

ইসলামী নাম ধারণ

তারা এখন ইসলামী কায়দায় নাম রাখতে শুরু করেছে, যেমন - আবদুল ওয়াহহাব, সুলতান আহমেদ পৌল ইত্যাদি। তারা আরো একধাপ এগিয়ে নিজেদের খৃষ্টান পরিচয় না দিয়ে নিজেদের পরিচয় দেয় ঈসায়ী মুসলমান। তারা কালিমাও বানিয়েছে- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ঈসা মসীহুল্লাহ।

যুবতী প্রচারক

খৃষ্টান মিশনারির নারী সদস্যরা তাবলীগের ছদ্মবেশে মুসলিম নারীদের ধর্মান্তরিত করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষিত খৃষ্টান নারীরা(ধর্মান্তরিত করার) লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য মুসলমানদের সাথে বৈবাহিকসূত্রে আবদ্ধ হচ্ছে, যাতে পরবর্তী জেনারেশনকে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করতে পারে। কারণ স্বামী মুসলমান হলেও পরবর্তী জেনারেশনই তাদের টার্গেট। এমনকি মহিলা ফেরীওয়ালাদের মাধ্যমে তারা ধর্মপ্রচার করে থাকে।

 

সাঁওতাল ভাইদের কি খবর ?

সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোক বেশীরভাগ বসবাস করে রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর তথা উত্তরাঞ্চলে।

পীরগঞ্জ থানার একটি পল্লীর কথা আলোচনা করবো, এই তথ্যটি"ধর্মান্তরের খোলা হাওয়া" ৭১ নং পৃষ্ঠা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এটা সাঁওতাল উপজাতির একটি দরিদ্র পল্লী। এ অঞ্চলে এ ধরনের বেশ কয়েকটি উপজাতি পল্লী আছে। যেমন - চৈত্রকল(মাহেলিপাড়া), খালিসা (মিশনপাড়া), বসুদেবপুর (ডুমারপাড়া), অনন্তরামপুর, দুর্গাপুর, উধলাপাড়া, পৈত্রীপাড়া, কাদিরাবাদ, মুনাইল ইত্যাদি।

এরা সবাই উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও সাঁওতাল, বুনো, উড়াও ও পৈত্রী ইত্যাদি নামে বিভক্ত। এদের পেশারও ভিন্নতা রয়েছে। কেউ বাঁশ-বেতের কাজ করে, কেউ করে কৃষি কাজ। এদের কারো স্থায়ী আয়ের কোন উৎস নেই। মুসলমান পাড়ায় গতর খেটে এবং বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র বিক্রি করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। এরা অত্যন্ত নিরীহ ও শান্ত প্রকৃতির। আলোচিত পল্লী রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার"চৈত্রকল ইউনিয়নে" অবস্থিত। এ ইউনিয়নের উপজাতির সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজার। তারা সবাই নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে।

ক্ষুধা এদের নিত্যদিনের সাথী, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত জীবন, দারিদ্রের নির্মম ক্ষতচিহ্ন এদের চেহারায়। বঞ্চনাকে ওরা ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হিসেবে মেনে নিয়েছে। দুঃখ ও যন্ত্রণাকে ওরা ভাগ্যলিপি হিসেবে ধরে নিয়েছে। তাই এর জন্য ওদের কারো প্রতি ক্ষোভ ও খেদ নেই। আছে শুধু জীবনের অচল চাকা একভাবে চালিয়ে নেওয়ার নিরন্তর প্রয়াস। জীবনের গ্লানি ও যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্য হয়তো তারা মদ ও নেশা প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ হিসেবে বেছে নিয়েছে। সভ্যতার আলো আজও ঐ দরিদ্র পল্লীতে প্রবেশ করেনি। তারা এখনো আদিম প্রথায় জীবন চালায়। শিক্ষা, চিকিৎসা এ অন্ধকার পল্লী থেকে নির্বাসিত।

তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানও অত্যন্ত সীমিত। বছরে একবার তারা ডালপূজা করে। অর্থাৎ গাছের একটি ডাল আসরের মধ্যভাগে পুঁতে তাকে ঘিরে সারারাত নারী-পুরুষ কীর্তনের মাধ্যমে অতিবাহিত করে। কৃষি মওসুমে যখন কাজ থাকে, তখন তারা মুসলমান পাড়ায় গিয়ে বিত্তবান ও স্বচ্ছল লোকদের বাড়িতে মজুরী খাটে। যখন কাজ থাকে না, আকালের সময় বনে জঙ্গলে বিভিন্ন গাছের পাতা ও বনজ আলু কুড়িয়ে আনে। হলুদ মরিচ মসলা ছাড়া শুধু লবণ দিয়ে সিদ্ধ করে আলু দিয়ে তারা ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করে। শীতের সময় এসব মানব সন্তানরা শীত নিবারণের জন্য আদিম প্রথায় উঁচু করে মাচা বাঁধে আর নিচে আগুন জ্বালিয়ে বসে রাত কাটায়। রংপুর, পীরগঞ্জ অঞ্চলে ছয় মাস পর্যন্ত আকাল থাকে। তখন তাদের কাজ থাকে না। আবার যারা বাঁশ-বেতের কাজ করে, তারাও তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারে না। তখন জীবন একেবারে অচল হয়ে পড়ে। মুসলমান পাড়ায় গিয়ে চেয়ে-চিন্তে ধার-কর্জ করে চলতেও তারা অভ্যস্ত নয়। অভাবের সময় এসব দরিদ্র পল্লীতে সরকারী- বেসরকারী পর্যায় ঋণদানেরও কোন প্রথা চালু নেই।

সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র রংপুর জেলার চৈত্রকল ইউনিয়নের। সেখানকার ছাব্বিশটি পরিবার প্রায় সবাই ইতিমধ্যে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে। চৈত্রকলস্থ "খলিশা মিশন" এ বিষয়ে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে চলেছে। পল্লীর নিভৃতকোণে নীরব বিপ্লব সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। বিশাল জমির উপর প্রতিষ্ঠিত খালিশা মিশনে স্থায়ীভাবে বহুলোক কর্মরত আছেন। এ মিশনে আছে চিকিৎসা সেবা ও দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ।

মাহেলী পাড়ার জনসংখ্যা প্রায় দুইশত। ওখানে সদ্য নির্মিত হয়েছে মনোরম একটি গির্জা। এর তত্ত্বাবধান করেন লুইস দুখু। তাকে প্রশ্ন করা হলো, উপজাতি সম্প্রদায় এদেশের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতির অঙ্গ। এ ঐতিহ্য-চ্যুতির কারণ কি? উত্তরে তিনি জানান, আমরা অবহেলিত সম্প্রদায়। আমাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার কেউ নেই। খৃষ্টানরা আমাদের কাছে আসে, তারা আমাদের সুখ-দুঃখে সহানুভূতি প্রকাশ করে। তাদের আদর-যত্ন আমাদের আকৃষ্ট করছে। খৃষ্টানরা কোন বৈষয়িক বিষয়ে সাহায্য প্রদান করে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, কই, তারাও তো কোন সাহায্য করছে না।

উধলাপাড়ার অশীতিপর বৃদ্ধা নৌরি, স্বামী রামধন। তার কাছে জানতে চাওয়া হলো, জীবন কেমন চলছে ? উত্তরে তিনি বললেন, কষ্ট করে চলি। সেখানকার উপজাতিদের দারিদ্র্য বিমোচনের কোন প্রকার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। এ দরিদ্র পল্লী আগে যে তিমিরে ছিল আজও সেই তিমিরেই আছে। হওয়ার মাঝে হয়েছে শুধু উপজাতির ধর্মীয় পরিচয় বিলুপ্তি। সুচতুর খৃষ্টানরা হয়তো জানে, কোন জাতি ও সম্প্রদায়কে ছলে-বলে, কৌশলে একবার ধর্মান্তরিত করতে পারলে তাদের প্রতারিত ও প্রবঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ সাময়িক। তারপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানবে - তারা খৃষ্টানের ঘরে খৃষ্টান।

এ তো হলো একটি ইউনিয়নের প্রতিবেদন, এ ছাড়া কতো ইউনিয়ন গ্রাম রয়েছে, সেখানে যারা এদের মতো বা এদের চেয়ে বেশী আমাদের কাছে সর্বদা অস্পৃশ্য সম্প্রদায় হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। আমরা তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না, যা ছিল আমাদের কর্তব্য, দায়িত্ব ও ঈমানি ফরিযা। পাশে না দাঁড়ানোর ফলে সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে খৃষ্টান মিশনারিরা তাদের পাশে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে ধর্মান্তরিত করছে। উচিৎ তো ছিল আমরা তাদের খোঁজ খবর নিবো।

উপজাতি সম্প্রদায় আমাদের প্রতিবেশী। তারা আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। নিবেদিত প্রাণ এসব হতদরিদ্র আদম সন্তানদের খোঁজ নেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু আমরা কি এ দায়িত্ব পালন করছি? অথচ প্রতিবেশীর সেবা ও খোঁজ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের গৌরবের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

ইসলাম আমাদেরকে প্রতিবেশীর কর্তব্য পালনের জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদিস বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- "যে ব্যক্তি পেটপুরে খায়, অথচ তার প্রতিবেশী অনাহারে রাত পোহায়, সে আমার উম্মত নয়।" অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন - "আল্লাহ'র শপথ, সে ব্যক্তি মুমিন নয়।" এভাবে তিনবার বললেন। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), এ কোন ব্যক্তি।" রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "যার ক্ষতি থেকে তার প্রতিবেশীর সম্পদ ও ইজ্জত নিরাপদ নয়।" এ থেকে প্রতিবেশীর অধিকারের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। এতে হিন্দু মুসলমান খৃষ্টানের কোন পার্থক্য নেই। প্রতিবেশী যে পরিচয়েই হোক, তার প্রতি বিশেষ কর্তব্য পালনকে ইসলাম বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। এ মহান কর্তব্যটুকু আমাদের পূর্ববর্তীদের দ্বারা যথাযথভাবে পালিত হয়েছিলো বিধায় দলে দলে লোক ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে।

বড় আফসোস! আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের হতভাগা অংশ(নোটঃ লেখক"হতভাগ্য উম্মত" লিখেছিলেন, আমি সেটা চেইঞ্জ করে দিয়েছি)। আরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসৃত নীতি বিচ্যুত হয়েছি। সেজন্য এতো দুর্গতি ও লাঞ্ছনা। এখানে একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়- আজ আমরা যাদের অবহেলা ও তাচ্ছিল্য ভরে দূরে সরিয়ে রাখছি, যাদের প্রতি আমাদের ন্যূনতম কর্তব্যবোধ আছে বলে মনে করছি না। হয়তো এমন দিন বেশী দূরে নয়, যেদিন এসব অবহেলিত সম্প্রদায় একটি বৃহৎ জাতিতে রূপ নিবে। তারা প্রশিক্ষিত হবে, আর অতীত বঞ্চনা ও প্রবঞ্চনার জন্য আমাদের দায়ী করবে। স্থায়ীভাবে আমাদের মাথা ব্যাথার কারণ হবে। তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত লেবানন। সেখানে খৃষ্টানরা স্থায়ীভাবে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে একটি সমৃদ্ধ মুসলিম দেশকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

ইসলাম হলো আমাদের কাছে আমানত। আমরা কি এই আমানত তাদের কাছে পৌঁছিয়েছি? ইসলামের দাওয়াত পাওয়া তাদের অধিকার। আমরা কি তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করিনি? এখনো সময় আছে তাদের পাশে দাঁড়াবার। এখনো সময় আছে তাদের আমানত পৌঁছানোর। আসুন, আজ থেকে আমরা তাদের হক পৌঁছে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করি। জাহান্নামের পথ থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতের পথ দেখিয়ে দেই। যা ছিল আমার আপনার প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় সুন্নাত।

 

একটি পরিসংখ্যান

দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়ন মূল দাবী হলেও তাদের কোন কোন এনজিও এসব কর্মকাণ্ডের আড়ালে খৃষ্টান মিশনারির "ধর্মান্তর কর্মসূচি" প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তারা সমাজের অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণীকে ধর্মান্তরের প্রধান টার্গেট বানায়। খৃষ্টান মিশনারি ও তাদের সহযোগী এনজিওগুলো কাজের ও কর্মসূচীর দিক দিয়ে ভিন্ন হলেও তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন। উভয়ের প্রধান লক্ষ্য বিশ্বে খৃষ্টান জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটানো। এ লক্ষ্য সামনে রেখে আমাদের দেশে এনজিও ও মিশনারিগুলো কাজ করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটা সফল। বাংলাদেশের খৃষ্টান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার লক্ষ্য করলে সে কথার প্রমাণ মিলে।

১৮৮১ সালে প্রতি ৬ হাজার লোকের মাঝে ১ জন খৃষ্টান ছিল। সে সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৪ সালে প্রতি ৩২৬ জনের মাঝে ১ জন, ১৯৮১ সালে প্রতি ২৯ জনের মাঝে ১ জন, ১৯৯১ সালে প্রতি বাইশজনের মাঝে একজন খৃষ্টান রয়েছে বলে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। ১৯৩৯ সালে খৃষ্টান জনসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯১ সালে আদমশুমারিতে খৃষ্টান জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখে। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে খৃষ্টান জনসংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ঢাকায় খৃষ্টানদের সবচেয়ে বড় গির্জা "হলি রোজারি"। ১৮৭৭ সালে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীগণ এটি নির্মাণ করেন। ১৯৫২ সালে উক্ত গির্জায় উপস্থিতির সংখ্যা ছিল ১৫৩ জন আর ১৯৭৬ সালে তা ৩০০০ জনে উন্নীত হয়, ১৯৮৩ সালে উপস্থিতি ৬০০০ জনে আর ১৯৯৮ সালে উপস্থিতির সংখ্যা ৫০,০০০ এ পৌঁছে।

বাংলাদেশে এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী বিদেশী সাহায্যপুষ্ট এনজিও সংখ্যা ৮৫০। এর বাইরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন নিয়ে কাজ করছে এমন এনজিওর সংখ্যা বিশ থেকে ত্রিশ হাজার অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতি ১.১৮ বর্গমাইলের মাঝে একটি এনজিও কাজ করছে।

বাংলাদেশে এনজিও কার্যক্রমের বিস্তার সম্পর্কিত ব্যাপারগুলোর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ পর্যন্ত এনজিও আওতাধীন গ্রামের সংখ্যা ৪০ হাজার, পরিবারের সংখ্যা ৩৫ লাখ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে এনজিওদের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকা। উপ-আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩০ হাজার। ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যা ১০ লাখ, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র ৪৪ লাখ, এনজিওদের রোপণকৃত বৃক্ষের সংখ্যা ৪ কোটি। উপরোক্ত তথ্য ও সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন খৃষ্টানদের সংখ্যা ছিল ৬ লক্ষ। কিন্তু ২০১০ সালে মদিনা ইউনিভার্সিটি একটি পরিসংখানে দেখায়, বাংলাদেশে বর্তমান খৃষ্টানদের সংখ্যা ১০ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি। আর বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৫ কোটির ঊর্ধ্বে। মুসলমানদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আর খৃষ্টানদের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রশ্ন জাগে, তারা কি একজন ১৩ জন করে সন্তান জন্ম দিয়েছে? আবার, জন্মনিয়ন্ত্রণ থিওরি তাদেরই মতবাদ। যদি বলা হয়, না; তাহলে এই বাকি জনসংখ্যা এলো কোত্থেকে ? অবশ্যই এরা ধর্মান্তরিত খৃষ্টান।

 

কি হচ্ছে দিনাজপুর ও পঞ্চগড়ে ?

লোমান তপন, পিতা মরটিন তপন। চকবানারসি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি উপজাতি খৃষ্টান, অর্থাৎ তিনি পূর্বে উপজাতি ছিলেন, বর্তমানে তিনি খৃষ্টধর্মাবলম্বী। তিনি জানান, চকবানারসি অঞ্চলে "নিচপাড়া মিশন" এর প্রচেষ্টায় প্রায় ৫ শত পরিবার খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে। নিচপাড়া মিশনটি এ প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবার আড়ালে ধর্মান্তরিতকরণের কাজে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। এটি ইটালিয়ান মিশন। এখানে দুজন ফাদার ও চারজন সিস্টার সার্বক্ষণিকভাবে মিশনের দায়িত্ব পালন করছেন। এ মিশনটি বীরগঞ্জ থানার উত্তরে, প্রায় তিন মেইল ভিতরে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। বিশাল জায়গা নিয়ে এর অফিস ভবন, গির্জা ও মিশনারি স্কুল স্থাপিত হয়েছে।

এছাড়াও মিশনের বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে চাকরিদানের লোভনীয় টোপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, খৃষ্টান মিশনারিগুলোতে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ না করলে চাকরি মিলে না। চাকরির প্রলোভনে পড়ে অনেক মুসলমান বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা প্রকাশ্যে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ না করলেও ভিতরে ভিতরে পুরোদস্তুর খৃষ্টধর্মনিষ্ঠ। মুসলমান ছেলে-সন্তানদের খৃষ্টধর্মে আকৃষ্ট করার জন্য মিশনারিগুলোতে প্রায়শই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে আকর্ষণীয় কর্মসূচী পালন করা হয়। এসব কর্মসূচীতে আকৃষ্ট হয়ে আশেপাশের মুসলমান সন্তানরা নিয়মিত মিশনে যাতায়াত করছে। ফলশ্রুতিতে নতুন প্রজন্মে খৃষ্টানিজম মানসিকতা গড়ে উঠছে। (বীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় তিন মাইল দক্ষিণে লুথারেন মিশনের প্রতিবেশী)। এ তো ছিল থানার প্রতিবেদন, তারপরেও এটি হলো আজ থেকে প্রায় ৭/৮ বছর পূর্বে। এখন একটু অনুমান করুন, এই সাত/ আট বছরে পরিস্থিতি কীরূপ হতে পারে। এই অধমের জন্মও সেই বীরগঞ্জ থানায়, তাই প্রায়ই তাদের সামনাসামনি হতে হয়। এক সময় দেখতাম, আমাদের(_?_) এলাকার সাঁওতালরা ধানক্ষেত ও জঙ্গল থেকে ইঁদুর ও শিয়াল ধরে খেতো আর সাধারণভাবে চলাফেরা করতো। আমরা যেহেতু তাদের কাছে যাইনি, তাদের পাশে দাড়াইনি, ফলে ভিন দেশ থেকে লাল চামড়ার লোকেরা তাদেরকে শিক্ষিত বানিয়েছে। একদিন এক সাঁওতাল ভাইয়ের সাথে কথাবার্তা হচ্ছিলো, সে গর্বের সাথে বলছিলো - আমাদের অমুক ডাক্তার খৃষ্টান, আমাদের অমুক অফিসার খৃষ্টান।

এই তো এই বছরের শুরুর দিকে একদিন বীরগঞ্জ উপজেলার শহর থেকে ভ্যানে করে বাড়িতে ফিরছিলাম। মেইন রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ ছোট ছোট মাটির ঘরের এক বিস্তীর্ণ মহল্লা। মহল্লাটি সাঁওতালদের। হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে মহল্লার মাঝে নতুন একটি ঘর, সেখানে কিছু ছেলে মেয়ে সারিবদ্ধভাবে হাঁটুতে ঠেক দিয়ে কি যেন বলছে, আমার কৌতূহল সৃষ্টি হলো। কারণ ইতিপূর্বে এমনটি কখনো দেখিনি, যদিও আমার যাতায়াত সাধারণত এ পথেই হয়ে থাকে। ভ্যানগাড়ি থামিয়ে সেখানে গেলাম আর একজনকে জিজ্ঞেস করলাম যে এখানে কি হচ্ছে। লোকটি উত্তরে বললো- উপাসনা হচ্ছে। আবার প্রশ্ন করলাম - কিসের উপাসনা। সে বললো - ক্যাথলিকদের উপাসনা। ক্যাথলিক! ক্যাথলিক তো খৃষ্টান। সে বললো- আমরাও তো খৃষ্টান। আমি বললাম - আপনারা তো খৃষ্টান ছিলেন না, আপনারা তো সাঁওতাল। কতদিন আগে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছেন? জবাবে বললো- এই তো কয়েকদিন হলো। কেন খৃষ্টান হলেন ? বললো- তারা আমাদের ঋণ প্রদান করে, আমাদের কাছে আসে। আমি সেই লোকটিকে বুঝালাম আর ইসলাম ধর্মের দাওয়াত দিলাম। সে উত্তরে বললো- আপনি তো আগে আসেননি, আগে বললে আমি ইসলামধর্ম গ্রহণ করতাম, এখন সম্ভব না। কারণ আমাদের গোষ্ঠীর সকলেই খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছেন। আমি মুসলমান হলে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে। এ তো ছিল সাঁওতাল বস্তির কথা। এমন আরো যে কতো মুসলিম পরিবারকেও খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত করছে, তা কি আমরা খবর রাখি ?

আমার বন্ধু মাওলানা আব্দুর রহমান সাহেব আমাকে বলছিলেন, আপনার পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ কারিতাসের দাওয়াতে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে তা কি খবর রাখেন? তিনি আরো বললেন - আমি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছি যে, এদের কয়েকজন খৃষ্টান নিজেদের পরিচয় গোপন রাখে, খৃষ্টান বলে প্রকাশ করে না।

আপনিও আপনার আশেপাশে খোঁজ করলে এমন অনেক মানুষ পাবেন, যারা মিশনারিদের ধোঁকায় বিভ্রান্ত। এদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। এ কর্তব্য পালনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের ব্রতী হওয়া আবশ্যক। নতুবা পরিণতি কি দাঁড়ায় তা বলা কঠিন।

 

দ্বিতীয় পার্ট নোট হিসেবে পড়তে ভিজিট করুন - https://bit.ly/2YQVPud

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বাংলাদেশে খৃষ্টান মিশনারির অপতৎপরতা ও আমাদের করণীয় (২)

 

 

 

 

The Greatest Nation·Sunday, April 7, 2019

 

 

খৃষ্টানদের চ্যালেঞ্জ

রমযানুল মুবারাকের শেষ দিনগুলোতে ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে বাড়ি যাওয়ার ধুম পড়ে। আমি দুজন নওমুসলিমকে নিয়ে আমার বাড়ি দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমরা কমলাপুর স্টেশনে যাচ্ছিলাম, এমন সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করে সালাম বিনিময়ের পর বুঝতে পারলাম, ফোন করেছেন মাওলানা রায়হান সাহেব(সম্ভবত তিনি জামিয়া নূরিয়া কামরাঙ্গির চর মাদরাসার দারুল ইকামা হোস্টেল পরিচালক)। তিনি বললেন - যুবায়ের ভাই, কয়েকদিন ধরে ফোন করছি, আপনাকে পাচ্ছি না। মাওলানা ওমর আলী সাহেবকেও পাচ্ছি না। আমি বললাম, হুজুর তো উমরার সফরে গিয়েছেন। এবার বলুন, কি খেদমত করতে পারি ? তিনি বললেন - আমাদের মাদ্রাসার এবতেদায়ী শ্রেণীর এক ছাত্র নাজিবুর রহমান জানালো, তাদের এলাকায় খৃষ্টানরা চ্যালেঞ্জ করেছে যে, আমরা তোমাদের কিছু প্রশ্ন করবো, যদি উত্তর দিতে পারো তাহলে আমরা মুসলমান হয়ে যাবো। আর যদি উত্তর দিতে ব্যর্থ হও, তাহলে তোমাদেরকে খৃষ্টান হতে হবে। এলাকাবাসী উত্তর খোঁজার লক্ষ্যে এই এবতেদায়ী ছাত্রের কাছে এসেছে। কারণ সে-ই ঐ এলাকার বড় হুজুর। এখন ছেলেটি এ বিষয়ে আমাদেরকে জানিয়েছে। যেহেতু দীর্ঘদিন আপনারা খৃষ্টান মিশনারির তথ্য অনুসন্ধান ও তাদের অপতৎপরতা প্রতিরোধের সাথে জড়িত, তাই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছেন কি ?আমি বললাম, অবশ্যই। ইন শা আল্লাহ।

আমি ঐ ছেলের নাম, মোবাইল নাম্বার ও পূর্ণ ঠিকানা সংগ্রহ করলাম। জানতে পারলাম, স্থানটি হলো দিনাজপুরের ফুলবাড়ী থানা। বিষয়টি নিয়ে ভাবতেই আমার খুব কান্না পেলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে বাস করে সত্য ধর্ম ইসলামের অনুসারী হয়ে মিথ্যার উপর ভর করা ভিত্তিহীন, বিকৃত ধর্মানুসারীর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় ! এর জন্য আমরাই দায়ী। দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে।

যাই হোক, ২৮ রমযানে বাড়ি ফিরলাম, চিন্তা - ঈদের আগের দিনই যাবো। ফোনে যোগাযোগ করে ঈদের পর তৃতীয় দিন বিতর্কের তারিখ ঠিক হলো। তৃতীয় দিন সকাল সকাল আমি বীরগঞ্জ থেকে রওনা হলাম, বন্ধু সারওয়ার ও ইমরান ভাইসহ সেই অজপাড়া গাঁয়ে পৌঁছলাম।

সেই এলাকায় খৃষ্টান মিশনারি"ওয়ার্ল্ড ভিশন সংস্থা" এলাকার মহিলাদের গরু, ছাগল ঋণ দেয় এবং প্রতি মাসে পশুপাখি কিভাবে লালন-পালন করবে তারও প্রশিক্ষণ দেয়। প্রশিক্ষণেরই এক পর্যায়ে কুরআনের উপর প্রশ্ন উত্থাপন করে, ধর্মান্তরিত করার লক্ষ্য বাস্তবায়নের তৎপরতায় লিপ্ত হয় এবং গ্রাম্য সরলমনা মহিলাদের এ বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে যে, যদি তোমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারো, তাহলে অফিসের আমরা সকলেই মুসলমান হয়ে যাবো। আর যদি উত্তর না দিতে পারো তাহলে তোমরা সকলেই খৃষ্টান হয়ে যাও। সেই মহিলারা মাদ্রাসার ছাত্র নাজিবুর রহমানকে প্রশ্নগুলো জানালো।

আমাদের আগমনে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। ঢাকা থেকে উলামায়ে কেরামের আগমন টের পেয়ে ওয়ার্ল্ড ভিশনের লোকেরা হতচকিত হয়ে পড়লো। বহু চেষ্টা করেও তাদের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। মোবাইলও ছিল বন্ধ।

এ হলো মিশনারিগুলোর অবস্থা। মুখে মুখে সেবার মোহনীয় শ্লোগান। এর আড়ালে জনগণের সরলতার সুযোগে ধর্মান্তরের চেষ্টা। এ ব্যাপারে এখনই সতর্ক করা আমাদের কর্তব্য।

 

মসজিদের খতীব খৃষ্টান

২০০৯ সালে এক সফরে লালমনিরহাটের আদিতমারি থানায় যাই। সেখানে যাওয়ার পর এলাকার মানুষ জানালো যে, আমাদের এলাকায় একজন খতীব সাহেব আছেন যিনি মসজিদে জুমআর খুতবায় এমন কিছু কথা বলেন, যা আপত্তিকর। তিনি বলেন, নামায পড়তে পড়তে যদি কারো কপালে দাগ পড়ে যায় তবুও সে জাহান্নামে যাবে। খতীব সাহবে আরো বলেন, কেয়ামতের পূর্বে ঈসা আলাইহিস সালামের পুনরাগমন ঘটবে। তখন তো তাকে মানতে হবেই। তাহলে এখন মানতে অসুবিধা কোথায়? আরো বলেন- মাটির নিচের নবী উত্তম না আসমানের উপরের নবী উত্তম ? যিন্দা নবী উত্তম না মৃত নবী উত্তম ইত্যাদি। আমরা যখন খতীব সাহেবের ব্যাপারে অনুসন্ধান করলাম, জানা গেলো তিনি আল-হানিফ কল্যাণ ট্রাস্টের একজন সক্রিয় সদস্য। আর আল-হানিফ কল্যাণ ট্রাস্ট হলো খৃষ্টান মিশনারির ছদ্মবেশী একটি সংস্থা। সেবার আবরণের খৃষ্টধর্ম প্রচারই যাদের মূল লক্ষ্য। সেখানে সেকান্দার মাস্টার নামে আল-হানিফ কল্যাণ ট্রাস্টের একজন সদস্যের সাথে সাক্ষাৎ হলো, যিনি একটি মসজিদের সভাপতি। তিনি আমাদেরকে কুরআনের উপর উত্থাপিত খৃষ্টানদের শিখানো বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলেন। যেগুলো দিয়ে তারা সর্বসাধারণকে বিভ্রান্ত ও ধর্মচ্যুত করে থাকে।

 

ঝিনাইদহে মুরতাদদের সাথে একদিন

২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ভগবান গড় গ্রামের (শৈলকূপা থানা ঝিনাইদহ) সফরের কথা বলি। এ সফরে আমাদের রাহবার ছিলেন স্থানীয় কলেজের ছাত্র রাকিবুল ইসলাম ভাই। গিয়ে দেখি সেখানের অনেক মুসলমান খৃষ্টান হয়ে গিয়েছে। খৃষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত স্থানীয় ঠাণ্ডামাতবর, এলাহী বখশ, বাদশা মিয়া আরো অনেকের সাথে সাক্ষাৎ হলো। তাদের সাথে কথাবার্তা চলছিলো। এক পর্যায়ে আমাদের আলোচনা মুনাজারার(বিতর্কের) রূপ নেয়, তবে তারা মুনাজারায় পরাজিত হয়। বিতর্কে অংশগ্রহণকারী তাদের একজন দাঈ "অমুল মাধুর্য" এর (যে ঐ এলাকায় ইয়াং সোসাইটির প্রধান) সাথে আমার খাতির জমে যায়। আমি তার দাওয়াতি কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলাম। উত্তরে তিনি বললেন, আমরা বই পুস্তক বিলি করি, বুঝাই আর আমাদের প্রোগ্রামগুলোতে দাওয়াত দেই। আমি ফের প্রশ্ন করলাম, আপনারা বই পুস্তকের টাকা পয়সা কোথায় পান ? উত্তরে বললেন, আমরা প্রত্যেকেই আয়ের এক দশমাংশ আল্লাহ'র রাস্তায় দান করি এবং দান করার পর সেদিকে ফিরেও তাকাই না। কেউ আমাদের খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করলে তাকেও এই দানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করি। আমাদের দাওয়াতি কাজের অর্থযোগান এভাবেই হয়। আর এভাবে সংগৃহীত টাকা দিয়েই আমরা বই পুস্তক কিনি আর বিতরণ করি। আমূল মাধুর্য জানালেন, তিনি একটি প্রাথমিক স্কুল পরিচালনা করেন। সেখানে মুসলমানের সন্তানরাও পড়াশুনা করে। তাদেরকে ইসলাম শিক্ষা নয় বরং খৃষ্টধর্মের দীক্ষা দেওয়া হয়। সেকুলার পদ্ধতিতে পড়ানো হয়। তিনি এ ধরনের বহু তথ্য দিলেন।

আমি মুসলিম ভাইদের জিজ্ঞাসা করতে চাই, আমরা কয়দিন কয়টি বই আমার প্রতিবেশী অমুসলিমের হাতে তুলে দিয়েছি ? আমরা কতোভাবে আমাদের টাকা খরচ করি, একটি টাকাও কি অমুসলিম ভাইদের পিছনে দাওয়াতের উদ্দেশ্যে খরচ করেছি ?

 

মুসলমানদের গ্রামে খৃষ্টানদের চার্চ

খবর পেলাম, জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানায় বহু মুসলমান খৃষ্টান হয়ে গিয়েছে, তাই ঐ অঞ্চলে সফর করি। প্রথমে মেলান্দহ জামিয়া হুসাইনিয়া মাদ্রাসায় গিয়ে সম্মানিত মুহতামিম, মুফতি শামসুদ্দিন সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করি। আমরা উভয়ে মাদারগঞ্জ থানার তেঘুরিয়া ইউনিয়নের কয়লাকান্দি গ্রামে পৌঁছি। সেখানে মুসলমানদের এলাকায় ন্যাজরিয়ান মিশনের একটি বিশাল গির্জা দেখতে পেলাম। ঐ এলাকার অনেক মুসলমানই খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে। আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করে ইসলাম ধর্মে ফিরে আসার দাওয়াত দেই। অনেকে বাইবেল ও কিতাবুল মুকাদ্দাস ফেরত দিয়ে স্বধর্মে ফিরে আসেন এবং তাওবা করেন। এভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে মিশনারিগুলো কাজ করে যাচ্ছে। অথচ তাদেরকে হেদায়েতের পথে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সামান্য অনুভূতিও আমাদের হয় না।

 

মাদারগঞ্জে কয়েক হাজার খৃষ্টান

৯ই ফেব্রুয়ারী ২০১১ ইং তারিখে মাদারগঞ্জের তেঘুরিয়া ইউনিয়নে আমাদের সফর হয়। সেখানে পৌছার পর স্থানীয় এক খৃষ্টান হাফেজ.... এসে আমাকে বললেন, আমাদের এখানকার প্রবীণ/ মুরব্বী (যিনি ধর্মান্তরিত খৃষ্টান) আপনাদের সাথে কথা বলতে চান। তখন আমি অধম, বন্ধুবর মাওলানা নুরুল ইসলাম ও ইঞ্জিনিয়ার আমিনুল ইসলামসহ তার কাছে যাই। গিয়ে দেখি জালাল সাহেব আসন দিয়ে বসে আছেন। সামনে বিছানার উপর ছড়ানো পবিত্র কুরআন, যেন এ কোন সাধারণ বই-খাতা ! আর ডায়েরি দেখে তাতে কি যেন দাগাচ্ছেন। আমরা সালাম দিয়ে প্রথমে কুরআন শরীফটি বিছানা থেকে বুকে উঠিয়ে নিলাম। এরপর তার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা হলো। তার আলোচনার বিষয় ছিল মিশনারিগুলোর শিখিয়ে দেওয়া প্রশ্নগুলো। আমরা তার প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতে লাগলাম, তিনি আমাদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে ব্যর্থ হলে তাদের বস(খৃষ্টান মিশনারিদের প্রধান) জাহাঙ্গীর আলম ওরফে লেবু ডাক্তারকে ফোন করলেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তরজমাতুল কুরআন, কিতাবুল মুকাদ্দাস ও কিছু নোট নিয়ে উপস্থিত হলেন। তার সাথে কিছুক্ষণ যুক্তিতর্কের পর বললাম, তর্ক কিংবা বিতর্ক কোনটি আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বরং সত্যকে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। তাই আপনার প্রতি আহবান থাকবে, পুনরায় ইসলাম ধর্মে ফিরে আসবেন।

 

খৃষ্টান প্রচারকের সাথে বিতর্ক ও দাওয়াত

হালুয়া ঘাটের এক চার্চে ফাদারের সাথে আমরা কয়েকজন দেখা করি। প্রথমে তাকে সালাম দিলাম।

যুবায়েরঃ আসসালামু আলা মানাত্তিবাআল হুদা।

ফাদারঃ ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

যুবায়েরঃ কেমন আছেন ?

ফাদারঃ ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন ?

যুবায়েরঃ আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আমরা আপনাদের চার্চ দেখতে এসেছি, দেখতে পারি কি ?

ফাদারঃ হ্যা, অবশ্যই দেখতে পারেন।

যুবায়েরঃ (চার্চ দেখতে দেখতে কিছু দাওয়াত) ফাদার সাহেব, দেখুন, আমাদের সমাজে একটি বড় ভুল বুঝাবুঝি আছে, তা হলো, আমরা যখন কোন হিন্দু বা খৃষ্টান ভাইদের দেখি, তাকে বিধর্মী মনে করে তার থেকে দূরে থাকি। হিন্দু খৃষ্টান ভাইরাও তাই করে। আসলে এমন করা ঠিক নয়। আমরা সকলেই মানুষ। আপনার কপালে লেখা নেই যে, আপনি খৃষ্টান। তদ্রূপ আমার কপালেও মুসলমান লেখা নেই। আমার চামড়া কাটলে রক্ত লাল হবে, আপনার চামড়া কাটলেও তাই। এর ব্যত্যয় হবে না। মূলত এই পার্থক্য আমরা নিজেরাই করে নিয়েছি। আমাদের মালিক কোন পার্থক্য করেননি। আমাদের প্রভু আল্লাহ সকলকে লক্ষ্য করে বলেন- "হে মানুষ সকল, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের উপাসনা করো, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন......" এখানে মালিক কোন ভাগ করেননি। এই মালিক এক, তার সাথে কোন শরীক নেই।

ফাদারঃ হ্যা, হ্যা, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমাদের বাইবেলেও তা আছে।

যুবায়েরঃ আচ্ছা, আপনার কাছে অনেক কিছু জানা যাবে। আমি জানতে চাই, বাইবেল কি আল্লাহ'র কিতাব ?

ফাদারঃ হ্যা, এটা আল্লাহ'র কিতাব। আপনাদের কিতাবে যাকে তাওরাত, ইনজিল নামে অভিহিত করা হয়েছে।

যুবায়েরঃ বলুন তো, মানুষের লেখা চিঠি কি আল্লাহ'র কালাম হতে পারে ?

ফাদারঃ না, কখনো হতে পারে না।

যুবায়েরঃ আপনার দাবী অনুযায়ী মানুষের কথা আল্লাহ'র কিতাবে স্থান পেতে পারে না, অথচ নতুন নিয়মের ২৭ অধ্যায়ের মধ্যে ১৪ টি অধ্যায় হলো সেন্ট পোলের চিঠি। আর সেন্ট পোল যীশুকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়ার অনেক পরে এসেছেন। সুতরাং তার চিঠিগুলো আল্লাহ'র কালাম হতে পারে না। প্রশ্ন জাগে, তা কিভাবে আপনাদের বাইবেলে স্থান পেলো!

ফাদারঃ উনি তো পবিত্র আত্মার সাহায্যে লিখেছেন।

যুবায়েরঃ যীশু তো বাংলাদেশীদের জন্য নবী নন। কারণ বাইবেলের মথির ২৪:১৫ তে আছে, যীশু বলেন - "আমি তো শুধু বনী ইস্রাইলের হারানো মেষদের জন্য প্রেরিত হয়েছি।" আর আমরা বাংলাদেশীরা বনী ইস্রাইলের লোক নই।

ফাদারঃ আমি এখন বলতে পারবো না, পরে আরো পড়াশোনা করে আপনাকে জানাবো।

যুবায়েরঃ দেখুন, আমাদের মাঝে আরেকটি ভুল বুঝাবুঝি আছে, তা হলো - হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাদের নবী? যদিও আপনারা তাকে মুসলমানদের নবী আর আমরা আমাদের নবী বলি। কিন্তু কুরআনে বলা হয়েছে- তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকলের নবী। সুতরাং কুরআনের ভাষ্যানুযায়ী তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকলের নবী। তাই আপনাকে আহবান করবো তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঈমান আনবেন এবং কুরআনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে তদনুযায়ী আমল করবেন।

ফাদারঃ আমার অনেক ইচ্ছা যে, কুরআন শরীফ পড়বো। একবার কুরআন শরীফ কিনতে গিয়েছিলাম, কিন্তু খৃষ্টান হওয়ায় আমার কাছে কুরআন শরীফ বিক্রি করেনি।

যুবায়েরঃ আমি আপনার কাছে একটি কুরআন শরীফ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ। আজকে আসি। আসসালামু আলাইকুম।

 

বাংলাদেশে খৃষ্টানদের ৬ টি ধর্মপ্রদেশ

বাংলাদেশে খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে পুরো দেশকে ৬ টি প্রদেশে বিভক্ত করেছে। যথা- (১) দিনাজপুর, (২) রাজশাহী, (৩) খুলনা, (৪) চট্টগ্রাম, (৫) ঢাকা, (৬) ময়মনসিংহ।

 

নীলফামারীতে মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার চাঞ্চল্যকর তথ্য

দৈনিক করতোয়ার ২১ এপ্ল্রিল ২০০৮ এর একটি সংবাদ এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো -

জলঢাকা প্রতিনিধিঃ নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার খুটামারা, কৈমারী, বালাগ্রাম, মীরগঞ্জ, শিমুলবাড়ী, কিশোরগঞ্জের পুটিমারী ও বড়ভিটার হিন্দুদের অর্থের লোভ দেখিয়ে খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। মেগা ফেলোশিপ চার্চ ও ইভানজেলিক্যাল ফ্রেন্ডস চার্চসহ ৫ টি সংগঠন নগদ অর্থ, চাল, ডাল, শিক্ষা সহায়তা ও ঋণ প্রদানসহ আত্মনির্ভরশীল কার্যক্রমের আড়ালে ধর্মান্তরিত করার কাজ জোরে-শোরে চালাচ্ছে। এ লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছে এলাকাজুড়ে অফিস, উপাসনালয় ও শিশুদের জন্য স্কুল। শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তরালে স্কুলগুলোতে চালানো হয় বিভিন্ন সভা ও সমাবেশ। আর প্রোগ্রামের মাধ্যমে খৃষ্টান ধর্ম বুঝিয়ে ধর্মান্তরিত করার কাজ চলে। ওমেগা ফেলোশীপ চার্চ এনজিওর নামে গ্রামের অভাবী লোকদেরকে অর্থসহ বিভিন্ন সহায়তার কথা বলে তাদের তৈরি স্কুল ও অফিসগুলোতে নিয়ে তাদেরকে খৃষ্টান বানানো হচ্ছে। গত ১৬ এপ্রিল খুটামারা ইউনিয়নের ২০ জন মহিলা ও ৪ জন পুরুষ; পুটিমারী, কচুকাটা ও পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের ১৮ জন; বড় ভিটা ও কৈমারী ইউনিয়নের ১০ জন মহিলা ও পুরুষের অভাবের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওমেগা ফেলোশীপ চার্চের কথা বলে দিনাজপুর, বীরগঞ্জ উপজেলার ৭ নং মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামের মিশন স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার সেখানে গিয়ে খৃষ্টান বানানোর কথা জানতে পারার পর এলাকার মেম্বার ও চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন। পরে ঐ ইউপির চেয়ারম্যান গোপাল চন্দ্র দেব শর্মা তাদেরকে উদ্ধার করে নিজ নিজ এলাকায় পাঠিয়ে দেন। বীরগঞ্জ থানার ওসি জানান, গত ১৬ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট প্রতারকদের বিরুদ্ধে থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা হলো - খুটামারা ইউনিয়নের খালিশা, খুটামারা গ্রামের টনে মামুদের স্ত্রী শাহী, টাটারি স্ত্রী ছারা, শাহারা, সুলতানের স্ত্রী আকলী, রবিউলের স্ত্রী নার্গিস, মৃত কলেজের স্ত্রী অহেদা, লবদ্দিনের স্ত্রী হাওয়া, বিশাদুর স্ত্রী হাওয়াতোন, বকশের স্ত্রী মজিলা, ওসমানের স্ত্রী আসমা, রশিদুলের স্ত্রী ক্যান্টি, ভালের স্ত্রী এপাতন, মৃত টোলার স্ত্রী রহিমা বেগম ও পাদুরার ছেলে লবদ্দিন, মৃত জমালার ছেলে রমজান(ভালে)।

 

৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ৫৫ মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা

নয়া দিগন্তের ২৭ মে ২০১০ ইং তারিখের একটি পেপার কাটিং এখানে তুলে ধরা হলোঃ

সাইফুল মাহমুদ, ময়মনসিংহ প্রতিনিধিঃ ........ প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে ঋণ প্রদানের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ৫৫ মুসলমান নারী ও পুরুষকে খৃষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করণের চেষ্টাকালে স্থানীয় জনতার সহায়তায় একজন বিদেশী ধর্মযাজকসহ তিন ধর্মযাজক ও তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত দুই পালককে আটক করে পুলিশ। এ সময় ৫৫ মুসলমান নারী ও পুরুষকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত সবাই জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা।

উদ্ধারকৃত নারী ও পুরুষেরা জানান, সরিষাবাড়ী উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের আবদুল বারেকের পুত্র রফিকুল, মাজারিয়া গ্রামের রফিক(পিতা - অজ্ঞাত) ও কাশেমের পুত্র রিপন এবং টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি উপজেলার বাসনিয়োগী গ্রামের আসেক আলীর পুত্র শামসু, তাদের পাঁচ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়ার কথা বলে। দুই সপ্তাহ ধরে তাদের বলা হচ্ছে যে, ঋণ নেওয়ার জন্য সবাইকে ময়মনসিংহে যেতে হবে। এই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সকালে তাদের সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা এলাকায় জড়ো করা হয়। সেখান থেকে তাদের একটি বাসযোগে ময়মনসিংহে নিয়ে আসা হয়। দুপুর নাগাদ বাসটি শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের ব্রিজের কাছে পৌঁছে। এখানে একজন বিদেশীসহ তিন ব্যক্তি তাদের বাস থেকে নামিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নিয়ে যান। এদের মধ্যে কয়েকজনকে নদের পানিতে গোসল করায় আর তাদের জিজ্ঞেস করে - তোমরা কি যীশুকে বিশ্বাস করো? এমন প্রশ্ন শুনে অনেকেই জানতে চান, ঋণ নিতে হলে যীশুকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? তখন শামসু তাদেরকে চুপ থাকার কথা বলে ধমক দেয়। এমন পরিস্থিতিতে কেউ কেউ পিছু হটতে থাকে। এ সময় নদের তীরে একজন মওলানাকে দেখে ঋণ প্রত্যাশীরা জানতে চান, ঋণ নেওয়ার সাথে যীশুকে বিশ্বাস করার কোন কারণ আছে কি? তখন হুজুর তাদের কথা শুনে বিষয়টি বুঝতে পারেন আর স্থানীয় লোকদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। এ সময় বেশ কিছু লোক জড়ো হয়। তারা বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করলে কোতোয়ালী থানার পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ইউনাইটেড পেন্টিকেস্টল চার্চ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান(প্রধান ধর্মযাজক) ফাদার রেভা সমর সাংমা ও ফাদার রেভা প্রদীপ সাংমাসহ তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত দুই পালক শামসু ও রফিকুলকে আটক করে। এ সময় ৩৫ নারী ও ২০ পুরুষকে উদ্ধার করা হয়। তাদের সাথে ১৫ শিশুও রয়েছে। তারা সবাই মুসলিম দরিদ্র পরিবারের লোক।

এ দিকে ইউনাইটেড পেন্টি কেস্টল চার্চ অফ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান (প্রধান ধর্মযাজক) আমেরিকান নাগরিক ফাদার রেভা জেমস অরভিন নয়াদিগন্তকে জানান, আমরা কাউকে জোর করে ধর্মান্তরিত করি না। আমাদের কোন এনজিও নেই। আমরা কাউকে ঋণ প্রদানও করি না, আমরা তাদেরকে টাকা দেওয়ার কথাও বলিনি। তবে তিনি আগতদের কাছে জানতে চান, তারা যীশুকে বিশ্বাস করে কিনা, তার ব্যাপটিস্ট তরীকা কিনা। তখন জবাবে তারা বলেছেন, হ্যা, এ কথা বলার পরই তাদের গোসল করতে বলা হয়। কেন গোসল করতে বলা হলো ? এ প্রশ্নের কোন জবাব দেননি তিনি। তিনি বাংলায় আরো বলেন, আমার মন খুব খারাপ। ওরা অ্যাকশন নিবে, এসব আমার অপছন্দ।

খৃষ্টান মিশনারিরা ছলচাতুরি করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ধর্মান্তরিত করার কাজ পুরোদমে করে যাচ্ছে।

 

খৃষ্টধর্ম প্রচারকদের কয়েকজন

(১) ড. উইলিয়াম কেরীঃ তিনি পি.এইচ.ডি. হোল্ডার। তিনি পশ্চিম বাংলায় কৃষি কাজ করেছেন। তার ভাষা ইংরেজি, তিনি এদেশে এসে বাংলা ভাষা শিখেন। তিনি দেখলেন, বাংলা ভাষা কোন সাহিত্যের মানে উত্তীর্ণ নয়। এটাকে ইংরেজি ভাষার সাথে মিলিয়ে একই ফর্মে একটি উন্নত ভাষা করা যায়। তিনি বহু বছর সাধনা করে এ বাংলাকে আধুনিক বাংলায় রূপান্তরিত করেন। বাংলা ভাষার উন্নতি সাধনে তার অবদান অনস্বীকার্য। তারপর তিনি কলকাতায় সুপিরিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজেই ঐ কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হোন। তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষায় বাইবেল প্রচার। তখন বাংলা বর্ণের কোন ছাপাখানা ভারতবর্ষে ছিল না। তিনি ইংল্যান্ডে অর্ডার দিয়ে বাংলা বর্ণের ছাপামেশিন নিয়ে আসেন আর বাংলা ভাষায় বাইবেল ছাপান। তিনি সর্বপ্রথম ইংরেজি বাইবেল বাংলায় অনুবাদ করে ভারতবাসীর মধ্যে বিলি করেন। এমন ত্যাগ যদি বর্তমান মুসলমানদের মধ্যে থাকতো, তাহলে আমাদের এতো দুর্দশায় পড়তে হতো না।

(২) মাদার তেরেসাঃ তিনি অবিবাহিতা ছিলেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় তার প্রতিষ্ঠিত ৩০০ এতিমখানা রয়েছে। মাদার তেরেসার এক বড় টার্গেট ছিল ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে খৃষ্টান রাষ্ট্রে পরিণত করা।

এ ছাড়াও ড. টমাস, ফাদার টর্সবার্লার, টর্বেন্ডে পিটারসন, আলফ্রেড বরীন মণ্ডল, ড. অলসন- খৃষ্টান মিশনারির এ সকল নেতারা বছরের পর বছর ধরে বাংলার এ দুর্গম পাহাড়ের ভিতরে জীবন যাপন করে খৃষ্টধর্ম প্রচার করেন। আমরা ইতিহাসে সাহাবায়ে কেরামকে ধর্ম প্রচারের জন্য যেভাবে নিবেদিত পেয়েছি, এই খৃষ্টান নেতাদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের উৎসাহ তার চেয়ে খুব বেশী না হলেও কম ছিল না। আমাদের ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। আমাদের ঐতিহ্য খৃষ্টানরা নিয়ে গেছে।

 

সেবা দিয়ে তাদের টার্গেট কি ?

পৃথিবীর পথে-ঘাটে পড়ে থাকা শিশুদের আর রাস্তার ধারে অবহেলিত জারজ সন্তানদের তারা পিকাপে করে নিয়ে যায় তাদের সেন্টারে। এ শিশুদের মেধাবীদেরকে তারা শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে ডাক্তার, পাইলট, সেনাবাহিনী ইত্যাদি বানায়। পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধ বাঁধলে এদেরকে ব্যবহার করে। যেমন বর্তমানে আফগান, ইরাকে যুদ্ধরত বহু আমেরিকান ও ব্রিটিশ সৈন্য মারা পড়ছে কিন্তু এদের অনেকের জন্য চোখের পানি ফেলার মতো কোন আপনজন পাওয়া যায় না, কারণ এদের অধিকাংশই পথের ধারের অবহেলিত পরিচয়হীন জারজ সন্তান।

 

মিশনারি স্কুলের মাধ্যমে তাদের টার্গেট

খৃষ্টান মিশনারি প্রেরক সমিতির সভাপতি বলেন, খৃষ্টান মিশনারিদের বড় উদ্দেশ্য, যে সব ছাত্র আমাদের স্কুল কলেজ থেকে শিক্ষা সমাপন করে বের হচ্ছে, তাদের মন মস্তিষ্ক আমাদের ধাঁচে গড়ে তোলা। (আপনি ঢাকায় বা বাংলাদেশের প্রায় অঞ্চলে দেখবেন একটি স্কুলে ছাত্র দেওয়ার চেয়ে অভিভাবকরা বেশী খুশী হোন মিশন বা গির্জা স্কুলে ছেলে মেয়েদের ভর্তি করতে পেরে। কারণ ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে, ইংরেজি বলতে পারবে, স্মার্ট হবে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ পাবে, বহির্বিশ্বে উচ্চ শিক্ষার জন্য যেতে পারবে।) তিনি বলেছেন, কোন গির্জা স্কুলে যদি কোন মুসলমান ছেলে পড়ে তাহলে আমাদের লাভ। কারণ নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। জুমআয় যাবে, ঈদের নামায পড়বে, মা-বাবা মারা গেলে জানাযায় যাবে কিন্তু মন-মেজাজ, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা ইসলাম বিমুখ হবে। ইসলামের পক্ষে সে কথা বলবে না। বরং সে নিজের অজ্ঞাতে আমাদের মিশনারিগুলোর একজন বড় পৃষ্ঠপোষক হয়ে যাবে। বর্তমানে তাদের কথার প্রতিফলনের বহু নমুনা দেখা যাচ্ছে।

আপনি দেখবেন, পৃথিবীর যেখানে খৃষ্টান মিশনারিগুলোর স্কুল আছে, সেখানে গির্জাও আছে। গির্জা ছাড়া পৃথিবীতে কোথাও তাদের স্কুল কলেজ গড়ে উঠেনি, এমনকি লন্ডন ইউনিভার্সিটিও না। তার পাশে রয়েছে ভেস্টওয়ান খ্রিস্টিয়ান চার্চ। কিন্তু আমরা মুসলমানরা যদি যদি কোন স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটির পাশে মসজিদ বানাতে চাই, তখন আমাদেরকে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক আখ্যায়িত করা হয়। আপনি নটরডেমে যান কিংবা মোহাম্মদপুরে আসাদগেট মিশনারি স্কুলে, সাথেই গির্জা দেখতে পাবেন। তিনি আরো বলেছেন, আমাদের স্কুলে যদি তাকে মেট্রিক বা ইন্টারমিডিয়েট পড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে সে আমাদের মিশনারির বিপক্ষে একটি টু শব্দও করবে না।

 

মিশনারি স্কুলের মাধ্যমে যা শিক্ষা দেওয়া হয়

দৈনিক নয়া দিগন্তের এক রিপোর্ট অনুযায়ী নীলফামারীতে আরো পাঁচটি সংগঠন রয়েছে, যারা ধর্মান্তরের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে যীশু খৃষ্টের বই, যীশু খৃষ্টের জীবনী ইত্যাদি পড়ায়। ছোটদেরকে"সিবগাতুল্লাহ" নামের একটি বই পড়ানো হয় যাতে বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের পাঠদান করে কচি বাচ্চাদের মগজ ধোলাই করা হয়। সেভেন ডে এডভেঞ্চারিস্টের একটি স্কুলে ছোট ছোট ছেলেদের বাধ্যতামূলকভাবে"ইটালি ডে জারি"র লেখা"আমার বাইবেলের বন্ধুগণ" পড়ানো হচ্ছে। জার্মানভিত্তিক ন্যাজরিয়ান মিশন সংগঠনটি বিনামূল্যে বই, খাতা, পোশাক এমনকি দুপুরের খাবারসহ বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে ধর্মান্তরিতকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

 

মিশনারি স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের উক্তি

হালুয়াঘাটে সফরকালে এক ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিলো। তিনি বলেন, আমার ছেলে মিশনারি স্কুলে বাইবেলও পড়ে। কথাটা খুব গর্বের সাথে বলছিলেন।

 

সমিতির মাধ্যমে প্রচার

খৃষ্টান মিশনারিগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামে-গঞ্জে পুরুষ-মহিলাদের নিয়ে সমিতি গড়ে তুলেছে। আর সেই সমিতির সদস্যদের পড়ানো হচ্ছে বাইবেল, বিভিন্ন সিডি প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে যীশুখৃষ্টের জীবনীমূলক চলচ্চিত্র। তাদেরকে পড়ানো হয় ইনজিল শরীফ, মানে বাইবেল। লুকের লেখা"হযরত ঈসা মসীহ" আর "মুসলমান ও হিন্দুরা ১০০ ভাগ জাহান্নামী আর খৃষ্টানরা ১০০ ভাগ জান্নাতি" সহ আরো কতো বিচিত্র বই। রাতের আঁধারে শিশু ও মহিলাদের দেখানো হয় বিভিন্ন সিডি।

"আগাবে" নামক একটি সমিতিতে সপ্তাহে ২ টাকা জমা নেওয়া হয় এ বলে যে, যখন এক হাজার টাকা জমা হবে, তখন তাদেরকে দশ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এ রকম লোভ দেখিয়ে তারা দরিদ্রদের হাত করছে। একজনকে ১৮ হাজার টাকার চাকরি দেওয়া হবে বলে খৃষ্টান বানিয়েছে। ইভানজেলিক্যাল ফ্রেন্ডস চার্চ ও খৃষ্টান লাইফ অফ বাংলাদেশ (সি.এল.বি.) 'র ইউনিয়ন ইনচার্জ নতুন রায়ের ভাষ্যমতে, ১২ ই জুন ৪৫ জন মুসলমান ও ১৩ ই জুন ৫৬ জন হিন্দুকে শিশাতলী গির্জায় নিয়ে খৃষ্টান বানানো হয়েছে।

 

নীলফামারী জেলায় খৃষ্টধর্ম প্রচার

নীলফামারী জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে ৩০০ গজ দূরে উকিলপাড়ায় অবস্থিত ইউনাইটেড পেন্টিকস্টাল চার্চ অফ বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন নিরবচ্ছিন্নভাবে ধর্মান্তরকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনটির আঞ্চলিক সমন্বয়ক প্রফুল্ল কুমারের দেওয়া তথ্যমতে শুধুমাত্র গত এক বছরে এই জেলাতেই ৫৩৬ জন হিন্দু ও ৪৫ জন মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করে খৃষ্টান বানানো হয়েছে। কেউ যদি ধর্মান্তরিত হওয়ার পর ঢাকার বাইবেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর পড়ে তার চাকরি ১০০ ভাগ নিশ্চিত।

 

নেত্রকোনা জেলায় ধর্মপ্রচার

নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরসহ বিভিন্ন এলাকার গারোদের খৃষ্টান বানাতে সক্ষম হয়েছে। নজরুল ইসলাম নামক প্রত্যক্ষদর্শীর দেওয়া তথ্যমতে নেত্রকোনা জেলায়"মৌ" নামক স্থানে যাওয়ার পথে দুটো মুসলমান ইউনিয়ন খৃষ্টান ইউনিয়নে পরিণত হয়েছে। অথচ সেখানে ৫ টি মাদরাসা রয়েছে।

 

মি. বুশের একটি ভাষণ

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাক আক্রমণের পূর্বে এক ভাষণ দেন যা ১৪ টি ভাষায় প্রচারিত হয়েছিলো। তিনি বলেছিলেন - ঈশ্বর মার্কিন সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন ভালোকে সম্প্রসারণ এবং মন্দকে প্রতিহত করতে। তাই এই সরকার বাইবেলে প্রদত্ত নীতি অনুযায়ী মার্কিন জাতিকে রক্ষা এবং সারা বিশ্ববাসীকে গোলামীর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য যুদ্ধে সৈন্য পাঠাচ্ছে। তিনি বলেন- মানুষকে মুক্ত করার জন্য আসলে খৃষ্টধর্ম প্রচার করতে হবে। মার্কিনীদের ছত্রছায়ায় খৃষ্টধর্ম প্রচার খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। যাদের বাপ নেই, মা নেই, আর যারা বিধবা, স্বামী নেই, তাদেরকে খৃষ্টান বানানোর জন্য পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

 

চট্টগ্রামে খৃষ্টানদের দাওয়াতি কাজ

দৈনিক ইনকিলাবের এক সাংবাদিক সাদেক হুসেন তার একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদনে বলেছেন, রাঙ্গামাটি থেকে দুই দিনের দূরত্বে ভারতের সীমানার কাছে একটি ইউনয়ন আছে "সাজেক"। এ এলাকায় ২০ হাজার মানুষ আছে যারা ইংরেজিতে কথা বলে। গিটার বাজিয়ে ইংরেজি গান গায় আর ছেলে-মেয়েরা জিন্স প্যান্ট পড়ে। ইউরোপীয় স্টাইলে তাদের জীবনধারা।

দৈনিক ইনকিলাবের প্রকাশিত একটি সূত্রমতে কারিতাস, ওয়ার্ল্ড ভিশন প্রভৃতি এনজিও দরিদ্র ও অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে সেখানকার বিপুল সংখ্যক মানুষকে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলায় বসবাসকারী উপজাতিরা খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে এবং সেখানে রয়েছে তাদের সুদূরপ্রসারী কর্মকাণ্ড। আর এ কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের কোন ঘটনা ঘটলেই পাড়া-পড়শি জানার আগেই তা পৌঁছে যায় বিশ্বব্যাপী। ঘটনাস্থলে থানার পুলিশ পৌঁছার আগেই ওয়াশিংটন, লন্ডন, টোকিও, ভ্যাটিকান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বিবৃতি আসতে থাকে।

 

জুমল্যান্ড পরিকল্পনা

একাধিক আন্তর্জাতিক খৃষ্টানসংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি আলাদা রাষ্ট্র করার চক্রান্ত চালাচ্ছে। মুসলিম রাজ্যের বুকে জুমল্যান্ড নামে একটি খৃষ্টানরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে। যেমনটি ইন্দোনেশিয়ায়"পূর্ব তিমুর" নামে প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ডতুল্য খনিজ সম্পদের অপার সম্ভাবনায়ময় এক দশমাংশ অঞ্চল তথা পার্বত্য এলাকাকে ঘিরে তাদের এ নয়া রাষ্ট্র তৈরির পরিকল্পনা। ৭ মে ২০০৬ ইং তারিখে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, সন্তু লারমার পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে স্বাধীন জুমল্যান্ডের পরিকল্পনা থাকলেও মিশনারিদের টার্গেট ভিন্ন। তাদের লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়ায় একটি খৃষ্টান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটানো।

অবশ্য প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকগণ মনে করেন, ইহুদি-খৃষ্টান বিশ্বের লক্ষ্য শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, এর সাথে ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোকে একত্র করে একটি বৃহৎ খৃষ্টরাষ্ট্রের জন্ম দিবে। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতেও বিশেষ করে ঐ সব অঞ্চলের উপজাতিদের মাঝে একই ধরনের মিশনারিগোষ্ঠীর জোরালো কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের মতে, এদের লক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলে খৃষ্টানরাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ শক্তিগুলোর প্রতিরক্ষাবলয় সৃষ্টি করা। ভূ-কৌশলগত দিক থেকে বিষয়টি তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের পার্বত্য এলাকা তথা মিজোরাম, অরুনাচল, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মনিপুরে এবং বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় দেশীয় ও ইউরোপীয় খৃষ্টান মিশনারিদের দ্বিমুখী তৎপরতায় ধর্মান্তরিত করার কাজ পুরোদমে চলছে। তাদের পরিকল্পনা হলো, যখন এ দুই পার্বত্য এলাকার অধিকাংশ মানুষ খৃষ্টান হয়ে যাবে তখন সন্তু লারমা গং গণভোটের দাবী তুলবে। এদিকে ইহুদি-খৃষ্টানদের ক্রীড়নক জাতিসংঘ গণভোটের পক্ষে চাপ সৃষ্টি করবে। এভাবে প্রতিষ্ঠা করবে তাদের স্বপ্নের স্বাধীন খৃষ্টরাষ্ট্র।

আমরা মুসলমানরা যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টাই, তাদের কাছে ইসলামের আমানত না পৌঁছে দেই, তাহলে আমাদেরও ভোগ করতে হবে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের পরিণতি।

 

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে ধর্মান্তরকরণ

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে গরীব অসহায়দের চিকিৎসা সেবার নামে তাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে খৃষ্টান বানানোর গভীর ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তারা বাস্তবায়ন করে চলেছে। মিশনারিদের এই নিরন্তর সাধনায় তারা আদৌ ব্যর্থ হচ্ছে না।

 

খৃষ্টান বানানোর কৌশল

কৌশল ১- যশোরে ফাতেমা নামক একটি হাসপাতাল আছে। প্রতিদিন সে হাসপাতালে প্রায় ছয়শত মুসলমান চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যায়। আর এ সুযোগে তারা ধর্মান্তরে আকৃষ্ট করার চাতুরীপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করে। জনৈক রোগীর ঘটনা, সে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলো। কর্তব্যরত নার্স তাকে তাকে একটি ঔষধের পোটলা দিয়ে বললো, এটা আল্লাহ'র নাম নিয়ে খেয়ো। সরল মহিলা সেবিকার পরামর্শ অনুসারে ঔষধ সেবন করলো বটে, কিন্তু রোগ সারলো না। পরদিন আবার গেলে তাকে আরেকটি ঔষধের পোটলা দিয়ে বললো, যীশুর নামে খেয়ে দেখো সারে কিনা। এবার ঔষধ সেবনে তার রোগ সারলো।(মূলত দ্বিতীয় পর্যায়ে সঠিক ঔষধ দিয়েছিলো) এভাবে প্রহসনের মাধ্যমে দেশের সরলপ্রাণ আত্মভোলা মুসলমানদের বিভ্রান্ত করছে মিশনারিরা।

কৌশল ২- খৃষ্টান মিশনারিগুলোর অনুদাননির্ভর এনজিওদের দ্বারা দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাজার হাজার প্রাথমিক স্কুল। নিরক্ষরতা দূরীকরণ শ্লোগানের আড়ালে সেখানে কোমলমতি শিশুদের মনে খৃষ্টধর্মের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির নিরন্তর প্রয়াস চালানো হচ্ছে। যেমন- খৃষ্টান মিশনারিগুলোর অনুদাননির্ভর একটি এনজিও দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্কুলে জনৈক শিক্ষিকা ছাত্রদের বললেন, বাড়িতে তোমাদের আব্বু-আম্মু তোমাদের বেশী ভালোবাসেন, না তোমাদের বাড়ির সেবকদের(কাজের লোকদের)। উত্তরে কোমলমতি শিশুরা বললো - বাবা-মা আমাদের বেশী ভালোবাসেন। তখন শিক্ষিকা বললেন - তোমাদের বাবা-মা তোমাদের স্নেহ করেন এজন্য যে, তোমরা তাদের সন্তান। তেমনই খৃস্টধর্মের প্রবর্তক যীশু হলেন আল্লাহ'র পুত্র, আর মুসলমান ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন আল্লাহ'র বান্দা ও দাস। এখন বলো, পুত্র হিসেবে আল্লাহ যীশুকে বেশী ভালোবাসেন, না মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) 'কে?

কৌশল ৩- খৃষ্টানরা পরিকল্পিতভাবে খৃষ্টধর্মের বর্তমান বিকৃতরূপকে জাগতিক উন্নতি, পরকালের মুক্তির একমাত্র সহজ উপায় হিসেবে উপস্থাপন করছে। তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষের দলীল হিসেবে ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতসমূহকে পেশ করছে। এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে আত্মভোলা সহজ-সরল জনগোষ্ঠী, ধর্মান্তরিত হচ্ছে অনেক মানুষ। যাদের ধর্মান্তর করার জন্য টার্গেট করা হয়, তাদের ধারণা দেওয়া হয় যে, পূর্বের নবীদের উপর ঈমান রাখাও ইসলামের মৌলিক বিধান। এক্ষেত্রে ঈমান হিসেবে ঈমানে মুসাসসালের অংশবিশেষ "নবীদের উপর ঈমান আনয়ন" এর আবশ্যকতার প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করা হয় অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে। এ ধরেনর প্রচারণার শিকার দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ থানার আমীর হামযা সম্পর্কে জানা যায়, সে নিজেলে ঈসায়ী মুসলমান হিসেবে দাবী করে। তার বক্তব্যের স্বপক্ষে "ঈমানে মুফাসসাল" কালেমার বিশেষ অংশ উদ্ধৃত করে যুক্তি দেখায় যে, এতে পূর্ববর্তী নবীদের উপর ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে এবং তা আবশ্যক, সে নিরিখে সে ঈসায়ী মুসলমান। এ সব ঘটনা বিশ্লেষণে এ বিষয়টি প্রকাশ পায় যে, ধর্মান্তর ঘটানোর জন্য যে কৌশলেরই প্রয়োজন দেখা দিক, সুচতুরভাবে তা প্রয়োগে তার সদা তৎপর থাকে।

কৌশল ৪- মুসলিমুদ্দিন সানোয়ার নামে এক যুবককে(যিনি খৃষ্টানদের প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন) জিজ্ঞাসা করলাম, কিভাবে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন। সানোয়ার বললেন, আমি দুইবার মিশনারির প্রতারণার শিকারে পরিণত হয়েছিলাম। প্রথমবার শিকার হয়েছিলাম ১৯৮৭ সালে। বই পাঠে আমার প্রচণ্ড লোভ ছিল। একদিন একটি বইয়ে"পোস্ট বক্স নং" সংযুক্ত একটি ঠিকানা পেলাম। বইটি ছিল খৃষ্টান মিশনারির প্রকাশিত। আগে শুনেছি, খৃষ্টানদের চিঠি-পত্র লিখলে তারা প্রচুর বই পাঠায়। তাই কোন কিছু চিন্তা না করেই ঠিকানা অনুযায়ী পত্র লিখলাম। এর কিছুদিন পরই ডাক মারফত আমার ঠিকানায় বই আসলো, সাথে একটি প্রশ্নপত্র। প্রশ্নপত্রটি দেখে বুঝলাম, বইগুলো পড়ে উত্তর দিতে হবে। হাতে সময় মাত্র সাত দিন। অনেক খুঁজাখুঁজির পর উত্তরগুলো লিখে পাঠালাম। পরবর্তীতে তারা আমার কাছে ডাকে আরো কিছু বই ও প্রশ্নপত্র পাঠালো। তখন আমি এইচ.এস.সি. ১ম বর্ষের ছাত্র। উত্তর লিখে নির্ধারিত বক্স নাম্বারে পাঠানোর পর তারা আবার এক সেট বই, প্রশ্নপত্র, নাম্বার ও সনদপত্র পাঠালো।

তৃতীয়বারের প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্ন দেখে একটু বিব্রতবোধ করলাম। প্রশ্নটি ছিল এরূপ- আপনি কি যীশুকে রিযিকদাতা বলে বিশ্বাস করেন ? আমি জানতাম, এ প্রশ্নের উত্তরে যদি হ্যা বলি, তাহলে আরো বই আসবে, অন্যথায় বই পাঠানোর এ ধারা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ঈমানের দাবীকেই আমি অগ্রাধিকার দিয়ে প্রশ্নের উত্তরে "না" লিখে পাঠালাম।

কৌশল ৫- সেই সানোয়ার দ্বিতীয়বার মিশনারির শিকার হলেন। সানোয়ার বলেন, আমি চাকরি পাওয়ার জন্য একদিন ঢাকায় ১০৫/১৬ মনিপুরী পাড়ায় সিএলবি অফিসের ঠিকানায় উপস্থিত হলাম। পরিচয়পর্বের পর সেখানের এক কর্মকর্তা আমাকে খৃষ্টধর্ম সম্পর্কে বেশ ধারণা দিতে লাগলো এবং বিভিন্ন ছবি দেখিয়ে তার উক্তিগুলোর যুক্তি দিতে লাগলো। আমি নীরবে তার কথার সায় দিচ্ছিলাম। তার কথার সারমর্ম ছিল, যীশুই এ পৃথিবীর একমাত্র অভিভাবক। যীশুকে ছাড়া আল্লাহ'কে পাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমার ইতিবাচক অবস্থাদৃষ্টে"ধর্মান্তর করা যাবে" মর্মে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো। সেদিন অফিস থেকে বের হওয়ার সময় আমাকে ২১/২২ মার্চ ১৯৯৯ ইং সালে ট্রেনিংয়ে যোগদানের জরুরী আহবান জানিয়ে বিদায় নিলো। সম্ভবত ৯ই অক্টোবর ১৯৯৯ ইং সালের ঘটনা - একজন ফাদার আমাকে খৃস্টধর্মের বড়ত্ব সম্পর্কে দীর্ঘক্ষণ বুঝান। এরপর ধ্যানের আসনে বসিয়ে একটি বই থেকে কিছু পড়ালো, তখন আমার চোখ বন্ধ ছিলো। পড়া শেষে আমাকে বলা হলো, আপনি খৃষ্টান হয়ে গেছেন। এরপর খৃষ্টধর্মের স্বার্থকতা ও ইসলামধর্মের অসারতা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো। এক পর্যায়ে আমাকে বললো- মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যক্তি হিসেবে একজন সাধারণ মানুষ, ইসলামধর্মে তার কৃতিত্ব নেই। একমাত্র যীশুই সমস্ত কিছুর অধিকারী। যীশুর জন্ম না হলে এ পৃথিবীর জন্ম হতো না।

কৌশল ৬- মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়ার একটি বড় কৌশল হলো, মিশনারিতে ধর্মান্তরিত হলেও নাম রাখে মুসলমানদের, যাতে মুসলমানরা বুঝতে না পারে। যেমন, যশোর জেলায় ফাতেমা হাসপাতাল নামে একটি মিশনারি হাসপাতাল আছে। হাসপাতালের প্রবেশমুখে শ্বেতপাথরে খোদিত সুন্দর একটি সিনারী আঁকা, এতে মাদার তেরেসার সদলবলে একটি সাঁকো পার হওয়ার দৃশ্য। ছবির নিচে সুন্দর করে লেখা- যীশু পীড়িত মানুষকে সেবাদানের জন্য এভাবে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। ছবিটি হাসপাতালের প্রবেশ পথের সামনের দেওয়ালে এমনভাবে সাঁটানো যে, যে কোন দর্শনার্থী ও সেবাগ্রহীতা লোকের নজর কাড়ে। হাসপাতালের গেটম্যানের নাম মুহাম্মাদ সৈয়দ, মূলত এই লোকটি খৃষ্টান। তদ্রূপ হাসপাতালের এম. ডি. ও প্রধান ডাক্তারসহ প্রায় সবাই খৃষ্টান হলেও মুসলিম নাম ধারণ করেছে। যেমন, এম. ডি.র নাম মুহাম্মাদ বোখারী।

এই হাসপাতালের পিছনে একটি গির্জা আছে। গির্জা ও হাসপাতালের মাঝামাঝি একটি পার্ক আছে। এ পার্কে টিলার উপর কৃত্রিমভাবে নির্মিত বিশাল আকারের একটি নারীমূর্তি। এর সামনে কয়েকটি নারীমূর্তির হাঁটু গেঁড়ে প্রণাম করার দৃশ্য। কয়েকটি ভেড়া হা করে চেয়ে আছে বিশাল নারী মূর্তিটির দিকে। এর মধ্যে একটি ভেড়া অলস ঝিমুচ্ছে। রোগী ও দর্শনার্থীরা ঘুরে ঘুরে পার্কে স্থাপিত মূর্তিগুলোর লীলা উপভোগ করছে। রোগীদের একঘেয়েমী দূর ও চিত্ত-বিনোদনের জন্য এ ব্যবস্থা। পার্কে স্থাপিত মূর্তিগুলো দেখলে মনে হয় - এগুলো গির্জার মহিমা ফেরি করে বেড়ানোর জন্য রাখা হয়েছে। সে পার্কে মিশনারির নিযুক্ত লোক দর্শনার্থী ও রোগীদের কাছে মূর্তিগুলোর অবস্থা বিশ্লেষণ করে মেরীর মহিমা প্রচার করে। যেমন, দর্শনার্থীদের বা রোগীদের বুঝায় যে, টিলার বড় নারী মূর্তিটি হলো মেরী, যাকে মরিয়ম বলা হয়। আর প্রণামরত ছোট ছোট নারী মূর্তিগুলো হলো স্বর্গীয় দূত, যাদেরকে আপনারা ফেরেশতা বলেন। অর্থাৎ, মেরী কোন একসময় পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন স্বর্গীয় দূতেরা তাকে দেখে প্রণাম করছে আর ভেড়াগুলো ঘাস খাওয়া বিরতি দিয়ে মেরীকে দেখছে। একটি ভেড়া বেখেয়ালে ঝিমুচ্ছে। স্থানীয় একজন আলিম জানান, রোগীদের পার্কে ঘুরানোর সময় গির্জার নিযুক্ত লোকেরা চাতুর্যের সাথে মেরীর মূর্তি ও গির্জার প্রতি ভক্তিমূলক ইঙ্গিত-ইশারা করে রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনার প্রসঙ্গ তোলে। আর হাসপাতালের দেওয়ালে সাঁটানো যীশুর ছবি, সাঁকো পার হওয়া সংবলিত আর্ট, গ্রামে গ্রামে ঘুরে যীশুর রোগীসেবা ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের রোগীর বেডের আশেপাশে খৃষ্টধর্মের বিভিন্ন বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়, যেন অবসর সময়ে রোগী নিজ থেকে বই হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে। এভাবে সেখানে লোকজনকে ধর্মান্তরে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

 

মিশনারি কর্মীদের নির্লজ্জ কাহিনী

১৭-৮-৯৮ ইং তারিখে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত রিপোর্টের অংশবিশেষ উল্লেখ করা হলোঃ

পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ থানার লক্ষ্মীরাজ গ্রামে দুইজন মহিলাকে ধর্ষণের অভিযোগে নারী উন্নয়ন সংস্থা প্রধান আতাউর রহমানকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এ সময় ধর্ষিতারা জানান, গত ১লা আগস্ট প্রশিক্ষণের নামে ৯ জন মহিলাকে গ্রামের অফিস লক্ষ্মীরহাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাত যাপনে তাদেরকে বাধ্য করা হয়। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ হলে একটি কক্ষে তাদেরকে আটকে রাখা হয়। রাত আনুমানিক ১ টার দিকে প্রতিষ্ঠানের পিয়ন অনুখুল ও মহিলা কর্মচারী লায়লা খাতুন তাদেরকে জানায়, বড় সাহেব তোমাদের সাক্ষাৎকার নিবেন। তারপর একজন একজন করে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে অবস্থানরত কয়েকজন লোক তাদেরকে রাতভর ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর থেকে পরদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত ঐ ঘরে তাদেরকে আটকে রাখা হয়। ছেড়ে দেওয়ার আগে ঘটনাটি ফাঁস না করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন ভয়-ভীতি দেখানো হয়। পড়ে মহিলারা গ্রামে ফিরে নিজ নিজ অভিভাবককে জানালে এবং লোকমুখে ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল বের করে। সেদিন থেকে এ এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।

তথ্যপঞ্জি - দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নয়াদিগন্ত, দৈনিক করতোয়া, ধর্মান্তরের খোলা হাওয়া, দেশ জগত।

এ ধরনের বহু ঘটনা গ্রামবাংলায় ঘটছে। কোনটা পত্রিকার খবর হয়, আবার কোনটা হয় না। অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে এনজিওদের বর্বরতা চাপা দিয়ে রাখে।

 

দাওয়াতি কার্যক্রম

আজ খৃষ্টান মিশনারিরা নিষ্ঠার সাথে তাদের দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের আহবায়িত মানুষ হলো মুসলমান। তাই মুসলমানদের কাছে তাদের মিথ্যা দাওয়াত পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তাই তো দেখা যায় গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, অফিস-আদালতে তাদের দাওয়াত চলছে। এমনকি আমাদের মসজিদেও তাদের দাওয়াত চলছে।

আজ থেকে বছর খানেক আগের কথা। আমি তখন মধ্য বাড্ডায় নৈশ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করি। একদিন সকালে আমার এক ছাত্র এসে বললো, কে যেন একটি ইনজিল শরীফ রেখে গেছে। এভাবেই চলছে তাদের দাওয়াতি কার্যক্রম।

স্কুল-কলেজে তাদের দাওয়াত চলছে হ্যান্ডবিল ও বই-পত্রের মাধ্যমে। সেমিনারের মাধ্যমে বুঝানো হচ্ছে, ঈসায়ী ধর্মই হচ্ছে গুনাহ থেকে মুক্তির একমাত্র সহজ পথ। কিন্তু আমরা কয়জন অমুসলিমকে দাওয়াত দেই? কয়জন হিন্দুকে ইসলামের কথা বলি ? কয়জন খৃষ্টানকে আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিচয় বলি ? খৃষ্টানরা তো জীবন বাজী রেখে আমেরিকা, ইতালি ও লন্ডন থেকে বাংলাদেশে আসে ধর্মপ্রচার করতে। তারা চলে যাওয়ার জন্য আসে না, এদেশেই তাদের অন্তিম সমাধি হয়। তার ভুরি ভুরি ঘটনা রয়েছে। এখানে একটিমাত্র উল্লেখ করছি।

ফাদার হুমরিক নামক এক খৃষ্টধর্ম প্রচারক বাংলাদেশের ময়মনসিংহে দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত কর্মরত। তার প্রচেষ্টায় ৩০ হাজার গারো উপজাতি খৃষ্টান হয়েছে। আর আমি আপনি কয়জন অমুসলিমকে মুসলমান বানাতে পেরেছি ? এ দেশে তো কোন মুসলমান ছিল না। আমরা মুসলমান হয়েছি কিভাবে? আমাদের আকাবিরগণ এদেশে এসেছেন ইসলাম প্রচার করার জন্য, তারা প্রচার করে চলে যাননি। দেখুন, সিলেটে শাহজালাল ইয়ামানী, খান জাহান আলী, কারামত আলী জৈনপুরী প্রমুখ বুযুর্গানে দ্বীন আমৃত্যু এ দেশে ইসলাম প্রচারের কাজ আঞ্জাম দিয়ে গেছেন।

 

চিঠির মাধ্যমে দাওয়াত

আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অমুসলিম নেতাদের চিঠির মাধ্যমে দাওয়াত দিতেন। আপনিও সেই সুন্নাত আদায়ের লক্ষ্যে দেশের অমুসলিম এম.পি. মন্ত্রীকে চিঠির মাধ্যমে দাওয়াত প্রদান করতে পারেন। আপনার চিঠিটা পাওয়া তাদের হক।

ভেবে দেখুন, কিছু করতে পারেন কিনা।

 

করণীয়

খৃষ্টান মিশনারির ধর্মান্তরের শিকার হয়ে অনেক সাধারণ মুসলমান চিরদিনের জন্য সরলপথ হারিয়ে জাহান্নামী হচ্ছে। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রচার করে মুসলিম মনন-মস্তিস্ককে খৃষ্টবাদের ছাঁচে নেওয়ার কৌশল করছে। এমতাবস্থায় প্রিয় ছাত্রভাইদের কর্তব্য, মিশনারিগুলোর তৎপরতার অবগতি ও তা দূর করার পন্থা চর্চার মাধ্যমে তাদের খৃষ্টরাজ্য গড়ার স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করা এবং তাদের অপতৎপরতার গতিকে রুখে দেওয়া। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে কয়েকটি কাজ করা যেতে পারে -

(১) মিডিয়াঃ মিডিয়ার মাধ্যমে সত্যকে সত্য হিসেবে মানুষের সামনে তুলে ধরা, যাতে তারা মিডিয়ায় অপপ্রচার চালিয়ে ইসলামের ক্ষতি সাধনে ব্যর্থ হয়।

(২) রাজনীতিবিদদের সতর্ক করাঃ খৃষ্টান মিশনারিগুলো এ দেশের রাজনৈতিক ফিল্ড নিজেদের দখলে আনার জন্য রাজনীতিবিদদের মগজ ধোলাই কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। তারা নেতাদের কাছে উপঢৌকন ও উপহার পেশ করে নিজেদের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং অর্থ-কড়ির মাধ্যমে স্বার্থ হাসিলের জোর তৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে। এর উৎকৃষ্ট নজির জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ও ফতোয়া বিরোধী রায় বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা। তাদের এ ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে আমাদের উচিত রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সরকারী বেসরকারি সিনিয়র কর্মকর্তা ও সব শ্রেণীর লোকদের উক্ত বিষয়ে সরাসরি ও চিঠির মাধ্যমে সতর্ক করা।

(৩) লেখালেখিঃ আজ লেখালেখি ও প্রকাশনার দিক দিয়েও তারা পিছিয়ে নেই বরং একধাপ এগিয়েই আছে। খৃষ্টান মিশনারিগুলো মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বই লিখে প্রচার করছে। তার মধ্যে কয়েকটি বইয়ের নাম আমি আপনাদের সামনে পেশ করছি - "গুনাহগারদের জন্য বেহেশতের পথ" (এই নামটির শুরুতে আরবিতে লেখা - "ত্বারিকুল জান্নাতি লিল মুযনিবি"), বেলালের লেখা"আপনার জন্য আমার অন্তরের কথা", "গুনাহ থেকে মুক্তির পথ", "কুরআনের আলোকে জান্নাতের পথ" ইত্যাদি। এগুলো হলো মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে লেখা খৃষ্টানদের বই। কিন্তু আফসোসের সাথে বলতে হয়, খৃষ্টানদের উদ্দেশ্যে কিংবা হিন্দুদের উদ্দেশ্যে লেখা কয়টি বই আছে আমাদের ?

আমার ভাই, আমাকে একটি বই দেখান যে, এই বইটি খৃষ্টানদের উদ্দেশ্যে লিখে তাদের মাঝে প্রচার করা হচ্ছে।

ভাই আমার, উঠুন, জাগুন, প্রতিজ্ঞা করুন আর টার্গেট বানান যে, আপনিও কিছু লিখবেন। অমুসলিমদের উদ্দেশ্যে লিখবেন আর তাদের কাছে প্রচার করবেন। (নোটঃ এ বিষয়ে বেশ কিছু আলিমের লিখিত বই রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম একটি বইয়ের নাম আর্টিকেলের শেষে উল্লেখ করা হলো) আজ তারা আমাদের দেশের লেখকদের কিনে নিয়েছে আর তাদেরকে ভ্রান্ত মতবাদটি বুঝাতে সচেষ্ট হয়েছে এবং বড় বড় লেখকদের কলম থেকে তাদের মতবাদ ও দাওয়াত প্রচার করাচ্ছে। আমরা কি কখনো সেই কলামিস্টদের কাছে গিয়েছি ? ইসলামের হক্কানিয়াত তাদের সামনে উপস্থাপন করেছি? আমরা কি তাদের বুঝিয়েছি যে, আখিরাতের ফিকির করে, ভবিষ্যৎকে চিন্তা করে আপনাকে ইসলামের পক্ষে লিখতে হবে ? উত্তর যদি "না" হয়, তাহলে তাদের কাছে কে যাবে ? কারা তাদেরকে বুঝাবে? তাদের কাছে কি দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য আসমান থেকে কোন ফেরেশতা আসবে ? না বন্ধু, না। আমাকে-আপনাকেই যেতে হবে।

উঠুন বন্ধু, আর কতোদিন ঘুমিয়ে থাকবেন, ঘুমিয়ে থাকার আর সময় নেই।

 

উলামায়ে কেরামের করণীয়

উলামায়ে কেরাম হলেন ধর্মীয় অভিভাবক। আর ধর্মীয় অভিভাবকদের দায়িত্ব তো আরো বেশী। ছকে বাঁধা দ্বীনি খেদমতে আবদ্ধ হয়ে থাকা তাদের শান নয়। সমাজের গভীরে অনুপ্রবেশকারী মিশনারি ও তাদের তাবেদার এনজিওদের অপতৎপরতার প্রতি সুতীক্ষ্ণ নজর রাখা তো তাদের ফরয কর্তব্য।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লক্ষ কোটি উম্মত সমাজের মিশন-আখড়ায় বন্দী হয়ে খৃষ্টান জগতে পাচার হয়ে চিরতরে জাহান্নামে ঝাঁপ দিচ্ছে- এ নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা থাকা প্রয়োজন। যারা দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে অহর্নিশ মানবেতর জীবন যাপন করছে, যাদের রোগে শোকে সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই, তাদের পাশে দাঁড়াবার মানসিকতা গড়ে উঠা আজ সময়ের দাবী।

কতো ভালো হতো, যদি উলামায়ে কেরাম নিন্ম বর্ণিত বিষয়ের প্রতিও মনোযোগী হতেন-

(১) সরাসরি খৃষ্টানদের দাওয়াত দেওয়া, বিশেষ করে যারা খৃষ্টধর্মের প্রচারক।

(২) ব্র্যাক, আশা ইত্যাদি স্কুলের মোকাবেলায় মসজিদে মসজিদে মক্তব প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রতিটি গ্রামে একটি করে ইসলামিক কিন্ডারগার্ডেন স্কুল কায়েম করা।

(৩) ব্র্যাক স্কুল, আনন্দ স্কুল ইত্যাদি স্কুলে মুসলমান বাচ্চাদের ইসলামী শিক্ষা দেওয়ার জন্য ধর্মীয় শিক্ষকের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা।

(৪) অমুসলিমদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছাত্রদেরকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করা।

 

ব্যবসায়ী ও বিত্তবানদের করণীয়

আল্লাহ আপনাদের অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন আল্লাহ'র রাস্তায় খরচ করার জন্য। আজ খৃষ্টানরা যদি তাদের আয়ের ১০ ভাগের ১ ভাগ তাদের মিথ্যা ধর্ম প্রচারের জন্য খরচ করতে পারে, তাহলে আমরা কেন আমাদের সত্য ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে খরচ করতে পারবো না। আমাদের তো বরং দ্বীন প্রচারের জন্য প্রয়োজনে সমস্ত সম্পদ ব্যয় করার মন-মানসিকতা থাকতে হবে।

 

চট্টগ্রামের উলামায়ে কেরামদের প্রতি আমার আবেদন

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এই অঞ্চলকে "মাদখালুল ইসলাম" বা ইসলামের প্রবেশ পথ বলা হয়। এই পার্বত্য এলাকায় বাস করে ৪৫ টি জাতি গোষ্ঠীর প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ। এতো কাছে হওয়া সত্ত্বেও বিশাল এই হিল বেল্টে আমরা ইসলামের আলো পৌঁছাতে পারিনি। অথচ সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে খৃষ্টান মিশনারিগুলো এদেশে এসে পাহাড়ের ভিতরে জঙ্গলের গভীরে গিয়ে এগুর্ণা, চাকমা, মারমা, তনচৈঙ্গা, চাক, ক্ষুমি, ভৌম ইত্যাদি উপজাতির হাজার হাজার মানুষকে খৃষ্টান বানিয়েছে। সেখানে মসজিদ তৈরি হওয়ার পূর্বে খৃষ্টানদের গির্জা তৈরি হয়েছে। কি আশ্চর্য! চট্টগ্রামের মুসলমান যারা দাঈ ইলাল্লাহ হিসেবে পরিচিত তাদের চোখের সামনেই উপজাতি ভাইদেরকে - যাদের কোন ধর্ম নেই, মিশনারিরা খৃষ্টান বানিয়ে ফেলছে। বলতে হবে, এটা আমাদের ব্যর্থতা। পাহাড়ের ভিতর খৃষ্টানরা স্কুল বানিয়ে, ঘর নির্মাণ করে, খাদ্য দিয়ে তাদেরকে বিনামূল্যে অন্ন, শিক্ষা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা মাদ্রাসা ঘেঁষে আরেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করছি, কিন্তু পাহাড়ের মধ্যে কোনদিন একটি মাদ্রাসা বানানোর উদ্যোগ নেইনি। আল্লাহ পাক আমাদেরকে এই ফিকির নিয়ে এগিয়ে আসার তাওফিক দান করুন, আমীন।

 

মাওলানা মুফতী যুবায়ের

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও দাঈ

সূত্রঃ পয়গামে সুন্নত ১৪৩১-৩২ হিজরি

 

আর্টিকেলটি নেওয়া হয়েছে এই বই থেকে - মুসলিম বিশ্বে ইহুদী খৃষ্টানদের মরণ ছোবল

 

আল্লাহ এই বইটির সংকলক ও সম্পাদক মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী এবং এই কাজের সাথে জড়িত সকলকে দুনিয়া ও আখিরাতে হাসানাহ দান করুন, আমীন।

 

আলিমগণ কর্তৃক রচিত এ সম্পর্কিত বেশ কিছু ভালো কিতাব রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত কিতাব ইযহারুল হক, শায়খ আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর রচিত পবিত্র বাইবেল পরিচিতি ও পর্যালোচনা ইত্যাদি বই।

 

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-3z

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সাহাবায়ে কেরামের প্রতি আল্লাহ তাআলার সতর্কতা প্রদান এবং পরবর্তীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা

 

 

The Greatest Nation·Thursday, August 29, 2019

 

 

 

بِسْمِ اللَّـهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ

أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّـهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ ۖ وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ

 

আয়াতের অনুবাদ

"যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় ভক্তি-বিগলিত হওয়ার সময় কি আসেনি, আল্লাহ'র স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ? এবং পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিলো তাদের মতো যেন তারা না হয়, - বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে পড়েছিলো, আর তাদের অধিকাংশ লোকই হলো ফাসিক।" (সূরাহ আল-হাদীদ, ৫৭ : ১৬)

 

পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে সম্পর্ক

পূর্ববর্তী আয়াতে হাশরের ময়দানের কিছু অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যে, মুনাফিকরা অন্ধকারে আচ্ছন্ন অবস্থায় অস্থির হয়ে মুমিনদেরকে ডাকবে আর বলবে, আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা করুন, আমরা আপনাদের আলোতে চলবো। কিন্তু তাদেরকে এর অনুমতি দেওয়া হবে না, কেয়ামতের ময়দানে যে নূর বা আলো পাওয়া যাবে তা হবে আল্লাহ পাকের প্রতি ঈমান ও আনুগত্যের আলো, যারা দুনিয়াতে ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং আল্লাহ পাকের হুকুম পালনে গাফলত করেছে, তারা ঈমানের নূর থেকে বঞ্চিত হবে।

আর এ আয়াতে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে যে, তোমরা কাফির ও মুনাফিকদের ন্যায় গাফলতের আবর্তে নিপতিত হয়ো না, যদি দুনিয়াতে এ সম্পর্কে গাফলত করা হয়, তবে আখিরাতে ঈমানের নূর থেকে বঞ্চিত হতে হবে। আর এ কথাও সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে, ইতিপূর্বে যাদের প্রতি আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে তথা ইয়াহুদী-নাসারারা দুনিয়ার জীবনের আনন্দ-উল্লাসে অতিবাহিত করেছে, আর এ অবস্থায় সুদীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়, পরিণতিতে তাদের ঈমান, তাকওয়া-পরহেযগারী এবং আল্লাহ পাকের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার সকল যোগ্যতা তারা হারিয়ে ফেলে। (তাফসীরে নুরুল কুরআন)

 

শানে নুযূল

(১) আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণনা করেন, ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন,

কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর তের বছরের মাথায় আল্লাহ তাআলা মুমিনদের হৃদয় কুরআনের প্রতি আকৃষ্ট না হওয়ার ব্যাপারে বিলম্ব হওয়ার অভিযোগ তুললেন আর বললেনঃ أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا

(ইবনে কাসির)

 

(২) ইমাম মুসলিম রহ. .... ইবনে মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণনা করেন, ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন,

আমাদের ইসলাম গ্রহণের চার বছর পর আল্লাহ তাআলা -

أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا

- এই আয়াত নাযিল করে আমাদেরকে তিরস্কার করলেন।

ইমাম নাসাঈ ও ইবনে মাজাহও হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। (ইবনে কাসির)

 

(৩) সুফিয়ান সওরী রহ. মাসউদী-এর মাধ্যমে কাসিম রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, কাসিম বলেন,

সাহাবাগণ একদিন আবেদন করলেন যে, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাদেরকে কিছু বলুন। তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেন (যার অনুবাদ) -

"আমরা আপনার কাছে সর্বোত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি ....." (সূরাহ ইউসুফ, আয়াত নং ৩)

এর কয়েকদিন পর সাহাবগণ আবারো বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাদেরকে কিছু বলুন। তখন আল্লাহ তাআলা নাযিল করেন এই আয়াতটি (যার অনুবাদ) -

"আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন সর্বোত্তম কথা ....." (সূরাহ আয-যুমার, আয়াত নং ২৩)

কিছুদিন পর সাহাবগণ অনুরূপ আবেদন করলে তখন আল্লাহ এই আয়াতটি অবতীর্ণ করেন -

أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا

(ইবনে কাসির)

 

(৪) ইবনে মুবারক রহ. তার"কিতাবুয যুহদ"-এ সুফয়ান রহ. এর সূত্রে আমাশ রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন,

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ যে আর্থিক সংকট ভোগ করছিলেন, মদিনায় আসার পর তারা কিছুটা সচ্ছলতা লাভ করেন, সেই সঙ্গে ইতঃপূর্বে তাদের যে উদ্যম-উদ্দীপনা ছিলো, তার খানিকটা তারা হারিয়ে ফেলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। (তাফসিরে মাজহারী)

 

তাফসীর

 

"যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় ভক্তি-বিগলিত হওয়ার সময় কি আসেনি, আল্লাহ'র স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ?"

 

আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় শাদ্দাদ ইবনে আউস রাঃ একটি হাদিস বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "মানুষের হৃদয় থেকে সর্বপ্রথম খুশু তথা বিনয়-নম্রতা উঠিয়ে নেওয়া হবে।" (ইবনে কাসির)

خشوع قلب -

এর অর্থ অন্তর নরম হওয়া, উপদেশ কবুল করা ও আনুগত্য করা। (ইবনে কাসির)

 

কুরআনের প্রতি অন্তর বিগলিত হওয়ার অর্থ এর বিধান তথা আদেশ ও নিষেধ পুরোপুরি পালন করার জন্য প্রস্তুত হওয়া এবং এ ব্যাপারে কোন অলসতা বা দুর্বলতাকে প্রশ্রয় না দেওয়া। (রুহুল মাআনী)

 

সাইয়েদ কুতুব এ আয়াতাংশ সম্পর্কে লিখেছেনঃ

পরম দয়ালু ও পরম করুণাময় মনিবের পক্ষ থেকে এটি একটি কার্যকর তিরস্কার। যে অন্তরগুলোর উপর তিনি তার অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন, তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহ'র আহবানে পরিপূর্ণরূপে সাড়া দিতে বিলম্ব হওয়ায় এখানে খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। কেননা, তাদের কাছে তিনি রাসুল প্রেরন করেছেন, যেন তিনি তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের উপর ঈমান আনার দাওয়াত দেন, তাদের অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের উপর সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল করেছেন এবং সৃষ্টিজগতে তার এমন সব নিদর্শন তাদের প্রত্যক্ষ করিয়েছেন, যা সতর্কীকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণে সক্ষম।

এ তিরস্কার স্নেহ মিশ্রিত, উদ্বুদ্ধকারী, আল্লাহ'র মহত্ত্ব উপলব্ধি করার প্রেরনা সঞ্চারক, তার স্মরণে উৎসাহদানকারী এবং যে মহাসত্য নাযিল হয়েছে তা যথোপযুক্ত ভীতি ও আত্মসমর্পণের মনোভাব নিয়ে গ্রহণের আগ্রহ সঞ্চারক। কিছুটা নিন্দা ও ক্ষোভের ভাব সহকারে প্রশ্ন করা হয়েছে। (ফি যিলালিল কুরআন)

 

"এবং পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিলো তাদের মতো যেন তারা না হয়, - বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে পড়েছিলো, আর তাদের অধিকাংশ লোকই হলো ফাসিক।"

 

ইমাম ইবনে কাসির লিখেছেনঃ

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী আহলে কিতাব ইয়াহুদি ও নাসারাদের ন্যায় হতে নিষেধ করেছেন, যারা আল্লাহ'র কিতাবকে (তাওরাত ও ইঞ্জিল) বিকৃত করে স্বল্প মূল্যে ওটা বিক্রি করে সর্বোপরি ওটাকে উপেক্ষা করে নানা ধরণের মনগড়া মতবাদের অনুসরণ করতে শুরু করেছে। আর আল্লাহ'কে বাদ দিয়ে তাদের আহবার রুহবানদের অনুসরণ করতে শুরু করেছে। ফলে তাদের অন্তর পাষাণ হয়ে সত্য গ্রহণ করার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখন ওদের অধিকাংশই দুষ্কর্ম পরায়ণ ফাসিক।

 

ইবনে আবু হাতিম রহ. ..... আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

বনী ইসরাইলের নিকট আসমানি কিতাব নাযিল হওয়ার পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। তাদের অন্তর পাষাণ হয়ে যায় এবং তারা আসমানি কিতাবের পরিবর্তে নিজেদের চাহিদা, রুচি ও স্বার্থ অনুযায়ী কিতাব আবিস্কার করে নেয়। এবং তারা পরস্পর এই পরিকল্পনা করে যে, চল আমরা বনী ইসরাইলদেরকে আমাদের এই কিতাব অনুসরণ করার আহবান জানাই। ফলে যে এটা অনুসরণ করবে তাকে আমরা ছেড়ে দিবো আর যারা এটা প্রত্যাখ্যান করবে তাকে হত্যা করবো। কার্যত তারা ওটাই করলো।

তাদের মধ্যে একজন বিজ্ঞ আলিম ছিলো। তিনি এই অধঃপতন দেখে সঠিক আসমানী কিতাবের মাসায়েল এই একটি সূক্ষ্ম বস্তুতে লিপিবিদ্ধ করে একটি শিংয়ের মধ্যে পুরে গলায় ঝুলিয়ে রাখেন।

কিতাব বিকৃতকারীরা বিপুল সংখ্যক হত্যাযজ্ঞ চালাবার পর একে অপরকে পরামর্শ দিলো যে, হত্যাকাণ্ড তো বহু করলাম। এবার চলো, অমুক ব্যক্তির নিকট গিয়ে আমাদের মতবাদ গ্রহণ করার আহবান জানাই। যদি সে মেনে নেয়, তা হলে তার দেখাদেখি অন্যরাও মেনে নিবে, আর যদি অস্বীকার করে তো তাকে হত্যা করে ফেলবো।

তারপর তারা সেই বিচিত্র লোকটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি আমাদের এই কিতাবে যা আছে ওটা বিশ্বাস করেন ? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটাতে কি আছে ? তখন তারা কিতাবটি পাঠ করে শুনায়। তখন তিনি গলায় ঝুলন্ত সঠিক কিতাবের প্রতি ইংগিত করে বললেন, হ্যাঁ, আমি এটা বিশ্বাস করি। উত্তর শুনে তারা তাকে ছেড়ে দেয়।

কিছুদিন পর লোকটি মৃত্যুবরণ করে। তখন মৃত্যুর পর দুষ্কৃতিকারীরা তল্লাশী চালিয়ে শিংয়ের মধ্যে সংরক্ষিত আসমানী কিতাবের অবিকৃত কপিটি খুঁজে পেলো। এটির পর বনী ইসরাইলরা বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়ে যায়। তারমধ্যে শিংয়ের মধ্যে সংরক্ষিত সঠিক কিতাবের অনুসারীরাই সর্বোত্তম দল। এই হলো আহলে কিতাবদের আসমানী কিতাব বিকৃতির সংক্ষিপ্ত কাহিনী।

 

আবু জাফর তাবারী রহ. ইব্রাহীম রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, ইব্রাহীম রহ. বলেন,

ইরতীস ইবনে উরকূব রহ. ইবনে মাসউদ রাঃ এর নিকট গিয়ে বললেন, হে আবু আবদুল্লাহ, ধ্বংস সেই ব্যক্তির, যে সৎ কাজের আদেশ দিলো না এবং অন্যায় কাজে বাঁধা প্রদান করলো না।

উত্তরে ইবনে মাসউদ রাঃ বললেন, ধ্বংস সেই ব্যক্তির যার অন্তর সৎ কর্মকে সৎ বলে এবং অন্যায়কে অন্যায় বলে বিশ্বাস করে না।

এই বলে তিনি উপরোক্ত কাহিনীটি বর্ণনা করেন। (ইবনে কাসির)

 

শাব্বির আহমাদ উসমানী লিখেছেনঃ

অর্থাৎ, ঈমান হলো অন্তর বিনম্র হওয়া, নসিহত ও আল্লাহ'র যিকিরের প্রভাব দ্রুত গ্রহণ করা। পূর্বে আহলে কিতাবগণ তাদের নবীদের সাহচর্যে এগুলো অর্জন করতো। দীর্ঘদিন পর তাদের মধ্যে উদাসীনতা এসে যায়, অন্তর কঠিন হয়ে পড়ে এবং পূর্বের অবস্থা বহাল থাকেনি। এরপর তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোক জঘন্য বিদ্রোহী ও নাফরমানী শুরু করে দিলো। এখন মুসলমানদের পালা। তাদের জন্য সময় এসেছে নিজেদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য থেকে অন্তরের নম্রতা পরিপূর্ণ, আনুগত্য, আল্লাহ'র যিকিরে বিনীত হওয়া ইত্যাদি গুণে যেন তারা গুণান্বিত হয় এবং সেই সুউচ্চ স্তরে উন্নীত হয় যে স্তরে কোন উম্মত উন্নীত হতে পারেনি। (তাফসীরে উসমানী)

 

মাওলানা আশরাফ আলী থানভী লিখেছেনঃ

অর্থাৎ, ইয়াহুদী-নাসারা যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিলো তারা দীর্ঘকাল আল্লাহ পাকের নাফরমানীতে লিপ্ত থাকলো এবং তাওবা করলো না। ফলে তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেলো এবং ফাসিক ও কাফিরে পরিনত হলো। (বয়ানুল কুরআন)

 

সাইয়েদ কুতুব লিখেছেনঃ

উদ্বুদ্ধ করা ও ক্ষোভ প্রকাশ করার পাশাপাশি সত্য গ্রহণে শৈথিল্য ও বিলম্ব প্রদর্শন থেকে সতর্কও করা হয়েছে, দীর্ঘকালব্যাপী এই শৈথিল্য প্রদর্শনে মানব হৃদয়ে যে মরিচা পড়ে ও আল্লাহ'র স্মরণে ক্রমাগত উদাসীনতা এবং সত্য গ্রহণে আগ্রহী না হওয়ার কারণে হৃদয়ে যে কঠোরতার সৃষ্টি হয়, এখানে তারও বিবরণ দেওয়া হয়েছে,

"এবং পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিলো তাদের মতো যেন তারা না হয়, - বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে পড়েছিলো, আর তাদের অধিকাংশ লোকই হলো ফাসিক।"

হৃদয় কঠিন হওয়ার পিছনে আল্লাহ'র অবাধ্য ও বিদ্রোহী হওয়া ছাড়া আর কোন কারণ নেই।

মানব হৃদয় দ্রুত পরিবর্তনশীল ও দ্রুত বিস্মৃতিপ্রবণ। এই হৃদয় যতক্ষণ স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল থাকে, ততক্ষণ তা হেদায়াতের আলো দ্বারা উপকৃত হয় ও উজ্জ্বলতর হয়, কিন্তু যখন তাকে আখেরাতের কথা ও তাকওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় না এবং সেও তা স্মরণ করে না, আর এই অবস্থায় দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে যায়, তখন তা কঠিন পাষাণের মতো হয়ে যায়, তার স্বচ্ছতা ও ঔজ্জ্বল্য অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। তাই এই হৃদয়কে সবসময় আখেরাতের কথা ও আল্লাহভীতির কথা স্মরণ করাতে থাকা উচিত যাতে সে আল্লাহ'র অনুগত ও বিনত হয়, তার উপর ক্রমাগত করাঘাত করতে থাকা উচিত, যাতে তা স্বচ্ছতা লাভ করে ও তার মরিচা ঝরে যায়। সর্বদা তাকে সজাগ ও সতর্ক করা উচিত, যাতে তা কঠিন ও পাষাণ না হয়ে যায়।

তবে যদি কোন হৃদয় কঠিন ও পাষাণ হয়েই যায়, তবে হতাশ হওয়া অনুচিত। কেননা, সেই পাষাণ হৃদয়ও সজীব হয়ে উঠতে পারে, তা হেদায়াতের জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে যেতে পারে এবং তা আল্লাহ'র স্মরণে বিগলিত হয়ে যেতে পারে। কেননা, আল্লাহ তাআলা তো নির্জীব মাটিতেও প্রাণ সঞ্চার করে থাকেন। আল্লাহ'র দেওয়া উজ্জিবনী শক্তিতে তা উজ্জীবিত হয়ে থাকে, তাতে ফল ও ফুল ফোটে এবং প্রাণীকুলকে খাদ্য যোগায়। অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলা যখন ইচ্ছা করেন তখন মৃত হৃদয়গুলোকেও পুনরুজ্জীবিত করেন। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ কথাই বুঝিয়েছেন ....." (ফি যিলালিল কুরআন)

 

তাফসীরে বুরহানুল কুরআনে এ আয়াতের শিক্ষা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছেঃ

আয়াত থেকে প্রমানিত হয়, মানুষ অনেক সময় গুনাহকে সাধারণ মনে করে এবং গুনাহ করার পর তাওবা করে না। ফলে ধীরে ধীরে তার অন্তর কঠিন হয়ে যায় এবং সে ঈমান থেকেই বঞ্চিত হয়ে পড়ে। বনী ইসরাইলের বেলায় এরূপ ঘটেছিলো। উম্মতে মুহাম্মাদীর বেলায় যেন সেরূপ না হয়।

 

মুহাম্মাদ শফী লিখেছেনঃ

মোটকথা, এই হুঁশিয়ারির সারমর্ম হচ্ছে মুসলমানদেরকে পুরোপুরি নম্রতা ও সৎ কর্মের জন্য তৎপর থাকার শিক্ষা দেওয়া এবং এ কথা ব্যক্ত করা যে, আন্তরিক নম্রতাই সৎ কর্মের ভিত্তি। (মাআরেফুল কুরআন)

 

(তাফসীর শেষে কিছু কথাঃ

একজন সাহাবী বলেছিলেন, কুরআন নাযিল হয়েছে আমলের জন্য, কিন্তু লোকেরা কুরআন তিলাওয়াতকেই একমাত্র আমল বানিয়ে নিয়েছে।

সুতরাং এই আয়াত কেবল তিলাওয়াত করে গেলেই এই আয়াতের হক আদায় হবে না, এই আয়াতের তাফসীর কেবল পড়ে গেলেই এই আয়াতের হক আদায় হবে না, এই আয়াতের হক তখনই আদায় হবে যখন আমরা এই আয়াত থেকে শিক্ষা নিয়ে ইখলাসের সাথে সুন্নতের অনুসরণে আমল করার জন্য কপটতাবিহীন ও আন্তরিক চেষ্টা করে যাবো।

আল্লাহ তাআলা সম্মানিত সাহাবাদের কারো কারো সামান্য উদ্যমহীনতা দেখেই আয়াত নাযিল করলেন - এটা শুধু তাদের প্রতিই সতর্কতা প্রদান নয়, বরং পরবর্তীদের জন্যও রয়েছে সতর্কতা। এই সতর্কতা বিভিন্নভাবে রয়েছে কুরআনের আরো আয়াতে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসেও। আর সাহাবায়ে কেরামের উদ্যমহীনতা আমাদের নিকৃষ্ট ও জঘন্য উদ্যমহীনতার মতো নয়, এটাও মনে রাখতে হবে।

সুতরাং কি হবে যদি আমরা আমাদের এই চরম গাফিলতিতে থাকা অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করি ?

তাকে বা তাদেরকে বলে দেওয়ার দরকার নেই, নিজের নফসকেই বলি -

হে নফস, হে আমার প্রতারক নফস, হে আমার নিকৃষ্ট নফস, ধ্বংস তোর জন্য যদি তুই ইখলাসের সাথে তাওবা-ইস্তেগফার করে তোর রব্বে কারীমের প্রতি ফিরে না যাস।

ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাকে আশ্রয় দান করুন আমার নিকৃষ্ট নফসের সোহবত থেকে, আমীন।

ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাকে তাওফিক দান করুন আপনার দিকে এমনভাবে দৌড়ে যাওয়ার, যেভাবে দৌড়ে যেতে দেখে আপনি আপনার গোলামের উপর সন্তুষ্টির হাসি হেসে দিবেন, আমীন।)

 

গ্রন্থপঞ্জীঃ

(১) তাফসীরে ইবনে কাসির - ইমাম ইবনে কাসির।

(২) তাফসীরে উসমানী - শাব্বির আহমাদ উসমানী।

(৩) তাফসিরে মাজহারী - কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী

(৪) তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন - মুহাম্মাদ শফী।

(৫) তাফসীরে বুরহানুল কুরআন - মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলাআ হেমায়েত উদ্দীন সহ আরো বেশ কয়েকজন আলেম।

(৬) তাফসীরে নুরুল কুরআন - মাওলানা মুহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম।

(৭) ফি যিলালিল কুরআন - সাইয়েদ কুতুব।

 

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-5B

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দৃষ্টি সংযত রাখার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা

 

 

 

The Greatest Nation·Friday, August 30, 2019

 

 

 

 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন,

"(হে নবী) আপনি মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজাস্থানের হিফাযত করবে। এটিই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয়ই তারা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।" (সূরাহ আন-নূর, আয়াত ৩০)

অতএব আল্লাহ পবিত্রতা ও আত্মিক উন্নয়নকে দৃষ্টি সংযত রাখার এবং লজ্জাস্থান হিফাযত করার প্রতিদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ নিষিদ্ধ বস্তু থেকে নিজের দৃষ্টি সংযত করার ফলে তিনটি উপকার হয় যেগুলো ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত মূল্যবান।

 

প্রথমতঃ ঈমানের মধুরতা আস্বাদন করা

যে ব্যক্তি আল্লাহ'র ভয়ে দৃষ্টি সংযত রাখে, তার কাছে ঈমানের সুমিষ্ট মাধুর্য এবং তা থেকে পাওয়া আনন্দ, নিষিদ্ধ বস্তু দেখে পাওয়া আনন্দের চেয়ে অনেক বেশী মনোহর। বস্তুত কেউ যদি আল্লাহ'র সন্তুষ্টির জন্য কোনকিছু পরিত্যাগ করে, তবে আল্লাহ আরো উত্তম কিছুর দ্বারা সেটির প্রতিস্থাপন করেন।

প্রবৃত্তি হলো নিষিদ্ধ কাজে প্রলুব্ধকারী এবং সুন্দর অবয়ব দেখতে ভালোবাসে। আর চোখ হলো হৃদয়ের দিশারী। হৃদয় তার দিশারীকে কোথায় কি আছে, তা খুঁজে দেখার দায়িত্ব দিয়ে বলে, "যাও! দেখো কোথায় কি আছে।" চোখ যখন সুন্দর কোন দৃশ্যের খবর দেয়, হৃদয়ে তখন তা পাওয়ার জন্য ভালোবাসার শিহরণ এবং আকাঙ্ক্ষা জাগে। হৃদয় এবং চোখের এই অভ্যন্তরীণ দোলাচল উভয়কেই অনবরত ক্লান্ত করে থাকে। যেমনটি বলা হয়েছে -

চোখকে যেদিন দিশারী বানিয়ে করালে সন্ধান,

তোমার চোখের লক্ষ্যবস্তু তোমায় করলো হয়রান,

এমন কিছু দেখলে যাতে ছিলো না নিয়ন্ত্রণ,

আংশিকও নয়, নয় পুরোপুরিও; বরং তোমার জন্য উত্তম ছিলো ধৈর্যধারণ।

কাজেই দৃষ্টিকে যখন কোন কিছু দেখা এবং নিরীক্ষণ করা থেকে সংযত রাখা হয়, হৃদয়ও তখন নিরর্থক অনুসন্ধান আর কামনার মতো ক্লান্তিকর কাজ থেকে বিশ্রাম পায়।

যে ব্যক্তি নিজের দৃষ্টিকে অবাধে বিচরণের সুযোগ দিবেন, তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে অবিরাম ক্ষতি এবং নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার মাঝে আবিস্কার করবেন। কারণ দৃষ্টিপাত থেকেই ভালোবাসার (মুহাব্বাত) জন্ম হয়, যার সূচনা হয় চোখ যা দেখেছে তার প্রতি মোহাবিষ্ট ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ার মাধ্যমে। এই ভালোবাসা ক্রমেই আকুল আকাঙ্ক্ষায় (صبابة) পরিণত হয়, যার দ্বারা হৃদয় তার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি অসংশোধনীয় মাত্রায় মোহাবিস্ট এবং নির্ভরশীল হয়ে যায়। এর মাত্রা বেড়ে আসক্তির (غرام) রূপ নেয়। এ আসক্তি এমন এক শক্তি যা আসক্ত ব্যক্তির পেছনে তেমনিভাবে লেগে থাকে, যেভাবে কোন পাওনাদার ঋণ পরিশোধের জন্য ঋণীর পেছনে লেগে থাকে। এই আসক্তি আরো বাড়তে থাকে এবং প্রেমাসক্তির (عشق) রূপ নেয় যা সকল প্রকার সীমা ছাড়িয়ে যায়। সবশেষে এর মাত্রা বেড়ে প্রেমোন্মাদনার (شغف) জন্ম হয় যা হৃদয়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকেও বেস্টন করে ফেলে। এ প্রেমোন্মাদনা ক্রমেই আনুগত্যের ভালোবাসায় (التتيم) রূপ নেয়। তাতাইয়্যুমের অর্থই হলো ইবাদাত। যখন বলা হয়, تيم الله তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, সে আল্লাহ'র ইবাদাত করেছে।

এভাবেই হৃদয় এমন কিছুর উপাসনা করা শুরু করে যার উপাসনা করা সমীচীন নয়। আর এসব কিছুর পেছনে একমাত্র কারণ একটি নিষিদ্ধ দৃষ্টিপাত। যে হৃদয় পূর্বে ছিলো মনিব, তা এখন শিকলাবদ্ধ; যা ছিলো মুক্ত ও স্বাধীন, তা এখন কারারুদ্ধ। এ হৃদয় চোখের দ্বারা নির্যাতিত এবং চোখের কাছে অভিযোগ করলে চোখ এখন বলে, "আমি তোমার দিশারী এবং আজ্ঞাবাহক। প্রথমে তুমিই আমাকে পাঠিয়েছিলে।" এখানে যা কিছু বলা হলো, তার সবই এমন সব হৃদয়ের জন্যই সত্য, যেসব হৃদয় আল্লাহ'র প্রতি ভালোবাসা ও একনিষ্ঠতাকে পরিত্যাগ করেছে। কারণ ভালোবাসার জন্য হৃদয়ের এমন কিছু চায়, যার প্রতি হৃদয় নিজেকে নিবেদিত রাখতে পারে। সে কারণেই, হৃদয় যখন শুধুমাত্র আল্লাহ'কে ভালোবাসে না এবং শুধু তাকেই উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে না, তখন নিশ্চিতভাবে সে অন্যকিছুর উপাসনায় লিপ্ত থাকে। আল্লাহ ইউসুফ আঃ সম্পর্কে বলেন,

"এভাবেই যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট ও অশ্লীলতা দূর করে দেই। নিশ্চয়ই যে আমার নিষ্ঠাবান বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।" (সূরাহ ইউসুফ, আয়াত ২৪)

আযীযের স্ত্রী একজন বিবাহিতা নারী হওয়া সত্ত্বেও তার হৃদয়ে প্রেমাসক্তি প্রবেশ করেছিলো। কারণ সে ছিলো মুশরিকা। অন্যদিকে ইউসুফ আঃ যুবক, অবিবাহিত ওবং গোলাম হওয়া সত্ত্বেও সে অপকর্ম থেকে তাকে রক্ষা করা হয়েছিলো। কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহ'র একনিষ্ঠ গোলাম।

 

দ্বিতীয়তঃ আলোকিত হৃদয়, স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি

আবু সুজা আল-কিরমানী বলেছেন, "যে ব্যক্তি নিজের বাহ্যিক অবয়বকে সুন্নাহ'র আদলে এবং অভ্যন্তরীণ সত্ত্বাকে সর্বদা আল্লাহ'র চিন্তা-গবেষণা এবং তার সচেতনতার আলোকে গড়ে তোলে, নিজের আত্মাকে প্রবৃত্তির অনুসরণ করা থেকে এবং নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দৃষ্টিকে সংযত রাখে, সর্বদা হালাল রুজি ভক্ষণ করে, সে ব্যক্তির উপলব্ধি এবং অন্তর্দৃষ্টি কখনোই ভুল হবে না।"

আল্লাহ লুত আঃ এর সম্প্রদায়কে কিভাবে শাস্তি দিয়েছিলেন, সে কথা উল্লেখ করে বলেছেন,

"নিশ্চয়ই এতে মুতাওয়াসসিমীনদের (স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন) জন্য রয়েছে নিদর্শনমালা।" (সূরাহ আল-হিজর, আয়াত ৭৫)

মুতাওয়াসসিমীন হলেন তারাই যারা স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। তারা হারাম বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না এবং এবং অশ্লীল কর্ম সম্পাদন করা থেকে বিরত থাকেন।

দৃষ্টি সংযত করা সম্পর্কিত আয়াতের পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ বলেছেন,

"আল্লাহ আসমানসমূহ ও জমিনের নূর।" (সূরাহ আন-নূর, আয়াত ৩৫)

এর কারণ হলো, কর্ম যেমন, কর্মের প্রতিদানও তেমন হয়। অতএব যে কেউ আল্লাহ'র সন্তুষ্টির জন্য নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দৃষ্টিকে সংযত রাখবে, আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা সেই ব্যক্তির জন্য নিষিদ্ধ বস্তুকে অনুরূপ অথচ তার চেয়ে অধিক উত্তম বস্তু দ্বারা প্রতিস্থাপন করবেন। তাই বান্দা যেহেতু তার চোখের আলোকে নিষিদ্ধ বস্তুর উপর পড়তে দেয়নি, আল্লাহ সেই বান্দার দৃষ্টি এবং অন্তরের আলোকে অনুগ্রহ দান করেন। ফলে ব্যক্তি সেসব বিষয় বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন, দৃষ্টি সংযত না করলে যেগুলো বোঝা এবং উপলব্ধি করা তার জন্য সম্ভব হতো না।

ব্যক্তি নিজের মধ্যে এ বিষয়টি আক্ষরিক অর্থেই উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ হৃদয় একটা আয়নার মতো এবং পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো সে আয়নার উপর মরিচার মতো। এ আয়না যখন স্বচ্ছ এবং পরিস্কার থাকে, তখন তাতে বাস্তবতার (হাকাইক) আক্ষরিক প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু যদি তাতে মরিচা পড়ে থাকে, তাহলে তাতে সুষম প্রতিফলন তৈরি হয় না। ফলে হৃদয়ে অনুমান এবং সন্দেহনির্ভর জ্ঞান ও অভিব্যক্তির উন্মেষ ঘটবে।

 

তৃতীয়তঃ হৃদয় হবে শক্তিশালী, দৃঢ় এবং সাহসী

দৃষ্টির আলোর জন্য আল্লাহ যেভাবে চোখকে সুস্পষ্ট প্রমাণের সহায়কশক্তি দিয়েছেন, হৃদয়ের দৃঢ়তার জন্যও তিনি হৃদয়কে সহায়ক শক্তি দান করবেন। এভাবে হৃদয়ে দুধরণের উপাদানের সমন্বয় ঘটবে। ফলে হৃদয় থেকে শয়তান বিতারিত হবে। হাদিসে উল্লেখ আছে -

"কেউ যদি নিজের পাশবিক প্রবৃত্তির বিরোধীতা করে, ভয়ে শয়তান তার ছায়া থেকেও পালিয়ে বেড়ায়।" (আবু নুয়াইম আল-আসবাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবাকাতুল আসফিয়া, আস সাআদা, কায়রো, মিসর; প্রথম সংস্করণ, ১৩৯৪ হি. = ১৯৭৪ খৃ., খ. ২, পৃ. ৩৫৬)

এ কারণেই যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে নিজের মাঝে গ্লানিময় আত্মাকে খুঁজে পায়, যে আত্মা দুর্বল, শক্তিহীন, ঘৃণার যোগ্য। বস্তুত যে ব্যক্তি আল্লাহ'কে মান্য করেন, আল্লাহ তার জন্য উচ্চমর্যাদা নির্ধারণ করেন। আর তাকে অমান্যকারীর জন্য আল্লাহ লাঞ্ছনা নির্ধারণ করেন,

"আর তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং দুঃখিত হয়ো না, আর তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি মুমিন হয়ে থাকো।"(সূরাহ আলি ইমরান, আয়াত ১৩৯)

"কেউ যদি সম্মান চায় (তবে তা যেন আল্লাহ'র কাছেই চায়), কেননা সকল সম্মান আল্লাহ'র-ই।" (সূরাহ ফাতির, আয়াত ১০)

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহ'র (আযযা ওয়া জাল্লা) চেয়ে অবাধ্যতা এবং পাপকর্মকেই বেশী প্রাধান্য দিবে, আল্লাহ সে বিরুদ্ধাচরণকারীকে লাঞ্ছিত করবেন। সালাফদের অনেকেই বলেছেন, "সম্মানের খোঁজে মানুষ রাজাদের দ্বারে যায়, অথচ আল্লাহ'র আনুগত্য ছাড়া কোন সম্মান নেই।" কারণ যারা আল্লাহ'র আনুগত্য করে, তারা আল্লাহ'কে নিজেদের বন্ধু এবং রক্ষাকারী হিসেবে গ্রহণ করে। আর যারা আল্লাহ'কে তাদের রব এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গ্রহণ করে, আল্লাহ কখনোই তাদেরকে অসম্মানিত করেন না।

একটি দুয়া কুনূতে এ কথাগুলোই বলা হয়েছেঃ যাকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন, সে অপমানিত হয় না, আর যাকে আপনি শত্রু হিসেবে গ্রহণ করেন, সে সম্মানিত হয় না।

 

মূলঃ ইগাসাতুল লাহফান মিন মাদায়িদিশ শয়তান (ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ) - মাকতাবাতুল মাআরিফ, রিয়াদ, সৌদি আরব, খ. ১, পৃ. ৪৭-৪৮।

অনুবাদঃ হামিদা মুবাশ্বেরা

অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছিলো মাসিক আত-তাওহীদের শাউওয়াল ১৪৩৮ হিজরী সংখ্যায়।

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-5L

 

 

 

 

 

 

 

 

হিজরী নববর্ষঃ কিছু কথা

 

 

 

The Greatest Nation·Saturday, August 31, 2019

 

 

 

শুরু হয়েছে আরো একটি নতুন হিজরী সন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির ১৩ বছর পর মক্কা থেকে যে বছর মদিনায় হিজরত করেন, সেই বছরকে প্রথম বর্ষ ধরে হিজরী সন গণনার সূচনা হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করেছিলেন রবিউল আউয়াল মাসে। সে বছরের মুহাররাম মাসকে প্রথম মাস ধরে হিজরতের বছরকে হিজরী প্রথম বর্ষ হিসেবে গণ্য করা হয়।

১২ টি চান্দ্রমাসে একটি হিজরী সন পূর্ণাঙ্গ হয়। প্রাক ইসলামী যুগেও আরবে চান্দ্রমাস হিসেবে দিনক্ষণ ও বছর গণনার প্রচলন ছিল। ইসলাম এ ব্যবস্থাকে বহাল রেখেছে। দিন-ক্ষণ, মাস ও বছর গণনার চাঁদ একটি বড় ও সহজ মাধ্যম। কুরআন মাজীদ চাঁদকে আল্লাহ প্রদত্ত হিসাবের মাধ্যম বলে উল্লেখ করেছে। ইরশাদ হয়েছে -

"তারা আপনার নিকট নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন যে, এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ ও হজ্জের দিনক্ষণ নির্ধারণের মাধ্যম।" (সূরাহ বাকারাহ, আয়াত ১৮৯)

অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

"আর তার জন্য নির্ধারিত করেছেন মনযিলসমূহ, যাতে তোমরা বছর গণনা ও হিসাব জানতে পারো।" (সূরাহ ইউনুস, আয়াত ৫)

এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হলো যে, পৃথিবী প্রদক্ষিণের কারণে চাঁদের বিভিন্ন পর্যায় ও অবস্থার অতিক্রমন এবং চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধি দ্বারা বর্ষ, মাস ও দিনক্ষণের হিসাব জানা যায়।

অবশ্য সূর্যও যে বছর মাস ও দিনক্ষণের হিসাব-নিকাশের একটি মাধ্যম তা অপর একটি আয়াতে বিবৃত হয়েছে। বলা হয়েছে -

"আমি রাতের চিহ্নকে তিরোহিত করে দিনের চিহ্নকে দর্শনযোগ্য করলাম, যাতে তোমরা আল্লাহ'র অনুগ্রহ তথা রুজি রোজগার অন্বেষণ করতে পারো এবং যাতে তোমরা বর্ষপঞ্জি ও দিনক্ষণের হিসাব অবগত হতে পারো।" (সূরাহ বনী ইসরাঈল, আয়াত ১২)

সৌরজগতের সকল উপগ্রহ বিশেষত পৃথিবীর অস্তিত্ব, পরিবেশ-প্রকৃতি ও আবহাওয়া সূর্যের উপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর আবহাওয়া, গতি পরিবর্তন, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ঋতুগুলোর একটির পর অপরটির আগমন সূর্যের প্রভাবেই ঘটে থাকে।

মৌসুমের এই বিভিন্নতার নানারকম উপকারিতার একটি এই যে, মানবজাতিসহ সকল প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য অন্যতম প্রধান উপকরণ খাদ্য। ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যের মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যপ্রাণ। মৌসুমের বিভিন্নতা না থাকলে নানা রকম খাদ্যপ্রাণ-সম্পন্ন রকমারি খাদ্য উৎপাদিত হতো না।

বলাবাহুল্য, সূর্যের কারণে মৌসুমের পরিবর্তনের ফলেই আমরা নানা জাতির ফল-ফলাদি, শাক-সবজী ও খাদ্য শস্যাদি লাভ করে থাকি। একেক মৌসুমে একেক রকমের ফসলের চাষাবাদ করা হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, ফসলের চাষাবাদ নিয়মিত সময়ের আগে বা পরে করলে পরিমিত পরিমাণ ও মানসম্পন্ন ফলন হয় না। কাজেই সৌরবর্ষ, মাস ও দিনক্ষণের হিসাব-নিকাশ মানুষের পার্থিব জীবন-যাত্রার এক অপরিহার্য উপাত্ত।

এ কারণেই ইসলাম এই হিসাব-নিকাশকে শুধু বৈধই রাখেনি বরং এই হিসাব-নিকাশের ব্যবস্থাকে কুরআন কারীম আল্লাহ'র একটি অনুগ্রহ বলে ব্যক্ত করেছে।

তবে কতিপয় ইবাদত ও শরয়ী অনেক বিধানের ক্ষেত্রে ইসলাম চান্দ্রমাসের হিসাবকেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। রমযানের রোযা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, হজ্জ, লাইলাতুর কদর, শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত, আশুরা ইত্যাদি চান্দ্রমাসের সাথে সম্পৃক্ত। এতদ্ব্যতীত তালাকপ্রাপ্তা নারী যদি ঋতুহীনা হয় তাহলে তার ইদ্দতকাল হবে তিন মাস। এই তিন মাস হিসাব করতে হবে চান্দ্রমাস অনুযায়ীই, সৌরমাস অনুযায়ী নয়।

নাবালেগ ছেলে-মেয়ে বালেগ-বালেগা হল কিনা, তা জানা যায় শারীরিক পরিবর্তন দ্বারা। ছেলের ক্ষেত্রে দাঁড়ি-মোচ গজানো, স্বপ্নদোষ হওয়া, মেয়ের ক্ষেত্রে ঋতুবতী বা গর্ভবতী হওয়া ইত্যাদি বিষয়কে শরীয়ত বালেগ হওয়ার আলামত হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু হরমোনের বিশৃঙ্খলার কারণে বা অন্য কোন কারণে যদি পনেরো বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও উপরোক্ত আলামতগুলো প্রকাশ না পায়, তবে সে ক্ষেত্রে ফিকহের মাসআলা হিসেবে ১৫ বছর বয়সকে বালেগ হওয়ার বয়সসীমা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এই পনের বছর হিসাব করতে হবে চান্দ্রমাস হিসেবে, সৌরমাস হিসাবে নয়। অতএব একজন মুসলমানের জীবনে চান্দ্রমাস, বছর ও দিনক্ষণের হিসাব-নিকাশ কতখানি গুরুত্ব রাখে তা সহজেই অনুমেয়।

শরয়ী বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে চান্দ্রমাস ও চান্দ্রবর্ষের হিসাবকে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারণ করার কারণ এই যে, ইসলাম যেহেতু সর্বকালীন ও সার্বজনীন বিশ্বধর্ম, কাজেই এর বিধি-বিধানগুলোও এমন হওয়া উচিত যাতে সর্বকাল ও সর্বস্থানের জন্য তা সমান কার্যকর এবং সমান বাস্তবায়নযোগ্য হয়। এমন হওয়া উচিত যাতে শিক্ষিত অশিক্ষিত, গ্রামবাসী ও শহরবাসী নির্বিশেষে সকলের জন্যই সে অনুযায়ী আমল করা সহজ হয়। বলাবাহুল্য, সৌর মাস, বর্ষ ও দিনক্ষণের হিসাব-নিকাশের সাথে যদি রোযা, হজ্জ ইত্যাদি ইবাদতগুলো এবং বিশেষত নারীর ইদ্দত, ছেলে-মেয়ের বালেগ হওয়ার বিষয় সম্পৃক্ত করা হতো তাহলে সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানগুলো সৌর বছর, মাস ও দিনক্ষণের হিসাব রেখে পালন করা সর্বকালের সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য সম্ভবপর হয়ে উঠতো না। কারণ সৌর বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য না থাকলে এবং জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যুৎপত্তি না থাকলে সৌর মাসের হিসাব-নিকাশ সম্ভব নয়।

পক্ষান্তরে চান্দ্রমাসের হিসাব পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন মানুষ অতি সহজেই করতে সক্ষম। এমনকি গভীর অরণ্যে, পর্বতচূড়ায় কিংবা জনমানবহীন কোন দ্বীপেও যদি সে আটকা পড়ে যায়, তবু চাঁদ দেখে অনায়াসেই সে চান্দ্রমাস ও দিনক্ষণের সাথে সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান পালন করে যেতে পারবে। এজন্য তাকে সৌর বিজ্ঞানের ছাত্র হতে হবে না। আধুনিক কোন যন্ত্রপাতিরও তার প্রয়োজন পড়বে না।

চান্দ্রমাসভিত্তিক হিসাব-নিকাশের ব্যবস্থার একটি বড় সুফল এই যে, রমযানের রোযা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ইত্যাদি ইবাদতকে চান্দ্রমাস ও বর্ষের সাথে সম্পৃক্ত করার কারণে এসব ইবাদতের মৌসুম পরিবর্তন হতে থাকে। প্রতিটি মৌসুমেই এসব ইবাদত করার সুযোগ লাভ হয়। কখনো গরমে, কখনো শীতে, কখনো শরতে, কখনো হেমন্তে ও বসন্তে। ফলে ইবাদতের মাঝে যেমন বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়, তেমনি ইবাদতকারীর মাঝেও বৈচিত্র্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়।

ইবাদতকারী লাভ করে নতুনত্বের আস্বাদ। বিশেষত সিয়ামের ক্ষেত্রে শীত গরমের সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘ উভয় প্রকার সিয়ামের সুযোগ লাভ হয়। দীর্ঘতম সিয়ামে অধিক ধৈর্যধারণ সিয়ামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে অধিক সহায়ক হয়। সংক্ষিপ্ত সিয়ামে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের সাথে সাথে অপেক্ষাকৃত কম কষ্ট করেও পূর্ণ নেকী লাভ করার কারণে সিয়াম পালনকারী শোকর আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়, যা তাকে আরো অধিক আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করতে সহায়তা করে।

পক্ষান্তরে এসব ইবাদতকে যদি সৌরমাস ও বর্ষের সাথে সম্পৃক্ত করা হতো, তাহলে এসব ইবাদত প্রতি বছর নির্দিষ্ট মাসে একই মৌসুমে অনুষ্ঠিত হতো। ফলে পরিবর্তন পিয়াসী মানুষ এক ধরণের একঘেয়েমি অনুভব করতো। এসব ইবাদতে বৈচিত্র্য ও নতুনত্বের স্বাদ থেকে মানুষ থাকতো বঞ্চিত।

ইত্যাদি কারণে ইসলাম মাস ও দিনক্ষণের সাথে সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানকে চান্দ্রমাসের সাথে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে, সৌর মাসের সঙ্গে নয়। চান্দ্রমাসের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানগুলোর ব্যাপারে যত্নবান হতে হলে চান্দ্রমাসের হিসাব রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই জরুরি। জরুরি নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা বজার রাখার জন্যও। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, বর্তমান মুসলিম সমাজে চান্দ্রমাসের হিসাব রাখার ব্যাপারে রয়েছে ক্ষমাহীন অবহেলা। যে কোন শ্রেণীর মানুষ সৌর মাসের হিসাব-নিকাশকে নখদর্পণে রাখে। ইংরেজি কতো সন চলছে, কোন মাস, আজ কতো তারিখ তা প্রায় সকলেই বলতে পারে। তদ্রুপ বাংলা সন, মাস ও তারিখের হিসাবও অনেকেই বলতে পারে। কিন্তু হিজরি সন ও তারিখ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে অজ্ঞতা প্রকাশ ব্যতীত গত্তান্তর থাকে না। সাধারণ লোক তো দূরের কথা দ্বীনদার শ্রেণীর লোকদের মাঝেও চান্দ্রমাসের হিসাব রাখার ব্যাপারে চরম ঔদাসীন্য ও অমার্জনীয় অবহেলা লক্ষ্য করা যায়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অবহেলা যে মারাত্মক দ্বীনী ক্ষতি বয়ে আনতে পারে তা অনেকেরই জানা নেই।

উদাহরণত হিজরি কতো সনের কোন মাসে সন্তান জন্মলাভ করলো, তার হিসাব না রেখে যদি কেউ বাংলা বা ইংরেজি বর্ষ মাসের হিসাব রাখে আর সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালে বালেগ হওয়ার বাহ্যিক কোন নিদর্শন না পাওয়া যায়, তবে চান্দ্রমাস হিসেবে সন্তানের বয়স পনের বছর পূর্ণ হল কিনা, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়; অথচ বালেগ হওয়া বা না হওয়ার সাথে দ্বীনী অনেক মাসআলা-মাসায়েল জড়িত। তদ্রূপ ঋতুহীনা তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত এবং যে নারীর স্বামী মৃত্যুবরণ করেছে তার চার মাস দশ দিনের ইদ্দত চান্দ্রমাসের সাথে সংশ্লিষ্ট। চান্দ্রমাসের হিসাব না রাখলে ইদ্দত শেষ হয়েছে কি হয়নি, প্রয়োজনের সময়ে এ ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি হতে পারে। আর ইদ্দত শেষ না হওয়ার সঙ্গেও বৈধাবৈধের অনেক বিষয় জড়িত। এই অবহেলা থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে।

হিজরি নববর্ষের সূচনায় আমাদের নতুন করে নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে হবে। সত্য প্রত্যয় ও তার বাস্তবায়ন হোক আমাদের সকলের সচেতন জীবনের সঙ্গী।

 

লিখেছেনঃ মাওলানা আবদুল গাফফার

প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিলো মাসিক আল কাউসার মুহাররম ১৪২৬ সংখ্যায়।

ব্লগপোস্ট লিঙ্কঃ https://wp.me/p43zxV-5Q