JustPaste.it

শামেলি থেকে সোহরাওয়ার্দীঃ সত্যিকার আল-ওয়ালা ওয়াল-বারার অনুপস্থিতির পরিণতি

 

ভারতবর্ষে ইসলামের দুশমন ক্রুসেডার ইংরেজদের কুফর ও ইলহাদের ভয়াবহ বিস্তার থেকে মুসলিমদের রক্ষা করতে ১৮৫৭ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের থানাভবন এলাকায় একটি স্বাধীন ইসলামি রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়। এই যুদ্ধটিতে যারা নেতৃত্ব দেন, তারা হলেন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রাহ., কাসেম নানুতবী রাহ. এবং রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.। আর এটি সকলের জানা যে, এই ৩ জন মহান ব্যক্তি-ই হলেন দারুল উলুম দেওবন্দের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা।  শামেলির যুদ্ধের কারণ এটি ছিল না যে, তারা ক্ষমতা দখল করবেন বরং ইংরেজরা যেভাবে মানুষকে কুফর ও ইলহাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ইসলামের আহকাম প্রতিষ্ঠা করাই ছিল উদ্দেশ্য। শামেলির যুদ্ধে মুজাহিদদের সামরিক পরাজয়ের পর উপরোক্ত ৩ জন মহান ব্যক্তি ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদে লড়াইয়ের প্রস্তুতির লক্ষ্যে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন, সেই মাদরাসাই আজকের দারুল উলুম দেওবন্দ।

 

শামেলির লড়াইয়ের পর তারা ইংরেজদের কুফুরি এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যকে ভণ্ডুল করে দেওয়ার লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে ইংরেজবিরোধী অবস্থান ছড়িয়ে দেন। তারা ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত আলিয়া মাদরাসা ও সেক্যুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার ঘোরতর বিরোধিতা করেন। ইংরেজদের সাথে সবধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এমনকি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য যেহেতু সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া ছাড়া কোনো পথ ছিল না এবং ইংরেজদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল,তাই তারা ইংরেজি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করারও বিরোধিতা করেন। এখানে ভাষার বিরোধিতা উদ্দেশ্য ছিল না বরং এই ভাষার অভিভাবক সেক্যুলার ক্রুসেডার ইংরেজদের কুফুরি এজেন্ডার বিরোধিতা-ই উদ্দেশ্য ছিল। এভাবে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল ক্রুসেডার ইংরেজদের সাথে শত্রুতা অর্থাৎ আল-বারার বহিঃপ্রকাশ।

পরবর্তীতে কেউ কেউ রাজনীতিতে জড়িত হলেও ব্যাপকসংখ্যক রাজনীতি বিমুখ ভূমিকা গ্রহণ করেন। কালক্রমে এই শিক্ষাব্যবস্থা ভারত,পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে- প্রচলিত সরকারি দুনিয়াবি শিক্ষার বিপরীতে দ্বীনি শিক্ষা আঞ্জাম দেওয়া। মানুষকে আল্লাহদ্রোহীতার অক্টোপাস থেকে বের করে হিদায়াতের আলোকোজ্বল রাজপথের সন্ধান দেওয়া।

বাংলাদেশে এই শিক্ষাব্যবস্থা ক্বওমী মাদরাসা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ভারতবর্ষে ইংরেজদের উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাওয়া সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থার বাইরে শুধুমাত্র সাধারণ মুসলিম ক্বওম বা জনতার সমর্থনের ভিত্তিতে চলে বিধায় ক্বওমী নামে পরিচিত হয়। সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা আলিয়া মাদরাসার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবস্থান ছিল ক্বওমী মাদরাসার,যা কারো অজানা থাকার কথা নয়। শুধুমাত্র আলিয়া মাদরাসা থেকে পরীক্ষা দেওয়ার কারণে অগণিত সংখ্যক ছাত্রকে ক্বওমী মাদরাসা থেকে বহিঃষ্কার করা হয়েছে।

সরকার এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং তার বিরোধিতার একটি মাত্র কারণই ছিল বলে আমার জানা। আর তা হচ্ছে সেসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য লোক তৈরি করা হয়, আর ক্বওমী মাদরাসায় ইসলামের আহকাম বাস্তবায়নের জন্য জনশক্তি তৈরি করা হয়।

 

দেওবন্দী উলামায়ে কিরাম যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জিহাদ/কিতালে লিপ্ত ছিলেন, তখন সরকারের সাথে মিলেমিশে এদেশের মুসলমানদের কল্যাণের দাবিতে অনেক ব্যক্তি কাজ করেছে। ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতবর্ষকে দারুল-আমান আখ্যা দিয়ে মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী মুসলমানদের অগ্রগতির চেষ্টা করেছে (এই তথ্যের প্রমাণ ব্রিটিশ কর্মকর্তা ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের লেখা ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ এর শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন)। ব্রিটিশদের সাথে মিলেমিশে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মুসলিমদেরকে এগিয়ে নেওয়া চেষ্টা করেছিল নবাব আব্দুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আহমদ সহ আরো অনেকে।  সেসময় দেওবন্দের এই আকাবীরগণ এই জৈনপুরী, নবাব আব্দুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আহমদদের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহী ও পশ্চাদপদ হিসেবে পরিগণিত ছিলেন । কেননা  দেওবন্দী উলামায়ে কিরাম ইংরেজদের সাথে সমঝোতা ও আপোষের পথ নয় বরং শত্রুতা ও বর্জনের পথ অবলম্বন করেছিলেন।  

 

এই ছিল শামেলির সেনাপতি কাসেম নানুতবী রাহ. এর দেওবন্দের অবস্থা। কিন্তু আজকে আমাদের সামনে এমন এক মুহুর্ত উপস্থিত যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ইংরেজদের প্রেতাত্মা বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট কুফুরী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু কোনো শামেলির যুদ্ধ হচ্ছে না বরং ইসলামের দুশমনদের সাথে শত্রুতা ও বর্জনের পথ পরিহার করে সমঝোতা ও আপোষের পথ অবলম্বন করা হচ্ছে।

আজকে আমরা এমন এক দেওবন্দী প্রজন্ম দেখছি যারা তাদের আকাবীরদের অনুসৃত পথকে ভুলপথ আখ্যায়িত করছে, আর বিপরীতে জৈনপুরী, নবাব আব্দুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আহমদদের পথকে সঠিক পথ আখ্যা দিচ্ছে।

এই করুণ পরিণতির কারণ কী ?

এই করুণ পরিণতির কারণ হচ্ছে ক্বওমী মাদরাসাগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমকালীন ঈমানধ্বংসকারী ইলহাদী মতবাদগুলোর মোকাবেলায় সঠিক আকীদার শিক্ষা ও চর্চার অনুপস্থিতি। প্রত্যেক যুগের হক্ব উলামায়ে কিরাম স্ব স্ব যুগের কুফরের মোকাবেলা করার জন্য মানুষকে প্রস্তুত করেছেন। কিন্তু বর্তমান ক্বওমী প্রজন্ম বর্তমান কুফরের ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ বলা যায়। ব্যতিক্রমী যে অল্পসংখ্যক আছেন, তারা ভিন্ন কোনো পরিস্থিতির সংস্পর্শে হয়তো এসবের ব্যাপারে অবগত হয়েছেন। এটি কাউকে হেয় করার জন্য নয় বরং বাস্তবতা তুলে ধরার জন্যই বলা।  আর এটি দুয়েক দিনের কিংবা দু’চার জনের ভিত্তিতে বলা হয়নি বরং প্রায় দেড় যুগ ধরে ঘনিষ্ঠভাবে ক্বওমী অঙ্গনের  শত-সহস্র ব্যক্তিদের থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলছি।

ইসলামের ইতিহাসে যতগুলো কুফুরী মতবাদের জন্ম হয়েছে, আমার দৃষ্টিতে তার মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য কুফুরী মতবাদ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। কত অগণিত সংখ্যক মুসলিমকে এই মতবাদ কাফির বানিয়েছে,তার সঠিক পরিসংখ্যান অসম্ভব। বর্তমান ক্বওমী শিক্ষাব্যবস্থায় সমকালীন কুফুরের ভয়াবহতার ব্যাপারে জানার তেমন কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। ফলে অতি সামান্যসংখ্যক আলিম হয়তো এই মতবাদের ভয়াবহতার ব্যাপারে অবগত আছেন। এই অঙ্গনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মুরব্বীরা পর্যন্ত এ ব্যাপারে ভালো ধারণা রাখেন না। যার ফলশ্রুতিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আলিমও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদেরকে মাদরাসায় মোটা অঙ্কের টাকা অনুদান দিয়ে বিচার করেন ! আওয়ামীলীগ হয়ে গেছেন এমন অভিযোগের জবাবে এমনকি নিজে আওয়ামীলীগ হয়ে গেলেও আপত্তি দেখেন না ! আওয়ামীলীগের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী কুফুরী আকীদা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকলে কস্মিনকালেও এমনটি বলার কথা নয়।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শুধু কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নয় বরং এটি একটি আলাদা মতবাদ ও ধর্ম, যা ইসলামের শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ও বড়জোর সামাজিক কিছু বিধানকে মানার অনুমতি দেয়। রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামের কোনো আহকামকে মানার কোনো অনুমতি দেয় না এই মতবাদ।

 

এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে সেই মতবাদ, যা সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ সহ্য করে না, সংবিধানে আল্লাহর নাম থাকা সহ্য করে না, প্রায় ৯০% মুসলিমের দেশকে কাগজে-কলমে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে সহ্য করে না। এই মতবাদের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের ব্যক্তিরা যেখানে প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে সংবিধানে ইসলামের সাথে যুক্ত কোনো শব্দ থাকাকে ‘ধর্মের কালো ছায়া’ বলে আখ্যা দেয়, সেখানে এমন একটি মতবাদের প্রকৃষ্ট অনুসারী দলের সাথে কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিৎ ছিল শামেলির প্রধান সেনাপতি কাসেম নানুতবি প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার আলিম ও তুলাবাদের ! 

 

যেহেতু ক্বওমী মাদরাসায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও অনুরুপ মানবরচিত কুফুরি মতবাদগুলোর ব্যাপারে সঠিক আকীদা শিক্ষা দেওয়া হয় না,তাই ব্যাপকসংখ্যক দেওবন্দীরা মাসলাহাতের দোহাই দিয়ে  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের পক্ষাবলম্বনে কোনো সমস্যা দেখবে না। যার কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সুস্পষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী হোয়াইট হাউজের অতিথি ফরিদ উদ্দিন মাসুদ খারাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি বরং নন্দিত ও বরিত হয়েছে।  ২০১৩ সালে ফরিদ উদ্দিন মাসুদকে খারাপ বলার কারণ তার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আকীদা ছিল না বরং হেফাযতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে ছিল। যার প্রমাণ, ফরিদ উদ্দিন মাসুদ এখন কলংকমুক্ত হয়ে আকাবিরের মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে চলেছে।

 

অনেকেই বলতে চান, এই স্বীকৃতি শুধু স্বীকৃতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ! এই সংবর্ধনা শুধু সংবর্ধনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ !  তারা হয় আত্মপ্রতারণার শিকার অথবা মানুষকে প্রতারিত করছে। বরং এটি পদস্খলনের এক মহাসড়ক, যে রাস্তা ধরে আল্লাহর শরিয়ত বাস্তবায়নের জন্য জন্ম নেওয়া দল সরাসরি ক্রুসেডারদের গ্রাউন্ড ফোর্স হিসেবে আল্লাহর শরিয়তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। উদাহরণঃ আফগানিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর আদর্শে গড়া দল আমেরিকার গ্রাউন্ড ফোর্স হিসেবে তালিবানদের ইসলামী শরিয়ত কায়েমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ইরাকেও ইখওয়ানুল মুসলিমীনের শাখা আমেরিকার সাথে মিলে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।  

 

এবার আলিয়া মাদরাসার পরিস্থিতির সাথে ক্বওমী মাদরাসার কিছু পার্থক্য জেনে নেই।  বাংলাদেশের অধিকাংশ আলিয়া মাদরাসা জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত হওয়ায়, তারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ব্যাপারে অনেকটা সচেতন থাকে। জামায়াত-শিবিরের প্রভাব থাকায় আলিয়া মাদরাসার ছাত্ররা মাওলানা মওদুদী, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ এবং মাওলানা আব্দুর রহীম সাহেবের এসংক্রান্ত বইপত্র পড়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ব্যাপারে অনেকটা অবগত থাকে।

পক্ষান্তরে ক্বওমী মাদরাসার ছাত্ররা যেহেতু এসব লেখকের বই সাধারণতঃ পড়ে না এবং সমকালীন কুফরের ব্যাপারে তেমন কোনো বই ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী নয়,  সেহেতু এখানে উলামা-তুলাবাগণ  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদেরকে ইসলামের পথে কোনো বাঁধা মনে করেন না বরং অনেকসময় মতপার্থক্য থাকা বিভিন্ন ইসলামী দলের চাইতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদেরকে ভালো মনে করেন। এর বহু দৃষ্টান্ত আমার চোখের সামনে ঘটেছে।

ফলে অদূর ভবিষ্যতে যা ঘটতে পারে- তা হচ্ছে ক্বওমী মাদরাসায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আওয়ামীলীগের শক্তিশালী দুর্গ গড়ে উঠার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কুফুরী থাবা থেকে নিরাপদ থাকার মজবুত কোনো উপাদান ক্বওমী মাদরাসার আলিম-ত্বলিবুল ইলমদের মধ্যে নেই।  অতি অল্পসংখ্যক যাদের মধ্যে আছে, তারা সেখানে অতীব সংখ্যালঘু এবং বিভিন্ন তকমার শিকার।

 

কিছু বক্তব্য দিয়ে হয়তো অনেকে বাস্তবতা আড়াল করার চেষ্টা করতে চাইবেন, কিন্তু তা বৃথাচেষ্টা।  

যেমন- এদেশে ক্বওমী অঙ্গনের উদীয়মান তারকা বক্তা ও রাজনীতিবিদ সুস্পষ্ট ফাতওয়া দিয়েছেন যে, যারা  বিশ্বাস করবে রাষ্ট্র ও ধর্ম আলাদা থাকএ, তারা বেইমান/কাফির হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে কী এই বক্তব্যের আকীদার ভিত্তিতে ক্বওমী অঙ্গনে কোনো অবস্থান দেখা গেছে ! না, কখনোই না। বরং উক্ত বক্তা-ই আরেক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী প্রেসিডেন্টকে মুসলিম জাতির ভবিষ্যৎ খলিফা হিসেবে আখ্যা দেন সুবহানাল্লাহ !

হেফাযতে ইসলামের মহাসমাবেশে সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলের মুখ দিয়ে এই বাক্যটি বের হয়েছে- এই সরকার মুরতাদ সরকার। এই সরকার নাস্তিক সরকার। কেননা তারা নাস্তিক্যবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে।

আচ্ছা, ভেবে দেখুনতো ! ৬ এপ্রিল ও ৫ মে যেসব কারণে এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সরকার মুরতাদ/নাস্তিক সরকার ছিল,তার কোনো একটি কারণ কী এরপর দূর হয়েছে ? না, হয়নি। তারা কী হেফাযতে ইসলামের একটি দফা মেনে নিয়েছে ! তাহলে কীভাবে সেই একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সরকার এখন ভালো সরকার হয়ে যায় ! কীভাবে এই সরকারের কুফরের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা যায় !

মূলতঃ ধর্মনিরপেক্ষতার আকীদাকে কুফুরী আকীদা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সরকারকে মুরতাদ/নাস্তিক সরকার বলাটা একধরণের রাজনৈতিক বক্তব্যের মত ছিল,যা বাস্তবে আকীদার উপর ভিত্তি করে ছিল না। যদি কুফর বি-ত্বগুতের আকীদার ভিত্তিতে আল-বারা হতো, তাহলে  ৫ মে’র আওয়ামীলীগ আর বর্তমান আওয়ামীলীগের মধ্যে মৌলিক কোনো তফাৎ নেই।

 

কেউ হয়তো বলতে চাইবে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা এখন আলিমদেরকে নির্যাতন করে না !  ইতিহাস প্রমাণ দেয়, ইংরেজদের সাথে যারা সমঝোতা ও আপোষ করে চলেছে, ইংরেজরা তাদেরকে কোনো নির্যাতন করেনি বরং অনুগ্রহ দিয়ে ধন্য করেছে। যেহেতু এখন কেরামত আলী জৈনপুরী ও স্যার সোইয়দ আহমদদের মতো সমঝোতা ও আপোষের পথ অবলম্বন করা হচ্ছে, তাই ভালো ব্যবহার দেখানো হচ্ছে।  আর উপস্থিত বাস্তবতা ইতিহাসের প্রতিধ্বনি করে জানিয়ে দেয়, ৫ মে’র মতো আন্দোলনে নামলে আবার ৬ মে’গণহত্যার শিকার হতে হবে নিশ্চিত।

কতক আত্মমর্যাদাবোধহীন আবার আওড়াচ্ছে ক্বওমী মাদরাসার সনদ প্রদানের মাধ্যমে নাকি তাদের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে ! কী নির্মম ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ! একদিকে সরকারের প্রভাবমুক্ত ক্বওমের দ্বারা পরিচালিত এই ক্রেডিট নেওয়া আবার বিপরীতে সরকারের স্বীকৃতিকে দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা বলতে কোনো লাজ-লজ্জাও দেখা যায় না।  

 

আসলে পদস্খলন হচ্ছে সুতা ছেঁড়া চেইনের মতো। একটির পর একটি হতেই থাকবে। আজ শুকরানা সংবর্ধনা কাল ধর্মনিরপেক্ষতার বন্দনা গাওয়া হবে, যেমনটি ফরিদ মাসুদ করছে। তারপর আরেকদিন ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, এই মর্মবাণী শুনিয়ে ইসলামকে বিরাট শক্তিশালী করা হবে !  ইতোমধ্যে ফরিদ মাসুদ একথা বলেছেও।

 

স্বীকৃতি ও সংবর্ধনার মাধ্যমে এই পদস্খলন শুরু হয়নি বরং এটি একটি ধাপ মাত্র। এর শুরু আরো বহু আগেই হয়েছে, যার প্রতিফলন দেখেছি জঙ্গিবাদ নাম দিয়ে জিহাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য,বিবৃতি,ফাতাওয়া, রোডমার্চের  স্বতস্ফূর্ত আয়োজনে।  ইসলামের দুশমনদের সাথে শত্রুতা ও দূরত্বের মূলনীতিতে প্রতিষ্ঠিত ক্বওমী মাদরাসা এখন ইসলামের দুশমনদের সাথে সমঝোতা ও আপোষের মাসলাক গ্রহণ করেছে। আর যেহেতু ত্বগুত সরকার প্রবল তাই সে তার কুফুরী এজেন্ডা বাস্তবায়নে আলিম ও ত্বলিবুল-ইলমদেরকে ব্যবহার করবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় জিহাদ ও মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ত্বগুতের সপক্ষে গ্রাউন্ড ফোর্স হিসেবে সরকারি জিহাদ করতেও দেখা যেতে পারে, যার কিছুটা প্রতিফলন ইতোমধ্যে দেখাও যাচ্ছে।  

 

ক্বওমী আলিমদের এই ত্বগুত সরকারকে সংবর্ধনা প্রদান ও তাদের ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে অগণিত সংখ্যক মানুষ পথভ্রষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে তৈরি হবে। সাধারণ মানুষ মনে করবে, ধর্মনিরপেক্ষতা কোনো সমস্যা না ! সমস্যা থাকলে কী আর আলিমরা এভাবে তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতো !!

এভাবেই আল-ওয়ালা ওয়াল বারা তথা ‘শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ভালোবাসা এবং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ঘৃণা করা’র নীতির অনুপস্থিতি  শামেলির সেনাপতির সারি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার সারিতে নিয়ে দাড় করায়। মা’আযাল্লাহ।

এহেন করুণ পরিস্থিতিতে যারা নিজেদের ঈমান ও আকীদাকে রক্ষা করতে চাইবে, তাদের এই ক্রমান্বয়িক পদস্খলনের ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া অত্যাবশ্যক। হক্ব আর বাতিল স্পষ্ট করতে হবে। এটি করতে গেলে নিজেদেরকে দেওবান্দিয়াতের ঠিকাদার মনে করা বৃহৎ শ্রেণিটি হক্বের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সাথে তাদের জন্য ত্বগুত সরকারের সহায়তাও মিলবে অনায়াসে।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে কুফর ও ইলহাদের মোকাবেলায় সোহরাওয়ার্দির পথ নয় বরং শামেলির পথ অবলম্বন করার তাউফীক্ব দান করুন।

 

লেখকঃ  Zamil Hasan

তারিখঃ ০৪/১১/২০১৮