অনুনয়-বিনয় নয়, উত্তরণের পথ কেবল সশস্ত্র সংগ্রাম
---------------
ইতিহাস ও যুগযুগান্তর সাক্ষী, দুনিয়ায় কোন সভ্যতা-সংস্কৃতি র অধঃপতনের পর তার উত্থান বা কোন নব্য সভ্যতা-সংস্কৃতির বিজয়; ব্যাপক বিপ্লব ও ক্ষমতায়ন ছাড়া সম্ভব হয়নি। আর এমনটি কখনো সম্ভব নয়।
কোন সভ্যতা যতই নৈতিক আদর্শমন্ডিত, বিবেকসম্মত ও মানবিক হোক না কেন, এবং চাই তা আসমানীই হোক না কেন; মানুষের নিকট তা সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্যতার জন্য অবশ্যই ব্যাপক বিপ্লব ও ক্ষমাতায়ন জরুরী। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্য সভ্যতার পতন ঘটিয়ে, তার উপর নৈতিক, আদর্শিক ও সামরিক আধিপত্য ছাড়া সামগ্রীক গ্রহণযোগ্যতা সম্ভব নয়।
আপনি যতই আপনার সভ্যতার উন্নত নীতিকথা, আদর্শ ও কল্যাণের কথা মানুষকে বুঝান না কেন, সঠিক, সুন্দর ও মুক্তির পথ দেখান না কেন; হাতেগোনা কিছু মানুষ ছাড়া কেউ আপনার দাওয়াহ গ্রহণ করবে না। আপনার মতবাদ সঠিক বুঝা সত্বেও আপনার আহবানে তারা সাড়া দিবেনা। বরং বলা ভালো তারা সাড়া দিতে পারবেনা।
কারণ খুব কম মানুষ এমন আছে যারা নিজেদেরকে সমাজ ও প্রচলিত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সত্যের পথ আকড়ে ধরতে পারে। অধিকাংশ মানুষই নিজেদেরকে সমাজ-সামাজিকতা, প্রচলিত পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে আলাদা ভাবতে পারেনা। কালের স্রোতধারাতেই তারা সাচ্ছন্দবোধ করে। এক্ষেত্রে তারা নিজেদেরকে অক্ষম ও বাধ্য মনে করে। কারণ তারা বাচঁতে চায়, কোনরকমে জীবনটি পাড় করতে চায়। প্রচলিত সভ্যতা থেকে বেড়িয়ে কোন সংকটে তারা জড়াতে চায়না। তাই তারা সত্য উপলব্ধি করা সত্বেও সত্যকে গ্রহণ করতে পারেনা।
পক্ষান্তরে আপনার সভ্যতা যতই নিম্ন ও গান্ধা হোক, আপনি যদি সামগ্রিককভাবে বিজয়ী হতে পারেন, ক্ষমতায়ন করতে পারেন, সমাজের প্রচলিত অবকাঠামো ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজের ভীত গড়তে পারেন, তবে সহজেই আপনার মতবাদের বিজয় হবে, মানুষ সহজেই তা গ্রহণ করবে। বরং বলা যায়, প্রচলিত ধারার সাথে মিলে সহজ জীবন যাপনের জন্য তারা গ্রহণে বাধ্য হবে। কারণ ঐ একই! খুব কম মানুষই নিজেদেরকে প্রচলিত স্রোতে ভাসা থেকে আলাদা করতে পারে। নমনীয়তা, সুন্দর আচরণ, সৎকাজের আহবান, সামাজিক খেদমত ইত্যাদির মাধ্যমে আপনি অবশ্যই মানুষের মন জয় করতে পারবেন, তাদের মুগ্ধ করতে পারবেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশকেই আপনার চেতনা-মতবাদ গ্রহণে পাশে পাবেন না, আপনার এত উত্তম দাওয়াহ ও এমন মনোমুগ্ধকর সভ্যতা-মতবাদকে তারা গ্রহণ করবে না। কারণ আপনি যদি দুর্বল হোন বা পরাজিত হোন, তবে এমন ভালো কাজ ও সদাচারণে আপনি তাদের দৃষ্টিতে অপারগ (যদিও আপনি বাস্তবে এমন না হোন)। আপনার সদাচারণ, উত্তম নসিহাহ, সামাজিক খেদমত ইত্যাদি হবে অপারগতা।
আশি বছরের বৃদ্ধা যিনাকারিনীর জন্য
ঘরের কোণে ইবাদতে মগ্ন হওয়া ছাড়া কিই বা করার থাকতে পারে,
আর এতে তার কেমন বুজুর্গীই বা প্রকাশ পাবে।
তবে অবশ্যই এ সমস্ত কার্যক্রম নব্য সভ্যতা- সংস্কৃতির ব্যাপক বিপ্লব ও ক্ষমতায়নের সহায়ক হতে পারে। বলা যায়, সহায়ক হিসেবে তা অত্যন্ত জরুরী!
বখেলাফ আপনি এত কিছু না করেও যদি প্রচলিত সভ্যতা-সংস্কৃতির অধঃপতন ঘটাতে পারেন, আপনার ক্ষমতায়ন করতে পারেন। অতপর আপনার সভ্যতা-মতবাদকে ছড়িয়ে দিতে চান, তবে আপনি খুব সহজেই সফল হবেন। মানুষ আপনার মতবাদকে খুব সহজেই মেনে নেবে।
এটাই দুনিয়ার নিয়ম, এটাই সুন্নাতুল্লাহ!
আপনার আমার বুঝে আসুক চাই না আসুক ইতিহাস কিন্তু এরই সাক্ষ্য বহন করে!
পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি লক্ষ্য করুন, তা কতইনা গান্ধা ও বিবেক বহির্ভূত সভ্যতা। কিন্তু মানুষ তার গান্ধেগী বুঝা সত্যেও তা গ্রহণ করছে, এর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদের অধিকাংশই বুঝে যে, "আমার মেয়ের রাত বিরাতে অন্য একটি ছেলের সাথে সময় কাটানো, ঘুরে বেড়ানো, ফোনে কথা বলা, বেগানা পুরুষের সাথে চ্যাটিং করা, হাসি মজা করতে করতে গায়ে পড়ে যাওয়া" এসব কাজ কখনোই ভালো নয়। দুর্নীতি, ঘুষ খাওয়া, সুদ দেয়া-নেয়া তা ইনসানিয়্যাতের মধ্যে পড়ে না। কোন সমাজে প্রতিতালয়ের অনুমোদন দেয়া, সমকামিতার প্রসার ঘটানো, ফ্রীসেক্সে উদ্বুদ্ধ করা সুস্থ বিবেকের খেলাফ।
তবুও তারা এসব করছে। করতে বাধ্য হচ্ছে। পশ্চিমা সভ্যতার যে স্রোত তাদের সমাজকে গ্রাস করছে, সে স্রোত থেকে নিজেদেরকে তারা আলাদা করতে পারছে না।
আপনি ইসলামের প্রাথমিক অবস্থার দিকে তাকান যখন মুসলিমগণ উত্তম নসিহাহ ও দাওয়াহ এর মাধ্যমে মক্কাবাসীদের তাওহীদের দিকে আহবান করেছিলেন। তখন তাদের এ দাওয়াহ কে মক্কাবাসীগন সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। মক্কার অনেকে ইসলামের প্রতি আসক্ত ছিলেন, এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু সমাজ ও পরিবেশ, প্রচলিত লাত-উজ্জার সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কজনই “সাবিকে আওয়াল” এর অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিলেন!!
খোদ আবু তালেব এর কথাই ধরুন, কেন তিনি ইসলামের সত্যতা উপলব্ধি করা সত্ত্বেও শ্রেষ্ঠতম মানব এর সামনে নিজেকে সোপর্দ করতে পারেননি?
কিন্তু দীর্ঘ কোরবানির জিহাদ-ক্বিতালের মাধ্যমে মুসলিমগণ যখন আরবের প্রচলিত শক্তিকে পরাস্ত করে দিলেন, নিজেদের শক্তিকে জানান দিলেন, ক্ষমতায়ন করলেন এবং বিশেষ করে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে জাহিলি সভ্যতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করলেন। তখন মানুষ দলে দলে তাওহীদের মতবাদ গ্রহণ করতে লাগলো, ইসলামে দাখিল হতে লাগলো।
অতঃপর এই ধারাবাহিকতায় মুসলিম মুজাহিদগণ যখন তৎকালীন দুই পরাশক্তি “কায়সার”(রোম) ও “কিসরা”(পারস্য) কে পরাভূত করলেন, কিসরার প্রসাদে আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুললেন! রোমান ও পারসিয়ান সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিলেন, তখন এই তাওহীদীদের সভ্যতাকে মানুষ সামগ্রিকভাবে খুব সহজেই গ্রহণ করতে লাগলো। ইসলাম পৃথিবীর এপ্রান্ত হতে ওপ্রান্ত ছড়িয়ে পড়লো। ফলে দুনিয়া ন্যায়-ইনসাফে ভরে গেল। হ্যাঁ, মানুষ এতো সহজে তখন ইসলাম গ্রহণ করতো তার সৌন্দর্যের সাথে সাথে তার শৌর্য-বীর্যের কারণে, তার ক্ষমতায়নের কারণে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের আর্থিক ধ্বসের কারণে বিশ্বের পরাশক্তির আসনে যখন একচ্ছত্রভাবে আমেরিকার আবির্ভাব ঘটে, তখন থেকেই একক ক্ষমতার বলে ও সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক কৌশলে যখন তারা তাদের সভ্যতাকে ছড়িয়ে দিতে চাইল, বিশ্বায়ন নীতি গ্রহণ করলো। তখন তারা খুব অল্পতেই সফল হলো। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নে খুব সহজেই এগিয়ে গেলো। মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই তা গ্রহণ করতে লাগলো। শক্তিধর ফ্রান্স ও বৃটেনের ফরাসি সভ্যতা ও ব্রিটিশ সভ্যতাও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়লো। প্রাচ্য ও উপমহাদেশের মুসলিমগণ হাজার বছরের প্রাচীন গৌরবময় ইসলামী সভ্যতা কে ভুলে গেল এবং তারাই ইসলামী সভ্যতাকে সেকেলে বলা শুরু করলো।
হায়! কোন সভ্যতার বুঝি এমনই অধপতন ঘটে!!
অতএব, মুসলিম জাতি ও তার সভ্যতার এমন অধপতনের পর পুনরায় তার উত্থানের জন্য সুস্পষ্ট কিতাল ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। প্রচলিত সমাজব্যবস্থা থেকে মানুষকে বের করার জন্য এই সমাজ ব্যবস্থার নির্মূল অবশ্যম্ভাবী। যতই উত্তম নসিহাহ, দাওয়াহ, সমাজসেবামূলক কার্যক্রম করা হচ্ছে, আপনি কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানুষকে আপনার পাশে পাচ্ছেন না, পাবেন না! আপনার মতবাদের সামগ্রিক বিজয় সম্ভব নয়! উত্তম নাসিহাহ ও সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে যদি সামগ্রিক বিজয় সম্ভব হতো, তবে 'ইখওয়ান' এর ইতিহাস টা ভিন্ন হতো। 'জামাতে ইসলামী' বাংলাদেশে ইসলামী হুকুমত কায়েমে সফল হতো। 'ইসলামী আন্দোলন' এর পীর সাহেবের অসংখ্য মজনুন মুরিদগণ অন্তত তাকে ভোট দিতো!
হ্যাঁ ভাই! এখন সশস্ত্র বিপ্লবের কোন বিকল্প নেই!!
মনে রাখবেন, দূর্বলের শত অনুনয়-বিনয়, উত্তম নসিহাহ ও সদাচারণ থেকে প্রতাপশালী-শক্তিমানের একটি মুচকি হাসিই মানুষকে বেশি আনন্দিত, প্রভাবিত করে!
এটাই মানুষের সাধারণ ফিতরত!
অতএব প্রতাপশালী ও শক্তিমান হওয়ার ফিকির করুন!!
লিখেছেন: শুয়াইব আল হাম্মাদ
সম্পাদনা: আহসান হাবীব ভাই