সালাফদের জীবনী:
স্মৃতির পাতায় আকাবির উলামা-
আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ.
আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. মুজাহিদ, আলেম, আবেদ, যাহেদ, দানশীল, খোদাভিরু, এ সবগুলো পরিচয়েই সমানভাবে পরিচিত। একটাকে আর একটার চেয়ে প্রাধান্য দেওয়া কঠিন। তবুও তাঁর মুখ্য পরিচয় হিসেবে ইলম ও জিহাদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয়। অর্থাৎ, তাঁর মুখ্য পরিচয় হল তিনি তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ও শ্রেষ্ঠ মুজাহিদ। তাঁর ইলমের মজলিসে নানা দেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্ররা এসে ভীড় করতো এবং তাকে এক নজর দেখার জন্য দূর দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতো। অনুরুপভাবে জিহাদের ময়দান থেকে তাঁর ভয়ে শত্রু-পক্ষের অনেক বড় বড় বীর যোদ্ধারা ময়দান ছেড়ে পলায়ন করতো। তাঁর ইলমের মজলিসের একটি ঘটনা: একবার বাদশাহ হারুনুর রশীদ তার স্ত্রীকে নিয়ে রাক্কায় ভ্রমণ করলেন। ঠিক ঐ সময়টাতে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক ও রাক্কায় অবস্থান করছিলেন। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য, তাঁর ইলমের মজলিসে একটু সময় বসার জন্য হাজার হাজার মানুষ এসে ভীড় করল। এতো মানুষ এক জায়গায় ভীড় করতে দেখে বাদশা-পত্নী তার পাশে থাকা কাউকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে এখানে এতো মানুষের ভীড় কেন? তাকে বলা হল, এখানে খোরাসানের আলেম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. এসেছেন। তাই তাকে দেখতে এতো মানুষের ভীড় হয়েছে। তখন বাদশা-পত্নী বলল, ‘খোদার কসম বাদশাহী তো এটাকেই বলে।’ দেখুন তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে স্বয়ং বাদশাহ হারুনুর রশীদ কী বললেন। ১৮১ হিজরিতে জিহাদ থেকে ফেরার পর রমজান মাসের কোন একদিন তাঁর ইন্তেকাল হল। তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ শুনে বাদশাহ হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আল্লাহর কসম সাইয়্যিদুল উলামার ইন্তেকাল হল’ এবার আসুন জিহাদের ময়দানে তাঁর কিছু বিরত্বের কথা নিয়ে আলোচনা করি। উবাদা ইবনে সুলাইমান বলেন এক যুদ্ধে আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. এর সাথে ছিলাম। উভয় বাহিনী মুখোমুখি দাঁড়ানোর পর শত্রু-পক্ষের এক লোক অগ্রসর হয়ে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান করল। অতঃপর মুসলমানদের এক লোক অগ্রসর হতেই সে তাকে হত্যা করে ফেলে। এভাবে তিনজন শহীদ হওয়ার পর মুসলমানদের মধ্য থেকে কাপড়ে চেহারা ঢাকা এক বীর যোদ্ধা এগিয়ে গেলেন এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে হত্যা করে ফিরে এলেন। অতঃপর লোকেরা তাকে ঘিরে ধরল; কিন্তু মুখের উপর কাপড় থাকার কারণে তাকে চেনা যাচ্ছিল না। তখন আমি তার কাপড় ধরে টান দিয়ে মুখের কাপড় সরিয়ে দেখি ইনি আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ.।
আরেকটি ঘটনা: আব্দুল্লাহ ইবনে সিনান বলেন, আমি একবার আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. এর সাথে তারতুসে অবস্থান করছিলাম। ইতিমধ্যে জিহাদের ডাক এসে গেল। তখন তিনি জিহাদে বের হয়ে গেলেন। অতঃপর দুই বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার পর শত্রু শিবির থেকে এক লোক অগ্রসর হয়ে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান করল। তখন এক মুসলিম যোদ্বা সামনে অগ্রসর হল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শহীদ হলেন। এরপর সে আবারও দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান করল। এভাবে একে একে ছয় জনকে হত্যা করার পর দুই বাহিনীর মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় বুক ফুলিয়ে তরবারী উচিয়ে অহংকারের সাথে ছুটাছুটি করতে লাগল আর মুসলমানদের দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ বান করছিল। কিন্তু কেউ সামনে অগ্রসর হচ্ছিল না। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ . সামনে অগ্রসর হয়ে তাকে হত্যা করলেন এবং একইভাবে কাফেরদের থেকেও ছয়জনকে হত্যা করার পর যখন আর কেউ সামনে আসার সাহস পাচ্ছিল না তখন তিনি দ্রুত ঘোড়া নিয়ে দূরে নির্জন এক জায়গায় চলে গেলেন। তখন আমি তার পিছে পিছে গেলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, আব্দুল্লাহ! তোমার কাছে আমার অনুরোধ, আমার এ কথা কাউকে বলবে না। অন্ততপক্ষে। আমার জীবদ্দশাতে নয়। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. ইলম অর্জন ব্যতীত বসে থাকাকে পছন্দ করতেন না। তাকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি আর কত ইলমের জন্য ছুটবেন? তিনি বলেছিলেন ইনশাআল্লাহ মৃত্যু পর্যন্ত। তিনি ঐ সকল লোকদের ব্যাপারে বলতেন যারা ইলম অর্জনে গাফেল- “ইলম অর্জন ব্যতীত মানুষ কিভাবে মহৎ হতে চায়। অনুরুপভাবে তিনি জিহাদ ব্যতীত ঘরে বসে থাকাকে ঘৃণা করতেন। তাইতো তিনি ইলম অর্জনের জন্য যে এলাকাতেই ভ্রমণ করেছেন, আর সেখানে জিহাদের ডাক এসেছে; তিনি সব কাজ ফেলে আগে জিহাদে শরীক হয়েছেন। তিনি জিহাদ ছেড়ে ঘরে বসে ইবাদতরত দরবেশদের তিরস্কার করে বলেন,
أيها الناسك الذي لبس الصوف
وأضحي يعد في العباد
إلزم الثغر والتعبد فيه
ليس بغداد مسكن الزهاد إن بغداد للملوك محلمناخ اللقارئ الصياد
হে দামী পশমী কাপড় পরিধানকারী এবং কুরবানির গোস্ত বক্ষণকারী আবেদ- দরবেশ! সিমান্তে গিয়ে ইবাদত বন্দেগী কর,
বাগদাদ তো যাহেদ-দরবেশদের থাকার জায়গা না। বাগদাদ তো রাজা-বাদশা আর চাটুকারদের স্থান।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. একবার এক সিমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে আবেদুল হারামাইন নামে পরিচিত বিখ্যাত সূফী ফুযাইল ইবনে ইয়াজ রহ. কে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠিতে লিখেন,
يا عابد الحرمين لو أبصرتنا لعلمت أنك في العبادة تلعب
ওহে আবেদার হারামাইন (মক্কা মদীনায় ইবাদতকারী)! তুমি যদি আমাদের ইবাদত দেখতে তাহলে বুঝতে পারতে আমাদের ইবাদতের তুলনায় তোমার ইবাদতগুলো খেলনা-ছলনা মাত্র।
من كان يخضب خده بدموعه فنحورنا بدمائنا تتخضب
ইবাদতের অতিশয্যে (তোমাদের) অশ্রু দিয়ে গাল ভিজে, আর আমাদের গ্রীবা রক্তে রঞ্জিত
أو كان يتعب خيله في باطل فخيولنا يوم الصبيحة تتعب
তোমাদের ঘোড়া গুলো বেহুদা বোঝা বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়, আর আমাদের ঘোড়া গুলো যুদ্ধের দিন ভোর বেলা যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়।
ريح العبير لكم ونحن عبيرنا رهج السنابك والغبار الأطيب
তুমি যখন ইবাদত করতে বস, তখন মেশকের সুগন্ধি ব্যবহার করে বস। আর আমাদের সুগন্ধি হচ্ছে, ঘোড়ার পদাঘাতে নির্গত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এবং যুদ্ধের ময়দানের ধুলা বালি।
لقد أتانا من مقال نبينا قول صحیح صادق لا يكذب
আর যেন রাখ! আমাদের ধুলাবালি সম্পর্কে আমাদের কাছে নবীজীর সত্য সঠিক বাণী এসেছে, যা কখন মিথ্যা হওয়ার নয়। আর তা হচ্ছে,
لا يستوي وغبار خيل الله في أنف امرئ ودخان نار تلهب
‘যুদ্ধের ময়দানের ধুলা বালি আর জাহান্নামের প্রজ্জলিত আগুনের ধোয়া কোন ব্যক্তির নাকে কখনই একত্রি হবে না।’
هذا كتاب الله ينطق بيننا ليس الشهيد بمية لايكذب
আর কিতাবুল্লাহ আমাদের ব্যাপারে এই বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে, ‘শহীদরা মৃত নয়। আর কিতাবুল্লাহ কখনও মিথ্যা বলে না।
ফুযাইল ইবেন ইয়ায রহ. এর নিকট যখন এই চিঠি পৌছল তখন তিনি এই চিঠি পড়ে অশ্রুসিক্ত অবস্থায় বলেন, আবু আব্দুর রহমান ঠিকই বলেছে এবং আমাকে সৎ উপদেশ দিয়েছে।
আল বালাগ
ম্যাগাজিন ইস্যু-১