দারসুল হাদিস:
রক্তের মূল্য
শাইখ তামিম আল আদনানি হাফিজাহুল্লাহ্
জিহাদ হচ্ছে গুরত্বপূর্ণ একটি ফরজ ইবাদত। জিহাদ হচ্ছে সর্বোত্তম আমল। জিহাদ হচ্ছে ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়া। জিহাদ হচ্ছে উম্মাহর সম্মান ও মুক্তির পথ। সুতরাং আমাদের সতর্ক থাকতে হবে আমাদের কারণে যাতে জিহাদ নামক এই শ্রেষ্ঠ ইবাদত কুলষিত না হয়। আমাদের কারনে যাতে মুজাহিদীনদের আদর্শ কলঙ্কিত না হয়। আমাদের হাত দ্বারা যাতে অন্যায়ভাবে কোন মুসলিমের রক্ত প্রবাহিত না হয়। আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে, অন্যায়ভাবে কাউকে তাকফির করে মুরতাদ ফতোয়া দেয়ার ক্ষেত্রে এবং অন্যায়ভাবে কোন মুসলিমের রক্ত প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক সময়ে শাম ও ইরাকের ভূমিতে আমরা দেখেছি কিছু গুলাত (সীমালঙ্ঘন কারী), তাকফিরী ও খারেজীরা ব্যাপকভাবে মুজাহিদীনদের তাকফীর করছে এবং তাদের মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে হত্যা করাকে বৈধ মনে করছে। এমনও হচ্ছে যে, একজন মুসলিম মুজাহিদকে মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অথচ সে চিৎকার করে বলছে,
أشهد الااله إلا الله وأن محمدا رسول الله
এই সীমালঙ্ঘনকারীরা বড় বড় উলামায়ে কেরামগণকে তাকফীর করছে এবং উলামাদের শিরচ্ছেদ করে তাদের মাথাকে পদদলিত করে উল্লাস করছে; উলামায়ে কেরামগণের প্রতি সামান্য শ্রদ্ধাবোধও তাদের নেই। তারা মসজিদে আত্মঘাতী আক্রমণ করছে এবং সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করছে; মুসলমানদের রক্তের সামান্যতম মূল্যও তাদের কাছে নেই। এই ফিতনা আজ শুধুমাত্র শাম ও ইরাকের মাঝেই সীমাবধ্য নয়, বরং তা পুরো পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছে। আজ পৃথিবীর সব জায়গাতেই এমন ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে যারা নিজের মতের সাথে অন্যের মতের অমিল হলেই তাকে তাকফির করে বসে এবং তাকে হত্যা করা বৈধ মনে করে। অথচ, ইসলামে একজন নির্দোষ মানুষের রক্তের মূল্য অনেক অনেক বেশি। আসুন আমরা দেখে নেই মুসলমানদের রক্তের মূল্য সম্পর্কে কুরআন ও হাদিস কী বলে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهُۥ جَهَنَّمُ خٰلِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُۥ وَأَعَدَّ لَهُۥ عَذَابًا عَظِيمًا
“যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে কোন মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুব্ধ হয়েছেন, তকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্যে ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।” (সূরা নিসা: ৯৩)
عن عبد الله بن عمرو بن العاص قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : والذي نفسي بيده لقتل مؤمن أعظم عند الله من زوال الدنيا
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, ঐ সত্তার কসম করে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ! একজন মুমিনকে (ইচ্ছাকৃত) হত্যা করা আল্লাহর তাআলার নিকট দুনিয়া ধ্বংসের চেয়েও গুরুতর। -নাসাঈ
عن ابن عمر رضي الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله علیه وسلم : لن يزال المؤم في فسحة من دينه ما لم يصب دما حراما
ইবনে ওমর রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, ‘মুমিন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত তার দীনের সীমার প্রসস্ততার মধ্যে থাকবে যতক্ষণ না সে কোন হারাম রক্ত প্রবাহিত করে।’ -বুখারী
عن أبي إدريس قال سمعت معاوية يقول سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : كل ذنب عسى الله أن يغفره إلا الرجل يقتل مؤمنا متعمدا أو الرجل يموت كافرا
আবু ইদরীস থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি মুআবিয়া রাযি. কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, ‘আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন তবে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা কারী এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণকারীকে ক্ষমা করবেন না।’ -নাসাঈ
عن عبد الله قال قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم- أول ما - بين الناس يوم القيامة في الدماء
আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম মানুষের মাঝে রক্তের বিচার হবে।’ -মুসলিম
عن ابن عباس سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم ، يقول : ثكلته أمه شماله، قتل رجلا متعمدا ، يجيء يوم القيامة آخذا قاتله بيمينه ، تشخب أو شماله، تشخب اوقبل. دما في قبل العرش، ، يقول : يا رب سل عبدك فيم قتلني؟
ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল ﷺ কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, তার মা তার জন্য ক্রন্দন করুক (অর্থাৎ সে ধ্বংস হোক) যে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন (নিরপরাধ) মানুষকে হত্যা কিয়ামতের দিন (নিহত ব্যক্তি) তার হত্যাকারীকে তার ডান হাত অথবা বাম হাত দিয়ে ধরে এবং ডান হাত অথবা বামহাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে রক্তাক্ত অবস্থায় আরশের সামনে এসে উপস্থিত হয়ে বলবে, হে আমার প্রতিপালক আপনি আপনার বান্দাকে জিজ্ঞাসা করুন সে কেন আমাকে হত্যা করেছিল?’ -মুসনাদে আহমদ
عن ابن سيرين سمعت أبا هريرة يقول قال أبو القاسم–صلى الله عليه وسلم « من أشار إلى أخيه بحديدة فإن الملائكة تلعة حتى وإن كان أخاه لأبيه وأمه
ইবনে সীরিন থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রা রাযি. কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, আবুল কাসেম ﷺ (রাসূল ﷺ এর কুনিয়ত) বলেন, “যে ব্যক্তি তার ভায়ের দিকে অস্ত্রের ইশারা করল, হোক না সে তার আপন ভাই; তার প্রতি ফেরেস্তারা অভিসম্পাত করতে থাকে যতক্ষণ না সে অস্ত্র সরিয়ে নেয়।-মুসলিম - ৩
عن أسامة بن زيد - رضي الله عنهما - ( قال بعثنا رسول الله - صلى الله عليه وسلم - في سرية قصځتا الحرقات من جهينة فأدركت رجل فقال لا إله إلا الله فطعنه فوقة في نفسي من ذلك فذكره لنبتي - صلى الله عليه وسلم - فقال رسول الله - صلی الله عليه وسلم - : أقال : لا إله إلا الله وقتلته ؟ قال قلت : يا رسول الله إنما قالها خوفا من السلاح قال : أفلا شققت عن قلبه حتى تعلم قالها أم لا ؟ فما زال يكررها على حتى تمنيت أني : أسلمت يومئذ
উসামা ইবনে যায়েদ রাযি. বলেন, রাসূল ﷺ আমাকে এক সারিয়াতে প্রেরণ করেছিলেন আমরা সকাল বেলা জুহায়না গোত্রের নিকটে কিছু অঞ্চলে আক্রমণ করলাম। আমি সেখানে এক লোককে ধরে ফেললাম। অতঃপর সে لا اله الا الله পাঠ করল। তা সত্ত্বেও আমি তাকে হত্যা করলাম। বিষয়টি নিয়ে আমি অস্বস্তি বোধ করছিলাম তাই আমি এটা রাসূল ﷺ এর নিকট উপস্থাপন করলাম, রাসূল ﷺ আমাকে বললেন, সে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়ল আর তুমি তাকে হত্যা করলে! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ﷺ সে তো অস্ত্রের ভয়ে এটা পড়েছে। তিনি বললেন, ‘সে অস্ত্রের ভয়ে পড়েছে না সত্যি সত্যি পড়েছে এটা জানার জন্য তুমি কেন তার হৃদয় চিরে দেখলে না?’ রাসূল ﷺ এটা এতোবার বলছিলেন যে, আমার মনে হতে লাগল! আমি যদি তখন মুসলমান হতাম, (অর্থাৎ পূর্বে মুসলমান না হয়ে তখন মুসলমান হলে তো আমার মাধ্যমে এ অপরাধ সংঘটিত হতো)।
অন্য হাদীসে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাযি. এর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে,
عن ابن عمر - رضي الله عنهما - قال : بعث النبي – صلی الله عليه وسلم - خالد بن الوليد - أحسبه قال - إلى بني جذيمة ، فدعاهم إلى الإسلام فلم يحسنوا أن يقولوا : أسلمنا ، فقالوا : صبانا صبانا ، وجعل خالد بهم قتلا وأسرا ، قال : ثم دفع إلى كل رجل منا أسيرا حتى إذا أصبح يوما أمرنا ، فقال : ليفان كل واحد منكم أسيرة . قال ابن عمر - رضي ا : والله لا أقتل أسيري ، ولا يقتل أحد من أصحابي أسيره ، قال : فقدمنا على رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فذكر له ما صنع خالة ، قال : فرفع يديه ، ثم قال : " اللهم أبرأ مما صنع خالد
ইবনে ওমর রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ﷺ খালেদ রাযি. কে বনী জাযীমায় প্রেরণ করলেন। খালেদ রাযি. তাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বললেন। তারা ইসলাম গ্রহণ করলাম- একথা ভালভাবে বলতে পারল না তাই তারা বলল, আমরা স্বধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলাম। কিন্তু খালেদ রাযি. তাদেরকে হত্যা এবং বন্দী করলেন এবং আমাদের প্রত্যেককেই একজন করে বন্দীর দায়িত্ব দিলেন। পরদিন সকালে আমাদেরকে প্রত্যেকের কাছে থাকা বন্দীকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। তখন ইবনে ওমর বলেন, আল্লাহর কসম আমি আমার বন্দীকে হত্যা করবো না এবং আমার সঙ্গীরা কেউ তার বন্দীকে হত্যা করবে না। তিনি বলেন, অতঃপর আমরা রাসূল ﷺ এর নিকট ফিরে আসলাম এবং তাঁকে খালেদ রাযি. এর বিষয়টি জানানো হল। তখন তিনি আকাশের দিকে হাত তুলে বললেন,
اللهم أبرأ مما صنع خالد
“হে আল্লাহ খালেদ যা করেছে আমি তার দায়িত্ব নেব না।”- বুখারী
عن أبي هريرة قال قال انبى -صلى الله عليه وسلم - والذي نفسى بيده ليأتين على الناس زمان لا يدرى القاتل في أى شئ قتل ولا يدرى المقتول على أى شئ و قتل
আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বলেন, “ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! মানুষের উপর এমন জামানা আসবে যখন হত্যাকারী জানবে না যে সে কী কারণে হত্যা করল এবং নিহত ব্যক্তিও জানবে না যে কী কারণে তাকে হত্যা করা হল।” -মুসলিম
সম্মানিত উপস্থিতি! উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসসমূহ থেকে একজন মুসলিমের রক্তের মুল্য যে কত বেশি তা স্পষ্টভাবে বুঝে আসে। উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসকে সামনে রেখেই আল কায়েদার সম্মানিত উলামায়ে কোরামগণ যুদ্ধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতার নির্দেশ দিয়েছেন; যাতে অনিচ্ছা স্বত্ত্বে অন্যায়ভাবে একজন মুসলিমের রক্ত প্রবাহিত না হয়। আল-কায়েদার পক্ষ থেকে মসজিদ, বাজার, পরিবহনরুট, জনসমাগমের স্থান ও সাধারণ মানুষকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানাতে সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং সন্দেহপূর্ণ যে কোন ধরনের আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে; এ ধরনের সকল আক্রমণ থেকে আল কায়েদার উলামায়ে কেরামগণ নিজেদের দায়মুক্তি ঘোষণা করেছেন।
শায়েখ আতিয়াতুল্লাহ আল লীবি রহ. বলেন,
فلتفني ولنفني تنظيماتنا و جماعاتنا ولا يراق علي ايدينا دم امرء مسلم
“পৃথিবী ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক আমাদের সংগঠন, দল এবং অস্তিত্ব; কিন্তু আমাদের হাত যেন বেআইনীভাবে মুসলমানের রক্ত ঝরার কারণ না হয়।
والله يا اخي أننا قد خرجنا في هذا الطريق لنصرة هذا الدين اننا قد خرجنا في هذا الطريق لإعلاء كلمة الله إننا قد خرجنا في هذا الطريق لنصرة المتضعفين
“হে আমার ভাই! আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমরা এই পথে বের হয়েছি এই দীনকে সাহায্য করার জন্যে। আমরা এই পথে বের হয়েছি আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্যে। আমরা এই পথে বের হয়েছি মাজলুম মুসলমানদের সাহায্য করার জন্যে; সুতরাং আমাদের দ্বারা যাতে এই দীন ও উম্মাহর অকল্যাণ সাধিত না হয় ।
আল বালাগ
ম্যাগাজিন ইস্যু-১