আত্মশুদ্ধি - ১৭
অহংকার ধ্বংসের মূল
মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ
সূচিপত্র
শোকরঃ অহংকার থেকে মুক্তির উপায়. 8
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيم
আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন, ওয়াস্-সালাতু ওয়াস্-সালামু আলা সাইয়িদিল আম্বিয়া-ই ওয়াল-মুরসালীন, ওয়া আলা আলিহী, ওয়া আসহাবিহী, ওয়ামান তাবিয়াহুম বি ইহসানিন ইলা ইয়াওমিদ্দীন, মিনাল উলামা ওয়াল মুজাহিদীন, ওয়া আম্মাতিল মুসলিমীন, আমীন ইয়া রাব্বাল আ’লামীন। আম্মা বা’দ,
মুহতারাম ভাইয়েরা! প্রথমে আমরা সকলেই একবার দুরূদ শরীফ পড়ে নিই।
اللهم صل على محمد وعلى آل محمد، كما صليت على ابراهيم وعلي آل إبراهيم، إنك حميد مجيد، اللهم بارك على محمد وعلى آل محمد، كما باركت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم إنك حميد مجيد.
বেশ কিছুদিন পর আবারও আমরা আরেকটি তাযকিয়া মজলিসে হাজির হতে পেরেছি, এই জন্য মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার দরবারে শুকরিয়া আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ।
মুহতারাম ভাইয়েরা, আজকে যে বিষয়টি আলোচনা করার ইচ্ছা করেছি তা হচ্ছে, অহংকার।
আমাদের প্রত্যেককেই জীবন চলার পথে অনেক নেতিবাচক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয় বা পরিহার করতে হয়। আমাদের কেউ ওগুলোকে পরিহার করতে পারে কেউ পারে না। যারা পারে তারা তাদের জীবনে সফলতা লাভ করে। আর যারা পারে না তারা এক সময় লজ্জিত হয়, অনুতপ্ত হয়।
আমাদেরকে যেসব নেতিবাচক জিনিস একদম পরিহার করতে হয় তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস হল অহংকার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমরা অনেকেই একে পরিহার করতে পারি না। আর এই না পারার কারণে আমাদের ক্ষতি যা হওয়ায় তা ঠিক হচ্ছে। আমাদের ঈমান-আমল অল্প সল্প যা-ই আছে তাও বরবাদ হচ্ছে। কম বেশি আমরা সবাই এ রোগে আক্রান্ত। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এ রোগ থেকে মুক্তি নসীব করেন।
আমাদের বিভিন্ন জনের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে এ রোগের বহির্প্রকাশ ঘটে থাকে। উদাহরণত, আমাদের কেউ কেউ দ্বীনের ব্যাপারে, কোরআন-হাদীসের ব্যাপারে নিজের বুঝের ওপর এমনই আস্থাশীল যে, ভাবখানা এমন যে, কোরআন-হাদীসের ব্যাপারে তিনি যা বুঝেন ওটাই সঠিক। অন্যরা যে যা-ই বলুক সবই ভুল। এর পরিণতিতে তিনি নিজের বুঝের উপর ভিত্তি করে অহরহ কোরআন-হাদীসের তাহরীফ করে যান। হয়তো তার খবরও নেই যে তিনি তাহরীফ করছেন।
বিশেষ করে বর্তমানে জিহাদের বিষয়গুলোকে তাহরীফ করে যারা উম্মতকে গোমরাহীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই এ রোগে আক্রান্ত। এভাবে তাহরীফ করে করে তারা নিজেদের দ্বীন-ঈমান ধ্বংস করে দিচ্ছেন। অথচ তাঁদের সে খবরই নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এ রোগ থেকে হেফাজত করুন, আমীন।
আমাদের করণীয়
আমরা যারা জিহাদী প্লাটফর্মে কাজ করি, আমাদের অন্তরে যেন কোনও ভাবেই এ রোগ না আসে সেদিকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। হাদীসে অহংকারের পরিচয় দেয়া হয়েছে, অহংকার হল, হক বা সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে তুচ্ছ মনে করা। আমরা সব সময় নিজেকে ছোট মনে করব। অপর ভাইকে বড় মনে করব। নিজের বুঝ বুদ্ধি ও সিদ্ধান্তকে কখনোই চুড়ান্ত মনে করব না। অন্য সবাইকে আমার চেয়ে বুদ্ধিমান, জ্ঞানী এবং দ্বীনের জন্য নিবেদিত মনে করব। সব সময় অন্য ভাইদেরকে সম্মান করব। তাদের যে কোন মতামত, প্লান পরিকল্পনা ও কাজকে সম্মান করব।
অহংকারের বিপরীত হল বিনয়। আমাদেরকে অহংকার পরিহার করে বিনয় অর্জন করতে হবে। কারণ বিনয়ের কারণে একজন ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায় পক্ষান্তরে অহংকার মানুষকে লাঞ্ছিত করে, অপদস্থ করে। অহংকারী নিজেকে বড় মনে করে কিন্তু মানুষ তাকে তুচ্ছ মনে করে। পক্ষান্তরে বিনয়ী নিজেকে ছোট মনে করে ফলে মানুষের দৃষ্টিতে সে হয় সম্মানের পাত্র।
অহংকারীর উপমা
আরবি একটি গল্পে অহংকারীর খুব চমৎকার একটি উপমা দেয়া হয়েছে। উপমাটি হল, কেউ যখন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে নিচের দিকে তাকায়, তখন নিচের সবকিছুই তার কাছে ছোট ছোট মনে হয়। নিজের দুই চোখ দিয়ে হাজারো মানুষকে সে ছোট ছোট দেখে। আবার যারা নিচে আছে তারাও তাকে ছোটই দেখে। একদিকে তার দুটি মাত্র চোখ (যা দিয়ে সে নিজেকে বড় আর সবাইকে ছোট দেখছে) অপর দিকে হাজারো মানুষের হাজার হাজার চোখ। (যা দিয়ে তারা তাকেই ছোট দেখছে) ঠিক তেমনি অহংকারী ব্যক্তি যখন সবাইকে তুচ্ছ মনে করে তখন তাকেও সবাই তুচ্ছ মনে করে।
প্রথম পাপ
অহংকার হচ্ছে সকল পাপের মূল। আরবীতে বলা হয়, উম্মুল আমরায-সকল রোগের জননী। সৃষ্টিজগতের প্রথম মানব হলেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম। আল্লাহ তাআলা যখন ফেরেশতাদেরকে মানব-সৃষ্টির ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন তখন তাঁরা বলছিলেন, আপনি এমন মাখলুক কেন সৃষ্টি করবেন, যারা পৃথিবীতে নৈরাজ্য ঘটাবে, একে অন্যের রক্ত ঝরাবে, অথচ আমরাতো আপনার তাসবীহ ও তাকদীসে মগ্ন আছি। মনে মনে তারা এও ভেবেছিল, আল্লাহ তাআলা কিছুতেই এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন না, যে আমাদের চেয়ে বেশি জানবে এবং যে তাঁর নিকট আমাদের চেয়ে অধিক সম্মানিত হবে। এসবের পরও আল্লাহ তাআলা যখন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করে তাদেরকে বললেন, তোমরা তাঁকে সিজদা কর তখন সবাই তাঁর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন।
এতো হল ফেরেশতাদের অবস্থা। তাদেরকে যা-ই আদেশ করা হল তা-ই তারা করলেন। কিন্তু ফেরেশতাদের মাঝে বেড়ে ওঠা শয়তান মাটি আর আগুনের যুক্তি হাজির করল। সে আগুনের তৈরি বলে মাটির তৈরি আদমকে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানাল।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ
আমি যখন ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সেজদা করো তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সেজদা করল। সে (সেজদা করতে) অস্বীকৃতি জানাল এবং অহংকার করল। সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা বাকারা ২ : ৩৪)
এই হল সৃষ্টি জগতের মধ্যে প্রথম পাপ। কী ছিল পাপটি? পাপটি ছিল, অহংকার। এ পাপের কারণেই শয়তান জান্নাত থেকে বিতাড়িত হল, চির অভিশপ্ত হল। মানুষের শত্রুতার ঘোষণা দিয়ে পৃথিবীতে নেমে এল। কত শক্ত শপথ সে সেদিন করেছিল, কুরআনের ভাষায়,
قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ. ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ ۖوَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ .
সে বলল, আপনি যেহেতু আমাকে পথচ্যুত করেছেন তাই আমি অবশ্যই তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকব। এরপর আমি তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবেন না। (সূরাআ‘রাফ ৭ : ১৬-১৭)
এই যে শয়তানের শপথ এবং এর পর থেকেই সে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে বনি আদমকে, এর মূলে তো সেই অহংকারই তাই না?
বর্তমান সময়ের শারীরিক রোগের মধ্যে ভয়ংকর একটি রোগ হচ্ছে ক্যান্সার। এ রোগ কিছুদিন মানব দেহে লুকিয়ে থেকে একসময় প্রকাশ পায়। আর যখন প্রকাশ পায় তখনই সেই রোগী চিকিৎসা করার জন্য অস্থির হয়ে যায়। তো রোগ প্রকাশ পাওয়া, রোগীর শরীরে রোগের আলামত ফুটে ওঠা এগুলোও এক প্রকার নিআমত। কারণ এর মাধ্যমেই রোগীর চিকিৎসার পথ উন্মোচিত হয়। এই ক্যান্সারের মতোই বরং তার চেয়ে ভয়ংকর একটি আত্মিক রোগ হল অহংকার। এ রোগটি এমন যে, কেউ কেউ নিজেও বুঝতে পারে না যে তার মধ্যে অহংকার আছে। রোগের অনুভূতিই যখন না থাকে তখন এর চিকিৎসার কথা ভাববে কীভাবে?
অহংকার কী?
এ প্রশ্নের সরল উত্তর হচ্ছে, কোনো বিষয়ে নিজেকে বড় মনে করে অন্য মানুষকে তুচ্ছ মনে করার নামই হল অহংকার। বাস্তবেই যে ব্যক্তি ছোট- বয়সে, অভিজ্ঞতায়, শক্তি-সামর্থে তাকে ছোট মনে করার নাম অহংকার নয়। বরং অহংকার হচ্ছে, সে ছোট বলে তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা এবং নিজেকে তার চেয়ে উত্তম মনে করা। যার ব্যাংক একাউন্টে কাড়িকাড়ি টাকা আছে, সে তো যে কিনা দিন আনে দিন খায় তাকে অর্থবিত্তে ছোট মনে করতেই পারে। এটা অহংকার নয়। অহংকার হচ্ছে তাকে তাচ্ছিল্য করা, গরীব বলে হেয় করা।
এটি একটি ঘাতক ব্যাধি
এই ঘাতক ব্যাধির কথা পবিত্র কুরআনে নানা ভাবে চিত্রিত হয়েছে। ঘাতক ব্যাধি এ জন্য বললাম, কারণ তা মানুষের অন্তরজগতকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। আর এর পরকালীন ক্ষতি তো আছেই।
যে অহংকার শয়তানকে ‘শয়তানে’ পরিণত করেছে, অভিশপ্ত করেছে, রহমত থেকে বঞ্চিত করেছে, সে অহংকারের মন্দ দিক সম্পর্কে আর কিছু না বললেও চলে।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
سَاَصْرِفُ عَنْ اٰیٰتِیَ الَّذِیْنَ یَتَكَبَّرُوْنَ فِی الْاَرْضِ بِغَیْرِ الْحَقِّ
পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার করে তাদেরকে আমি আমার নিদর্শনাবলি থেকে বিমুখ করে রাখব। (সূরা আ‘রাফ ৭:১৪৬)
إِلَـٰهُكُمْ إِلَـٰهٌ وَاحِدٌ ۚ فَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ قُلُوبُهُم مُّنكِرَةٌ وَهُم مُّسْتَكْبِرُونَ ﴿٢٢﴾ لَا جَرَمَ أَنَّ اللَّـهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْتَكْبِرِينَ ﴿٢٣﴾
তোমাদের মাবুদ এক মাবুদ। সুতরাং যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না তাদের অন্তরে অবিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেছে এবং তারা অহংকারে লিপ্ত। স্পষ্ট কথা, তারা যা গোপনে করে তা আল্লাহ জানেন এবং যা প্রকাশ্যে করে তাও। নিশ্চয়ই তিনি অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা নাহল ১৬:২২-২৩)
আয়াতগুলোর শিক্ষা
উদ্ধৃত আয়াতগুলো থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা হচ্ছে,
১. অহংকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাঁর নিদর্শনাবলী থেকে বিমুখ করে রাখেন। তার অন্তর ও চোখকে তিনি সত্য অনুধাবন এবং সঠিক পথ অবলোকন করা থেকে ‘অন্ধ’ করে দেন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় আমাদেরকে তাঁর নির্দশনাবলি নিয়ে চিন্তা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ চিন্তা একজন ব্যক্তির সামনে আল্লাহ পাকের বড়ত্ব, কুদরত এবং আমাদের ওপর তাঁর সীমাহীন অনগ্রহের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই মহান প্রভুর কাছে সে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে সঁপে দিতে প্রস্তুত হয়, কৃতজ্ঞতায় সিজদাবনত হয়। তাই আল্লাহ যদি কাউকে তাঁর ওসব নিদর্শন থেকে বিমুখ করে রাখেন তাহলে সে যে দ্বীনের সরলপথ থেকেও ছিটকে যাবে তা বলাই বাহুল্য।
২. অহংকার কেবল তারাই করতে পারে আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি যাদের ঈমান নেই, বিশ্বাস নেই।
৩. আল্লাহ তাআলা অহংকারীকে পছন্দ করেন না। কী ইহকাল আর কী পরকাল, একজন মানুষের অশান্তি, লাঞ্ছনা আর সমূহ বঞ্চনার জন্যে এরপরে কি আর কিছু লাগে?
‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ এ বিশ্বাস যাদের আছে তাদেরকে এ কথা মানতেই হবে যে, প্রকৃত সম্মান পেতে হলে অবশ্যই আল্লাহ তাআলার প্রিয়পাত্র হতে হবে।
অহংকার যে কী ভয়াবহ তা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সুস্পষ্ট ভাবেই বলে দিয়েছেন।
একটি হাদীস লক্ষ্য করুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لاَ يَدْخُلُ الجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ كِبْرٍ، وَلاَ يَدْخُلُ النَّارَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ إِيمَانٍ.
তিল পরিমাণ অহংকার যার অন্তরে আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, আর তিল পরিমাণ ঈমান যার অন্তরে আছে সে (চিরস্থায়ী ভাবে) দোজখে যাবে না। জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৯৮
দুটি বিষয় লক্ষণীয়
এক. অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না। জান্নাতে যেতে হলে ‘কলবে সালীম’ অর্থাৎ অহংকার ও সব ধরনের আত্মিক ব্যাধিমুক্ত পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হতে হবে।
দুই. হাদীসে জান্নাতের বিপরীতে দোজখের কথা বলা হয়েছে আর ঈমানের বিপরীতে অহংকারের কথা বলা হয়েছে। অথচ ঈমানের বিপরীত তো কুফর আসার কথা ছিল। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, হাদীসে কত কঠিন ভাবে অহংকারকে চিত্রিত করা হয়েছে, বিন্দু পরিমাণ অহংকার নিয়েও কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না!
উপস্থিত এক ভাইঃ ভাই তার মানে কি তিল পরিমাণ অহংকার থাকলে ঈমান থাকে না?
উস্তায হাফিঃ বিষয় হচ্ছে তিল পরিমাণ অহংকারই এক সময় অহংকারীর ঈমান নষ্ট করা পর্যন্ত নিয়ে যায়। অহংকার যে মানুষকে কতটা অন্ধ ও বাস্তবতাবিমুখ করে তোলে, সেই দৃষ্টান্তও রয়েছে কুরআনে কারীমে।
এ পর্যন্ত যত পাপী যত পাপ করেছে, ফেরাউন ও নমরুদের সঙ্গে কি কারও পাপের তুলনা চলে! তারা পাপ ও অবাধ্যতার সকল সীমা লঙ্ঘন করেছিল। এ সবের মূলে ছিল তাদের অহংকার।
তারা যখন অহংকার করে নিজেকে বড় আর অন্যদেরকে তুচ্ছ ভাবতে শুরু করল, এরই এক পর্যায়ে নিজেদেরকে ‘খোদা’ বলে দাবি করে বসল।
কেউ যখন আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে শরিক করে, হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী সেটা হয় সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ।
এ শিরকের গোনাহ আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। এ তো হল আল্লাহর সঙ্গে শরিক করার পরিণতি। তাহলে কেউ যদি নিজেকেই খোদা বলে দাবি করে তাহলে তার অপরাধটা যে কতটা জঘন্য তা কি বলে বোঝানো যাবে?
মক্কার মুশরিকরা যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে মেনে নেয়নি, এর মূলেও ছিল এই অহংকার। অহংকারের কারণেই পূববর্তী নবীগণকে তাঁদের জাতি মিথ্যাবাদী আখ্যায়িত করেছিল। মক্কার মুশরিকদের কথা পবিত্র কুরআনে এভাবে আলোচিত হয়েছে-
وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ هَـٰذَا الْقُرْآنُ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ
তারা বলে, এই কুরআন কেন দুই এলাকার কোনো মহান ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হল না! (সূরা যুখরুফ ৪৩:৩১)
শোকরঃ অহংকার থেকে মুক্তির উপায়
অহংকার থেকে মুক্ত থাকতে হলে কী করতে হবে-সে পথও বাতলে দিয়েছে আমাদের পবিত্র কুরআন। সে পথ শোকর ও কৃতজ্ঞতার পথ। বান্দা যখন শোকর আদায় করবে, কৃতজ্ঞতায় সিজদাবনত হবে, সবকিছুকেই আল্লাহর নিআমত বলে মনেপ্রাণে স্বীকার করবে তখন তার কাছে অহংকার আসবে কোত্থেকে?
শোকর করার অর্থই হল, আমার যা প্রাপ্তি, সবই আল্লাহর নিআমত ও অনুগ্রহ। এখানে আমার কোনোই কৃতিত্ব নেই। এ ভাবনা যার মনে সদা জাগরুক থাকে, অহংকার তার মনে বাসা বাঁধতেই পারে না।
সূরা কাহফে দুই ব্যক্তির উপমা দেয়া হয়েছে এভাবে
-وَاضْرِبْ لَهُم مَّثَلًا رَّجُلَيْنِ جَعَلْنَا لِأَحَدِهِمَا جَنَّتَيْنِ مِنْ أَعْنَابٍ وَحَفَفْنَاهُمَا بِنَخْلٍ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمَا زَرْعًا
كِلْتَا الْجَنَّتَيْنِ آتَتْ أُكُلَهَا وَلَمْ تَظْلِمْ مِنْهُ شَيْئًا وَفَجَّرْنَا خِلَالَهُمَا نَهَرًا
وَكَانَ لَهُ ثَمَرٌ فَقَالَ لِصَاحِبِهِ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَنَا أَكْثَرُ مِنكَ مَالًا وَأَعَزُّ نَفَرًا
وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَن تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا
وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِن رُّدِدتُّ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِّنْهَا مُنقَلَبًا
قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِن تُرَابٍ ثُمَّ مِن نُّطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلًا
لَّكِنَّا هُوَ اللَّهُ رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِرَبِّي أَحَدًا
وَلَوْلَا إِذْ دَخَلْتَ جَنَّتَكَ قُلْتَ مَا شَاء اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ إِن تُرَنِ أَنَا أَقَلَّ مِنكَ مَالًا وَوَلَدًا
অর্থঃ তুমি তাদের সামনে দুই ব্যক্তির উপমা পেশ কর, যাদের একজনকে আমি আঙ্গুরের দুটি বাগান দিয়েছিলাম এবং সে দুটিকে খেজুর গাছ দ্বারা ঘেরাও করে দিয়েছিলাম আর বাগান দুটির মাঝখানকে শস্যক্ষেত্র বানিয়েছিলাম।
উভয় বাগান পরিপূর্ণ ফল দান করত এবং কোনোটিই ফলদানে কোনো ত্রুটি করত না। আমি বাগান দুটির মাঝখানে একটি নহর প্রবাহিত করেছিলাম।
সেই ব্যক্তির প্রচুর ধনসম্পদ অর্জিত হল। অতঃপর সে কথাচ্ছলে তার সঙ্গীকে বলল : আমার অর্থসম্পদও তোমার চেয়ে বেশি এবং দলবলও তোমার চেয়ে শক্তিশালী।
নিজ সত্তার প্রতি সে জুলুম করেছিল আর এ অবস্থায় সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না, এ বাগান কখনো ধ্বংস হবে।
আমার ধারণা, কিয়ামত কখনোই হবে না। আর আমাকে আমার প্রতিপালকের কাছে যদি ফিরিয়ে নেয়া হয় তবে আমি নিশ্চিত, আমি এর চেয়েও উৎকৃষ্ট স্থান পাব। তার সঙ্গী কথাচ্ছলে তাকে বলল, ‘তুমি কি সেই সত্তার সঙ্গে কুফরি করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, তারপর শুক্র থেকে এবং তারপর তোমাকে একজন সুস্থসবল মানুষে পরিণত করেছেন?
আমার ব্যাপার তো এই যে, আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহই আমার প্রভু এবং আমি আমার প্রভুর সঙ্গে কাউকে শরিক মানি না।
তুমি যখন নিজ বাগানে প্রবেশ করছিলে, তখন তুমি কেন বললে না; মা-শা-আল্লাহ, লা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ (আল্লাহ যা চান তা-ই হয়, আল্লাহর তাওফিক ছাড়া কারও কোনো ক্ষমতা নেই)! (সূরা কাহফ (১৮) : ৩২-৩৯)
এই তো শোকর ও কৃতজ্ঞতার তালীম-তুমি তোমার বাগান দেখে কেন বললে না, ‘আল্লাহ যা চান তা-ই হয়’!
একটি ঘটনা
মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ রহ. ছিলেন বিখ্যাত এক বুযুর্গ। মুহাল্লাব নামক এক লোক তার পাশ দিয়ে রেশমি কাপড় পরে দম্ভভরে হেঁটে যাচ্ছিল। বুযুর্গ তাকে বললেন : এভাবে হাঁটছ কেন? সে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, আপনি জানেন, আমি কে? মুতাররিফ রহ. উত্তরে যা বলেছিলেন তা আমাদের সবার অন্তরে লিখে রাখার মতো। তিনি বলেছিলেন-
أوَّلُكَ نُطْفَةٌ مَذِرَةٌ، وَآخِرُكَ جِيْفَةٌ قَذِرَةٌ، وَأَنْتَ فِيْمَا بَيْنَ ذلِكَ تَحْمِلُ الْعَذِرَةَ.
অর্থ: তোমার সূচনা পুঁতিগন্ধময় বীর্যে, সমাপ্তি গলিত লাশে আর এ দুয়ের মাঝে তুমি এক বিষ্ঠাবাহী দেহ। (তাফসীরে কুরতুবী, সূরা মাআরিজের ৩৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
এই তো হল আমাদের হাকীকত। তাই অহংকার করার সুযোগ কোথায়? আপনি কোটি কোটি টাকার মালিক? কী নিশ্চয়তা আছে যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা আপনার হাতে থাকবে?
আজ যিনি ক্ষমতার কুরসিতে আসীন, যার দাপটে পুরো এলাকা কম্পমান, এই ক্ষমতা ও দাপটের স্থায়িত্বের গ্যারান্টি দেবে কে?
সকাল বেলার ধনীরে তুই ফকির সন্ধ্যা বেলা’-এ তো আমাদের চারপাশের দেখা বাস্তবতা।
আজ আপনি যাকে তুচ্ছ মনে করছেন, হেয় প্রতিপন্ন করছেন, ভবিষ্যতে আপনি যে তার অধীনস্থ হয়ে যাবেন না - এর কী বিশ্বাস আছে?
চলমান একটি উদাহরণ দিই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি ছেলেবেলায় ফেরি করে চা বিক্রি করতেন। আর এখন সে অহংকারের কোন মসনদে বসে আছে তা তো সবারই জানা আছে। বর্ণবাদ যেখানে চরমে। আমেরিকার মতো দেশে কৃষ্ণাঙ্গ ওবামা শ্বেতাঙ্গদের ওপর দাপটের সঙ্গে টানা আট বছর ছড়ি ঘুরিয়েছে।
এ-ই যখন দুনিয়ার বাস্তবতা, তাহলে অহংকার কীসে? অহংকারের মধ্যে লাঞ্চনা ছাড়া ভালো কিছুই নেই।
এবার যদি দ্বীনী প্রসঙ্গে বলি, সেখানেও একই কথা। আপনি অনেক বড় মুজাহিদ, আপনার অধীনে বহু ভাই জিহাদের কাজ করছেন, কিংবা আপনি অনেক বড় আবেদ, চারদিকে আপনার সুখ্যাতি, অনেক ইলমের অধিকারী আপনি, সবাই আপনাকে আল্লামা বলে, কিংবা আপনি দুহাত ভরে দান-সদকা করেন, চারদিকে ‘হাতেম তাঈ’ বলে পরিচিত, অথবা ইসলামের একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবে আপনি সুপরিচিত, তাই বলে কি অহংকার করার কোন সুযোগ আছে? যারা আপনার চেয়ে দুর্বল, ইবাদত-বন্দেগিতে, ইলমে-আমলে সর্বক্ষেত্রে, তাদেরকে কোনো ভাবে তাচ্ছিল্য করার সুযোগ আছে?
সব সময় মনে রাখতে হবে, আল্লাহর কাছে আমলের ‘পরিমাণ’ মূল জিনিস নয়। আমলের ‘মান’টাই হল মূল। হোক তা পরিমাণে সামান্য।
কুরআনের ভাষায় আল্লাহ তা’আলা বলেন:
اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقٰىكُمْ .
আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী। -সূরা হুজুরাত ৪৯: ১৩
তাই বাহ্যত যে দুর্বল, কে জানে-তাকওয়ার শক্তিতে আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে সে সবল হয়ে উঠেছে কিনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
رُبّ أَشْعَثَ مَدْفُوعٍ بِالأَبْوَابِ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لأَبَرّهُ.
অর্থ: কত এলোমেলোকেশী এমন আছে, যাকে দরজায় দরজায় তাড়িয়ে দেয়া হয়, অথচ সে যদি আল্লাহর নামে কোনো কসম করে বসে, আল্লাহ তা পূর্ণ করে দেন! -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬২২
সুবহানাল্লাহ!! আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে অহংকার পরিহার করে বিনয়ী হওয়ার তাওফীক দান করেন। আমীন।
উপস্থিত এক ভাইঃ মুহতারাম ভাই! আমার কাছে বহুদিন আগে এক অটোরিকশা চালক একটি বিষয় জানতে চেয়েছিলেন। সেটি হলো- কেউ যদি নামাজ না পড়ে, তাহলে কি তাকে তাচ্ছিল্য করা যাবে? এর কী জবাব হতে পারে ভাই?
উস্তাদ হাফিঃ লোকটি নামায না পড়েও যদি নামাযের প্রতি এবং দ্বীনের সকল বিষয়ের প্রতি মহাব্বত রাখে তাহলে তাকে তাচ্ছিল্য না করে বুঝানো উচিত। আর যদি ব্যতিক্রম হয় তবে ভিন্ন কথা।
মুহতারাম ভাইয়েরা, আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে অহংকার ও সব ধরনের আত্মিক ব্যাধিমুক্ত পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে ইখলাসের সাথে জিহাদ ও শাহাদাতের পথে অবিচল থাকার তাওফীক দান করুক।
আমরা সকলে মজলিস থেকে উঠার দোয়াটা পড়ে নিই।
سبحانك اللهم وبحمدك،أشهدأن لاإله إلا أنت،أستغفرك وأتوب إليك
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين
وآخردعوانا ان الحمد لله ربالعالمين
************