সমকালিন প্রসঙ্গ •
কোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রিক দেবীর মূর্তি
পাথরের মূর্তি বড় নাকি সংবিধান নামক মূর্তি?
শাইখ তামিম আল-আদনানী হাফিজাহুল্লাহ
نحمده و نصلى على رسوله الكريم اما بعد
সম্প্রতি এ দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপন করা হয়েছে একটি অর্ধনগ্ন নারী মূর্তি। গ্রীক মূর্তি পূজারীদের বিশ্বাস–‘দেবী থেমিস’ এর এ মূর্তিটি হল ন্যায়–পরায়ণতার দেবী। এ মূর্তিটি নিয়ে আমাদের সামাজে দুই ধরনের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। একদিকে, সুশীল-সেক্যুলার ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দালাল শাহবাগী গোষ্ঠী। তাদের দাবী–এ মূর্তিটি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে। তারা আরও বলছে–এটি কোন মূর্তি নয়; বরং এটি হল ভাস্কর্য। আর যারা এই মূর্তির বিরোধিতা করে; তারা হল মধ্যযুগীয়, বর্বর ও সাম্প্রদায়িক। তারা মুক্তিযুদ্ধ ও হাজার বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতির বিরোধী শক্তি। অপরদিকে, হেফাজতে ইসলাম সহ বিভিন্ন দলে বিভক্ত বাংলাদেশের আলেম সমাজ সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত এই মূর্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত। মূর্তি অপসারণের জন্য বিবৃতি প্রকাশ, স্মারক লিপি পেশ এবং কঠিন আন্দোলনের হুমকি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছেন। আমরা এই উভয় পক্ষের কাছেই কিছু প্রশ্ন করতে চাই। প্রথমে সুশীল-সেক্যুলার চেতনা ব্যবসায়ীদের কাছে কিছু প্রশ্ন করছি।
প্রথম প্রশ্ন: তোমরা বলছ–ভাস্কর্য আর মূর্তি দু’টি আলাদা জিনিস। ভাস্কর্য আর মূর্তি যে দু’টা আলাদা জিনিস; এই তথ্য তোমরা কোন উৎস থেকে পেয়েছ? আর কিভাবেই বা তোমরা এটা মনে করলে–মূর্তির সংজ্ঞা মুসলমানরা ইসলাম থেকে না নিয়ে তোমাদের কাছ থেকে নিবে?
চেতনা ব্যবসায়ীদের কাছে দ্বিতীয় প্রশ্ন–কিভাবে গ্রীক দেবীর মূর্তি বাঙ্গালী সংস্কৃতির পরিচায়ক হয়? নাকি বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলতেই তোমরা মূর্তি পূজাকে বোঝাও?
চেতনা ব্যবসায়ীদের কাছে দ্বিতীয় প্রশ্ন–কিভাবে গ্রীক দেবীর মূর্তি বাঙ্গালী সংস্কৃতির পরিচায়ক হয়? নাকি বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলতেই তোমরা মূর্তি পূজাকে বোঝাও? আর চৌদ্দশত বছর আগে নাযিলকৃত ইসলামের বিধান পালন করার কারণে যদি বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের তোমরা মধ্যযুগীয় বলে বেড়াও। তাহলে, হাজার বছর আগে যেই মূর্তির উপাসনা করা হত; সেই গ্রিক মূর্তির প্রতি তোমাদের ভালোবাসার কারণে, তোমাদের জাহেলিযুগীয় বললে খুব বেশি বলা হবে কি? যদি গ্রিক মুশরিকদের থেমিস দেবীর মূর্তিকে ধর্মনিরপেক্ষ আদালতের সামনে স্থাপন করতে তোমাদের এত আগ্রহ হয়; তাহলে সম্পূর্ণ মানব রচিত সংবিধানে বিসমিল্লাহ আর নামেমাত্র রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকলে তোমাদের এত আপত্তি কেন? তোমাদের কথিত ধর্ম নিরপেক্ষতার ফিল্টারে ইসলাম ছাড়া আর কিছুই কি আটকায় না?
আর হেফাজতে ইসলামসহ সরকারের কাছে দাবী আদায়ে আন্দোলনরত সম্মানিত উলামায়ে কেরামের প্রতি আমাদের প্রশ্ন–যেখানে বাংলাদেশের নিম্নো থেকে সর্বোচ্চ সব আদালতেই মানব রচিত কুফরী সংবিধান দিয়ে বিচার কার্য পরিচালিত হয়। যেখানে সংবিধানে পরিস্কার ভাবে বলা আছে- “সংবিধানই হল এই দেশের সর্বোচ্চ আইন, এর সাথে সাংঘর্ষিক বাকি সব আইন বাতিল।” যেখানে এই সুপ্রিম কোর্ট থেকে অহরহ ইসলাম ও শরিয়াহ বিরোধী আইন পাশ করা হয়। সেখানে এই সুপ্রিম কোর্ট নামক মন্দিরকে ফেলে মন্দিরের দরজার সামনের মূর্তিকে নিয়েই শুধু আপনারা কথা বলছেন? অথচ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কালামে মাজীদে এরশাদ করেছেন,
ان الحكم لا لله
“বিধান দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।”
যে কোর্টে আল্লাহর বিধানকে রহিত করে নিজেদের রচিত বিধান দ্বারা বিচার-ফয়সালা করা হয়। আল্লাহর আইনকে সংবিধান বিরোধী ঘোষণা করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। সেই কোর্টই যদি বহাল থাকে, স্বয়ং খোদার আসনে সমাসীন থাকে; তাহলে তার সামনে মূর্তি থাকা বা না থাকা নিয়ে আন্দোলন করে কি লাভ? মূর্তির আখড়া ঠিক থাকুক, শুধু এই একটি মূর্তিকে অপসারণ করলেই চলবে; এটাই কি তাওহীদী চেতনার দাবী। মূর্তি কি কেবল সুপ্রিম কোর্টের সামনেই স্থাপিত হয়েছে? প্রকাশ্যে আর কোথাও কি মূর্তি স্থাপিত নেই।
হে উলামায়ে কেরামগণ!
যে সুপ্রিম কোর্ট স্বয়ং একটি তাগুত, যেই সুপ্রিম কোর্টই একটি মূর্তি; সেই সুপ্রিম কোর্টের ব্যাপারে নিরব থেকে কেন শুধুতার সামনের মূর্তিটি নিয়েই কথা বলছেন? হেহে উলামায়ে কেরামগণ!
বাংলাদেশের মানুষ এখনো বোঝে না যে, এ সুপ্রিম কোর্টে আল্লাহর বিধান বিরোধী আইন দ্বারা বিচার-ফয়সালা করা হয়, কুরআন বিরোধী আইন দ্বারা বিচার কার্য পরিচালনা করা হয়। মানব রচিত কুফরি সংবিধান বাস্তবায়নের মূল আখড়াই হল দেশের সর্বোচ্চ আদালতখ্যাত এই সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু এই মহা
সত্য বিষয়টা আপনারা তো জানেন। এই সত্য বিষয়টা উম্মতকে জানানো কি আপনাদের দায়িত্ব নয়? নবীর ওয়ারিশ হিসেবে উম্মতকে এই ভয়াবহ শিরক ও কুফর থেকে সতর্ক করা কি আপনাদের ওপর আবশ্যকীয় নয়? তাহলে কেন আপনারা এই দায়িত্ব পালন থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধুমাত্র গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণের জন্য মূর্তি পূজারীদের কাছে কাকুতি-মিনতি করছেন?
হে উলামায়ে কেরামগণ!
মূর্তির পক্ষে আমরা কথা বলছি না। মূতির্র পক্ষে আমাদের অবস্থানও নয়। আমরা শুধুমাত্র আপনাদের এ সত্যকে উপলব্ধি করার আহবান করছি–এই তাগুত শাসক গোষ্ঠীর কাছে আবেদন করে কী লাভ হয় আমাদের? ইতিপূর্বেও তো আপনারা তাদের কাছে আবেদন করেছিলেন। আপনাদের ন্যূনতম দাবীও কি আদায় করতে পেরেছিলেন? সেই দিন তো অসংখ্য নিরস্ত্র অপ্রস্তুত মুসলমানেরই রক্ত ঝরেছিল। অনেক ভাই শহীদ হয়েছিল। কিন্তু আপনারা আপনাদের কোন দাবীই আদায় করতে পারেন নি। তাহলে আবারো কেন এই মুরতাদ শাসক ও মূর্তির রক্ষকদের কাছে মূর্তি অপসারণের দাবী? এ যেন শিয়ালের কাছেই মুরগি রক্ষার আবেদন! এই মুরতাদ শাসকগোষ্ঠী, গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমকে সশস্ত্র শক্তি দ্বারা প্রতিহত না করে শুধুমাত্র একটি মূর্তি সরানোর আবেদন করা বুজদিলি ছাড়া আর কিছুই নয়।
হে উম্মাহর রাহবার উলামায়ে কেরাম!
কেন আপনারা এই উম্মাহকে লাঞ্ছনা আর অপদস্থতার পথে নিয়ে যাচ্ছেন? কেন
নিজেদের দায়িত্ব পালন থেকে বারবার পিছিয়ে যাচ্ছেন? কেন সত্যকে জনগণের সামনে স্পষ্ট করছেন না? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কি বলেন নি?
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
‘অতঃএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন! যা আপনাকে আদেশ করা হয়। এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেন না।’ - সূরা হিজর: ৯৪
এই উম্মাহ তো ইজ্জতের জিন্দেগী অথবা ইজ্জতের মৃত্যুকে প্রাধান্য দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এই উম্মাহকে সম্মান আর মর্যাদাময় জিন্দেগির পথ দেখিয়ে গেছেন। আল্লাহর মনোনীত এই উম্মাহকে গাইরুল্লাহ এর সামনে মাথা নত থেকে রক্ষা করুন! বাস্তবতা বুঝার চেষ্টা করুন! আর উম্মাহর সামনে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করুন–“আল্লাহর কালেমাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে।” আর বাস্তবেই যদি মূর্তির অভিশাপ থেকে এই উম্মাহকে রক্ষা করতে চান; তাহলে আল্লাহর মনোনীত বিধান জিহাদে বের হয়ে পড়ুন! আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقٰتِلُوهُمْ حَتّٰى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِ ۚ فَإِنِ انتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
‘আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক; যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়। এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।’ - সূরা আনফাল: ৩৯
আসমান ও যমিনের মালিক বলেছেন,
وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنٰفِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُۥ وَرُسُلَهُۥ بِالْغَيْبِ ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِىٌّ عَزِيزٌ
‘আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এ জন্যে যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রাসূলগণকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।’–সূরা হাদীদ: ২৫
হে বাংলার উলামায়ে কেরামগণ!
আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেখানো পথ অনুসরণ করুন! কেননা, তিনি পবিত্র কাবা ঘর থেকে মূর্তি অপসারণ করে দেখিয়ে গেছেন–কিভাবে মূর্তি অপসারণ করতে হয়! আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই বাতিল মা’বুদসমূহের ফিতনা থেকে হেফাজত করুন! আমীন!
আল বালাগ
ম্যাগাজিন ইস্যু-২