JustPaste.it
ইসলামী বসন্ত: ১০ম পর্ব
পূর্ব আফ্রিকাঃ দক্ষিণে ইসলামের সুরক্ষিত সীমান্তশহর
(প্রথম খণ্ড)
শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ

 


অনলাইনে পড়ুন

 

অনলাইনে ছড়িয়ে দিন

 

ডাউনলোড করুন

pdf

 

word

——————–——————–——————–——————–——————–——————–——————–

ইসলামী বসন্ত: ১০ম পর্ব

পূর্ব আফ্রিকাঃ দক্ষিণে ইসলামের সুরক্ষিত সীমান্তশহর

(প্রথম খণ্ড)

শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ

 **********

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সমগ্র বিশ্বের মুসলিম ভাইয়েরা-

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ.

হামদ ও সালাতের পর-

এটি ইসলামী বসন্তের ধারাবাহিক পর্বসমূহের দশম পর্ব, যা আমি নবুয়্যতের আদলে খিলাফতব্যবস্থা ফিরে আসার সুসংবাদ দান এবং অবিচার, দুর্নীতি দূরীভূত করার জন্য শুরু করেছিলাম। এই পর্বে আমি আমার সম্মানিত ভাইদের সাথে মুসলিম দেশসমূহের ব্যাপারে আলোকপাত করতে চাই। যেন তাদেরকে এই সুসংবাদ দিতে পারি যে, প্রকৃত বসন্ত হলো ইসলামী বসন্ত। যা নিঃসন্দেহে অচিরেই বিজয়ীরূপে আসছে ইনশাআল্লাহ।

প্রথম পাচঁটি পর্বে আমি ইরাক ও শামে ক্রুসেডারদের আক্রমণের বিরুদ্ধে এবং ওয়াজিরিস্তানের বিপরীতে আমেরিকান পাকিস্তানিদের অপরাধের বিরুদ্ধে আমাদের আবশ্যকীয় করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছি।

এমনিভাবে তথাকথিত খেলাফত সম্পর্কেও আলোকপাত করেছি, যা ইবরাহীম আল-বদরী ও তার সঙ্গীরা দাবি করেছে। অনুরূপভাবে আমি মুজাহিদীনের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারেও গুরুত্বারোপ করেছি। তাছাড়া আমি এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছি এবং জিহাদের কাতারে বিচ্ছিন্নতার বিস্ফোরণের ভয়াবহতা সম্পর্কেও আলোচনা করেছি।

এমনিভাবে ষষ্ঠ পর্বে ইরানী সাফাবীদের বিপদ সম্পর্কে আলোকপাত করেছি।

সপ্তম পর্বে ইয়েমেনে চলমান বিপদের ভয়াবহতা নিয়ে আলোকপাত করেছি।

আর অষ্টম পর্বে পূর্ব এশিয়ার ইসলামের সীমান্তবর্তী এলাকার মুসলমানদের নিয়ে আলোকপাত করেছি।

তারপর নবম পর্বে পূর্ব তুর্কিস্তানের মুসলমানদের ব্যাপারে আলোকপাত করেছি। বর্তমান দশম পর্বে পূর্ব আফ্রিকার মুসলমানদের নিয়ে আলোকপাত করার ইচ্ছা করেছি।

*****

এই পর্বের আলোচনা শুরু করার আগে পূর্ব আফ্রিকার দৃঢ় ইসলামী সীমান্তের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সর্বাগ্রে উল্লেখ করাটা উপকারী হবে বলে মনে করছি। যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেরণের সময় থেকে নিয়ে অদ্যাবধি ইসলামের সাথে জুড়ে আছে। সাহাবীদের (রাযিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইন) প্রথম প্রজন্মের একটি গ্রুপ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। তাঁদের হাতেই আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জানাযার নামায পড়েছিলেন।

আরববাসী ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার পরে তাদের একটি ব্যবসায়িক কাফেলা পূর্ব আফ্রিকায় গমন করেন। অতঃপর ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। মানুষেরা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় প্রবেশ করতে শুরু করে। কিন্তু মানুষেরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার এই মহান দ্বীনের হেদায়াত লাভ করাটা পূর্ব আফ্রিকার ক্রুসেডারদেরকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছিল, কারণ তারা আবিসিনিয়ার প্রতিনিধিত্ব করত। আমি এমনটাই বুঝতে পেরেছি, যেমনটা উত্তর আফ্রিকার খৃষ্টানরা বুঝতে পেরেছিল। তা হলো যদি জনগণকে মুসলমানদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে মুসলমানদের দাওয়াত তাদের মাঝে জয়লাভ করবে। সুতরাং আবিসিনিয়ার খৃষ্টানরা মুসলমানদের বিরদ্ধে শক্রতা আরম্ভ করে দিল, যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। এমনিভাবে মিসরের প্রধান গির্জার অবস্থাও অনুরূপ, যা দীর্ঘ সময়কাল ধরে মুসলমানদের বিরোধিতা করে যাচ্ছে এবং প্রত্যেক স্বেচ্ছাচারী ত্বাগুত সরকার মুসলমানদের উপর হামলার পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে।

এই শত্রুতার বহির্প্রকাশ ঘটে মাসু‘ও শহরে আহবাশের আক্রমণ এবং সেখানে মুসলমানদের হত্যা করা ও তাদের প্রতিনিধিত্ব গ্রহণ করার মাধ্যমে। তারপর আহবাশ ৮৩ হিজরী সালে জেদ্দা শহরে আক্রমণ করার জন্য জলদস্যুদের একটি দলকে উৎসাহিত করে। ফলে তারা হত্যা, লুটতরাজ ও বোঝাইকৃত জাহাজগুলিকে ধ্বংস করে দেয়। যাতে করে রোমানদের সাথে উত্তর ফ্রন্টের চাপ হালকা করতে পারে। কিন্তু খলীফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি একটি অভিযান পরিচালনা করেন, যার মাধ্যমে ‘দাহলাক’ দ্বীপপুঞ্জের উপর দখল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। পাশাপাশি সেখানে একটি ঘাঁটি নির্মাণ করেন, যাতে করে আহবাশের তৎপরতার উপর নজরদারী করতে পারেন এবং আফ্রিকানদের উপকূলের দিকে অগ্রসর হতে পারেন। ফলে নিরাপত্তা ও দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আত্মার প্রশান্তি লাভ হয়। কারণ, তা স্বভাবধর্ম। অন্যদিকে আবিসিনিয়ার গির্জা পিছনে পড়ে যায়। মুসলমানরা হিজরী প্রথম শতাব্দিতে ‘হাররা’ শহর প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা ১৩৪৯ হিজরী মোতাবেক ১৮৯৬ সালে আবিসিনিয়ার বাদশাহ দ্বিতীয় মেনেলিকের সৈন্যরা আক্রমণ করার আগ পর্যন্ত স্বাধীন ছিল।

পূর্ব আফ্রিকার উপকূল আবিসিনিয়া থেকে চুক্তিগত ও রাজনৈতিক দিক থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং পূর্ব আফ্রিকান মুসলিমরা আবিসিনিয়ার মুসলিম অংশ সহ পরবর্তী খেলাফত রাজ্যের বাদশাহর অধীন হয়ে যায়।

ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম, বিশেষত আবিসিনিয়ার চার্চের মাঝে শতাব্দীকাল যাবৎ তিক্ত দ্বন্দ্ব হয়েছে। তথাপি ইসলামের প্রচার-প্রসার অব্যাহত থাকে। এমনকি পূর্ব আফ্রিকার অধিকাংশ অধিবাসী মুসলমান হয়ে যায়। অপরদিকে আবিসিনিয়ার অধিকাংশ জনগণও ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করে। উপরন্তু বর্তমানে আবিসিনিয়ার ৬০% জনগণই হলো মুসলমান অধিবাসী।

ইসলামী দেশসমূহের দুর্বলতার কারণে ইউরোপীয়রা পূর্ব আফ্রিকা দখল করতে শুরু করে। তারপর পর্তুগিজরা আসলো, অতঃপর আবার তারা চলে গেল। তারপর আবিসিনিয়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের সাথে জোট গঠন করল।

এতকিছু হওয়ার পরেও মুসলিমরা আত্মসমর্পণ করেনি, বরং আরো দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করেছে। একাধিক সংগ্রামী আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে ‘আদলা’ সাম্রাজ্যের সংগ্রাম অন্যতম, যা ৯২৩ হিজরী সালে মিসরের অটোমানদের প্রবেশের ক্ষেত্রে তার পিছনের দিককে শক্তিশালী করে। ফলে লোহিত সাগরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং সেখানে একটি নৌ বহর স্থাপন করে ও তার ঘাঁটি জেলা শহরে প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে তা মুসলমানদের সংকল্পকে আরো দৃঢ় করে। তারা খৃষ্টান আহবাশের উপর আক্রমণ করে এবং এতে করে আদলা সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি পায়। অতঃপর তার সাথে সোমালিয়া ও আবিসিনিয়ার অংশগুলিও যোগদান করে এবং তার অঞ্চলের অনেক অধিবাসী মুসলমান হয়। ফলে সাধারণভাবে ইউরোপের অর্থোডক্স চার্চ ও বিশেষভাবে পর্তুগাল সাহায্য প্রার্থনা করে। পাশাপাশি ৯৪২ হিজরী সালে ইউরোপীয় অর্থোডক্স চার্চকে তার মতবাদ বজায় রাখাসহ ক্যাথলিক চার্চের অংশ হতে আবেদন করে। অতঃপর পর্তুগিজ সৈন্যবাহিনী আসলো এবং  ৯৪৯ হিজরী সালে মাসূ‘উতে অবতরণ করে। কিন্তু মুসলমানরা তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ৯৪৫ থেকে ৯৪৭ হিজরী সালের মাঝামাঝিতে আবিসিনিয়া কেন্দ্রের মাঝে আদলার সুলতান ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম তাজর প্রদেশ খুলতে সক্ষম হন। অতঃপর ৯৫০ হিজরী সালে আবিসিনিয়ায় একটি পর্তুগিজ বাহিনী আসে। এরপর পর্তুগিজ বাহিনী ও ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিমের বাহিনীর মাঝে আবিসিনিয়ার কেন্দ্রে তানা লেকের কাছাকাছি প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাতে ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম মারা যান ও তাঁর বাহিনী পরাজিত হয়।

তারপর আধুনিক ক্রুসেডাররা আক্রমণ আরম্ভ করে। আবিসিনিয়ার খৃস্টান রাজ্য তার সাথে সহযোগিতা করে।

১৩০০ হিজরী মোতাবেক ১৩৮২ ইংরেজি সালে ব্রিটিশরা মিশরের উপর জবরদখল প্রতিষ্ঠা করে পূর্ব আফ্রিকায় অটোমান সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে মিশরের সম্রাটের অঞ্চলগুলি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তার কেন্দ্র ছিল হারারেতে। তিনটি জেলা তার অনুসরণ করত। তা হলো তাজৌরা, যাইলা’ ও বারবারা। আর ব্রিটেন পূর্ব আফ্রিকার জায়গাগুলি রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে খালি করে দিতে মিশরীয় বাহিনীকে আদেশ দেয়, যাতে করে তারা আহবাশের খ্রিস্টানদের সাথে পূর্ব আফ্রিকার বিভাজনের ক্ষেত্রে দখলকৃত পশ্চিম এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়।

মিশরের তখনকার শাসক ছিলেন তৌফিক আল-খেদভী। তিনি শুধুমাত্র ইংরেজদের এজেন্ট ছিলেন। মিসরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন বড় শাইখ তাঁকে পরিচালনা করেন। তাঁরা হলেন শাইখ মুহাম্মাদ আলীশ, শাইখ হাসান আল-আদাবী এবং শাইখ আল-খালফাভী। দ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়ে ও দেশীয় সৈনিকদের পক্ষপাতিত্ব করে তারা এমন করেছেন।

আর তাঁর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আর্মেনিয়-খ্রিস্টান নূর পাশা। সে হাররা ও সোমালিয়া বন্দর খালি করার আদেশ জারি করে। তবে হাররার গভর্নর তাকে বলেছিলেন যে, খালি করা খুব কঠিন হবে।  কারণ মিশরীয় সৈন্য এবং কর্মচারীরা এই অঞ্চলের জনগণের সাথে একত্রিত হয়, বিশেষ করে বিবাহের মাধ্যমে। তাই খালি করার পরে দেশে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। ফলে তাকে বরখাস্ত করা হয় এবং তার স্থানে অন্য একজন গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। পাশাপাশি তাকে ইংরেজ অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্টারের তত্ত্বাবধানে দিয়ে দেওয়া হয়। তাকে কর্মচারী বা কর্মকর্তার ছাঁটাই প্রক্রিয়ায় বিলম্বিত অফিসারদের বেতন স্থগিত করার অনুমতি প্রদান করা হয়।

অন্যদিকে মিশরীয় সৈন্যরা হাররাকে খালি করে দিতে অস্বীকার করে এবং তারা বিদেশী আক্রমণকারীদের মুখোমুখি হতে অধিবাসীদের সাথে মিলে একটি জোট গঠন করে। এমনিভাবে নূরপাশা যাইলা’র গভর্নরকে এটি খালি করার নির্দেশ প্রদান করে।

এই সমস্ত ঘটনা মন্দ যুগের সুস্পষ্ট বর্ণনা দেয়। এটি মুসলমানদের ভূমি দখল করতে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে ও ক্রুসেডার শত্রুকে সহায়তার জন্য মুরতাদদের এজেন্ট পুতুল সরকারগুলি কর্তৃক করা হয়। তাছাড়া সেই যুগ থেকে অদ্যাবধি পূর্ব আফ্রিকা ও সমগ্র ইসলামী ভূখন্ডে মুরতাদদের এজেন্ট সরকারগুলি অবলীলায় এসব করে যাচ্ছে।

এই ঘটনাই একথা প্রমান করে যে, মিসর ও পূর্ব আফ্রিকার মুসলমানেরা ক্রুসেডার শত্রুর মুখোমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদেরেকে এক উম্মাহ-জাতি বিবেচনা করতেন। তাঁরা প্রতীকী উসমানীয় খিলাফাতের বিদ্যমান দূর্নীতি সত্বেও তাদের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন।

এই ঘটনা ও অনুরূপ অন্যান্য ঘটনাবলী আরবী মাদরাসাগুলির ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকগুলিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমনিভাবে আনওয়ালের যুদ্ধ, ককেশাস বা পূর্ব তুর্কিস্তানের জিহাদ সম্পর্কে তাতে কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না।

এ সমস্ত ঘটনা আমাদেরকে আহ্বান করছে যে, আসুন! আমরা অল্পসময় নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করি যে, পূর্ব তুর্কিস্তানের ও মধ্য এশিয়ার আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত কাফিরদের জবরদখল ও ককেসাশ থেকে মধ্য আফ্রিকার জবরদখলের বিষয়গুলি কী কারণে আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল?

আমাদের কাফির শক্রুরা মৌলিক দুটি কারণে আমাদেরকে পরাজিত করেছে। যথা:

এক: আমাদের উপর তাদের অস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব থাকা।

দুই: রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, যা মুসলমানদের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

আমাদের উপর তাদের অস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব থাকার ব্যাপারে কথা হলো: তারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে আমাদের থেকে অগ্রগামী হয়ে গেছে এবং তাতে আমাদেরকে পিছনে ফেলে গেছে। কারণ, মুসলমানরা কয়েক শতাব্দি পর্যন্ত তাদের বোধশক্তিকে তর্কশাস্ত্রের কুটিল প্রশ্নের জালে ও বিকৃত সুফিবাদের রহস্যের সন্ধানে ব্যয় করেছে। ফলে তারা তাদের প্রতি নির্দেশিত দ্বীনের বিধান আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিজীব নিয়ে এবং স্থল স্থাপত্য বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা করা থেকে বিরত থেকেছে। অন্যদিকে তাদেরকে যার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, এমন নিষিদ্ধ বিতর্ক ও চিন্তা-ভাবনা নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েছিল।

এর জন্য শুধু আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানীর ত্ববাকাতুল আউলিয়া  নামক কিতাবটির উপর একবার দৃষ্টি বুলানোই যথেষ্ট হবে। তাতে আপনি দেখতে পাবেন যে, বিকৃত সুফিবাদ মুসলমানদের বোধশক্তি, মন-মানসিকতাকে কী পরিমাণ অধঃপতিত করেছিল। অথচ তিনি তাঁর যুগের বড় বড় উলামায়ে কেরামের মাঝে অন্যতম একজন ব্যক্তি ছিলেন!!!

সুতরাং এই কিতাব ও এ জাতীয় অন্যান্য কিতাবে শা‘রানী সুস্পষ্টভাবেই পাপাচারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, স্বেচ্ছাচারী বরং সুস্পষ্ট কুফর প্রকাশকারীদের একটি গ্রুপের বন্ধুত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য মুরীদদের আহ্বান করেছেন। এমনিভাবে তিনি মুরীদদেরকে আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা শাইখকে দ্বীন, বোধশক্তি বা শিষ্টাচারবিরোধী কিছু করতে দেখলে প্রতিবাদ না করে। তাছাড়া তাতে এমন কিছু কিচ্ছা-কাহিনী চালিয়ে দিয়েছেন, যা উল্লেখ করতে কলম ও জবান দুটোই বিরক্তি অনুভব করে।

বিশেষ করে আবদুল্লাহ মাজযুব সম্পর্কে কিছু দুঃখজনক তামাশার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে সেখানে পারদর্শী আলেম ও অধিক কাশফ হয় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথচ সে হাশীশ নামক মাদকদ্রব্যের পাত্র তৈরি ও বিক্রয় করত। এটাকে তার কারামাতের মধ্যে গণ্য করত যে, যে ব্যক্তি তার থেকে হাশীশ (মাদকদ্রব্য) ক্রয় করবে, সে তা (হাশীশ) থেকে তাওবা করবে এবং পুনরায় তার দিকে ফিরে যাবে না। (শাযারাতুয যাহাব, খণ্ড নং-৮, পৃষ্ঠা নং-২২১, আল-কাওয়াকিবুস সা’য়িরাহ, খণ্ড নং-১ পৃষ্ঠা নং-২৮৭)

এখানে হাশীশের ব্যবসা করাকে আওলিয়ায়ে কেরামের কাজ বলে গণ্য করা হয়েছে! অথচ এখানে উল্লেখ করা হলো না যে, কী কারণে ক্রয়-বিক্রয় করার আগে ক্রেতা ও বিক্রেতা তাওবা করল না?!  আল্লাহর কোনো ওলীর জন্য কি হারাম মাল গ্রহণ করা জরুরী??!! তাওবাকারী ব্যক্তি প্রথমে হাশীশ পান করে মাতাল হবে, যাতে করে তার তাওবার রোকন পূরণ হয়???!!!

উম্মাহর বিজয়ের একটি শর্ত হলো হাশীশ ব্যবসা থেকে পবিত্র থাকা। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন:

(وَإِن تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لا يَكُونُوا أَمْثَالَكُمْ)

অনুবাদ: “যদি তোমরা বিমুখ হও, তিনি অন্য জাতিকে তোমাদের স্থলবর্তী করবেন; তারা তোমাদের মতো হবে না।” (সূরা মুহাম্মাদ-৩৮)

তিনি (শা‘রানী) তাদের (পীরদের) পাপাচারিতার ব্যাপারে নিন্দা করতে ও তাদের অসম্মান করতে নিষেধ ‍করছেন। যারা তাদের সম্মানহানী করবে তাদের ঘৃণা করেছেন। অথচ তাদেরকেই জ্ঞানী বলে দেওয়া হলো?! (শাযারাতুয যাহাব, খণ্ড নং-৮, পৃষ্ঠা নং-৩৭৩)

এমনভাবেই দুটি বিচ্যুতির সংমিশ্রণ ঘটে। তা হলো তর্কশাস্ত্রের সম্মান ও বিকৃত সূফিবাদের কল্পকাহিনী।

এই দুটি বিচ্যুতিই মুসলমানদের বোধশক্তিকে আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিজীব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বিরত রেখেছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কালামে পাকে ইরশাদ করেন:

(قُلْ سِيرُوا فِي الأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ثُمَّ الله يُنشِئُ النَّشْأَةَ الآخِرَةَ)

অনুবাদ: “হে নবী! আপনি বলুন: ‘তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং অনুধাবন কর, কীভাবে তিনি সৃষ্টি আরম্ভ করেছেন। অতঃপর আল্লাহ সৃষ্টি করবেন পরবর্তী সৃষ্টি।” (সূরা ‘আনকাবূত, আয়াত নং-২০)

তিনি আরো ইরশাদ করেন:

أَوَلَمْ يَنظُرُواْ فِي مَلَكُوتِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَا خَلَقَ الله مِن شَيْءٍ.

অনুবাদ: “তারা কি লক্ষ্য করে না, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌম কর্তৃত্ব সম্পর্কে এবং আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার সম্পর্কে?”

(সূরা আ‘রাফ, আয়াত নং ১৮৫)

তর্কশাস্ত্র হলো গ্রীক দর্শনের নীতিমালার উপর নির্ভরশীল, যাকে আধুনিক বিজ্ঞান ভেঙে চূর্ণ করে দিয়েছে। এটি উলামায়ে কেরামের বোধশক্তিকে কুটিল প্রশ্নের জালে ক্লান্ত করে দিয়েছে, যা বুলেট ছুড়তে পারে না, কামান দাগাতে পারে না এবং জাহাজে ভ্রমণ করতে পারে না! অপরদিকে বিকৃত সূফীবাদ তাদেরকে দুনিয়াতে থেকে অদৃশ্য করে দিয়েছে, তাদেরকে অন্যায়-অশ্লীল কাজের বাধা প্রদান করতে নিষেধ করে দিয়েছে এবং পাপাচারীদের ও স্বেচ্ছাচারীদের, এমনকি সুস্পষ্ট কুফরী প্রকাশকারীদের বন্ধুত্বকে তাদের জন্য সুশোভিত করে দিয়েছে। তাদের থেকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের মর্যাদা, শরীয়তের শাসনব্যবস্থার মর্যাদা, মু‘মিনদের প্রতি ভালোবাসা ও কাফিরদের সাথে সম্পর্কহীনতার মর্যাদা উঠে গেছে….!!!

এ কারণেই যে ব্যক্তি বিকৃত সুফিবাদের সাথে জড়িত, তার জন্য শরীয়তের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে ফাসিক, মুরতাদ শাসকের শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করে নেয়া সহজ হয়ে গেছে। বহুবার মাশায়েখরা তার (শাসকের) প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন, এমনকি অনেকসময় তাকে আল্লাহর ওলী বলে গণ্য করে করেছেন। উদাহারণস্বরূপ সায়্যিদ মুহাম্মাদ আল-হাযরামী সম্পর্কে শা‘রানী বর্ণনা করেছেন যে, তিনি জুমু‘আর খুৎবা দানের সময় বললেন: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তোমাদের জন্য ইবলীস (আ:) ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ-প্রভু নেই।”

(ত্বাবাকাতুশ শা‘রানী, খণ্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং-৯৪ তাফসীরুল মানার থেকে বর্ণনাকৃত, তাফসীরুল মানার, খণ্ড নং-১১, পৃষ্টা নং-৩৪৭-৩৪৮)

এমনিভাবে মুসলমানদের ভূমিগুলি জোরজবরদস্তি করে দখল করে নেওয়ার ক্ষেত্রে যারা কাফিরদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে,তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হওয়াটা সূফীদের জন্য সহজ হয়ে গেছে। অনেকবার মাশায়েখরা তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন। পাশাপাশি তারা ইসলামী ভূমির উপর আক্রমণকারী কাফিরদের বিপরীতে সশস্ত্র জিহাদ ছেড়ে দেওয়াকে মেনে নিয়েছে। কারণ, মাশায়েখরা ও ভণ্ড ওলীরা এ ব্যাপারে অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করেন। তারা মানুষের চাহিদা পুরা করবে বরং তাদের কুকুরগুলি তাদের চাহিদা পূরণ করবে। যেমনটি শা‘রানী ও অন্যান্যরা আবুল খাইর আল-কুলিবাতি থেকে বর্ণনা করেছেন। (আল-কাওয়াকিবুস সা’য়িরাহ, খণ্ড নং-১, পৃষ্ঠা নং-৭১, শাযারাতুয যাহাব, খণ্ড নং-৮, পৃষ্ঠা নং-৪১)

আর এ কারণেই আমেরিকানরা ঘোষণা দিচ্ছে যে, ভ্রান্ত সুফীদের গ্রুপকে সমর্থন করা উচিত। র‍্যান্ড ইনস্টিটিউটও এর উপর জোর দিয়েছে। “মডারেট ইসলামী নেটওয়ার্ক বিনির্মাণ” নামক বইয়ে এসেছে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের সম্ভাব্য অংশীদাররা তিনটি গ্রুপের বিভক্ত। যথা:

ক) ধর্মনিরপেক্ষ, খ) উদার মুসলিম, এবং গ) মডারেট ঐতিহ্যবাদীরা, যাদের মধ্যে সুফিবাদীরাও রয়েছেন।

“সিভিল ডেমোক্র্যাটিক ইসলাম” নামক বইয়ে তাদেরকে আধুনিকতাবাদীদের মাঝে গণ্য করা হয়েছে। তাদেরকে সমর্থন করা ও তাদের অবস্থা আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন বলা হয়েছে।

এর মাধ্যমে আমেরিকানদের, পশ্চিমাদের ও ইথিওপিয়ানদের সোমালিয়ায় সূফিবাদী গ্রুপদেরকে সমর্থনের বাস্তবতা আরো সুচারূপে স্পষ্ট হয়। যারা ক্রুসেডার জোটের সারিতে থেকে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

পাশাপাশি মার্কিন শাসনের অধীনস্থ মিশরীয় ইহুদীবাদী সিসির দারুল ইফতা সোমালিয়ায় হরকাতু শাবাবিল মুজাহিদীনের বিরুদ্ধে সূফিবাদের আন্দোলনকে সমর্থনের উপর গুরুত্বারোপ করেছে।

যে সময়ে মুসলমান উলামায়ে কেরামের বোধশক্তি তর্কশাস্ত্রের অসার বিতর্কে ও বিকৃত সূফিবাদের রহস্যের সন্ধানে নিমগ্ন, ঠিক সেই সময়ে ইউরোপ জেগে উঠে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ফলে গির্জার দার্শনিক তামাশা থেকেও নিষ্কৃতি পেতে শুরু করে। পাশপাশি প্রকৃতির গোপন রহস্য উন্মোচনেও অগ্রসর হতে শুরু করে এবং মুসলমানদের পরাজিত করার প্রচেষ্টা হিসাবে এবং সম্পদলাভের লালসায় ভৌগোলিক বিভিন্ন অনুসন্ধান-আবিষ্কার শুরু করে।

এক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন পর্তুগালের রাজা হেনরি। তার ক্রুসেডার নৌবাহিনী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণায় ভরপুর ছিল, যাকে শা‘রানী (শা‘রানীর জন্ম ৮৯৮হিজরী মোতাবেক ১৪৯৩ ইংরেজি। আল্লামা যিরিকলীর আল-আ‘লাম, খণ্ড নং-৪, পৃষ্ঠা নং-১৮০) জন্মের  প্রায় চল্লিশ বছর পূর্বে পঞ্চম পোপ নিকোলা কর্তৃক একটি চিঠিতে আশীর্বাদ করেছিলেন। তাতে লেখা ছিল: “নিশ্চয় আমার এক মহা আনন্দ হলো এটা জানানো যে, আমাদের প্রিয় সন্তান পর্তুগালের রাজা হেনরী, তার পিতা রাজা জং কিং-এর হুবহু পদচিহ্ন অনুসরণ করে মাসীহের সৈন্যদের মধ্য থেকে একজন সক্ষম সৈনিকরূপে আল্লাহর শক্র ও মাসীহের শক্র কাফির মুসলমানদের বিরুদ্ধে যাত্রা করবে।”

এই সেই হেনরী, শা‘রানীর জন্মের প্রায় ৮০ বছর আগে যে তাঁর পিতা প্রথম কিং-এর সাথে মুসলমানদের থেকে সেতু বিজয়ে অংশীদার ছিলেন। এরপর তিনি যখন রাজত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন ইউরোপে প্রথম একাডেমি অব ন্যাভিগেশন সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন। সামুদ্রিক বিষয়ের ব্যাপারে অভিজ্ঞ একদল বিজ্ঞানী তাতে অন্তর্ভুক্ত করেন। তদ্রূপ তিনি একটি সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেন। এমনিভাবে তিনি আফ্রিকান উপকূল থেকে আগত বিদেশী জাহাজগুলির তথ্যসংগ্রহের কাজ করেন। যেমনভাবে তিনি জাহাজ নির্মাণের উন্নতিতেও কাজ করেছিলেন, এমনকি সেই সময়ে জাহাজের মালামাল আশি থেকে একশ টন পর্যন্ত বহন করতে সক্ষম ছিল।

তিনি পশ্চিম আফ্রিকায় অভিযান প্রেরণ করেন। অতঃপর পর্তুগিজরা বিষুবরেখা অতিক্রম করে এবং শা‘রানীর জন্মের প্রায় পাঁচ বছর আগে উত্তমাশা অন্তরীপে (Cape of Good Hope) পৌঁছে। তারপর শা‘রানীর জন্মের পাঁচ বছর পর তারা হিন্দুস্তানে পৌঁছেছিল।

নৌবাহিনীর রাজা হেনরি খ্রিস্টান ধর্ম বিস্তারের জন্য আফ্রিকায় একটি পর্তুগিজ-খ্রিস্টান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। অ্যাবিসিনিয়ার রাজা সেন্ট জন সেখানে পৌঁছানোর জন্য ঘানা শহর সম্প্রসারিত করেছিলেন, যেন মুসলমানদের বিতাড়নে অথবা তাদেরকে ধর্মান্তরকরণে সেখান থেকে আধ্যাত্মিক এবং সামরিক সাহায্য করা যায়।

উলামায়ে কেরাম যখন ভিত্তিহীন তর্কশাস্ত্র ও সূফিবাদের কল্পকাহিনীতে নিমগ্ন, তখন এই সবকিছু হয়ে গেছে। অথচ এই সূফিবাদকেই হাশিশ ব্যবসায়ী আর নাস্তিকরা পবিত্র মনে করে।

আমাদেরকে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ফ্যাক্ট হলো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, যন্ত্রনাদায়ক শাসনব্যবস্থা, যা জিহাদের পতন ঘটানো, গৃহযুদ্ধ এবং হারাম সম্পদ জমা করার দিকে নিয়ে গেছে। এমনিভাবে তা বিলাসী জীবন-যাপনের দিকে গেছে। ফলে জিহাদের জন্য আবশ্যক ইলমের প্রতি উদাসীনতা তৈরি হয়েছে।

অথচ দুঃখের বিষয় হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন রাদিয়াল্লাহু আনহুম কর্তৃক সতর্কতার বাণী থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ভয়াবহতা সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলমান-ই গাফেল-অমনোযোগী।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন:

“لَتُنْقَضَنَّ عُرَى الإِسْلامِ، عُرْوَةً عُرْوَةً، فكُلَّمَا انْتَقَضَتْ عُرْوَةٌ، تَشَبَّثَ النَّاسُ بِالَّتِي تَلِيهَا، فَأَوَّلُهُنَّ نَقْضًا الْحُكْمُ، وَآخِرُهُنَّ الصَّلاةُ”.

অনুবাদ: “অবশ্যই ইসলামের এক এক বন্ধন করে সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। তারপর যখনই কোনো বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে, তখনই মানুষ তার পরবর্তী বন্ধন ছিন্ন করার পিছনে লাগবে। সর্বপ্রথম তারা শাসন ছিন্ন করবে আর সর্বশেষ তারা নামায ছিন্ন করবে।” (আল-জামিউস সগীর ও যিয়াদাত, হাদীস নং-৯২০৬, খণ্ড নং-১, পৃষ্ঠা নং-৯২১)

শাইখ আলবানী রহ. এই হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

এমনিভাবে হযরত ওমর রাযি. বলেন:

“مَنْ بَايَعَ رَجُلًا عَنْ غَيْرِ مَشُورَةٍ مِن الْمُسْلِمِينَ فَلَا يُبَايَعُ هُوَ وَلَا الَّذِي بَايَعَهُ تَغِرَّةً أَنْ يُقْتَلَا”.

অনুবাদ: “যে কেউ মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতিত কোনো ব্যক্তির হাতে বায়আত করবে, তার অনুসরণ করা যাবে না এবং ঐ ব্যক্তিরও না, যে তার অনুসরণ করবে। কেননা, উভয়েই হত্যার শিকার হওয়ার আশংকা রয়েছে।” (সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ যিনার কারণে বিবাহিতা গর্ভবতী মহিলাকে রজম করা। হাদীস নং-৬৩২৮, খণ্ড নং-২১, পৃষ্ঠা নং-১০৬)

নবুয়্যতের আদলে খেলাফতব্যবস্থা অধঃপতিত হয়ে যন্ত্রণাদায়ক শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছে। যা শুরা’র ব্যাপারে মুসলমানদের অধিকার হরণ করে, নির্যাতন-অবিচার, স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের নিষেধাজ্ঞার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

একটি দুঃখজনক হাস্যকর বিষয় হলো, আমি মুতাওয়াতির সহীহ হাদীসের দলিলাদি পেশ করেছিলাম যে, শূরাব্যবস্থা খেলাফতে রাশেদার বুনিয়াদী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যা ইবরাহীম আল-বদরীর শাসনের দুর্নীতির পরিমাণ নির্দেশ করে। যা যন্ত্রণাদায়ক শাসনব্যবস্থার একটি খুব খারাপ উদাহরণ হিসাবে সুবিধাবাদীদের তাকফিরের সাথে সংযুক্ত। তাদের কেউ আমাকে উত্তর দিয়েছে যে, মুতাআখখিরীন শাফেয়ীরা চল্লিশজন ব্যক্তির দ্বারা খেলাফতব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাকে অনুমোদন দিয়েছেন!!!

সুতরাং আমি সহীহ হাদীসের কিতাবাদি থেকে ও সকলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে বারংবার সংঘটিত খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মপন্থা থেকে সঠিক দলিলাদি উপস্থাপন করার চেষ্টা করি। আর তা এমন সব উক্তির দ্বারা উপস্থাপিত হয়, যা যন্ত্রণাদায়ক শাসনব্যবস্থাকে সঠিক বলে বিবেচিত করে এবং বড় বড় উলামায়ে কেরামের বক্তব্যের বিরোধিতা করে। উক্তিগুলি অবক্ষয়ের যুগে লেখা হয়েছিল। এমনিভাবে মিসরের মামলুক রাজবংশ খলীফাকে অপসারণ করে এবং অন্য একজনকে নিয়োগ করে। তাদের আগে বাগদাদের তুর্কি সৈন্যরা খিলাফতকে তার চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

যার কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি খলিফা থেকে একটি ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছিলেন। তন্মধ্যে কেউ কেউ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং কারো কারো দু’চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। সর্বশেষ যন্ত্রণাদায়ক শাসনব্যবস্থার হাস্যরসাত্মক নাটক, যা আমাদেরকে পশ্চিমা ক্রুসেডারদের সামনে এই বিপর্যয়মূলক পরাজয়ের দিকে পরিচালিত করেছে।

আর তার কথার অর্থ হলো, যদি কোনো ব্যক্তি তার চল্লিশজন ছেলে ও নাতী নিয়ে মুসলিম দেশগুলির উপকণ্ঠে একটি উপত্যকার কোনো গ্রামে নিজেকে খলীফা বলে ঘোষণা করে, তাহলে তার জন্য তাদের বাইয়াত নেয়া বৈধ।

এই সবগুলিই খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মপন্থার বিরোধিতা, যা অসহিষ্ণুতা বা প্রতারণা অথবা ইবরাহীম আল-বদরীর গ্রুপের ফায়েদা দানের উদ্দেশ্যে করা হয়।

আমাদের পরাজয়ের আরো কারণ হলো যে, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা আমাদেরকে বিভক্ত করে দিয়েছে। পাশাপাশি খেলাফতের রাজ্যগুলিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাঙা রাজ্যে পরিণত করে দিয়েছে।

এমন দিন আসছে, যে দিন কোনো ব্যক্তি শাইখ উসামা রহ. ও তাঁর সাথীদের মতো অগ্রদূতদের নির্মিত মুজাহিদীন ও মুসলমানদের ঐক্যের কাঠামোকে ভেঙে দিতে চেষ্টা করবে। ফলে সারি ভেঙ্গে যাবে এবং বাইয়াত ভঙ্গ হয়ে যাবে। যাকে সে ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করে নিজেকে ধার্মিক ভাববে এবং বাইয়াত ও ক্ষমতা ছাড়াই নিজেকে খলীফা বলে ঘোষণা দিয়ে দিবে। এমনিভাবে যারা তার হাতে বাইয়াত হবে না, তাদের বিরুদ্ধে তার মুখপাত্র যুদ্ধের ঘোষণা প্রদান করবে। বরং তাদের সাথে যারা যুদ্ধ করবে, এমনকি তারা যদি শরীয়ত প্রতিষ্ঠার জন্যও যুদ্ধ করে, তার পরেও তারা সবাই মুরতাদ বলে গণ্য হবে!

আর যখন আমেরিকান যুদ্ধবিমানগুলি সিরিয়া ও ইরাকের উপর আক্রমণ করা আরম্ভ করে, তখন আমরা তা প্রতিরোধ করতে তাদের নিকট সহযোগিতার একটি উদ্যোগ পেশ করি। প্রত্যুত্তরে আমরা শুধু গালি-গালাজ ও তাকফির করা এবং মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে হুমকি-ধমকি-ই পেয়েছি। এ জন্য কয়েকবার আমরা তাদের নিকট জিজ্ঞাসা করেছি যে, আমাদেরকে তাকফির করার দলিলাদির ক্ষেত্রে আপনাদের সরকারী বিবৃতি কী? এবং তারা কারা, যারা ইবরাহীম আল-বদরীর জন্য কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়? অথচ সে এ ব্যাপারে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। গালিগালাজ আর তাকফির ছাড়া তারা কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। ফলে তারা মহান আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে-

فَإِذْ لَمْ يَأْتُوا بِالشُّهَدَاءِ فَأُولَئِكَ عِنْدَ اللَّهِ هُمُ الْكَاذِبُونَ.

অনুবাদ: “যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সে কারণে তারা আল্লাহর নিকট মিথ্যাবাদী।” (সূরা নূর- ১৩)

আল্লাহ তা‘আলার রহমতে আমরা সর্বদা তাদেরকে তাওহীদের কালিমার ছায়াতলে মুজাহিদীন ও মুসলমানদের ঐকের জন্য আহ্বান করেছি এবং বর্তমানেও এই আহ্বান অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি আমরা সকল মুজাহিদ ও মুসলিমকে আহ্বান করি যে, আসুন! আমরা পরস্পরে ঐক্যবদ্ধ, একতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে নবুয়্যতের আদলে খেলাফত প্রতিষ্ঠা, শরীয়তের শাসনব্যবস্থা ও মুসলিমদের ভূমিগুলি পুনঃরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। উপরন্তু আমরা পক্ষপাতিত্ব, জাতীয়তা ও গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যাই। পাশাপাশি আপনাদেরকে যেন আমেরিকার হুমকি-ধমকি ভীত-বিহ্বল না করে। কেননা, তারা আমাদেরকে সৃষ্টি করেনি, রিযিক দেয় না, জীবিত করে না এবং মৃত্যুও দেয় না।

আপনাদের কাছে কি পৌঁছিয়েছে? হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।

আজ এই পর্যন্তই। ইনশা আল্লাহ আগামী পর্বে পূর্ব আফ্রিকার মুসলমানদের নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি।

 

وآخر دعوانا أنِ الحمدُ للهِ ربِ العالمين، وصلى اللهُ على سيدِنا محمدٍ وآلِه وصحبِه وسلم.

والسلامُ عليكم ورحمةُ اللهِ وبركاتُه.

আস-সাহাব মিডিয়া কর্তৃক  ১৮ মার্চ ২০১৮ ইং তারিখে প্রকাশিত

الربيع الإسلامي الحلقة العاشرة

شرق إفريقيا ثغر الإسلام الجنوبي

(الجزء الأول)

বক্তব্যের অনুবাদ