পরিবেশনায়.....
সূচি...
১. ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট
২. ইমামত বা খিলাফাহ কী?
৩. খলীফাহ মনোনীত হওয়ার পদ্ধতি
খলীফাহকে মনোনীত করবে কারা?
৪. খোলাফায়ে রাশেদীনের খলীফাহ মনোনীত হওয়ার পদ্ধতি
আবু বকর রাযি. খলীফাহ মনোনীত হওয়ার ঘটনা
৫. কে খলীফাহ বা ইমাম?
৬. কারা আবু বকর আল-বাগদাদীকে খলীফাহ মনোনীত করেছে?
৭. আইএসের খিলাফাহ ঘোষণার পর্যালোচনা:
৮. আইএস কি খিলাফাহ ঘোষণার বিষয়ে বিশ্বের কোনো মুজাহিদ জামা‘আতের পরামর্শ নিয়েছে?
৯. আইএসের খিলাফাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের খিলাফাহ’র মাঝে পার্থক্য
১০. ঐক্যবদ্ধ উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী আইএস এবং এ ব্যাপারে রাসূল সা. এর হাদীস
১১. আবু বকর আল-বাগদাদীর শাসনের হুকুম
১২. শেষ কথা
১. ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট
আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত পরিপূর্ণ দ্বীন ইসলামকে পৃথিবীর বুকে কায়েম এবং তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যমীনে আল্লাহর শাসন তথা খিলাফাহ’র গুরুত্ব অত্যধিক। মুসলিম উম্মাহ যতদিন খিলাফাহ প্রতিষ্ঠিত রাখতে পেরেছিলো; ততদিন মুসলিম উম্মাহর সম্মান ও নেতৃত্ব সমগ্র দুনিয়াব্যাপী বিস্তার লাভ করেছিলো।
এই উম্মাহ যখনই দুর্বল ও বিভক্ত হয়ে পড়লো; দ্বীনের শত্রুরা তখনই খিলাফাহ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছিলো। ফলে খিলাফাহ’র অনুপস্থিতিতে বিশ্বজোড়া নেতৃত্ব দেওয়া মুসলিম জাতি একেবারে অসহায় ও পরনির্ভরশীল একটি পঙ্গু জাতিতে পরিণত হলো।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে রাশিয়া বিরোধী আফগান জিহাদকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এক অপূর্ব জাগরণ উদ্ভব হয়। আফগানিস্তানে বিভিন্ন পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ১৯২৪ সালে তুরষ্কের উসমানী খিলাফাহ’র আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির পর দীর্ঘ প্রায় ৭২ বছর পর সর্বপ্রথম ১৯৯৬ সালে আমীরুল মু’মিনীন মোল্লা মুহাম্মাদ উমর রহ. এর নেতৃত্বে আফগানিস্তানে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নবুয়তের আদলে প্রতিষ্ঠিত এই নব ইসলামী রাষ্ট্রে গোটা দুনিয়া থেকে উম্মাহর সর্বাধিক সচেতন সদস্যগণ জিহাদের দীক্ষা লাভ করে দুনিয়ার দিকে দিকে জিহাদের মাধ্যমে দ্বীন কায়েমের এই তাওহীদী চেতনা ছড়িয়ে দিতে থাকেন।
উম্মাহ আবারো স্বপ্ন দেখতে শুরু করে হারানো শৌর্য-বীর্য ফিরে পাবার। হারানো খিলাফতের প্রত্যাশায় গোটা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুজাহিদগণ। পুরো দুনিয়ায় আল্লাহর দ্বীন কায়েমের লক্ষ্যে পরিচালিত আলামী জিহাদ এক অভূতপূর্ব সাড়া লাভ করে। সিরিয়ায় জিহাদ শুরু হওয়ার পর আলামী জিহাদে ব্যাপক গতির সঞ্চার হয়।
মুসলিম উম্মাহ যখন হৃদয় প্রশান্তকারী সুবহে সাদিকের পর বিজয়ী ভোরের অপেক্ষায় অপেক্ষমান, এমনি এক পরিস্থিতিতে আলামী জিহাদে নেতৃত্ব প্রদানকারী তানযীম আল-কায়েদার সাথে যুক্ত ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক আল-কায়েদার নির্দেশনা অমান্য করে সিরিয়ায় তাদের শাখা প্রসারিত করে। অথচ তখন সিরিয়ায় আল-কায়েদার অফিসিয়াল শাখা ছিলো। তারা নাম দেয় ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক এন্ড শাম। অতঃপর ২০১৪ সালের জানুয়ারির শুরুতে সিরিয়ায় আসাদ বিরোধী বিভিন্ন গ্রুপের সাথে ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক এন্ড শাম (ISIS) বা বর্তমান আইএসের যুদ্ধ বেধে যায়। এ সংঘাতকে কেন্দ্র করে আইএস আস্তে আস্তে চরমপন্থা অবলম্বন করতে থাকে। একে একে তারা বিভিন্ন দলকে মুরতাদ আখ্যা দিতে থাকে। একপর্যায়ে আল-কায়েদার শাখাসহ সবাইকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে যুদ্ধ করতে থাকে। অতঃপর ২০১৪ সালের ২৯ শে জুন আইএস নিজেদেরকে খিলাফাহ বলে দাবী করে।
ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক যেহেতু আল-কায়েদার সাথে যুক্ত একটি দল ছিলো; তাই তাদের বিপথগামীতা ও মুসলিমদের রক্ত প্রবাহের মতো ভয়ানক কাজের দুর্নাম আল-কায়েদার উপর আসতে থাকে।
এমতাবস্থায় আল-কায়েদার সম্মানিত আমীর শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ বিভিন্নভাবে আইএসকে তার এসব ভ্রষ্টতা থেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। যার প্রমাণ হিসেবে রয়েছে শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ’র বহু বার্তা।
একপর্যায়ে কোনোভাবেই আইএসের সীমালঙ্ঘন ও অন্যায় তাকফীর বন্ধ না হওয়ায় এবং সিরিয়ার মুজাহিদগণের রক্তপাতের কারণে আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় মাজলিসে শূরা বা কেন্দ্রীয় কমান্ড ২০১৪ সালের ৩ রা ফেব্রুয়ারি একটি অফিসিয়াল বার্তা প্রকাশ করে তৎকালীন ISIS এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং তাদের যেকোনো কাজের দায়ভার থেকে আল-কায়েদাকে মুক্ত ঘোষণা করেন।
উক্ত বার্তার বাংলা অনুবাদ..... http://bit.ly/2qU5E8s
মূল আরবী বার্তা..... http://bit.ly/2qMSAlT
গ্লোবাল জিহাদের সম্মানিত আলিম শাইখ আবু কাতাদা আল-ফিলিস্তিনী হাফিযাহুল্লাহ’র পক্ষ থেকে ২০১৪ সালের ২৮ শে এপ্রিল প্রকাশিত এক বার্তায় (তিনি) আইএসকে সুস্পষ্ট ভাষায় ‘খারিজী’ (হাদীসে বর্ণিত জাহান্নামের কুকুর) বলে সাব্যস্ত করেছেন।
অর্থাৎ আইএসের খিলাফাহ ঘোষণার ২ মাস পূর্বে স্পষ্ট ভাষায় এই দলটির ভ্রান্ত আকীদা এবং মুজাহিদগণের রক্ত হালাল করার অপরাধে এই দলটিকে খারিজী বলে ফাতাওয়া দেন গ্লোবাল জিহাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন আলিম।
‘বালাকোট মিডিয়া’ পরিবেশিত উক্ত বার্তার বাংলা অনুবাদের লিংক.... http://bit.ly/2sDOL2W
মূল আরবী বার্তার লিংক.... https://justpaste.it/resala-1435
২০১৪ সালের মে মাসের মাঝামাঝি (১৪৩৫ হিজরীর রজব মাসের মাঝামাঝি) গ্লোবাল জিহাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মানিত আলিম শাইখ মাক্বদিসী হাফিযাহুল্লাহ তৎকালীন ওঝওঝ (বর্তমান আইএস) এর সাথে জিহাদ ও মুজাহিদ শব্দ ব্যবহার বেমানান বলে বার্তা দিয়েছেন। তিনি আইএসকে সিরিয়ার আল-কায়েদার শাখা ‘জাবহাতুন নুসরা’র মুজাহিদগণকে হত্যা, তাকফীর এবং আইএসের বিভিন্ন মিথ্যাচারের জন্য অভিযুক্ত করে দুনিয়ার সব মুজাহিদীনকে এই ভ্রান্ত দলটির ব্যাপারে সতর্ক করেন।
শাইখ আবু মুহাম্মদ আসিম আল-মাকদিসী হাফিঃ এর বার্তাটির অনুবাদ পড়ুন......
লিংক-১....... http://bit.ly/2rFTPXB
মূল আরবী বার্তার লিংক.... http://bit.ly/2rpxwEZ
যেহেতু আইএসের খিলাফাহ ঘোষণার প্রায় ৫ মাস পূর্বে আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় কমান্ড আইএসের বাতিল আকীদা ও মুসলিমদের রক্ত হালাল করার কারণে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন, প্রায় ২ মাস পূর্বে শাইখ আবু কাতাদা আল-ফিলিস্তিনী হাফিযাহুল্লাহ আইএসকে সুস্পষ্ট ভাষায় খারিজী বলে আখ্যা দেন, প্রায় দেড় মাস আগে শাইখ মাক্বদিসী হাফিযাহুল্লাহ আইএসের সাথে জিহাদ ও মুজাহিদ শব্দ ব্যবহার না করার আহবান জানান; তাই এই বাতিল দলটির খিলাফাহ ঘোষণার এই মনগড়া দাবী গ্রহণযোগ্য হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
কিন্তু যারা আইএসের ভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে অবগত নয়; কিংবা আইএসের সমর্থকরা যেহেতু দাবী করে থাকে যে, তাদের এই বাতিল আকীদাই নাকি সঠিক আকীদা!! তাই শরীয়ার দৃষ্টিকোণ থেকেও আইএসের দাবীকৃত খিলাফাহ’র গ্রহণযোগ্যতা পর্যালোচনা করা জরুরী।
২. ইমামত বা খিলাফাহ কী?
আল্লাহ তা‘আলার যমীনে আল্লাহর বিধান কায়েম করার জন্য মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বই হচ্ছে খিলাফাহ। মুসলিম উম্মাহর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথা ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ এর বাই‘আত ও সম্মতির ভিত্তিতে ইসলামী শরী‘আর আলোকে উম্মাহকে পরিচালনার দায়িত্ব যে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পালন করে থাকে, মূলতঃ তাই হচ্ছে খিলাফাহ। খিলাফাহ কায়েম করা এবং তা কায়েম রাখা সালাত ও সিয়ামের মতো ব্যক্তিগত কোনো ইবাদত নয়; বরং এটি মুসলিম উম্মাহর একটি সম্মিলিত দায়িত্ব। সালাত ও সিয়াম বা অনুরূপ ইবাদত পালন করার জন্য কোনো নিয়ন্ত্রিত ভূখন্ড কিংবা সামরিক শক্তির প্রয়োজন হয়না। পক্ষান্তরে খিলাফাহ সম্পূর্ণই তা থেকে ভিন্ন। এর অস্তিত্বই নির্ভর করে মুসলিম উম্মাহর সামর্থ্য ও শক্তির উপর। এ জন্য দেখা যায়, ইসলামের শত্রুদের চক্রান্ত এবং অন্যান্য কারণে, যখনই মুসলিম উম্মাহ বিভক্ত ও শক্তিহীন হয়ে পড়েছে; তখনই খিলাফাহ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইমামত বা খিলাফাহ’র মূলভিত্তির ব্যাপারে সালাফে-সালিহীনের বক্তব্য উল্লেখ করে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন,
وَلِهَذَا قَالَ أَئِمَّةُ السَّلَفِ : مَنْ صَارَ لَهُ قُدْرَةٌ وَسُلْطَانٌ يَفْعَلُ بِهِمَا مَقْصُودَ الْوِلَايَةِ ، فَهُوَ مِنْ أُولِي الْأَمْرِ الَّذِينَ أَمَرَ اللَّهُ بِطَاعَتِهِمْ مَا لَمْ يَأْمُرُوا بِمَعْصِيَةِ اللَّهِ ، فَالْإِمَامَةُ مُلْكٌ وَسُلْطَانٌ ، وَالْمُلْكُ لَا يَصِيرُ مُلْكًا بِمُوَافَقَةِ وَاحِدٍ وَلَا اثْنَيْنِ وَلَا أَرْبَعَةٍ ، إِلَّا أَنْ تَكُونَ مُوَافَقَةُ هَؤُلَاءِ تَقْتَضِي مُوَافَقَةَ غَيْرِهِمْ بِحَيْثُ يَصِيرُ مُلْكًا بِذَلِكَ . وَهَكَذَا كُلُّ أَمْرٍ يَفْتَقِرُ إِلَى الْمُعَاوَنَةِ عَلَيْهِ لَا يَحْصُلُ إِلَّا بِحُصُولِ مَنْ يُمْكِنُهُمُ التَّعَاوُنُ عَلَيْهِ ؛ وَلِهَذَا لَمَّا بُويِعَ عَلِيٌّ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ - وَصَارَ مَعَهُ شَوْكَةٌ صَارَ إِمَامًا............. فَإِذَا أَمَّرَهُ أَهْلُ الْقُدْرَةِ مِنْهُمْ صَارَ أَمِيرًا
“আর এ কারণে সালাফ ইমামগণ বলেন, শাসনের উদ্দেশ্য হাসিল হয় এমন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যার জন্য অর্জিত হয়, তিনিই হচ্ছেন উলুল আমর; আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার আদেশ না দেবে। আর ইমামত হচ্ছে শাসনক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। আর শাসনক্ষমতা একজন, দুইজন, চারজনের একমত হওয়ার মাধ্যমে শাসনক্ষমতা বলে গণ্য হবে না; বরং সেইসব লোকদের একমত হওয়ার দ্বারা যদি অন্যদের একমত হওয়ার প্রয়োজন পূরণ হয়, তাহলে তা শাসনক্ষমতা বলে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে এমন প্রত্যেক বিষয় যা সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, তা ততক্ষণ পর্যন্ত অর্জিত হবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত বিষয়ে সাহায্য করতে সক্ষম হবে এমন ব্যক্তিদের না পাওয়া যাবে। আর এ কারণে যখন আলী রাযি. কে বাই‘আত প্রদান করা হয় এবং উনার সাথে ক্ষমতা ছিলো, ফলে তিনি ইমাম হিসেবে গণ্য হলেন।...........যখন তাদের মধ্যে কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিরা আলী রাযি. কে আমীর হিসেবে মনোনীত করলেন, তখন তিনি ইমাম হিসেবে গণ্য হলেন।” - মিনহাজুসসুন্নাহ...., ১ম খ-, ৫২৭-৫২৮ পৃষ্ঠা
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. আরো বলেন,
فَكَوْنُ الرَّجُلِ أَمِيرًا وَقَاضِيًا وَوَالِيًا وَغَيْرَ ذَلِكَ مِنَ الْأُمُورِ الَّتِي مَبْنَاهَا عَلَى الْقُدْرَةِ وَالسُّلْطَانِ ، مَتَى حَصَلَ مَا يَحْصُلُ بِهِ مِنَ الْقُدْرَةِ وَالسُّلْطَانِ حَصَلَتْ وَإِلَّا فَلَا ؛ إِذِ الْمَقْصُودُ بِهَا عَمَلُ أَعْمَالٍ لَا تَحْصُلُ إِلَّا بِقُدْرَةٍ ، فَمَتَى حَصَلَتِ الْقُدْرَةُ الَّتِي بِهَا يُمْكِنُ تِلْكَ الْأَعْمَالُ [12] كَانَتْ حَاصِلَةً وَإِلَّا فَلَا . وَهَذَا مِثْلُ كَوْنِ الرَّجُلِ رَاعِيًا لِلْمَاشِيَةِ ، مَتَى سُلِّمَتْ إِلَيْهِ بِحَيْثُ يَقْدِرُ أَنْ يَرْعَاهَا ، كَانَ رَاعِيًا لَهَا وَإِلَّا فَلَا ، فَلَا عَمَلَ إِلَّا بِقُدْرَةٍ عَلَيْهِ ، فَمَنْ لَمْ يَحْصُلْ لَهُ الْقُدْرَةُ عَلَى الْعَمَلِ لَمْ يَكُنْ عَامِلًا
“সুতরাং কোনো বিষয়ে কোনো ব্যক্তির আমীর, কাযী এবং ওয়ালী বা অন্য কিছু হওয়ার মূলভিত্তি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করে। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মাধ্যমে যা অর্জিত হওয়ার, যখনই তা অর্জিত হবে; তখনই উক্ত বিষয়টি হাসিল হবে, অন্যথায় নয়। যখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন কাজগুলোর কোনো একটি কাজ ক্ষমতা ছাড়া অর্জিত হবে না। সুতরাং যখনই ক্ষমতা অর্জিত হবে, যে ক্ষমতা উক্ত কাজগুলো সম্পাদন করা সম্ভব করে তুলবে; তখন তা কার্যসম্পাদনকারী বলে গণ্য হবে, অন্যথায় নয়। এটি কোনো ব্যক্তির গবাদিপশুর রক্ষণাবেক্ষণকারী (রাখাল) হওয়ার মতো, যখনই তার প্রতি এই গবাদিপশু রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা অর্পণ করা হবে; তখনই সে রক্ষণাবেক্ষণকারী (রাখাল) বলে গণ্য হবে, অন্যথায় নয়। সুতরাং এমন কোনো কর্ম নাই, যা উক্ত বিষয়ে সক্ষমতা ছাড়া হয়। আর তাই যার জন্য কোনো কাজের ক্ষমতা অর্জিত হবে না, সে উক্ত কাজের দায়িত্বশীল (কর্মী) বলে গণ্য হবে না।”
যখন মুসলিমদের কোনো খলিফাহ/খিলাফাহ থাকবে না, সেই অবস্থায় খলীফাহ মনোনয়নের পদ্ধতি হচ্ছে, আবু বকর রাযি. কে খলীফাহ মনোনয়নের ন্যায়। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের পূর্বে খলীফাহ মনোনীত করে যাননি। আইএস যখন খিলাফাহ ঘোষণা করেছে, তখন যেহেতু পৃথিবীতে খিলাফাহ প্রতিষ্ঠিত ছিলো না অর্থাৎ খলীফাহ ছিলো না; তাই আবু বকর রাযি. এর মনোনয়নের বিষয়টি স্পষ্ট হলেই আইএসের দাবীকৃত খিলাফাহ’র ভ্রান্তি দিবালোকের চেয়েও উজ্জ্বল হবে।
৩. খলীফাহ মনোনীত হওয়ার পদ্ধতি
খলীফাহকে মনোনীত করবে কারা??
খলীফাহকে মনোনীত করবে ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’। ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ হচ্ছেন, মুসলিম উম্মাহর উলামা ও নেতৃত্বস্থানীয় সে সব ব্যক্তিবর্গ; যাদের কথার উপর মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং যাদের কাছে যমীনে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় শাওকাহ তথা শক্তি বিদ্যমান থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, আবু বকর রাযি. কে খলীফাহ মনোনয়নের সময় সর্বপ্রথম আনসার ও মুহাজিরদের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রথম বাই‘আত তথা বাই‘আতে খাছছা দিয়েছিলেন; যা মুসলিমরা সর্বসম্মতিক্রমে মেনে নিয়েছিলেন। অতঃপর সকল সাহাবায়ে কেরাম বাই‘আত প্রদান করেছিলেন।
অনুরূপভাবে উসমান রাযি. কে খলীফাহ মনোনয়নের সময় উমর রাযি. এর গঠন করা ৬ সদস্য বিশিষ্ট পরিষদ ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ এর ভূমিকা পালন করেন। এই ৬ জনের সিদ্ধান্ত মুসলিম উম্মাহ মেনে নিয়েছিলেন।
৪. খোলাফায়ে রাশেদীনের খলীফাহ মনোনীত হওয়ার পদ্ধতি
আবু বকর রাযি. খলীফাহ মনোনীত হওয়ার ঘটনা
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের দিন অর্থাৎ ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সাকীফায়ে বনু সাঈদায় একত্রিত হয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার একপর্যায়ে উমর রাযি. সর্বপ্রথম, অতঃপর উপস্থিত সমস্ত মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ আবু বকর রাযি. এর হাতে বাই‘আতে খাছছা সম্পন্ন করেন।
তার পরের দিন অর্থাৎ ১৩ রবিউল আউয়াল মঙ্গলবার মাসজিদে সমবেত হয়ে সমস্ত মুসলিম আম বাই‘আত সম্পন্ন করেন।
আল্লামা ইবনে কাছীর রহ. ‘আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ’ গ্রন্থে সাকীফায়ে বনু সাঈদার ১ম বাই‘আতের বিস্তারিত উল্লেখের পর বলেন, “এটা ছিলো সোমবারের দিন শেষের ঘটনা। পরের দিন মঙ্গলবার সকালে লোকজন মাসজিদে সমবেত হোন এবং মুহাজির-আনসার নির্বিশেষে সকলে বাই‘আত গ্রহণ করলেন।” -আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, বাংলা অনুবাদ (ই. ফা. বা.), ৫ম খ-, পৃষ্ঠা: ৪১১
আবু বকর রাযি. এর খলীফাহ মনোনয়নের ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন,
وَلَوْ قُدِّرَ أَنَّ عُمَرَ وَطَائِفَةً مَعَهُ بَايَعُوهُ ، وَامْتَنَعَ سَائِرُ الصَّحَابَةِ عَنِ الْبَيْعَةِ ، لَمْ يَصِرْ إِمَامًا بِذَلِكَ ، وَإِنَّمَا صَارَ إِمَامًا بِمُبَايَعَةِ جُمْهُورِ الصَّحَابَةِ ، الَّذِينَ هُمْ أَهْلُ الْقُدْرَةِ وَالشَّوْكَةِ . وَلِهَذَا لَمْ يَضُرَّ تَخَلُّفُ سَعْدِ بْنِ عُبَادَةَ ؛ لِأَنَّ ذَلِكَ [ لَا ] يَقْدَحُ فِي مَقْصُودِ الْوِلَايَةِ ، فَإِنَّ الْمَقْصُودَ حُصُولُ الْقُدْرَةِ وَالسُّلْطَانِ اللَّذَيْنِ بِهِمَا تَحْصُلُ مَصَالِحُ الْإِمَامَةِ ، وَذَلِكَ قَدْ حَصَلَ بِمُوَافَقَةِ الْجُمْهُورِ عَلَى ذَلِكَ . فَمَنْ قَالَ إِنَّهُ يَصِيرُ إِمَامًا بِمُوَافَقَةِ وَاحِدٍ أَوِ اثْنَيْنِ أَوْ أَرْبَعَةٍ ، وَلَيْسُوا هُمْ ذَوِي الْقُدْرَةِ وَالشَّوْكَةِ ، فَقَدْ غَلِطَ ؛ كَمَا أَنَّ مَنْ ظَنَّ أَنَّ تَخَلُّفَ الْوَاحِدِ أَوِ الِاثْنَيْنِ وَالْعَشَرَةِ يَضُرُّهُ ، فَقَدْ غَلِطَ
“আর যদি নির্ধারিত হতো যে, উমর রাযি. এবং উনার সাথে কিছু ব্যক্তি আবু বকর রাযি. কে বাই‘আত দিতেন এবং বাকী সকল সাহাবাগণ বাই‘আত প্রদান করা থেকে বিরত থাকতেন; তাহলে আবু বকর রাযি. ইমাম/খলীফাহ হিসেবে গণ্য হতেন না। আর নিশ্চয়ই তিনি (আবু বকর রাযি.) ইমাম/খলীফাহ হিসেবে গণ্য হয়েছেন অধিকাংশ সাহাবাগণের বাই‘আতের মাধ্যমে। যারা হচ্ছেন ক্ষমতা ও কর্তৃত্বসম্পন্ন। আর এই কারণে সা’দ ইবনে উবাদাহ রাযি. এর বাই‘আত প্রদান না করা কোনো ক্ষতি করেনি। কেননা, তা কর্তৃত্বের মূল উদ্দেশ্য বিনষ্ট করেনি। কেননা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সামর্থ্য ও কর্তৃত্ব অর্জন করা; যাদের মাধ্যমে ইমামত বা খিলাফতের কল্যাণ সমূহ অর্জিত হবে। আর তা (আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ এর) অধিকাংশের একমত হওয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি বলবে, তিনি একজন অথবা দুইজন অথবা তিনজনের বাই‘আতের মাধ্যমে ইমাম হয়ে যান, আর তারা সামর্থ্য ও শক্তির অধিকারী ছিলো না; তাহলে সে ভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে। অনুরূপভাবে যে ধারণা করে, একজন বা দুইজন ও দশজন ব্যক্তি পিছনে থাকার কারণে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেও ভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে।” -মিনহাজুস সুন্নাহ..., ১ম খ-, পৃষ্ঠা: ৫৩০-৫৩১
উমর রাযি. এর খলীফাহ মনোনয়নের ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন,
وَالْكَلَامُ هُنَا فِي مَقَامَيْنِ : أَحَدُهُمَا : فِي كَوْنِ أَبِي بَكْرٍ كَانَ هُوَ الْمُسْتَحِقَّ لِلْإِمَامَةِ ، وَأَنَّ مُبَايَعَتَهُمْ لَهُ مِمَّا يُحِبُّهُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ ، فَهَذَا ثَابِتٌ بِالنُّصُوصِ وَالْإِجْمَاعِ . وَالثَّانِي : أَنَّهُ مَتَى صَارَ إِمَامًا ، فَذَلِكَ بِمُبَايَعَةِ أَهْلِ الْقُدْرَةِ لَهُ . وَكَذَلِكَ عُمَرُ لَمَّا عَهِدَ إِلَيْهِ أَبُو بَكْرٍ ، إِنَّمَا صَارَ إِمَامًا لَمَّا بَايَعُوهُ وَأَطَاعُوهُ ، وَلَوْ قُدِّرَ أَنَّهُمْ لَمْ يُنَفِّذُوا عَهْدَ أَبِي بَكْرٍ وَلَمْ يُبَايِعُوهُ لَمْ يَصِرْ إِمَامًا ، سَوَاءٌ كَانَ ذَلِكَ جَائِزًا أَوْ غَيْرَ جَائِزٍ
“এখানে বক্তব্য দু’টি বিষয়ে (রাফেযীদের মিথ্যা অভিযোগের জবাবে)। প্রথমতঃ আবু বকর রাযি. এর ক্ষেত্রে, আর তিনি ইমামত/খিলাফাহর জন্য যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। আর আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ভালোবাসতেন এমন লোকদের বাই‘আত তাঁর জন্য ছিলো। এটি দলীল ও ইজমা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিষয়।
দ্বিতীয়তঃ নিশ্চয়ই তিনি তখন ইমাম/খলীফাহ হলেন, যখন উহা তাঁর জন্য ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বাই‘আত প্রদানের মাধ্যমে (নির্ধারিত হলো)। অনুরূপভাবে উমর রাযি. (এর বিষয়টি); যখন আবু বকর রাযি. তাঁর জন্য অঙ্গীকারনামা রেখে গেলেন। নিশ্চয়ই যখন তাঁরা (মুসলিমরা) তাঁকে বাই‘আত প্রদান করেছেন এবং আনুগত্য করেছেন; তখনই তিনি ইমাম/খলীফাহ হিসেবে গণ্য হলেন। যদি প্রাধান্য পেতো যে, তাঁরা (সাহাবাগণ) আবু বকর রাযি. এর অঙ্গীকারনামা বাস্তবায়ন না করতেন এবং উমর রাযি. কে বাই‘আত না দিতেন; তাহলে তিনি ইমাম/খলীফাহ হিসেবে গণ্য হতেন না। এটি জায়েয হোক কিংবা না জায়েয হোক, তা সমান।” -মিনহাজুস সুন্নাহ..., ১ম খ-, পৃষ্ঠা: ৫৩০
উসমান রাযি. এর খলীফাহ মনোনয়নের ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন,
فَيُقَالُ أَيْضًا : عُثْمَانُ لَمْ يَصِرْ إِمَامًا بِاخْتِيَارِ بَعْضِهِمْ ، بَلْ بِمُبَايَعَةِ النَّاسِ لَهُ ، وَجَمِيعُ الْمُسْلِمِينَ بَايَعُوا عُثْمَانَ [ بْنَ عَفَّانَ ] ، وَلَمْ يَتَخَلَّفْ عَنْ بَيْعَتِهِ أَحَدٌ . قَالَ الْإِمَامُ أَحْمَدُ فِي رِوَايَةِ حَمْدَانَ بْنِ عَلِيٍّ : " مَا كَانَ فِي الْقَوْمِ [ ص: 533 ] أَوْكَدُ بَيْعَةً مِنْ عُثْمَانَ كَانَتْ بِإِجْمَاعِهِمْ " فَلَمَّا بَايَعَهُ ذَوُو الشَّوْكَةِ وَالْقُدْرَةِ صَارَ إِمَامًا ، وَإِلَّا فَلَوْ قُدِّرَ أَنَّ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بَايَعَهُ ، وَلَمْ يُبَايِعْهُ عَلِيٌّ وَلَا غَيْرُهُ مِنَ الصَّحَابَةِ أَهْلِ الشَّوْكَةِ لَمْ يَصِرْ إِمَامًا
“(রাফেযীদের মিথ্যা দাবীর জবাবে) অতঃপর বলা হবে, উসমান রাযি. তাদের কতিপয়ের বাই‘আতের মাধ্যমে ইমাম হয়ে যাননি; বরং জনগণের বাই‘আতের মাধ্যমে (তিনি ইমাম হয়েছেন)। সমস্ত মুসলিম উসমান ইবনে আফফান রাযি. কে বাই‘আত দিয়েছিলেন। একজন ব্যক্তিও উনাকে বাই‘আত দেওয়া থেকে পিছে থাকেননি। হামদান বিন আলীর বর্ণনায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেন, তাঁদের ইজমার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত উসমান রাযি. এর বাই‘আতের চেয়ে অধিক শক্তিশালী কোনো বাই‘আত কোনো কওমের মধ্যে হতে পারে না। শক্তি ও কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিগণ উনাকে বাই‘আত দেওয়ার পর তিনি ইমাম নিযুক্ত হলেন। অন্যথায় যদি আব্দুর রহমান বিন আউফ উনাকে বাই‘আত প্রদান করতো আর আলী রাযি., অন্যান্য সাহাবীগণের মধ্যে কর্তৃত্ব সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উনাকে বাই‘আত না দিতেন; তাহলে তিনি ইমাম হিসেবে গণ্য হতেন না।” -মিনহাজুসসুন্নাহ..., ১ম খ-, পৃষ্ঠা: ৫৩২-৫৩৩
আলী রাযি. এর খলীফাহ মনোনয়নের ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন,
وَلِهَذَا لَمَّا بُويِعَ عَلِيٌّ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ - وَصَارَ مَعَهُ شَوْكَةٌ صَارَ إِمَامًا............. فَإِذَا أَمَّرَهُ أَهْلُ الْقُدْرَةِ مِنْهُمْ صَارَ أَمِيرًا
“আর এ কারণে যখন আলী রাযি. কে বাই‘আত প্রদান করা হয় এবং উনার সাথে ক্ষমতা ছিলো, ফলে তিনি ইমাম হিসেবে গণ্য হলেন। যখন তাঁদের মধ্যে কর্তৃত্ব সম্পন্ন ব্যক্তিগণ আলী রাযি. কে আমীর হিসেবে মনোনীত করলেন; তখন তিনি ইমাম হিসেবে গণ্য হলেন।” -মিনহাজুস সুন্নাহ..., ১ম খ-, পৃষ্ঠা: ৫২৭
৫. কে খলীফাহ বা ইমাম?
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَعَدَلَ كَانَ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرٌ وَإِنْ يَأْمُرْ بِغَيْرِهِ كَانَ عَلَيْهِ مِنْهُ
“নিশ্চয়ই ইমাম হচ্ছেন ঢালস্বরূপ। তার পিছনে থেকে লড়াই করা হয় এবং তার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা হয়। যদি সে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার নির্দেশ দেয় এবং ইনসাফ করে; তাহলে এজন্য তার বিনিময় রয়েছে। আর যদি সে এসব ব্যতীত অন্য কিছুর নির্দেশ দেয়; তাহলে তার দায়ভার তার উপরই বর্তাবে।” -সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ, হাদীস: ১৮৪১
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় সহীহ মুসলিমের শ্রেষ্ঠতম ভাষ্যকার ইমাম নাববী রহ. বলেন,
قَوْلُهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( الْإِمَامُ جُنَّةٌ ) أَيْ : كَالسِّتْرِ ; لِأَنَّهُ يَمْنَعُ الْعَدُوَّ مِنْ أَذَى الْمُسْلِمِينَ ، وَيَمْنَعُ النَّاسَ بَعْضَهُمْ مِنْ بَعْضٍ ، وَيَحْمِي بَيْضَةَ الْإِسْلَامِ
“রাসূলসাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী: (ইমাম হচ্ছেন ঢালস্বরূপ) অর্থাৎ আড়াল স্বরূপ। কেননা তিনি (ইমাম) মুসলিমদের কষ্ট দেওয়া থেকে শত্রুকে বাধা দেয়। আর মানুষের একাংশকে অপর অংশের উপর (কষ্ট দেওয়া) থেকেও তিনি বাধা দেন। আর তিনি ইসলামের মৌলিক বিষয়ের সুরক্ষা প্রদান করবেন।” -শরহে নাববী ‘আলা মুসলিম
পর্যালোচনা:
আবু বকর আল-বাগদাদী, আইএসের নেতা ও সমর্থকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখতে চাই, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস অনুযায়ী ইমাম/খলীফাহ মুসলিমদের উপর থেকে কষ্ট দূর করবেন, কাফিরদের হামলা প্রতিহত করবেন ঢালের মতো। বলুন তো আবু বকর আল-বাগদাদী কোথায় দুনিয়ার মুসলিমদের উপর থেকে কষ্ট দূর করছেন? কেননা আপনাদের মুখপাত্র তো ঘোষণা করেছে, আবু বকর আল-বাগদাদী সারা দুনিয়ার মুসলিমদের ইমাম ও খলীফাহ!! আপনাদের এই খলীফাহ কি শিয়া রাফেযীদের কল্পিত সেই খলীফাহ’র অনুরূপ হয়ে যাননি; রাফেযীরা যাকে কর্তৃত্ব ছাড়াই ইমাম বা খলীফাহ বানিয়ে রেখেছে !!
খলীফাহ কে? এ ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. আরো বলেন,
وَقَالَ فِي رِوَايَةِ إِسْحَاقَ بْنِ مَنْصُورٍ ، وَقَدْ سُئِلَ عَنْ حَدِيثِ النَّبِيِّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - " مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ لَهُ إِمَامٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً " مَا مَعْنَاهُ ؟ فَقَالَ : تَدْرِي مَا الْإِمَامُ ؟ الْإِمَامُ الَّذِي يُجْمِعُ عَلَيْهِ الْمُسْلِمُونَ ، كُلُّهُمْ يَقُولُ : هَذَا إِمَامٌ ؛ فَهَذَا مَعْنَاهُ
“ইসহাক ইবনে মানসূরের রেওয়ায়েতে তিনি (ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই হাদীস, “যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা গেলো যার কোনো ইমাম নেই, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করলো” সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করা হলো, এই হাদীসের মর্ম কী? অতঃপর তিনি বললেন, তুমি কি জানো ইমাম কে? ইমাম হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যার উপর মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হয়। প্রত্যেকে বলবে, ইনি হচ্ছেন ইমাম। এটাই এই হাদীসের মর্মার্থ।” -মিনহাজুস সুন্নাহ..., ১ম খ-, পৃষ্ঠা: ৫২৯
পর্যালোচনা:
উপরোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করে আইএসের নেতা ও সমর্থকরা মানুষকে তাদের দাবীকৃত খিলাফাহ’র দিকে আহবান করে থাকে। এই হাদীসের ব্যাপারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের অন্যতম দুনিয়া খ্যাত ইমাম ও ফকীহ ইমামু আহলিস সুন্নাহ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর বক্তব্যটি যেনো আইএসের নেতা ও সমর্থকরা ভালো করে পড়েন এবং তাদের দাবীকৃত খলীফাহ আবু বকর আল-বাগদাদীর অবস্থান জেনে নেন।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন,
وَهُوَ أَنَّ النَّبِيَّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - أَمَرَ بِطَاعَةِ الْأَئِمَّةِ الْمَوْجُودِينَ [ الْمَعْلُومِينَ ] الَّذِينَ لَهُمْ سُلْطَانٌ يَقْدِرُونَ بِهِ عَلَى سِيَاسَةِ النَّاسِ لَا بِطَاعَةِ مَعْدُومٍ وَلَا مَجْهُولٍ ، وَلَا مَنْ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ ، وَلَا قُدْرَةٌ عَلَى شَيْءٍ أَصْلًا
“আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের কর্তৃত্ব রয়েছে এমন বিদ্যমান (পরিচিত) আমীরদের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন; যার মাধ্যমে তারা মানুষের বিভিন্ন বিষয়াদি পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। অস্তিত্বহীন ও অপরিচিতকে আনুগত্যের কথা বলেননি। আর তার আনুগত্যের কথাও বলেননি, যার কর্তৃত্ব নেই এবং মূলতঃ কোনো কিছুর উপর ক্ষমতা নেই।” -মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ/ মিনহাজুস সুন্নাহ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১১৫
পর্যালোচনা:
আইএস যে তাদের এই মনগড়া দাবীকে সারা দুনিয়ার জন্য খিলাফাহ এবং আবু বকর আল-বাগদাদীকে সারা দুনিয়ার ইমাম/খলীফাহ বলে ঘোষণা করলো, দুনিয়ার মুসলিমদের উপর তাদের কর্তৃত্ব কোথায় বলুন তো!!? আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শিয়া রাফেযীদের আকীদা হচ্ছে, ইমামের কর্তৃত্ব না থাকলেও তিনি ইমাম বলে গণ্য হবেন। যেমন, তারা বিশ্বাস করে তাদের ইমাম এখন লুকিয়ে আছেন!!
আইএসের এই দাবীর সাথে রাফেযীদের আকীদার কি অবিশ্বাস্য মিল!! মুসলিমদের নিরাপত্তা প্রদান তো দূরের কথা ইরাক-সিরিয়ার সামান্য কিছু ভূমি দখলে নিয়ে সারা দুনিয়ার মুসলিমদের ইমাম বলে দাবী করছে!! আলহামদুলিল্লাহ, উম্মাহর সালাফে-সালিহীন ইমামগণের বক্তব্যের আলোকেই আমরা আইএসের এই মনগড়া ও বাতিল দাবীর জবাব দিয়েছি।
মুসলিম উম্মাহর ইমাম বা খলীফাহ কে হবেন, এ ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. আরো বলেন,
وَأَمَّا قَوْلُ [ الرَّافِضِيِّ ] . إِنَّهُمْ يَقُولُونَ : إِنَّ الْإِمَامَ بَعْدَ رَسُولِ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - أَبُو بَكْرٍ ، بِمُبَايَعَةِ عُمَرَ ، بِرِضَا أَرْبَعَةٍ ' فَيُقَالُ لَهُ : لَيْسَ هَذَا قَوْلَ أَئِمَّةِ أَهْلِ السُّنَّةِ ، وَإِنْ كَانَ بَعْضُ أَهْلِ الْكَلَامِ يَقُولُونَ : إِنَّ الْإِمَامَةَ تَنْعَقِدُ بِبَيْعَةِ أَرْبَعَةٍ ، كَمَا قَالَ بَعْضُهُمْ : تَنْعَقِدُ بِبَيْعَةِ اثْنَيْنِ ، وَقَالَ بَعْضُهُمْ : تَنْعَقِدُ بِبَيْعَةِ وَاحِدٍ ، فَلَيْسَتْ هَذِهِ أَقْوَالَ أَئِمَّةِ السُّنَّةِ . بَلِ الْإِمَامَةُ عِنْدَهُمْ تَثْبُتُ بِمُوَافَقَةِ أَهْلِ الشَّوْكَةِ عَلَيْهَا ، وَلَا يَصِيرُ الرَّجُلُ إِمَامًا حَتَّى يُوَافِقَهُ أَهْلُ الشَّوْكَةِ عَلَيْهَا الَّذِينَ يَحْصُلُ بِطَاعَتِهِمْ لَهُ مَقْصُودُ الْإِمَامَةِ ، فَإِنَّ الْمَقْصُودَ مِنَ الْإِمَامَةِ إِنَّمَا يَحْصُلُ بِالْقُدْرَةِ وَالسُّلْطَانِ ، فَإِذَا بُويِعَ بَيْعَةً حَصَلَتْ بِهَا الْقُدْرَةُ وَالسُّلْطَانُ صَارَ إِمَامًا
“আর রাফেযীদের বক্তব্য, তারা বলে থাকে, নিশ্চয়ই রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পরে ইমাম হিসেবে আবু বকর উমরের বাই‘আতের মাধ্যমে চারজনের সন্তুষ্টিতে হয়েছিলেন।
তার জবাবে (আমাদের পক্ষ থেকে) বলা হবে, এটি আহলুস সুন্নাহর ইমামগণের বক্তব্য নয়। যদিও কোনো কোনো কালাম শাস্ত্রবিদ বলে থাকেন, ইমামত চারজনের বাই‘আতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে। যেমন, তাদের কেউ বলে, দুইজনের বাই‘আতের মাধ্যমে (ইমামত) প্রতিষ্ঠিত হবে। এমনকি কেউ বলে, একজনের বাই‘আতের মাধ্যমে (ইমামত) প্রতিষ্ঠিত হবে। এগুলো আহলুস সুন্নাহর ইমামগণের বক্তব্য নয়। বরং আহলুস সুন্নাহর ইমামগণের নিকট ইমামত প্রতিষ্ঠিত হবে (জনগণের উপর) ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ইমামতের উপর একমত হওয়ার মাধ্যমে। একজন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত ইমাম হবে না, যে পর্যন্ত না ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিগণ ইমামতের উপর একমত না হবেন, যাদের আনুগত্যের মাধ্যমে ইমামতের উদ্দেশ্য অর্জিত হবে। আর নিশ্চয়ই ইমামতের উদ্দেশ্য হচ্ছে তা; যা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মাধ্যমে অর্জিত হয়। অতঃপর যখন কোনো ব্যক্তিকে এমন বাই‘আত প্রদান করা হয়, যার মাধ্যমে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অর্জিত হয়; তাহলে তিনি ইমাম হিসেবে গণ্য হবেন।” -মিনহাজুস সুন্নাহ..., ১ম খ-, পৃষ্ঠা: ৫২৬-৫২৭
৬. কারা আবু বকর আল-বাগদাদীকে খলীফাহ মনোনীত করেছে?
আইএসের খিলাফাহ ঘোষণা দেওয়ার সময় আইএসের মুখপাত্র আবু মুহাম্মাদ আদনানী বলেন,
فقررت الدولة الإسلامية، ممثّلة بأهل الحل والعقد فيها؛ مِن الأعيان والقادة والأمراء ومجلس الشورى: “إعلان قيام الخلافة الإسلامية”، وتنصيب خليفة للمسلمين، ومبايعة الشيخ..... وقد قبل البيعة؛ فصار بذلك إمامًا وخليفة للمسلمين في كل مكان،
وننبّه المسلمين: أنه بإعلان الخلافة؛ صار واجبًا على جميع المسلمين مبايعة ونصرة الخليفة إبراهيم حفظه الله، وتبطل شرعيّة جميع الإمارات والجماعات والولايات والتنظيمات
the Islamic State – represented by ahlul-halli-wal-‘aqd (its people of authority), consisting of its senior figures, leaders, and the shūrā council – resolved to announce the establishment of the Islamic khilāfah, the appointment of a khalīfah for the Muslims, and the pledge of allegiance to the shaykh (sheikh).....(Baghdadi)…… And he has accepted the bay’ah (pledge of allegiance). Thus, he is the imam and khalīfah for the Muslims everywhere.
We clarify to the Muslims that with this declaration of khilāfah, it is incumbent upon all Muslims to pledge allegiance to the khalīfah Ibrāhīm and support him (may Allah preserve him). The legality of all emirates, groups, states, and organizations, becomes null…….
“অতঃপর (বিশিষ্ট) ব্যক্তি, নেতৃবৃন্দ, উমারা এবং মাজলিসে শূরার সমন্বয়ে গঠিত ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ এর প্রতিনিধিত্ব দ্বারা পরিচালিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) ‘ইসলামী খিলাফাহ কায়েমের ঘোষণা’ ও মুসলিমদের জন্য খলীফাহ নির্ধারণ এবং শাইখ.......(বাগদাদী) কে বাই‘আত প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আর তিনি বাই‘আত গ্রহণ করেছেন এবং এর মাধ্যমে তিনি সকল স্থানের মুসলিমদের জন্য খলীফাহ ও ইমাম হয়ে গেলেন।
আমরা মুসলিমদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছি, এই খিলাফাহ ঘোষণার মাধ্যমে সকল মুসলিমের উপর ওয়াজিব হয়ে যাবে খলীফাহ ইবরাহীম হাফি. কে বাই‘আত প্রদান করা ও সাহায্য করা। আর তা (খিলাফাহ ঘোষণা) সকল ইমারত, জামা‘আত, কর্তৃত্ব ও তানযীমসমূহকে বাতিল করে দেবে।”
আইএসের মুখপাত্রের খিলাফাহ ঘোষণার পুরো বার্তার ইংরেজি অনুবাদ... http://bit.ly/1qJIT2l
আরবী টেক্সট..... http://bit.ly/2qV0uZD
৭. আইএসের খিলাফাহ ঘোষণার পর্যালোচনা:
আইএসের মুখপাত্রের উপরোক্ত ঘোষণায় যে সব বিষয় সুস্পষ্ট হলো, তা হচ্ছে-
১। আইএসের দলীয় মাজলিসে শুরা ও তাদের নেতারা এই খিলাফাহ ঘোষণা করেছে এবং আবু বকর বাগদাদীকে খলীফাহ মনোনীত করেছে। তার মানে এটি একটি দলীয় খিলাফাহ আর বাগদাদী হচ্ছেন তাদের দলীয় খলীফাহ। মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধিত্ব দূরের কথা, তাদের কাউকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেসও করা হয়নি।
২। তাদের দলের নেতাদের ঘোষিত খিলাফাহ ও বানানো খলীফাহকে সারা দুনিয়ার খলীফাহ বা ইমাম হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছে; যার বিন্দুমাত্র অধিকার তাদের নেই। এটি সম্পূর্ণ শরী‘আহ বহির্ভূত একটি অবাস্তব কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়।
৩। মুসলিম ভূখ-গুলোর অতি সামান্য এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সারা দুনিয়ার মুসলিমদের জন্য আনুগত্য করাকে ওয়াজিব বলে এক নতুন শরীয়ত তথা ‘বিদ‘আতি মতবাদ’ প্রণয়ন করেছে, যেই মতবাদের সাথে ‘খোলাফায়ে রাশেদীনের খিলাফাহ’ তথা ‘খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহ’র কোনো সম্পর্ক নেই ।
৪। আইএস তাদের এই দলীয় খিলাফাহ ঘোষণার মাধ্যমে দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে মুসলিমদের আনুগত্যের ভিত্তিতে যেসব বৈধ ইমারাহ, জামা‘আহ এবং তানযীম রয়েছে, সেগুলোকে বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। পৃথিবীর ইতিহাস এধরণের ঘটনায় ভরপুর যে, স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় জবরদখলের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা বৈধ কর্তৃত্বকে বাতিল ঘোষণা করে। এক্ষেত্রেও তার হুবহু পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। নিজেদের দাবী করা দলীয় খিলাফাহ ঘোষণার মাধ্যমে ‘ইসলামী ইমারত আফগানিস্তান’ এর মতো শরয়ী ইমারতকে বাতিল করে দেয়! অথচ ‘ইসলামী ইমারত আফগানিস্তান’ বিরাট সংখ্যক মুসলিমের এবং আফগানিস্তানের ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ তথা কর্তৃত্বসম্পন্ন উলামা ও নেতৃত্বের বাই‘আতের মাধ্যমে গঠিত হওয়া একটি ইসলামী ইমারত বা ইসলামী রাষ্ট্র। এমনকি এই ইমারতের একজন সৈনিক ছিলেন শাইখ উসামা বিন লাদেন রহ.। শুধু তাই নয় স্বয়ং বাগদাদীও এই ইমারতের অধীনস্ত একজন সৈনিক ছিলো।
৮. আইএস কি খিলাফাহ ঘোষণার বিষয়ে বিশ্বের কোনো মুজাহিদ জামা‘আতের পরামর্শ নিয়েছে?
না, তারা কারো সাথে পরামর্শ দূরের কথা আলোচনা পর্যন্ত করেনি। অথচ খিলাফাহ/খলীফাহ গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্ত হচ্ছে, মুসলিম উম্মাহ যাদের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ থাকবে সে ধরণের শক্তি ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের বাই‘আতের মাধ্যমে খলীফাহ নিযুক্ত হওয়া।
আইএসের খিলাফাহ ঘোষণা দেওয়ার সময় আইএসের মুখপাত্র আবু মুহাম্মাদ আদনানী বলেন,
وإن قالوا لكم: “لقد افتأتّم عليهم!؛ فهلّا كنتم استشرتموهم فأعذرتموهم واستملتموهم؟”؛ فقولوا لهم: إن الأمر أعجل مِن ذلك؛ {وَعَجِلْتُ إِلَيْكَ رَبِّ لِتَرْضَى}، [طه: 84]، وقولوا لهم: مَن نشاور؟!، ولم يقرّوا أنها دولة، وقد أقرّت أمريكا وبريطانيا وفرنسا أنها دولة!، مَن نشاور؟!؛ أنشاور مَن خذلنا؟، أم نشاور مَن خاننا؟، أم نشاور مَن تبرّأ منا وحرّض علينا؟، أم نشاور مَن يعادينا؟، أم نشاور مَن يحاربنا؟، مَن نشاور؟، وعلى مَن افتأتنا؟!.
وَإنَّ الَّذي بيني وَبينَ أبي وَبينَ بني عمِّي: لَمختلِفٌ جدّا
If they tell you, “You have stepped over them and acted on your own judgment. Why did you not consult the other groups, pardon them, and tolerate them?” Then say to them, “The issue is too urgent.”
{And I hastened to You, my Lord, that You be pleased} [Tāhā: 84].
And say to them, “Whom would we consult? They never recognized the Islamic State to begin with, although America, Britain and France acknowledge its existence. Whom would we consult? Should we consult those who have abandoned us? Those who have betrayed us? Those who have disowned us and incited against us? Those who have become hostile towards us? Those who wage war against us? Whom would we consult, and whom did we step over?”
Indeed the difference between me and my brothers and cousins is very big.
“যদি তারা তোমাদেরকে বলে, “তোমরা তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছো! কেন তোমরা তাদের সাথে পরামর্শ করোনি, তাদের অজুহাত গ্রহণ করোনি এবং তাদেরকে আকর্ষণ করোনি? তখন তাদেরকে বলে দাও, “বিষয়টি খুবই তাড়াহুড়ার ব্যাপার।”
“আমি আপনার প্রতি তাড়াতাড়ি এসেছি হে আমার রব, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হোন।” -সূরা ত্বহা: ৮৪
এবং তাদেরকে বলো, “আমরা কাদের সাথে পরামর্শ করবো? তারা এখনো স্বীকৃতি দেয়নি যে, এটি একটি দাওলা বা রাষ্ট্র। অথচ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এর অস্তিত্ব স্বীকার করেছে।
আমরা কাদের সাথে পরামর্শ করবো? আমরা কি তাদের সাথে পরামর্শ করবো; যারা আমাদেরকে অপমানিত করেছে?
অথবা আমরা কি তাদের সাথে পরামর্শ করবো; যারা আমাদের সাথে খেয়ানত করেছে?
অথবা আমরা কি তাদের সাথে পরামর্শ করবো; যারা আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং আমাদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়েছে?
অথবা আমরা কি তাদের সাথে পরামর্শ করবো; যারা আমাদের সাথে শত্রুতা করেছে। অথবা আমরা কি তাদের সাথে পরামর্শ করবো; যারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। আমরা কার সাথে পরামর্শ করবো?? আমরা কাদেরকে আকর্ষণ করবো??
“নিশ্চয়ই আমার সাথে আমার পিতা ও চাচাতো ভাইদের বিরাট মতভেদ রয়েছে। (কবিতার লাইন) ”
পর্যালোচনা:
আইএসের মুখপাত্রের খিলাফাহ ঘোষণার বার্তার উপরোক্ত বক্তব্য প্রমাণ করে, তারা খিলাফাহ’র বিষয়ে পরামর্শের জন্য তাদের দলের বাইরে দুনিয়ার কোনো মুসলিমতো দূরের কথা, কোনো মুজাহিদ জামা‘আতকেও উপযুক্ত মনে করেনি; বরং জিহাদী জামা‘আতের বিরুদ্ধে তারা বিভিন্ন অভিযোগ আরোপ করেছে।
৯. আইএসের খিলাফাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের খিলাফাহ’র মাঝে পার্থক্য
প্রথমতঃ
খিলাফাহ ও খলীফাহ গ্রহণযোগ্য হওয়ার অত্যাবশ্যক শর্ত হচ্ছে, যেই মুসলিম ভূখন্ডগুলো খিলাফাহ’র অন্তর্ভুক্ত সেখানকার শক্তি ও কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিরা খলীফাহ’র ব্যাপারে একমত হয়ে উক্ত খলীফাহকে বাই‘আত প্রদান করবেন; যাদের উক্ত ভূখ-ে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নের সামর্থ্য রয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের খিলাফাহ ছিলো কর্তৃত্ব ও সামর্থ্যরে ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত; যা আমরা উপরে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. এর বিভিন্ন বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে জানতে পেরেছি।
পক্ষান্তরে ইরাক-সিরিয়ার কিছু এলাকার বাইরে আইএসের কর্তৃত্বে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূখ- নেই বললেই চলে। এমনকি ইরাক-সিরিয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায়ও তারা মুসলিমদেরকে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয়নি। আর বর্তমানে তাদের নিয়ন্ত্রিত ভূখ- তাদের এই বাতিল খিলাফাহ ঘোষণার সময়ের তুলনায় তিন ভাগের একভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আকীদা হচ্ছে, ইমামত বা খিলাফাহ কর্তৃত্ব ও সামর্থ্যরে সাথে যুক্ত। পক্ষান্থরে শিয়া রাফেযীদের আকীদা হচ্ছে, ইমামত কর্তৃত্ব ও সামর্থ্যরে সাথে যুক্ত নয়; বরং কর্তৃত্ব ও সামর্থ্য না থাকলেও একজনকে ইমাম মানতে হবে। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, আইএস শিয়াদেরকে পাইকারিহারে হত্যা করলেও ইমামত তথা খিলাফাহ’র ক্ষেত্রে তারা শিয়াদের আকীদার মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং তাদের এই খিলাফাহ ঘোষণা শিয়াদের এই আকীদাকেই উপস্থাপন করেছে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. উনার জগদ্বিখ্যাত এবং আহলুস সুন্নাহর আকীদা সম্বলিত কিতাব ‘মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ’তে শিয়া রাফেযীদের এই বাতিল মতবাদের খ-ন করেছেন।
আইএস কি সারা দুনিয়ার মুসলিমদেরকে নিরাপত্তা প্রদান ও শরী‘আহর মাধ্যমে পরিচালনা করছে? প্রশ্নই আসে না! তাহলে কীভাবে আবু বকর আল-বাগদাদী নিজেকে সারা দুনিয়ার খলীফাহ দাবী করতে পারে!!!
যেহেতু আইএসের দাবীকৃত এই খিলাফাহ’র দুনিয়ার মুসলিমদের উপর কর্তৃত্ব নেই; তাই মৌলিকভাবেই তাদের এই খিলাফাহ একটি অবাস্তব ও মনগড়া দাবী। এ ধরণের কর্তৃত্বহীন দাবীর খিলাফাহ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কোনো কারণ নেই।
দ্বিতীয়তঃ
খোলাফায়ে রাশেদীন সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সেইসব সাহাবীগণের বাই‘আতের মাধ্যমে মনোনীত হয়েছিলেন; যাদের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ এবং যমীনে আল্লাহর শরী‘আহ কায়েমের সামর্থ্য তাদের ছিলো।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. উনার কিতাবে এ বিষয়টি বারবার উল্লেখ করেছেন, যার অকাট্য প্রমাণ আমরা উপরে প্রদান করেছি। পক্ষান্তরে আবু বকর আল-বাগদাদীর দাবীকৃত এই খিলাফাহ শুধুমাত্র তার দলের নেতাদের দ্বারা ঘোষিত হয়েছে। ফলে ইরাক-সিরিয়ার তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো ব্যতীত দুনিয়ার অন্যান্য ময়দানে শরী’আহ কায়েমের কোনো সামর্থই তাদের নেই। যেমনঃ সোমালিয়ায় আল-কায়েদার শাখা আল-শাবাব মুজাহিদরা সেখানকার বিস্তীর্ণ ভূমিতে শরী’আহ কায়েম করেছে। যেহেতু সেখানে আল-শাবাব মুজাহিদদের শাওকাহ বা সামর্থ রয়েছে, তাই সেখানকার কর্তৃত্বস¤পন্ন ইসলামী রাষ্ট্রই সেখানকার বৈধ প্রশাসন। আর শরী’আহ কায়েমকারী সেই শক্তিস¤পন্ন বৈধ প্রশাসনকে বাদ দিয়ে ইরাক-সিরিয়ায় বসে নিজেকে তাদের উপর খলীফাহ দাবী করা ঠিক সেরকম হাস্যকর, যেরকম যদি কোনো ব্যক্তি ইন্দোনেশিয়ায় বসে এদেশের সরকার বলে ঘোষণা দেয়। শরী’আহ বহির্ভূত এধরণের অবাস্তব দাবিকে অপ্রকৃতিস্থ লোকের উদ্ভট কাজ ছাড়া আর কীই বা বলা যায়।
আফগানিস্তানে তালিবান মুজাহিদরা হচ্ছেন সেখানকার শক্তিস¤পন্ন কর্তৃত্বের অধিকারী। তালিবানদের অধীনে আফগানিস্তানের অর্ধেক বা তার বেশি এলাকা রয়েছে। কিন্তু ইরাক-সিরিয়ায় কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেই ব্যক্তি দুনিয়ার মুজাহিদদের কোনো তোয়াক্কা না করে নিজেকে সারা দুনিয়ার খলীফাহ বলে ঘোষণা করেছে। শুধু তাই নয়, এই আইএস তালিবানদেরকে মুরতাদ বলে আখ্যা দিয়েছে।
খোলাফায়ে রাশেদীনের সু¯পষ্ট মানহাজের আলোকে আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল-জামা’আহর আকীদা ও নীতি হচ্ছে, শক্তিস¤পন্ন কর্তৃত্ববান ব্যক্তি, যাদের উপর উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ এবং যারা যমীনে আল্লাহর শরী’আহ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম, এমন ব্যক্তিদের বাই’আতের ভিত্তিতে খলীফাহ মনোনীত হবেন।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, আইএসের এই খিলাফাহ ঘোষণার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল-জামা’আহর আকীদা ও নীতি এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের খলীফাহ মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে স¤পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
তৃতীয়তঃ
খোলাফায়ে রাশেদীনের খলীফাহ মনোনয়ন থেকে স্পষ্ট যে, খিলাফাহ’র মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কেননা মুসলিম উম্মাহর গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিগণ যখন কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন উম্মাহ উক্ত ব্যক্তিকে নিজেদের ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে।
পক্ষান্তরে আইএসের দাবীকৃত এই খিলাফাহ যেহেতু মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তথা ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ এর কোনো ধরনের সম্মতি এবং বাস্তবিক কর্তৃত্ব ছাড়া অবাস্তব ও দলীয় একটি দাবী মাত্র; ফলে এটি মুসলিম উম্মাহর মাঝে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করেছে। এমনকি তারা মুসলিমদের জামা‘আতের মধ্যে অনৈক্য তৈরির মধ্য দিয়েই এই মনগড়া খিলাফাহ ঘোষণা করেছে। অতঃপর আইএসের মুখপাত্র আবু মুহাম্মাদ আদনানী قل للذين كفروا ستغلبون অডিও বক্তব্যে তাদের এই বাতিল ও অবাস্তব খিলাফাহ’র দাবীকে না মানলে দুনিয়ার প্রায় সকল মুজাহিদকে তাকফীর করে হত্যার ঘোষণা দিয়েছে।
***খোলাফায়ে রাশেদীনের খিলাফাহ’র সাথে আইএসের দাবীকৃত খিলাফাহ’র পার্থক্য বুঝতে খোলাফায়ে রাশেদীনের ৪ জন খলীফাহ’র মনোনয়নের ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ এর সুস্পষ্ট বক্তব্যগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেই................
“আর যদি নির্ধারিত হতো যে, উমর রাযি. এবং উনার সাথে কিছু ব্যক্তি আবু বকর রাযি. কে বাই‘আত দিতেন এবং বাকী সকল সাহাবাগণ বাই‘আত প্রদান করা থেকে বিরত থাকতেন; তাহলে আবু বকর রাযি. এর মাধ্যমে ইমাম/খলীফাহ হিসেবে গণ্য হতেন না। আর নিশ্চয়ই তিনি (আবু বকর রাযি.) ইমাম/খলীফাহ হিসেবে গণ্য হয়েছেন অধিকাংশ সাহাবাগণের বাই‘আতের মাধ্যমে। যারা হচ্ছেন ক্ষমতা ও কর্তৃত্বসম্পন্ন।”
“যদি প্রাধান্য পেতো যে, তাঁরা (সাহাবীগণ) আবু বকর রাযি. এর অঙ্গীকারনামা বাস্তবায়ন না করতেন এবং উমর রাযি. কে বাই‘আত না দিতেন; তাহলে তিনি ইমাম/খলীফাহ হিসেবে গণ্য হতেন না।”
“উসমান রাযি. তাদের কতিপয়ের বাই‘আতের মাধ্যমে ইমাম হয়ে যাননি; বরং উনাকে জনগণের বাই‘আতের মাধ্যমে (তিনি ইমাম হয়েছেন).................. যদি আব্দুর রহমান বিন আউফ উনাকে বাই‘আত প্রদান করতো আর আলী রাযি.,অন্যান্য সাহাবাগণের মধ্যে কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উনাকে বাই‘আত না দিতেন; তাহলে তিনি ইমাম হিসেবে গণ্য হতেন না।”
“আর একারণে আলী রাযি. কে বাই‘আত প্রদান করা হয় এবং উনার সাথে ক্ষমতা ছিলো, ফলে তিনি ইমাম হিসেবে গণ্য হলেন। যখন তাদের মধ্যে কর্তৃত্ব সম্পন্ন ব্যক্তিগণ আলী রাযি. কে আমীর হিসেবে মনোনীত করলেন, তখন তিনি ইমাম হিসেবে গণ্য হলেন।”
যেখানে অধিকাংশ সাহাবী এবং ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ’ এর প্রায় সকল সাহাবীর বাই‘আত ব্যতীত শুধু উমর রাযি. এবং কিছু সাহাবীর বাই‘আতের মাধ্যমে আবু বকর রাযি. খলীফা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতেন না, যেখানে আবু বকর রাযি. এর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যদি সাহাবায়ে কেরাম একমত না হতেন; তাহলে কিছু সাহাবীর সম্মতির ভিত্তিতে উমর রাযি. খলীফাহ নিযুক্ত হতেন না, যেখানে উমর রাযি. এর অসীয়তকৃত ৬ জন সাহাবীর মধ্যে আব্দুর রহমান বিন আউফ রাযি. কিংবা কিছু সাহাবী মিলে বাই‘আত দিলেই উসমান রাযি. খলীফাহ হতেন না, সেখানে কীভাবে আবু বকর আল-বাগদাদী আইএসের দলীয় শূরার বাই‘আতের ভিত্তিতে সারা দুনিয়ার মুসলিমদের জন্য ইমাম ও খলীফাহ নিযুক্ত হয়ে যান!!! সুবহানাল্লাহ!!! খোলাফায়ে রাশেদীনের ৪জন খলীফাহ’র মনোনয়নের পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান করে মনগড়া খিলাফাহ দাবী করতে পারে, কিন্তু সেটিকে ‘খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নুবুয়্যাহ’ বলে দাবী করে কীভাবে!! আল্লাহ তা‘আলার ভয় নাই থাকুক, মানুষের কি চক্ষুলজ্জা বলতেও কিছু নেই!!
১০. ঐক্যবদ্ধ উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী আইএস এবং এ ব্যাপারে রাসূল সাঃ এর হাদীস:
আইএসের এই বাতিল মতবাদ প্রসারের পূর্বে অর্থাৎ মুজাহিদগণকে তাকফীর করা এবং তাদের এই অবৈধ তাকফীরকে হালাল করার মাধ্যম হিসেবে কথিত খিলাফাহ ঘোষণার পূর্বে গোটা দুনিয়ার মুজাহিদগণ ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। এটি এমন একটি সত্য; যা কোনো মানুষের পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
সারা দুনিয়ার মুজাহিদগণ শাইখ উসামা বিন লাদেন রহ. এর নেতৃত্বে আর শাইখ উসামা বিন লাদেন রহ. এর বাই‘আত আমীরুল মু’মিনীন মোল্লা উমর রহ. এর অধীনে থাকায় গ্লোবাল জিহাদের অন্তর্ভুক্ত সকল মুজাহিদ ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু আইএস তাদের দাবীকৃত খিলাফাহ ঘোষণা করে সারা দুনিয়ার জিহাদের ময়দানে তাকফীর এবং বিভেদের বাজার বসিয়েছে।
উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
(مَنْ أَتَاكُمْ وَأَمْرُكُمْ جَمِيعٌ عَلَى رَجُلٍ وَاحِدٍ، يُرِيدُ أَنْ يَشُقَّ عَصَاكُمْ، أَوْ يُفَرِّقَ جَمَاعَتَكُمْ، فَاقْتُلُوهُ (رواه مسلم.
অর্থঃ “তোমরা কোনো একজন ব্যক্তির উপর ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় যদি অন্য কেউ তোমাদের ঐক্য ভাঙতে চায় অথবা তোমাদের জামা’আতে বিভক্তি সৃষ্টি করতে চায়,তাহলে তোমরা তাকে হত্যা করো।” (সহীহ মুসলিম,হাদীস নং-৩৪৪৯)
ওমর রাঃ বলেন (হাদীসে মাওক্বুফ),
فَمَنْ بَايَعَ رَجُلًا عَلَى غَيْرِ مَشُورَةٍ مِنْ الْمُسْلِمِينَ فَلَا يُتَابَعُ هُوَ وَلَا الَّذِي بَايَعَهُ تَغِرَّةً أَنْ يُقْتَلَا (رواه البخاري)
অর্থঃ “যে ব্যক্তি মুসলিমদের সাথে পরামর্শ করা ব্যতীত কাউকে বাই’আত দিলো,তাকে অনুসরণ করা হবে না। বরং সে এবং যাকে বাই’আত দিয়েছে উভয়েই নিজেদেরকে হত্যার জন্য পেশ করেছে। ” (সহীহ বুখারী, ৬৮৩০ নং হাদীস এবং আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ,বাংলা অনুবাদ, ৫ম খণ্ড,পৃঃ ৪০৮)
খলীফাহ মনোনয়নের জন্য ৬ সদস্যের একটি পরিষদ গঠন করে উমর রাঃ বলেছিলেন.....
فَمَنْ تَأَمَّرَ مِنْكُمْ عَلَى غَيْرِ مَشُورَةٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ فَاضْرِبُوا عُنُقَهُ "
অর্থঃ “ মুসলিমদের পরামর্শ গ্রহণ ব্যতীত তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি নিজেকে আমীর দাবী করবে,তোমরা তার গর্দানে আঘাত করো (অর্থাৎ তাকে হত্যা করো।) ” (সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারী, খণ্ড নং-৭, পৃষ্ঠা-৮৪)
উপরোক্ত হাদীসগুলোর ভিত্তিতে চিন্তা করুন, যে ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করেছে, হাদীস অনুযায়ী যেখানে সে একজন অপরাধী ও শাস্তির যোগ্য ব্যক্তি। এমন ব্যক্তির জোরপূর্বক মনগড়া খিলাফাহ ঘোষণা ও নিজেকে খলীফাহ দাবী করা কী করে গ্রহণযোগ্য হতে পারে!!? দ্বীন ও আকলসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি এধরণের খিলাফাহ’র বাতিল দাবীর সাথে একমত হতে পারে না।
১১. আবু বকর আল-বাগদাদীর শাসনের হুকুম:
একজন ব্যক্তি দুইভাবে কর্তৃত্ব লাভ করে।
এক. খোলাফায়ে রাশেদীনের মতো অর্থাৎ উম্মাহর শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের বাই‘আতের মাধ্যমে; যাদের মাধ্যমে উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ।
দুই. জবরদখলের মাধ্যমে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. এ ব্যাপারে বলেন,
فَالْحِلُّ وَالْحُرْمَةُ مُتَعَلِّقٌ بِالْأَفْعَالِ ، وَأَمَّا نَفْسُ الْوِلَايَةِ وَالسُّلْطَانِ فَهُوَ عِبَارَةٌ عَنِ الْقُدْرَةِ الْحَاصِلَةِ ، ثُمَّ قَدْ تَحْصُلُ عَلَى وَجْهٍ يُحِبُّهُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ ، كَسُلْطَانِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ ، وَقَدْ تَحْصُلُ عَلَى وَجْهٍ فِيهِ مَعْصِيَةٌ ، كَسُلْطَانِ الظَّالِمِينَ
“সুতরাং কর্তৃত্ব এবং মর্যাদা বাস্তব কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা হচ্ছে মূলতঃ অর্জিত ক্ষমতা বা সামর্থ্য অর্জনের নাম। অতঃপর তা কখনো এমনভাবে অর্জিত হবে; যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে হবে। যেমন, খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনক্ষমতা। আবার কখনো এমনভাবে অর্জিত হবে; যা পাপযুক্ত হবে। যেমন, জালিমদের শাসনক্ষমতা।” -মিনহাজুস সুন্নাহ..., ১ম খ-, পৃষ্ঠা: ৫৩০
আইএসের মুখপাত্রের মাধ্যমেই আমরা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় জানতে পেরেছি যে, আবু বকর আল-বাগদাদীকে খলীফাহ ঘোষণা করেছে তাদের দলের শূরার সদস্যরা, ইরাক-সিরিয়ার কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিগণ নয়। আর খোলাফায়ে রাশেদীনের সম্পূর্ণ বিপরীত পন্থায় তারা এই দলীয় খিলাফাহ ঘোষণা করেছে। তদুপরি তাদের মুখপাত্র খিলাফাহ ঘোষণার বার্তায় স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তারা তরবারির ধারালো প্রান্তের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করেছেন। সুতরাং তারা ইরাক-সিরিয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় জবরদখলের মাধ্যমে শাসক হয়েছেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. এর উপরোক্ত স্পষ্ট বক্তব্য অনুযায়ী জবরদখলের মাধ্যমে তাদের এ ধরনের ক্ষমতা অর্জন গুণাহের শামিল।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. এ ব্যাপারে আরো বলেন,
. وَالْقُدْرَةُ عَلَى سِيَاسَةِ النَّاسِ إِمَّا بِطَاعَتِهِمْ لَهُ ، وَإِمَّا بِقَهْرِهِ لَهُمْ ، فَمَتَى صَارَ قَادِرًا عَلَى سِيَاسَتِهِمْ بِطَاعَتِهِمْ أَوْ بِقَهْرِهِ ، فَهُوَ ذُو سُلْطَانٍ مُطَاعٍ ، إِذَا أَمَرَ بِطَاعَةِ اللَّهِ
“মানুষকে পরিচালনার ক্ষমতা হয় আনুগত্যের মধ্য দিয়ে অর্জিত হবে অথবা তাদের উপর জোরপূর্বকভাবে হবে। যখনই কোনো ব্যক্তি মানুষকে পরিচালনার ক্ষমতা আনুগত্যের ভিত্তিতে কিংবা জোরপূর্বকভাবে আদায় করবে; সে তখন আনুগত্যসম্পন্ন কর্তৃত্বের অধিকারী হবে, যখন সে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের নির্দেশ দেবে।” -মিনহাজুসসুন্নাহ..., ১ম খ-, পৃষ্ঠা: ৫২৮-৫২৯
অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি জবরদখলের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করে; তাহলে যতক্ষণ সে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশ দেবে,ততক্ষণ উক্ত জবরদখলের অধীন এলাকার মানুষের উক্ত শাসককে আনুগত্য করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও আইএস আল্লাহর বিধানের আলোকে মানুষকে পরিচালিত না করে বরং তারা তাদের ভ্রান্ত আকীদার মাধ্যমে মানুষকে বিপথগামী করছে। ফলে একজন জবরদখলকারী শাসক আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশের ফলে যে আনুগত্যসম্পন্ন কর্তৃত্বের অধিকারী হয়, আবু বকর আল-বাগদাদী সেই অধিকারও লাভ করবে না; বরং তাদের বাতিল আকীদার প্রসারের কারণে আইএসের নিয়ন্ত্রিত এলাকায়ও তাদের আনুগত্য বৈধ নয়।
১২. শেষ কথা
আলহামদুলিল্লাহ্, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের কওল এবং সালাফে-সালিহীন ইমামগণের নির্ভরযোগ্য বক্তব্যের মাধ্যমে খিলাফাহ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে তার সাথে আইএসের দাবী করা খিলাফাহর পার্থক্য উপস্থাপন করেছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলের হৃদয়কে সত্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিন।
আইএসের মনগড়া দাবীকৃত খিলাফাহ’র বাস্তবতা উপস্থাপনের প্রেক্ষিতে আমরা তানযীম আল-কায়েদার পক্ষ থেকে উম্মাহকে আশ্বস্ত করতে চাই, তানযীম আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই খিলাফাহ কায়েমের লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তানযীম আল-কায়েদা সেই লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্রও পিছপা হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ্। অবশ্য আইএসের নেতারা গ্লোবাল জিহাদের নেতৃত্ব দেওয়া আল-কায়েদার বিরুদ্ধে খিলাফাহ সংক্রান্ত বহুবিধ অপপ্রচার চালিয়ে থাকে। তানযীম আল-কায়েদা খোলাফায়ে রাশেদীনের পদাঙ্ক অনুসরণে ‘খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নুবুয়্যাহ’ কায়েমে বদ্ধপরিকর। তানযীম আল-কায়েদা সেই খিলাফাহ কায়েমের লক্ষ্যে সোমালিয়ায় প্রায় আড়াই লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকায় শরী‘আহ ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেছে। ইয়েমেনে বিস্তীর্ণ ভূমিতে শরী‘আহ কায়েমও নিরবচ্ছিন্ন জিহাদ চালিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার মালিতে অনেক এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেখানে আল্লাহর বিধান কায়েম ও জিহাদ অব্যাহত রেখেছে। তানযীম আল-কায়েদা উম্মাহর নিরাপত্তা দিতে সক্ষম সত্যিকার খিলাফাহ কায়েমের লক্ষ্যেই মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে জিহাদের দামামা বাজিয়ে রণাঙ্গন প্রস্তুত করছে, আলহামদুলিল্লাহ্। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর অফুরন্ত রহমতের মাধ্যমে উম্মাহর সীমালঙ্ঘনকারী এবং অবুঝ দল ও সদস্যদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন, ঈমানের পতাকাকে বিজয়ী করুন, আর কুফরের পতাকাকে লাঞ্চিত-অপদস্থ ও পরাজিত করুন। আমীন।