JustPaste.it

05baa83aa0f94c2f8e758a1d330a0c78.jpg

 

আত্মশুদ্ধি – ১৪

 

 

ঈমানের মিষ্টতা লাভের উপকারিতা

(পর্ব)

 

মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ

 

 

 

 আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা সাইয়িদিল আম্বিয়া-ই ওয়াল-মুরসালীন, ওয়া আলা আলিহী, ওয়া আসহাবিহী আজমাঈন। আম্মা বা’দ

প্রথমে আমরা সকলেই একবার দুরূদ শরীফ পড়ে নিই।   

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

আলহামদুলিল্লাহ এক সপ্তাহ পর আবার আমরা আরেকটি তাযকিয়া মজলিসে হাজির হতে পেরেছি, এ জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শুকরিয়া আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ।

মুহতারাম ভাইয়েরা! গত মজলিসে ঈমানের মিষ্টতা লাভের উপকারিতাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় উপকারিতাটি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আজকে ঈমানের মিষ্টতা লাভের তৃতীয় ও চতুর্থ উপকারিতা নিয়ে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।   

ঈমানের ‍মিষ্টতা দ্বীনের উপর অবিচল ও দৃঢ় থাকার কারণ

ঈমানের মিষ্টতা লাভের তৃতীয় উপকারিতা হল, এটি দ্বীনের উপর অবিচল ও দৃঢ় থাকার কারণ হয়। যারা ঈমানের স্বাদ ও মিষ্টতা পেয়ে যায় তাদের জন্য দ্বীনের উপর ইস্তিকামাত বা দৃঢ় থাকা সহজ হয়ে যায়।

ইসলাম যেহেতু একটি পূর্ণাংগ দ্বীন। তাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি অংশের জন্য রয়েছে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান। সেই বিধানগুলো পুরোপুরি পালন করার মাধ্যমে সীরাতে মুস্তাকীম তথা সরল পথের উপর অটল ও অবিচল থাকা ইসলামের এক অনিবার্য দাবি। প্রকৃত ঈমানদারদের জন্য যা খুবই সহজ। হোক তা মসজিদে কিংবা কর্মক্ষেত্রে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কিংবা হাট-বাজারে কিংবা নিজের ঘরে।

একজন প্রকৃত মুসলমানের বৈশিষ্ট্যই হল, ইসলামের ছোট বড় প্রতিটি বিধানের ওপর অটল-অবিচল থাকা, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছোট বড় প্রতিটি সুন্নাহ পালনে যত্নবান হওয়া। কোনো ব্যক্তি কিংবা পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলামের ছোট থেকে ছোট কোন বিধান, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছোট থেকে ছোট কোনো সুন্নাহও না ছাড়া।

এর বিপরীত হল দূর্বল ঈমানদার ও মুনাফিকদের অবস্থা। তাদের মাঝে অবিচলতা নেই। আজ এদিক তো কাল ওদিক। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَعْبُدُ اللَّهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ

মানুষের মধ্যে কিছু আছে এমন, যে এক প্রান্তে (সন্দেহের মধ্যে) থেকে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি তার ভালো কিছু হাসিল হয় তাহলে সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে। আর যদি তার ওপর কোন পরীক্ষা এসে পড়ে তাহলে সে নিজের মুখের ওপর (আগের কুফরির অবস্থায়) ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই হারায়। এটাই হল প্রকাশ্য ক্ষতি।

(সুরা হজ : আয়াত ১১)

প্রকৃত মুমিনের কর্তব্য হল, ইসলামের ছোট বড় প্রতিটি বিধানকে এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছোট বড় প্রতিটি সুন্নাহকে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং মৃত্যু পর্যন্ত তার উপর অটল ও অবিচল থাকা।

ঈমানের ওপর অবিচল থাকো

হযরত সুফিয়ান বিন আব্দুল্লাহ রাযি. বর্ণনা করেন, একদিন আমি (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে) বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলে দিন যেন ওই বিষয়ে আপনার পর আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করতে হয়। তিনি বললেন, তুমি বলো,

آمَنْت بِاَللَّهِ ثُمَّ اسْتَقِمْ

আমি আল্লাহর ওপর ঈমান আনলাম, এরপর (এ কথার যাবতীয় হক আদায়ের মাধ্যমে এর ওপর) অবিচল থাকো। সহী মুসলিম ৩৮

হাদীসে যে ইস্তেকামাত বা অবিচল থাকার কথা বলা হয়েছে এর উদ্দেশ্য হল, ইসলামের ছোট বড় প্রতিটি বিধানকে এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছোট বড় প্রতিটি সুন্নাহকে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরা। মৃত্যু পর্যন্ত এর উপর অবিচল থাকা।

দ্বীনের উপর অবিচল থাকার জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে একটি দোয়াও শিখিয়েছেন।

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ

হে অন্তরের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে দ্বীনের ওপর অবিচল রাখুন।

তো ঈমানের মিষ্টতা লাভের তৃতীয় উপকারিতা হলো, ঈমানের মিষ্টতা লাভ করার দ্বারা দ্বীনের উপর অবিচল থাকা সহজ হয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে দ্বীনের উপর অবিচল থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।

ঈমানের ‍মিষ্টতা দুনিয়ার যাবতীয় বিপদ-মসিবত, কষ্ট-ক্লেশকে হালকা করে দেয়

এবার ঈমানের মিষ্টতা লাভের চতুর্থ উপকারিতা নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ

ঈমানের ‍মিষ্টতা এমনই একটি জিনিস যারাই তা লাভ করে তাদের জন্য দুনিয়ার যাবতীয় বিপদ-মসিবত, কষ্ট-ক্লেশ একদম হালকা হয়ে যায়।

দেখুন, জেলে বন্দী থাকাকালে জেল সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ.এর কিছু অমূল্যবানী,  

-এই জেলখানা হল আমার জান্নাত, আমি এখন জান্নাতের বাগানে আছি।

-আমার বন্দিত্ব হল নির্জন (ইবাদতের) জায়গা, আর আমার নিহত হওয়াটা হল শাহাদাত, আর আমাকে দেশান্তর করে দেওয়াটা হল (আল্লাহর রাস্তার) দেশ ভ্রমণ।

একবার তিনি একটি দুর্গে বন্দী ছিলেন তখন সেই দুর্গ সম্পর্কে বলেছিলেন, এই দুর্গটি যদি স্বর্ণ দিয়ে ভরপুর করে দেওয়া হয় তবুও তা আমার কাছে আমার বন্দী জীবনের নেয়ামতের সমান হবে না।-আল ওয়াবেলুস সাইয়িব ৪৮

হাদীসে এমন বেশ কিছু ঘটনা এসেছে, যে ঘটনাগুলো থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, কেউ যখন  ঈমানের ‍মিষ্টতা পেয়ে যায় তখন তার জন্য দুনিয়ার যাবতীয় বিপদ-মসিবত, কষ্ট-ক্লেশ একদম হালকা হয়ে যায়। ওগুলো থেকে মাত্র দুটি ঘটনা উল্লেখ করছি।

হযরত আসিম ও খুবাইব রাযি.র ঘটনা

হযরত আমর বিন আবু সুফিয়ান রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশজন সাহাবীকে কিছু সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠান। আসিম বিন সাবিত আনসারিকে তাদের দলপতি নিয়োগ করেন। যিনি ছিলেন আসিম বিন ওমর বিন খাত্তাব রাযি.র নানা। 

তাঁরা রওনা হন। যখন উসফান ও মক্কার মাঝামাঝি হাদআত নামক স্থানে পৌঁছেন, তখন হুযায়েল গোত্রের একটি শাখা যাদেরকে ‘বনি লিহইয়ান বলা হতে, তাদের কাছে সাহাবীদের ছোট এ দলটির কথা আলোচনা করা হল।     

আলোচনার পর তারা প্রায় দুইশত তীরন্দাজ তাঁদেরকে ধাওয়া করার জন্য পাঠায়। তারা সাহাবীদের পায়ের চিহ্ন দেখে আগাতে থাকে। একসময় তারা তাঁদের একদম কাছাকাছি পৌঁছে যায়। সাহাবায়ে কেরাম তাদেরকে দেখে একটি উঁচু টিলায় আশ্রয় নেন।

কাফেররা তাদেরকে ঘিরে ফেলে বলতে থাকে, তোমরা নিচে নেমে এসো, আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তোমাদেরকে হত্যা করব না। তখন দলনেতা আসিম বিন সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আল্লাহর কসম! আমি কোনো ভাবেই কাফেরদের নিরাপত্তায় টিলা থেকে অবতরণ করব না।

অবশেষে কাফেররা তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করে এবং তাঁরাও ওখানে থেকে নিজেদের সাধ্যমতো যুদ্ধ করতে থাকেন। একসময় আসিম রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ সাতজন শহীদ হয়ে যান। অবশিষ্ট তিনজন খুবাইব আনসারি, জায়েদ বিন দাসিনা এবং আব্দুল্লাহ বিন তারেক রাযি. নিচে নেমে আসেন। কাফেররা তাদেরকে হাতের কাছে পেয়েই ধনুকের রশি খুলে তাদেরকে বেঁধে ফেলে।

তখন হযরত আব্দুল্লাহ বিন তারেক রাযি. বলে উঠলেন, ‘শুরুতেই বিশ্বাসঘাতকতা! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না, যারা শহীদ হয়েছেন আমি তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করব।’

তখন কাফেররা তাকেও শহীদ করে ফেলে এবং খুবাইব ও জায়েদ রাযি.কে নিয়ে চলে যায়।

তারা মক্কায় নিয়ে দুজনকেই বিক্রি করে দেয়। এ ঘটনাটা বদরের যুদ্ধের পরের। তখন মক্কার হারিস বিন আমেরের ছেলেরা তাদের পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য খুবাইব রাযি.কে কিনে নেয়। বদর যুদ্ধে খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু হারিসকে হত্যা করেছিলেন। খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু কিছুদিন তাদের কাছে বন্দি থাকেন।

হারিসের কন্যা -যিনি পরে মুসলমান হয়েছেন তিনি- বলেন, যখন হারিসের পুত্ররা খুবাইবকে হত্যা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল, তখন তিনি আমার কাছে একটি ক্ষুর চান।

আমি তাকে ক্ষুর দেই। তখন আমার ছোট এক সন্তান আমার অজ্ঞাতে খুবাইবের কাছে চলে যায়। আমি দেখলাম, আমার ছেলে খুবাইবের ঊরুর ওপর বসে আছে এবং খুবাইবের হাতে ক্ষুর। এটা দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। খুবাইব আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন যে, আমি ভয় পাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, তুমি কি ভাবছো, আমি তাকে হত্যা করব? কখনোই আমি তা করব না।

তিনি (হারিসের কন্যা) বলেন, আল্লাহর কসম! আমি খুবাইবের মতো উত্তম বন্দী কখনও দেখিনি। আল্লাহর শপথ! আমি একবার দেখলাম, তিনি লোহার শিকলে আবদ্ধ অবস্থায় আঙুর খাচ্ছেন, যা তার হাতেই ছিল। অথচ তখন মক্কায় কোনো ফল ছিল না। এটা ছিল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রদত্ত রিযিক, যা তিনি খুবাইবকে দান করেছেন।

তারা যখন খুবাইবকে হত্যা করার জন্য হরমের বাইরে নিয়ে গেল, তখন তিনি তাদেরকে বললেন, আমাকে দুই রাকাত সালাত আদায় করতে দাও। তারা তাকে অনুমতি দিল। তিনি দুই রাকাত সালাত আদায় করলেন। সালাতের পর তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা যদি ধারণা না করতে যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে দেরি করছি তাহলে আমি সালাতকে আরও দীর্ঘ করতাম। এরপর তিনি দোয়া করলেন,  

اللهم أحصهم عددا، واقتلهم بددايعني متفرقين-، ولا تبق منهم أحدا

হে আল্লাহ! তাদের সবাইকে গুণে রাখুন। সবকটাকে ধ্বংস করুন। কাউকেই ছাড়বেন না।

 এরপর তিনি নিম্নের কবিতাটি আবৃত্তি করেন,

فلست أبالي حين أقتل مسلماً *** على أي شقٍ كان لله مصرعي

وذلك في ذات الإله وإن يشأ *** يبارك على أوصال شلو ممزعِ

যখন আমি মুসলিম হিসেবে শহীদ হচ্ছি, তখন আমি কোনো কিছুরই পরোয়া করি না।

আল্লাহর উদ্দেশ্যে আমাকে যেখানেই মাটিতে লুটিয়ে ফেলা হোক না কেন।

আমার এ মৃত্যু আল্লাহ তায়ালার জন্যই হচ্ছে। তিনি যদি ইচ্ছা করেন;

তবে আমার দেহের প্রতিটি খন্ডিত জোড়াসমূহে বরকত দান করবেন’

অবশেষে কাফেররা তাকে শহীদ করে দেয়।  

কাউকে বন্দি অবস্থায় শহীদ করা হলে তার জন্য দুই রাকাত সালাত আদায়ের এ রীতি হযরত খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহুই চালু করে গেছেন। সহী বুখারী : ৩০৪৫ (সংক্ষেপিত)

দেখুন ভাই, এখানে হযরত খুবাইব রাযি. শহীদ হয়ে যাবেন নিশ্চিত জেনেও কত শান্ত ও নিশ্চিন্ত ছিলেন। যেন তাঁর কোনো পেরেশানিই নেই। এটা একমাত্র ঈমানের মিষ্টতা লাভের কারণেই সম্ভব হয়েছে। সত্যিই যখন কোন বান্দার ঈমানের মিষ্টতার মহা দৌলত নসীব হয়ে যায় তখন তার জন্য দুনিয়ার যাবতীয় বিপদ-মসিবত, কষ্ট-ক্লেশ একদম হালকা হয়ে যায়।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন হুযাফা রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ঘটনা

এমনই আরেকটি ঘটনা আছে হযরত আব্দুল্লাহ বিন হুযাফা রাদিয়াল্লাহু আনহু’র। ঘটনাটি ঘটেছিল হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খিলাফতকালে।  

রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যেয়ে একদল মুসলিম রোমানদের হাতে বন্দী হন। রোমান সম্রাট জানতে পারলেন এই বন্দীদের মাঝে একজন সাহাবীও আছেন।

রোমান সম্রাট সাহাবীদের অনেক ভালো ভালো গুণের কথা শুনেছিল। কোন সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করার তার খুব ইচ্ছা ছিল। তাই সে বন্দী সাহাবীকে তার কাছে নিয়ে আসতে বলল। বন্দী সেই সাহাবী ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাদিয়াল্লাহু আনহু। রোমান সম্রাট অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাদিয়াল্লাহু আনহুর দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর তাঁকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি খ্রিস্টান হয়ে যাও তোমাকে মুক্ত করে দেবো এবং সম্মানজনক অবস্থায় থাকার ব্যবস্থা করে দেবো। হযরত আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘৃণা ও দৃঢ়তার সাথে বললেন, এতো অনেক দূরের কথা। তোমার এ প্রস্তাব গ্রহণ করার চেয়ে হাজার বার মৃত্যুবরণ করা আমার কাছে অনেক বেশি পছন্দনীয়।

তখন সম্রাট বলল, আমার প্রস্তাবে রাজি হলে আমি তোমাকে আমার অর্ধেক সম্রাজ্য দিয়ে দিব! আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, শুধু তোমার সম্রাজ্য কেন আরবরা যে সব এলাকা দখল করেছে তুমি যদি তাও আমাকে দিয়ে দাও তবুও আমি এক পলকের জন্যও আমার দ্বীন ত্যাগ করব না। সম্রাট বলল, তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করব। তিনি উত্তর দিলেন, তোমার যা ইচ্ছা তাই কর। তখন সম্রাট তাঁকে শূলে চড়িয়ে তীরন্দাজদেরকে নির্দেশ দিল তার হাত-পায়ের আশপাশে তীর ছুড়তে। আর এদিকে সে তাঁকে খ্রস্টান হওয়ার জন্য বলতে লাগল। কিন্তু যখন সে দেখল, তাঁকে কোনো ভাবেই মানানো যাচ্ছে না তখন সে ফুটন্ত তেলের একটি বিশাল পাত্র আনতে বলল। পাত্রটি আনা হলে একজন মুসলিমকে এনে সেই সেই পাত্রে ফেলে দেওয়া হয়। ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার হাড়গুলো গোশত থেকে আলাদা হয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটছিল আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাদিয়াল্লাহু আনহুর চোখের সামনে।

তখন সম্রাট তাঁকে লক্ষ্য করে বলল, এবার কি তুমি তোমার ধর্ম ছাড়বে? তিনি ঘৃণার সাথে উত্তর দেন, কিছুতেই না।

সম্রাট তাকে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেয়। কর্মচারীরা যখন আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাযি.কে তেলের কাছে নিয়ে যেতে লাগল তখন তাঁর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে।  কর্মচারীরা সম্রাটকে জানাল যে, তিনি তো কাঁদছেন। 

সম্রাট ভাবল, হয়তো সে ভয় পেয়েছে তাই তাঁকে ফিরিয়ে আনতে বলল। সম্রাট বলল, এখন কি তুমি ইসলাম ত্যাগ করতে প্রস্তুত?

আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাদিয়াল্লাহু আনহু তার কথা প্রত্যাখ্যান করে বললেন, তুমি কি মনে করেছো, আমি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি। আমি বরং এ কথা ভেবে কাঁদছি যে, আমার একটাই মাত্র জীবন আর তা এখনই শেষ হয়ে যাবে। আমার তামান্না হল, আমার দেহে যতগুলো পশম আছে আমার যদি ততগুলো জীবন থাকতো তাহলে আমি একটা একটা করে সবগুলোকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে দিতাম! কিন্তু আমার তো মাত্র একটাই জীবন। এ কথা ভেবেই আমি কাঁদছি।

রোমান সম্রাট তাঁর কথা শুনে হতবাক হয়ে যায়। তখন সে আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলল, তুমি কি আমার কপালে একটি চুমু খেতে পারবে? তাহলে আমি তোমাকে মুক্ত করে দেবো। 

আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, পারবো তবে সবাইকে মুক্ত করে দিতে হবে। সম্রাট রাজি হল। আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্রাটের কপালে চুমু দিলেন এবং সকল বন্দীদের নিয়ে পরদিন মদীনায় ফিরে এলেন।

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ঘটনা শুনে খুবই আনন্দিত হন। তারপর সবাইকে লক্ষ্য করে বলেন, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, তাঁর কপালে চুমু খাওয়া। আমিই তা প্রথমে শুরু করছি।

দেখুন ভাই, এখানে হযরত আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা রাযি. শহীদ হয়ে যাবেন নিশ্চিত জেনেও কেমন নিশ্চিন্ত ছিলেন। কোন ধরণের দুশ্চিন্তা পেরেশানি তাঁকে যেন স্পর্শই করেনি। এটা একমাত্র ঈমানের মিষ্টতা লাভের কারণেই সম্ভব হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সাহাবায়ে কেরামের মতো ঈমান নসীব করেন, আমরাও যেন তাঁদের মতো ঈমানের মিষ্টতা লাভ করতে পারি। আমীন।

মুহতারাম ভাইয়েরা! আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করুন এবং ইখলাসের সাথে জিহাদ ও শাহাদাতের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন।

আমরা সকলে মজলিস থেকে উঠার দোয়াটা পড়ে নিই।

سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين

وآخر دعوانا ان الحمد لله رب العالمين

 

**************