JustPaste.it



আত্মশুদ্ধি – ১৩

 

 

 

ঈমানের মিষ্টতা লাভের উপকারিতা

(পর্ব)

 

মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ

 

 

 আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা সাইয়িদিল আম্বিয়া-ই ওয়াল-মুরসালীন, ওয়া আলা আলিহী, ওয়া আসহাবিহী আজমাঈন। আম্মা বা’দ

প্রথমে আমরা সকলেই একবার দুরূদ শরীফ পড়ে নিই।   

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

আলহামদুলিল্লাহ বেশ কিছুদিন পর আবার আমরা আরেকটি তাযকিয়া মজলিসে হাজির হতে পেরেছি, এ জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শুকরিয়া আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ।

মুহতারাম ভাইয়েরা! গত সপ্তাহে ঈমানের মিষ্টতা লাভের কিছু উপকারিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আসলে উপকারিতা তো অনেক তবে ওগুলো থেকে মাত্র চারটি উপকারিতার কথা গত মজলিসে আলোচনা হয়েছিল। উপকারিতাগুলো হল,  

১। ঈমানের মিষ্টতা লাভের দ্বারা একজন মুমিনের জীবন সুখময় হয়।

২। অন্তরে কুফর, ফিসক এবং গুনাহের তিক্ততা অনুভব হয়।

৩। এটি দ্বীনের উপর অবিচল ও দৃঢ় থাকার কারণ হয়।

৪। ঈমানের ‍মিষ্টতা পার্থিব জীবনের যাবতীয় কষ্ট ও মসিবতকে হালকা করে দেয়।

এই চারটির মধ্যে প্রথম উপকারিতাটি নিয়ে গত সপ্তাহে একটু বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল। আজকে ইনশাআল্লাহ দ্বিতীয় উপকারিতাটি নিয়ে আলোচনা করা হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

ঈমানের মিষ্টতা লাভের উপকারিতা

ঈমানের মিষ্টতা লাভের দ্বিতীয় উপকারিতা হচ্ছে, এর মাধ্যমে অন্তরে কুফর, ফিসক এবং গুনাহের তিক্ততা অনুভব হয়।

যারা প্রকৃত মু’মিন তারা ঠিকই নিজেদের অন্তরে কুফর ও ফিসকের তিক্ততা অনুভব করেন। তারা ইসলামের বিধানগুলো পালন করার মাঝেই তৃপ্তি অনুভব করেন।

মনে রাখতে হবে, গুনাহ আমাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেই ক্ষতিকর। গুনাহের কারণে গুনাহগার দুনিয়াতেও লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অপদস্থ হয়। দুনিয়ার জীবনে তার অশান্তির সীমা থাকে না। অনেক সময় দুনিয়ার জীবনটা তার জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠে। সারকথা হল, গুনাহের কারণে দুনিয়াতেও নানাবিধ শাস্তি ও আজাব-গজবের মুখোমুখি হতে হয় আর আখেরাতের শাস্তি এবং অবর্ণনীয় দুর্ভোগ তো আছেই।

গুনাহ কেবল গুনাহগারের আত্মার জন্যই ক্ষতিকর এমন নয় বরং তার আত্মা ও দেহ দুটির জন্যই ক্ষতিকর। গুনাহ তার জন্য এক ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনে। গুনাহ তার আত্মার জন্য এমন ক্ষতিকর যেমন বিষ দেহের জন্য ক্ষতিকর। গুনাহের কিছু ক্ষতিকর দিক ও ভয়াবহ পরিণতি এখন আপনাদের সামনে পেশ করছি যেন আমরা ছোট বড় সব ধরণের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে আরও বেশি সতর্ক হতে পারি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে  ছোট বড় সব ধরণের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।

 

গুনাহের উল্লেখযোগ্য কিছু ক্ষতি

১ম ক্ষতিঃ গুনাহের কারণে বান্দা ইলমে দ্বীন থেকে বঞ্চিত হয়

ইলম হল একটি নূর, যা আল্লাহ তা’আলা আমাদের অন্তরে দান করেন। আর গুনাহ হল, অন্ধকার। গুনাহ এবং সত্যিকারের ইলম কখনো একত্রিত হতে পারে না। এ জন্যই কেউ গুনাহে লিপ্ত হলে নিশ্চিতভাবেই সে প্রকৃত ইলম হতে বঞ্চিত হয়। ইলমের কিছু কথা হয়তো মুখস্থ করে নিতে পারবে কিন্তু সত্যিকারের ইলম থেকে সে বঞ্চিত হবে।

২য় ক্ষতিঃ গুনাহের কারণে বান্দা রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়

হযরত সাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

إنَّ الرَّجُلَ لَيُحرَمُ الرِّزقَ بالذَّنبِ الَّذي يُصيبُه

কোন ব্যক্তি গুনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণে রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়। সহী ইবনে হিব্বান ৮৭২

৩য় ক্ষতিঃ গুনাহ দেহ ও আত্মা দুটোকেই দুর্বল করে ফেলে 

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. বলেন, নেক আমলের দ্বারা ব্যক্তির চেহারা উজ্জল হয়, অন্তর আলোকিত হয়, রিযিক বৃদ্ধি পায়, আয় রোজগারে বরকত হয়, দেহের শক্তি বৃদ্ধি পায়, অন্যান্য মানুষের অন্তরে তার প্রতি মহব্বত বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে গুনাহের কারণে গুনাহগারের চেহারা কুৎসিত, অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং দেহ দুর্বল হয়ে যায়। তার রিযিকে সংকীর্ণতা দেখা দেয় এবং অন্যান্য মানুষের অন্তরে তার প্রতি ঘৃণা জন্মায়। ফলে কেউ তাকে ভালো চোখে দেখে না।

 

৪র্থ ক্ষতিঃ গুনাহ বান্দাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য থেকে বঞ্চিত করে

যদি গুনাহের কারণে দুনিয়াতে কাউকে অন্য কোন শাস্তি নাও দেয়া হয়, তবুও সে একটি শাস্তি ঠিকই পাবে। তা হল, আল্লাহ তাকে অনেক ইবাদত থেকে বঞ্চিত করে দেবেন। আখেরাতে বিরাট মর্যাদা পাওয়ার আমলগুলো থেকে সে বঞ্চিত হবে। তার গুনাহের কারণ সেই আমলগুলো করার তাওফীক আল্লাহ তাকে দেবেন না।

একবার একলোক হযরত হাসান বসরী রহ.র কাছে এসে বলল, আমি আল্লাহর হুকুম অমান্য করছি, গুনাহ করছি, তারপরও যে আল্লাহ আমাকে ধন-সম্পদ দিচ্ছেন। পার্থিব জীবনে প্রশস্ততা দিচ্ছেন। নিজেকে কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত মনে হচ্ছে না। (এর কারণ কী?) উত্তরে হযরত হাসান বসরী রহ. বললেন, তুমি কি শেষ রাতে (তাহাজ্জুদের) নামায পড়তে পারো? বলল, না। পারি না। তিনি বললেন, আল্লাহ যে তোমাকে তাঁর একান্ত সাক্ষাত থেকে বঞ্চিত করে দিয়েছেন এটাই তোমার (শাস্তির) জন্য যথেষ্ট।

৫ম ক্ষতিঃ গুনাহ বান্দার অন্তর থেকে গুনাহের প্রতি ঘৃণার অনুভূতি নষ্ট করে ফেলে

গুনাহগার গুনাহকে ঘৃণা করার অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। ধীরে ধীরে গুনাহের কাজে সে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং গুনাহ করতে কোন প্রকার কুন্ঠাবোধ করে না। এমনকি যদি সমস্ত মানুষও দেখে ফেলে এবং সমালোচনা করা শুরু করে, তারপরও সে সেই গুনাহটা করতে লজ্জাবোধ করে না। এটি তার ধ্বংসের একটি নিদর্শন।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহ আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন মুমিন গুনাহকে এমনভাবে ভয় পায়, যেন সে একটি পাহাড়ের নিচে আছে, তার আশংকা, পাহাড়টি তার উপর ভেঙ্গে পড়বে। পক্ষান্তরে একজন বদকার গুনাহকে মনে করে যেন তার নাকে একটি মাছি বসে আছে, হাত নাড়া দিল আর সে চলে গেল।

৬ষ্ঠ ক্ষতিঃ গুনাহ লাঞ্ছনা ও অপমানের কারণ হয়

গুনাহের কারণে গুনাহগার লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। কেননা, সকল ইজ্জত ও সম্মান একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অতএব আল্লাহর আনুগত্যের বাহিরে যা-ই করা হবে, নিশ্চিতভাবে তা অপমান ও অপদস্থের কারণ হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-

 

مَن كَانَ يُرِيدُ الْعِزَّةَ فَلِلَّهِ الْعِزَّةُ جَمِيعًا

যে সম্মান চায় তার জানা উচিত, সকল সম্মান একমাত্র আল্লাহরই জন্য। (সুরা ফাতির: ১০)

অর্থাৎ ইজ্জত-সম্মান আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমেই তালাশ করতে হবে। আল্লাহর নাফরমানি করে কখনোই সম্মান লাভ করা যাবে না।

৭ম ক্ষতিঃ গুনাহের কারণে বিবেক বুদ্ধি নষ্ট হয়ে যায়

বিবেক বুদ্ধি আল্লাহ তাআলার দান। এটি একটি আলোর মতো। এর মাধ্যমে বান্দা ভালো মন্দ পার্থক্য করতে পারে। কেউ যখন অনবরত গুনাহ করতে থাকে তখন তার সেই আলোটা অকার্যকর হয়ে যায়। ফলে সে আর ভালোটাকে ভালো এবং মন্দটাকে মন্দ হিসেবে আলাদা করতে পারে না। কখনো ভালোটাকে মন্দ আর মন্দটাকে ভালো মনে করতে শুরু করে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ অবস্থা থেকে হেফাযত করুন, আমীন। 

৮ম ক্ষতিঃ গুনাহের কারণে অন্তরে মরিচা ধরে যায়

আল্লাহ তা’আলা বলেন-

كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِم مَّا كَانُوا يَكْسِبُونَ

কখনও না, বরং তারা যা করে, তাই তাদের হৃদয় মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে।

[সুরা মুতাফফিফীন ৮৩:১৪]

হযরত হাসান বসরী রহ. একদিন তার সামনে উপস্থিত লোকদেরকে বললেন,

تدرون ما الإرانة؟ الذنب بعد الذنب، الذنب بعد الذنب حتى يموت القلب .

তোমরা কি জানো 'অন্তরের মরিচা' কী? 'অন্তরের মরিচা' হল, গুনাহের পর গুনাহ। গুনাহের পর গুনাহ। যার ফলে এক সময় অন্তর মরে যায়।

৯ম ক্ষতিঃ গুনাহ অভিশাপ টেনে আনে

গুনাহের কারণে বান্দা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিশম্পাতের উপযুক্ত হয়। কারণ, তিনি বিভিন্ন ধরণের গুনাহ কারীর উপর অভিশম্পাত করেছেন। যেমন, সুদগ্রহীতা, সূদদাতা, লেখক ও সাক্ষী সকলের উপর অভিশম্পাত করেছেন। চোরের উপর অভিশম্পাত করেছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যেমন, খাজা বাবা, দয়াল বাবা, শাহআলী বাবা ইত্যাদির নামে পশু জাবেহকারীর উপর অভিশম্পাত করেছেন। ছবি অংকনকারী, মদপানকারীসহ এমন আরও অনেকের উপর অভিশম্পাত করেছেন।

গুনাহের ক্ষতিকর দিকগুলো জানার পর এবার আমরা একটু জেনে নিই, আল্লাহ না করুন যদি কখনো আমাদের থেকে কোন গুনাহ হয়ে যায় তাহলে আমাদের করণীয় কী?

গুনাহ হয়ে গেলে করণীয়

গুনাহ হয়ে গেলে করণীয় হল, সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তাওবা করা। কোন গুনাহ বাহ্যত যত ছোটই হোক তাকে ছোট মনে করা যাবে না। অবশ্যই ছাড়তে হবে এবং তাওবা করতে হবে। কারণ, ছোট গুনাহ বার বার করতে থাকলে তা আর ছোট থাকে না, কবীরা গুনাহ হয়ে যায়।

আল্লাহ তা’আলা বলেন: 

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَّصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো, আন্তরিক তাওবা। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশে নদী প্রবাহিত থাকবে। (সূরা তাহরীম;)

তাওবা কীভাবে করা হবে?

ইমাম নববী রহ. তাঁর বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থ রিয়াযুস সালিহীনে এ ব্যাপারে খুব চমৎকার কথা বলেছেন, তিনি বলেন,

قَالَ العلماءُ : التَّوْبَةُ وَاجبَةٌ مِنْ كُلِّ ذَنْب، فإنْ كَانتِ المَعْصِيَةُ بَيْنَ العَبْدِ وبَيْنَ اللهِ تَعَالَى لا تَتَعلَّقُ بحقّ آدَمِيٍّ فَلَهَا ثَلاثَةُ شُرُوط : أحَدُها : أنْ يُقلِعَ عَنِ المَعصِيَةِ، والثَّانِي : أَنْ يَنْدَمَ عَلَى فِعْلِهَا، والثَّالثُ : أنْ يَعْزِمَ أَنْ لا يعُودَ إِلَيْهَا أَبَدًا. فَإِنْ فُقِدَ أَحَدُ الثَّلاثَةِ لَمْ تَصِحَّ تَوبَتُهُ، وإنْ كَانَتِ المَعْصِيةُ تَتَعَلقُ بآدَمِيٍّ فَشُرُوطُهَا أرْبَعَةٌ: هذِهِ الثَّلاثَةُ، وأنْ يَبْرَأ مِنْ حَقّ صَاحِبِها، فَإِنْ كَانَتْ مالًا أَوْ نَحْوَهُ رَدَّهُ إِلَيْه، وإنْ كَانَت حَدَّ قَذْفٍ ونَحْوَهُ مَكَّنَهُ مِنْهُ أَوْ طَلَبَ عَفْوَهُ، وإنْ كَانْت غِيبَةً استَحَلَّهُ مِنْهَا، ويجِبُ أنْ يَتُوبَ مِنْ جميعِ الذُّنُوبِ، فَإِنْ تَابَ مِنْ بَعْضِها صَحَّتْ تَوْبَتُهُ عِنْدَ أهْلِ الحَقِّ مِنْ ذلِكَ الذَّنْبِ وبَقِيَ عَلَيهِ البَاقي .

وَقَدْ تَظَاهَرَتْ دَلائِلُ الكتَابِ والسُّنَّةِ، وإجْمَاعِ الأُمَّةِ عَلَى وُجوبِ التَّوبةِ .

ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, ছোট বড় সকল গুনাহ থেকে তাওবা করা জরুরি। গুনাহটি যদি শুধু আল্লাহর হক সংশ্লিষ্ট হয়। তার সাথে বান্দার হক সম্পৃক্ত না থাকে। (অর্থাৎ শুধু আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করা হয়েছে। কোন বান্দার হক নষ্ট করা হয়নি) তাহলে তাওবা কবুল হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত,

এক. ওই গুনাহ সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা।

দুই. কৃত গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।

তিন. সামনে কখনও সেই গুনাহে লিপ্ত হবে না বলে দৃঢ় সংকল্প করা। যদি এ তিনটি শর্তের কোন একটিও ছুটে যায় তাহলে তাওবা কবুল হবে না। আর যদি সেই গুনাহটি বান্দার হকের সাথে সম্পৃক্ত হয় (অর্থাৎ এর মাধ্যমে আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করার পাশাপাশি কোনো বান্দার হকও নষ্ট করা হয়েছে) তাহলে তাওবা কবুল হওয়ার জন্য চারটি শর্ত। উপরের তিনটি। সঙ্গে আরও একটি। তা হল, হকদারের কাছে তার হক ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ বা অন্য কিছু নিয়ে থাকে তাহলে তা ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি কারো ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে থাকে কিংবা এ জাতীয় কোন অন্যায় করে থাকে তাহলে সেই ব্যক্তির সামনে নিজেকে পেশ করতে হবে যেন সে প্রতিশোধ নিতে পারে অথবা তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। যদি কারো গীবত-দোষচর্চা করে থাকে তাহলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। ছোট বড় সকল গুনাহ থেকে তাওবা করা জরুরি। কেউ কিছু গুনাহ থেকে তাওবা করল,  কিছু গুনাহ থেকে করল না হকপন্থী ওলামায়ে কেরামের মতে এতেও তার তাওবা কবুল হবে। যে সব গুনাহ থেকে তাওবা করেনি শুধু তা- থেকে যাবে। তাওবার অপিহার্যতার ব্যাপারে বহু আয়াত ও হাদীস রয়েছে এবং এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের ইজমা বা ঐক্যমত্যও রয়েছে। [ইমাম নববী রহ.র কথা সমাপ্ত]

হাদীসে এসেছে,

عن أبي حمزةَ أنسِ بنِ مالكٍ الأنصاريِّ خادِمِ رسولِ الله صلى الله عليه وسلم رضي الله عنه قَالَ : قَالَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم : للهُ أفْرَحُ بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ مِنْ أَحَدِكُمْ سَقَطَ عَلَى بَعِيرهِ وقد أضلَّهُ في أرضٍ فَلاةٍ . مُتَّفَقٌ عليه

وفي رواية لمُسْلمٍ : للهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يتوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتهِ بأرضٍ فَلاةٍ، فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابهُ فأَيِسَ مِنْهَا، فَأَتى شَجَرَةً فاضطَجَعَ في ظِلِّهَا وقد أيِسَ مِنْ رَاحلَتهِ، فَبَينَما هُوَ كَذَلِكَ إِذْ هُوَ بِها قائِمَةً عِندَهُ، فَأَخَذَ بِخِطامِهَا، ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الفَرَحِ : اللَّهُمَّ أنْتَ عَبدِي وأنا رَبُّكَ! أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الفَرَحِ .

হযরত আনাস বিন মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন বান্দা তাওবা করলে আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন যে তার উট মরুভুমিতে হারিয়ে ফেলার পর পুনরায় ফিরে পায়।-সহী বুখারী ৬৩০৯; সহী মুসলিম ২৭৪৭

সহী মুসলিমের অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, কোন বান্দা যখন তাওবা করে তখন আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন যে তার উটের পিঠে চড়ে কোনো মরুভূমি অতিক্রম করছিল। হঠাৎ উটটি তার কাছ থেকে পালিয়ে যায়। তার খাদ্য ও পানীয় সবই ওটার পিঠে থাকে। (বহু খোঁজাখুঁজির পর) নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ে। হঠাৎ দেখে উটটি তার সামনে দাঁড়ানো। তখন সে উটটির লাগাম ধরে খুশির চোটে বলে ওঠে, হে আল্লাহ! আপনি আমার বান্দা আর আমি তোমার প্রভু। সীমাহীন খুশির কারণে সে ভুল করে ফেলে।

অন্য হাদীসে এসেছে,

عن أبي موسَى عبدِ اللهِ بنِ قَيسٍ الأشْعريِّ رضي الله عنه عن النَّبيّ صلى الله عليه وسلم، قَالَ : إنَّ الله تَعَالَى يَبْسُطُ يَدَهُ بالليلِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ النَّهَارِ، ويَبْسُطُ يَدَهُ بالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ اللَّيلِ، حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ  مَغْرِبِها . رواه مسلم.

হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা রাতের বেলা তাঁর (রহমতের) হাত প্রসারিত করে রাখেন দিনের বেলা যারা গুনাহ করে ফেলেছে তারা যেন (রাতের বেলাই) তাওবা করে নেয় এবং দিনের বেলা (রহমতের) হাত প্রসারিত করে রাখেন রাতের বেলা যারা গুনাহ করে ফেলেছে তারা যেন (দিনের বেলাই) তাওবা করে নেয়। যে পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হবে সে পর্যন্ত এই নিয়ম চলতে থাকবে। সহী মুসলিম ২৭৫৬

হাদীস দুটি থেকে বুঝা যায়, বান্দা যখন তাওবা করে তখন আল্লাহ তার প্রতি সীমাহীন খুশি হন। তাই কখনো কোনো গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করে ফেলা চাই। একটুও দেরি না করা চাই।

ইন্টারনেটের গুনাহ থেকে কীভাবে বেঁচে থাকবো?

এখন আমি আপনাদের সামনে এমন কিছু উপায়ের কথা উল্লেখ করছি যা অবলম্বন করলে আমরা ইন্টারনেটের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারবো ইনশাআল্লাহ  

এক। বিসমিল্লাহ বলে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করা। বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলে ইনশাআল্লাহ কেবল ভালো কাজেই আপনার ইন্টারনেট ব্যবহার হবে। কারণ, যার অন্তরে সামান্যতম হলেও ঈমান আছে, আল্লাহর ভয় আছে সে কখনোই আল্লাহর নাম নিয়ে অন্যায় কাজ করতে পারে না। তাই বিসমিল্লাহ বলে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করলে আপনি অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন ইনশাআল্লাহ

দুই। গুনাহ থেকে বাঁচার দৃঢ় ইচ্ছা ও সংকল্প, পাশাপাশি শয়তানের হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং দোয়া করা।

তিন। নিজের মোবাইলে এবং কম্পিউটারে সব ধরণের অশ্লীল সাইডগুলো ব্লক করে রাখা।

চার। বাসায় কম্পিউটারটি এমন স্থানে রাখা যা সবার নজরে পড়ে। সবাই দেখে এমন জায়গায় বসে ইন্টারনেটে কাজ করা। তা মোবাইলে হোক বা কম্পিউটারে। এতে শয়তান কুমন্ত্রণা দেয়ার সুযোগ কম পাবে। 

পাঁচ। যথাসম্ভব একাকী অবস্থান করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা। কারণ, একা থাকলেই শয়তান কুমন্ত্রণা দেয়ার সুযোগটা বেশি পায়। তাই যথাসম্ভব অন্যান্য ভাইদের সাথে থাকার চেষ্টা করুন। সব সময় অফলাইনে না পারলে অন্তত অনলাইনে। আর মাঝে মধ্যে যদি সম্ভব হয় তাহলে হক্কানী কোন আলেমের (আমাদের মানহাজের হোক বা না হোক) সোহবতে কিছু সময় কাটানোর চেষ্টা করুন। তাঁদের মজলিসে বা মাহফিলে যান। এর মাধ্যমেও শয়তানের হাত বেঁচে থাকা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। 

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সব ধরনের অশ্লীলতা থেকে হেফাযত করুন এবং ইন্টারনেটকে একমাত্র ভালো কাজে ব্যবহার করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

ঈমানের মিষ্টতা লাভের কিছু উপকারিতা নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছিল। আসলে উপকারিতা তো অনেক তবে ওগুলো থেকে মাত্র চারটি উপকারিতার কথা গত মজলিসে বলেছিলাম এবং প্রথম উপকারিতাটি নিয়ে কিছু কথাও আরজ করেছিলাম। আজ আলহামদুলিল্লাহ ২য় উপকারিতা নিয়ে কিছু কথা বলা হয়েছে। বাকি রইল আরও দুইটি উপকারিতা। ওগুলো নিয়ে সামনের মজলিসগুলোতে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে ঈমানের মিষ্টতা লাভ করার তাওফীক দান করুক। আমীন।  

মুহতারাম ভাইয়েরা! আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করুন এবং ইখলাসের সাথে জিহাদ ও শাহাদাতের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন।

আমরা সকলে মজলিস থেকে উঠার দোয়াটা পড়ে নিই।

سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين

وآخر دعوانا ان الحمد لله رب العالمين

 

***************