JustPaste.it

20 gajwatur-rasul

গাজওয়াতুর রাসূল:

বদরের যুদ্ধ

 

বদর যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান একটি যুদ্ধ। ইসলামী ইতহাসের মহান সকল যুদ্ধই এর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শুধু তাই নয় পুরো ইসলামই তো বদর যুদ্ধের ওপর দাঁড়ানো। তাই রাসূল ﷺ এর যুদ্ধা ভিজানের সিরিজ আলোচনা বদর যুদ্ধ দিয়েই শুরু করছি। কুরাইশদের অর্থনৈতিক শক্তির মূলে ছিল, সিরিয়ার সাথে তাদের শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক। এই অর্থনৈতিক দম্ভ-অহংকার এবং এ শক্তির কারণেই তারা রাসূল ﷺ এবং সাহাবীদের মক্কা থেকে উৎপীড়ন করে তাড়িয়ে দিতে পেরেছিল। সুতরাং কুরাইশরা যদি অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী এবং আরো মজবুত হতে পারে তাহলে নিঃসন্দেহে তারা মদীনায় আক্রমণ করে বসবে এবং সবে মাত্র গজে উঠা ইসলাম-বৃক্ষকে সমূলে উপড়ে ফেলবে এবং পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে ইসলামকে মুছে ফেলবে। প্রকৃতপক্ষে কুরাইশদের পরিকল্পনাও ছিল এমনই। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জন্য এ বাস্তব সত্যটা উপলব্ধি করা মোটেও কঠিন কিছু ছিল না; বরং তিনি এ বিষয়টা আগ থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। একারণেই রাসূল ﷺ যখন শুনতে পেলেন ‘কুরাইশরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়ায় প্রেরণ করছে। তখন সাথে সাথে একশ পঞ্চাশ অথবা দুইশ জনের বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেনে কুরাইশদের বাণিজ্যিক কাফেলাকে আটকে দিতে। কিন্তু রাসূল ﷺ উশাইরা নামক স্থানে পৌঁছার আগেই আবু সুফিয়ান তার কাফেলা নিয়ে এ স্থান অতিক্রম করে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। তাই রাসূল ﷺ সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে মদীনায় ফিরে আসেন। অতঃপর যখন আবু সুফিয়ানের কাফেলা শাম থেকে মক্কার দিকে ফিরে আসার সময় হল, রাসূলুল্লাহ সা. তখন কুরাইশ-কাফেলার গতিবিধি লক্ষ করার জন্য তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ এবং সাঈদ ইবনে যায়েদ রাযি. কে মদীনার পশ্চিমে সমুদ্র তীরের দিকে পাঠালেন। তারা দুজন হাতরা নামক স্থানে এসে কুরাইশ কাফেলার ফিরে আসার অপেক্ষা করতে লাগলেন

.هذه عير قريش فيها أموالهم فأ خرجوا إليها لعل الله ينفلكموها

‘এই তো কুরাইশদের কাফেলা। এতে তাদের প্রচুর ধন-সম্পদ আছে। সুতরাং তোমরা এর উপর আক্রমণ কর। হতে পারে আল্লাহ তাআলা গণিমত হিসেবে তোমাদেরকে তা দান করবেন। মুসলিম বাহিনীর মদীনা ত্যাগ যেহেতু বড় কোন সৈন্যবাহিনী অথবা মক্কার বড় কোন বাহিনীর সাথে মোকাবিলার আশংকা ছিল না তাই তিনি কাউকে নির্দিষ্টভাবে বের হতে বলেননি; বরং এটা সকলের ইচ্ছাধীন রেখেছিলেন। যার ইচ্ছা বের হবে, যার ইচ্ছা মদীনায় রয়ে যাবে। কোন ধরণের বাধ্যবাধকতা নেই। রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং তার সাথে তিনশত তের মতান্তরে চোদ্দ কিংবা সতের জন সাহাবী খুব দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়ে গেলেন। এতো তাড়াহুড়া, দ্বিতীয়ত বড় কোন যুদ্ধের আশংকা থাকায় প্রস্তুতি তেমন ভাল হয়নি এবং যুদ্ধ সরঞ্জামও একেবারে নেই বললেই চলে। পুরো মুসলিম বাহিনীর সাথে মাত্র সত্তরটি উট এবং এক দুইটি ঘোড়া ছিল। একেকটি উটের পিঠে পালাক্রমে তিন চারজন করে লোক আরোহণ করছিল। কোন ধরণের বাধ্যবাধকতা না থাকায় অনেকে মদীনায় রয়ে যান। তাই তাদের ইমামতির জন্য ইবনে উম্মে মাকতুম রাযি. কে নির্ধারণ করা হয়। এদিকে বাহিনী রওহা নামক স্থানে পৌঁছলে সেখান থেকে আবু লুবাবা ইবনে আব্দুল মুনজিরকে মদীনার খলীফা নিযুক্ত করে তাকে সেখান থেকে মদীনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বদর অভিমুখে ছুটেছে কাফেলা এরপর মুসআব ইবনে উমায়েরের হাতে পুরো বাহিনীর পক্ষ থেকে সাদা রঙ্গের একটি পতাকা তুলে দেওয়া হয়। অতঃপর আনসার ও মুহাজিরদের দুই ভাগে ভাগ করে আনসারদের পতাকা দেওয়া হয় সাদ ইবনে মুআজ রাযি. কে এবং মুহাজিরদের পতাকা দেওয়া হয় আলী ইবনে আবু তালিব রাযি. কে। এই দুই পতাকা ছিল কাল রঙের। এরপর রাসূল ﷺ এই নিঃসম্বল বাহিনী নিয়ে মদীনার সিঁড়িপথ ধরে বদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।

এবং সদরা নামক স্থানে পৌছে বাছবাছ ইবনে আমর আল জুহানী এবং আকী ইবনে আবু জাগবা আল জুহানী নামক দুইজনকে গুপ্তচর হিসেবে আবু সুফিয়ানের সংবাদ নেওয়ার জন্য বদরের দিকে প্রেরণ করেন। এদিকে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশদের কাফেলাটি খাদ্য ও অস্ত্র-সম্ভার নিয়ে মক্কায় ফেরার পথে মদীনার নিকটবর্তী উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করছিল। আবু সুফিয়ান খুবই বিচক্ষণতা ও সতর্কতার সাথে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। পথে একে ওকে জিজ্ঞাসা করছিল মদীনার মুসলমানদের পক্ষ থেকে কোন ধরণের হামলার আশংকা আছে কি না? কেননা এ বিপুল খাদ্য ও অস্ত্র-সম্ভার শত্রুপক্ষের হাতে চলে গেলে কুরাইশের ভাগ্য বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে পড়বে। এবং এর দায়ভার তাকেই বহন করতে হবে। এভাবে তারা যখন বদরের নিকটবর্তী একটি পাহাড়ের নিকট পৌছল, তখন মাজদিয়া ইবনে আমর নামক এক লোকের সাথে দেখা হল। তাকে মদীনার বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, এমন কোন বাহিনী দেখিনি তবে দুইজন লোককে এ টিলার উপর তাদের উট থেকে নামতে দেখেছি। তারা সেখানে নেমে পানি পান করে আবার চলে গেছে। তখন আবু সুফিয়ান খুব দ্রুত সে দিকে গেল এবং সেখানে পড়ে থাকা উটের গোবর নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বুঝতে পারলো এর মধ্যে যে খেজুরের বীচি আছে এগুলো মদীনার খেজুরের বীচি। তখন তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করে সমুদ্র তীরবর্তী অন্য একটি পথ নিল। এবং কুরাইশদের কাছে জরুরী সাহায্যের বার্তাসহ জমজম ইবনে আমর আল গিফারী নামক এক লোককে ভাড়া করে দ্রুতগামী সওয়ারী দিয়ে মক্কায় পাঠালো। সে খুব দ্রুত মক্কার উপকণ্ঠে এসে উটের কান দুটো কেটে হাওদা উল্টোমুখো করে এবং নিজের পোশাকে রক্ত মেখে এক অভিনব সাজে মক্কায় প্রবেশ করলো। ফলে মক্কায় খুব দ্রুত কানকাটা সওয়ারের আগমণ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো। এবং মূহুর্তের মধ্যে কৌতুহলী মানুষের ভিড় জমে গেলো। আর সে জনতার সামনে তাদের কাফেলার বিপদে পড়ার সংবাদ দিল এভাবে

يا معشر قریش ! أموالكم مع أبي سفيان قد عرض لها محمد في أصحابه ، لا أرى أن تدركوها : الغوث الغوث

“হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমাদের কাফেলা মুহাম্মদের হামলার মুখে রয়েছে। নিজেদের সম্পদ যদি রক্ষা করতে চাও তাহলে এই মুহূর্তে সাহায্যের জন্য ছুটে চল। মক্কাবাসীরা এ সংবাদ পেয়ে খুব দ্রুত প্রস্তুত হয়ে আবু জাহেলের নেতৃত্বে বের হয়ে গেল। তখন মক্কাবাসীদের অবস্থা ছিল এই হয়তো নিজে বের হবে অথবা তার পক্ষ থেকে অন্য একজনকে পাঠাবে। আবু লাহাব ব্যতীত কুরাইশদের প্রায় সকল নেতাই বের হয়েছিল। আবু লাহাব তার পক্ষ থেকে অন্য একজনকে পাঠিয়েছিল। অন্য দিকে বনী আকী ব্যতীত মক্কার আসে-পাশে থাকা সকল গোত্র থেকেই কেউ না কেউ এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় তেরশত। এর মধ্যে ছিল একশ অশ্বারোহী এবং সাতশ বর্ম পরিহিত যোদ্ধা। তাদের সাথে ছিল অসংখ্য উট। বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল আবু জাহেল এবং তার সহযোগী হিসেবে ছিল আরো নয়জন কুরাইশ নেতা। এদিকে আবু সুফিয়ান ঘুরপথে নিরাপদে মক্কায় পৌছে গেল এবং আবু জাহেলকে ফিরে আসার বার্তা দিয়ে দ্রুতগামী সওয়ার পাঠালো। যখন কুরাইশ বাহিনীর নিকট আবু সুফিয়ানের এই বার্তা পৌছল তখন তারা মক্কায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা করল। কিন্তু অহংকারী, নিষ্ঠুর , নৃশংস আবু জাহেল দাঁড়িয়ে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমরা বদর প্রান্তরে ঘুরে আসা ব্যতিত মক্কায় ফিরে যাব না। আমরা সেখানে তিন দিন থেকে মদ আর নারী নিয়ে নেচে গেয়ে ফুর্তি করবো এবং উট জবাই করে খাবো। যাতে করে পুরো আরবের লোকেরা আমাদের বিরত্বের কথা জানতে পারে এবং চিরজীবন আমাদের ভয় করে চলে, আর আখনাস ইবনে শারীক আবু জেহেলের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিপরীত মত দিল। কিন্তু কুরাইশরা তার এই পরামর্শ মানল না। তাই সে এবং তার মিত্র বনী জুহরা সেখান থেকে মক্কায় ফিরে গেল । তারা বদরে অংশ গ্রহণ করেনি। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন শত। অতঃপর বনু হাশেমও ফিরে আসতে চাইলো। কিন্তু আবু জাহেল তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাদেরকে থাকতে বাধ্য করল। ফলে কুরাইশরা এক হাজার সৈন্য নিয়ে বদরের দিকে রওয়ানা হল। রাসূল ﷺ ওয়াদিয়ে যাফিরন নাম স্থানে থাকা অবস্থায় তাঁর কাছে কুরাইশদের সমর সজ্জায় সজ্জিত হয়ে বদরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সংবাদ এলো। কুরাইশদের অগ্রসর হওয়ার সংবাদ নিয়ে চিন্তা-গবেষণার পর তাদের মোকাবিলার সিদ্ধান্ত ছাড়া অন্য কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কোন সুযোগ ছিলনা। কেননা কুরাইশদের যদি এভাবে বিনা বাধায় বদরের প্রান্তরে অবস্থান করতে দেওয়া হয়, তাহলে পরো আরবের মধ্যে। কুরাইশদের একটা প্রভাব ও দাপট সৃষ্টি হবে এবং মুসলমানদের দুর্বলতার কথা প্রকাশ পাবে। মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ রাখে তখন এমন যে কোন গোত্রই মদীনায় আক্রমণের সাহস দেখাবে। অন্য দিকে এ নিশ্চয়তাও তো নেই যে, কুরাইশরা বদর থেকে ফিরে যাবে, মদীনায় এসে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করবে না। এ সকল বিষয়কে সমনে রেখে রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবীদের সাথে পরামর্শে বসলেন যে, এ পরিস্থিতিতে কী করা যায়। অর্থাৎ কুরাইশদের মুখোমুখি হবে, না মদীনায় ফিরে যাবে। তখন মুহাজিরদের পক্ষ থেকে আবু বকর এবং ওমর রাযি. অগ্রসর হয়ে কাফেরদের মোকাবেলা করার পক্ষে মত দিলেন। অতঃপর মিকদাদ ইবনে আমর রাযি. দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল আপনি তাই করবেন যা আল্লাহ আপনাকে নির্দেশ দেন। আল্লাহর কসম আমরা ঐরকম কথা বলব না যে রকম বনী ইসরাইলরা মুসা আ. কে বলেছিল । কুরআনের ভাষায়

قَالُوا يٰمُوسٰىٓ إِنَّا لَن نَّدْخُلَهَآ أَبَدًا مَّا دَامُوا فِيهَا ۖ فَاذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقٰتِلَآ إِنَّا هٰهُنَا قٰعِدُونَ

‘তারা বলল, হে মুসা আমরা কখনো সেখানে প্রবেশ করবো না। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সেখানে বিদ্যমান থাকবে। অতঃএব, আপনি ও আপনার পালনকর্তাই যান এবং উভয়ে যুদ্ধ করে নিন। আমরা এখানেই বসে আছি।’ (সুরা মাইদা-২৪)

কিন্তু আমরা বলবো, আপনি আপনার প্রভূর নির্দেশ নিয়ে অগ্রসর হোন এবং যুদ্ধ করুন; আমরাও আপনার সাথে যুদ্ধ করবো। এ সকল প্রতিশ্রুতি তো ছিল মুহাজিরদের পক্ষ থেকে। কিন্তু আনসাররা কী বলে তা তো তিনি এখনো শুনেন নি। তাই রাসূল ﷺ আনসারদের পক্ষ থেকে কিছু শুনতে চাচ্ছিলেন। কারণ তারা ছিল সংখ্যায় বেশী এবং মুহাজিররা ছিল সংখ্যায় কম। অন্যদিকে আকাবার চুক্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, মদীনার অভ্যন্তরে যতদিন মহা নবী ﷺ থাকবেন ততদিন আনসারগণ তাকে সাহায্য করবেন। কিন্তু এখন তো তিনি মদীনার বাইরে। তাই রাসূল ﷺ বললেন ,

أشيروا علي أيها الناس

‘হে লোকসকল! আমাকে পরামর্শ দাও।’ তখন আনসারদের পতাকাবাহী সাদ ইবনে মুআজ রাযি. বুঝতে পারলেন রাসূল ﷺ এ কথার মাধ্যমে কাদের উদ্দেশ্য নিচ্ছেন। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ﷺ আপনি কি আমাদের সিদ্ধান্ত জানতে চাচ্ছেন? রাসূল ﷺ বললেন, হ্যাঁ। তখন সাদ রাযি. বললেন , হে আল্লাহর রাসূল ﷺ আপনার উপর আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস আছে এবং আমরা শপথ নিয়েছি যে আপনি যা বলবেন আমরা তা শুনবো এবং মান্য করবো। সুতরাং এখন আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন আমরা সে সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকবো। ঐ সত্তার কসম করে বলছি যিনি আপনাকে সত্যবাণী দিয়ে পাঠিয়েছেন; যদি আপনি আমাদের (নিকটের) ঐ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন আমরা তা করবো এবং সেখানে যদি আপনি ডুব দেন আমরাও আপনার সঙ্গে ডুব দেব। আমাদের একজনও পিছপা হবে না। আগামীকাল শত্রুর মুখোমুখি হতে আমাদের কোন দ্বিধা নেই। আমরা যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং যুদ্ধকর্মে আমাদের বিশ্বস্ততার কথা সকলেই জানে। যুদ্ধক্ষেত্রে আল্লাহ আমাদের কর্মদক্ষতা আপনাকে দেখাবেন বলে আমরা আশা করি এবং আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতা দেখে আপনার চোখে সিগ্ধতা নেমে আসবে। এ কথায় রাসূল ﷺ খুবই আনন্দিত হলেন এবং বললেন,

سيروا وابشروا فإن الله تعالى قد وعدني احدى الطائفتين ، والله لكأني الآن أنظر الى مصارع القوم

“তোমরা এগিয়ে যাও এবং উফুল্ল হও যে, আল্লাহ তাআলা আমাকে দুই দলের একটির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহর কসম! এখনই আমার চোখে ভাসছে যে শত্রুরা আমাদের পদতলে শায়িত রয়েছে।

এরপর রাসূল ﷺ সাহাবীদের নিয়ে বদরের দিকে রওয়ানা হলেন এবং বদরের নিকবর্তী এক স্থানে এসে যাত্রা বিরতি করলেন। রাসূল ﷺ আবু বকর রাযি. কে সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে আগত বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য বের হয়ে গেলেন। এরপর সন্ধায়। আবারও আলী ইবনে আবি তালিব, যুবায়ের ইবনে আওয়াম এবং সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযি. কে কুরাইশ বাহিনীর খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য পাঠালেন। তাঁরা বদরের কূপের নিকট থেকে কুরাইশ বাহিনীর পানি সংগ্রাহক দুই লোককে ধরে আনেন। রাসূল ﷺ তখন নামাজ পড়ছিলেন। সাহাবীরা তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা বলল, আমরা কুরাইশদের পানি সংগ্রাহক। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম একথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, কারণ তাদের ধারণা ছিল আবু সুফিয়ান কাফেলা নিয়ে এখনও এ অঞ্চল অতিক্রম করে নি। বরং তারা আশপাশেই কোথাও আছে। এবং এরাও আবু সুফিয়ানের কাফেলার কেউ হবে তাই তাঁরা ভাবলেন এরা মিথ্যা বলছে। এরা আবু সুফিয়ানেরই লোক। তাই তাদের প্রহার করে জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যি করে বল তোরা আবু সুফিয়ানের লোক না?। অতঃপর তারা বলল, হ্যা আমরা আবু সুফিয়ানের লোক। অতঃপর তাদের প্রহার বন্ধ করা হল। তখন রাসূল ﷺ নামাজ শেষ করে বললেন, তারা যখন সত্য বলছিল তখন তোমরা বিশ্বাস করনি আর যখন মিথ্যা বলেছে তখন বিশ্বাস করেছে। অতঃপর রাসূল ﷺ তাদের কাছে কুরাইশের খবর জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বলল, এই তো তারা এই পাহাড়ের ওপাশে। তারপর বললেন, বল তারা কত জন এসেছে? তারা বলল আমরা জানি না। রাসূল ﷺ বললেন, তারা প্রতিদিন কতটি উট জবাই করে? তারা বলল, এক দিন নয়টা একদিন দশটা। রাসূল ﷺ বললেন, তারা সংখ্যায় নয়শত থেকে এক হাজার। এরপর রাসূল ﷺ তাদের কাছে জানতে চাইলেন, কুরাইশদের কোন কোন নেতা এসেছে? তারা আবু জাহেলে, উতবা, শাইবা, উমাইয়া ইবনে খালফ, নজর ইবনে হারেছসহ সকল নেতার নামই বলল। তখন রাসূল ﷺ সাহাবাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,

هذه مكة قد ألقت اليكم أفلاذ كبدها

“এই তো, মক্কা তার কলিজার টুকরাদের তোমাদের কাছে অর্পন করেছে। রাসূল ﷺ বাহিনী নিয়ে পাহাড় অতিক্রম করে কিছুটা উত্তর দিকে বদরের একটি কূপের পাশে অবস্থান নিলেন। তখন লুহবাব ইবনে মুনজির, তিনি সামরিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন; রাসূল ﷺ কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ﷺ, আমরা কি আল্লাহ তাআলার নির্দেশে এখানে অবস্থান নিয়েছি যে, আমরা এখান থেকে সরতে পারবো না, নাকি যুদ্ধ- কৌশলের কারণে আমরা এখানে অবস্থান নিয়েছি, রাসূল ﷺ বললেন,

بل هو الرأي و الحرب و المكيدة

বরং যুদ্ধ কৌশলের কারণে।

তখন সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল ﷺ আমাদের আরো অগ্রসর হয়ে শত্রু বাহিনীর পানির কূপগুলোর কাছাকাছি অবস্থান নেওয়া উচিত, যাতে আমরা তাদের পানিগুলো নষ্ট করে দিতে পারি এবং নিজেদের জন্য একটি জলাধার নির্মাণ করে তা পানি দিয়ে পূর্ণ করতে পারি; যাতে যুদ্ধ চলাকালে আমরা প্রায়েজনীয় পানি সংগ্রহ করতে পারি আর শত্রুরা কোন পানি সংগ্রহ করতে না পারে। তখন রাসূল ﷺ বললেন,

لقد اشرت بالرأى

(হাঁ) তুমি সঠিক পরামর্শই দিয়েছ।

অতঃপর রাসূল ﷺ সৈন্য বাহিনী নিয়ে মধ্যরাতের দিকে শত্রুদের পানির একেবারে নিকটে এসে অবস্থান নিলেন। এবং নিজেদের জন্য একটি জলাধার নির্মাণ করলেন। আর শত্রুর পানির কূপগুলো ধ্বংস করে দিলেন। অতঃপর সাদ ইবনে মুআজ রাযি. একটি সামরিক হেড কোয়াটার নির্মাণের প্রস্তাব করলেন।

 

যেখান থেকে রাসূল ﷺ যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং প্রয়োজ নীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারেন। এক কথায় যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারেন। রাসূল ﷺ এমন প্রস্তাবের জন্য তার। প্রশংসা করে তার জন্য দোআ করলেন। যুদ্ধের ময়দানের উত্তর-পূর্ব পার্শ্বে একটি টিলার উপর যুদ্ধ পচিালনার জন্য সামরিক হেড কোয়াটার নির্মাণ করা হল। এবং সাদ ইবনে মুআজ রাযি. এর নেতৃত্বে রাসূল ﷺ এর জন্য একটি দেহরক্ষীদল গঠন করা হল। অতঃপর রাসূল ﷺ পাশের একটি গাছের কাছে নামাজে দাঁড়ালেন এবং সাহাবায়ে কেরাম রাযি. পরম প্রশান্তিতে ভোর পর্যন্ত ঘুমালেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِذْ يُغَشِّيكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّنَ السَّمَآءِ مَآءً لِّيُطَهِّرَكُم بِهِۦ وَيُذْهِبَ عَنكُمْ رِجْزَ الشَّيْطٰنِ وَلِيَرْبِطَ عَلٰى قُلُوبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الْأَقْدَامَ

‘যখন তিনি আরোপ করেন তোমাদের উপর তন্দ্রাচ্ছন্ন তা নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রশান্তির জন্য এবং তোমাদের উপর আকাশ থেকে পানি অবতরণ করেন, যাতে তোমাদিগকে পবিত্র করে দেন এবং যাতে তোমাদের থেকে অপসারিত করে দেন শয়তানের অপবিত্রতা। আর যাতে করে সুরক্ষিত করে দিতে পারেন। তোমাদের অন্তরসমূহকে এবং তাতে যেন সুদৃঢ় করে দিতে পারেন তোমাদের পাগুলো।’ (সূরা আনফাল ১১)

পরদিন তথা দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজান ঊষালগ্নের সঙ্গে সঙ্গেই রাসূল ﷺ সাহাবীদেরকে শ্ৰেণীবদ্ধ করতে লাগলেন আর তখনই একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। রাসূল ﷺ তাঁর হাতের তীর দিয়ে কাতার সোজা করছিলেন। এমন সময় সাওয়াদ ইবনে গাজিয়্যা রাযি. বার বার আগে বেড়ে যাচ্ছিলেন। তখন রাসূল ﷺ তাঁর হাতের তীর দিয়ে তার পেটে ধাক্কা দিয়ে বললেন,

استويا سواد

‘সাওয়াদ! কাতার সোজা কর।

তখন সাওয়াদ রাযি. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনি আমাকে ব্যাথা দিয়েছেন। সুতরাং আমাকে বদলা নিতে দিন। তখন রাসূল ﷺ তাঁর পেটের কাপড় সরিয়ে বললেন, নাও তীর দিয়ে খোঁচা দিয়ে আমার থেকে বদলা নাও। (কারণ তখন তার পেটে কাপড় ছিলনা) তখন সাওয়াদ রাযি. নবীজির কাছে এসে তার পেট মুবারকে চুমু খেলেন। তখন রাসূল ﷺ বললেন,

ما حملك علي هذا ياسوياسواد!

সাওয়াদ কী হল! এমনটি করলে যে?’

সাওয়াদ রাযি. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল যুদ্ধতো লেগেই যাচ্ছে। তাই আমি চাইলাম সর্বশেষ আপনাকে একটু ছুঁয়ে যাই। মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু তাঁরা সকলেই আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং রাসূলের নির্দেশে তারা সংঘবদ্ধ ও দৃঢ়চিত্ত ছিলেন। শ্রেণীবিন্যাস হয়ে গেলে যুদ্ধ শুরুর পূর্বে মহানবী ﷺ সৈন্যদের সর্বশেষ নির্দেশ দিলেন, শত্রুপক্ষ নিকটবর্তী হলে তীর নিক্ষেপ করবে তবে দূরে থাকতে নয়। তারা আক্রমণ না করলে তোমরা আক্রমণ করবে না, অতঃপর রাসূল ﷺ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাঁর হেডকোয়াটারে চলে গেলেন। তাঁর সাথে ছিলেন আবু বকর রাযি. এবং সাদ ইবনে মুআজ রাযি. এর দল।

এদিকে শত্রু শিবিরে এক হাস্যকর ঘটনা ঘটল। তা হল, নির্বোধ আবু জাহেল আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করে বলল, “হে আল্লাহ! সে আমাদের আত্মীয়তার বন্ধনে ফাটল সৃষ্টি করেছে। এবং এমন এক দীন নিয়ে এসেছে যা আমরা জানি না। হে আল্লাহ! আগামীকাল তাকে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত কর। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে, আপনার নিকট প্রিয় ও যাকে আপনি ভালবাসেন তাকেই বিজয় দান করুণ। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করে বলেন,

إِن تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَآءَكُمُ الْفَتْحُ ۖ وَإِن تَنتَهُوا فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَإِن تَعُودُوا نَعُدْ وَلَن تُغْنِىَ عَنكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْـًٔا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ

“(হে কাফের সম্প্রদায়) তোমরা যদি সত্যের বিজয় চাও, বিজয় তো তোমাদের সামনেই এসেছে, তোমরা যদি এখনো (মুসলমানদের অনিষ্টকরণ হতে) বিরত থাকো, তবে তা তোমাদের পক্ষেই কল্যাণকর, আর যদি পুনরায় তোমরা এরকম কাজ কর, তবে আমিও তোমাদেরকে পুনরায় শাস্তি দিবো, আর তোমাদের বিরাট বাহিনী তোমাদের কোনই উপকারে আসবে না, নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুমিনদের সাথে রয়েছেন।” (সুরা আনফাল ১৯)

যুদ্ধ শুরু: যুদ্ধের সূচনা হয় এভাবে যে  মাখযুম গোত্রের আসওয়াদ জলাধারের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে এবং বলতে থাকে, আল্লাহর কসম! আমি হয় তো তাদের ওখান থেকে পানি নিয়ে আসবো না হয় তা ধ্বংস করবো। অন্যথায় এর জন্য নিজের জান দিব। সে এগিয়ে আসতেই হামযা রাযি. তাকে আক্রমণ করলেন এবং হত্যা করলেন। তখন ওতবা সামনে এগিয়ে এসে দন্দ্ব যুদ্ধের প্রস্তাব করল। ওতবার দুপাশে দাঁড়ালো তার ভ্রাতা সায়বা এবং পুত্র ওয়ালিদ। মুসলমানদের পক্ষে এগিয়ে এলেন আউফ ইবনে হারেছ, মুআইদ ইবনে হারেছ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রাযি.। ওতবা তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জানল যে তারা আনসার। ওতবা তখন বলল, তোমাদের উপর অসি চালনা করে হাত কলুষিত করতে চাইনা। তোমরা আমাদের সমকক্ষ নও। তখন সে রাসূল ﷺ এর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, “মুহাম্মাদ! যুদ্ধের সাধ থাকলে আমাদের সমকক্ষ কুরাইশদের পাঠাও। রাসূল ﷺ আনসারগণকে সরে যেতে বললেন এবং উবায়দা, হামযা, এবং আলী রাযি. কে সামনে ডেকে আনলেন। ওতবার সম্মুখে হামযা রাযি. দাঁড়ালেন ওলিদের সম্মুখে আলী রাযি. এবং সায়বার সম্মুখে উবায়দা রাযি.। যুদ্ধ শুরু হল। চোখের পলকে হামযার আঘাতে ওতবা নিহত হল আলীর আঘাতে ওলিদের দেহ দ্বিখণ্ডিত হল; কিন্তু উবায়দা রাযি. ও সায়বার মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হল। তারা উভয়েই উভয়কে আঘাত করল। অতঃপর হামযা এবং আলী রাযি. এসে একসঙ্গে আঘাত করে সায়বাকে দ্বিখন্ডিত করলেন এবং উবায়দাকে স্কন্ধে তুলে রাসূল ﷺ এর নিকটে নিয়ে গেলেন। উবায়দা রাযি. এর পা কেটে গিয়েছিল। তিনি আহত অবস্থায় থেকে চার অথবা পাঁচ দিন পর মদীনায় ফেরার পথে শহীদ হন। এরপর শুরু হল সর্বাত্মক যুদ্ধ এবং ক্রমশ তা ঘোরতর রুপ ধারণ করতে লাগল। অস্ত্রশস্ত্রে পূর্ণ সজ্জিত এক হাজার যোদ্ধার মোকাবে লায় প্রায় নিরস্ত্র তিনশত তের জন মুজাহিদ। যেন হাজার নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র মেষপালের উপর কিংবা প্রবল ঝড় নিভিয়ে দিতে চাইছে ছোট্ট প্রদীপ। কিন্তু মুমিনগণ আল্লাহর উপর ভরসা করে দৃঢ়ভাবে কুরাইদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন এবং পাল্টা আক্রমণ করে করে শত্রু বাহিনীকে একেবারে বিপর্যস্ত করে তুললেন। দুই ভাইয়ের বীরত্ব মদীনা বাসীরা সকলেই জানতেন যে, আবু জাহেল হচ্ছে ইসলামের সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু। সে প্রিয় নবীজিকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। সে নরাধম এবং পাপিষ্ট। তার জন্যেই এই যুদ্ধের সূত্রপাত। আনসারিদের মধ্য থেকে মুওয়াজ ও মুআওয়াজ নামক অল্প বয়সী দুই ভাই প্রতিজ্ঞা করলেন যে, এ দুবৃত্তকে যেভাবেই হোক তারা হত্যা করবে। না হলে প্রাণ দেবে। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ যুদ্ধের ময়দানে যেখানে ছিলেন সেখানে এই দুই ভাই এসে আবু জাহেলের সংবাদ জানতে চাইলেন। তিনি দুজনকে অদূরে অবস্থানরত আবু জাহেলের প্রতি ইশারা করে দেখিয়ে দিলেন। এরা দুজন তখন বাজপাখীর মত প্রাণপণে আবু জাহেলের উপর ঝাপিয়ে পড়লেন এবং তাকে ধরাশয়ী করল। আবু জাহেলের পুত্র ইকরামা পিছন থেকে এসে মুআওয়াজের বাম বাহুতে এমনভাবে তরবারী দিয়ে আঘাত করল যে তার বাহুটি কেটে গেল কিন্তু পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হল না। মুআওয়াজ ঝুলন্ত হাতটা পায়ের নিচে রেখে টেনে ছিড়ে ফেললেন এবং এক হাত নিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ আবু জাহেলের মাথা কেটে তাকে হত্যা করলেন। ওতবা ও আবু জাহেলের মৃত্যুতে কুরাইশ বাহিনী সম্পূর্ণরুপে ভেঙ্গে পড়ল এবং নিরুৎসাহিত হল । তারা আর যুদ্ধ করতে সাহস পেল। এই যুদ্ধে মহান আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে সরাসরি ফেরেশতাদের মাধ্যামে সাহায্য করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّى مُمِدُّكُم بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلٰٓئِكَةِ مُرْدِفِينَ

স্বরণ কর সেই সংকটময় মুহূর্তের কথা, যখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্যের আবেদন করেছিলে, আর তিনি সেই আবেদন কবুল করেছিলেন, (আর তিনি বলেছিলেন) আমি তোমাদেরকে হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করবো, যারা ধারাবাহিকভাবে আসবে। (সূরা আনফাল: ৯)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِذْ يُوحِى رَبُّكَ إِلَى الْمَلٰٓئِكَةِ أَنِّى مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ ءَامَنُوا ۚ سَأُلْقِى فِى قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوا فَوْقَ الْأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ

(ঐ সময়ের কথা স্বরণ কর) যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতদের নির্দেশ করলেন, আমি তোমাদের সাথে আছি, সুতরাং তোমরা ঈমানদারদের সঙ্গে থেকে শক্তি বৃদ্ধি করে তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত ও অবিচল রাখো , আর আমি কাফেরদের হৃদয়ে ভীতি সঞ্চার করে দেব  অতঃএব তোমরা তাদের ঘাড়ে আঘাত হানো, আর আঘাত হানো তাদের অঙ্গুলিসমূহের জোড়ায় জোড়ায়। (সুরা আনফাল ১২)

যুদ্ধের এক পর্যায়ে রাসূল ﷺ এক মুঠো কংকর নিয়ে শত্রুদের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। এই কংকর আল্লাহর আদেশে কুরাইশদের চোখ ভরে গেল। এবং ব্যাকুল ব্রিতকর অবস্থায় কুরাইশরা তখন পলায়ন করল। কুরাইশদের পলায়নের সময় রাসূল ﷺ আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন।

এ বিষয়ে পরে ওহী নাযিল হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلٰكِنَّ اللَّهَ قَتَلَهُمْ ۚ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلٰكِنَّ اللَّهَ رَمٰى ۚ وَلِيُبْلِىَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلَآءً حَسَنًا ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

‘তোমরা তাদের হত্যা করনি, বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন, আর (হে নবী ﷺ) যখন তুমি (ধুলোবালি) নিক্ষেপ করেছিলে তখন তা মূলতঃ তুমি নিক্ষেপ করনি; বরং আল্লাহই তা নিক্ষেপ করেছিলেন, এবং এটা করা হয়েছিল মু'মিনদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে তাদের কষ্টের উত্তম পুরস্কার দান করার জন্যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও সব কিছু জানেন।  (সুরা আনফাল ১৭)

এই যুদ্ধে মহান আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের বিজয় দান করলেন। এবং হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য করে দিলেন। বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের প্রায় সকল নেতৃবৃন্দ নিহত হয়েছিল। এদের মধ্যে ওতবা, সায়বা, আবু জাহেল, উমাইয়া ইবনে খালফ প্রমুখ। নেতৃবৃন্দ ছিল। এই যুদ্ধে কুরাইশদের মোট ৭০ জন নিহত হয় এবং অনুরূপ সংখ্যক বন্দী হয়। অন্য দিকে মুসলমানদের মাত্র ১৪ জন শহীদ হন। যুদ্ধবন্দীদের মদীনায় নিয়ে আসা হলে রাসূল ﷺ প্রথমে তাদের ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন যে এদের ব্যাপারে কী করা যায়। হযরত আবু বকর রাযি. বিনীত নিবেদন করলেন, এরা সবাই আমাদের আপনাপন গোত্রের লোক। সবাই আত্মীয় - স্বজন। সুতরাং মুক্তিপণের বিনিময়ে এদের ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ওমর রাযি. বললেন, “এরা সবাই ইসলামের শত্রু। সুতরাং এদের ব্যাপারে আত্মীয়-অনাত্মীয় ভেদাভেদের কোন সুযোগ নেই। এদের সবাইকে হত্যা করা উচিত। আমরা প্রত্যেকেই নিজনিজ হাতে নিকটতম আত্মীয়দেরকে কতল করবো। কিন্তু রাসূল ﷺ আবু বকর রাযি. এর মতামতকে প্রাধান্য দিলেন এবং মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদের মুক্তি দেবেন বলে ঘোষনা করলেন। যুদ্ধবন্দীদেরকে সাহাবীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয় এবং তাদের যাতে কোন কষ্ট না হয় সে দিকে লক্ষ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। সাহবীগণ রাসূল ﷺ এর নির্দেশে বন্দীদের প্রতি খুবই উদার ব্যবহার করেন। তারা নিজেরা খেজুর খেয়ে দিন কাটিয়ে দেন। অথচ বন্দীদের জন্য নিয়মিত আহার্যের ব্যবস্থা করেছেন। সে যুগে বন্দীদের প্রতি সদ্ব্যবহারের কোন নিয়ম ছিল না বরং দুর্ব্যবহার এবং হত্যাই ছিল বন্দীদের প্রাপ্য। কিন্তু সেই সময়ে রাসূলে খোদা ﷺ বন্দীদের প্রতি সদাচরণের যে নীতি নির্মাণ করলেন তাঁর উদারতা এবং মানুষের প্রতি মানবিক আচরণ একটি নতুন জীবনবোধের জন্ম দিল।

اللهم صل وسلم على نبينا محمد وعلى آل محمد

আল বালাগ

ম্যগাজিন ইস্যু-১