JustPaste.it

ccdeb92f920e525680dfe2f469612cf2.png

ক্রোধ দমন ও নিয়ন্ত্রণ করার উপায়

 

মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ

 

 

আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন, ওয়াস্-সালাতু ওয়াস্-সালামু আলা সাইয়িদিল আম্বিয়া-ই ওয়াল-মুরসালীন, ওয়া আলা আলিহী, ওয়া আসহাবিহী, ওয়ামান তাবিয়াহুম বি ইহসানিন ইলা ইয়াওমিদ্দীন, মিনাল উলামা ওয়াল মুজাহিদীন, ওয়া আম্মাতিল মুসলিমীন, আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।

আম্মা বা’দ: 

মুহতারাম ভাইয়েরা! প্রথমে আমরা সকলেই একবার দুরূদ শরীফ পড়ে নিই।

اللهم صل على محمد وعلى آل محمد، كما صليت على ابراهيم وعلي آل إبراهيم، إنك حميد مجيد، اللهم بارك على محمد وعلى آل محمد، كما باركت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم إنك حميد مجيد.

ভাইয়েরা আবারও আমরা আরেকটি তাযকিয়া মজলিসে হাজির হতে পেরেছি, এই জন্য মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার দরবারে শুকরিয়া আদায় করি, আলহামদুলিল্লাহ।

মুহতারাম ভাইয়েরা, আজকে যে বিষয়টি আলোচনা করার ইচ্ছা করেছি তা হচ্ছে, ক্রোধ দমন ও নিয়ন্ত্রণ করার উপায়

আমাদের প্রত্যেককেই জীবন চলার পথে অনেক নেতিবাচক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আমাদের কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কেউ পারে না। যারা পারে তারা তাদের জীবনে সফলতা লাভ করে। আর যারা পারে না তারা এক সময় লজ্জিত হয়, অনুতপ্ত হয়। 

আমাদেরকে যেসব নেতিবাচক জিনিস নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস হলো নিজের ক্রোধ ও রাগ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমরা অনেকই একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আজকে আমরা ইনশাআল্লাহ এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো যে, আমরা কীভাবে নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো?

প্রথমেই একটি হাদীস পেশ করছি,

وعن أبي هريرةَ رضي الله عنه : أنَّ رَجُلًا قَالَ للنبي صلى الله عليه وسلم : أوصِني قَالَ : لا  تَغْضَبْ فَرَدَّدَ مِرارًا، قَالَ : لاَ تَغْضَبْ . رواه البخاري.

হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন, তুমি (কখনো কারো সাথে) রাগ করবে না। লোকটি একই কথা কয়েক বার বলল। ( আমাকে কিছু উপদেশ দিন) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (প্রতি বারই) বললেন, তুমি (কখনো কারো সাথে) রাগ করবে না। (সহী বুখারী ৬১১৬)

হাদিসে যে সাহাবীর কথা হয়েছে তিনি ছিলেন হযরত জারিয়া বিন কুদামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু।

উল্লেখিত হাদিসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জাওয়ামিউল কালিম’- এর মধ্য থেকে অন্যতম একটি হদীস। যে বাক্য সংক্ষিপ্ত হয় কিন্তু তাতে ব্যাপক অর্থ ও মর্ম নিহিত থাকে তাকেই জাওয়ামিউল কালিমবলা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞ আলেমগণ এ হাদিসের সুদীর্ঘ ব্যাখ্যা করেছেন। কেননা এতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। প্রতিটি মুসলমানের উচিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি উপদেশ মেনে চলা ও নিজের জীবনে পূর্ণ বাস্তবায়ন করা।

রাগ আমাদের চরিত্রের স্বাভাবিক একটি বিষয়। রাগ আসতেই পারে। রাগ আসাটা দূষণীয় নয়, দূষণীয় হল তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। 

আমরা যখন রেগে যাই তখন পরিণাম চিন্তা না করে অনেক সময় এমন কথা বলে ফেলি বা এমন কাজ করে ফেলি, যার জন্য পরে আমাদেরকে লজ্জিত হতে হয়। নিজের জীবন অনুসন্ধান করলে হয়তো দেখতে পাবো আমাদের জীবনের অনেক সুযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে এই রাগ ও ক্রোধ। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, রাগের মাথায় কিছু করলে তার ফল কখনই ভালো হয় না।

আপনাকে অবশ্যই রাগ সংবরণ করতে হবে। আপনি যদি মাসউল হোন তাহলে তা আরও বেশি জরুরি। কারণ, অধীনস্থ ভাইদেরকে পরিচালনা করতে গিয়ে রাগ করে আপনি নিজেই যদি সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলেন তাহলে মাসউল হিসেবে আপনি যে আস্থার জায়গায় অবস্থান করছেন তা মুহুর্তেই ধবসে যেতে পারে।

এই জন্য আমরা যারা জিহাদী প্লাটফর্মে কাজ করি আমাদেরকে অবশ্যই ভাইদের সাথে রাগ করা পরিহার করে চলতে হবে। ভাইদের সাথে রাগ একদমই করা যাবে। কোন ভাই ভুল করলে নরম ভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। তারগীব ও তাহরীদের মাধ্যমেই কাজ নিতে হবে। রাগ করা যাবে। কোন ভাইকে তিরস্কার করা যাবে না।

ক্রোধের বিভিন্ন প্রকার

এখন আমরা ক্রোধের প্রকার নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। ক্রোধ প্রথমত দুই প্রকার।

ক) প্রশংসনীয় ক্রোধ, যেমন কোন মুসলিম যখন আল্লাহদ্রোহী কোন কাজ হতে দেখে, তখন সে ক্রুদ্ধ হয়। এই ক্রোধ প্রশংসনীয়। এমন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট পুরস্কৃত হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন—

 

ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ

এটাই বিধান। আর কেউ আল্লাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার নিকট তা তার জন্য উত্তম। (সূরা হজ : ৩০)

 

খ) নিন্দনীয় ক্রোধ, যেমন নিজের অন্যায় দাবী প্রতিষ্ঠা করার জন্য ক্রুদ্ধ হওয়া। এমন ক্রোধ হতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন।

ক্রোধ বা রাগের উৎস কী

কী কী কারণে ক্রোধ বা রাগ সৃষ্টি হয়, তা জানা থাকলে আমাদের জন্য রাগ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। সেই কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল

ক) স্বভাবগত কারণে।

খ) অহংকারের কারণে।

গ) নেতৃত্বের লালসা জনিত কারণে।

ঘ) অনর্থক কলহ ও ঝাগড়াঝাটির কারণে।

ঙ) অত্যধিক হাসি তামাশা ও ঠাট্টা বিদ্রুপের কারণেও কখনো কখনো ক্রোধ চলে আসে।

ক্রোধের কুফল  

ক্রোধের কুফল ও মন্দ পরিণতি বলে শেষ করার মতো নয়, তার কয়েকটি হচ্ছে,

ক. ক্রোধ যে কোন ব্যক্তির বুদ্ধিকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও অকেজো করে দেয়, ফলে উত্তেজনার বশীভূত হয়ে সে এমন কাজ করে ফেলে বা এমন কথা বলে ফেলে যার ফলে পরবর্তীতে তাকে লজ্জিত হতে হয়।

খ. যারা অযথা রাগ করে মানুষ তাদের থেকে পলায়ন করে, কেউই তার কাছে থাকতে চায় না। ফলে সে কখনো মানুষের ভালোবাসা ও আন্তরিকতা লাভ করতে পারে না। সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখে।

গ. ক্রোধ হল মানুষের মাঝে শয়তানের প্রবেশদ্বার। এ পথে শয়তান প্রবেশ করে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে খেলা করে।

ঘ. ক্রোধ পাপ কাজের দ্বার উন্মুক্তকারী।

ঙ. ক্রোধ নিজেদের মধ্যে থাকা পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যকে ভেঙে দেয়।

চ. ক্রোধ স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। অত্যধিক ক্রোধ মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলে, আর মস্তিষ্ক হল সম্পূর্ণ শরীরের নিয়ন্ত্রক। ফলে তা বহু মূত্র, রক্তের চাপ ও হার্টের দুর্বলতাসহ অনেক রোগের কারণ হয়।

ছ. ক্রোধের এক অনিবার্য পরিণতি হল, এর ফলে নিজের মর্যাদা, কখনো নিজের সম্পদ নষ্ট হয়

ক্রোধ থেকে বাঁচার উপায়

এবার আমরা ক্রোধ থেকে পরিত্রাণের কিছু উপায় নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। উপায়গুলো হল,

১. যে সমস্ত কারণে মানুষ ক্রুদ্ধ হয় সেই কারণগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করা।

২. সব সময় মুখ ও অন্তর দিয়ে আল্লাহর জিকির করতে থাকা। কারণ, শয়তানের কু-প্রভাবের কারণেই মানুষ ক্রোধান্বিত হয়। তাই কেউ যখন সব সময় আল্লাহর জিকির করতে থাকতে তখন সে শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। রাগ উঠে গেলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর জিকির করা চাই।  

৩. ক্রোধ দমন করা এবং মানুষকে ক্ষমা করার সওয়াবের কথা স্মরণ করা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন

 

الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاء وَالضَّرَّاء وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

যারা স্বচ্ছলতা ও অভাব উভয় অবস্থায় (নিজের সম্পদ আল্লাহর পথে) ব্যয় করে এবং যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালবাসেন। [সুরা ইমরান ৩:১৩৪]

 

একটি হাদীসে এসেছে, হযরত আবু দারদা রাযি. থেকে বর্ণিত, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলল, আপনি আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,

لا تَغْضَبْ، ولكَ الجنة

তুমি কখনো কারো সাথে রাগ করো না, প্রতিদানে তোমার জন্য জান্নাত। (আত তারগীব ৩/৩৮৪ (সনদ সহী), আল মাতজারুর রাবেহ ২৭৪)

৪. রাগের মন্দ পরিণতির কথা স্মরণ করা। রাগান্বিত ব্যক্তি যদি ওই সময় তার যে আকৃতি হয় তা দেখতে পেত তাহলে লজ্জায় তখনি সে ক্ষান্ত হয়ে যেত।

৫. নিজ অবস্থা পরিবর্তন করা, যে অবস্থায় রাগ এসেছে তা থেকে অন্য অবস্থা গ্রহণ করা। দাঁড়ানো থাকলে বসে পড়া, আর বসা থাকলে শুয়ে পড়া।

عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَنَا ‏ "‏ إِذَا غَضِبَ أَحَدُكُمْ وَهُوَ قَائِمٌ فَلْيَجْلِسْ فَإِنْ ذَهَبَ عَنْهُ الْغَضَبُ وَإِلاَّ فَلْيَضْطَجِعْ ‏.‏

আবু যার রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কারোর যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগের উদ্রেক হয় তাহলে সে যেন বসে পড়ে। এতে যদি তার রাগ দূর হয় তো ভালো, অন্যথায় সে যেনো শুয়ে পড়ে। (সুনানে আবু দাউদ ৪৭৮২) (হাদিসটি সহী)

৬. ওজু করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

إِنَّ الْغَضَبَ مِنَ الشَّيْطَانِ وَإِنَّ الشَّيْطَانَ خُلِقَ مِنَ النَّارِ وَإِنَّمَا تُطْفَأُ النَّارُ بِالْمَاءِ فَإِذَا غَضِبَ أَحَدُكُمْ فَلْيَتَوَضَّأْ ‏ ‏.‏

রাগ হচ্ছে শয়তানী প্রভাবের ফল। শয়তানকে আগুন হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আগুন পানি দিয়ে নিভানো যায়। অতএব তোমাদের কারো রাগ হলে সে যেন উযু করে নেয়।
(সুনানে আবু দাউদ ৪৭৮৪) (হাদিসটি দূর্বল)

৭. রাগ এলে সাথে সাথে أعوذ بالله من الشيطان الرجيم পড়ে নিবে। কারণ শয়তানের কুমন্ত্রনার কারণেই রাগ আসে যখন কেউ এ বাক্যটি পড়ে নেবে তখন শয়তান তার কাছ থেকে দূর সরে যাবে। হাদিসে আছে—

عن سُلَيْمَانَ بن صُرَدٍ رضي الله عنه قَالَ : كُنْتُ جالِسًا مَعَ النَّبيّ صلى الله عليه وسلم، وَرَجُلانِ يَسْتَبَّانِ، وَأَحَدُهُمَا قدِ احْمَرَّ وَجْهُهُ، وانْتَفَخَتْ أوْدَاجُهُ، فَقَالَ رَسُول اللهِ صلى الله عليه وسلم : إنِّي لأَعْلَمُ كَلِمَةً لَوْ قَالَهَا لَذَهَبَ عَنْهُ مَا يَجِدُ، لَوْ قَالَ : أعُوذ باللهِ منَ الشَّيطَانِ الرَّجِيمِ، ذَهَبَ عنْهُ مَا يَجِدُ . فَقَالُوا لَهُ : إنَّ النَّبيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : تَعَوّذْ باللهِ مِنَ الشَّيطَانِ الرَّجِيمِ . مُتَّفَقٌ عَلَيهِ

হযরত সুলাইমান বিন সুরাদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বসে ছিলাম। এ সময় দুজন লোক একে অপরকে বকাঝকা করছিল। তাদের একজনের চেহারা (রাগে) লাল হয়ে গিয়েছিল এবং গলার শিরাগুলো ফুলে উঠেছিল। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি এমন একটি বাক্য জানি; যদি সে তা বলত তাহলে তার রাগ দূর হয়ে যেত। যদি সে আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রাজীম (আমি বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি) বলত তাহলে তার রাগ দূর হয়ে যেত। কয়েকজন গিয়ে তাকে বলল, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তুমি আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রাজীম পড়ো। (সহী বুখারী ৩২৮২; সহী মুসলিম ২৬১০)

এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক কুরআনে বলেন,

 

وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

তুমি যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো কুমন্ত্রণা অনুভব করো তাহলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করো নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সুরা হা-মীম ৪১ : ৩৬)

 

৮. সব সময় দুনিয়া-আখেরাত উভয় জগতে কাজে লাগবে এমন কোন কাজে ব্যস্ত থাকা। অপ্রয়োজনীয় কাজে নিজের সময় একদম ব্যয় না করা। 

উপরোক্ত ৮টি বিষয় মেনে চললে আশা করা যায় রাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।  

তাছাড়া আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আত্মসংযম বা রাগ নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। যা অর্জন করা সকল মুসলিমের জন্য বিশেষ করে আমাদের দ্বীনি ভাইয়ের জন্য আবশ্যক।

যে ব্যক্তি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে হাদীসে তাকে প্রকৃত বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

ليس الشديد بالصُّرَعة، إنما الشديد الذي يملك نفسه عند الغضب - متفق عليه

সে প্রকৃত বীর নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়। বরং প্রকৃত বীর সে-, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।” [সহীহ বুখারী ৫৬৮৪]

অত্যাধিক রাগ মানুষকে পাপের পথে পরিচালিত করে। এটি আত্মশুদ্ধি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জনের ক্ষেত্রে এক বিরাট অন্তরায়। এটি সত্যিকার মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়।

রাগ বা ক্রোধকে দমন করে সহনশীলতা, কোমলতা, ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটা ব্যক্তির এক মহৎ গুণ। মহান আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকীদের প্রশংসা করে বলেছেন,

 

وَالَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ وَإِذَا مَا غَضِبُوا هُمْ يَغْفِرُونَ

(মুত্তাকী তারাই) যারা বড় গোনাহ ও অশ্লীল কার্য থেকে বেঁচে থাকে এবং ক্রোধাম্বিত হলে মাফ করে দেয়। [সুরা শূরা ৪২:৩৭]

 

অধিক রাগ মানুষকে পাপের পথে পরিচালিত করে বলেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-  

إِذَا غَضِبَ أَحَدُكُمْ وَهُوَ قَائِمٌ فَلْيَجْلِسْ فَإِنْ ذَهَبَ عَنْهُ الْغَضَبُ وَإِلاَّ فَلْيَضْطَجِعْ ‏ ‏.‏

তোমাদের কারোর যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগের উদ্রেক হয় তাহলে সে যেন বসে পড়ে। এতে যদি তার রাগ দূর হয় তো ভালো, অন্যথায় সে যেনো শুয়ে পরে। (সুনানে আবু দাউদ ৪৭৮২) (হাদিসটি সহী)

রাগ নিয়ন্ত্রণ করার আরও কিছু উপায়

যার ওপর রাগ উঠেছে তাকে সামনে থেকে সরিয়ে দেয়া বা নিজে সরে যাওয়া এবং তাকে ক্ষমা করে দেয়া। এটা দু’জনের জন্যই ভালো ফল নিয়ে আসবে। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করা যে, রেগে গেলে নিজেরই ক্ষতি হবে, তার কোনো ক্ষতি হবে না। এতে আপনা আপনি রাগ কমে যাবে ইনশাআল্লাহ

তাছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় রাগের মূল কারণ হল, নিজের হীনম্মন্যতা। মানুষ রাগারাগি ও দুর্ব্যবহার করে নিজের দুর্বলতাকেই ঢাকার চেষ্টা করে

রাগ বা ক্রোধ ঈমানের বড় শত্রু। আবার ক্রোধ যেমনিভাবে মানুষের ঈমান ও আত্মার শত্রু তেমনিভাবে অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ জীবনেরও বড় শত্রু। ক্রোধের কারণে মানুষের পশুসুলভ আত্মা সক্রিয় হয়। চেহারা বিবর্ণ হয়, মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। যার কারণে অনায়াসে মুখে অশ্লীল কথা, অঙ্গে অশ্লীল ভঙ্গি প্রকাশ পায়।

এখন আমি সাহাবা যুগের একটি ঘটনা তুলে ধরছি, এর মাধ্যমে আমরা দেখবো, আমাদের মহান পূর্বসূরিগণ কীভাবে নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন?

হযরত আলী রাযি.র রাগ নিয়ন্ত্রণ  

কোন এক যুদ্ধে তুমুল লড়াই চলছে। এমন সময় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু কাফেরদের এক সৈন্যকে কাবু করে তার বুকের ওপর চড়ে বসলেন। তরবারির আঘাতে যখনই তাকে হত্যা করতে যাবেন তখনই কাফের সৈন্যটি হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর মুখে থুথু মারল।

তৎক্ষণাৎ হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তার বুকের ওপর থেকে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে যান। ওই কাফের আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, হাতের মুঠোয় পেয়েও কেন আমাকে হত্যা না করে ছেড়ে দিলেন?

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি যখন তোমাকে হত্যা করতে যাচ্ছিলাম তখন তা ছিল কেবল আল্লাহর জন্য। কিন্তু যখন তুমি আমাকে থুথু নিক্ষেপ করলে তখন তোমার ব্যবহারে আমি ক্রুদ্ধ হয়েছি। তখন তোমাকে হত্যা করা হলে তা আমার ক্রোধের কারণেই হত্যা করা হত। তখন কাজটি খালেস আল্লাহর জন্য হত না। তাই তোমাকে ছেড়ে দিলাম। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কথা শুনে কাফের সৈন্যটি তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করে।

কারো মাঝে রাগ একদম থাকতে পারবে না বিষয়টি কিন্তু এমন নয় বরং রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এটিই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া যার মধ্যে রাগ বলতে কিছু নেই তার মধ্যে তেজস্বিতাও থাকে না। রাগ মানুষের মাঝে থাকবেই, তাকে শুধু নিয়ন্ত্রণ করতে পারাই হল মূল কাজ।  

খুশি হওয়া, আনন্দিত হওয়া যেমন একটি মানবিক আচরণ, রাগ হল তার বিপরীত। এটাকে অমানবিক আচরণ বলার সুযোগ নেই, এটিও মানবিক আচরণের মধ্যে পড়ে। এটিও মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তবে রাগ যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখনই কেবল তাকে অমানবিক আচরণ বলা হয়ে থাকে।

আমাদের মাঝে এমনও কেউ আছেন যারা কারণে অকারণে হঠাৎ রেগে যান। হঠাৎ রেগে যাওয়া একটি মানসিক সমস্যাও বটে। মানসিক সমস্যা বর্তমান আধুনিক সমাজের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। আমাদের সমাজ যত উন্নত হচ্ছে, মানসিক সমস্যার পরিমাণও তত বাড়ছে। রাগ এমন একটি মানসিক সমস্যা যা কারো বেলায় প্রকট আকার ধারণ করে। তখন রাগকে শুধুমাত্র রাগ কিংবা ক্রোধের মধ্যেই চিহ্নিত করা যায় না, তখন সেটাকে পাগলামি হিসেবেই আমরা ধরে নিই। এই পাগলামি থেকে বেঁচে থাকার জন্যও আমাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।

কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আসলেই কি সব সময় রাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? কেউ যদি আমার মা-বাবাকে তুলে গালি দেয় কিংবা অকারণে আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে তখনও কি রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?

আমি বলবো, হ্যাঁ তখনও সম্ভব! এমন পরিস্থিতিতেও রাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ধরুন কেউ আপনার বিরুদ্ধে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করল। আপনার বাবা-মা নিয়ে যাচ্ছেতাই বলল। আপনি চুপচাপ শুনে গেলেন কিছুই বললেন না।

তখন গালিগালাজ করা ওই ব্যক্তিটির কী অবস্থা হবে একটু ভাবুনতো। সে আপনাকে উত্তেজিত করতে চেয়েছিল। সে চাচ্ছিল, আপনিও যেন রাগান্বিত হন। কিন্তু আপনি কিছুই বললেন না। ফলে তার উদ্দেশ্যই নস্যাৎ হয়ে গেল। সে আপনাকে যে গালিগুলো দিলো আপনি ওগুলোকে গায়েও মাখলেন না।  

মনে রাখবেন, সে গালিগালাজ করে আপনার ভদ্রতা নষ্ট করতে চেয়েছিল। আপনি গালির জবাব দেয়ার অর্থই হচ্ছে তার উদ্দেশ্যকে সফল করা। তার গালিগালাজ যে আপনার ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারলো না, এটাই তার পরাজয়।

আরেকটি ঘটনা 

এক লোক পুলিশের চাকুরী করত। তার দায়িত্ব ছিল ট্রাফিক সেকশনে। সারা দিন রোদে দাঁড়িয়ে থেকে তার মাথার টেম্পার এমনই গরম হয়ে থাকত। এদিকে তার স্ত্রী ছিল খুবই বদমেজাজী। অকারণেই স্বামীর সাথে ঝগড়া শুরু করত। এমনিতেই স্বামীর সারা দিন ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করে মেজাজ চড়া হয়ে থাকে, দিন শেষে ঘরে ফিরে আসা মাত্রই স্ত্রীর সাথে শুরু হয়ে যায় গালি-গালাজ, ঝগড়া-বিবাদ

একবার সে চিন্তা করল এভাবে তো দাম্পত্য জীবন চলবে না, কী করা যায়? চিন্তা-ফিকির করে সিদ্ধান্ত নিল, এর সমাধানের জন্য সে হযরত থানবী রহ. এর কাছে যাবে।

পরের দিন ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরার আগে থানবী রহ. এর দরবারে গিয়ে হাজির। সব ঘটনা হযরতের কাছে খুলে বলল।   

হযরত তার কথা শুনে বললেন, আজকে তুমি বাসায় গিয়ে তার গালি-গালাজ ও দুর্ব্যবহারের কোনো উত্তরই দিবে না। একদম চুপ মেরে থাকবে। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও বাসায় পৌঁছা মাত্রই স্ত্রীর গালি-গালাজ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আজ সে কিছুই বলছে না। তাকে চুপ থাকতে দেখে তার স্ত্রী আরও খেপে যায়। ও বলতে থাকে, আজকে বুঝি ভাব ধরেছ? বোবা শয়তানে ধরেছে তোমাকে, না?

পরের দিন স্বামী আবার থানবী রহ. এর দরবারে এসে হাজির। এসে বলল, ‘হুজুর আমি আজকে বাসায়ই যাব না। সে এখন টিটকারী মেরে আজে-বাজে কথা বলে -যা শুনে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি না। থানবী রহ. বললেন সবর কর, আজকেও বাসায় যাও এবং আগের মতো শুধু শোনে থাকবে, কোনো উত্তর দিবে না।

এভাবে লোকটি তিন দিন পর্যন্ত বহু কষ্ট করে রাগ থামিয়ে সবর করে গেল। চতুর্থ দিন যখন সে বাসায় ফিরল তখন তার স্ত্রী তার পা জড়িয়ে ধরল আর বলতে লাগল, স্বামী গো! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি কত খারাপ! আমি তোমাকে কত কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু তুমি যে এত ধৈর্যশীল, আগে জানতাম না। আসলে আমিই খারাপ, আমিই ভুল করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও।  

দেখুন, এই হল রাগ হজম করার ফল।

রাগ করে কি আসলে কোনো উদ্দেশ্য হাসিল হয়?

এক কথায় উত্তর হল, না, হয় না। বরং কিছু কৌশল অবলম্বন করলে রাগ থেকেও বাঁচা যায়, উদ্দেশ্যও হাসিল হয়। যেমন কেউ যদি আপনাকে ঠকানোর চেষ্টা করে। রেগে না গিয়ে ওই ঘটনা থেকে আপনি শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হয়ে যান। আপনার ওপর যদি কোনো অবিচার করা হয় তাহলে সেই অন্যায়ের প্রতিকার করার মতো শক্তি এবং সঙ্ঘবদ্ধতা অর্জন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, ধৈর্য ধারণ করুন। কোনো কাজের স্বীকৃতি না পেলে স্বীকৃতির প্রত্যাশা না করে কাজ করে যান। কাজই আপনাকে প্রতিদান দেবে।  

কেউ আপনাকে নিয়ে বিদ্রুপ করলে, রেগে গিয়ে তার উদ্দেশ্যকেই সফল করবেন না। নিজের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে তুলে দিয়ে আপনি কেন মানুষের হাসির পাত্র হবেন। আপনি বরং স্বাভাবিক থাকুন। এতে সে-ই ভড়কে যাবে। আপনার মানসিক চাপ থাকলে, রেগে গেলে চাপ বাড়বে বৈ কমবে না।

পরিস্থিতি নাজুক হলে আসল কৌশল হলো মাথা ঠাণ্ডা রাখা। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করলে, যৌক্তিক জবাব তুলে ধরুন। যুক্তিসঙ্গত কথা বুঝতে না চাইলে, উত্তেজিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন।

যে ভাষায় বললে অপরপক্ষ বুঝবে তাকে সে ভাষায়ই বোঝান। প্রয়োজনে সময় নিন। সবশেষে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর একটি কথা বলে আজকের আলোচনা শেষ করছি।

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু রাগান্বিত অবস্থায় চারটি কাজ করতে নিষেধ করেছেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শপথ গ্রহণ, শাস্তি প্রদান ও আদেশ প্রদান।

ভাইয়েরা, আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রাগ-গোস্বা সংবরণ করে চলার তাওফীক দান করুক। আমীন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ইখলাসের সাথে জিহাদ ও শাহাদাতের পথে অবিচল থাকার তাওফীক দান করুক

আমরা সকলে মজলিস থেকে উঠার দোয়াটা পড়ে নিই।

سبحانك اللهم وبحمدك،أشهدأن لاإله إلا أنت،أستغفرك وأتوب إليك

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين

وآخردعوانا ان الحمد لله ربالعالمين

*************