বর্তমান মুসলিম দেশসমূহের শাসকবর্গ ও তাদের শাসন – শায়খ আবু মুহাম্মদ আসেম আল-মাকদিসি (হাঃ) [পর্ব ২]
তাদের যুক্তি খন্ডনঃ ইবনে আব্বাস রাদিঃ এর মতের সঠিক ব্যাখ্যা।
আলি রাঃ ও মুয়াবিয়া রাঃ এর মধ্যে মতপার্থক্য এবং ভ্রাত্রিঘাতি যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য উভয় পক্ষ থেকে একজন করে সালিস নির্ধারণ করা হল। তখন খারেজীরা ক্ষেপে উঠল এবং বলতে লাগলো (আরবি) ‘তোমরা মানুষদেরকে বিচারের ভার দিয়েছ’ অতঃপর এই আয়াত পাঠ করতে লাগলো- অর্থঃ ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে ফায়সালা করে না তারা কাফির।’ তখন ইবনে আব্বাস রাঃ বললেন, কুফরু দুনা কুফরু ‘এটা সে পর্যায়ের কুফর নয়’।
আমাদের এই অধ্যায়গুলোতে সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করার বিষয় হল আমরা এখানে যে শিরক ও কুফরের কথা বলেছি, তাহলো আল্লাহর আইনের পরিবর্তে নিজের পক্ষ থেকে আইন প্রণয়ন করা এবং সে আইনেই বিচার পরিচালনা করা। আমাদের কথার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের অনুসারি কোন মুসলিম শাসক কোন বিচারকার্যে ইসলামি শরীয়তের সঠিক বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বীয় প্রবৃত্তির তাড়নায় কোন শিথিলতা করে ফেললে সে সাথে সাথে কাফির হয়ে যাবে। (বিষয়টি ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করা জরুরী) আর ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে যে উক্তিটি (কুফরু দুনা কুফরু) বর্ণিত আছে বলে উল্লেখ করা হয়,৫ তার সম্পর্ক হল এই দ্বিতীয় পর্যায়ের শাসকদের সাথে। আর প্রথম পর্যায়ের শাসকদের (যাদের শিরকের আলোচনা পূর্বে সবিস্তারে উদ্ধৃত হয়েছে) বিষয়ে ইবনে আব্বাস রাঃ এর সাথে খারেজীদের কোনই মতানৈক্য হয়নি। কেননা সে জামানায় মুসলমানদের এমন একজন শাসকও ছিলেন না যিনি আল্লাহর সাথে সাথে নিজেকেও আইন প্রণয়নের অধকারি হিসেবে দাবী করার মত দুঃসাহস দেখাতে পারেন। অথবা কোন একটি বিষয়ে নিজের পক্ষ থেকে কোন বিধান প্রণয়নের কথা ভাবতে পারেন। কেননা এটা তাদের নিকট সর্বসম্মতিক্রমে বড় কুফর ছিল (যা কোন মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়)।
আর ইবনে আব্বাস রাঃ ‘আর তোমরা যদি তাদের অনুসরণ করো তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা মুশরিকে পরিণত হবে।'[সুরা আন’আম- ১২১] এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ উল্লেখ করে বলেন, এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে কোন একটি বিধানে মুশরিকদের অনুসরণ করা ব্যাপারে [তানবিরুল মিক্ববাস মিন তাফসিরি ইবনে আব্বাস- ১/১৫৩] সেই জামানার খারেজীরা যে বিষয় নিয়ে কোন্দল সৃষ্টি করেছিল তা যদি হুকুম তথা বিচার পরিচালনাকে তাশরিই’ তথা আইন প্রণয়নের অর্থে নিত, তাহলে ইবনে আব্বাস রাঃ কিছুতেই আইন প্রণয়নকে কুফরু দুনা কুফরু বলতেন না। আর এটা বলা কিভাবেইবা বলা সম্ভব? কারণ তিনি তো ছিলেন কুরআনের উত্তম ব্যাখ্যাকারী।
বরং ঐ জামানার খারেজীরা, ‘যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুসারে ফায়সালা করে না তারাই কাফির।'[সুরা মায়িদা- ৪৪] এই আয়াতটি সাহাবায়ে কিরামের কিছু ইজতিহাদি বিষয়কে ভুল সাব্যস্ত করে ব্যবহার করতো।
তার একটি দৃষ্টান্ত হল যখন আলি রাঃ এবং মুয়াবিয়া রাঃ এর মধ্যে মতপার্থক্য এবং ভ্রাত্রিঘাতি যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য উভয় পক্ষ থেকে একজন করে সালিস নির্ধারণ করা হল। তখন খারেজীরা ক্ষেপে উঠল এবং বলতে লাগলো ‘তোমরা মানুষদেরকে বিচারে ভার দিয়েছ’ অতঃপর এই আয়াত পাঠ করতে লাগলঃ ‘যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুসারে ফায়সালা করে না তারাই কাফির’ এবং তারা দাবী করতো, যে ব্যক্তিই বিচার পরিচালনার ক্ষেত্রে সামান্য কমবেশি করল, তার ব্যাপারেই বলা যাবে যে, সে আল্লাহর বিধান মোতাবেক বিচার পরিচালনা করলনা সুতরাং সে কাফির। তাই তার নিযুক্ত উভয় বিচারক এবং তাদের বিচারের ব্যাপারে যারা সন্তুষ্ট ছিল সকলকে কাফির বলে ঘোষণা করল। এমনকি আলি রাঃ এবং মুয়াবিয়া রাঃ কেও কাফির বলতে লাগলো(নাউযুবিল্লাহ)। আর এটাই ছিল খারেজীদের ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হওয়ার প্রথম কারণ। আর এ কারনেই তাদের প্রথম ফিরক্বাকে ‘মাহকামাহ’ বলা হয়।
এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম রাঃ তাদের সাথে আলোচনা পর্যালোচনা করলেন। ইবনে আব্বাস রাঃ ছিলেন যাদের অন্যতম। তিনি তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, এই বিচারক নির্ধারণ মুসলমানদের মাঝে বিবাদ মিটানোর জন্য। এটাতো আল্লাহর বিধান ব্যতিরেকে এমন বিচার পরিচালনার জন্য নয় যাকে কুফরি বলা হয়। আর তিনি প্রমাণস্বরূপ কুরআনের অপর একটি আয়াত পেশ করলেন যা অবতীর্ণ হয়েছে স্বামি-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ মিটানোর জন্য। ‘আর যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশংকা করো তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও।'[সুরা নিসা- ৩৫]
স্বামি-স্ত্রীর মধ্যকার বিবাদ মিটানোর জন্য যদি বিচারক নির্ধারণ বৈধ হয় তাহলে মুহাম্মদ সাঃ এর উম্মতের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য কেন বৈধ হবে না? ইতিহাসে উল্লেখ আছে এভাবে তিনি আর দলিল পেশ করেন এবং তিনি বলেন এই বিষয়টিকে (যদিও তার মাঝে কিছু ভুলভ্রান্তি ও সত্যবিচ্যুতি হয়েছে) তোমরা যে ধরনের কুফর মনে করছ এটা সে ধরনের বড় কুফর নয়। আর একথার উপর ভিত্তি করেই কুফরু দুনা কুফরু বাক্যটিকে ইবনে আব্বাস রাঃ এর দিকে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়। এ ঘটনার পর তাদের একদল ভুল বুঝতে পেরে সত্য পথে ফিরে আসে। অপর দল আপন অবস্থায় অতল থাকে। অতঃপর আলি রাঃ এবং সাহাবায়ে কিরাম তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
সুতরাং একটু ভেবে দেখুন! আল্লাহর সাথে নিজেকেও বিধানদাতা বানানো, আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তন করা, গাইরুল্লাহকে বিধানদাতা হিসেবে গ্রহণ করা, গনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র অথবা অন্য কোন তন্ত্র-মন্ত্রকে দ্বীনরূপে গ্রহণ করা আর অন্যদিকে সাহাবায়ে কিরাম রাঃ খারেজীদের মাঝে যে বিষয়ে মতানৈক্য হয়েছে এবং সাহাবায়ে কিরাম তাদের সাথে কথা বলে তাদের দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন ও ছোট কুফর বলেঘসনা দিয়েছেন এই দুই বিষয়ের মাঝে আদৌ কি সামান্যতম মিল আছে? তাহলে সাহাবায়ে কিরামের এই ঘটনার দ্বারা বর্তমান সময়ে দলিল পেশ করে এই সমস্ত স্পষ্ট এবং জঘন্য কাফিরদের পক্ষে কেন সাফাই গাওয়া হচ্ছে? সারকথা হলঃ আল্লাহ সুবঃ এর বাণীঃ
‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে ফায়সালা করে না তারাই কাফির।’
এটা দুই ধরনের কুফরকে শামিল করেঃ বড় কুফর ও ছোট কুফর। ইসলামী শরিয়ার অনুসারি মুসলিম শাসক যদি জুলুম অথবা অন্যায়ভাবে বিচার পরিচালনা করে তাহলে তা ছোট কুফর। আর যদি নিজের পক্ষ থেকে আইন প্রণয়ন করে তাহলে তা হবে স্পষ্ট বড় কুফর।
আর এ কারনেই সালাফে সালেহিনগণ এই আয়াতকে যখন প্রথম ক্ষেত্রে (অর্থাৎ জুলুম ও অন্যায়ের ক্ষেত্রে) ব্যবহার করতেন তখন এটাকে ছোট কুফরির অর্থে ব্যবহার করতেন। আর যখন দ্বিতীয় ক্ষেত্রে (অর্থাৎ প্রণয়ন ও আইন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে) প্রমাণ পেশ করতেন তখন এটাকে স্বাভাবিক তথা বড় কুফরের অর্থে গ্রহণ করতেন। যদিওবা এই আয়াতের মূল অর্থ হল বড় কুফর। কেননা এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিলো ইয়াহুদিদের সম্পর্কে যখন তারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়েছিল এবং নিজেদের তৈরি আইনের উপর ঐক্যমত পোষণ করেছিল। আর তাদের এই কাজ ছিল প্রকাশ্য বড় কুফর যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এই বিষয়টিতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। যেমনটি সাহিহ মুসলিমে আছেঃ “রাসুলুল্লাহ সাঃ একবার যিনার অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কালিমাখা এক ইয়াহুদির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন রাসুল সাঃ ইয়াহুদিদেরকে ডাকলেন এবং বললেন তোমাদের কিতাবে কি যিনার শাস্তি এটাই আছে? তারা বলল হ্যাঁ! অতঃপর রাসুল সাঃ তাদের একজন আলিমকে ডাক দিয়ে বললেন, তোমাকে ঐ সত্তার শপথ করে বলছি যিনি মুসা আঃ এর উপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন, তোমরা কি তোমাদের কিতাবে যিনার শাস্তি এমনটিই পেয়েছে? সে বলল, আল্লাহর শপথ! আপনি যদি আমাকে শপথ না দিতেন, তাহলে আমি আপনাকে বলতাম না, আমরা আমদের কিতাবে যিনার শাস্তি পেয়েছি রজম(প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা)। কিন্তু আমাদের মর্যাদাশীল ব্যক্তিরা অহরহ যিনায় জড়িয়ে পড়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্য থেকে যখন কোন মর্যাদাবান লোক যিনা করতো আমরা তাকে ছেড়ে দিতাম। আর কোন সাধারন লোক যিনা করলে আমরা তার উপর হদ(দণ্ডবিধি) কায়েম করতাম। পরবর্তীতে আমরা এ বিষয়ে পরামর্শ করলাম। যে, আসুন আমরা যিনার জন্য এমন একটি বিধান প্রণয়ন করি যা বিশিষ্ট সাধারণ সকল মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। তখন কালিমাখা এবং দোররা মারার ব্যাপারে আমাদের ঐকমত হয়। এতদশ্রবণে রাসুল সাঃ বললেন, হ্যাঁ আল্লাহ আমিই সর্বপ্রথম তোমার এমন আদেশকে জীবিত করেছি যে আদেশকে তারা শেষ করে ফেলেছিল। তখন আল্লাহ সুবঃ অবতীর্ণ করলেনঃ ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে ফায়সালা করে না তারাই কাফির[সুরা মায়িদা- ৪৪] (জালিম[সুরা মায়িদা- ৪৫] ও ফাসিক[সুরা মায়িদা- ৪৭])।’ এ সবগুলো আয়াত কাফিরদের সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়।”[সাহিহ মুসলিমঃ কিতাবুল হুদুদ- ২৮(১৭০০)]
যদি খারেজীরা এই আয়াতকে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতো যে ইয়াহুদিদের মত আল্লাহর আইঙ্কে পরিবর্তন কিংবা বর্জন করে নিজেদের রচিত আইন দ্বারা বিচার ফায়সালা করে তাহলে আব্বাস রাঃ সহ অন্য সাহাবায়ে কিরাম কিছুতেই তাদের এ সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করতেন না এবং এই আয়াতের আসল অর্থই বর্ণনা করতেন। অন্য কোন ব্যাখ্যার দিকে যেতেন না। আসল বেপার হল সেই জামানায় এ ধরনের বড় কুফর অর্থাৎ আল্লাহর আইনকে পরিবর্তন করে মানব রচিত আইনে বিচার পরিচালনার অস্তিত্বই ছিলনা। কারণ যদি এর অস্তিত্ব থাকতই তাহলে তারা এর প্রমাণস্বরূপ শুধু এই একটি আয়াত কেন বরং এর চেয়ে বেশি স্পষ্ট ও অধিক উপযোগী একাধিক আয়াত পেশ করতো। (যে সমস্ত আয়াতের ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই।) যেমন আল্লাহ সুবঃ বলেনঃ
‘তাদের কি এমন শরীক আছে যারা তাদের জন্য বিধান দিয়েছে এমন দ্বীনের যার অনুমতি আল্লাহ দেননি।'[সুরা শু’রা- ২১]
‘আর শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্ররোচনা দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিবাদ করে। আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো, তবে নিশ্চয়ই তোমরা মুশরিক।'[সুরা আন’আম- ২১]
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন কবুল করতে চাইবে তার থেকে তা কবুল করা হবে না।'[আলে ইমরান- ৮৫]
এসকল স্পষ্ট এবং অকাট্য আয়াতকে এই জন্য দলিল হিসেবে পেশ করে নাই যে, আলোচ্য আয়াতগুলোর কোন একটি বিষয়ই সাহাবায়ে কিরামের সময় বিদ্যমান ছিলনা।
সুতরাং সাহাবায়ে কিরাম রাঃ খারেজীদের উত্তরে যে কথা বলেছিলেন তা এই জামানার কুফর ও শিরক নিমজ্জিত শাসনের পক্ষে প্রমাণস্বরূপ পেশ করা নিতান্তই অযৌক্তিক ও অজ্ঞতার পরিচায়ক। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি এই কাজটি করে তাহলে সে সত্যকে মিথ্যার চাদরে ধেকে ফেলার অপচেষ্টা চালাল এবং আলোকে আঁধারে পরিণত করার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত হল। বরং (কা’বার রবের শপথ!) সে এক ভয়ানক অপরাধ করল।
ভাবার বিষয় হল, খারেজীরা সাহাব্যে কিরামের যে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করেছিল সেটি এবং বর্তমান শাসকদের অবস্থা এক নয়। বরং উভয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি উভয় বিষয়কে এক মনে করে, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় সাহাবায়ে কিরামের বিষয়টি এবং এই সমস্ত শিরক দুটি একই মাপের। আর সাহাবায়ে কিরামকে তাদের সমমাপের মনে করা মানে সাহাবায়ে কিরামকেও তাদের মত কাফির ভাবা(নাউযুবিল্লাহ)। আর যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কিরামদের তাকফির করবে সে নিজেই কাফির হয়ে যাবে। কেননা সাহাবায়ে কিরামের প্রতি আল্লাহ সুবঃ সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটা কুরানের স্পষ্ট আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং ঐ সমস্ত শাসকদের শিরক সমূহ থেকে কোন একটিকেও যদি সাহাবায়ে কিরামের প্রতি সম্বন্ধযুক্ত করা হয় তাহলে তা কুরআনের স্পষ্ট আয়াতকে অস্বীকার করা হবে অথবা আল্লাহর ব্যাপারে বলা হবে যে, তিনি কাফিরদের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়েছেন!(নাউযুবিল্লাহ) আর এ সবগুলোই কুফরি।
সুতরাং হ্যাঁ মুমিনগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সাহাবায়ে কিরামের কাজকে এই জামানার কাফিরদের সাথে তুলনা করে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিওনা।
দ্বিতীয় সংশয়ঃ তারা তো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে।
তারা বলেঃ কিরূপে তোমরা আইন প্রণয়নকারী শাসকবৃন্দ ও তাদের সাহায্যকারী সমস্ত সৈনিক, নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য ও অন্যদেরকে কাফির ঘোষণা দাও? আর এ কারণে তোমরা তাদেরকে সালাম পর্যন্ত দাওনা, তাদের সাথে কাফির সুলভ আচরণ করো। অথচ তারা সাক্ষ্য দেয় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই’। তোমাদের কাছে কি উসামা রাঃ এর ঘটনা পৌঁছেনি?
উসামা বিন যায়েদ বিন হারিসা রাঃ বলে ন যে, রাসুল সাঃ জুহায়না গোত্রের হুরাকা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমাদের পাঠালেন। আমরা খুব ভোরে সেই সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করলাম এবং আমরা তাদের পরাজিত করলাম। আমি এবং একজন আনসার এক ব্যক্তির পিছু নিলাম। আমরা যখন তাকে ঘিরে ফেললাম তখন সে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলল, আনসার তার মুখে কালিমা শুনে নিবৃত হলেন। কিন্তু আমি তাকে বল্লম দ্বারা এমন আঘাত করলাম যে, তাকে মেরেই ফেললাম। আমরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরে এলে রাসুল সাঃ এর নিকট এ খবরটি পৌঁছল। তিনি আমাকে ডেকে বললেনঃ হ্যাঁ উসামা! তুমি কি তাকে ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরেও হত্যা করে ফেলেছ? আমি আরয করলাম। হ্যাঁ আল্লার রাসুল! সে ব্যক্তি তো আত্মরক্ষার জন্য এ অথা বলেছিল। রাসুল সাঃ আবার বললেনঃ তুমি কি তাকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরে হত্যা করেছ? এভাবে রাসুল সাঃ বারবার আমার প্রতি একথা বলতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আমার মনে এ কথার উদয় হল যে, হায়! আজকের এ দিনের আগে যদি আমি ইসলাম গ্রহণ না করতাম।[সাহিহ মুসলিমঃ কিতাবুল ঈমান- ১৫৯_(৯৬)]
আল্লাহ সুবঃ ইরশাদ করেনঃ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে বের হবে তখন তোমরা পরিক্ষা করবে, আর তোমাদের কেউ সালাম করলে তাকে তোমরা বল না যে তুমি মুমিন না।'[সুরা নিসা- ৯৪]
এমনিভাবে হাদিসে ইরশাদ হয়েছেঃ ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল আর সে সাক্ষ্য দিত যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাঃ আল্লাহর রাসুল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।'[মুসনাদে আহমাদ সাহিহ সনদেঃ ২২০০৩; তাবারানি ৭৯/২০; নাসাইঃ ১১৩৪; ইবনে খুজামাহঃ ২/৭৮৭]
এমনিভাবে হাদিসে এক ব্যক্তির ব্যাপারে এসেছে, যে কিয়ামত দিবসে ৯৯ টি গুনাহের খাতা বহন করে আনবে আর সে নিজেকে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত ভাববে। এই খাতা গুলোকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ লিখিত একটি চিরকুটের সাথে অজন দেয়া হবে। অতঃপর চিরকুটের পাল্লাই ভারী হবে।[ইবনে মাজাহঃ৪৩০০, তিরমিজিঃ ২৬৩৯; সনদ সাহিহ]
আর এক হাদিসে আছে,
“হুযাইফা রাঃ বর্ণনা করেন, রাসুল সাঃ বলেছেন কোন এক রাত্রিতে কিতাবুল্লাহকে উঠিয়ে নেয়া হবে, তার থেকে একটি আয়াতও জমিনে অবশিষ্ট থাকবে না। বৃদ্ধ মানুষের একটি দল থাকবে যারা জানবে না যে, সিয়াম কি জিনিস, সদক্বা কি জিনিস আর কুরবানিই বা কি জিনিস। তারা বলবে আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের এই কালিমা (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এর উপর পেয়েছি, তাই আমরা এই কালিমা পাঠ করি। সেলাহ রহঃ(হাদিস বর্ণনাকারী) জিজ্ঞাসা করলেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তাদের কি উপকারে আসবে? অথচ তারা জানে না সালাত কি জিনিস, সাদাকেয়া কি জিনিস কি জিনিস, কুরবানি কি জিনিস! হুযাইফা রাঃ উত্তরে বললেন। হে সেলাহ! ‘কালিমা তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত দিবে।'”[মুসতাদরাক হাকিমঃ ৮৬৩৫; হাকিম বলেন ইমাম মুসলিমের শর্তানুসারে হাদিসটি সাহিহ; ইমাম যাহাবি সনদের ব্যাপারে চুপ থেকেছেন।]
আমদের জবাবঃ আল্লাহ সুবঃ ইরশাদ করেনঃ ‘তিনিই তোমাদের প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যার কিছু আয়াত মুহকাম এইগুলি কিতাবের মূল আর অন্যগুলো মুতাশাবিহ যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে তারাই ফিতনা এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহাতের অনুসরণ করে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে আমরা ইহা বিশ্বাস করি।'[আলে ইমরান- ৭]
সুতরাং আল্লাহ সুবঃ স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেনঃ
তিনি মানুষের জন্য প্রেরিত শরিয়তে কিছু মুহকাম আয়াত(সুস্পষ্ট আয়াত) দিয়েছেন- যার উপর শরীয়তের মূল ভিত্তি। মতবিরোধের সময় তা (মুহকাম আয়াত) থেকেই ফায়সালা গ্রহণ করতে হবে। এর বিপরীতে রয়েছে কিছু মুতাশাবিহ আয়াত(অস্পষ্ট আয়াত) যেগুলোর অর্থ একাধিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকার কারণে প্রমানের ক্ষেত্রে অস্পষ্ট। যার অর্থ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানেনা। এ ধরনের আয়াতের দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্য হল বান্দাদেরকে পরিক্ষা করা যে, তারা কোন আয়াতগুলোর অনুসরণ করে।
অতএব, যারা ভ্রান্তিবিলাসে মত্ত এবং পথভ্রষ্ট তারা মুতাশাবিহ আয়াত সমুহের অনুসরণ করেন, আর মুহকাম আয়াত সমুহ ছেড়ে দেয়। যাতে করে তারা এই আয়াতগুলোর অপব্যাখ্যা দিতে পারে এবং মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে।
যারা সত্যের অনুসারি এবং মজবুত ইলমের অধিকারী তারা মুতাশাবিহ আয়াত সমূহকে মুহকামের উপর ন্যস্ত করেন। কেননা মুহকাম আয়াত হল কিতাবুল্লাহর মূল অংশ এবং এর উপরই তার ব্যাখ্যার ভিত্তি। ইমাম শাতিবি রহঃ তার “আল ই’তেসাম” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, এই নিয়মটি শুধুমাত্র কিতাবুল্লাহর জন্যই নয়, বরং ইহা হাদিস ও সিরাতে রাসুল সাঃ এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ এমন কিছু হাদিস এবং ঘটনা বর্ণিত আছে যাতে বলা হয়েছে বা যা সংঘটিত হয়েছে বিশেষ কোন পরিস্থিতিকে সামনে রেখে(যে হাদিসগুলো মুতাশাবিহ এর পর্যায়ে)। সুতরাং এমন হাদিস্কে যদি গ্রহণ করা হয়, আর তার সাথে সম্পর্কিত অথবা তার মুল অর্থ ব্যাখ্যাকারী অপর হাদিসকে (যা মুহকামের পর্যায়ে) ছেড়ে দেয়া হয়। তাহলে এটা মুহকামকে বাদ দিয়ে মুতাশাবিহা গ্রহন করার মতই হবে।
এমনিভাবে কোন ব্যক্তি যদি কোন “আ’ম”কে তার “মুখসসিস”(মুখাসসিস/মুকায়্যিদঃ ঐ বিষয়কে বলা হয় যার দ্বারা আ’ম তথা ব্যাপকভাবে উল্লেখিত বিষয়কে শর্তযুক্ত করা হয়।) ব্যতিরেকে অথবা কোন “মুত্বলাক্ব” কে (আ’ম/মুত্বলাক্বঃ ঐ বিষয় যাকে কোন ধরনের শর্ত ছাড়া ব্যাপকতার সাথে উল্লেখ করা হয়।) তার “মুকায়্যিদ” ব্যতিরেকে গ্রহণ করে অথবা অনেকগুলো মূলনীতি থেকে তার ইচ্ছামত এক-দুটি গ্রহণ করে তাহলে তাহলে এটা এমন হবে যে, পরস্পর অপরিহার্য দুটি বিষয়ের মধ্য হতে একটিকে গ্রহণ ও অপরটিকে বর্জন করা হল। উল্লেখিত সবগুলো বিষয়, মুহকামকে বাদ দিয়ে মুতাশাবিহা গ্রহণ করার নামান্তর। আর যে ব্যক্তি এরূপ কাজ করল সে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আল্লাহর ব্যাপারে চরম মিথ্যাচার করল এবং শরীয়ত যা বলেনি তা শরীয়তের সাথে যুক্ত করে দিল। অথচ তার উপর জরুরী ছিল আল্লাহ ও তার রাসুল সাঃ এর সকল কথার প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং সবগুলি গ্রহণ করা এবং পরিপূর্ণ ভাবে মেনে চলা। কেননা নিজের মনমত যা হয় তা মেনে নিয়ে বাকি গুলোকে ছেড়ে দেয়া, পথভ্রষ্টদের রীতি এবং অধিকাংশ ভ্রান্তদের ভ্রান্তির কারণ। কেননা খারেজীরা ঐ সময় ভ্রান্ত হয়েছে যখন তারা কিছু ‘নস’ (আয়াত এবং হাদিস) কে গ্রহণ করেছে এবং কিছু নস্কে ছেড়ে দিয়েছে। তারা আল্লাহর এই আয়াতকে গ্রহণ করেছে, ‘আর যদি কেউ আল্লাহ ও তার রাসুলের অবাধ্য হয়, আর তাঁর নিরধারিত সীমালঙ্ঘন করে, তিনি তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন, সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।'[সুরা নিসা- ১৪]
এই আয়াতের ভিত্তিতে তারা, যে ব্যক্তিই কবিরা গুনাহ করতো, তাকেই অমুসলিম ঘোষণা করতো। অথচ এটি হল একটি আ’ম আয়াত, যার সঠিক মর্ম তার ‘মুখাসসিস’ ছাড়া অনুধাবন করা সম্ভব নয়। তার ‘মুখাসসিস’ হল অপর একটি আয়াত, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করেননা তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সেতো ঘোর পথভ্রষ্ট হল।'[নিসা- ১১৬]
এই আয়াতের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে তারা শুধু প্রথম আয়াতের ভিত্তিতে বিধান বর্ণনা করেছে, ফলে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এমনিভাবে মুরজিয়ারা পথভ্রষ্ট হয়েছে শুধু ঐ সমস্ত ‘নস'(আয়াত ও হাদিস) কে গ্রহণ করার কারণে যেগুলোতে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
যেমনঃ অর্থঃ ‘যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে'[তিরমিজিঃ ২৬৩৮; মুসনাদে আহমাদঃ ২২২০৩; সনদ হাসান]
তাই তারা আমলের ব্যাপারে চরম অবহেলা করেছে এবং ভেবেছে যে, কোন ব্যক্তি মুসলিম হওয়া এবং জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য শুধু কালিমা পাঠ করাই যথেষ্ট। যদিও সে( যারা শুধু মুখে কালিমা উচ্চারণ করাকে ঈমানের জন্য যথেষ্ট মনে করে) কালিমার শর্ত সমূহ বাস্তবায়ন এবং তার দাবী সমুহ পূরণ করেনা; এমনকি যদিও তা তার জন্য সম্ভব ছিল এবং তার সাধ্যের মধ্যেই ছিল। অথচ উলামায়ে কিরাম শর্তগুলো ও দাবিগুলি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। যেমন, ইমাম বুখারি রাঃ সাহিহ বুখারিতে ওহাব বিন মুনাব্বাহ এর বরাতে উল্লেখ করেন, “ওহাব বিন মুনাব্বাহ কে বলা হল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ কি জান্নাতের চাবি না? তিনি বললেন হ্যাঁ! সকল চাবির জন্য দাঁত আবশ্যক, যদি তুমি দাঁত যুক্ত চাবি নিয়ে আস, তাহলে তোমার জন্য (জান্নাত) খুলে যাবে নতুবা নয়।”[সাহিহ বুখারির ১২৩৭ নং হাদিসের ভূমিকা] কালিমার দাঁত হল তার শর্তসমুহ পূর্ণ করা এবং এই দাঁতকে বিনষ্ট করে এমন কাজ থেকে বিরত থাকা। কেননা যে ব্যক্তি দ্বীন-ইসলামের হাকিকত অর্থাৎ অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরেছে সে নিশ্চিতভাবে জানে যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হল তার মাঝে নিহিত অর্থ (আল কুফরু বিত ত্বাগুত) ‘ত্বাগুতকে অস্বীকার করা’ ও (আল ঈমান বিল্লাহ) ‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস’।
সুতরাং কালিমার অন্তর্নিহিত অর্থের প্রতি লক্ষ করা ও তার দাবিগুলি পূর্ণ করা এবং তার বিপরীতমুখী জিনিস থেকে বিরত থাকা ব্যতীত শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণ করা আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। তাইতো লাআহ তা’য়ালা ইরশাদ করেনঃ ‘তুমি জেনে রাখো তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই।'[সুরা মুহাম্মাদ- ১৯](এই আয়াতে জানার কথা বলা হয়েছে) তিনি আর ইরশাদ করেনঃ
‘তবে তারা ছাড়া যারা জেনে শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়।'[সুরা যুখরুফ- ৮৬](এখনেও জেনে শুনে সাক্ষ্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে।) এমনিভাবে হাদিসে এসেছেঃ
‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল, আর সে জানত; আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ [মুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন লিল হাকিম- ২৪২; সনদ সাহিহ]
উল্লেখিত হাদিস এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, শুধু উচ্চারণ নয় বরং অর্থ জানা এবং বিশ্বাস করা কালিমার জন্য শর্ত। আর এই কালিমার অর্থ দুটি জিনিসকে অন্তর্ভুক্ত করে। এক- আল্লাহর এককত্বকে মেনে নেয়া। দুই- আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল উপাস্যকে বর্জন করা। ইমাম নববি রহঃ এই কালিমার উপর সাহিহ মুসলিমে একটি অধ্যায়ে বিন্যাস করেছেন তাহলো- “ “অর্থাৎ যে ব্যক্তি তাওহীদের উপর মৃত্যুবরণ করল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
এখানে আমাদের লক্ষণীয় বিষয় হল যে, তিনি ‘যে বলল’ বলেননি, বরং তিনি বলেছেন ‘তিনি তাওহীদের উপর মৃত্যুবরণ করল’। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল তাওহীদকে নিসচিতভাবে বাস্তবায়ন করা, যে তাওহীদ এই কালিমার অর্থের মধ্যে নিহিত আছে। কালিমার হক্বগুলো আদায় না করে এবং তার বিপরীতমুখী বিষয় সমূহ থেকে বিরত না থেকে শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণ করা কালিমার উদ্দেশ্য নয়। যেমন, বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে যে,
রাসুল সাঃ মু’য়াজ রাঃ কে ইয়ামানে পাঠানোর সময় অসিয়ত করেছিলেন এবং দাওয়াতের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে বলেছিলেনঃ অর্থঃ ‘সর্বপ্রথম তুমি তাদেরকে দাওয়াত দিবে তারা যেন তাওহীদকে স্বীকার করে নেয়।'[সাহিহ মুসলিম- ৩১(১৯) তাওহীদ প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স; সাহিহ বুখারি- ৭৩৭২]
এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, কালিমার অর্থ হল গ্রহণ ও বর্জন। শুধুমাত্র উচ্চারণ নয়।
সুতরাং এই সমস্ত মুসলিম বেশধারী তাহুতদের সৈনিক ও অন্যান্য সাহায্যকারী, যারা এই তাগুতদেরকে অস্বীকার করাতো দূরের কথা বরং তাগুতদেরকে সাহায্য করে, তারা মুসলিম হতে পারেনা।
তাই তারা যদি এই শিরকের উপরেই মারা যায় তাহলে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। যদিও তারা হাজার বার মুখে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করে।
মুসায়লামাতুল কাযযাবের অনুসারীরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতো, সালাত আদায় করতো, সিয়াম পালন করতো। মুহাম্মাদ সাঃ আল্লাহর নাবী ও রাসুল এ কথার সাক্ষ প্রদান করতো। কিন্তু তারা শুধুমাত্র রাসুলের রিসালাতের সাথে অপর এক ব্যক্তিকে শরীক করতো, ফলেতারা কাফির হয়ে গেছে। তাদের রক্ত ও সম্পদ মুসলিমদের জন্য হালাল হয়ে গেছে। কালিমা পাঠ তাদের কোনই উপকারে আসেনি। একটি মাত্র কারণ ছিল, আর তাহলো রাসুলের রিসালাত নবুয়্যতে অপর একজনকে অংশীদার করা। তাহলে ঐ ব্যক্তির অবস্থা কি হবে যে মুহাম্মাদ সাঃ এর সৃষ্টিকর্তার সাথে অপর কাউকে শরীক করে? উল্লিখিত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম, কালিমা শুধু মুখে উচ্চারণই যথেষ্ট হবেনা বরং তার অর্থ জানতে হবে ও শর্ত মানতে হবে।
বিজ্ঞ উলামায়ে কিরাম কালিমার শর্ত সমূহ উল্লেখ করেছেন এবং এর প্রমাণগুলো পেশ করেছেন। যাত কোন মুসলিম এটাকে শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণের বাক্য না ভাবে।
শর্তগুলো এইঃ
১। কালিমার দাবীগুলি জানা থাকা অর্থাৎ গ্রহণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো জানা থাকা।
২। কালিমার দাবিগুলো অবনত মস্তকে মেনে নেয়া।
৩। মুখে উচ্চারণ করা ও মুখে স্বীকার করা।
৪। সব ধরনের শিরক থেকে মুক্ত হয়ে শুধুমাত্র এক আল্লাহর জন্য আ’মল করা।
৫। কালিমার দাবী গুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা এবং এতে কোন সংশয় না রাখা।
৬।কালিমার শর্তপূরণকারী এবং তদানুযায়ি আমলকারীর প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা রাখা। কালিমার বিরোধিতাকারীদের প্রতি ঘৃণা রাখা।
৭। কালিমার সব দাবী মুখে ও অন্তরে গ্রহণ করে নেওয়া এবং যারা এই কালিমাকে অস্বীকার করে এবং বিরোধিতা করে তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা।
এই অধ্যায়ের শুরুতে প্রতিপক্ষের উল্লেখিত দ্বিতীয় হাদিসঃ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এই কথা সাক্ষ্য দিয়ে মৃত্যুবরণ করল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[মুসনাদে আহমাদ- ১৬৪৮৩; সনদ সাহিহ]
এর জবাবে আমরা বলবঃ এই হাদিসটির সঠিক অর্থ বুঝার জন্য তাকে কিতাবুল্লাহর নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয়ের সাথে মিলাতে হবে। কেননা হাদিসের যে অর্থ তারা গ্রহণ করেছে তা কিতাবুল্লাহর সাথে সাংঘর্ষিক। আয়াতদ্বয় হলঃ
১। ‘অতএব, যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়।'[সুরা বাক্বারা- ২৫৬]
২। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্ট হল।'[সুরা নিসা- ১১৬]
সুতরাং কোন মুশরিক যদি হাজার বা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে এবং তার অর্থকে অনুধাবনও করে, কিন্তু শিরক করে এবং তাগুতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করে, তাহলে আল্লাহ তা’য়ালা তাকে কখনো ক্ষমকা করবেন না এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। যেমন তিনি বলেছেনঃ ‘নিশ্চয়ই যে আল্লাহর সাথে শিরক করবে, আল্লাহ তা’আলা তার উপর জান্নাত হারাম করবেন। আর তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।'[সুরা মায়িদা- ৭২]
এ বিষয়ে অন্য হাদিসগুলোও আমাদের জানা থাকা উচিৎ। তাহলে প্রকৃত অবস্থা বুঝতে সহজ হবে। হাদিসে এসেছেঃ
“‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, আর সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি আল্লাহর রাসুল।’ যে ব্যক্তি এই দুই সাক্ষ্য প্রদান করে আল্লাহর সাথে এমতাবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, সে এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিল না, তাহলে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [সাহিহ মুসলিমঃ কিতাবুল ঈমান- ৪৪(২৭)]
অপর হাদিসে এসেছেঃ “যে ব্যক্তি সত্য হৃদয়ে সাক্ষ্য দিবে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল’ আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামকে হারাম করে দিবেন।” [সাহিহুল বুখারি- ১২৮; আধুনিক প্রকাশনী- ১২৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ১৩০]
এ ধরনের আর অন্যান্য হাদিসেও বিষয়টি পুরোপুরিভাবে স্পষ্ট রয়েছে। আর এভাবেই সকল নস(আয়াত ও হাদিস) এর সমন্বয়ে দ্বীন বুঝে আসে, ইলম অর্জিত হয় এবং আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি ও ইচ্ছা জানা যায়।
এ কারণেই ইমাম নববি রহঃ এ ধরনের(যে ব্যক্তি এই কথা সাক্ষ্য দিয়ে মৃত্যুবরণ করল) হাদিসের ব্যাখ্যায় কতিপয় আলিমের মতামত ব্যক্ত করেছেন।
‘হাসান বসরি রহঃ এর মত হলঃ এই হাদিসগুলো মুজমাল তথা সংক্ষিপ্ত যার ব্যাখ্যা আবশ্যক। উক্ত হাদিসে উদ্দেশিত ব্যক্তি হল সে, যে কালিমা মুখে উচ্চারণ করবে তার হক্ব আদায় করবে এবং তার আবসসকিয় বিষয়গুলো পালন করবে।’
‘ইমাম বুখারি রহঃ বলেনঃ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল ঐ ব্যক্তি, যে তাওবা ও রোনাজারির সময় এই কালিমা পাঠ করে এবং তার থেকে ঈমান বিনষ্টকারী কোন কথা বা কাজ প্রকাশ পাওয়ার পূর্বেই সে মৃত্যুবরণ করে।’
আমরা পূর্বোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝতে পেরেছি যে, তাওহীদের মূল ভিত্তি হল আল কুফরু বিত ত্বাগুত(ত্বাগুতকে অস্বীকার করা) ও আল ঈমান বিল্লাহ(আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন) এবং এই কালিমার যাবতীয় শর্তসমুহ পূরণ করা। অতএব হাদিসে চিরকুটের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝার জন্য সেটাকে আল্লাহর স্পষ্ট আয়াতের সাথে মিলাতে হবে।
আল্লাহ সুবঃ ইরশাদ করেন,
অর্থঃ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্ট হল।'[সুরা নিসা- ১১৬]
অতএব সে যে ৯৯ টি খাতা নিয়ে এসেছিল সেগুলো কিছুতেই কুফর বা শিরক ছিল না বরং অন্য কোন গুনাহ ছিল। কেননা শিরককারীকে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করবেন না এবং জান্নাত তাদের জন্য হারাম। কারণ এই সমস্ত রেজিস্টারের মধ্যে কোন একটি গুনাহ যদি ঈমান বিধ্বংসী হত তাহলে তার চিরকুটের ওজন ভারী হত না এবং ঐ ব্যক্তি নাজাতও পেত না। কারণ তার এই চিরকুট তখন সঠিক তাওহীদের হত না, বরং এটা হত মুখ নিঃসৃত বাক্য মাত্র। যার অর্থের দিকে লক্ষ্য করা হয়নি এবং তার দাবিও পূর্ণ করা হয়নি।
এই সমস্ত রেজিস্টারের মধ্যে যদি গাইরুল্লাহর জন্য ইবাদাত এবং আল্লাহর সাথে বিধানদাতা সাব্যস্ত করা অথবা বিধানদাতাকে সাহায্য করা, তাদের সাথে ভালোবাসা রাখা, দ্বীনকে কটাক্ষ করা এবং দ্বীনের মুজাহিদগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত কোন অপরাধ থাকে তাহলে এই চিরকুট কোন কাজেই আসবে না। কেননা এই সকল অপরাধ মানুষকে ব্যর্থ-বিফল করে দেয় এবং তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করে দেয়। বরং এই রেজিস্টার সমূহ ছিল শিরক ব্যতীত অন্যান্য গুনাহ যা তাওহীদ বিনষ্টকারী নয়।
উক্ত হাদিসে তাওহীদের গুরুত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব বুঝানো হয়েছে এবং এটাই বুঝানো হয়েছে, যে ব্যক্তি তাওহীদকে মেনে নিবে এবং স্বীয় প্রভুর সন্তুষ্টি অনুযায়ী সে তার শর্তগুলো পূর্ণ করবে। আল্লাহ তা’আলা তার বাকি সব গুনাহ গুলো ক্ষমা করবেন। হাদিসে কুদসিতে এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট ভাবে বর্ণিত আছেঃ
অর্থঃ ‘হে আদম সন্তান! তোমরা যদি দুনিয়া সমান গুনাহ নিয়েও আমার কাছে আসো অতঃপর আমার সাথে সাক্ষাৎ করো এমন অবস্থায় যে, তোমরা আমার সাথে কাউকে শরীক করনি, তাহলে আমি তোমাদেরকে তার সমপরিমাণ মাগফিরাত দান করব।'[তিরমিজি- ৩৫৪০; সিসিলাতুল আহাদিস আস-সাহিহাহ লিল আলবানি- ২৮০৫; সনদ সাহিহ]
উল্লেখিত হুযাইফা রাঃ এর হাদিসটি (কোন এক রাত্রিতে কিতাবুল্লাহকে উঠিয়ে নেয়া হবে……) যদি সাহিহ হয়[হাকিম বলেন, ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদিসটি সাহিহ], তাহলে এর উদ্দেশ্য হবে, ঐ সমস্ত লোক যারা এই কালিমা ব্যতীত শরীয়তের অন্যান্য জিনিস সম্পর্কে বেখবর। সে এই কালিমার শর্তগুলো পূর্ণ করবে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না। (কেননা আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন না, যে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে) তাহলে তারা তাওহিদে বিশ্বাসীদের মধ্যে গণ্য হবে। আর তারা যে সালাত, যাকাত, কুরবানি ইত্যাদি আদায় করেনি এ জন্য আল্লাহর নিকট ওজর পেশ করবে কেননা প্রমাণ ছাড়া শরীয়ত বুঝা সম্ভব নয়, অথচ হাদিসে উল্লেখ আছে, তাদের সময় কিতাবুল্লাহকে উঠিয়ে নেয়া হবে, ফলে তার একটি আয়াত বাকি থাকবে না। আর কিতাবুল্লাহ হল এমন এক হুজ্জাত(প্রমাণ) যা আল্লাহ সুবঃ অবতীর্ণ করেছেন মানুষদেরকে সতর্ক করার জন্য। আল্লাহ সুবঃ বলেছেনঃ
অর্থঃ ‘আর এ কুরআন আমার কাছে ওহী করে পাঠানো হয়েছে যেন তোমাদেরকে এবং যার কাছে এটা পৌঁছবে তাদেরকে এর মাধ্যমে আমি সতর্ক করি।'[সুরা আন’আম- ১৯]
সুতরাং যার নিকট কুরআন পৌঁছবে তার আর কোন অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না। আর যার নিকট কুরআন পৌঁছাবে না সে শরিয়ার শাখাগত বিষয়ে অক্ষম বিবেচিত হবে কিন্তু সে তাওহীদের মৌলিক বিষয়ে অক্ষম সাব্যস্ত হবে না।
কেননা তাওহীদ এমন একটি বিষয় আল্লাহ যার জন্য অনেক প্রমাণ পেশ করেছেন। আর এজাতীয় লোকদের অবস্থা হবে যায়েদ বিন আমর বিন নুফাইল এর ন্যায়। তার নিকট কোন নবি না আসা সত্ত্বেও তিনি একজন একনিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন। কেননা তিনি তাওহীদের মৌলিক দাবী সমূহ পূর্ণ করেছিলেন এবং ইবরাহীম আঃ এর শরীয়তের অনুসারি ছিলেন। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, তিনি বলতেনঃ
“হে আল্লাহ! আমি যদি তোমার ইবাদাতের সর্বোত্তম পদ্ধতি জানতাম তাহলে সেভাবেই তোমার ইবাদত করতাম। কিন্তু আমি তা জানিনা।”[ফাতহুল বারী ইবনে হাজার- ২১/২১৮]
শরীয়তের বিস্তারিত বিষয় সমূহ যে গুলো রাসুল সাঃ এর মাধ্যম ছাড়া জানা সম্ভব নয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে ওজর গ্রহণ করা হবে। কেননা সে তো জানেই না সালাত কি জিনিস? যাকাত কি জিনিস? এ কারণে এগুলোর ক্ষেত্রে অক্ষমতা গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু তাওহীদের বিষয়টি ব্যতিক্রম। তাওহিদের মৌলিক দাবী পূর্ণ করা ছাড়া মুক্তি নেই। কেননা তাতো বান্দার প্রতি আল্লাহর প্রথম দাবী। আর এ কারণেই তিনি সমস্ত রাসুলকে প্রেরন করেছেন এবং এর উপর অনেক প্রমাণ পেশ করেছেন। কিন্তু মুহাদ্দিসিনে কিরামের মত অনুযায়ী, (আরবি) এই উক্তিটি রাসুল সাঃ এর নয়। আর কতিপয় মুহাক্কিক আলিমের মতে হাদিসটি সাহিহ নয়। কেননা হাদিস্তির রাবী আবু মুয়াবিয়া খজেম আজ-জারীর ছিল ‘মুদাল্লিস’ (উস্তাদের নাম গোপনকারী)। আর আ’মাশ ছাড়া অন্যান্যদের থেকে তার বর্ণিত হাদিসগুল ‘যাঈফ'(দুর্বল)। আর এটা সে আ’মাশ ব্যতীত অন্যান্যদের থেকে বর্ণনা করেছে, তা ছাড়া সে ছিল কঠোর মুরজিয়া৬। যেমনটি ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ ও অন্যান্য মুহাদ্দিসিনে কিরাম বর্ণনা করেছেন, আর এটা হল ঐ হাদিস যার দ্বারা কঠোর মুরজিয়ারা প্রমাণ পেশ করে থাকে। আর উলামায়ে কিরাম বিদ’আতিদের এমন বর্ণনাকৃত হাদিস গ্রহনের ক্ষেত্রে সতরক করেছেন যে দ্বারা তারা তাদের বিদ’আতি কাজে সাহায্য গ্রহণ করে। আর এই হাদিস দ্বারা মুরজিয়ারা তাদের মতের পক্ষে সাহায্য গ্রহণ করে, সাথে সাথে এই হাদিসটি ‘যায়ীফ’ এবং ‘মুদাল্লিস’ (মুদালিসঃ ঐ হাদিস বর্ণনা কারী যে তার পুরবের রাবীর নাম গুপন করে।)।
আর উসামা রাঃ এর হাদিসটি (“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা সত্ত্বেও তুমি তাকে হত্যা করলে?”) ছিল ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে যে যুদ্ধের ময়দানে ইসলাম গ্রহণ করেছে, আর ইসলামের নাওয়াকিদ(যা ঈমান নষ্ট করে দেয়) থেকে কোন একটি তার থেকে প্রকাশ পায়নি। এই পরিস্থিতিতে তাকে হত্যা করা বৈধ ছিলনা। কেননা লোকটা ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তার ঈমান বিনষ্টকারী কোন জিনিস প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে হত্যা না করা আবশ্যক ছিল। আর এ কারনেই ইমাম নববি রহঃ সাহিহ মুসলিমে আরবি(অর্থাৎ কোন কাফির ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করার পর তাকে হত্যা করা হারাম) এই শিরনামে একটি অধ্যায় এনেছেন। কিন্তু ভালভাবে জেনে রাখা উচিৎ, সে যদি পরবর্তীতে এই কালিমার উপর অটল না থাকে, এই কালিমার মৌলিক দাবিগুলো পূর্ণ না করে এবং তার নাওয়াকিদ(যা ঈমান ধ্বংস করে দেয়) থেকে বিরত না থকে, তাহলে সে মুসলিম বলে গণ্য হবেনা। বরং তাকে হত্যা করা বৈধ হবে। সুতরাং উভয় বিষয়ে পার্থক্য অনুধাবন করা উচিৎ। আর হাদিসে উল্লিখিত ব্যক্তি হত্যা করার পূর্বমুহূর্তে ইসলাম গ্রহণ করেছে। আর তার থেকে কোন নাওয়াকিদ(ঈমান বিনষ্টকারী কোন কথা বা কাজ বা বিশ্বাস) পাওয়া যায়নি। সে তো এমন ব্যক্তি ছিলনা যে বছরের পর বছর নিজেকে মুসলিম দাবী করে আসছে অথচ সে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। আর বিপরীতে ত্বাগুত ও ত্বাগুতের বন্ধুদের সাথে এবং ত্বাগুতের বিধানদাতাদের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। কেননা এই ব্যক্তি যদি হাজার বার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে তাহলেও এই কালিমা তার সামান্য উপকারে আসবে না, যতক্ষণ না সে কুফর ও শিরক ছেড়ে দেয় এবং যে সব ত্বাগুতের সে অনুসরণ করে, বন্ধুরূপে গ্রহণ করে ও যার রক্ষক হিসেবে নিয়োজিত, সে সব ত্বাগুতের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে। আর এটাই হল কালিমার মূল দাবী। যা আমাদের তাকফিরকৃত ব্যক্তিরা পালন করছে। আল্লাহর বানীঃ
অর্থঃ ‘আর যে ব্যক্তি তোমাদেরকে সালাম দেয় তোমরা তাকে বলবে না তুমি মুমিন নও।'[সুরা নিসা- ৯৪]
এই আয়াতের শানে নুযুলঃ হাদিসে আছে, যুদ্ধের সময় একবার সাহাবাগণ একজনকে আক্রমন করতে গেলে সে ভয়ে তার কাছে যা কিছু ছিল সব সাহাবীদের দিয়ে কালিমা পড়ে ফেলল। সাহাবাগণ তখন লোকটাকে হত্যা করল, তারা ভেবে ছিল লোকটা তাদের ভয়ে কালিমা পড়েছে। আল্লাহ তা’আলা তখন বিষয়টি যে তাঁর অপছন্দনীয় এটা জানিয়ে উক্ত আয়াতটি নাযিল করেন।
কোন ব্যক্তি যদি নিজেকে মুসলিম দাবী করে, আর তার মাঝে ইসলামের বিপরীত কোন কিছু না পাওয়া যায় তাহলে তার বাহ্যিক অবস্থার উপর বিচার করা উচিৎ। কিন্তু যখন প্রকাশ পাবে সে মুসলিম দাবী করে, এর সাথে সাথে অন্য কুফরিও করে তাহলে তার ইসলাম গ্রহণযোগ্য হবে না। যতক্ষণ না সে এই সকল জিনিস থেকে মুক্ত হয় এবং একনিষ্ঠ ভাবে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনের দ্বীনকে গ্রহণ করে। এই কারনেই আল্লাহ তা’য়ালা এই আয়াতের পূর্বে এবং পরে বলেছেন (আরবি) অর্থাৎ তোমরা অনুসন্ধান করো।
৫। মুসতাদরাক হাকিম এর বর্ণনাটিতে আল হাকিম বর্ণনা করেন, আলি বিন হারব থেকে, তিনি সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ থেকে, তিনি হিশাম বিন হুজাইর থেকে, তিনি তাউস থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাস বলেছেন, ‘এটা ঐ কুফর নয় যেদিকে তোমরা ঝুঁকে পড়ছ(বুঝাতে চাচ্ছ), “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেই অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারা কাফির” হচ্ছে ছোট কুফর, বড় কুফর নয়[কুফরু দুনা কুফরু]।'[আল মুসতাদরাক হাকিম, ভলিয়ম- ২, পৃষ্ঠা- ৩১৩]
হাদিসটির বিশুদ্ধতাঃ যদিও আল হাকিম উক্ত হাদিসটিকে সাহিহ বলেছেন; কিন্তু সত্যতা হল এই যে, ইমাম আহমাদ, ইয়াহইয়া ইবনে হুজাইর এবং আরও অনেকে হিশাম বিন হুজাইরকে ‘যাঈফ’ বলেছেন (দেখুন, তাহযীব আত তাহযীবঃ খণ্ড- ৬/২৫)। ইবনে আদিও তাকে ‘যাঈফ’ বর্ণনাকারীদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন এবং আল উকাইলিও একই কথা বলেছেন (আল মুযাফা আল কাবির, খণ্ড- ৪/২৩৮)। সুতরাং এই হাদিসটিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যাবে না এবং এই একই রাবী হিশাম বিন হুযাইর এর কারণেই প্রায় একই হাদিসের আরেকটি বর্ণনা যা ইবনে কাছীর উল্লেখ করেছেন (তাফসিরুল কুরআনিল আজীম, খণ্ড- ২/৬২) সেটিও ‘যাঈফ’ এবং দলীল হিসেবে অগ্রহণযোগ্য।
৬। মুরজিয়া একটি বাতিল ফিরক্বা। এদের আক্বিদা সমূহের মধ্যে রয়েছেঃ
কেবল আল্লাহ ও রাসুলের মা’রেফাতের (পরিচয়) নামই ঈমান। আমল ঈমানের মূলতত্বের পর্যায়ভুক্ত নয়। ঈমানের সাথে কোন পাপাচার মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। এ চিন্তাধারার কাছাকাছি আর একটি দৃষ্টিভঙ্গি এই ছিল যে, ভাল কাজের নির্দেশ ও খারাপ কাজে নিষেধ এর জন্য যদি অস্ত্র ধারণের প্রয়োজন দেখা দেয়; তাহলে এটা একটা ফিতনা। সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খোলা জায়েজ নয়। আল্লামা আবু বকর জাসসাস এ জন্য অত্যন্ত কঠোর ভাষায় মুখ খোলে অভিযোগ করে বলেন, এসব চিন্তা জালিমের হাত সুদৃঢ় করেছে। অন্যায় এবং ভ্রান্তির বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিরোধ শক্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মুরজিয়ারা ‘আমলের দিক দিয়ে ইসলামকে পঙ্গু করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে প্রকাশ করল যে; সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি ইসলামী আদেশ সংক্রান্ত আমল সমূহের সাথে ঈমানের কোনই সম্পর্ক নেই। এসব করমের দ্বারা ঈমান বাড়ে না। অনুরূপ ব্যভিচার, মদ্যপান, জুয়া, চুরি ইত্যাদি অন্যায় কাজে ঈমান কমে যায় না। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহকে স্বীকার করার পর কোন গুনাহই মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। মুরজিয়ারা এভাবে শরীয়তের অনুশাসন বাতিল করে ঈমান কেবল মুখে মুখে উচ্চারণ ও মনে বিশ্বাস করাই যথেষ্ট বলে প্রচার করে। এভাবে এরা ইসলামের বিধি-নিষেধ পালনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট শিথিলতা ও সুবিধার আমদানি করল। ইমাম ইবনুল জাওযী রহঃ তাদের(মুরজিয়া) আক্বীদা সম্পর্কে বলেছেনঃ তাদের বিশ্বাস কালিমা শাহাদাত একবার পাঠ করার পর যত প্রকার অন্যায় করুক ঐ অন্যায়ের শাস্তি ভোগের জন্য আদৌ জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে না।