JustPaste.it


مؤسسة الحكمة
আল হিকমাহ মিডিয়া
Al-Hikmah Media

 

تـُــقدم
পরিবেশিত
Presents

 

الترجمة البنغالية
বাংলা অনুবাদ
Bengali Translation

 

بعنوان:
শিরোনাম:
Titled

 

"نحو وعي صحيح"
বিশুদ্ধ চেতনার দিকে
Towards pure consciousness

 

للشيخ خالد بن عمر باطرفي حفظه الله
শাইখ খালিদ বিন উমর বাতারফি হাফিযাহুল্লাহ
By Sheikh Khalid bin Umar Batarfi Hafizahullah

 

 

للقرائة المباشرة والتحميل
সরাসরি পড়ুন ও ডাউনলোড করুন
For Direct Reading and Downloading


روابط بي دي اب
PDF (844 KB)
পিডিএফ ডাউনলোড করুন [৮৪৪ কিলোবাইট]
https://banglafiles.net/index.php/s/MwGrRaSYXWngpZf


https://archive.org/download/bishoddo-chetonar-dike/BisuddhoChetonarDike%20-%20SaikhBatarfiHafizahullah.pdf


https://top4top.io/downloadf-1896rdsqn1-pdf.html


https://download.ru/files/xm3oph2j


https://mymegacloud.com/index.php?dl=b7091acaff12d9eb32ef702d09d97a5e


https://krakenfiles.com/view/d0686b5b7f/file.html


https://www.solidfiles.com/v/6dyqKrpvDWz4N

 

 

روابط ورد
Word (587 KB)
ওয়ার্ড [৫৮৭ কিলোবাইট]
https://banglafiles.net/index.php/s/ogb4aZtAFYqHjAz


https://archive.org/download/bishoddo-chetonar-dike/BisuddhoChetonarDike%20-%20SaikhBatarfiHafizahullah.docx


https://top4top.io/downloadf-1896yvwxq2-docx.html


https://download.ru/files/O9RqaRbB


https://mymegacloud.com/index.php?dl=c7d4b6aeff46d2ecea3c60128c800266


https://krakenfiles.com/view/9436704651/file.html


https://www.solidfiles.com/v/V7AMe2XaKM6KV

 

 

روابط الغلاف- ١
book Banner [497 KB]
বুক ব্যানার ডাউনলোড করুন [৪৯৭ কিলোবাইট]
https://banglafiles.net/index.php/s/matjCxW2Cp2brH5


https://jpcdn.it/img/ec881c8b8a3d496682cbb73ccd9c0a14.jpg


https://mymegacloud.com/index.php?dl=3e8cd286bb06c33758836307ad840bb6


https://jpcdn.it/img/ec881c8b8a3d496682cbb73ccd9c0a14.jpg


https://download.ru/files/tLLw7nAv


https://krakenfiles.com/view/2ccc6d6612/file.html


https://www.solidfiles.com/v/BRBWxvv2WGX4a

 

 

روابط الغلاف- ٢
Banner [1 MB]
ব্যানার ডাউনলোড করুন [1 মেগাবাইট]
https://banglafiles.net/index.php/s/Yc6GFXZ5AwRHc84


https://jpcdn.it/img/77bd11b56a100ef4ef566ed36b9b6c48.jpg


https://mymegacloud.com/index.php?dl=c8d4426b7942c8ec5e1a655132e53612


https://jpcdn.it/img/77bd11b56a100ef4ef566ed36b9b6c48.jpg


https://download.ru/files/bNxYMHQt


https://krakenfiles.com/view/34bcd2203c/file.html


https://www.solidfiles.com/v/WGzKnay5axAq6

 

 

 

************

 

 

বিশুদ্ধ চেতনার দিকে

 

মূল

শাইখ খালিদ বিন উমর বাতারফি হাফিযাহুল্লাহ

 

অনুবাদ
আনাস আব্দুল্লাহ

[আলিম, শিক্ষক ও দাঈ]

 

সম্পাদনা

আল হিকমাহ সম্পাদনা বোর্ড

 

 

 

 

 

সূচিপত্র

 

প্রথম পর্ব: ভূমিকা.. 4

দ্বিতীয় পর্ব: মুসলিম হোন. 8

তৃতীয় পর্ব: মুখলিস হোন. 12

চতুর্থ পর্ব: আল্লাহওয়ালা হোন. 20

পঞ্চম পর্ব: হিকমতের অধিকারী হোন. 27

ষষ্ঠ পর্ব: অনুরাগী হোন. 34

সপ্তম পর্ব: ইনসাফকারী হোন. 40

 

 

 

 

 

 

প্রথম পর্ব: ভূমিকা

بِسْمِ اللَّـهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ

নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তার প্রশংসা করছি এবং তার নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি আমাদের অন্তরের অনিষ্ট থেকে এবং আমাদের মন্দ কর্ম থেকে। তিনি যাকে পথপ্রদর্শন করেন, তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তাকে পথপ্রদর্শনকারী কেউ নেই।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। তিনি বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, আমানতের হক্ক যথাযথভাবে আদায় করেছেন, উম্মতের কল্যাণ কামনা করেছেন এবং আমৃত্যু আল্লাহর পথে জিহাদ করেছেন। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে সেই সর্বোত্তম প্রতিদান দান করুন, যা একজন নবীকে তার উম্মতের পক্ষ থেকে দিয়ে থাকেন।

আম্মাবাদ:

আমাদের জাতি ক্রমাগত বিপদ, সংকট ও ফেতনার মধ্য দিয়ে কাল অতিক্রম করছে। চারিদিকে অন্ধকার রাত্রির ন্যায় ফেতনা, যা সহনশীলকেও অস্থির করে তোলে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিটি মুমিন মুসলমান ও মুজাহিদের জন্য নিজ আচরণের ক্ষেত্রে, নিজের সকল সামাজিক আচরণবিধির ক্ষেত্রে, বিশেষত: জিহাদি জীবনের আচরণের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ বিভক্তির ফেতনায় জর্জরিত। উম্মতের মাঝে বিভক্তি, দলসমূহের মাঝে বিভক্তি, মাযহাবসমূহের মাঝে বিভক্তি। এছাড়াও আরো নানান ধরনের বিভক্তি আমাদের মুসলিম জাতিকে নানান দলে এবং গ্রুপে বিভক্ত করে রেখেছে।

এ সকল দল, গ্রুপ ও মাযহাব নিয়ে এমন ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়েছে, যার ফলে সাধারণ মুসলমানদের মাঝে নিজ দলের বুঝ আর বিশুদ্ধ ইসলামের বুঝের পার্থক্য দেখে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষা ও শিক্ষকের অপ্রতুলতা একটি প্রধান কারণ। মুসলিম ও মুজাহিদগণকে সঠিক বুঝ ও ইসলামের সঠিক চেতনা শিক্ষা দিবেন এমন উপযুক্ত শিক্ষকের কমতি রয়েছে।

আরবি وعي শব্দের অর্থ চেতনা।  আল মুজামুল ওয়াসিত অভিধানে وعي অর্থ হল: সংরক্ষণ, মূল্যায়ন, বুঝ ও নিখুঁত উপলব্ধি। الوعيّ অর্থ হল: চতুর ও বুঝমান।

‘তাহযীবুল লুগাহ’ এর মধ্যে এসেছে, ভাষাবিদ লাইস বলেন: وعي অর্থ হল, অন্তর কর্তৃক কোন কিছুকে সংরক্ষণ করা।

ইবনে মানযুর ‘লিসানুল আরবে’ বলেন: وعي হল অন্তর কর্তৃক কোন কিছুকে সংরক্ষণ করা। কোন কিছুকে বা কথাকে وعي করেছে মানে হল, তাকে মুখস্থ করেছে, বুঝেছে ও গ্রহণ করে নিয়েছে। যেমন হাদিসের মধ্যে এসেছে: “আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে সজীব করুন, যে আমার কথা শুনেছে, অতঃপর তা وعي (সংরক্ষণ বা মুখস্থ) করেছে। কারণ যাদের নিকট পৌঁছানো হয়, তাদের মধ্যে অনেক এমন আছে, যারা সরাসরি শ্রোতা থেকেও অধিক সচেতন, বুঝমান।”

স্বভাবতই وعي এর যে অর্থগুলো আমরা পেলাম, এগুলো মুমিনদের জন্য, বিশেষত: মুজাহিদগণের জন্য, বিশেষ করে যারা এ যুগে বসবাস করছে, তাদের খুব প্রয়োজন।

যে যুগে বহু ধরণের ফেতনা, বিপদ ও সংকট বিরাজ করছে, মানুষ দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে, তখন আমরা এ ধরণের শিক্ষার আসরগুলো থেকে যে বিষয়গুলোর আশা করি, তা হল:

১- মুসলিম যুবকদের মাঝে সচেতনতার হার বৃদ্ধি করা। যেন সে তার কর্মময় জীবনে সঠিকভাবে চলতে পারে। এমনিভাবে আমরা তাকে ইসলামের ব্যাপারে বিশুদ্ধ চেতনা ও বিশুদ্ধ বুঝ দেয়ার চেষ্টা করবো, যাতে সে অন্য মানুষের সাথে - চাই সে মুসলিম হোক বা কাফের - আচার-আচরণের পদ্ধতি বুঝতে ও জানতে পারে। যেমন সহীহুল বুখারীতে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু  থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ.

“আল্লাহ যার ব্যাপারে কল্যাণ চান, তাকেই দ্বীনের বুঝ দান করেন।” (সহীহুল বুখারী ৭১, মুসলিম ১০৩৭, ইবনু মাজাহ ২২১, আহমাদ ১৬৩৯২, মুওয়াত্তা মালিক ১৬৬৭, দারেমী ২২৪, ২২৬)

সুতরাং মানুষ শুধু কুরআন-সুন্নাহর মূলপাঠগুলো শিখবে- এতটুকুই কর্তব্য নয়, বরং তার সাথে সাথে তাকে মূল পাঠের অর্থ বুঝতে হবে এবং বাস্তব জীবনে এ সমস্ত পাঠগুলোর প্রয়োগ জানতে হবে। এভাবেই বিশুদ্ধ বুঝ তৈরি হবে ইনশা আল্লাহ।

২- আমরা আরো চাই যে, এসকল শিক্ষার আসরগুলো থেকে একজন মুসলিম, বিশেষ করে মুজাহিদরা আমাদের বর্তমান জামানার নব উদ্ভূত সমস্যাগুলোকে বুঝা ও বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করা শিখতে পারবে। জানতে পারবে কীভাবে ফেতনাসমূহের মোকাবেলা করতে হবে এবং কীভাবে বিভক্তি ও দল কেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যাতে করে নিজের দল বা জামাতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব অন্তরে না আসে। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বিশুদ্ধ ইসলামের পক্ষপাতিত্বই যেন করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ  

“হে মুমিনগণ! (কোন বিষয়ে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের থেকে আগে বেড়ে যেও না। আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন।” (সূরা হুজরাত ৪৯:১)

এমনিভাবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ رَسُوْلِه. رَوَاهُ فى المُوَطَّا

“আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে গেলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এ দু’টি জিনিস আঁকড়ে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার অবর্তমানে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল: আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ।” (মুয়াত্তা ইমাম মালিক রহ. হাদিস নং ১৬০৪)

স্বভাবতই এ সকল পাঠগুলোর পদ্ধতি হবে: পুণ্যবান পূর্বসূরিদের বুঝের আলোকে কুরআন-সুন্নাহ বুঝা। আমরা আলেমদের (বিশেষত: সমসাময়িক আলেমদের) বক্তব্য ও মতামতগুলোর মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করতে চাই না। শুধুমাত্র যেটা সালাফে সালিহীনদের (আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করুন) বুঝের অনুকূল হবে, সেটাই গ্রহণ করা হবে।

মহান আরশের অধিপতি মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ ও বিশুদ্ধ চেতনা দান করুন! আমাদেরকে সেসকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যারা কথা শ্রবণ করে, অতঃপর তার মধ্য হতে উত্তম কথাটির অনুসরণ করে। আমাদেরকে সেসকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যারা নিজেদের দ্বীনের ক্ষেত্রে অগ্রগামী। নিশ্চয়ই তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং তিনি দু’আ কবুল করেন।

আমাদের সর্বশেষ কথা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক । 

 

 

দ্বিতীয় পর্ব: মুসলিম হোন

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর এবং তার পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের উপর।

অত:পর-

এ যুগে আমরা দেখছি - যে মুসলমানকে আল্লাহ শ্রেষ্ঠত্ব দান করলেন, মুসলিম বানিয়ে অনুগ্রহ করলেন, পক্ষান্তরে সৃষ্টির অনেক জীবকে এই মহান দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন - সেই মুসলিম আজ গর্ব করছে দল, সংগঠন, গোত্র, জাতীয়তা বা ভূখণ্ড নিয়ে। অথচ কথা, কাজ ও নামের ক্ষেত্রে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ততা নিয়ে তাদের খুব কমই গর্ব করতে দেখা যায়।

কতগুলো আচরণ থেকে এই বিষয়টা স্পষ্ট হয়। যেমন:

১. নিজ দলের সদস্যদের প্রতি দয়াশীল হওয়া আর অন্য মুসলিমদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করা

২. মুসলমানদের পরাজয়ের মাধ্যমে হলেও নিজের দলের বিজয় কামনা করা।

৩. নাফরমান মুসলমান, ‘আহলে কিবলা’ তথা আমাদের কিবলার অনুসারী বিদআতি মুসলিম এবং যে সকল পথভ্রষ্ট মুসলমান ধর্ম থেকে বের হয়ে যায়নি - তাদের উপর অহংকার করা, তাদেরকে দাওয়াত না দেওয়া এবং তাদের হেদায়াত কামনা না করা।

৪. নিজ দলের উপকার ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তীব্র ব্যাকুলতা, কিন্তু ইসলাম ও মুসলিমদের সেবার ব্যাকুলতা না থাকা।

মুসলমানদের কথা, কাজ ও নামের দিক থেকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ততা নিয়ে গর্ব করার মতো চিত্র খুব কম দেখা যায়। পরিতাপের বিষয়: উলামা, তালিবুল ইলম এবং মুজাহিদগণের মধ্যেও এটা বিদ্যমান। আপনি দেখবেন, উলামা ও তালিবুল ইলমগণ নিজেদের কোন একটি মাদরাসা নিয়ে গর্ব করে আর অন্যান্য ইসলামী মাদরাসাগুলোকে অবজ্ঞা করে ও একপাশে ফেলে দেয় । হ্যাঁ, কতিপয় মাদরাসা হক এবং কুরআন-সুন্নাহ গ্রহণের ক্ষেত্রে তুলনামূলক এগিয়ে আছে। কিন্তু তাই বলে একেবারে মাসুম ও নিষ্কলুষ নয়। প্রত্যেকেরই কিছু কথা গ্রহণীয় ও কিছু বর্জনীয় আছে।

এই নির্দিষ্ট মাদরাসার সাথে সম্পৃক্ততা এবং অন্যান্য মাদরাসাগুলোর ব্যাপারে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ শুধুমাত্র মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে শত্রুতা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং পরিতাপের বিষয়, এটা ওই মাদরাসার সাথে সম্পর্ক রাখে এমন সাধারণ মুসলিমদের সাথে আচরণের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়।

উদহারণ স্বরূপ- একজন মুসলিম হয়তো হানাফি মাযহাবের সাথে সম্পৃক্ত, কিন্তু সে শাফিঈ মাযহাব, বা হাম্বলী মাযহাব বা ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহর মাযহাবের সাথে সম্পর্কিত মুসলমানদের সাথে শত্রুতা করে। আরও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এমন আচরণ আমাদের মাদরাসা বা দলের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন সাধারণ মুসলিমের সাথেও করা হচ্ছে। তার সাথে শত্রুতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহই একমাত্র সাহায্য কারি।

 

তাই হে আমার মুসলিম ভাই,

আপনাকে এই মহান দ্বীন নিয়ে গর্ব করতে হবে। এই দ্বীনের সাথে সম্পর্কিত প্রত্যেকের প্রতি নমনীয় হবেন, এমনকি যদিও সে বিরোধী দলের হয়। সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝের প্রতি দাওয়াত দিতে ব্যাকুল থাকবেন। প্রত্যেক মাদরাসার হকসম্মত বিষয়টি গ্রহণ করুন। কোন সাম্প্রদায়িকতা বা পক্ষপাতিত্ব ব্যতীত যোগ্য ও মর্যাদাবানদের মূল্যায়ন করুন। সর্বদা মনে রাখবেন, আপনি একজন মুসলিম। আপনার গর্ব হবে ‘ইসলাম নিয়ে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ قَبْلُ وَفِي هَذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَاعْتَصِمُوا بِاللَّهِ هُوَ مَوْلَاكُمْ فَنِعْمَ الْمَوْلَى وَنِعْمَ النَّصِيرُ  

“এবং আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে (তাঁর দ্বীনের জন্য) মনোনীত করেছেন। তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোন সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। নিজেদের পিতা ইবরাহীমের দ্বীনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর। সে পূর্বেও তোমাদের নাম রেখেছিল মুসলিম এবং এ কিতাবেও (অর্থাৎ কুরআনেও), যাতে এই রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হতে পারে আর তোমরা সাক্ষী হতে পার অন্যান্য মানুষের জন্য। সুতরাং নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর। তিনি তোমাদের অভিভাবক। দেখ কত উত্তম অভিভাবক তিনি এবং কত উত্তম সাহায্যকারী।” (সূরা আল-হজ্জ ২২:৭৮)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

المُسْلِمُ أخُو المُسْلِمُ، لاَ يَخُونُهُ، وَلاَ يَكْذِبُهُ، وَلاَ يَخْذُلُهُ، كُلُّ المُسْلِمِ عَلَى المُسْلِم حَرَامٌ عِرْضُهُ وَمَالهُ وَدَمُهُ، التَّقْوى هاهُنَا، بحَسْب امْرىءٍ مِنَ الشَّرِّ أنْ يَحْقِرَ أخَاهُ المُسْلِم

“আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তাকে মিথ্যা বলবে না (বা মিথ্যাবাদী ভাববে না), তার সাহায্য না করে তাকে অসহায় ছেড়ে দেবে না। এক মুসলিমের মর্যাদা, মাল ও রক্ত অপর মুসলিমের জন্য হারাম। তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি এখানে (অন্তরে) রয়েছে। কোনো মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করাটাই একটি মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’’ (মুসলিম ২৫৬৪, তিরমিযী ১৯২৭)

যেমন কবি বলেছেন:

ابي الاسلام لا اب لي سواه  * إذا افتخروا بقيس او تميم

যখন তারা (তাদের পিতৃপুরুষ) কায়েস ও তামিমকে নিয়ে গর্ব করে, তখন আমি বলি, আমার পিতা হল ইসলাম, ইসলাম ব্যতীত আমার কোন পিতা নেই।(অর্থাৎ আমি একমাত্র ইসলাম নিয়েই গর্ব করি)

আরেক কবি বলেন:

كما رفع الإسلام سلمان فارس  *  فقد وضع الشرك النسيب أبا لهب

যেমনিভাবে ইসলাম সালমান ফার্সিকে উপরে উঠিয়েছে, তেমনি শিরক আবু লাহাবকে নিচে নামিয়েছে।

আমাদের সর্বশেষ কথা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

 

তৃতীয় পর্ব: মুখলিস হোন

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের উপর এবং তার পরিবারবর্গ, সাহাবাগণ ও যারা তাঁর সাথে বন্ধুত্ব রাখে তাদের উপর। অতঃপর:

সকলেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদিসটি সর্বদা বলে থাকেন:

حَدَّثَنَا الْحُمَيْدِيُّ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ الزُّبَيْرِ، قَالَ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، قَالَ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ الأَنْصَارِيُّ، قَالَ أَخْبَرَنِي مُحَمَّدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ التَّيْمِيُّ، أَنَّهُ سَمِعَ عَلْقَمَةَ بْنَ وَقَّاصٍ اللَّيْثِيَّ، يَقُولُ سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ ـ رضى الله عنه ـ عَلَى الْمِنْبَرِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ "‏ إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ

আলক্বামাহ ইব্‌নু ওয়াক্কাস আল-লায়সী রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত-

আমি উমর ইব্‌নুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ কাজ (এর প্রাপ্য হবে) নিয়ত অনুযায়ী। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে ইহকাল লাভের অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে- তবে তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হবে, যে জন্যে, সে হিজরত করেছে।” (সহিহ বুখারী ৫৪, ২৫২৯, ৩৮৯৮, ৫০৭০, ৬৬৮৯, ৬৯৫৩; মুসলিম ২৩/৪৫ হাঃ ১৯০৭, আহমাদ ১৬৮) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১)

এমনকি সাধারণ মুসলমানগণও এই গুরুত্বপূর্ণ হাদিসটি ব্যাপকভাবে বলে থাকেন। এটাকে উলামায়ে কেরাম সার্বজনীন হাদিসগুলোর মধ্যে গণ্য করেন।

ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ তার সহিহ এর অনেক স্থানে এটা পুনরাবৃত্তি করেছেন। এমনকি তার কিতাবের সূচনা করেছেন এই হাদিসের মাধ্যমে। এটা করেছেন মুসলমানদের জীবনে এই হাদিসের গুরুত্ব ও মর্যাদার কারণে।

আমরা জানি যে, মানুষের কোন কাজই নিয়ত ছাড়া হয় না। নিয়ত ছাড়া কোন কাজ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব না।

যেমন ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেছেন:

“কেউ যদি নিজের ঐচ্ছিক কাজগুলোকে নিয়তমুক্ত করতে চায়, তাহলে এটা পারবে না। যদি মহান আল্লাহ মানুষকে নিয়ত ছাড়া নামায ও ওযু করার দায়িত্ব দিতেন, তাহলে এটা এমন জিনিসের দায়িত্ব চাপানো হত, যা সামর্থ্যের বাইরে, সাধ্যের বাইরে।”

অনেক সময় একই কাজ অনেক মানুষ করে, কিন্তু তাদের নিয়তের মধ্যে পার্থক্য থাকে। এখানেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদিসটির কার্যকারিতা দেখা যায়- “প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করেছে, তাই পাবে।”

সুতরাং হে মুসলিম ভাই!

আপনি যত নেক আমল করবেন, তাতে আপনার পুরস্কার হবে ওই কাজে আপনার আল্লাহর প্রতি ইখলাস বা একনিষ্ঠতার হিসাবে। নেক আমল আল্লাহর নিকট কবুল হওয়া - উক্ত কাজে আপনার আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা এবং রাসূলের সুন্নাহ অনুসরণের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا  

“সুতরাং যে নিজ রবের সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং নিজ রবের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে।” (সূরা কাহফ ১৮:১১০)

সুতরাং হে মুসলিম!

আপনি কি চান, আপনার ইখলাস-একনিষ্ঠতার মধ্যে কোনরূপ ত্রুটি থাকার কারণে আপনার আমল ব্যর্থ হয়ে যাক বা আপনার পুরস্কার কমে যাক?!

হে প্রিয় মুজাহিদ ভাই,

এই প্রশ্নটি আমি বিশেষভাবে আপনাকে করছি। কারণ আপনি পরিবার ও প্রিয়জনদের ছেড়ে এসেছেন। আপনি বৈশ্বিক তাগুতগোষ্ঠী এবং তাদের দোসরদের সাথে শত্রুতা প্রদর্শন করেছেন। আপনি মন্দ আলেম এবং যারা নিজ পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হয়ে আছে, তাদের বিরোধিতা করছেন। তাই সাবধান! সাবধান!! শয়তান যেন আপনার নিকট এই দরজা (নিয়তের দরজা) দিয়ে না আসে।

জেনে রাখুন, জিহাদের মধ্যে থাকাকালীন সময়ে এই দরজা (নিয়তের দরজা) দিয়ে যে সকল প্রতিবন্ধকতাগুলো আসে, তা বহুবিধ। তন্মধ্যে কয়েকটি হল: নেতৃত্বের লোভ, প্রসিদ্ধি, গনিমত, প্রদর্শনের ইচ্ছা, সমশ্রেণীর লোকদের প্রতি হিংসা, অহংকার, অন্যদের হীনদৃষ্টিতে দেখা ইত্যাদি। এছাড়াও আরো অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে, যেগুলো আপনার মধ্যে ঢুকে গেলে, তা আপনার জিহাদকে নষ্ট করে দিবে এবং আপনার আমলকে বাতিল করে দিবে। আল্লাহ আমাকে এবং আমাদের সবাইকে এ থেকে রক্ষা করুন।

এক্ষেত্রে আপনার জন্য এ হাদিসটিই যথেষ্ট, যা ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ “অধ্যায়: যে ব্যক্তি প্রদর্শন ও সুখ্যাতির জন্য যুদ্ধ করবে, সে জাহান্নামের অধিকারী হবে”এর অধীনে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি রাসূলুল্লাহকে বলতে শুনেছি:

حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ حَبِيبٍ الْحَارِثِيُّ، حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ الْحَارِثِ، حَدَّثَنَا ابْنُ جُرَيْجٍ، حَدَّثَنِي يُونُسُ بْنُ يُوسُفَ، عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ يَسَارٍ، قَالَ تَفَرَّقَ النَّاسُ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، فَقَالَ لَهُ نَاتِلُ أَهْلِ الشَّامِ أَيُّهَا الشَّيْخُ حَدِّثْنَا حَدِيثًا سَمِعْتَهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ نَعَمْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ "‏ إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ ‏.‏ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لأَنْ يُقَالَ جَرِيءٌ ‏.‏ فَقَدْ قِيلَ ‏.‏ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ ‏.‏ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ ‏.‏ وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ ‏.‏ فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ ‏.‏ وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلاَّ أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ ‏.‏ فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ ‏"‏ ‏.‏

“সুলাইমান ইবনু ইয়াসার রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত-

তিনি বলেন, একদা লোকজন যখন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট থেকে বিদায় নিচ্ছিল, তখন সিরিয়াবাসী নাতিল (রহিমাহুল্লাহ) বললেন, হে শায়খ! আপনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট থেকে শুনেছেন এমন একখানা হাদিস আমাদেরকে শুনান। তিনি বলেন, হ্যাঁ! (শুনাবো)। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যার বিচার করা হবে, সে হচ্ছে এমন একজন যে শহীদ হয়েছিল। তাঁকে উপস্থিত করা হবে এবং আল্লাহ তাঁর নিয়ামতরাশির কথা তাকে বলবেন এবং সে তার সবটাই চিনতে পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে।) তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, এর বিনিময়ে‌ কী আমাল করেছিলে?’ সে বলবে, আমি তোমারই পথে যুদ্ধ করেছি এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি বরং এ জন্যেই যুদ্ধ করেছিলে যাতে লোকে তোমাকে বলে, তুমি বীর। তা বলা হয়েছে, এরপর নির্দেশ দেয়া হবে। সে মতে তাকে উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার করা হবে যে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করেছে এবং কুরআন মাজীদ অধ্যয়ন করেছে। তখন তাকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের কথা তাকে বলবেন এবং সে তা চিনতে পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে।) তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, এত বড় নিয়ামত পেয়ে বিনিময়ে তুমি কী করলে? জবাবে সে বলবে, আমি জ্ঞান অর্জন করেছি এবং তা শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন অধ্যয়ন করেছি। জবাবে আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি তো জ্ঞান অর্জন করেছিলে এজন্যে যাতে লোকে তোমাকে জ্ঞানী বলে। কুরআন তিলাওয়াত করেছিলে এ জন্যে যাতে লোকে বলে, তুমি একজন ক্বারী। তা বলা হয়েছে। তারপর নির্দেশ দেয়া হবে, সে মতে তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার হবে যাকে আল্লাহ তাআলা সচ্ছলতা এবং সর্ববিধ বিত্ত-বৈভব দান করেছেন। তাকে উপস্থিত করা হবে এবং তাকে প্রদত্ত নিয়ামতসমূহের কথা তাঁকে বলবেন। সে তা চিনতে পারবে (স্বীকারোক্তিও করবে।) তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘এসব নিয়ামতের বিনিময়ে তুমি কী আমল করেছো?’ জবাবে সে বলবে, সম্পদ ব্যয়ের এমন কোন খাত নেই যাতে সম্পদ ব্যয় করা তুমি পছন্দ কর, আমি সে খাতে তোমার সন্তুষ্টির জন্যে ব্যয় করেছি। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি বরং এ জন্যে তা করেছিলে যাতে লোকে তোমাকে দানবীরবলে অভিহিত করে। তা বলা হয়েছে। তারপর নির্দেশ দেয়া হবে। সে মতে তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (সহিহ মুসলিম ই.ফা. ৪৭৭০, ই.সে. ৪৭৭১)

নিয়তের সব ধরণের সমস্যা এই হাদিসের মর্মের আওতাভুক্ত। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত।

আমরা আমাদের জিহাদি যাত্রার শুরুর দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদিসটি পড়তাম, যা ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন:

‏"‏ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَبِرَسُولِهِ وَأَقَامَ الصَّلاَةَ وَصَامَ رَمَضَانَ، كَانَ حَقًّا عَلَى اللَّهِ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ جَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَوْ جَلَسَ فِي أَرْضِهِ الَّتِي وُلِدَ فِيهَا ‏"‏‏.‏ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ نُبَشِّرُ النَّاسَ‏.‏ قَالَ ‏"‏ إِنَّ فِي الْجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ أَعَدَّهَا اللَّهُ لِلْمُجَاهِدِينَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ، فَإِذَا سَأَلْتُمُ اللَّهَ فَاسْأَلُوهُ الْفِرْدَوْسَ، فَإِنَّهُ أَوْسَطُ الْجَنَّةِ وَأَعْلَى الْجَنَّةِ، أُرَاهُ فَوْقَهُ عَرْشُ الرَّحْمَنِ، وَمِنْهُ تَفَجَّرُ أَنْهَارُ الْجَنَّةِ ‏"‏‏.‏ قَالَ مُحَمَّدُ بْنُ فُلَيْحٍ عَنْ أَبِيهِ ‏"‏ وَفَوْقَهُ عَرْشُ الرَّحْمَنِ ‏"

“আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি যে ঈমান আনল, সালাত আদায় করল ও রমযানের সিয়াম পালন করল সে আল্লাহর পথে জিহাদ করুক কিংবা স্বীয় জন্মভূমিতে বসে থাকুক, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যায়। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা কি লোকদের এ সুসংবাদ পৌঁছে দিব না? তিনি বলেন, আল্লাহর পথের মুজাহিদদের জন্য আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে একশটি মর্যাদার স্তর প্রস্তুত রেখেছেন। দু’টি স্তরের ব্যবধান আসমান ও জমিনের দূরত্বের ন্যায়। তোমরা আল্লাহর কাছে চাইলে ফেরদাউস চাইবে। কেননা এটাই হল সবচাইতে উত্তম ও সর্বোচ্চ জান্নাত। আমার মনে হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ-ও বলেছেন, এর উপরে রয়েছে আরশে রহমান। আর সেখান থেকে জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে।” (সহিহ বুখারী ই ফা – ২৭৯০)

আমরা এ হাদিস পড়ে বিস্মিত হতাম এবং আশা করতাম, আমরা যেন মুজাহিদগণের স্তরসমূহের সর্বোচ্চ স্তরে থাকি। তখন আমরা মুজাহিদগণের স্তরসমূহের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছার পদ্ধতি সম্পর্কে আলেমগণকে জিজ্ঞেস করলাম। আমাদেরকে উত্তরে বলা হল: এটা জিহাদের মধ্যে মুজাহিদগণের ইখলাস ও আমলের হিসাবে হবে। তার জিহাদের কাজে আমীর বা মাসুল হওয়া আবশ্যক নয়। বরং একজন সৈনিক হয়েও সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারে।

এর প্রমাণ হল এই মহান হাদিস, যা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। রাসূল বলেন:

"‏ تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ وَعَبْدُ الدِّرْهَمِ وَعَبْدُ الْخَمِيصَةِ، إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ، وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ، تَعِسَ وَانْتَكَسَ، وَإِذَا شِيكَ فَلاَ انْتَقَشَ، طُوبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَشْعَثَ رَأْسُهُ مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ، إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ، وَإِنْ كَانَ فِي السَّاقَةِ كَانَ فِي السَّاقَةِ، إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ، وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ

“লাঞ্ছিত হোক দিনারের গোলাম, দিরহামের গোলাম এবং শালের গোলাম। তাঁকে দেওয়া হলে সন্তুষ্ট হয়, না দেওয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। এরা লাঞ্ছিত হোক, অপমানিত হোক। (তাদের পায়ে) কাঁটা বিদ্ধ হলে কেউ তা তুলে দিবে না। ঐ ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ, যে ঘোড়ার লাগাম ধরে জিহাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে, যার মাথার চুল এলোমেলো এবং পা ধূলিধূসরিত। তাঁকে পাহারায় নিয়োজিত করলে পাহারায় থাকে আর (সৈন্য দলের) পেছনে রাখলে পেছনেই থাকে। সে কারো সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তাঁকে অনুমতি দেয়া হয় না এবং কোন বিষয়ে সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না।” (বুখারী ২৮৮৭, মিশকাত ৫১৬১)

ইবনুল জাওযী রহিমাহুল্লাহ বলেন: “সে হল এমন অখ্যাত ব্যক্তি, যিনি কোন সুখ্যাতি চান না।”

আল্লামা খালখালি বলেন: এর অর্থ হল, ‘যা আদেশ করা হয়, তাই পালন করা এবং যেখানে রাখা হয়, সেখানেই থাকা, আপন স্থান ত্যাগ না করা। প্রহরা ও পিছনের অংশে থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেহেতু এ দু’টি কাজ সর্বাধিক কষ্টকর’।

তাই প্রিয় মুজাহিদ ভাই,

আপনি যদি আপনার আমীরের মধ্যে স্বজনপ্রীতি দেখতে পান, তাহলে স্মরণ করুন: (আমি) নিজে মুখলিস হই

যদি এমন কাউকে আপনার উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়, যে হিজরত ও জিহাদের ক্ষেত্রে আপনার থেকে নবীন, তাহলে স্মরণ করুন: (আমি) নিজে মুখলিস হই

যদি অন্যকে দেওয়া হয়, কিন্তু আপনাকে বঞ্চিত করা হয়, তবে স্মরণ করুন: (আমি) নিজে মুখলিস হই

আপনার জিহাদি জীবনের, এমনকি আপনার সমগ্র জীবনের স্থায়ী স্লোগান যেন হয়:

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّـهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿﴾ لَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ ﴿﴾

আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল।” (সূরা আনআম ৬:১৬২-১৬৩)

আমাদের সর্বশেষ কথা: সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

 

 

চতুর্থ পর্ব: আল্লাহওয়ালা হোন

সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য। পূর্ণাঙ্গ দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক সম্মানিত নবী, আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর এবং তার পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের উপর। তারপর:

ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন:

“অন্তরের জিহাদও চার স্তরের:

এক. সেই হেদায়াত (পথনির্দেশ) ও সত্য দ্বীন শিখার ব্যাপারে অন্তরের সাথে জিহাদ করা, যা ব্যতীত তার ইহকালে ও পরকালে কোন সফলতা ও সুখ লাভ হবে না। যখন তার জ্ঞানের মধ্যে এটা অনুপস্থিত থাকবে, তখন সে উভয় জগতে হতভাগা হবে।

দুই. জানার পর তার উপর আমল করার ব্যাপারে অন্তরের সাথে জিহাদ করা। অন্যথায় আমল ছাড়া শুধু ইলম তার কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারবে না।

তিন. দ্বীনের দিকে আহবান করার ব্যাপারে এবং যে দ্বীন জানে না, তাকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে অন্তরের সাথে জিহাদ করা। অন্যথায় সে সেসকল লোকের অন্তর্ভুক্ত হবে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ ও হেদায়াত গোপন করে। তার এই ইলম তার কোন উপকারে আসবে না। এটা তাকে আল্লাহর শাস্তি থেকেও রক্ষা করতে পারবে না।

চার. আল্লাহর পথে দাওয়াতের কষ্টে এবং সৃষ্টিজীবের অত্যাচারে ধৈর্য ধারণ করার ব্যাপারে এবং এসব কিছু আল্লাহর জন্য সহ্য করার ব্যাপারে অন্তরের সাথে জিহাদ করা।

কেউ যখন এই চার স্তর পূর্ণ করবে, তখন সে আল্লাহওয়ালাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। সমস্ত সালাফগণ এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, কোন আলেমকে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহওয়ালা বলে অভিহিত করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে হক না চিনবে, সে অনুযায়ী আমল না করবে এবং তা অন্যকে শিক্ষা না দিবে। সুতরাং যে শিখবে, আমল করবে এবং অন্যকে শিক্ষা দিবে, তাকেই ঊর্ধ্ব জগতে মর্যাদার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে বলে ডাকা হবে।”

বর্তমানে আমাদের মুসলিম জাতি, এমনকি গোটা বিশ্ব যে ব্যাপক দুর্যোগ ও ফেতনার মধ্যে বসবাস করছে, এ সময় আমাদের জন্য নিজেদের বিষয়াবলীতে সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর থাকা, পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়া এবং আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান বের করা কতটা প্রয়োজন!?

আর এই উদ্দেশ্য আমাদের দ্বীনের বিধানাবলীর বুঝ ও পারদর্শিতা ব্যতীত এবং আল্লাহ তা’আলার শরয়ী নীতিমালা ও জাগতিক নীতিমালা জানা ব্যতীত অর্জিত হবে না। এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য অর্জনকারীকে শুধু ইলম অন্বেষণকারী হলেই চলবে না। কারণ কত তালিবুল ইলম (ইলম অন্বেষণকারী) এমন আছে, যে সঠিক পথ পায়নি। শুধু তাই নয়, অনেকের ইলম তার জন্য বিপদের কারণ হয়েছে, সে এর দ্বারা উপকৃত হতে পারেনি। কত আলেম এমন আছে, যে তার ইলমকে দুনিয়াবি লক্ষ্য পূরণের বাহন বানিয়েছে।

যে জিনিসটির সত্যিকার প্রয়োজন, তা হল: আমাদেরকে আল্লাহওয়ালা হতে হবে। আমরা ইলম শিখব তা অনুযায়ী আমল করার জন্য। তারপর তার দিকে আহবান করব এবং তার উপর আমল করতে ও তা প্রচার করতে গিয়ে যে কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়, তাতে ধৈর্য ধারণ করব। বর্তমানে আমাদের উম্মতের অনেক যুবকরা যে জিনিসটির উপযুক্ত গুরুত্ব দেয় না, তা হল: আমাদের রবের কিতাব এবং আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ থেকে উৎসারিত শরয়ী ইলম, যা আমাদের পুণ্যবান পূর্বসূরিদের বুঝের ভিত্তিতে হয়। আমাদের মাঝে অনেক তালিবুল ইলমের মধ্যে যে জিনিসটির ঘাটতি থাকে, তা হল: ইলম অন্বেষণের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ নিয়ত, যা ইলম অনুযায়ী আমল করার দিকে নিয়ে যায়।

এ দু’টি জিনিস থাকলেই এমন কীর্তিমান প্রজন্ম গড়ে উঠবে, যারা সৎ কাজের আদেশ করবে, মন্দ কাজে বাধা প্রদান করবে, বিনষ্টকারীরা যা নষ্ট করে দিয়েছে, তা সংস্কার করবে এবং উম্মাহর পুণ্যবান পূর্বসূরি সংস্কারকদের যাত্রা পূর্ণ করবে। এ পথে যদি তার সামনে কোন প্রতিবন্ধকতা আসে বা কোন কষ্ট ও অপছন্দনীয় বিষয় ঘটে, তখন সুদৃঢ় পাহাড়ের ন্যায় অটল থাকবে। কোন বিপদ তাকে টলাতে পারবে না এবং প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ুও তার ভিত নাড়াতে পারবে না।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا ‏.‏ وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ

“শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিন অপেক্ষা উত্তম ও প্রিয়। তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ আছে। তোমার উপকারী বিষয় অর্জনের প্রতি সচেষ্ট হও, আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর, অক্ষম হবে না। তোমার কোন বিপদ ঘটলে এমনটা বলবে না যে, আমি এটা করলে এটা হত। বরং বল: আল্লাহ (এমনটা) নির্ধারণ করেছেন। তিনি যা চেয়েছেন, তাই করেছেন। কারণ ‘যদি’ কথাটি শয়তানের কাজের দরজা খুলে দেয়।”  (সহিহ মুসলিম ই ফা – ৬৫৩২)

হাসান বসরী রহিমাহুল্লাহ বলেন: তুমি যদি এমন বিচক্ষণ লোক দেখতে চাও, যার ধৈর্য নেই, তবে এমন অনেক দেখতে পাবে। তুমি যদি এমন ধৈর্যশীল ব্যক্তি দেখতে চাও, যার মাঝে বিচক্ষণতা নেই, তবে তাও অনেক দেখতে পাবে। কিন্তু তুমি যদি বিচক্ষণ ধৈর্যশীল (উভয় গুণে গুণান্বিত) দেখতে চাও, তবে সেটা অনেক বড় বিষয়। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:

وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يُوقِنُونَ  

“আর আমি তাদের মধ্যে কিছু লোককে, যখন তারা সবর করল, এমন নেতা বানিয়ে দিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথপ্রদর্শন করত এবং তারা আমার আয়াতসমূহে গভীর বিশ্বাস রাখত।” (সূরা সাজদা ৩২:২৪)

তাই শক্তি ও বিচক্ষণতার উপকরণগুলো অবলম্বন করা আল্লাহর প্রতি ঈমানের দৃঢ়তার অংশ এবং দুনিয়ার প্রতিষ্ঠা ও পরকালের স্থায়ী নেয়ামতের প্রতিশ্রুতির প্রতি নিশ্চিত বিশ্বাসেরই অংশ।

দূরদর্শী শাইখ বিজ্ঞ আলেম ইবনে কায়্যিম আলজাওযিয়াহ রহিমাহুল্লাহর পূর্বোল্লিখিত বক্তব্যটি কাঙ্ক্ষিত আল্লাহওয়ালা হওয়ার পদ্ধতির ব্যাপারে প্রশান্তিদায়ক ও পরিপূর্ণ একটি বর্ণনা। এর মাধ্যমেই একজন মানুষ নিজের কার্যাবলীর ব্যাপারে পরিষ্কার সিদ্ধান্তের মধ্যে থাকতে পারবে, আল্লাহর ইচ্ছায় দাওয়াতের ভার বহনে সক্ষম হবে এবং নিজের ও উম্মতের জন্য উপকারী হতে পারবে।

এ যুগে আমরা অনেক মানুষের মুখে এই বাক্যটি খুব বেশি বেশি শুনি যে: “এখনো আমরা জানতেই পারিনি যে, হক কোথায় এবং কার সাথে!” এই দিশেহারা ভাব এবং সত্য-সঠিকের সন্ধান না পাওয়ার কারণ হকের অস্পষ্টতা বা প্রচ্ছন্নতা নয়। বরং এর কারণ হল, আমাদের অনেক মানুষের শিক্ষা গ্রহণের উৎস ও ভিত্তি সঠিক না থাকা।

আমরা দ্বীন ও দ্বীনের বিধি-বিধান আল্লাহর কিতাব এবং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করি না। কুরআন-সুন্নাহ বুঝার ক্ষেত্রে আমাদের মাপকাঠি সালাফে সালিহীন (পুণ্যবান পূর্বসূরিগণ) এবং আমাদের মাঝে বিদ্যমান সেই সকল আল্লাহওয়ালা আলেমগণ হয় না, যারা পুণ্যবান পূর্বসূরিদের বুঝ আঁকড়ে ধরেন, যারা ইলম শিখেছেন, তার উপর আমল করেছেন এবং যেভাবে শিখেছেন, সেভাবেই অন্যের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। তারা যখন এই ইলম ও তাবলীগের কারণে পরীক্ষার সম্মুখীন হন, তখন সবর ও ত্যাগ শিকার করেন।

বরং পরিতাপের বিষয়, আমাদের জ্ঞান আহরণের উৎস হয়ে গেছে টেলিভিশনের স্ক্রিন, বিভিন্ন চ্যানেল ও তার আলোচকরা। ইন্টারনেট পেইজ এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- যেমন: ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ইত্যাদি! অথচ সেখানে যে প্রকাশনা, চিত্র ও নামসমূহ দেখা যাচ্ছে, তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধর্মীয় ও আদর্শগত অবস্থা আমরা জানি না।

যে পূর্ব হতেই নিজের ভিত্তি তৈরি করে নিয়েছে, হক-বাতিল ও ভুল-সঠিকের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হয়ে গেছে, তার জন্য উল্লেখিত মিডিয়া উপকরণগুলো থেকে উপকৃত হতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এগুলোকেই জ্ঞান আহরণের উৎস ও ভিত্তি বানিয়ে ফেলাই বিভ্রান্তি ও বিকৃতি। আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের জ্ঞান আহরণের উৎসের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ  

“হে মুমিনগণ! (কোন বিষয়ে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের থেকে আগে বেড়ে যেও না। আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন।” (সূরা হুজরাত ৪৯:১)

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের থেকে আগে বেড়ে যেও না”-এর অর্থ হল, কিতাব-সুন্নাহ বিরোধী কথা বলো না।

আর শরয়ী বর্ণনাসমূহ বুঝার ভিত্তি বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:

فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ

“অতঃপর তারাও যদি সেরকম ঈমান আনে, যেমন তোমরা ঈমান এনেছ, তবে তারা সঠিক পথ পেয়ে যাবে। আর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা মূলত শত্রুতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে।” (সূরা বাকারাহ ২:১৩৭)

মহান পবিত্র আল্লাহ আরো বলেন:

وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا  

“আর যে ব্যক্তি তার সামনে হেদায়াত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে ও মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য কোন পথ অনুসরণ করবে, আমি তাকে সেই পথেই ছেড়ে দেব, যা সে অবলম্বন করেছে। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব, যা অতি মন্দ ঠিকানা।” (সূরা নিসা ৪:১১৫)

এ সকল আয়াত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে যে: হেদায়াত ও সঠিক পথ আছে কুরআন-সুন্নাহ বুঝার ক্ষেত্রে সালাফদের নীতি অনুসরণের মাঝে এবং এটা ছেড়ে তাদের পরবর্তী অন্যদের বুঝের দিকে না যাওয়ার মাঝে, চাই তারা যতই আবেদ (ইবাদতগোজার) ও যাহেদ (দুনিয়াবিমুখ) হোক।

ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন: “ইলম হল: আল্লাহ যা বলেছেন এবং তাঁর রাসূল বলেছেন এবং সাহাবীগণ যা বলেছেন”। তারাই গভীর বুঝের অধিকারী। কোন ইলম আজ আপনাকে নির্বুদ্ধিতাবশত রাসূলকে আর অমুক-তমুকের কথাকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে নিয়োজিত করেছে?!

এক্ষেত্রে মানুষ তিন শ্রেণীর:

এক. এমন আলেম, যিনি তার ইলম অনুযায়ী আমল করেন, দলিল-প্রমাণের সাথে আল্লাহর পথে আহবান করেন এবং আল্লাহর পথে আগত কষ্টে সবর করেন।

দুই. এমন তালিবুল ইলম (ইলম অন্বেষণকারী), যে সত্যের সন্ধান করে, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ ছাড়া কোন কিছুর পক্ষপাতিত্ব করে না।

তিন. অন্ধ অনুসরণকারী, অজ্ঞ। এদের মধ্যে যাকে আল্লাহ তাওফিক দান করেন, তাকে আল্লাহওয়ালা আলেমদের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন। আর যে বঞ্চিত হয়, সে জাহান্নামের দরজার আহ্বানকারীদের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদেরকে ও সমস্ত মুসলমানদেরকে এ থেকে আশ্রয় দান করুন।

এমনিভাবে আলী ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন:

“মানুষ তিন প্রকার:

১. আল্লাহওয়ালা আলেম।

২. মুক্তির পথে চলমান শিক্ষা অর্জনকারী।

৩. মূর্খ বর্বর- যে যেদিকে আহবান করে, সেদিকেই যায়। প্রত্যেক বাতাসের সাথে তাল মিলায়। ইলমের নূরে আলোকিত হয়নি। মজবুত খুঁটি আঁকড়ে ধরেনি।”

তাই হে মুসলিম মুজাহিদ ভাই,

আপনি আপনার জ্ঞান আহরণ ও তার উৎসের ক্ষেত্রে আল্লাহওয়ালা হোন। যদি এটা না হতে পারেন, তাহলে আল্লাহওয়ালা আমলদার আলেমদের অনুসরণ করুন। কিন্তু সেসকল পথভ্রষ্ট নামধারী আলেমদের অনুসারী হওয়া থেকে সাবধান! যারা নষ্ট করে, বিকৃত করে, কিন্তু তারা মনে করে, তারা সঠিক পথে আছে এবং সংশোধন করছে।

ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সিরীন রহিমাহুল্লাহ বলেন: “এই ইলমই হল দ্বীন, তাই খেয়াল কর - কার থেকে দ্বীন গ্রহণ করছো।”

আমাদের সর্বশেষ কথা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

 

 

পঞ্চম পর্ব: হিকমতের অধিকারী হোন

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল সাহাবীগণের উপর।

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ  

“তিনি যাকে চান হিকমাহ (জ্ঞানবত্তা) দান করেন। আর যাকে হিকমাহ দান করা হল, তার বিপুল পরিমাণে কল্যাণ লাভ হল। উপদেশ তো কেবল তারাই গ্রহণ করে, যারা বুদ্ধির অধিকারী।” (সূরা বাকারাহ ২:২৬৯)

আবু ইসমাইল আল হারাবি রহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘হিকমাহ’ হল কোন বস্তুকে তার উপযুক্ত স্থানে সুদৃঢ়ভাবে রাখা।

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন: হিকমাহ হল - যা করা উচিত, যেভাবে করা উচিত এবং যে সময় করা উচিত, তা সেভাবে সেসময় করা।

ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন: হিকমাহ এমন ইলম, যা বিধি-বিধান সংবলিত, মহান আল্লাহর পরিচয় দানকারী, দৃষ্টির গভীরতা ও মনের সভ্যতা আনয়নকারী, সত্যকে সত্যে পরিণতকারী এবং তার উপর আমল বাস্তবায়নকারী এবং কুপ্রবৃত্তি ও ভ্রান্তির অনুসরণ করতে বাধাদানকারী। আর হাকিম হল, যার মাঝে এ বিষয়গুলো থাকে।

আমরা হিকমাহ এর এই সংজ্ঞাগুলো থেকে এই সারকথা বের করতে পারি যে, এটা হল কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক জ্ঞানের পূর্ণাঙ্গতা, যার ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রত্যেক বিষয়কে তার উপযুক্ত স্থানে রাখতে পারে এবং তার সামনে আগত সকল ঘটনাবলী ও সমস্যাবলী সঠিকভাবে সমাধান করতে পারে।

আর হাকিম হল, যার মাঝে এ বিষয়গুলোর সমন্বয় ঘটে। এটা অর্জিত হবে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা এবং তাঁর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নার মাঝে হক অনুসন্ধানের মাধ্যমে। তারপর মন্দের প্রতি প্ররোচনা দানকারী প্রবৃত্তির স্বার্থ পরিত্যাগ করতে হবে এবং তার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে হবে। হকের ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করা যাবে না।

এমন ব্যক্তিকেই আল্লাহ হিকমাহ দান করেন। তখন সে কোন চিন্তা করলে সেটা হয় উত্তম চিন্তা। কোন কথা বললে সেটা হয় উত্তম কথা এবং কোন আমল করলে সেটা হয় উত্তম আমল।

আপনি যখন প্রথম প্রজন্ম, তথা সাহাবা, তাবিয়ীন, তাবে তাবিয়ীন ও তাদের পরবর্তী পুণ্যবান পূর্বসূরিদের (আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করুন!) ব্যাপারে চিন্তা করবেন, তখন দেখতে পাবেন, তারা হিকমাহর এই মহান মর্মটি অর্জন করেছিলেন। যার ফলে তাদেরই একজন অপরজনের ব্যাপারে একথাও বলেছেন যে: “যদি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কোন নবী হত, তবে অমুক হত।” এটা ইমাম হাসান আল বাসরী রহিমাহুল্লাহর ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছিল।

মূর্খ দার্শনিকদের একটি বিস্ময়কর মূর্খতা হল, তারা কতিপয় কাফের ও নাস্তিককে হাকিম বা প্রজ্ঞাশীল বলে অভিহিত করে। তারা আমাদের ইমামগণ ও পুণ্যবান পূর্বসূরিদের হিকমাহ দেখেনি। যে তাদের হিকমাহর ঝর্ণাধারা থেকে পান করেছে এবং তাদের জ্ঞানের নদী থেকে অঞ্জলি ভরেছে, সেই হিকমত লাভ করতে পেরেছে।

আমাদের এ সময় নানামুখী ফেতনার তরঙ্গ এবং ভালো-মন্দ মিশ্রিত হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে হিকমাহ (প্রজ্ঞা) ও হাকিমদের (প্রজ্ঞাবানদের) খুব প্রয়োজন। যারা বিশুদ্ধ ইলমের নূরে আলোকিত হবেন এবং প্রতিটি বস্তুকে যথাযথ স্থানে রাখবেন। ফলে কঠোরতার জায়গায় নমনীয় হবেন না, নমনীয়তার জায়গায় কঠোর হবেন না। নীরবতার জায়গায় কথা বলবেন না এবং কথা বলার স্থানে নীরব থাকবেন না। তিনি বুঝবেন, উপযুক্ত সময়ে ও উপযুক্ত স্থানে তাদের কী উপযুক্ত ভূমিকা থাকা উচিত।

কারণ হিকমাহবঞ্চিত লোকের দ্বারা অনুপযুক্ত স্থানে কঠোরতা তার উপর এবং তার আশপাশের সকলের উপর মারাত্মক বিপর্যয় টেনে আনবে। এমনভাবে হিকমাহবঞ্চিত লোকের দ্বারা অনুপযুক্ত স্থানে কোমলতাও হতভাগা ব্যক্তিদেরকে তার উপর ও তার আশপাশের সকলের উপর দু:সাহসী করে তুলবে। প্রজ্ঞাবান হল, যে প্রতিটি স্থানে সঠিক আচরণ করতে তাওফিকপ্রাপ্ত হয়।

এ যুগে যাদের জন্য হিকমাহ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তারা হলেন, যারা বিকৃতিকারীদের বিকৃতিকে সংস্কারের জন্য কাজ করেন। অর্থাৎ মুমিন মুজাহিদগণ। যেমন কথিত আছে: “হিকমাহ হল মুমিনের হারিয়ে যাওয়া সম্পদ, সে যেখানেই ওটা পায়, সেখান থেকেই সর্বাগ্রে তা নিয়ে নেয়।”

এজন্য তাদের উচিত হিকমার আসল উৎস, তথা আল কুরআনুল কারীম, বিশুদ্ধ নববী সুন্নাহ এবং শরয়ী বর্ণনাসমূহ বুঝার ক্ষেত্রে পুণ্যবান পূর্বসূরিদের এবং তাদের সময়ে তাদের বাস্তবতায় সংঘটিত ঘটনাবলীতে তাদের কর্মপদ্ধতি থেকে হিকমাহ অনুসন্ধান করা এবং তা অর্জনের চেষ্টা করা। মুজাহিদগণেরও উচিত হিকমাহ অর্জনে চেষ্টার ত্রুটি না করা। যদিও তা এমন কারো থেকে হয়, যে এর যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তার মুখ থেকে তা বের করে দিয়েছেন। যেমন কথায় আছে: “পাগলদের মুখ থেকেও হিকমাহ গ্রহণ কর।”

মুজাহিদগণকে অবশ্যই বীরত্ব, ক্ষিপ্রতা ও উদ্যমতার অধিকারী হতে হবে। কিন্তু এই বীরত্ব, শক্তি ও ক্ষিপ্রতা হিকমত ছাড়া হলে তা কখনো নেতিবাচক ও বিরূপ ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপর বিপর্যয় নেমে আসবে। কখনো তাদেরকে বিকৃতি ও উল্টো পথে নিয়ে যাবে। অথবা বিভ্রান্তি ও ভুলের মধ্যে গোঁড়ামি সৃষ্টি করবে এবং অবশেষে তাদেরকে নিহত বা বন্দি বা বিতাড়িত হিসাবে ধ্বংস করে দিবে। এই ফলাফল অনুসন্ধানকারী ও গবেষকগণ দেখেছেন অতীত সম্প্রদায়ের মাঝে এমনটা হয়েছে আর এ যুগেও কেউ কেউ এই পদ্ধতিতে গোমরাহ হয়েছে।

আমি এটা বলি না যে, এরকম পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক ঘটনাগুলোর সকল লোকগণ পথভ্রষ্ট ও সত্যবিরোধী। বরং কখনো কখনো তাদের মাঝে পুণ্যবান সংস্কারকগণও ছিলেন। কিন্তু তারা তাদের কার্যাবলীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিকমাহ থেকে দূরে থেকেছেন। তবে আল্লাহ তাদের চেষ্টা ও পরিশ্রমের জন্য তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করবেন। যেমন কবি বলেছেন:

الرأي قبل شجاعة الشجعان هو أول وهي المحل الثاني

فإذا هما اجتمعا بنفس حرة بلغت من العلياء كل مكان

অনুবাদঃ “বাহাদুরের বাহাদুরিরও পূর্বে জ্ঞান। এটা প্রথম আর ওটা দ্বিতীয় পর্যায়ে। আর যখন কোন মর্যাদাবান ব্যক্তির মাঝে উভয়টার সমাবেশ ঘটবে, তখন সে সর্বস্থানে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যাবে।”

এর বিপরীতে যে বীরত্ব, শক্তি ও ক্ষিপ্রতা ছাড়া এবং আল্লাহর পথে কাজ, পরিশ্রম ও বিপদের ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া শুধু জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকেই যথেষ্ট মনে করে, তার প্রকৃত অবস্থা হল, সে কাপুরুষ; হিকমাহ ও জ্ঞানের দাবি করে নিজের কাপুরুষতা ও ভঙ্গুরতা আড়াল করছে।

যেমন কবি বলেন:

ير الجبناء أن العجز عقل و تلك خديعة الطبع اللئيم

وكل شجاعة في المرء تغني ولا مثل الشجاعة في الحكيم

অনুবাদঃ কাপুরুষরা মনে করে, অক্ষমতাই জ্ঞান। এটা হল হীন স্বভাবের ধোঁকা।

মানুষের যেকোনো বীরত্ব তাকে স্বয়ংসম্পন্ন করেহিকমতওয়ালার মাঝে বীরত্বের সমতুল্য কিছু নেই।”

রাসূলুল্লহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতের কতক লোককে তাদের মাঝে হিকমাহ থাকার কারণে প্রশংসা করেছেন এবং হিকমতকে ঈমান ও ফিকহের সাথে মিলিয়েছেন। আর তাদের গুণাবলীর মধ্যে কোমলতা ও নম্রতাও উল্লেখ করেছেন। যেমন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ مُحَمَّدٍ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَمْرٍو، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ أَتَاكُمْ أَهْلُ الْيَمَنِ هُمْ أَضْعَفُ قُلُوبًا وَأَرَقُّ أَفْئِدَةً الإِيمَانُ يَمَانٍ وَالْحِكْمَةُ يَمَانِيَةٌ ‏"‏ ‏.‏ وَفِي الْبَابِ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ وَأَبِي مَسْعُودٍ ‏.‏ وَهَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ ‏.‏

তোমাদের নিকট ইয়ামানবাসী এসেছে। তারা খুব নরম মন ও কোমল হৃদয়ের লোক। ঈমান ইয়ামান হতে এসেছে এবং প্রজ্ঞাও ইয়ামান হতে এসেছে”। (জামে আত-তিরমিজি৩৯৩৫)

অন্য বর্ণনায় এসেছে:

أتاكم أهلُ اليمنِ ، هم أَلْيَنُ قلوبًا ، و أَرَقُّ أفئدةً

“তোমাদের নিকট ইয়ামানবাসী এসেছে, তারা সর্বাধিক নরম অন্তর ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী।”

এই হাদিস শরীফ থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, হিকমাহকে ঈমান ও ফিকহের সাথে মিলানো হয়েছে। হিকমাহর অধিকারী মুমিন ফকীহ - কোমলতা ও নম্রতার দিকটিকে, কঠোরতা ও রুক্ষতার উপর প্রাধান্য দেয়। অনুপযুক্ত পাত্রে ও অনুপযুক্ত স্থানে কঠোরতা ও রুক্ষতাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদিসেরই অপর একটি বর্ণনায় নিন্দা করেছেন।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

حديث أَبي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: الْفَخْر وَالْخُيَلاءُ في الْفَدَّادينَ أَهْلِ الْوَبَرِ، وَالسَّكينَةُ في أَهْلِ الْغَنَمِ، وَالإِيمانُ يَمانٍ، وَالْحِكْمَةُ يَمانِيَةٌ

গর্ব ও অহমিকা রয়েছে - চিৎকার ও শোরগোলকারী বেদুঈনদের মধ্যে, স্বস্তি ও শান্তি - বকরী পালকদের মধ্যে, ঈমান ইয়ামানবাসীদের মধ্যে এবং হিকমাতও ইয়ামানবাসীদের মধ্যে বেশী রয়েছে”। (বুখারী পর্ব ৬১ : /১ হাঃ ৩৪৯৯, মুসলিম ১/২১ হাঃ ৫২)

তাই একজন মুমিন মুজাহিদ চেষ্টা করবে মানবসভ্যতার যাত্রাকে সঠিক ও সংশোধন করতে, তাদেরকে হেদায়েতের দিকে পথনির্দেশ করতে এবং তাদেরকে বান্দার দাসত্ব থেকে বের করে বান্দার রবের দাসত্বের দিকে নিয়ে যেতে। বিভিন্ন ধর্মের জুলুম থেকে ইসলামের ইনসাফের দিকে এবং দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিশালতার দিকে নিয়ে যেতে। সে হিকমাহর স্তরে পৌঁছতে চেষ্টা করবে। হিকমাহর অধিকারী পুণ্যবান মুমিন ফকীহগণের সাথে উঠাবসা করবে এবং এই উদ্দেশ্য অর্জনে একটুও অলসতা করবে না, যার ব্যাপারে মহান পবিত্র আল্লাহ বলেছেন:

يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ  

“তিনি যাকে চান হিকমাহ (জ্ঞানবত্তা) দান করেন। আর যাকে হিকমাহ দান করা হল, তার বিপুল পরিমাণে কল্যাণ লাভ হল। উপদেশ তো কেবল তারাই গ্রহণ করে, যারা বুদ্ধির অধিকারী।” (সূরা বাকারাহ ২:২৬৯)

কবি বলেছেন:

ولم أر في عيوب الناس شيئا   كنقص القادرين علي التمام

অনুবাদঃ পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম ব্যক্তি ত্রুটির মধ্যে পড়ে থাকার চেয়ে বড় দোষ আমি মানুষের মধ্যে দেখিনি।”

তাই হে মুজাহিদ ভাই,

হিকমাহ অর্জনের জন্য ব্যাকুল হোন। হয়ত আল্লাহ আপনাকে সেই সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করবেন, যাদের হাতে মানবসভ্যতার সংস্কার হবে। আর যত লোক আপনার হাতে হেদায়েতের অনুসারী হবে, প্রত্যেকের পুরস্কার আপনার জন্য লেখা হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم قَالَ مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا.

“যে ব্যক্তি কাউকে সৎ পথের দিকে আহ্বান করে, তার জন্য সেই পরিমাণ ছওয়াব রয়েছে, যা তার অনুসারীদের জন্য রয়েছে। অথচ এতে তাদের নিজস্ব ছওয়াবে কোনরূপ কমতি হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কাউকে পথভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করে, তার জন্যও ঠিক সেই পরিমাণ গোনাহ রয়েছে, যা তার অনুসারীদের জন্য রয়েছে। অথচ তাদের নিজস্ব গোনাহে কোনরূপ কমতি হবে না”। (মুসলিম, মিশকাত হা/১৫৮)।

আমাদের সর্বশেষ কথা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

 

ষষ্ঠ পর্ব: অনুরাগী হোন

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক রাসূলদের সর্দার, আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এবং তার পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের উপর।

অতঃপর:

আমাদের জাতি আজ যে ফেতনা ও বিভক্তির মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করছে এবং সঠিক পথ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মুসলিমগণ যে অস্থিরতায় মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা এই হাদিসে কুদসিরই বাস্তব নমুনা। এটি ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ আবু যর রাযিয়াল্লাহু তাআআলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন: নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

عَنْ أَبِي ذَرٍّ الْغِفَارِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه و سلم فِيمَا يَرْوِيهِ عَنْ رَبِّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى، أَنَّهُ قَالَ: "يَا عِبَادِي: إنِّي حَرَّمْت الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي، وَجَعَلْته بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا؛ فَلَا تَظَالَمُوا. يَا عِبَادِي! كُلُّكُمْ ضَالٌّ إلَّا مَنْ هَدَيْته، فَاسْتَهْدُونِي أَهْدِكُمْ

“আল্লাহ্ বলেছেন:"হে আমার বান্দাগণ! আমি জুলুমকে আমার জন্য হারাম করে দিয়েছি, আর তা তোমাদের মধ্যেও হারাম করে দিয়েছি; অতএব তোমরা একে অপরের উপর জুলুম করো না।

হে আমার বান্দাগণ! আমি যাকে হেদায়েত দিয়েছি সে ছাড়া তোমরা সকলেই পথভ্রষ্ট। সুতরাং আমার কাছে হেদায়েত চাও, আমি তোমাদের হেদায়েত দান করব”। (সহীহ মুসলিম – ২৫৭৭)

তাই এই সংশয়ের যুগে, পথভ্রষ্টতা ও প্রবৃত্তিপূজার আধিক্যের যুগে - আমাদের জন্য হেদায়েত অন্বেষণের বিভিন্ন উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা প্রয়োজন। তন্মধ্যে একটি উপায় হল - ইনাবাত তথা অনুরাগ বা মনোযোগ।

আল্লামা জুরজানির সংজ্ঞামতে ইনাবাত হল, অন্তরকে সংশয়ের আঁধার থেকে মুক্ত করা।

কেউ বলেন: ইনাবাত হল, সবকিছু থেকে ফিরে সবকিছুর মালিকের দিকে ধাবিত হওয়া।

কেউ বলেন: ইনাবাত হল, উদাসীনতা থেকে স্মরণের দিকে এবং অপরিচিত ভাব থেকে ঘনিষ্ঠতার দিকে ফেরা।

আন নিহায়াহ গ্রন্থে এসেছে: ইনাবাত হল, তওবার মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফেরা।

বলা হয় - সে প্রত্যাবর্তন করেছে, সে প্রত্যাবর্তন করে, প্রত্যাবর্তন করণ, সুতরাং সে একজন প্রত্যাবর্তনকারী- যখন কেউ আগমন করে ও প্রত্যাবর্তন করে।

 

ইনাবাতের মধ্যেই হেদায়েত:

আল্লাহর কিতাব থেকে এর দলিল হল, আল্লাহর বাণী-

اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ  

“আল্লাহ যাকে চান বেছে নিয়ে নিজের দিকে টানেন। আর যে কেউ তাঁর অনুরাগী হয়, তাকে হেদায়েত দান করেন।” (সূরা আশ-শূরা 42:১৩)

সুতরাং যখন মানুষ আল্লাহর অনুরাগী হয় এবং তার স্বাভাবিক নীতি হয়ে যায় আল্লাহর প্রতি অনুরাগ ও তার দিকে ফেরা, তখন এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে সত্যের দিকে পথনির্দেশ করার এবং সে যে অস্থিরতার মধ্যে ছিল তা থেকে উত্তরণের একটি উপলক্ষ বা কারণ হয়।

ইবনে কাসির রহিমাহুল্লাহ বলেন: “আল্লাহ যাকে চান বেছে নিয়ে নিজের দিকে টানেন। আর যে কেউ তাঁর অনুরাগী হয়, তাকে হেদায়েত দান করেন।”- অর্থাৎ তিনিই হেদায়েতের উপযুক্ত ব্যক্তির জন্য হেদায়েত নির্ধারণ করেন আর যে সঠিক পথের উপর পথভ্রষ্টতাকে প্রাধান্য দেয়, তার জন্য পথভ্রষ্টতা লিখে দেন। একারণেই তিনি বলেছেন:

وَمَا تَفَرَّقُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ

“আর তারা যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, তা করেছে তাদের কাছে নিশ্চিত জ্ঞান আসার পরই।” (সূরা আশ-শূরা 42:১৪)

অর্থাৎ তারা তাদের নিকট হক পৌঁছে যাওয়া এবং তার ব্যাপারে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরও হকের বিরোধিতা করেছে। একমাত্র অবাধ্যতা, অহংকার ও কষ্টই তাদেরকে এতে প্ররোচিত করেছিল।

ইবনে কাসির রহিমাহুল্লাহর কথা থেকে আমাদের নিকট প্রতিভাত হয় যে, মানুষ যখন অনুরাগী হতে চায় এবং অনুরাগী হয়ে যায়, তখন আল্লাহ তা’আলা তাকে হেদায়েত দান করেন।

সা’দী রহিমাহুল্লাহ বলেন:

“আর যে কেউ তাঁর অনুরাগী হয়, তাকে হেদায়েত দান করেন”-এই যে কারণটা, যেটার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর হেদায়েত লাভ করে, তা হল নিজ রবের প্রতি অনুরাগ তৈরি হওয়া ও মনোযোগ সেদিকে দেয়া। অন্তরের উদ্দীপনাগুলো তখন সেদিকেই আকৃষ্ট হয়। সুতরাং বান্দার পক্ষ থেকে হেদায়েত অনুসন্ধানের পরিশ্রমসহ যেকোন ভালো ইচ্ছাই আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়েত সহজ করে দেওয়ার একটি উপলক্ষ বা কারণ। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَامِ

“এর মাধ্যমে আল্লাহ যারা তাঁর সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করে, তাদেরকে শান্তির পথ দেখান।” (সূরা মায়িদা ৫:১৬)”

(সা’দী রহিমাহুল্লাহর বক্তব্যটি শেষ হল।)

এমনভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরো বলেন:

قُلْ إِنَّ اللَّهَ يُضِلُّ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ أَنَابَ

“বলে দাও, আল্লাহ যাকে চান পথভ্রষ্ট করেন। আর তিনি তাঁর পথে কেবল তাদেরকেই হেদায়েত (দিশা) দান করেন, যারা তার অনুরাগী হয়।” (সূরা আর-রা’দ ১৩:২৭)

তাই যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে ফিরে, পূর্বকৃত সকল গুনাহ থেকে তওবা করার মাধ্যমে সর্বদা আল্লাহর প্রতি অনুরাগী থাকে, আল্লাহর হুকুমে এটাই তার হেদায়েতের কারণ হয়। সেই অস্থিরতা থেকে নিষ্কৃতি লাভের কারণ হয়, যা আজ গোটা ইসলামী বিশ্বকে ছেয়ে ফেলেছে। কেবল যাদের উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা রহম করেছেন, তারা ব্যতীত।

ইবনে কাসির রহিমাহুল্লাহ বলেন: “বলে দাও, আল্লাহ যাকে চান পথভ্রষ্ট করেন। আর তিনি তাঁর পথে কেবল তাদেরকেই হেদায়েত (দিশা) দান করেন, যারা তাঁর অনুরাগী হয়”- অর্থাৎ যে আল্লাহর প্রতি মনোযোগী হয়, তার দিকে ফিরে, তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে এবং অনুনয়-বিনয় করে।

ইমাম বাগাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন: এই মনোযোগের কারণে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তার দিকে পথপ্রদর্শন করেন। কেউ এভাবে ব্যাখ্যা করেন: যে অন্তর দিয়ে তার দিকে ফিরে, তিনি তাকে নিজ দ্বীনের পথ দেখান।

সুতরাং এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, ইনাবাত বা অনুরাগ হেদায়েত লাভের একটি মাধ্যম এবং কারণ।

এমনভাবে আল্লাহর আয়াতসমূহ স্মরণ করাও হেদায়েত লাভের একটি মাধ্যম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আয়াতসমূহ স্মরণ করার কারণসমূহ থেকে একটি কারণ হল - আল্লাহর দিকে অনুরাগী হওয়ার পর তার আয়াতসমূহ দ্বারা যেন সত্যকে বুঝা এবং জানা যায়। আল্লাহর এই বাণীই তা প্রমাণ করে-

وَمَا يَتَذَكَّرُ إِلَّا مَنْ يُنِيبُ

“উপদেশ তো সেই গ্রহণ করে, যে (আল্লাহর প্রতি) অনুরাগী হয়।” (সূরা মু’মিন ২৩:১৩)

ইবনে আতিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন: আল্লাহর বাণী- “উপদেশ তো সেই গ্রহণ করে, যে (আল্লাহর প্রতি) অনুরাগী হয়”- এর অর্থ হল, এমনভাবে গ্রহণ করা, যা গ্রহণযোগ্য এবং যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে উপকৃত করে। কারণ আমরা দেখি, অমনোযোগীও উপদেশ গ্রহণ করে। কিন্তু যেহেতু সেটা উপকারী নয়, একারণে সেটাকে ‘উপদেশ গ্রহণ করা হয়নি’ বলে গণ্য করা হয়েছে।

আল্লাহর কিতাবে আমাদেরকে অনুরাগীদের পথ অনুসরণ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কারণ তারাই অন্যান্য মানুষের তুলনায় হেদায়েতের অধিক নিকটবর্তী। তাই অনুরাগীদের পথ অনুসরণ করার দ্বারা আমরাও সত্যের দিশা, তথা হেদায়েত পেতে পারব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ

“এবং সেই ব্যক্তির পথ অনুসরণ কর, যে আমার অভিমুখী হয়েছে।” (সূরা লোকমান ৩১׃১৫)

ইমাম সা’দী রহিমাহুল্লাহ বলেন: “এবং সেই ব্যক্তির পথ অনুসরণ কর, যে আমার অভিমুখী হয়েছে”- তারা হল, যারা আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাসী, তাদের রবের কাছে আত্মসমর্পণকারী এবং তাঁর অনুরাগী। তাদের পথের অনুসরণ করার অর্থ হল, আল্লাহর প্রতি মনোযোগী হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের নীতি অনুসরণ করা অর্থাৎ অন্তরের উদ্দীপনা ও ইচ্ছাগুলো আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হওয়ার পর সেই কাজের জন্য শারীরিক চেষ্টা-প্রচেষ্টা করা, যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এবং তাঁর নিকটবর্তী করে দেয়।

সুতরাং আমরা আল্লাহর অনুরাগী হওয়ার মাধ্যমে হেদায়েতের পথ জানতে পারব। এই আদর্শের উপরই ছিলেন জাতির পিতা ইবরাহীম খলিলুল্লাহ আলাইহিস সালাম। যেমন আল্লাহ তা’আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَحَلِيمٌ أَوَّاهٌ مُنِيبٌ

“নিশ্চয়ই ইবরাহীম অত্যন্ত সহনশীল, (আল্লাহর স্মরণে)অত্যধিক উহ্-আহ্কারী (এবং সর্বদা আমার প্রতি)অনুরাগী ছিল।” (সূরা হুদ ১১:৭৫)

একারণেই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম জাতির নেতা ছিলেন এবং সৃষ্টিজীবের হেদায়েতের মাধ্যম ছিলেন।

আমাদেরকে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আদর্শ অনুসরণ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম একটি জাতি ছিলেন, যেমনটা আল্লাহ তা’আলা উল্লেখ করেছেন। জাতির নেতা ও নবীদের বাবা ইবরাহীম আলাইহি সালাম অনুরাগী-মনোযোগীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। একারণেই তিনি আল্লাহর হুকুমে হেদায়াতপ্রাপ্তদের প্রধান হয়েছেন।

মহান আরশের অধিপতি মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে অনুরাগীদের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তার সরল-সঠিক পথের হেদায়েত (দিশা) দেন। নিশ্চয়ই তিনি এ কাজে সক্ষম এবং দু’আ কবুলকারী।

আমাদের সর্বশেষ কথা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

 

 

সপ্তম পর্ব: ইনসাফকারী হোন

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁরই প্রশংসা করছি এবং তাঁর সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি আমাদের অন্তরের অনিষ্ট হতে এবং আমাদের মন্দ কর্ম হতে। আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করেন, তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তাকে পথপ্রদর্শনকারী কেউ নেই।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক। তার কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। তিনি বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। আমানত আদায় করে দিয়েছেন। আল্লাহ তার মাধ্যমে আমাদের দুশ্চিন্তার অবসান করেছেন।

তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে এমন এক দ্বীনের উপর রেখে গেছেন, যার রাতগুলো দিবসের মত। একমাত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যক্তিই তার থেকে বিচ্যুত হতে পারে। তিনি আমৃত্যু আল্লাহর পথে যথাযথভাবে জিহাদ করেছেন। তাই আল্লাহ তাকে আমাদের পক্ষ থেকে সেই সর্বোত্তম প্রতিদান দিন, যা তিনি একজন নবীকে তার উম্মতের পক্ষ থেকে দিয়ে থাকেন।

আম্মাবাদ..

বর্তমান যুগ - যে যুগে দ্বীনের কর্মী, উলামা, তালিবুল ইলম এবং মুজাহিদিনদের মাঝে অনেক মতবিরোধ দেখা দিয়েছে, এ যুগে আমাদের ইনসাফের খুব বেশি প্রয়োজন। বিশেষ করে তার সাথে - যার পুণ্যের পরিমাণ বেশি আর মন্দের পরিমাণ কম।

দ্বীনের কর্মীদের ভুল-ত্রুটির কারণে যেন আমরা তাদেরকে ফেলে না দেই। তাদের সঙ্গে বে-ইনসাফী না করি এবং তাদেরকে তাদের হক থেকে বঞ্চিত না করি। কারণ এটা সেই ন্যায়পরায়ণতা, যার প্রতি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে উৎসাহিত করেছেন।

অভিধানে ইনসাফ অর্থ হল (‘লিসানুল আরব’এর সংজ্ঞার সারকথা): অন্যকে নিজের থেকে অর্ধেক প্রদান করা। অর্থাৎ আপনি যে অধিকার ভোগ করেন, তা অন্যকেও প্রদান করা। এবং বলা হয়- আমি অমুকের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পেয়েছি, অর্থাৎ আমি আমার হক পরিপূর্ণ আদায় গ্রহণ করেছি। এমনকি আমি ও সে অর্ধেকের ক্ষেত্রে বরাবর হয়েছি।

মুহাম্মদ কিলআজী তার “মু’জামু লুগাতিল ফুকাহা” নামক অভিধানে বলেন: ইনসাফ হল তা, যা জুলুমের বিপরীত।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর মহান কিতাবে ইনসাফের প্রতি উৎসাহ প্রদান এবং জুলুম থেকে সতর্ক করে কতিপয় আয়াত উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন -

وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ

“আর মানুষকে তাদের জিনিস-পত্র কম দিও না।” (সূরা আল-আ’রাফ ৭:৮৫)

তিনি আরো বলেন:

وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا

“এবং যখন কথা বলবে, তখন ন্যায্য কথা বলবে।” (সূরা আল-আনআম ৬:১৫২)

ইবনে কাসির রহিমাহুল্লাহ বলেন: আল্লাহ তা’আলা কথা ও কাজে আপন-পর সকলের সাথে ইনসাফ বা ন্যায়নীতি অবলম্বন করতে আদেশ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেকের জন্য, প্রত্যেক সময় ও প্রত্যেক অবস্থায় ন্যায়নীতি অবলম্বন করতে আদেশ করেছেন।

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন।” (সূরা আন-নাহল ১৬:৯০)

ইবনে উয়াইনাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন: আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আল্লাহর এই বাণী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল: إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ । তিনি বললেন: আয়াতে উল্লেখিত ‘আদল’ অর্থ হল ‘ইনসাফ বা ন্যায়নীতি’। ‘ইহসান’ অর্থ হল অনুগ্রহ। ইবনে উয়াইনাহ এটা তার ‘উয়ুনুল আখইয়ার’ এ উল্লেখ করেছেন।

এছাড়াও আরো অনেক আয়াত রয়েছে, যা ইনসাফের প্রতি উৎসাহিত করে এবং জুলুম থেকে সতর্ক করে। ইনসাফের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল: নিজের থেকে মানুষকে ন্যায়বিচার করা। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ

“হে মুমিনগণ! তোমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে যাও আল্লাহর সাক্ষীরূপে, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে কিংবা পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।” (সূরা আন-নিসা ৪:১৩৫)

ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ তার সহীহে আম্মার ইবনে ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মুআল্লাক সনদে দৃঢ়তার শব্দ ব্যবহার করে উল্লেখ করেন: আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: যে ব্যক্তি তিনটি জিনিস নিজের মাঝে একত্রিত করল, সে ঈমানকে একত্রিত করল: “নিজ থেকে ন্যায়বিচার করা, পৃথিবীকে শান্তি উপহার দেওয়া এবং সংকটের মাঝেও আল্লাহর পথে খরচ করা।”

যেটা পূর্বে বলেছি যে - বিশেষভাবে দ্বীনের কর্মী, আলেমদের এবং যাদের পুণ্যের পাল্লা ভারি - তাদের ভুলের ক্ষেত্রে ইনসাফ করা। এ বিষয়টি পূর্বেও ছিল, এখনো আছে। আহলুস-সুন্নাহ ওয়ালা জামাত নিজ প্রতিপক্ষদের ব্যাপারে সর্বাধিক ইনসাফ করেন। এ ব্যাপারেই শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহিমাহুল্লাহ তার “দারউ তাআরুযিল আকল ওয়ান নাকল” পুস্তিকায় প্রথমে এমন এক দল আলেমের কথা উল্লেখ করেন, যাদের বিভিন্ন বিদআতি ও হক-পরিপন্থী মতামত ছিল, তারপর বলেন:

“কিন্তু এদের প্রত্যেকেরই ইসলামে যথেষ্ট অবদান এবং বহু স্বীকৃত নেক আমল ছিল। অনেক নাস্তিক ও বিদআতিদের যুক্তি খণ্ডনে এবং অনেক আহলুস সুন্নাহর অনুসারীদের সাহায্যকরণে এই ব্যক্তিদের এমন এমন অবদান আছে - যা সকলের নিকট স্পষ্ট। যারা এদের প্রকৃত অবস্থা জানেন, তারা এদের ব্যাপারে সঠিক তথ্য, সততা, ন্যায় ও ইনসাফের সাথে আলোচনা করেছেন।

কিন্তু যখন তাদের নিকট এই সর্বজন গৃহীত মূলনীতিটি সংশয়পূর্ণ হয়ে গেল, যেটা শুরু হয়েছিল মু’তাযিলাদের থেকে (অথচ তারা ছিল জ্ঞানী-গুণী), তখন তাদের প্রয়োজন হল এটা প্রতিহত করার এবং তার অনিবার্য ফলাফলগুলো মেনে নেওয়ার। এর কারণেই তাদের জন্য এমন অনেক কথা বলা আবশ্যক হয়ে পড়ল - যা মুসলমান, উলামা ও দ্বীনদারগণ প্রত্যাখ্যান করেন। এ কারণে মানুষের মধ্যে কেউ তাদের গুণাবলী ও ভালো কাজগুলোর কারণে তাদেরকে মর্যাদা দিতে লাগল। আর কেউ তাদের কথার মধ্যে বিভিন্ন বিদআত ও ভ্রান্তি থাকার কারণে তাদের নিন্দা করতে লাগল। কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল মধ্যমপন্থা”।

এটা শুধু এদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং অন্যান্য অনেক আলেম ও দ্বীনদারের মাঝেও এটা ঘটেছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সকল মুমিন বান্দাদের ভালো কাজগুলো গ্রহণ করবেন আর মন্দগুলো ক্ষমা করবেন।

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের সেই ভাইদেরকেও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি কোন হিংসা-বিদ্বেষ রেখ না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি অতি মমতাবান, পরম দয়ালু।” (সূরা আল-হাশর ৫৯:১০)

কোন সন্দেহ নেই - যে রাসূলের দিক থেকে আগত ইলমের মাধ্যমে সত্য ও দ্বীন অন্বেষণ করার জন্য পরিশ্রম করবে, আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল করবে, আল্লাহ তার ভুলগুলো ক্ষমা করবেন। সেই দু’আর প্রতিফলন স্বরূপ, যা তিনি তার নবী ও মুমিনদের জন্য কবুল করেছেন। তিনি বলেছেন:

رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দ্বারা যদি কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়, তবে সেজন্য তুমি আমাদের পাকড়াও করো না।” (সূরা বাকারাহ ২:২৮৬)

বে-ইনসাফীর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। যেমন হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা বা পক্ষপাতিত্ব, অজ্ঞতা, অন্ধ অনুসরণ, প্রবৃত্তি, সমশ্রেণীর প্রতি হিংসা।

বে-ইনসাফী থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে কয়েকটি উপায়ে। তন্মধ্যে কয়েকটি হল: আল্লাহর ভয়, মুসলমানের সম্মানের ব্যাপারে সতর্কতা এবং এ বিষয়টির ভয়াবহতা অনুধাবন করা। এমনভাবে সংশ্লিষ্ট মাসআলা ও তার প্রবক্তার ব্যাপারে সূক্ষ্মভাবে যাচাই করা, চাই মতটি যা ই হোক না কেন।

অর্থাৎ তিনি সেটা বলেছেন কি না, বা বলে থাকলে কী বলেছেন। যদি বলে থাকেন, তাহলে কোন দিক থেকে বলেছেন। হতে পারে তিনি ভুল ব্যাখ্যা করেছেন অথবা অজ্ঞ ছিলেন, তখন তাকে শিক্ষা দান করতে হবে। অবশ্যই মুসলমানদের মাঝে কল্যাণকামিতার চেতনার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। তাই আমি কারো প্রতি উপদেশ পেশ করার পূর্ব পর্যন্ত তার ব্যাপারে কোন হুকুম আরোপ করব না। যখন তার সামনে উপদেশ পেশ করা হবে এবং তার থেকে বিমুখতা দেখা যাবে, সেই সময় অবশ্যই সত্যকে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করতে হবে।

আরেকটি উপায় হল - কোন পক্ষপাতিত্ব না করে শুধুমাত্র হকের পক্ষে থাকা। চাই সেটা আমাদের দল, আমাদের আদর্শ এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী হোক। মূলকথা হল - একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, আমাদেরকে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হতে হবে। আমরা আমাদের জীবনে যা কিছু বলি এবং যা কিছু করি, তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। আমরা যদি ইনসাফ না করি, তাহলে এটা আমাদের প্রতি আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধের কারণ হতে পারে। এ জাতীয় উপায়গুলো আমাদেরকে বে-ইনসাফী থেকে রক্ষা করতে পারে।

আমাদেরকে জুলুম থেকে পরিপূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ তার সহীহে আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

عَنْ أَبِي ذَرٍّ الْغِفَارِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه و سلم فِيمَا يَرْوِيهِ عَنْ رَبِّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى، أَنَّهُ قَالَ: "يَا عِبَادِي: إنِّي حَرَّمْت الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي، وَجَعَلْته بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا؛ فَلَا تَظَالَمُوا

“আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে আমার বান্দাগণ! আমি আমার নিজের উপর জুলুমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের পরস্পরের মাঝেও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা একে অপরের প্রতি জুলুম করো না।” (সহীহ মুসলিম – ২৫৭৭)

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, সহীহুল মুসলিমে হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللّهِ ﷺ: «اتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَاتَّقُوا الشُّحَّ فَإِنَّ الشُّحَّ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ: حَمَلَهُمْ عَلى أَنْ سَفَكُوا دِمَاءَهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ». رَوَاهُ مُسْلِمٌ

 “তোমরা জুলুম থেকে সতর্কভাবে বেঁচে থাক। কারণ জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে। আর কৃপণতা হতে বেঁচে থাকবে, কারণ কৃপণতা তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছে। এ কৃপণতাই তাদেরকে প্ররোচিত করেছে রক্তপাতের জন্য এবং হারাম কাজকে হালাল করার দিকে”। (মুসলিম - ২৫৭৮)

মহান আরশের অধিপতি মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে জুলুম থেকে রক্ষা করেন। আমাদেরকে সৃষ্টির সকল জীবের সাথে, এমনকি আমাদের বিরোধীদের সাথেও ইনসাফ করার তাওফিক দান করেন। কিয়ামতের দিন আমাদের ঘাড়ে কোন জুলুমের অভিযোগ বাকি না রাখেন, বিশেষত: মুসলমানদের বিরুদ্ধে জুলুমের অভিযোগ।

মহান আরশের অধিপতি মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদের প্রতি তার দয়া বর্ষণ করেন। আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদার ভাইদেরকে ক্ষমা করেন এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের ব্যাপারে কোন হিংসা-বিদ্বেষ অবশিষ্ট না রাখেন। নিশ্চয়ই তিনি পরম মহানুভব, অসীম দয়ালু।

আমাদের সর্বশেষ কথা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

 

**********


مع تحيّات إخوانكم
في مؤسسة الحكمة للإنتاج الإعلامي
قاعدة الجهاد في شبه القارة الهندية (بنغلاديش)
আপনাদের দোয়ায়
আল হিকমাহ মিডিয়ার ভাইদের স্মরণ রাখবেন!
আল কায়েদা উপমহাদেশ (বাংলাদেশ শাখা)
In your dua remember your brothers of
Al Hikmah Media
Al-Qaidah in the Subcontinent [Bangladesh]