আত-তাওকিদ – শায়খ সুলাইমান আল উলওয়ান
তাওহিদ ও তাওহিদের সঠিক দাওয়াত নিয়ে শায়খ আল-আল্লামা সুলাইমান বিন নাসির আল-উলওয়ানের অনবদ্য একটি রচনা হল আত-তাওকিদ। সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর অর্থবোধক এ লেখাটি ইন শা আল্লাহ সকল মনযোগী পাঠকের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে।
إِنَّ الْحَمْدَ لِلَّهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا مَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلاَ هَادِىَ لَهُ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
বাদ হামদ ও সালাত।
তাওহিদ হচ্ছে বান্দার উপর আল্লাহর অধিকার। একারণেই তাকে সামর্থ্য প্রদান করা হয়েছে। সময়ের উত্তম অংশ এজন্যেই দেওয়া হয়েছে। এটাই একজন মুসলিমের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। আর তাওহিদ না জানা এবং ত্যাগ করা তার জন্যে দুর্ভাগ্য। আল্লাহ তায়ালা যে তাওহিদ বান্দাহের জন্যে আবশ্যক করেছেন, প্রত্যেক বান্দার এ সম্পর্কে জানাশোনা আবশ্যক। এমনিভাবে তাওহিদের বিপরীত বিষয়াবলিও জানা আবশ্যক। নতুবা মানুষ নিজের অজ্ঞাতসারেই শিরকে লিপ্ত হবে।
অনেক বিষয় তার বিপরীত বিষয় দ্বারা চেনা যায়, ভালোর বিপরীতটাই ভালোকে প্রকাশ করে।
যে শিরককে চিনবে না, অবশ্যই সে শিরকে পতিত হবে। যেমন অনেক দেশেই এমন বহু লোক আছে, যারা নিজেদেরকে ইসলামের অনুসারী দাবি করে অথচ কবরের চতুর্পাশে তাওয়াফ করে, কবরবাসির জন্যে নযর-নেয়ায নিয়ে যায়, এদের জন্যে মান্নত করে, এদের জন্যে পশু কুরবানি করে, এদের কাছে সাহায্য চায়, এদের কাছে আশ্রয় চায়, বিভিন্ন বিপদ আপদ থেকে মুক্তির জন্যে, রোগ-ব্যধি থেকে মুক্তির জন্যে এবং হতাশা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এদের কাছে প্রার্থনা করে (নাউযুবিল্লাহ)। এতকিছুর পরও সে নিজেকে ইসলামের অনুসারী দাবি করে। এত অজ্ঞতা, পথভ্রষ্টতা এবং দ্বীন সম্পর্কে বিমুখতা সত্ত্বেও সে নিজেকে ইসলামের ধারক-বাহক ও সাহায্যকারী দাবি করে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহই আমাদের জন্যে যথেষ্ট ও উত্তম অভিভাবক।
অবস্থা যখন এমন― যার বিবরণ ও আলোচনা আমরা করলাম, তখন আমাদের জন্য আবশ্যক হলো এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধিক সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা। অনেক মানুষ আছে যারা এত্থেকে গাফেল ও বিমুখ। তাই আমাদের উচিৎ, তাওহিদের প্রচার ও এর বাণী সঠিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া, যেমনিভাবে নাবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উম্মতের মধ্যে বিশেষভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ, তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত আর তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ তথা এটা বিশ্বাস ও স্বীকার করা যে, আল্লাহই হচ্ছেন খালিক (স্রষ্টা), রাযিক (রিযিকদাতা), মূল নিয়ন্ত্রক― এগুলোতো মক্কার কাফিররাও স্বীকার করতো। অথচ তাদের শিরক ছিলো কী ভয়াবহ! আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ﴾
আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। বলুন, সকল প্রশংসা আল্লাহরই। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জ্ঞান রাখে না। (সুরা লুকমান: ২৫)
অথচ এই যুগে এমনও লোক পাওয়া যায় যারা ওই যুগের মুশরিকদের স্বীকার করা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহও স্বীকার করে না। কিন্তু যে তাওহিদ সহকারে রাসুলগণ প্রেরিত হয়েছেন, তা হলো তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ, অর্থাৎ প্রতিটি ইবাদাতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক মানা। অবশ্য এর ভেতরেই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ ও তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
অধ্যায় : ০১
তাওহিদের এত মর্যাদার কারণেই নাবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে এত গুরুত্ব দিয়ছেন। মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায়ও তিনি তাওহিদের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন,
لَعَنَ اللَّهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ
ইহুদি-খৃস্টানদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক, তারা তাদের নাবিদের কবরসমূহকে সিজদার জায়গা বানিয়ে নিয়েছে।
নাবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে, যদি আমরা তাদের মতো করি তাহলে আমাদের উপরও তাদের মতো অভিশাপ বর্ষিত হবে, যেভাবে তাদের উপর বর্ষিত হয়েছে, কেননা কবরকে সিজদার জায়গা বানানো মারাত্মক পর্যায়ের শিরক।
যখন নাবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কষ্ট বেড়ে গেলো তখন তিনি বললেন,
ائْتُونِي بِكِتَابٍ أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لَا تَضِلُّوا بَعْدَهُ
তোমরা খাতা কলম নিয়ে এসো, আমি তোমাদেরকে এমন ওসিয়ত লিখে দিবো, যার ফলে তোমরা আমার পরে পথভ্রষ্ট হবে না।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তখন নাবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যথা বেড়ে গেলো। আমাদের সামনে আল্লাহর কিতাব আছে, এটাই যথেষ্ট। এমতাবস্থায় উপস্থিত লোকদের মধ্যে উচ্চবাক্য শুরু হয়ে যায়। তখন নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা আমার সামনে থেকে চলে যাও, আমার সামনে ঝগড়া করা উচিৎ নয়।
নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওসিয়ত করা ব্যতীতই ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু তিনি যদি ওসিয়ত করতেন তাহলে অবশ্যই তাওহিদকে বাদ দিতেন না। এ কথা প্রমাণ করে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে হাসান সনদে তিরমিযিতে বর্ণিত হাদিসটি। তিনি বলেন,
من سرَّه أَنْ ينظُرَ إلى الصحيفة التي عليها خاتَمُ مُحمَّدٍ صلى الله عليه وسلم ، فليقرأ هؤلاء الآيات : ﴿قُلْ تَعالَوْا أَتْلُ ما حَرَّمَ ربُّكُمْ عليْكم أَلاَّ تُشْرِكوا به شيئا وبالوَالِدَيْنِ إحْسَانا ، ولا تَقْتُلوا أَوْلادَكم مِنْ إِملاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وإِيَّاهم ، ولا تَقْربُوا الفَوَاحِشَ ما ظَهَرَ مِنْها ومَا بَطَنَ ، ولا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتي حَرَّمَ اللّه إلا بالحقِّ ، ذَلِكمْ وصَّاكمْ بِهِ لَعَلَّكم تَعْقِلونَ ،ولا تَقْرَبُوا مَالَ اليَتِيم إلا بالتي هي أَحْسنُ حتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ ، وأوْفُوا الكَيْلَ ، والمِيزَانَ بالقِسْطِ ، لا نُكَلِّفُ نفْسا إلا وُسعَها ، وإذا قُلْتُم فاعْدِلوا ، ولَوْ كان ذَا قُرْبَى ، وبِعَهْدِ اللّه أوْفُوا ، ذلكم وصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكم تَذكَّرُونَ ، وأنَّ هذا صِراطِي مُسْتَقيما ، فاتَّبِعُوهُ ولا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيِلهِ ، ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُون﴾
যে ব্যক্তি নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ ওসিয়ত পড়তে চায় সে যেনো আল্লাহর এই আয়াত পড়ে :
আপনি বলুন, এসো! আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শোনাই, যেগুলো তোমাদের রব তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন। তা এই যে, ১. আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরিক করবে না, ২. পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করবে না। ৩. স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রতার ভয়ে হত্যা করবে না, কেননা আমিই তোমাদেরকে এবং তাদেরকে আহার দেই, ৪. নির্লজ্জতার ধারেকাছেও যাবে না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য; ৫. ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন তাকে হত্যা করবে না। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুঝতে পার (সুরা আনয়াম: ১৫১)।
সুরা আনআমের যে আয়াতটি ইবনে মাসউদ উল্লেখ করেছেন এতে প্রথমেই তাওহিদের ব্যাপারে আলোচনা এসেছে এবং তাওহিদের বিপরীত বিষয়াদি থেকে নিষেধ করা হয়েছে। ইবনু মাসউদের মতো মহান সাহাবি থেকে এরকম আলোচনা তাওহিদের গুরুত্ব ও মহত্বের প্রতি নির্দেশ করে। মানুষ ইলম ও দ্বীনের যে পর্যায়েই পৌঁছুক না কেনো, সর্বদা সে তাওহিদেরই মুখাপেক্ষী। তাওহিদ থেকে সে কখনো মুক্ত হতে পারবে না।
এ সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে অনেক মানুষ ভুল করে। আর বলে, এ যুগের মানুষের জন্যে তাওহিদের আলোচনা দরকার নেই, কেননা তারা শিরক মুক্ত ইসলামি দেশে বাস করছে ইত্যাদি। অথচ এ ধরনের কথাবার্তা সুস্পষ্ট মূর্খতা। যদি কিছুক্ষণের জন্যে মেনেও নেয়া হয়, তারপরেও এ কথার কোনো বাস্তবতা নেই। বরং আজ সর্বত্র শিরক ছড়িয়ে পড়ছে, বিদয়াত ব্যাপক ও বিস্তৃত হচ্ছে। অথচ এর অস্বীকারকারী ও অপছন্দকারী নেই। আল্লাহর কাছেই অভিযোগ করি, তার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি।
তাওহিদের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব বোঝার জন্য এটাও সহায়ক যে, নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য হুকুম ফরয হওয়ার পূর্বে ধারাবাহিক দশ বছর শুধু তাওহিদেরই দাওয়াহ দিয়েছেন। এটাও তাওহিদের গুরুত্ব প্রমাণ করে। কেননা তাওহিদ ব্যতীত আল্লাহ তায়ালা কোনো আমলই গ্রহণ করেন না। নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুয়ায ইবনু জাবালকে ইয়ামানে পাঠানোর প্রাক্কালে তাকে বলেছিলেন,
إِنَّكَ تَقْدَمُ عَلَى قَوْمٍ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ فَلْيَكُنْ أَوَّلَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَى أَنْ يُوَحِّدُوا اللَّهَ تَعَالَى
তোমাকে আহলে কিতাবের কাছে পাঠানো হচ্ছে, সুতরাং প্রথমেই তুমি তাদেরকে আল্লাহর তাওহিদের দাওয়াহ দিবে।
এজন্য নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দাওয়াহ কার্যক্রমের শুরুতেই বলেছিলেন,
قُولُوا لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ تُفْلِحُوا
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো সফল হয়ে যাবে।
নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন,
لَقِّنُوا مَوْتَاكُمْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ
তোমরা মৃত্যু উপকন্ঠে উপস্থিত ব্যক্তিকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ স্মরণ করিয়ে দাও।
এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা একজন মুসলিমকে পরিষ্কার ও স্পষ্ট করে দেয় যে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলিম তাওহিদের মুখাপেক্ষী। কেননা তার জীবন তাওহিদ দ্বারাই ঘটিত, আর তাওহিদ অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ, অতীব প্রয়োজনীয়। আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো নাবি-রাসুলকে পাঠান নি, যিনি তাঁর জাতিকে তাওহিদের দিকে আহবান করেন নি। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে রাসুলদের সম্পর্কে বলেন, তারা নিজেদের জাতিকে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন এই বলে যে,
﴿اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ﴾
তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।
অন্য আয়াতে বলেন,
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ فَمِنْهُمْ مَنْ هَدَى اللَّهُ وَمِنْهُمْ مَنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلَالَةُ﴾
আমি প্রত্যেক জাতির কাছে একেকজন রাসুল প্রেরণ করেছি (এই মর্মে যে), তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে কাউকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন এবং কারো উপর পথভ্রষ্টতা সত্যায়িত হয়েছে। (সুরা নাহল: ৩৬)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,
﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ﴾
আমি আপনার পূর্বেও সমস্ত রাসুল পাঠিয়েছি এই প্রত্যাদেশ সহকারে যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, সুতরাং আমারই ইবাদাত করো। (সুরা-আম্বিয়া: ২৫)
সুতরাং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই কালিমার দাবি হচ্ছে― সম্মানের ক্ষেত্রে, ভয় ও আশার ক্ষেত্রে এবং ইবাদতের অন্যান্য শাখার ক্ষেত্রে আল্লাহ একক। এমন কোনো রাসুলকে পাঠানো হয় নি, যারা এই মূল ভিত্তির স্বীকৃতি দেন নি। কারণ এটাই দ্বীনের মূল ভিত্তি।
মুসনাদে আহমাদে এসেছে। ইবনু উমর রাযি থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
بُعِثْتُ بِالسَّيْفِ حَتَّى يُعْبَدَ اللَّهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَجُعِلَ رِزْقِي تَحْتَ ظِلِّ رُمْحِي وَجُعِلَ الذِّلَّةُ وَالصَّغَارُ عَلَى مَنْ خَالَفَ أَمْرِي وَمَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
আমি তরবারি সহকারে প্রেরিত হয়েছি, যাতে একক আল্লাহর ইবাদত করা হয়, আমার রিযিক আমার বর্শার ছায়াতলে রাখা হয়েছে। আর লাঞ্ছনা ও অপমান রাখা হয়েছে তাদের জন্যে, যে আমার নির্দেশের বিরোধিতা করবে, যে অন্যদলের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে।
এর দ্বারাও তাওহিদের গুরুত্ব ও মহত্ব বোঝা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিন শুরু হয় তাওহিদের দ্বারা, শেষও হয় তাওহিদের দ্বারা। তিনি ফজরের উভয় রাকায়াতে (তাওহিদের বিবরণ সম্বলিত) সূরা কাফিরুন এবং সূরা ইখলাস তিলাওয়াত করতেন।
এমনিভাবে মাগরিবের প্রথম দুরাকায়াতে উপরোক্ত সূরাদ্বয় তিলাওয়াত করতেন। আমরা এ সুরা দুটিতে তাওহিদের বিবরণ পাই। সুরা কাফিরুনে গায়রুল্লার ইবাদত থেকে বৈরিতা ঘোষণা করা হয়েছে, আর সূরা ইখলাস হচ্ছে তাওহিদুল ইলুহিয়্যাহ, তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ ও তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত সম্পর্কিত।
অধ্যায় : ০২
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর সাহাবা কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম তাঁর অনুসৃত পথেই চললেন। তারা তাওহিদের সুস্পষ্ট আলোচনার দায়িত্ব নিলেন। এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করলেন। আর এ বিষয়ে তারা এজন্য মনোযোগী হলেন যে, তারা ভালোভাবে বুঝতেন― তাওহিদ ব্যতীত রাষ্ট্র ও জনগণের ভিত্তি শক্তশালী হবে না। তারা বিনিদ্র রজনি কাটিয়েছেন, দিনে পিপাসার্ত থেকেছেন তাওহিদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কেনো এমন হবে না? অথচ তারা পরিতৃপ্তিদায়ক পানীয় পান করেছেন, ইলমুশ শারিয়াহ শিখেছেন, তাদের ব্যাপারে ওহিও নাযিল হয়েছে। আর নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সামনে ছিলেন সকাল-সন্ধ্যা।
তারা পূর্ব-পশ্চিমে বিভিন্ন দেশ জয় করেছেন। এসব জায়গায় তারা তাওহিদ ও ইখলাসের কালিমাহ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ঝাণ্ডা সমুন্নত করেছেন। এরপর দেশ সুসংসত হয়েছে এবং শিরক ও ইলহাদের শিকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে।
এরপর এই মানহাজেই অতিক্রম করেছেন তাবিয়িন, তাবি-তাবিয়িন। তারা সকলেই তাওহিদকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার দায়িত্ব পালন করেছেন। এভাবেই প্রথম তিন যুগের মানুষ কথা ও কাজে সর্বশ্রেষ্ঠরূপে পরিণত হয়েছিলো।
এরপর এমন যুগ আসলো যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিদয়াত ও কুকর্ম প্রকাশিত হওয়া শুরু হলো। এভাবেই তারা মন্দকে ভালোর বিনিময়ে পরিবর্তন করা শুরু করে দিলো। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহর যুগ পর্যন্ত এভাবেই চললো। এরপর যখন প্রাজ্ঞ শায়খ, মহান আলেম, অভিজ্ঞ ফকিহ ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ স্বীয় যুগে তাওহিদের ব্যাপারে অত্যধিক গোমরাহি ও মূর্খতার ছড়াছড়ি দেখলেন, তখন তিনি দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। তাওহিদের সুস্পষ্ট আলোচনা শুরু করলেন, যার প্রভাব প্রায় নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিলো, যার চিহ্নটুকুও মুছে গিয়েছিল, গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া কারো কাছে তা স্পষ্ট ছিলো না।
তিনি আল্লাহর রাস্তায় পূর্ণভাবে জিহাদ শুরু করলেন। দিনে-রাতে, প্রকাশ্যে-গোপনে, কলমে, যবানে, অস্ত্র ও তলোয়ারের সাহায্যে আহবান করা শুরু করলেন। তাওহিদকে উম্মাহর সামনে সুস্পষ্ট করলেন। এভাবেই তাওহিদের দাওয়াত নিয়ে ছুটলো অশ্বারোহী দল। চারিদিকে হকের আওয়াজ সমুন্নত হলো। তাঁর দাওয়াত দ্বারা আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদেরকে উপকৃত করলেন, পথভ্রষ্ট ও বিদয়াতিরা পথের দিশা পেলো।
এরপর এই দাওয়াত নিয়ে আলিমদের একটি দল দাঁড়ালেন এবং আর মানুষের সামনে তাওহিদের সুস্পষ্ট বিবরণ তুলে ধরলেন। এভাবে দিনকাল অতিবাহিত হতে লাগলো।
কালক্রমে আবার শুরু হলো অন্যায়-অবিচার, ধ্বংসাত্মক বিদয়াত, বিদয়াতি ওসিলা ইত্যাদি। তখন আল্লাহ তায়ালা শাইখুল ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহর আবির্ভাব ঘটান। আল্লাহ তাঁকে অফুরন্ত প্রতিদান দিন, বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করান। তিনি তাওহিদের দাওয়াহ দেওয়া শুরু করেন। বান্দাদেরকে নিষেধ করেন তাদের রবের সাথে কাউকে সমকক্ষ হিসেবে গ্রহণ না করতে। এ ব্যাপারে তিনি একটি গ্রন্থ লিখেন, কিতাবুত তাওহিদ হাক্কুল্লাহি আলাল আবিদ (তাওহিদ বান্দার উপর আল্লাহর হক)। এ গ্রন্থেই তিনি একজন মুসলিমের প্রয়োজনীয় তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ, তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ এবং তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত নিয়ে আলোচনা করেন। এই গ্রন্থ দ্বারা ছোট-বড় সর্বশ্রেণির মানুষই উপকৃত হয়।
এরপর এ দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাদের হিদায়াতপ্রাপ্ত মহান অনুসারীরা ও ছাত্ররা, যারা জ্ঞানে-গুণে অতুলনীয়। তারা বান্দাদেরকে তাদের রবের দিকে আহবান করা শুরু করেন। বিপদে সাহায্যের জন্যে, দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্যে এবং হতাশা থেকে উত্তরণের জন্যে তারা প্রকৃত মাবুদের দিকেই ফিরে যেতেন। এভাবে তারা নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অমিয় সুধা থেকে পান করেন, আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর রহম করুন।
এরপর এ যুগে এমন কিছু উত্তরসূরী তৈরি হলো― তারা যা করে না তাই বলে, যার ব্যাপারে নির্দেশিত হয় নি তাই করে। অথচ তারা দাবি করে এ যুগের মুসলমান তাওহিদ সম্পর্কে আলোচনার মুখাপেক্ষী নয়। বর্তমান যুগের মানুষের সামনে এর বয়ান জরুরি নয়। এটা চেনার জন্যে বিস্তারিত আলোচনারও প্রয়োজন নেই...। এভাবে তারা নিজেরাও গোমরাহ হলো, অন্যদেরকেও গোমরাহ করলো। কত কঠিন তাদের মুখের কথা। তারা যা বলে, তা তো সবই মিথ্যা।
মনে হয় এদের কাছে তাওহিদ হচ্ছে শুধুমাত্র আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করা। যদি তাই হয়, তবে যার কারণে রাসুলগণ প্রেরিত হয়েছেন, যার আলোচনার জন্যে কিতাব নাযিল হয়েছে সে ব্যাপারে তাদের মূর্খতাই প্রকাশিত হয়।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
যে তাওহিদ নিয়ে রাসুলগণ এসেছেন তার একটি হলো, আল্লাহর উলুহিয়্যাহ। অর্থাৎ মানুষ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, একমাত্র তারই ইবাদত করা হবে, একমাত্র তারই উপর ভরসা করা হবে, একমাত্র তার জন্যেই বন্ধুত্ব স্থাপন করা হবে, একমাত্র তার জন্যেই শত্রুতা করা হবে, একমাত্র তাঁর জন্যেই সমস্ত আমল করা হবে। আর এগুলো তার আসমা ওয়াস সিফাতেরও প্রমাণ।
এরপর শাইখ কুরআনের কিছু আয়াত উল্লেখপূর্বক বলেন,
তাওহিদ দ্বারা শুধুমাত্র তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ অর্থাৎ এই বিশ্বাস রাখা যে, একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন সমগ্র পৃথিবীর স্রষ্টা এটা উদ্দেশ্য নয়। এই ধরনের ধারণা পোষণ করে কিছু কালামি ও সুফিরা। তারা মনে করে, যদি রুবুবিয়্যাহ দলিলাদি দ্বারা প্রমাণিত হয়ে যায় তাহলেই তাওহিদের মূল লক্ষ্য প্রমাণিত হয়ে যায়, যদি এটার সাক্ষ্য দেয়, এরই মাঝে নিজেকে মগ্ন করে দেয়, সে যেনো নিজেকে পুরো তাওহিদেই মগ্ন করলো। আল্লাহ তায়ালা যেসব গুণের অধিকারী বান্দা যদি এগুলো স্বীকার করে নেয়, আর তার অন্তরকে নিষিদ্ধ সব বিষয় থেকে বিরত রাখে, এ কথা স্বীকার করে যে, একমাত্র আল্লাহই সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা; এরপরও একজন মানুষ মুওয়াহহিদ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে এ কথার সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, একমাত্র তিনিই ইবাদতের উপযুক্ত, নিজেকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করে নেয়। আর ইলাহ হচ্ছেন মাবুদ, যিনি একমাত্র ইবাদতের উপযুক্ত। ইলাহ অর্থ এই নয় যে, যিনি নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারেন; সিফাতের ক্ষেত্রে মুতাকাল্লিমরা যেমনটা মনে করে থাকেন। এটাই আবুল হাসান আল-আশয়ারি এবং তার অনুসারীরা দাবি করেন, অথচ তারা তাওহিদের প্রকৃত অবস্থাই বুঝেন নি, যা সহকারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন। কেননা আরবের মুশরিকরা স্বীকার করতো যে, একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন সবকিছুর স্রষ্টা। এরপরেও তারা মুশরিক ছিলো। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ﴾
তাদের অনেকেই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে। (সুরা ইউসুফ: ১০৬)
সালাফদের একদল বলেন,
تسألهم: من خلق السموات والأرض ؟ فيقولون: الله، وهم مع هذا يعبدون غيره
তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করেন, কে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন? তারা বলে, আল্লাহ! অথচ তারা এরপরও তারা অন্যের ইবাদত করে।