পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে
আন-নাফির বুলেটিন
ইস্যু ১০
জুমাদাল উলা ১৪৩৮ হিজরী
আপনি সৌভাগ্যের জীবন ও শাহাদাতের মরণ পেয়েছেন!
মুজাহিদ ইমাম শায়েখ উমর আব্দুর রহমান রহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবন ওই সকল গুণাবলী ও অবস্থান দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল, যা শুধু মহান মানুষদের অর্জিত থাকে। তাঁর জীবনের উদাহরণ হচ্ছে একটি আলোকিত চাঁদের ন্যায়, যে আলোতে সর্বস্তরের, সকল যুগের সত্যান্বেষী মানুষেরা পথের দিশা খুঁজে পায়। সমগ্র জীবনব্যাপী তাঁর মহান কীর্তিগুলো ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খোদিত আছে, বাস্তবিকই তিনি ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে আছেন।[1]
কোথায় সেই কারারক্ষীরা?
কোথায় তাঁর কারারক্ষীরা?
কোথায় তাঁর জল্লাদ?
কোথায় তার প্রতিপক্ষ দল যারা অন্যের জীবনের জন্য নিজের ঈমানকে বিক্রি করে দিয়েছিল?
ইতিহাস তাদের শুধুই আবু জাহেল ও আবু রিগালের[2] ন্যায় স্মরণ করবে।
فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاءً ۖ وَأَمَّا مَا يَنْفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الْأَرْضِ ۚ كَذَٰلِكَ يَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ
অতএব, ফেনা তো শুকিয়ে খতম হয়ে যায় এবং যা মানুষের উপকারে আসে, তা জমিতে অবশিষ্ট থাকে। আল্লাহ এমনিভাবে দৃষ্টান্তসমূহ বর্ণনা করেন।
(সুরা রা’দ ১৩:১৭)
তাঁর স্নিগ্ধ ও সুরভিত জীবন যুগে যুগে উম্মাহর সন্তানদের পাথেয় হয়ে থাকবে এবং তাদের গৌরব ও সম্মানের পথে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এবং আল্লাহর তাকদিরের প্রতি ধৈর্য্যশীল ও পুরস্কার প্রত্যাশীদের জন্য তিনি এক জীবন্ত উদাহরণ। সূর্যোদয়ের পরে সিতারাগুলোর আর কোন প্রয়োজন নেই।
শায়খ অসাধারণ জীবনের অধিকারী ছিলেন, তথাপি তার মৃত্যুতে তিনি কৃতজ্ঞ হয়েছেন। তাঁর এই মৃত্যু তাঁর শত্রুদের উদ্দেশ্যে যেন বলে দিচ্ছে যে:
এই জানাযার দিনটিই আমাদের এবং তোমাদের মাঝে পার্থক্য দেখিয়ে দিয়েছে। তাঁর জানাযায় ছিল বিপুল লোক সমাগম। ন্যায়পরায়ণ লোকদের একটা বিরাট অংশ এর সাক্ষী হয়ে আছে। পায়ে হেঁটে, যানবাহনে চড়ে এত বিপুল সংখ্যক লোক এসেছিল যে, রাস্তাঘাট এবং চারপাশের ঘরবাড়ি গুলো অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল, দোকানপাট গুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং জানালাগুলোতেও ভীড় জমেছিল। ইতিহাসে এমন আর কোন গ্রাম নেই যেখানে তার জানাযার মত এত বিপুল লোক সমারোহ হয়েছিল।[3]
মানুষ এক প্রকৃতিরই হয় ও দোষমুক্ত তো মৃতরাই হয়ে থাকে,
বিরোধীরা চিৎকার করে বলছেঃ পুরুষেরা সব কোথায়?
এখানে, ইবনে আব্দুর রহমান তাঁর খাটিয়ায় শুয়ে আছে।
চোখ মেলে দেখ, পর্বতসদৃশ ভীড়গুলো কিভাবে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে।
আপনার জানাযা আমাদের আহলুস সুন্নাহর ইমাম, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি[4] প্রমুখ মহান ব্যক্তিত্বদের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, যিনি জেলে বন্দী হওয়ার দরুণ মৃত্যু বরণ করেছেন। আনুমানিক ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করেছিল। এছাড়াও, শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি[5] দামেস্কের দুর্গে একাকী বন্দী থাকা অবস্থায়, তাঁর সেলের অভ্যন্তরে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর উপরে এর বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ে নি। তাঁর জানাযাও আড়ম্বরপূর্ণ ছিল ও বিপুল পরিমাণ লোক সমাগম ঘটেছিল এবং ইমাম যাহাবি রহমাতুল্লাহি আলাইহি[6] এর বর্ণনামতে, হাজার হাজার ন্যায়পরায়ণ লোক এতে অংশগ্রহণ করেছিল।
আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন হে শায়েখ আব্দুর রহমান! আল্লাহ যেন আপনাকে নবী, সিদ্দিকীন ও শহীদদের সাথে জান্নাতের উচ্চস্তরে আসীন করেন। কতই না উত্তম সাথী তাঁরা!
ও আল্লাহ! আপনার বান্দা আব্দুর রহমানকে ক্ষমা করে দিন। হক্বের অনুসারীদের মধ্যে তাঁর মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করুন এবং জীবিতদের মধ্য হতে তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণকারী বানিয়ে দিন। আমাদের ও তাঁকে ক্ষমা করুন। হে বিশ্ব জাহানের রব! তাঁর কবরকে আরো প্রশস্ত করুন এবং তাঁর কবরকে আলোকিত করে দিন।
______________________________________________________________________
[1] তাওহীদ ও জিহাদের আলেম, মুসলিম জাতির প্রাণপ্রিয় শায়েখ উমর আবদুর রহমান রহমাতুল্লাহি আলাইহি গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সলিট্যারি কনফেনমেন্টে যাবজ্জীবন কারাভোগরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ উনার খেদমতকে কবুল করেন! তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসে দাখিল করেন!
তিনি ১৯৩৮ সালে মিশরে জন্ম গ্রহণ করেন। শায়েখ উমর আবদুর রহমান ছিলেন আমাদের সময়কার অন্যতম কিংবদন্তী। তিনি ১১ বছর বয়সে কুরআনের হিফয শেষ করেন, যদিও জন্মের ১০ মাস বয়সে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। তিনি শরিয়াহ বিভাগের উপর তার স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শেষ করেন। শায়েখ পরবর্তীতে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাফসীরের উপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।
জামাল আব্দুন নাসেরর পাশবিক সরকারের বিরুদ্ধাচারণে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি নির্ভয়ে মুসলিমদেরকে বলেছিলেন এই অত্যাচারী মুরতাদের মৃত্যুর পর তার জানাযা না পড়তে। তার ঐতিহাসিক ফতোয়ায় ইসলামের তৎকালীন শত্রু মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে মুজাহিদ খালিদ ইসলাম্বুলী (রহঃ) হত্যা করেন। বিচারকালীন সময়ে তিনি বজ্রকন্ঠে সত্যের ঘোষণা দেন এবং শরিয়াহ কায়েমের জন্য কোর্টে সরাসরি আহ্বান জানান। অতঃপর তাকে কারারুদ্ধ করে তার উপর কঠিন নির্যাতন চালায় মিশরের সরকার।
শায়েখ মিসরীয় সাবেক জিহাদি সংগঠন “আল জামাআতুল ইসলামিয়্যাহ” এর আমীর ছিলেন।
আমেরিকার ভিসা পাওয়ার পর এবং আমেরিকায় ইসলাম প্রচারের ইমাম হয়ে শায়খ তার দাওয়াতি মেহনত অব্যহত রাখেন। তার দীপ্ত দাওয়াতি প্রচারণা অনেক মুজাহিদদের চোখ খুলে দিয়ে আল্লাহর শত্রুকে আক্রমণের প্রেরণা যুগিয়েছিল। কুফরের ইমাম আমেরিকা ১৯৯৩ সালে তাকে গ্রেফতার করে তাকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে।
শায়খ আইমান আয যাওয়াহিরি (আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন) সহ আরো অনেক মুজাহিদিন শায়েখরা তার মুক্তির দাবি জানায়, যখন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ছিল নিশ্চুপ।
শায়েখের একটি ঐতিহাসিক বক্তব্য হচ্ছে-
“যদি কেউ তাদের ন্যায্য দাবি প্রাপ্তির অধিকার রেখে জঙ্গি হয়, তাহলে আমরা জঙ্গিই, আর আমরা জঙ্গি হওয়াকে স্বাগত জানাই। কুরআনই এই জঙ্গিবাদ তৈরী করে। আল্লাহর পথে জিহাদ করার অন্যতম মাধ্যম হল আল্লাহর শত্রুদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করা”। - শায়েখ উমর আবদুল রহমান (রহঃ)
শায়েখ ডঃ উমর আবদুর রহমানের মেয়ে আসমা তার বাবার মৃত্যুর সংবাদটি নিশ্চিত করেন। তিনি ১৯৯৩ সাল থেকে আমেরিকার কারাগারে যাবজ্জীবন কয়েদী হিসেবে বন্দী ছিলেন।
শায়েখের শাহাদাতে তাঁর পরিবার ও মুসলিম উম্মাহকে জামাআত কায়েদাতুল জিহাদ ও তাঁর অঙ্গসংগঠনসমূহ শোঁক বার্তা জানিয়েছে। মুসলিম উম্মাহকে শায়েখের হত্যার বদলা নিতে আহবান করেছে। এছাড়াও মুসলিম বিশ্বের বড় বড় জ্ঞানী ব্যক্তিরা সমবেদনা জানিয়ে বার্তা প্রদান করেছেন, যাদের অন্যতম হচ্ছেন আরব বিশ্বের প্রখ্যাত আলেম শায়েখ আবু মুহাম্মাদ আসেম আল মাকদিসি দাঃবাঃ।
শায়েখ অনেকগুলো কিতাব লিখেছেন, যার মধ্যে (الشريعة الإسلامية شريعة شاملة كاملة) “আশ শরিয়াতুল ইসলামিয়্যাহ শারিয়াহ শামিলাহ ওয়া কামিলাহ” অন্যতম। আন নাফির বুলেটিন হিসেবে প্রকাশিত এই নসিহতটি শায়েখ কারাগারে বসে লিখেছিলেন। সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাগণ নিচের লিংক থেকে দেখে নিতে পারেন।
http://www.ilmway.com/site/maqdis/MS_8861.html
এছাড়াও শায়েখের অন্যান্য রচনাবলী ও সাক্ষাৎকারসমূহ, অডিও ও ভিডিওসমূহ নিচের লিংক এ পাবেন ইনশা আল্লাহ।
http://www.ilmway.com/site/maqdis/MS_8860.html
[2]ঐতিহাসিক গাদ্দার আবু রিগাল ছিল বনু সাকিফ গোত্রের লোক, যে কুখ্যাত বাদশাহ আবরাহাকে পথপ্রদর্শন করেছিল। ঘটনা হল ৫৭০ বা ৫৭১ খৃষ্টাব্দে ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা পবিত্র কাবা শরীফ ভাঙ্গার জন্য ৬০ হাজার পদাতিক, ১৩টি হাতি (অন্য বর্ণনা মতে ৯টি হাতি) সহকারে মক্কার পথে রওয়ানা হয়। পথে প্রথমে যু-নফর নামক ইয়ামনের একজন সরদার আবরদের একটি সেনাদল সংগ্রহ করে তাকে বাধা দেয়। কিন্তু যুদ্ধে সে পরাজিত ও ধৃত হয়। তারপর খাশ'আম এলাকায় নুফাইল ইবনে খাশ'আমী তার গোত্রের লোকদের নিয়ে তার পথ রোধ করে। সেও পরাজিত ও গ্রেফতার হয়ে যায়। সে নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য আবরাহার সেনাদলের পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
এ সেনাদল তায়েফের নিকটবর্তী হলে বনু সকীফ অনুভব করে যে এত বড় শক্তির মোকাবিলা করার ক্ষমতা তাদের নেই এবং এই সংগে তারা এ আশঙ্কাও করতে থাকে যে, হয়তো তাদের লাত দেবতার মন্দিরও তারা ভেঙে ফেলবে। ফলে তাদের সরদার মাসউদ একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আবরাহার সাথে দেখা করে। তারা তাকে বলে, আপনি যে উপাসনালয়টি ভাঙতে এসেছেন আমাদের এ মন্দিরটি সে উপাসনালয় নয়। সেটি মক্কায় অবস্থিত। কাজেই আপনি আমাদেরটায় হাত দেবেন না। আমরা মক্কার পথ দেখাবার জন্য আপনাকে পথ প্রদর্শক সংগ্রহ করে দিচ্ছি। আবরাহা তাদের এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। ফলে বনু সাকীফ আবু রিগাল নামক এক ব্যক্তিকে তার সাথে দিয়ে দেয়। মক্কা পৌঁছতেই যখন আর মাত্র তিন ক্রোশ পথ বাকি তখন আলমাগান্মাস বা আল মুগান্মিস নামক স্থানে পৌঁছে আবু রিগাল মারা যায়। আরবরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত তার কবরে পাথর মেরে এসেছে। তাকে অভিশাপ দেয়। এখনো অবধি আরবের লোকেরা সমাজের গাদ্দার ও মুনাফিকদের ক্ষেত্রে আবি রিগালের উদাহরণ দিয়ে থাকে।
[3] শায়েখ উমর আব্দুর রহমান রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর জানাযার ঐতিহাসিক ভিডিও-
হাজার হাজার মানুষ শায়েখ উমর আব্দুর রহমান এর জানাযায় শরিক হয়েছে। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উঁচু মকাম দান করুক, আমিন...।
শায়েখ আমেরিকার কারাগারে বসে “মুসলিম জাতির প্রতি অসিয়ত” শীর্ষক একটি চিঠিতে বলেছিলেন-
“আমার ভাইয়েরা, যদি তারা আমাকে হত্যা করে - যা তারা করবে - আমার জানাযা বহন করবে, এবং আমার পরিবারের কাছে আমার দেহ দিয়ে দিবে, কিন্তু কখনো আমার রক্তকে ভুলবেনা, কখনো এর হক ছারবেনা! বরং আমার প্রতিশোধ নিবে তাদের থেকে সবচেয়ে তীব্র এবং ভয়ংকর রুপে! এবং স্মরণ করবে যে তোমাদেরই এক ভাইকে হত্যা করা হয়েছে আল্লাহর রাস্তায়, শুধু মাত্র সত্য বলার কারনে......”
[4] নাম, উপনাম ও বংশ পরিচয়
নাম : আহমাদ, পিতা মুহাম্মদ, দাদা হাম্বল, উপনাম আবূ আব্দুল্লাহ।
বংশনাম : আহমাদ বিন মুহাম্মদ বিন হাম্বল বিন হিলাল বিন আসাদ বিন ইদ্রীস—- আশ্শায়বানী, আল-মারওয়াযী, আল-বাগদাদী। ইমামের ১৩তম পূর্ব পুরুষ শায়বান এর দিকে সম্পৃক্ত করায় আশ শায়বানী, তাঁর জন্মভূমি মুরউ এর দিকে সম্পৃক্ত করায় আল-মারওয়াযী, অতঃপর ইমামের অবস্থান বাগ্দাদ এর দিকে সম্পৃক্ত কারয় ‘‘আল বাগ্দাদী।’’
জন্ম ও প্রতিপালন : ইমাম আহমাদ (রহ.) ১৬৪ হিঃ রবিউল আউয়াল মাসে মুরউতে জন্ম গ্রহণ করেন। কেউ কেউ বলেন তিনি মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় মুরউ হতে বাগদাদে আসেন অতঃপর বাগদাদে জন্ম হয়। ছোট কালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন ফলে তিনি ইয়াতীম অবস্থায় মার কাছে পালিত হন।
শিক্ষা জীবন : ইমাম আহমাদ (রহ.) ছোট বয়সেই শিক্ষায় মনোনিবেশ হন। তিনি প্রখর মেধাশক্তিসম্পন্ন ছিলেন। অতি সহজেই অনেক কিছু মুখস্ত করে ফেলতেন। ইব্রাহীম আল হারবী (রহ.) বলেন : ‘‘মনে হয় যেন আল্লাহ তা’আলা ইমাম আহমাদকে আদি-অন্তের সকল প্রকার জ্ঞান দান করেছেন।’’
শিক্ষা সফর : জ্ঞান পিপাসু ইমামুস সুন্নাহ্ ইমাম আহমাদ (রহ.) বাগদাদের উল্লেখযোগ্য সকল আলিম হতে শিক্ষা গ্রহণের পর বিভিন্ন প্রান্তে জ্ঞান আহরণে ছুটে চলেন। তিনি সফর করেন কুফা, বাসরা, মক্কা, মদীনা, ত্বারতুস, দামেস্ক, ইয়ামান, মিসর ইত্যাদি অঞ্চলে। তিনি পাঁচবার হাজ্জব্রত পালন করেন তন্মধ্যে তিনবার পায়ে হেঁটে হাজ্জ পালন করেন।
আহলুস সুন্নাহর ইমাম : ইমাম আহমাদ (রহ.) সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্ত্তত কিন্তু প্রকাশ্যভাবে সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা হতে সামান্যতম ছাড় দিতে প্রস্ত্তত নন, প্রয়োজনে জীবন জেতে পারে তবুও সুন্নাহর অনুসরণ বর্জন হতে পারে না, ইমাম ইসহাক বিন রাহুয়াহ (রহ.) বলেন : ‘‘যদি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল না হতেন এবং তাঁর ইসলামের জন্য ত্যাগ স্বীকার না হত তাহলে ইসলাম বিনাশ হয়ে যেত, অর্থাৎ যখন সকলেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কুরআনকে মাখলুক হিসাবে স্বীকার করে নিল, তখন পৃথিবীর বুকে একজনই মাত্র ইসলামের সঠিক বিশ্বাস ধারণ করেছিলেন, তিনিই হলেন ইমাম আহমাদ। আল্লাহ তা’আলা তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের সঠিক আকীদাহ্ বিশ্বাসকে টিকিয়ে রেখেছিলেন।
রাসূল (ছাঃ) হতে চলে আসা কুরআনের সঠিক বিশ্বাস : ‘‘কুরআন আল্লাহ তা’আলার বাণী, কোন সৃষ্ট বস্ত্ত নয়।’’ কিন্তু জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের আবির্ভাবে এ বিশ্বাসে বিকৃতি ঘটানো হয়, শুরু হল ‘‘কুরআন মাখলুক বা সৃষ্ট বস্ত্ত’’ এ ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রচারণা, এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে আববাসীয় খলীফা হারুনুর রশীদ এবং পরবর্তী খলীফা মামুনুর রশীদ প্রভাবিত হলেন এ ভ্রান্ত বিশ্বাসে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা হল সকলকে বিশ্বাস পোষণ করতে হবে যে, ‘‘কুরআন মাখলুক বা সৃষ্ট বস্ত্ত’’, এ বিশ্বাসের কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারবে না। বাধ্য হয়ে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় প্রায় সকলেই ঐক্যমত পোষণ করলেন শুধুমাত্র দু’জন দ্বিমত পোষণ করেন, ইমাম আহমাদ (রহ.) ও মুহাম্মাদ বিন নূহ (রহ.)।
ইমাম আহমাদ (রহ.) সম্পর্কে আলিম সমাজের প্রশংসা :
(১) ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী (রহ.) বলেন : আল্লাহ তা’আলা রাসূল (ছাঃ)-এর পর দু’জন ব্যক্তির মাধ্যমেই ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন হলেন আবূ বকর রাজিঃ যার মাধ্যমে মুরতাদ ও ভন্ড নাবীদের দমন করেছেন, আর অপরজন আহমাদ বিন হাম্বল, যার মাধ্যমে কুরআনের মানহানীর সময় কুরআনকে সমুন্নত করেছেন।
(২) ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব আল ওয়াররাক (রহ.) বলেন : ‘‘আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের মত আর কাউকে দেখিনি, তাকে জিজ্ঞাসা করা হল আপনি অন্যের চেয়ে ইমাম আহমাদের মাঝে জ্ঞান-গরিমার বা মর্যাদার বেশী পেয়েছেন কি? তিনি বললেন : ইমাম আহমাদ এমন একজন ব্যক্তি যাকে ৬০,০০০ (ষাট হাজার) প্রশ্ন করা হল, তিনি সকল প্রশ্নের জবাবে হাদ্দাছানা ওয়া আখ্বারানা অর্থাৎ শুধু হাদীস হতে জবাব দিয়েছেন অন্য কিছু বলেন নি।
(৩) ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন : আমি বাগদাদ হতে বের হয়ে ইমাম আহমাদের চেয়ে অধিক আল্লাহভীরু, তাকওয়াশীল, ফাকীহ ও জ্ঞানী আর কাউকে পাইনি।
ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর ইন্তেকাল : জন্মের পরই মৃত্যুর পর্ব, আল্লাহ তা’আলার এ নিয়মের ব্যতিূম মহামানব মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর ক্ষেত্রেও ঘটেনি, ঠিক একই নিয়মের শিকার হলেন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইমাম- ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)। ২৪১ হিজরী ১২ রবিউল আউয়াল শুক্রবার সকল মাখলুককে ছেড়ে মহান খালিক এর ত্বরে পাড়িজমান। আল্লাহ তাঁকে জানণাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমীন!
ইমম (রহ.)-এর জানাযায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হয় যে, ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব আল ওয়ার্রাক (রহ.) বলেন : জাহেলী যুগে কিংবা ইসলামী যুগে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাবেশ ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। খোলা মরুভূমিতে প্রথম জানাযা সম্পন্ন হয় যাতে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৬-৮ লক্ষ, কেউ কেউ বলেন দশ লক্ষ, আর নারীর সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার। এ ছাড়াও কয়েকদিন পর্যন্ত জানাযা চলতে থাকে।
জানাযার এ বিড়ল দৃশ্য প্রমাণ করে ইমাম আহমাদ সত্যিই সত্যিই আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআতের ইমাম।
সুত্র- হুলিয়াতুল আউলিয়া- ৯/১৬২ পৃঃ, তাহযীবুল কামাল- ১/৩৫ পৃঃ, তারিখে বাগদাদ- ৪/৪১৪ পৃঃ, সিয়ারু আলামিন নুবালা- ১১/১৭৮ পৃঃ, আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ- ১০/৭৭৫ পৃঃ, মানাকিব লি ইবনুল জাওযী- ১৮ পৃঃ, ইত্যাদি।
[5] তাকিউদ্দিন আহমদ ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি (জন্ম: ২২ জানুয়ারি ১২৬৩ - মৃত্যু: ২০ সেপ্টেম্বর ১৩২৮),
পূর্ণ নাম: তাকিউদ্দিন আবুল আব্বাস ইবনে আবদুল হালিম ইবনে আবদুস সালাম ইবনে তাইমিয়া আল হারানি
ছিলেন একজন সালাফি আলেম, দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও যুক্তিবিদ। কুখ্যাত মঙ্গোল আক্রমণের সময় তিনি জীবিত ছিলেন। তিনি ইসলামি আইনের ক্ষেত্রে হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। ইবনে কুদামার পাশাপাশি তার অনুসারীরা তাকে হাম্বলি মাজহাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করেন। তাদের দুজনকে একত্রে “দুই শাইখ” ও ইবনে তাইমিয়াকে আলাদাভাবে শাইখুল ইসলাম বলে সম্বোধন করা হয়।
ইবনে তাইমিয়া কুরআন ও সুন্নাহর প্রাথমিক যুগের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করার পক্ষাপাতি ছিলেন। তিনি একজন মুজাহিদ ও মুজতাহিদ আলেম ছিলেন। মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে তিনিই জিহাদের ফতোয়া দিয়েছিলেন। মোঙ্গলরা এসময় ইসলাম গ্রহণ করলেও শরিয়ার অনুসরণ না করায় তিনি তাদের অমুসলিম হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
গ্রন্থ রচনা: তিনি ৫০০ এর অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। “আল-জাওয়াবুস সহীহ লিমান বাদালা দ্বীনিল মাসিহ” তার লিখিত একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ।
[6] ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহঃ এর ছাত্র ইমাম যাহাবি রহঃ এর প্রকৃত নাম হচ্ছে মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে উসমান ইবনে কাইয়ুম আবু আব্দুল্লাহ শামসুদদীন আয-যাহাবী। (জন্ম: ১২৭৪ - মৃত্যু: ১৩৪৮) তিনি একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ইসলামি ইতিহাসবেত্তা। তিনি ইমাম যাহাবী নামে পরিচিত।
জন্ম ও পরিচয়
ইমাম যাহাবী ৫ অক্টোবর ১২৭৪ সালে দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর পিতামহ উসমানের সময় থেকে তাঁর পরিবার সেখানে বসবাস করে আসছিলো। তিনি মাঝে মাঝে তার পিতার পেশার কারণে নিজেকে ইবনুল যাহাবী (স্বর্ণকারের পুত্র) হিসেবে পরিচয় দিতেন।
শিক্ষাজীবন
তিনি আঠারো বছর বয়সে হাদিস শিক্ষার জন্য দামেস্ক থেকে বালবেক, হিমস, হামা, আলেপ্পো, নাবুলুস, কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, জেরুজালেম, হিজাজ ইত্যাদি স্থানে ভ্রমণ করেন। শিক্ষা সমাপ্ত হলে দামেস্ক ফিরে আসেন এবং শিক্ষকতা ও হাদিস গবেষণা শুরু করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ২ জন উল্লেখযোগ্য ইমাম হলেনঃ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ এবং ইবনে দাকিকুল ইদ রহঃ।
শিক্ষকদের তালিকা
তাঁর হাদিস, ফিকহ ও আকিদার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণ হলেনঃ
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ
ইবনে দাকিক আলইদ রহঃ
ইবনুল জাহিরি রহঃ প্রমুখ
অবদান
অল্পবয়সেই তিনি ইতিহাসবিদ, জীবনীকার এবং হাদিস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ পরীক্ষক হিসাবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। তাঁর প্রায় ১০০ টি রচনার বেশিরভাগ-ই গুরুত্বপূর্ণ। হাদিস ও ইতিহাসের পাশপাশি রিজালশাস্ত্রে তাঁর অবদান অপরিসীম। এছাড়া তিনি চিকিৎসাবিদ্যা নিয়েও কাজ করেছেন। বিশেষ করে ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ চিকিৎসাকর্ম সংক্রান্ত কাজে তার উপস্থাপনায় সহজবোধ্যতা ছিল। তাঁর শিক্ষার প্রভাবে পরবর্তীকালে জন্ম হয় জগৎবিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ এবং নাসির আল দিমাশকির । তাঁর রচিত কিতাবগুলো থেকে এখনো ইসলামিক স্কলার ও ছাত্ররা জ্ঞানলাভ করে থাকেন। এই ৭০০ বৎসর যাবত তাঁর কিতাবগুলো পঠন-পাঠন হয়ে আসছে, এবং এখনো সমান জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।
মৃত্যু
ইমাম আয-যাহাবি বৃদ্ধ বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং এর ২ বৎসর পর ১৩৪৮ সালে এই মহান ইমাম মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর যে ৩ সন্তান (এক কন্যা ও দুই পুত্র) জীবিত ছিলেন তারা হলেনঃ একমাত্র কন্যা আমাত আল আযিয এবং ২ পুত্র: আব্দুল্লাহ ও আবু হুরাইরা আব্দুর রহমান।
ইমাম সুয়ুতি রহঃ বলেনঃ
“বর্তমানকালের হাদিসবিশারদগণ রাবি-সমালোচনা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে চারজন মুহাদ্দিসের উপর নির্ভর করেন, যারা হলেনঃ আল মিযযি, আয-যাহাবী, আল ইরাকী এবং ইবনে হাজর আসকালানি রহমাতুল্লাহি আলাইহিম ”
প্রণীত পুস্তক
সিয়ারু আলামিন নুবালা
তারিখ আল ইসলাম আল কাবির
তাযকিরাতুল হুফফাজ
আল কাবাইর
আরও অনেকগুলো......
https://archive.org/download/AnNafir10/an%20nafir%20-10.pdf
http://www.mediafire.com/file/760f9ji1z9h3132/an+nafir+-10.pdf
WORD
https://archive.org/details/AnNafir10_