JustPaste.it

 

আত্মশুদ্ধি – ০৬

 

আল্লাহর রহমত থেকে

নিরাশ না হওয়া

 

মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ

 

মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহঃ আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা সাইয়িদিল আম্বিয়া-ই ওয়াল-মুরসালীন, ওয়া আলা আলিহী, ওয়া আসহাবিহী, ওয়ামান তাবিয়াহুম বি ইহসানিন ইলা ইয়াওমিদ্দীন, মিনাল উলামা ওয়াল মুজাহিদীন ওয়া আম্মাতিল মুসলিমীন। আমীন ইয়া রাব্বাল আ’লামীন। 

আমরা সকলেই প্রথমে দুরূদ শরীফ পড়ে নিই।  

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

আলহামদুলিল্লাহ এক সপ্তাহ পর আবার আমরা আরেকটি তাযকিয়া মজলিসে হাজির হতে পেরেছি, এ জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শুকরিয়া আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ।

আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া

মুহতারাম ভাইয়েরা, আজকে আমাদের আলোচ্য বিষয় হল, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া। 

নৈরাশ্যতা মানুষকে বিভিন্ন দিক দিয়ে আক্রান্ত করে থাকে। এটি কাউকে কেবল পার্থিব বিষয়ের ক্ষেত্রেই হতাশাগ্রস্ত করে তোলে, এমন নয়, বরং এটি কোন মানুষকে তার দ্বীনী ও পরকালীন বিষয়েও হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। মানুষের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের পাপের পরিমাণ অনেক বেশি। অনেকেই সারাদিন পাপের মধ্যে ডুবে থাকেন। কেউ কেউ নিজে পাপ করে আবার অন্যদেরকেও পাপের দিকে আহবান করে। এভাবে কেউ কেউ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেবল পাপই করে চলে। এভাবে দীর্ঘ একটি সময় পার হওয়ার পর কোন একসময় তার অন্তরে অনুশোচনা জাগে এবং সে অসীম দয়াময় আল্লাহকে স্মরণ করে। তখন পিছনের পাপের দিকে তাকিয়ে একরাশ হতাশা ও নৈরাশ্যতা তাকে ঘিরে ধরে। সে তখন ভাবে, আমি এত এত পাপ করেছি, আল্লাহ কি আমাকে ক্ষমা করবেন?

অনেক সময় গোনাহের পঙ্কিলতা থেকে পরিচ্ছন্ন হওয়ার সম্ভাবনাটুকু এ ধরণের হতাশার আঘাতে শেষ হয়ে যায়। আবার এমন গোনাহগার কাউকে দেখে অনেক দ্বীনদার লোকেরাও হতাশ হয়ে যায় যে, একে মনে হয় আর সঠিক পথে আনা যাবে না!

আসল কথা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার রহমত সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতাই এ ধরণের হাতাশার মূল কারণ। বাস্তবতা হচ্ছে, আল্লাহর রহমত যখন কারো ভাগ্যে জুটে যায় তখন তো ইসলামের চরম দুশমনও মুহূর্তের ব্যবধানে ইসলামের বিরাট খাদেমে পরিণত হয়ে যায়। এবার এর কয়েকটি জ্বলন্ত উদাহরণ পেশ করছি।

হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাযি.র ঘটনা  

ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী আমাদের সবারই জানা। তবুও নিজেদের ঈমানকে একটু তাজা করার জন্য ঘটনাটা বলছি। যখন মক্কার কাফেররা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতি কার্যক্রমকে কোনও ভাবেই বন্ধ করতে পারছিল না, আবার আরবের কঠিন গোত্রপ্রীতির কারণে কেউ তাঁকে হত্যা করার সাহসও পাচ্ছিল না, এমন পরিস্থিতিতে একদিন এক কুরাইশী নওজওয়ান ওমর বিন খাত্তাব ইসলামের নবী মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে হত্যা করার সংকল্প নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হাতে খোলা তলোয়ার। উদ্দেশ্য একটাই। নতুন এ নবীকে হত্যা করা এবং তাঁর দাওয়াতি মিশনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া। 

কিন্তু আল্লাহ তাআলার রহমত ও কুদরত দেখুন। কাফেরদের পুরো সমাজ মিলে যে কাজটি করার হিম্মত করেনি, ওমর একাই তা করার জন্য বেরিয়ে পড়ল। কত বড় হিম্মত দেখুন! ওমরের এ মিশন সফল হওয়ার অর্থ, ইসলামের সূর্য চিরদিনের জন্য ডুবে যাওয়া।

যে কিনা এত বড় জঘন্য একটি অপরাধ করতে যাচ্ছে একটু পর সেই হয়ে গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাণ প্রিয় সাহাবী।

এখানেই কি শেষ? না, পরবর্তীতে তিনিই হলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা। পুরো মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় সর্বোত্তম ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাথে যে দশজন সাহাবীকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, তিনি হয়ে গেলেন তাঁদের দ্বিতীয়জন। যাদেরকে ‘আশারায়ে মুবাশশারা’ বলা হয়ে থাকে।  

ইসলামের ইতিহাসের পরতে পরতে এমন অনেক বরেণ্য মনীষীর দেখা মিলবে, যারা তাঁদের জীবনের শুরুর দিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম মানুষ ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তারা এতটাই বড় হয়েছেন যে, এখনো আমরা তাঁদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। হযরত ফুযায়ল বিন ইয়ায রহ., হযরত মালিক বিন দিনার রহ., হযরত ইবরাহীম বিন আদহাম রহ. সহ আরও অনেক মনীষী রয়েছেন।

পাকিস্তানের জুনায়েদ জামশেদের ঘটনা

সাম্প্রতিক সময়ের একটি উদাহরণ দেই। পাকিস্তানের সঙ্গীতশিল্পী জুনায়েদ জামশেদ। জীবনের শুরুর দিকে তিনি ছিলেন পপ তারকা। সেই জগতে তিনি ছিলেন যারপরনাই সফল। বিশ্বজোড়া তার খ্যাতি। ওই জগতটা যে কতটা নোংরা, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে!

কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁকে সেখান থেকে তুলে এনে দ্বীনের পথে এমন উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছালেন যে, বিশ্বজুড়ে দ্বীনদার মুসলমানদের কাছে তিনি হয়ে উঠলেন একজন প্রিয় মানুষ। পৃথিবীর আনাচে কানাচে এমন কত শত ‘জুনায়েদ জামশেদ’ যে ছড়িয়ে আছে, তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।

এক সময়কার গায়ক, সন্ত্রাসী, ডাকাত, ইসলামের চরম দুশমন আল্লাহর রহমতে হয়ে যাচ্ছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। দ্বীনের দাঈ। যাদের মাধ্যমে আরও হাজারো মানুষ দ্বীনের আলোতে আলোকিত হচ্ছে। এই বাস্তবতাকে আমরা যদি সামনে রাখি তাহলে আমাদের জন্য কি হতাশ হওয়ার কোনো সুযোগ আছে? আল্লাহ কখন কাকে হেদায়েত দিবেন, কখন কার দ্বারা দ্বীনের বিরাট কাজ নিবেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। আমাদের কাজ হল, হতাশ না হয়ে আল্লাহর যা হুকুম তা সঠিক ভাবে পালন করে যাওয়া। 

আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না

দেখুন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কী দ্ব্যর্থহীন ভাবে আমাদেরকে বলছেন,

قُلْ یٰعِبَادِیَ الَّذِیْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ،  اِنَّ اللهَ یَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِیْعًا  اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُ.

আপনি (আমার বান্দাদেরকে) বলে দিন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল দয়ালু। (সূরা যুমার ৩৯ : ৫৩)

একই কথা তিনি পার্থিব সংকট নিয়েও বলেছেন। দুনিয়ার কোনো সংকটই তো আসলে স্থায়ী নয়। গোটা দুনিয়াটাই যেখানে ক্ষণস্থায়ী, সেখানে দুনিয়ার সংকট কীভাবে স্থায়ী হবে?

পবিত্র কুরআনের একটি ছোট সূরা ‘সূরা আলাম নাশরাহ’। এ সূরায় আল্লাহ তাআলার ওয়াদা করছেন,

 

فَاِنَّ مَعَ الْعُسْرِ یُسْرًا  اِنَّ مَعَ الْعُسْرِ یُسْرًا.

নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গেই স্বস্তি আছে, নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গেই স্বস্তি আছে। (সূরা আলাম নাশরাহ ৯৪ : ৫-৬)

আল্লাহ তাআলার এ ওয়াদা সর্বকালের জন্যেই। বিশেষ কোন স্থান বা কালের জন্য নয়।

তিনি অসহায়ের আহ্বানে সাড়া দেন

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলার একটি বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে-

 

اَمَّنْ یُّجِیْبُ الْمُضْطَرَّ اِذَا دَعَاهُ وَ یَكْشِفُ السُّوْٓ ءَ وَ یَجْعَلُكُمْ خُلَفَآءَ الْاَرْضِ، ءَاِلٰهٌ مَّعَ اللهِ، قَلِیْلًا مَّا تَذَكَّرُوْنَ.

বরং তিনিই (শ্রেষ্ঠ), যিনি অসহায়ের আহ্বানে সাড়া দেন, যখন সে তাঁকে ডাকে এবং তিনি বিপদাপদ দূর করে দেন আর তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে (তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের) স্থলাভিষিক্ত করেন। আল্লাহর সঙ্গে কি অন্য কোনো মাবুদ আছে? তোমরা খুব সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর। (সূরা নামল ২৭ : ৬২)

একজন মুমিন কখনোই হতাশ হতে পারে না। সে সব সময় আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে আশাবাদী থাকবে। নিরাশ কখনোই হবে না। দ্বীনী ও পরকালীন বিষয়ে তো না-ই, নিরেট পার্থিব বিষয়েও না।  

এ বিশ্বাস সব হতাশাকে দূর করে দেয়  

আমাদের তো এমনই হতে হবে ভাই। যে মুমিনের অন্তরে সর্বশক্তিমান আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস থাকবে তার হতাশ হওয়ার সুযোগ কোথায়! আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস একজনের মুমিনের অন্তরের সব হতাশাকে দূর করে দেয়।

সফলতা ও ব্যর্থতার মাপকাঠি 

সাইয়েদ কুতুব শহীদ রহ. এর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফসীর ফি যিলালিল কুরআন’ এর  একটি অংশ আপনাদের সামনে উল্লেখ করছি - যেখানে তিনি অতি সংক্ষেপে মানুষের সফলতা ও ব্যর্থতার কারণ চিহ্নিত করেছেন। সাইয়েদ কুতুব শহীদ রহ. বলেন -

‘মানুষ একই সাথে মাটির তৈরি ও আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত মাখলুক। তাই তার মধ্যে পাপ-পুণ্য, কল্যাণ-অকল্যাণ দুই ধারার প্রকৃতি সমানভাবে ক্রিয়াশীল। এ কারণে সে কোনটি কল্যাণকর, কোনটি অকল্যাণকর তা বাছাই করে যেকোন দিকে নিজেকে পরিচালিত করতে সক্ষম। আল্লাহ মানুষের মধ্যে এই ক্ষমতাকে সহজাত করে দিয়েছেন। যাকে তিনি কুরআনে কখনো ‘ইলহাম’ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করেছেন যেমন,

 

فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا.

অতঃপর তিনি তার অন্তরে পাপ ও পূণ্যের জ্ঞান দান করেছেন। (সূরা শামস ৮-৯)

আবার কখনো ‘হিদায়াত’ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করেছেন যেমন,

وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ.

আমি তাকে (পাপ ও পূণ্য) দু’টি পথই দেখিয়ে দিয়েছি। (সূরা বালাদ ১০)

এই সহজাত দু’টি প্রবণতার সাথে মানুষের অন্তরাত্মায় আরো একটি বোধগম্য ও প্রভাবশালী শক্তি রয়েছে, যার নাম হল ‘বিবেক’। যে ব্যক্তি এই ‘বিবেক’কে তার অন্তরাত্মার পরিশুদ্ধির কাজে নিয়োজিত করতে পারে, নেক আমলের মাধ্যমে তার প্রবৃদ্ধি সাধন করতে পারে এবং অন্যায় ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে বিজয়ী করতে পারে সে-ই হয় সফল ও কামিয়াব। আর যে ব্যক্তি তার বিবেকের প্রতি অবিচার করে এবং তাকে দুর্বল করে ফেলে সে-ই হয় ব্যর্থ। (তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনঃ ৮/৪৮)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে দুনিয়া ও আখেরাতে পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

মুহতারাম ভাইয়েরা! আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করুন এবং ইখলাসের সাথে জিহাদ ও শাহাদাতের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন।

আমরা সকলে মজলিস থেকে উঠার দোয়াটা পড়ে নিই।

سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين

وآخر دعوانا ان الحمد لله رب العالمين

 

******************