- [ভাই আহমদ আত তুরকিস্তানির একটি অডিও সাক্ষাৎকার থেকে ধারণকৃত]
আল্লাহর পথে হিজরত–
আহমদ আত তুরকিস্তানী
সকল প্রশংসা এক আল্লাহর জন্যে। সালাত ও সালাম শেষ নবীর ওপর; যার পরে আর কোন নবী আগমন করবেন না। পর সমাচার আলহামদুলিল্লাহ! আমি একজন মুসলিম হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেছি। জন্ম গ্রহণ করেছি–একটি মুসলিম পরিবারে। কিন্তু, শরীয়তের আদেশ-নিষেধের প্রতি আমি ছিলাম–একেবারে বেখেয়াল। তবে, আল্লাহর করুণায় ২০০৫ সালে আমি একজন মুত্তাকী ভাইয়ের সাক্ষাত লাভ করি। তিনি আমাকে দেখালেন–হেদায়েতের আলোকিত পথ। আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে তাঁকে উত্তম প্রতিদান দান করুক! তিনিআমাকে শরীয়তের ইলম শেখার উপদেশ দেন। আর আমি তাই করলাম। মাদরাসার লেখাপড়া আমার জীবনের গতি বদলে দেয়। ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। আমার অন্তর প্রসারিত হয়ে যায় ছাত্র ভাইদের জন্যে। আমরা একে অপরের সাথে চিন্তা বিনিময় করতাম। সাহায্য করতাম একজন অপরজনকে। এ যেন একটি পরিবার! বছর দুয়েক পর নিজ গ্রামে ফিরে আসি। তারপর, শহরে পাড়ি জমাই কোন কাজের খোঁজে। কিন্তু, যখন রাস্তার ওপর যত্রতত্র অশ্লীল কাজের সয়লাব দেখি; আমার অন্তর কষ্টে ফেটে পড়ে। আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি আমার একাকিত্বে। দয়াময়ের কাছে ফরিয়াদ করলাম তিনি যেন আমাকে এ অশ্লীল অঙ্গন থেকে মুক্ত করেন। আমাকে দিশা দেন সঠিক পথের। অতঃপর, আমি হিজরতের মাঝেই দেখতে পাই এ অশ্লীল পরিবেশ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় । কিন্তু, অভাবের তাড়নায় এ বিষয়ে আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কিন্তু, আল্লাহ তাআলা আমাকে এ পথে বের করার ইচ্ছা করেছেন। আমি আমার এক ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। তারপর, আবার আমার মনে আন্দোলিত হয়ে ওঠল নতুন করে হিজরতের প্রেরণা। তিনি জানালেন “হিজরতে বের হওয়ার রাস্তা তার জানা আছে।” আমাকে আরও বললেন “যদি তুমি আমাদের সাথে এ কাজের সাথী হতে চাও। তবে, আমি তোমার সহায়তা করব।” জানালেন “আমাদের হিজরত হবে কষ্টের। পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে পাহাড়ী পথ।” পরামর্শের জন্যে আমার একজন উসতাযের কাছে গেলাম। আমার শিক্ষাজীবন থেকেই তাঁদের সাথে পরিচয়। আর তিনিও আমাকে হিজরত ও জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহতে যেতে উৎসাহিত করতেন। ঐ সময় তিনি আমার মাঝে ভয় আর পরিবারের মায়া দেখেছেন। কিন্তু, হঠাৎ তিনি পরিবর্তন হয়ে যান।পরিবর্তন দেখা দেয় তাঁর কথায়। তিনি আমাকে আটকাতে লাগলেন। আমাকে জিহাদের পথে যেতে বারণ করলেন। কিন্তু, কিছুসময় পরে আমার মনে আল্লাহর কালামে এ বিষয়টির হুকুম দেখার ইচ্ছা জাগে। এ সময় আমি তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে সহায়তা পাই। আমার ওপর আল্লাহর আরেকবার দয়া। আমার চোখ পড়ল এ আয়াতে “আর মুমিনরা আল্লাহর ওপরই ভরসা করে।” তারপর আল্লাহ আমার অন্তর খুলে দিলেন। সকল কুহেলিকা দূর করে দিলেন। যা আমার পথকে আটকে রেখেছিল। আমাকে ফেলেছিল প্রতারণায়। আমার কাছে হিজরতের সব বিষয় খোলাসা হয়ে গেল। আমার হিজরত আমার সৌভাগ্য। যখন আমি চিন্তা করলাম। হিজরতের ওপর দৃঢ় হলাম। স্ত্রীর ভালোবাসা আর পরিবারের মায়া আমাকে পিছুটানতে পারে নি। আমি তখন এ থেকে ছিলাম শত ক্রোশ দূরে। এমনকি আমি নিজে নিজেই বলে ওঠলাম “আমি কি অনুভূতিহীন কোন প্রাণী-!” আমি আমার পরিবার-পরিজন, ভালোবাসার স্বজন ছেড়ে চলে যাচ্ছি! কিন্তু, আল্লাহর শোকর, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমার অন্তরে শান্তির ফোয়ারা ঢেলে দিলেন। অবশেষে, আমরা দশজন ভাই মিলিত হলাম। পায়ে হাঁটার রাস্তায় পৌঁছতে গাড়িতে চড়লাম। আর অচিরেই শুরু হবে পদব্রজ, ইনশাআল্লাহ!
অবশেষে, পৌঁছলাম কাঙ্খিত জায়গায়। গাড়ি থেকে নেমেই রাত-দিন একটানা হাঁটতে হল। এক জায়গায় বসলাম কিছুটা আরামের আশায়। আশপাশে প্রচন্ড ঠান্ডা। আর আমরা ছিলাম সীমান্তবর্তী পাহাড়ে; রাতে হাঁটতাম, দিনে আরাম করতাম। যেন, কেউ না দেখে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পাহাড়ী পথ অতিক্রম করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এবার পাহাড়ী গুহার পাশ কেটে পাথুরে পথ ধরলাম। রাতের গাঢ় কালো আঁধার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অগত্যা আমরা এগিয়ে যাচ্ছি কেবলার দিকে, ধীরে ধীরে; সূর্য অস্ত যায় যেদিকে। জানতাম এদিকেই আমাদের গন্তব্য, আর এদিকেই আমাদের উদ্দিষ্ট স্থল। এক রাতে প্রস্তারাকীর্ণ উপত্যকা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। আঁধারে ছেয়ে আছে চারদিক; আর সেখানেই রাত কাটাতে হল। মনে হচ্ছিল মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল। সবাই ভিজে গেলাম সামানসহ। কাছে থাকা ব্যাগগুলো দিয়ে কোন রকম নিজেদের বৃষ্টি
থেকে বাঁচালাম। ফজরের সময় ওঠলাম ঘুম ছেড়ে। শীতের প্রকোপে দাঁতের সাথে দাঁতের ঘর্ষণ হচ্ছিল। নামাজ পড়ে আবার অব্যাহতভাবে চলল আমাদের পথ চলা। প্রকৃতিও তখন হয় উঠেছিল প্রাণবন্ত। আশপাশে রাখালরা ছাগল চরাচ্ছে; তাই কিছুক্ষণ পরই পাশের একটি বনে আশ্রয় নিলাম। আসরের পর আমাদের পথ চলা আবার শুরু হল। ততক্ষণে কুয়াশায় আছন্ন হয়ে গেছে চারপাশ। সহসা সূর্যের আলোও হারিয়ে গেল; আমরা দিক ঠাহর করতে পারছিলাম না। নিরুপায় হয়ে হাঁটছিলাম সামনের দিকে। আমরা শুনতে পেলাম কেউ একজন কাঠ কাটছে। নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারলাম আমরা এখন এক রাখালের বাড়িতে। তাই বাড়ি ছেড়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। কিন্তু, একপাল ছাগল আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। মনে হল গাছের পেছনে পলায়ন করা নিরাপদ। তবুও বাঁচা গেল না; বাড়ির কুকুরটা আমাদের ধরে ফেলল। আর কুকুরটাও ডাকছিল অনবরত। অবশেষে, আমাদের দিকে দু’জন লোক এগিয়ে এল। আমরা মনে মনে বললাম “এই বুঝি শেষ!” তাদের একজন আমাদের কাছে এসে বলল “কারা তোমরা? এখানে এলে কিভাবে?” আমাদের কেউ একজন উত্তর দিল “আমরা মুসাফির। এখানে ভ্রমণে এসেছিলাম; কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলি।” তাদের একজন বলল “তোমরা কি অন্যদেশে পালাতে চাইছো?” আমরা না সূচক মাথা নাড়লাম। কিছুক্ষণ কথা বলার পর তারা বুঝতে পারল আমরা মুসলিম। আমাদেরকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়ন করল। সেখানে আমরা কিছুসময় আরাম করলাম। তাদের মা আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন “যদি তোমরা এই পাহাড়ের পিছনে চলে যেতে; তবে তোমাদেরকে পুলিশ ধরে নিয়ে যেত।” আল্লাহর শোকর আদায় করলাম আমরা; তিনিই আমাদের হেফাজত করেছেন। আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। আমাদের মনের খবর জানার পর, তারা আমাদের পথ দেখিয়ে দিল। আমরা বনে ফিরে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। অতঃপর, আল্লাহর নামে অগ্রসর হতে লাগলাম পাহাড়ের চূড়ার দিকে। চলার পথেই শুরু হল বৃষ্টি। চূড়ায় ওঠে সামনের শহরের দিকে যাত্রা করলাম। হাঁটতে হাটঁ তে রাত হয়ে গেল। আর রাতটাও ছিল খবু অন্ধকার। আমরা আলোও জ্বালাতে পারছিলাম না। হঠাৎ শুনতে পেলাম কেউ আমাদের দিকে আসছে। ভেবেছিলাম চীনা সেনা হবে। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে প্রায় আধঘন্টা যাবৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কাঁপছিলাম শীতের প্রচন্ডতায়। শরীরের উষ্ণতা ক্রমশ নিচে নামতে লাগল। ভাবছিলাম চাইলেও আমরা আর ফিরে যেতে পারব না। সৈন্যরা আসলে আমরা পালাতেও পারব না। তাই, নিয়তকে পরিশুদ্ধ করে নিলাম। ভরসা করলাম একমাত্র আল্লাহর ওপর। সিদ্ধান্ত নিলাম আমরাআমাদের সফর পর্ণূ করব। যদি চীনের সৈন্যরা আমাদের ধরে ফেলে; তবে, এই ছুরি হাতেই তাদের হত্যা করব। আর যদি আমরা নিহত হই; তাহলে, তা হবে আল্লাহর পথে শাহাদাত, ইনশাআল্লাহ! সকাল পর্যন্ত আমরা হাঁটতে লাগলাম। আমাদের পোষাক থেকে বৃষ্টির পানি ঝরছিল। আমরা আগুনও ধরাতে পারলাম না; কারণ, ধোঁয়ার উপস্থিতিতে রাখালরা অবস্থান জেনে যাবে। ভেজা-ঠান্ডা কাপড়েই শুয়ে পড়লাম। পাহাড়ের মাঝে আমাদের সফর ছয় দিন যাবৎ চলতে লাগল। আর পাহাড়গুলো ছিল খুবই পিচ্ছিল । আমরা নিজেদেরকে গাছের সাথে ঠেক দিয়ে চলছিলাম; যেন ঘুমের কারণে, নিচে না পড়ে যাই। এভাবেই আমাদের সফর চলতে থাকল। পাশের শহরের তালাশ করতে করতে একটি চারণভূমিতে এসে পড়লাম। আর এর মাঝ দিয়ে এগুতে লাগলাম। তা পূর্ণ ছিল লম্বা লম্বা ঘাসে। সারা রাত চলার পর, বড় দরজার কাছে আসলাম। এর পিছনেই তিনটি ঘর। বাড়িকে পিছনে ফেলে আমরা দৌড় লাগালাম উঁচুভূমির দিকে। ঘন ঘাসের মাঝে কাটিয়ে দিলাম পুরো রাত। ফজরের নামাজ পড়ে আবার সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম দক্ষিণ পাশে কংক্রিটের তৈরি একটি টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। মনে করলাম এটা পাশের দেশের প্রাচীর। পরে উত্তর দিকে দৃষ্টি দিলাম; সেদিকে লোহার লম্বা টাওয়ার দেখলাম। আমরা মনে করেছিলাম এগুলো নেটওয়ার্ক টাওয়ার। পরে বুঝলাম নেটওয়ার্ক টাওয়ার নয়; এগুলো পর্যবেক্ষক টাওয়ার। একটি চীনে, অপরটি পাশের দেশে। আর আমরা এ দু’টোর মাঝে। সিদ্ধান্ত নেয়া হল আমরা সূর্যাস্তের পরে রওয়ানা দিব। রাতে তিন ঘণ্টা হাঁটার পর সামনে পেলাম কাঁটাতারের প্রাচীর। এতে সামনে আর এগুতে পারলাম না। পরামর্শে সিদ্ধান্ত হল পাহাড়ী অঞ্চলে যাওয়া পর্যন্ত আমরা প্রাচীর ঘেষে চলতে থাকব। কারণ, পাহাড়ের মধ্যে প্রাচীর বানানো হয় নি।
আমরা চলতে লাগলাম; আর দু’প্রাচীরের মাঝে একটি রাস্তাও পেয়ে গেলাম। আমরা এর ওপর দিয়ে চলতে থাকলে, একসময় গাড়ীর রাস্তা পেয়ে যাব। এই রাস্তাটা দু’টি দেশের মাঝখানে। আর এটি একটি সীমান্তপথ; যা নজরদারী করার জন্যে বসানো হয়েছে। আমরা সবাই জানতাম যদি সেনাবাহিনীর গাড়ি আসে; তাহলে আমরা এই দেশ ত্যাগ করতে পারব না। অবশেষে আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা হাঁটতে থাকলাম দিগন্তপথে। যেখানে আছে মুক্তির মোহনা, শান্তির ফোয়ারা। প্রায় ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর আল্লাহর করুণায় প্রাচীরের কাঁটাতারের মাঝে একটি ফাঁক পেলাম। যা বৃষ্টির কারণে তৈরি হয়েছে। আমরা ওখান দিয়ে প্রবেশ করলাম। আর এভাবেই প্রবেশ করলাম পার্শবর্তী দেশে! সে সময় আমাদের যে, কি আনন্দ লাগছিল! তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আল্লাহ তাআলার এই অনুগ্রহে আমরা তাঁর অনেক শুকরিয়া আদায় করলাম। প্রতিবেশী দেশে প্রবেশ করে, আমরা নিকটবর্তী পাহাড়ে চড়লাম। সেখানে অনেক আলো দেখা যাচ্ছিল। আর লক্ষ্য করলাম দু’শ মিটার দূরে সেনাবাহিনীর একটি তাঁবুদেখা যাচ্ছে। যদি আমরা ওদিকে পনের মিনিট হাঁটতাম; নিঃসন্দেহে তারা আমাদের ধরে ফেলতে পারতো। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা তাদের নাকের ডগা দিয়ে হেঁটে আসলাম; তারা আমাদের দেখতে পায় নি। আমরা আমাদের সফর চালিয়ে গেলাম পশ্চিমের দিকে। আমাদের কাছে এই দেশে অবস্থানকারী ভাইদের মোবাইল নাম্বার আছে। কিন্তু সমস্যা হল বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের মোবাইলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে, আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। পূর্ণ একদিন আমরা সেখানে অবস্থান করলাম। তারপর সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আমাদের সফর পূর্ণ করব। পুরো এক রাত হাঁটার পর আমরা সমতল ভ‚মিতে পৌঁছলাম। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা দু’ঘণ্টা যাবৎ হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়লাম এক কৃষি জমির ওপর। সেখানে এক কিলোমিটার দূরত্বে একটি বাড়ি ছিল। আমরা ঝুঁকি পরিহার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর চলে এলাম পাহাড়ী পথে। অনেক দীর্ঘ সময় ধরে আমরা আরাম করলাম। আর আমরা কিছু রাখালের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেও; তাদের সাথে কোন কথা বলি নি। তারাও আমাদের সাথে কোন কথা বলে নি। আমাদের সাথে যে পরিমাণ খাবার ছিল; তা শেষ হয়ে গেল। খাবার কেনার দোকান এখান থেকে প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে। দুই ভাই খাবার আনতে গেলেন; আর বাকীরা অবস্থান করছিলাম পাহাড়ে। আমরা মাগরিবের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম; কিন্তু তারা তখনও ফিরে নি। তাদের জন্যে আমাদের দুশ্চিন্তা হতে লাগল। আমরা এ দেশের ভাষা বুঝি না। সাথে তেমন অর্থকড়িও নেই। আমরা ঠিক করতে পারছিলাম না আমাদের কী করা উচিত। তাই, আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতি করে, একনিষ্ঠ মনে দোয়া করতে লাগলাম। আর আমরা সেখানেই রাত কাটালাম ঐ দুই ভাইয়ের অপেক্ষায়। ফজরের সময় ওঠে দেখি আমাদের ঐ দুই সাথী ফিরে এসেছে। তাদের দেখে আমরা খুবই আনন্দিত হলাম। তারা খাবার নিয়ে এসেছে; সবাই খাবার খেয়ে নিলাম। তারা বলল “রাখালদল আমাদের পাহাড়ে অবস্থানের কথা সেনাবাহিনীকে বলে দিয়েছে। তারা এখন আমাদের তালাশ করছে।” আমরা সূর্যোদয়ের আগে আগে পাহাড় থেকে নামতে শুরু করলাম।যেহেতু আমরা দিনে বের হই না; তাই, আমরা একটি জায়গা খুঁজতে থাকলাম। উপযুক্ত একটি জায়গা পেয়েও গেলাম। তখন আমরা সবাই ছিলাম ভয়ার্ত। একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করছিলাম “অবশেষে আমরা কি জিহাদের ভূমিতে নিরাপদে পৌঁছতে পারবো!?”
মাগরিবের নামাজের পর আমরা ক্ষেতের মাঝ দিয়ে ফজর পর্যন্ত চললাম। সবাই পিপাসার্ত ছিলাম; কিন্তু পানি পাচ্ছিলাম না। খাবারও তেমন নেই। নিজেদের মধ্যে পরামর্শের পর সিদ্ধান্ত হল; আমরা কিছুলোক যাব পাহাড়ের দিকে; আর কিছু যাব খাবার সংগ্রহের জন্যে গ্রামের দিকে। একজন ভাই পরামর্শ দিলেন আমরা ক্ষেতের মাঝ দিয়ে চলতে থাকলে হয়তো তরমুজ পেয়ে যেতে পারি। অথবা খাওয়ার জন্যে অন্য কিছুপেয়ে যাব। আমরা তার এই ভাবনার প্রশংসা করলাম। আর সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। সামনে দু’টি কূপ পেলাম। আমাদের এক ভাই কূপের পাশে গেল। কূপ দু’টি শুকিয়ে কাঠ সদৃশ হয়ে আছে। পানির পরিবর্তে সে আমাদের কাছে একটি কবুতর নিয়ে আসল। পরে রান্না করার জন্যে আমরা সেটাকে জবাই করলাম। আমাদের দু’সাথীর ক্রমশ রোগ বেড়ে যাচ্ছিল। তারা চেয়েছিল আমরা যেন তাদের রেখে সামনে এগিয়ে যাই; আর আমাদের সফর পূর্ণ করি। আমরা তাদের কথায় কান দিলাম না; বরং তাদের নিয়ে সামনে এগিয়ে
গেলাম। আবহাওয়া তখন খুব গরম। সমতল পথে চলতে চলতে এক সময় আমরা একটি ছোট খালের সামনে এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে পানি পান করলাম। এবং গোসল সেরে নিলাম। আর খেয়ে নিলাম আমাদের সাথে সর্বশেষ যা ছিল; তাও। সামান্য বিশ্রামের পর আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। অবশেষে আল্লাহর অনুগ্রহে পেয়ে গেলাম কাঙ্খিত পথ। সামনেই দেখলাম তরমুজ ও ফুটির ক্ষেত। আমরা সেখান থেকে কিছুটা খেয়ে নিলাম। তারপর, দু’জন ভাইকে পাঠালাম এখানে অবস্থানরত আমাদের ভাইদের পর্যন্ত পৌঁছার পথ খুঁজতে। আমরা তরমুজের ক্ষেতেই রয়ে গেলাম; আর অসুস্থ ভাইদের জন্য কবুতরের স্যুপ তৈরি করলাম। তাদেরকে খাইয়ে আমরাও কিছুটা খেলাম।
সেখানে তিন রাত অবস্থান করেছি আমরা। এরই মাঝে অসুস্থ দুই ভাইও সুস্থ হয়ে গেল। অবশেষে, ঐ দুই ভাই খাবার ও খুশির খবর নিয়ে এলেন। তারা যোগাযোগ করতে পেরেছেন আমাদের আনসার ভাইদের সাথে। আর অচিরেই তারা এসে আমাদেরকে নিয়ে যাবে। ভাইয়েরা গাড়ি যোগে এসেছেন। এবং আমাদেরকে নিয়ে যেতে পূর্ণ এক রাত লেগেছে। আমরা শহরের ভিতরেই থাকতে লাগলাম। তাঁরা আমাদেরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। অবশ্য, সবাই এক জায়গায়ই ছিলাম। অবশেষে দীর্ঘ পদব্রজের পর আমরা বিশ্রাম নিলাম। তাদের আতিথেয়তায় আমরা দশ দিন থাকার পর, ভাইয়েরা বললেন আমাদের সফরটা বাস যোগে সমাপ্ত করতে হবে। সীমান্তবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত আমরা বাসে চড়ে গেলাম। সেখানে কিছু ভাই ছিল আমাদের অপেক্ষায়। তাঁরা গাড়ি দিয়ে আমাদেরকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল। ফজরের পর আমরা সীমান্ত এলাকা অভিমুখে রওয়ানা হলাম। এর পিছনে প্রায় বিশ মিটারের একটি নদী। বলা হল পনের মিনিট আমাদেরকে পানি দিয়ে হাঁটতে হবে। তারপর সেখানে আমরা পাব আমাদের জন্যে অপেক্ষমান গাড়ি। প্রকৃতপক্ষে, আমরা নদী পথে অপর দেশে প্রবেশ করে, আমাদের জন্য অপেক্ষমান গাড়িতে আরোহণ করলাম। আর মূলতঃ এটি ছিল চোরা পথে সফর। অবশেষে, কোনরূপ থামানো ব্যতীত তৃতীয় দেশে প্রবেশ করলাম। সেখানে বেশি দেরি না করে, আমাদের সফর শুরু হল চতুর্থ দেশের দিকে। নিরাপত্তার খাতিরে আমরা বাসে আরোহণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
চতুর্থ দেশে প্রবেশ করার পর, আমরা দুই গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন যায়গায় চলে গেলাম। ভাইয়েরা আমাদেরকে এখানে একটি সুন্দর বাড়িতে নিয়ে এল। এবং ভালোভাবে আমাদের মেহমানদারী করল। আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন! সেখানে আমরা দুই মাস অবধি অবস্থান করলাম পাসপোর্টের অপেক্ষায়। আমাদের পরিচয় পত্র না থাকায় বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল। পাসপোর্ট পেয়ে আমরা নিরাপদে বের হতে লাগলাম। সপ্তাহ খানেক পর আমরা অন্য দেশের উদ্দেশ্যে বিমানে আরোহণ করলাম। সেখানে মুজাহিদ ভাইয়েরা আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। আল্লাহ তাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করুন! তাঁরা আমাদের মেহমানদারী করল। রাতে গাড়িতে চড়িয়ে আমাদেরকে নিয়ে গেলেন মুজাহিদদের একটি এলাকায়। বাজারে গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। সে গাড়ির অপেক্ষায়; যে গাড়িতে চড়ে আমরা আমাদের তুর্কিস্তানি ভাইদের নিকট যাব! আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছি; যখন দেখেছি আমাদের আশপাশে ইসলামি নিদর্শন; যা জিহাদের ভূমি ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না। অবশেষে, একদিন পর আমরা আমাদের কাঙ্খিত ‘আল হিজবুল ইসলামি আত-তুরকিস্তানি’ এর ভাইদের কাছে পৌঁছলাম। এর প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমরা গেলাম মুজাহিদ ভাইদের একটি বাসস্থানে। আমরা খুবই আনন্দিত হলাম; যখন দেখলাম ভাইদের কাছে প্রায় সকল ধরনের অস্ত্র আছে। এক সপ্তাহ যাবৎ আমরা এক আনসার ভাইয়ের বাড়িতে থাকার পর, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। অতঃপর এক সপ্তাহ পর ভাইয়েরা আমাদেরকে সেনা প্রশিক্ষণে নিয়ে গেলেন। প্রশিক্ষণ শেষে আমরা প্রহরায় ও আল্লাহর শত্রুদের মোকাবেলায় অংশগ্রহণ করলাম।সবশেষে, আমি আমার ভাইদের উদ্দেশ্যে বলব “যখন তুমি আল্লাহর ওপর ভরসা করবে; তখন আল্লাহ তোমার জন্য পথ করে দিবেন। তোমাদের তুর্কি ভাইদের ৯০% সীমান্তপথে কোনরূপ পাসপোর্ট ব্যতীত জিহাদের ভূমিতে এসে পৌঁছেছে।” আর সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্
وَمَن يُهَاجِرْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ يَجِدْ فِى ٱلْأَرْضِ مُرَٰغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةًۚ وَمَن يَخْرُجْ مِنۢ بَيْتِهِۦ مُهَاجِرًا إِلَى ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ يُدْرِكْهُ ٱلْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُۥ عَلَى ٱللَّهِۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
(আন নিসা ৪:১০০)
আল বালাগ
ম্যাগাজিন ইস্যু-২