সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষধ দিবো কোথায়?
আবু আবদুল্লাহ
বর্তমান মুসলিমবিশ্বের পরিস্থিতি যদি এক বাক্যে প্রকাশ করার কথা বলা হয়, তাহলে মুখ ফসকে যে বাক্যটি বেরিয়ে আসবে তা হচ্ছে সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিবো কোথায়? এই কথার সাথে আপনার দ্বিমত করার অবকাশ আছে। যদি শেষপর্যন্ত সঙ্গে থাকেন তাহলে আশা করি দ্বিমত অনেকাংশ কমে আসবে। আসুন, তাহলে এবার আলোচনাটা সামনে এগিয়ে নিই। আমরা যদি মুসলিম উম্মাহর বর্তমান শত্রুর গতিবিধির ওপর নজর বুলাই তাহলে দেখতে পাই, ইসলামের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের যতসব শত্রু আছে, সবাই ভিন্ন ভিন্ন অজুহাতে এই মজলুম উম্মাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এক শত্রু ইয়াহুদী। তারা আমাদের প্রথম কিবলা কেড়ে নিয়েছে, অতঃপর সেখানে আমাদের প্রবেশও বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের আরেক শক্র হচ্ছে খ্রিষ্টান। তারা ভিন্ন ভিন্ন ফ্রন্টে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, ওয়াজিরিস্তান, মালি, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য-আফ্রিকা এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে তারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নানা ছদ্মাবরণে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আরেক শত্রু হচ্ছে মুশরিক। এরা কখনো হিন্দুর অবয়বে, আবার কখনো বৌদ্ধের অবয়বে চীন, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকায় আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আরেক শত্রু হচ্ছে মুনাফিক তথা যিন্দীক। এই শত্রুরা কখনো শীয়াদের আকৃতিতে, আবার কখনো নুসাইরীর আকৃতিতে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন ও বাহরাইনে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কুরআন শরীফে উপরোক্ত চার শত্রুকে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রধান শত্রু চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই এভাবে বিন্যাস করলাম। আর আজ এরা সবাই একাট্টা হয়ে আমাদের নির্মূল করতে নেমেছে। এদিকে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচর্যা করছে শকুল গডফাদার জাতিসংঘ। অতীতে কোনোদিন সব শত্রু আমাদের বিরুদ্ধে একসাথে এভাবে একাট্টা হয় নি। এতো গেলো আমাদের শত্রুর গতিবিধি। এবার নামধারী মুসলিম শাসকদের উপর চোখ বুলান। তাহলে দেখবেন যে, শকুল গডফাদার জাতিসংঘ, আমেরিকা ও ইইউয়ের সামনে তাদের জুতা সাফ করা ও হাত কচলিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো অবদান নেই। যে জায়গায় গেলে ওই শত্রুরা নিজেদের জুতো কর্দমাক্ত হওয়ার আশঙ্কা করে সেখানে তারা এদেরকে ব্যবহার করে। সৌদী, পাকিস্তান ও তুরস্কের এ ক্ষেত্রে একই অবস্থা। এতো গেলো বহির্বিশ্বের অবস্থা। এবার শুনুন, স্বদেশের কথা। প্রথমেই আমরা বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির উপর একটু চোখ বুলাই। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার কথাই প্রথমে আমাদের স্মরণ হবে, মানে- বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির জিরো টলারেন্স চলছে! অনেকে এ কথার ওপর তীব্র আপত্তি তুলে বলবেন, আপনার চোখে কি বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোর আন্দোলন-ফান্দোলন নজরে পড়ে না?
আমি বলবো, হ্যাঁ, নজরে পড়ে! কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি, ইসলামি রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য কী? আন্দোলন-ফান্দোলন? না, শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা? দেখানতো, এতো বছর রাজনীতি করার পর অন্তত অন্তত একটি এলাকায় এক সেকেন্ডের জন্যে শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা করার খবর! যদি হালির পর হালি ইসলামি দল বৃদ্ধির নাম ইসলামি রাজনীতির সফলতা হয়ে থাকে, তাহলে কেনো এদেশে পাপাচারের হার বাড়ছে? কেনো শাহবাগে বদমাশদের প্রকাশ্য র্যালি হচ্ছে? এটা কি ইসলামি রাজনীতির ব্যর্থতা নয়? আপনি একদিকে রুমের মধ্যে এসি চালু করলে, অন্যদিকে দরোজা-জানালা খুলে দিলেন, তাহলে কি এ এসির কোনো অর্থ আছে? বস্তার পর বস্তা ওষুধ খেলেন, কিন্তু রোগ মোটেও কমলো না; তাহলে কি এ ওষুধের কোনো মূল্য থাকে? এমনিভাবে হালির পর হালি ইসলামি দল গজিয়ে ওঠার পরও যদি এদেশে শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা না হয়, পাপাচার বেড়েই চলে, তবে কি এটা ইসলামি দলের সফলতা? আপনি এবার এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে চোখ বুলান, তাহলে দেখবেন, এটা কোনো মানুষ তৈরির সিলেবাস নয়, বরং এটা হচ্ছে পরিমল-পান্না তৈরির সিলেবাস, যার দ্বারা তৈরি হবে ঐশীর মতো মেয়ে; পরবর্তীতে এরাই কয়েকটা বয়ফ্রেন্ডের সাথে শয়নের জন্যে মা-বাপকে কুপিয়ে মারবে। এটা হচ্ছে মানুষকে পশু বানানোর সিলেবাস। যার প্রধান লক্ষ্য পেটতন্ত্র বাস্তবায়ন। সকাল-সন্ধ্যা কুকুরের মতো পেটের ধান্ধায় ছোটাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। নিজের সৃষ্টিকর্তাকে চিনা এর লক্ষ্য কখনোই নয়!
-আবুল মালের কথা শুনলে এটা আরো দৃঢ় হয়।
এবার আসুন, আমাদের নিজেদের উপর চোখ বুলাই। তাতারীদের হাতে বাগদাদ পতনের সময় সেকালের আলেমদের যে অবস্থা ছিলো, কমিউনিস্টদের হাতে বোখারা-সমরকন্দের পতনের সময় তখনকার আলেমদের যে অবস্থা ছিলো, বর্তমানে এই উম্মাহর কঠিন দুর্দিনে আমাদের আলেমদের অবস্থা এরচেয়ে কম নয়। যেসব মাসআলা-মাসায়িলের সমাধান আমাদের পূর্বসুরী আলেমরা বছরের পর বছর দিনকে রাত করে, রাতকে দিনকে করে সূর্যের আলোর মতো পরিষ্কার সমাধান দিয়ে গেছেন, আজ সেসব মীমাংসিত বিষয় নিয়ে নতুনভাবে ফিতনা ছড়ানো হচ্ছে। ফোঁড়াকে চুলকাতে চুলকাতে টিউমার বানানো হচ্ছে। কথায় কথায় চলছে ফতোয়া। আরেকদল আছেন, যারা টিভি স্ক্রীনের সামনে স্টুডিওতে এসির ভেতরে বসে শুধু শিরক বেদাত বলে মুখে ফেনা তুলছেন, অথচ তাদের বেদাত বুলি হচ্ছে সীমিত কয়েকটি বিষয়ের উপর, রাষ্ট্রকর্তৃক শতাধিক শিরক-বেদাত নিয়ে ওদের টু শব্দ নেই। আছেন শুধু কথিত শিরক-বেদাত নিয়ে নিজেদের ইলমের লালবাতি জ্বালাতে।
এবার বলুন, উম্মাহর বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমার উপরোক্ত উক্তি উল্লেখ করা কি ভুল হয়েছে? আশাকরি এতক্ষণের সহযাত্রায় আমাদের মতের দূরত্ব অনেকটা কমে এসেছে। বর্তমান মুসলিমদের অবস্থাকে যদি আপনি একটি বিল্ডিংয়ের সাথে তুলনা করেন, তাহলে জেনে রাখুন, এই বিল্ডিংয়ের পিলার, ইট, বালু, পাথর ও রঙসহ সবকিছুর ডেট ওভার হয়ে গেছে। যেকোনো সময় রানা প্লাজার কাহিনী ঘটতে পারে। এই যদি হয় বিল্ডিংয়ের অবস্থা, তাহলে কি আমাদের উচিৎ নয়, এটা ভেঙ্গে নতুন আরেকটি বিল্ডিং নির্মাণ করা? আজ ইসলাম নামক বিল্ডিংয়ের ভেতর বস্তুবাদ, ভোগবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, শিরক ও বেদআত ইত্যাদি পিলার, ইট, পাথর, বালু, সিমেন্ট হিসেবে ঢুকে তা পতনোন্মুখ করে দিয়েছে। সুতরাং এটা তছনছ করে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা রচনা করতে হবে, যেভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবের জাহিলি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে ইসলাম নামক বৃক্ষের জন্ম দিয়েছেন। নতুবা কখনো পিলার, আবার কখনো ইট বদল করে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। আর এই নতুনব্যবস্থা হচ্ছে। আমাদের হারানো ধন, গৌরবের মুকুট ‘খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ।’
যে খলীফা নির্বাচিত হবেন উম্মাহের দীনদার প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আলেমদের মতামতের দ্বারা। যে খলীফার প্রধান লক্ষ্য হবে উম্মাহকে এক করা, বিভক্ত করা নয়। যিনি শুধু শুধু বায়য়াত তলব না করে উম্মাহর সংরক্ষণের দিকে মনোযোগী হবেন। যাকে এই উম্মাহ স্বাগত জানাবে, যার ভয়ে পালিয়ে যাবে না, সমুদ্রে ডুবে মরবে না। যিনি হযরত আবু বকর রাজিয়াল্লাহু আনহুর মতো একই সাথে কয়েক ফ্রন্টে সৈন্য পরিচালনা করবেন, হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু আনহুর মতো ফেকহী ইখতেলাফকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাধান দিবেন। যিনি হযরত হাসান রাজিয়াল্লাহু আনহুর মতো প্রয়োজনে ক্ষমতা থেকে সরেও উম্মাহর আভ্যন্তরীণ রক্তপাত বন্ধে সচেষ্ট হবেন। যার ভয়ে ইউরোপ-আমেরিকা আমাদের উপর ছড়ি ঘুরানোর পরিবর্তে ট্যাক্স দিবে। জানি এগুলো স্বপ্ন, কিন্তু এর বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। যদি এমন শাসকের ছায়ায় অন্তত একদিন বসবাস করতে পারতাম!!
আল বালাগ
ম্যাগাজিন ইস্যু-১