JustPaste.it

 

অরাজকতার কবলে বিশ্ব

 

মূল

শাইখ আবু উবাইদা আব্দুল্লাহ আল আদম রহিমাহুল্লাহ

 

অনুবাদ

মুহাম্মাদ সালমান বাঙ্গালী

 

 

 

بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه ومن والاه.

আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি…

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। রহমত এবং শান্তি বর্ষিত হোক রাসুলুল্লাহ , তাঁর পরিবার-পরিজন, সাথীবর্গ এবং সকল নবীপ্রেমিকেরদের ওপর।

প্রায় নয় মাস পূর্বে অর্থাৎ বরকতময় আরব বিপ্লবেরও আগে একবার আমি শায়খ হাকিম আতিয়াতুল্লাহ লিবীর কাছে বসা ছিলাম। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম যে, কিছু আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রে চলমান সংকট, অস্থিতিশীলতা, বিশৃংখলা, অরাজকতা এবং বর্তমান সময়ে এসবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছু লিখবো। সুনির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে এবং বিশেষ কিছু মাপকাঠি অনুসারে এসকল রাষ্ট্রে এজাতীয় বিশৃংখলা ও অরাজকতা সাড়া ফেলবার মতোই ঘটনা। এখানে সুনির্দিষ্ট শর্ত এবং মাপকাঠির কথা এজন্যই বললাম যে, মুসলমানের এক ফোটা রক্ত আমার কাছে পৃথিবী এবং পৃথিবীর সব কিছু অপেক্ষা অধিক মূল্যবান।

উম্মতের অবস্থা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা এবং দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পর আমার কাছে মনে হয়েছে, ক্রুশ উপাসক ও তাদের আজ্ঞাবহ স্বৈরাচারী শাসকদের অন্যায় শাসন এবং লাঞ্ছনা-গঞ্জনার যে কালো অধ্যায় মুসলমানরা আজ পার করছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য জাতীয় জীবনে এমন একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হওয়া প্রয়োজন, যা আরব ও মুসলিম বিশ্বকে তার করণীয় স্পষ্ট করে দিবে। সে পরিস্থিতির আলোকে বিশ্বময় খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঐশী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইসলামী সমাজগুলো একটির পর একটি প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে। এই ধরণের পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে আমি “প্রশংসনীয় বিশৃঙ্খলা" বলে থাকি। কারণ এজাতীয় বিশৃঙ্খলা ও মানবিক বিপর্যয় জিহাদি আন্দোলন প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের পক্ষে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয়। এ ধরণের পরিবেশে জিহাদি আন্দোলন এমন এক গতিতে ও পদ্ধতিতে বিকশিত হয় যেটা শত্রুর পক্ষে পুরানো পলিসি দিয়ে মোকাবেলা করা দুষ্কর হয়ে পড়বে। এর ফলে আরব অঞ্চলের পরিস্থিতি এবং তার উপর ভিত্তি করে গোটা বিশ্বের পরিস্থিতি এমন এক ঘোলাটে অবস্থায় যাবে যে, বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কেমন হতে পারে এবং মুসলমানদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা করতে ব্যর্থ হবে।

আসলে এই বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরামর্শের জন্য শায়েখ আতিয়াতুল্লাহ'র সঙ্গে বসা ওই বৈঠকে আমি হযরতের কাছে এ বিষয়ে আমার লেখার আগ্রহ প্রকাশ করি। আল্লাহ তাকে সম্মানিত করুন! তিনি তৎক্ষণাৎ একই বিষয়ে কিংবা কাছাকাছি কোন একটি বিষয়ে তাকে দেয়া শায়খ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ'র একটি উপদেশ আমাকে শুনিয়ে দেন। শায়খ (আকরামাহুল্লাহ্) আমাকে পরামর্শ দেন, এ বিষয় নিয়ে যেন আমি ঘাঁটাঘাঁটি বা লেখালেখি না করি। কারণ এতে করে সমালোচকদের পক্ষে মুজাহিদদেরকে দোষারোপ করা এবং অপবাদ দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। শাইখ উসামা বিন লাদেন ইতিপূর্বে তাঁকে এমনই পরামর্শ দিয়েছিলেন। আর এখন তিনি আমাকে সেই একই পরামর্শ দিলেন।

আল্লাহর অনুগ্রহে এখন সময় এসেছে। আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদেরকে দিয়ে আমাদের আশানুরূপ একটি ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছেন। আর তা হল আরব জাতিগুলোর আত্মকলহ।

স্বৈরাচারী তাগুত শাসকদেরকে উচ্ছেদ করা, মুসলিম উম্মাহর ওপর থেকে লাঞ্ছনা ও অপমানের বোঝা দূর করা এবং আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত মুসলমানদের হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য এটা খুব প্রয়োজন ছিল। এ কারণে আমি আশা করব, জিহাদ এবং মুজাহিদদের সম্পর্কে অবগত এমন ব্যক্তিরা এ বিষয় নিয়ে আমাদের লেখালেখি ও রচনা-পর্যালোচনার ব্যাপারে আপত্তি তুলবেন না। আল্লাহর কাছে আমরা এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি যে, ইসলাম এবং মুসলমানদের স্বার্থে তিনি বিশ্বময় চলমান এই সংকটকে আরো বৃদ্ধি করে দেবেন। কেউ যদি একান্তই আপত্তি করতে চান, তিনি যেন স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের অভ্যুত্থান, বিপ্লব ও গণজাগরণের ব্যাপারে আপত্তি না করে অন্যান্য বিষয়াবলীতে আপত্তি তোলেন। আমি মনে করি বর্তমান সময়ে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এমন কাজ করবেন না।

পূর্বের দিনগুলোতে আমি চিন্তা করতাম, আরব ও মুসলিম বিশ্বের যেসব রাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বিপর্যয়ের ফসল ঘরে তোলার জন্য উপযোগী, সেসব রাষ্ট্রে যদি প্রশংসনীয় বিপর্যয় দেখা দেয় তাহলে কেমন হবে!! আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে আমার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে। আজ কেবল আরব রাষ্ট্রগুলোই প্রশংসনীয় বিপর্যয়ের দিকে যাত্রা করছে না, বরং আরব রাষ্ট্রগুলোর মত না হলেও শ্লথ গতিতে ইউরোপ আমেরিকাসহ গোটা খ্রিস্টান ও রোমান সাম্রাজ্য এমনি এক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

তাই আরব বিশ্বে – বিশেষ করে যেসকল রাষ্ট্রে গণবিপ্লব বিস্ফোরণের ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। বরং তাগুত শক্তি এবং তাদের স্বৈরশাসনের শৃঙ্খল ছিন্ন করে স্বাধীনতা লাভের ডাক সেখানে ক্রমশ বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে, বর্তমান অবস্থাটা প্রাক অধুনা যুগের অস্থিতিশীল আরব পরিস্থিতির দিকে মোড় নিচ্ছে। সেসময়কার মত স্বায়ত্তশাসনকামী মনোভাব আরববিশ্বে আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন পর্যায়ে হচ্ছে, প্রতি স্তরেই সুনির্দিষ্টভাবে এই মনোভাব বৃদ্ধির কাজ এগিয়ে চলছে।

কেউ যদি মনে করে এতদাঞ্চলে বিপ্লব পূর্ব যুগের মত স্থিতি ও স্বস্তি ফিরে আসা সম্ভব; কেউ যদি আশা করে পশ্চিমা রীতিতে গণতন্ত্রের সফল চর্চা হিসেবে এখানে বিভিন্ন দলের মাঝে ক্ষমতার পালাবদল ও দ্বিপাক্ষিক বিনিময় ঘটবে, আর তার হাত ধরে রাজনৈতিক স্থিতি ও নিরাপত্তা ফিরে আসবে, এমন ব্যক্তি আসলে বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত নয়। এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটা বলা যায় যে, সে আরব জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্যের কথা জানে না। আরবরা নিম্নোক্ত কারণে ক্ষমতার দ্বিপাক্ষিক আদান-প্রদানের কোনো সিস্টেমে আদৌ অভ্যস্ত নয়:—

প্রথমত: জাতিগতভাবেই আরবদের বৈশিষ্ট্য হলো, সাধারণ অবস্থায় তারা একে অন্যের অধীনস্থতা মেনে নিতে পারে না। রাজনৈতিক অস্থিরতা চলাকালে - যখন সশস্ত্র তৎপরতার সুযোগ অবারিত থাকে - এমন পরিস্থিতিতে কোন নবী রাসূলের আবির্ভাব, কোন ধর্মীয় একাধিপত্য কিংবা ধর্মের অন্য কোন বিরাট প্রভাব ছাড়া আরবদের ইতিহাসে একতার কোন নজির নেই। যে কোন প্রকারে ধর্মীয় চরিত্র ও ধর্মীয় আবহ সৃষ্টি না হলে তারা এক প্লাটফর্মে আসতে পারে না। ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন স্বীয় 'মোকাদ্দমা' গ্রন্থে এমনটিই বলেছেন। আরব ঐক্যের যে সূত্রগুলো বলা হলো, পশ্চিমা গণতন্ত্রের ছায়ায় তার কোনোটিই বাস্তবায়নের সুযোগ নেই।

দ্বিতীয়তঃ একই রাষ্ট্রে বহু ধর্মীয় সম্প্রদায় ও বর্ণবাদী গোষ্ঠীর উপস্থিতি সাধারণত স্থিতিশীলতার পথে বাধা হয়ে থাকে। আর এর ফলে স্বাভাবিকভাবে সুষ্ঠু ও নিরাপদ পন্থায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে ক্ষমতার পালাবদল ও দ্বিপাক্ষিক বিনিময় একরকম অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। বিশেষজ্ঞ মহলের কাছে ইরাক, লেবানন, প্যালেস্টাইনের জ্বলন্ত উদাহরণ রয়েছে।

তৃতীয়তঃ বিশেষত আরব জাতি এবং সাধারণভাবে মুসলমানেরা আদর্শিক কারণে এজাতীয় শাসন নীতির প্রকৃতি বুঝতে বা মেনে নিতে পারেনা। তারা পূর্বে এমন ব্যবস্থাতে অভ্যস্ত ছিল না আর আগামীতেও অভ্যস্ত হবার কোন সম্ভাবনা নেই। এর কারণ আরব জাতির সে বৈশিষ্ট্য, যা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি।

চতুর্থত: আরবের লোক ধর্মীয় অনুপ্রেরণা অথবা বস্তুবাদী জোর প্রয়োগ ছাড়া কখনো মাথা নত করে না। কোন একটি তাগুত এসে তাদের উপর চেপে বসে লোহা ও আগুনের ভয় দেখিয়ে তাদেরকে বশ বানিয়ে ফেলবে(!) এটা আরবদের ক্ষেত্রে সম্ভব না। কারণ তারা নিজেদের রক্ত দিয়ে কাপুরুষতা নামক মূর্তি ধ্বংসের ইতিহাস রচনা করেছে। আর এই কাপুরুষতা পরিত্যাগ করতে তাদেরকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে গেছেন মোহাম্মদ আরাবি মোস্তফা । আর গণতান্ত্রিক সিস্টেমে মানুষকে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা দিয়ে পরিচালিত করা হয় না, আবার লোহা ও আগুন দিয়ে সর্বোচ্চ জোর খাটিয়েও তাদেরকে বাগে আনা হয় না। এক কথায়, জাতি হিসেবে আরব যাদের নাম, তাদের মাঝে গণতন্ত্র কখনোই সফল হতে পারে না।

পঞ্চমত: গণতন্ত্র অধিকাংশ আরব নাগরিককে তার আকাঙ্ক্ষার অনুরূপ সাফল্য অর্জনের সুযোগ দিতে পারবে না। তার আয়েশী জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করতে পারবে না। অথচ এই আয়েশী জীবনের লোভেই কোথাও কোথাও একদল লোক গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিল। গণতন্ত্রের এই ব্যর্থতার কারণ হলো, নাগরিকদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর মত পর্যাপ্ত নিজস্ব ক্ষমতা এ সকল রাষ্ট্রের নেই। আর এতে করে দেখা যাবে, সাধারণ নাগরিক তার জীবনযাত্রায় বিশেষ কোন পরিবর্তন অনুভব করছে না। এর থেকে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। এরপর সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করার সেই পুরানো চিত্র…দিনশেষে লাভের খাতায় শূণ্য। যেখান থেকে পথ চলা শুরু হয়েছিল সেখানেই ফিরে আসা।

এদিকে বিশ্ব স্থিতিশীলতার মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত রোমানরা আজ তার উভয় বাহু ইউরোপ-আমেরিকাকে নিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে অর্থনৈতিক ধ্বস ও দেউলিয়াপনার দিকে এগিয়ে চলেছে। এই অর্থনৈতিক মন্দা প্রতিকারের জন্য মাঝে মাঝে আমরা যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শুনি, তা সাময়িক কিছু চেষ্টা-প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। আদতে এর কোন স্থায়ী সমাধান নেই। কারণ অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করার এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, যা আল্লাহ তাআলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল, কখনোই এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না। কারণ এটা এমন এক যুদ্ধ যেখানে পুঁজিবাদীদের প্রতিপক্ষ হচ্ছে প্রতাপশালী প্রতিশোধ-গ্রহণকারী এমন এক সত্তা, যিনি অহমিকা ও আত্মম্ভরিতার ধোঁকায় রেখে শত্রুকে ধ্বংস করেন।

নিঃসন্দেহে এই আরব বিপ্লব সেই কাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়, যা আরব অঞ্চলকে গোত্রভিত্তিক শাসনের দিকে নিয়ে যাবে। এরফলে গোটা অঞ্চলজুড়ে এক নেতৃত্ব শূন্যতা বিরাজ করবে। চলমান এই বিশৃঙ্খলা প্রাক বিপ্লব যুগের মত বিশ্বকে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলবে। একই সঙ্গে পশ্চিমা অর্থনীতি ধ্বসে পড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এভাবেই একপর্যায়ে বিশ্বময় এমন এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, যার দরুন আল্লাহর ইচ্ছায় তারা নিজেরাই এই বিশ্ব ব্যবস্থা পরিবর্তনে উদ্যোগী হবে।

আমেরিকা আজ মৃত্যুশয্যায়। বলতে গেলে সে এখন তার শেষ সময় পার করছে। তার অপর অংশ ইউরোপের চাইতেও দ্রুত এখানে বিপর্যয় দেখা দেবে। কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতির মেরুদণ্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জাতিগত ঐক্যের নিয়ামক ‘ডলার’ আজ কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতো অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছে। আমেরিকান অর্থনীতি বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি। সে মার্কিন অর্থনীতিই এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। অতএব এর পতন মানে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতন। আর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতন মানেই এক চরম অরাজকতা।

আমরা পূর্বেও উল্লেখ করেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশৃংখলা ও বিপর্যয়ের সবচেয়ে নিকটে। কারণ ডলারের সাহায্যে এবং অর্থনীতির জোরে সংযুক্ত তার রাজ্যগুলির মাঝে বর্ণবাদী, জাতিগত অথবা সাম্প্রদায়িক কোন সমন্বয়ক নেই। তাই এর অর্থনীতি যখন দুর্বল হয়ে এক পর্যায়ে ধ্বসে পড়বে, তার সঙ্গে সঙ্গে এর সামাজিক কাঠামোও ভেঙে পড়বে। কারণ সেখানে কোন জাতিগত ঐক্য নেই, যা এই বিপর্যয় ও পতন ঠেকাতে কাজ করতে পারবে। আবার এমন কোন সার্বজনীন মতবাদও নেই, যা বিভাজন রোধ করবে। ডলার ব্যতীত গোটা আমেরিকাবাসীর জন্য পূজনীয় দ্বিতীয় কোন বোধগম্য বিষয় নেই। এই ডলারই তাদের একমাত্র উপাস্য।

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মুসলমানদের বুকের উপর চেপে থাকা আরব প্রতিমাগুলো এবং আরব অঞ্চলে সৃষ্ট অরাজকতা—আপাতদৃষ্টিতে এটা থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনাই আমি দেখছি না। অপরদিকে গ্রেট রোমান তার উভয় বাহু ইউরোপ ও আমেরিকাকে নিয়ে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। এখন শুধু গুহামুখে পতিত হবার অপেক্ষা। আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, এখানে আমি যে পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করলাম, এটাই বিশ্বব্যাপী মুমিনদের ক্ষমতায়নের পথের যত বাধা-বিপত্তি ও কাঠিন্য রয়েছে, সব অপসারণ করবে। আর পাশাপাশি বিশ্বকে একটি পুণ্যময় খেলাফত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করবে, যার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন আমাদের নবী করিম মোহাম্মদ

আমি সেই প্রতিশ্রুত মেহমানকে দেখতে পাচ্ছি, যিনি পৃথিবীর বর্তমান অন্যায়-অনাচারে পূর্ণ অবস্থা থেকে পরিবর্তন করে ন্যায়-ইনসাফ দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন। এ সময়টা যেন বু'আস যুদ্ধের কাল, যে যুদ্ধে আউস ও খাজরাজের নেতৃস্থানীয় লোকগুলো নিহত হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে মদিনা বিশ্বনেতা মোহাম্মদ কে এবং তার সাথীবর্গকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল এবং সর্বপ্রথম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। সিদ্দিকে আজম তনয়া আয়েশা সিদ্দিকা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন— “বু'আস যুদ্ধকে আল্লাহ তা'আলা তাঁর রাসূলের জন্য সংঘটিত করেছিলেন। মদিনায় তিনি এমন এক সময় আগমন করেছিলেন, যখন মদিনাবাসীর অভিজাত মহল ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন আর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবৃন্দ নিহত হয়ে গিয়েছিলেন।” হ্যাঁ, সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে আজ। প্রথম যুগের মুসলমানদের জন্য বু'আস যুদ্ধের দিন যেমন ছিল, শেষ যুগের মুসলমানদের জন্য বর্তমান আরব বিপ্লবগুলি ঠিক তেমনি। সময়ই কথা বলবে, অনাগত ভবিষ্যতে সবই পরিস্কার বুঝা যাবে ইনশা আল্লাহ।

অনাগত সেই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমি সাধারণভাবে সকল মুসলমানকে এবং বিশেষভাবে জিহাদি সংগঠনগুলোকে কয়েকটি উপদেশ দিতে চাই :

১. গর্ব ও অস্থিত্বের প্রতীক অস্ত্রকে আঁকড়ে ধরুন। সামনের দিনগুলোর জন্য তা সংরক্ষণ করে রাখুন। কোন অবস্থাতেই তা হাতছাড়া করবেন না, চাই ইতিহাসের যত কুখ্যাত নামেই জর্জরিত হতে হোক না কেন। এ বিষয়ে কারো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দ্বারা প্রতারিত হবেন না।

হে মুজাহিদ ভাই!

এক মুহূর্তের জন্যও এ কথা ভুলা যাবে না যে, যে অস্ত্র বহন করিয়ে আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করেছেন, তা কেবলই শরীয়তসম্মত গঠনমূলক জিহাদের মত বৈধ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোন গোত্রীয় কোন্দলে অথবা জাহিলি সাম্প্রদায়িকতার জন্য তা ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের এ বিষয়ে সজাগ থাকা অনিবার্য যে, মুসলমানদের রক্ত পবিত্র। গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া আল্লাহর কাছে অন্যায়ভাবে এক ফোটা রক্তপাতের চেয়ে তুচ্ছ।

২. আসন্ন যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে মনস্তাত্ত্বিক, শারীরিক, বৈষয়িক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকুন। বর্তমানে মাঝারি মেয়াদে বিভিন্ন স্থানে একটি লড়াই মোকাবেলা করার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা আমাদের নেই। তাই এই মুহূর্তে বহি:শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই আমার কাছে অনেকটাই দুষ্কর মনে হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে, তা প্রতিশ্রুত পূণ্যময় খিলাফত ব্যবস্থার দিকে যাত্রার শুরু এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

৩. বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থার পতনের পর সৃষ্ট নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণের জন্য এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল পুনর্গঠনের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। লিবিয়া ও ইয়ামানে আজ যেমনটা ঘটেছে, আগামী দিনে সিরিয়াতে তেমনটা ঘটবে ইনশা আল্লাহ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গোত্রীয় কোন্দলে জর্জরিত রাষ্ট্রগুলোতে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের চিত্র আজ আমাদের কাছে স্পষ্ট। তাই জিহাদি কর্মকাণ্ডের নেতৃবৃন্দ এবং স্ব স্ব অবস্থানে বরণীয় ও অনুসরণীয় – বুদ্ধি-বিবেচনাবোধ সম্পন্ন অভিজাত মহলের দায়িত্ব হলো, দুর্যোগকালীন সে পর্যায়ে জাতিকে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা এবং শিষ্টাচার, সদাচার-নীতি ইত্যাদির শিক্ষা লাভ করা। এর জন্য আমি আবু বকর নাজি হাফিজাহুল্লাহ রচিত "ইদারাতুত তাওয়াহহুশ" গ্রন্থখানা অধ্যয়নের কথা বলব। আল্লাহর রহমতে এটি এ বিষয়ের সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ ।

৪. ফলাফল পেতে তাড়াহুড়া না করা এবং এখানে সেখানে সাময়িক কর্তৃত্ব লাভের দ্বারা প্রতারিত না হওয়া। কারণ যুদ্ধ সবেমাত্র শুরু। এদিকে শত্রু বরাবরই শক্তিশালী। আর যতদিন তারা শক্তিশালী থাকছে, তাৎক্ষণিকভাবে প্রকৃত অর্থে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা লাভের পথে তারা বস্তুবাদী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেই যাবে। তারা যেকোনো উপায়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেই যাবে। তাই এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। শক্তির বড়াই এবং ধোঁকায় পড়া যাবে না। বরং নতুন নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আমাদেরকে ধীরস্থিরতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৫. সত্যনিষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম এবং খোদাভীরু নেতৃবৃন্দের আশেপাশে সমবেত হয়ে তাদের হাত ধরে পথ চলতে হবে। আর অতীতে যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, বর্তমানে নাম দেখে প্রতারিত হওয়া যাবে না। কারণ ব্যক্তি চেনা যায় সত্যের দ্বারা, ব্যক্তির দ্বারা সত্যকে চেনা যায় না।

৬. মানুষদেরকে মুসলমানদের আসন্ন বিজয় ও মর্যাদার সুসংবাদ দিয়ে তাদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। উম্মাহ যে খেলাফতে রাশেদা প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলেছে, জনসমক্ষে এ বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। তাদেরকে দাওয়াহ্ দানের ক্ষেত্রে নম্রতা অবলম্বন করা চাই। দাওয়াতের ভাষায় এবং সম্বোধনে তাদের সঙ্গে কঠোরতা এবং রুক্ষতা পরিহার করে চলতে হবে। যেভাবে বললে বুঝবে, সেভাবে তাদেরকে সম্বোধন করা জরুরী। আর তড়িঘড়ি করে তাদেরকে কাফের বলা থেকে, ফাসেক বলা থেকে, বেদাতপন্থী বলা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। কারণ আরব জাতিগোষ্ঠীগুলো বর্তমানে আল্লাহর দ্বীন এবং তার সঠিক ও বিশুদ্ধ বুঝ থেকে অনেক দূরে। তাই তাদের সত্য দ্বীনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং এই দ্বীন অনুযায়ী জীবনকে পরিচালনা করতে শেখানো একান্তই প্রয়োজন।

৭. কাগুজে মুদ্রার ওপর নির্ভরতার সমাপ্তি ঘটিয়ে এর স্থলে সরাসরি স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন শুরু করতে হবে। কারণ অচিরেই এ সমস্ত কাগুজে মুদ্রা তার মূল্যমান হারাবে। রোমান সাম্রাজ্যে আসন্ন অর্থনৈতিক অচলাবস্থার দরুন অনিবার্যভাবেই এমনটা ঘটবে।

এই ছিল আমার কয়েকটি উপদেশ। আল্লাহর কাছে দুয়া করি, তিনি যেন সর্বস্থানে মুসলমানদেরকে হেফাজত করেন! তাদের রক্তপাত বন্ধ করেন এবং যত অপছন্দনীয় বিষয় রয়েছে, তা থেকে তাদেরকে দূরে রাখেন। তাদের জন্য হেদায়েতের পথে চলা সহজ করে দেন। তাদেরকে তাঁর পছন্দনীয় পথে চলার তাওফিক দান করুন। তাদেরকে এমন মর্যাদা দান করুন যা অন্য কেউ লাভ করতে পারে না।

 

লেখক—

আবু উবাইদা আব্দুল্লাহ আল আদাম

১৪ জিলকদ, ১৪৩২

 

***************