JustPaste.it

 

আত্মশুদ্ধি – ১২

ঈমানের

মিষ্টটা লাভের উপায়

 

মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ

 

 

মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহঃ আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা সাইয়িদিল আম্বিয়া- ওয়াল-মুরসালীন, ওয়া আলা আলিহী, ওয়া আসহাবিহী আজমাঈন। আম্মা বা’দ

প্রথমে আমরা সকলেই একবার দুরূদ শরীফ পড়ে নিই।   

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

আলহামদুলিল্লাহ বেশ কিছুদিন পর আবার আমরা আরেকটি তাযকিয়া মজলিসে হাজির হতে পেরেছি, জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শুকরিয়া আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ।

ঈমানের মিষ্টতা লাভের উপায়

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হচ্ছে, ঈমানের মিষ্টতা লাভের উপায়। এ সম্পর্কে আমি প্রথমেই একটি হাদীস উল্লেখ করছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ: أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ بَعْدَ أَنْ أَنْقَذَهُ اللهُ مِنْهُ، كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ رواه البخاري

তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকবে, সে ঈমানের মিষ্টতা লাভ করবে। গুণগুলো হচ্ছে,

১। যার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রিয় হবে।

২। যে কাউকে মুহাব্বত করলে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই মুহাব্বত করে।

৩। আল্লাহ তাকে কুফরি থেকে মুক্তি দেয়ার পর পুনরায় কুফরির দিকে ফিরে যাওয়াকে সে এমন অপছন্দ করে, যেমন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে।

এবার হাদীসটি একটু ব্যাখ্যার সাথে বুঝার চেষ্টা করি। প্রথমেই বলি, হাদীসে উল্লেখিত حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ  বা ঈমানের মিষ্টতা বলে উদ্দেশ্য কি? ইমাম নববী রহ. বলেন,

قال العلماء: معنى حلاوة الإيمان استلذاذه الطاعات، وتحمله المشاق في رضى الله ورسوله، وإيثار ذلك على عرض الدنيا

ওলামায়ে কেরাম বলেন, ঈমানের মিষ্টতার অর্থ হচ্ছে, ইবাদতের স্বাদ অনুভব করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি লাভের জন্য কষ্টকর বিষয়গুলো সহ্য করে নেয়া এবং এগুলোকে দুনিয়ার সব কিছুর উপর প্রাধান্য দেওয়া। শরহে নববী ২/১৩

যে সব আমলের দ্বারা অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়

হাদীসে উল্লেখিত প্রথম কথাটি হচ্ছে, যার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রিয় হবে।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম রহ. তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মাদারিজুস সালিকীনে এমন কিছু আমলের কথা বলেছেন, যেগুলো করার দ্বারা অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। আমলগুলো হল,

ক) অর্থ ও মর্মের প্রতি লক্ষ্য করে কুরআন তেলাওয়াত করা।

খ) নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা।

গ) সর্বদা আল্লাহর স্মরণে থাকা, মুখে, অন্তরে ও কাজ-কর্মে।

ঘ) আল্লাহর ভালোবাসা নিজের জানের চেয়েও বেশি থাকা।

ঙ) আল্লাহর সত্যনিষ্ঠ বান্দাদের সাথে উঠা-বসা করা।

চ) এমন সব বিষয় থেকে দুরে থাকা যা আল্লাহ ও বান্দার অন্তরের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়। (মাদারিজুস সালিকীন : ৩/১৭)

আমরা সবাই এ আমলগুলো করার চেষ্টা করব তো ভাই?

উপস্থিত ভাইয়েরাঃ জী ইনশাআল্লাহ।

এতো হল এমন কিছু আমল যা দ্বারা অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। এবার এমন কিছু আমল বলি, যার দ্বারা অন্তরে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।

যে সব আমলের দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা অন্তরে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য ওলামায়ে কেরাম বেশ কিছু আমলের কথা উল্লেখ করছেন। তার মধ্যে কয়েকটি হল, 

ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ অনুসরণ করা।

খ) সুখে-দুখে সর্বাবস্থায় তাঁর আদেশ-নিষেধগুলো মেনে চলা।

গ) তাঁর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার চেষ্টা করা।

ঘ) তাঁর সুন্নাহ ও আদর্শের প্রচার-প্রসার করা।

ঙ) তাঁর উপর বেশ বেশি দুরুদ-সালাম পাঠ করা।

আমরা সবাই এ আমলগুলো করার চেষ্টা করব তো ভাই?

উপস্থিত ভাইয়েরাঃ জী ইনশাআল্লাহ।

কোন বান্দাকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই মুহাব্বত করার কী অর্থ?

এতো গেল হাদীসের প্রথম অংশের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা। এবার হাদীসের দ্বিতীয় অংশের ব্যাখ্যাটা একটু দেখি;

হাদীসে দ্বিতীয় যে গুণটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল, সে কাউকে মুহাব্বত করলে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই মুহাব্বত করে। এ অংশটির ব্যাখ্যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য হাদীসে এভাবে দিয়েছেন,

أَحِبَّ فِي اللهِ، وَأَبْغِض فِي اللهِ، وَوَالِ فِي اللهِ، وَعَادِ فِي اللهِ، فَإِنَّمَا تُنَالُ وِلاَيَةُ اللهِ بِذَلِكَ، لاَ يَجِدُ رَجُلٌ طَعْمَ الإِيمَانِ وَإِنْ كَثُرَتْ صَلاَتُهُ وَصِيَامُهُ حَتَّى يَكُونَ كَذَلِكَ

তুমি কাউকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসো, আল্লাহর জন্য কারো সাথে বিদ্বেষ পোষণ করো, আল্লাহর জন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করো, আল্লাহর জন্য কারো সাথে শত্রুতা পোষণ করো, তবেই তুমি আল্লাহর বন্ধুত্ব লাভ করবে, এ গুণগুলো অর্জন না করা পর্যন্ত কেউ ঈমানের স্বাদ পাবে না, যদিও তার নামায-রোযার পরিমাণ অনেক বেশি হয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১৩/৩৬৮)

অন্য এক হাদীসে এসেছে,

مَن أحبَّ أن يذوقَ طعمَ الإيمانِ فليُحِبَّ في اللهِ .

যে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ লাভ করতে চায়, সে যেন (কাউকে ভালোবাসলে) একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে। (মুসনাদে আহমাদ : ২/২৯৮)

কারো সাথে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা পোষণের ক্ষেত্রে তা একমাত্র আল্লাহর জন্য হচ্ছে কি না, অবশ্যই লক্ষ্য করতে হবে। একেই বলে, আল ওয়ালা ওয়াল বারা।  

কুফরির দিকে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো অপছন্দ করে

হাদীসে তৃতীয় যে গুণটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল, আল্লাহ তাকে কুফরি থেকে মুক্তি দেয়ার পর পুনরায় কুফরির দিকে ফিরে যাওয়াকে সে এমন অপছন্দ করে, যেমন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে।

হাদীসের এ অংশের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন, কারো অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা থাকার আলামত হল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যা পছন্দনীয়, তার কাছেও তা-ই পছন্দনীয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যা অপছন্দনীয় তার কাছেও তা-ই অপছন্দনীয়।

অতএব ঈমান যখন কোন বান্দার অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায় তখনই সে ঈমানের স্বাদ ও ‍মিষ্টতা লাভ করে। এই অবস্থায় সে কুফর, ফিসক ও গুনাহের তিক্ততা অনুভব করে। পাপের তুলনায় দুনিয়াবি কষ্ট সহ্য করা তার কাছে বেশি প্রিয় মনে হয়। যেমনটি হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম বলেছেন,

رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ

হে আমার রব! তারা আমাকে যেদিকে ডাকছে, তা থেকে জেলখানাই আমার কাছে বেশি প্রিয়। সূরা ইউসুফ ৩৩

হযরত বিশর আল হাফী রহ. বলেন, তোমার প্রিয়জন যা ঘৃণা করবে তুমি তা পছন্দ করবে, এটা মুহাব্বতের আলামত নয়।

এই হল হাদীসের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা। এবার আমরা ঈমানের মিষ্টতা লাভের কিছু ফায়েদা ও উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ

ঈমানের মিষ্টতা লাভের কিছু ফায়েদা 

ঈমানের মিষ্টতা লাভের বেশ কিছু ফায়েদা রয়েছে। নিম্নে তা থেকে কয়েকটি উল্লেখ করছি;  

১। ঈমানের মিষ্টতা লাভের দ্বারা একজন মুমিনের জীবন সুখময় হয়।

২। কুফর, ফিসক ও গুনাহের তিক্ততা অনুভব হয়।

৩। এটি দ্বীনের উপর অবিচল ও দৃঢ় থাকার কারণ হয়।

৪। ঈমানের ‍মিষ্টতা পার্থিব জীবনের যাবতীয় কষ্ট ও মসিবতকে হালকা করে দেয়।

এবার এই ফায়েদাগুলো নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করি।

প্রথম ফায়দাঃ ঈমানের মিষ্টতা লাভের দ্বারা একজন মুমিনের জীবন সুখময় হয়

এখানে যে সুখের কথা বলা হচ্ছে তা দ্বারা উদ্দেশ্য, অন্তরের সুখ বা মানসিক সুখ। একজন সত্যিকারের মুমিন দুনিয়াতে বাহ্যত যত কষ্টেই থাকুক, তার উপর যত জুলুম-অত্যাচারই করা হোক তারপরও সে মানসিকভাবে খুবই সুখী থাকে। তার আত্মা আনন্দিত থাকে।  

বাস্তবতা হচ্ছে, ঈমান ও নেক আমলের মাধ্যমেই বান্দা প্রকৃত সুখ ও আনন্দ লাভ করতে পারে। যা অন্য কোনো ভাবে লাভ করার কেউ কল্পনাও করতে পারে না

ঈমান ও নেক আমলের বদৌলতে দুনিয়ার জীবন সুখময় হওয়ার পাশাপাশি আখেরাতের জীবন সুখময় হওয়ার বিষয়টি তো আছেই। অনন্তকালের জান্নাত। যেখানে সুখই সুখ। দুঃখের কোনো নাম নিশানাও নেই।

আল্লাহর কোন হুকুম পালন করার মাধ্যমে যে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করা যায় তা কারো নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলে বলে বুঝানো যাবে না।   

এই জন্যই আমরা দেখতে পাই, আজকে বহু মুমিন মুজাহিদ আল্লাহর দ্বীন জিন্দা করতে গিয়ে কঠিন থেকে কঠিনতম জুলুম-নির্যাতন সহ্য করছেন। তবুও তারা আন্তরিকভাবে সুখী

কুরআন-হাদীসের আলোকে আন্তরিক সুখ-শান্তি অর্জনের কিছু উপায় আছে। এবার আমরা সেই উপায়গুলো নিয়ে একটু আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ

কুরআন-হাদীসের আলোকে আন্তরিক সুখ-শান্তি অর্জনের উপায়

এক ফরজ ও নফল ইবাদতগুলোর মাধ্যমে সুখ লাভ করা

আল্লাহ তা’আলা বলেন,

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ

যে কেউ ঈমানদার অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র (সুখী ও আনন্দময়) জীবন দান করবো এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের শ্রেষ্ঠ কাজের পুরষ্কার দেবো [সূরা আন-নাহল (১৬) : ৯৭]

এক হাদীসে এসেছে,

عن أبي هريرة رضي الله عنه قَالَ: قَالَ رَسُول الله صلى الله عليه وسلم : إنَّ الله تَعَالَى قَالَ : مَنْ عادى لي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بالحَرْبِ، وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدي بشَيءٍ أَحَبَّ إلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيهِ، وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقرَّبُ إلَيَّ بالنَّوافِلِ حَتَّى أحِبَّهُ، فَإذَا أَحبَبتُهُ كُنْتُ سَمعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ، ويَدَهُ الَّتي يَبْطِشُ بِهَا، وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشي بِهَا، وَإنْ سَأَلَني لأُعْطِيَنَّهُ، وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لأُعِيذَنَّهُ . رواه البخاري

হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনো বন্ধুর সাথে শত্রুতা পোষণ করে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করি। আমি আমার বান্দার ওপর যে সব ইবাদত ফরয করেছি তা অপেক্ষা আমার কাছে অধিক প্রিয় কোনো কিছু দ্বারা সে আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। (অর্থাৎ ফরয ইবাদতগুলো আমার কাছে সব চে প্রিয় হওয়ার কারণে এর মাধ্যমে বান্দা আমার নৈকট্যও বেশি লাভ করে) আর নফল ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা আমার আরও নৈকট্য লাভ করতে থাকে, এক পর্যায়ে আমি তাকে ভালোবাসতে থাকি। আর আমি যখন তাকে ভালোবাসি তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে, তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে এবং তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায় তাহলে আমি অবশ্যই তাকে তা দেই এবং সে যদি আমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় দেই। সহী বুখারী ৬৫০২

হাদীস থেকে বুঝা যায়, আল্লাহর তাআলার কাছে সব চেয়ে পছন্দনীয় ইবাদত হল ফরয ইবাদত এবং ফরয ইবাদতের পর বেশি বেশি নফল ইবাদত করা (যেমন, তাহাজ্জুদের নামায পড়া, অন্যান্য সুন্নত ও নফল পড়া এবং কুরআন তেলাওয়াত করা ইত্যাদি) আল্লাহ তাআলার মহব্বত লাভের অন্যতম একটি উপায়।

হাদীস থেকে এও বুঝা যায় যে, যে ব্যক্তি ফরয আদায়ের পাশাপাশি নফলও বেশি বেশি আদায় করে আল্লাহ তাআলা তাকে ভালোবাসেন। তার দোয়া কবুল করেন এবং তাকে হেফাযত করেন।

ফরয ইবাদতের পাশাপাশি বেশি বেশি নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমরা যদি আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা অর্জন করতে পারি তাহলে আমাদের জীবন সুখময় হবে। স্বয়ং আল্লাহ যদি আপনাকে ভালোবাসেন তাহলে আপনার আর কিসের ভয়?

দুইআল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে সুখ লাভ করা

 আল্লাহ তাআলা বলেন,

 

الَّذِينَ آمَنُواْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللّهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

যারা ঈমান আনে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখো, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি লাভ করে। [সূরা আর-রাদ (১৩) : ২৮]

ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. লিখেছেন, আমি একদিন ফজরের পর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. এর কাছে গেলাম। তিনি তখন থেকে নিয়ে সূর্য ওঠার অনেকক্ষণ পর পর্যন্ত যিকিরে ব্যস্ত ছিলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘এ হলো আমার সকালের নাস্তা। আমি এটি গ্রহণ না করলে সারাদিন শক্তি পাবো না’। এ সময়টাতে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে রবের নিকট সমর্পণ করে দিতেন। দুআ করতেন, ইস্তিগফার করতেন, অনুনয় বিনয়ের সাথে তাঁকে ডাকতেন

তিন কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সুখ লাভ করা

 আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاء وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ وَلاَ يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إَلاَّ خَسَارًا

আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা মুমিনদের জন্য সুচিকিৎসা এবং রহমত। [সূরা বনি ইসরাইল (১৭) : ৮২]

কোরআন সব ধরণের আত্মিক ব্যাধি, দুশ্চিন্ত ও পেরেশানির জন্য অব্যর্থ চিকিৎসা।

চার সব রকমের ভালো কাজের মাঝে সুখ লাভ করা

আলাহ তা’আলা বলেন,

إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ

সৎকর্মশীলগণ নেয়ামতের মাঝে থাকবে বা জান্নাতে থাকবে।

وَإِنَّ الْفُجَّارَ لَفِي جَحِيمٍ

আর দুষ্কর্মকারীরা জাহান্নামে থাকবে। [সূরা আল-ইনফিতার (৮২) : ১৩-১৪]

কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, সৎকর্মশীলগণ নেয়ামতের মাঝে থাকবে বা জান্নাতে থাকবে, বলে যে ওয়াদা করা হয়েছে তা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দুষ্কর্মকারীদের যন্ত্রণার বিষয়টিও একই। দুনিয়ায় জান্নাতি সুখ লাভের কিছু লক্ষণ হল, আত্মিক প্রশান্তি ও প্রফুল্লতা আর জাহান্নামের যন্ত্রণার লক্ষণ হল, আত্মিক অস্থিরতা ও অশান্তি।

তারা তাদের যৌবন, স্বাস্থ্য, সম্পদ, পরিবার ইত্যাদি দ্বারা কোনো সুখ পায় না। সারাক্ষণ টেনশন, অস্থিরতা আর নানা দুশ্চিন্তা। রাতে বিছানায় গেলে ঘুমও আসে না, অনেকে তো ঔষধ খেয়েও ঘুম আনতে পারে না। পক্ষান্তরে একজন নেককার মুমিনের অবস্থা সম্পুর্ণ এর ব্যতিক্রম। সে দুনিয়াতেই জান্নাতি সুখ ও প্রশান্তি অনুভব করতে থাকে।

পাঁচ. সালাতের মাধ্যমে সুখ লাভ করা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আযান দিতে বলে বললেন,

يا بِلالُ، أرِحْنا بالصَّلاةِ.

হে বিলাল! আমাদেরকে সালাতের মাধ্যমে প্রশান্তি দাও। (সুনানে আবু দাউদ ৪৯৮৫; মুসনাদ আহমাদ ২৩০৮৮)

অন্য হাদীসে এসেছে,  

جُعِلَت قُرَّةُ عَيني في الصلاةِ .

সালাতকে আমার চোখের শীতলতা বানানো হয়েছে। (সুনানে নাসাঈ ৩৯৩৯ ও মুসনাদ আহমাদ ১৪০৬৯)

নিজের কোন আপনজন বা প্রিয় ব্যক্তির সাথে কথা বলতে পারাটা কী আনন্দের! তাহলে যখন আমরা আল্লাহর সাথে কথা বলতে নামাযে দাঁড়াই তখন আমাদের অনুভূতি কেমন হওয়া উচিত?

হাদীসে জিব্রাঈলে এসেছে,

أنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأنَّكَ تَرَاهُ فإنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فإنَّهُ يَرَاكَ،

(ইবাদতের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সালাতের ক্ষেত্রে) ইহসান হল, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো। যদি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে তিনি তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন। সহী মুসলিম ৮

ছয়. আল্লাহকে চিনা ও জানার মাধ্যমে সুখ লাভ করা

বান্দা যখন আল্লাহকে চিনতে পারে, তখন সে তার অন্তরে অন্য রকম একটি শান্তি পায়। চারিদিকে তাকালে আমরা আল্লাহর কত কত সৃষ্টি দেখতে পাই। প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে লুকিয়ে আছে কত কত নিদর্শন। আমরা আল্লাহকে দেখতে না পেলেও তাঁর সৃষ্টিসমূহ দেখতে পাই।

বান্দা যখন তাঁর রবের সৃষ্টি দেখে তাঁর অসীম কুদরতের কথা অন্তরে চিন্তা করে  তখন সে তার অন্তরে শান্তি পায়। হযরত আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

ذاقَ طَعْمَ الإيمانِ مَن رَضِيَ باللَّهِ رَبًّا، وبالإسْلامِ دِينًا، وبِمُحَمَّدٍ رَسولًا.

যে ব্যক্তি আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসূল হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট, সে ঈমানের মিষ্টতার স্বাদ পাবে। (সহীহ মুসলিম ৩৪)

যারা দ্বীন বিমুখ হয়ে শুধু দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত, তারা যে কত অশান্তি আর অস্থিরতার মধ্যে আছে তা একটি ঘটনা বললে সহজে বুঝে আসবে।

 

 

আজকের মতো শান্তি আমি কোনও দিন পাইনি

ঘটনাটি আমেরিকান এক কর্পোরেট অফিসের সিইও’র। তার ধনসম্পদের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু তার মনে একটুও সুখ ছিল না। সারাক্ষণ অস্থির থাকত। রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করত, ঘুম হতো না।

সে তার কোম্পানিতে চাকুরিরত এক মুসলমানকে দেখে অবাক হত। লোকটি তেমন উচ্চপদস্থ নয়, বেতনও কম। কিন্তু দেখে মনে হত, খুব সুখে আছে। কখনো তার চেহারায় দুঃচিন্তার ছাপ দেখা যায় না

একদিন সে ওই মুসলমানকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, কীভাবে সব সময় তুমি এমন হাসিখুশি থাকো? লোকটি বললো, আমি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করি, আমি তাকে চিনেছি এবং নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে জানি। তাই আমি সুখী।

সিইও বলল, তুমি কি এমন কিছু জানো, যা আমাকে পথ দেখাতে পারে? তখন লোকটি সিইওকে সেই ইসলামিক সেন্টারে নিয়ে যায় যেখান থেকে সে দ্বীন শিখেছে। সিইও সেখানে গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন কথাবার্তা শুনে ইসলাম গ্রহণ করল। সে ঘোষণা দিল, আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।

এই কালিমা বলা মাত্রই সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে বলতে লাগল, আজকের মতো শান্তি আমি জীবনে কোনও দিন পাইনি।

এই হল নিজের মালিক আল্লাহকে চিনার সুখ।  

 

সাত. ঈমানের মাঝে সুখ অনুভব করা

আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন,

الَّذِينَ آمَنُواْ وَلَمْ يَلْبِسُواْ إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُوْلَـئِكَ لَهُمُ الأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ

যারা ঈমান আনে এবং ঈমানকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যেই শান্তি এবং তারাই সুপথগামী। [সূরা আল-আনআম (৬) : ৮২]

দুনিয়া ও আখিরাতে মুমিন যে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে, তার শিকড় হলো ঈমান। যার ঈমান যত মজবুত হবে সে তার অন্তরে তত বেশি প্রশান্তি অনুভব করবে। আর যার ঈমান যত দুর্বল হবে সে তার অন্তরে তত বেশি অস্থিরতা অনুভব করবে।

আরেকটি ঘটনা বলি।

এক পশ্চিমা লেখকের অভিজ্ঞতা

একবার এক পশ্চিমা লেখক কোন এক কারণে আরবের বেদুঈনদের সাথে থাকতে শুরু করেন। তিনি তাদেরই মতো পোশাক পরতেন, তারা যা খেত তিনিও তা-ই খেতেন। তাদের মতো তিনিও এক পাল মেষ পালন করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে “The Messenger” নামে একটি বই লিখেন।

তিনি আলেম ওলামা কিংবা ইসলামী চিন্তাবিদদের মাঝে ছিলেন না। যাদের মাঝে ছিলেন তারা ছিলো বেদুঈন মেষপালক। তিনি তার অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন এভাবে যে, আমি মরুবাসী আরবদের কাছে শিখেছি, কী করে দুশ্চিন্তা দূর করতে হয়। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তাকদিরে বিশ্বাস করে। নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করে। তাদের ওপর কোন বিপদ এলে তারা যে হাত গুটিয়ে বসে থাকে, এমনও নয়।  

তিনি আরও লিখেন, একবার মরুঝড়ের কারণে আমাদের অনেকগুলো পশু মারা যায়। আমি এতে খুব হতাশ হয়ে যাই। কিন্তু আরবদের দেখলাম, তারা একে অপরের কাছে ছুটোছুটি করছে, গান গাইছে আর বলছে, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের চল্লিশ শতাংশ ভেড়ার কোনও ক্ষতি হয়নি। যখন তারা দেখল, আমি চিন্তিত, তখন আমাকে বললো, ‘রাগ আর দুশ্চিন্তা করে কোনও লাভ নেই। সব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত।তা সত্ত্বেও তারা ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় কোনো ত্রুটি করেনি। তাকদিরে বিশ্বাস করা বলতে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকাকে বোঝে না

তিনি আরও লিখেন, একবার গাড়িতে করে তাদের সাথে মরুভূমিতে যাত্রা করলাম। একটা টায়ার ফেটে গেলো। আমি রেগে গেলাম। তারা বললো, ‘রাগ করে লাভ নেই।গাড়িটা তিন চাকায় কিছুক্ষণ চললো। তারপর তেল শেষ হয়ে একেবারে থেমে গেলো। তারপর তারা নেমে পায়ে হেঁটেই হরিণের বেগে চলতে লাগলো। তারা ছিলো খুবই সুখী। তারা কবিতা আওড়াচ্ছিল আর আমার সাথে কথা বলছিলো।

তাদের সাথে সাত বছর কাটিয়ে আমি যা বুঝলাম তা হল, ইউরোপ ও আমেরিকায় বসবাসরত যেসব মানুষ একাকিত্ব, মানসিক রোগ আর মাদকাসক্তিতে ভোগে, তারা আসলে পশ্চিমা শহুরে জীবনের কারণেই এসব রোগে আক্রান্ত হয়। এটা এমন এক জীবনব্যবস্থা যা তাড়াহুড়াকে তাদের জীবনের মূলনীতি বানিয়ে নিয়েছে।

মুহতারাম ভাইয়েরা! এতক্ষণ আমরা ঈমানের মিষ্টতা লাভের প্রথম ফায়দা নিয়ে আলোচনা করেছি। বাকি রয়ে গেছে আরও তিনটি ফায়দা। সামনের মজলিসে বাকিগুলো নিয়ে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ঈমানের মিষ্টতা লাভ করার তাওফীক দান করুক। আমীন।

আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করুন এবং ইখলাসের সাথে জিহাদ ও শাহাদাতের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন।

আমরা সকলে মজলিস থেকে উঠার দোয়াটা পড়ে নিই।

سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين

وآخر دعوانا ان الحمد لله رب العالمين

************