চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তির মূল্যায়ন
মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ
মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহঃ আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা সাইয়িদিল আম্বিয়া-ই ওয়াল-মুরসালীন, ওয়া আলা আলিহী, ওয়া আসহাবিহী, ওয়ামান তাবিয়াহুম বি ইহসানিন ইলা ইয়াওমিদ্দীন, মিনাল উলামা ওয়াল মুজাহিদীন ওয়া আম্মাতিল মুসলিমীন। আমীন ইয়া রাব্বাল আ’লামীন।
আমরা সকলেই প্রথমে দুরূদ শরীফ পড়ে নিই।
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
আলহামদুলিল্লাহ বেশ কিছুদিন পর আবারও আমরা আরেকটি তাযকিয়া মজলিসে হাজির হতে পেরেছি, এ জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শুকরিয়া আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ।
চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তি আল্লাহর দান
মুহতারাম ভাইয়েরা, আজকে আমাদের আলোচ্য বিষয় হল, ‘চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তির মূল্যায়ন করা’। আমাদের কর্মশক্তি ও চিন্তাশক্তি আল্লাহ তাআলার বিরাট দান। একে কোনও ভাবেই অবহেলা করা যাবে না। আল্লাহ প্রদত্ত এ মূল্যবান শক্তি দুটিকে একদম ব্যবহারই না করা কিংবা আল্লাহর নাফরমানির কাজে ব্যবহার করা, দুটোই অতি মূল্যবান এ নেয়ামতদ্বয়ের প্রতি চরম অকৃতজ্ঞতা। এ সংক্রান্ত একটি হাদিস বলি।
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
المُؤْمِنُ القَوِيُّ خَيرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ المُؤْمِنِ الضَّعيفِ، وَفي كُلٍّ خَيرٌ، اِحْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ، واسْتَعِنْ بِاللهِ وَلا تَعْجَزْ، وَإنْ أَصَابَكَ شَيءٌ فَلا تَقُلْ لَوْ أنّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا، وَلَكِنْ قُلْ : قَدَّرَ اللهُ، وَمَا شَاءَ فَعلَ؛ فإنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيطَانِ . رواه مسلم
(দৈহিক ও মানসিকভাবে) সবল মুমিন দুর্বল মুমিন অপেক্ষা উত্তম এবং আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ আছে। তুমি ওই সব কাজের প্রতি আগ্রহী হও যা তোমার জন্য উপকারী হবে এবং (তার জন্য) আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করো। দূর্বলতা প্রদর্শন করো না। (ওসব কাজ করতে গিয়ে) যদি তোমার ওপর কোনো বিপদ আসে তাহলে এ কথা বলো না যে, আমি যদি এ রকম করতাম তাহলে এ রকম হতো (অর্থাৎ যদি ওসব কাজ থেকে দূরে থাকতাম তাহলে বিপদ থেকে বেঁচে যেতাম) বরং বলো, আল্লাহ এমনই নির্ধারণ করে রেখেছেন। তিনি যা চেয়েছেন তা-ই করেছেন। কারণ, ‘যদি’ কথাটি শয়তানের কাজের দরোজা খুলে দেয়। সহী মুসলিম : ২৬৬৪
হাদিসের শিক্ষা
এ হাদিস থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু শিক্ষা পাই, নিম্নে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হল,
১। নিজের কর্মশক্তি ও চিন্তাশক্তিকে আল্লাহপ্রদত্ত মূল্যবান নিআমত বলে বিশ্বাস করা।
২। এই গুণ ও যোগ্যতার প্রতি অবহেলা না করা এবং এগুলোকে অকার্যকর না করা।
৩। এগুণগুলোকে কোন অন্যায় কাজে ব্যবহার না করা।
৪। এগুণগুলোকে কেবল সত্য ও ন্যায়ের ক্ষেত্রে এবং শরিয়তসম্মত উপকারী ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা।
একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, এই হাদিসে কর্মশক্তি ও চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য কী গভীর শিক্ষা রয়েছে। চলুন, এবার হাদিসের কথাগুলো একটি একটি করে বোঝার চেষ্টা করি।
সবল মুমিন দুর্বল মুমিন অপেক্ষা উত্তম
হাদিসের প্রথম বাক্য হল,
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيّ خَيْرٌ وَأَحَبّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضّعِيفِ، وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ .
সবল মুমিন দুর্বল মুমিন অপেক্ষা উত্তম এবং আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ আছে।
এখানে প্রথমে আমাদেরকে ‘দুর্বলতা’ ও ‘সবলতা’র দিকগুলো বুঝতে হবে। হাদিসের ব্যাখ্যাকারগণ এ নিয়ে বেশ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। একেক জনের আলোচনায় একেকটি দিক উঠে এসেছে।
ইমাম নববী রহ. বলেন,
المراد بالقوة هنا عزيمة النفس والقريحة في أمور الآخرة فيكون صاحب هذا الوصف أكثر إقداما على العدو في الجهاد وأسرع خروجا إليه وذهابا في طلبه وأشد عزيمة في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر والصبر على الأذى في كل ذلك واحتمال المشاق في ذات الله تعالى وأرغب في الصلاة والصوم والأذكار وسائر العبادات وأنشط طلبا لها ومحافظة عليها ونحو ذلك.
এখানে শক্তি বলে উদ্দেশ্য, আখিরাতের বিষয়াদিতে উদ্যমী ও কর্মতৎপর স্বভাব। এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি জিহাদের ময়দানে দুশমনের মোকাবেলায় অধিক অগ্রগামী হয়, অন্যদের আগে বের হয় এবং দ্রুত অগ্রসর হয়। আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারের ক্ষেত্রে এবং সকল বিষয়ে কষ্ট সহ্য করা ও আল্লাহর জন্য কষ্ট স্বীকার করার ব্যাপারে অধিক শক্তি-সাহসের পরিচয় দেয়। সালাত, সাওম, যিকির-অযিফা ও অন্যান্য ইবাদত বন্দেগির ক্ষেত্রে বেশ আগ্রহী হয় এবং তা পালনে খুব তৎপর এবং ধারাবাহিকতা রক্ষায় অধিক সক্ষম হয়। (শরহে মুসলিম)
ইমাম নববী রহ. যে শক্তির কথা বলেছেন তা মূলত চিত্ত ও স্বভাবের শক্তি যাকে হিম্মত বা সাহস বলেও ব্যক্ত করা যায়। নেক কাজে উদ্যম-উদ্দীপনার হিম্মত বা সাহস। এই শক্তির অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর ইচ্ছায় এমন এমন কাজ করতে সক্ষম হয়, যা তার চেয়ে বহু গুণে বেশি দৈহিক ও বাহ্যিক শক্তির অধিকারী ব্যক্তির পক্ষেও সম্ভব হয় না।
একটি জ্বলন্ত উদাহরণ
নেক কাজে সুউচ্চ হিম্মত ও সাহসের এক জ্বলন্ত উদাহরণ হল, উনিশজন মর্দে মুজাহিদ কর্তৃক এগারই সেপ্টেম্বরের বরকতময় বিমান হামলা। পাহাড়সম হিম্মতের অধিকারী এ মর্দে মুজাহিদগণ এ হামলার মাধ্যমে গোটা বিশ্বব্যাপী আমেরিকার কর্তৃত্ববাদী মানসিকতাকে একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন।
অনেকে মনে করে, আমরা যারা বাঙ্গালী তারা বুঝি সব কাজেই দুর্বল। না ভাই, বাস্তবতা হচ্ছে, যারাই ইখলাসের সাথে জিহাদের কাজে জড়িত হয় তারা যে দেশেরই হোক তারা কখনোই দুর্বল নয়। তাদের মাঝে আগে কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও জিহাদই তাদের সকল দূর্বলতাকে সবলতায় পরিণত করে।
জিহাদের কাজে আল্লাহপ্রদত্ত কর্মশক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহারের কিছু ধরণ হল,
১। জিহাদের কাজে হিম্মত ও সাহসিকতার সাথে অগ্রসর হওয়া।
২। আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারের বিস্তৃত অঙ্গনের নানান কাজে উদ্যম ও সাহসিকতার সাথে এগিয়ে যাওয়া।
৩। ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগি, যিকির-তিলাওয়াত, ইসলাহে নফস ইত্যাদি বিষয়েও উদ্যমী ও তৎপর হওয়া। এ প্রত্যেকটি কাজই আলাদা আলাদাভাবে আল্লাহপ্রদত্ত কর্মশক্তির যথাযথ ব্যবহারের একেকটি উদাহরণ।
‘উমূরে আখিরাহ’ বলে কী উদ্দেশ্য?
ইমাম নববী রহ. উপরোক্ত হাদিসটির ব্যাখ্যায় أمور الآخرة বা ‘আখিরাতের বিষয়াদি’ বলে একটি শব্দ এনেছেন। এটি বলে তিনি কী বুঝিয়েছেন, তা সঠিকভাবে বোঝা প্রয়োজন। এ শব্দটির উদ্দেশ্য কী, তা বুঝতে পারলে হাদিসের মর্মের বিস্তৃতি ও গভীরতা বোঝা সহজ হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুমিনের জীবনের সকল কাজই ‘উমূরে আখিরাহ’ বা আখিরাতের কাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয় এবং শরিয়তের বিধান অনুসারে হয়।
একজন মুমিনের পুরোটা জীবন শরিয়তের বিধান অনুযায়ী হবে। মুমিন হওয়ার দাবী এটাই। ইবাদত-বন্দেগি থেকে শুরু করে আয়-উপার্জন, লেনদেন, দাম্পত্য জীবন, সামাজিকতা, শিক্ষা-দীক্ষা, আনন্দ উৎসব সব কিছুই একজন মুমিনের জন্য ‘উমূরে আখিরাহ’ বা আখিরাতের বিষয়াদি।
তেমনিভাবে জীবনের সকল অবস্থা অর্থাৎ সুখ-দুঃখ, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সুস্থতা-অসুস্থতা, সফলতা-ব্যর্থতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-নিরানন্দ ইত্যাদি সবই ‘উমূরে আখিরাহ’ - আখিরাতের বিষয়াদির ক্ষেত্র। সবগুলো ক্ষেত্রেই শরিয়তের বিস্তারিত বিধি-বিধান ও দিক নির্দেশনা রয়েছে। কোন মুমিন যখন সেই বিধানগুলো যথাযথ ভাবে পালন করে তখন তার ওই কাজগুলো আর দুনিয়ার কাজ থাকে না, আখেরাতের কাজে পরিণত হয়ে যায়।
কাজেই ইমাম নববী রহ’.র ‘উমূরুল আখিরাহ’ বা ‘আখিরাতের বিষয়াদি’ শব্দটিকে দুনিয়ার কল্যাণকর ও শরিয়ত অনুমোদিত কাজকর্মে অনীহা ও অলসতা প্রদর্শনের পক্ষে যুক্তি হিসেবে নয়; বরং এইসকল কাজে উদ্যম ও তৎপরতার পাশাপাশি সেগুলোকে সঠিক নিয়ত ও সঠিক কর্মপন্থার মাধ্যমে আখিরাতের কাজে পরিণত করার ইসলামি চেতনাই গ্রহণ করতে হবে।
তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সাধারণ ‘মুবাহ’ বা ‘বৈধ’ পর্যায়ের কাজকর্মের চেয়ে শরিয়তের ‘মামূরাত’ বা ‘করণীয়’ কাজের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর এ কারণেই মানুষের চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তি ব্যবহারের অগ্রগণ্য ক্ষেত্রও এটিই।
প্রত্যেকের মাঝেই কল্যাণ আছে
হাদীসের দ্বিতীয় বাক্য হল,
وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ
তবে তাদের প্রত্যেকের মাঝেই কল্যাণ আছে। অর্থাৎ সবল মুমিন ও দুর্বল মুমিন উভয়ই কল্যাণের অধিকারী।
ইমাম নববী রহ. বলেন,
لاشتراكهما في الإيمان مع ما يأتي به الضعيف من العبادات
কারণ, উভয়েই ঈমানের অধিকারী। তাছাড়া দুর্বল মুমিনও তো বিভিন্ন ইবাদত ও নেক আমল করে থাকেন। (শরহে মুসলিম, নববী)
এটি হাদিসের শিক্ষার যথার্থতা ও ভারসাম্যের একটি দৃষ্টান্ত। সবল মুমিনের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার সময়ও দুর্বল মুমিনকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে না; বরং তাকেও স্বস্থানে রাখা হচ্ছে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই ভারসাম্য ও ন্যায়পরায়ণতা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
হাদিসের وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ বাক্যটিতে চিন্তার দিগন্ত উন্মোচনকারী যে শিক্ষা আছে তা যদি উপলব্ধি করা যায় তাহলে বর্তমান যুগের অনেক মুমিন, মুসলমান নিজেরাও যেমন হীনমন্যতা থেকে নিষ্কৃতি পাবে তেমনি অন্যরাও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা রক্ষার প্রেরণা খুঁজে পাবে। হাদিস শরীফের এই বাক্যটি মূলত প্রথম কথাটিরই পরিশিষ্ট।
উপকারী কাজের প্রতি লালায়িত হও
হাদিসের তৃতীয় বাক্যে বলা হয়েছে,
احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ، وَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَلَا تَعْجَزْ
তুমি ওই সব কাজের প্রতি লালায়িত হও যা তোমার জন্য উপকারী হবে এবং (তার জন্য) আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করো। দূর্বলতা প্রদর্শন করো না।
হাদিসে আমাদেরকে উপকারী সকল বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হওয়া নয়; বরং ‘লালায়িত হওয়া’র কথা বলা হচ্ছে।
উপকারী বিষয় কী? মুমিনের কাছে উপকারী বিষয়ের তালিকা অনেক দীর্ঘ। উপকার-অপকারেরও তার কাছে রয়েছে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। মুমিনের কাছে ওসব বিষয়ই উপকারী, যা আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ অনুসারে হয়। আল্লাহ তাআলার নাফরমানির দ্বারা পার্থিব কোনো উপকার হাসিল হলেও বাস্তবে সেটা উপকার নয়।
ইসলাম যেহেতু আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আগত দ্বীন, তাই ইসলামের শিক্ষা মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রে বিস্তৃত। জীবনের সকল প্রয়োজন পূরণের এবং সকল কল্যাণ অর্জনের অবকাশ ইসলামে আছে, যদি বাস্তবেই তা প্রয়োজন হয় এবং কল্যাণের বিষয় হয়।
আর এ কারণেই মুমিনের কাছে উপকারী বিষয়ের তালিকা অনেক দীর্ঘ, যা জীবন ও জগতের এবং দুনিয়া-আখিরাতের সকল উপকারী বিষয়কে শামিল করে। তবে এই সবকিছুর মূল কথা ও সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য ও আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব ও প্রতিদান লাভের আশা। জীবনের সকল কাজে এই পন্থা ও প্রেরণা অনুসরণ করতে হবে।
ইমাম নববী রহ. উপরোক্ত বাক্যের ব্যাখ্যায় বলেন,
معناه احرص على طاعة الله تعالى والرغبة فيما عنده
এর অর্থ হচ্ছে, (সব কাজে) আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের প্রতি এবং (অনুগত বান্দাদের জন্য) তাঁর কাছে যে প্রতিদান রয়েছে তার প্রতি লালায়িত হও।
‘যদি’ কথাটি শয়তানের কাজের দরোজা খুলে দেয়
হাদিসের পরের বাক্যটি হল,
وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ، فَلَا تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا، وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ، فَإِنّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشّيْطَانِ.
(ওসব কাজ করতে গিয়ে) যদি তোমার ওপর কোনো বিপদ আসে তাহলে এ কথা বলো না যে, যদি আমি এ রকম করতাম তাহলে এ রকম হতো। (অর্থাৎ যদি ওসব কাজ থেকে দূরে থাকতাম তাহলে এ বিপদ থেকে বেঁচে যেতাম) বরং বলো, এটাই আল্লাহর ফায়সালা। তিনি যা চেয়েছেন তা-ই করেছেন। কারণ, ‘যদি’ কথাটি শয়তানের কাজের দরোজা খুলে দেয়।
ইমাম সুবকী রহ. বলেন, ‘যদি’ শব্দ ব্যবহারের বর্জনীয় ক্ষেত্র দুটি;
এক। যখন একটি ভালো কাজ করার সুযোগ থাকে তখন কোনো কিছুর অভাবের কারণে সেই কাজটি ত্যাগ করা উচিত না। কাজেই এক্ষেত্রে যদি কেউ বলে, ‘যদি ওই জিনিসটি পেতাম তাহলে এই কাজটি করতাম।’ অথচ ওই জিনিসটি ছাড়াও কাজটি করা সম্ভব। এই ‘যদি’ টি হচ্ছে ‘নিন্দিত যদি’। এ ক্ষেত্রে ওই জিনিসটি ছাড়াই কাজটি সম্পন্ন করে ফেলবে।
দুই। কেউ যখন দুনিয়াবী কোনো কাম্য বস্তু লাভে ব্যর্থ হয় তখন সেই বিষয়ের দুঃখ ও আফসোসে নিজেকে ব্যস্ত করবে না। কারণ এতে একে তো তাকদীরের প্রতি অসম্মতি প্রকাশ করা হয়, দ্বিতীয়ত এই দুঃখ-আফসোসে কোনো উপকারও নেই। বরং এ কারণে অপ্রাপ্তির ক্ষতিপূরণ হত এমন উপকারী কাজ থেকেও বঞ্চিত হতে হয়।
সারকথা হল, ‘যদি’ শব্দের ব্যবহারে যদি বর্তমানের কোনো ভালো কাজের ক্ষেত্রে অবহেলা হয় কিংবা অতীতের কোনো ব্যাপারে তাকদীরের প্রতি অসম্মতি প্রকাশ করা হয় তাহলে এই ‘যদি’র ব্যবহার হবে নিন্দনীয় ও বর্জনীয়।
ইমাম সুবকী রহ.র এ বক্তব্যে শুধু আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যাই নয়, বরং এ বিষয়ক অন্যান্য হাদীসের সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও পাওয়া গেল। তবে সহীহ মুসলিমের আলোচ্য হাদীসে প্রধানত দ্বিতীয় শিক্ষাটি পাওয়া যায়। তা হল, মুমিন দ্বীন-দুনিয়ার কাম্য ও উপকারী বিষয় অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে, অবাঞ্ছিত ও ক্ষতিকর বিষয়াদি থেকে আত্মরক্ষার জন্য যথাসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু এ্ররপরও ফলাফল যদি অন্যরকম কিছু হয় তাহলে একে আল্লাহর হুকুম বলে মেনে নেবে। সুবহানাল্লাহ! এর চেয়ে সুন্দর, বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা আর কী হতে পারে?
তো উপরের হাদীসে আমরা দেখতে পেলাম, ইসলাম আমাদের কত গুরুত্বের সাথে ভালো কাজে ও ভালো বিষয়ে উৎসাহিত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে! দ্বীন-দুনিয়ার উপকারী বিষয়াদিতে কর্ম-তৎপর হওয়ার কী বাস্তবসম্মত শিক্ষা দান করেছে! ইসলামের এই শিক্ষাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করে আমরা যদি তার যথার্থ অনুসরণ করতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরা দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা লাভ করতে পারবো। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে দুনিয়া ও আখেরাতে পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
মুহতারাম ভাইয়েরা! আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করুন এবং ইখলাসের সাথে জিহাদ ও শাহাদাতের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন।
আমরা সকলে মজলিস থেকে উঠার দোয়াটা পড়ে নিই।
سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين
وآخر دعوانا ان الحمد لله رب العالمين
******************