JustPaste.it

ভূ-গোলময় পৃথিবী


লক্ষ্যের প্রতি অবিচল তুর্কী নেতা আরবাকানঃ
দিশেহারা সেক্যুলার পাশ্চাত্য
মুহাম্মাদ মুহিউদ্দীন


তুরস্কের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল রেফাহ পার্টির নেতা নাজমুদ্দীন আরবাকানের সরকার ও তাঁর রাজনৈতিক পলিসি বর্তমানে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের প্রচার মাধ্যমগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাসউদ ইয়ালমাস সরকারের পতনের পর নাজমুদ্দীন আরবাকানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা লাভ করা সকলের জন্যে একটি বিষ্ময়কর ঘটনা ছিল। কারোই একথা বোধগম্য হচ্ছিল না যে, তানসু সিলার- আরাবাকান কোয়ালিশন সরকার গঠনে একমত হলো কীভাবে? তুরস্কের সেক্যুলার সেনাবাহিনী, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও আমেরিকা আরবাকানকে কীভাবে স্বীকৃতি দিল? তখন অনেকেই মনে করেছিল, আরবাকান ক্ষমতা লাভের জন্যে আমেরিকা এবং সেক্যুলারিজমের সঙ্গে আপোস করে নিয়েছেন। আলজেরিয়ার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞরা আরবাকানের এ পলিসিকে সঠিক বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু আরাকানের বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতি এবং তার রাজনৈতিক পলিসি ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে, না, তিনি ক্ষমতার স্বার্থে আমেরিকার সঙ্গে কোনো আপোস করেননি। বরং তিনি নির্বাচনের পূর্বে ঘোষিত পার্টির ইশতেহার অনুযায়ী কাজ করছেন এবং ইসলামী দেশগুলোর ঐক্যের জন্যে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত ৯৬ এর ১২ আগষ্ট নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত নওয়ায়ে ওয়াক্ত পত্রিকা আরবাকান সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন

 

প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছেঃ


“আমেরিকান প্রচার মাধ্যমগুলোর রিপোর্ট অনুযায়ী তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দীন আরবাকানের ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সফর ক্লিনটন প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রধানমন্ত্রী আরবাকানের নেতৃত্বে রেফাহ পার্টির কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন সাম্রাজ্যের জন্যে বিরাট হুমকি বলে মন্তব্য করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্র ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকার অবরোধ নীতি ন্যাটোয় তুরস্কের সক্রিয় ভূমিকা এবং ইসরাইলের সঙ্গে তুরস্কের বিশেষ সম্পর্কের ব্যাপারে প্রভাব ফেলতে পারে। সবচেয়ে বেশী চিন্তার বিষয় হলো, তুরস্ক ইরানকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করে ফেলতে পারে । তাছাড়া আমেরিকা তুরস্ক থেকে যেসব বিশেষ সহযোগিতা পেত, আরবাকানের ক্ষমতা লাভের পর তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
ইতিপূর্বে তুরস্ক ইরান, সিরিয়া, ইরাক ও বসনিয়ার ব্যাপারে মার্কিন নীতির সমর্থন ও সহযোগিতা করত। ইসরাঈলের সঙ্গেও তুরস্ক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষণমূলক সম্পর্ক গড়ে চলছিল। তুরস্ক-ইসরাঈল সম্পর্কের মধ্যে তুরস্ক নেতৃবর্গের ব্যাপকহারে ইসরাঈল সফর, ইসরাঈলকে তুরস্কের নদ-নদী থেকে পানি প্রদানের পরিকল্পনা, তুরস্ক ইসরাঈল ও জর্দান মিলে কনফেডারেশন তৈরীর পরিকল্পনা, তুরস্ক ইসরাঈল প্রতিরক্ষা চুক্তি ইত্যাদি বিশেভাবে উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু, আরবাকান সরকার থেকে ইসরাইল এ ধরনের সহযোগিতা ও সুসম্পর্কের আশা করতে পারছেনা। কারণ, আরবাকান একটি ‘মুসলিম ন্যাটো’ গঠন করার চেষ্টা করছে। এবং ইরাক ও সিরিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখছে। তাছাড়া ইসরাঈলের আতংক হামাসের মত সংগঠনের তিনি প্রশংসা করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা মতে আমেরিকা তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের সহযোগী তানুস সিলার এবং তুরস্ক সেনাবাহিনীর কাছে প্রত্যাশা করছে, যেন তারা আরাবাকানকে আমেরিকা ও ইসরাঈল বিরোধী তৎপরতা থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট হয়। বিশ্লেষকরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছে যে, আরবাকান যদি আমেরিকা ও ইসরাঈলের সহযোগিতা বন্ধই করে, তা হলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টায় প্রভাব পড়তে পারে এবং আমেরিকার রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনেতিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে ইরাক কুয়েত তথা উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে ইরাকের মাধ্যমে মিসর, জর্দান ও তুরস্ক অনেক সুবিধা লাভ করত। ইরাকে ১৫ লাখ মিসরী কাজ করত এবং শত শত কোটি ডলার মিসরে পাঠাতো। ইরাকে ব্যবসা করে জর্দান আয় করেছিল দুই শত কোটি ডলারেরও বেশী অর্থ। নিউইয়র্ক টাইমস এর রিপোর্ট মোতাবেক ইরাকের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের অবরোধের ফলে তুরস্কের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী জাগরণ ঠেকানোর জন্যে আমেরিকা ও ইসরাঈল দুটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে। প্রথমত, বিশ্বের কোথাও ইসলামপন্থীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবে, না। আলজেরিয়া ও মিসর এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দ্বিতীয়ত, কোনো দেশে যদি কোনো ইসলামপন্থী দল ক্ষমতায় এসেই যায়, তাহলে যে ভাবেই হোক তাদের কোনঠাসা করে রাখতে হবে। পদে পদে সমস্যা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা সামনে অগ্রসর হতে না পারে। সুদানে এ পলিসিই প্রয়োগ করা হয়েছে।
গত বছরের ২০ আগষ্ট ওয়াইস অফ জার্মানী আরবাকানের পলিসির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছে যে, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দীন আরবাকান পাশ্চাত্যের নিশ্চিত অসন্তোষ উপেক্ষা করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টায় জয়লাভ করেছে। ইরান, পাকিস্তান ও দূর প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করাকে টার্গেটের অন্তর্ভুক্তির সাথে সাথে সিরিয়া ও ইরানকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ অর্থনৈতিক ফোরাম তৈরির জন্যেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
গালফ নিউজ এর এক রিপোর্ট মোতাবেক পাকিস্তান সফর কালে প্রধানমন্ত্রী আরবাকান বলেছেন, তুরস্কের অবস্থান ফুটিয়ে তোলার জন্যে তিনি প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টায় নিয়োজিত আছেন। তিনি আরো বলেন, 'আমি একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটি মুসলিম ব্লক স্থাপনের জন্যে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র সফর করছি। আমার এতদসংক্রান্ত প্রস্তাবাবলীর প্রতি মিসর, ইরান ও পাকিস্তানের উচ্চস্তরের নেতৃবর্গ ইতিমধ্যেই সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। জনাব আরবাকান বলেন, কোনো দেশকেই এমন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়, যা অন্য দেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর ওপর মোড়লীপনা করা আমেরিকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের জন্য এটি একটি মারাত্মক সমস্যা। এ সমস্যার মোকাবিলা করার জন্যে আমি সব ক’টি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশের নেতৃবর্গের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাতে আমেরিকার চাপের মোকাবিলা করার জন্যে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে একটি ফ্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করা যায়।'
গাল্ফ নিউজের-ই অপর এক রিপোর্ট অনুযায়ী তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দীন আরবাকানের পক্ষ থেকে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির সাম্প্রতিক উদ্যোগকে আরব রাজ্যও স্বাগত জানিয়েছে, গাল্ফ নিউজ প্রফেসর আরবাকানের এই পলিসির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছে যে, আরবাকান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তুরস্কের সবচেয়ে বড় বিপ্লব সাধনকারী শাসক। ইতিমধ্যে তিনি পাকিস্তান, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুর সফর শুরু করে দিয়েছেন। এর মধ্যে চারটিই মুসলিম রাষ্ট্র। এতে বুঝা যায় যে, আরবাকান মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে প্রয়াসী। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা আরবাকানের এই নীতির পর্যালোচনা করতে গিয়ে লিখেছে যে, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী আরবাকান মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে পাশ্চাত্যকে মোটেই তোয়াক্কা করছেন না। মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক সম্পর্ককে তিনি মুসলিম বিশ্বের-ই পারস্পরিক স্বার্থের মধ্যে নিহিত রাখতে চান। আরব বিশ্বেরও এতে জোর সমর্থন রয়েছে। কারণ,এ পথেই তারা ইসরাঈলের কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে বলে আশাবাদী।
আরবাকানের এ নীতি আমেরিকার মনঃপুত নয়। তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে দুই হাজার দুই শত কোটি ডলারের বানিজ্য চুক্তির পর আমেরিকার এ মনোভাব দিবালোকের ন্যায় ফুটে উঠেছে।
কবরস সমস্যার সূত্র ধরে তাই আমেরিকা তুরস্কের পিছনে লেগে গেছে। গত বছর ১১ আগষ্ট গ্রীসের দু’জন ইউনানী বিক্ষোভকারী সীমান্ত অতিক্রম করে তুরস্কের জাতীয় পতাকার অবমাননা করলে তুরস্ক সেনাবাহিনী তাদের হত্যা করে। তুরস্ক-গ্রীস ঝগড়ার ইতিহাসে এটি ছিল একটি সাধারণ ঘটনা। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তানসু সিলার এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, আমরা আমাদের জাতীয় পতাকার অবমাননা বরদাশত করতে পারিনা। কিন্তু, আমেরিকা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে এবং আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেকুলাস বারনাস তানসু সিলারের বিবৃতির নিন্দা করে বলেছেন, 'পতাকা কাপড়ের একটি টুকরা মাত্র। একে কোনো অবস্থাতেই মানুষের জীবনের উপর প্রাধান্য দেয়া যায় না। অপরদিকে আমেরিকার চারজন কংগ্রেস সদস্যও এ ঘটনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মার্কিন সরকারের নিকট তুরস্কের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপের দাবি জানিয়েছেন।
আমেরিকার এ কঠোর অবস্থান গ্রহণের পর মালয়েশিয়া সফরকালে আরবাকান বলেছেন, এ অবরোধ তুরস্কের পরিবর্তে গ্রীসের বিরুদ্ধে করা উচিত। পাশ্চাত্য সংবাদ এজেন্সী স্বীকার করেছেন যে, দু' ব্যক্তি হত্যার ঘটনায় আমেরিকার এই কঠোর অবস্থান মূলতঃ তুরস্ক-ইরান বাণিজ্য চুক্তিতে আমেরিকার অসন্তোষেরই বহিঃপ্রকাশ।
উল্লেখ্য যে, তুরস্ক-ইরানের এ চুক্তি আমেরিকার কোনো আইনের পরিপন্থী ছিল না, যার স্বীকারোক্তি সাপ্তাহিক ‘ইকোনোমিষ্ট পত্রিকা‘ও তার সাম্প্রতিক একটি সংখ্যায় ব্যক্ত করেছে। ইকোনোমিষ্ট এর পর্যালোচনা মোতাবেক জাপান ও পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের সঙ্গে যে ধরনের বাণিজ্য করে থাকে, তুরস্ক-ইরান বাণিজ্য চুক্তি তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। সাপ্তাহিক ইকোনোমিষ্ট পাশ্চাত্যকে এই বলে সাবধান করে দিয়েছে যে, তারা যেন তুরস্কের শান্তিকামী ইসলামী সরকারের বিরোধিতায় অবতীর্ণ না হয়।

অনুসৃতিঃ বেদার ডাইজেষ্ট