ধারাবাহিক উপন্যাস
মরণজয়ী মুজাহিদ-৪২
মল্লিক আহমদ সারওয়ার
১৭ আগষ্ট। সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে। স্নিগ্ধ সমীরণ বইছে। আকাশে অসংখ্য তারা। এই মাত্র একাদশী চাঁদ পূর্বাকাশে উঁকি দিয়েছে। আলী ও দরবেশ খান পাহাড়ের চুঁড়ায় বসে গল্প করছেন। অদূরেই চেক পোস্ট। হঠাৎ করে নিরাপত্তা চৌকি থেকে ফাঁকা ফায়ারের শব্দ ভেসে এলো। একটু পরই দেখা গেল, আকাশ আলোকিত করে রঙ্গিন গোলার আলোর ঝলকানীতে আকাশ ছেয়ে গেছে। আলী আশংকা করছিলেন। শত্রু পক্ষ হয়তো আমাদের উপর বড় ধরনের কোন আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু আলী বুঝতে পারছিলেন না, হামলার আগে ওরা এমন ধুমধাম শুরু করলো কেন?
দরবেশ খান বললেন, এটা নিশ্চয়ই ওদের কোন কূটচাল, আফগান সরকারী বাহিনীর ধুমধামের সাথে আক্রমণ করার সময় এটা নয়। অবশ্যই এর মধ্যে অন্য কোন রহস্য আছে। আমাদের সতর্ক হওয়া উচিৎ।
সমবেত সবাই একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছিলেন। এরই মধ্যে আব্দুর রহমানকে আসতে দেখা গেল। তার সাথে কয়েকজন আরব মুজাহিদ। আফগান জিহাদে বিভিন্ন আরব দেশের কিছু সংখ্যক মুজাহিদ অংশ নিয়েছেন। আলীর নাম শুনে বহু আরব মুজাহিদ তার সান্নিধ্যে থেকে জিহাদ করার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। আলী তাদের জন্য ক্যাম্পের পাশেই স্বতন্ত্র একটি ঘাঁটি তৈরী করিয়ে দিয়েছিলেন। আরবদের গ্রুপ কমান্ডার ছিল মিশরী এক যুবক, নাম আবু হামেদ। ইরানী, তুর্কী, শ্রীলংকান, বার্মীজ, ফিলিস্তিনী, ভারতীয়, জন্মু-কাশ্মীরী, ফিলিপাইনী, কুর্দিস্তানীসহ অন্যান্য দেশের মুজাহিদদেরও আরবদের সাথে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। বিদেশী মুজাহিদদের ঐ ঘাঁটিটির নাম ছিল ‘ইমাম শামেল ঘাঁটি’।
গত এক মাস ধরে আব্দুর রহমান সন্ধার আগেই বাসায় চলে যেতো। সন্ধ্যার পর আব্দুর রহমানকে ফিরে আসতে দেখে আলী চিন্তান্বিত হলেন।
আব্দুর রহমান, আবু হামেদ আগন্তুক অন্যান্য মুজাহিদ আলীর কাছে এসে নীরবে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ সালাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। আলী তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সবার চেহারায় গম্ভীর উদ্বেগের ছাপ। এদের অবস্থা দেখে আলী ও সাথীরা পেরেশান হলেন। উদ্বেগের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, আব্দুর রহমান খবর কি?
আব্দুর রহমান তখনও চুপ। আলী প্রতিউত্তরে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু তার কন্ঠে কোন কথা বেরুলনা।
‘আবু হামেদ! কি ব্যাপার, কেউ কিছুই বলছো না কেন, বল কি হয়েছে’ আলী গভীর উৎকন্ঠা জড়িত কণ্ঠে বললেন।
আলীর দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবেও কেউ কথা বললোনা। তারা সবাই বলতে চাচ্ছিল কিন্তু অত্যধিক শোকাতুর হওয়ার ফলে কারো কণ্ঠ থেকে কোন শব্দ বেরুতে পারছিল না।
আলী চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার? তোমরা কেউ কথা বলছো না কেন?’
আলীর চিৎকারের পরও কারো মুখে কথা ফুটলো না। সবার চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠলো। আব্দুর রহমান আলীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। অন্যান্যরাও শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল।
আলী ও তার সাথীরা এখনো কিছু আঁচ করতে পারেননি। আলী আব্দুর রহমানকে সান্ত্বনার জন্য বললেন, ‘ভাই আব্দুর রহমান! বল, কি হয়েছে। যুবায়দার কিছু হয়নি তো?’ আব্দুর রহমান ধরা গলায় অস্পষ্ট আওয়াজে বললো, ‘না ওর কিছু হয় নি।’
আলীঃ ‘তাহলে হয়েছেটা কি বলো!’
আব্দুর রহমানঃ ‘শত্রুরা আমাদের সবচেয়ে বড় সুহৃদকে হত্যা করেছে।’
আলী ভাবলেন, রুশ বাহিনী হয়তো কোন মুজাহিদ নেতাকে খুন করেছে।
আলী জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘রুশবাহিনী কি কোন মুজাহিদ নেতাকে শহীদ করেছে?’
আব্দুর রহমান বললোঃ হ্যাঁ, সবচেয়ে বড় নেতাকেই শহীদ করেছে।’ কোন সে নেতা? বলো, আলীর প্রশ্ন।
আব্দুর রহমানঃ ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক-এর বিমানে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। জিয়াউল হকের সাথে আরো কয়েকজন পাকিস্তানী জেনারেলও নিহত হয়েছেন। রুশবাহিনী জিয়ার মৃত্যুতে উল্লাস করে ফাকা ফায়ার ও রঙ্গিন গোলা নিক্ষেপ করছে।’
খবরটি ছিল মুজাহিদদের জন্য বজ্রাঘাতের মতো। জিয়াউল হক এর মৃত্যুর সংবাদে সবাই মুষড়ে পড়লেন। সবার চোখে অশ্রু। জিয়াউল হকের মৃত্যু সংবাদ শুনে সবাই পাথর হয়ে গেলেন। অনেক্ষণ পর্যন্ত নীরবে অশ্রুপাত করলেন মুজাহিদরা। কান্নার জোয়ার কিছুটা স্তিমিত হলে আলী পাহাড় চূঁড়া থেকে নেমে নিজ কামরায় চলে গেলেন।
এক কান দু’কান করে জিয়াউল হক এর মৃত্যু সংবাদ অল্পক্ষণের মধ্যে সারা ক্যাম্পে ছড়িয়ে গেল। মুজাহিদরা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে পড়লো। এক দু’ করে কিছুক্ষণের মধ্যে আলীর কামরার সামনে কয়েকশ মুজাহিদ সমবেত হলো। কামরার ভিতরে আলী, আব্দুর রহমান, দরবেশ খান, আবু হামেদ বসে আছেন, সবাই নীরব। কারো মুখে কথা নেই। নীরবে কারো কারো গন্ডদ্বয় বেয়ে অশ্রুগড়িয়ে পড়ছে। আর বাহিরে তখন হাজার মুজাহিদের সমবেত হু হু ক্রন্দনরোল। কোন কোন মুজাহিদ তো উচ্চ স্বরে চিৎকার করে কাঁদছে।
এমন বিস্ময়কর দৃশ্য হয়তো পৃথিবী কমই প্রত্যক্ষ করেছে। যে দৃঢ়চেতা সাহসী মুজাহিদরা নিজেদের মা-বাপ, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন সবাইকে চোখের সামনে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করতে দেখেছে, তদুপরি তাদের মন এতোটা ভেঙ্গে পড়েনি, আজ ভিন দেশের একজন প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে তাদের মধ্যে শোকের প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। জিয়াউল হকের মৃত্যুতে শেরদিল আফগান বীর মুজাহিদের কঠিন মজবুত অন্তরগুলো দুঃখে শোকে হাহাকার করে ওঠলো। শুধু আলীর ক্যাম্প নয়, সারা আফগানিস্তানের মুজাহিদদের মাঝে জিয়াউল হকের মৃত্যু গভীর শোকের মাতম সৃষ্টি করেছিল। মুজাহিদ নেতারা আফগান জিহাদের ভবিষ্যত সাফল্যের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন, তারা জানতেন, জিয়ার মৃত্যু মানে মুজাহিদদের যাবতীয় সরবরাহ ব্যবস্থা রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। আন্তর্জাতিক অঙ্গণের বাধাগুলো আরো প্রকট হয়ে দেখা দেওয়া।
এক বৃদ্ধ মুজাহিদ আলীর কামরায় প্রবেশ করে আলীকে সম্মোধন করে বললেন, কমান্ডার সাহেব, জিয়াউল হক সাহেবের মুত্যু আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা, তা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু বাইরে সাধারণ মুজাহিদদের অবস্থা খুবই করুণ। ওরা দায়িত্ব জ্ঞান ভুলে গিয়ে যেমনটা করছে। আপনাকে এসময় কাতর হলে চলবেনা। ওদের শান্তনা দিয়ে শামলে দিতে না পারলে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পাছে এই সুযোগে শত্রুরা না আবার আক্রমণ করে বসে।
ফয়েজ বাবা! আমি কিংকর্তব্য বিমুঢ়। আমি ওদের কি বলে শান্তনা দেবো। ওদের মন ভরে কাঁদতে দিন। দুঃখ যন্ত্রণা শোক ওরা ভুলে গেছে। ওদের কাঁদতে দিন, কাদুক! এই বলে আলী দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন।
‘হায় আল্লাহ! জীবনে কখনও এমন দেখিনি। দশ বছর ধরে আফগানিস্তানে জিহাদ চলছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলতে দেখেছি, নিজ হাতে ছিন্ন ভিন্ন লাশের পাহাড় আপসারণ করেছি। শত শত মানুষ মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে দেখেছি। আফগানদের রক্তের বন্যা বয়ে যেতে দেখেছি, কিন্তু শেরদিল আফগানদের তো কখনও এভাবে কাঁদতে দেখিনি’। বৃদ্ধ মুজাহিদ ফয়েজ স্বগতোক্তি করে এ কথাগুলো উচ্চারণ করলেন।
চীফ কমান্ডার ওয়ারলেসে আলীকে কল করলেন। ওয়ারলেস সেটের কাছে যে মুজাহিদ বসা ছিলো সে রিসিভ করে আলীকে বললো কমান্ডার সাহেব! ‘চীফ কমান্ডার আপনার সাথে কথা বলবেন।’
আলী চীফ কমান্ডারের পয়গাম শোনার জন্য রিসিভার তুললেন। চীফ কমান্ডার বললেনঃ ‘তোমার কন্ঠস্বর শুনে বোঝা যাচ্ছে, জিয়ার মৃত্যু সংবাদ তোমাদের ক্যাম্পেও পৌঁছে গেছে। এজন্যই আমি তোমাকে ওয়ারলেস করলাম। সংবাদটা শুনে আমি এতই বিমুঢ় হয়ে পড়েছি যে, জীবনে কখনও আমি এমন শোকাতুর হয়নি। জিয়ার মৃত্যুতে আমার সকল প্লান-প্রোগ্রাম এলো মেলো হয়ে গেছে। আমার এখানেও পুরোক্যাম্পে শোকের মাতম নেমেছে। সবাইকে ডেকে সমবেত করে ঘন্টাব্যাপী আমি তাদের শান্তনা দিতে চেষ্টা করেছি। তবুও এখন অনেকের মন ভারাক্রান্ত। সকল মুজাহিদ ক্যাম্পে একই অবস্থা বিরাজ করছে। পাকিস্তান থেকে এই মাত্র খবর পেলাম, ওখানকার অবস্থাও অনুরূপ। উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে ক্রন্দনের রোল উঠেছে। একটা প্রকট আশংকা বিরাজ করছে আশ্রয় শিবিরগুলোর নিরাপত্তার ব্যাপারে।
আমি আশা করি, তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি শামাল দিতে পারবে। হিম্মত হারালে চলবে না। ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। তুমি সাহস হারিয়ে ফেললে, মুজাহিদরা বিভ্রান্ত হবে তাতে করে দুশমনদের পরিকল্পনাই সফল হবে। ধৈর্য্য ও সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দুশমনদের যাবতীয় কূটচাল আমাদের পর্যদুস্ত করতেই হবে। তোমার তো অবশ্যই স্মরণ আছে, ওহুদ যুদ্ধে শয়তানীচক্র যখন নবীজী (সাঃ) এর শাহাদাতের গুজব মুসলমান শিবিরে ছড়িয়ে দিলো, তখন অনেক সাহাবীই বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছিলেন। অনেকেই জিহাদের বিরতি টানার ইচ্ছে করছিলেন, আল্লাহ তাআলার কাছে এ মুহূর্তটি খুবই অপছন্দনীয় হয়েছিল।
জিয়া আমাদের একজন অকৃত্রিম বন্ধু, সহযোগী ছিলেন। আমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে জিহাদ করছি। যে আল্লাহ জিয়াকে আমাদের সহযোগী বানিয়েছিলেন, তিনি এখনও আছেন এবং চিরদিন থাকবেন যে আল্লাহ জিয়াকে আমাদের সুহৃদ বানিয়েছিলেন, তিনিই আবার অনুরূপ কাউকে আমাদের সহযোগী বানিয়ে দিবেন। কাজেই হতাশ হবার কিছু নেই। নিজেকে দৃঢ় করে উদ্ভূদ পরিস্থিতি এবং ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করো। এদিকে গভীর মনোযোগ দাও যাতে অভ্যন্তরীণ কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। ক্যাম্পে কুরআন খানী শুরু করে দাও। শুকরিয়া, অন্যান্য ক্যাম্পেও আমাকে যোগাযোগ করতে হচ্ছে। আগামী কাল জিয়ার জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য আমি ইসলামাবাদ যাচ্ছি। ফিরে এসে কথা হবে। আল্লাহ হাফেজ।’
চীফ কমান্ডারের সাথে কথা বলে আলীর মন অনেকটা হালকা ও দৃঢ় হলো। তিনি উঠে দাড়ালেন এবং কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন। বাহিরে শতশত মুজাহিদ অপেক্ষা করছিলো। আলীর মনে হলো যে, ক্যাম্পের কোথাও দায়িত্বে কোন মুজাহিদ নেই। সবাই এখানে এসে গেছে। সমবেত মুজাহিদদের উদ্দেশ্যে আলী হাক দিলেন। আলীর আওয়াজ শুনে মুজাহিদদের অনেকেই চিৎকার করে কান্না শুরু করল। পরিস্থিতি এমনই দুঃসহ বেদনা কাতর ছিলো যে, আলী কিছুই বলতে পারছিলেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে মুহাম্মদুল ইসলাম কুরআন তিলাওয়াত শুরু করে দিল। কুরআনের বাণী মুজাহিদদের মধ্যে অনেকটা স্থিরতা এনে দেয়। ভিলাওয়াত শেষ হলে আলী জলদ গম্ভীর ভাষায় ভাষণ শুরু করলেনঃ
প্রিয় বীর মুজাহিদ সাথীরা!
পরিস্থিতির আকষ্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ। জানিনা কোথেকে কথা শুরু করবো। জিয়াউল হক আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। শতাব্দীতে এমন দু’ একজন সাহসী পুরুষের জন্ম হয়। জিয়া তাঁর প্রজ্ঞা, দক্ষতা, বিচক্ষণতা, সততা, ধর্মনিষ্টা ও সাহসিকতার দ্বারা শত বাধা প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে আমাদের সাহায্য করেছেন। ফলে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পরাশক্তি রাশিয়াকে আমাদের মতো সহায় সম্বলহীন মানুষেরা চরমভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হচ্ছি। কম্যুনিস্ট উত্থানের পর প্রায় শতাব্দিকালের মধ্যে আমাদের হাতেই প্রথম ওদের চরম পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করতে হলো।
জিয়াউল হক রুশ-ভারতের হুমকী-আক্রমণের পরোয়া না করে আমাদের সব ধরনের সাহায্য করেছেন। তিনি আমাদের শুধু সামরিক সহযোগিতাই করেননি, আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দক্ষ কূটনীতি চালে রাশিয়ার সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছেন এবং সমগ্র মুসলিম ও আরব বিশ্বকে আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। যার ফলে সারা মুসলিম বিশ্বের সবখানেই আমাদের প্রতি সাহায্য, সহযোগিতা, সমর্থন, সহানূভূতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
বন্ধুগণ! রাশিয়া ও নজিবুল্লার শেষ টার্গেট সম্পর্কে আমরা অবগত হতে পেরেছিলাম। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি দুশমনরা ওদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সফল হবে। তা ভাবতে পারিনি।
বন্ধুগণ! আমি নির্দ্ধিধায় বলতে পারি, শহীদ জিয়াউল হকের মতো মর্দে মুমিন প্রেসিডেন্ট এ শতাব্দিতে দু’একজন জন্মেছে বইকি। জিয়া উপমহাদেশের দ্বিতীয় আওরঙ্গজেব, আফগানিস্তানের জন্য শিহাবুদ্দীন ঘোরীর প্রতীক ছিলেন। তিনি আমাদের জন্য সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর মতো আশির্বাদ হয়ে এসেছিলেন। আমি আজ আপনাদের জানাচ্ছি যে, এ মর্দে মুমিন শুধু আমাদের সহযোগিতা করেই ক্ষান্ত থাকেননি, স্বশরীরে বহুবার আফগানিস্তানের একাধিক অভিযানে শরীক হয়েছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে প্রত্যক্ষ দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
দু’বছর আগে আমি যখন খোস্ত বিজয় অভিযান নিয়ে অত্যন্ত চিন্তান্বিত ছিলাম হঠাৎ একদিন সেখানে জিয়া উপস্থিত হয়ে আমাকে প্রত্যক্ষ দিক নির্দেশনা ও কৌশল নির্ধারণে অপূর্ব সহযোগিতা করেছিলেন। তার প্রতিটি নির্দেশনাই ছিল ফল প্রসূ ও বাস্তবসম্মত। হঠাৎ একদিন আমি চীফ কমান্ডারের ম্যাসেজ পেলাম। তিনি জানালেন, তোমার এখানে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আসছেন। রাস্তায় পর্যাপ্ত পাহারার জন্য জায়গায় জায়গায় মুজাহিদ নিয়োজিত করো। পাহাড়ের উপর ক্যাম্প অফিসে তুমি ছাড়া আর কোন মুজাহিদকে থাকতে দিবেনা। কেউ যেন জানতে না পারে যে, তোমার এখানে কোন বিশেষ ব্যক্তি আসছেন।
আমি ভাবলাম, হয়তো কোন মুজহিদ নেতা আসবেন! আমি সব ব্যবস্থা ঠিক ঠাক করে পাহাড়ের উপর বসে একটি দূরবীন দিয়ে আশ-পাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। অনেক দূরে দেখা গেল, ঘোড়ায় আরোহন করে কয়েকজন লোক এদিকে আসছে। দেখতে দেখতে তারা আমাদের ক্যাম্পের চেকপোষ্ট পর্যন্ত এসে গেল। ঘোড়া থেকে নেমে আগন্তুক সকলে পায়ে হেটে পাহাড়ের উপর উঠতে লাগল।
আমি পাহাড় থেকে নেমে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকে সবাইকে আফগানী মনে হচ্ছিল। কিন্তু আগত বিশেষ ব্যক্তি যখন আমার সাথে মুসাফাহ করলেন, বিষ্ময়াবিভূত হলাম, আরে ইনি যে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক! পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শত্রুর মুখোমুখি ভয়ংকর এ যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিজে হাজির হবেন তা আমি কখনও ভাবতেও পারিনি।
জিয়া নিজ সন্তানের মতো আমার সার্বিক অবস্থার খোঁজ খবর নিলেন, জিহাদে আমার ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। আলোচনায় আমি যখন তার কাছে জিহাদের বর্তমান পরিস্থিতি এবং আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা পেশ করলাম, তিনি খুবই প্রীত হলেন এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করলেন। যাবার আগে তিনি আমাকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিয়ে বললেন, আমাকে যদি অন্যান্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতে না হতো তাহলে তোমার যাবতীয় কার্যক্রম বিস্তারিত শুনতে পারতাম। দু’আ করি, আল্লাহ তোমাকে কামিয়াব করুন৷ কমান্ডার আলী! জীবনের কোন মুহুর্তেই হিম্মত হারাবেনা। বিজয় ওই ব্যক্তির পদচুন্বন করে, যে আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয় এবং অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে কোন প্রতিবন্ধকতার পরোয়া করেনা।
জিয়ার কথাগুলো আজো আমার কানে ঝংকৃত হচ্ছে। বিংশ শতাব্দির বর্তমান মুসলিম বিশ্বে জিয়ার মতো আরো দু’চারজন প্রেসিডেন্ট থাকলে বিশ্বের মজলুম মুসলমানদের অবস্থা এতো করুণ হতো না।
এ পর্যন্ত বলে আলী বাকরদ্ধ হয়ে পড়লেন। তার মুখ থেকে আর কথা বেরুল না। দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেললেন। আবারো মুজাহিদরা উচ্চ স্বরে কান্না জুড়ে দিল।
পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য এবার আব্দুর রহমান দাঁড়িয়ে বললেনঃ বীর মুজাহিদ ভাইয়েরা! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। শত্রুরা ষড়যন্ত্র করে জিয়াউল হককে হত্যা করেছে, যাতে আমাদের দুর্বল করতে পারে। তোমরা এভাবে শোকাচ্ছন্ন হয়ে থাকলে দুশমনদের ষড়যন্ত্র সফল হয়ে যাবে আর আমরা বিজয়ের দ্বার প্রান্তে এসে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হবো।
দেখতে পাচ্ছো, দুশমনরা আনন্দে মেতে উঠেছে আর আমরা এখনও শোকে কেঁদে মরছি। জিয়াউল হক জীবনের চূড়ান্ত নজরানা জিহাদের পথে নিবেদন করে আপন লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। জিয়ার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসার দাবী হচ্ছে, জীবনবাজী রেখে কাবুল বিজয়কে ত্বরান্বিত করা। এরপর অন্যান্য মজলুম মুসলমানদের সাহায্যে অগ্রসর হওয়া। বন্ধুগণ! আমাদের শত্রুপক্ষ খুবই দুর্বল মনোবলের অধিকারী। ওরা যোগ্যতা, সাহসের দ্বারা আমাদের সাথে না পেরে আমাদের বন্ধুকে অত্যন্ত ঘৃণ্য প্রক্রিয়ায় হত্যা করেছে। এখন আমাদের কর্তব্য হবে শহীদ জিয়াউল হকের স্বপ্নবাস্তবায়নে শত্রুদের সকল দুরভিসন্ধি নস্যাত করে দেয়া।
আব্দুর রহমানের পর দরবেশ খান দাঁড়িয়ে বললেনঃ বন্ধুগণ! আমরা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে শপথ করছিঃ প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়ার খুনের প্রতিশোধ নেয়া আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আগামী প্রজন্ম অব্যশই আমাদেরকে ক্ষমা করবে না। এ খুনের বদলা আমাদের নিতেই হবে।
এ সময় এক মুজাহিদ দাঁড়িয়ে বললোঃ কমান্ডার সাহেব! দুশমনরা আমাদের প্রতি বিদ্রুপ করে উল্লাস করছে। ওদের প্রতিটি ফাঁকা আওয়াজ আর রঙ্গিন গোলা আমাদের কলিজা বির্দীণ করছে। আমাদের অনুমতি দিন, আমরা দুশমনদের আজ রাতেই উল্লাসের মজা মিষিয়ে দিই। এতে করে আমাদের দুঃখ হালকা হবে। মুজাহিদের কথার সমর্থনে সমবেত মুজাহিদরা উচ্চ কণ্ঠে নারায়ে তকবীর দিয়ে সারা ক্যাম্প কাঁপিয়ে তুললো।
আলী বললেনঃ বন্ধুরা! আমি তোমাদের দাবী সমর্থন করি, কিন্তু আমাদের ভাবতে একটু সময় দাও। আপাততঃ সবাই নিজ নিজ ছাউনীতে দায়িত্বে ফিরে যাও। আমি তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আজ রাতে হামলা না হলেও আগামী কাল ঠিকই দেখবে দুশমনদের আমরা রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে ছাড়ব।
ক্যাম্পের সকল বিভাগীয় প্রধান, গ্রুপ কমান্ডার ও গুরুত্বপূর্ণ নেতৃস্থানীয় মুজাহিদদের জরুরী এক সভায় ডাকা হলো। ভাবগম্ভীর পরিবেশে বৈঠক বসল। বৈঠকে বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণের পর সিদ্ধান্ত হলো, আগামী কাল শত্রুপক্ষের উপর হামলা হবে এবং আশে-পাশের অন্যান্য ক্যাম্পকেও আক্রমণে শরীক হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো।
পরদিন সূর্যাস্তের পরপরই দু’হাজার চৌকস মুজাহিদের একটি সুদক্ষ বাহিনী তৈরী হলো। তারা শত্রু ছাউনীর তিন দিক থেকে এক সাথে আক্রমণ করল। মাত্র একদিক শত্রুবাহিনীর পালায়নের জন্য খোলা রাখল।
মুজাহিদরা এতো ক্ষীপ্রগতি ও অতর্কিতে হামলা করেছিল যে, শত্রুবাহিনী হামলা মোকাবেলা করার কথা ভাবতেও পারেনি। ওরা দিগবিদিক ছুটাছুটি করে রাত বারোটার দিকে ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে শুরু করল। প্রহরায় যারা ছিল ওদের পক্ষ থেকেও আসা জবাবী গোলা নিক্ষেপ বন্ধ হয়ে গেল। মুজাহিদরা আরো কিছুক্ষণ গোলা নিক্ষেপ করে হামলায় বিরতি টেনে অতি সতর্কবস্থায় সামনে অগ্রসর হতে লাগল। ছাউনীর পাশে গিয়ে আলী বললেন, বেলা উঠার আগে কোন মুজাহিদ শত্রু ছাউনীতে প্রবেশ করবেনা। হয়তো শক্রবাহিনী কোন কূটচাল চালতে পারে। বোকার মতো এতে ফেঁসে যাওয়া ঠিক হবেনা সকাল বেলা মুজাহিদরা যখন শত্রু ছাউনীতে প্রবেশ করল, দেখতে পেল, চতুর্দিকে শক্র সৈন্যেদের লাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। তবে প্রায় দু’শোর মতো শত্রু সৈন্য কংক্রীটের তৈরী বাংকারে লুকিয়ে ছিল, ওরা মুজাহিদদের দেখা মাত্র হাতিয়ার ফেলে সারেন্ডার করল।
শত্রুবাহিনীর পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে কয়েকজন মুজাহিদ শহীদ হলো এবং শতাধিক আহত হলো।
মুজাহিদ সমর্থক ক্যাপ্টেন আব্দুস সাত্তার কয়েকজন সরকারী সেনা অফিসার নিয়ে আলীর সামনে এসে বললেন, আপনাদের পক্ষ থেকে হামলার খবর শুনে এরা অনেক কাজ করেছে। [চলবে]
ভাষান্তরঃ শহীদুল ইসলাম