JustPaste.it

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

 

মানবতার সেবার নামে এনজিওরা আমাদের ড্রাকুলার ন্যায় শোষণ করছে

আবদুল্লাহ আল ফারুক

===================================================================

 

       দেশের সর্বত্র এনজিওদের অবাধ বিচরণের কারণঃ দেশের সর্বত্র এনজিওদের অবাধ বিচরণের অন্যতম কারণ হল সরকারের ব্যর্থতা। বিদেশী দাতা সংস্থাসমূহ দেশের আর্থ- সামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকারকে যে অর্থ সাহায্য প্রদান করে তার সিংহভাগই প্রশাসনের দক্ষতার অভাবে দুনীতিবাজদের লুটপাট, প্রকল্প বাস্তবায়নে অলসতা ও গড়িমসির কারণে কাজে খাটে না। আশির দশকের শুরুতে সামরিক শাসন এবং পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদের প্রশাসন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হলে বিদেশী দাতা সংস্থাসমূহ সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। তারা ধীরে ধীরে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। তারা সরকারকে দেয়া ঋণ সাহায্য এবং সরকারী প্রকল্প বাস্তবায়নে এনজিওদের অংশগ্রহণের শর্ত জুড়ে দেয়। মূলত পাশ্চাত্যের এই দাতা সংস্থা সমূহ কোন দেশের সরকারের ওপর তাদের প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য তথাকথিত ঋণ সাহায্যকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য দাতা সংস্থার সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে। তাই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সচরাচর যা ঘটে প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং অদক্ষতা-এই দুয়ের অভিযােগ তুলে তারা সংশ্লিষ্ট দেশের সার্বিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য কৌশলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এনজিওদের উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশ নেয়ার সুযােগ করে দেয়। আমাদের দেশও তথাকথিত দাতা গােষ্ঠী সেই অস্ত্রই প্রয়ােগ করেছে।

 

        ১৯৮৪ সালে প্যারিসে বিশ্ব ব্যাঙ্ক আয়ােজিত সাহায্যদাতা কনসাের্টিয়াম বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল উপস্থিত হলে সাহায্যদাতারা তাদের নিজ নিজ দেশের এনজিও সমূহকে লেলিয়ে দেয়। পাশ্চাত্যের এনজিও সংস্থা সমূহ সেই বৈঠক ঘেরাও করে দাবী তােলে যে, পশ্চিমা এনজিওগুলিকে বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযােগ দেয়া না হলে বাংলাদেশকে সাহায্যদান স্থগিত রাখতে হবে। সেদিন প্রতিনিধি দল এই চাপের মুখে নতি স্বীকার করে এক ধরণের দাসখত লিখে দিয়ে কনসাের্টিয়ামের বরাদ্দ কোন প্রকারে আনতে পেরেছিল। (ইনকিলাব, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯২]

 

        সেই থেকে শুরু হয়েছে এনজিওদের স্বেচ্ছাচার এবং দাতা সংস্থাসমূহের সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পালা। এরপর প্রতিবারই বিশ্ব ব্যাঙ্ক, ইউএনডিপি ও অন্যান্য দাতা সংস্থা সমূহ সরকারকে দেয়া বরাদ্দের একটা অংশ দুর্নীতি ও অযােগ্যতার প্রশ্ন তুলে এনজিওদের বরাদ্দ দিচ্ছে। দাতা সংস্থাসমূহ নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে এদেশে কর্মরত কোন এনজিও কত টাকা পাবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এর মধ্যে ব্রাকের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। গত ৩ থেকে ৬ই নভেম্বর ১৯৯২, রােমে দাতা সংস্থাদের বৈঠকে ব্রাক কত টাকা সাহায্য পাবে তা নির্ধারণও করে দেয়া হয়।

 

        এদিকে এরশাদ সরকারের দুর্নীতির প্রতি বিশেষ দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে এনজিও গােষ্ঠি এদেশে তাদের তৎপরতাকে আরও বিস্তৃত করে। তারা ১৯৮৮ সালে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেনারেল এরশাদকে সংবর্ধনা দেয়। সেই সংবর্ধনায় এনজিও প্রতিনিধিরা সরকারী কর্মকাণ্ডে তাদের অংশ গ্রহণের আবদার জানায় এবং এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ সালে তাদের সরকারী কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণের সুযােগ দেয়া হয়। এর পরই বহু সরকারী আমলা বিভিন্ন এনজিওর সাথে জড়িয়ে পড়ে তাদের বিশেষ স্বার্থ উদ্ধার করে। শােনা যায়, এভাবে সরকারী কর্মকর্তা ও এনজিও গােষ্ঠির মধ্যে একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার দরুন রাষ্ট্রীয় অনেক গােপন দলিল পাচার হয়ে বিদেশে চলে যায়।

 

       শুরু হল এনজিও গােষ্ঠীর দৌরাত্ম্যঃ দাতা সংস্থার চাপ এবং এনজিওদের অবৈধ চাপের কাছে সরকারের নতি স্বীকারের ফলে এনজিওরা সীমাহীন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে। তারা সরকার এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতির তােয়াক্কা না করে রাষ্ট্র বিরােধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়। এ বিষয়ে সরকার কোন এনজিওকে সতর্ক করে দিলে বা শাস্তিমূলক ক ব্যবস্থা নিলে সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট এনজিও'র বিদেশী মুরব্বী দাতা গােষ্ঠীর পক্ষ থেকে সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার হুমকি আসে। ফলে ই সরকার বাধ্য হয়ে অপরাধী সংস্থার অপরাধ এ মাফ করে দেয় এবং উক্ত সংস্থা পরবর্তিতে আরাে ক্ষতিকর তৎপরতায় লিপ্ত হয়। ১৯৯২ সালে এডাব নামে একটি প্রভাবশালী এনজিও সরকারের অনুমতি ছাড়া বিদেশ থেকে অর্থ গ্রহণ এবং বেআইনী ভাবে এদেশের রাজনৈতিক তৎপরতায় জড়িয়ে গেলে সরকার তার রেজিষ্ট্রেশন বাতিল করে দেয়। কিন্তু ২৪ ঘন্টার মধ্যে সরকার পুনরায় বিদেশী দাতা সংস্থার হুমকির কারণে তার রেজিষ্ট্রেশন বহাল করতে বাধ্য হয়।

 

        এনজিও-দাতাগােষ্ঠীর গােপন আতাতঃ যেহেতু এনজিও গােষ্ঠী দাতাদের নিকট থেকে অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে, তাই তাদের দাতাদের কিছু লিখিত এবং অলিখিত গােপন শর্ত পালন করতে হয়। এর অন্যতম শর্ত হল, দাতাদের ইচ্ছার বাহিরে কোন কিছু করা যাবে না। এনজিও সংস্থা অর্থ সাহায্যের জন্য দাতাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তারা দাতাদের শর্ত রাষ্ট্র বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে হলেও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। মাঝে মাঝে স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কিনা তা তদন্ত করার জন্য দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে তদন্ত দল আসে। তদন্তে যে সব সংস্থা বেশী অনুগত এবং বিশ্বাস ভাজন প্রমাণিত হয় দাতা সংস্থা তাদের সাহায্য প্রদানের বেলায় অগ্রাধিকার প্রদান করে। ফলে প্রতিটি এনজিও অধিক বিশ্বাসভাজন হওয়ার জন্য দাতাদের শর্ত পালিত হচ্ছে কিনা সেদিকেই। লক্ষ্য রাখে, সরকারী নিয়ম-নীতি লংঘিত হলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। কেননা দাতা সংস্থা সমূহের মধ্যে গােপন আতাতের কারণে তাদের কোন আশ্রিত এনজিও সংস্থা কোন দেশের বেকায়দায় পড়লে সম্মিলিত দাতাসংস্থা জোট সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে উদ্ধার করে।

 

        সরকারী নিয়ম অনুযায়ী ফাণ্ড সংগ্রহ করার জন্য অনুমােদনের দরকার হয়, কিন্তু এদেশে বহু সংস্থা অনুমােদন ছাড়াই বিদেশ থেকে ফাণ্ড সংগ্রহ করে, আবার কেউ কেউ ফাণ্ড খরচ করার পর সরকারের অনুমােদন নেয়। এজন্য তারা আমলাতন্ত্রের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। দাতা সংস্থাসমূহের অবৈধ প্রভাবের কারণে এসব সংস্থা গােপনে যে ফাণ্ড সংগ্রহ করেছে এবং দাতা সংস্থা সমূহের দেয়া বরাদ্দ কিভাবে ব্যয় করছে তার কোন সঠিক হিসাব সরকারী দপ্তরে দেয়ার প্রয়ােজন মনে করে না। ফলে সরকার তাদের প্রকৃত কার্যকলাপ, মুখােসের আড়ালে আসল চেহারা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে না। তাদের কাজের কোন অডিট হয় না, সরকারী অর্থের বিদেশী সাহায্যের কতটুকু খরচ করল, কতটুকু লুটপাট হল তার কোন সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। সরকারী কোন দপ্তরের ৪০ কোটি টাকার অধিক ব্যয় করতে সরকার প্রধানের অনুমােদন প্রয়ােজন হয়। কিন্তু এসব সংস্থা ১০০ কোটি টাকাও সরকারের অনুমােদন ছাড়া ব্যয় করলে সরকারের কিছুই করার নেই। তাছাড়া দাতা সংস্থা সমূহও এনজিওদের দেয় সাহায্যের পুরােপুরি কোন হিসাব নেয় না। ফলে এনজিওরা অর্থ ব্যয়ে একটা অলিখিত স্বাধীনতা পেয়ে যাচ্ছে। এরই সুযােগে ‘বস’ শ্রেণী দারিদ্র্য বিমােচনের নামে বিলাসী জীবন যাপন করছে। অর্থের পাহাড় গড়ে তুলছে। এভাবেই পাশ্চাত্যের ভাগ্যান্বেষীরা সেবার নামে যে এনজিও সংগঠন গড়ে তুলেছে তার মূল উদ্দেশ্য অর্জন করে চলছে।

 

        এনজিওদের এ কেমন সেবাঃ এনজিও ব্যুরাের মতে, ১৯৮৮ থেকে ৯০ পর্যন্ত দুই বছরে প্রায় ৫০টি বড় এনজিও প্রায় দেড়শ কোটি টাকা সাহায্য গ্রহণ ও খরচ করে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ গ্রহণকারী এনজিওদের মধ্যে রয়েছে কারিতাস ২২ কোটি ৩ লাখ টাকা, ব্রাক প্রায় ১৪ কোটি টাকা, নিজেরা করি ১১ কোটির অধিক, প্রশিকা মানবিক প্রায় ১০ কোটি টাকা, সুইডিশ মিশন ৭ কোটির অধিক, এ সি সি প্রায় সাড়ে ৪ কোটি, টিডি এইচ ৪ কোটির অধিক, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি প্রায় ৪ কোটি টাকা অনুমােদনবিহীন সাহায্য পায়। অনুমােদনবিহীন তালিকায় আরাে আছে অষ্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিষ্ট মিশনারী সােসাইটি, কনসার্ন এস এম এন বি ওয়াই এ ডব্লিউ সি এ, বরিশাল ডেভেলপমেন্ট সােসাইটি, এফ সি, ওয়ার্ল্ড মিশন, সালভেশন এম, এন সি ওয়াই এন সি এ, ইত্যাদি। অবৈধভাবে শুধু অর্থই নয় অনুমােদনবিহীন প্রকল্পের কাজও তারা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার দাতাদের পছন্দ না হলে সে প্রকল্পের অর্থ সংস্থান হয় না। প্রকল্পক্ষেত্রে দাতাদের ভাল লাগা না লাগাই চূড়ান্ত। আইন আছে, করণীয় তালিকাও দেয়া আছে, কিন্তু এসব তােয়াক্কা করে না এনজিওরা। এরশাদের আমলে ৯০-এর জুন মাস থেকে বিগত ২ বছরে এনজিওসমূহ ১৫০ কোটি টাকা বিদেশী সাহায্য সরকারের অনুমােদন ছাড়া গ্রহণ করে। এজন্য কোন মামলা হয়নি। এ সময়ে ১৮০০ কোটি টাকা অনুদান নেয়া হয়েছে। যার ৬০ ভাগ ব্যয় হয়েছে। প্রশাসনিক ও প্রতিষ্ঠানিক কাজে মাত্র ৪০ ভাগ অর্থাৎ ৮০০ কোটি টাকার কাজ দেখানাে হয়েছে।

 

        সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওগুলাে প্রকল্পের ৬০ শতাংশ প্রশাসনিক খাতে ব্যয় করে এবং ২০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যয় করে কর্মসূচী বাস্তবায়নে দাতাগুলাের অর্থে এনজিওর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিপুল অংকের বেতন, ঢালাওভাবে বিদেশ সফর, গাড়ি ব্যবহার এবং বিলাস বহুল জীবন যাপন খাতে ব্যয় করে। বাংলাদেশে এনজিও প্রতিষ্ঠা করা এখন লাভের ব্যবসা। যেহেতু এসব বেসরকারী সংস্থা সরকারী নিয়ম-কানুনের বাইরে অবস্থান করে সেহেতু অর্থনৈতিক নিয়ম শৃঙ্খলার বালাই সেখানে নেই। প্রতিটি প্রকল্প থেকে এনজিওগুলাে মােটা অংকের পয়সা উপার্জন করে। এনজিওদের দাবী অনুযায়ী তারা আমাদের সেবা করতে এসেছে। কিন্তু তাদের কর্মকর্তাদের সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ী, বাড়ী ও অন্যান্য বিলাসিতার উপকরণ দেখলে কে বলবে যে তারা স্বেচ্ছাসেবক? তাদের বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় হচ্ছে প্রশাসনিক দফতর, গাড়ী, কর্মচারীদের মােটা বেতন-ভাতা প্রদানে। ফলে তাদের তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পের ভাগে পড়ছে সামান্য অর্থ যা উচ্ছিষ্টই বলা চলে। এদেশের অধিকাংশ এনজিওর অফিস ভাড়া ৫০ হাজার টাকা থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত, কর্মকর্তাদের বেতন ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার/৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তাদের একটা ল্যাট্রিনের পেছনেই প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকার মত খরচ হয়। লুটে পুটে খাওয়ার এই পদ্ধতিই কি পাশ্চাত্যের সেবার মর্ডান ব্রাণ্ড?

 

       এনজিও সম্পর্কে সরকারী নীতিমালাঃ এনজিও সম্পর্কিত প্রথম আইন হয় ১৯৭৮ সালে। এর পূর্বে ১৯৬০-৬১ সালে জনহিতকর প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত একটি আইন ছিলাে। এই আইনে বিদেশী অর্থগ্রহণ সম্পর্কিত কোন বিধি- বিধান ছিলাে না। কিন্তু স্বাধীনতার পর যথেচ্ছা বিদেশী অর্থ আসতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালে দি ফরেন ডােনেশন (ভলেন্টারী একটিভিটিজ) রুলস নামে নতুন আইন প্রণীত হয়। ১৯৮২ সালে প্রণীত হয় দি ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেগুলেশন অর্ডিনেন্স। এর পর দেশী ও বিদেশী বেসরকারী সংস্থা তথা এনজিওদের কার্যক্রমে সমন্বয় ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের তদারকির জন্য ১৯৯০ সালের জুন মাসে প্রেসিডেন্টের সচিবালয়ের অধীনে এনজিও বিষয়ক ব্যুরাে গঠন করা হয়। এনজিও বিষয়ক ব্যুরাে এনজিওদের নিবন্ধন, প্রকল্প অনুমােদন সহ কর্মরত এনজিওদের অর্থ ছাড়, বিদেশী কর্মকর্তাদের নিয়ােগ অনুমােদন দিয়ে থাকে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়ােগ ধার্যকৃত বিভিন্ন ফি, সার্ভিস চার্জ আদায় ও এনজিওদের পেশকৃত বিভিন্ন প্রতিবেদন, বিবরণ, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন এবং এনজিও কার্যক্রমের ওপর প্রতিবেদন তৈরি, কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নে প্রয়ােজনে মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন, আয় ব্যয়ের তদারকির দায়িত্ব এনজিও ব্যুরাের।

 

এনজিও ব্যুরাের নীতিমালায় রয়েছেঃ

        (ক) সরকারী নীতি বা জাতীয় নিরাপত্তার পরিপন্থী না হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এনজিওদের উৎসাহিত করা।

 

        (খ) এনজিওরা যাতে সরকারের আইন ও নীতিমালার মধ্যে তাদের কর্ম পরিধি সীমিত রাখে তা নিশ্চিত করা।

 

        (গ) সরকারের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত প্রকল্প অথবা এর সুনির্দিষ্ট অংশ এনজিওর মাধ্যমে সম্পন্ন করা যাবে।

 

        (ঘ) বিদেশী ও বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত এনজিও ১৯৭৮ সালের আইন মােতাবেক এনজিও ব্যুরাে নিবন্ধন প্রদান করবে। আবেদনের ১২০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করা হবে। নিবন্ধন ইতিমধ্যে বাতিল না হলে ৫ বছরের জন্য কার্যকর থাকবে।

 

        (ঙ) বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট এনজিও তাদের কার্যক্রম সরকার অনুমােদিত প্রকল্পসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে। প্রকল্প প্রস্তাবসমূহ অনুমােদনের জন্য এনজিও বিষয়ক ব্যুরােতে পেশ করতে হবে। আবেদন প্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে হবে।

 

        (চ) এনজিও বিষয়ক ব্যুরাে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে বিদেশী পরামর্শদাতা, বিশেষজ্ঞ বা উপদেষ্টা নিয়ােগের ছাড়পত্র প্রদান করবে।

 

        (ছ) জেলা প্রশাসক এনজিও বিষয়ক ব্যুরাের পক্ষে তাদের নিজ নিজ এলাকায় এনজিওদের কার্যক্রম পরীক্ষণের দায়িত্ব পালন করবেন। ৬ মাস অন্তর ব্যুরাের মহাপরিচালকের নিকট রিপাের্ট প্রদান করবেন। জেলা প্রশাসক প্রকল্প পরিদর্শনেও যাবেন। অর্থাৎ ১৯৭৮ ও ৮২ সালের রেগুলেশনের সঙ্গে ১৯৯০ সালে সরকারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণের বিধান করে এনজিও ব্যুরাে করা হয়। এরশাদের আমলে এনজিওদের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ সময়ই গঠিত হয়ে এনজিওদের কেন্দ্রীয় সমিতি “এডাব”। ১৯৮৮ সালে এনজিওদের পক্ষ থেকে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেনারেল এরশাদকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এই সংবর্ধনায় এনজিও প্রতিনিধিরা সরকারী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের দাবী তােলে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ সালের জুনমাসে গঠিত হয় এনজিও বিষয়ক ব্যুরাে এবং এনজিওদের সরকারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযােগ করে দেয়া হয়। ১৯৭৮ ও ৮২ সালের আইনে সরকারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এনজিওদের অংশ গ্রহণের সুযােগ ছিলাে না।

 

        এনজিওদের জন্য বাধ্যতামূলক করণীয় ও পালনীয়ঃ নিবন্ধনের জন্য বিদেশী ও বৈদেশিক সাহায্য পুষ্ট এনজিওদের জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন রয়েছে। বিদেশী সাহায্য গ্রহণ ও ব্যবহার করে স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রমে আগ্রহী ব্যক্তি বা সংস্থাকে ১৯৭৮ সালের সংশ্লিষ্ট অ্যাক্টের ৩ ক (১) ধারা অনুযায়ী আবেদন করতে হয়। নিবন্ধনের জন্য বিদেশী এনজিওদের এক হাজার ডলারের সমপরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা এবং দেশী এনজিওদের পাঁচ হাজার টাকা ফি দিতে হয়। অনুমােদন ছাড়া প্রকল্প নেয়া যাবে না। বিদেশী সাহায্যপুষ্টদের এনজিও ব্যুরাে থেকে পূর্ব অনুমােদন নিতে হবে এবং অনুমােদিত প্রকল্পের মধ্যে কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ থাকবে।

 

        প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা ব্যক্তি বিদেশী মুদ্রায় প্রাপ্ত সকল অর্থ সাহায্য যে কোনাে একটি সিডিউল ব্যাংকের একটি মাত্র একাউন্টের মাধ্যমে গ্রহণ করবে। বিদেশে উদ্ভুত অথচ এদেশে পাওয়া সকল সাহায্যও একটি ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে। এভাবে সাহায্য গ্রহণ করে তা বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য স্থানান্তর করা যাবে। বিদেশী সাহায্যের হিসাব বইয়ে নির্ধারিত নিয়মে হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে। বিদেশী সাহায্য গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়ম- নীতির লংঘন হলে ব্যুরাের পরিচালক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। এক্ষেত্রে আইন ভঙ্গের অভিযােগে ব্যবস্থা গ্রহনে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডি আই জিকেও ক্ষমতা দেয়া আছে।

 

       ধর্ম প্রচারের সাথে জড়িত এনজিওঃ সরাসরি খৃস্টান ধর্ম প্রচারের সঙ্গে যুক্ত এমন ৫২টি এনজিও সনাক্ত করেছে এনজিও ব্যুরাে। এরা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে খৃস্টান ধর্ম প্রচার করছে। এর মধ্যে রয়েছে

 

        (১) ওয়ার্ল্ড মিশনারী ইভানজেলিমজ

        (২) দি সালভেশন আর্মি

        (৩) বাংলাদেশ ফরেন মিশন বাের্ড

        (৪) মে নাইট সেন্ট্রাল কমিটি (এম- সি সি)

        (৫) সেভেস্থতে এ্যাডভেষ্টিস্ট চার্চ অব বাংলাদেশ

        (৬) এ্যাডভেষ্টিন্টন ডেভেলপমেন্ট এও রিলিফ এজেন্সি ইন্টারন্যাশনাল

        (৭) নিউজিল্যাণ্ড ব্যাপটিস্ট মিশনারী সােসাইটি

        (৮) বাংলাদেশ লথার মিশন (ভেনিস)

        (৯) ইন্টারন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান ফেলােশীপ

        (১০) ব্যাপটিষ্ট মিড মিশন বাংলাদেশ

        (১১) নিউ সেন্টার

        (১২) ব্যাপটিস্ট মিশনারী সােসাইটি

        (১৩) সােস্যাল এণ্ড ইন্সটিটিউশন বাের্ড

        (১১৪) চার্চ অব গড মিশন

        (১৫) ক্রিশিয়ান সার্ভিস সােসাইটি

        (১৬) কমিউটিনি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট

        (১৭) ফিনিস ফ্রি ফরেন মিশন

        (১৮) এসােসিয়েশন অব ব্যাপটিস্ট

        (১৯) ক্রিশ্চিয়ান রিফর্ম ওয়ার্ল্ড রিলিফ কমিটি

        (২০) ওয়াল্ড মিশন, অব বাংলাদেশ

        (২১) বাংলাদেশ লুথার মিশন (ফিনিস)

        (২২) ইয়ং ওমেন্স ক্রিশ্চিয়ান এসােসিয়েশন অব বাংলাদেশ

        (২৩) বাংলাদেশ বাইবেল সােসাইটি

        (২৪) কলেজ অব ক্রিশ্চিয়ান থিওলােজি

        (২৫) ক্রিশ্চিয়ান ন্যাশনাল ইভানজেলিজম

        (২৬) দি অষ্ট্রেলিয়ান ব্যাপটিস্ট মিশনারী সােসাইটি

        (২৭) ওয়াল্ড এলাইনন্স অব ওয়াই এম সি

        (২৮) ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ওয়াই এম সি এ বাংলাদেশ

        (২৯) নিউ এপােষ্টলিক চার্চ অব বাংলাদেশ

        (৩০) কালভেরী এপােষ্টেলিক চার্চ

        (৩১) এসেম্বেলস অব গড মিশন

        (৩২) সান্তাল মিশন নরওয়েজিয়ান

        (৩৩) প্রিন্স বেটরিয়ান ফেলােসিপ ইন বাংলাদেশ

        (৩৪) বাংলাদেশ লুথার্ন মিশন নােরওয়েজিয়ান

        (৩৫) জাতীয় চার্চ পরিষদ

        (৩৬) দি চার্চ অব বাংলাদেশ সােশাল ডেভেলপমেন্ট প্রােগ্রাম

        (৩৭) ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ ইউ এস এ

        (৩৮) রেইনবাে হাউস ইন্টারন্যাশনাল

        (৩৯) ক্রিশ্চিয়ান লাইফ বাংলাদেশ

        (৪০) কোনােবিয়া

        (৪১) লাইফ বাংলাদেশ

        (৪২) ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (সিসিডিবি)

        (৪৩) কারিতাস বাংলাদেশ,

        (৪৪) সুইডিশ ফ্রি মিশন

        (৪৫) হিড বাংলাদেশ

        (৪৬) চেশিয়ারস ফাউণ্ডেশন হােমস

        (৪৭) এ্যাকশন এইড

        (৪৮) ওয়াল্ড মিশন প্রেয়ার লীগ

        (৪৯) আইডিয়াস ইন্টারন্যাশনাল

        (৫০) রংপুর দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস (আর ডি আর এস)

        (৫১) দীপ শিখা

        (৫২) ওয়াল্ড মিশন।

        [সাপ্তাহিক পূর্ণিমা ২৫শে নভেম্বর, ১৯৯২]

 

       দেশের নাগরিকদের রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতায় তথা গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত করাঃ এনজিও গােষ্ঠী মােটা বেতন ভাতা, বিদেশ ভ্রমণের সুযােগ প্রদান প্রভৃতির প্রলােভন দেখিয়ে এদেশের মেধাবী ও প্রতিভাবান গবেষক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের তাদের তৎপরতায় জড়িয়ে ফেলেছে। সরকারী কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত হওয়ার সুযােগ পেয়ে উচ্চ পদস্থ এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আমলাদের সাথে এনজিওদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে। ফলে কোন কোন আমলা বা কর্মকর্তাও অধিক উপার্জনের প্রলােভনে এনজিও তৎপরতার সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এর ফলশ্রুতিতে এনজিওরা এসব গবেষক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি এবং আমলাদের গবেষনা তথ্য পরিসংখ্যান সংগ্রহ প্রভৃতি তৎপরতায় ব্যবহার করছে। এসব বিক্রি হয়ে যাওয়া কর্মকর্তারা এনজিও কর্মকর্তাদের কাছে নিজেদের যােগ্যতা জাহির করার জন্য সরকারী কর্মস্থলে রক্ষিত গােপন ও মূল্যবান তথ্য পরিসংখ্যান ব্যবহার করে অহরহ এভাবে রাষ্ট্রীয় গােপন তথ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে। এদেশেরই নাগরিকদের মাধ্যমে এদেশে এখন অধিকাংশ শিক্ষকই এনজিওর মালিক অর্থাৎ তারা জনগণের রক্ত চোষায় নিয়ােজিত। এমন কোন বুদ্ধিজীবি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে কোন না কোনভাবে এনজিওর সাথে জড়িত নয়। বিদেশী অর্থের কাছে এভাবে আমাদের দেশের সকল চিন্তা-চেতনা, প্রতিভা, মেধা, বিবেক-বুদ্ধি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এক ভয়াবহ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বন্ধ্যাত্বের পথে।

 

        এনজিও কার্যক্রম সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিযে একজন এনজিও কর্মী (প্ৰাক্তন রাজনৈতিক কর্মী) বললেন, “কোন প্রকৃত সচেতন দেশ প্রেমিক ব্যক্তি এনজিওতে কাজ করতে পারে না। কারণ, আমি ২৫/৩০ জন মেয়েকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে ডাটা কালেকশন করি, সেগুলাে পাচার হয়ে যায় বিদেশে। ফলে বিদেশ থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় এদেশের বাজার, মানুষের চাহিদার, এমনকি পরােক্ষভাবে রাজনীতিও। আমি নিজেও তা বুঝি, কিন্তু অভাবের তাড়নায় জেনেও তাই করে যাচ্ছি। এ কাজ করে আমি মাসিক ৬০০০/৭০০০ টাকা আয় করি। অন্য কোথাও চাকরী করতে গেলে ৩০০০ টাকা বেতনের চাকরীও পাব না। আমি নিজেও বুঝি, আমার কাজ প্রকৃত পক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহীতামূলক। কারণ, আমি দেশের গােপন তথ্য সংগ্রহ করে বিদেশে পাচার কাজে সহায়তা করে যাচ্ছি।”

 

        (দৈনিক ইনকিলাব,২০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯২) এভাবে এদেশের যুবক, যুবতী, গবেষক, শিক্ষকদের মােটা অংকের বেতনের ফাঁদে ফেলে দেশের গোপন তথ্য পাচারে গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত করা হচ্ছে। সম্পূর্ণরূপে আমরা এখন সাম্রাজ্য শক্তির অক্টোপাশের শিকার।

 

 ═──────────────═