JustPaste.it

মােহর সম্পর্কিত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও তার সংশােধন

আশরাফ আলী থানভী (রাহঃ)

===================================================================

 

মােহর আদায় করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান

        মােহর সম্পর্কিত বড় ত্রুটি হলাে, অধিকাংশ মানুষ মােহর আদায় করার ব্যাপারে আন্তরিক ইচ্ছাই রাখেনা। স্ত্রী তালাক প্রাপ্তা হলে কিংবা মৃত্যু বরণ করলে স্ত্রী বা তার ওয়ারিশরা মােহর উসূল করে নেয়ার চেষ্টা করলেও তা আদায় করার ব্যাপারে স্বামী কোন তাকিদ অনুভব করে না। বস্তুতঃ একে মানুষ স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করে। যেমন, মােহর নির্ধারণের সময় কম-বেশীর ব্যাপারে যদি বাক ক-বিতণ্ডা হয় তখন অনেকে দিব্যি বলেই ফেলে, মিয়া অত কথার প্রয়ােজন কি? একটা ঠিক করে নিলেই তাে হয়, পরে দিবেই বা কে, আর নিবেই বা কে। অর্থাৎ এদের নিকট মােহর শুধু নামের জন্য নির্ধারিত হয়, দেয়া-নেয়ার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

 

        উল্লেখ্য যে, প্রথমত এই দাবী সম্পূর্ণ ভুল ও অগ্রহণযােগ্য। শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী মােহর স্ত্রীর ন্যায্য পাওনা। যেসব ঋণ আদায় করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য স্ত্রীর মােহর আদায় করাও স্বামীর উপর অনুরূপ একটি ফরজ। তবে যদি স্ত্রী স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে মােহর মাফ করে দেয় কিংবা অন্য কোন কারণে স্ত্রী মােহরের অধিকার হারিয়ে ফেলে সে কথা স্বতন্ত্র। যেমন, মােহরের আংশিক বা সম্পূর্ণ স্বামীর উত্তরাধিকারে চলে যাওয়া বা বিবাহের পর মিলনের পূর্বেই তালাক প্রাপ্তা হওয়া ইত্যাদি। এব্যাপারে ফেকাহর বিভিন্ন কিতাবে বিস্তারিত আলােচনা রয়েছে।

 

মােহর আদায় করার ইচ্ছা না থাকলে স্বামী ব্যাভিচারী হিসেবে মুত্যুবরণ করবে

        বস্তুতঃ মনে রাখতে হবে যে, মােহরকে মামুলী মনে করা এবং তা আদায় করার সদিচ্ছা না থাকা এতই মারাত্মক অপরাধ যে, হাদীসে এব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। যেমন, কানযুল উম্মালে বর্ণিত হয়েছে, রসুল (সঃ) বলেছেনঃ “যদি কোন ব্যক্তি কোন মহিলাকে বিবাহ করে এবং তার মােহর নির্ধারিত করে কিন্তু যদি তার একাংশ কিংবা মােটেই না দেয়ার নিয়ত রাখে, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যাভিচারী রূপে মৃত্যুবরণ করবে এবং ব্যভিচারী রূপেই আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাৎ হবে।”-কানযুল উম্মাল, খঃ ৮ পৃঃ ২৪৮

 

        এখন মােহর আদায় না করার ইচ্ছা এবং সেই কারণে ব্যভিচারী রূপে মৃত্যুবরণ করার হুশিয়ারীর সাথে এই কাজ ও এর শাস্তির মাঝে সম্পর্ক কি তা জানা মূলত মুখ্য না হলেও অনুসন্ধিৎসু মনের জিজ্ঞাসার জবাবে তার একটি সূত্র উল্লেখ করব। কিন্তু এর পূর্বে তাকে বুঝতে হবে যে, বিবাহ ও ব্যভিচারের মধ্যে পার্থক্য কি?

        হাদীসের আলােকে বুঝা যায় যে, বিবাহ এবং ব্যভিচারের মধ্যে পার্থক্য হলাে তিনটি (১) অভিভাবক (২) দু'জন সাক্ষী এবং (৩) মােহর নির্ধারণ।-কানযুল উম্মাল, খঃ ৮ পৃঃ ২৪৫, ২৪৬, ২৪৭. ২৯৬, ২৯৭।

 

কোন শরয়ী আমলই আল্লাহর নিকট নিয়ত ব্যতীত গ্রহণযােগ্য নয়

         মােহর নির্ধারণ করা একটি আমল। কিন্তু যদি তা আদায় করার ইচ্ছা না থাকে তবে তা নির্ধারণ করা না করা সমান কথা। ইতিপূর্বে প্রমাণ করা হয়েছে, মােহর নির্ধারিত না হওয়া ব্যভিচারের বৈশিষ্ট। এ হিসাবে এই বিবাহ ব্যভিচার তূল্য প্রমাণিত হলাে। আর এ কারণেই এমন স্বামীর বিবাহ মিলনকে ব্যভিচার আখ্যায়িত করা হয়েছে।

 

যার মােহর আদায় করার ইচ্ছা নেই সে আত্মসাৎকারী এবং চোর বলে অভিযুক্ত হবে

         উপরােক্ত হাদীসের দ্বিতীয় অংশ হলাে, যদি কোন ব্যক্তি কারাে থেকে কোন বস্তু খরীদ করে এবং তার মূল্য আদায় করার ইচ্ছা না রাখে কিংবা যদি কেউ ঋণ করে তা আদায় করার প্রয়ােজন মনে না করে অথবা যদি কেউ কারাে থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে তা আদায় করতে না চায়, তাহলে সে ব্যক্তি দুনিয়ায় এবং কিয়ামতের দিন পরের সম্পদ আত্মসাৎকারী এবং চোর বলে আখ্যায়িত হবে। অতএব মােহর যা আদায় করা ওয়াজিব যদি কেউ পরিশােধ করার ইচ্ছা রাখে, তাহলে হাদীসের দ্বিতীয় অংশ অনুযায়ী সেও পরের অর্থ আত্মসাৎকারী এবং চোর বলে অভিহিত হবে। অতঃপর এমন ব্যক্তি একাধারে দু’টি অপরাধে অপরাধী বলে চিহ্নিত হবে। সুতরাং সে একাধারে দুটি সাবধানবাণীর ক্ষেত্র বলে বিবেচিত হলাে। তাই পূর্বের তুলনায় আরেকটু জোরালােভাবে, বলতে চাই, এপরও কি তােমরা সাবধান হবেনা, এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি কি এখনও সংশােধন করবে না?

 

নিজের সামর্থের অধিক মােহর নির্ধারণ করা উচিত নয়

        উপরােক্ত ত্ৰুটির সংশােধন ও সমাধানের সহজ পথ হলাে, যে পরিমান মােহর নির্ধারিত হবে, তা আদায় করার পূর্ণ ইচ্ছা থাকতে হবে। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে যে, এধরনের অবিচল প্রতিজ্ঞা সে ক্ষেত্রে রাখা যায় যে ক্ষেত্রে তা আদায় করার সামর্থ থাকে। অন্যথায় আদায় করার নিয়ত কল্পনার গণ্ডিতে বন্দী হয়ে থাকে। কোন দিন এর বাস্তবায়ন ঘটে না। মনে করুন, যার একশত টাকা দেয়ার সামর্থ নেই তার একলাখ সােয়া লাখ তাে দূরের কথা দশ, পাঁচ হাজার টাকা আদায় করা তার জন্য শুধু কঠিনই নয় বরং সম্পূর্ণ অসাধ্য ব্যাপার। এমতাবস্থায় যখন তার তা আদায় করার সাধ্য নেই তখন সে তা আদায় করার অটল প্রতিজ্ঞা রাখবে কি করে? সুতরাং সাধ্যের অতিরিক্ত মােহর নির্ধারিত হওয়ার কারণে সেও হাদীসে বর্ণিত হুশিয়ারীর ক্ষেত্রে পরিণত হবে। সুতরাং এত সব ঝামেলা ও সমস্যা এড়ানোর একটি মাত্র পথ আছে, তাহলে সাধ্য ও সামর্থের অধিক মােহর ধার্য্য না করা। যেহেতু অধিকাংশ লােক অধিক মােহর আদায়ে সামর্থহীন তাই সাধারণত মােহর কম নির্ধারণ করাই নিরাপদ ও বুদ্ধিমানের কাজ।

 

হাদীসে মােহর কম নির্ধারণের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে

        মােহর অধিক পরিমাণে নির্ধারণ করা এমন একটি জঘন্য কাজ যা উপরােক্ত সমস্যাগুলাে সৃষ্টি করে। একারণেই হাদীসে মােহরের পরিমাণ বেশী হওয়াকে অপছন্দ করে তা পরিমাণে অল্প নির্ধারণ করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন, হযরত ওমর (রাঃ) একদিন খুতবা দান করার সময় বলেন যে, “তােমরা মােহর পরিমাণে কম নির্ধারণ কর। কারণ, মােহর বেশী হওয়াই যদি দুনিয়ায় সম্মান কিংবা আল্লাহর নিকট মুত্তাকী হওয়ার কারণ হতাে, তা হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ছিলেন এর সর্বাধিক উপযুক্ত ব্যক্তি। কিন্তু রাসূল (সঃ)-এর কোন স্ত্রী বা কন্যার মােহর বার “উকিয়া” বা চারশত আশি দেরহামের বেশী ছিল না। (এক দেরহামের পরিমাণ দাড়ায় চারআনা চারপয়সা।)

 

        হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “মােহর কম হওয়াও মহিলাদের জন্য এক ধরনের সৌভাগ্য”।-কানযুল উম্মাল

 

        অন্য এক হাদীসে মহানবী (সঃ) বলেছেনঃ “উত্তম মােহর তা যা পরিমাণে কম এবং যা আদায় করা সহজ”।-কানযুল উম্মাল পৃঃ ২৪৯

 

        হযরত ওমর (রাঃ)-এর যে বক্তব্যটি উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, অনেকের ধারনা, পৱবর্তীতে এই বক্তব্য তিনি প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু তাদের এ ধারণা ঠিক নয়। আসল ঘটনা হলাে, এক সময় তিনি লােকদের বেশী মােহর নির্ধারনের প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের জন্য মােহরের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে দিতে চেয়েছিলেন যে, নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অধিক মােহর কেউ নির্ধারণ করতে পারবে না এবং কেউ তদপেক্ষা বেশী নির্ধারণ করলেও তা আদায় করা তার জন্য আইনতঃ ওয়াজিব হবে না। কিন্তু এক বৃদ্ধার অভিযােগের প্রেক্ষিতে তিনি এরূপ চিন্তা বাদ দেন। অর্থাৎ এরূপ আইনের প্রচলন করা থেকে তিনি বিরত থাকেন।

 

নিজের সাধ্যের চেয়ে অধিক মােহর গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ

        মােট কথা মহানবী (সঃ)-এর বিভিন্ন হাদীস এবং ছাহাবা কিরাম (রাঃ)-র মতামত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নিজের সাধ্যের অতিরিক্ত মােহর কবুল করে নেয়াও শরীয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ।

 

        যেমন, রাসূল (সঃ) বলেছেন, “নিজেকে নিজে অপমান করা কোন মুমিনের জন্য শােভা পায় না।” সাহাবা কিরাম (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষ নিজেকে নিজে কিভাবে অপমানিত করে? উত্তরে আল্লাহর রাসূল (সঃ) বললেন, “যে কষ্ট সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয় তা নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নেয়ার মানেই হলাে নিজেকে নিজে অপমানিত করা।”-তিরমিযী

 

        এই হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, নিজের সাধ্যের অধিক মােহর নির্ধারণ করা উচিত নয়। যথাসম্ভব কম মােহর নির্ধারণ করাই ইসলামের নৈতিক বিধান।

 

ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মতে মােহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ হলাে দশ দিরহাম

        এখন প্রশ্ন হলাে, মােহর অল্প হওয়া এবং অল্প হওয়ার নির্দিষ্ট কোন পরিমাণ আছে কিনা। ইমাম শাফিয়ী (রহঃ)-এর মতে মােহর কম হওয়ার নির্দিষ্ট কোন পরিমাণ নেই। মূল্যবান বস্তু হলে তা যত অল্পই হােক তা মােহর হতে পারবে। এমনকি এক পয়সা হলেও। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)-এর এই অভিমতের স্বপক্ষে কয়েকটি হাদীস নিম্নরূপঃ

 

        সামান্য কিংবা অধিক মােহরের বিনিময়ে বিবাহ করবে।

 

        একটি কোড়ার বিনিময়ে হলেও।

 

        একটি লােহার আংটির বিনিময়ে হলেও।

 

        দু'মুষ্টি গম, ছাতু, খেজুর বা আটার বিনিময়ে হলেও।

 

        অথবা একটি মাত্র দিরহামের বিনিময়ে।

 

        যদিও তার মুষ্টিতে পীলু বৃক্ষের ফলও থাকে।

 

        যদি তা দু'মুষ্টি খাদ্যের বিনিময়েও হয়। -কানযুল উম্মল পৃঃ ২৪৮, ২৪৯

 

        পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মতে মােহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ হলাে দশ দিরহাম। দশ দিরহামের কম হলে তা জায়িয হবে না। এমনকি বিবাহের সময় যদি স্পষ্টভাবে দশ দিরহামের কমের কথা উল্লেখও করা হয়, তবুও দশ দিরহামই আদায় করতে হবে।

 

        ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মাযহাবে নিম্নোক্ত হাদীস সমূহ প্রসিদ্ধ। তবে সনদের দিক থেকে সেগুলাে যথেষ্ট দুর্বল।

 

        “হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, দশ দিরহামের কমে মােহর হয় না।”

 

        হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেন, “যে পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে স্ত্রীর গুপ্তাংগ ব্যবহার হালাল তার নুন্যতম পরিমাণ হলাে দশ দিরহাম।”

        “হযরত আলী (রাঃ)-এর আরেকটি বর্ণনা হলাে, দশ দিরহামের কম মােহর হয় না।”

 

        তবে “ফতহুল কাদীরের” লেখক একটি উত্তম সূত্রে এই হাদীসগুলাে নকল করেছেন।

 

        “এহইয়া উসসুনান” কিতাবে এব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

 

        ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) তাঁর মতের স্বপক্ষে যে দলীলসমূহ পেশ করেছেন তার উত্তরে আমরা বলব, সেই হাদীসগুলাে মূলত সাধারণ মােহর সম্পর্কিত নয় বরং মােহরে মু'আজজাল সম্পর্কিত। অর্থাৎ বিবাহ হয়ে যাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ে যে পরিমাণ মােহর নগদ আদায় করা হয় উপরােক্ত হাদীসগুলােতে তারই পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে, অন্য একটি বর্ণনায় এর সমর্থন পাওয়া যায়। তা হলােঃ

 

        হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাঃ) বর্ণনা করেন, ‘কেউ কোন মহিলাকে বিবাহ করলে যদি তাকে কিছু না দেয়া পর্যন্ত তার কাছে যেতে সক্ষম না হয়, তাহলে তাই করবে। এমনকি যদি পায়ের একটি মাত্র জুতা ছাড়া স্ত্রীকে দেয়ার মত কিছুই না থাকে তবে তা খুলে তাকে দিয়ে তার কাছে যাবে।

 

        আর যেহেতু আবু হানীফা (রহঃ)-এর দলিল তার দাবী প্রমাণের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট সেহেতু এ ব্যাপারে অন্য কোন ব্যাখ্যা করতে যাওয়া অনর্থক।

 

ইখতেলাফের ক্ষেত্রে সাবধানতার সাথে আমল করাই উত্তম

        তবে ইখতেলাফের ক্ষেত্রে সাবধানতার। সাথে আমল করা অধিক সংগত। আলােচ্য ক্ষেত্রে দশ দিরহামের কমে মােহর জায়েয হওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে, কিন্তু দশ দিরহামে জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কারাে কোন দ্বিমত নেই। সুতরাং দশ দিরহামের উপর আমল করাই নিরাপদ। যেমন, চুরির নিছাব (কত পরিমাণ মাল চুরি করলে চোর বলা যাবে) কারাে মতে চার দিনার এবং কারাে মতে দশ দিরহাম। এ ক্ষেত্রে চার দীনারে হাত কাটা যাবে কিনা সে ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে, কিন্তু দশ দিরহাম পরিমাণ চুরী করলে হাত কাটার ব্যাপারে কারাে দ্বিমত নেই। এমতাবস্থায় দশ দিরহামের কথা গ্রহণ করাই নিরাপদ। কিন্তু তদপেক্ষা কম হলে সে ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকার কারণে দণ্ড ওয়াজিব হবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আর যে কোন সন্দেহ দণ্ড প্রয়ােগ রহিত করে। এজন্য সন্দেহের ক্ষেত্রে হাত না কাটাই নিরাপদ। অতএব মােহরের ক্ষেত্রেও দশ দিরহামকে ন্যূনতম নেছাব সাব্যস্ত করাই নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়। উপরন্তু চুরির নেছাব দশ দিরহাম সাব্যস্ত হওয়ার কথাও ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-র মােহরের কথাকে শক্তি যােগায়। কেননা, এতে প্রমাণিত হয় যে, একটি হাত তথা মানব দেহের একটি অংগের নূন্যতম মূল্য হলাে দশ দিরহাম। তাহলে একজন মহিলার বিশেষ অংগের মূল্য তদপেক্ষা কম হবে কেন?

 

মােহর অধিক নির্ধারণ করার দুনিয়াবী কুফল

        এতক্ষণ মােহর বেশী হওয়ার প্রশ্নে দ্বীনী ক্ষতি সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে। অধিক মােহর একদিকে সুন্নাতের খেলাফ, অপরদিকে সামর্থ না থাকার দরুন তা আদায় করার প্রতি অনিচ্ছা সৃষ্টি হয়। অথচ অপরাধের পর্যায়ে একে ব্যাভিচারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। তাছাড়া মােহর অধিক ধার্য হওয়ার কারণে যে সব দুনিয়াবী বা জাগতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, চোখেই দেখা যায়। যেমন, অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল-মিশ না হওয়ার ফলে স্বামী স্ত্রীর হক আদায় করে না। অনেক ক্ষেত্রে মােহর বেশী হওয়ার কারণে তালাকও দেয় না। কারণ, তালাক দিলে তাে আর মােহর আদায় না করে পারবে না। অবশেষে অধিক মােহর স্ত্রীর কল্যাণ সাধনের পরিবর্তে অকল্যাণ ও অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 

        অনেকে মােহর বেশী হওয়ার লাভ এই মনে করে যে, তাহলে আর স্বামী স্ত্রীকে ত্যাগ করতে পারবে না। কিন্তু তারা একথা বুঝে না যে, ত্যাগ করতে না পারাই সর্বক্ষেত্রে কল্যাণকর নয়। যেমন, উপরােক্ত পরিস্থিতিতে মােহর বেশী হওয়ার কারণে ত্যাগ করতে না পারায় কোন কল্যাণটা হয়েছে বলুন? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, স্ত্রীর মৃত্যুর পর বকেয়া মােহর আদায়ের জন্য-স্ত্রীর অভিভাবকরা আদালতের শরণাপন্ন হয়। ফলে মােহরের পরিমাণ অত্যাধিক হওয়ার কারণে বেচারার ভিটেমাটি সর্বস্বই খােয়াতে হয়। যার ওপর নির্ভরশীল ছিলাে তার এবং তার পরিবারের ডাল ভাতের সংস্থান। অতএব অধিক মােহর ধার্য্য করার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ক্ষতিসমূহের সার কথা হলাে, “দুনিয়া আখেরাত দু-ই বরবাদ হলাে যা সুস্পষ্ট ক্ষতি ”।-সূরা আল-হজ্জ, ১১ আয়াত

 

        এতাে গেল যদি মােহর আদায় না করে কিংবা আদায় করার ইচ্ছা না থাকে সে ক্ষেত্রের ক্ষতিসমুহের কথা। কিন্তু যদি স্বামী আল্লাহ ভীরু হয় এবং হুককুল ইবাদ তথা বান্দার হকসমূহ থেকে দায়মুক্ত হওয়ার জন্য মােহর আদায় করতে চায়, তখন তাকে বড়ই বে-কায়দায় পড়তে হয় যে, এতগুলাে টাকা পরিশােধ করার সামর্থ তাে তার নেই। ফলে চিন্তা-পেরেশানী এবং অস্থিরতার বােঝা নিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে-উপার্জন করে তা অল্প অল্প আদায় করতে থাকে। কিন্তু মােহরের পরিমাণ বেশী হওয়ার কারণে এ দায় সহজে শেষও হয় না। ফলে তার আজীবনের যাবতীয় উপার্জন এবং পুঁজি এতেই শেষ হয়ে লােকটি দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়। কিন্তু যেহেতু এতগুলাে সমস্যার মূলে হলাে স্ত্রী, তাই এ কারণে তার প্রতি স্বামীর ধীরে ধীরে অপ্রসন্ন হয়ে পড়ে। যা থেকে স্ত্রীর প্রতি প্রথম অনিহা সৃষ্টি হয়, তারপর শুরু হয় শত্রুতা।

 

        অবশেষে সুখময় দাম্পত্য জীবন গঠন করা ছিল যে বিবাহের উদ্দেশ্য, মােহরের আধিক্যের কারণে ফল হলাে তার বিপরীত। অর্থাৎ ঘৃণা, অনীহা ও শত্রুতা ইত্যাদির কারণে তাদের সংসার হলাে অশান্তির আধার। সুতরাং যে কারণে বিবাহের মূল উদ্দেশ্যই ধ্বংস হয়ে গেল, যার কারণে দু'টি মানুষের দাম্পত্য জীবন হলাে বিষময়, নেমে আসল তাদের জীবনে অশান্তির অমানিশা, সেই মােহরের আধিক্য কোন কালেই পছন্দনীয় এবং গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। নিম্নোক্ত হাদীসটির অর্থও তাই। হাদীসটি হলাে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “মােহর ধার্যের ক্ষেত্রে তােমরা সহজ পন্থা অবলম্বন কর (অর্থাৎ মােহর পরিমাণে কম ধার্য কর)। কারণ, অনেক পুরুষ (আল্লাহর ভয়ে কষ্ট-ক্লেশ করে) স্ত্রীর মোহর আদায় করে বটে কিন্তু আজীবন স্ত্রীর প্রতি তার মনে বিদ্বেষ ও শত্রুতা থেকে যায়।”-কানযুল উম্মাল, খঃ ৮ পৃঃ ২৪৯

 

        উপরােল্লেখিত কথা হযরত ওমর (রাঃ)-ও তার এক খুতবায় উল্লেখ করেছেনঃ

        “তােমাদের মধ্য থেকে কেউ আবার স্ত্রীর অত্যধিক মােহর আদায় করে। কিন্তু এর ফলে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর মনে বিদ্বেষ ও শত্রুতা ভাব জন্ম নেয়।”

 

        আমার অভিজ্ঞতা হলাে, আমার প্রথম স্ত্রীর মােহর ছিল পাঁচ হাজার টাকা আর দ্বিতীয় স্ত্রীর মােহর ছিল পাঁচ শত টাকা। আল্লাহর মেহেরবানীতে উভয়ের মােহরই আমি আদায় করেছি। কিন্তু প্রথম স্ত্রীর মােহর আদায় করতে আমাকে অত্যন্ত বেগ পেতে হয়েছিল। পিতার ধন ভাণ্ডার যদি এ ব্যাপারে আমার সহযােগি না হতাে তাহলে এই পেরেশানি আমার দাম্পত্য জীবনকে নিঃসন্দেহে অস্থির করে তুলতো আর দ্বিতীয় স্ত্রীর মােহর একদিনের স্বাভাবিক আয় থেকেই আমি অনায়াসে আদায় করতে পেরেছি। এ ক্ষেত্রে আমাকে কোন বেগ পেতে হয়নি। আবার যদি চেষ্টা করার পরও আদায় করতে পারা না যায়, তাহলে অন্তরে আরেকটি হীনমন্যতা জন্ম নেয়, যা সম্পূর্ণ আত্মমর্যাদার পরিপন্থী। তাহলাে, স্ত্রীর নিকট এ ব্যাপারে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। এজন্য স্ত্রীকে অনুরােধ করতে হয়। কিন্তু প্রথমত, আবেদন মঞ্জুর করার অধিকার তাে স্ত্রীর হাতে। তা মঞ্জুর না করার অধিকারও তার আছে। দ্বিতীয়ত, আবেদন মঞ্জুর করলেও স্ত্রীর কাছে দরখাস্ত করাটাই একটা অপমানজনক কাজ।

 

        একজন সুপুরুষের জন্য যা কখনই শােভনীয় নয়। এজন্য আল্লাহতায়ালা মােহরের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার দু'টি পন্থা উল্লেখ করার পর দ্বিতীয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। দু'টি পন্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন, “ যদি স্ত্রী কিংবা যার হাতে বিবাহ বন্ধন রয়েছে সে মাফ না করে দেয়।” (অর্থাৎ বিবাহের পর মিলনের পূর্বেই যদি স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে শরীয়তের আইনে স্ত্রী নির্ধারিত মােহরের অর্ধেক পাবে। কিন্তু স্ত্রী ইচ্ছা করলে সেই অর্ধেক মাফ করে দিতে পারে কিংবা স্বামী ইচ্ছা করলে পুরােটাই আদায় করতে পারে অথবা তালাকের পূর্বে সম্পূর্ণ মােহর আদায় করে থাকলে সে অর্ধেকের দাবী ত্যাগ করতে পারে। অতঃপর দ্বিতীয় পন্থাকে প্রাধান্য দিয়ে বলা হয়েছে, “ তালাকের পূর্বে মােহর আদায় করে থাকলে তালাকের পর এখন বাকী অর্ধেক ফেরত না নিয়ে ক্ষমা করে দেয়া কিংবা এখনও সম্পূর্ণ মােহর আদায় করা তােমাদের (স্বামীদের) তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী "।

 

        সার কথা হলাে, মােহরের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার দু'টি পন্থা থাকলেও প্রথমটি পছন্দনীয় নয়। কারণ, তা আত্মমর্যাদার পরিপন্থী। এতে প্রমাণীত হলাে যে, অধিক মােহর নির্ধারিত করা কখনও চরিত্রিক দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যা কখনই পছন্দীয় নয়। তাও আবার তখনই গ্রহণযােগ্য হবে যদি মাফ নেয়ার ব্যাপারে স্বামী আল্লাহর তায়ালার এই ঘােষণার প্রতি লক্ষ্য রাখে, “ যদি তারা (স্ত্রীগণ) প্রসন্ন মনে খুশীর সাথে তােমাদেরকে দান করে তা তােমাদের জন্য বৈধ, অন্যথায় যদি চাপ প্রয়ােগ করে জোরপূর্বক মাফ নেয়া হয়, তাহলে তা মাফ হবে না। ”

 

        মােহর মাফের ক্ষেত্রে আন্তরিক প্রসন্নতা শর্ত মােহর মাফ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রীর মনের প্রসন্নতার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। অন্যথায় যদি আত্মমর্যাদার সাথে সাথে খােদাভীতিও বিলুপ্ত হয়ে যায় অর্থাৎ প্রভাব খাটিয়ে বা চাপ সৃষ্টি করে জোরপূর্বক মাফ নেয়া হয় তবে আল্লাহর নিকট তা কিছুতেই গ্রহণযােগ্য হবে না; বরং মােহর আদায় করার পূর্বে তা যেমন ওয়াজিব ছিল তেমনি বহাল থাকবে। এরূপ অবস্থায় যদি কারাে মধ্যে আত্মমর্যাদা এবং খােদাভীতি সমানভাবে থাকে কিন্তু সামর্থ না থাকে তা হলে তার আর বিপদের কোন সীমা থাকে না। স্ত্রীর এত পরিমাণ মােহর আদায় করে কিভাবে দায়মুক্ত হবে, সেই চিন্তায় তার জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় যদি সে অল্প অল্প করে সম্পূর্ণ আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে বাকীটুকুর জন্য পরকালে ক্ষমা পাওয়ার আশা থাকলেও বেচারার জাগতিক জীবনতাে তিক্ত হলাে। আর স্বামীর জীবন তিক্ত হলে স্ত্রীর জীবন কি আর মধুময় হয়? মােট কথা এতে ক্ষতি আর অশান্তি ছাড়া কিছুই নেই।

 

মােহর বেশী ধার্য করার ক্ষেত্রে উপকারিতা

        কেউ কেউ মনে করে যে, মােহর বেশী হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা থাকলেও উপকারিতাই বেশী। মােহর কম হলে স্বামীর ওপর কোন রকম চাপ সৃষ্টি হয় না বিধায় তার পক্ষে স্ত্রীকে ত্যাগ করে অন্য বিবাহ করায় তেমন কোন বাঁধা থাকে না। কিন্তু মােহর বেশী হলে মন চাইলেই তা সম্ভব হয় না।

 

        এর উত্তরে আমরা বলব, আমরা একথা বলছি না যে, মােহর নিতান্তই কম হতে হবে। বরং আমাদের উদ্দেশ্য হলাে, মােহর যেন এত বেশী না হয় যা তার ইহলােক-পরলােক ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বরং এই দু’য়ের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে যেন সব কুল রক্ষা পায়। তা ছাড়া যার অন্তরে আল্লাহর ভয় নেই কোন নীতিই তাকে অপকর্ম থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে না। এমন ঘটনা কি চোখে পড়ে না যে, অনেকে বিপুল পরিমাণ মােহরের দায়ে আবদ্ধ, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে স্ত্রীর হক আদায় না করে অন্য মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হতে কুণ্ঠাবােধ করে না। এমন অত্যাচারীদেরকে কেউ রুখতে পারে না। কারণ, হয় তো সে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি যার সামনে কথা বলার সাহস কারো নেই। অথবা তার সম্পদ বলতে কিছুই নেই, তাই তাকে বলেও লাভ নেই। এমতাবস্থায় বিপুল পরিমাণ মােহবের মাধ্যমে হতভাগীকে জেলখানায় আবদ্ধ রেখে লাভটা কি শুনি? এভাবে জামাতার বন্দীশালায় রেখে আপনারা কন্যাদের কোন উপকার করতে চান, হতভাগীনী জীবনে একটি বারও শান্তির মুখ দেখতে পাবে কি?

 

মােহর অধিক হওয়া রোসম বই নয়

         মােহর বেশী ধার্য করার কারণ স্বরূপ অনেকে বলে থাকেন, মােহর কম হওয়া অপমানজনক, আর বেশী হওয়া সম্মানজনক। তাই সম্মানের জন্যই আমরা মােহর বেশী ধার্য করে থাকি।

 

        এ যুক্তির প্রেক্ষিতে আমরা বলব, প্রথমত, মােহর কম হওয়ার ব্যাপারে যদি ভারসাম্য রক্ষা করা হয় তবে অপমানের কিছুই নেই। দ্বিতীয়ত, আপনাদের এই ধারণা বাস্তব হলেও কিন্তু লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশী। ক্ষতির তুলনায় যার উপকারিতা একেবারেই নগণ্য। তৃতীয়ত, মােহর বেশী ধার্য করা সম্মান জনক হওয়ার সাথে সাথে যদি তা আদায়ের ইচ্ছা না থাকে, তাহলে আমার ওস্তাদ মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবী (মৃতঃ ১৩০২) রহঃ-এর ভাষায়, “মােহরের পরিমাণ যত বেশী হবে ইজ্জত-সম্মানও যদি তত বেশী হয় তাহলে শুধু এক লাখ, সােয়া লাখ কেন সাত রাজার ধন, পৃথিবীর ধন ভাণ্ডারই শুধু নয় বরং তারও. দ্বিগুণ আরাে কয়েকগুণ যত বলা যায় তা ধার্য করলেই বা দোষ কি? কারণ, দেয়া-নেয়ার তাে কোন ঝামেলা নেই দরকার শুধু সুনাম আর সুনাম।

 

        কিন্তু যে যা-ই বলুক, প্রকৃত পক্ষে এটা একটা সামাজিক বদ রােসম। বাস্তবে এ শান্তি বলতে কিছুই নেই বরং দাম্পত্য জীবনে নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত হওয়াই এর একমাত্র পরিণাম। সুতরাং এই রােসম পরিত্যাগ করা অপরিহার্য হওয়ার ব্যাপারে সংশয়ের কোন অবকাশ থাকতে পারে না।

 

        অতএব, সুধী পাঠক বৃন্দ! রসম-রেওয়াজ আর কুসংস্কার পরিত্যাগ করে আপনার সুবিবেচক এবং শরীয়াতের অনুসরণে যত্নবান হােন। তবে যে সব ক্ষেত্রে সাহবে মিছিলের পাত্রীর পিতৃকুলের যেসব মহিলা রূপে, গুণে, সম্পদে, বয়সে, দ্বীনদারী, বিচক্ষণতা, যােগ্যতা ও শিক্ষা দীক্ষায় পাত্রীর সপর্যায়ের তাদের জন্য নির্ধারিত মােহরের পরিমাণের) মােহর ধার্য করার নিয়ম সে ক্ষেত্রে আমার উপরােক্ত পরামর্শ অনুযায়ী এভাবে কাজ করতে হবে, সমাজের সকলে মিলে একত্রিতভাবে সমাজে এই নিয়ম পরিবর্তন করে ফেলুন যেন মােহরে মিছিলের পরিমাণ অল্প হয়। এরপর আর করাে প্রশ্নের কোন অবকাশ থাকতে পারে না।

 

মােহর ধার্য করার সময় পরিমাণ নির্ধারণ করে নেওয়া আবশ্যক

         মােহর সম্পর্কে আরেকটি ত্রুটি হলাে যে, অনেকে পরিমাণ উল্লেখ না করে শুধু “মুহাম্মাদী শরীয়াত অনুযায়ী” শিরােণামে মােহর ধার্য করে। “মােহাম্মাদী, শরীয়াত অনুযায়ী” একথায় অর্থ নির্ধারণ করা হয় না। বস্তুতঃ এভাবে মােহর ধার্য করা আর না করা সমান কথা। সুতরাং মােহর ধার্য না করার যে গুনাহর কথা উপরে বলা হয়েছে এক্ষেত্রেও তা প্রযােজ্য হবে। তদুপরি, পরে যদি মােহর আদায়ের সময় বিবাদ সৃষ্টি হয়, তখন পরিমাণটা কত ধার্য করা হবে? আবার মােহরে মিছিল ধার্য করাও সাধারণত সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ, সকল শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে মােহর অনির্দিষ্ট থাকার এই অনিয়ম ব্যাপক হারে প্রচলিত। কাজেই মােহর ধার্য করার সময়ই তার পরিমাণ নির্ধারণ করে নিতে হবে।

 

মােহরের ক্ষেত্রে মূল্যবান বস্তু হওয়া শর্ত

         এর চেয়ে জঘন্যতম আরেকটি বাজে প্রথার কথা শুনেছি যে, কোথাও কোথাও নাকি দু’চার কলসি মশা, মাছি, ছারপােকা ইত্যাদি মােহর ধার্য করা হয় যা আদায় করতে মানুষ সক্ষম নয়। কিন্তু শরীয়াতের বিধান মতে মােহর সম্পদ তথা এমন বস্তু হতে হবে যার মূল্য আছে। অবশ্য এই সব বস্তু মাল না হওয়ার কারণে তা আদায় করাও ওয়াজিব নয়। মােহর রূপে তা ধার্য করা আর না করা সমান কথা। তা ছাড়া যারা এরূপ করে তারা শরীয়াতের বিধান পরিবর্তন করার অপরাধে দণ্ডিত হবে। স্বামীর মৃত্যুর পর মােহরের বিনিময়ে স্বামীর সমুদয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল করে নেয়া স্ত্রীর জন্য জায়েয নয় মােহরের ব্যাপারে আরেকটি ক্রটি ঘটে স্ত্রীর পক্ষ থেকে। তাহলাে, অনেক সময়ই দেখা যায় যে, স্বামীর মৃত্যুর পর তার যে সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আয়ত্ত করা সম্ভব তার সবই স্ত্রী দখল করে নেয় এবং মনে মনে ভাবে যে, এগুলাে আমি আমার প্রাপ্য মােহরের বিনিময়ে রেখে দিলাম, যদিও তার মূল্য প্রাপ্য মােহরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশী হয়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, যেহেতু সাধারণত এসব বস্তু দ্বারা মােহর নির্ধারণ করা হয় না কাজেই নিজ ইচ্ছায় তা মােহরের বিনিময়ে দখল করে নেয়া জায়িয নয়। বরং বিচারকের ফয়সালা কিংবা অন্যান্য ওয়ারিশদের সম্মতি সাপেক্ষে কেবল তা বৈধ হতে পারে। যদি ওয়ারিশদের মধ্যে বালেগ কেউ না থাকে এবং সে যত পরিমাণ সম্পত্তি দখল করতে চায় তার মুল্য যেন মােহরের পরিমাণের চেয়ে বেশী না হয়। এবং যদি বিচারকের ফয়সালা লাভের কোন ব্যবস্থা করা না যায় এবং ওয়ারিশরাও তার প্রাপ্য দিতে না চায়, তবেই শুধু শক্তি প্রয়ােগ করে সে তার মােহরের অর্থের সমমূল্য পরিমাণ সম্পত্তি ভােগ করতে পারবে। অন্যথায় নয়।

 

মােহরের ব্যাপারে স্বামীর কতিপয় ক্রটি

         অপরদিকে স্বামীর একটি ত্রুটি হলাে, স্বামী কিছু স্বর্ণালংকার বা পােষাক-পরিচ্ছদ কিংবা ঘর-বাড়ী বা জায়গা জমি স্ত্রীকে দিয়ে তার নামে তা'লিখে দেয় এবং নিজে মনে মনে নিয়ত করে যে, এগুলাে আমি স্ত্রীকে মােহরের বিনিময়ে দিয়ে দিলাম এবং মােহর আদায় করে দিলাম। মনে রাখবেন, এভাবে যত কিছুই দেয়া হােক তাতে মােহর আদায় হয় না। কারণ, মােহরের বিনিময়ে এসব বস্তু দেয়া মূলত ক্রয়-বিক্রয়ের শামিল এবং ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের পূর্ণ সম্মতি থাকা শর্ত। সুতরাং মােহরের বিনিময়ে যদি উপরােক্ত বস্তুগুলাে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে স্ত্রীকে সুস্পষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করতে হবে যে, মােহরের বিনিময়ে আমি তােমাকে এই জিনিসগুলাে দিতে চাই তুমি কি তাতে রাজী আছ? যদি স্ত্রী তাতে সম্মত হয় এবং যদি তা মােহর জাতীয় বস্তু নাও হয়, যেমন মােহর হলাে মূলত টাকা আর এর পরিবর্তে যা দিতে চায় তাহলে ঘর-বাড়ী বা কাপড়-চোপড়, তাহলে কম বেশীর বিবেচনা না করে শুধুমাত্র স্ত্রীর সম্মতিতেই এই বিনিময় জায়িয হবে। আর যদি প্রস্তাবিত বস্তু মােহর জাতীয় হয় যেমন, মােহর নির্ধারণ করা হয়েছিলাে টাকায় আর সে দিতে চাচ্ছে স্বর্ণের অলংকার, তাহলে এক্ষেত্রে শর্ত হলাে যে, মােহর এবং বিনিময়ে প্রদেয় এই বস্তুর মূল্য সমান হতে হবে। যেমন, মােহর যদি একশত টাকা হয় আর অলংকারের মূল্য হয় পঞ্চাশ টাকা তাহলে এই বিনিময় জায়িয হবেনা। তবে-জায়িয হওয়ার দু'টি পথ আছে। প্রথমত এই অলংকার দ্বারা পঞ্চাশ টাকা আদায় করবে ২ বাকী পঞ্চাশ টাকা স্ত্রী মাফ করে দিবে। দ্বিতীয়ত, যদি দু’জনে আলােচনার মাধ্যমে আপােষ করে নেয়, তাহলে শরীয়তের নিকট তা গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ তখন ধরে নেয়া হবে যে, পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে এই অলংকার দেয়া হলাে আর বাকী পঞ্চাশ টাকা ক্ষমা করে দেয়া হলাে।

 

স্ত্রী মৃত্যু শয্যায় শায়িত অবস্থায় মােহর মাফ করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না

         মােহরের ব্যাপারে আরেকটি ত্রুটি হলাে, অনেক মহিলা মুত্যু শয্যায় শায়িত হয়ে মােহর মাফ করে দেয় আর এতে মােহর মাফ হয়ে গিয়েছে বলে স্বামী নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এভাবে মাফ করা মূলত ওয়ারিশদের জন্য অছিয়াত করার নিয়ম যা অন্যান্য ওয়ারিশদের সম্মতি ব্যতিরেকে জায়িয হয় না। সুতরাং এই মাফ দ্বারা সম্পূর্ণ মােহর মাফ হবে না। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে স্বামীর সম্পদের যতটুকু প্রাপ্ত হবে ঠিক ততটুকু পরিমাণ মাফ হবে। আর বাকী অংশ স্বামীর দায়িত্বে ওয়াজিব থেকে যাবে। তবে যদি ওয়ারিশগণ সকলেই মাফ করার ব্যাপারে সম্মত হয় তা হলে পুরােটাই মাফ হয়ে যাবে। আর যদি কেউ মাফ করে আর কেউ না করে কিংবা ওয়ারিশদের মধ্যে কোন নাবালেগ থাকে তাহলে নাবালেগ ছাড়া আর যারা সম্মত হবে শুধু তাদের অংশই মাফ হবে, অন্যদের নয়।

 

স্বামীর মুমূর্ষ অবস্থায় স্ত্রীর নিজের মােহর মাফ করে দেয়া

         এ ক্ষেত্রে আরেকটি ক্রটি হলাে এই যে, অনেক সময় স্বামীর মৃত্যুকালে স্ত্রী তার মােহর মাফ করে দেয়। এখানে কথা হলাে, স্ত্রী যদি প্রসন্ন মনে তা মাফ করে তাহলে মাফ হয়ে যাবে আর যদি অন্যরা জোরপূর্বক স্ত্রীর থেকে মাফের প্রতিশ্রুতি আদায় করে তা হলে আল্লাহর নিকট তা মাফ হবে না এবং জোর-জবরদস্তী করে এভাবে মাফ নেয়া কারাে জন্য উচিতও নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে মাফ না করানাের মধ্যে মঙ্গল নিহিত ই থাকে। যেমন, মীরাছ সূত্রে প্রাপ্য সম্পদ যদি স্ত্রীর জীবন-যাপনের জন্য যথেষ্ট না হয় তখন মােহরের টাকা তার উপকারে আসে। এটা একটা মানবিক বিষয় বটে।

 

 

 ═──────────────═