JustPaste.it

সমকালীন প্রসঙ্গ

হিলারী ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরঃ 

সমাজ শোষণের জায়িয প্রক্রিয়ার অংশ নয় তো?

পর্যবেক্ষক

 

গত ২রা এপ্রিল বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফাস্ট লেডী হিলারী ক্লিন্টন। তিন দিনের এক বেসরকারী সফরে তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করা। বিশেষ করে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা যে দারিদ্র বিমোচন কর্মকান্ড চালাচ্ছে তা' স্বচক্ষে দেখে অভিজ্ঞতা অর্জন। তার প্রদত্ত বক্তৃতা ও সাংবাদিকদের সাথে বিভিন্ন আলোচনায় তিনি বলেছেন যে, ডঃ ইউনুস প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কর্মকান্ড ও এর সাফল্যে তিনি ও ক্লিন্টন খুব মুগ্ধ হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের মডেলে একটি তহবিল গঠন করে তা নিজ রাজ্যে বাস্তবায়নের উদ্দ্যোগও তারা গ্রহণ করেছেন, তাই বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তার এই সফর এবং যশোরে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন। তার সফরের উদ্দ্যোগ গ্রহণের পেছনে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ ইউনুসের ব্যাপক ভূমিকার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। পরিশেষে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য এনজিও পরিচালিত কর্মকান্ডের সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করে এনজিওদের কর্মকান্ডে ব্যাপক প্রেরণা যুগিয়েছেন। 
ডঃ ইউনুসের আহ্বানে হিলারী এদেশ সফর ও গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ভূয়সী প্রশংসার খবর যখন এদেশের পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে ঠিক তখনই ৪ঠা এপ্রিল দৈনিক ইত্তেফাকে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক সম্পর্কে ছোট্ট আর একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরটি ছোট হলেও এর বিষয়বস্তু ব্যাপক গুরুত্বের দাবী রাখে। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সুদের হার হ্রাসের আবেদন শিরোনামের রিপোর্টটির সারাংশ হল-'দরিদ্র ঋণ গ্রহীতাদের নিকট থেকে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ও কোন কোন এনজিও ২০ ভাগ হারে সুদ আদায় করছে।' মিয়া আব্দুল্লাহ ওয়াজেদ নামের সরকার দলীয় জাতীয় সংসদের শিল্প সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য এক লিখিত পত্রে অর্থমন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন যে, গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ওপর বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। অথচ বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক গত ৯৪ সনেও গ্রামীণ ব্যাঙ্ককে ৫৬৫ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করেছে। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের তফসীলভুক্ত ব্যাঙ্ক নয় বিধায় এর সুদের হার নির্ধারণের অধিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নেই। শিল্প বানিজ্যের জন্য তফসীলভুক্ত ব্যাঙ্ক সমূহ সাড়ে ৭ হতে ৯ ভাগ সুদহারে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ দেয়। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ২০ শতাংশ হারে সুদ আদায় শুরু করে ঋণ প্রদানের পরের সপ্তাহ হতে। এতে ঋণ গ্রহণকারী সহায় সম্বলহীন মানুষ আরও অসহায় হয়ে ওঠে। তিনি পত্রে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সুদের হার ৯% করা, ঋণ পরিশোেদের মেয়াদ ২ বৎসর করা, চক্রবৃদ্ধি হারের পরিবর্তে সরল সুদ হার প্রবর্তন করারও আবেদন জানান।
মিয়া আব্দুল্লাহ ওয়াজেদের এ পত্রের মারফত জানা যায়, গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ঋণের সুদ দেশের যে কোন বানিজ্যিক ব্যাঙ্কের সুদের হারের দ্বিগুণেরও বেশী। অন্য ব্যাপারটি হল গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ঋণের সুদ নির্ধারনে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক তথা সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, এ ব্যাঙ্কটির কার্যক্রম সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এ ব্যাঙ্কটি দারিদ্র বিমোচনের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে কাজ করলেও চড়া সুদে ঋণ দিচ্ছে, চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আদায় করছে।
জনাব মিয়া আব্দুল্লাহর পত্রে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হলেও এ ব্যাঙ্কের কর্মকান্ডের মধ্যে এর চেয়েও ভয়ঙ্করতম সূক্ষ্ম এক অর্থনৈতিক শোষণের প্রক্রিয়া রয়েছে। হিসাব নিকাশের জটিল অংকের মধ্যে এ চাতুর্য লুকিয়ে রয়েছে। উপর থেকে এর কিছুই বুঝা যায় না। এ এক অদৃশ্য চাতুর্য। যেমন ধরা যাক কোন ব্যক্তি গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে ১০ লক্ষ টাকা ঋণ বাবদ নিল। ব্যাঙ্কের নিয়মানুযায়ী এই টাকার ১০ ভাগ কেটে রাখা হবে এবং কিস্তি শেষ হলে তা ফেরত দেয়া হবে। গ্রহীতাকে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি হিসেবে এই টাকা শোধ করতে হবে। নিয়মানুযায়ী ২০% সুদের হিসেবে ১০ লক্ষ টাকায় ১ বছর পর সুদাসল আদায় হবে ১২ লক্ষ টাকা। প্রতি মাসিক কিস্তি হিসেবে আমরা যদি হিসাব করি তাহলে ব্যাঙ্ক প্রতি মাসে ১ লক্ষ টাকা আদায় করছে। এর মধ্যে আসল হল ৮৫ হাজার টাকা এবং সুদ ১৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ গ্রহীতা মাত্র ১ মাস ৮৫ হাজার টাকা খাটিয়ে ১৫ হাজার টাকা সুদ দিচ্ছে। অথচ তার এই টাকা পুরো বছর খাটার কথা ছিল এবং সেই হিসেবে সে সুদের টাকা দিচ্ছে। এভাবে সে ৬ মাসে শোধ করছে ৬ লক্ষ টাকা, এর মধ্যে সুদ হল ১ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ ৬ মাসে ৫ লক্ষ টাকার সুদ দিতে হচ্ছে ১ লক্ষ টাকা। যে হিসেবে তাকে ৪০% হারে সুদ দিতে হচ্ছে। তবে হিসেবে আরও ফাঁক রয়েছে। ঋণের টাকা দেয়ার আগে ১০% টাকা কেটে রাখার নিয়মে ১০ লক্ষ টাকার ১ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্কের কাছে জমা থাকবে, কিস্তি পরিশোধ হলে এ টাকা ফেরত পাবে। গ্রহীতা এ টাকা খাটানোর কোন সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু এ ১ লক্ষ টাকার সুদ ২০ হাজার টাকা তাকে পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ ৯ লক্ষ টাকা এক বছর খাটিয়ে তাকে বছর শেষে দিতে হবে ১২ লক্ষ টাকা। সুদের সোজা হিসেবে এর সুদের হার দাড়ায় ৩৩%। তবে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের নিয়মানুযায়ী হিসেব করলে কেমন হয় দেখা যাক। মনে করি কোন ব্যক্তি ৫০০০ টাকার ঋণ নিল। ২০% হারে এর সুদ হবে ১০০০ টাকা। সুদাসল ৬০০০ টাকা গ্রহীতাকে ৫২ সপ্তাতে পরিশোধ করতে হবে। এতে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি হবে আসল ৯৬ টাকা + ১৯ টাকা সুদ =১১৫ টাকা। ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ নেয়ার পরবর্তী সপ্তাহ থেকে কিস্তি দিতে হবে। অর্থাৎ সে প্রথম সপ্তাহে ৯৬ টাকা খাটিয়ে ১৯ টাকা সুদ দিল কিন্তু মাত্র ৭ দিন খাটার জন্য ৯৬ টাকার সুদ হয় ১৯:৫২=০.৩৬ টাকা। এছাড়া আসল ৯৬ টাকাও তার পুরো বছর খাটিয়ে বছর শেষে ফেরত দেয়ার কথা আর ৯৬ টাকার সুদ ১৯ টাকাও একবছর খাটিয়ে বছর শেষে দেয়ার কথা। কিন্তু সে ৯৬ টাকায় ৭ দিনে ১৯ টাকা সুদতে দিলই এর সাথে এক সপ্তাহ পরেই তার আসল কমে ৫০০০-৯৬=৪৯০৪ টাকায় এসে দাড়াল। এভাবে প্রত্যেক সপ্তাহে তার আসল ৯৬ টাকা করে কমতে থাকবে এবং ১৯ টাকা হারে প্রতি সপ্তাহে সে সুদ দিয়ে যাবে। বছরের শেষ সপ্তাহে সে মোট আসল ফেরত দিচ্ছে মাত্র ৯৬ টাকা। অথচ বছর শেষে পুরো ৫০০০ টাকা খাটিয়েই দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৫০০০ টাকা সে পুরো বছর খাটাতে পারেনি খাটাতে পেরেছে মাত্র ৯৬ টাকা। কিন্তু ২০% হারে সে বাৎসরিক হিসেবেই সুদ পরিশোধ করেছে।
এ হিসেবে ১০০ জন গ্রহীতা যদি প্রথম সপ্তাহের কিস্তি হিসেবে ১১৫০০ টাকা পরিশোধ করে তবে শুধুমাত্র সুদ হিসেবে তারা দিচ্ছে ১৯০০ টাকা। অর্থাৎ ৯৬০০ টাকায় এক বছরে ১৯০০টাকা দেয়ার হিসাব খাতাপত্রে থাকলেও হিসেবের জটিল প্যাচের কারণে তারা মাত্র ৭ দিনে সে সুদ দিচ্ছে। কিন্তু টাকা খাটার হিসেবে ৭ দিনে ৯৬০০ টাকার মোট সুদ হওয়া উচিত ছিল মাত্র ৩৬ টাকা। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক নিয়ে নিচ্ছে ১৯০০ টাকা! প্রতারণা আর সমাজ শোষণ কাহাকে বলে। এর চেয়ে চমৎকার শুভংকরের ফাঁকি আর আছে কি?
আমরা ঐতিহাসিক কাল থেকে শোষণ বঞ্চনার শিকার এক জাতি। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী আমাদের দুর্বলতার সুযোগে আমাদের বিভিন্ন উপায়ে শোষণ করে সমৃদ্ধ বাংলাকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে। এজন্য শোষণ-বঞ্চনা আমাদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তাই দারিদ্র বিমোচনের নামে আমাদের এরূপ জঘন্য ভাবে শোষণ করা হলেও আমরা একে সহজভাবে মেনে নিচ্ছি। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম সভ্য রাষ্ট্রের একজন ফাস্ট লেডী যখন সমাজ শোষককে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এক ব্যক্তির শোষণ প্রক্রিয়াকে সমাজ উন্নয়নের সহায়ক বলে চালিয়ে দেন এবং এ জাতীয় কর্মকান্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন তখন আমাদের করুণা বোধ করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে। আসলে মানিকে মানিক চেনে এতো চিরন্তন সত্য কথা। তিনি যে পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিনিধি সে পুঁজিবাদ মুনাফা ছাড়া আর কিছুই চেনে না। যে কোন উপায়ে হোক অধিক মুনাফা অর্জনই পুঁজিবাদের একমাত্র লক্ষ্য। দারিদ্র বিমোচনের নামে সুকৌশলে মুনাফার পাহাড় গড়তে ওস্তাদ ব্যক্তি যে তাদের পুঁজিবাদী সমাজে বরমাল্য পাবে এতে বিস্মিত হওয়ার আমাদের কিছুই নেই। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের হিসেবের এই পুকুর চুরি আমরা সহজে অনুধাবন করতে না পারলেও আমেরিকার চতুর মানুষদের না বুঝার কথা নয়। তবুও তারা গ্রামীণ ব্যাঙ্ককে আমাদের নিকট দাতা হাতেম তাই রূপে চিহ্নিত করতে অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক এবং এ জাতীয় কতিপয় শোষক এনজিওকে আমাদের সোনালী ভবিষ্যত গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখছে এমন একটা ভান করছে, মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণা চালাচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য কি? আসল ব্যাপার হল এ শোষণের নেপথ্যে রয়েছে এই উৎসাহ দাতারাই। তাদের অনুদান, সাহায্য, সহযোগিতায় আমাদের দেশের তথাকথিত সেবক এনজিও সমূহের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এই দাতারা চান তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতি এভাবে তাদের দ্বারা সৃষ্ট গুটি কতেক সেবকরূপী শোষকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে। আমরা যত দ্রুত এর গুঢ় রহস্য উপলদ্ধি করব ততই জাতির জন্য মঙ্গল।