JustPaste.it

উত্তম বিচার

ডাঃ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী

 

               কোন এক সময়ে এক নিরপেক্ষ বিচারক বসবাস করতেন। তার চার ছাত্রকে তিনি পরীক্ষা করতে চাইলেন। পরীক্ষাটি ছিল একটা কাহিনী নির্ভর। একদিন তিনি তার ছাত্রদেরকে সে কাহিনী বললেন। তিনি শুরু করলেনঃ

              একদিন এক ব্যক্তির বাসায় মধ্যাহ্ন ভোজে অংশগ্রহণের জন্য কিছু অতিথি অপেক্ষা করছিল এবং অতিথিদের জন্য দুধ ক্রয়ের উদ্দেশ্যে তিনি ভৃত্যকে বাইরে পাঠালেন। ভৃত্য বিরাট এক গামলাসহ দুধওয়ালার দোকানে পৌঁছলো এবং সেটিকে দুধে পূর্ণ করে দুধ ওয়ালার পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে গৃহপানে রওনা হলো।

             ভৃত্যটি যখন পথ অতিক্রম করছিল, তার মাথার উপর দিয়ে একটি সারস জাতীয় পাখী একটা বিষাক্ত সাপ বহন করছিল। ভৃত্যটির অজ্ঞাতসারে কয়েক ফোটা সাপের বিষ সাপটির মুখ থেকে খোলা দুধের গামলায় পড়ে।

            ভৃত্যটি গামলা পাচককে দিল। পাচক দুধকে কিছু মিষ্টি দুধে পরিণত করলো। দুধ অতিথিদের পরিবেশন করা হলো। বিষাক্ত দুধ পান করে অতিথিরা এক এক করে ধরাশায়ী হলো এবং মৃত্যুবরণ করলো।

               বিজ্ঞ বিচারক তার ছাত্রদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “এসব মৃত্যুর জন্যে কোন ব্যক্তি দায়ী? আমি চাই যে, এ বিষয়ে তোমরা সবাই নিজ নিজ মতামত লিখে আমার নিকট দেবে।”

             চারজন ছাত্র প্রত্যেকেই কিছুক্ষণের জন্যে চিন্তা করলো। এরপর বিষয়টি সম্বন্ধে নিজ নিজ মতামত লিখে নিজেদের জবাব জমা দিল। প্রথম ছাত্র বলেছিল “আমি যদি বিষয়টিতে ফয়সালা দিতাম তবে আমি ভৃত্যকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করতাম। তার উচিত ছিল দুধের গামলাখানা ঢেকে আনা।”

               নিরপেক্ষ বিচারক এই বলে এ রায়কে বাতিল ঘোষণা করলেনঃ “যদিও এটা সত্য যে, খাদ্যদ্রব্য সব সময়ই ঢেকে রাখা উচিত, তথাপি একটা দুধের গামলার মধ্যে সাপের বিষ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এতই ক্ষীণ যে সেটা পূর্ব থেকে অনুমান করা সম্ভব নয়। গামলা যে অবশ্যই ঢেকে রাখতে হবে এমন কোনো আইন নেই।”

             অতঃপর পরবর্তী ছাত্র তার মতামত পড়ে শুনালঃ “আমি যদি বিচারক হতাম, আমি কাউকে এ অপরাধের জন্য দায়ী করতাম না। বলতে হয় যে, মুখে একটা বিপজ্জনক সাপসহ উড়াটা ছিল সারস জাতীয় পাখীটির অপরাধ। আমরা বিবেকহীন প্রাণীদের শাস্তি দিতে পারিনা। এটা অতিথিদের ভাগ্যের ব্যাপার। কেউ বিছানায় মৃত্যুবরণ করেন কেউ আবার মরেন যুদ্ধের ময়দানে।”

             বিচারক এ জবাবের সঙ্গেও একমত হননি। তিনি ছাত্রদেরকে বললেন, এটাকে ভাগ্যের ব্যাপার বলে তুমি ঠিক করনি। এ ধরনের জবাব “কে দায়ী” এ সমস্যার সমাধান দানে সক্ষম নয়। অথচ একজন বিচারককে অবশ্যই সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তোমার মতামত কি? তিনি তৃতীয় ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন। “আমি যদি বিচারক হতাম, আমি মেযবানকে শাস্তি প্রদান করতাম। যদি তিনি দুধ পরীক্ষা করতেন, তিনি বুঝতে পারতেন যে সেগুলো খারাপ ছিল এবং তিনি সে জিনিস তার অতিথিদের পরিবেশন করতেন না। আমি বলি, মেযবান অপরাধী। যদি কোন সাপ দেখা নাও যেত তথাপি দুধ অন্যভাবে বিষাক্ত হতে পারতো।”

              ‘না’-বিচারক উত্তর করেন, এটা সম্পূর্ণ ভুল। সন্দেহ করার কোন কারণই মেযবানের ছিল না। পরিবেশন করার পূর্বে অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে এমন কেমন আইন নেই। সাপের বিষ যে দুধে ছিল সেটা মেযবানের পক্ষে কি করে জানা সম্ভব ছিল?

            চতুর্থ ছাত্র বললোঃ “এ বিষয়টিতে আরও তদন্ত প্রয়োজন।” বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছ?”

              ছাত্রটি বললঃ “আমার মতামত হচ্ছে যে, ঘটনার এ ব্যাখ্যা সঠিক নয়। আকাশে বাহিত অনেক দূরের একটা সাপের মুখের বিষ যদি দুধে পতিত হতো, তবে বিষের ফোটার শব্দ শোনা যেত অথবা দুধের একটা ঢেউ সৃষ্টি হওয়ার বিষয় অনুভব হতো। এর ফলে ভৃত্য হয়তো বিপদ সম্বন্ধে সজাগ হয়ে যেত। যদি বিষের উৎস যে কি সেটা কি করে জানা যাবে? যদি ভৃত্য বা অন্য কেউ দেখে থাকতো এবং মেযবানকে জানাতো, তবে কেউ মৃত্যুবরণ করতো না। অপরদিকে কেউ যদি নাই দেখে থাকে, তবে পাখী ও সাপের গল্প এলো কোথা থেকে?

              প্রথমতঃ আমি সে ব্যক্তিটিকে প্রশ্ন করে আমার তদন্ত কাজ শুরু করতাম। ভৃত্য, দুধওয়ালা, পাচক এবং সে পরিবারকে সবাইকে আমি প্রশ্ন করতাম। এরপর সতর্কতার সঙ্গে তাদের জবাব নিয়ে বিচার করে দেখতাম। সারস জাতীয় পাখীর গল্পটি যদি মিথ্যা হতো, তবে গল্পের বর্ণনাকারী সম্বন্ধে আমি সন্দিহান হতাম। হতে পারে যে ভৃত্যর নিকট বিক্রিত দুধ ছিল দুষিত এবং দুধওয়ালাই গল্পটা তৈরী করেছে। অথবা হতে পারে, ভৃত্যের অথবা পাচকের অতিথিদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ছিল, তাদেরই একজন গল্পটির রূপ দিয়েছে।

              ক্ষেত্রে যে-ই মিথ্যা বলেছে সে একজন অপরাধী। অপরপক্ষে গল্পটি সত্যও হতে পারে। এতএব সেটা পরীক্ষা করা দরকার। সম্ভাবনা সমূহও আমাদেরকে বিচার করা দরকার। একজন উত্তম বিচারক তিনি, যিনি তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। তিনি সকল উপাদান বিচার বিশ্লেষণ করে দেখেন। কে অপরাধী কে নির্দোষ সেটা নির্ণয় করার জন্য সকল সন্দেহ হতে দূর হওয়ার প্রয়োজনে এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব জানতে হবে। এসব সমাপ্ত হলে শাস্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।”

             সম্মানিত বিচারক বলেনঃ “উত্তম কর্ম! আমি তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য এ গল্পটা ফেদেছি। এটা স্পষ্ট যে চতুর্থ ছাত্র সবচেয়ে সুন্দরভাবে বিজ্ঞতার সঙ্গে বিচার করতে সক্ষম এবং সে একজন উত্তম বিচারক হবে।”