JustPaste.it

 আমরা যাদের উত্তরসূরী

একজন পর্যটকের দৃষ্টিতে ইমাম শামিল (রহঃ)

অধ্যাপক এস. আকবর আহমেদ

======================================================

 

        এ ছিল এক ক্লান্তিকর শান্তিমূলক কর্মসূচী। মধ্য এশিয়ায় পক্ষকালব্যাপী পরিশ্রমসাধ্য সফর এবং তথ্যচিত্রের জন্য দৃশ্যগ্রহণ আমাকে দৈহিক ক্লান্তির শেষ বিন্দুতে নিয়ে এসছিল বলা যেতে পারে।

 

        কিন্তু এজন্য আমার বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই। কারণ এই সফর ছিল দাঘিস্তানের মর্দে মুজাহিদ ইমাম শামিলের স্মৃতিরোমন্থন ও তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের এক বিরল সুযোগ। তাঁর পাহাড় প্রমাণ ব্যক্তিত্ব এবং দাঘিস্তানের জাতীয়তা ও নিজস্ব পরিচিতি রক্ষায় তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা পুনরাবিষ্কারের অপূর্ব মওকা আমাকে দারুণভাবে টানছিল। সেই সঙ্গে পূর্বের রুশযুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত উত্তর ককেশিয়ার স্বল্প পরিচিত অথচ ঐতিহ্যমণ্ডিত মুসলিম সমাজ সম্পর্কেও এই সফর জানার সুযোগ করে দিয়েছিল।

 

        সুফী এবং মুজাহিদ — এই উভয় ভূমিকার সমন্বয় দেখতে পাওয়া যায় ইমাম শামিলের অসামান্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইমাম শামিল শুধু সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধেই তাঁর শক্তিশালী এবং সাহসিকতাপূর্ণ অভিযান চালান নি বরং সেই সঙ্গে তাঁর অদাঘিস্তানী স্বদেশবাসীদের উপর শরীয়তী শাসন ব্যবস্থা লাগু করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।

 

        ইমাম শামিল তামাম মুসলিম দুনিয়াতেই কম-বেশী পরিচিত। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর স্বদেশবাসীকে সাম্রাজ্যবাদী, রাশিয়ার কবলে পড়ে সংখ্যা লঘু হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে। মহারানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে তাঁর পত্র বিনিময়, রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে তাঁর জিহাদ, ইসলামীশাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর দৃঢ় সংকল্প প্রভৃতি তাঁকে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তিতে পরিণত করেছিল। খলিফা উমর (রাঃ) ছিলেন ইমামের আদর্শ। বলা হয়ে থাকে যে, বেআইনী কাজের অপরাধে নিজের মাকে তিনি চাবুক মারার আদেশ দিয়েছিলেন। উমর (রাঃ) তাঁর পুত্রকে যে শাস্তি দিয়েছিলেন, ইমাম শামিল ইনসাফের স্বার্থে তা অনুকরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ অবধি ইমাম শামিলের পুত্রের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তিনি মায়ের পক্ষ থেকে নিজেই বেত্রাঘাত গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসেন।

 

        ইমামের জীবন ছিল পাহাড়ী-শার্দুলের মতই রোমাঞ্চকর। কার্লমার্কস ও টলস্টয়ের মত ইউরোপের সুবিখ্যাত ব্যক্তিরা নিজেদের রচনায় ইমাম শামিল সম্পর্কে সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছেন। স্বাধীনতা কি তা যদি উপলব্ধি করতে চান তাহলে ইমাম শামিলের দৃষ্টান্তের দিকে নজর দিন ’-লিখেছেন কার্লমার্কস। কার্ল মার্কস-এর এই স্বীকৃতি বলশেভিক বিপ্লবের পর তাঁকে একই সঙ্গে, শ্রদ্ধা ও বিরোধিতার এক অনন্য অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে ; একজন মুসলিম ইমাম যিনি সারা জীবন ইসলামের জন্য সংগ্রাম করেছেন, স্বয়ং কার্লমার্কসও তাঁকে সপ্রশংস স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিগত শতাব্দীতে ইমাম শামিল দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করেন।

 

        একটি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রসার রোধ, অপরটি শরীয়তী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন। ইমাম শামিল অসংখ্যবার রশিয়ানদের পরাস্ত করেছিলেন, কিন্তু দাঘিস্তান ছিল আবেষ্টনী পরিবৃত। জর্জিয়া, আজারবাইজান এবং সারকাশিয়া — যে রাজ্যগুলো দাঘিস্তানের ভৌগোলিক সীমাকে পরিবেষ্টন করেছিল। চারপাশের সে দেশগুলিকে রুশরা দখল করে নিয়েছিল। এক সময় দাঘিস্তানের দশ লক্ষ অধিবাসীর জন্য রুশরা দু’লক্ষ সৈন্য পাঠিয়েছিল, অর্থাৎ প্রতি ৫ জন মানুষ পিছু ১ জন করে রুশ সেনা। শেষ পর্যন্ত ইমামের পরাজয়ের সাথে সাথে দাঘিস্তানেরও পতন ঘটে।

 

        উনবিংশ শতাব্দী ছিল ইউরোপীয় উপনিবেশিকতাবাদের যুগ। আর শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে ইমাম পর্যন্ত পরাস্ত হন। হজ্ব পালনের জন্য তিনি আরবে যান এবং সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। মদিনা আল মুনাওওয়ারায় তাঁকে দাফন করা হয়। দাঘিস্তানের রাজধানী মাখারকালার মিউজিয়ামে ইমাম শামিলের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র এখন গর্বের সঙ্গে দেখানো হয়। তাঁর সেই সবুজ ঝাণ্ডা এখন বিবর্ণ শ্বেত বর্ণের। তাঁর তলোয়ার, খঞ্জর এবং বিজয়ী রুশ সেনাপতির সামনে তাঁর আত্মসমর্পণের মুহূর্তটিকে ধরে রাখা হয়েছে এক বিরাট তৈলচিত্র করে। কিন্তু এই মুহূর্তেও রাশিয়ানরা তাঁকে রাজকীয় শালীনতা প্রদর্শন করে সম্মান জানায় তাঁকে। শামিলের দৈহিক সাহস ছিল কিংবদন্তির ন্যায় এবং তাঁর সারা গায়ে বহু ক্ষতচিহের দাগ।

 

        তিনি ছিলেন নক্ শবন্দী ধারার অনুসারী। তাঁর নক্ শবন্দী শেখ (আধ্যাত্মিক গুরু)-এর কন্যাকে তিনি বিবাহ করেছিলেন। তুরস্কে এখনও তাঁর বংশধররা রয়েছেন।

 

        ইমাম শামিল ১৮৩৪ থেকে ১৮৫৯ অবদি শাসন করেছিলেন। অবশ্য তাঁর আগেও দু’জন ইমাম স্বাধীন ইমামত প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়াস চালিয়েছিলেন। এতে সামন্ত প্রভু খানেরা মোটেই খুশী ছিল না। তারা শরীয়তী ব্যবস্তা প্রবর্তনের বিরোধী ছিল। কারণ শরীয়া আইন তাদের প্রভূত্বকে ব্যাপকভাবে খর্ব করেছিল এবং কর্তৃত্ব চলে যাচ্ছিল খোদায়ী আইন বলবৎ কারীদের হাতে। খানেদের কিছু ব্যক্তিকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। কেউ পালিয়ে গিয়েছিল আবার কেউ ক্ষমতা পুনরুদ্ধার-এর আশায় রাশিয়ানদের সাথে গোপনে যোগাযোগ গড়ে তুলছিল। ইমাম শামিল তাঁর সরকার চালানোর জন্য একটি ইসলামী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, সেই সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন দক্ষ প্রশাসককুল। তাঁর ছিল এক ‘মজলিশে শুরা’ (পরামর্শ পরিষদ) এবং ছিল নায়েববৃন্দ-যাঁরা কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি জেলা প্রশাসনের প্রধানও ছিলেন। ইরোপীয় শক্তিগুলি মুসলিম এলাকা সমূহ যখন দখল করতে আরম্ভ করলো মুসলিম প্রতিরোধ বাহিনী তখন গ্রামীন ও পাহাড়ী উপজাতি এলাকাগুলিতে আশ্রয় নেয়।

 

        এই প্রতিরোধ আন্দোলন পরিচালনা করার জন সুফী ভাবধারার বহু জনপ্রিয় নেতার আবির্ভাব ঘটেছিল। সমগ্র মুসলিম জগতে এর প্রতিফলন দেখা যায়। সাইরিনা–ইকাতে সানুসি, সুদানে মাহাদি, সোয়াতে আখুন্দ, পেশোয়ারে সৈয়দ আহমাদ বেরলভি এবং দাঘিসতানে ইমাম শামিল মুসলিম জাগরণে নেতৃত্ব দেন। ইমাম শামিল এবং সোয়াতের আখুন্দের মধ্যে একটি লক্ষণীয় মিল দেখা যায়। দুজনেই ছিলেন সমসাময়িক এবং নকশবন্দী। দুজনেই তাঁদের অনুসারীদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের বিরুদ্ধে জেহাদে স্বয়ং নেতৃত্ব দেন। দুজনেই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা গঠনের আশা পোষন করতেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যে শক্তিগুলোর সঙ্গে তাঁদের মোকাবিলা করতে হচ্ছিল তাদের প্রকৃতির উপরও অনেক কিছু নির্ভরশীল ছিল। ইমাম শামিল রুশদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আর আখুন্দ দাঁড়িয়েছিলেন বৃটিশদের বিরুদ্ধে। বৃটিশরা ছিলো রুশদের অপেক্ষা অধিকতর উদার। এবং পরিশেষে তারা আকুন্দের একজন বংশধরকে সোয়াতের শাসনকর্তা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। বৃটিশরা তাকে ‘সোয়াতের ওয়ালী’ এই সরকারী খেতাবেও অভিষিক্ত করে।

 

        ইমাম শামিলের একটি কাহিনী রয়েছে। তাঁর পরাজয়ের পর তিনি হজব্রত পালনের জন্য আরবের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ওসমানীয় খলিফার সাথে এক পর্যায়ে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ইমাম শামিলের দিকে খলিফা ও ওসমানীয় সুলতান মোসাফা করার জন্য তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন। প্রত্যুত্তরে ইমাম শামিল তাঁর বাম হাত বাড়িয়ে দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘যখন রুশদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য আপনাকে আমার প্রয়োজন ছিল এবং আমি আমার ডান হাত প্রসারিত করেছিলাম সেই সময় আপনি আমায় কোন কিছুই দেন নি।’

 

আজও মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের সম্পর্কে একই ধরণের অভিযোগ শোনা যায়। ইমাম শামিলের স্মৃতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় নিজস্ব ও স্বকীয় পরিচিতি, গর্ব, সম্মান এবং প্রতিরোধের কথা। তিনি ইসলাম ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের সমন্বয় সাধন করেছিলেন। রুশরা তাঁর গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাঁর সম্পর্কিত সমস্ত উল্লেখ ও ইতিহাস–ঐতিহ্যকে যথাসম্ভব মুছে দেয়ার চেষ্টা করে। সরকারী ভাবে তাঁকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এখন তাঁর উপর অনেক তথ্য-চিত্র তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, নাটক ও পালা লেখা হচ্ছে। গত এক-দেড় বছরের মধ্যে ইমাম শামিলের নামে ব্যাপকভাবে রাস্তাঘাট ও বিভিন্ন সংস্থা গড়ে উঠেছে। দাঘিসতানে তাঁকে যে কত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হয় — এ হচ্ছে তারই প্রমাণ। শামীল সব সময় ছিল এক পরিচিত নাম-নীরব প্রতিবাদের প্রতীক। ইমামই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যাঁকে দাঘিসতানবাসীরা সব থেকে বেশী শ্রদ্ধা করে। এর মূলে রয়েছে তাঁর অবিরাম সংগ্রাম, সব রকম বাধা বিপত্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস এবং দৈহিক শক্তি মত্তা।

 

        দাঘিসতান কৃষ্ণসাগর এবং কাম্পিয়ান সাগরের মধ্যস্থিত একটি দেশ। এটি এমনই এক কেন্দ্রবিন্দু যেখানে তিনটি সংস্কৃতি, তিনটি সাম্রাজ্য এবং তিন জাতির লোক এসে মিলিত হয়েছে। এর উত্তরে রয়েছে রুশরা, পশ্চিমে তুর্কীরা এবং দক্ষিণে ইরানী বা পারসিকরা। পামির উপত্যকায় যেমন রুশ, চীনা এবং বৃটিশ সাম্রাজ্য এসে মিশেছে- এটাও তেমনি আর এক সম্মিলন-বিন্দু। রাজধানী শহর মাথাচকালা হচ্ছে সোভিয়েত। আদলে তৈরি এক বিরাট, বৈচিত্রহীন, নিরানন্দ ও জীর্ণ শহর। আমরা প্রদেশের উপরাষ্ট্র প্রধানের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি সোভিয়েত আচার ও ধ্যান ধারণায় অভ্যস্ত এক দাঘিসতানী। তার ঘরে বসে বোঝার উপায় নেই যে, আমরা দাঘিসতানে রয়েছি। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের চাঁদ-তারা সমন্বিত নয়া ঝাণ্ডায় ইসলামের প্রতিফলন দেখা যায়। উপরাষ্ট্রপ্রধান জানালেন, এ সম্পর্কে বিবেচনা করা হচ্ছে জারের সময় থেকে এ অঞ্চলগুলিতে রুশদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব পড়েছে, তবে উল্লেখযোগ্য কোন কিছুই তারা সৃষ্টি করতে পারে নি। বিরাট কোন প্রাসাদমালা, উঁচুমানের কোন শৈল্পিক নিদর্শন-এসবের কোন কিছুই নয়। যা আছে তা খুবই নিকৃষ্ট, শ্রীহীন, এলোমেলো। দাঘিস্তান মধ্য এশিয়া থেকে খানিকটা আলাদা প্রকৃতির। এই দুর্গম এলাকার সীমারেখার মধ্যে প্রায় ২০ লাখ সুন্নী মুসলমানের বসবাস, এরা আবার ত্রিশটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত। তাদের রয়েছে নিজস্ব পুর্বপুরুষের বংশ তালিকা, নিজ নিজ প্রথা ও রীতি-নীতি এবং আঞ্চলিক ভাষা।

 

        এদের জীবন ব্যবস্থায় গোষ্ঠীগত নিয়ম নীতি সমূহ (আদত) একই সঙ্গে এদের শক্তি ও দুর্বলতার পরিচায়ক। এই নিয়মনীতিসমূহ প্রত্যেক গোষ্ঠীকে যেমন আত্মচেতনা বজায় রাখতে সহায়তা করে, অপরদিকে তাদেরকে জটিল নিয়ম-নীতির বেড়াজালে বন্দী করেও রাখে। উপজাতি গোষ্ঠীগুলো সংখ্যায় খুবই কম এবং অনেক সময়ই তারা পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে। তারা নিজেরাও তাদের হতাশাজনক পরিস্থিতির ব্যাপারে সচেতন। রুশ সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের ঘেরাটোপে তারা ক্রমেই আবদ্ধ হয়ে পড়ছিল।

 

অথচ তারা হচ্ছেন ঘোরতর রূপে ইসলামী, ঘোরতর রূপে দেশজ এবং ঘোরতর গোষ্ঠীগত উপজাতি-সংস্কৃতির মানুষ। নবীর সম্মানে নামের সঙ্গে মুহাম্মদ যোগ করা তাদের সমাজে আবশ্যকীয়। তৃতীয় প্রজন্মের ক্ষেত্রে প্রত্যেকবার এখানে পূর্বপুরুষের একই নাম পুনরায় রাখা হয়। ফলে আমাদের এখানকার পরামর্শদাতা ডঃ মুহাম্মাদ খানের দাদুও ছিলেন মুহাম্মদ খান এবং এইভাবেই ট্রাডিসন বহমান রয়েছে।

 

        দাঘিসতানীদের নিয়ননীতিসমূহের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাহসিকতার অনুভূতি, জাতি-ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব এবং ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ইসলামের সঙ্গে একাত্মতা। ওয়াদা পালনকে উচ্চ সম্মান দেওয়া হয়। নিজেদের মর্যাদা ও সাহসিকতাকে অতি মূল্যবান মনে করা হয়। দাঘিসতানের নিয়ম-নৈতিকতা অনুযায়ী বিদেশী উপনিবেশিকতাবাদীদের অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়ে থাকে। তারা বিশ্বাস করে, উপনিবেশবাদীরা সম্মান বোধ বিহীন মানুষ। কেননা তারা সাহসিকতা, মেহমানদারী এবং ধর্মবিশ্বাসে আস্থাশীল নয়। দাঘিসতানীরা যে নীতি পদ্ধতি মেনে চলে তাতে রয়েছে ‘নাসম’- সম্মান ও মর্যাদাবোধ এবং অন্যায়ের প্রতিকার। তাদের সাহিত্যে ‘আদমকি’ কথাটি এসেছে আদম থেকে অর্থাৎ এমন মানুষ হওয়া যে মানুষের সম্মান করবে, ভদ্র, দয়ালু ও মেহমান নওয়াজ হবে। তারপর হচ্ছে ‘ঈমানকি’ অর্থাৎ মুসলমান হওয়া, আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে শ্রদ্ধা করা। এছাড়া রয়েছে সুফীইজম, আল্লাহ’তে বিশ্বাস, নবীতে বিশ্বাস, কুরআনে বিশ্বাস, হাদীস ও জ্ঞানচর্চা। সেই সঙ্গে রয়েছে ‘যিকির’, যখন মানুষ নির্জনে আল্লাহর নাম অবিরত উচ্চারণ করে হৃদয়ে ঈমানের শিখাকে প্রজ্জ্বলিত রাখে।

 

        দাঘিসতানে অনেক ইসলামী প্রথাও রয়েছে। শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শয়তানকে তাড়ানোর জন্য তার চারপাশে কালো চক দিয়ে একটি বৃত্তরেখা এঁকে দেওয়া হয়। আমাকে বলা হল, এ হচ্ছে আদতের (দেশজ নিয়মপদ্ধতি) অন্তর্ভুক্ত। দাঘিসতানের সাধারণ মানুষ মনে করে, শরীয়ত বা ইসলামের সঙ্গে আদতের কোন সংঘর্ষ নেই, এটা শরীয়ত না হলেও অনৈসলামিক কিছু নয়। তারা যেমন শিশুর চারিদিকে চকের দাগ দেয় আবার তাকে কলেমাও শোনায়।

 

        বিভিন্ন গোষ্ঠীর ও উপজাতির অনন্য এ সমাজব্যবস্থাকে স্ট্যালিন ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেছিলো। উপজাতি এবং অনেক গোত্রকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। কিন্তু দাঘিসতানের পাহাড় পর্বতের বাধা, দৃঢ়তর ঐক্যবদ্ধ সমাজ এবং উপজাতিদের শক্তিশালী নিয়মনীতির ফলে স্ট্যালিন পুরোপুরি সাফল্য লাভ করতে ব্যার্থ হয়। আরেকটি অলৌকিক ব্যাপার আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা দারবন্দের ঐতিহাসিক কেল্লাটির ছবি তোলা সবে শেষ করলাম। এই কেল্লাটি এখানে ইসলাম আগমনের পূর্বে তৈরী করা হয়েছিল। ককেশাস পর্বত এবং কাম্পিয়ান সাগরের মাঝে অবস্থিত এই দুর্গটি সক্রিয়ভাবে দক্ষিণ পারস্য সাম্রাজ্যের দিক থেকে যাযাবর জাতিদের আগ্রাসী অভিযানকে রুখে দেয়। এই দুর্গকে আরো মজবুত করা হয়েছে লোহার বিশাল শেকল দ্বারা। এগুলি কেল্লা থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। পারস্য ভাষায় এই দুর্গকে তাই দ্বারবন্দ বলা হয় অর্থাৎ ‘বন্ধ দ্বার’। দুর্গের বাইরে একটা গাছের নীচে বসে বহুদূর বিস্তৃত পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ড্রাব সোবিয়েত শহরের দিকে কোনরূপ দৃষ্টিপাত না করে দৃষ্টিকে ইচ্ছামত মেলে দিলাম কম্পিয়ানের দিকে। আমাকে বলা হল যে, আরবরা যখন প্রথম এই এলাকায় আসে তখন তারা ইসলামের অন্যতম একটি প্রাচীন মসজিদ এই দ্বারবন্দ নির্মান করেছিল।

 

        এধরণের আর একটি অভিযানে আরবরা স্পেনে উপনীত হয়েছিল এবং অন্য আর একটি অভিযান তাদেরকে ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বারপ্রান্ত সিদ্ধু-এ নিয়ে আসে।

 

        সোভিয়েত শাসনকালে দ্বারবন্দের মসজিদটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাকে তারা একটি বড় হাজতে পরিণত করে। এখানে লোকদের ধরে এনে নৃশংস জুলুম চালানো হত। নামাযের মূল স্থানে রান্নাঘর স্থাপন করা হয়েছিল। দেড়-দু’বছর আগে মসজিদটি পুনরায় মুসলমানদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন নামাজের প্রায় ওয়াক্তে মসজিদটি মুসল্লী দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। নারী-পুরুষ সকলেই এখানে নামায পড়তে আসে। আমি বসে এই সমস্ত আলোড়নকারী ঘটনাবলী সম্পর্কে চিন্তা করছিলাম। ক্রমশঃ উপলব্ধি করতে পারলাম আযানের বেহেশতি সুমধুর ধ্বনি ধীরে ধীরে আমার কানে প্রবেশ করছে। এবং রমনীয় শান্ত বিকেলটিতে তা আকাশে বাতাসে ভেসে চলেছে। ঐ মসজিদ থেকে আযানের এক আওয়াজ আসছিল। ঈমানদারদের তা প্রার্থনার জন্য আহবান জানাচ্ছিল কল্যাণময় জীবনের দিকে। স্বচকিত বিস্ময়ের মধ্যে আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম।

 

        রুশ বিপ্লবের পূর্বে দাঘিসতানে দু'হাজার পাঁচশ মসজিদ ছিল। মাত্র ডজন খানিক মসজিদ ছাড়া বাকি সবগুলিই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এখন এর মধ্যে দু’শ মসজিদ নব নির্মিত হয়েছে-নিয়মিত প্রার্থনা চলছে। স্ট্যালিনের আমলে এখানকার প্রায় তিন হাজার আলিমকে খুন করা হয়। ফলস্বরূপ জনগণের কাছে কেবল ইসলাম সম্বন্ধে মৌলিক কিছু জ্ঞানই অবিশিষ্ট ছিল। শুধু কুরআন এবং কিছু হাদীস তারা পড়তে পারত। আমাদেরকে খাজবুলাত খাজবুলাতব (হিজবুল্লাহ’র রুশীয়করণ) তার গ্রামের প্রধান হলটি দেখালেন। খাজাবুলাতব দাঘিসতানের অন্যতম ইসলামী নেতা। এই হলে এসে রুশী সৈনিককেরা মদ খেত ও মাতলামী করতো। এখানে অশ্লিল ছবি ও অশালীন অসামাজিক কাজকর্ম অবাধে চলতো। আমি নিজেই দেখলাম, বর্তমানে এটিকে এক মাদ্রাসায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। ছাত্ররা এখানে ইসলাম শিক্ষা করছে। এই গ্রামে ইতিমধ্যেই ত্রিশটি মসজিদ গড়ে উঠেছে। আমাদের দেখানো হ’ল কিভাবে রাশিয়ানরা করবস্থানের খোদাই করা পাথর এবং মসজিদ থেকে আরবী ক্যালিওগ্রাফি (কুরআনের আয়াত) খুলে নিয়ে গেছে। এগুলো তারা তাদের বিন্ডিং তৈরীতে ব্যবহার করেছে এবং সেগুলোর ঘোরতর অমর্যাদা করা হয়েছে। খাজবুলাতব দাঘিসতানেই ইসলামী ঊষার প্রতীক্ষায় ছিলেন। তিনি আমাকে ঘনিষ্ঠভাবে বেশ কিছু প্রশ্ন করেনঃ “উজবেকিস্তানের কাফির প্রেসিডেন্ট করিমভকে বাদশা ফাহাদ কি করে কাবা শরীফে উমরাহ করতে যাবার অনুমতি দিলেন? তিনি কি জানেন না করিমভ একজন সাচ্চা নাস্তিক?”

  

        এতদিনকার বে-ইনসাফির বিরুদ্ধে দাঘিসতানবাসীদের ক্রোধ যে ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে তার আলামতগুলি খুবই স্পষ্ট। আমাদের পরামর্শদাতা ডাঃ খানের চাচা আলী মুহাম্মদ নিউফিকে বাস করেন। এর অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় চার হাজার। প্রধান সড়ক থেকে দূরে হলেও দ্বারবন্দ থেকে আধঘন্টায় এখানে পৌছানো যায়। আলী মুহাম্মাদের বয়স প্রায় ষাট, ইউরোপীয়দের মতোই দেখতে, মুখে ক্লান্তির ছাপ। শরীর কিন্তু বেশ শক্ত সমর্থ। স্বল্পভাষী এই বৃদ্ধ আমাদেরকে উদার আতিথেয়তায় গ্রহণ করলেন। বললেন, তাদের এই গ্রামে কেউ কখনও অভুক্ত থাকে না। গ্রামের প্রত্যেকেরই ঘরের পেছনে ছোটছোট ব্যক্তিগত জমি আছে। লোকেরা সেগুলিতে নিজেদের জন্য শস্যাদি ও তরিতরকারি উৎপন্ন করে। কিন্তু গ্রামের গলিগুলো কর্দমাক্ত, নোংরা এবং বদ্ধজলায় পরিপূর্ণ। টিনের ছাদ এবং কাঠ দিয়ে স্বল্প খরচে তৈরি করা হয়েছে বাড়িগুলো। সেখানে টেলিফোন বা টেলিভিসনের বালাই নেই। পর্যটকেরও প্রশ্ন ওঠে না। দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্নই বলা যেতে পারে। মাখাচকালা থেকে নিউফিক রাস্তা বরাবর পথের দুধারে আমরা বহু আঙ্গুরের ক্ষেত, চেরী ফলের বাগান এবং সবুজ শস্যক্ষেত্র দেখেছি। দেশটি ফলেমূলে সমৃদ্ধ — আর সমুদ্র যোগান দেয় অফুরন্ত মাছ। কেবলমাত্র রুশীয় শাসন ব্যবস্থাই এমন এক সমৃদ্ধশালী দেশকে দারিদ্রের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে।

 

        আলী মুহাম্মাদ আমাকে একটি কাহিনী শুনিয়েছিলেন, যা আমাকে শুধু অভিভূতই করেনি বরং সোভিয়েত শাসনের স্বরূপটিও আমার সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিল। সেই সঙ্গে ইসলামের তাকত ও অজেয় প্রাণশক্তিকেও নতুন করে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। আমার কৌতুহলী জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি তাঁর সাতবছর বয়সের এক ঘটনার কথা শোনান। মনে হল তাঁর জরা দূর হয়ে গেছে এবং অগ্নুৎপাতের মত তাঁর ক্রোধ ফেটে পড়ছিল। তিনি বর্ণনা করলেনঃ বালক অবস্থায় যখন তিনি রাতে বিছানায় ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন, অপরিচিত ব্যক্তিরা কিভাবে জোর করে তাদের ঘরে ঢুকে পড়ে। তার মা-বাপকে বেইজ্জত করে এবং তাঁকে বিছানা থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়। সমগ্র পরিবারকে রাস্তায় নামতে হয়। তার বাবা মা ছোট ভাই এবং তাঁকে এই বলে হুশিয়ারী দেওয়া হয় যে, যদি তাদেরকে গ্রামের পঞ্চাশ থেকে সত্তর মাইল পরিধির ত্রিসীমানায় দেখা যায় তা হলে গুলি করে মারা হবে। রুশদের কাছে তাদের অপরাধ ছিল তারা মুসলমান ও মধ্যবিত্ত চাষী। দিনের পর দিন ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করে তাঁরা তাদের পরিচিত জনৈক ব্যক্তির গ্রামের দিকে অগ্রস হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তারা বর্তমানের এ গ্রামটিতে বসতি করে। তাদের বংশের অন্য কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সাহস করতে পারেনি-পাছে কর্তৃপক্ষের রোষ তাদের উপর আপতিত হয় এই ভয়ে।

 

        ডঃ খানের চাচা নিজেকে আর ধরে রাখতে পরলেন না। দাঘিসতানের এই শক্ত মানুষটি আমাদের ভিডিও ক্যামেরার সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। বললেন, কেন আমি এই রুশ শাসনকে ঘৃণা করবো না? তারা আমার চারজন আত্মীয়কে হত্যা করেছে, আমার জীবন বরবাদ করে দিয়েছে। ব্যথায় তাঁর মুখ কুচকে যাচ্ছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কিভাবে এত দিন বুক বেঁধে রয়েছেন? আসমানের দিকে মুখ তুলে অশ্রুসিক্ত চোঁখে আলী খান বলেন, শুধু আল্লাহর উপর ভরসা করেই আমি সবর করতে পেরেছি।

 

        ফেরার পথে মাথাচালকা বিমানবন্দরে সোভিয়েত শাসন ও এলাকার লোকজনের প্রকৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ ঘটল। বিমান বন্দরে তুমুল বিশৃঙ্খলা। সমমেত জনমণ্ডলীর মধ্যে একরকম লড়াই করে রিসেপসনে পৌছালাম। কেউ ইংরেজি জানে না। এও জানে না, কি হচ্ছে বা কখন বিমান ছাড়বে। শেষ অবধি শোনা গেল, বিমানে তেল নেই, তাই যাত্রা অনিশ্চিত। পরে শুনলাম কেবল মস্কোর বিমানটি এখনই ছাড়বে। জনতা পাগলের মত ছুটতে লাগালো। তাদের ধাক্কায় ধাক্কায় আমিও এগিয়ে গেলাম। মনে ভয়, কে জানে কোন বিমানে চড়ে, বসি। ফলে চিৎকার করতে লাগলাম মস্কো মস্কো বলে। নইলে কে জানে শেষ অবধি হয়তো অন্যকোন দুর্গম প্রজাতন্ত্রের আরও দুর্গম বিমান ঘাঁটিতে নামিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত উড়ো জাহাজে উঠে এলাম। প্রত্যেক এ্যারোফ্লাট প্লেনের যা বৈশিষ্ট্য, খোলা টয়লেট, গা গোলানো দুর্গন্ধ মুহূর্তের মধ্যে আমার নাকে এসে লাগলো। উড়ো জাহাজের ভেতরটা ছিল হট্টগোলে পরিপূর্ণ। অশান্ত দাঘিসতানীরা জোর গলায় কথাবার্তা বলছিলেন। এই পরিস্থিতিতে ব্রিফকেস খুলে কুরআন বের করে পড়া ছাড়া আমার আর কোন গত্যন্তর ছিল না। আমার পাশের যাত্রী আমাকে কুরআন পড়তে দেখে যেই আবিষ্কার করলেন যে, আমি মুসলমান, তিনি উত্তেজিতভাবে নিজেদের ভাষায় সহযাত্রীদের কাছে তা ঘোষণা করলেন। সংগে সংগে আমাকে বহু যাত্রী চেরীফল ও রুটি বাড়িয়ে দিলেন, ভালবাসার প্রতীক হিসেবে আমি তা গ্রহণ করলাম। আমার পাশের যাত্রী আমার কুরআনটি হাতে নিলেন, যদিও আমরা একে অপরের ভাষা কিছুই জানি না — তিনি আরবিতে কয়েকটি বাক্য লিখে গর্বের সঙ্গে আমাকে দেখালেন।

 

        আমি তাকে কুরআনটি উপহার দিলাম। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, অলৌকিকভাবে দাঘিসতানে ইসলামী চরিত্র ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসছে। নইলে কোথায়, তিনি কুরআন পড়া শিখবেন? দাঘিসতান থেকে নাম করা আধুনিক সোভিয়েত শিল্পী ও বহু মহাকাশচারীরা প্রখ্যাত হয়েছেন। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, তারা যেন সোভিয়েত ব্যবস্থায় মিশে গেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রুশদের সঙ্গে দাঘিসতানী জনগণের বিন্দুমাত্র ভালবাসাও অবশিষ্ট নেই। দঘিসতানীরা মনে করে, রুশরা নীচুমানের সংস্কৃতির মানুষ। তারা লোভী, তাহজীবহীন। মেহেমানদারী কি বস্তু তা রুশীরা জানে না। সর্বোপরি তারা ভয়ানক ভীতু। তাদের বিধি বিধান বলে কিছু নেই। ফলে তারা অবজ্ঞার পাত্র।

 

        দাঘিসতানের লোকেরা এখনও আত্মপ্রত্যয়ের সাথে মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে হাঁটে। তাদের দেশজ আচার-ঐতিহ্য নিয়ে তারা গর্বিত যা গড়ে উঠেছে শরীয়া ও আদতের এক অপূর্ব সমন্বয়ে। তারা বয়স্কদের সম্মান করে এবং নারীদের সঙ্গে শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যাবহার করে। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত সেখানে শরীয়তী আদলত চালু ছিল। তারা এই বলে গর্ব করে যে, দাঘিসতান ছিল ইসলামী ইলম ও শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র। সারা দুনিয়া থেকে মুসলমানরা এখানে জ্ঞান হাসিল করতে আসত।

 

        বেশির ভাগ দাঘিসতানীই বর্তমান রুশশাসন থেকে মুক্তি পেয়ে সম্পূর্ণ আজাদী অর্জন করার পক্ষপাতী। তারা মনে করে দাঘিসতানের যে সম্পদ-উপকরণ রয়েছে তা তাদের ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। তাদের রয়েছে পেট্রল, গ্যাস, শুকনো ফলমূল, সমুদ্র, পাহাড়, উর্বর উপত্যকা। কিন্তু তারা এও জানে যে, কূটনৈতিক দিক থেকে তারা এক জটিল ভৌগোলিক রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে পরিবেষ্টিত। এছাড়া, দাঘিস্তানে এখন দু'লাখ রুশ আস্তানা গেড়ে নিয়েছে। কাজেই দাঘিস্তানীরা যদি পূর্ণ আজাদীর সংগ্রাম শুরু করে তাহলে ভবিষ্যৎ খুব একটা মসৃণ হবে না। তাই বলে কি তারা বসে থাকবে? তারা পরাধীনতার শেকল জড়িয়ে নিরব থাকার জাতি নয়। ইমাম শামিলের স্বপ্ন তারা বাস্তবায়িত করবেই-ইনশাআল্লাহ।