আমরা যাদের উত্তরসূরী
এক অমুসলিমের হৃদয়ে মহানবী (সাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা
আহমদ আল-ফিরোজী
=====================================================================
হাকিম ইবনে হুযাম তখনো ইসলাম গ্রহণ করেন নি । শিরক ও পৌত্তলিকতার জালে আবদ্ধ থাকার ফলে তিনি মুসলমান ও দ্বীন ইসলামের শত্রুদের ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু । কুরাইশদের এই বরণীয় নেতার ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ভাব থাকলেও আশ্চর্যজনক ভাবে রাসূলে খোদা সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেম ও ভালোবাসায় তিনি ছিলেন পানোম্মত্ত ।
বিখ্যাত ইতিহাস ও হাদীস বিশারদ ইবনে আসাকির (রহঃ) তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে যুবাইর ইবনে বুকাইরের সূত্রে নকল করেছেন , যখন নির্দয়, অত্যাচারী কাফের শক্তি নবী হাশেম, কতিপয় সাহাবী ও রাসূলে খোদা (সাঃ) কে পাহাড়ের বেষ্টনীতে বন্দী করে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং সকল প্রকার যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল যখন নবীজী (সাঃ) কে সাহাবী ও আপনজনদের নিয়ে গাছের পাতা ও ছাল চিবিয়ে জীবন ধারণ করতে হয়েছিল । সেদিন সেই কঠিন সময়ে কার এমন সাধ্য ছিল যে, গোত্রীয় বন্ধন ছিন্ন করে এদের রক্তচক্ষু এড়িয়ে নবীজি ও তার সাথীদের সাহায্য করবে?মহানবী (সাঃ) এর এমন দূরাবস্থায় হাকীম ইবনে হুযাম অত্যন্ত ব্যাকুল ছিলেন, কি করে তাঁর সাহায্য করা যায় । কোন উপয়ান্তর না দেখে অবশেষে শামদেশ থেকে কাফিরদের তিযারতি মাল-পত্র বহনকারী উটবহর যখন আসত তখন তিনি সেগুলোকে মহানবী ( সাঃ) এর অবরুদ্ধ ঘাটির কাছে নিয়ে খুব বেশি করে পিটাতেন, আর তখন মাল বোঝাইকৃত উটগুলো ছুটাছুটি করে ওই বন্দী ঘাটিতে ঢুকে পড়লে বনী হাশেম সেগুলোকে ধরে তা থেকে মালপত্র সংগ্রহ করে নিজেদের আহারের ব্যবস্থা করতেন ।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের বর্ণনাঃ হাকীম ইবনে হুযাম (রাঃ) বলেন, "কাফের অবস্থায়ও নবীজি (সাঃ) এর প্রতি আমার ছিলো গভীর ভালোবাসা । হিযরতের পর যখন মহানবী (সাঃ) মদীনায় চলে যান, তখন হজ্ব মৌসুমে একদিন ইবনে হুযাম দেখতে পেলেন, আরবের এক ধনাঢ্য খ্যাতনামা বাদশাহ জিইয়াজানের বহু মূল্যবান একটি চাদর বাজারে বিক্রি হচ্ছে । প্রেম ও মুহব্বতের টানে মূল্যবান এ চাদরটি কিনে তিনি নবীজি (সাঃ) কে উপহার দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন । বহু চড়া দামে সেটি তিনি খরিদ করে মদিনায় দরবারে নববীতে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, " হে মুহাম্মদ! আমার পক্ষ থেকে এ চাদরটি উপহারস্বরূপ গ্রহণ করুন । "
কাফেরদের পক্ষ হতে উপহার গ্রহণ করা সম্পর্কীয় বহু বর্ণনা হাদীসের কিতাবে যদিও পাওয়া যায় কিন্তু এখানে নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুযাইমার উপহার গ্রহণ করলেন না । তিনি হুযাইমার গভীর ভালোবাসার আভাস পেয়ে ছিলেন যে, এ মূহুর্তে এরূপ ব্যবহার করলে ইসলামের দাওয়াত সে গ্রহণ করবে । তাই মহানবী (সাঃ) তাকে বললেন,"আমি অমুসলিমের উপহার গ্রহণ করি না । যদি ইচ্ছা হয় উপযুক্ত দামের বিনিময়ে আমার কাছে এটা বিক্রি করতে পার । "
এক বর্ণনায় হাকীম ইবনে হুযাম বলেন, 'এ ঘটনায় আমি দারুণ মর্মাহত হলাম । হুজুর (সাঃ) এর পক্ষ থেকে আমার উপহার প্রত্যাখ্যান ও দামের বিনিময়ে তা তার হাতে তুলে দেয়া আমার নিকট ভালো লাগল না । ব্যথিত মন নিয়ে ওখান থেকে উঠে প্রতিজ্ঞা করলাম, সর্বপ্রথম যে লোকটির সাথে আমার দেখা হবে শত কম মূল্য হলেও তার কাছেই আমি চাদরটি বিক্রি করে দেব । এদিকে যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) কে হুজুর (সাঃ) আমার পেছনে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, "যখন সে এটাকে বিক্রি করতে চায়,তুমি এটাকে খরিদ করে নিয়ে এসো" । অতএব, যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) চাদরটি খরীদ করে নেয়ার পর সেটি আমি মহানবী (সাঃ) এর গায়ে দেখতে পেয়ে আমার আর খুশি ধরে না । কারণ যে কোন অবস্থায়ই হোক আমার আসল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে । হাকীম ইবনে হুযাম (রাঃ) বলেন, " এ চাদরটি পরিধান করলে মহানবী (সাঃ) কে দুনিয়ার সকল বস্তু থেকে আমার কাছে সুন্দরতম মনে করার ফলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর সাথে বহু জিহাদেই আমি অংশগ্রহণ করতে পারি নি । মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত আমি ইসলাম গ্রহণের প্রয়োজন উপলব্ধি করতে পারি নি, যা আমার জন্য দুঃখের কারণ বৈ কি । (ইবনে আসাকির, ৪র্থ খন্ড) ।
"ইসলাম তলোয়ারের জোরে প্রসার লাভ করেছে"-এমন অন্যায় ও মিথ্যা অপবাদ দিয়ে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে চায় তাদেরকে বলা উচিত, 'তোমরা ইবনে হুযামের জীবনী দেখ, তাকে কোন তলোয়ারের ভয় দেখিয়ে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল?'
ইসলাম গ্রহণের পরপরই হযরত হাকীম (রাঃ) হুনাইনের যুদ্ধে হুজুর (সাঃ) এর সাথে জিহাদে শরীক হয়েছিলেন । একদিন এক প্রয়োজনের তাগিদে হাকীম (রাঃ) নবীজির কাছে কিছু সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি তাকে কিছু মুদ্রা সাহায্য করেন । অনুরূপ আরেকদিন প্রার্থনা করলে নবী কারীম (সাঃ) হাকিম (রাঃ) কে কিছু দান করে উপদেশ করলেন যে, " দান অতি মিষ্ট বস্তু । দান গ্রহীতা যদি পরমুখাপেক্ষীহীন মন নিয়ে তা গ্রহণ করে তাহলে এটা তার জন্য বরকত বয়ে আনে । আর যদি দানের প্রতি গ্রহীতার লোভ থাকে তবে কোন দিন সে সাবলম্বী হতে পারে না । বরং তার অবস্থা হয় 'খেয়েও ক্ষুধার্ত ' ব্যক্তির মতো । জেনে রাখো, গ্রহীতার হাত থেকে দাতার হাত উত্তম" । হযরত হাকীম (রাঃ) এ উপদেশটুকু আজীবনের জন্য মেনে নিয়ে বলেছিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনার পর আজ থেকে আমি কোন দিন কারো কাছে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে কষ্ট দেব না । এরপর থেকে তিনি মালে গণিমত থেকেও অংশ নিতেন না । হযরত আবু বকর ও উমার (রাঃ) তাঁকে মালে গণিমত থেকে অংশ নিতে ইচ্ছা করলে হযরত হাকীম (রাঃ) তাদেরকে উক্ত হাদীস শুনিয়ে তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করতেন ।
হযরত হাকীম ইবনে হুযাম (রাঃ) এর বিচক্ষণ পরামর্শঃ
এক সময় হযরত উমার (রাঃ) সাহাবায়ে কেরামদের জন্য কিছু ভাতা নির্ধারণের লক্ষ্যে সকল আনসার ও মুহাজির সাহাবীদের সমন্বয়ে পরামর্শ সভা আয়োজন করলেন । সকলেই এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন দেন । কারণ এর ফলে সবাই নির্বিঘ্নে দ্বীনি কাজে মগ্ন থাকতে পারবে ।
পর্যায়ক্রমে যখন হাকীম (রাঃ) এর পরামর্শের পালা আসলো,তিনি আরজ করলেন, "আমিরুল মু'মিনীন! আপনি কখনো এ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না । আপনার ভাতা ব্যবস্থা কুরাইশদের আর্থিক কাঠামো ধ্বংস করে দেবে । বর্তমানে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য আছে, ভাতা চালু হলে তারা ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে দিবে । আর আপনার পরবর্তী খলিফাগণ যদি ভাতা বন্ধ করে দেন তখন ব্যবসা ও ভাতা উভয়ই বন্ধ হওয়ার ফলে কুরাইশগণ মহা বিপদে পড়ে যাবে" । (ইবনে আসাকির,৪৬১,৪র্থ খন্ড) ।
═──────────────═