JustPaste.it

ভূগোলময় পৃথিবী

 

ধারাবাহিক নিবন্ধআফগান সংকটের অন্তরালে পরিবর্তিত শিরোনাম

জিহাদ মুজাহিদদের সমালোচনার জবাব

বিশ্বব্যাপী আফগান জিহাদের প্রভাব

মনযূর আহমাদ

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ইউরোপের হৃদয় মূলে নয়া জীবনের জয়গানঃ বসনিয়ার স্বাধীনতার লড়াই

            আফগানিস্তানে রাশিয়ার চরম পরাজয়ের ফলে সুবিশাল একটি পরাশক্তি সার্বিকভাবে দারুণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তার শক্ত পাঞ্জার বজ্র আঁটুনি ঠিলা হয়ে যায় একেবারেই। একে মানবী রূপ দিয়ে বুঝতে হলে বলতে হবে, প্রচণ্ড নদী ভাঙ্গনে সর্বস্বহারা এক পথে বসা পথকলী পরিবার। জোত জমিদারী শেষ, ম্লান হয়ে গেছে তার ভূপৃষ্ঠ কাঁপনে দাপট মাতুব্বরী হুংকার। নিজের সম্রাজ্য ভেংগে খান খান। এবার সুহৃদয়রাও ক্ষেপেছে। পশ্চিমে তার প্রভাব খর্ব হয়ে আসছে। তার অঙ্গুলী হেলানে কেউ আর এখন ওঠবস করেনা। পশ্চিম ইউরোপ চাচ্ছে স্বাধীনতা ও মুক্ত বাজার অর্থনীতি। এই পশ্চিম ইউরোপের একটি অংশ বসনিয়া। যেখানে ইসলামে বিশ্বাসী জনতা সংখ্যাগরিষ্ঠ। দীর্ঘদিন কম্যুনিস্ট শাসনের বজ্র আঁটুনিতে তারা ছিল নির্বাক ও নিস্পেষিত। নামায, রোযা পালন ও ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করা ছিল তাদের জন্য নিষিদ্ধ-চরম অপরাধতুল্য। কিন্তু ইসলামী জীবন যাপনের কল্যাণীয় স্বাদ গ্রহণে তারা উন্মুখ হয়েছিল। তারা ছুঁতে চাচ্ছিল ইসলামের রশ্মী পরশ। তাদের এ ইচ্ছা দিন দিন উজ্জীবিত হচ্ছিল, মুক্তির দোয়া ও জালিম কম্যুনিস্ট শাসকদের প্রতি তাদের বদদোয়ার উচ্চারণ প্রতি মুহূর্তে উচ্চকিত হচ্ছিল। এদিকে আফগান জিহাদ ও মুজাহিদদের বিজয় তাদের এ ইচ্ছা ও চেতনায় নতুন মাত্রা যোগায়।

            সময়ে বিশাল কম্যুনিস্ট বলয় দ্রুত নির্জীব হয়ে পড়ছিল। মুজাহিদের প্রচন্ড আঘাতে ও তাদের অভাবনীয় বিজয় চিন্তায় (!) ক্যান্সার আক্রান্ত অবস্থায় লবেজান দসায় দাঁড়ায় পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেংগে যায়। মধ্য এশিয়ায় অভ্যূদয় ঘটে প্রায় এক ডজনের মত স্বাধীন ও স্বায়ত্বশাসিত মুসলিম স্টেট। মুসলমানরা নতুন আবেগে ফিরে, আসতে থাকে ইসলামের শীতল ছায়ায়।

            এরই রেশ ধরে কস্যুনিস্ট যুগোস্লাভিয়ার কম্যুনিটি ভেংগে পাঁচ ভাগ হয়ে যায়। যার একাংশ হলো, বসনিয়া। এই সেই বসনিয়া, যে ইউরোপের বুকের উপর দাঁড়িয়ে সকল ষড়যন্ত্র ও বাধা উপেক্ষা করে খুনের দরিয়া ও লাখো জীবন নযরানা দিয়ে ইসলাম ও স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উড্ডীন করে রেখেছে।

            ইউরোপের খ্রিষ্টবাদী কম্যুনিস্ট শাসকেরা বসনিয়ার মুসলমানদেরকে তাদের ঐতিহ্য-ইতিহাস ও দ্বীন থেকে সম্পূর্ণ ভুলিয়ে রেখেছিল। সত্তর বছরে খোদাদ্রোহী শাসকেরা অত্যন্ত কৌশলে মুসলিম জনতার জীবন থেকে ইসলামকে নির্বাসন করে রেখেছিল। ফলে তারা যে মুসলিম ঘরানার সন্তান, সে কথাই ভুলে বসেছিল। আচরণে অভ্যাসে আঁচ করা যাবেনা যে, তারা এককালে মুসলিম ছিল। তাদের তাওহীদী বিশ্বাস ও ইসলামী যিন্দেগীকে ছিনিয়ে নিয়েছিল নাস্তিক্যবাদী কম্যুনিষ্ট শাসকেরা।

            এই সেদিন এক বসনীয় মহিলা জনৈক মুজাহিদকে বলেছিল, ‘আমার পিতা সামাজিক পরিচয়ে মুসলমান ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি অপপ্রচারে প্রভাবান্বিত হয়ে ইসলামের চেয়ে খ্রিষ্টবাদকে উত্তম মনে করতেন। ইসলামের প্রতি তার চরম ঘৃণা ছিল। তিনি নিজেকে খ্রিষ্টান হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন।’

            মহিলা আরো বলেছিল, ‘বসনিয়ার মুসলিম ঘরানার মেয়েরা খ্রিষ্টান ছেলেদের সাথে অনুরূপ মেলামেশা করে যেরূপ খ্রিষ্টান ছেলে-মেয়েরা পরস্পরে প্রেম ও শরীর ভোগ করে থাকে। ভরা যৌবনে আমার নিজের বন্ধুটিও ছিলো একজন খ্রিষ্টান যুবক। যার সাথে আমি বহু দিন একই বিছানায় শুয়েছি ও রাত কাটিয়েছি। সামাজিক পরিচয়ে আমরা মুসলমান ছিলাম বটে, কিন্তু ইসলামের আদর্শ সম্বন্ধে কোন ধারণাই আমাদের ছিলনা।’

            ‘আমার জীবন ছিলো অত্যন্ত আয়েশী। আজ আমারা বন্দী ও বিপন্ন, বিধ্বস্ত আমাদের জীবন, তবুও আমি সুখী এবং প্রশান্তি উপলব্দি করছি। উদ্বাস্তু ক্যাম্পে মুজাহিদদের যুদ্ধাস্ত্র পরিষ্কার করার সুযোগ পেয়ে আমি গর্ববোধ করছি। ইসলামী জীবনাচার ও একনিষ্ঠ মুসলিমদের সংস্পর্শে আমি নবজীবন লাভ করে এক নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করেছি। আমার পিতা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তবে তার অনুসন্ধানী মন অবশ্যই স্বীকার করত, একমাত্র ইসলামেই রয়েছে নিরাপত্তা, মর্যাদা ও শান্তি।’

            আফগান রণাঙ্গনে মুজাহিদদের বিজয়ের পূর্বে মুসলিম অমুসলিম কেউ কল্পনাও করেনি, ইউরোপের বুকে বসনিয়াও জ্বলে উঠবে দিগন্তব্যাপী ইসলামের আলোক রশ্মীতে। ইউরোপের কোন অংশে কোন কালেও যে স্টেট প্রতিষ্ঠিত হবে, তা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। কেননা সেখানের মুসলিম জনতা নেতৃত্ব ও ক্ষমতার দিক দিয়েই দুর্বল ছিলনা,  তাদের বিশ্বাস ও জীবনাচরণেও ইসলামী আদর্শের লেশমাত্র ছিলনা। একমাত্র আফগান জিহাদের প্রেরণাই তাদেরকে রুখে দাঁড়াতে শক্তি জুগিয়েছিল। একই পথ-পরিক্রমায় তারা আজ বসনিয়ার বুকে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছে। তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল, তারা আবার ফিরে পেয়েছে ইসলামী জিন্দেগীর অব্যাক্ত সুস্বাদ।

            আল্লাহ যাকে হেদায়েত দেন, বিজয়ী করেন, কেউ তাকে গোমরাহ ও পরাজিত করতে পারেনা। বসনিয়ার স্বারীনতা অর্জনে কোন রাজনীতি ও শান্তিচুক্তি যে কাজে আসেনি, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে কেন আমরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার চিরন্তন নিয়ম ত্যাগ করে পাশ্চাত্যের গলীয রাজনীতি চর্চায় মেতে রয়েছি?

            আগে বলেছি, বসনিয়ার মুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কে কোনই ধারণা ছিলনা। তাদের জীবনাচারের কোন ক্ষেত্রে ইসলামের সামান্যতম আভা পরিলক্ষিত হতনা। তবে তারা অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিকট মুসলমান হিসাবে পরিচিত ছিল। তাদের এই নামসর্বস্ব মুসলিম পরিচয়টুকুও ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের সহ্য হয়নি। তারা চেয়েছিল ইউরোপের বুক থেকে মুসলিম পরিচয় বহনকারী প্রতিটি বনী আদমকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। এই খ্রিষ্টগোষ্ঠীই আজ বিশ্ব মোড়লীপনার ঠিকাদারী নিয়েছে। অবুঝ মুসলমানেরা এদেরকে এখনো মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠাতা ও রক্ষাকর্তা মনে করছে। পৃথিবীর প্রতিটি খ্রিষ্টাবাদী নেতা যে মুসালমদের জন্য এক একটি হিংস্র হায়েনা, বসনিয়ার ধবংসজ্ঞের পর সে কথায় এখনো যাদের বিশ্বাস হয় না, তারা অপমানজনক মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকুন। এখনো যাদের শুভ বুদ্ধির উদয় ঘটেনি, তাদের মস্তক যে বন্ধক দেয়া সে কথা উদাহরণ ও দলীল সহ ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই বলে মনে করছি?

            ১৯৯৫ সনে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বসনিয়ার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত আবেগঘন ভাষায় বলেছিলেন, দুঃস্বপ্ন মাত্র। এখন ইসলামী বসনিয়ার সীমানায় ওদের প্রবেশ করা অসাধ্য ব্যাপার। আজ বসনিয়ার মুসলমানরা বিশ্বাস ও জীবনাচরণেই কেবল মুসলমান নয়, বরং তারা আজ অন্যদেরও ইসলামী আদর্শ শিখাচ্ছে, বিশ্বাসের সংশোধন করছে। আজ তারা অযুত জীবনের কুরবানীর বিনিময়ে একশত পঁচিশ কোটি মুসলমানকে ভুলে যাওয়া জিহাদের সব শিখাচ্ছে। আফগান জিহাদে পরীক্ষিত ও পোড় খাওয়া বহু আরব মুজাহিদ বসনিয়ার জিহাদে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটান হচ্ছে, ইবাদত-আমলের প্রতি সকল মুসলমানকে উদ্বুদ্ধ করার জোরদার অভিযান চলছে। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, স্কুল কলেজ খুলে দেয়া হয়েছে, সংক্ষিপ্ত বসন স্কাট পরতে অভ্যস্ত মেয়েরা আজ পর্দার সাথে ক্লাশে যোগদান করছে।

বসনিয়ার জিহাদ ইউরোপীয় অপশক্তির নীল নকসা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। মুসলিম মিল্লাতকে আল্লাহর একত্ববাদে মযবূত বিশ্বাস, আল্লাহতে ভরসা ও কুফর পরাজিত করণের একমাত্র পথ জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার ডাক দিচ্ছে। ইউরোপের সকল মুসলমানকে তারা আজ এক বিশ্বাসের সূত্রে একত্রিত করতে সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। বসনিয়ার ওপর চাপিয়ে দেয়া অসম যুদ্ধ আমাদেরকে একথা বুঝতে বাধ্য করেছ যে, পৃথিবীর প্রতিটি কাফির আজন্ম মুসলমানের শত্রু। এমন জানী শত্রুর সাথে কিভাবে বন্ধুত্ব হতে পারে? এবার আপনিই বলুন, আফগান জিহাদের ফলাফল বিশ্ব মুসলিমের জন্য অকল্যাণ না কল্যাণ বয়ে এনেছে?

 

যুলুম থেকে মুক্তির সত্যিকার পথ দেখিয়েছে আফগান জিহাদঃ

আফগান জিহাদের পূর্বে পৃথিবীর যে কোন এলাকার মুসলমান যুলুম থেকে নিস্কৃতির জন্য দোয়া বাদে আর কি করতে পেরেছে। তারা পিঠ পেতে আঘাত সয়েছে আর মুখ দিয়ে বলেছে, আল্লাহ মুক্তি দাও! মুসলিম মিল্লাত যালিমকে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো, কৌশল ভুলে বসেছিল। অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় ভূগছিলো গোটা মুসলিম বিশ্ব। অনিশ্চয়তার নিকষ তাদের ঘিরে ফেলেছিল চতুর্দিক থেকে। মুক্তির কোন পথ তারা খুঁজে পাচ্ছিলনা। যুলুমে নিস্পেষিত হওয়া যন্ত্রণাদায়ক বটে, কিন্তু তার চেয়েও ভয়াবহ হলো, যুলুম থেকে নিষ্কৃতির পথ খুঁজে না পাওয়া। একঘন্টা কেন, এক সপ্তাহও মানুষ অন্ধকারে ঘরে থাকতে পারে, কিন্তু যদি সে আঁধার জীবন দীর্ঘ হতে থাকে এবং যদি সে আঁধার থেকে আলোতে আসার কোন পথ খুঁজে না পায়, তখন তার নিকট এক একটি মুহূর্ত এক বছরের মত দীর্ঘ মনে হয়, সে হতাশায় মৃতবৎ হয়ে যায়। আফগান জিহাদ এই ও পথহারা আঁধারে ডুবন্ত মুসলিম মিল্লাতকে অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ দেখায়, আঁধার তাড়াতে আলো জ্বালানোর কৌশল শেখায়। তারপরও কি কেউ বলবে, আফগান জিহাদ কোন কল্যাণ বয়ে আনেনি?

যদিও মুক্তির ও মুসলিম নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই পথ সম্পর্কে কুরআন-হাদীসে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে এবং প্রিয় নবী (সাঃ) জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত দ্বীন প্রতিষ্ঠায় এ পথে তৎপরতা চালিয়ে ছিলেন, অধিকাংশ শিক্ষিত মুসলমান ও আলিম সমাজ অবশ্য জানেন যে, জিহাদই মুক্তির পথ, কিন্তু মুসলিম উম্মাহ চরমভাবে নেতৃত্বহীনতার স্বীকার। দ্বিতীয়তঃ জিহাদের বাস্তব কোন নমুনা তাদের সামনে ছিলনা।

আল্লাহর কোটি শুকরিয়া, আফগান জিহাদে মুজাহিদদের কুরবানী ও একনিষ্ঠতা দেখে মজলুম মুসলিম জনতা জেগে উঠেছে, তারই পথ ধরে ইউরোপের বুকে বসনিয়ার জন্ম হয়েছে, ইসলামী চেসেনিয়ার আত্নপ্রকাশ ঘটেছে এবং কাশ্মির, ফিলিস্তিন, বার্মা, তাজিকিস্তান ও আলজেরিয়ায় অবিরাম জিহাদ চলছে। কে অস্বীকার করবে যে, এই বিজয় ও প্রতিরোধ জিহাদের একমাত্র প্রেরণা আফগান জিহাদ নয়? এর পরও কি কেউ প্রশ্ন করবে, জীবন ও রক্তক্ষয় ছাড়া কি উপকার হয়েছে আফগান জিহাদ দিয়ে? [চলবে]

অবলম্বনেঃ আমেরেকী ইয়াহুদী সাজেস