আমাদের দেশের চালচিত্র
ইসলামঃ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এক বিকল্পহীন পথ
মুহাম্মদ ফারুক হোসাইন খান
আধুনিক যুগের একটি মুখরোচক শব্দ মানবাধিকার। সচেতন মানুষ মাত্রের মুখেই এখন এ কথাটি শোভা পাচ্ছে। বুদ্ধিজীবীদের এ শব্দটি ব্যবহার না করতে পারলে বক্তৃতা সম্পূর্ণ হয় না। রাজনীতিকদের রাজনীতি শুদ্ধ হয় না মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিঃস্বার্থ ত্যাগী প্রমাণ না করতে পারলে। এ দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কর্মতৎপর রয়েছে বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা। তারা আইনগত, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধি দিয়ে দুর্গত ব্যক্তিদের সাহায্য করে যাচ্ছে। দেশে মানবাধিকার শব্দটি নিয়ে এত বেশী তোলপাড় হওয়ার কারণ হলো আমাদের এ সমাজে বর্তমানে মানবাধিকার লংঘনের হার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে যেখান সুযোগ পাচ্ছে অপরের অধিকার বেপরোয়া ভাবে লংঘন করে চলছে। এ সুযোগে কেউ মানবাধিকার নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে, কেউ একে চাপাবাজীর বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে। কেউ জনকল্যাণের নাম করে রাজনৈতিক আবরণে জনগণের মানবাধিকার লংঘন করছে, আবার কেউ অর্থনৈতিকভাবে সমাজ শোষণ করে সমাজকে নিংড়ে ছোবড়া বানাচ্ছে।
ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত মানবাধিকার লংঘনের পাশাপাশি এ দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবেও মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। জনগণের কল্যাণের কথা বলে যারা ক্ষমতার মসনদে আসীন হন,তাদের নিয়ন্ত্রণেই প্রতিনিয়ত এ কর্মটি সংঘটিত হচ্ছে। আর তা হলো সরকারী বেতন ব্যবস্থার বৈষম্য। এ বৈষম্য বেসরকারী সেক্টরসমূহ ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও গড়ে উঠেছে।
আমাদের দেশে সরকারীভাবে যে বেতন স্কেল অনুসৃত হয়, তাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অর্থনৈতিক চাহিদার প্রতি নজর দেয়া হয়নি। এখানে ব্যক্তির পদ ও সার্টিফিকেটের মূল্যায়ন করা হয়েছে মাত্র। অর্থাৎ এখানে ব্যক্তির মর্যাদা, যোগ্যতা ও প্রতিভাকে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে পরিমাপ করা হয়েছে। এখানে যে ব্যক্তির পদ বেশী মর্যাদাবান, যে ব্যক্তির সার্টিফিকেটের মূল্য বেশী সে ব্যক্তির অর্থনৈতিক প্রাপ্তির পরিমাণও বেশী। তাই কোন অফিসের বসের বেতন স্কেল যদি হয় ১০ হাজার টাকা সে অফিসের অফিস সহকারীর বেতন স্কেল হয় ১৫৩০ টাকা। একজন সচিব আর অফিস সহকারীর মধ্যে পদ আর সার্টিফিকেটের কারণে এ আকাশ-পাতাল অর্থনৈতিক বৈষম্য। এখানে অফিস সহাকারীর পারিবারিক প্রয়োজনের কোন মূল্য নেই। ধরা যাক কোন অফিস সহকারীর স্ত্রী ও তিন সন্তানের পরিবার রয়েছে। এ ছাড়া পিতা-মাতা জীবিত থাকলে তাদেরও ভরণ-পোষণ ব্যয় বহন করতে হবে। হয়ত এ সাত সদস্যের পরিবারের সে একাই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার সার্টিফিকেটের জোড় এস, এস, সি অথবা এইচ, এস, সি। তাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অফিস সহকারীর একটা পদ জুটিয়ে নিয়েছে। এ পরিবারটির ঢাকা বা যে কোন শহরে থাকতে দু কামরার বাসস্থান লাগবে। ফ্লাটতো স্বপ্নের ব্যাপার, বেঁচে থাকার তাগিদে সে যদি টিন সেট ঘরের দু' কামড় ভাড়া নেয় তবে এ বাজারে তা যতই নিম্নমানের হোক ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা লাগবেই। এরপর এ পরিবারের দৈনিক বাজার খরচ কতে হবে। ধরা যাক প্রতিদিন চার কেজি চালের প্রয়োজন যার বর্তমান মূল্য দাড়ায় ৪ x ১৬ = ৬৪ টাকা। এরপর মাছ, তরকারী, তেল, মশলা প্রভৃতির জন্যে এ বাজারে ৫০ টাকার কমে কোনক্রমেই চলে না। অতএব দৈনিক বাজার খরচ দাড়ায় ৬৪+৫০=১১৪ টাকা। এ ছাড়া ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া, জামা কাপড়, চিকিৎসা খচর তো রয়েছেই। স্বল্প, উপার্জনের এ পরিবারটির চিকিৎসা খরচ বেশীই লাগার কথা। কেননা এরা ভেজাল জিনিসের ওপরই বেশী নির্ভরশীল। ভেজাল চাল, ভেজাল তেল, পুষ্টিবিহীন তরকারী, আধাপচা মাছ তাদের নিত্যদিনের খাবার তালিকায় থাকবেই। তবে এ পরিবারটির শিক্ষা, বস্ত্র ও চিকিৎসার এ তিনটি মৌলিক চাহিদা বাদ দিয়ে দেখা যাক মাসিক খরচ কত লাগে। বাসস্থান ১৫০০ + বাজার খরচ (১১৪ X ৩০) ৩৪২০ টাকা = ৪৯২০ টাকা। অথচ লোকটির মাসিক বেতন সর্বসাকুল্যে ২৫০০ টাকা!! এ পরিবারটির কোন সদস্যের যদি জটিল কোন অসুখ হয় তবে তার চিকিৎসার জন্যে কোন আধুনিক ক্লিনিক, অপারেশন থিয়েটার বা বিদেশ যাওয়া তো দূরের কথা সাধারণ চিকিৎসার ব্যয় বহন করাও দুষ্কর হয়ে পড়বে। এ লোকটির কোন সন্তানের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য কোন উচ্চমানের ডিগ্রী অর্জনের ব্যয়ভার বহন করা হবে আকাশ কুসুম কল্পনা। যে লোকটির বেতন অপেক্ষা সর্বনিম্ন সাংসারিক ব্যয় তিনগুণেরও বেশী সে লোকটি এ বাজারে কিভাবে জীবন ধারণ করবে? এ লোকটি বাধ্য হয়ে কেন দুনীতির পথ গ্রহণ করবে না, সে কেন বসের সাক্ষাৎ প্রার্থীর নিকট থেকে ২০ টাকা বকশিশ দাবী করবে না? এ লোকটি বেঁচে থাকার তাগিদেই দুনীতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে। এ দুনীতি তার বিলাস ব্যাসনের জন্য নয় গাড়ী বাড়ীর জন্য নয়। নিতান্ত বেঁচে থাকার তাগিদেই।
পক্ষান্তরে, এ লোকটির বসের জীবন যাত্রা সম্পূর্ণ বিপরীত। লোকটি মাষ্টার্স ডিগ্রীধারী তাই আজ সে অফিসের বস। এ বস লোকটির বেতন স্কেল যদি হয় ৮৫০০/= তবে এর সাথে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা মিলে তা চৌদ্দ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া সে কিস্তির সুবিধায় সরকারী কলোনীতে আবাসস্থল পাচ্ছে, গাড়ী, টেলিফোন সুবিধা পাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করলে বর্তমানে একটি পরিবার মাসিক ৬০০০ টাকা থেকে ৬৫০০ টাকার মধ্যে সাংসারিক ব্যয় বহন করতে পারে। কিন্তু বেতন বাবদ অতিরিক্ত অর্থ তাকে বিলাসিতার পথে টেনে নিয়ে যায়। বাজার খরচ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবন যাত্রার সর্বত্রই বিলাসিতার প্রভাব পড়ে। দামী ফার্ণিচার, ফ্রিজ, রঙ্গিন টেলিভিশন, ডিস এন্টিনা, ভিসিয়ার তার স্টাটাস বৃদ্ধির জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
অফিস সহকারী যেখানে স্বল্প বেতনের কারণে তার স্ত্রী সন্তানের নিত্য প্রয়োজনীয় পোষাক কিনে দিতে হিমশিম খায় সেখানে তার বসের স্ত্রীর বাটিক করা বা কারুখচিত পারের শাড়ী পরিধান করা প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাড়ায়। একদিকে অফিস সহকারীর বিবাহযোগ্যা কন্যা অর্থের অভাবে পিতার দুশ্চিন্তা বাড়াতে থাকে অন্যদিকে বসের কন্যার রংয়ের ম্যাচ করে জুতা, শাড়ী, জুয়েলারী, প্রসাধনীর আব্দারের পেছনে হাজার হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপরও বসের বিলাসিতার শেষ নেই। তার চাই বাড়ী, গাড়ী, মোটা অংকের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স। তাই সে ছোটে মোটা অংকের অবৈধ অর্থের পেছনে। দুর্নীতির মাধ্যমে তার উপার্জিত অর্থের পরিমাণও অফিস সহকারীর পরিমাণ থেকে বিশাল বৈষম্যে অবস্থান করে। অফিস সহকারী বাঁচার তাগিদে দুনীতির আশ্রয় নেয় আর তার বস বিলাসিতার চাহিদা মেটাতে এ কর্মটি করে থাকে। অফিস সহকারী ক্যান্সারের জন্য হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেও বস লোকটি একটু সর্দি লাগলেও সিঙ্গাপুর যায় চিকিৎসা করাতে। কেরানীর ছেলে কোন রকমে টেনে টুনে আইএ পাশ করে কেরানীগিরীই করে আর বসের ছেলে বিদেশে পড়াশুনা করে হয় দেশের ভবিষ্যত কৃতি সন্তান। এভাবে আর্থিক বৈষম্যকে কাজে লাগিয়ে বস শ্রেণী উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে দেশের বসগিরী চালিয়ে যায়। কেরানীর দল আজীবন কেরানীগিরী আর বসদের তোষামোদ করেই জীবনপাত করে।
একটি সভ্য সমাজে মানবাধিকার নিয়ে এহেন তামাশা চলছে। বিশেষ করে যে সমাজের সিংহভাগ লোকই ইনসাফের ধর্ম ইসলামে বিশ্বাসী। আমাদের রয়েছে একটি সুশৃঙ্খল সরকার ব্যবস্থা। যার প্রধানতম উদ্দেশ্যই হলো সর্বস্তরের জনগণের মৌলিক অধিকার শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান প্রভৃতি নিশ্চিত করা, দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের সুখ-শান্তির জন্য পরিকল্পনা মাফিক রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। কিন্তু এ দেশের যে সরকার কাঠামো প্রতিষ্ঠিত আছে, তা কি সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণের জন্যে নিবেদিত? সরকার কি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছে? মোটেই নয়। প্রচলিত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ইনসাফের কোন নাম গন্ধও নেই। এ ব্যবস্থায় সাত সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির বেতন ১৫৩০ টাকা আবার হয়তো তিন সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মাসিক বেতন ১৪ হাজার টাকা। একজনের মাসিক আয়ের অর্থে দু মুঠো অন্নই জুটে না। আর একজন দিব্যি হালুয়া রুটি খেয়ে প্রসাদোপম বাড়ীতে বসবাস করার অর্থ পাচ্ছে।
একদিকে একজন অর্থের অভাবে তার সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারছে না। অন্যদিকে আর একজন অর্থের প্রাচুর্যের জন্যে বিলাসিতায় হাবুডুবু খাচ্ছে। অর্থের প্রয়োজন কার বেশী, সাত সদস্যের পরিবারওয়ালার না তিন সদস্যের পরিবার ওয়ালার? অফিস সহকারী পিতার আর্থিক অনটনের জন্যে হয়তো উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে পারেনি, তাই বলে তার পরিবার ফুটপাতে বাস করবে, অন্যদিকে বস লোকটি উচ্চ শিক্ষালাভে সমর্থ হয়েছে বলে তাকে প্রয়োজনেরও অধিক অর্থ প্রদান করতে হবে এ কেমন ইনসাফ? অর্থের প্রয়োজন কি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য না সার্টিফিকেট ও মর্যাদাবান পদের চাহিদা পূরনের জন্য? মানুষকে মানুষের মতো বাঁচতে সাহায্য করার অপেক্ষা পদ ও সার্টিফিকেটকে লালন করার গুরুত্ব এ প্রশাসনের কাছে এতবেশী কেন?
উচ্চ শিক্ষাকে যারা জ্ঞান পরিমাপের মাপকাঠির অপেক্ষা অধিক অর্থ উপার্জনের মাপকাঠি মনে করে, তাদের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। ইনসাফের অপেক্ষা যারা মাথা গণনায় বেশী পারদর্শী, সে গণতন্ত্রীরাও এ প্রশ্নের কোন সুরাহা করতে পারবে না। এর সুষ্ঠু সুরাহার জন্যে আমাদের অবশ্যই ইসলামে ফিরে যেতে হবে। যেখানে বেতন স্কেল নির্ধারিত হবে পদ মর্যাদা ও সার্টিফিকেটের মূল্যের ওপর ভিত্তি করে নয়, পরিবারের সদস্য সংখ্যা ও মোট খরচের ওপর ভিত্তি করে। এখানে অল্প শিক্ষিতের পারিবারিক সদস্যরা সমাজে অপাংক্তেয় হবে না তাদেরও বাঁচার মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা হবে। পক্ষান্তরে, বস শ্রেণীর অতিরিক্ত প্রাচুর্য কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বিলাসিতার মোহ থেকে হেফাজত করা হবে। এখানে অফিস সহকারীর যেমন দুনীতির আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে হবে না। তদ্রুপ সকল প্রকার বাহুল্য ও বিলাসিতার পথ রুদ্ধ করে বস শ্রেণীরও দুর্নীতি বন্ধ করে দেয়া হবে। এখানে সকল শ্রেণীর সকল মানুষের প্রধান মৌলিক অধিকার সমূহ সুনিশ্চিত করা হবে সর্বাগ্রে। সচিব সাহেবের চিকিৎসা যদি মেডিকেল কলেজে সম্ভব হয়, তবে সেখানেই হবে। আবার কেরানীর চিকিৎসার জন্য যদি লন্ডন যেতে হয়, তবে তাকে লন্ডনেই যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হবে। ইসলামী ব্যবস্থায় জনগণের অর্থ সর্বাগ্রে অভাবগ্রস্থের, অসহায় জনগণের জন্যেই ব্যয় হবে। কেননা, জনগণের উন্নতি হলে দেশের উন্নতি হবে, জনগণ বাঁচলে দেশ বাঁচবে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অসহায়, দুর্গত রেখে মুষ্টিমেয় উচ্চ শিক্ষিত বস শ্ৰেণীকে মেদ, চর্বিবহুল করে বাঁচিয়ে রাখলে দেশের কোন উন্নতি হবে না। মানবাধিকার ও ইসলাম দরদী ব্যক্তিবর্গ এ ব্যাপারে একটু সুদৃষ্টি দেবেন কি?