JustPaste.it

ইতিহাস কথা বলে

ইবনে মাকসুদ

===================================================================

 

        মদীনার উপকণ্ঠ, সময়ের স্রোতে নিঝুম রাত আরও গভীরতর হচ্ছে। চারিদিকে ছেয়ে আছে এক স্নিগ্ধ নিঝুম নিরবতা, মুর বালীয়াড়ীর উপ্ততা ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসছে। পাশেই এক পাহাড়ের পাদদেশে বিশ্রাম নিচ্ছে যুদ্ধ ফেরৎ এক ফৌজ। মুজাহিদ সাহাবীদের অনেকেই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে। কেউ কেউ ঘুমায়নি, শুয়ে আছে। পাহারাদার মুজাহিদরা বিশ্রামরত মুজাহিদদের পাহারা দিচ্ছে যাতে শত্রু সৈন্য অতর্কিতে হামলা করে না বসে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমে পাহারারত মুজাহিদরাও ঢলে পড়ছে তন্দ্রার আবেশে। পাহারারত মুজাহিদদ্বয়ের একজন অপর জনকে বল্লো, আমরাও যদি ঘুমিয়ে পরি তাহলে আমাদের ফৌজী কাফেলার ওপর হামলার আশংকা আছে। তাই একটা উপায় হল, তুমি কিছু সময় ঘুমিয়ে নাও এবং আমি নামাজে মশগুল হই। তাহলে একসাথে দু’জন ঘুমিয়ে পরার সম্ভবনা থাকবে না। একথা বলে তিনি নামাজে দাড়িয়ে গেলেন। ওদিকে শত্রু সৈন্যের ক্ষুদ্র একটি দল রাত্রিকালীন আক্রমণের ইচ্ছায় মুজাহিদদের পেছনে ওঁত পেতে আছে সুযােগের অপেক্ষায়। মুসলিম ফৌজের অবস্থানে একটা ছায়া নড়তে দেখে তীর নিক্ষেপ করল।

 

        কোন সাড়া না পেয়ে দ্বিতীয় তীর এরপর তৃতীয় তীর মারল। সব কটি তীর গিয়ে বিধল গিয়ে নামাজরত মুজাহিদ সাহাবীর শরীরে। তারপরও তিনি অটল অবিচল নামাজে দাড়িয়ে রইলেন, তার শরীর ঝরা রক্তে শিক্ত হল পাশে শুয়ে থাকা সাহাবীর দেহ। একজন মুমিনের রক্ত ঝরবে আর তিনি শুয়ে থাকবেন একি সম্ভব? না, তিনি তখনই লাফিয়ে উঠলেন এবং কয়েকজন মুজাহিদকে নিয়ে শত্রুদের ধাওয়া করলেন। ওরা তাড়া খেয়ে উর্দ্ধশ্বাসে পালিয়ে গেলাে। আহত মুজাহিদ সাহাবীকে পরে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি তীর লাগা সত্ত্বেও কেন নামাজে মশগুল রইলেন? তিনি উত্তর দিলেন, “সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত করছিলাম, আর আমার দেহ মনে তার অপূর্ব স্বাদ ছড়িয়ে পড়ছিল, তাই নামাজ ছাড়তে ইচ্ছা হল না।” আল্লাহর পথে অনবরত গুলী বৃষ্টির মাঝে জান কবুল মুজাহিদরাই কে6৬বল এর স্বাদ অনুভব করতে পারে। এ কোন অসাধারণ কথা নয়। আল্লাহর রাহে নিবেদিত প্রাণ মুজাহিদদের এটাই প্রকৃত ইতিহাস।

 

        এ আল্লাহর সম্মুখে বিনয় অবনত মস্তকে এবাদত গুজারী এবং তাঁর ভালবাসার কি অপরূপ চিত্র! এ দৃশ্যই নবীজি (সাঃ)-এর মনে লালীত সে আকাঙ্ক্ষার বাস্তবরূপ। নবীজী (সাঃ) বলেন “তােমরা রাতের আঁধারে হবে আবেদ, আরৈলললল দিবসে যুদ্ধের ময়দানে হবে শাহসওয়ার।” আর যতদিন এ দু'টি বৈশিষ্ট্য উম্মাহর মাঝে বিদ্যমান ছিল ততদিন বিশ্বে তারা বিজয়ী ছিলেন, শিরােন্নত জাতি হিসেবে ছিলাে তাদের পরিচয়। তখন তাদের পদভারে কেঁপে উঠতে ইহুদী নাসারার অন্তরাত্মা, তাদের অশ্বের পদভারে জালিমের সিংহাসন হতে চূর্ণবিচূর্ণ। এ দুটি গুণের একটি যখন তারা হারিয়েছে তখন পরিণত হয়েছে জুলুমবাজে। বিজয়ের শিরােপা হারিয়ে দুশমনের হাতেও নিষ্পেষিত হয়েছে। অতীত ইতিহাসের বিজয় গাঁথার পাশাপাশি পরাজয়ের সে করুণ চিত্রই আমাদের সামনে পেশ করেছে। ৬ষ্ঠ খৃস্টাব্দে তাতারী হামলায় বাগদাদ নগরী পর্যদস্ত।

 

        বহু শতাব্দী ধরে তীলে তীলে গড়ে ওঠা বাগদাদের সব সঞ্চয় ও সম্পদ সম্পূর্ণ রূপে ধংশপ্রাপ্ত হয়। যেন মুসলমানদের বীরত্ব বীৰ্য শেষ হয়ে গেছে। ভয় ও শংকার সামনে হিম্মত ও প্রত্যয় ভেঙ্গে খান খান হয়েছে। ধ্বংসের এ তাণ্ডবলীলা স্বেচ্ছাচারী মুসলিম শাসক অন্যায়-আশ্রিত সমাজের দীর্ঘদিনের অপকীর্তির ফসল বই নয়। তারা কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শ বিচ্যুত হয়ে ক্রমে আয়েশ ও বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে তরবারী চালনার পরিবর্তে পারস্পরিক হানাহানিতে নিজেদের শক্তি খর্ব করেছে। ফল দাঁড়াল এই, মুসলমানরা নিজেদের গৌরবের সূর্য চেয়ে চেয়ে নীরবে ডুবতে দেখলাে। মা বােনদের আত্মলুষ্ঠিত হলাে তাদেরই সামনে। তাদের সংগৃহীত পৃথিবীর সেরা গ্রন্থাগার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাে জ্বালিয়ে দেয়া হলাে যা ছিলাে তাদের স্বাতন্ত্রিক সভ্যতা ও সাংস্কৃতির অহংকার। এ সব ধংসলীলা নিজেদের চোখের সামনেই ঘটল, কিন্তু মুসলিম উম্মাহ ও তাদের শাসককূল তার প্রতিবাদ করতেও সক্ষম হয়নি। তাদের মাঝে ভীরুতা এমনভাবে জেঁকে বসেছিল যে, তাতারীরা যদি কোন লােককে বলতাে তুমি এখানে দাঁড়াও আমি তরবারীখানা নিয়ে আসি তােমাকে হত্যা করব, সে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকত। তাতারী এসে তাকে হত্যা করত। পালিয়ে যাওয়ার সাহসটুকুও তার হতাে না। কারণ কি তা নবীজি (সাঃ) চৌদ্দশত বৎর আগেই বলে গেছেন।

 

         “যখন তােমরা জিহাদ ছেড়ে দেবে, তােমাদের ওপর আল্লাহ পাক আপতিত করবেন লাঞ্চনা।” আজকের বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ অঢেল সম্পদ ও বাধুনিক প্রযুক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের অবক্ষয় ও লাঞ্চনার কারণ এটাই যা নজীবী (সাঃ) বলে গিয়েছেন। শক্তি ও পাশবিকতায় উন্মত্ত হয়ে তাতারীরা লণ্ড ভণ্ড করে দিয়েছিল তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রাণ কেন্দ্র বাগদাদ নগরীকে। শহরের অলি গলি ভরে উঠেছিলাে তখন লাশের স্তুপে, রক্তের প্রবাহে রঙ্গীন হয়ে ছিলাে দজলা নদী। কোন অপরাধের কারণে তাদের এ করুণ দশা হলাে, যারা শতাব্দী ধরে যে ভূমি সিঞ্চন করেছিল বুকের তাজা রক্তে সে ভূমিতে তারা আজ লাঞ্চিত, অপমানিত ও ধ্বংসের মুখােমুখি দাড়িয়ে কেন? এ প্রশ্ন ছিল তখন সবার হৃদয়ে। কিন্তু যা হবার ছিলাে তা হয়েই গেলাে। একথা আমাদের জন্য যেমন দুঃখজনক তেমনি সতর্ক উপদেশ বাণীও বটে। তাদের ব্যর্থতা জেদি লেখকের কলমে চিত্রিত হয়েছে। আমাদের পথ বুঝে নিতে ওই দিনের বাগদাদের ইতিহাসই যথেষ্ট। ইতিহাসের বিদগ্ধ মুসলিম পাঠকের সামনে সে চিত্র আজো জীবন্ত হয়ে উঠে মনে প্রশ্ন তুলে কেন এমন হলাে? অতীত সােনালী ইতিহাসের পাতা মসিলিপ্ত করার জন্য কারা দায়ী? এরপর সে নিজেই বর্তমান মুসলিম উম্মাহর দিকে তাকিয়েও আশংকায় শিহরিত হয়ে উঠে, না জানি সে ব্যর্থময় অতীত আবার জীবন্ত হয়ে উঠে নাকি! হ্যা এটাই হলাে আল্লাহ পাকের অমােঘ বিধান। যে জাতী তার দায়িত্ব, স্বকীয়তা ও আদর্শ ভুলে যায় তখন তার নেতৃত্ব, স্বাধীনতাও অবশ্যই অপসারিত হয়।

 

        বাগদাদে তাতারী হামলার সম্পর্কে ঐতিহাসিক আল্লামা সাবকী বলেন, “বাগদাদে তাতারী হামলার দিন তৎকালিন খলীফা নিজ বাসভবনে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। তার কন্যা পাশেই উপবিষ্ট ছিল। এক তাতারী খলীফাকে দেখে তীর ছুঁড়ে মারলে তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বিধল শাহাযাদীর গায়ে। শাহাযাদী ঢলে পরল চীর নিদ্রার কোলে।

 

ঐতিহাসিকদের বর্ণনা খলীফা কন্যার প্রবাহিত রক্তে আপনা হতেই মেঝেতে কয়েকটি কথা লেখা হল, “আল্লাহ পাক কোন কওমকে বিপদগ্রস্থ করতে চাইলে তাদের জ্ঞানীজনের মেধা অকেজো হয়ে পড়ে, আর নিরাপরাধদের রক্তে পবিত্র মাটি রঞ্জিত হয়।” (তাবাকাতে সাবকী ৫ খণ্ড)

 

        সে সময় ধ্বংসের ধারাবাহিকতায় খলীফাতুল মুসলিমীনের স্ত্রী তাতারী বাদশাহ হালাকু খানের হাতে বন্দী হলেন, হালাকু খান তার সম্ভ্রম হরণে বদ্ধপরিকর। বেগমও যথাসময়ে এ দুঃসংবাদ পেলেন। এ দুর্যোগকালে তার সতীত্ব লুষ্ঠিত হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কারণ এর আগে হাজারাে যুবতীর সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছে। খলীফার স্ত্রী এ কথা জানতে পেরে একটা উপায় বের করলেন। খাদেমকে ডেকে তার কানে কানে কিছু বলে তিনি নিশ্চিত হলেন। হালাকু খানের প্রকোষ্টে তাকে ডাকা হলাে, তার চেহারায় কোন ভীতির ছাঁপ নেই, উপরন্তু সামনের দেয়ালে ঝুলানাে তরবারী দেখে হালাকু খানকে বললেন, ‘এটা খলীফার বিশেষ তরবারী, এটার বিশেষ গুণ হল খলীফার নির্দেশ না পেলে কারাে গায়ে একটি আচড় কাটতে পারে না। আপনার বিশ্বাস না হলে এক্ষনি তার প্রমাণ দেখাই।’ খলীফা পত্নীর কথায় হালাকু খান আশ্চর্য হয়ে উৎসাহ প্রকাশ করলেন। তিনি ঐ দাসীকে ইঙ্গিত করলে দাসী তরবারী দিয়ে বেগমের উপর প্রচণ্ড আঘাত করলাে। এ আঘাতে এ সতী নারী প্রাণ ত্যাগ করলেন। জীবনের বিনিময়ে বাঁচালেন আপন সতীত্ব। হালাকু খান নিজ ব্যর্থতা দেখে ক্রোধান্বিত হল; কিন্তু শিকার তাে হাত ছাড়া হয়ে গেছে। জাতির এ মহৎপ্রাণী নারী নিজের রক্ত ঢেলে অবলাদের সতীত্ব রক্ষার পথ বাতলে দিলেন। আর মানুষ রূপী পশুদের বলে দিলেন আমরা প্রাণ দিব, তবুও সতীত্ব দেব না।

 

═──────────────═