JustPaste.it

মুসলিম উম্মাহর চিহ্নিত দুশমন সেদিন থেকে আজ

-আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী

=================================================================

 

        ইসলাম দুশমনদের পক্ষ থেকে ঠেলে দেওয়া চরম ক্ষতিকর দু'টি বস্তুর হাতে সেদিনের মুসলমান যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি আজও মুসলিম জাতির ঐক্য ও সংহতিতে ফাটল ধরিয়ে ইসলামের প্রসার ও অগ্রগমনে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করছে। এর একটি হলো ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সেদিনের গ্রীক এবং আজকের খ্রিস্টান-পাশ্চাত্য বিশ্বের চরম বস্তুবাদী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মুসলিম দেশে অনুপ্রবেশ। সন্দেহ নেই যে, ইসলামের প্রথম নির্দেশ ছিল লেখা ও পড়ার মাধ্যমে অজানা বিষয় সম্পর্কে জানা, তথা জ্ঞান লাভ করা এবং রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের বানী মু'মিনের হারানো সম্পদ; যেই তা পাবে আহরণ করবে। মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেখানে যা পাওয়া যায় তা গোগ্রাসে আত্মস্থ করতে থাকে। এক্ষেত্রে তারা ন্যূনতম সর্তকতা ও দূরদর্শিতার দাবীমেটাতেও ব্যর্থহয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান গলী-ঘুপচীতে যে মানবীয় দুর্বলতাজনিত অজ্ঞতা ও ভ্রান্ত চিন্তাধারার অধিবাস রয়েছে, শত্রুর পেতে রাখা মরণ ফাঁদ সেখানেও ওঁত পেতে ধ্বংস কান্ড ঘটাবার অপেক্ষায় রয়েছে, মুসলমান তা ভুলে গেল ভুলে গেল এবং নির্বিচারে সকল কিছুই গ্রহণ করে চলল। ইসলামের জটিলতামুক্ত সহজ-সরল জ্ঞান-বিজ্ঞান লাভের মাধ্যমে যথেষ্ট আত্ম-সচেতন আত্মপরিচিতি লাভ করার পূর্বে বস্তুবাদী জড়িত জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাধ্যমে বদ্ধ কপাটে আঘাত হানা মুসলমানদের জন্য চরম আত্মঘাতির শামিল ছিল। গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে রোমান, পারসিক ও হিন্দু ভারতের বাতিল জ্ঞানের অনুপ্রবেশও ঐ একই সঙ্গে ঘটে। ফলে জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির স্বার্থে চিন্তাধারা ও মনমানসিকতার যে ঐক্য দরকার সেই ঐক্য বাধাগ্রস্ত হল। পরস্পর-বিরোধী চিন্তাধারা ও মতাদর্শ অনিবার্যভাবে মুসলিম চিন্তার ঐক্যে আঘাত হানল। মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরাল। তারা নানা ফির্কা ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত হল। এসব ফির্কা তাদের নিজ নিজ মতবাদের শুচিতা ও অভ্রান্ততা নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হল। আর এই সুযোগে ইসলাম-দুশমন শক্তিগুলো মুসলমানদের উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে নিল। মুসলমানরা ইসলাম বিরোধী শক্তির পদানত হল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে মুসলিম চিন্তার ঐক্যে ফাটল ধরানোর এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে বিরোধী শক্তি যে কিরূপ সক্রিয় ছিল নিম্নোক্ত ঘটনায় তার পরিচয় মিলবে।

 

        খলিফা মা'মুনের সীমাহীন জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রীতি ইতিহাস পাঠকের অজানা নয়। দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় লিখিত সকল পুস্তক আরবী ভাষায় তরজমা করিয়ে আরবী ভাষাভাষী জনগণের সামনে তিনি তা তুলে ধরেন। কনস্টান্টিনোপলের রোমক সম্রাটকে একবার তিনি সেখানে রক্ষিত গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের সকল বই পুস্তক তার নিকট পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য লিখেন। সম্রাটের এতে ইতস্তত করতে থাকায় পোপ বলেন, আপনি এখনই সেগুলো পাঠিয়ে দিন। কেননা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে এর চেয়ে বড় অস্ত্র আর নেই। ফলে তাদের অখন্ড ধর্মবিশ্বাসে একবার ফাটল ধরাতে পারলে অতি সহজেই তাদেরকে আমরা আমাদের সহজ শিকারে পরিণত করতে সক্ষম হব। সম্রাট পোপের এই উপদেশ তৎক্ষণাৎ মেনে নেন। অল্প দিনেই পোপের উক্তি সত্যে পরিণত হয়। এসব পুস্তকের অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় অখন্ড ও সংহত মুসলিম মিল্লাত শত শত পরস্পর বিরোধী ফির্কায়ে পরিণত হয় এবং শত্রুর পরিবর্তে নিজেরাই নিজেদের ভাইয়ের গলা কাটার জন্য তৈরি হয়। খলীফা মামুন এর সময় যে অস্ত্র মুসলমানদেরকে উম্মাতে মুহাম্মদী এর পরিবর্তে শীয়া-সুন্নী মাযহাবী লা-মাযহাবী, মু'তাযিলা রাফেযী প্রভৃতির দ্বন্দে ও মুসলিম ঐক্যের মূর্ত প্রতীক বাইতুল্লাহ শরীফের এক মসল্লার পরিবর্তে চার মুসাল্লা কায়েমের মাধ্যমে সতধা বিচ্ছিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেছিল। সেই একই অস্ত্র আজও মুসলিম বিশ্বকে রাজতন্ত্রী, গণতান্ত্রী, সমাজতান্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ, আঞ্চলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী, পুঁজিবাদী, সামরিক একনায়কতত্ত্ববাদী প্রভৃতি শিবিরে বিভক্ত করে রেখেছে। আজও মুসলমান ওহাবী-সুন্নী মাযহাবী লা মাযহাবী কিয়ামী লা-কিয়ামী ইত্যাদি শতবিধ দ্বন্দের শিকারে পতিত হয়ে দুর্বল শক্তিহীন জাতি হিসেবে শত্রুর নিত্য মার খাচ্ছে।

 

        ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান ও কাফির-মুশরিকদের দ্বিতীয় সফল হাতিয়ার ছিল মুসলিম অভিজাত পরিবারের বিশেষ করে শাসন কর্তৃত্বে সমাসীন পরিবারে তাদের নারীদের অনুপ্রবেশ। সম্মুখ সমরে ইসলাম ও মুসলিম শক্তির সঙ্গে এটে উঠতে না পেরে তারা এ সহজ পন্থাটি এখতিয়ার করেছে। আর মুসলিম রাজা-বাদশাহ সুলতানগণ তাদের অজ্ঞ কিংবা অজ্ঞাতসারে অমুসলিম রমনীদের তাদের মহলের ঠাই দিয়ে যেমন নিজের ঘরের খবর পরকে জানানোর সুযোগ দিয়েছেন, তেমনি জন্ম দিয়েছেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের। আর প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লাভবান হয়েছে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী শক্তিই,  ক্ষতিগ্রস্ত ও উপেক্ষিত হয়েছে ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থ। মুসলিম হারেমে নারী পাচার ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান ও অংশীবাদী কাফির সবাই যে সমান উৎসাহী ছিল এবং এর পেছনে যে রাজনৈতিক কারণ ক্রিয়াশীল ছিল তারা তাদের সাক্ষেও পাওয়া যায়। টি, এ, আর্চার ও চার্লস লিভার্জ কিংসফোর্ড জাতি সমষ্টির ইতিহাসে ক্রুসেড গ্রন্থে লিখেছেনঃ

 

        ক্রুসেড যুদ্ধের দুটি উদ্দেশ্য ছিলঃ তাহলো পবিত্র স্থান সমূহের উপর খ্রিস্টান সরকারগুলোর দখল কায়েম করা এবং ইউরোপে ইসলামের প্রচার ও প্রসারকে স্তব্ধ করে দেওয়া।

 

        এরপর তিনি লিখেনঃ

 

        "ইউরোপ সীমান্তের বাইরে পা রাখার পর ক্রুসেড নাইটরা রাজনৈতিক বিয়ে করেন যার নযির অথো ২য় (Otho) ব্যতীত আর কোথাও মেলে না। শুধু তাই নয়, সম্রাট অ্যাডওয়ার্ড ১ম কে অত্যান্ত আস্থার সঙ্গে এ পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, ইউরোপের সুন্দরী সাহাজাদীদেরকে প্রাচ্যা ভাষার জ্ঞান দান করে প্রেরণ করা হোক যাতে তাদেরকে তুর্কীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর শাসনকর্তাদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যায়। তারা ঈশ্বরের কৃপায় ও নিজেদের সৌন্দর্যের কমনীয় আকর্ষণে তাদের স্বামীকে খ্রিস্ট ধর্মে নিয়ে আসতে পারবে। যা অনেকাংশে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।

 

        তৃতীয় ক্রুসেড যুদ্ধের অন্যতম নায়ক ইংল্যান্ড রাজ সিংহ হৃদয় রিচার্ড গাযী সালাউদ্দিন আইয়ুবীর সঙ্গে উপর্যুপরি যুদ্ধেও কোনরূপ জয়-পরাজয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা পেতে ব্যর্থ হয়ে সুলতানের নিকট সন্ধির প্রস্তাব করেন এবং শান্তি ও সৌহাদ্যের নিদর্শনস্বরূপ তার বোন রূবেলকে সুলতানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মালিকুল 'আদিলের সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব নিয়েছিলেন।

 

        তুরস্কের 'উসমানীয় খিলাফতে এই ধরনের রাজনৈতিক বিয়ের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। সুলতান আওর খান সর্বপ্রথম ক্যান্টাকুযীন এর কন্যাকে বিয়ে করেন এবং তিনি তাঁর পৈতৃক ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সুলতানের মহলে অবস্থানের অনুমতি লাভ করেন। আওরখানের উত্তরাধিকারী সুলতান মুরাদ (১ম) বুলগোরিয়ার সম্রাট সীস্মান কন্যাকে বিয়ে করেন। সুলতান বায়েজীদ সার্বিয়া রাজকুমারী তানিয়াকে বিয়ে করেন। তুরস্কের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান সুলায়মান রোক্সেলেন নামক জৈনকা রাশিয়ান মহিলাকে বিয়ে করেন। এ মহিলা সুলতানের হারেমের সর্বময় কর্ত্রী হিসেবে প্রাসাদ রাজনীতিই কেবল নয়, সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে ও তাঁর অসামান্য প্রভাব খাটিয়ে নিজস্ব খাতে চালিত করতেন। ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিস্তৃত ভূভাগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসক হিসেবে অপ্রতিহত প্রভাব ও দোর্দন্ড প্রতাপের মালিক হলেও হারেমের এই কুর্ত্রীর নিকট সুলতান ছিলেন শাসিত প্রভাবহীন। রাজা করে রাজ্য-শাসন রাজারে শাসিয়েছে রাণী কবির এ কথা সুলতান সুলায়মান ও রানী রোক্সেলেন এর ক্ষেত্রে আশ্চর্য রকমের সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে।সুলতান রাণীর আঁচলে ছিলেন বন্দী। রাণী তার অপ্রতিহত ক্ষমতা ও প্রভাবকে চিরকালের জন্য সংরক্ষিত করার স্বার্থে নিজ গর্ভজাত অপদার্থ,মদ্যাসক্ত ও বিলাসী শাহযাদা সলীমকে কিভাবে সুলতান হিসাবে মনোনয়ন দেবার জন্য চক্রান্ত জাল বিস্তার করেন এবং সুলতানের মুসলিম স্ত্রীর গর্ভজাত বীরপুত্র শাহযাদা মুস্তাফাকে দুনিয়ার আলো বাতাস থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়-সাম্রাজ্যের যোগ্য উত্তরসূরি সম্ভাব্য সন্তানকে হত্যা করেন সুলতান সুলায়মান নিজে তার এই রাশিয়ান স্ত্রীর গোপন চক্রান্তের শিকার হয়ে।

 

        ঠিক একই ভাবে তিনি দ্বিতীয় পুত্র শাহযাদা বায়জীদকেও তার চার সন্তানসহ হত্যা করান। এভাবেই এই কুচক্রী মহিলা তার গর্ভজাত অপদার্থ পুত্রের সিংহাসন লাভের পথ নিষ্কণ্টক করে এবং সেই সঙ্গে উসমানীয় খিলাফতের ধ্বংসের পথও প্রশস্ত করে। শুধু তাই নয়, এই মহিলা সুলতানকে পরামর্শ দিয়ে বিরাট খিলাফতের ভাবী কর্ণধার তুর্কি শাহযাদাদেরকে সুলতানী প্রাসাদের চার দেওয়ালের মধ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করে এবং তাদের দৈহিক প্রশিক্ষণ ও রাজকার্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ থেকে দূরে রাখেন ফলে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী জীবন যাপনে অভ্যস্ত, দৈহিক শক্তিতে কমযোর এবং রাজকার্যের জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত এসব শাহজাদা নিজেদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার ঢাকতে আরো বেশি করে চার দেয়ালের মধ্যে নিজেদের বন্দি করে ফেলেন। সেইসঙ্গে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত যুদ্ধলব্ধ দাসী-বাঁদীদের সঙ্গে বিলাসী জীবন অতিবাহিত করতে শুরু করেন। এভাবে পরবর্তী সুলতানগণের অধিকাংশই জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেললেন। ইউরোপের এইসব পুরোনারীই তাদের কমনীয় সৌন্দর্যের দ্বারা রাজনীতির আসর জাঁকিয়ে বসে। আর এদের মারফত মুসলিম রাজনীতির সূতা ধরে খ্রিস্টান ইউরোপে একদা তাদের অন্তরাত্মায় কাঁপন সৃষ্টিকারী তুর্কি খেলাফতের কেন্দ্র তুরস্ককে "ইউরোপের রুগ্ন মানুষটি" পরিণত করতে সদর্পে এগিয়ে চলে। অবশেষে তারাই তাদের "মানুষপুত্রটি" কে দিয়ে যেভূখণ্ড সাত বছরের অধিককাল ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের জন্য বেদেরেগ রক্ত ঝরিয়েছে, দিয়েছে নিঃস্বার্থভাবে সীমাহীন কোরবানী, সেই ভূখন্ড থেকে ইসলামের শাশ্বত আওয়াজকে ঝোটিয়ে বিদায় করতে প্রয়াস পায়।

 

        সুলতান সুলায়মানের পূর্বসূরী সুলতান মুরাদ (৩য়)এর উপর হারেমের চার মহিলার প্রভাব ছিল সীমাতিরিক্ত। একজন ছিলেন সুলতান-ই ওয়ালেদা নুর বানু, দ্বিতীয়জন মুরাদের প্রিয়সী সুলতানা সফিয়্যা (ভেনিসের রাজকুমারী) ইনি যুদ্ধ ও সন্ধির ক্ষেত্রে অসাধারণ প্রভাব খাটাতেন। ভেনিস বহুবার যুদ্ধে উস্কানি দেওয়া সত্ত্বেও এই মহিলার কারণে তা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়নি। তৃতীয়জন ছিলেন জৈনকা হাঙ্গেরীয়ান মহিলা। ইনি বেশ কিছুদিন যাবৎ সফিয়্যার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। চতুর্থজন ছিলেন ফাসাদের সর্বময় কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন।স্পেনে ও আমরা একই ইতিহাস লক্ষ্য করেছি। স্পেন থেকে আট শত বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাস বিয়োগান্ত বিপর্যয়ের পিছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে ভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বিয়েও তো অন্যতম ছিল। শুধু স্পেন নয়, ভারতবর্ষের সাত শত বছরের মুসলিম শাসনের শেষ অধ্যায়েও আমরা ঐ ইতিহাস দেখতে পেয়েছি। হিন্দু-ভারত মুসলিম শক্তির সঙ্গে উপর্যুপরি সম্মুখ যুদ্ধের ও সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে অনুপ্রবেশ নীতি গ্রহণ করে। নিরক্ষর মোগল বাদশাহ আকবরকেই তারা উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হিসেবে বেছে নেয়।

 

        আকবরের নিজেই হিন্দু রাজপুত রমনী বিয়ে করেন এবং পুত্র জাহাঙ্গীরকে যোধপুরের রাজার পৌত্রীর সঙ্গে বিয়ে দেন। এভাবে তিনি রাজ প্রসাদ কে হিন্দু রাজপুতদের জন্য অবাধ উন্মুক্ত করেন। ফলে অল্প দিনেই মুঘল হারেমে ষড়যন্ত্রের আখড়ায় পরিণত হয়। অধিকন্তু মোগল শাহজাদাদের রক্তে হিন্দু রক্তের মিশ্রণ ঘটে এবং তাদের শৈশবের চিন্তা ও চেতনায় মায়ের মারফত কমবেশি হিন্দু ভাবধারা ও দর্শনের প্রভাব পডে। তাদের মাতৃকুলের প্রশ্রয়েও তাদের জগাখিচুড়ি মানসিকতার জন্য দায়ী হতে পারে। শাহযাদার দারা শিকুর বাস্তব জীবন ও তার লিখিত 'মাজমা'উল বাহরায়েন' এ মানসিকতার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। হিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ধারার ভেতর তাদের চিন্তার প্রতিফলন লক্ষ করে তাকে শাহজাহান পরবর্তী ভারত সম্রাট হিসেবে সমাসীন করবার মাধ্যমে নিজেদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা পুনরুদ্ধার মানসে জোর তৎপরতা শুরু করে এবং 'মাজমা'উল বাহরায়ন"এ বর্ণিত হিন্দু-মুসলিম উপজাতিগোষ্ঠীকে বৃহত্তর ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যে লীন করার সংগ্রাম চালায়। দারা শিকুর পরাজয়ের আশা ভঙ্গ ঘটলেও পুনরায় মারাঠা নেতা শিবাজীর দ্বারা তারা তাদের লালিত বাসনার সংহত প্রকাশ ঘটাতে চেষ্টা করে। বিরাট ভারতবর্ষ জুড়ে মারাঠা শক্তির উত্থান প্রচেষ্টার ভেতর হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদ লক্ষ্য করে দূরদর্শী মুসলিম চিন্তানায়ক শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রঃ) আহমদ শাহ আবদালীর মারফত সে বাসনাকে গুড়িয়ে দেন এবং ভারতের বুকে ইসলাম ও মুসলমানদের ভবিষ্যৎ শঙ্কামুক্ত করেন।

 

        পূর্বেই বলেছি ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রই মুসলিম নামধারী ব্যক্তিদের সহযোগিতাও অংশগ্রহণ ছাড়া সফল হয়নি। ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল দিয়ে ব্রিটিশ শক্তির আগমন, মীরজাফরের গাদ্দারী ও সহযোগিতা ছাড়া কেবল রাজবল্লভ, উমিচাঁদ ও ক্লাইভের পক্ষে যেমন সম্ভব ছিল না তেমনি হায়দ্রাবাদের নিজাম বিশ্বাসঘাতক সাদিকের সহযোগিতা ব্যতিরেকে তার পক্ষে এদের এদেশের বুকে সুদীর্ঘকাল টিকে থাকা ও সম্ভব ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর কেশরী সুলতান ফতেহ আলী টিপুর ব্যর্থতা ও শাহাদাতের পেছনে যেমন করীম শাহের বিশ্বাসঘাতকতা কোনদিন ভুলবার নয়। তেমনি আর এক মুজাহিদ ই আজম ভারতের বুকে প্রথম খিলাফাহ প্রতিষ্ঠাকারী সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (রঃ) দুঃখজনক পরাজয়, ব্যর্থতা ও শাহাদাত লাবের পেছনেও দূররাণী নেতা সুলতান মুহাম্মদ শাহসহ তার অপরাপর ভাই এবং হিন্দু দূর্গাধিনতি খাভী খান, বালাকোটে শের সিংহের পথ  প্রদর্শক কতিপয় গাদ্দারের ভূমিকা ও নেহাত কম নয়। বাগদাদের আব্বাসী খিলাফতের ধ্বংস সাধনে, সে সাথে পাঁছ শত বছরের সঞ্চিত মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার স্মৃতি-চিহ্ন বিনাশে ইবনে আল কারীম নাম যেমন ইতিহাস চিরদিন ঘৃনা ভরে উচ্চারণ করবে, তেমনি স্পেনের সেসব মুসলিম নামধারী কুলাঙ্গারদের ও ধিক্কার দেবে যারা আপন মুসলিম ভাইয়ের গলা কাটতে পার্শবর্তী খ্রিস্টান শক্তির দিকে সাগ্রহে হাত বাড়িয়েছে সহযোগিতার বিনিময় সেসব ভূখন্ড স্বেচ্ছায় তাদের হাতে তুলে দিয়েছে যা জয় করতে মুসলিম মুজাহিদবৃন্দরা বুকের  তাজা খুন অকাতরে ডেলে দিয়েছিলেন; বিশেষভাবে ধিক্কার দেবে স্পেনের হতভাগ্য শেষ সুলতান আবু আব্দুল্লাহকে যে স্পেনের মুসলমানদের শেষ ভরসা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও স্বাধীনচেতা তার পিতা গ্রানাডার সুলতান হাসানকে পর্যুদস্ত করতে ক্যাস্টিলের খ্রিস্টান বাদশাহ ফার্ডিন্যান্ডের দরবারে সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিল এবং বিনিময়ে একে একে বিজিত এলাকা তার হাতে তুলে দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিল।ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের ধ্বংস কামনায় আমরা ইয়াহুদী ও খ্রিস্টান জাতির বিভিন্নমুখি ষড়যন্ত্রের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযা-ই আকদাস থেকে পবিত্র দেহ চুরির ঘৃণ্য অপরাধের কথা যেমন জানি তেমনি জানি মুসলিম আরবের বুকে বিষ ফোড়া ইয়াহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে ষড়যন্ত্রের কথাও। আরও জানি যারা অন্যায় ভাবে ফিলিস্তীন থেকে মুসলিম অধিবাসীদের যুগে যুগের পৈত্রিক ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদে ইয়াহুদীদের সহযোগিতা দিয়েছে।

 

        এই খ্রিস্টান বিশ্বই এককালে ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতকে সমূলে উৎখাতের নামে মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যারা স্পেনের আট শত বছরের মুসলিম হুকুমতকে মুসলিম নারী-পুরুষ-শিশু বৃদ্ধ নির্বিচারে তলোয়ারের মুখে নিক্ষেপ করেছিল অবশিষ্টদেরকে খ্রিস্টান হতে বাধ্য করেছিল। তারাই 'লরেন্স অব অ্যারাবিয়া'র মাধ্যমে তুরস্কের ইসলামী খিলাফতের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে আরব জাতীয়তাবাদের ঢেউ তোলে বিদ্রোহের প্ররোচনা দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তারাই তুরস্ককে শত্রু পক্ষে যোগ দিতে বাধ্য করে। অবশেষে সেই অপরাধে বিশাল বিরাট তুর্কী খিলাফতকে টুকরো টুকরো করে দেয়। আজকের ইয়াহুদী, খ্রিস্টান ও ব্রাক্ষণ্যবাদীচক্র সেই একই উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তাই মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেছেনঃ "হে মুমিনগণ! তোমাদের আপনজন ছাড়া অপর কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। আর কাফিররা তোমাদেরকে ক্ষতি করতে ত্রুটি করবে না; যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে তাই তারা কামনা করে। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং তাদের হৃদয় যা গোপন রাখে তা আরো গুরুতর। তোমাদের জন্যে নিদর্শন বিশেষভাবে বিবৃত করেছি, যদি তোমরা অনুধাবন কর। (৩:১১৮)

 

*****