ধারাবাহিক উপন্যাস
মরণজয়ী মুজাহিদ-40
মল্লিক আহমাদ সরওয়ার
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অন্যান্য মুজাহিদদের নিয়ে আব্দুর রহমান বায়ের গলিতে অগ্রসর হলো। একটু অগ্রসর হলেই সামনে পড়লো এক বিশাল বাড়ী। আব্দুর রহমান আলীকে বললো, এটাই সে বাড়ী, যা অত্র এলাকায় ‘খাদ’ এর দফতর।
বাড়িটি ছিল যথেষ্ট সুরক্ষিত। ভিতরে প্রবেশ করা ছিল দুরূহ ব্যাপার। কি ভাবে ভিতরে ঢোকা যায়, এ ব্যাপারে দু'জন পরামর্শ করে ঠিক করলেন, পাশের বাড়ীর ছাদ দিয়ে ওই বাড়ীর পাচিল টপকে ভিতরে প্রবেশ করবেন। সিদ্ধান্ত ঠিক করে লাগোয়া বাড়িটির দরজায় কড়া নাড়লেন আলী। বাড়ীওয়ালা মেইন দরজা না খোলে একটি খিড়কি খুলে হাক দিলেন, কে? লোকটির হাক শুনেই আলী ধরে নিলেন, আরে এতো পাকিস্তান সীমান্ত প্রদেশের মিলিশিয়া বাহিনীর অফিসার উমর সাইয়্যাদ-তার বিশ্বস্ত বন্ধু। আলী নিজের নাম বললেন, আমি কমান্ডার আলী। দরজা খুলুন। আপনাকে ভীষণ প্রয়োজন। আলীর পরিচয় দিলে উমর সাইয়্যাদ দরজা খুলে তাদের ঘরে আসতে আহবান করলেন। আব্দুর রহমান চার মুজাহিদকে দিক নির্দেশনা দিয়ে বাইরে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রেখে বাকীদের নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন।
উমর সাইয়্যাদ এতো রাতে দলবল সহ আলীকে আসার কারণ জিঞ্জেস করলেন। জানতে চাইলেন, কমান্ডার আলী! এতো রাতে কি দরকার হয়ে পড়লো? আলী তাদের অপারেশন ও পটভূমি বিস্তারিত বললেন। উমর আলীকে সমর্থন করে বললেনঃ আলী বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সন্দেহ করছিলাম যে, এই এলাকায় কোন গুপ্ত দল ক্রিয়াশীল। আমি উর্ধ্বতন মহলে লিখিতভাবেও আমার সন্দেহের কথা জানিয়েছিলাম, কিন্তু অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তারা বললো, উদ্ভট চিন্তা না করে নিজের দায়িত্বে মনোযোগ দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমার কোন কোন বন্ধু অফিসার এও বললো যে, এ এলাকায় অধিকাংশ নিরপরাধ মুজাহিদরা থাকে। তাছাড়া এ বাড়িটি ব্যবহার করে মজলুম মুজাহিদরা। শুধু শুধু নিরাপরাধ মানুষদের ধরে এনে হয়রানী করার কোন অর্থ হয় না। এদের এসব কথা- বার্তায় সমর্থন না পেয়ে আমি আর সন্দেহটাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারলাম না।
বুঝা গেল, কতিপয় পাকিস্তানী অফিসারও এই শত্রু পক্ষের সাথে আতাত করেছেঃ আলী বললেন। উমর সাইয়্যাদ বললেনঃ স্বাধীনতা বিরোধী গাদ্দার ছাড়া নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ড বাইরের লোকেরা এসে করতে পারে না। এরাই টাকার লোভে দুশমনদের সব ধরনের তথ্য সামগ্রী সরবরাহ করে। যার ফলে শান্তিকামী মানুষের ঐকান্তিক আগ্রহ ও চেষ্টা সত্ত্বেও চোরাগুপ্তা হামলা এ পর্যন্ত বন্ধ করা যাচ্ছে না।
উমর সাইয়্যাদ মুজাহিদদের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে নিজের বন্দুক এনে দিলেন এবং ছাদের উপরে উঠে ‘খাদ’ দফতরে হানা দেয়ার সম্ভাব্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দিক নির্দেশনা দিলেন।
উমর সাইয়্যাদের সহযোগিতার ফলে অনায়াসে মুজাহিদরা ছাদ টপকে ‘খাদ’ দফতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হলেন। এখানে কেউ হানা দিতে পারে এ ব্যাপারে দুস্কৃতিকারীরা ছিল সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত। যার ফলে এরা সার্বক্ষণিক কোন পাহারাদার নিযুক্তির প্রয়োজন বোধ করেনি। নিশ্চিন্তে সবাই ঘুমিয়েছিল। আর ঘুমের মধ্যেই ওরা সব আব্দুর রহমান ও আলীর হাতে ধরা পড়লো। দুষ্কৃতিকারীদের দল নেতা আফগান কম্যুনিষ্ট সরকারের সেনা অফিসার মেজর গুলখানও ধরা পড়লে এদের হাত পা বেঁধে সারা ঘর তল্লাশি করা হলে, একটি শক্তিশালী ওয়ারলেস সেটসহ অনেকগুলো ওয়াকিটাকি, হাত ও টাইম বোমা, বোমা তৈরীর সরঞ্জাম, গোলাবারুদ, অস্ত্র, আফগান মুজাহিদ স্থাপনা ও পাকিস্তানী সামরিক স্থাপনার নক্সা, খাদের নীল নক্সার লিটারেচার, রিভালভার এবং হিরোইনের বিরাট মওজুদ ওদের ঘরে পাওয়া গেল। ওয়ারলেস সেটটি ছিল এমনই শক্তিশালী যে পাক সরকারী ইনফরমেশন ফাকি দিয়ে অতি সহজেই কাবুল পর্যন্ত খবর অনায়াসে পৌছাতে ওদের কোন বেগ পেতে হতো না।
আলী ওদের প্রণীত পরিকল্পনায় চোখ বুলিয়ে দেখলেন, এতে পাকিস্তান শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে পরস্পরে বিরোধ সৃষ্টির পরিকল্পনাও রয়েছে। এ থেকেই বোঝা গেল, ওরা পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নী দাঙ্গা সৃষ্টির অন্তরালেও সক্রিয় রয়েছে।
আব্দুর রহমান চারজন মুজাহিদকে এখানে থাকতে বললেন, যাতে সকালে বাড়ীটি আরো ব্যাপক তল্লাশি করে দেখা যায় কোথাও লুকানো গোপন গোলা-বারুদ ও অস্ত্র আছে কিনা।
উমর সাইয়্যাদ কয়েদীদের মুজাহিদ দফতরে পৌঁছানোর জন্য নিজের গাড়ী দিয়ে সহযোগিতা করলেন। আলী উমর সাইয়্যাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপাততঃ পাক সরকারী কর্তৃপক্ষকে আমাদের অপারেশন সম্পর্কে অবহিত না করাই ভালো হবে। সরকারী কর্তৃপক্ষ জেনে ফেললে, এদের ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য রাজনৈতিক চাপ আসতে পারে, তখন সকল আয়োজনই পন্ড হয়ে যাবে।
উমর সাইয়্যাদ আলীর সাথে একমত হলেন। মুজাহিদ দফতরে নিয়ে সব বন্দীকে একটি কামরায় আটকে রাখা হলো। ইত্যাবসরে চা পান করতে করতে আব্দুর রহমান আলীকে বললো, গত কদিন যাবত আসফ খানের উপর আমার সন্দেহ হচ্ছিল। সন্দেহকে নিরীক্ষা করে দেখার জন্য আমি ওর গতিবিধি ও বাসস্থানের উপর গভীর দৃষ্টি রাখছিলাম। যে এলাকায় সে থাকে, সেখানকার এক প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ মুহাজির আসফের কর্মকান্ডে সন্দিহান ছিলেন। অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম, আসফের স্ত্রী ছিল কাবুল ইউনিভার্সিটির সাবেক ছাত্রনেত্রী! সে ছাত্রাবস্থায় কম্যুনিষ্ট সরকারের পক্ষে নেতৃত্ব দিত। সে কাবুলে ফেরার হওয়ার খবর প্রচার করে এখানে এসে আসফকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে। সে পড়া-শুনা করা কালীন সময়েই খাদের বেতনভোগী কর্মচারী ছিল। আসফকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য ছিল মুজাহিদ হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত পৌঁছার পথ সুগম করা। আসফ একজন নিষ্ঠাবান মুজাহিদ হওয়ার পরও ওর তৈরী ফাদে ফেঁসে যায় এবং এক সময় উচ্চ অর্থের টোপ গিলে সেও খাদের সদস্য হয়ে যায়। স্ত্রীর সুপারিশে খাদ কর্তৃপক্ষ আসফকে অফিসার পদে নিযুক্ত করে। বর্তমানে পাকিস্তানে তাদের যে কয়টি অফিস আছে, তন্মধ্যে এটি অন্যতম। আসফ, তার স্ত্রী ও মেজর গুলখান খাদের অফিসার। তন্মধ্যে আসফের স্ত্রী খাদের বড় অফিসার।
সীমান্ত এলাকায়ই পঞ্চাশের বেশী এদের বেতনভুক্ত চর আছে। তা ছাড়া সারা পাকিস্তানে রয়েছে হাজার হাজার অনুচর।
লাগাতার কয়েকদিন অনুসন্ধান করার পর গ্রেফতার শেষে ওদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি ও তথ্য বের করতে আমাকে অবশ্য কঠিন পন্থাই গ্রহণ করতে হয়েছে। সাধারণতঃ 'খাদ' প্রতিপক্ষের কাছ থেকে তথ্য জানার জন্য যে পন্থা অবলম্বন করে, আমি এদের ব্যাপারে তাই প্রয়োগ করেছি। এরা যে ধরনের কঠিন শক্র, এদের মুখ খোলাতেও এমন কঠিন পন্থা অবলম্বন করা ছাড়া গতি ছিল না।
চা পান শেষে মেজর গুলখানকে জিজ্ঞাসাবাদের কামরায় নিয়ে আসা হলো। অনেক চেষ্টা করার পর তার মুখ খুললো এবং সে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল। এ ভাবে প্রত্যেক বন্দীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর এদের দেয়া তথ্য একটি রেজিষ্টারে রেকর্ড করা সহ সাথে সাথে টেপও করা হলো।
বন্দীরা শহর ও শহরতলীর যে সব এজেন্টের নাম প্রকাশ করলো, এদের গ্রেফতার করার জন্য কয়েকটি মুজাহিদ দল রাতেই পাঠানো হলো। অধিকাংশ অনুচরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হলেও কিছু সংখ্যক পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। আর যে সব এজেন্ট শহরের বাইরে অবস্থান করে এবং সরকারী চাকুরীতে নিযুক্ত, এদের লিষ্ট তৈরী করে পাকিস্তানী সরকারী কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো।
অপারেশন শেষ হওয়ার পর আলী আব্দুর রহমানকে বললেন, তুমি অবশিষ্ট এজেন্টদের গ্রেফতার শেষ হলেই ওদের নিয়ে আফগানিস্তানে চলে যাবে। অন্যথায় পাক সরকারী কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি জেনে গেলে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই হেড কোয়ার্টারে পৌঁছবো।
আব্দুর রহমান প্রায় দুপুরে ঘুম থেকে উঠল। ইতিমধ্যে আরো ডজন খানিক খাদ এজেন্টকে গ্রেফতার করে মুজাহিদরা নিয়ে এলো।
তাহেরা এবং খলিল আব্দুর রহমানের বিস্ময়কর গোয়েন্দা অপারেশনে খুব খুশী হলো। খলিল আব্দুর রহমানকে বললোঃ ভাইজান! আমি বলছিলাম না, দেখবেন আপনার সময়ও কেটে যাবে, গুরুত্বপূর্ণ কাজও হবে। এখন তো আমার কথাই সত্যি হলো, সময় তো আপনার কাটলোই, বিরাট কাজও করে ফেললেন।
হ্যাঁ ভাই! এ কাজের সকল কৃতিত্ব তোমার। তুমি না বললে এ ভাবনা আমাদের মাথায় আসতো না। আব্দুর রহমান খলিলকে উৎসাহিত করার জন্য এ কথা বললো।
আসরের সময় আব্দুর রহমান তাহেরা ও তার মায়ের কাছে আফগানিস্তান ফিরে যাওয়ার কথা জানাল। হঠাৎ করে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তাহেরা খুব বিচলিত ও মর্মাহত হলোঃ স্বভাবগত অনুরোধ করে বললো, ভাইজান! আর কয়েকটা দিন থেকে যান।
আব্দুর রহমান তাহেরাকে এখন আফগানিস্তান যাওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনের কথা বিস্তারিত বললো। তাতে তাহেরা আর বাধা দিতে পারলো না। কিন্তু তবুও বললোঃ রণাঙ্গনে গিয়ে আমার কথা ভুলে যাবেন না; যখনই সুযোগ পাবেন, অমনি সোজা এখানে চলে আসবেন। আমরা আপনার সার্বিক মঙ্গল ও সফলতার জন্য সব সময় দোয়া করবো।
আসফের স্ত্রীসহ খাদ-এর গ্রেফতারকৃত সব বন্দীদের কয়েকটি সামরিক ট্রলিতে করে একদল মুজাহিদের প্রহরায় আব্দুর রহমান আফগান হেড কোয়ার্টারে নিয়ে এলো। আব্দুর রহমান খলিল ও আলীর অপারেশনের বিবরণ শুনে চীফ কমান্ডার খুব খুশী হলেন আর তাদেরকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করলেন এবং বললেন, তোমাদের এ অপারেশন মুজাহিদদের সাফল্যের মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
কয়েকদিন পর আলী হেড কোয়ার্টারে পৌঁছলেন। চীফ কমান্ডার আলী ও আব্দুর রহমানের পরামর্শে মুজাহিদদের মধ্যে শত্রুপক্ষের অনুচর অনুপ্রবেশ রোধ ও ওদের দুষ্কৃতি প্রতিরোধে তাদের গোয়েন্দা শাখা পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
আলী ও আব্দুর রহমান এক সপ্তাহ হেডকোয়ার্টারে কাটিয়ে নিজ ক্যাম্পে রওয়ানা হলেন।
নিজ ক্যাম্পে পৌছালে আলীকে দেখা মাত্র মুজাহিদরা ফাকা গুলী ছুড়ে আলীর প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানাল এবং নারায়ে তাকবির ধ্বনিতে পুরো ক্যাম্প মুখরিত করে তুললো।
আলী সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে অফিসে গিয়ে বসলে ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার দরবেশ খান আলীকে বিগত এক মাসের কার্যক্রমের বিবরণ দিল। আলী দরবেশ খানের কার্যক্রম শুনে অত্যন্ত খুশী হলেন। আলীর সাথে প্রয়োজনীয় কথা শেষে দরবেশ খান আব্দুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, ভাই আব্দুর রহমান মাফ করবেন, শুরুতেই আপনাকে একটা খবর জানাতে ভুলে গেছি। দু' সপ্তাহ আগে রাশিয়া থেকে যুবাইদা নামের এক তরুণী এখানে এসেছিল। ও বললো যে, সে আত্মীয় সূত্রে আপনার পরিচিত এমনকি ফুফাতো বোন। আমরা তাকে মেহমান খানায় রেখেছি।
আলী ও আব্দুর রহমান যুবাইদার আগমনে চিন্তিত হলেন। উভয়েই তাড়াতাড়ি মেহমান খানার দিকে পা বাড়ালেন। যুবাইদা তাদের দেখে প্রথমে অত্যন্ত আনন্দিত এবং পরক্ষণেই বিমর্ষ হয়ে কাঁদতে লাগলো। আব্দুর রহমান যুবাইদার অবস্থা দেখে-অমঙ্গল চিন্তায় উদ্বিগ্ন হলেন। ভাবলেন অবশ্যই কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। না হয় যুবাইদা এখানে একাকী আসতো না। আর শুধু আমার জন্যে যুবাইদা দেশ ত্যাগ করলে আমাকে পেয়েও কান্নার কথা না।
আলী যুবাইদাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ‘যুবাইদা! লক্ষী বোন, ধৈর্য্য ধর, বল কি কারণে হঠাৎ তোমাকে একাকী এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে?' যুবাইদা নিজেকে শান্ত করে কিছুক্ষণ পর বললো, 'আপনারা আসার দু'সপ্তাহ পরই মামা ও মামীকে কেজিবির গেয়েন্দারা ধরে নিয়ে গেছে। জানি না কেমন করে কেজিবি আপনাদের সম্পর্কে জানতে পারলো।
দু' সপ্তাহ পর্যন্ত মামা মামীর সাথে কাউকে দেখা করতে দেয়নি। দু সপ্তাহ পর্যন্ত জানার উপায় ছিলনা যে তাদের কোথায় রেখেছে। অনেক সুপারিশ ও টাকা খরচ করার পর আব্বু দু’সপ্তাহ পর তাদের অবস্থান জানতে পারেন।
আমি যখন জেলখানায় তাদের দেখতে যাই তখন দেখেছি অত্যাচার ও নির্যাতনে তাদের শরীর খারাপ হয়ে গেছে। মামার ডান হাতের হাড় পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেলেছে। মাত্র দু'সপ্তাহে তাদের ওপর এমন জুলুম অত্যাচার করেছে যে, প্রথমে মামাকে আমি চিনতেই পারিনি। মামার সাথে বেশী কথা বলতে ওরা আমাকে সুযোগ দেয়নি। মামা কঠোর পাহারাদারীর মধ্যেও আমার কানে কানে বললেন, মা তুমি আব্দুর রহমানের কাছে চলে যাও, এখানে তোমার ভবিষ্যত নিরাপদ নয়। মা, এই কেজিবি বন্য জানোয়ারের চেয়েও আরা বেশী হিংস্র, অসভ্য। আমি মোটেও ভাবতে পারিনা যে, ওদের নাপাক অত্যাচারের হাত তোমার পবিত্র শরীর স্পর্শ করুক। শেষে মামা বললেন, তুমি আগামী পরশু আবার আসবে, আমি তোমাকে আফগানিস্তানে পৌঁছার গাইড লাইন জানিয়ে দেব।
একদিন পর তিন চারজন কম্যুনিষ্ট নেতার সুপারিশের পর আমি মামার সাথে সাক্ষাত করতে গেলাম। কড়া প্রহরাধীনে মামা আমার সাথে ফ্রি কথা বলার সুযোগ পেলেন না। মামা শুধু আমার কানে কানে বললেন, মা তুমি আফগানিস্তান গিয়ে আব্দুর রহমানকে আমাদের শুভাশীষ জানিও এবং বলল আমাদের গ্রেফতারী ও শাহাদাতে যেন ও অশ্রু না ফেলে। বরং অর্পিত দায়িত্ব এবং জিহাদী মিশন যেন অব্যাহত রাখে। বিচলিত হয়ে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সুষ্ঠু ভাবে কাজ করে।
এরপর মামা আমার কানে কানে একটি ফোন নাম্বার জানালেন। বললেন, এই নম্বরে মাহমূদ বুখারীর সাথে যোগাযোগ করবে। মাহমূদ বুখারীকে বলবে, তোমাকে আইয়ুব বুখারী ও ইসমাইল সমরকন্দীর কাছে পৌঁছে দিতে। ইসমাইল সমরকন্দীকে বলবে, তিনি যেন আফগানিস্তানের আহমদ গুল খানের কাছে তোমাকে পৌঁছে দেন।
আমি মামার দেয়া ফোন নাম্বার ও নামগুলো মুখস্ত করে নিলাম এবং কারাগার থেকে বেরিয়ে নিরাপদ জায়গায় এসে সাংকেতিক ভাবে ফোন নম্বর ও নামগুলো নোট করে নিলাম। অতঃপর এদিনই আমার এক বিশ্বস্ত বান্ধবীর ঘর থেকে মাহমুদ বুখারীকে ফোন করলাম এবং টাউন পার্কে বিকেলে মিলিত হওয়ার সময় নির্ধারণ করলাম।
সাক্ষাতে আমি মাহমূদ বুখারীকে পুরো পরিস্থিতি জানালাম। তিনি বললেন, আমার জানা মতে কেজিবি তোমাদের পরিবারের পিছনেও লেগেছে। ওরা তোমাদের প্রতি নজর রাখছে, যে কোন সময় তোমাকে গ্রেফতার করতে পারে। কাজেই আগামী কাল তুমি আমাকে কোন ফোন করোনা, অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে আমিই তোমার সাথে যোগাযোগ করবো।
এক সপ্তাহ পর একটি ছোট্ট বালক একটি প্যাকেট নিয়ে আমাদের বাড়ী এলো। প্যাকেটটি পোস্ট অফিস হয়ে আসেনি দেখে আমার সন্দেহ হলো। আমি আমার কামরায় নিয়ে প্যাকেটটি খুললাম। দেখতে পেলাম প্যাকেটে এক সেট নতুন কোট প্যান্ট। আর একটি চিরকুটে লেখা ‘আগামী কাল সকাল সাতটায় সিটি হোটেলের কাছে।
গভীর রাত পর্যন্ত আব্বা আম্মার সাথে আমি কথা বলছিলাম। কথায় কথায় আমি আব্বাকে বললাম, “শুনলাম কেজিবি নাকি আমাদের গতিবিধি সেন্সর করছে আব্বু?” আব্বু বিচলিত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, একথা তোমাকে কে বললো?
বললাম, আমাকে যেই বলুক আপনি বলুন কথাটি ঠিক না মিথ্যা?
বেটী! কথা সম্পূর্ণ ঠিক। কেজিবির সন্দেহ আব্দুর রহমান এখানে আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তুমি জানো। আব্বার কথায় আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে ওরা আমাকে গ্রেফতার করছেনা কেন?
বেটী! তোমাকে গ্রেফতার করার পথ বন্ধ করার জন্যে সম্ভাব্য সব চেষ্টা করেছি, কিন্তু মা! কেজিবি এমন ধূর্ত যে, ওরা আমাকেও সন্দেহ করতে শুরু করেছে। বেটী! রাশিয়ায় বসবাস করা বিষাক্ত সাপের সাথে বসবাস করার মতো। সাপের যতো সেবা যতই করোনা কেন, সুযোগ পেলে ওরা ঠিকই ছোবল মারবে। আমার নিজের জীবন নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই বেটী। তোমার নিরাপত্তা নিয়েই আমার যতো ভাবনা। কখন ওরা তোমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় জানা নেই।
আব্দুর রহমান যখন এসেছিল তোমাদের উচিত ছিল আমাকে অবগত করানো, তাহলে আমি তোমাকে আব্দুর রহমানের সাথে পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, তোমরা কেউ আমাকে বিশ্বাস করতে পারোনি। আমি কম্যুনিষ্ট বটে, তবে তোমার আর আব্দুর রহমানের শত্রু নই। তোমরা আমাকে অবিশ্বাস না করলে আজ তোমার মামা মামীর এ দুরবস্থা হতো না। মুজাহিদদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে তাদের কারাগারের অন্ধ কুটিরে যেতে হতোনা।
‘আমার ভাইয়ের না হয় ভুল হয়ে গেছে কিন্তু এখন আমার মেয়ের জীবন বাঁচাতে তো একটা কিছু করবে?’ উদ্বেগের স্বরে বললেন আম্মু।
আব্বু হতাশা ব্যক্ত করে বললেন, ‘খুবই কঠিন কাজ। আমি সম্ভাব্য সকল চেষ্টাই করেছি। জানো, রাশিয়ায় নামমাত্র মুসলমান হওয়াও অমার্জনীয় অপরাধ। রুশ সরকার কোন তুর্কিদের বিশ্বাস করেনা। তুর্কীদের সামান্য ত্রুটিকেও ওরা রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করে। রুশরা মনে করে তাদের আচরণে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে এবং যে কোন সময় মুসলমানরা রাশিয়ায় আফগানদের মতো অভ্যন্তরীন জিহাদ শুরু করতে পারে।
আমি বললাম, 'আব্বু, যদি রাশিয়ায় অভ্যন্তরীণ জিহাদ শুরু হয়ে যায় তবে আপনি কার পক্ষাবলম্বন করবেন, রুশ কম্যুনিষ্টদের না মুজাহিদদের? আবু বললেন, “বেটী নিজ দেশের কোন বিকল্প নেই। আজ আমরা স্বাধীন থাকলে তোমার মামা মামীর এ করুণ অবস্থা কখনও হতোনা।
জীবনভর রাশিয়ার পক্ষে খাটলাম, শেষ ভাগে শুধু সরকারের কাছে একটি মাত্র আর্জি করলাম আর তখনই আমাকে বলা হলো যে, মনে হয় তুমিও মুজাহিদদের পক্ষে। যদি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, অবশ্য স্বাধীনতা যুদ্ধ অনতিবিলম্বেই শুরু হবে, তবে অবশ্যই আমি মুজাহিদদের পক্ষে কাজ করবো।” (চলবে)
ভাষান্তরঃ শহীদুল ইসলাম