JustPaste.it

---আমরা যাদের উওরসুরী--- 

===============================
বরেণ্য মুরব্বী ও বুযুর্গ আলিম মাওলানা আব্দুল আজিজ (রহঃ)
আব্দুর রহীম ইসলামাবাদী
------------------------------------------★


দেশের খ্যাতনামা আলেম, ইসলামী শিক্ষাবিদ ও বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব এবং গােপালগঞ্জ জেলার গওহর ডাঙ্গা খাদেমুল ইসলাম মাদ্রাসার মুহতামীম হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ ছাহেব (রহঃ)। গত ১৭ই সেপ্টেম্বর '৯৪ইং শুক্রবার গওহরডাঙ্গায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ----রজিউন।  মৃত্যুকালে তাহার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। মরহুম মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেব (রহঃ) ১৩০৯ বাংলা সনে পিরােজপুর জেলার নাজিরপুর থানার অন্তর্গত চৌঠাই মহল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম মুন্সী মুফিজ উদ্দীন। তিনি শর্ষিনার পীর হযরত মাওলানা নেছার উদ্দীন সাহেবের (রহ) প্রতিষ্ঠিত শর্ষিনা দারুচ্ছুন্নাৎ আলীয়া মাদ্রাসা থেকে জামাতে উলা পাস করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তার মুজাহীদে আজম হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ)-এর সাথে দ্বীনি সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং তিনি হযরত ফরিদপুরী (রহ)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। হযরত মাওলানা আবদুল ওহাব পীরজী হুজুর (রহ), হযরত মাওলানা মােহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) ও হযরত মাওলানা সাহারানপুর ও থানাভবন থেকে যাহিরী ও বাতেনী শিক্ষা সমাপন শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে শামসুল হক ফরিদপুরী (রহঃ) আত্মনিয়ােগ করেন। এ সময় খুলনার গজালিয়ায় একখানা দ্বীনী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন তারা। মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেবও এর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন। মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেব (রহ) তখন হযরত ফরিদপুরী সাহেব (রহ) ও অন্যান্যদের কাছে গজালিয়া মাদ্রাসায় হাদীস শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। মুরুব্বীগণ গজালীয়া ছেড়ে চলে আসার সময় হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেবকে মাদ্রাসাটির দায়িত্ব দিয়ে আসেন। তিনি মাদ্রাসাটি পরিচালনা করতে থাকেন। এক সময় হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ) নিজ এলাকায় একখানা দ্বীনী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করার জন্য মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেবের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়ে। তিনি তাকে গওহরডাঙ্গা এসে খাদেমুল ইসলাম মাদ্রাসাকে গড়ে তােলার আহ্বান জানালে মাওলানা আবদুল আজিজ মরহুম এতে রাজি হন এবং গওহরডাঙ্গায় এসে মাদ্রাসার মুহতামীম এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই থেকে ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সুদীর্ঘ ৫৭ বছর কাল গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মুহতামীম হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। একটি প্রাথমিক স্তরের মাদ্রাসাকে দাওরায়ে হাদীস (টাইটেল) মাদ্রাসায় উন্নীত করার এবং একে অর্ধশতাধিক বছর কাল দক্ষতার সাথে পরিচালনা করার ব্যাপারে মরহুম যে অবদান রেখেছেন তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দক্ষিণ বাংলায় তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে শত শত মাদ্রাসা। অসংখ্য মাদ্রাসা পরিচালনার ব্যাপারেও তার যথেষ্ট সহযােগিতা ও অবদান ছিল। গওহরডাঙ্গা আজ দেশের এক শীর্ষস্থানীয় ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র। হাদীস, তাফসীর, ফেকাহ প্রভৃতির দরস হচ্ছে সেখানে। গাওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা ও মরহুম সম্পর্কে বিখ্যাত লেখক আলেম মাওলানা নূর মােহাম্মদ আজমী লিখেছেনঃ “মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ)-র পৃষ্ঠপােষকতায় গওহরডাঙ্গা খাদেমুল ইসলাম মাদ্রাসা ১৩৪৪ বাংলা মােতাবেক ১৯৩৭ ইংরেজী মধুমতি নদীর অদূরে স্থাপিত হয় এবং ১৩৬৫ বাংলা মােতাবেক ১৯৪৯ ইংরেজী উহাতে হাদীস শিক্ষা আরম্ভ হয়। মােহতামীম মাওলানা আবুল আজীজ সাহেবের আপ্রাণ চেষ্টায় মাদ্রাসাটি দ্রুত উন্নতি করিয়া চলিয়াছে।” (দ্রঃ হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাস-পৃঃ ৩৮৭) হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ) এর পৃষ্ঠপােষকতা এবং হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেবের পরিচালনায় গড়ে উঠা বিশাল ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র। গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা থেকে উত্তীর্ণ শত শত আলেম, হাফেজ, ক্বারী আজ দেশে বিদেশে ইসলামের বহুমুখী খেতমদ আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। শত শত আলেম মুহাদ্দেস, মুফতী, ইমাম প্রভৃতি তৈরী করে মরহুম সদকায়ে জারীয়ার যে অবিরত ধারা উদ্ভোধন করে গেছেন তা দ্বারা কেয়ামত পর্যন্ত কবরে শুয়ে শুয়ে তিনি সওয়াব লাভ করবেন। দুনিয়ায় মানুষের হাজারাে উপকারের মধ্যে সবচেয়ে বড় উপকার হলো কাউকে আলেমে দ্বীন রূপে তৈরী করে দেয়া । অসংখ্য গরীব, মিসকিন, এতিম সন্তানকে দ্বীনি এলম অর্জনের সুব্যবস্থা করে দিয়ে মরহুম যে অবদান রেখে গেছেন তা কখনও ভুলা যাবে না। ইতিহাসে এ নাম চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। একটি দ্বীনি মাদ্রাসা কিভাবে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হয় তার দিক নির্দেশনা লাভ করা যেতে পারে হযরত মাওলানা মরহুমের জীবন থেকে। আদর্শ প্রশাসক ছিলেন তিনি। মুসলমানরা তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান মাদ্রাসা পরিচালকদের হাওয়ালা করে থাকেন। এর সুষ্ঠু ব্যবহার করাই মাদ্রাসা পরিচালকদের প্রধানতম দায়িত্ব । মরহুম এ ব্যাপারে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন জনগণের সম্পদ যেন অপচয় না হয়, আলাহর বান্দাগণের কলিজার টুকরাে সন্তান যাতে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে সে ব্যাপারে মরহুমের সদা সতর্ক দৃষ্টি থাকত। হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ) একজন বিশিষ্ট আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ, ইসলাম প্রচারক এবং ওয়ায়েজ হওয়ার সাথে সাথে একজন বিশিষ্ট পীরে কামেলও ছিলেন। দেশে তাঁর বহু মুরিদ ও মুতাকিদ রয়েছে । তিনি হযরত মাওলনা শাসমুল হক ফরিদপুরী (রহ) ও হযরত মাওলানা মােহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ) এর অন্যতম খলীফা ছিলেন। তিনি ইন্তেকালের পূর্বে হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক সাহেবের বিশিষ্ট খলীফা হযরত মাওলানা হাকিম মােঃ আখতার সাহেবের কাছ থেকেও খেলাফত লাভ করেন। মােহাজেদে আজম হযরত মাওলনা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ)-এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী অরাজনৈতিক সংগঠন "খাদেমুল ইসলাম জামাতের" পরিচালনার ব্যাপারেও মরহুমের বিরাট ভূমিকা ছিলো। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি খাদেমুল ইসলাম সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইসলামের প্রচার, প্রসার এবং খেদমতে খালকের ব্যাপারে তার উৎসাহ ছিলাে উল্লেখ করার মত । তিনি ছিলেন মানুষের কল্যাণকামী, দরুদী এবং একজন যথার্থ মুরব্বী। সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথেও তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পাকিস্তান আমলে হযরত মাওলানা আতহার আলী সাহেব (রহ), হযরত মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন, খতীবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ সাহেব (রহ) প্রমুখ কর্তৃক পরিচালিত নেজামে ইসলাম পার্টির ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। আইয়ুব খানের আমলে মুসলিম পারিবারিক আইন পরিবর্তন, জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রভৃতি চাপিয়ে দেয়া ইসলাম বিরােধী সরকারী পদক্ষেপ সমূহের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনেও তার ভূমিকা ছিল কৃতিত্বপূর্ণ ! যে কোন শরীয়ত বিরােধী কার্যকলাপের তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ইসলামী বিধি বিধান প্রতিষ্ঠা হােক সব সময় তিনি তা চাইতেন । এ লক্ষ্যে তার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব তা তিনি করতেন। ১৯৮১ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ) তওবার ডাক দিয়ে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার দাবীতে নির্বাচনী জিহাদে ঝাপিয়ে পড়লে মরহুম মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেব (রহ)-ও এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুরের (রহ) সাথে বহু সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এবং আল্লাহর জমিনে আলাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ছিলেন। বাংলাদেশে ইসলামী সাহিত্যের প্রচার প্রসারের ব্যাপারেও তাঁর বিশেষ উৎসাহ ছিল। যারা এর সাথে নিবেদীত প্রাণ তাদেরকে তিনি উৎসাহ দিতেন । ঐক্যবদ্ধ ভাবে ইসলামী আন্দোলন গড়ে তােলার জন্যও সকলের প্রতি তার পরামর্শ ছিল । আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা বিশ্বাসকে তিনি ঐক্যের পূর্বশর্ত বলে মনে করতেন। কয়েক বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত “সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায়ও তার উৎসাহ ও প্রেরণা বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি যেখানে যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন সে অনুষ্ঠানের সভাপতির পদ লাভ করতেন। তিনি তার বয়স, ইলম, হিলম, তাকওয়া পরহেজগারীতে সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। দক্ষিণ বঙ্গে তার ন্যায় ব্যক্তিত্ব ছিল বিরল । ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি উম্মতে মােহম্মদীর কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। মরহুম একজন আবেদ ও জাহেদ ব্যক্তি ছিলেন । তার তাহাজ্জুদ নামায পর্যন্ত কাযা হতে দেখা যেত না। তিনি পবিত্র হজ পালন করেন এবং কয়েকটি দেশ সফর করেন। যে কোন সমস্যার সমাধান ও প্রশ্নের জবাব তিনি দিতে পারতেন খুব সহজে। আল্লাহ পাক তাকে এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রজ্ঞা দান করেছিলেন । দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও আল্লাহর উপর ভরসা ছিল তার পথ চলার পাথেয়। সুন্নতের উপর চলতে সচেষ্ট ছিলেন বরাবরই । আকাবির, ওলামা ও বুযুর্গদের প্রতি তাঁর ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল উল্লেখ করার মত । আল্লাহ্ পাক তাকে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা নসীব করুন। আমিন। হযরত মাওলানা আবদুল আজীজ সাহেব (রহ) আজ আমাদের মাঝে নেই। তার পয়গাম কি আজ আমাদের-জন্য? আমাদের মতে তাঁর পয়গাম হলাে, দেশের ৬৮ হাজার গ্রামে কুরআনী মক্তব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দ্বীনি শিক্ষার আলাে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। অসহায় দুঃস্থ মানুষের কল্যাণ করতে হবে, করতে হবে খেদমতে খালক। ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে আল্লাহর হুকুম এবং নবী করীম (সাঃ)-এর সুন্নাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতেই জনগণের মুক্তি। এ লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্যে আজীবন তিনি সচেষ্ট ছিলেন। আমরাও একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সচেষ্ট হই, আল্লাহর সন্তোষ লাভে মনােযােগী হই, এটাই পয়গাম তার ।