JustPaste.it

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

মরণজয়ী মুজাহিদ-43

মল্লিক আহমাদ সরওয়ার

 

            ক্যাপ্টেন আব্দুস সাত্তার সমমনা কয়েকজন মুজাহিদ অফিসার নিয়ে আলীর মুখোমুখি হয়ে বললেন, আপনার পক্ষ থেকে হামলার খবর পেয়ে কয়েকজন মুজাহিদ সমর্থক সেনা অফিসার কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। তারা আপনাদের আক্রমণ শুরু হবার পর সরকারী বাহিনীর মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টিতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। রাত বারোটার সময় আমরা কয়েকজন নেতৃস্থানীয় আফগান অফিসার, রুশ জেনারেল ও কর্মকর্তাদের বললাম যে, অবস্থা বেশী ভালো দেখা যাচ্ছেনা, আপনারা নিরাপদ স্থানে চলে যান আমরা মোকাবেলায় কোন ত্রুটি করবোনা। এভাবে শীর্ষ কমান্ডদাতাদের সদর দফতর থেকে সরিয়ে দেয়ার পর অধঃস্তন রুশ অফিসাররা ভীত হয়ে পালাতে শুরু করে।

               ক্যাপ্টেন আব্দুস সাত্তার আরও বললেন, জিয়াউল হক এর শাহাদাতের খবর পেয়ে নজিবুল্লাহ সরকারের সেনাবাহিনী ও রুশ সৈন্যরা আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। রাতব্যাপী শহরের সব খানে মদ্যপ মাতালদের হৈ হুল্লোড় বেলেল্লাপনা নাচ গান চলে। কম্যুনিস্টদের আমি ইতিপূর্বে কখনও এতো আনন্দ উৎসব করতে দেখিনি। জিয়ার মৃত্যুতে মুজাহিদ সমর্থক সিপাহী অফিসারদের সামনে ঘোর অমানিশা নেমে আসে, অনেকে রাতভর দু’আ করেছে, ভবিষ্যতের দুঃশ্চিন্তায় কেঁদে রাত কাটিয়েছে। আর কমুনিস্টরা জিয়ার মৃত্যুতে বিজয় উৎসব ও মদ-মাতলামীর উন্মত্ততায় মেতে ওঠে।

            মুজাহিদদের পরিকল্পনা ছিল সম্মুখ সমরে পলায়নপর কুচক্রী রুশ বাহিনী চক্রান্তের মাধ্যমে জিয়া হত্যার পর যে উল্লাসে মেতেছে এর একটা উপযুক্ত জবাব দেয়া। যাতে করে এরা উপলব্ধি করে মুজাহিদরা জিয়ার মৃত্যুতে শোকাতুর হলেও হীনবল ও জিহাদ ভুলে যায়নি। অনায়াস লব্ধ ক্যাম্পের পতন তাদেরকে অতিরিক্ত সাফল্য এনে দিল, হস্তগত হলো বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। আশাতীত বিজয়ে তাই মুজাহিদরা ছিল আনন্দিত।

              এ লড়াইয়ে সামরিক অস্ত্রের পাশাপাশি মুজাহিদদের হাতে কয়েকটি হেলিকপ্টারও অর্ধশতাধিক তেলভর্তি অয়েল ট্যাংকার ও কয়েক শ খাদ্য বোঝাই কার্গো লরিও দখল এল।

              রাতের অপারেশনে মুজাহিদরা ছিল ক্লান্ত। আলী কয়েকজনকে পাহারার দায়িত্ব দিয়ে বাকীদের বিশ্রাম করার নির্দেশ দিলেন। ক্লান্ত হলেও আশাতীত সাফল্যে মুজাহিদরা ছিলো উজ্জীবিত। অনেকেই সাগ্রহে ঘুরে ফিরে দেখছিল রুশ বাহিনীর তৈরী বিশাল বিশাল অস্ত্রাগার ও সামরিক সরঞ্জামাদি। আর অনেকেই গা এলিয়ে দিয়েছিলেন উন্মুক্ত ময়দানে সুবিধা মতো জায়গায়। তখন বেলা এগারোটা। হঠাৎ করে ডজন খানিক বোমারু বিমান মুজাহিদদের উপর বোম্বিং শুরু করলো। বোম্বিং তো নয় যেন বোমা বৃষ্টি।

             সকাল এগারোটা থেকে রাত পর্যন্ত শত্রু বাহিনী বিরতিহীনভাবে বোম্বিং করলো। অপ্রস্তুত মুজাহিদরা ভয়াবহতার আকস্মিকতায় আত্মরক্ষা না মোকাবেলা করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তা ছাড়া আত্মরক্ষার জন্য রুশ বাহিনীর পরিত্যক্ত ব্যাংকারগুলোও নিরাপদ ছিলনা। যার ফলে তাদের পরিস্থিতি মোকাবেলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। বোমা বৃষ্টির মধ্যেই বিমান বিধ্বংসী কামান দাগিয়ে হামলা মোকাবেলার চেষ্টা করছিলেন তারা। কিন্তু শত্রু বাহিনীর বিমানগুলো এতো বেশী উপর থেকে বোম্বিং করছিল যে, টার্গেট করা সম্ভব হচ্ছিল না। তবুও সন্ধ্যা পর্যন্ত মুজাহিদরা পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করে।

              রুশ বাহিনী ওদের পরিত্যক্ত ছাউনী ছাড়াও আশপাশের গ্রামগুলোতেও অগণিত বোমা নিক্ষেপ করে তছনছ করে দেয়। শহর ও নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে নিরপরাধ বেসামরিক মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো। নিহত হলো সহস্রাধিক নারী, শিশু ও বয়স্ক পুরুষ। ধংসের ব্যাপকতার তুলনায় মুজাহিদদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল কম। তদুপরি শতাধিক মুজাহিদ শহীদ ও শ’ছয়েকের মতো আহত হলো। হঠাৎ করে একটি বোমার খন্ডাংশ এসে আলীর গায়ে পড়ল। পড়ে গেলেন আলী।

              সন্ধ্যার পর শত্রু বাহিনীর বোম্বিং ক্ষ্যান্ত হলো বটে, কিন্তু চতুর্দিকে আহত ও স্বজনহারা মানুষের আর্তচিৎকারে কেয়ামত নেমে এলো।

            অঝোর ধারায় রক্তপাতের কারণে আলীর অবস্থা শোচনীয় হতে লাগল। শত্রু ছাউনী অপরিকল্পিতভাবে দখলে নেয়ার জন্যে আলীর মনে প্রথম দিকে একটু অনুশোচনাবোধ ছিল। এই অনুশোচনা বোধটা নিজে আহত হওয়ার জন্যে ছিলনা, যন্ত্রণাটা ছিল বিপুল পরিমাণ নিরাপরাধ মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির জন্য। জান মালের ক্ষয়ক্ষতি রোধের জন্য আলী দ্রুত বিজিত ক্যাম্প ছেড়ে মুজাহিদ ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। বললেন, তোমরা দুশমনদের সকল ব্যাংকার ক্যাম্প ধ্বংস করে দিয়ে রাতারাতি ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নাও।

            আহত আলীকে ক্যাম্পে পৌঁছানোর পথে মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি বেহুশ হয়ে গেলেন। মুজাহিদ ডাক্তারগণ প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু দুদিনের মধ্যে তারা আলীর চেতনা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। টানা দু'দিন আলী বেহুশ অবস্থায় কেটে যাওয়ায় ডাক্তাররাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। জিয়ার শাহাদাতের পর আলীর অসুস্থতা এবং দু'দিনের মধ্যে চেতনা ফিরে না পাওয়ায় মুজাহিদদের মধ্যে হতাশার আঁধার নেমে আসে। আহত মুজাহিদরাও নিজের দুঃখ- যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে আলীর জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। নিজের জীবনের পরিবর্তে আলীকে সুস্থ করে দেয়ার জন্য অহর্নিশি আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতি করে মোনাজাত করেন। ক্যাম্পের সকল মুজাহিদ আলীর জন্য দুআ করছে। যুবায়দা আলীর অসুস্থতায় ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। রাতভর সে আলীর সুস্থতার জন্য জায়নামাযে দুয়ায় মগ্ন থাকেন। আলীর প্রধান সহচর আব্দুর রহমানের সামনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।

            আলীর অসুস্থতা জনিত কারণে অথবা যে কোন ভাবে আলী দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে আব্দুর রহমান সে দায়িত্ব পালন করবেন সেটা নির্ধারিত ছিল। তিন দিন যাবত আব্দুর রহমান কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন।

            কমান্ডার আব্দুর রহমান আলীর শয্যা পাশে উপবিষ্ট। কাছেই বসা মুহাম্মদুল ইসলাম, দরবেশখান, আবু হামেদ, ক্যাপ্টেন আব্দুস সাত্তার। সবার হৃদয়, ঠোটে একটাই শব্দ একই কামনা, হে আল্লাহ আলীকে সুস্থ করে দিন।

            আলীর চেতনা হারানোর চতুর্থ দিন। এমন সময় চীফ কমান্ডার ও খলীল একই সাথে আলীর কামরায় প্রবেশ করেন।

            আলীর আহত হওয়ার খবর শুনে চীফ কমান্ডার দ্রুত আলীর অবস্থা দেখার জন্য ছুটে আসেন। খলীল আলীর জন্য সুসংবাদ বয়ে নিয়ে আসছিল, কিন্তু আলীর আহত হওয়া ও চার দিন যাবত চেতনাহীনতার খবর শুনে সুসংবাদের কথা খলীল ভুলে গেল। তার দু’চোখ গড়িয়ে পড়তে লাগলে শোকাশ্রু।

              চীফ কমান্ডার তার অনুমতি ছাড়া শত্রু ছাউনী দখলের ঝুঁকিপূর্ণ হামলার জন্য রাগান্বিত ছিলেন, কিন্তু এখানে এসে পরিস্থিতি ও আলীর অবস্থা দেখে তিনি নিজের ক্ষোভ চেপে রেখে উদ্বেগাকুল মুজাহিদদের উদ্দেশে বললেন,

            তোমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। চেয়ে দেখো আমাদের চেয়ে দুশমনদের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশী। জিহাদের ময়দানে এমন দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে। ময়দানে শক্রদের কোমর ভেঙ্গে গেছে, এরা আর প্রাদেশিক কর্তৃত্বে ফিরে আসতে পারবেনা। এই অভিযানের ফলে আমাদের কাবুল আক্রমণের পথ প্রশস্ত হলো। অচিরেই দেখবে আমরা কাবুল দখল করে দুশমনদের চিরতরে বিতাড়িত করতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ।

             পঞ্চম দিন আলী আস্তে আস্তে চোখ মেললেন। আলীর পাশে সমবেত মুজাহিদদের অন্তর খুশীতে ভরে উঠল। আলী পাশে বসা চীফ কমান্ডারকে দেখে খুব ক্ষীণস্বরে বললেন, মাননীয় কমান্ডার সাহেব, আমি খুব লজ্জিত! আমার জন্য, মুজাহিদদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।

            চীফ কমান্ডার বললেন, “বেটা আলী! আমিতো তোমাকে অবিস্মরণীয় বিজয়ের মোবারকবাদ জানাতে এসেছি। তোমার এই অভিযান কাবুল কম্যুনিস্ট সরকারের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে। বিজয় সাফল্যের তুলনায় মুজাহিদদের ক্ষয়ক্ষতি বেশী নয়। আগে তোমার শরীর সুস্থ হোক, বললেন কমান্ডার।

            অদূরে দাড়ানো খলীল আলীকে কথা বলতে দেখে আলীর কাছে অগ্রসর হয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করল, ভাইজান! শরীরটা এখন কেমন লাগছে?

             ‘তুমি কখন এলে খলীল! তুমি এসেছো খুব ভালো হয়েছে। তোমাদের দেখার জন্য আমার মনটা ছটফট করছিল।’ এ কথাটি শেষ করতে না করতেই আবার আলী অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।

             ঘন্টা খানিক পর আলী আবার চোখ খুললেন। অন্যান্য মুজাহিদদেরকে হাতের ইশারায় বাইরে যেতে বললেন। চীফ কমান্ডার, আব্দুর রহমান ও খলীল ছাড়া সবাই কামরার বাইরে চলে গেল।

             আলী খলীলের হাতটি টেনে নিজের হাতে নিয়ে বললেন, খলীল তোমরা কেমন আছো, তাহেরা, আম্মী কেমন আছে?

             খলীলঃ ভাইজান! আমি আপনার জন্য সুসংবাদ নিয়ে এসেছি।

              আলীঃ কি সুসংবাদ?

            খলীলঃ আমি চাচা হয়েছি । ভাবীর একটি সুন্দর ছেলে জন্ম নিয়েছে।

            আলীঃ আলহামদুলিল্লাহ! কবে তুমি চাচা হলে? কি নাম রেখেছ তোমার ভাস্তের?

             খলীলঃ হাসান মুহাম্মদ।

            আলীঃ সুন্দর নাম রেখেছ। ফিরে গিয়ে তাহেরাকে আমার মোবারকবাদ ও আম্মীকে সালাম জানিও। চীফ কমান্ডার ও আব্দুর রহমান পুত্রসন্তান লাভে আলীকে মোবারকবাদ জানালেন।

            এসময়ে আলীর দু’চোখ বন্ধ হয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর আবার চোখ খুলে চীফ কমান্ডারকে ইঙ্গিতে কাছে আসার অনুরোধ করলেন।

           চীফ কমান্ডার ঝুঁকে আলীর মুখের কাছে মাথা এনে তার মাথায় হাত রেখে বললেনঃ আলী!

              ‘কমান্ডার সাহেব! আপনি শুরু থেকেই আমাকে আপন সন্তানের মতো আদর-স্নেহ করেছেন। জীবন সায়াহ্নে আমি কি দিয়ে যে আপনাকে শুকরিয়া জানাব জানিনা।’ বললেন আলী।

              বেটা আলী! ধৈর্য হারিওনা! আগে তোমার অসুখ ভালো হোক! সব মুজাহিদ তোমার অসুস্থতায় কাতর। তোমার সুস্থতার জন্য সবাই দু’আ করছে।

              কমান্ডার সাহেব! আমার শেষ মঞ্জিল খুবই কাছে এসে গেছে; যে মঞ্জিলের জন্য আমি অনেক দিন থেকে আশান্বিত হয়ে আছি। আমি দুনিয়ায় আপনাদের মতো মূল্যবান ব্যক্তিদের সংস্পর্শে ক’দিন কাটাতে পেরেছি বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আমার অবর্তমানে একমাত্র ছোট্ট ভাই খলীল, বন্ধু আব্দুর রহমান, যুবায়দা ও তাহেরা যেন আর শূন্যতায় কষ্ট না পায় এদিকে আপনি একটু দৃষ্টি রাখবেন। এদের মান-ইজ্জতের প্রতি দৃষ্টি রাখবেন। এরপর চীফ কমান্ডারকে সামরিক বিষয়ক কয়েকটি গোপন তথ্য জানিয়ে মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেলেন আলী!

              খানিক্ষণ পর আব্দুর রহমানকে বললেন, ‘বন্ধু! তোমার বোনের কাছে গেলে তাকে আমার পক্ষ থেকে মোবারকবাদ দিও। ওর প্রতি খেয়াল রেখো। আর বলো, সে যেনো হাসানকে একজন নিষ্ঠাবান মুজাহিদ হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে।

             জীবনের অন্তিম মুহূর্তে তাহেরাকে কাছে না পাওয়ার দুঃখ নিয়ে যাচ্ছি। তবে এতটুকু সান্ত্বনা পাচ্ছি এই বলে যে, ওর কোল জুড়ে হাসান নামের যে সন্তান এসেছে একে বুকে নিয়ে সে দুঃখ- যন্ত্রণা ভুলে যেতে পারবে।

            একটু থেমে খলীলের প্রতি ইশারা করে তাকে আরো কাছে আসতে বললেন। খলীল বিষন্ন মনে আলীর মাথার কাছে ঝুঁকে বসল। আলীর কথা পূর্ব থেকেই অস্পষ্ট হয়ে আসছিল। এখন অস্পষ্টতা আরো বেড়ে গেল। আওয়ায খুব ক্ষীণ হয়ে পড়ল।

              খলীল কথা বোঝার জন্য কানের কাছে মাথা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আলী খুব কষ্ট করে ক্ষীণ আওয়াজে খলীলের হাতটি বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘ভাইয়া তুমি জিহাদে শরীক হওয়ার জন্য খুব আগ্রহী ছিলে। আমি তোমার উপকারার্থে আগে অনুমতি দেইনি। এখন আমার সময় শেষ। আমার পরে তুমি সক্রিয় জিহাদে যেতে পারো। আমি একান্তভাবে কামনা করি আমার বংশের কেউ না কেউ জিহাদী ময়দানে সক্রিয় থাকুক।

             মনে রেখো ভাইয়া! জিহাদের ময়দানে খুব কঠিন কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়; কখনও হিম্মত হারাবেনা, পরম ধৈর্য্য ও বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করবে, দেখবে সাফল্য সব সময়ই তোমার পদচুম্বন করবে।

            লক্ষীভাই! তোমার ভাবীর প্রতি সুনজর রেখো। আর আব্দুর রহমানকে আপন বড় ভাই মনে করে তার নির্দেশ মতো চলবে।’

            অনেক কষ্টে কথা কয়টি বলে আলী চোখ মুছলেন। পাশে বসা সবাই মনে করছিলেন, আবার হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন আলী। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। শরীরটা একটু কেঁপে ঝাকুনি দিল । নীরব, নিঃসাড় হয়ে এলো তার শরীর। কিছুক্ষণ পর আলীর ঠোট কেঁপে উঠল। খুব বিধ্বস্থ আওয়াজে আলী মুখ থেকে শোনা গেল, হে আল্লাহ! আপনি মুজাহিদদের বিজয় দিন, সাহায্য করুন! আল্লাহু.............আকবার.........লা.......... ইলাহা..........ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম)। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহী রাজিউন)।

             একটা অপার্থিব নীরব নিঃস্তব্ধতায় ভরে গেল আলীর কামরা। উপস্থিত সবাই যেনো হারিয়ে ফেললেন বাহ্যিক চেতনা। একটা অলৌকিক মোহমায়া তাদের আভীষ্ট করে ফেলল। মনোমুগ্ধকর মিষ্টি সৌরভে ভরে গেল কামরাটি। কিছুক্ষণ মোহবিষ্ট সময় কাটানোর পর কামরায় অবস্থানকারী চীফ কমান্ডার ও আব্দুর রহমান পরস্পর জিজ্ঞাসু নেত্রে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। ততক্ষণে কামরার ভিতরের বিস্ময়কর সৌরভ সুবাস ছড়িয়ে পড়লো কামরার বাইরে। কামরার বাইরে অপেক্ষমান মুজাহিদরা পরস্পর জিজ্ঞেস করছিলেন এ আশ্চর্য সুঘ্রাণ কোথেকে আসছে। এ গন্ধ তো দুনিয়ার কোন সুগন্ধির মতো মনে হয়না। এক মুজাহিদ বললেন, আমরা বংশ পরস্পরায় সুগন্ধি ব্যবসায়ী, পৃথিবীর সব সুগন্ধি সম্পর্কে আমার জানা আছে, এমন গন্ধ কখনও দেখিনি। আমি নিশ্চিত এ ঘ্রাণ অপার্থিব।

             যে ডাক্তার আলীর চিকিৎসা করছিলেন, তিনি আলীর হাত ধরে পালস দেখছিলেন। ডাক্তার হাত ছেড়ে দিলেন। বিমর্ষ হয়ে গেল ডাক্তারের চেহারা। দু'হাতে নিজের মুখে চেপে ধরলেন ডাক্তার। হাত ভেদ করে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ছড়িয়ে পড়লো।

             অবস্থা অনুমান করতে পেরে খলীল ও আব্দুর রহমানের বুক ভেঙ্গে কান্না বেরিয়ে পড়ল । চীফ কমান্ডার নিজের দুঃখবোধ অনেক কষ্টে চেপে রেখে আব্দুর রহমান ও খলীলকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললেন, ‘প্রিয় মুজাহিদ বন্ধুরা! তোমরা কেঁদো না, দেখছোনা শহীদদের আত্মা আর অসংখ্য জান্নাতি ফেরেশতা শহীদ আলীর আত্মাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে। ওরা জান্নাতী খুশবু ছড়িয়ে সারা পথ গুলজার করে আলীর আত্মাকে মহা সমারোহে জান্নাতে নিয়ে যাবে। তোমরা এ সময়ে না কেঁদে খুশী মনে আলীকে বিদায় দাও এবং তার অনুসৃত পথে চলার শপথ নাও।’

            আলীর শাহাদাতের খবর যখনি কামরার বাইরে ছড়িয়ে পড়ল দফতর থেকে ক্যাম্প ছাউনী সর্বত্র আহাজারী, কান্নার রোল পড়ে গেল। যে কান্না, শোক থামানোর জন্য আলী শত্রু ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আলীর মৃত্যুতে মুজাহিদদের শোক যন্ত্রণ আরো বৃদ্ধি পেল।

            কমান্ডার আলীর শাহাদাতে আব্দুর রহমান আলীর স্থলাভিষিক্ত হলেন। খলীলকে নিযুক্ত করা হলো গোয়েন্দা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। তাহেরা আলীর বিরহ ব্যাথাতুর মনে শপথ নিল হাসানকে পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তোলার। যুবায়দা ও তাহেরা নারী ফ্রন্টে কাজ করতে লেগে গেল।

              আলীর শাহাদাত আফগান জিহাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের মোড় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। যে সূচনার ভিত্তি আলীর মতো ব্যক্তিরা।

(সমাপ্ত)

ভাষান্তরঃ শহীদুল ইসলাম