JustPaste.it

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

মরণজয়ী মুজাহিদ

মল্লিক আহমাদ সরওয়ার

 

=======================================================================

 

        দেয়ালের এপাশ থেকে আলী তাদের সমস্ত কথা বার্তা শুনল। এতে তার সন্দেহ দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হল যে, আঃ করীম হুকুমতের হাতে বন্দী হয়েছেন।

 

        তার কাছে প্রচুর টাকা ছিল। মনে মনে, সিদ্ধান্ত নিল, আঃ করীমের মাকে কিছু টাকা হাদিয়া দিবে। কিভাবে দিবে? দান হিসেবে তো সে নিবেই না। আলীর মনে সুন্দর এক বুদ্ধি উদয় হলো। আঃ করীমের মা ফিরে এসে আলীর কাছে কিছু বলার পূর্বে সে বল্লো, আম্মা! আমার খুব তাড়া আছে। আসল কথা হল, গত বছর আঃ করীম ভাই থেকে আমার আব্বু কিছু টাকা ঋণ নিয়েছিলেন, সেগুলো উসুল করতে এসেছিলাম। একথা বলে সে পকেট থেকে পাঁচ হাজার আফগানী রূপী বের করে আঃ করীমের মাকে দিয়ে বল্লো, আঃ করীম আসলে এগুলো তাকে দিয়ে বলবেন, এগুলো আমান গুল পাঠিয়েছে, বাকী টাকাও জলদী পরিশোধ করবে। আঃ করীমের মা-টাকা হাতে নিয়ে বল্লেন, বেটা, কিছু না খেয়ে তোমাকে বিদায় দিতে পারি না। তোমাকে কিছু খেতেই হবে।

 

        তাড়াতাড়ি বাজার থেকে কিছু কিনে এনে খানা তৈরী করে আলীকে খাওয়ালেন। খানা খেয়ে আলী ঘর হতে বের হওয়া মাত্র অকস্মাৎ চার জন ব্যক্তি তাকে বন্দী করে গাড়িতে তুলে খাদের অফিসে নিয়ে যায়। খাদ আফগানিস্তানের একটি সরকারী গোয়েন্দা বিভাগ যা ভারতীয় এবং রুশ জাদরেল গোয়েন্দাদের সমন্বয়ে গঠিত। কাজ হল, প্রতি মুহূর্তে মুজাহিদদের গতিবিধি ও তৎপরতার প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখা প্রথমে। ডঃ নজীব খাদের প্রধান ছিল। সে এখন বারবাকের পরিবর্তে আফগানিস্তানের পুতুল সরকার প্রধান। প্রকৃত পক্ষে খাদের দফতর হল এক ভয়াবহ জিন্দান খানা ও নির্যাতন কক্ষ। বন্দীদের উপর এমন নির্যাতন এমন বর্বরতা চালানো হয় যে, অধিকাংশ বন্দী তা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এক পরিসংখ্যানে গত আট বছরে খাদের নির্যাতনে কমপক্ষে এক লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। রাশিয়ার কে,জি,বি-র মতই অবিকল এর দানবীয় অবয়ব।

 

        বন্দী করার পর আলীকে এক বাড়ীর বড়সড় এক কুঠরিতে নিয়ে শক্ত করে চেয়ারের সাথে বাঁধা হল। তাকে বারবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছিলো, মুজাহিদদের সাথে তোমার সম্পর্ক কি? তুমি কোন গ্রুপের সদস্য? কোন্‌ কোন্‌ পাহাড়ে মুজাহিদদের ঘাটি আছে কি মিশন নিয়ে তুমি গারদেজ এসেছো? কি উদ্দেশ্যে মেজর ফাইয়্যাজের সাথে দেখা করতে চাও?

 

        এসব প্রশ্নের উত্তরে আলীকে নীরব থাকতে দেখে দৈত্যকায় এক ব্যক্তি এগিয়ে এসে আলীর গায়ে কষে দশ-বিশটা ঘুষি লাগিয়ে দেয়। তাসত্ত্বেও আলী নীরব। জলন্ত সিগারেট দিয়ে তার শরীর দাগানো হল, যার যন্ত্রণা অসহনীয়। এরপর তার শরীরে শুই ফুটানো হল। এসব কিছু আলী সহ্য করছে, তবুও কিছু বলছে না।

 

        প্রচণ্ড ব্যাথায় আলীর শরীর নীল হয়ে যায়। তবুও সে নির্বাক। এরপর তাকে মাটিতে শুইয়ে পিনযুক্ত বুট ও লাঠি দ্বারা তার শরীর ক্ষত বিক্ষত করা হল। অধঃমুখী করে ছাদের সাথে ঝুলিয়ে দিল। পায়ের দিকে সেলোয়ারের মুখ বন্ধ করে তাতে ইদুর ছেড়ে দিল, তার মুখ বরাবর মাটিতে মরিচ পোড়া দিল। এসব নির্যাতন ছিল অসহনীয়। এ কঠিন মুহুর্তে হযরত বেলাল (রাঃ)-এর ঘটনা তার স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠে আলী দেখে পেল, তাওহীদের ঘোষণা দেয়ার কারণে হযরত বেলাল (রাঃ) কে জ্বলন্ত অংগারে নিক্ষেপ করা হলে তখন তাঁর মুখে শুধুই উচ্চারিত হচ্ছে আহাদ আহাদ, এ দৃশ্য আলীর মনে সাহসের সঞ্চার করে।

 

        ছাদ হতে আলীকে অজ্ঞান অবস্থায় নামানো হল, জ্ঞান ফিরে এলে তার চোখে প্রচণ্ড জ্বালা শুরু হয়। ব্যথায় প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কুকড়ে যাচ্ছে। শরীরের কয়েক স্থান থেকে রক্ত ঝরে কাপড়ে জমাট বেঁধে আছে।

 

         কিছুক্ষণ পর দু' ব্যক্তি এসে তার চোখ বেঁধে অন্ধকার এক কামরায় ফেলে গেল। কামরার একদিক হতে একজন লোক এসে টেক দিয়ে আলীকে উঠিয়ে নিজের জায়গায় নিয়ে বসাল, আলী আবার জ্ঞান হারায়। এ কামরায় মোট চারজন লোক, সবাই মিলে আলীর জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু ভোর পর্যস্ত আলীর জ্ঞান ফিরল না।

 

        পরে আলীর জ্ঞান ফিরে আসে, তখনও চক্ষু দু'টি ব্যথায় জ্বলছে। সমস্ত শরীর আঘাতে আঘাতে নীল হয়ে গেছে। সে উঠতে চাইলো কিন্তু পারল না। কুঠরিতে এখনও আধো আধো অন্ধকার। ওই চার ব্যক্তি আলীর নিকট এসে তাকে তুলে ভর দিয়ে বসাল, একজন কয়েকটা শুকনো রুটির টুকরা আর এক গ্লাস পানি আলীকে দিয়ে বল্লো, এগুলো খেয়ে নাও। আলী শুকনো রুটির শক্ত টুকরা গুলো চিবাতে পারছে না। মুখের ওপর প্রচণ্ড আঘাতের কারণে চোয়াল নাড়লেই অসহনীয় ব্যথা পায়। তাই শুকনো রুটি পানিতে রেখে দিল। কিছুক্ষণ পর ভিজে নরম হলে আস্তে আস্তে সেগুলো খেয়ে নিল। ওই ব্যক্তি পকেট থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে বল্লো, এটা খেয়ে নাও ব্যথা কমে যাবে। আধ ঘন্টা পর আলীর ব্যথা কিছু কমে আসলে সে কামরার লোকদের জিজ্ঞেস করল, আমি এখন কোথায় আছি আর আপনার কারা? শুশ্রুষাকারী ব্যক্তিটি বলো, আমরা বন্দী, আমরা সবাই এখন জেলখানায় আছি। আচ্ছা তেমার অপরাধটা কি?

 

        আমার তো অপরাধ একটাই যে আমি আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদে বিশ্বাসী। আফগানিস্তানে এখন এ বিশ্বাস পোষণ করাই সবচেয়ে বড় অপরাধ। চুরী, ডাকাতি আর খুন-খারাবীর অপরাধ এদেশে ক্ষমা করা হয়, কন্তু আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা ক্ষমাহীন অপরাধ। কারণ আল্লাহর নাম নিলে সরকার মনে করে যে, তার রক্তচোষা লাল বিপ্লব বুঝি ব্যর্থ হবে। তাই আমাদেরকে বিপ্লব বিরোধী আখ্যা দিয়ে জেন্দান খানায় নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এরপর তাদের ওপর বর্বরতার নির্মম স্টীম রোলার চালানো হয়, যাতে আল্লাহর বন্দেগী ছেড়ে আমরা খোদাদ্রোহী নমরুদের অনুসারী হই। কিন্তু এ অমানুষগুলো ভুলে যাচ্ছে যে, আমরা একত্ববাদের পতাকাবাহী হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর রূহানী সন্তান। সে যুগের নমরুদের সামনে যেমন তিনি মাথা নোয়াননি, বরং চীর সমুন্নত ছিল তার তাওহীদে বিশ্বাসী শীর। তেমনি এসব নমরুদের সামনেও আমাদের এ তাওহীদী শীর কোনদিন ঝুকবে না ঝুকতে পারে না। বরং যুগে যুগে তাওহীদের ঘোষণা দিতে এ শীর উন্নত থাকবেই। ইনশাল্লাহ। আলীর কথা শুনে এক ব্যক্তি বল্লো, মেজর ফাইয়্যাজ। আমাদের মতই এর অপরাধ। এজন্য তাকে আমাদের সেলেই নিক্ষেপ করা হয়েছে। আলী মেজর ফাইয়্যাজের নাম শুনে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, আপনিই কি মেজর ফাইয়্যাজ?

 

        হ্যা! আমিই, তুমি কি আমার কথা জান,

        হ্যা! জানি, আলী উত্তর দিল।

        আমি জানতে চাই যে, আমাকে কিভাবে চিন?

 

        আলী প্রথম সব কথা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ সে চিন্তা করল যে, এটা আবার শক্রর কোন চাল নয় তো। মনে মনে বলল, এ ব্যক্তি মেজর ফাইয়্যাজ কিনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে অতিরিক্ত আর একটি কথাও বলবনা। মেজর ফাইয়্যাজই তাকে বল্লো, তোমাকে কিভাবে বিশ্বাস করাব যে, আমিই মেজর ফাইয়্যাজ। এরা আমার সঙ্গী মাসুদ, জারতাজ ও সাইফুল্লাহ। বিশ্বাস না হয় তো তাদেরকে জিজ্ঞেস কর।

 

        এ নামগুলি শুনে আলীর মনে পড়ল যে, এদেরকেই তো সে শহরে তালাশ করেছিল। তথাপি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে জিজ্ঞেস করল, আপনার আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সাথী কোথায়? এক দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে মেজর ফাইয়্যাজ বললেন, তুমি বোধহয় আঃ করীমের কথা বলছ।

 

        হ্যা, আঃ করীমের কথাই বলছি। এখন আমি নিশ্চিত হলাম যে, আপনিই মেজর ফাইয়্যাজ। এখন বলুন, আঃ করীম কোথায় এবং কি অবস্থায় আছে?

 

        মেজর ফাইয়্যাজ আলীকে বল্লো, সে তো আর আমাদের মাঝে নেই। রুশী নরপশুরা তার উপর বর্বরতার সব পন্থা প্রয়োগ করে, কিন্তু সে ছিল এক অটল পর্বত, যা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েও টলবে না, তার প্রতিটা হাড্ডী ভেঙ্গে দেয়া হয়, গরম সিক দিয়ে তার চোখ দাগানো হয়, শেষ পর্যস্ত আমাদের চোখের সামনেই তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হল। আগুনের জলত্ত শিখায় শাহাদাত বরণ করলেন এ মর্দে মুজাহিদ। কিন্তু তার মুখ হতে ‘উহ’ শব্দটুকুও হল না। তিনি মহান, আমার ধারণার চেয়েও মহান।

 

        এটুকু বলে মেজর ফাইয়্যাজ হাটুতে মথা রেখে কাঁদতে শুরু করলেন। আলীর চোখ হতেও অশ্রু ঝরে পড়ল। আলী অশ্রু মুছে বলল যে, আঃ করীমের মাতা এখনো তার অপেক্ষা করছেন। এরপর সে বন্দী হওয়া পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা শুনাল। সব শুনে মেজর ফাইয়্যাজ বল্লো যে, এর অর্থ তোমাকেও আঃ করীমের পড়শী ইয়াসীনই বন্দী করিয়েছে। লোকটা অত্যন্ত নীচু ও ভ্রষ্ট প্রকৃতির। উপরন্ত কমিউনিস্ট আর খুব লোভী।

 

        মেজর ফাইয়্যাজের নিকট আলী তার সাব কথা বল্লো, আপনার ব্যাপারে কমান্ডার সাহেব অত্যন্ত পেরেশান ছিলেন, আমাকে আপনার সংবাদ নেয়ার জন্যই গরদেজ পাঠানো হয়। ছাউনীতে গিয়ে আপনার কথা জিজ্ঞেস করলে সবাই বল্লো, আপনি বদলী হয়েছেন। কোথায় বদলী হয়েছেন এ কথার উত্তরে সবাই বল্লো, জানিনা। আলী জুতার দোপাট্টার মধ্য হতে কমান্ডারের লিখিত চিঠি বের করে মেজর ফাইয়্যাজের হাতে দিল। আলীর মজা ছিল মোটা চামড়ার, সে চামড়ার মধ্যখানে ফাঁক করে তার ভিতর চিঠি রেখে সলিসন দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়। শত তল্লাশীর পরও তা আবিষ্কার করা মুশকিল। তল্লাশীকারীরা আলীর জুতার তলা ছিরেও কিছু পায়নি। আলীর বুদ্ধি মত্তা দেখে মেজর ফাইয়্যাজ খুব বিশ্মিত হলেন।

 

        চিঠি পড়ে মেজর ফাইয়্যাজ আলীকে বল্লেন, তিন মাস পূর্বে আমার উপর রুশীদের সন্দেহ হয়। আড়াই মাস পূর্বে মুজাহিদদের সহযোগিতা করা ও তাদের কাছে অস্ত্র পাচারের অপবাদ দিয়ে আমাকে বন্দী করা হয়। তবে আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণের পক্ষে তাদের কাছে কোন প্রমাণ ছিল না। তোমার মত আমার উপরও নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু আমার নিকট থেকে কোন তথ্য তারা বের করতে পারেনি। এরপর আঃ করীমের পড়শীর ষড়যন্ত্রে আমার এ সাথীরাও বন্দী হয়। কিন্তু আমি এই ভেবে আশ্চার্যান্বিত হচ্ছি যে, তারা আমাদেরকে এখনো কেন জীবিত রেখেছে।

 

        আলী এখানে আসার পর এক সপ্তাহ হয়েছে। এর মধ্যে তার, যখমও প্রায় ভাল হয়ে গেছে! এ সময় মেজর ফাইয়্যাজের আন্তরিক শুশ্রুার কথা ভুলবার নয়। নিয়মিত তিনি তাঁর নিজের অর্ধেক খানা আলীকে খাওয়াতেন। অষ্টম দিনে একজন রুশী অফিসার এ সেলে এসে মেজর ফাইয়্যাজ ও আলীকে বল্লো, এখনো সময় আছে, আমাদের প্রশ্নের উত্তর দাও, না হলে অন্য জেলে তোমাদের পাঠানো হবে, যেখানে তোমাদের গোস্ত কিমা করে কুত্তাকে ভক্ষণ করান হবে।

 

        মেজর ফাইয়্যাজ রুশী অফিসারের কথার উত্তর দিয়ে বললেন, ওহে নরপশু! আমাদের সাথী আঃ করীমের ধৈর্য্য আর দৃঢ়তা তুই দেখেছিস, এখন আমাদের ওপর তোরা যেমন ইচ্ছা নির্যাতন করতে পার, আমরাও ইনশাআল্লাহ আঃ করীমের রেখে যাওয়া পতাকা উঁচু করে ধরে রাখব।

 

        প্রয়োজন হলে দ্বীনের জন্য আল্লাহর পথে শাহাদাত বরন করব। তবুও তোদের প্রলোভনে আটকা পড়ে আখেরাত নষ্ট করব না।

 

        আল্লাহ, ইসলাম ও আখেরাতের কথা শুনে রুশী অফিসারের মাথায় রক্ত চড়ে যায়, সে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে অশালীন কথা উচ্চারণ করে মেজর ফাইয়্যাজের গালে একের পর এক থাপ্পর কষতে থাকে। রুশী অফিসারের মুখে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) সম্পের্কে অশালীন উক্তি শুনে আলী ক্রোধে  উক্তি শুনে আলী ক্রোধে জ্বলে উঠে। সে সহ্য না করতে পেরে রুশীর কলার ধরে ঘুষির পর ঘুষি লাগিয়ে তার দাঁত ভেঙ্গে দেয়। আরো সৈন্য এসে অফিসারকে না বাঁচালে আলী তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে ছাড়ত। আলীর ঘুষি খেয়ে রুশ অফিসার ক্রোধে গালি দিতে দিতে ফিরে গেল। অধিনস্ত সৈন্যদের নির্দেশ দিল এদেরকে অন্য সেলে কুকুরের সামনে ফেলে দিয়ে আস।

 

        রুশী অফিসার ফিরে গেলে সাথীদের উদ্দেশ্যে মেজর ফাইয়্যাজ বললেন, বন্ধুরা আমার! মনে হয় আমাদের অন্তীম সময় ঘনিয়ে আসছে। সব ধরণের নির্যাতন সহ্য করার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হও। রুশি যে সেলের কথা বলে গেল ভা আমি দেখেছি। কত কঠিন ওখানের শাস্তি তা আমি জানি। সামরিক ছাউনীর অদূরে এক বেসরকারী বাড়ীতে এ নির্যাতন কক্ষটি। নির্যাতনের সর্বাধুনিক মেশিন এখানে রয়েছে। এখানে এমন মেশিনও আছে যার একদিকে কোন মানুষকে ফেলে দিলে অপর দিক দিয়ে তার গোস্ত কিমা হয়ে বেরিয়ে আসে। ওখানে এক কামরায় রক্তপিপাসু কুকুর আছে, যেগুলো মুহূর্তের মধ্যে জীবিত মানুষের শরীর ছিরে টুকরো টুকরো করে ফেলে। আর রয়েছে বিষধর সাপ ও ফুটন্ত তেলের বিরাটকায় কড়াই। এ ফুটন্ত তেলের মধ্যে কয়েদীদের নিক্ষেপ করা হয়। অনেক সময় কয়েদীদের এমন সব টিকা দেয়া হয় যার প্রতিক্রিয়ায় উন্মত্ত হয়ে তারা নিজের শরীর নিজে খামচাতে থাকে। নিজেই নিজের শরীর রক্তাক্ত করে। ওখানে চিমটা দ্বারা জীবিত মানুষের নখ উপড়ে ফেলা হয়। মোট কথা এমন কোন কঠিন নির্যাতন নেই যা ওখানে কয়েদীদের ওপর প্রয়োগ না করা হয়। তবে বন্ধুরা আমার! সর্বদা একথা স্মরণ রাখবে যে, আমাদের পূর্বে দ্বীন ও আজাদী প্রিয় হাজারো মুজাহিদ এসব নির্যাতন অম্লান বদনে সয়ে গেছেন। তারা ফুটন্ত তেলে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, বেয়নট দিয়ে তাদের গোস্ত কেটে সেখানে লবন মরিচ ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। একে একে তাদের শরীরের সর্ব অঙ্গ কর্তন করা হয়েছে। তথাপী তারা বাতিলের সামনে মাথা নোয়াননি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের মুখে এ সত্য উচ্চারিত হয়েছে যে, ইসলাম ব্যতীত আর সব মতাদর্শ ভ্রান্ত, একজন বীর আফগানী জীবিত থাকা পর্যন্ত তারা এদেশে কোন কমিউনিস্ট রুশীর অস্তিত্ব সহ্য করবে না। তাই এসো, সবাই মিলে এ বজ্র কঠিন শপথ গ্রহণ করি, “আমরাও আত্মত্যাগী সে সব শহীদদের পথ ধরেই চলব এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন আমাদেরকে ধৈর্য্য শক্তি দান করেন।” সবাই একথায় আমীন বল্লো।

 

        রাত নয়টা। পাঁচজন কয়দীকে নিয়ে একটা গাড়ী গারদেজের রাস্তা দিয়ে মৃত্যুকুপ নামক জেলের দিকে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে রুশীরা আসার পর হতে সন্ধ্যার পরপবই গারদেজ শহরের রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ে। রুশীদের ভয়ে লোকজন এ সময় ঘর হতে বের হয় না। এমনকি কমিউনিস্টরাও নিজ পরিবারের মহিলাদের সতিত্ব রক্ষার্থে সন্ধ্যায় দরজায় তালা লাগিয়ে দিত। কয়েদীদের গাড়ী ছুটে চলার সময় রাস্তায় নীরবতা বিরাজ করছিল।

 

        আলীর আঘাতে আহত রুশ অফিসার কয়েদীদের নির্মম মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য জেল খানায় অস্থির ভাবে পায়চারী করছিল। জল্লাদদেরকে সে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলো, এক বন্দীকে বিষধর সাপের কক্ষে নিক্ষেপ করে দু'জনকে কিমার মেশিনে ফেলবে। আর যে আমাকে ঘুষি মেরেছিল তাকে ফেলবে ফুটন্ত তেলের কড়াইর মধ্যে। ক্ষুধিত কুকুরের সামনে ফেলবে মেজর ফাইয়্যাজকে। রুশী অফিসারের গায়ে হাত তোলার পরিণাম যেন সে হাড়ে হাড়ে টের পায়। দেখে ছাড়বো আজ, কে তাদের খোদা, কত শক্তি তার, কিভাবে রক্ষা করে সে তার বিশ্বাসীদের।

 

        রুশী অফিসার এদিকে অস্তির ভাবে অপেক্ষা করে আল্লাহর শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করছিল। ওদিকে গাড়ীর ড্রাইভার গাড়ীর মোড় ঘুরিয়ে ভিন্ন পথে শহরের বাইরে আরেকটি বড় সড়কে এসে উঠল গাড়ী ফুলম্পীডে ধেয়ে চলছে, জনমানবহীন একটা নীরব জায়গায় এসে ড্রাইভার সড়ক ছেড়ে গাড়ী নীচে নামিয়ে দুই ফালং দূর গিয়ে গাড়ী থামাল। পিছনের দরজা খুলে সশস্র সৈন্যদের নীচে ডাকল, গাড়ী সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকায় সৈন্য দুটি বুঝতেই পারেনি যে, তারা জেল খানার পরিবর্তে বিরান কোন ভূমিতে চলে এসেছে। তারা নিশ্চিত মনে গাড়ী থেকে নামতেই ড্রাইভার ছো মেরে তাদের ক্লাসনকভ ছিনিয়ে নিয়ে নির্দেশ দিল, বন্দী জলদি গাড়ি থেকে নামাও। তাদের চোখ ও হাতের বাধন খুলে দাও। জ্যোৎস্না রাত, চারিদিকে চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণ। ঝিকঝিক করছে, বন্দীরা চাঁদের রোশনীতে ড্রাইভারকে চিনতে পারল, ও তো নূর মুহাম্মাদ। সৈন্যদ্বয় বন্দী অবস্থায় কাঁপতে লাগল থর থর করে। আলী মেজর ফাইয়্যাজের সাথে নূর মুহাম্মাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। আনন্দে সবাই কোলাকুলি করে। একে অপরকে মুবারকবাদ জানায়।

 

অনুবাদঃ আবূ উসামা

 

 

═──────────────═