JustPaste.it

আঁধার থেকে আলোর পথে

 

টগবগে এক হিন্দু নওজোয়ানের ইসলাম গ্রহণ অবিশ্বাসীদের দুঃসহ জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ এবং তার আফগান জিহাদে অংশগ্রহণের প্রাণবন্ত এক উপাখ্যান

গঙ্গা খেকে জমজম

মল্লিক আহমদ সরওয়ার

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

হিন্দুরা ছিল বড় চতুর এবং ষড়যন্ত্রে পাকা। তারা ভাল করেই জানতো যে, মুসলমানদের উপস্থিতিতে তারা আমাকে ধরতে পারবে না। তাই তারা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে আমাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। শুরু হলো আমার ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা।

থানার ওসি প্রথমে আমাকে কোন ভয় নেই, বল তোমাকে কে ফুসলিয়েছে? কে প্ররোচিত করেছে? সেই বদজাত মুসলমানের নাম বল। দেখবে, আমরা তার হাড্ডি পিষে আটা বানিয়ে ফেলব।

আমি বললাম, “আমাকে আমার মন প্ররোচিত করেছে। আমার প্রতিপালক আমাকে প্ররোচিত করেছেন, সত্য এবং বাস্তবতা আমাকে ইসলামের প্রতি প্রলুব্ধ করেছে।”

এক হিন্দু সখেদে বলে উঠল, “ওসি সাহেব! এই নিষ্পাপ বালকটির উপর মোচলমানরা (মুসলমানরা) যাদু করেছে। এসব কথা রামচন্দ্র বলছে না, বলেছে তার ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা কোন ‘মুচলমান’ ।”

থানার ওসি আবার সোহাগভরে জিঙ্গেস করতে শুরু করলেন, “দেখ বেটা! আমরা জানি যে, মুসলমানরা বড় ধূর্ত ও ধান্দাবাজ। তারা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আমাদের ছেলে-মেয়েদের বেওকুফ বনায়। তুমি এখনো ছোট এবং সহজ- সরলও বটে। এই কচি বয়সে তুমি ওদের চালাকী বুঝতে পারবে না। যদি ওরা তোমাকে টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে থাকে, তাও আমাদের বল।”

আমি বললাম, “আমাকে কোন মুসলমান টাকা পয়সার লোভ দেখায়নি। আমি ইসলামকে সত্য ধর্ম জেনে এবং বুঝে গ্রহণ করেছি।”

থানার ওসি কোমল স্বরে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলল, “দেখ বেটা! ওই ধান্দাবাজ মুসলমানদের প্ররোচনায় তুমি নিজেকে কঠিন বিপর্যয়ের মাঝে নিক্ষেপ করছ। এদের স্বার্থ হাসিল হওয়ার পর দেখবে, এরা তোমাকে ত্যাগ করে একা ফেলে রাখবে এবং তোমার বিপদে-আপদে তারা ফিরেও তাকাবে না। বিপদে সব সময় নিজের মা-বাপ, ভাই-বোন ও নিকটাত্মীয়জনই কাছে আসে। অতএব, তুমি ভগবানের কাছে ক্ষমা চাও। ভগবান হলেন মহান। তিনি তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন। পন্ডিতজি এবং আমরা সবে মিলে ভগবানের নিকট তোমার ক্ষমার জন্য আর্জি পেশ করবো। যদি ভগবানকে তুমি খুব দ্রুত রাজি না করাও, তাহলে তার ক্রোধ তোমাকে ধ্বংস করে দেবে”।

জবাব দিলাম, “আমি তোমাদের কোন ভগবানকে মানি না। আর তোমাদের কোন ভগবানের সন্তুষ্টি কিংবা অসন্তুষ্টির পরওয়াও করি না, ধারও ধারি না আমি। তোমাদের ভগবান তো তার উপর বসে থাকা ক্ষুদ্র মাছিটাকেই তাড়াতে পারে না, “আমার কি ক্ষতিটা করবে?”

আমার দৃঢ়চেতা স্পষ্ট কথাগুলো শুনে ওসি সাহেব চিৎকার দিয়ে বললেন, “ইতর, বদমাশ, হতভাগা কোথাকার! তুই আমাদেরই সামনে আমাদের ভগবানের শানে গোস্তাখী করছিস, তাঁকে অপমান করছিস? আমি তোর হাড্ডি ছাতু বানিয়ে ছাড়ব”।

নির্যাতন শুরু হল। আমাকে মাটির উপর শুইয়ে দেয়া হল। ডান্ডা দিয়ে সজোরে পিটাতে থাকল। সে এক দুঃসহ যন্ত্রণা, অসহনীয় নির্যাতন। আমি মানসিকভাবে এইসব নির্যাতন সহ্য করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমি জানতাম যে, এখন আমার ঈমানের পরীক্ষার সময়। এটা সেই মহা পরীক্ষার অগ্নিকুণ্ড, যাতে হযরত বেলাল (রাঃ), হযরত সোহাইব (রাঃ) এবং হযরত খুবাইব (রাঃ)-এর মত মহান সাহাবীগণ পুড়ে পুড়ে খাঁটি স্বর্ণ হয়েছিলেন। ঐ মহা-মনীষীদের ঘটনা জাফর আলী আমাকে শুনিয়েছিল। মক্কার মুশরিকদের জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন আর সাহাবা-ই কেরামগণের ঈমানের দৃঢ়তা ও তাঁদের ইসলামে অবিচল থাকার ঘটনা আমার স্মরণ ছিল। আজ তাঁদের সেই সুন্নত আমার আদায় হচ্ছে। সূরা আনকাবুতে প্রদত্ত আল্লাহ্‌ তায়ালার নির্দেশের কথাও আমার মনে ছিল, যা আমি কোন এক বই-এ পড়েছিলাম। আল্লাহ্‌ বলেছেন- “মানুষ কি এটা ধারণা করছে যে, শুধু এতটুকু বললেই তা যথেষ্ট হয়ে যাবে যে, আমি ঈমান এনেছি, আর তাদেরকে কোন পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পূর্ববর্তী সবাইকে আমি পরীক্ষা করেছি। আল্লাহ্‌ নিশ্চয় জানেন যে, (প্রকাশ্য ঈমানের দাবীতে) কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী”। (সূরা আনকাবুতঃ আয়াত-২)

আমি আমার সত্যবাদীতা প্রমাণ করতে চাচ্ছিলাম। আমি সংকল্প করেছিলাম, এ পরীক্ষায় আমাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে। তাই আমি আমার আল্লাহ্‌র নিকট নির্যাতনে অটল ও দৃঢ় থাকার শক্তি প্রার্থনা করে বললামঃ হে আল্লাহ্‌! আমি দুর্বল, এই সীমাহীন জুলুম আর অত্যাচারের মধ্যে আমাকে অটল রাখ। যেভাবে তুমি আমাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দিয়েছ, তেমনিভাবে এখন এর সত্যতার সাক্ষী হবার তওফীক দান কর।”

মক্কার মুশরিকরা যদি ৩৬০ প্রতীমার পূঁজা করে থাকে, তাহলে এখানে মুশরিক, কাফের ও হিন্দুরা শত সহস্র প্রতীমার পূঁজাই শুধু করছে না বরং তারা তো গাভী এবং হনুমান নামে পরিচিত বড় বড় বানরকেও দেবতার মর্যাদায় সমাসীন করে রেখেছে। তবে সে যা-ই হোক, একটি বিষয়ে এদের মিল রয়েছে। তা হলো, এরা উভয় সম্প্রদায় জালেম এবং এদের ধর্মও ভিত্তিহীন-মনগড়া।

প্রতিটি আঘাতে আমার মুখ দিয়ে আহ্‌-শব্দের সাথে শুধু বেরুত- “হে আল্লাহ্‌! আমাকে সাহায্য কর”। আল্লাহ্‌ শব্দটি শুনে হিন্দুদের লাঠি নতুন প্রাণ পেত, দ্বিগুণ শক্তিতে গর্জে উঠতো। তারা ক্ষোভে-দুঃখে ফেটে পড়তো এবং প্রচণ্ড শক্তিতে ডান্ডা কষতো। অত্যাচারের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আমি ভয় করছিলাম, পাছে এই আমি যদি শক্তি, সাহস ও উদ্যম হারিয়ে ফেলি! যখনই একটু হুঁশ ফিরে পেতাম, তখনই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্‌ তায়ালার এই দৃপ্ত উচ্চারণটি আমার মুখে মৃদু গুঞ্জরণ তুলতোঃ “যারা বলেছে যে, আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতিপালক এবং এটা বলে এর উপর দৃঢ় থেকেছে, তাদের উপর ফেরেশতাগণ অবতরণ করে এবং তাঁদেরকে বলে যে, ভয় পেও না কোন চিন্তাও করো না এবং যে জান্নাত সম্পর্কে তোমাদের সাথে ওয়াদা করা হয়েছে, তার সুসংবাদে আনন্দিত হও। আমি তোমাদের ইহলৌকিক জীবনেও সঙ্গে আছি পারলৌকিক জীবনেও সঙ্গে থাকবো। সেখানে তোমরা যা কিছু চাইবে পাবে, আর যা কামনা করবে, তা হয়ে যাবে। এটা তোমাদের জন্য ঐ মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্‌র অবদান, যিনি ক্ষমাশীল এবং অনুগ্রহকারী।” (সূরা হা-মীম আস- সাজদা-৩০-৩২)

এই আয়াতের মাধ্যমে আমি শক্তি যোগাতাম। উপরন্তু সেই নওমুসলিম যুবতীর দৃঢ়তার পরাকাষ্ঠাও আমার সামনে উপস্থিত ছিল যে নারী হয়েও সে জীবন্ত পুড়েছে, তার সুদৃঢ় অবস্থান থেকে এক বিন্দু পিছনে সরে দাঁড়ায়নি। এসব চিন্তা করে আমার সাহস বেড়ে যেতো।

আমার শরীরের উপর দিয়ে বেতের আঘাতের পর আঘাত চলতেই থাকল। আমার আজও স্মরণ আছে যে, যখন তারা আমার পায়ের তলায় ডান্ডা মারতো, তখন আমার কাছে মনে হতো যে, আমার চোখ দু'টো যেন ছিটকে বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে। যদি আমার উপর আমার আল্লাহ্‌র সাহায্য না থাকতো এবং তিনি যদি আমার সহ্যশক্তি ও সাহস না যোগাতেন, মনোবল দৃঢ় না রাখতেন তাহলে হয়তো এই কঠিন পরীক্ষায় আমি নিশ্চিত বিফল হতাম।

মুসলমানরা মামলা দায়ের করল। মেডিক্যাল করার জন্য আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয় যাওয়া হলো। ডাক্তার আমাকে মানসিক রোগী ও পাগল ঘোষণা করলেন। এর উপর ভিত্তি করেই জজ সাহেব মামলা খারিজ করে দিলেন। কেননা ডাক্তার এবং জজ উভয়ই উগ্রবাদী হিন্দু ছিলেন। তাদের নিকট পেশার চেয়ে, আপন কর্তব্যের চেয়ে নিজের মিথ্যা ভগবানের সন্তুষ্টি অর্জন ছিল অধিক কাম্য।

আমাকে দেড় মাস পর্যন্ত কারাগারের অন্ধকার কুঠোরীতে রাখা হলো। যখন আমি কিছু বলতে চাইতাম, তখনই দুই দুইজন কিংবা তিন তিনজন করে হিন্দু পুলিশ আমাকে মারতে শুরু করতো এবং ততক্ষণ পর্যন্ত মার চালিয়ে যেত, যতক্ষণ না আমি আবার বেহুঁশ হয়ে পড়তাম।

অনেক সময় মারের প্রচণ্ডতায় ঘাবড়ে যেতাম, এই ফাঁকে শয়তান আমাকে এই বলে প্ররোচিত করত, “পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরে যাও এই ভাল।” এই ব্যাপারটি আমাকে আরও পেরেশান করে তুলতো। আমি আল্লাহর সামনে অবনত হতাম এবং দোয়ার জন্য হাত উঠাতাম-

-“হে আল্লাহ! হে প্রতিপালক! আমার হৃদয়কে হিদায়েতের আলোয় উদ্ভাসিত করে আবার (ভুল পথের দিকে) তুমি অন্ধকারে ঠেলে দিও না। তোমার পক্ষ থেকে আমার উপর রহমত বর্ষণ কর। নিঃসন্দেহে তুমিই সর্বদাতা। (আলে ইমরান)

এছাড়া আরও অনেক দোয়া-যা আমার ম্মরণে ছিল, তা দিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে চাইতে থাকলাম। সে দোয়াগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে দু'টি উল্লেখযোগ্য। একটি হচ্ছে ঐ দোয়া, যা বনি ইসরাইল জালেম ফেরাউনের জুলুম থেকে রক্ষা পাবার জন্যে আল্লাহ্‌র কাছে চেয়েছিলঃ

“হে আমাদের পরওয়ারদেগার! আমাদেরকে জালেমদের জুলুমের প্রয়োগস্থল বানিও না এবং আমাদেরকে তোমার রহমতের দ্বারা ঐ সমস্ত লোকদের থেকে মুক্তি দাও যারা কাফের।” (সূরা ইউনুস)

দ্বিতীয় দোয়াটিও ফেরাউনের জুলুমের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ ছিল সেই দোয়া, যা ফেরাউনের দরবারে যাদুকররা হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর ঈমান আনার পর আল্লাহ্‌র নিকট করেছিল। দোয়াটি ছিল নিম্নরূপঃ

“হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে ধৈর্যধারণের শক্তি দাও। আর তোমার আনুগত্য স্বীকার করা অবস্থায়ই যেন আমাদের মৃত্যু হয়। (সূরা আ'রাফ)

দেড় মাস পরে আমাকে হিন্দুদের হাতে তুলে দেয়া হলো। হিন্দুরা আমাকে আমার মা-বাবাকে দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করল। প্রথমে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন এবং পরে হুমকি-ধমকি দিল। কিন্তু আমি ইসলাম ত্যাগ করে পুনরায় হিন্দু হতে কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। শেষ পর্যায়ে এসে তারা আমাকে হত্যাযোগ্য বলে বিবেচনা করল। আমার কাছে আমার পরিণতি ঐ নওমুসলিম মেয়েটির মত হবে বলে মনে হলো। আমি চিন্তা করতে লাগলাম যে, না জানি কেমন কষ্ট দিয়ে দিয়ে আমাকে ওরা হত্যা করবে আবার মনে হতো যে, ঐ নওমুসলিম মেয়ের মত আমাকেও জীবন্ত পুড়িয়ে মারবে হয়ত। আমি কি সেসব সহ্য করতে পারবো? আবার একাই স্বগতোক্তি করতাম যে, যে আল্লাহ্‌ এর পূর্বেকার অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন, সেই আল্লাহ্‌-ই আমাকে ভবিষ্যতে কষ্ট সহ্য করার শক্তি ও সাহস যোগাবেন।

আমি হিন্দুদের পিঞ্জিরা থেকে পালাতে চেষ্টা করলাম; কিন্তু পারলাম না। তারা আমাকে ধরে ফেলল। ভীষণভাবে পেটাল। অবশ্য এই পিটুনী তখন আর আমার জন্য নতুন কোন বিষয় ছিল না। বিগত দেড় দেড়টি মাস ধরে আমার সাথে এই ব্যবহারই করা হচ্ছিল। গোঁড়া ও উগ্রপন্থী হিন্দুরা ক্ষুধার্ত কুকুরের ন্যায় আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কেউ চুল ধরে টানছিল, কেউ মনের ঝাল মিটাতে নানা ভাষায় গালি দিচ্ছিল। সমস্ত আত্মীয়-স্বজন আর অনাত্মীয়দের মধ্যে শুধুমাত্র আমার ভাবী আমাকে ঐ খুনী হিন্দুদের নির্মম থাবা থেকে মুক্ত করার নিষ্ফল চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন। গ্রামের মুসলমানরা ছিল অসহায়। পুলিশের ভয়ে তারা আমাকে কোন সাহায্য করতে পারছিল না।

বহু দূর-দূরান্ত থেকে পন্ডিত, ঠাকুর এবং সাধুরা এসেছিলেন। তারা যে কোন মূল্যে আমাকে হিন্দু বানাতে চাচ্ছিলেন। আমাকে তারা এত মার মারল যে, আমি বেহুঁশ হয়ে গেলাম। যখন হুঁশ আসল, তখন দেখলাম, আমার পায়ে মোটা রশি বাঁধা এবং সে রশি ধরে আমাকে টেনে-হেঁচড়ে শংকর মন্দিরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিদারুণ পরীক্ষার এই চরম মুহূর্তে মা, বাবা, ভাই, বোন সবাই আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বরং তারাও অন্যান্য হিন্দুদের মত আমার রক্তের নেশায় ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিলেন।

তারা অবিরাম আমাকে টেনেই চলছিল। আমার গোটা পৃষ্ঠদেশে মারাত্মক জখম হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় ক্ষণে ক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যেতাম, আবার ক্ষণেই জ্ঞান ফিরে পেতাম। জানি না তারা এত কষ্ট দিয়ে দিয়ে আমাকে কেন হত্যা করতে চাচ্ছিল। তারা আমাকে নওমুসলিম যুবতীর মত আগুন দিয়ে কেন জ্বালিয়ে দিল না, যাতে আমি মুহূর্তে জুলে-পুড়ে মরে যেতাম। সম্ভবত আশপাশের গ্রামগুলোতে যে সমস্ত শুদ্র এবং কুলীনরা মুসলমান হয়েছিল, তাদের সবার প্রতিশোধ ওরা আমার উপর নিচ্ছিল। আমি এক অসহায় শিকারের মত তাদের হাতের নাগালে এসে গিয়েছিলাম। তারা আমার দেহটাকে চিরে ফেড়ে খাবলে খাবলে নিচ্ছিল। তারা হাতে তালি দিচ্ছিল আর অট্টহাসি হাসছিল। আমার সাথে তারা অন্যান্য মুসলমানদেরকেও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছিল।

এই জুলুম-নির্যাতনের কল্পনাও আমি করতে পারতাম না, যা ইসলাম গ্রহণ করার ‘অপরাধে’ আমার উপর চলছিল। কষ্টের আতিশয্যে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। পথ-ঘাটের ইট সুড়কি আর কাটা আমার শরীরে বিদ্ধ হচ্ছিল। আমি আল্লাহ্‌র দরবারে দোয়া করতে লাগলামঃ

“হে আল্লাহ্‌! আমার মৃত্যুকে সহজ করে দাও এবং আমার জীবনের শেষ মুহূর্তে ঈমানের সাথে থাকতে দাও। হে আল্লাহ্‌! এই দুঃসহ কষ্ট থেকে আমাকে মুক্তি দাও।”

ঐ দুরাবস্থার সময় যখন আমি কালেময়ে তায়্যিবা পড়তাম, তখন আমার স্বর্গীয় প্রশান্তি অনুভব হতো। এমন মনে হতো, যেন আমার কোন কষ্টই নেই।

শংকর মন্দির আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় সোয়া কিলোমিটার দূরে। ঘোসির নিকটবর্তীই আবার নরওয়াল গ্রাম। এই নরওয়াল গ্রাম আর চম্বরিয়া গ্রামের মাঝামাঝি একটি জঙ্গল। এই জঙ্গলের মধ্যে মন্দিরটা। মন্দিরের সামনে একটি পুকুর। পুকুরটি ডোঙ্গা পুকুর নামে পরিচিত। এর এক পাড়ে শ্বশান ঘাট, যেখানে হিন্দুরা তাদের মৃতদের পোড়ায়।

আমার ধারণা হচ্ছিল, এখন ওরা আমাকে এখানে জীবন্ত পোড়াবে। তখন আল্লাহ্‌র সাথে সাক্ষাতের আনন্দে তরঙ্গের মত এক অব্যক্ত বিদ্যুৎ আমার সারা শরীরে বয়ে গেল। আমি আমাকে এই দুনিয়া থেকে বহু দূরের অন্য এক জগতে দেখতে লাগলাম। “মউতের দৃশ্যপট, মৃত্যুর পর কি হবে”? ইত্যাদি যেসব কিতাব পড়েছিলাম, তাতে বর্ণিত একেকটি বিষয় আমার স্মৃতিপটে ভাসতে লাগল। আল্লাহ্‌ তায়ালার দরবারে দোয়া করতে লাগলামঃ “হে আল্লাহ্‌! জাহান্নাম থেকে আমাকে বাঁচাও, কবরের হিসেব-নিকেশ আমার জন্য সহজ করে দাও। আমাকে প্রিয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শাফায়াত নসীব কর এবং তোমার দিদারের সৌভাগ্য দান কর”।

আমাকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে সমস্ত কাপড় খুলে সেগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হলো এং হলুদ রং-এর ধুতি পড়ানো হলো। ছাই এনে আমার সারা শরীরে মাখান হলো আর কপালে তিলক এঁটে দেয়া হলো। তারা আমার মাথা নেড়ে করে দিল; কিন্তু এক গুচ্ছ চুল টিকি বানিয়ে রেখে দিল। শূকরের দুটা বাচ্চা এনে বলি দেয়া হলো এবং তার রক্ত দিয়ে আমাকে গোসল করানো হলো। এরপর আসলো পন্ডিত মশাই। তিনি শাস্ত্রালোচনা করলেন, রামায়ন পাঠ করতে লাগলেন।

এসব হতে দেখে আমি ভাবছিলাম যে,  হিন্দুরা আমাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার পূর্বে তাদের ধর্মীয় প্রথাগুলো পালন করে নিচ্ছে। এই সব প্রথা পালন করতে দেখে আমি আল্লাহ্‌র নিকট আরজ করতে লাগলাম, “হে আল্লাহ্‌! এই সব প্রথা-পর্ব আর কুসংস্কারের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তুমি জান যে, আমি এখানে বড় অসহায়, এজন্য আমাকে মাফ করে দাও”।

আমি এসব চিন্তা-ভাবনার মাঝে ডুবে ছিলাম। এর মধ্যেই পন্ডিত সাহেব প্রথা-পর্ব শেষ করেই ঘোষণা দিলেন যে, মুহাম্মদ আলী আবার রামচন্দ্র হয়ে গেছে। এ ঘোষণা শুনে হিন্দুরা আনন্দে নাচতে লাগল। মিষ্টি বিতরণ করা হলো এবং হিন্দুরা একে অপরকে মোবারকবাদ জানাতে লাগল।

তাদের এই সিদ্ধান্ত আমার জন্য শুধু অপ্রত্যাশিতই ছিল না; চরম দুঃখজনকও ছিল। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, আর হিন্দুরা আমাকে যে ধরনের জীবন ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছিল, তা আমার নিকট ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। আমি তো রামচন্দ্র হয়ে আর একটি মুহূর্ত বেঁচে থাকতে চাই না। বরং মুহাম্মদ আলী হয়ে হাজার বার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছিলাম এক পায়ে দাঁড়িয়ে। তাই আমার জীবনের এই মুহূর্তটা আমার জন্য পূর্বেকার সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা আর জুলুম-নির্যাতনের চেয়েও বেশি কষ্টদায়ক ছিল। তাদের খোশ-খবরী এবং আনন্দের অট্টহাসি আমার কানে খঞ্জরের ধার হয়ে বিদ্ধ হচ্ছিল। আমি অধিকক্ষণ ধৈর্যধারণ করতে পারছিলাম না। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিলামঃ “এই হিন্দু সমাজ! তোমরা ভাল করে শুনে রাখ, তোমরা আমাকে দ্বিতীয়বার আর হিন্দু বানাতে পারবে না। আমি এক আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে পাথরের তৈরি প্রতীমার সামনে মাথা অবনত করতে পারব না। আমি ঘোষণা করছি যে, আমি মুসলমান। আমাকে মুসলমানদের নিকট যেতে দাও।”

এ কথাগুলো বলতেই তারা আবার আমাকে মারতে শুরু করল। সামান্য বিরতি দিয়ে দিয়ে তারা আমাকে মেরে চলল একেবারে রাত পর্যন্ত। রাতে আমাকে মন্দিরের ভেতরে আবদ্ধ করে তালা লাগিয়ে সমস্ত হিন্দুরা যার যার বাড়িতে চলে গেল। মন্দিরের মধ্যে আমাকে বন্দি করতে গিয়ে পন্ডিত সাহেব বললেনঃ তুমি ভগবানের শত্রু, তুমি ভগবানের ক্ষমতা ও শক্তিকে অস্বীকার কর, তুমি আমাদের দেবতাদের কটু কথা বল, খারাপ বল। আজ রাতে ভগবানের কৃপায় জীন এবং ভূত তোমাকে খাবলে খাবলে খাবে”।

“আমি যদি এখনও রাম চন্দ্রই থাকতাম, তাহলে হয়তবা আমাকে খাওয়া হতো। কিন্তু এক লা-শারীক আল্লাহ্‌র কসম, আমি এখনো মুহাম্মদ আলীই আছি। আর ঐ সমস্ত ভূত আমার নাম শুনেই হাওয়া হয়ে যাবে”। পন্ডিত সাহেবের ঐ কথার জবাবে আমি এ কথা বললাম।

মন্দিরের মধ্যে মা কালির ভয়াবহ মূর্তি ছিল। এছাড়াও গণেশ এবং অন্যান্য অনেক মূর্তি উপস্থাপিত হল। গোমাতার মূর্তিও ছিল। রাতের নিস্তব্ধতায় আমি মন্দিরের মধ্যে একা ছিলাম, আর এ ছিল এক ভয়াবহ দৃশ্য। যদি মুসলমান হওয়ার আগে আমাকে এখানে একা থাকতে হতো, তাহলে হয়তো ভয়ের তীব্রতায় মাত্র কয়েক মুহূর্তে মৃত্যুমুখে পতিত হতাম। কিন্তু এখন আমার স্বীয় খোদার প্রতি এমন দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এই পাথর আর মাটির মূর্তি আমার কোন অনিষ্ট করতে পারবে না। এর পরও কিন্তু আমার মনের কোণে ভয় কিছু ছিলই। সে ভয় ছিল এই কারণে যে, ছোট থেকে এই পর্যন্ত ঐ সমস্ত দেবতাদের পূঁজা করে এসেছি এবং জন্মের পর থেকে এদের সম্পর্কে ভিত্তিহীন, মিথ্যা-বানোয়াট শত-সহস্র কল্পকাহিনী শুনেছি। যার একটা প্রভাব তো অবশ্য মনের কোণে এখনো অবশিষ্ট আছে। সম্ভবত ঐ ভয়কে মন থেকে একেবারে মুছে ফেলার জন্যই আমার আল্লাহ্‌ আমাকে এখানে আবদ্ধ করিয়েছেন। ঐ ভয়কে দূর করার জন্য আমি সারা রাত আল্লাহ্‌কে স্বরণ করছিলাম। যে আয়াত এবং দোয়া স্মরণ ছিল, তা পাঠ করছিলাম।

আমার পিঠ মারাত্মক ক্ষত-বিক্ষত ছিল। তাই চিত হয়ে শুতে পারছিলাম না। সমস্ত শরীর জুড়ে জখমের প্রচণ্ড ব্যাথা। এই ব্যাথা আরও প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর হচ্ছে। আমি যন্ত্রণায় কোকাচ্ছিলাম। জানি না রাতের কোন্‌ প্রহরে এবং কিভাবে আল্লাহ্‌ তায়ালা আরামদায়ক ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আমাকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এর পরে সে যন্ত্রণা আর হয়নি, প্রশান্তিতেই রাখলেন।

দ্বিতীয় দিন সমস্ত হিন্দুরা আমাকে জীবিত দেখে হতবাক্‌ হয়ে গেল। কিন্তু ঐ সমস্ত মূর্তিপূজকদের ভাগ্যে গোমরাহীই লিপিবদ্ধ ছিল। এই জন্য এরা সব কিছু দেখেও সত্যকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এক্ষেত্রে তাদের এটা মেনে নেয়া উচিৎ ছিল যে, মাটি আর পাথরের ভগবান কোন শক্তি বা ক্ষমতার মালিক হতে পারে না এবং মানুষকে কোন ক্ষতিও করতে পারে না। উল্টো তারা বলতে শুরু করলঃ

“আমাদের ভগবান বড় রহমদিল। তিনি তোমাকে সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য দীর্ঘ সুযোগ দিতে চান। তাই তিনি তোমাকে জিন-ভূতদের থাবা থেকে রক্ষা করেছেন। অতএব, আমরা তোমাকে বলছি যে, যত দ্রুত পার-হিন্দু মতাদর্শকে দ্বিতীয়বার গ্রহণ কর। আর যদি তা না কর, তাহলে আবার ভগবানের অসন্তুষ্টি তোমাকে পুড়ে ভম্ম করে দেবে”।

আমি তাদের কথা শুনে ঐ দূরাবস্থাতেও না হেসে পারলাম না। পারলাম না এই ভেবে যে, পাথরের তৈরী মূর্তির মাঝেও আবার হৃদয় আছে যে, সে 'রহমদিল' হবে? আমি তাদেরকে বললাম, “তোমাদের এই সব মাটি আর পাথরের ভগবান আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তবে শোন, তোমরা যদি নিজেদের জন্য স্থায়ী শান্তি চাও, জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল জ্বলতে না চাও, তাহলে ইসলাম গ্রহণ কর”।

আমার উপর আবার শুরু হলো নিপীড়ন- নির্যাতন। “আমি চিন্তা করতে লাগলাম যে, এই জালেমদের হাত থেকে উদ্ধার করার মত এখানে আমার কেউ নেই। কিন্তু পরক্ষণেই আমার মন বলে উঠত যে, আমার আল্লাহ্‌ তো এই সমস্ত কিছু দেখছেন এবং শুনছেন, আল্লাহ্‌ তায়ালার চেয়ে বড় রক্ষাকারী আর কে হতে পারে? “নিঃসন্দেহে আল্লাহ্‌ তোমাদের মাওলা এবং সর্বোত্তম সাহায্যকারী”

বিগত চব্বিশ ঘণ্টা যাবৎ আমি কিছু খাইনি। তারা আমাকে খাবার দেয়ার কোন প্রয়োজনও মনে করেনি। এটা আল্লাহ্‌ তায়ালার বড় দয়া ছিল যে, তিনি আমাকে ক্ষুধা সহ্য করার শক্তি দিয়েছিলেন। আমার মা-বাবা, ভাই-বোনরা তো অন্য হিন্দুদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আমাকে মেরে ফেলার জন্য ব্যস্ত ছিলেন। শুধু একজন মাত্র মানুষ তখনও আমার প্রতি সদয় ছিলেন। তিনি আমার ভাবী, যিনি বাড়ীতেও আমাকে ঐ সমস্ত জালেমদের জুলুম থেকে বাঁচাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্ট করেছিলেন।

জেল থেকে মুক্ত করার জন্যও তিনি রাত- দিন একাকার করে ফেলেছিলেন। আবার এখনও এই জঙ্গলের মন্দিরে হানা দেয়ার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। পন্ডিত এবং পূজারীদের থেকে আমাকে মুক্ত করার জন্যও তিনি রাত-দিন এক করে ফেলেছিলেন। আবার এখনও এই জঙ্গলের মন্দিরে খানা দেয়ার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তিমি পন্ডিত এবং পূজারীদের হাতে পায়ে ধরে খাবার আনার অনুমতি আদায় করেছিলেন। এর জন্য তিনি কত মিথ্যার আশ্রয়-ই না নিয়েছিলেন। আমার প্রতি তার এই মমত্ববোধের জন্য ভাইয়্যার হাতে পিটুনিও তাকে খেতে হয়েছিল। কিন্তু আমার জন্য তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা আমি কোন দিন ভুলতে পারব না। প্রকৃত পক্ষে তিনি একজন স্নেহময়ী বোন এবং ভালবাসা ও মমতায় মা'র ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনিই সকাল-বিকাল আমার জন্য মন্দিরে খাবার নিয়ে আসতেন।

মন্দিরের দিন-রাতগুলো আমার নিকট ছিল খুবই কষ্টকর। ক্ষতস্থানের প্রচন্ড ব্যাথা আমাকে দিনে বসতে দিত না আর রাতে দিত না আরামে একটু শুয়ে ঘুমোতে। আমি এই দুরাবস্থার মধ্যে দিন-রাত কেঁদে কেঁদে আল্লাহর নিকট দোয়া করতামঃ

“হে আল্লাহ! তুমি সত্য। ইসলাম সত্য, তোমার রাসূলও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্য। হে আমার আল্লাহ! আমার যদি জীবন অবশিষ্ট থেকে থাকে, তাহেল আমাকে এই সমস্ত জালেম কাফেরদের হাত থেকে পরিত্রাণ দাও। আর যদি জীবন বাকী না থাকে, তাহলে শীঘ্র আমাকে তোমার কাছে নিয়ে নাও। কাফেরদের নির্দয় মার আমার এখন আর সহ্য হচ্ছে না।”

আল্লাহ্‌ আমার দোয়া কবুল করলেন। আমার মাথায় আল্লাহ্‌ তাআলা একটি বুদ্ধি জাগিয়ে দিলেন যে, আমাকে এখান থেকে রাতে কেটে পড়া উচিৎ।

মন্দির খুব প্রশস্ত ছিল। রাতে এখানে কেউ থাকতো না। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া মুশকিল হলেও অসম্ভব নয়। তবে মন্দিরের দেয়াল অত্যন্ত উঁচু ছিল। আমি সব কিছু নিরীক্ষণ করে পরিকল্পনা করলাম যে, মূর্তির উপর উঠে দীপ মন্ডপ পর্যন্ত সহজেই পৌঁছতে পারব। যদি একটা রশি কোনভাবে পাই, তাহলে সে রশি মূর্তির গলায় বেধে দ্বীপ মন্ডপে রেখে বাইরে ঝুলিয়ে পরে নিরাপদে এ নরকপুরী থেকে বেরিয়ে যেতে পারব।

আমি ভাবী থেকে এই সাহায্য নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। দ্বিতীয় দিন ভাবী আমার জন্য যখন খানা নিয়ে এলেন, তখন আমার সিদ্ধান্তের কথা তাকে জানালাম। সিদ্ধান্তের পুরো পরিকল্পনা শুনে তিনি বললেনঃ “হায়....। তুমি ভগবানের মাথায় চড়ে পালাবে?” কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বললেন যে, আমি আমার ভাইকে এই চরম বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য সব কিছুই করবো।

রাতের খাবার নিয়ে যখন তিনি আসলেন, তখন কোমরে পেচিয়ে একটি রশিও নিয়ে এলেন। আমি তাঁকে বললাম যে, এই পর্যন্ত আপনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। অন্যদের মত আপনিও আমাকে ছেড়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তা না করে এত সাহায্য যখন করলেন, শেষ বারের মত আরেকটি উপকার করতে হবে। অমুক মুসলমানকে একটু খবর দিবেন যে, আমি আজ রাতে এখান থেকে পালিয়ে আসব। সে আমাকে অমুক পিপুল গাছের নীচে পাবে।

ভাবী আমার এখান থেকে পালানোর পরিকল্পনায় আনন্দিতও হলেন আবার দুঃখিতও হলেন। তিনি চলে যাবার জন্য দাঁড়িয়ে দুঃখ বিজড়িত কণ্ঠে বললেন, “রাম চন্দ্র!”

আমি বললাম, “না ভাবী! আমার নাম মোহাম্মদ আলী।”

“ঠিক আছে, মোহাম্মদ আলীকেই বলছি। তুমি আমার সহোদর ভায়ের চেয়েও প্রিয়। আমার খুব দুঃখ লাগছে যে, তুমি এখান থেকে চলে গেলে সারা জীবনে তোমাকে হয়ত আর দেখতে পাব না। কিন্তু তোমার উপর এখানে যে অত্যাচার চলছে, তা দেখেও আমি সইতে পারি না। তুমি যতখানি জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছো, আমার হৃদয়েও ততখানি ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। রাতভর আমি তোমার জন্য কেঁদেছি। আমি তোমার ভাই, মা, বাবা সবাইকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা কোন কিছুই শুনতে চান না। তুমি এখান থেকে চলে গেলে তোমার কথা আমার সারাক্ষণ মনে পড়বে। তবে আমি এতটুকু সান্ত্বনা পাব যে, তুমি এই সীমাহীন নির্যাতন থেকে মুক্ত রয়েছো। আমি প্রার্থনা করি, তুমি যেখানেই যাও ভগবান যেন তোমাকে ভাল রাখেন, সুখে রাখেন, শান্তিতে রাখেন।”

আমি ভাবীকে বললাম, “ভগবান নয় ভাবীজান, আল্লাহ বল।” তখন তিনি হেসে বললেনঃ “ঠিক আছে আল্লাহ-ই বললাম”

এতটা স্নেহময়ী যে ভাবী, সে ভাবীকে ছেড়ে যেতে আমারও বড় দুঃখ হচ্ছিল। তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন আমি ভাবলাম যে, তার এই অসামান্য সাহায্যের জন্য তাঁকে কমপক্ষে ধন্যবাদ জানাতে হয়। আমি আওয়াজ দিয়ে তাঁকে ফিরে আসার জন্য ডাকলাম এবং বললাম, “ভাবীজান। আমার এই দুর্দিনে যখন মা-বাবা এবং ভাই- বোনরা সবাই আমাকে ত্যাগ করেছেন, তারা আমার রক্তের পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছেন, তখন আমার পাশে আছেন শুধু আমার আল্লাহ আর আছ তুমি। আমি বলতে পারছিনা যে, কী ভাষা দিয়ে আমি তোমার এই ত্যাগের কৃতজ্ঞতা জানাব। আমি তোমার এই স্নেহ, মায়া ও নির্মল ভালবাসার কথা জীবনের শেষ নিঃশাস পর্যন্তও ভুলতে পারব না। আমার জন্য তুমি যে পরিমাণ মার খেয়েছো এবং দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছো, আমি তোমার সেই ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবো না।”

আমি লক্ষ্য করলাম যে, ভাবীর দু'চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়েছে, সে অশ্রুতে চোখের দু'কোন ভিজে উঠেছে। ভেজা চোখ তিনি আঁচল দিয়ে মুছলেন। আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। তিনি হয়ত কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর সে আওয়াজ দীর্ঘ তপ্ত নিশ্বাস আর কান্নার গোমকে আটকে গেল। আবেগের বাস্কোচ্ছ্বাসে তিনি দৌড়ে দৃষ্টি সীমায় হারিয়ে গেলেন।

দেবী কালি মা'র পাথরের লম্বা জিহ্বা বেরিয়ে আছে। আমি তার জিহ্বায় রশিটি ভাল করে বাঁধলাম।

পালাবার সমস্ত আয়োজন-প্রয়োজন শেষ করেছি। এমন সময় হঠাৎ আমার মাথায় হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ঘটনা মনে পড়ে গেল। যখন শহরের সমস্ত মানুষ মেলায় চলে গেল, তখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মন্দিরে গিয়ে কোন মূর্তির মাথা উড়িয়ে দিলেন, আবার উড়িয়ে দিলেন কোনটার কান, কোনটার নাক আবার কোনটার হাত। আমি ভাবলাম, এত বড় সুযোগ পেয়েও এই মন্দিরের মূর্তিদেরও এ অবস্থা না করে ইব্রাহীম (আঃ)-এর সুন্নত আদায়ের অসীম সওয়াব হাসিল করা থেকে কেন বঞ্চিত হবো?

আমার সারা অঙ্গ আঘাতে আঘাতে ক্ষত- বিক্ষত ছিল। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও কোন চিকিৎসা না করায় ক্ষতস্থানগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়েছিল। প্রচণ্ড ব্যাথায় চিন চিন করছিল সারা শরীর। কিন্তু এ সত্ত্বেও সুন্নতে ইব্রাহীমকে পুনর্জ্জীবিত করতে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি মন্দিরে লাগিয়ে রাখা মূর্তির ছবিওয়ালা পোস্টারগুলো ছিড়ে ফেললাম। একটা ইট হাতে নিয়ে মূর্তিগুলোর চেহারা বিকৃত করে দিতে শুরু করলাম। কোনটার নাক, কোনটার কান, আবার কোনটার মুখ ভেঙ্গে দিলাম।

দূরের পল্লীতে মোরগের ডাক শোনা গেল। সময় অনুমান করে রশি ধরে দেয়াল টপকিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়লাম। মুসলমান ব্যক্তিটি পিপুল গাছের নিকটে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আমার পরণে ছিল মাত্র একটা ধুতি। আমার উপর ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে কিঞ্চিত তাকে অবহিত করলাম। সে আমাকে তাঁর গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে জৈনপুরের “রিয়াজুল উলুম”-এর দিকে ছুটে চলল।

জৈনপুর আমাদের গ্রাম থেকে ১০০ কিলোমিটার দূর। মাওলানা আব্দুল হালীম সাহেব রিয়াজুল উলুমের মুহতামিম। আমরা ক'দিন পর্যন্ত তাঁর কাছেই থাকলাম। এরপর তাঁর নির্দেশেই আবার বোম্বের দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

বোম্বের হাজী শামছুদ্দিন সাহেবের কাছে গিয়ে উঠলাম। তিনি আমাদের গ্রামের লোক এবং প্রতিবেশী। হাজী সাহেব দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে শিক্ষা সমাপন করেছেন। বোম্বে তিনি বড় ব্যবসায়ী, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রথম সারির একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আবার মদনপুরের তায়্যিবা কলেজ পরিচালনা কমিটির জেনারেল সেক্রেটারী।

আমি দারুণভাবে আহত ছিলাম। আমাকে অনতিবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করান হল। অপারেশন করে আমার পিঠের চামড়ার ভেতর থেকে অনেকগুলো ইট-শুড়কি এবং কাটা বের করা হলো, যা হেঁচড়ানোর সময় পিঠে বিঁধে গিয়েছিল। ছয় মাস নাগাদ আমি একটানা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এ সময় আমার খতনাও সম্পন্ন হয়েছিল।

হাজী সাহেবের নিকট প্রায় একটি বছর অবস্থান করলাম। এরপর আমাকে দারুল উলুম এমদাদিয়া বোম্বেতে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল। এখানে আমি তিন বছর ছিলাম। এই তিন বছরে প্রাথমিক উর্দু, দেখে কুরআন শরীফ পাঠ করা এবং প্রথম শ্রেণীর পরীক্ষা পর্যন্ত পৌঁছুলাম।

এই সময়ে আমার ভাবীর কথা বেশ মনে পড়তে লাগল। কিন্তু শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারছিলাম না। এমন সময় খবর পেলাম যে, আমার পরিবারের লোকজন আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেননা আমাকে দ্বিতীয়বার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেয়ার খায়েশ তাদের অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম হাজী সাহেব বোম্বে থেকে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। তার নিকট ভাবীর উদ্দেশ্যে একটি পত্র লিখে দিলাম এবং হাজী সাহেবকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিলাম যে, এ খবর যেন কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও টের না পায়।

কে জানে কেমন করে বাড়ির মানুষ আমার খোঁজ জানতে পারল এবং আমাকে ধরার জন্য গ্রামের অন্য ক'জন হিন্দুকে সঙ্গে নিয়ে বোম্বে এসে উপস্থিত হলো। তাদের অনুরোধে মাদ্রাসায় এবং হাজী সাহেবের বাসায় বারংবার পুলিশ চক্কর দিতে শুরু করল। এই অবস্থা দেখে হাজী সাহেব অন্যান্য আলেমদের সাথে আমার ব্যাপারে পরামর্শ করলেন। কোন একজন পরামর্শ দিলেন যে, আমাকে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়া হোক। কেউ বা বললেন ইরান পাঠাতে। শেষ সিদ্ধান্ত হলো পাকিস্তানে পাঠানোর সেখানেই নাকি নিরাপদে থাকা যাবে। পাকিস্তানই যাওয়া হলো।

এরপর এক পর্যায়ে আফগানিস্তানের জিহাদের প্রতি আমার মন দারুণভাবে আকৃষ্ট হলো এবং জিহাদের ময়দানে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লাম। জিহাদে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য অর্জনের দুর্বার আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই তীব্রতর হতে লাগল।

সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্যই ১৯৮৭ খৃষ্টাব্দে আমি আফগানিস্তান সফরে যাই। পাকতিয়া প্রদেশের আল-ফাতাহগঞ্জের অদূরবর্তী ফয়েজ পোস্টে অবস্থান করলাম। সরফরাজ সাহেব ছিলেন আমাদের কমান্ডার। আমি এখানে ১৬ দিন কাটালাম। এই অল্প সময়ে আমি আগ্নেয়াস্ত্রের প্রাথমিক ট্রেনিং সম্পন্ন করলাম এবং যাত্রী ছাউনীতে আক্রমণে অংশগ্রহণ করলাম। দ্বিতীয় দফায় জমিয়াতুল মুজাহিদীনের আমীরের সাথে খোস্ত এলাকার নিকটবর্তী ‘বাড়ি' এলাকায় গিয়েছিলাম। এখানে এক সপ্তাহ থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণও করি। ঐ লড়াইয়ে ভয়ংকর এক বোমা বিস্ফোরণে কমান্ডার সাহেবের বাম পা উড়ে যায়। রক্তের ফোয়ারা বইতে শুরু করে। কিন্তু আল্লাহ্‌র ঐ মুজাহিদ বান্দা তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমাদেরকে জিহাদের তালকীন দিচ্ছিলেন। আধা ঘণ্টা পরেই তিনি শাহাদাত বরণ করলেন। ঐ হামলায় আবদুস সাত্তার মূলতানী নামের আরেক মুজাহিদের পা মারাত্মকভাবে আহত হয়। হাটু পর্যন্ত কেটে ফেলার নির্দেশ হলো। তখন তিনি নিজেই সামান্য ঝুলে থাকা পায়ের টাখনু এক ঝটকায় ছিড়ে ফেললেন। সময় মত সাহায্যকারী ডাক্তার পাওয়া গেল না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তিনিও শাহাদাত বরণ করলেন।

আমি পাকতিয়ার উরগুন ও খোস্তের নিকটবর্তী এলাকায়ও গিয়েছিলাম। ‘বাড়ি’তে কমান্ডার খালেদও আমার সামনেই শহীদ হন এবং খালিদ মাহমূদ ও আব্দুর রহমান নামের আল্লাহর দুই মুজাহিদের পা কাটা যায়।

আমি যতবারই আফগানিস্তান গিয়েছি, প্রতিবারই আমার প্রবল আগ্রহ ছিল যে, আল্লাহ্‌ তা'য়ালা যেন আমাকে শাহাদাতের পেয়ালা পান করিয়ে সৌভাগ্যবান করেন। কিন্তু মনে হয় আমি নিজেকে এখনও শহীদ হবার যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারিনি।

(সমাপ্ত)

 

অনুবাদঃ নকীব আশরাফ