আমার দেশের চালচিত্র
স্বাধীনতার রজতজয়ন্তিঃ তালেবানের ন’মাসঃ
তারা পেয়েছে বীরত্বের মালা আমরা পরেছি
গোলামীর জিঞ্জির
ফারুক হোসাইন খান
চমকে ওঠার মতো একটা খবর। মুসলমান মাত্রেই এ খবরে রোমাঞ্চিত হবেন, গর্বিত হবেন। মরচে ধরা ঈমান সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতো সজীব হয়ে উঠবে। খবরটি হলো, ইসলামের সিংহ পুরুষদের ও সফলতা সম্পর্কিত। তালেবানের অভাবনীয় অগ্রগতি ও সফলতায় ভীত-সন্ত্রস্ত পাশ্চাত্য শক্তি আফগানিস্তানের ওপর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার জল্পনা কল্পনা চালানোর প্রেক্ষিতে এ খবরের সৃষ্টি হয়েছে। পাশ্চাত্যের ইসলাম বিদ্বেষীদের এ ধরণের জল্পনার বিরুদ্ধে অত্যন্ত বীরোচিত জবাব দিয়েছেন আফগান অর্থমন্ত্রী মৌলভী ইহসানুল্লাহ ইহসান। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেন, “এ ধরনের হুমকি হলো শয়তানী হুমকী মাত্র। আফগান জনগণ যদি ইসলাম ও তাকওয়ার ওপর অটল থাকে, তাহলে এমন কোন শক্তি নেই, যারা আমাদের বিরুদ্ধে কোন অবরোধ আরোপ করে ক্ষতি করতে পারবে। আর যদি কেউ এমনটি করেই বসে, তাহলেও আমরা তার পরোয়া করিনা, তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের অতি উর্বর জমি দান করেছেন। আমরা আমাদের কারখানায় উৎপাদিত পোষাক পরব আর নিজেদের জমিনে উৎপন্ন খাদ্য খাব। আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি কোন অবরোধ না আসে, তিনি যদি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, তা হলে শপথ আল্লাহর, আন্তর্জাতিক কোন অবরোধ আমাদের একটি চুলও বাঁকা করতে পারবে না”।
সাবাস আফগান মুজাহিদ মন্ত্রী! আপনার এই বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা, ঈমানদীপ্ত চেতনার জন্য আপনাকে জানাই হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধা আর অভিনন্দন। সিংহ সেতো বনের রাজা, কার এত দুঃসাহস তাকে চ্যালেঞ্জ করে। এক হুঙ্কারেই সে সমগ্র বনভূমি প্রকম্পিত করে তুলবে, এতো স্বাভাবিক। দুনিয়ায় মুসলমান থাকবে আবার শয়তানী শক্তির ধ্বজাধারীরা তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর দুঃসাহস করবে, তাকে রক্তচক্ষু রাঙাবে, তা হতে পারে না। সিংহ শাবকদের নির্জীব করে মেষ শাবকে পরিণত করে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখা যেতে পারে কিন্তু সিংহ শাবক গর্জন করবেই আর কলিজা হিম করা এ গর্জনের মাধ্যমেই সকলকে জানান দেবে তার শ্রেষ্ঠত্ব, শক্তিমত্তা।
ইসলামের সিংহ পুরুষদের সূতিকাগার আফগান ভূমির সিংহ পুরুষরা আবার গর্জে উঠেছে। শয়তানী ক্ষমতাদর্শী পশ্চিমা বিশ্বকে জানান দিয়েছে তাদের আগমন বার্তা আফগান অর্থমন্ত্রী তার দৃঢ় উচ্চারণে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমাদের শয়তানী বুদ্ধির কাছে আর যে-ই মাথা নত করে রাখুক, আফগান জনগণ কোনক্রমে তা করতে রাজী নয়। আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা জ্ঞাপনকারী আফগানরা তোমাদের হুমকী ধমকির কোন পরোয়াই করে না। তাদের এই ইস্পাতদৃঢ় মনোবল বিমূর্ত হয়ে ওঠে আর একটি ঘটনায়। ঘটনাটি হলো কান্দাহার নগরীর। বিশ্ব মুরুব্বী জাতিসংঘে কর্মরত এক বেলজীয় অফিসারের ঘরে এক শিয়া মহিলার আপত্তিকর যাতায়াতের অভিযোগে তালেবান পুলিশ শিয়া মহিলাকে গ্রেফতার করে ও বেলজীয় অফিসারকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে। সভ্যতাগর্বী বেলজিয়াম এতে মহা ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ক্রোধের সাথে তারা তালেবান সরকারকে হুমকী প্রদান করে যে, এ বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার না করলে তারা আফগানিস্তানে সকল সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দেবে। তবে এ হুমকীকে তারা সামান্য পরোয়াও করেনি। তালেবান সরকার বেলজিয়ামকে ততোধিক দৃঢ়তার সাথে জানিয়ে দেয় যে, “তারা ইসলামী সরকারের খোদায়ী বিধানের বিরুদ্ধাচারণকারী কাউকেই মুহূর্তের জন্যও ক্ষমা করবেন না। বেলজীয় অফিসার শুধু ইসলামী আইন নয়, জাতিসংঘ সনদও ভঙ্গ করেছে।” মুখপাত্র আরও বলেন যে, ইসলাম আফগান জনগণের সর্বাপেক্ষা প্রিয় ও মুল্যবান বিষয়। ইসলামের স্বার্থে আমরা এত ত্যাগ স্বীকার করেছি। ইসলামের প্রশ্নে কারো হুমকীর কাছে আমরা মাথা নত করবো না। ইসলামী আইনের প্রশ্নে কোন বিদেশী সংস্থা যদি আফগানিস্তানে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে চায়, তাহলে আমরা তাতে কখনই বাধা দেবো না। আমরা মনে করি, এমন সংস্থা কাল নয় আজই বন্ধ করে দেয়া হোক।”
ইসলামী আদর্শের স্বাতন্ত্র রক্ষা ও বিকাশে তালেবানের এ চারিত্রিক দৃঢ়তা আমাদের নিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়-সেই ইসলামের অভ্যূদয়ের সময়কার ইতিহাসের পাতায়। ইসলামের বার্তাবাহক রাসূল (সাঃ) একত্ববাদের বাণী প্রচারে অটল, অবিচল। শত ভয়-ভীতি, নির্যাতন-নিপীড়ন, প্রলোভনের বেড়াজাল ছিন্ন করে ইসলামের প্রচার করেই যাচ্ছেন তিনি। তাঁর এ চারিত্রিক দৃঢ়তায় কাফির-কুরাইশরা তো হতবাক। মুহাম্মদকে থামাতে তারা নতুন টোপ দিলো। তাদের দেবতার বিরুদ্ধে প্রচারণা বন্ধ করলে আরবের সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে তার সাথে বিবাহ দেয়া হবে, মক্কার ক্ষমতা তার হাতে তুলে দেয়া হবে। লক্ষ্যের প্রতি অবিচল নবী (সাঃ) প্রত্যুত্তরে জানিয়ে দিলেন, ‘আমার এক হাতে সূর্য আর এক হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমি আমার দায়িত্ব কর্তব্যকে পরিত্যাগ করবো না।’ এবার এল এক বছর আল্লাহর ইবাদত ও এক বছর দেবতার পূজা করার আপোষ ফর্মূলা, যার পরিপেক্ষিতে সূরা কাফিরূন নাজিল হয়। যার মাধ্যমে এই ধরনের আপোষমূলক ফর্মুলা নাকচ করে দেয়া হয়। এবারও কুরাইশরা রাসূল (সাঃ) এর চারিত্রিক দৃঢ়তায় ফাটল ধরাতে ব্যর্থ হল। আবার শুরু হলো সর্বাত্মক নির্যাতন, নিপীড়ন-রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হলো। রাসূল (সাঃ) শোয়াবে আবু তালিবে তিনটি বছর এ কঠিন বয়কট মোকাবিলা করলেন। শুকনো চামড়া, গাছের ছাল-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করলেন, তবু আদর্শের জন্য ইসলামের জন্য কোন আপোষ করার কথা ভাবলেন না।
নবীজীর আদর্শের বাস্তব প্রতিমূর্তি যেন এই তালেবান মুজাহিদরা। ১৯ বছরের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান। দুনিয়ার যত মানবিক প্রয়োজন যত অভাব-অনটন একযোগে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে যেন এদেশে। তবুও আদর্শের খাতিরে বৈদেশিক সেবা সাহায্যের বিনিময়ে এতটুকু ছাড় দিতেও তারা ইচ্ছুক নন। ১৯ বছর যুদ্ধের আগুনে জ্বলে পুড়ে আফগানিস্তান এখন নিঃস্ব, রিক্ত। কিন্তু তালেবানরা ক্ষমতা গ্রহণের পর কেউ না খেয়ে মারা গেছে বলে শোনা যায়নি। কাবুলের রাস্তায় রাস্তায় ছিনতাই, ডাকাতি, খুন অপরহরণ, গণ অসন্তোষ চলছে বলেও শোনা যায়নি। অথচ মাত্র নয় মাসের যুদ্ধের পর বাংলাদেশের কী অবস্থাটাই না হয়েছিল।
স্বাধীনতার ২৫টি বছর পার করে আমরা এখন পূর্ণ যৌবনে পা দিয়েছি। কিন্তু সদ্য ক্ষমতা গ্রহণ করে তালেবান যা' করতে পেরেছে আমরা এতদিনেও তা' পারিনি। দুনিয়ার কোন রাষ্ট্র তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়নি। অথচ সেই তালেবান জাতিসংঘের মতো সংস্থার একজন অফিসারকে বহিষ্কার করেছে ইসলামী আইন ভঙ্গ করার দায়ে। এই জাতিসংঘই আবার একজন তালেবান শুরা সদস্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করে বাংলাদেশ সফরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। উদ্দেশ্য গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সরেজমীনে তদন্ত করা। একমাস পূর্বে তালেবান সরকার আমেরিকা ও জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য গ্রামীণ ব্যাংকের সকল কর্মকান্ড আফগানিস্তানে বন্ধ করে দেয় এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেশ ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। অর্থাৎ ইসলামী আদর্শের প্রতিপক্ষ কোন শক্তি, সংস্থাকেই তারা আফগানিস্তানের মাটিতে স্থান দিতে নারাজ।
আফগানিস্তানের তুলনায় আমরা যদি আমাদের মাতৃভূমির প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তবে কী দেখতে পাই? ১১ কোটি মুসলমানের দেশে ইসলামকে অপদস্থ, কোনঠাসা করে রাখতেই আমরা স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। ইসলামের চেয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জাগতিক স্বার্থই আমাদের কাছে বড় এবং প্রিয়। তাই পূর্ববর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে মাদক সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে, কতগুলি কারণে মাদক ডিলারদের লাইসেন্স বন্ধ করা যায় না। এদেশে অনেক বিদেশী আছে, তাদের জন্য লাইসেন্স প্রথা বহাল রাখা হয়েছে।
এসব বিদেশীরা আমাদের উন্নয়ন ও সেবায় নিয়োজিত। তাই নির্ধিধায় ইসলামে হারাম ঘোষিত ব্যবসাকেও তিনি পারমিট দিয়েছিলেন একমাত্র বিদেশীদের তোয়াজ করার উদ্দেশ্যে। অথচ, মাদক নিষিদ্ধ আফগান ভূমিতেও হাজার হাজার বিদেশী কর্মরত আছে।
এদেশে তথাকথিত সেবামূলক সংস্থাগুলোর সেবার ধরণ সম্পর্কে কে না জানে। অথচ বিশ্ব ব্যাংক ও দাতা গোষ্ঠীর চোখ রাঙ্গানীর ভয়ে সে সব হজম করে চলছে আমাদের নেতৃবৃন্দ। আমাদের ঈমান-আকীদা, নারীর সম্ভ্রম, ইসলামী আদর্শ নিয়ে বিদেশী সংস্থাগুলো কত খেলা না খেলছে। তারপরও তথাকথিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রম আমাদের কাছে কতবেশী গুরুত্বপূর্ণ।
আগেই বলা হয়েছে, আমরা পঁচিশ বছরে যা পারিনি তালেবান তা ৯ মাসে করে দেখিয়েছে। তারা রাশিয়াকে যেমনি পরোয়া করেনি, তেমনি সদ্য গঠিত মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহের জোটকেও পরোয়া করেনা। অথচ, আমরা এক ভীরু প্রতিবেশীর ভয়েই তটস্ত। তাদের দাসখত দিয়ে সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে দু'পয়সা কামানোর চিন্তায় বুদ হয়ে আছি। কোন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের আগে কয়েকবার ভেবে নেই বিশ্বব্যাংক ও দাতাগোষ্ঠীর ইশারা-ইংগিতের কথা।
আমাদের এ ব্যর্থতার মূলে রয়েছে ইসলামকে দূরে ঠেলে দেয়ার আত্মঘাতি প্রবণতা। ইসলামকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আমরা একটি দাস জাতিতে পরিণত হচ্ছি, আর তালেবান ইসলামকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরেছে বলে তারা প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করছে। তালেবানরা আল্লাহর সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল বলে তারা বেলজিয়ামের হুমকির মুখে কঠোর জবাব দিতে সামান্য ইস্তততঃ করেনা। পক্ষান্তরে, আমাদের স্বাধীনতা রক্ষায় আল্লাহ অপেক্ষা আগুনের শিখার ওপর নির্ভরতার কারণে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সর্বোপরি বিবেকের স্বাধীনতাও হানাদাররা গ্রাস করে নিতে উদ্যত হয়েছে।
তালেবানের জ্ঞানের উৎস আল-কুরআন, আল-হাদিস। ফলে তালেবান নিয়নন্ত্রিত আফগানিস্তান আজ সিংহ পুরুষদের বিচরণ ভূমি। পক্ষান্তরে আমরা আল-কুরআন, আল-হাদিসকে নিষিদ্ধ করে পাশ্চাত্বের জাহেলি চিন্তা-চেতনা, বিদ্যা-বুদ্ধি আহরণে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি বলেই বোধ হয় বিদেশী এক অন্ধকার জগতের বাঈজী এসে এদেশের মাটিতেই আমাদের পিতৃপরিচয় তুলে গালাগাল করে গেল, অথচ আমাদের কণ্ঠে একটু প্রতিবাদের ক্ষীণ আওয়াজও ফুটলো না।
আজ আমাদের অবশ্যই অতীত কর্মকান্ডের খতিয়ান পর্যালোচনা করতে হবে। আফগানিস্তান, চেচনিয়া, বসনিয়া, সুদানের মতো দেশ যদি সীমিত শক্তি ও সমর্থ নিয়ে ইসলামদ্রোহী বিশ্বকে বে-তোয়াক্কা করে চলতে পারে, তবে আমাদের কেন এত দুর্বলতা। আমরা কেন তোয়াজ তোষামুদে জাতি হিসেবে নিজেদের নিহিত করব?