রক্তাক্ত জনপদ
বসনিয়ার একটি গ্রামে নির্মম হত্যাযজ্ঞের করুণ দাস্তান
মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন
জানিয়া, বসনিয়ার সেব্রেনিসা শহরের অদূরে অবস্থিত লিহুবিচি মের ছোট্ট এক কুটিরে তার বাস। সর্ব হায়েনার নির্মম নির্যাতনে নিহত স্বামী হারেছের স্মৃতিই এখন তার একমাত্র সম্বল। এক বছরের কন্যা লায়লাও হারানো পিতার অচেনা ছবিটি হাতে নিয়ে চুমু খায়, আদর করে। পরিবারের, বংশের সব কজন পুরুষ সার্ব হায়েনার হাতে শহীদ হওয়ার খবর লায়লার আজও অজানা রয়ে গেছে।
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে সার্ব বাহিনীর সেব্রেনিসা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ জবর দখল করার সময় জানিয়ার গ্রাম ও পরিবারের উপর এই প্রলয় সংঘটিত হয়। জাতিসংঘ কর্তৃক ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ঘোষিত এই শহরে সার্ব বর্বর বাহিনী যখন অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আক্রমণ চালায়, তখন শহরের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত ইউরোপিয়ান সৈন্যরা তাদের প্রতিরোধ করার পরিবর্তে শহরটি সার্বদের হাতে তুলে দেয়। সার্ব খ্রিষ্টানরা উন্মত্ত হিংস্র হায়েনার ন্যায় বিনা বাধায় শহরে ঢুকে পড়ে। বাসা-বাড়ী থেকে নারী-পুরুষ ও শিশু কিশোরদের টেনে হেচড়ে বের করে। পুরুষদেরকে তাদের স্ত্রী সন্তান ও আত্মীয় স্বজনের চোখের সামনে জবাই করে হত্যা করে। তাদের ধন-সম্পদ, আসবাব-পত্র লুট করে নিয়ে যায়। ঘর-বাড়ী আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তারা নিহতদের টেনে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গণকবরে পুতে রাখে। সেব্রেনিসা শহরের আট হাজার মুসলমান তখন নিখোঁজ বলে ঘোষিত হয়। জনিয়াও সেই হাজারো হতভাগা মহিলার একজন, যারা সার্ব বাহিনীর সেই বর্বর নির্যাতনে স্বামী হারিয়ে এখন ঘরের কোনে বসে কেবল অশ্রুপাত করছে।
জানিয়ার স্বামী হারেছকে মেব্রেনিসার পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক বধ্যভূমিতে শহীদ করা হয়। সার্ব বাহিনী বন্দী মুসলমানদের উপর গুলি বৃষ্টি বর্ষণ শুরু করলে হারেছ মারাত্মক আহত হয়ে আগন ভাই ম্যাভলদীন ওরাক-এর উপর লুটিয়ে পড়ে। ভাগ্যক্রমে ম্যাভলদীন এই গুলি বৃষ্টির মধ্যোও নিরাপদ থাকে এবং শহীদদের লাশের নীচে চাঁপা পড়ে প্রাণে বোঁচ যায়। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা লাশের নীচে চাপা পড়ে থাকার পর যখন সে বুঝতে পারল যে, সৈন্যরা এবার চলে গেছে, তখন সে উঠে বধ্যভূমি থেকে পালিয়ে যায়। ম্যাভলদীন জানায়, সার্ব বাহিনীর যদি সন্দেহ হতো যে, কোনো বন্দী আহত হওয়ার পর এখনো কোনো রকমে বেঁচে আছে, তা হলে পুরো ম্যাগজিন শূন্য করে হলেও তাকে হত্যা করে তবে ক্ষান্ত হতো। জানিয়া ম্যাভলদীনের মুখে এই নির্মম কাহিনী একাধিকবার শুনেছে, কিন্তু তার অবুঝ মন বার বার বলছে, হয়তো বা প্রিয়তম স্বামী হারেছ হাসি মুখে কোনো এক সময় এসে দরজায় করাঘাত করে বলবে, জানিয়া, আমি এসেছি।
সার্ব নেতা রাদোভান কারাজদিক ছিলেন এই লিহুবিচি হত্যাকান্ড ও ধ্বংসজ্ঞের প্রধান নায়ক। সৌভাগ্যক্রমে সার্ব বাহিনীর গ্রেফতারী ও ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে প্রাণে রক্ষা গাওয়া ম্যাভলদীন বালেন, লিহুবিচির এই গণহত্যায় রাদোভান কারাজদিক শুধু ঘটনাস্থলে উপস্থিত-ই ছিলেন না বরং রীতিমত গণহত্যার কমান্ড দিচ্ছিলেন এবং ততক্ষণ না সার্ব বাহিনীর এই প্রত্যয় জন্মে যে, এবার সমস্ত মুসলমান বন্দী মারা গেছে ততক্ষণে তারা সে স্থান ত্যাগ করত না। লিহুবিচি নামক গ্রামের উপর সার্ব বাহিনী যে নরকীয় প্রলয় সৃষ্টি করেছিল, তা জুমুম ও বর্বরতার এক অন্ধকার উপাখ্যান বইকি। সেব্রেনিসা থেকে ছ’মাইল দূরে সুউচ্চ পর্বতমালার মাঝে অবস্থিত এই মুসলিম বসতি ছিল পার্শ্ববর্তী জনবসতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এগ্রামের সকল বাসিন্দা ছিল পরস্পর আত্মীয়তা বন্ধনে আবদ্ধ। আজ তা’ধ্বংসাবশেষ রূপে সার্ব হায়েনার নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের আওতাভুক্ত। ১২৬ সদস্যের এই গ্রামের ৩৩ জন নিখোজ রয়েছেন। তন্মধ্যে ১৩ জন মহিলা, ১ জন পুরুষ ও একটি শিশু রয়েছে। জীবনে বেচে যাওয়া নারী ও শিশুরা বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে আত্মীয়দের ফিরে পাওয়ার আশা বুকে নিয়ে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো অতিবাহিত করছেন। তাদের গ্রামের ২৫টি সাজানো বসত বাড়ীর ধ্বংবশেষ সার্ব হায়েনার নৃশংস হত্যাযজ্ঞের দগে দগে সাক্ষ্য বহন করে চলেছে!
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ‘নিরাপদ শহর’ সেব্রেনিসার যখন পতন হয়, তখন প্রায় পনের হাজার মুসলমান লিহুবিচি গ্রামের গা ঘেঁসে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে লোকালয় ত্যাগ করছিলেন। এই পথে জাতিসংঘের নিরপত্তা বাহিনীর বিশটি ক্যাম্প ছিল। ইতিপূর্বে এই পথে পালিয়ে বেশ ক’টি কাফেলা বসনীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তারপরে যে ক’টি কাফেলা এ পথ অতিক্রম করতে চেয়েছিল তাদের কেউই সার্ব হায়েনার আক্রমণ থেকে রক্ষা গায়নি। সার্ব বাহিনী জাতিসংঘ নিরাপত্তা বাহিনীর সব কটি, ক্যাম্প ঘেরাও করে হল্যান্ডের সৈন্যদেরকে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য করে এবং তাদের উর্দি ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরা তা পরে নেয়।
মুসলিম কাফেলা এই ক্যাম্পের নিকট পৌঁছলেই নিরাপত্তা বাহিনীর উর্দি পরিহিত সার্ব বাহিনী তাদের পার্শ্ববর্তী একটি ফ্যাক্টরীর ভবনে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে ফেলত। ১৯৯৫-এর ১২ জুলাই যে মুসলমানদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের মধ্যে বার বছর বয়সের একটি বালকও ছিল। হাসীম সালাজিক আর ম্যাভলদিন ওরাক ব্যতীত বাকী গ্রেফতারকৃতদের কারুর-ই কোনো হদীস পাওয়া যায়নি। পলায়নপর পনের হাজার মুসলমানের ভাগ্যেও এর ব্যতিক্রম কিছু জুটেনি।
জাতিসংঘ তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট মোতাবেক নিরাপত্তা বাহিনীর এই ক্যাম্পের নিকট গ্রেফতারকৃত মুসলমানদের পার্শ্ববর্তী একটি ভবনে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। অনেককে পার্শ্ববর্তী গ্রামে নিয়ে গিয়ে প্রথমে তাদের-ই হাতে কবর খনন করানো হয়। তারপর তাদের উপর বৃষ্টির মত এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করে এবং বুলডোজারের মাধ্যমে নিহত, আহত ও জীবিতদের একত্রে কবরে পুতে রাখা হয়। এই রাজপথে সফরকারী মুসলিম কাফেলার সঙ্গে সার্ব বাহিনীর নৃশংস আচরণের পর স্থানীয় লোকেরা এখন একে ‘মৃত্যুর রাজপথ’ নামে অভিহিত করে থাকে।
এই রাজপথে সফর করেও ম্যাভলদীন অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যেতে সক্ষম হয়। আকাশচুম্বী পর্বতমালার মাঝে এঁকে বেঁকে চলা এই রাজপথটি যুদ্ধের আগে তুজলা শহরে শাক-সবজী ও ফলফলাদি সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত হতো। ক্যামনিকা হয়ে এই সড়কটি বসনিয়ার প্রধান সড়কের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়েছে। ম্যাভলদীনের কাফেলা ক্যামনিকা গিয়ে পৌঁছলে সার্ব বাহিনী যারা ভারী অস্ত্র নিয়ে উঁচু স্থানে মোর্চা বেধে বসে ছিল তারা ট্যাংক, মেশিনগান ও মর্টার নিয়ে কাফেলার উপর ঝাঁপিয়ে গড়ে। ঘেরাও করে ফেলে মুসলিম কাফেলাকে। সার্ব বাহিনীর নির্মম গুলির আঘাতে কাফেলার অধিকাংশ মুসলমান ঘটনাস্থলে-ই শাহাদাত বরণ করেন। আক্রমণ এত আকাস্মিক ছিল যে, কাফেলার লোকেরা নিজেদের সামলানোর কোনো সুযোগ-ই পেলনা কৌশলে ভাগ্যক্রমে যে ক’জন প্রাণে রক্ষা পেতে সক্ষম হয়েছিল, তারাও পরবর্তীতে সার্বদের টহল বাহিনীর হাতে ধরা গড়ে যায়। শিশু হাসানকেও এসময় গ্রেফতার করে অন্যদের সঙ্গে একটি গুদামে বন্দী করে রাখা হয়। পরে শাস্তি স্বরূপ সার্বরা তাকে পার্শ্ববর্তী কুপ থেকে পানি তুলে আনার কাজে লাগায়। সার্ব খ্রিষ্টান বাহিনী ও মুসলমান বন্দীদের জন্য প্রথমবার পানি আনতে গিয়ে হাসান দেখতে গেল, কুপের সন্নিকটে একস্থানে স্তুপ হয়ে গড়ে আছে বেশ ক’জন মুসলমানের যবাই করা লাশ। লাশের স্তুপের উপরে এখনো ছটফট করছে গলাকাটা একটি কিশোরী। পাশেই একজন সার্ব সেনাটি তাঁর হাসান ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দেখছে, এদের জবাই করে হত্যাকারী কুপের পানি দিয়ে তার রক্তমাধা খঞ্জরখানা পরিষ্কার করছে।
সার্ব খ্রিষ্টানরা জাতিসংঘের নিরপত্তা বাহিনী থেকে ছিনিয়ে নেয়া উর্দি পরে মুসলমানদের গ্রাম, পল্লী ও আশপাশের জঙ্গলে ঢুকে মেগাফোন দ্বারা মুসলমানদেরকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা বাহিনীর আশ্রয়ে এসে যাওয়ার আহবান করত। নিরাপত্তা বাহনীর সৈনিক মনে করে মুসলমানরা সরল মনে বেরিয়ে আসত কিংবা পাহাড়ের উপর থেকে নীচে নেমে আসত। এই সুযোগে সার্ব বাহিনী তাদের গ্রেফতার করে পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা ভাবে বন্দী করে রাখত। সেব্রেনিসা তুজলার পতনের পর সর্ববাহিনী মুসলিম নারী-যুবতী এমনকি বৃ্াদ্ধাদের পর্যন্ত ব্যাপক হারে সম্ভ্রমহানী করে। মুসলিম যুবতী ও কিশোরীদের তারা বলত, এখন থেকে মুসলমান নয় তোমাদের সার্ব খ্রিষ্টান জন্ম দিতে হবে। সার্ব বাহিনীর গণধর্ষণের শিকার হয়ে কোনো মুসলিম মাহিলা মরণাপন্ন হয়ে পড়লে কোনো বৃদ্ধ মুসলমানকে ডেকে এনে তাকেও মুমূর্ষ ধর্ষিতা মুসলিম নারীর সম্ভ্রম হরণ করতে বাধ্য করতো। সার্ব হায়েনার এরূপ পাশবিক, অমানবিক ও নির্মম আচরণে শিকার হয়ে কত যে মুসলমান মস্তিস্কের ভারসাম্য হারিয়েছে, এরুপ নৃশংস কাজ করতে অস্বীকার করায় কত যে মুসলমানের প্রাণ দিতে হয়েছে, তার হিসাব কে রেখেছে।
হাসানকে প্রথমে বিউনেকা অতঃপর অন্যান্য মুসলমানদের সাথে কুঞ্জিনক পুলজির কাছে একটি ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ময়দানটি মুসলমানদের লাশে পরিপূর্ণ ছিল। সে দেখতে পেল যে, ময়দানে প্রায় ৫০০ মুসলমান সারিবদ্ধ ভাবে দন্ডায়মান। প্রত্যেকেই পিছমোড়া করে বাঁধা। অল্প কিছুক্ষণ পর কয়েদীদের স্তুপীকৃত লাশের উপর শুয়ে পড়ার আদেশ দেওয়া হলো। সার্ব হায়েনাদের আদেশ অমান্য করার সাধ্য কারো নেই। সকলেই শুয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ নানাভাবে ভীতি প্রদর্শনের পর এবার আদেশ হলো, তোমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ। প্রায় সকলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে গড়ল।
এরপরও যারা বেঁচে ছিল, তাদের মধ্যে ছিল কয়েকটি শিশু। এক সার্বনেতা সৈন্যদের আদেশ দিল, শিশুদের আলাদা করে ফেল। ওদের বাঁচতে দাও, যাতে ভবিষ্যত বংশধরদের ওরা সার্বদের নামে ভয় দেখাতে পারে। হাসানকে আরো তিনটি শিশুর সঙ্গে আলাদা করে রাখা হলো। এ ভাবে সে এ যাত্রা ও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল।
ম্যাভলদীনের কাফেলার কয়েকজন ক্যবমানিকায় সার্বদের হত্যা থেকে রেহাই পেয়েছিল বটে, কিন্তু নিরাপদ অঞ্চলে পৌঁছুতে হলে তাদের এখনো এমন একটি সড়ক অতিক্রম করতে হবে, যেখানে মোড়ে মোড়ে সার্ব হায়েনারা মুসলমানদের খুজে বেড়াচ্ছে। ম্যাভলদীন ও তার সঙ্গী হারেছ দু’দিন পর্যন্ত সড়কটি অতিক্রম করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তৃতীয় দিন তারা সার্বদের হাতে ধরা গড়ে যায়। গ্রেফতার করে তাদের স্থানীয় একটি স্কুলের বিরাট এক হল ঘরে আবদ্ধ করে রাখে। তিন হাজারের মত মুসলমান পুর্ব থেকেই ওখানে আটক রয়েছে। ১৪ জুলাই অতিরিক্ত আরো কিছু সার্ব বাহিনী এই অস্থায়ী বন্দীশালায় এসে উপস্থিত হয়। তারা এসে বন্দী মুসলমানদের জানালো যে, তোমাদেরকে বন্দী বিনিময়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হবে, তোমা প্রস্তুত হও।
বন্দী বিনিময়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার নাম করে মুসলমানদের ট্রাকে তুলে নেওয়া হলো। স্কুল হলের দরজায় দাঁড়িয়ে ম্যাভলদীন শুনতে পেল যে, কমান্ডার জেনারেল রাদাভোন কারাজ দিক বন্দীদের হত্যা করার ব্যাপারে সার্ব অফিসারদের নির্দেশনা দিচ্ছেন।
ট্রাক করে কয়েক মাইল দূরে নিয়ে গিয়ে মুসলমান বন্দীদেরকে বলা হলো, তোমরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যাও। ম্যাভলদীন তার সঙ্গী হারেছকে বলল, আমার মনে হচ্ছে ওরা হত্যা করার জন্য আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। ম্যাভলদীনের মুখ থেকে কথাটা সম্পূর্ণ বের হতে না হতেই শুরু হলো গুলি বর্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য মুসলমান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। ম্যাভলদীনের সঙ্গী গুলিবিদ্ধ হয়ে তার গায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে কিছুক্ষণ ছটফট করার পর সেও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। ম্যাভলদীনের মৃত্যু এখনো বহু দূরে বলে লাশের নীচে চাপা গড়ে এযাত্রাও সে বেঁচে গেল।
এভাবে একের পর এক ট্রাক ভর্তি করে মুসলমানদের আনা হলো আর এরুপ নির্মম ভাবে হত্যা করা হলো। দিন শেষে রাত এলো। সার্ব হায়েনারা দিনভর মুসলমানদের জীবন নিয়ে হোলি খেলার পর এবার চলে গেল। ম্যাভলদীন লাশের নীচে থেকে নিজেকে টেনে বের করে লাশ ভর্তি ময়দান ত্যাগ করতে ইচ্ছা করল। হঠাৎ তারই মত প্রাণে রক্ষা পাওয়া আর এক মুসলমানের সাথে তার সাক্ষাৎ হলো। নাম তার হারীস সিলাজিক। বয়স ৫৬ বছর। বন্দীদশায় একটানা অনাহার আর সার্ব হায়েনাদের নির্যাতনের ফলে হারীস সিলাজিক পা তুলে হাটতে পারছেন না। ম্যাভলদীন দুর্বল বৃদ্ধ সিলাজিককে কাধে করে দুর্গম পাহাড়ী পথ আর গভীর বনের মধ্যদিয়ে রওয়ানা হয়ে এক সময় মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পৌঁছুতে সক্ষম হয়।
জানিয়া ভালো করেই জানে যে, ম্যাভলদীন যা বলছে, সবই সত্য। হাসানও এ ঘটনার বাস্তব সাক্ষী যে, গরবা নামক এলাকায় বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে শহীদ করা হয়েছে এবং তার পিতাও এ হত্যাকান্ডে সার্ব হায়েনার নির্মম শিকারে পরিণত হয়ে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু জানিয়ার মত হাসানের মায়েরও মন বলছে, তার স্বামী এখনো বেঁচে আছেন। তার এই আশাবাদীতার যুক্তি হলো, হাসান স্বচক্ষে তার পিতার লাশ দেখেনি।
লিহুবিচি গ্রামের ১২৬ জন মুসলমানের সঙ্গে যে পশুশুলভ আচরণ করা হয়েছে, তা থেকে অনুমান করা যায় যে সমগ্র বসনিযা হার্জেগোভিনায় কি রকম প্রলয় সৃষ্টি করেছিল মুসলিমবিদ্বেষী সার্ব-খ্রিষ্টান বাহিনী। রেডক্রসের এক রিপোর্টে জানা গেছে, সেব্রেনিসা পতনের পর সার্বরা আট হাজার মুসলমানকে শহীদ করেছে। তন্মধ্যে সেই তিন হাজার মুসলমানও ছিল, যাদেরকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে যুদ্ধ বন্দীরূপে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। অপরদিকে বসনিয়া সরকারের দাবি হলো, কেবল সেব্রেনিকা অঞ্চলের অধিবাসী শহীদদের সংখ্যা-ই অন্তত এগার হাজার। সেব্রেনিসার আশপাশের এলাকার শহীদদের এ হিসেবে যোগ করা হলে এসংখ্যা ৩৯ হাজারে দাঁড়ায়।
লিহুবিচির এই মুসলিম গ্রামটি তাবৎ বিশ্বের মুসলিম সরকারগুলোর আত্মমর্যাদাবোধহীনতা ও ইসলামী চেতনার প্রতি অনীহার স্বাক্ষ্য স্বরূপ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়ে আছে। তবুও তাদের কোনো অভিযোগ নেই। কারণ তারা জানে, কাশ্মীর, চেচনিয়া, ফিলিপাইন, বার্মা, ফিলিস্তীন, ইথিগিয়া, কম্বোডিয়া, তাজিকিস্তান,আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান প্রভৃতি তার-ই সহযাত্রী বৈ নয়।
সৌজন্যে: বেদার ডাইজেস্ট