কাছ থেকে দেখা
তালেবানের দেশে কয়েকদিন
মাওলানা মুহাম্মাহ আদম খান
[নিবন্ধের শুরুতেই পাঠকের আস্তে করে একটি ধাক্কা খাওয়ার আশংকা রয়েছে। প্রথমেই হয়ত আপনি ভাববেন, “আমি কাহিনীর মধ্যখান দিয়ে পড়া শুরু করছি না তো!' হ্যাঁ, কাহিনীর দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে আপনি পড়ছেন। কারণ যে পত্রিকা থেকে এ সফরনামাটি আমরা নিয়েছি, সে পত্রিকার এই ধারাবাহিক লেখাটির প্রথম কিস্তি আমাদের নিকট পৌঁছেনি। যে কারণে এর প্রথম অধ্যায়টি আপনাদের নিকট পেশ করতে না পারার জন্য আমরা দুঃখিত।
সফরকালঃ '৯৬ খৃস্টাব্দের শেষের দিকে। সফরকারীদের পরিচিতিঃ লেখক আদম খান, শিক্ষক, জামেয়া ফারুকিয়া, করাচি। ওবায়দুল্লাহ খালেদ, ভাইস প্রিন্সিপাল, জামেয়া ফারুকিয়া, করাচি। মুহাম্মদ ইউসুফ আফশানী, দাফতরিক কর্মকর্তা, জামেয়া ফারুকিয়া, করাচি! –অনুবাদক]
কমান্ডার আহমাদ জানের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমরা জালালাবাদ যাওয়ার আকাংখা ব্যক্ত করলাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে আমিও আপনাদের সঙ্গে যাবো; জালালাবাদ গভর্নরের সঙ্গে আমার দেখা করতে হবে। শুনে আমরা যারপরনাই আনন্দিত হলাম।
তিনি সঙ্গে থাকায় এই সফর থেকে আমরা বেশ উপকৃত হয়েছি এবং তালেবান ইসলামী আন্দোলন ও তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকাসমূহ সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করতে পেরেছি। সব মিলিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গী হওয়া আমাদের জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত এক নেয়ামত।
সফর শুরু হলো। কমান্ডার আহমাদ আমাদেরকে গাড়ীতে বসালেন। কিন্তু, যখন দেখলাম যে, আমাদেরকে বসিয়ে তিনি নিজে চালকের আসনে বসলেন, তখন আর আমাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না। অর্থাৎ-কমান্ডার আহমাদ জান নিজেই গাড়ীর চালক!
আমাদের দেশে তো পুলিশের একজন সাধারণ অফিসারও নাকে মাছি বসতে দেন না ,ড্রাইভার হওয়া তো দূরের কথা। কিভাবে মানুষের সস্তা প্রশংসা পাওয়া যায়, নবাবী চাল চলনের মাধ্যমে অশিক্ষিত জনগণের সমীহ আদায় করা যায়, আমাদের নেতারা এমনি চিন্তায় মগ্ন থাকেন। কোনো রকম নেতৃত্বের একটা আসন পেয়ে গেলে অহংকার আর আত্মম্ভরিতায় তারা এতই বে-পরোয়া হয়ে উঠে যে, সাধারণ মানুষকে তারা আর মানুষই ভাবতে পারে না। অথচ এই অংহকার-ই একদিন তাদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কমান্ডার আহমাদ জানের এই সরলতা ও বিনয় আমাদের কাছে তাঁর মর্যাদা বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। প্রভাব-প্রতিপত্তি আসলে যে কি জিনিস, তখন আমি তা উপলব্ধি করতে পারলাম। এই চরিত্র একা আহমাদ জানের নয়-তালেবানের প্রত্যেক মুজাহিদ এবং কমান্ডারের এই একই অবস্থা দেখতে পেলাম। প্রদেশের গভর্নর হোন কিংবা অফিসের একজন সাধারণ কর্মচারী, কারো মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। কেউ সেলুট পাওয়ার অপেক্ষাও করেন না, দাঁড়োয়ানের গাড়ীর দরজাটা খুলে দেওয়ার অপেক্ষাও নয়। তালেবানের যত কমান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম, প্রত্যেককেই আমরা একজন সেবক রূপে পেলাম।
ইসলামী শিক্ষার বাস্তব নমুনা
গাড়ী চলতে শুরু করলে যখন দেখলাম যে, গাড়ী রাস্তার বামে নয়-ডান দিক দিয়ে চলছে, তখন আমি আনন্দে বাগবাগ হলাম। হৃদয়ের গভীর থেকে অজান্তে বেরিয়ে এলো কৃতজ্ঞতার বাণী ‘আলহামদুলিল্লাহ'। বুঝলাম, আফগানিস্তানে তাহলে এখন ট্রাফিক ইসলামী শিক্ষা অনুসারে রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলাচল করে!
ইসলামে যে কোন ভালো কাজ ডান দিক থেকে শুরু করার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাপড় পরা, মোজা পরা, মসজিদে প্রবেশ করা, মেসওয়াক করা, চোখে সুরমা মাখাতো, মোসাফাহা করা ও পানাহার ইত্যাদি সব কাজ ডান দিক থেকে শুরু করতেন এবং উম্মতকেও এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। তালেবানের আফগানিস্তানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ সুন্নতের বাস্তবায়ন দেখে আমি আনন্দ ধরে রাখতে পারলাম না।
আমরা এক সময় ইংরেজের গোলাম ছিলাম । ইংরেজ বিতাড়িত হওয়ার পর এখনও আমরা তাদের-ই গোলামী করছি। আমাদের দেশের গাড়ি-ঘোড়া রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলাচল করে সেই গোলামীর কথা-ই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ইংরেজরা উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হলো আজ বহু দিন। কিন্তু, আমাদের চাল-চলন, উঠা-বসা পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সবকিছু তাদেরটাই রয়ে গেছে। কিন্তু এমন একটি দেশ সফর করতে পেরেছি বলে আমি অত্যন্ত আনন্দবোধ করছি, ইংরেজ শাসকদের এই অপসংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। বর্তমান যুগে রাস্তার ডান দিক দিয়ে গাড়ী চলাচল করার মত সুন্নত পালিত হওয়া কম কথা নয়।
কমান্ডার আহমাদ জান দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত একাগ্রচিত্তে গাড়ী চালাতে থাকেন এক পর্যায়ে মুফতী কেফায়েতুল্লাহ সাহেব নীরবতা ভঙ্গ করে স্থানীয় লোকদের আচার-ব্যবহার ও তালেবান উত্থানের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেন। কমান্ডার আহমাদ জান গম্ভীর কণ্ঠে তার জবাব দেন। অতঃপর মাওলানা ইউসুফ আফশানী ও মাওলানা উবায়দুল্লাহ খালেদ বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেন। কমান্ডার আহমাদ জান পশতু ভাষায় প্রশ্নের জবাব প্রদান করেন আর আমি দোভাষীর দায়িত্ব পালন করি।
উঁচু-নীচু রাস্তা দিয়ে টলতে টলতে আমাদের গাড়ী সম্মুখপানে এগিয়ে চলছিল এবং প্রশ্নোত্তরের ধারাও অব্যাহত ছিল। কয়েক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গাড়িটি এক সময়ে সমতল ও পিছঢালা রাস্তায় গিয়ে উনীত হলো। তখন নামাযের সময় হওয়ায় তালেবানের একটি চেকপোস্টের নিকট গাড়ী থামাতো হলো। সেখানে শুশ্রুমন্ডিত উজ্জল চেহারার কয়েকজন যুবকের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হলো। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ-পরিচয় হলো না। ফলে তারা কারা তা আর জানতে পারলাম না। শুধু সালাম-মুসাফাহার মধ্যে সাক্ষাৎপর্ব সমাপ্ত হলো। এখানে ছোট একটি পার্কে আমরা নামায আদায় করলাম।
আল্লাহর মদদ
সেখান থেকে রওয়ানা হওয়ার পর কমান্ডার আহমাদ জান আমাদেরকে আল্লাহর মদদের কয়েকটি ঘটনা শুনালেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, তালেবানকে আল্লাহ তা'আলা এত প্রভাব-প্রতিপত্তি দান করেছেন যে, তা ভাবতেই অবাক লাগে। আফগানিস্তানে যেসব সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ঠ ছিল এবং যাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস কারো ছিল না, তালেবানের প্রতিপত্তির কাছে তারা সকলে-ই হার মানতে বাধ্য হয়েছে। বহু জায়গায় আমাদের হাতের একটি মাত্র ইংগিতে বহু সন্ত্রাসী অস্ত্র সমর্পন করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ত্যাগ করতে দেখা গেছে।
কমান্ডার আহমাদ জান আমাদেরকে এতদসংক্রান্ত একটি বিস্ময়কর ঘটনা শুনান যে, একটি পাহাড়ের উপর প্রায় চার শত সশস্ত্র সন্ত্রাসী পরিখা খনন করে অবস্থান করছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে আমি কয়েকজন সঙ্গী সহ তাদের নিকট গেলাম এবং দূর থেকে ইশারায় বললাম যে, আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তারাও ইংগিতে আমাকে তাদের কাছে যেতে বলে। নিকটে পৌঁছে আমি তাদের তালেবান ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিবরণ দিলাম এবং এ কথা বুঝাবার চেষ্টা করলাম যে, আমরা তোমাদের হিতাকাংখী, আমরা দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করি এবং দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আর কতকাল তোমরা এভাবে পাপ-পংকিলতায় ডুবে থাকবে। দেশের মানুষের জান-মাল নিয়ে তামাশা এবার বন্ধ কর। আল্লাহর কাছে তাওবা কর এবং দেশের শান্তি-শৃংখলা বিনষ্ট করা থেকে বিরত হও। এসো আমরা সকলে মিলে দেশ গড়ার কাজে অংশ গ্রহণ করি এবং আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেদের উৎসর্গ করি।
সংখ্যায় আমরা তাদের তুলনায় নিতান্তই নগন্য ছিলাম। কিন্তু আল্লাহর কি মহিমা! আমার বক্তব্যের পর অবিলম্বে তারা আমাদের কাছে আত্নসমর্পণ করে এবং অস্ত্র ত্যাগ করে আমাদের আনুগত্যে চলে আসে। এই ঘটনা এলাকার লোকদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং তালেবানের প্রতি এলাকার লোকদের আস্থা বহুগুণ বেড়ে যায়।
গাড়ীর বাইরে ডানে-বামে তাকিয়ে আমি দেখতে পেলাম যে, এখন আর ধারে-কাছে কোনো পাহাড় নেই। রাস্তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। দূর থেকে কুনড় নদী চোখে পড়ল, যার কূল ঘেঁষে বিপুল সংখ্যক গাছের ঝোপঝাড় দেখতে পেলাম। বিস্তৃত ফসলাদির জমি, একটু পর পর তালেবানের চৌকি এবং মাটির তৈরি ঘর-বাড়িও চোখে পড়ল। অত্র এলাকায় কাঁচা ঘরের প্রচলন ব্যাপক। কাঁচা মাটির তৈরি হওয়া সত্ত্বেও ঘরগুলো ঝড়-বৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ। এটা ওখানকার আবহাওয়ার-ই প্রভাব বোধ হয়। তা ছাড়া অত্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাতও হয় কম। বরফগলা পানি দ্বারা-ই ওখানকার ফসলাদি উৎপন্ন হয়।
মজার ব্যাপার হলো, এখানকার মসজিদগুলোও বসতবাড়ির ন্যায় কাঁচা মাটির তৈরি। মসজিদে মিনারের প্রচলন খুবই কম। অনেক সময় বহিরাগত মানুষ এই ভেবে বিস্মিত হয় যে, এ কেমন মুসলিম দেশ, এখানে কোনো মসজিদ নেই। কোনো কোনো জায়গায় গাছের ঝোপঝাড়ের নীচের শূণ্য জায়গা-ই মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে কাবুল, কান্দাহার ও হেরাত প্রভৃতি অঞ্চলের মসজিদগুলো পাকা এবং মিনারবিশিষ্ট।
একটু সামনে অগ্রসর হয়ে দেখতে পেলাম, অসংখ্য যয়তুনের বাগান। রাস্তার দু'ধারে সারিবদ্ধ ভাবে অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। মনে হলো যেন, মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দ উদযাপনের অংশ হিসেবে গাছগুলো রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে হেলে-দুলে পথচারীদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। রাস্তার দু'পার্শ্বে পরিচ্ছন্ন পানির নহর স্বাধীনতার জয়গান গেয়ে কুলকুল রবে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে জালালাবাদ পর্যন্ত সবুজ-শ্যামল ফসলী জমি আর ফল-ফলাদি ও গাছ-গাছালির বিপুল সমাহার।
আমাদের গাড়ী দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে! বিল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা পাখপাখালি সারাদিনের ভ্রমন শেষে আপন নীড়ে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। কিষান ও রাখালেরা কাজ শেষে ঘরে ফিরছে। দৃষ্টি সীমা পর্যন্ত সবুজ-শ্যামল বাগ-বাগিচা আর গমের ক্ষেত চোখে পড়ছে।
পূর্ব দিকে দ্রুত প্রবাহমান নদী এবং ফসলি জমির মধ্যখানে বড় একটি পাথর খন্ডের উপর এক বৃদ্ধ আফগানীকে বসে থাকতে দেখলাম, যার জীর্ণ পোশাক, শীর্ণ দেহ আর মুখমন্ডলে ভেসে ওঠা চিন্তার ছাপ তার দারিদ্রের প্রমাণ বহন করছিল। কিন্তু তার শক্ত হাতে মোটা ও ভারী একটি কাঠ দেখলাম, যা বন্দুকের চেয়েও ভয়ংকর মনে হলো। তাকে দেখে কোনো ডুবন্ত নৌকার মাঝি অথবা এমন একজন রাখাল বলে মনে হলো, যার পালের সব কটি বকরী বাঘে খেয়ে ফেলেছে।
তখন মাগরিবের সময় হয়ে গেছে। আমরা গাড়ীটি সড়কের এক পার্শ্বে রেখে কাঁচা মাটির তৈরি কামরার মত একটি মসজিদে প্রবেশ করলাম। কমান্ডার আহমদ জান প্রথমে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ খালেদকে নামায পড়াবার আবেদন করেন। কিন্তু পাল্টা আবেদনের ফলে তিনি নিজেই নামাযের ইমামতির দায়িত্ব পালন করলেন। নামায শেষ করে পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সারি সারি মানুষ আমাদের সঙ্গে নামায আদায় করেছে এবং রাস্তার দু'ধারে অসংখ্য গাড়ী দন্ডায়মান। আল্লাহর আদেশ এবং নামাযের মত ইবাদাতের এতো গুরুত্ব দেখে আমরা সীমাহীন আনন্দিত হলাম।
নামায শেষে গাড়ীতে উঠে আমরা যতই জালালাবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম, অন্ধকার ততই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল। দূর থেকে জালালাবাদ বিমান বন্দরের টিমটিমে বাতি চোখে পড়ল। বিমান বন্দর অতিক্রম করে আমরা জালালাবাদ শহরে প্রবেশ করলাম। শহরের অধিকাংশ দোকান-পাট তখন বন্ধ। মাত্র দু'চারটি ফলের দোকান আর কয়েকটি হোটেল খোলা দেখলাম। পরে জানতে পারলাম, বিক্ষিপ্ত সহিংস পরিস্থিতির কারণে সম্প্রতি তালেবান সরকার আদেশ জারী করেছে যে, রাতের নির্দিষ্ট একটি সময়ের পর সমস্ত দোকান-পাট বন্ধ রাখতে হবে। আমরা যখন শহরে প্রবেশ করেছি, তখন দোকান-পাট বন্ধ হওয়ার সেই সময়টি ঘনিয়ে আসছিল। অন্ধকারের কারণে শহরের সৌন্দর্য আর আমাদের উপভোগ করা ভাগ্যে হলো না।
কমান্ডার আহমাদ জান আমাদেরকে সোজা মেহমানখানায় নিয়ে গেলেন। মেহমানখানার গেটে ক্লাশিনকভ হাতে একজন মুজাহিদ দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি গেট খুলে দেন এবং সালাম দিয়ে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান। ভিতরে প্রবেশ করে আমাদের গাড়ী একটি দোতলা ভবনের সামনে গিয়ে থেমে যায়। গাড়ী থেকে নেমে আমরা সিড়ি বেয়ে একটি দরজা পার হয়ে ভবনের ঠিক মধ্যখানে উপনীত হলাম। এটি ছিল ভবনের ভিতরে প্রবেশ করার পথ, যা ডানে-বামে বিভক্ত হয়ে একটি হল পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। হলের বামদিকের একটি কামরায় আমাদের সামানপত্র রাখা হলো। কামরায় উন্নতমানের কার্পেট বিছাতো ছিল। জানালাগুলোতে বুলাতো ছিল দামীদামী পর্দা। অন্যান্য কামরাগুলোও মূল্যবান ফার্নিসার, সোফা সেট, কার্পেট, আকর্ষণীয় পর্দা এবং ঝাড়লণ্ঠন দ্বারা সজ্জিত।
মজার ব্যাপার হলো, এই বিলাসবহুল ভবনটি কিছু দিন আগেও এমন একজন মুজাহিদ নেতার দখলে ছিল যার সম্পর্কে সকলেই জানতো যে তিনি রাতে ইটের উপর মাথা রেখে ঘুমান। কিন্তু আসলে ঘটনা এমন ছিল না। আরবের কোনো শায়খ পেশোয়ারের মুজাহিদ ক্যাম্পে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আসলে লোক দেখাতোর জন্য তখন তিনি মাথার নীচে ইট রেখে ছেড়া চাটাইয়ে শয়ন করতেন এবং লোকদের বুঝাতেন যে, যে সব মুজাহিদ পাথরের উপর শুয়ে রাত কাটায়, আমিও তাদের দুঃখ-দুর্দশার সমান অংশীদার। এ-কারণে আমিও নরম বিছানায় পিঠ লাগাই না।
কিন্তু তার বাসস্থান দেখে-বর্তমানে যাকে তালেবান সরকার মেহমানখানা হিসেবে ব্যবহার করছে-আমরা বুঝতে পারলাম যে,হাতির দাঁত খাওয়ার জন্য একটি আর দেখাতোর জন্য আরেকটি। বুঝতে পারলাম, আসলে তিনি সেই চ্যাম্পিয়ান লড়াকুর ন্যায়, যে ফাইভ স্টার হোটেলের ডাইসে দাঁড়িয়ে জিহাদ বিষয়ে এমন বক্তৃতা প্রদান করে যে, শুনে মনে হয়, সকাল-সন্ধ্যা ইনি-ই ময়দানে লড়াই করেন। অথচ লড়াইয়ের ময়দানে কখনোই তিনি পা রাখেননি। তার জিহাদ শুধু পত্রিকার পাতা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ এবং ক্ষমতার মোহে পড়ে পরস্পর রক্তপাত আর খুনাখুনির জন্ম দেন, পরিণামের কথা বেমালুম ভুলেই যান। অবেশেষে আল্লাহ তাআলা তালেবানকে তার উপর বিজয় দান করেন।
এখনও আমরা খাওয়া-দাওয়া করিনি। ফলে খাওয়ার এন্তেজাম করা হলো। দস্তরখানা বিছাতো হলো। গোশত, বড় বড় রুটি ও ভাত প্লেটে করে আমাদের সামনে রাখা হলো। সবশেষে ফল এবং লাল চা-ও পরিবেশন করা হলো।
আফগানীরা পানাহারে লৌকিকতায় অভ্যস্ত নয়। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে মৌলিক প্রয়োজনাদির ব্যবস্থা হয়ে গেলে আর তারা বাড়াবাড়ি করতে যায় না। ইসলামের শিক্ষাও অনুরূপ।
আমরাও যদি আজ বিলাসিতা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে সমাজ জীবনে সরলতা অবলম্বন করি, তা হলে অর্ধেক সমস্যা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। যে দরিদ্রতার জন্যে আজ আমরা হা হুতাশ করি, তার মূল কারণ আমরা বিলাসিতা বশতঃ সামর্থের চেয়ে বেশী ব্যয় করতে চাই।
আফগানিস্তানে অভাব আছে, প্রচন্ডভাবে আছে। কারণ, একে তো আফগাস্তিানের অধিকাংশ এলাকা আবাদ অযোগ্য এবং পাহাড়ী। দীর্ঘ দিনের যুদ্ধে এদেশ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, চরম অর্থ সংকট। কিন্তু তালেবানের সরলতা আর অল্পে তুষ্টি দেখে আমাদের প্রত্যয় হলো যে, ইনশাআল্লাহ অল্প সময়ের মধ্যেই তালেবান দেশের অর্থ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে।চাষাবাদযোগ্য উর্বর এলাকাগুলোতে যথেষ্ঠ চাষ হচ্ছে। তা ছাড়া আফগানিস্তানের মাটি খনিজসম্পদে ভরপুর। তালেবান অতি তাড়াতাড়ি এসব খনিজসম্পদ দ্বারা উপকৃত হতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে। দেশের সমস্যার সমাধান করা তালেবানের পক্ষে সহজ হওয়ার আরো একটি অন্যতম কারণ হলো, তালেবানের মধ্যে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার যে চেতনা দেখলাম, তাতে আমরা দৃঢ় আশাবাদী যে, অদূর ভবিষ্যতে তালেবান আফগানিস্তানকে একটি উন্নত ও সচ্ছল সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে সক্ষম হবে।
আহার পর্ব শেষ হলে পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত হলো যে, করাচী ফোন করতে হবে। মেহমানখানার যিম্মাদার ছিলেন মৌলভী খাইরুল্লাহ। তিনি আমাদের গাড়ীতে করে টেলিফোন একচেঞ্জে নিয়ে যান। কিন্তু করাচীর লাইন পাওয়া গেল না। অগত্যা আমরা মেহমানখানায় ফিরে এলাম। আফগানিস্তানে রাস্তাঘাটের ন্যায় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও বিধ্বস্ত। কাবুল থেকে বাইরে যোগাযোগ করা তো একেবারে অসম্ভব। তবে হেরাত ও কান্দাহারে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটা ভালো হয়েছে।
এই বিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠন এখন তালেবানের অন্যতম কাজ। রাস্তাঘাট, বিধ্বস্ত কলকারখানা ও বড় বড় প্রতিষ্ঠান সবই অচল। বিশাল বিশাল অট্রালিকা এখন ধ্বংস্তুপে পরিণত। তালেবানের এসব চ্যালেঞ্জ এর মোকাবেলা করে দেশ গড়ার কাজে উত্তীর্ণ হতে হবে।
প্রকৃত ইসলামী জীবন ব্যবস্থা এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা একটি দেশের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি অর্থনৈতিক, কৃষি, শিল্প, ইত্যাদির ক্ষেত্রেও আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করা সময়ের বলিষ্ঠ দাবি। এসব কাজে সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য আল্লাহ তালেবানকে তৌফিক দিন। (চলবে)
সৌজন্যেঃ আল-ফারুক, করাচী
অনুবাদঃ মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন