শিশুর পরিচর্যা ও মনন গঠনে পিতা-মাতার করণীয়
মাওলানা আশরাফ আলী থানুভী রহ.
(পাশ্চাত্যের বিকৃত প্রভাবে বর্তমান বিশ্বের মুসলিম সমাজে যে পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে, তা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও, উদ্বেগজনক। পাশ্চাত্যের সামাজিক কুপ্রভাব থেকে আমাদের ভবিষ্যত প্রজম্মকে বাঁচানোর জন্যে কঠিনভাবে পরিবারিক পরিবেশে ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী শিশু সন্তানদের গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী কাল আগে উপমহাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলিম-বুযুর্গ, যুগের মুজাদ্দেদ মাওলানা আশরাফ আলী থানুভী (রহঃ) পাশ্চাত্যের অধঃপতন দেখে মুসলিম মিল্লাতের ভবিষ্যত প্রজম্মকে এ ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্যে যে রত্নতুল্য দিক নির্দেশনা দিয়ে ছিলেন জাগো মুজাহিদের সম্মানিত পাঠক/পাঠিকাগণের উদ্দেশ্যে আমরা তারই সরল বঙ্গানুবাদ পেশ করলাম।)
সন্তান প্রত্যেক মানব দম্পত্তির পরম চাওয়া। সন্তান আল্লাহর দেয়া এক বিশেষ নেয়ামত। সন্তান ছাড়া মানব জীবনে যেমন পূর্ণতা আসে না, তেমনই মানবাত্মা সন্তানের শূন্যতায় তৃপ্ত হয় না, শান্তি পায় না। তাই দেখা যায়, যে কোন পাষাণ বা কুপথের যাত্রী কোন মহিলাও জীবনে সন্তানের মা হওয়ার উদগ্র বাসনায় পেটে সন্তান ধারণ করে তার চিরন্তন বাসনাকে পূর্ণ করে। মাতৃত্বের বা পিতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরে নিজেকে মনে করে ধন্য। পৃথিবীতে মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য আল্লাহ তা'আলা সকল মানুষের মধ্যেই ঢেলে দিয়েছেন সন্তানের চাহিদা।
আপনি একজন মুসলমান। আপনাকে আল্লাহ তাআলা সন্তান দান করলেন। তখন এই সন্তানকে লালন-পালন শিক্ষাদানের দ্বারা সৎচরিত্রবান হিসাবে গড়ে তোলা আপনার অপরিহার্য কর্তব্য। শিশু কথা বলা শেখার পর আপনার প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, তাকে কালিমা- তাওহীদ শিখানো। এরপর তার চেতনা ও উপলব্ধি বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ভালো-মন্দের পার্থক্য তার সামনে তুলে ধরা। তাকে মার্জিত বিনম্র, সদালাপী হিসাবে বেড়ে ওঠার জন্যে আপনাকে বিশেষভাবে যত্ন নিতে হবে। সে যেন কারো কাছে লোভনীয় কোন বস্তু দেখলে এর প্রতি আকৃষ্ট না হয়, এজন্যে দরকার প্রত্যেক মা-বাবার সাধ্যানুযায়ী শিশুদেরকে উন্নত বস্তু পরিবেশন করা। শিশুর পাওয়ার চাহিদা যদি অত্যাধিক বেড়ে যায়, কোন বস্তু প্রাপ্তির জন্য জেদ করে বসে, তবে তাকে অতো সহজে সেই বস্তুটি না দেয়াই ভালো। সে যেনো নিজের জিদের প্রতি অতিশয় আস্থাশীল না হয় সেজন্যে তার সেই অহমিকা দমিয়ে দিতে হবে। অন্যথায়, শিশুর নিজের চাহিদা মিটানোর খেয়াল বাড়বে, যা একজন সাধারণ গৃহস্তের পিতা-মাতা হয়ে আপনার পক্ষে মিটানো সম্ভব হবে না। শিশু যেন একাকী কোন বস্তু না খায়, অন্যকেও স্বেচ্ছায় শরীক করে, তার চরিত্রে এমন অভ্যাস গড়ে তোলার দরকার। তবে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে, যে বস্তু আপনি শিশুকে দিবেন সেটি শুধু এককভাবে তার কর্তৃত্বাধীন করে দিবেন না। কারণ এতে করে শিশু ওই বস্তুটির একচ্ছত্র মালিক হয়ে যায় এবং এতে অন্য কারো অংশীদারিত্ব থাকে না। আপনিও তার নিজস্ব বস্তুতে দখলদারী করার নৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এজন্যে যে কোন বস্তু-টাকা, খাদ্য দ্রব্য, খেলনা যাই হোক না কেন তাকে ধার স্বরূপ দিবেন, যাতে এতে সহজেই অংশীদারিত্বের সুযোগ থাকে।
শিশু যেন কখনো মিথ্যা না বলে এজন্যে তার মনে মিথ্যার প্রতি ঘৃণা জন্মানো দরকার। শিশুকে বোঝাতে হবে, মিথ্যা বলা একটি ঘৃণ্য, অপছন্দীয় কাজ। মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না। মিথ্যা বললে গুণাহ হয়। লজ্জাজনক কাজ কর্মের বিভেদ পার্থক্য তাকে পরিস্কারভাবে অনুধাবন করার মতো মনোবল সৃষ্টি করতে হবে।
শিশু যে কোন অপরাধ করলে তা যেনো সে অকপটে স্বীকার করতে পারে অতোটুকু অভয় তাকে দেয়া উচিৎ। না হয় অন্যায়-অপরাধকে চাপিয়ে রেখে অপরাধ প্রবণতার প্রতি শিশুর গোপন আকর্ষণ বেড়ে যাবে। অপরাধ, বেহায়াপনা অত্যন্ত গর্হিত ও বর্জনীয় কাজ, তা শিশুকে বিনা শাসনে বোঝাতে হবে। তারপরও যদি শিশু অপরাধের পুনরাবৃত্তি করে তবে তাকে আরো সতর্কতার সাথে এটা অনুধাবন করানোর চেষ্টা করতে হবে যে, এসব নিষিদ্ধ কাজ করলে তোমার ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে, জগতের মানুষ তোমাকে সম্মান করবে না, জীবনে তোমাকে অনেক বড় হতে হলে সকল অপরাধ বর্জন করতে হবে। না হয় আখেরাতেও তোমাকে ভোগ করতে হবে কঠিনতম শাস্তি। শিশু যেনো তর্কাতর্কিতে অভ্যস্ত না হয়। কোন অসঙ্গত কথা বলে ফেললে বা বড়দের প্রতি কটুক্তি করলে সে যেন কৃতকর্মের ত্রুটি বোঝার সাথে সাথে নির্দ্বিধায় ক্ষমা চাইতে পারে এবং এতে তার মহত্ত্বই বৃদ্ধি পাবে, শিশুকে এ বিষয়টি শিখাতে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মেয়ে ও ছেলে শিশুদের একত্রে বসবাস, ঘুমানো ও খেলাধুলা না করতে দেয়াই ভালো। বেগানা বয়স্ক শিশুরা একত্রে অবাধ মেলামেশা করার ফলে মনে যে টান ও পরস্পর প্রীতি জনন, তা-ই আগামীতে (যৌবনে) এসে একে অন্যের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। যার পরিণতি হয় লজ্জাজনক। এতে করে ছেলেদের পৌরুষ গঠন ও মেধার ক্ষতি হয়। মেয়েদের করে তুলে স্কুল চিন্তার অধিকারীনী।
শিশুকে একাকী, গোপনে বা নিরিবিলি খেলতে বা থাকতে না দেয়া উচিৎ। এতে শিশুর মনে অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। নির্দোষ খেলাকে একটি নন্দিত কাজ বলে অভিভাবকদের মেনে নিতে হবে। না হয় শিশু স্বাভাবিক কাজকেও অস্বাভাবিক ভাববে, শিশুর ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য ক্ষমতা হ্রাস পাবে। নিজেকে আড়াল করার প্রবণতা জম্ম নেবে শিশুর মধ্যে।
শিশু যদি পুরোপুরি বুঝমান নাও হয়, তবুও শিশুর সামনে অভিভাকদের প্রকাশ্যে যা লজ্জাজনক এমন কাজ না করা উচিৎ। কেননা, শিশু তার পরিচ্ছন্ন মেধায় এ দৃশ্য ধারণ করে। তার অনুভূতি পরিপক্ক হলে স্মৃতির পর্দা থেকে সে ওই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে-যা আপনার জন্য অপমানজনক ও আপনার প্রতি শিশুর শ্রদ্ধাবোধের পতন ঘটায়।
শিশু সন্তানের সাথে অত্যাধিক হাসি-তামাশা না করা উচিৎ। এতে করে শিশু তার অভিভাবক ও বড়দের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। বেপরোয়া হলে শিশুরা বড়দের সামনেও যাচ্ছে তাই বলে ও করে বসে, যা আপনার জন্য খুবই পীড়াদায়ক হবে। অভিভাবকের প্রতি সমীহ মিশ্রিত শ্রদ্ধাবোধ থাকলে শিশু বেয়াড়া হয়ে যায়। আপনারা অত্যধিক খোলামেলা হওয়ার কারণে শিশুও ব্যবহারের বেলায় বড় ছোটর ব্যবধান করতে ভুল করবে।
কৈশোরে উত্তীর্ণ প্রায় শিশুদেরকে বড়দের অগোচরে ছেলে-মেয়ে একসাথে খেলা করতে না দেয়া উচিৎ। তবে হ্যাঁ, যদি শিক্ষণীয় ও প্রয়োজনীয় কিছু থাকে, তবে কোন বয়স্ক ব্যক্তি তাদের মধ্যে উপস্থিত থেকে তাদের দিক- নির্দেশ দেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় প্রথম কৈশোরের দুরন্তপনা এদের মধ্যে অনাকাঙ্খিত বিষয় চর্চার জম্ম দিতে পারে। শিশু পাঠ উপযুক্ত হওয়ার পরই তাকে কোন মক্তব বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো উচিৎ। তবে শিশু যেনো প্রথমেই কুরআন শিখতে পারে এ দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যে স্কুল, পাঠশালায় অতি যত্নের সাথে শিশুদের পড়ানো ও মনন-মেধা, চরিত্র গঠনের শিক্ষা দেয়া হয়, শিশুকে সে ধরনের প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার আগে সেখানকার শিক্ষকদের চাল-চলন, মন-মানসিকতা যাচাই করে নেয়া প্রয়োজন। আপনাকে একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, ওস্তাদের প্রতিচ্ছবিই হয়ে থাকে ছাত্র। শিশু অবস্থায়ই রুচিহীন শিক্ষকের পাল্লায় পড়লে শিক্ষকের কুপ্রভাবে শিশুর মনন-মেধা ও রুচিবোধে বিকৃতি ঘটতে পারে।
বালকদেরকে বড় বড় আলেম-উলামা, ইসলামী চিন্তাবিদ, জ্ঞানীদের কাছে নিয়ে যাওয়া ভাল। আল্লাহ ওয়ালাদের সংস্পর্শ শিশুর ঈমানী শক্তি বর্ধনে সহায়ক এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাত তাকে নিজের ব্যক্তিত্ব গঠনে ফলপ্রসূ প্রভাব রাখতে পারে।
শিশু প্রতিপালনে ও তাকে বলিষ্ট ব্যক্তিত্ববান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য নিম্নে কাজগুলো করা অত্যন্ত জরুরীঃ
(১) জন্মের পর শিশুকে যদি অন্যের দুধ পান করাতেই হয় তবে অবশ্যই নেক, চরিত্রবান, ধর্মানুরাগী মহিলা নির্বাচন করা কর্তব্য। কারণ মাতৃদুগ্ধের কার্যকারী প্রভাব সুদূর প্রসারী।
(২) অনেকেই শিশুদের মনে সিপাই, সেনা, পুলিশের প্রতি ভীতি সৃষ্টি করে। কোন ব্যাপারে শান্ত করার জন্য সেনা পুলিশের ভয় দেখায়। এটা ঠিক নয়, এতে শিশুর মনোবল হ্রাস পায় । বালক শিশুর পৌরুষ গঠনে তা খুবই অন্তরায়।
(৩) শিশুকে প্রতিবার একটি নির্দিষ্ট সময়ে দুধ দেয়ার অভ্যাস করা। এতে শিশুর স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, বিরক্তও কম করবে।
(৪) শিশুর পরিধেয় কাপড়, বিছানা, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি খুব পরিস্কার রাখবে। শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী। শিশুকে বিলাসী সাজ- পোশাকে অভ্যস্ত করা অনুচিৎ।
(৫) ছেলে শিশুদেরকে পুরুষালী কাপড় এবং মেয়েদেরকে মেয়েলী কাপড় পরিধান করানো। এর ব্যতিক্রম করা ক্ষতিকর। বাল্যাবস্থায় মেয়েদেরকে বিলাসী দ্রব্য ও অলংকারাদি না দেয়াই ভাল। এতে মেয়েদের মনে অলংকারের মোহ বেড়ে যায়। অনেক সময় অলংকার শিশুদের জন্য আত্মঘাতির কারণ হয়। আর বড় হলে সে এর বিপরীত পরিবেশকে মানিয়ে নিতে পারে না। যা অনেক ক্ষেত্রে অশান্তির কারণ হয়ে দাড়ায়!
(৬) ছোট শিশুর হাতে অন্যকে দান করাবে। খাদ্য জাতীয় বস্তু শিশুদের দিয়ে অন্য ভাই-বোন ও পরিবারের সদস্য বা ফকির মিসকিনদের দেয়াবে, যাতে শিশুর মনে প্রশস্ততা বাড়ে, দান খয়রাতের মনোবৃত্তি তার হৃদয়ে জম্ম লাভ করে।
(৭) অতি ভোজন-প্রেমিক মানুষদের লোকে পেটুক বলে ঘৃণা করে, শিশুদের এটা বুঝানো দরকার, যাতে শিশুরা অতি ভোজনের প্রতি নিরুৎসাহিত হয়। শিশু ছেলে মেয়ে যাই হোক, মাত্রাতিরিক্ত বিলাস ব্যসনে অভ্যস্ত না করা উচিৎ। অতি বিলাসী ছেলে মেয়ে জীবনের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়।
(৮) কথা বলার সময় শিশুকে শব্দ নিয়ন্ত্রণের প্রতি যত্নবান করে তুলবে। শিশুরা যেন উচ্চ আওয়াজে কথা না বলে, এ অভ্যাস ছোট বেলা থেকেই গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিশেষ করে মেয়েদের বাচনভঙ্গি যেনো কখনোও কর্কশ না হয় এর প্রতি খেয়াল রাখা আবশ্যক।
(৯) বাড়ীতে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অত্যধিক ফ্যাশনপ্রিয় ছেলে মেয়ে বা বেশী কৃত্রিম চাল-চলনে অভ্যস্থ বিলাসী শিশুদের থেকে আপনার সন্তানকে দূরে রাখাই নিরাপদ।
(১০) মিথ্যা, পরনিন্দা, ঝগড়া, প্রতারণা, ধোকাবাজী, হিংসা-বিদ্বেষ, অনর্থক কথা বলা, অর্থহীন তর্ক করা, বেশী হাসি-ঠাট্টা করা, বিনা ভাবনায় অনিয়ন্ত্রিত কথা বলা, অর্থবহ কথা বলার প্রতি উদাসীনতা থাকা, এসব ক্ষতিকর দিকসমূহ সম্পর্কে শিশুকে সতর্ক করা অভিভাবকের অপরিহার্য কর্তব্য। অন্যায় আচরণ করলে অবশ্যই শাসন করবে। অন্যায়ের প্রশ্রয় শিশুকে চরিত্রহীন ও বখাটে হতে সাহায্য করে।
(১১) সন্ধ্যা রাত্রেই শিশুকে ঘুমাতে না দেয়া উচিৎ এবং সকাল সকাল শিশুকে জাগিয়ে দেয়া দরকার।
(১২) সাত বছর বয়স হলেই, শিশুকে নামাযের প্রতি মানোযোগী করানোর চেষ্টা করা। দশ বছর বয়সে অবশ্যই কুরআন শরীফ পাঠে সক্ষম করা।
(১৩) পড়তে সক্ষম হলেই শিশুদেরকে ঐতিহাসিক গল্পের বই, পীর আওলিয়া, নবী রাসূলদের কাহিনী পড়তে দেয়া বা তাদেরকে সত্য কাহিনী শোনানোর গুরুত্ব অপরিসীম।
(১৪) বাল্যাবস্থায় বাজারী নভেল, উপন্যাস, তথাকথিত সাহিত্য ম্যাগাজিন হাতে তুলতে না দেয়া এবং এর প্রতি নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে মননশীল পুস্তকের প্রতি আকর্ষণ জন্মানো আবশ্যক।
(১৫) পড়াশোনা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ফেরার পর তাকে আনন্দদায়ক ও নির্দোষ খেলার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। এতে শিশুর মন সুস্থ থাকবে। প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ স্তিমিত হবে না। আতশবাজী, পটকা, ককটেল ইত্যাদির প্রতি যেন শিশু আকৃষ্ট না হয়। জুয়া, মার্বেল, বাজি খেলায় মেতে না ওঠে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
(১৬) ছুটির দিনে বা কোথাও বেহুদা বেড়ানোর নামে পয়সা খরচ না করে, হোটেল, রেস্তোরা, চাইনিজে পয়সা খরচ না করে বরং ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানগুলোতে বাচ্চাদের যথাসম্ভব নিয়ে যাওয়া উচিত। বিশেষ করে যেখানে প্রাকৃতিক বিভিন্ন বিষয়, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কোন রুচিবান মানুষ শিশুদের নিয়ে বর্তমান সময়ের পার্কগুলো, চাইনিজ রেস্তোরা, সিনেমা বা ষ্টেডিয়ামে নিয়ে যেতে পারে না।
(১৭) মেয়ে শিশুকে অবশ্যই একজন সফল মাতৃত্বের ক্ষমতা অর্জনের উপযোগী শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। সন্তান ধারণ ও সংসার পরিচালনায় একজন মায়ের যথেষ্ট সুশিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
(১৮) মেয়েদের ঘর সজ্জা, দরকারী কাপড় তৈরী, হস্তশিল্পে পারদর্শী, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, খাদ্যের গুণগত মান, রন্ধন প্রণালীতে সিদ্ধহস্ত ইত্যাকার গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজে নৈপুণ্যতা অর্জনে দক্ষ করে তোলা অভিভাবকের কর্তব্য।
(১৯) ছেলে মেয়ে কোন বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিলে তাকে সাবাস দিয়ে উৎসাহিত করা উচিত। প্রয়োজনে তার এই কৃতিত্বের জন্য পুরস্কার দেয়া ভালো, এতে করে সে আরও উৎসাহ পাবে। পক্ষান্তরে যদি ঘটনাচক্রে চরম খারাপ কোন কাণ্ড ও ঘটিয়ে বসে, তবে তাকে ঘর ছাড়া না করে শাসানো প্রয়োজন। সাথে সাথে নীরবে সন্তানকে এ বিষয়টি বুঝানো দরকার যে, এ বিষয়টির জন্য মানুষ তাকে কতোটুকু ঘৃণা করবে অথবা তা প্রকাশ পেলে তাদের মর্যাদায় কী মারাত্মক আঘাত আসবে। সন্তান যেন তার ভুল বুঝতে পারে এবং এ রকম দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রতি ঘৃণা বোধ করে এজন্যে তার চৈতন্যবোধে পরিবর্তন সাধন করা প্রধান কর্তব্য। শিশু সন্তানরা যেন নিজের কাজ, কাপড়-চোপড়, থালা-বাসন, ব্যবহার্য দ্রব্য, বই-খাতা, কিতাবাদি, বিছানার আসবাব পত্র, আলমারী, বুকসেল্ফ ইত্যাদি নিজেই পরিস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করে এ উপদেশ দেয়া দরকার। এলোপাথাড়ী ময়লাযুক্ত থাকা, যেখানে সেখানে কাপড়াদি রেখে দেয়া ও অপরিস্কার থাকার প্রতি সন্তানদের কড়া শাসন করা অপরিহার্য।
(২০) শুধু শুধু উদ্ভট কল্পকাহিনী,ভূত-প্রেত- দৈত্য দানবের কিস্সা শিশুদের পড়তে না দেয়া উচিত। যে সব পুস্তকে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, দ্বীন দুনিয়ার বিভিন্ন শিক্ষনীয় বিষয় আছে শিশুদের তাই পড়তে দেয়া দরকার।
(২১) নিজ সন্তানদের কারিগরী-টেকনোলজী তথা হস্তশিল্পের কোন না কোন বিষয়ের অবশ্যই জ্ঞান দেয়া প্রয়োজন। এতে বেকারত্বের গ্লানী কোন সময়ই আপনার সন্তানকে বিপর্যস্ত করতে পারবে না।
(২২) ছেলে মেয়ে-বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তাদের হাতে কিছু কিছু কাজের দায়িত্ব পরীক্ষামূলকভাবে ছেড়ে দেয়া উচিৎ, যাতে করে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করতে সুযোগ যায়।
(২৩) শিশুদের হাতে মাঝে মধ্যে কিছু পয়সা দেয়া উচিৎ, যা তারা স্বাধীন মতো খরচ করবে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, শিশু যেন এই পয়সা গোপনে এমন কাজে খরচ না করে, যা সে প্রকাশ করতে চায় না।
(২৪) বন্ধুদের সাথে আপনার শিশু সন্তান যেন আপনার বাড়ী-গাড়ী, ঐশ্বর্য, ব্যক্তিত্ব বা কৌলিন্যের বড়াই না করে, এ ব্যাপারে তাকে সজাগ করা উচিৎ। কারণ এটা অহমিকার একটি অংশ। এতে সে বন্ধু মহলে তিরস্কৃত হবে। ব্যক্তিত্ব গঠনে এই স্বভাব খুবই অন্তরায়।
আহারাদিতে শিশুদের শিক্ষণীয়ঃ
শিশুকে নিজের হাতে খেতে ছোট বেলা থেকেই শিখাবে। শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়াবে। নিজের সম্মুখের দিক থেকে খাবে। অন্যের দিক থেকে কোন কিছু টেনে খাবে না। ক্ষুধার্তের মতো খাবে না। খাদ্যরত অন্যদের পাত্রের দিকে খেয়াল করবে না। বেশী তাড়াতাড়ি খাবে না। খাদ্য চিবিয়ে খাবে। মুখের গ্রাস না গিলে দ্বিতীয়বার মুখে গ্রাস দিবে না। খেতে বসে জামা কাপড়ে দাগ লাগাবে না। জামা কাপড় গুটিয়ে বসবে। কোন প্রকার থালা-বাসন বা চিবানোর শব্দ যেনো না হয়, তা খেয়াল রাখবে। হাতের আংগুল প্রয়োজনের অধিক ফাঁক করবে না। লোকমা ছোট ছোট করে নিবে। কাটা চামচ ব্যবহার করা ঠিক না।
ঘরে প্রবেশ করা ও বসার ধরণঃ
শিশুকে বুঝাতে হবে, ঘরে কেউ মেহমান এলে তার সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করতে হবে, তার সাথে সদালাপ ও নম্রভাবে কথা বলতে হবে। ঘরের যেখানে সেখানে থুথু ফেলা যাবে না। ফেলতে হলে উঠে গিয়ে ফেলে আসবে বা নাক ঝেড়ে আসবে। হাঁচি বা হাই এলে মুখে হাত রাখবে। থুতনির নীচে হাত দিয়ে বসবে না। আঙ্গুল মটকাবে না। অপ্রয়োজনে অন্যের প্রতি বার বার তাকাবে না। ভদ্রভাবে বসবে। বার বার কথায় কথায় শপথ বা কসম খাবে না। বিনা প্রয়োজনে কথা বলবে না। অন্যের কথা গুরুত্ব সহকারে শুনবে। কথা ভালো না লাগলে অথবা নোংড়া গল্প করলে সেখান থেকে উঠে নীরবে চলে যাবে, না হয় ভদ্রতা সহকারে কথার প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করবে। হঠাৎ করে যদি বেশী লোকজন আসে, আর বসার বা থাকার জায়গা না হয়, তা হলে তোমার নিজের বসার বা থাকার জায়গায় অন্য কাউকে শরীক করে নাও। কোথাও গেলে, কারো সাথে সাক্ষাত হলে, প্রথমেই সালাম করবে। কেউ সালাম দিলে সালামের জবাব দিবে। এ প্রসঙ্গে অন্য কোন বাক্য ব্যবহার করা ঠিক নয়।
অনুবাদঃ শহীদুল ইসলাম