সমকালিন প্রসংগ
তুরস্ক ও আলজেরিয়ার ইসলামপন্থীদের
রাজনীতিঃ শেখার আছে অনেক কিছু
আব্দুল্লাহ আল ফারুক
তুরস্কের ইসলামপন্থী প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন আরবাকান সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। এ পদত্যাগ তিনি স্বেচ্ছায় নয়-চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে করেছেন। ১৯৯৫ সালের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজয় লাভ করে বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পার হয়ে যে সরকার গঠন করেছিলেন তার মেয়াদ ছিল চার বছর। কিন্তু তার সরকারের মেয়াদ এক বছর তিনমাস যেতে না যেতেই তিনি পদত্যাগ করলেন এবং আগামী অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচন আহবান করেছেন। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী তার সরকারের অপর শরীক দল মাদারল্যান্ড পার্টির প্রধান তানসু সিলারের পরবর্তী মেয়াদের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেয়ার কথা থাকলেও প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল ট্রুপাথ পার্টির নেতা মাসুদ ইলমাজকে সরকার গঠনের আহবান জানালে তিনি নতুন সরকার গঠন করেছেন।
সরকার গঠনের পর আস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই মাসুদ ইলমাজ ইসলামের বিরুদ্ধে এক দফা জিহাদ ঘোষণা করেছেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ জিহাদ পরিচালনা করার জন্যই যেন তিনি সরকার গঠন করেছেন। সরকার গঠনের পর তার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে সোজা বলে দিয়েছেন, তার সরকার দেশে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার সংকুচিত করে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য সমূহ সমুন্নত রাখবে। এ লক্ষ্যে পার্লামেন্টে আস্থা ভোটের পর একটি নয়া শিক্ষা আইন উপস্থাপন করা হবে। তুরস্কে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা শক্তিশালী করাই হবে তার সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
আরবাকানের পদত্যাগ এবং তানসু সিলারের পরিবর্তে মাসুদ ইলমাজের সরকার গঠন প্রভৃতির মূল ইস্যু হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে একজন ইসলামপন্থী প্রধানমন্ত্রীকে সহজে মেনে নিতে পারে নি। উপরন্তু দেশের সেনাবাহিনী নিজেদেরকে সাংবিধানিক দায়িত্ব হিসেবে তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষক মনে করে। এ ছাড়া রয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল। তিন বাহিনী প্রধান ও স্টারধারী জেনারেলদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এ কাউন্সিলের ওপর। ফলে তারা সরকারের ওপর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের অজুহাতে ইচ্ছেমত উপদেশ বিলাতো ও ছড়ি ঘোরাতোর সুযোগ পাচ্ছে। ইসলামপন্থী আরবাকান ছিলেন এদের কাছে অসহায়। কেননা, সরকার গঠনের সময় তিনি শপথ নিয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান রক্ষা করার।
সরকার গঠনের পর তার দলের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এসব সেক্যুলার মহল প্রচণ্ড হৈ চৈ শুরু করে। তারা আরবাকানকে বারবার সংবিধান রক্ষার শপথের কথা মনে করিয়ে দেয়। আরবাকান তবুও কোন কোন ক্ষেত্রে আদর্শ, ইসলামী নীতি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেন। আমেরিকা-ইউরোপ ও দেশীয় সেক্যুলার মহলের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি কয়েকটি মুসলিম দেশ সফর করেন এবং দ্বিপাক্ষিক অনেক চুক্তি সম্পাদন করেন। এসব দেশের মধ্যে লিবিয়া ও ইরানও অন্তর্ভূক্ত ছিল। সেই থেকে সেক্যুলার মহলের সাথে তার তীব্র টানপোড়নের সম্পর্ক।
আরবাকান সরকার গঠন করেছেন আর একটি সেক্যুলার দল তানসু সিলারের মাদারল্যান্ড পার্টির সাথে জোট গঠন করে। উভয় দলের সমান সংখ্যক সদস্য দিয়ে মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হওয়ার চুক্তিতে এ জোট গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদেও তানসু সিলারের সরকারের মেয়াদের অর্ধেক সময় অধিষ্ঠিত থাকার কথা চুক্তিতে উল্লেখ ছিল। দু’মেরুর দ্বিমুখী আদর্শের লোক নিয়ে আরবাকান তার প্রশাসন চালাতেও হিমসিম খাচ্ছিলেন। আরবাকান চাচ্ছেন এক রকম তো তানসু সিলার করছেন আরেক রকম। সরকার গঠনে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সরকার পরিচালনায় ছিল সুস্পষ্ট অনৈক্য। আরবাকান যাচ্ছেন ইরান, লিবিয়ায় ইসলামী দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে, অন্যদিকে তার সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তুরহান যাচ্ছেন ইসরাঈল, আমেরিকা সফরে।
সেক্যুলার মহলের কাছে আরবাকান এত অসহায় ছিলেন যে, সেনাবাহিনী প্রধান ইসরাঈল সফরে গিয়ে আরবদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিহত অজ্ঞাত পরিচয় ইহুদী বীরদের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পন করে আসলেও মৃদু ভৎর্সনা করারও সুযোগ তার ছিল না। উপরন্তু তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও সেনাবাহিনী প্রধান ইসরাঈলের সাথে গেল জানুয়ারীতে এক সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে আসে। এ চুক্তির পর উভয় দেশের সেনাবাহিনী এক যৌথ মহড়ায়ও অংশ নেয়। উক্ত চুক্তিতে ইসরাঈলকে তুরস্কের বিমান ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর এসব কর্মকান্ড আরবাকানের রাজনৈতিক আদর্শের বিরোধী হলেও তিনি ছিলেন এক অসহায় দর্শক। নির্বাচনের আগে তিনি তুরস্কে মার্কিন ঘাঁটি থাকার প্রচন্ড বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সরকার গঠনের পর তার দেশে অবস্থিত ৪টি মার্কিন ঘাঁটির মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং পুনরায় চুক্তি নবায়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। মন্ত্রীপরিষদের যে বৈঠকে এ নবায়নের অনুমোদন দেয়া হয়, সে বৈঠকে সভাপতি ছিলেন মার্কিন ঘাঁটির চরম বিরোধিতাকারী স্বয়ং আরবাকান।সেনাবাহিনী এবং মন্ত্রীদের প্রচণ্ড চাপের মুখে তিনি এ চুক্তি নবায়নে রাজী হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
আরবাকান এ বছর হজ্জ পালন করেছেন। কিন্তু সেনাবাহিনী তার এ পবিত্র হজ্জ পালনের বিষয়েও দুর্গন্ধ খোঁজার দৃষ্ঠতা দেখায়। নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক বৈঠকে চীফ অফ জেনারেল স্টাফ জেনারেল সিভিকবে তাকে সরাসরী সৌদি আরবের দালাল বলে আখ্যায়িত করে। এর আগে এক জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে পাঁচ তারকাওয়ালা জেনারেলরা আরবাকানকে নয় ঘন্টাব্যাপী মৌলবাদ সম্পর্কে জেরা করে এবং মৌলবাদ উস্কে দেয়ার জন্য তাকে সরাসরি অভিযুক্ত করে। অতপর প্রচন্ড চাপের মুখে তিনি তাদের দাবী অনুযায়ী কাজ করতে সম্মত হন। এ ঘটনার পর মার্চ মাসে সেনাবাহিনী তার কাছে একটি তালিকা উপস্থাপন করে, যাতে ১৪ জন জেনারেলের নাম ছিল। এরা ইসলামী মানসিকতার অধিকারী' বলে সেনাবাহিনী থেকে তাদের পদচ্যুত করার সুপারিশ করা হয়। আরাকান বাধ্য হয়ে তাদের পদচ্যুত করার অনুমতি দিয়ে দেন।
ইসলামপন্থীর ইমেজ নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া আরবাকান দেশে কিছু নতুন মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। এসব নতুন স্থাপিত মাদ্রাসায় ছোট ছোট শিশুদের ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান ও কুরআন শিক্ষা দেয়া হতো। এ সব মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকলে তা সেক্যুলারপন্থীদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তুরস্কে ৫ বছরের আগে কোন শিশুকে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া যাবে না-এ ধরনের একটি আইন আছে! সেক্যুলারপন্থী রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সেনাবাহিনী এ আইনকে অবলম্বন করে আরবাকানের সমালোচনার সয়লাব বইয়ে দেয়! জেনারেল কেনান জেনিস নামের একজন অফিসার, মৌলবাদের সমর্থন করা জন্য আরবাকানের বিরুদ্ধে সংবিধান লংঘনের অভিযোগ করেন। সেনাবাহিনী, সেক্যুলার রাজনীতিক ইসলাম বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের এসব কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আরাবাকানের রেফা পার্টির সমর্থকরা বিভিন্ন বিশাল সভা-সমাবেশে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকে। ফলে আরবাকানের রেফাহ পার্টি ও সেক্যুলারদের মধ্যে সংঘাত তীব্রতর হয়ে উঠে। সেনাবাহিনী ইসলামপন্থীদের দমন, তথাকথিত মৌলবাদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার, নতুন স্থাপিত মক্তব-মাদ্রসাগুলো বন্ধ করে দেয়া, শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের বাধ্যবাধকতার বয়স সীমা পাঁচ থেকে আটে উন্নীত করে আইন পাশ প্রভৃতিসহ ২০ দফা দাবীনামা আরবাকানের নিকট পেশ করে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে তা বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দেয়। দাবীনামা পত্রে আগে সেনাবাহিনী দেশের সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার, শিল্পপতিদের প্রতিনিধিদের ডেকে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা অক্ষুন্ন রাখতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহবান জানায়। চারিদিকে এত সব প্রতিকূলতার কারণে অবশেষে আরবাকান পদত্যাগ করে জনতার কাতারে গিয়ে দাঁড়ান।
আরবাকান ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র এক বছর তিন মাস। এসময় কয়েকটি মুসলিম দেশ সফর ও কিছু সংখ্যক মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়া ছাড়া তার সকল নির্বাচনী অঙ্গীকার অপূর্ণই থেকে যায়! নির্বাচনের সময় তিনি সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা, দেশ থেকে মার্কিন ঘাঁটি তুলে দেয়া, ইসলাম বিরোধী সকল অশ্লীলতা-অপসংস্কৃতি বন্ধ করা, জেরুজালেম উদ্ধার, চেচনিয়া, কাশ্মীর, ফিলিস্তিন প্রভৃতি মজলুম মুসলমানদের সাহায্য করা, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার এবং তুর্কী সমাজ ব্যবস্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলেন। ক্ষমতায় গিয়ে এসবের বাস্তবায়ন তো দূরের কথা বরং মধ্য প্রাচ্যের মুসলমানদের চিরশত্রু ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর হয় তারই আমলে। ইসলামপন্থীদের সমর্থক এ অজুহাতে সেনাবাহিনী থেকে কয়েকজন জেনারেলের বহিষ্কার আদেশে তিনিই স্বাক্ষর দেন। স্বাধীন আফগানিস্তান ও তালেবান ইসলামী সরকারের অন্যতম দুশমন আব্দুর রশিদ দোস্তাম তারই শাসনামলে তুরস্কে আশ্রয় গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছে এবং সে তুরস্কে বসেই তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। তার আমলে ইসরাঈলকে তুরস্কের বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। ফলে ইসরাঈল এ সুবিধাটুকু একমাত্র আরব মুসলমানদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করবে। সর্বোপরি আরবাকান মার্কিনীদের তুরস্কে নিজ ঘাঁটি স্থাপনের চুক্তি নবায়নে নিজেই সই দিয়ে অনুমোদন দিয়েছেন। আগেই বলা হয়েছে আরবাকান স্বইচ্ছায় নয় বাধ্য হয়েই এসব আদর্শ-বিরোধী কর্মকান্ডে অনুমোদন দিয়েছেন। কেননা, ক্ষমতা লাভের সময় তিনি তো ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান এবং তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অক্ষুন্ন রাখার শপথ নিয়েছিলেন। অতএব সংবিধান পরিপন্থী তার রাজনৈতিক আদর্শ সংবিধানের রক্ষকরা বাস্তবায়িত হতে দেবে কেন?
১৯৭৩ সালে আরবাকান তুরস্কে ইসলামী ধারার রাজনীতি প্রবর্তন করেন এবং দীর্ঘ দিন রাজনীতির পর ১৯৯৬ সালে একটি সেক্যুলার দলের সাথে জোট বেঁধে ক্ষমতায় যান। ২৩ বছর রাজনীতির ময়দানে সংক্রিয় থেকে ক্ষণিকের জন্য ক্ষমতায় গিয়ে যে ভোগান্তির স্বীকার হয়েছিলেন, তা তো নিবন্ধের শুরুতে আলোচিত হয়েছে। পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেও তিনি তার রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়িত করা তো দূরের কথা বরং আদর্শ বিরোধী কর্মকান্ডকেও তিনি অনুমোদন দিতে বাধ্য হয়েছেন। সামরিক বাহিনী সর্বদা তাকে চাপের মুখে রেখেছে এবং একটি অঘোষিত অভূত্থান ঘটিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। আরবাকান সরকার গঠনের পর থেকেই দেখা গেছে, সকল সেক্যুলার মহল একজোট।
আলজেরিয়ায়ও ইসলামপন্থীরা নির্বাচনে জয়লাভ করার পর সেনাবাহিনী ও সেক্যুলার মহল জোটবদ্ধ হয়ে ইসলামপন্থীদের বিজয় কেড়ে নিয়েছিল, নির্মম দখল অভিযান চালিয়ে তাদের স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চালাতো হয়েছিল । যে দমন অভিযান অব্যাহত আছে এখতো।
তুরস্কের ঘটনা প্রবাহ আরবাকানকেও হয়তো সেদিকে ঠেলে দিচ্ছে। আগামী নির্বাচনে আরবাকান নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে মহাপবিত্র জ্ঞানে যারা রক্ষক বনে গেছেন তারা যে তাকে এক মুহূর্তও শান্তিতে থাকতে দেবে না তার লক্ষণ তো সুস্পষ্ট। গুটি কতক মাদ্রাসা ও মসজিদ নির্মাণ এবং সরকারের ওপর অবৈধ ছড়ি ঘোরাতোর মাতব্বরীর বিরুদ্ধে খানিকটা প্রতিবাদ জানাতেই যারা একটা অঘোষিত অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ছেড়েছে, সেই পবিত্র সংবিধান সংশোধনী বা ইসলামের পক্ষে কোন বিল পার্লামেন্টে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলে এ মহ পাপের বিরুদ্ধে যে তারা অন্ততপক্ষে একটা মিনি কিয়ামত সংঘটিত করে ছাড়বে,সে আলামত স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। পক্ষান্তরে আরবাকান নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তার ফলাফল যে কি দাঁড়াবে, তা তো গত এক বছর তিন মাসে প্রমাণিত হয়ে গেছে।
আলজেরিয়ায় ইসলামপন্থীদের ব্যালেটের পথ থেকে বুলেটের পথে ঠেলে দেয়ার পর নাজমুদ্দিন আরবাকানকে পদত্যাগে বাধ্য করা ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে সেক্যুলার মহল ও সেনাবাহিনীর যুদ্ধংদেহী মতোভাব থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। বিশেষ করে যারা প্রচলিত গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। বৈদেশিক শক্তি দ্বারা প্রভাবিত আলজেরিয়ার সেনাবাহিনী ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় আসার আগেই অভূত্থান ঘটিয়েছিল আর তুরস্কে ইসলামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও সেনাবাহিনী একটা অঘোষিত অভূত্থান ঘটিয়ে ইসলামপন্থী সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। উভয় দেশের ইসলামপন্থীরা একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন।কেউ ক্ষমতার যাওয়ার আগে, কেউ ক্ষমতায় যাওয়ার পরে। উভয় দেশের ঘটনাবলীর মধ্যেও একটা সাদৃশ্য রয়েছে। আছে আমাদের শেখার অনেক উপাদান। যেমনঃ
১। নাজমুদ্দিন আরবাকানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং সরকারের অন্যতম অংশীদার ছিলেন তানসু সিলার। পার্লামেন্ট, সচিবালয়, সরকারী কোন অনুষ্ঠান বা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে আরবাকানের পাশাপাশি পাশ্চাত্য স্টাইলের পোষাক পরিহিতা ধর্ম বর্জিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত এ মহিলা তার জীবন দর্শন অনুযায়ী সরকারী কাজে অংশ নিতেন। এছাড়া পার্লামেন্টেও তার মতো সুসজ্জিত সুশোভিত বহু সেক্যুলার নির্বাচিত মহিলা সদস্য ছিল। ইসলামী শরীয়াহর পরিভাষায় যাদের দাইয়্যুস আখ্যা দেয়া হয়েছে, তাদের সাথে নিয়েই পার্লামেন্টে বসতে হতো আরবাকানকে। এদের এ বেপরোয়া উপস্থিতির দ্বারা পার্লামেন্টের পরিবেশ কলুষিত করা (চোখ ও মুখের যিনা থেকে আত্মরক্ষা) থেকে বিরত রাখার কোন অধিকার তাদের ছিল না। এ ধরনের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করলে সংবিধান অনুযায়ী তা উক্ত সদস্যাদের অধিকার ক্ষুন্ন বলে গণ্য হতো এবং দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে মানবাধিকার লংঘন বলে অভিহিত করে সরকারের বিরুদ্ধে একটা চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালাতো। হয়ত তখন সরকারের শরীক দল তানসু সিলারের নেতৃত্বাধীন মাদারল্যান্ড পার্টি সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতো। আলজেরিয়ার ইসলামপন্থীরাও সরকার গঠন করার সুযোগ পেলে একই পরিস্থিতির শিকার হতো। কেননা সে নির্বাচনেও সেক্যুলার ও কমুনিষ্ট পার্টির কয়েকজন মহিলা সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল।
এ পর্যায়ে সরকার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে আরবাকানকে ইসলামের একটা ফরজ বিধান অহরহ লংঘনকে যেমন চোখ বুজে হজম করে যেতে হয়েছে, তদ্রপ সরকারে মহিলাদের অংশ গ্রহণের অবৈধ-বৈধতার বিষয়টিও চেপে যেতে হয়েছে।
২। আলজেরিয়ায় ক্ষমতা গ্রহণের আগেই ইসলামপন্থীদের সেনাবাহিনী বাধা প্রদান করেছে, এ বাধা প্রদানে দেশের অন্যান্য সেক্যুলার মহলেরও মদদ ছিল। পক্ষান্তরে তুরস্কে সেক্যুলার রাজনীতিক ও অন্যান্য মহল ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা গ্রহণে প্রথম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং এর চূড়ান্ত রূপ দেয় সেনাবাহিনী সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। আরবাকান নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট তাকে সরকার গঠনের আহবান জানালেও পার্লামেন্টে সেক্যুলার দু'টি দলের সদস্যরা তার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। উভয় দেশের সেক্যুলার মহল এবং সেনাবাহিনীর ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে এ অবস্থান নেয়ার একমাত্র কারণ হলো ইসলাম। উল্লেখ্য, যে তানসু সিলার ও তার দল প্রথমবার আরবাকানের ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল, সেই ইসলামের বিরুদ্ধাচারণকারীদের সাথে নিয়ে পরবর্তীতে আরবাকানকে সরকার গঠন করতে হয়েছিল। ফলে, আরবাকান সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী (তানসু সিলারের দলের সদস্য) ইসরাঈলের সাথে চুক্তি তথা ইসরাঈলকে স্বীকৃতি প্রদান করে মুসলিম উম্মাহর পিঠে ছুরিকাঘাত হানলেও আরবাকানের কিছুই করার ছিল না।
আলজেরিয়া ও তুরস্কের ইসলামপন্থীদের এ অসহায়ত্বের প্রধান কারণ ছিল ইসলাম বিরোধী ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সংগঠিত শক্তির দাপট। ইসলাম বিরোধী এ সংগঠিত শক্তিকে অক্ষুন্ন রেখে আলজেরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামপন্থীরাও যদি ক্ষমতায় যেত, তবে যে কোন সময় আরবাকানের মতো ভাগ্যবরণ করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো, তাদেরও আরবাকানের মতো সার্বক্ষণিক চাপের মুখে থাকতে হতো।
৩। উভয় দেশের ইসলামপন্থীরা যদি দেশে সার্বিকভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতো, তবে এক ভয়াবহ জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। ইসলামপন্থীদের কিসাস, রজম প্রভৃতি শরয়ী বিধান বিল পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে নিতে হতো। এসব বিল পার্লামেন্টে উত্থাপিত হলে প্রচলিত বিধি অনুযায়ী বিরোধী দল বিরোধিতা করত। এসব বিল পাশের বিরুদ্ধে তারা হাজারো যুক্তির অবতারণা করতো। এমনিতেই সেক্যুলার মহল এসব শরয়ী বিধানকে মধ্যযুগীয় বর্বরআইন বলে সমালোচনা করতে অভ্যস্ত।অথচ আল-কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ঘোষিত বিধানের বিরুদ্ধাচারণ সুস্পষ্ট কুফরী কাজ। পার্লামেন্টে যারা এ সুস্পষ্ট কুফরীর অবতারণা করতো, তাদের ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী শাস্তি বিধান ইসলামী সরকারের জন্য অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু উক্ত দেশ দুটির কোন ইসলামী সরকার কি এ অপরাধের শাস্তি দিতে সক্ষম হতো? কেননা প্রচলিত পদ্ধতিতে সরকারের যে কোন কর্মকান্ডের বিরোধিতা, সমালোচনা করা বিরোধী দলের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত।
৪। আরবাকান পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের সময় তুরস্কের বর্তমান সংবিধান রক্ষা করার অঙ্গীকার করেছিলেন, সরকার গঠনের সময়ও আরেক দফা অঙ্গীকার করতে হয়। আলজেরিয়ার ইসলামপন্থীরাও যদি সরকার গঠন করার সুযোগ পেতো, তবে তাদেরও আলজেরিয়ার সংবিধান (অনেক ইসলাম বিরোধী বিধি বিধানের সমাহার রয়েছে এতে) রক্ষা করার শপথ নিতে হতো। কেননা, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান পরিবর্তন করার ক্ষমতার অধিকারী হলেও পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করার পরেই সে সুযোগ পেতেন না। ঈমানদার মুসলমান-বিশেষ করে যারা একটি ইসলামী সরকারের পরিচালনা করবেন, তাদের এমন একটা অনৈসলামিক সংবিধানকে রক্ষার শপথ নেয়া কতখানি গ্রহণযোগ্য?
৫। প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটি সরকারের মেয়াদ চার অথবা পাঁচ বছর। উল্লেখিত দেশদ্বয়েও ইসলামপন্থীদের সরকারের মেয়াদ ছিল চার ও পাঁচ বছর। অর্থাৎ-চার পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসতে হবে। প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় সৎ-অসৎ ও মুর্খ-জ্ঞানীর মর্যাদা সমান। স্বাভাবিকভাবে একটি সমাজে অসৎ ও মুর্খের সংখ্যাই সব সময় বেশী থাকে।সুতরাং এ অসৎ ও মুর্খ দায়িত্বহীনদের অবিবেচনা ও প্রলোভনের শিকার হওয়ার কারণে নির্বাচনের ফলাফল ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে, যেমনটা গণতান্ত্রিক বিশ্বে অহরহ ঘটছে। ফলে ইসলামপন্থীদের স্থানে পুনরায় সেক্যুলার দল ক্ষমতায় আসতে পারে। তখন অনিবার্যভাবে ইসলামী নীতি-আদর্শ বদলে দিয়ে সেক্যুলার নীতি-আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাবে এভাবে সেক্যুলার শক্তির কাছে ক্ষমতা অর্পন করা এবং ইসলামী নীতি আদর্শ নিয়ে তাদের টানা-হেঁচড়া করার সুযোগ দেয়া (বর্তমান তুরস্কে যা ঘটছে) কি ইসলাম সম্মত বলে বিবেচিত হবে?
৬। আলজেরিয়া ও তুরস্কের ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রথম কাতারে ছিল বিদেশী মদদপুষ্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় অফিসার। আলজেরিয়ার ৮০% জনগণের সমর্থনে ধন্য ইসলামপন্থীদের বিজয়কে কয়েকজন অফিসার সেনানিবাসে বসে নস্যাৎ করে দেয় মুহূর্তের মধ্যে। ইসলাম পন্থীদের ন্যায্য অধিকারকে কেড়ে নিলেও বিদেশী মোড়লরা একটা টু শব্দও করে নি বরং নেপথ্যে থেকে অভুত্থানকারীদের বাহবা দিয়েছে। তুরস্কের ঘটনাবলীর নেপথ্যে সিআইএ ও ইসরাঈলী গুপ্তচরদের হাত আছে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। ইসলামপন্থীরা এসব সংগঠিত ইসলাম বিরোধী শক্তিকে প্রতিহত করে ইসলামী আন্দোলনের সুফলকে রক্ষা করতে পারেন নি। কেননা অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করে অধিকার প্রতিষ্ঠার মতো শক্তি তাদের ছিল না। তুর্কী সেনাবাহিনী তো তাদের অসম্ভব রকমের বাড়াবাড়িকে সংবিধান সম্মত এবং সংবিধান রক্ষার ‘মহৎকাজ’ বলে দাবী করেছে। বিশ্বের তথাকথিত গণতন্ত্রের মানসপুত্ররাও তাদের সমর্থন করে গেছে। অথচ আরবাকান ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির অনুসারী হলে তাদের ভূমিকা হতো ঠিক এর উল্টোটা। সর্বোপরি, তুরস্ক ও আলজেরিয়ার ঘটনাবলী থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, প্রচলিত গণতান্ত্রিক পথে গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করা যায়-পূর্ণাঙ্গ ইসলাম নয়। তবে এ পথে ইসলামের টুকিটাকি কিছু বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা সম্ভব বটে, কিন্তু তার স্থায়িত্বের কোন নিশ্চয়তা নেই। গণতান্ত্রিক দেশে ইসলামপন্থী সরকার যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন তাকে আদর্শিক ছাড় প্রদান করতে হয়, কুফরী পথের অনুসারীদের সাথে সহ-অবস্থান করতে হয়, আপোষ করতে হয়। এ ছাড়া এতটুকু ইসলামী বিধান বাস্তবায়নের প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানদের ওপর আরো বড় ধরনের জুলুম চেপে বসার আশঙ্কা থাকে। যেমনঃ তুরস্কে দীর্ঘ দিন যাবৎ সেক্যুলার সরকার শাসন ক্ষমতায় থাকলেও মুসলমান শিশুদের পাঁচ বছর বয়স হলে ধর্ম শিক্ষা দেয়া যেত। কিন্তু আরবাকানের পদত্যাগের পর সেনাবাহিনীর পরামর্শ অনুযায়ী এ বয়স সীমা আট বছরে উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছে নতুন সরকার। ইসলামপন্থী আরবাকানের অন্যতম সাফল্য ছিল শিশুদের ইসলামী শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করা। নতুন সরকার এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে আরো কঠোরভাবে ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি রক্ষা করতে চাইছে, মুছে ফেলতে চাইছে আরবাকানের ২৩ বছরের আন্দোলনের ফসলটুকু। অতএব, ইসলামী দলগুলোর গণতন্ত্র চর্চা করে কি লাভ বলুন?