আলোকপাত
বিশ্বনবী (সঃ) এর পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল
উবায়দুর রহমান খান নদভী
নবুওত কোনো শিক্ষা, যোগ্যতা বা অর্জনযোগ্য বিষয়ের নাম নয়। দক্ষতা, মেধা বা প্রতিভা দিয়ে নবী হওয়া যায় না। চর্চা, অধ্যবসায়, অনুশীলন ও সাধনা দ্বারা দুনিয়ার সব কিছু অর্জন সম্ভব হলেও নবুওত বা রিসালাত লাভ করা সম্ভব নয়। নবুওত সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ পাকের মনোনয়ন। আল্লাহর পয়গাম মানবজাতির কাছে বহন করে আনা এবং তার প্রচার করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ নবী-রসূল মনোনীত করেন। “আল্লাহ মানবকুল থেকে রসূল মনোনীত করে থাকেন।” এই আয়াতে যে সত্যটি ফুটে ওঠে, তারই পূর্ণ বিকাশ ঘটে প্রিয়নবী (সঃ) সম্পর্কে আল্লাহ পাকের এ উক্তিতেঃ “প্রত্যাদেশকৃত ওহী ভিন্ন তিনি নবী করীম (সঃ) মন থেকে কোন কথা বলেন না।”
আল্লাহ পাকের মনোনয়ন ও ওহীর মাধ্যমে পরিচালনার বৈশিষ্ট্যে নবী-রাসূলগণের সত্তা বা ব্যক্তিত্ব অতুলনীয়। বিশ্বের সকল মনীষী, কৃতীপুরুষ, বিজয়ী বীর, রাষ্ট্রনায়ক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ধর্মপ্রবর্তক ও সংস্কারকের জীবনে তার নিখুঁত পরিকল্পনা ও সুনিপুণ কর্মকৌশলের ভূমিকা অনুপাতেই তার সাফল্য ও ব্যর্থতার আদর্শের আলোচনায় এ বিষয়টি মুখ্য হয়ে আসে না। এখানে আসে প্রতিটি কর্ম সাধনা ও পরিবর্তনের পেছনে খোদায়ী প্রত্যাদেশের বর্ণনা। আর প্রত্যাদিষ্ট কর্মপদ্ধতির আলোকে পরিচালিত নবুওতি আন্দোলন তথা তৎপরতার সার্থক রূপরেখার বিবরণ। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) -এর জন্মের পূর্ব থেকেই তার আবির্ভাব ও জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মপ্রচারক কর্তৃক বিবৃত হয়েছে ভবিষ্যদ্বাণী। পূর্ববর্তী নবীগণও সংবাদ প্রদান করেছেন শেষ নবীর আগমনের। অতএব, আখেরী নবী (সঃ)-এর আবির্ভাব ছিল পূর্ণরূপে পরিকল্পিত ও খোদায়ী ব্যবস্থাপনার আওতাধীন। পরিবেশ, পরিস্থিতি, সময় ও সমাজ একজন সাধারণ অথচ অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তিকে নবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেনি। যা অন্যান্য কৃতীপুরুষ বা মনীষীদের বেলায় ঘটে থাকে। এ হিসেবে নবী-রাসূলগণ সম্পূর্ণভাবেই ব্যতিক্রম।
মাতৃ উদর থেকেই পিতৃহীন অবস্থায় পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়া, বালক বয়সে বিদেশে- বিভুইয়ে বিজন প্রান্তরে মাতৃহারা হওয়া, দাসীর সাহায্যে পিতামহের গৃহে পৌঁছা, অল্পকালের ব্যবধানে পিতামহের মৃত্যু ঘটায় দরিদ্র পিতৃব্যের সংসারে অনাথ অবস্থায় নীত হওয়া ইত্যাদি পথ-পরিক্রমায় শিশু-কিশোর ও তরুণ মুহাম্মদ (সঃ) এর যে মনো-দৈহিক বিকাশ সাধিত হয় তা নিঃসন্দেহে তার ভবিষ্যত জীবনের কর্ম সাধনা ও তৎপরতার জন্য উপযোগী সূচনা পর্ব। একটি অনন্য আদর্শিক জীবন সংগ্রাম ও সর্বপ্লাবি যুগবিপ্লবের সুদৃঢ় ভিত্তিমূল। মহান প্রভুর প্রত্যক্ষ পরিচালনায় প্রাকৃতিক নিয়মেই মহানবী (সঃ) এর পার্থিব দিবস-রজনী চল্লিশটি বর্ষ পরিক্রমণ করে একটি পরিণত মানবের পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করে। প্রিয়নবী (সঃ) কে নবুওতের দায়িত্ব লাভের সময়-দুয়ারে উপনীত করে। সাধারণত সকল নবীই সে সময়কালে নবুওতের মর্যাদাগত দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।
বুদ্ধি- বিবেচনা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও মেধা মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলগণও উত্তম গুণাবলীর অধিকারী। তাদের ব্যক্তিগত জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও চেতনা সকল মানুষের চেয়ে বেশি বিশুদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ। তদুপরি তারা খোদায়ী নির্দেশনায় ধন্য। ব্যক্তি বা মানুষ হিসেবে নবী-রাসূলগণের প্রাক-নবুওত জীবনও অনুপম বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আমাদের প্রিয়নবী (সঃ) এর যৌবনে নিজ জাতি ও সমাজের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে তিনি নিজ নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও মানবিক গুণাবলীর দ্বারা সমাজকে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছেন। কাবা গাত্রে কালো পাথর স্থাপন সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে তার উপর বিবাদমান জনতার পূর্ণ আস্থা এবং তার প্রজ্ঞাপূর্ণ সমাধানের প্রতি গোটা আরব সম্প্রদায়ের সানন্দে সমর্থন ও অংশগ্রহণ থেকে আমরা মহানবী (সঃ) এর কর্ম কৌশলের অনুপম নৈপুণ্যের প্রমাণ পেতে শুরু করি।
নবুওত প্রাপ্তির আগে গোত্রীয় দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বিশেষত ফিজার যুদ্ধোত্তরকালে তরুণ মহানবী (সঃ) এর সমাজসেবা ও সাংগঠনিক সমাজকল্যাণ কর্মসূচী থেকেও আমরা তার গণমুখিতার নীতির প্রমাণ পাই। যুদ্ধবিধ্বস্ত গোত্র, পর্যুদস্ত জনগোষ্ঠী ও অনাথ, পিতৃহীনের পুনর্বাসন সংস্কার ইত্যাদি তো সর্বপ্রথম তিনিই আরবদের শিখিয়েছেন। হিলফুল ফুজুল বা “ফজলগণের অঙ্গীকার” তার সামাজিক কর্মসাধনারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা ও জনপ্রিয়তার লাইম লাইটে উঠে আসাও কি একজন উদীয়মান জননেতা ও যুব ব্যক্তিত্বের সুচিন্তিত কর্মকৌশলের প্রমাণবহ নয়?
হযরত নবী করীম (সঃ) এর পিতৃব্য আবু তালিবের ঘরে দিনযাপন করলেও ব্যক্তিগত কর্ম ও দায়িত্ব থেকে তিনি কখনোই পিছিয়ে থাকেননি। চাচার ঘরোয়া কাজে অংশগ্রহণ এবং তার পেশাগত দায়িত্বে সহযোগিতা ইত্যাদি হযরতের মানবিক নৈতিকতারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। চাচার সহযাত্রী হয়ে অখণ্ড শামের উদ্দেশ্যে বাণিজ্য যাত্রাও তরুণ মুহাম্মদের সমাজ ও জীবন ঘনিষ্ঠতারই বহিঃপ্রকাশ। এরপর যখন চাচার সংসারের জানালা দিয়ে তিনি চোখ রাখলেন বাইরের বিশাল ভূবনে, দেখলেন জীবন সংগ্রামের আরো বিস্তৃর্ণ ময়দান। ধনকুবের ব্যবসায়ী খাদীজা বিনতে খোয়াইলিদের বাণিজ্য-কাফেলার ব্যবস্থাপক নিযুক্ত হয়ে গেলেন বানিজ্যে শাম দেশে। সুন্দর ব্যবস্থাপনা, সুদক্ষ পরিচালনা আর বিপুল বিশ্বস্ততায় প্রচুর লাভ হলো বানিজ্যে। বাণিজ্য কর্মীদের রিপোর্ট শুনে হযরত খাদীজা যুবক মুহাম্মদের সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন তার অভিভাবক-চাচা আবু তালিবের কাছে। বিয়ে হলো। হযরত এবার চাচার বাড়ি থেকে বিবি খাদীজার ঘরে স্থানান্তরিত হলেন, সাথে সাথে নিয়ে এলেন আদরের ছোট চাচাত ভাই আলীকে। এবার তিনি হযরত খাদীজার ব্যবসায় ম্যানেজিং পার্টনার। মা খাদীজা হলেন যুবক মুহাম্মদের নবুওত পূর্বকালীন কর্মতৎপরতার একনিষ্ঠ সহায়িকা। এভাবে কাটলো দেড় দশক। খাদীজার দেয়া ক্রীতদাস যায়েদ ইবন হারিসা এখন নবীজীর পুত্র বলে পরিচয় লাভ করেছে। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি নবুওত লাভ করেন। মা খাদীজা, হযরত আলী আর যায়েদ ইবনে হারিসা ঘরের ভেতর সর্বাগ্রে প্রিয়নবীর উপর ঈমান এনে নতুন দ্বীনের প্রথম মহিলা, কিশোর ও ক্রীতদাস সদস্যরূপে ইতিহাসে আসন লাভ করেন। আর বাইরের পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ঈমান আনয়নকারী ব্যক্তি প্রিয়নবীর সর্বাগ্রে বিশ্বাসী বন্ধু হযরত আবু বকর (রাঃ)। স্বাবলম্বী হওয়া, ঘরবাধা, জীবিকার উপায় অবলম্বন আর সামাজিক প্রতিষ্ঠার ভীত গড়ার এ ধারাক্রম কি সুন্দর পরিকল্পনা আর উত্তম কর্মকৌশলের সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না? রাসূল আকরাম (সঃ) নবুওত প্রাপ্তির পর সর্বপ্রথম আদিষ্ট হলেন, “আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।” ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্যে তিনি তাই নিজ গৃহে খানার দাওয়াত দিয়ে জমায়েত করলেন কুরাইশের হাশেমী নেতৃবর্গকে। কথা বললেন অতি বিনয় অথচ আত্মবিশ্বাসী বলিষ্ঠতার সাথে। কাজ হলো না বটে, তবে সম্পর্ক সৃষ্টি হলো। আবু কুবায়স পর্বতে চড়ে পরবর্তী ঘোষণা দিলেন। ইসলামের প্রকাশ্য আহবান। প্রচারের এ সূচনা লগ্নেও ব্যবহার করলেন ভাষা-বক্তৃতার এক নিটোল কৌশল। “আমি যদি বলি এ পর্বতের পেছন থেকে এক দুর্ধর্ষ শক্রদল ধেয়ে আসছে, তোমাদের তছনছ করে দিতে, তোমরা কি বিশ্বাস করবে?” আরো বললেন, “এক জীবন কাটিয়েছি আমি আপনাদের হয়ে, আমাকে তো আপনারা সত্যবাদী ও বিশ্বাসী রূপেই দেখেছেন।” এ ভাবে মনো-চৈতনিক ক্ষেত্র তৈরি করে তবে দিয়েছেন নতুন বার্তাটি। এ সবই ছিল নবীজির কাজের সৌন্দর্য, প্রাণপূর্ণ কর্মকৌশল।
ইসলাম প্রচারে বাধাবিঘ্ন যখন চরম, আরকাম ইবনে আরকাম (রাঃ) এর ঘরে গোপনে তখন প্রিয়নবীর মিশন চলছেই। রাতের আঁধারে নতুন মুসলমানেরা সমবেত হয় এই ঘরে। আবার ফর্সা হওয়ার আগেই তাদের ফিরে যেতে হয় নিজ নিজ ঠিকানায়। হুযুর (সঃ) দু'আ করেন, “হে আল্লাহ! খাত্তাবের পুত্র উমর অথবা আবুল হিকাম উমর, এদের একজনকে আমার সাথে কাজে লাগিয়ে দিন।” প্রভাবশালী ব্যক্তির দুর্বিনীতি উত্থান ছাড়া শান্ত নিরীহ ও সরল মানুষের এ ছোট্ট কাফেলাটি অবরোধ ভাঙতে পারছে না, আঁচ করতে পেরেই হুযুর এ দু'আ করেছিলেন এবং খাত্তাব-পুত্র ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তিতে ব্যক্তিগত প্রভাব মিশিয়ে দারে আরকামের গোপন নামাযকে নিয়ে কায়েম করে দিয়েছিলেন কাবা প্রাঙ্গণে।
হিজরতের প্রাক্কালে নিজের বিছানায় হযরত আলী (রাঃ) কে শুইয়ে রেখে যাওয়ার এক উদ্দেশ্য এটাও ছিল, যেন কেউ এ কথা বলতে না পারে যে, মুহাম্মদ আমাদের গচ্ছিত আমানত টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি সাথে নিয়ে বিদেশ চলে গেছে। আর মদীনায় যাওয়ার পরিচিত পথটি মক্কা থেকে উত্তর দিকে চলে গেলেও হুযুরের হিজরতের রাস্তাটি ঐতিহাসিকরা স্থির করেছেন দক্ষিণমুখী রূপে। মজার বিষয় হলো, সওর গিরিগুহায় ঘুর পথে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার লক্ষ্যে বেছে নিয়েছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী রাস্তা। কর্মকৌশল তো এখানেও আমরা দেখতে পাই।
মদীনার পথে একলোক হযরত আবু বকর (রাঃ) কে বলে, “আপনার সাথী লোকটাকে তো চিনলাম না।” সিদ্দীকে আকবার খুবই সতর্কভাবে সাবধানী জবাব দিলেন, “ইনি? ইনি আমার রাহবার। পথ দেখানো তার কাজ।” শংকা কেটে গেলে হুযুর (সঃ) মৃদু হেসে হযরত আবু বকর (রাঃ) এর এই রহস্যময় উত্তরে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। লোকটি বুঝতে পেরেছে, হুযুর বোধ হয় আবু বকরের (রাঃ) মরু- ভ্রমণের পেশাদার কোন পথপ্রদর্শক। আর পৌঁছানোর ব্যাকুলতায়ও কত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রিয়নবীর মূল পরিচয়। ইনি তো সত্যিই রাহবার। সত্য পথের দিশারী। বাচনিক কৌশলের এ ঘটনার প্রতি ব্যক্ত সমর্থন থেকে আমরা নবীজীর আদর্শের প্রাণময়তার সন্ধান পাই। মদীনা থেকে আগত ব্যক্তিবর্গের সাথে চুক্তির মাধ্যমে মদীনায় যখন প্রিয়নবী (সঃ) এর পূর্ণ পরিচিত ও তার আনুগত্যের প্রস্তুতি পর্ব সমাপ্ত হয়, তখনি আল্লাহর নির্দেশে তিনি মুসলিম জনগোষ্ঠীসহ সে নগরীতে হিজরত করেন। হিজরতের পর বিভিন্ন গোত্র ও বংশের পাড়ায় আবাস গ্রহণের জোরদার আবেদন একটি সমস্যা রূপে দেখা দিলে হুযুর (সঃ) সংকট নিরসনে উটের গতি বা ইচ্ছার সাহায্য নেন। তিনি বলেন, এর পথ ছেড়ে দাও, এ, উটনীটিই আল্লাহর আদেশক্রমে সঠিক স্থানে গিয়ে থামবে। হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) যখন রাসূলে করীম (সঃ) এর বসবাসের জন্য নিজের দ্বিতল গৃহটি ছেড়ে দিচ্ছেন, তখন হুযুর বললেন, আমার জন্য উপরে নয়, নীচের অংশটিই খালি করে দাও। লোকজন আসবে, বৈঠক হবে, তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে উপরের কোঠায় থাক। মসজিদে নববী নির্মাণের জন্য যে জায়গাটি ক্রয় করা হয়, এটি সাহল ও সোহায়ল ভ্রাতৃদ্বয় বিনা পয়সায় হুযুর (সঃ) কে দিতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি, পিতৃহীনদের দান নিয়ে ইসলামের প্রথম কেন্দ্রীয় মসজিদ নয়, টাকা দিয়েই এটা কিনতে হবে। সাহল ও সোহায়ল বিনিময় গ্রহণ করলো।
গোত্রীয় অসন্তোষ নিরসনে উটের ইচ্ছার উপর জোর দেয়া, বসবাসের জন্য আবু আইয়ুব আনসারীর গৃহের বহিমূর্খ ও নীচের অংশ নির্ধারণ এবং মসজিদে নববী নির্মাণে অনাথদের জমি নগদ মূল্যে ক্রয় ইত্যাদি কর্মকৌশল নিঃসন্দেহে নিপুণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। হিজরত উত্তরকালে মদীনায় ইসলামী সমাজ কায়েমের সূচনাপর্ব ছিল মুহাজিরদের পুনর্বাসন। মদীনাবাসী আনসারীদের একজনকে একজন মুহাজিরের দায়িত্বভার দেয়ার সুন্দর সহজ নিয়মে যে চিরন্তন ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধন রচিত হয় তার প্রভাবে গোটা ইসলামী যুগেই তার সুফল প্রসব অব্যাহত রাখে। এতে করে মদীনা শরীফে শরণার্থী শিবির বা সমাজবিচ্যুত অভিবাসন গড়ে ওঠেনি, যা পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্বিতীয় এক ঘটনা। মদীনার প্রাচীন গোত্রগুলো নানা ধর্মাবলম্বী নাগরিক, বিভিন্ন পেশার অধিবাসী নিয়ে হুযুর একটি ঐতিহাসিক 'সমঝোতা স্মারক' রচনা করেন, যা 'মদীনা সনদ' নামে আখ্যা পায়। এই সামাজিক সংবিধান ছিল দল-গোত্র-ধর্ম স্বার্থে পেশা ও নীতি নির্বিশেষে সকল মদীনাবাসীর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দলিল। এই কাজটি বিশ্বনবীর কর্ম-পরিকল্পনা ও কৌশলের প্রকৃষ্টতম প্রমাণরূপে আমরা উল্লেখ করতে পারি। মদীনার নগর-কর্তা হলেন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। তাঁর সাথে ইয়াহুদী, অগ্নিপূজক ও মুশরিকদেরও সুন্দর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থেকে ইসলামের সার্বজনীন আদর্শ এবং বিশ্বশান্তির ধারণা পাওয়া সহজ হয়ে ওঠে। প্রতিরক্ষা, সামাজিক সুবিচার, পেশাগত স্বাধীনতা, নৈতিক স্বকীয়তা, ধর্মীয় স্বাধিকার ও নাগরিক আনুগত্য বা শৃংখলার মূলমন্ত্র নিয়ে রচিত হয় এই বহুজাতিক বহুমাত্রিক দলিল। এর মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল ইসলামের ধর্মীয় জিহাদে অমুসলিম নাগরিকদের সামাজিক অংশগ্রহণ। অমুসলিম মুনাফিকদের দল নিয়ে প্রিয়নবী যাত্রা করেছিলেন হক-বাতিলের লড়াইয়ে। ওহুদ প্রান্তরে পৌঁছার পথেই দুর্বলচেতা মুনাফিকরা কেটে পড়ে, তথাপি হুযুর এদের প্রকাশ্যে সমালোচনা, বহিষ্কার বা বিচার করেননি। কেননা ঐক্য, সংহতি ও সামাজিক শৃংখলা একজন শাসকের ভাবমূর্তিকে শক্রশক্তির সামনে উজ্জ্বল ও প্রভাবশালী রূপে তুলে ধরে থাকে। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আত্মঘাতী তৎপরতার সংবাদ শত্রুদের মাঝে সাহস বৃদ্ধি করে।
মক্কার মুশরিকরা মদীনায় আক্রমণ পরিচালনা করে। প্রিয়নবী (সঃ) এর নব অংকুরিত সুখী সমাজের ভিত তছনছ করে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অর্থ, রসদ ও অস্ত্রের যোগান দেয়ার জন্য তারা যৌথ বাণিজ্যের কাফেলাসহ আবু সুফিয়ানকে অখন্ড শামে পাঠায়, ফেরার পথে সুফিয়ানের কাফেলার উপর আক্রমণ চালনার মাধ্যমে শত্রুর সমরশক্তি বিনাশ এবং নিজেদের ফেলে আসা সম্পদ ও অধিকার আদায়ের যৌক্তিকতা নিয়ে মদীনার প্রতিরক্ষা বাহিনী ঘুরে বেড়ায় মক্কা-সিরিয়া মহাসড়কে। গোপনে খবর পেয়ে আবু সুফিয়ান সমুদ্র তীর বেয়ে মক্কায় পৌঁছে যায়। কিন্তু আক্রমণের নেশা তাদেরকে আবারো টেনে আনে নিরীহ মদীনার পানে। বদর প্রান্তরে যুদ্ধ বাধে। এরপর আবার সংঘটিত হয় ওহুদের রক্তক্ষয়ী সংঘাত। হুযুর রণক্ষেত্রে সৈন্য বন্টন, কাতারবন্দী, নেতৃত্ব ব্যবস্থাপনা, ঘাটি প্রহরা ইত্যাদির তদারক করেন পরম নৈপুন্য ও দক্ষতার সাথে। সকল বিরোধী শক্তির সমন্বিত অভিযান, আহযাবের যুদ্ধে প্রিয়নবী (সঃ) তার মর্যাদাবান অনুচর ইরানের সালমান ফারসী(রাঃ) এর পরামর্শে গ্রহণ করেন আরব বিশ্বের অভিনব সমর পদ্ধতি পরিখা খননের মাধ্যমে অরক্ষিত সীমান্তে ব্যারিকেড সৃষ্টির প্রয়াস যা আরবীয় যোদ্ধাদের জন্য ছিল বিস্ময়কর। এ ছাড়া প্রতিটি কাজে, সাধনায়, সংগ্রামে সাধারণ সৈনিকদের সাথে, সরল নাগরিকদের সাথে মহানবীর উদার অংশগ্রহণ, কাজের স্পৃহা, গতি ও উৎকর্ষকে করে তুলতো বহুগুণ তেজি ও উজ্জ্বল। খন্দক বা পরিখা খননের সময় সাহাবীরা ক্ষুধাতৃষ্ণার অবস্থা হুযুরকে অবহিত করলে তিনি নিজের পেটের কাপড় উঠিয়ে প্রদর্শন করেন, ক্ষুধা- কাতর দেহকে সোজা রাখার প্রয়োজনে বাধা দু'খানা পাথর। ভবিষ্যদ্বাণী করেন, “পরিখা খননে কোদাল চালনায় ছিটকেপড়া পাথরখন্ডের উপর থেকে বিচ্ছুরিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গে আমি পারস্য সম্রাটের রাজকীয় প্রাসাদ দেখতে পাই।” এ সবই তোমাদের করতলগত হচ্ছে অচিরেই।
শত্রুর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উৎসে আঘাত, আক্রমণাত্মক দুশমনের বিরুদ্ধে লড়াই, সহচরদের পরামর্শ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো, ভিনদেশী প্রক্রিয়া-প্রযুক্তি ব্যবহার, কর্ম-তৎপরতায় নিজের অংশগ্রহণ ইত্যাদি থেকেও উত্তম কর্মকৌশল ও সুন্দর পরিকল্পনার নিদর্শনই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বদরের যুদ্ধে যারা মুক্তিপণ পরিশোধে অক্ষম, তাদের জন্যে হুযুর শর্ত জুড়ে দেন, ওরা প্রত্যেকে যেন মদীনার দশজনকে স্বাক্ষর ও শিক্ষিত করে তোলে। এই হলো তাদের মুক্তিপণ। এ কেমন কর্মনৈপূণ্য! কত সুন্দর সমাধান। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল কৌশলগুলো ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে। হুযুর (সঃ) সহস্রাধিক সাহাবীকে নিয়ে মক্কা সীমান্তে হুদায়বিয়ায় গিয়ে পৌঁছলেন। হযরত উসমান (রাঃ) গেলেন মক্কার নেতৃবর্গের সাথে বৈঠকে। প্রস্তাবঃ এ বছর মুহাম্মদ (সঃ) তার সহচরদের নিয়ে কাবা ঘর তওয়াফ তথা উমরা করবেন। আত্মরক্ষার তরবারী তাদের কোষবদ্ধ থাকবে। সমরসজ্জা থাকবে না। কিন্তু না; কাফিররা এতে রাজী হলো না। হুদায়বিয়ার নেতা সোহায়ল এলো সন্ধি চুক্তি সই করতে। শর্তঃ এ বছর নয় আগামী বছর উমরা করবেন তারা। কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় পালিয়ে গেলে তাকে মক্কা ওয়ালাদের হাতে তুলে দিতে হবে, তবে কেউ মদীনা থেকে মুরতাদ হয়ে মক্কায় এলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না ইত্যাদি। উমরা ও মাতৃভূমি ভ্রমণের উদ্বেলিত আবেগে উৎসাহে বিপত্তি আর বিনীত সন্ধিচুক্তির শোকে সাহাবীরা ক্ষুব্ধ এবং শোকাহত। হযরত উমর (রাঃ) উচ্ছ্বসিত আবেগ আপ্লুত হয়ে নবীজীকে জড়িয়ে ধরে অবুঝ শিশুর মতো বলে উঠলেন, “ও নবী! আমাদের মিশন কি সত্যনিষ্ঠ নয়, আপনি কি সত্য নবী নন? তবে কেন এত অবমাননা, এত গ্লানি স্বেচ্ছায় মেনে নিতে হবে আমাদের?” অব্যক্ত উচ্চারণে সব সাহাবী সোচ্চার-“মর্যাদার লড়াইয়ে আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত।”
অপূর্ব ধৈর্য ও অফুরন্ত স্থিরতা, শান্ত সৌম্য অবয়বে আনত নয়নে প্রিয়নবী (সঃ) কেবলই অন্তরমুখী। এতেই রয়েছে আমাদের সুস্পষ্ট বিজয়, মহা প্রাপ্তি। এখানে শক্তি নয়, যুক্তির হবে জয়। আবেগের নয়, ত্যাগের, প্রাবল্যের নয়, বিনম্রতার সদাচারের। তিনি সাহাবীদের বললেন, এখানেই মাথা মুড়িয়ে বা ছেটে পশুগুলো কোরবানী করা হোক। শোক ও অবদমিত উদ্ধেলতায় সব অনড় নিশ্চল। হুযুর (সঃ) তাঁবুতে গিয়ে বিবি উম্মে সালমাকে বললেন, ওরা যে আমার নির্দেশ শুনছে না। কি সর্বনাশ, যদি আল্লাহর গযব নেমে আসে। বিবি বললেন, “আপনি মৌখিক নির্দেশ আর দেবেন না। নিজে গিয়ে এ আমলগুলো শুরু করে দিন, দেখবেন, জানবাজ সাহাবীরা কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে এক নিমিষেই।” আর হলোও তাই।
হুদায়বিয়া থেকে হুযুর ফিরে এলেন। দু'টি বছরও ঘুরেনি। এরি মধ্যে এ সন্ধিচুক্তির সর্বপ্লাবি সুফল ইসলামকে বহু দূর এগিয়ে নিয়েছে। দু'হাজারের কম সাথী নিয়ে হুদায়বিয়ার অভিযাত্রী এবার দশ সহস্র সঙ্গী নিয়ে চলেছেন মক্কা জয়ে। আল্লাহ কতই শক্তিমান, কত মহান।
শত্রুর সাথে সংঘাতের চেয়ে কৌশলগত সমঝোতা ভালো, নীতিহীন প্রতিপক্ষের সাথে চুক্তিই উত্তম। কেননা এটা তারা সহজেই ভঙ্গ করে এবং বিরোধী পক্ষকে অ্যাকশানে যাওয়ার বৈধতা দিয়ে দেয়। নিপীড়িত হয়ে জনসমর্থন পাওয়া সহজ, আক্রমণের চেয়ে বিনম্র প্রত্যাবর্তন এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে সংগঠনকে গণমুখী করে। এসব কর্মকৌশলের ফলে হুদায়বিয়ার আপাত নতজানু সন্ধি বৃহত্তর ও চূড়ান্ত বিজয়ের ভূমিকা রূপে প্রতিষ্ঠিত হলো। সহকর্মীদের উচ্ছসিত আবেগ নিরুত্তরে স্তিমিত করে সময়ে এর সঠিক ব্যবহার প্রকৃত নেতার জন্যে অবশ্য অপরিহার্য। কৌশলগত প্রয়োগ এ আদর্শও কম গুরুত্ববহ নয়। মক্কা বিজয়ের পর সাধারণ ক্ষমা, আল্লাহর ঘরে আশ্রয় লাভকারীদের সুরক্ষা, অস্ত্র সংবরণকারী, স্বগৃহে অবস্থানকারীদের নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি এককালের চরম দুশমন আবু সুফিয়ানের বাড়িকেও নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষণা করা কত বড় কৌশল ছিল, তা কি বলে বুঝাতে হয়? হুনায়নের যুদ্ধে প্রাপ্ত গনীমতের মাল বন্টনে নওমুসলিম, মক্কার বিশিষ্ট্য ব্যক্তিবর্গ এবং অতীত প্রতিপক্ষ পরিবারের ‘নববন্ধু’ সদস্যদের অগ্রাধিকার প্রদান কৌশল ও প্রজ্ঞার সর্বোৎকৃষ্ট পর্যায়ে পড়ে।
তদানীন্তন বিশ্বের দুই পরাশক্তি, পার্শ্ববর্তী রাজ্যের শাসকবর্গ এবং প্রাদেশিক গভর্নরদের প্রতি পত্র দেয়ার মাধ্যমে তাদের সাথে ইসলামের লেনদেন, শান্তি-যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূত্রপাত করে গিয়ে তিনি তার ভবিষ্যতে উত্তরাধিকার, খলীফাগণের কর্মপন্থা নির্দেশ করে গিয়েছেন। আদর্শ শিক্ষা-সংস্কৃতি, কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে দিয়ে তিনি ভবিষ্যতে নেতৃত্বকে এগিয়ে যাওয়ার পথ ও প্রেরণা দিয়ে যান। শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক বিষয়াদি, বিচার, কৃষি, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও সমর বিষয়ক দফতর প্রতিষ্ঠা করে তিনি তার সকল দায়িত্ব সমাপ্ত করে হযরত আবু বকর (রাঃ) কে জাতির ইমাম নিযুক্ত করে যান। খোলাফায়ে রাশেদীনকে দিয়ে যান অনুসরণীয় আদর্শের প্রবক্তার স্বীকৃতি। বলে যানঃ “দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি তোমাদের জন্যে। এই দু'টি শক্ত করে আকড়ে থেকো- পথচ্যুত হবে না। এক-আল্লাহর কিতাব, দুই-আমার সুন্নাহ্।” বিদায় হজ্জে দিয়ে যান দ্বীনের পূর্ণতার ঘোষনা। শেষ ভাষণ পরিগণিত হলো মানবতার মুক্তির চূড়ান্ত সনদরূপে।
তেইশ বছরের নবুওতি কর্মসাধনার স্বর্ণসৌধ যখন নিটোলপূর্ণ তখন বললেন, “প্রধান বন্ধুর সাথে মিলিত হতে চাই- আল্লাহ রফীকে আ’লার সাথে। এরপর পার্থিব জীবনাবরণ থেকে মাকামে মাহমুদের পথে মহাপ্রয়াণ।
প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছি, ওহীর দ্বারা পরিচালিত নবী-জীবনে কর্মকৌশল ও পরিকল্পনার গুরুত্ব একেবারেই শূন্য। সকল নবী রাসূলের বেলায়ই এ কথা। সুতরাং বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে আর আলোচিত জীবনের পবিত্রতম নাজুকত্বে এ নগন্য অধম দারুণ উৎকণ্ঠিত। তথাপি আড়ষ্ট ভীরুতার কালিতে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হলাম প্রিয়তমের জীবনের আলোকময় কিছু কর্ম ও পদক্ষেপের বাহ্যিক নৈপুণ্য ও কৌশল। আমার অনিচ্ছাকৃত কোন অবমূল্যায়ন বা অনুভব-অভিব্যক্তির হীনতা যেন স্পর্শ না করে মহান রাসূলের পদধুলিকেও। পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল নিয়ে কলম ধরার প্রেরণা অবশ্য পেয়েছি আল্লাহ পাকের এ বানী থেকে “যিনি তার রাসূলকে নিরক্ষর সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রেরণ করেছেন, তিনি তাদের সামনে তার (আল্লাহর) আয়াত তিলাওয়াত করবেন, তাদের শুদ্ধ ও পবিত্র করবেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন।” 'হিকমত' শব্দটির ব্যাপক অর্থের মাঝে কর্মকৌশলও যে রয়েছে, এতে হয়ত কেউই ভিন্নমত পোষণ করবেন না।